জন্মদিনের পায়েসের গন্ধ বহুদিন পাননি সুধা। আহা ছোটবেলার সেই দিনগুলোতে কত অপেক্ষা থাকত এই দিনটার জন্য। বাবা কদিন আগে থেকেই বলতেন,' বল তোর কি কি খেতে ইচ্ছে তাই হবে জন্মদিনে। তবে সবই নিরামিষ রান্না হবে কিন্তু। শুভ অনুষ্ঠানে নিরামিষ পদই ভালো।'
সুধা হেসে বলত,' মায়ের হাতের সেই ফুলকো লুচি ছোলার ডাল আর সাধনের দোকানের রসগোল্লা এটাই ভালো বাবা। আর মা তো পায়েস করবেই।'
জন্মদিন মানেই একটা নতুন জামা,নতুন গল্পের বই আর তার সাথে গরম লুচি পায়েসের সুবাস।
বিকেল হতে হতেই বারান্দা ভরত ছোট্ট ছোট্ট চপ্পলে সুধার বন্ধুরা এসে হাজির হত। তাদের হাতে থাকত রঙিন কাগজে মোড়া গল্পের বই, কলম,শো পিস। । ওরা সুধার জামাটায় হাত দিত। কি সুন্দর জামাটা রে!
বাবা এনেছে রে,এই দেখ সাথে কি সুন্দর ক্লিপ! জামা জুতো আর মাথায় ছোট্ট ঝুটিতে চিকচিক করত লাল তারার ক্লিপ। সবাই এলে মায়ের বানানো নক্সাকাটা আসনে বসত সুধা। ঐ আসনটা সুধার খুব পছন্দের ছিল।
সেই আসনে লক্ষ্মী মেয়ের মত মাথা নীচু করে বসত। মা বাবা আর বাড়ির বড়রা মাথায় ঠেকাত ধান দূর্বা আর প্রদীপের শিখা।
তারপরেই বন্ধুদের সাথে গল্পের মাঝেই রান্নাঘর থেকে ভেসে আসত গরম লুচির সুবাস। একটু বাদেই ওদের ঘরের মেঝেতে আসন পাতা হত তাতে সারি দিয়ে বসত ওরা সবাই আর তারপরই মন ডুবে যেত খাবারের স্বাদে।
ঘুমের মধ্যেই সুধা ভেসে যায় মায়ের আদরে আর খাবারের গন্ধে। কতদিন বাদে যেন মায়ের আঁচলের গন্ধটা আবার ভাসছে নাকে,ওর শরীরটা প্রাণভরে মাখছে মায়ের হাতের আদরমাখা ছোঁয়া। বন্ধুদের পাশে বসেই আব্দার করছে সুধা,' ও মা লুচিটা যে খুব গরম গো একটু ফুটো করে দাও না।'
-' দ্যাখ তোরা মেয়ের কান্ড! আসলে কিছু না আমার হাতে খাবে একটু।'
সত্যিই মায়ের হাতে কতদিন খায়নি। সুধা অস্ফুটে ডাকে,' মা তুমি কোথায়?'
-' এই তো আমি,তোর বাবাও আছে। আয় চলে আয় আমার কাছে একদম বুকের মাঝে।'
বুকের ভেতরে একটা অসহ্য কষ্ট হয়েছে কাল বাবানের কথাটা শোনার পর থেকে। শুধু কান্না চেপে সুধা বলেছিলেন,' কালই যেতে হবে?'
বাবান আর বৌমা বলেছিল,' হ্যাঁ কালই যেতে হবে তুমি তো শুনেছ আগেই,পরশু ভোরেই তো আমাদের যাওয়া।
ঘুম থেকে উঠে মাকে বাইরে না দেখে অবাক হয় বাবান। বারবারই বলে দিয়েছিল সকাল সকাল রেডি হয়ে নিতে। নিশ্চয় বাগানে গাছ দেখছে। সত্যি কী যে করে?
-' বাবলি মাকে দেখেছ?'
-' দরজা তো বন্ধ ঘরে আছেন বোধহয়,কথাটা শোনার পরে তো কথাই বলেননি। রাতে খেলেনও না।'
বাড়িতে লোকজনের ভীড় জমেছে। সুধার নিষ্প্রাণ দেহ শুয়ে বিছানায়। মায়ের জন্মদিনটা বাবান ভুলে গেলেও সুধা ভোলেননি। তাই তো ওদেরকে ফাঁকি দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে না গিয়ে একদম চলে গেলেন মায়ের হাত ধরে তারাদের দেশে।
সবাই বলল সুখের মৃত্যু, ডাক্তার বাবু লিখে গেলেন ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক।
গল্প 2
বাসা
গাড়ির জানলায় বসে বারবার আনমনা হয়ে যায় তৃষা। গতকাল রাতের বৃষ্টির পর কতদিনের তৃষিত গাছপালা জল পান করে তৃপ্ত হয়ে শান্তিতে ডালপালা নাড়ছে। সত্যিই বোধহয় সুন্দরী জন্মভূমি। এই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে আর গাছপালায় রয়েছে কত বৈচিত্র্য আর সৌন্দর্যের মোহময় মুগ্ধতা। তাও আমরা ভ্রমণপিপাসু মানুষের দল ঘুরে বেড়াই পৃথিবীর এ প্রান্তে ওপ্রান্তে। মন বলে ওঠে থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগতটাকে। অত্রি পাশ থেকে বলে," দিদি এখানে শুধু বৃষ্টি হয়েছে বুঝলে। কিন্তু আমরা যেখানে যাব সেখানে খুব ঝড় হয়েছে। কত গাছপালা যে ভেঙে পড়েছে তার ঠিক নেই। মানে তুমি সেবারে যে নিম গাছটার তলায় বসেছিলে শুনলাম সেটাও পড়ে গেছে।"
-" খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম রে গাছটাকে,কত পাখির বাসা ছিল ওখানে। মাঝে মাঝেই আম গাছের ডালের ফাঁক থেকে আসছিল কোকিলের ডাক।"
-" তাই তো যাওয়া দিদি,ওদের ভাঙা বাসাগুলো যে আবার ঠিকঠাক করে দিতে হবে।"
আন্দামান থেকে ভাঙা মন নিয়ে ফিরে এসেছিল তৃষা। অনেক দিন চুপটি করে বসেছিল ঘরের কোণে। তারপর মাসতুতো ভাই অত্রির হাত ধরেই এই এনজিও 'ভালোবাসাতে' কাজ শুরু করে। এর আগে ওদের সাথে বন্যাত্রাণ দিতেও গেছিল আসামে। তবে এবারের এই অভিনব কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না তৃষার। পুজোর আগে যেখানে জামাকাপড় দিতে এসেছিল, সেখানেই আবার যাচ্ছে পাখিদের ভাঙা ঘর বেঁধে দিতে।
সুজয়দা খুব সুন্দর সুন্দর মাটির ছোট ছোট হাড়ি এনেছে। তার মধ্যে কী সুন্দর ফুটো করা,যাতে সহজেই পাখিরা যাওয়া আসা করতে পারে।
-''অত্রি দেখেছিস এরমধ্যেই পাখিগুলো কেমন উঁকি মারতে শুরু করেছে হাড়িগুলোতে। ইশ্ কী যে ভালো লাগছে আমার দেখে!"
-" হ্যাঁ তৃষা এভাবেই তো ভেঙে যাওয়া ঘর আবার যত্নে বাঁধতে হয়। ঝড় তো আসতেই পারে তাই বলে তো থামলে আর ভয় পেলে চলবে না। ভাঙা ঘর আর ভাঙা মন নিয়ে কী সারাজীবন বাঁচা যায় নাকি?"
তৃষা সুজয়ের কথার কোন জবাব না দিয়ে আধশোয়া নিমগাছটার ডালে গিয়ে বসে আনমনা হয়। আর মনে পড়ে ওর ভাঙা ঘরের কথা,যা বিয়ের দুই বছরের মধ্যে একটা পরকীয়ার ঝড়ে এলোমেলো হয়ে গেছিল। হঠাৎই চোখটা জলে ভরে যায় তৃষার। অত্রি ডাকে," দিদি এদিকে এসো পাখিদের বাসা বাঁধা দেখে যাও।''
Comments
Post a Comment