Skip to main content

শিব ঠাকুরের আজব দেশে

#শিব_ঠাকুরের_আজব_দেশে#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
গল্প১
"ফুল বেলপাতা সব হাতে নিন,হ‍্যাঁ নিয়েছেন তো এবার হাত জোড় করে মন্ত্র বলুন।"
 পুরোহিত মশাই যতটা সম্ভব উঁচু গলায় বলে যাচ্ছেন শিব পুজোর মন্ত্র। সাথে গলা মিলিয়েছেন মহিলারা। সবারই পরনে সুন্দর পুজোর পোশাক। তাদের মাঝেই একটু আড়ষ্ট হয়ে জায়গা করে নিয়েছেন সুশোভন। দু একজন বাঁকা চোখে তাকিয়েছে,একজন তো বলেই ফেলেছে," এখানে সব মেয়েরা বসে তারমধ‍্যে আবার উনি,একটু সরে বসুন দেখি। বৌমা এদিকে একটু চেপে এসো।" সুশোভন বোঝেন সুন্দরী বৌমাকে পুরুষের ছোঁয়া থেকে বাঁচাতে তৎপর শাশুড়িমা।
      ততক্ষণে ওদিক থেকে নির্দেশ আসে," হয়েছে এবার শিবের মাথায় ফুল বেলপাতা দিয়ে গঙ্গাজল ঢালুন। এক এক করে আসুন ভিড় করবেন না।"
            মেয়েদের লাইনের শেষে অপেক্ষা করেন সুশোভন। তারপর ভক্তিভরে জল ঢেলে বাতি ধরিয়ে দেন। চরণামৃত আর প্রসাদটুকু নিয়ে মন্দির থেকে বাড়ির দিকে রওনা দিতে হঠাৎই মুখোমুখি হলেন অতীনবাবুর।
    চিরকালের রসিক অতীনবাবুর মুখে হাসি ফুটে ওঠে," আরে মশাই পুত্রবতীদের ভিড়ে আজ নীলের দিনে আপনি কেন? নীলের পুজো তো মায়েরাই করে সন্তানের কামনায়।"
    সুশোভনের মুখেও হাসির ঝিলিক ফোটে," সন্তানদের দশমাস দশদিন গর্ভে রেখে জন্ম দিয়ে লালন পালন করার সাথে সাথে সন্তানের কামনায় উপোস সবটুকু করে শুধু মাতৃদেবীই নমস‍্যা হবেন? মানে স্বর্গের চেয়েও গরিয়সী হবেন তা কেমন করে হবে? আমারও তো বাপ হিসেবে কিছু করণীয় আছে। তাই চলে এলাম উপোস করে নীলের ঘরে বাতি দিতে। হাফ পুণ‍্য আর হাফ ডিউটি ভাগ করে নিলুম আরকি।"
      থামার পাত্র অতীনবাবুও নয় তাই বললেন," তা এতদিনে মনে হল শুধু মায়েরাই করবে নীল পুজো তা চলবে না বাপেদেরও করা চাই? অনেকটা দেরি করে ফেললেন মশায়।"
     সুশোভন হেসে বলেন," তবে চুপিচুপি একটা কথা বলি। উনি ডাইরিয়াতে একদিন আগে একদম কুপোকাত বেশ কয়েক শিশি স‍্যালাইন খেয়েছেন। এখন ভালো আছেন তবে উপোস বন্ধের হুকুম ডাক্তারের। তাই অগত‍্যা আমাকেই....."
            সুশোভনকে অনেকদিন চেনেন অতীনবাবু জানেন ওঁর একমাত্র ছেলে অনেকদিন বিদেশে। এখানে কর্তা গিন্নী এখন একে অপরের সঙ্গী। অসুস্থ বৌকে সামলে ছেলের মঙ্গল কামনায় ছুটে এসেছেন মন্দিরে। শুধু মায়েরা কেন বাবারাও বোধহয় অনেক কিছুই করতে পারে নিঃশব্দে।
   ওদিক থেকে সুশোভন হাঁক মারেন," আসি ভাই ওদিকে আরেকজনের মাথায় একটু ফুল চরণামৃত ঠেকাতে হবে। যত্ত সব সংস্কার!"
         অতীন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন যতই বল সংস্কার তবু ছাড়তে পার কই? আসলে সন্তানের মঙ্গল যে সবাই চায়।@রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী।

গল্প ২

       সারাদিন অ্যাডের কাজ করতে করতে একটা সময় ক্লান্ত লাগে নয়নার। তবুও ক্লান্ত আঙুলের আলপনা দিয়ে যায় ল‍্যাপটপের স্ক্রীনে। টাইপ করে শব্দ গুলোকে চটজলদি। তারমধ‍্যেই বাড়িতে ফোন করে কথা বলে মানবী পিসির সাথে। বাবাকে ঠিকঠাক খেতে দিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করে নেয়।
               ...." হ‍্যালো ম‍্যাম এখনও হয়নি কাজ সারা? আমি ভাবছিলাম তুমি এতক্ষণে ফ্রী হয়ে গেছ। ওকে আমি ওয়েট করছি।"
    স্ক্রীন থেকে মুখটা তুলে একটু হেসেই আবার কাজে মন দেয় নয়না। 
অভিষেক ওদের অফিসে নতুন জয়েন করেছে মাস খানেক আগে। হঠাৎই একদিন আলাপ হয়ে গেছিল ট্রেনে আসতে আসতে। অবশ‍্য ওর সেকশন আলাদা,তেমন কাজের চাপ নেই। যেদিনই তাড়াতাড়ি হয়ে যায় নয়নাকে একবার পিং করে অথবা হাজির হয় এসে। নয়না বোঝে অভিষেক ওকে পছন্দ করে। তবে এখনও মুখে ওকে কিছু বলেনি।
     এক মনে কাজ করে যাচ্ছে নয়না অভিষেকের চোখ বারবারই ওর দিকে গিয়ে আটকে যাচ্ছে। সাধারণ বাঙালী মেয়েদের এই বয়েসে বিয়ে হয়ে যায়। নয়নাকে অবশ‍্য তেমনভাবে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি। একদিন একটু শুরু করতেই নয়না বলেছিল," না ফিউচার নিয়ে কিছু ভাবিনি। আসলে আমার কিছু ইস‍্যুস আছে।"
    অভিষেক আর কিছু বলেনি বুঝতে পেরেছিল শেয়ার করতে চায় না নয়না। আর করবেই বা কেন,মাত্র কয়েকদিনের তো আলাপ।
               স্টেশনে যাবার পথে বাদশার রোলের দোকানের সামনে এসে অভিষেক বলে," আমার খুব খিদে পেয়েছে। খুব ভালো এগ চিকেন রোল বানায় ওরা। আজ কিন্তু আমি খাওয়াবো।"
       নয়না ঘাড় নাড়ে," আজ আমার একটু তাড়া আছে এমনিতেই একটু দেরি হয়ে গেছে। আজ নীল পুজো আমি খাবো না। তুমি খেয়ে নিয়ে এস। আমি এগিয়ে যাচ্ছি।"
         অভিষেকের মনে তখন হাজার একটা প্রশ্ন ভোকাট্টা ঘুড়ির মত বাতাসের ধাক্কায় ভেসে ওঠে। তাহলে নয়না কি বিবাহিতা? নিশ্চয় ওর কোন বাচ্চা আছে? তাহলে?
      নয়না এক মুহূর্তে অভিষেকের মুখটা পড়ে নিয়ে ছোট্ট একটা হাসির লাল রুমাল উড়িয়ে চলে যায় স্টেশনের দিকে।

       বাড়ি এসে সন্ধ‍্যেবেলায় বাতি জ্বালিয়ে চোখ বুজে প্রার্থনা করে চরণামৃত আর প্রদীপের ওম এনে বাবার মাথায় যত্নে বুলিয়ে দেয়।
             হুইল চেয়ারে বসে থাকা অনির্বাণ জড়িয়ে ধরেন মেয়েকে," আমার পাগলী মা,মানবী তাড়াতাড়ি ওর খাবারটা নিয়ে আয়। আমি না খাইয়ে দিলে তো আবার খাওয়া হয় না আমার বুড়ি মায়ের। কি দরকার এই সব পুজো করে শরীর খারাপ করার?"
              নয়না কিছু না বলে শুধু বাবার আদরটুকু নেয় প্রাণভরে। ও তখন দুই বছরের বাবা মায়ের সাথে ফিরছিলো দাদুর বাড়ি থেকে কলকাতায়। হঠাৎই অ্যাক্সিডেন্ট। মা বাঁচেনি,বাবার পা দুটো বাদ গেছিল। বুকের কাছে জড়িয়ে ধরেছিল নয়নাকে বাবা। তারপর থেকে ওদের বাবা মেয়ের সংসার। কখনও কোন অভাব বুঝতে দেননি বাবা। নিজে পা হারালেও নয়নাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন সবটুকু দিয়ে।
       মেয়ের মাথায় হাত আদরে স্পর্শটুকু মাখাতে মাখাতে ভাবেন অনির্বাণ সেদিনের ছোট্ট খুকু কখন যে মা হয়ে উঠেছে বুঝতেই পারেননি।@রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী

গল্প ৩

      প্রথম সন্তানের জন্মের পর নীলিমা যখন নীলের উপোস করতে চেয়েছিল ওর শাশুড়িমা ছড়া কেটে পান চিবোতে চিবোতে বলেছিলেন," নীলের ঘরে দিয়ে বাতি জল খেয়ো গো পুত্রবতী ,বুঝলে বৌমা এমনটাই শুনে আসছি সেই কোন ছেলেবেলা থেকে। এই করে তো তোমার কাকিমাকে আমার শাশুড়িমা নীলের ব্রত করতেই দেননি। তবে আমার সাথে পারেননি আমার তো প্রথমেই ছেলে। তা এখন যুগ পাল্টেছে। সবাই সমান ছেলে হোক বা মেয়ে হোক।"
      শাশুড়ি মায়ের কথার ভাজে ভাজে যে প‍্যাঁচ লুকিয়ে আছে তা না বুঝতে পারার মত বোকা নয় নীলিমা। তবুও সেটাকে পাত্তা না দিয়েই বলল," হ‍্যাঁ মা সন্তান সন্তানই হয়। দুজনকে জন্ম দিয়ে বড় করতে আর মানুষ করতে একই কষ্ট। আর আমার তো মনে হয় মেয়েদের শুভায়ু কামনায় আরও বেশি করে ঠাকুর পুজো করা উচিত। আমাদের সমাজের নিয়মে কোথায় গিয়ে কার ঘরে পড়বে কে জানে? ভালো থাক মেয়েরা,চারদিকে মেয়েদের যা হেনস্থাদেখে আসছি সেই সীতা দ্রৌপদীর যুগ থেকে।"
      ওর কথা শুনে আর তেমন কিছু বলতে পারেন নি  শাশুড়িমা। তবে ওঁর আশায় ছাই দিয়ে তিন বছর বাদে আরেকটি কন‍্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে নীলিমা। অনেকদিন ধরেই দুই সন্তানের মঙ্গলকামনায় নীলের ব্রত করে আসছে নীলিমা। দেখতে দেখতে অনেকটা বড় হয়ে গেছে দুই মেয়ে,নীলিমার ঘর ভরেছে মেয়েদের কলকাকলিতে। নীলিমা এখন ঘোর সংসারী। তবে সাজানো সংসারে হঠাৎই ছন্দপতন। খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে নীলিমা এখনই রক্ত দিতে হবে।
        শীর্ষা আর রাই দুজনেই দিতে চায় রক্ত মাকে। অবশেষে শীর্ষা দিল রক্ত।
   নার্সিং হোমে শুয়ে থাকা নীলিমা চোখ খুলেছে একটু আগেই। নার্স হেসে বলছে," আর কোন ভয় নেই বিপদ কেটে গেছে। ধন‍্যি মেয়েরা আপনার, দুজনেই সমান।উঃ কি না পারে!"
     অবাক হয়ে যায় নীলিমা, সত‍্যিই বোধহয় সঠিক মূল‍্যবোধ আর শিক্ষায় সন্তানকে মানুষ করলে তারা সবই পারে। আজ যে বড় গর্ব হচ্ছে এমন মেয়েদের মা হতে পেরে। অজান্তেই দূর্বল হাতটা কপালে উঠে যায়..আমার সন্তানেরা যেন ভালো থাকে।@রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী।


Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...