#চুপকথা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
বাবার বিয়ের দিনটা আবছা মনে পড়ে রূপকথার,
ওকে দুধটা খাইয়ে দিতে দিতে সুধামাসি বললো,"এই যে রূপি খেয়ে নাও দুধটা চুপটি করে একদম নক্কীসোনা হয়ে বুঝেছো তো।"
রূপকথা বলেছিলো," বাপি কোথায়?আমি দুধ খাবোনা..বাপির কাছে খাবো।"
"বাপি আজ ব্যস্ত আছে রে মা,তার এখন অনেক কাজ। আজ তার বে না?আমাদের রূপির নতুন মা আসতিছে কত মজা।"
গোল গোল চোখ করে মাসির দিকে তাকিয়ে ছিলো রূপকথা। "বে টা কি? মা আবার নতুন হয় নাকি?"
কোনরকমে দুধটা খাইয়ে একটা ঢাউস পুতুল দিয়ে ওকে বসিয়ে রেখে সুধামাসি কাজ সারছিলো। আর রূপকথা ওর মেমসোনাকে জড়িয়ে ধরে বলছিলো,"আচ্ছা বলতো মেম বে কি?"
রূপকথার বাপি আর ও দুজনেই তো ভালো ছিলো,যদিও ও মাঝে মাঝেই বলত মায়ের কথা। বাপি বলত,"আসবে,আসলে তোর মা খুব রাগী।রাগ কমলেই আসবে।"
"আমি তো সোনা মেয়ে বাপি তাহলে মা রাগ করলো কেন?তুমি না হয় দুষ্টু। মাকে আসতে বলোনা বাপি।"
তাহলে এতদিনে মা আসছে,কিন্তু বাপি ওকে নিয়ে গেলোনা কেন মাকে আনতে?একা একাই গেলো!ওকে দেখলে মা আর একটুও রাগ করতে পারতোনা। একদম মায়ের গলা জড়িয়ে ধরতো আদর করে।
অন্যদিন বাপি অফিসের পর তাড়াতাড়ি ফিরে আসে,দুজনে মিলে কত খেলা করে ওরা। আজ আসছেইনা,কত্ত দেরি করছে। সুধামাসিও এদিকে কিসব কাজ করছে,কেন যে ওরা বোঝেনা ওর খুব একা একা লাগে। সন্ধ্যের একটু বাদেই মিতুনকাকি এলো,মিতুনকাকি ওর কাকিমণি,মাঝে মাঝে আসে ওদের বাড়িতে।
" এই তো রূপকথা আমার মিষ্টি মেয়েটা। সুধামাসি ওর জামাটা দাওনা ওকে একটু সাজিয়ে দিই। দাদাভাইরা আর ঘন্টাখানেক পরেই এসে পড়বে।"
লাল সাদা লেস বসানো একটা নতুন ফ্রক এনে দেয় মাসি.."এই নাও বৌদিমনি,তুমিই সাজিয়ে দাও ওকে। আমাকে তো হাজার একটা প্রশ্ন করে জ্বালিয়ে মারছে।বে কি? মা আবার নতুন হয় নাকি? এবার তুমিই সামলাও।"
" ঐ জন্যই তো আমি চলে এলাম,দাদাভাই ফোন করেছিলো। তুমি বরণডালাটা সাজিয়ে রেখো বুঝলে।"
মিতুনকাকির সাথে অনেকটা বকবক করলো রূপকথা। " তোমার গায়ে কি সুন্দর গন্ধ গো! আচ্ছা মায়েদের গায়ে কি এমনি গন্ধ হয় নাকি?আমার মায়ের গায়েও আছে?"
মিতুনকাকির কোলে বসে গলা জড়ায় রূপকথা। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে ওর কাকির..'কি জানি,কেমন হবে তোর নতুন মা?দাদাভাই যে কি সব কান্ড করছে কে জানে?"
রূপকথার জন্মের পর ওর বৌ হয়ে আসা,মিতুন আসলে রূপকথার বাবার খুড়তুতো ভাইয়ের বৌ। সবটাই শুনেছে ও শ্বশুরবাড়িতে এসে আসলে দাদাভাইয়ের সঙ্গে তেমন কারো সম্পর্ক নেই শুধু ওর বর প্রণবে ছাড়া। তবুও রূপকথার জন্যই মাঝে মাঝে চলে আসে এই বাড়িতে মিতুন। ওর শাশুড়ি দেশের বাড়ি থাকেন তাই না হলে রাগই করতেন।
ততক্ষণে একটু রাত হয়েছে,বাইরে গাড়ির আওয়াজ পেয়ে মুখ বাড়ায় মিতুন।
"সুধামাসি বরণডালাটা নিয়ে এসে দাঁড়াও আমি দরজাটা খুলি। রূপসোনা তুমি খেলা করো,আমি একটু বাদেই তোমাকে নিয়ে যাবো।"
বাইরে একটু বাদেই উলুর আওয়াজ শুনতে পায় রূপকথা,মা কি তাহলে এলো?ওকে কেউ নিয়ে যাচ্ছেনা কেন?ঐ তো শঙ্খ বাজছে পুজো হচ্ছে মনে হয়। দরজা দিয়ে বেড়িয়ে বারান্দা পার হয়ে সিঁড়ির মুখটায় দাঁড়ায় ও..."আরে আরে এই তো আমাদের রূপ চলো,চলো বাবা ডাকছে তোমায়।"
মিতুনকাকি ওকে কোলে তুলে নেয়।
ঐ তো বাপি দাঁড়িয়ে আছে,তাহলে পাশেরটাই মা হবে।
"বাপি,বাপি তুমি কোথায় ছিলে এতোক্ষণ? আমাকে কোলে নাও। আমি আজ দুধ খাইনি রাগ করে।"
মেয়েকে দেখেই হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নেয় শুভ। বাপির গলা জড়িয়ে মায়ের দিকে তাকায় রূপকথা,মা ওকে আদর করছেনা কেন?
" আমি মায়ের কোলে যাবো।"
মেয়েকে দিতে হাত বাড়ায় শুভ অহনার দিকে।
" প্লিজ শুভ,সারাদিন যা গেলো। আগে আমি একটু চেঞ্জ করে নিই তারপর। ওর মাসি কোথায়?আয়া মাসি ওকে কোলে নাও.."
সুধামাসি তাড়াতাড়ি এসে কোল নেয় ওকে।" দাদাবাবু আপনেরা বিশ্রাম নেন,আমি দেখছি ওকে।"
"একটু কোলে নিতে পারতে ওকে অহনা,বাচ্চা তো.."
অহনার মুখের দিকে তাকিয়ে আর বেশি কিছু বলতে পারেনা শুভ।
ওদের সাথে ঘর পর্যন্ত এসে মিতুনও আর খুব একটা অপেক্ষা করেনা। বাইরে থেকে কিছু খাবারের প্যাকেট আনানো হয়েছিল সেগুলো দিয়ে সবাইকে বরের সাথে বাড়ির ফেরার উদ্যোগ নেয়। আর লোকজন বলতে তো তেমন কেউ নয়,শুভর দুজন বন্ধু আর অহনার অফিস কলিগ আর দিদি।
শুভ তখন সবেই বাবা হয়েছে,মা হওয়ার পর সব সময়ই ব্যস্ত থাকতো রেনা বাচ্চা নিয়ে। একটু যেন বেশিই সাবধান সব সময়। ওর আর রেনার মাঝে তখন শুধুই বাচ্চা আর কিছুনা।এক একসময় বাচ্চার শরীর খারাপ হলে অদ্ভুত রাগ করতো ও,ঝামেলাও হতো। ব্যাস বাচ্চা নিয়ে চললো বাপের বাড়ি,এখানে নাকি যত্ন হচ্ছেনা ঠিকমত।
কি হয়েছিলো,হয়ত কিছুই না অথবা একঘেয়ে দাম্পত্যে কি দমবন্ধ হয়েছিলো শুভর। হয়ত তাই। শুভ সংসারী নয় একটু বোহেমিয়ান, বেড়াতে ভালোবাসে,থিয়েটার দেখতে ভালোবাসে। রেনাও তো ভালোবাসতো একসময়,কিন্তু বিয়ের চারবছর বাদে বাচ্চা হওয়াতেই কি এখন ও শুধুই মা আর কিছুনা? মনে হত ওর জীবনে শুভর কোন জায়গাই নেই। বললেই বলতো.." তুমি কেমন বাবা?এত হিংসুটে।বাবাদেরও অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হয়। বাড়িতেই তো থাকোনা সারাদিন।"
দূর্বল সত্যিই কেমন যেন দূর্বল হয়ে গিয়েছিলো একলা শুভ সেই সময় অহনার প্রতি।ওর ভালোবাসার জায়গাগুলো চট করে বুঝে নিয়েছিলো অহনা। অহনার সাথে থাকতে ওর ভালো লাগতো মনে হতো অহনা ওকে একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দিচ্ছে,ওর খেয়াল রাখছে। অহনাই বলতো.." টিফিন আনেননি শুভদা? আপনার জামাটা তো আয়রন করা নেই আজ?" রেনা যেগুলো খেয়াল রাখতোনা অহনা খেয়াল রাখতো। মনে হত কতদিন ওর দিকে পাশ ফিরেও শোয়না রেনা তাকানো তো দূর।
প্রথমটা প্রেম ছিলোনা তবে কেমন যেন মনে হত ওর একলা হয়ে যাওয়া মনটাকে অহনা বোঝে। ওর ভালোলাগা বোঝে যা রেনা বোঝেনি এই চারবছরে,অথচ একসময় বাড়ির সবার অমতে রেনাকে বিয়ে করেছিলো।
অহনা চুম্বকের মত টানতে শুরু করেছিলো শুভকে,শুভকে ওর ভালো লেগেছিলো। বুঝেছিলো সংসারী নয় ছেলেটা,একটু বেশিই অভিমানী আর আবেগপ্রবণ। ওর ভালোলাগা গুলো একটু একটু করে বুঝে নিয়েছিলো। কাছে এসেছিলো খুব সাবধানে। প্রথমে মিথ্যে কথা বলত শুভ বাড়িতে দেরি করে এসে। পরে জানাজানি হয়েছিলো একটু একটু করে সবটাই।
রাগে দুঃখে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো রেনা,যেখানে ভালোবাসা ভাগ হয়ে গেছে সেখানে সে থাকবে কি করে?সোজাসুজিই বলেছিলো," আমার পুরোটাই চাই,তুমি বলো যেমন আমার ছিলে সেভাবেই আবার ফিরে আসবে। মাঝেরটা ভুলে যাবো আমি।"
কোন উত্তর দিতে পারেনি শুভ,রেনা চিৎকার করেছিলো কেঁদেছিলো," ছিঃ এইভাবে আমার সংসারটা ভাঙলো অসভ্য মেয়েটা! তোমার লজ্জা করলোনা,তুমি না বাচ্চার বাবা?"
শুভ কিছু বলতে চেয়েছিলো,বলেছিলোও কিন্তু না অহনাকে ছাড়া বোধহয় আর সম্ভব ছিলোনা। ঘর ছেড়েছিলো রেনা,তারপর কোর্ট ডিভোর্স অনেককিছুই হয়েছিলো। অনেকদিন সময়ও লেগেছিলো।
শুভও রূপকথাকে নিয়ে চলে এসেছিলো পুরোনো ফ্ল্যাট ছেড়ে নতুন বাড়িতে। অসহ্য লাগতো ঐ বাড়িটা। রেনা হয়ত কিছু দায়িত্ব ওকে দেবার জন্যই রূপকথাকে স্বেচ্ছায় রেখে গিয়েছিলো। রূপ তখন দেড়বছরের।
ইশ্ কি সব ভাবছিলো যেন! হঠাৎই অহনা এসে দাঁড়ায়..ওর পরনে হাউসকোট,চুলগুলো খোলা। লম্বাচুলে ভালোই লাগছে অহনাকে। " আজ শাড়ি পরতেই পারতে।"
" ছাড়ো তো,বিয়ে না তো পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। বাবা! অন্য মেয়ে হলে এতদিনে অন্য ছেলের গলায় ঝুলে যেতো।নেহাত ভালোবেসে ফেলেছি তাই।"
অহনার কথাগুলো খোঁচা মারে শুভকে,কিছু বলেনা। সুধামাসি এসে জিজ্ঞেস করে," দাবাবু রূপির মনটা খারাপ, খেতে চাইছিলোনা। আমি কোনরকমে চাপড়ে ঘুম দিয়েছি,ওরে এই ঘরে দিয়ে যাবো তো?"
শুভ কিছু বলার আগেই অহনা বলে ওঠে,"এখন থেকে রূপ তোমার কাছেই শোবে মাসি। আমি সারাদিন অফিস করে আসবো এত ধকল নিতে পারবোনা। আর আজ তো.."
সেদিন ফুলশয্যা নয় ঠিকই তবুও শুভর শরীরের গন্ধ আর ওর শরীরের ঘামের চেনাজানা অনেক আগেই হয়ে গেছে,তাই হয়ত সেভাবে নতুনত্বের আশ্বাসে মনটা শিকারি হতে চায়না অহনার। আজ সত্যিই খুব বিশ্রামের দরকার।
বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে অহনা,শুভরও আজ বড় অস্থির লাগে..একবার গিয়ে সুধামাসি র ঘরে উঁকি দেয়,সুধামাসি তখনো রান্নাঘরে।বড় মেমটার গলা ধরে শুয়ে আছে মেয়েটা। গালে তখনো চোখের জলের দাগ।দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুভ এরপর থেকে বাপির বদলে হয়ত মেমের গলাটা জড়িয়েই শুতে হবে মেয়েটাকে।
ওর মাথায় হাত দিতে,গালে একটা চুমু খেতে খুব ইচ্ছে করে,কিন্তু সাহস হয়না। যদি ঘুম ভেঙে বায়না করে বাপি তোমার কাছে শোবো তাহলে! ততক্ষণে সুধামাসি এসে পড়েছে,মাসিকে দেখে ঘর থেক বাইরে আসে শুভ একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। সুধামাসিরও, দীর্ঘশ্বাস পড়ে কি কপালপোড়া মেয়ে ভগবান! মা ফেলে রেখে গেছে,বাপও পর হলো। পরের বাড়ির বাচ্চার ওপর মায়া করেই বা কি লাভ!কবে আছে কবে নেই।
" কি গো,সোফায় বসে কি করছো?"
অহনার ডাকের মধ্যে পাকা গিন্নীর গন্ধ পায় শুভ। রেনাও কিগো,হ্যাঁ গো বলতো। যদিও ওর কথায় একটু টান ছিলো। অহনা রেনার মত ফর্সা নয়,শ্যামলা আর ছিপছিপে। রেনা,ফর্সা গোলগাল ছিলো একদম রূপের মতই শুধু ঐ নাকটা বাদ দিয়ে..রূপের নাক শুভর মত টিকোলো তাই রূপ মনে হয় আরো সুন্দর হবে।
অহনার পেছন পেছন ঘরে আসে শুভ,অহনার গায়ে পারফিউমের গন্ধ,গন্ধটা নতুন লাগে হয়ত বিয়ের জন্য কিনেছে। অহনা পারফিউম পাগল,রেনা পারফিউম মাখতোনা। ওর শরীরে মুখ ডুবিয়ে শুধু শরীরের সোঁদা গন্ধেই প্রথমে পাগল পাগল লাগতো শুভর।
ইশ্ কি সব ভাবছে,অহনা ওকে জড়িয়ে ধরেছে একদম নিজের খুব কাছের করে। ভালো লাগছে শুভর তবুও কেন যেন মিস্ করছে একটা আলতো নরম হাত আর গালের ছোঁওয়া। আচ্ছা রূপকে কি একপাশে নিয়ে শোওয়া যেতনা! ও তো এখনো ছোট,বাপি ছাড়া আর কিছু বোঝেনা।
শুভর এলোমেলো মনটা পড়তে খুব বেশি সময় লাগেনা অহনার। নিজের পাওনাটা খুব ভালোই বুঝে নিতে জানে অহনা তাই শুভকে কি করলে ঘুম পাড়াতে পারবে চট করে তা বুঝে নিলো। আদিমকাল থেকে সাধু,সন্ন্যাসী সবারই ধ্যানভঙ্গ হতো যেই মন্ত্রে তা আ্যপ্লাই করলো অহনা। মাঝে একটা অদ্ভুত জেদ হয়ে গিয়েছিলো ওর,এতদিন যখন লেগে আছে শুভকে ওর চাইই..কালো,বেঁটে,রোগা বলে প্রথমটা অনেক পাত্রই নাকচ করে ওকে। শরীরটাও একসময় ভালো যেতোনা,প্রায়ই ভুগতো। শুধু পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো বলে চাকরিটা চট করে পেয়ে যায় শুভদের অফিসে। হয়ত বা ভালোলাগা প্রথমে,তারপর জেদ আর সবশেষে জয়। নাহ্ ওর কোন অপরাধবোধ হয়নি,একটা অসুখী পুরুষকে ও সুখী করেছে। তার মানে সেই ক্ষমতা ওর আছে। কি দিয়েছিলো রেনা শুভকে? যদি সত্যিই দেয় তাহলে ওর এত না পাওয়া ছিলো কেন? শুভর দূর্বলতাগুলো হয়েছিলো অহনার অস্ত্র। যদিও আড়ালে অনেকেই ছি ছি করেছিলো,সামনে বলতে সাহস পায়নি ওর মুখের জন্য।
ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে শুভ। চোখ খুলতে খুলতে বেলা হয়ে যায়। অহনা চা নিয়ে এসেছে। " তুমি কেন?সুধামাসি.."
"এখন থেকে তোমার সব দায়িত্ব আমার,আমি কাউকে করতে দেবোনা তোমার কাজ। সুধামাসি আছে,তোমার মেয়ে উঠে পড়েছে ওকে দেখছে।"
অহনার লম্বা চুল ঢাকে শুভর মুখ নরম আদরে।
এমনি করে একটু একটু করে ঢেকে ফেলেছিলো অনেক কিছু অহনা আর শুভকে অধিকার করেছিলো পুরোপুরি। ও কি পরবে,কোথায় যাবে,কি খাবে সবটাই। রূপকথা একটু একটু করে বুঝতে পেরেছিলো ওকে ওর মেমসোনার সাথেই থাকতে হবে। কাঁদতে,কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিলো একসময়।
শুভ পারেনি ঠিক বন্ধুত্ব করাতে ওদের। অহনাকে ভয় পেতো রূপ। " বাপি,আমি দুধ খাবোনা"বললেই অহনা বলতো," সুধামাসি ওকে আর দুধ দেবেনা,শুধু ব্রেড খাক।"
"সেকি অহনা! দাও আমি ভুলিয়ে খাইয়ে দেবো।"
" থাকনা,দুদিন দুধ খেতে না দিলে আপনিই খাবে। ভেবোনা শুভ।"
রূপ বুঝতে পেরেছিলো ওকে আর কেউ ভুলিয়ে খাওয়াবেনা।যেটা বলবে খাবেনা সেটা আর কেউ খেতে দেবেনা। বাপিটাও যেন কেমন হয়ে গেছে,ওকে আর আগের মত আদর করেনা। মা বাড়িতে থাকলে ওর কাছে আসেইনা। না থাকলে আদর করে।
রূপ এখন ক্লাশ ওয়ানে পড়ে,মা সবসময় বলে অনেক বড় হয়ে গেছে ওকে কোলে নিতে হবেনা। বাপি এখনও কোলে নেয় তবে ওকে নয় ভাইকে। রূপ এখন দিদি,মা কিছুদিন আগে হসপিটালের থেকে একটা ভাই এনেছে। কি সুন্দর তুলতুলে নরম একটা ভাই।তবে মা ওর কাছে খুব একটা যেতে দেয়না এখন।বলে," দূর থেকে দেখো।ও ছোট ব্যথা পাবে।" রূপের কষ্ট হয়না আর কারণ ভাইকে ও খুব ভালোবাসে। মা বাপি যখন চলে যায় তখন ভাইকে খুব আদর করে ও স্কুল থেকে এসে।
অহনা রূপকে পছন্দ না করলেও রূপের সাথে বিল্টুর অদ্ভুত বন্ডিং হলো। আর রূপের ভালোবাসার জগত হলো ভাইয়া।
রূপ দেখতে দেখতে অনেকটাই বড় হয়ে গেছে মেয়ের পড়াশোনাটার ব্যাপারে অবশ্য খেয়াল রেখেছিলো শুভ।ভালো স্কুলেই দুই ছেলেমেয়েকেই পড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলো।
তবে অহনার সব ফাইফরমাশ মোটামুটি খাটতে হত রূপকে।একটা সময় আয়ার খরচ বেশি বলে বিল্টু একটু বড় হয়ে যাবার পরই
সুধামাসিকে ছাড়িয়ে দেয় অহনা। রূপ সেদিন খুব কেঁদেছিলো সুধামাসিকে জড়িয়ে ধরে।
" কেঁদোনি মা,চিরকাল কে কাজের নোক রাখবে।তুমি বড় হয়েছো এখন নিজেই খেয়াল রেখো নিজের।"
সেই খেয়াল রাখা শুরু নিজের তারপর ভাইয়ের আবার একটু বড় হওয়ার পর সংসারেরও।
" রূপ আজকে একটু ফ্রায়েডরাইস বানিয়ে রাখিস।আমার দেরি হবে আজ আসতে,বিল্টু বায়না করছিলো।"
"আচ্ছা"..রূপ জানে না বললে মায়ের জেদ আরো বেড়ে যায়। তাই মোটামুটি সব কাজেই হ্যাঁ বলে।
*************
রূপ কলেজ পাশ করে ইউনিভার্সিটিতে এখন।
রূপের মধ্যে আজকাল একটু যেন পরিবর্তন দেখে অহনা। শান্ত রূপ একটু যেন চঞ্চল,আজকাল ফিরতে দেরি করে মাঝে মাঝে বলে স্যারের ওখানে এক্সট্রা নোট নেওয়া ছিলো।শুভ জানে যে রূপ ভীষণ বাধ্য আর স্টুডিয়াস পড়াশোনাতেও খুব ভালো তাই হয়ত স্যার একটু বেশিই কেয়ার নেন।
" তুমি একটু খবর নাও,এতক্ষণ কি পড়ে স্যারের কাছে? শুনেছি ওনার তো বয়েসও খুব একটা বেশি নয়। এদিকে উনি দেরি করে আসবেন আর অফিস থেকে এসে বাড়ির কাজ আমাকে করতে হবে।"
" কেন দি তো অনেক রান্না করে মা,দিয়ের তো সামনে পরীক্ষা।"
" তুই চুপ কর,এই হয়েছে এক দিয়ের চামচা। জন্ম দিলাম আমি আর ভক্ত হলো রূপের।"
তবে বাড়িতে বোমা ফাটলো যখন রূপ বললো ও স্যারকে ভালোবাসে আর বিয়ে করতে চায়।
" রূপ এ আমি মানতে পারছিনা।শুনেছি ভদ্রলোক ম্যারেড একটা বাচ্চা আছে।তোকে তো আমি কিছু কম করে বড় করিনি।সামনে তোর কত ব্রাইট ফিউচার এইভাবে একটা দোজবরে বিয়ে কেন করবি? মানছি ওনার ওয়াইফ মারা গেছে তবে একটা বাচ্চা তো আছে?"
অহনা চিৎকার করে, "বোঝো তাহলে,দেখেছো তো ভালো স্কুলে কলেজে পড়িয়ে কি লাভ হলো? শেষে একটা বাচ্চাওয়ালা লোককে বিয়ে করছে। ছি ছি! বিদায় করো ওকে এখুনি বাড়ি থেকে, যা পারে করুক। আমার ছেলেটা নষ্ট হবে ওর জন্য।"
" তুমিও তো একদিন একটা বাচ্চাওয়ালা লোকের ঘর ভেঙেছিলে মা? মনে পড়ে?
আমি তো কারো ঘর ভাঙবোনা বরং একটা বাচ্চা ওর মাকে পাবে আমার মধ্যে। তোমাকে আমি মা বলি,আমি বিশ্বাস করেছিলাম বাবা আমার মাকে আনছে ফিরিয়ে।কিন্তু পরে বুঝেছিলাম তুমি আমার নিজের মা নও।নিজের মা কখনো মেয়ের দুধ খাওয়া বন্ধ করেনা। মা না থাকার কি কষ্ট আমি জানি তাই আমি ঐ মা হারা বাচ্চাটার মা হবো একদম সত্যিকারের মা।"
অহনার মুখ দিয়ে আর কোন কথা বেরোয়নি। আজ আর রূপ তাকে ভয় পায়না বুঝেছিলো। তবে রূপ এত কথা জানলো কি করে যে ও শুভর ঘর ভেঙেছিলো?
রূপকথার মধ্যে কোনদিন এত জেদ দেখেনি শুভ তাই বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়েছিলো বিয়েটা। অহনা জেদ করে না গেলেও একা গিয়েছিলো ছেলের বাড়িতে কথা বলতে। মেয়েটা কোথায় যাচ্ছে কেমন ছেলে একবার দেখা দরকার।যদিও ইউনিভার্সিটিতে পড়ায় রূপকথার চেয়ে বয়েসে বছর দশেকের বড় শুনেছে।
ড্রয়িং রুমে বসে দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন অস্থির লাগে শুভর। রূপকথার ছবি তাও আবার শাড়ি সিঁদুর পরা! না না কি করে হয় এটা?
শরীরটা খুব অস্থির লাগে হঠাৎই। জিজ্ঞেস করেই ফেলে.." আচ্ছা এই ছবিটা কবে তোলা হয়েছে? মানে রূপকথার?"
খুব শান্ত গলায় শান্তনু উত্তর দেয়.." এটা পরিণীতার ছবি আমার মৃতা স্ত্রীর। দেড় বছর আগে হঠাৎই একটা আ্যক্সিডেন্টে,বুবলু তখন মাত্র ছমাসের। নিজে চলে গিয়ে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। বাপের বাড়ি থেকে ফিরছিলো গাড়ি করে সেইসময় ঘটে দুর্ঘটনা।
বাদবাকি কথাগুলো কানে ঢোকেনা শুভর,মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে। চোখটা ভিজে যায় কান্নায়,পরী আর নেই!
রেনা রূপকে ওর কাছে ছেড়ে দিয়ে দুই যমজ মেয়ের মধ্যে পরীকে নিয়ে চলে গেছিলো। বলে গিয়েছিলো কোনদিন যেন খোঁজ না করে ওদের। হারিয়ে গিয়েছিল রেনা আর পরী শুধু রয়ে গেছিলো রূপ। হঠাৎই এতো বছর বাদে আবার কেন এইভাবে অতীত ফিরে এলো সামনে! হায় ভগবান মেয়েটাও আর নেই!
সব কথা পরিস্কার হয়ে যায় শুভর,রূপকে দেখে হয়ত চমকে উঠেছিলো শান্তনু। তারপর হয়ত কোনভাবে কথাটা বেড়িয়ে আসে হয়ত রেনার সাথেও দেখা হয়েছে ওর। কিন্তু রূপ তো জানতোনা ওর অতীত।
শান্তনু বলতে থাকে তখন....
" আসলে পরীও আমার ছাত্রীই ছিলো হঠাৎই দেখা ভালো লেগে গেলো।ও তখন সবে কলেজে, আমিও তখন রিসার্চ করছি। বাড়ি থেকে আপত্তি করেনি বিয়েটা হয়ে গিয়েছিলো। তারপর হঠাৎই এই ঘটনা। প্রথমে রূপকথাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মামণিকে ফোন করেছিলাম..মামণি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেননি তারপর বলেছিলেন 'ওর বাবার নামটা একবার জিজ্ঞেস কোরো। আমি জানতাম পরিণীতার যমজ বোনের কথা মামণি আমাকে সব বলেছিলেন। বিশ্বাস করুন আমরা কিন্তু কেউ জোর করিনি রূপকথাকে আমাকে বিয়ে করতে। "
বুবুলুটা থপ থপ করে এসে ওর বাবার কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। ওকে দেখে অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো শুভর।হাতদুটো বাড়িয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে পরিণীতার ছবির কাছে দাঁড়িয়ে চোখের জল বাঁধ মানলোনা..." তুই ক্ষমা করে দে তোর বাপিকে।"
বড় অস্থির মন নিয়ে বাড়ি ফিরলো শুভ।
" কেমন দেখলে তোমার মেয়ের দোজবরকে? যা পারতো করতো,আবার ঘটা করে গেছে দেখতে।" বিদ্রূপের স্বরে বলে অহনা।
" হয়ত এর থেকে যোগ্য কাউকে রূপের জন্য আমি হাজার খুঁজেও পেতামনা।"
শুভর কথা শুনে অবাক হয়ে যায় অহনা।
রূপের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে জলের ধারা।মায়ের আদরের ছোঁয়া আর দুঃখী মুখটা খুব মনে পড়ে। মা দিদিকে নিয়ে একটা চাকরি করে কাটিয়ে দিয়েছিলো জীবন আর কোনদিনই ভরসা করেনি কাউকে। দিদি চলে যাওয়ার পর মায়ের কথা ভাবতেই আরো চোখ ভিজে যায় রূপকথার। ও নিশ্চয় পারবে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে বুবুলুর আসল মা হতে।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment