আবার একটা পুজো এসেছে আকাশে নীল নীল ছেঁড়া মেঘের খেলা। কলকাতা থেকে একটু বাইরের দিকে গেলেই দেখা যায় কাশফুলের মেলা। সারাবছর অপেক্ষায় কাটে আমাদের এই সময়টার জন্য মনে হয় মা আসছেন। আসলে মা দুর্গা ধনী গরীব সকলের ঘরের মেয়ে উমা। যাকে সুখ দুঃখের কথা বলা যায় ঘরের মেয়ের মত পিঁড়ে পেতে বসিয়ে শাক ভাত খাওয়ানো যায়। ছোট বড় সবাই আশা করে বসে থাকি আমরা মা আসছে,ঐ তো মায়ের পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আসলে মা শব্দটা বড় নিরাপদ একটা আশ্রয়,ভীষণ মিঠে একটা নাম। যাঁর কাছে শান্তি পাওয়া যায়,যাঁর আদরে শাসনে আর শিক্ষায় শেখা যায় অনেক কিছু। জীবনে চলার পথে মায়ের শেখানো সব কিছুই আমাদের সাহায্য করে এগিয়ে যেতে। মনে হয় মা আমাদের সাথেই আছেন সবসময়। দশহাতে রক্ষা করছেন মা দুর্গা আর আমাদের মা দুহাতে ধরে রেখেছেন সংসারের সবটা। মা বলে ডাকলে শরীর মন সব যেন জুড়িয়ে যায়।
ছোটবেলার পুজোর আনন্দ আর এখনকার পুজোর অনেক ফারাক। অনলাইনে শপিং হচ্ছে কত জামা জুতো এসে জমা হচ্ছে ঘরের কোণে কিন্তু সেই আনন্দ যেন আর খুঁজে পাই না। আমার ঠাকুরদা খুব ভালো সেলাই করতেন। আমাদের ছোটবেলায় ঠাকুরদার দেওয়া উপহার ছিল রঙিন ছিটকাপড় কিনে বানানো জামা। মোটামুটি একই কাপড় আর ডিজাইনে বাড়ির সব মেয়েদের মানে আমাদের বোনেদের জামা হত। বাড়ির সবাইকে জামাকাপড় দিতে হত বলে বাবার কাছ থেকে বেশি জামা পেতাম না। তবে জেঠু,মামাবাড়ি,কাকা,ঠাকুরদা সবারটা মিলিয়ে অনেকগুলোই জামা হয়ে যেত। পুজো মানেই আগে থেকে বারবার করে দেখতাম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জামাগুলো। আমাদের পুজোর বাজার মোটামুটি একটা বাধা দোকান থেকেই করতেন বাবা। বেশ সকাল সকাল গিয়ে সেই দোকানের গদিতে বাবা গুছিয়ে বসতেন আমি আর মাও সাথে যেতাম। মা লিস্ট বের করতেন তারপর সেই লিস্ট ধরে ধরে সবার জন্য জামাকাপড় কেনা হত। মাকে পুজোতে কখনও তেমন ভালো শাড়ি কিনতে দেখিনি আলাদা করে। বাড়ির সবার জন্য যা কেনা হত ঠিক তেমনি একটা শাড়ি বরাদ্দ থাকত মায়ের জন্যও। সাধারণ জীবন যাপনে খুব বেশি অভ্যস্ত ছিলেন মা,তাতেই সবসময় খুশি থাকতেন।
জিনিসপত্র কিনে বেশ কয়েকটা ব্যাগ দোকানে রেখে একেবারে জুতো আর টুকটাক সাজগোজের জিনিস কিনে বাড়ি ফেরা হত। বাবা কাজল, লিপস্টিক নেলপালিশ পরা একদম পছন্দ করতেন না। আমার নেলপলিশ আর কাজল পরার নেশা ছিল। নেল পলিশ পরতে পারতাম না বাবার ভয়ে দেখলেই বকতেন বলতেন নখের জেল্লা নষ্ট হয়ে যাবে। তবে কাজল মা বাড়িতেই পেতে দিতেন সেটাই চোখে লাগাতাম। আমার সংগ্ৰহে প্রথম লিপস্টিক এলো বিয়ের পরে,একথা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি। তার আগে স্নো পাউডার আর কাজলেই সমাপ্ত ছিল সাজ। শীতকালে আসত বাড়িতে কোল্ডক্রীম। মা অবশ্য মাঝেমাঝেই দুধের সর মাখিয়ে দিতেন।
পুজোর বাজার লোককে দেখানো তখন একটা রেওয়াজ ছিল। সেটা বেশ খুশিমাখানো অনুভূতি। বাবা যেখানে চাকরি করতেন সেখানে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে কাকিমারা আসতেন পুজোর জামাকাপড় দেখতে। আমরাও যেতাম জামাকাপড় দেখতে,সেটাতে বেশ একটা ভালোলাগা ছিল।সবাইকে দেখিয়ে নতুন জিনিসের আনন্দ ভাগ করে নেওয়াতে এক অনন্য সুখ ছিল।
আমার বাবা মা দুজনেই শিক্ষক শিক্ষিকা হওয়ায় টানা একমাস ছুটি পাওয়া যেত পুজোতে। তবে পুজোর দিনগুলো শহরে আর গ্রামের বাড়িতে ভাগাভাগি করে কাটাতাম। আবার কখনও বাইরে বেড়াতে চলে গেছি। তবে পুজোর কদিন বাড়িতে থাকতেই পছন্দ করতেন বাবা। বাবার হাত ধরে অনেক বড় মানে মোটামুটি বিয়ের আগে পর্যন্ত ঠাকুর দেখেছি। আমাদের দেশের বাড়িতে পুজো হয় তাই নবমী দশমী আমাদের ওখানেই কাটত। একটা ঠাকুরেই ছিল অপার শান্তি। মন্দিরে শঙ্খঘন্টা বাজলেই ছুটে যাওয়া। ঢাকের বোল আর শিউলির গন্ধ পাগল করত ছেলেমানুষ মনটাকে। হাল্কা শীতের পরশ মাখা ভোরে দিদিদের সাথে অন্ধকার থাকতেই মেতে উঠতাম শিউলি ফুলে সাজি ভরাতে। আমাদের গ্ৰামের বাড়ির সামনের রাস্তায় মেলা বসত মানে এখনও বসে তবে আমার যাওয়া হয়নি অনেক বছর। আমাদের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবাই মিলে সেই মেলাতে নজর রাখতাম আর তার সাথে চলত আড্ডা আর জমাটি গল্প। তার মধ্যে বড়দের ছাদ থেকে চোখে চোখে ভালোলাগা ছড়ানোও ছিল। গল্পের মাঝেই টুক করে নেমে কিছু কিনে নিয়ে চলে আসতাম। গরম জিলিপি আর মাটির পুতুল কেনা ছিল ছোটবেলার পরম পাওয়া। পোড়া মাটির জাঁতা,ছাগল,গরু আর মেয়ে পুতুল পাওয়া যেত। বেশ অন্যরকম দেখতে ওগুলো।
মেলা দেখার পয়সা দেবার জন্য বাড়ির বড়রা বসে থাকতেন খুচরো নিয়ে। সেখান থেকে সবাই ভাগ পেত। ঠাকুর বিসর্জনের শেষে সব বাড়িতে ঘুরে ঘুরে প্রণাম করতে যেতাম বাবা মায়ের সাথে আমিও। মোটামুটি নারকেল নাড়ু আর নিমকি খেয়ে পেট ফুলে ঢোল হত। বাড়তি কিছু নাড়ু থাকত হাতে।
মালদা শহরের পুজো দেখতাম মামাবাড়ি এসে। ছাদে উঠে বা সিঁড়িতে বসেই দেখা যেত লোকজন আর ঠাকুর। ঝকঝকে সেই রাতগুলো ভাসে চোখে এখনও।
বিয়ের পর কলকাতায় চলে আসি। পুজোর বাজার তখন কলকাতা থেকেই হত। বাবার সাথে হাতিবাগানে গিয়ে দুজনে মিলে জামাকাপড় কিনতাম। দোকানে গিয়ে ভরাট গলায় বাবা বলতেন বেশ একটা রঙচঙে জড়িপাড় শাড়ি দেখাবেন এবার মেয়ের জন্য। জড়ির পাড় শাড়ি আর সোনার গয়নার সাজ বাবার খুব পছন্দ ছিল। আবার কখনও আমি আর মা যেতাম বাজারে। মা নিজে না সাজলেও আমাকে সাজত দেখতে খুব ভালোবাসতেন। বেশ আনকমন শাড়ি মায়ের পছন্দ ছিল। বেশিরভাগ পুজোতেই একটা দুটো দিন ঠাকুর দেখে বাইরে বেড়াতে চলে যেতাম কারণ সেই সময় সবার ছুটি থাকত। মা বাবাও সঙ্গে যেতেন বেশিরভাগ সময়। ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল ওদের কাঁধে নিয়েও ওর বাবা ঠাকুর দেখিয়েছে। শ্বশুরমশাই, বাবা মা সবাইকে নিয়ে বাগবাজারের ঠাকুর দেখা একটা অভ্যেসের মধ্যেই ছিল। তারপর সেখানে থেকে কখনও চলে গেছি কুমোরটুলি হয়ে একদম কলেজ স্কোয়ার আর মহম্মদ আলি পার্ক। কলেজ স্কোয়ারের ঠাকুর বাবার খুব পছন্দ ছিল। গত কয়েক বছরে অনেক কিছু হারিয়েছি। মা বাবা দুজনের আর কেউ নেই। ছেলেমেয়েরাও বেশ বড় হয়েছে এখন ওরা শাড়ি কিনে দেয় মাকে সাজাতে ছেলে কিনে আনে ড্রেস। এখন অবশ্য পাল্টেছে পুজোর রূপ করোনায়। তবুও পুজোর আগের দিনগুলোতে কান পাতি মায়ের পায়ের শব্দ শোনার জন্য। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়,মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দিনগুলোর কথা খুব।মহালয়ার দুদিন বাদে আমার মা চলে গেছিলেন বারবার মনে পড়ে সেই সব কান্নাভেজা দিনের কথা তবুও বলি ভালো রেখো মা সবাইকে। মা বলে যে তোমাকেই ডাকি এখন,আর যে কেউ নেই মা বলে ডাকার তাই আগলে রেখো দশহাতে আপদে বিপদে।
Comments
Post a Comment