Skip to main content

হাউস কিপিং

#হাউস_কিপিং#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#


তুমি আসবে বলেই
 আকাশ মেঘলা বৃষ্টি এখনও হয়নি
তুমি আসবে বলেই কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো ঝরে যায়নি।
তুমি আসবে বলেই...ফোনটা বাজতে থাকে আপন ছন্দে। 
    খুব প্রিয় গান অংশুর তাই অনেকবার বদলে ফেলবে বলেও বদলাতে পারেনি। তবে অফিসে থাকাকালীন মোটামুটি ফোনটা ভাইব্রেশনে রেখে দেয় না হলে আবার এই নিয়ে হয়ত মজা করবে সবাই। বেশ কয়েকবার ক্লায়েন্টকে ফোন করেছে কিন্তু তখন কেউ ধরেনি বারবার বেজে গেছে। লোকেশন দেওয়া থাকলেও  সবসময় একবার ফোন করে নেয় ওরা সঠিক লোকেশনে সঠিক সময়ে পৌঁছনোর জন‍্য। বাইকটাকে সাইড করে ফোনটা ধরে ওপার থেকে আওয়াজ আসে গম্ভীর গলায়,' হ‍্যালো।'
   অংশু নরম গলায় বলে,' স‍্যার আমি দশ মিনিটে আসছি।'
 -'একটু যদি জায়গাটা বলে দেন সুবিধা হয়।'
  ওপার থেকে গড়গড় করে বাড়ির লোকেশন বলে দেন ভদ্রলোক। আরও বলেন উনি এখন বাইরে। বাড়িতে লোক আছে  অংশু যেন ভালোভাবে কাজটা করে। ওদের সাইটে গিয়ে রিভিউ আর রেটিং দেখেই অংশুকে নিয়েছেন।'
-' হ‍্যাঁ স‍্যার ডোন্ট ওরি আপনি কাজ দেখে রেটিং আর রিভিউ দেবেন।'
          পলাশপুরে বড় হলেও এই কয়েক মাসে কলকাতা শহরটাকে বেশ চিনে নিয়েছে প্রয়োজনেই। চাকরিটা যে খুব দরকার ছিল তাই আপাতত যা পেয়েছে তাতেই মোটামুটি চলে যাচ্ছে। সারাদিনই ব‍্যস্ততার মধ‍্যে কেটে যায়। রাতে মৌলালীর কাছে মেসের একফালি বিছানায় শুয়ে স্বপ্ন চোখে মাখতে মাখতে ঘুমিয়ে পড়ে অংশু। বারবার মনে হয় এম এ পাশ করে নিশ্চয় এই কাজ করতে হবে না একদিন একটা ভালো চাকরি ঠিক পেয়ে যাবে। বাড়িতে জানে সবাই একটা কোম্পানীতে চাকরি করে অংশু।
   অংশু শান্তি পায় এই ভেবে যাক বাড়িতে মিথ‍্যে কথা বলেনি ও। সত‍্যিই তো একটা কোম্পানীতেই চাকরি করে। কিন্তু কি কাজ করে সেটা বাড়ির লোক জানে না। তবে অংশু বিশ্বাস করে কোন কাজই ছোট নয় সব কাজই মানুষের শেখা উচিত। কাজের উঁচু নিচু আর ছোট বড় হয় না। তবুও তো নিজের খরচ বাঁচিয়ে বাড়িতে হাজার দশেক টাকা পাঠাতে পারে।

      হেলমেটটা হাতে নিয়ে পিঠের ঢাউস ব‍্যাগটা সামলে লিফ্টে ওঠে অংশু। বেশ বড় অ্যাপার্টমেন্টটা। ওদের পলাশপুরের টিনের চাল দেওয়া বাড়ির সাথে মেলে না তবুও বড় প্রিয় সেই বাড়ি পলাশের। মাধবীলতার ছায়া মাখা ওদের বাড়ি আর মায়ের হাতের শাক, ছোট মাছের চচ্চড়ি আর মুসুর ডালের স্বাদ স্বাদ বড় টানে ওকে। এই সুখ বোধহয় কোথাও নেই।
     দরজার বেলে হাত রাখে দুবার আওয়াজ হতেই দরজা খুলে যায়। নিজের আইকার্ড দেখায় অংশু। আজ ওর কাজ এই ফ্ল্যাটের ক্লিনিং বেশিরভাগ সময় ওর সাথে একজন থাকে একা একটু বেশি পরিশ্রম হয়ে যায় কিন্তু সামনে পুজো কাজের চাপ আছে তাই আজ একাই সারতে হবে সবটা। দরজা খুলেছে শালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়ে,সাজগোজ করেছে বেশ। তবে কথাবার্তার টানে মনে হচ্ছে এই বাড়ির সহায়িকা। তবে ভীষণ কাটা কাটা কথা বলে মেয়েটা আর খুবই চালাক চতুর।
 ফ্ল্যাটের মেজারমেন্ট আগেই দেওয়া ছিল মোটামুটি বড় ফ্ল্যাট। মেয়েটা সমানে কথা বলে যাচ্ছে,' আগে রান্নাঘর থেকে শুরু করুন শেষে বাথরুমে যাবেন। আমাকে জিজ্ঞেস করে ঘরে ঢুকবেন কারণ আমাকে থাকতে হবে তো সাথে। আর ভালো করে পরিস্কার করবেন দাদা বারবার বলে গেছে আমাকে।'
    ওদের কাজের জায়গায় বেশি কথা বলা বারণ ইয়েশ অথবা ওকে ম‍্যাডামেই কাজ চালাতে হয়। তাই চটজলদি নিজের জিনিসপত্র নিয়ে কাজে লেগে পড়ে অংশু। মেয়েটা দাঁড়িয়ে সমানে কথা বলে যাচ্ছে একটু বিরক্ত লাগে অংশুর বাড়িতে কি কেউ নেই আর? এত কথার মধ‍্যে কি কাজ করা যায়? ওকে ম‍্যাম বলে একমনে নিজের কাজ করে যায়।
           রান্নাঘর ডাইনিং পরিস্কার করে এবার ঘর পরিস্কার করার পালা। একটা করে জায়গা ধরে ঝকঝকে তকতকে করে ছবি তুলে কোম্পানীকে পাঠাচ্ছে অংশু। আগের আর পরের দুটো ছবিই তুলে নিচ্ছে। হঠাৎই কানে আসে একটু জোরে বলা কথার টুকরো..' এই ঘরটা তো এবার পরিস্কার করবে তুমি এবার পাশের ঘরে যাও দেখি সারাদিন শুয়ে থাকা ছাড়া আর তো কোন কাজ নেই।'
     অবাক হয় অংশু কথাটা কাকে বলছে মেয়েটা! নিশ্চয় কোন বয়স্ক মানুষকে। আজকাল কাজের লোকেরা বয়স্ক মানুষকে যেন ভীষণ দাপটে রাখে কাজ করতে করতে দেখেছে অংশু। ওদের গ্ৰামের বাড়ির ঠাম্মা দিদিমার মত শহুরে ঠাকুমা বা মাসিমারা ভালো নেই। অনেক টাকা থাকলেও আছে শুধু একাকীত্ব আর কাজের লোকের দাপট।

          মনটা ভারী হয়ে যায় হঠাৎই। হাতে ক্লিনিং মেশিনটা নিয়ে দাঁড়ায় বাইরে। ওদিক থেকে আবার আওয়াজ আসে,' কি হল? কথা যাচ্ছে না কানে? আরে ওঠো দিকিনি।'
   একটা ক্লান্ত আওয়াজ কানে আসে ওর...
-' এই ঘরটা বাদ দিয়েই করতে বল। কি হবে এই ঘর পরিস্কার করে? আমি তো একাই থাকি।'
-' বেশি কথা বোল না,ওহ তোমার তো আবার পা চলে না ভালো করে। চল এই নাও তোমার লাঠি।'
   কেমন যেন অদ্ভুত রাগ হয় অংশুর কেন যে এইসব কাজ নিয়েছে? আহা এই হচ্ছে সব বড়লোক বাড়ির ছিরি! ওপরে চেকনাই ভেতরে কিছু নাই।
     ওরও তো দেরি হয়ে যাচ্ছে তাই অধৈর্য্য হয়ে বলে,' ম‍্যাম এই ঘরটা শুরু করি?'
   মেয়েটা ওর গলা শুনে বাইরে বেরিয়ে আসে,' যত্তসব ঝামেলা আমার। আচ্ছা এটাই হোক আগে তারপর ওটা হবে।
    এক ঝলক ঘরটা দেখে অংশু একটা ছবি তোলে প্রথমে। ঘরে একটা সিঙ্গেল ডিভান পাতা। একটা ছোট আলমারি আর চেয়ার টেবল। দেওয়ালে একটা পেন্টিং,ছবিটাতে চোখ আটকে যায় হঠাৎই অংশুর। তারপরেই আবার মন দেয় কাজে। মেয়েটা কথা বলতে থাকে,' এই ঘরটাতে তো তেমন কিছুই নাই এখনি হয়ে যাবে। নিজের ঘর আমি গুছিয়েই রাখি ভালো করে।'
   অংশু কথা না বলে জিনিসপত্র সরিয়ে দেওয়াল বিছানা পরিস্কারের কাজে লেগে যায় ওর ভ‍্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে। তোষক ওল্টাতেই চোখে পড়ে যায় জিনিসটা.. একটা কন্ডোমের প‍্যাকেট। এমন জিনিস যে আগে চোখে পড়েনি তা নয়। হাউস ক্লিনিং করতে আকছার কন্ডোম,মদের বোতল অথবা স‍্যানেটারি ন‍্যাপকিন দেখে অংশু।
     তবে আমার ঘর বলে জাহির করেছে মেয়েটি অথচ তোষকের তলায়! 
    নিজের প্রশ্নকে আবার তোষক চাপা দিয়ে পেছনে তাকায় অংশু যাক মেয়েটা নেই এখানে তবুও ভালো। 
  হয়ত আবার বয়স্ক মানুষটাকে দাবড়ানি দিতে গেছে...
     নিজের বাকি কাজটা সেরে ফেলতেই দেখে মেয়েটা এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে।
-' হয়ে গেছে?'
-' দেখে নিন ম‍্যাম।'
-'হ‍্যাঁ ঠিকই আছে, তোষকটা পরিস্কার করেছেন তো?'
  ঢোক গেলে অংশু তারপর বলে,' হ‍্যাঁ ওপর নীচ সব ক্লিন করে দিয়েছি। এবার একটা ছবি তুলব আমি।'
    ছবি তুলতে গিয়ে এবার পেন্টিংটা তুললো অংশু কি সুন্দর ছবিটা! ঠিক ওদের গ্ৰামের মত।

       ডাইনিংয়ে এসে দাঁড়ায় অংশু সামনের ঘরটার পর্দা নড়ে ওঠে মেয়েটা গজগজ করছে,' নাও ধরো দেখি তোমার লাঠি। কখন থেকে বলছি লোকটা এবার এই ঘরে আসবে।'
       বড় মায়া হয় মানুষটার ওপর অংশুর। কি বদমাইশ কাজের লোক!
    কিন্তু পা টেনে টেনে খুব কষ্ট করে পর্দার বাইরে বেরিয়ে আসা মানুষটাকে দেখে একটা মুহূর্তের জন‍্য মনটা তোলপাড় হলেও তাকে আবার সামলায় অংশু।
  মহুল!
 এভাবে যে কোনদিন মহুলের সাথে দেখা হবে স্বপ্নেও ভাবেনি অংশু। এক বৃষ্টি ভেজা ঝোড়ো হাওয়া এসে যেন এলোমেলো করে দিল মনটা ওর। এক মুহূর্তের জন‍্য দুজনের দুই চোখ মিলে গেল। ওকে দেখে যেন মহুলও বলতে চাইল অংশু দা তুমি এখানে কেন?
   হয়ত একই প্রশ্ন অংশুরও মহুল তুই এখানে কি করছিস? কি হয়েছে তোর? তোর পাহাড়ী ঝর্ণার মত হাসিটা কেন মুখে মাখানো নেই?
       -' আপনি যান ও ঘরে। আমি আসছি এক্ষুণি। ভালো করে পরিস্কার করবেন। সবচেয়ে নোংরা হয়েছে এই ঘরটা। নিজেও পরিস্কার করবে না কাউকে ঢুকতেও দেবে না।'
       চুপ করে নিজের কাজ করে যাচ্ছে অংশু। মন ভেসে যাচ্ছে বানভাসি কান্নার বন‍্যায়। তবুও ও জানে ছেলেদের কাঁদতে নেই। এ ঘরের দেওয়ালেই গোছা গোছা ফুলের ছবি প্রজাপতি বসে আছে তার ওপর। আর আশ্চর্য লাগে না অংশুর ও জানে এই ছবি কার আঁকা। 
    ঘর পরিস্কার করতে করতে অদ্ভুত অনুভূতির একটা শিরশিরে প্রবাহ ওর মন বেয়ে নেমে যায়। সত‍্যিই হয়ত একেই বলে দুর্ভাগ্যের চরম পরিণতি। আজ ওর পুরোনো ভালোবাসার নতুন ঘর ঝাড়পোছ করতে হচ্ছে ওকে। এই বিছানায় হয়ত স্বামী সোহাগের কত মুহূর্ত কাটায় মহুল। রাতে ঝড় ওঠে এই বিছানায়, কাঁপে খাটের পাঁজর থরথর করে। তারপর একসময় ক্লান্ত মহুল স্বামীর আদরে স্নিক্ত হয়ে শরীর এলিয়ে দেয়।
     ঘরে ইতস্তত ছড়ানো ছেটানো কিছু ওষুধপত্র আর মলম সেগুলো গোছায় অংশু। মহুল অসুস্থ, পায়ে ওর চোট আছে ভালো করে হাঁটতে পারে না তাই এই মেয়েটা বোধহয় সব সামলায়। তবে এত শান্ত কেন মহুল? মেয়েটা কত কিছু বলছে ওকে। অথচ ও...গলার কাছটাতে ডেলা পাকায় অংশুর।কত স্বপ্ন ছিল ওর,ওদের বাড়িতে শীতল পাটি বিছানো খাটে শোবে মহুলকে বুকে জড়িয়ে। সারারাত আদরে আদরে ভরিয়ে রাখবে ওকে।
             আজ মহুলকে নিয়ে শোয়ার স্বপ্ন অতীত এখন ও প্রেমিকার বেডরুম সাফাই করছে।
     ঘরটা বেশ বড় একটা পাশে দেখতে পায়  অসমাপ্ত একটা ছবি। একটা মেয়ের ছবি,বক্ষদেশ অর্ধনগ্ন তাতে পোড়া দাগ আর আঁচড় তারপর আর শেষ হয়নি ছবিটা।
     অংশু ওর নিপুণ হাতে ছবিটা মুছে ঝকঝকে করে।
 মেয়েটা বকবক করে,' এত সুন্দর ঘরখানা তে রাজ‍্যের আবর্জনা এনে জড়ো করেছে। ইশ্ এইটা একটা ছবি! টান মেরে ফেলে দিতে হয়।'
    ..অংশুর বলতে ইচ্ছে করে কেন ফেলে দেবেন এটা? আপনি কে এত বড় বড় কথা বলার? আর যদি দিতেই হয় আমাকে দিন। কিন্তু বলতে পারে না। কিছুক্ষণ বাদে বলে,' ম‍্যাডামকে দেখে নিতে বলুন একবার সব ঠিক আছে কি না?'
        কথাটা শুনে ইরা একটু বিরক্ত হলেও মনে মনে ভাবলো ঠিকই যে থাকে এখানে তার একবার দেখে নেওয়া উচিত। তাই বললো,' হ‍্যাঁ এবার দাদার ঘর থেকে নিজের ঘরে এসো দেখিনি ওটাও তো পরিস্কার হবে। আর দেখে নাও সব ঠিক আছে কি না? নাহলে তো বাপু আমিই চোর হব।'
    ওর কথা শুনে খুব হাসি পেলেও কিছু বলতে পারে না মহুল শুধু বলে আচ্ছা। এই বাড়িতে সবচেয়ে বড় চোর তো ও তাই ওকে বন্ধ করে রাখা হয়। 

      অংশু ঘরে দাঁড়িয়ে তখন,ঘরের এখনকার চেহারাটা ক‍্যামেরাবন্দি করছে। একটা পায়ের আওয়াজে পেছন ফেরে দেখে পর্দাটা সরিয়ে মহুল দাঁড়িয়ে হাতে ওয়াকিং স্টিকটা। আবার দুজনের চোখ মিলে গেল কিন্তু কিছু বলতে পারল না অংশু। মহুলের চোখটা বড় বিষণ্ণ লাগল। অংশুর খুব ইচ্ছে করল ওর সাথে কথা বলতে। একটা সময় একদিন কথা না বললে আর দেখা না হলে ওদের দুজনের চলত না।কিন্তু মেয়েটা পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
   মহুল এক পা এগিয়ে আসে অংশু বলে,' দেখে নিন ঠিক আছে কি না সব কিছু? ছবিগুলো আমি মুছে পরিস্কার করে দিয়েছি আপনি খুব ভালো আঁকেন।'
-' এখন আর আঁকি না আর রঙ ফুরিয়ে গেছে।'
  কথাটা ছোট হলেও এতটাই গভীর যে অংশুর বুকে এসে লাগলো। ইশ্ যদি একবার একটু কথা বলতে পারত ওর সাথে! কতদিন বাদে দেখছে ওকে। তারপরেই ভাবে মহুল হয়ত চিনতেই পারেনি ওকে। বড়লোকের বৌ মহুল কবেই ভুলে গেছে পলাশপুরের অংশুদাকে যে ওকে পাগলের মত ভালোবাসত।

    মেয়েটা তাড়া লাগায়,' আপনার হয়েছে? পাশের ঘরে চলে যান এবার। আমি আসছি সব দেখিয়ে দেব। ওটা দাদার ঘর অনেক জিনিস ছড়ানো আছে।'

       হঠাৎই কলিংবেল বেজে ওঠে মেয়েটা বিরক্ত হয় খুব,' দুপুরেও এরা জ্বালিয়ে মারে। দেখি আবার কে এলো। আমার হয়েছে এক কাজ পঞ্চাশ বার দরজা খোলা।'
     অংশু আর মহুল এখন সামনাসামনি দাঁড়িয়ে। হঠাৎই মহুল বলে ওঠে,'তোমার নাম্বারটা একটু দেবে? তাড়াতাড়ি দাও।'
    পকেট থেকে কার্ডটা বের করে মহুলের হাতে দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মেয়েটার পায়ের আওয়াজ শুনেই।
            অনেকগুলো মদের বোতল দাদার ঘরে,কাজের মেয়ের তোষকের তলার কন্ডোমের প‍্যাকেট আর মহুলের চোখে শরতের রোদের বদলে বর্ষার মেঘের আনাগোনা কদিন ভালো থাকতে দেয়নি অংশুকে। অনেক ক্লায়েন্টের বাড়িতে যায় ও সবার নাম ঠিকানা সবসময় মাথাতেও থাকে না কাজ করে আসার পরই ভুলে যায় তবে হ‍্যাপি হোমের ঠিকানাটা মনের মধ‍্যেই রয়ে গেল।
      তাড়াহুড়ো করে শুধু কার্ডটাই দিতে পেরেছিল অংশু। কোম্পানীর কার্ডে ওর নাম আর ফোননম্বর লেখা। আর কোন কথা হয়নি তবুও ভেবেছিল মহুল হয়ত একবার ফোন করবে কিন্তু প্রায় সাতদিন হয়ে গেল কোন ফোন করল না মহুল। আজকাল নোন আননোন সমস্ত ফোনই ধরে অংশু।
       মহুল নামটা দুবছর আগে জীবন থেকে মুছে গেলেও আবার ঘোরাঘুরি করে আসেপাশে সবসময়। ইচ্ছে করে একবার ওদের হ‍্যাপি হোমের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ও যদি বারান্দায় দাঁড়ায়। কিন্তু সাত তলার ওপর থেকে কি ওকে দেখতে পাবে মহুল? মানুষ যখন ওপরে উঠে যায় নিচের সব আবছা হয়ে যায়। মহুলও যে আজ অনেক ওপরে উঠে গেছে। ওকে যদি একবাক্স রঙ কিনে দিতে পারত। তারপরেই নিজেকে শাসন করে অংশু মহুল তো এখন অন‍্যের বৌ। ঐ গুরুগম্ভীর লোকটা ওর বর যে ওকে অনেক অনুরোধ করার পর ফাইভ স্টার দিয়েছে।
     ওদের পলাশপুরে সেনদের বাড়িতে মহুলরা ভাড়া থাকত। কানাকানিতে শুনেছিল মহুলের মা নেই যাকে ও মা বলে সে নাকি ওর সৎ মা। তবে পরে মনে হয়েছিল যে মা মেয়ের মন পড়তে পারে না সে কোনভাবেই সৎ মা হতে পারে না বরং অসৎ বললে ভুল হবে না। মহুলের বাবা ওদের ওখানে গ্রামীণ ব‍্যাঙ্কে চাকরি করতেন হঠাৎই একদিন স্ট্রোক হয়ে প‍্যারালাইসিস হয়ে যাওয়ায় ওদের সংসারে বিপর্যয় নেমে আসে। একটা সময় এক বছর সুবীর কাকুর কাছে অঙ্কও করেছে অংশু আর তখন থেকেই টুকরো ভালোলাগা মহুলকে। অংশু যখন টেনে মহুলের তখন এইট। কিশোর মনের অনুভূতি মনেই রেখেছিল অংশু তারপর ও যখন বিএ পড়ছে কলেজে তখন এক দোলের দিনে আবীর মাখাতে গিয়ে মনের কথা বলে ফেলেছিল অংশু।
 -' ধ‍্যাৎ তুমি যে কি না! কতটা আবীর দিয়ে দিলে মাথায় মা মারবে আমাকে।'
   মারার কথাটা শুনে খুব মনকেমন হয়েছিল। ইশ্ ওর জন‍্য মেয়েটা মার খাবে।
 -' একটু দাঁড়া আমি ভালো করে পরিস্কার করে দিচ্ছি। এটা ফুলের পাপড়ি গুড়ো। আমার কথার উত্তরটা তো দিয়ে যা।'
    অংশু একটা ফু়ঁ দেয় ওর চোখে মুখে। মহুলের মুখে পড়ে অংশুর গরম নিঃশ্বাস। আবীরের গুড়ো উড়তে শুরু করে হাওয়াতে। আর অংশুর ভালোবাসায় মন পুড়িয়ে বাড়ি ফেরে মহুল। ফিরতেই এক চোট বকা খায় মায়ের কাছে।
  -' কতবার বলেছি না বড় হয়েছিস এখন ধিঙ্গিপনা ছাড় কোথায় গেছিলি শুনি? এমন রঙ দিল কে? আমি সারাদিন রুগী টেনে মরছি আর উনি ওদিকে ফূর্তি করে বেড়াচ্ছেন। দেব চুলের মুঠি ধরে এক কিল পিঠে।'
    মহুল শুনতে পায় বাবার গোঙানি বুঝতে পারে ওকে মারার কথা শুনে বাবা চিৎকার করছে। তাড়াতাড়ি মুখচোখ মুছে বাবার কাছে এসে বসে। হাত বোলায় বাবার গায়ে।'
    রাতে ভাইবোন ঘুমিয়ে পড়লে ওর লাল সিঁথিটা ভাঙা আয়নায় দেখে মহুল। কত স্বপ্নের লাল নীল সবুজ রঙ ঘোরাঘুরি করে মনের চারপাশে।
    আঁকার খাতাটা নিয়ে আঁকতে বসে মহুল
রঙের বাক্সটা হাতে নিয়ে অংশুদার ছোঁয়া অনুভব করে। টিউশন পড়িয়ে এই বাক্সটা ওকে কিনে দিয়েছে। একসময় বাবা এনে দিত বাবার অসুখের পর আর কেউ দেয় না কিছু। রঙের বাক্সটা আবার ছুঁয়ে রঙের ছোঁয়া দিয়ে ভরিয়ে ফেলে খাতাটা।

       ঘরের প্রতিটা জিনিসে অংশুদার হাতের ছোঁয়া পায় মহুল। ওয়াকিং স্টিক নিয়ে আস্তে আস্তে ছুঁয়ে দেখে সব কিছু। ওর অগোছালো ঘর, বাথরুম সবেতেই যেন অংশুদার গন্ধ লেগে রয়েছে।
        অংশুদাকে কয়েকবার জড়িয়ে ধরেছে বাঁধের পেছনে বড় বটগাছটার আড়ালে। অংশুদার কাছে থাকলে সব দুঃখ ভুলে যেত মহুল। দিনরাত মায়ের বকাঝকা, কাজের লোকের মত খাটানো। ছবির খাতা ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া সব। খুব সুন্দর কথা বলত ও,বলত জীবনটা খুব সুন্দর। দেখিস একদিন আমরা খুব ভালো থাকব।
     ভালো থাকার কথা শুনে হাসি পেল মহুলের। ওর মা একদিন হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল ওদের। কার কাছে খবর পেয়ে হাজির হয়েছিল জোড়া মন্দিরের পেছনে। দুজনে তখন মুখোমুখি বসে হাতে হাত রেখে ভালোবাসায় ব‍্যস্ত চোখে স্বপ্নের লুকোচুরি। 
মা চিৎকার শক্ত করে চুলের মুঠি চেপে ধরেছিল ওর। যন্ত্রণায় কেঁপে উঠেছিল মহুল। ওর মা তখন এলোপাথাড়ি চড় কিল মারছে।
 -' কি করছেন কি? ওকে ছাড়ুন শিগ্গিরি। এভাবে মারবেন না।'
-' তোর সাহস তো কম নয় বদমাশ ছেলে তুই আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছিস। কি ক্ষমতা আছে তোর শুনি? আজকের পর তোকে ওর ছায়া মাড়াতে দেখলেও আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। ওহ্ বাপ আর বেটি মিলে আমাকে জ্বালিয়ে মারছে গো। মরেও না এই দুটো।'
       দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহুল সেই অংশুদার সাথে শেষ দেখা। তারপর মায়ের ইচ্ছেই পূরণ হয়েছিল। বাবা চলে গেছিল কিছুদিন পরেই। আর ও মোটামুটি মরেই  গেছে,আর ও মরলেই বা কার কি আসে? বরং ভালোই হয়। ওর খোঁজ নেবার মতও কেউ নেই আর।
         বেশ কিছু টাকা নিয়ে ওকে মোটামুটি মা বিক্রি করে দিয়েছিল ওর থেকে বারো বছরের বড় মামার বন্ধু এই লোকটার কাছে। এক সপ্তাহের মধ‍্যেই ওকে রেখে এসেছিল মামাবাড়িতে মা। মায়ের ভাইও মায়ের মতই ওকে পার করে টাকা গুনেছিল। বিয়ের পর দিল্লীতে চলে এসেছিল ওরা।
   অংশুও তাই শুনেছিল রাতারাতি ভালো ছেলে দেখে ওর বিয়ে দিয়েছে মামারা।
    মহুলের বরের নাম আর স্বভাবের সামঞ্জস্য বিয়ের পরেই বুঝেছিল। বিক্রমের বিক্রমে মহুল থরথর করে কাঁপত। লম্বা,কালো,ভারী চেহারার লোকটা ওর শরীর নিয়ে যখন খেলত তখন ভয়ে হাঁফিয়ে যেত বছর কুড়ির মহুল।
 -' ধ‍্যাৎ একদম মিয়োনো তুমি। দেখেশুনে ছোট টবকা ছুড়ি আনলাম ঘরে এতগুলো টাকা দিয়ে তা এর তো কোন দমই নেই। তা তোমার নাকি কোন নাগর ছিল? তার সাথে শুয়েছ নাকি?'
  কথাটা শুনে চমকে ওঠে মহুল কেমন যেন ভাষাগুলো কানে লাগে ওর। অংশুদার গায়ের গন্ধ নিয়েছে অনেকবার কিন্তু কি বলছে লোকটা!
 -' শুনেছ তো আমার আগের বিয়ে ছিল। ও চলে যাওয়ার পর অনেকদিন একাই ছিলাম। তা ভুলোর কথা ফেলতে পারলাম না বলেই আবার।'
     মহুল কখনও জানতে চায়নি বিক্রমের আগের বৌ কেন মারা গেছিল তবে ওর সাথে ছ মাস থেকেই বুঝতে পেরেছিল মারা যাবার অনেক কারণই থাকতে পারে। মদ,জুয়া মেয়ে মানুষ অনেক রকম নেশাই ছিল লোকটার। তবুও কোথাও যাবার নেই এই কারণেই রয়ে গেছে মহুল। ওর শাসন আর আদর দুটোতেই কেঁপে উঠত মহুল। ছোটবেলা থেকেই ওর 
 রন্ধ্রে রন্ধ্র ভয় ঢুকে গেছে। মায়ের চড় থাপ্পড় আর ধমকে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিল একদম। অংশু অনেক বোঝাত ওকে এত ভয় না পেতে তবুও একটা ভয় তাড়া করত সবসময় ওকে।
     বিক্রমের আদরে মহুলের মা হবার সম্ভাবনা হল। ঐ লোকটা যে ওকে আঁচড়ে কামড়ে আদর করে কে জানে তার সন্তান কেমন হবে? তবুও নিজের পেটে হাত রাখে মহুল হয়ত এতদি পরে ওর নিজের কেউ আসছে। বিক্রম বাইরে বেরোনোর সময় বরাবরই তালা দিয়ে যায় মহুলকে কেন যেন একটা অবিশ্বাস তাড়া করে ওকে। মহুলের যখন তিন মাস তখন কলকাতায় চলে আসতে হল বিক্রমকে,ঐ অবস্থাতেও বিক্রমের আদরের বহর মেটাতে অস্থির হয়ে পড়ে মহুল। কঁকিয়ে ওঠে,' ওহ্ ছাড়ো বাচ্চাটার কষ্ট হচ্ছে। আমার ভয় করছে।'
 গালাগালি দিয়ে ওঠে বিক্রম,'বাচ্চাটাকে ঐ জন‍্যই রাখতে চাইনি। বিয়ের পর একটু আনন্দ করব তা নয় মাঝে একটা বাচ্চা এনে হাজির করল। এবার সামলাও হ‍্যাপা। এরপর একে একা বাড়িতে রেখে কাজে যাওয়া মুশকিল হবে।'
 -' তুমি কাজে যাও আমি পারবো থাকতে।' দাঁতে দাঁত চিপে বিক্রমের আদর সহ‍্য করে মহুল। ঐ গন্ডারটার কাছে ও যেন একটা নরম হরিণ।
       বিক্রমকে কাজের জন‍্য দিল্লী,মুম্বাই করতে হয় তাই হঠাৎই একদিন ইরাকে হাজির করেছিল।
 -' এ আজ থেকে এখানে থাকবে চায়ের দোকানের পুতুমাসি দিলো ওকে বলল ভালো। আমাকে তো এদিক ওদিক যেতেই হচ্ছে শুনলাম চালাক চতুর আছে সব সামলে নেবে। তোমাকে দিয়ে তো কিছু হয় না।'
     ওকে দিয়ে যে কিছুই হয় না তা কয়েকমাস বাদেই টের পেয়েছিল মহুল। ও ইরাকে দেখে প্রথমে একটু আপত্তি করেছিল,' একা ভালোই তো ছিলাম আমি সামলাতাম ঠিক। তাছাড়া কম বয়সী মেয়ে সব পারবে নাকি?'
    ইরা যে সব পারে তা কিছুদিন বাদেই বুঝেছিল। যখন আটমাসের প্রেগন‍্যান্ট মহুল ঘুম ভেঙে দেখেছিল ওর ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। কয়েকদিন বিক্রম আর ওর কাছে শোয় না বলে তোমার শরীর ভারী হয়েছে কখন পা তুলে দিই আবার আমি পাশের ঘরে গিয়ে শুই। একটু বেঁচেছিল মহুলও।
  বিক্রমের মুখের মদের গন্ধ আর আদরের হাত থেকে।
              দরজা বাইরে থেকে বন্ধ দেখে অবাক হয়েছিল মহুল। তারপর অ্যাটাচ বাথরুমে গিয়ে হাল্কা হয়ে ফিরে এসেছিল কিন্তু মনটা হাল্কা হয়নি। ভোরবেলা দরজা খুলে গেছিল। সূর্যের আলোতে নিজের শরীরের চেনা চিহ্নগুলো দেখতে পেয়েছিল ইরার গলায় আর পিঠে। 
     নিজের অধিকার হারিয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছিল মহুল কিন্তু ওদের সাথে পারেনি। ইরার অঙ্গুলী হেলনে এখন সংসার চলে। শুধু ঝগড়াঝাটি করে নিজের সন্তানটাকে বাঁচাতে পারেনি মহুল প্রথমে ভেবেছিল পা পিছলে গেছে পরে বুঝতে পেরেছিল পায়ের তলায় পিছল কিছু লেগেছিল তারপর আর জ্ঞান ছিল না মহুলের। হেসেছিল ইরা মনে মনে ভেবেছিল বেশ হয়েছে দ‍্যাখ এবার মজা। বাচ্চাটাকে হারিয়ে পা ভেঙে পায়ের অপারেশন করে প্লেট বসিয়ে বাড়ি ফিরেছিল একদম নিঃস্ব হয়ে। ফিরে এসে দেখেছিল ওর রঙের কৌটোর রঙ শুকিয়ে গেছে। অনেক কৌটো ফেলে দিয়েছে ইরা। আর শেষ করা হয়নি ছবিটা।
      আজকাল আর ওরা ওর ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে না। রাতের অন্ধকারে ফ্ল্যাটবাড়িটা জীবন্ত যমালয় বলে মনে হয় ইরার। কখনও বা বিক্রম ট‍্যুর থেকে দুপুরে ফিরলে দুপুরেও বিষাক্ত নিঃশ্বাস আর জান্তব ভালোবাসার গোঙানি শুনতে পায় মহুল। দরজা বন্ধ করে কান চাপা দিয়ে বসে থাকে তখন।
    অবশ‍্য বিক্রম আলাদা ঘরে শুলেও কখনও স্বামীত্বের অধিকার খাটাতে চড়াও হয় ওর ওপরেও,স্বাদবদল করতে এসেও সুখ পায় না তেমন। জোর করে ওর ভাঙা পা সরিয়ে বিশাল দেহটা চেপে বসে ওর ওপর। ঘেন্নায় চিৎকার করে মহুল,' সরে যাও,আমার লাগছে।'
  ওর মুখটা চেপে ধরে বিক্রম,'স্বামী পরম দেবতা তার ইচ্ছেতে বাধা দিতে নেই। রাণীর মত রেখেছি,কোন কাজ করতে হয় না আর কি চাই?'
       বিক্রমের জিভ সরীসৃপের মত ওর শরীরে ঘোরাঘুরি করে বিষ ছড়িয়ে যায় সারা শরীরে কিছু বলতে পারে না মহুল। শুধু ঘোর কাটার পর শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে ধুয়ে ফেলে শরীরের অলিগলিতে জমা আবর্জনা।
         
        তুমি আসবে বলেই আকাশ মেঘলা
বৃষ্টি এখনও হয়নি...অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে তার মধ‍্যেই ফোনটা বেজে ওঠে অংশুর। এখন আবার কে ফোন করল? কাজের এ টু জেড শেষ করে এই সবে ফিরছে আস্তানার পথে। এমন সময় কে আবার?
     তবুও সামনে চায়ের গুমটিতে সাইড করে বাইকটা থামায়। একটা আননোন নম্বর থেকে ফোনটা।
-' হ‍্যালো।
-' আমি মহুল বলছি,আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারো অংশুদা? আমি যে কোন কাজ করে নেব তোমার বোঝা হব না।'
   অংশু কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে যায়। ট্রুকলারে নামটা দেখে অংশু লেখা আছে সোমা রায়। তাই আর ফোন করতে সাহস পায় না অংশু। কে জানে কার ফোন এটা। সেদিন মহুলদের ফ্ল্যাট পরিস্কার করতে গিয়ে একটা আবছা ছবি আঁকা হয়ে গেছে অংশুর মনে ও বুঝতে পেরেছে মহুল ভালো নেই। ঐ গম্ভীর গলার লোকটা কি ঐ মেয়েটার সঙ্গে শোয়? নাকি মেয়েটা কোন অন‍্য পুরুষের কাছে যায়? মেয়েটার এত দাপটই বা কেন? মহুল খুঁড়িয়ে হাঁটে মেয়েটার সব কথা মুখ বুজে সহ‍্য করে ব‍্যাপারটা কি?

      মহুলের নিজস্ব কোন ফোন নেই বাড়িতে একটা ল‍্যান্ডফোন আছে তবে লক করা। ফোন ধরতে পারে করতে পারে না। আর ওর তো কেউ নেই কাকেই বা ফোন করবে। একা ঘরে বসে মাঝেমাঝেই পলাশপুরের স্কুলের বন্ধুদের কথা মনে পড়ে ওর। সেদিন ইরা বাইরে বেরিয়েছিল বিক্রমও বাড়িতে ছিল না। বাইরে তালা থাকলেও দরজাটা খুলে দাঁড়িয়েছিল মহুল। পাশের ফ্ল্যাটে থাকলেও ওকে অনেকটা বোঝে সোমা। তাই ওকে ওভাবে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,' ইরা নেই বুঝি,তালা ঝুলিয়ে চলে গেছে সত‍্যিই দুরন্ত সাহস। আমি হলে এমন লোককে..কিছু বলবি রে?'
     সোমাদির কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে অংশুদাকে ফোন করেছিল মহুল। সোমাদি বলেছিল,' কথা বলে নে ইচ্ছেমত। আনলিমিটেড আছে।'
    কিন্তু ইরার ভয়ে বেশি কথা বলতে পারেনি মহুল ফোনটা ছেড়ে দিয়েছিল। ভাগ‍্যিস দিয়েছিল ফোনটা। একটু পরেই চলে এসেছিল ইরা।
       সোমাকে এতদিন কিছু না বললেও হয়ত সোমার দেওয়া পুরোনো ফোনটা মহুলের কাজে লেগে গেছিল। আজকাল বিক্রম আর ইরার না থাকার সময়টা সোমার দেওয়া পুরোনো ফোনটা খুলে অংশুর সাথে যোগাযোগ করে মহুল বারবারই মনে হয় ওর কাছের কেউ আছে এই পৃথিবীতে। সবাই অসুন্দর নয়,সোমাদি আর অংশুর মত মানুষও আছে এই পৃথিবীতে।
      মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা মাস সামনেই বৈশাখ মাস। জীর্ণতা কাটিয়ে আবার নতুন সাজে সাজাতে চায় সবাই বাড়িঘর। তাই বিক্রমের বুকিং অনুযায়ী আবার মহুলের অপরিস্কার সংসার সাজাতে এলো অংশু। হয়ত এই দিনটার অপেক্ষায় ছিল অংশুও। আজ বাইরের প‍্যাসেজটা ক্লিন করতে করতে চাবির ছাপটা নিয়ে নিয়েছে। মহুল অবশ‍্য ইরার সামনে আগের বারের মতই করল। শুধু বার কয়েক চোখাচোখি হয়েছে ওদের। একটা সময় মহুলের মনে হয়েছিল ও কি অন‍্যায় করছে? কিন্তু সোমাদি আর অংশু ওকে বুঝিয়েছে ও কোন অন‍্যায় করেনি হয়ত অন‍্য কোন মেয়ে হলে আগেই চলে যেত কোথাও। সোমাদি বলেছিল,' বড় ভীতু রে তুই? এত ভয় কিসের শুনি?'

             অনেকটা লড়াই করে রীতিমত সুযোগ বুঝে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তালা খুলে অন‍্যের বৌকে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল অংশু। বিক্রম থানা পুলিশ করেছিল কিন্তু পারেনি কিছুই করতে। ফ্ল্যাটের সবাই ওর বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছিল। জয় হয়েছিল অংশুর ভালোবাসার। ওর বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেসে গেছিল মহুল,' এই ছেঁড়া কাটা শরীরটাকে নিয়ে কি করবে তুমি? ঐ মানুষটা যে আমার শরীর মন সব মেরে ফেলেছে।'
    হাসে অংশু,' ভালোবাসাটাকে বোধহয় মারতে পারেনি তাই তো আবার আমি অন‍্যের ঘর পরিস্কার করতে গিয়ে নিজের মনের মানুষ খুঁজে পেলাম হঠাৎই। আবার আমাদের ভালোবাসা ধুয়ে মুছে দেবে সব অন্ধকার মহুল। রঙে রঙে ভরে যাবে তোমার ফ‍্যাকাসে হয়ে যাওয়া ক‍্যানভাস। তোমার শুকনো রঙের কৌটোতে রঙ ভরে দেব।'
  -' আমি আবার পারব স্বপ্ন দেখতে? আবার ছবি আঁকব? আবার ছুটে পাহাড়ে উঠতে পারব?'
-' নিশ্চয় পারবে মহুল আমি আছি না তোমার সাথে। এই এক বছরে পরিস্কারের কাজটা আমি ভালোই শিখেছি যে। দেখবে তোমার শরীর মনের সব ধুলো ঝেড়ে আবার একটা সুন্দর ভোর উপহার দেব তোমাকে।'
        অনেকদিন বাদে যত্নে সিঁথি আঁকছে মহুল। ওর লম্বা চুলটা পিঠে খেলা করছে ভেসে ভেসে। মন ভেসে যায় অংশুর। অনেক কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা এবার ওর মনের ফ‍্যাকাসে ক‍্যানভাস সাজাবে মুঠো মুঠো উজ্জ্বল রঙ দিয়ে। হয়ত সেইভাবে সামর্থ‍্য নেই ওর তবুও ভালো থাকার আর রাখার স্বপ্নরা পাখনা মেলুক আকাশে দল বেঁধে নীল মেঘের হাত ধরে।
   ফোনটা বাজছে 'তুমি আসবে বলেই সোনালী স্বপ্ন ভিড় করে আসে চোখে......
সমাপ্ত:-



  

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...