Skip to main content

যশোদা

#যশোদা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

বেল বাজার আওয়াজে দরজা থেকে খবরের কাগজটা নেয় যশোদা। চোখ রাখে প্রথমেই খবরে,বাড়ির অন‍্যেরা তখনো ঘুমের দেশে।
          হেডলাইন আর ছবিটাতে চোখ পড়ে যায়,খবরটাতে একটু যেতেই চোখটা বুজে ফেলে যশোদা,তাড়াতাড়ি ছুটে বেডরুমে যায় রাহুল দিব‍্যি ঘুমোচ্ছে শান্তনুর গায়ে পা তুলে দিয়ে।
                 ঘুমন্ত রাহুলের গায়ে মমতায় হাত বোলায় যশোদা।তারপর ছুটে আসে এই ঘরে নিশা আর নীল ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে গুটিশুটি মেরে।
            সন্তানদের ঘুমোতে দেখে যেন স্বস্তিতে চোখ বোজে যশোদা। তবুও বার বারই কেন চোখের সামনে ভাসছে ছবিটা। রেলের প্ল‍্যাটফর্মে চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে আছে মা আর ছোট্ট শিশুসন্তান যার একমাত্র অবলম্বন মা সেই মা মৃত তা না জেনেই...জানবেই বা কি করে ঐ দুধের শিশু? সে চাদর সরাচ্ছে মাকে দেখতে হয়ত বা মাতৃস্নেহ পাবার আশায় অথবা খাবারের খোঁজে।
                        রান্নাঘরে কাজে মন দিতে পারেনা যশোদা, বাচ্চাটা কত বড় হবে? একদম যেন রাহুলের মত। শ্বশুরমশাই উঠে পড়েছেন তাই চা বসানোর উদ‍্যোগ নেয় যশোদা।পরে আবার একবার চা হবে শান্তনু উঠলে।
               চা টা নিয়ে শ্বশরমশাইয়ের ঘরে দাঁড়িয়েছে যশোদা,উনি খবর চালিয়েছেন বড় স্ক্রীনের স্মার্টটিভিতে বার বারই ভেসে ওঠে বাচ্চাটার ছবি সে প্ল‍্যাটফর্মে শুয়ে থাকা মৃত মায়ের চাদর তুলছে আর তার সাথে নানা রকম মন্তব‍্য।

        " দেখেছো বৌমা,বুড়ো মানুষ কিই বা করবো সকালে উঠে একটু খবর শুনি।তা এমন একটা খবর! আর সব চ‍্যানেলে বার বার দেখাচ্ছে। মানুষের কি কোন কাজকম্ম নেই গো,বাচ্চাটাকে না সামলে বসে বসে ভিডিও করেছে। কি দিন এলো গো,সবেই লোকে ফুটেজ খেতে চায়?"
      " চুপ করুন বাবা,আপনি বরং রেডিওতে ভালো গান শুনুন।আমি চালিয়ে দেবো?"
      " তাই দাও মা,এইসব খবরে কেন যেন বুকের ভেতরের ঘা টা থেকে আবার রক্ত বেরোতে থাকে। বাচ্চাটাকে দেখেছো ঠিক দুবছর আগের আমাদের রাহুল।"
         গলাটা বুজে আসে যশোদার," হ‍্যাঁ বাবা দেখেছি। আপনি গান শুনুন,সেই একই তো খবর এখন বরং থাক।"
                 রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে তোমারও অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি ধাই।কোথাও দুঃখ,কোথাও মৃত‍্যু,কোথা বিচ্ছেদ নাই।
        যশোদা ময়দাতে জল দিয়েছে আলু চচ্চড়ি বসিয়ে। ছেলেমেয়েদের ভীষণ পছন্দ লুচি আর সাদা আলু তার মধ‍্যে সবচেয়ে বেশি পছন্দ ছোট ছেলে রাহুলের। রান্নাঘরে লুচি ভাজার গন্ধ পেলেই হলো প্লেট নিয়ে হাজির,মাম্মা লুচি দাও।
                যশোদা দেখে দেখে ফুলকো লুচিগুলো দেয় ওকে,খেতে না পারলে নিশা একদম খাইয়ে দেয় ভাইকে। নিশা আর নীল বেশ কিছুটা বড় হয়ে যাওয়াতে পুরো আধিপত্য এখন এই কুচোটার বাড়িতে।
             ইশ্,ময়দাতে কতটা জল ঢেলে ফেলেছে বার বারই চোখে ভেসে আসছে ছবিটা।সকাল থেকেই আজ যেন একটা কান্না পাওয়া দিন। গতকাল আবার কিছুটা ঝড়বৃষ্টি হয়েছে,নিরীহ কয়েকটা প্রাণও গেছে।তার মধ‍্যে এই খবরটাই বারবার আহত করছে যশোদার মাতৃত্বকে।
           মনে করিয়ে দিচ্ছে দুবছর আগের একটা দিনের কথা। ওর শাশুড়িমা তখন বেঁচে,শান্তনুই প্রথম খবরটা এনে যশোদাকে দিয়েছিলো.." বুঝলে তোমার রাইবাঘিনী আর নেই,যশোদা সেই যে সে পালিয়েছিলো তোমার কথা না শুনে একেবারেই চলে গেলো।"
         শাশুড়িমা লুটিয়ে পড়েছিলেন কান্নায়।যশোদা হারিয়ে গিয়েছিলো বিন্দু বিন্দু মেঘভাঙা কান্নায়। ওর সেই আদরের ননদ,শান্তনুর চেয়ে অনেক ছোট,যশোদাই তো এই বাড়িতে এসে মানুষ করেছিলো তাকে।তার সব বায়নাই সামলাতে হত যশোদা আর শান্তনুকে। কলেজে পড়তে পড়তে কেমন যেন পাল্টাতে লাগলো কি একটা গোপন করছে মনে হত যশোদার।
         " টিকলি তুই আমার ছোট বোন থেকে সত‍্যিই এবার রাইবাঘিনী হয়ে গেছিস এবার। কিছু বললেই একদম খাই খাই করে তেড়ে আসিস কেন?"

     " আচ্ছা আমি কি বড় হইনি বৌদি? 
সব সময় তোমার পারমিশন নিয়ে সব করতে হবে? 
কোথাও যাবো বললেই মা বলে বৌমাকে বলে যাবি।"

         " যেতেই হবে আমাকে বলে,মা তো আমাকেই তোর লোকাল গার্জেন করেছে।
 মা আর সামলাতে পারছেনা তার সুন্দরী মেয়েকে।"
          অদ্ভুত বিচ্ছিরি ভাবে কথা বলেছিলো টিকলি," শোন আমি এই বাড়ির মেয়ে আর তুমি বৌ,আমার অধিকার আছে নিজের মত চলার।"

          অপমানিত হয়েছিলো যশোদা তবুও বলেছিলো," টিকলি আমি অনেক বড় তোর থেকে এইভাবে কথা বলিসনা। শাসন আমি তোমাকে করবোই তা তোমার যতই রাগ হোক। ভালোবাসি তাই শাসন করি।"
          টিকলিকে জড়িয়ে ধরেছিলো যশোদা রেগে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েছিলো টিকলি।
                তারপর একদিন হঠাৎই বাড়ি ছেড়েছিলো টিকলি। ওরা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো শুনেছিলো ছেলেটা মস্তান প্রকৃতির, ভালো নয়। পরে দেখা গিয়েছিলো অনেকটা টাকা,গয়না বাড়ি থেকে উধাও। চিঠিতে লেখা ছিলো....

      " আমি এগুলো নিয়ে গেলাম, তোমরা বিয়ে দিলে তো এগুলো আমিই পেতাম। জানি তোমরা ওকে মেনে নেবেনা তাই আমি চলে গেলাম।"

                     অনেক চেষ্টা করেছিলো যশোদা আর শান্তনু ফেরাতে পারেনি টিকলিকে। বদলে গেছিলো টিকলি।ফোন ধরতোনা,ওর বর ধরলে আজে বাজে কথা বলতো।
          শাশুড়িমা কান্নাকাটি করতেন। হঠাৎই বছর খানেক বাদে ফোন করেছিলো টিকলি।শুনেছিলো ওর ছেলে হয়েছে কিছু টাকা পাঠালে ভালো হয়। পাঠিয়েছিলো শান্তনু।আবার দুমাস বাদে,তারপর আবার,আবার পরের মাসে টাকা চেয়েছে টিকলি। যশোদা বলেছিলো," কি করছিস এত টাকা নিয়ে? আমরা তো পেরে উঠছিনা এবার?"
   " ওর ব‍্যবসার কাজে লাগবে,আমার ভাগ থেকে দাও।"
     শ্বশুরমশাই বলেছিলেন," কিসের ভাগ? আমি কি মরে গেছি যে এখনই ভাগ চাইছিস? তুই চলে আয় এখানে তারপর দেখছি কি ব‍্যবসা করে দেওয়া যায়।"
                    কিছুদিন ফোন করেনি টিকলি,শান্তনু খোঁজ করতে গেছিলো শুনেছিলো ওরা কোথায় গেছে কেউ জানেনা পাওনাদারের চাপে।
                  বেশ কিছুদিন বাদে খবর এসেছিলো,আসলে দুঃসংবাদ বাতাসে ভেসেই আসে। টিকলি আর নেই,সুইসাইড। ওদের ঢুকতেই দেওয়া হয়নি প্রায়। শাশুড়িমা সেই বিছানা নিয়েছিলেন আর ওঠেননি। একদিন শান্তনু অফিস থেকে এসে বলেছিলো..." যশোদা,টিকলির বাচ্চাটাকে নাকি ওরা অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেবে। শয়তানটা আবার বিয়ে করেছে।"
          টিকলি ননদ হলেও যশোদা ওকে অপত‍্যস্নেহে বড় হতে দেখেছে।তাই আঁতকে উঠেছিলো.." সেকি! আমাদের বাড়ির বাচ্চা অনাথ আশ্রমে বড় হবে? আমরা মরে গেছি নাকি?
      তুমি এটা হতে দিয়োনা প্লিজ একটু দেখো। যে করেই হোক এটা থামাতে হবে।যে করেই হোক।"

         আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলো শান্তনু কে জানে কোন কোন মানুষের নামের সাথে বোধহয় তার স্বভাবের খুব মিল থাকে। নাহলে যশোদার কোল তো ভরা,নিশা আর নীলকে নিয়ে সুখের সংসার ওদের।বড়ও হয়েছে ওরা তবুও যশোদা মাতৃত্বের দায়িত্ব নিতে চায়!

       " তুমি ভালো করে ভেবে দেখো যশোদা কি বলছো। ভালো করে ভাবো।বাচ্চাটার সব দায়িত্ব কিন্তু নিতে হবে।তুমি পারবে তো?"

              " আমি পারবো,সবটা পারবো। তবুও টিকলির ঐ দুধের বাচ্চাটাকে অনাথআশ্রমে যেতে দিতে পারবোনা। ইশ্ কাকে ভরসা করেছিলো টিকলি?"

        " আর নিশা,নীলের কথা ভেবেছো। ওদের একবার জিজ্ঞেস করে নাও।"

             সবার ইচ্ছেতেই মোটামুটি মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করে একেবারে লেখাপড়া করে আইনত দুবছরের রাহুলকে ঘরে এনেছিলো শান্তনু আর তারপর থেকেই রাহুল এই বাড়িতে।যশোদাই এখন রাহুলের মা আর শান্তনু বাবা।
      শান্তনু হেসে বলে," মামা মানে মা যোগ মা তাই তো বেটাকে ফেলতে পারলামনা।"
                      ওদের জলখাবারের জোগাড় করে স্নান করে ষষ্ঠী পুজোর ডালা সাজায় যশোদা।এবার যেন সবই মনকেমনের মাঝে কোনরকমে করা। ঠাকুরমশাই এসেছেন,ছাদেই ছোট করে নিয়মরক্ষা হলো ষষ্ঠীপুজোর। যশোদার কোলজুড়ে বসে আছে রাহুল।নিশা আর নীল বলছে," ভাই তুই ছোট বলে সবসময় মায়ের কোলে বসবি তাইনা?"
      রাহুলের হাতের মুঠোয় যশোদার আঁচল।
                 যশোদা তিন ছেলেমেয়েকে কাছে টেনে আদর করে বলে..." ছোটু তো আমার গোপাল।"
        পুজো শেষ হলে সবার হাতে হলুদ সুতো আর মাথায় পাখার বাতাস দেয় যশোদা। শ্বশুরমশাই বলেন, "তোমার মাতৃত্বের শীতলতায় ভালো থাক ওরা। ভালো থেকো তুমিও মা,মায়েদেরকে যে ভালো থাকতেই হবে।"
        মনকেমন করা সকালের ছবিটা চোখের সামনে আসে আবার।চোখ বন্ধ করে যশোদা বলে ভালো থাক মায়েরা আর তাদের সবার সন্তানেরা।
©রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
   ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করুন।
সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...