-'খুলেই দেখ না।'
টিকিটটা নিয়ে তাড়াতাড়ি চোখ রাখে তাতে মুনিয়া।
-' কাশ্মীর বাই ফ্লাইট!'
-' হ্যাঁ তারপর ওখানে কয়েকদিন থেকে কার্গিল হয়ে লেহ লাদাখ । তারপর ফেরার পথে মানালী হয়ে ফেরা দেন চন্ডীগড় থেকে একদম ফ্লাইট। মধ্যবিত্ত বরের সুইজারল্যান্ডে। মানে কাছাকাছি কোথাও একটা নিয়ে যাওয়া।'
রাণার শেষ কথাটায় একটা কেমন যেন বিষাদের সুর শুনতে পায় মুনিয়া। ও বুঝতে পারে রাণা সবসময় ওকে বেস্টটাই দিয়েছে।
রাণাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খায় মুনিয়া। রাণা বুঝতে পারে মুনিয়া একটা আলতো আদরের ছোঁয়া দিয়ে ওকে খুশি করতে চাইছে মুনিয়া।
-" খুব খুশি আমি,আমার অনেকদিনের ইচ্ছে লেহ লাদাখ যাব। ইশ্ এতদিনে সেই ইচ্ছেপূরণ।"
-' কই কোনদিন তো বলনি আমাকে তুমি লাদাখ যেতে চাও?'
-' না বলতেই যখন সব পাই তখন বলব কেন?'
-' তবুও একটা ইচ্ছের কথা বলেছ আমাকে। আমি নিয়ে যাব ঠিক তোমাকে প্রমিস। আসলে আমাদের মানে আমার জীবনে সবই লেটে হয়।'
-' লেটে মানে?"
রাণা এবার হেসে ওঠে প্রেম ভালোবাসা, বিয়ে,হানিমুন সবই দেরি দেরি করে।'
মুনিয়া রাণার কোলে মাথা রেখে শুয়ে হেসে গড়াগড়ি করে,' রাণা ডোন্ট লাই বাবুসোনা আমার। তুই যখন ক্লাশ টুয়েলভে তখন প্রথম প্রেমে পড়েছিস আমাকে বলেছিস। সে দিক থেকে ইউ আর সিনিয়ার টু মি। আমি তো ফার্সট ইয়ারের মাঝামাঝি।'
-' ওসব কথা থাক না এখন। শুধু উল্টোপাল্টা বকা সবসময়। আর কিন্তু বেশি দেরি নেই যেতে সুতরাং যাবার প্ল্যানিংটা হোক এবার।'
-' সে তো হবেই,কত নতুন ড্রেস তো আছে। সেগুলো নিয়ে নিলেই হবে। শুধু কয়েকটা উইনটার গার্মেন্ট নিতে হবে। তোমারও লাগবে। হানিমুন বলে কথা। আগের জ্যাকেটটা পরে যাওয়া যাবে না। সে সব হবে ঠিক। আচ্ছা সে কেমন দেখতে ছিল? আমার থেকে সুন্দর?'
' মুন তুই মাঝে মাঝে এমন ছেলেমানুষী করিস না। কিছু খেতে দে। আচ্ছা আমি কফি করে আনি। তুই বরং কুকিগুলো নিয়ে আয়।'
' আমার ভালো লাগছে না। একটু পরে যাবে তুমি বোসো না একটু। আচ্ছা কেমন ছিল সে? ব্রেকআপের পর কোনদিন পা পিছলে গিয়ে পড়তে তার প্রোফাইলে? অথবা হোয়াটস অ্যাপে দেখতে ওর লাস্ট সীন?'
হঠাৎই কি শুরু করেছে মুনিয়া? রাণার কেমন যেন একটু অস্বস্তি হয়।
-' আমরা তো বর্তমানে বেশ ভালো আছি মুনিয়া। হৃদয়ভাঙা দুই প্রাক্তন আবার নতুন কাউকে নিয়ে স্বপ্ন সাজিয়েছি। আমাদের বারান্দা বাগানের ফুলে মাখামাখি আমাদের ভালোবাসার সুবাস। তারমধ্যে কেন আবার অতীত নিয়ে টানাটানি?'
-' তুই তো কোনদিন তেমন ভাবে জানতে চাসনি কিছু তাই আমি বলিনি। আর বইয়ের যে পাতাগুলো কবে ছিঁড়ে গেছে নতুন ক্লাশে উঠে নতুন পড়াতে মন দিয়েছি তখন আর আগের পড়ায় কি হবে?'
রাণা আলসে হয়ে শুয়ে পড়ে ওর পাশে জড়িয়ে ধরে মুনিয়াকে আজ ওর সব কথা বন্ধ করে দিতে ইচ্ছে করছে ঠোঁটদুটো বন্ধ করে।
একা থাকার এই এক জ্বালা! কখনও আদরে আর কখনও ঝগড়ায় কেটে যায় দিন। কোনদিন খাওয়াও হয় না আদরের চোটে। তারপর মাঝরাতে উঠে মাইক্রোওভেনে পি পি শুরু হয়।
রাণার আদরে মুখ ডোবায় মুনিয়াও। জড়ানো গলায় বলে,' আমি জানি সেদিন সুইজারল্যান্ডের কথাটা শুনে তোর খুব খারাপ লেগেছে। সত্যিই তো আমি জানি এখন অত বড় একটা ট্রিপ করা ইমপসিবল। তবুও আমি যেতে চেয়েছিলাম কেন জানিস?'
' কেন আবার? পাগলীর ইচ্ছে তাই।'
মুনিয়া বলে,' কিছু বুঝিসনি,ওটা জ্বালা।
এই যন্ত্রণায় কতজন জ্বলছে আমার মত জানিস? ফেসবুক স্ট্যাটাস বড় যন্ত্রণার। আমিও তাই পাল্লা দিতে চেয়েছিলাম। তারপর হঠাৎই মনে হয়েছিল মুহূর্তগুলোকে চেটেপুটে ভোগ করে ভালো থাকার নামই জীবন। আমাদের মা বাবার সময় তো স্ট্যাটাস ছিলই না। ঠাম্মার কথা ভাব,আমাদের সবাইকে নিয়ে কত হ্যাপি আছে। আমি প্রমোদের প্রোফাইলে গেছিলাম। দেখেছিলাম ওরা সুইজারল্যান্ড গেছে। তাই আমারও ইচ্ছে করেছিল। ও যা পারে তা আমরা পারি না কেন? তুই হয়ত রাগ করবি শুনে।'
রাণা অবাক হয়ে যায় মুনিয়ার কথা শুনে,' রাগ করব কেন? ভালো বন্ধু,প্রথম প্রেম কি ভোলা যায়? প্রোফাইলেই তো গেছিস। বাড়ি গেলেও রাগ হত না তবে একটু অভিমান হত।
ও হয়ত তোকে আমার থেকেও বেশি ভালো রাখতে পারত। কিন্তু সত্যি কি ও তোকে ভালোবেসেছিল?'
মুনিয়ার গলাটা হঠাৎই ঝাপসা হয়, ' ভালোবাসেনি তো,একদম ঠিক বলেছিস। আসলে আমরা দুটোই ভীষণ বোকা বুঝলি। খুব খুব বোকা। তাই আমাদের সবাই ঠকায়। তবুও আমরা ওদের কথা ভাবি তাই না?'
রাণা অবাক হয়ে যায় মেয়েটার আজ হঠাৎ কি হল? তবে কি ওর কথাতে ও দুঃখ পেয়েছে? মধ্যবিত্তদের সুইজারল্যান্ড কথাটা ওর বলা উচিত হয়নি।
মুনিয়া আজ কাঁদছে হঠাৎ, মনটা খারাপ হয়ে যায় রাণার। সবসময়ই তো ওকে খুশি রাখতে চেয়েছে রাণা। ও জানে ওর প্রাক্তন প্রেমের জায়গায় এত গভীর ক্ষত যে নিজেকে শেষ করে ফেলতে চেয়েছিল একসময় মেয়েটা। যার কাছ থেকে এত আঘাত পেয়েছে কেন দেখে ওর প্রোফাইল কে জানে?
নিজেকে হঠাৎই প্রশ্ন করে রাণা,ভেতর থেকে কে যেন বলে তুইও তো দেখতিস একসময়। হ্যাঁ রাণাও খুঁজেছে ঝুমকে কত ঘুমজাগা রাতে গোপনে। তবে নাহ্ একটা সময় ওর বিকৃত ছবি দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। মনে মনে ভেবেছিল এটাই হয়ত ওর পরিণতি ছিল।
মুনিয়ার মুখ বালিশে ঢাকা। অভিনয় করে চলতে শেখেনি মুনিয়া। তেমনভাবে কোনদিন কাঁদেওনি রাণার কাছে। তবে আজ কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছে।
সব সত্যি কথা বলে দিতে ইচ্ছে করছে ওকে।
ওর মুখটা দুহাতে জড়ায় রাণা,' যাওয়াটা ক্যানসেল করে দিই বরং। আমি ভাবলাম আজ কত খুশি হবে আমার বৌটা। আজই তুই এত কাঁদছিস। কেন বলত? আমি কি হার্ট করেছি তোকে? সরি সোনা। আর ভালোই তো আমরা দুই বোকা বেশ তো আছি একসাথে প্রায় পাঁচমাস। আমার একটা মহা পাগলী বৌ।'
**********************
মুনিয়া মুখেচোখে জল দিয়ে এসেছে কফি করে এনেছে রাণা। খুব মুডি মুনিয়াটা,ঝগড়ুটে অথচ নরম।
হয়ত খুব বেশিদিন নয় তবুও এরমধ্যে ভালো করেই বুঝেছে মুনিয়াকে। কাউকে ভালোবাসলে একদম পাগলের মত ভালোবাসে।
ওদের বারান্দাটা একটুকরো মিঠে বাতাসের ছোঁয়া নিয়ে আসে ওদের জীবনে। সবুজ পাতা আর ফুল দেখে কতটা সময় কেটে যায় ওদের। বাইরে গেলে কিছু টব ল্যান্ডলেডির কাছে ছাদে রেখে যাবে ভেবেছে।
' কফিটা ভালো হয়েছে? এখন হাল্কা লাগছে অনেকটা? ভালো লাগছে মন? এই উইকএন্ডেই আমি যাব শপিংয়ে। যা যা কেনার কিনে নিবি তখন।
কথাগুলো বলে রাণাও হাসে খিলখিল করে হাসে মুনিয়া,' কখনও তুমি আবার কখনও তুই। আমি কি বাচ্চা নাকি যে শপিং করে মন ভালো করবি। সত্যিই আজ অনেকটা হাল্কা লাগছে। কিন্তু এখনও অনেক কথা বাকি?'
রাণার বুকের ভেতরটা কাঁপে এবার, মুনিয়া কি বলতে চায় আরও? প্রমোদের সঙ্গে কাটানো সময়ের কথা? নাহ্ আর কিছু জানতে চায় না রাণা। তাহলে কি কথা বাকি?
আদুরে গলায় মুনিয়া বলে,' তোর কথা তো কিছু শোনাই হল না! সব সময় কম কথা বলিস। কোনদিন যাসনি পথ ভুলে এক্সের প্রোফাইলে?'
-' আমি তো ফেসবুক করি না তুই জানিস তো। শুধু হোয়াটস অ্যাপ করি তাও শুধু কাজের জন্য। সারাদিন যা চাপ কাজের সময় হয় না।'
-' আগে কোনদিন দেখিসনি ব্রেকআপ হওয়ার পর? জানতে ইচ্ছে করেনি কেমন আছে সে? তার বর্তমান কেমন?'
রাণা নিজেকে আড়াল করতে পারে না আর আজ কি যে হয়েছে মুনিয়ার কে জানে?
-' সত্যি দেখেছি প্রথম প্রথম। সুন্দরী ছিল সে তবে তোর মত মনটা মিঠে ছিল না। বিয়ে হয়ে গেছে দেখেছিলাম। বরের গাড়ি,বাড়ি আছে ওর কাছে হাইফাই মানে বেটার অপশন ছিল। আসলে সবাই তো ভালো কিছুই চায় জীবনে। এতে দোষের কি আছে?"
মুনিয়া কফি শেষ করে ওর গা ঘেঁষে বসে। রাস্তাটা বেশ ফাঁকা। সামনের গাছটায় পাখিরা ডানা ঝাপটাচ্ছে। হয়ত ওরাও রাতের নিরালায় ভালোবাসাবাসি করছে।
-' মামণি জানত? মানে কিছু বলেনি? আমার মা প্রথমে খুব আপত্তি করেছিল।'
-' হ্যাঁ জেনেছিল,খুব অশান্তি করেছিল। তারপর অবশ্য কিছু বলেনি। বাবা বুঝিয়েছিল। তবে এই যে মহারাণী ঠাম্মা কিন্তু ওকে কাজললতা দেয়নি।
ঠাম্মা তার নতুন দিদিভাইকে ঠিক চিনেছিল।'
রাণার কথায় মন হারিয়ে যায় মুনিয়ার সত্যিই কি আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছিল সেবার পুজোতে রাণাদের বাড়িতে গিয়ে।
' ঘরে চল এবার, ফ্রীজে তদন্ত করি কি খাব রাতে? আজ মনে হচ্ছে হাওয়া খেয়েই রাত কেটে যাবে।'
-' আজ না খেলেও হয় মনে হচ্ছে সত্যিই খুব হাল্কা লাগছে আজ। এই কথাগুলো আমাদের আগেই শেয়ার করা উচিত ছিল। অবশ্য আমার অনেক কথাই তো তোর জানা।'
-' আমি তো কখনও জানতে চাইনি মুনিয়া, কি দরকার আমাদের বর্তমানের সাজানো সংসারে অতীতকে টেনে এনে? "
-" সত্যিই কি অতীতকে এত সহজে মোছা যায় রাণা? কখনও কি ঘুরে ফিরে আসে না মনে? আমাদের আলস্যে অথবা অভ্যেসেই তো অতীতের হাতছানি ফিরে ফিরে আসে। আজ ঐ গানটা গাইবি একবার.. কতবার তোর আয়না ভেঙেচুরে....প্রথম শুনেছিলাম কৃষ্ণনগরে। খুব ভালো লেগেছিল। তবে আগে বল তাকে দেখেছিলি?"
উফ্ফ সত্যি আর ভালো লাগছে না রাণার ইচ্ছে করছে সবটুকু বলে দিতে মুনিয়াকে। কিন্তু মৃত অতীতকে হঠাৎ জাগিয়ে বর্তমানকে মৃত করবে কেন? না না কিছুতেই নয়। যা গেছে স্বেচ্ছায় তাকে যেতে দেওয়াই ভালো।
রাণা বলে,' হমম দেখেছি সোশ্যাল মিডিয়ায় ওদের ভিডিও হানিমুনের ছবি। তবে বিদেশে নয়,এদেশেই তোলা। তারপর আর কোন ইন্টারেস্ট ছিল না।'
মুনিয়াকে একদম কাছে জড়িয়ে ধরে রাণা শুয়েছে। আজ মনে হচ্ছে মুনিয়াকে অনেকটা বেশী ভালোবাসা দরকার। মাঝে মাঝেই ওর আব্দারে গান শোনাতে হয় ওকে। নিজে কয়েক লাইন গেয়ে,ইউটিউবটা চালিয়ে দেয় রাণা। হাওয়াতে নেটের পর্দা উড়ছে। এলোমেলো বাতাসে মনটা খুবই অগোছালো রাণার,কেন যেন মুনিয়াকে কিছুতেই সত্যিটা বলতে পারল না যে সেদিনের সেই গলা পোড়া মেকআপ আর্টিস্ট ওর এক্স ছিল। যাকে নিয়ে মুনিয়ার সহানুভূতির শেষ ছিল না সেই মেয়েটা একটুও ভালো না। খুব খুব খারাপ। অনেক খারাপ ভিডিও দেখেছে ওর। গলাটাই বা কে পুড়িয়েছে কে জানে?
*************************
বাপের বাড়িতে এসে প্রথমে খুব অসুবিধা হয়েছিল ঝুমের। গরম লাগত এসি ছাড়া,শক্ত বিছানা। মনে হত সব যেন কেমন। একদিন বলাতে মায়ের কাছে শুনেছিল..' কে মাথার দিব্বি দিয়েছে মা এখানে আসতে। বেশ তো নিজে দেখেশুনে বিয়ে করেছিলি। ওখানে থাকলেই তো পারতিস। আমার হয়েছে যত জ্বালা। ভগবান মরণও হয় না আমার!"
ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল ঝুম কেন এসেছিলাম জান না। আমি মরে গেলেই ভালো হত দেখছি। তোমরাও বাঁচতে আর আমিও বাঁচতাম।"
বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল নাড়াচাড়া করে ঝুম। এখন এটাই একমাত্র অসময়ের সঙ্গী।
বর্ধমান থেকে ফিরে আসার পর রাণার প্রোফাইল খুঁজেছিল এই প্রথম ও। সত্যিই তেমনভাবে কোনদিন রাণাকে মিস্ করেনি ও। মৈনাকের ভালোবাসা আর ওর দেওয়া সুখে একদম বুঁদ হয়েছিল ও। তবে রাণার সাথে দেখা হবার পর যেন হঠাৎই ইচ্ছে হয়েছিল দেখতে কেমন আছে রাণা? ওদের ছবি দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল।
তবে খুব হতাশ হয়েছিল দেখে, কোন আপডেটই নেই। কবেকার একটা ছবি লাগানো। গুটি গুটি পাতা উল্টে উঁকি দিয়েছিল মুনিয়ার প্রোফাইলে আসলে ওর বন্ধু পুতুলের ফ্রেন্ডলিস্টে ও আছে। মানে পুতুলই বলেছিল পাঠাতে।
একটু একটু করে দেখেছিল যতটা দেখা যায় ওদের ছবি। অবশ্য মুনিয়ার একার ছবিই বেশি সেখানে। তবে যেখানে যেখানে দুজনের ছবি দেখে সেখানে দাম্পত্যের গভীরতা মাপে ঝুম। অবশ্য মনে হয় নতুনই বিয়ে হয়েছে।
একটা সময় নিজেই হেসে ফেলে ঝুম,হাত বোলাতে থাকে ওর কোচকানো গলাটাতে কতটা গভীর ছিল ওদের দাম্পত্য? নাকি সেখানে ছিল শুধুই লোভ আর লালসা। পাকা শিকারীর মত ওকে ছিপে গেঁথে তুলেছিল মৈনাক। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করত ওর অল্প জামাকাপড় পরা ছবি।
নিজের পেটটায় হাত রাখে ঝুম। দুবার মা হওয়ার সম্ভাবনা হয়েছিল ওর। প্রথমবার অতি উৎসাহে বলে ফেলেছিল মৈনাককে। কিছুতেই রাখতে দেয়নি বাচ্চাটাকে। বলেছিল ফিগার খারাপ হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়বার একান্ত গোপনে সামলাতে চেয়েছিল বাচ্চাটাকে ঝুম তবুও পারেনি। ঐ কথাটা মনে হলেই অদ্ভুত কান্নায় গলা জড়িয়ে আসে ওর। কিছু বলেনি মৈনাককে তবুও একদিন খাওয়াদাওয়ার কিছুক্ষণ বাদে খুব পেটে ব্যথা। তারপরেই রক্তে ভেসে যাওয়া।
কিছুই জানে না এমন ভাব করেছিল মৈনাক। জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বলেছিল,'আমি বাবা হব,অথচ আমাকেই বলনি। তিনমাস হয়ে গেছে। জানলে ডাক্তার দেখাতাম।'
' তুমিই আমাকে ওষুধ খাইয়েছ। তাই ও থাকল না।'
-' কি যে বল! বিরিয়ানি এনে দিলাম খেতে চাইলে বলে। শোন সামনের মাসে গোয়া যাব আমরা। তারমধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠ। ফল ওষুধ সব এনে দেব খাবে। আর মাসাজ করাবে ভালো করে। মোটা হয়ে যাচ্ছ কেমন যেন?
-' আর কত কি চাও তুমি? আমাকে আর কত কি করতে হবে?'
-' অনেক কিছু চাই আমি। না ইচ্ছে হলে কোর না,বাপের বাড়ি চলে যাও। ইচ্ছেমত পার্লারে যাচ্ছ। ড্রেস কিনছ তাতে হচ্ছে না। তাহলে যাও তোমাদের ঐ খুপড়ি বাড়িতে।'
একমাস বাদে ওরা গোয়া গেছিল। ওখানে কি হয়েছিল ভেবে চমকে ওঠে আজও ঝুম। অসহ্য যন্ত্রণা হয় শরীর জুড়ে।
*****************
কয়েকদিন মৈনাক ওকে ডুবিয়ে রেখেছিল ভালোবাসার চাদরে। সারাক্ষণ ঝুম্মা আর ঝুম্মা। অনেকদিন বাদে ঝুম্মা ডাকটা যেন আবার কানের কাছে শুনতে পেল ঝুমকা। অদ্ভুতভাবে ভালোবাসার মানুষের বদলের সাথে সাথে ভালোবাসার নামগুলো ও পাল্টে যায়। রাণা ওকে ডাকত ঝুম বলে,বলত আমি অত বড় নামে ডাকতে পারব না। অবশ্য ঝুম্মা নামটা আর নেই এখন। বরং লোকে ওকে আদর করে ঝুম বলেই ডাকে। সোহিনীদির মুখে প্রথম ঝুম নামটা শুনে চমকে উঠেছিল প্রথমে।
অনেক ফল এনেছে মৈনাক, একটা রান্নার লোকও রেখে দিয়েছে ওর শরীর খারাপ বলে। ওর ডায়েট নিয়ে খুব চিন্তা মৈনাকের। সবসময় বলে,' শোন যা চার্ট করা আছে সেই মত খেয়ো বুঝলে। ডঃ তোমাকে কার্বোহাইড্রেট কম খেতে বলেছে। প্রোটিন বেশি। ইস্ আমি যদি আগে একটু নজর দিতাম তাহলে এমন হত না। তুমিও যে কি আমাকে তো বলবে?'
ঝুমের তখন মনে হয়েছিল সত্যি বোধহয় মৈনাক ওকে ভালোবেসে এইসব করছে।
-' আচ্ছা আমাদের কয়েকদিন বাদেই তো গোয়া গেলে হত তাই না? আরেকটু সেরে উঠতাম আমি।'
-' আমি কি তোমাকে না সারিয়ে নিয়ে যাব ভেবেছ? কতদিন আগে থেকে ঠিক করা আছে প্ল্যানটা। ভেবেছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দেব। তারমধ্যেই যা কান্ড ঘটল। যত্ন করা হচ্ছে সব ঠিক হয়ে যাবে। গোয়া থেকে ফিরে আসার পর আবার হয়ত সুখবর আসবে।'
স্বপ্নের গভীরে ডুবে গেছিল ঝুমকা। মনে মনে চলে গেছিল গোয়ায়। ওখানে কোন বড় হোটেলে নিজেকে কল্পনা করেছিল। মৈনাকের আদরে আদরে ডুবে যাবে কোন একটা নরম বিছানায় জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে। তাই একটু লজ্জা পেয়ে বলেছিল
-' ইশ্ এত তাড়াতাড়ি! আবার!'
ওর গলায় ঠোঁট ঘষতে ঘষতে মৈনাক বলেছিল," হুঁ আবার। মৈনাকের মত তোমার শরীরকে জাগাতে কে পারে শুনি? এবার একদম সিন্ধু থেকে মুক্তো এনে সাজিয়ে দেব ঝুম্মাকে। আমার ঝুম্মা।'
ড্রেস ট্রায়াল দিতে দিতে হাঁফিয়ে গেছিল ঝুমকা।
ইশ্ সব এমন ছোট ছোট ড্রেস! বেশিরভাগই তো বিকিনি। তাছাড়া এই প্যান্টি ভেতরের জামা এইসব এত দাম দিয়ে কিনেছ কেন? এগুলো তো হিরোইনেরা পরে। এগুলো পরে বাইরে ঘুরব নাকি?'
' ঘুরবে,ওর ওপর একটা পাতলা কাপড় জড়িয়ে নাও। এই তো এগুলো এনেছি। বুকের কাছটা বেঁধে নেবে। দাঁড়াও আমি দেখাচ্ছি। বোকাই থেকে গেল আমার বৌটা। মানুষ আর করা গেল না।'
মৈনাক একটা ভিডিও চালিয়ে দিয়েছে। ঝুম দেখে বিকিনির ওপর জড়ানো কাপড়ের টুকরোটা খুলে মেয়েরা স্নান করছে।
-' এটা কি গোয়াতে?'
-' হ্যাঁ আমাদের দেশ বলে ঢাকাঢুকি লাগে। মালদ্বীপ হলে এইসব কিছুই লাগত না। তুমি শুধু আমি যা বলব তাই কর তাহলে কোথায় না নিয়ে যাব তোমাকে।'
-' আর কি করব? তোমার কথামত পোজ দিচ্ছি। ভিডিও করছ আমার ছোট ছোট জামা পরিয়ে। শরীরের অনেকটা দেখছে লোকে। আর কত?'
-' বোকা মেয়ে একটা! তোমার দিদির মত একমাথা থ্যাবড়ানো সিঁদুর পরে কপালে ধ্যাবড়া টিপ পরে সাজলে ভালো হত তাই না? কত লোক তোমার ভিডিওতে কমেন্ট করেছে দেখেছ?'
-' আমার থ্যাবড়া সিঁদুরই ভালো ছিল। দিদি কি সুন্দর দুটো ছেলেমেয়ে শ্বশুর শাশুড়ি নিয়ে ঘর করছে! আমার তো মনে হয় মাঝে মাঝে আমি হোটেলে আছি। আর আমি তোমার বৌ নয় মডেল। কমেন্ট আমি দেখেছি। খুব বাজে কমেন্টও অনেকে করে। কেউ আমার সাথে শুতে চায়,কেউ আমার সাইজ নিয়ে কথা বলে। আবার কেউ বা.....'
কথা বলতে বলতে হাঁফায় ঝুমকা। মৈনাক ওকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেয় তারপর ওর শরীর দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে,' নিজেকে কখনও চিনলে না। কত ভালো ফিগার তোমার। এটা তো ভগবানের দেওয়া। তোমার যা আছে তাকে কাজে লাগাবে না।'
-' কাজে তো লাগিয়েছি,বিয়ে হয়েছে। এবার ঘরসংসার করব। তেমন হলে চাকরিও করতে পারি।'
মৈনাক হঠাৎই হো হো করে হেসে ওঠে,' ধুর ঘরে বসে টাকা রোজগার করতে পারলে কে যায় চাকরি করতে? পাগলী একটা আমার ঝুম্মা। ঝুম্মা রে...."
মৈনাক আর কথা বলতে দেয় না ঝুমকাকে। মেতে ওঠে শরীরের খেলায় নিপুণভাবে।
গোয়াতে গিয়ে মৈনাক ওকে নিয়ে উঠেছিল খুব নিরিবিলিতে একটা ছোট পুরোনো হোটেলে। কেমন যেন পুরোনো পুরোনো গন্ধ ঘরগুলোতে। মনে হচ্ছিল কারো একটা বাড়ি এখন হোটেল করেছে। বলেছিল ওর কোন এক বন্ধুর কাকার বাড়ি। কেমন যেন ভয় ভয় করেছিল ঝুমকার। পাশেই খ্রীষ্টানদের কবরখানা।
মৈনাককে বলেছিল জায়গাটা যেন কেমন তাই না? খুব চুপচাপ শান্ত আর ছমছমে। মৈনাক বলেছিল ভালোই তো একটু শান্তিতে থাকা যাবে কদিন। কোন ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই। তুমি সাজবে তোমার মত আর আমি দেখব।
-' এত নিরিবিলি ভালো লাগে না কোথায় ভাবলাম একটু দোকান দেখব। বীচে ঘুরব। তা না!'
-' আরে পাশেই তো সমুদ্র। সেখানে শুধু তুমিই স্নান করবে আর কেউ থাকবে না। এখানে যা বিদেশীদের উৎপাত তারচেয়ে আমি আর তুমি এই বেশ ভালো।'
একটা দিন মোটামুটি কেটেছিল। মৈনাক ইচ্ছামত ভিডিও তুলেছিল ঝুমকার। বিচে নিয়ে গিয়ে বিকিনি পরিয়ে যেমন খুশি ছবি তুলেছিল।
ঝুমকা অস্থির হয়ে গেছিল গরম বালিতে শুয়ে। বলেছিল,' আর পারছি না। এবার ছাড়,চল যাই।'
মৈনাকের গলাটা কর্কশ হয়ে উঠেছিল,' এইজন্য বলেছিলাম এখনি বাচ্চা নিয়ো না। ওষুধ খাওনি ইচ্ছে করে। এখন পারছি না বললে হবে?'
মৈনাক ঝুমকার সাথে তোলা নগ্ন ভিডিও চড়া দামে বাইরে বিক্রি করত। আর গোয়াতে এনেছিল সেইজন্যই। পরের দিন সকালে হঠাৎই বলল আজ একটা ছোট ফিল্মের জন্য কয়েকজন আসবে। তখন কিছু বুঝতে পারেনি ঝুমকা।
উঃ সেইদিনের কথা ভুলতে পারেনা ঝুমকা। একটা অপরিচিত লোক ঝাপিয়ে পরেছিল ওর ওপর। টেনে খুলে ফেলেছিল ওর জামাকাপড়।
বাধা দিতে মরিয়া হয়ে সামনে রাখা কাঁচের বিয়ারের বোতল ভেঙে রুখে দাঁড়িয়েছিল ঝুমকা। লোকটা ভয় পেয়েছিল হঠাৎ তারপর রাগে প্রচণ্ড চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে গেছিল ঘর থেকে।
মৈনাক এসে ঘরে ঢুকেছিল,গলা টিপে ধরেছিল ঝুমকার। চিৎকার করছিল ঝুমকা,' এই জন্য আমাকে এখানে এনেছ? কত টাকায় আমাকে বিক্রি করেছ। ছিঃ ছিঃ। এর থেকে মেরে ফেল আমাকে।'
মৈনাক গালাগালি দিয়ে উঠেছিল, ওর চুল ধরে টেনে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বুকের ওপর চেপে বসেছিল,' সতী নারী আমার! এই দেখ তোর সতীপনা। দেখবি এই দেখ। এবার থেকে যার সাথে বলব তার সাথে শুবি তুই। টাকা নিয়েছি শুবি না মানে। নাহলে মেরেই দেব।'
এর আগে মৈনাকের এমন মূর্তি কখনও দেখেনি ঝুম। সিডি চলতে থাকে,নিথর হয়ে বসে থাকে ঝুম। ওকে নিয়ে একের পর এক নীল ছবির ভিডিও। কখন হয়েছে এইসব! ওদের আদর সোহাগকে বাজারে বিক্রি করেছে মৈনাক!
মৈনাকের হাত থেকে নিজেকে কোন মতে ছাড়িয়ে এক দলা থুতু ফেলে মাটিতে ঝুমকা। তারপর উন্মাদের মত চড় ঘুষি মারতে থাকে ওকে।
মৈনাক ওকে ধাক্বা দিয়ে ফেলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,' যা খরচ করে এখানে এসেছি তার পুরোটা উশুল করে হাতভর্তি করে ফিরব। সাধে এতদিন প্রোটিন খাইয়েছি নাকি? সেগুলো গেল কোথায়? এই কদিন তিন শিফ্টে লোক আসবে ভিডিও হবে। না করলে একদম অ্যাসিড দিয়ে মুখ পুড়িয়ে দেব তোর। সুন্দরী...'
ওকে বাইরে থেকে আটকে মৈনাক চলে গেছে। হয়ত বা খদ্দেরদের সাথে রফা করতে। ঝুম এদিক ওদিক হাতড়াতে থাকে ফোনটার জন্য। কিন্তু ফোনটা খুঁজে পায় না। ঘরটা এমন একটা জানলাও নেই। বাথরুমে গিয়ে চিৎকার করে হেল্প হেল্প করে কোন লাভ হয় না। নিজের অপদার্থতার ওপর নিজের ঘেন্না ধরে যায়। ছিঃ ওকে দিয়ে এগুলো কি করিয়েছে মৈনাক? তার মানে ওরা যেখানে থাকে সব জায়গায় ক্যামেরা লাগানো আছে। কি করবে ও এখন? এরপর বেশ্যাবৃত্তি করতে হবে? আর ভাবতে পারে না ঝুমকা। হঠাৎই নজর পড়ে ঘরের কোণে রাখা বোতলটার দিকে আজ সব কিছু শেষ করে দেবে ও এই ভেবে আগুন ধরায় কেরোসিন ফেলে। এখন ভেবে অবাক লাগে কোথা থেকে ওখানে কেরোসিন এসেছিল কে জানে? আগুন লাগলে হয়ত কেউ দরজা খুলবে। আর না খুললে না খুলবে ও মরে যেতে চায়। আর বাঁচতে চায় না।
আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আগুন গ্ৰাস করেছিল ওকেই। মুহূর্তের উত্তেজনায় পুড়েছিল নিজেও সেই আগুনে। বুক আর গলাটা বীভৎস ভাবে পুড়ে গেছিল। ঘরের মধ্যে তখন পাগলের মত ছোটাছুটি করছে ঝুম সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে কম্বল জড়িয়ে। হয়ত কম্বলটাই কিছুটা বাঁচিয়েছিল ওকে। তারপর আর কিছু মনে নেই জ্বালা যন্ত্রণা ছাড়া।
**************************
কেউ বা কারা ওকে হসপিটালে ভর্তি করেছিল। মৈনাক পালিয়ে গেছিল। পুলিশের জেরা থেকে বাঁচেনি ঝুমও। বুক আর গলা পুড়ে গেছিল। কুরূপা ঝুমকে ফেলে চলে গেছিল মৈনাক। ওর সম্বন্ধে তেমন কিছু বলতে পারেনি পুলিশকে। বারবার মনে হয়েছিল যদি সব জানতে পারে পুলিশ। লেখালেখি হয় কাগজে ওকে নিয়ে যে ও কি কাজ করত।
পঁচিশ দিন প্রায় ওখানে হসপিটালে থেকে ওখানকার মানুষের সহযোগিতায় ফিরে এসেছিল ঝুম। গিয়ে দাঁড়িয়েছিল চাদর মুড়ি দিয়ে আবার নিজের পুরোনো আস্তানায়। মৈনাকের সাথে ওকে বোঝাপড়া করতেই হবে। গিয়ে দেখেছিল বাড়িতে তালা কেউ নেই সেখানে। ওটা নাকি ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাট ছিল। কোথায় খোঁজ করবে মৈনাকের? মহুয়ার কাছে?
মহুয়া ফোন তোলেনি। ওদের বাড়ির লোক চিনতে চায়নি ওকে। দরজাও খোলেনি। অবশেষে মায়ের কাছেই আবার ফিরে গেছিল। একবছর ঘর থেকে বেরোয়নি ভয়ে। যদি কেউ ওকে চিনে ফেলে ওর ভিডিও দেখে? পাগল হয়ে গেছিল প্রায় ঝুম। তারপর সোহিনীদির সাথে আলাপ। সোহিনীদির এনজিও থেকে খুব চেষ্টা করেছিল মৈনাককে খুঁজতে। কিন্তু উধাও হয়ে গেছিল লোকটা।
আজকাল মাঝে মধ্যে মনে হয় ঝুমকার হয়ত কেউ খুনই করে ফেলেছে। নাহলে হয়ত অন্য কোন মেয়ের সর্বনাশ করছে। কথাটা ভাবলেই হাড়হিম হয়ে যায় ওর। সত্যিই বোধহয় নিজের লজ্জা বাঁচাতে লোকটাকেও বাঁচালো ও। তারপরই আবার ভয় পায়,যদি আবার ফিরে আসে?
আজকাল কাজের মধ্যে থাকলে অনেকটা ভালো থাকে ঝুমকা।
**********************
কদিন বেড়াতে যাবার তোড়জোড় করতে গিয়ে জুনির বাড়িতে আসা হয়নি ওদের। যদিও রাণার সঙ্গে মাঝে মাঝে অফিসে দেখা হয় ওর।
ওদের যাবার আগের উইকেন্ডে জুনি আর অম্লান এল। জুনি এখন অনেক ধীরস্থির। ওকে দেখে হাসে রাণা। সেই ছটফটানি আর নেই। সব আস্তে আস্তে করছে। মুনিয়াকে একবাক্স চকোলেট আর কিছুটা ড্রাইফ্রুটস দিয়ে বলে,' খুব মিস্ করব তোদের। রেগুলার ছবি আপডেট করবি। এগুলো রাখ কাজে লাগবে। অবশ্য হানিমুনে সাথে আর কেউ না থাকাই ভালো।'
' সত্যিই এমন সময় প্ল্যানটা হল যে তোরা যেতে পারলি না। পুতুলকে আর কৌশিককে বলেছিলাম। ওরা তো পুরী গেল।'
' ছাড় বস তোমরা এনজয় কর খুব দারুণ জায়গা। আমার ঘোরা বন্ধুদের সাথে তবে জুনির যাওয়া হয়নি।'
' হ্যাঁ সবই বন্ধুদের সাথে ঘুরে রেখেছে।'
অনেক গল্প আড্ডায় আর কথায় কথায় সময় কেটে যায় ওদের। মুনিয়া আনমনা হয়ে ভাবে সামনের সপ্তাহে এইসময় কাশ্মীরে থাকবে ওরা।
কাশ্মীরে যাব যাব করে ওদের কারোরই আসা হয়নি। রাণার বাবা এমনিতেই ভীতু। তাই কথা উঠেও চাপা পড়ে গেছে। রাণাদের হোটেল একদম ডাললেকের পাশে। তবে ওদের ট্র্যাভেল এজেন্টের ইচ্ছে ওরা আগে একদিন হাউসবোটে থেকে তারপর
হোটেলে আসুক।
রাণা একা একা সব করব ভাবলেও মায়ের উৎপাতে পারেনি তাই অগত্যা ট্রাভেল এজেন্টের সাথেই আসতে হয়েছে।
ওদের হাউসবোটের নাম কুইন,ছোট্টখাট্টো সাজানো গোছানো বোট। দেখে মনে হয় কোন নবাবের জল মহলে এসে পড়েছে। খুব সুন্দর জাফরির কারুকার্য। খাওয়া দাওয়া সবই বোটে।
রাতের খাবার খেয়ে ওরাই তখন একা বোটে। বাইরেটা আটকে ঘরের উষ্ণতা উপভোগ করে ওরা। মুনিয়া বলে,' আমার একটু ভয় ভয় করছে। একদম একা আমরা এখানে।'
' কোন চিন্তা নেই, পাশের বোটেও লোক আছে। কাল সকালেই দেখবে আসিফুল এসে চা ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করবে।'
কোথা দিয়ে যে স্বপ্নের মত চারটে দিন কেটে গেল বোঝাই গেল না। রাণা অবাক হয়ে দেখে এখানে এসে যেন আরও সুন্দরী হয়েছে মুনিয়া। ওর গালেও ঠান্ডায় লালচে আভা।
খুব তাড়াতাড়ি গুলমার্গ,শোনমার্গ আর পহেলগাঁও ঘুরতে হল।
মুনিয়া বলল,' ইশ্ এত তাড়াতাড়ি কি হয়? আরও কয়েকটা দিন হলে হত।'
-' হ্যাঁ এমনিতেই দশদিনের ছুটিতে এসেছি। এরপর অফিস বলত লাইফটাইম হানিমুনে থেকে যাও।'
দুজনেই হা হা করে হাসে। হাসির রেশটুকু মেখে নিয়েই কাল ভোরে রওনা দেওয়া লাদাখের পথে।
খুব ভোরেই ওদের গাড়ি এসেছিল। ভোরের ঠান্ডা মেখে রওনা দেওয়া লাদাখের পথে। তবে সেদিনটা কার্গিলে থেকে তারপর যাওয়া আবার পরদিন। মুনিয়ার গায়ে লালটুকটুকে সোয়েটার সাথে সাদা প্যান্ট। মাথায় মাখন সাদা টুপি। বেশ লাগছে ওকে দেখতে। রাণার গায়ে সাদা সোয়েটার আর নীল জিন্স, মাথায় টুপি। দুজনকেই বেশ লাগছে দেখতে। ওদের গাড়িতে সহযাত্রী হিসেবে রয়েছে আরেকটা পরিবার ওরাও বাঙ্গালোরেই থাকে লাকিলি একসাথেই হয়ে গেছে এখানে এসে। মানে একই ট্যুর অপারেটর ওদের।
কাশ্মীরে ঘোরাঘুরি একসাথেই করেছে ওরা। রাণা প্রথমে একটু আপত্তি করলেও এক গাড়িতে যেতে তারপর দেখেছে শেয়ারিং করে সব দিকেই সুবিধা। ওরাও তো মোটে দুজন,যখন তখন কোন অসুবিধা হলে একজন একদম একা হয়ে যাবে। তাছাড়া প্রাইভেসি তো আছেই হোটেলে সুতরাং অসুবিধা তেমন কিছু নেই। ভালোই হয়েছে বরং। রাণা মুনিয়ার মত অত কথা বলতে পারে না। মুনিয়াটা বকবক করতে ভালোবাসে খুব ভালোই হয়েছে বেশ গল্প করতে করতে যেতে পারছে।
সাথের সহযাত্রী যারা তারা তিনজন,স্বামী স্ত্রী আর পাঁচবছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে। মুনিয়া আলাপ করতে করতে জেনেছে রুমকিদি দিল্লীতে বড় হয়েছে আর প্রবালদা পাটনায়। কিন্তু মনেপ্রাণে বাঙালী ওরা। দুজনেই সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। প্রায় আট বছর বাঙ্গ্যালোরে আছে।
পাটনা নামটা শুনে কেমন যেন চমকে ওঠে মুনিয়া। তবে সেটা এক মুহূর্তের জন্যই। একটা সময় এই পাটনাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছে মনে মনে মুনিয়া। নিজেই পৌঁছে গেছিল প্রমোদদের বাড়িতে ওর বর্ণনা শুনে। কতবার ওদের উঁচু লোহার গেট পেরিয়ে বড় বাগান পেরিয়ে মনে মনে ঘুরে এসেছে।
আর কিছু জিজ্ঞাসা করারও অবশ্য নেই তাই শুধুই রুমকিদিকে বলে," তুমি পাটনায় যাও শ্বশুরবাড়িতে?"
-' কম যাই গো এখন। মানে ঐ হয়ত দেওয়ালীর সময় যাওয়া হয়। শ্বশুর শাশুড়িমাকে আমাদের কাছে এনে রেখে দিই বেশি সময়। ওঁরা থাকলে বাবলি ভালো থাকে। দাদা আম্মা খুব প্রিয় ওর। আর তোমার প্রবালদা তো একদম মাম্মাস বয়।'
-' তাই! আর রুমকি যে মাম্মাস বেবি।'
হাসে প্রবালদা রুমকিদির দিকে তাকিয়ে। 'আসলে আমরা দুজনেই সিঙ্গল চাইল্ড বুঝলে তাই আমাদের মা বাবারাই মোটামুটি বেশ কিছুদিন করে পালা করে থেকে যান এখানে। ওঁরা আমরা বাবলি সবাই ভাল থাকি।
মুনিয়া মনে মনে ভাবে কি সুন্দর আন্ডারস্ট্যান্ডিং করে চলছে ওরা।
বাবলিটা ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে। ওরা দেখতে দেখতে চলেছে। প্যাকেট ব্রেকফাস্ট দেওয়া আছে তবুও প্রবালদার আবদারে আলু পরাঠা খেতে হল। তবে সত্যিই অসাধারণ টেস্ট। আলু পরাঠা আর চা খেয়ে একদম চনমনে মনটা। তার মাঝেই গাড়ি থামিয়ে ফটোশুট। পাহাড়ের রূপ যে কত রকম হতে পারে তা এখানে না এলে সত্যিই বোঝা যায় না। ধীরে ধীরে বনানীর আদর মাখা পাহাড়ের শোভা ছেড়ে ওরা এগিয়ে যায় কার্গিলের পথে। বেশ শনশনে হাওয়া থাকলেও আকাশে সোনা রোদের মাখামাখি। মন ভালো হয়ে গেছে সবার। বাবলির ঘুম ভেঙে গেছে। মুনিয়া ওকে পেয়ে একদম চাঙা।
রুমকি বলে,' তোমাদের হানিমুনে আমরা কাবাবে হাড্ডি হলাম না তো?'
' কি যে বল না? সত্যিই আমরা লাকি যে মনের মত ট্যুর পার্টনার পেয়েছি। অন্য কেউ সাথে থাকলে জানিনা কেমন লাগত বাট খুব এনজয় করছি।'
মুনিয়ার হাসিমুখটা ছুঁয়ে যাচ্ছে রাণাকে। মাঝে মাঝেই ফটো আর ভিডিও তুলছে ওরা। যতটা সাথে করে নিয়ে যাওয়া যায়। ডলের আব্দার দাদা নিয়ে গেলি না তো আমাকে। তাহলে পুরোটা সাথে করে আনবি। মা পাশ থেকে বকছিল ওকে খুব কান্ডজ্ঞান নেই বলে।
মুনিয়াই মাকে বলে,' মা ও খুব আদুরে,ওকে বোকো না। সত্যিই তো সবাই যেতে পারতে তাহলে খুব ভালো লাগত।'
' যেমন আমার মেয়ে,তেমন বৌমা দুটোর মাথাতেই বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। এই বিয়ের পর প্রথম বাইরে যাচ্ছ তা নয় পুরো কৃষ্ণনগরের বাড়িকে সাথে নিয়ে যাবে। সাবধানে ঘুরে এস। বরফে বেশি লাফালাফি কোর না বুঝলে। একবার নাহয় একসাথে পুরী যাব। কতদিন জগন্নাথ দর্শন করি না।'
রাণার দিকে তাকিয়েছিল মুনিয়া ও চাইছিল রাণা কিছু বলুক। রাণা বলেছিল,' এ আর এমন কি মা যখন বলবে তখন হয়ে যাবে।'
******************************
কার্গিল স্মৃতিমাখা শহর। কার্গিলের ওয়্যার মেমোরিয়াল দেখে আসতে আসতে রাস্তায়। কেমন যেন অদ্ভুত একটা শিহরণ হয় মনে। আমরা নিজেদের কত ছোটছোট চাওয়া পাওয়া নিয়েই দিন কাটিয়ে দিই অথচ দেশের জন্য প্রাণ হারায় কত শহীদ। আসতে আসতে দেখেছে ফাঁকা পাহাড়ে বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে সেনা। সত্যি বাড়ি ঘর ছেড়ে কোথায় আছে দাঁড়িয়ে। সবটাই শুধু কাজ নয় এর সাথে আছে দেশপ্রেমের মিশেল। সিন্ধু নদের শাখা সুরু মাঝে মধ্যেই উঁকি দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছিল রাস্তায়। তবে কার্গিলের পাশেই নদী। ওদের হোটেল থেকে খুব সুন্দর প্রকৃতিকে দেখা যায়। অনেকটা জার্নির পর গরম চায়ের আদর আর প্রকৃতির সবুজ চাদরে মন ভরে যায়। নদীর আওয়াজও কানে আসে। তবে বর্ষার নদী তাই জলটা কেন যেন ঘোলাটে লাগল এখানে।
সন্ধ্যেটা জমিয়ে আড্ডা হল প্রবালদার ঘরে তার সাথে প্রবালদার আনা পানীয়ে চুমুক দিয়ে চাঙা হল ওরা সবাই। মুনিয়া একটু আপত্তি করছিল। রুমকিদি বলল,' খা একটু ভালো লাগবে, রোমান্টিক ফিলিংস আসবে আরও।'
মুনিয়া একটু লজ্জা পায়। রাণা হাসে,কখন যে ওদের সম্পর্ক তুই হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি।
বাড়িতে কথা হয় সবসময়ই,আলাদা একটা সিমকার্ড সেইজন্যই এনেছে রাণা আজ পুতুল আর জুনি অম্লানদার সাথেও কথা হল।
-' কেমন চলছে রে? আমি ভালো জায়গা বলেছি তাই না?'
' সত্যিই খুব ভালো অম্লানদা। কি যে ভালো লাগছে!'
মুনিয়ার উচ্ছ্বলতা ছুঁয়ে যায় রাণাকে। প্রতিটা রাত যেন নতুন করে সুগন্ধ মাখাচ্ছে দাম্পত্যে। সেইজন্যই বোধহয় মাঝেমাঝে বাইরে বেরিয়ে পড়তে হয়। শুধু মুনিয়াটা খুব শীতকাতুরে এই একটা মুশকিল।
সকালের সূর্য সোনারঙ ছড়ানোর আগেই ওরা বেরিয়ে পড়ে ভোরের স্নিগ্ধতা মাখতে মাখতে। বাবলিটা ঘুমিয়ে কাদা। ওকে সামলাতে সামলেতে রুমকিদি বলে,' কেউ আসার আগেই ঘুরে নিবি বেশি বেশি করে। প্ল্যানিং তাড়াতাড়ি নাকি?'
মুনিয়ার গালে লাল আভা ছড়ায়,' এখনি কি?'
-' তোর বরটা একটু চাপা তাই খুব মজা করতে পারি না। সব ঠিকঠাক তো এমনিতে? আমি কিন্তু মজা করছি অন্য ব্যাপারে। খুব কেয়ারিং কিন্তু। লাভ ম্যারেজ।'
হাসে মুনিয়া বুঝতে পারে কি বলতে চাইছে রুমকিদি তাই ঘাড় নাড়ে।
-' ওহ্ তাহলে ওখানে পৌঁছে গল্প শুনব।'
রাস্তায় তেমন কিছু ভালো খাবার পাওয়া যায় না। সুতরাং রুটি সবজি চা খেয়ে দুপুরটা কেটে গেল। পাহাড়ের রূপে মুগ্ধ ওরা। কোথাও কোন গাছপালা নেই। লাদাখ শীতল মরুভূমি, তাই পাহাড়েও মরুভূমির সাজ। কোথাও পাহাড় হাতির মাথার মত আবার কোথাও যেন অজস্র নদীর মত সর্পিল চিহ্ন আঁকা পাহাড়ের বুকে। বারবারই মনে হচ্ছে এ পথ যদি না শেষ হয়। রাস্তা বেশ ভালো তবে শুনল মানালীর রাস্তা একদম ভালো নয়।
পথে মনাস্ট্রী দেখে হোটেলে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বেলা গড়িয়ে সূর্য পাটে যাবার পথে। মুনিয়ার কপালটা ভালো করে ঢেকে দেয় রাণা, কপালটা ঢেকে রাখ নাহলে মাথা ধরতে পারে। এখানে একটু সমস্যা হয় অনেকের। অসুবিধা নেই আমি ওষুধ এনেছি।'
মুনিয়া ওর কানে কানে বলে,' কি ওষুধ! ভালোবাসার ওষুধ।'
রাণা ওকে জড়িয়ে ধরে আদরে,' সেটা তো আছেই। সেটা মাখিয়েই তো পাগলীটাকে ভালো রাখি। তার সাথে অন্য ওষুধও আছে।
হোটেলের কাঠের ঘরের নরম বিছানায় তখন উত্তাপ ছড়ায় ভালোবাসা। মুনিয়া রাণাকে জড়িয়ে ধরে পরম নির্ভরতায়। প্রতিটা আজের প্রতি মুহূর্তে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে খুব বেশি করে ভালোবাসায়।
***************************
রেজাল্টটা এনে যত্ন করে তুলে রাখে ফাইলে। মা খুশি হয়েছে দেখে। অন্য সময় মাঝে মাঝে মাথা গরম হলে চেঁচামেচি করে,' কেউ ঠেকে শিখে আর কেউ ঠকে শেখে। ভাগ্যিস সোহিনীর মত মেয়েরা আসে আমাদের এই পাড়ায় তাই একটা গতি হল তোর। হায় ভগবান এই মেয়েকে নিয়ে কত গর্ব ছিল আমার। তোর দিদি ঠিকই বলে অতি বড় সুন্দরী না পায় বর,আর অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর।'
-' উঃ মা চুপ কর তো সবসময় দিদি আর দিদি। প্রাইভেটে বি.এ টা তো পাশ করলাম নাকি? এখন তো আরও ট্রেনিং নিচ্ছি। আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দেখাতে হবে।'
-' কাকে দেখাবি শুনি? কে দেখবে তোকে আমি মরলে?'
-' আমাকেই তো দেখতে হবে আমাকে মা তাই তো নিজেকে আবার ঘষে মেজে চেষ্টা করছি।'
সেদিন কনে সাজাতে সাজাতে হঠাৎই মনে হয়েছিল রাণার কথা। একসময় রাণা বলেছিল ওর আঁকার হাত যা ভালো ও বুটিক খুলতে পারে। হঠাৎই স্বপ্নে হারিয়ে গেছিল ঝুম ও বুটিক খুলবে? ওর নিজের বুটিক হবে? তবে সোহিনীদির কাছে এই কথা বলেনি। সোহিনীদি ওকে ছাড়তে চায় না বলে কাজ আমি শিখিয়েছি তুই এখানেই থাক। কিন্তু সত্যি এই টাকাতে সংসার চালানো মুশকিল। আজকাল অবশ্য এদিক ওদিক টুকটাক সাজাতে যায় ঝুমকা।
সেদিন বড় বাজার থেকে কয়েকটা কাটা কাপড় আর রঙ তুলি কিনে এনেছে ঝুমকা। আজকাল যখন মনে ঝড় ওঠে উথাল পাথাল করে তখন বসে বসে সেই আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে দেয় কাপড়ের টুকরোতে ঝুমকা। প্রথমে হাতটা নড়ে গেছে ভালো হয়নি। একটু একটু করে ভালো হতে লাগল হাতের কাজ। নিজের মনে হল এই তো পারছি,নিশ্চয় পারব।
কতদিন মাঝরাত হয়ে যায় ঝুমকার কাপড়ে নক্সা আঁকতে।
****************************
মুনিয়ার চোখে খুশির ঝলক খেলা করে,নুবড়া ভ্যালিতে যাওয়ার রাস্তাটা যেমন বিপজ্জনক তেমনি বোধহয় অসাধারণ। রুমকিদি আর প্রবালদা আসেনি এই ট্রিপটাতে,বাবলির অতটা জার্নি সহ্য হবেনা বলে ওরা আগেই ঠিক করেছিল যাবে না।
আজ রাণার সাথে খুব একান্তেই মুনিয়া। মুনিয়ার পরনে আজ কাশ্মীরী মেয়েদের মত পোশাক। অনেকেই দেখছে ওকে মুগ্ধ হয়ে।
শীতল মরুভূমির সৌন্দর্যের মায়ায় আজ সত্যিই চোখ আটকে যাচ্ছে বারবার। তারমধ্যে মুনিয়া ডাবল হাম্প অর্থাৎ দুই কুঁজ বিশিষ্ট উটের পিঠে উঠল। এখানেই একমাত্র দেখা যায় এমন উট। বেশ কয়েকঘণ্টা আনন্দ করে রওনা দেওয়া লেহর পথে। যদিও প্রবালদা বলেছিল,' একটা রাত থাকতেও পার ওখানে তোমরা যদি প্রবলেম হয়। কারণ এতটা পথ তো।'
ওরা রাজি হয়নি থাকতে সুতরাং সব দেখে তুষারশুভ্র পাহাড়ের কার্পেটে পা ঘষে গাড়ি এগিয়ে চললো। সাথে রইল অনেক ভিডিও আর ছবি আর কিছু ভালোবাসা মোড়ানো মুহূর্ত।
গতকাল লেহ শহরের অনেকটাই ওরা গাড়ি করে ঘুরে দেখেছে। ভীষণ সুন্দর লেহ শহর,পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বাড়ি আর মনাস্ট্রী দেখা যায়। ওখানকার প্যালেস,শান্তি স্তূপ,মনাস্ট্রী সবকিছুই মোটামুটি দেখা হয়ে গেছে। কিছু মার্কেটিংও করেছে মুনিয়া। বিয়ের পর প্রথম বাইরে আসা সুতরাং সবার জন্য কিছু নিতেই হবে। যদিও রাণা একটু সাবধান করেছে,ব্যাগ ভারী করিস না মুন। তবুও নতুন বৌকে আর বেশি কিছু বলতে পারেনি। ওর বাবা এই নিয়ে মায়ের সাথে কিছু করে। তাই নিয়ে মায়ের সাথে ঝামেলাও হয়। সুতরাং নো ঝামেলা।
হাসি,গল্পে,আড্ডায় আর প্রেমে দেখতে দেখতে কেটে গেছে দিনগুলো। আগামীকাল প্যাংগঙ গিয়ে একদম মানালী হয়ে ফিরে যাওয়া।
দুদিন বিশ্রাম নিয়ে বাবলি অনেকটা ভালো আছে তাই ওরা সবাই মিলেই গেল প্যাংগঙের রাস্তায়। এই রাস্তাতেও সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। তবে রাস্তা কোথাও বড় বেশি খারাপ।
চোখে বরফের সাদা রঙ মেখে এগিয়ে যাওয়া লেকের দিকে সত্যিই বোধহয় ভগবানের সৃষ্টি অসীম তাই এত ওপরে এত সুন্দর লেক সৃষ্টি হয়েছে। অপূর্ব নীল রঙের জল তাতে সাদা পাখির দল ভেসে বেড়াচ্ছে খুশি হয়ে।
খুশি হয়ে গেল ওরাও,ইচ্ছেমত ফটো তুলে লেকের জলের নীল মনে মাখিয়ে ফিরে আসার আগে লেকের ধারে থ্রী ইডিয়ট রেস্তোরাঁয় বসে গরম থুপকা আর কফি খেয়ে শরীর চাঙা করে নিল। পাংগঙে গিয়ে অনেকেই থাকে কিন্তু মুনিয়ার কথা ভেবেই রাণা আর থাকার ঝুঁকি নেয়নি। তাছাড়া বাবলিও রয়েছে সাথে।
একটু কষ্ট হলেও হোটেলে গিয়ে নিশ্চিন্তে শ্বাস ফেললো ওরা।
-' সত্যি আমার ভীষণ ভয় করছিল কিন্তু রাস্তায় তাইনা মুনিয়া? তবে আমার বাবলি সোনা আজ একদম লক্ষ্মী হয়েছিল।'
-' হ্যাঁ বাবলির আন্টি থাকলেই বাবলি খুশি।'
নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে মুনিয়াকে দেখে রুমকি আর প্রবাল। ও তখন বাবলির সাথে খেলতে ব্যস্ত।'
-' খুব মিস্টি মেয়েটা তাই না? ওদের প্রেমের গল্প শুনলাম বুঝলে। মোটামুটি ফ্ল্যাটপার্টনার থেকে লাইফ পার্টনার এখন। দারুণ ব্যাপার।'
-' আমরাও তো অফিস কলিগ থেকে মানে আগে আমি বস তুমি...আর এখন তুমি বস আর আমি...'
-' আমি কি শুনি? তুমি কি?'
রাণা ক্যামেরা ঘোরাতে থাকে একমনে ছবিগুলো দেখছে। একটু এডিট করলে খুব ভালো হবে ছবিগুলো।
আসলে এডিটিং বোধহয় শুধু ছবিতেই নয় জীবনেও দরকার। খারাপ অভিজ্ঞতাগুলো এডিট করে যদি ভালো গুলো দিয়ে রিপ্লেস করে নেওয়া যায় তাহলে হয়ত সত্যিই ভালো থাকা যায়।
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। রুমকিদিরা অনেকটা দূরে থাকে ওদের বাড়ি থেকে তাই যাওয়া না হলেও ফোনে বেশ কথা হয় মাঝে মাঝে। চলার পথে আর জীবনের বাঁকে কখন যে কত মানুষ এভাবে আপন হয়ে যায় ভাবাই যায় না।
ওখান থেকে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটে কিছু পোস্ট করতে পারেনি মুনিয়া তাই এসে কয়েকদিন অফিস করার পরে ছবিগুলো নিয়ে বসে পছন্দের কয়েকটা ছবি পোস্ট করে। তার মধ্যে অবশ্য জুনি আর অম্লানদার ওখানে ঘুরে আসা হয়ে গেছে।
অনেকটা বেশি করে করে দুজনেই থ্যাঙ্কস জানালো অম্লানকে,' যাক ম্যাডাম খুশি সুতরাং আমরাও খুশি। কি রাণা?'
রাণার চোখেও খুশির ঝলক খেলে যায়। মুনিয়ার আনা স্টোলটা গায়ে ফেলে দেখে জুনি,' খুব সুন্দর হয়েছে রে। জানিস এখন নড়াচড়া করছে একটু একটু করে।'
মুনিয়া মনে মনে ছুঁতে চায় জুনির মাতৃত্বকে। জুনি ওর থেকে খুব অল্প বড় তবে সব দিক দিয়েই সিনিয়ার।
- ' তোর কষ্ট হচ্ছে না তো?'
-' না রে,এটা যেন একটা অন্য অনুভূতি। তোর যখন হবে তখন বুঝতে পারবি।'
রাতে রাণাকে বলে জুনির কথাগুলো। রাণা হা হা করে হাসে।
' এই হাসছিস কেন শুনি? নিজেই এখনও ছোট সে আবার এই সব ভাবে।'
-' ইশ্ আমি তো জুনির কথা বলছিলাম। এবার ঠাম্মা কি বলছিল জান?'
-' হ্যাঁ জানি,শতপুত্রের জননী হও নিশ্চয় বলেছে। মানে ঠাম্মার কমন ডায়ালগ সেই মহাভারতের যুগের।'
-' আরও অনেক বেড়াব,বেশি বেশি করে ভালোবাসব তারপর ভাবব। ভালোবাসার সুযোগই তো পাচ্ছি না। সারাদিন দুজনেরই অফিসের চাপ।'
***********************
টুকরো কাপড় প্রায় শেষ,সেদিন একটা ওড়না পরে গেছিল পার্লারে সবাই ওকে ঘিরে ধরেছে কোথা থেকে কিনেছে? হঠাৎই বুদ্ধি করে ঝুম বলে দিদির বাড়ির কাছে কেউ একজন করে সেখান থেকে দিদি পাঠিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দুজন বলল তাদেরও চাই। ঝুম ইচ্ছে করেই একটা দাম বলল আর রঙটা জিজ্ঞাসা করে নিল। ভেবেছে কয়েকটা থান এনে তাতে কাজ করবে। সবসময় তো এমনিতেই সব দিয়েছে এমনকি নিজের সম্মানটুকুও। এখনও মাথা নিচু করেই চলতে হয় যদি কেউ চিনে ফেলে। টাকার যে ওরও খুব দরকার।
রাতে কেন যেন ঘুম হয় না ভালো করে ঝুমকার। সেদিন রাণার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভীষণ শরীর খারাপ করেছিল। তবুও এক দুবার রাণার প্রোফাইলে গেছে ঝুমকা। আজ হঠাৎই ইচ্ছে হল একবার দেখতে। কিন্তু কিছুতেই প্রোফাইলটা খুঁজে পেল না ঝুম। তাহলে কি রাণা ওকে সত্যি ব্লক করে দিয়েছে? অনেকদিনের না দেখা বা হারিয়ে যাওয়া ঝুমকার প্রতি রাণার মনের কোণে হয়ত জায়গা ছিল। কিন্তু ঝুমকাকে দেখার পর রাণা হয়ত সেই জায়গাটাকে ঘেন্নার বেড়া দিয়ে ঘিরে দিয়েছে চিরতরে।
রাণার প্রোফাইল না দেখতে পেয়ে কেন যেন খুব মন খারাপ হল ঝুমকার। পুতুলের প্রোফাইল থেকে মুনিয়ার প্রোফাইলে গিয়ে দেখল খুব ভালো আছে রাণা। সেদিনের সেই বোকাসোকা ছেলেটা যে একবুক প্রেম নিয়ে ওর সামনে এসেছিল সে আজ খুব ভালো আছে।
হয়ত জীবন সবসময়ই মানুষকে কিছু দিয়ে যায়,কখনও বা ভালোবাসা আবার কখনও অভিজ্ঞতা। আজ ঝুমকার অভিজ্ঞতার ঝুলিটাই বড় বেশি ভারী।
************************
অতীত হয়ত অনেক কিছুই দিয়েছে রাণাকে। একটা সময় ঝুমকার সাথে কাটানো সময়টাও খুবই মূল্যবান ছিল। অনেক ভালোলাগা মিশে ছিল মুহূর্তগুলোতে তবুও আজ ওর জীবনে শুধুই মুনিয়া। তাই কোনমতেই যেন অতীতের ছায়া ওর বর্তমানে না পড়ে তার জন্য একটু বেশিই সাবধানী হয়েছে রাণা। হয়ত বারবার ঝড়ের ধাক্কা সওয়ার ক্ষমতা ওর নিম্নবিত্ত নিরীহ মনের নেই। তাই এতদিন ফেসবুকে উঁকি না মারা রাণা হঠাৎই একদিন ফেসবুকে ঢুকে ঝুমকে ব্লক করে দেয়। যদিও একটা সময় ঝুম নিজেই রাণাকে অকারণেই আনফ্রেন্ড করে দিয়েছিল।
ভেবেছিল নিজের অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাকটিভেট করে দেবে। হঠাৎই মনে হল মুনিয়া কিছু ভাবতে পারে। তাই থাক না আছে যেমন থাক।
অনেকদিন বাদে নিজের এডিট করা অনেকগুলো ছবি দিয়েছে প্রোফাইলে রাণা। অবশ্য সবগুলোই প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। তাতেই বন্ধুরা খুব খুশি। তবে মুনিয়া ঠোঁট ফোলালো,'আমাদের দুজনের কোন ছবি দিলি না। অন্ততঃ তোর নিজের একটা ছবি দে। ডিপিটা তো চেঞ্জ কর।'
' করেছি তো ডিপি চেঞ্জ, কি সুন্দর বরফের পাহাড়ের ছবি দিয়েছি। সবাই কত প্রশংসা করল। নাহ্ রাণা তোমার কিছু কোয়ালিটি আছে।'
কথাটা বলে নিজেই হেসে ফেলে রাণা।
-' কোয়ালিটি আছে তো। সবচেয়ে বড় কোয়ালিটি আমার বরটা খুব খুব ভালো।'
ভালোবাসার অনেকগুলো রঙিন ছবি মুনিয়ার আবদারে আলো করে রাণার প্রোফাইল। বন্ধুরা মজার মজার কমেন্ট করে। অনেকদিন বাদে ফেসবুকে চোখ রাখে রাণা। একসাথে বসে কমেন্ট পড়ে ওরা। 'দেখেছিস তো? এইজন্য আমি ছবি দিই না। কিসব লিখছে ওরা।'
' লিখুক না,ওরাও দেখুক একটু রোমান্টিক রাণাকে।'
কথা আর হাসিতে ভালোবাসার ছবির রঙ লাগে মুনিয়ার গালে আর কপালে।
এখন মাঝেমাঝেই শরতের উঁকিঝুঁকি আকাশে বাতাসে,কৃষ্ণনগরের বাড়িতে ঠাকুরের কাঠামোর গায়ে মাটি মাখানো হয়ে গেছে। আর কিছুদিন বাদেই পুজো। মুনিয়ার বিয়ের পর এই প্রথম পুজো। তাই ভেতরে একটা অদ্ভুত আনন্দ। এর আগে দুটো পুজোর দশমীর দিন কৃষ্ণনগরেই কেটেছে ওর অদ্ভুত ভাবেই। একবার অপ্রেমে যাওয়া শুধু অনুরোধ রাখতে। আরেকবার একদম প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে যাওয়া।
এবারের পুজোতে মিশে আছে সিঁদুরখেলার আনন্দ,মাকে বরণ করা অঞ্জলি দেওয়া সব কিছু। মামণি আগে থেকেই বলে দিয়েছে একদম টানা থাকতে হবে এই কদিন কৃষ্ণনগরের বাড়িতে।
কলকাতা থেকে মা আর বাবাও নাকি আসবে সেই সময় ওখানে। মুনিয়া যাতে মা বাবাকে মিস্ না করে তার জন্য সব ব্যবস্থাই রেডি।
মুনিয়া বলে মাকে,' আচ্ছা রাণার বাবার কোন ক্রাশ ছিল না তো তোমার ওপর?'
-' এই পাজি মেয়ে গুরুজনদের ব্যাপারে ওসব বলতে নেই। তোর শ্বশুরমশাই তো বোধহয় স্কুল থেকে প্রেম করত। একদিন জিজ্ঞেস করিস।'
-' মা তুমিও পারো একদম। আমি জিজ্ঞেস করব।'
-' করবি, এত জানার যখন ইচ্ছে।'
মনটা খুশি হয়ে ওঠে মুনিয়ার আবার একটা ছুটির আনন্দে। কয়েকদিনের অফিসের একঘেয়েমি থেকে ছুটি। একা একা থাকতে হবে না, ব্রেকফাস্ট, ডিনার বানানোর চাপ নেই শুধু মজা আর মজা।
বারান্দা থেকে গল্প করে মুনিয়া মিসেস আয়ারের সাথে। মিসেস আয়ারের চোখে ভাসে কলকাতার পুজোর ছবি মুনিয়ার কথায়। উনি বলেন অনেক ছবি তুলে পাঠাতে হোয়াটস অ্যাপে। শুধু জুনিটার জন্য মনটা খারাপ লাগে। ও বেচারা যেতে পারবে না। ওকে দেখাশোনার জন্য আঙ্কেল আন্টি আসছেন। এবারের পুজোটা এখানেই কাটবে ওর।
' এবার তুই আনন্দ কর একদম জমিয়ে। রায়চৌধুরী বাড়ির নতুন বৌয়ের চোখভরা কাজল আর কপালে সিঁদুরের টিপ পরনে জরির পাড়ের শাড়ি আমি সব দেখতে পাচ্ছি।'
-' কত ভালোবাসে আমাকে আমার বন্ধুটা! মিস্ ইউ সোনা।'
-' তোর ভালোবাসাকে জল দিয়ে মহীরুহ করতে পারলে বাঁচি। কত ফুল ফুটবে ফল ধরবে। যদিও ফুল তো ফুটে গেছে অলরেডি। ভালো থাকিস দুজনে,রাণাকে আগলে রাখিস। একটু চাপা ছেলে তো।'
-' তোর ছোট বাচ্চাটা নিশ্চয় কবি হবে। হঠাৎ এইসব বলছিস কেন? আমি কি আগলে রাখি না? অবশ্য ও আমাকে আগলায় বেশি।'
-' আমি ঘটক তো তাই দায়িত্ব তো থেকেই যায়।'
হাসিতে গল্পে রঙ মাখে ওদের বন্ধুত্ব আরও বেশি করে।
রাণার অফিসে কাজের চাপ খুব বেড়েছে, আজকাল আর তেমন করে সময়ই পায় না রাণা। সেদিন হঠাৎই রাণা অফিস থেকে এসে বলল,' এত চাপ বেড়েছে কাজের আর পারা যাচ্ছে না। আমাকে হয়ত ডিসেম্বরে বাইরে যেতেও হতে পারে। যদিও এখনও তেমন করে কিছু বলেনি। তবে যেতে হতেও পারে কি করব বুঝতে পারছি না।'
-' ডিসেম্বর তো দূরে এখন। আগে কৃষ্ণনগরের থেকে ঘুরে আসি তারপর দেখা যাবে।'
মুনিয়ার কাছে এসে বসে রাণা,' বি সিরিয়াস মুন, সত্যিই যেতে হতে পারে আমাকে। আমার একটুও ভালো লাগছে না। তোকে ছেড়ে কি করে?'
রাণার মাথায় হাত দিয়ে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দেয় মুনিয়া,' চাকরির জন্য যেতে হতে পারে যখন তখনই। কি আছে এত চিন্তার? প্রবালদাই তো দুবছর থেকে এসেছে স্টেটসে শোনোনি? রুমকি দি তো তখন অফিস করেছে এখানেই। আবার দুবছর বাদে সব ঠিকঠাক।'
' আমি থাকবো কি করে? আমি প্রবালদা নই মুন? রুমকিদির সাথে বাবলি ছিল তখন। তোকে একা রেখে না না? হবে না। তাহলে তুই যাবি তো আমার সাথে?'
-' রাণাটা সত্যিই একটা বাচ্চা ছেলে। আচ্ছা আমার অফিস চাকরি এই সব নেই নাকি। আগে বলুক অফিস থেকে তারপর ভাবা যাবে। আপাতত আমি ওসব কিছু ভাবছি না। শুধু পুজোর কথাই ভাবছি। আমার বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে প্রথম পুজো।
রাণার মনের মেঘটা উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে মুনিয়া। রাণা যে কাজটা করে সে কাজে যখন তখনই ওকে বাইরে পাঠাতে পারে জানে মুনিয়া। তাই বলে ও সবসময় কি যেতে পারবে নাকি ওর সাথে?
-' চিন্তা নেই কোন,আমি ঠিক থাকব বসে আমার বরের অপেক্ষায়। এই বাড়িতে তো একসময় আমি একাই থাকতাম। আবার নাহয় ব্যাচেলর লাইফে ফিরে যাব। যা খুশি তার করব। আহা দারুণ হবে।'
-' কিছু দারুণ হবে না,আই রিয়েলি মিস্ ইউ মুনিয়া।'
রাণাকে আদর করে মুনিয়া,' ইশ্ আমার ভালোমানুষ বরটা রে। বৌকে ছেড়ে যেতে হবে বলে কি কষ্ট বেচারার। নে ওঠ এবার কফি ঠান্ডা হচ্ছে তো।'
মাঝে কেটে গেছে বেশ অনেকগুলো দিন। মুনিয়া কয়েকদিন ধরে একগাদা শপিং করল অফিস থেকে বেরিয়ে একা একাই। রাণা দুদিন উইকএন্ডে এসেছিল। আর আসতে পারেনি বেচারা। অন্য সময় হলে জুনিকে নিয়ে আসত এখন তো কোন উপায় নেই। সেদিন মার্কেটিং করতে করতে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল রুমকিদি আর বাবলির সাথে। ভীষণ মজা হল মুনিয়ার। বাবলিকে অনেকদিন বাদে দেখে খুব ভালো লাগল। রুমকিদির সঙ্গে অনেকটা সময় কেটে গেল মুনিয়ার,তারপর ক্যাফেতে একটু খেয়ে ফিরতে ফিরতে বেশ দেরিই হয়ে গেল। যদিও এরমধ্যে দুবার কথা হয়েছে রাণার সাথে। ও বলছিল নিয়ে যাবে নাকি অফিস ফেরত।
মুনিয়া বারণ করে দিয়েছে,' তুই যা আমি ক্যাবে ফিরে যাব। অযথা এতটা আসতে হবে না।'
রুমকিদির কাছে জানতে পারে প্রবালদা আবার বাইরে গেছে তবে এবার অতদিন নয় হয়ত মাস দুয়েকের জন্য।
' তোমার খারাপ লাগছে না? মানে একা একা?'
-' বেশ আছি রে। অভ্যেস হয়ে গেছে তো। তারপর আছে না বাবলি। তোর যখন হবে বুঝবি সময় কেটে যায় কি করে। তারপর আসছে রে সামনে মাসে শাশুমা আর শ্বশুরজী। কটা দিন একটু এনজয় করে নিই বুঝলি।'
মুনিয়া মনে মনে হাসল যদিও রাণা শুনলে বলবে ইশ্ আমি চলে যাবার পর একলা থাকার প্ল্যান করছ।
ক্যাবে বসে শরীরটা এলিয়ে দেয় মুনিয়া। রুমকিদির সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগল। রুমকিদি বারবার বলে দিয়েছে রাণাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে একদিন যাওয়ার কথা। যদি এখন নাও হয় তবে বাবলির জন্মদিনে কিন্তু আসতেই হবে।
মুনিয়া একটু অন্যমনস্ক হয় বাবলির জন্মদিনের তারিখটা শুনে কি জানি সেই সময় রাণা কোথায় থাকবে। অন্যমনস্ক হয়ে বলে,' বাবলিসোনার জন্মদিনে খুব চেষ্টা করব গো আসার। আর তোমরাও এসো একদিন।'
' আসব তো,তোদের দাদা আসুক তারপর যাব।'
বাবলি আদুরে গলায় বলে,' প্রমিস করো আসবে।'
-' একদম সোনা।'
*************************
খাটের ওপরে অনেকগুলো ওড়না,সালোয়ার জমে আছে। কতগুলো টি শার্টও আছে। আজকাল পার্লার থেকে এসে একটু ঠান্ডা হয়ে আঁকায় মন দেয় ঝুম। অনেকগুলো কাজের অর্ডার পেয়েছে। ও অবশ্য তেমন করে প্রথমে বলেনি কাজগুলো ও করছে। তবে এখন আর না বলে উপায় নেই। বারবারই মনে হয় হাতে কিছু টাকা থাকলে আরও মাল কিনে কাজ করতে পারে। একদিন সোহিনীদির সাথে কথা বলেছিল। সোহিনীদি তেমন আগ্ৰহ দেখায়নি,' ঝুম সামনে পুজো খুব চাপ পার্লারে এখন মন দিয়ে কাজ কর সোনা। আমি এই সময় ওভারটাইম দিই এছাড়া বোনাস তো আছেই। এখানে এত পরিশ্রম করে ওসব করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে যাবি। আর কে কিনবে তোর কাছে এইসব?'
-' না গো,ভালো লাগে তাই করি। মনটাও ভালো থাকে। একটা লোন পেলে আরও কিছু মাল কিনতে পারতাম।'
সোহিনী একটা দায়সারা উত্তর দেয়,' আচ্ছা বাবা দেখব আমি,আপাতত পুজোর চাপটা সামলে দে প্লিজ। হ্যাঁ তোদের পাড়ার আরও যদি কেউ কাজ করে বলিস একটু।'
মুনিয়ার মনটা উড়ুউড়ু কালই তো ওদের যাওয়া। ওহ্ কখন যে বাড়িতে যাবে! ডল তো লাফালাফি করছে আগে থেকেই। ভিডিও কলিং করে সব দেখানো হয়ে গেছে নতুন বৌদিভাইকে।
' অনেক গল্প আর মজা হবে আগে তো এসো এখানে। কত কথা জমে আছে।'
-' প্রেম করছিস নাকি? কি এত কথা?'
-' তুমি এসো তো আগে। আমার ওসব হবে না। মা জানতে পারলে দেবে একদম। মাকে তো চেন না।'
শাশুড়িকে একটু হলেও চেনে মুনিয়া। রায়চৌধুরী বাড়ির বড় বৌ,চারিদিকে নজর। কড়া হাতে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন,সংসার সামলেছেন এমনকি নারকেলের নাড়ুতেও কড়া পাক দেন। মামণির রাগী মুখটা কাজললতা ফেরত দেবার দিনই
দেখেছিল মুনিয়া। খুব খারাপ পেয়েছিলেন।
এয়ারপোর্টে মা বাবা এসেছিল,একটা দিন কলকাতায় থেকে একদম মা বাবাকে নিয়ে সোজা কৃষ্ণনগরে। তাছাড়া মুনিয়াকে একটু ব্যাঙ্কেও যেতে হবে। গয়নাগাটি কিছু নিতে হবে সাথে। বাড়ির পুজো বলে কথা। তাছাড়া এইসময় না পরলে আর পরবে কবে?
ব্যাঙ্কে দাঁড়িয়ে লকারে যাবার জন্য একটু অপেক্ষা করে মুনিয়া। এই ব্যাঙ্কে আসতে ওর ভালো লাগে। কত ছোট থেকে এখানে আসছে মায়ের সাথে,মোটামুটি যারা আগে থেকে আছে অনেকেই চেনে ওকে। তাছাড়া এখন তো বাবার বন্ধু প্রদীপকাকু ওখানে আছেন। বাবা বারবার বলে দিয়েছেন,' কিছু অসুবিধা হলে প্রদীপকে বলিস বুঝলি। খুশি হবে তোকে দেখলে।'
-' কি অসুবিধা হবে বাবা? আমি কি বাচ্চা নাকি?'
-' না মানে এই যদি লকারের সইটই না মেলে। রাণাটাও তো নেই ওর আবার কিসব কাজ আছে গেল।'
-' বাবা আমি পারব ভেব না তুমি। কাজ হয়ে গেলে ট্যাক্সি করেই নাহয় চলে আসব।'
অপেক্ষা করতে করতে একটু বিরক্ত লাগে মুনিয়ার ওহ্ একজন ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা ঢুকেছেন কখন বেরোচ্ছেন না। কি যে করছে কে জানে!
হঠাৎই মুনিয়াকে কে যেন পেছন থেকে বলে..' দিদি এখানে! '
মুনিয়া অবাক হয়ে পেছন ঘুরে দাঁড়ায়, চেনা লাগে ঠিক চিনতে পারে না তবে হঠাৎই নজর পরে স্কার্ফ ঢাকা গলাটায় মনে পড়ে যায়। তার আগেই ও বলে ওঠে,' ঐ যে বিয়েবাড়িতে কনে সাজাতে গেছিলাম মানে আপনার বন্ধুকে।'
- ' হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে। তুমি এখানে?'
-' আমাদের পার্লার থেকে এটা কাছে হয় তাই এখানেই আসতে হয়। একটা লোনের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলাম হচ্ছে না কিছুতেই। কতদিন ধরে ঘুরছি। তাই আবার এসেছি।'
ওর মুখটা দেখে সত্যি মায়া হয় মুনিয়ার কে জানে পার্লারে কাজ করে কত পায়। নিশ্চয় খুব অভাব। একবার কি প্রদীপ কাকুকে বলবে?
তারপরেই রাণার কথা মনে হল,এমন উপকার করার জন্য বকুনিও খায় রাণার কাছে। তাই জিজ্ঞেসা করে,' কোন বিশেষ দরকার?'
' হ্যাঁ খুব দরকার ছিল,আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।'
মুনিয়ার বিবেক ওকে আর থামতে দেয় না। যাক মেয়েটার যদি একটু উপকার হয়। তাই তাড়াতাড়ি ওকে বাইরে রেখে নিজেই প্রদীপকাকুর সাথে দেখা করে একটু কথা বলে নেয় ওর ব্যাপারে। তারপর ঝুমকাকে ডাকে। প্রদীপকাকু বলেন,' যখন মুনিয়ার চেনা কেউ তখন তো তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করতেই হবে।'
হঠাৎই কৃতজ্ঞতায় চোখটা ঝাপসা হয় ঝুমের। মুনিয়া ওর পিঠে একটা হাত রাখে,' আমি চলি দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার অন্য কাজ আছে। একটু খোঁজ নিয়ো মনে হয় হয়ে যাবে।'
ঝুমের ইচ্ছে হয় মুনিয়ার ফোননম্বরটা নিতে কিন্তু আর বলতে পারে না। আসলে মুনিয়াকে ব্যাঙ্কে দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনি ঝুম। তবে ও যে এভাবে ওর উপকার করে দিয়ে যাবে ভাবতে পারেনি।
সত্যিই বোধহয় পৃথিবীটা গোল আর এখানে আজও ভালো মানুষের বাস তাই একদিন যে প্রাক্তনকে নিভৃতবাসে পাঠিয়েছিল নিজের খেয়ালে আজ তার বৌ ওর উপকার করল।
কিন্তু জানলে কি করত? নিজেকে প্রশ্ন করে ঝুম।
***************************
লাল সিল্কে জরির পাড় দেওয়া শাড়িটা রাণাই নিয়ে এসেছিল পছন্দ করে। আজ সেটা গায়ে দিয়ে সত্যিই নিজের প্রেমে ভাসতে ইচ্ছে করে মুনিয়ার। রাণা ওর গলার হারের ক্লিপটা লাগাতে লাগাতে বলে,' এবার একদম পারফেক্ট বৌ বৌ লাগে। ওখানে তো বৌ ইমেজটা পাই না। এখানে এসে আবার নতুন করে দেখছি। পছন্দ হয়েছে শাড়িটা!'
-' লিপস্টিক পরে ফেলেছি,নাহলে একটা চুমু দিয়ে বলতাম একদম মনের মত হয়েছে।'
অনেকদিন বাদে বাড়ির পথে চলেছে রাণা,তবে এবারের যাওয়া বেশ অন্যরকম সাথে শ্বশুরমশাই শাশুড়িমা আর মুনিয়া। এই রাস্তায় যেতে যেতে কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে ওঠে মনটা। একেই বোধহয় বাড়ির টান বলে।
ওদের কৃষ্ণনগরের বাড়ি তখন জমজমাট। বাবা বাইরেই অপেক্ষায় বান্ধবী আসছে বলেই বোধহয় আগ্ৰহটা বেশি। বাড়ি থেকে সবাই বেরিয়ে গেটের সামনে দাঁড়ায়। সত্যি বলতে এই আপ্যায়নটা দারুণ লাগে মুনিয়ার। সবার সাথে একদম মেতে যায় পুজোর আনন্দে মুনিয়া। চারদিকে শুধু পুজো পুজো গন্ধ আর আকাশে শরতের মেঘের খেলা। রাণা অবশ্য সবার সাথে দেখা করেই মুনিয়াকে হাত নেড়ে হাওয়া। মুনিয়া জানে পুরোনো বন্ধুদের সাথে নিশ্চয় একছুটে দেখা করতে গেল রাণা।
গেট পেরিয়ে গোপাল মন্দির তারপর দুর্গা দালান। বড় চেনা এই ঠাকুরের মুখটা মুনিয়ার। আজ হয়ত এই মায়ের জন্যই মুনিয়া কাজললতার আদর মেখে এই বাড়ির বৌ হয়েছে। ঠাম্মা তো তাই বলেন।
বাড়িতে আনন্দের হাট বসেছে,রাণা বলে এখন আর আগের মত আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই ওদের তবে মায়ের পুজো মা নিজেই করিয়ে নেন তাঁর ইচ্ছেমত।
শাশুড়ি মায়ের চেয়েও শ্বশুরমশাই বেশি মাই ডিয়ার মুনিয়ার। আগে আঙ্কেল ছিল এখন বাপি বলে।
মুনিয়া সরভাজা খেতে ভালোবাসে বলে আগে থেকে অর্ডার দিয়ে সব জোগাড় করে রেখেছেন। ওর মা দেখে মুগ্ধ সব কিছু। মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে আদর পাচ্ছে সবাই মাথায় করে রেখেছে তা দেখে যে কোন মা বাবাই খুশি হয়। অনেক আদরে সন্তান পালন করে তাকে পরের বাড়িতে পাঠাতে যে কেমন লাগে তা হয়ত মেয়ের মা বাবাই ভালো জানে।
ওদের আদরযত্নের মাঝে মুনিয়াকে ওর মা বলে,' টাকা তো অনেকেরই থাকে। টাকাটাই সব নয়। কত ভালোবাসছে সবাই আমার মেয়েকে এটা দেখেই তো শান্তি।'
পিসি কাকু তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে একদম বাড়ি ভরপুর। মুনিয়া খুব বলেছে পুতুলকে আসতে। অবশ্য পুতুলেরও এবার বিয়ের পর প্রথম পুজো তাই বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি দুই তরফের মন রাখতে আর্ধেক পুজো কলকাতায় আর আর্ধেক পুজো শ্বশুরবাড়ির গ্রামে থাকবে। মুনিয়াকে ফিসফিস করে বলে,' ইশ্ কলকাতার পুজো ছেড়ে গ্রামে থাকা,কি বিচ্ছিরি বল তো! অবশ্য শাশুড়িমা বলছেন একবার থেকে দেখো কত আনন্দ হয় এখানে। নতুন বৌ চলে গেলে নাকি বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাবে।'
' আমারও তো সেম বাট আমি এবার পুরোটাই এখানে থাকব। দারুণ মজা হচ্ছে এখানে। শুধু আড্ডা,সাজগোজ আর খাওয়াদাওয়া।'
পুতুল মজা করে,' শুধু আড্ডা না মেরে শাশুড়িমা কে একটু সাহায্য কর খুশি হবেন।'
-' একদম পাকা গিন্নী হয়েছ দেখছি কদিনেই! চলে আয় প্লিজ দশমীর দিন সিঁদুর খেলা হবে। মেলাতে ঘুরব,চুড়ি কিনব।'
পুতুলের মনে পড়ে গতবারের আর আগেরবারের কথা। প্রথমবার খুব মজা হয়েছিল সত্যিই।
ওদের কথার মাঝে কৌশিক এসে দাঁড়ায়,' কি কথা হচ্ছে এত ফোনে?'
-' মুনিয়া বলছে যেতে ওখানে যাবে দশমীতে?'
-' মাকে একবার জিজ্ঞাসা করে নেব তারপর।'
মুনিয়া এখন অনেক কিছুই বোঝে তাই আর কিছু বলল না। তবে মামণিকে বলতেই মামণি পুতুলের শাশুড়িমাকে ফোন করে ওদের সবাইকে আসতে বলল। যদি পুতুলের আসা হয়।
***********************
শান্তা আলমারি খোলে বাড়িতে তাঁতী আসে ওদের,ওখান থেকেই সবার জন্য শাড়ি কিনে রাখে একটু একটু করে। পুজোতে সবাইকে দিতে হয়। তাই মোটামুটি একরকম শাড়িই কেনা থাকে সবার জন্য। শুধু নতুন বৌমার জন্য একটু স্পেশাল। প্রথম পুজো বলে কথা।
মুনিয়ার নতুন শাড়ির গন্ধ নিতে খুব ভালো লাগে।
' সব রেডি করে রেখেছ একদম!'
'হ্যাঁ সব গোছানো আছে,এখন শুধু আনন্দ কর। কতদিন বাদে এলে তারপর একটু একটু করে সব শিখে নিয়ো। তুমিই তো বাড়ির বড় বৌমা।'
-' মা তোমার বড় বৌমা এখনও বাচ্চা মেয়ে জান তো? মাঝেমধ্যে এত কাঁদে সামলানো মুশকিল।'
-' তুই নিশ্চয় ওর পেছনে লাগিস,এখানে থাকতে বোনটাকে বিরক্ত করতিস। নিশ্চয় তাই করিস।'
রাণার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকায় শান্তা।
-' না মা ও কিছু করে না। আমারই মাঝে মাঝে মুড সুইং করে।'
-' সে আবার কি দিদি ভাই? এখন ঝগড়াঝাটি আর রাগ কেন? এখন তো শুধুই ভাব ভালোবাসা। এই দেখো না আমাদের বিয়ের পঞ্চাশ তো কবেই পেরিয়েছে তাও তোমাদের দাদান আমাকে চোখে হারায়। শুধু বলে এখানে একটু বোসো দেখি কাছটায়। সারা জীবন তো কত ছোটাছুটি করলে। এখন বৌমারা সামলাক,তুমি বোসো। আ মরণ,এখন আবার তোবরা গালে বসে গপ্প হবে। পালিয়ে এলুম তোমার কাছে।'
শান্তা শাড়ির আঁচলে গা ঢেকে ঘর থেকে বাইরে চলে যায়। যাক একটু গল্প করুক ঠাম্মা,নাতি,নাতবৌ।
মুনিয়া খুব মজা পায়,' ও ঠাম্মা দাদুর সাথে পুরোনো দিনে কেমন ভালোবাসা ছিল তোমার একটু বলো না গো?'
-' আচ্ছা দুষ্টুমিতে তো খুব পাকা দেখছি নতুন দিদি! সেই ভালোবাসা চলত ইশারায় আর চোখে চোখে। শাশুড়িমা খুব কড়া ছিলেন দুপুরবেলা তো মোটেই শুতে দিতেন না। আচারের বয়াম রোদে দেওয়াতেন, কাপড় ওল্টাতে ছাদে পাঠাতেন। সাবুর পাপড় শুকোতে দিতেন। আর তোমার দাদান খুব রাগ করত। যত ভালোবাসা সেই রাতে। তার মধ্যে একদিন ছাদে বসে আছি হঠাৎ পিঠে একটা ঢেলা লাগল। উঃ বলে ফিরে তাকাতেই দেখি তাতে একটা ছোট কাগজের টুকরো বাঁধা..' মা তো ঘুমিয়ে পড়েছে, একটু ঘরে এসো।'
মুনিয়া রাণার দিকে তাকায় রাণা বলে ভালোবাসার চিরকুট দাদানও দিত।
' হ্যাঁ দাদান তোমার চেয়ে বেশি রোমান্টিক ছিল। দেখেছ তো?'
-' তখন তো এইসব হোয়াটস অ্যাপ ছিল না নতুন দিদি তাই এভাবেই আমাদের কথা হত। এবার এদিকে এস তো,কানে কানে একটা কথা বলি।'
মুনিয়া কান রাখে ঠাম্মার খুব কাছাকাছি, রাণাও কান পাতে। ঠাম্মা ফিসফিস করে,' সে আসছে কবে? তারজন্য যে কাজললতা বানিয়ে ফেলেছি।'
মুনিয়ার গালে লাল রঙের আভা ছড়ায়,' ঠাম্মা, এত তাড়াতাড়ি!'
রাণা হাসে,' আমিও শুনে ফেলেছি সব। তবে মেয়েই যে হবে তা জানলে কি করে? যদি ছেলে হয় তাহলে কাজললতা কি হবে?'
' প্রথমে মেয়ে হওয়াই ভালো ঘরে লক্ষ্মী আসবে।'
মুনিয়া জিভ কাটে,' আবার দ্বিতীয়? ঠাম্মা তোমার প্ল্যান তো অনেক বড়।'
হাসির রেশ ছড়িয়ে পড়ে ওদের মনে তার মধ্যেই ঠাম্মার ডাক পড়ে যায় দাদান ডাকছে।
' আসি রে নতুন দিদি তোরা আনন্দ কর জমিয়ে আমার কেষ্টঠাকুরের বাঁশী বেজেছে গো।'
মোটামুটি গ্রুপ ভাগ হয়ে গেছে এখানে। মুনিয়া যথারীতি ননদ দেওরদের গ্ৰুপে। রাণা তো মোটামুটি বেপাত্তা বন্ধুদের সাথে। মুনিয়াকে ডল বলেছিল,' বৌদিভাই দাদাকে একটু বক না। দিনরাত আড্ডা দিচ্ছে বন্ধুদের সাথে আর ধোঁয়া ছাড়ছে।'
মুনিয়া ঠোঁট উল্টে বলেছিল,' আমি এখন ফ্রী একদম,তোরা এবার সামলা তোদের দাদাকে। একটু স্বাধীনতা দে বেচারাকে। নাহলে মা দুর্গা রাগ করবে।'
মুনিয়ার কথা শুনে হেসে অস্থির হয় ওরা সবাই। সত্যি আমাদের বৌদিভাই একদম নাম্বার ওয়ান। কিছু বুদ্ধি রাখ তুমি।
মুনিয়া হাসে আর ভাবে রাণাটা একটু ডিস্টার্বড অফিসের কথা শুনে। মনটা একটু খারাপও ওর। তবে মুনিয়া বারবার বলে দিয়েছে এই পুজোর মধ্যে শুধুই আনন্দ আর অন্য কোন কথা নয়।
যাক বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে একটু হালকা থাক ছেলেটা। ওর হাসিমুখটা দেখতে ভালো লাগছে মুনিয়ার।
সারা বাড়িতে পুজোর গন্ধ ছড়ানো,মুনিয়া তো মা বাবাকে খুঁজেই পাচ্ছে না। এবার ওর মায়ের পাঠানো বেনারসী পরেছেন মা দুর্গা। গতবার নাকি মা মানত করে গেছিল। সত্যিই তো ভালো আছে মুনিয়া। অথচ এই মুনিয়াই একদিন পৃথিবীর আলো দেখতে চায়নি,মুখ সরিয়ে নিয়েছিল।
আলোতে আলোতে সেজেছে বাড়ি সন্ধ্যা আরতী হচ্ছে মুনিয়াকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে চোখ ফেরাতে পারে না রাণা। মুনিয়াকে এমন করে সিঁদুরের টিপে আর সিঁথি ভর্তি সিঁদুরে কে সাজিয়েছে কে জানে? যদিও রাণা ব্যাঙ্গালোরে থাকতে এই সাজে মুনিয়াকে দেখেনি কখনই। তবে বেশ লাগছে এই বৌ বৌ সাজে মুনিয়াকে। হয়ত পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে যারা সাজতে পারে তাদেরকেই এমন সুন্দর লাগে।
আজ সপ্তমী,প্রতিবারের মতই দুপুরে একদম জমিয়ে বাঙালী খাওয়াদাওয়া। ঝুরঝুরে আলুভাজা আর শুক্তো রাণার খুব প্রিয় মা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওদের খাওয়ালো। যদিও মুনিয়া একটু আপত্তি করছিল,' মামণি আমি তোমাদের সাথে খেতে বসব।'
শান্তা চোখ পাকিয়ে ধমকায়,' ছেলেমেয়েদের না খাইয়ে আমরা বসব কি করে? বাচ্চাদের সাথে বসে যাও খেতে।'
-' আমি বাচ্চা!'
-' বাবা মায়েদের কাছে ছেলেমেয়েরা সবসময় বাচ্চা।'
হয়ত এটাই অনেক বড় পাওয়া মুনিয়ার কাছে। ননদ দেওরদের সাথে মজাতে ডুবে গিয়ে একদম কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া।
পুজোর আনন্দ,অষ্টমীর অঞ্জলি আর নতুন শাড়ির গন্ধে দেখতে দেখতেই দিনগুলো কেটে পুজো দশমীতে পা দেবে দেবে করছে।
অষ্টমীর পুজো যে এত সুন্দর হয় তা মুনিয়া জানত না এবার শাশুড়িমা নিজের সাথে ওকে অ্যাসিসট্যান্ট করে নিয়েছিলেন। 'দেখ কত ভালো লাগবে মায়ের পুজোর অঞ্জলি তারপর সন্ধিপুজো।'
মামণির সাথে হাত দিয়ে পদ্ম ফোটাতে থাকে মুনিয়া লালপাড়ের সাদা শাড়ি পরে। রাণা ভিডিও তুলতে ব্যস্ত। ভাইবোনেরা তাই নিয়ে মজা করছে।
' আমাদের আর কে ছবি তুলে দেবে বল,বৌদিভাই পদ্ম ফোটাচ্ছে আর দাদাভাই ছবি তুলছে।'
ডলের মনে একটু করে দোলা লাগছে, মুনিয়াকে বলেছে সেই কথা। মুনিয়া প্রথমে একটু গম্ভীর হয়ে বলল,' এই যে বললি মা খুব রাগ করবে জানলে,তুই নাকি কোনদিন কিছু করবি না। তাহলে সবটাই বাজে কথা। একদিন নিয়ে আয় তবে বুঝব। আজ বিকেলে আনব?'
-' মানেটা কি? সে কোথায় থাকে?'
-' ঐ তো ওদের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। অবশ্য ও কলকাতায় থাকে ছুটিতে এসেছে।'
হেসে ফেলে মুনিয়া,' ওহ্ বাবা এ তো ছাদে ছাদেই প্রেম। তা কবে থেকে চলছে এসব শুনি? মামণিকে বলতেই হবে।'
-' প্লিজ বৌদিভাই কাউকে বোল না। তাহলে ঝামেলা হবে। আমি এখনও হ্যাঁ করিনি বলেছি বৌদিভাই আগে হ্যাঁ বলুক তারপর।'
অষ্টমীর সন্ধ্যায় আরতি হলে মুনিয়ার শ্বশুরবাড়ির ছাদে এসেছিল আনন্দ। যাদবপুরে পড়ছে ইলেকট্রিক্যাল ফাইনাল ইয়ার। আলাপ করে কথা বলে বেশ ভালো লাগল মুনিয়ার।
হঠাৎই বলে ফেলল,' ডলকে ভালো লাগে? ডলও কি তোমাকে পছন্দ করে? চিরকুট দিয়েছো নাকি?'
অবাক হয়ে তাকায় আনন্দ,মানে?
'মানে এই ছাদ থেকে ঐ ছাদে কিছু দেওয়া নেওয়া হয় নাকি?'
' মাঝে মাঝে পেয়ারা দিই,ও ভালোবাসে তাই।'
-' শুধু পেয়ারা? আর কিছু না? মানে চিঠি বা মেসেজ।'
-' ও তো কিছু বলেইনি এখনও,শুধু সময় নিয়ে যাচ্ছে।'
ডল মুখ লুকিয়ে হাসে তখন।
-' হ্যাঁ ডল বলে দে এবার মাঝে মাঝে চিরকুট দিতে পারে।'
আনন্দর ভালো লেগে যায় মুনিয়া বৌদিকে,খুব মজা করতে পারে আর যেন একদম ছেলেমানুষ।
তাড়াতাড়ি একটা প্রণাম করতে যায়। মুনিয়ার ভালো লাগে ছেলেটার সরলতা তাড়াতাড়ি লাফ দিয়ে ওঠে না না এখন না জমিয়ে রাখ সব পরে একদম সব নেব একসাথে।
ঠাকুর দেখতে বেরোয় না ঝুম আজকাল। অথচ একটা সময় কি নাচুনীই ছিল। এই নিয়ে মায়ের কাছে কত বকা খেয়েছে রাত করে বাড়ি ফেরার জন্য। শুধু অষ্টমীর অঞ্জলি দিয়ে আসে মাকে নিয়ে পাড়ার ক্লাবে। প্রথম প্রথম সবার অনেক কৌতূহল ছিল ওকে নিয়ে এখন সবটাই অভ্যেস হয়ে গেছে সবার দেখে দেখে। এবার পুজোতে মাকে একটা শাড়ি আর চটি কিনে দিয়েছে ঝুম। নিজের উপার্জিত টাকায় এই প্রথম কিছু দিল মাকে। বোধহয় এ এক অন্য আনন্দ। রাত জেগে পুজোর আগে অনেক শাড়ি পাঞ্জাবীতে কাজ করেছে ঝুম ইনকামও খারাপ হয়নি। লোনটা পেলে একটা কিছু ভাবতে পারত। এখন তো পুজো ব্যাঙ্কও বন্ধ। ঐ কথা ভাবতে গিয়ে মুনিয়ার কথা মনে হল ঝুমের। রাণা সত্যিই ভালো বৌ পেয়েছে। তবে ও তো জানেনা রাণার সাথে একসময় ওর প্রেম ছিল। তাহলে হয়ত মুখ ঘুরিয়ে নিত কবেই।
পুতুল আগেই ফোন করেছিল আসছে ওরা সবাই। পিসিমাও খুশি হল জেনে যাক ভালোই হয়েছে এই সুযোগে দাদা দিদিও আসছেন।
জুনিকে ফোন করে মুনিয়া,' মিস্ ইউ জুনি। এখান থেকে যাই তোকে অনেকগুলো খবর দেব। ডলুও ডুবেছে মনে হচ্ছে। তবে ছেলেটা বেশ ভালো। নিজেকে বেশ বড় বড় মনে হচ্ছে এখন বুঝলি। তোর বেবিটা কি করছে? হাত পা ছুড়ছে নাকি?'
-' আর বলিস না ফুটবল খেলেই যাচ্ছে। তবে ডলের কথাটা তোদের মামণিকে আর রাণাকেও বলিস। তুই সবটা জেনে চুপ করে থাকিস না।'
এই জন্যই জুনের ম্যাচিওরিটিকে ভরসা করে মুনিয়া।
পুতুলরা এসে গেছে শুনে মনটা খুশিতে নেচে ওঠে মুনিয়ার কতদিন বাদে দেখা হবে আবার। খুব পাকা গিন্নী হয়ে গেছে পুতুল।
স্নান করে এলোচুলে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসে মুনিয়া। রাণা কৌশিকদার সাথে কথা বলছে। মুনিয়া পুতুলকে জড়িয়ে ধরে,' কি সুন্দর লাগছে তোকে! কর্তা গিন্নী একদম ম্যাচিং ভীষণ ভালো লাগছে।'
' আমার ননদ পাঠিয়েছে এইগুলো, আরে যে আমার সাজগোজ সব ঠিক করেছিল। বলল সুশ্রী পার্লারের থেকে নেওয়া। ওরা আজকাল এগুলো রাখছে। আমাকে যে সাজিয়েছিল সে করছে।'
হঠাৎই মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায় মুনিয়ার,ঐ জন্যই বোধহয় ওর টাকার দরকার। তবে আর কিছু বলে না পুতুলকে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে কাজে।
সিঁদুর খেলাতে আর ধুনুচি নাচে ওরা সবাই মেতে উঠেছে। এবার রাণা মুনিয়ার সাথে যোগ দিয়েছে দেওর ননদেরাও। আনন্দও এসেছে বাড়িতে ওকেও নাচতে দেখে হঠাৎই মুনিয়া।
নাচতে নাচতে একটু ব্রেক নিয়ে মামণির পাশে বসে বলে,' মা এই ছেলেটা কে গো? ডলের পাশে নাচছে।'
শান্তার মুখে প্রশ্রয়ের হাসি খেলে যায়,' ও আনন্দ পাশেই থাকে। খুব ভালো ছেলে। তুমি দেখোনি আগে? অবশ্য ও তো কলকাতায় থাকে।'
মুনিয়া একটু সাহস পেয়ে বলে,' বেশ মানিয়েছে ওকে ডলের সাথে তাইনা মা? ডলের শ্বশুরবাড়ি কাছাকাছি হলে ভালো হয়। যা আদুরে ও।'
- ' সবই মায়ের ইচ্ছে, কার বাড়িতে চাল মেপে এসেছে কে জানে?'
ডল এসে ওকে টেনে নিয়ে যায় নাচতে তবে মুনিয়া বোঝে হয়ত বা মামণিও কিছুটা আন্দাজ করেছে।
সিঁদুরে মাখামাখি মুনিয়া, আর কোন সঙ্কোচ নেই সিঁদুর মাখতে। রাণার ক্যামেরাও আজ সব মুহূর্ত বন্দি করতে ব্যস্ত। পুতুল একটু নেচে বসে পড়ে। কৌশিক ওকে বসতে বলে ইশারায়। মুনিয়া ওকে ডাকে,পুতুল হাসে বলে হাঁফিয়ে গেছে। এখনও কেউ জানে না বাড়িতে তবে পুতুলের শরীর একটু করে জানান দিচ্ছে হয়ত কেউ আসতেও পারে। কৌশিককে বলেছিল পুতুল,আমার যেন কেমন মনে হচ্ছে। কৌশিক বলেছে,' হয় যদি হোক। সবাই খুশিই হবে।'
পুতুল বসে বসে আনমনা হয়ে যায় একটু ভয়ও করে। মা দুর্গার কাছে হাত জোড় করে সব যেন ঠিক থাকে।
মেলাতে ঘুরতে বেরোয় ওরা সবাই। মুনিয়া দেখে দূরে ডলকে একগোছা লাল চুড়ি কিনে দিচ্ছে আনন্দ। নস্টালজিক হয়ে যায় মুনিয়া,রাণাকে বলে,' আমার চুড়ি কোথায়?'
ডল ছুটতে ছুটতে আসে,'বৌদিভাই তোমার জন্য চুড়ি এনেছি, তোমার কোনটা পছন্দের বল,লালটা নেবে?'
-' লালটা তোকেই ভালো মানাবে তুই বরং হলুদগুলো দে।'
ডলের গালে লাল আভা লাগে আনন্দের মুখে হাসি ছুঁয়ে যায়।
পুতুলরা চলে গেছে সন্ধ্যের পরেই। দাদান ঠাম্মাকে প্রণাম করতে আসে রাণা আর মুনিয়া। ঠাম্মা আদর করে ওদের নিজের হাতে মিষ্টি খাওয়ান। তারপর রাণার হাতে টাকা আর মুনিয়ার হাতে আবার লাল ভেলভেটের ব্যাগ দেন। মুনিয়া বলে,' কি আছে এতে?'
' তোকে বলেছি না কাজললতা গড়িয়ে রেখেছি আগাম। রেখে দে নতুন দিদি।'
-' তোমার কাছে থাক ঠাম্মা এখন,পরে নেব।'
-' না নতুন দিদি তোর কাছেই থাক এই বুড়ো ঠাকুমার কি ভরসা আছে?'
রাণা মুনিয়া দুজনেই জড়িয়ে ধরে ঠাম্মাকে। রাণা বলে,' আজকে শুভদিনে এসব কথা কেন? এমন বললে আর কথা বলব না। '
মুনিয়ার চোখটা একটু ঝাপসা হয়। কেন যেন ঠাম্মার কথাকে ও খুব বিশ্বাস করে তাই দুই হাত পাতে। রিনরিন করে হাতের চুড়ি আর বালা,' দাও ঠাম্মা এই হাত পাতলাম।'
কাজললতা নিয়ে ঠাম্মাকে প্রণাম করে মুনিয়া। ঠাম্মা মাথায় হাত রাখেন,' সুখে থাক তোরা, অটুট হোক তোদের বন্ধন।'
*********************
ওদের চলে আসার সময় রাণা অফিসের কথা বলল। শুনে সবারই মনটা একটু খারাপ হল। সবার এক কথা না গেলেই ভালো হয় বাইরে। সবেই তো নতুন বিয়ে হয়েছে এইসময় বাইরে চলে যাবে!
শান্তা বলল,' যেতে হলে যাবি কি আর করা যাবে? তবে মুনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যাস। ও একা একা কি করবে? মানে তুই চলে গেলে একা এখানে সব সামলাতে পারবে?'
মুনিয়া ওর মায়ের সাথে চোখাচোখি করে তারপর বলে,' আচ্ছা মামণি,রাণা কি সবসময় আমার সঙ্গে থাকত নাকি? আমি তো প্রথমে গিয়ে ওখানে একাই ছিলাম। সবটাই একাই সামলাতাম। অবশ্য জুনি ছিল কিছুদিন।'
' আমিও ছিলাম কিছুদিন,আর তখন দেখেছি কি করত মুনিয়া একা একা।'
-' মামণি দেখছ কেমন পেছনে লাগছে আমার!'
-' পেছনে লাগবে কেন রাণা তো ঠিকই বলছে আমারও খুব চিন্তা লাগছে। বেশ দুটোতে ছিল একসাথে এইসময় এই অফিসের চিন্তা।'
-' তোমরা কি বলতে চাইছ আমি খুব বুঝতে পারছি মা। তোমরা চাইছ আমি আমার চাকরি ছেড়ে দিয়ে রাণার সাথে চলে যাই তাই তো?'
সবার চাওয়ার কথাটা মুনিয়াই বলে ফেলে তারপর তাকিয়ে দেখে এদিক ওদিক। মামণি,মা,বাবা,বাপি রাণা সবাই চুপ। শুধু ডলই বলে ওঠে তাহলে ভীষণ ভালো হবে,কত সুন্দর ঘোরার জায়গা ওখানে। যারা বিদেশে যায় শুধু ঘুরে বেড়ায় আর সুন্দর সুন্দর ছবি পোস্ট করে। ইশ্ আমরা যদি যেতে পারতাম।'
' যাবে সোনা,ঠিক যাবে। তবে আমি যাচ্ছি না তোমার দাদাভাইয়ের সাথে চাকরি ছেড়ে। এত পড়াশোনা করলাম কেন? ওখানে গিয়ে হাউসওয়াইফ হয়ে থাকা আমার একদম পোষাবে না।'
মুনিয়ার কথাটাও ফেলা যায় না। সত্যি তো ছেলের মতই মানুষ হয়েছে মুনিয়া। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে চাকরি করছে। ও চাকরি ছেড়ে যাবে কেন?
মুনিয়ার কথাটা শুনে রাণার মুখের হাসি একদম নিভে যায়। মুনিয়াকে জোর করতে পারছে না কিন্তু ওর যে খুব কষ্ট হবে মুনিয়াকে ছেড়ে থাকতে। অথচ কেন যেন এই কথাটা মুনিয়াকে বলতে পারছে না। এক দুবার বলতে চেয়েছিল কিন্তু মুনিয়া যখন বলেছিল সব কম্প্রোমাইজ মেয়েদেরই বা করতে হবে কেন? আর কিছু বলতে পারেনি রাণা।
শান্তা তাও বলে,' এখনি তো কিছু হচ্ছে না,পরে ওখানে গিয়ে ভেবে দেখ ঠান্ডা মাথায়। কাছে তো নয় যে আমি গিয়ে মাঝেমাঝেই থেকে আসব।'
মুনিয়ার মাও সুর মেলায় শান্তার কথায়,' আমারও তো অফিস আছে তাই কি করেই বা যাব? তবুও মাঝে মাঝে চেষ্টা করব যেতে।'
' মা আমি ঠিক থাকব,আর কতদিনই বা? দুটো বছর ঠিক কেটে যাবে। আচ্ছা আমি যদি বাইরে যেতাম তাহলে রাণা চলে যেত সব ছেড়ে? মেয়েদের এত নরম ভাব কেন তোমরা?'
একটা চিন্তার অস্থির হাওয়ার পরশ জড়িয়ে ফিরে আসে ওরা। শান্তারও মন কেমন হয়,মা দুর্গার থানে হাত জোড় করে বলে,' তুমিই দেখ সব,আমার ছেলেমেয়েরা যেন ভালো থাকে।'
ফেরার সময় শ্বশুরমশাই মানে বাপি একদম প্যাকেট প্যাকেট গুছিয়ে মিস্টি দিয়ে দিয়েছেন তারমধ্যে কিছুটা জুনির।
ওকে খাওয়াতেই হবে এখানকার সব মিস্টি। মা বারবার বলে দিয়েছে,' গিয়েই সব পৌঁছে দিবি ওর ওখানে। বেচারা খুব ভালোবাসে খেতে। তারপর এখন এই অবস্থায় আসতেও পারেনি মেয়েটা এখানে।'
সুতরাং ফিরে আসার পরেই জুনির ওখানে ছুটতে হল রাণা আর মুনিয়াকে। জুনির শরীরে এখন মাতৃত্বের আদরে ভরপুর,এই কদিনেই বেশ অন্যরকম লাগছে ওকে দেখতে।
সবার আদর ভরা জিনিসপত্র আর শাড়ি পেয়ে খুব খুশি জুনি।
-' সবাই আমাকে কত ভালোবাসে দেখেছিস! একদম তত্ত্ব করে পাঠিয়েছে সব। যাক বাবা আর লোভ দিলাম না। পুতুলের কি খবর রে? কেমন আছে ও?'
' বেশ ভালো আছে,একটু মোটাসোটা হয়েছে। একদম পুরো গিন্নী। কৌশিকদা বেশ কেয়ারিং বৌকে চোখে হারাচ্ছে।'
' আমাদের রাণাই বা কম কি? জানিস কত কেঁদেছে আমার কাছে বাইরে যাওয়ার কথা শুনে। কতগুলো টিস্যু যে ভিজিয়েছে বলে শেষ করতে পারব না।'
রাণা চোখ পাকায় জুনিকে,' কি শুরু করেছিস জুনি! ইশ্ একদম যাচ্ছেতাই আমার বন্ধুরা।'
-' এই যে মুনিয়া সুতরাং অন্যের বরেদের গুণগান না করে আমার বন্ধুর দিকে একটু তাকা। বেচারাটা শান্ত ছেলে বলে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে।'
জুনির কথা শুনে মুনিয়া খিলখিল করে হাসলেও কোথায় যেন একটা কষ্ট হয় খুব। সত্যিই যত কথাই বলুক না কেন রাণা চলে যাবে ভাবলেই একটা যে কেমন লাগছে ঠিক বলে বোঝাতে পারবে না মুনিয়া। সব কিছু বোধহয় শেয়ার করা যায় না।
**********************
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। সেদিন রবিবার আর এই দিনটাতে মুনিয়ার অনেকটা সময় বাথরুমে কাটে। ওর এই আরামের স্নানের সঙ্গী কখনও রাণাকেও হতে হয়। ডুবে যায় দুজনে আবেশে তালগোল পাকিয়ে যায় ঘন্টা মিনিটের হিসেব। সুখী দাম্পত্যে লাগে ভালোবাসার দস্যিপনার ঝোড়ো হাওয়া।
মুনিয়া বাথরুমে অবিরাম বারিধারায় ভিজছে। ওর সাবান শ্যাম্পুর গন্ধ এদিকেও ছড়িয়েছে। রাণা আজ মন দিয়েছে গার্লিক চিকেন বানাতে।
হঠাৎই মুনিয়ার ফোনটা সুরেলা সুরে বাজতে থাকে।
বিরক্ত লাগে রাণার,উঃ এখন আবার কে ফোন করল! রান্নাঘর থেকে হাত ন্যাপকিনে মুছে বাইরে আসতে আসতেই ফোনটা কেটে যায়। রাণা দেখে আননোন নম্বর। ততক্ষণে মুনিয়া বাথরুম থেকে মুখ বাড়িয়েছে,' কে ফোন করেছে? ধরেছিলি?'
-' আননোন নম্বর কেটে গেল ধরতে ধরতেই। তুই এসে করে নিস।'
-' রান্না হয়ে গেছে?'
মুনিয়া হাতের ইশারায় রাণাকে ডাকে। মুনিয়ার ভেজা হাতের আকর্ষণে এগিয়ে যায় রাণা। রান্নাঘরে সাময়িক প্রেমের বিরতিতে তখনকার মত ইন্টারভ্যালের পরদা নামে।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে মুনিয়ার মনে পড়ে ফোনের কথা।
'ইশ্ ফোনটা কখন এসেছিল! মাথাতেই ছিল না।'
' আর থাকে কিছু মাথাতে? আমার রান্না পড়ে আছে এদিকে। ভীষণ মুডি তুই! আর জেদীও।'
রাণার ঘাড়ে ভেজা চুল ছোঁয়ায় মুনিয়া,' ভালো লাগেনি রিমঝিম শাওন শুনতে শুনতে....'
হারিয়ে যায় রাণা। মুনিয়া ফোনটা হাতে নেয় নম্বরটা ডায়াল করে...' হ্যালো কে? মানে এই নম্বর থেকে একটা ফোন এসেছিল।'
ওদিক থেকে ভেসে আসে একটা সরু পাতলা গলা, প্রথমেই থ্যাঙ্কস বলি। আমার লোনটা হয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহেই পেয়ে যাব হয়ত। সবটাই আপনার জন্য তাই ফোন করলাম।'
মুনিয়ার মাথাটা প্রথমে কাজ করল না। প্রেমে ভেজা মনে লিঙ্কটা আসতে একটু দেরি করল। তারপরেই বলল,' আচ্ছা আচ্ছা বুঝতে পেরেছি খুব ভালো। কিন্তু আমার নাম্বার কি করে পেলে?'
একটু ইতস্তত করে ও বলে,' সরি,আসলে আপনার বন্ধু গেছিল মানে যাকে আমি সাজিয়েছিলাম। আমি ফোননম্বরটা চেয়ে নিয়েছি। কিছু না খুব ইচ্ছে করছিল আপনাকে খবরটা দিতে।'
' ও আচ্ছা বুঝেছি, তোমার হাতের কাজ তো খুব সুন্দর। আমি তো দেখলাম পুতুল পরেছিল।'
' হ্যাঁ ওটাই আরও বাড়াতে চাই।'
টুকটাক কথায় অনেকটা সময় কেটে গেছে। রাণার অসমাপ্ত কাজ মোটামুটি সমাপ্ত এখন। কার সঙ্গে এত কথা বলছে মুনিয়া?
এখনও ভেজা চুলে জলের টুপটাপ। শুকনো তোয়ালেটা ওর কাঁধে রাখে রাণা। বলে চলে যায় ঠান্ডা লাগবে,ভেজা জামায়। রাণার কথাটা ওপারে পৌঁছয় তরঙ্গ বেয়ে। একটা হাল্কা শিহরণ খেলে যায় ঝুমের মনেও। বৌকে কতট ভালোবাসে আন্দাজ করতে পারে। অবশ্য একদিন এই ভালোবাসাই ও অবহেলাতে হারিয়েছে।
কথা বলতে বলতে মুনিয়া রাণার দিকে তাকিয়ে হাসে। ওর এই কেয়ারিং স্বভাবটাই মুনিয়া খুব মিস্ করবে ও না থাকলে। কে ওর চুল মুছিয়ে দেবে? অফিসের তাড়ায় স্যান্ডউইচ খাইয়ে দেবে? কে মাথা যন্ত্রণা হলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে?
মুনিয়া ফোনটা রেখে বারান্দায় তোয়ালে মেলে আসে।
রাণা জিজ্ঞেস করে এই ভেজা চুলে এতক্ষণ ধরে কার সঙ্গে কথা বলছিল মুনিয়া।
-' ওহ্ আর বলিস না একজন ফোন করেছিল ধন্যবাদ জানাতে। আমি তো ভাবতেই পারিনি ওর কাজটা হয়ে যাবে। যাক হয়ে গেছে শুনে ভালো লাগছে।'
-' কি কাজ করেছিস? অফিসের কাজ নাকি?'
-' হ্যাঁ একটা লোনের ব্যাপার,আরে পুতুলকে যে মেয়েটা সাজিয়েছিল না হঠাৎই একদিন ব্যাঙ্কে দেখা তার সাথে। যেদিন লকারে গেছিলাম। ও আমাকে চিনেছে,বলল আমি ঝুমকা। প্রবীর কাকুকে একটু বলেছিলাম। কাজটা হয়ে গেছে ওর। নিডি মেয়েটা খারাপ লাগে।'
'পৃথিবীর সবার অভাব দূর করার জন্য কি তুই আছিস? জানিস সত্যিই কারা নিডি? তোরা কেউ কি আমাকে শান্তি দিবি না! ওহ্ গড! সব খারাপ শুধু আমার সাথেই হয় কেন!'
রাণাকে এমন অদ্ভুতভাবে চিৎকার করতে কখনও শোনেনি মুনিয়া। অবাক হয়ে যায় মুনিয়া। রাগে হাফাচ্ছে রাণা,মুখটা লাল হয়ে গেছে হঠাৎই। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে ....
রাণার হঠাৎ চিৎকার শুনে মুনিয়ার প্রথমে খুব রাগ হয়েছিল। সবাই একরকম হয়। পুরুষ মানেই বৌদের ব্যাপারে পোজেসিভ। এ আবার কি ধরনের অসভ্যতা। মুনিয়া কার সাথে কথা বলবে কাকে হেল্প করবে সেটা রাণা ঠিক করে দেবে! স্ট্রেঞ্জ তো....
তারপরে রাণার দিকে তাকিয়ে আর রাগ করতে পারে না। টেবিলে মুখ ঢেকে বসে আছে রাণা।
মুনিয়া ওর কাছে যায়। রাগ না করে ওর মাথায় হাত রাখে--' কি হয়েছে? আমাকে বল। আমি একটুও রাগ করব না। আমি একটা মেয়েকে সাহায্য করেছি সে ফোন করে থ্যাঙ্কস জানিয়েছে দ্যাটস অল। কি এসে যায় তাতে? কেন এত রিঅ্যাক্ট করছিস তাতে? রাণা চুপ করে থাকিস না। তোর মুখ দেখে বুঝতে পারছি তুই ভালো নেই। কি হয়েছে বল,আমার কিন্তু এবার একদম ইমপেশেন্ট লাগছে।'
মুনিয়ার কোমর জড়িয়ে ছেলেমানুষের মত ওর পেটে মুখ ডোবায় রাণা,' আমি বলছি,সব বলছি। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না প্লিজ। বল আমার ওপর রাগ করবি না। আমাকে ছেড়ে যাবি না।'
মুনিয়া অবাক হয়ে যায় রাণার কথা শুনে,একটা ছেলে যে এত নরম হতে পারে এর আগে সত্যিই দেখেনি মুনিয়া। আসলে ছোট থেকেই দেখে এসেছে ছেলেরা সব পারে,ওরা কাঁদে না। ওরা সুপার ম্যান। আজকে রাণাকে দেখে বুঝল অনেকদিনের কোন জমা কষ্টের মেঘ হঠাৎই মেঘভাঙা বৃষ্টির মত ভাসিয়ে দিতে পারে যে কোন ছেলের চোখই। কান্নাটা বোধহয় শুধুই মেয়েদের একমাত্র সম্পত্তি আর অস্ত্র নয়।
রাণা,এবার বকব আমি। কেন আমি ছেড়ে যাব আবার ভালো বরটাকে? কি হয়েছে বল?
রাণা আবার চিৎকার করে ওঠে,' ঐ যে ঐ মেয়েটা ঝুমকা একটা অত্যন্ত খারাপ মেয়ে,ভীষণ খারাপ। ওর এখানে কি দরকার? কেন ও আসছে আবার আমাদের জীবনে?'
চিকেন অনেকক্ষণ ঠান্ডা হয়ে গেছে। ফ্রায়েড রাইসের সব্জি আর চালের আজ মিলমিশ হয়নি ভালোবাসায়। ওরা দূর থেকেই একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
রাণাকে শান্ত করতে অনেকটা সময় কেটে গেছে মুনিয়ার। রাণা যেটুকু জানে ঝুমকে আজ সবটাই বলে দিয়েছে কোন রকম সঙ্কোচ ছাড়া।
' হ্যাঁ বুঝলাম ও ভিডিও করত,বা কেউ ওকে দিয়ে করাত। কিন্তু এখন ওর এই অবস্থা কে করেছে? '
-' সত্যিই আমি কিচ্ছু জানি না। আমি ব্রেকআপ হওয়ার পর অনেকদিন ওকে দেখিনি। এমন কি তোর মত পা পিছলে ফেসবুকে গিয়েও নয়। তুই জানিস আমি ফেসবুকে থাকিই না।'
' তুই ওকে চিনতে পেরে সেদিন তাড়াতাড়ি চলে গেছিলি তাই না? এখন সবটা আমার কাছে একদম পরিস্কার হয়ে গেল। তুই কোন একসময় কাউকে ভালোবাসতিস অনেকগুলো বছর পরে হঠাৎই তো দেখা হতেই পারে কখনও কোথাও। তাতে এত ভেঙে পড়ার কি আছে রাণা? তুই তো সেদিনই আমাকে বলতে পারতিস মেয়েটা তোর এক্স ছিল। কি এমন হত?'
' আই হেট হার মুনিয়া, এই ধরনের মেয়েদের জাস্ট আমি ঘেন্না করি। তুই যদি ওর ভিডিওগুলো দেখতিস!'
-' হয়ত বাধ্য হয়েছিল করতে। এখন ভালো হতে চায়,নিজে কিছু করতে চায়।'
-' করুক না কে বারণ করেছে,তবে এই ব্যাঙ্গালোরে ছুটির দিনের দুপুরে আমাদের দাম্পত্যে ও এসেছে কেন? তুই আর কখনও ওকে অ্যালাউ করবি না। কখনও নয়।'
মুনিয়ার মুখটা হঠাৎই শক্ত হয়ে ওঠে,' ও তো আমাদের মধ্যে হঠাৎই এসে পড়েছিল রাণা। আমি তো ওকে ডাকিনি। তবে ওর সাথে তোর কাটানো মুহূর্তগুলো তো মিথ্যে নয়। আজ হয়ত সেগুলো খারাপ, কিন্তু একটা সময় এই মেয়েটার স্বপ্ন দেখে কত ঘুমভাঙা রাতে চাঁদ দেখেছিস তাই না? আমার অতীত,তোর অতীত ছিল। ওরাও ছিল,আছে আর থাকবেই এই পৃথিবীর কোথাও। শুধু আমরা নিজেদের মধ্যে ওদের নিয়ে আর কোন ভুল বোঝাবুঝি রাখব না।'
' আমাকে ভুল বুঝিস না মুনিয়া। সত্যিই আমি ওকে দেখে ভয় পেয়েছিলাম। ভালো লাগেনি একটুও ওকে দেখে। আজ যখন তোকে ফোন করেছে তখন খুব রাগ হয়েছিল। মনে হয়েছিল আমাকে কখনও শান্তি পেতে দেবে না এই মেয়েটা।'
মুনিয়া কিছু বলে না তবে বুঝতে পারে রাণা হয়ত সত্যিই অন্য ছেলেদের থেকে আলাদা তাই ঝুমকাকে পণ্য হতে দেখে কষ্ট পেয়েছিল। সবাই তো এক হয় না।
এই ঘৃণার আড়ালে হয়ত কোথাও ভালোবাসা আছে। যাকে একসময় ভালোবেসেছিল তার সর্বনাশ দেখে হয়ত সবাই খুশি হতে পারে না।
তবে প্রমোদ হয়েছিল হয়ত খুশি। তাই ওর এই পৃথিবীতে থাকা বা না থাকা কোন ম্যাটারই করেনি ওর কাছে। কোনদিন কারো কাছে কিছু বলেনি এই ব্যাপারে। এখনও ভাবলে খুব খুব কষ্ট হয় মুনিয়ার।
কত ভুল মানুষকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল ও । তবুও এ পোড়া মন এখনও অতীতের পানে হাঁটে,অবাধ্য মনটাকে আবার বোঝায় মুনিয়া। ভুলে গিয়ে ভালো থাকতে বলে।
অনেকটা ঝড়ের পর ক্লান্ত হয়ে গেছে রাণা। মুনিয়া ওকে বলে,' চল এবার খাবি দেখ আমার বানানো রাইস কেমন হয়েছে। তুই তো সব ছড়িয়ে এসেছিলি। আমি গুছিয়ে ফেলেছি। হয়ত ভুলে গিয়ে ভালো থাকার নামই জীবন।'
খাওয়া শেষ হতে হতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। তারমধ্যে ঝড়বৃষ্টি সবই হয়ে গেল। তবুও আজ রাণার অনেকটা শান্ত লাগছে। কারণ অতীতের অনেকটা জমানো কথা বলে আজ ও অনেক হাল্কা।
***********************
ফোনটা রেখে ঝুমকা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। নিজের মনেই এঁকে নিয়েছে রাণার প্রবাসী নতুন সংসারের ছবি। ও যখন প্রথম ফোন করেছিল তখন কেউই ফোন ধরেনি,তখন কি ওরা বাড়িতে ছিল না?
না না মুনিয়া তো স্নান করছিল,ওর চুলে জল ঝরছিল রাণা বলল। তাহলে কি একসাথেই........
মৈনাকের সঙ্গে বাথটবে কাটানো মুহূর্তগুলোতে প্রথমে ভেসে যেত আবেগে ঝুমকা। তারপর একটা সময় যেন অসহ্য হয়ে গেছিল। তখন বেশি বাড়াবাড়ি মনে হত। একটা সময় দাম্পত্যে প্রেমের চেয়ে সিনেমাই বেশি দেখত ঝুম। আদরের সময় বেশি বাড়াবাড়ি। সবসময় নায়িকার মত সাজগোজ করে ছবি তোলা। খুব মিস্ করত মা আর দিদির জীবন। কই ওদেরকে তো কোনদিন বাবা বা জামাইবাবুকে খুশি করার জন্য এত কিছু করতে হয়নি। ঝুমের ফিগার, পোশাক, খাওয়াদাওয়া সবকিছুই মাপা ছিল।
মৈনাক বলত শরীর ভালো থাকবে। কথাটা মনে করে হাসি পেল আবার ঝুমের হ্যাঁ বলির পাঁঠাকে খাইয়ে দাইয়ে যত্ন করত মৈনাক।
লোনটা হয়ে যাবার পর নিজের উচ্ছ্বাস সামলাতে না পেরে ফোনটা করে ফেলেছে ঝুম। পরে মনে হল মুনিয়া হয়ত কিছুই জানে না। তবে রাণা যদি জানতে পারে ও ওর বৌকে ফোন করেছিল। নিজেকে হঠাৎই কেমন যেন খুব খেলো মনে হল ঝুমের। কি দরকার ছিল ফোনটা করার সত্যিই মনে হল। রাণা ওকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। রাণার চোখে একরাশ বিরক্তি দেখেছিল ঝুম এক পলকেই হয়ত বা ঘেন্নাও। আজ কেন হঠাৎই ও আবার উঁকিঝুঁকি করতে যাচ্ছে ওদের সাজানো সংসারে। কি ছিল এমন থ্যাঙ্কস না জানালে? পুতুলদিকে বলে দিলেই তো হত।
যাক যা হবার হয়ে গেছে। আর কোনদিনই ফোন করবে না। তবুও নাম্বারটা ডিলিট করতে গিয়েও ডিলিট করতে পারে না ঝুম। ওর কনট্যাক্টে মুনিয়ার নামটা রয়েই যায়।
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। দেখতে দেখতে শীতের আনাগোনা শহরে। তবে এখানে শীতে তেমন কিছু বোঝা যায় না। সামনের মাসে ওদের বিয়ের তারিখ। হাসি মজায়,ঝগড়ায় আর প্রেমে একটা বছর কেটে যাবার পথে। খুশির পাশাপাশি মনে উত্তুরে হাওয়ার মনখারাপের ছোঁয়া মুনিয়ার।
ওদের বিয়ের তারিখের পনেরো দিন বাদেই রাণা চলে যাবে বাইরে। মোটামুটি এখন পুরোটাই কনফার্ম হয়ে গেছে। একা এই বাড়িতে থাকতে হবে এটা ভেবে ভোররাতে অনেক সময় ঘুম ভেঙে যায় মুনিয়ার। মন কেমন করে খুব। ভালো করে জড়িয়ে ধরে রাণাকে গুটিশুটি মেরে ওর বুকের কাছে গিয়ে শোয়।
-'আবার কবে আসবি তুই?
-' এখনও তো গেলামই না। আগে যাই তারপরে তো বলব কখন ছুটি পাব দেশে ফেরার। হয়ত মাস ছয়েক দেরি হবে,একবছরও হতে পারে। চেষ্টা করব যত তাড়াতাড়ি পারি আসার। তুই যাবি না আমার কাছে? নতুন দেশে দুজনে সব ঘুরে দেখব একসাথে।'
-' যাব তো আমি। দেখতে হবে না কোথায় আছিস কি করছিস?'
-' মন যে চায় না যেতে তবুও যেতেই হবে কিছু করার নেই। আমি ওখানে গিয়ে সব ঠিক করে একদম টিকিট পাঠিয়ে দেব আমার মুনিয়ার জন্য।'
ওদের গুনগুন আলাপের মধ্যেই একটু একটু করে ভোরের আলো ফোটে। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ওরা। ওদের একটুকরো স্বপ্ন বাগানের ছোঁয়ায় মন ভালো করে নেয় দুজনেই। ওপাশ থেকে মিসেস আয়ার হাত নাড়েন সুপ্রভাতের ছন্দে।
আজ অফিস থেকে ফিরতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে রাণার হঠাৎই অম্লানদার ফোন জুনিকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে। মুনিয়াকে ফোন করে দিয়েছিল জানতে পেরেই। এইসময় অম্লানদার পাশে থাকাটা জরুরী। বেশ অনেকটা রাত হয়ে গেছে। মুনিয়া বারান্দায় ঘোরাঘুরি করে হঠাৎ ফোনটা বাজে রুমকিদির ফোন দেখে ভালো লাগল মুনিয়ার। যাক কিছুটা সময় কেটে যাবে ফোনআড্ডায় খোশ মেজাজে।
রুমকিদি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে প্রবালদা ফিরবে সামনের মাসেই..' ভালোই হয়েছে বল বাবলিটার বার্থডের আগেই প্রবাল ফিরছে। তোরা কিন্তু আসছিস সেদিন আমি অনেক আগে থেকেই বলে রেখেছি কিন্তু।'
' রুমকিদি তোমার হল সারা আর আমার শুরু। প্রবালদা ফিরবে আর রাণাট চলে যাবে। একদম সব ফাইনাল হয়ে গেছে গো। সামনের মাসে আমাদের অ্যানিভার্সারির পরই চলে যাবে।'
' গলাটা এত ফিউজ কেন? কত ভালো খবর এটা লোকে পার্টি করে রীতিমত। আর তুই মন খারাপ করছিস। চিয়ার আপ মুনিয়া তোর বর বিদেশে যাচ্ছে।'
-' প্রথমে তো ভালো লাগছিল দিদি এখন আর ভালো লাগছে না। একটু চাপ লাগছে মন খারাপও হচ্ছে গো।'
-' আরে আমরা আছি না? চলে আসবি এখানে মাঝেমাঝেই। আমিও চলে যাব বাবলিকে নিয়ে।'
-' তাই বাবলির জন্মদিনে বোধহয় যাওয়া হবে না গো।'
-' আমি কিছু শুনছি না আসতেই হবে বাবলি আশা করে আছে। শনিবার সেদিন,রাত্রে থেকে পরদিন ফিরবি একদম। তার আগে তোদের অ্যানিভার্সারির পার্টি হবে তো?'
-' একদিন ট্রিট হবে গো,তবে অনুষ্ঠানটা বাড়িতে গিয়েই হবে। রাণা চলে যাবে তো তাই একবার বাড়িতে যাব তার আগে।'
কথায় কথায় অনেকটা সময় কেটে যায়।
রাণা ফিরে এসেছে জুনিটা খুব কষ্ট পাচ্ছে সারাটাদিন ধরে। ওর কাছে শুনল মুনিয়া কাল সিজার হবে জুনির। রাণা হাসতে হাসতে বলে,' মা বলত মা হওয়া কি মুখের কথা! সত্যিই বোধহয় তাই রে। কেমন ছটফটে জুনিটা একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। অম্লানদা খুব টেনশন করছে। সব ঠিক হয়ে যাবে কালই এই বলে চলে এসেছি। কাল একটু সকাল সকাল বেরোব বুঝলি।'
' কাল আমাকেও নিয়ে যাস সাথে,ওখান থেকেই অফিসে চলে যাব।'
-' না না অত ধকল নিতে হবে না। তুই না বলিস তোর হসপিটালে ভালো লাগে না। অফিসের পরে যাস বরং ততক্ষণে কিছু একটা খবর এসে যাবে।'
রাণার সাথে টুকরো কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে মুনিয়া। পরদিন অফিসেই খবর পায় রাণার কাছেই প্রথম জুনির ছেলে হয়েছে। খুশিতে লাফায় মুনিয়া,' আমি তাহলে ঠিকই বলেছিলাম। ঐ জন্যই এত লাথি মেরেছে জুনিটাকে। ইশ্ কখন যে দেখব! জুনি ভালো আছে তো? তুই অফিসে চলে গেছিস?'
-' এই যাচ্ছি এখন,ফোন করেছিলাম।'
মুনিয়া ভিজিটিং আওয়ার্সের মাঝেই চলে যায় কাজ সেরে। অম্লানদাকে খুব খুশি লাগে দেখতে নতুন বাবা হয়েছে তাই বোধহয়। জুনির পাশে কটে শুয়ে আছে পুচকেটা। দিব্যি হাত পা নাড়ছে। জুনি একটু ড্রাউজিং তখনও তাই আর খুব একটা অপেক্ষা করে না মুনিয়া। ওকে হাত নেড়ে চলে আসে। ক্যাবে ফিরতে ফিরতে পুতুলকে ফোন করে মুনিয়া। বেশ কয়েকদিন ওর সাথে কথা হয় না। বিয়ে করে কতটা পাল্টে যেতে পারে মানুষ তা পুতুলকে দেখেই বোঝা যায়। সারাক্ষণই কৌশিক নাহলে শাশুড়িমা। শান্ত পুতুল আরও শান্ত হয়ে গেছে।
জুনির কথাটা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে পুতুল,' ইশ্ কি ভালো খবর! আরেকটাও খবর আছে তোকে বলা হয়নি।'
-' কি খবর রে?'
- ' আমারও হয়ত,মানে কেউ আসছে।'
-'ইশ্ ইটস টু তাড়াতাড়ি পুতুল। আমি তো পরপর মাসিই হয়ে যাচ্ছি দেখছি। টেক কেয়ার সাবধানে থাকিস। রাণা শুনলেই তো আমার পেছনে লাগবে।'
-' হ্যাঁ এরপর তোর খবর আসুক কিছু।'
-' না রে আমার এখন প্ল্যানিং নেই কোন, সবেই তো বিয়ে হল। রাণা বাইরে চলে যাবে। এখন তাই কিছু ভাবছি না। তোদের বেবিদের নিয়ে আগে খেলে নিই।'
কথা বলতে বলতে পৌঁছে যায় নিজের একটুকরো আস্তানায় মুনিয়া। রাণা আগেই চলে এসেছে তাই কফি টিফিন সব রেডি টেবিলে। এটুকুই অনেক মনে হয় মুনিয়ার। রাণা চলে গেলে কে এত ভালোবেসে দেবে এসব? তখন নিজেকেই সব করতে হবে। কথায় কথায় পুতুলের গুড নিউজটা দেয় রাণাকে। রাণাও একটু মজা করে এই সুযোগে,' এবার বাড়ি গেলে ঠাম্মা আবার বলবে। কাজললতা কিন্তু রেডি অনেকদিন।'
-' ইশ্,শুধু বাজে কথা! কাজললতা আগে রেডি। কে আসবে ঠিক নেই।'
**********************
রাণার ভিসার ব্যবস্থা টিকিট সব হয়ে গেছে এর মধ্যেই কয়েকদিনের জন্য কলকাতা আর কৃষ্ণনগরে আসা। মুনিয়াকে কলকাতায় রেখে কৃষ্ণনগরে চলে এসেছে রাণা। মুনিয়া দুটো দিন থেকে একদম বিবাহবার্ষিকীর আগের দিন আসবে। মায়ের ইচ্ছে মেয়ে দুএকটা দিন থাক কাছে। সুতরাং দুজনেই আলাদা আলাদা করে মায়ের আদর খাচ্ছে কিছু করার নেই। শান্তারও মনটা ভালো নেই ছেলেটা চলে যাবে সেই কতদূরে। ডলেরও মনটা ভালো নেই তবুও দাদাভাই আসাতে বাড়িতে খুশির সমুদ্দুর। তারপর আবার একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠান আছে বাড়িতে।
আনন্দও কয়েকদিনের জন্য এসেছে বাড়িতে সুতরাং সব মিলিয়ে মনটা খুব ফুরফুরে ডলের। তবে বৌদিভাই না আসা পর্যন্ত সবটা জমছে না। এরমধ্যে বেশ কয়েকবার ফোন হয়ে গেছে বৌদিভাইয়ের সঙ্গে,' তুমি চলে এসো তাড়াতাড়ি। এদিকে সব একদম রেডি। বাবার অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে মিস্টি। বাড়িতে খুশির মেজাজ। আনন্দদাও তোমাকে মিস্ করছে।'
মুনিয়া খিলখিল করে হাসে,' কতদূর এগোলি? এখনও দাদা! মা জানতে পেরেছে?'
-' জানলে জানুক,আমি আর ভয় পাই না।'
-' আমি যাচ্ছি,দেখি কত সাহস বেড়েছে? চলে যাব রে এই তো কালই।'
সামনে অনুষ্ঠান তাই নিজেকে একটু গ্রুম করতে পার্লারে এসেছে মুনিয়া। এখানে না এলেও হত। তবুও ইচ্ছে করেই এই পার্লারে এসেছে মুনিয়া। ঝুমকা নামের ঐ মেয়েটাকে আরেকবার সামনে থেকে দেখতে চায়। অবশ্য রাণাকে কিছুই বলেনি মুনিয়া এ ব্যাপারে। সেদিন রাণা ওভাবে রিঅ্যাক্ট করার পর আর কোন কথা হয়নি এই মেয়েটার সম্বন্ধে। তবুও অচেনা ঝুমকা এখন অনেকটা চেনা ওর কাছে। রাণার চোখ দিয়ে চিনেছে ওকে। শুধু জানতে পারেনি ওর পুড়ে যাবার কথাটা। তাই আজ ওকেই কাছ থেকে দেখার জন্য সুশ্রী পার্লারে পা রাখে মুনিয়া।
পার্লারটা বেশ বড় এর আগে কখনও এখানে আসা হয়নি। বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান তাছাড়া নিজেকে সাজিয়ে রাখতে খুব ভালো লাগে মুনিয়ার ও বিশ্বাস করে শরীরের সুস্থতা অনেকটাই মনের ওপর নির্ভর করে। মন ভালো থাকলে শরীরও ভালো থাকে। আর মনকে ভালো রাখতে বোধহয় নিজেকে একটু গুছিয়ে রাখা জরুরী। একটা সময় মাকেও দেখেছে সকাল বিকেল পাটভাঙা একটা শাড়ি পরে নিজেকে সাজাতে। মায়ের শাড়ির সেই মিঠে গন্ধটা এখনও মাঝেমধ্যেই পায় ব্যাঙ্গালোরে মুনিয়া। কত গন্ধের পরশেই ডোবানো থাকে জীবন। এখন আবার রাণার গায়ের গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বাড়িতে সব জায়গাতেই রাণার শরীরের গন্ধের মাখামাখি। রাণাও পায় মুনিয়ার গন্ধ। ওর ভিজে চুলে কখনও নাক ডোবায়। বাথরুমে গিয়ে বলে,আঃ সারা বাথরুমে মুনিয়া মুনিয়া গন্ধে মাখামাখি। জুনির বেবেটার গায়েও একটা কি মিস্টি গন্ধ,হাতগুলো নরম নরম।
নিজের নামটা ওদের খাতায় রেজিস্টার করে নরম সোফাটায় এলিয়ে দেয় শরীরটা মুনিয়া। একটা ম্যাগাজিনে চোখ রাখে তার মাঝেই ওর চোখ খোঁজে সেই মেয়েটাকে যাকে নিয়ে একটা সময় ওদের সুখের নীড়ে ঝড় উঠেছিল।
বেশ অনেকটা সময় কেটে গেছে। রাণা এরমধ্যে একবার ফোনও করেছে। রাণাও একটু ব্যস্ত কিছু ব্যাঙ্কের কাজকর্ম সারতে হচ্ছে ওকে।
-'কোথায়? ফোনটা নট রিচেবল বলছে। অনেকক্ষণ ট্রাই করছি।'
-' জাহান্নামে।'
-' ইশ্ আগে বললে আমিও তো যেতাম সেখানে। বি সিরিয়াস মুন মজা করিস না।'
-' একটু পার্লারে এসেছি,কতদিন যাওয়া হয় না।'
পার্লারের কথা শুনে বুকটা কেমন যেন করে রাণার।
-' পার্লারে ওহ্ আচ্ছা। বাড়ির কাছেই আছিস তো। বেশি দেরি করিস না। কাল সকালেই আসা কিন্তু এখানে।'
কিছু কথা রাণার গলার কাছে আটকে থাকে আর মুনিয়াও কিছু কথা জোর করে রেখে দেয় মনের লকারে শুধু বলে
-' একদম ভাবিস না,কলকাতা শহরের বুকে একটা সময় দাপিয়ে বেরিয়েছি। এখন আর ফোন করিস না ব্যস্ত থাকব। ফোন ধরতে পারব না। আমার হয়ে গেলে ফোন করে দেব আমার কেয়ারিং হাবি।'
ওপার থেকে খিলখিল করে হাসে মুনিয়া,রাণার মন দোটানায় ভাসে। মুনিয়া আবার সেই পার্লারে যায়নি তো? তারপরেই নিজেকে শাসন করে একচোট তারপর আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফোন ছেড়ে দিয়ে।
মুনিয়ার ডাক পড়েছে,পার্লারটা বেশ বড়। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে আসে মুনিয়া। ও যেমন ভেবেছিল মানে পুতুলকে সাজানোর সময় যা ভেবেছিল কোন একটা ছোটখাটো পার্লার থেকে সাজাতে আসছে ওকে তা নয়। হয়ত পুতুলের খুড়তুতো ননদের পরিচিত বলেই ওরা আরও বেশি যত্নে সাজিয়েছে পুতুলকে।
ওপরে উঠেই চেনামুখ খুঁজতে যায় মুনিয়া। ঝুম প্রথমে ওর নজর না কাড়লেও এখন ঝুমের ছবি ওর চোখে স্পষ্ট হয়ে আছে ওকে দেখলেই চিনতে পারবে। কিন্তু কাউকেই তো দেখছে না। মানে ঐ যে সোহিনীদি বা ঝুম কেউই নেই।
মুনিয়াকে ওরা যত্ন করে চেয়ারে বসায়,বুকে তোয়ালে জড়িয়ে মাথায় ব্যান্ড বেঁধে মুনিয়া নিজেকে পুরোপুরি ওদের কাছে ছেড়ে দিয়েছে। একসাথে দুটো মেয়ে ব্যস্ত ওর পরিচর্যায়। হয়ত এই আরামটুকু উপভোগ করতেই লোকে পার্লারে যায়। কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে বেশ রাণী রাণী মনে হয়। চুলের পরিচর্যা করতে করতে মেয়েটা বলে,' ম্যাম আজকে প্রথম এসেছেন তাই না? আচ্ছা চকলেট ওয়াস্কটা করে দিই। ভীষণ ভালো ওটা আর পায়ে বাবল পেডিকিউর। খুব কমফোর্ট ওটাতে।'
বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে মেয়েরা কাজ করছে।
' মুনিয়া একটু আনমনা হয়ে বলে,যেটা ভালো হবে সেটাই করে দাও। আচ্ছা ঝুমকা বলে একজন আছে কেউ? মানে শুনেছি ও নাকি ভালো সাজায়? আর সোহিনীদি?'
মেয়েটা বলে,' ওহ্ ঝুমকাদি, হ্যাঁ আছে তো। তবে আজ ওর অফ ডে। আমাদের তো প্রতিদিন খোলা তাই এভাবেই ছুটি থাকে আমাদের। আর সোহিনী ম্যাম একটু দেরিতে আসেন। চলে আসবেন একটু পরেই।'
' আপনি চেনেন ম্যামকে?'
-' হ্যাঁ একবার দেখা হয়েছিল।'
মেয়েটা কাজ করতে করতে টুকটাক কথা বলতে থাকে। ম্যাডামের গুনগান করে। মুনিয়ার কানে ঢোকে না সেইসব কথা। ও বুঝতে পারে আজকে বোধহয় ও ঠিক করেনি এখানে এসে। হয়ত ঠাম্মাই ঠিক বলেন ভগবান যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ঝুমের সাথে দেখা হলেই বা ও কি করত? ওকে কি বলতে পারত তুমি রাণার সাথে প্রেম করতে তাই না? আমি সব জেনে ফেলেছি। নাকি জিজ্ঞাসা করত তোমার গলাটা কি করে পুড়ল গো?
সত্যিই ঝুমকা আসেনি জেনে কেন যেন বেশ হাল্কা লাগছে ওর এখন। রাণা তো বারবারই ওকে বারণ করেছে ওর সাথে কোন যোগাযোগ না রাখতে তবুও অবাধ্য মন মাঝে মাঝে পাগলামি করে বসে।
পার্লারের শীতলতার মধ্যে প্রায় দুঘন্টা কাটিয়ে মুনিয়া যখন ক্যাবে উঠেছে তারমধ্যেও সোহিনীদি আসেনি। যাক ভালোই হয়েছে। ওদের কাজ বেশ ভালো। নিজেকে বেশ ঝকঝকে লাগছে মুনিয়ার। সবসময় অফিসের স্ট্রেস নিয়ে যত্ন হয় না ঠিক নিজের যাক এই সুযোগে বেশ একটু রিফ্রেশমেন্ট হল।
বাড়িতে এসে মেসেজ করে দেয় রাণাকে বাড়ি এসে গেছে।
বাড়িতে এসে দেখে মা সব ছড়িয়ে বসে। সত্যিই মা বাবা দুজনেই খুব ভালোবাসে কৃষ্ণনগরে যেতে। পুরোনো বন্ধুত্ব এখন আত্মীয়তার সূত্রে বেঁধেছে। সেই আমেজটাকে উপভোগ করে চেটেপুটে।
-' মা তুমি এত কি ছড়িয়েছ?'
-' কি পরব তাই ভাবছি,তোর বাবাও কি পরবে বলছিল।'
- ' আচ্ছা এত শাড়ি তবুও চিন্তা। আমি যে রাণী ব্যাঙ্গালোর সিল্কটা দিয়েছিলাম সেটা পর না।'
-' কি যে বলিস! এখন শাশুড়ি হয়েছি ওসব পরা চলে নাকি? মেয়ের বিবাহবার্ষিকী মেয়ে পরবে লাল তার পাশে মায়ের সাজ রাণী রঙে।'
-' মা আমি তো এই ঘিয়ে শাড়িটা পরব ভেবেছি। ওখানে মানে দক্ষিণে শুভ অনুষ্ঠানে ওরা এইরকম রঙ পরে।'
-' মুন খুব বকুনি খাবি এবার, ওটা রেখে দে ওখানে পরবি। জায়গাটা কৃষ্ণনগর ব্যাঙ্গালোর নয়। মাসিমা খুব রাগ করবে দেখলে।'
-' আচ্ছা বেশ,লাল,নীল,সাদা সব রঙই নিয়ে যাব। ঠাম্মা যা বলবে তাই হবে।
**********************
শীতের সকালে ওরা রওনা দেয় কৃষ্যনগরের দিকে। বিয়ের পর এই প্রথম নিজের মত একা বাপের বাড়িতে কয়েকদিন কাটালো মুনিয়া। সেই আগেকার এলোমেলো জীবন, যখন খুশি ওঠা আর যা খুশি করা। একছুট্টে মেয়েবেলার দিনে পৌঁছে যাওয়া মায়ের আঁচলের নরম গন্ধে মুখ ডুবিয়ে।
শীতের সকালে লঙ ড্রাইভ বেশ ভালো লাগছে মুনিয়ার মনে পড়ে যাচ্ছে কত কি? কে ভেবেছিল এই দিকেই ওর শ্বশুরবাড়ি হবে। একসময় প্রমোদের সঙ্গে কলেজ বাঙ্ক করে লঙড্রাইভে এসেছে এদিকে তবে এতটা নয়। প্রথম যখন এসেছিল ট্রেনে করে এখানে তখন বুঝতেই পারেনি এখানেই ওর বিয়ে হবে। মামণি ঠিকই বলেছেন কে জানে কার কোথায় চাল মাপা। গাড়ির ডিকিতে ভর্তি ট্রে,পেছনেও ট্রের ছড়াছড়ি। সবটাই মা বাবার উদ্যোগে, তত্ত্ব নিয়ে রীতিমত যাচ্ছে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে। ওরা আসার আগে থেকেই সব জোগাড় হয়ে গেছে মায়ের। মুনিয়া রাগ করেছিল 'মা এত জিনিস কেন এনেছ বল তো? রাণা চলে যাবে বিদেশে আমি এখানে একা। এগুলো কে ব্যবহার করবে? আমি কিন্তু এইসব নিয়ে যেতে পারব না।'
-' আমি বুঝেই কিনেছি মুন,অনেক কিছুই রাণার লাগবে। ওর নিয়ে যেতে হবে। ওখানে তো খুব ঠান্ডা। দেখবি ওর পছন্দ হবে। মানে তোদের আর কিনতে হবে না।'
- পরে অবশ্য মায়ের কথা শুনে দেখেছিল অনেক কিছুই কাজের জিনিস কিনেছে মা শীত কাম বিবাহবার্ষিকীর তত্ত্ব হিসেবে।
পথের দূরত্ব কেটে গাড়ি এসে দাঁড়ায় ওদের কৃষ্ণনগরের বাড়িটার সামনে। রাণাকে দেখে মনটা ভালো হয়ে যায় মুনিয়ার। যেন বেশ কতদিন বাদে দেখা। ওদের বাড়ির সামনের বাঁধানো বারান্দায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল রাণা। গাড়ির আওয়াজে এক এক করে সবাই আসে বাইরে। মুনিয়াকে চন্দন লালের মিশেলে হাজার বুটির ঢাকাইয়ে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে সাথে গলাবন্ধ মুক্তোর চোকারে সাজে লেগেছে অন্য মাত্রা।
ডল এসে জড়িয়ে ধরে ওকে,' বৌদিভাই, কতদিন বাদে এলে তুমি! কি সুন্দর লাগছে তোমাকে। দেখি দেখি মাথায় কি দিয়েছ?'
-' আর বলিস না মায়ের উৎপাতে ফুল লাগাতে হয়েছে। যেন বিয়েবাড়িতে আসছি।'
-' তাই তো এসেছ। দাঁড়াও এখানে একদম নড়বে না।'
মুনিয়া অবাক হয়ে যায়,দাঁড়াবে আবার কেন? বাবা তখন তত্ত্বর ট্রে নামাতে ব্যস্ত। হঠাৎই বাড়ির ভেতর থেকে শঙ্খ বাজানোর আওয়াজ আসে সাথে উলুর আওয়াজ। মনটা উড়ে যায় মুনিয়ার একবছরের আগের এক বিশেষ দিনে যখন এভাবেই রাণার সাথে গাঁটছড়া বেঁধে এসে দাঁড়িয়েছিল ও।
মামণির হাতে বরণ ডালা সাথে কাকিমা আর পিসিমা ওদের আদরের ছোঁয়ায় মনটা ভালো হয়ে যায় মুনিয়ার। রাণার দিকে তাকায়। রাণা ঘাড় নাড়ে যেন কিছুই জানে না। তত্ত্ব,বরণ,উলু,শঙ্খ সব মিলে একদম বিয়েবাড়ির ফুল ফ্লেভার। কেমন যেন নস্টালজিক লাগে মুনিয়ার। সত্যিই বোধহয় ভালোবাসা ভরা একটা শ্বশুরবাড়িতে আসতে পেরেছে ও। আর সবটাই রাণার জন্য। বাড়ি জুড়ে তখন হৈ হৈ চলছে।
মুনিয়া বুঝতে পারে রাণা চলে যাবে বলে সবারই মনটা খারাপ আর সেটাকে ভুলে ভালো থাকার জন্য বাড়ি জুড়ে উৎসবের মেজাজ।
ঠাম্মাকে প্রণাম করে মুনিয়া। আদরে ওর চিবুকে হাত ঠেকায় ঠাম্মা,'আবার কবে আমার শ্যাম রাইকে একসাথে দেখব কে জানে? এবারের পুজোটা বোধহয় খুব একা একা কাটবে। অভ্যেস খারাপ করে দিয়েছ নতুন দিদি।'
-' আমি তো চলেই আসব ঠাম্মা এখানে। সব হবে দেখো। মন খারাপ একদম কোর না।'
বেশ অনেকটা বড় আয়োজন হয়েছে পরেরদিনের জন্য বুঝতে পারে মুনিয়া। আসেপাশের বাড়ির অনেকেই এসে দেখে যাচ্ছে তত্ত্ব। ছোট জায়গার এই সুন্দর বন্ধনটা খুব টানে মুনিয়াকে। ওর মা বাবাও বেশ আনন্দে মেতে উঠেছে সবার সাথে। ফোনটাকে একটু আগলে রেখেছে মুনিয়া। কাল থেকে বারবারই মনে হয়েছে সুশ্রী পার্লারে যাওয়াটা ওর ঠিক হয়নি। ওখানে গিয়ে ঝুমকার খোঁজই বা করার কি দরকার ছিল?
লোনটা পেয়ে নিজের ব্যবসাটাকে বাড়ানোর চেষ্টায় কদিন ছোটাছুটি করেছে খুব ঝুমকা। যদিও সোহিনীদি ওকে ছাড়তে চায় না। গত প্রায় এক বছর এখানে আছে ঝুমকা। আজকাল কেউ এলেই ওর কথা বলে। সবাই ওর হাতের ছোঁয়া নিতে চায়। সোহিনীদি তাই বলেছে,' ঠিক আছে তুই ব্যবসা করবি কর তবুও অন্ততঃ তিনদিন আয় পার্লারে।'
নরকের যন্ত্রণায় যখন বিদ্ধ ঝুমকা সোহিনীদি ওকে আবার আলো দেখিয়েছিল তাই সোহিনীদির কথা ফেলতে পারে না ঝুম। আপাতত ওদের বাড়ির দুটো ঘরের মধ্যে একটা ঘরকে নিজের কাজে লাগিয়েছে। কাজ করতে করতে এখানেই এক কোণে শুয়ে পড়ে। কখনও মা ডেকে নিয়ে যায় পাশের ঘরে। এখন মা একমাত্র অবলম্বন ওর। তবে দিদি আজকাল মাঝে মাঝে ফোন করে,' যাক যা হয়েছে হয়েছে। ওসব ভুলে যে কাজে মন দিতে পেরেছিস এটাই অনেক। ভাবতেই পারিনি আমার এত সুন্দর বোনটার এই অবস্থা হবে।'
এইসব কথা অনেকবার শুনেছে মুনিয়া আর ভালো লাগে না,' দিদি ছাড় ওসব। তুই বলেছিলি না কয়েকটা শাড়ি আর পাঞ্জাবীর অর্ডার আছে। আমাকে হোয়াটস অ্যাপ করে দিস কোন ডিজাইনগুলো ওরা পছন্দ করেছে তৈরি করে দেব।'
সারাদিনই নিজেকে ব্যস্ত রাখে এইভাবে ঝুমকা। নিজের হাতদুটোর দিকে তাকায় মাঝে মাঝে এখন ওরাই ওকে ভালো থাকার দায়িত্ব নিয়েছে। মানে এটাই বোধহয় খুব সত্যি কথা নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব
নিজের হাতে রাখাটাই জরুরী। অন্যের ওপর নির্ভর করলেই মুশকিল।
পার্লারে এসে কাজে ডুবে যায় ঝুমকা,বিয়ের সময় চলছে। অনেকেই আসছে নিজেকে ঘষেমেজে নতুন রূপে সাজাতে। কতজনের চোখে স্বপ্ন দেখে ঝুম স্বপ্নমাখা চোখে মেয়েগুলো বলে সারা শরীরের রোম তুলে পরিস্কার করে দিতে। কেউ বা সারা শরীর ব্লিচ করায় ফর্সা দেখাতে। ফর্সা কথাটা মনে করে হাসি পেল ঝুমের একসময় এই সুন্দর রঙই ওর শত্রু হয়ে গেছিল,রূপে ধার না দিয়ে যদি গুণে ধার দিত।
' ঝুমকাদি কাল না একজন কাস্টমার তোমার কথা বলছিল। সোহিনীদির কথাও বলছিল।'
ফেসিয়াল করতে করতে একবার তাকায় ঝুমকা,' কি নাম? অনু বৌদি নাকি? মানে মোটা মত।'
' না গো এর আগে দেখিনি কখনও, বেশ মিস্টি দেখতে কমবয়েসী। তবে বিয়ে হয়ে গেছে।'
' কি বলছিল?'
' কিছু না তেমন শুধু খোঁজ করছিল।'
হঠাৎই ঝুমকার কেন যেন মুনিয়ার কথা মনে হল। তারপর মনে হল কি করবে মুনিয়া এখানে? ওরা তো এখানে থাকেই না।
ডলের সঙ্গে সন্ধ্যেবেলায় ছাদে উঠেছে মুনিয়া। আনন্দ এসেছে। রাণা বন্ধুদের সাথে বেরিয়েছে। এখানে এসে একটু আড্ডা মারার সুযোগ পায় রাণা। তাছাড়া রাণা থাকলে আনন্দ তেমনভাবে ফ্রী হতে পারে না।
হঠাৎই ফোনটা বেজে ওঠে মুনিয়ার। ফোনটা ধরবে কিনা ভাবে মুনিয়া। অথচ ওটা বাজছে নিজের তালে একবার ডলের দিকে তাকায় মুনিয়া। ও আনন্দর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বলে,' তুমি কথা বলে নাও,আমরা গল্প করছি এ পাশে।'
হ্যালো কে বলছেন আপনি? হ্যাঁ খুব নেটওয়ার্ক সমস্যা এখানে। ঠিক শুনতে পাচ্ছি না।
ওদিক থেকে ঝুমকা প্রাণপন জোরে বলে,' হ্যালো আমি ঝুমকা।'
মুনিয়া বলে,' কে? ঠিক বুঝতে পারছি না। ও আচ্ছা হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি।'
'তুমি কি আমাদের পার্লারে এসেছিলে কাল? ইশ্ আমার অফ ছিল দেখা হল না।'
মুনিয়া উত্তর দেয়,' কই না তো? আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি। ছাড়ছি।'
অবাক হয়ে যায় ঝুমকা দুপুরে খেতে খেতে ঝিমলি কে ছবিটা দেখিয়ে বলেছিল,' এই বৌদিটা নাকি রে?'
ঝিমলি মাথা নেড়েছিল হ্যাঁ হ্যাঁ। বাবা তুই ঠিক চিনেছিস তো।
তারপরেই মনে হল সন্ধ্যেবেলায় একটা ফোন করে। কেন এসেছিল? কোন দরকার ছিল নাকি? বাবা যেন চিনতেই পারল না। ভালো বর পেলে মেয়েগুলো এমনি হয়ে যায়। চোখের চামড়া মোটা হয়ে যায়। একটা সময় তো ওরও হয়েছিল এমন।
তারপর হঠাৎই মনে হল হয়ত রাণা ছিল সামনে। রাণার কাছ থেকে কি সব জেনেছে মেয়েটা?
তারপরেই মনে হল যাক যা হয়েছে ভালোই হয়েছে অন্ততঃ পুরোনো প্রেমিকের বৌয়ের পায়ে মুখে ক্রিম মাসাজ করতে হয়নি ওকে।
একটা অদ্ভুত অপরাধবোধ হয় মুনিয়ার ঝুমকাকে মিথ্যে বলে। কি করবে ও? ডলের সামনে ওর সাথে কি কথা বলত?
বিরক্ত হয়ে ফোনটা একপাশে ফেলে দেয় ঝুমকা। সত্যিই বোধহয় ওদের মেয়েদের কৌতূহল বেশি। আর সেই জন্যই বোধহয় মেয়েদের সমস্যাও বেশি। মুনিয়া হয়ত কোন একটা কৌতূহল মেটাতেই এসেছিল ওদের পার্লারে। আবার ও কে এসে ওর খোঁজ করেছে সেটা জেনেও নিরস্ত হয়নি। আবার অত্যন্ত কৌতূহলে ফোনও করে বসল। সত্যিই কি অবস্থা! নিজেকে কেন যেন খুব ফালতু মনে হল ঝুমকার। সত্যিই ওর কোন আত্মসম্মান নেই তাই এক্সের বৌয়ের সাথে ভাব করতে গেছে। রাণাকে তো কবেই মন থেকে মুছে ফেলেছিল ওর বৌকে নিয়ে অত মাথাব্যথাই বা কেন?
মুনিয়ার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কেন যেন বলছিল ওকে ঝুমকা ফোন করতে পারে। নিজেকে খুব বকতে ইচ্ছে করে মুনিয়ার। রাণা যা করতে ওকে বারণ করে দিয়েছে তা হঠাৎই করতে গেল কেন কে জানে?
তবে ঝুমকার বুদ্ধির তারিফ না করে পারল না মুনিয়া। ঝুমকা বোকা মেয়ে নয়। ও ঠিক বুঝতে পেরেছে মুনিয়া এসেছিল। ভাগ্যিস রাণা ছিল না সামনে। তাহলে আজকের বসন্ত বাতাসে ঝোড়ো হাওয়া লাগত। হয়ত ছোটখাটো একটা দাম্পত্য অশান্তিতে কালকের দিনটা খারাপ হত। রাণা চলে যাবে দিন পনেরো পরে। এই পনেরো দিন মুনিয়া প্রতিটা মুহূর্তে ফুল ফুটিয়ে ভালো থাকতে চায়। আনন্দ আর ডলের সাথে কথা বলতে বলতে কললিস্ট ক্লিয়ার করার সাথে সাথে ঝুমকার নম্বরটা ব্লক করে মুনিয়া।
আর কখনই কোন কথা বলার দরকার নেই মেয়েটার সাথে।
বাইরে ততক্ষণে অন্ধকার নেমেছে,ওরা নিচে নেমে আসে ওদের গোপাল মন্দিরে ঠাকুরমশাই আরতি করছেন। মুনিয়া হাতজোড় করে প্রার্থনা করে। হয়ত কিছুই না তবুও মনটা একটু ভারী মনে হয়।
ঠাম্মা সন্ধ্যা আরতির শিখা এনে ওর মাথায় দেন রাণা যে কখন এসে ওর পেছনে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি মুনিয়া। ঠাম্মার কথায় চমকে পেছনে তাকায়।
'আমার দাদুভাই আর নতুন দিদির বন্ধন অটুট রেখ,ভালো থাক ওরা।'
************************
আরতির পর জমজমাট আসর বসে ওদের বাড়ির ঘোরানো বারান্দায়। বাপির আনা মিস্টি আর নোনতায় সবাই জমে আছে। তার সাথে কালকের গল্পে সবাই জমেছে। রাণাও গল্পে মশগুল সবার সাথে। শুধু মুনিয়া মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যাচ্ছে। কেন ও ঝুমকাকে বলতে পারল না ও ওদের পার্লারে গেছিল। হয়ত বা ডল ছিল বলে? নাকি ভয় পেল সত্যিটা বলতে?
অথচ এই কথাটা কারো সাথে শেয়ার করতে পারল না মুনিয়া। মা রাণার অতীত সম্বন্ধে কিছুই জানে না। মায়ের কাছে সবটা বললে খুবই বকা খাবে মুনিয়া। রাণাকেও কখনও বলতে পারবে না। ওর মা সবসময় বলে মুনিয়া খুব বোকা আর ছেলেমানুষ। কথাটা বোধহয় একদম ঠিক তাই আবার একটা ছেলেমানুষী করে ফেলেছে।
ও শুনতে পায় মা বলছে,' আমার তো চাকরি আছে এখনও তিনবছর। দেখি ওর বাবাকেই পাঠিয়ে দেব মেয়ের কাছে। যা ছেলেমানুষ মেয়েটা আমার। কখন মন খারাপ করবে,তখন সামলাবে কে? এখন তো জুনিও ব্যস্ত বাচ্চা নিয়ে।'
-' আমারও তো সেটাই চিন্তা,যা মুডি মুনিয়া। এই করে কদিন খাবে আর কতদিন না খেয়ে থাকবে কে জানে?'
রাণার কথায় খুব মনখারাপ করল মুনিয়ার তবুও নিজেকে সামলে বলল,' কে কাকে সামলাবে কে জানে? আমি ঠিক খাব বরং যে বলছে সেই হয়ত খাবে না। কাজ করতে করতে হয়ত ঘুমিয়েই পড়বে।'
'তাই তো বলছি নতুন দিদি তোমরা দুটিতে একসাথেই থাকো। আজও মন্দিরে বললাম সেই কথা।'
শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হয় শান্তা। এই নিয়ে তো এর আগে অনেক কথা হয়েছে। মুনিয়া হয়ত রাগ করতে পারে সেই ভেবেই শাশুড়িমাকে থামায়,' মা শিক্ষিত মেয়ে চাকরি করে। হুট কথায় কি চাকরি ছাড়তে পারে? আর বাবু তো বছর দুই বাদেই চলে আসবে।'
ঠাম্মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন,' দুই বছর! সে তো অনেকদিন। তোমাদের বাবা তো আমি দুদিন বাপের বাড়ি গিয়ে থাকলেই তোলপাড় করত। ইশ্ কি বলতে কি বলে ফেললাম।'
ঠাম্মার গালে লালচে আভার ছোঁয়া লাগে। ইশ্ ছেলে বৌরা সামনে বসে আছে তাদের সামনে বেশিই মজা করে ফেলেছেন। ঠাম্মার এই লজ্জাটা ছুঁয়ে যায় রাণা মুনিয়াকে। শান্তা আর ওর জা চোখ চাওয়াচাওয়ি করে। মনে মনে বলে এখনই বা কম প্রেম কোথায়। বাবা তো সবসময় চোখে হারান আপনাকে। আপনার ছেলেরা যদি এমন হত! ঘরে তো মনই বসে না তাদের। ছেলের বিবাহবার্ষিকী সেই আনন্দে কোথায় কোথায় ঘুরছে। চা সিঙারা খেয়ে হাওয়া।
আজ ঠাম্মার কথা শুনে মুনিয়া আর কিছু বলতে পারে না। সত্যিই তো রাণাকে ছেড়ে ও কখনই থাকেনি তেমন করে এই একটা বছর। সবে দুটো দিন বাপের বাড়িতে থেকে এল। তাই মনে হচ্ছে দুই বছর হবে।
রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে ওরা। মুনিয়ার ইচ্ছে ছিল আরেকটু আড্ডা দেবে সবার সাথে। তা হল না। এখানে চাঁদের আলোতে বসে খোলা উঠোনে আড্ডা দিতে মুনিয়ার খুব ভালো লাগে। এমন সুযোগ আর মেলে কোথায়? তারপর বাড়িতে কোন উৎসব থাকলে তো কথাই নেই আনন্দই আনন্দ। এবার এসে মুনিয়া দেখল কিছুদিনের মধ্যে আনন্দ বাড়ির ছেলে হয়ে উঠেছে। নিশ্চিন্ত হল মুনিয়া যাক সবাই খুশি আছে এটাই ভালো। রাণা চলে গেলে বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাবে। ডলটা খুব বেশি দাদা দাদা করে ও কিছুটা ভালো থাকবে। প্রেম শুধু সূচনা নয় আরেক জীবনের হয়ত ভালো রাখতেও সাহায্য করে।
দোতলার ছাদে এই শোয়ার ঘরটা খুব প্রিয় মুনিয়ার। ওর বিয়ের কিছুদিন আগেই এই ঘরটা নতুন করে সাজিয়েছে বাপি। রাণা ওকে জড়িয়ে ধরে খুব কাছে আনে। রাণার বুকের কাছে এসে মুনিয়া ওর আদরে ডুবতে চায়। রাণা বলে,' দুদিন দেখিনি,আজ তো চোখই ফেরাতে পারছিলাম না। ফ্ল্যাটে ছোট প্যান্ট পরে ঘোরাঘুরি করা মুনিয়াকে একদম লক্ষ্মীঠাকুরের মত লাগছিল। তবে আমার কপাল খারাপ দেখি আমার বৌ আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।'
' ইশ্ সারাদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে এল। শুধু দুষ্টুমি না।'
-' সত্যি ভীষণ সুন্দর লাগছে। আমার বৌ অবশ্য এমনিতেই মিঠে মুনিয়া।'
হাল্কা করে গানটা চালিয়ে দেয় রাণা, প্রিয় গানের কলিতে ডুবে যায় রাণা। মুনিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। অনেকটা উষ্ণতা ভাগাভাগির মাঝে দেওয়াল ঘড়িতে ঢংঢং করে বারোটা বাজে।
মুনিয়াকে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে রাণা ওর কানে কানে বলে,' শুভ বিয়ের প্রথম জন্মদিন। মেঘেদের উড়ো চিঠি কখনও যেন না আসে আর কারো নজর যেন না লাগে আমাদের সুখী দাম্পত্যে।'
রাণার বুকে মুখ ঢেকে থাকা মুনিয়ার মনের কোণে কোথায় যেন রাণার কথাগুলো জোরে ধাক্কা খেল। সত্যিই তো রাণা অতীতকে ভুলতে চায়,অথচ মুনিয়া কেন অতীতকে ভুলতে পারে না? মাঝে মধ্যেই মেঘেদের উড়ো চিঠিকে উড়িয়ে নিয়ে আসে ওদের নিশ্চিন্ত জীবনে। তেমনি ভাবেই তো আরেক টুকরো কালো যেঘের সন্ধানে গেছিল। কি হবে ওর জেনে ঝুমকার কি হয়েছিল। প্রত্যেকেরই বোধহয় জানার আর চেনারও একটা গন্ডী থাকা দরকার। সেই গন্ডী পেরোনোর ফল সবসময় ভালো হয় না। রাণা ওর পাশ থেকে উঠে গেছে। উঠে লাইটটা জ্বালায় রাণা,মুনিয়ার গলায় একটা পেনডেন্ট দেওয়া চেন পরিয়ে দেয়।
' আজ কেন? কি এটা? এখন তো কত খরচ এমনিতেই।'
' আমাকে রেখে গেলাম তোর মাঝে। খুলে দেখ এটা।'
মুনিয়া দেখে প্রথমে খুব হাসে। রাণার মুখটা বোকা বোকা লাগে,' তোর পছন্দ হয়নি'
' হয়েছে রোমিও, পাশাপাশি রাণা আর মুনিয়াকে আমি গলায় রেখে দেব তাই তো?'
' হ্যাঁ।'
' মনের মাঝে সবসময়ই থাকবি,যেখানেই থাকিস না কেন?'
রাণার দেওয়া মোড়কটা খোলে মুনিয়া, যদিও ও জানে এতে কি থাকতে পারে। মুনিয়ার প্রিয় পারফিউম, চকোলেট আর একটা খুব সুন্দর শাড়ি। সাথে একটা সুন্দর নাইটড্রেস।'
-' কখন কিনলি এইসব? নাইটড্রেসটা খুব সেক্সি হয়েছে কিন্তু।'
-' সব সময় শুধু মজা এটা কাল পরতে হবে কিন্তু।'
মুনিয়া ওর গিফ্টটা কাল দেবে বলে রেখে দেয়। আজকের রাতটা শুধু রাণারই হোক।
ভোরের আলো অনেক আগেই ফুটেছে। একটু ঘুম ভাঙতে দেরি হয় মুনিয়ার। তাড়াতাড়ি উঠতে যায়। রাণা আরেকটু দেরি করিয়ে দেয় আজ উষ্ণতার পুরোটাই মেখে নিতে ইচ্ছে করছে রাণার।
-' ইশ্ ছাড়! অনেকটা বেলা হয়েছে।' রাণাকে অনেকগুলো আদরের চিহ্ন এঁকে দিতে দিতে মুনিয়া বলে।
-' এমন দিন আবার কবে আসবে কে জানে? কেউ আজ ডাকতে আসবে না।'
-' খুব পাজি হয়ে গেছিস কিন্তু। আমি চললাম বাথরুমে। পুতুল আসবে মনে আছে তো?'
রাণার চুলগুলো এলোমেলো করে মুনিয়া বাথরুমে ঢোকে। বালিশে মুখ ঢাকে রাণা। মুনিয়ার চুলের গন্ধ আর গায়ের গন্ধ পায়।
মুনিয়া পুতুল আর কৌশিকদাকে আসতে বলেছিল। তারপর অবশ্য বলেছিল,' তোর প্রবলেম হলে আসিস না। আমি দেখা করে আসব। আবার কবে আসা হবে জানি না।'
পুতুল মুনিয়ার ছোটবেলার বন্ধু তাই খুব মিস্ করে ওকে। পরে পুতুল বলল,' আমরাই যাব অনেকদিন কোথাও যাই না। অসুবিধা হবে না।'
মুনিয়া স্নান করে একদম বেরোয়,ও রাণার শাড়িটার কথা জানত তাই ঠিকই করেছিল স্নান করে ঐ শাড়িটাই পরবে। তাড়াতাড়ি শাড়ি পরে নিচে নেমে এসে দেখে শাশুড়িমা পুজোর জোগাড়ে ব্যস্ত। যে কোন ভালো কাজের সূচনা এভাবেই হয় ওদের বাড়িতে।
মুনিয়াকে ওর মা ইশারা করে সবাইকে প্রণাম করতে। জিভ কাটে মুনিয়া, সত্যিই ভুল হয়ে গেছে।
সবাইকে প্রণাম করে মুনিয়া, শুধু ঠাম্মা বলে,' কাজললতাটা গুছিয়ে রেখেছ তো নতুনদিদি?'
-' হ্যাঁ ঠাম্মা মামণির কাছে রেখে দিয়েছি।'
শান্তা শাশুড়িমাকে বলে,' আছে মা যত্নে রাখা। রাণা কই? ভাবলাম দুজনকে একসাথে মন্দিরে নিয়ে যাব।'
-'একটু দাঁড়াও দিদিভাই,এটা রাখো কাছে। তোমার ঠাম্মার এখন আর তেমন কিছু নেই। এই রূপোর সিঁদুর কৌটো আমার মায়ের ছিল। তুমি এটা থেকে সিঁদুর দিয়ো। এখন তুমিই তো এ বাড়ির নতুন মা তাইনা?'
গতকাল ও আসার পরই শান্তা ওর হাতে শাড়ি,আলতা,সিঁদুর আর ঝুমকো দিয়েছে। শান্তা জানে মুনিয়া তেমন না সাজলেও ঝুমকো ওর খুব পছন্দ তাই। আজ সকালে স্নান সেরে রাণার দেওয়া হারের সাথে ঝুমকোটা পরেই ও নিচে নেমেছে। ঝুমকো কানে দিয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতেই ঝুমকার কথা মনে হয়েছিল হঠাৎই। সত্যিই একটা বাজে কাজ করে ফেলেছে।
রাণার কথা হতেই মুনিয়া হাসে। ইশারা করে এখনও ঘুমোচ্ছে। বাপি পা বাড়ায় সিঁড়ির দিকে। ততক্ষণে রাণা নেমে এসেছে।
দুজনেই দুজনকে দেখে অবাক হয়,রাণার পরনে মুনিয়ার পছন্দের পাজামা পাঞ্জাবি আর মুনিয়ার পরনে লাল জড়ির পাড়ের হলুদ সিল্কের শাড়ি।'
মন্দিরে গিয়ে মনটা ভালো হয়ে যায় মুনিয়ার। মনে জমে থাকা সব অপরাধ বোধ আর কষ্ট দূর হয়ে যায়। ঠাকুরকে ও বলে রাণা যেখানেই যাক ও যেন ভালো থাকে। একা থাকতে হয়ত ওর খারাপ লাগবে, তবুও জীবনে উন্নতি করুক রাণা। কৃষ্ণনগরের সেই মুখচোরা ছেলেটা পৃথিবীটাকে চিনুক।
একটু বেলা হতে না হতেই পুতুলরা এসে গেল। পুতুলের শরীরে ভরা জোয়ারের ছোঁয়া। মুনিয়া জড়িয়ে ধরে ওকে,'কতদিন বাদে তোকে দেখলাম রে। কি সুন্দর দেখতে হয়েছিস রে!'
অনুষ্ঠানের আনন্দে আর সবার একসাথে হওয়াতে ম্যাজিক টাচে বাড়ি জমজমাট। ননদ দেওরদের সাথে ঠাম্মা কাকিমা আর পিসিমা সবাই মেতে উঠেছে। ওদের আনন্দের সঙ্গী হতে গিয়ে গা ভাসালো রাণা আর মুনিয়াও। মালাবদল,কেক কাটা সবই হল। আর তার সাথে প্রচুর ছবি তোলা হল। জুনি বেচারা ওখান থেকেই ভিডিও কলে দেখল অনুষ্ঠান।
কৌশিকদাকে আজ বেশ খোলামেলা লাগল মুনিয়ার। এই প্রথম সবাই মিলে অনেক গল্প হল। পুতুলরা আজ ওদের বাড়িতেই থাকবে রাতে সুতরাং শুধুই মজা আর হৈ চৈ। ডলকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আজ। এর আগে কোনদিন তেমনভাবে শাড়ি পরে ওকে দেখেনি মুনিয়া।
বাপির তত্ত্বাবধানে একদম খাঁটি বাঙালি খাবারের আয়োজন। রাধাবল্লভী,আলুর দম,পাঁঠার মাংস,ভেটকি পাতুরি আর চিংড়ি মালাইকারি সবই হয়েছে উইথ পোলাও।
'বাপি এত আয়োজন করেছ! কই আগে তো কখনও বলনি?'
-' সারপ্রাইজ মামণি,ছেলেটা বাইরে চলে যাবে মনটা ভালো নেই বুঝলে তবুও এই উপলক্ষ্যে বেশ একটু আনন্দ করা গেল আর কি।' ছেলে আর বৌমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে মনকে ভালো করে হাসিমুখে অনুষ্ঠানের দেখভাল করেন।
মুনিয়াকে ইশারায় ডাকে শান্তা। মুনিয়া যেতেই বলে,' আনন্দর মা বুঝলে। আগে তো বাড়ির মধ্যে দিয়েই যাতায়াত ছিল এখন পাঁচিল উঠে মাঝে দেখা কম হয়। কাল আমাদের একটু ওঁদের বাড়ি হয়ত যেতে হবে।'
মুনিয়া প্রণাম করে ভদ্রমহিলাকে। উনি বলেন,' কাল সন্ধ্যেতে তুমিও যেয়ো কিন্তু বৌমা। '
মুনিয়া ডলের দিকে তাকায়। ডলের মুখে রাঙা আলতার মাখামাখি। মুনিয়া বুঝতে পারে কিছুটা।
পুতুল এসেই মুনিয়ার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বলেছিল,'আজকে হয়ত পরা হবে না কাল একবার পরিস পারলে দুজনে। একবার খুলে দেখ পছন্দ হয়েছে কি না? সেই পুজোর সময়ে তোর খুব পছন্দ হয়েছিল না আমাদের কাপল ড্রেস। তাই তেমনি একটা আনিয়েছি আমার ননদকে দিয়ে কলকাতা থেকে।'
স্মৃতির গলিপথে হেঁটে হঠাৎই একটা হোঁচট খায় মুনিয়া, ঝপ করে প্যাকেটটা খুলে ফেলে। একটা খুব সুন্দর সাদা লালে গণেশ জননী মোটিফের শাড়ি আর তার সাথে ম্যাচিং পাঞ্জাবী। লেবেলটা চোখে পড়ে মুনিয়ার, ঝুমস্ ক্রিয়েশন।
- ' অপূর্ব হয়েছে দেখতে রে! নিশ্চয় পরব। এখানে না হলেও ওখানে গিয়ে পরে তোকে ছবি পাঠাবো। আমি এটা রেখে আসি বুঝলি।'
-' তুই গল্প কর মুন,আমি রেখে আসছি।'
-' মা তুমি গল্প কর,আমি এখনি রেখে আসছি। পুতুলের দেওয়া জিনিস বলে কথা।'
ঘরে এসে একটু হাঁফায় মুনিয়া, ওর আর রাণার মধ্যে কোন ভুল বোঝাবুঝি আর রাখতে চায় না। কি করতে যে পুতুলকে বলেছিল... তখন কি আর জানত?
তাড়াতাড়ি লেবেল দুটো কেটে ওদেরকে জানলা দিয়ে মুক্ত হাওয়ায় উড়িয়ে দেয় মুনিয়া। ঝুমকার সৃষ্টি ওর আলমারিতে থাকলেও ঝুমস্ ক্রিয়েশন হাওয়ায় ভেসে উড়ে গিয়ে পড়ে পাশের ঝোপে।
রাতটা খুব আনন্দে কেটে যায় খাওয়া দাওয়া আর গল্পে। আজ রান্নার লোক সারাদিন রান্না করেছে বলে মোটামুটি শাশুড়িরা মুক্ত রান্নাঘরের ঝামেলা থেকে তাই সবাই মিলে শুধুই আনন্দ করা।
পুতুলের শরীরেও নতুন অতিথির আনাগোনা এই নিয়ে রীতিমত গবেষণা হল বাড়িতে। ঠাম্মা বললেন,' আমার লক্ষ্মী পুতুল দিদিভাইয়ের কোল জুড়ে রাজকন্যাই আসবে মনে হচ্ছে। এত সুন্দরী যে হয়েছ।'
' ঠাম্মা আমার মত্নের কোন দাম নেই। '
-' একদম দাদুভাই যত্নে তো ভরিয়ে দিয়েছ কানায় কানায়। শুধু আমার দাদুভাইটা নতুন দিদিকে ভালো করে আদর যত্ন করতে পারল না। এখন তো আবার চলে যাচ্ছে সাত সমুদ্দুর পাড়ে।'
ঠাম্মা সত্যি কিছু কথা বলতে পারে! উফ্
কৌশিক রাণাকে ইশারা করে ,'আদর যত্নের ইঙ্গিতটা বুঝেছিস তো? আজ থেকেই আদর যত্নের শুরু হোক ভালো করে।'
-' ইশ্ এখন আর বেশি আদর যত্নে কাজ নেই। তারপর মুনিয়া সেই আদরের ঠ্যালা একা সামলাবে কি করে?'
মুনিয়া অনেকবার এই কথাগুলো শুনেছে আসলে বিয়ের পর বাচ্চা হওয়ার একটা ইস্যুস চলেই আসে। এখনও মা ঠাকুমারা বংশ বৃদ্ধির ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড বেশি।
রাতে পুতুলকে নিয়েই একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠান হয়ে গেল। ওদের অনুষ্ঠানের মধ্যেই আরেকটু সাব সেলিব্রেশন। শান্তা পুতুলকে সাজিয়ে গুছিয়ে খেতে দিয়ে নতুন শাড়ি,আলতা সিঁদুর আর পায়ের আঙটি দিলেন। সারা বাড়িতে একটা খুশি খুশি ভাব। শুধু উড়ু উড়ু মন ডলের কাল তো আনন্দদাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা বড়দের। ওর খুব চিন্তা হচ্ছে কি জানি কি হবে আবার?
কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পায়নি পাজিটা গম্ভীর হয়ে বলেছে,' আমি কি জানি? ওসব বড়দের ব্যাপার। তবে মা বাবা খুব রেগে আছে দেখেছি।'
অগত্যা মুনিয়ার কাছে এসে ঘ্যানঘ্যান করে। মুনিয়া হাসে,' এত বোকা নাকি তুই! তোর হবু শ্বশুরবাড়ি দেখতে আমাদের নেমন্তন্ন করেছে। আমার তো তাই মনে হয়।'
-' তাহলে ও বলছে কেন মা বাবা রেগে আছে?'
-'ধ্যাৎ পাগলী,এই বোকা ননদটাকে নিয়ে যে কি করি!
কালই তো যাচ্ছি তারপর দেখা যাবে কি হয়। আমার মনে হয় তোর দাদা যাবার আগেই একটা কোন ভালো খবর শুনে যাবে।'
সেদিন সব আনন্দ আর গল্প সামলে ওদের ঘরে যেতে বেশ দেরি হয়ে যায়। আর হাতে দুটো দিন তারপরেই ফেরার পালা। আবার কবে এত আনন্দ হবে কেউ জানে না। তাই সবাই উপভোগ করল অনুষ্ঠানের ফাঁকে আনন্দর মেজাজটা।
মুনিয়া রাণার দেওয়া রাতের পোশাকটা পরে এসেছে। হালকা নীলচে আলোতে দুধ সাদা পোশাকে মুনিয়াকে খুব সুন্দর লাগছে। তবুও একবার ভালো করে দেখার জন্য লাইটটা জ্বালায় রাণা। সারা ঘরে রজনীগন্ধার গন্ধ আজ মনে করিয়ে দিচ্ছে এক বছর আগের অনেক স্মৃতি। মুনিয়ার শরীরের খাঁজগুলো উঁকিঝুঁকি মারছে স্বচ্ছ রাতের পোশাকের স্বচ্ছতা ভেদ করে। রাণার দেওয়া পারফিউমটা হাতে নিয়েছে মুনিয়া। রাণা নিজেই হালকা করে গন্ধ ছড়ায় মুনিয়ার শরীরে। ওর আদরে চোখ বুজে আসে মুনিয়ার। রাণা বারণ করলেও শোনেনি মুনিয়া আগেই খুব সুন্দর একটা স্যুট করিয়ে দিয়েছিল ওকে। আজ ওর হাতে নিটোল একটা আঙটি পরিয়ে দেয় মুনিয়া। ও জানে রাণা তেমনভাবে কিছু হাতে রাখতে পারে না। তবে এটা অনেক দেখে কিনেছে। আঙটির মাঝখানে ইংরেজী আর শব্দ জড়িয়ে রেখেছে এমকে। রাণা হাসে তার সাথে হাসে মুনিয়াও। দুজনের কাছেই এভাবে দুজনের থাকা। লেখাটা খুব লক্ষ করলে বোঝা যাবে। এমন করে করে দিয়েছে ওরা।
ফেলে আসা একবছরের স্মৃতির পথে হাঁটতে হাঁটতে ভালোবাসার অজানা পথে হঠাৎই হারিয়ে যায় ওরা। ঘরে তখন আবছা অন্ধকার, জানলা দিয়ে ঢুকেছে চাঁদের আলো।
ভালোবাসার রঙমেখে আদরে বুজে আসে স্বপ্নমাখা চোখগুলো আদরে কথা বলতে বলতে।
*********************
ঘুমে চোখটা বুজে আসে ঝুমকার। কাজ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতেই পারেনি। মা এসে ডাকতেই চমকে ওঠে।
- ' এই মেয়েকে নিয়ে হয়েছে আমার এক জ্বালা। সারাদিন এত পরিশ্রম কি সইবে নাকি? পার্লারের কাজ তারপর আবার এই আঁকাআঁকি। চল ঘুমোতে চল এবার। ঠান্ডা লেগে যাবে তো বাইরে হিম পড়ছে।'
মায়ের বকুনি শুনে ওদের একফালি ঘরের বিছানায় মায়ের পাশে শুয়ে পড়ে ঝুমকা। মা নিজের মনে বকবক করতে থাকে।
-' মা কাজ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জানো কাজ না থাকলে মানুষের আর বাঁচার ইচ্ছে থাকে না।'
-' কি জানি বাপু আমার তো মনে হয় সারাদিন এত কাজ,কবে যে ছুটি পাব। তুই যে কি বলিস!'
-' যে একবার অনেকদিন ছুটি পেয়েছে সে জানে মা ছুটিও একটা সময় আনন্দ না দিয়ে দমবন্ধ করে দেয়।'
মা বকবক করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। ঝুমের ঘুমটা ভেঙে গেছে,এখন আর কিছুতেই আসতে চাইছে না। আজকাল কাজ ঝুমকে অনেকটা ভালো রেখেছে। রাতে আর দুঃস্বপ্ন দেখে ওর ঘুম ভাঙে না। বরং রাতে জেগে থাকলে ওর মাথায় ঘুরতে থাকে হরেক ডিজাইনের চিন্তা। এখন হোয়াটস অ্যাপেই অনেক অর্ডার পায় ঝুমকা। বাড়ি থেকেও জিনিস নিয়ে যায় লোকে। একটা মেয়েকে রেখেছে ঝুমকা। ওকে সাহায্য করার জন্য। ঝুম যখন পার্লারে যায় তখন ও একটু সামলায়। সোহিনীদিকে ছাড়তে পারেনি ঝুম। ঝুমকে খুশি রাখার জন্য ওর অনেক জিনিসই সোহিনীদিও বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয়।
আজকাল ভালো মেয়ে পাওয়া খুব মুশকিল তাই সোহিনী ঝুম ব্যবসা আর পার্লার দুটোই একসাথে চালাতে পারে সেটা মাথায় রেখেছে। প্রথমে অবশ্য সত্যিই একটু খারাপ লাগছিল ওর ব্যবসা করার কথা শুনে। তবে এখন দেখেছে কিছু ছাড়লে যদি পাওয়া যায় অনেকটা তবে ক্ষতি কি?
জীবনে পাওয়ার সাথে সাথে বোধহয় ছাড়তেও শেখা উচিত সবারই। স্বাধীনতা দিলে বোধহয় সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার সবাই করে না।
সোহিনীদির আশ্রয়ের বাইরে আসতে একটু ভয় পায় ঝুমকাও। সত্যিই তো ওরাই একসময় ওর পাশে দাঁড়িয়েছে। আবার যদি কখনও মৈনাক ওকে আবার---
ভেবেই চমকে ওঠে ঝুমকা। শয়তানটা যদি আবার কখনও ফিরে আসে তখন কি করবে ও? সোহিনীদি অবশ্য বলেছে ফিরে আসলে ওর নিস্তার নেই। দেখে নেবে ওরা। সোহিনীদির কথা শুনে নিশ্চিন্ত লেগেছিল ঝুমের।
মোবাইলে চোখ রাখে ঝুমকা,একবার ঘুম ভাঙলে আর ঘুম আসতে চায় না। ওদের বাড়ির পাশের নিম গাছটায় কোন রাতজাগা পাখি ডাকছে। ঘুমোতে চায় ঝুমকা,অনেকটা ঘুমোতে চায়। ওর শরীরে মনে অনেকটা ক্লান্তি। ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে চোখ বোজে ঝুমকা। আস্তে আস্তে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।
পুতুলরা দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে চলে গেছে। কাল রাতের পরে আজকের সকালটা সত্যিই খুব সুন্দর ছিল। পুতুল বারবার বলে গেছে শাড়ি আর পাঞ্জাবী পরে একটা ছবি যেন ওকে পাঠায়। কৌশিক দেখলে খুশি হবে। মুনিয়া বুঝতে পারে পুতুল হাউসওয়াইফ সুতরাং ওর মত স্বাধীন নয়।
-' একদম পরব রে। ওখানে একটা ছোটখাটো ট্রিট দিতে হবে রাণার অনারে। সেদিন পরব। ওখানে এই ধরনের আনকমন শাড়ি সবাই খুব পছন্দ করে। তোকে ছবি পাঠাব অবশ্যই। সাবধানে থাকিস। নিজের যত্ন নিস।'
শান্তা কালকের নানা ঝকমারিতে ব্যস্ত ছিল আজ পুজো সেরে শাশুড়িমায়ের ঘরে যায়।
' মা বলছিলাম কি আনন্দর মা আজ আমাদের ওদের বাড়িতে সন্ধ্যেবেলায় যেতে বলেছে।'
-' তা যাও বৌমা। পাশের বাড়ি যাবে তার আবার কি? একসময় আনন্দর ঠাকুমা যমুনা আমার কাছে কত আসত দিদি দিদি করে। বেচারার সাত তাড়াতাড়ি ডাক পড়ল।'
-' মা আমার একটু কেমন যেন লাগছে।'
-' বৌমা, তুমি তো মা। মেয়ের মনের কথা পড়তে পারনি? আমি তো পুজোতেই বুঝেছিলাম। কত ছোটবেলার সঙ্গী ওরা। আরও কিছু যদি হয় হোক। আমার আপত্তি নেই। ভালো হবে। আমার ছেলে তো মেয়েকে চোখে হারায়। কাছেই থাকবে।'
-' মা এখন ছেলেমেয়েরা কাছে থাকে? কোথায় চাকরি নিয়ে চলে যাবে। আমার ছেলেটাও তো চলে যাচ্ছে।'
নিজেকে সামলাতে পারে না শান্তা কেঁদে ফেলে ঝরঝর করে। চোখের জল বাঁধ মানে না।
-' মন খারাপ করে না বৌমা। নতুন দিদির মন খারাপ হবে,দাদুভাইটা এমনি চুপ করে গেছে। বেচারা একটু বৌ নেওটা।'
শাশুড়িমার কথার ধরনে হেসে ফেলে শান্তা।
সন্ধ্যের পরেই ওরা যায় আনন্দদের বাড়িতে। রাণা যেতে চাইছিল না। তবুও আসতে হয়েছে। মুনিয়া এর আগে ওদের বাড়িতে আসেনি। খুব সুন্দর আধুনিক সাজে সাজানো বাড়ি,রান্নাঘর সবই।
চা মিস্টি খেতে খেতে আনন্দর মা বলেন..' আনন্দর তো সামনেই পরীক্ষা। তার আগেই হয়ত ক্যাম্পাসিং হবে। তবে বয়েসটা এখনও খুব কম। অবশ্য কোথায় চাকরি পাবে জানি না।'
শান্তার একটু অস্বস্তি হয় শুনে। কি জানি এরপর কি বলবে। মুনিয়ার দিকে তাকায়। প্রথম শুনে ডলকে খুব বকেছিল।
' একি? সবাই চুপচাপ কেন? কি হল? আমি বলছিলাম ডলকে আমাদের সবার ভালো লাগে। আশাকরি ডলও আনন্দকে পছন্দ করে। তবে যদি তো কিছুদিন অপেক্ষা করো তোমরা দিদি তাহলে খুব ভালো হয়।'
মুনিয়াই প্রথমে রাণার দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। তারপর সবার গল্পে জমে ওঠে। সত্যিই তো ওরা দুজনেই অনেকটা ছোট। আগে ভবিষ্যত তারপর অন্য কিছু। মুনিয়া আর রাণা গিয়ে আনন্দর সঙ্গে আড্ডা দিল এই সুযোগে শুধু ডলটার আসা হয়নি। অবশ্য কাকিমা ওরা আসতেই বলেছেন,' ডলু কোথায়? ও এলো না কেন? ওর জন্যই তো ওর কাকু ফিশফ্রাই এনেছে। আচ্ছা আনন্দ গিয়ে দিয়ে আসবে।'
প্রেম করা নিয়ে অনেক মন কষাকষি আর অশান্তি হয়। তবুও ভালো ডল অনেক লাকি। কার যে মন কোথায় বাঁধা পড়ে কে বলতে পারে। ঠাম্মার কথাটা আজ খুব বেশি করে মনে পড়ল মুনিয়ার।
আনন্দদের বাড়ি থেকে অনেকটা হ্যাপি হ্যাপি ভাইবস নিয়ে ফিরে এল ওরা সবাই। মুনিয়া বলল ,'এই শোন এদিকে আয়, এই নে ফিশফ্রাই খা। আনন্দ আসতে চাইছিল আমিই বারণ করলাম।'
-' ও আসুক আমি কি করি দেখ,কাল থেকে আমাকে সমানে টেনশনে রেখেছে।'
-' তোকেও কেউ টেনশনে রাখে! সত্যিই অবাক হলাম রে। আনন্দ খুব ভালো ছেলে,বাড়িটাও ভালো।'
-' বৌদিভাই তুমি শেষে ওর দলে গেলে খুব খারাপ কিন্তু।'
অনেকটা ভালোলাগা আর টুকরো মনখারাপের কান্না নিয়ে ফিরে এসেছে আবার ওদের ফ্ল্যাটে। শান্তারও খুব মন খারাপ ওরা চলে যাওয়ার পর। যতটা পেরেছে গুছিয়ে দিয়েছে খাবার দাবার,' ওকে কদিন এগুলো দিয়ো বুঝলে। আলুভাজা আমি অনেকটা করে দিয়েছি প্যাকেট করে সাথে দিয়ো।'
মায়ের দেওয়া খাবার গুলো দেখে খুব খুশি হয়েছিল রাণা,' মা আমি আলুভাজা সাথে নিয়ে যাব লাগেজে।'
কৃষ্ণনগরের ছোটছোট সুখস্মৃতি,মুনিয়াকে ছেড়ে যাওয়া। নতুন জায়গার কাজের দায়িত্ব সব কিছুর চিন্তায় রাণার খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। আজকে সন্ধ্যেবেলায় ওদের ফ্ল্যাটে একটা ছোট গেটটুগেদার আছে। আসলে ওদের অ্যানিভার্সারি আর রাণার চলে যাওয়া সব মিলিয়ে একটা ছোটখাটো পার্টি। মুনিয়াটা গুটিশুটি মেরে ওর বুকের কাছে এসে ঘুমিয়েছে। ওকে জড়িয়ে ধরে রাণা। এই পাশাপাশি থাকার টাচটা খুব মিস্ করবে ওখানে।
আজকের সবটাই বাইরে থেকে আসবে। তাই মুনিয়ার কোন চাপ নেই। শুধু সাজগোজ করে আড্ডা দেওয়া।
ট্রলি থেকে গতকালই শাড়ি আর পাঞ্জাবীটা বের করে রেখেছে মুনিয়া। তেমনভাবে এখানে শাড়িই পরা হয় না। জিন্স আর কুর্তা পরে বেরিয়ে যায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা পরে নিজেকে দেখে মুনিয়া। যদিও শাড়িটা খুব সুন্দর দেখতে তবুও কেন যেন শাড়িটা গায়ে জড়াতে গিয়ে বারবারই ঝুমকার মুখটা মনে পড়ে মুনিয়ার। কি অদ্ভুতভাবে রাণার প্রেমিকার আঁকা শাড়ি আজ ইচ্ছা বা অনিচ্ছা যাতেই হোক গায়ে দিতে হয়েছে মুনিয়াকে।
পুতুলটা পারে বটে,শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং জুয়েলারী দিয়ে দিয়েছে একদম। পুতুলের সাজগোজে একটা এথনিক ছাপ আছে। ওকে মানায় বেশ ভালো লাগে। শাড়িটা পরে গায়ে চন্দনের গন্ধ ছড়ায় মুনিয়া। ও জানে এই গন্ধটা রাণার খুব প্রিয়।
রাণা একটু বাইরে গেছিল আইসক্রিম আনতে। মুনিয়াকে দরজা খুলতে দেখে অবাক হয়ে যায় সাধারণত মুনিয়া সিল্ক আর সোনার গয়না পরতে ভালোবাসে আজ একদম অন্যরকম দেখতে লাগছে মুনিয়াকে।
-' কি হল? কি দেখছিস? খারাপ লাগছে দেখতে?'
-' না না একদম নিউ লুক, বেশ লাগছে। তাই তো দেখছি।'
- ' পুতুল দিয়েছে এটা,তোর জন্যও দিয়েছিল। ওকে প্রমিস করেছিলাম পরে ছবি দেব। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। জুনি তাড়াতাড়ি আসবে পুচকেটাকে রেখে আসবে বাড়িতে তাই। রুমকিদি একটু দেরি করবে বলছিল।'
মুনিয়া সামনেটা একটু গুছিয়ে রাখছে। রাণা পাঞ্জাবী পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। পুতুলের পছন্দ বেশ ভালো। এর আগে ওর পর্দা তো পুতুলই পছন্দ করে পাঠিয়েছিল। আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে রাণা। হঠাৎই পাঞ্জাবীতে আঁকা মোটিফের দিকে চোখটা যায়,কেমন যেন চেনা লাগে। ওর কি এইরকম কোন পাঞ্জাবী ছিল?
Comments
Post a Comment