হঠাৎই ব্যাঙ্গালোরে চাকরি নিয়ে চলে আসা কৃষ্ণনগরের একটা যৌথ পরিবারের ছেলে রাণার। ঘরের ভাড়া বেশি হওয়াতে শেয়ার করে থেকে গেল একটা ফ্ল্যাটেই রুম শেয়ার করে অবশ্য রুম পার্টনার একটা মেয়ে ভালো নাম মৌবনী ডাক নাম মুনিয়া। মুনিয়া দাপুটে,সুন্দরী আর আধুনিকা এমন ভাব করে যেন ওকে এখানে থাকতে দিয়ে ধন্য করেছে। ও ঘরে থাকে, ডাইনিং রাণার। দুজনের দিন কাটছিল কাটাকুটি খেলাতে রাণার থাকার মেয়াদ ওখানে ছিল ছমাস। হঠাৎই একদিন সারপ্রাইজ ভিজিটে সাতসকালেই চলে এলেন রাণার বাবা একদম যাচ্ছেতাই ব্যাপার রাণার তো হাত পা ঠান্ডা হবার অবস্থা তবুও ব্যাপারটা বেশ সুন্দর করে ম্যানেজ করে নিল মুনিয়া। রাণার বাবাও অবাক হলেন না যেন আগেই বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাপারটা। মুনিয়াকে দুর্গা পুজোতে যাবার নেমন্তন্ন করেও গেলেন যাবার আগে। গা জ্বলে গেল রাণার, কি দরকার ছিল মেয়েটাকে বলার! যদিও পুজোতে বাড়ি গিয়ে অনেক আনন্দের মধ্যে রাণা ভেবেছিল যাক ঐ মেয়ে আসবে না নিশ্চয়। কিন্তু নাহ্ দশমীর দিন বন্ধু পুতুলকে নিয়ে কলকাতা থেকে চলে এল মুনিয়া কৃষ্ণনগরে। মুনিয়ার সৌন্দর্য্য আর মিঠে ব্যবহার ওদের বাড়ির সবাইকে মুগ্ধ করল। দশমীর বিকেলে ধুনুচি নাচে রাণাদের সাথে মাতল মুনিয়াও। ওর গালেও লাগল সিঁদুরের ছোঁয়া। একটু অপ্রস্তুত হলেও সামলে নিল মুনিয়া। রাণার মনে হল ওকে নিয়ে সবাই অযথা বাড়াবাড়ি করছে। সন্ধ্যেবেলায় ছাদের অন্তক্ষরী খেলাতে রাণা গাইল কতবার তোর..আমার মতে তোর মত কেউ নেই। সবাই একটু হাসলো। রাণার বোন ডল ভাবল ওর দাদাটা এত ভালো তবুও ওর গার্লফ্রেন্ড ওকে ছেড়ে গেল। ওদের বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী ঠাকুর বিসর্জনের পর ঠাম্মা দাদুর ঘরে প্রণাম করতে গেল সবাই। মুনিয়াও গেল সাথে রাণা আর ওর মাও। হঠাৎই ঠাম্মা একটা কান্ড করলেন একটা ছোট ভেলভেটের ব্যাগ মুনিয়াকে দিলেন অবাক হল সবাই। মুনিয়ার অস্বস্তি হল। রাণার বিরক্তি হল হঠাৎই ঠাম্মার বাড়াবাড়ি দেখে। খুলে দেখা গেল ওর মধ্যে একটা খুব সুন্দর রূপোর কাজললতা। একটা সময় এ বাড়িতে মেয়ে হওয়া বন্ধ হয়েছিল তাই কন্যাসন্তানের আশায় মানত করা হয়েছিল রূপোর কাজললতা। তারপর থেকে মা দুর্গার হাতে থাকে রূপোর কাজললতা। এ বাড়ির মেয়েদেরও বরণ করা হয় কাজললতা দিয়ে।
রাণা বুঝতে পারে ঠাম্মার ইঙ্গিত চরম অস্বস্তি হয় মুনিয়ার কারণ ওর বয়ফ্রেন্ড আছে প্রমোদ। কিছুদিন বাদেই প্রমোদ আসবে ব্যাঙ্গালোরে তখন লিভ ইনে থাকবে ওরা তেমনি কথা হয়েছে। প্রমোদের সাথে ওর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় থেকে প্রেম। প্রমোদ দেখতে সুন্দর, বড়লোক তবে অবাঙালী। শেষ পর্যন্ত পরের দিন যাবার আগে কাজললতা ফিরিয়ে দিয়ে যায় মুনিয়া রাণার মায়ের কাছে। একটু অসন্তুষ্ট হয় রাণার মা শান্তা,কিছু করার নেই দোষ তো করে ফেলেছেন শাশুড়িমা।
রাণা মায়ের কাছ থেকে শোনে সবটা ঠিক করে নেয় ওখানে আর বেশিদিন থাকবে না। তবে এখনি নয় একটু সময় নিয়ে ফ্ল্যাট দেখবে। হঠাৎই ওদের মধ্যে বন্ধুত্বটা একটু একটু করে জমতে থাকে। চিরকুট আদানপ্রদান হতে থাকে। মুনিয়ার জন্মদিনে রাণা ওর ঘুমের মধ্যেই ওর ঘরে রেখে যায় অর্কিডের গোছা আর পারফিউম। তবে মনের অনুভূতি শাসন করে চেপে রাখে রাণা মুনিয়ার জন্মদিনের দিনই বলে ওদের কমন ফ্রেন্ড জুনি আর অম্লানের সামনে ও চলে যাবে। মনটা খারাপ হয় মুনিয়ার তবুও ভাবে প্রমোদ আসলে তো ওকে চলে যেতেই হত তার আগে ও নিজে চলে যাচ্ছে সেটাই ভালো।
দূরে চলে যাবার পর দুজনেই মিস করে দুজনকে। তবুও মুনিয়া ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঘর গোছাতে কারণ প্রমোদ আসবে কিছুদিন বাদেই। এর মাঝেই রাণা ওদের ওর ফ্ল্যাটে ইনভাইট করে। অনেকদিন বাদে মুনিয়াকে দেখে খুব ভালো লাগে রাণার ওকে বাইকে করে নিয়ে যায় ফ্ল্যাটে। জুনিরাও এসেছিল সারাদিন দারুণ কাটল ওদের। রাণার ফ্ল্যাটের সাজানো মন কাড়ল মুনিয়ার শুনল পুতুল কিনে পাঠিয়েছে পরদা। এই নিয়ে মজাও হল। রাতে ওরা চলে যাবার পর রান্নাঘরে একটা গিফ্টপ্যাক আর অনেকদিন বাদে মুনিয়ার লেখা চিরকুট পেল মুনিয়া একটা টাই আর ফ্রেঞ্চ পারফিউম রেখে গেছে লিখেছে বন্ধুত্বের গিট্টুটা টাইট করে বেঁধে গেল টাই দিয়ে। মনটা উড়ে যায় রাণার।
হঠাৎই একদিন জুনির ফোন আসে ওকে হসপিটালে ডাকে ওরা মুনিয়া নাকি খুব অসুস্থ। ছুটে আসে রাণা শোনে মুনিয়া নাকি সুইসাইড করতে গেছে ঘুমের ওষুধ খেয়ে। মনপ্রাণে প্রার্থনা করে রাণা,কাছে না হলেও এই পৃথিবীর কোথাও একটা বেঁচে থাক ঝগড়ুটে মেয়েটা। অনেক লড়াইয়ের পর চোখ খুলেছে মেয়েটা, ও তো বাঁচতে চায়নি কেন ওরা বাঁচালো ওকে? প্রমোদের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে এক বড়লোকের মেয়ের সাথে। শ্বশুরের টাকায় বাইরে এমবিএ করতে যাচ্ছে প্রমোদ। মুনিয়া বলাতে ওকে যা খুশি বলেছে প্রমোদ। নিতে পারেনি সেটা মুনিয়া,সবাই তো ওদের সম্পর্কে জানে। কি নিয়ে বাঁচবে ও?
তবে সবার শুভকামনায় একটু একটু করে ভালো হয়ে ওঠে মুনিয়া। রাণা চিরকুটে লেখে পৃথিবীটা খুব সুন্দর এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়িসনা।
মুনিয়া ওর ফ্ল্যাটে চলে গেছে। ওকে আগলাতে ছুটে এসেছে ওর মা বাবা। একদিন রাণা যায় ওকে দেখতে ওকে দেখে মুনিয়ার মা বলে ওঠেন তুমি এখানে থাকলে ও এমন কিছু করতে পারত না। মুনিয়া রাণাকে কফি করে দেয়। ওর মনে আছে রাণা ওর হাতের কফি ভালোবাসে। রাণা ভালোবাসায় ডুবে যায় কিন্তু প্রকাশ করে না দূর্বলতা। হঠাৎই জুনি ওকে বলে মুনিয়ার সুইসাইড অ্যাটেম্পট করার জন্য ওকে রাখবে না ঐ ফ্ল্যাটে। রাণা বুঝতে পারে জুনি এবার বলবে মুনিয়াকে ওর ফ্ল্যাটে রাখতে। তাই পথটাই বন্ধ করে দেয় প্রথমেই না করে। অবশেষে মুনিয়া কিছুদিনের জন্য একটা লেডিস হস্টেলে থাকে। মাঝে মাঝে মুনিয়ার হস্টেলের সামনে রাণাকে দেখা যায়।
হঠাৎই জুনি আর অম্লান প্ল্যান করে উটি যাবার। রাণা প্রথমে রাজি না হলেও রাজি হতেই হল। উটির পাহাড়ি রাস্তায় ভোরের আলো দেখতে দেখতে খুব কাছাকাছি এসে পড়ে মুনিয়া আর রাণা। কিন্তু কেউ কারো কাছে ধরা দেয়না। রাণা জানে মুনিয়া একটা ধাক্কা খেয়েছে তাই কখনই ওকে কিছু বলা যাবেনা। তবে মুনিয়া ময় হয়ে ওঠে ওর ঐ কটা দিন। সত্যিই দারুণ জায়গাগুলো আর মুহূর্তগুলো। জুনি আর অম্লান খুব ভালো একটা প্ল্যান করেছে। ওদেরকে একসাথে দেখে ভালো লাগে জুনির। মুনিয়ার জন্য রাণাটাই পারফেক্ট একদম। কেন যে মেয়েটা বুঝতে চায়না ছেলেটার ভালোবাসা।
ওরা ফিরে এসেছে কয়েকদিন হল। মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। হঠাৎই ভালোবাসার কথা বেরিয়ে এল অসুখে। রাণার খুব জ্বর এল,মুনিয়া পারল না না এসে থাকতে। তারপরেই জ্বরের ঘোরে মনের কথা বলে ফেলল রাণা। ভালোবাসা বাসি পাকা হয়ে গেল। মনে বসন্তের মিঠে বাতাস লাগল মুনিয়ার। মুনিয়া এখন ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে একদম রাণার ফ্ল্যাটের কাছেই রাণার বাইকের বাঁশী শুনেই নেমে আসে মুনিয়া। রাণা ওকে পৌঁছে দেয় অফিসে।
দেখতে দেখতে আরেকটা পুজো এসে যাচ্ছে। রাণা বাড়িতে আসে পুজোতে। ওর বোন ডল মাঝে মাঝেই উঁকি দেয় দাদার মোবাইলে দেখে ময়না নামের কেউ একটা দাদাকে কল করে মেসেজ করে। কিন্তু কে এই ময়না? মুনিয়া দিদিটাই তো ভালো। হঠাৎই রাণা শোনে ওর বাবার বন্ধুরা বাড়িতে আসছে ওকে দেখতে। রাণা ভোরে উঠেই কলকাতা চলে যায় নবমীর দিন। সেখানে জুনি,পুতুল, মুনিয়া আরও সব বন্ধুদের সাথে সারাদিন কাটায়। বোনকে বলে অফিসের কাউকে রিসিভ করতে কলকাতা এসেছে কাল ফিরবে। বাড়ির সবাই বিরক্ত হয়। শান্তা কড়া করে ওকে ফিরতে বলে বাড়িতে।
জুনি পুতুল বারবার রাণাকে বলে এবার বাড়িতে সব বলতে কারণ মুনিয়ার মা বাবাও ওর জন্য পাত্র খুঁজছেন। মা বাবাকে সব বলবে এই ভেবেই অনেক রাতে বাড়ি ফেরে রাণা। মাকে বলেই ফেলে ময়না বলে কেউ নেই ও মুনিয়া। আচ্ছা কাজললতা টা কি ফেরত দেওয়া যায়না মানে মুনিয়া ফেরত পেতে পারেনা? ছেলের কথা শুনে হাসে শান্তা বলে ঠাকুমাকে বলতে হবে। পরদিন ঠাকুমার ঘরে গিয়ে সাহস করে বলেই ফেলে কাজললতা মুনিয়াকে দেবার কথা। ঠাকুমা বলেন আগে নতুন দিদিভাই আসুক তারপর।
হঠাৎই একটা কান্ড ঘটে বাইরে থেকে বাবার ডাক শোনে রাণা ওঁর বন্ধুরা এসেছেন প্রমাদ গোণে রাণা। বাইরে এসে বসন্তের মিঠে বাতাসে মন ভরে ওমা মুনিয়াকে নিয়ে ওর মা বাবা এসেছেন! মুনিয়ার মা বাবার কলেজের বন্ধু। পেছনে দাঁড়িয়ে হাসে জুনি ইআর পুতুল।
দশমীর বিকেল জমে ওঠে ধুনুচি নাচে প্রেমের আদরে। ঠাম্মার ঘরে গিয়ে প্রণাম করে কাজললতা নিতে হাত পাতে মুনিয়া। ঠাম্মা মুচকি হেসে বলে সুদ সমেত ফেরত দেব সময়ে।
কোন এক মিঠে দিনে গায়ে হলুদের তত্ত্বে আসে রূপোর গাছকৌটোর সাথে রূপোর কাজললতা। রায়চৌধুরীদের বৌ হয়ে শ্বশুরবাড়িতে পা রাখল মুনিয়া। ওরা এখন একই ফ্ল্যাটে থাকে,খুনশুটি মাখা দাম্পত্যে মেখে রয়েছে গাঢ় ভালোবাসা। বন্ধুত্বটা আছে সেই আগের মতই।
Comments
Post a Comment