Skip to main content

মেঘ কুয়াশার পরে

#মেঘ কুয়াশার পরে#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

আজ হসপিটাল থেকে ফেরার পথে নাম না জানা ফুলের গোছা পাহাড়ের খাঁজে ফুটে থাকতে দেখে মনটা ভালো হয়ে যায় অপূর্ণার। ওর এই অপূর্ণা নামটা কেন যে ঠাকুমা দিয়েছিলেন তা জানে না। ছোটবেলায় দু একবার জিজ্ঞেস করেছিল উত্তর পেয়েছিল ঐ অপূর্ণা নামটাই তো পূর্ণ হল তোর ভাই আসার পর। ওরা দুই ভাই বোন অপূর্ণা আর পূর্ণ। ভেবে হাসি পায় প্রথম নাতনি হওয়াতে ঠাকুমার অপূর্ণ সাধের জন‍্য ও অপূর্ণা আর ভাই পূর্ণতা এনে পূর্ণ। তবে অনিকেত ওকে শুধুই পূর্ণা বলে ডাকে। পূর্ণার আদর যত্ন নাকি ওকে সম্পূর্ণ করে রেখেছে। না হলে এক চোখ হারিয়ে আরেক চোখেই তো নিজের সম্পূর্ণ পৃথিবীটা পূর্ণা আর আনন্দর মধ‍্যে দেখে। অনেকবার বুঝিয়েছে পূর্ণা,'সেই কবে ছোটবেলায় ভলি বল খেলতে গিয়ে একটা চোখ নষ্ট হয়েছে সেই কষ্টটা এখনও ভুলতে পারনি না? আর আমি যে তোমার চোখেই আমার সম্পূর্ণ পৃথিবীর মানচিত্র আর কত এলোমেলো স্বপ্ন দেখি। তোমার ছাত্রদের মনেও তো কত স্বপ্নের প্রদীপ জ্বালিয়ে আঁধার থেকে আলোর পথে নিয়ে যাও তুমি।'

       খাতাতে নতুন লেখা কবিতাটায় ভালোবাসার শেষ টান দিতে দিতে পূর্ণাকে কাছে টেনে নিয়েছিল অনিকেত। ওর ভরাট গলায় গেয়ে উঠেছিল 'তুমি আর আমি আর আমাদের সন্তান এই আমাদের পৃথিবী।'
     কয়েকটা ফুল তুলে খোঁপায় আটকায় পূর্ণা। মাথার এখানে সেখানে রূপোলি রেখার লুকোচুরি। চুল একটা দুটো পাকছে তবুও সাজতে ইচ্ছে করে আর নিজেকে ভালো রাখতে ইচ্ছে করে। 
             এই হাঁটা পথটুকু পেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে একটু অপেক্ষা তার মধ‍্যেই বাস বা জিপ যা পাবে তাতে করে পৌঁছে যাবে জলঢাকা।

     পূর্ণা আর অনিকেত ওদের একমাত্র ছেলে আনন্দকে নিয়ে জলঢাকাতে থাকে। আগে ওখানকার হসপিটালেই ছিল। মাস ছয়েক আগে কিছুটা দূরে বদলি হয়ে গেছে। অনিকেত জলঢাকার স্কুলেই পড়ায়। আনন্দ সেই স্কুলেরই সেরা ছাত্র। এবার বারো ক্লাসের পরীক্ষা দেবে।
      বাইরে হিমেল হাওয়ার হাল্কা চাদর ছুঁয়ে যায় পূর্ণাকে। তাই চট করে মাথাটা ঢাকে ওর বোনা উলের স্কার্ফে । বেশ একটু শীতের আমেজের ছোঁয়া মাখানো চারিদিক এখন। যদিও আর কদিন বাদেই আসবে বসন্তের হাতছানি।
       পূর্ণার বাড়িতে ফিরতে সন্ধ‍্যে হয় প্রায়ই। সেদিনও আকাশে সন্ধ‍্যা তারা ফুটেছে। বাইরে থেকেই চোখে পড়ে অনিকেত তখনও বাগানে গাছেদের নিয়ে ব‍্যস্ত। সবুজের মাঝে ছোট্ট একটুখানি ভালোবাসার বাড়ি ওদের। অনিকেত বলে শান্তিকুটির। সত‍্যিই বোধহয় অনেকটা ক্লান্তি ভরা দিনের শেষে অনিকেতের কাঁধে মাথা রেখে ছেলেকে কাছে জড়ায় পূর্ণা ওর শান্তিমাখা গৃহকোণে। 
      ওকে দেখেই এগিয়ে আসে অনিকেত,' তোমার অপেক্ষাতেই বাইরে দাঁড়িয়ে আছি সেই কখন থেকে। গাছেদের সাথেই গল্প করে কাটালাম স্কুল থেকে ফিরে। ছেলেটা তো সারাদিন মুখই তোলে না বই থেকে।'
        পূর্ণা না হেসে পারে না সত‍্যিই কিছু মিঠে কথায় মন ভরাতে পারে অনিকেত। তবে ঐ কথাটুকুই তো ভালো রাখে পূর্ণাকে। চোখের ভাষা হয়ত কিছুটা অস্পষ্ট কারণ ওর পাথরের স্থির চোখটা লুকিয়ে রাখে অনেক আবেগ আর দুঃখ হয়ত তাই মুখের ভাষা ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয় সবসময়।
 -' আচ্ছা আর দেড় মাস বাদেই তো ওর পরীক্ষা সেটা খেয়াল আছে? এখন পড়বে না তো কবে পড়বে? তারপর ওর জয়েন্ট দেওয়া আছে। জান তো তুমি কত স্বপ্ন ওর চোখে। আর তুমিই তো ওকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছ।'
    একটু চুপ করে থাকে অনিকেত হঠাৎই মনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়.. আচ্ছা স্বপ্ন দেখা মানে কি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া? অনিকেতের স্বপ্ন একটা ভালো মানুষ হওয়া যার একটা সুন্দর মন থাকবে। কম্পিটিশনের রেসের মাঠে ছুটতে ছুটতে একটা সময় যেন যন্ত্র হয়ে উঠছে ছেলেগুলো তারপর যান্ত্রিকতা কেড়ে নিচ্ছে একটু একটু করে মন, অনুভূতি আর বিবেক বুদ্ধি।
  -' আচ্ছা পূর্ণা,আমাদের ছোটকু নাইবা দিল জয়েন্ট। কি এসে যাবে তাতে? আমার মত ছাত্র পড়ালেই বা কি আছে? ওর মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে প্রতিদিন বাঁচবে কত ছাত্র যন্ত্র হবার হাত থেকে?'
      মুহূর্তে মুখটা পাল্টে যায় পূর্ণার,' এটা ঠিক নয়,ও যদি পারে তাহলে কেন ডাক্তার হবে না? মা নার্স আর বাবা শিক্ষক বলে কি ওকেও শিক্ষক বা কেরাণী হতে হবে? আর ওর স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া তুমি নিজের মত করে ওকে ভাবতে দাও। ঠিক একদিন ও অনেক বড় ডাক্তার হবে।'
      স্বপ্ন দেখতে দেখতে পূর্ণার মুখে খেলা করে রামধনুর সাত রঙের ছবি। অনিকেতের বুকে একটু হলেও রক্তক্ষরণ হয়। ছোটবেলায় রঙ তুলি আর কবিতার বই নিয়ে ছেলেটার কত সময় কেটে যেত। প্রথম যেদিন হাত বাড়িয়ে অনিকেতের কলমটা ধরেছিল আনন্দ মন ভরে গেছিল বাবা হিসেবে। বলেছিল,' কার ছেলে দেখতে হবে তো,মাস্টারমশাইয়ের ছেলে তো কলমই ধরবে। সেই ছেলের হাতে রঙ পেন্সিলের বদলে ছুরি কাঁচি ধরিয়ে দিতে চায় পূর্ণা। আর ছেলেটাও মেতেছে সেই খেলাতে। ওর ছোটবেলায় কেনা প্রিয় লেখকদের গল্পের বইগুলো এখন মাঝে মাঝে রোদে দিয়ে যত্নে আলমারিতে সাজায় অনিকেত। 
              মায়ের কথার শব্দে পড়া ছেড়ে উঠে এসেছে আনন্দ এই সময়টা ওর ব্রেক। অনিকেত আগে থেকেই চা বানিয়ে ফ্লাক্সে ভরে রাখে তারপর পূর্ণার হাতের জমজমাট মুড়িমাখার সাথে বেশ কিছুক্ষণ চলে সারাদিনে কে কি করেছে সেই গল্প।
   ' দেখি দেখি মা তোমাকে আজ কি সুন্দর লাগছে! খোঁপায় কেমন সুন্দর ফুল লাগিয়েছ। বাবা মাকে দেখেছ?'
  -' না রে তোর বাবা আমাকে দেখেই না,কই কিছুই তো বলেনি আমাকে এতক্ষণ?'
-' অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর তোর মাকে আমিই প্রথম দেখব বলে কখন থেকে বারান্দায় আর বাগানে ঘোরাফেরা করছি। শুধু বলতে পারিনি।'
         ওরা বাবা ছেলে হাসছে পূর্ণা ডুবে যায় অতীতে, মনে মনে ভাবে আর কবে তুমি বলবে। তোমার বলব বলব ভাবতে যে সবেতেই অনেকটা দেরি হয়ে যায়।
      আমাকে ভালোবাসতে সে কথা বলতে যদি এত দেরি না করতে...
       আকাশে ততক্ষণে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে দূরে পাহাড়ে টিমটিমে আলোর মালা দেখতে দেখতে আনমনা হয়ে যায় পূর্ণা।
 -' কি গো মা,বাটি তো প্রায় শেষ করে দিলাম আমরা। তুমি খাও। কি ভাবছ এত?'
   তাড়াতাড়ি করে ওদের কথাতে যোগ দেয় পূর্ণা,' হ‍্যাঁ তোর বাবা বলছিল খুব পড়াশোনা করছিস সারাদিন ধরে। বাবার কষ্ট হয় তোকে দেখে।'
-' মা আমাকে এখন পড়তেই হবে। কত কম্পিটিশন তুমি  জান না?'
 

     তবে সব কম্পিটিশনকে পেছনে ফেলে ওর রেজাল্টে দেখিয়ে দিয়েছিল আনন্দ সবাইকে যে জলঢাকার অনিকেত স‍্যারের ছেলে সেরার সেরা।  
      সেই দিনটার কথা মনে পড়লে খুশিতে হারিয়ে যায় পূর্ণা। ওদের ছোট্ট বাড়িতে কত লোকের সমাগম। সবাই ভিড় করেছে আনন্দকে অভিনন্দন জানাবে বলে। জেলায় প্রথম আর রাজ‍্যে তৃতীয় হয়েছিল আনন্দ।
      সারাটা দিন একটা মিস্টি অনুভূতিতে কেটে গিয়েছিল পূর্ণার। নিজেকে গর্বিত মা বলে মনে হয়েছিল। বারবার ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে ইচ্ছে করেছিল। আজকে যে ছেলে খুশির হাট বসিয়েছে বাড়িতে একটা সময় এই ছেলেটার পৃথিবীতে আসাটাই অনিশ্চিত ছিল। হয়ত অনিকেত না থাকলে পাশে আনন্দকে পৃথিবীতে আনতেই পারত না পূর্ণা। তবে এখন আর অতীতের দিকে তাকিয়ে বর্তমানকে ভারাক্রান্ত করতে চায় না। আনন্দ কাণায় কাণায় ভরিয়ে দিয়েছে ওর মাতৃত্বকে। হেল্থ সেন্টারের সুপারভাইজার অপূর্ণা রায় এখন কাণায় কাণায় পূর্ণ ছেলের গৌরবে। শুধু অনিকেতের পাথরের চোখের ভাষা পড়তে পারে না পূর্ণা। যদিও ছেলের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু বাবা তবুও অনিকেত কেন যেন চায়নি প্রথমে ডাক্তার হোক ছেলে। তবে ওদের মা আর ছেলের ইচ্ছের কাছে আর তেমন মুখ খোলেনি তবুও বলেছিল,' মাঝে মাঝে নিজের স্বপ্নের রঙপেন্সিলের বাক্সটা খুলে দেখিস। মন মেঘলা দিনে খুলে বসিস তোর প্রিয় চাঁদের পাহাড় বা ফেলুদার বই।'
      ছেলেটাকে ছোট্ট থেকে নিজের হাতে গড়েছিল অনিকেত। নিজেও একটা সময় স্কুলের মেধাবী ছাত্র ছিল তবে সংসারের অভাবের জন‍্য ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন কোনটাই দেখা হয়ে ওঠেনি। কোন রকমে টিউশনি পড়িয়ে নিজের পড়ার খরচ জোগাড় করত। আর কতই বা রোজগার হত তখন,সেটা দিয়েই ওর নিজের খরচ আর ওদের মা ছেলের সংসার চলে যেত। একটা সময় অবশ‍্য পূর্ণাও ওর ছাত্রী ছিল। তবে নার্সিং ট্রেনিংয়ে চলে যাবার পর মাঝে মাঝে দেখা হত ওর সাথে। পূর্ণার দিক থেকে তেমন কোন টান না থাকলেও অনিকেতের ভালো লাগত ওকে,তবে অবস্থার কারণে তেমন ভাবে কোনদিনই বলা হয়ে ওঠেনি ওর ভালোলাগার কথা। আজও হয়ত তেমনভাবে নিজের ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলতে পারে না পূর্ণাকে। তবে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হলেও একচোখেই পড়তে পারে পূর্ণার মন। ভালো রাখতে চায় ওকে।

      ********************************
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। আনন্দ এখন সার্জারীর ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। কদিন বাদেই পরীক্ষা শেষে সার্জেন হয়ে বেরোবে আনন্দ। তবে এখানেই থেমে থাকতে চায় না এগিয়ে যেতে চায় আরো। বেশ কিছুটা দূরে হলেও পূর্ণা আর অনিকেত মাঝেমাঝে চলে আসে আনন্দর কাছে। একমাত্র সন্তান,তাকে না দেখে কতদিন থাকা যায়? আনন্দর হাসিমুখটা ভরিয়ে দেয় পূর্ণাকে। কত পরিশ্রম আর চাপ সয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। মাঝে মাঝে নিজেরই অধৈর্য্য লেগেছে পূর্ণার অনিকেতকে বলেছে,' তুমি বোধহয় ঠিকই বলেছিলে, ডাক্তারি পড়ার স্বপ্নের বীজটা একটা সময় ওর মনে আমিই বপন করেছিলাম সেটা না করলেই ভালো হত বোধহয়।'
  -' এমন কেন ভাবছ পূর্ণা, আমাদের ছোটকু খুশি হয়েই পড়াশোনা করছে। কত বড় দায়িত্ব ওর এখন। আমাদের শুধু ওর পাশে থাকতে হবে।'
      চুপিচুপি ছেলেকে মনের কথা জিজ্ঞেস করে অনিকেত,' ছোটকু,কেউ আছে নাকি তোর স্পেশাল বান্ধবী? একদিন নিয়ে আয় দেখি আমিও।'
-' কেউ নেই বাবা,আর থাকলে তোমাকেই আগে বলব। তুমিই তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আবার বান্ধবী!মা সেবার কি কান্ড করেছিল মনে নেই?'
     অনিকেত হাসলেও মনটা একটু ভারী হয়ে যায়। হয়ত কিছুক্ষণের জন‍্য হারিয়ে যায় আনন্দও। জলঢাকাতে ওদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই থাকত মেঘারা। স্কুলে যাবার পথে মাঝে মাঝেই ওর সাথে দেখা হয়ে যেত। মেঘাকে ভালো লাগত ওর। মেঘার দুষ্টুমি,ভাসা চোখ আর বকবকানি ছুঁয়ে যেত ওকে। অনেকদিনই অনিকেতের কাছে অঙ্ক করতে চলে আসত মেঘা। পূর্ণা হসপিটাল থেকে এসে দেখত আনন্দ আর মেঘাকে নিয়ে পড়াতে বসেছে অনিকেত।
   দুই পরিবারের মধ‍্যেও একটা সুন্দর সম্পর্ক ছিল।
        আকাশের রামধনু দেখতে দেখতে আর পাহাড়ের মেঘ কুয়াশায় ভাসতে ভাসতে হঠাৎই একদিন মেঘা ভালোবেসে ফেলেছিল আনন্দকে। কিশোরী বেলার প্রথম প্রেমে ভাসতে ভাসতে অনেক স্বপ্ন দেখেছিল আনন্দকে নিয়ে। কিন্তু মুখোমুখি বলতে পারেনি। পড়ার ফাঁকে প্রথম প্রেমের অনুভূতি জড়ানো একটা চিঠি আনন্দর অঙ্ক বইয়ের পাতার মাঝে রেখে চলে গেছিল। পড়া হয়ে যাওয়ার পর চলে গেছিল মেঘা। ওর বাবা ততক্ষণে চলে এসেছিলেন ওকে নিতে। যাবার আগে একটা চোরা চাউনিতে আনন্দর দিকে তাকিয়েছিল মেঘা,আনন্দ তখনও এক মনে খাতায় অঙ্ক করছে। 
             রাতে চিঠিটা পেয়েছিল আনন্দ অনেকবার পড়েছিল সেই চিঠি। অদ্ভুত একটা শিহরণ হয়েছিল মনের ভেতর। তারপর একটা সময় একটু একটু করে হারিয়েছিল আনন্দও মেঘার কালো চোখের পাতায়। স্কুল থেকে ফেরার সময় ওদের বাড়ির সামনে এসে সাইকেলের বেলটা হঠাৎই বেজে উঠত আনন্দর। অনেকদিন ওর সাইকেলের পেছনে বসেই ওদের বাড়িতে পড়তে চলে আসত মেঘা। কত এলোমেলো কথা হত দুজনের।
     অনিকেত কেন যেন পড়তে পেরেছিল ছেলের চোখের ভাষা কিন্তু কিছু বলেনি। তবে আনন্দর যত্নে গুছিয়ে রাখা ভালোবাসার চিহ্ন মাখা কার্ড আর চিঠি বইয়ের তাক গোছাতে গোছাতে হাতে পড়েছিল পূর্ণার। আর সেবারই ইলেভেনের পরীক্ষায় খারাপ ফল করেছিল আনন্দ। মাকে এতটা উত্তেজিত হতে এর আগে কখনও দেখেনি আনন্দ। রাগে উত্তেজনায় কেঁপেছিল পূর্ণা তারপর বলেছিল,' তুইও আমার বিশ্বাস ভাঙলি শেষে! আমার এতদিনের আশা স্বপ্ন সব শেষ হল। আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না আমার।'
  আনন্দ অবাক হয়েছিল দেখে মাকে। বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল কি এমন করেছে ও যার জন‍্য মাকে মরে যেতে হবে? তবে এখনকার ছেলেমেয়েদের মত উদ্ধত হয়ে প্রতিবাদ করতে পারেনি। শুধু মাকে বলেছিল মেঘা ওর ভালো বন্ধু আর কিছু না। এবার সত‍্যিই পরীক্ষা খারাপ হয়েছে তবে ও সামনের পরীক্ষাতে খুব ভালো করবে একদম প্রমিস। 
  অনেক বুঝিয়ে পূর্ণাকে শান্ত করেছিল অনিকেত।
' কি ছেলেমানুষী করছ পূর্ণা? এখন কত ছোট ওরা ওদের মনে কি এত কিছু আছে? হয়ত শুধু একটু ভালোলাগার ছোঁয়াছুঁয়ি।'
-' ঐ ভালোলাগাতেই অনেক বিপদ ঘটে যায়,তুমি হয়ত জান না কিন্তু আমি জানি। আমি ভাবতেই পারি না ছোটকু আমাকে না জানিয়ে এগুলো লুকিয়ে রেখেছিল। সবাই আমার বিশ্বাস ভেঙেছে।'
 মায়ের কান্নার আওয়াজ পাশের ঘর থেকে ওর কানে এসেছিল,বুঝতে পারেনি বারবার মা বিশ্বাস ভাঙার কথা বলছিল কেন? মায়ের সাথে পরিবারের আর কারো তেমন কোন সম্পর্ক দেখেনি আনন্দ। দাদু দিদা এখন না থাকলেও মামার নামও কোনদিন মায়ের মুখে শোনেনি ও। ছোট থেকেই শিখেছে মা বাবা আর ও এই ওদের পৃথিবী।
      তবে এই ঘটনার পর আনন্দর সাইকেলের বেল আর বাজত না মেঘাদের বাড়ির সামনে এসে। অশান্তি ছড়িয়েছিল দুই পরিবারের মাঝেও। মেঘার পড়তে আসা বন্ধ হয়েছিল,বাড়িতে খুব বকাও খেয়েছিল। মাস ছয়েক বাদে জলঢাকা থেকে অন‍্য কোথাও ট্রান্সফার নিয়ে ওর বাবা চলে গিয়েছিলেন হঠাৎই। তার আগে একদিন লুকিয়ে দেখা করেছিল মেঘা,খুব কেঁদেছিল। আনন্দর প্রথম ভালোবাসা কোন এক মনখারাপের বিকেলে মেঘের তলায় ঢাকা পড়ে গেছিল। তবুও মাঝে মাঝে মেঘার কথা মনে হয় আনন্দর কোন বৃষ্টি ঝরা শ্রাবণের বিকেলে। কে জানে ওরা কোথায় আছে? এভাবেই হয়ত জীবনের জলছবি থেকে মুছে যায় কত নাম।

****************************

       আনন্দর প্রথম পছন্দ পাহাড় আর এই ব‍্যাপারে বাবা ছেলের খুব বনিবনা। তাই পাহাড় থেকে দূরে থাকতে আনন্দর ভালো লাগে না। গতকালই ফোন করেছিল কোন একটা ট্রেকিং গ্ৰুপের সাথে পাহাড়ে ট্রেক করতে যাবে। পূর্ণা প্রথমে একটু কিন্তু করে ওঠে। পরে ভাবে তবুও ভালো সেটা ওদের এই দিকেই। 
-' শোন তোরা তো প্রথমে এন জে পিতেই নামবি তারপর তো ওখান থেকে গাড়ি ধরবি। তারপর তো তোদের ট্রেকিং শুরু। আচ্ছা এত কাছে এসে একবার বাড়ি আসবি না তা কখনও হয় নাকি?'
-' মা সাথে একগাদা ছেলেমেয়ে থাকবে, আমরা একটা গ্ৰুপে যাচ্ছি তো।'
-' তাহলে আমরা গাড়ি করে এন জে পি চলে যাই তাহলে হবে তো? একটু দেখে আসব কতদিন তোকে দেখি না।'
        আর কিছু বলার নেই মাকে। ও জানে মাকে বললেও মা থামবে না। তবুও বলে,' ঐ পাঁচ দশ মিনিটের দেখাতে মন ভরবে না মা। আচ্ছা দেখো তুমি যখন শুনবেই না।'
       অনিকেত একই কথা বলাতে তখনকার মত থামলেও খবরটা শুনে আর না এসে থাকতে পারল না পূর্ণা আর অনিকেত। গজগজ করে পূর্ণা,' এখনকার মেয়েদের শখ মন্দ না। দেখেছ তো একটা বিপদ ঘটালো আর আমার ছেলেটাকে শেষে রক্ত দিতে হচ্ছে।'
         তোর্সা সেন স্মার্ট, সুন্দরী ছিপছিপে বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। পাহাড় ওর প্রথম প্রেম যদিও অনেক ছেলে ওকে দেখে ক্রাশ খায় তবুও ও তেমনভাবে কাউকে এখনও পাত্তা দেয়নি। বাবাকে বলে দিয়েছে পরিস্কার চাকরি করবে। তারপর নিজের ইচ্ছেমত দেশে বিদেশে ঘুরবে ফিরবে। আর বাবা এবং আদরের জিকোকে নিয়ে লাইফ কাটিয়ে দেবে। সত‍্যিই তো ও চলে গেলে বাবাকে দেখবে কে? দুবছর আগেই তো মা হঠাৎই ওদের ছেড়ে চলে গেল একদিন। তবে ওর প্রথম প্রেম পাহাড় যে ওকে এভাবে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে মাথা ফাটিয়ে অজ্ঞান করে দেবে তা ভাবেনি কখনও। এতটাই ব্লাড বেরিয়ে গেছে যে রক্ত পর্যন্ত দিতে হয়েছে। ভাগ‍্যিস আনন্দদা সঙ্গে ছিল তাই প্রথম ট্রিটমেন্ট স্পটেই হয়ে গেছিল আর বাকিটা হসপিটালে। অদ্ভুতভাবে আনন্দদাই ওকে রক্ত দিয়েছিল। 
               প্রথমে তোর্সার ওপর যতই রাগ করুক না কেন। ওকে দেখে আর রাগ করতে পারল না পূর্ণা। এখন কিছুটা ভালো আছে মেয়েটা। আনন্দর থেকে বেশ কিছুটা ছোট। কত আর বয়েস হবে? বাইশ তেইশ হয়ত। আজ আনন্দর জন‍্য সত‍্যিই গর্ব হয় পূর্ণার,ভালো লাগে অনিকেতেরও। আনন্দদের গ্ৰুপে মেয়েটা ছিল বলে হয়ত অনেক বড় বিপদের হাত থেকে বেঁচে গেল এই যাত্রা।
    পূর্ণাকে দেখে মিহি গলায় তোর্সা বলল,' থ‍্যাঙ্ক ইউ আন্টি।
-' আমাকে কেন থ‍্যাঙ্ক ইউ বলছ? তুমি রেস্ট নাও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ। বাড়ি ফিরতে হবে তো।'
-' তুমি ভাগ‍্যিস আনন্দদাকে ডাক্তার করেছিলে তাই তো এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম। আমার মা সবসময় বলত আমাকে ডাক্তার হতে,আমার ভালো লাগত না।'
-' মাকে খবর দিয়েছ?'
 -' আমার মা নেই আন্টি,আর বাবাকে বলতে আমিই বারণ করেছি শুনলেই ব‍্যস্ত হয়ে উঠবে। আর আমি তো এখন ভালো আছি। বন্ধুরা অনেকেই সাথে আছে। ওরাই বলল সামলে নেবে।'
-' নাহ্ এটা ঠিক করনি,একটা খবর দেওয়া উচিত ছিল।'
      আনন্দ ইশারা করে মাকে। পূর্ণা আর কিছু না বলে তোর্সাকে হাত নেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। বারবার ছেলেকে বলে,'তুই ঠিক আছিস তো? কোন কষ্ট নেই তো বাবা। দূর্বল লাগছে?'
-' আমি একদম ঠিক আছি মা,তুমি অযথা এতটা দৌড়ে এলে।'
 অনিকেত আনন্দর মাথায় হাত রাখে ওর পছন্দের আদরটা একবার করে অগোছালো চুলগুলো একটু গুছিয়ে দিয়ে বলে,' এই তো আমাদের আসল হিরো।'

       *************************

মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন কলকাতায় ফিরেও আনন্দকে ভোলেনি তোর্সা‌। সার্জেন হিরোকে কি সহজে ভোলা যায়? তাই মাঝে মাঝেই ফোন করে আর টুকরো মেসেজ করে। তোর্সার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে আনন্দরও দুজনের অনেক পছন্দই সুন্দর মিলে যায় তাই কথাও এগিয়ে চলে ঝর্ণার মত ঝরঝরিয়ে। পাশ থেকে উপল আওয়াজ দেয়, 'জলঢাকাকে তো মাঝেমাঝেই তোর্সা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে। প্রেমে পড়লি নাকি? এবার তো আমি বোধহয় বন‍্যায় ভেসে যাব।'
-' ধুৎ এই বয়েসে আবার প্রেম হয় নাকি? এখন তো সবটাই ক‍্যালকুলেশন।'
   আনন্দ ওর সুরেলা গলায় গেয়ে ওঠে 'প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে'...
-' তাই নাকি বস? তা কে ছিল সে?'
-' ছিল একজন,এখন পাস্ট। কোথায় আছে জানি না। বাট ভুলতে পারিনি প্রথম চোট খাওয়া তো। হোঁচটও বলতে পারিস। হঠাৎই প্রেমে পড়ে হৃদয় ফাটিয়েছিলাম।' দুই বন্ধুর হেসে ওঠে একসাথে হঠাৎই।
           তোর্সার আব্দার ছিল ওর জন্মদিনে ওদের বাড়িতে আসতেই হবে। প্রথমটা একটু আপত্তি করেছিল আনন্দ তবে শেষ পর্যন্ত রাজি হতে হয়েছিল অবশ‍্য সাথে উপলেরও নিমন্ত্রণ ছিল। অনেক খুঁজে পেতে দুটো ট্র‍্যাভেলের বই আর একবাক্স চকোলেট নিয়ে ওদের বাড়িতে যায় দুজনে। বাড়িটা দেখে অবাক হয় আনন্দ, ওদের জলঢাকার শান্তিকুটিরের সাথে এই বাড়ি মেলে না। বাড়িই বলে দেয় তোর্সাদের আর্থিক অবস্থার কথা। উপল ফুট কাটে,' দেখে নাও বস আমাদেরও হয়ত ভবিষ‍্যতে হতে পারে এমন বাড়ি। আর তোমার শ্বশুরবাড়ি।'
-' কি যা তা বলিস! তোর্সা একটা পুচকে মেয়ে এখনও ছেলেমানুষী যায়নি। আমি ওসব ভাবিনি কখনই।'
- ' আচ্ছা দেখা যাক।'
 কলিং বেলে হাত রাখে আনন্দ ভেতর থেকে জিকোর আওয়াজ শোনা যায়। ওকে না দেখলেও ওর মালকিনের কাছে গল্প শুনেই চেনা হয়ে গেছে।
    দরজা খুলে দাঁড়ায় খোদ জিকোর মালকিন। পিঙ্ক গাউনে বেশ লাগছে তোর্সাকে। মাথায় ম‍্যাচিং ব‍্যান্ড বেঁধে বেশ একটা বেবি লুক আর পেছনে ওর বাধ‍্য জিকো ল‍্যাজ নাড়তে নাড়তে অতিথিদের উঁকি দিয়ে দেখছে। বুঝেছে বোধহয় এরা খাস মেহেমান তাই ভদ্র সভ‍্য হয়ে আছে। ঢুকেই তোর্সাকে প্রথমেই হ‍্যাপি বার্থডে জানায় ওরা। ' ইশ্ এতক্ষণে আসার সময় হল! আমি কতক্ষণ ধরে ওয়েট করছি। ডাক্তার মানেই সব কটা টাইমের ব‍্যাপারে যাচ্ছেতাই। এসো ভেতরে।'
          আনন্দর প্রথমে একটু অস্বস্তি হলেও পরে সেটা কেটে গেল কারণ নিমন্ত্রিত তেমন বেশি কেউ নেই তোর্সার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ছাড়া। আর কয়েকজনকে তো ও আগেই চেনে বেড়াতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল। আনন্দ আর উপলের কাছে ওরা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের দলবল।
        আলাপ হল তোর্সার বাবার সাথেও মানে যার একান্ত আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারেনি ওরা। তোর্সা বারবার বলেছে,' বাবা কিন্তু ভীষণ ভাবে এক্সপেক্ট করে তোমাদের সো প্লিজ কাম আনন্দদা অ্যান্ড ইউ টু উপলদা। মানে তোমরা তো আবার মাণিকজোড়।'

        মেয়ের মুখে অনেকবার ছেলেটার নাম শুনেছেন কিন্তু আজ চাক্ষুষ দেখার সুযোগ হল। সত‍্যিই একটা মস্ত বড় উপকার করেছিল ছেলেটা। খাওয়া দাওয়া আর গল্পে সুন্দর সন্ধ‍্যেটা কাটলো অনেকদিন বাদে ওদের সবারই। তোর্সা এসে দুবার আদুরে গলায় বলে গেল,' বাপি আজ তুমি আমার আর জিকোর দিকে দেখছই না আনন্দদা আর উপলদাকে নিয়েই আছ।'
-' তোকে তো সবসময় দেখছি মামণি। আসলে এক প্রফেশনের লোক তো আমরা তাই সুন্দর গল্প জমেছে আর কি। '
       কথা বলতে বলতে বারবারই মুগ্ধ হচ্ছিলেন ডঃ বিদ‍্যুৎ সেন। খুবই ভদ্র ছেলেটা,কি সুন্দর শান্ত আর নম্র অথচ খুবই বুদ্ধিদীপ্ত। কথা শুনে বুঝলেন সাধারণ মধ‍্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। তবে এই ছেলে অনেক দূর এগিয়ে যাবে কারণ ডাক্তারিকে ভালোবেসে ডাক্তার হয়েছে। উপল ছেলেটিও ভালো, তাই বোধহয় দুজনের এত বন্ধুত্ব। উপল ঝাড়গ্ৰামের রাজ পরিবারের ছেলে। তবে আনন্দ কেন যেন মন কেড়ে নিয়েছে ডঃ সেনের। এমন একটা ছেলের সাথে তোর্সার বিয়ে দিতে পারলে ভালো হত। তোর্সার তো দেখতে দেখতে এই বছরে তেইশ হবে। তেমন হলে লন্ডনে পাঠিয়ে এম সি এইচ করিয়ে নিয়ে আসবেন আনন্দকে। উপযুক্ত হবে এই ছেলেটি তোর্সার জন‍্য। কিন্তু মেয়ে তো বিয়ে করবে না সাফ বলে দিয়েছে এদিকে সবসময় আনন্দদার গল্প করছে। দেখা যাক যদি মেয়েকে কোনমতে বুঝিয়ে রাজি করা যায়। তবে আনন্দর হাসি আর কথা ছুঁয়ে থাকে ডঃ সেনকে ও চলে যাবার পরেও। বারবার বলে দেন মাঝে মাঝেই চলে আসতে সময় পেলেই। তোর্সার ভালো লাগবে তাহলে।
      ভবিষ‍্যতের একটা কল্পনার জাল বোনেন মনের মাঝে এত ভালো একটা ছেলেকে সত‍্যিই বাঁধতে ইচ্ছে করে আত্মীয়তার বন্ধনে। দেখা যাক ভবিষ্যত কি বলে? তাছাড়া তোর্সা যদি রাজি হয়।

    মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। সেদিনের পর আর তোর্সাদের বাড়িতে যাওয়া হয়নি ওদের পরীক্ষা,ওটি,এমার্জেন্সী প্র‍্যাকটিকাল ইত‍্যাদি নিয়ে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। মাঝে তোর্সা একদিন এসেছিল কলেজ ফেরত কফি হাউসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে চলে গেল ওদের সাথে বারবার বলে গেল পরীক্ষা শেষে বাড়িতে যেতে।
      
        ******************
-' বাবা জানো আজ কফিহাউসে গেছিলাম, একটু আড্ডা দিলাম আনন্দদা দের সাথে।'
-' তা ওদের আনতে পারতিস তো ধরে।'
-' ওরা খুব ব‍্যস্ত সময় নেই,তাই আমিই গেলাম ছুটে। বলতেই বলল তুই যদি চলে আসিস তাহলে আড্ডাটা হয়। জীবন একেবারে বোঝা হয়ে গেছে।'
  -' বাবা একেবারে তুইয়ে নেমে গেছিস! ওরা কিন্তু অনেকটা বড় তোর থেকে।'
-' তাতে কি হয়েছে ওরা তো দাদার মতই আমি তো দাদাই বলি ওদের।'
     আজকালকার মেয়েদের মনের ভেতর দেখতে পাওয়া বোধহয় ভীষণই শক্ত। তবুও ডঃ বিদ‍্যুৎ সেন বলেন,' আচ্ছা আনন্দকে তোর কেমন লাগে? আমার কিন্তু খুব ভালো লাগে ছেলেটাকে। উপলও ভালো কিন্তু আনন্দ সেরার সেরা। আজকালকার দিনে অমন ছেলে পাওয়া বড় শক্ত।'
-' হ‍্যাঁ ওরা দুজনেই খুব ভালো তবে আনন্দদা সত‍্যিই ভীষণ ভালো। পাওয়া শক্ত সেটা আবার কি?'
-' না মানে বলছিলাম তোর আনন্দকে পছন্দ?'
   বাবার কথা শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ে  তোর্সা,ওর ঝাঁকড়া চুলে দোলা লাগে। চোখে খেলা করে দুষ্টুমি ভরা হাসির ঝিলিক।
 -' পছন্দ মানেটা কি শুনি? আনন্দদাকে সত‍্যি আমার ভীষণ পছন্দ। তবে তুমি কি বলছ শুনি? মানে তুমি কি আমার বিয়ে দেবে নাকি আনন্দদার সাথে? একটু পরিস্কার করে বল তো?'
-' নাহ্ কি আর বলব,মানে এমন একটা ছেলেকে বেশ কাছের করে পেতাম ভালো হত আমার পাগলী মেয়েটার জন‍্য।'
-' বাবা সত‍্যিই তুমি পারো বটে। আমি বলেছি না বিয়ে করব না। আমার একমাত্র প্রেম পাহাড়ের সাথে।'

     তোর্সা যাই বলুক না কেন মনের ইচ্ছেটা মনে চেপে রেখেই আনন্দ পরীক্ষার পর একদিন আসতেই ওর কাছ থেকে ওদের বাড়ির ফোন নম্বরটা নিলেন। আনন্দর একটু অবাক লাগাতে জিজ্ঞেস করেই ফেললো কারণটা।
-' আরে তেমন কিছু না আমি তো মাঝেমাঝেই যাই ওদিকে একবার ইচ্ছে রইল তোমাদের বাড়ি যাবার। তাই একটু আলাপ করতে চাই। আর সত‍্যি বলতে কি তোমার সাথে কথা বলে এত আনন্দ পাই মনে হয় একবার দেখি তোমার মা বাবাকে।'
   বাবা মায়ের কথা শুনে ভালো লাগে ওরও। সত‍্যি বাবা মা পাশে না থাকলে আজ এখানে পৌঁছতে পারত না।

    মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন বাড়িতে এসেছে অনেক দিন বাদে আনন্দ। পরীক্ষার পর একান্ত অবসর বহুদিন বাদে। উপলও বাড়ি গেছে। আবার কবে ওর সাথে দেখা হবে জানে না। পূর্ণা আর অনিকেতের মনে খুশির হাওয়া যাক অনেকদিন বাদে ছেলেটা কাছে আছে। নিজের কাজের ফাঁকেই ছেলের পছন্দের রান্না করতে ব‍্যস্ত পূর্ণা। সন্ধ‍্যেবেলা আবার জমজমাট আড্ডার আসর বসে গল্পে কেটে যায় বেশ অনেকটা সময়। 
          সেদিন সন্ধ‍্যের আড্ডার পর পূর্ণা রান্নাঘরে ব‍্যস্ত। অনিকেতের ফোনটা বাজছে অনেকক্ষণ ধরে। নিজের মনে বকবক করে পূর্ণা,' বাবা আর ছেলে একবার গল্পে বসলে আর দেখতে হয় না। ফোন বাজছে কোন খেয়াল নেই।'
    শাড়ির আঁচলে হাতটা মুছে টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা নিতে গিয়ে ট্রু কলারে ভেসে ওঠা নামটাতে চোখ যায় ওর। কেমন যেন সারা শরীরে একটা কাঁপুনি উঠে মাথাটা ঘুরে যায়। আলমারিটা ধরে নিজেকে সামলায় ততক্ষণে অনিকেত উঠে এসেছে।
     ফোনটা নিতে হাত বাড়ায় ও, পূর্ণা ফোনটা ছেড়ে দিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। তাওয়ার রুটিটা পুড়ে গেছে একদম। গ‍্যাসটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে শুনতে পায় অনিকেত ফোনে কথা বলছে। কি এত ফোনে কথা বলছে? কে এই লোকটা? নামটা যে ওর ভীষণ চেনা।'

    পূর্ণার মনে হল অতীতের বন্ধ দরজাটা হঠাৎই হাট করে খুলে গেছে আর হু হু করে ঢুকছে শীতল উত্তুরে হাওয়া। কেমন যেন জমে যাচ্ছে পূর্ণার হাত পা গুলো। আরেকটা রুটি বেলতে চেষ্টা করে অনেক কষ্টে কিন্তু পারে না। অনেকদিন আগের কতগুলো ঘটনা জলছবির মত ভাসতে ভাসতে আবার মনের মাঝদরিয়ায় বান ডেকেছে। তবুও নিজেকে সামলায় পূর্ণা আস্তে আস্তে গিয়ে দাঁড়ায় অনিকেতের কাছে। 
    নিজেকে সামলাতে না পেরে জিজ্ঞেস করে পূর্ণা।
  -' কে ফোন করেছিল? কার সাথে কথা বলছিলে এতক্ষণ ধরে?'
 -' তোর্সার বাবা উনি। আরে ছোটকু রক্ত দিয়েছিল যে মেয়েটাকে মনে আছে তো? ছোটকু মাঝে মাঝে নাকি যায় ওদের বাড়িতে। অনেক প্রশংসা করলেন ওর। মনে হয় আরও কিছু বলতে চান একটু ছোঁয়া দিলেন তার। আমাদের বাড়িতেও আসবেন বললেন।'
  -' অনেক কিছু মানে কি? কিসের ছোঁয়া? হঠাৎই আমাদের বাড়িতে আসবেন কেন?'
 অনিকেতের মুখে হাল্কা হাসির ছোঁয়া,' মনে হল আনন্দকে খুব পছন্দ ওঁর মেয়ের জন‍্য। তবে বাকিটা আমি কি করে বলব? তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস কর?'
     
     'তোর্সাদের বাড়িতে তুই কেন যাস? আমাদের ফোননম্বর দিয়েছিস কেন ওর বাবাকে? তুই কি তোর্সাকে পছন্দ করিস?'
  মায়ের অনেকগুলো প্রশ্নে অবাক হয়ে বই থেকে মুখ তোলে আনন্দ এই কয়েকটা মাসকে কাজে লাগাতে চায় ও তাই পড়াশোনা চলছেই। মায়ের মুখটা কেমন যেন পাল্টে গেছে। অনেক বছর আগে এমন চেহারা দেখেছিল মায়ের যখন ও মেঘার সাথে মিশত। মা এত পজেসিভ কেন? ও কার সাথে মিশবে তা কি এখনও মা ঠিক করবে?
   তবুও নিজেকে সংযত করেই বলে,' হ‍্যাঁ তোর্সাদের বাড়ি গেছি দু তিন দিন। আঙ্কেল খুবই ভালোবাসেন আমাকে। তোর্সার সাথে আসলে আমার অনেক পছন্দ মেলে যদিও অনেকটা ছোট আমার থেকে। তাই কথা বলতে ভালো লাগে।'
-' ওর বাবা কি ডাক্তার?'
-' হ‍্যাঁ, তুমি কি করে জানলে?'
-' তোর বাবাকে ফোন করেছিলেন।'
-' ওহ্ আঙ্কেল ফোন করেছিলেন। হ‍্যাঁ ডাক্তার তো,একদম বিলেত ফেরত ডাক্তার। আমাকেও বলেছেন এম সি এইচটা যেন বাইরে থেকে করে আসি।'
          আনন্দর ঘরের সোফাটায় বসে পড়ে পূর্ণা অনেক কষ্টে গলায় জোর এনে বলে,' তোর্সার ছবি আছে? মানে ওদের বাড়ির?'
-' হঠাৎ তোর্সাকে নিয়ে পড়লে কেন মা? আর ওকে তুমি দেখেছ তো?'
-' নাহ্ তবুও আরেকবার দেখা। ওর ছবি,ওর বাবা মায়ের ছবি।'
 -' ওর মা নেই। কিছুদিন আগে মারা গেছেন। তাই হয়ত ওর প্রতি একটা দূর্বলতাও আছে আমার। বাবাকে তেমন পায় না,মা নেই। সারাদিন কুকুর নিয়েই কাটায় মেয়েটা। এছাড়া আর কিছু না।'
      হঠাৎই কেমন যেন বেপোরোয়া লাগে পূর্ণাকে, 'ছবি দেখাতে বললাম তো তোকে।'
    আর কিছু না বলে তোর্সার জন্মদিনের কিছু ছবি বের করে আনন্দ। হঠাৎই ফোনের পুরো স্ক্রীনটা ঝাপসা লাগে পূর্ণার। তারপর আর কিছু মনে নেই।

***********************

           বেশ ছোটাছুটি গেছে রাতে ওদের বাবা ছেলের। হঠাৎই প্রেসারটা বেশ বেড়ে গেছে পূর্ণার। আনন্দ আর অনিকেত অনেকটা সময় ধরে পাশেই বসে আছে ওর। আনন্দ হাতের মুঠোয় মায়ের হাত ধরে পালস রেট দেখে আবার। নাহ্ অনেকটা শান্ত এখন। যাক কোন কারণে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছিল হয়ত। ঘুমোক শান্তিতে, এখন ঘুমোলেই ভালো। বেশ অনেকটা রাতে বিছানায় যায় আনন্দ কিন্তু ঘুম আসে না। তোর্সাদের বাড়ির ছবিগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ কি এমন হল মায়ের? মা যেন একটু বেশিই পজেসিভ ওর ব‍্যাপারে। হঠাৎই মেঘার কথা মনে হল আবার। এখন আবার তোর্সাকে নিয়ে মায়ের প্রবলেম। কিন্তু কেন?
   পূর্ণা ঘুমোচ্ছে কিন্তু ঘুম নেই অনিকেতের চোখে। হঠাৎ কি হল পূর্ণার? তোর্সার বাবার ফোনের কথা শুনে কেমন যেন ক্ষেপে উঠেছিল পূর্ণা। তারপর আনন্দ বলল ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎই নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
       ক্লান্তিতে চোখটা বুজে এসেছিল,ঢং ঢং করে দেওয়াল ঘড়িতে দুটো বাজে। বাইরে তখন নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। পূর্ণা চোখ খোলে। ঘরের হালকা নীল আলোটা জ্বলছে,ওর সারা শরীরে কেমন যেন আড়ষ্টতা,গলাটা শুকিয়ে গেছে হাত বাড়ায় জল খেতে। ওর হাতটা ধরে অনিকেত,' কেমন লাগছে এখন? তুমি দাঁড়াও আমি জল দিচ্ছি। দেখি মাথাটা একটু তোলো তো।'
       জলটা খেয়ে নিজেকে আর সামলাতে পারে না পূর্ণা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। আগে যতবার এমন করে কেঁদেছে পূর্ণা অনিকেত ওকে বুকের মধ‍্যে জড়িয়ে ধরে বলেছে,' ভুলে যাও সব কথা আমি তো আছি সবসময় তোমার সাথে। আনন্দকে মানুষ করতে হবে তো।'
    আবার বহুদিন পর এমন করে কাঁদছে পূর্ণা। অনিকেতের মনে পড়ে যায় প্রায় আঠাশ বছর আগের একটা দিনের কথা....
   একই পাড়াতে থাকত ওরা অনিকেত পড়াত একটা সময় পূর্ণাকে মনে মনে ভালোবাসত পূর্ণাকে তবে সাহস পায়নি কোনদিন কিছু বলার। কলকাতায় পড়তে গেল পূর্ণা দেখতে দেখতে পা রাখল ফাইনাল ইয়ারে। অনিকেত তখনও চাকরি পায়নি তবুও তার মধ‍্যেই হঠাৎই বিয়ে হয়ে গেল ওদের। টিউশন থেকে ফেরার পথে হঠাৎই দেখা হয়ে গিয়েছিল ওর সাথে,বাইরে তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। অনিকেত জিজ্ঞেস করেছিল,' এত রাতে কোথায় যাচ্ছিস?'
     শুধু ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল পূর্ণা তারপর হনহন করে ছুটে গেছিল স্টেশনের দিকে। অনিকেত হঠাৎই ওর হাতটা চেপে ধরেছিল,'এভাবে এত রাতে কিছুতেই যাওয়া হবে না তোর। কি হয়েছে? কাকু বকেছে?'
        তারপর জোর করেই ধরে এনেছিল ওদের বাড়িতে তারপর সব কথা শুনেছিল। সেদিনও কথায় কথায় অনেকটা রাত পার হয়ে গেছিল কিন্তু নিজের কলঙ্কের পুরো কথা বললেও সেই মানুষটার নাম বলতে পারেনি পূর্ণা। অবশ‍্য অনিকেতও জোর করেনি শুধু বলেছিল,' এখন কি করবি?'
-' আমি বাচ্চাটাকে মেরে না ফেললে বাবা থাকতে দেবে না বাড়িতে। আমি ওকে মারতে চাই না।'
-' তাহলে চল সেই মানুষটার কাছে যে তোর এই অবস্থা করেছে। দায়িত্ব তাকে নিতেই হবে। তুই ভয় পাস না আমি আছি তোর সাথে।'
   -' সে এখানে নেই গত মাসে চলে গেছে বাইরে।'
   -' তুই জানাসনি তাকে?'
    অনিকেতের প্রশ্নের জবাবে কি বলবে ভেবে পায়নি পূর্ণা। ওয়ার্ড ডিউটি করার সময় মাত্র ছমাস আগেই পরিচয় হয়েছিল ওদের। দুজনেরই তখন পড়া চলছে একজন এম এস করছে আর ও নার্সিং। যদিও পেশার ফারাক ছিল তবুও ভালোবাসা হয়ে গেছিল। নিজেকে তখন পৃথিবীর অন‍্যতম সুখী মানুষ বলে মনে হয়েছিল ওর। স্বপ্নে ভেসেছিল এই ভেবে যে ওর ডাক্তার বর হবে। তারপর যৌবনের উন্মাদনায় ভেসে গেছিল দুজনেই। সত‍্যিই তো নিজের ইচ্ছেতেই মিলেছিল ওর সাথে বেশ কয়েকবার। তারপর ও বলেছিল অপেক্ষা করতে। চাকরি পেলে তারপর বিয়ে করবে। কিন্তু না বলে বিদেশে চলে যাবে হঠাৎই সুযোগ পেয়ে তা ভাবেনি পূর্ণা। একটা বাড়িতে ভাড়া থাকত ও সেই সময় অনেকবারই গেছে সেখানে পূর্ণা তারপর একদিন বাড়ি থেকে ফিরে গিয়ে সেখানে গিয়ে একটা চিঠি পেয়েছিল জানতে পেরেছিল ওর ভালোবাসার মানুষ কদিন আগেই দেশ ছেড়েছে। নিজের আবেগের ফল যে এমন হতে পারে তা ভাবেনি পূর্ণা। যখন জানতে পারে ও সন্তানসম্ভবা তখন অনেক খোঁজ করে বিদেশের ফোননম্বর জোগাড় করে ফোন করেছিল উত্তর পেয়েছিল,' আমি তোমাকে জোর করিনি,নিজের ইচ্ছেতে আমার কাছে এসেছিলে,এই মুহূর্তে আমি এইসব নিয়ে ভাবতে পারছি না অ্যবরসন করিয়ে নাও। দরকার হলে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।'

     ভালোবাসার মানুষ টাকা দেখিয়েছিল আর বাড়ির লোক লোকলজ্জার ভয়ে গলাধাক্কা দিয়েছিল কারণ ওর জেদ কিছুতেই বাচ্চাটা নষ্ট করবে না। আত্মগ্লানিতে অবসাদে প্রায় মরতে বসা পূর্ণাকে একদিনের মধ‍্যেই বিয়ে করেছিল অনিকেত। যদিও প্রথমে খুব আপত্তি করেছিল পূর্ণা তবুও রাজি হয়ে গেছিল বাচ্চাটার জন‍্য। ওর অবৈধ সন্তানকে হাসিমুখে কোলে তুলে নিয়েছিল অনিকেত নিজের সন্তানের মর্যাদা দিয়ে। আর কখনও পূর্ণার অতীত নিয়ে কাটাছেঁড়া করেনি অনিকেত শুধু একদিন জিজ্ঞেস করেছিল,' নামটা একবার জানতে পারি তার? সে কে?'
     পূর্ণা বলেনি বলেছিল,' আমাকে আর কোনদিন জিজ্ঞেস করবে না তার কথা। সে অনেকদিন মৃত আমার কাছে।'
     অনিকেতের পাথরের চোখটা কোন অনুভূতি প্রকাশ করেনি শুধু ভেবেছিল সেই মৃত প্রেমিকের সন্তানকে বাঁচানোর জন‍্য কত চেষ্টা মেয়েটার।

      যে মানুষটার নাম কোনদিন অনিকেতকে বলেনি আজ রাতের নির্জনতাকে সঙ্গী করে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বাকি কথাটুকু অনিকেতকে না বলে পারল না। হয়ত আজ না বললে অনেক বড় বিপর্যয় ঘটে যাবে আনন্দর জীবনে।
     পূর্ণার মুখে সব কথা শুনে চমকে ওঠে অনিকেতও,' মানে তুমি কি বলছ! ঐ বিদ‍্যুৎ সেন মানে তোর্সার বাবা আনন্দর বাবা?'
     আনন্দর বাবা কথাটা চাবুকের মত বিঁধে যায় পূর্ণাকে,' না না আনন্দর আসল বাবা তুমি। তোমার কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই।'
    পূর্ণার কথা শুনে হঠাৎই কেন যেন হাসি পায় অনিকেতের। মনে হয় শুধুই ভালোবেসেছিল পূর্ণাকে কোনদিনই লাভ,ক্ষতি,ঋণ নিয়ে ভাবেনি। তাই নিজেকে শক্ত করে বলে,' যা সত‍্যি তা সত‍্যিই, আনন্দ ডঃ বিদ‍্যুৎ সেনের ছেলে। তাই ছেলেকে তুমি ডাক্তার করতে চেয়েছিলে। সত‍্যিই বোধহয় কখনও রক্ত কথা বলে তাই তো হঠাৎই তোর্সার সাথে দেখা হয়ে গেল।'

-' প্লিজ আস্তে কথা বল,আনন্দ শুনতে পাবে।'
-' শুনলে ক্ষতি কি পূর্ণা? আনন্দ বড় হয়েছে ওর উচিৎ এবার ওর আসল বাবাকে চিনে নেওয়া।'
     হঠাৎই দরজাটা খুলে যায়,বাইরে তখন আবছা আলোর লুকোচুরি তারমধ‍্যে আনন্দকে দেখে চমকে ওঠে পূর্ণা।
  -' ঠিকই বলেছ তোমরা এবার বোধহয় আমার আসল বাবাকে চিনে নেওয়া উচিৎ। আর কতদিন আমাকে অন্ধ করে রাখবে মা?'
        অনিকেতের বুকটা কেঁপে ওঠে। বাবা সাজার খেলা সাঙ্গ হওয়ার ঘন্টা শুনতে পায় কোথায় যেন। শহরের নাম করা ডাক্তার বিদ‍্যুৎ সেনের ছেলে আনন্দ। কেন সে এই সামান্য স্কুল মাস্টার বাবাকে বাবা বলে ডাকবে?

   তারচেয়ে বরং ওরা মা ছেলে কথা বলুক। আজ যে পূর্ণাকেই সব বুঝিয়ে বলতে হবে ছেলেকে। দমবন্ধ করা একটা ভোরে খুব অস্বস্তি হয় অনিকেতের খুব ইচ্ছে করে বাগানের খোলা হাওয়ায় একটু নিঃশ্বাস নিতে।
-' তোমরা কথা বল,ছোটকু মাকে দেখিস যেন শরীর খারাপ না করে।'
  হঠাৎই আনন্দ কাছে এসে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে অনিকেতকে,' তুমি কোথায় যাচ্ছ বাবা আমাকে ছেড়ে? আজ যে আমার সত‍্যিকারের বাবার খুব প্রয়োজন।

      মায়ের সাথে আমার কথা বলার মত কিছুই নেই,আমি শুধু তোমাকে চাই বাবা। তুমিই তো ছিলে আমার বেস্টফ্রেন্ড,ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড।'

      অনিকেতের পাথরের চোখটারও আজ বড় জল ঝরাতে ইচ্ছে করছে আসল চোখটার সাথে। নকল বাবা অনিকেত যে আজ সত‍্যিই সত‍্যিকারের বাবা হয়ে উঠেছে।
     সন্তানের কাছে নিজের কালিমাখা মুখটা দেখাতে ইচ্ছে করে না পূর্ণার কখনও ভাবেনি এমন দিন আসবে জীবনে। তাই তো কবেই সবাইকে ছেড়ে এতদূর চলে এসেছে। তবে আজ না বললে হয়ত তোর্সার সাথে আনন্দর...তারপর আর ভাবতে পারে না।

***************************

   বাইরে বাগানে স্থলপদ্ম পাপড়ি মেলেছে,সত‍্যির আলোতে আলোকিত হয়ে আকাশটা বড় উজ্জ্বল। অনিকেত আনন্দকে জিজ্ঞেস করে,' তোর্সার সঙ্গে তোর কোন সম্পর্ক ছিল না তো?'
-' নাহ্ ছিল না। তবে ওকে ভালো লাগত আমার, আসলে আমাদের পছন্দ একরকম ছিল। আজ মনে হচ্ছে ভাগ‍্যিস সম্পর্ক ছিল না। বাবা আজই যে আমাকে কলকাতা যেতে হবে।'
   অনিকেতের মুখে ভাজ পড়ে আবার।
-' ভেবো না, তোমার ছোটকু সব একাই সামলাতে পারবে।'

      গতকালই আনন্দ চলে গেছে,পূর্ণা কেন যেন আর বিশেষ কিছু বলতে পারেনি। শুধু ভয় পেয়েছে,কি করতে চায় ছেলেটা কে জানে?

        আনন্দ প্রথমে ভেবেছিল একটা চিঠি লিখবে ডঃ বিদ‍্যুৎ সেনকে। তারপর ভেবেছে নাহ নিজেই গিয়ে দাঁড়াবে একদম সামনে।

    সবটা শুনে প্রথমটা অবিশ্বাস্য লাগলেও আনন্দর কঠোরতার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ অসহায় লাগল প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই ডঃ বিদ‍্যুৎ সেনের।
 তবুও বলেছিলেন প্রথমে---
-' পূর্ণা? কোন পূর্ণা? আমি কাউকে চিনি না এই নামে।'
 আনন্দর মুখে ব‍্যাঙ্গের হাসি খেলে যায়,' তাহলে অপূর্ণাকে বোধহয় মনে আছে আপনার। একটা সময় ছাত্র সার্জেনের প্রেমিকা ছিল যে ট্রেনি নার্সটি?'
    এসিতে থাকলেও ঘাম জমে শরীরে।
   ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করেন,' তুমি কে? মানে পূর্ণা তোমার কে?'
 -' আমার মা অপূর্ণা আর আমি সেই কুমারী মায়ের সন্তান যাকে একদিন আপনি মেরে ফেলতে টাকা পাঠিয়ে দেবেন বলেছিলেন। ছিঃ,ভাবতেও লজ্জা করছে আমার। তবে আমার সত‍্যিকারের বাবা জলঢাকার অঙ্ক স‍্যার অনিকেত বাবু। আর আপনাকে আমি ঘৃণা করি। ভাগ‍্যিস আমি আমার নিজের বাবার মত নাহলে হয়ত আপনার মত তোর্সার সাথেও বেড শেয়ার.....ইশ্ ভাবতে পারছি না জাস্ট।'

    ছেলেটা একরাশ ঘৃণা ছিটিয়ে অনেকক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে। কতক্ষণ ঘোরের মধ‍্যে বসে ছিলেন জানেন না হঠাৎই ফোনটা বেজে ওঠে,সমানে রিঙ হয়ে যায়। আচ্ছন্নের মত ফোনটা ধরেন ওপার থেকে ভেসে ওঠে..' হ‍্যালো বাবা তোমার চেম্বার হয়ে গেছে? তাড়াতাড়ি এসো আজ তোমার বার্থডে সে খেয়াল আছে? খেতে বেরোব তো আমরা।'
-' হ‍্যাঁ রে আসছি আমি।'
    গাড়িতে বসে ভাবনার অতলে তলিয়ে যান ডঃ সেন। যে সন্তানকে একদিন আবর্জনা বলে মারতে চেয়েছেন, অপূর্ণাকে সামান‍্য নার্স বলে পাত্তা দেননি এতবছর বাদে তার সন্তানই আজ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বড় ভালোবেসে ফেলেছিলেন আনন্দকে। সবটা শোনার পর ওকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছিল আমাকে ক্ষমা করে দে বাবা।
         কিন্তু ওর চোখে আজ শুধু ঘৃণা। তবুও একটু যদি একবারের জন‍্য জড়িয়ে ধরতে পারতেন ওকে। ভাগ‍্যিস তোর্সার বিয়েটা হয়নি ওর সাথে...ভেবেই বুকটা কাঁপে। ওরা তো ভাই বোন।

*******************************
  মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। অনেকবার চেষ্টা করেও আনন্দকে ফোনে পায়নি তোর্সা। অদ্ভুতভাবে হারিয়ে গেল আনন্দদা। উপলদাকে ফোন করেও আনন্দদার কোন হদিস পায়নি। 

           বাগান থেকে সাজিতে ফুল তুলেছে মন ভরে পূর্ণা। জীবনে একটা সাঙ্ঘাতিক ঝড় উঠেও তা থেমে গেছে আবার সব চলছে আগের মতই। শুধু আনন্দ চুপচাপ পড়াশোনা করছে সামনেই ওর এমসিএইচ পরীক্ষা। অনিকেত যদিও বলেছিল বাইরে পড়তে যেতেও পারে আনন্দ তবে দেশে থেকেই পড়াশোনা করতে চায় আনন্দ। ফুল তুলে বারান্দায় পা রাখতেই গাড়ির শব্দে পেছন ফেরে পূর্ণা। একবার দেখেও চিনতে ভুল হয় না তোর্সাকে। আবার বুকটা কেঁপে ওঠে। আনন্দ কলকাতায় কেন গেছিল? কি করেছে ওখানে? ও তেমন কিছু বলেনি আর এতদিন ওরাও কিছু জিজ্ঞেস করেনি। অনিকেতই বলেছিল কিছু না জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু এই মেয়েটা এখানে কেন হঠাৎ? কি চায় ও?

    পূর্ণার মনে জমা প্রশ্ন বেশ রুক্ষতার সাথে বাইরে এসে ধাক্কা খায়।
-' তুমি এখানে কেন? কি চাই?
-' যদি বলি আমার মা নেই তাই তোমার কাছ থেকে একটু মায়ের আদর আর আনন্দদার কাছ থেকে দাদার ভালোবাসা পাব বলে এসেছি। আমাকে ফিরিয়ে দেবে মণি মা?'
    অনেকটা রুক্ষতা ভেদ করেও নরম মাটির স্তর ভিজে বেশ কিছুটা শীতল জল এসে ভিজিয়ে দেয় পূর্ণাকে। বুঝতে পারে আনন্দর মত তোর্সার কাছেও আজ খুব পরিস্কার সত‍্যিটা।
   ততক্ষণে আনন্দ আর অনিকেত বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। আনন্দকে দেখে তোর্সা অনুযোগের সুরে বলে,' দাদা এভাবে আমাকে কষ্ট দিলে? কত খুঁজেছি তোমাকে তারপর ঠিকানা নিয়ে একদম চলে এলাম।'

    বাবার আনন্দদার আর মণিমার সামনে দাঁড়াতে সাহস না হলেও তোর্সা হারাতে চায় না ওর হঠাৎই খুঁজে পাওয়া দাদাকে। তাই তাড়াতাড়ি করে আনন্দর হাতে পরিয়ে দেয় রাখী আজ যে রাখী পূর্ণিমা।
   আনন্দ প্রথমে হাতটা সরিয়ে নিলেও অনিকেত ওর হাতটা ধরে এগিয়ে দেয় তোর্সার দিকে।

   মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো মাস। আনন্দ আর তোর্সার মাঝে কখন যে জড়িয়ে গেছে ভাইবোনের বন্ধন হয়ত ওরা কেউ বুঝতেই পারেনি। বেশ কয়েক মাস হল আনন্দ মুম্বাইয়ে টাটা মেমোরিয়াল হসপিটালে এমসিএইচ করতে গেছে। উপলের ফোনের ইনবক্সে আজকাল তোর্সার আদুরে প্রেমের গল্পে মাখামাখি। 
শুধু ডঃ সেনের মাঝে মাঝেই আনন্দর কথা বড় মনে পড়ে। বড় ভালোবাসতে আর কাছে পেতে ইচ্ছে করে ছেলেটাকে। পূর্ণার কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করে হাতজোড় করে। যদিও জানেন তা কোনদিন হবার নয়। ভালো থাক ছেলেটা ওর সত‍্যিকারের বাবার সাথে। তবুও একটা কথা ভেবে শান্তি হয় ওঁর অবর্তমানে অন্ততঃ একলা হয়ে যাবে না তোর্সাটা। হঠাৎই খুঁজে পাওয়া দাদাটা থাকবে ওর আসেপাশে। মনে মনে বলেন,ভালো থাক ওরা বেঁচে থাক ওদের ভাইবোনের সম্পর্ক।

*********************

       অনেকদিন বাদে পুজোতে বাড়ি ফিরছে আনন্দ। হ‍্যান্ডব‍্যাগটা ওপরে তুলতে বেশ অসুবিধে হয় পাশে রাখা লাগেজের জন‍্য। ও যখন ব‍্যাগ তুলতে ব‍্যস্ত হঠাৎই একটা সুরেলা স্বর শুনতে পায়,' মে আই হেল্প ইউ?'
      মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর তবুও ঝর্ণার মত সুরেলা গলাটা বড় চেনা লাগে আনন্দর। এক ঝলক তাকাতেই নজরে পড়ে ঠোঁটের ওপরের তিলটা।
 নিজের অজান্তেই বলে ফেলে,' মেঘা না? '
   এয়ারহোস্টেসের দুষ্টুমি ভরা হাসি আর বুকের পাশে লেখা নামটাই বলে দেয় অনেক কিছু।
      ডিউটির ফাঁকে টুকরো কথায় আনন্দ জানতে পারে মেঘা আজও ওকে মিস্ করে তাই হয়ত আর কেউ আসেনি ওর জীবনে। আকাশের বুকে এদেশ থেকে ওদেশে ভেসেই কেটে যাচ্ছে বেশ জীবন।

      মেঘের দেশ থেকে মাটিতে পা দিয়েও আনন্দর মন জুড়ে রয়ে যায় হঠাৎ মেঘাকে দেখার স্মৃতি। তবে ফোন নম্বরটা নিতে আর ভুল করেনি।
     বাড়িতে ঢুকতেই ফোনটা বেজে ওঠে আপন খেয়ালে স্ক্রীন জুড়ে ভেসে ওঠে মন ভালো করা নীল মেঘ। কথা শুনে পূর্ণা বুঝতে পারে ওপারে কোন মেয়ে,অনিকেতের দিকে ইশারা করে হাসে।
      অনিকেতও হাসে,' ছোটকু ওপারে কে? মনে হচ্ছে বিশেষ কেউ? এমন তো কথা ছিল না। বেস্টফ্রেন্ড কিছুই তো জানে না।'
-' হ‍্যাঁ বাবা,শুনলে তুমিও অবাক হবে আজ হঠাৎ মেঘার সাথে দেখা হল ফ্লাইটে। ও এয়ারহোস্টেস। কি আশ্চর্য ব‍্যাপার বল তো। এই তো এলাম বলার সুযোগ পেলাম কই?'
  পাশ থেকে পূর্ণা বলে,'আমাকে একটু মেঘার সাথে কথা বলাবি? অনেক বড় অপরাধ করেছি। আজ কেন যেন খুব হাল্কা লাগছে। সত‍্যিই বোধহয় পৃথিবীটা গোল।'
   অনেকদিন বাদে মা বাবার মাঝে দাঁড়িয়ে দুহাতে ওদের জড়িয়ে আনন্দ বলে,' অমন কথা বোল না মা। তোমরা ছিলে বলেই তো জীবনে এগিয়ে যেতে পেরেছি। আদরের সাথে সাথে শাসনটাও যে দরকার ছিল তখন।'
     চোখটা ভেজে অনিকেত আর পূর্ণার,হয়ত এখানেই সন্তান মানুষ করার স্বার্থকতা। 
সমাপ্ত:-

        

     
     
   
  



      

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...