নিজেকে আয়নার সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎই পেছনে মুনিয়াকে দেখে রাণা।
-' কেমন লাগছে আমাদের পাশাপাশি দেখতে? বাহ্ সুন্দর ফিট করেছে পাঞ্জাবীটা। সত্যিই পুতুলের পছন্দ আছে তাই না?'
রাণার মনে প্রশ্নের উড়ো মেঘের ছড়াছড়ি তখন তবুও তখনকার মত সেগুলো মনের বুকপকেটে রেখে হাসে,' সত্যিই খুব ভালো দেখতে হয়েছে পাঞ্জাবী টা। পুতুলের পছন্দ আছে।'
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ঝপাঝপ কয়েকটা সেল্ফি তুলে নেয় মুনিয়া। দুজনের মনেই হয়ত আছে কিছু দ্বন্দ্ব তবুও তারমধ্যেই ছন্দে থাকা। হয়ত সব দ্বন্দ্ব ভুলে ছন্দটুকু জীবনে রাখার নামই ভালো থাকার চেষ্টা।
মুনিয়া ছবিগুলো দেখে সত্যিই ওদের ছবিতে ওদের সুন্দর ম্যাচিং ড্রেস আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছে। সত্যিই বোধহয় অনেক কিছুই এমন ঘটনা ঘটে যায় যা কখনই ভাবেনি।
অনেকদিন বাদে জুনির সাথে দেখা হল। সবাই ওদের দেখে এককথায় সুন্দর সাজগোজের প্রশংসা করল এমন কি রুমকি দিও।
-' কলকাতায় কত এক্সক্লুসিভ জিনিস পাওয়া যায়! কোথা থেকে কিনেছিস এটা?'
-' আমার বান্ধবী গিফ্ট করেছে গো,বলল তো ওর ননদকে দিয়ে আনিয়েছে। ঠিক জানি না। জানলে বলে দেব তোমাকে ফোনে।'
খাওয়া দাওয়া আর আড্ডায় একদম জমজমাট পরিবেশে সবাই ওদের হ্যাপি লাইফ উইশ করল আর রাণাকে হ্যাপি জার্নি। শুধু সব কিছুর মধ্যে মুনিয়ার মনে হল আজ ওদের মধ্যে কোথা থেকে যেন ঝুমকা এসে পড়েছে হঠাৎই। সব কিছুর মধ্যে ঝুমকার জয়ই বোধহয় হল অনেকটা। ওদের সুন্দর সাজগোজের ছবি মুঠোফোনে বন্দি করল সবাই।
পুজোর সময় যদি একবারও জানত ঝুমকা রাণার এক্স ছিল তাহলে হয়ত.. ইশ্ কি সব ভাবছে মুনিয়া! রাণা ওকে খুব ভালোবাসে রাণার কোন দূর্বলতা নেই ঝুমকার ব্যাপারে। বরং ও ভীষণ বিরক্ত ওর ওপর। হঠাৎ এইসব ভাবছে কেন ?
রাত গভীর হয়েছে,ভালোবাসা গভীরতর। এই কয়েকটা দিন রাণা ওকে আদরে ভরিয়ে রেখেছে। হয়ত হাতে থাকা কটা দিন অনেকটা নিয়ে আর দিয়ে যেতে চায়।
মাঝে কয়েকটা দিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেছে। মুনিয়া কাউকে ফোন করতে পারেনি তেমন করে। বরং বাড়ি থেকে আর বন্ধুরাই ওকে ফোন করেছে। আসলে মনটাও ভালো নেই,রাণার চলে যেতে আর মাত্র দুটো দিন। অনেকটা সাহস ধরে রাখা মুনিয়ার আজকাল খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। সব কিছু যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মনে হয় কিছু যেন একটা নেই নেই। তারপর রাণার গায়ে হাত দিয়ে আবার মনটা ভালো লাগে। নিজের অস্থিরতা চাপা দিয়ে হাসিমুখে থাকার চেষ্টা করে রাণা,এর মধ্যে অফিসেও একটা ছোটখাটো সেলিব্রেশন হয়ে গেল।
রাণা যাবার আগের দিন সন্ধ্যেবেলায় পুতুল ফোন করেছে। সত্যিই পুতুলকে ফোন করা হয়নি মুনিয়ার। যদিও মেসেজে বলেছে ওর দেওয়া ড্রেসটা পরেছে ওরা,সবাই খুব প্রশংসা করেছে। কিন্তু ছবি পরে পাঠাবো বলেও আর পাঠানো হয়নি মুনিয়ার।
তাই পুতুল ফোন করতেই প্রথমে সরি বলে নেয় মুনিয়া, ' তোকে ছবি পাঠাবো সোনা। আসলে এত কাজ বেড়েছে কি বলব? তোর শরীর ঠিক আছে তো?'
' আমি ছবির জন্য ফোন করিনি, তোর শরীর মন ঠিক রাখিস। নিশ্চয় খুব খারাপ লাগছে। আসলে বিয়ের পর লাইফ পাল্টে যায় অনেকটাই। রাণাকে একটু দে কথা বলি। আর ছবি আমি পেয়ে গেছি আজই।'
-' হ্যাঁ এক মিনিট, দিচ্ছি রাণাকে। ছবি কোথায় পেলি?'
-' জুনির প্রোফাইলে দেখলাম, ওর কাছ থেকে নিলাম। ভীষণ ভীষণ সুন্দর লাগছিল তোদের।'
-' সবটাই তোর দেওয়া উপহারের জন্য।'
-' যাকে দিয়েছি সে এত সুন্দর ক্যারি করেছে,সেই জন্য আরও ভালো লাগছে। কৌশিক দেখেও খুব খুশি। আসলে আয়ডিয়াটা ওর ছিল।'
রাণার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে পুতুল। ফোনটা স্পীকারে দিয়ে দুজনেই কাজ করে কথা বলতে বলতে। পরপর ফোন আসতেই থাকে। আজ কৃষ্ণনগরের বাড়ির সবাই মোটামুটি রাণার সঙ্গে কথা বলেছে এমনকি আনন্দও। নিজেকে কেমন যেন ভিআইপি বলে মনে হয় রাণার।
শুধু মুনিয়ার মুখটা আজ খুব শুকনো লাগছে। কেন যেন ভালো করে খেল না মেয়েটা। রাণাকে বারণ করেছিল তবুও রাণা শোনেনি আজ মুনিয়ার পছন্দের রান্না নিজেই করেছিল।
' আবার কবে আসবি তাই খাইয়ে যাচ্ছিস?' কথাটা বলতে গিয়েও গলায় আটকায় মুনিয়ার। শুধু বলে আজ কোথায় আমি খাওয়াব রান্না করে তা না...'
' আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই করেছি। ভালো করে খাওয়া দাওয়া করিস। অবশ্য তোর বাবা তো আসবেন সামনের সপ্তাহে কিছুদিন থেকে যাবেন। এটা ভেবেই নিশ্চিন্ত লাগছে।'
খুব ভালো হয়েছে রান্না,তবুও মুনিয়ার আজ কেন যেন শুধু কান্না পাচ্ছে। রাণাকে বলতে ইচ্ছে করছে আমার খুব মন কেমন করছে। আমাকেও নিয়ে চল তোর সাথে।
নিজেকে সামলায় মুনিয়া, রাণা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে বারবারই বলছে।,'ইশ্ কি দরকার ছিল আমাকেই পাঠানোর বাইরে? সবটাই অফিসের দোষ,আমি ভালো আছি ওটা ওদের সহ্য হচ্ছে না। তবে এবার তোকে আমি সুইজারল্যান্ড ঘোরাতে পারব মুনিয়া। তুই যখন জার্মানীতে আসবি তখন দুজনে মিলে প্যারিস আর সুইজারল্যান্ড ঘুরে আসব। তুই গেলেই যাব।'
হঠাৎই মুনিয়া বলে ওঠে,' আচ্ছা রাণা,আমাকে সুইজারল্যান্ড নিয়ে যাবার জন্যই কি তুই বিদেশে যাবার অফারটা নিয়েছিস?'
এক দুই সেকেন্ডের জন্য চুপ করে যায় রাণা, তারপর বলে,' ধ্যাৎ পাগলী, আমার কি কষ্ট হচ্ছে না তোকে ছেড়ে যেতে। তবে আমি আশায় আছি সেই ভালো দিনগুলোর যখন তুই যাবি ওখানে দুজনে মিলে খুব ভালো সময় কাটাবো।'
মুনিয়া নিঃশ্বাস ফেলে,' হ্যাঁ বললেই অফিস আমাকে ছুটি দেবে এতগুলো দিন বাইরে বরের কাছে যাবার জন্য।'
অনেক আশা,স্বপ্ন,চোখের জল আর ভালোবাসার মধ্যেই রাত্রিটা পার হয়ে সকাল হয়। মিস্টার আয়ার এসে নিচে দাঁড়িয়েছেন, জুনি আর অম্লানদা ওদের নতুন গাড়িটা নিয়ে এসেছে। রাণাকে এয়ারপোর্টে ছেড়ে একদম মুনিয়াকে নিয়ে ওদের বাড়ি চলে যাবে তেমনি কথা হয়েছে। মুনিয়ার মন ভালো রাখার জন্য এটুকু করতে চায় জুনি। তাছাড়া শনি রবি দুটো দিন পরপর ছুটি আছে। মিসেস আয়ারের হাঁটার অসুবিধা, ওপর থেকেই হাত নেড়ে বলেন কোন চিন্তা না করতে।
মসৃণ রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে এয়ারপোর্টের দিকে। মুনিয়ার মুখে আজ আর হাসি নেই। রাণা পেছনের সীটে বসে ওর হাতটা ধরে রেখেছে যত্নে। জুনি মাঝে মাঝে আয়নায় দেখছে ওদের। মুনিয়া বাইরের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলাচ্ছে। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে রাণাকে জড়িয়ে ধরে খুব ইমোশনাল হয়ে পড়েছিল মুনিয়া। ওকে সামলাতে গিয়ে নিজেও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। অনেকটা চোখের জল মেশানো আদরে আর চুমুতে ভেসে গিয়েছিল দুজনেই।
এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে ওরা রাণা জুনি আর অম্লানদাকে জড়িয়ে ধরে...' সবাইকে খুব মিস্ করব। মুনিয়া রইল দেখিস একটু। আজ খুব আপসেট হয়ে আছে। এত সাহস দেখিয়ে এখন ব্যাস আমার মন খারাপ করালো।'
-' মুনিয়া যা আদর করে দে বেচারাকে। আমরা মুখ ঘুরিয়ে আছি দেখছি না।'
মুনিয়ার চোখে লালচে আভা,রাণা একটু আগেই ভেতরে চলে গেছে। ওরাও এখন ফিরে যাবে কারণ আর থেকে লাভ নেই। এরপর রাণা আপডেট দেবে,তারপর পৌঁছে ফোন করবে।
**************************
আজকাল ঝুমকার ব্যবসা মোটামুটি সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়ে যায়। ঝুমকার হাসি পায় একসময় যেটা ছিল ওর ভয়ের জায়গা এখন সেটাই ওর জয়ের জায়গা।
ফেসবুকের পাতা ওল্টাতে থাকে ঝুমকা,কাল রবিবার সপ্তাহে একটা দিন পুরো ছুটি নেয় ও। সেদিন নিজের মত নিজে কাজ করে। কাগজে কলমে নক্সা এঁকে কাটিয়ে দেয় অনেকটা সময়। বাড়িতে একটু রান্না করে,দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে। বাজার করে আনে। সেদিন ওদের মা মেয়ের ছোট রান্নাঘর থেকে মাংসের সুবাস ভেসে আসে।
ফেসবুক দেখতে দেখতে হঠাৎই থমকে যায় ঝুমকা। পুতুলদি একটা ছবি পোস্ট করেছে।
ভালো করে ছবিটা দেখে ঝুমকা ওর বানানো পাঞ্জাবী আর শাড়ি পরে! বারবার ছবিটা দেখে ঝুমকা। সত্যিই বোধহয় পৃথিবীটা ছোট হতে হতে মুঠোয় বন্দী হয়ে গেছে। পুতুলদি বোধহয় নিজেও জানে না যে শাড়িটা ওর বানানো তাহলে হয়ত ওকে ট্যাগ করত। একটা সাজানোর মেয়েকে আর কে মনে রাখে? নিঃশ্বাস পড়ে ঝুমকার। হোয়াটস অ্যাপে পেমেন্ট করে হয়ত অর্ডার দিয়েছিল কেউ তারপর ডেলিভারি গেছে।
রাণা বোধহয় জানে না ওর পিঠেবুকে আল্পনা এঁকেছে ঝুমকার তুলি। অবশ্য রাণাকে মনে করেই ওর আবার তুলি ধরা। ওর আঁকার হাত দেখে রাণাই বলেছিল ও বুটিক খুলতে পারে। পুরোনো প্রেমিক কবেই দুয়ো হয়ে গেছে জীবন থেকে তবে তার কথা মনে করেই ভালো থাকতে শিখেছে আবার ঝুমকা।
বাড়িতে ফিরলে যতটা খারাপ লাগত ততটা লাগল না জুনির ওখানে এসে। জুনির পুচকেটা মাতিয়ে রাখল ওদের সবাইকে। মুনিয়া দেখল জুনি কি সুন্দর সব সামলাচ্ছে। অথচ ও আর জুনি কাছাকাছি বয়েসী।
এরমধ্যে রাণার সঙ্গে অনেকবারই কথা হয়েছে। ওয়াইফাই পেয়ে ভিডিও কলও করেছে রাণা। অনেকটা পথ পেরিয়ে নিজের গন্তব্যে পৌঁছে গেছে রাণা। আর হয়ত মন খারাপের অবকাশ নেই এবার নতুন দেশে মানিয়ে আর মেনে নিয়ে ভালো থাকার প্রস্তুতি।
মুনিয়া ফিরে এসেছে নিজের বাড়িতে। প্রথমটা দরজা খুলে খারাপ লাগলেও হঠাৎই মনে খুশির হাওয়ার দোলা লাগে। ও যেখানে চাবিটা রাখে সেখানে টেবিলের ওপর রাণার লেখা চিরকুট...' এতক্ষণে ফেরা হল মহখরাণীর। নিশ্চয় খুব ভালো কেটেছে দুটো দিন জুনির ওখানে। আমি একদম একা এখানে। এবার তুইও একা হয়ে যাবি আমার মতই। তবুও আমাদের ভালো থাকতে হবে। মিস্ ইউ মুন,লাভ ইউ।'
মুনিয়া ফিরে গেল সেই আগের দিনগুলোতে কিছুক্ষণের জন্য।
সময় বোধহয় একটা সময় তার প্রলেপ দিয়ে ভুলে ভালো থাকতে শেখায়। রাণার সারাদিনের কাজ আর মুনিয়ার ব্যস্ততা ওদের ভালো থাকতে অভ্যেস করালো একটু একটু করে।
এরমধ্যে অবশ্য মুনিয়ার বাবা এসে পনেরো দিন থেকে গেছেন। সে আরেক মুশকিল বাবাকে নিয়ে। বাবা সারাদিন কি করে? এখানে অত বাজার করা নেই বেশি বাজার করলে মুনিয়া রাগ করে।
তারপর বারবারই বলত তোর মা যে কি করছে একা একা? শেষে মায়ের জন্য মন খারাপ হচ্ছে এটা কনফেস করেই চলে গেছে।
অবশ্য মুনিয়ার ভালো হয়েছে তাতে সত্যিই মায়ের জন্য চিন্তা হচ্ছিল তারপর বাবা এই একা ফ্ল্যাটে সারাদিন! যাক সবাই নিজের মত ভালো থাক। অবশ্য ডলু বলেছে ওর পরীক্ষার পর এসে কিছু দিন থেকে যাবে। মুনিয়া মজা করেছে,' এখানে আনন্দ নেই কিন্তু, যে ছাদে দাঁড়ালেই দেখা যাবে।'
কখনও কলকাতায়, কৃষ্ণনগরে আর একান্তে রাণার সাথে কথা বলে সময় কেটে যায় মুনিয়ার।
দেখতে দেখতে দুটো মাস কেটে গেছে। রুমকিদি ফোন করেছিল সামনের শনিবার বাবলির বার্থডে আবার মনে করিয়ে দিল। অবশ্য এর মধ্যে দুদিন বাবলিকে নিয়ে ওর কাছে ঘুরে গেছে রুমকিদি।
রুমকিদি নিজের ছন্দেই হুকুমের সুরে বলে গেছে,' আমি কিন্তু কিছুই শুনছি না। রাণা নেই,কি করে যাব। এইসব শুনছি না। তাড়াতাড়ি চলে আসবি। সেদিনটা আমাদের ওখানে থেকে ফিরবি পরদিন।'
রুমকিদির কথার ঝড় বন্ধ হলে মুনিয়া বলে,' আচ্ছা বাবা যাব তবে রাতে ফিরে আসব গো।'
-' হুঁ বুঝেছি রাত জেগে ফোনালাপ হয়,উইকএন্ড প্রেম। বাট আসতেই হবে কিন্তু। প্রবাল কি তোকে নিয়ে আসবে গিয়ে?'
-' না গো,আমি চলে আসতে পারব।'
রাণার কাছে আপত্তি করলেও রাণাই বলে,' যা না ঘুরে আয় দেখবি ভালো লাগবে।'
-' ধ্যাৎ একা একা ভালো লাগে নাকি?'
-' বাবলি আছে তো তোর বন্ধু। ভালো লাগবে দেখিস।'
শুক্রবার অফিস থেকে ফেরার পথে বাবলির জন্য একটা বড় ডল আর চকলেট কিনে ফেরে মুনিয়া। বাবলিদির জন্য একটা পারফিউমও কেনে। ওদের অ্যানিভার্সারি তে যাওয়া হয়নি। তাছাড়া কাউকে পারফিউম দিতে খুব ভালো লাগে মুনিয়ার। পারফিউম প্রতিবার গায়ে মাখার সময় সেই মুখটা মনে পড়ে যে সেটা দিয়েছে।
অনেকটা সময় রাণার সাথে কথা বলে বালিশ আঁকড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মুনিয়া। দুপুর পেরিয়ে বিকেলের আলো চোখে লাগতেই নিজেকে সাজায় মুনিয়া। অনেকদিন আগে কেনা সাদা লঙড্রেসটা একবার পরে আর পরা হয়নি। রাণা বলে সাদাতে মুনিয়াকে খুব ভালো লাগে।
ড্রেসটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায় মুনিয়া। মাথার চুলটা উঁচু করে বাঁধে। কানে সাদা মুক্তোর ঝোলা দুল পরে। হাতে সাদা ব্যাগ আর জুতোটা পরে নিজেকে আয়নায় দেখে। রাণা দেখলেই বলত স্নো হোয়াইট। নিজেকে আরেকবার ভালোবাসলো মুনিয়া।
শহরের আকাশে হাল্কা মেঘের আনাগোনা,বৃষ্টির উড়োচিঠি এসেছে মনে হয়। মুনিয়া আপনমনেই বলে বৃষ্টিতে সাদা জামা! সেটা ভালোই,বৃষ্টিতে সাদা বেশ লাগে। ব্যালকনির সবুজের সামনে দাঁড়ায় মুনিয়া বেশ কয়েকটা সেল্ফি তোলে। ছবি তোলার ম্যানিয়ার জন্য রাণাও পেছনে লাগত কত। হোয়াটস অ্যাপ করে রাণাকে একটা দুটো ছবি,আর দু তিনটে লাইন লিখে দেয়। রাণা উত্তর দেয় খুব বেশি রাত্রি না করতে। আর যদি রাত্রি হয় তাহলে থেকে যেতে বা প্রবালদাকে বলতে ড্রপ করে দিতে।
ইশ্ ওখানে থেকে সমানে গার্জেনগিরি করছে!
ওপাশ থেকে একটা লাভসাইন দিয়ে উত্তর আসে স্নো হোয়াইট কথা শুনতে হয় বরের। দূরে থাকলেই বা গুরুজন বলে কথা।
টুকরো খুনশুটির পর রওনা দেয় মুনিয়া। চারদিকের সবুজের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলেছে ক্যাব। মাঝে মাঝে হাল্কা বৃষ্টিতে স্নান করে বড় গাছগুলো বেশ ঝরঝরে হয়ে ডালপালা মেলেছে। আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ঘরে ফেরা কিছু পাখির দল। রুমকিদিরা একটু দূরে থাকে। এই দিকটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা আর অনেক গাছপালা। মন হারিয়ে যায় মুনিয়ার,আনমনা হয়ে যায় যেতে যেতে। ম্যাপে চোখ রাখে,আর খুব একটা বেশি নয় মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছে যাবে।
হোয়াটস অ্যাপ মেসেজের পাতাটা ওল্টায় ঝুম বেশ অনেকগুলো অর্ডার ঢুকেছে। দিদি একটা সময় রাগ করলেও এখন ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য ঝুমকাই বলেছে,' তুই কিছু অর্ডার ধরে দে আমাকে তোর পরিচিত যারা আছে বা জামাইবাবুর ওখানে যদি কয়েকটা রাখা যায় আমার কালেকশন তাহলে লোকে জানবে। একটা সময়ের স্বপ্ন দেখে ঝুমকা যখন বিদেশেও ওর জিনিস যাবে।
দিদিকে বলেছিল কিছু দেবে। দিদি রাগ করেছে,' বোনের কাছ থেকে কমিশন নেব তুই ভাবলি কি করে? তুই না সত্যিই অনেক বদলে গেছিস। সম্পর্ক ভালোবাসায় হয় কমিশনে আর প্রয়োজনে হয় না। আমার ভালো লাগে বলতে সবাইকে আমার বোনের হাতের কাজ এগুলো।'
ঝুমকার চোখের কোণটা ছলছল করে একটা সময় ওর ভিডিও দেখে লজ্জায় মুখ ঢেকেছিল দিদি। আজ তবুও একটা জায়গা নিজেই তৈরী করতে পেরেছে। যৌবন,সৌন্দর্য সব কিছুর ওপরেও সবচেয়ে আপন বোধহয় নিজের হাতদুটো। এই দুটো হাতের ওপর যদি ভরসা থাকে তাহলে হাত দিয়েই ভাগ্যের রেখা পাল্টে দেওয়া যায় অন্ততঃ কিছুটা।
দিদির কথা তবুও শোনে না ঝুমকা। দিদি হাউসওয়াইফ, যদিও জামাইবাবুর পুরো টাকাতেই দিদির অধিকার তবুও নিজের মত কিছু করে দিদিকে দেয়। ' দিদি রেখে দে,আমি লাগলে তোর কাছ থেকে ধার নেব। তখন সুদসমেত ফেরত দিবি।'
অনেক না পাওয়ার মধ্যে সম্পর্কের এই ছোট মিষ্টতা নিয়ে বাঁচতে চায় ঝুমকা।
ওর দিদি মন্দিরা আজকাল মাঝে মাঝেই বলে,' সারাদিন গাধার খাটনি খেটে শরীরটা কেমন হয়েছে দেখেছিস? এবার একটা ছেলে দেখি বরং সব জানিয়েই বিয়ে দেব।'
বিয়ের কথাতে চমকে ওঠে ঝুমকা। শিউরে ওঠে বিয়ে নামক দাসত্বের শৃঙ্খলের কথা ভেবে,' দিদি আর কখনও বলিস না এই কথা। আমাকে বাঁচতে দে তোরা। আমি বাঁচতে চাই। তাছাড়া ঐ শয়তানটার সাথে তো আমার ছাড়াছাড়ি হয়নি।'
এক কথা সোহিনীদি বলেছিল একদিন। আচ্ছা মেয়ে হলে কি বিয়ে করতেই হয়। এক ফোঁটা সিঁদুরের লাল রঙের বিনিময়ে জীবনে কত যে কালো রঙ দেখতে হয়েছে ওকে তার হিসেব কে রাখে?
ছাড়াছাড়ির কথা সোহিনীদির সাথেও হয়েছিল। সোহিনীদি হা হা করে হেসে বলেছিল,' তোদের বিয়ে মন্দিরে হয়েছিল না? ওটা আবার বিয়ে নাকি? এমন কত বিয়ে ঐ শয়তানটা করেছে কে জানে? একবার যদি আসত এখানে।'
সোহিনীদির কথায় ভরসা পেয়েছিল ঝুম। মন্দিরের বিয়ে নাকি বিয়ে নয়। তাহলে সবার সামনে সাতপাকে বেঁধে যে বিয়ে সেটা বিয়ে? উত্তর খুঁজেছিল ঝুমকা।
************************
নিজের ডেস্টিনেশনে এসে গেছে মুনিয়া। নামার আগে মোবাইলের ফ্রন্ট ক্যামেরায় একবার নিজেকে দেখে নেয়। সামলে নেয় ছড়িয়ে পড়া চুলগুলোকে যত্নে। যাক তবুও ভালো বাতাসের ঠান্ডা হাওয়ার পরশ জল হয়ে ঝরেনি। মেঘেদের উড়ো চিঠি উড়ে গেছে কোথাও। রুমকিদিরা এখানে একটা বাড়ি কিনে নিয়েছে। সাজিয়ে নিয়েছে নিজেদের মত। সবসময়ই ওদের দুজনের মধ্যে কারো মা বাবা এসে থাকেন তাই বাড়ি হওয়াতে খুব সুবিধা হয়েছে। বাবলির জন্মদিনের জন্য ঠাম্মা,দাদান আর দাদু দিম্মা সবাই এসেছে। আগেই খবর পেয়েছে মুনিয়া। খুব মজা রুমকিদির। এখন নাকি একদম ফ্রী কিছুই সামলাতে হয় না ওকে। সবটাই মা বাবারা দেখছে।
সামনের ছোট্ট বাগান পেরিয়ে দরজার সামনে পা রাখতে রাখতে খাবারের গন্ধ ভেসে আসে নাকে। একদম শুদ্ধ দেশি ঘিয়ের গন্ধ। নিশ্চয় বাবলির ঠাম্মা কিছু স্পেশাল ডিশ রান্না করছে নাতনির জন্য। রুমকিদি মজা করে বলে,' পাটনাইয়া মানুষ তো বুঝলি আধা বিহারী মোটামুটি। একদম চুটিয়ে হিন্দীতে বকবক করে,ছট পূজাতে ঠেকুয়া বানায় আর দেওয়ালীতে লাড্ডুর ঝুড়ির ছড়াছড়ি।'
ঠেকুয়ার কথা শুনে মুনিয়া খুব নস্টালজিক হয়ে পড়েছিল একটা সময়ে কলেজে প্রমোদের আনা ঠেকুয়া নিয়ে মোটামুটি মারামারি হত। তবে প্রমোদ ঠিক আলাদা করে ঠেকুয়া প্যাক করে আনত ওর জন্য। ও ভালোবাসে বলে।
বেল বাজতেই ভেতরে বাবলির গলা পায় মুনিয়া। বাবলি ছুটে আসে রুমকিদির সাথে।
ওকে দেখে রুমকিদি জড়িয়ে ধরে। 'কি সুন্দর লাগছে তোকে হোয়াইট পরে! একদম ডল লাগছে। আয় আয়।'
-' আমি একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছি রুমকিদি। তুমি এখনও রেডি হওনি কেন? আমি তো ভাবলাম তুমি সারপ্রাইজ দেবে।'
-' এই তো এখন রেডি হব,একটু সিলেক্ট করে দে তো। আর বাবলিকে তুই সাজিয়ে দিবি। ওর ড্রেস সব গুছোনো আছে। আর বলিস না মাম্মীজি কিচেনে পুরো ধুম মাচিয়ে রেখেছে। সকালে মা বেঙ্গলী ডিশ কিছু বানালো এখন উনি আবার একটু মিঠাই বানাচ্ছেন। তাই একটু হেল্প করছিলাম।'
-' তোমার তো খুব মজা এখন! একদম জমজমাট বাড়ি। আয় বাবলি সোনা আমি সাজিয়ে দিই। প্রবালদা কোথায় গো?'
-' এসে পড়বে রে একটু বাইরে গেছে কতগুলো কাজ আছে। একদম কেকটা নিয়ে ফিরবে।'
বাবলিদির সঙ্গে ভেতরে এসে বেশ একটা বাড়ি বাড়ি ফ্লেভার পেল মুনিয়া। রুমকিদির মা বাবাকে এর আগে দেখেছে মুনিয়া তবে আঙ্কেলজী আর আন্টিজীকে এই প্রথম দেখল। রুমকিদি বলে দিয়েছে আঙ্কেলজী আন্টিজী বলবি,আমার মা বাপিকে তো কাকু কাকিমা বলিসই। প্রথমে এসেই মুনিয়া একদম ঠেকুয়ার স্বাদ পেল আন্টিজীর আদরে। আধাভাঙা বাংলায় কথা বলেন ওঁরা মুনিয়াকে আদর করে ঠেকুয়া খাওয়ালেন ও ভালোবাসে শুনে।
বাবলিদি ফিসফিস করে বলল,' বুঝলি পাটনায় থেকে একদম বাঙালীত্ব খোয়া গেছে ওদের। আমরা রসগোল্লা সন্দেশ নিয়ে যাই কারো বাড়ি গেলে। আর ওঁরা নিয়ে আসে ঝুড়ি ভরা লাড্ডু,ঠেকুয়া,নিমকি আর প্যাড়া নিয়ে।'
' তোমরা নিশ্চয় ভালোবাসো তাই আনেন। আমার শ্বশুরমশাই যেমন সরপুরিয়া আনেন আমার জন্য। শাশুড়িমা ছেলেকে খাওয়ান ঝুরো আলুভাজা।' বাবলিকে সাজাতে সাজাতে বলে মুনিয়া।
' আর বলিস না বাবলি তো এগুলো পছন্দ করে প্রবালও। সারাদিন খুটুর খুটুর করে খেয়ে যাচ্ছে।'
' আর তুমি?'
-' আগে খুব খেয়েছি রে এখন কন্ট্রোল করছি রে। দেখত কেমন লাগছে এই ড্রেসটা পরে? নাকি আরেকটা যেটা বললি সেটা পরব?'
-' ভীষণ ভালো লাগছে গো দেখতে। আর চেঞ্জ কোর না। মা মেয়ে একদম ম্যাচিং ম্যাচিং খুব ভালো লাগছে।'
সুন্দর করে সাজানো ডাইনিং হলে রঙীন বেলুনের ছড়াছড়ি। বাবলিকে একটা ছোট্ট প্রজাপতির মত লাগছে। মুনিয়ার আনা পুতুলটা নিয়ে অনেকগুলো ছবি তুলে দিল ওর মুনিয়া। ওদের মা মেয়ের ছবিও হল। মুনিয়ার সাথেও বেশ কয়েকটা ছবি হয়ে গেল।
রুমকিদির সাথে খাবার দাবার গুলো গুছিয়ে রাখল মুনিয়া। প্রবালদা এসে গেছে কেক নিয়ে। কেক দেখে মহা খুশি বাবলি। অনেকদিন বাদে প্রবালদাকে দেখল মুনিয়া।
রুমকিদি আর প্রবালদাকে টাই আর পারফিউম দেয় মুনিয়া। সঙ্গে সঙ্গে গায়ে স্প্রে করে নেয় রুমকিদি। ওর এই ছেলেমানুষী স্বভাবটা খুব টানে মুনিয়াকে। ভীষণ হাসি মজা করে সবাইকে জমিয়ে রাখতে পারে রুমকিদি।
' ইশ্ কি দারুণ রে পারফিউমটা। লাভ ইউ মুনিয়া সোনা। মাঝে মাঝেই এইরকম গিফ্ট দিস তো। আর ঐ শাড়িটার কথা মনে আছে? ওটার হদিশ পেলে জানাস।'
রুমকিদির কথার মাঝেই চমকে ওঠে মুনিয়া। রুমকিদি এখনও ভোলেনি শাড়ির কথা! কি করে রুমকিদিকে এনে দেবে শাড়ি? ঝুমকে ও ফোন করতে পারবে না। দেখা যাক যদি পুতুল পারে?
প্রবালদা বলল,' ওহ্ মুনিয়াকে ওটা দাও যেটা আমি এনেছি।'
-' ইশ্ সত্যিই তো।'
রুমকিদি একটা অনেক বড় চকোলেট আর ব্যাগ ওকে এনে দেয় ওয়াড্রোব খুলে।
-' তোর দাদা এনেছে,অফিসে নিয়ে যাস। আর চকলেটটা একাই খাস। অবশ্য রাণা ওখানে অনেক চকোলেট খাবে। খুব মিস্ করছি ওকে রে।'
বাইরে ততক্ষণে সন্ধ্যের আঁধার নেমেছে,ঘর আলোতে ঝলমল করছে। পরপর অনেক গেস্ট আসছে। কেক কাটার পর ছাদে সুন্দর শেডের তলায় খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেছে ওরা। যাক বৃষ্টি নেই ভালোই হয়েছে। অবশ্য হলেও অসুবিধা নেই। রুমকিদি ভালো বলে ওদের ছাদে বৃষ্টিতে বসে ওয়াইন বা বিয়ার খেতে দারুণ লাগে। সাথে অবশ্যই রোস্টেড চিকেন থাকবে। রাণা শুনে খুব মজা পেয়েছিল।
প্রবালদা বলেছিল,' তবে মা বাবারা থাকলে করি না খুব একটা। ওরা না থাকলে হানিমুন মুডে চলে যাই।'
' একদম বাধ্য ছেলে আর বৌমা। অন্য দিকে বাধ্য মেয়ে আর গুডবয় জামাই।'
স্টার্টার ডাইনিং টেবিলেই সাজিয়ে রেখেছে ওরা। বাবলি গিফ্ট পেয়ে খুব খুশি একবার ছুটে ঠাম্মা আবার একবার দিদার কাছে যাচ্ছে। দুই দাদু সবার সাথে গল্পে ব্যস্ত। সবাই কফি আর টুকটাক খাবার খেতে ব্যস্ত। রুমকিদি সবার সাথেই আলাপ করিয়ে দিয়েছে মুনিয়াকে। ভালো লাগছে মুনিয়ার একটা অন্যরকম পরিবেশে এসে। অথচ আসবে কি না ভাবছিল একটা সময়। রাণাকে ছাড়া একা একা কি করবে ভেবে চিন্তা হচ্ছিল। রাণাই বলল যেতে। তাছাড়া বাবলির বায়না তো আছেই।
-' মাম্মা আমি কেক কাটব না? কখন কাটব? আমার ফ্রেন্ডরা তো সবাই এসে গেছে। '
-' হ্যাঁ মা এই তো কাটবে এখনি। আঙ্কেল এসে পড়ুক,পাপাকে ফোন করেছিল এসে পড়বে একটু বাদেই। তারপর কাটব।'
-' আমরা তাহলে আইসক্রীম চকলেট খাব কার্টুন দেখতে দেখতে।'
রুমকি মুনিয়াকে ইশারা করে,' তুই একটু বাচ্চাগুলোকে ম্যানেজ কর বুঝলি। চকোলেট আর আইসক্রীম দিয়ে। একটু বাদেই কেক কাটবো আমরা। একজন এখনও আসেনি। আমি এদিকটা দেখছি।'
মুনিয়া টিভির ঘরে ড্রেসটা ছড়িয়ে বসে ওদের সঙ্গে বকবক করে চকলেট দিতে দিতে। সবার সাথেই দোস্তি হয়ে যায় একটু বাদেই। ওদের আব্দারে পছন্দের কার্টুন চালিয়ে দিয়ে মেতে যায় আনন্দে। বাবলির বন্ধু ইভা ওর কোলের কাছে বসে। বাবলি একদম মুনিয়ার কোলে বসে। ইভা বলে,' ও ফেয়ারি আমাকে একটু কোলে নাও না?'
-' কেমন বোকা দেখেছ? এটা ফেয়ারি নয় আমার আন্টি।'
ওদের খুনশুটি খুব উপভোগ করে মুনিয়া। হঠাৎই রুমকিদি ডাকে,' বাচ্চেলোগ আ যাও ইধার,বাবলি সোনাকে নিয়ে আয় মুনিয়া এবার কেক কাটবে। বাবলি বেটা আও ইধার দেখো কোন আয়া হ্যায়?'
মুনিয়া ওদেরকে নিয়ে ছটফট করে বেরিয়ে আসে,' চলো চলো সবাই,এবার কেক কাটতে হবে। বাবলি সোনা চল চল।
বাবলি ওর দিকে হাত বাড়ায়,' আমি তোমার কোলে কোলে যাব। কোলে নাও।'
মুনিয়া হাত বাড়ায়,'দুষ্টুমি হচ্ছে! আয় চল কোলেই যাবি।'
রুমকিদির গলা শোনা যায় আবার বাবলি...…
মুনিয়া বাবলিকে কোলে নিয়ে তাড়াতাড়ি আসে।
রুমকিদি বলে,' এসো বাবলি এখানে দাঁড়াও। প্রবাল মাম্মীজিকে পাপাজী আর ভাইয়াকে বুলাও ইধার।'
প্রবালদার মা বাবার সাথে যাকে দেখে তাকে দেখে চমকে ওঠে মুনিয়া। রুমকিদির কথাগুলো ঠিকমত কানে ঢোকে না।
'মুনিয়া এর জন্যই ওয়েট করছিলাম আমার প্যায়ারা হ্যান্ডসাম দেবরজী প্রমোদ।'
মেঘ ঘনিয়ে আসে কোন সময় যেমন আজ বিকেলে এসেছিল তবে জল ঝরেনি। কিন্তু এখন মুনিয়ার মনে হল মেঘেদের উড়োচিঠি সত্যিই আসে হঠাৎই কিচ্ছু না বলে কয়েই। কি করবে ও হঠাৎই কিছু বুঝতে পারে না তবে ততক্ষণে প্রমোদের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেছে। সেই প্রমোদ যাকে একদিন না দেখলে মুনিয়ার সব আলো নিভে যেত। কলেজে গিয়ে যার পাশে বসে খুনশুটি না করলে মুনিয়ার আজকের দিনটা ফালতু বলে মনে হত। যার হাতে হাত দিয়ে ভেসে যেত আনন্দ আর উচ্ছ্বলতায়। যার বলিষ্ঠ দুই বাহুর মধ্যে নিজেকে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে হত। আজ মাঝের ঝড়ঝাপটা পেরোনো বছরগুলোর পর তাকে হঠাৎই একটা আপদ বা বিপদ বলে মনে হল।
বুকটা কেঁপে উঠল মুনিয়ার ছবির মত ভাসতে লাগল একসাথে কাটানো পাঁচটা বছরের কথা চোখের সামনে। চোখটা ঝাপসা হল হঠাৎই, কিন্তু তখন ঘরে অনেক লোক। হালকা লাল নীল আলো জ্বলছে তারমধ্যেই নিজেকে মুহূর্তে সামলে নিলো মুনিয়া। রুমকিদির দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। প্রমোদের মুখেও হাসি তবে তা খুশির না অস্বস্তির তা জানে না মুনিয়া। জানতেও চায় না।
কেক কাটছে বাবলি। সবাই এক সুরে হ্যাপি বার্থডে বলছে। মুনিয়ার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না।
বারবার মনে একটা কথাই ভেসে উঠল, কেন চলে গেলি রাণা ঠিক এই সময়টাতেই। আজ যে খুব মিস্ করছি তোকে। আমাকে এখান থেকে কে নিয়ে যাবে? আমি উড়োচিঠি ভরা খামটা খুলতে চাই না। অতীতকে তো সেই কবেই উড়িয়ে দিয়ে সেখানে নতুন জীবনের চারাগাছ লাগিয়েছিলাম যা এখন ফুলে ফুলে ভরপুর। তবুও কেন অতীত আমার সামনে এল? ঐ শয়তান টার মুখ আমি দেখতে চাই না। ও আমাকে ঠকিয়েছিল। ভালোবাসার মৃত্যু দেখতে না পেরে নিজেকেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলাম আমি।
অন্যমনস্ক তালগোল পাকানো মুনিয়ার ঘোর ভাঙে বাবলির ডাকে,' আন্টি তুমি কেক খাবে না?'
মুনিয়া মুখে হাসি রাখতে চেষ্টা করে বাবলির ছোট্ট আঙুলের আদরমাখা কেকের টুকরো মুখে নেয়। ক্লিক ক্লিক করে ছবি উঠছে। রুমকিদি ওকে ইশারা করে কেকটা একটু কেটে দিতে। মুনিয়া না বলতে পারে না কাঁপা কাঁপা হাতে কেক কেটে ভাগ করতে যায়।
' মুঝে দিজিয়ে আপ,ম্যায় কাট দেতি হুঁ। মালুম হোতা হ্যায় আপকা তবিয়ত আচ্ছা নেহি।'
রুমকিদি একটু হেসে প্রমোদের দিকে তাকায়,' ও মাই কেয়ারিং দেবরজী। তুই চলে আয় এদিকে মুনিয়া। তোর কি খারাপ লাগছে? সত্যিই তো মুখটা শুকনো লাগছে। কখন এসেছিস অথচ সেই থেকে তেমন কিছু খেলি না।'
কেক ভাগ করতে করতে মুখ তোলে প্রমোদ, হঠাৎই বলে ,' একটা চকলেট খাইয়ে দাও ভাবি ঠিক হয়ে যাবে। তুরন্ত এনার্জি পেয়ে যাবে।'
মুনিয়া অবাক হয়ে যায় এই কথাটা যে কতবার প্রমোদের মুখে শুনেছে তার ঠিক নেই। খাওয়া নিয়ে সবসময় সমস্যা ছিল মুনিয়ার। বেশিরভাগ দিন টিফিন আনত না। আবার বাইরের খাবারও না পসন্দ অথচ খিদে খিদে পাচ্ছে ভাব। শরীর এলিয়ে দিত প্রমোদের ঘাড়ে। আর পারছি না,ভালো লাগছে না। এবার মরে যাব মনে হচ্ছে।'
প্রমোদ মজা করে বলত,' মরবে তোর দুশমন মুন্নী, ইয়ে লে লো হ্যায় না মেরে পাশ চকলেট। তুরন্ত এনার্জি মিলেগা।'
চকোলেটের প্রেমে ডুবে যেত এভাবেই নানা অছিলায় মুনিয়া। রাণাও জানে মুনিয়া চকোলেট ভালোবাসে। তাই ফ্রীজে মজুত করে রাখে চকলেট। খাবার কম চকলেট বেশি। যাবার আগেও রেখে গেছে সব এনে গুছিয়ে।
রুমকিদি কাজের মধ্যেই একটা চকলেট এনে ধরে। মুনিয়ার মুখটা তেতো হয়ে গেছে ভেতর থেকে। চকোলেটটা হাতে নিয়ে খাচ্ছি বলে মুঠোতে রাখে,রুমকিদি আমি না তাড়াতাড়ি চলে যাব মানে একটু বাদেই চলে যাব। কেন যেন সত্যিই শরীরটা ভালো লাগছে না। গা গুলোচ্ছে।'
রুমকিদি একটা সন্দেহের হাসি দেয় ওর দিকে তাকিয়ে,' এনি গুড নিউজ?'
' ধ্যাৎ, না না। সত্যিই আমি চলে যাব।'
-' তা কি করে হয় এখনও ডিনার করিসনি। আচ্ছা তোকে ওপরে যেতে হবে না। আমি মাকে বলছি তোকে নিচেই খেতে দিয়ে দেবে। প্লিজ না খেয়ে যাস না। আর তোর দাদাই তো তোকে ছেড়ে দেবে বলেছিল। তুই বরং রেস্ট নে,ও তোকে ছেড়ে এলে আমি নিশ্চিন্ত।'
কেক কাটার পর দাদার সাথে ছাদে চলে আসতে হয়েছে প্রমোদকে। একটু সবাইকে দেখভাল করার জন্য। ছাদে এসে এদিক ওদিক দেখে প্রমোদ মুনিয়াকে দেখতে পায় না। বেশ কিছুটা আগে দেখেছিল এখন ভাবী বা ও কাউকেই তো দেখছে না।
মুনিয়াকে কোনরকমে ম্যানেজ করে নিচে রেখে ওপরে উঠে আসে রুমকি। হঠাৎই মেয়েটার কি হল কে জানে? রাণা চলে যাবার পর মেয়েটার মনটা ভালো নেই বুঝতে পারে রুমকি। তবুও তো ওকে ভালো থাকতে হবে। কি জানি ভালো করে খাওয়াদাওয়াও হয়ত করে না। নিচে মাকে ওকে দেখতে বলে। উপায় নেই তাই আসতেই হয় এখানে, সবাই ওর জন্য অপেক্ষা করছে। হোস্ট না থাকলে কি করে হবে। রুমকিদি চলে যেতেই বাথরুমে যায় মুনিয়া, হঠাৎই কেমন যেন বমি পেলো আবার। অনেকটা তেতো জল বেরিয়ে এল গলা দিয়ে আর চোখটা ভিজল নোনতা জলে। সব সময় ওর সঙ্গেই এইসব হয় কেন? রাণার এক্সের সাথে ওরই দেখা হল,কথা হল। রাণা ভুল বুঝল ওকে। একটা শুকনো ঝড় উঠল ওদের দাম্পত্যে। তারপর আবার প্রমোদ কেন এল এখানে? প্রমোদকে রুমকিদির রিলেটিভ হতে হল? কই এর আগে তো কখনও শোনেনি প্রমোদের নাম রুমকিদির কাছে।
আর এখানে একটুও থাকা নয়,ওকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে হবে এখান থেকে। সত্যি হয়ত এরপর নিজে নিজেকে সামলাতে পারবে না যদি প্রমোদ ওর মুখোমুখি হয়ে কোন কথা বলে। না ও প্রমোদের মুখোমুখি কিছুতেই আর হতে চায় না।
মাসিমণিকে বুঝিয়ে মোটামুটি পালিয়ে আসে একটু বাদেই মুনিয়া ঐ বাড়ি থেকে। যদিও রুমকিদি বকবে বলে মাসিমা খাবার দিয়ে দিয়েছেন জোর করে। বারবার বলছিলেন,' একবার রুমকির সাথে দেখা করে যাও। আমাকে বকবে খুব কিন্তু।'
-' আমি রুমকিদির সাথে কথা বলে নেব মাসিমণি। এখন শুনলে অযথা টেনশন করবে। আমি পৌঁছে ফোন করব একদম। আমি আসি মাসিমণি।'
মুনিয়া জানে রুমকিদির মায়ের একটু হাঁটার অসুবিধা তবুও দরজার কাছে এসে দাঁড়ান। বাগান পেরিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে মুনিয়া ক্যাবে বসে পড়ে।
ক্যাব চলতে শুরু করেছে,ড্রাইভারকে এসিটা বন্ধ করতে বলে জানলাটা খুলে দেয় মুনিয়া। যে বাড়িটা বিকেল থেকে ওকে আনন্দে ডুবিয়ে রেখেছিল একটা সময় প্রমোদকে দেখার পর ঐ বাড়িটা রীতিমত নিঃশ্বাস আটকে গলাবন্ধ করে দিয়েছিল ওর। বাইরের হাওয়ায় অনেকটা হাল্কা লাগে ওর। অনেকটা শ্বাস টানে বাইরে থেকে বুকে জমে থাকা পাথরটা নড়িয়ে দেবার জন্য। অনেকক্ষণ ফোনে হাত দেয়নি মুনিয়া। এখন ফোনটা খুলতেও ইচ্ছে করছে না মুনিয়ার। একদম বাড়ি গিয়ে ফোনটা দেখবে।
ছাদে হাল্কা মিউজিক বাজছে সবাই ব্যস্ত খাওয়া দাওয়া আর গল্পে। প্রমোদ একটু ফাঁকায় একপাশে দাঁড়ায় ওর মনে অনেক প্রশ্নের ভীড়। কখনও ভাবেনি মুনিয়ার সাথে এভাবে দেখা হতে পারে! মুনিয়া কেমন যেন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ওকে দেখে বুঝতে পারে প্রমোদ। আগের কথা মনে পড়ল প্রমোদের,সবই শুনেছিল কিন্তু কিছুই করার ছিল না। মুনিয়া এখন ওর অতীত তবুও ওর সঙ্গে কাটানো সময়গুলো আর কলকাতাকে খুব মিস্ করে প্রমোদ। কিছুদিন আগে কলকাতায় যেতে হয়েছিল। একা একাই ঘুরে বেড়িয়েছে অতীতের হারিয়ে যাওয়া গলিপথ দিয়ে। একা একাই বসে হলদিরামে লস্যি খেয়েছে। কফি হাউসে গিয়ে স্যান্ডউইচ আর কফি।
কিন্তু মুনিয়া কোথায় গেল? অনেকক্ষণ হয়ে গেল ওকে ছাদে আসতে দেখেনি। কিন্তু মুনিয়ার মুখোমুখি ও কি করে হবে? তবুও একবার দেখতে ইচ্ছে করছে খুব মুনিয়াকে।
নিচে নেমে আসে প্রমোদ, এই বাড়ির সব ঘর ওর পরিচিত নয়। আজকেই প্রথম এই বাড়িতে এসেছে ও। তবুও বুঝতে পারে মুনিয়া চলে গেছে। খারাপ লাগল প্রমোদের এমন একটা পরিস্থিতি হতে পারে মানে মুনিয়া এখানে আসবে জানতে পারলে কখনই আসত না এখানে।
তবে সত্যিই কি মুনিয়াকে কখনও খোঁজেনি ও? মুনিয়ার হাসি,ছেলেমানুষী, আবেগ,উচ্ছ্বাস সবই ঘুরে ফিরে মনে এসেছে এই কটা বছরে।
*************************
বাড়িতে ফিরে এসে ড্রেসটা খুলে ফেলে আবার বাথরুমে ঢোকে মুনিয়া। বাথরুমে দাঁড়িয়ে কাঁদা ওর পুরোনো অভ্যেস। এমন কান্না কতই কেঁদেছে প্রমোদ চলে যাবার পর। আর সেই রাতটা,কিচ্ছু চাই না আমি আজীবন ভালোবাসা ছাড়া। আজও প্রতিটা মৃত্যুর দিকে ছুটে যাওয়ার মুহূর্ত মুনিয়ার মনে আছে।
রাণা এসে ওকে আর তেমনিভাবে কাঁদতে দেয়নি কখনও তবুও মুনিয়া কেঁদেছে পুরোনো কথা মনে করে। বর্তমানের বুকে মুখ লুকি চোখের জলে ভিজে ভুলতে চেয়েছে অতীতকে। কিন্তু আজ তো রাণাও নেই কাকে বলবে ওর কষ্টের কথা? শাওয়ার চালিয়ে হাউহাউ করে কাঁদে মুনিয়া,রাণার চলে যাবার কষ্ট প্রমোদের সাথে দেখা হওয়ার যন্ত্রণা সব যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে তোয়ালে জড়িয়ে মুনিয়া এখন বাড়িতে কেউ নেই ও ওর মত থাকতে পারে। ফোনটা বাজছে একটানা সুরে। নিজেকে সামলে ফোনটা ধরে মুনিয়া। রাণা ফোন করেছে।
-' তুই কোথায়? ইন্টারনেট অফ করা। অনেকগুলো মেসেজ করেছি কোন উত্তর নেই। এখনও ফিরিসনি নাকি? এর আগে আরও দুবার ফোন করেছিলাম। এবার না ধরলে প্রবালদাকে ফোন করতাম।'
প্রবালদাকে ফোন করার কথা শুনে একটু চমকে ওঠে মুনিয়া। তারপর বলে,' না না আমি তো বাড়িতেই। ফিরে এসে একটু বাথরুমে গেছিলাম। এত টেনশন করিস কেন?'
রাণার গলাটা নিশ্চিন্ত লাগে,' যাক ভালো হয়েছে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছিস। আমিও ভাবছিলাম ওদিকটা ফাঁকা ফাঁকা। প্রবালদা যদি তোকে পৌঁছে দেয় ভালো হয়।'
আজ যেন রাণার অত্যন্ত আদরের দুঃশ্চিন্তাকে বাড়াবাড়ি মনে হল মুনিয়ার। আজ আর ওর বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না,' ওদের বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান রাণা। আমি কি ওখানে বারোটা অবধি থাকব! ক্যাব পেয়েছি চলে এসেছি। এত যখন ভাবিস,কেন চলে গেলি। থাকতেই তো পারতিস।'
- ' আমি তো তোকে নিয়েই যেতে চেয়েছিলাম। কি হয়েছে? মন খারাপ? মুড সুইং। একবার ভিডিও কলে আয় একটু দেখি আমার বৌটাকে। বুঝতে পেরেছি প্রবালদা আর রুমকিদির প্রেম দেখে আমার বৌয়ের মন খারাপ। '
মুনিয়া কি বলবে রাণাকে ভেবে পায় না। তবে ওর এই ফোলা ফোলা চোখমুখ দেখলে রাণার মন খারাপ হবে ও জানে। ও কি বলবে প্রবালদা আর রুমকিদির প্রেম নয় ওর পুরোনো প্রেম আবার ফিরে এসেছে অতীতের হারিয়ে যাওয়া পথ ধরে।
-' কি হল? নেটটা অন কর।'
-' ওয়াইফাইটা কাজ করছে না আজ। মোবাইল নেটে ব্যালেন্স নেই। প্রমিস কাল একদম ভোরবেলায় ফোন করব। আমি ঠিক আছি ভাবিস না। অনেক খাওয়াদাওয়া হয়েছে এবার শুয়ে পড়ব।
রাণা খুব রাগ করল বুঝতে পারে মুনিয়া, তবুও মেনে নিল ওর সব কথা। শুধু বলল,' মন ভালো নেই সেটা বললেই তো হয়। শুধু অজুহাত সাজাস কেন? .. ভালো লাগবে। কাল কথা হবে।'
ফ্রীজে খাবারের কৌটোগুলো রেখে দেয় মুনিয়া। সত্যি আজ কিছুই খাবার ইচ্ছে নেই। প্রমোদের চকলেটে এনার্জি পাওয়া যায় কথাটা আবার মনে হল। সত্যিই তখন ইচ্ছে করল একটা চকলেট খেতে হঠাৎই। প্রবালদাও তো দিয়েছে একটা চকলেট,সেটাই বরং .....হঠাৎই মনে হল তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ব্যাগটাই ফেলে এসেছে ওখানে।
চিন্তার সুতোর জাল বুনতে বুনতে চোখটা লেগে গেছিল মুনিয়ার। ফোনটা বেজে ওঠে হঠাৎই। ঘড়িতে চোখ যায় মুনিয়ার প্রায় এগারোটা রুমকিদির ফোন।
-' কি ব্যাপার বলত? কতগুলো মেসেজ করেছি কোন উত্তর নেই। নেট অফ করা। ফোনও করিসনি।'
-' শরীরটা ভালো লাগছিল না গো বাড়িতে এসেও বমি করেছি। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নেট আর খোলাই হয়নি।'
-' এখন ঠিক আছিস তো? ইশ্ কিছু খাওয়া হয়নি তোর। আমাকে প্রমোদ বলল,তোমার বোন চলে গেছে। তখন গেস্ট ছিল তাই ফোন করা হয়নি। ঠিকই তো ছিলি হঠাৎ কি হল?'
-' কিছু না গো,জাস্ট অ্যাসিডিটি।'
রুমকিদি ফোন রেখে দিয়েছে অনেকক্ষণ। ঘুম ভেঙে যাওয়ায় আর ঘুম আসে না মুনিয়ার। নিজেকে প্রশ্ন করে সবাইকে বলেছে ওর কিছু হয়নি। সত্যিই কি ওর কিছু হয়নি?
তারপর রাণার ঢঙে নিজেকে শাসন করে,মুনিয়া তুই সত্যিই বোকা। যে ছেলেটার জন্য একদিন মরতে বসেছিলি আজ তাকে দেখে হঠাৎই খারাপ লাগা কেন? বরং ওকে বুঝিয়ে দে তুই খুব ভালো আছিস।
হঠাৎই আবার বালিশটা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে মুনিয়া... মুনিয়া যে একা একা ভালো থাকতে পারে না। রাণা তুই কোথায়? আই মিস্ ইউ,আই নিড ইউ।
রাত্রে অনেকটা দেরিতে শুতে যায় রাণা তারপরেও ভালো করে ঘুম হয় না । মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙেছে। ঘড়িতে সময় মিলিয়ে দেখেছে আর ভেবেছে মুনিয়া হয়ত ঘুমোচ্ছে। সত্যিই হয়ত ওয়াইফাই কাজ করছে না। মুনিয়াকে কি একবার ফোন করবে শুতে যাবার আগে? মুনিয়া খুব মুডি জানে রাণা। তবে ওর মনটা ভালো। একটু বেশি আদুরে আর খামখেয়ালী। অনেক সময় যা খুশি কাজকর্ম করে পরে রাণার কাছে বকুনি খায়। কিন্তু আজ কি হয়েছে তেমন করে কিছু বললো না। তবে রাণার মনে হয়েছে কোন কারণে মন ভালো নেই মুনিয়ার।
রুমকিদিকে রাণার খুব একটা ভালো লাগে না কেন জানে না। একটু যেন মনে হয় খামখেয়ালী। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরছে পার্টি করছে। অবশ্য অফিসও করছে। আসলে তেমনভাবে সংসারের চিন্তা করতে হয় না তাই হবে হয়ত। এখনও মা আর শাশুড়িমা সংসার চালাচ্ছে। একদিন সেই কথা বলাতে মুনিয়ার কাছে খুব বকুনি খেয়েছিল।
-' রুমকিদির মতই হওয়া উচিত সবারই। কি সুন্দর সব কিছু ব্যালেন্স করে চলছে। আবার অফিসও সামলাচ্ছে। জীবন তো একটাই তাই নিজের মত বাঁচছে। আমার তো ভালো লাগে।'
রাণা আর কিছু বলেনি। জীবন একটাই কথাটা আজকাল খুব শোনে রাণা। কি জানি আগে কখনও মা বাবাকে ঠাম্মাকে এমন কিছু বলতে শোনেনি কখনও।
মুনিয়াকে বলেছিল রাণা যে ও রুমকিদিকে দুদিন দেখেছে কারও সাথে একটা বাইকে করে ঘুরতে। একদিন একটা ক্যাফেতে বসে আড্ডা দিতেও দেখেছে সিগারেট হাতে। তখন প্রবালদা এদেশে ছিল না। মুনিয়াকে বলতে ও রাগ করেছিল,' তোর মধ্যবিত্ত মানসিকতা এবার একটু ঝেড়ে ফেল তো। একটা ওয়ার্কিং লেডি হয়ত কোন কলিগের সাথে ক্যাফেতে গেছে,অথবা বন্ধু। মেয়েদের ছেলেবন্ধু থাকতে পারে না? এখন আর আমাদের মা মামণির যুগ নেই রাণা।'
রাণা ঢোক গিলছিল,' না তা বলছি না। সেটা তো থাকতেই পারে। প্রবালদা নেই তো বাড়িতে তাই ভাবছিলাম। তা তো ঠিকই, জুনি যেমন আমার বন্ধু।'
সেদিনের মত আলোচনা থেমে গেছিল ওখানেই। রাণা কথা ঘুরিয়ে অশান্তি এড়িয়েছিল। মুনিয়ার রাগ হয়েছিল, ছেলেরা যা যা করতে পারে মেয়েরা করতে পারে না কেন? সব সময় মেয়েরা এটা করলে দোষ,ওটা করলে দোষ।
এমনও হতে পারে রুমকিদির কোন কথায় কি হার্ট হয়েছে মুনিয়া? তারপরেই ভাবে না না সেটা হবে কেন?
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছে রাণা। মুনিয়া অনেক রাত্রি পর্যন্ত ছটফট করে কাটিয়েছে কিন্তু এই যন্ত্রণার ভাগ করা যায় না তাই চুপ করে নিজেই পুরো যন্ত্রণাটা অনুভব করে। আর বুঝতে পারে আজও হয়ত ভুলতে পারেনি প্রমোদকে। সত্যি কি প্রথম প্রেম ভোলা যায়?
প্রমোদের জন্য ও একদিন মরতে বসেছিল এটা ভেবেই বোধহয় বেশি খারাপ লাগছে মুনিয়ার। যাকে ঘেন্না করেছে,খুব খুব রাগ হয়েছে যার ওপর তার সঙ্গে কেন হঠাৎই দেখা হল? কি দরকার ছিল এভাবে রুমকিদির বাড়িতে ওকে দেখার।
হঠাৎই মুনিয়ার মনে হল রুমকিদির সঙ্গে যখন কথা হয়েছে শুনেছিল ও আর প্রবালদা দুজনেই সিঙ্গল চাইল্ড তাই তো মা বাবারা ওদের সাথেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে থাকে। হঠাৎ করে দেওর এল কোথা থেকে?
তাছাড়া প্রমোদরা তো অবাঙালী আর রুমকিদিরা মানে প্রবালদা বাঙালী। চিন্তাগুলো জট পাকানো হয়ে মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে মুনিয়ার। সত্যিই যেদিন পাটনার নাম রুমকিদির মুখে শুনেছিল কেমন যেন চমকে উঠেছিল মুনিয়া। একটা সময় তো পাটনা ওর স্বপ্নে ছিল। কিন্তু স্বপ্নেও কখনও ভাবেনি প্রমোদের সাথে প্রবালদার সম্পর্ক থাকতে পারে।
প্রমোদ সত্যি সত্যি রুমকিদির কে হয়? তবে আত্মীয় সেটা বুঝেছে মুনিয়া। প্রমোদকে রুমকিদির শ্বশুর শাশুড়ির সাথে কথা বলতে দেখেছে।
চোখের সামনে আসা অনেকগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া ছবিকে জুড়তে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে মুনিয়া বুঝতেই পারেনি। ঘুমের মধ্যে অসংখ্য ঘটনার ভিড় কুচি কুচি কাগজের মত স্বপ্নের আকাশে ভাসতে থাকে।
হঠাৎই ফোনটা বাজতে থাকে বারবার এলোমেলো সুরে চোখ খুলতে ইচ্ছে করে না মুনিয়ার। এত সকালে কে ফোন করছে? বালিশে কান ঢাকা দেয় মুনিয়া। আবার বাজতে থাকে ফোনটা। আধবোজা চোখে ফোনটা টেনে নেয় মুনিয়া জড়ানো গলায় বলে হ্যালো।
ওদিক থেকে একটা জোরালো বকুনি শুনতে পায়,' এখন এখানে কটা বাজে জানিস? এখানে এখনও সকাল হয়নি তবুও আমি উঠে বসে আছি। কফির জল ফুটছে। রাতে ঘুম হয়নি বৌয়ের মন খারাপ বলে।'
-' আজ তো রবিবার এত সকালে ফোন করলি কেন? আমি তো করতাম ফোন। এখন ওয়াইফাই কাজ করছে মনে হয়। ভিডিও কল করব।'
-' সে ঠিক আছে। তুই ভালো আছিস তো? সত্যিই কেন যেন মনটা ভালো লাগছিল না।'
একটা কৃত্রিম হাসির ছন্দে হেসে ওঠে মুনিয়া,' অত দূরে বসে মন খারাপ করলে হবে? এখানে যে কত কি ঘটে যাচ্ছে এদিকে।'
কি কথা বলতে কি কথা বলছে! নিজেই চমকে ওঠে মুনিয়া। কোন শুধু রাণা কেন কোন পুরুষের কাছেই এটা সুখবর নয় যে তার বৌয়ের পুরোনো প্রেমিক ফিরে এসেছে আবার। আর প্রমোদকে যে মুনিয়া কতটা ভালোবাসত তা জানে রাণা। কোন মেয়ে যখন মরতে যায় ভালোবাসা হারিয়ে তখন সেই ভালোবাসা কতটা অমূল্য হতে পারে তা জানে রাণা।
তাই তো ওকে সবসময় আগলে রাখে রাণা। হয়ত বা অনেকটা বেশি প্রশ্রয়ে রাখে।
কফির জল অনেক আগে ফুটে গেছে। সুইচটা অফ করে দেয় রাণা।
'কি ঘটে যাচ্ছে এদিকে শুনি? কি বলছিলি একটু আগে? মুনিয়া এনিথিং সিরিয়াস? আমার ভালো লাগছে না কাল বলছিলি কেমন যেন বমি পাচ্ছে।'
রাণার শেষ কথাটুকুর রেশ ধরে অনেকটা হাল্কা হয়ে যায় মুণিয়া।
' ধ্যাৎ বমি পাচ্ছে মানে আমি কি প্রেগনেন্ট নাকি? কি বুদ্ধি মাথায়! সব ঠিক আছে। আমি আরেকটু ঘুমোবো। এগারোটার সময় উঠব একদম। তুইও আরাম করে ঘুমো। বারোটার সময় ফোন করব,ততক্ষণে তোর ওখানেও সকাল হয়ে যাবে। বৌ বৌ করে এত অনিয়ম করিস না।'
' একটাই তো বৌ আমার, তারপর আবার নতুন বিয়ে করেছি এখনও মাঝে কেউ আসেনি। তাকে রেখে এসে ভালো লাগে নাকি?'
হঠাৎই অভিমানে মুনিয়ার চোখ ভেজে,' তাহলে ছেড়ে গেছিস কেন? তোর মুনিয়া যে এখনও ছেলেমানুষ।'
মুনিয়ার অভিমান টুকু মুঠোতে ধরে রাণা। কয়েক হাজার মাইলের ওপার থেকে ভেসে আসে ওর গলা,' জানি তো,তাই তো ঘুম আসছে না। আচ্ছা ঘুমো এখন পরে কথা হবে।' ওপার থেকে রাণার ফ্লাইং কিস ভেসে এসে ছুঁয়ে দেয় মুনিয়াকে।
**************************
রাতে ভাবীকে প্রমোদই প্রথম বলেছিল মুনিয়া চলে গেছে। রুমকি তখন সময় পায়নি তবে পরে খবর নিয়েছিল। গেস্টরা চলে যাবার পর অনেকক্ষণ ওরা বসে গল্প করছিল। বাবলিটা ঘুমিয়ে পড়েছে ক্লান্ত হয়ে অনেকক্ষণ।
প্রমোদের রাতে ফেরা হয়নি ওর গেস্টহাউসে। প্রমোদ এখানে আসবে শুনে প্রবাল বলেছিল ওদের এখানে থাকার কথা। রাজি হয়নি প্রমোদ বলেছিল,অফিস থেকে থাকা অ্যারেঞ্জ করেছে তাই ওখানে থাকাই ভালো। তবে সময় পেলেই চলে আসবে ভাইয়ার বাড়িতে।
এখানে আসার দুদিনের মধ্যেই যে বাবলির জন্মদিন হবে জানত না। ভাবী ভাইয়ার অনুরোধে চলে আসতে হয়েছে এমনিতেই যদিও ও আসত। কিন্তু এখানে এসে যে হঠাৎই এমন হবে বুঝতে পারেনি। নিজেকে সামলেছে প্রমোদ খুব খুব ইচ্ছে করছিল মুনিয়ার সাথে কথা বলতে কিন্তু বলতে পারেনি। এতদিন বাদে আর কি কথাই বা বাকি আছে? তবুও ওর খুব জানতে ইচ্ছে করছে মুনিয়ার কথা। নিশ্চয় ভাবীর সঙ্গে ওর ভালো দোস্তি আছে। ভাবী বলতে পারবে। কিন্তু কিভাবে বলবে মানে জানতে চাইবে মুনিয়ার কথা?
গতকাল কথা বলতে বলতে অনেকটা রাত্রি হয়ে গেছিল। প্রমোদকে ঘুমোতে যেতে বলে রুমকি আর প্রবাল ঘরে ঢোকে। রুমকি হোয়াটস অ্যাপে মন দেয় বিছানায় এসে। প্রবাল রুমকিকে কাছে টানতে চায়।
আজকে বাবলি অনেকটা আগেই দিদার কাছে শুয়ে পড়েছে। বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর রুমকিকে কেমন যেন এলোমেলো লেগেছে প্রবালের। রুমকি মন দিতে পারছে না কাজে। আজকাল সিগারেট খায় রুমকি। যদিও এইসব নিয়ে প্রবালের তেমন মাথাব্যথা নেই। শুধু মা বাবার সামনে ভালো হয়ে থাকলেই হল। রুমকিকে এতদিন অনেকটা চাপ নিতে হয়েছে বুঝতে পারে প্রবাল।
রুমকির স্বচ্ছ পোশোকের আড়ালে উঁকি মারে ওর পেলব শরীরটা। তবে এখন অনেকটা রোগা হয়ে গেছে রুমকি। বললে বলে ডায়েট করছে। বেশ নেশা নেশা লাগে প্রবালের।
-' কি এত করছ ফোন নিয়ে? আজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছিল। অনেকদিন বাদে তোমাকে এত সুন্দর সাজতে দেখলাম। কাছে এসো।'
মেসেজ টাইপ করতে করতে অন্যমনস্ক রুমকি বলে,' আমার দিকে তাকানোর সময় আছে তোমার? সারাদিন তো জব,প্রজেক্ট আর অ্যসাইনমেন্ট নিয়ে আছ? ঘুমোও অনেক রাত হয়ে গেছে।'
রুমকির কথা শোনে না প্রবাল ওকে জোর করে কাছে টানে। রুমকির অবাধ্য মনটা আর প্রতিবাদ না করে বাধ্য শরীরটাকে ছেড়ে দেয় প্রবালের কাছে। সব অভিমান চাপা পড়ে যায় ভালোবাসার তাপে। শুধু ফোনটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠে জানান দেয় কারো মেসেজ আসছে।
ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেছে প্রমোদের। এখানে তখনও কেউ ওঠেনি। সকালে সবসময়ই শরীরচর্চা করা অভ্যেস প্রমোদের। আজও বেশ কিছুটা হেঁটে আসে শান্ত রাস্তা দিয়ে। অনেকবারই মনে হয় মুনিয়া হয়ত কাছাকাছি কোথাও থাকে। একটা সময় তো এখানে আসার কথা ছিল ওর তারপর আর আসা হয়নি। খুব রাগ হয়েছিল জানতে পেরে মুনিয়া একটা ছেলের সঙ্গে থাকছে। পরে মনে হয়েছিল ওকে বিয়ে না করে ভালোই হয়েছে।
কিন্তু গতকালের পর বারবার মুনিয়ার বন্ধুত্বটাকে খুব মিস করেছে প্রমোদ। মুনিয়ার হাসি,ওর রাগ,ওর চকলেট প্রেম সবই মনে পড়ছে। কলকাতা তো মুনিয়া চিনিয়েছিল ওকে। প্রেমিকা মুনিয়াকে হারিয়েছিল অনেকদিন আগেই প্রমোদ নিজের দোষে তবে এখন বুঝছে বন্ধুত্বটুকুও ধুয়ে মুছে গেছে। একটুও নেই। মুনিয়া ওকে হেট করে তাই ওকে দেখে ওর বমি পেয়েছিল। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রমোদ।
আজ একটু দেরিতে ঘুম ভেঙেছে রুমকির । মোবাইলটা নিয়ে ছাদে উঠে যায়। একটু ডিপ ব্রিদিং করে মেসেজ বক্সে চোখ রাখে। মুনিয়াকে ও খোঁজে। ওকে একটা ছবি পাঠায়। বুঝতে পারে মুনিয়ার নেট অফ হয়ত ঘুমোচ্ছে। নিচে চোখ যায়,গেট খুলে ঢুকছে প্রমোদ। অনেকটা ঘাম ঝরিয়ে এসেছে। প্রমোদের সারা শরীরের ট্যাটু,লম্বা চুল ওকে বেশ অন্য মাত্রা দিয়েছে। প্রবালটা যেন দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন টাকার চিন্তা। প্রমোদকে হাত দেখায় রুমকি।
প্রমোদ ওপরে উঠে আসে। টুকরো কথার ফাঁকে প্রমোদ ভাবতে থাকে কি ভাবে মুনিয়ার কথা জিজ্ঞেসা করবে?
ভাবীকে হোয়াটস অ্যাপ দেখতে দেখে বলে,' পাতা চলা কুছ? খবর জানলে তোমার বোনের?'
অন্যমনস্ক ভাবে রুমকি বলে,' কার? '
-' ভাবী ও মুনিয়া, কাল হঠাৎই চলে গেল না।'
রুমকি চোখ তুলে প্রমোদের দিকে তাকায়,' তুম্ পহেচানতে হো? মানে তুমি মুনিয়াকে চেন?'
আচমকা ভাবীর প্রশ্নে অবাক হয়ে যায় প্রমোদ ওর বাবা ঠিকই বলে বাঙালী লোগ মছলি খাতা উসি লিয়ে দিমাগ ভাগতা খুব। ভাবী তো সত্যিই ভীষণ ইনটেলিজেন্ট। তবুও ধরা দিতে চায় না,কি দরকার ভাবীর সব জানার? ভাবীর থেকে ভাইয়া জানবে তার থেকে জানবে সবাই। মুনিয়া যাকে বেশ কিছুদিন আগে মন থেকে মুছে ফেলেছিল। কিন্তু সত্যিই কি মুছে ফেলতে পেরেছিল? সে আবার সামনে এসে যাওয়াতে মনটা যেন পাগল পাগল হয়ে গেছে আবার। সবচেয়ে খারাপ লাগছে ওর জন্য মেয়েটা খাওয়াদাওয়া না করেই চলে গেছে। ও এসে পুরা সন্ধ্যাটা বরবাদ করে দিয়েছে মেয়েটার।
ভাবীর সঙ্গে ওর দোস্তি আছে এটুকু বুঝতে পেরেছে প্রমোদ। প্রথম যখন ওকে দেখে তখন ও বাচ্চাদের সাথে মজা করছিল প্রমোদকে দেখার পরই ওর মুডটা একদম চেঞ্জ হয়ে যায় লক্ষ্য করেছিল ও।
প্রমোদকে চুপ করে থাকতে দেখে রুমকি আবার বলে,' দেবরজী আমি কিছু বলেছি তো? চেনো মুনিয়াকে?'
-' ম্যায় ক্যায়সে পহেচান....'
ওর কথা শেষ হতে না হতেই রুমকির মুখে খেলে যায় একটা দুষ্টুমি ভরা হাসি,' আমার কেন যেন দুইয়ে দুইয়ে চার মনে হচ্ছে। কাল মুনিয়া খুব ভালো মুডে ছিল,ঠেকুয়া খেল। বাবলিকে সাজিয়ে দিল। বাবলিকে নিয়ে ছিল অনেকটা সময়। হঠাৎই তোমার সাথে ইনট্রোডিউস করানোর সময় দেখলাম মেয়েটা যেন একদম ফিকে পড়ে গেল। সত্যি কাল কিছু মনে হয়নি। আজ ভোরেও ওর লাস্ট সীন দেখলাম অন হয়নি। তারপর ছবিগুলো দেখছিলাম, কি সুন্দর লাগছিল ছবিগুলো। কিন্তু কেক কাটার ছবিটাতে একদম ফিউজ। '
' ও ম্যায় ক্যায়া জানে? আমাকে ভিলেনের মত দেখতে মনে হয়। উসি লিয়ে ডর গয়ি মালুম।'
রুমকির এবার একটু অধৈর্য্য লাগে সত্যিই তো দারুণ সেয়ানা তো ছেলেটা। প্রমোদকে তেমন করে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি রুমকির। ওর যখন বিয়ে হয় তখন প্রমোদকে দেখেছে তেমন করে অন্তরঙ্গতা বাড়েনি। ওর ছোট মাসি শাশুড়ির ছেলে প্রমোদ। প্রবালরা বাঙালী হলেও মাসি বিয়ে করেছিল বিহারী পরিবারে। সুতরাং প্রথম দিকে এই নিয়ে তেমন বনিবনা হয়নি বাড়ির সাথে।
শাশুড়ির কাছে শুনেছে প্রমোদের বাবা একসময় ওখানকার নামকরা মস্তান ছিল। সেই সুবাদেই মোটামুটি পাড়ার সুন্দরী মেয়েকে ঘরে তুলেছিল। ভয়েই হোক বা ভালোবাসায় ছোট মাসিকে সরানো যায়নি সিদ্ধান্ত থেকে। সবার মুখে কালি ছিটিয়ে পালিয়ে গেছিল। অগত্যা প্রবালের দাদু দিদা পাড়া ছেড়েছিলেন লজ্জায় আর বিরক্তিতে।
অবশ্য সে অনেক আগের কথা। এখন মেসোমশাইয়ের বয়েস হয়েছে। হয়ত অভ্যেসও কিছুটা পাল্টেছে ছেলেমেয়ে হওয়ার পর। সুখেই আছে মাসি। তবে এখনও কুশ শর্মাকে সবাই একডাকে চেনে।
রুমকির বলতে ইচ্ছে করে মজা করে একটা কথা তবুও নিজেকে সামলে নেয় শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় বলে। এমনিতে ঠোঁটকাটা মেয়ে হিসেবে রুমকির বদনাম আছে।
তাই নিজেকে একটু সামলে বলে,' তুম কলকাত্তা মে থা না কভি? মানে তোমার কলেজ তো ওখানেই ছিল। ক্যায়া নাম থা উস্ কলেজ কা? কোন কলেজ?'
প্রমোদের এবার সত্যি নিজেকে একদম ক্যাপচার্ড লাগে। ও কি কলেজের নাম ভুলভাল বলবে? যদিও নিজের বাড়ির তেমন কেউ ওর ফ্রেন্ডলিস্টে নেই তবুও এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে অ্যাবাউট ইনফরমেশন জানতে কতক্ষণ? তাছাড়া প্রবালদা তো জানেই ওর কলেজের নাম।
' কলেজ সে ক্যায়া মতলব ভাবী?'
' মুঝে মতলব হ্যায় দেবরজী। ঐজন্যই তো জিজ্ঞেস করছি। ওকে দাঁড়াও আমি দেখছি। মুনিয়া তো,হ্যাঁ মনে পড়েছে। আমি যদি ভুল না করি তবে তোমার কলেজও তো সেম। তোমার ভাইয়ার কাছে শুনেছিলাম একদিন। ভুলে গেছিলাম। হঠাৎই মনে পড়ল এখন।'
প্রমোদের নিরাপত্তার বেড়া এবার ভেঙে পড়ে একদম। বুঝতে পারে ভাবী সত্যিই বুদ্ধিমতী তাই ওকে এভাবে জেরা করে আসল কথাটা জানতে চাইছে। খুব ভুল করেছে প্রমোদ কলেজের নামটা এত জল ঘোলা না করে বলে দিলেই পারত।
এখন এরপর কি বলবে ভাবীকে? এতটা ইন্টারেস্ট না দেখালেই পারত মুনিয়ার ব্যাপারে। এরপর তো ভাবী বলবে নিশ্চয় মুনিয়া ওকে চিনত বা প্রমোদ সম্পর্কে ওর কোন খারাপ এক্সপিরিয়েন্স আছে বলেই ও এমন ভেঙে পড়েছিল। কি করে ম্যানেজ করবে সবটা?
ওর মা খুব একটা রুমকি ভাবীকে পছন্দ করে না। সবসময় বলে বাঙালী মেয়ে ভীষণ চালাক। শাশুড়ি শ্বশুরকে দিয়ে বেবি সিটিং করিয়ে নিজে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। চাকরি করে বলে মাথা কিনে নিয়েছে দিদির। এর থেকে ঘরেলু মেয়ে হলেই ভালো হত। একটা সময় মায়ের আর বাবার কাছে বাঙালী মেয়েদের বদনাম শুনে প্রমোদ ভাবত মুনিয়াকে মেনে নেবে তো ওর বাড়ির লোক? অথচ ওর মা তো বাঙালী,বাবা মাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। অবশ্য ওর মাকে দেখে কেউ বুঝতেও পারবে না মা বাঙালী পরিবারের মেয়ে ছিল কোন একসময়। পুরো বাঙালীত্ব খোয়া গেছে মায়ের।
হঠাৎই ভাবীর হাসির শব্দে চমকে ওঠে প্রমোদ।
-' আরে ক্যায়া হুয়া দেবরজী,তুমি তো ঘাবড়ে গেলে একদম। আরে মজা করছিলাম আমি চল নিচে চা খাবে তো? আমি ভাবলাম প্যায়ারের চক্কর ছিল টিল নাকি? ঐ যেমন ফিল্মে দেখায়।'
'ভাবী তুম তো লেডি শার্লক হোমস নিকলি।'
-' কথাতে কিছু হবে না আমি যা ভাবছি তা তাহলে ঠিক। মুনিয়াকে চেন তুমি তাই তো?'
প্রমোদ একটু গম্ভীর হয়,' জান না ক্যায়া বহত জরুরী হ্যায়?'
রুমকির এবার অধৈর্য্য লাগে বুঝতে পারে দেওরটি তার বেশ গভীর জলের মাছ। এমনিতেই মাসিশাশুড়ি আর মেসোশ্বশুরকে তেমন ভালো লাগে না রুমকির। বড়লোক বলে খুব নাকউঁচু আর অহঙ্কারী। আর মাসিশাশুড়ি তো মোটামুটি একদম খাস দেহাতী মহিলা মানে সব সময় শুনিয়ে জী বলে ঘোমটার আড়ালে ছড়ি ঘোরায়। রুমকি জানে ওর চালচলন খুব একটা পছন্দ নয় ওঁর। না হোক বয়েই গেছে। একবার দুবার গেছে নিয়মরক্ষা করতে। তবে শাড়ি পরে একদম মাথায় ঘোমটা টেনে যেতে হয়েছে।
যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে রুমকির দরকার হলে বাকিটা মুনিয়ার কাছে জেনে নেবে। কি দরকার ফালতু কথা বাড়ানোর। এই নিয়ে মনোমালিন্য হলে প্রবালের কাছে কথা শুনতে হবে। তবে ওর মাথায় যখন ঢুকেছে কথাটা ও জেনেই ছাড়বে। নিশ্চয় কোন তো লিঙ্ক আছে।
প্রবাল ওপরে উঠে এসেছে সাথে ফ্লাক্সে চা। আজ প্রবালের মুখে অনেকটা হাসি। হয়ত অনেকদিন বাদে দাম্পত্যে খুশির পাল তুলে খুশি প্রবাল। রুমকিকে তেমন করে কতদিন কাছে পায় না।
দাদাকে দেখে হাঁফ ছাড়ে প্রমোদ। ওহ্ ভাবী তো বহত খতরনাক।
' কি গল্প হচ্ছে এত দেওরের সাথে? মা চা করে দিল তাই একদম নিয়ে চলে এলাম। চা খেতে খেতে গল্প কর। আমি একটু গাছগুলো দেখি।'
প্রমোদের দিকে তাকিয়ে একটা জেরক্স মেশিন হাসি ছুঁড়ে দিয়ে চা ঢালতে থাকে রুমকি। প্রমোদ চায়ের কাপটা নিয়ে ছাদের কোণে এগিয়ে যায়। দাদার সাথে কথা বলার জন্য। রুমকি চা হাতে হাল্কা চুমুক দিয়ে ভাবনাগুলো আরেকবার তাজা করে নেয়।
***********************************
রাণাকে এগারোটা বললেও অতটা সময় বিছানাতে থাকতে পারে না মুনিয়া। আগেই উঠে পড়ে তখন প্রায় দশটা বাজে। বাথরুমে গিয়ে একেবারে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে একটু বারান্দায় দাঁড়ায়। আয়ার আন্টি হাত নাড়ে। জিজ্ঞেস করে কালকের পার্টি কেমন ছিল? কোন অসুবিধা নেই তো? মাথা নাড়ে মুনিয়া। একটু কথা আর হাসি বিনিময় করে গাছের পরিচর্যা করে ঘরে আসে মুনিয়া। এবার খিদে পাচ্ছে। আজ আর কোন রান্না করবে না। ফ্রিজে যা আছে তাই দিয়েই চলে যাবে। চা নিয়ে বসতে বসতেই মায়ের ফোন আসে। মাকে বলবে কি না বলবে ভাবতে ভাবতেও বলে ফেলে মুনিয়া। সত্যিই ওর কথাটা কাউকে শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে।
মেয়ের কাছে প্রমোদের কথা শুনে আঁতকে ওঠে মুনিয়ার মা,' হায় ভগবান! এমনও হয়! জন্মদিনের বাড়িতে গিয়ে এতদিন বাদে ছেলেটার সাথে দেখা হল।'
-' মা আমার যে কালকে কি হয়েছে বলে বোঝাতে পারব না। তুমি তো সবই জানতে মা। আমাদের তো বিয়ে হবে বলেই সব ঠিক ছিল।'
-' এই যে বোকা মেয়ে তোর কি আর কোনদিন বুদ্ধি হবে না নাকি শুনি? যা গেছে তা গেছে। কি হত সেটা ভেবে লাভ নেই। কি হয়েছে সেটা ভাব।'
-' ভাবি তো মা,তাই তো খারাপ লাগে। সব তো ঠিকই চলছিল এরমধ্যে হঠাৎ কেন প্রমোদ এল?'
কথা বলতে বলতে গলাটা ধরে যায় মুনিয়ার।
-' মুন এবার আমি বকব কিন্তু,তাই ভাবি ফোন বন্ধ এতক্ষণ কেন মেয়ের? আমি তো হোয়াটস অ্যাপ দেখে ফোন করি। দেখছি অন হসনি কাল থেকে।'
-' কাল খুব খারাপ লাগছিল মা তাই।'
-' রাণার সাথে ফোনে কথা বলেছিস তো? কতদূরে থাকে ছেলেটা! আমার অনেক ভাগ্য এমন একটা জামাই আর বিয়াইবাড়ি পেয়েছি। যা হয়েছে ভালো হয়েছে। আগেই বলেছিলাম বিহারী তারপর অত বড়লোক।'
-' হ্যাঁ মা যা হয়েছে ভালো হয়েছে খুব ভালো হয়েছে। প্রমোদ একটা শয়তান। ওকে দেখার পর আমার শরীর খারাপ করছে। ভাবতেও খারাপ লাগছে ও রুমকিদির দেওর।'
-' রুমকির গল্প তো করেছিস বলেছিস ওরা দুজনেই সিঙ্গল চাইল্ড তো দেওর এল কোথা থেকে?'
-' জানিনা আমি মা। জিজ্ঞেস করিনি।'
-' জিজ্ঞেস করার দরকারও নেই আর রুমকির বাড়িতেও যাবার দরকার নেই। নিজের মত নিজে থাক। সামনে মাসে আমি যাব দিন সাতেক থেকে আসব নাহয়।'
-' মা এত ব্যস্ত হয়ো না আমি ভালো আছি। এখন রাখি রাণার সাথে কথা বলব। আগে একটু কৃষ্ণনগরে ফোন করে নিই।'
-' আচ্ছা আমি ছাড়ছি,শোন একটা কথা রাণাকে কিন্তু প্রমোদের ব্যাপারে কোন কথা বলবি না। কোন ছেলে খুশি হবে জেনে বৌয়ের সাথে ওর পুরোনো বন্ধুর দেখা হয়েছে। সন্দেহ ও করতে পারে। রাণা একটু অন্যরকম নরম মনের ছেলে। মনে থাকে যেন।'
এই কথাটাই মাকে জিজ্ঞাসা করবে ভেবেছিল। উত্তরটা এমনিতেই পেয়ে গেল।
- ' মা আমি তো ভেবেছিলাম রাণাকে বলব সবটা।'
-' বোকামি করিস না মুন। আমি জানি তো আমার মেয়েকে তাই বললাম। শোন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহ ঢুকে গেলেই মুশকিল। সন্দেহে কত সংসার ভেঙে যায়।'
একটু আগে মা ফোনটা রেখে দিয়েছে,মুনিয়া বুঝতে পারে ওর কথা শুনে মায়ের মনটাও খুব অশান্ত হয়েছে। তবে মায়ের শেষ কথাটা ওর মনে ঢুকে গেছে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহ ঢুকে গেলেই মুশকিল সন্দেহে কত সংসার ভেঙে যায়।
না না রাণা ওকে পাগলের মত ভালোবাসে,রাণার মন খারাপ হয় ওর সন্দেহ হয় এমন কিছু ও করবে না। ঝুমকে নিয়ে মুনিয়ার কোন সন্দেহ হয়নি কারণ রাণা ওর মুখও দেখতে চায়নি। তবুও কে বলতে পারে রুমকিদির দেওর প্রমোদ শুনে রাণার কি মনে হবে?
মনের ঝড়কে সরিয়ে কৃষ্ণনগরে ফোন করে মুনিয়া। ডলের সঙ্গে অনেকটা গল্প করে মনটা হাল্কা হয়। নিজেকে একটু সাজিয়ে নেয় মুনিয়া, রাণা যাতে আন্দাজ করতে না পারে ঝড়ের ধাক্কায় মুনিয়া কতটা ভেঙেছে।
****************************
সবুজের মাঝে আলো ফুটেছে, রাণা যেখানে থাকে সেখানে চারদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। বাইরে এসে দাঁড়ায় রাণা অন্যদিন হলে হয়ত আরেকটু ঘুমোত তবে আজ আর ভালো লাগছে না। ফোনটা খুলে মুনিয়ার লাস্ট সীনটা দেখে। এই তো মুনিয়া অন দেখাচ্ছে। সুতরাং আর দেরি না করে ফোন করে ওকে।
মনে মনে বাণভাসি মুনিয়াকে নিজেকে সাজিয়েছে টাটকা হাসি দিয়ে একপাশে সরিয়ে গতকালের বাসি মন খারাপকে। ছোট থেকে মাকে তেমন করে কিছু গোপন করেনি মুনিয়া, শুধুমাত্র প্রমোদের সাথে কাটানো কিছু ব্যক্তিগত মুহূর্ত ছাড়া। একটা সময় স্কুল থেকে এসে বকবক করত তারপর কলেজ থেকে এসে কিছুক্ষণ মায়ের পাশে শুয়ে বকবকম করতেই হত নাহলে ভালো লাগত না। এখনও জীবনের জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে মায়ের সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা করে মুনিয়া। তাই রাণার সাথে পুরোনো ছন্দে বকবক করল কালকের পার্টি নিয়ে কিছুটা। গাছেদের দেখানো হল কিছুক্ষণ। তারপরে অনেক অনেক ভালোবাসার কথা। সত্যি বলতে সারা সপ্তাহ শেষে জমানো ভালোবাসার কথা বলার সকাল তো দুটো দিনই আসে সপ্তাহে।
কথার মাঝে রাণা বলে,' কাল কি হয়েছিল বল তো? তবে আমি জানি কাল তুই কেঁদেছিস। তোকে দেখতে পাইনি কিন্তু লুকোনো চোখের জলের হদিস পেয়েছি। জানিস না তুই কাঁদলে আমার ভালো লাগে না।'
আদুরে গলায় মুনিয়া বলে,' জানি তো। আর ভাবিস না আজ মুড ভালো আছে একদম। তুই কি খাবি আজ?'
' কি আর খাব যা খাবি খাচ্ছি। এখন একটু ভালো লাগছে। এখন ভাবছি আরেকটু ঘুমিয়ে নেব। মাথাটা ঠান্ডা হয়েছে তো। এখানে তো এখন আর্লি মর্ণিং।'
মুনিয়া হাসে,ওর হাসিটা ভালো লাগে রাণার। অনেকটা আদর হয়ে যায় ফোনে ফোনেই।
মুনিয়ার ফোনটা ছেড়ে কিছুক্ষণ বিছানায় অলসভাবে ডুব দেয় রাণা। হোয়াটস অ্যাপটা খোলা ইনবক্সে মেসেজ আসে। ওহ্ পুতুল, এতদিন বাদে বোধহয় সময় পেয়েছে। ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা হয় মেসেজেই। পুতুল অভিযোগ করে ওর শরীর খারাপ অথচ রাণা কোন খবর নেয় না।
-' কি করি বল,বৌকে নিয়েই তো পাগল হয়ে যাচ্ছি। ওহ্ একটা কথা বলা হয়নি পাঞ্জাবীটা দারুণ হয়েছিল। অবশ্য তোমার পছন্দ সবসময় ভালো।'
পুতুল বুঝেও না বোঝার ভান করে,' কোন পাঞ্জাবী?'
' আরে আমাদের দিয়েছিলে না।'
-' এতদিনে! আমি তো ভুলেই গেছিলাম। থ্যাঙ্ক ইউ।'
-' থ্যাঙ্কস তো তোমার পাওনা। ওটার কিন্তু হাই ডিমান্ড অনেকেই চেয়েছে। মুনিয়া বলেনি তোমাকে? অবশ্য তোমার চয়েস সবসময় ভালো।'
' নাহ্ মুনিয়া কিছু বলেনি তো। অবশ্য বুটিকের তো তাই সিঙ্গেল পিস্ এগুলো।'
রাণার ইচ্ছে হচ্ছিল হঠাৎই জিজ্ঞাসা করার কোন বুটিকের। কিন্তু কোথায় যেন বাধে,তাই আর জিজ্ঞাসা করে না।
সন্ধ্যেবেলায় মুনিয়াকে ফোন করে পুতুল। শনিবার রবিবার ওরা বন্ধুরা একটু গল্প করে। আজ সারাদিন মুনিয়া ফোন না করাতে পুতুল ফোন করে।
' আজ রাণার সঙ্গে একটু আড্ডা হল রে হোয়াটস অ্যাপে। পাঞ্জাবীর প্রশংসা করল এতদিনে। বলল অনেকেই নাকি চেয়েছে। তুই বলেছিস কি না বলল।'
' হঠাৎই একটু চমকে ওঠে মুনিয়া তবুও বলে হুঁ একজন বলছিল। তোকে বলা হয়নি রে।'
' কেউ নিলে বলিস আমি হোয়াটস অ্যাপ করে দেব। মেয়েটা নিডি।'
-' কেন ওর বিয়ে হয়নি?'
-' অত জানি না রে,তবে বরের সাথে থাকে না মনে হয়। কি দরকার লোকের দুঃখের জানলা খোলার। আমি জিজ্ঞাসা করিনি।
পুতুলের সাথে একথা সেকথা বলে ফোনটা রেখে দেয় মুনিয়া। হঠাৎই মনে হল পুতুলও বোধহয় ওর থেকে বেশি ম্যাচিওরড। কিন্তু রাণাকে ও বলেনি তো পাঞ্জাবীটা কোথা থেকে কিনেছে?
উঃ উল্টোপাল্টা কত যে চিন্তা আসে মাথায়। এই জন্য বোধহয় বলে অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।
বালিশে আবার মুখ ডোবায় মুনিয়া, প্রায় নটা বাজে রাতে খেতে ইচ্ছে করছে না আজ।
ফোনটা বাজে, ধরেনা মুনিয়া। আবার রিং হতে দেখে রুমকিদি। সত্যিই সকালে একটা ছবি পাঠিয়েছিল কোন উত্তর দেয়নি মুনিয়া। কাল এতটা সময় ছিল ওখানে তারপর হঠাৎই চলে এল ওরই একটা ফোন করা উচিত ছিল।
--' হ্যাঁ বলো। সরি গো সকালে অনেকটা দেরিতে উঠেছি মেসেজটা দেখেছি বাট রিপ্লাই দেওয়া হয়নি।'
-' ইটস্ ওকে ডিয়ার। আমি খুব মিস্ করছিলাম তোকে। কাল কিছু না খেয়ে চলে এসেছিস।'
-' তাতে কি মাসিমণি সব দিয়ে দিয়েছে এখন দুদিন খাব। বাবলি ঠিক আছে তো? ছাদের ছবিগুলো পাঠিয়ো দেখব।'
-' হ্যাঁ পাঠাবো শিওর। সকাল থেকে খুব বিজি ছিলাম রে দেওরজী ছিল তো। এই একটু আগেই গেল। তারপর তোকে ফোন করছি।'
যে প্রশ্নটা করা উচিত ছিল না হঠাৎই মুনিয়া সেই প্রশ্নটা করে ফেলে...' প্রবালদা সিঙ্গল চাইল্ড না?'
-' হ্যাঁ রে প্রমোদ আমার মাসিশাশুড়ির ছেলে।'
মুনিয়ার কৌতূহলকে কাজে লাগায় রুমকি..' মেসোশ্বশুর বিহারের মানুষ।'
' ও তুমি কখনও আগে বলনি তো তাই বুঝতে পারিনি।'
-' ও তো তোদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই পড়ত বলল চেনে তোকে। তুই চিনতে পেরেছিস ওকে? অবশ্য অত ভিড়ের মধ্যে এতদিন বাদে....?'
রুমকির কথার শেষটুকুর মধ্যে ফোনটা কেটে দেয় মুনিয়া। কি বলবে এখন ও রুমকিদিকে?
রুমকি আবার ট্রাই করে কানেকট করতে শোনে দ্য নাম্বার ইউ আর ডায়ালিং ইস কারেন্টলি সুইচড্ অফ।
কথাটা যে সঠিক জায়গাতে লেগেছে বুঝতে পারে রুমকি। গতকাল থেকেই মাথায় কথাটা ঘুরেছে। হল টা কি মুনিয়ার বেশ তো ছিল, হাসছিল আর মজা করছিল। কত ছবি তুলল বাবলির সঙ্গে তারপরেই হঠাৎই দেবরজীর এন্ট্রি হল আর মুনিয়ার শরীর খারাপ শুরু হল। এমন কি বাড়ি যাবার আগে একবার রুমকিকে বলেও গেল না। সত্যিই ভীষণ স্ট্রেঞ্জ! রুমকিকে একটা সময় বন্ধুরা বলত তুই ইঞ্জিনিয়ার না হয়ে গোয়েন্দা হতে পারতিস।
সত্যিই এইসব চিন্তা ওর মাথাতেই আসে হঠাৎই। আর মাথাতে এলে সহজে যায় না। মুনিয়া একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেছিল প্রমোদকে দেখে। রুমকি বুঝতে পারে মেয়েটা খুব নরম প্রকৃতির কয়েকটা মাস ধরে দেখছে তো ওকে। তারপর বর নেই এখানে একদম একা থাকে। কত আর বয়েস হবে?
তবে প্রমোদ মানে ওর দেওর গভীর জলের মাছ,অতক্ষণ খুঁচিয়েও মুনিয়া সংক্রান্ত একটা কথাও বের করতে পারেনি মুখ থেকে। এমন কি একই কলেজে পড়ার কথাও নয়।
কলেজের কথাটা অবশ্য ও আন্দাজেই বলেছিল তবে এখন পুরোপুরি কনফার্ম। আচ্ছা মুনিয়ার ফোনটা কি অফ হয়ে গেছে সত্যিই। নাকি ওকে অ্যাভয়েড করার জন্য ফোনটা অফ করে দিল?
বাবলিটা মাঝখানে শুয়ে হাত পা ছড়িয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। প্রবালও পাশ ফিরে শুয়েছে। এই সপ্তাহের মধ্যেই মা বাবা আর শ্বশুর শাশুড়ি চলে যাবে কিছুদিনের জন্য। তখন নাহয় একদিন মুনিয়ার ওখানে ঘুরে আসবে বাবলিকে নিয়ে।
মুনিয়ার প্রোফাইলে একবার যায় রুমকি কাভার পিকচারে ওদের হানিমুনের ছবি। সত্যি এবার খারাপ লাগছে রুমকির মুনিয়াকে এভাবে ক্রশ না করলেই হত। আসলে সবটাই ঐ প্রমোদের জন্য। ও এত নৌটঙ্গী না করলেই পারত। তবে একবার যখন মনে হয়েছে সত্যিটা ও জেনেই ছাড়বে। কিছু তো একটা ব্যাপার আছেই।
এই তো মুনিয়ার কলেজের নাম দেওয়া রয়েছে পরিস্কার। অবশ্য সেম কলেজ হলেই বা কি ইয়ার এক নাও হতে পারে। কোন অ্যাফেয়ার্স ছিল নাকি কে জানে? ভাবতে হচ্ছে ব্যাপারটা।
ওর কথা খুব মনে পড়ে রুমকির। মুনিয়া কি এখন ঘুমিয়ে পড়েছে? বেচারা মেয়েটার কোন খারাপ অভিজ্ঞতার জন্য যদি প্রমোদ দায়ী থাকে তাহলে হয়ত নিশ্চয় কষ্ট পাচ্ছে। তবে প্রমোদ যদি মুনিয়ার অশান্তির কারণ হয় তবে ওকে ছাড়বে না রুমকি। প্রবাল যা বলে বলুক। রুমকি এইসব দিক দিয়ে কাউকে ছাড়েনি। যেমন ছাড়েনি ওর এক্স বয়ফ্রেন্ডকে। কোন রকম ইগনোরেন্স অ্যালাউ করতে পারে না রুমকি। নিজেকে প্রেশাস ভাবে সব সময়। মেয়েরা খেলার জিনিস নাকি?
যখনই দেখেছে সম্পর্কে ভালোবাসা নেই,গার্লফ্রেন্ডকে প্রায়োরিটি দেওয়া নেই তখন কি দরকার ভাই সেই সম্পর্কের। এই করে তিনবছরের পুরোনো প্রেম এককথায় ছেড়ে না না ছিঁড়ে দিয়েছিল।
প্রবাল অবশ্য পুরোটাই জানে। আর জানাই তো ভালো দুজনেরই যখন একটা অতীত ছিল। দুজনেই পরিস্কার হয়ে গেছে দুজনের কাছে।
তবে এখন প্রবালের সঙ্গে ঝামেলা হলেই বলে মাঝে মাঝে,' এটাই তোমার সমস্যা রুমকি আসলে সবসময় মা বাবার এত আদর পেয়ে এসেছ যে সবসময় নিজের মর্জিটাকেই বড় করে দেখ।'
-' একদম নয় আমি নিজের মর্জিকে বড় করে দেখি না। আমি ঠিকটাকেই বড় করে দেখি। আর ভুলটাকে ভুল।'
-' সব সময় মুখের ওপর সব কথা বলা ভালো নয় রুমকি। ওতে অশান্তি বেশি।'
-' সাজানো আর লোকদেখানো শান্তির থেকে অশান্তি ভালো। আমার ঘরে আগুন লেগেছে আর আমি দেখাচ্ছি ফাগুনের পলাশ ফুটেছে এমন মেয়ে আমি নই।'
রুমকির মেজাজের হদিশ কিছুটা শাশুড়িমাও জানেন। বৌমার আড়ালে ছেলেকে বলেছেন আগে চাকরি করা মেয়ে বিয়ে করেছ এখন কথা শোনো। তবে রুমকির সামনে সব চুপচাপ।
তবে প্রবাল রুমকিকে প্রেশাস ভাবে। সত্যিই তো রুমকির মত হাইলি কোয়োলিফায়েড মডার্ন বৌ ওদের পরিবারে নেই। শুধু মেজাজটাই খুব ক্ষাপ্পা এই যা। তবে সবাইকে নিয়ে থাকে তো। সে যে কারণেই হোক। ও দিব্যি মাসের পর মাস অ্যাডজাস্ট করে থাকে মা বাবার সাথে।
রুমকির রাতজাগা মুঠোফোনের ডাকবাক্সে উড়োচিঠি আসে।
--' জেগে আছিস এত রাতে?'
--' হ্যাঁ ঘুম আসছে না তুই কি করছিস এত রাত অবধি?'
-' তোকে মিস্ করছিলাম একটু কথা বলব বলে। খুব ইচ্ছে করছে কথা বলতে। একটু ভিডিও কলে আসবি।'
-' কি যে সব বোকা বোকা কথা বলিস! পরে কথা হবে এখন ভালো লাগছে না। ঘুমিয়ে পড়ব এখন।'
-' বুঝতে পারছি হাবি আছে সাথে।'
-' হ্যাঁ আছে তো। বেডরুমে তো থাকবেই। কোথায় থাকবে?'
' আগে তো রাতে কথা বলতিস।'
' তখন প্রবাল ছিল না এখানে।'
-' আমারই কপালে শান্তি নেই। জীবনে শুধু অশান্তি। তখন কেন যে তোকে প্রপোজ করিনি। এখন ভাবি তোর সাথে যদি বিয়েটা হত।'
এমন কথা অনেকবার বলেছে সন্দীপ। ছেলেদের এই একটা সমস্যা বেশি কথা বললে আল্টিমেট ঐ একজায়গায় এসে গড়াগড়ি দেয়। লাভ,সেক্স, ফ্লার্ট করা। রুমকি মেসেজেই বলে..
-' কি উল্টোপাল্টা বলছিস! ড্রিঙ্কস নিয়ে বসেছিস নাকি?'
-' হ্যাঁ ওটাই তো এখন রাতের সঙ্গী আমার।'
রুমকি জানে এখন অনেক রোমান্টিক কথাবার্তা বলবে সন্দীপ। প্রথমটা সন্দীপকে প্রশ্রয় দিয়েছে রুমকিই। ওর পাতার পর পাতার রোমান্টিক মেসেজ এনজয় করত রুমকি। যদিও মাঝে মাঝে বলত ফ্লার্ট করছে ওকে...' কি বলিস তুই? ইশ্ আমার বরটা যদি এত রোমান্টিক হত। সারাক্ষণ কাজ আর কাজ।'
তবে আজকাল কেমন যেন আর ভালো লাগে না রুমকির। একটু বাড়াবাড়ি মনে হয় সন্দীপের কাজকর্ম। ঘুমন্ত বাবলির দিকে তাকিয়ে রুমকির মনে হয় সন্দীপকে এতটা প্রশ্রয় দেওয়া ওর উচিত হয়নি। বাবলিটা ওর নাইটড্রেসটা হাতের মুঠোতে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে।
ইচ্ছে করেই ফোনটা বন্ধ করে দেয় রুমকি। বুঝতে পারে কখনও বাধ্য হয়েও ফোন বন্ধ করতে হয়। কলেজে কখনও বুঝতেই পারেনি ওকে সন্দীপ পছন্দ করে। সন্দীপকে ওরা সেভাবে ছেলে বলে মনেই করেনি কখনও। সব সময় মজা ইয়ারকি করেছে ওর সাথে। তারপর একটা সময় হায়ার এডুকেশনে রুমকি অন্য জায়গায় গেল। দুবার প্রেম হল। একবার ব্রেকআপ পরের বার সোজা বিয়ে তখনও সন্দীপ মনের আসেপাশে ছিল না।
তারপর এতবছর বাদে হঠাৎই ওর সাথে দেখা হয়ে গেল ওদের হেড অফিসে। প্রথমে সত্যি দারুণ ফিলিংস হয়েছিল মনে হয়েছিল এতগুলো বছর মাঝেই নেই কোথাও। আবার সেই কলেজের আড্ডাতেই বসেছে দুই বন্ধু। সন্দীপই প্রথমে চিনেছিল,প্রশংসা করেছিল খুব রুমকির। ' আরে রুমকি না? আগের চেয়েও তো অনেক অনেক সুন্দরী হয়েছিস দেখতে। তুই কি ম্যারেড?
রুমকি হেসে গড়িয়ে পড়েছিল,' অবভিয়াসলি ম্যারেড। বেবি আছে।'
-' ওয়াও বোঝাই যায় না তো। আসলে তোর সাথে এই এতগুলো বছরে একদম যোগাযোগ হয়নি।'
প্রবাল তখন বাইরে,প্রথমে আড্ডা দিতে তারপর অভ্যেসে বেশ অনেকদিন দেখা করেছে ওরা। দুজনেই ডুবে গেছে পুরোনো বন্ধুত্বের গল্পে ঘন্টার পর ঘন্টা। সন্দীপ মুগ্ধতায় তাকিয়ে থেকেছে রুমকির দিকে। একটু একটু করে শুনেছে ওর সুখী দাম্পত্যের গল্প। নিজের সুখের জানলাটা বেশি করেই খুলে দিয়েছিল প্রথম আলাপে সন্দীপের কাছে রুমকি।
হঠাৎই একদিন সন্দীপ বলেছিল,' জানি তুই খুব সুখী রুমকি বাট কোথাও কিন্তু খুব একা তুই। আই ফিল ইয়োর একাকীত্ব।'
-' একা হব কেন? সারাদিন মেয়ে শ্বশুর শাশুড়ি আর মা বাবাকে নিয়ে কেটে যায়। তারপর অফিস আছে।'
ঠোঁটে সিগারেট চেপে সন্দীপ বলেছিল, ' আমি ভালোবাসার একলা হয়ে যাবার কথা বলছিলাম। মানে হাবি তেমন সময় দিতে পারে না তাই তো?'
গলাটা একটু আটকে গেছিল রুমকির সত্যিই বোধহয় একটা সময় একসাথে দেখা ভালোবাসার স্বপ্নগুলো একলা হয়ে যায়। শুরু হয় সবার মধ্যে থেকেও একলা চলার লড়াই। প্রবাল আজকাল আর সেভাবে নজর দেয় না ওর দিকে। এই ট্রিপটা না নিলেও হত তবুও চলে গেল বাইরে।
রুমকি কথা পাল্টে জিজ্ঞাসা করেছিল,' তোর কথা বল। মানে তোর বিয়ে ছেলেমেয়ে। কিছুই তো বলিসনি তেমন।'
বারবারই এড়িয়ে গেছে সন্দীপ,' ছাড় ওসব কথা। বিয়ে একটা হয়েছে কিন্তু মোটামুটি নষ্ট বিয়ে। এখন সেপারেশনে আছি। পাগল বুঝলি পাগল। থাকা যায় না ওর সাথে। সত্যিই প্রথমে বুঝিনি। তারপর এখানে অফারটা পেয়ে চলে এসেছি। টাকা পাঠিয়ে দিই ওতেই খুশি থাকে ও।'
সন্দীপের কথা শুনে অবাক হয়েছিল রুমকি। খুব খারাপ লেগেছিল। ' আচ্ছা মানলাম সব কিন্তু চিকিৎসা করালেই ঠিক হয়ে যাবে।'
-' ছাড় সেসব কথা এই পাগল সেই পাগল নয় রে। অনেক চেষ্টা করেছি। ঐ এখনও কাগজে কলমে সম্পর্ক ঝুলে আছে বুঝলি আর মোটা টাকা পাঠিয়ে জল দিচ্ছি সম্পর্কে। ওতেই বেশ টিকে আছে।'
চ্যাটে থাকা বোধহয় একটা সময় অভ্যেস হয়ে যায়। প্রবাল যখন বাইরে রুমকি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল সন্দীপের সাথে কথা বলায়। এই কয়েকমাসে বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়েছে। রুমকি মাঝে মাঝে ভাবত ওর অবস্থাও তো সন্দীপের মতই। প্রবালের সাথেই বা ওর ভালোবাসার সম্পর্ক কতটুকু? অফিসের চাপে কোথায় হারিয়ে গেছে সেই ছোট ছোট অনুভূতি গুলো। রুমকিকে টেক্কা দিয়ে আরও অনেক অনেক এগিয়ে গেছে প্রবাল অথচ রুমকি বাচ্চার জন্য কম্প্রোমাইজ করেছে। একটা চাপা অসন্তোষ জমে ছিল রুমকির মনে। আর সেই জায়গাটাতে একটু একটু করে ঢুকে পড়তে চেয়েছিল সন্দীপ।
কিন্তু এবার বাইরে থেকে এসে হয়ত দীর্ঘ বিরহের পর প্রবাল আবার যেন সেই আগের প্রবাল। রুমকিকে আবার বাঁধতে চায় নব নব অনুরাগে। ওর ছোট ছোট সুবিধা অসুবিধাগুলোর লক্ষ্য রাখে।
-' সত্যি রুমকি এবার খুব মিস্ করেছি তোমাদের। সত্যিই আমি বাড়িতে না থাকলে কত কি তোমাকে সামলাতে হয়? এমন কি আমার মা বাবাকেও। বাবার শরীর খারাপের সময় তুমি যা করেছ!'
-' তুমি বোঝো সবটা? তুমি তো রুমকিকে শুধু ঠোঁটকাটা আর ঝগড়ুটে বলে মনে কর। ছাড়ো অত তেল দিতে হবে না। উনি বোধহয় আমার বাবা নয়।'
প্রবাল জানে রুমকি কথা বললে আর থামবে না তাই রুমকির ঠোঁট বন্ধ করে দেয় আদরে।
দাম্পত্যের ফাঁকটুকু মেরামতের কাজ যত দ্রুত এগোয় রুমকির কথা কমতে শুরু করে সন্দীপের সাথে।
*********************************
রুমকিদির কাছে প্রমোদের কথা শুনে ফোনটা বন্ধ করে দিলেও আর ভেঙে পড়েনি মুনিয়া। কালকের হঠাৎই আসা সাইক্লোন ওকে ভেঙে দিয়েছিল চুরমার করে। আজ মুনিয়া জানে ঝড় এলে ও সামলে নেবে ঠিক। মাকে ও সব বলেছে। মা তো আছে সাথে সুতরাং ভয় কি? দরকার হলে সব কথা বলবে রুমকিদিকে। রাণা বোধহয় ঠিকই বলত,এখন মনে হচ্ছে রুমকিদির কৌতূহল একটু বেশিই।
কাল রাতে অনেকক্ষণ ওর আরেকটা নম্বর থেকে রাণার সাথে কথা বলেছে। বারবারই মনে হয়েছে দূরে হলেও রাণার ভালোবাসা ওকে জড়িয়ে আছে।
ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেছে মুনিয়ার, কাল ওভাবে ভয় পেয়ে ফোনটা অফ না করলেই হত। কি হত রুমকিদিকে বললে যে ও প্রমোদকে চেনে।
পরক্ষণেই আবার মনে হয়,রুমকিদির সাথে ওর কত দিনের আলাপ? রুমকিদিই বা জানবে কেন ক্ষতর খবর। সত্যিই বোধহয় আমরা বিশ্বাস করে এ নিজেদের গোপন ক্ষতর খবর দিয়ে দিই। তারপর হয়ত খোলা জানলা দিয়ে কীটপতঙ্গ ঢুকে ক্ষতটা শুধু বিষাক্তই হয়।
ভোরে উঠে কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থাকে মুনিয়া। আকাশে সূর্য হামা দেওয়ার অপেক্ষায়। ভোরের বাতাস শান্ত করে মুনিয়ার মন ভাবে যা হয় হবে। ও তো কোন ক্রাইম করেনি।
মোবাইলটা অন করে রুমকিদিকে একটা মেসেজ করে সকালে উঠেই মিথ্যে বলতে হয়...' সরি গো কাল ফোনটাতে চার্জ ছিল না বুঝতে পারিনি গো। পরে কথা হবে। টেক কেয়ার। অফিসে যাব।'
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন তারপরে আর ফোন করেনি রুমকিদিকে। এড়িয়ে গেছে মুনিয়া। একটা ট্যুরের পার্টনার ছিল কি এমন হবে যোগাযোগ না থাকলে?
সেদিন রবিবার সকালে হঠাৎই বেলটা বাজে। স্যান্ডউইচ আর কফি নিয়ে খেতে বসেছিল মুনিয়া।
এইসময় তো কেউ আসে না। এখন আবার কে এল এই সকালে?'
আই হোলে চোখ রেখে অবাক হয়ে যায় মুনিয়া। কি করবে দরজাটা খুলবে?
মুনিয়ার চিন্তার জাল কেটে বেলটা আবার বেজে ওঠে টুং টাং শব্দে। মুনিয়া দরজা খোলে। মুখে চটজলদি একটা হাসির প্রলেপ মাখানোর চেষ্টা করে,
' ও মা রুমকিদি তুমি? সক্কাল সক্কাল। বাবলি কই? প্রবালদা?'
-' তোর ব্যাপারটা কি শুনি তো? বাবলি আর প্রবাল না এলে কি ঢুকতে দিবি না? সর বাবা অনেকটা ড্রাইভ করে এসেছি দুবার বেল বাজিয়েছি তারপর খুলেছিস। আগে বসতে দে।'
রুমকিদির এই খোলামেলা বোহেমিয়ান স্বভাবটা খুব ভালো লাগে মুনিয়ার। সংসার করছে,চাকরি করছে অথচ খুব একটা চাপ নেয় না বিন্দাস থাকে একদম। নিজেই হুটহাট এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে ড্রাইভ করে।
-' ওহ্ বুঝেছি,বরের সাথে গভীর রাত অবধি বকবক। তারপর ঘুমোতে দেরি,লেট রাইজিং অ্যান্ড এখন ব্রেকফাস্টের তোড়জোড় করে কফিতে চুমুক। আমি হতভাগা তাতে বাগড়া দিলাম হঠাৎই উদয় হয়ে।'
মুনিয়ার হাতে একটা বড় প্লাস্টিক আর কতগুলো খাবারের কনটেইনার ধরিয়ে দেয় রুমকি।
-' কি আছে এতে গো?'
-' তোমার ব্যাগ আর চকলেট মামনি। আর তো রাখা যাচ্ছে না। এরপর আমার বাড়িতে যে নেংটি ইঁদুর টা আছে সে খেয়ে নিত এটা।'
- ' ভালোই তো বাবলি খেলে আমারও ভালো লাগত।'
-' খুব নেকু হয়েছিস তো আজকাল। প্রবাল খুব রাগ করছে বলছে বারবার সেদিন মুনিয়া হঠাৎই চলে গেল। তুমি আর কোন খোঁজ নিলে না। শরীর ঠিক আছে না চেকআপ করাবে।'
' ধ্যাৎ আমার কিছুই হয়নি। তা প্রবালদা এলো না কেন? তুমি কফি খাবে তো? দাঁড়াও আমি আনছি বানিয়ে।'
-' হ্যাঁ শুধু ঐটুকুই কর। বাদবাকি আমি এনেছি। মা সব গুছিয়ে দিয়েছে করে। আজ তোর এখানে দুপুরে খাবো গল্প করব তারপর বিকেলে একটা বন্ধুর সাথে দেখা করে যাব বাড়িতে।'
-' বাবলি থাকবে অতক্ষণ? কাঁদবে না?'
-' ওর দিদামা আর দাদু থাকলে আর কিছু লাগে না। আর প্রবাল গেছে পাটনায় শ্বশুর শাশুড়িকে দিতে। অন্য সময় একাই যায় এবার শ্বশুরমশাইয়ের শরীর ঠিক নেই তাই ও গেছে।'
মুনিয়া কফির গন্ধে ভেসে মনে মনে হাসে তার মানে আজ রুমকিদির একদম ছুটি। বর নেই,শ্বশুর শাশুড়িমা নেই। আজ মা বাবার আদুরে মেয়ে রুমকিদি। সংসারের চাপ ঘাড় থেকে ফেলে বেরিয়ে পড়েছে নিজের মত।
টেবিলে কফি আর স্যান্ডউইচ এনে রাখে মুনিয়া। ওর কফিটা গরম করে নিয়ে একেবারে বসে।
ডিভানে উঠে কুশন কোলে করে জমিয়ে বসেছে রুমকিদি। অন্য সময় কত খুশি হয়েছে মুনিয়া রুমকিদি আসাতে। আজ কেন যেন একটু নার্ভাস লাগে। কে জানে রুমকিদি কথা বলতে বলতে কোন কথায় চলে যাবে। মুনিয়া কি পারবে সব কথার উত্তর দিতে?
রুমকিদি কফির খুব প্রশংসা করল তারপর কফি খাওয়া হয়ে গেলে ব্যাগটা খুলে বেশ বড় একটা ট্যাব বের করল।
-' ওমা দারুণ তো! নতুন কিনেছ নাকি?'
-' প্রবাল কিনে দিয়েছে রে। এখন তার খুব বৌয়ের দিকে নজর দেখছি। বাবলির জন্মদিনের পরেই কিনে দিল। আসলে অ্যানিভার্সারির সময় তেমন কিছু হয়নি কারণ শ্বশুরমশাই অসুস্থ ছিলেন। তাই হঠাৎই একদিন দেখি এনেছে।'
-' হঠাৎ পাওয়া গিফ্ট কি ভালো লাগে না? রাণাও মাঝে মাঝে এমন হঠাৎই গিফ্ট এনে দিত আমাকে। আমার বেশিরভাগ শাড়িই তো ওর দেওয়া। খুব পছন্দ করে শাড়ি।'
মুনিয়া একমনে বলে যায় রাণার কথা। কেমন আছে রাণা,এখন কি করছে ওখানে। ঘরের কাজকর্ম কেমন করে সামলাচ্ছে এইসব।
রুমকি হাসে ওর দিকে তাকিয়ে,' হ্যাঁ একদম প্রথম প্রথম ছাড়াছাড়ি তো তাই এত মিস্ করছিস। একটা সময় অভ্যেস হয়ে যাবে দেখবি। এই যেমন আজই প্রবাল নেই বলে চলে এলাম তোদের বাড়ি। থাকলে পারতাম নাকি?
সত্যিই রে হঠাৎ কিছু পাওয়ার মজাই আলাদা। এই দেখ না প্রবাল যখন ওদেশে আমি এদিকে সত্যিই বোর হচ্ছি। মাঝে মধ্যে রাগও হচ্ছে একা সব সামলাতে। হঠাৎই অনেক বছর আগের কলেজের এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেল। সত্যিই আমি তো প্রথমে চিনতে পারিনি। তারপর ও চিনলো আমাকে তারপর একছুটে চলে গেলাম কলেজের সেই দিনগুলোতে।
রুমকিদি একা একাই অনেকগুলো কথা বলে যাচ্ছে। তাই মুনিয়া যোগ দেয়,' তোমার কলেজ ফ্রেন্ড? মানে ছেলে না মেয়ে?'
- ' অবভিয়াসলি ছেলে। হঠাৎ জিজ্ঞেস করছিস কেন?'
-' না না আমি ভাবলাম বান্ধবী বোধহয় হয়ত এখানে এসেছে।'
-' আরে না না,এই ছেলেটার সাথে বহুদিন যোগাযোগ ছিল না সেই কলেজের পরে। আমার কিন্তু ছেলে বন্ধুই বেশি ছিল। একটু ঠোঁট কাটা টমবয় মত ছিলাম তো তাই মেয়েরা খুব একটা কাছে ঘেঁষত না।'
-' তাই? প্রবালদার সাথে তাহলে কলেজেই আলাপ। মানে প্রবালদাও চেনে তোমার বন্ধুকে?'
-' না না প্রবাল আর আমার আলাপ এমবিএ করতে গিয়ে। সন্দীপ আরও পুরোনো বন্ধু। তবে দেখলাম বন্ধুত্বটা আছে এখনও মরচে ধরেনি।'
' তাহলে তোমার প্রেম মোটামুটি ম্যাচিওরড প্রেম আমার মতই। মানে একটু দেরিতে হয়েছে।'
রুমকি হেসে গড়িয়ে পড়ে,' না না স্কুল থেকেই খুচখাচ প্রেমে পড়েছি তবে সেগুলো সিরিয়াস ছিল না। প্রবালের আগে একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল তিনবছর কিন্তু টেকেনি। মানে আমিই ভেঙে দিয়েছিলাম সম্পর্কটা।'
মুনিয়া একটু আনমনা হয়,এর আগে রুমকিদিকে এইসব গল্প করতে শোনেনি। তখন বাবলি থাকত সাথে ওর সাথে মজা করেই সময় কেটে যেত। আজ বারবার কেন প্রেমের বাদ্যি বাজাচ্ছে রুমকিদি?
প্রসঙ্গটা পাল্টাতে মুনিয়া বলে,' চল তোমাকে ব্যালকনিতে নিয়ে যাই আমার বন্ধুদের দেখবে চল। এখন এরাই আমার প্রেম। রাণা অনেক গাছ করে দিয়ে গেছিল। ওদের যত্ন করে কথা বলে কেটে যায় সময়।'
রুমকি বাইরে যায় মুনিয়ার সাথে,' বাহ্ দারুণ সাজিয়েছিস তো বাইরেটা! একদম সুখী গৃহকোণ। সত্যিই ফ্ল্যাটের একটা আলাদা স্বাদ আছে। প্রবালের আবার বাড়ি পছন্দ।'
-' রাণারও তাই গো,আসলে নিজেদের খোলামেলা বাড়ি তো।'
-' দেখব নাকি কিছু তোদের জন্য আমাদের কাছাকাছি?'
-' এখন হবে না গো। ও ফিরুক তারপর দেখব।'
'আচ্ছা বেশ তাই হবে। তবে আমাদের বাড়ির কাছাকাছি হলে খুব ভালো হয় দারুণ মজা হবে।
তখন থেকে আমিই শুধু বকবক করছি। একটা কথা বলব?'
মনের ভেতরটা একটু চমকে ওঠে মুনিয়ার,' বলো না? তোমাকে আবার পারমিশন নিতে হচ্ছে?'
রুমকি ওকে জড়িয়ে ধরে,' আমি এলাম,প্রচুর বকবক করলাম। বাট আই মিস্ দ্যাট মুনিয়া। ইউ চেঞ্জড আ লট ডিয়ার। মুখের হাসিটা মিসিং,একটু পেল কম কথা বলছে। আগের সেই টাপুরটুপুর মুনিয়া কই? যার হাসিতে হঠাৎই বৃষ্টি ঝরত? কি হয়েছে? এনি প্রবলেম?'
মুনিয়া কি করে বলবে প্রবলেমটা হয়ত এখন তুমিই রুমকিদি। কেন যেন আমি তোমার কাছে ফ্রী হতে পারছি না। ভাবছি সবটা বলে দেব অথচ তাও বলতে পারছি না। নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কথা কি শেয়ার করা উচিত? মা বারবারই বারণ করেছে কাউকে কিছু না বলতে। নিজেকে সামলে মুনিয়া বলে।
-' কোথায়? এই তো দিব্যি খাচ্ছি দাচ্ছি গল্প করছি। দাও তোমার নতুন ট্যাবে তোলা ছবিগুলো দেখাও দেখি। বাবলির বার্থডেতে তোলা সব ছবি নিয়েছ এখানে? আমার তো দেখা হয়নি দেখাও।'
রুমকি ছবিগুলো বের করে মুনিয়া একের পর এক ছবি দেখে উৎসাহে। বাহ্ ওর ছবিগুলো তো বেশ উঠেছে। অথচ একটা সময় রাণাকে বিরক্ত করেছে কত ভালো ছবি তুলে দেবার জন্য।
ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎই প্রমোদের ছবি এসে পড়ে। সেদিন প্রমোদের দিকে তাকাতে ইচ্ছে না করলেও আজ রুমকিদির পাশে বসে মুনিয়া বলতে পারে না রেখে দাও আর ভালো লাগছে না দেখতে।
ছবি দেখাতে দেখাতে রুমকিদি সবসময়ই কথা বলছিল। ঐ যেমন বলে আরকি, ইশ্ আমাকে এটাতে বাঁদরী লাগছে। ওমা দেখ বাবলির চোখটা ট্যারা এসেছে। এই আমাদের অফিসের কলিগরা তোর সাথে তো আলাপ হয়েছে কয়েকজনের।
পরপর প্রমোদের ছবি আসছে। কেমন যেন অসহ্য লাগে মুনিয়ার। কথা ফেরাতে বলে মুনিয়া,' তোমার কলেজের সেই পুরোনো বন্ধু আসেনি গো? যার কথা খুব বলছিলে।'
রুমকি হঠাৎই একটু সামলে নেয় নিজেকে তারপর বলে,' বলেছিলাম আসতে। কিছু কাজ ছিল তাই আসেনি। পরে বাবলির জন্য গিফ্ট দিয়েছে।'
-' ও আচ্ছা,চলো এখন কিচেনে ঢুকি লাঞ্চ করবে তো?'
' ছবিগুলো দেখে নে তারপর খাব। তোকে একটু কথাটা ঘুরিয়ে মিথ্যেই বললাম রে। সন্দীপকে আমি ইচ্ছে করেই বলিনি। সন্দীপের কথা বলতে গেলে একটা গল্প হয়ে যায়। আসলে সন্দীপকে একটা সময় বন্ধু ছাড়া অন্য চোখে দেখিনি। এখন মাঝে মাঝেই বলে আমার ওপর ওর নাকি ক্রাশ ছিল। সেই ক্রাশ কে বাড়িতে ডেকে সর্বনাশ ঘটায় কে বল।'
কথা বলতে বলতে একচোট হেসে নেয় রুমকিদি। রুমকিদির হাসি মানে প্রাণখোলা হাসি ভালো লাগে মুনিয়ার।
' দারুণ বললে তো!'
' হ্যাঁ সন্দীপ নামটার সাথে কস্মিনকালেও পরিচয় ছিল না প্রবালের। একেই আমার সাথে মাঝে একটু ঝামেলাই হচ্ছিল প্রবালের। তারপর কি দরকার যেচে অশান্তি আনার। ভাববে হয়ত বরের অ্যাবসেন্সে পরকীয়া করছিলাম।'
- ' সত্যি তুমি কিছু মজা করতে পার রুমকিদি।'
-' তুই এবার একটা সত্যি কথা বলবি। তুই আমার দেওরকে চিনিস? তোদের তো একই কলেজ ছিল তাইনা?'
হঠাৎই মুনিয়া অদ্ভুত একটা জোর পায় ভেতর থেকে। কি এত ভয় সত্যি বলতে।
-' কেন ও তোমাকে কিছু বলেছে আমার কথা?'
-' না ও কিছু বলেনি। সত্যি কথা বলতে ও আমার রিলেটিভ হলেও ওর সাথে এই আমার দ্বিতীয়বার দেখা। ওর বিয়েতেও আমার যাওয়া হয়নি তোর দাদা গেছিল। ওর থেকে তুই আমার অনেক কাছের। সেদিনের পর আর আসেনি বাড়িতে।'
-' তুমি কি আরেকবার চা খাবে রুমকিদি?'
-' নাহ্ একটু বাদেই তো খাবার খাব তুই বোস। বল আমাকে কষ্টগুলো চেপে থাকিস না। তোর হাসিমুখটা খুব মিস্ করছি।'
-' আমি প্রমোদকে চিনতাম রুমকিদি। খুব ভালো করেই চিনতাম একদম কাছের থেকে চিনতাম। পাগলের মত ভালোবাসতাম ওকে। প্রমোদই আমার লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট ছিল। এইটুকুই তো জানতে চেয়েছ তুমি। নাকি আরও কিছু?'
বলতে বলতে হঠাৎই উত্তেজনায় হাঁফায় মুনিয়া।
-' আর কিছু বলতে হবে না তোকে শান্ত হ এবার। আমি অনেক জিজ্ঞাসা করেও ওর কাছে উত্তর পাইনি। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল এটাই।'
-' এবার জেনেছ তো সবটা। রাণা জানে,সবাই জানে। রাণা সব জেনেই আমাকে বিয়ে করেছে। পাগলের মত ভালোবাসে আমাকে তুমি তো দেখেছ। তবে শুনে রাখ একটা সময় প্রমোদের একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি সব করতে পারতাম। আর ওর কাছে চরম আঘাত পেয়ে একদিন আমি সুইসাইড করতে গেছিলাম।'
মুনিয়া কাঁদছে,নিজেকে শক্ত করে ধরে রাখবে ভেবেও পারেনি। যে ক্ষতটার ওপর মলম লাগিয়ে এসেছে এতদিন আজ আবার সেটা রক্তাক্ত। তবে এই রক্তক্ষরণটা দেখুক রুমকিদিও। এটা জানার জন্যই তো সকালে ছুটে এসেছে ওর এখানে। প্রমোদ কেমন সেটা জানাও দরকার।
' থাক থাক মুনিয়া প্লিজ শান্ত হ এবার। ক্ষততে জমে থাকা পুঁজরক্ত টা বের করে দেওয়াটাও জরুরী। আমি হয়ত খোঁচা দিয়েছি। সত্যি খুব খারাপ লাগছে আমার। কিন্তু আজকের পর দেখবি অনেক অনেক হাল্কা লাগবে তোর।'
-' কিচ্ছু হাল্কা লাগবে না রুমকিদি। আমি ভেবেছিলাম অনেক দূরে আছে প্রমোদ আর কোনদিন ওকে দেখতে হবে না। কিন্তু সত্যি ওকে দেখে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি। তোমার প্রথম ভালোবাসা তুমি ছেড়ে চলে এসেছিলে রুমকিদি। প্রমোদ আমাকে ঠকিয়েছিল আমার বদনাম করেছিল। খুব খারাপ, খুব খারাপ ও। সবাই তোমার মত নয় রুমকিদি, আমি নরম আমি চাপ নিতে পারি না।'
রুমকি মুনিয়ার মাথায় হাত বোলায়, মুনিয়া নিজেকে সামলে বলে,' ঠিক আছে রুমকিদি। তোমাকে বলে সত্যিই আমার হালকা লাগছে। এড়িয়ে যেতে আর মিথ্যে কথা বলতে কার ভালো লাগে বল?
তুমি একটু বোসো আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি বাথরুম থেকে।
রুমকির বুকে একটা চাপা কষ্ট হয় তবুও ভাবে যাক জমা কথাগুলো বলে ও হাল্কা হয়েছে। ওদের খোলামেলা সম্পর্কটা কেমন যেন হয়ে গেছিল। হয়ত সত্যিটা এড়িয়ে যেতে ফোন করাও বন্ধ করে দিয়েছিল মুনিয়া। ভালো লাগছিল না রুমকির তাই হয়ত এখানে আসা।
মুনিয়ার ফোনটা বাজে, রুমকি তাকিয়ে দেখে রাণার ফোন। থাক মুনিয়া এসেই ধরবে।
কিছুক্ষণ বাদেই মুনিয়া বের হয়ে আসে বাথরুম থেকে অনেকটা ফ্রেশ লাগছে ওকে তবে চোখটা লালচে। বুঝতে পারে রুমকি প্রেমটা কতটা গভীর ছিল।
' তুমি ফ্রেশ হলে হয়ে নাও।'
- ' হ্যাঁ যাচ্ছি রে,ওহ্ রাণা কল করেছিল।'
-' আচ্ছা আমি দেখছি,তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।'
-' খুব খারাপ লাগছে রে। রাণাকে কিছু বলিস না।'
-' না রুমকিদি তুমি তোমার ক্রাশের কথা যখন প্রবালদাকে ত্রাশের ভয়ে বলতে পারনি তখন আমি কি করে বলি যার জন্য আমি মরতে বসেছিলাম একদিন সে ফিরে এসেছে। দাম্পত্যে অশান্তির গর্ত খুঁড়ে কি হবে?'
রুমকি বাথরুমে মুনিয়া রাণার সাথে কথা বলছে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। বাইরে হালকা ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছে ওকে। বাথরুমের আয়নাতে মুখটা দেখে রুমকি হঠাৎই মনে হল ওর মুখটাতে এক পোঁচ কালি মাখিয়ে দিয়েছে মুনিয়া। ওর শেষ কথাটা কেমন যেন খোঁচার মত বেঁধে রুমকির মনে।
******************************
রাণার সাথে স্বাভাবিক ছন্দেই কথা বলতে থাকে মুনিয়া মাইক্রোওভেনে খাবার গরম করতে করতে। রুমকিদিকে কথাগুলো বলে অনেকটা হাল্কা লাগছে ওর। সত্যিই অকারণে একটা অদ্ভুত ভয় ওকে চেপে ধরেছিল। এত ভয় কিসের সত্যিই তো। প্রমোদ যদি দিব্যি ওকে চকলেট খাওয়াতে বলতে পারে রুমকিদিকে ওকে কেক কাটতে হেল্প করতে চায় ওরই বা এত ভয় কিসের? ও কি করেছে এমন।
আজকে তো মনে হচ্ছে ওর ওভাবে ওখান থেকে চলে আসাটাও একটা মস্ত বোকামি হয়েছে। দিব্যি ওখানে থাকতে পারত তারপর সময় হলে চলে আসত। ও যদি অতটা নার্ভাস না হত তাহলে তো কেউ কিছুই বুঝতে পারত না। প্রমোদ তো একবারও নিজেকে ধরা দেয়নি। তাহলে ওর এত ভয় কেন?
নিজেকে শাসন করে মুনিয়া,' বি স্টেডি মাইসেল্ফ। পৃথিবীটা গোল সুতরাং একদিন দেখা হতই এখন শুধু জানতে হবে ভালো থাকার রহস্য। মুনিয়া একবার হেরেছে আর কিছুতেই হারবে না।'
রাণাকে নিচু গলায় বলে,' রুমকিদি এসেছে। এখন বেশি কথা বলছি না। একটু ধর রুমকিদির সাথে একটু কথা বলে নিস। নাহলে হয়ত খারাপ ভাববে। আমি তো বাথরুমে ছিলাম। দিদিই বলল তোর ফোন।'
রাণার সাথে তেমন হৃদ্যতা গড়ে ওঠেনি রুমকিদির। কতদিনই বা দেখছে ওদের। তবুও মুনিয়ার কথা ফেলতে না পেরে অল্প কিছুটা কথাও বলল।
-' চলে এলাম মুনিয়ার সাথে একটু টাইমপাস করতে। আমাদের এখন বেশ মজা আর গল্প হচ্ছে এখানে। কেমন লাগছে ওখানে?'
-' হ্যাঁ অবশ্যই অনেক উন্নত সব কিছু। কিন্তু সব কিছু ছেড়ে এখানে থাকতে ভালো লাগছে না।'
-' এরপরের বার এলে একদম মুনিয়ার টিকিট করে নিয়ে এসো। বেচারার মাঝে মাঝেই মন খারাপ হয়। কদিন কথা হয়নি ফোনে তাই চলে এলাম আজ।'
-' ওকে দিদি,আপনারা এনজয় করুন পরে কথা হবে।'
রুমকির আনা খাবার আর মুনিয়ার ফ্রীজের মজুত খাবারে টেবিল বেশ সেজেছে। মুনিয়া চটপট কয়েকটা ফ্রাইও ভেজে নিয়েছে।
মুনিয়ার গিন্নীপনা দেখে অবাক হয় রুমকি। বেশ কাজের হয়ে গেছে মুনিয়া রাণা চলে যাবার পর। বাইরে যখন গেছে তখনও দেখেছে রাণা খাবার সার্ভ করে দিত ওকে।
-' ওহ্ দারুণ সাজিয়েছিস তো টেবল। অনেকটা সিরিয়াস আলোচনা হয়েছে। মেঘ করেছে,বাজ পড়েছে এমনকি ভারী বৃষ্টিও হল। তবুও একটা কথা না বলে পারছি না তুই যদি আমার জা হতিস বেশ হত।'
-' কেন জায়ের থেকে বোনটা কম মিঠে নাকি? আমার তো মনেহয় এখনই বেটার রিলেশনে আছি দিদি। সত্যিই সবটাই কেমন যেন গল্পের মত।'
-' হ্যাঁ ঠিক বলেছিস বোনটা অনেক মিস্টি সম্পর্ক। জায়ে জায়ে রেষারেষি থাকে। আমারও খুব অদ্ভুত লেগেছে ভাবতে জানিস হঠাৎই তোদের সাথে দেখা,ট্যুর পার্টনার হয়ে কত ঘুরলাম। দিদি বোনের সম্পর্ক হল। তারমধ্যে তোর অতীত ফিরে এল আমারই বাড়িতে। তবে যা হয়েছে ভালো হয়েছে রে,কত ভালো বর আর শ্বশুরবাড়ি তোর। ঐ বাড়িতে ঢুকলে ঘুঙ্গট টেনে থাকতে থাকতে লাইফ হেল হয়ে যেত। একদম খাস বিহারী ওরা।'
একটু অন্যমনস্ক হয় মুনিয়া ওর সদ্য প্রেমে পড়া মনে তখন ছিল ঘুঙ্গটেরই স্বপ্ন। হাত ভর্তি চুড়ি পরবে মাথায় ঘোমটা দেবে। হাতের মেহেন্দীতে লেখা থাকবে প্রমোদের নাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে....
-' কিছু ঘটনা কোন কারণেই ঘটে রুমকিদি। তুমি এত ভেব না। হয়ত আমি একটু বেশি রুড হয়ে গেছিলাম। খুব খারাপ লাগছিল গো। তবে সত্যি আমার শ্বশুরবাড়ি খুব ভালো আর রাণার তো তুলনাই হয় না। জান আমার মা আর শ্বশুরমশাই দুই বন্ধু। এই নিয়ে অনেক মজা হয়।'
-'না না। ছাড় তো ওসব কথা। রাণা যখন আসবে ওর সাথে গিয়ে ওদেশের সব ঘুরে নিবি। দেখবি কত ভালো লাগবে।'
-' হ্যাঁ দেখি গো,ইচ্ছে তো আছেই যাবার।'
খাওয়া দাওয়া আর আড্ডাতে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। রুমকির ভালো লাগল মুনিয়ার মুখের শ্রাবণের মেঘ কেটে শরতের রোদ উঠেছে। তবে এত সুন্দর একটা মেয়েকে প্রমোদ রিজেক্ট করল কেন কে জানে? কত কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা যে মরতে বসেছিল।
হবেই না বা কেন যেমন পরিবার ওদের তেমনি তো ছেলে হবে।
রোদ পড়ে আকাশে বিকেলের হাতছানি প্রায়। রুমকি মুনিয়াকে একটা আদরের ছোঁয়া দিয়ে ওর ওখান থেকে চলে আসে। গাড়ি চালাতে চালাতে বারবার মনে পড়ে ওর মুখটা। খারাপ লাগে একা একা সবটা সামলাচ্ছে মেয়েটা। এমনকি মনের অসুখও সেদিক দিয়ে ও অনেকটা লাকি। বাবলিকে নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে মাঝে মাঝে নিজেকেও নিজে ভুলে যায়। ভাগ্যিস মা আর শাশুড়িমা এসে অনেকটা সামলায়। ফোনটা বারবার রিং হচ্ছে গাড়িটা সাইড করে ফাঁকা দেখে। প্রবাল ফোন করেছে।
' হম্ বল,গাড়ি চালাচ্ছিলাম তো ধরব কি করে।'
' রুম এবার বাড়িতে চলে যাও,অনেকক্ষণ তো বেরিয়েছ। মুনিয়া ঠিক আছে তো?'
' একটা কাজ আছে সেটা সেরেই বাড়ি যাব সোজা। মুনিয়া ঠিক আছে। অনেক কথা হল পরে তোমাকে বলব। আমি পৌঁছে যাব ডোন্ট ওরি। মা কা লাডলা একা একা আদর খাও।'
' খাচ্ছি তো বাট সবাই থাকলে ভালো হত। মৌসি এসেছে পাপাকে দেখতে। তোমার কথা বলছে। প্রমোদের পাঠানো জিনিসগুলো দিলাম।'
- ' প্রমোদ এসেছিল নাকি?'
-' হ্যাঁ স্টেশনে এসেছিল মা পাপার সাথে দেখা করতে।'
-' ওকে গল্প কর। পরে কথা হবে।'
প্রমোদের কথাটা শুনে মাথাটা গরম হয়ে যায়। বাড়িতেই তো আসতে পারত। ওকে অ্যাভয়েড করার জন্য স্টেশনে এসেছে। আবার একবার মুনিয়ার কান্নাভেজা মুখটার কথা মনে হল।
গাড়ি চালাতে চালাতে আবার ফোন...কোথায়?
'আসছি পাঁচমিনিট। ওয়েট।
************************
বাড়ির সামনে বোর্ডটা ঝুলিয়ে দেখে ঝুমকা দূর থেকে তাকিয়ে। প্রথমে প্রচার করেনি নিজের একদম নিঃশব্দে কাজ করে গেছে। সেদিন সোহিনীদি বলল আমি বলেছি পাঁচুকে একটা বোর্ড করে দিতে তোর বুটিকের জন্য।
' কি যে বল! আমার আবার বুটিক।'
-' শোন বিনয় ভালো তবে বেশি বিনয় ভালো নয়। আমার পার্লারে একটা দুটো পিস রাখলেই তো বিক্রি হয়ে যায়। অনেকেই তো তোর ওখানে যেতে চায়। একটু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখবি না?'
-' আমার আবার সাজানো।'
-' সত্যিই তোকে দেখে আমার ভালো লাগে ঝুম,যে মেয়ের হয়ত স্থান হতে পারত কোন খারাপ জায়গায়। তোকে বিক্রি করেও দিতে পারত। সেই ঝুমকা আবার স্বপ্ন দেখছে নিজের কিছু করার। তবে প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাস না।'
মজা করে ঝুমকা হেসে ওঠে আর দু কলি গান গেয়ে দেয়,' তোমায় হৃদ মাঝারে রাখব ছেড়ে দেব না।'
নিজের ছোট ছোট স্বপ্নগুলো সাজাতে পেরে ভালো লাগে ঝুমকার। একসময় ও হয়ত রাণাকে ছেড়েছিল নিজেই উচ্চাকাঙ্ক্ষায় তবে রাণাই ওর মনে সেই কবে স্বপ্নের চারাগাছ বপন করেছিল। আজ সেই চারাগাছ মহীরুহ না হলেও একটা পাতলা শিউলি গাছ তো হয়েছে যার শরতের প্রথম ফুলের সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে থাকে ঝুমকা। স্বপ্ন দেখে নতুন করে বাঁচার দুঃস্বপ্নকে ভুলে।
কখনও যদি সামনাসামনি আবার রাণার সাথে দেখা হয় তাহলে এবার ওকে দুটো কথা শুধু বলবে। জানে যদিও রাণার দুচোখে শুধু ঘেন্না ওর জন্য তবুও উপকার স্বীকার করতে চায় ঝুম যদি কোনদিন সুযোগ পায়।
আচ্ছা মৈনাক কি ওকে কোন কিছুই দেয়নি? হ্যাঁ দিয়েছে তো কঠিন থেকে কঠিনতর হবার শিক্ষা। জীবনের খারাপ আর ভালো দুই অভিজ্ঞতাই বোধহয় মানুষকে শেখায় অনেক কিছু।
দিদি ফোন করেছিল খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে,' এই বোন শোন না বেশ কয়েকটা শাড়ি আর পাঞ্জাবীর অর্ডার পেয়েছি বুঝলি। তবে তাড়াতাড়ি দিস। ওরা চলে যাবে বলছিল তাই তাড়াতাড়ি নিতে চায়।'
-' আচ্ছা ভালো তো,তুই একটু বলিস সবই হাতে আঁকা তাড়াতাড়ি করতে হলে একটু চার্জ বেশি পড়বে।'
-' আমি বলে দিয়েছি,তুই বলার আগেই। ওসব নিয়ে কোন সমস্যা নেই। ওদের প্রচুর টাকা সবাই ভালো ভালো চাকরি করে। শুধু বলেছে আঁকাগুলো যেন একদম ইউনিক হয়।'
ঝুমকা দিদির বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারল না সত্যিই দিদি যে এভাবে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ভাবা যায় না।
ফোনটা ছেড়ে মাথাটা পুরোপুরি ডিজাইনে দেয় ঝুম। এখন সবসময় ভালো ভাবনা মনে রাখতে চায় খারাপ গুলো ডিলিট করে। কাজগুলো ভালো করে করতে হবে দিদির পাড়ার লোক বলে কথা।
******************
গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে লক করে নামে রুমকি। সন্দীপ বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে দেখে একগাল হাসে,' ওহ্ লুকিং বিউটিফুল মাই লাভ। একটু আদর করে দিতে ইচ্ছে করছে।'
-' সন্দীপ,একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না। কতক্ষণ এসেছিস?'
' অনেকটা আগে,চারটে সিগারেট ধ্বংস করলাম,কিছু সুন্দরী দেখলাম। তবে এখন দেখছি আমার বান্ধবীই সেরা। সত্যিই মেয়েদের বোধহয় ম্যাচিওরিটি একটা অন্য লুক দিয়ে যায়।'
প্রবাল কখনও এই ধরনের কথা বলে না। ভালোবাসার কথা ওর মুখে আসে না খুব একটা। ওর কথা প্রয়োজনীয় ফিরেছ, এসেছ,সব ঠিক আছে এই ধরনের। আর সন্দীপ পুরো উল্টো,ও ভালো কথা বলতে পারে যেটা প্রবাল পারে না। কেয়ারিং খুব,ওর সঙ্গে থাকলে মোটামুটি নিজেকে প্রিন্সেস লাগে রুমকির। প্রবাল ফিরে আসার পর তেমনভাবে আড্ডা দেওয়া হয়নি ওর সাথে। মেসেজও এখন নিয়ন্ত্রণ করেছে রুমকি। আগে উইকএন্ডে মাঝ রাত্রি পর্যন্ত কথা হত সন্দীপের সাথে। এখন খুব বেশি হলে এগারোটার গন্ডী পেরিয়েই ফোন বন্ধ করে রুমকি।
কয়েকদিন ধরেই সন্দীপ বলছিল,' তুই তো এখন সেকেন্ড আইডেনটিটি নিয়েই ব্যস্ত। আচ্ছা তোর বর আগে না বন্ধু আগে?
' আমার বাবলি আগে,তারপর আমার আমি আর তারপর অন্য সব।'
ওর জবাব শুনে একটু থমকে গেছিল সন্দীপ। হয়ত রুমকির এই বুদ্ধিমত্তাই অনায়াসে জয় করে ফেলতে পারে অনেক পুরুষের মন। তবুও নিজেকে সামলে বলে,' আরে সেসব নয় আমি বলছি কার সাথে আগে আলাপ হয়েছিল তাই শুনি? মানে আমি না তোর হাবি?'
' অবশ্যই তুই। বাট হোয়াই ডু ইউ কমপেয়ার উইথ হাবি? খুব বোকা বোকা প্রশ্নটা বুঝলি সন্দীপ। বন্ধু একটা খোলা জানলা অনেকটা মুক্ত আকাশ। বন্ধুত্বের মধ্যে কোন চাওয়া পাওয়া ইগো থাকবে না।'
' আমি কি তেমন বন্ধু?'
' ভেবে বলব,এখনই কিছু বলতে পারছি না।'
আবার বোকা বনেছিল সন্দীপ। বলেছিল তবুও 'কেন?'
' অনেক বছর আগে হারিয়ে গেছিলি। তারপর হঠাৎই উদয়। প্রথমটা ঠিক ছিল তারপর একটু প্রেম প্রেম ভাব তোর। ঠিক বুঝতে পারছি না। তাই আগে দেখি আরেকটু ভালো করে তারপর বলব।'
' একদিন দেখা কর না। অনেকদিন নির্ভেজাল আড্ডা মারিনি। আজকাল তোকে তো সেভাবে পাওয়াই যায় না। সব সময় ব্যস্ত। আমার খোলা জানলাটাকে একদম বন্ধ করে দিয়েছিস। বড্ড হাঁফিয়ে উঠি রে,সংসারে তো তেমন করে সুখ পেলাম না। তোর সাথে কথা বলেই একটু ভালো থাকি।'
সন্দীপকে না করতে পারেনি কেন যেন রুমকি। এই কয়েকমাস সন্দীপ নানা ভাবে চেষ্টা করেছে ওর মন ভালো রাখতে। কখনও রুমকির কিছু কাজও করে দিয়েছে। তাই আজ মুনিয়ার বাড়ি যাবে বলে অনেকটা সময় হাতে নিয়ে বেরিয়েছে। মুনিয়ার ওখানে অতটা সময় হয়ত না থাকলেও হত। কিন্তু পরিস্থিতি এমন হয়ে গেল হঠাৎ কিছু করার নেই।
যাক কিছুটা হাল্কা লাগছে এখন। সন্দীপ একটা সিগারেট বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে।
' নাহ্ খাব না মুড নেই আজ। একটু কন্ট্রোল করছি। ব্যাপারটা বাজে।'
-' কেন বর জেনে ফেলেছে?'
-' জানলেই বা কি ওসব ভাবি না।'
-' কেন ও খায় না?'
-' নাহ্ রে,ঐ মাঝে মধ্যে একটু আধটু ড্রিংকস। আসলে আমারই প্রবলেম হচ্ছে।'
সন্দীপের কেন যেন আজকে রুমকিকে অন্যরকম লাগে। বেশ তো লাগত আগে হাতে গ্লাসে পানীয়,ঠোঁটে সিগারেট। সুখী সংসারের মধ্যেকার ছিদ্রগুলো দেখতে বেশ লাগে সন্দীপের। তখনই মনে হয় ও শুধু অসুখী নয় সারা পৃথিবীটা দাম্পত্যের অসুখে ভরে গেছে। সাজানো গোছানো দাম্পত্যের মাঝে দূরত্বের ছড়াছড়ি। সুখী সংসারের আড়ালে অসুখের চালচিত্র। আগে রুমকিকে বেশ নষ্ট মেয়ে বলে মনে হত। আজ যেন রুমকি একটু সাবধানী। দূরত্ব মেপে চলেছে নিপুণ হাতে।
কথার জাল বিছোয় সন্দীপ ও জানে রুমকি খুব কবিতা শুনতে ভালোবাসে তাই নিভৃত কোণে।
'তোর ঠোঁটটা আজ ভীষণ পুরুষ্ঠু,যেন কোন শিল্পী তুলি দিয়ে যত্নে এঁকেছে রঙটা। ইচ্ছে করে যদি একবার স্পর্শ করতে পারতাম তোর ঠোঁটের রঙ। মাখতাম আমার মনের সাদা ক্যানভাসে। ল্যামিনেশন করে রাখতাম যত্নে।'
রুমকির দিকে তাকায় সন্দীপ বোঝার চেষ্টা করে ওর অনুভূতির গভীরতা।
রুমকি হাসে,' আমি তুলি দিয়ে ঠোঁট এঁকে এলাম তোর সাথে দেখা করব বলে। লিপস্টিক ব্যাগেই আছে দাঁড়া তোর শার্টটা খোল বুকে মাখিয়ে দিই কিছুটা।'
-' উঃ দিলি তো মুডটা নষ্ট করে। তোরা মেয়েরা বড় নিষ্ঠুর।'
-' কটা মেয়েকে এমন কথা বলেছিস? তোর বৌকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। যার স্বামীর এত প্রেম,তার সংসারে অপ্রেম ঢুকল কোথা দিয়ে।'
-' সবাই সব বোঝেয়না রে। দাঁড়া তোকে একটা কবিতা শোনাই। তোর প্রিয় কবির।
তুমি সাহসিনী,
তুমি সব জানলা খুলে রাখো
মধ্যরাত্রে দর্পণের সামনে তুমি
এক হাতে চিরুনী
রাত্রিবাস পরা এক স্থির চিত্র
যে রকম বতিচেল্লি এঁকেছেন:
ঝিল্লীর আড়াল থেকে
আমি দেখি তোমার সুটাম তনু
ওষ্ঠের উদাস-লেখা
স্তনদ্বয়ে ক্ষীণ ওঠা নামা
ভিখারী বা চোর কিংবা প্রেত নয়
সারা রাত আমি থাকি তোমার প্রহরী
তুমি সব জানলা খুলে রাখো
মধ্যরাত্রে দর্পণের সামনে তুমি
এক হাতে চিরুনী
রাত্রিবাস পরা এক স্থির চিত্র
যে রকম বতিচেল্লি এঁকেছেন:
ঝিল্লীর আড়াল থেকে
আমি দেখি তোমার সুটাম তনু
ওষ্ঠের উদাস-লেখা
স্তনদ্বয়ে ক্ষীণ ওঠা নামা
ভিখারী বা চোর কিংবা প্রেত নয়
সারা রাত আমি থাকি তোমার প্রহরী
এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল সন্দীপের দিকে রুমকি প্রতিটা কথা ছুঁয়ে যাচ্ছিল ওকে। কি অসাধারণ অনুভূতি প্রতিটা শব্দে। এমন কবিতা যদি কোনদিন ওকে প্রবাল শোনাত!
কবিতা শেষ হতেই বলে,' সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ককটেল। ওহ্ অসাধারণ, অসাধারণ।'
রুমকির হাতটা নিজের হাতে ধরে সন্দীপ। হঠাৎই কেমন যেন অস্বস্তি হয় ওর বুঝতে পারে সন্দীপের হাতটা বন্ধুত্ব পেরিয়ে আরও এগিয়ে আসতে চাইছে।
কেমন যেন মনটা অস্থির হয়ে ওঠে রুমকির। হঠাৎই ফোনটা বেজে ওঠে।
-'একমিনিট আমি আসছি। হ্যাঁ মা, এই তো আসছি আমি। কি বাবলি খুব কাঁদছে? বাবলি সোনা এই তো মাম্মা আসছে,তোমার জন্য অনেক চকোলেট আনব।'
বাড়ি এসে বারবারই হাতটা ধুতে ইচ্ছে করে রুমকির। অথচ সন্দীপকে অনেকদিন বাদে দেখে জড়িয়ে ধরেছিল আনন্দে হাত মিলিয়েছিল সেই প্রথম দিন তবে আজ কেন এমন মনে হচ্ছে? বারবার একটা অস্বস্তি হচ্ছে সন্দীপের আঙুলগুলো যেন ওর হাতটাকে শক্ত করে চেপে ধরেছিল।
বাবলির ফোলাফোলা চোখ দুটো দেখে মন খারাপ হয় রুমকির। আজকে নাকি খুব কাঁদছিল মেয়েটা।
*************************
উইকএন্ডে রাণা একটু কাছাকাছি একটা বাঙালী অ্যাসোসিয়েসন আছে সেখানে যায় ওখানে রাণার গানের বেশ কদর হয়েছে। সত্যি বোধহয় গান কবিতা দিয়ে সবার মন জয় করা যায়। কি করবে একা একা তাই মাঝে মাঝে এখানে চলে আসে। মাঝে মাঝেই গেট টুগেদার হয়,খাওয়াদাওয়া আর অনুষ্ঠান হয়।
এখানে সেভাবে দিনে দিনে অনুষ্ঠান হয় না সবার সুবিধা দেখে উইকএন্ডেই অনুষ্ঠান হয়।
পঁচিশে বৈশাখ কবেই চলে গেছে তবুও সবার ইচ্ছেতে বেশ জোরালো রিহার্সাল চলছে। মুনিয়াকে ফোনেই গান শোনায় রাণা।
' তোমরা তো জমে আছ একদম। রাণা তো বাথরুম সিঙ্গার বলেই নিজেকে ভাবত এখন হঠাৎই স্টেজে উঠবে রাণা। সত্যিই খুব ভালো।'
-' আর বলিস না এরা ছাড়বে না তোকে তো অনিরুদ্ধ আর মৌমিতার কথা বলেছি। আমাদের কৃষ্ণনগরের ছেলে। ওখানে সেভাবে আলাপ ছিল না এখানে এসে আলাপ।'
-' খুব ভালো জার্মানিতেও কৃষ্ণনগর। এভাবেই ভালো থাকতে হবে। কিছু করার নেই।'
রবিবার অনুষ্ঠানের দিন ওখানেই খাওয়াদাওয়া। রাণা সকাল থেকেই মুনিয়াকে দুবার শুনিয়েছে গানটা। বেশ ভালোই হয়েছে বলেছে মুনিয়া। খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে ওরা। এখানে অনুষ্ঠান মানেই খাওয়াদাওয়া, হৈ চৈ,গল্প আনন্দ আর মোটামুটি ফ্যাশন শো। কে কত ভালো সাজতে পারে।
মুনিয়াকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে রাণা কি পরবে?
-' অবশ্যই পাজামা পাঞ্জাবী পরবি। দুটো পাঞ্জাবী তো দিয়েছি সাথে। তার বেশিও হতে পারে। তুই তো পছন্দ করে নিলি।'
অসহ্য এই কাজটা,এই সব মুনিয়াই সামলাত। ও শুধু পরে বেরোত। সাজানোর দায়িত্ব মুনিয়ার।
ওখানে পৌঁছেই দেখা হয়ে গেল অনিরুদ্ধর সঙ্গে।
' কি ভালো লাগছে ভাই রাণা তোকে!'
অবাক হয়ে যায় অনিরুদ্ধর পাঞ্জাবীটা দেখে রাণা। এই ধরনেরই তো একটা পাঞ্জাবী ওর ছিল মানে পুতুল দিয়েছিল। কই ওটা তো খুঁজে পেল না।'
কথা বলতে বলতে মৌমিতা এসে পাশে দাঁড়ায়। আজ মৌমিতাকে দেখে মুনিয়ার কথা খুব মনে হল রাণার। ঠিক ওদের মতই কাপল ড্রেস পরেছে ওরা।
মৌমিতা আসতেই কলার তোলে অনিরুদ্ধ,' এবার বল কেমন লাগছে আমাদের?'
' খুব ভালো লাগছে দুজনকে,নিশ্চয় বুটিক কালেকশন।'
-' হ্যাঁ রাণাদা,তবে কৃষ্ণনগরের। এখানের নয়। নতুন একটা বুটিক সুশ্রী বুটিক। খুব ভালো কালেকশন। আমরা তো মোটামুটি চার সেট ড্রেস এনেছি দুর্গা পুজো,সরস্বতী পুজো পর্যন্ত নিশ্চিন্ত। তোমার লাগলে দেখতে পার ফেসবুকে আছে দাদা।'
অনুষ্ঠানের ছোট ছোট ভিডিও মুনিয়াকে পাঠাতে পাঠাতে বলে,' আজকে অনিরুদ্ধ আর মৌমিতা আমাদের মত কাপল ড্রেস পরেছিল । ছবিতে দেখ। একদম আমাদের মত। বলল সুশ্রী বুটিক থেকে কিনেছে।'
মুনিয়ার চিন্তার জাল কেটে যায় হঠাৎই.. 'ওহ্ আচ্ছা। সত্যিই খুব সুন্দর লাগছে।'
-' মিস্ ইউ মুন তুই থাকলে আমাদেরকেও সবাই দেখত।'
মুনিয়া বালিশে মুখ ডোবায় গোল পৃথিবীর ঘুরপাকের ঘূর্ণীতে ঘুরতে ঘুরতে ঝুমকার পাঞ্জাবী পৌঁছে গেছে জার্মানীতে আর প্রমোদ পৌঁছে গেছে এখানে। অথচ ও কিন্তু রাণার সঙ্গে ঐ পাঞ্জাবীটা দেয়নি,এখানেই আছে ওটা।
**************************
সময় যে কিভাবে জাল বুনে যায় নিজের খেয়ালে কে জানে। কখন কাকে এনে কার সামনে দাঁড় করায় কেউ বলতে পারে না। পুতুলের দেওয়া পাঞ্জাবী থেকে একদিন লেবেলটা খুলে ফেলে দিয়েছিল ছুঁড়ে রাণার অলক্ষ্যে আজ সেই লেবেলই উড়তে উড়তে কাটা ঘুড়ির মত উড়ে গেছে জার্মানীতে। সুশ্রী বুটিক নামটা পরিচিত হয়ে গেল অবশেষে রাণার কাছে।
অবশ্য এতে মুনিয়ার কোন হাত নেই বরং ও যদি কোনদিন বলত ঝুমকার বুটিকের পাঞ্জাবী এটা তাহলে রাণা হয়ত গায়েই দিত না ওটা। প্রথম প্রেমের তিক্ততা এখনও মনে মাখা রাণার। আর মুনিয়ার একরাশ ঘৃণা আর দুঃখ সেই ছেলেটার প্রতি যে ওকে ভালো থাকতে দেয়নি। মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
মুনিয়ার সাথে অনেকক্ষণ কথা শেষ হয়ে গেছে,ভারতীয় সময় অনুযায়ী এখন অনেক রাত মুনিয়া নিশ্চয় ঘুমের দেশে। রাণা ফোনটা চেক করে,নিজের গাওয়া গান শোনে আবার ঘুরিয়ে। সেই কবে স্কুল কলেজের পর আর তেমন করে গান গাওয়া হয়নি এতদিন বাদে সবার উৎসাহে পুরোনো অভ্যেস নাড়াচাড়া করা। অনিরুদ্ধ আর মৌমিতার ছবিটা দেখে আবার। মৌমিতা মুনিয়ার বয়সীই হবে,হাউসওয়াইফ। অনিরুদ্ধর সাথে চলে এসেছে বিয়ের পরই এখানে। বেশ আছে দুটোতে মিলেমিশে। মুনিয়াকে খুব মিস্ করে রাণা। ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে সুশ্রী বুটিকের পেজটা খোঁজে রাণা,ওদের কৃষ্ণনগরে এমন বুটিক কোথায়? মাকে বলে দেবে তাহলে। মা তো বারোমাস কেনাকাটা করা। ওদের বড় পরিবার কারো না কারো অনুষ্ঠান লেগেই আছে।
মুনিয়াকে সাজাতে খুব ভালো লাগে রাণার,অবশ্য মুনিয়া বেশি ওয়েস্টার্ন আউটফিট পছন্দ করে। অফিসে যেতে ওটাই সুবিধা। তবে সিল্কের শাড়ি ওর খুব পছন্দের। রাণার পছন্দ মুনিয়া ভালোবাসে পছন্দ করে সারপ্রাইজ গিফ্টও।
ওহ্ বাবা সুশ্রী সার্চ করতে গিয়ে একগাদা নাম আসছে।
বাইরে চুপচাপ পরিবেশ, নিস্তব্ধতা ঘুমের দেশে নিয়ে যেতে ডাকে রাণাকে। হঠাৎই সুশ্রী বুটিক চোখে পড়ে এই তো অনিরুদ্ধ আর মৌমিতা লাইক করেছে পেজটা। কিন্তু লোকেশন তো কৃষ্ণনগর নয় কলকাতা। কৃষ্ণনগর শুনে সত্যিই ওর কৌতূহল হয়েছিল। এই সুদূর প্রবাসে বসেও কৃষ্ণনগর মিস্ করে রাণা। ওখানকার কাউকে কাছে পেলে মনে হয় আপনজন। যেমন অনিরুদ্ধ আর মৌমিতাকে দেখে মনে হয়েছে।
বাহ্ বেশ সুন্দর সব কালেকশন,রাণা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। সামনেই তো মুনিয়ার জন্মদিন তেমন হলে এখান থেকে একটা ভালো শাড়ি খুঁজবে মুনিয়ার জন্য। ওরা তো সিল্কেও হ্যান্ডপেন্টিং করছে এই তো ছবি। মুনিয়ার খুব লাল পছন্দ এমন একটা শাড়ি তো থাকতেই পারে ওর জন্মদিনের সারপ্রাইজ গিফ্টে। শাড়িটার স্ক্রীনশট নিয়ে রাখে রাণা। মুনিয়াকে দেখাবে? না না এটা সারপ্রাইজ থাকবে বরং,হঠাৎই এমন একটা শাড়ি পাঠিয়ে ওকে বেশ অবাক করে দেওয়া যাবে। পেজটা লাইক করে রাণা। এমনিতে প্ল্যানিং তো থাকেই জন্মদিন নিয়ে,এবার দূর থেকে যতটা পারা যায় দেখবে। ঐ দিনটা মেয়েটা একদম একা থাকবে ভাবলেই মনটা খারাপ হল রাণার। ওর বাবা মাও আসতে পারবেন না শুনেছে। যাক ভিডিও কলিংয়ে সেলিব্রেশন চলবে এবার সবাই মিলে একসাথে।
*****************************
জুনির সাথে অনেকদিন দেখা হয় না। কেন যেন কদিন ধরে ওর কথা খুব মনে হচ্ছে মুনিয়ার। জুনির সঙ্গে কথা বলে নিমেষেই মন ভালো করত একটা সময় এখন জুনি অফিস আর বাচ্চা সামলে নাকাল।
প্রথম মা হয়েছে অনেক কিছুই বোঝে না। তারপর ছেলেটা খুব ভুগছে।
সেদিন বিকেলে হঠাৎই জুনির কাছে যায় মুনিয়া।
' আরে মুনিয়া পাখি! আয় বুকে আয়। কতদিন দেখি না তোকে। এত রোগা হয়ে গেছিস কেন? খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছিস নাকি বিরহে?'
' হ্যাঁ রে তাই তো এলাম তোর একটু আদর খেতে। সারপ্রাইজ ভিজিট।'
জুনির ওখানে গিয়ে পুচকেটাকে নিয়ে অনেকটা সময় কেটে গেল মুনিয়ার। কি সুন্দর ছটফটে হয়েছে।
বুঝতে পারল জুনির সময় কি ব্যস্ততায় কাটছে। জুনি ছটফট করে এদিক ওদিক তার মাঝেই বকবক করে নিজের ছন্দে। পুচকেটা গড়িয়ে গড়িয়ে খাটের এ মাথা ও মাথা করছে।
' দেখেছিস তো কেমন পাজি হয়েছে এক মুহূর্তে ডিগবাজি খাবে খাট থেকে বলে রেডি হয়ে আছে। '
'তুই অফিস করছিস কি করে? একে ছেড়ে?'
' আয়া আছে একজন। তোর হলে তুই বুঝবি তখন।'
-' আমার কথা ছাড়,আমি এখন লঙ ডিসট্যান্স রিলেশনে আছি। এখনও প্রেম চলছে সংসার সেভাবে করলাম কই?'
মুনিয়ার শেষ কথাটায় একটা করুণ সুর বাজে।
' সব হবে সোনা,এই তো দেখতে দেখতে কয়েকটা মাস হয়ে গেল। পুজোতে রাণা আসবে তো?'
-' জানি না রে,কি হবে? ও বলছিল একদম সামারে আসবে তখন আমাকে নিয়ে যাবে আমি কিছুদিন থেকে আসব।'
-' সামার! সে তো অনেক দেরি! এতদিন বরকে ছেড়ে থাকবি কি করে? ও না এলে তুই চলে যাস। অবশ্য ঐ সময় ওখানে খুব ঠান্ডা। তোর ঘোরা হবে না ভালো করে। তবে বরের কাছে যাবি এটাই তো মজার। আমি হলে অম্লানকে ছেড়ে থাকতে পারতাম না।'
একমনে বকবক করে যাচ্ছে জুনি। মুনিয়া আনমনা হয় ওকে কি বলবে প্রমোদের কথাটা?
কলিংবেল বাজে জুনি ছুটে যায়,' এক মিনিট অম্লান এল বোধহয়। তোকে দেখে খুব খুশি হবে।'
অনেকটা সময় আড্ডা দিলেও আর কথাটা বলা হল না মুনিয়ার। একটা সময় বাড়ি ফিরে এল। রাণা চলে যাবার পর অনেক প্ল্যানিং করেছিল কি কি শিখবে আর করবে। সবটাই জলে গেছে,কোনকিছু যেন ভালো লাগে না। ওদিকে ডল মাঝেমাঝেই বলে,' ও বৌদিভাই তুমি ড্রাইভিং শিখলে? আমি যখন যাব তোমার কাছে তখন তুমি গাড়ি চালাবে আমি ঘুরব।'
' দাদা তো বলেছে,তুমি ড্রাইভিং শিখলেই গাড়ি আসবে। সত্যিই তোমার কি অসুবিধা এখন অফিস যেতে। দাদাটাও নেই এখানে।'
-' তাতে কি হয়েছে আমি তো দিব্যি যাচ্ছি অফিসে। দাঁড়া শিখব ড্রাইভিং। তোর ড্রাইভারের খবর কি বল? কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তোকে? ওর ক্যাম্পাসিং হল? ও আরেকটু পড়াশোনা করতে চায় গো।'
- 'হম বুঝেছি, এখনই কলকাতা ছাড়তে চায় না তোকে ছেড়ে যেতে হবে বলে। যাক বিয়েটা দাদাভাই এলে করিস।'
-' কি যে বলো না! তুমি কদিন ছুটি নিয়ে এসে ঘুরে যাও না। মা বলছিল তুমি খুব রোগা হয়ে গেছ।'
-' হ্যাঁ যাব দাঁড়া ছুটি পেলেই।
নাহ্ এবার ড্রাইভিংটা শিখতেই হবে নাহলে অন্ততঃ যদি স্কুটি চালানোটাও শিখত তবে সহজ হত অফিস যাওয়া।
***************************
অনেকক্ষণ বাদে হোয়াটস অ্যাপটা খোলে ঝুমকা। অনেকগুলো অর্ডার এসেছে আজকাল সব সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে মাঝে মাঝে তবুও কাজই ওকে ভালো রেখেছে। দিদির মেসেজটাও দেখে,ফেসবুক খুলিস দেখবি তোর স্বপ্ন সফল হয়েছে।
-' কি স্বপ্ন রে দিদি?'
-' তোর জামাকাপড় বিদেশেও যাচ্ছে আজকাল। ভাবতে পারছিস তোর হাতের কাজ বিদেশে গেছে! আমার তো খুব আনন্দ হচ্ছে। ওরা যখন নিয়েছে তখন তো বলেনি। তাহলে আরেকটু বেশি দাম চাইতাম।'
-' দিদি লোভ করতে নেই,আমি জানি বেশি লোভে কি হয়।'
তাড়াতাড়ি ফেসবুকে যায় ঝুমকা ওর বুটিকের পেজে পোস্ট করেছে কাপল ড্রেস পরা ছবি একটা আরেকটা সিঙ্গেল সিঙ্গেল হাজব্যান্ড ওয়াইফ। কি সুন্দর জায়গাটা! বিদেশের জায়গা,দেখে যেন মনে হচ্ছে স্বর্গ। যে বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে তুলেছে সেই বাড়িটাও তো খুব সুন্দর।
মৈনাক ওকে কত স্বপ্ন দেখিয়েছিল ওকে নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরবে। হ্যাঁ হয়ত বিক্রি করে দিত আরবে নিয়ে গিয়ে। আবার চমকে ওঠে ঝুমকা। যাক ও না গেলেও ওর সৃষ্টি বিদেশে পা রেখেছে। রিভিউ দিয়েছে সবাই খুব প্রশংসা করেছে। সুশ্রী বুটিককে ধন্যবাদ জানিয়েছে।
মনটা আনন্দে ভরে যায় ওর,আবার দিদিকে ফোন করে।
****************************
মুনিয়ার বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর প্রমোদের সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে রুমকির। কেন এমন করল প্রমোদ? ওকে কিছু বলা দরকার। মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে এখনও। ঠিক আছে এখনও তো প্রমোদ ওকে সরি বললে ভুল স্বীকার করলে অনেকটা হয়ত ভালো থাকতে পারে মুনিয়া। একটা ভুল বোঝাবুঝির দেওয়াল অযথা ভারাক্রান্ত করছে মেয়েটাকে। কিন্তু ঠিক সুযোগ হয় না। নিজের ব্যস্ততা অফিস সব নিয়ে মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা দিন।
প্রবালকে বলেছিল ব্যাপারটা। প্রবালের শুনে খুব খারাপ লাগল আসলে মুনিয়া ওকে দাদা বলে সুতরাং একটা সফ্ট কর্ণার তো আছেই তবুও বলল,' তুমি এইসবে থেক না। দুজনেই এখন ম্যারেড হ্যাপি আছে কি দরকার পাস্ট নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার?'
-' না প্রমোদ হয়ত জানেই না মুনিয়া মরতে বসেছিল।'
-' জানলেই বা কি এসে যায়? এখন কি লাভ হবে কিছু? থাক সব একরকম। যেমন চলছে চলুক। তুমি তো জান মেসোকে। এখনও বাড়িতে রিভলবার রাখে। মুনিয়া বেঁচে গেছে ঐ ফ্যামেলিতে যায়নি বলে। সারাদিন শুধু টাকা আর জমি এই নিয়ে আছে।'
পাশ ফেরে রুমকি ভাবে তুমিও বা কম কি। তোমারও তো সারাদিন টাকার চিন্তা। রুমকি কি ভালোবাসে রুমকির কি ভালোলাগা কিছুই আজকাল আর ভাব না। কতদিন কোথাও যাইনি আমরা একসাথে।
তোমার থেকে সন্দীপ অনেক ভালো কথা বলে। শুধু ওর বাড়াবাড়ি টা ইদানিং কেন যেন ভালো লাগে না রুমকির। সন্দীপের চোখের বন্ধুত্বের ভাষাটা কেমন যেন পাল্টে গেছে। নিজেকে আগলাতে চায় রুমকি তবুও সন্দীপের কথা আর কবিতা ওকে আকর্ষণ করে।
সেদিনের পর আর ভাবীদের ওখানে যাওয়া হয়নি প্রমোদের যদিও ভাইয়া ভাবী দুজনেই ওর হোয়াটস অ্যাপে আছে। ওকে আসতে বলেছে বারবার তবুও ভাবীকে কেমন যেন লাগে ওর। খুব বুদ্ধি রাখে,ওর কাছ থেকে জানতে চায় মুনিয়ার কথা। কিন্তু ও কি বলবে। এই মেয়েটাকে পাঁচবছর ও ভালোবেসেছে। বিয়ে হবার কথা ছিল এমন কি লিভ ইন করবেও ভেবেছিল।
সামনের সপ্তাহে ভাইয়ার বার্থডে বারবার বলে দিয়েছে ভাইয়া ও যেন চলে আসে। কেউ আসবে না ঐ একটু গল্প হবে। যেতেই হবে ওকে,কিছু করার নেই। তাই সেদিন অফিস থেকে বেরিয়ে কিছু গিফ্ট কিনবে বলে বেরিয়েছে। হঠাৎই রাস্তায় মুনিয়াকে দেখে জানলা দিয়ে। কতদিন এই শহরে এদিক ওদিক ঘুরতে গিয়ে ওকে খুঁজেছে কিন্তু পায়নি। গাড়িটা কি থামাতে বলবে? তাহলে এদিকেই ওর অফিস। সাদা শার্ট আর নীল ডেনিমে বেশ লাগছে মুনিয়াকে। প্রমোদের চোখ ওকে ঘুরে দেখে আবার। একদিন যে ছিল বড় কাছের আজ সে কতদূরের কিন্তু কেউ কাউকেই ভুলতে পারেনি। তাই তো মুনিয়ার সেদিন শরীর খারাপ লেগেছিল। যেতে যেতে হঠাৎই প্রমোদের মনে হল গাড়িটা থামিয়ে ওকে নিয়ে ড্রপ করে দিলে ভালো হত। কে জানে কতক্ষণ এভাবে রাস্তায় থাকবে দাঁড়িয়ে।
কিন্তু মুনিয়া কেন উঠবে ওর গাড়িতে?
পরের সপ্তাহে ভাইয়ার বার্থডেতে এসে আর ভাবীকে অ্যাভয়েড করতে পারেনি প্রমোদ। প্রবাল বাড়িতে না থাকায় তখন সোজাসুজি মুনিয়ার কথা জিজ্ঞাসা করে প্রমোদকে রুমকি। বলেও দেয় ও মুনিয়ার কাছে সবটা শুনেছে। মুনিয়া সেদিন খুব ভেঙে পড়েছিল সেটাও বলে। প্রমোদ মাথা নিচু করে,' মুঝে মালুম হ্যায় সব। বন্ধুদের কাছে শুনেছি। অনেকেই বাজে কথা বলেছে আমাকে।'
-' তাহলে কেন এইসব করলে ওর সাথে? বল আমাকে? তোমার ভাইয়াও জানে এটা। আমাকে বারণ করেছিল। কিন্তু ওর শুকনো মুখটা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। মেয়েটা খুব জলি। তারপর ওর হাবি এখানে নেই।'
প্রমোদের মনে হয় সেইজন্য বোধহয় সেদিন একা দাঁড়িয়েছিল ওখানে ক্যাবের জন্য। ভাবতেই পারেনি এখানে এসে এমন কিছু ফেস করতে হবে ওকে। এত বছর যে শহরে আসেনি হঠাৎই কাজে আসতে হল এখানে। আর ভাবীর বাড়িতেই দেখা হয়ে গেল মুনিয়ার সাথে!
'ও বহত বাত,বলব তোমাকে সব পরে কখনও ফোনে। আমাদের সব কথাই তো তুমি জান দেখছি। ওকে বলব সব। ভাইয়া আসছে গাড়ির আওয়াজ আসছে।'
****************
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। সেদিন অফিস থেকে বেরোতে বেশ দেরি হয়ে গেছে মুনিয়ার। তারপর সমানে অঝোরে বৃষ্টি। এই দিনগুলোতে খুব মন খারাপ হয় ওর। বৃষ্টি আর মেঘলা দিন না পসন্দ মুনিয়ার। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেছে ক্যাব বুক করার হয়নি। সবে একটা করেছে কিন্তু অনেকটা পরে আসবে দেখাচ্ছে। এমনিতেই প্রায় আধভেজা হয়ে গেছে।
হঠাৎই একটা গাড়ি ওর একদম গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। অবাক হয় মুনিয়া, একটু ভয়ও পায়। রাস্তাটা মোটামুটি ফাঁকা। অদ্ভুত তো,এভাবে গাড়িটা এখানে এসে দাঁড়ালো কেন? পেছনের দরজাটা খুলে দেয় কেউ।
মুনিয়া সামনের দিকে পা বাড়ায় তাড়াতাড়ি। বলা যায় না কে কি মতলবে আছে। যদিও এখানকার পরিবেশ ভালো। তবুও হঠাৎ কত ঘটনাই তো ঘটে যায়।
গাড়িটাও একটু এগিয়ে যায় তারপর সামনের জানলার কাঁচ নামে.....মুনিয়া আআআআ,বাবলি মাসিকে ডাক তো।
অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে মুনিয়া, বৃষ্টিতে তো কিছুই বুঝতে পারেনি। ওহ্ রুমকিদি। যাক ভালো হয়েছে। ওর ক্যাবটা এবার ক্যানসেল করবে। কখন বুক করেছে। ওদিক থেকে আবার আওয়াজ আসে..
'পেছনের দরজাটা খোলা উঠে আয় জলদি। ভিজে যাচ্ছে সব। জলদি মুনিয়া।'
তাড়াতাড়ি করে ছাতাটা বন্ধ করে উঠে বসে গাড়িতে কিন্তু তারপরেই মনে হল এমন যদি জানত তাহলে কখনই উঠত না গাড়িতে। দরকার হলে আজ হেঁটেই বাড়ি ফিরত।
ও উঠে বসা মাত্র গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। বাবলি খুশিতে হইহই করে ওঠে...মাসি আমি তোমার কাছে আসব। কিন্তু পেছনের সিটের অন্ধকারে এককোণে যে বসে আছে তাকে দেখে মুনিয়ার আর কোন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। বরং বলতে ইচ্ছে করছে রুমকিদিকে বাবলিকে পেছনে পাঠিয়ে এই শয়তানটাকে সামনে বসিয়ে নাও রুমকিদি।
তুমি তো সবটা জান তাহলে কেন আমাকে দেখে গাড়ি থামালে? আমিও খেয়াল করিনি এত বৃষ্টিতে তাহলে উঠতামই না। কথাগুলো মনে মনে ভাবলেও বলতে পারে না মুনিয়া। প্রমোদকে হয়ত একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়ে যাবে। তাই বলে,' তুমি বাড়ি যাচ্ছিলে তো রুমকিদি, আমাকে বরং পরের রাস্তার বাসস্টপে নামিয়ে দিয়ো। ওখানে বাস পেয়ে যাব। অযথা অতটা ঘুরে ঘুরে যাবে কেন?'
-' তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে,কোথায় পাবি এখন বাস। আর হঠাৎ নামবি বা কেন? এনি প্রবলেম? তোকে নামিয়ে দিয়ে আমরা ফিরে যাব।'
সবটা বুঝেও চুপ করে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই রুমকির। এত বৃষ্টিতে ওকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে প্রথম দেখেছিল প্রমোদই। রুমকির চোখে পড়েনি। প্রমোদই বলেছি
' ভাবী তুম মুঝে ছোড় দো ইধার। মালুম হোতা মুঝসে প্রবলেম। আমি নেমে গেলে কোন সমস্যা থাকবে না। ও একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার বদলে আমার থাকা ভালো।'
প্রমোদ যে এভাবে উত্তর দিতে পারে ভাবেনি মুনিয়া। ও চুপ করে যায় আর কিছু বলে না। রুমকি গাড়ি চালাতে চালাতে বলে, 'বৃষ্টিতে খুব চাপ নিয়ে ড্রাইভ করছি,মাথা খারাপ করিস না চুপ করে বোস। প্রমোদ তুম ভী।'
গাড়ি নিজের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, বাবলি সিটের ওপরে উঠে বসে পেছনে তাকিয়ে বকবক করতে থাকে মুনিয়ার সাথে। অগত্যা মুনিয়াকে কথা বলতে হয়।
ওদের কথার মাঝে কখনও ঢুকে পড়তেও হয় প্রমোদকেও বাবলি ওকেও বলে আঙ্কেল শুনো না। ওর এই শুনো না ডাকটা খুব ভালো লাগে প্রমোদের।
' আঙ্কেল তোমার ঐ ম্যাজিক বক্সের চকলেট দাও মাসিকে। আমাকে যে দিয়েছো। নিকালো জলদি।'
ম্যাজিক বক্স কথাটা কানে ধাক্কা দেয় মুনিয়ার, প্রমোদের কাছে এখনও ম্যাজিক বক্স আছে? একটা সময় ঐ ম্যাজিক বক্সে যখন তখন থাবা বসাত মুনিয়া। ইচ্ছেমত চকলেট বের করে মুখে ভরত।
প্রমোদের কাছে কোন উত্তর না পেয়ে বাবলি আবার বলে,' আঙ্কেল ম্যাজিক বক্স নিকালো না।'
প্রমোদ ব্যাগ থেকে একটা বাক্স বের করে বাবলির হাতে দেয়। ওকে বলে,' তুম দে দো মাসিকো, আর তুমিও নিয়ে নাও। তোমার মাসি আমার সঙ্গে বাত করছে না দেখেছ না। আমি দিলে নেবে না।'
রাগে মুনিয়ার গাল দুটো গরম হয়ে যায়। কি নির্লজ্জ ছেলেটা! ও কি মাঝের দিনগুলো ভুলে গেছে?
কি কথা বলবে ওর সাথে মুনিয়া? হাই প্রমোদ নাইস টু মিট ইউ। এতদিন বাদে তোমাকে দেখে আমার মন ভরে গেছে। এসো ভাব করি দুজনে আবার।
গাড়ি চালাতে চালাতে রুমকি আনমনা হয় একটু হাসিও ফোটে ঠোঁটের কোণে। সত্যিই খুবই খারাপ সিচুয়েশন। মুনিয়া বোধহয় মনে মনে ওর মুন্ডুপাত করছে। সত্যিই বেচারা মেয়েটা। অথচ কিছু করার ছিল না ওকে এভাবে রাস্তায় দেখে কি করে চলে আসত ওরা?
বাবলি চকলেটের বাক্সটা খোলে,অবাক হয়ে যায় মুনিয়া এই বাক্সটা অনেকদিনের চেনা ওর সেই কলেজের সময় থেকেই এই বাক্সটাই তো আনত প্রমোদ। এখনও আছে এটা! হয়ত কিছু স্মৃতি পুরোনো চশমার মত থেকে যায় মানুষের কাছে কখনও কাজে লাগতে পারে এই ভেবে। না না হয়ত অনেক মেমরিজ আছে বলে এখনও ফেলেনি এটা। প্রমোদ কি ওকে মনে রেখেছে? হতেই পারে না। ওর শেষ কথাগুলো মনে পড়ে মনটা তিক্ততায় ভরে ওঠে মুনিয়ার।
বাবলি ততক্ষণে একটা চকোলেট খুলে নিজের মুখে দিয়ে ওর দিকে বাড়িয়েছে।
মুনিয়া বাবলিকে আদর করে,' বাবলি সোনা আমি চকলেট খাই না। তুমি বক্স বন্ধ করে বসে পড় মার অসুবিধা হচ্ছে।'
'খাওনা গো..প্লিজ।'
সত্যিই মহা মুশকিল,রাস্তার আবছা আলো বৃষ্টি ভেদ করে কাঁচের জানলায় উঁকিঝুঁকি মারছে ভেতরে আসার জন্য। তারমধ্যেই মুনিয়া বুঝতে পারে প্রমোদ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎই মুনিয়ার ফোনটা বেজে ওঠে স্ক্রীনে রাণার নামটা ভেসে ওঠে ফোনটা ধরতে ধরতে বাবলির বাড়ানো হাত থেকে চকলেটটা নেয় মুনিয়া। ইচ্ছে করছিল ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিতে। সেটা না করে ব্যাগের বাইরের পকেটে রাখল।
' পৌঁচেছিস?'
' না রাস্তাতে। যাচ্ছি এখন বাইরে খুব বৃষ্টি তাই দেরি হল। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাব। তারপর ফোন করব। এখন রাখছি।'
প্রমোদ বুঝতে পারে মুনিয়ার হাবি ফোন করেছে। তাহলে খুবই কেয়ারিং হাবি ওর। অতদূরে বসে খোঁজ রাখছে মিসেস কি করছে। কখন বাড়ি এল। মুনিয়ার হয়ত এমনি একজন হাবির দরকার ছিল। তবুও প্রমোদের জানতে ইচ্ছে করে খুব কতটা সুখে আছে মুনিয়া? যতটা সুখের স্বপ্ন দেখত একটা সময় ওর হাত ধরে অতটাই কি সুখে আছে মুনিয়া?
দেখতে দেখতে মুনিয়ার বাড়ি এসে গেছে। মুনিয়া নামার উদ্যোগ নিয়েছে। নামতে পারলেই তো বাঁচে অনেকক্ষণ সেটাই মনে হয়েছে। তবুও ভাগ্যিস বাবলিটা ছিল তাই ওর সাথে বকবক করে কিছুটা সময় কেটে গিয়েছে। নাহলে পেছনে সীটে বসে থাকা দুই অতিপরিচিত মানুষ অপরিচিতের মত বসে থাকত এতক্ষণ কি করে? কত কথাই তো মনে উঁকি দিয়ে গেছে তবুও কথা বলার কোন ইচ্ছাই জাগেনি মুনিয়ার মনে।
ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে,দরজা খুলে বাইরে বেরোয় মুনিয়া। বাবলিকে একবার জড়িয়ে ধরে সামনের দরজা খুলে। বাবলি লাফিয়ে ওর কোলে ওঠে। রুমকিও ততক্ষণে নিচে নেমেচে ড্রাইভিং সীট ছেড়ে,' আঃ একটু পা ছাড়িয়ে নিলাম। ওকে মুনিয়া আসি এখন যাক তোকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পেরে আমারও ভালো লাগছে। বাবলি নেমে আয় চল এবার বাড়ি যেতে হবে।'
বাবলিকে সীটে বসিয়ে দিতে যায় মুনিয়া। ওর মনে তখন একটা দ্বিধা কাজ করছে রাণা সবসময় বলে কেউ পৌঁছে দিতে এলে তাকে বাড়িতে আসতে বলতে হয়। অন্ততঃ একটু কফি অফার করতে হয়। অন্যসময় হলে তো ও ঠিক নিয়ে যেত টেনে রুমকিদিকে। বাট এখন কি করবে?
' মাম্মা আমি মাসির বাড়ি যাব একটুখানি। এখনি চলে আসব চলো না গো। মা চলো না....'
বাবলির কথা শুনে সত্যিই লজ্জা পায় মুনিয়া,' হ্যাঁ রে বাবলি তোর মাসিটা পচা হয়ে গেছে আমারই তো বলা উচিত ছিল। আসলে ভাবলাম রাত্রি হয়ে গেছে তাই বলতে পারছি না। রুমকিদি চলো কফি খেয়ে যাবে। বাবলি যখন বলছে চল।'
রুমকির গালে হাসির ছোঁয়া ওর কাছে এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে আর কানেকানে বলে,' তোর কফি খুব স্পেশাল,খেয়ে গেলেই হত। কিন্তু প্রমোদ ও কি করবে?'
তারপর একটু জোরেই বলে রুমকি,' থাক আজ নয় আরেকদিন আসব। বাবলি চল পাপা এসে যাবে তো।'
**************************
বাবলির বায়নার কাছে হার মানতে হল রুমকিকে কিন্তু প্রমোদকে কি বলবে? হঠাৎ প্রমোদই বলল,' ভাবী তুম যাও,মুঝে ফোন কর না হ্যায় কুছ। আমি গাড়িতেই আছি। জলদি এসে যেও।'
মুনিয়া যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল তবুও একটা দোটানা মনে রয়েই গেল। ঠাম্মার কথাটা খুব মনে হল কখনও শত্রুও যদি এসে দাঁড়ায় বাড়ির দরজায় তাকে ফিরিয়ে দিতে নেই। কিন্তু কি করবে ও?
তাড়াতাড়ি কফি বসিয়ে দেয় মুনিয়া। রুমকিকে বলে ফেলে,' আজ প্রমোদ যখন ছিল তোমার আমাকে তোলা উচিত হয়নি গো। তুমি বোধহয় বুঝতে পারছ না আমার সিচুয়েশনটা। ওর সাথে পাশাপাশি বসে এতটা আসা.. এ তো বোধহয় সিনেমাকেও হার মানায়। কেন জানি না আমার জীবনটা সিনেমার মত হয়ে যাচ্ছে সত্যিই আর পারছি না।'
বাবলি চকলেট নিয়ে ব্যস্ত মুনিয়া ওকে কুকি দেয় প্লেটে। মুনিয়ার মোটা টেডিটা ওর খুব পছন্দের।
' আচ্ছা মুনিয়া, তুই যদি প্রমোদের সাথে কথা বলিস একবার তাহলে কি হবে? ও তো তোর ক্লাসমেট ছিল। প্রেমে ব্রেকআপ হয়েছে আমি মানছি। বাট এখন তুই ম্যারেড হ্যাপি ওকে এত কিসের ভয়?'
' ভয় না দিদি,আই হেট হিম। ও রাণাকে নিয়ে জড়িয়ে অনেক কথা বলেছে আমার সম্বন্ধে। ওর জন্য আমি মরতে বসেছিলাম।'
-' মরাটা বাড়াবাড়ি করেছিস খুব,একদম ছেলেমানুষী ওটা। পোষায়নি গেছে যাক। তুই নিজের কাছে প্রেশাস। তোর থাকা না থাকা ও ঠিক করবে নাকি? বাট সত্যিটা জানলে আই থিঙ্ক ওকে ক্ষমা করতে পারবি।'
-' আমি জানতে চাই না আর কিছু রুমকিদি।'
-' ওকে সোনা। আজ আর সময় নেই, থ্যাঙ্কস বেবি ফর দ্য কফি। সত্যিই বোধহয় দরকার ছিল এটার। প্রমোদটা মিস্ করল। অনেক আগেই বলছিল কফি খাবে। হঠাৎই বৃষ্টিটা এলো।'
কথা বলতে বলতে রুমকিদি চলে যায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে। মুনিয়া এসে বারান্দায় দাঁড়ায়,অবাক হয়ে দেখে প্রমোদ গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কানে ফোন নিয়ে কথা বলতে বলতে ওদের বাড়ির দিকেই তাকিয়ে আছে। আবছা অন্ধকারে প্রমোদকে ভালো করে দেখে মুনিয়া। ঝুটি বাঁধা ট্যাটু করা শর্মাজী যে একটা সময় মুনিয়ার পারফেক্ট ম্যাচ ছিল সে জাস্ট একটা অনেক দূরের মানুষ। যার দিকে তাকাতেও ভালো লাগে না মুনিয়ার। তবুও আজ ভালো করে দেখল অনেকদিন বাদে দূর থেকে প্রমোদকে। একই রকম আছে শুধু মাথার চুলটা অন্য স্টাইলে কাটা,এখনও বোধহয় নিয়মিত শরীরচর্চা করে।
প্রমোদ এখন পরপুরুষ, একটা সময় ওর শরীরের ছোঁয়া শিহরণ জাগাত মুনিয়ার মনে। আজ ছোঁয়া বাঁচিয়ে দূর থেকে আরেকবার লুকিয়ে পরিত্যক্ত ভালোবাসাকে দেখল মুনিয়া।
রুমকিদি নিচে নেমে গেছে অনেকগুলো ব্যালকনির মাঝে মুনিয়ার ব্যালকনি প্রমোদ চিনত না। গাড়িতে উঠে বসেছে প্রমোদ। ভাবীকে হাত নাড়তে দেখে বুঝতে পারে এই ব্যালকনিতে মুনিয়া এসে দাঁড়িয়েছে। আবছা আলো আঁধারে গাড়ির কাঁচ ভেদ করে মুনিয়াকে খোঁজার চেষ্টা করে প্রমোদ।
মুনিয়ার মনে উঁকি দেয় রুমকির কথাগুলো প্রমোদ অনেকক্ষণ কফি কফি করছিল। মুনিয়া কি একটু বেশি রুড হয়ে যাচ্ছে? একটু বেশি ভাবছে প্রমোদকে নিয়ে? তবে কি আজ ওকে একবার ওপরে আসতে বলা উচিত ছিল?
রুমকিদি কি বলতে চাইছিল ওকে? মানে ক্ষমা করার কথা।
ফোনটা বেজে ওঠে ভাবনার জাল কেটে যায় মুনিয়ার রাণা ফোন করেছে। অনেক কথায় ডুবে যায় মুনিয়া। সারাদিনের জমে থাকা সব কথা বলে যায় শুধু বলেনি আজ রুমকিদি আর প্রমোদ ওকে পৌঁছে দিয়ে গেছে।
মাঝে কেটে গেছে বেশ অনেকগুলো দিন। আজকাল মাঝে মাঝে মুনিয়ার অফিসের সামনে দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় যায় প্রমোদ। কি জন্য ও নিজেও মাঝে মাঝে ভেবে পায় না। হয়ত মুনিয়াকে একবার দেখার জন্য। ওকে দেখার পর মনে হয়েছে এখনও খুব কষ্ট পায় মুনিয়া ওর জন্য। সত্যিই তো কত খারাপ কথা বলেছে ওকে। একবার,শুধু একবার যদি ওর কাছে ক্ষমা চাইতে পারত। কিন্তু মুনিয়া কিছুতেই ওর সাথে দেখা করবে না জানে প্রমোদ।
**************************
সামনের সপ্তাহে মুনিয়ার জন্মদিন। স্ক্রীনশট নেওয়া শাড়িটা মুনিয়ার জন্য বেশ কিছুদিন আগে বুক করেছে রাণা। তবে ওর দ্বারা হয়নি। ধ্যেৎ এরা বুটিক খুলেছে কিন্তু কোন সিস্টেম নেই এদের। কবে মেসেজ করেছে কিন্তু কোন উত্তর নেই। অবশেষে মৌমিতাকে দিয়ে বুক করিয়েছে শাড়িটা।
দিদির কাছ থেকে জানতে পেরেছে ঝুমকা শাড়িটার কথা। ওকে স্ক্রীনশট দিয়েছিল কাস্টমার। শাড়িটা রেডি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঝুমকা। বেশ কয়েকদিন লাগে সবকিছু রেডি করে দিতে। সত্যিই শাড়িটা খুব সুন্দর হয়েছে। যা করে নিজের গায়েই ফেলে দেখে ঝুমকা। আজকাল একটা মেয়েকে দিয়ে ওর শাড়িগুলোর অ্যাড করায়। যদিও ওর সাথে কাজ করে কৃষ্ণা ও সবসময় বলে,' ঝুমকাদি শুধু শুধু তুমি পয়সা দাও অন্য মেয়েকে। তোমার এত সুন্দর ফিগার তুমি তো দিব্যি নিজের শাড়ি নিজে গায়ে ফেলে ছবি তুলে দিতে পার।'
' তুই চুপ কর কৃষ্ণা,আমার গলাটা দেখেছিস!'
'সব ঢাকা দেওয়া যায়। যা ইচ্ছে কর তুমি আর কি বলব।'
নিজেকে আর মডেল করার কোন ইচ্ছে নেই ওর। কত ভয়ে ভয়ে যে থাকে তা একমাত্র ও নিজেই জানে। শয়তানটা তো আছে নিশ্চয় কোথাও। সোশ্যাল মিডিয়ায় আর নিজের কোন ছবি দেয় না ঝুমকা।
দিদিকে ফোন করে ঝুমকা ,'শাড়িটা হয়ে গেছে তো। ঠিকানাটা দে কোথায় যাবে কুরিয়ার করতে হবে তো।'
' হ্যাঁ বলেছি আমি আজ দেবে ঠিকানা দিলেই তোকে দেব। টাকাটা তো আগেই দিয়েছে। কি জানি এত দেরি করে কেন ঠিকানা দিতে?'
দিদি কয়েকটা প্রয়োজনীয় কথা বলে ফোনটা ছেড়ে দেয়।
বিকেলে হোয়াটস অ্যাপে ঠিকানাটা ফরোয়ার্ড করে দিয়েছে দিদি। মোবাইলের স্ক্রীনে চোখ রেখে অবাক হয়ে যায় ঝুমকা..মিসেস মুনিয়া রায়চৌধুরী ব্যাঙ্গালোরের ঠিকানা। কে বুক করেছে শাড়িটা তাহলে? মুনিয়া না অন্য কেউ?
নাকি রাণা? দিদি তো বলল কৃষ্ণনগরের কেউ একটা বুক করেছে শাড়িটা। ওরা এর আগে অনেক কিছু কিনেছে। বাইরে থাকে।
ভগবান ওকে দিয়ে আর কি করাবে ভাবে ঝুমকা। কুরিয়ারের ছেলেটা এলে একটা সুন্দর গিফ্ট বক্সে ম্যাচিং জুয়েলারী আর পার্স সহ প্যাক করা শাড়িটা দিয়ে দিল ঝুমকা। ওপরে নামটা জ্বলজ্বল করছে মুনিয়া রায়চৌধুরী অবশ্যই মিসেস। মিসেস অফ ঝুমকাস প্রাক্তন।
***************************
গতকাল রাতে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে রাণার সঙ্গে মোটামুটি এখানকার সময়ের দুটোর পরেও। মুনিয়া বুঝতে পারে বৌয়ের জন্মদিন অথচ ও এখানে নেই এই কষ্টটাই হয়ত বেশি হচ্ছে রাণার। তাই যতটা সম্ভব ওকে সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করছে কারণ কালকে আবার অফিস আছে। বারোটা বাজার সাথে সাথে ডল আনন্দ ওরাও ফোন করে জুনি আর পুতুল মেসেজ করে হোয়াটস অ্যাপে। পুতুলের সময় এসে যাচ্ছে সামনে যে কোনদিনই ভালো খবর পাবে মুনিয়া।
একটু কনফারেন্স কলে আড্ডাও হয়ে যায় কৃষ্ণনগরের সাথে জার্মানী আর ব্যাঙ্গালোরের। বেশ মনটা খুশি হয়ে যায় মুনিয়ার। মনে হয় কিছুক্ষণের জন্য সবাই আছে সাথে। স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে ঘুমিয়ে পড়ে মুনিয়া। ছোটবেলায় এই দিনটা খুব প্রিয় ছিল ওর। গতকাল রাতে মাও ফোন করে খুবই দুঃখ করল,' ভেবেছিলাম চলে আসব,তোর সাথে কাটাব দিনটা। কিন্তু কিছুই হল না,এমন কিছু অফিসিয়াল কাজ পড়ে গেল।'
-' ঠিক আছে মা,ফোনে তো থাকবই একদম কাছাকাছি এত ভাবছ কেন?'
-' না পায়েসটা করে খাওয়ানো হবে না তোকে।'
-' মা আমি পায়েস করে খেয়ে নেব,তাহলে হবে তো?'
সকালে তাড়াতাড়ি উঠতেই হয় কারণ অফিস আছে। আজ ভোরেই উঠে পড়েছে মুনিয়া কারণ কৃষ্ণনগরের ফোন বেজেছে ঠাম্মা,মামণি আর বাপির সঙ্গে কিছুটা কথা হল।
-'নতুন দিদিভাই, তোমার জন্মদিনে আমি পায়েস করে আজ গোপালকে ভোগ দেব। আমার গোপাল যেন দাদুভাই আর দিদিভাইকে খুব ভালো রাখে।'
কিছু ছোট্ট কথা অথচ সেই কথার আন্তরিকতা স্পর্শ করে মুনিয়ার মন। মুনিয়ার হঠাৎই কেন যেন খুব কান্না পায়। এই বিশেষ দিনগুলোতে কেন যেন মন আপনজনকে চায় খুব।
মামণি বলল,' তোমার জন্য একটা জিনিস রেখেছি,আমি তোমাকে হাতে হাতে দেব। ভালো থেক আর খুশি থেক সবসময়। তোমার বাপি তো যাবার বায়না করেছিল সরপুরিয়া নিয়ে। আমি বারণ করলাম। ওখানে গিয়ে আবার ঝামেলা বাড়াবে।'
মুনিয়া হাসে,' ডল যখন আসবে তখন বাপিকে পাঠিয়ো।'
কথা বলা শেষে দরজা খোলে মুনিয়া পেপারের জন্য। পেপারটা রাণার অভ্যেস,মুনিয়া রেখে দিয়েছে ভালোবেসে। পেপারটা নিতে গিয়ে অবাক হয়ে যায় মুনিয়া একটা খুব সুন্দর হলুদ গোলাপের বোকে বাইরে রাখা। ওটা নিতে গিয়েও দুবার ভাবল নেবে কি না তারপর নিয়ে এল ভেতরে নিশ্চয় জুনির কাজ এটা। কালকে রাতে ফোন করেনি আজ সারপ্রাইজ দেবে বলে।
গোলাপটা ঘরে এনে মুগ্ধ হয়ে দেখে মুনিয়া তারপরেই ফুলের স্তরে গোপনে রাখা ছোট কার্ডটা খোলে কার্ডটা খুলতেই মিঠে সুরে বেজে ওঠে হ্যাপি বার্থডে টু ইউ গানের সুর। সুন্দর একটা ছোট্ট কার্ড নিচে ছোট্ট করে লেখা,হ্যাপি বার্থডে মুন্নী।
রাগ হলেও কেন যেন রাগ করতে পারল না আর মুনিয়া। লেখাটা যে কার সেটা ও বুঝতে পেরেছে। মুনিয়ার মন নরম,যেখানে যতটা কঠিন হওয়া দরকার সেটা করলেও পরে অনুতাপ হয়। যেমন সেদিন বারবারই রুমকিদির কথাটা কানে বেজেছে ওর হয়ত আজও ভোলেনি..' প্রমোদ অনেকক্ষণ ধরে বলছিল কফি খাবার কথা বৃষ্টিতে খাওয়া হয়নি।'
যে মানুষটা একসময় ছিল তার দিবারাত্রির স্বপ্ন। কত একসাথে বসে এক গ্লাস থেকে স্ট্র দিয়ে ভালোবাসার কফি আর হট চকোলেট শেকে চুমুক দিয়ে নিজেদের ভালোবাসাকে উত্তপ্ত করেছে। সে আজ বাইরে দাঁড়িয়ে রইল মিছে অজুহাতে অবশ্য মুনিয়াও তাকে বলেনি আসতে। তপ্ত কফির উষ্ণতা এখন ঠান্ডা সম্পর্কের শীতলতায়।
নিজের জন্মদিন ফেসবুকে হাইড করে রেখেছে মুনিয়া নোটিফিকেশন আসে বলে। একগাদা মেকি উইশ আর ভালো লাগে না ওর। তবুও যারা জানে তারা শুভেচ্ছা জানায়। এই কয়েকটা বছরে মুনিয়ার কাছে প্রমোদের শুভেচ্ছা কোনদিনই আসেনি ব্রেকআপের পর,সম্পর্কে ঝুলেছিল মরচে ধরা একটা তালা যার চাবি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল মুনিয়া জঞ্জালের মত। আজ আবার হঠাৎই কেন প্রমোদ খুলতে চাইছে সেই মরচে ধরা তালাটা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে?
ফুলগুলো ভালো করে আবার দেখে মুনিয়া, ওদের কোন দোষ নেই, গায়ে লাগেনি কোন পাপ। মুখে মিঠে নিষ্পাপ হাসি ওদের। সকালের সাতরঙা রোদের আদর মেখে হাসছে ওরা। হঠাৎই মুনিয়ার মনে পড়ে একবার ভ্যালেনটাইন্স ডে তে চারটে হলুদ গোলাপ আর চকলেট দিয়ে প্রমোদ বলেছিল,' অভি ইয়ে চার রাখ লো হামারা চার সাল পুরা হুয়া। অনেক দাম বলছে আজ। পরে যখন চাকরি করব তখন চারশো গোলাপ দেব।'
হাতে গোলাপ নিয়ে উত্তজনায় মুনিয়া ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল ও আই লাভ হলুদ গোলাপ।'
সেদিনের সেই উত্তেজনা আজ বিরক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে আর কেন যেন রাগ হয় না মুনিয়ার। পরিস্থিতি ওকে অনেকটা কুল হতে শিখিয়েছে। সত্যিই কেন মাথা গরম করে নিজের শরীর খারাপ করবে? তাই বোকেটাকে নীরবে রেখে দেয় ওর সুখী গৃহকোণের কোন এক আড়ালে। শুধু মনে জমে রইল কিছু যাযাবর প্রশ্ন।
নিজেকে আজ একটু স্পেশাল করে সাজায় আজ মুনিয়া। সবারই বোধহয় নিজেকে একটু ভালো করে রাখাটা জরুরী। অবশ্য এটা রুমকিদির কাছ থেকে শোনা, ' যত্নে রেখ আমিটাকে। কে আর তার খেয়াল রাখে?' রুমকিদি নাকি ইচ্ছেখেয়ালে শ্রীর পেজটা ফলো করে। কথাগুলো লেখিকা শ্রী' র। দুটো লাইন অথচ কত গভীর অর্থ হাসি কান্না শোক দুঃখ সবটাই কত দায়িত্ব নিয়ে সামলাতে হয় এই আমিটাকেই। তার সাথে অন্য সব চাপ তো রয়েছেই। আজ মুনিয়া শাড়ি পরে রাণাকে মনে করে। বিশেষ দিনে শাড়িকেই বেশি গুরুত্ব দেয় রাণা। সেই জড়ির পাড়ের অফ হোয়াইট শাড়িটা পরাই হয়নি অ্যানিভার্সারিতে,ওটাই পরে আজ। সাথে মামণির দেওয়া ঝুমকো আর রাণার দেওয়া লকেটটা। কপালে আঁকে ছোট টিপ তার তলায় আরেকটা বিন্দু। গায়ে ছড়ায় চন্দনের গন্ধ। সাজটা বেশ দক্ষিণী ছোঁয়ায় হয়েছে। রাণা থাকলে অবশ্যই বলত সাথে ফুলের মালা মাথায় জড়ালেই খুব সুন্দর দেখাত তোকে। বাইরে বারান্দার বোগেনভেলিয়া গাছটার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছবি তুলে রাণাকে পাঠায়। বেচারা হয়ত ঘুমোচ্ছে এখন।
সাজগোজ করতে করতে হঠাৎই আবার মনে হয় বোকেটা কে রেখে গেল এখানে? তাহলে কি প্রমোদই এসেছিল? না না হতে পারে না নিশ্চয় কোন ডেলিভারি বয়কে দিয়ে পাঠিয়েছে। কিন্তু ওর অ্যাড্রেস তো সেভাবে রুমকিদিও জানেনা!
*************************
আজ প্রবালদার দেওয়া ব্যাগটা নিয়েছে মুনিয়া, ব্যাগটা খুব সুন্দর। মুনিয়া জানে প্রবালদা ওকে বোনের মতই ভালোবাসে।
ও দরজা খুলে নিচে নামতেই ওর ল্যান্ডলেডির সাথে দেখা হয়ে গেল। উনি বললেন আর্লি মর্ণিংয়ে যখন সামনের বাগানে গাছে জল দিচ্ছেলেন তখন হঠাৎ একজন এসে ওর কথা জিজ্ঞেস করছিল। হাতে একটা খুব সুন্দর বোকে ছিল।
মুনিয়া তাড়াতাড়ি করছে তখন বলল,' ইয়েস গট ইট। মনে হয় কুরিয়ারের লোক হবে।'
' মে বি বাট ভেরি ওয়েল বিহেভড অ্যান্ড হ্যান্ডসাম।'
বাই আন্টি বলে তাড়াতাড়ি ক্যাবে উঠে পড়ে মুনিয়া। বুঝতে আর বাকি থাকে না ওর কে এসেছিল বোকেটা দিতে। কিন্তু কেন হঠাৎই এত আদিখ্যেতা শুরু করেছে প্রমোদ? সত্যিই কি ও অনুতপ্ত? কি জানি ওকে আর বিশ্বাস করে না মুনিয়া। একটুও না। ওর ছায়াও মারাতে চায় না। তবুও কেন কালো বেড়ালের মত ওর সাজানো দাম্পত্যর মাঝে এসে হাজির হচ্ছে কে জানে? কেন যে রাণাটা চলে গেল এইসময়?
অবশ্য ওরই বা কি দোষ? অফিসের কাজ পড়েছে তাই অনেক মন খারাপ নিয়েই যেতে হয়েছে বেচারাকে।
অফিসে পৌঁছে অন্য সব কথা ভুলে গেল মুনিয়া। ক্যাবে বসেই একটু হোয়াটস অ্যাপ করেছে রাণার সাথে। তার মধ্যে জুনির ফোন এলো। ওর সাজ দেখে রাণাও খুশি। শুধু বলল,' খুব মিস্ করছি রে,বৌয়ের জন্মদিন অথচ থাকতে পারলাম না।'
কথার মাঝে রাণা আর বলতে পারল না ওর গিফ্টটা এসেছে কিনা? নিশ্চয় কেক আর গিফ্ট কিছুই এখনও আসেনি। অবশ্য কেকটা অফিসের ঠিকানায় পাঠিয়েছে রাণা। সত্যিই তো বাড়িতে কেকটা নিয়ে কার সাথেই বা সেলিব্রেশন করবে ও? জুনিও ফ্রী নেই যে আসবে। তবে শাড়িটা তো বাড়িতেই দেওয়ার কথা,এখন মনে হচ্ছে কোন রেপুটেড জায়গা থেকে নিলেই ভালো হত। কেন যে কৃষ্ণনগরের শুনে শুধু শুধু নস্টালজিক হল কে জানে?
মুনিয়া পৌঁছতেই ওর ডিপার্টমেন্টের ওরা একসাথে হয়ে ওকে উইশ করল। এইজন্য এই অফিসটা খুব ভালো লাগে ওর। সবাই ওকে খুব ভালোবাসে। ওর কাজ জায়গাটা কি সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো আর চকোলেটের বাক্স রাখা। সবাই জানে মুনিয়া চকোলেটের পোকা।
লাঞ্চ টাইমের আগেই রাণার পাঠানো কেক,ক্যান্ডেল,কুকি সব এসে যায়। পার্টি একদম জমজমাট। মুনিয়ার ভালোবাসার মানুষ যে অত দূরে বসে সবার জন্য এতটা ভেবেছে এটা ভেবেই ওর খুব ভালো লাগছে। সত্যিই রাণা কম কথা বললেও খুব চিন্তা করে কাজ করে। এত বড় কেকটা অফিসে পাঠানোতে সেলিব্রেশন একদম গ্ৰ্যান্ড হল। বাড়িতে ও কিই বা করত একা একা। শুধু মন খারাপ হত। অনেক ছবি আর ভিডিও ক্যামেরাবন্দি হয়। রাণাকে পাঠাতে হবে। দুঃখের কিছু নেই দেখ কত ভালো করে জন্মদিন হল। তুই বরং কিছু খেতে পেলি না। হয়ত বেচারা স্যান্ডউইচ খেয়েই আছে।
কিছু কিছু দিন মনে একটা হালকা অনুভূতির পালক ছুঁইয়ে যায়। ছুটির পর অফিস থেকে বেরিয়ে বাইরে আসে মুনিয়া ওর বাড়ির দিকে তেমন কেউ থাকে না তাই ওকে একাই ফিরতে হয়।
' মুনিয়া, আয় আয় উঠে পর তাড়াতাড়ি।'
রুমকিদিকে দেখে অবাক হয় মুনিয়া। তবে তার আগে গাড়িটা খুব ভালো করে দেখে নেয়। নাহ্ সেখানে আর কেউ নেই।
-' তুমি এখানে হঠাৎ! তোমার অফিস তো উল্টোদিকে।'
ততক্ষণে সামনের দরজাটা খুলে দিয়েছে রুমকিদি। মুনিয়া নিশ্চিন্তে উঠে বসে সামনের সীটে।
--' আমার অফিস উল্টোদিকেই হোক বা সোজা দিকেই হোক তাতে কি? আজ মনে হল তোকে লিফ্ট দেব তাই চলে এলাম। আমারও তো খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তোকে।'
রুমকিদির এই জোর করে মন কেড়ে নেওয়া ব্যাপারটা খুব ভালো লাগে মুনিয়ার তাই বোধহয় রাগ করতে ইচ্ছে হলেও সবসময় রাগ করা যায় না।
-' কি ভীষণ সুন্দরী লাগছে তোকে দেখতে,সত্যিই চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। এত সুন্দর সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে থাকবি ক্যাবের জন্য তা হয়? তাই তো ছোঁ মেরে তুলে নিলাম তোকে।'
মুনিয়া হাসে হঠাৎই তবে এই হাসিতে মিশে আছে আজ শুধু আনন্দ। আজকের দিনটা সকাল থেকে যদিও অন্যরকম করে শুরু হয়েছে তবুও মুনিয়া নিজেকে সামলে নেবে আর খুশি থাকবে এটাই ঠিক করেছে।
রুমকিদি বেশ স্পীডে চালাচ্ছে গাড়ি মুনিয়া হাওয়ায় ভাসতে থাকে ওর চুল উড়ছে খামখেয়ালে। হঠাৎই গাড়িটা একটা ছোট ক্যাফের সামনে এনে দাঁড় করায়। আগে কোনদিন এখানে আসেনি। বেশ সুন্দর ছিমছাম পরিবেশ চারদিকে সবুজের ছোঁয়া।
' বাড়ি যাব না? তুমিও তো ফিরবে। বাবলি আছে বাড়িতে।'
-' আজকা শাম তেরি নাম। আজ একটু হট চকোলেট খেয়ে যাব সাথে স্ন্যাক্স। মুনিয়া পাখির জন্মদিন বলে কথা। বাবলির দিদা আছে তো। তোর প্রবালদা বলছিল তোকে বাড়িতে নিয়ে যেতে। তার থেকে এই ভালো। একটু আড্ডা দিয়ে যাব।'
হ্যাপি বার্থডে বলে রুমকি মুনিয়াকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেল আনন্দে।
মুনিয়া বুঝতে পারে রুমকিদি কোথা থেকে জানতে পেরেছে।
তবে ওর চোখট একটু ঝাপসা হয়ে যায় যখন দেখে রুমকিদি ব্যাগ থেকে পায়েসের কৌটোট বের করেছে।
হঠাৎই খুব মায়ের কথা মনে হল ওর।
-' মুখটা হাঁ কর দেখি,ভেতরে তো বাইরের খাবার হয়ত অ্যালাউ করবে না তাই গাড়িতে বসেই খাইয়ে দি।'
স্ন্যাক্স, কফি আর গল্পে ডুব দিতে দিতে অনেকটা সময় কেটে যায়। মুনিয়া অবাক হয় রুমকিদি তো ওকে একবারও প্রমোদের বোকের কথা জিজ্ঞেসা করছে না। তাহলে কি জানে না কিছুই?
তবে ওর বলা উচিত কথাটা। তাই সকালের কথাটা বলে,' দরজার বাইরে বোকেটা দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম বুঝলে। পরে বুঝলাম কে পাঠিয়েছে। তবে প্রমোদ যে নিজে দিতে এসেছিল তা বুঝতে পারিনি। তুমি জান গো? মানে তোমাকে বলেছে?'
---' আমিও একদম সারপ্রাইজড শুনে রে। যদিও ও বলেছে আমাকে আজ তোর বার্থডে আমি লেগ পুলিং করেছি ওর বলেছি এক্সের বার্থডে যখন এতদিন মনে আছে দেন ট্রিট দাও। রাজি হয়ে গেছিল একদম। বাট এটা বলেনি। তুই শিওর ও এসেছিল দিতে? কোন ডেলিভারি বয় তো হতে পারে।'
-' আমার ল্যান্ডলেডি ওকে দেখেছে। যা ডেসক্রিপশন দিয়েছে বুঝলাম ও নিজেই এসেছিল। আচ্ছা কি চায় ও বল তো?'
' ও মনে হয় তোকে সরি বলতে চায়,অথবা তোকে যে কথা বলা হয়নি তেমন কিছু বলতে চায়।'
-' কিন্তু এখন তো সবই মিনিংলেস আমার কাছে। আমি ম্যারেড। আমার বর খুব ভালো আমাকে খুব ভালোবাসে। শ্বশুরবাড়িতে সবাই আমাকে মাথায় করে রাখে ওকে বলে দিয়ো।'
-' ও সব জানে মুনিয়া, বাট হি ওয়ান্টস টু এক্সপ্লেইন সামথিং। তোর ফ্রেন্ডশিপ ও খুব মিস্ করে।'
মুনিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল রুমকি ওকে ইশারা করে,' লিভ ইট চল আমরা অন্য কথা বলি।'
হঠাৎই মুনিয়ার ফোনটা বেজে ওঠে।
-' হ্যালো ম্যাম আপনার একটা পার্সেল আছে,আরেকবার অ্যাড্রেসটা বলবেন প্লিজ।'
মুনিয়া অ্যাড্রেস কনফার্ম করে মিনিট পনের বাদে আসতে বলে।
' এবার উঠি চল রুমকিদি শুনলে তো।'
গাড়িতে যেতে যেতে রুমকিদির বলা কথাগুলো আবার কানে ভাসল মুনিয়ার। কি এক্সপ্লেইন করতে চায় প্রমোদ?
আজ মুনিয়াকে নামিয়ে দিয়ে যাবার উদ্যোগ নেয় রুমকি বেশ কিছুটা পথ যেতে হবে একা।
-'রুমকিদি থ্যাঙ্ক ইউ ফর এভরিথিং, সাবধানে ড্রাইভ কোরো।'
-' এনজয় দ্য নাইট,লাভ ইউ ডিয়ার। সবটাই প্রমোদের আইডিয়া ছিল পায়েস টু লিফ্ট। ও বারণ করেছিল আমি বলেই ফেললাম। অফিসে আসার পথে বোধহয় তোকে দেখেছে। তাই বলল শাড়ি পরে এসেছিস...অসুবিধা হতে পারে। কিছু বলব ওকে?'
হঠাৎই মুনিয়ার কেন যেন কান্না পেল,প্রমোদের সেই পুরোনো চেহারাটা বারবার চোখের সামনে আসছে কেন? এর থেকে যাকে হেট করে এসেছে সেই প্রমোদই তো ভালো ছিল। ওর কেমন মাথাটা গুলিয়ে যায়।
শুধু বলে,' ও কি আমাকে ফলো করছে নাকি আজকাল?'
'ওর অফিস তো ওদিকেই তাই হয়ত যাতায়াতের সময় চোখে পড়েছে। তোর অফিসের সামনে দিয়েই বোধহয় যাতায়াত করে।'
-'ওকে বাই, আসি আমি। নাহলে তুই হয়ত আবার জিজ্ঞেসা করবি কেন যাতায়াত করে ওখান দিয়ে?'
রুমকিদি হাসতে হাসতে গাড়ি স্টার্ট করে মুনিয়ার একটা অদ্ভুত রাগ হয়। বেছে বেছে ওকে ওদিকেই অফিস নিতে হল!
রুমকি ওর অবস্থাটা বুঝতে পারে,ভালোবাসা এত গভীর আর পুরোনো ছিল যে তার স্মৃতি এখনও মুনিয়ার মনে স্পষ্ট হয়ে আছে। কোথাও একটুও ধুলো জমেনি। বরং ধুলো জমলেও মুনিয়ার কান্না সেগুলো ধুয়ে সাফ করে দেয় মাঝে মাঝে।
রুমকি তো ওকে বলতেই পারেনি,ওর বাড়ির থেকে কিছুটা দূরে প্রমোদ থাকে। অবশ্য দোষ ওর নেই একদম। ওকে যখন অফিস অ্যাকোমোডেশন দিয়েছিল তখন ও জানতই না মুনিয়া এদিকেই থাকে।
জানতে পেরে চেঞ্জ করতে চেয়েছিল কিন্তু হয়নি। রুমকি সেদিন তো তাই মুনিয়াকে ড্রপ করে ওকে ছেড়ে একদম বাড়ি ফিরল।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই আবার ফোনটা বাজে রাণা ফোন করেছে।
'পাচ্ছিলাম না কেন? ট্রাই করছি কিছুক্ষণ।'
'এই ফিরছি। রুমকিদি লিফ্ট দিল একটা ছোট ট্রিটও দিল,পায়েস খাওয়ালো। ঢুকছি এখন।'
-' ওকে পরে ফোন করছি আবার।'
রাণার মনটা একটু ভারী হয়। মুনিয়াকে শাড়িটা পাঠানোই কি বেকার হল নাকি? নিশ্চয় পায়নি শাড়ি তাহলে বলত। রুমকিদি আজকাল যেন একটু বেশি অ্যাটেনশন দিচ্ছে মুনিয়াকে। ও না থাকায় বোধহয় মুনিয়ার একাকীত্বে একটু বেশি অধিকার করেছে ওকে রুমকিদি। অবশ্য মুনিয়ার একটা সঙ্গীরও তো দরকার, আজকাল জুনিও ব্যস্ত থাকে। খুব আদুরে আর নরম মনের মেয়ে ও। একটু বাদেই ভিডিও কল করবে।
শাড়ির প্যাকেট বাক্সবন্দি হয়ে যথাসময়ে এসে পৌঁছয় মুনিয়ার কাছে। অনেকটা খুশির রঙ মাখে মুনিয়ার মন। অত দূরে থেকে রাণা সবসময় চেষ্টা করে যাচ্ছে ওকে খুশি রাখতে। তাই খুশির পরশ টুকু মেখে থাক ওদের ভালোবাসা। তাতে যেন কোন দুঃখ না লাগে।
একটু ফ্রেশ হয়ে প্যাকেটটা খোলে মুনিয়া। সুন্দর একটা গিফ্টবক্স তবে ওপরের নামটা দেখে কেমন যেন লাগে মুনিয়ার। রাণা ঝুমস্ ক্রিয়েশন থেকে শাড়ি কিনেছে ওর জন্য? তাহলে কি ঝুমকার সাথে রাণার আবার যোগাযোগ হয়েছে? না না তা কি করে হতে পারে?
মাথায় এলোমেলো চিন্তার সুতো জট পাকিয়ে যায় মুনিয়ার। তবুও রাণার দেওয়া উপহার হাতে নিয়ে গায়ে মাখে মুনিয়া। খুব সুন্দর শাড়িটা,সাথে ম্যাচিং পার্স আর গয়না।
জিনিসগুলো কে বানিয়েছে জানে না মুনিয়া তবে বিউটিপার্লারে কাজ করা মেয়েটা এই একটা বছরে নিজেকে ভালো তৈরি করেছে বুঝতে পারে মুনিয়া।
তাহলে কি রাণার সাথে ওর কথা হয়?
ইশ্ কি সব যে ভাবছে?
ফোনটা বেজে ওঠে আবার, বিছানায় সব জিনিসগুলো ছড়িয়ে রেখে ফোনটা ধরে মুনিয়া।
'শাড়িটা পেয়েছি। মানে জাস্ট পেলাম। ঠিক সময়েই এসেছে।'
রাণা অপেক্ষা করে আছে মুনিয়ার মুখে প্রশংসা শোনার জন্য।
-'তোর ভালো লেগেছে? পছন্দ হয়েছে? আমার তো তেমন পছন্দ নেই। তবুও খুব ভালো লাগল তাই ওটাই সিলেক্ট করেছি।'
-' কত কি এসেছে! সবগুলো এক্সক্লুসিভ। খুব সুন্দর।'
নিজের মনের ছবি একদম ভারী কাগজে চাপা দিয়ে মুনিয়া নিজের মত বলে যায়।
- উফ্ নিশ্চিন্ত। একটা সময় দেরি দেখে মনে হচ্ছিল অযথা একটা ফালতু জায়গা থেকে নিলাম। তার থেকে এখানকার কোন রেপুটেড শপ থেকে নিলেই হত অনলাইনে।'
- ' খুব ভালো হয়েছে মাই স্মার্ট হাবি। তুই এইসব বুটিক জানিস তা তো জানতাম না। বাট সবগুলো খুব পছন্দ হয়েছে।'
নিজেকে লুকিয়ে রাখতে কি সুন্দর শিখে গেছে মুনিয়া। ভালোবাসায় গোপনীয়তা ভালো নয় তবে যে সত্যি শুধু জটিলতা বাড়ায় তাকে গোপন করা ভালো তা বিশ্বাস করে মুনিয়া। হয়ত পরিস্থিতি শিখিয়েছে ওকে। কি বলবে ও রাণাকে তুই ঝুমের বুটিকের শাড়ি কেন কিনেছিস আমার জন্য? তুই কি ওর সাথে যোগাযোগ রেখেছিস?
আর রাণা কি এত বোকা যে ঝুমকার সাথে যোগাযোগ রেখে ওর বুটিকের শাড়ি ওর জন্য কিনবে?
আজ বরং রাণাকে অনেক খোলামেলা আর নিজেকে বোকা মনে হল মুনিয়ার যখন হঠাৎই হলুদ গোলাপের বোকের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু কি করবে ও?
রাণা অনেক কথা বলে যায় নিজের মত। মুনিয়া ওকে জিজ্ঞাসা করে অতদূর থেকে কিভাবে কিনল শাড়ি?
-' আমার দ্বারা হত না কিছুই,আমি অগত্যা মৌমিতার দ্বারস্থ হয়ে ওকে দিয়েই বুক করিয়েছি।'
রাণার একটা কথাই মুনিয়ার হাজার প্রশ্নের উত্তর হয়ে ওর কাছে ফিরে আসে। মুনিয়া বুঝতে পারে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা রাণার ভালোবাসা সোজা সরল পথ ধরে বারবারই ছুটে আসতে চায় ওর কাছে। কেন যেন নিজেকে অপরাধী মনে হয় মুনিয়ার। তবুও কিছুতেই প্রমোদের কথা রাণাকে বলে কোন অশান্তি আনতে চায় না ওদের দূরত্ববন্দি দাম্পত্যে।
মুঠোফোনের মুখোমুখি কলে অনেকটা সময় আড্ডা দেয় মুনিয়া সবার সাথে। একসঙ্গে মা বাবা,শ্বশুর শাশুড়িমা ননদ আর কৃষ্ণনগরের বাড়ির লোকজন। ওদের সামনে বসেই ওকে খেতে হয়। মাও শান্তি পায় ওকে পায়েস খেতে দেখে। রাণার দেওয়া শাড়িটা গায়ে ফেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাইকে দেখালো। আর মনে মনে ভাবল কি যে সব ঘটে যায় কখনও অনিচ্ছায় কখনও বা ভুলক্রমে।
রাতের গভীরতা বাড়ে মুনিয়ার চোখে ঘুম আসে না। আজ কেন যেন মনটা খুব চঞ্চল একেই বোধহয় বলে ভাগ্যচক্র। যে লেবেল ও ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে এসেছিল জানলা দিয়ে আজ সেটাই উড়ে এসেছে আবার ওর শোবার ঘরে।
মিউজিক সিস্টেমে হালকা সুরে বাজতে থাকে তুমি যাকে ভালোবাসো স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো তার জীবনে ঝড়।
সত্যিই কি মুনিয়ার জীবনে কোন ঝড় উঠবে? যে ঝড়কে সামলাতে হবে শুধু মুনিয়াকেই?
*************************
রাত্রে শুয়ে শুয়ে অনেক কথা মনে আসে ঝুমকার। এই শাড়িটার ক্ষেত্রে নিশ্চয় আর কোন ফিডব্যাক পাবে না। অথচ কত কষ্ট করে দিনরাত এক করে বানিয়েছে শাড়িটা। যাক পছন্দ হলেই ভালো। ওর আর কি? টাকা পেয়েছে করে দিয়েছে।
কদিন ধরেই মাঝেমধ্যে একটা মিসড কল আসছে ঝুমকার ফোনে। ফোন ধরলে কোন কথা বলে না। নম্বরটা বুক করে রেখেছে ঝুমকা কদিন ফোনটা আসার পর। কে ফোন করতে পারে ওকে? সে কথা বলছে না কেন? মৈনাক ফোন করছে না তো? বুকটা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে যায় ঝুমকার। কালই একবার সোহিনীদিকে বলবে কথাটা। কিন্তু ও তো তেমনভাবে নিজের ফোননম্বর ফেসবুক পেজেও দেয়নি। সেখানে তো দিদির নম্বর দেওয়া আছে।
মুনিয়ার ওখান থেকে আসতে একটু দেরিই হয়ে যায় রুমকির। ও আসতেই বাবলি ওকে জড়িয়ে ধরে। প্রবালও ফিরে এসেছে ততক্ষণে।
একটু ফ্রেশ হয়ে প্রমোদকে ফোন করে রুমকি।
' তোমাকে অনেক কষ্টে থ্যাঙ্কস বলেছে। ও সমঝ গয়ি যো তুম বোকে লে আয়া। সবটাই ক্লিয়ার ওর কাছে।'
-' নিশ্চয় খুব রাগ হয়ে গেছে তাই না?'
-' জানি না তবে আজ অনেকটা কুল দেখলাম ওকে। মুনিয়া ভালো আছে এখন। আজকে অনেক আনন্দ করেছি আমরা। ও তোমাকে বলতে বলেছে মুনিয়া খুব ভালো আছে কেন তুমি ওর পেছনে পড়ে আছ?'
-' ওকে বলনি আই মিস্ অনলি ফ্রেন্ডশিপ।'
-' আমি চেষ্টা করছি তবে বন্ধুত্ব আর হবে না মনে হয়। তুমি অন্যায় করেছিলে।'
প্রবাল যে কখন এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি রুমকি।
-' রুমকি এসব কি করছ তুমি? অযথা রাণা আর মুনিয়ার মধ্যে প্রমোদকে আনছ কেন? সবাই তোমার মত নাও হতে পারে?'
রুমকি বাঁকা চোখে প্রবালের দিকে তাকায়,' আমার মত মানে? কি বলছ তুমি?'
-' তোমার অনেক বন্ধু তাদের সাথে সবসময় চ্যাট করছ। মিট করছ। মুনিয়া তেমন নাও হতে পারে।'
-' আমার বন্ধুদের নিয়েও তোমার প্রবলেম প্রবাল? ওরা আমাকে ভালো রেখেছে। কতটা সময় আমাকে দাও তুমি সারাদিন?'
আজকাল বাইরের চাপে অশান্তি করতেও ভালো লাগে না প্রবালের। তার ওপর রুমকির মা বাবা আছে বাড়িতে।
' তোমার বন্ধুদের নিয়ে আমার কোন প্রবলেম নেই। তুমি হ্যাপি থাকছ যখন থাক। বাট প্রমোদের ওয়াইফ আছে আমি চাই না ও আবার এমন কিছু করুক যাতে দুটো ফ্যামিলি নষ্ট হয়।'
-' ওরা যা পারে করুক,ইউ ডোন্ট ইনভলভ ইন দেয়ার রিলেশন। এটা আমি চাই।'
প্রবালের কথা শুনে রাগ হলেও চুপ করে থাকে রুমকি। প্রমোদের সব কথা শুনে ওর বারবার মনে হয়েছে কিছু না হলেও ওদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি মিটলে অন্ততঃ মুনিয়া ভালো থাকবে।
প্রবাল পাশ ফিরে শুয়েছে,রুমকি জানে ও একটু বাদেই ঘুমিয়ে পড়বে।
ফোনটা হাতে নিয়ে ঘাটতে থাকে রুমকি একরাশ বিরক্তিতে প্রমোদ যেহেতু ওর ভাই তাই বোধহয় বেশি অধিকার ফলাচ্ছে প্রবাল।
রুমকি সেলফোন থেকে কয়েকটা ছবি প্রমোদকে পাঠায়। ছবিতে খুব কাছ থেকে মুনিয়াকে দেখে প্রমোদ। একদিন যে খুব কাছে ছিল আজ তার ছবি দেখছে নিজের মুঠোতে ধরে। তবে ছবিগুলো দেখে ডিলিটও করে ফেলতে হবে। রাখতে পারবে না কাছে।মুনিয়া এখন সত্যিই মুছে গেছে ওর জীবন থেকে। শুধু ওকে দেখার পর কেন যেন একটা শূন্যতা তাড়া করছে ওকে।
ছবিগুলো দেখতে দেখতে আনমনা হয় প্রমোদ। মুনিয়া এখন অনেক পরিণত আর সুন্দর। ভালো আছে মুনিয়া ভাবী বলেছে।
প্রমোদের ফোনটা বাজে মধু ফোন করেছে। মধু প্রমোদের বৌ। অনেক বড়লোকের মেয়ে। বাপের বাড়িতেই থাকতে ভালোবাসে বেশি। প্রমোদ ওর জীবনের জুয়েলারী বক্সের একটা গয়নার মতই গলায় মঙ্গলসূত্রে বাঁধা। সকাল রাতে দুবার ফোন করে বুঝিয়ে দেয় ওর অস্তিত্ব। সেখানে মনের কথা খুব কমই হয়। অভ্যেসে বলা রোজকার কিছু কথা বাজতে থাকে ওপার থেকে নিজের ছন্দে।
অভ্যেসে কথা বলতে থাকে প্রমোদ স্পীকার অন করে ঘরে ও একা। তার সাথে ওল্টাতে থাকে আপনমনে ছবির গ্যালারী। চোখে প্রাক্তন প্রেমিকার ছবি ভাসে কানে আধো আদরে বৌয়ের কথা আসে। কি অদ্ভুত জীবনের জলছবি। কাউকেই জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি প্রমোদ।
অন্ধকার রাতে রুমকির ব্রাইটনেশ কম করা ফোনে সন্দীপের মেসেজ আসে,' কতদিন দেখি না তোকে। তুই কি আমাকে অ্যাভয়েড করছিস? এই মুহূর্তের একটা সেল্ফি পাঠা প্লিজ খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।'
-' পাগল হলি নাকি? অন্ধকার ঘর,সবাই ঘুমোচ্ছে।'
-' প্লিজ একবার একটা ছবি পাঠা। সত্যিই ঘুম আসছে না। বাথরুমের আলোতে তুলে পাঠা প্লিজ। '
সন্দীপ রুমকিকে সর্বনাশের পথে আমন্ত্রণ করে দেখে রুমকি রাজি কিনা? কারণ ওতেই বুঝবে ও বাজি জিতবে।
গ্যালারীতে থাকা একটা সেল্ফি পাঠায় রুমকি অগত্যা।
-' বুঝেছি আগের তোলা।'
সন্দীপ টাইপ করে ও কেন এত সুন্দরী হল...
রাতের পাঠানো অক্ষরের রাশি হাসি ফোটায় রুমকির মুখে। হঠাৎই প্রবাল পাশ ফেরে জড়িয়ে ধরে ওকে দাম্পত্যের উষ্ণতার অভ্যেসে। সাবধানী রুমকি ইনবক্স খালি করে ফোনটা রেখে দেয়।
Comments
Post a Comment