মুঠোফোনে আওয়াজ হতেই ব্যস্ত হয় মাধুরী ঐ বোধহয় ছেলের মেসেজ এল। আজ সারাদিন ওর সাথে যোগাযোগ করা যায়নি একদম। ওহ্! এই হয়েছে এক বাউন্ডুলে ছেলে যাব যাব করে এমন জায়গায় গিয়ে বসে আছে যেখানে কোন নেটওয়ার্ক নেই। এ যেন সারাদিন অনন্ত অপেক্ষার পর শ্রীমানের একটা ফোন পেয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া। মা হওয়ার যে কত জ্বালা তা এখন বোঝে খুব ভালো করে। একটা সময় ভগবানকে বলত কবে যে বড় হবে ছেলেটা আর এখন মনে হয় ছোট ছিল তাই ভালো এত উৎপাত তখন করেনি। এর আগেও সোলো ট্রিপে গেছে পিকলু তবে সে জায়গায় ফোন পাওয়া যেত কিন্তু এখানে তো যোগাযোগ করাই যায় না।
আগেই অবশ্য সে কথা বলে গেছে ছেলেটা তবুও অগত্যা ট্র্যাভেলিং এজেন্টকে মেসেজ করে মাধুরী। ওপার থেকেও একই উত্তর আসে এখন ট্রিপে আছে, রাতে হোমস্টেতে গিয়ে ফোন করবে নিশ্চয়।
ওর অস্থিরতা দেখে বিকাশ বলে এই জন্য আমাদের বাঙালী ছেলেমেয়েদের কিছু হল না। সারাক্ষণ মায়ের তাবেদারি তারপর বৌয়ের নজরদারি আর তারপর শেষ বেলায় মেয়ের খবরদারি। মোটামুটি নারীদের পায়ের তলায় থেকেই কখন যে জীবনের শেষ হয়ে যায়। আরে ছেলে তোমার বড় হয়েছে এত চিন্তা কিসের শুনি? বিন্দাস ঘুরছে বেড়াচ্ছে দেশ দেখছে। তা নয় ফোন করে পঞ্চাশ বার জিজ্ঞেস করবে, বাবু ঠিক আছিস তো? খেয়েছিস? ঘুমিয়েছিস? বাথরুম করেছিস? বেশি করে জল খা বাবা।
কবিগুরু সেই কবেই বলে গেছেন সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী...
তুমি চুপ কর তো। বাবারা এই রকমই হয়। কোন চিন্তা ভাবনা নেই। মা হওয়ার যে কত জ্বালা তা যদি বুঝতে।
ওহ্ বাবারা এমনি হয় তাই না? আর তোমার ছেলের সেই ট্রেন থামানোর কথা মনে নেই বুঝি? তখন কে ছোটাছুটি করেছিল শুনি? নিজে তো চুপ করেই বসেছিলে ট্রেনের মধ্যে।
বিকাশের কথায় মাধুরীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে সত্যি বাবা কি মিচকে পাজি ছিল তখনই। এমনিতে চুপচাপ থাকত। তবে বেড়াতে যেতে ছোট থেকেই খুব ভালোবাসত তাই না?
আরে কার ছেলে দেখতে হবে তো? আমি যেমন পাহাড় দেখতে ভালোবাসি তেমনি হয়েছে ব্যাটা। সময় পেলেই ছুটে চলে যায় পাহাড়ে। পিকলুকে নিয়ে সেই প্রথম যখন পাহাড়ে গেছিলাম তুমি তো কত ভয় পেয়েছিলে ঐ টুকু ছেলে কি করবে? ঠিকমত থাকবে কি না,খাবে কি না সেই কত চিন্তা। তারপর শেষে পিকলুর জন্য ওর দিদা দাদু সঙ্গী হল আমাদের।
বাব্বা মনে নেই আবার,পুজোর সময় টিকিট না পেয়ে সেই ভেঙে ভেঙে ট্রেন জার্নি। এখান থেকে লক্ষ্মৌ তারপর ওখান থেকে আবার কাঠগোদাম এক্সপ্রেসে করে নৈনিতাল। হাওড়া স্টেশনে পৌঁছেই একটু বাদেই ঘুমিয়ে পড়ল দিদার কোলে দুধ খেয়ে। তারপর ট্রেন ছাড়তেই দুলুনিতে উঠে পড়ে ঐ দেড় বছরের ছেলে দুলে দুলে বলতে লাগল ঝিকঝিক ঝিকঝিক। নাতির কথা শুনে বাবা মায়ের কি হাসি! আর তখন ও নিজেও হাসছে সবাইকে দেখে।
ছোট ছোট আনন্দ তবুও কত খুশি ছিলাম সবাই একসাথে তাই না?
ছোট ছোট আনন্দ উপভোগ করে খুশি থাকার নামই তো জীবন। স্লিপারে যাচ্ছি অথচ সবাই মিলে জমিয়ে তাস খেলছি। পাশের বাচ্চাগুলো এসে পিকলুর সাথে খেলে যাচ্ছে। তুমি আর মা বসেছ গল্প করতে সামনের মহিলার সাথে। ট্রেন অথচ বেশ একটা পরিবার পরিবার ভাব। এখন এসিতে গিয়েও সেই সুখ আর পাই না বুঝলে। আমাদের পিকলুর মত সবাই আমরা বদলে যাচ্ছি খুব তাড়াতাড়ি। পরিবর্তন হচ্ছে অভ্যেসেও। আগে আমাদের ছোটবেলায় জানলার ধারে বসার জন্য মারামারি হত ভাইবোনে। এখন পাশে জানলা তবুও চোখ বাইরে নেই। চোখ আছে হাতের মুঠোয়। আরে হাতের মুঠোতেই যদি সবসময় আটকে থাকবি তাহলে এত খরচ করে বাইরে আসা কেন শুধু শুধু?
হ্যাঁ ঠিক বলেছ। মনে আছে তোমার লক্ষ্মৌতে পৌঁছে পিকলু প্রথম আইস্ক্রীম খেলো বার বার জিভ বার করে দিচ্ছে আরও খাবে বলে। আর আইকিম আইকিম বলছে।
তোমার মনে আছে মাধুরী কাঠগোদাম এক্সপ্রেস অনেক লেট ছিল। ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করে করে আমরা অতিষ্ঠ প্রায় তারপর তিনি এলেন আর তারপরে দুলকি চালে চলতে থাকলেন।
মনে নেই আবার? ট্রেন চলার মাঝে একবার খাবার দিতে এল। আমাদের খাবার থেকে কিছুটা ভাত তুলে একটা বাটিতে করে মেখে খানিকটা গুড়ো দুধ দিয়ে পিকলুকে খাওয়াতে বসলাম আমি। তা কিছুতেই খাবে না নানা বায়না শুরু করল। বাধ্য হয়ে বাবার লাল হাত ব্যাগটা ওকে ভোলানোর জন্য দিলাম যাতে খেয়ে নেয় চুপ করে। দেওয়া মাত্রই দেখলাম সাথে সাথেই ভ্যানিস ব্যাগটা। মানে মুহূর্তে ওটাকে জানলা দিয়ে ফেলে চুপ করে বসে। এদিকে তো তখন হৈ হৈ কান্ড।
সে আর বলতে শ্বশুরমশাইয়ের অনেক দরকারী জিনিস মানে ঘড়ি চশমা পার্স সব ঐ ব্যাগে সুতরাং আমি চেন ধরে ঝুলে পড়লাম ছেলের অপকর্মের ঠ্যালা সামলাতে। কতটা এগিয়ে গেল এইসব করতে করতে ট্রেনটা, তবুও অবশেষে থামলো।
ইশ্ তুমি তখন তো লুঙ্গি পরেই ছুট মেরেছো ব্যাগ খুঁজতে।
কি করব তখন? সেই সময় তো সবাই বেশি সময়ের জার্নিতে লুঙ্গি পরে ফেলত আমি আর বাবাও তাই করেছি। ওহ্ কতটা ছুটে গেছি লাইন ধরে তার আগে মনে হচ্ছিলো মারি একটা চাটি বিচ্ছুটাকে।
তুমি যাবার পর তো আমি বকছি ওকে সমানে। আমার বকা খেয়ে চুপটি করে বসে আছে কোন কথা নেই। তখন গিয়ে দাদু দিদার কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তবুও সে যাত্রা ব্যাগটা পাওয়া গেছিল এই রক্ষা।
হ্যাঁ মাধুরী এদিকে হলে কি হত জানি না তবে একজন ব্যাগটা পেয়ে সাইকেলে ঝুলিয়ে স্টেশনের দিকে যাচ্ছিলো তার কাছ থেকেই পেলাম ব্যাগটা।
আর তুমি আসার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা। যাক ব্যাগটা পাওয়া গেছে। আমারই তখন নিজেকে দোষী মনে হচ্ছিল। আমিই তো ওকে ব্যাগটা দিয়েছিলাম।
বিকাশ হেসে ফেলে,তোমার মনে আছে সারা রেল গাড়ির প্যাসেঞ্জার এসে ওকে দেখে যাচ্ছিলো। এমন কি গার্ড এসেও দেখে গেলেন কার জন্য চেন টানা হয়েছে।
ওহ্ কি কান্ড! শেষে আমাকে রীতিমত মিস্টি খাওয়ার টাকা দিতে হল।
মনে নেই আবার? তারপর যতবার বলেছি দাদুর ব্যাগ ফেলেছিস কেন? সাথে সাথে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলত, আবাব। মানে আবার সেই কথা বলছ?
পিকলুর কথা বলতে বলতে ওরা দুজনেই হারিয়ে গেছিল ওর ছেলেবেলায়। হঠাৎই ফোনটা বেজে ওঠে। মাধুরী তাড়াতাড়ি করে ফোন ধরে,দাঁড়াও পিকলুর ফোন।
-হ্যাঁ রে ঠিক মত আছিস তো? উঃ সারাদিন কি দুঃশ্চিন্তা গেল। একবারও ফোন পাচ্ছি না।
-মা চিন্তা কোর না দারুণ দেখছি। ওহ্ কি সুন্দর সব জিনিস দেখছি! নেটওয়ার্ক পেয়েই তো ফোন করলাম।
-কি করছিলে তোমরা?
দুজনেই একসাথে স্পীকারে মুখ রেখে বলে ওঠে তোর প্রথম বেড়াতে যাবার গল্প করছিলাম। সেই নৈনিতালের গল্প।
- আবার! মা সে তো কতবার বলেছ।
বলেছি তো,তবুও আমরা যে তোদের ছোটবেলাতেই রয়ে গেছি এখনও তাই তো খুব চিন্তা হয় সবসময়। আমাদের ছোট্ট পিকলু যদিও অনেকটা বড় হয়ে গেছে তবুও আমাদের কাছে সন্তানেরা বোধহয় সবসময় তাদের মিঠে ছেলেবেলাতেই থেকে যায়।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment