Skip to main content

ইলিশ সুন্দরীর স্বপ্নে

শাড়ির প‍্যাকেট হাতে নিয়ে ট্রাম থেকে নেমেই চোখে পড়ে যায় বাবলুদার ম‍্যাগাজিন কর্ণারটা। রঙীন পুজোসংখ‍্যার দিকে একবার চোখ না মিলিয়ে আর পা বাড়াতে পারে না ঋতু। কি সুন্দর সুন্দর সব ম‍্যাগাজিনের কভার পেজ। বাড়িতে পুজোর জন‍্য হয়ত একটা পূজাসংখ‍্যা আসবে তবুও বাবলুদার দোকানে দাঁড়িয়ে বেশ চোখ রাখা যায় সবগুলোর পাতাতেই একবার করে। আজকাল অবশ‍্য অনেকেই বুদ্ধি করে পলিথিন কাভারে ঢেকে পূজাসংখ‍্যা বের করেন যাতে ঋতুর মত অনেকেই দৃষ্টিসুখে বইয়ের সাথে ভাব করা থেকে বঞ্চিত হয়। সকালের পর এই সময়টা ম‍্যাগাজিনের দোকানটা বেশ ফাঁকা থাকে। ওকে দেখেই মুখ উঁচু করে হাসে বাবলুদা, ও বৌদি যে। কোন বই লাগবে নাকি? এবার কিন্তু দারুণ দারুণ সব বই বেরিয়েছে। কোনটা লাগবে নিন ডিসকাউন্ট আছে সবেতেই।
     একটু লাজুক হাসে ঋতু,আগে একটু দেখে নি তারপর বলছি কোনটা নেব। তাড়াতাড়ি ওর পছন্দের বইগুলোর পাতা উল্টে শাড়ি,গয়না আর রান্নার পাতাগুলো একবার দেখে নেয়। তার সাথে গল্পের সূচিপত্রটাতে চোখ বুলিয়ে নেয়। হঠাৎই চোখ পড়ে যায় এই পুজোতে সাবেকি নিয়মে রান্নার পাতাটাতে একটু চোখ বুলিয়ে খুব নস্টালজিক লাগে ঋতুর। নিমেষে মনে পড়ে যায় কত পুরোনো কথা। কপালে সিঁদুর পরা জোড়া ইলিশের নাকে নথ আর ছোট্ট লাল শাড়ি জড়ানো দেখে সত‍্যি খুব ভালো লাগে। এমনটাই তো ও দেখেছে ছোটবেলায় শুধু তার সাথে এখন যোগ হয়েছে একটুখানি নবীকরণের চমক।
   এখানে দাঁড়িয়ে পুরোটা পড়া যাবে না তাই হাত বাড়ায়। এই পুজোতে কেন যেন খুব পুরোনো কথা মনে হয়েছে বারবার ঋতুর। তাই হঠাৎই খেয়াল হয়েছিল একটা সুন্দর চওড়া পাড়ের তাঁতের শাড়ি কেনার। অবশ‍্যই সেটা লাল পাড় হবে যেমন ওর দিদা পরত। তার সাথে দোকানে গিয়ে একদম হাতে সুন্দর ডিজাইনের মকর মুখের শাঁখা আর লাল টুকটুকে পলা পরেই এসেছে। বইটা হাতে নিয়ে বাবলুদার দিকে বাড়িয়ে দেয় ঋতু, এই বইটা দিয়ে দিন।
    নিজের মনে বকবক করে বাবলুদা এই বইটা খুব ভালো হয়েছে তাই না বৌদি? সামনে ইলিশ মাছ আর রান্নার ছবিগুলো কিন্তু হেভ্ভি তাই না?
      হাসে ঋতু ইলিশের প্রেমে ভেসে যায় বোধহয় সব বাঙালী। যেমন রূপোলী সুন্দরীকে দেখতে তেমনি খেতে আর দামীও তেমন।
    পুজোর গন্ধে মাখা চারিদিক। আকাশে নীল মেঘের খুনশুটি আবার তার মধ‍্যেই কখনও কালো মেঘের হুমকিতে ভয় পেয়ে আকাশের কান্না। তবে আজকের সকালটা বেশ। ঘরের অনেকটা সামলে ভিড় এড়াতে এই সময়টা বেরিয়ে টুক করে ওর প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বেশ ফিরে এসেই পেয়ে গেল পছন্দের একটা বইও পুজোর গন্ধ আর আনন্দের মাঝে বইটা খুবই স্পেশাল ঋতুর কাছে। নতুন বই না এলে ঘরে বেশ পুজো পুজো মনে হয় না। টাকা দিয়ে নতুন বইয়ের চকচকে মলাটটাতে আরেকবার হাত বোলায় ঋতু। খুব ইচ্ছে করে একবার গন্ধটা নিতে।

          বাড়িতে এসে জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে সকালে রান্না করা খাবারে পেট ভরিয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। এই সময়টা ওর একান্ত নিজের সময়।
 যাক বাবা সব হয়ে গেছে মোটামুটি, শাড়িটা গায়ে ফেলে দেখে নিয়েছে কয়েকবার। এরপর বইটাতে চোখ রাখবে একদম নিশ্চিন্তে। ওর সুডৌল হাতে নতুন পরা শাঁখা পলা নানান সুরে আওয়াজ করে চুড়ির সাথে ভাব জমিয়েছে এর মধ‍্যেই। বেশ লাগছে দেখতে হাতটা,অনেকদিন ইচ্ছে ছিল এমন এক জোড়া শাঁখা পরবে। মায়ের পুজোর কদিন সাবেকি সাজে আর বাঙালী রান্নায় ডুব দিতে খুব ইচ্ছে করে।
          বইটাতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চোখ রাখে ঋতু। মন ভরে দেখে সাজগোজ আর ফ‍্যাশনের পাতাটা। কেন যেন খুব সিরিয়াস কিছু আজকাল আর ভালো লাগে না। আসলে জীবনটাই বড্ড সিরিয়াস হয়ে গেছে। তারপর সব শেষে চোখ রাখে রান্নার পাতায়। আজকাল বাঙালীর রান্নাঘরে মোগলাই,চাইনিজ,থাই,ভিয়েতনামের রান্নায় কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেই শাপলার ডাল,কচুরলতি দিয়ে নারকেল চিংড়ীর আদর মাখা ভাবের মন মাতানো পদ অথবা মোচার কোপ্তা আর ঝুরি আলু ভাজার মুচমুচে শব্দ। এখন অনলাইনের ফুড ডেলিভারি সংস্থাগুলোর সাইটে গেলেই দেখা যায় ফুলকো লুচি থেকে খিচুড়ি সবই পাওয়া যাচ্ছে। বাবা মায়ের বিবাহবার্ষিকী বা জন্মদিনে রেস্টোরেন্টে বাঙালী থালি খেয়ে সেল্ফি তুলে স্ট‍্যাটাসে দেয় সবাই। মাটির গ্লাস কলাপাতা আর ধোঁয়া ওঠা ভাতে কলাপাতার গন্ধ মাখা পাঁঠার মাংস কেমন যেন নস্টালজিক করে দেয় হঠাৎই।

      ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমী নবমী আর দশমীর মেনু পড়তে পড়তে হারিয়ে যায় ঋতু খুব মনে পড়ে ওর দাদুর বাড়িতে কাটানো দশমীর দিনের কথা। ঢাকার মানুষ হওয়ার জন‍্য দশমীর পর আর বাড়িতে ইলিশ মাছ রান্না হত না। তাই দশমীতে হত ইলিশের নানান পদ। তার মধ‍্যে ইলিশের সরষে নারকেল আর জিরে বাটা দিয়ে বানানো স্পেশাল রেসিপির সুগন্ধ চোখ বুজেই পায় ঋতু। তার সাথে ভাজা,মিস্টিকুমড়ো দিয়ে কাঁটার ঘন্ট,কচুরশাক আরও কত কি। আহা কি অপূর্ব তার স্বাদ! তারপর আবার সরস্বতী পুজোর দিন বা অন‍্য কোন ভালো দিন দেখে জোড়া ইলিশ আসত ঘরে। সেই মাছকে বরণ করে সাজানো হত বড় কাঁসার থালায় পাশাপাশি। সিঁদুরের টিপের সাথে সাথে নাকে নোলক পরে আরও খুলে যেত ইলিশ সুন্দরীর সাজ। অনেক সময় দিদা মাছকে সাজাতেন নতুন লাল সাদা চেক ছোট্ট নতুন গামছায়। এখন অবশ‍্য সেই গামছাই ফ‍্যাশনের হাই ট্রেন্ডে তারপর মাছ পুজো শেষে বড় বঁটি আর কাঠের পাত্রে জল নিয়ে কাটতে বসা হত সেই মাছ। একবার ভালো করে ধুয়ে নেওয়া হত আঁশ ছাড়িয়ে গোটা অবস্থায়। তারপর আর ধোয়া হত না। একটা অদ্ভুত সুন্দর ঝোল রাঁধার নিয়ম ছিল সেই মাছ দিয়ে। একটা বড় গোটা বেগুন আর শুধু জল লবণ হলুদ আর কাঁচালঙ্কায় তেল ছাড়া রান্না হত সেই মাছ।
      অত‍্যন্ত স্বাস্থ‍্যসম্মত সেই ডায়েট হিলসার ঝোল দিয়ে মাখা ভাতের স্বাদ যারা পেয়েছে জীবনে তারা হয়ত কখনই ভুলতে পারবে না।
     ষষ্ঠীতে নিরামিষ, সপ্তমীতে মাছের কালিয়া,অষ্টমীতে অঞ্জলির পর নিরামিষ ভোগ,নবমীর কচি পাঁঠার ঝোল কলাপাতায় সাথে একটু বাসন্তী পোলাও আর দশমীর ইলিশ সুন্দরীর সাথে অনেকক্ষণ আলাপচারিতায় বড্ড নস্টালজিক হয়ে পড়েছিল ঋতু। বারবার মনে হচ্ছিল বইয়ে দেখে নয় ঐ স্পেশাল রান্নার স্বাদ যদি আরেকবার পাওয়া যেত দিদার হাত থেকে। সেই কবে খেয়েছিল তবুও আবারও ইচ্ছে করে।
        চোখের সামনে একটা একটা করে পর্দা সরে যাচ্ছে। কত কি দেখতে পাচ্ছে যেন হঠাৎই। দিদা ইলিশ মাছ সাজাচ্ছে কড়াতে। শিল নোড়ায় সরষে বাটা হচ্ছে। মা বসে নারকেল কোরাচ্ছে আর ইলিশের সুবাস মাখছে ঋতু রান্নাঘরের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে।

       হঠাৎই বারবার একটা আওয়াজ কানে আসতে থাকে ভাবনাদের জাল কেটে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে এদিক ওদিক। দিদাকেও আর দেখে না। মাও নেই কুড়ুনি ফেলে চলে গেছে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে ঋতু ইশ্ ফোনটা অনেকক্ষণ বেজে যাচ্ছে। তাহলে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল?
    ফোনটা ধরতেই শুনতে পায় বরের গলা,কি গো এতক্ষণ কি করছ? বেল বাজাচ্ছি তো। দরজাটা খোলো।
     দরজা খুলে মুখে লাজুক হাসি হেসে হাই তোলে ঋতু,ইশ্ একদম ঘুমিয়ে পড়েছিলাম অবেলায় বই পড়তে পড়তে। বেশ ভালো একটা স্বপ্ন দেখলাম জান তো?
   -দুপুরের ঘুমেও স্বপ্ন!
  -হ‍্যাঁ মশাই। তাও আবার ইলিশ মাছের স্বপ্ন আমার দিদা রান্না করছে।
 তোমার সেই ইলিশ প্রেম! হবে হবে পুজোর মধ‍্যে একদিন। আমি টেবিল বুক করে রাখব আগে থেকে। দেখি কত ইলিশ খেতে পার তুমি?
-ধুৎ ওতে কোন মজা আছে নাকি? গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতে মখমলে নারকেলের দুধে চোবানো সর্ষেমাখা ইলিশকে কাঁচা তেল হলুদে স্নান করিয়ে তোমাকে খাওয়াবো আমি। সত‍্যিই খুব নস্টালজিক লাগছে জান আজ। খুব মিস করছি পুরোনো দিনগুলো।
  অনিন্দ‍্য হা হা করে হেসে উঠে বলে, বাঙালী দুটো উৎসবে খুব বেশি নস্টালজিক হয়ে খাঁটি বাঙালী হতে চায় জানো।
    কোন দুটো উৎসব?
 আরে নববর্ষ আর দুর্গাপূজা। তাই তো আমার বৌয়ের গায়ে আজ খুব বং গন্ধের মাখামাখি। হাত সেজেছে শাঁখা পলায়,প‍্যাকেট থেকে উঁকি মারছে তাঁতের শাড়ি বিছানায় নতুন গন্ধ মাখা চকচকে পাতার পূজাসংখ‍্যা।
      বলো জয় দুগ্গা মায়ের জয়।

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...