চওড়া লালপাড় গরদের আঁচলে রূপোর মাছে আটকানো চাবির গোছাটা ঝুমঝুমিয়ে বেজে উঠল আরেকবার তার সাথে নাকের নথটাও দুলে উঠলো বিশাখার। নিজেই গজগজ করেন কিছুটা আপন মনেই। চারদিকে ছোটাছুটি করে আর যেন পারা যাচ্ছে না।
আরেকবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেন ভালো করে হ্যাঁ সব ঠিক আছে চারদিক একদম ভরা ভরন্ত। শুধু নতুন বৌ যখন রান্নাঘরে ঢুকবে তখন দুধ উথলানো দেখালেই মোটামুটি রান্নাঘরের নিয়ম সারা।
সেই দায়িত্বটা অবশ্য ছোট জাকে দিয়েছেন বিশাখা। সবাই মিলে না করলে সত্যি পেরে ওঠা যেত না। তিন জা মোটামুটি হাত লাগিয়েছে সব কাজেই। যদিও এক বাড়িতেই সবার আলাদা সংসার এখন তবুও বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা তাই সবাই এগিয়ে এসেছে আনন্দ করেই।
একটু বাদেই ওরা চলে আসবে। আয়নাতে একবার নিজেকে দেখে নেন বিশাখা এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলটাকে একটু সাজিয়ে নেন। মাথার ঘোমটা টেনে নেন খোঁপা পর্যন্ত। মেয়ে সব গুছিয়ে দিয়ে গেছে কি কি পরবে। বিশাখার এক ছেলে এক মেয়ে। রূপাঞ্জন বড় আর অঞ্জলি ছোট। বারবার বলে গেছে ফটোশুট হবে তাই মা যেন ভালো করে সেজে থাকে। বিউটি পার্লারে গিয়ে ঘষামাজা করা খুব একটা পছন্দ নয় বিশাখার তবুও মেয়ের আব্দারে খোঁপা বাঁধতে হয়েছে সাধারণ করে শাড়ি পরতে হয়েছে। মোটামুটি আজ সাবেকি শাশুড়ি সাজে বিশাখা। আর শাড়ি গয়না নথ নাড়িয়ে চলছে ছোটাছুটি। শিবশঙ্কর অবশ্য একবার এসে বলে গেছেন বেশি ছোটাছুটি না করতে যা হবার তার সবই হবে আছে তো সবাই।
মুখ নাড়া দিয়েছে বিশাখা,'সংসারটা তো আমার,ওদেরকে না বলে দিলে ওরা সব করবে কি করে শুনি? তুমি তো বলেই খালাস। তোমার মায়ের আমল থেকে যে নিয়ম চলে আসছে তা ভাঙি কি করে শুনি?'
-' তা তুমি যা খুশি কর,আমি না করছি না তবে এরা সব এখনকার দিনের ছেলে মেয়ে অত নিয়ম মানবে কেন শুনি? একটু নিয়মে ছাড় দাও এবার থেকে।'
-' ছাড় দাও বললেই ছাড়া যায় নাকি? একটা মাত্র ছেলে আমার তার মঙ্গল অমঙ্গল নেই নাকি? সব হবে যেমন শিখেছি শাশুড়ির কাছে। আমাদের কম নিয়ম করতে হয়েছিল নাকি?'
বিশাখার সাথে কথায় পারা মুশকিল তাই রণে ভঙ্গ দিয়ে শিবশঙ্কর পা বাড়ান বাইরে শুধু হাসতে হাসতে বলে গেলেন,' আচ্ছা বেশ যা করার করে যাও তবে দেখো প্রথম দিনেই মেয়েটা ঘাবড়ে না যায়।'
রূপোর মাছখানা আঁচলে আবার শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে মনে মনে ভাবেন বিশাখা শেখার শুরু প্রথম থেকে হওয়াই ভালো তাহলে আর পরে অসুবিধা হবে না।
উত্তর কলকাতার সিংহরায় বাড়ির ছেলের বৌ হয়ে আসছে দক্ষিণ কলকাতার সোমলতা। রূপাঞ্জনের সাথে বছরখানেক ধরে পরিচয় থাকলেও এর আগে কখনও ওদের বাড়িতে আসেনি। অবশ্য বিশাখা আর শিবশঙ্কর মেয়ে দেখে এসেছেন মোটামুটি তিন দফায় আত্মীয় স্বজন নিয়ে। মেয়ের বাড়ি দেখে প্রথমে একটু নাক উঁচু করলেও ছেলের দাবীর কাছেই হার মানতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত ঐ মেয়েকেই ছেলে বিয়ে করবে।
রূপাঞ্জনদের বড়বাজারে গয়নার দোকান হলেও রূপাঞ্জন কলেজে পড়ায় আর পি এইচ ডি করতে গিয়েই আলাপ হয়েছিল জুনিয়র সোমলতার সাথে। তারপর কিছুদিন কাজের ফাঁকে ঘোরাঘুরি আর প্রেমালাপের বন্যায় ভেসে যাওয়া তারপর দুই বাড়ির ইচ্ছেতেই একদম ছাদনাতলায়।
বিশাখার ইচ্ছে ছিল মোটামুটি বি.এ বা এম এ পাশ হবে মেয়ে। শিক্ষিত হবে অথচ ঘরেই থাকবে,সংসারের নিয়ম কানুন শিখে সংসারকে চালিয়ে নিয়ে যাবে। যত্ন করবে স্বামী আর শ্বশুরশাশুড়ির। হালখাতার সময় গা ভর্তি গয়না পরে দোকানে গিয়ে পুজোর জোগাড় করবে। কিন্তু মেয়ে পিএইচডি করছে শুনে কেমন যেন একটা লেগেছিল।
ছেলেকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়েছিল,' হ্যাঁ রে ও কি তোর সমান নাকি পড়াশোনাতে?'
শুক্তো দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে উত্তর দিয়েছিল রূপাঞ্জন,' আমার থেকে জুনিয়র ও এখনও তো ওর কমপ্লিট হয়নি বাকি আছে।'
বাকি আছে শুনে একটু স্বস্তি পেয়েছিলেন বিশাখা যাক বিয়ের পর সবই যাবে জলে হয়ত। তাঁরও তো উচ্চ মাধ্যমিক দেবার পর আর পড়া হয়নি।
খুশি হয়েছিল জলি মানে অঞ্জলি,' মা কত শিক্ষিত বৌদি আসবে আমাদের তাই না?'
-' হ্যাঁ মা,তবে তোমার কিন্তু এই বি এ পাশের পরেই বিয়ে দেব। জান তো তোমার বাবার বয়েস হচ্ছে তাই ছেলে মেয়ের বিয়ে দিয়ে এবার নিশ্চিন্ত হতে চাই।'
-' আমিও দাদার মত পড়ব মা। তাছাড়া বৌদিভাইও তো আসছে কত পড়াশোনা জানা আমিই বা কম পড়াশোনা শিখব কেন?'
এক ধমকে মেয়েকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন বিশাখা,' চুপ কর বেশি বকবক করিস না। সবই ওকে দাদার মত করতে হবে যেন। আরে দাদা ছেলে আর তুই হচ্ছিস মেয়ে সুখে ঘর সংসার করবি।'
মায়ের কথা শুনে মুখ ফুলিয়েছিল অঞ্জলি কিন্তু ভয়ে কিছু বলেনি।
বিয়ের আনন্দে কদিন সবাই বাঁধন ছাড়া। লোকজনে বাড়ি গমগম করছে একদম। বিশাখার কাছে খবর এসেছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়ছে ওরা। জায়েদের তাড়া দেয় আবার বিশাখা,' ওরে রান্নাঘরের সব সারলি তো এতক্ষণ এবার একটু গয়না শাড়ি পর বৌমা নিয়ে জন( রূপাঞ্জনের ডাক নাম) কিন্তু একটু বাদেই আসছে ফোন করেছিল।
ওদিক থেকে সাড়া আসে,' হ্যাঁ দিদি,আসুক না ওরা আমাদের তো সব গোছানোই আছে এক্ষুনি রেডি হয়ে নিচ্ছি আর তুমি তো রেডিই একদম।'
একটু বাদেই বাইরে বাজনার আওয়াজ শোনা যায়। জনের মত না থাকলেও বাড়ির নিয়ম বাজনা তো করতেই হয় তাই কোন ত্রুটিই রাখেননি বিশাখা। বাজনার আওয়াজ শুনে মুখ টিপে হাসে সোমলতা,' বেশ লাগছে কিন্তু এখন মানে রয়্যাল রয়্যাল ভাব। তোমাদের বাড়িতে ড্যাং ড্যাং করে বাদ্যি বাজছে।'
মুখ টিপে হাসে জন,' নতুন বৌকে এসব বলতে নেই সবই মায়ের ইচ্ছে। ভালোই তো বিয়ে তো একবারই হবে না হলে একটু জমকালো বিয়েই হোক।'
শাশুড়িদের লাইন দেখে বেশ লাগলো সোমলতার। সবাই কি সুন্দর লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ওদের অপেক্ষায় পরনে সুন্দর জড়ির লাল পাড়ের শাড়ি। মনে হয় এক দোকান থেকে কেনা। ভালোলাগার সাথে সাথে আবার হাসি পায় সোমলতার খুব ইচ্ছে করে মোবাইলে একটা ছবি তুলতে শাশু মায়েদের। তবে নতুন বৌ ও সুতরাং বাধ্য মেয়ের মত গাঁটছড়া সামলে বরের পাশে এসে দাঁড়ায়। মায়ের কথা খুব মনে পড়ল। মায়ের এইরকম যৌথ পরিবারে বিয়ে করা নিয়ে খুব আপত্তি ছিল। বারবারই বলেছে,' উত্তর কলকাতার মানুষ ওরা তারপর একটা শরিকি বাড়িতে সবাই থাকে তুই কি পারবি ওদের মাঝে মানিয়ে নিতে? পড়াশোনাটা না শেষ হলে কিন্তু খুব খারাপ লাগবে আমার।'
ভালোবাসার স্বপ্নের কাছে তখন সবটাই আবছা লেগেছিল মায়ের আদরের সমুর। তাই সপাটে উত্তর দিয়েছিল সব সামলে নেবে। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে বাড়িতে পা দিয়ে নিয়ম সামলাতে সামলাতে অস্থির হয়ে যায়। অবশ্য পাশ থেকে ননদ আর দেওরের দল বলে,' বৌদি খেলে যাও একদম ফুল এনার্জিতে আমরা তো আছিই। ছক্কাটা তোমাকেই মারতে হবে।'
নতুন বৌমার সাথে রান্নাঘরে ঢুকেছে শাশুড়িরা অনেক কষ্টে করা রান্নাবান্নার ঢাকা সরিয়ে সরিয়ে দেখাচ্ছে ওকে তার মাঝেই কিছুটা দুধ উথলে একাকার হল। এটা নাকি শুভ ইঙ্গিত। একটানা ভরা ভরা দেখছি সব বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সোমলতা। ওর বরটা একদম হাওয়া ফিল্ড থেকে এখন। খেলার ময়দানে ওকে একা ছেড়ে দিয়ে বেশ আছে। ছোট ননদ দেওররা মায়েদের বকার ভয়ে রান্নাঘরে ঢোকেনি। চারদিকে খাবার দেখতে দেখতে খিদে পেয়ে যাচ্ছে,ওহ্ এক কাপ চা পেলে বেশ হত হঠাৎই মনে হল ইউনিভার্সিটির উল্টোদিকে রাজুদার চায়ের কথা,মনে হতেই আনচান করে উঠলো খাঁচাবন্দি হৃদয় খানা। তখনও রান্নাঘরে দেখানোই চলছে হঠাৎই ফোনটা বেজে ওঠে। বিশাখা গম্ভীর মুখে তাকান একবার তারপর বলেন,' এদিকটা হয়ে যাক তারপর কথা বলবে। শুভকাজে কথা বলতে নেই।'
-' কাকিমা এক মিনিট বাবা ফোন করেছে মনে হয় কিছু দরকার আছে আমি একটু শুনে নিই নাহলে মন দিতে পারব না দেখার ব্যাপারে।'
কাকিমা ডাকটা শুনে একটু অস্বস্তি হয় বিশাখার সত্যিই যুগ বদলাচ্ছে নিজের মা ছাড়া অন্যের মাকে আজকালকার ছেলেমেয়েরা মা বাবা বলতে চায় না।
ফোনটা ধরেই হঠাৎই চেঁচিয়ে ওঠে সোমলতা...' একদম চার মেরেছে, কি বলছ বাবা! উঃ আমি যদি একটু দেখতে পেতাম।'
রান্নাঘরের বাইরে থেকে জলি বলে,' কে চার মারলো বৌদিভাই? খেলা হচ্ছে নাকি?'
মেয়েকে ধমকে বৌকে থামিয়ে দিলেন বিশাখা হঠাৎই,' চুপ করবি তোরা,কাজটা তো সারতে দে নাকি?'
শাশুড়িমায়ের হঠাৎ শাসনে চুপ করে যায় সোমলতা বাকি কাজটুকু সেরে নেয় লক্ষ্মী হয়ে। যদিও ভেতরে ভেতরে সমানে উশখুশ করল কতক্ষণে আবার বাবার সাথে কথা বলতে পারবে। বিশাখা বুঝতে পারলেন ফোন আসার পর থেকেই মন উড়ু উড়ু মেয়ের এই এত শিক্ষিত মেয়েকে সংসারে বাঁধাই মুশকিল।
ওর ছোট জা ততক্ষণে বলে,' দিদি সবই মোটামুটি দেখানো হয়ে গেছে গো। এবার ওকে ছেড়ে দিই। আর তোমার ওদিকে যা যা করানোর আছে সেগুলো শেষ করে তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ছাড়ুক।'
ছোট কাকিমার কথায় একটু ভরসা পেল সোমলতা যাক তবুও একজন জামাকাপড় ছাড়ার কথা বলেছে। ওহ এই মোটুসোটু বেনারসী খানা পরে আর ভালো লাগছে না। সত্যি বিয়ে করা এক মস্ত হ্যাপা। ওরা বাইরে বেরোতেই ননদ আর ছোট দুই দেওর ওর কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,' ও বৌদিভাই কে চার মেরেছে গো? যাক তুমি কিন্তু বেশ খেলেছো রান্নাঘরে।'
ওদের কথা শুনে আবার উত্তেজনা ফস করে কোল্ডড্রিংকেসের বোতলের মত বেরিয়ে আসে সোমলতার,' আমাদের মুন্টি সোনা রে। আরে কাল থেকে খোঁজ নেই তাই মনটা খারাপ লাগছিল আজ বাবা দেখেছে সিঁড়ির তলায় চারটা ছানা দিয়েছে। কি আনন্দ হচ্ছে জানিস! শুধু আমি দেখতে পেলাম না। ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যাই।'
তবে বিশাখার চোখের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি ছুট করতে চাওয়া মনটাকে মুঠোতে ভরে নিয়ে তখনকার মত সোমলতা বাকি নিয়ম শেষ করতে চলে যায়। বৌভাত আর ফুলশয্যা শেষে অনেকটা রঙ মাখে সোমলতা কিছুটা অনুরাগের আবার কিছুটা রাগেরও। এই বাড়িতে নিয়ম নিয়ে একটু বেশি বাড়াবাড়ি সবেতেই। শাশুড়িমা হাউজ ওয়াইফ হলেও চাবিতে বেঁধে রেখেছেন বাড়ির সব সদস্যদের মোটামুটি। হয়ত কোথাও সেটা ভালো আবার কোথাও একটু বাড়াবাড়ি। শ্বশুরবাড়িতে নিয়ম অন্ততঃ দিনের বেলা শাড়ি পরতে হবে নাহলে আসেপাশের মানুষ বলবে কি?
'হ্যাঁ কাকিমা পরব তো? আচ্ছা দেখ তো এই শাড়িগুলো সুন্দর না?' মায়ের দেওয়া রেডিমেড শাড়ি চারটে বের করে বিছানায় রাখে সোমলতা। শাড়ি দেখে অবাক হয়ে যায় ওরা সবাই। বিশাখার দুই জা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে,' ও মা ইলাস্টিক লাগানো শাড়ি,কুচি রেডি করা পরার তো কোন ঝামেলা নেই। কত সুবিধা হয়েছে আজকাল! আমাদের সময় কত হিমসিম খেয়েছি শাড়ি সামলাতে। অবশ্য তখন কত কম বয়েস আমার তাই না দিদি?'
সোমলতার বয়েস নিয়ে প্রথমেই একটু আপত্তি ছিল বিশাখার তাই এই সুযোগ হাতছাড়া না করে বলেন,' শুধু তোর কেন আমরা সবাই তো কত ছোট বয়েসে এই বাড়িতে এসেছি।'
ছোট ছোট কথা হয়ত কিছুই নয় তবুও গায়ে বেঁধে সোমলতার তাই বলে,' তখন তো বাবা মায়েরা এটাই ভুল করত,পড়াশোনা শেখানোর আগেই বিয়ের চিন্তা করত। এখন তো আর তা হয় না,আগে পড়াশোনা ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়ানো। অনেক স্বপ্ন দেখা নিজের ভবিষ্যত নিয়ে তারপর বিয়ে।'
বিরক্ত লাগে বিশাখার যখন দেখে ওর ছোট জা মুখটা ছোট করে উঠে যায়। এ বাড়ির বৌদের মধ্যে ও কিছুটা বেশি পড়াশোনা জানে। বি এ অনার্স পাশ করেছিল লুকিয়ে বিয়ের পর। যদিও শাশুড়িমায়ের খুব আপত্তি ছিল। রাগও করেছিলেন জানতে পেরে। বিশাখার মনে হল এত যদি সব নিজের কথা ভাবা তবে নিজেকে নিয়েই তো বেশ থাকতে পারতে শুধু শুধু বিয়ে করা কেন? শুধু বলে দেন,' আমাদের বাড়ির সব শাড়িই কিন্তু এমনি মানে ইলাস্টিক লাগানো নয়,আমি তোমার শাড়ি পরা ছবি দেখেছি আর শুনেছি তুমি শাড়ি ভালোবাসো। এখানে এইসব সুবিধা নেই,তোমাকে দিলাম এবার তোমার যা ইচ্ছে কর।'
এই যা খুশি কর কথাটা ওর মা খুব বলে আর এই কথাটা যে একপ্রকার না বাচক তা খুব ভালো করে বোঝে সোমলতা। যা খুশি কর মানেই তোমার যা খুশি করাতে আমার একটুও মত নেই। আর এটা শ্বশুরবাড়িতে সুতরাং যা ইচ্ছে কর বললেও করা যায় না।
মা আর বৌয়ের মধ্যে দাঁড়ায় রূপাঞ্জন,সোমলতার স্বাধীনচেতা মনোভাব একটা সময় বেশি টানলেও আজকাল একটু বেশি তার্কিক বলেই মনে হয় ওকে। আগে থেকে বোঝালেও এই বাড়িতে এসে সেই মাকে প্রথমে কাকিমা বলে ফেললো। ফুলশয্যার রাতে মোটামুটি একটা ছোটখাটো ক্লাস নিতে হল ওর তারপর থেকে কয়েকদিন উহ্য সংলাপে কথোপকথনের পর এখন মামণিতে এসেছে। আর বাবাকে বাপি বলে ডাকছে। যাক বাঁচা গেছে। মা বাবা নাহলেও কাছাকাছি কিছু।
সেদিকে বাঁচলেও কাজ ভাগের নিয়মের ব্যাপারে একটু বেশি কড়া সোমলতা। চিরকালই নিজের জামাকাপড় ফেলে রেখেছে রূপাঞ্জন মা কেচে গুছিয়ে রাখবে এই ভেবে। আর হয়েছেও তাই বাড়ির বড় ছেলে,পড়াশোনায় ভালো তাকে কিছুই করতে শেখাননি বিশাখা বরং অঞ্জলিকে কাজ শিখিয়েছেন ও জামাকাপড় ফেলে রাখলে চেঁচামেচি করেছেন। যাক তাতে কাজও হয়েছে,এখন মোটামুটি মেয়ে পরিপাটি করে সব গুছিয়ে রাখে। এমন কি তাঁর শাড়িও গুছিয়ে আলমারিতে তোলে মেয়ে। অবশ্য গজগজও করে দাদাকে কাজ শেখাওনি আর আমাকে কেন? তবে ওকে পাত্তা না দিয়ে মেয়েদের এটা করতে হয়,ওটা শিখতে হয় বলে চুপ করিয়ে রেখেছে মা।
সোমলতাও বাপের বাড়িতে রূপাঞ্জনের মত বরাবরই জামাকাপড় ফেলে ছড়িয়ে চলে গেছে এসে দেখেছে সব পরিস্কার পরিপাটি করে তোলা। ও বাড়িতে ওর ছোটখাটো জিনিসও হিসেবে থাকত মায়ের। তবে এ বাড়িতে এসে নিজের সব নিজেকেই গুছোতে হয় এমনকি বরেরটাও। মামণি বলে দিয়েছেন জন কিছু পারে না আগে সবই মা করে দিত এখন বৌ করবে।
আজকাল ছেলের বিয়ের পর আর দরকার না হলে ছেলে বৌয়ের ঘরে পা রাখেন না বিশাখা তার অবশ্য কারণও আছে। এটা অবশ্য কর্তার হুকুম উনি বলেছেন,' ওদের নতুন বিয়ে হয়েছে যখন তখন ও ঘরে হুট করে যেয়ো না।'
-' তুমি তো আমাকেই বলবে যেয়ো না। আর ওদের কান্ডজ্ঞান নেই? যখন তখন চুমু খাচ্ছে মেয়েটা। আমি তো জন বেরোনোর আগে টিফিন নিতে বলার কথা বলতে গিয়ে..সত্যি বড় নির্লজ্জ আজকালকার ছেলেমেয়ে।'
-' যাক তবুও তোমার ছেলে মেয়ে কথাটা বলেছো। থাক একটু ভালোবাসায় কদিন। এরপর তো যে যার কাজে বেরিয়ে পড়বে। তুমি বরং দরজাটা টেনে দিয়ে চলে এসো। এই প্রেম ভালোবাসা আর আমরা তেমনভাবে করার সুযোগ পেলাম কই? চিরকালই তো ছেলে আর মেয়ে এই করেই গেলে।'
বরের কথা শুনে রাগ হলেও মনে পড়ে গেল নিজেদের কথা বিশাখার। বিয়ের ছমাস যেতে না যেতেই ছেলে পেটে এলো তারপর অবশ্য বেশ দেরিতে মেয়ে মাঝে দুটো সন্তান নষ্ট হয়ে যাবার পর। শাশুড়িমায়ের নিয়ম যৌথ পরিবারের দায়িত্ব এইসব করে জীবনটাকে আর সেভাবে উপভোগ করা হল কই? তবুও ছেলেমেয়েদের সামনে দেখে মনে হয় এই অনেক শান্তি।
জিনিসপত্র গুছোনো ধোয়া মেলা নিয়ে ছোটখাটো দাম্পত্য কলহ শুরু হয় রাতের আদরের মাঝেই। তাই সোমলতার মান ভাঙাতে একটু একটু করে কাজ শিখছে রূপাঞ্জন। তবে জন্মে অবধি মা কাকিমাকে বরাবর দেখেছে বাবা কাকাদের জামাকাপড় গুছিয়ে তুলে রাখছে,ধুচ্ছে মেলছে তাই নিজের অজান্তেই এতদিন যত্নে রাখা পৌরুষ মাঝেমাঝেই বিদ্রোহ করে ওঠে। ছেলেকে দেখে খুব খারাপ লাগে বিশাখার এই দুএক মাসে বৌমাকে একটু হলেও চিনতে পেরেছেন বিশাখা। নিজের অধিকার কড়ায় গন্ডায় আদায় করে বড় হয়েছে এই মেয়ে নিজে না খেটে অপরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে শিখেছে বেশ। আহা রে বেচারা ছেলেটা কোনদিন কোন কাজ করেনি সে কি না জামা প্যান্টে ইস্ত্রি বুলিয়ে কলেজে যাচ্ছে,ছাদে গিয়ে মেলে আসছে। অবশ্য জায়েরাও ছি ছি করছে শুধু ছোটই বলছে,' আমার বিট্টুকেও এখন থেকেই কাজ শেখাবো দিদি। সব কাজ সবার জানা দরকার, এতে আবার ছি ছি কি আছে? তোমার দেওরের এমন একটা বৌ হলে ভালো হত।'
-'তুই চুপ কর,তুই আমি পারবোই না ছেলেদের কাজ করতে দিতে। সবটাই মেয়ের মায়ের দোষ,কিছুই শেখায়নি মেয়েকে শুধু পড়াশোনা করিয়েছে। ওর বাবাকেও তো দেখলাম চা বানিয়ে নিয়ে এলো। তোর ভাসুর চা করবে নাকি?'
অবশ্য সোমলতা বলেছে অঞ্জলিকে,' জানিস আমাদের সমাজে আমরা প্রথম থেকেই মেয়েকে মেয়েই ভাবি মানুষ ভাবি না। আর সেখানেই ছেলে আর মেয়েদের ফারাক। একদল জন্মই নিয়েছে সব পারি বলতে তার মধ্যে অবশ্য আমার মা আর মামণিও আছে। তবে আমার বাবা মায়ের সাথে সব করে দরকার হলে। আচ্ছা মেয়েদেরও তো মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ওদের কেউ ফল কেটে দিক বা খাবার গুছিয়ে খেতে দিক। সবসময় ওরা কেন সবার শেষে বসবে?'
অঞ্জলি ফিক করে হেসে বলে,' সব পারির মধ্যে আমিও আছি,আর তুমিও ঠিক একটু করে ঢুকে যাবে। মা ছাড়বে নাকি তোমাকে? সব শিখিয়ে নেবে।'
শিখতে সোমলতারও আপত্তি নেই তবে নিজের পড়াশোনা সামলে বেশি রান্নাঘরে সময় দিতে পারে না তবে চেষ্টা করে সময় পেলে সাহায্য করতে। ওর শ্বশুরবাড়ির অবস্থা বেশ ভালো কিন্তু বাড়ির বৌরা রান্না করে। সবাইকে খাইয়ে যত্ন করে সংসারে পরিতৃপ্তি লাভ করে। নিজেকে মাঝে মাঝে সত্যি একটু বেমানান লাগে এই বাড়িতে সোমলতার। জন বোধহয় ভুলই করেছে ঘরোয়া মেয়ে বিয়ে করলেই ওর ভালো হত। আসলে ছেলেরা বিয়ের আগে সবই চায় মোটামুটি তবে শেষে টিকে থাকে সুগৃহীণী গুণটাই বোধহয়। মানে অন্ততঃ এই বাড়িতে এসে তাই মনে হয়েছে। ওর মাকে বলতেই মা বকা দিয়েছে,' তুই বেশি ভাবিস সবটা নিয়ে,সবকিছু নিয়ে রিসার্চ করতে যাস না। সংসারটা এমন একটা জায়গা যেখানে কিছু না জেনে ঢুকলেও হেসেখেলে পি এইচ ডি করে নেওয়া যায়।'
ওদের বাড়িতে থাকা চারটে ছানা সামলানো বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে সোমলতার মনে হয়েছিল হয়ত মায়ের কথাটাই ঠিক একদিন ও সংসারে ঠিক পিএইচডি করে ফেলবে অবশ্য তার আগে যেটা এখন করছে সেটা শেষ হয়ে যাবে।
বিশাখার সংসারের এতদিনের আঁকড়ে ধরা কিছু নিয়মে চিড় ধরল উচ্চশিক্ষিত বৌমার হাত ধরে। শাড়িতে ইলাস্টিক না লাগাতে পারলেও অষ্টমঙ্গলার পরেই প্রথমে রাস্তায় পা রাখল পছন্দের পোষাক পরেই। সোমলতা বিশ্বাস করে স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয়,শালীনতা বোধহয় যোগ করে সৌন্দর্যে আলাদা মাত্রা। আর বাসে ট্রামে যাতায়াত করবে সুতরাং যাতে অভ্যস্ত তেমন পোষাকই ভালো।
সিংহরায় বাড়ির নতুন বৌকে নিয়ে কদিন ওদের বিবেকানন্দ রোডের বড় বাড়িটাতে কানাকানি হলেও একটা সময় সবাই চুপ করে গেল। তবে সোমলতা বুঝতে পারে শাশুড়িমায়ের মনের মত বৌমা হতে পারেনি এখনও। তারমধ্যে যখন ড্রাইভিং শেখার কথা বলল বাড়িতে প্রথমে রূপাঞ্জন আপত্তি করল,' কি দরকার বলত? তোমাকে তো বলেছি বাড়ির গাড়ি নিয়ে বেরোও। কলকাতা শহরে গাড়ি চালানো কি মুখের কথা নাকি? লাইসেন্স তো আমারও আছে।'
-' গাড়িটা বাবা দোকানে নিয়ে যান,আরেকটা গাড়ি হলে তো আমি আমার মত যেখানে খুশি যেতে পারি। জলিকেও নিয়ে এদিক ওদিক বেরোতে পারি।'
-' তোমার আলাদা গাড়ি চাই? আচ্ছা গাড়ি কিনে ড্রাইভার রেখে দেব আমি। তুমি আবার নিজে গাড়ি কিনবে কেন? আর তাছাড়া তোমার স্টাইপেন বা কত টাকা? ঐ টাকাতে গাড়ি কেনা হবে?...'
রূপাঞ্জনের শেষ কথাটাতে কেমন যেন অদ্ভুত ধাক্কা লাগল সোমলতার স্টাইপেনের টাকা। কেন ও কি নিজের ইচ্ছে মত কিছুই করতে পারে না? একটা গাড়ি কেনা অনেক দিনের শখ। ওদের বাড়িতে গাড়ি ছিল না। মা বাবার বয়েস হচ্ছে ওদেরও কাজে লাগবে গাড়িটা। আর নিজে চালানোটা শিখে নিলেই ব্যাস।
সোমলতা বুঝতে পারে মামণি হাল ছেড়ে দিয়েছে বলতে গেলে ওর ওপর ভরসা করাই যায় না এটা কেন যেন পদে পদে বোঝে সোমলতা। কিছু করতে গেলেই বলে ওঠে,' থাক থাক তুমি ঘরে যাও,নিজের টুকু দেখো তাহলেই হবে আমি এদিকে সামলে নেব।'
বিশাখা মুখে ওকে কিছু না বললেও তেমন কারণে অকারণে বকা খায় অঞ্জলি। হয়ত ওর ওপর জমে থাকা রাগটা মেয়ের ওপরে উশুল করেন। খারাপ লাগে খুব সোমলতার, এই বাড়িতে বড় সোজাসাপ্টা ছেলেমানুষী ভরা ঐ ননদ দেওর দুটো ওরাই ওর বন্ধু। নিজের কাজের ফাঁকে সময় পেলেই মেতে ওঠে ওদের সাথে ছাদের আড্ডাতে বা লুডো খেলাতে। রূপাঞ্জন বর হিসেবে ভালো তবে হয়ত একটু বেশি সজাগ পৌরুষ সম্বন্ধে তাই সোমলতার বৌ ইমেজটাই বেশি পছন্দ ওর স্বাধীন সোমলতাকে একটু বেশিই নাকউঁচু মনে হয় আর সেখানেই বালিশের দূরত্ব মাঝে মাঝে বাড়ে ফাঁক জমে দুজনের মাঝে। ভালোবাসার খুনশুটি ভরা শক্ত বাঁধন আলগা হয় অভিমানে বা অভিযোগে। দেখতে দেখতে এই বাড়িতে বেশ কতকগুলো মাস কাটিয়ে দিয়েছে সোমলতা। বাপের বাড়ি গিয়ে তেমন করে থাকা হয়নি বিয়ের পর থেকে অবশ্য মা বাবাও কেন যেন বলেন নতুন বিয়ে হয়েছে এখন শ্বশুরবাড়িতে থাকা ভালো। নতুন শ্বশুরবাড়ি,নতুন বর এই কথাগুলো যে কতবার শুনেছে এরমধ্যে তার কোন ঠিক নেই। নতুন জিনিসে নাকি খুব আনন্দ থাকে,নতুন জামাকাপড় নতুন বেড়ানোর জায়গা নতুন বর সবই নাকি আনন্দে ভরা। কিন্তু সোমলতার কেন যেন মনে হয় এই আনন্দের পুরোটা ও যেমন উপভোগ করতে পারছে না তেমনি উল্টোদিকেও জমছে অসন্তোষ।
সকালে ছেলে বৌমার খাবার টিফিন সব গোছাতে হিমসিম খান বিশাখা,সকালে সোমলতা রান্নাঘরে কোন সময় দিতে পারে না। ঘুম থেকে উঠেই চা বানিয়ে খেয়ে কিছুটা ফ্লাক্সে রেখে চলে যায় ড্রাইভিং শিখতে। সেই চা খাওয়ার সময়ও হয়ে ওঠে না তাঁর কারণ রাধামাধবের পুজো করেই ঢুকতে হয় রান্নাঘরে। কোনরকমে একটা ডাল ভাজা আর মাছ করে দিতেই হয় তারই ফাঁকে ওদের টিফিন বানাতে হয়। সোমলতা আপত্তি করেছিল,' আমি খেয়ে নেব মামণি কিছু বাইরে। তুমি আর আমার জন্য ঝামেলা নিয়ো না। ছেলে আর মেয়েটা বলে উঠেছিল কিসের ঝামেলা টিফিন তো মা করেই তুমিও নিয়ে যাবে বাড়িতে থাকলে তো খেতেই।
ওরা যে কথা অপকটে বলে ফেলে তা বলতে পারে না ও কিন্তু ভেতরে ভেতরে অপরাধবোধ হয় আর তারই তাগিদে একদিন বলে ফেলেছিল খাবার টেবিলে বসে সবার মাঝে,' আচ্ছা একটা রান্নার লোক রাখলে হয় না? মানে মামণির ভার একটু কমে যায়। আসলে আমি তো তেমন কিছুই সাহায্য করতে পারি না।'
-' এতদিন তো আমাদের সবাইকে তোমার মামণিই রান্না করে খাইয়েছে আর বিশাখার হাতের রান্না খেয়ে মোটামুটি সুস্থ আছি এতদিন। তাছাড়া তুমি কাজ করতে পারবে না তেমন তা তো আমরা জানিই। তোমার একটা বাইরের জগত আছে তাই শুধু শুধু খারাপ পাওয়ার কি আছে?'
রান্নাঘর থেকে কথাটা শুনে মনটা ভারী হয়ে গেছিল বিশাখার,বেশ রাগও হয়েছিল তাই আর না বলে পারেননি,' তুমি পড়াশোনা কর তা তো আমরা জানতামই। এ বাড়িতে বৌয়েরাই রান্নাবান্না করে এসেছে এতকাল কাজটা আমি ভালোবেসেই করি। ছেলেমেয়ে স্বামী তাদের খাওয়াতে ভালো লাগে নিজের হাতে করে।'
-' না আসলে তাড়াতাড়ি করে সব সামলাতে হয় তো তাই যদি একজন একটু সাহায্য করে দিত।'
-' সাহায্য করার জন্য টুলির মা তো আছেই। তুমি বরং তোমার কাজটা ঠিকমত কর। সময় পেলে তখন তোমার মামণির হাতে হাতে একটু করে দিয়ো।'
-' সে সময় আর ওদের হবে না সে আশা না করাই ভালো। যতদিন না উঠছি চিতায় আমাকেই টানতে হবে সংসার।'
-' মা তোমার মুখে কি কিছুই আটকায় না,যা খুশি বলে যাচ্ছ। আমি আর খাব না উঠে যাচ্ছি। এখন দেখছি বিয়ে না করলেই ভালো ছিল।' রূপাঞ্জন রাগ করে উঠে যায়।
সোমলতার খুব ইচ্ছে হল বলতে,' তুমিও তো মায়ের হাতে হাতে কাজ শিখতে পারতে ছেলেরাও তো কত কাজ করে।'
নিজেকে তবুও সংযত করে সোমলতা কারণ এর আগে এক দুবার শুনেছে ওরা সূর্য বংশীয় এই বংশের পুরুষরা ঘরের কাজ করে না তবুও যুগের বদলে অনেক কাজই এখন করতে হয়। এমনিতেই রান্নার লোক রাখতে বলাতে ছোটখাটো একটা অশান্তি হয়েছে। সত্যিই তো ঘরের বৌয়ের বদলে রান্নার লোক দিয়ে ক্ষতিপূরণ কি হয়? অঞ্জলি গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে,' কি যে বল না মা? আমি আছি,বৌদি আছে সবাই আছে তোমার সাথে। তোমার কথা সবাই ভাবে। আর কখনও এমন বোল না।'
সেদিন রাতের খাবারটা কেন যেন বিস্বাদ লাগল সোমলতার তবুও গলায় ঢোকালো অনেকটা জলের সাথে ও রূপাঞ্জনের মত খাবার ফেলে উঠে যেতে পারল না। জল ঝরলো সেদিন রাতে দুই ঘরেই। সোমলতা অভিমানে কাঁদলো,কি এমন বলেছিল ও যে মামণি একদম মরার কথা বলে ফেলল। রান্নার লোক তো আজকাল ঘরে ঘরে।
রূপাঞ্জন একটু অস্বস্তিতে পড়ে তাই বোঝায়,' শোন যেভাবে চলছে চলুক না। বাবার হার্টের অসুখ তাই মা নিজের মত হাল্কা রান্না করে। কি দরকার ছিল এত কিছু বলার?'
ওপাশের ঘরে বিশাখা অভিযোগ করতে করতে কেঁদে ফেলেন,' আমি তো সারাজীবন রান্নাঘর আগলাবার দায় নিয়ে এসেছি। তবুও মেয়েটাকে কিছু বলি, বৌকে তো বলার উপায়ই নেই। পড়াশোনা, গাড়ি চালানো বাপের বাড়ি এইসব নিয়ে বেশ আছে। সংসার তো শুধু আমার।'
-' তোমারই তো সংসার,তুমি তো বেঁধে রেখেছ আমাদের সবাইকে। এত সহজে রাগ করলে হবে? সব ঠিক হয়ে যাবে। ছেলেমেয়ে দুটো কোথাও যেতেও পারেনি বিয়ের পর থিসিস জমা দেবার জন্য। এবার সব হয়ে গেলে আমরা যাবো পুরী আর ওরা যাক নিজের মত কোথাও।'
-' কোথায় কি কথা হচ্ছে তারমধ্যে নিয়ে এলেন বেড়ানোর কথা। যেমন বাবা তেমন ছেলে।'
সোমলতাদের ঘরেও তখন লাইট জ্বলছে। বৌয়ের অভিমানের সিঁদুর মাখা মুখটায় আদরে জড়িয়ে চুমু খায় জন..' পাগলী একটা কখন যে কি করবে তা কে জানে? আচ্ছা বাবা এবার তো থামো। তোমার থিসিস জমা দেওয়া শেষ এবার কিন্তু আমরা বাইরে বেড়াতে যাব। হানিমুন হল না এখনও সে খেয়াল আছে?'
রূপাঞ্জনের কথায় চোখ মোছে আবার সোমলতা,' কোথাও যেতে হবে না। আমি বরং চলে যাব কালই ও বাড়িতে কদিন ওখানেই থাকব।'
-' কে যেতে দেবে শুনি? রাগ করে কোথাও গিয়ে শান্তি পাবে না। তাই রাগ মিটুক তারপরে যাবে। তার আগে বল কোথায় যাওয়া যায় বেড়াতে?'
একটু মিঠে কথায় আর রূপাঞ্জনের আদরে তখনকার মত মান ভুলে গিয়ে ওর রোমশ বুকের মধ্যে মুখ রাখে সোমলতা। আদরে ডুবে হারিয়ে যায় বেড়াতে যাবার স্বপ্নে। সামনের পুজোর ছুটির আনন্দের স্বপ্নে মন হারিয়ে যায় বরফের পাহাড়ে। রূপাঞ্জন ওর শরীরে খাঁজে খাঁজে হাত রাখতে রাখতে বলতে থাকে পাহাড়ের গল্প। কিছুক্ষণ বাদে ক্লান্ত হয়ে রাত সোহাগের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সোমলতা, মুছে ফেলে অভিমান।
শিবশঙ্কর বোঝান বিশাখাকে সংসারটা জুড়ে রাখতে। ভাঙা তো বড়ই সহজ জোড়াই কঠিন। আগে বোধহয় মন ভাঙে তারপর ভাঙে সম্পর্ক আর সম্পর্কের বাঁধন আলগা হলে ভাঙে সংসার। কাজ তো দরকারে টাকা দিয়েও করিয়ে নেওয়া যায় কিন্তু সোমলতার মত অত শিক্ষিত বৌমা কজনের বাড়িতে আছে?
-' আমি তো অত শিক্ষিত চাইনি গো,আমাদের ছেলের যত্ন নেবে সংসারের লক্ষ্মীমন্ত বৌ হবে এমনটাই চেয়েছিলাম। এ তো শুধু বাইরে বাইরে মন। আচ্ছা ওর গাড়ি শেখার কি দরকার ছিল বলতো?'
-' ও আজকালকার মেয়ে বিশাখা সব শিখতে চায় এরা ঘরে বাইরে সমান তালে এগিয়ে যেতে চায়। তুমি বরং জলিকেও শেখাও কাজে লাগবে।'
-' যত ছাড় বৌমা আর মেয়ের বেলায়, আর আমার পড়াটা যখন বন্ধ হয়েছিল তখন তো কিছু বলনি? জলিকে অত আস্কারা দিয়ো না। আমি তাড়াতাড়ি বিয়ে দেব ওর। বিয়ে পাশটা দিয়ে নিক আগে।'
-' ও তো বি কম পড়ে,ভাবছিলাম ছেলেটার তো এইসবে মন নেই মেয়েটা যদি ব্যবসা বুঝতো আজকাল তো কত করছে মেয়েরা।'
-' সে কি মেয়ের বিয়ে দেব না? শেষে গিয়ে বসবে দোকানে? সত্যি তোমার বুদ্ধি একদম লোপ পাচ্ছে।'
-' আরে আমার বুদ্ধি তো সেই কবেই লোপ পেয়েছে। যবে থেকে তোমাকে পেয়েছি তখন থেকেই তুমি চালাক আর আমি বোকা।'
বরের কথার সূক্ষ্ম ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে রাগ করেন বিশাখা। তারপর একটা সময় শিবশঙ্করের বোঝানোর দ্বারাই মাথা ঠাণ্ডা করে ঘুমিয়ে পড়েন বিশাখা।
মাঝরাতের গন্ডগোল সেদিনের মত থামিয়ে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেন শিবশঙ্কর একটা মস্ত এরোপ্লেনে চড়ে অঞ্জলিটা যেন কোথায় যাচ্ছে। স্বপ্নের মাঝেই চোখ ভিজে যায়। বড় প্রিয় মেয়ে তাঁর,ওর আদরে শাসনে বেশ দিন কেটে যাচ্ছে। মেয়েকে আবার বিয়ে দিতে হবে? পরের ঘরে চলে যাবে? আজকাল সোমলতার কোন কাজই তেমন খারাপ লাগে না তাই মনে হয় বারবার জলিটাও তো এমনভাবেই কারো বাড়িতে যাবে বৌ হয়ে।
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। নিজের কাজ অনেকটা গুছিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত সোমলতা। এখন তাই সময় পেলেই ননদকে নিয়ে রান্নাঘর দখল করে কায়দা করে মামণিকে সরিয়ে দিয়ে। নতুন রান্না ট্রাই করে ইউটিউব দেখে। খুশি হয় রূপাঞ্জনও। মাঝে মাঝে কাকি শাশুড়িরাও এসে খেয়ে যান সেই রান্না। কিছুটা ছাড়লেও বৌমার প্রশংসা কেমন যেন বুকে বাজে বিশাখার। সারাদিন খেটে যে প্রশংসা পাননি তেমন করে সেই প্রশংসা চেটেপুটে নিয়ে ঝুলিতে ভরছে মেয়েটা। একেই বলে ভাগ্য,কে বুঝবে ডাল ঝোল করতেও ঘাম পরে। কি একটু করছে সাজাচ্ছে তাতেই ধন্য ধন্য করছে সবাই। এমন কি শিবশঙ্করও সেদিন বাটারফ্রাই খেয়ে একদম মুগ্ধ। রাগে গা জ্বলছিল বিশাখার যে লোককে এক চামচ তেলে রান্না করে খাওয়ান সে একদম চেটেপুটে তেলেভাজা খাচ্ছে।
-' তুমি এই মাখন দিয়ে বানানো ফ্রাই খাচ্ছ?'
-' বেশ হয়েছে বুঝলে,একদম পল্টুর ফ্রাইয়ের থেকেও ভালো।'
-' মামণি আমি টিস্যু দিয়ে তেল মুছেই দিয়েছি। চল এবার তুমি খাও।'
মনের জ্বালা মেটাতে অম্বলের দোহাই দিয়ে আর খেলেন না বৌমার রান্না। ছাড়তে চাইলেও বোধহয় এই সংসারে চট করে ছাড়া যায় না কিছুই।
বারবারই মনে হল সোমলতার কথাতেই যেন তাঁর বর ছেলেমেয়েরা এমন কি বাড়ির লোকজনও চলছে। কে বলবে নতুন বৌ লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সারা বাড়ি। আর মেয়েটাও হয়েছে তেমনি সারাক্ষণ বৌদি আর বৌদি।
মা বাবার সাথে দেখা করে ফেরার সময় গড়িয়াহাট থেকে কয়েকটা রাখী কিনে ফেরে সোমলতা। কালই তো রাখী, দেওরদের আর ননদকে পরাবে। এই বাড়িতে ওরাই ওর ভাইবোন। একমাত্র সন্তান হওয়ার জন্য তেমন করে ভাইয়ের বা বোনের ভালোবাসা পায়নি কখনও।
পূর্ণিমা বলে একটু ছোট করে পুজো করছেন বিশাখা। সোমলতার পরনেও আজ লালপাড় বেগমপুরী শাড়ি,ঘাড় পর্যন্ত কাটা চুল একটু উঁচু করে বাঁধা। চোখের চশমা খুলে রেখেছে কপালে একটা ছোট্ট সিঁদুরের টিপ আঁকা। সকালে ওকে দেখেই বিশাখার মনে হয়েছে এই তো বেশ লাগছে দেখতে। কেন যেন ওকে প্রথম থেকেই দেখে মনে হয়েছে এই মেয়ে মোটেই সংসারী নয়,মনই নেই সংসারে। দিন রাত ছুটছে পড়ার পেছনে আর স্বপ্নপূরণের পেছনে।
মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে তার স্বপ্নই তো হবে গুছিয়ে সংসার করা। আজকালকার মেয়েরা যে কি চায় তা নিজেও জানে না। আর এর খপ্পরে পড়ে বিগরোচ্ছে অঞ্জলিটা। নাহ এবার পাশ দিলেই ওর বিয়েটা দিয়ে দেবার ইচ্ছে বিশাখার,এখন দেখতে বেশ লাগে মেয়েকে। যে দেখবে তারই পছন্দ হবে। তাছাড়া দিনকাল ভালো নয় তাই নিজেরা দেখেশুনে দিয়ে দেওয়াই ভালো। বাড়ির বৌ যেমন আঠাশ ঊনত্রিশ বছরে এসে তার শ্রীচরণ সংসারে রাখলো মেয়ে যেন তেমন না হয়। পুজো করতে করতেই রাজ্যের ভাবনা মাথায় ভিড় করে। এ বাড়ির নিয়ম পুজো শেষে ঠাকুরকে রাখী পরানোর পর রাখী পরায় ভাইদের বোন। আর মেয়ে বলতে তো বাড়িতে ঐ একজনই আর সবারই ছেলে সুতরাং অঞ্জলির খুব আদর বাড়িতে। মেয়েকে মেয়ের মতই বড় করেছেন বিশাখা একদম লক্ষ্মীমন্ত করে। যার ঘরে যাবে সেখানে মন জয় করবে সবার। ছেলের বৌয়ের মত ছোট চুল আর ছেলে ছেলে ভাব নেই একদম মেয়ের। কথাবার্তায় নরম সরম কাজেকর্মে পটু। বিশাখার সাথে হাতে হাতে করে সব দিকেই চৌখশ মেয়ে। সেলাই,আঁকা,রান্না সবই করে সুন্দর গুছিয়ে। এমন কি পুজোর কাজও।
আর এই বৌ কিছুই শিখে আসেনি,আজ বোঝাতে গিয়ে রীতিমত রাগ হচ্ছিল বিশাখার। ঠিক করে ফলই কাটতে পারে না। জানেই না কোথায় কি লাগে। এই বাড়িতে পড়েছিল বলে বেঁচে গেল। সবার মাথার ওপর চড়ে বসে আছে।
পুজো শেষে আরতির শিখা নিয়ে প্রথমে ছেলে মেয়ের মাথায় ঠেকান বিশাখা। তারপর সোমলতার মাথাতেও দেন আরতির শিখা,সোমলতার মুখে হাসি ফোটে। হাসে রূপাঞ্জনও।
অঞ্জলি ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাখী বাঁধতে। দাদা আবার কলেজে চলে যাবে তাই তাড়াহুড়ো। মিস্টির থালাটা এগিয়ে দেন বিশাখা,' নে এবার ওকে মিস্টি খাইয়ে দে। তাড়াতাড়ি কর মা ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে।'
ওদের রাখী পরানোর শেষে অঞ্জলিকে ডাকে সোমলতা,' দেখি তোর হাতটা। আমার তো নিজের ভাই বোন নেই তাই তোকে একটা রাখী পরাবো অবশ্য ভাইদের জন্যও এনেছি।'
খুশিতে মুখটা ঝলমল করে ওঠে অঞ্জলির,' আরেব্বাস আমিও রাখী বাঁধবো। গিফ্টও দেবে আমাকে?'
' হ্যাঁ দেব তো।'
ওদের কথার মধ্যে বিশাখা এসে পড়েন,' ওমা ওকে হঠাৎ রাখী পরাচ্ছো কেন? এ হচ্ছে ভাইবোনের ব্যাপার। ও তো সম্পর্কে তোমার ননদ।'
-' তাতে কি হয়েছে মামণি ও তো এখন আমাকে ভালোবাসায় বেঁধে রেখেছে সবসময় তাই একটা রাখী পরাতে ইচ্ছে হল। কেন বোনকে দিদি পরাতে পারে না?'
বিশাখার সুর চড়ে যায় হঠাৎ,' তুমি ওর দিদি না বৌদি। অঞ্জলি এই বংশের একমাত্র মেয়ে। নিয়মের বাইরে গিয়ে এসব করার কি দরকার? তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি। মেয়েমানুষেরা আবার রাখী বাঁধে নাকি?'
ওর মা হলে হয়ত চিৎকার করত সোমলতা বলত,' মেয়ে আগে তারপর মানুষ নয় মা। আগে মানুষ তারপর মেয়ে বল। রাখী বাঁধলে কিই এমন হত?'
তবুও অঞ্জলি এই বংশের একমাত্র আদরের মেয়ে তাই ওকে মানুষ বলার বদলে মেয়েমানুষ ভেবেই খুশি হন মামণি। সত্যি তো রাখী না বাঁধলেই বা কি হয়।
অঞ্জলির হাতে গিফ্টটা দিয়ে রাখীটা মুঠোতে করে ঘরে নিয়ে চলে আসে সোমলতা। রূপাঞ্জন কলেজে চলে গেছে একটু আগেই। আজকাল ছোটছোট মনখারাপ গুলো সয়ে নিতে শিখেছে একাই। ওকে বললেও তো একই কথা বলবে ও।
অঞ্জলি সাহস পায় না মাকে কিছু বলতে মায়ের সংস্কারের বেড়া ডিঙোনোর সাহস ওর নেই তবুও বলে,' বৌদির খুব খারাপ লাগল মনে হয় মা। তুমি এভাবে না বললেই পারতে।'
-' বড় বাড়াবাড়ি সব ব্যাপারে ওর। নিজে তো যা খুশি করছে। কিন্তু তোর অমঙ্গল কিছু হলে তখন?'
সোমলতা শাড়িটা ছেড়ে এলিয়ে দেয় শরীরটাকে বিছানায়। একটা সময় মনে হয়েছিল ওরা দুজনেই এক বিষয় নিয়ে পড়েছে ভালো ম্যাচিং হবে ওদের। কিন্তু দুজনের মাঝে যে পরিবারও থাকে তা কখনও ভাবেইনি আগে। আজকাল বেনিয়মে চলা প্রতিবাদী সোমলতা আয়নায় নিজেকে ঠিকমত চিনতে পারে না। মাঝেমধ্যে মনে হয় ওর মত মেয়ের সংসার না করলেই হত।
এলোমেলো চিন্তায় মন হারিয়ে যায় দূরে কোথাও। নিজের স্বপ্নগুলো আবার কুড়িয়ে এক জায়গায় করে ভাবনার মাঝেই। মনে ভাবে জীবন তো একটাই তাই জীবন নদী বাইতে গিয়ে ঝড়ঝঞ্ঝা যা আসুক না কেন স্বপ্ন দেখা ছাড়বে না।
-' বৌদিভাই তুমি খুব খারাপ পেয়েছ তাই না? মা যে হঠাৎ হঠাৎ কেন এমন করে কে জানে? কি হত রাখী পরলে এমন? যাক যা হয়নি তা নিয়ে মন খারাপ কোর না। মা এমনি,আসলে ঠাকুমা যে ভাবে শিখিয়েছেন তার বাইরে হাঁটতে পারে না। তবে তুমি কিন্তু আমাকে রক্ষা করবে বড় দিদি বা মিস্টি বৌদির মত সবসময়।'
সোমলতা বুঝতে পারে জলি ওকে ভোলাতে এসেছে। আসলে ওরও খারাপ লেগেছে। তাই বলে,' ভালো করে পড়াশোনা করে মেয়েমানুষ হবার আগে মানুষ হয়ে যা। নিজের মত চাকরি করবি,নিজের পায়ে দাঁড়াবি সোজা হয়ে। ব্যাস নিজেই নিজের রক্ষা করতে পারবি।'
-' জানি না গো আমার চাকরি করা হবে কি না। মা তো বলছে গ্ৰ্যাজুয়েট হয়ে গেলেই ব্যাস আর পড়তে হবে না।'
-' তুই কি চাস? তুই যা চাস তাই করবি।'
-' কি যে বল তা হয় নাকি? মা বাবা আর তোমরা যা ঠিক করবে তাই হবে। আমার ইচ্ছে থাকে নাকি? গাড়ি চালানোই শিখতে দিল না।
জলির গালটা টেপে সোমলতা,'ওরে চালাক মেয়ে। আমরা ঠিক করব আবার কি? তার মানে তোর বিয়ে করার ইচ্ছে আছে তাই তো?'
মাথা নিচু করে অঞ্জলি ওর গালে লাল আভা ধরে।
' না গো ঐ বড় রাস্তার মোড়ের লিলিদির কত বয়েস হয়ে গেছে। বেশি পড়াশোনা করতে গিয়ে আর বিয়েই হল না।'
-' বুঝেছি,তা কাউকে পছন্দ আছে নাকি? দেখব আমি?'
-' কি যে বল না! মা জানতে পারলে একদম দেবে।'
-' মাকে খুব ভয় পাস তাই না?'
-' সবাই পায়,তুমিও পাও। কি পাও না?'
আনমনা হয় সোমলতা সত্যিই ওর উচ্ছ্বলতা,আনন্দ,খামখেয়ালীপনা সবই গিয়ে ধাক্কা খায় মামণির এতদিন ধরে গড়ে তোলা শক্ত প্রাচীরে। তবুও নিয়ম ভাঙতেই হবে মাঝে মাঝে নাহলে নিয়মের শ্যাওলা ধরা পথে হাঁটতে গিয়ে কখন যে স্বপ্নেরা হারিয়ে যাবে।
****************************
বিয়ের পর এই প্রথম বেশ কয়েকদিনের জন্য বাইরে বেরিয়েছে ওরা। আগে মামণি বাপী আর কাকিমারা পুরী ঘুরে এলো তারপর ওরা বেরোলো একদম সিমলা হয়ে কাজা,কল্পা,কিন্নর হয়ে ফিরবে ওরা। তবুও সোমলতার মনটা একটু উৎকন্ঠায়। থিসিসটা অ্যাপ্রুভ হয়ে গেলে একটু নিশ্চিন্ত হওয়া যেত। পাহাড়ের চড়াই উৎরাই আর ভালোবাসার খাড়াই বাইতে বাইতে দুজনের মনেই খুশির ঢেউ। রূপাঞ্জন বারণ করলেও মাঝে মাঝেই জানলা নামিয়ে ঠান্ডা হাওয়াতে নাক ডোবাচ্ছে সোমলতা। হিমেল হাওয়ার ঠান্ডা ছোঁয়া শীতল করে দিচ্ছে্
সেই গালটা আবার ভালোবাসায় ঘষে দিচ্ছে রূপাঞ্জনের গালে। অদ্ভুত সুন্দর গল্পকথার দেশ কিন্নর। এখানে কিন্নরীদের বাস। মনে হয় কোন স্বর্গপুর থেকে নেমে এসেছে কিন্নরীরা। তবে কিন্নরদেশে মহিলাদের আসন অনেক উঁচুতে। সব ব্যাপারেই নিজস্ব মতামত দিতে পারে মহিলারা।
সবুজ আপেলের গাছের ছড়াছড়ি এখানে। আপেল বাগানে গিয়ে ছেলেমানুষী ভরা আচরণে মেতৈ ওঠে সোমলতা। দেখতে দেখতে কেটে গেল বেশ কয়েকটা দিন। সারাদিনের ঘোরাঘুরি আর ভালোবাসার ছোঁয়াছুঁয়ি পূর্ণতা পেত গরম কম্বলের তলার উষ্ণ আদরে। এই কদিন নেটওয়ার্ক তেমন ছিল না বললেই চলে বাড়ির সঙ্গে টুকটাক যোগাযোগ ছাড়া আর অন্য কিছু করা হয়নি।
রূপাঞ্জন বলে,' বেশ ভালো হত এমন একটা নিরিবিলিতে যদি চাকরি নিয়ে চলে আসতে পারতাম। কোনরকম নেটওয়ার্ক থাকবে না। শুধু ভালোবাসার নেটওয়ার্ক ছাড়া।'
-' তারপর একটা সময় সেই ভালোবাসাতেও অরুচি চলে আসবে বুঝেছ প্রফেসর।'
-' ইশ্ দিলে তো ঠান্ডা জল ঢেলে আমার ফুটন্ত আবেগে।'
ওদের গাড়ি তখন কুমঝুম পাসের বরফ ভেঙে এগিয়ে চলেছে মানালীর দিকে। ছবি তুলতে তুলতে আরো কাছাকাছি আসে ওরা। দুজনে দুজনকে বাঁধে আরও কাছাকাছি,শরীরে জমে উষ্ণতা।
রাতে মানালীর হোটেলটায় এসেছে ওরা। সকালে ঘুম ভেঙেই দেখে হোটেল থেকেই দেখা যাচ্ছে বিয়াস নদী আর দূরের পাহাড়। রূপাঞ্জন তখনও ঘুমোচ্ছে কম্বল মুড়িয়ে। নিজেকে একটু গুছিয়ে,গরম শালটা জড়িয়ে বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে সোমলতা। চোখটা আরাম পায়,সত্যি বড় সুন্দর পাহাড়ের সৌন্দর্য্য। মুঠোফোনে হাত রাখে একটা দুটো ছবি বা ভিডিও তোলার জন্য। হঠাৎই দেখে বেশ নেটওয়ার্ক আছে বাইরে। সুতরাং একঝলক চোখ রাখতে যায় নিজের মেইলে আর হোয়াটসঅ্যাপে। মেইলটা খুলে মনটা ভালো হয়ে যায় হঠাৎ। তারপর মনে মনে অনেকটা ভালোবেসে ফেলে আজকের সুন্দর পাহাড়ী শহরটাকে। এই সকালটা অনেকদিন মনে থাকবে ওর।
তাড়াতাড়ি ঘরে আসে ইশ্ এই ছেলেটা এখনও ঘুমোচ্ছে। কি করবে আগে বাবাকে বরং একটা ফোন করে নেবে,হ্যাঁ সেটাই ভালো হবে।
দক্ষিণ কলকাতায় ওদের ছোট ফ্ল্যাটে খুশির বন্যা বয়ে গেল সোমলতার থিসিস অ্যাপ্রুভ হওয়ার খবরে। যাক এতদিন বাদে মেয়েটার মনের ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সোমলতার টানা বকবকানিতে ঘুম ভেঙে যায় রূপাঞ্জনেরও। কান পাততেই বুঝতে পারে খবরটা কি। তবুও চোখ বুজে ঘুমোনোর ভান করে থাকে।
বাইরের কথা শেষ করে ঘরে এসে ঢোকে সোমলতা,' এই শুনছ একটু আগেই মেল দেখলাম এতদিন তো নেটওয়ার্ক ছিল না। যাক এতদিনে,উঃ সত্যি এই বেড়ানোটা আমার জন্য লাকি আর তুমিও।'
উচ্ছ্বাসে অনেকগুলো চুমু গিয়ে পড়ে রূপাঞ্জনের গালে। হঠাৎই সোমলতা খেয়াল করে অদ্ভুত ঠান্ডা রূপাঞ্জন, যেন কোন তাপ উত্তাপ নেই ওর।
তাই জিজ্ঞেস করে,'এই কি হল? তুমি খুশি হওনি? এতগুলো হামি দিলাম।'
-' এটা তো হওয়ারই ছিল,জানিই তো আমার বৌ একদিন না একদিন ডক্টরেট হবে। মা বাবাকে একবার বলে দিয়ো। একটু ঘুমোতে পারলাম না শান্তিতে কাল এতটা জার্নি গেছে।'
পাশ ফিরে শুয়েছে রূপাঞ্জন,সোমলতার নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগে। শুধু শুধুই এতগুলো আবেগের গরম চুমু ঐ ঠান্ডা মানুষটাকে দিতে গেল। কি চায় রূপাঞ্জন? সোমলতা হাউস ওয়াইফ হয়ে থাক ওর মায়ের মত?
নিজেকে সামলালো সোমলতা,নাহ্ মাথা গরম করবে না। অনেক খেটেছে এই কয়েকটা বছর এই প্রাপ্তি ওর একান্ত নিজের তাই নিজেকে অন্ততঃ একবার গ্ৰেট জব বলা উচিত।
ওদের ফিরতে আর দুটো দিন বাকি তারমধ্যে হঠাৎই যেন ওদের সম্পর্কটা ঝাঁঝবিহীন কোকাকোলার মত হয়ে গেল। আবেগী রূপাঞ্জন যেন বড় বেশি উদাসীন, কষ্ট পেল সোমলতা। একটা জয়ের আনন্দ ভালোভাবে উপভোগ করতে গিয়ে পরাজিত হল কোথাও।
ছেলের বৌয়ের ফোন পেয়ে ঠোঁট ওল্টান বিশাখা, 'আর কি এবার বর বৌ সমান সমান। এমনিতেই তো যা খুশি তাই করছে এবার পিএইচডি শেষ করে ধরাকে সরা জ্ঞান করবে।'
সোমলতার সাফল্যে তেমন খুশি কেউ হল না শুধু বাড়ির ছোট দেওর ননদরা বসে রইল বৌদিভাইয়ের কাছ থেকে ট্রীট পাবার আশায়। সোমুর নামে অবশ্য পুজো দিলেন ওর মা কালীঘাটে আর মনে মনে বললেন এবার সুখে ঘর সংসার করুক মেয়েটা। একটা ভালো চাকরি পেলেই হবে।
সুখ বোধহয় সবার ভাগ্যে থাকে না তাই সোমলতার মেয়েমানুষ থেকে মানুষ মেয়ে হবার লড়াইয়ে একটু একটু করে দূরে সরে যেতে লাগলো ভালোবাসার বর আর ঘর।
অল্প আলগা হয়ে যাওয়া সম্পর্কের বাঁধন আরো আলগা হল যখন সোমলতা রূপাঞ্জনকে বলল ও পোস্ট ডক্টরেট করতে চায়।
আকাশ থেকে পড়ে রূপাঞ্জন ওর মুখে রাগের লাল রঙ মাখানো রাতের বন্ধ ঘরে টিউবের আলোতে সেই রঙ চিনতে ভুল হয় না সোমলতার।
-' তুমি কি চাইছ বলত? কয়েকটা তো চাকরির ভালো অফারও ছিল। সেগুলো নিলেই তো পারতে। যা ভাববে তাই করবে নাকি? আমাদের বাড়ির কোন নিয়মকানুন নেই?'
-' সারাদিন শুধু নিয়মকানুন আর কুসংস্কার। পড়াশোনা করতে হলেও নিয়মকানুন ভাঙে? সত্যি খুব হাসি পেল তোমার মত শিক্ষিত মানুষের মুখে এই কথা শুনে। চাকরি আমি করব কিন্তু আগে পোস্ট ডক্টরেট করব তারপর।'
-' আর আমাদের সংসার তার কি হবে? মা চিরকাল ঘানি টানবে সংসারের। আর তুমি বাইরে ঘুরে বেড়াবে ইচ্ছেমত। ড্রাইভিং শিখেছ,গাড়ি কিনেছ আর কি করতে চাও তুমি?'
-' অনেক কিছু করতে চাই। শুধু আমি কেন আমরা দুজনে করব। জীবন তো একটাই।'
-' নাহ আমার অত উচ্চাশা নেই। আমি সাধারণ পরিবারের ছেলে সবাইকে নিয়ে চলাতেই আনন্দ আমার।'
-' আমিও তাই চলতে চাই,কিন্তু কই এতগুলো মাস পেরিয়ে বছর পেরোলাম আমাকে আপন করে নিলো না তো মামণি। তাঁর কাছে আমি একটা অপদার্থ।'
বিরক্তি,রাগ,ঝগড়া আর চোখের জলের ঝাপটা আজ পৌঁছলো বিশাখার ঘরেও। ব্যস্ত হলেন শিবশঙ্কর,' কি হয়েছে ওদের? একবার দেখো। বেশ জোরে চ্যাঁচামেচি করছে জন। এসব কি?'
-' ঐ মেয়ে তো কম নয়। ঠান্ডা মাথা গরম করে দিতে পারে মানুষের। একদম লক্ষ্মীছাড়া মেয়েমানুষ। একটুও মন নেই সংসারে।'
ওদের অশান্তির কারণ শুনে তার মধ্যে না এসে বিশাখা আরও ইন্ধন দিয়েছেন। বেশ কয়েকদিন হল ওদের মধ্যে ভালো করে কথা বলা নেই। আদর সোহাগের চিহ্নটুকু একদম নিশ্চিহ্ন ইগোর লড়াইয়ে।
রাগ করে সোমলতা বাপের বাড়ি চলে এসেছে। রূপাঞ্জন একবারও আসেনি ওকে নিতে। সোমলতার মা ফোন করেছিল বলেছে কলেজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে সময় পেলে যাবে।
বাড়িতে তখন আরেক তৎপরতা শুরু হয়েছে অঞ্জলির বিয়ে নিয়ে। অনেক ধনী আর আধুনিক পরিবার থেকে অঞ্জলির সম্বন্ধ এসেছে। সোমলতা বারবার বলেছিল ননদকে আরও পড়াশোনা করতে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে। বৌদির শেখানো সে কথা বলতে গিয়ে বাড়িতে মা আর দাদার কাছে খুব বকা খেয়েছিল।
বিশাখা বলেছিলেন,' কত বড় ঘর আর বর। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর কি আছে? ঐ বাড়িতে তো নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে হাঁটতেই হবে না। চারটে গাড়ি। আর স্বামীর গৌরবেই তো মেয়েদের গৌরব।'
পণের পরিমানের কথাটা সোমলতার কানেও গেছিল শুনে অবাক হয়ে গেছিল টাকার অঙ্কটা। ঐ বাড়ি থেকে ছোটকাকিমা মাঝে মাঝে ফোন করে আর ছোটদেওরটা।
-' আমি হলে কখনও এই বিয়েতে রাজি হতাম না। এতো রীতিমত অসম্মানের ব্যাপার। অঞ্জলি কিছু বলল না?'
-' না রে ওরা মেনে নিয়েছে। তাছাড়া দাদার টাকা তো আছেই একমাত্র মেয়ের বিয়ের জন্য মনমত পাত্র কিনেছেন। তাছাড়া এ বাড়িতেও পণ নেওয়া তো ছিল। একমাত্র তোর কাকাই প্রেম করেছিল বলে কিছু জোটেনি। অবশ্য তার জন্য আমাকে অনেক শুনতে হয়েছিল।'
আদরের ননদের সেই গৌরবময় বিয়েতে অবশ্য থাকা হয়নি সোমলতার। মাঝে একদিন শ্বশুরবাড়িতে এলেও কেউ ওর সাথে কথা বলেনি। এমন কি অঞ্জলিও। নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে চলে গেছিল অনেকটা মন খারাপ নিয়ে। বুঝতে পেরেছিল বিয়েটা হয়ত আর বাঁচাতে পারবে না। ওর মা খুব কেঁদেছিল কথাও শুনেছিল মায়ের কাছে সোমলতা..' আচ্ছা তোর পোস্ট ডক্টরেট না করলে কি এসে যায়? এমন করে কি কেউ সংসার ভাঙে?'
-' যে আমার সাফল্যে খুশি হয় না আমাকে চিরকাল মেয়েমানুষ হিসেবেই দেখে সেখানে আর কিসের সংসার?'
সত্যিই মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই যতটা সাফল্য নিজের পড়াশোনাতে পেয়েছে সোমলতা ততটা অন্ধকারই নেমে এসেছে চারদিক দিয়ে ওর জীবনে। মা খুব অসন্তুষ্ট ও চলে আসাতে।
-'এতই যদি অশান্তি দুজনের তাহলে বিয়ে করলি কেন?'
-' মা বিয়ে করা মানে কি জীবনের স্বপ্ন আশা সবেতে জল ঢেলে দেওয়া?'
-' এমন বলছিস কেন? সংসার বাঁধাটাও তো মেয়েদের একটা স্বপ্ন। আচ্ছা মাঝামাঝি কিছু একটা হয় না?'
-' সত্যি মা আমার মুশকিল একটাই জানো তো আমি বোধহয় মানুষ বেশি আর মেয়ে কম। আসলে সত্যিই আমার রূপাঞ্জনকে আরেকটু ভালো করে চেনা উচিত ছিল। আর তুমিই তো বলতে ভালো করে পড়তে,কত শাসন করতে না পড়লে। তার কি হল এখন? সবটাই কি শুধু শ্বশুরবাড়ির লোকের মন পেতে করেছি?'
-' তা নয়,কাল রাতে বেয়াই ফোন করেছিলেন সামনেই তো অঞ্জলির বিয়ে ততদিন তোকে এখানেই থাকতে বলেছেন। তাই দেখ যদি যাওয়াটা বন্ধ করা...'
আজকাল হঠাৎ হঠাৎ রাগ হয়ে যায় সোমলতার,' ওহ্ এখন তোমাকে কাজে লাগিয়েছে। মা সব কিছুর একটা প্রশেস আছে তাছাড়া আমার টিকিট হয়ে গেছে রূপাঞ্জন তো জানে।'
-' তোর সাথে কথা হয়?'
-' হ্যাঁ হয়েছিল একদিন।'
প্রায় চারমাস হয়ে গেল আমেরিকা চলে এসেছে সোমলতা। খুব আশা করেছিল যাবার আগে নাহলে এয়ারপোর্টে অন্ততঃ রূপাঞ্জন আসবে। কিন্তু রূপাঞ্জন আসেনি।
সোমলতার একগুঁয়েমি জেদ অনেকটাই দেখেছে ওদের প্রেমের সময়টাতে কিন্তু সেটা যে সংসারটাকে নষ্ট করবে তা ভাবেনি রূপাঞ্জন। একটার পর একটা সিঁড়ি উঠেই যাচ্ছে ও। কি চায় মেয়েটা? ওকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চায় অনেক দূরে? বেশ তো পিএইচডি হয়ে গেছিল কিন্তু থামবে না কারণ ওকে টেক্বা দিতে হবে যে। নিজের স্বপ্নপূরণ ছাড়া আর কারো কথা ভাবেনি মেয়েটা। না মায়ের মনের মত হতে পেরেছে না ওকে বুঝেছে। একবারও কি ওর কথাটা ভাবলো? সত্যিই মা ঠিক বলে নিজের অধিকার আদায় করা ছাড়া আর কোন দিকেই মন নেই এই মেয়ের। কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয় তা শেখেই নি কখনও। ভালোবাসা আর ভালোলাগা হঠাৎই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে মিলেমিশে গেল ব্যক্তিগত ইগোর সাথে। সব ব্যাপারেই রূপাঞ্জনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চায় সোমলতা হয়ত সেটাতেই ওর বেশি আত্মসম্মানে লাগে।
সোমলতার বারবার মনে হয়েছে এত ইগো ওর পোস্ট ডক্টরেট করা নিয়ে রূপাঞ্জনের অথচ ওর একবারও মনে হচ্ছে না যে একজন স্ত্রী তার স্বামীর শিক্ষা বা পদমর্যাদায় গর্বিত হয় যখন তাহলে একজন স্বামী কেন বড় মুখ করে বলতে পারে না তার স্ত্রীর সম্বন্ধে ভালো কিছু কথা। সবসময় শিক্ষায় বা পদমর্যাদায় স্বামীকেই উঁচুতে থাকতে হবে কেন?
নিজের ওয়ান রুম অ্যাপার্টমেন্টটা এখন ওর অস্থায়ী ঠিকানা তবুও অনেক কাজের মাঝে এখানেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সোমলতা। কাউকে খুশি করার তাগিদ এখানে নেই। নিজে নিজেকে খুশি করে বেশ কেটে যাচ্ছে দিন। ওদের সম্পর্কে বরফের চাঁই জমে গেলেও বরফের ভারে সুতোটা একেবারেই ছিঁড়ে যায়নি। কাকিমার কাছে আর মায়ের কাছে শুনেছে অঞ্জলির বিয়ের সময় ওর শ্বশুরবাড়ির মানুষের সামনে নাকি ওর শাশুড়িমা বড় গলা করে বলেছেন বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে হঠাৎই চলে যেতে হয়েছে একমাত্র বৌমাকে। এত ভালো পড়াশোনায় মেয়েটা যে ওরাও চেয়েছেন বৌমা এগিয়ে যাক। নিজেদের ব্যর্থতাকে বেশ কায়দা করে ঢেকেছেন বিশাখা। আর সোমলতার মা বাবাকেও মেয়ের সরু সুতোর মত নড়বড়ে সম্পর্কের সুতোটায় মাঞ্জা দেবার প্রচেষ্টায় যেতে হয়েছে ওর ননদের বিয়েতে দামী সোনার গয়না নিয়ে। কাকিমা ওখান থেকে ওর কাছে একটু একটু করে পাঠিয়েছে বিয়ের আপডেট। নিজের কাজের অবসরে সেসব দেখতে দেখতে অঞ্জলির মুখটা দেখে নস্টালজিক হয়ে পড়েছিল সোমলতা। হয়ত মায়ের ভয়েই ওর সাথে কথা বলার সুযোগ পায়নি সেদিন। কিন্তু তারপরে বারবার সরি বলেছে মেসেজে।
#অঞ্জলির শ্বশুরবাড়ি#
খুব তাড়াতাড়ি করে বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছিল রুদ্রর সাথে অঞ্জলির। ওদের বাড়ি থেকে তাড়া ছিল খুব তাই ভালো ছেলে পেয়ে এ বাড়ির থেকেও দাবী মেনে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রুদ্রদের অনেক বড় বাড়ি,ওরা তিন ভাই বোন নেই। অঞ্জলি এ বাড়ির ছোট বৌ। বড় জা বুটিক চালায় বাড়ির নীচ তলায়,মেজ জা চাকরি করে। বাড়িতে বেকার বলতে অঞ্জলি আর শাশুড়িমা। বাড়ির অন্য বৌয়েরা সংসারে সময় দিতে পারে না তেমন তাই অঞ্জলির মত মেয়েকেই ওদের দরকার ছিল। বাড়িতে রান্নার লোক থাকলেও অঞ্জলির যেহেতু রান্নাবান্না ভালো জানা আছে মানে সবটাই শুনে নিয়েছেন এ বাড়ির লোকেরা তাই বাড়ির অনেক দায়িত্ব অঞ্জলির। সকাল থেকে উঠে পুজোর ঘরে কাজ করা তারপর সবজি কেটে দেওয়া রান্নার লোকের হাতে হাতে। তার আসার আগে জলখাবার চা বানিয়ে টেবিলে হাজির করা। রান্নার লোক মাঝেমধ্যেই কামাই করে সে না এলে পুরো রান্নার দায়িত্ব পড়ে অঞ্জলির ওপর। বাড়িতে অনেকগুলো লোক তাই কাজও অনেক সব কিছু সামলে হাঁফিয়ে ওঠে অঞ্জলি। ওদের চারতলার ছাদে গিয়ে আকাশ দেখে আর নিজের মুক্তি খোঁজে। মাকে কিছু তেমন বলতে পারে না মাকে বললেই মা বলে একদিন সবাইকে সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় রে। আমি তেমনটাই শেখাবো,তোর ঐ বৌদির মত হোস না যেন। দেখবি ধীরে ধীরে সব অভ্যেস হয়ে যাবে। রুদ্রর ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে যায়, তেমন ভাবে ওর মনের কথা শোনার সময় নেই ওর। যেদিন শরীরের টানে শরীর কাছে আসে সেদিন আদরের মাঝে একটু নিজের কথা বলতে চায় অঞ্জলি,' চল না আমরা কোথাও ঘুরে আসি। বাবাকে একটু বলে কদিন সময় করে।'
-' ব্যবসা পুরো আমাকেই দেখতে হয়। বাবা তো শুধু হাজিরা দেয় তাছাড়া ব্যবসার অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়।'
-' কেন তোমাদের নাকি অনেক বড় ব্যবসা?'
নিজেকে সামলেছিল রুদ্র,' হ্যাঁ অনেক বড় ব্যবসাই তো তবে বাজারে অনেকটা টাকা আটকে আছে।'
-' আমার বাবা যে টাকা দিয়েছিল সেটা?'
অঞ্জলি যে হঠাৎ করে টাকার কথা বলতে পারে ভাবতে পারেনি রুদ্র তাই হঠাৎই রুদ্রমূর্তি ধরে। বরের মেজাজ আছে তা বুঝেছে অঞ্জলি তবে এতটা রাগতে দেখেনি কখনও। হঠাৎই ধমকে চিৎকার করে ওঠে রুদ্র,' এই শোন মিত্তির বাড়ির পুরুষেরা মেয়েমানুষদের কোন কৈফিয়ৎ দেয় না। শাড়ি,গয়না,ভালোমন্দ পাচ্ছ তাই নিয়ে খুশি থাক। বাড়ির দরজাতে গাড়ি আছে যেখানে খুশি যাচ্ছ আর কি চাই?'
এই একটা বছরে মেয়েমানুষ কথাটা অনেকবার শুনেছে ওর এমবিএ পাশ করা বরের কাছে। অনেক রাত লুকিয়ে চোখের জল ফেলে কেটে যায় অঞ্জলির। সুখের ঘরের খাঁজে খাঁজে জমেছে অসুখের শ্যাওলা। বুঝতে পারে কেবলমাত্র টাকার জন্য ওর এই বাড়িতে বিয়ে হয়েছে। শুনতে হয় ঐ তো ওদের কাজের বৌয়ের মেয়েও তো এম এ পাশ। কি যোগ্যতা আছে অঞ্জলির? না করে চাকরি,না আছে তেমন কোন শিক্ষা দীক্ষা। একটাই পারে পুজোর জোগাড় আর রান্না তাই করুক বরং। ওর মেজ জা নিজে গাড়ি চালিয়ে অফিসে যায় দোতলার বারান্দা থেকে দেখে খুব বৌদিভাইয়ের কথা মনে পড়ে অঞ্জলির। কত বলেছে গাড়ি চালানো শিখে নে। পড়াশোনা কর ভালো করে,নিজের পায়ে দাঁড়া। মন খারাপ করা সকালটায় খুব মানুষ হয়ে নিজের মত নিজে বাঁচতে ইচ্ছে করল অঞ্জলির।
ওর মোটামোটা গয়নাগুলো ব্যবসার টাকার প্রয়োজনে বন্ধক দিয়েছে রুদ্র। বাপের বাড়িতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই মিথ্যে কথা বলে টাকা চেয়ে আনে অঞ্জলি। মা গয়নার কথা বললে বলে লকারে আছে। তবে শুধু বারবার মনে হয় বৌদিভাই থাকলে হয়ত তাকেই বলা যেত ওর কথাগুলো। দাদাকে তো আজকাল বাড়িতে বেশি পাওয়াই যায় না। মা দুঃখ করে লক্ষ্মীছাড়া সংসারটার কথা বলে,' কি করতে ছেলেটা বাড়ি আসবে। সারাদিন পড়াশোনা নিয়েই আছে দেখি। একেই চুপ ছিল আরও চুপ হয়ে গেছে।'
একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ভেদ করে উঠে আসে অঞ্জলির মিত্তির বাড়ির অন্দরের লুকোনো ক্ষতগুলো বুকে বেঁধেই ফিরে যায় আবার। বলে যায়,'ভালো আছি আমি। তোমরা ভেবো না। ও একটা ফ্ল্যাট কিনবে বলছিল কিছু টাকা লাগতে পারে বাবাকে বলে রেখ।'
মেয়ের দিকে অবাক হয়ে তাকান বিশাখা তারপর সামলে বলেন,' হ্যাঁ হ্যাঁ বলব। তোদের আলাদা বাড়ি হবে নিশ্চয় দেবে টাকা।'
*****************
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো মাস,নিজের কাজের ব্যস্ততায় দিন কেটে যায় সোমলতার। সেদিন ডিপার্টমেন্ট থেকে এসে প্রতিদিনের অভ্যেস মত লেটার বক্সে হাত দেয়। যাক এতদিন বাদে মনে হচ্ছে কিছু এসেছে। এই অভ্যেসটা বাড়ি থেকেই সোমলতার। কিন্তু এই খামটাতে কি আছে? তবুও দেশের চিঠি পেয়ে কেমন যেন দোটানায় পড়ে সোমলতা। তবে কি এটা ওদের বিয়ে ভাঙার কোন চিঠি নাকি?
চেঞ্জ করেই এক কাপ কফি নিয়ে চিঠিটা খোলে সোমলতা। তারপর কেটে গেছে কখন অনেকটা সময় বুঝতেই পারেনি। একটা একটা করে গল্পের পর্দা সরে গেছে সামনে থেকে। কখনও চোখ ভিজে গেছে ওর আবার কখনও রাগে গা জ্বালা করেছে। একটা সময় চিঠিটা শেষ করে ওটা বুকের ওপর রেখে শুয়ে পড়ে কানে শেষ কথাদুটো বাজতে থাকে ...আমি মেয়েমানুষ না মানুষ মেয়ে হতে চাই বৌদিভাই। তুমি কেন অত দূরে চলে গেলে? তুমিই তো আমাকে বলেছিলে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। এত অপমান সহ্য করে গাড়ির চাকায় পা রেখে চলতে চাই না আমি। রুদ্র কথায় কথায় টাকা চায়। অন্য বৌরা চাকরি করে আমার সেই যোগ্যতা নেই বলে বাবার কাছ থেকে টাকা আনতে হবে। নাহলে মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করতে হবে। হাতের মুঠোটা শক্ত হয় সোমলতার মনে হয় ও যদি থাকত দেশে তাহলে ঠিক বুঝিয়ে দিত।
খামের ভেতরে রাখা ছোট্ট সুতোর রাখীটা বৌদিভাইকে পাঠিয়েছে অঞ্জলি। হয়ত দাদার থেকেও বেশি নির্ভর করেই পাঠিয়েছে। নাহ্ একটা কিছুই করতে হবে। ওকে কি এখন ফোন করবে? নাহ্ থাক কোথায় আছে এখন কে জানে? তাহলে কি একটা মেসেজ করবে ওর দেওয়া ফোননম্বরে?
নিজেকে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে একটু গুছিয়ে নেয় সোমলতা। সিংহরায় পরিবারের সঙ্গে একটা সরু সুতোতে ওর সম্পর্ক ঝুলছে। সেখানে ও কি জন্য এই সবে নাক গলাতে যাবে? শাশুড়ি মায়ের মুখটা আবার আজ বারবার মনে পড়ে সোমলতার। যিনি বারবারই মনে করান মেয়ে মানুষের সয়ে থাকাটাই ধর্ম,সবার সুখেই ওদের সুখ। বেশি মান আর হুঁশ না থাকাই ভালো মেয়েদের। সোমলতা সিংহরায় পরিবারের অপদার্থ, অযোগ্য আর আত্মসুখী বৌ।
আচ্ছা রূপাঞ্জন, মামণি আর বাপি কি সব জানে? নাকি ভয়ে আর লজ্জায় কাউকেই কিছু বলেনি মেয়েটা? অনেক কথা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে সোমলতার তারপর একটা সময় চোখটা বুজে আসে।
********************
শীতের পরে আকাশে বাতাসে বসন্তের হাতছানি। ড্রাইভ করার মাঝেই পিং আওয়াজে ছবি আর মেসেজটা এসে ঢোকে। স্ক্রীনে চোখ যায় সোমলতার একটা ভালোবাসা আঁকা ইমোজি পাঠিয়েছে ওর সই ননদিনী। আজকাল মজা করে ঐ নামেই অঞ্জলিকে ডাকে সোমলতা।ছবিটা পরেই দেখবে। গাড়িটা পার্কিংয়ে রেখে ফোনটা খোলে সোমলতা এবার সত্যি হাসি পায় ওর। সই ননদিনী ড্রাইভ করছে আর পাশে বসে বিশাখাদেবী। ইশ্ শেষে মেয়েকে মেয়েমানুষ থেকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে এই বয়েসে মেয়েকে নিয়ে ড্রাইভিং শেখাতে বেরিয়েছেন ভদ্রমহিলা। তাহলে বোধহয় সত্যি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়,যে নিয়মের বাঁধ ভেঙেছিল সোমলতা আজ তা দিয়ে হু হু করে ঢুকেছে বন্যার জল। আর বানভাসিতে ভেসে যাচ্ছে সব সংস্কার।
এ দেশে থেকেও মেয়েটার পাশে থাকার চেষ্টা করেছে যতটা পেরেছে। সেই কবে বলেছিল আয় আমরা বেঁধে থাকি হয়ত সেই বাঁধনই এই দুঃসময়ে আরও জোরালো হল। শুধু তেমন করে কথা হয় না রূপাঞ্জনের সঙ্গে। অভিমান হয় সোমলতার। খুব মনে পড়ে যায় সেই সব দিনগুলোর কথা। কত গল্প আড্ডা আর আদরে ভেসেছে দুজন।
দুজনের কেউই তেমনভাবে স্বাভাবিক হতে পারে না দুজনের কাছে। সোমলতার মনে অভিমানের বাসা আর রূপাঞ্জনের মনে সঙ্কোচের বাঁধন। কেউই ভাঙতে পারে না সেই প্রাচীর। তবে বাড়িতে এখন সারা দিনে অনেকবার সোমলতার গুণগান হয়।
সেটা অবশ্য অঞ্জলির মুখে শুনেছে সোমলতা। শুধু খারাপ লাগে অঞ্জলিটার জন্য। তবে মাথা নিচু করে নয় নিজের ভালোলাগা নিয়ে এবার ওকে বাঁচতেই হবে মাথা উঁচু করে।
কিচেনে খাবারগুলো গুছিয়ে ঘড়িটা দেখে সোমলতা এখনি ওকে বেরোতে হবে। সকাল থেকে এত তাড়াহুড়ো করতে করতে যেন হাঁফিয়ে যায়। সারা সপ্তাহের সব কাজ পড়ে থাকে এই রবিবারের জন্যই। ওয়াশিং মেশিনটা চালিয়ে দিয়ে টাইমার সেট করে একবার লিস্ট দেখে নেয়। অনেক কিছু নেই ঘরে তাই আজ একটু স্টোরে বেরোতেই হবে।
বাইরের বেলটা বেজে ওঠে সাড়া দেয় সোমলতা নিশ্চয় মিসেস জোনস একা থাকেন মাঝেমাঝে চলে আসেন ওর কাছে। আবার বেলটা বাজে। তাড়াতাড়ি দরজাটা খোলে সোমলতা.... আরেএএএএ তুই! আমি তো ভাবতেই পারছি না। সত্যি আমি টোটালি স্পীচলেশ। মহা পাজি তো তুই। কালই তো কথা হল।'
-' এই যে সারপ্রাইজ আমিও দিতে পারি দেখেছ তো,তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হল চলে এলাম।'
তার পরের টুকু বোধহয় ইতিহাসের মত লম্বা গল্প। প্রথমে এমবিএ করার কথাটা বলেছিল সোমলতা তবে সাহস পায়নি আর কিছু বলতে। তবে ওর দেখানো স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দিতে রূপাঞ্জন খোঁজ খবর করে এমবিএ করতে পাঠিয়েছে বোনকে এদেশে। বড় হেনস্থা হয়েছে মেয়েটা কথায় কথায়। এবার অন্ততঃ নিজের মত করে বাঁচুক ওর ইচ্ছেমত।
সোমলতা ঠোঁট ফোলায়,' দেখেছিস তো সেই তোদের মধ্যে আমার কোন জায়গা নেই। এত কিছু করলি এখানে চলে এলি অথচ আমি কিছু জানতেই পারলাম না। তাইতো আমি শুধু ভাবছি তুই একা একা এতটা চলে এলি কি করে? মানে তোকে ছাড়লো মামণি?'
-' ও বৌদিভাই একটা কথা বলব,প্লিজ রাগ কোর না। দাদাও এসেছে আমার সাথে ও যে পোস্ট ডক্টরেট করবে এখানে। তাই দুজনেই চলে এলাম।'
-' সত্যি তোরা ভীষণ খারাপ। যা এক্ষুনি এখান থেকে বিদায় হয়ে যা। যা বেরো দেখি। এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলি আমার সাথে?'
সোমলতার রাগ দেখে কাচুমাচু হয়ে যায় অঞ্জলির মুখটা। তবে কি দাদা আর বৌদির মিল হবে না কখনই।
প্লিজ বৌদিভাই একবার দাদাকে ঢুকতে দিয়ো,একটু কথা বোলো ওর সাথে। আমরা সবাই তোমাকে চাই। তোমার বর, মামণি বাপি সবাই।
হেসে ফেলে সোমলতা অঞ্জলির কানটা মলে দেয় আগের মত আদরে তারপর বলে,' সত্যিই তুই আমার রাইবাঘিনী, যতই সই ননদিনী বলি না কেন। সেই দাদার হয়ে ওস্তাদি করতে এসেছিস তাই না?'
রূপাঞ্জনের প্রথম উপহার দেওয়া গন্ধটা বিকেলে গায়ে মাখে সোমলতা। সামনের গাছের সোনালী পাতাগুলো ছড়িয়ে আছে মাটিতে,কিছু নতুন পাতা আবার এসেছে গাছটাতে। হয়ত পুরোনো মান অভিমান ভুলে আবার ভালোবাসার কুঁড়ি ফুটবে ওদের জীবনে। অবশ্য এটা অঞ্জলির বলা কথা...' আমার জীবনে সত্যিকারের ভালোবাসা ছিল না শুধু ব্যবসা ছিল। দাদাভাই তোমাকে ভালোবাসে ওকে ফিরিয়ে দিয়ো না প্লিজ।'
দরজার বেলটা বাজে সোমলতার কঠিন হৃদয়ে আজ ভালোবাসার রঙ লেগেছে ঐ বোধহয় রূপাঞ্জন এলো। কিন্তু সত্যি কি ও আগের মত ছুটে দরজা খুলে ওর দিকে তাকিয়ে সেই হাসিটা হাসতে পারবে?
রূপাঞ্জন কিছুটা আগে এসেছে অঞ্জলিই দরজাটা খুলে দিয়েছিল তারপর কফি করার অজুহাতে কিচেনে চলে গেছে।
অনেকদিন বাদে মুখোমুখি ওরা। সোমলতা জিজ্ঞেস করে সোজাসুজি,' সবই তো শেষ করে দিয়েছিলে আবার কেন এসেছ? আমি সত্যি ভালো আছি।'
রূপাঞ্জন যা উত্তর দিল তা বোধহয় আশা করেনি সোমলতা। রূপাঞ্জন বলে,' কেন যেন সেই মানুষ বেশি আর মেয়ে কম মেয়েটাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিল। জানি তো তুমি ভালো থাকবে কারণ নিজেকে ভালো রাখতে যে তুমি শিখেছ অনেক আগেই। তাই নিজের ইচ্ছেকে বাঁচিয়ে রাখতে মাথা নোয়াও নি কখনও। এই বর্বর বরটাকে কি আরেকবার....'
গরম কফি নিয়ে ঘরে এসেছে অঞ্জলি,' প্লিজ বৌদিভাই আবার তুমি আমাদের নিজের হয়ে যাও না গো।'
সোমলতা মনে মনে বলে আমি তো মনে মনে তোদের সাথেই ছিলাম। কিন্তু মুখে বলে,' তোর দাদাকে বল বেশি মানুষ কম মেয়ে এই অপদার্থ বৌটার সাথে মানিয়ে চলতে পারবে তো?'
-' একদম পারবে গো,তাই তো এতদূরে চলে এলাম।'
-' সব কথা তুই বলবি, না ও কিছু বলবে?'
-' ঘর ভাঙার কষ্টটা যে এখন দুজনেই বুঝি গো।'
সোমলতা অঞ্জলির কাঁধে হাত রাখে ভীষণ খারাপ লাগে ওর জন্য তবুও ওর মানুষ হবার ইচ্ছে হয়ত ওকে ঠিক পৌঁছে দেবে এক নতুন স্বপ্ন দেখার দেশে।
-
Comments
Post a Comment