Skip to main content

লিভিং টুগেদার2 শেষ অংশ 2

সন্দীপ পরপর উষ্ণতা মাখা মেসেজ পাঠিয়ে সর্বনাশের ভালোবাসার গোপন ঘরে ডাকে রুমকিকে।
  ভীষণ রাগ হয়,এদিকে ও বসে আছে পথ চেয়ে আর রুমকি এখন বরের আদর খাবে তা কি করে হয়? সন্দীপ জানে ওর কথার জাদু,কবিতা ভরিয়ে দিতে পারে যে কোন মেয়ের আবেগী মন।

      তবে রুমকি বেশ রহস‍্যময়ী। ধরি ধরি করেও ওকে ধরতে পারে না সন্দীপ। কাছে এসেও কাছে আসে না । অবশ‍্য এই ধরনের মহিলাদেরই বেশি পছন্দ ওর। একদিকে বিবাহিত কোন ঝামেলা নেই মানে ঘ‍্যানঘ‍্যান করবে না যে আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি চল বিয়ে করে ফেলি। তারপর ইনডিপেনডেন্ট মানে হাতে ঢালাও টাকা,সন্দীপ বিল পে করতে গেলে নারী স্বাধীনতার ঘন্টি বেজে ওঠে বুকের দরজায়। সুতরাং বেশিরভাগ বিল পে করে রুমকি। তারপর একঘেয়ে দাম্পত‍্যে অভ‍্যস্ত ডালভাত খাওয়া প্রেমে একটু বিরিয়ানির স্বাদ পেলে মন্দ কি?

         রুমকিকে বেশ কয়েকটা আদুরে মেসেজ করেও কোন উত্তর পায় না সন্দীপ। বুঝতে পারে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে নাহলে বরের সাথে বিছানার পুরোনো খেলায় মত্ত। মেজাজটা খিঁচড়ে যায় সন্দীপের সবে একটু জমে উঠেছিল প্রেমের অভিনয়টা একদম জল ঢেলে চলে গেল।
     নামের পাশে গোলাকার সবুজের সন্ধানে চোখ ঘোরাতে থাকে সন্দীপ। তোর্সাকে একটা টেক্সট করবে? অবশ‍্য তোর্সাটা গভীর জলের মাছ। প্রথমে কদিন ওর সাথে খুব কথা বলেছে। তারপর প্রোফাইল ঘেটে ওর ছবি দেখে বলেছে,' ও মা সন্দীপ তুই তো একদম বুড়িয়ে গেছিস! আমার না ঠিক এইরকম মাঝবয়েসী লোকদের ভালো লাগে না। আসলে আমার অনেক ইয়ঙ্গ বন্ধু। মাঝবয়েসী মানেই সেই সেক্স,আর প্রেমের চচ্চড়ি রাঁধা। আমি তো বিয়েই করিনি। নিজের রেপুটেশন খারাপ করতে পারব না।'
  সবে চল্লিশ পেরিয়ে এর মধ‍্যেই মাঝবয়েসী হয়ে গেল তোর্সার কাছে? রাগে গা জ্বলে যায় সন্দীপের। বিয়ে না করে নিজেকে এখন কচি খুকি ভাবছে তোর্সা। 

       নাঃ ভালো লাগছে না ঘুম আসছে না দুই চোখে। অনেকেরই ইনবক্সে উত্তেজক মেসেজের ফাতনা ফেলে সন্দীপ। নাহ্ কোন উত্তর নেই অথচ সবুজের আলো জ্বলছে। সবাই কি মরে গেল নাকি?

    হঠাৎই রীতা মেসেজ করে,' কি রে সন্দেশ, রসগোল্লার হাড়ি নিয়ে এই কানা রাতে বসে কি করছিস? তোর বৌ বকে না এত রাতে জেগে বান্ধবীদের মেসেজ করিস?'

 -' কথা বলতে ইচ্ছে করলে বল,হঠাৎই বৌ নিয়ে কথা কেন? বন্ধুত্বের মাঝে বৌ আসে কেন? আমাদের বন্ধুত্বটাই তো আগে ছিল।'
-' চিরকালই ছ‍্যাবলা রয়ে গেলি। এখন বয়েস যত বাড়ছে তত নিজের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস বাড়ছে তাই না? নিজেকে আবার সাজিয়ে প্রেমিকের জায়গায় দেখতে চাস নাকি? বলছি রাজন‍্যা কোথায়?'

      নেটটা অফ করে দেয় সন্দীপ,অসহ‍্য একদম।
রাজন‍্যার কথা বলে যে কি মজা পায় এরা জানে না। রাজন‍্যার কথা ভাগ‍্যিস রুমকি জানে না। 
  রীতাকে খুবই এড়িয়ে চলে সন্দীপ তবুও মাঝে মাঝে এসে উল্টাপাল্টা বলে যায় ওকে। আসলে একসময় রাজন‍্যার সাথে আলাপ ওর হাত ধরেই হয়েছিল।

      রাজন‍্যাকে কোনদিনই পাত্তা দেয়নি সন্দীপ। ওদের থেকে দুই ক্লাশ নিচে পড়ত। দেখার মধ‍্যে চোখদুটো ছাড়া আর তেমন কিছু ভালো ছিল না। ওর জেঠতুতো দিদি বাসবীকে সন্দীপ পছন্দ করত। মাঝেমাঝেই ওদের বাড়িতে গেছে আড্ডা মারতে,তখন রাজন‍্যাও আসত ওদের সাথে গল্প করতে। বাসবীকে তখনও সেভাবে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া হয়নি দেবে দেবে করছে। তার মধ‍্যে হঠাৎই একদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে বাসবীকে দেখেছিল শুভেনের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায়। রাগে অন্ধ হয়ে গেছিল সন্দীপ। দু নৌকাতে পা দিয়ে চলেছে বাসবী! একসাথে দুটো ছেলেকে নাচাচ্ছে?
     বাসবীকে জব্দ করার জন‍্য হঠাৎই রাজন‍্যাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিল সন্দীপ। খুব আত্মসম্মানে লেগেছিল বাসবীর,' তুই পোলাও ফেলে শেষে পান্তা খেলি। আর কোথাও বিয়ে করতে পারলি না। শেষে আমার খুড়তুতো বোকা বোনটাকে? আমার চোখের সামনে ঘুরবি ওকে নিয়ে?'

   -' বেশ করেছি,একসাথে কতগুলো সম্পর্ক চালাতে চাস? ভাগ‍্যিস আমি নিজের চোখে দেখে ফেলেছিলাম।'
-' কিসের সম্পর্ক? তুইও তো কতদিন আমাকে জড়িয়ে ধরেছিস। শুভেন যে ঐরকম করবে আমি জানতাম না। যাক যা করেছিস খুব ভালো। রাজন‍্যার সাথে ভেঙে দে বিয়েটা। আমার ইগোতে লাগছে। কি আছে ওর না রূপ না গুণ? কাকার অবস্থা খুব খারাপ। মা ভালোবাসে তাই আসে এই বাড়িতে।'

     উল্টে যাওয়া গেমটা আর সোজা করতে পারেনি বাসবী তবে সন্দীপকে সুখী হতে দেয়নি। জেদ চেপে গেছিল সন্দীপের বাসবীকে জব্দ করতেই হবে ও ঠকিয়েছে ওকে। তবে রাজন‍্যাকে নিয়ে সুখী হতে পারেনি ও। ভালোবাসাই ছিল না তো মাঝে। যদিও সন্দীপের মত ভালো পাত্র পেয়ে এক কথাতেই রাজি হয়ে গেছিল রাজন‍্যার বাবা মা। অসুখী সন্দীপ এখন সবার সুখে আগুন জ্বালাতে চায়।
    রাজন‍্যাকে কোনদিন চায়নি সন্দীপ শুধু বাসবীকে জব্দ করতে বিয়ে করেছিল রাজন‍্যাকে। উঁচু পদে কাজ করা সন্দীপ। বাসবীর খুড়তুতো বোন নিম্ন মধ‍্যবিত্ত পরিবারের। নিজের যোগ‍্যতার সাথে কোথাও মেলাতে পারেনি রাজন‍্যাকে।
    যদিও সন্দীপের মা ভালোবেসে ফেলেছিলেন রাজন‍্যাকে। কিন্তু সন্দীপের ভালোবাসা তেমন করে কোনদিন পায়নি রাজন‍্যা। একটা সময় কারণটা জানতে পেরেছিল রাজন‍্যা অদ্ভুতভাবে ভেঙে পড়েছিল ও,' তুমি আমাকে ব‍্যবহার করেছিলে দিদিকে জব্দ করার জন‍্য? ছিঃ ছিঃ কোনদিন আমাকে ভালোবাসনি তুমি!'
    অবহেলার অন্ধকারে ডুবে গিয়ে প্রায় আধপাগল হয়ে গেছিল রাজন‍্যা। সন্দীপ সবার কাছে বলে বেরিয়েছিল রাজন‍্যা পাগল। ও একটা অসুখী মানুষ।

       অনেকেই সন্দীপকে বিশ্বাস করেছিল। শুধু সত‍্যিটা জানত মাত্র কয়েকজন। 
        এখন সন্দীপের অভ‍্যেস হয়ে গেছে সুখের ঘরে একমুঠো অসুখ ছড়িয়ে দেওয়া। নিজের না পাওয়া দিতে ভাঙতে চায় অনেকের সুখের স্বর্গ। অনেক আগে পুরোনো বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া রুমকি সন্দীপের মিথ‍্যেটাকে সত‍্যি বলেই দেখেছে এতদিন। মনে হয়েছে হয়ত সত‍্যিই অসুখী সন্দীপ।

*********************
 খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেছে আজ মুনিয়ার। কালকে রাতে অনেক রাতে ঘুমোলেও আজ ভোরের আলো চোখে লাগতেই উঠে পড়ে মুনিয়া। বাইরে এসে দাঁড়ায়। তখনও শহরের ঘুম ভাঙেনি তেমন করে। আদরে গাছেদের গায়ে হাত বোলায় মুনিয়া একটু তারপরে চেয়ারে বসে। সামনের গাছটায় অসংখ‍্য পাখির কিচিরমিচির। সামনের রাস্তায় অনেকে তখন হাঁটছে। রাণা থাকতে মাঝে মাঝে দুজনে সকালে বেরোত হাঁটতে এখন অনেকদিন আর বেরোনো হয় না মুনিয়ার। হঠাৎই চমকে ওঠে মুনিয়া, সামনের রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে ওর খুব পরিচিত কেউ।
      মুনিয়ার অবাধ‍্য চোখদুটো সন্দেহকে সত‍্যি করার জন‍্য আবার তাকিয়ে দেখে। হ‍্যাঁ ঐ তো প্রমোদ,ওর টানটান চেহারা লম্বা চুল সবই খুব চেনা মুনিয়ার। তাহলে প্রমোদ কি এদিকেই থাকে? না কি এতটা রাস্তা পেরিয়ে এখানে এসেছে শুধু ওর বাড়ি এখানে বলে?

     রোজ প্রমোদের চোখ পড়ে বারান্দায়। ওর জানা হয়ে গেছে মুনিয়ার বারান্দার হদিস। হয়ত মুনিয়ার বারান্দার বোগেনভেলিয়ারা হাতও নাড়ে ওকে। কিন্তু আজ প্রমোদ না তাকিয়েই বুঝতে পারল আজ শুধু বোগেনভেলিয়া নয় তার মাঝে দাঁড়িয়ে এই বারান্দার বাসিন্দা। যে হঠাৎই অবাক হয়েছে প্রমোদকে এই পথে দেখে।

    ঘরে চলে আসে মুনিয়া। সত‍্যিই এখন খুব রাগ হচ্ছে ওর আর ও এখানে থাকবে না। রাণাকে সব বলবে প্রমোদের কথা। বলবে ওকে এখান থেকে নিয়ে যেতে। কেন যে রুমকিদির সাথে আলাপ হয়েছিল কে জানে? আজ প্রমোদকে যেন বেশি করে আবার চেনালো রুমকিদি। রুমকিদি না থাকলে কে জানতে পারত এই শহরের কোন কোণে মুনিয়া আছে বাসা বেঁধে।

     বারান্দা থেকে চলে আসে মুনিয়া। নাহ্ এবার ওকেই একদিন রুমকিদির সাথে কথা বলতে হবে। শেষ পর্যন্ত প্রমোদ ওর বাড়ির রাস্তাতেও হাঁটতে শুরু করেছে? জাস্ট অসহ‍্য।

    ভেতর থেকে এক অদৃশ‍্য শক্তি আবার মুনিয়াকে কুল হতে বলে। নিজের কাজ নিয়ে ভুলে গিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করে মুনিয়া।

**********************

     সকালে ঘুম থেকে ওঠার একটু পরেই সোহিনীদির ফোনটা পায় ঝুমকা। অবাক হয় সোহিনীদি আবার কেন? আজ তো ওর অফ ডে। হয়ত বলবে প্লিজ আয় একবার দেরিতে হলেও।
   সত‍্যিই একসাথে দুটো সামলাতে আজকাল হিমসিম খাচ্ছে ঝুমকা। কিন্তু সোহিনীদির উপকারের কথা ভেবে না খরতে পারছে না কিছুতেই।
-' হ‍্যালো বল দিদি।'
-' তুই খবরের কাগজ নিস?'
-' না নিই না তো। কে পড়বে কাগজ? মা পড়বে না,আমার সময় হয় না। কেন কি হয়েছে গো?'
-' একটা খবরে চোখ আটকালো আমার, পুলিশ তদন্ত করছে বলছে। ধৃতের নাম মৈনাক। অনেক বিয়ে করেছে। এক নারী পাচারচক্রের সঙ্গে যুক্ত। '
   কথাগুলো শুনে কেমন যেন হাত পা কাঁপতে থাকে ঝুমকার। যে আশঙ্কায় দিনের পর দিন ও ঘরে লুকিয়ে থেকেছে। রাতে ঘুমোয়নি। সেটাই সত‍্যি হল অবশেষে?
 ' ছবি দিয়েছে গো লোকটার? জানি না এই সেই শয়তানটা কিনা? ছবি দেখলে চিনতে পারতাম।'
-' নাহ ছবি নেই রে কোন। তবে আমার মনে হচ্ছে এই মৈনাকই সেই মানে তোর শয়তান বরটা। বেশ হয়েছে।'
  খবরটা শুনে ভীষণ ভয় লাগে ঝুমকার, পুলিশ যদি ওকেও জিজ্ঞাসাবাদ করার জন‍্য ধরে নিয়ে যায় তাহলে কি হবে?
 -' আমার ভীষণ ভয় করছে গো দিদি,যদি আমাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ? অনেক কষ্টে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি গো।'
-' আমরা আছি তো সাথে শুধু শুধু তোকে ধরে নিয়ে যাবে কেন? একটুও ভয় পাস না। আমাদের পুরো দল আছে তোর সাথে।'
   সোহিনীদির সাথে কথা বলার পর কেন যেন অদ্ভুত একটা মন খারাপে ভেসে যায় ঝুমকা। তবে পেপারটা ওকে দেখতেই হবে তাই ওর বুটিকের মেয়েটাকে পাঠায় মোড়ের মাথা থেকে পেপারটা আনতে।

      খবরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে ঝুমকা। হ‍্যাঁ মনে তো হচ্ছে এই সেই মৈনাক। কে জানে ওর সর্বনাশ করার পর আরও কতগুলো বিয়ে করেছে শয়তানটা?
     ও প্রতিবাদ করেনি ভয়ে,ওর পেছনে তখন কেউ ছিল না। অন‍্য কেউ ছাড়বে কেন ওকে? খুব ভালো হয়েছে। এতদিনে শয়তানটা শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু ওকে যদি ডাকে পুলিশ? ওরা কি এখান থেকে চলে যাবে কৃষ্ণনগরে?

***************************

মুনিয়া অফিস থেকে ফিরতেই রাণা ফোন করে,' গুডনিউজ পেয়েছিস?'
  -' কি খবর?'
-' পুতুলের মেয়ে হয়েছে। তোদের চিন্তা একদম ঠিক। ঠাম্মা একদম কারেক্ট।'
   মুনিয়ার একটু অভিমান হয়। মুনিয়ার বন্ধু পুতুল অথচ ওকে খবর না দিয়ে রাণা খবর পেল?
-' কেন এত সেন্টিমেন্টাল হচ্ছিস? পুতুল তো এখনও নার্সিংহোমে। কৌশিক আমাকে মেসেজ করেছে বলেছে তোকে বলতে। অফিসে আছিস বলে ফোন করেনি।'
   কেন যেন আজকাল একটুতেই মন খারাপ হচ্ছে মুনিয়ার। রাণা বুঝতে পারে তাই মজা করে বলে সবই হচ্ছে অনেকদিন বরের আদর না খাওয়ার ফল। তুই আমাকে মিস্ করছিস বাট বলছিস না।
    মুনিয়ার চোখটা ছলছল করে অনেক কিছু তো বলতে চাই কিন্তু কেন যেন বলতে পারছি না। যদি তুই আমাকে ভুল বুঝিস। যদি আমাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। তাই নিজেকে সামলে বলে,' মিস্ তো করছিই। কবে আসবি শুনি? আমার কিছু ভাল্লাগে না।'

-' আমারও কিছু ভাল্লাগে না,এত দূরে রয়েছি ওদিকে আমার আদুরে বৌটা কাঁদছে কারো ভালো লাগে নাকি? এবার ওখানে গেলে একটা ব‍্যবস্থা করে আসতে হবে। যাতে তোর ভালো লাগে।'
-' কি ব‍্যবস্থা শুনি? চাকরি ছেড়ে চলে যাব তাই তো?'
-' আমি কখন বললাম সেটা? ঐ জুনি আর পুতুলের মত আমাদেরও একটা বেবি আনতে হবে দেখছি। অবশ‍্য তুই একা এত কিছু পারবি না। তাহলে...'
-' তাহলে কি শুনি? শখ মন্দ নয় বেবি একা আমি সামলাব!'
-' তাহলে একটা বয়ফ্রেন্ডের ব‍্যবস্থা করতে হবে। যে তোকে অফিসে পৌঁছে দেবে,গল্প করবে তোর সাথে।'

     খুব রাগ হয়ে যায় মুনিয়ার বলে,' আমি বয়ফ্রেন্ড জোগাড় করে নেব। তখন বুঝবি কি হয়?'
-' প্লিজ মুনিয়া, আমি জাস্ট জোক করছিলাম। এমন করলে আমাকে মরতে হবে এবার।'

    মুনিয়া বুঝতে পারে কথায় কথায় অনেকটা মজা করতে করতে কিছুটা সত‍্যি বেরিয়ে এসেছে। প্রমোদের ফিরে আসাটা রাণা কিছুতেই নিতে পারবে না।

      মুনিয়া পাখি মনের জানলা ফাঁকা করে আরেকবার জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,' সব ভুলতেই হবে আমাকে। সব ভুলে ভালো থাকতে হবে। কিন্তু প্রমোদ কেন বারবার ওর মনের আয়না ভেঙে ফিরে ফিরে আসতে চায়?


***********************

  কদিন ভয়ে ভয়ে কাটছে ঝুমকার কিছু দুঃশ্চিন্তা কারো সাথে বোধহয় ভাগ করে নেওয়া যায় না। নিজেকেই কুড়ে কুড়ে খায়। সোহিনীদি ওর কালো মুখ দেখে বকুনি দিয়েছে। তবুও শুধু মনে একটা ভয়। ফোনটাকে মাঝে মাঝেই দেখে কোন ফোন এলে ধরতে ভয় পায়। দুপুরের দিকে একটা ফোন এল হঠাৎই ঝুমকা ফোন ধরে যা শুনল ওর মন ভয়ে কেঁপে উঠল।
  ' হ‍্যালো আপনাকে একবার ভবানীপুর থানায় আসতে হবে।'
   ঝুমকা কারণ জিজ্ঞেস করতেই যা উত্তর পেল সেই ভয়েই ওর দিন কাটছিল কদিন ধরে। অনেকদিন বাদে আবার হাউহাউ করে কাঁদলো ঝুমকা আমার কি কোন পরিত্রাণ নেই? একটা ভুলের মাসুল আর কতদিন ধরে গুনব আমি?
    তাড়াতাড়ি সোহিনীদির কাছে ফোন করে ঝুমকা।
সোহিনী শুনে অবাক হল,' তুই কিছু বললি না কেন? মানে তুই ওর সাথে থাকিস না কোন সম্পর্ক নেই তোদের।'
-' বলেছি গো সব,কিছুতেই শুনবে না। বলল কোন চিন্তা নেই। কিন্তু আসতেই হবে। আমি তো প্রথমেই বলেছিলাম আমি চিনি না মৈনাককে।'

     সোহিনী আর ওদের দলের দুজন ঝুমকার সাথে যায় এইজন‍্য ওদের হাত ছাড়েনি। 
   বুকের ভেতরটা দুমরে মুচড়ে যায় ওর। কি দেখবে কে জানে? সেই গোয়ার ঘটনার পর ওকে আর দেখেনি।

   -' কি বলব বল তো? '
-' মিথ‍্যে কিছু বলবি না। যা সত‍্যি তাই বলবি। মনে সাহস রাখ শয়তানটা যেন ছাড়া না পায় কিছুতেই আমরা তো আছি সাথে।'

        এমন দিন যে কখনও জীবনে আসবে ভাবেনি ও। আজ গরাদের ভেতরে মৈনাক আর বাইরে ঝুমকা। একটা সময় ওকে গরাদের ভেতরে রেখে মৈনাক চলে গেছিল।

        মৈনাকের দৃষ্টিতে আজ যেন এক অন‍্য অনুভূতি মাখানো। কালি পড়েছে চোখের তলায় কয়েকদিনের দাড়ি গালে। সেই জৌলুস আর নেই চেহারার মধ‍্যে।
  ও বোধহয় চায় ঝুমকা ওর সম্বন্ধে খুব ভালো ভালো কথা বলুক।
    পুলিশের জেরায় সব বলে দেয় ঝুমকা। অনেকদিন আগে মৈনাকের বিরুদ্ধে ও থানায় অভিযোগ করেছিল সে কথাও জেনেছে পুলিশ।
  -' কোন ভয় পাবেন না,সকাল থেকে তিনটে বৌয়ের সাথে কথা বললাম শয়তানটার। আপনি তিন নম্বর। এরপরে আরো দুজন আসবে। মেয়ে পাচার,নোংরা ভিডিও, ব্ল‍্যাকমেলিং আরও কত কি যে করেছে শেষ নেই তার।'

       -' ও বেরোলে আমাকে বাঁচতে দেবে না।'
-' আগে বেরোতে পারবে তবে তো। এখন বাড়ি যান দরকারে ডাকা হবে।'

    যেতে যেতেও একবার ওর অতীতের স্বপ্নের কালপুরুষকে তাকিয়ে দেখে। মৈনাকের চোখদুটো দেখে কেমন যেন ভয় হয় ঝুমকার। মনে মনে বলে এই নরকে পচে মর তুই শয়তান।

       বাড়িতে গিয়ে সেদিন ভালো করে খেতে পারেনি ঝুমকা অদ্ভুত একটা ভয় আর মন খারাপ হয়েছিল। তবে তারপর আদালত চত্বরে অনেকবার গেছে ঝুমকা। খোঁজ রেখেছে মৈনাকের কেসটা কি হল? মনে মনে চেয়েছে ও শাস্তি পায় যেন।
       দুদিন কোর্টের ভিড়ে বোরখা পরে এসেছিল ঝুমকা যাতে মৈনাক ওকে চিনতে না পারে। কিন্তু কৌতূহল ওকে বাড়িতে থাকতে দেয়নি। 

     এই করে অনেকদিন বিউটিপার্লারে যাওয়া হয়নি ওর। সোহিনীদি বকেছে,' কাজে থাক ঝুমকা। কি ভাবিস এত? একদম ভয় পাস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।'
    ভয়টা সত‍্যিই কেটে গেছে ঝুমকার এখন শিকারীর চোখ দিয়ে রেখেছে কখন শাস্তি হবে শয়তানটার। সরকারী পক্ষের হয়ে সাক্ষী দিতে হয় ঝুমকাকে। ও প্রথমে রাজি হয়নি। সোহিনীদি বলে,' ফিরে দাঁড়া তুই ভয় পাস না। মৈনাক বুঝুক ঝুমকা আজ শক্ত ইস্পাত আর মাটির দলা নয়।

            

মাঝে বেশ কয়েকদিন পার্লারে আসেনি ঝুম। আজ অনেকদিন বাদে এসেছে তবে সাথে মিস্টি নিয়ে। সোহিনী কারণটা জানলেও আর কেউ জানে না। সকালে মন্দিরে পুজো দিয়ে প্রসাদের অনেকটা মিস্টি নিয়ে এসেছে। আসামী স্বামীর শাস্তিতে আশ্বস্ত ঝুমকা মনের শান্তি খুঁজেছে পুজো দিয়ে। অনেকগুলো বছরের সাজা হয়ে গেছে মৈনাকের এখন হয়ত ঝুমকে আর ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না অন্ততঃ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে। তবে শান্তির মাঝেও কিছু অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তা তাড়া করে ঝুমকাকে। সত‍্যিই মৈনাক জেলে থাকবে তো? নাকি কোন উপায়ে বাইরে বেরিয়ে এসে ওকে আবার? হঠাৎই ভয় লাগে আবার ঝুমকার। মৈনাক অনেকদিন বাদে ওকে দেখে কোর্টে অনেক ভালোবাসার কথা বলছিল,ও নাকি খুব সুখে রেখেছিল ঝুমকাকে। ভরে দিয়েছিল ওকে। কেমন ভাবে ভরে দিয়েছিল তা বলেছিল ঝুমকা যার ভার এখনও বয়ে চলেছে ও।
   তবুও বাঁচতেই হবে ওকে এখন আর কারো জন‍্য নয় শুধু নিজের জন‍্য বাঁচতে চায় ঝুমকা। নিজের ছোট ছোট স্বপ্নগুলো গুছিয়ে রাখতে চায়। থাকতে চায় একটু নিজের মত।

      ********************

   প্রায় ছমাসের বেশি হয়ে গেল সন্দীপ আর বাড়ি মুখো হয়নি। মাসের দশ তারিখের মধ‍্যে কিছু টাকা পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করে। রাজন‍্যাকে মা কেন যে পছন্দ করে জানে না সন্দীপ। বিয়ের পর থেকেই রাজন‍্যা সম্বন্ধে সব আগ্ৰহ হারিয়েছে সন্দীপ। বাসবীকে বুঝিয়ে দিয়েছে সন্দীপ চাইলে সব করতে পারে। বাসবীকে শেষ পর্যন্ত শুভেনকেই বিয়ে করতে হয়েছে আর কোন উপায় নেই। অসুখে সুখ খুঁজে মোটামুটি টিকে গেছে বাসবী শুভেনের সাথে। বাঁদরের গলায় মুক্তার হার মনে হত একটা সময় সন্দীপের এখন মনে হয় বাঁদরের গলায় বাসবী গাঁদার মালা। অন‍্য সবার ঘরে উঁকি দিলেও বাসবীর সাথে আর কোনদিন কথা হয়নি। সন্দীপ নিজেকে ফাঁকি দিতে চাইলেও মন বলে যায় মাঝে মাঝে বাসবীকে সত‍্যিই ও ভালোবাসত তাই বোধহয় ওর বিশ্বাসঘাতকতা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি।
     সত‍্যিই বলতে তো রাজন‍্যার কোন দোষ ছিল না,শুধু শুধু কষ্ট পেল মেয়েটা। প্রিয় জেঠিমা ওকে আর দেখতে পারে না। যে ছেলের সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ের কথা হয়েছে তাকে পটিয়েছে ঐ মেয়ে সুতরাং ক্ষমা নেই তার। 
     ফাঁকা বিছানায় একা শুয়ে নিঃশ্বাস ফেলে রাজন‍্যা সত‍্যিই ও কখনও ভাবেনি দিদির সাথে সন্দীপের প্রেম আছে। দিদির কত বন্ধুই তো আসত বাড়িতে।
              সন্দীপকে খোঁজে রাজন‍্যা, ভাবে কোনদিন হয়ত ঠিক হয়ে আবার ওর কাছে ফিরবে সন্দীপ। ভাবতে ভাবতে ঘুমের ওষুধ খাওয়া রাজন‍্যার চোখদুটো জড়িয়ে আসে। পাশের ঘর থেকে মা ডাকেন,' বৌমা ঘুমোলে নাকি? একটু পাখাটা অফ করে দাও শীত করে।'
   রাজন‍্যা সন্দীপের কেয়ারটেকার কাম আয়া। একদিক দিয়ে ও আছে বলেই অনেক নিশ্চিন্তে আছে।
   শুধু ওর পাশে বাসবীকে ভাবলেই কেমন যেন রাগ হয়।
    ডাক্তারের কাছে এসেছে রাজন‍্যা,এখন অনেকটা ভালো আছে তবুও মেডিসিন সাপোর্ট নিতে হয়। ভালোবাসা বিহীন জীবনে সন্দীপের পোড়া ভালোবাসার গল্প শুনে হাফিয়ে উঠেছিল রাজন‍্যা। একটু একটু করে অবসাদে ডুবে গেছিল। সন্দীপ না থাকাতে বরং কিছুটা ভালো আছে রাজন‍্যা।

     ওখানেই হঠাৎ দেখা হয়ে গেছিল অগ্নিভর সাথে। ওর স্কুলের বন্ধু এখন মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ।
   অগ্নিভ সন্দীপের মত সুখের ঘরে হানা দেয় না। অসুখের ঘরে সুখের চাবিকাঠি ছোঁয়াতে চায়।
-' রাজন‍্যা না? ঠিক ধরেছি।'
 রাজন‍্যা না চেনার ভান করে। মানসিক রোগের চিকিৎসা করাতে এসেছে এখানে দেখা বন্ধুর সঙ্গে?
   -' আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না তো..'
-' আর কত দেখাবি? বড়লোক হলে বোধহয় এমনি হয় সবাই। ওষুধের ফেরিওয়ালা বন্ধুকে চিনতে চায় না। ভুলে গেলি তো? আমার কিন্তু মনে আছে অঙ্কের খাতায় কবিতা লেখা আর ছবি আঁকা রাজন‍্যাকে।'

    আর আটকাতে পারেনি অগ্নিভকে রাজন‍্যা। ওখান থেকে বেরিয়ে একটা ছোট দোকানে বসে কাঁচের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে অসুখের কথা বলেছিল রাজন‍্যা।
 ' একা শাশুড়িমা নিয়ে থাকি তো কেমন যেন অবসাদ।' চোখটা জলে ভরেছিল। ঝরে না পড়া চোখের জল অনেক কিছু বলে যায়। ওষুধের ফেরিওয়ালা অগ্নিভ এনেছিল ওকে মনসিজে। একটু একটু করে রাজন‍্যা খুঁজে পেয়েছিল নিজেকে। সন্দীপের অগোচরেই রাজন‍্যা সুস্থ হয়ে উঠেছিল। সন্দীপদের উঠোন ভর্তি রাজন‍্যার গাছ বন্ধুদের দল। ছাদের ঘরে একটা একটা করে জমছে ওর আঁকা। বিছানার পাশে রাখা খাতায় পরপর আসছে হারিয়ে যাওয়া কবিতারা। একটু একটু করে সব পেয়েছির দেশে লেখা চিঠির উত্তর আসছে রাজন‍্যার তালা দেওয়া ডাকবাক্সে। সন্দীপের অবহেলাটুকু সঙ্গী করেই ভালো থাকতে শিখেছে রাজন‍্যা কারণ অগ্নিভর মত ভালো বন্ধু ওর আছে।
   সব পুরুষই সন্দীপের মত হয় না যারা ইশারায় আমন্ত্রণ করে সর্বনাশের পথে হাঁটতে। অনেকেই বাঁচায় সর্বনাশের হাত থেকে।

    রাজন‍্যার মন পাখনা মেলেছে এক মুঠো রোদ ধরতে, গাছেদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গুনগুন করে গায়। গান আর কবিতারা এখন ঘোরাঘুরি করে ওর মনের আসেপাশে।
     সন্দীপের মা নিঃশ্বাস ফেলে ভাবেন অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছেলেটাকে নষ্ট করল। ঘরে এত ভালো একটা বৌ থাকতে মন টেকেনি ছেলের।

**************************

       সন্দীপের মনের আসেপাশে রুমকি ঘোরে আজকাল সারাক্ষণ। বাগে এনেও কেন যেন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে সব কিছু। বর না থাকার সময় সন্দীপকে নানা ভাবে কাজে লাগিয়েছে রুমকি আর এখন বর এসে যাওয়াতেই প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এই হচ্ছে এক নাটক মেয়েদের। শুধু বন্ধু চাইলেই তো হবে না তাকে তো সময়ও দিতে হবে। রুমকির ঐ ভরাট ঠোঁটে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে সন্দীপের। মেসেজ করলে বলে কত বাওয়াল আর করবি। মাঝবয়সী প্রেমটাকে একটু আগলে রাখ যে কোন ঠোঁট দেখলেই তোর ডুব মারতে ইচ্ছে করে? তোর এদেশে জন্ম না হয়ে ও দেশে হলেই ভালো হত। যখন তখন ডুব মারতিস।
    এত প্রেম তোর শুধু বৌটা বুঝল না। বৌয়ের কথা শুনে গা জ্বালা করে সন্দীপের শুধু বলতে পারল না আমার সুন্দরীদের দেখলেই প্রেম জাগে। ওকে দেখে জাগে না।

       -' সবাই যদি সব বুঝত তাহলে শাহজাহান সব বেগমের জন‍্যই একটা করে তাজমহল,সাজমহল,পেঁয়াজ মহল বানাত। শুধু মমতাজকেই প্রাধান্য দিত না।'
       সন্দীপকে এড়াতে চাইলেও প্রতিদিনই ওর মেসেজে রুমকির ফোনবাক্স ভরে আবার সেটাকে খালি করে ফেলতে হয়।

******************************
  আজকাল মাঝে মাঝেই ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায় মুনিয়ার কেন জানে না। আবার হয়ত বা কিছু খোঁজার জন‍্য। ঘুমভাঙা মুনিয়া বারান্দায় এসে না দাঁড়ালেও বেডরুমের পর্দা তুলে রাস্তায় চোখ রাখে। প্রমোদ কখনও হেঁটে যায় আপন ছন্দে। শরীরচর্চার আনন্দে নাচে ওর ঝাঁকড়া চুলও।
             তবে প্রমোদ আর আজকাল বারান্দায় তাকায় না আপনমনেই হেঁটে যায়। মুনিয়া ভাবে হয়ত ওকে সেদিন বারান্দায় দেখেছে । ভোরবেলায় হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছুরই মিঠে কড়া লুকোচুরি খেলায় কেউই কখনও ধরা দেয় না কাউকে।
    একরাশ বিরক্তি মনে থাকলেও মুনিয়ার অবাধ‍্য চোখজোড়া মাঝে মাঝেই ভোরবেলা জেগে ওঠে কৌতূহলে। আজও কি সে এসেছে? কেন বারবার আসে এই রাস্তাতেই প্রমোদ? 



*****************************
  
      এদেশে এসে কাজ আর পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়েছে বেশ রাণা। অনেকের সাথে আলাপ হয়ে বেশ সময় কেটে যায়। ভালো কিছু দেখলেই মুনিয়াকে ছবি তুলে পাঠায়। মনে মনে পৌঁছে যায় মুনিয়ার কাছে ওদের ছোট্ট নিড়ে।
     মাঝে মধ‍্যেই মিস্ করে মুনিয়াকে,মা বাবা বোনকে আর নিজের দেশের মাটির গন্ধকে। সবই সাজানো গোছানো সুন্দর এখানে তবুও কি যেন মিসিং। মাঝে মাঝেই মনটা উতলা হয়ে যায়। একা একা মুনিয়া সব কি করে সামলাচ্ছে? কাজের অভ‍্যেস খুব একটা ছিল না ওর। অফিসে যাওয়া আসাই বা কি করে করছে?
    সবসময় বলে ঠিক আছি আমি অত ভাবিস না। যদি অত ভাবিস তো চলে আয় থাকতে হবে না ওখানে। যে কথা মুনিয়া সহজে বলে রাণা বলতে পারে না। শান্তা ভেবেছিল কিছুদিন একা থাকার পর হয়ত মুনিয়ার মন ফিরবে। একসাথে দুটো থাকলে মনে একটা শান্তি পাওয়া যায়। এখনকার ছেলে মেয়েগুলো সব সৃষ্টি ছাড়া। একা একা থাকে সব কি যে করে কে জানে? একা থাকবি তো বিয়ে করা কেন বাপু? বিয়ের পর এই সংসারে এসে কখন যে এটাই বাড়ি হয়ে গেছিল বুঝতেই পারেনি। আজকাল মনে হয় এই বাড়ির এত নিয়মকানুন পুজো আচ্চা সব বোধহয় একটা সময় বিলীন হয়ে যাবে কালের নিয়মে কিছুই করার নেই। ছেলেমেয়েরা ভালো পড়াশোনা শিখে কি করে থাকবে বাড়িতে? বাইরে তো যেতেই হবে। তবুও মেয়েটা বাড়িতে আছে বলে অনেকটা জমজমাট বাড়িটা। ছেলের কথা খুব মনে হয় শান্তার। আজকাল ভালো মন্দ কিছু রাঁধতে গেলেই ওর কথা মনে পড়ে খুব।

     বেশ কয়েকদিন রুমকিদির সাথে দেখা হয় না মুনিয়ার হয়ত একদিকে ভালোই। রুমকিদির সাথে দেখা হলেই কোন ভাবে প্রমোদের কথা চলে আসে। 

         ভোরে ঘুম ভাঙলে অনেকদিনই মুনিয়ার চোখে প্রমোদ ধরা পড়েছে। তবে সবদিন ঘুম ভাঙে না। দেরিতে ঘুম ভাঙলেও বারান্দায় এসে দাঁড়ায় অভ‍্যেসে মুনিয়া গাছেদের পরিচর্যা করে নিজের মত। মাঝে কদিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে জানলায় চোখ রেখেছে মুনিয়া। প্রমোদকে কদিন দেখেনি মুনিয়া। কিছুটা শান্তি আর কিছুটা অস্বস্তির মিশেল মুনিয়ার মনে। ভালো হয়েছে হয়ত এই পথ পাল্টেছে প্রমোদ। আবার অবচেতন মনে একটু দুঃশ্চিন্তাও হয় মুনিয়ার। পরমুহূর্তেই নিজেকে শাসন করে যে ছেলেটা একদিন ওকে নিয়ে কোন চিন্তা করেনি হঠাৎই ওকে নিয়ে এত মাথাব‍্যথা কেন মুনিয়ার? তবুও মুনিয়ার মনে কাজের ফাঁকে এলোমেলো চিন্তার মিশেল কি জানি হয়ত চলে গেছে এখান থেকে নিজের শহরে।

    প্রমোদ হয়ত ওকে কিছু বলতে চেয়েছিল শোনার প্রয়োজন বোধ করেনি মুনিয়া। রুমকিদি কিছু বলতে চেয়েছিল ওর জন্মদিনের রাতে তারপর দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে আর অপেক্ষা করেনি।
    একটু কি বেশিই নিজেকে কঠোর করে প্রমোদকে ইগনোর করেছে মুনিয়া? নাকি ওর আচরণ প্রমোদকে বুঝিয়ে দিয়েছে আজও ওকে ভুলতে পারেনি মুনিয়া।
     সত‍্যিই তো ভুলতে পারেনি ওকে মুনিয়া। জীবন থেকে ভালোবাসার পাঁচটা বছর কি মুছে ফেলা এতই সহজ! প্রথম ভালোবাসা, প্রথম ছোঁয়া,প্রথম আবেগ আর প্রথম ভালোলাগার অনুভূতি মনের গোপনে আজও আছে উজ্জ্বল প্রতিমুহূর্ত এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে মন কোন এক গোপন কুঠুরিতে এক চোরা বাক্সে। তবে চোরাই বা কেন? রাণার কাছে তো কত কান্নাই কেঁদেছে প্রমোদের খারাপ আচরণে। রাণাও ঝুমকে দেখে ওর রাগ প্রকাশ করেছিল ওর কাছে।

      প্রমোদের সাথে দেখা না হলে হয়ত একটু একটু করে নিজেকে মেরামত করে ফেলতে পারত মুনিয়া। কিন্তু ওর মন দেওয়ালের শক্ত কাঠামোটা বানানোর আগেই প্রমোদকে দেখার ঝোড়ো হাওয়া আর মুশলধারে বৃষ্টি সব এলোমেলো করে দিল। মনে না করতে চাইলেও প্রতি ভোরের লুকোনো অভ‍্যেসে জড়িয়ে গেছে প্রমোদ। ওকে খুঁজতেই যেন পরপর পাঁচদিন সকালে উঠেছে তাড়াতাড়ি মুনিয়া। কিন্তু প্রমোদ আসেনি আর। প্রমোদ এখন পরপুরুষ লোকে শুনলে ওকে ছি ছি করবে। কিন্তু পরপুরুষ হলেও নিজের জীবনের প্রথম পুরুষকে মিস্ করল মুনিয়া।

          রুমকিদিকে অনলাইনে দেখে রাতে মেসেজ করে মুনিয়া। টুকটাক কথা হয়। কিন্তু প্রমোদের কথা কিছু বলতে পারে না মুনিয়া। রুমকিদিও আজ অদ্ভুতভাবে কোন কথা বলে না প্রমোদের সম্বন্ধে। বাবলি আর প্রবালদা বারবার আসে ওদের গল্পে। রাণার কথা জিজ্ঞেসা করে ওকে। কবে আসবে রাণা? সংসারের টুকটাক গল্প করে ওর সাথে। কিন্তু ভুলেও একবারও প্রমোদের কথা নয়। মুনিয়া ভেবেছিল নিশ্চয় একবার হলেও পুরোনো অভ‍্যেসে পুরোনো কথায় আসবে রুমকিদি। প্রমোদকে মিস্ করলেও কোধ কথাই বলতে পারে না রুমকিদিকে মুনিয়া। তবে বুঝতে পারে খারাপ কিছু হয়নি নিশ্চয় ভালোই আছে। এমনি তো ওর স্বভাব আর কিই বা হতে পারে? হয়ত বা বাড়িতেই গেছে।

       বেশ কিছুদিন বাদে দিন পনেরোর ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে প্রমোদ। মধু খুব একটা এখানে থাকে না। বাপের বাড়িতেই থাকতে পছন্দ করে। ও এসেছে বলে এখানে এসেছে। বড়লোক বাবার আদুরে মেয়ে মধু শ্বশুরবাড়িতে খুব একটা পোষায় না। ওর বাবার লাডলী বিটিয়া সুতরাং মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে একটুও ভালো লাগে না এম এল এ রাঠোর প্রসাদের।মধুর সাথে ওর বিয়ে হবে কখনই ভাবেনি প্রমোদ। সত‍্যি বলতে তখন বিয়ে করার কোন প্ল‍্যানই ছিল না শুধুমাত্র বাবার কথার অবাধ‍্য হতে পারেনি প্রমোদ। অন‍্যসময় হলে হয়ত বিদ্রোহ করত। তবে তখন সেইরকম কোন পরিস্থিতি ছিল না। বাড়িতে তখন তুমুল অশান্তি। তাই বাধ‍্য হয়েই তখন বিয়ে করতে হয়েছিল মধুকে। ও রাজি না হলে কি হত জানে না ও। মুনিয়ার কথা কোনদিনই সাহস করে বাড়িতে বলতে পারেনি। নিজেকে আজকাল নিজেরই করুণা করতে ইচ্ছে করে প্রমোদের। প্রবাল ভাইয়ারা বাঙালী তাও ভাবীকে নিয়ে অনেক কথা বলেছিল মা। সবই শুনত আর ভাবত যখন মুনিয়া এ বাড়ির বৌ হয়ে আসবে কি জানি কি সমস‍্যা হবে? যা হয় হোক,দরকারে বাড়িতে থাকবে না।
      একটা সময় মুনিয়াকে বাড়ির বৌ করার স্বপ্ন দেখলেও সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেছিল যখন ওর ছোট বোনের প্রেম হয়েছিল মধুর ভাইয়ের সাথে।

       বাড়িতে যখন জানাজানি হল সবটা তখন সাঙ্ঘাতিক অবস্থা বাড়িতে। ওর ছোট বোন বেবি তখন প্রেগনেন্ট, বন্ধ ঘরে অশান্তি চলছে। ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয় প্রমোদের। জানা গেল স্থানীয় নেতার ছেলে রাজিন্দরের সাথে ওর প্রেম। অথচ জল এতদূর গড়িয়ে গেছে কিন্তু কেউ জানে না। তারপর বাড়িতে শুধুই লজ্জা আর দমবন্ধ করা অশান্তি। 
       রাজেশকে চাপ দিল ওরা বিয়ে করার জন‍্য। রাজিন্দর অস্বীকার না করলেও বলে দিল বাবা মানছে না আর বাবা না মানলে ওর পক্ষে বেবিকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। কারণ ও কোন কাজ করে না।ওর সাথে হাতাহাতি হয়েছিল প্রমোদের। খুব বকা খেয়েছিল বাবার কাছে। বাবা বলেছিল এখন যা পরিস্থিতি তাতে ওরা বেবিকে মেনে না নিলে বিষ খাওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই। কারণ লোক জানাজানি হয়ে গেছে। মা তখন বেবিকে খুব মারছে ঘরে বন্ধ করে। অগত‍্যা ওর বাবাকে মাথা নিচু করে যেতে হয়েছিল রাঠোর প্রসাদের কাছে। প্রথমে কিছুতেই রাজি হয়নি কথা উঠেছিল বেবির স্বভাবের ব‍্যাপারেও। তবে পরে হঠাৎই ভেতর থেকে ডাক পড়েছিল রাঠোর প্রসাদের। তারপরেই বলেছিলেন একমাত্র মেয়ের অনুরোধেই এই বিয়েতে তিনি রাজি হচ্ছেন। তবে একটা শর্ত আছে পাল্টি বিয়ে করতে হবে। ওঁর লাডলি বিটিয়া মধুকে যদি প্রমোদ বিয়ে করতে রাজি হয় তাহলেই রাজিন্দরের সাথে বেবির বিয়ে হবে তার সাথে দহেজ আছে পঞ্চাশ লাখ টাকা। অবশ‍্য প্রমোদের ভবিষ‍্যতের সব খরচ দেবেন উনি।

      বাবা যেদিন প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল কোন কথা বলতে পারেনি প্রমোদ। পাগলের মত হয়ে গেছিল। কি বলবে ও মুনিয়াকে, কদিন বাদেই তো ওর ব‍্যাঙ্গালোরে যাওয়ার কথা। কত স্বপ্ন দেখছে মেয়েটা।
    বাবাকে বলবে ওর নিজের কথা? সাহস হয়নি বলার। তবে কি পালিয়ে যাবে বাড়ি থেকে? হঠাৎই বোনটার কথা খুব মনে হল। ওর পায়ে পড়ে কেঁদেছে বোনটা,' ভাইয়া তুম মান লো নহি তো মুঝে মরনা পড়েগা।'
     মুনিয়ার কথা একটু একটু বেবি জানত,একদিন ওর ছবি দেখেছে ভাইয়ার সাথে। তবুও নিজের কথা ভেবে আর কোনদিকে তাকায়নি।

      প্রমোদের আর ব‍্যাঙ্গালোরে আসা হয়নি এনগেজমেন্ট হয়ে গেছিল অনেক ধুমধাম করে। বিয়ের পর সোজা পাড়ি জমিয়েছিল প‍্যারিসে ম‍্যানেজমেন্ট করতে। মাঝে একবার এসে মধুকে নিয়ে গেছিল ওখানেই হানিমুন হয়েছিল ওদের। নিজের ভাবা ভবিষ‍্যতের ছবি মুহূর্তে পাল্টে গিয়ে অন‍্যরকম হয়ে গেছিল। তবে মুনিয়া ওকে কতটা ভালোবাসত তা জানতে পেরেছিল ওর সুইসাইডের খবরে। 
    ও ভেবেছিল ওর খারাপ ব‍্যবহার মুনিয়াকে শক্ত করবে। ওর প্রতি ঘৃণা মুনিয়াকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু মুনিয়া যে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা কখনই ভাবেনি। প্রেম ব্রেকআপ তো কতই হয় মানুষের জীবনে। একজনের সঙ্গে দেখা স্বপ্নগুলো অনেকেই নিভৃতে দেখে অন‍্য কারও সাথে।
    অনেক পরিচিত আদরের হাত ভুলে অন‍্য কারো হাত ধরে অনেকেই এগিয়ে চলে জীবনে। একই ঠোঁট বারবার এঁঠো হয় অনেকেরই ভালোবাসার আদরে আবার অন্তরঙ্গ আদরের চাদরে অনেক সময় পাল্টায় সঙ্গী। তেমনভাবে মুনিয়াকে ভুলে মধুর ভেজা ঠোঁটে ডুব দেয় প্রমোদ। ওর নরম আদুরে থলথলে শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে বোঝাতে হয় খুব ভালোবাসে ওকে। কারণ ওর বাবা বারবার বলে দিয়েছে মধু যদি ভালো না থাকে তাহলে বেবিও ভালো থাকবে না ঐ বাড়িতে। তাই মধুকে ঠাকুরের মত আদরযত্নের আরতি চড়িয়ে ভালো রাখে প্রমোদের বাড়ির লোকজন। হয়ত মধু ছিল বলেই ঐ বাড়ির বৌ হতে পেরেছে বেবি,আজ বেবির ছেলে ঐ বাড়ির বংশধরের স্বীকৃতি পেয়ে আদরে আছে। নাহলে যে কি হত কে বলতে পারে? 
       মাথায় ঘোমটা দিয়ে জরির শাড়ি আর গা ভরা গয়না নিয়ে বেবি যখন বাপের বাড়ি আসে তখন দেখেও ভালো লাগে ওদের। 
    তবুও মাঝেমাঝেই মুনিয়া জ্বরে ভোগে প্রমোদ। যে কথা হয়নি বলা সেকথা খুবই বলতে ইচ্ছে করে ওকে। একটা সময় মুনিয়াকে ঠকানোর অভিযোগে ওকে ত‍্যাগ করেছিল বন্ধুরা। মুনিয়ার পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার কথাটা শুনে ওকে মাফ করতে পারেনি কেউ।

         অনেকদিন বাদে প্রমোদকে পেয়ে নিজেকে উজাড় করে দিতে চায় মধু। বাপের বাড়িতে মায়ের কাছ থেকে শিখে এসেছে ছেলেদের বাঁধতে যা লাগে তা মেয়েদের কাছেই থাকে। আনমনা প্রমোদ ভাবনার জালে বন্দি হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। একটু অবাক হয় মধু ভাবে কেন যেন চুপচাপ এবার খুব মানুষটা। আজকে কি ওকে দেখতে সুন্দর লাগছে না? পাড়া প্রতিবেশীরা মাঝে মাঝেই বলে মধু অনেক শিবপুজো করেছে বলে প্রমোদের মত বর পেয়েছে।
      তবে নিন্দুকরা বলে রাঠোরের বুদ্ধি আছে এইট পাশ করা মোটা মেয়েকে সুযোগ বুঝে গছিয়ে দিল ভালো ছেলের গলায়। যেমন ছেলেটা একটা বলদ তেমন মেয়েটা। 
     মধু জানে শুধু শরীর দিয়েই মন জয় করে নেওয়া যায় পুরুষের মন। তাছাড়া ওর বাবা তো কিছু কম রাখেনি। সব দিক দিয়েই ভরে রেখেছে জামাইকে।

     ভোরবেলা টুকরো টুকরো স্বপ্নের ঘোরে প্রমোদের মন ভিজে যায়। মনে হয় ঘুমের ঘোরে মুনিয়াকে দেখেছিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে অথচ ও তাকিয়ে দেখেনি। স্বপ্নে আবার হাঁটে মুনিয়ার বাড়ির রাস্তার সামনে মনে মনে বলে একটু কথা কি বলবি না আমার সাথে? কতদিন পরে দেখলাম তোকে।
    ঘুমের ঘোরে ছটফট করে প্রমোদ,মধু ওকে জড়িয়ে ধরে আরো নিজের করে। নিজের ঠোঁটের আদরে ওকে ভেজায়।  ভোরের আধো ঘুমে মধুর আদরে নিজেকে হারায় প্রমোদ।

***************************

    মুনিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে রুমকি বোঝে মুনিয়ার মনের কথা হয়ত। কিন্তু ধরা দেয় না কিছুতেই। প্রমোদ মুনিয়ার বাড়ির সামনে দিয়ে মর্ণিং ওয়াক করে জানে রুমকি। এই দিকটাতে অনেকেই হাঁটতে আসে। সবুজে ঘেরা চারদিক,মসৃণ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় শরীর আর মন ভালো রাখতে। সত‍্যিই প্রমোদ না জেনেই ওর অফিসের ঠিক করা অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছিল তখন জানতাই না মুনিয়া এদিকে থাকে। তবে এখন হাঁটতে আসাটা অভ‍্যেস হয়ে গেছে।
    রুমকি বুঝতে পারে মুনিয়া হয়ত জানতে চায় প্রমোদের কথা। কিন্তু এমনিতেই আগ বাড়িয়ে অনেক কথা জানতে গিয়ে মুনিয়ার কাছে খারাপ হয়েছে রুমকি। তাই ও আর কিছু বলবে না। কারণ এই নিয়ে প্রবাল খুব বিরক্ত হয়েছে।
     প্রবাল খুব ভয় পায় ওর মেসোমশাইকে। যদি এখানের কোন কথা ওদিকে যায় তাহলে সেক্ষেত্রে হয়ত পুরো দোষটাই ওদের ঘাড়ে পড়বে। 
 -' বন্ধুত্ব ছিল,এখন আর কিছু নেই। দুজনেই বিবাহিত তাই ওদের মধ‍্যে তুমি আর এসো না রুমকি। মুনিয়া ভালো মেয়ে,ওর বর এখানে নেই। সবাই তোমার মত স্ট্রং নয়।'
-' হোয়াট ডু ইউ মিন?'
-স্ট্রং ইন দ‍্য সেন্স তুমি অনেক বেশি ম‍্যাচিওরড,তুমি বয়েসেও বড় মুনিয়ার থেকে। আমাদের দুজনেরই তো এক্স ছিল তাদের নিয়ে আমাদের মাথা ব‍্যথা আছে নাকি?'
   গজগজ করে রুমকি,' মাথা ব‍্যথা নেই আবার? তুমি অনুর সাথে কথা বল না? এই তো ওর ফ্ল্যাট পর্যন্ত ইন্টেরিয়র করার লোকের হদিসও তুমি দিলে।'
-' সবটাই তোমার সামনে রুমকি। এর মধ‍্যে কোন লুকোচুরি নেই। আমি এটা বুঝি, আমার লাইন এটা। ও হেল্প চেয়েছে বলে দিলাম। এখন শুধু বন্ধুত্ব আছে আর কিছু নেই। অনু আমার স্কুলের বন্ধু ছিল। সম্পর্ক কেটে গেছে বলে বন্ধুত্ব থাকবে না?'
-' প্রমোদ সেই বন্ধুত্বটাই মিস্ করছে প্রবাল। ওর কথাগুলো যদি মুনিয়াকে বলতে পারত তাহলে ভালো হত। বাট মুনিয়া তো ওকে দেখতেই পারে না।'
-' ছাড় ওসব মুনিয়া যথেষ্ট বড়,ওয়ার্কিং। তোমাদের কোনটা রাগ আর কোনটা অনুরাগ কে বলতে পারে? হয়ত মুনিয়ার রাগের পেছনেই অনুরাগ লুকিয়ে আছে। এখনও প্রমোদের সাথে কাটানো প্রতি মুহূর্তে বাঁচে মরে মুনিয়া। তুমি আর সেই অনুরাগে ক্রিম মাখাতে এসো না। বন্ধুত্ব রিনোভেশন করতে চাইলে ওরাই করবে। সন্দীপের সাথে তোমার বন্ধুত্বের মাঝে কে ছিল? হঠাৎই খুঁজে পেয়েছ।'
   প্রবালের শেষ কথাটায় একটু চমকে ওঠে রুমকি তারপরে বলে,' হঠাৎ সন্দীপ এখানে এল কোথা থেকে? আশ্চর্য কথা তো মুনিয়া আর প্রমোদের কথায় সন্দীপ এল কেন?'
   -' এল কারণ অনুও এসেছে। তবে রুমকি অনু সুখে আছে আর সন্দীপ অসুখে। এই অসুখবিলাসী মানুষ কে নিজের জীবনে বেশি এন্ট্রী দিয়ো না কে বলতে পারে ওর মনের অসুখ আমাদের জীবনেও না ছড়িয়ে পড়ে....'
-' প্রবাল আর ইউ জেলাস অফ সন্দীপ?'
-' নাহ্ আমি অসুখী দাম্পত‍্যকে ভয় পাই। কে বলতে পারে সন্দীপও হয়ত সেভাবেই ওর অসুখের বিষ একটু একটু করে ছড়াচ্ছে আমাদের মধ‍্যে?'

     প্রবালের শেষ কথাটুকু খুব ভারী লেগেছিল রুমকির। তাই মুনিয়াকে আর বিশেষ কিছু বলে না। মুনিয়া তো বলতে পারে ও কি জানতে চায়?



**************************

     আজ উইকএন্ডে খুব বোর লাগছে মুনিয়ার, একটুও কেন যেন ভালো লাগছে না। রাণাকে বার বার বিরক্ত করে মেসেজ করে। অনেকটা সময় ফোনে ওকে সঙ্গ দেয় রাণা। সত‍্যিই তো এতদূর থেকে ফোন ছাড়া মন ভালো করার কোন থেরাপি ওর জানা নেই।
   -' আচ্ছা দাঁড়া ভিডিও কলিং করি চারপাশটা দেখাই তোকে।
-' সে তো আমি অনেকবার দেখেছি। পুরোনো হয়ে গেছে। আমি ঘুরতে যাব তোর হাত ধরে।'
-' পাগলী ক্ষেপেছেন, বুঝতে পারছি। আমি হাত ধরে কি করে নিয়ে যাব?'
    কিছুক্ষণ খুনশুটি করে শেষে মুনিয়া নিজেই ঠিক করে আজ একাই বেরোবে একটু বাইরে মন ভালো করার হদিশ খুঁজতে। আগে তো কতই বেরোত বাইরে। এখনই অনেকদিন বাইরে যাওয়া হয় না। অদ্ভুত একটা আলসেমি চেপে বসেছে।
   অনেকদিন বাদে নিজেকে সুন্দর করে সাজায় মুনিয়া। আজ চোখ ঠোঁট সবই আঁকে নিজের ইচ্ছেমত। অনেকগুলো নতুন জামাকাপড় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে তারমধ‍্যে একটা পরে আয়নার সামনে নিজেকে দেখে কাছাকাছি একটু ঘুরে আসবে ভেবে টুকটাক কতগুলো জিনিস কিনব ভেবেও একটু দূরেই চলে আসে।
         কেনাকাটা করতে করতে অন‍্যমনস্ক মুনিয়া হঠাৎই চমকে ওঠে কারো হাতের ছোঁয়ায়। পেছন ফিরেই অবাক হয়ে যায়। 'জুনি তুই!'
-' হ‍্যাঁ আমি, তো। এতদূরে এসেছিস আর আমার ওখানে যাস না কেন? ভাগ‍্যিস আমি বেরিয়েছি নাহলে দেখাই হত না।'
-' বেবিটা কোথায়? ওকে আনিসনি কেন?'
-' ও বাড়িতেই আছে, ওর ঠাম্মার কাছে রেখে আমি বেরিয়েছি একটু কেনাকাটা আছে রে।'

      অনেকদিন বাদে আজ সেই পুরোনো বন্ধুত্বের গন্ধটা পেল ওরা দুজনেই। জুনির হঠাৎই মনে হল মাঝের দিনগুলো ভুলে গিয়ে আবার মুনিয়ার সাথে আছে সেই পুরোনো দিনটাতে। কিছুটা সময় শপিংয়ে ব‍্যস্ত থেকে দুই বন্ধু অনেকদিন বাদে গল্পে মেতে ওঠে কত কথা যে হয়নি বলা এতদিন। 

        মুনিয়া আজ জুনিকে মনের সবটুকু বলে অনেকটা হাল্কা হতে চায়। জুনির সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎই মুনিয়া বলে,' প্রমোদ ফিরে এসেছে জুনি।'
-' হোয়াট! কি বলছিস তুই? প্রমোদের সাথে তোর যোগাযোগ হয়েছে? কোথায়?'
-' বিশ্বাস কর আমি যোগাযোগ করতে চাইনি কিন্তু তবুও প্রমোদ এতদিন বাদে মাঝেমাঝেই আমার সামনে এসে উস্কে দিয়ে যাচ্ছে কত স্মৃতি। আমার ভালো লাগছে না রে কিছু। একদম ভালো লাগছে না।'

    একটু একটু করেই সব কথা বলে ফেলে মুনিয়া জুনিকে। অবাক হয়ে যায় জুনি,এমন ঘটনাও ঘটতে পারে? অবশ‍্য ঘটতেই পারে না ঘটারই বা কি আছে? তবে মুনিয়া বোধহয় বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছে প্রমোদকে। কেন যে ওকে নিয়ে এত ভাবছে? একই শহরে আছে তো আছে কিসের মাথাব‍্যথা? থাক দুজনে দুজনের মত।
   মনে মনে কথাগুলো আওড়েও মুখে বলতে পারে না জুনি কারণ মাঝে তো রাণা নেই। রাণা থাকলে কিছুতেই মুনিয়া এতটা দূর্বল হতে পারত না।
  তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,' রাণাকে বলেছিস?'
-' রাণাকে বলা যায় জুনি? কতদিন ভেবেছি তোকে বলব বলতে পারিনি তুই ব‍্যস্ত থাকিস।'
       জুনির ওপর ভরসা করে মুনিয়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজের থেকেও বেশি।
   -' থাক এখন বলার দরকার নেই। তবে তোরা দুজনেই এখন ম‍্যারেড।'
 -' আমি জানি জুনি। তবুও ও কিছু একটা বলতে চায় আমাকে। বিশ্বাস কর আমি ওর সাথে একটাও কথা বলিনি।'
   মুনিয়ার চোখের ভাষা চেনে জুনি, খুব সরল আর ভালো মেয়েটা। হয়ত বা একটুও বোকাও। ওর হাতে হাত রাখে জুনি।
  -' কি বলতে চায়? আর সেটা শুনেই বা তোর কি হবে? দুজনের রাস্তা আজ সম্পূর্ণ আলাদা তোদের।'
-' আর বন্ধুত্ব টা?'
-' তোদের বিয়ে না হলে হয়ত বন্ধুত্ব ফিরে আসত কিছুটা ধোয়ামোছা করে আবার। কিন্তু রাণা বা প্রমোদের বৌ অথবা আমাদের সমাজ এটাকে পরকীয়া বলেই দেখবে। তাছাড়া তোর মনে রাখা উচিত ওর জন‍্য তুই মরতে বসেছিলি।'
-' আমি জানি জুনি সবটা জানি। তবুও এতদিন বাদে ও যদি কিছু বলতে চায় আমি শুনতে চাই। তুই বলে দে একবার আমি শুনব কি? সত‍্যিই কিছু ভাবতে পারছি না আমি।'
    রাণার সাথে খুশি থাকা ঝলমলে মুনিয়াকে আজ দেখে অবাক হল জুনি। রাগও হল ওর ওপর। বুঝতে পারে প্রমোদকে ক্ষমা করে দিতে চায় মুনিয়া। নরম মনের মেয়ে মুনিয়া হয়ত আর বইতে পারছে না একটা কষ্ট নিয়ে পথ চলতে। জীবন অনেক কিছু দিলেও অতীতের কথা প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায় ওকে। প্রমোদের সাথে তো সামনাসামনি কথাই হয়নি ওর।।   কখনও বোধহয় কিছু মনের কষ্ট মেটাতে সামনাসামনি কথা বলারও প্রয়োজন আছে। ভাগ‍্য যে সুযোগ ওর সামনে এনে দিয়েছে তা আর হাতছাড়া করতে চায় না মুনিয়া। তাই একবার কথা বলে পুরোনো হিসাবনিকাশ লাভ ক্ষতির পুরোনো খাতাটা ছিঁড়ে ফেলে দিতে চায়। কিন্তু প্রমোদকে ক্ষমা করে আবার যদি মুনিয়া আমন্ত্রণ করে নষ্ট প্রেমকে ওর একলা মনে? একলা নিভৃত অবকাশে প্রমোদের সাথে কথা বলে? রাণাকে ছাড়া তো সত‍্যিই একদম একলা মুনিয়া। 

      নিজের মনের মধ‍্যে ভিড় করা প্রশ্নগুলো মনেই রেখে জুনি বলে,' আচ্ছা বেশ। প্রমোদকে তো আমিও দেখেছি একদিন নাহলে একসাথেই বসে কথা বলে নেওয়া যাবে। দেখা যাক ও কি বলতে চায়? ওর বলা কথা ওর মুখ থেকে শুনে নেওয়াই ভালো।'
    -' না না আমি কখনই ওর সাথে যেচে কথা বলব না। তবে ও যদি বলে আমি শুনতে চাই। রুমকিদিও মনে হয় জানে অনেক কথা। তবে আমি শুনতে চাইনি।'
    অনেক কথার আড়ালেও মুনিয়া যত্নে গোপন করে একটা কথা প্রমোদ ওর বাড়ির সামনে দিয়ে সকালে হেঁটে যায় হয়ত বা অভ‍্যেসে নয়ত.....
    না না আর ভাবতে চায় না মুনিয়া। জুনিই বলে, 'রাণাকে এখন কিছু বলিস না। ও এলে বলিস। সন্দেহের পোকা মনে একবার ঢুকলে তা যে কত গভীরে ঢুকে মনকে কেটে ছিন্নভিন্ন করে ভাবা যায় না। এমনিতেই বৌকে ছেড়ে থাকতে মন খারাপ বেচারার। আমাকে মাঝেমাঝেই বলে তোর খবর নিতে। সত‍্যি রে সোনা খুব ব‍্যস্ত থাকি আজকাল পুচকেকে নিয়ে। হ‍্যাঁ রে পুতুলের মেয়েকে দেখেছিস? কি মিস্টি হয়েছে দেখতে।'
     অনেক এলোমেলো কথার মধ‍্যে মুনিয়ার মনের কথাগুলো ভাবায় জুনিকে।

   অনেকদিন বাদে জুনির সঙ্গে দেখা হয়ে অনেকটা কথা বলে মনটা হাল্কা লাগে মুনিয়ার।
  --' প্রমোদের ফোননম্বরটা আমি মুছে ফেলেছিলাম অনেকদিনই,ফেসবুক থেকেও ওকে বিদায় করেছিলাম দুগ্গা দুগ্গা করে শুধু তোর সাথে খারাপ করেছিল। আজ সত‍্যিই কেন যেন অবাক হয়ে গেলাম।'
-' কি অবাক?'
-' মুনিয়ার মনে আছে এখনও প্রমোদ। সত‍্যিই কেন যেন অবাক হলাম। এই রুমকিদির সাথে কেন যে আলাপ হয়েছিল তোর?'
   এই কথার কোন উত্তরই নেই মুনিয়ার কাছেও। তাই আবার কিছুটা এলোমেলো কথার শেষে বাড়ি ফেরার পালা।

*************************

      ফেসবুকে থাকার চেয়ে হোয়াটস অ্যাপ বেশি পছন্দের সন্দীপের। মেসেঞ্জারে মেসেজের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় ব‍্যস্ত সন্দীপ হঠাৎই ফেসবুকে রাজন‍্যার লেখা কবিতা দেখে ফেলে। খুব অবাক হয় সন্দীপ,বার বার করে উঁকি দেয় রাজন‍্যার কবিতার ঘরের অন্দরে। 
 রাজন‍্যা! এই কি সেই রাজন‍্যা যে একদিন সন্দীপের ভালোবাসা ভিক্ষা করে লুটিয়ে কেঁদেছিল? না না এই রাজন‍্যা নিশ্চয় সেই রাজন‍্যা নয়। রাজন‍্যার তো ফেসবুকে কোন অ্যাকাউন্ট ছিল না তেমন। বিয়ের সময় একটা ছোট্ট বোতাম টেপা কালো ফোন নিয়ে ওদের বাড়িতে এসেছিল যে মেয়েটা সে আজ কবিতার ব্লগ খুলেছে? বেশ কয়েক হাজার ফলোয়ার্স অনেক লাইক আর শেয়ার। বেশ কয়েকমাস আগে বাড়ি গিয়েছিল সন্দীপ। রাজন‍্যার সাথে ফোনে তেমন কথাও হয় না। ওকে পাগল বলেই আন্ডার এস্টিমেট করে। মায়ের সাথে সারাদিনে একবার কথা বলার সময় ওখানে থাকে রাজন‍্যা। ফোনে মাঝে মাঝে টুকরো কথা বলে এই যেমন এই মাসে বেশি টাকা পাঠাতে হবে মায়ের ইসিজি আরও সব টেস্ট আছে। বা ইলেকট্রিক বিল অনেকটা বেশি এসেছে হঠাৎ করেই। তার মাঝেই সন্দীপ ছুঁড়ে দিয়েছে তির্যক কথার বাণ,' পাগলের ডাক্তারের ওষুধের খরচ বেড়েছে নাকি?'
    সত‍্যিই মাঝে রাজন‍্যার চিকিৎসার খরচ কিছুটা বেড়েছিল কিন্তু আজকাল কয়েকটা টিউশন পড়ায় রাজন‍্যা চেষ্টা করে নিজের টুকটাক খরচ চালিয়ে নিতে। শাশুড়িমা রাগ করেছিলেন প্রথমে,' যার বর এত ভালো চাকরি করে তাকে টিউশন করতে হবে কেন? আমি সন্দেশকে বলব বেশি টাকা পাঠাতে।'
    কিছু অজুহাতে কথা এড়িয়ে গেছিল রাজন‍্যা। সেই টাকাতেই একটা বড় ফোন কিনেছে অবশ‍্য সবটাই একটু একটু করে হয়েছে মনসিজে যাবার জন‍্য। আর ওষুধের ফেরিওয়ালা বন্ধু তো আছেই।

          অবাক হলেও রাজন‍্যাকে বলতে পারে না সেই কথা সন্দীপ শুধু মনে মনে কৌতূহল জোরালো হয়। সেই লাজুক সাদামাটা মেয়েটা যে ঘুমের ওষুধ খেয়ে অনেক বেলা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমোত ওকে সন্দীপ ব‍্যবহার করেছে শুনে। সেই রাজন‍্যা কবিতার পেজ খুলেছে? লাইকের বন‍্যায় ভাসছে রাজন‍্যা,কমেন্টে প্রশংসার ছড়াছড়ি।
    বাড়িতে ফোন করে সন্দীপ,অসময়ে ফোন করাতে অবাক হয় মা তবুও আজ প্রথমেই রাজন‍্যার কথাই জিজ্ঞাসা করে সন্দীপ। জানতে পারে ও বাড়িতে নেই বেরিয়েছে।
  ' এখন সন্ধ‍্যেবেলা কোথায় বেরিয়েছে আবার? তোমাকে একলা রেখে বাড়িতে।'
 -' প্রতিদিন তো বেরোয়। অনেকক্ষণ পরে আসে। দুপুরে খাওয়াদাওয়া হলেই ভালো করে তৈরী হয়ে বেরিয়ে যায়।'
-' কোথায় যায় তুমি জান না?'
  ছেলের সন্দেহের আগুনে একটু ঘি ছড়িয়ে দেন ইচ্ছে করেই নিভা,' যাকে আমার ছেলে বৌয়ের মর্যাদাই দেয়নি। বাড়ির আয়ার মত রেখে দিয়েছে। খাওয়া পরার চুক্তিতে আয়া। তাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে আমার ভালো লাগে না। আমার সব গুছিয়ে দিয়ে সে গেছে। রাতে এসে খেতে দেবে বিছানা করবে। আমি তো পঙ্গু নই? আর তুই তো রাতে ফোন করিস এখন কেন?'
-' অদ্ভুত কথা বলছ তো? ফোন সময় ধরে করতে হবে?'
-' তাই তো করে এসেছিস। তাই আজ অবাক হলাম।'

      মায়ের সাথে কথা বলে অদ্ভুতভাবে মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় সন্দীপের। আজকাল মা যেন কেমন বদলে গেছে। আর রাজন‍্যাই বা কোথায় যায়?
      বিকেলে টিউশন পড়ানোর কথাটা ছেলেকে ইচ্ছে করেই বলেন না নিভা। যাক মেয়েটা বাঁচুক আত্মসম্মান নিয়ে। একটু ভালো থাক নিজের মত।

      অদ্ভুত একটা খারাপ লাগা বাসা বাঁধে সন্দীপের মনে। কেন যে বাসবীকে জব্দ করতে বিয়ে করেছিল রাজন‍্যাকে কে জানে? তার থেকে না বিয়ে করাই বোধহয় ভালো ছিল। অবশ‍্য বিয়ে না করলে অবশ‍্য সবাই বলত ধোকা খাওয়ার যন্ত্রণাটা ভুলতে পারেনি সন্দীপ।

     খারাপ হয়ে যাওয়া মেজাজটাকে ভালো করতে আজ রুমকির অফিসের বাইরে অপেক্ষা করে সন্দীপ। অনেক দিন ওরা মিট করে না,বললে রাজিও হয় না রুমকি। আজ একদম ওকে তুলে নিয়ে যাবে। তুলে নিয়ে যাওয়া কথাটা ভেবে নিজের খুব হাসি পেল হঠাৎই।

     অনেকটা সময় অপেক্ষা করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সন্দীপ। অগত‍্যা মেসেজ করে কোন উত্তর পায় না। তারপরে ফোন করে অনেকটা পরে ফোন ধরে রুমকি একটা চাপা ধমক দেয়,' তোকে বলেছি যখন তখন ফোন করিস না।'
-' আমি অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে।'
 -'ফোন রাখ,আমি অফিসে যাইনি বাবলির শরীর ভালো নেই।'
   ফোনটা কেটে দেয় রুমকি। হঠাৎই নিজেকে কেমন যেন খুব একলা লাগে সন্দীপের। কেন যেন সবার ভালো থাকা ওর সহ‍্য হয় না।

       ****************************

 আজকাল অভ‍্যেসেই ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায় মুনিয়ার ভোরের সূর্য দেখতে ভালো লাগে। অনেকটা পজেটিভ এনার্জি পাওয়া যায়। গাছেদের ভালোবাসা মাখতে মাখতে হঠাৎই আবার প্রমোদকে চোখে পড়ে যায় মুনিয়ার। অনেকগুলো প্রশ্ন জমেছিল মনে তবে ভাবল ঠিকই ভেবেছে বাড়ি গেছিল বৌয়ের আদর খেতে। হঠাৎই কেমন যেন নিজের ওপর রাগ হল মুনিয়ার আবার। 
        আজ মুনিয়া আর থামের আড়ালে যেতে পারে না। চলে যাওয়ার কোন অবকাশ নেই আজ। প্রমোদ অনুভব করে মুনিয়ার অস্তিত্ব ওর অদৃশ্য চোখটা বলে দেয় মুনিয়া ওকে দেখছে।

         মুনিয়ার সাথে কি কথা হয়েছিল তা কেন যেন অম্লানকেও শেয়ার করতে পারে না জুনি। তবে কেন যেন মনে হয় বারবার মুনিয়ার একাকীত্ব ওকে দূর্বল করছে একটু একটু করে। প্রমোদের সাথে তেমন কোন বন্ধুত্ব ছিল না ওর মুনিয়ার সাথে বেশ কয়েকবার ওকে দেখেছে। তাতেই যেটুকু আলাপ।
     একবার যদি জানতে পারত ও মুনিয়াকে কি বলতে চায়? হয়ত সবটাই মিথ‍্যে কথা। প্রমোদ সব পারে। প্রমোদের জন‍্য রাণা আর মুনিয়ার মধ‍্যে ভুল বোঝাবুঝি হোক তা হতে পারে না। রাণার সাথে পুরো সম্পর্কটাই তো গড়ে উঠেছিল ওদের সামনে।

     ক‍্যালেন্ডারের পাতায় চোখ রাখে মুনিয়া। রাণাকে খুব মিস্ করে আজকাল। বারবার মনে হয় রাণা থাকলে জীবন এত জটিল হত না বরং রাণার সাথে প্রমোদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে আসত ও কত সুখে আছে। কবে যে আসবে কে জানে? বললেই বলে এই তো সবে গেলাম এখনই কি ছুটি দেয় নাকি?

            ক‍্যালেন্ডার দেখতে দেখতে হঠাৎই আঙুলটা আটকে যায় মুঠোফোনে মনে পড়ে পুজোর কথা সামনের পুজোটা রাণাকে ছাড়াই কেটে যাবে ওর। কিন্তু রাণাকে ছাড়া কিভাবে? 
    হঠাৎই ফোনটা বাজতে থাকে নিজের খেয়ালে রুমকিদি। অবাক হল মুনিয়া হঠাৎ ফোন দেখে। সেদিন কেমন যেন ছাড়া ছাড়া কথা বলছিল রাতে মেসেজে তারপর আর কথা হয়নি কোন। অবশ‍্য মুনিয়া উত্তর পেয়ে গেছে প্রমোদ ফিরে এসেছে আবার।
         -' কাল একবার আসবি অনেকদিন আসিস না। বাবলির মাঝে শরীরটা খারাপ ছিল। নাহলে আমি চলে আসতাম।'
   কথাটা শুনে খারাপ লাগল মুনিয়ার সত‍্যিই ওর খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল।
     
           প্রবালদা যথারীতি আবার ট‍্যুরে ওদের বাড়িতে আসার খুব একটা ইচ্ছে না থাকলেও বাবলির শরীর খারাপ শুনে না করতে পারেনি মুনিয়া। রাণাও বলেছে ঘুরে আসতে। 
     বাবলিটা সত‍্যিই বেশ রোগা হয়ে গেছে ভুগে ভুগে। মুনিয়াকে পেয়ে খুব খুশি হয়ে একটু খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়ল।
        বাবলিকে বিছানায় দিয়ে আজ মুনিয়ার কাছে সেই না বলা কথার অজানা রাজ‍্যে নিয়ে গেল রুমকি। একটু একটু করে বলল প্রমোদের সব কথা ওর কাছে।
     মুনিয়ার মনে হল রুমকিদি কোন একটা বড় সিনেমা হলে নিয়ে গিয়ে একটা সিনেমা চালিয়ে দিয়েছে ওর সামনে আর ও বসে বসে দেখছে পুরোটা।
    তবে এটা কি সত‍্যি না প্রমোদের বানানো কোন গল্প?
   সত‍্যিই কি প্রমোদ ওর প্রেগনেন্ট বোনের বিয়ের জন‍্য ছেলের বাবার জোরাজুরিতে বিয়ে করতে বাধ‍্য হয়েছিল?

         বাড়িতে ফিরে এলোমেলো মনটা গুছিয়ে নিতে চায় মুনিয়া। একটা অদ্ভুত গল্প শুনল আজ। রুমকিদিকে গল্পের শেষে জিজ্ঞাসা করেছিল,' আচ্ছা তুমি এত খবর কিভাবে জানলে? আর আমাকেই বা সব বললে কেন? এতদিন বাদে সত‍্যি মিথ‍্যে এইসব জেনেই বা আমার কি লাভ? আমার মনে প্রমোদের আর কোন জায়গা নেই।'
     একটা ছোট্ট টুকরো হাসি নিয়ে ঠোঁট উল্টোয় রুমকি,' আচ্ছা,আমি ভাবলাম হয়ত তুই কোন কারণে কষ্ট পাচ্ছিস প্রমোদকে দেখলেই ভীষণ রাগ হচ্ছে বা শরীর খারাপ হচ্ছে তাই শেয়ার করলাম।'
-' তুমি কি আগে জানতে? বলনি তো।'
-' না জানতাম না তোর প্রবালদার কাছে একদিন খুব রাগ করে বলেছিলাম ওকে যেন বাড়িতে অ্যালাও না করে ভীষণ খারাপ ছেলে। তখনই... তারপর প্রমোদও বলেছে।'
 -' ইশ্ প্রবালদা আমার কথা জেনেছে!'
-' আগে জানত না। প্রমোদের বাড়ির কেউই জানত না যে ওর প্রেমিকা আছে।'
-' হ‍্যাঁ সেই পথ আগে থেকেই পরিস্কার করে রেখেছিল। কাউকে না জানিয়ে। যা হয়েছে দুজনের জন‍্যই ভালো হয়েছে। দুজনেই ভালো আছি নিজের মত।'

     কেন যেন আর কিছুই বলতে পারেনি মুনিয়া। রাণার সাথে অনেকক্ষণ কথা হয় ফোনে। খুব বলতে ইচ্ছে করল ওকে যদি প্রমোদ কখনও এসে যায় এই শহরে তাহলে কি হবে? যদি দিনের শুরুতে পায়ের ছাপ রেখে যায় আমারই বাড়ির রাস্তায় তাহলে কি করব?
    কিন্তু কিছুই বলতে পারল না। কতদূরে আছে ছেলেটা হয়ত এটা ভেবেই খুশি থাকে মুনিয়া ওর কথা ভেবেই ভালো আছে। সেখানে যদি জানতে পারে মুনিয়ার বর্তমানে মাঝে মাঝেই উঁকি অতীতের তাহলে কি হবে? যদি জানতে পারে অতীতের চেনামুখ ঘোরাঘুরি করছে মাঝেমাঝেই সামনে তাহলে?


    আজ রুমকিদির কাছে সব কিছু শুনে কেন যেন খুব খারাপ লাগল মুনিয়ার রাগ হল খুব প্রমোদের ওপর কথাগুলো জানিয়ে তো একটা চিঠি লিখতে পারত ওকে। একবারও মনে হয়নি মুনিয়ার কথা? বোনকে বাঁচাতে গিয়ে মুনিয়ার মরে যাওয়া নিয়ে মাথাই ঘামায় নি। আসলে বোধহয় সম্পর্কের গভীরতা মুনিয়া যতটা ভালোবাসা দিয়ে মেপেছিল ও মাপেনি কখনই। সত‍্যিই ছেলেরা অদ্ভুত হয়। কই রাণাও তো ঝুমকাকে নিয়ে অত ভাবে না কখনই। ওর সবটা জুড়েই তো মুনিয়া এখন। ঠিক তেমনি নিশ্চয় প্রমোদের সবটা জুড়েই এখন ওর বৌ। শুধু শুধু ওর কথা এত ভাবছে মুনিয়া।

    তবুও আজ খুব কান্না পেল মুনিয়ার কেন যে এমন কান্না পায় মাঝে মাঝে ও জানে না। নিজেকে খুব একলা মনে হল আজ,ভীষণ রাগ হল রাণার ওপর একসাথে থাকবি বলেও কেন চলে গেলি হঠাৎ। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। সবাই সেলফিশ আমার কষ্ট নিয়ে কারো কোন মাথাব‍্যথা নেই। কেউ নিজের প্রবলেম আমার সাথে শেয়ার করেনি কখনও শুধু আমাকে কষ্ট দিয়ে গেছে। অনেকটা চোখের জলে বেশ কিছুটা কষ্ট ধুয়ে মুছে গেল।

     নানা কাজের ব‍্যস্ততায় ফেসবুকে আসা হয় না রাণার। মাঝে মাঝে সময় পেলে উঁকি দেয়। আজ রাতে শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসতে চাইছে না বারবারই মুনিয়ার কথা মনে হচ্ছে। ফেসবুক খুলে অনেকগুলো পুরোনো ছবিতে চোখ রাখল রাণা। একটা ভালো লাগা মনকে ছুঁয়ে গেল হঠাৎই।
    নোটিফিকেশন দেখতে দেখতে হঠাৎই একটা ভিডিওর নোটিফিকেশন দেখল ওহ্ সেই বুটিকের পেজটার। ও লাইক করেছে পেজটা তাই হয়ত এসেছে।
    ভিডিওটা ওপেন করে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল রাণা ঝুমকা! হ‍্যাঁ কিছুদিন আগের দেখা ঝুমকা তবে কোন অশ্লীল ভিডিও নয় ঝুমকা শাড়ি বিক্রি করছে সোশ‍্যাল মিডিয়ায়। নিজের হাতে ডিজাইন করা শাড়ি।
    ওহ্ সত‍্যি ও ভীষণ বোকা,মৌমিতার কাছে কৃষ্ণনগরের কথা শুনে ইমপ্রেসড হয়ে শেষে ঝুমকার বুটিক থেকে শাড়ি কিনল ও! মুনিয়া ফেসবুকে অ্যাকটিভ থাকে। নিশ্চয় ও জানে এটা ঝুমের বুটিক.......
     ওহ্ আর ভাবতে পারে না রাণা। নিজের অজান্তেই জাস্ট দেশের নস্টালজিয়ায় একটা বড় ভুল করে ফেলেছে। সত‍্যিই তো মুনিয়া আর কিছু বলেনি শাড়িটার ব‍্যাপারে। নিশ্চয় খুব কষ্ট হয়েছে ওর।
     ইশ্ ও যদি ভাবে ঝুমকার সাথে এখনও যোগাযোগ আছে ওর?
  নাহ্ মুনিয়ার সাথে একবার কথা বলতে হবে এ ব‍্যাপারে। কিন্তু কি বলবে?
    অতীতে ডুব দেয় রাণা ওর সামনে মুনিয়া নেই,ও ঝুমের ভিডিও দেখলেও কেউ ওকে কিছু বলবে না। আরেকবার খুলে দেখে ভিডিওটা। পাকা ব‍্যবসায়ী ঢঙে একটার পর একটা শাড়ি দেখিয়ে তার রঙ ঢং ডিজাইনের প্রশংসা করে শাড়ি দেখিয়ে যাচ্ছে ঝুম।

     অনেকদিন আগে যে স্বপ্ন ওকে রাণা দেখিয়েছিল সেই স্বপ্নের জাল বুনে অনেকটা এগিয়ে গেছে ঝুম। কিন্তু কেন? ওর সেই বড়লোক বর কোথায় এখন? 
    একটা সময় ঘেন্না করা ঝুমকাকে নিয়েও কিছু প্রশ্ন জাগল রাণার মনে।
    তার সাথে খুব করুণা হল বোকা রাণাকে। এবার কি করে সবটা সামলাবে? পেজটা আনফলো করে রাণা। সত‍্যি একটা যাচ্ছেতাই কান্ড করে ফেলেছে। মুনিয়ার মুড বুঝে ওর কাছে বলতে হবে সবটা। এমনিতেই মুনিয়া খুব টাচি সামান‍্য ব‍্যাপারে খুব চিন্তা করে। 
        অ্যাটলিস্ট ঐ ঝুমের জন‍্য নিজেদের মধ‍্যে কোন তিক্ততা চায় না রাণা।

*************************

      সন্দীপের মতই অনেকগুলো বছর পরে কথা হল রীতার সাথে রুমকির। রীতাকে একটা সময় তেমন পাত্তা দিত না। তবে এতদিন বাদে ফেসবুকে ফ্রেন্ডশিপ পাঠানো রীতাকে দেখে অবাক হল রুমকি। আসলে একটা সময় অনেকদিন বাদে দেখা বন্ধুর কথা জানতে খুব ইচ্ছা করে। তারপর যদি সেই বন্ধুকে আগের থেকে ভালো থাকতে দেখা যায়। তারপর একটা সময় যথারীতি কথা ফুরিয়ে যায় আবার চেনাজানা শেষ করে আমরা ফিরি সেই প্রাত‍্যহিক গন্ডীতে। 
     রীতা আগের থেকে অনেক অনেক সুন্দরী হয়েছে। বরকে দেখতেও বেশ ভালো। কলকাতায় কোন একটা ব‍্যাংকে দুজনেই চাকরি করে। ওকে ফোনও করেছিল রীতা,ফোনে অনেকটা চেনাজানা হয়ে গেল দুই পুরোনো বন্ধুর। হয়ত একবার মিলিয়ে দেখা কে বেশি ভালো আছে?

      সেদিন হেড অফিস থেকে বেরিয়েই সন্দীপের সাথে আবার দেখা। কদিন ওকে অ্যাভয়েড করছিল রুমকি। আজ একদম মুখোমুখি। কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে ওরা। নিজের মনের যন্ত্রণা ঢাকতে রুমকির মন জিততে নানা রকম চেষ্টা করে সন্দীপ। রুমকিকে আজ কেমন যেন ঠান্ডা লাগছে। মেয়েদের এই একটাই সমস‍্যা। একটা সময় মিইয়ে যায় বর আর বাচ্চার অজুহাতে।
    রুমকির মন ফেরাতে বলে,' একটা কবিতা নিবেদন করব আজকের সন্ধ‍্যায় শুধু তোরই জন‍্য বলবি কার কবিতা?'
     ওকে থামিয়ে রুমকি বলে,' আজ আমি কবিতা বলব শুধুমাত্র তোর জন‍্য শুনে বলবি কেমন লেগেছে? আর কার কবিতা?'
    অবাক হয়ে যায় সন্দীপ ওর কথা শুনে তবুও একমুঠো ভালোলাগা ছুঁয়ে যায় ওকে এই তো সেই চেনা রুমকি। যে ওর জন‍্য কবিতা বলবে।
   ' আমার তোর মত মনে থাকে না তাই মোবাইলে চোখ রেখেই বলছি কিন্তু।'
     রুমকি নিজের ছন্দে কবিতা পাঠ করতে থাকে একদৃষ্টে সন্দীপ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখ দিয়ে ছুঁতে চায় রুমকির আবেগটুকু। সত‍্যিই আজ প্রেমের আবেগে ভেসেছে রুমকি কবিতা বলতে বলতে।
     কিছুক্ষণ বাদে থামে রুমকি ওর চোখদুটো কেমন যেন ঝাপসা লাগে সন্দীপের।
  রুমকি ভেজা গলায় বলে,' কেমন কবিতাটা? আর কার লেখা বল? তুই তো কবিতা গুলে খাস। আর আমাদের মাঝে কবিতাটা আছে বলেই হয়ত কবিতা শোনার জন‍্যই মাঝে মাঝে চলে আসি।'
    সন্দীপ নিখুঁত অভিনয়ে বলতে থাকে,' অসাধারণ লাগল, এত ভালো পাঠ করলি তুই! অবশ‍্য একটা সময় শুনেছি...'
     ওকে থামায় রুমকি তারপরে বলে,' এবার বল কার
কবিতা?'
-' না চেনা কারো নয় তবে বেশ ভালো লিখেছে। একদম গভীর অনুভূতি থেকে উঠে আসা লেখা।'
 -' স্বীকার করছিস তাহলে ভালো লেখা। আমার খুব প্রিয় একজন কবি। কিছুদিন হল পড়ছি খুব ভালো লেখে। তুইও পড়ে দেখতে পারিস রাজন‍্যা চক্রবর্তীর কবিতা।'
      সন্দীপের হাসিমাখা মুখটা হঠাৎই কালিমাখা হয়ে যায়। কি বলছে রুমকি!
-' অবাক হলি নাকি? রাজন‍্যা চক্রবর্তী বেশ নাম করেছে কবিতার জগতে পা রেখেই। ভালো ভালো বাচিক শিল্পীরা অডিও করছে। আমি হঠাৎই একদিন শুনেছিলাম একটা অডিও,তারপর ফলো করি পেজটা। আচ্ছা রাজন‍্যা তোর বৌয়ের নাম না? সেই পাগল বৌটা না?'
  সুর পাল্টে যায় সন্দীপের হঠাৎই,' কি যা তা বলছিস হঠাৎ! আমারই ভুল হয়েছিল তোকে কবিতা শোনাতে যাওয়া। আমার বৌয়ের কথা তুই কি জানিস? ও লিখবে কবিতা!'
-' সেটাই ভুল হয়েছিল। প্রথমে বন্ধু ভেবেই হাত বাড়িয়েছিলাম। তোর সাথে কথা বলতে বলতে ডুব দিতাম  দিনগুলোতে। পরে ধীরে ধীরে পাল্টে গেল তোর কথার ধারা। কিছুটা এড়িয়ে চললেও পারিনি চলতে। রীতার সঙ্গে ভাগ‍্যিস এতদিন বাদে যোগাযোগ হল। তাইতো সব জানতে  পারলাম এক অসুখী স্বামীর স্ত্রীকে অসুস্থ করে তোলার গল্প।'
   রীতার কথা শুনে চমকে উঠলেও নিজেকে বাঁচাতে ঢাল ধরে সন্দীপ,' ওহ্ ইনটেলিজেন্ট স্মার্ট রুমকি এখন রীতার বুদ্ধিতে চলছে? সেই নেকু, মেয়েটা।'

-' সত‍্যিই সেই নেকু রীতা মেয়েটা তোর বোকা পাগল বৌটাকে আমাকে চিনিয়ে দিয়েছে। আজকের পর আমাকে আর মেসেজ করিস না। তার চেয়ে কবিতার পেজটা ফলো করিস। একটা অসুখী,বোকা আর পাগল মেয়ে কতজনকে অনুপ্রাণিত করে দেখিস। ইভেন আমিও ওর ফ‍্যান হয়ে গেছি এই কদিনে। অসাধারণ লেখে।'
    হঠাৎই রুমকির হাতটা চেপে ধরে সন্দীপ দুহাতে,' আমাদের মুহূর্তগুলো? আমি তোকে ভালোবাসি।'
 
         ভালোবাসার কথাগুলো অসহ‍্য লাগে শুনতে রুমকির,' হাতটা ছাড় ভালো লাগছে না। আমার তো মনে হয় তোর মানসিক চিকিৎসা দরকার। অদ্ভুত একটা মনোবিকারে ভুগছিস তুই। নিজের ঘরে খাল কেটে অন‍্যের ঘরেও সিঁধ কাটছিস।'

  রীতার কথা শুনে রাগে ফুটেছিল রুমকি। সন্দীপ সবসময় বলত বৌ পাগল ওর কোন সুখ নেই জীবনে।
   আজ ভগবান সেই সুযোগ দিয়েছেন। যোগ‍্য জবাব দিতে পেরেছে রুমকি।

   রুমকির করা অপমান ভুলতে পারে না সন্দীপ। ওর শেষের কথাগুলো বারবার হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে ওকে। সত‍্যিই কি পাগল হয়ে গেছে সন্দীপ?
  তবে রাজন‍্যার সাথে হিসেব ওকে নিতেই হবে। কোথায় যাচ্ছে ও প্রতি বিকেলে? কবিতা লেখা বের করে দেবে একদম। মাকে দেখার জন‍্য খাওয়া পরা আর ডাক্তার দেখানোর খরচ দিয়ে রেখেছে ওখানে ওকে।
        হঠাৎই বাড়ি টানে ওকে। যেতেই হবে এবার বাড়ি ওকে। যে রাজন‍্যা একদিন ওর কাছে ভালোবাসা ভিক্ষা করেছিল ভিখারীর মত তার সব দম্ভ ভেঙে চুরমার করে দেবে ঘুচিয়ে দেবে কবি হবার শখ। ওর নরম শরীরটাকে পিষে বুঝিয়ে দেবে স্বামীত্বের অধিকার কাকে বলে?

       বাড়িতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যায় সন্দীপের রাতের আঁধারেই আজ সব হিসেব হবে। কামনা বাসনা আর হিংসায় উন্মত্ত সন্দীপ খোঁজ করে রাজন‍্যার।
     মায়ের কাছে একজন অন‍্য মহিলাকে দেখতে পায়। রাগ আরও চরমে ওঠে,' কে রেখেছে উনাকে মা?' বাহ্ বেশ পাখা গজিয়েছে তোমার বৌমার। কোথায় সে? আজ ফিরুক দেখছি তারপর।'

**********************


        'অযথা মাথা গরম করিস না সন্দেশ সে নেই সে চলে গেছে এখান থেকে। কি জন‍্য থাকবে বলতে পারিস এখানে? তবে ফোনে তদারকি করে মাঝে মাঝে আসে।'
-' কোথায় গেছে? ওর ঐ বাপের বাড়িতে? ওদেরই তো সংসার চলে না।'
     তবুও সন্দীপের কোন আস্ফালনেই কাজ হয় না। সত‍্যিই চলে গেছে রাজন‍্যা। এতদিন ও অবহেলা করেছে রাজন‍্যাকে আজ জবাব দিয়ে গেছে ও। নিজের আত্মসম্মান বাঁচানোর শিক্ষা পেয়েছে রাজন‍্যা। হয়ত নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছে নতুন করে।

         নিজেকে হঠাৎই অসহায় লাগে ভীষণ সন্দীপের। প্রেমিকা,বান্ধবী এমন কি ঐ বোকাসোকা বৌটাও ওকে ছেড়ে চলে গেল! কি নেই ওর?
  ' মাথা ঠান্ডা কর বিশ্রাম নে। অনেক তো হল এবার ফিরে আয় এখানে বল অসুস্থ মাকে রেখে অতদূরে...'
   -' তোমরা কেউ আমাকে বুঝলে না মা শুধু নিজের স্বার্থটাই দেখলে সবাই। আমারও যে একটা মন আছে।'
-' আয় কাছে এসে বোস তো দেখি,তোর মনটা বড়ই অসুখী আর অসুস্থ। কখনই শেখেনি অল্পে খুশি হতে। মনকে সুখী করতেও শিখতে হয় বাবা। সে তো বড়ই অবুঝ। রাজন‍্যা কত যত্নে ওর অসুস্থ মনটাকে সুস্থ করে এখন ভালো আছে।'
 -' তাহলে তুমি জান ও ভালো আছে।শুধু আমিই ভালো নেই।'
-' ভালো থাকতেও শিখতে জানতে হয় বাবা।'

        সন্দীপের সাথে বেশ কিছুদিন কোন কথাই আর হয়নি। নিজেকে হঠাৎই খুব ছোট মনে হয়েছে রুমকির। সন্দীপকে প্রথম দেখে অনেকদিন বাদে বন্ধুকে খুঁজে পাওয়ার যে আনন্দ ছিল তা অদ্ভুতভাবে মেসেজের গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে পরকীয়ার জালে আটকা পড়েছিল। আচ্ছা সত‍্যিই কি মহিলা পুরুষের বন্ধুত্ব হয় না? সন্দীপ কেন যে এমন কে জানে? রীতার কাছে সবটা জেনে অদ্ভুত লেগেছিল, একটা মাঝবয়েসী পুরুষের এমন বিকার হতে পারে?

     নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এক নতুন শিক্ষা নিল আবার রুমকি। পুরোনো বন্ধুও কখনও প্রেমিকের জায়গায় বসতে চায়,বন্ধুত্ব হারিয়ে যায়। কস্মিনকালেও সন্দীপের সাথে ওর প্রেম ছিল না। সে অপকটে কেমন সাজিয়ে ভালোবাসি কথাটা বলে যায় বারবার। প্রবাল ঠিকই বলেছিল রাণা আর মুনিয়ার মাঝে আর কখনই বন্ধুত্ব হবে না ফিরে ফিরে আসবে সেই পুরোনো কথা। পুরোনো প্রেমে লাগবে পরকীয়া নামক কালির ছোপ। ক্ষতিগ্রস্ত হবে হয়ত দুজনেরই দাম্পত‍্য। বিপদে সম্পদে একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতিরা বোবা হয়ে মাথা ঠুকবে হয়ত কোন বদ্ধ ঘরের দেওয়ালে।

     আজকাল তাই পারতপক্ষে আর মুনিয়াকে মেসেজ করে না রুমকি। নিজের একটু অগোছালো সংসারকে বেশি সময় দেয় ফোনকে বিশ্রামে রেখে। অফিস ঘর বাবলি ছাড়াও মাঝে মাঝে টেনে নেয় পুরোনো গীটার বা কবিতার বই নিজের মনকে ভালো রাখতে। 

 **************************
  অনিরুদ্ধ মৌমিতা সেদিন এসেছে রাণার ওখানে কথায় কথায় মৌমিতা বলে,' দাদাভাই মুনিয়ার একটা ছবি দাও না ঐ শাড়িটা পরে। আর বোল না ঐ মহিলা মাঝে মাঝে মেসেজ করছে একটা রিভিউ দেওয়ার জন‍্য।'
  রাণা কি বলবে ঠিক ভেবে পায় না। সত‍্যিই তো মুনিয়াকে দেখেনি শাড়িটা পরতে আর যাবেই বা কোথায় পরে? গায়ে ফেলা অবস্থায় দেখেছে।
-' এখনও পরেনি মনে হয় আচ্ছা পরলে বলব ছবি দিতে। তুমি চেনো ঐ ভদ্রমহিলাকে? 
-'হ‍্যাঁ মন্দিরাদি,আমাদের পাড়ায় থাকেন তবে বুটিক বোধহয় ওঁর বোনের তাই শুনেছি। আচ্ছা আমি বলে দেব পরে দেবে।'
     নাহ্ আজই মুনিয়ার সাথে শেয়ার করবে সবটা না জানি মুনিয়া কি ভেবেছে? যদিও কিছু বলেনি।

         রাতের অবকাশে ফোনে রাণা বলতে চায় মুনিয়াকে ওর মনের কথা কিন্তু কিভাবে বলবে?
     তবুও বলতেই হবে আজ যেভাবেই হোক...
  'আমি একটা খুব বড় ভুল করে ফেলেছি না জেনেই মুন,প্লিজ আমাকে ভুল বুঝিস না। সত‍্যিই আমি জানতাম না।'
    অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয় মুনিয়ার রাণা কি বলতে চায় ওকে? তাই জানতে চায়..' রাণা আবার কি ভুল করল শুনি? ভুল তো মুনিয়া করে সবসময়। রাণা ওকে শুধরে দেয় বোঝায়।'
-' মজা করিস না সত‍্যিই একটা কাঁটা যেন আটকে গলাতে কিন্তু বলতে পারছি না।'
-' রাণা প্লিজ বল এবার, আর ভালো লাগছে না।'
- ' তোর বার্থডেতে যে শাড়িটা পাঠিয়েছি সেটা ঝুমকার বুটিক থেকে কেনা সত‍্যিই আমি জানতাম না। শাড়িটা বুক করিয়েছিলাম মৌমিতাকে দিয়ে। ও সাথে জুয়েলারী আর পার্স পছন্দ করে দিয়েছিল।'
      জানা কথাটা রাণার মুখ থেকে শুনে সত‍্যিই নিজেকে কেমন যেন বোকা মনে হল মুনিয়ার। রাণা যা করেছে সেটাই হয়ত ঠিক। নিজেদের মধ‍্যে গোপনীয়তা অনেক সমস‍্যা ডেকে আনে। তবুও মজা করল..' মৌমিতা না ঝুমকাই পছন্দ করে দিয়েছে সব। সত‍্যিই খুব বোকা হয়েছিস। আচ্ছা ঝুমকার সাথে তোর কথা হয়েছে?'
        -' কি সব বলছিস! ও আমি সব খুলে বললাম আর তুই মজা করছিস? কেন ওর সাথে কথা বলব আমি? আগে জানলে ওখান থেকে শাড়ি আমি কখনই কিনতাম না। গড প্রমিস।'
   রাণার মুখে অনেকদিন বাদে এই কথাটা শুনল।
- ' এমনি ইচ্ছে করল মজা করতে। আচ্ছা আমি যদি মজা করে একটা কথা বলি সেটা শুনবি তো?'
   রাণা যেখানে ঝুমকার কথা ওকে অপকটে বলতে পারে সেখানে ও কেন বলতে পারবে না প্রমোদ এসেছে এখানে।
   -' ওহ্ অনেকটা হাল্কা লাগছে বলতে পেরে। এবার তুই বল তোর কথা। কি হল আবার? অফিসের সমস‍্যা?'
 -' জীবনের সমস‍্যা মনে হচ্ছে হঠাৎই জানিস। তুই কেন আমাকে ছেড়ে গেলি এখন? খুব খুব দরকার মুনিয়ার রাণাকে। প্রমোদ এসেছে এখানে।'
   হঠাৎই একটা অদ্ভুত ধাক্বা লাগল অনেকটা দূরে থেকেও রাণার বুকে। প্রমোদ এসেছে? সেই প্রমোদ যার ভালোবাসা হারিয়ে একদিন মরতে বসেছিল মুনিয়া।নিজেকে সামলে বলে,' এসেছে তো এসেছে। এত বড় একটা শহরের কোন এক কোণে আছে আমার বৌয়ের মনে না থাকলেই হল। কে বলল প্রমোদ এসেছে? বন্ধুরা?'
-' না রে আমার চোখ দুটো দেখেছে ওকে আমার মনটা মুখ ফিরিয়ে নিয়েও মুখোমুখি হয়েছে ওর।'
-' মানে ঠিক বুঝলাম না। কোথায় দেখা হল? কথা হয়েছে নাকি? আর হলেই বা কি চেনা মুখ,চেনা মানুষ অচেনা হয় নাকি?'
     ভারী বুকের থেকেও খুব হাল্কা করে শব্দগুলো বলে রাণা।
     মুনিয়া আজ মনের চোরা কুঠুরিতে যা জমে ছিল তার সবটাই বলতে থাকে রাণাকে একটু একটু করে শুধু বলতে পারে না রোজ সকালে প্রমোদ অভ‍্যেসে বা কৌতূহলে হাঁটে রাণার পরিচিত পথেও। হয়ত মুনিয়ার ও অভ‍্যেসে এসে গেছে প্রমোদের সকালে দ্রুতপায়ে দৌড়ে পার হওয়া ওদের বাড়ির পথটুকু।
    সব কথার শেষে বলে,' সত‍্যিই আমার ভালো লাগছে না মনে হচ্ছে চাকরি ছেড়ে বা একটা বেশ লম্বা ছুটি নিয়ে চলে যাই তোর কাছে। তোর বুকের কাছে আবার গুটিসুটি মেরে ঘুমোব,আদর মাখব দুই গালে আর কোন চিন্তা থাকবে না।'
  -' সত‍্যিই আসতে চাস তুই?'
-' যদি পারতাম এখনি এই মুহূর্তে।'
   রাণার আবেগ হঠাৎই আর বাধা মানে না,'এতদিন বলিসনি কেন?'
  -' বলতে পারিনি ভয় পেয়েছিলাম,হেরে যাওয়ার আর হারানোর ভয়।'

        মুনিয়া ফোন রেখে দিয়েছে বেশ কিছুটা আগে এদেশে এখন গভীর রাত। তবে বেশ অনেকটা পরে রাণার ঘুমের সময় হয়ে গেলেও ঘুম আসে না চোখে। বারবার মনে হয় প্রমোদ ফিরে এসেছে। প্রমোদ এখনও সাহসী,আবার হয়ত যাচাই করতে চায় মুনিয়ার দুচোখ কি কথা বলে? তাই ওর জন্মদিনে গোলাপ দিয়ে গেছে বোধহয়। সত্যি কিছু ভালো লাগে না। আজ সত‍্যিই খুব খারাপ লাগছে মুনিয়ার জন‍্য। শেষে প্রমোদকে প্রবালদার ভাই হতে হল!
     বোনকে বাঁচাতে বিয়ে করেছে না আরো কিছু,বড়লোক শ্বশুর দেখে মাথা ঘুরে গেছে।
   হয়ত ওর এই মনখারাপটা বাঁচাতেই মুনিয়া কিছু বলেনি ওকে শুধু কষ্ট পেয়েছে নিজে নিজে।
     শুধুই কি মুনিয়ার জন‍্য মনখারাপ? হয়ত সন্দেহের একটা ছোট্ট সূঁচালো তীরও বিঁধলো রাণার মনে।
    ইশ্ জুনিটা যদি একটু কাছাকাছি থাকত তাহলে ভালো হত। অন্ততঃ এই সময়টাতে মুনিয়ার মন ভালো থাকত।

**************************

     মাঝে কেটে গেছে বেশ কতগুলো দিন,প্রমোদের অদৃশ‍্য চোখ বেশ কিছুদিন আর মুনিয়াকে দেখতে পায় না। ওর খোলা জানলা বলে দেয় কোথাও ঠিক আছে মুনিয়া। হয়ত বা ঘুমোচ্ছে। নিজের মনকে বেঁধে রাখতে চেষ্টা করছে মুনিয়া। 

       আর হয়ত মাঝে দুটো মাস তারপরেই প্রমোদকে ছাড়তে হবে এই শহর। একটা কাজ নিয়ে এসেছিল কয়েক মাসের জন‍্য এখানে। এই শহর আবার মনে করিয়ে দিল সেই মুখটা যেটা ও ভুলতে বাধ‍্য হয়েছিল।
     শুধু মুনিয়ার সঙ্গে যদি একবার কথা বলতে পারত ভালো করে। রুমকি ভাবী সব বলেছে ওকে শুনেছে প্রমোদ তবুও একবার যদি সামনাসামনি কথা হত। ওর হাতে সত‍্যিই আর বেশি সময় নেই। আর হয়ত কোনদিন দেখা হবে না মুখোমুখি এভাবে। যে কথাগুলো বলার ছিল তা আর বলা হবে না....

        জুনি আজ ফোন করেছিল মুনিয়াকে অনেকক্ষণ কথা বলল তারপরে হঠাৎই বলল,' আমাদের এখানে একদম পাশেই একটা ফ্ল্যাট আছে সেখানে চলে আসবি? দুই বন্ধু কাছাকাছি থাকব,সকালে বিকেলে বেশ গল্প হবে।'
  মুনিয়ার হঠাৎই কেমন যেন মনটা মেঘলা হয়ে যায় তবুও নিজেকে সামলে বলে,' রাণার আইডিয়া তাই না? এইজন‍্য আমি ওকে কিছু বলতে চাইনি। আমার ফ্ল্যাটটা বড় মনে জড়িয়ে গেছে রে। কতদিন আছি। ওখানে সবাই আমাকে ভালোবাসে। আচ্ছা ভেবে দেখি বলব।'
    রাণাকে কিছু না বললেও একটু অভিমান হয় মুনিয়ার তাই ফোনে ওকে বলে,' জুনির বাড়ির কাছে আমাকে পাঠিয়ে আমাকে নিশ্চিন্ত করতে চাইছিস? না নিজে নিশ্চিন্ত হতে চাইছিস?'
  -' মুনিয়ার হঠাৎ করা প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারে না রাণা।'

   রাণা মুনিয়ার মত অপকটে সব কথা বলতে পারে না তবে মুনিয়ার মনের গভীরতা মাপতে পারে। ও জানে মুনিয়া খুশি হয়নি প্রমোদকে দেখে। একা কষ্ট পেয়েছে অনেকটা কাউকে বলতে পারিনি। অথচ প্রমোদকে এড়িয়ে যেতেও পারেনি। রুমকিদির হাত ধরে প্রমোদ এসেছে বারবার ওর সামনে। কখনও ও মুনিয়াকে মিস্ করে এখনও বোঝাতে জন্মদিনে নিজে আড়ালে থেকে রেখে গেছে ফুলের তোড়া।
     মুনিয়া প্রমোদকে ভোলেনি দেখে কখনই রাগ হয়নি রাণার বরং মুনিয়ার সরলতা ওর ভালো লাগত। সেই তুলনায় ও ঝুমের কথা অনেকদিন বলতে পারেনি। ভেবেছিল শুনলে মুনিয়ার খারাপ লাগবে। একই কারণে মুনিয়াও মনে চেপে রেখেছে সব খারাপ লাগা। রাণার খারাপ লাগতে পারে সন্দেহ হতে পারে এই ভেবে। তবে এখন সবটাই জলের মত পরিস্কার। সত‍্যিই রাণারও আর একটুও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে পৌঁছে যায় মুনিয়ার কাছে। কিন্তু কোন উপায় নেই। সত‍্যিই খুব খুব মিস্ করল মুনিয়াকে। সেই জেদী,অভিমানী আর হয়ত অনেকটা রাগী হলেও নরম মনের মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতে খুব খুব ইচ্ছে করল।
    বাড়িতে ফোন করে কি বলবে বাবাকে কদিন মুনিয়ার কাছে থেকে আসতে। তারপরেই সাবধানী হয় রাণা এমনিতেই মুনিয়ার অভিমান হয়েছে জুনির বাড়ির কাছে ফ্ল্যাটের কথা বলায়। মনে হচ্ছে রাণা ওকে সন্দেহ করছে না না এখন এসব বলা যাবে না। বরং আরও বেশি করে ভালোবেসে ওর সাথে থাকতে হবে। কারণ অনেকটা কষ্ট করে মুনিয়াকে সুস্থ করতে হয়েছিল সেই সময়। দিনের পর দিন অবসাদে ভুগেছে মুনিয়া। ওর মনে আর কোন আঘাত লাগুক সত‍্যি চায় না রাণা।
     রাণার কথা শুনে মুনিয়ার মনে হয় কত লাকি ও। এমন করে যদি একে অপরের মনের কষ্টগুলো মানুষ বুঝত তাহলে বোধহয় সুখবন্দীপ্রেমে কাটত জীবন আদুরে রূপকথায়। কিন্তু জীবন এমন তো নয়। প্রতি পদক্ষেপে হয় যাচাই,তুমি কি করলে আর আমি কি করলাম। কে কতটা দিলাম আর কতটা ফেরত পেলাম সেই হিসেবেই মেঘলা হয়ে যায় কত সোনা রোদ মাখা দিন।

        আকাশে নীল মেঘের ভেলার সাজগোজ, আনমনা মুনিয়া অফিস থেকে ফেরার সময়। রাণাকে ছাড়া বড় ফিকে সামনের পুজোর দিনগুলো। এখনও তো জানায়নি কবে আসতে পারবে। যদিও কৃষ্ণনগরে বরাবরের মতই চলছে ব‍্যস্ততা। বারবার ফোন করছে ডল,' বৌদিভাই কি করছ এবারের প্ল‍্যানিং? শপিং করছ তো? আমি তো শুরু করে দিয়েছি শপিং।'
     মুনিয়ার মনের ভালো না লাগাটা চাপা দিয়ে ডলের সাথে বকবক করে অনেকটা সময় কেটে যায়। সবার সাথে কথা বলে মনে হয় সবার মধ‍্যেই আছে।

        সেদিন বিকেলে টুকটাক কিছু কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয়ে যায় মুনিয়ার। ব‍্যাগগুলো একহাতে ধরে লেটারবক্সে হাত দেয় মুনিয়া। হয়ত বেশিরভাগ দিনই থাকে তা ফাঁকা তবুও একটা অভ‍্যেস হয়ে গেছে দেখা। খামটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে মুনিয়া, টাইপ করে লেখা ওর নাম। কোথা থেকে এসেছে কে জানে? কিছুই তো লেখা নেই।
      সব কিছু একপাশে রেখে নিজেকে ফ্রেশ করে খামটা খোলে মুনিয়া। ভালোবাসার চিরকুটে অভ‍্যস্ত মুনিয়ার কাছে এসেছে অনেকদিন বাদে একটা চিরকুট। তাতে অবশ‍্য লেখা নেই কফি করা আছে খেয়ে নিস,অথবা তোর দেওয়া গন্ধটা মেখে অফিসে গেলাম ফুলগুলো খুব সুন্দর হয়েছে দেখতে।
      অল্প কিছু লেখা তবে ঝরঝরে ইংরেজীতে। লেখাটা চেনা মুনিয়ার এই তো কিছুদিন আগেই দেখেছিল। প্রমোদ লিখেছে ফোন নম্বর পেতে পারতাম কিন্তু ইচ্ছে করেনি ফোন করতে,জানি কথা বলবি না। একবার শুধু একবার কি দেখা করে কথা বলতে পারি আমরা? আর কোনদিন হয়ত দেখা হবে না আমি চলে যাব আবার অন‍্য কোথাও।'
      তারিখ সময় আর জায়গাটায় চোখে আটকে যায় মুনিয়ার। হঠাৎই মনে পড়ে সেদিন তো প্রমোদের জন্মদিন। একটা সময় এইদিনে কত প্ল‍্যান থাকত।
     চিঠিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল মুনিয়া। আর তো কিছু শোনার নেই,সবটাই ও শুনেছে রুমকিদির কাছে। হয়ত সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি হবে। তবে আশ্চর্য লাগে,সেই পুরোনো পন্থাতেই প্রমোদ আজও জানিয়েছে মনের কথা।
    এখান থেকে চলে যাবে সেকথা ও জেনে কি করবে? আবাহন বিসর্জন কোনটাই এখন ওর জন‍্য মনে নেই। রাণাকে সব শেয়ার করতে পেরে অনেকটা ভালো আছে মুনিয়া। তবে আজকাল ওদের কথার মাঝে ভুল করেও কেউ আর প্রমোদ বা ঝুমের কথা আনে না। ভালো থাকতে চায় নিজেদের ছোটছোট ভালোলাগা আর আপনজনেদের নিয়ে।
      চিরকুট টা আবার পড়ে মুনিয়া, প্রমোদকে যতটা চালাক ভেবেছিল ততটা নয়। একটা সময় ওর বুদ্ধি নিয়ে মজা করত ওরা। এটা যদি ওর নেতা শ্বশুর দেখে তাহলে কি হবে? নিজের ছেলেমানুষীতে মুনিয়া হাসে আবার। রাণাকে বলবে এই চিরকুটের কথা? 
    মানে এই যে আমার প্রবাসী বর তোমার বৌয়ের প্রাক্তনের সাহস তো বাড়ছে দিন দিন। আমাকে চিঠিপত্র লিখছে। না না কি হবে বলে? হয়ত বেচারার মনে আরও সন্দেহ ঢুকবে। তাছাড়া ও তো যাবে না সুতরাং এত ভাবনায় কি দরকার। রান্নাঘরে গিয়ে খাম সমেত চিঠিটা পুড়িয়ে ফেলে মুনিয়া। এতে বোধহয় আর কারোরই প্রয়োজন নেই। আগুনটা নিভে যেতে ওর মনের আগুনও একটু ঠান্ডা হয়। ছাইটুকু এক জায়গায় করে ফেলে দেয় ডাস্টবিনে। কিছু চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াই ভালো। এমনভাবে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে তো অনেক কিছুই কিন্তু সব কি ফেলা যায়?

          অনেকদিন বাদে রুমকিদির ছবি দেখল ফেসবুকে। প্রবালদা আর বাবলিকে নিয়ে উটি বেড়াতে গেছে। ছবিগুলো দেখে অতীতে ডুব দেয় মুনিয়া। ইশ্ কি ভালো ছিল সেই দিনগুলো! তখন অবশ‍্য প্রেম ছিল না রাণার সাথে। তবুও একটা অদ্ভুত আবেশে জড়ানো ছিল সময়টা। ভালো করেছে রুমকিদি বেশ ফ‍্যামেলি টাইম এনজয় করছে।

         পরপর কয়েকদিন ছুটি ছিল তার মধ‍্যে একদিন জুনির বাড়িতে কাটলো ওদের পুচকেটা খুব চঞ্চল হয়েছে। জুনিও এক কথা বলল কি ভালো ছিল উটির ট‍্যুরটা। একরাশ ঝলমলে খুশি নিয়ে ফিরল মুনিয়া। রাতে অনেকটা সময় রাণার সাথে ফোনে কথা হল। পুজোর কথাও বলল,রাণা থাকবে না বলে একটুও ভালো লাগছে না।
    ..' কবে কি পড়েছে একটু ডেটগুলো বলত। এখানে তো কিছুই বুঝতে পারি না তেমন করে। চারদিকে একটু একটু করে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। শরতের রঙটা বুঝতে পারছি না।'
-' তুই কি করবি জেনে শুনি, যে আসবেই না তার কি এসে যায় সময় আর তারিখের হিসেবে?'
    রাণাকে তারিখের কথা বলতেই মুনিয়া হিসেব করে আর সত‍্যিই বেশিদিন বাকি নেই। কিন্তু তার একসপ্তাহ আগে.....মুনিয়ার আঙুলটা একটা তারিখে এসে থামে প্রমোদের জন্মদিন। ওকে অনেক আগে থেকে আসতে বলেছে। যদিও সবই পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছে মুনিয়া তবুও টু বি নট টু বি এই নিয়ে একটা হুটোপুটি খেলা করে মনটা। কাজটা করা কি উচিত হবে? না কি যাবে? 

       সময় যত এগোতে থাকে মুনিয়ার মনের টানাপোড়েন বাড়তে থাকে তত। ভীষণ অস্থির লাগে মুনিয়ার। জুনিকে বলে কি ওর সাথে যাবে? জুনি তো বলেছিল কোনদিন সত‍্যিই যদি কিছু বলতে চায় প্রমোদ ও সাথে থাকবে ওর। পুড়িয়ে ছাই করে ফেলা অক্ষরমালা হঠাৎই জীবন্ত হয়ে ডাকে মুনিয়াকে একবার কথা বলতে চায় প্রমোদ খুব কি ক্ষতি কিছু হবে? তারপর তো ও চলেই যাবে। সত‍্যিই তো এই কয় মাসে কোনদিনই কথা হয়নি ওদের মাঝে।

    কি করবে মুনিয়া? রাণার সাথে সুখী দাম্পত‍্যে ও কিছুতেই পরকীয়ার কালির ছিটে লাগাতে চায় না। তবুও কেন যেন অদ্ভুত একটা অস্থিরতা ওকে গ্ৰাস করছে।

     আজ সকাল থেকে বড় এলোমেলো মুনিয়া। দেখতে দেখতে এসে গেছে সেই দিনটা,কালই সেই দিন। নিজের নানা কাজের মধ‍্যে বারবার আনমনা মুনিয়া। পুড়ে যাওয়া অক্ষরগুলো পুড়ে গিয়েও মনকে পোড়াচ্ছে।
    সারাদিনই নিজেকে ব‍্যস্ত রাখে মুনিয়া। রাণার সাথে মাঝে একটা দুটো মেসেজে কথা হয়েছে। কি একটা কাজ যেন পড়েছে। ফিরতে দেরি হবে। অনেকটা রাত্রি পর্যন্ত অপেক্ষা করে একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে মুনিয়া।
         হঠাৎই বেল বাজার আওয়াজ পায়। প্রথমে ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারে না আওয়াজ কোথা থেকে আসছে। তারপর বেলটা আবার বাজে। অদ্ভুত একটা ভয় করে মুনিয়ার। কোন খারাপ খবর? না খারাপ মানুষ?
  

        খুব সাবধানে আই হোলে চোখ রাখে মুনিয়া নিঃশব্দে। তারপর বুকের ভেতরের ঘড়ির পেন্ডুলামটা
 খুব জোরে জোরে দুলতে থাকে। এক ঝটকায় লক খুলে রাণাকে জড়িয়ে ধরে মুনিয়া।
       বড় ঢাউস ট্রলিটাকে ঘরে ঠেলে দিয়ে মুনিয়াকে জড়িয়ে ধরে রাণা। মাঝ রাতে এক অদ্ভুত আনন্দের ঘোরে ডুবে যায় মুনিয়া। রাণা ওর অনুভূতি দিয়ে ছুঁতে চায় মুনিয়ার অস্থির মনটাকে। মুনিয়া বেশ কিছুক্ষণ ডুবে রয়েছে ওর বুকে। ওকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না রাণারও। এতদিন বড্ড অস্থিরতায় ডানা ঝাপটেছে মুনিয়া পাখি এখন একটু ওর শান্তির নীড়ে মুখ ডোবাক। মুনিয়ার গাল দুটো খুব ভেজা,রাণা ওর গাল দুটো দুহাতে ধরে বলে,' আমি এসে গেছি তো আর কেন কান্নাকাটি। আর একদম কোন মনখারাপ নয়। দেখি আমার বৌটাকে একটু কাছ থেকে। কতদিন ছুঁই না তোকে।'
   -' আমাকে আগে বলিস নি কেন তুই আসছিস? নিশ্চয় সবাই জানে শুধু আমি ছাড়া তাই তো?'
  রাণার মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি খেলে যায়,' তাই তো মাঝরাতে এসে একদম হামলা। অনুভব করলাম মুনিয়ার বুকের ধুকপুক।'

**************************
  মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ওঠা মুনিয়া রাণার আদরে জাগলো সারারাত। সত‍্যিই কি অদ্ভুতভাবে একটুও ক্লান্তি নেই রাণারও। মনে হচ্ছে যেন এভাবেই তো একসাথেই ছিল এতদিন মাঝখানের দিনগুলো ছিলই না কখনই।
            ভোরের আলোর গন্ধ মাখে কতদিন বাদে একসাথে। হঠাৎই মুনিয়া আবদার করে,' কতদিন কোথাও যাইনি আমরা বেড়াতে যাব এখনই। একসাথে দু তিনটে দিন কাটাবো কোথাও যেখানে শুধুই থাকব আমরা। সত‍্যিই আর পারছি না কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছে।'
     এমনিতেই কদিন এখানে থেকে মুনিয়াকে নিয়ে ওর চলে যাওয়ার কথা কৃষ্ণনগরে তবুও যখন মুনিয়া বলেছে তখন তো যেতেই হবে। মুনিয়ার জন‍্য সবটুকু করতে ইচ্ছে করছে আজ রাণার। সেই ছটফটে মুনিয়াটাকে আবার খুঁজে পেতে চায় রাণা তার জন‍্য যদি নিরুদ্দেশে পাড়ি দিতে হয় তাতেও রাজি রাণা।
           সবুজ রাস্তায় ঢেউ তুলে এগিয়ে চলেছে ওদের গাড়িটা, মুনিয়ার এলোমেলো মনটা আর অগোছালো ঘর রইল পেছনে পড়ে। খোলা হাওয়া দোলা দেয় ওর ক্লান্ত মনে। রাণার খুব কাছে বসে ওর ভালোবাসাকে মুঠো ভরে নিতে চায় মুনিয়া। মুনিয়াকে খুশি করতে এক কথাতেই দশমিনিটের প্ল‍্যানেই ঘরে তালাবন্ধ করে বদ্ধ মনকে উড়িয়ে দিল রাণা।

       মুনিয়া আদুরে সুরে বলল,'একবারও রাগ হল না আমি বললাম বায়না করে আজই বেরোব এখনি বেরোব আর সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়লি। কতটা পথ পেরিয়ে এলি।'
-' আমি তো জানি আমার ক্ষেপি বৌকে তারপর এতদিন বাদে ভালোবাসায় ডুব দিতে আমারও ইচ্ছে করছিল একটু নির্জনে। সত‍্যিই তো দুজনে কতদিন কোথাও যাইনি। বেশ ভালো লাগছে কতদিন বাদে চেনা শহরে চেনা মানুষের সাথে খুব কাছাকাছি বসে চলে যাচ্ছি নিরুদ্দেশে।'
     মুনিয়া প্রাণভরে হাসে অনেকদিন বাদে জানতে চায় কোথায় যাচ্ছে ওরা? সত‍্যিই তো গাড়ি চলছে আর চলছে এই দিকটায় কোনদিন এর আগে আসেনি ওরা। ও যাবো বলে বায়না করে বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে বেরোনোর মোটামুটি একঘন্টা বাদেই গাড়ি এসে হাজির। কোনরকমে কয়েকটা জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়েছে মুনিয়া। দু তিন দিন হয়ত থাকবে কত আর লাগবে? নিজের অবাধ‍্য চুলগুলো উঁচু করে বেঁধে একটা টপ আর জিন্স পরে রেডি হয়ে গেছে মুনিয়া।
 -' এই তো মুনিয়া একদম স্মার্ট ট‍্যুরিস্ট হয়ে গেছে। দেখি দেখি একবার।' চট করে একটা সুন্দর সানগ্লাস ওর চোখে পরিয়ে পারফিউমটা স্প্রে করে দিয়েছিল সারা গায়ে। রাণার এটা বরাবরের অভ‍্যেস বিয়ের পর থেকেই একসাথে কোথাও গেলে মুনিয়াকে সুগন্ধি স্নান করায় রাণা তারপর ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে সেই সুগন্ধ মাখে নিজেও গালে মুখে আর শরীরে। শিহরণ জাগে মুনিয়ার সারা শরীরে।
 -' আমার জন‍্য এনেছিস?'
-' আরও কিছু আছে,এই দুটো সাথে নিয়ে নে কাজে লাগবে। অন‍্যগুলো থাক পরে বের করব। এখানে এসে তোর মনের বাক্স খুলতেই তো ব‍্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমার বাক্সে তেমন কিছু নেই ফিরে এসে দেখাব।'
    রাণার কয়েকটা ছোট্ট কথা মুনিয়াকে ছুঁয়ে যায় কথাগুলো ছোট হলেও খুব গভীর হয়ত বা একটু ভারীও।

    রাস্তার পর রাস্তা পেরিয়ে গাড়ি চলেছে নিজের মত মাঝে একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে কফি আর ছোট্ট ব্রেকফাস্ট করে নিল ওরা।
   রাণা বেশ কিছুক্ষণ নেট দেখেছে,মুনিয়া বুঝতে পারে বৌয়ের বায়নায় বেচারা গুগলভাইয়ের কাছেই উপদেশ নিচ্ছে অন‍্য সময় হলে অম্লানদা হয়ত গাইড করত। তবে মুনিয়াকে নিয়ে আসার আগে একটাই শর্ত দিয়েছে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছি কিন্তু যেখানে নিয়ে যাব সেখানেই যেতে হবে কিছু বলা যাবে না।
     ঘাড় নেড়েছে মুনিয়া। রাণা যে ওকে ওর দোটানার ছোট্ট কুঠরি থেকে বের করে খোলা আকাশের নিচে নিয়ে এসেছে এটাই অনেক বড় পাওয়া ওর কাছে।
      অনেকটা পেছনে পড়ে রইল প্রমোদের জন্মদিনের আমন্ত্রণের সন্ধ‍্যা আর ভুলেও শুনতে হবে না কোন কথা যা ও শুনতে চায় না। সত‍্যিই কি ফিরে আসবে সেই দিনগুলো? সত‍্যিই কি মুনিয়ার হসপিটালে কাটানো সেই দিনগুলো ভুলে যাওয়া যাবে? 
     মনে মনে ভগবানকে বলে ভাগ‍্যিস রাণা এসেছিল সেই দুঃস্বপ্নের রাতে হঠাৎই।
      -' আমরা কোথায় যাচ্ছি বল না?'
  -' শর্তভঙ্গ হচ্ছে কিন্তু।' বলেই হাসে রাণা। এর মাঝে বাড়ি থেকে দুবার ফোন হয়ে গেছে। কিছু কথাই না বলা রাখে রাণা। যদি শোনে কাল মাঝ রাতে এখানে ঢুকে এখনি ওরা আবার বেড়াতে বেরিয়েছে তাহলে সত‍্যিই বাড়িতে ভাববে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে একদম। রাতে ফোন করে বলবে বরং।

       উদুপী নামটা অনেকবার শুনেছে মুনিয়া কর্ণাটকে থাকার সুবাদে কিন্তু যাওয়া হয়নি কখনও। সবসময় অফিস আর বাড়ি করে কেটে গেছে কখন যাবে।
    রাণা চটজলদি চিন্তা করে এখানে আসার প্ল্যান করেছে। নিশ্চয় মুনিয়ার ভালো লাগবে এখানে।

       উদুপীতে যখন গাড়ি এসে দাঁড়ায় একরাশ ভালোলাগা ছড়িয়ে যায় মুনিয়ার মনে। চারদিকে একটা সুন্দর আবেশ ছড়ানো সুন্দরী উদুপী। মুনিয়ার সাথে একটু নিভৃতে কাটানোর জন‍্য রাণা মুঠোফোনে বুক করে ফেলেছিল মেসরিজাইজিং ব‍্যাকওয়াটারে থাকার জন‍্য ক্রুজ। এইরকম সুন্দর ব‍্যবস্থা জলের মধ‍্যে থাকতে পারে তার অভিজ্ঞতা কাশ্মীরে হলেও। এখানে এই অভিজ্ঞতা এর আগে কখনও হয়নি মুনিয়ার। চারদিকে জল আর ছায়ামাখা পরিবেশের মাঝে যখন ক্রুজে উঠে এল ওরা ঠিক মনে হল এ বোধহয় এক ভালোবাসার স্বর্গ। অনেকদিন পর রাণার সাথে এখানে এসে হঠাৎই মুনিয়ার কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল। ক্রুজের সুন্দর সাজানো ঘরে রাণাকে আদরে জড়ায় মুনিয়া আর আমাকে ছেড়ে যাস না। চিন্তায় চিন্তায় এবার মুনিয়া মরে যাবে।'
-' এত সাহসী মুনিয়ার মুখে হঠাৎ এমন কথা কেন শুনি? কি সুন্দর জায়গায় এসেছি আমরা এবার ভালো করে আনন্দ কর। দাঁড়া তো এখানে ছবি তুলে দিই। ইশ্ কতদিন ছবি তুলিনি তোর।'
            ভীষণ ভালো ব‍্যবস্থা এখানে, লোকজনের ভিড় খুব একটা নেই নিজের মত ঘুরে ঘুরে ছবি তুলছে ওরা। মুনিয়ার মনের সব খারাপ লাগা হঠাৎই ম‍্যাজিক ম‍্যানের ম‍্যাজিকে উধাও হয়ে গেছে।

           পড়ন্ত বিকেলে সূর্য তার লাল আভা ছড়িয়েছে আকাশে আর কিছুক্ষণের মধ‍্যে অস্তে যাবার তোড়জোড়। মুখোমুখি বসে রাণা আর মুনিয়া ডুব দিয়েছে অনেকদিন বাদে মন ভালো করা গল্পে। ঠিক মনে হচ্ছে প্রকৃতি মা আদরে তার আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে জলের ওপর চারদিকের গাছের ছায়া মন জুড়োনো অনুভূতি দিয়ে স্নিগ্ধ করছে দীর্ঘদিনের চিন্তায় অবসন্ন মুনিয়ার মন। সব উদ্বেগ আর চাপ এক নিমেষেই দূর হয়ে গেল।
             কফির কাপের চুমুকে নেমে আসে একটু একটু করে সন্ধ‍্যার আঁধার। রাণার ঘাড়ে মাথা রাখে মুনিয়া।

***********************
   মুনিয়া কি আসবে? আজ এই ভাবনা সকাল থেকেই আনমনা করেছে বারবার প্রমোদকে। এই কদিন মুনিয়াকে আর দেখেনি। ভাইয়া ভাবীও বেশ কয়েকদিন ছিল না। তাছাড়া ভাইয়া বাড়িতে থাকলে ওর একটু বাধো বাধো লাগে। বেশ কদিন যাওয়া হয়নি ওদের বাড়িতে। 
          সন্ধ‍্যের আগেই প্রমোদ এসে দাঁড়ায় হোটেলের সামনের রাস্তায়। গাড়িতে বসেই অপেক্ষা করে মুনিয়ার জন‍্য। এই দিকটা বেশ নির্জন,তেমন কোন গাড়ির ভিড় নেই। মুনিয়া এলে ওকে এখান দিয়েই আসতে হবে। সময়,তারিখ জায়গা সবই তো লিখে দিয়েছিল ঠিকঠাক। বলেছিল এখানেই অপেক্ষা করবে।
তবে ওর মন বলছে নিশ্চয় আসবে মুনিয়া। ওকে এখনও ভুলতে পারেনি মুনিয়া। প্রথমদিন ওকে দেখে অদ্ভুত রিঅ্যাক্ট করেছিল। খুব খারাপ লেগেছিল কিন্তু তবুও কিছু বলতে পারেনি। তারপরে কখনও ভুলেও একটা কোন কথা বলেনি। তবে আজ নিশ্চয় আসবে ওর চিঠি পেয়ে। 

          অপেক্ষায় কেটে গেছে অনেকটা সময় বারবার ঘড়ির দিকে তাকায় প্রমোদ আর মনে মনে বলে মুন্নী প্লিজ। তবে মুনিয়াকে ফোন করার সাহস ওর নেই। যদিও একদিন ভাবীকে বলেছিল মুনিয়ার ফোননম্বরের কথা। অদ্ভুতভাবে ভাবী বলেছিল,' কারও কনসেন্ট না নিয়ে মোবাইল নম্বর শেয়ার করা ঠিক নয়। আর বিশেষ করে সেটা মুনিয়ার নম্বর তোমার ভাইয়া জানলে খুব রাগ করবে। নিজের ফ‍্যামেলির কথা ভাব, তেমন কিছু হলে আমাদের ঘাড়েই সব দোষ পড়বে। মেসো যা রাগী তারপর বেবির ভবিষ্যত আছে। আর তোমার শ্বশুরবাড়িতে জানলে কি হবে ভেবেছ?'
    প্রমোদ বুঝতে পেরেছিল ভাইয়ার শেখানো কথা বলছে ভাবী। অথচ এক সময় ভাবী ওর কষ্টটা বুঝেছিল।
শুধু বলেছিল,' আমার কোন ফ্রেন্ড থাকতে পারে না? আশ্চর্য তো!'


        ক্রুজের আলোগুলো খুব উজ্জ্বল,একঝলক ঠান্ডা বাতাসের উচ্ছ্বাস মুনিয়াকে স্নান করাচ্ছে শীতলতায়। ঘড়িতে চোখ রাখে মুনিয়া সেই সময়টা অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছে। প্রমোদ হয়ত এতক্ষণে বাড়ি ফিরে গেছে। একটা অদ্ভুত প্রতিশোধের প্রশান্তি ফুটে ওঠে ওর চোখেমুখে। একদিন প্রমোদের জন‍্য ছিল ওর মন উতলা করা অপেক্ষা। যার জন‍্য মাঝে মাঝে রাণার অস্তিত্বও অসহ‍্য লেগেছে। আজ প্রমোদ একটু হলেও বুঝুক মুনিয়া সব পারে। প্রত‍্যাখ‍্যান একটু হলেও বুঝুক প্রমোদ আর কোনদিনই ওকে দেখতে বা ওর সাথে কথা বলতে চায় না মুনিয়া সেটা বুঝিয়ে দিতে চায় ওকে।
    নিজের নরম মনটাকে আর বারবার ভাঙতে দেবে না কাউকে। হয়ত যা হয়েছে তা ভালোর জন‍্যই হয়েছে। প্রমোদ বুঝুক আজ কথা না রাখলে কেমন লাগে। তাছাড়া মুনিয়া তো ওকে কোন কথাই দেয়নি। অদ্ভুত একটা আনন্দ হল মুনিয়ার। প্রমোদ আজ অতীত, আর সেই পুরোনো গল্প শোনার কোন ইচ্ছে ওর নেই। ক্ষমাটা দুবছর আগে চাইতে পারত প্রমোদ।

 ক্রুজে তখন মিউজিক বাজছে রাণার কোমর জড়ায় মুনিয়া। ওর শরীরটা এলিয়ে দেয় পরম নির্ভরতায় রাণার বুকের মধ‍্যে মনে মনে ভাবে আবার ভাগ‍্যিস তুই হঠাৎই এলি।
      আজ বারবার মনে হল একটা কবিতার কথা মুনিয়ার কেউ কথা রাখেনি....কেউ কথা রাখে না। আর মুনিয়ার সাথে তো কোন কথাই হয়নি ওর।

        বাড়িতে ফিরে এসে এক বিধ্বস্ত,ক্লান্ত মুনিয়াকে দেখেছিল রাণা। অথচ চব্বিশ ঘন্টা পার হতে না হতেই রাণার ভালোবাসার ভরসাটুকু সাথে নিয়ে বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে মুনিয়া। বিয়ের আগের দিনগুলো আর পরের দিনগুলো বোধহয় সত‍্যিই আলাদা।

       প্রমোদ ফিরে আসার পথে ইচ্ছে করেই যেন মুনিয়ার বাড়ির সামনে দিয়ে এল বড় চেনা হয়ে গেছে বারান্দাটা হঠাৎই বড় আঁধার কালো লাগল সব কিছু। কোন আলোর অস্তিত্ব নেই। আর কিছু দেখতে পায় না প্রমোদ শুধু অন্ধকারটাই চোখে ভাসে। অনেক দিন বাদে জন্মদিনের রাতটা একমুঠো অন্ধকারে কাটল প্রমোদের।

***********************

   ক্রুজ আর হোটেল মিলিয়ে দুদিনে ফেরা হল না ওদের। অনেকদিন বাদে এত কাছাকাছি থাকার আনন্দে ছুটির মেয়াদ বাড়ল। মুনিয়া উধাও হল রাণার সাথে আফটার লঙ বিরহের পর হানিমুনের আনন্দে।
    বেশ কাছে ব‍্যাঙ্গালোর থেকে অথচ আসা হয়নি ওদের তাই এখানে যা যা দেখার সবই দেখল মন ভরে ওরা। অনেকগুলো প্রাচীন মন্দির আছে এখানে। মুনিয়ার গ‍্যালারীতে ভরে গেল নানান সুন্দর দৃশ‍্যের ছবি তবে ও আর ফেসবুকে কিছু পোস্ট করতে চায় না। একটা সময় সত‍্যিই মনে হত গ্ৰহণ লেগেছে ওদের সুখী দাম্পত‍্যে। হয়ত মুনিয়াও অনেকটা দায়ী ছিল নিজের মনকে বাঁধতে পারেনি মুনিয়া।
-' ভালো লাগছে জায়গাটা? হ‍্যাপি?' রাণা আদরে ডুবিয়ে দিয়ে বলে মুনিয়াকে।
-' খুব,আচ্ছা এখানেই যদি থেকে যাই আমরা।'
-' না বাচ্চা মেয়ে,আমাদের ফিরতে হবে তো? কত কাজ আছে এখনও। তারপর তোর অফিস? তারা তো মাঝে মাঝেই জ্বালাচ্ছে। শান্তি নেই একটু আদরে কাটাব বৌয়ের সাথে সেখানেও অফিসের যন্ত্রণা।'
-' আর যদি না যাই ওখানে চলে যাই নিরুদ্দেশে?'
-' আচ্ছা নাই বা গেলাম তবে কৃষ্ণনগরে তো যেতে হবে সবাই অপেক্ষা করছে ওখানে।'

        বেরানোর জায়গায় থাকতে চাইলেও থাকা যায় না। তাই মুনিয়াকেও ফিরতে হয়েছে ওদের পরিচিত সাজানো সংসারটায় আবার। তবে ভীষণ আনন্দে কেটে গেল মুনিয়ার সেই বোরিং দিনগুলো হঠাৎই রাণার ভালোবাসায়। আবার সেই খুনশুটি, আনন্দ আর হাসিতে ভেসে বন্ধুদের সাথে গেটটুগেদার। সবাই খুশি এতদিন বাদে রাণাকে পেয়ে।
       রাণা আসার খবর পেল প্রবাল,রুমকিও। মুনিয়া না জানাতে চাইলেও হঠাৎই দেখা হয়ে গেল রাণার সাথে প্রবালদার। শুধু প্রমোদের চিরকুট আর মুনিয়ার ইচ্ছাকৃত অবহেলার কথা রইল দুই প্রাক্তনের মনের মাঝেই। পোড়া ছাইয়ের রঙ গাঢ় কালো তাই মনটাকে বারবার ধুয়ে ফেলতে চেয়েছে মুনিয়া রাণার ভালোবাসা দিয়ে।
       মুনিয়া যে শহর থেকে কদিন নিভৃতবাসে হারিয়ে গেছিল সেই শহরে কয়েকদিন মুনিয়াকে খুঁজেছিল প্রমোদ ওর সবুজ আদরমাখা বারান্দায় তবে বন্ধ জানলাগুলো বলে দিয়েছিল নেই মুনিয়া।
    মুনিয়া কোথায় যেতে পারে এই ভাবনায় হারিয়ে যাওয়া প্রমোদকে ফিরে যেতে হয়েছিল তাড়াতাড়ি করে ওর পরিচিত জগতে। হঠাৎই শ্বশুরবাড়ি থেকে খবর এসেছিল মধুর শরীর ভালো না প্রমোদ যেন চলে আসে।

    এখানকার কাজের মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল প্রমোদের তবুও হয়ত একটা অপেক্ষা ছিল তবে সেদিনের পর সেই অপেক্ষা ফুরিয়েছে। খারাপ লাগাটা হয়ত একটু হলেও বুঝেছে প্রমোদ। হয়ত এই কথা আর কাউকেই কোনদিন বলতে পারবে না।
বাড়িতে এসে আর প্রমোদের আর ফেরা হয় না অবশ‍্য তেমনি প্রস্তুতি নিয়ে চলে এসেছে ও। মধু মা হতে চলেছে তবে ডাক্তার বলেছে থাইরয়েড থাকার জন‍্য খুব সাবধানে থাকতে হবে ওকে। শ্বশুরবাড়িতে খুশির জোয়ার। 


       অনেকগুলো ভালোলাগার দিনের কথা মনে পড়ছে আজ বেশি করে মুনিয়ার। সেদিন রাতে রাণার হঠাৎই চলে আসা। তারপর হুট করে বেরিয়ে পড়া দুজনে মিলে নিরুদ্দেশে একফালি আনন্দের জানলা খুলে গেছিল হঠাৎই ওর আনন্দের জীবনে। দুঃখগুলো ছটফটিয়ে বেরিয়েছিল জানলার ফাঁক দিয়ে। রাণাই বের করে দিয়েছিল ওদের। জুনি অম্লানদার সাথে জমিয়ে আড্ডা আর বন্ধুদের সাথে গেটটুগেদার করে কোথা দিয়ে কেটে গেছিল ব‍্যাঙ্গালোরের কয়েকটা দিন। মুনিয়া আবার চনমনে হয়ে উঠেছিল। একটু একটু করে মুছে গিয়েছিল এতদিনের জমানো সবটুকু খারাপ লাগা। শুধু ওখান থেকে ফাইনালি চলে আসার আগে রুমকিদির সাথে দেখা করা হয়নি। রাণার তেমন ইচ্ছে ছিল না ওদের বাড়িতে যাবার। তাছাড়া প্রবালদার সাথে তো ওর দেখা হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ কথাও হয়েছে। আসলে তখন তো মুনিয়া জানতই না রাণাকে ছেড়ে আর থাকতে পারবে না একা। 
তবে বাবলির জন‍্য খুব খারাপ লাগে,খুব ভালোবাসত ওকে। হয়ত কোনদিন বায়না করবে মাসির বাড়ি যাওয়ার। সত‍্যিই জীবনে কত সম্পর্ক আসে হঠাৎই, বেশ কিছুটা ভালোবাসা বাসি হয় আবার নতুন সম্পর্কের বাঁধনে মানুষ আবদ্ধ হয় অন‍্য কারো সাথে হঠাৎই নতুন কোন জায়গায় এসে।
     এখানে এখন মুনিয়ার অনেক চেনামুখ। বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ওদের সাথে। মাঝে মাঝেই এক সাথে দেখা করে হৈ হৈ আনন্দ হয় নিজেদের মধ‍্যে। কখনও কাছাকাছি ঘুরে আসে সবাই মিলে। মৌমিতার সাথে তো খুব ভালো আলাপ হয়ে গেছে মুনিয়ার।

    সেবার ব‍্যাঙ্গালোর থেকে কৃষ্ণনগরে এসে কদিন পুজোর আনন্দে কেটে গিয়েছিল মাতোয়ারা হয়ে বরাবরের মতই। উৎসবের শেষে রাণার ফেরার কথা ছিল একদম মুনিয়াকে সাথে নিয়ে। সব ব‍্যবস্থাই মোটামুটি করে এসেছিল রাণা আর যেটুকু বাকি ছিল সেটুকু সেরে নিয়েছিল ছুটির অবকাশে একদম কোমর বেঁধে। 
    অবাক হয়েছিল মুনিয়া মা বাবা,মামণি বাপি,ডল সবাই জানে অথচ ও জানে না। তারপর বুঝেছিল চক্রান্ত চলেছে অনেকদিন ধরেই। সবার ইচ্ছে ওরা একসাথে থাকুক।
  মাকে বলেছিল মুনিয়া,' মা তোমরা সবাই জানতে রাণা আসবে আমি যাব ওর সাথে। অথচ আমাকে কিছু জানাওনি?'
-' এটাই তো মজা মা,যা ঘুরে আয় দেখে আয় নতুন দেশ। সংসারই তো করা হল না তেমন করে তোদের। দুজনে দু জায়গায় আমার চিন্তায় ভালো লাগে না।'

     ওদিকে মিঠে হাসিতে মুখ ভরেছিল ঠাম্মার,' বলেছিলাম না রাই বিহনে শ‍্যাম আর শ‍্যাম বিহনে রাই, কেমনে থাকবে দিদিভাই আর দাদুভাই? এই বেশ ভালো হল দুগ্গা দুগ্গা করে একসাথে নতুন দেশে গিয়ে নতুন আনন্দে ঘর পাত দেখি।'

          মন খারাপ করেছিল ডল,' বৌদিভাই কতদূরে চলে যাচ্ছ তুমি। আমার আর তোমার কাছে গিয়ে থাকা হল না।'
-' ছমাসের জন‍্য তো যাচ্ছি বোকা। ফিরে এলেই তখন দুজনে খুব মজা করব একসাথে।'
-' সত‍্যিই তুমি ফিরবে তো? নাকি থেকে যাবে ওখানেই?'
 মুনিয়া হেসে বলেছিল,' মানে? ঠিক ফিরব দেখিস।'

    সত‍্যিই ফিরে একবার এসেছিল,কিন্তু থাকতে পারেনি। হার মেনেছিল জেদী মুনিয়া।

            খাবার গরম করতে করতে আবার আনমনা হয়ে যায় মুনিয়া। মায়ের কথাগুলো খুব মনে হচ্ছে মুনিয়ার। সেই ছটফটে মুনিয়া সত‍্যিই এখন বিদেশে চুটিয়ে সংসার করছে রাণার সাথে। 
কৃষ্ণনগরের জমাটি দিনগুলো কাটিয়ে অফিসে লম্বা ছুটি নিয়ে বেশ কিছুদিনের জন‍্য চলে এসেছিল জার্মানীতে তারপর একটা সময় মনে হয়েছিল রাণাকে ছেড়ে থাকা বোধহয় আর সম্ভব হবে না তাই একবার ফিরে এসে অফিসের সাথে সারা টুকটাক ফর্মালিটির হিসেব নিকেশ মিটিয়ে আবার ফিরে গেছিল রাণার কাছে কারণ রাণার ওখানে থাকার মেয়াদ বেড়েছিল আরও দুইবছর। অফিসের সবাই বলেছিল চাকরিটা না ছাড়তে ওরা খুব মিস্ করবে মুনিয়াকে। কিন্তু নাহ্ একলা ঘরে একলা থাকা মুনিয়া কয়েক মাসেই বুঝেছিল একাকীত্বের কষ্ট তাই আর ভাবেনি কিছু।

            একটু একটু করে এখানে মানিয়ে নিয়েছে মুনিয়া রাণা বলেছিল ও চাইলে এখানে কোন কাজ করতে পারে। অনেকেই কাজ করছে এখানে। ওকে আদরে জড়িয়ে মুনিয়া বলেছিল,' সেই কতটুকু বেলা থেকে চাকরি নিয়ে বাইরে চলে এসেছি মামা বাবা ছাড়া কাটিয়েছি দিব‍্যি কতদিন। কিন্তু তোকে ছাড়া থাকা যে একদম সম্ভব নয় তা সত‍্যিই বুঝেছি। এখন মজা করব ঘুরব বেড়াব তারপর কিছু ভাবব আবার।'

-' বুঝেছি মুনিয়া এখন একদম সুগৃহিণী হয়ে থাকতে চায়। জীবনে কোন চাপ নেই যখন যা খুশি করা তাই তো?'
      মুনিয়ার সেইসব কথা মনে পড়ে গালে লালচে আভা ধরল। সত‍্যিই এখানে এসে যখন প্রথম ছয়মাস ছিল তখন মনে হয়েছিল কোন এক স্বপ্নের রাজ‍্যে হানিমুনে এসেছে। অতিথি বৌয়ের ওপর কোন দায়িত্ব চাপায়নি রাণা। আদরে নরম কম্বলে জড়িয়ে মুখের কাছে রেখে গেছে গরম কফি আর স‍্যান্ডউইচ। অফিস থেকে এসে গরম স‍্যুপে চুমুক দিয়েছে দুজনে গল্পে ডুবে যেতে যেতে।
      রাণার সাথে কাছাকাছি অনেকগুলো জায়গা ঘুরে এসেছে প্রতিটা উইকএন্ডে। কিছু ছবি পাঠিয়েছে হোয়াটস অ্যাপে বন্ধুদের। তবে সুইজারল্যান্ডের ট্রিপটা সত‍্যিই অসাধারণ ছিল। সত‍্যিই পৃথিবীর রঙ রূপ কত বিচিত্র। মানুষের রঙ আর প্রকৃতির রঙ সবই স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন নিজের মত। এদেশের ট্রেনগুলো খুব সুন্দর। ট্রেনে করে যেতে যেতে সবুজের গালিচায় মন হারিয়েছিল মুনিয়া। মনে পড়ে গেছিল একটা খুব জনপ্রিয় হিন্দী সিনেমার কথা। সুইজারল্যান্ডকে দেখবে বলে দু তিন বার দেখেছে টিভিতে সিনেমাটা। ভীষণ রোমান্টিক লাগত তখন। 
  সবুজে চোখ মাখতে মাখতে একটা সময় পৌঁছে গেছিল এঙ্গেলবার্গে। সেন্ট্রাল সুইজারল্যান্ডের একটা ছোট শহর বা গ্রামও বলা যায়। একদম নিরিবিলি আর চারদিকে বরফের পাহাড় ঘেরা। স্টেশনে নেমে রাণার হাতদুটো জড়িয়ে ধরেছিল মুনিয়া কিছুটা আনন্দে আর কিছুটা উষ্ণতার খোঁজে। একটা নিরিবিলি হোটেলে ছিল কদিন বারান্দায় দাঁড়ালেই আল্পসের সৌন্দর্য্য দেখা যেত। ওখান থেকেই মাউন্ট টিটলিস গেছিল ওরা। বরফের পাহাড় নুবড়া ভ‍্যালি যাবার পথেও দেখেছে,অপূর্ব সুন্দর। তবে সৌন্দর্য্যৈ আল্পস্ও একদম অনন‍্য। সমতল থেকে  রোপওয়ে আর লিফ্টে করে অনেকটা উঁচুতে উঠে গিয়েছিল ওরা তারপর একদম চলে গেছিল বরফের ভালোবাসা মাখামাখি সাদা পাহাড়ে। চারদিকে শুধুই সাদা বরফের পাহাড়। মুনিয়ার মনের মত করে অনেক ছবি তুলে দিয়েছিল রাণা বলেছিল,' আজ সব কিছু ভুলে একদম মন খুলে আনন্দ করে নে। ওহ্ সত‍্যি কতদিনের স্বপ্ন ছিল আমার।'
    মুনিয়ার চোখদুটো ছোটাছুটি করে চারদিকে সত‍্যিই কোন কথা আর বলতে ইচ্ছে করছে না। শুধু ইচ্ছে করছে ইচ্ছেমত ছোটাছুটি করতে।

    মুনিয়া কোন ছবি সোশ‍্যাল মিডিয়ায় না দিলেও রাণা দিয়েছিল। মুনিয়ার কেন যেন মনে হয়েছিল ওদের সুখী দাম্পত‍্যে আর যেন কোন পুরোনো সম্পর্কের ছায়া না পড়ে।

      রাণার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকায় প্রবাল দেখেছিল ছবি। ভালো লেগেছিল দেখে ওদের সুখী দাম্পত‍্য। একটা সময় রুমকির সাথে এই নিয়ে অনেক মনোমালিন্য হয়েছে ওর। প্রমোদকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছিল ও। অথচ এখান থেকে দিব‍্যি চলে গেল ওদের কিছু না জানিয়ে। এখন তো দিব‍্যি বৌ নিয়ে সুখে সংসার করছে,শুনেছে বৌ প্রেগনেন্ট। না করে উপায়ও নেই অবশ‍্য ওর শ্বশুর চাইলে যখন তখন কাউকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে। হয়ত সেই ভয়টাই পেয়েছিল প্রবাল, মুনিয়ার যেন কোন ক্ষতি না হয়। কোনক্রমে এই কথা পাটনায় গেলে ভীষণ বিপদ হবে। অথচ রুমকি তখন বন্ধুত্ব ফেরাতে ব‍্যস্ত। কিছুতেই বোঝাতে পারেনি পুরোনো প্রেমিক আর প্রেমিকার মধ‍্যে বন্ধুত্ব হয় না।
      রুমকিকে ছবিগুলো দেখিয়েছিল প্রবাল,' দেখ আবার ছেলেমেয়ে দুটো কি সুন্দর এনজয় করছে।মুনিয়াকে দেখে বেশ ভালো লাগছে।'
   সংক্ষেপে শুধু ভালো বলেছিল রুমকি। খুব অভিমান হয়েছিল মুনিয়ার ওপর একবার বলেও গেল না যাবার সময়। আজকাল আর কথাও হয় না। নিশ্চয় নতুন দেশে নতুন ফোন নম্বর হয়েছে। অথচ একটা সময় রুমকি কত ওকে কম্পানী দিয়েছে। মন ভালো রাখতে ছুটে গেছে বারবার।
   মানুষ বোধহয় এমনি হয় হয়ত সব কিছু ভুলে যায় একসময়।
      তবে রুমকির ভুল ভেঙেছিল কয়েকদিন বাদেই যখন ওর হোয়াটস অ্যাপে মুনিয়া মেসেজ করেছিল..
 ' সরি রুমকিদি এখানে এসে সব নতুনভাবে শুরু করেছি। একটু অসুবিধা হয়েছে বেশ কিছুদিন। তোমার নম্বরটা রাণাই দিল,প্রবালদার কাছে পেয়েছে। ভালো থেক গো। বাবলিকে খুব মিস্ করি।'
       রুমকিদির সাথে ইচ্ছে করেই যে সম্পর্কের ফাঁকটা তৈরি করেছিল আজ তাতে একটু প্রলেপ দিয়ে হাল্কা লাগল মুনিয়ার।

**************************
বাইরে হিমেল হাওয়ার ছোটাছুটি, ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় মুনিয়া। প্রাকৃতিক দৃশ‍্যে ইউরোপের তুলনা নেই তাছাড়া কত কি যে আছে দেখার। যা দেখে তাই মুগ্ধ করে। কু কু ক্লক দেখতে গিয়ে খুব মজা পেয়েছিল। কি সুন্দর মানুষের সৃষ্টি ঠিক প্রতিঘন্টায় দরজা খুলে বেরিয়ে আসে ডান্সিং কাপল পাখির ডাক আর বাজনায় সুন্দর নাচ দেখিয়ে ভেতরে চলে যায়। আবার আধঘন্টা পরে এসে সুন্দর করে সময় হিসেব করে বলে যায় বাজনায়। জার্মানী খুব সুন্দর জায়গা তবুও মুনিয়া মাঝে মাঝেই মিস্ করে নিজের দেশের মাটির গন্ধ। প্রতিদিন কথা হয় বাড়ির সাথে তবুও মুনিয়া ভাবে আবার কবে যাওয়া হবে ওদের প্রিয় কলকাতায়, কৃষ্ণনগরের সবার সাথে পুজোর সময় মজা করবে।
    এখানে এসে একটু একটু করে সংসারের পুরো ফ্লেভারের স্বাদ নিয়ে মুনিয়া এখন একটু বেশিই সংসারী। সেই অগোছালো ছোট প‍্যান্ট পরে ছোটাছুটি করা মেয়েটা এখন একসাথে সামলাতে পারে অনেক কাজ।
   তবুও রাণা আগলে রাখতে চায় ওকে। যতটা পারে দুজনে মিলে মিশে করে নেয় সবকিছু। মাঝে মাঝে কেমন যেন একটু অপরাধী মনে হয় নিজেকে। হয়ত ওর এই আগলে রাখার জন‍্যই মুনিয়া একা থাকতে পারল না আর। তবুও মুনিয়ার সাথে কাটানো সময়টা খুব প্রেশাস ওর কাছে এখন। প্রতিটা দিন যেন আরও সুন্দর বার্তা নিয়ে আসে।
     ছোট্ট ঘরে আদরে ঝগড়ায় আর খুনশুটিতে পাতা ওদের সংসারে একটু একটু করে লেগেছে সদ‍্য আসা বসন্তের হাওয়া। তবে খুব ইচ্ছে থাকলেও পুজোতে আর কৃষ্ণনগরে যাওয়া হবে না মুনিয়ার। ওর মন খারাপ শুনে বাড়ির সবার মন খারাপ হলেও ঠাম্মার কাজললতা গড়ানোর স্বপ্নটা বোধহয় এবার সত‍্যি হতে চলেছে। মুনিয়া আর রাণার মধ‍্যে এবার সত‍্যিই কেউ আসতে চলেছে।

***************************
  ফোনে খবরটা পেয়ে কপালে হাত ঠেকান ঠাম্মা, 'মায়ের আসার আগেই কত বড় একটা খবর এলো তাই না বৌমা? বিলিতি মেমসাহেব আসবে এই রায়চৌধুরী বাড়িতে একদম খোদ বিলেত থেকে মনে হয়।'
   ' ও মা মেমসাহেব না সাহেব কে আসবে কে বলতে পারে? তবে সত‍্যিই এটা খুব ভালো খবর। কিন্তু মুনিয়া একা একা সব সামলাবে কি করে তাই ভাবছি?এই সময় কত কি খেতে ইচ্ছে করে। সত‍্যিই এমন সময় হবে সবটা কিছুই করতে পারব না।'
  -' মা তোমরা যে কোথায় পড়ে আছ না? ঐ দেশে সব পাওয়া যায়। যা ভাববে আনিয়ে খাবে। আর তেমন হলে তুমি ভিডিও কলে বলে দেবে সব। আর ইউটিউব তো আছেই। আহা কি মজা আমার আমি পিসি হব এবার। খুব চটাকাব ওটাকে নিয়ে।'
-' দাঁড়া বাপু আগে সব ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক। সবেই তো খবরটা পেলাম। এবার মাকে ভালো করে মানত করে রাখব।'
-' মা আমি বলি কি তুমি আর বাবা চলে যাও এখান থেকে মোটামুটি কেজি দশেক সরপুরিয়া আর পোস্ত নিয়ে। বৌদিভাইয়ের কিন্তু দুটোই খুব ফেভারিট।'
-' যেতে পারলে তো ভালোই হত কিন্তু সে আর হবে নাকি এদিকের সব কে সামলাবে?'
      মা ঠাকুমা সবার এত ভাবনা চিন্তার মাঝে মুনিয়াকে সুন্দর করে সামলে নিয়েছে রাণাই। এ যেন জীবনের এক অন‍্য অধ‍্যায়। ভালোবাসার যত্ন নিতে নিতে কখন যে এক ভালোবাসার অঙ্কুর বেড়ে উঠেছে মুনিয়ার মধ‍্যে বুঝতেই পারেনি। তারপর হঠাৎই শরীর খারাপ আর অরুচি শুরু। কদিন তো বিছানা থেকে মাথা তুলতেই পারেনি মুনিয়া। তারপর ঠাম্মাই বলল ওখান থেকে ফোনে। মুনিয়াটা সত‍্যিই বোকা বারবার বলছে না না হজমের গন্ডগোল। অবশ‍্য রাণাই বা কম কি বোকা? কদিন ধরে সমানে বেচারাকে এনজাইম আর অ্যান্টাসিড খাইয়ে গেছে। তারপরেই এল রিপোর্টটা। 
         জুনির পুত্র আর পুতুলের কন‍্যা একটু একটু করে বেশ অনেকটা বড় হয়ে গেছে এতদিনে। মুনিয়া বোধহয় একটু কম ম‍্যাচিওরড ওদের তুলনায়। তবুও এবার আস্তে আস্তে অনুভব করছে একটা প্রাণের অস্তিত্ব নিজের মধ‍্যে।
       রাণার দায়িত্ব অনেকটাই বেড়েছে অবশ‍্য কখনও এটাকে বাড়াবাড়ি বলে টুকটাক ঝামেলাও হয় ওদের।
তবুও মুনিয়ার খুব ভালো লাগে অনুভব করতে ওর কেয়ারিং বরের যত্ন আত্তি। কলকাতা থেকে ওর মা বাবাও বলেছিল আসার কথা কিন্তু মুনিয়াই বারণ করেছে। বলেছে,' মা এখন এত ব‍্যস্ত হওয়ার কোন দরকার নেই আমি ভালো আছি গো। রাণা খুব কেয়ারিং। ভীষণ যত্ন নিচ্ছে আমার। মানে বলতে পার বেশ বাড়াবাড়ি করছে।'
     চিকেন স‍্যুপ ঢালতে ঢালতে হাসে রাণা,' আমি বাড়াবাড়ি করছি? এই সময় আমি না থাকলে কে পাশে থাকবে শুনি?'
       প্রথম মাতৃত্ব আর পিতৃত্বের স্বাদ পাশাপাশি থাকতে থাকতে একটু একটু করে অনুভব করছে ওরা। মনে হয় কেমন যেন স্বপ্নের মত কেটে গেল এতগুলো দিন। দূরে থাকাকালীন কত টানাপোড়েন। অথচ কাছাকাছি হয়ে কি সুন্দর ভাবে কাটল কতগুলো দিন। আসলে সম্পর্ককে একটু শক্ত করতেও বোধহয় সময় দিতে হয়। রাণা মুনিয়ার হয়ত সেই সময়টুকু খুব দরকার ছিল। সত‍্যিই তো তেমন করে প্রেম হতে না হতেই ওদের বিয়ে হয়ে গেল। ওদের বিয়ে করার তাড়াহুড়ো না থাকলেও মুনিয়ার মা বাবাই খুব চাইছিলেন রাণার মত কেউ একজন আসুক মুনিয়ার জীবনে। যে মুনিয়াকে আগলে রাখবে,বুঝবে ওর পাগলামি। হয়ত বা সহ‍্য করবে খামখেয়ালী, একগুঁয়ে জেদী মেয়েটাকে। তাই মেয়ের জীবনে আবার কেউ আসবে আসবে করছে এটা জানার পর আর কোন দিকেই তাকাননি ওঁরা। চটজলদি বিয়ে তারপরের একটা বছর অফিসের চাপের মধ‍্যেই লেট হানিমুন।
     আর তারপরের সময় টুকুতে যখন একলা অবকাশে ডুব দেয় তখন একটুকরো মনখারাপের মেঘ ওকে ঘিরে ধরে। কেমন ছিল সেই দিনগুলো ভাবতে চায় না মুনিয়া। একলা বাড়িতে তালা খুলে এসে ঢোকা। চুপিচুপি গাছেদের সাথে কথা বলা। কখনও বাথরুমের কল খুলে অঝোরে কাঁদা অসহ‍্য অতীতকে সামনে দেখে। আবার হঠাৎই মনে উঠেছিল ঝড় রাণা ঠিক সময় এসেছিল ভাগ‍্যিস তাই হয়ত সেই ঝড় ভালোবাসার বৃষ্টি হয়ে ঝরেছিল অঝোরে। ভাসিয়ে নিয়ে ওকে চলে আসতে বাধ‍্য করেছিল সবাইকে ছেড়ে এই দূর প্রবাসে। এখন নিজেকে মনে হয় সত‍্যিই মুনিয়া খুব ভালো আছে। হয়ত ভগবান যা করেন সবটুকুই ভালোর জন‍্য তাই রুম পার্টনার হয়ে হঠাৎই এসেছিল রাণা আর তারপর অশান্ত মুনিয়াকে শান্ত করে ঢুকে পড়েছিল ওর জীবনে।
     রাণা অফিসে গেছে, টুকটাক করে নিজের ছোট্ট সংসারকে গুছোচ্ছে মুনিয়া। সারাক্ষণ বসে থাকতে কার ভালো লাগে? জুনি ফোন করেছে ফোনটা স্পীকারে দিয়ে পাস্তায় সস্ মেশাচ্ছে মুনিয়া। ভীষণ বিজ্ঞের মত অনেক উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে জুনিটা। কি করতে হবে আর কি করবে না। মুনিয়া হাসতে হাসতে বলে ,'এখানে আমাদের ক্লাশ হয় আমাদের। রাণাকেও করতে হচ্ছে ক্লাশ। অনেক কিছু শিখছি সোনা।'
    -' আমারটা যা বিচ্ছু হয়েছে কি বলব,প্লে স্কুলে যাচ্ছে রে এখন। কিছুটা নিশ্চিন্ত আমি।'
-'জুনি আমাদের স্কুলের দিনগুলো খুব মিস্ করি তাই না। তখন আমাদের লাইফে বরেরা ছিল না। স্কুলের গেটের বাইরের খাবারগুলো ডাকত হাত মেলে।'
-' সত‍্যিই প্রাইসলেশ ছিল রে দিনগুলো। কত বড় হয়ে গেলাম।'
    কথায় কথায় মন হারায় মুনিয়াও মিস্ করে আবার দেশের মাটির গন্ধ আর মা বাবা কৃষ্ণনগরের সবাইকে। কথা বলতে বলতে পাস্তা আর চিকেন ক‍্যাসারোল বন্দি করে মুনিয়া।
         অনেকটা সময় কেটে গেছে রাণা ফিরেছে বাইরের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা। বাড়ির সাথে কথা বলতে বলতে খাওয়াতে মন দেয় রাণা। মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে ভীষণ ভালো হয়েছে। রাণার ভালোলাগা টুকু ছুঁয়ে যায় মুনিয়াকে মনে হল ওর ভেতরের ছোট্টটাও সেই আনন্দটা মন ভরে নিল।

    দেখতে দেখতে কয়েকটা মাস কেটে গেছে মুনিয়া একটু করে বোঝে এখন ছোট্টটার দুষ্টুমি। কৃষ্ণনগরের পুজো আর জার্মানীর পুজো একসাথে উপভোগ করল এবার মুনিয়া। ওখানে বেশ ভালো করেই পুজো হয়।
    রাণার সাথে সাজগোজ করে এবার এক অন‍্য স্বাদের পুজো আর খাওয়া দাওয়াতে ডুব দিল মুনিয়া। মৌমিতা আর অনিরুদ্ধ প্রায় দুবছর বাদে এবার দেশে গেছে। ওর মত গতবার মৌমিতার যাওয়া হয়নি,এবার একদম বেবিকে নিয়ে গেল। অবশ‍্য তাতে অসুবিধা নেই এখানে অনেকের সাথেই ওর বন্ধুত্ব আছে। এবার সবাই মুনিয়াকে একদম স্পেশাল কেয়ারে ঘিরে রেখেছে একদম ভি আই পি ট্রিটমেন্ট পাচ্ছে মুনিয়া। রাণা হাসছে সবার কান্ড দেখে,' আমি যে বাবা হতে চলেছি কেউ আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।'
          ডল আর আনন্দের সৌজন‍্যে ওখানকার পুজোও ভিডিও কলে দেখল মুনিয়া। গত একটা বছরে ডল অনেকটা পরিণত হয়ে গেছে। আনন্দ চাকরি পেয়েছে আপাততঃ কলকাতায় আছে। ওদের ইচ্ছে আর খুব একটা দেরি না করার। তবে ডলের এম এসসি কমপ্লিট হলে তবে হয়ত হবে। কৃষ্ণনগরের পুজো দেখতে দেখতে নষ্টালজিক হয়ে পড়ে মুনিয়া। রাণার সাথে প্রথম ধুনুচি নাচের কথাও খুব মনে হল। ঠাম্মার আশীর্বাদ সত‍্যি হয়ে কেমন ফিরে এল জীবনে।
   ঠাম্মাও সবার সাথে হাত নাড়ে,' এবার মায়ের পেট থেকেই দেখে নাও সোনা সামনেবার আমার কোলে বসে পুজো দেখবে।'
 রাণা হাসে,' ঠাম্মা তোমার কত ইচ্ছে গো। এদিকে তো পায়ের ব‍্যথায় হাঁটতেই পার না।'
-' হাঁটবো না মানে নাচব দাদাভাই দেখবে কি করি।'
  সবাই হেসে ওঠে ঠাম্মার কথা শুনে। মনটা ভালো হয়ে যায় মুনিয়ার।

*************************
     মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন সেদিন দুপুরে হঠাৎই মৌমিতা এল। অনেকগুলো দিন মৌমিতার সাথে দেখা হয়নি। অনিরুদ্ধ দা এলেও মৌমিতা বেবিকে নিয়ে থেকে গেছিল। তারপর ফিরে এসে সোজা ওর কাছে। মুনিয়ার শরীর এখন অনেকটা ভারী হয়ে গেছে। মৌমিতার খুব ইচ্ছে ওদের বাড়িতে সবাই মিলে মুনিয়াকে নিয়ে একটা সাধের অনুষ্ঠান করা। এখন বেবি শাওয়ার বলে যেটা খুব পরিচিত।
        মুনিয়ার অবাক লাগে এত দূরে থেকেও কোন কিছুই বাকি যাচ্ছে না। একটা চাপা আনন্দও হয়।
  মৌমিতা সমানে গল্প করতে থাকে ওর সাথে মুনিয়া তাকিয়ে দেখে ওকে খুব সুন্দর করে সেজে এসেছে ও। বেবি হওয়ার পর আরও সুন্দর হয়েছে ও মাতৃত্বের ছোঁয়ায়।
 -' কালকে বুঝেছ আমরা সবাই একটা করে কিছু রান্না করে এনে এক জায়গায় বসে আনন্দ করব। তোমার ফেভারিট যা যা আমি জানি। সবই হবে।'
-' আমার কি ফেভারিট? তুমি কি করে জানলে?'
-' কেন রাণা দা বলেছে সব। সব শুনেই আমার জানা হয়ে গেছে।'
 মুনিয়া হাসে,'তার মানে রাণাও আছে তোমাদের দলে? সত‍্যি পারো তোমরা। তোমাকে কি সুন্দর লাগছে গো! অনেকক্ষণ ধরে দেখছি।'
   মৌমিতা খুব খুশি হয় শুনে,' শাড়িটা ভালো না? তোমার জন‍্যও এনেছি ওখান থেকে।'
      মৌমিতার সাথে কথায় কথায় আবার ঝুমস্ ক্রিয়েশনের কথা উঠে আসে। আজ মুনিয়া অনেক কিছুই জানল মৌমিতার কাছে। হয়ত একসময় যা জানতে চেয়েছিল পুরোটাই আজ জেনে গেল মৌমিতার কাছে।
 -' আমাদের পাশেই থাকে মন্দিরাদি বুঝলে,ওরই বোনের বুটিক। একাই করে সবটা তবে খুব ভালো কাজ ওদের। মেয়েটা খুব দুর্ভোগের শিকার বরটা ক্রিমিনাল। কোন রকমে পালিয়ে এসেছিল হয়ত বিক্রি করে দিত খদ্দেরদের কাছে তবে আগুনে পুড়ে গেছিল বুঝলে। এখন লোকটা জেলে আছে। মেয়েটা কষ্ট করেছে খুব এখন একটু ভালো আছে। তাই একটু হেল্প হয় বলে কিনি আর সত‍্যিই খুবই ইউনিক আর আনকমন। তোমার জন‍্য যেটা এনেছি দেখো খুব সুন্দর।'

     মৌমিতার একমনে বলে যাওয়া কথার মধ‍্যে আনমনা হয়ে যায় মুনিয়া। ইচ্ছে করলেও হয়ত সবাইকে ঘৃণা করা যায় না। আজ কেন যেন ঝুমকার দুর্ভাগ্য ছুঁয়ে গেল মুনিয়ার মন। সবার ভাগ‍্যে হয়ত রাণার মত ছেলে থাকে না। সাময়িক লোভে ঝুমকা পা দিয়েছিল গভীর খাদে।

    আজ মুনিয়াকে মৌমিতার ওখানে ছেড়ে দিয়ে রাণা অফিসে যাবে। মুনিয়াকে দেখে অবাক হল রাণা সত‍্যিই চোখ ফেরানো গেল না ওর দিক থেকে। অনেকদিন বাদে শাড়ি পরেছে মুনিয়া। এই শাড়িটা কোনদিনই পরতে দেখেনি মুনিয়াকে। ও নিজেও কোনদিন পরতে বলেনি ওকে বরং বলেছিল কাউকে দিয়ে দিতে।
 -' কেমন লাগছে আমাকে? কিছু তো বল।'
-' সত‍্যিই চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। কিন্তু এই শাড়িটা পরলি কেন? আমি তো বারণ করেছিলাম।'
-' ইচ্ছে হল তাই। পরা হয়নি তো শাড়িটা একসময় পছন্দ করে কিনে দিয়েছিলি তো। শাড়িটার তো কোন দোষ নেই।'
    মুনিয়ার আসন্ন মাতৃত্বের সৌন্দর্য্য রাণার মনকে নরম করে। সত‍্যিই লাল শাড়িতে ভীষণ সুন্দর লাগছে ওকে। মৌমিতার বাড়িতে ওকে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় রাণা। যাবার সময় বলে,' সাবধানে থাকিস আমার সুন্দর বৌটাকে যেন কেউ নজর না দেয়।'
-' ইশ্ সবসময় মজা করা তাইনা?'
   সারাটা দিন অদ্ভুত একটা ভালোলাগায় আর ভালোবাসায় কেটে গেল মুনিয়ার। ওরই বয়েসী অনেকে কেউ আবার ছোট তবে অনেকেই একদম পাকা গিন্নী নিয়ম কানুন সব জেনে নিয়েছে পরিপাটি করে একদম। মৌমিতা তো একবার শাশুড়িমাকে ভিডিও কল করে সব ব‍্যবস্থা দেখিয়ে নিল। মুনিয়া এর আগে কারো সাধের অনুষ্ঠান দেখেনি। মৌমিতার সময় ও এখানে ছিল না। সত‍্যিই একটা মজার অনুষ্ঠান করল ওরা ওকে নিয়ে। ওর শাড়ি গয়নার প্রশংসা সবাই করল। এটা বোধহয় মেয়েদের একান্ত কমন রোগ অবশ‍্য এটা রাণার কথা।
    মৌমিতা সবাইকে বলল ঝুমস্ ক্রিয়েশনের কথা। মুনিয়া বুঝতে পারল মন্দিরাদি বেশ পরিচিত ওর। মুনিয়াকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে খেতে দিল ওরা তার সাথে ফটো তোলা গান আনন্দ সবই হল। রাতে ছেলেরাও এন্ট্রি পেল পার্টিতে মানে রাণাও একদম পেটপুজো করে মুনিয়াকে নিয়ে বাড়িতে ফিরল। অনেকদিন বাদে একটা দিন ভীষণ ভালো কাটল মুনিয়ার। শাড়ি ছেড়ে আরামদায়ক খোলামেলা পোষাক পরল মুনিয়া। আজকে দুষ্টুটার ছটফটে ভাবটাও বেশি। মায়ের আনন্দে আর ভালোমন্দ খেয়ে ও ছটফট করছে আনন্দে।
  রাণা আদরে কান পাতে ওর অস্তিত্বের ধুকপুক শোনার জন‍্য। অদ্ভুত একটা ভালো লাগায় মনটা ভরে যায়। যে আসছে সে একান্তই ওদের দুজনের ভালোবাসার সৃষ্টি।

************************

     সকাল থেকেই শান্তার আর ওদের বাড়ির সবার মনটা বড় অস্থির। মুনিয়ার মাও আজ অফিসে যেতে পারেননি চিন্তায়। গতকাল থেকেই খুব কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। তবে এখনও কিছু হয়নি। এখানে ডাক্তাররা একদম শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেন নরমাল ডেলিভারি করানোর। ঠাম্মাও শ‍্যাম রাইয়ের পায়ে ফুল দিতে দিতে বলেন,'নতুন দিদিভাইয়ের কষ্ট কম কর ঠাকুর। সব যেন ভালোয় ভালোয় হয়ে যায়। কতটা দূরে আছে মেয়েটা। প্রথম মা হতে চলেছে তো।'
      রাণা মুনিয়ার কাছেই আছে এখানের ডঃ এটা অ্যালাউ করে। বারবার ওর হাত চেপে ধরছে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। একটা সময় মনে হচ্ছে নাহ্ আর দেখা যাচ্ছে না কষ্ট। 
         আজ মায়ের কথা খুব মনে হল রাণার কত সময় মায়ের ওপর রাগ করেছে কারণে অকারণে। কত কষ্ট করে ওকে পৃথিবীতে এনেছে মা।
     রাণার ফোন করার কথা,অথচ এখনও ফোন আসছে না। ডল আর আনন্দ বেশ কয়েকবার হোয়াটস অ্যাপ কল করেছে ধরেনি রাণা। বাড়িতে কারো মুখে খাবার ওঠেনি আজ ভালো করে। আসলে রাণা তো তখন ওটিতে। 
            সন্ধ‍্যের আলো জ্বলে উঠেছে,শান্তা ঠাকুর ঘরে সন্ধ‍্যে দেবার আয়োজন করছে ওরা বাবা মেয়ে বসে আছে খবরের আশায়। এমন সময় ফোন আসে রাণার ডলই ধরে তারপর ওর চিৎকারে সবাই ছুটে আসে কি হল আবার?
  -' কিছু হয়নি গো আমি পিসি হয়েছি তাই একটু চেঁচামেচি করে আনন্দ প্রকাশ করছি। সারাদিন খাইনি তো। বাবা তাড়াতাড়ি মিস্টির বাক্স খোল।'
 -' আরে কি হয়েছে সেটা তো বল। দে আমাকে ফোনটা দে।'
 -' মা দাদাভাই ফোনটা রেখে দিয়েছে এখন অনেক কাজ আছে ওদিকে। মেয়ে হয়েছে গো মেয়ে। আহা আমি বলেছিলাম না। ইচ্ছেমত সাজাবো ওকে।'
     -' কেমন পাজি দেখেছেন মা, আমরা চিন্তায় মরছি।'
-' বৌমা জোরে শঙ্খটা বাজাও তো দেখি বাড়িতে লক্ষ্মী এল। আচ্ছা আমাকে দাও শঙ্খটা তুমি উলু দাও।'
     শাঁখের আওয়াজ আর উলুতে ভরে উঠল বাড়ি। ঠাম্মার বলা কথা সত‍্যি করে কাজললতা নিতে এল নাতির ঘরে পুতনী।
-' মা বাবাকে বলুন গিয়ে রাণার মেয়ে হয়েছে। খুব খুশি হবেন শুনে।'
-' হ‍্যাঁ বৌমা এই যাই। উনি অসুস্থ তাই নাহলে হীরের নাকছাবি আদায় করে ছাড়তাম।'
  ডল পেছনে লাগে ঠাম্মার,' আহা এখনও কত গয়নার শখ!'
-' আবার নতুন করে সাজতে ইচ্ছে করছে রে দিদিভাই। নাতির ঘরে লক্ষ্মী এল যে। কি নাম দেব বল তো? লক্ষ্মী?'
-' ঠাম্মা সেই পুরোনো নাম চলবে না। তোমার যা খুশি বল। আমি তো নাম ঠিক করে ফেলেছি রাণীয়া। রাণা আর মুনিয়া মিলে একদম রাণীয়া।"

     মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা দিন মুনিয়া এখন কিছুটা ভালো আছে। রাণা কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছে অফিস থেকে। মুনিয়া দেখে অবাক হয়ে যায় এত ভালো করে কি করে ধরছে ঐ পুচকেটাকে রাণা?
 -' দেখিস পড়ে যাবে তো। আমার কেমন ভয় লাগছে।'
-' কিচ্ছু ভয় নেই সোনা, রাণীয়াকে আমি একদম সুন্দর করে ধরেছি কোন ভয় নেই তোর। আমি একজন ট্রেনিং নেওয়া বাবা। তাছাড়া কাকুর ছেলেকে তো আমি কত ছোট থেকে কোলে নিতাম আমার অভ‍্যেস আছে।'
      একটু একটু করে মুনিয়াও সুন্দর সবকিছু করতে পারছে রাণীয়ার। ওর একমাসের ছবি দেখে লাফালাফি করে ডল,' মা দেখ কত বড় হয়ে গেছে। আমার তো মনে হচ্ছে আমি এখনি চলে যাই ওকে চটকাতে।'
-' রক্ষে কর মা। তোমার পাল্লায় পড়লে বেচারার একদম দুর্গতির অন্ত থাকবে না। সত‍্যিই ভাবলে অবাক লাগে রাণাটা কি সুন্দর করে সব কিছু করে দিচ্ছে ওকে।'
    ভিডিও কলে সবটা দেখে মুনিয়ার মায়েরও অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগে সত‍্যি কি সুন্দর করে একটু একটু করে যত্ন করে বড় করছে বাচ্চাটাকে। কবে যে দেখবেন ভেবে মনটা খুব উতলা লাগে।

**********************

   দেখতে দেখতে রাণীয়ার বয়েস প্রায় পাঁচ মাস হয়ে আসছে। মুনিয়া প্রতিদিনই পারলে মেয়ের ছবি তোলে। তবে মেয়ে রাণার খুব ভক্ত,ওর পায়ের শব্দটাও চেনে একদম। বাবার অফিস থেকে ফেরার অপেক্ষায় যেন বসে থাকে। বাবাকে দেখলেই কোলে উঠে বসে থাকতে চায়। ওদের দুজনের যত্নে রাণীয়া একটু একটু করে বড় হচ্ছে। এখন তো মুনিয়া এক পলকও চোখের আড়ালে করতে পারে না ওকে। কখন যে ডিগবাজি খাবে কেউ জানে না। কার মত এত দুষ্টু হয়েছে কে জানে? অবশেষে পিসিই দায় নিয়েছে, ও বৌদিভাই রাণীয়া আমার মত হয়েছে।'
-' এইবার বোঝা গেছে। আমি তো তাই ভাবছি তোর দাদা তো শান্ত ছিল। আমিও তাই।'
 -' ইশ্ কত শান্ত ছিলি তা তো আমি দেখেছি। মা পিসি সব কটা দুষ্টু ছিল। ওদের থেকে এক কাঠি ওপরে হয়েছে রাণীয়া।'
   ওদের কথার মাঝেই জমে যায় জোর আলোচনা রাণীয়ার মুখেভাত নিয়ে। অনেকদিন বাদে ওদের দেশে যাওয়ার সময় এগিয়ে আসছে। বেশ ভালো সময়ে রাণীয়ার মুখেভাত হবে একেবারে পুজো আর মুখেভাত সব মিটিয়ে ফিরবে রাণা। মুনিয়া অবশ‍্য আরো কিছুদিন থেকে পরে ফিরবে। তেমন ভাবেই টিকিট কেটেছে ওরা। ওদিকে সবার মনে খুশির ঢেউ। ছবিতে দেখা আর সামনে দেখা দুটোর মধ‍্যে অনেক পার্থক্য। গুটি গুটি পায়ে নাতনীর ছোটবেলা কেটে যাচ্ছে অথচ ওরা দেখতে পাচ্ছে না। এখানে থাকলে তো সবার কোলে কোলেই বড় হয়ে যেত।
     এখন শুধু দিন গোনা ওদের আসার অপেক্ষায়। দিন গুনছে মুনিয়াও কবে আবার দেশে ফিরবে। গায়ে মাখবে আপনজনের গন্ধ। মায়ের গায়ের গন্ধ নেবে মন ভরে। রাণীয়াকে দেবে ঠাম্মার কাছে। বারবারই বলতেন ঠাম্মা,'কে জানে সব দেখে যেতে পারব কিনা? কাজললতা তুই রেখে দে দিদিভাই তোর কাছে।'
     মনে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা মুনিয়ার এখন। বারবারই মনে হচ্ছে এবারের আসল ভি আই পি কিন্তু রাণীয়া। যদিও রাণার একটু চিন্তা ওখানে গিয়ে মেয়ের শরীর ঠিক থাকবে তো? আসলে আবহাওয়ার একটা বিরাট পার্থক্য। তবুও ভরসা একটাই মা দুর্গা নিশ্চয় সব ঠিক করে দেবেন। রাণার অগাধ বিশ্বাস বাড়ির ঠাকুরের ওপর। ওদের যে কোন শুভকাজ মাকে স্মরণ করেই হয়। রাণীয়াও ভাত খাবে মন্দিরে বসেই।
       মুনিয়া একটু একটু করে সব গুছিয়ে নিচ্ছে সত‍্যি কতগুলো দিন এখানে কেটে গেল। সেই অগোছালো ছটফটে মুনিয়া এখন অনেক গোছানো। দিব‍্যি সামলাচ্ছে পুচকেটাকেও। হয়ত সময় আর পরিস্থিতি শিখিয়ে দিয়েছে অনেক কিছুই হাত ধরে।
     রাণীয়ার মুখে ভাত ছাড়াও আরেকটা অনুষ্ঠান আছে বাড়িতে। আনন্দর বাবা মা ডলকে আশীর্বাদ করে রাখতে চান। প্রথমে একটু অবাক হয়েছিল শুনে মুনিয়া। বলেছিল এখনই আশীর্বাদ কেন? তারপর শুনল এমন নাকি হয় ওদের ওখানে। ওখানে এখনও কাগজের চুক্তির থেকে আশীর্বাদ অনেক দামী। বিয়েটা পরে হলেও ওদের সবার সামনে হয়ে যাক এখন একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠান। অনেক দিন তেমন কোন অনুষ্ঠান বাড়িতে হয় না তাই রাণীয়ার ছোট্ট পা বাড়িতে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই অনুষ্ঠানের শুরু।

********************************
 অনেকদিন বাদে ফেসবুকে চোখ রেখেছে রুমকি। আজকাল বাবলির পড়াশোনার চাপ বেড়েছে অফিস থেকে এসেই ওকে নিয়ে বসতে হয়। শ্বশুরমশাই আর বাবা দুজনেই অসুস্থ তাই ইচ্ছে হলেই কেউ আসতে পারেন না। বরং ওদেরকেই যেতে হয় মাঝে মাঝে। সুতরাং রুমকি এখন ঘোর সংসারী, মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায় রুমকি। নিজেকে মেলাতে পারে না আগের সাথে। অনেকদিন পর্যন্ত নিজের মেয়ে মেয়ে ইমেজটাই ছিল তবে এখন বাবলির মা বেশি রুমকি। 
হঠাৎই অবাক হয়ে যায় মুখপত্রিকার রঙিন ছবির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে । প্রথমটা বিরক্তিতে মুখ ফিরিয়ে নিলেও শুনতে শুরু করে। দাড়িওয়ালা মুখটা প্রথমে অচেনা লাগলেও পরে গলা শুনে আর চিনতে অসুবিধা হল না সন্দীপকে।

 অনেকদিন আগেই বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ ঘটেছিল একটা সময় ওর ফোন নম্বর,মেসেঞ্জার আর ফেসবুক সবই ব্লক করেছিল রুমকি। অদ্ভুত পাগলামি করত সন্দীপ,একটা সময় রুমকিও ওকে ভয় পাচ্ছিল। বাইরের বন্ধুর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে অবশেষে মুখ রেখেছিল নিরাপত্তার ঘেরাটোপের খোঁজে প্রবালের বুকেই। প্রবাল খুঁজে পেয়েছিল নতুন করে রুমকিকে। একটু হয়ত আরও বেশি যত্নশীল হতে চেষ্টা করেছিল ওর প্রতি। ভালোবাসা ছড়াতে চেয়েছিল একটু বেশি করে।
      পরে খবর পেয়েছিল ওর বৌ ওকে ছেড়ে চলে গেছে তখন মোটামুটি আধপাগল সন্দীপ। সবসময় একে ওকে ফোন করে। অফিসে যায় না বাড়িতে চিৎকার করে ফাটায়। সবটাই রীতার কাছে শোনা। কেউই আর ওকে পাত্তা দেয় না। একটা সময় প্রেমের বৈঠা বাইতে বাইতে সন্দীপ ভেসে গেছিল অপ্রেমের দেশে। হারিয়ে গেছিল সবার কাছ থেকে।
     আজ হঠাৎই ওকে আবৃত্তি করতে দেখে অবাক হল রুমকি। তাও আবার রাজন‍্যার পেজে। রাজন‍্যা লিখত,ভীষণ ভালো ওর কবিতা তবে ওকে পাঠ করতে শোনেনি কখনও রুমকি। ভালো করে দেখল রুমকি রাজন‍্যার পেজেই পোস্ট করা হয়েছে ভিডিওটা। এই একটা গুণ সত‍্যিই প্রশংসনীয় ছিল সন্দীপের। কিন্তু যে সন্দীপ রাজন‍্যার কথা শুনলেই রেগে যেত সে আজ ওর কবিতা পড়ছে! যাক ভালো থাক অন্ততঃ সুমতি হোক ওর। 

          রাজন‍্যা এখন মনসিজেই একটা ছোটখাটো চাকরি করে। অনেকদিনের সম্পর্ক ওর এই জায়গাটার সঙ্গে। হয়ত ওর জীবনের হারিয়ে যাওয়া পথগুলো খুঁজে পেয়েছিল এখানে এসেই। হঠাৎই একদিন ফোনে নাম লেখাতে গিয়ে চমকে উঠেছিল সন্দীপের নাম শুনে। পরে দেখেছিল ওকে। প্রথমে চিনতে পারেনি পরে আঁতকে উঠেছিল। ওর মায়ের কথা ভেবে খুব খারাপ লেগেছিল। তারপর অলক্ষ‍্যে থেকেই একটু একটু করে চেষ্টা করেছে ভালো হতে সন্দীপকে। কিন্তু কখনও তেমনভাবে সামনে আসেনি। সুস্থ হওয়ার পর সন্দীপ অবশ‍্য শুনেছিল মায়ের কাছে সবটা। সুস্থ হয়ে অনেকগুলো মেসেজ করেছিল রাজন‍্যার পেজের ইনবক্সে তারপর ওর লেখা কবিতা পাঠ করে করে পাঠাত। রাজন‍্যার কবিতা অনেকেই পাঠ করে। সন্দীপও হয়ে থাক তেমনি একজন। এছাড়া আর কোন গল্পই ভাবতে ইচ্ছে করে না ওকে নিয়ে রাজন‍্যার। তবে বুঝতে পারে ওর মত নিজের ভালোলাগাকে সঙ্গী করে বাঁচতে শিখেছে সন্দীপ। রাজন‍্যাকে মূল স্রোতে ফিরিয়েছিল মনসিজ আর অগ্নিভর। নাহলে কোথায় যে হারিয়ে যেত নিজেও জানে না। হঠাৎই চোখের কোণটা ভিজে ওঠে রাজন‍্যার বাইকে করে ডঃ মিট করার পথে হারিয়ে গেছিল অগ্নিভ একদিন। ওকে যা বলবে বলেছিল একদিন অবকাশে,তা আর বলা হয়নি কোনদিনই। তবুও সব সয়ে ভালো আছে রাজন‍্যা ওর কাজ আর কবিতা ওকে ভালো রেখেছে। ভালো থাকতে হলে বোধহয় কাজ খুঁজে নেওয়াটা জরুরী।

****************************

      অনেকদিন বাদে দেশের মাটিতে পা রেখেছে রাণা আর মুনিয়া। অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে আবার দেশের মাটিকে ছুঁতে চাওয়া। খুব চিন্তা ছিল রাণীয়াকে নিয়ে হয়ত ওর কোন অসুবিধা হবে। প্রথম প্লেনে উঠে এতটা পথ এসেছে। কিন্তু একদম লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে ছিল সারাটা পথ।
-' ও বুঝতে পেরেছে বুঝলি যে এবার সবার আদর খেতে যাচ্ছে।'
 -'এবার তুমি বলা অভ‍্যেস কর। ওখানে গেলেই মামণি বকবে। বলবে মা বাবা হয়ে এখনও তুই তোকারি চলছে?'
  -' হ‍্যাঁ অভ‍্যেস করতে হবে একদম এবার। রাণীয়া বড় হলে সত‍্যিই তো কি হবে?'

    রাণীয়াকে নিয়ে ওরা বাইরে বেরিয়ে আসে এর মধ‍্যেই দুবার ফোন হয়ে গেছে। মুনিয়া হঠাৎই অবাক হয়ে যায়, 'জুনি,ডল,আনন্দ? বাবা মা আসবে তো বলেছিল।'
      অনেকগুলো হাসিমুখের উচ্ছ্বাসে ভেসে যায় ওরা। ডলটা পুরো গেছে একদম। সকালেই এসে গেছে কলকাতায় ওদের রিসিভ করবে বলে। ওদের সবার কথাতে জেগে গেছে রাণীয়া। বাবার কোল থেকে চোখ ঘুরিয়ে সবাইকে দেখে।
 -' এই তো রাণীয়ার ঘুম ভেঙেছে। বাড়ি চল তোকে চটকাবো।'
- ' এই একদম না,প্লিজ ওকে কষ্ট দিস না।'রাণা বলে।
    ততক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ওদের ভাইবোনের খুনশুটি শুরু হয়,' ইশ্ তুই যদি বাবা তো আমি পিসি আমি ওকে আদর করবই।'
      জুনি ওদের সাথে দেখা করবে বলেই এসেছে। অবশ‍্য ওকে নেমন্তন্ন করা ছিল আগে থেকেই।
       গল্পে গল্পে মুহূর্তে কেটে যায় পথটুকু ওদেরকে মুনিয়ার বাপের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে একটু গল্প করে খেয়ে ডল আর আনন্দ চলে গেল। গাড়িটা আনন্দই এনেছিল। জুনির সাথে বেশ কিছুটা গল্প হল।
   -' থেকে যা না দুটো তো দিন একসাথে যাব।' মুনিয়া বলল।
 আনন্দর দিকে ইশারা করে ডল হাসিতে বোঝায় একসাথে এসেছে তাই একসাথেই যাবে। মুনিয়ার মা বুঝতে পারে না কি করে যত্ন করবে নাতনিকে। তবে রাণীয়া বেশ আছে। সময় মত খাবার পেলে এমনিতে চুপচাপ থাকে। 
  -' সত‍্যিই রাণার কোন তুলনা নেই। কিভাবে সামলাচ্ছে আমার দিদিভাইকে।'
-' মা এত বোল না আমিও কম কাজ শিখিনি। ওর সামনে বললে কলার তুলবে দেখ।'
   মেয়ের হাসি ছুঁয়ে যায় মাকে। সুখকুঠুরির চাবিটা যত্নে আঁচলে বেঁধেছে মুনিয়া ভেবেও ভালো লাগে। অথচ একটা সময় কত ঝামেলা গেছে মেয়েটার ওপর।

    কৃষ্ণনগরের বাড়ির পথটুকু অনেক চেনা রাণার তবুও ইচ্ছে হচ্ছে আজ প্রতিটা গাছপালা আবার নতুন করে দেখতে। কলকাতার বাতাসে পুজোর গন্ধ আর কদিন বাদেই তো পুজো। কৃষ্ণনগরের বাড়িটা সুন্দর রঙে সেজেছে পুজো আর রাণীয়ার মুখেভাতের জন‍্য তার সাথে ডলের আশীর্বাদও তো আছে।
        বাড়ির সামনে সবাইকে দেখে খুব ভালো লাগে ওদের। কতদিন বাদে সবাইকে দেখছে। কিন্তু সবার নজর তখন রাণীয়ার দিকে। ভেতর থেকে শঙ্খের আওয়াজ ভেসে আসে। ছেলে বৌমাকে জড়িয়ে ধরে শান্তা। তারপর হাত বাড়িয়ে দেয়,' আমার কাছে দে ওকে। কতদিন অপেক্ষা করে আছি। একদম হাত পা ধোয়া পরিস্কার। এসো রাণীয়া দিদিভাই।'
 -' আমিও একটু ছুঁই ঠাকুরদা বলে কথা। আমাকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না।'
   হেসে ওঠে সবাই,ডল ক‍্যামেরাবন্দী করে রাখে মুহূর্তগুলো খুব যত্নে।

          মুনিয়া ঠাম্মাকে খোঁজে। ডল ওর হাত ধরে ঠাকুরঘরের বারান্দায় নিয়ে আসে। একটা রূপোর থালাতে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো তাতে রাণীয়ার ছোঁয়া মাখিয়ে ঠাম্মা ঠাকুরের পায়ে ছড়িয়ে দেন। অবাক হয়ে যায় মুনিয়া। রাণীয়ার ছোঁয়া ফুলের পাপড়িতে পা ঢেকেছে ঠাকুরের। দুগ্গার কাঠামোতে মাটির যত্নের কাজ প্রায় শেষ আর মাত্র কদিন বাকি...

          দেখতে দেখতে রাণীয়ার মুখেভাতের দিন চলে এল। মুনিয়ার মা বাবা আগের দিনই চলে এসেছেন। জুনি অম্লানদা পুতুল সবাই আসবে। উৎসবের আনন্দ পার করে মুনিয়াকে ছুঁয়ে যাচ্ছে সবার সাথে মেলার আনন্দ। রাণা একটু বেশিই কেয়ারিং মেয়েকে নিয়ে,অবশ‍্য সেটা ঠিক আছে কারণ সুস্থ রাখতে হবে রাণীয়াকে। ডল আজ রাণীয়াকে সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছে। খুব সুন্দর করে মাথার দুপাশে দুটো ছোট্ট ঝুটি লাল ফিতেয় বেঁধে লাল টুকটুকে বেনারসী পরিয়েছে। মুনিয়া তো দেখে অবাক।
 'এতটুকু শাড়ি পেলি কোথায়? একদম তো রেডি টু ওয়‍্যার।'
-'কি সুইট লাগছে না আমার রাণীয়াকে। এরপর মুকুট মালা পায়ের মল সব পরাবো।'
-' কাঁদবে তো এত কিছু পরে। দেখ তোর দাদা এসে কি করে এখনি।'
     তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাণীয়া পাকা বুড়ির মত সাজুগুজু করে কাজললতা ধরল হাতে,পায়ে আঁকল লাল আলতার আলপনা। ঠাম্মা আদরে চোখ মুছলেন,' অনেক আদর নতুন দিদি এই বুড়ো ঠাম্মার কথা রেখেছিস। আজ আমাদের খুব আনন্দর দিন।'
   মুনিয়া আদরে জড়ায় ঠাম্মাকে। পুতুলের মেয়েটা এরমধ‍্যে বেশ বড় হয়ে গেছে। জুনি খুব মজা করল ওদের সাথে,' শোন এবার আমাকে চোখ রাখতে হবে এই দুই মেয়ের ওপর। ছেলে বড় হচ্ছে তো।'
   ওর কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। খাওয়াদাওয়া আর লোকজনে একদম জমজমাট অনুষ্ঠান বাড়ি সাথে চলছে ফটোশ‍্যুট। ডলকেও ভীষণ সুন্দর লাগছে আজ দেখতে। রাণা সবদিক সামলাতে সামলাতে মাঝেমাঝেই দেখে যাচ্ছে মেয়েকে।

     দেখতে দেখতে অনেকদিনের প্ল‍্যানে সাজানো একটা দিন কেটে গেল খুব আনন্দে। রাণীয়া অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে গেছে ক্লান্ত হয়ে। শান্তা ওকে শুইয়ে দিয়ে গেছে। রাণার বুকে মাথা রাখে মুনিয়া,' সব কেমন পাল্টে গেল তাই না? একটা সময় এই ঘরে আমরা দুজন থাকতাম আজ আমাদের মাঝে রাজকন‍্যা এসে গেছে।'
   ' সত‍্যিই রে খুব খারাপ অভ‍্যেস হয়ে গেল কি করে যে ওকে ছেড়ে দুটো মাস থাকব? শুধু শুধু বায়না করলি এখানে থাকার। দিব‍্যি চলে যেতাম একসাথে।'
-' খুব সেলফিশ তো তুই! আমাকে ছেড়ে এতদিন যে ছিলি? এখন মেয়ের বেলাতেই যত। বুঝেছি।'
-' কিছুই বুঝিসনি তোর জন‍্য মন খারাপ করত এখন দুজনের জন‍্য আরও অনেক মন কেমন করবে।'
-' আমিও তো বাবা মায়ের মেয়ে আর এই বাড়ির আদরের আমরা দুজনেই কিছু সময় থাকি না ওদের সাথে।'
  এই কথাটা শোনার পর সত‍্যিই আর কিছু বলতে ইচ্ছে করে না রাণার।

**************************
 দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। পুজোতে সবার দেওয়া জামাকাপড়ে ভালোবাসার ঝুড়ি উপচে পড়েছে রাণীয়ার। তারপর আছে পিসির সাজানোর ঘটা। তবে ওরা দেখে অবাক হয় কেমন চুপটি করে বসে ডলের কাছে সাজে।
-' একদম পিসির মত পাকুনি হয়েছে। কেমন চিনেছে দেখ শুধু। ঠাকুমাকে পাত্তাই দেয় না।'
-' তুমি ঘুরু ঘুরু করাও তাহলেই পাত্তা দেবে দেখ।'

     বাড়ির সবার সাথে মিলেমিশে রাণা আর রাণীয়ার সাথে কাটানো পুজো যেন একটা অন‍্যরকম আনন্দমাখা পুজো এবার। শ্বশুরমশাই তো সরপুরিয়া সরভাজা এনে খাওয়াতে ব‍্যস্ত বরাবরের মত।
   এখানে এসে অবধি তেমন করে বন্ধুদের সাথে বেরোনোই হয়নি রাণার। নবমীর দিন তাই বেরিয়েছে একটু আড্ডা দেবার আনন্দে। কৃষ্ণনগরের পুজো এখন অনেক জমজমাট। সত‍্যিই অবাক লাগে দেখে রাণার।
    অনেকদিন বাদে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল শুভর সাথে। একসময় রাণার সাথে এক স্কুলে পড়ত তবে তারপর ও এখানেই পড়াশোনা করে এখন বোধহয় বাবার ব‍্যবসা সামলায়। 
        ওর সাথে দেখা হয়ে কত পুরোনো কথাতে ডুব দেয় রাণা। মনে পড়ে যায় স্কুলের ছেলেমানুষী ভরা দুষ্টুমির দিনগুলো। ওদের চারজনকে জোর করেই বাড়িতে নিয়ে যায় শুভ। রাণা না করতে পারে না একটা সময় ওদের বাড়িতে কত এসেছে। খুব ভালো ছিলেন ওর মা। ভীষণ সুন্দর নাড়ু আর তালের বড়া বানাতেন অনেক বড় করে জন্মাষ্টমী হত ওদের বাড়িতে।
       বসার ঘরে বসে আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎই রাণা চমকে ওঠে চা আর মিস্টি নিয়ে যে ঘরে ঢোকে তাকে দেখে। শুভ ওদের সাথে আলাপ করিয়ে দেয় ওর বৌকে ওদের সাথে। শুধু রাণা বলতে পারে না আমাদের চেনাজানা অনেক পুরোনো। কিছু কথা হয়ত বলা যায় না মুখ ফুটে তাই ফর্মালিটি রাখতে হাত তোলে রাণা।
      সবেই এই শ্রাবণের কোন এক সন্ধ‍্যায় বিয়ে হয়েছে ঝুমকার শুভর সাথে। সবটাই অবশ‍্য দিদির জোর করার জন‍্য। শুভ মাঝেমাঝেই আসত ওদের বাড়িতে কলকাতা এলেই,ওদের দোকানে ঝুমের ডিজাইন করা কিছু জিনিস রাখত বিক্রির জন‍্য। দিদিই ঠিক করে দিয়েছিল। তারপর হঠাৎই ঝুমকে ভালো লেগেছিল ওর। কিন্তু কিছুতেই রাজি হয়নি ঝুমকা। দিদি বুঝিয়েছিল খুব,' বোন সংসার কর আবার। নাহলে ঐ শয়তানটা হয়ত ফিরে এসে কোনদিন ভর করবে তোর ওপর। ছেলেটা খুব ভালো, মা বাবা নেই বলে কেউ উদ‍্যোগ করে বিয়ে দেয়নি।' অবশেষে রাজি হয়ে গেছিল ঝুম। তবে সবটাই জানিয়েছিল শুভকে। যদিও শুভর অজানা তেমন কিছু ছিল না।
   
     তবে রাণা যে আবার এভাবে ওর সামনে আসবে তা কখনই ভাবেনি। তবুও আজ কিছুটা স্বস্তি হয় বোধহয় ঝুমের সাথে সাথে হয়ত রাণারও ওকে ভালো থাকতে দেখে। শুভ সত‍্যিই খুব ভালো ছেলে।

  বাড়িতে এসে রাতে একলা ঘরে এই সত‍্যিটা শেয়ার না করে পারে না রাণা।
 মুনিয়া ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিজেকে দেখছে রাতের পোষাকে। রাণা ওর কাঁধে হাত রাখে,' আজ ঝুমকে দেখলাম আবার। ওর বানানো চা খেলাম।'

  মুনিয়ার চোখে দুষ্টু হাসি খেলে যায়,' তাই? ঝুমকা এখানে হোটেল খুলেছে নাকি?'
-' উহু, ওর বিয়ে হয়েছে আমাদের এক বন্ধুর সাথে ওর বাড়িতেই।'
   মুনিয়া রাণার ঘাড়ে হাত রাখে,' ভালোই হয়েছে রে যা হয়েছে। ভালো থাক মেয়েটা।'
-' তুইও একথা বলছিস!'
  রাণার গলায় মুখ ঘষে মুনিয়া,' আমরা যখন ভালো আছি তখন থাক ওরাও ভালো নিজের মত।'
      রাণার ক্ষত এখন পুরোপুরি শুকনো আর কোন দাগছোপ নেই তাই আজ ওরও মনে হল সবটা ঠিক হয়ে যাক।

       দশমীর দিন শান্তা মুনিয়াকে ডেকে ওর হাতে দিলেন খুব সুন্দর একটা রূপোর মিনে করা চাবির গোছা। অবাক হয়ে যায় মুনিয়া,' কি করব আমি মামণি? মানে এটা..'
 ' একটা সময় এতে অনেক চাবি থাকবে তাই গড়িয়ে রেখেছি। তুমিও তো বাড়ির বড় বৌ।'
   মুনিয়া হেসে ফেলে,' মামণি,তোমাদের আদরে আদরে আমার তো কোন ট্রেনিং হলই না। মাঝে মাঝে ভুলে যাই আমি এ বাড়ির বৌ।'
-' মানে?' হাসেন শান্তা।
-' আমার তো মনে হয় আমিই মেয়ে এই বাড়ির।'
 শাশুড়িদের অনেক বদনাম, তবুও মুনিয়ার একটা কথাই অনেকটা শান্তি দিল শান্তাকে।

     তবে ডলের আশীর্বাদের দিন মুনিয়ার নিজেকে বেশ বড় বৌমা বলে মনে হল। আজ সুন্দর একটা আশমানী রঙে গোলাপী রঙের ছোঁয়া মাখা ঢাকাইয়ে সেজেছে মুনিয়া। ওদেশে থেকে তো মোটামুটি শাড়ি পরতে ভুলেই গেছিল। এখানে এসে শাড়ি গয়না পরা আমার আমিটাকে বেশ লাগল দেখতে মুনিয়ার। রাণার চোখও মাখামাখি ভালোলাগার ছোঁয়ায়।
     রাণীয়া কদিনে যেন আরেকটু বড় হয়ে গেছে। ডলের একদম আজ্ঞাবহ হয়ে উঠেছে। ওর গলা শুনলেই একদম ছটফট করে ওঠে। আজ পাউডার ঢেলে লিপস্টিক ভেঙে একাকার করল ওকে সাজানোর ফাঁকে।
   মুনিয়া রাগ করে চোখ পাকাতেই পিসির হাসি দেখে একটা দুষ্টুমি ভরা হাসি দিল।
   ডলকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে আজ। মেয়ের দিকে তাকিয়ে মনটা ভারী হয় শান্তার। বড় ন‍্যাওটা ছিল মেয়েটা সারাক্ষণ বাড়িকে মাতিয়ে রাখত। তারও শ্বশুরবাড়িতে যাবার সময় হয়ে এল। 
      আনন্দদের বাড়ি থেকে যে এত কিছু দিয়ে ওকে আশীর্বাদ করবে সত‍্যিই কেউ ভাবেনি। আজ ডলেরও চোখ ভিজল অকারণেই বারবার মনে হল কেমন যেন বড় হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি।
      তবে দুই বাড়ির সবাই খুব খুশি কাছাকাছি ভালো পরিবার পেয়ে। সত‍্যিই অবাক কান্ড,বেশিরভাগ এমন ক্ষেত্রে ঝামেলাই হয় বেশি। আসলে ডল আর আনন্দ দুজনেই খুব ভালো। আর পরিবারের শিক্ষাটাই বোধহয় আসল। পরিবারের এই বন্ধন ওদেশে খুব মিস্ করে রাণা। একমাত্র বোনকে ভালো থাকতে দেখে ভালো লাগার সাথে সাথে মনটা খারাপ হল রাণারও। বাবা আড়ালে গিয়ে মনটা খারাপ করে আছে। রাণা কাছে গিয়ে বোঝায়,' এখন তো বিয়ে হচ্ছে না বাবা এত মন খারাপ করছ কেন?'
-' বাড়িটা বড় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে রে। কদিন বাদে তো তোরাও...' বলতে বলতে গলাটা কাঁপে বাবার। রাণার কেমন যেন মনে হল যে বাবাকে এতদিন ছটফট করে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে,কোনদিন ভাবেই নি বাবার বয়েস হচ্ছে। সত‍্যিই বোধহয় বাবা অনেকটা দূর্বল আগের থেকে। অদ্ভুত একটা মনখারাপের কুয়াশা ঘিরে ধরে রাণাকে।

       দেখতে দেখতে রাণার যাবার সময় চলে আসছে। আজকাল ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে যায় রাণার। মুনিয়া আর রাণীয়া তখনও ঘুমোচ্ছে। ওকে হাল্কা আদর করে নিজের পুরোনো জায়গায় এসে বসে আরেকটু বেশি করে গন্ধ নেয় নিজের দেশের মাটির।
    হঠাৎই মা এসে ঘাড়ে হাত রাখে,' এত সকালে উঠেছিস কেন বাবু?'
-' একটু বস না মা কথা বলি।'
  শান্তা বুঝতে পারেন ছেলের মন খারাপ। আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,' আমরা ভালো থাকব ভাবিস না। আচ্ছা মুনিয়া পারবে তো দিদিভাইকে নিয়ে একা যেতে?'
-' পারবে মা অত ভেবো না। শখ করেছে থাকুক। রাণীয়া সবার আদরে কাটাক কিছু দিন।'

  ********************
 বেশ কয়েকদিন হল রাণা চলে গেছে, কিছু করার নেই কাজের জন‍্য আসতেই হল। রাণীয়া আর মুনিয়া এখন রাণার অভ‍্যেসে জড়িয়ে গেছে। ওদের ছাড়া সত‍্যি আর ভালো লাগছে না। মুনিয়ার কৃষ্ণনগর আর কলকাতা করে বেশ কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। কৃষ্ণনগরে থাকলে তো মেয়ের তেমন দায়িত্ব ওকে নিতেই হয় না। ঠাম্মা পর্যন্ত ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকে। ক‍্যালেন্ডারের দিকে চোখ রাখে মুনিয়া ওর ফেরার সময়ও আস্তে আস্তে হয়ে আসছে।
    সবার অনেক চিন্তা থাকলেও কিছু করার নেই সময় এসে যাওয়াতে মুনিয়াকে রওনা দিতেই হয়। শান্তার মন খুব খারাপ আজ। আসলের চেয়ে বোধহয় সুদের আদর বেশি। তাই নাতনিকে ছাড়তে বড় কষ্ট হল ঠাকুমা, দিদুন দাদুদের। ঠাম্মাও মন খারাপ করলেন। মুনিয়ার বারবারই মনে হল আবার যেন তাড়াতাড়ি ফিরতে পারে দেশে।
    মা বাবা ডল আনন্দ আর শ্বশুরমশাই এলেন এয়ারপোর্টে ওদের সাথে। রাণা বারবার ফোন করছে এদিকে।
-' দেখেছিস,একটুও ভরসা নেই কতবার ফোন করছে। ঠিক চলে আসব ভেবো না। আমি বোর্ডিং পাস নিয়ে জানাব। লাগেজ বেশি নেই চিন্তা কিসের?'
-' খুব মিস্ করব গো রাণীয়াকে আর তোমাদের। তাড়াতাড়ি চলে এস আবার।'
-' একদম, তোর বিয়েতে তো আসবই আবার। মন খারাপ করিস না।'
    মা,বাবা আর খুব চেনা মুখগুলো পেছনে ফেলে রেখে এগিয়ে যায় মুনিয়া ওকে ফিরতে হবে রাণার কাছে।

     ঠিকমত বোর্ডিং পাস আর অন‍্য ফর্মালিটি সেরে নিয়ে সবাইকে ফোন করে মুনিয়া। রাণীয়াকে বেল্টে বেঁধে নিয়েছে যত্নে বুকের কাছে। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে ও।

         ফ্লাইটে খুব একটা কোন সমস‍্যা করেনি রাণীয়া তাছাড়া এয়ারহোস্টেস রা খুব হেল্প করছে ওকে।

    দুবাই এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছয় মুনিয়া। এখান থেকে ফ্লাইট চেঞ্জ হবে তেমনি টিকিট। ওয়াইফাই কানেক্ট করে সবাইকে যোগাযোগ করে নিয়েছে। এখন কিছুক্ষণের অপেক্ষা। আসেপাশে অনেক ভারতীয় বসে আছে। বেশ ইন্ডিয়া ফিলিংস আসছে মুনিয়ারও।
   রাণীয়া মায়ের কোলে বসে নানান বায়না আর ছটফট করছে। ওর সাথে খেলার জন‍্য দুএকটা ছোট বাচ্চা মাঝেমাঝেই এসে দৌড়ে চলে যাচ্ছে। ওর পাশে বসে থাকা ভদ্রমহিলার বাচ্চা ছেলেটা খুব খেলছে রাণীয়ার সাথে। টুকটাক কথা বলে মুনিয়াও।

        ওরা মুনিয়ার সাথে একই ফ্লাইটে থাকার জন‍্য মুনিয়ার সুবিধা হল। একদম সামনে পেছনে সীট পড়েছে ওদের। বাচ্চা ছেলেটা খুব ছটফটে ওকে দেখে ভালো আছে রাণীয়া। অনেকটা সময় তবুও বেশ কেটে গেল।
    
 এয়ারপোর্টের সব ফর্মালিটি সেরে বাইরে বেরিয়েছে মুনিয়া। বেশ একটু আগেই রাণাকে মেসেজ করে দিয়েছে অ্যারাইভড। নিশ্চয় এতক্ষণে চলে এসেছে।

রাণার মেসেজ পায়,' একটু ওয়েট কর এই এসে গেছি প্রায়,গাড়িটা সমস‍্যা করেছে হঠাৎই।' ট্রলি হাতে রাণীয়াকে বুকে বেঁধে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে মুনিয়া।

 আবার দেখা হয়ে যায় ওদের মা ছেলের সাথে ওরা ওকে দেখে হেসে হাত নেড়ে বাই করে। মুনিয়াও হাত নাড়ে তবে আর কিছু বলতে পারে না। হঠাৎই নজর পড়ে একটু দূরেই প্রমোদ দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে বাচ্চা ছেলেটা জোরে ডাকে পাপা, তারপর ছুটে গিয়ে উঠে পড়ে ওর কোলে। সানগ্লাসটা মাথা থেকে নামিয়ে চোখে দেয় মুনিয়া, রাণীয়াকে বুকে চেপে ধরে অপেক্ষা করে রাণার জন‍্য।


কয়েকটা বছর মাঝে কেটে গেলেও সেই অভিমানী মুখটা একটুও চিনতে ভুল হয় না প্রমোদের। এখানেও মুনিয়া! সত‍্যিই এবার অবাক না হয়ে আর পারে না প্রমোদ। তবে আজকে কি একবার ওর সাথে দুটো কথা বলা যায় না?

      ততক্ষণে মধু ওর হাত ধরেছে। একবার পেছনে তাকিয়েও এগিয়ে যায় প্রমোদ একটু দূরে রাখা ওর গাড়িটার দিকে। সমস্ত জিনিস গাড়িতে তুলে ওদের বসিয়ে দিয়ে এক মিনিট সময় নিয়ে প্রমোদের অবাধ‍্য পা দুটো তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে যায় পেছনের দিকে। এয়ারপোর্টের সামনে তখনও লোকজনের ভিড়। প্রমোদ মুনিয়াকে খোঁজে এদিক ওদিক। এখানেই তো দাঁড়িয়ে ছিল,তাহলে কি চলে গেল?
     হঠাৎই চোখটা আটকে গেল একটু দূরে,বাইরে তখন মেঘ কেটে গিয়ে ঝলমলে রোদ উঠেছে। খুব দ্রুত পায়ে ছুটে আসছে চশমা পরা একজন কেউ তার বাড়ানো দুহাতে আদরে বন্দি তখন মুনিয়া। 

     প্রমোদ পা বাড়ায় সামনের দিকে। সুখী মুনিয়ার ছবিটা বারবার ভেসে ওঠে গাড়ির উইন্ডোস্ক্রীনে।

      



      

 



         
      
        

       
       



-

         

       
     
            


     

            




       
          
    
       


      
     

    


   

     
  
       


 
     
  

  

    
  
      

     

           

     

    



Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...