মুখটা নিভে গিয়েছিল শৈলপুত্রীর। চোখ ঘিরে রেখেছিল বিষাদের ছায়া। ব্যস্ত হয়েছিল নটরাজ,' ইশ্ আপনি চিন্তা করবেন না। অবাক হয়ে যাবে এই ছবি দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরবে।
বহুদিন বাদে ছেলেকে পেয়ে বাড়িতে খুশির আবহাওয়া। দেওঘর থেকে আসার সময় নটরাজের ব্যাগ ভর্তি থাকে ওখান থেকে আনা খাবার দাবার আর মিষ্টিতে। বাবা তো বাচ্চাদের মত বসে থাকেন সেগুলোর প্রত্যাশায়। নটরাজ সংসারী না হলেও সংসারের মানুষের ভালোবাসা আর ইচ্ছেগুলো বোঝে। বাড়ির মানুষদের আর প্রিয়জনদের এই খুশিটুকু ছুঁয়ে যায় ওকে। নিজেকে ঠিক মনে হয় এখন বাবার মত। একটা সময় বাবা অফিসের কাজে বাইরে গেলে ও বসে থাকত খাবারের প্রত্যাশায়। এখন ওর ব্যাগে উঁকিঝুঁকি মারেন বাবা সময় বদলেছে চিত্রটা পাল্টেছে। নটরাজের মায়া মমতা সত্যিই অন্যরকম। ঠিক ব্যাচেলার ছেলেদের সাথে মেলে না। তাই ব্যাগ থেকে বের করে প্যাঁড়া ক্ষীর,ঘি,শৈলপুত্রীর বানানো তিলের নাড়ু,পৈঠা আর চিড়ের মোয়া। সাথে অবশ্য ফুলবন্তীর বানানো বড়িও আছে। মা তো বড়ি পেয়ে খুব খুশি!
-' আহ্ এই একটা দারুণ জিনিস এনেছিস! সবই তো দুই জায়গায় দেখছি ভাগ করা। এত জিনিস এনেছিস। ও মা খেসারী আর ছোলা মটরের শাকও আছে! একজন কিন্তু খুব খুশি হবে এগুলো পেয়ে।'
-' এগুলো মথুরার দেওয়া মা। সাহাব বাড়িতে যাবে শুনে যে যা পেরেছে এনে দিয়েছে হাতে করে। এমনকি আখের গুড়ও আছে একদম ওদের ক্ষেতের। এই ভালোবাসা টুকু বয়ে আনতে আমার তো হাল খারাপ। তবুও কাউকে দুঃখ দিইনি।'
-' তোকে সবাই খুব ভালোবাসে তাই না?'
-' হ্যাঁ মা একদম খাঁটি ভালোবাসা। ওখানকার মানুষগুলোর সাথে খুব জড়িয়ে গেছি গো।'
বাবা ততক্ষণে মোয়া নাড়ু আর প্যাঁড়া নিয়ে বসে পড়েছে। মুখে দিয়েই আহা শব্দটা বেরিয়ে আসে,'ওহ্ কতদিন বাদে খাচ্ছি রে! মনটা ভরে গেল একদম। মায়ের বানানো তিলের নাড়ুর মত স্বাদ। এই গুড় এখানে পাওয়াই যায় না। আহা কি মুড়মুড়ে খেতে!'
-' তোর বাবাকে দেখেছিস কেমন মিষ্টি খাবার লোভ বেড়েছে! আরে শক্ত নাড়ু খেয়ে দাঁত ভেঙো না আবার। নাহ্ হারাধনকে ফোন করে আসতে বলি শাক,বড়ি,নাড়ু,পেঁড়া নিয়ে যাক দাদা আবার খুব ভালোবাসে এইসব খেতে। নাহলে তো রক্ষা নেই সবই তোমার পেটে যাবে।'
-' দেখ কি অবস্থা! স্বামী একটু খাচ্ছে ঘুরে ফিরে সহ্য হচ্ছে না সব দাদার বাড়িতে পাঠানোর জন্য ব্যস্ত। শত্তুর সব!'
-' দেখ কথার কী ছিরি! আমার ছেলের আনা জিনিস আমি ওর দাদুর বাড়ি পাঠাব না! সবসময় শুধু বাজে বকা।'
-' বাবা তুমি খাও আমি মামুবাড়ির জন্যও এনেছি তো সব আলাদা করে। আর পরশুই তো আমরা সেখানে যাব।'
তবে মা আমাকে আর বাবাকে কাউকেই বিশ্বাস না করে হারাধন কাকাকে ফোন করে আনিয়ে মিষ্টি,মোয়া,পেঁড়া,বড়ি আর নাড়ু দিয়ে পাঠিলো দিল।
নটরাজ খুব তাড়া দিয়ে মোটামুটি সামনে বসে থেকে ছবিটা বাঁধিয়ে আনল সুন্দর ফ্রেমে। বাঁধাই করাতে ছবিটার সৌন্দর্য্য আরও বেড়ে গেল। এখন যার জন্য এত কিছু করা তাঁর পছন্দ হলেই হল।
হারাধন কাকার পৌঁছনোর পরই ফোনে বেজে উঠল সেই গুরুগম্ভীর গলাটা,' কি ভোলা মহেশ্বর আমাকে ভুলে গেলি নাকি? কতদিন দেখা হয় না আমার আধফালি হৃদয়ের সাথে। চলে আয় একটু গল্প করি। অনেক কথা জমে আছে।'
-' হ্যাঁ যাব তো মামু তোমাকে দেখতে আর আদর খেতে যে বড় ভালো লাগে আমার। তবে একটা দিন একটু সময় দাও কিছু কাজ নিয়ে এসেছি অফিসের সেটা সামলে পরশু সকাল থেকেই গিয়ে হানা দেব। মামীমাকে বোলো সেই স্পেশাল মুইঠ্যাটা যেন থাকে।'
-' সব আয়োজন হয়ে গেছে। তুই শুধু চলে আয়। ওহ্ কতদিন বাদে তিলের নাড়ু খাচ্ছি রে। আহা কি স্বাদ! তোর মামীমা তো নিজেই শাক নিয়ে বসেছে কাটতে। আহা বড় মাটির গন্ধ মিশে আছে রে জিনিসগুলোতে।'
মাঝে কেটে গেছে একটা দিন খুবই ব্যস্ততার মধ্যেই। অন্যসময় হলে হয়ত এরমধ্যে একবার ঘুরে আসত মামাবাড়ি তবে ইচ্ছে করেই যায়নি নটরাজ। একেবারে সারপ্রাইজ গিফ্টটা নিয়েই যাবে।
************************
অনেকদিন বাদে খাবার টেবিলে মুখোমুখি বসেছে ওরা দুই ভাই। আজ দেবের লুচি খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। তাই আশাকেও মালতীর মায়ের সাথে হাত লাগাতে হয়েছে। সকাল থেকে দুজনে মিলে লেগে পড়ে মোটামুটি ঠিক সময়ে জলখাবার দিতে পেরেছে।
মালতীর মা তখনও কড়াইয়ে লুচি ছেড়ে চলেছে।
-' আচ্ছা মা আগে তো প্রতি রবিবার লুচিই হত। কতদিন বাদে লুচি খাচ্ছি। বাবা থাকলে কিন্তু এমন হত না। আর বেবি তো ওস্তাদ ছিল এইসব বানাতে।'
আশা কিছু না বললেও আদিত্য বলে ওঠে,' দাদা খাচ্ছিস খা না মা তো দিয়েছে বানিয়ে আবার সকালে ঐ নামটা নেওয়া কেন?'
আদিত্যর বিরক্তভাব দেখে দেবের রাগ হয় আজ। তাই না বলে পারে না,' একটা মেয়ে বাড়ি থেকে হঠাৎই একদিন চলে গেল। মেয়েটা অনাথ কেউই নেই তেমন পরিচিত,কোথায় গেল একবারও আমরা খোঁজ করলাম না। তার নামটুকু নেওয়া কি অপরাধ?'
-' আমরা তো তাকে তাড়াইনি,চলে গেছে নিজের ইচ্ছেতেই কি করব তাহলে? সারা রাজ্য খুঁজব?'
-' হয়ত একটা খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল তা আমরা নিইনি। অবশ্য আমি এখনও যাতায়াতের পথে দেখি যদি কখনও নজর পড়ে।'
-' দাদা তুমি চুপ কর অতবড় টিনের বাক্সটা টেনে নিয়ে যে চলে যেতে পারে সে একা ছিল না নিশ্চয় কারও সাথেই সে গেছে ফন্দী করে।'
ওদের কথার মধ্যেই মধু এসে দাঁড়িয়েছে,দেবের দিকে বজ্রদৃষ্টিতে তাকায় তারপরে ভালোমানুষী করে বলে,' হ্যাঁ তবে কিছু হোক না হোক কাজটা ভালো করত মেয়েটা। থাকতেই পারত এই বাড়িতে মাসির হাতে হাতে টুকটাক কাজ চালিয়ে নিত। খাওয়ার অভাব হত না।'
-' বড়বৌমা থাক সেসব কথা,এই সংসার এখন তোমাদের আমিও তো বাতিলের দলে। এখন এই সংসারের দায়িত্ব তোমাদের নিতে হবে।'
মালতীর মা গজগজ করে,'সেই আশাতেই থাক যে এরা দায়িত্ব নেবে। নড়ে বসে না সারাক্ষণ আয়না দেখছে।'
আশা হাঁক মারেন,' লুচি নিয়ে আয় কটা,ওরা বসে আছে।'
-' কাউকে পাঠাও আমি উনুন ছেড়ে যেতে পারবনি নুচি পুড়ে যাবে।'
-' মা এটাও বড় বেড়েছে। আমি হলে বিদায় করতাম কবে। আপনি বলে সহ্য করেন।'
-' বিদায় করে চলবে কি করে বৌমা? কাজগুলো কে করবে? আমার পক্ষে আর এত ঝামেলা নেওয়া সম্ভব নয়। আজকাল কেন যেন কিছুই ভালো লাগে না।'
নিজের কথার প্যাঁচ খোলার চেষ্টা করে মধু,' মা এখনি না ভালো লাগলে হবে? সামনে ঠাকুরপোর বিয়ে এবার কিন্তু খুব হইহই করব আমরা। সব ঘটা করে হবে। যা হয়েছে আগের বার!
আদিত্যর মনটা হঠাৎই কেন যেন ভারী হয়ে যায়। দেবেরও আর ইচ্ছে করল না লুচি নিতে। কিছু স্মৃতি বোধহয় বড় বেশি ভারী হয়। হয়ত মুক্তি পেয়েও মুক্ত হওয়া যায় না তার থেকে। একটা ছায়া পেছন পেছন ঘোরে সবসময়। যদি কোনদিন সত্যিই কেউ এসে কৈফিয়ত তলব করে কেন ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল ওরা?
**************************
আজ মামুর জন্মদিন গত দুবছর এখানে ছিলেন না মামু তাই ওদের খুবই ফাঁকা কেটেছে এই দিনটা। তাই এবছরের পুরো আনন্দটা উপভোগ করতে চায় ওরা সুতরাং সকাল সকালই চলে এসেছে এ বাড়িতে নটরাজ মা বাবাকে নিয়ে।
মামাকে শুভ জন্মদিন বলতেই মামা ওকে জড়িয়ে ধরেন সেই ছোটবেলার মত আদরে।
-' দেখি দেখি আমার আদরের ইয়ঙ্গ অফিসার ভাগ্নেকে। খুব দাপটে নাকি কাজ করছিস ওখানে? কে বলবে আমার সেই সেদিনের ছোট্ট ভোলা নাটু এত কাজের হয়ে গেছে।'
-' মামা সেই নামটা কেন? তুমি চল একবার দেখবে তোমার ভোলা নাটু কত কি করতে পারে।'
-' বাহ্ বাহ্ নিজেকেই তো ভোলা নাটু বলছিস। আর আমি বললেই দোষ?'
-' নাহ্ মামু এই নামটা তোমার মুখে শুনব বলেই তো এতদিন বাদে ছুটে আসা। কতদিন বাদে তোমাকে দেখছি মামু। মামীমা কোথায় গেল? দেখছি না তো।'
-' রান্নাঘরে কোমর বেঁধে লেগেছে আজ। এখনও তো আমার জন্মদিনের দিন ও রাঁধে জানিস তো। তারপর ভোলা নাটুর জন্য মুইঠ্যা হচ্ছে।'
ওদের হাসিতে জমে ওঠে অনেকদিন বাদে আড্ডা। দুপুরে জমিয়ে খাওয়ার পর কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি নিয়ে বাড়িতে চলে যায় নটরাজ একদম ফুলের বোকে কেক আর সেই উপহারটা নিয়ে ফেরে। মামা বিদেশী আর দেশী দুই মিলিয়ে মিশিয়ে জন্মদিন করতে ভালোবাসেন সুতরাং পায়েস কেক সবই হয়েছে। কেক কাটার পর মামার হাতে উপহারটা দেয় নটরাজ।
-' আরে এত ভারী এটা! কি আছে এতে?'
-' আমি ধরে আছি মামু তুমিই খুলে দেখ কি আছে?'
মোড়ক খুলে রীতিমত সন্মোহিত হয়ে যান মামা দেখে নটরাজের খুব ভালো লাগে। তবে অপেক্ষা করে মামা কি বলছে শোনার জন্য।
-' আরে লাবণ্য আমার ভোলা নাটু কি করেছে এটা! ওহ্ আমি তো ভাবতেই পারছি না শেষে আমার ছবিও কেউ আঁকবে!'
ছবিটা বাড়িতেও কাউকে দেখায়নি নটরাজ তাই ছবিতে ঝুঁকে পড়েছে তখন সবাই। আর সবার চোখেমুখে শুধুই বিস্ময়। এ ছবি যে কথা বলে,এ তো শুধু ছবি নয়।
-' মামা তোমার পছন্দ হয়েছে? যদি তুমি ভালো বল তাহলে শিল্পীর পরিশ্রম সার্থক।'
-' সত্যিই আমি ভাষা হারিয়েছি রে,কে এঁকেছে এমন ছবি? তাঁর হাতে যে যাদু আছে। এই শিল্পী মা সরস্বতীর আশীর্বাদ ধন্য। নিশ্চয় অনেক খরচ করে আঁকিয়েছিস!
-' হ্যাঁ মামা সত্যিই যাদু আছে তার হাতে তবে কোন পারিশ্রমিক সে এখনও নেয়নি।'
মামাকে আনমনা দেখে নটরাজ নিজের গায়ে মানে ছবির গায়ে আদরে হাত বোলাচ্ছেন মামা,' আমার চশমা দাড়ি এমন কি কাটা ভ্রুটাও নিখুঁত রে। তবে ছবির কোথাও শিল্পীর নাম নেই কেন? পেশাদারী শিল্পীরা তো একটা নাম লিখে দেয় তাঁর শিল্পকর্মে।'
বাড়ির সবাই তখন মামার কথা শুনতে ব্যস্ত মামীও খুব খুশি ছবিটা দেখে। নটরাজ বলে,' খুব সাধারণ একটা মেয়ে মামু কিন্তু তুলির টান কথা বলে। গ্ৰামেই থাকে সাধারণ কালি,লতাপাতা দিয়ে রঙ বানিয়ে ছবি আঁকে। তবে এ ছবির পেছনে ও যে পরিশ্রম দিয়েছে তার এক ফোটাও ফেরত আমি দিতে পারিনি। শুধু রঙ আর কাগজ কিনে দিয়েছিলাম।'
-' কে এই মেয়ে? দেওঘরেই থাকে? কী নাম তার?'
-' হ্যাঁ মামা পাহাড়ের কোলে ওদের ছোট বাড়ি পাশে ক্ষেত। পাড়ার বাচ্চাদের আঁকা শেখায়,পড়ায়। নেহাতই সাধারণ চেহারায় তবে গুণে অসাধারণ। নাম শৈলপুত্রী।'
হঠাৎই মামা অদ্ভুতভাবে চিৎকার করে ওঠেন উত্তেজনায়। মামীও চমকে ওঠেন।
-' শৈলপুত্রী! কোথায় সে? আমি তাকে দেখতে চাই এক্ষুনি। আমাকে নিয়ে যাবি নাটু ভোলা তার কাছে?'
-' বুঝলে রেবা এই বোধহয় সেই শৈলপুত্রী যাকে আমি খুঁজছি।'
অবাক হয়ে যায় নটরাজ মামার কোন কথাই তো ওর মাথায় ঢুকছে না। হঠাৎ মামা শৈলপুত্রী নামটা শুনে এত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন কেন?
দাদাকে এমন অস্থির দেখে নটরাজের মা লাবণ্য তাড়াতাড়ি দাদার কাছে ছুটে যায়।
-' কি হয়েছে দাদা তুমি এমন অস্থির হলে কেন? তোমার শরীর খারাপ করবে। এই ছেলেটা যে কি করে না? কোথা থেকে একটা ছবি আঁঁকিয়ে নিয়ে এল তাই দেখে দাদা তুমি এত উত্তেজিত হলে কেন?'
-' আমার কিছু হয়নি এখন শুধু যা ভাবছি সেটা সত্যি হলেই হয়। আচ্ছা রেবা তোমার কথা তো সব ঠিক হয় তুমি বল না।'
মামীমা লজ্জা পান,' কি সব বলছ ছেলেমানুষের মত! আমি আবার কি সত্যি বললাম?'
-' তুমিই তো বলেছিলে শৈলপুত্রী দুর্গার আরেক নাম সে নিশ্চয় এই পৃথিবীতে ঠিক জায়গা করে নেবে কোথাও। আচ্ছা ভোলা ওর বাবার নাম কি তুই জানিস না?'
-' নাহ্ মামু আমি তো ওর স্কুলের মাস্টারমশাই না যে বাবা মায়ের নাম জানব। তবে তোমার জন্য আমি মাস্টারমশাই,উকিল যা হতে বলবে হয়ে যাব। তোমার ঐ শৈলপুত্রীর মানে আমাদের শৈলপুত্রীর সব জেনে তোমাকে জানাব। একদম জেরা করে জানব সবটা পাকা উকিলের মত।'
-' না না অতদিন আমি অপেক্ষা করতে পারব না। আমার তো আজই চলে যেতে ইচ্ছে করছে তার কাছে। তবে জানি না এই আমার বেবি কি না?'
-' হ্যাঁ দাদা,তুমি কি শৈলজাদার মেয়ের কথা বলছ? সে কোথা থেকে আসবে এখানে?'
-' তোকে বলা হয়নি লাবু শৈলজা আর নেই রে,মেয়েটার সাথে শিবনারায়ণের ছেলের বিয়ে হয়েছিল। মানে শিবনারায়ণ দেখতে গেছিল শৈলজাকে শেষ সময়ে আমি তখন ফ্রান্সে তখনই হঠাৎ মেয়েটার দুর্দশা দেখে ঝোঁকের মাথায় বিয়ে দেয় ছেলের সাথে। তবে তুই তো জানিস আশা কেমন? মানে তোরই তো বন্ধু ছিল। ওরা টিকতে দেয়নি মেয়েটাকে। মেয়েটা হারিয়ে গেছিল। কোথায় যেন চলে গেছিল।'
-' দাদা এ তো অনেক বড় ঘটনা। শৈলজাদা আর নেই! সত্যিই খুব খারাপ লাগছে গো শুনে। তাহলে তুমি কি ভাবছ ঐ বেবি মানে শৈলপুত্রী? আমাকে তো কিছুই বলনি গো।'
-' তোমার দাদা ইচ্ছে করেই বলেনি গো একেই তোমার ছেলেকে নিয়ে চিন্তা থাকে তারপর আবার ঠাকুরজামাই অসুস্থ। তোমার দাদা আর তুমি দুজনেই তো শৈলজাদাকে খুবই ভালোবাসতে। আর সত্যি বলতে ওঁর জন্যই তো তোমার দাদা আজ উঠে দাঁড়াতে পেরেছে। তাই বলল থাক শৈলজাটা চলে গেছে ওঁর মেয়েটা হারিয়ে গেছে কোথায় এই খবরটা লাবুকে নাই বা দিলাম।'
-' আচ্ছা দাদা চল এবার পায়েস কেক খাবে। এতক্ষণ তো শুধু কথা হল।'
অপূর্ব তখনও একমনে ছবিটা দেখছেন এই একটা ছবি তাঁকে অবাক করে দিয়েছে। মূর্তি তো তিনিও বানান সময়ের সাথে সাথে যশ এসেছে কপালে, প্রতিষ্ঠাও। শুধু বোকা শৈলজাটারই কিছু হয়নি। তবে এই শৈলপুত্রী নিশ্চয়ই বেবি। তাই তো বাপের গুণ পেয়েছে মেয়েটা। তবে এত ভালো পোট্রেট বানানো তো মুখের কথা নয়।
-' হ্যাঁ রে ভোলা তুই মেয়েটার কথা কিছু জানিস না? কোন কথা হয়নি তোর সাথে?'
-' কথা অনেক হয়েছে মামু তবে সবই কাজ সংক্রান্ত। মেয়েটার শিক্ষা,গুণ,ধৈর্য্য আর সাহস আমাকে অবাক করেছিল। বলেছিলেন যে ওর বাবা মা নেই চাচার কাছেই তাই থাকে।'
অবাক হন অপূর্ব শিবনারায়ণের কোন ভাই যে দেওঘরে থাকেন তা তো কখনই শোনেননি। তবুও ভালো এই চাচাজী থাকায় মেয়েটার কোন ক্ষতি হয়নি মানে বেঁচে গেছে।
-' হ্যাঁ রে ওর চাচাজীর নাম জানিস?'
-' দাঁড়াও মনে করার চেষ্টা করে দেখি চাচীর নাম সাবিত্রী। হ্যাঁ মনে পড়েছে এবার চাচার নাম হরিহরণ।'
হঠাৎই ছেলেমানুষের মত অস্থির হয়ে ওঠেন অপূর্ব,' হরিহরণ হ্যাঁ নামটা বড় চেনা যেন কোথায় শুনেছি। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না।'
নটরাজের বাবা এসে তাড়া দেন,' ওহ্ যত গন্ডগোল পাকালো আমার পাগলা ভোলা। দাদা চলুন হরিহরণ কি একটা আছে নাকি? এই নামের কত বিহারী হয়,বাঙালীদেরও নাম হয়। হবে কোন দারোয়ানের নাম। চলুন খুব খিদে পেয়েছে অনেকক্ষণ ধরে গন্ধ পাচ্ছি রান্নার। ও বৌদি নীচে তো আপনার ভাইপো আর ভাইঝি সব জোগাড় করে ফেলেছে। আমি খবর দিতে এলাম।'
অন্যমনস্ক অপূর্ব হঠাৎই বলে ওঠেন,' এই তো মনে পড়েছে এই নাম শৈলজার কাছেই শুনেছি। কিন্তু কে এই হরিহরণ মনে নেই। যাক তবুও ভালো একটা ভালো মানুষের কাছে আছে মেয়েটা। শৈলজা যখন চিনত তাকে তখন ভালোমানুষ হবে।'
-' মামু সেই যে শৈলজা মামুর মেয়ে তুমি জানলে কি করে? এক নামে আর কেউ থাকতে পারে না? হ্যাঁ তবে ওর মা বাবা নেই একদিন শুনেছিলাম সেটা মিলছে। আর চাচী বলে ভদ্রমহিলাকে। যাক তুমি মাথা ঠান্ডা কর আমি ওখানে পৌঁছে সব খবর দেব তোমাকে। এখন তো খেতে চল। সত্যিই সবাই অপেক্ষা করছে। আর বাবা তো ভীষণ রেগে যাচ্ছে।'
নটরাজের কথা শুনে মা আর মামীমা চলে যান নীচে যাবার আগে মামীমা বলে যান,' আমি রুবিকে পাঠাবো ও ডাকলেই চলে আসবে একদম। নটরাজ মামাকে নিয়ে চলে আসবি। ওহ্ ঠাকুরঝি কি লোক দেখেছ তোমার দাদা!'
-' তোমার আদরে বৌদি। যা বলে সবই তো তুমি মেনে নাও।'
একটা ভালোলাগার হাসি ছুঁয়ে যায় রেবাকে কোন সন্তান নেই ওঁদের তবুও ওঁরা সুখী একে অপরের ভালোলাগা নিয়ে বেঁচে আছেন। অপূর্বর ছাত্ররাই তাঁর সন্তান তুল্য আর রেবার ভাইপো ভাইঝিরা। একজন আহত মানুষকে অনেকটা আদরে আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন জীবনের মূলস্রোতে ওঁরা দুজন মানে রেবা আর শৈলজা দা। তাই তো শৈলপুত্রীর জন্য এইটুকু পাগলামি তো খুবই স্বাভাবিক।
লাবণ্য আর রেবা চলে যেতেই অপূর্ব নটরাজকে বলেন,' এবার তোর সাথে আমাকে নিয়ে যাবি নাটু দেওঘর? আমি যাব।'
নটরাজের চোখমুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এমনিতেই মামু ওর খুব প্রিয় মানুষ। তারপর ওর কাজের জায়গায় মামুকে নিয়ে যেতে পারবে ভেবে কল্পনায় মন ডুবে যায়। মামু তো একা যাবে না তার মানে মামীমা আর মা বাবাও যাবে। মা তো বলবেই,' এতগুলো লোক যাচ্ছি আমরা তোর ফুলবন্তী কি পারবে নাকি সামলাতে?' সুতরাং বেশ বড় টিম। ভেবেই নটরাজের ব্যাচেলার মনের সুখপাখীটা আনন্দে ডানা ঝাপটে নেয়।
তবে নিজেকে সামলায় নটরাজ,' তুমি যাবে আমি তো ভাবতেই পারছি না! সত্যিই খুব মজা হবে মামু। তবে আমি যাবার দুচারদিন বাদে এস তোমরা। মানে আমি এর মধ্যে খোঁজ খবর নিই সেই মেয়ের আসল পরিচয় কি তারপর। মানে ততক্ষণে আমি একটু গুছিয়েও নেব।'
ওদের কথার মাঝেই রুবি এসে পড়েছে। 'ভাই চল মণি তুমিও চল,মামণি ডাকছে নীচে। সবাই বসে আছে খাবার জন্য।'
-' হ্যাঁ চল মা এই যাই। তোর তো আজ সারাদিন খুব খাটুনি গেল মা।'
-' কি যে বল! কাজের মধ্যেই থাকতে আমার খুব ভালো লাগে। তাছাড়া তোমার জন্মদিনে আমি রান্না করব না তা কি হয় নাকি?'
রুবি এগিয়ে যেতেই ওরা পা বাড়ায়। অপূর্ব বলেন,' এই মেয়েটাও খুব ভালো রে আমাদের সবটা আগলে রেখেছে একা হাতে। শুধু বিয়েটাই করল না। যাক এভাবেই ভালো থাকলে থাক। আসলে ওর মুখের দাগগুলো..'
-' হ্যাঁ মামা গুণটা আর কজন দেখে? আমিই কি শৈলপুত্রীকে প্রথমে দেখে বুঝেছিলাম এত গুণ ওর? রুবিদিও তেমন। কি সুন্দর হাতের কাজ!'
***************************
প্রেমের ঘনিষ্ঠতা একসময় একঘেয়েমিতে পরিণত হয়। আদিত্য বিবাহিত ছিল,বিয়ের সাধারণ নিয়ম কানুনের সাথে সে পরিচিত। যদিও কিছুই অন্তর থেকে করেনি করতে হয় করে গেছে। নামমাত্র হলেও এ বিয়ে ওর জীবনে দ্বিতীয় বিয়ে সুতরাং সেই উচ্ছ্বাস ওর নেই। তাছাড়া ফুলশয্যার রাতের প্রথম শরীর ছোঁয়ার যে রোমাঞ্চ তাও তাকে অধীরে অপেক্ষা করায় না আর কারণ ইতি মধ্যেই সে দুজন নারীর শরীরের ঢেউ ভাঙতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাই এই জীবনটাই তার বেশ লাগে যেখানে কোন চাপ নেই তেমন মানে বৌয়ের নিত্য নতুন বায়না মেটানো নেই। কথা শোনা নেই আবার সকালে উঠেই দাদার মত হাতে বাজারের থলে নিয়ে বাজারে ছোটাও নেই। দাদা অনেকটা বাবার মত তবে বাবা রাগী ছিলেন। দাদার সেই স্বভাবও নেই মনেহয় বৌদির ঠেলায় সবই গেছে। সুতরাং আদিত্য ব্যাচেলার লাইফে বেশ আছে। তাছাড়া সানন্দাদের বাড়িও ফাঁকা তাই সেখানে অফিসের পর অনেকটা সময় কাটিয়ে কবিরাজী কাটলেট খেয়ে দিব্যি বাড়িতে এসে পেট ভরা আছে আজ খাব না বলে শুয়ে পড়া যায়। মানে কোন খিদেই তখন আর থাকে না।
আশা অবশ্য খুব রাগ করেছেন একদিন।
- 'শোন সানন্দার সব মিটলেই বিয়েটা করে ফেল তাড়াতাড়ি। প্রতিদিন এত রাত অবধি কে খাবার নিয়ে বসে থাকবে? যার যার সে সামলাও।'
-' মা এবার থেকে আমার খাবার,ঘরে ঢাকা রেখে দিয়ো আমি এসে খাব।'
আশা আর কিছু বলেন না বুঝতে পারেন কথা শুনতে আজকাল ভালো লাগে না ছেলের। তাই মালতীর মাকে দিয়ে সেই ব্যবস্থাই করিয়েছেন। তবে আদিত্যর নিজের খারাপ লেগেছে যখন কয়েকদিন খাবার নষ্ট হয়েছে। বাবা থাকলে খুব অশান্তি করতেন কারণ রাতের খাবার ওদের একসাথেই খেতে হত বরাবরই। অল্প হলেও খেতে হত।
তাই আজকাল বলেই যায়,' আমার খাবার রেখ না আমি খেয়ে আসব।'
আদিত্যর আদরে ডুব দিতে গিয়ে ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ রাখে সানন্দা। আরও ছটা মাস বাকি। ওহ্ আর ভালো লাগে না। পাড়ার লোকজন অবশ্য কিছু বলে না হয়ত ভেতরে বলে। তবে সবাই জানে সানন্দার বিয়ে হবে আদিত্যর সাথে।
-' ইশ্ আর ভালো লাগে না! আমার আইবুড়ো নাম বোধহয় আর ঘুঁচবে না। তার আগেই না কোন ঘটনা ঘটে যায়।'
-' অনেক ঘটনা ঘটেছে আর কোন ঘটনা নয়। এবার সত্যিই সাবধানী হতে হবে আমাদের।'
-' হুঁ চূড়ান্ত অসাবধানী হয়ে আবার সাবধানী। মা চলে যাওয়াতে তো তোমার ভালো হয়েছে।'
-' তোমার হয়নি?প্রথম আমন্ত্রণ তো তুমিই করেছিলে। তখন অবশ্য শৈলপুত্রী এখানেই ছিল।'
ওদের মাঝখানে ঐ মেয়েটা সবসময় এসে উঁকি মারে কেন?
-' এর মধ্যে তুমি ওর নাম নিলে কেন হঠাৎ? চলে গিয়েও মেয়েটা যায়নি তোমার জীবন থেকে। একদম মুডটাই খারাপ করে দিলে।'
-' সরি...আমি এমনিই বলে ফেলেছি। সত্যিই তো সে ছিল। আচ্ছা আর বলব না।'
-' বাজে কথা বোল না আবার বলবে তুমি। রাত হয়ে গেছে এখন বাড়ি যাও পরে কথা হবে।'
মুড অফ হয়ে যায় আদিত্যরও। বাড়ি ফিরে আসে গাড়ি নিয়ে। আলো মাখা কলকাতার বুকে গাড়ি চালাতে চালাতে মনে হয় কি ছিল মেয়েটার? হয়ত কিছুই নয়। আবার অনেক কিছু মানে ভালো রাঁধত মেয়েটা,পুজোর জোগাড় করত,উঠোন ভরা আল্পনা দিত। সে তো সব মেয়েরাই পারে মোটামুটি তবুও ওর তেজ ওর কথা আর সবশেষে একা একা বাড়ি ছাড়ার মত ওর ঔদ্ধত্য মনে করিয়ে রেখেছে ওকে। বুঝিয়ে দিয়ে গেছে ওরা তাড়িয়ে দেওয়ার আগে বাড়ি ছেড়ে মিশ্রাবাড়ির মেয়েরা কারও কাছে মাথা নীচু করে না। তারা মরে গেলেও আত্মসম্মান বিক্রী করে না।
************************
সকালে উঠে উঠোন ঝাঁটপাট দিয়ে সাফসুতরা করে মুছে নিয়েছে শৈলপুত্রী। তাতে আঁকছে মনের মত আলপনা আজ চাচীর বাড়িতে পূজা আছে। চাচা ভী অনেকদিন বাদে আসবে আজ খবর পেয়েছে। তাই অনেক কাজ বাড়িতে। এই দুই দিন ঐ বাচ্চাগুলো আর বড়দের ছুটি দিয়েছে শৈলপুত্রী। তবে আজ সাঁঝে সবাই আসবে প্রসাদ পেতে। চাচী ভয় পেলেও শৈলপুত্রী বলেছে ও সামলে নেবে সব। একটু পুরি সব্জি আর পায়েস,হালুয়া,নাড়ু বানাবে ভগবানের জন্য আর সবাইকে খাওয়াবে খিঁচড়ি সব্জি। এমন পুজোর জোগাড় তো কতই করেছে ও একা। আসেপাশের বাড়িতে পূজা হলেও ওর ডাক পড়ত কাজের জন্য। পূজার কাম করতে খুব ভালো লাগত ওর।
সন্ধ্যেবেলায় পুজোর ধূপের গন্ধে চারিদিক ভরে উঠেছে। বাচ্চাগুলো ভিড় করেছে পুজো দেখবে বলে। চাচাও এসে গেছে। চাচা আসতেই কত কথা জানতে ইচ্ছে করেছে শৈলপুত্রীর। তবুও নিজেকে সামলেছে,' সব ঠিক হ্যায় না উধার? মাসী ক্যায়সে হ্যায়? ওহ্ মুঝে ভুল গয়ি না?'
ব্যাগ থেকে ওর জন্য নতুন শাড়ি,হাতের চুড়ি আর টিপের পাতা দিতে দিতে হরিহরণ বলে,' ইয়ে লে ইসমে দো শাড়ি হ্যায় ও লাল বালা ম্যায় নে লায়া আর ও নীল মাসী নে দি। হম সব বাতা দিয়ে উসকো। আসতে চাইছিল মগর ছুট্টি কাঁহা। মাজী বহত গুস্যে মে হ্যায়।'
-' কিঁউ? কুছ হুয়া ক্যায়া?'
-' না না কুছ নেহি। তু কাম কর অব। তোর চাচী ওখানকার কথা বলছি শুনলে বকবে আমাকে। শাড়ি তো দেখ পহেলে। লাল শাড়ি আজ পহেন না বেটি।'
শাড়ি দুটো বুকে জড়ায় শৈলপুত্রী চোখটা ভিজে আসে বাবার কথা মনে হয় খুব। কলকাতায় গেলেই বাবা এমন কত কি আনতেন।
মনটা ভারী হয় হরিহরণেরও কত বড় বাড়ির মেয়ে আর বড় বাড়ির বৌ সেই মা আজ তাঁর কুঁড়ে ঘর আলো করে আছে। তাকে কিই বা দিতে আর খাওয়াতে পারছে ওরা?
নিজেকে লাল শাড়িতে জড়িয়ে মাটির দেওয়ালে লাগানো কাঁচের আয়নাটায় দেখেছে শৈলপুত্রী। মুখটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আসলে শাঁখা সিঁদুর তো ওখানেই ছেড়ে রেখে এসেছিল। নাহ্ সিঁদুর ছেড়ে আসেনি লাল আভাটুকু নিয়েই অন্ধকারে পা বাড়িয়েছিল টিনের বাক্সটা চাচাজীর সাথে সন্তর্পণে টেনে এনে সিঁড়ি দিয়ে। তবে এখানে এসে সব কিছু শোনার পর সাবিত্রী চাচী বকেছিলেন। বলেছিলেন,' ধো ডাল ও সুহাগ,যাহা সোহাগ নেহি তো সুহাগ ক্যায়সে হাঁ? এ লাল দাগ তুঝে জিনে নেহি দেগী পোছ দে উসে। যো তুঝে ছোড়কে দুসরে ঔরতকে পাস যাতা উসিকা সিন্দুর কিঁউ অভি তক রাখা মাথেমে?'
খুব কষ্ট হয়েছিল,হাউ হাউ করে কেঁদেছিল শৈলপুত্রী। বাবা যে দেখে গেছেন এই সিঁদুর,কত নিশ্চিন্তে চোখ বুজেছিলেন আজ সেই সিঁদুর সে মুছে দেবে?
তারপর সত্যিই একসময় অনভ্যাসে মুছে গেছিল সেই সিঁদুর জলের প্রবাহে। আর কখনই ইচ্ছে হয়নি অপমানের লাল রঙে সিঁথি রাঙিয়ে নিজেকে সধবা প্রমাণ করতে।
সাবিত্রী চাচী ওকে দেখে খুশি হয়ে বলেন,' বহত খুবসুরত বিটিয়া। ইয়ে লে এ বিন্দী আর চুড়ি পরে লে। বাহ্ এই তো কত সুন্দর আমার বিটিয়া। তেরে চাচা নে আচ্ছা শাড়ি লায়া দোনো কে লিয়ে।'
আজ শৈলপুত্রীকে বেশ অন্যরকম দেখতে লাগছে ওর অবাধ্য চুলের এলো খোঁপা একটু হলেও ছন্নছাড়া ঠিক ওরই মত,বেয়ারা বললেও ভুল হয় না। তাই সেগুলো যথারীতি আদরে ঝরে পড়েছে ওর কপালের চারপাশে আদরের প্রত্যাশায়। লাল হলুদ রঙের পরশে ওর কালো রঙে উজ্জ্বলতার আভা। ছোটাছুটি করে কাজ করাতে মুখে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ধুনোর ধোঁয়া আর ঘন্টার আওয়াজে চারিদিকে বেশ একটা পুজোর আমেজ। বাচ্চাদের একটা করে কাজ দিয়ে ব্যস্ত রেখেছে শৈলপুত্রী বিন্তি মাটির গ্লাস ধুয়ে রাখছে মংলু মুন্না ফুলিয়া কলা পাতা কেটে এনেছে সেগুলো ধুয়ে মুছে একপাশে রেখেছে। পুজো হলেই প্রসাদ খাবে। দিদি কত কি বানিয়ে ঠাকুরের কাছে দিয়েছে। সাবিত্রী আর হরিহরণ পুজোর কাছে বসেছে পাশাপাশি। পুজো প্রায় শেষের দিকে ধূপের ধোঁয়াটা চারদিকে ছড়িয়ে সুন্দর একটা পবিত্রতা মাখিয়ে দিয়েছে ওদের ছোট্ট বাড়িটাতে। একটু বাদেই যজ্ঞ হবে। শৈলপুত্রী আরতির পঞ্চপ্রদীপ খানা নিয়ে যত্নে আগলে উঠোনে নেমে আসে। বাচ্চারা আর মেয়েরা ভিড় করে আসে আরতি নিতে।
-' আরে সামালকে,ইতনা হুটপাট মত কর। সব কো মিলেগা ভগবান কা আশীর্বাদ। চুপচাপ বৈঠ যা।'
হঠাৎই ওদের ভিড়ের মধ্যে একটা স্তব্ধতা নেমে আসে শৈলপুত্রী অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে নটরাজকে। এর মধ্যে বাবুজী কখন এসেছে ও খেয়ালই করেনি। বাচ্চাগুলো বসে পড়ে তাড়াতাড়ি। মহিলারা ঘোমটা টেনে সরে যায় পাশের বারান্দায়।
শৈলপুত্রী আরতি নিয়ে নটরাজের সামনে দাঁড়ায়। দুহাত বাড়িয়ে আরতির শিখা নিয়ে কপালে মাথায় মাখে নটরাজ। পুজোর দিন যে এভাবে এখানে এসে পড়বে ভাবেনি। মামার খুবই তাড়া ছিল পারলে তো তিনি নিজেই আসতেন ওর সাথে অনেক কষ্টে মা আর মামীমা বুঝিয়েছেন আগে ও গিয়ে সব জানুক তারপর যাওয়া যাবে ওখানে। শুধু শুধু ব্যস্ত হয়ে যখন তখন গেলে হয় নাকি?
তাই সকালে ট্রেন থেকে নেমে অফিস করেই ছুটে এসেছে খোঁজ নিতে। অবশ্য নিজেরও কৌতূহল কম নয় কারণ যদি ব্যাপারটা মিলে যায় তাহলে তো একদম দুইয়ে দুইয়ে চার। ওহ্ একদম সিনেমার মতই সবটা। না হলে কোথাকার শৈলপুত্রী কোথায় ঘুরে এখানে এসেছে। তাও আবার নটরাজের সাথেই তার দেখা আর ওকে ছবি এঁকে দেওয়া। সেই ছবি আবার মামার হাতে আসতেই মামার কৌতূহল। তারপর এই শৈলপুত্রী নামটার ম্যাজিক ঘুমোতে দেয়নি নটরাজকেও। কিন্তু এত লোকের মধ্যে কি করে কথা বলবে?
নটরাজকে দেখে ভেতরটা কেঁপে ওঠে শেলপুত্রীর সেই যে সেদিন ছবি নিয়ে গেল বাবু তারপর আর একদিনও আসেনি। অবশ্য ফুলবন্তী বলেছিল বাবু ফেরেননি এখনও। কিন্তু ছবিটা কেমন হয়েছে? যদি সেই মানুষের পছন্দ না হয়ে থাকে?
তাড়াতাড়ি চেয়ারটা এগিয়ে দেয় নটরাজের দিকে,' আপনি বসুন। পূজা হচ্ছে বাবুজী প্রসাদ খেয়ে কিন্তু যেতে হবে আমি নিজে সব বানিয়েছি। আমার ছবিটা ওঁনার পছন্দ হয়েছে? আমি খুবই চিন্তায় আছি কদিন ধরে।'
নটরাজের মুখে হাসি খেলে যায়,' বলছি আপনাকে সব শুধু শুনে রাখুন খুব পছন্দ হয়েছে। বাকিটা পরে বলছি।'
শৈলপুত্রীর মনটা খুশিতে ভরে ওঠে ভেতর থেকে চাচী ডাকেন,' আ যা বিটিয়া, যজ্ঞ চল রহা হ্যায়।'
শৈলপুত্রী ছুটে চলে যায় ভেতরে তবে ঠাকুরকে আবার প্রণাম করে যে ঠাকুর মান রেখেছেন ওর। নিজের জীবনের ওপর ভরসা হারিয়ে ফেলেছিল তবে যাক একটু হলেও আশার আলো দেখিয়েছেন ভগবান।
নটরাজ অপেক্ষা করে,আজ মথুরা নেই সাথে তবে ফুলবন্তী আছে হাজির সুতরাং এখানে একলা হবার তেমন কোন ব্যাপার নেই। আকাশে গোল থালার মত পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। এমন দৃশ্য কলকাতায় দেখা যায় না বাড়িঘরে ঢাকা পড়ে আকাশ। বাচ্চাগুলো উঠোনে বসে প্রসাদ খাচ্ছে হই হই করে। ওকে দেখে নমস্তে জানায় চাচা কিন্তু এত লোকের মাঝে কি করে জানতে চাইবে মামুর বলা কথাগুলো?
পুজোর প্রসাদের থালা থেকে প্রসাদ দিচ্ছে শৈলপুত্রী হ্যাজাকের আলোতে বসে লোকজন খাচ্ছে। রীতিমত ছোটাছুটি করছে মেয়েটা কখনও হাতে গরম খিচুড়ির বালতি আবার কখনও প্রসাদের থালা। অবাক হয়ে দেখে নটরাজ এত জীর্ণ শীর্ণ চেহারার মেয়েটা এমন ক্ষমতা রাখে কি করে? নটরাজ না করলেও কেউ শুনল না ফুলবন্তী এগিয়ে এসেছে,' বাবুজী প্রসাদ তো লেনাই পড়েগা। বহত মেহনত সে সব কিয়া দিদি নে। পূজাবাড়ি মে প্রসাদ লেনা জরুরী হ্যায়।'
ফুলবন্তীর কথা শুনে হাসে নটরাজ। হাসে শৈলপুত্রী আর হরিহরণও।
-' ওহ্ উপায় নেই আর আচ্ছা অল্প করে একটু দিন।' নটরাজ দেখে পরিবারের সবার মুখে খুশি উপচে পড়েছে ওকে খাওয়াতে পেরে। শৈলপুত্রী তাড়াতাড়ি ছুটে মাটির থালাতে সব সাজিয়ে দেয়। কোথা থেকে একটা টেবিল এনে ওখানে সাজিয়ে দিয়েছে ওর প্রসাদ ফুলবন্তী। আর নিজে সেখানে পাহারায় দাঁড়িয়ে।
হরিহরণ বলে,' সাহাব প্রসাদ ঠিক আছে তো? হামার বিটিয়া অনেক মেহনত সে বানিয়েছে সব কুছ।'
'খুব সুন্দর মানে অপূর্ব রান্না হয়েছে।' সত্যি এত সুন্দর ভোগ রান্না হয়েছে যে নটরাজের নিজের মনে হয় এই ভোগ যত্ন আর ভালোবাসা নিয়ে বানানো হয়েছে তাই বোধহয় অমৃত। আর শৈলপুত্রীর ছুটোছুটি করে সবার পাতে প্রসাদ দেওয়া দেখে মনে হচ্ছে অবশ্য ওর মুখের কথা চাচাই বলল,'বাবুজী আমাদের আজ বড় সৌভাগ্য যে আপনাকে একটু প্রসাদ দিতে পেরেছি। ভগবানজীকা লাখ লাখ কৃপা। বিটিয়ারাণী যে আমার সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা আছে।'
অবাক হয়ে যায় নটরাজ সত্যিই আজকের আয়োজন দেখে বোধহয় মেয়েটাকে এই নামে ডাকা যায়। কেউই ফিরে যাচ্ছে না না খেয়ে।
এত জোগাড় একা হাতে করেছে!
ততক্ষণে চারিদিক একটু ফাঁকা হয়েছে ফুলবন্তী তাড়া দেয় বাবুকে কারণ নটরাজ অফিসের জিপ আনেনি সাথে মথুরাও নেই তাই প্রতাপ আর ফুলবন্তী পৌঁছে দেবে ওকে। নটরাজ ইশারা করে একটু কথা বলে এখনি যাবে। কিন্তু কথাটা কি করে শুরু করবে ভেবে পায় না।
হরিহরণ চাচা কাছাকাছি নেই শৈলপুত্রীকে ডাকে নটরাজ,' একটু কথা ছিল। আমাকে এখনি চলে যেতে হবে রাত্রি হচ্ছে ফুলবন্তী,প্রতাপ দাঁড়িয়ে আছে।'
-' হ্যাঁ বলুন,সত্যিই বহত সময় আপনি এসেছেন আমার আরও আগে সেটা ভাবা উচিত ছিল। চাচা ভী যাবে আপনাকে এগিয়ে দিতে।'
-' আপনার আঁকা ছবি দেখে আমার মামা কেমন যেন অবাক হয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারেননি। আসলে মামা নিজেও তো মূর্তি বানান দেশে বিদেশে যায় সেই মূর্তি মানে ভাস্কর্যের স্রষ্টা আর কি। আপনার নাম শুনে অবাক হয়ে গেছেন মামা। তাঁর জন্যই আমার এখানে আসা।'
হঠাৎই একসাথে দুজনে প্রশ্ন করে ফেলে ওরা।
শৈলপুত্রী বলে,' কি নাম আছে আপনার মামার?
নটরাজ বলে,' আপনার বাবার কি নাম?
হরিহরণ মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে তখন বিটিয়াকে যে এখানে এনেছে সেই বাত কেউ জানে না। এই সাহাব কোন পুলিশের আদমী নয় তো? একটু ভয় লাগে বলা যায় না ও বাড়ি থেকে যদি পুলিশ লাগায় তাহলে তো বাড়ির বৌকে ভাগিয়ে নেওয়ার জন্য ওর চাকরি আর ইজ্জত দুই যাবে। হয়ত হাজত বাস করতেও হবে।
তাই বলে,' আমি ওর চাচা আছি বাবুজী,বাপ মা ওর নেই বেচারী বহত দুঃখী। যো লোগ নেই আর তাঁদের নামে কি কাম? এখন আমরাই ওর সব।'
নটরাজ বুঝতে পারে হরিহরণ ওকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। হয়ত কোন একটা ভয় কাজ করছে ওঁর কিন্তু ওকে জানতেই হবে কি সেই কারণ? কেন ওকে নাম বলতে চায় না হরিহরণ? তাছাড়া ও মামুকেই বা কি বলবে? ও জানে মামু কালই হয়ত ফোন করবে অফিসে।
তাই একদম চট করে সিদ্ধান্ত নেয় আর বলে ফেলে,' আপনার বাবার নাম শৈলজা মিশ্র তাই না? আপনি লাভার রাজবাড়ি মিশ্র পরিবারের মেয়ে তাই তো?'
হরিহরণ চমকে ওঠে কথাগুলো শুনে এই কথা সাহাব জানল কি করে? নিশ্চয় ওরা পুলিশ লাগিয়েছে বিটিয়ার খোঁজ লাগাতে। আর ওর পেছনেই এসেছে পুলিশ। তাই তো এতদিন দেশে আসেনি। এবার সাবিত্রী এত জোর খবর পাঠালো তাই আসতেই হল।
শৈলপুত্রী অবশ্য একটুও চমকায় না সোজাসুজি বলে,' আপনার মামু কি অপূর্ব সান্যাল? মানে অপূর্ব আঙ্কেল?'
-' আপনি কি করে জানলেন?'
-' যেভাবে আপনি জেনেছেন সেভাবেই।'
-' মানে আপনি যখন ছবিটা এঁকেছিলেন তখনই মামুকে চিনতে পেরেছিলেন? তবুও আমাকে কিছুই বলেননি!'
-' না পুরোপুরি চিনতে পারিনি তবে চেনা লেগেছে খুব বিশেষ করে ভুরুর ঐ কাটা দাগটা। আসলে আমি ওঁকে শেষ দেখেছি প্রায় সাত আট বছর আগে। তখন আমি বেশ ছোট আর আঙ্কেলের মুখে দাড়িও ভী ছিল না। তাই শুধু বারবার মনে হয়েছে কোথায় দেখেছি। আপনি চলে যাবার পর হঠাৎই মনে হয়েছিল নামটা। তারপর আজ যখন আপনি বাবার নাম নিচ্ছেন মনে হল ঠিক আঙ্কেলই হবেন।'
শৈলপুত্রীর বুদ্ধির তারিফ না করে পারে না নটরাজ। সত্যিই তো তখন কি করে আর বলত যে ওঁর চেনা চেনা লাগছে ভদ্রলোককে। এমনিতেই নটরাজকে ওরা সবাই সমীহ করে অফিসার হিসেবে। শৈলপুত্রীর সাথেও সেইরকমই সম্পর্ক তাই না বলতে পারাটাই স্বাভাবিক। সুতরাং নটরাজকে কথা শুরু করতে হয়। চাচাজী অবশ্য হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন এতক্ষণ পুলিশের ভয়ে রীতিমত তার জ্বর আসছিল।
তাই চাচাজী বলে ওঠেন,' বাবুজী কোঈ মুশিবত হবে না তো। ডর গয়্যা ম্যায়নে বহত।'
-' না না কোন ভয় নেই,মামু খুব খোঁজ করেছেন শৈলপুত্রীর একটা সময় বিদেশ থেকে ফেরার পর। তখন শুনেছেন শৈলপুত্রী নিখোঁজ।'
-' কৌন বোলা সাহাবজী? বাবুজী কো তো ম্যায়নে নেহি দেখা। বাড়িতে তো আসেনি।'
-' নাহ শুনলাম শোভাবাজারের কারখানায় গিয়েছিলেন। সেখানেই শুনে এসেছেন।'
মনটা উথালপাথাল করে শৈলপুত্রীর। তাহলে ভাইয়াজীর কাছে গেছিলেন অপূর্ব আঙ্কেল। বলে ওঠে,' ভাইয়াজী বহত আচ্ছা আছে। ভাইয়াজী বলেছে আমার কথা?'
-' আমি অত জানি না আপনি তো সাঙ্ঘাতিক মানুষ দেখছি একা একা কাউকে না বলে এভাবে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন!'
-' আমি নিয়ে এসেছি বিটিয়াকে সাহাব আমি না নিয়ে এলে মরে যেত বেচারী হয়ত গঙ্গা মাঈয়াতে জান দিয়ে দিত।'
পুজোর বাড়ির পরিবেশ ভারী হয়ে গেছে ততক্ষণে শৈলপুত্রীর মুখে কোন কথা নেই। নটরাজ ঘড়ি দেখে ওরও অনেকটা দেরি হয়ে গেছে এবার ওকে ফিরতেই হবে। তাই বলে,' আচ্ছা আমি যাই এবার যাক অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকবেন মামু এটা জেনে যে আপনিই ওঁর বন্ধুর মেয়ে শৈলপুত্রী। আর এখানে ভালোই আছেন। অনেক খুঁজেছেন মামু আপনাকে এমনকি কাটিহারেও লোক পাঠিয়েছেন।'
শৈলপুত্রীর চোখ মাটির দিকে কান্না তার আর আসে না তবুও পুরোনো স্মৃতির খনি খুঁড়ে কিছু তিক্ত মুহূর্ত আবার এসেছে সামনে। তারই কথা মনে হয়,হয়ত অপূর্ব আঙ্কেল আগে এলে এতটা অসহায় অবস্থা ওর হত না।
বাইরে ফুলবন্তী আর প্রতাপ অপেক্ষায় রয়েছে আলো হাতে। প্রতাপের হাতে মোটা লাঠি,চাচাও এগিয়ে যায় ওদের সাথে কিছুটা পথ। নটরাজের মনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয় সত্যিই কি ভগবান অলক্ষ্যে বসে দাবার ঘুঁটি সাজান নিজের মত তাই এই দেওঘরে এসে এতদূর গ্ৰামে হঠাৎই শৈলপুত্রীর সাথে দেখা হল আবার ওকেই দিল মামুর ছবি আকতে! হোয়াট আ মিরাকেল! হরিহরণ মনে মনে ভাবে সবই শিবজীর কৃপা। যাক কেউ তো একজন আছে মেয়েটার যে ওকে খুঁজেছে। ও তো ভেবেছিল ও মরে গেলেও কারও কিছু আসে না।
*****************************
নটরাজ জানে মামু কতটা অস্থির হয়ে আছে তবুও রাতে আর ফোন করবে না কাল সকালে বরং অফিস থেকে ফোন করবে। সারাদিন অফিস তার আগে ট্রেনের ধকলে ও নিজেও বেশ ক্লান্ত তারপর অনেকটা সময় কেটে গেছে চাচাদের বাড়িতে। তবুও ভালো একটা জট খুলে গেছে মামার অনুমানই ঠিক হয়েছে। মামা খুবই খুশী হবেন শুনে।
ডুবুরী হয়ে সিন্ধু সেঁচে এত তাড়াতাড়ি যে মুক্তো পাবে নটরাজ সেকথা ভাবতে পারেনি নিজেও তাই মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। তৃপ্ত মন ঘুমিয়ে পড়ে শান্তিতে।
স্টুডিয়োর ফোনটা বেজে ওঠে শব্দ করে তাড়াতাড়ি ছুটে যান অপূর্ব। এ নিশ্চয় নাটু ভোলার ফোন। সত্যিই তো তাঁর নিজেরও কম আগ্ৰহ নেই ফোনটা পাবার মেয়েটার জন্য এতদিন খুবই অশান্তি ছিল তাঁর মনে অপরাধবোধও ছিল।
-' হ্যালো।'
-' মামু আমি বলছি গো।'
-' আগে আসল কথাটা বল আমি ঠিক না ভুল? খবর নিয়েছিস?'
-' নাহ্ মামু তুমি ভুল এ শৈলপুত্রী আলাদা।'
-' নাটু দুষ্টুমি করে না বাবা তোর মামার বয়েস হয়েছে এত টেনশনে রাখিস না। আমি জানি সেই শৈলজার মেয়ে। ছবিই বলেছে সেই কথা। এ তুলির টান যে আমার বড় চেনা। চোখে পাওয়ার হয়ত হয়েছে তবুও রঙের মিল আমি চিনি।'
নটরাজ হেসে ওঠে ওপার থেকে,' হ্যাঁ মামা ঠিক বলেছ এই তোমার শৈলপুত্রী তোমার বন্ধুর মেয়ে। হরিহরণ চাচার সাথেও দেখা হয়েছে ভাগ্যক্রমে উনি শিবনারায়ণ বাবুর বাড়িতে দারোয়ানের কাজ করেন মেয়েটার দুর্গতি দেখে নিজেই নিয়ে এসেছেন এখানে। যাক পুরোটাই অবশ্য গোপন রেখেছে ওরা।'
-' যাক বুকটা বড় হাল্কা লাগছে রে নাটু কথাতে বলে না নরানাং মাতুলক্রমঃ আমি কিছু না করতে পারলেও ভগবান তোকে দিয়ে তা করিয়ে নিয়েছেন।'
-' হ্যাঁ মামু সত্যিই আমারও ভালো লাগছে অত ট্যালেন্টেড একটা মেয়ের জন্য কিছু করতে পেরেছি। তবে আরও অনেক কিছু ওর প্রাপ্য কারণ ওখানে ছেলেগুলো আর মহিলারা একটু কিছু শিখছে শুধুই শৈলপুত্রীর চেষ্টাতেই। তবে মামু তুমি আবার শোভাবাজারে গিয়ে বলে এসো না শৈলপুত্রীর খোঁজ পেয়েছ। চাচা বারবার বারণ করে দিয়েছেন।'
-' ঠিক বলেছিস তো। ভাগ্যিস বললি আমি তো ভাবছিলাম শিবের বড় ছেলেকে খবরটা দেব। আচ্ছা আচ্ছা না না মেয়েটা ভালো থাক।'
-' আচ্ছা মামু এবার রাখি,কাজ পড়ে আছে অনেক সব সারতে হবে। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে থাক এখন।'
-' কি বলিস নিশ্চিন্ত'
-' মানে?'
-' আরে আমরা দেওঘরে যাব না? এই তো কথা হল আমরা যাব দেওঘর। তুই আগে যা তারপর।'
নটরাজ হেসে ফেলে ও তাহলে দেওঘর আসার ভূত মামার মাথা থেকে নামেনি এখনও। তাই বলে,' হ্যাঁ হ্যাঁ সে তো খুবই ভালো কথা। চলে এসো সবাই। তবে মামীমা যা ভালো বুঝবে তাই করবে।'
-' ইশ্ আবার মামীমা কেন? আমার কোন ইচ্ছে নেই?'
-' আচ্ছা মামু তুমি এখানে কেন আসতে চাইছ আমাকে দেখতে না শৈলপুত্রীকে?
ওহ্ এই ছেলেও কম কথা জানে না সত্যিই তো মেয়েটাকে দেখতে বড় ইচ্ছে করে। কে জানে গ্ৰামের গরীব ঘরে কেমন আছে মেয়েটা? হয়ত বড় কষ্টে আছে। নটরাজ বলেছে গ্ৰামের পরিবেশ খুব একটা ভালো নয়। তাই মেয়েটাকে এখানে এনে রেখে একটু আঁকা আর পড়াশোনা শেখানো গেলে সত্যিই কত ভালো হত।
-' আরে দুই হবে। তোর ওখানেও তো যাইনি সুতরাং সব হবে একসাথে। তার সাথে ভোলেবাবার কাছে পুজো দেওয়া আর প্যাঁড়া খাওয়া সবই হবে।'
নটরাজের আর কোন কথাই বলা চলে না সুতরাং এবার অপেক্ষা কবে মা বাবা আর মামা মামী আসবেন।
*************************
-' হ্যাঁ রে দেব আর তো তিনমাস বাদেই সানন্দার মায়ের কাজ। তারপরেই ভাবছি ওদের বিয়েটা দিয়ে দেব।'
দেবের অদ্ভূত একটা হাসি পায় মায়ের কথা শুনে বিয়ের আর কি কিছু বাকি আছে? শুধু ঐ সিঁদুরের ছাপটাই পড়েনি।
-' হ্যাঁ মা কাজটা শেষ হলে একটা তারিখ দেখে নিয়ো,যত তাড়াতাড়ি হয়ে যায় সেটাই ভালো।'
-' হ্যাঁ বলছিলাম কি আমার কিছু গয়না যদি ছাড়িয়ে নিয়ে আসতিস। মানে সানন্দাকে তো বিয়েতে গয়না দিতে হবে। কিছু গয়না রাখা ছিল ওর জন্য। তবে ঐ মেয়েটাকেও কয়েকটা দিয়েছিলাম। অবশ্য সে সব রেখেই গেছে।'
-' তাহলে আর কি মা,ঐ গয়নাগুলো দিয়ে দাও সানন্দাকে। আমি দেখছি যদি আরও কিছু গয়না টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনা যায়।'
মধু দরজার ওপাশ থেকে চোখ রাঙায় দেবকে। ওর কোন হেলদোল না দেখে নিজেই বলে,' মা বিয়ের খরচ তো কম নয় এখনি এত টাকা কোথায় পাওয়া যাবে?'
-' তবুও কিছু তো লাগে বৌমা,সানন্দাকে পুরোনো গয়না দিই করে?'
-' যা গয়না ঘরে আছে সেটা দিয়েই কাজ চালান। তাছাড়া আপনার সব গয়না ওকেই দেবেন নাকি? একবার ওকে পরালে তো খুলে নিতেই পারবেন না।'
-' খুলব কেন বৌমা,ওগুলো ওরই থাকবে।'
-' তা কেন? ওতে মানে আপনার গয়নাতে তো আমারও ভাগ আছে।'
মধুর কথাগুলো দেবের ভালো লাগে না হয়ত কথাগুলো ঠিক তবুও মা কষ্ট পাচ্ছেন। তাই চলে যাবার উদ্যোগ নেয়। নাহ্ এবার মাকে কিছু গৎনা এনে দিতেই হবে।
বড়বৌমার কথার কি উত্তর দেবেন ভেবে পান না আশা শুধু বলেন,' তোমাকেও তো দিয়েছি বৌমা সব সাজিয়ে। অনেক বেশি দিয়েছি।'
********************
এককালে শিবনারায়ণের যে সম্পদ দেখে অপূর্বর প্রেমকে উপেক্ষা করে আশা এদিকেই ঝুঁকেছিলেন আজ সেই সম্পদ শিবনারায়ণের মৃত্যুর সাথে সাথে ঠিকমত দেখাশোনার অভাবে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত। আশাকে কখনও কষ্ট পেতে দেননি শিবনারায়ণ বরং আশার যতটা প্রাপ্য তার থেকে অনেক বেশি উশুল করে নিয়েছেন দাস দাসী চাকর দারোয়ানে পরিবৃত বাড়িটাতে আজ অনেকটা সময় একা একাই কেটে যায় আশার। বড় বৌমাও কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে এখন সবসময় শুধু হিসেব আর আমার ভাগে কতটা থাকবে তা ভাবতেই ব্যস্ত। এদিকে আদিত্য মাঝে মাঝেই এসে বলে যাচ্ছে বিয়ের জন্য কি কি লাগবে তা একটু একটু করে জোগাড় করতে।
আশা বাধ্য হয়েই সেদিন বললেন,' তোরা দুই ভাই কথা বলে সবটা ঠিক করে নে। আমার হাতে তেমন কিছুই নেই খুচখাচ কিছু গয়না ছাড়া ভারী গয়না সবই বের করে দিয়েছি সেগুলো যদি উদ্ধার হয় তো সাজিয়ে দেব।'
-' উদ্ধার হয় মানেটা কি মা? তোমার গয়না এভাবে চলে যাবে সব? দাদাকে বল ওগুলো নিয়ে আসতে। বৌদি অন্যরকম কথা বলছে এখন আমার তো মনে হয় সব গয়না বৌদির কাছেই আছে।'
-' তোরা নিজেরা কথা বলে নে আমার সত্যিই ভালো লাগে না আর। তাছাড়া কারখানার আয়েই তো সংসার চলে তাই সংসার চালানোর প্রয়োজনে আমাকে দিতে হয়েছে গয়না এটাই ভেবে নে। তুই সংসারে তো তেমন কিছু করিস না আগে তোর বাবা করত এখন দেব করে।'
-' মা তুমি শুধু আমাকে দোষ দিচ্ছ আমি চাকরি করব না ব্যবসা দেখব? বল কি লাগবে সংসার চালাতে আমি এনে দিচ্ছি। তবে সানন্দা এই বাড়িতে বৌ হয়ে আসছে ওকে সাজিয়ে নিয়ে আসার দায়িত্ব আমাদেরই। ওর তো মা বাবা কেউই নেই।'
হঠাৎই আশা বলে ফেলেন,' এতদিন তোকে কিছু বলিনি তবে আজ বলছি বিয়েতে তুই কিছু খরচ করিস। তোর বাবা থাকলে হয়ত বলতাম না। কিন্তু এখন সত্যিই বলতে হচ্ছে। মানে সানন্দার শৌখিন জিনিসপত্র কিছু গয়না কিনিস। আমি দেখব আমার কাছে কত আছে তার থেকে কতটা দেওয়া যায়..'
আদিত্যর গলার স্বর চড়ে,' ওহ্ বুঝেছি এত গয়না আমাদের থাকতে এখন সানন্দার গয়না আমাকেই কিনে দিতে হবে? কই বড়বৌমার বেলাতে তো তোমরাই সব দিয়েছ তাহলে এখন নিয়ম এমন কেন?'
-' বলছি তো তখন তোর বাবা ছিলেন,এখন অনেক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।'
-' মা প্লিজ গয়নাটা যা করে হোক ব্যবস্থা করতেই হবে নাহলে সানন্দা খুবই অসন্তুষ্ট হবে আর আমাদের কোন সম্মান থাকবে না। আচ্ছা মা সেই গয়নাগুলো কোথায়?'
আশা বুঝেও না বোঝার ভান করেন,' কোন গয়না?'
-' ওহ্ তুমি বুঝতে পারছ না। বাবা যেগুলো রেখেছিল মানে..'
শৈলপুত্রীর নামটা বলতে জিভে আড়ষ্টতা আসে আদিত্যর তবুও বলে,' ঐ মেয়েটার গয়নাগুলো মানে সে তো আর নেই। এতদিন যখন আসেনি তখন আর আসবে না। সুতরাং গয়নাগুলো সানন্দাই পরবে। আমি এখন এত গয়না কিভাবে কিনব? আর তুমি দেখ তোমার গয়নাগুলো উদ্ধার করতে পার কি না? বাড়ির বৌ হয়ে আসবে যে তার তো প্রাপ্য থাকে বাড়ির গয়না।'
আশা কিছু বলতে পারেন না কি বলবেন এখন? অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিয়ে ছেলেকে তিনিই মাথায় তুলেছেন সুতরাং এটুকু তাঁরই প্রাপ্য। শুধু বলেন মৃদু স্বরে যদি সে আসে ফিরে কোনদিন তখন কি বলব তাকে?'
-' কোন অধিকারে আসবে সে? এ বাড়ির সাথে আর তার কোন সম্পর্ক নেই।'
-' তবে গয়নাগুলো যে তার বাপের বাড়ি থেকে আনা। সেটা ভুলে যাচ্ছিস কি করে?'
-' কী প্রমাণ আছে তার? যাদের খাওয়া জুটত না দেনার দায়ে বাড়ি বিক্রী হয়েছে তাদের ঘরে কোথা থেকে আসবে গয়না? আর তার গয়নাতে কোন জোর নেই তাই সেটা না নিয়েই গেছে।'
আশা ছেলের কথা শুনে চুপ করে যান। আজ বড়ছেলে বাড়িতে নেই মধুও বাপের বাড়ি গেছে। মালতীর মা কোথায় যেন বেরোল আজকাল তারও বড় পা বেড়েছে এদিক ওদিক যাবার। হঠাৎই সবার ওপর অদ্ভুত রাগ হল আশার। তাই আদিত্যর কথার কোন উত্তর না দিয়েই বললেন,' তুই বেরোবি তো? যাক আমাকে আর ডাকিস না আমি পুজোর ঘরে গেলাম।'
আদিত্যর মনে হল ওর কথা মায়ের পছন্দ হয়নি তাই মা চলে গেলেন পুজোর ঘরে। কিন্তু সত্যি যদি দাদা গয়না ছাড়িয়ে আনতে না পারে তখন ঐ মেয়েটা যে গয়না রেখেছে সেটাই ভরসা। একেই সানন্দা মেজাজী তারপর বিয়েটা ঠিকঠাক না হলে আর রক্ষা নেই। আসলে বোধহয় মুখরা মেয়েদের জয় সর্বত্র। কথায় বলে বোবার শত্রু নেই কিন্তু বোবার বোধহয় অনেক শত্রু যারা পদে পদে খুঁচিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে তুমি বোবা। আর যার মুখের জোর আছে তাকে সবাই ভয় পায় ঘাটাতে ঠিক যেমন আদিত্যর অবস্থা। বর্তমানের মন রাখতে সে প্রাক্তনের কাছে মাথা নীচু করতেও রাজী তার অলক্ষ্যে।
**************
নটরাজ অনেকবার বারণ করেছিল কিন্তু মামার জেদ আর বায়নারই জয় হয়েছে শেষে মামীমাও রাজি আর মা বাবাও রাজি সুতরাং আসছে ওঁরা। প্রতাপকে দিয়ে ইতিমধ্যে বাগানটা সাফসুতরা করে ফেলেছে ফুলবন্তী। ঘরদোর নিজে হাত লাগিয়ে আরও ঝকঝকে করে তুলেছে প্রায় প্রতিদিন একবার করে দিন গোনে। বিকেলে দিদির কাছে পড়তে গিয়ে প্রায়দিনই রান্নার গল্প তোলে। শৈলপুত্রী বকুনি দেয়,' পহেলে পড়াই ফির ওহ্ চুলা চৌকি। চুপচাপ লিখো।'
মথুরা আর নটরাজ দুজনেই স্টেশনে থাকবে সেকথা জানিয়ে দিয়েছে বাড়িতে। সুতরাং চিন্তার কিছু নেই একবার গিয়ে পৌঁছতে পারলেই হল। স্বামীর মাঝবয়েসের ছেলেমানুষীকে আগলাতে অস্থির রেবা। বহুদিন বাদে ট্রেনে চড়ে একদম ছেলেমানুষের মত হয়ে উঠেছেন অপূর্ব। কখনও বাদাম,আবার কখনও ঝালমুড়ি কিনে খাচ্ছেন। তারপর মেতে যান পথের আনন্দে ডুব দিয়ে গল্পে মেতে উঠেছেন। কত পুরোনো কথা ভাগ করে নিচ্ছেন বোন ভগ্নীপতি আর রেবার সাথে।
' দেখেছ ঠাকুরঝি শুধু দেখ,এই মানুষ এই বয়েসেই এমন তাহলে ছোটবেলায় কেমন ছিল? তিন বন্ধু একসাথে সব রকম দুষ্টুমি করেছে।'
-' হ্যাঁ বৌদি যদিও আমি দাদার থেকে কিছুটা ছোট তবুও জানি গো মাকে ভীষণ জ্বালিয়েছে একটা সময়।সারাদিন মাটি কাদা নিয়ে কাজ করত। মারপিট করে আসত পাড়ার ছেলেদের সাথে। দেখছ না এখনও ভুরুতে কাটা দাগ আছে।'
অপূর্বর মুখে হাসি খেলে যায়,' ওটা তো ভোঁতা ছুরি দিয়ে গাছের ডালে নক্সা কাটতে গিয়ে ছিটকে এল হারে রে রে বলে আমারই চোখের দিকে। তারপর অযথা রক্তপাত তার সাথে অবশ্য মায়ের চপেটাঘাত। উঃ কি রাগী ছিল মা একদম লাবণ্যর মত। তাই তো ওর ছেলেটা এত ভালো হয়েছে,মাকে এখনও ভয় পায়।'
-' বৌদি দেখছ দাদা কেমন আমাকে ঠুকে দিল দাদা, আমি নাকি মায়ের মত রাগী। আর আমার ছেলে নাকি শান্ত। ইশ্ একদম মামার মতই হয়েছে,যেখানে গন্ডগোল সেখানে উনি আছেন। দরকারে মারপিট করেও চলে আসতে পারে।'
-' আসবেই তো মেরে নাকি মার খেয়ে আসবে? আমার বাবা বলতেন মার দিয়ে আসবি তারপর দেখে নেব। মার খেয়ে এসে কাঁদবি না ঘরে।'
লাবণ্য হাসে দাদার কথা শুনে হাসেন রেবাও। লাবণ্য মনে মনে ভাবে আর তুমিই দাদা শেষে মার খেলে মানে প্রেমের ময়দানে আর জিততে পারলে না। তবে যা হয়েছে ভালো হয়েছে নাহলে এমন ভালো বৌদি কি আর আসত ঘরে? হ্যাঁ হয়ত বৌদিকে আশার মত রূপসী দেখতে নয় তবুও মানুষটা সত্যিই খুব ভালো। আর বৌদির হাতের জাদুদে মুহূর্তে রূপসী হয়ে ওঠে কত মহিলা। কি সুন্দর কনে সাজায় বৌদি! অবশ্য দাদা সেই গুণের পূর্ণ স্বীকৃতি দিয়েছে।
-' দাদা বুঝলেন আমিও ছেলেকে সেই শিক্ষাই দিয়েছি যে অন্যায়ের সাথে যাতে আপোষ না করে। আরে মানুষ হয়ে যখন জন্মেছে এই মনুষ্যত্বটাই তো আসল নাকি?'
ওদের কথা,গল্প আর খাওয়ার মধ্যে একের পর এক স্টেশন ছুটে চলে দ্রুতগতিতে। অপূর্ব ডুবে যান নিজের কৈশোরে আর যৌবনে। মনে পড়ে যায় শৈলজাদাদের লাভার বাড়িটার কথা। ট্রেনে যাবার সময়ই দেখা যেত বাড়িটা দূর থেকে পুরোনো লাল রঙ মেখে বটগাছের ডালপালার ছায়া জড়ানো বাড়িটাকে রাজবাড়ি বলত সবাই। এককালের রমরমা ঠাটবাট গেলেও মানুষগুলো ছিল দিল দরিয়া ওঁরা গেলেই শৈলজার মা মানে মা মানে ওঁদের প্রিয় জ্যাঠাইমা সেই ভোরবেলা উঠে লুচি তরকারি আর ক্ষীর করে খাওয়াতেন। আহা কি স্বাদ সেই ক্ষীরের,একদম লালচে রঙের ঘন ক্ষীর এখনও যেন সেই স্বাদ লেগে আছে মুখে। পুকুর থেকে আনা হত জ্যান্ত কই মাছ সেই মাছের একটা বিশেষ পদ করতেন জ্যাঠাইমা নাম জিজ্ঞাসা করলে বলেছিলেন,' এই হল গিয়ে কই মাছের হরগৌরী। হ্যাঁ রে ঠিক হয়েছে তো খেতে? কি রে শৈল? অপু?'
শৈলজা মুখে ভাতের দলা দিতে দিতে বলত,' আগে খেয়ে নিই তারপর বলছি। অপু বলুক ও প্রথম খাচ্ছে।'
জ্যাঠাইমাকে জিজ্ঞেস করে অপূর্ব জেনেছিলেন এই পদের নাম হর গৌরী মানে শিব পার্বতী একদিকে তাই লাল রঙ আরেক দিকে সবুজ। দুরকম ঝোল করে একপাশে লাল ঝোল আরেক পাশে সবুজ ঝোল মানে কাঁচা লঙ্কা ধনেপাতা বাটা দিয়ে সবুজ ঝোল করে ঢালা হত।
আহা সেই বাড়ির মেয়ে এখন অন্য বাড়িতে আশ্রিতা। নিজের কিছুই নেই মেয়েটার ভাবলে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। ওর জন্যই তো উদ্যোগী হয়ে এতটা পথ আসা। শৈলজার চোখে জল যে দেখেছেন স্বপ্নে। মেয়ের সংসার বেঁধে দিলেও সেই সংসার তো তার করা হল না। হায় রে মানুষের কপাল!
-' দাদা আস্তে আস্তে রেডি হয়ে যান যশিডি এল বলে। এরপরই নামতে হবে। এখান থেকে আর কিছুটা নটরাজ তো গাড়ি আনবে।'
-' ওহ্ যশিডি এসে পড়েছি যাক নিশ্চিন্ত।'
রেবা আর লাবণ্য টুকটাক জিনিস ঢুকিয়ে নিচ্ছে ট্রেন খুব বেশি সময় দাঁড়াবে না সুতরাং তাড়াতাড়ি করে নেমে যেতে হবে।
********************
নটরাজ আর মথুরা হাজির ছিল আগে থেকেইঝ
ট্রেনটা প্রায় একঘন্টা লেট করেছে। সবাইকে দেখে খুব আনন্দ হয় নটরাজের। মথুরা ততক্ষণে ড্রাইভার কে নিয়ে মালপত্র নামিয়ে নিয়ে গেছে একদম গাড়িতে।
-'মামু কোন কষ্ট হয়নি তো তোমার? বাবা তোমার শরীর ঠিক তো?'
-' একদম ঠিক আছে সবাই কোন চিন্তা নেই চল এবার যাওয়া যাক। হ্যাঁ রে রান্নাবান্না করেছিস তো? না আমার বোনটাকে নামতে হবে রান্নায়।'
-' মামু চল তো আগে। তুমি কি খাবে বল একবার সব খাওয়াব তোমাকে।'
অপূর্ব পথে আসতে আসতে নস্টালজিক হয়ে পড়েন কেন যেন মনে হয় এই পথঘাট সব কিছু তাঁর বড় চেনা সবেতেই মিশে আছে ছেলেবেলার মাটির গন্ধ। নাটু ভোলার কোয়ার্টার খানা বেশ পছন্দ হয়েছে তাঁর সামনে সুন্দর বাগান তাতে উঁকি দিচ্ছে সদ্য ফোটা ফুলের গুচ্ছ। চারপাশে বেশ সবুজে সবুজ তার মধ্যে বেশ পাহাড়ের দৃশ্যও দেখা যায় বারান্দায় বসে। অপূর্ব হাঁক মারেন,' ওরে তোরা ভেতরে যা আমি তো এই বারান্দায় বসে কাটাব দিন। আহা কি সুন্দর বারান্দা! ওরে নাটু আমি এখানেই থেকে যাই এখানে বসেই পাথর কেটে বানাব নানা মূর্তি।'
মামীমা ভেতরে নটরাজকে বলেন,' তোর মামু ভারী খুশি দেখেছিস। না এলে এখানে চলতই না। তা সে কোথায়? যাকে দেখতে এখানে আসা।'
-' ফুলবন্তী আনবে বিকেলে ওকে। এখন তোমরা খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নাও।'
-' আরে না না ফুলবন্তীকে আনতে হবে না। আমিই যাব তার সাথে দেখা করতে। একটু ঘোরাও হবে ওদিকটা। দেখতে হবে তো আমাকে কার ঘরে আছে আমার প্রিয় বন্ধুর আদরের মেয়েটা। ফুলবন্তী...'
ফুলবন্তী মাথায় ঘোমটা টেনে এসে দাঁড়ায়,' সাহাব চায়ে লিজিয়ে। কুছ বোলেঙ্গে ক্যায়া?'
-' হাঁ উসে মত লানা হম সব যায়েঙ্গে উধার।'
-' আচ্ছা বাবুজী,চাচী ভী আপ সব কো বুলায়ী উধার উসকি ঘরমে।'
চায়ে চুমুক দিয়ে সবারই একটা পরিতৃপ্তির আওয়াজ বেরিয়ে আসে আহ্ সত্যিই ফুলবন্তী বেশ অনেক কিছু শিখে গেছে এই কয়েক মাসে। লাবণ্য রান্নাঘরে গিয়ে অবাক কত সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রান্না করেছে ওদের জন্য। লাউঘন্ট করতেও জানে ফুলবন্তী! সত্যি ভাবা যায় না।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া হলে একটু গড়িয়ে রোদ পড়তেই ওঁরা বেরিয়ে পড়েন আজ অবশ্য নটরাজ ওদের সাথে যায়নি। মথুরাকে নিয়ে হাটে গেছে মামুর পছন্দের কিছু পেলে কিনবে এই আশাতে। যদিও মথুরা বারবার বারণ করছিল।
আজ অপূর্ব,রেবা আর লাবণ্যদের সঙ্গী ফুলবন্তী আর ওর ছেলেটা। বাচ্চাটার উৎসাহের শেষ নেই। নটরাজের মত ওঁরাও সঙ্গে করে এনেছেন বাচ্চাদের জন্য কিছু জিনিস আর ফুলবন্তীর শাড়ি।
রেবা বলেন ফুলবন্তীকে,' বহত দূর তো বাড়ি ইতনা রাস্তা আতা হ্যায় তুম! কষ্ট নহি হোতা?'
-' লাবণ্য তোর বৌদির হিন্দী শুনেছিস? এবার ফুলবন্তী না অসুস্থ হয়ে পড়ে।'
-' ইশ্ তোমার সবেতেই ইয়ারকি।'
-' মুঝে মালুম হো গয়া সাহাব। আমি তো বাংলা ভী বুঝি। না মেম সাহাব কষ্ট আছে না কিছু ভেগে ভেগে চলে আসি।'
-' নাও এবার বোঝো,তোমার যেমন হিন্দী তেমন ফুলবন্তীর বাংলা। আর কতদূর রে ফুলবন্তী? কি রে খোকা?'
-' আ গয়ে সাহাব ব্যাস থোড়া দূর।'
-' দাদা এদের থোড়া মানে বুঝেছেন তো? এইজন্য নাটু টাঙা করে আসতে বলেছিল। আপনি তো শুনলেন না।'
-' আচ্ছা ফেরার সময় দেখব যদি কষ্ট হয় টাঙাতে চড়ব।'
সরষে ক্ষেত পেরিয়ে ওরা গ্ৰামের মধ্যে ঢুকে পড়ে ফুলবন্তী দেখায় ঐ যে চাচীর বাড়ি এদিক দিয়ে রাস্তা।
বাড়িটা দেখে ভালোই লাগে অপূর্বর যাক মাটির মেয়ে মাটির কাছাকাছি আছে। দুপাশে ক্ষেত মাঝে বাড়িটা তবে কতটা নিরাপদ সেটাই কথা। এর আগের ঘটনা লাবণ্যর কাছে শুনেছেন।
বাড়ির কাছাকাছি এসে ফুলবন্তীর ছেলেটা খরগোশের মত ছুট লাগায় ধুলো উড়িয়ে ওর মিঠে গলার ডাক শোনা যায় দিদি ও লোক আ গয়ে....
রেবা কোনদিন শৈলপুত্রীকে দেখেননি। অপূর্ব অনেক আগে কাটিহার গেলেও তাঁর যাওয়া হয়নি। শৈলজা ঠাকুরপোকে দেখেছে এক দুবার মাত্র। শিবনারায়ণের বাড়িতে আশার কাছে অপমানিত হবার পর তিনি আর কলকাতা আসেননি। রেবার ব্যবহার করা সিঁদুরের কৌটোখানা তাঁরই দেওয়া। হাতে দিয়ে বলেছিল,' বৌঠান অক্ষয় হোক তোমার সীমন্ত,সুখে রেখ আমার খামখেয়ালী বন্ধুটাকে।'
কিছু কথা মনে থেকে যায় চিরকাল। অপূর্ব উৎসুক হয়ে তাকান বাড়িটার দিকে হঠাৎই দেখেন একজন মাঝবয়েসী মহিলার সাথে প্রায় ছুটে বেরিয়ে আসছে একটা লাল ডুরে শাড়ি জড়ানো মেয়ে মাথায় ঝাঁকড়া চুল হাওয়াতে উড়ছে সেটা অযত্নে বাঁধা একটুকরো লাল ফিতেতে তবুও সেই অযত্নে গোছানো কেশরাশিই বলে দেয় এই শৈলজার শৈলপুত্রী। খুব ছোটবেলায় ওকে দেখেছিলেন অপূর্ব তখন ওর ঝাঁকড়া চুল দেখে শৈলজাকে বলেছিলেন,' চুল দেখেই বলে দেওয়া যাবে এ হচ্ছে শৈল কন্যা শৈলপুত্রী।'
-' কেন ওর চোখ দুটো? হাতের আঙ্গুল আর তুলির টান সেও তো আমার মতই।'
-' তাই নাকি? এখনি ওর তুলি কথা বলে?'
শৈলজা হাঁক দিয়েছিলেন,' বেবি লে আ ও ড্রয়িং খাতা দিখা আঙ্কেল কো।'
মুগ্ধ হয়েছিলেন অপূর্ব। আজও তেমনি এক অনন্য অপত্যসুখে মনটা ভিজে গেল মেয়েটাকে দেখে। যার বাঁচার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন সে কিভাবে যেন আবার নতুন দেশে নতুন বেশে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
শৈলপুত্রীর মুখে লাজুক হাসি তাড়াতাড়ি ছুটে এসে প্রণাম করে ওদের মুখে বলে নমস্তে আঙ্কেলজী।
-' শৈল কন্যা শৈলপুত্রী বুঝেছ রেবা যার এই ঝাঁকড়া চুলগুলো বলে দেয় ওর বাবা শৈলজা। বড় বেশি মিল বাবার সাথে মেয়েটার।'
ফুলবন্তী আর সাবিত্রী চাচী ওঁদের তাড়াতাড়ি করে বসতে দেয় আর হাত পা ধোয়ার জল দেয়।
শৈলপুত্রী পা মোছানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অপূর্ব বলেন,' ও সব থাক তুই আয় তো দেখি আমার পাশে বোস। তোকে যে কোনদিন দেখতে পাব সেই আশাই তো ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভাগ্যিস নটরাজ ছবিটা নিয়ে গেছিল তাই তো জানলাম। ভালো আছিস তো মা?'
শৈলপুত্রীর চোখটা এখন আর সবসময় ভেজে না তবুও আজ ভিজে উঠল বাবার কাছে কত শুনেছে বন্ধুদের নাম। গর্ব করতেন বাবা। বরং ও শেষ সময়ে বলত,' বাবা ও দোস্তি কিছু হয় না ওঁরা বড়া আদমী তুমি গরীব তাই তো কেউ আসে না তোমার খোঁজ করতে।'
-' আরে পাগলী ও লোগ কামকে আদমী হ্যায়। আমার মত বেকার নাকি ওরা? আরে অপূর্ব তো মাঝে মাঝেই মানি অর্ডার পাঠায়।'
-' তুমি কিঁউ নাও? মিশ্রাবাড়ির ছেলে তুমি কেন সাহায্য লিবে?'
-' তোকে একটু ভালো রাখতে চাই যে মা। আমার মায়ের যে খুব কষ্ট।'
-' হোনে দো,মগর ভিখ নহি মাঙনা।'
অপূর্বর কথায় মাথা নাড়ে শৈলপুত্রী,' ভালো আছি আঙ্কেল। আপনার তবিয়ত ঠিক আছে তো?'
রেবা ওদের কথার মাঝে ব্যাগ থেকে বের করে কিছু জিনিস সাবিত্রীর হাতে দেয়। সাবিত্রী বলে,' বিটিয়াকো হম নে আচ্ছে সে রাখা মেমসাহাব মুঝে মালুম হ্যায় বড়া ঘর কী লড়কি হ্যায়।'
রেবা বুঝতে পারে আত্মসম্মান প্রবল এদের তবুও বুঝিয়ে বলে অপূর্ব নিজের হাতে কিনেছেন সব না নিলে ওঁরা দুঃখ পাবেন। টুকটাক কথাবার্তায় সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অপূর্ব জিজ্ঞেস করেন শৈলপুত্রীকে,' তুই আমার সাথে যাবি মা?'
-' কোথায় যাব?'
-' কেন কলকাতায়?'
-' মগর কিঁউ?'
কলকাতা শহরের প্রতি আর কোন টান নেই শৈলপুত্রীর ছোটবেলায় অনেক বায়না করেছে বাবার কাছে মুঝে ভী একবার লে চল বলে কিন্তু বড় হবার পর ঐ শহরটাতে পা রেখে বুঝেছিল বড় প্রাণহীন এই শহর। এখানে সকালে কাঠঠোকরা এসে জানলায় খুটখাট শব্দ করে না। এখানে পূর্ণিমার চাঁদ হাত বাড়িয়ে ডাকে না এখানে অন্তরের আন্তরিকতা নেই আছে শুধুই কৃত্রিমতা যে যত বেশি নিজেকে কৃত্রিমতায় মুড়িয়ে নিতে পারে সে তত বেশি ভালো। রঙ মাখা ঠোঁটে নকল হাসি,আইলাইনার মাখা চোখে কুটিল চাউনি সবই কেমন যেন মনে পড়ে গেল শৈলপুত্রীর।
-' বাবা নেই কিন্তু তোর আঙ্কেলজী তো আছে। আমার তো ইচ্ছে করে মাকে নিয়ে কাছে রাখি। তোর খোঁজ যখন পেয়েছি তখন তোকে নিয়ে যাব। যাবি তো মা?'
-' আমি ওখানে গিয়ে কি করব? কলকাতা আমার ভালো লাগে না কেমন যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।'
সাবিত্রীর মুখটা ছোট হয়ে যায় বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে তাহলে কি বিটিয়া চলে যাবে? হরিহরণ কলকাত্তা থাকে এই বিটিয়া ওর সঙ্গী হয়ে গেছে। ওকে ছেড়ে থাকবে কি করে?
-' বাবুজী মত লে যানা উসে,ওহ্ বিটিয়া তো মেরি জান বন গয়ী। মেরে পাস রহেগী ও।'
কথা বলতে বলতে চোখ মোছে সাবিত্রী। শৈলপুত্রী এসে গলা জড়িয়ে ধরে সাবিত্রীর ওর বিপদের দিনে ওরাই হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এখানে এসেও কত পাগলামি করেছে কিন্তু তাতে হয়েছে কি কখনও চাচীকে দেখেনি একটুও বিরক্ত হতে বরং স্নেহের স্পর্শ মাখিয়ে ওর অসুস্থ হয়ে যাওয়া মনটাকে একটু একটু করে সুস্থ করে তুলেছে। আজকের শৈলপুত্রীকে চেনাই যায় না হয়ত মেলানোও যায় না সেই কলকাতা থেকে শুধু একটা টিনের বাক্স সাথে করে নিয়ে আসা দিশাহারা মেয়েটার সাথে। আজকের শৈলপুত্রী আবার দশভুজা তার হাতে কখনও হাতা খুন্তি,কখনও ঝাঁটা লাঠি আবার কখনও রঙ তুলি পেন্সিল। সে শাসন করতে পারে আবার ভালোবাসতে পারে। মনে বিষম চোট খাওয়া শৈলপুত্রীর এখন আবার মন বসেছে এই দেওঘরে। এখানকার মাটি আকাশ লোকজন ওকে ভালোবেসে ফেলেছে তাই আর নতুন কোন আশ্রয়ের খোঁজে ছাড়তে চায় না এই পায়ের তলায় আঁকড়ে ধরা মাটিটুকু।
-' তু রো মত চাচী কাঁহা যাউঙ্গী ম্যায় তুঝে ছোড়কে? ম্যায় তো হমেশা তেরে পাস রহুঙ্গী।'
সাবিত্রী আদরে জড়ায় শৈলপুত্রীকে। অপূর্ব আর রেবা অবাক হন ওদের বন্ধন দেখে। রেবা ইশারা করেন অপূর্বকে। লাবণ্য এসে দাদার ঘাড়ে হাত রাখে,' দাদা ও যেখানে ভালো আছে সেখানে থাক। তুমি অযথা মন খারাপ কোর না। আর নটরাজ তো এখানে আছেই সুতরাং ওর কাছে সব খবরই পাবে।'
-' আঙ্কেলজী আপ দুখী মত হোনা। আমি চলে যাব যখন মন হয় কলকাত্তা। সাহাবজী তো আছেই আবার চাচা ভী যায় কলকত্তা। আমি এখানে ভালো আছি। আমি চলে গেলে এই বাচ্চাদের আর ফুলবন্তীদের কি হবে? ওরা তো আবার পড়াশোনা ছেড়ে দেবে তাই না?'
ছোটবেলায় মেয়েটাকে দেখেছিলেন অপূর্ব তাঁর অভিজ্ঞতা দেখেছে অনেক। চোখের দৃষ্টি অনেক বেশি পরিপক্ক তা দিয়ে বুঝতে পারেন আশা যাকে সামান্য মেয়ে বলে অবহেলা করেছে সে আসলে অনন্যা। সত্যিই আশা মানুষ চিনতে শিখল না আজও।
-' তুই যাবি না মা,কিন্তু তোর এত ভালো আঁকার হাত আমি শিবনারায়ণকে কি বলব? সে যে আমার স্বপ্নে এসেছিল।'
দাদাকে এত আবেগে ভাসতে দেখে লাবণ্য রেবাকে বলে,' বৌদি দাদাকে একটু ঠান্ডা হতে বল।'
-' বাবা আপনার স্বপ্নে এসেছিল? আমার কাছে কিন্তু আসে না কখনও। আমি তো কত খুঁজে বেড়াই বাবাকে। কি বলল বাবা আমার কথা?'
লাবণ্যকে চুপিচুপি অপূর্বর বাবা বলেন,' দেখেছ কেমন মিল ওদের? কি সুন্দর কথা বলছে! আসলে দুজনেই তো শিল্পী।'
-' শিবনারায়ণ আর শৈলজা দুটোই এসেছিল। শিবনারায়ণ শুধু তাকিয়ে ছিল তবে শৈলজার চোখে জল দেখেছি।'
-' বাবাকে বলবেন আমি ভালো আছি। আবার রঙ তুলি নিয়ে কাম করছি। বাচ্চাদের পড়াচ্ছি। যারা পড়াশোনা জানত না তাদের পড়াশোনা শেখাচ্ছি। শৈলপুত্রী বাঁচতে শিখে গেছে।'
-' কিন্তু আমি যে ভেবেছিলাম তোকে আর্ট কলেজে ভর্তি করে দেব। এত সুন্দর আঁকার হাত তোর। আমার এক ছাত্র ওখানে আছে।'
আর্ট কলেজের কথা শুনে শৈলপুত্রীর দুই চোখে স্বপ্নের মেঘেরা ভাসতে শুরু করে দিল দিশাহারা হয়ে। খুব মনে হল বাবার কথা। বাবারও তো খুব ইচ্ছে ছিল ও আর্ট কলেজে ভর্তি হোক। কিছু কিছু স্বপ্ন তো অধরাই থেকে যায়। হয়ত এটাও সেইরকম কোন অধরা স্বপ্ন। তাই বলে,'আঙ্কেলজী আমি ভালো আছি সব স্বপ্ন কি সবার পূরণ হয়? আমি আর কারও বোঝা হয়ে বাঁচতে চাই না।'
শৈলপুত্রীর মাথায় হাত রাখেন অপূর্ব,' ধুৎ পাগলী মেয়ে কখনও বাবার বোঝা হয়? আচ্ছা বেশ আমি জোর করব না তোর যখন ভালো লাগবে তখনই আসিস। তোর নিজের ছবি আর আঁকাই তোকে খরচ জুগিয়ে দেবে একলা চলতে। আমি জানি তো মিশ্র রাজবাড়ীর মেয়ে শৈলপুত্রীর আত্মসম্মান সবার থেকে বড়।'
একথা ও অনেকবার বলেছে কিন্তু আঙ্কেল কি করে জানলেন? ও প্রশ্ন করার আগেই অপূর্ব বলেন,' এই আত্মসম্মানটাকে কখনও হারাস না মা। আজ বড় গর্ব হচ্ছে আমার শৈলজার শৈলপুত্রীকে দেখে। অনেক বড় হ মা। আমি যতদিন আছি ততদিন ভাববি বাবার মত কেউ আছে।'
শৈলপুত্রীর চোখটা ছলছল করে,রেবা এসে ওর কাঁধে হাত রাখে,' সবাই আছি আমরা তোর সাথে মা যখনি মনে হবে নিজের বাড়িতে চলে আসবি।'
নিজেকে সামলাতে শৈলপুত্রী ছুটে ভেতরে চলে যায়। সকাল থেকে যে ওরা দুজন এত কিছু করল তা তো খেতে দেওয়াই হল না।
লাবণ্য এবার একটু ব্যস্ত হয় এবার তো যেতে হবে সন্ধ্যে নেমে আসছে তারপর নটরাজ বাজারে গেছে। ফুলবন্তী গিয়ে রান্না করবে। তবে যাব বললেই তখনি যাওয়া হয় না শৈলপুত্রী ততক্ষণে দৌড়ে এসেছে ঘর থেকে সাথে ফুলবন্তী ছাড়াও আরও একজন মেয়ে। ওরা না করলেও খেতেই হল পুরী সব্জি হালুয়া আর ক্ষীর। রেবা ক্ষীর খেতে আপত্তি করলে অপূর্ব বলেন,' খেয়ে দেখ রেবা খাঁটি গরুর দুধের ক্ষীর। ঠিক এমনি ক্ষীর বানাতেন জ্যাঠাইমা। তবে শৈলপুত্রী তুই শিখলি কী করে? জ্যাঠাইমা তো অনেকদিন আগেই...'
-' বাবা শিখিয়েছেন তো,সব বাবার কাছে শেখা।'
সত্যিই অসাধারণ স্বাদ রান্নার,ওঁরা আপত্তি করাতে সাবিত্রী সবিনয়ে বলেছিল,' বহত তকলিফ সে লড়কি খুদ বানায়া সব। থোড়া সে লে লিজিয়ে। আপলোগ তো ভগবান হ্যায় হমারে লিয়ে।'
সত্যিই এই আন্তরিকতা বোধহয় অবহেলা করা যায় না। তাই ওঁরাও পারলেন না। শৈলপুত্রীর আর সাবিত্রীর আন্তরিক ব্যবহার ছুঁয়ে গেল সবাইকেই। বাইরে হঠাৎই জিপের শব্দ শোনা গেল। ফুলবন্তী চঞ্চল হয়ে ওঠে,' সাহাব আয়া মালুম হোতা।'
একটু বাদেই বোঝা যায় নটরাজ নয় মথুরা চলে এসেছে জিপ নিয়ে কারণ সন্ধ্যে হয়ে আসছে তাই ওঁদের নিয়ে যেতে। অপূর্ব জিপে ওঠার আগে মাথায় হাত রাখেন শৈলপুত্রীর,' কয়েকদিন আছি মা এক দুদিন এই বুড়োটার সাথে সঙ্গ দিস। আমাদের ভালো লাগবে। নাটু তো সময়ই পায় না তেমন।'
ঘাড় নাড়ে শৈলপুত্রী,ফুলবন্তীকে সাথে করেই নিয়ে যান ওঁরা। শৈলপুত্রী ফুলবন্তীর হাতে টিফিনকৌটো ধরিয়ে দেয় কারণ নটরাজ আটার হালুয়া খুব ভালোবাসে। জিপটা এগিয়ে যায় হাত নাড়ে শৈলপুত্রী মনটা যেন কেমন করে ওঠে ভাবে বাবারা যদি তিন দোস্ত একসাথে থাকত তো কত ভালো হত। আকাশের দিকে তাকায় শৈলপুত্রী তারা হাসছে মিটমিট করে বাবাকে মনে পড়ে খুব।
ওঁরা ফিরে আসতেই ভাগ্নে মামুকে ধরল..' মামু তুমি শুধুই এখানে শৈলপুত্রীর জন্য এসেছ। অভাগা আমি কখন বাজার থেকে এসেছি তোমার দেখা নেই। তাই মথুরাকে পাঠালাম ধরে আনতে।'
-' আর বলিস না দাদার গল্পই শেষ হয় না। তারপর তো ঐ মেয়ে না খাইয়ে ছাড়বে না কিছুতেই।'
-' হুঁ বুঝেছি মা তাই তোমরা একদম খেয়ে এলে। অবশ্য খাওয়াতে পারলে কিছুই চান না উনি। আমীও মুক্তি পাই না। আটার হালুয়া খেয়েছ?'
-' হ্যাঁ খেলাম রে।'
-' আপকে লিয়ে ভী হ্যায় সাহাব।'
সন্ধ্যেবেলা চায়ের সাথে একটা জমাট আড্ডা বসে তাতে বারবারই আসে শৈলপুত্রীর কথা। ওর আত্মসম্মানের কথাও উঠল। নটরাজের কানে ভাসল আবার ওর কথাটা হাম মিশ্রাবাড়ির মেয়ে ভিখ নেহি লেতে সাহাব।'
ফুলবন্তীর দেশী চিকেনের গন্ধে চারিদিক ম ম করছে। অপূর্ব আহ বলে ডাক ছাড়েন। রেবা বকুনি দেন,' এই তো বেবি এত খাওয়াল এখনই আবার আহ্।'
-' মনটা খুশি আছে রেবা,বেবি আমাদের সাক্ষাৎ দশভুজা। তারপর মেয়েটা ভালো আছে এটাই শান্তি। দেখি ওর একটা ব্যবস্থা করতে পারি কি না? আরে দেওঘরের জল ভীষণ ভালো।'
-' কি ব্যবস্থা দাদা?'
-' ঐ আর্ট কলেজে যদি ভর্তি করা যেত। দেখি।'
মামুর কথা শুনে খুশি হয় নটরাজও সত্যিই যদি প্রতিভার মূল্যায়ন হয়।
ওদের কথার মাঝে ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন নটরাজের বাবা,' হ্যাঁ রে মাছ পাওয়া যায়নি হাটে?'
-' ছিল বাবা,তোমরা রাতে খাবে না দেখে আনিনি। আসলে আমার তো ফ্রীজ নেই। কাল টাটকা মাছ ফুলবন্তী বা মথুরা নিয়ে আসবে আমি বলে রেখেছি। বাইরে সাইকেলের ঘন্টির আওয়াজ শোনা যায়।
-' ঐ বোধহয় প্রতাপ এল সাইকেল নিয়ে,ফুলবন্তীকে নিয়ে একেবারে যাবে। ওকে বলে রাখছি। কি মাছ খাবে? দেখি যদি কই মাছ পাওয়া যায়।'
কই মাছের কথা শুনে মনটা নেচে ওঠে অপূর্বর মনে পড়ে জ্যাঠাইমার হাতে রান্না করা কই মাছের হরগৌরী। ততক্ষণে প্রতাপ ভেতরে চলে এসেছে নটরাজ ওকে মাছের কথা বলছে। অপূর্ব বলেন,' কত কি মনে পড়ে যায় ভায়া জান এইসব জায়গায় এলে।'
সবার সাথে মিলে হাসিতে গল্পে ভরে গেল নটরাজের কোয়ার্টারটা বড় সুন্দর যেন পরিবেশটা মা বাবা মামা মামীমা এত্ত আদরের ছড়াছড়ি। সব সামলে ফুলবন্তী একটু দেরিতেই যায়। প্রতাপ আছে তাই চিন্তা নেই। সকালে মাছ নিয়ে এসে রান্না করবে বলে যায়।
নটরাজ বলে দেয় জলখাবার ও আনিয়ে নেবে গরম গরম ডালপুরী আর জিলিপি। ফুলবন্তী এসে রান্না করলেই হবে।
পরদিন বেশ বেলা হয়ে যায় ফুলবন্তীর পাত্তা নেই। লাবণ্য চিন্তায় পড়েন যদিও নটরাজ বলেছে ও দুপুরে এসে খেয়ে যাবে। আর চিন্তার কিছু নেই ফুলবন্তী ঠিক আসবে।
বেশ বেলায় ফুলবন্তী এসে ঢোকে নটরাজ তখন অফিসের পথে। প্রতাপ সাইকেলে করে নিয়ে এসেছে।
নটরাজ কিছু বলার আগেই লাবণ্য বলেন,' ইতনা দের কেন রে? ম্যায় চিন্তাতে মরছি। ও তোর সাহাব খাবে না?'
লাবণ্যর হিন্দীতে হেসে ফেলে সবাই। ফুলবন্তী নাকের নথ নাড়িয়ে বলে,' মাজী ম্যায় সব সামাল দুঙ্গী। চিন্তা কেন করছ?'
-' আরে ইয়ে ব্যাগ মে ক্যায়া হ্যায় প্রতাপ? মছলি খরিদা ক্যায়া? মিলা মছলি?'
-' হাঁ সাহাব ম্যায় তো সাত বাজে লায়া মছলি।'
নটরাজ ভেবে পায় না এত দেরি কেন। যাক গে ওর আর সময় নেই এবার বেরোতে হবে। ফুলবন্তী ব্যাগটা নিয়ে এসে টেবিলে রাখে। একটা টিফিন ক্যারিয়ার বেরোয় তবে ওটা খুলতেই অবাক হয়ে যায় সবাই।
অপূর্বর মুখে তখন মুগ্ধতার টুকরো হাসির মাখামাখি,' আহা কই মাছ! আরে এ তো মনে হচ্ছে কই মাছের হরগৌরী। বেবি পাঠিয়েছে?'
-' হাঁ সাহাব দিদি নে মছলি পকাকে ভেজি। উসে মালুম হ্যায় আপকো পসন্দ হ্যায় ক্যায়া বোলতা মুঝে মালুম নেহি।'
রেবা অবাক হয়ে যান মেয়ের বুদ্ধি দেখে বলেন,' কোথা থেকে জানল কে জানে?'
-' দিদিকে পিতাজী নে বাতায়া। সব বাত মালুম হ্যায় উসে।'
ফুলবন্তীর কাছে জানতে পারে প্রতাপ মাছ এনে ফুলবন্তীকে কাটতে বলেছিল কারণ মাজীরা কি করে জ্যান্ত মাছ কাটবে? ফুলবন্তী রীতিমত নাকাল জ্যান্ত মাছ কাটতে। তারপর শৈলপুত্রী রীতিমত কেটে ধুয়ে একদম রান্না করে পাঠিয়ে দিয়েছে। তার সাথে ছোট মাছের চচ্চড়ি সবই অপূর্বর পছন্দের তা জানে শৈলপুত্রী। সুতরাং মনের আনন্দে সবটুকু করে পাঠিয়েছে।
অপূর্ব বলেন,' উসকো কিঁউ নেহি লায়া সাথ মে?'
-' অব বাচ্চেলোগ কো পড়ায়েগী সাহাব।'
দুপুরে খেতে বসে সবাইকে মুগ্ধতা ছেয়ে যায় এই মেয়ে যেন মন পড়তে পারে সবার আঙ্কেলকে ফিরিয়ে দিলেও অলক্ষ্যে থেকেও সবার পছন্দের দিকে নজর রেখেছে। লাবণ্য বলেন,' ফুলবন্তী টা ফাঁকিবাজ দাদা তুমি জান না। দেখেছে লোকজন এসেছে কাজ বেশি ব্যাস ওকে দিয়ে একেবারে রান্না করিয়ে এনেছে।'
ওরা মামা ভাগ্নে হাত চাটে।
' সত্যি মামা শৈলপুত্রীর গুণের শেষ নেই। তোমার জন্য একটা নতুন পদ খাওয়া হল। যাক মা ফুলবন্তী বুদ্ধির কাজই করেছে।'
*******************
বিকেলে ফুলবন্তী একাই এল ওরা সবাই অবাক হল দেখে যে শৈলপুত্রী আসেনি সাথে। অথচ বলেছিল আসবে বিকেলে। মেয়েটা শুধু রান্না করে পাঠালো অথচ এল না। ফুলবন্তী বলল চাচীর শরীরটা ভালো নেই তাই দিদি আসেনি। কাল ঠিক আসবে।
রেবা অপূর্বকে আড়ালে বলেন,' হয়ত চাচীই ওকে আসতে দেয়নি। সেদিন ওকে যখন কলকাতা যেতে বলছিলে কতটা অস্থির হয়েছিলেন ভদ্রমহিলা লক্ষ্য করেছিলে?'
-' হ্যাঁ করেছিলাম আসলে চাচী একদম একলা থাকেন এখানে। শৈলপুত্রী আসাতে উনিও জীবনে কিছু রঙ খুঁজে পেয়েছেন। কখন কিভাবে যে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। তারপর অপরিচিত মানুষ হয় প্রিয়জন। পরিচিত চলে যায় বহুদূর। দেখ কালও আসে কি না? কাল না এলে আমার কিন্তু খুব খারাপ লাগবে রেবা। জানি গ্ৰামের ব্যাপার মেয়েটাকে এখানে এনে রাখা ঠিক হবে না। তাছাড়া আমরা যে ওখানে থাকব সেটাও সম্ভব নয়। অথচ ওকে দেখতেই তো এখানে আসা তাই না।'
রেবা অপূর্বর মনটা পড়তে পারেন। হয়ত অপূর্ব চাইছেন মেয়েটাকে কিছুটা সময় কাছে রাখতে ওর ছবি আঁকা দেখতে। সত্যিই তো ওকে দেখতেই কাজকর্ম ফেলে এতটা পথ আসা। তাই বলেন,' তুমি মন খারাপ কোর না আমি দেখছি সকালে আমরা যখন বেড়াতে বেরোব জিপে করে ওকে সাথে তুলে নেব। চাচীও চাইলে যেতে পারেন আমাদের সাথে।'
রেবার কথা শুনে শান্তি লাগে অপূর্বর। আজ সন্ধ্যেতে বৈদ্যনাথের আরতি দেখলেন সবাই। মন ছুঁয়ে গেল সবারই মনে জাগল ভক্তিভাব। যদিও এই সময় বেশ ভীড় হয় মন্দিরে তবুও নটরাজ আর মথুরার চেষ্টাতে বেশ নির্বিঘ্নেই দর্শন হল। তাছাড়া পুলিশ ইন্সপেক্টর চৌবের সাথেও অপূর্বর ভাব জমল। আসলে দীর্ঘদিন একটা ভালো কাজের সাথে যুক্ত হওয়ায় আর অনেক খ্যাতনামা মানুষের মূর্তি বানানোর জন্য সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষই অপূর্বর পরিচিত। তার মধ্যে মন্ত্রী,ডাক্তার,পুলিশ,উকিল সবই আছে।
ভোরের পাখির কিচিরমিচির শুনে ঘুম ভেঙে যায় অপূর্বর নাটুর কোয়ার্টারটা বেশ খোলামেলা। মন ভালো হয়ে যায় এখানে। একটা সময় বাঙালী এইসব জায়গাতে হাওয়া বদল করতে আসত। ভেতরে ওরা এখনও ঘুমোচ্ছে বারান্দায় বসে দেখতে পান গ্ৰামের গরীব মানুষেরা মাথায় বোঝা নিয়ে যাচ্ছে। কারও মাথায় ইটের বোঝা কেউ আবার মাথায় করে গাছের শুকনো ডালপালা নিয়ে যাচ্ছে। কোন মহিলার বুকে জড়ানো জীর্ণ চেহারার শিশু। বড় মন খারাপ হল অপূর্বর এই জন্য ভাগ্নে কলকাতা থেকে এত জামাকাপড় নিয়ে এখানে আসে। কে জানে শৈলপুত্রী ঠিকঠাক মত খেতে পায় কিনা? চেহারাটা মেয়েটার বড় জীর্ণ বয়েস আর কত হবে? বড় জোর বাইশ তেইশ। তবে ওদেরকে যেভাবে যত্নে খাইয়েছে তাতে মনে হয় না খুব একটা অভাব আছে। হরিহরণ তো শিবনারায়ণের ওখানে কাজ করে অল্প কিছু জমিও আছে সাবিত্রী চাচী বলছিল। মেয়েটাকে কিছু দিতে পারলে ভালো হত। কিন্তু শৈলজা দরকারে হাত পেতে টাকা নিলেও এই মেয়ের আত্মসম্মান খুব বেশি। ফুলবন্তীর কাছে শুনেছেন ছাত্র পড়ায় তাতে অল্প কিছু রোজগার হয়।
হঠাৎই অপূর্বর মনে একটা চিন্তা আসে কলকাতাতে তো কত এক্জিবিশন হয়। তাঁর নিজেরও তো হয় সেখানে যদি শৈলপুত্রীর আঁকা ছবি দেওয়া যায়। কিন্তু এত দূর থেকে কিভাবে যাবে সেই ছবি? তাহলে তো ওর একটা ভালো স্টুডিও দরকার যেখানে শান্তিতে একটু আঁকতে পারবে। এখানে সংসারের কাজ ছাত্র পড়ানো এর মাঝে কখন সময় পাবে? তাছাড়া সাবিত্রীর বাড়িতে ইলেকট্রিক আলোও তো নেই। চিন্তায় ডুব দেন অপূর্ব।
-' কখন উঠেছ? আমাকে ডাকনি কেন? একটু চা করে দিতাম।'
-' থাক রেবা একসাথেই খাব সবাই। নাটু উঠেছে?'
-' নাহ্ ওঠেনি সাতটা তো বাজে এবার সবাই উঠবে। আমি বরং চায়ের জল বসাই।'
-' বসাবে,একটু পাশে বোস না রেবা। দুজনে একটু গল্প করি।'
রেবা তাঁর পাগল স্বামীকে চেনেন বুঝতে পারেন অপূর্বর মনে কিছু কথা ঘুরছে যা তাঁকে বলতে চান।
-' আচ্ছা বাবা এই তো বসলাম একদম পাশে। ঠাকুরজামাই উঠলে মজা করবে দেখ। বলবে দাদা বৌদির প্রেম দেখেছ লাবণ্য। নাও বল এবার সব কথা।'
রেবার হাতে হাত রাখেন অপূর্ব,' আচ্ছা রেবা আমি যদি বেবির জন্য কিছু করি তুমি রাগ করবে? বড় অভাগা মেয়েটা,কত বড় বাড়ির মেয়ে অথচ সব হারিয়ে অনাথ। এমন কি বিয়েটাও টিকল না। আমি তো সে কথা জিজ্ঞাসা করার সাহসই পাইনি। মেয়েটার ভেতরে আগুন আছে আমি চাই সেই আগুনটা জ্বলুক সব অশুভ পুড়ে গিয়ে শুভশক্তির জন্ম হোক।'
রেবা অপূর্বর হাতটা আগলে রাখেন যত্নে সত্যিই হয়ত এমন স্বামী পাওয়া ভাগ্যের সন্তান ওঁদের নেই কিন্তু সেই দুঃখ রেবাকে বুঝতেই দেননি কখনও। যখন যা করতে চেয়েছে করতে দিয়েছেন। আজ শৈলপুত্রীকে দেখে রেবার নিজের কথাই মনে হল অল্প কিছু প্রতিভা ছিল রেবার ভালো সাজাতে পারতেন আল্পনা দিতে পারতেন। সেই প্রতিভাকে উস্কে দিয়েছিলেন অপূর্ব তাই তো জন্ম হয়েছিল রূপলেখার। অপূর্ব সবসময় বলতেন,' স্বামীর পদমর্যাদা কেন হবে নারীর পরিচয়। আপন কৃতীত্বে সে করুক বিশ্বজয়। তা যতটুকু হোক রেবা কাজের ছোট বড় হয় না।'
রেবার আবার মনে পড়ল কথাগুলো তাই তিনি বললেন,' মা দুর্গা যখন মহিষাসুর বধ করবেন তখন দেবতারা তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন অস্ত্র। এবার তুমি তোমার মায়ের হাতে ধরিয়ে দাও অস্ত্র। দরকারে আমি,নটরাজ,লাবণ্য সবাই দেব এমনকি চাচী চাচাও।'
অপূর্ব উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন,' রেবা তুমি কি সুন্দর কথা বল গো! আমি কি অস্ত্র দেব? তুমি কি দেবে? নটরাজ লাবণ্য ওরাই বা কি দেবে? চাচী চাচা ওরা?'
-' তুমি দেবে তোমার ভাস্কর্য আর রঙ,আমি শেখাবো আলপনা,তত্ত্ব সাজানো নিজেকে ঘষামাজা। নটরাজ পড়াশোনাতে একটু সাহায্য করবে। লাবণ্য শেখাবে সেলাই। চাচী তো শেখাচ্ছে প্রকৃতিকে জয় করে বাঁচতে। আর লাঠি চালানো শেখাবে চাচা। অবশ্য সে বোধহয় ওর শেখা হয়ে গেছে। নটরাজের কাছে শুনেছি কি ভাবে লাঠি নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে ঐ মেয়ে।'
-' রেবা ইউ আর এক্সলেন্ট। আই লাভ ইউ ডিয়ার মাই হানি।'
ভালোবাসার কথা অসংখ্য গোলাপের পাপড়ির আভা ছড়িয়ে দিতে পারে যে কোন সময় যে কোন মুখে। রেবা ও তাই আরক্ত মুখে সেই ভালোবাসার পাপড়ি মাখলেন। হয়ত এখানেই অপূর্বর জয় কারণ তিনি নারীকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে কখনও দ্বিধাগ্ৰস্ত হন না।
মামা মামীকে এমন একটা রোমান্টিক মুডে দেখবে ভাবতে পারেনি নটরাজ। ওদের শেষবেলার ভাব ভালোবাসাটুকু ছুঁয়ে গেল ওকেও। তাই বিরক্ত করবে না ভেবে পা বাড়ায়। কিন্তু ধরা পড়ে যায়।
-' ওহ্ তুই শুনে ফেলেছিস সবটা? না মামু কিছু শুনিনি আর যদি শুনেও থাকি ক্ষতি কি?'
-' একদম ক্ষতি নেই,মামার মত এই ভালোবাসার রঙটুকু মেখে রাখিস শেষবেলাতেও। কি রে আছে নাকি কেও?'
-' না মামু সময় পেলাম কোথায়? আর তোমার শেষবেলা আবার কি? এখন অনেকদিন ভালো থাকতে হবে।'
নটরাজ যে কখন এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে ওঁরা বুঝতেও পারেননি।
-' মামু অস্ত্র মোটামুটি ওর হাতেই আছে শুধু একটু শান দিতে হবে। মামীমা কি সুন্দর কথা বল তুমি! শৈলপুত্রীর হাতে অস্ত্র কি সুন্দর বললে। এ যুগের শৈলপুত্রী সে হার মানবে কেন? ঠিক বলেছ। তোমরা গল্প কর আমি চা আনছি।'
-' আরে তোরা বস আমি করছি চা।'
-' না মামী আজ আমার হাতের চা খাও। গল্প কর আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। দেখ আমি কেমন কাজ শিখেছি। ঐ তো মা আর বাবাও উঠে পড়েছে।'
চা জলখাবার খেয়ে রেডি হতেই জিপ এসে পড়েছে নটরাজের অফিসে যেতেই হবে সুতরাং মথুরা ভরসা। ফুলবন্তী সকাল সকাল এসে জলখাবার আর দুপুরের পরোটা কষা মাংস করে দিয়েছে। ফুলবন্তীকে দিয়ে বলে পাঠান রেবা শৈলপুত্রীকে তৈরি হতে ওঁরা ওকে সাথে নিয়েই যাবেন আজ ঘুরতে।
*********************
জিপের আওয়াজ শুনেই চাচী এসে বাইরে দাঁড়ায় ওঁদের নমস্তে জানায়। গাড়ি থেকে নেমে আসেন রেবা শৈলপুত্রীর কথা জিজ্ঞাসা করেন। চাচীকে বলেন পরশু ওঁরা ফিরে যাবেন তাই শৈলপুত্রীর সাথে সময় কাটানোর ইচ্ছে সবার। আসলে ওর জন্য তো এতটা দূরে আসা।
সাবিত্রী মাথা নাড়ে,' জরুর যায়েগী বিটিয়া,আ রহী হ্যায়। ব্যাস অভি।'
সাবিত্রী ডাক ছাড়েন বিটিয়া আ যা।
রেবা সাবিত্রীর সাথে ভেতরে আসেন ওদের অপেক্ষা করতে বলে। শৈলপুত্রী তখন ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ওর দিকে তাকান রেবা এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল কোনরকম করে মাথায় চূড়ো করে বাঁধা। খুব সাধারণ ভাবে পরা একটা নীল ছাপা শাড়ি। হাত আর কপাল সবই ফাঁকা। শৈলপুত্রীর মুখটা একটা সাদা ক্যানভাসের মত লাগে রেবার। আচ্ছা ওকে একটু নিজের শিল্পী হাতের ছোঁয়া দিলে কেমন হয়? বেশি সময় নেবেন না রেবার দক্ষ হাতে দশ মিনিট যথেষ্ট। বাইরে এসে অপূর্বকে একটা ইশারা করেন আমি আসছি ওকে নিয়ে একটু বোস তোমরা।
অবশ্য এই মনোরম প্রকৃতির মাঝে অপেক্ষায় থাকতে খারাপ লাগছে না কারও। কারণ গরমকাল নয় তখনও সুন্দর বসন্তের আবহাওয়া তাই প্রকৃতি সুন্দর এখন।
রেবা শৈলপুত্রীকে বলেন,' আমি যে শাড়ি দিয়েছি ওটা পরিসনি কেন মা? আমি তো দেখি একবার কেমন মানিয়েছে আমার মাকে শাড়িটা।'
মাকে অনেকদিন আগে হারিয়েছে শৈলপুত্রী কোন মহিলার কাছে মাতৃসুলভ ব্যবহারে মনটা হঠাৎই খুব ভিজে যায় শৈলপুত্রীর। তবুও বলে,' ও তো অনেক দামী শাড়ি আছে। অত দামী কাপড় যে আমি পরিনি।'
-' তুইও যে বড় দামী মা,আমাদের ঠাকুরপোর মেয়ে তুই। তিনি যে বড় ভালো মানুষ ছিলেন।'
আর বোধহয় কিছু বলা চলে না সুতরাং শৈলপুত্রী আত্মসমর্পণ করে রেবার কাছে। নীল রঙের জড়ির বুটিতে সাজানো লালপাড় শাড়িতে জড়ান রেবা ওকে। শহরের কত বড়লোকের সাজগোজ মেয়েকে সাজান রেবা। আজ এই নিরাভরণ মাকে সাজাতে চান নিজের হাতে। নিজের একটা মেয়ের বড় সাধ ছিল যাকে মনের মত সাজাবেন। আজ এই মেয়েটাকে দেখে কেন যেন বড় মায়া হয়। অবাক হন দেখে শাড়ি জামা গায়ে দিয়েই তো মায়ের রূপ খুলেছে। নিজের দক্ষ হাতে ওর পরা অগোছালো শাড়িকে সুন্দর করে আধুনিকতার ছোঁয়া দেন। এবার রেবা ব্যাগ খুলে হাল্কা প্রসাধনের ছোঁয়া দেন ওর চেহারায়। নিজের বিয়ের বৌভাতের দিনটা মনে পড়ে শৈলপুত্রীর। একমাত্র ঐ একটা দিনই সেজেছিল ও বাবার উৎসাহে। তবুও সেই সাজ যেন ছিল উগ্ৰ ওর জা বারবার এসে বলছিল আরও একটু সাদা মাখাও যা কালো! ঠোঁটে আরও রঙ দাও। তারপর পেয়েছিল সানন্দার দেওয়া টিনের রঙের বাক্স। একটা সময় আধপাগল হয়ে কত রঙ মেখেছে ঐ টিনের বাক্স থেকে।
ওর ভাবনায় ছেদ পড়ে হঠাৎই রেবা বলেন,' চল চল হয়ে গেছে। আচ্ছা দেখ তো মা এবার নিজেকে একবার আয়নাতে। দেখি পছন্দ হয়েছে কি না? ওহ্ তোর হাত তো একদম খালি! দেখি আমার ব্যাগে।'
নিজেকে আয়নার সামনে দেখতে ভয় পায় শৈলপুত্রী যতবার দেখে ততবার শ্বশুরবাড়ির অপমানের দিনগুলো মনে পড়ে যায়। কারা যেন আসেপাশে ফিসফিস করে বলে মেয়েটা বড়ই কুরূপা তাই স্বামীর শ্বশুরবাড়ির কারও মন পেল না। যে মেয়ের রূপ নেই তার আবার কি আছে? এই মেয়েকে কি বাইরে বার করা যায় নাকি? চাকরদের সাথেই মানায় একে।
তাই বলে,' কি দেখব? আপনি সাজিয়েছেন আপনা হাতে ঠিকই হবে। সবই ছেড়ে রেখে এসেছি ওখানে। আমার কুছু পরতে ভালো লাগে না।'
অপূর্ব মজা করে বলেন রেবার ব্যাগে আলপিন টু এলিফ্যান্ট থাকে। রেবা হাতব্যাগ থেকে চুড়ি আর গলার চেন বের করে পরিয়ে দেন ওকে। তারপর নিজেই মুগ্ধ হন নিজের হাতের ছোঁয়ায় মেয়েটাকে সাজাতে পেরে। লম্বা টিপটা যেন শৈলপুত্রীকে খুব মানিয়েছে এ যেন ওর অদৃশ্য ত্রিনয়ন।
এবার ওর সামনে হাত ব্যাগ থেকে আয়নাটা বের করে ধরেন,' দেখ নিজেকে এবার,আমার মা বলতেন সাজলে গুজলে বেটি আর লেপলে পুছলে মাটি। মাটিকে যেমন লেপে পুছে রাখলে তাতে আল্পনা দিলে সুন্দর লাগে তেমন শৃঙ্গার স্ত্রীর ভূষণ। তাতে কোন লজ্জা নেই। এ আমাদের নারীত্বের অহঙ্কার।'
শৈলপুত্রীর অবাক লাগে রেবার কথা শুনে কই এমন করে তো কেউ ওর সাথে কথা বলেনি আগে।
রেবাকে বলে,' কাকিমা তুমি কত আচ্ছা বাত কর মনে জোর পাই সাহস আসে। বাতই আসল জান তো। বাতই সবকুছ ওহ্ কভি তোড় দে তো কভি জোড় দে।'
বাইরে তখন কালী গাইয়ের ঘন দুধের চা আর সাবিত্রীর বানানো ঠেকুয়াতে আসর জমে উঠেছে। খাব না বলেও সবাই নিয়েছেন হাতে।
রেবা শৈলপুত্রীকে সাথে নিয়ে বাইরে আসেন। এতগুলো মানুষের সামনে সেজেগুজে আসতে লজ্জা লাগে শৈলপুত্রীর কখনও সে এমন করে সাজেনি। মাথা নীচু করে দাঁড়ায় তাই।
-' চল এবার আমার মাকে সাজিয়ে নিয়ে এলাম।'
-' সত্যিই বৌদি তোমার তুলনা নেই। কি ভালো লাগছে গো সত্যিই। দাদা দেখেছ?'
-' দেখছি রে তপস্বিনী উমা আমার এখন সাক্ষাৎ দুর্গা এবার হাতে অস্ত্র নিলেই হবে।'
**************************
চাচীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ওঁরা শৈলপুত্রীকে সাথে নিয়ে বেরোলেন। আজ মেয়েটাকে দেখে সাবিত্রীর মনটা জুড়িয়ে গেল। আহা কত অযত্নে থাকে বিটিয়া আজ মেমসাব সাজিয়ে দিতে কত সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। ওর থুতনিটা ধরে আদর করে দেয় সাবিত্রী। শৈলপুত্রী জিপে উঠে বসে বারবার বলে চাচী যেন ঠিক সময়ে খেয়ে নেয়।
লাবণ্যও ফুলবন্তীকে বলে সকাল সকাল গিয়ে মশলা বেটে সব জোগাড় করে রাখে যেন। আজ লাবণ্য আর রেবাই রান্না করবেন। আর তো মাঝে একটা দুটো দিন। ফুলবন্তী হাসে,' জী মাঈজী আমি সব রেডি করে রাখব। আপলোগ যান।'
শৈলপুত্রীকে সাথে নিয়ে গল্প গল্পে আর মথুরার গাইডেন্স পেয়ে দেওঘর খুব ভালো ঘোরা হল ওঁদের। নওলাখা মন্দির,তপোবন পাহাড়,ত্রিকূট পাহাড় সব ঘুরে সবাই তখন ক্লান্ত। একটু বসে বিশ্রাম নিতেই শৈলপুত্রী বের করে ঝুড়ি থেকে শুকনো খাবার মথুরা চা ঢালে। অপূর্বর মনে হয় অনেকদিন বাদে এত সুন্দর একটা পিকনিক হল শুধু নাটুটাই থাকতে পারল না। চা খেতে খেতে অপূর্ব শৈলপুত্রীকে আবার বলেন,' এত ভালো গুণ গুলো নষ্ট করে দিবি মা? আমি চেষ্টা করব যদি হয় তো ভর্তি হবি আর্ট কলেজে?'
-' কিন্তু সে তো অনেক রূপিয়া আঙ্কেল। আমার তো কিছু নেই।'
-' তোর এই বুড়ো আঙ্কেলটা তোকে পড়াতে পারে না? নাকি আমাকে আপন ভাবিস না? আচ্ছা না হয় নিজেই টিউশানি করে চালাবি।'
শৈলপুত্রী কিছু বলতে পারে না শুধু বলে,' আচ্ছা ভেবে দেখব। এখন তো চা খেয়ে নিন।'
ওঁরা যখন ফিরলেন তখন সূর্য প্রায় অস্ত যাবার পথে। নটরাজ তখন বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে। ফুলবন্তী কিছুটা আগেই এসেছে। রেবা আর অপূর্বর কথায় শৈলপুত্রীও এসেছে ওঁদের সাথে। কথা হয়েছে একটু খাওয়াদাওয়া করে যাবে মেয়েটা। সারাদিন ওরও তো ঘোরাঘুরি গেছে। মথুরা ওকে আর ফুলবন্তীকে একসাথে পৌঁছে দেবে বাড়িতে।
জিপ থেকে শৈলপুত্রীকে নামতে দেখে অবাক হয়ে যায় নটরাজ। সেদিনের সেই তেজী অগোছালো মেয়েটা আজ কেমন যেন নম্র,শান্ত হয়ত বা অনেক বেশি সুন্দরও। তবে ওকে এত সুন্দর শাড়িতে গয়নায় সাজালো কে? নিশ্চয় মামীমার কাজ। নটরাজের সাথে চোখাচোখি হতেই শৈলপুত্রী দেখে অবাক হয়ে সাহাব ওকেই দেখছে। মাথা নীচু করে ও,একটু অপ্রস্তুত হয় এত সাজগোজ করেছে বলে। রেবা ওর হাত ধরেন,' আয় মা একটু খেয়ে যাবি। সারাদিন তোরও অনেক খাটনি গেছে।'
চাচী একা আছে বলতেই ফুলবন্তী হাসে বলে পাড়ার বাচ্চারা সব ওখানেই আছে। আর মহিলারাও সুতরাং চিন্তার কিছু নেই। কাজ সেরে একসাথে চলে যাবে।
-' ওহ্ খুব ঘুরলে তাহলে মামু?'
-' হ্যাঁ রে মন ভরে ঘুরলাম, কিন্তু তোকে খুব মিস্ করছিলাম। তুই থাকলে আরও ভালো হত।'
ওদের কথার মাঝেই সাইকেলের টিংটিং শোনা যায় চায়ের কাপ টেবিলে রেখে গেটের দিকে ছুটে যায় ফুলবন্তী প্রতাপ এসেছে হাটের থেকে।
নটরাজ জিজ্ঞেস করে,' মিলা ক্যায়া?'
অপূর্ব আর ওর বাবা অবাক হন কি আবার মিলবে?
প্রতাপ দাঁত বার করে হাসে,' সাহাব বহত তকলিফ সে মিলা।'
-' কি মূল্যবান বস্তু এনেছ প্রতাপ সিংহ যে এত আহ্লাদ?'
-' মামু শুনলে তুমিও আহ্লাদিত হবে ও বালি হাঁসের মাংস এনেছে। আমি বলেছিলাম যদি পায়।'
অপূর্বর চোখ দুটো চকচক করে ওঠে মনে পড়ে যায় ফেলে আসা দিনের কথা। শৈলজাদের বাড়ির বড় ঝিলে আসত বালি হাঁসের দল। তার থেকে একটা দুটো যেত এই বুভুক্ষু তিন বন্ধুর পেটে। আহা সে কি স্বাদ! তার সাথে জ্যাঠাইমা করে দিতেন আতপ চালের ঘি ভাত। একটু লালচে শক্ত মত হলেও তার স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে। কতবার এই হাঁসের মাংসের লোভেই শৈলজার পিছু পিছু গেছেন।
তবে প্রতাপের আনা হাঁসের মাংস দেখে পিছু হটল দুই রাঁধুনী।
-' এ হাঁসের মাংস আমি রাঁধতে পারব না। নাটু যে কি করে না?' লাবণ্য বলেন।
-' ওর কি দোষ? তোমার দাদা কাল গল্প করছিল তাই এনেছে। আমিও তো পারি না এই মাংস করতে। ফুলবন্তী তু পাকালে হাঁস কা মাংস।'
ওঁদের কথা শুনে শৈলপুত্রী আর ফুলবন্তী হেসে অস্থির। হাসে প্রতাপও সে তখন কলতলায় মাংস ধুতে ব্যস্ত।
শৈলপুত্রী বলে,' আপনারা গিয়ে বসুন গল্প করুন আমি রান্না করে দেব মাংস। আমি পারি।'
রেবার মায়া হয় মেয়েটাকে দেখে একটু সেজেগুজে বেরিয়েছিল আবার রাঁধতে বসবে এখন? তাই বলেন,' এই শাড়ি পরে রাঁধবি দাঁড়া তোকে একটা কাপড় দিই।'
-' কিছু হবে না আমি সামলে নেব।'
রান্নাঘরের দরজায় ফুলবন্তী ফাই ফরমাশ খাটছে। বসার ঘর থেকে খাবারের গন্ধে মনটা আনচান করে ওঠে অপূর্বর। মনে হচ্ছে সেই চেনা গন্ধ ভেসে আসছে অতীতের জানলা ফুটো করে।
রান্না করে সবাইকে খাইয়ে শৈলপুত্রী আর ফুলবন্তী বাড়ি গেল আজ। সবার মুখের পরিতৃপ্তি টুকু আজকে ওর প্রাপ্তি। এই টুকু পাওয়ার লোভ ছাড়তে নারাজ ও। ঘি ভাতের সাথে হাঁসের মাংস দেখে চমকে ওঠেন অপূর্ব,' এই রান্না তো জ্যাঠাইমা করতেন! তাই ভাবি এত সুন্দর গন্ধ আসছে কোথা থেকে এ তো বড় চেনা গন্ধ।'
-' আপনি ভালোবাসেন আমি জানি। তাই তো বানালাম।'
-' কোথা থেকে শিখলি এই রান্না? কে বলেছে এত সব?'
- ' বাবার কাছ থেকেই শেখা আর শোনা সব। মা তো সেই...'
থমথমে পরিবেশটাকে হাল্কা করে নটরাজ,' মামু এবার বোধহয় একদম ঠিক বোঝা যাচ্ছে এই তোমার শৈলজার কন্যা মিশ্রাবাড়ির যথার্থ উত্তরাধিকারী।'
-'তা আর বলতে। তোর মা আর মামীমাকে দেখ দিব্যি হাঁসের মাংস খেয়ে যাচ্ছে। এই কত কি করল মাংস দেখে।'
-' সত্যিই খুব ভালো রান্না হয়েছে তাই না ঠাকুরঝি? গল্প শুনেছিলাম এই খেলাম।'
-' হ্যাঁ বৌদি,আমিও ভেবেছিলাম খাব না এখন দেখলাম না খেলে ভুল করতাম।'
-' না খেলেই পারতে,আমরা আরেকটু ভাগে বেশি পেতাম।'
সবার হাসি মজাতে মনটা ভরে ওঠে শৈলপুত্রীর ঠিক যেন মনে হচ্ছে ওদের লাভার বাড়িতে সবাই একসাথে বসে খাচ্ছে। ছোটবেলায় ডুব দেয় শৈলপুত্রী।
আরও দুটো দিন আনন্দে কাটিয়ে কলকাতা ফেরেন ওঁরা সবাই। শৈলপুত্রী দেখা করতে এসেছিল।অপূর্ব আর রেবা দুজনেই বলেন আপনজন ভেবে যেন সব সুবিধা অসুবিধা জানায় ওঁদের। বাবার মতই কেউ একজন আছে পাশে সেকথা যেন মনে রাখে।
-' আমাকেও মনে রাখিস মা তোকে কয়েকদিন কাছে রাখতে ইচ্ছে করে নিজের হাতে তৈরী করতে ইচ্ছে করে।'
শৈলপুত্রী এই কদিনে সত্যিই সবার মনের কাছাকাছি চলে এসেছে তাই বলে,' যাব কাকিমা,থাকব আপনার বাড়িতে কলকাতা গেলে।' সেই কলকাতা, মনটা হারিয়ে যায় শৈলপুত্রীর। যেখানে ওর শ্বশুর ঘর ছিল,বর ছিল। এখন আর কিছু নেই। কিন্তু ওর গয়নাগুলো সেগুলোর কি হবে? কত অভাব গেছে ওদের কিন্তু সেই গয়নাতে বাবা হাত দেননি। আগলে রেখে দিয়েছিলেন ওর বিয়েতে দেবেন বলে।
নিজের ওপর রাগ হয় শৈলপুত্রীর কেন এত অভিমান ওর যে ভালোবাসেনি তার ওপর? গয়নাগুলো চেয়ে নিয়ে মাথা উঁচু করেই তো আসতে পারত? কেন এভাবে পালিয়ে আসতে গেল?
আদিত্যর বাড়িতে ঝি চাকরের মতই ছিল শৈলপুত্রী তাই ও চলে যাওয়াতে কারই বা কি এসে যায়? হরিহরণ চাচার কাছে শুনেছে ওদের অবস্থা এখন আর আগের মত নেই। সানন্দার মা মারা গেছে তাই বিয়েটা পিছিয়ে গেছে। মাসের হিসেব করে শৈলপুত্রী যে কোনদিনই ওর হয়নি তাকে যত্নে ঠাঁই দিয়েছিল বুকে। আর হয়ত কয়েক মাস বাদেই সে সানন্দার সাথে ঘর বাঁধবে সুখে।
***********************
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। শৈলপুত্রীর রোজনামচা যেমনকার তেমন চলছিল হঠাৎই নটরাজ ফুলবন্তীকে দিয়ে খবর পাঠায় হয়ত কয়েকদিনের জন্য শৈলপুত্রীকে কলকাতা যেতে হবে। চাচা খবর দিয়েছে। চাচার কথা শুনে চিন্তায় কেঁদে ওঠে সাবিত্রী হঠাৎই চাচার কি হল? নিশ্চয় চাচার তবিয়ত খারাপ তাই খবর এসেছে। ফুলবন্তীর খবর শোনার পর চাচীকে আটকানো যায় না বিটিয়ার সাথে একদম হাজির হয় নটরাজের ওখানে তখন বিকেল প্রায়।
-' বাবুজী আপ হামকো সচ বাতাইয়ে। কি হয়েছে ওর চাচার?'
-' চাচী কিছু হয়নি,সব ঠিক আছে। চাচা খবর করেছে তোমার বিটিয়াকে কলকাতা পাঠাতে। তাছাড়া মামুরও এক্জিবিশন আছে তাঁর ইচ্ছে ওখানে আপনার কিছু আঁকা থাক। সেজন্য আপনাকে কলকাতা যেতে হবে। তাছাড়া আপনার...'
কথাটা নটরাজের মুখ দিয়ে বেরোয় না মামু ফোন করেছে শৈলপুত্রীর ছেড়ে আসা বর নাকি আবার বিয়ে করছে হরিহরণ চাচা এসেছিলেন খবর দিতে। শৈলপুত্রীর না জানা অনেক কথা শুনল নটরাজ এবার। বড় দুঃখজনক ঘটনা। ঘর বেঁধে দেওয়া হয়ত সহজ কিন্তু সেই ঘরকে টিকিয়ে রাখা খুবই কঠিন। এমনি ঘর বেঁধেছিলেন দুই বন্ধু ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ ভেবে কিন্তু তা টেকেনি। শৈলপুত্রী ফিরে এসেছিল সর্বস্বান্ত হয়ে।
' কি আর ছিল এমন ওর মামু?'
-' ছিল না আছে এখনও অনেক কিছু যা সেই মেয়ে হেলায় ফেলে এসেছে ওখানে। সে কথাই বলতে এসেছিল হরিহরণ। যেভাবে হোক মেয়েটাকে পাঠানোর ব্যবস্থা কর। তাছাড়া আমি চাই ও আঁকার এক্জিবিশনটাতে যোগ দিক কত বাইরের নামকরা শিল্পী আসবেন।'
সব কিছু শুনে আর আপত্তি করে না চাচী। ঠিক হল সামনের শুক্রবার মথুরার ভাতিজার সাথে ওকে পাঠানো হবে কলকাতা। শৈলপুত্রীর রাতে ঘুম আসে না খুঁজে ফেরে বাবার অভয় স্পর্শ অথবা মায়ের আঁচলের কোণের আদরমাখা গন্ধ টুকু। এখানেই তো বেশ ছিল আবার কেন কলকাতা যেতে হবে? কলকাতা যে মন খারাপের জায়গা। সাবিত্রী ওর মাথায় হাত রাখেন আদরে,' বিটিয়া, বাবা বৈদনাথ কো শরণ লে। তু জরুর পাশ হোগী পরীক্ষা মে। তেরি চাচা হ্যায় তো উধার। ও মালতীকে মা ভী হ্যায়। তেরি অপূর্ব আঙ্কেলজী হ্যায়। কিঁউ ইতনা ঘাবড়া গয়ী হাঁ?'
-' চাচী তুম ভী চল না হামারে সাথ কলকাত্তা।'
-' পাগলী ইয়ে কালী গাই ও বাছরা কো ক্যায়া হোগা? কুছ দিনকে তো বাত ফির তো আ যায়েগী হামারে পাস। পাঠশালা চালানা হ্যায় না?'
ট্রেনের জানলায় বসে উদাস হয়ে যায় শৈলপুত্রীর মন মংলু,মুন্না,বিন্তিরা ছুটে এসেছিল পেছন পেছন। যতক্ষণ দেখা যায় হাত নাড়ছিল,চাচী কান্না মুছে সাহস দিচ্ছিল। ঠিক যেন মনে হচ্ছে নিজের বাড়ির সবাইকে ছেড়ে পরদেশে যাচ্ছে। ওর টিনের বাক্সাটা ভী ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো। শুধু ব্যাগে করে একটা দুটো জিনিস নিয়ে এসেছে শৈলপুত্রী জামাকাপড়ের সাথে। সাহাব ভী এসেছিলেন সব বুঝিয়ে বলে দিলেন। একটু একটু করে চেনা জায়গাটা আর মানুষগুলো দূরে চলে যায়।
মথুরার ভাইপো ওকে ঘাবড়াতে বারণ করে। নটরাজ বলেই দিয়েছে ওকে শৈলপুত্রীকে নিয়ে একদম ওর মামার বাড়ি একচল্লিশ বাই তিন নিউ আলিপুরের সান্যাল ভিলায় পৌঁছে দেবে।
*************************
বিয়ের বেনারসীটা গায়ে ফেলে দেখে সানন্দা। কিছু শাড়ি আগে কেনা হলেও বেনারসী কেনা হয়নি। শাড়ি কিনতে ও আর আদিত্যই এসেছে। ওদের বাড়ির শাড়ি সুতরাং মধুদিকে আনার কোন প্রয়োজন বোধ করেনি। আজকাল মধুদিকে কেন যেন খুব একটা ভালো লাগে না সানন্দার কথায় কথায় বোঝাতে চায় সংসারের সব দায়িত্ব ওর বরের মাথায়। সমস্ত খরচ একা সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। গায়ে জ্বালা ধরলেও আদিত্যকে বলে সানন্দা,' ব্যবসাতে তো তোমারও ভাগ আছে এত কথা বলে কি করে তোমার বৌদি? এভাবেই চলুক সংসার তুমি কিছু খরচ করতে যেয়ো না যেন।'
আদিত্য ভালোমানুষী করে কিছুটা,' দাদাকে তো সামলাতে হচ্ছে ব্যবসা আমি তো দেখতে পারি না কিছু। তাই দায়িত্ব বেশিটাই ওর মাথায়।'
-' সে যাই হোক,একটা কিছু তো করবে। তুমি কিন্তু দেখ মায়ের কি আছে? অবশ্য আমি এলে সব দেখে নেব একটু একটু করে।'
আদিত্যর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে,আবার বিয়ে করছে। জানে না এবার ওর কপালে কি আছে? তবে মাকড়সার জাল ওকে এমনভাবে জড়িয়েছে ও এখন অসহায় পতঙ্গ। এখান থেকে বেরোনো সম্ভব নয়। আবশ্য এই কথাটা সানন্দাকে বললে বলবে কে কাকে জালে জড়িয়েছে কে জানে? দুজনেই এখন বন্দি জালে।
আদিত্যর প্রথম জোর করে ঘাড়ে চাপানো স্ত্রী শৈলপুত্রীর রূপ ছিল না,অথবা সৌন্দর্য্য কিছু থাকলেও তা কখনও খুঁজে দেখেনি আদিত্য। যার ওপর রাগ বিতৃষ্ণা তার দিকে তাকাতেই তো ইচ্ছে করেনি সেখানে সৌন্দর্যের মাপ মাপার প্রয়োজনই হয়নি। ভালোবাসা থাকলে মনে অসুন্দরকেও সুন্দর লাগে প্রতিক্ষণে। দাম্পত্য চলে নির্ভরতায় আর ভালোবাসায় সত্যিই কি বেশি রূপসী বলে বেশি ভালোবাসা পাওয়া উচিত নারীর? রূপই কেন হবে শুধুমাত্র ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা? একজন নারীর অবদান থেকে যায় সংসারের প্রতি আনাচে কানাচে তার স্বামী সন্তানের জীবনেও সুতরাং সেখানে সম্মান টুকুই প্রাপ্য আগে। আদিত্যদের বাড়িতে শৈলপুত্রীর সেই সম্মান ছিল না কখনই। আসলে ওকে তো কেউ ভালোই বাসেনি।
আদিত্য শৈলপুত্রীর বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখেছে কখনই উঁকি মারেনি মনে। কখনও একান্ত আলাপে কাটিয়ে মাপতে চায়নি ওর মনের গভীরতা অথবা শরীরের উত্তাপ। কখনও ওর এলোমেলো চুল সরিয়ে আদরে চুমু খায়নি গালে। ওর কষ্টের রান্নাকে অবহেলা করবে বলেই দূরে সরিয়ে শুকনো পাউরুটি খেয়ে চলে গেছে। আর শৈলপুত্রীর গুণ সে তো মণি মানিকের মত খাঁটি জহুরীই একমাত্র করতে পারে তার কদর। সেই ক্ষমতা ছিল না আদিত্যর। ওর চোখে রঙীন সস্তা চশমা যার ঘষা কাঁচে চকচকে যা দেখেছে গিল্টি করা সেটাকেই সোনা বলে ভেবেছে ও। শৈলপুত্রীর সবই খারাপ লেগেছে মানে ভালো খারাপ যা ছিল ওর মধ্যে। কখনও খারাপটা সরিয়ে ভালোটা দেখতে চায়নি। মা আর বৌদি তারমধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল আরও নেগেটিভিটি সুতরাং কাপড় বা গয়না কেনার পর যদি কেউ প্রথমেই বলে খারাপ সেটা আর পছন্দ থাকে না। কোথায় যেন মনটা খারাপ কথাটাই ভাবতে থাকে। শিবনারায়ণের দ্বারাও সম্ভব হয়নি খারাপটুকু সরিয়ে ভালোর দিকে টেনে আনতে ছেলেকে। বরং বাবার একটা হঠকারিতার মাশুল হিসেবে শাস্তি দিতে চেয়েছিল বাবাকে। তার বিনিময়ে নিজে বেছে নিয়েছিল বিষের ভান্ড। নটরাজ স্বল্প আলাপে শৈলপুত্রীর যত গুণের বিচ্ছুরণ নটরাজ দেখেছে তার একভাগও আদিত্যর ভাগ্যে জোটেনি।
সানন্দা ডাকে,' কি গো? দেখ এদিকে একবার। কেমন লাগছে এই শাড়িটা? আমাকে মানাবে তো?'
সানন্দার ফর্সা রঙে লাল বেনারসীটা ভালো মানাবে এতে সন্দেহ নেই তবুও আদিত্য বলে,' তুমি যা পর তাতেই তো ভালো লাগে। তোমার যা পছন্দ নাও। এখন তো সবটা তোমাকেই দেখে নিতে হবে।'
-' তাহলে তুমি এসেছ কেন আমার সাথে? শুধু ভালো বলতে? এছাড়া কোন মতামত নেই তোমার?'
হঠাৎই কেমন যেন রাগ হয়ে যায় সানন্দার। আদিত্য অবাক হয় ওর দোষ কোথায়? কিন্তু তবুও কিছু বলে না। সানন্দা বরাবরই মুডি,মা মারা যাবার পর আরও বেশি মর্জির মালিক হয়ে উঠেছে। ও শাড়ির কি বোঝে তার থেকে বৌদিকে আনলেই পারত বা সানন্দার কোন বান্ধবীকে।
তবুও কোন কথা কাটাকাটি না করে একটু একটু করে সানন্দার সাথে থেকে বাজার করল আদিত্য। অদ্ভুত কপাল ওর প্রথম বিয়ে হয়েছিল সেখানেও শ্বশুর বাড়ির কেউ ছিল না এখানেও একই অবস্থা হল। জামাই আদর বলে ওর ভাগ্যে আর কিছু নেই।
*********************
মন খারাপের মেঘকুয়াশায় ঢাকা সকালটাতে স্টেশনে পা রাখে শৈলপুত্রী। কলকাতা শহর তার তেমন পরিচিত নয় তাই মথুরার ভাতিজা তাকে সামলে চোখে চোখে রেখে বাসে ওঠায়। যদিও অপূর্ব বলেছিল ট্যাক্সিতে যেতে তবুও শুধু শুধু অত টাকা খরচ করতে চায় না ও।
অপূর্বর আর রেবার আজ ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেছে। দোতলার বারান্দায় কিছুক্ষণ পায়চারি করে চেয়ার পেতে বসেছেন। দুবার চা খাওয়া হয়ে গেছে। রেবা ফুল তুলছে বাগানে। বারান্দা থেকে রাস্তায় নজর রাখেন। নটরাজ যা সময় বলেছে এতক্ষণে তো মেয়ের চলে আসার কথা। কে জানে দেরি হচ্ছে কেন?
সামনের গেটে আওয়াজ হতেই বোঝেন ওরা আসছে হয়ত এবার। শিবু দরজা খুলে দেয়। ওহ্ বুঝতে পারেন ওরা বাসে এসেছে। ভালো হয়েছে রেবা নিচেই ছিল,ও শৈলপুত্রীকে কাছে টেনে নেয়। ছেলেটাকে খেয়ে যেতে বলে।
বাড়িটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় শৈলপুত্রী ওর ছেড়ে আসা শ্বশুরবাড়ির মত পুরোনো বাড়ি নয় নতুন বাড়ি মনে হচ্ছে খুব সুন্দর সাজানো গোছানো।
অপূর্ব ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। তবে রেবা জানাল একটু পরিস্কার হয়ে আসছে ওপরে। একসাথেই জলখাবার খাবে।
প্রথমে ভয়ে ভয়ে যেই বাড়িটাতে পা রেখেছিল এখানে কদিন থাকতে থাকতে সেই বাড়িটাকে বেশ চিনে ফেলেছে। ছটফটে স্বভাবের মেয়েটা ছুটে গিয়ে চা দিতে যায় কখনও রান্নাঘরে ঢোকে অপূর্বর জন্য পছন্দের কিছু করে দিতে কিন্তু বকুনি খায় রেবার কাছে,' এই যে মেয়ে তোকে এখানে কেন আনা হয়েছে জানিস?'
-' মালুম আছে। ছবি আঁকার জন্য। আমি তো করছি সেই কাম।'
-' শুধু কাম করলে তো হবে না নিজেকে তৈরী করতে হবে একটু একটু করে। দিন যে এগিয়ে আসছে।'
শৈলপুত্রীর অবাক লাগে বলে,' কোন দিন ও ছবির কম্পিটিশন? আমার হয়ে যাবে তার আগে।'
রেবা ভেবে পান না কি করে ওকে আসল কথাটা বলবেন। অথচ অপূর্ব বলেছেন তাঁকে বলতে কথাটা।
রেবাকে চুপ করে থাকতে দেখে অপূর্ব বলেন,' তোকে যে সাহসী হতে হবে। শক্ত হতে হবে আর নিজেকে সাজাতেও হবে। একটা ছোটখাটো যুদ্ধ করতে হবে তো মা শৈলপুত্রী?'
শৈলপুত্রী হাসে,' কৌন যুদ্ধ আঙ্কেল? ফোটোর তৈয়ারী?'
-' রেবা তুমিই বোঝাও ওকে।'
-' কাল থেকে রুবি তোর গ্ৰুমিং করবে। নিজেকে একটু ঘষামাজা করে নে। অস্ত্র ধরতে হবে তো?'
-' কেন?'
-' তোর শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে তো।'
ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে ওর ঐ বাড়িতে কেন যেতে বলছে ওরা ওকে? তবে কি ওরা সবাই একজোট হয়ে ওকে ঐ বাড়িতে রেখে আসতে চায়?
কিন্তু ও কিছুতেই ওখানে যাবে না আর অসম্মানিত হতে।
তাই বলে,' মরে গেলেও আমি যাব না ওখানে। ওহ এই জন্য আমাকে এখানে এনেছেন? চাচার ভী বোঝ হয়ে গেছি আমি।'
-' কিন্তু তোকে তো যেতেই হবে মা?' অপূর্ব বলেন।
শৈলপুত্রী এলোমেলো চুল ঝাঁকিয়ে বলে,' আমি কেন যাব ওখানে শুনি?'
-' তোর গয়না আনতে।'
রেবার কথা শুনে চুপ করে যায় শৈলপুত্রী কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হয় বারবার শব্দগুলো তোর গয়না আনতে...তোর গয়না আনতে।
শৈলপুত্রীর গয়না সেই গয়নায় জড়িয়ে আছে ওর মায়ের স্পর্শ। গয়না হয়ত আনতে পারেনি কিন্তু মায়ের ছবিতে এঁকে দিয়েছে একটা একটা করে সেই গয়নাগুলো। হঠাৎই সাহাব এসে পড়েছিলেন সেদিন বলেছিলেন,'কার ছবি এটা?' অনেকটা ওর মতই দেখতে। পরে ছবিটা আঁকা হলে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল শৈলপুত্রী এমন কান্না ওকে কখনও কাঁদতে দেখেনি সাবিত্রী। পরে শুনেছিল মায়ের একমাত্র চিহ্ন মেয়েটা আনতে পারেনি শ্বশুরবাড়ি থেকে। ফিরে এসেছিল নিঃস্ব হয়ে। সত্যি বলতে নিজের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে একটা গোপন ব্যথা বুকের পাঁজরে মাঝে মাঝে হলেও সেই গয়নার আশা ছেড়ে দিয়েছিল শৈলপুত্রী। কারণ ঐ গয়নায় অনেকেরই লোভ দেখেছিল। তবুও একটা সময় স্বামীর বিছানায় শুতে পেরেই ধন্য হয়ে স্বামীকে দিতে চেয়েছিল সেই গয়না তারপর শাশুড়িকে। ভেবেছিল ঐ গয়নাটুকুর বিনিময়ে যদি পুত্রবধূ আর প্রকৃত স্ত্রীর মর্যাদা নিয়ে থাকতে পারে ঐ সংসারে। কিন্তু তা হয়নি সম্ভব কোনমতেই পদে পদে অসম্মানিত হয়েছে।
আজ এতদিন বাদে ঐ বাড়িতে কোন মুখে গয়না নিতে যাবে ও? ওকে দেখলেই তো সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর ওপর। হয়ত ওকেই চোর বলবে উল্টে। কাদা ছিটাবে ওর চরিত্রে হয়ত বা চাচা আর মালতীর মায়েরও চাকরি যাবে। কোন ভাবে যদি জানতে পারে ওর পালানোর পেছনে চাচা আর মালতীর মা আছে তাহলে কি হবে?
কাটিহার থেকে আসা শৈলপুত্রীর এখন সাহস বেড়েছে তবুও আজ তার বড় ভয় করছে কি ভাবে সে এত কিছু করবে?
-' কি রে তুই গয়না ফেরত নিবি না? চুপ করে আছিস কেন? এই তুই মিশ্রা বাড়ির মেয়ে?' অপূর্ব ওর ভেতরের আগুনটা জ্বালানোর চেষ্টা করেন।
-' আচ্ছা এখন ঘুমোতে যা কাল তোর সাথে একজন দেখা করতে আসবে তার কাছে সব কিছু শুনে তারপর যা বুঝবি করিস।'
রাতে ভালো করে ঘুম আসে না শৈলপুত্রীর এই বাড়ির সবাই ভালো কিন্তু এই শহরে কেন যেন ভালো লাগছে না ওর মনটা ছটফট করছে আবার দেওঘর ফিরে যেতে। ঐ মাটি ওখানকার লোকজন বাচ্চাগুলোর জন্য খুব মন কেমন করছে। কয়েকমাসে খুব নিজের হয়ে গেছিল সব কিছু। এখানে অপূর্ব আঙ্কেল ওকে আদিত্যর ওখানে পাঠাতে চান কিন্তু ও গয়না দাও বললে ওরা গয়না দিয়ে দেবে?
এখনও আদিত্যর হাতের থাপ্পড়ের জ্বালা ওর গালে হয় মাঝে মাঝেই। এভাবে কখনও কেউ ওকে মারেনি, আশার অলুক্ষণে অপয়া কথাগুলো মনের দরজায় ধাক্কা মারে মাঝে মাঝেই। মধুর কর্কশ ব্যবহার ভুলতে পারে না। সানন্দার শয়তানি আর অপমান মনে করলে রাগ হয়ে যায় প্রচণ্ড।
রেবা অপূর্বকে বলেন,' কি করে পাঠাই ওকে ও বাড়িতে বলত?'
-' কিছু করার নেই পাঠাতেই হবে। এই গয়নাগুলো উদ্ধার করতেই হবে। কোন অধিকারে ওরা ওর গয়না হাতাবে? যেখানে কবেই ডিভোর্সের কাগজে সই করিয়ে নিয়েছে। এক বছর পুরো হবার আগেই ডিভোর্স হয়েছে রেবা সুতরাং সব ও পাবে। আমি উকিলের সাথে কথা বলেছি। শৈলজার বন্ধু হিসেবে এটা আমি আমার কর্তব্য বলে মনে করি।’
-' নটরাজ ফোন করেছিল,ও বলেছে দরকারে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে। আসলে মেয়েটার দুঃখ আর লড়াই সবাইকে ছুঁয়ে গেছে। এখন আমাদের সবারই ওর পাশে থাকতে হবে।'
অপূর্ব যত্নে রেবার হাতে হাত রাখেন,' এই জন্য বোধহয় তোমাকে এত শ্রদ্ধা করি রেবা। আসলে কখনও স্ত্রীর মূল্যবোধকে ভালোবাসার সাথে শ্রদ্ধা করতে হয়। তুমি যদি এভাবে পাশে না থাকতে হয়ত আমি সেভাবে কিছু করতে পারতাম না।'
হয়ত অল্প কিছু কথা তবুও এটুকু সম্মান স্বামীর কাছে পেলেই পরিতৃপ্তিতে মন ভরে যায়।
-' সব সময় আছি পাশে। তুমি ভেবো না শৈলপুত্রীকে জিততেই হবে।'
**************
পরদিন সকালে যে এল তাকে দেখবে এই বাড়িতে আশা করেনি শৈলপুত্রী। অথচ এই শহরে এসে বারবার মনে হয়েছে যদি একবার দেখা হত। চাচা একবার এসেছিল তবে মাসী যে আসবে তা ভাবতে পারেনি।
-' মাসী তুমি এখানে? কি করে এলে?'
-' দাঁড়াও বাপু একটু শ্বাস ফেলি আগে। ওহ্ কতটা পথ গো সেই একমাথা থেকে আরেক মাথা। মনটা পড়ে রয়েছে সেই যবে থেকে শুনেছি। ওরে মেয়ে শেষে আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিলি? একবার মনে হল না মাসী কাঁদবে।'
শৈলপুত্রী আদরে জড়ায় মাসীকে,' আমার জন্য তুমি ছুটেছিলে এদিক সেদিক আমি জানি মাসী। তোমার কামটা চলে যেত। আমি ভালো আছি দেখ।'
সত্যিই নতুন বৌকে দেখে শান্তি লাগে মালতীর মায়ের একটু ভরা ভরন্ত হয়েছে চেহারাটা। চুলগুলো বেঁধেছে চূড়ো করে পরনে নতুন শাড়ি। অনেক কথা হয় দুজনের মধ্যে মালতীর মাকে জিজ্ঞেস করে কিভাবে সে এল এখানে?
-' গঙ্গাস্নানে এয়েছি বলে চলে এলুম গো। ছুটি দেবে না কিছুতেই বড় বৌ। এখন তো সেই সংসারে গিন্নীপনা করে। আমাদের বৌদিমণি এখন তেমন কোন কথা কয় না। তাছাড়া বাড়িতে বে তো তার জন্য কত আদিখ্যেতা চলছে।'
শৈলপুত্রীর আর কথা শুনতে ইচ্ছে করে না বলে,' ও সব থাক। অন্য কথা বল। একদিন আমার সাথে থাকবে সারাদিন। ছাদে বসে দুজনে গল্প করব।'
-' তুমি আগে আমার কথা শোন। ঐ শয়তান মেয়েটা যে তোমার সংসারে শনির নজর দিয়েছিল সে ঢুকছে বাড়ির বৌ হয়ে। ছি ছি বিয়ের আগেই যা কান্ড! আর শোন এ বাড়ির অবস্থা এখন তেমন ভালো না।'
-' কি হয়েছে?'
-' কি আবার? পাপ ঢুকেছে। কারখানার নাম করে বৌদির গয়না গেছে। জানি না সে কোথায় গেছে। এখন বড় বৌটাও শয়তানি শুরু করেছে।'
-' থাক মাসি ছাড়ো ওসব কথা।'
-' ছাড়ব কেন? তুমি একটা কথা শুনে রাখো তোমার গয়না দিয়েই সাজানো হবে বৌভাতে নতুন বৌকে। তোমার গয়না গো যা তোমার বাবা দিয়েছিল। তুমি তা মেনে নেবে কিছু কইবে না?'
ভেতরটা কেমন যেন জ্বলে ওঠে শৈলপুত্রীর সেই মেয়েটা মানে সানন্দা ওর গয়না পরে সেজে বসবে কেন? কোন অধিকারে? ওহ্ এইজন্য আঙ্কেল বলছিল ছোটখাটো যুদ্ধ করতে হবে। আদিত্যর বিয়ের কথাটা বলতে পারছিল না আসলে সেই কথাটা এখন শুনল। মনের আগুনটা কিছুতেই নিভছে না ওর মনে হচ্ছে এখনি গিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে আসে সবটুকু। কত কষ্টে বুকে করে আগলে রেখেছিল বাবা,না খেয়ে থাকলেও নষ্ট করেনি। সেই গয়না পরবে সানন্দা যে টিনের বাক্স দিয়ে ওকে অপমান করেছিল!
মালতীর মা চলে গেছে মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা দিন শৈলপুত্রীর মনের আগুনটা নেভে না। ওটাকে আরও বেশি উস্কে দিয়েছে মালতীর মা।
ছবিতে রঙ করছে শৈলপুত্রী কালো মেঘের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে আগুন রঙ তার শিখায় জ্বলছে আকাশ। অপূর্ব দেখে মুগ্ধ হন মাথায় হাত রাখেন,'কি রে লড়াইটা করবি তো? আমি তো মানে আমরা তো আছি সাথে ভয় কি? জয় তোর হবেই।'
স্টুডিয়োর ফোনটা বেজে ওঠে। অপূর্ব ফোনটা ধরেন কথা শুনে শৈলপুত্রী বুঝতে পারে সাহাবজী ফোন করেছে। তাড়াতাড়ি তুলি নামিয়ে রেখে ফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। অপূর্বকে ইশারা করে ও একটু কথা বলবে।
-' হ্যাঁ রে শৈলপুত্রী ভালো আঁকছে এখন যে ছবিটা আঁকছে সেটা আরও অসাধারণ। তুই আসবি তো?'
-' হ্যাঁ আসব মামু,ইচ্ছে তো আছে। তুমি তো আছই। আচ্ছা উনি কী রাজী হয়েছেন ঐ ব্যাপারটায়। আমি তাহলে পুলিশের ব্যাপারটা দেখতে পারি।'
-' রাজী ওকে হতেই হবে। ভয় পেলে চলবে কেন? বেবি দাঁড়িয়ে আছে বোধহয় কিছু বলবে হয়ত চাচীর খবর নেবে। অনেকদিন হল এসেছে তো।'
শৈলপুত্রী ফোনটা হাতে নেয় নটরাজের সাথে ফোনে প্রথম কথা বলা ওর। ফোন আসে তখন আঙ্কেল কথা বলেন ওর কথা হয় ও বুঝতে পারে। আজ নিজেই কথা বলছে,' হ্যালো, আমার একটা সামান আনবেন সাহাবজী। চাচীকে বললেই দিবে। আমি সাথে আনিনি। ও রঙের বাক্সা।'
নটরাজ অবাক হয় শুনে, এখানে কত রঙ আবার ওর পুরোনো রঙের বাক্স নিয়ে কি করবে মেয়েটা?
-' কোন রঙ মামুকে বললেই এনে দেবেন উনি।'
-' না না ওসব নেহি চাচী জানে আমার এক বাক্সা ছিল টিনের সাজগোজ করতাম আগে। ওটা আমার চাই। আপনি এনে দেবেন?'
আর কিছুই বলতে পারে না নটরাজ, কে জানে কি করবে এই বাক্স দিয়ে মামীর তো বিউটি পার্লার আছে। তারপর আবার কি প্রয়োজন ওনার সাজের বাক্স? সাজগোজ তো কিছুই করেন না এদিকে.. তবুও বলে,' আচ্ছা বেশ আমি ফুলবন্তীকে বলে দেব,চাচীকে বলতে।'
-' মনে করে বলবেন সাহাব ওটা আমার খুব দরকার আছে।'
নটরাজ হাসে সত্যিই এই মেয়ের মন বোঝা মুশকিল কখন যে কি দিয়ে কি করতে চায়?
***********************
মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা দিন নটরাজ কলকাতা এসেছে সাথে নিয়ে এসেছে শৈলপুত্রীর সেই টিনের বাক্সটা। চাচীকে খবর পাঠানোতে নাকি খুব রাগ করেছে বলেছে ঐ বাক্সটা তো মেয়েটাকে পাগল বানিয়েছিল ওর আবার দরকার কেন? চাচী একটা কাপড়ে মুড়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিয়েছে বাক্সটা।হয়ত যাতৈ নটরাজ না দেখতে পায় সেইজন্য। তার সাথে কিছু খাবার দাবার পাঠিয়েছে সাহস করে সবার জন্য। বারবার বলে দিয়েছে সাহাব যেন রাগ না করেন। নটরাজ বুঝতে পারে মেয়েটাকে অবলম্বন করে ভালো ছিল চাচী বাড়িটা ছিল জমজমাট এখন আর মন লাগছে না একদমই।
-' এই নিন আপনার বাক্স,দেখুন সব ঠিক আছে কি না? অবশ্য আমি খুলে দেখিনি। আর এই কি সব খাবার। চাচী দিয়েছে।'
নটরাজের কথাতে শৈলপুত্রী লজ্জা পায় বলে,' আমার কি এমন সোনা সম্পত্তি আছে ওতে যে খুলে দেখলে ক্ষয়ে যাবে। তবে না খুলে ভালো হয়েছে নাহলে আপনি হাসতেন।'
-' হুঁ কলকাতা এসে ভালোই কথা বলছেন দেখছি। যাক আপনার এক্জিবিশনের ছবি দেখব বলে চলে এলাম।'
-' চলে এলি কি রে? আমি তো তোকে আনলাম নাটু। আয় দেখে যা। দেওঘর থেকে কলকাতা এসে কেমন আঁকছে।'
শৈলপুত্রীর প্রথম আঁকার কথা মনে হয় নটরাজের চেয়ারের পায়াতে হেলান দেওয়া বোর্ডে রঙ করছিল। আজ মামু একজন ভালো শিল্পীর যা থাকে সব দিয়েছেন ওকে। তখনকার ছবি ছিল প্রকৃতির বুকে প্রাকৃতিক রঙ দিয়ে এখন সেই ছবিতে পেশাদারিত্বের ছাপ। মুগ্ধ হয়ে গেল নটরাজ,' সত্যিই মামু এই তোমার ছায়াটা বোধহয় খুব দরকার ছিল ওর। ছবিগুলো যেন কথা বলছে। আর এই ছবিটা এটা তো জাস্ট.. অবশ্য আমি আগেও দেখেছি এই ছবি।'
-' আমার মায়ের ছবি এটা তখন এমনি স্কেচ করেছিলাম। এখন আবার আঁকলাম।'
-' মামা জান ওর আঁকা এই ছবিটা দেখেই প্রথম আমার পোট্রেট আকানোর কথা মনে হয়েছিল।'
-' আমার কাছে বৌঠানের ছবিটাই সেরা। ঠিক এমন সাজেই বৌঠানকে দেখেছি বিয়ের সময়। আর গয়নাগুলো দেখেছিস তো এই সবই ওদের বাড়ির গয়না যেটা এখন শিবনারায়ণের বাড়ির লোকেরা আত্মসাৎ করেছে। সবচেয়ে খারাপ লাগে শৈলজার বংশের জিনিস আর মেয়েটার শেষ সম্বল। ওর তো কিছুই নেই বলতে গেলে।'
-' কিছু নেই কেন বলছ মামু আমরা সবাই ওর সাথে আছি। তুমি আছ,মামী আছে,চাচা,চাচী আছে। সবচেয়ে বেশি কাছের ওর নিজের গুণ আর আত্মসম্মান। সেটাই জিতিয়ে দেবে ওকে দেখ।'
হঠাৎই শৈলপুত্রী বলে ওঠে,' আমি যাব সেই গয়না আনতে। কতদিন ধরে শুধু ভেবেছি,আর ভাবব না আমি যাব এবার আর সেইদিন যাব।'
সেইদিন বলতে কোন দিন বোঝেন না অপূর্ব তবুও ওঁর অবাক লাগে অনেক বুঝিয়ে যাকে রাজি করা যায়নি যাকে সে হঠাৎই একদম রাজি হল কি করে? যাক রেবা শুনলে খুশি হবে।
অপূর্ব ওর মাথায় হাত রাখেন,' তোর কাকিমা শুনলে খুব খুশি হবেন। তাহলে তো যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতিও করে রাখতে হবে পুরো দস্তুর।'
রাতে শুয়ে ক্যালেন্ডারে চোখ রাখে শৈলপুত্রী। পরশু ওদের এক্জিবিশন তারপর দুদিন বাদেই বিয়ের দিনটা। এর মধ্যে নিজেকে ঘষেমেজে আবার গড়ে নিতে হবে। কয়েকটা কাজও আছে,কাকিমা আর রুবিদিকে বলবে সব কিছু।
এমন একজন শিল্পীর ছবি যে নামীদামী চিত্রকরদের পাশে জায়গা করে নেবে তা অপূর্ব জানলেও নটরাজ সত্যিই ভাবেনি। তবে এখানে শৈলপুত্রীর ছবির প্রশংসা শুনে অবাক হল। এমন কি ওর মায়ের ওয়েল পেন্টিংটা অনেক দামে কিনতে চেয়েছেন একজন বিদেশী শৈলপুত্রী রাজি হয়নি। যদিও তার টাকার দরকার তবুও সে টাকার জন্য মাকে বেচে দিতে পারবে না। মৃত মায়ের কম বয়েসের এই ছবিটা বারবার দেখে হারিয়ে যায় ও। ছবিটা নিজের জন্যই এঁকেছিল।
দুটো ছবি এমনিতেই বিক্রী হল ভালো দামে। অবাক হয়ে গেল শৈলপুত্রী ওর নিজের আঁকা ছবি বিক্রীর টাকা!
আদিত্যদের বাড়িটা গমগম করছে সকাল থেকেই আজ আদিত্যর বৌভাত। আত্মীয়স্বজনেরা এসে পড়েছেন। বিয়েটা কোনরকম ভাবে সারা হয়েছে। কারণ ঐ পক্ষে সানন্দার মা বাবা কেউই নেই তাই যতটুকু না করলে নয় সেইভাবে হয়েছে। শুধু শুধু নিজের টাকা পয়সা বেশি খরচ করতে একদম নারাজ সানন্দা। তবে আদিত্যকে বলে দিয়েছে বিয়েটা যেমনি হোক ওদের বাড়ির বৌভাত যেন খুব ঘটা করে হয়। জেনে বুঝেই বড়লোক বাড়িতে বৌ হয়ে আসছে সুতরাং যা কিছু অপূর্ণ সাধ তা পূরণ করার দায়িত্ব আদিত্যর। মা যেহেতু বলেছিল তাই শাড়ি কাপড় কেনার দায়িত্ব নিজেই নিয়েছে সানন্দার পছন্দের শাড়ি এমন কি বৌদি দাদা মা আর বাড়ির কাজের লোক টুকটাক মাসি পিসিদেরও শাড়ি এসেছে। তবে সানন্দার জন্য একটা হীরের আঙটি আর হীরের লকেট কিনতেই মোটামুটি ঢোক গিলেছে। যে আদিত্য কোনদিন শৈলপুত্রীকে একটা বাদাম ভাজার প্যাকেটও কিনে দেয়নি অথবা তাঁতের শাড়িও সাধ করে এনে দেয়নি সে আজ দিলদরিয়া হয়ে হীরের গয়না কিনছে। অবশ্য না কিনে উপায় নেই একটু একটু করে সানন্দার ছড়ানো জালে পুরোপুরি ফেঁসে গেছিল।
-' কি রে গয়না কি কিনলি দেখা? তোকে বলেছিলাম বেশি কিছু কিনতে। আমার কাছে তেমন কিছু নেই।'
মায়ের কথা শুনে শুনে ক্লান্ত লাগে আদিত্যর একথা তো কতবার শুনেছে। এখনি হীরের গয়না দেখালেই মুশকিল। তখনই আবার অন্য কথা শুরু হবে।
দেব ইতস্ততঃ করে কিছু গয়না এনে মায়ের হাতে দেয়,' মা এতটুকু আনতে পেরেছি,বাকিটা পরে এনে দেব।'
মন মালিন্য আর দরকষাকষির মধ্যে ঠিক হয়েছিল শৈলপুত্রীর গয়না পরেই আসবে সানন্দা। প্রাক্তন স্ত্রীর গয়না তো ওরই প্রাপ্য।
আলোতে আলোতে ঝলমল করছে বাড়ি আগের দিন থেকেই। সানন্দা দুধে আলতায় পা ডুবিয়ে ঘরে এসেছে অবশ্য আশার তেমন কোন হেলদোল নেই এসব নিয়ে একটা দায়সারা ভাব এসে গেছে আজকাল। আর সানন্দা এ বাড়িতে এত বার এসেছে যে প্রথম আসার মাধুর্য টুকু আর নেই। হয়ত বা আদিত্যর কাছেও তাই। বড় বেশি চিনে ফেলেছে সানন্দার শরীর,স্বভাব,মন আর অভ্যেসগুলোকে। সুতরাং এখানে সাবধানী হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। নিজের হাতের চূড় জোড়া আর নতুন বানানো লোহা বাঁধানো দিয়ে মুখ দেখেছেন আশা। হয়ত বা হাতটাও কেঁপেছে ভেবে যে এইটুকুও গেল আর রইল বালা জোড়া। জরোয়া হারখানা র কথা খুব মনে পড়ে। সানন্দার আশাতে তখনকার মত ছাই পড়লেও সে খুশি হল দেখে যখন আশা আলমারি থেকে গয়না বের করে ওকে দেখালেন সেই চোখ জুড়ানো গয়নাগুলো। লোভে আর আর পরিতৃপ্তিতে সানন্দার চোখ দুটো জ্বলে ওঠে। সত্যিই এমন গয়না ওর পরিচিত কারও কাছেই নেই।
আশা কিছুটা হলেও মাপলেন সানন্দার চোখটা মাপেন আশা। হঠাৎই কেমন যেন একটা খারাপ লাগায় মনটা ভরে যায়......
সন্ধ্যেবেলায় সানাইয়ের সুর ছড়িয়ে পড়েছে সারা পাড়ায়। হঠাৎই বিয়েবাড়ির সামনে একটা বেশ দামী গাড়ি এসে দাঁড়ায়। অনেকেই অবাক হয় দেখেন গাড়িটা। দেব সামনে অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য ছিল ইচ্ছে অনিচ্ছা যাতেই হোক বাবার অবর্তমানে এই দায়িত্ব তাকেই মাথা পেতে নিতে হয়েছে। ওপরের বারান্দায় বন্ধুদের সাথে কথা বলছিল আদিত্য। বিয়েবাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছে ওদের বাড়ির কাছেই। ওদের পুরোনো বাড়িতেই অবশ্য আদিত্যর আগের বৌভাত হয়েছিল বাড়ির সামনে আর উঠোন জুড়ে প্যান্ডেল করে। এবার অন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কারণ এই বিয়ে আদিত্যর ইচ্ছের বিয়ে সুতরাং কোন আয়োজনের ত্রুটি রাখা হয়নি।
এত বড় গাড়ি থেকে কে নামছে? ওদের নিমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে এমন গাড়ি কার আছে ভেবে অবাক হল দুই ভাই সুতরাং এখন দেখার পালা কে নামছে? আদিত্যর বন্ধুরা ওকে খোঁচা মারে,' কে এল রে? সানন্দার কোন আত্মীয় বা বন্ধু নাকি রে?
তবে আর খুব একটা বেশি অপেক্ষা করতে হল না দেখা গেল উর্দি পরা ড্রাইভার এসে দরজা খুলে দিতেই পা দেখা যায় এবং দেখে বোঝা যায় কোন মেয়েই হবে। দামি গাড়ি থেকে নেমে পা রাখছে মেয়েটা মাটিতে হিলহিলে শরীর তাতে আদরে জড়িয়ে আছে একটা দামি মখমলে জরির শাড়ি আর হাতে সুন্দর সোনালী ব্যাগ পায়ে হিল জুতো আরেক হাতে রঙীন মোড়কে মোড়া একটা বাক্স।
আদিত্যর বন্ধুরা ওপর থেকে দেখে আওয়াজ দেয়,' কে রে? চিনিস নাকি? উফফফ কি সুন্দর ফিগার দেখেছিস দেখে তো মনে হচ্ছে যেন কোন মডেল হবে। চুলগুলো ঠিক ওভাবে বাঁধা। আদিত্যর চোখ তখন অবাক হয়ে দেখছে মেয়েটার মধ্যে কোন জড়তা নেই কি সুন্দর একদম দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে গেটের দিকে। তাড়াতাড়ি করে নীচতলায় নামতে যায় আদিত্য আলোর ঝলকানিতে ভালো করে না দেখা গেলেও কেমন যেন চেনা চেহারাটা। কিন্তু সবটাই একটা অদ্ভুত দুঃস্বপ্নের মত আঁধার আলোতে ঘেরা কিছুতেই যেন কিছু মেলাতে পারে না সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। আদিত্যর কেমন যেন লাগে সিঁড়িতে পা রেখেও থমকে যায়। পেছন থেকে বন্ধুরা হেসে ওঠে একসাথে,' আরে আমরাও তো যেতে পারতাম,একা যাচ্ছিস কেন? আলাপ করাস কিন্তু।'
আদিত্যর বুকে তখন ঝড়,কে এই মেয়ে এত বড় গাড়ি থেকে নেমে উপহার হাতে ওদের বাড়ির দিকে চলেছে? এতক্ষণে বোধহয় নীচে ফুলের সাজানো গেট পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে। আচ্ছা দাদা তো ওখানে আছে। ওকি শৈলপুত্রী? না না সেটা কি করে হবে হয়ত ও সানন্দার কোন বান্ধবী আজ এসেছে সানন্দার নিমন্ত্রণে। কিন্তু এই হাঁটা এই চুল সবই তো ওর বড় চেনা নাহ্ সত্যিই যদি ও শৈলপুত্রী হয় তাহলে ওকে কিছুতেই ঢুকতে দেওয়া হবে না। একদিন যে ডিভোর্স পেপারে সই করে সব দাবী ছেড়ে এই বাড়ি থেকে ভোরের অন্ধকারে চলে গেছিল তার এখানে কি দরকার?
আদিত্য তাড়াতাড়ি নেমে আসে নীচে হঠাৎই কানে যায় ওর কথারই প্রতিধ্বনি।
-' কে তুমি বেবি না? কোথায় ছিলে এতদিন? এখানে আজ এসেছ কেন? মানে কি দরকার?'
-' দরকার আছে বড় ভাইয়া,আমাকে যেতে হবে ভেতরে।'
দেব আর কিছু বলতে পারে না ও বুঝতে পারে অনেকদিন আগে দেখা শৈলপুত্রীর সাথে এই শৈলপুত্রীর অনেক গরমিল। আজ সে আত্মবিশ্বাসী, সুন্দরী,ব্যক্তিত্ব আর তেজ তাকে করে তুলেছে অনন্যা।
সুতরাং ওকে বাধা দেওয়ার মত কোন শক্তিই ওর নেই। শৈলপুত্রী সামনের দিকে পা বাড়ায় চাচার কাছে আগেই জেনে নিয়েছে বাড়িটার সব কিছু সুতরাং এই মুহূর্তে সামনেই এগিয়ে যাবে সে।
আদিত্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবার তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে আসে,' লছমী, চাচা ওকে আটকাও কিছুতেই যেন ভেতরে না যেতে পারে।'
ভেতরে কত লোকজন তার মাঝে গিয়ে এই মেয়েটা কি সিনক্রিয়েট করবে কে জানে?
আদিত্যর ডাকে কেউই ছুটে আসে না। হয়ত হরিহরণ আগে থেকেই বলে রেখেছিল ওদের তাই এই সময় কেউই নেই আসেপাশে। শৈলপুত্রী কিছুই তোয়াক্কা করে না এই সবের। আজকের শৈলপুত্রীর তেজ মা দুর্গার মত,নামের সাথে আজ সে নিজেই সেই নামের অর্থ বহন করার মত ক্ষমতা রাখে। অবাক হয়ে যায় আদিত্য ওকে দেখে। সেদিনের দেখা সেই ভয় পাওয়া মেয়েটা আজ যেন ভয়কে জয় করেছে। নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়েছে। ওরা দুই ভাই অবাক হয়ে যায় ওকে দেখে। কোথায় যেন শৈলপুত্রীর আজকের সৌন্দর্যের কাছে ম্রিয়মান সানন্দার মেকআপ করা চন্দন মাখা মুখখানা। এমন সুন্দর করে কে সাজালো ওকে? সত্যিই কি শৈলপুত্রী এত সুন্দর! নাকি ওকে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে? হয়ত নিজেকে যখন সুন্দর লাগে তখন আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী আর অহঙ্কারী হয়ে ওঠে নারী। কিন্তু আজ শৈলপুত্রীর হারানোর আর কিছু নেই,ভয়ও সে পায় না তার সাথে আছে সবাই সুতরাং জিতে সে আসবেই।
কদিন ধরে রেবা সমানে পড়েছিলেন মেয়েটাকে নিয়ে বারবার রাগ করে বলেছেন,' চুপ করে বসে থাক তো দেখি যা করব তাই দেখ বসে বসে। নিজেকে অযত্ন করে চুলের কি হাল করেছে? তেমন দুরাবস্থা হাত পায়ের। কোনদিন বুঝি একটুও দেখিসনি তাকিয়ে নিজের দিকে। শুধু ছবিতে রঙ ভরলেই হবে? নিজের চেহারাতেও একটু রঙ ভরতে হয়।'
-' আমার ভালো লাগে না সাজতে। তেল দিতাম তো চুলে।'
-' হ্যাঁ বুঝেছি কি দিতে চুলে। রুবি কাঁচিটা নিয়ে আয় তো। আর সুতোটাও আনবি।'
কাঁচি দেখে ছুটোছুটি করলেও শেষে কাকিমার ধমকে এবড়োখেবড়ো চুলের ডগাকে শাসন করে বাধ্য করে তাকে বেশ সুন্দর ঢঙে সাজানো হয়। ওর জোড়া ভুরুকে যত্নে সুতোর ছোঁয়া দিয়ে সাজায় রুবি দিদি। উঃ আহ্ করলেও নিজের চেহারা আয়নায় দেখে অবাক হয়েছিল শৈলপুত্রী। নিজেই লজ্জাতে মুখ ঢেকেছিল খোট্টা গাইয়া মেয়েটাকে কাকিমা আর রুবিদি মিলে একদম আধুনিকা করে ফেলেছে ততক্ষণে।
রূপলেখা থেকে বাড়িতে এনে বলেছিলেন রেবা,' ওহ্ এই দেখ তোমার বেবিকে। আমাকে আর রুবিকে জ্বালিয়ে মেরেছে সমানে। তারপর নিজেকে দেখে লজ্জায় মুখ ঢেকেছে।'
-' সত্যিই তোমার জবাব নেই রেবা। এ কাকে দেখছি আমি! মোটামুটি মডেল বললেও কেউ অবিশ্বাস করবে না।'
-' তুলি র টান শুধু ও দিতে পারে না আমিও পারি।'
নটরাজ এসে অবাক হয়ে গেছিল শৈলপুত্রীকে দেখে,' আরে আমি তো চিনতেই পারিনি ভেবেছি অন্য কেউ।'
রাঙা মুখে শৈলপুত্রী রেবাকে বলেছিল,' কাকিমা এমন করেছ যে কেউ চিনতে পারছে না।'
-' আচ্ছা বল তো নাটু দেওঘরের সেই পাগলীটা ভালো না এই শৈলপুত্রী?'
নটরাজের এবার একটু অস্বস্তি হয় তবে ওর কাছে প্রথম দেখা সেই শৈলপুত্রী অনেক বেশি ধারালো, দাপুটে আর বলিষ্ঠ। সেই শৈলপুত্রী জীর্ণ শীর্ণ এক তপস্বিনী যার মধ্যে কোন প্রলেপ ছিল না। আজকের শৈলপুত্রী আধুনিকা, তাকে মোড়ানো হয়েছে প্রলেপে,ধারালো করা হয়েছে তার টিকোলো নাককে আরও,জলছবির মত চোখে পরানো হয়েছে সৌন্দর্যের কাজল। রুক্ষ ঠোঁটে রঙ বুলিয়ে তা আঁকা হয়েছে আরও পুরুষ্ঠু করে কিন্তু শৈলপুত্রীর এই নবরূপের দিকে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকার মত মানসিক দৃঢ়তা নটরাজের নেই। হয়ত বা কোথাও নড়ে যাবে তার চরিত্রের দৃঢ়তা। শৈলপুত্রীর ঐ কাজলকালো চোখের গভীর দীঘিতে ডুব দিতে ইচ্ছে করবে এলোমেলো মনটার। সুতরাং নিজেকে সামলে বলে,' আমি কি এত বুঝি নাকি? আমার কাছে শৈলপুত্রী মানেই এক দাপুটে মেয়ে, গ্ৰামের বাচ্চাদের দিদি আর রঙ তুলি নিয়ে খেলা করা একটা রুক্ষ হাত।'
-' এই তো ভালো বুঝিস নাটু ঠিক আমার মতই। আমি তো তোর মামীকে বলেছিলাম ও যখন চায় না এত সাজগোজের দরকার নেই। তা ঐ রুবিটা আর তোর মামী শুনলে তো।'
-' না বাইরের চটকেও নারী অনন্যা হয় কখনও আর সেটাই দরকার এখন। শৈলপুত্রীকে দুর্গা হতে হবে এখন। আমি কিছু ছবিও তুলে রেখেছি ওর ক্যামেরাম্যানকে দিয়ে। রূপলেখাতে রেখে দেব।'
সেদিন শুরু হয়েছিল ওর গ্ৰুমিং,কদিন রুবিদি আর কাকীমা সমানে শিখিয়েছে কেমন করে হাঁটবে কিভাবে কথা বলবে,কেমন করে হাসবে। যাক ওদের ট্রেনিং শেষে শৈলপুত্রী পুরোপুরি তৈরী। মাস দুয়েক আগের দেওঘর থেকে আসা মেয়েটাকে সত্যিই আজকের সাথে মেলানো যায়নি। পুলিশ বলেছিল আপনি আগে যান আমি স্যারের সাথে গাড়িতে অপেক্ষা করছি একটু পরে যাচ্ছি। একদম ভয় পাবেন না এগিয়ে যান,দেখুন ওরা কি বলে। তবে আপনার জিনিস আপনি পাবেন মানে আমরা পুরোপুরি চেষ্টা করব।
শৈলপুত্রী আজ ঝঞ্ঝার মত আদিত্যর পাহারাদারেরা তার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারল না। পেছন ফিরে অভিভূতের ওকে দেখে দেব এই কি সেই বেবি যাকে উঠতে বসতে কথার চাপে পিষে মারত মা আর মধু যার গায়ে হাত দিয়েছে আদিত্যও। সে আজ আবার ঘুরে এসেছে না জানি আজ কি ঘটনা ঘটবে।
আদিত্যর বন্ধুরা নেমে এসেছে নীচে এমন সুন্দরী তন্বী ধনী মহিলাকে একবার দেখার জন্য। বিয়ে বাড়িতে এমন সুন্দরী কেউ নেই যদি একবার আলাপ করা যেত। মালতীর মায়ের সাথে সিঁড়িতে ওঠার পথেই দেখা হয়ে যায় শৈলপুত্রীর। সেও জানে আজ নতুন বৌ আসবে। শৈলপুত্রীর ইশারায় সে সরে যায় অন্যদিকে। আদিত্য ধুতি সামলে ওর পেছনে পেছনে উঠে আসে বলতে বলতে,' থাম তুমি,কিছুতেই এভাবে বিনা আমন্ত্রণে আসতে পার না এই বাড়িতে।'
শৈলপুত্রীর সেই কথাতে কিছুই এসে যায় না। ও থো আর এখানে নেমন্তন্ন খেতে আসে না। শৈলপুত্রী এখন আর মাথা নীচু করে হাঁটে না মাথায় ঘোমটা দিয়ে। সাহসী দৃপ্ত পদক্ষেপে চলে এসেছে ততক্ষণে ফুল দিয়ে সাজানো আলো ঝলমলে হল ঘরে। যেখানে সুখের ফুলের দোলনায় দোল খেতে খেতে গা ভরা গয়না পরে সানন্দা ফুলের সাজে সেজে বসে আছে বান্ধবীদের সাথে,মধুও আছে সঙ্গে। উপহার যা পাচ্ছে তা মধু নিয়ে আলমারিতে তুলে রাখছে। আশাও বসে আছেন আত্মীয়দের সঙ্গে সেখানেই একপাশে। যেদিন শৈলপুত্রীর বৌভাত ছিল সেদিন একটা গাইয়া মেয়েকে শিবনারায়ণ তাঁর আদরের ছোটছেলের বৌ করে হঠাৎই এনে হাজির করল বলে মনে একটুও সুখ ছিল না আশার রাগে জ্বালা করছিল সর্বাঙ্গ।
আজও কেন যেন আশার মনে সেই সুখের ছোঁয়া নেই হয়ত সেই মানুষটাই তো নেই যাকে দেখিয়ে বলবেন তোমার বিশ্বাসী বন্ধুর মেয়ে তো চলে গেছে সেই কবেই ছেলেটা আর কতদিন বসে থাকবে।তাই বিয়েটা দিতেই হল। তারপর মনে হল সত্যিই কি চলে গেছে না চলে যেতে বাধ্য হয়েছে? একটুও ছিটেফোঁটা ভালোবাসা কোনদিনই তো দেননি তাকে এমন কি স্বামীর মৃত্যুর জন্য ওকেই দায়ী করেছিলেন।
হঠাৎই একটা গুঞ্জন শুনে সবাই দরজার দিকে তাকালো আদিত্য ততক্ষণে একদম শৈলপুত্রীর কাছে চলে এসেছে। সেদিকে না তাকিয়ে এগিয়ে যায় যেখানে কনে বসে আছে সেদিকে। আদিত্য হঠাৎই দিকবিদিক শূন্য হয়ে শৈলপুত্রীর হাতটা ধরে ফেলে। সানন্দা অবাক হয়ে যায় দেখে মেয়েটা কে প্রথমে বুঝতে পারে না তবে বুঝতে পারে খুব তাড়াতাড়ি যখন এক ঝটকায় আদিত্যর হাতটা ছাড়িয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়।
সানন্দার মুখে একটা কুটিল হাসি ফুটে ওঠে ওহ্ পুরোনো বরের বিয়ে দেখতে এসেছে সেজেগুজে। পাশ থেকে বন্ধুরা কানাকানি করে,' কে রে মেয়েটা? আদিত্যর হাত ছাড়িয়ে চলে এল। খুব সুন্দর দেখতে কিন্তু। দেখে তো মনে হচ্ছে বড়লোকের মেয়ে।'
ওদের কৌতূহল দেখে অবাক হয় সানন্দা,ভীষণ বিরক্ত লাগে একটু আগেই ওর রূপের প্রশংসা করছিল এখনি সুর পাল্টালো কিন্তু সত্যিই তো মেয়েটা একদম বদলে গেছে তাহলে কি কোন বড়লোকের ছেলের সাথে?.....
সানন্দার মনে হিংসের আগুন জ্বলে দাউদাউ করে। শৈলপুত্রী স্থির চোখে দেখছে সানন্দাকে একটা একটা করে প্রথম দিন থেকে পাওয়া ওর দুর্ব্যবহার গুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। এই মেয়েটার জন্যই ও কোনদিন আদিত্যকে কাছে পায়নি। আদিত্য বিবাহিত জেনেও শৈলপুত্রীকে হারিয়ে ওকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল মেয়েটা।
অবাক হয়েছেন আশা,এ কে? হ্যাঁ বড় চেনা কিন্তু এখানে কেন? ভয়ে বুকটা কাঁপে হঠাৎই বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন নিমন্ত্রিত লোকজন এর মধ্যে কোন ঝামেলা হবে না তো?
মধু এসে আশার পাশে দাঁড়ায় চাপা স্বরে বলে,' মা চিনতে পারছেন? একদম অন্যরকম হয়ে গেছে দেখেছেন? কে বলবে এই সেই মেয়ে। এতো ভোল...'
-' বৌমা চুপ কর,কিন্তু আজকের দিনে কেন এসেছে এখানে?'
কেউ কিছু বলার আগে আদিত্য বলে,' কেন এসেছ এখানে? চলে যাও। নিজেকে সামলাতে পারে না আদিত্য।
হঠাৎই একটা হাসিতে চমকে ওঠে সবাই। শৈলপুত্রী হাসছে কিন্তু জ্বলছে ওর চোখ দুটো সানন্দার দিকে তাকিয়ে। ওর বাবার যত্নে আগলে রাখা সব গয়না পরে ঐ মেয়েটা বসে আছে। ছিঃ লজ্জাও করে না এদের! যারা দিনরাত ওকে ভিখারির মেয়ে বলে অপমান করেছে আজ সেই ভিখারির মেয়ের গয়নাতে ওদের কি প্রয়োজন?
-' আরে এত ভয় কিসের? বিয়েবাড়ির সাজ দেখতে এলাম। নতুন বৌকে কেমন দেখতে লাগছে তা দেখতে এলাম।'
সানন্দা বলে,' ওহ্ এইসব দেখতে বিনা নিমন্ত্রণে চলে এলে? সত্যিই তোমার স্বভাব যাবে না। কখনও হঠাৎই কারো কাঁধে চেপে বসেছ আবার আজই চলে এলে...'
আসেপাশের লোকজন অবাক হয়ে দেখছে লজ্জায় মাথা কাটা যায় আশার দেবকে বলেন,' একটু সামলা,তোর কথা তো শুনত।'
-' হাঁ চলে এলাম দেখতে আর গিফ্ট দিতে। তোমার একটা কামের জিনিস আমার কাছে থেকে গেছে। এখন এটা লাগবে তোমার বরের মন ভোলাতে। নাও ব্যবহার কোরো। আর হ্যাঁ সব দামী জিনিস আছে। তোমার মত সস্তার জিনিস নয়। মিশ্রাবাড়ির মেয়েরা কখনও ছোট জিনিস মানুষকে দেয় না।'
সানন্দার হাতে রঙীন কাগজে মোড়া উপহার ধরিয়ে দেয় শৈলপুত্রী।
সানন্দা বলে,' কি আছে এতে?'
-' আরে বাদ মে খোলকে দেখ না। আর হাঁ এবার এই ভিখারির মেয়ের গয়নাগুলো খোল দেখি। হা সব খোলনা জলদি জলদি। আমার আর এখানে থাকার ইচ্ছা নাই ইশ্ যারা ভিখারির ভী গয়না চুরি করে সেখানে থেকে কি করব? খোল তাড়াতাড়ি হামার সব গয়না। ও মুকুট,আমলেট,মানতাসা,হার,বালা,দুল সব কুছ।'
ঘরের মধ্যে এর থেকে ভূমিকম্প হলেও বোধহয় ভালো ছিল। ততক্ষণে সবাই হাসাহাসি করছে গোপনে। আদিত্য আর সানন্দার বন্ধুরা একদম চুপ করে গেছে।
বাড়ির সম্মানটুকু বাঁচাতে ছুটে আসে দেব।
-' বেবি তুমি চলে যাও আজ। আমাদের সম্মান এভাবে মাটিতে মিশিয়ো না। আজ অনুষ্ঠান হয়ে যাক। তারপর কথা বলব। এখন যাও।'
বড়াভাইয়ার কথা শুনে দুর্বল হয় মন শৈলপুত্রীর কি করবে ও? পরক্ষণেই নিজেকে শক্ত করে। নাহ্ অপমানের বদলা ও নেবেই। যদি ওর গয়না ওরা এভাবে সানন্দাকে না পরাত তাহলে হয়ত ও আসত না। কিন্তু আজ গয়নাগুলো নিয়েই যাবে খুলে ওর গা থেকে। এই মেয়েটা ওর বরকে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল।
-' বড়া ভাইয়া ওকে বলুন আমার গয়না খুলে দিতে। নাহলে আমি নিজেই খুলে নেব সব।'
সানন্দা বলে,' আদিত্য তুমি চুপ কেন? ওর এত সাহস আমার গায়ে হাত দেবে? দেখি হাত দাও গায়ে। তারপর কি করি।'
শৈলপুত্রী তখন মরিয়া ও ভেবে পায় না কি করবে..
**********************
নটরাজ গাড়িতে বসে অধৈর্য্য হয়ে ওঠে,ধৈর্য্য হারান অপূর্ব ও সত্যিই তো এতক্ষণ কি করছে মেয়েটা? অথচ বলল একাই সব সামলে নিয়ে আসবে। অনেক সময় পার হয়ে গেল কোন বিপদে পড়েনি তো ও?
-' শুনুন মিঃ সেন আর দেরি করা যায় না এবার আমার মনে হয় আপনার যাওয়া উচিত ওখানে। কি বল মামু? ওরা অনেকে শৈলপুত্রী একা যদি ওরা ওর কোন ক্ষতি করে?'
অপূর্ব বলেন,' হ্যাঁ ঠিক বলেছিস,এবার আমাদের যাওয়া উচিত ভেতরে। আমি যাব আপনার সাথে।'
আজ মামাকে কেমন যেন বেপোরোয়া লাগে নটরাজের মায়ের কাছে বড় হবার পর শুনেছে পুরোনো কথা। কেন মামুর বন্ধুত্ব ভেঙেছিল শিবনারায়ণের সাথে। অথচ এত বছর বাদে মামা যাবে সেখানে? না না সেটা ঠিক হবে না। তাই বলে,' যে বাড়িতে তুমি কোনদিনই যাওনি সেখানে যাওয়া তোমার ঠিক হবে না। আমি যাচ্ছি ওনাদের সাথে নিয়ে।'
-' আপনাদের কারোরই যাওয়ার দরকার নেই আমার মনে হয়। তাতে অনেক কথা হবে তাছাড়া আমার কাছে তো অভিযোগ দায়েরের কাগজপত্র সবই আছে সুতরাং কোন সমস্যা নেই। আমি দরকারে হাতে হাতকড়া পরাতেও পারি।'
অপূর্বর সহৃদয় মনটা কেঁপে ওঠে একসময় শিবনারায়ণ তাঁর পরম বন্ধু ছিলেন তাই তাঁর পরিবারের কোন ক্ষতি হোক এটা কাম্য নয় তাই বললেন,' নাহ্ প্রথমে কথায় বলবেন তারপর কাজ না হলে দেখা যাবে।'
মিঃ সেন সাথে দুজন মহিলা পুলিশ নিয়ে এগিয়ে যান ওদের অপেক্ষা করতে বলে।
ততক্ষণে সানন্দার মরিয়া ভাব দেখে আদিত্য এগিয়ে আসে সত্যিই আজ ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে। যাকে একদিন অবজ্ঞা করেছিল সে আজ শোধ নিতে এসেছে রানীর বেশে ওর রূপ আর ঐশ্বর্য্যর কাছে সানন্দা যেন বড়ই ম্রিয়মাণ।
শৈলপুত্রী বলে,' হাঁ ও উপহার যা দিয়েছিলে তুমি আমাকে সেগুলো ফেরত দিলাম। তবে মেকআপের জিনিস গুলো সব বিদেশী দামী,তোমার মত ওসব ফালতু জিনিস আমি মাখি না। আশাকরি ও দিয়ে আমার ব্যবহার করা পুরানা বরের আর পুরানা ঘরের লোকদের ভুলাতে পারবে।'
শৈলপুত্রীর কথাগুলো শুনে ছ্যাঁকা লাগে সানন্দার ও যেন ওর মায়ের মত কথা বলছে। পুরোনো বর,পুরোনো ঘর। আদিত্য ওর ব্যবহার করা বর! ওহ্ কি বলছে মেয়েটা।
আদিত্য থ হয়ে যায় শুনে আজ যেন গরম লাভার মত অগ্নুৎপাত হচ্ছে শৈলপুত্রীর মুখ দিয়ে।
মধু এসে পড়ে ওদের মধ্যে,' এত কথা তোমার আসে কোথা থেকে শুনি? এ গয়না তোমার তার প্রমাণ কি আছে শুনি। তুমি তো একদম এক কাপড়ে এসেছিলে এই বাড়িতে। কিছুই তো ছিল না। ছিল শুধু একটা টিনের বাক্স যেটা তুমি সাথে নিয়ে গেছ। প্রমাণ দাও যে এই গয়না তোমার।'
বিয়েবাড়িতে তখন যা হবার হয়ে গেছে লজ্জায় আশার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হল। কোন কুক্ষণে অন্যের গয়না বের করে দিয়েছিলেন সানন্দাকে পরাতে। এই সব হয়েছে ঐ বড় বৌমার জন্য। দেব গয়নাগুলো ফেরত দিল না তাই তো বাধ্য হয়ে আদিত্য আর মধুর পরামর্শে। হায় ভগবান কি লজ্জা!
মধুর কথাতে দিশাহারা লাগে শৈলপুত্রীর বুঝতে পারে শুধু ওর তেজ আর কথা দিয়ে গয়না নিয়ে যেতে পারবে না এরা ওকেই চোর সাজাতে চায়। কিন্তু এই গয়না যে ওর তা তো সবাই জানে। আর বাবাও তো নেই যে ওর পাশে দাঁড়াবে। কোথায় পাবে প্রমাণ?
হঠাৎই চারদিকে গুঞ্জন শুরু হওয়ায় পেছনে তাকায় শৈলপুত্রী ওহ্ যাক পুলিশ পাঠিয়েছে আঙ্কেল।
ইনস্পেক্টর সেন দেবকে ডাকেন বলেন,' অভিযোগ আছে যে বিয়ের একবছরের মধ্যে ডিভোর্স হওয়া সত্ত্বেও মেয়েটি কোন কিছুই ফেরত পায়নি। অনেক গয়না আর টাকা আছে তার এই বাড়িতে। সেগুলো ফেরত না দিলে আদিত্য বাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে সাথে আপনাদেরও তোলা হবে গাড়িতে।'
দেব ব্যবসা সামলালেও স্বভাবে ভীতু তাই আদিত্যকে কথা বলতে হয়, শুনুন ইন্সপেক্টর শুধু মুখে বললেই হবে না। ওর জিনিস আর টাকার প্রমাণ দিয়ে নিয়ে যাবে।'
সানন্দার ফুলের দোলনা এখন কাঁটার বিছানা বলে মনে হচ্ছে সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,' স্যার যদি ও প্রমাণ না দিতে পারে তাহলে আমরা ওর বিরুদ্ধে চুরি আর মানহানির মামলা করব। কার সাথে লড়তে এসেছে ও জানে না।'
হতাশ লাগে শৈলপুত্রীর ও কি করে প্রমাণ করবে এই গয়নাগুলো ওর। ততক্ষণে পুলিশও ওকে জিজ্ঞেস করছে,'আচ্ছা আপনার কাছে কি গয়নাগুলোর মেমো আছে? তাহলে দিন প্রমাণ ছাড়া এগোনো যাচ্ছে না।'
-' ওগুলো তো অনেক আগের গয়না,আমাদের বংশের গয়না। মাকে দিয়েছিলেন ঠাকুরদা। আমি মেমো কোথায় পাব?'
মধু আর আদিত্যর মুখে একটা জয়ের হাসি ফুটে ওঠে। হাসে সানন্দাও এবার বোঝো কোথায় এসেছ জিনিস নিতে। তোমাকে জেলে পাঠাবো আমরা।
******************
অনেকটা কান্না গলার কাছে এসে আটকে যায় শৈলপুত্রীর ততক্ষণে মালতীর মাও এসে দাঁড়িয়েছে ওখানে একপাশে। মনটা আকুলি বিকুলি করছে রাগে আর যন্ত্রণায় বড় ছেলেটাও চুপ করে আছে, বৌদি বা কি ভালো করেই তো জানে এই গয়না নতুন বৌয়ের। এত অধম্ম কেন করছেন এই বয়েসে? এমনিতেই তো কত ক্ষতি হচ্ছে সংসারের এরপর তো মিছে কথা বলার দায়ে তো মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে। মালতীর মায়ের ইচ্ছে হল সবার মাঝে গিয়ে চিৎকার করে বলতে,' আমি সাক্ষী আছি গো এইসব গয়না ওর। ও মারধোর খেয়ে চলে গেছিল ওরা তাড়িয়ে দেবে সেইজন্য। গয়না তো তখন লকারে কি করে নিয়ে যাবে? এই গয়না ওর আমি দেখেছি নিজের চোখে।'
মেয়েটাকে দেখে বড় কষ্ট লাগে তবুও ওকে আর চাচাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছে বারবার কোন কিছুতেই যেন না থাকে ওরা। কেউ যেন জানতে না পারে ওদের সাথে শৈলপুত্রীর সম্পর্ক ছিল তাহলে আরও সর্বনাশ হবে।
শৈলপুত্রী বাবাকে স্মরণ করে মনে মনে কি করবে ও? সত্যিই এখন বড় ভয় হচ্ছে ওর এমন তো ভাবেনি যে ক্যাশমেমো লাগবে। উপায় না দেখে ওর দেবের কাছে যায় এই বাড়িতে শ্বশুর মারা যাবার পর এই মানুষটা দুএকবার ওর পক্ষে কথা বলেছে। ' বড়া ভাইয়া আপনার তো মালুম আছে এই গয়না আমার। অন্য কিছু হলে আমি ফেরত চাইতাম না। চাইনি তো কিছুই,আমার কাটিহারের মকান বিক্রীর টাকা ভী ছিল কিছু তা তো আমি চাইনি। কিন্তু এ আমার মায়ের নিশানি আছে। আমাদের রাজবাড়ির গয়না। এই গয়না আপনারা অন্য কাউকে কিছুতেই দিতে পারেন না। আমার বাবা খুব কষ্টে আগলে রেখেছিলেন এই গয়না। নষ্ট করেননি এত অভাবেও। আপনি বলুন এই গয়না আমার।'
অপরাধের বোঝা দেবের মাথায় চেপে বসে তার ভালোমানুষীর সুযোগ সবাই আর কতদিন নেবে? মধু বজ্রদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এগিয়ে এসে শৈলপুত্রীকে বলে,' তোমার তো সাহস কম নয় আমার হাজব্যান্ড ভালো বলে তাকে দিয়ে নিজের পক্ষে কথা বলাবে? আদিত্য তো ঠিক বলেছে প্রমাণ দিয়ে নিয়ে যাও গয়না।'
নিরুপায় শৈলপুত্রী আশার কাছে দাঁড়ায় বড় খারাপ লাগে এই মানুষটাকে অনুরোধ করতে তার প্রথম দিন থেকেই কুটিলতার বীজ পুঁতেছিলেন ছেলের মনের মধ্যে। বিষাক্ত করে তুলেছিলেন ছেলের মন দরজা খুলে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন সানন্দাকে একটু একটু করে অন্দরে ঢুকতে। তবুও শৈলপুত্রী আজ দিশেহারা হয়ে বলে,' আপনি তো বৌভাতের দিন ঐ গয়না নিজে বাবার হাত থেকে নিয়েছিলেন,জানেন এই গয়না আমার। আপনি কি করে এই গয়না মানে মিশ্রা পরিবারের গয়না দিচ্ছেন অন্য কাউকে। ছিঃ আমার ব্যবহার করা স্বামীর সাথে ব্যবহার করা গয়নাও গায়ে চড়িয়ে সেজে বসেছে। আপনি কথা বলুন এবার নাহলে পাপ কাউকে ছাড়বে না আমি বলছি।'
আশার দমবন্ধ হয়ে আসে,কি অন্যায় তিনি করেছেন শিবনারায়ণ কোনদিন তাঁকে ক্ষমা করবেন নি বলবেন হয়ত আশা তুমি এমন ছি ছি। তুমি তো অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রর মতই অপত্যস্নেহে অন্ধ হয়ে মেয়েটার হেনস্থা দেখছ! ওর অভিশাপ যে তোমাকেও ছাড়বে না।
শৈলপুত্রীর সাজানো চুল এলোমেলো, শাড়ির ভাজ অবিন্যস্ত হয়ে গেছে লড়াই করতে। আদিত্য ইন্সপেক্টর কে বলে ওকে এখান থেকে নিয়ে যেত ও হিংসাতে পাগল হয়ে গেছে। প্রথম ওকে দেখেই এটা বোঝা উচিত ছিল,তখনই ঘাড় ধাক্বা দিয়ে বের করে দেওয়া উচিত ছিল।
-' আপনি এভাবে একজন মহিলার সম্পর্কে কথা বলতে পারেন না। উনি পাগল তার কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে? বরং উনার পক্ষে কেউ কথা বললে গয়না শুদ্ধ আমি আপনাদের নিয়ে যেতে পারি।'।ইনস্পেক্টর বলেন।
দেব এসে হাত জোড় করে,' স্যার আপনারা এখন যান,পরে এসে আমরা থানায় কথা বলব। এমনিতেই অনেকটা অপমানিত হয়েছি আমরা। অনুষ্ঠানটা প্লিজ হতে দিন।'
শৈলপুত্রীর চোখ ছাপিয়ে জল আসে,কেউ কি সত্যিটা বলবে না। আর মালতীর মা বা চাচাকে তো ও চুপ করে থাকতে বলেছে। তাছাড়া ওদের কথা কে বা বিশ্বাস করবে?
-' আপনি বরং চলুন কিছু প্রমাণ থাকলে পরে আনবেন আমরা ব্যবস্থা নেব। আর ডিভোর্স তো আপনি স্বেচ্ছায় দিয়েছেন তখনও কিছু দাবী করেননি।'
-' ইন্সপেক্টর এক মিনিট...'
হঠাৎই পেছন থেকে একটা ভারী গলার আওয়াজে শৈলপুত্রী ছুটে যায়,' আঙ্কেল,ওরা সব ঝুট বলছে। বলছে প্রমাণ দিতে। ও ফটো দেখাও আমার মায়ের ওতে তো সব গহনা আছে।'
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর তবুও অপূর্বকে চিনতে অসুবিধা হয় না আশার তেমনি কালো গায়ের রঙ আর পেটানো চেহারা শুধু মাথার চুলগুলো এখন সাদা। তবে সেই শীর্ণ চেহারার অপূর্ব এখন ব্যক্তিত্ব আর আভিজাত্যের আলোতে উজ্জ্বল। একটা সময় সবচেয়ে বেশি দুষ্টু আর ডানপিটে ছিল অপূর্ব।
দেব আশ্চর্য হয় অপূর্ব সান্যালকে এখানে দেখে। ওহ্ তাহলে শৈলপুত্রীকে খুঁজে পেয়েছেন অপূর্ব কাকু। কিন্তু কি ভাবে? আচ্ছা তাই এত বড় দামী গাড়ি নিয়ে এসেছে মেয়েটা।
-' চিন্তা করছিস কেন মা আমার কাছে আছে প্রমাণ। তুইও তো জানিস তবে মনে হয় ভুলে গেছিস এত মিথ্যের চাপে। তবে ধর্মের কল বোধহয় বাতাসে নড়ে তবে সেই বাতাসটা যখন বইতে দেরি করে তখন ঝড় তুলতে হয়। আজ আমি তুলব সেই ঝড়।'
অপূর্বর কথা শুনে আশার বুক কাঁপতে থাকে মনে পড়ে যায় কত বছর আগের একটা কথা,' আশা তোকে দেখলে আমার বুকে ঝড় ওঠে। কি সুন্দর তুই দেখতে!'
আজ এত বছর বাদে কি ঝড় তুলবে অপূর্ব? ওর চরিত্রের কোন অতীতের কথা উঠে আসবে না তো? না না কেন আদিত্য এত বাড়াবাড়ি করল? সব শুনে জেনে সত্যি কথাটা বলা উচিত ছিল তাঁরই। বলে দিলেই হত,' আমরা জানতাম না তুমি কোনদিন ফিরবে। নিজের ইচ্ছেতেই চলে গেছিলে একদিন। জানতেই পারিনি বেঁচে আছ কিনা? ঠিক আছে একটা ভুল হয়ে গেছে তোমার গয়না নিয়ে চিরতরে চলে যাও। আর কখনও এস না।' কিন্তু নাহ্ বলতে পারেননি সে কথা হার স্বীকার করার ভয়ে।
-' ইনস্পেক্টর সেনকে একপাশে ডাকেন অপূর্ব সবার চোখ তখন অপূর্বর দিকে। কি এমন প্রমাণ আছে তাঁর কাছে যে এই গয়না শৈলপুত্রীর।'
সাথে মহিলা পুলিশদের নিয়ে এগিয়ে যান ইনস্পেক্টর সেন সানন্দার দিকে। শৈলপুত্রীকে ও ডাকেন এদিকে আসতে। তারপর সানন্দাকে বলেন,' আচ্ছা আপনারা তো বলছেন এই গয়নাগুলো আপনাদের তো ঐ ব্যাপারটা একই হল গয়নার ক্যাশমেমো দেখান। কারণ নিশ্চয় বিয়ে উপলক্ষেই কেনা হয়েছে গয়নাগুলো।'
সানন্দার মুখে জোঁকের মত নুন পড়ে একদম চুপসে যায়। মিঃ সেন তখন জেরা করছেন,' হ্যাঁ দেখান মেমো,আমরা অপেক্ষা করছি।'
সানন্দা নিজেকে বাঁচাতে এবার মরিয়া হয়ে ওঠে,' এগুলো আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে দিয়েছে। আমি সাথে করে আনিনি। এইগুলো আমার বাপের বাড়ির। আমার মা বাবা কেউ নেই কে আর দেবে সাজিয়ে গুছিয়ে।'
সানন্দার নরম স্বরে একটুও ভেজেন না মিঃ সেন। তিনি আদিত্যকে বলেন,' ওহ্ তাই বুঝি,তাহলে তো কোন সমস্যাই নয়। আপনাদের বাড়ি তো এই পাড়াতেই। তাড়াতাড়ি গিয়ে মেমো আনুন কারণ আমি ওটা দেখেই সিদ্ধান্ত নেব। আসলে কেসটা অনেক ওপর মহল থেকে এসেছে সুতরাং আমারও অনেক দায়িত্ব।'
আদিত্য এবার ঢোক গেলে পরিস্থিতি সামাল দিতে দেব তাড়াতাড়ি করে গরম কফি আর কবিরাজি কাটলেট এনে ওদের নিতে বলে,' কাকু আজ ভাইয়ের বৌভাত। এই টুকু নিতেই হবে। স্যার আপনি একটু নিন। আগে খেয়ে নিন পরে কথা হবে।'
কবিরাজি সামনে দেখেও নিজেকে সামলান অপূর্ব। উত্তর কলকাতার কবিরাজি সত্যিই খাসা। কিন্তু খেতে তিনি এখানে আসেননি। তারপর এই বাড়িতে খাওয়ার কোন প্রশ্নই নেই। আশার বাড়ি এটা যেখানে মেয়েটাকে ওরা অযথা মিথ্যে বদনাম দিয়ে হেনস্থা করছে। তাই ওঁরা অবহেলার সাথে খাবার দূরে সরিয়ে রাখলেন।
-' না এসব নিয়ে যান। দেখছেন তো আমরা এখানে কাজ করতে এসেছি।' ধমকের সুরে বলেন ইন্সপেক্টর সেন।
আদিত্যকে এবার চাপ দেওয়া হয় আবার বলা হয় দেবকেও বাড়ি গিয়ে ক্যাসমেমো আনতে তখনি নাহলে পুলিশ এবার বাড়িতে যাবে। হঠাৎই সুর পাল্টায় আদিত্য,' আসলে এই গয়নার ক্যাসমেমো বোধহয় দেওয়া যাবে না। কারণ এই গয়না তো অনেক পুরোনো আমার মায়ের। তাই বোধহয় মায়ের কাছেও এই গয়নার ক্যাসমেমো নেই।'
আশার হঠাৎই মাথা ঘুরে ওঠে এমনিতেই শরীরটা খারাপ লাগছিল। আদিত্যর হঠাৎ কি হল কেন ওঁর দিকে এই তীরটা কেন ছুঁড়লো? এখন কি করে সামলাবেন তিনি? তারপর এতদিন বাদে অপূর্ব এসেছে এখানে। এতবছর যাঁর সামনাসামনি হননি।
-' আপনার মাকে ডাকুন,তাঁর সাথেই তাহলে কথা বলতে হবে।'
হাল্কা শীতেও আশা ঘামতে থাকেন দরদর করে। কি করবেন এখন? এক মিথ্যে বলতে মিথ্যের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে সে খেয়াল নেই ছেলেদের। এত লোভ আর জেদ কেন ওদের?
ততক্ষণে সবাই তাকিয়েছে আশার দিকে। হঠাৎই আশার অবস্থা দেখে কেমন যেন করুণা হল অপূর্বর। এ কি চেহারা হয়েছে আশার! যে রূপ তাঁর বুকে একসময় ঝড় তুলেছিল সেই আশা আজ জরাজীর্ণ। হয়ত রেবা অনেক বেশি ব্যক্তিত্বময়ী আর সুন্দরী আশার পাশে। ব্যক্তিত্বের ছটা আর ভালো মন মানুষকে অনেকদিন সুন্দর করে রাখে। কুটিলতার ছায়া একটা সময় ঠিক পড়ে চোখে মুখে। আজ সেকথা বড় মনে হল অপূর্বর। আশা অপূর্বর দিকে তাকাতে পারছেন না লজ্জায়,নিজেকে মিথ্যেবাদী বলে এবার ভয় হচ্ছে।
-' আঙ্কেলজী ওঁকে ছেড়ে দিন। চলুন আমার গহনার দরকার নেই।'
ততক্ষণে মিঃ সেন বলেন,' এই গয়না যে আপনার তার কোন প্রমাণ আপনি না দিতে পারলে আমরা নিয়ে যাব সাথে করে গয়না তারপর প্রমাণ দিয়ে নিয়ে যাবেন।'
-' এক মিনিট ইন্সপেক্টর জী আমার মনে পড়েছে সব কুছ বাবা মনে করিয়ে দিল হঠাৎ। আঙ্কেল জী আমার কাছে প্রমাণ আছে যে এই গয়না মিশ্রাবাড়ির। আর মিশ্রাবাড়ির মেয়ে কখনও লোভে ঝুট বলে না।'
অপূর্বর সাথে নটরাজও ওপরে উঠে এসেছিল হরিহরণের কাছে খবর পেয়ে কিন্তু শুধুই দেখেছে সবটা। কোন কথা বলেনি,শুধু মনে মনে চেয়েছে জিতে যাক শৈলপুত্রী কারণ মামুকে ও বলেছিল তুমি বলবে উল্টে ওদের প্রমাণ দিতে যে এই গয়না ওদের। সবই তো ঠিক এগোচ্ছে আদিত্যর মাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে এখনই উনি সত্যি বলে ফেলবেন। তবে শৈলপুত্রী এটা কি বলছে? অবাক হয়ে যায় ওর কথা শুনে। কি প্রমাণ দেবে ও এখন?
অপূর্ব শৈলপুত্রীকে ইশারা করেন তারপর কাছে গিয়ে শোনেন কি বলতে চায় ও। নারীকে অসম্মানিত করতে তাঁরও ভালো লাগে না আশা এক কালে লাবণ্যর প্রিয় বান্ধবীও ছিল। থাক যদি শৈলপুত্রীর জন্য ওকে না...
সানন্দার খুব রাগ হয় আদিত্যর আর ওদের সবার ওপর বেশ শাস্তি হচ্ছে ওর মায়ের। নিজেদের গয়না সব সরিয়ে অন্যদের গয়না পরিয়েছে ওকে এবার বুঝুক। সবাই অপমান করলে ও নিজেও ছাড়বে না ছিঃ সবাই আজ দেখল ওর অপমান। ততক্ষণে পুলিশ মহিলা কনস্টেবল নিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এবং মিস্টার সেন আদেশের সুরে বলেন,' ম্যাডাম,আপনার গয়নাগুলো খুলুন এবার আমাদের কাজ আছে। যদি অসুবিধা হয় বলবেন আমাদের মহিলারা অফিসার আপনাকে সাহায্য করতে পারে।'
রাগে ফেটে পড়ে সানন্দা,' কেন খুলব বলতে পারেন গয়না? আর সব গয়না খুলব কেন শুনি? অনেক গয়না আমার বাপের বাড়ির।'
-' অনেক সময় নষ্ট করেছেন,আর করবেন না প্লিজ। এবার তাহলে জোর করে খুলে নেওয়া হবে।'
সানন্দার চোখ ভর্তি জল,রাগে সারা শরীর জ্বলছে। একটা একটা গয়না খুলে দিতে দিতে নিরাভরণ ও। কেমন যেন কুৎসিত লাগছে ওকে দেখতে। বাইরের সাজ আর সাজানো মুখোশ সবই খুলে এসেছে। শৈলপুত্রীর অদ্ভুত একটা শান্তি হয় যা সে বলে বোঝাতে পারবে না। কত আশা করে বাবা ওর বিয়ে দিয়েছিলেন ও ভালো থাকবে বলে। অথচ একটা দিনও ওরা ওকে ভালো রাখেনি। নিজের মত ভালো থাকতে চাইলেও থাকতে দেয়নি। খাঁচায় আটকানো ময়না ভেবে খুঁচিয়ে মেরেছে।
সবাই তখন ভিড় করেছে দেখতে ব্যাপারটা কি? দেব আজ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ মধুর ওপর ওরও আর ইচ্ছে করছে না মধুর মুখ দেখতে হয়ত আজ এতটা হত না যদি মধু গয়নাগুলো আটকে না রাখত।
ইনস্পেক্টর আতস কাঁচ নিয়ে দেখছেন হ্যাঁ শৈলপুত্রী যা বলেছিল সেটাই ঠিক। প্রত্যেকটা গয়নাতেই মেনকা মিশ্র লেখা আছে যেগুলো সে নিজের বলে দাবী করেছে।
-' আচ্ছা এই মেনকা মিশ্রকে আপনি চেনেন? একদম সত্যি কথা বলবেন। আপনার বাপের বাড়ি কি মিশ্র?'
আশা অসহায়ের মত মাথা নাড়েন, 'তাহলে মেনকা মিশ্র কে?'
চোখে না দেখলেও শুনেছেন শৈলজার বৌয়ের নাম ছিল মেনকা। সুতরাং আর কিছু বলার মুখ নেই। ভেঙে পড়েন আশা।
-' মেনকা মিশ্রকে আমি চিনি না এই গয়না আমার নয় আমি আর কিছু বলতে পারব না।'
যদিও শৈলপুত্রী বলেছে তবুও ইন্সপেক্টর আরেকবার বলেন,' আপনি চেনেন মেনকা মিশ্র কে শৈলপুত্রী মিশ্র?'
- ' মেনকা মিশ্র আমার মা,আজ থেকে দশবছর আগে মারা গেছেন। আমাদের বড় পরিবার ছিল তাই সব বৌদের গয়নাতে নাম লেখা থাকত যাতে পরে কোন ঝামেলা না হয়। কেউ ভাগ চাইতে না পারে। আমি ভুলে গেছিলাম যে গয়নাতে মায়ের নাম লেখা আছে। তাই বোধহয় এতটা সময় নষ্ট হল।'
শৈলপুত্রী কোমরে গুজে রাখা পুরোনো ভেলভেটের ব্যাগটা বের করে গয়নাগুলো ভরে নিয়ে অনেকক্ষণ চলে গেছে যাদের নিয়ে এসেছিল তাদের সাথে। ইন্সপেক্টর বলে যান,' মিথ্যে বলার জন্য আপনাদের শাস্তি হতে পারত অনেক সময় নষ্ট করালেন আমাদের। প্রথমেই দিয়ে দিতে পারতেন গয়নাগুলো। যাক মিঃ সান্যাল এবং শৈলপুত্রী মিশ্র কেউ যখন চান না আমরা আর এগোই সেক্ষেত্রে থাক...তবে ভবিষ্যতে ওর টাকা যা আছে ফেরত দিয়ে দেবেন।'
যেতে যেতে আশার দিকে একটা চাউনি দিয়ে যান অপূর্ব যা বলে যায়,' ছিঃ আশা এতটা নীচে নেমে গেছ তুমি!'
*************************
আজ সানন্দার বৌভাত আর ফুলশয্যা ছিল। কত স্বপ্ন দেখেছে যে জাঁকজমক করে বিয়ে হবে তার,বড়লোক শ্বশুরবাড়ি এসে গা ভর্তি গয়না পরে ফুলের সাজে সেজে ফুলপরীর মত বসবে সেই ফুলের সাজ যেন এলোমেলো হয়ে গেছে এক ঝড়ে। সানন্দার চুল এলোমেলো মাথার সোনার মুকুট নেই। লোভে পড়ে যে সাজে নিজেকে সাজিয়ে পরিতৃপ্ত হয়েছিল ভেবেছিল আদিত্যকে ওর কাছে দাবী করতে যেমন শৈলপুত্রী কোনদিনই আসেনি তেমনি হয়ত ওর গয়নাও চাইতে আসবে না বোকা মেয়েটা কোনদিনই। সুতরাং শৈলপুত্রীর বর আর ঘরের মতই এই সব কিছু তারই হবে চিরতরে। কিন্তু শৈলপুত্রী সাধ মিটিয়ে প্রতিশোধ নিয়ে সব গয়না শুধু নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি এতদিন ধরে জমিয়ে রেখেছিল ওর দেওয়া সেই রঙচটা টিনের বাক্সও যেটাতে দামি প্রসাধনী ভরে দিয়ে মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে গেছে উপহার হিসেবে। এ যেন সানন্দা ওকে ইট মারতে গিয়ে পাটকেল খেল। নিজের জিনিস ফেরত নিয়ে ওর জিনিস ফেরত দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে মিশ্রাবাড়ির মেয়েরা ভিখিরীর মেয়ে নয় তাদেরও আত্মসম্মান বলে কিছু আছে।
আশা অবাক হয়ে সব দেখেছেন,যেই মেয়েটাকে কোনদিন পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিতে পারেননি সব সময় মনে হয়েছে শৈলজার মেয়ে শৈলপুত্রী চিরকালই মনে হয়েছে শৈলজাটা কাঙাল,চালচূলোহীন সব হারিয়ে বন্ধুদের কাছে হাত পাতত। তাঁর মেয়ের আবার কি শিক্ষা হবে? ইশ্ কোনদিন দেখেননি গয়নার উল্টোপিঠে কি লেখা আছে। সব গয়নাতেই মেনকা মিশ্রা খোদাই করা আছে ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা। এত বড় হেনস্থা হতে হল সবটাই বড়বৌমা আর ছোটছেলের জন্য। শিবনারায়ণ বেঁচে থাকতে তো ঐ গয়নাতে কোনদিনই হাত দিতে দেননি তাঁকে।
আজ যে শৈলপুত্রীকে কাঙাল বলে অবহেলা করেছিলেন,কথায় কথায় অপমান করতেন কুরূপা বলে তার ব্যক্তিত্বের আর আভিজাত্যের কাছে ফিকে হয়ে গেছে আশার পছন্দের দুই বৌমা। শেষেও মেয়েটা জিতে চলে গেল,হয়ত পুলিশ ইচ্ছে করলে আজ আদিত্যর ভীষণ শাস্তি হতে পারত। ফুলশয্যার রাতটা হয়ত হাজতেই কাটাতে হত,আরও একটা ফাটল ধরত শিবনারায়ণের গড়া সাম্রাজ্যে। মুখ দেখানো যেত না কোথাও। তার থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে তাদের।
ওরা চলে যাবার পরই লজ্জা ঢাকার কোন জায়গা না পেয়ে শরীরের অবস্থা খারাপ এই অজুহাতে বিয়েবাড়ি থেকে বাড়িতে চলে আসেন আশা। আদিত্যর বন্ধুরা ওর কাঁধে হাত রেখে বলেছিল,' ইস্ কি সাঙ্ঘাতিক মেয়ে রে! এই তোর আগের বৌ ছিল? আমরা তো আগে দেখিনি মানে কোনদিনই কোথাও নিয়ে যাসনি। শুনেছিলাম বাইরে বের করা যায় না। তবে এখন তো দেখছি এই মেয়ে রাজ্য জয় করতে পারে।'
আদিত্যর অসহ্য লাগে হঠাৎই সব কিছু মনে হচ্ছিল বন্ধুদের বিদায় করে চুপচাপ একলা অন্ধকার ঘরে বসে থাকে। আজ ওদের সবার মুখে কালি লেপে মেয়েটা চলে গেছে। হয়ত আদিত্যকে বুঝিয়ে গেছে মিশ্রাবাড়ির মেয়েরা শুধু মার খায় না মার দিতেও জানে। তবুও তোমাকে আমি ক্ষমা করে গেলাম করুণা করে
ছত্রভঙ্গ বিয়েবাড়ি আত্মীয় বন্ধু অনেকেই যারা এতক্ষণ মজা দেখেছেন তাঁরা ভালো কথা বলছেন। সবার কথা শুনে দেব ক্লান্ত তাই হাত জোড় করে বলে,' আমাদের মানসিক অবস্থা ভালো নয়। আপনারা দয়া করে খেয়ে যাবেন ভালো করে।'
ওদের কারও মুখে খাবার না ঢুকলেও বাইরের লোকেরা খেয়ে দেয়ে একসাথে দুই বৌয়ের তান্ডব দেখে পরিতৃপ্তি নিয়ে মুখরোচোক আলোচনা করতে করতে পান চিবুতে চিবুতে বাড়ি গেলেন।
আদিত্যর কানে এল কয়েকটা কথা...' সত্যিই এদের পোড়া কপাল,নাহলে অমন মেয়েকে তাড়িয়ে আবার কেউ বিয়ে করে নাকি? আগের বৌটাকে দেখেছ কি সুন্দর দেখতে! কত বড় ঘরের মেয়ে অত গয়না এনেছিল সাথে।'
-' আরে কপাল মন্দ হলে যা হয়,ওর সাথে যে এসেছিলেন চেন তাকে? অপূর্ব সান্যাল, এখন তো দেশ বিদেশ জুড়ে নাম। এই মেয়েটা তো দারুণ আঁকে আরে আমি তো দেখেই....'
ওরা কথা বলতে বলতে চলে যায় আদিত্যর মনে ছুঁচের মত বেঁধে কথাগুলো। শৈলপুত্রী ভালো আঁকে! কি সব নতুন নতুন কথা শুনছে? এরাই বা এত জানল কি করে? এ কেমন যেন একটা রূপকথার গল্প একটা ঘুটেকুড়ুনি মেয়ে হঠাৎই উধাও হয়ে গেল তারপর একদিন ফিরে এল উর্বশী হয়ে। তবে কি ওদেরই চেনা হয়নি ঠিকমত শৈলপুত্রীকে?
নিজের সমস্ত কিছু ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আজ আদিত্যর গালে একটা চড় বসাতে ইচ্ছে হল সানন্দার। পুরোটাই মিথ্যে গল্প ওর কাছে করে এসেছে এতদিন ধরে। ওদের নাকি এত কিছু আছে। আজ যদি মেয়েটার গয়নাগুলো না পরত তবে তো এই হেনস্থা ওকে সইতে হত না।
সিঁড়ি দিয়ে চিৎকার করতে করতে ওঠে সানন্দা,' তোমাদের সব চালাকি আমি বুঝে গেছি। তোমার মাকে ডাক,কেন তিনি এভাবে আমাকে অপমান করলেন। দেব বারান্দায় এসে মায়ের ঘরের সামনে দাঁড়ায় মধুকে বলে,' ওকে চুপ করতে বল এখন, মায়ের শরীর ভালো নয়। শুয়েছেন একটু। আর এই সব তোমাদের বুদ্ধিতে হয়েছে সুতরাং তোমরা সামলাও। ভাই তুইও ছিলি এর মধ্যে। এত রাতে এভাবে চিৎকার কোর না। আজ তোমাদের ফুলশয্যা এখন ঘরে যাও।'
দেবের গলাতে আজ এমন কিছু ছিল যাতে কেউ আর কোন কথা বলতে পারে না। খটখট করে হিলতোলা জুতো পরে সানন্দা ঘরে গিয়ে ঢোকে পাগলের মত গয়নাগুলো ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে। তারপর ছিঁড়তে শুরু করে খাটের ফুলগুলো।
ওকে সামলাতে হিমসিম খায় আদিত্য,' থাম সানন্দা তুমি কি পাগল হলে নাকি? এত টাকা দিয়ে সাজানো এই খাটকে কি করলে?'
সানন্দা শৈলপুত্রীর মত সহনশীল নয় তাই প্রথম রাতেই আদিত্যর পাঞ্জাবী টেনে ছিঁড়ে ফেলে,' আমি পাগল? তোমরা আমাকে পাগল করেছ। কি বলে গেল মেয়েটা তুমি ওর ব্যবহার করা বর। বল কত বার শুয়েছিস ওর সাথে? আমাকে বলতেই হবে। ঘরে বৌ আবার বাইরে আমি।'
সানন্দার পলিশ করা ম্যানার খসে অসভ্যতা আর বর্বরতা উঁকি দেয় আঁতকে ওঠে আদিত্য। এ কোন সানন্দা! এর থেকে তো মালতীর মায়ের সহবত শিক্ষা ভালো। কড়া গলাতে সানন্দার সাথে কথা বলতে গিয়ে একটা থাপ্পড় এসে পড়ে ওর গালে। ফুলশয্যার রাতে সাধ করে বিয়ে করা সুন্দরী, শিক্ষিতা ম্যানার্স জানা বৌয়ের কাছ থেকে চুমুর বদলে থাপ্পড় খেয়ে ফিরিয়ে থাপ্পড় দিতে পারে না বরং সানন্দাকে ভয় পায়। আর বুঝতে পারে একদিন শৈলপুত্রীকে থাপ্পড় মেরে এই ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল এ হয়ত তারই প্রতিফল।
সানন্দার ছিঁড়ে ফেলা ফুলে সারা ঘর বিধ্বস্ত খাটে তখন ফুলশয্যা না হয়ে শরশয্যা হচ্ছে। আদিত্য কোনরকমে সানন্দাকে শান্ত করতে যায় কিন্তু লাভ হয় না কিছুই। সানন্দার তখন মুখোশ খসে গেছে সব রাগ পড়েছে ওর ওপর। ক্লান্ত শরীরে আদিত্য বিছানা আশ্রয় করতে যায় সানন্দা চিৎকার করে ওঠে,' এখান থেকে বিদায় হয়ে যা,একদম আমার সামনে আসবি না। পাশে শুতে এসেছে। যে বৌয়ের সম্মান রাখতে পারে না তাকে স্বামী বলে আমি মানি না।'
আদিত্য ঘরের এককোণে রাখা সোফায় চুপ করে বসে থাকে। সানন্দা শাড়ি ছুঁড়ে একপাশে ফেলে দিয়ে সায়া ব্লাউজ পরে শুয়ে গালাগালি করে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘুমিয়ে পড়ে।
মধু কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল,হয়ত ফুলশয্যার ঘরের কিছু দৃশ্য উপভোগ করার জন্য। হঠাৎই দেব ওকে টেনে ঘরে নিয়ে যায়।
-' এ কি আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছ কেন? আশ্চর্য তো!'
-' চুপ করে এখানে শুয়ে পড়। আর যা যা মায়ের গয়না চুপ করে কাছে রেখেছ তা বার করবে তিনদিনের মধ্যে। নাহলে তোমাকে আমি ডিভোর্স দেব।'
-' এত বড় কথা তুমি বলছ কোন সাহসে? আমাকে ডিভোর্স দেবে?'
-' হ্যাঁ দেব,তোমার সাথে সংসার করার ইচ্ছে আমার নেই। ছাড়া পেয়ে যা খুশি তুমি কর।'
মধুর বুকটা কেঁপে ওঠে এতদিন ও দেবকে হুমকি দিয়ে এসেছে আজ যে এভাবে দেব রুখে দাঁড়াবে তা ভাবেনি।'
-' আমাদের ভালো ভেবেই রেখেছি গয়নাগুলো। তোমার তো কোনদিন বুদ্ধিই হল না।'
-' আমার বুদ্ধির দরকার নেই মধু তোমার মত দুর্বুদ্ধি সংসার নষ্ট করে আমি সংসারটা বাঁচাতে চাই। ঠিক আছে তোমার গয়না নিয়ে তুমি থাক। আমি যেখানে খুশি চলে যাব।'
এই দেব বড় অচেনা মধুর তাই ভয় পায়। বলে,' আচ্ছা আমি সব দেব তোমার হাতে যা খুশি করবে।'
-' হ্যাঁ তাই করব। আমি মায়ের জিনিস মাকে দিয়ে দেব।'
-' সব তোমার ভাই আর তার বৌ নেবে।'
-' নিক মধু আমি একটু শান্তি চাই আর অপরাধের বোঝা বইতে পারছি না।'
সোফাতে বসে থাকতে থাকতে একটা সময় শুয়ে পড়ে আদিত্য। এটা ওর দ্বিতীয় ফুলশয্যা। এর আগেও একবার খাট সাজানো হয়েছিল, তবে মনটা কাদায় ভর্তি তখন আদিত্যর ফুলের গন্ধ পায়নি,কৃপা করে মেয়েটাকে খাটের এক কোণে শুতে দিয়েছিল বাবার ভয়ে। সবাই শৈলপুত্রীর মত নয় তাই আজ ওর নিজের ঘরেই খাটে শুয়ে সানন্দা আর ওকে গলাধাক্কা আর থাপ্পড় দিয়ে বিতাড়িত করেছে খাট থেকে।
হয়ত সেই ফুলশয্যায় তবুও ফুলের ছোঁয়া কিছুটা ছিল কাপড় ছেড়ে গয়নাগুলো খুলে একপাশে শুয়েছিল সাবধানে মেয়েটা আজ যে শুধু কাঁটার জ্বালা। আসলে মানুষ বড়ই অদ্ভুত সে নিজে যে কী চায় তা নিজেই জানে না। যখন সেই চাওয়া ভুলে ভরা হয় তখন সঠিক চিনতে পারে কিন্তু ততক্ষণে ঠিক ঠিকানাবদল করে ফেলেছে।
**********************
গয়না নিয়ে অপূর্ব সান্যালের দামি বিদেশী গাড়িতে ওঠে শৈলপুত্রী আর পেছনের দিকে ফিরে তাকায় না। নটরাজ অন্য গাড়িতে উঠলেও অপূর্ব আঙ্কেল ওর সাথেই ওঠেন। দমবন্ধ লাগে শৈলপুত্রীর গাড়ি চলতে শুরু করলে জানলা খুলে দিয়ে হাওয়ায় ভাসাতে চায় নিজের মনটাকে। অনেক দিনের জমে থাকা সবটা আজ উগড়ে দিয়ে এসেছে। একটা সময় টিনের বাক্সটা নিয়ে কতই না পাগলামি করেছে। মনে হয়েছে সাজগোজ করেনি বলেই বরের মন পায়নি। জোকারের মত মুখে রঙ মেখেছে। আজ বুঝতে পারে ঐ বাড়িটা আর তার লোকজনেরা ওর আত্মীয় আর নিজের বাড়ি হবার যোগ্য নয়। তাই তো সম্পর্কটা ভেঙে গেছে। হয়ত ভগবান যা করেন তা ভালোর জন্যই করেন। অপূর্ব ওর মাথায় হাত রাখেন,' বেবি মা যুদ্ধ জয়ের শেষে বড় ক্লান্ত হয়ে গেছিস তাই না রে? আয় একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। নাটুটা ভাগ্যিস বুদ্ধি দিয়েছিল ওদের মেমো দেখাতে বলতে। নাহলে ওরা জব্দ হত না। তবে শেষটা তুই সামলে নিলি।'
-' ওহ্ সাহাবজী এইসব বলে ছিল? ভাগ্যিস তখন এলেন না হলে আমি সত্যিই পারতাম না। একটা সময় ভয় পেয়ে গেছিলাম।'
অপূর্ব হেসে ফেলেন,' বাবা নেই তো কি? আছে তো বাবার মত কেউ। আমি না গিয়ে পারি? অথচ ঐ বাড়ির লোকদের সাথে কোনদিনই সম্পর্ক রাখিনি। কত নিচে নেমে গেছে আশা! একটা সময় ও লাবণ্যর বন্ধু ছিল জানিস?'
শৈলপুত্রী মাথা নাড়ায় জানে আরও হয়ত অনেক কিছুই জানে। তাই বলল,' আমাদের কাকিমা সবচেয়ে ভালো। কত মায়ের মত প্যায়ার করে আমাকে। কি সুন্দর সাজিয়ে দিয়েছে।'
-' সত্যিই রে মা রেবার তুলনা হয় না। ওখানে তো তোকেই সবাই দেখছিল দেখছিলাম। হীরে ফেলে কাঁচ নিয়ে মেতেছে ছেলেটা। অবশ্য সবার কি হীরে চেনার চোখ থাকে? কিন্তু আমার আছে।'
লজ্জা পায় শৈলপুত্রী ততক্ষণে বাড়ির সামনে এসে গাড়িদুটো দাঁড়িয়েছে। ইনস্পেক্টর সেনও চলে গেছেন কাজ শেষে। গাড়ির আওয়াজ শুনে রেবা ছুটে আসেন বারান্দায়। অনেকটা সময় অস্থিরতার মধ্যে কেটেছে।
শৈলপুত্রী ছুটে আসে গাড়ি থেকে নেমে।
-' আরে আস্তে আয়,ছুটিস না পরে যাবি। জিতে এসেছিস তো? তোর গয়না?'
-' সব এনেছি কাকিমা।'
-' আরে জিতে এসেছে কি একদম ওদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে এসেছে। রেবা কিছু খেতে দাও কিছুই খাওয়া হয়নি। শুধু বিয়েবাড়ির ভালো খাবারের গন্ধই শুঁকে এলাম। কই রে নাটু মামীকে কবিরাজির প্যাকেট দে। ওহ্ পেটে ইঁদুর চোর পুলিশ খেলছে।'
রেবা হাসেন,' তুমিও ভেতরে গেছিলে নাকি? দুর্গার সাথে?'
-' যেতে হয়েছিল রেবা। সে অনেক কথা পরে বলছি খেতে খেতে।'
রেবার হঠাৎই মনে হয় তাহলে তো আশার মুখোমুখি হতে হয়েছিল অপূর্বকে তাই মজা করে বললেন,' তা তোমার বোনের বন্ধু তোমাকে কিছু খেতেও দিল না।'
অপূর্বর মুখটা একটু গম্ভীর হয় নিজেকে সামলান,' আমার মেয়েকে যারা অপমান করেছে তাদের ওখানে খাওয়া কিসের? দিয়েছিল আমি খাইনি। তবে এবার খাব জমিয়ে।'
মুখ ফসকে কথাটা বলে নিজেরই অপরাধী লাগে রেবার কথাটা না বললেই পারতেন মানুষের দূর্বল জায়গায় আঘাত না দেওয়াই ভালো। তাই নিজেই সামলান নিজেকে অপূর্বর সাথে কথা বলে।
**********
পরম তৃপ্তিতে মুখে খাবার তোলেন অপূর্ব,উত্তর কলকাতার সেই বিখ্যাত দোকানটার ভেটকি কবিরাজি যা একসময় তিন বন্ধু মিলে কত ভাগ করে খেয়েছেন মনের সুখে। আজ আবার সেই ইচ্ছে হঠাৎই মনে জেগে উঠেছে জয়ের আনন্দে তাই মামুর প্রিয় ভাগ্নে তখনি বুঝতে পেরে গাড়ি থামিয়ে কিনে এনেছে।
-' বুঝলে রেবা কতই তো খাবার খাই তবে আজকের স্বাদ যেন মুখে লেগে থাকবে অনেকদিন। এ শুধু তো খাওয়া নয়। এ হচ্ছে জিতের আনন্দে পেট পুরে খাওয়া।'
-' ওহ্ মামু তুমি তো মোটামুটি ওদের প্যান্ট না না নতুন বরের ধুতির কাছা খুলে দিয়েছিলে গো।'কথাটা বলে শৈলপুত্রীর দিকে তাকায় নটরাজ। ওর মুখটাকে একবার তাকিয়ে দেখে শৈলপুত্রীর ততক্ষণে সাজ বদল হয়ে গেছে। সেই আটপৌরে সাজের শৈলপুত্রী যাকে দেখে কে বলবে এই তো কিছুক্ষণ আগে বিয়ে বাড়িতে ঝড় তুলেছিল। নটরাজের চোখে অবশ্য এই শৈলপুত্রী বড় চেনা,যে সাধারণে অসাধারণ। সত্যিই তো প্রথম দিন শৈলপুত্রীকে দেখে ও বুঝতেই পারেনি কত গুণ আর প্রতিভা লুকিয়ে আছে ঐ মাটির উঠোনে বসে ভাঙা চেয়ার ঠিক করা মেয়েটার মধ্যে। তবে আজ শৈলপুত্রীকে দেখে বুঝতে পেরেছে নাম তার একদম সার্থক এই মেয়ে কখনও ডুরে শাড়ি কোমরে জড়িয়ে পুজোর জোগাড় করে কমলা রূপে,আবার কখনও সরস্বতীর মত বিদ্যা দান করে কখনও রণচন্ডী হয়ে কৃপাণ সিংয়ের লোকেদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় আবার কখনও অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে অসুর বধ করে। আজ অবশ্য ঐ আদিত্য নামের ভদ্রলোককেই অসুর মনে হয়েছে নটরাজের। কথাটা মনে হতেই হাসি পেল খুব। হঠাৎই হাসতে গিয়ে বিষম খেল নটরাজ, সাঙ্ঘাতিক রকমের বিষম। চোখ নাক মুখ দিয়ে জল বেরিয়ে বিচ্ছিরি কান্ড হঠাৎই দমবন্ধ হবার অবস্থা। হঠাৎই পিঠে একটা জোরে কিল খেয়ে চমকে উঠে দম ফেলল নটরাজ।
আরেব্বাবা সাঙ্ঘাতিক মেয়ে তো! রীতিমত একটা জোরে কিল বসালো আর তাতেই দম ফেলল নটরাজও।
-' উঃ কি হাতে জোর আপনার! তবে বাঁচলাম মনে হচ্ছিল দম আটকে যাবে।'
একটু লজ্জা পায় শৈলপুত্রী,' আপনার লেগেছে খুব তাই না?'
' না না খুব লাগেনি তবে দু একদিন ব্যথা থাকবে মনে হচ্ছে।'
অপূর্ব হা হা করে হেসে ওঠেন,' এটাও শৈলজার কাছ থেকে শেখা তাই না? আমি দেখেই বুঝতে পেরেছি।'
মাথা নাড়ে শৈলপুত্রী তারপর বলে,' কি করব? আপনি খেতে খেতে হাসছিলেন কেন? তাই তো কবিরাজি গলায় আটকে গেছিল। আমি হাতুড়ে কবিরাজ উপায় না দেখে বসিয়ে দিলাম এক কিল।'
এতক্ষণ ওর অবস্থা দেখে রেবা অস্থির হয়ে গেছিলেন ছেলেটার চোখমুখ ঠেলে বেরোচ্ছে তো। কি করবেন ভেবে পান না। তারপর শৈলপুত্রীর কথা আর কান্ড দেখে বলেন,' বেশ করেছিস, তোর আঙ্কেলের পিঠেও একটা দিতে হত আমি ভাবছিলাম। কি হাসছিল দুজনেই। ও তো বিষম খায় সবসময়।'
-' রেবা হাতুড়ে কবিরাজি শিখে নাও বুঝলে তাহলে কাজে আসবে ভবিষ্যতে।'
-' আমি শিখব কেন? কবিরাজকে তো কাছেই রেখে দেব আবার কি চিন্তা।'
শৈলপুত্রী কথাটা শুনে আনমনা হয়ে যায় কাকিমা কি বলছে? ও কি আর ফিরবে না দেওঘরে কখনও। চাচীকে যে ও বলে এসেছে কদিন বাদেই চলে আসবে কাজ শেষ হয়ে গেলেই। মংলু,বিন্তি,পুলুয়া,মুন্না ওদের কি হবে? চাচীকে চিঠি লিখতে শেখানো হয়নি এখনও বলেছে নিজে যাতে চাচাকে চিঠি লিখে পাঠাতে পারে সেটা দেখবে।
নটরাজ ওর চোখের ভাষা পড়তে চায়। হয়ত বা চট করে পড়ে ফেলতে পারে তাই বলে ওঠে,' কি হল এখানে থাকার কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল নাকি? দেওঘরকে খুব মিস্ করছেন মনে হচ্ছে। আপনার কালী গাই আর ছাত্রদের তাই না? আমি তো পরশুই বেরিয়ে যাব। দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে গেল।'
-' সে কি রে নাটু তুই চলে যাবি নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম ওকে নিয়ে কাল পরশু একবার আর্ট কলেজে যাব। সুশোভন বলেছিল একবার আনতে শৈলপুত্রীকে।'
-' হ্যাঁ মামা আমাকে আর কি দরকার। কালকের লড়াই তো তোমরা বেশ লড়লে আমি তো শুধু দেখলাম। কিন্তু তোমার বেবি এখানে থাকবে কি না আদৌ তা জিজ্ঞেস করেছ তো ভালো করে?'
-' ও আবার কি বলবে,কাল ওকে নিয়ে বেরোব এতগুলো গয়না তো আর ব্যাঙ্কে ছাড়া বাড়িতে রাখা যাবে না। তাই একটা লকারের ব্যবস্থা করব। আর তারপর সুশোভনের ওখানে নিয়ে যাব।'
-' ওহ্ তাহলে তো কাল তোমার অনেক কাজ। আচ্ছা বেশ সব সেরে নাও মামু আমি এবার আসি। তুমি শৈলপুত্রীর বিজয় কাহিনী মামিমাকে শোনাও। আমি বলতে গেছিলাম কিন্তু যা বিষম খেলাম মনে হয় আদিত্য বাবু খুব গালাগাল করছেন।'
-' থাক ঐ নাম টা আর নাই বা নিলেন সাহাব। আমার ভালো লাগে না ঐ নামটা শুনতে। আজকের পর আরও ইচ্ছে করে না। ছিঃ মানুষ এত লোভী আর বদমাশ হতে পারে? আঙ্কেল না থাকলে হয়ত এরা আমাকে জেলে নিয়ে যেত। ভাগ্যিস আঙ্কেলের সাথে এলেন সবাই।'
আদিত্য আর কিছু বলতে পারে না সত্যিই মেয়েটার ওপর একটুও কোন সহানুভূতি ছিল না মানুষটার! ওর স্ত্রীকে দেখে অবাক হয়েছে আদিত্য সত্যিই মানুষ অন্ধ এখনও সুন্দরের মাপ চামড়ার রঙেই নির্ধারিত হয়।
-'আসি আমি মামু কাল পারলে রাতে আসব একবার।'
হঠাৎই শৈলপুত্রী বলে ওঠে,' আপনি আর একটা দুটো দিন থেকে যেতে পারেন না সাহাব? আমি যাব আপনার সাথে।'
অপূর্ব অবাক হয়ে বলেন,' কি যাবি রে এখন? তোর কাকিমা তো তোকে নিজের কাছে রাখবে বলে ঠিক করেছে। আমি কলেজে ভর্তি করে দেব।'
-' আঙ্কেল আমি একটু ঘুরে আসি,আমার মন খারাপ করছে খুব। তারপর আবার চলে আসব।'
সত্যিই এরপর আর কিছুই বলার নেই কারণ জোর করা যায় না এভাবে। সুতরাং নটরাজ বলে,' আচ্ছা কালকের কাজগুলো মিটে যাক তারপর দেখছি যদি আপনার যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়।'
পরের দিন নানা ব্যস্ততায় কেটে গেল। যাক অপূর্ব সাথে থাকার জন্য একদিনের মধ্যেই সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। শৈলপুত্রীর নামে লকার খুলল দেখে অবাক হয়ে গেল ও মনে হল ওর পৃথিবীটা সেই কাটিহারের ট্রাঙ্ক থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকটা বিস্তৃত হয়ে গেল। শৈলপুত্রীর অ্যাকাউন্টে জমা পড়ল ওর দুটো ছবি বিক্রির টাকাও। অপূর্ব বললেন ওদের বাড়ি বিক্রির টাকাটা আদায় হলে সেটাও শৈলপুত্রীর নামে রাখা হবে।
-' আঙ্কেলজী ছেড়ে দেন, অত খাটতে হবে না গয়নাতে নাম লিখা ছিল তাই পেয়েছি। টাকাতে তো আর নাম লেখা থাকে না। তাই দরকার নেই,ধরে নিন আমি ছটা মাস ছিলাম ঐ বাড়ি তার খাওয়া খরচটা শুধে দিয়ে এলাম। আমি যে ভিখারির মেয়ে না বরং ভিক্ষা দিতে পারি সেটা ওরা বুঝুক।'
এইটুকু একটা মেয়ে অথচ তার কথার গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়ে গেল অপূর্বকে।
শৈলপুত্রীর মনে হল সত্যিই তো সে ভিখারির মেয়ে নয় সে ভিক্ষাও দিতে পারে সেটা বুঝুক আদিত্য।
*********************
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায় সানন্দার কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। বরাবরই তার দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস। কাল রাগের মাথায় সায়া ব্লাউজ পরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। অথচ সুন্দর ফিনফিনে নেটের পোশাক কিনেছিল আদিত্যকে সঙ্গে নিয়ে। আদিত্যর পাঞ্জাবির পকেটে রয়ে গেছে সানন্দাকে উপহার দেবার জন্য কেনা হীরের আংটি। এত অশান্তির পর তিতকুটে মনে অনেকক্ষণ সোফায় বসে থেকে থেকে আদিত্য ওখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অঘোরে। ঘুম বোধহয় সব থেকে ভালো বন্ধু যে অনায়াসেই কিছুক্ষণের জন্য শান্তির আঁচল বিছিয়ে শীতল পাখার বাতাসে আদর করে নরম করে দেয় মানুষের মনের দুঃখ,কষ্ট আর যন্ত্রণা।
সানন্দা বাথরুম থেকে এসে নিজের বাক্স থেকে একটা স্লিভলেশ পোশাক গায়ে পরে নেয়। ওহ্ কিভাবে এত কিছু পরে ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে? আদিত্যর দিকে তাকিয়ে আবার রাগে গা জ্বলে যায়। ইশ্ কি করে অফিসে গিয়ে মুখ দেখাবে বন্ধুদের কাছে? সবাই তো সব জেনে গেছে।
হঠাৎই শৈলপুত্রীর একটা কথা আবার মনে পড়ে যায় ওর ব্যবহার করা বর আর ঘর। সত্যিই তো এই খাটে শৈলপুত্রী শুয়েছে। হয়ত এই ঘরেই কত রাত আদিত্য... আর ভাবতে পারে না সানন্দা। না না আদিত্য তো বলেছে ওর সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না তাহলে ব্যবহার করা কথাটা বারবার বলছিল কেন নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন কথা আছে।
আদিত্যর কাছে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে দেখে সানন্দা। আদিত্যর সুন্দর চেহারা যা দেখে ওর কাছে পতঙ্গর মত উড়ে এসেছিল সানন্দা তা একরাত্রির যুদ্ধেই ঢলে পড়েছে। ক্লান্ত শ্রান্ত আদিত্য আদিত্য সরু সোফাটাতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সানন্দার একটুও কষ্ট হয় না যে ওর ফুলশয্যার রাতটা শুধু শুধু নষ্ট হল। নাহ্ এখনি আদিত্যকে ডাকতে হবে।
হঠাৎই আদিত্যর ঘুমটা ভেঙে যায়,ও দেখে সানন্দা ওর মুখের কাছে ঝুঁকে ওকে দেখছে। আদিত্য সানন্দার মান ভাঙাতে দুই হাত বাড়িয়ে দেয় ওকে কাছে টেনে নিতে আদিত্যর শক্ত হাতের বাঁধনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধরা পরে সানন্দা।
আদিত্য বলে,' আর রাগ করে থেক না প্লিজ। আমাকে ক্ষমা করে দাও। গয়না আমি তোমাকে গড়িয়ে দেব। দেখি আঙুলটা দাও এদিকে ইশ্ কাল কিছু হল না। শুধু একটা মেয়ের শয়তানিতে।'
-' আমার তো এখন তোমাদের শয়তান বলে মনে হচ্ছে। আচ্ছা একটা কথার জবাব দাও আমাকে। আমি এর আগেও তোমাকে বলেছি।'
-' আচ্ছা বল কি জানতে চাও?'
-' ও বারবার আমার ব্যবহার করা বর বলছিল কেন? তোমাকে কিভাবে ব্যবহার করেছে? বল তোমাকে বলতে হবে। নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক ছিল। তাই ও বারবার এ কথা বলছিল।'
-' কি এসে যায় সানন্দা তাতে? শরীরের সাথে কি সম্পর্ক? ওকে আমি তো মন থেকে কোনদিনই মেনে নিইনি।'
হঠাৎই সানন্দা আদিত্যকে ওর মাথায় হাত দিতে বলে এত পজেসিভ সানন্দাকে কেন যেন ভয় পায় আদিত্য নিজেও তাই অবলীলায় অশান্তি এড়াতে সানন্দার মাথায় হাত রেখে বলে শৈলপুত্রীর সাথে ওর কোন শারীরিক সম্পর্ক ছিল না। অথচ প্রথম শরীর চেনা হয়ত সানন্দাকে দিয়ে শুরু হলেও শৈলপুত্রী ওকে ভিক্ষা দিয়েছিল দুহাত ভরে যেমন গতকাল রাতে এত কিছুর পরও ওর হাজতবাস আটকে দিল।
কোথাও গিয়ে আদিত্যর মনে একটা কাঁটা বিঁধে রইল। আদিত্য যে স্বামী হিসেবে মোটেও সৎ নয় সেটা আবার প্রমাণ করল সানন্দার মাথায় হাত দিয়ে মিথ্যে কথা বলে।
***********************
শৈলপুত্রীর জন্য দেওঘরে যাওয়াটা অফিসে ফোন করে একদিন পেছোতেই হল নটরাজকে। মামিমা বললেন,' ওকে তুই নিয়ে যা কদিন থেকে আসুক ওখানে। এই ভাঙা বছরে তো ভর্তি হতে পারবে না সুশোভন বলেছে তোর মামুকে সুতরাং এখন ওখানে থেকে আসুক। মেয়ে মন খারাপ করে বসে আছে তা দেখে ভালো লাগে না।'
-' হ্যাঁ যা নাটু ওকে নিয়েই যা সাথে। একা পাঠাতে ভরসা হয় না। সুশোভন তো ওর আঁকা দেখে একদম মুগ্ধ। বলল স্যার এ তো একদম ভগবান দত্ত প্রতিভা। কি করে রঙ বানায় তা গল্প করল। যাক ভর্তির ব্যবস্থাটা পাকা করে এলাম একদম।'
-' মামু এই সুশোভন কে গো?'
-' আমার ছাত্র বলতে পারিস,একটা সময় আমার সঙ্গে কাজও করেছে কিছু। তারপর চাকরিটা পেয়ে গেল। একদম খামখেয়ালি আপন ভোলা ছেলে। খুব ভালো কাজ করে।'
কলকাতা থেকে রুবিদিকে দিয়ে অনেক টুকটাক জিনিস আনিয়েছে শৈলপুত্রী। নিজেও একদিন গেছিল কাকিমার সাথে বাজারে। বাচ্চাদের জন্য নিয়ূ যাবে কিছু আর চাচীর জন্য ওর নিজের রোজগারের পয়সায়। মনে আর খুশি ধরে না প্রায় দুটো মাস হয়ে গেল সবাইকে দেখে না। সামনে বাচ্চাগুলোর পরীক্ষা আবার ওদেরকে পড়াবে। রেবা মন খারাপ করেন বাড়িটা ভরে ছিল আবার খালি হয়ে গেল।
-' এই পাগলীকে তুমি কি করে বাঁধবে রেবা? ও যে একদম ওর বাবার মত। সব লোককে দিতে পারলেবট বাঁচে। ওকে যেতে দাও।'
ট্রেনের জানলায় বসে মন হারায় শৈলপুত্রী,ছেলেমানুষের মত দেখে ছুটে চলে যাওয়া গাড়িগুলো আর গাছপালা বাড়িঘর। নটরাজ আনমনা হয়। এই প্রথম একা একা কোন মেয়ের দায়িত্ব নিয়ে ও যাচ্ছে। দেওঘর থেকে কলকাতায় পা রাখার দিনের শৈলপুত্রীর চেয়ে আজকের শৈলপুত্রী অনেক সুন্দর। অবশ্য সবটাই মামিমা আর রুবিদির কৃতীত্বে।
স্টেশনে গাড়ি থামে নটরাজ চায়ের ভাড় ওর সামনে ধরে,' খেয়ে নিন চা। তারপরে খাবার বের করুন আমার খুব খিদে পেয়েছে।'
লজ্জা পায় শৈলপুত্রী ইশ্ সত্যিই তো অনেকটা সময় গেছে ওর মামিমা আর মা অনেক খাবার দিয়ে দিয়েছে।
-' এক্ষুনি দিচ্ছি,খুব ভুল হয়ে গেছে।'
-' এত ব্যস্ত হতে হবে না চা খেয়ে দিলেই হবে। তবে আপনার বানানো চায়ের মত ভালো নয়। যা পেলাম আনলাম।'
-' ও চা আপনার পছন্দ, আচ্ছা ওখানে আসবেন আমি বানিয়ে দেব।'
*********************
সাহাবজী যে এত যত্ন করতে পারেন মানুষকে তা অবাক হয়ে দেখল আজ শৈলপুত্রী এমন করে ওর দিকে নজর তেমন কেউ দেয়নি। অবশ্য ওর শ্বশুরমশাই নজর দিতেন একটা অপরাধের বোঝা ছিল ওঁর মাথাতে যে মেয়েটাকে সবাই অবহেলা করছে ওর অযত্ন হচ্ছে এই ভেবে। সারাটা রাস্তা একসাথে বসে সাহাবের সাথে খাওয়া মাঝে মাঝে গল্প করা এইসব স্বপ্ন ওর কাছে। অবাক হয়ে দেখেছে মাঝে মাঝে নটরাজকে মনে হয়েছে মানুষ এত ভালো হতে পারে? নটরাজ হয়ত ইচ্ছে করেই একটু বেশি নজরে রেখেছে শৈলপুত্রীকে ওর ফেলে আসা শ্বশুরবাড়ির চিত্র দেখে ভালো করেই বুঝতে পেরেছিল যে কোন পর্যায়ে অসম্মানিত হয়েছে মেয়েটা ওখানে। যারা বাড়ির বৌকে অকারণে জেলে পাঠাতেও দ্বিধা করে না তারা মানুষ নয়। এদের ঠিক পশুও বলা যায় না। নটরাজের সাথে ট্রেনে কাটানো কয়েকটা ঘন্টা হয়ত মিঠে ডাইরিতে লেখা থাকলো গোপনে দুজনেরই কাছে।
শৈলপুত্রীকে নিয়ে দেওঘরে নামতেই নটরাজের মনে হল হঠাৎই বিশেষ কাউকে নিয়ে ফিরেছে ও। ভালো কাজ আর ভালোবাসা কখনও দ্বিগুণ হয়ে হয়ত ফিরে আসে নিজেরই কাছে। কিন্তু এরা জানল কি করে শৈলপুত্রী ফিরছে ওর সাথে?
তারপর বুঝতে পারে মথুরার কাছে শুনেছে ফুলবন্তী আর সেই খবরই প্রচার হয়েছে পাড়াতে। বাচ্চাগুলো ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরে দিদি করে। ফুলবন্তীও খুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে,' দিদি ইতনে দিন কাঁহা থী বহত য়্যাদ আ রহা থা।'
-' সাহাব সে পুঁছো ও আঙ্কেলজী তো অভি ভী মনা কর রহা থা। মগর হম ভাগকে আয়ে।'
নটরাজ হাসে এই মেয়েকে আরও কিছু দিন আটকে রাখলে হয়ত নিজেই পালিয়ে চলে আসত কোনদিন। ওদের সাথে চলে যায় শৈলপুত্রী নটরাজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখে ওর হাতের ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করে বাচ্চাগুলো। সেদিনের বিয়েবাড়ির সাজে সাজানো আধুনিক মডেল শৈলপুত্রী এক নিমেষেই মিলেমিশে গেছে ওদের সাথে। ধুলো পথে প্রায় ছুটতে ছুটতে আর হাসতে হাসতে চলেছে ওদের সাথে সত্যিই বোধহয় এই শৈলপুত্রীকে হঠাৎই কেউ দেখলে জংলী বলেই ভাববে। কিন্তু মেকি শৈলপুত্রীর থেকে এই নিরাভরণ খাঁটি শৈলপুত্রীকে বেশি চেনা মনে হয় নটরাজের। হঠাৎই পেছন ফিরে তাকায় শৈলপুত্রী অবাক হয়ে যায় দেখে সাহাব ওদের দিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই হাত নাড়ে নটরাজ। শৈলপুত্রী হাসে তারপর অবাধ্য চুলের গোছা নাড়িয়ে খোলা আঁচল হাওয়াতে উড়িয়ে চলে যায়।
নটরাজের কাছে আশ্চর্য লাগে কে বলবে এই মেয়েটা কদিন আগে ঝড় তুলেছিল ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিল নিজের প্রাপ্য আজ কেমন শালোয়ার কামিজ পরে লাফাতে লাফাতে বাচ্চাগুলোর কাঁধে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে। কদিনের মা বাবার আদর খাওয়ার পর আবার সেই নিজের একলা কোয়ার্টার একটু ফাঁকা লাগে প্রথমটা তারপর আবার মানিয়ে নেয়। প্রতিবারের মত মা এবারও এক গাদা জিনিস দিয়ে দিয়েছে। ফুলবন্তীও রান্না করে রেখেছে সুতরাং আজ খেয়ে দেয়ে একটা ঘুম দিয়ে মন আর শরীরকে চাঙা করে নিয়ে কাল থেকে আবার অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে।
নটরাজ লম্বা,গায়ের রঙ চাপা মানে কালো অনেকটা মামার মতই। পেটানো চেহারা কাটা কাটা চোখ নাক মুখের গড়ন আদিত্যর মত সুন্দর নয় নটরাজ তবে মনের দিক থেকে অনেকটা সুন্দর। অন্যের দুঃখে কাঁদে ওর মন এখানে থেকেও কলকাতা গেলেই কত জিনিস আনে এনে গরীব মানুষের হাতে তুলে দেয়। খাবার খেতে খেতে মামু মামী মা বাবার কথা খুব মনে হল আজ। ওঁরা যখন এসেছিলেন কি আনন্দ না হয়েছিল। এখন কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সবটা। মা চলে যাবার সময় কথাটা বলতে গিয়ে মুশকিলে পড়েছিল মা আর মামিমা দুজনেই বলেছিল,' এবার একটা মেয়ে দেখি,এত কলেজ স্কুল আর ইউনিভার্সিটি পাশ হয়ে এলি তবুও একটা মেয়ে জোগাড় হল না তোর। এই বিহারী রাজ্যে আর কোথায় মেয়ে পাওয়া যাবে? এবার মেয়ে দেখি কি বল? তোর বাবারও শরীর খারাপ হচ্ছে মাঝে মাঝে। দুটিতে থাকবি আর একা লাগবে না।'
-' মা এত তাড়া কিসের? এই তো সবে চাকরি পেলাম। দাঁড়াও সারা জীবনের ব্যাপার একটু বুঝে নি আগে। এই তো বেশ আছি নিজের মত শুধু শুধু কেন আবার।'
********************
সানন্দা হাত কাটা একটা পোশাক পরে বাইরে বেরিয়ে আসে। ঘড়িতে তখন প্রায় নটা। আজ ওদের দুজনের ছুটি। ভোরে বৌকে মিথ্যের প্রলেপে শান্ত করে আদিত্য দু একটা চুমু টুমু খেয়ে সানন্দাকে জড়িয়ে ধরতে পেরেছে তারপর যথারীতি নিজের পরিচিত খাটে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়েছে। সত্যিই গতকাল যা গেছে তাই বিধ্বস্ত শরীর মন।
আশা পুজোর জন্য তুলসী পাতা তুলছিলেন বারান্দায় রাখা টবের গাছটা থেকে। একটা সময় ছাদে গিয়ে আশার ফুল তুলসী আনতে কষ্ট হয় বলে একটা ছোট টগরের গাছ আর তুলসীপাতার গাছ বারান্দায় বড় বড় টবে লাগিয়ে দিয়েছিল শৈলপুত্রী। তারপর নিত্য পুজোর জোগাড় এখান থেকেই হয়ে যায়। আজ নিজেরও বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না তাঁর। সানন্দার পোশাক দেখে অবাক হন আশা এই বাড়ি ও বাড়ি মিলে অনেক শাড়ি কেনা হয়েছে তার কোনটাই কি পরতে ইচ্ছে করল না? যাক যে যার খুশিমত চলুক। মালতীর মাকে ডাক দেয় সানন্দা,' কি ব্যাপার তোমার বলত? কটা বাজে? দরজা নক করে চা দিতে পারনি?'
-' আমি অত পারি না বাপু,এখেনে ফ্লাক্সে রাখি সবাই নিয়ে যায় যে যখন ওঠে। বৌদিও তাই ঢেলে নেয়। একা হাতে কত কি সামলাব?'
কাজের লোকের এত বড় কথা সহ্য হয় না সানন্দার। গতকাল থেকে বারবারই একটা কথা মনে হয়েছে সানন্দার আজ ওদের বৌভাতের দিন ও যে শৈলপুত্রীর গয়না পরে সাজবে সে খবর শৈলপুত্রীকে কে দিল? যে কোন দিন এসেই গয়না নিয়ে যেতে পারত। বেছে বেছে বৌভাতের দিন এল সব পন্ড করতে! নিশ্চয় এই বাড়িতে এমন কেউ আছে যে সব খবর দিচ্ছে মেয়েটাকে। কালও ঠিক তাই হয়েছে হঠাৎই ঐ আর্টিস্ট লোকটা উঠে এল মেয়েটার আঙ্কেল হয়ে। যখন মেয়েটাকে মরণকালে ওর বাবা বন্ধুর ছেলের ঘাড়ে চাপিয়েছিল তখন কোথায় ছিল এই আঙ্কেল? নাহ্ সব নিশ্চয় এই বুড়িটার কাজ। তাই গলা বড় করে এবার চারপাশে তাকিয়ে বলে,' এই শোন আমার মেজাজ ভালো নেই। কাজের লোক কাজের লোকের মত থাকবে।'
সানন্দার কথায় চোখ ভরে মালতীর মায়ের দাদা এই বাড়িতে ওকে বোনের মতই রাখতেন। সেই বাড়িতে নতুন বৌ আসতে না আসতেই এত কথা! সত্যিই থাকার জায়গা নেই তাই নাহলে কবে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেত।'
-' আমি কাজের লোকের মতই থাকি।'
-' এই শোন এই বাড়ির গোপন কথা কে পাঠাচ্ছে বাইরে? কাল ঐ মেয়েটাকে কে এনেছে? আমার তো মনে হয় সব তোমার কাজ। কি ঠিক বলছি না?'
ভয়ে ভেতরটা কাঁটা হয়ে যায় মালতীর মায়ের। এসব কি বলছে এই বৌ। ওকে কি কোনভাবে সন্দেহ করছে নাকি? না কিছুতেই ধরা দেবে না ও। তাহলে তো সাঙ্ঘাতিক কান্ড হবে।
আশা ফুলের সাজি হাতে ওদের মাঝখানে এসে দাঁড়ান শৈলপুত্রীকে তিনি কোনদিন বৌমা বলেননি তাই সানন্দাকেও নাম ধরেই ডাকলেন,' একি কথা সানন্দা! ওরা অনেক পুরোনো লোক এই বিষয়ে কেন বাইরে কথা বলবে?'
মালতীর মা ইচ্ছে করছিল বলতে,' যাক তবুও কাউকে বলতে হয়নি ধম্মের কল বাতাসে নড়ে।'
-' বৌদিমণি আমারে এবার বার করে দেন। এত অপমান আর সহ্য হয় না।'
মধুও এসে দাঁড়ায়,' হ্যাঁ কথাটা তুলে ভালো করেছ সত্যিই তুমি খবরাখবর দিচ্ছ নাকি? অবশ্য আমি বের করতে পারব।'
আসলে কিছুই নয় একটু ধমক ধামক করে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চায়।
-' তোমরা এবার চুপ কর, ওকে আজ কাজ করতে দাও। যদি ওকে ছাড়িয়ে দাও তাহলে দুজনে ভাগ করে সব করতে হবে।'
আশার কথা শুনে ওদের মুখটা শুকিয়ে যায়। আর আশা আবারও ওদের দিকে তাকিয়ে সাজিতে ফুল তুলে ঠাকুরঘরে ঢুকে যান।
*******************
-' নাও লিখো এবার সব।এ দো মহিনা মে সব ভুল গয়া।'
সাবিত্রীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে মেয়ের বকা খেয়ে। বলে,' তু নেই তাই দিমাগ চলেনি। এবার আবার শিখেঙ্গে সব।'
-' চাচী তুমি এমন বাংলা হিন্দী সব কোথা থেকে শিখলে? সত্যিই তুমি যেন কেমন হয়ে গেছ। আমাকে একটুও প্যায়ার করলে না।'
সাবিত্রী ওর মাথায় হাত রাখে,' সারে দিন য়্যাদ হত। বাবার কাছে পূজা ভী দিয়েছি। কিতনা রোয়ি ম্যায়।'
শৈলপুত্রী মনে মনে ভাবে তোমাদের সবার শুভকামনা আমাকে জিতিয়ে দিয়েছে। নাহলে এই যুদ্ধ জেতা সহজ ছিল না। কতদিন বাদে আবার গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেই শ্বশুরবাড়ির লোকগুলোর সামনে। বরের বিয়েতে গিয়ে রীতিমত খবরদারি করে এল। চাচীকে বাক্সটা ফেরত দেবার গল্প করতেই চাচী হেসে অস্থির।
-' সাবাস বেটি বহত আচ্ছা কিয়া। ও বাক্সা তেরি সব কুছ লুট লিয়া। মুঝে তো সমঝ আ গয়া এহি বাক্সা হোগা।'
-' হ্যাঁ চাচী তবে ওকে অনেক দামি জিনিস ভরে দিয়ে এসেছি।'
-' ইয়ে তু কিঁউ কিয়া? ও হি তো ঠিক থা। বেকার পয়সা বরবাদ কিয়া।'
-' দিলাম ও বুঝুক মিশ্রাবাড়ির মেয়েরা কাউকে ভিক্ষা দিলেও ছোট জিনিস দেয় না।'
টেলিফোন ডিরেক্টরীতে চোখ রাখে দেব নাহ্ শৈলপুত্রীর সাথে অপূর্ব আঙ্কেলের কি করে যোগাযোগ হল সেটা ওকে জানতেই হবে। একবার কি ফোন করবে? এই এতগুলো মাস কোথায় ছিল বেবি? এল তো একদম রূপ বদল করে। বেবির এই পরিবর্তন কে করল? বৌভাতের দিন ওকে দেখে চমকে উঠেছিল দেব। মেলাতে পারেনি। এই তো ফোন নম্বরের কার্ডটাও বইয়ের ভেতরেই আছে। তাহলে একটা ফোন করবে? আচ্ছা উনি কি ওর সাথে কথা বলবেন সত্যি?
আদিত্যর ওপর কেমন যেন করুণা হয় দেবের মোহে পড়ে আর মা বৌদির উস্কানিতে আধুনিক জীবন সাথী খুঁজতে গিয়ে নিজের অজান্তেই মনের খোলা জানলাটাই বন্ধ করে দিয়েছে। শৈলপুত্রী ছিল মাধবীলতার মত কি সুন্দর হালকা সুবাস দিয়ে সবাইকে জড়িয়ে থাকতে চেয়েছিল। আর বৌভাতের দিনই শুরু হয়েছে স্বামী স্ত্রীর অশান্তি যা এখনও চলছে কথায় কথায়। কেমন যেন একটা নড়বড়ে ভাঙনের রাজপ্রাসাদ হয়েছে ওদের বাড়িটা। যে বাড়ির রান্নাবান্না আর উঠোনে দেওয়া আধমোছা আলপনাটা বলে যায় শৈলপুত্রী আছে কোথাও একটা। বাতাসে মিশে আছে ওর দীর্ঘশ্বাস,ছাদের পাখিগুলোর জল খাবার হাড়িটাতে আছে ওর হাতের ছোঁয়া। ছোট ছোট মাটির হাড়ি দিয়ে ঘর বেঁধে দিয়েছিল পায়রাদের শুধু ওর নিজেরই ঘর বাঁধা হয়নি। স্বামীর অযত্ন পাওয়া শুকনো মুখ নিয়ে একটা মেয়ে এখনও ঘোরে হয়ত এই বাড়ির আনাচে কানাচে। কতটুকু চাহিদা ছিল ওর? এক একদিন দেব কারখানা থেকে এসে দেখেছে এক তরকারি ভাত আর বেশ কিছুটা আলুসেদ্ধ নিয়ে রান্নাঘরের মাটিতে বসে মালতীর মা মাসির সাথে গল্প করতে করতে পরমানন্দে খেয়েছে মেয়েটা। মালতীর মা মাসিকে বলতে শুনেছে,' সবাইকে সব খাইয়ে সেদ্ধ ভাত খেতে বস। তুমি না রাজবাড়ির মেয়ে কত ভালো মন্দ খেয়েছ।'
- ' সে অনেক পুরোনো কথা মাসি,আমি তো কষ্টেই মানুষ হয়েছি। মা অসুস্থ ছিল,সবাই ঠগিয়ে বাবাকে কিছু দেয়নি। ও আমার অভ্যেস আছে। তোমার নতুন বৌ এত তাড়াতাড়ি মরবে না দেখো। অলক্ষ্মীটার মরণ হবে না।'
-' তোমার মুখে কি কিছুই আটকায় না নতুন বৌ,অলক্ষ্মী হবে কেন ছিঃ ছিঃ এদের অলক্ষ্মী ধরেছে।'
দেবের মনে হয় কথাগুলো হয়ত সত্যি নাহলে এই বাড়িতে আর কোন হাসি মজা নেই আছে শুধু এক দমবন্ধ করা পরিবেশ। কখনও চলে ওর সাথে মধুর অশান্তি আবার কখনও চাপা চিৎকারে ঘুম ভাঙে মাঝ রাতে। সানন্দা শৈলপুত্রী নয়,সে তার অধিকার বুঝে নিতে চায় কড়ায় গন্ডায়। অবশ্য শৈলপুত্রী ও তো এসেছিল তার ন্যায্য অধিকার বুঝতে। টাকা পয়সা ব্যবসা সামলে দেব হিসেবটা ভালো বোঝে। তাই কারখানার ছাদে উঠে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে ভাবে কে শেখালো এমন হিসেব বেবিকে? যে মেয়ে ভয়ে ভয়ে থাকত সে এখন সাহসী, সেজেগুজে তার রূপ হার মানায় মধু বা সানন্দাকে। ব্যক্তিত্ব তার প্রখর, খালি পায়ে যে একতলা দোতলা তিনতলা দৌড়ে বেড়াত তার পায়ে হিল তোলা জুতো। এলোমেলো ঝাঁকড়া চুলে আধুনিক ছাপ। অপূর্ব কাকু একদিন হঠাৎই এসেছিলেন ওর খোঁজ নিতে। এই মানুষটা দেবের অপরিচিত,বাবার কাছে দুএকবার নাম শুনেছে। কিন্তু দেখেনি। সেই খোঁজ নিয়ে যাবার পর কখনও আর ওকে ফোন করেনি। অবশ্য বলেই গেছিলেন তোমার ভাইয়ের সাথে অন্য কারও সম্পর্ক আছে তাই না?
তাই হয়ত বেবির খোঁজ পেয়ে আর জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। বুঝতেই পেরেছিলেন ভালোবাসার অভাব,অবহেলা আর অত্যাচারে ঘর ছেড়েছে মেয়েটা। তারপর গয়নার কথাটা যখন জানতে পেরেছেন তখন আর কোন কিছুই জানতে তাঁর বাকি নেই।
তবুও ফোন করে দেব,কিছু হয়ত নয় তবুও একটু যোগাযোগ রাখা। বাড়িতে কেউ শুনলেই হয়ত অশান্তি করবে এ নিয়ে কিন্তু এখানে তো আর কেউ নেই সুতরাং একবার কথা বলাই যায়।
ওপার থেকে মহিলার গলা শোনা যায়,' হ্যালো, কে বলছেন আপনি? কাকে চাইছেন?'
অস্বস্তি হয় দেবের,'আমি দেব বলছি অপূর্ব কাকাবাবু আছেন?'
অপূর্বকে ইশারায় ফোনটা ধরতে বলে ঘরের দিকে পা বাড়ান রেবা।
-' হ্যালো কাকাবাবু আমি দেব বলছিলাম।'
অপূর্বর কপালে ভাজ পড়ে। সেদিন ওদের ওখানে গিয়ে মনটা খুব তেতো হয়ে গিয়েছিল। কদিনে সেটা কাটিয়ে উঠেছেন। তারপর হঠাৎই কি মনে করে ফোন করেছে ছেলেটা? কই সেদিন তো একটা কথাও বলেনি মুখ দিয়ে যে গয়নাগুলো বেবির তাহলে তো এত লড়াই করতেই হত না। আশা আর আশার বড় ছেলে অন্ততঃ সত্যি বলতে পারত। এত লোভ আর ভয় কিসের? অথচ প্রথম দিন কথা বলে ছেলেটাকে ভালোই লেগেছিল ওর।
-' হ্যাঁ বল কি বলতে চাও?আমার একটু তাড়া আছে।'
দেব বুঝতে পারে ওকে এড়াতে চাইছেন ভদ্রলোক।
-' না খুব দুঃখিত সেদিন আপনাকে কোন সাহায্য আমি করতে পারিনি শুধু অশান্তির ভয়ে। প্রথমে সত্যি কথাটা বলে দিতে পারলে এতটা সমস্যা ভোগ করতে হত না আপনাদের।'
হা হা করে হেসে ওঠেন অপূর্ব চমকে ওঠেন রেবা তাড়াতাড়ি করে বাইরে এসে দাঁড়ান। শোনেন অপূর্ব বলছেন,' আরে সমস্যা কিসের? সমস্যা কত ভালো জান সমস্যা মানুষকে শেখায় কত কিছু। সাহসী করে সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করে। যার জীবনে বেশি সমস্যা তার জয় হয় আরও বেশি। যাক ছাড় বুঝেছি তুমি ভাই আর বৌকে ভয় পাও। যাক সে সব কথা তবে আমি ভাবতে পারিনি কয়েকটা গয়নার জন্য তোমরা এত নীচে নামতে পার।'
-' সেই অপরাধের বোঝাতেই কদিন খুব মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছি সেই জন্য আপনাকে ফোন করলাম। বিশ্বাস করুন বেবিকে আমি বোনের মত ভালোবাসি। কিন্তু তবুও সেদিন তার পাশে দাঁড়াতে পারিনি তাই খুব খারাপ লেগেছে।'
-' ওহ্! এই জন্য ফোন করেছ মানে দুঃখপ্রকাশ করতে? শৈলপুত্রী নামের অর্থ জান তো? ও নিজের লড়াই নিজেই করতে পারে। আর আমি তো ছিলামই। বাবা না হলেও বাবার মত কেউ তো তাই দায়িত্ব এড়াই কি করে? শৈলজা যে আমাদের সবাইকে সাহায্য করেছে একটা সময়ে।'
-' আচ্ছা কাকাবাবু বেবি তো হঠাৎই একদিন আমাদের বাড়ি থেকে আপনি তার খোঁজ করছিলেন আমার কারখানায় এসে। হঠাৎই ওকে পেলেন কি ভাবে? আমি তো বেবিকে দেখে সেদিন প্রথমে চিনতেই পারিনি। সত্যিই দুর্গার মতই লাগছিল দেখতে।'
এবার ভীষণ বিরক্ত লাগে অপূর্বর,' ওহ্ শুধু দুঃখপ্রকাশ নয় তার মানে বেবির সম্বন্ধে জানতে চায় ছেলেটা। বেবিকে কোথায় পাওয়া গেছে সবটুকু।'
-' কাকাবাবু বেবি কি আপনার কাছে থাকে? তাহলে ওর সাথেও একটু কথা বলতাম আমাকে বড়া ভাইয়া বলত বেবি।'
ছেলেটাকে ওর ভাইয়ের থেকে ভালো ভাবলেও অপূর্ব বোঝেন বুদ্ধি ভালো রাখে এই ছেলেও। তবে খুব ঠান্ডা মাথায় চালাকি করে সবটা জানতে চায়। এবার সে বেবির কাছে পৌঁছতে চায়। না শক্ত হতে হবে অপূর্বকে।
-' তোমাকে ভালো ভাবেই বলছি বেবি তোমার সাথে কথা বলতে চায় না। মানে ও বাড়ির সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না বেবি। আর যার কেউ নেই তার ভগবান থাকেন হয়ত সেভাবেই বেবিকেও আমি পেয়েছি। হ্যাঁ আর ভবিষ্যতে ফোন কোর না এখানে। আমিই একটা সময় নম্বরটা দিয়ে এসে ভুলই করেছি।'
এতটা সোজাসুজি যে কাকাবাবু ওকে মুখের ওপর এতগুলো কথা বলে দেবেন ভাবেনি দেব। তবুও আবার বলে,' নাহ আমি ভাবছিলাম কিছু টাকা ওকে ফেরত দেব। সেদিন ইন্সপেক্টর বলছিলেন মানে ওদের বাড়ি বিক্রির টাকাটা।'
নাহ বেবির কোন হদিশ এদের দেবেন না তিনি। কারণ বাড়ির নির্দোষ দুটো কাজের লোক যুক্ত বেবির সাথে। তাই বলেন,' ঐ টাকার আর কোন দরকার নেই বেবির। হয়ত গয়নাটাও ছেড়ে দিত কিন্তু মায়ের স্মৃতি তাই এতটা সাহস করে গেছিল। তাছাড়া সৎ মানুষের আবার ভয় কি? স্বয়ং ভগবান তাকে আগলে রাখেন। যাক আমি রাখছি এখন।'
এরপর আর কোন কথা চলে না তাই বাধ্য হয়ে দেবকে ফোনটা রাখতে হয়। সেদিন মধু আর সানন্দা মিলে মালতীর মাকে জেরা করছিল। কথাটা শুনে আদিত্যর মনে হয়েছে ঠিকই তো সানন্দা বৌভাতে বেবির গয়না পরেই বসবে এই খবর কে তাকে দিল? তাহলে কি এ বাড়ির কেউ বেবিকে পোঁছে দিয়েছে কাকাবাবুর কাছে? কিন্তু কে? মালতীর মায়ের পক্ষে চেনা সম্ভব নয় কাকাবাবুর বাড়ি আর কে হতে পারে? শৈলপুত্রীকে বাড়ি থেকে কে বের করে নিয়ে গেল টিনের বাক্স সমেত? কে সব খবর দিচ্ছে? হরিহরণ চাচা? কিন্তু চাচা বহুদিন এ বাড়িতে আছে বাবা খুব বিশ্বাস করতেন। শৈলপুত্রী যখন যায় চাচা তো তখন দেশে। তাহলে কি ঐ নতুন লোকটার কান্ড? কিন্তু সেই বা কাকাবাবুকে চিনবে কি করে? অনেকগুলো কি ভাবতে গিয়ে দেবের কেমন যেন মাথা গুলিয়ে যায়।
তবে কাকাবাবু জানেন সবটাই,আগে হলে যদিও বা জানতে পারত কিন্তু সেদিন কাকাবাবুর এ বাড়িতে এসে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তারপর ওদের সম্বন্ধে খুবই খারাপ ধারণা হয়েছে। কারখানার হঠাৎই ক্ষতি,ভাইয়ের বিয়েতে এমন কান্ড সব মিলে দেবের মনে ভয় হয় কে জানে কোথাও আবার কোন গুপ্ত শত্রু নেই তো ওদের? যে বিরাট ক্ষতি চায়।
দেবের ধারণা পুরো ভুল সে ওকে কে বোঝাবে? বরং শৈলপুত্রীকে ভালোবাসার আর ভালো রাখার অনেক লোক হয়েছে ওদের খারাপ থাকাটা ভবিতব্য। আজকাল মালতীর মা আর চাচা দুজনেই ভয়ে ভয়ে থাকে। দেখা হয় তবুও তেমন কথা বিনিময় হয় না হয়ত কাজটা দুজনের খুব দরকার তাই সাবধানে থাকাই ভালো। কিছুতেই জানানো যাবে না যে শৈলপুত্রীকে দেওঘরে নিয়ে গিয়েছিল হরিহরণ। আর বাকিটা তো ওর ভাগ্য হয়ত খুব খারাপ কপাল করে আসেনি মেয়েটা তাই এমন ভালো সাহাব মেমসাহাবের আশ্রয় পেয়েছে। মালতীর মা এই বাড়ির কান্ড কারখানা দেখে মনে মনে ভাবে হীরে ফেলে ঝুটো কাঁচে ভরেছে ঝুলি এখন দিবা রাত্রি হাত পা কেটে মরছে।
সানন্দা আর আদিত্যের দাম্পত্যে অজস্র ফুটো দিয়ে হু হু করে ঢোকে শীতলতা যেখানে কোন উষ্ণতা নেই। নেই কোন দাম্পত্যের সুখ পরশ শুধু আছে মনোমালিন্যের ঢিল ছোঁড়া আর কথার কচকচানি। সেই রাত্রে শৈলপুত্রীর অপমান আর গয়না খুলে নিয়ে যাওয়াটা কিছুতেই মানতে পারেনি সানন্দা।
একটা সময় নেহাতই মজার ছলে একটা রঙ চটা টিনের বাক্সে ফুটপাতের কিছু সস্তা লিপস্টিক, নেলপলিশ, রুজ,পাউডার স্নো,কাঠের আয়না ভরে যে মজার খেলাটা খেলেছিল সেটাই কখন যে পাথরের মত ওর বুকে চেপে বসেছে তা ভাবতেও পারেনি। হয়ত অন্যের সাজানো সংসার ভেঙে যে সুখী হওয়া যায় না তা সকলেই বোঝে দেরিতে যা ওর মা বুঝেছিল কিন্তু সানন্দার এখনও সে বোধ হয়নি। আবার সানন্দা হেরে গেল শৈলপুত্রীর কাছে। বিয়ের দিন শৈলপুত্রীর গা ভর্তি গয়নার কাছে লাঞ্ছিত হয়েছিল ওর উপহার। আর আজ গয়না তো গেছেই কিন্তু টিনের বাক্সটা ফেলতে পারেনি। বিয়ে বাড়ির সব উপহারের সাথে বাক্সটা আবার হাত ঘুরে ফিরে শুধু কেন কলকাতা থেকে দেওঘর আবার দেওঘর থেকে কলকাতা ফিরে এসেছে। বাক্সটাও অনেকটা শৈলপুত্রীর মতই,এখন আর বাক্সটাকে ঠিক অবহেলা করা যায় না কারণ বাক্সটা রঙচটা হলেও ওর ভেতর ভরা আছে প্রায় দশটা বিদেশী লিপস্টিক,নেল পলিশ,দামী মেকআপ আর পাউডার,সুন্দর ভাজ করা আয়না,মাথার চুলের দু তিন রকম ব্রাশ।
বাক্সটা কাগজে মুড়ে নিয়ে এসেছিল শৈলপুত্রী। নিজের উপহার গোছাতে গিয়ে দেখল কাগজটা ছেঁড়া ভাঙা ক্ষয়াটে দাঁত বের করে হাসছে যেন বাক্সটা। দেখে গা পিত্তি জ্বলে গেছিল ওর বলেছিল,' এটাকে কে এনেছে এখানে? বিদায় কর এখনি। দিদি তুমি এনেছ নাকি এটা?'
মধু ঠোঁট ওল্টায়,' হ্যাঁ আমাকে যখন দায়িত্ব দিয়েছ সব গুছিয়ে আনতে তখন আমিই তুলে দিয়েছিলাম গাড়িতে।'
-' গঙ্গায় পাঠিয়ে দিলে না কেন এটাকে। আর এটা খুললই বা কে?'
-' আমিই খুলেছি,একবার দেখলাম কি আছে এতে যেটা এত গুছিয়ে এনে তোমার হাতে দিয়েছে।'
আর কথা খরচ না করে নিজেই বাক্সটা খোলে সানন্দা। এই কদিন রাগের মাথায় কিছু ছোঁয়নি। তারপর মনে হয়েছে ওর জা যা চালাক হয়ত এই ফাঁকে কত কি সরিয়ে ফেলেছে। তাই আজ এসে বসেছে দুই জা মিলেই।
বাক্সটা খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে ওর দেওয়া সস্তার জিনিস কিছু নেই তার বদলে একদম দামি কসমেটিকস ভরা শুধু বাক্সটাই রঙ চটা টিনের।
-' কি অবস্থা দেখ! এত খরচ করে এই সব দামি জিনিস এই বাক্সে দেয়? খোট্টার বুদ্ধি। একটা সুন্দর মেকআপ বক্স দিতে পারত। তুমি কি এটা ফেলে দেবে?'
-' কেন বলত?'
-' না একটু আগেই তো বলছিলে গঙ্গায় ফেলে দিতে তাই জিজ্ঞেস করছি। ফেলতে হলে আমাকে দিয়ো।'
-' কেন?'
-' এই তো বললে ফেলে দিতে,যাহ্ বাবা! আমি জিনিস গুলো নিয়ে নেব তারপর বাক্সটা মাঝ গঙ্গায় ফেলে দেব।'
সানন্দা অবাক হয়ে যায় ওর জায়ের বুদ্ধি দেখে দামি কসমেটিকস দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারছে না। সত্যি লিপস্টিকের রঙগুলো দারুণ। শৈলপুত্রী চালাক হয়েও চালাক নয়। এত খরচ করে এইসব কিনেছে! পরক্ষণেই শৈলপুত্রীর কথাটা মনে পড়ে গেল আমরা মিশ্রাবাড়ির মেয়েরা ভিক্ষা দিই দুহাত ভরে। কথাটা মনে হয়ে কান জ্বালা করে উঠল সানন্দার তবুও লোভ বড় সাঙ্ঘাতিক ফেলব ভেবেও ফেলে দিতে পারে না জিনিসগুলো। ওগুলোর আর কি দোষ সুতরাং থাক সানন্দার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে। অবশ্য মধুকেও নিরাশ করল না সানন্দা ইচ্ছে না করলেও একটা নেলপলিশ আর লিপস্টিক দিল। মধু মনে মনে বলল,'ছোট মন আর লোভী,ফেলে দেবে ভেবেও ফেলতে পারল না দামি জিনিস দেখে মাথা ঘুরে গেল।'
নিজের অজান্তেই সানন্দা ওর সাজঘরের অন্দরে বিষ গাছের ফলের চাষ করে ফেলল। সাজের জিনিস বা সুগন্ধ এমনি যা প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় যে দিয়েছে তার নাম। সুতরাং সানন্দার ঠোঁটে, মুখে,গায়ে শৈলপুত্রী ওর নামের ছাপ রেখে গেল। আয়নায় নিজেকে দেখে ঠোঁট রঙ করতে গিয়ে ঠিক তেমনি চমকে উঠেছিল সানন্দা শৈলপুত্রী যেন দাঁড়িয়ে আয়নার ভেতরে বলছে,' মন ভোলাতে হবে সবার কারণ কেউ তোমাকে পছন্দ করে না। নাও নাও দামি রঙ লাগিয়ে সুন্দর হয়ে যাও।'
ছুঁড়ে ফেলে দেবে ভেবেও ফেলতে পারে না কিছুই।
***************************
সেদিন গ্ৰামের দিকে একটা কাজে আসতে হয়েছিল নটরাজকে। মনে হল শৈলপুত্রীর একটা খবর নিয়ে গেলে হত। কেন যেন মামুর সাথে সাথে নটরাজের নিজেরও মন যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ওকে নিয়ে। প্রথমে এতটা গুণের সাথে পরিচয় ছিল না মেয়েটার পরে যত দেখেছে ততই অবাক হয়েছে। গ্ৰামেও অনেকের বিস্ময় শৈলপুত্রী তার সাথে কিছু মানুষের ঈর্ষা জড়িয়ে আছে। নটরাজ কেন যেন নিজেও চায় না শৈলপুত্রী বেশিদিন এখানে থাক। কলকাতার ঘটনার পর মনে হয় শৈলপুত্রীর কলকাতাতেই থাকা ভালো কারণ ওর জন্য চাচা বিপদে পড়তে পারেন।
বাড়িতে ঢুকবে কি না ভাবছিল কারণ খবর পেয়েই যায় মথুরা বা ফুলবন্তীর কাছ থেকে। কখনও মুন্নাও এসে যায় বকবক করে দিদি কি করেছে এই সব। ফুলবন্তীকে জিজ্ঞেস করেছে নটরাজ,' খালি খানা পাকাতি সারে দিন না ড্রয়িং ভী করতি?'
-' সাহাব,টাইম কাঁহা। হামলোগ পড়তূ,বাচ্চেলোগ পড়তে ফির ঘর কে কাম। কালী গাইকে ভী বাছরা হুয়া এক। দিদি কে বহত কাম।'
নটরাজের ভীষণ রাগ হয় সত্যিই মেয়েটার মাথায় ছিট আছে। মামীমার এত আদর মামুর অতবড় স্টুডিও সব ছেড়ে কালী গাইয়ের বাছুরের দেখভাল করছে। আঁকাও দিয়েছে জলে ফেলে। নাহ্ মামুকে বলতে হবে সব। কবে ওর কলেজ শুরু হবে কে জানে?
তারপরেই মনে হয়েছে কেন এত মাথাব্যথা ওর ঐ মেয়েটার জন্য? যা পারে করুক গিয়ে। তবুও পারে না। পড়ন্ত বিকেলে গাড়িটা রেখে সরু পথ ধরে এগিয়ে যেতেই দেখে মানে রীতিমত অবাক হয় দেখে মিশ্রাবাড়ির কন্যাকে তিনি গরুর দুধ দোয়াচ্ছেন। চাচী বাছুরকে সামলাচ্ছে। ওহ্ ভাবা যায় না কদিন আগেই মোটামুটি কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে যার ছবি বিক্রি হল তার এই অবস্থা। ওকে দেখে কোন পাত্তা না দিয়ে এক মনে দুধ দুইয়ে উঠে দাঁড়ায়।
-' চাচী এবার ছোড় দো উসে,যাহ্ বাছরা দুধ পি লে। আপনি বসুন আসলে দুধ তুলছিলাম তো তাই..'
-' আপনি আর কি কি করতে পারেন বলবেন? সত্যি ধন্যি মিশ্রাবাড়ির মেয়ে।'
-' চাচীর কাছ থেকে শিখেছি। আপনি বসুন আমি চা করে নিয়ে আসি।'
নটরাজের কেমন যেন অভিমান হয়,' নাহ চা খাব না। মামু যে আপনার ভর্তির ব্যবস্থা করেছেন তা পড়বেন তো?'
নটরাজের কথা চাচীও বুঝতে পারে তাই বলে,' সাহাব ওর চাচা ভী বলছিল বিটিয়ার এখন কলকাতা থাকলেই ভালো। ও বাড়িতে বহত পুছতাছ করছে সব সময়।'
-' হ্যাঁ চাচী আপনার হয়ত একটু খারাপ লাগবে তবুও ওর দিক থেকে ওটাই মঙ্গল।'
-' আমি যাব তো,কখন না বলেছি? আপনি চা খাবেন তো? দেখুন আজ আরও ভালো লাগবে আমাদের কালী গাইয়ের দুধের চা।'
নটরাজ হেসে ফেলে,এত সরলতা মেয়েটার মধ্যে যে রাগ করবে ভেবেও রাগ করতে পারে না। ওড়না উড়িয়ে দৌড়ে বালতি হাতে ভেতরে চলে যায় শৈলপুত্রী।
*********************
দেওঘরের মাটি আর মানুষগুলোকে ভালোবেসে আপন করে নিলেও শৈলপুত্রীর এখানকার কাজ শেষ হওয়ার সময় হয়ে এসেছে এবার নিজের স্বপ্নগুলোকে মুঠোয় ভরে বাঁচতে পারেনি কোনদিনই পরিস্থিতি ভেঙে দিয়েছে স্বপ্ন বারবার করেই। তবুও অপূর্ব আঙ্কেল বারবার খবর পাঠাচ্ছেন চাচাও চিঠি পাঠিয়েছেন কলকাতা থেকে শৈলপুত্রীর আর ওখানে থাকার দরকার নেই। মালতীর মাকে বারবার জেরা করছে সানন্দা,আজকাল বোনঝিকে দেখতে গেলেও সন্দেহ করে ওকে। এর মধ্যে হরিহরণকে একদিন জিজ্ঞেস করেছে বাড়ির বড় ছেলে দেব যে চাচা যখন দেশে গেছিল তখন যাকে রেখে গেছিল তাকে পাওয়া যাবে কি না? আরেকবার ভালো করে জিজ্ঞেস করত কিভাবে শৈলপুত্রী এখান থেকে বেরিয়ে গেছে। কে ওকে সাহায্য করেছে। সুতরাং যদি কোনমতে জানাজানি হয় যে হরিহরণের বাড়িতেই শৈলপুত্রী আছে তাহলে আর উপায় নেই। মাথা ঠান্ডা করে শৈলপুত্রী একলা ঘরে বসে চাচীর কাছে কেঁদে ফেলে,' আচ্ছা চাচী ওরা কেন এখনও হামার পিছে পড়ে আছে বলত? চাচা ভী টেনশনে আছে। নেহি অব হম চলে যায়েঙ্গে।'
সাবিত্রীকে এতদিন বড় মায়াতে বেঁধেছে মেয়েটা। ছেলের বৌয়ের কাছে যে আদর পায়নি সেটা এই মেয়েটা ওকে দিয়েছে উজাড় করে কিন্তু নাহ এবার ওর চলে যাওয়াই ভালো সবারই জন্য কারণ আর এখানে থাকা ঠিক নয়। এতদিন শৈলপুত্রী নিখোঁজ বা মৃত ছিল ওদের সবার কাছে এখন শৈলপুত্রীর দেখা মিলেছে ওদের নজরে পড়েছে এক অপরিচিত শৈলপুত্রী। সুতরাং সাদামাটা শৈলপুত্রীর দুর্গা হয়ে ওঠার রহস্যটা সবাই জানতে চায়।
সাবিত্রী গ্রামের সাধারণ মহিলা,এতদিন পড়াশোনাও শেখেনি। এখন সামান্য লিখতে পড়তে পারে। ঐ দুবিঘা জমি আর কালী গাইয়ের দুধ বেচে হরিহরণের পাঠানো টাকায় ভালো ভাবেই সংসার চলে যায় এইটুকু সুখ হারাতে চায় না সাবিত্রী। মেয়েটাও পড়াশোনা শিখে বড়া আদমী বনুক কারণ এই গ্ৰামে এই বয়েসী অবিবাহিত মেয়ে রাখা বিপদ। বাবুজী, মথুরা,চৌবে জী আছে বলে সব মুশকিল আসান হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাবুজী যদি এখানে না থাকে তাহলে কি হবে? ফুলবন্তী তো বলছিল বাবুজীর ট্রান্সফার হয়ে যেতে পারে।
-' নেহি বেটি তু চলি যা জিতনী জলদি হো শকে।'
-' হাঁ চাচী অব কলকাত্তামে রহেনা সহী হোগা মেরে লিয়ে। ওহ্ ভাগ্যিস ও আঙ্কেলে কাকিমা ছিলেন। নাহলে যে কোথায় যেতাম আমি?'
কথাগুলো বলতে বলতে খুব কান্না পেল শৈলপুত্রীর। তবুও কিছু করার নেই এবার ওকে চলে যেতেই হবে আলোর খোঁজে। ওর মনখারাপের কথা শুনে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন অপূর্ব আঙ্কেল তাতে লেখা আছে..' মনখারাপ কেন বেবি মা তোকে আসতে হবে এবার আলোর খোঁজে। কতদিন অন্ধকার থেকে বাঁচতে দেওঘরের ঐ ছোট্ট ঘরটায় মুখ লুকিয়ে থাকবি? যেটুকু আলো ছড়িয়েছিস তা যে সব নয় আরও অনেক আগুন আছে তোর মাঝে চকমকি ঠুকে সেই আগুন জ্বালিয়ে আলোতে ভরে দে চারপাশ।'
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন আর মাঝে একটা সপ্তাহ তারপরেই দেওঘর ছেড়ে চলে যাওয়া হয়ত এবার যাবে সাথে ওর ট্রাঙ্কটাও আগের বার ওটাকে এখানে রেখে গিয়ে মনটা খুব খারাপ হয়েছিল বারবারই মনে হত ওর ফেলে আসা স্মৃতির ঝাঁপিটা ওর থেকে অনেক দূরে। তাছাড়া কলেজে ভর্তি হলে আবার কবে আসতে পারবে জানে না। তাই এখন কলকাতা বেশি আপন করে থাকতে হবে।
রাতের আঁধারে বেবির চোখ ভেজে আবার খুব ইচ্ছে করে বাইরে বেরিয়ে তারাদের সাথে কথা বলতে কিন্তু সাহস পায় না। মনে মনে বলে বাবা আর কত বার ঠিকানা পাল্টাব বলতে পার? প্রথমে কাটিহার তারপর কলকাতা তারপরে দেওঘর ঘুরে আবার পাড়ি দেওয়া কলকাতার উদ্দেশ্যে। এখানে সাধারণ ভাবে মানুষ হওয়া শৈলপুত্রীর মানিয়ে নিতে অসুবিধা হয়নি। অবসর আর অবসাদ কেটে গেছে পড়িয়ে,ছবি এঁকে আর ঘরের কাজ করে। অবস্থার বিপাকে পড়ে সব কাজই শিখেছিল। তাই এখানেও চাচীর সাথে হাত মিলিয়ে সবই করত। শ্বশুরবাড়ি এসে ওকে কেউ আপন করে নেয়নি যার ফলে ওর দিন কাটত কাজের লোকেদের সাথে। আশা আর মধু বলত যে যেমন তেমন সঙ্গী খুঁজে নেয়।
অপূর্ব আঙ্কেলরাও তো বড়লোক ওখানে গিয়ূ মানিয়ে নিতে পারবে তো? অবশ্য ও থেকে এসেছে ওখানে কাকিমা ওকে মাথায় করে রেখেছিলেন। যত্ন, আদর ভালোবাসা আর পরিচর্যায় মুড়িয়ে রেখেছিলেন। তবুও নিজের বাড়িটা বড় মনের আনাচে কানাচে ঘোরে শৈলপুত্রীর। কত ইচ্ছে হয়েছে একবার গিয়ে দেখে আসবে লুকিয়ে কেমন আছে বাড়িটা। কতদিন দেখে না অথচ কত প্রিয় ছিল ঘরগুলো, উঠোন,রান্নাঘর আর কুয়োর পাড়টা। জানে কাকিমাও ওকে ভালোবাসবেন,আঙ্কেল যত্ন করবেন তবুও শৈলপুত্রীর ভয় হয়,অদ্ভুত একটা ভয় যেন আশ্রয় হারিয়ে ফেলছে এমন ভয়।বাচ্চাগুলোর খুব মনখারাপ দিদি কদিন বাদে চলে যাবে বলে। সাবিত্রী ওদের বোঝায়,' আরে ফির আয়েগী দিদি উসে ভী তো পড়াই করনা হ্যায় না?'
বিন্তি অবাক হয়ে বলেছিল,' দিদি ভী পড়াই করেগী?উসকি শাদী নেহি হোগী?'
শৈলপুত্রী চুপ করে গেছিল। উত্তর সাবিত্রীই দিয়েছিল,' আরে পাগলী পহেলে পড়াই করেগী,ফির নোকরী উসকে বাদ শাদী। তু ভী অ্যায়সে করনা সমঝি?'
শৈলপুত্রীকে চুপচাপ দেখে মন খারাপ করে সাবিত্রীর। আর তো হাতে দুটো দিন তারপরেই চলে যাবে মেয়েটা তাই বলে,' কাল মন্দির হোকে আ যা বেটি। কাল তো সোমবার ভী হ্যায় না। জলদি চলে যানা ম্যায় ফুলবন্তী কো বোল দুঙ্গী।'
মন্দিরে যাবার কথা শৈলপুত্রীর নিজেরও মনে হয়েছে। এই দেওঘরে এসে অনেকবারই ঘুরে এসেছে বাবার মন্দির থেকে। কলকাতা থেকে ফিরে এসেও পুজো দিতে গেছে। বাড়িতে রাখা ছোট শিবঠাকুরের ছবি সাথে করে এনেছিল আর এনেছিল পাথরের শিবলিঙ্গ যা বাবা নিষ্ঠাভরে পুজো করতেন। বলতেন ভোলে বাবা পরম দয়ালু আর তুই তো শৈলপুত্রী তাই ভোলে বাবার পূজা তো তোকে করতেই হবে। শিবের মত বর যে আসবে শৈলপুত্রী হাসত,' ও শিব বাবা ও তো শ্মশান মে রহেতা,কাপড়া নেহি উসকে পাস।'
-' আরে ধুর পাগলী ও সব সে সুন্দর হ্যায় ইশ লিয়ে তো পার্বতী তপস্যা কিয়া।'
শৈলপুত্রীর ছোট্ট মাথায় অত কিছু ঢোকেনি তবে হঠাৎই যখন আদিত্যর সাথে বিয়ে হয়ে গেছিল এক কথায় তখন ভেবেছিল যাক ওর বরটা সুন্দর শিবের মত নয়। কিন্তু ভাবতে পারেনি যে এমন হবে। পুরোনো কথা না ভাবতে চাইলেও মনে পড়ে যায় কখনও কখনও।
ভোরবেলা উঠে তৈরি হয়েছে শৈলপুত্রী তাড়াতাড়ি স্নান সেরে। ওর হাতে আজ লাল হলুদ চুড়ির গোছা পরনে লাল হলুদ ফুলের শাড়ি চাচী কিনে দিয়েছে সব ও চলে যাবে বলে। তাই চাচীর ইচ্ছে ওগুলো পরেই আজ পূজা দিয়ে আসুক মন্দিরে। হাতে পূজার সামগ্ৰী ঘটি নিয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়াতেই ফুলবন্তী এসে ডাকে,' দিদি চল জলদি,তুমহে মন্দির ঘুমাকে মুঝে ভী যানা হ্যায় কাম মে।'
তখনও আকাশের পর্দা সরিয়ে সূর্য মামা উঁকি দেয়নি পুরোপুরি। তবে হালকা আলো ফুটেছ। তাড়াতাড়ি ওরা পা চালায়। যত তাড়াতাড়ি যাবে ততই ভালো। আজ সোমবার তাই মন্দিরে অনেক লোকজন আসে। আর চাচী এই সোমবার খুব মানে।
মন্দির চত্ত্বরে তখনই বেশ ভিড় জমেছে। শৈলপুত্রী আর ফুলবন্তী দাঁড়ায় লাইনে। ফুলবন্তী সমানে বাবা বৈদ্যনাথকে স্মরণ করে চলেছে। মন্ত্রে, প্রদীপের আলোতে আর ধূপে মন্দির জমজমাট। খুব ভালো করেই পূজা দেয় শৈলপুত্রী, বেলপাতা ফুল জল সবই দিতে পারে। মাঝে মাঝেই আসে বলে পূজারীও ওকে চিনে গেছে। পূজা শেষে কপালে মেটে সিঁদুরের টিপ পরে বেরিয়ে আসে ওরা দুজন। ফুলবন্তীর সাথে মন্দির চত্বর পরিক্রমা করে এবার ফিরে যাবে। যাবার সময় ইচ্ছে আছে ফুলবন্তীর হাতে সাহাবজীর জন্য একটু পেঁড়া পাঠিয়ে দেবে। চাচী বারবার বলে দিয়েছে। ফুলবন্তীকে বলতেই বলেছে,' তুম ভী ঘুম কে যানা থোড়া। বাত ভী তো করনা হ্যায় কলকাত্তা যায়েগী না।'
ফুলবন্তী আগে পেছন পেছন শৈলপুত্রী দুজনে পরিক্রমা করে বেরোতে যাবে মন্দির থেকে এমন সময় পেছন থেকে শুনতে পায়।
-' আরে বেবি না? এখানে এই দেওঘরে!'
কথাটা শুনে ফিরে না তাকালেই হত। তবুও হঠাৎই মনকে কিছু চিন্তা করার অবকাশ না দিয়েই ওর চোখটা ফিরে তাকায়। গলাটা ভীষণ চেনা...
তবে তাকানোর পর মনে হল ফিরে না তাকালেই ভালো হত। সোজা এগিয়ে গেলেই হত।
ওকে যে ডাকছিল সে ও পেছন ফিরতেই সামনে এগিয়ে আসে,' সত্যিই আমি ভাবতেই পারছি না তোমাকে এই ভাবে দেখব এখানে! আমার তো রীতিমত গায়ে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করছে আমি স্বপ্ন দেখছি না তো।'
শৈলপুত্রী কোন উত্তর না দিয়ে এবার তাড়াতাড়ি পা বাড়ায়। কেন যে পেছন ফিরে তাকিয়েছিল। ফুলবন্তী অবাক হয় শৈলপুত্রীর আচরণে। কে এই লোকটা? দিদি যেন একে দেখে ঘাবড়ে গেছে। আস্তে ওর হাতে চাপ দিয়ে বলে,' কৌন ইয়ে,ঘাবড়াও মত কুছ নেহি হোগা। সব হামারা জান পহেচান হ্যায় ইধার।'
-' অব চল তুরন্ত বাদ মে বোলেগী সব।'
কিন্তু ততক্ষণে ওকে যে ডেকেছিল সে ওদেরকে ধরে ফেলেছে আর একদম শৈলপুত্রীর সামনে এসেই দাঁড়িয়েছে। এদিক ওদিক দেখে শৈলপুত্রী কি করবে ও এখন? কোথায় যাবে?
বেশ অনেকদিন কোথাও যায়নি দেব,বাড়িতে পরপর একটার পর একটা ঘটনা ঘটে চলেছে। বাবা থাকতে মাঝেমধ্যে এদিক ওদিক যেত বন্ধুদের সাথে। এক দুদিন কাটিয়ে ফুসফুসে অনেকটা হাওয়া ভরে চলে আসত। কিন্তু এর মধ্যে সেই অবকাশ হয়নি। প্রকৃতি ওকে টানে,ভালো লাগে। মধুর পছন্দ শহর দিল্লী,বম্বে,গোয়া হলে মধু যেতে চায়। সুতরাং এই এক দুদিনের ট্রিপ মোটামুটি বন্ধুদের সাথেই সারে ও। যদিও বারবার বলেছিল মধুকে সাথে গেলে চল শুনেছি ভালো জায়গা। আর আমার ইচ্ছে একটু পুজো দেব। মাও বলছে বারবার বাবা বৈদ্যনাথকে ধরে অনেকের অনেক কিছু হয়। যদি আমাদেরও কিছু একটা হয়। মধু চোখ সরু করে বলেছিল,' ডাক্তার তো দেখানো হচ্ছে,ভগবান কি চিকিৎসা করবেন?' অবাক হয়েছিল দেব সাধারণতঃ মেয়েরাই এগুলো বেশি বিশ্বাস করে।
-' তুমি যাও ঘুরে এস আমি দুদিন বাপের বাড়ি থেকে আসব। এখানে আর ভালো লাগছে না বাড়িটা কেমন যেন চিড়িয়াখানা হয়ে গেছে।'
অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও দেব বলতে পারে না। হয়ত এই চিড়িয়াখানা ওরাই করেছে বাড়িটাকে। তবে এটা চিড়িয়াখানা নয় সেখানেও তো কত আনন্দ থাকে। এ যেন একটা নিষ্প্রাণ পুরী।'
গতকাল রাতেই এখানে এসেছে দেব। বন্ধুরা ঘুমোলেও ভোরে ঘুম ভেঙে স্নান করে ছুটে এসেছে মন্দিরে মায়ের কথা মত। ভেবেছিল একদম পুজো দিয়ে ফিরবে তাই আসা এখানে। কিন্তু শৈলপুত্রীকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে এক জায়গায়। তারপর কিছুটা সময় শুধু অনুসরণ করেছে দেখেছে চোখ বন্ধ করে মন্ত্র পড়ছে তাই ডাকেনি ইচ্ছে করেই। তারপর আর পারেনি নিজেকে সামলাতে। সেদিনের পর কিছুতেই ভুলতে পারেনি শৈলপুত্রীর প্রতিটা পদক্ষেপ দেব ভীষণ ভাবে বেবির রূপ বদল সবার মত দাগ কেটে গেছিল ওর মনেও। আজ আবার আরেকবার চমকে উঠল এই দেওঘরের শিবজীর মন্দিরে ওকে দেখে। এই তো কিছুদিন আগে অপূর্ব কাকুকে ফোন করেছিল যে বেবি কোথায়? শুনেছে সে আছে কিন্তু কথা বলতে চায় না। তবে এখানে কি করছে বেবি? কার বাড়িতে এসেছে এখানে নাকি বেড়াতে?
শৈলপুত্রী দেখে বড়া ভাইয়া ওকে অবাক হয়ে দেখছে। যদিও ওর পরনে নতুন ভাজ ভাঙা শাড়ি তবুও এ সেই চেনা বেবি যার সাথে মেলানো যায় না কিছুতেই সেদিনের সেই হিলতোলা জুতো আর দামি শাড়ি পরা ঢেউ খেলানো চুল আর ঠোঁট আঁকা বেবিকে। এমন তো কতই হয় এক রকম দেখতে কেউ থাকে। তবে কি এই বেবি আসল সে নকল কেউ ছিল?
শৈলপুত্রী বুঝতে পারে বড়া ভাইয়াকে এড়িয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব হবে না। এখনই অনেকগুলো প্রশ্নের তীর আসবে ওর দিকে ছুটে কিন্তু কি করে ও সামলাবে এসব? যদি বলে ও এখানে কোথায় থাকে তাহলে তো মুশকিল হবে সবচেয়ে আগে চাচার। ওকে আশ্রয় দেবার অপরাধে একজন বিশ্বাসী লোক পড়বে চোরের তালিকাতে। কিছুতেই তার থেকে নিস্কৃতি পাবে না মানুষটা। ওদের সবাইকে চেনে শৈলপুত্রী মধু,সানন্দা,আদিত্য আর ওর প্রাক্তন শাশুড়ির কেউই ছাড়বে না চাচাকে। এই ভয় অনেকদিন ধরেই পাচ্ছিল চাচা আর আজ হঠাৎই ঘটনা ঘটে গেল। মনে মনে মহাদেবকে স্মরণ করে শৈলপুত্রী। কি আছে দেবতার মনে?
দেব একদম ওদের সামনে দাঁড়িয়ে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করে,' আচ্ছা বেবি আমি কি এতটাই খারাপ মানুষ যে আমাকে চিনতে না পেরে তুমি চলে যাচ্ছ হন হন করে।'
-' কিসকো ঢুন্ড রহে হ্যায় আপ? মালুম হোতা কোই গলতি হুয়ী আপ কো।'
দেব শান্ত ভদ্র কিন্তু বুদ্ধিমান ও বুঝতে পারে যে কোন কারণেই হোক বেবি ওকে চিনতে চায় না তাই এমন করছে। এই বেবি তো ওর ভীষণ চেনা,এভাবেই তো থাকত ওদের বাড়িতে। বরং বৌভাতের দিন দেখা বেবি ওর অপরিচিত। কখনও দেখেনি বেবিকে অমন সাজে।
-' আমি জানি আমাদের ওপর তোমার অনেক রাগ আর অভিমান। সেইজন্য আমার লজ্জার শেষ নেই। সেদিন কোন সাহায্য করতে পারিনি আমি।'
-' হমলোগ জলদি মে হ্যায় আপ কো হম পহেচানতে নেহি।'
বেবির ব্যবহারে খুব অপমানিত লাগে দেবের কখনও ও নিজে বেবির সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি তবে কেন এমন আচরণ করছে মেয়েটা!
মাথার ঘোমটা তুলে দেয় শৈলপুত্রী হাতে পুজোর সামগ্ৰী নিয়ে পা বাড়ায় সামনের দিকে। হাল ছাড়ে না দেবও না এই হেয়ালীর জট ওকে ছাড়াতেই হবে। তাই পুজো দেওয়া মাথায় উঠে যায় ওর। বরং ওদের পেছন পেছন যেতে থাকে। ফুলবন্তী পেছনে দেখে একবার আস্তে আস্তে বলে,' ও তো ফলো কর রহা হ্যায় দিদি। কৌন হ্যায়?'
-' অব চল,জান পহেচানকে হ্যায়।'
শৈলপুত্রী ঠিক করে নেয় এবার ও দেবের সামনাসামনি হবে। কেনই বা পালাবে আর সাহাবজী তো আছেই এখন ও চাচার ওখানে যাবে না বরং সাহাবজীর কোয়ার্টারে যাবে। একটা মিথ্যে বলতে গিয়ে আরও কোন ঝামেলা হতে পারে তাছাড়া এত ভয় কিসের? আর নটরাজকে তো দেব চেনেই সুতরাং চিন্তা নেই। এখন কি বলবে?'
দেব আবার ডাকে,' বেবি একবার দাঁড়াও,তুমি এতটা খারাপ ব্যবহার করতে পার আমি ভাবতেও পারি না। আমি তোমাকে সত্যিই আমার ছোট বোনের মত দেখেছি। শৈলজা কাকু কাকিমার কথা ভুলতে পারি না।'
ততক্ষণে ওরা মন্দিরের রাস্তা ছেড়ে আরও এগিয়ে গেছে। দেবের শেষ কথাটা ছুঁঁয়ে যায় ওকে সত্যিই মানুষ হিসেবে বড়া ভাইয়া কোনদিনই খারাপ ছিলেন না। তাই ফুলবন্তীকে থামতে বলে আর ঘুরে দাঁড়ায়।
দেবের মুখটা উজ্জ্বল হয় মুহূর্তে,' আমি জানি তো তুমিই আমার বোন বেবি। আমি ক্ষমাপ্রার্থী তোমার কাছে। সেদিন আমাদের বাড়িতে সবাই যা করেছে তোমার সাথে তাতে এমনি ব্যবহার তোমার করার কথা।'
দেবের সাথে আর সত্যিই কোন কথা বলার মত নেই শৈলপুত্রীর তাই বলে,' হ্যাঁ আমিই বেবি। কিছু বলবেন আর? আমার তাড়া আছে।'
-' তুমি কি এখানে থাক? কোথায়? অপূর্ব আঙ্কেলের কাছে শুনেছি তুমি কলকাতায় থাক। এখানে দেখে অবাক হলাম। মনে হচ্ছে দেখে বেড়াতে আসনি,এখানে থাক।'
সাদামাটা বলে যে মানুষটাকে ভেবেছে শৈলপুত্রী দেখে তাঁরও কৌতূহল কোন কম নয়। আচ্ছা এদের এত মাথাব্যথা কেন ওকে নিয়ে? কিন্তু কিছুতেই ধরা দেওয়া যাবে না যে ও চাচার বাড়িতে থাকে। তাই বলল,' হ্যাঁ আমি কদিনের জন্য এসেছি এর পরই চলে যাব। আপনি এত কথা জানতে চাইছেন কেন বলুন তো? আমার সাথে তো সেই কবেই ও বাড়ির সম্পর্ক চুকে গেছে। শুধু এসেছিলাম সেদিন বাধ্য হয়ে গয়না নিতে। আর কিছু চাই না আমার। আপনি আসুন আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।'
-' এখানে কোথায় বাড়ি তোমার? মানে কার বাড়িতে এসেছ?'
-' অপূর্ব আঙ্কেলের ভাগ্নের বাড়িতে এসেছি কদিন হল।'
কথায় কথায় বেশ অনেকটা এগিয়ে এসেছে ওরা একটু এগোলেই নটরাজের কোয়ার্টার। ওহ্ আরও কেউ এসেছেন বুঝি। শৈলপুত্রী মাথা নাড়ে।
ফুলবন্তী বলে,' সাহাব আপ অব যাইয়ে আপ কো পূজা কে দের হো যায়েগা।'
অস্বস্তি হয় শৈলপুত্রীর অদ্ভুত আচরণ করছে আজ বড়া ভাইয়া। তবে কি ওরা ওকে সন্দেহ করে? এখন কি আবার যেতে চাইবে নাকি ওর সাথে? সাহাব তো কিছুই জানে না। কি হবে তাহলে?'
হঠাৎই যা ভেবেছিল তাই হল,দেব বলল,' কত দূরে তুমি উঠেছ? বেশ লাগছে জান বেবি মনটা আজ অনেক হাল্কা। আসলে ও বাড়িতে কখনও ইচ্ছে থাকলেও তোমাকে সহানুভূতি দেখাতে পারিনি মা আর মধুর দাপটে। তাই একটা অপরাধ আমাকে তাড়া করত। তোমাকে ভালো থাকতে দেখে সত্যিই খুব ভালো লাগছে।'
শৈলপুত্রীর এই কথাগুলোতে আর কিছু যায় আসে না এমনিতেই ওর মনটা ভারী ছিল কয়েকটা দিন এখান থেকে চলে যেতে হবে। এখন আরও একটা দুশ্চিন্তার পাথর চাপল বুকে। তাছাড়া দেব ভাইয়া তো ওকে সেদিন একটুও সাহায্য করেনি এখন ক্ষমা চেয়ে কি হবে?
-' হাঁ আপনি এখন যান। আমারও জলদি আছে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।'
-' বেবি এক মিনিট একটু অপূর্ব কাকুর সাথে দেখা করে যেতাম। ভীষণ ভালো মানুষ, তোমাকে যে এত আগলে রেখেছেন তার জন্য কেন যেন আমার শান্তি লাগছে।'
-' উনি তো আসেননি,আমি নটরাজ বাবুর সাথে এসেছি ওঁর বোনের ছেলে উনি। নটরাজ বাবু অফিসে বেরোবেন তাই আমাকে এখনি ফিরতে হবে। কলকাতা ফিরে দেখা করে নেবেন।'
অবাক হয়ে যায় দেব অপূর্ব কাকু একা এই নটরাজ নামের ভদ্রলোকের সাথে বেবিকে দেওঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে! সব কিছু কেমন যেন গোলমেলে লাগছে ওর। বেবি অপূর্ব কাকুর ওখানে থাকে দামি গাড়ি থেকে নেমেছিল সেদিন হিল পরে আজ বেবির পরনে সাধারণ শাড়ি,হাতে কাঁচের চুড়ি দেখতে অনেকটা হিন্দুস্থানী মেয়েদের মত। কেন যেন স্টেপ কাট চুলের শৈলপুত্রী মিশ্রা যে দামি মার্সেডিজ গাড়ি থেকে নেমেছিল এই বেবি মানে শৈলপুত্রীর সাথে মেলানো যায় না। কোথায় যেন একটা রহস্যের গন্ধ পায় দেব। মাথায় হিন্দী সিনেমার সীতা অওর গীতার কিছুটা অংশ ভেসে ওঠে। শৈলপুত্রীর কোন যমজ বোন নেই তো? যে অপূর্ব কাকুর কাছেই মানুষ। হতেই পারে।
দেব কিছুটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে বলে,' ওহ্ আচ্ছা,আমি তো দুদিন আছি তোমার থাকার জায়গাটা দেখে গেলে আরেকবার এসে দেখা করে যেতাম। আর হয়ত কখনও এভাবে দেখা হবে না। আর তোমার কত টাকা রাখা ছিল বাবার কাছে মনে আছে? আমি চেষ্টা করছি টাকাটা ফেরত দিতে।'
যে জবাব সেদিন দিতে পারেনি তা আজ দিল শৈলপুত্রী,' ও টাকা আপনারা রেখে দিন,আমি ছিলাম ভিখারির মেয়ে তাই ওটা আমার খাবার খরচ হিসেবে রেখে দিন। গয়না ভী আমি লিতাম না কিন্তু ও আমার মায়ের গয়না তা অন্য কেউ পরবে সেটা হয় না। তাই তো আবার যেতে হল। নাহলে তো সব ছেড়েই এসেছিলাম।'
ফুলবন্তী খুব বিরক্ত হয় এই বেহুদ্দা আদমীটার ওপর। ও মন্দির সে ওদের পিছে পড়ে আছে প্রতাপ থাকলে কখনই হাঁকিয়ে দিত ছেলেদের ডেকে। দিদির জীবনের কিছু কাহানী ও জানে কথা শুনে বুঝতে পারে এই আদমী কে হতে পারে। ঐ তো কাছেই বাবুজীর কোয়ার্টার দেখা যাচ্ছে। এই আদমী তো যাচ্ছে না কিছুতেই তাই শৈলপুত্রীর কথা বলার ফাঁকে ছুট লাগায় ফুলবন্তী না বাবুজীকেই বুলাতে হবে।
-' ওহ তোমার সাথে যে ছিল সে কে? হঠাৎই চলে গেল দৌড়ে তোমাকে না বলে? নতুন জায়গা তো এভাবে চলে গেল!'
-' ও আমাদের কোয়ার্টারে কাজ করে দেয় হাতে হাতে। ঠিক আছে আপনি যান এখন। আপনি যাদের সাথে এসেছেন নিশ্চয় খুঁজবে আপনাকে। তাছাড়া আপনি মন্দিরে পূজাও তো দেবেন।'
-' সবাই কি আমার মত? ওরা ঠিক ঘুমোচ্ছে এখনও। হ্যাঁ পূজা তো দেবই ভগবান আমার আজ মনের ইচ্ছে পূরণ করে দিয়েছেন তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার সুযোগ হল। চল নতুন জায়গা তোমাকে বরং পৌঁছে দিই বাড়িতে।'
-' নাহ তার আর দরকার হবে না আমি এসে পড়েছি ফুলবন্তী গিয়ে খবর দিল। চল শৈলপুত্রী অনেকটা বেলা হয়ে গেছে কখন পুজো দিতে গেলে ফুলবন্তীর সাথে। আরে রান্না তো করবে নাকি? আমি খেয়ে বেরোব তো। চল চল। হ্যাঁ আপনি আসতে পারেন এখন নমস্কার।'
নটরাজ নমস্কার জানিয়ে আপনি এবার আসুন মশাই এমন ইঙ্গিত দিলেও নড়ে না দেব। ভদ্রলোককে চেনা লাগছে ওহ্ ওদের বাড়িতেই তো দেখেছে পরে ঢুকেছিল কিন্তু কোন কথা হয়নি মানে কথা বলেনি চুপ করেছিল ওরই মত। তাই হাত তুলে নমস্কার জানায় তারপর বলে,' আমাকে নিশ্চয় চিনতে পারছেন মানে সেদিন তো ছিলেন আপনি ওখানে। বেবি আমাকে বড়া ভাইয়া বলত। আপনিই তো নটরাজ বাবু? মানে বেবি বোধহয় আপনার কথাই বলছিল।'
-' হ্যাঁ আমি নটরাজ এখানে চাকরি করি।'
-' বেবি তাহলে আপনার সাথেই কলকাতা থেকে এসেছে?'
নটরাজ বুঝতে পারে বোকা সেজে থাকলেও এই ভদ্রলোকের বুদ্ধিও কম নয়। ভালোমানুষী করে জানতে চায় অনেক কিছুই,হয়ত সন্দেহও করে। নাহ্ এবার একে থামাতে হবে কারণ এটা তো বলা যাবে না বেবি চাচার বাড়িতে থাকে তাহলে একটা গরীবের হেনস্থা হবে শুধু শুধু।
- ' হ্যাঁ আমার সাথেই এসেছে,আরে মশাই দুদিন বাদে যার সাথে বিয়ে হবে তারও তো চেনা দরকার নতুন সংসারটা ভালো করে। তাই নিয়ে এলাম। হঠাৎ বিয়ে হয়ে পরে ধাক্কা খাবার থেকে চিনে জেনে নেওয়া ভালো। আর শৈলপুত্রী ভীষণ গুণী মেয়ে ওরও তো একটা পছন্দ আছে। আপনিও আসতে পারেন চা খেয়ে যাবেন। এককালে আত্মীয় ছিলেন ওর। চা কিন্তু দারুণ বানায় ও রান্নাও খুব ভালো করে। আরও কত গুণ বলব ছবি দুর্দান্ত আঁকে,গান গায়,পড়াতে পারে। আমি তো ওর গুণেই মুগ্ধ।'
শৈলপুত্রী অবাক হয়ে নটরাজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, সাহাব কী বলছে এই সব! ওর সাথে সাহাবজীর বিয়ে হবে?
নটরাজ একটানা কথা বলে যাচ্ছে শৈলপুত্রীর সাথে অবাক হয়েছে দেবও। ভালো করে তাকিয়ে দেখে ছেলেটাকে গায়ের রঙ চাপা মানে কালোই বলা চলে। অনেকটাই মিল আছে অপূর্ব কাকুর সাথে। তবে অতটা কালো নয়। মোটামুটি ছ ফিটের মত লম্বা ওদের দুই ভাইয়ের মত ফরসা না হলেও চোখ নাক বেশ টানটান আর লম্বা পেটানো চেহারা। এখন পরনে পাজামা পাঞ্জাবি তাতেও বেশ লাগছে। ওদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মায়ের কাছে সেরা ছেলে আদিত্য কারণ আদিত্য দেখতে সুন্দর, দেবের চেয়েও ফরসা তারপর পড়াশোনা শিখেছে ভালো চাকরি করে। পড়াশোনা বেশি হয়নি দেবের টেনে টুনে বি কম তারপর বিদ্যে বুদ্ধি কম বলে ঠাঁই হয়েছিল বাবার ব্যবসাতে।
বাবা বলেছিলেন,' আরে মন ছোট করিস না দুজনেই চাকরি করলে আমার এত বড় ব্যবসাটা কে দেখবে শুনি?'
তারপর থেকেই দেব পুরোপুরি ব্যবসাতে আর আদিত্য চাকরিতে। দেব ঘরোয়া আর আদিত্য বেপোরোয়া। শিবনারায়ণ পরে ভেবেছিলেন একটা সময় যদি বেবির সাথে দেবের বিয়ে হত তাহলে মেয়েটাকে এতটা কষ্ট সইতে হত না। কিন্তু তা কি আর হয়? যার সাথে যার লেখা।
দুজনকে পাশাপাশি দেখে দেব,নাহ্ ভালো মানিয়েছে ওদের দুজনকে। যাক মেয়েটা ভালো আছে একজন ভালো সঙ্গী জীবনে পাচ্ছে এর থেকে আর বেশি কি হতে পারে? তাছাড়া মেয়েটার গুণ নিয়ে কত কথা বলল। ওদের বাড়িতে তো শুনে এসেছে সারাক্ষণ মা মধু ভাই যাচ্ছেতাই করে অপমান করত।
শৈলপুত্রীর পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে। এই সব কথাগুলো সাহাবকে কে বলতে বলেছে? ফুলবন্তী কোথায়? ও কি গেছিল সব বলতে সাহাবকে? নাহ্ এভাবে আর মিথ্যা বলা উচিত নয় সত্যি কথা বলে দেওয়া উচিত। তাই ও বলে,' না না ওসব কিছু নয় আমার খুব ইচ্ছে ছিল দেওঘর দেখার আর পূজা দেওয়ার।'
-' আরে এত লজ্জার কি আছে এতে শুনি। উনি যখন বলছেন তোমাকে বোনের মত দেখেন তখন ওঁরও সত্যিটা জানা উচিত। হ্যাঁ আসি এবার অনেকটা দেরি হয়ে গেছে আমাকে অফিসের জন্য রেডি হতে হবে।'
দেব হেসে বলে,' নাহ্ এতদিন বাদে যখন দেখা হল তখন আমি আর আপনার চা খাওয়াবার আমন্ত্রণটা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। সত্যিই বেবির হাতের চা দুর্দান্ত। বাবা তো ও আসার পর ওর হাতে ছাড়া চা খেত না।'
শৈলপুত্রী নটরাজের দিকে তাকায়। নটরাজ বিরক্ত হলেও স্বভাবজাত হাসিটা ঝুলিয়ে রাখে ঠোঁটের কোণে বুঝতে পারে অসীম কৌতূহল এই লোকটার এ একদম ওর আস্তানা অবধি গিয়ে তবে ছাড়বে। কিছু করার নেই সত্যিই এতটা অভদ্রতা করা যায় না।
নটরাজ দেবের সাথে কথা বলতে বলতে আসছে শৈলপুত্রী কোয়ার্টারের দিকে পা বাড়ায় তাড়াতাড়ি। বুকের ভেতর গরম হাতুড়ি ঘা মারতে থাকে। ঠিক করেছিল চাচীর কথা মত সাহাবকে পেঁড়া দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু এবার কি হবে কে জানে? ওকে আর চাচাকে বাঁচাতে কি করল সাহাব।
দেব বাইরের বারান্দায় বসে,নাহ্ সত্যিই এই জায়গাটা খুব সুন্দর। বাড়িতে গিয়ে যদি বলে ওখানে গিয়ে বেবির সাথে দেখা হয়েছে আর ওর হবু বরের সাথে বিয়ের আগেই ঘোরাঘুরি করছে এখানে ওখানে। তাহলে তো আর রক্ষা নেই আর এই চা খাবার কথা তো বলাই যাবে না। মধু একেবারে ঘাড় মটকে দেবে। এমনিতেই গয়না ফেরত দিতে বলেছে মাকে তাই এত রাগ। যাক ওসব ভেবে লাভ নেই।
চা বিস্কিট ভুজিয়া আর প্রসাদের পেঁড়া খেয়ে আদিত্য বেশ কিছুটা আগে চলে গেছে। অবশ্য যাবার সময় আবার ওদের কাছে ক্ষমা চেয়ে গেছে। আর নটরাজের আতিথেয়তার সুখ্যাতি করে গেছে,' আরে সেদিন তো কোন কথাই হয়নি। সত্যিই আমি ভাবতে পারিনি আপনি এত ভালোমানুষ। যাক নিশ্চিন্ত লাগছে বেবির জন্য। আর ওর কষ্ট হবে না।'
হা হা করে হেসে উঠেছিল নটরাজ,' আরে শৈলপুত্রীকে কষ্ট দেবে কে? সেই তো ত্রিনয়নের তেজে জ্বলে পুড়ে মরবে। কি শৈলপুত্রী ঠিক বললাম না?'
লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে চলে এসেছিল শৈলপুত্রী ফুলবন্তীকে সরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছিল। বুকটা কাঁপছিল তিরতির করে এমন করে কারও কাছ থেকেই বোধহয় শোনেনি কখনও। মাছ ভাজতে ভাজতে আনমনা হয়ে যায় লাল হয়ে যায় মাছগুলো ও নিজেও লজ্জা পায় এটা কি হল? ফুলবন্তী ব্যস্ত হয়ে রান্নাঘরে ঢোকে হাতে জলখাবার নিয়ে,' দিদি জলদি সে কুছ খা লো,কিতনে দের হো গয়ে বাবুজী বোলা তুমে ভী খানে কে লিয়ে। ও হাঁ বাবুজী তুমে বুলা রহা বাহার মে।'
খাবার খেতে হাত ওঠে না ওর চিন্তা,ভয় লজ্জা সব মিলে কেমন যেন অস্থির লাগছে মনে হচ্ছে এখুনি কলকাতা চলে যেতে পারলে ভালো হত। কি করবে ও? চাচীর বাড়ি চল যাবে লুকিয়ে? কিন্তু যদি আবার বড়া ভাইয়া এখানে আসে তাহলে কি হবে? না না চাচাকে বিপদে ফেলা যাবে না।
-' আপনি বসুন এখানে, এ কি মুখটা এত শুকনো কেন শরীর ঠিক আছে তো আপনার?'
কিছুক্ষণ আগের নটরাজকে আর খুঁজে পায় না শৈলপুত্রী এ অন্য মানুষ যেমন সাহাবজী ঠিক তেমন।
-' আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে ভাগ্যিস তখন আপনি এসেছিলেন নাহলে যে কী করতাম! আচ্ছা আমি এখন কোথায় যাব? চাচীর ওখানে তো যাওয়া যাবে না। আমি চাই না চাচার বিপদ হোক।'
-' আমিও চাই না মামুও বারবার বলে দিয়েছেন সে কথা। অদ্ভুত মানুষ এই ভদ্রলোক, দেখে মনে হল ভালো কিন্তু খুব বেশি কৌতূহল আর সেটাই আমার অপছন্দের।'
-' আপনি আমাকে আজই কলকাতা পাঠিয়ে দিন যেভাবেই হোক। আমি এভাবেই চলে যাব। নাহলে ফুলবন্তী গিয়ে নিয়ে আসবে আমার জিনিসপত্র।'
-' আপনি অযথা এতটা চাপ নেবেন না। ওঁকে কি বলেছি শুনেছেন তো? তাই একা আপনাকে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে না। হয়ত কাল আবার এসে হাজির হলেন। মানে হতেই পারেন তখন আমি কি বলব? আচ্ছা উনি যেন কবে যাবেন বললেন?'
-' পরশু তো বলছিলেন।'
-' আমাদের যাবার কথা তার পর দিন। যাক তাই হবে আপনিও সবার সাথে দেখা করে নেবেন। তবে ওকে কিছু বলার দরকার নেই আমরা কবে যাব মানে যদি দেখা হয়। আর আমার তো মনে হচ্ছে আবার দেখা হবে।'
-' আমি এখন কি করব? কোথায় থাকব? কোথায় যাব?'
কথাগুলো বলতে গিয়ে খুব অসহায় লাগে ওর চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে। খারাপ লাগে নটরাজেরও সত্যিই খুব চিন্তার কথা তবে বুদ্ধি করে চলতে হবে।
-' নাহ শৈলপুত্রীর চোখে আগুন মানায় জল মানায় না। আপনি এখানে থাকবেন মানে আমার এখানে আমি তো তাই বলেছি ওঁকে।'
-' আপনার এখানে থাকব? লোকে আপনাকে কি বলবে তার ধারণা আছে? না না আমার জন্য আপনার বদনাম হোক তা হয় না। আপনি আমাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিন।'
নটরাজ আর কিছু বলে না ভেতরে গিয়ে ফুলবন্তীকে কি সব বলে। একটু বাদেই লাফাতে লাফাতে আসে ফুলবন্তী বাবু বলেছেন ফুলবন্তী, মুন্না প্রতাপ সবাই দুটো রাত এখানেই থাকবে। তেমন হলে মথুরাও থাকবে। এতগুলো ঘর আছে,আউট হাউসও তো আছে।
-' দিদি বহত মজে মে রহেঙ্গ হম। পিকনিক মানায়েঙ্গে।'
বাড়িতে সব ব্যবস্থা করে প্রতাপ ছেলেকে নিয়ে চলে এসেছে। ও আর মথুরা আউট হাউসে থাকবে। ফুলবন্তী আর শৈলপুত্রী থাকবে রান্নাঘরের সামনের ঘরটাতে। চাচীর জন্য খুব মন খারাপ করে ওর। চাচী নাকি খুব কেঁদেছে বলেছে গরীব হওয়ার অনেক জ্বালা।
দুটো দিন ভালোই কেটে গেল দেখতে দেখতে এখানে। নটরাজের একলা সাম্রাজ্য আলো হয়েছে সুশ্রী হাতের ছোঁয়ায়। এই দুদিনে ফুলবন্তীকে সাথে নিয়ে সুন্দর করে গুছিয়ে দিয়েছে ঘরদোর। গোলাপ গাছে সার দিয়েছে ফুলদানিতে রেখেছে বাগান থেকে আনা হাসনুহানা। ব্যাচেলার নটরাজের মন হাসনুহানার গন্ধে উতলা হয় একটু ছোঁয়া লাগে যত্নের। এমন কেউ যদি যত্ন করার মত হয় মন্দ হয় না। বিছানায় শুয়ে জানলা দিয়ে আসা ফুলের গন্ধে শৈলপুত্রীর ঘুম আসে না মাথায় ঘোরে কত কথা। মনে পড়ে ওর বাবা মায়ের কথা। বড়া ভাইয়াকে বলা সাহাবজীর কথাগুলো। সাহাবজী খুব ভালো, ওর চোখে দেখা একজন ভালো মানুষ। তবে সাহাবজীর কথা ঠিক দুদিনে দুবার করে এসে দেখা দিয়ে গেছে বড়া ভাইয়া। নটরাজ হেসে বলেছে শৈলপুত্রীকে কিসের টানে ভদ্রলোকের এত টান কে জানে? চা না বেবি? নাকি অন্য কোন কৌতূহল?
যাক নিশ্চিন্ত যে চলে গেছে এবার দেব ভালো করেই খবর নিয়েছে নটরাজ। বন্দি শৈলপুত্রী ফিরেছে পথের ধুলো উড়িয়ে চাচীর ওখানে। কিন্তু বাড়ির সামনে পাড়ার লোকের জটলা দেখে অবাক হয়ে যায় শৈলপুত্রী হয়ত এটাই গ্ৰামের পরিবেশ শহর হলে কেউ মাথা ঘামায় না কে কোথায় গেল? পাড়ার কিছু লোক নাকি কৃপাণ সিংয়ের উস্কানিতে বলছে শৈলপুত্রীর চরিত্রে দোষ আছে তাই তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন নেয় না,সিঁদুর মুছে ঘোরে। কেন ও দু রাত্রি সাহাবজীর ওখানে থেকে এল? শৈলপুত্রী বোঝে এদের রাগ শুধু ওর ওপর নয় এরা সাহাবজীকে বদনাম করতে চায়।
আর মাত্র তো একটা দিন তখনও ওরা ওকে এখানে শান্তি পেতে দেবে না? ও তো চলেই যাবে কিন্তু সাহাবজীর কি হবে? চাচী আর ফুলবন্তী ওদের সাথে কথা বলে চলে যায় ওরা। শৈলপুত্রীর আজ খুব কান্না পায় কেন যে ওর সাথে এমন হচ্ছে কে জানে? আর কত লড়াই করতে হবে ওকে? সাহাবজী যদি ওর জন্য বিপদে পড়ে? চাচীকে বলতেই চাচী বলে সবাই ভুলে যাবে সব ও চলে গেলে। সাহাব ওপর তলার লোকের সাথে উঠাবসা করে কেউ কিছু করতে পারবে না।
মন খারাপের হিমেল হাওয়া মনের জানলা দিয়ে ঢুকলো হু হু করে শৈলপুত্রীর। দেখতে দেখতে দিন শেষ আজই ও চলে যাবে ওর আনা পুরোনো ট্রাঙ্কে গুছিয়ে নেয় শেষ সম্বলটুকু এবার আবার যাযাবরের যাত্রা শুরু এক মুলুক থেকে আরেক মুলুকে।
তবে নটরাজের কাজের জন্য আরও দুদিন বাড়তি থাকা হল দেওঘরে কিন্তু সেই থাকা খুব একটা সুখকর হল না আসেপাশে উঠল নানা কথা। কেন শৈলপুত্রী নটরাজের ওখানে দুদিন থেকে এল তা নিয়ে নানা আলোচনা হল পাড়া জুড়ে।
মেয়েদের চরিত্রের একটু ফাঁক পেলেই তা নিয়ে বোধহয় মহাভারত লেখা যায় আমাদের দেশেই সুতরাং শৈলপুত্রী আর বাদ যাবে কেন?
*************************
বেশ কিছুদিন বাদে নটরাজ ফিরছে বাড়িতে। ছেলে আসা মানেই খুশির দোলা লাগে ওঁদের স্বামী স্ত্রীর মনে। বেশ কদিন আগে থেকেই ফ্রীজ ভরে ভালোমন্দে। কর্তা গিন্নী মিলে লম্বা লিস্ট করেন কি কি খাওয়াবেন ছেলেকে। পটলের দোরমা খেতে খুব ভালোবাসে তাই লাবণ্য তোড়জোড় শুরু করেছেন অল্প বানালে হয় না দাদাকে পাঠাতে হয়। নাহলে দাদার অভিযোগ হবে শুরু। কর্তাকে আবার বাজারে পাঠিয়ে নিজে পটলের ছাল ছাড়াতে ব্যস্ত। তার মধ্যেই ফোনটা বেজে ওঠে। ওহ্ বাড়িতে কেউ নেই যে বলবে ফোনটা ধরতে বাধ্য হয়েই উঠতে হয়।
-' হ্যালো, কে বলছেন?'
-' চিনতে পারছিস লাবণ্য কে বলত আমি?'
লাবণ্য স্মৃতির সিঁড়ি ভাঙে আর ভাবে এই গলা তার বড় চেনা কিন্তু সে কেন ফোন করবে তাকে? বহুদিন তো কোন সম্পর্ক নেই তাই বলে,' নাহ আমি চিনতে পারছি না।'
ওকে আর ভাবার সুযোগ না দিয়ে ওপাশ থেকে একটা হাসির আওয়াজ পাওয়া যায় হঠাৎই মিছরির ছুরি উপমাটার কথা মনে পড়ে যায় লাবণ্যর শৈলজা দা বলেছিলেন কথাটা। তবুও ধরা দেয় না লাবণ্য।
-' বাবা সত্যিই কত বদলে গেছিস! অথচ একটা সময় দিনরাত পড়ে থাকতিস আমাদের বাড়ি। কত সিনেমা দেখেছি একসাথে। আরে আমি আশা রে।'
মানুষ কতটা নির্লজ্জ হতে পারে ভাবে লাবণ্য। দাদার কাছে শুনেছে আশার কান্ড। আর আগের কথা তো বলারই নয় সেইজন্য তো সম্পর্ক ভেঙে গেছিল।
-' হঠাৎই আমাকে ফোন করলি কেন এত বছর বাদে? কি দরকার? আর আমার নম্বর পেলি কোথায়?'
-' কতগুলো প্রশ্ন করলি। একবারও জিজ্ঞেস করলি না আমি কেমন আছি। নিশ্চয় জানিস তোর শিবনারায়ণ দা আর নেই।'
-' হ্যাঁ শুনেছি।'
-' আমি ভালো নেই রে লাবু। তোকে পুরোনো নামে ডাকতে ইচ্ছে করল। তোর তো সুখের সংসার। ছেলেও তো খুব ভালো।'
আশার এই মন ভোলানো কথা ভালো লাগে না লাবণ্যর। তাই বলে,' কি বলবি বল,আমি একটু ব্যস্ত আছি রান্না করছি। পরে কথা বলব।'
-' শুনলাম ছেলের বিয়ে দিচ্ছিস মানে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?'
-' কি বলছিস! কে বলল তোকে এইসব। হ্যাঁ তবে দেব বিয়ে।'
-' ওহ্ রেজেস্ট্রী হয়ে গেছে বুঝি?'
-' আশা কি বলছিস এতদিন পর ফোন করে? আমি রাখছি এখন।'
-' আরে দাঁড়া আমিও তো শুনে অবাক তাই আর পারলাম না তোকে ফোনই করে ফেললাম। দেব তো তোর হবু বৌমাকে দেখে এসেছে দেওঘরে।'
-' কে দেব? কাকে দেখেছে? ঠিক বুঝলাম না।'
লাবণ্যর কেমন যেন শরীর খারাপ করে হঠাৎই।
-' আরে দেব আমার বড় ছেলে। বন্ধুদের সাথে দেওঘরে গেছিল হঠাৎই ওখানে শৈলপুত্রীর সাথে দেখা মন্দিরে। আরে ছেলেটা আমার খুব ভালো। মেয়েটা তো কম জ্বালায় নি আমাদের। সংসার শেষ করল,তোর দাদাকে মারল এমনকি আদিত্যর দ্বিতীয় বিয়েটাও সুখের হতে দিল না।'
লাবণ্য এবার কিছুটা বুঝতে পারে। তবে দাদাও বলেছে দেওঘরে শৈলপুত্রী কোথায় আছে তা যেন না প্রকাশ পায়। কিন্তু ব্যাপারটা কি? আশা কি বলতে চায়? মানুষের কৌতূহল শেষ করে দেয় অনেক কিছু বপন করে বিষবৃক্ষ।
-' দেখা হয়েছিল তো কি হয়েছে? হতেই পারে।'
-' আরে সে তো ঠিক আছে। কিন্তু তোর ছেলের সাথেও তো দেখা হয়েছে সেই বলেছে শৈলপুত্রীর সাথে তার বিয়ে ঠিক তাই কদিনের জন্য এসেছে তাকে নিয়ে নিজের সংসার দেখাতে। দেব আবার পরেরদিন ভোরবেলা গেছিল মেয়েটা চা করে খাইয়েছে।'
হয়ত আশা যা বলছে সব মিথ্যে কিন্তু মা বাবাকে না জানিয়ে এটা কি করল নটরাজ। এখনি এমন একটা সিদ্ধান্ত এভাবে!
তবুও নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করে না লাবণ্য কিন্তু গলা কাঁপে,' হ্যাঁ তাতে কি হয়েছে? তোর ছেলেই বা গেছে কেন বারবার ওদের ওখানে?'
-' আরে যাবে না! বিয়ের দিন কম করেছে মেয়েটা! কি সাজ! সেই মেয়ে আবার ওখানে কয়লা জ্বালিয়ে রান্না করছে। সত্যি মানুষ না বহুরূপী কে জানে? তবে তোর ছেলে আর মেয়ে পেল না? শেষে ঐ অলক্ষ্মীটাকে?'
ফোনটা আওয়াজ করে রেখে দেয় লাবণ্য তবে মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এটা কি করল নাটু?
***************
আশা ওপার থেকে দুবার হ্যালো হ্যালো করে।
-' মা রেখে দিন ফোনটা ওষুধে কাজ হয়েছে দেখছেন না ফোনটা মাঝপথেই কেটে দিয়েছে। যাক এবার জমবে খেলা। আমাদের সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে নতুন করে সংসার পাতা? এবার দেখ কেমন লাগে?'
-' লাবণ্য কিন্তু ভালো করে ধরা দিল না বুঝলে। তবে শৈলপুত্রী যে ওখানে গেছে তা জানে মনে হল উল্টে আমাকে বলল দেব বারবার কেন গেছে ওদের ওখানে?'
-' সে যা বলে বলুক তবে অলক্ষ্মী,অপয়া কথাগুলো ঠিক মনে গেঁথে যাবে। এতদিন সংসার করেছে মেয়েটা আদিত্যর সাথে এক বিছানায় শুয়েছে। ওরা কি আর মেয়ে পেল না যে একমাত্র ভালো চাকরি করা ছেলের সাথে ঐ অপয়া মেয়ের বিয়ে দেবে?'
-' হ্যাঁ আমিও তো তাই ভাবছি। এটা কি করল লাবণ্য? অপূর্বদা কে বাদ দিলাম চিরকাল কোন বুদ্ধিসুদ্ধি নেই। মূর্তি গড়ে গেছে ঐ বাউন্ডুলে বন্ধুর পাল্লাতে পড়ে। তবে লাবণ্য তো এমন নয় সে মানছে কেন বিয়েটা?'
-' মা ছেড়ে দিন তেমন হলে আরেকবার ফোন করবেন। ও আমাদের মাথা নুইয়ে দিয়েছে এবার আমরা ওর সুখে আগুন জ্বালিয়ে দেব।'
কিছু কথা নিজের মধ্যে চেপে রেখে হজম করা মুশকিল তাই দেবও পারেনি বেবিকে হঠাৎই দেখে চুপ করে থাকতে। এত বড় খবরটা না দিয়ে পারা যায় নাকি? যে মেয়েটাকে এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে ওরা তাকে যেচে বিয়ে করছে কেউ আর বেশ ভালো পাত্রর সাথেই বিয়ে ঠিক হয়েছে। সুতরাং মা আর বৌকে খবরটা দিয়েই ফেলেছে ওখান থেকে ফিরে আসার পর সবচেয়ে মুখ্য খবর বোধহয় এটাই ছিল যে বেবির সাথে দেখা হয়েছে মহা সুখে সে আছে দেওঘরে। অপূর্ব কাকুর ভাগ্নের সাথে তার বিয়ে। মধু শুনে অ্যা করে উঠেছিল প্রথমে,' সে কি ঐ কালো ছেলেটার সাথে? ওমা সেদিন এসেছিল তো সাথে। যাক ভালো হয়েছে প্যাঁচা পেঁচির বিয়ে হচ্ছে।'
-' মধু তোমার মুখে কি কিছুই আটকায় না নাকি? শৈলপুত্রী পেঁচি? সেদিন বিয়েবাড়িতে তো ওকে দেখে চেনাই যাচ্ছিল না। কি সুন্দর লাগছিল!'
-' কি ব্যাপার বল তো? তোমার এত টান হঠাৎই মেয়েটার ওপর? দেওঘরে গিয়ে ছুটে ছুটে গেছ ওদের ওখানে। মানে তোমাদের যা চরিত্র দুই ভাইয়ের সুতরাং কিছুই বিশ্বাস করা যায় না।'
- ' মধু সব কিছু বলার সীমা রেখ। তোমাকে আগেও বলেছি।'
-' যে মেয়েটা এক বাড়ি লোকের মাঝে আমাদের সম্মান ধুলোতে মিশিয়েছে। গয়না খুলে নিয়ে গেছে তার সুখ দেখে তোমার এত আনন্দ কেন শুনি? আমি হলে তো ফিরেই তাকাতাম না। উনি আবার চা খেতে গেছেন সেখানে।'
দেবের আদিখ্যেতার বহর দেখে রাগ করেন আশাও আজ তো ঐ মেয়েটার জন্যই আদিত্যর মনে একটুও আনন্দ নেই। সারাদিন অপমান করছে সানন্দা উঠতে বসতে। শুধু ওকে নয় সবাইকে অপমানিত হতে হচ্ছে। আশাকেও ছেড়ে কথা বলে না সানন্দা।
তাই বলেন,' সত্যিই দেব কোন আক্কেল নেই তোর? কি জন্য কথা বলেছিস ওর সাথে? বৌমা ঠিকই বলেছে পেঁচার সাথে পেঁচির বিয়ে। অপূর্বদার বোনপো তো ওঁর মতই কালো। কোন রাজপুত্র ওকে বিয়ে করবে শুনি?'
-' মা থাম রঙ দিয়ে কি সব বিচার হয় নাকি,অবশ্য তোমরা তাই করে এসেছ চিরকাল। আমি কথা বলে দেখেছি ছেলেটা ভালো। সুখেই থাকবে বেবি ওর সাথে।'
ভীষণ রাগ হয় মধুর চেঁচিয়ে ওঠে হঠাৎই,' বাহ্ বেশ তাহলে এবার কন্যাদানটা তুমিই করে দিয়ো বরং। সত্যি কোন লজ্জা নেই তোমার! মা দেখেছেন তো এর সাথে আমাকে সংসার করতে হয় কোন বুদ্ধি নেই মাথাতে।'
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বৌদির চিৎকার কানে এসেছিল আদিত্যর। একটু দাঁড়িয়ে শুনেই বুঝতে পেরেছে ভাগ্যিস সাথে সানন্দা নেই বন্ধুর জন্মদিনে গেছে। না হলে যে কি অশান্তি লাগত কে জানে?
' দাদা একটা কথা বলছি তোকে ঐ মেয়ের কোন কথা যদি এই বাড়িতে আর কোনদিন উঠেছে তো আমার থেকে আর কেউ খারাপ হবে না। বাবা দাদা যে মানুষের এত বড় শত্রু হতে পারে তা বোধহয় আমার থেকে বেশি কেউ জানে না।'
সবার গালমন্দ খেয়ে দেব একদম চুপসে গেছিল ও ভেবেছিল ওর সন্দেহের কথা বলবে মানে ঐ শৈলপুত্রী আর ওদের বাড়িতে আসা মেয়েটা কি এক? কিন্তু কিছুই বলা হল না। আরেক দফা তিক্ততা সৃষ্টি হল বাড়িতে। মালতীর মা সব শুনল কিন্তু আর কি করবে? নতুন বৌ নাকি কলকাতা আসছে চাচা বলেছে তাহলে একদিন আবার চুপটি করে তাকে দেখে আসবে। সত্যিই যদি মেয়েটা একটা ভালো বর পায় তো খুব ভালো হয়। যতই এ ও থাক না কেন দিনের শেষে একটা কাঁধ আর বুকের খুব দরকার হয় যেখানে মাথা রেখে আদর অভিযোগ আর নির্ভর সবই করা যায়। কত কথা থাকে সব কি সবাইকে বলা যায় নাকি? তাই একটা ভালো মানুষের দরকার হয় যার সাথে সব ভাগ করে নেওয়া যায়। ভালো থাক নতুন বৌ অন্য কারও সাথে।
দেব আর কিছু বলতে পারে না সবার আক্রমণে নীচে নেমে আসে সিঁড়ি দিয়ে একতলার বৈঠকখানায় গিয়ে বসে। এই ঘরটা ওর খুব প্রিয়,বাবার সাথে এখানে বসে হিসেব করেছে কত। চাচার ঘর থেকে রামায়ণ পাঠের আওয়াজ শোনা যায়,বাইরে রাস্তায় টানা রিক্সার টুন টুন ঘন্টির শব্দ। দেওঘরের কথা মনে পড়ে খুব। ভালো লেগেছে ঐ টুকরো এক ফালি বাতাসের সুগন্ধ যা মুঠোতে করে ভরে এনেছে। চাচার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় দেব,চাচা পাঠ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় বুকটা একটু কাঁপে।
-' ক্যায়া কুছ হুয়া বাবুজী?'
-' চাচা তোমাদের দেওঘর খুব সুন্দর। তুমি তো বাড়ির ঠিকানাই দিলে না। বললাম কিছু দিতে হলে দাও আমি পৌঁছে দেব।'
-' নহি বাবুজী সব ঠিক আছে। আমরা বহত গরীব আছি বাবু মাটির বাড়িতে থাকি। ও ওখানে একেলা থাকে আর বহত দূর ভী আছে তাই তো..'
-' আচ্ছা, ঠিক আছে। আবার কখনও গেলে যাব।'
দেব চলে গেছে হরিহরণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তবে মধু আর আশার অসহ্য লাগে আর তারই পরিণতি হিসেবে কদিন বাদে লাবণ্যর ফোন নম্বর জোগাড় করে ওকে ফোন করে আশা। অবশ্য ততক্ষণে সানন্দার কানেও কথাটা গেছে। সানন্দার ইচ্ছে করে মেয়েটাকে ধরে...আদিত্যকে সে কথা বলতেই আদিত্য বলে,' আমাদের জীবন এমনিতেই খুব জটিল হয়ে গেছে আর সমস্যা এন না সানন্দা। মা বলেছে তো কিছু একটা করবে।'
তবে আশা ফোন করে যা বলল সেটা শুনে লাবণ্যর মনটা ভেঙেচুরে গেল। তখন আর ওর ইচ্ছে করছে না পটলের দোরমার জোগাড় করতে। নারকেল কুড়ুনি এক পাশে পড়ে থাকে। লাবণ্যর মনে ঝড় ওঠে আশা যেন কি বলল হ্যাঁ সত্যিই তো শৈলপুত্রী অনেকদিন সংসার করেছে ওদের বাড়িতে। তাছাড়া ওকে এনে কারও ভালো তো হয়নি। এতই যদি লক্ষ্মীমন্ত হয় তো শৈলজাদার বাড়িতেও তো কোন সমৃদ্ধি ছিল না। আর শিবনারায়ণ দা কি করে ওর জন্য মারা যাবে? কি করছিল ও? মাথাতে জট পাকিয়ে যায় লাবণ্যর। ঘি আর আগুন পাশাপাশি রাখতে নেই। সর্বনাশ তো দাদাই করল,ছেলেটার সাথে ওকে পাঠিয়ে দিল। মামা আর ভাগ্নে দুজনেই তো ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তবে না না ওকে ছেলের বৌ হিসেবে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না লাবণ্য। নটরাজের সাথে যাতে থাকতে পারে তাই জেদ করে দেওঘরে গেল এখন তো তাই মনে হচ্ছে। নাহলে এখানে তো কলেজে ভর্তি হয়ে গেছিল বৌদির এত আদর যত্ন সব ছেড়ে কেন দেওঘরে গেল? কি আছে ওখানে? ঐ কাজের মেয়ে ফুলবন্তীটা মহা পাজি,নিজে রান্না করতে পারে না ওকে দিয়ে রান্না করিয়ে ছেলেটার মন ভুলিয়েছে। নাহ্ নটরাজের সাথে কথা বলবে মানে বলতেই হবে। নিশ্চয় সে আশার ছেলেকে বলেছে ওকে বিয়ে করবে।
কত দেবতার দোর ধরে এই ছেলে হয়েছে বিয়ের সাত বছর বাদে লাবণ্যর। সাধ করে নাম দিয়েছিল শিবের নামে আদর করে ডাকে ভোলা বলে সত্যিই বড় ভালো ছেলেটা। এই রকম ছেলেরা মানুষের দুঃখে ভোলে। অবশ্য দাদাকেই বা কি বলবে তার আগে থেকেই তো মেয়েটাকে চেনে নটরাজ। ওর জন্য তো দাদা ওকে খুঁজে পেয়েছে। হায় ভগবান এমন যে হতে পারে আগে তো ভাবেনি।
হয়ত এমনিতে শৈলপুত্রীকে নটরাজ কখনও বিয়ে করতে চাইলে মেনেও নিত লাবণ্য কিন্তু আশা যে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে মনে তাতে ওর মন সন্দেহের আগুনে পুড়তে শুরু করল। শৈলপুত্রীকে নিয়ে নটরাজ হয়ত এতক্ষণে ট্রেনে উঠে পড়েছে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবে লাবণ্য। নিশ্চয় ওদের বসার জায়গা পাশাপাশি,গল্প করতে করতে আসছে দুজনে। সব ভেবেই কেমন অস্থির লাগে। দরজার বেলটা বাজতে থাকে.... মনে হয় বাজার থেকে একগাদা বাজার করে নটরাজের বাবা এল ছেলে আসার আনন্দে। কিন্তু কি করে বলবে তাকে এই সব?
********************
শৈলপুত্রীর যাওয়ার সময় হয়ে আসছে,আর হয়ত কখনই আসবে না এই গ্ৰামে চাচী তাই বলেছে না আসাই ভালো। কারণ লোকেরা উপকারের মর্যাদা জানে না যাদের জন্য এত করল মেয়েটা তারাই আঙুল তুলল ওর দিকে। তাছাড়া ও বাড়ির বড়ছেলে ওকে দেখেছে দেওঘরে সুতরাং সে যদি আবার আসে? তার থেকে চাচী বরং চলে যাবে ওর কাছে।
শৈলপুত্রীর মনটা সরল সাদামাটা তাই বলে,' চাচী আমি চাকরি করে বাড়ি কিনব,আমার নিজের বাড়ি হবে সেখানে কালী গাই,বাছরা নিয়ে তোমাকে রাখব। চাচা,মালতীর মা ভী থাকবে আমাদের সাথে। ফুলবন্তীকে ভী লিব।'
-' পাগলী,পুরা গাঁও কো লে জানা। আরে তেরি ফির সে ঘর বসেগী শাদী হোগী। আচ্ছা পতি মিলেগা।'
শৈলপুত্রীর চোখ ভেজে আর কোন স্বপ্ন সে দেখতে চায় না শুধু নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। এভাবে কতদিন ভেসে বেড়াবে এর বাড়ি ওর বাড়ি?
ফুলবন্তীর সাথে এসেছে শৈলপুত্রী,মথুরা এসেছিল জিপ নিয়ে কারণ ওর বাক্সটা তো আছে। গ্ৰামের বাচ্চাগুলো অনেকটা পথ জিপের পেছন পেছন দৌড়ে এসেছে। তারপর একটা সময় সব আবছা হয়ে গেছে। কালী গাইটার পিঠে হাত রেখে সাবিত্রী কান্নায় ভেঙে পড়েছে। অনেকটা কষ্টে চোখ দুটোকে বাঁধন দিয়ে রেখেছিল আর তারা কথা শুনল না। বড় মায়া পড়ে গেছিল মেয়েটার ওপর। খুব একলা হয়ে গেল আবার। গ্ৰামের কজন মহিলা ওকে ঘিরে থাকল।
প্রথমবার কলকাতা গেছিল ফেরার শর্তে এবার আর রইল না পিছুটান। টিনের বাক্সটা সীটের তলায় রেখে গেছে মথুরা। মুন্না আর ফুলবন্তী চোখ মোছে। ট্রেন ছাড়ছে দরজায় দাঁড়িয়ে শৈল আস্তে আস্তে আবছা হয়ে দূরে সরে যাচ্ছে অনেক কিছুই শুধু স্মৃতিটুকু বেদনায় বুকে মেখে নটরাজের ডাকে সীটে এসে বসে। নটরাজ বিবাহিত নয়, মেয়েদের ঠাঁই ছাড়ার যন্ত্রণা সে তেমন দেখেনি তবে আজ শৈলপুত্রীর কষ্ট তাকে ছুঁয়ে গেল। কতদিন এভাবে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াবে অনাথ,স্বামী পরিত্যক্ত মেয়েটা যা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছে তাই দূরে সরে গেছে।
তবে তখনও এটা জানত না যে খুব তাড়াতাড়ি ওকেও শৈলপুত্রীর থেকে দূরে সরে যেতে হবে। আর কিনে দিতে পারবে না ওর রঙ খাতা কাগজ। অথবা এইভাবে ট্রেনে পাশাপাশি বসে আর যাওয়া হবে না চা খেতে খেতে।
****************
দু তিনবার বেল বাজার পর দরজা খোলে লাবণ্য।
-'কি গো,এত ভারী ব্যাগ হাতে দাঁড়ানো যায় নাকি? বয়েস হচ্ছে তো। তোমার এমন মুখ চোখ কেন? শরীর খারাপ হল নাকি? একটু আগে তো ঠিক ছিলে।'
স্বামীকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে লাবণ্য। তাড়াতাড়ি ব্যাগ নামিয়ে লাবণ্যকে নিয়ে বিছানায় বসান নটরাজের বাবা।
অঝোরে কাঁদে লাবণ্য,' তুমি এইসব বাজার ফেলে দাও আমার কিছু ভালো লাগছে না হাত পা কাঁপছে আমি রান্না করতে পারব না। হে ভগবান আমার ছেলেটার কি হবে?'
লাবণ্যর কান্না দেখে আর একমাত্র ছেলের কথা শুনে নার্ভাস হয়ে পড়েন উনিও তাই তো আজ তো নাটুর আসার কথা তাহলে কি ট্রেনে কোন বিপদ হল তাই ফোন এসেছে?
-' লাবণ্য এত কেঁদ না আমাকে বল বড় অস্থির লাগছে। দাদাকে ফোন করব নাকি?'
-' দাদাকে তুমি কিছু বল না। এইসব দাদার জন্য দাদা যদি ঐ মেয়েটাকে এখানে না আনত...হে ভগবান।'
-' আরে কোন মেয়ে কার কথা বলছ?'
-' ঐ শৈলপুত্রীর কথা,নটরাজ নাকি ওকে বিয়ে করবে।'
-' দেখি কান্না থামাও,শান্ত হও। কে বলেছে তোমাকে এই সব কথা? আমাকে সব বল।'
-' নটরাজ নাকি আশার ছেলেকে বলেছে আশা বলল।'
- ' আশা তোমার সেই বন্ধু না? তুমি এত কিছু শুনেও তার সাথে যোগাযোগ রেখেছ? দাদা জানলে কত রাগ করবেন আর কষ্ট পাবেন একবার ভেবেছ?'
- ' আমি তো আশাকে ফোন করিনি ও বলল হঠাৎই ফোন করে আজ এইসব যে মেয়েটা অপয়া ওদের অনেক ক্ষতি হয়েছে ওকে ঘরে এনে আর তাকেই নাকি নটরাজ বিয়ে করবে বলেছে। আমি কিছু ভাবতে পারছি না গো।'
-' তুমি শান্ত হও লাবণ্য। আচ্ছা তোমাকে রান্না করতে হবে না। এই বয়েসে এত বড় বোকামি কর কি করে? আশা বরাবর কুটিল নিজের ঘরের আর মনের আগুন তোমার মনে ছড়িয়ে দিল। আর তুমি তা নিয়ে জ্বলছ? ছেলেকে বিশ্বাস কর না? আসুক সে আগে তারপর তার সাথে কথা বলে কাঁদতে বোসো।'
***********************
আজ ট্রেনে খুব চুপচাপ লাগছে শৈলপুত্রীকে সেবার দেওঘরে ফেরার উচ্ছ্বাসের মত একটুও আনন্দ কলকাতার দিকে যাওয়াতে নেই। বরং একটা ভয় আর দুশ্চিন্তার ঢেউ বারবার ঝাপটা মারছে মনে। অবশ্য বড়া ভাইয়াকে দেখার পর দেওঘরের দিনগুলো আশঙ্কায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তখন মনে হয়েছিল কলকাতা ফিরে যাওয়াই ভালো চাচীর ছোটখাটো মাটির বাড়ির দেওয়াল বড় নরম তাতে যে কোন কিছু ভাঙন ধরাতে পারে আঙ্কেলের বাড়ির বড় লোহার গেট ভাঙা অত সহজ নয়। তারপর আঙ্কেলের ক্ষমতা অর্থ সবই আছে। দূনিয়ায় যার ক্ষমতা বেশি তাকে সবাই ভয় পায়।
-'কি ভাবছেন এত? মুখে হাসি নেই কেন? আমি কিন্তু এমন শৈলপুত্রীকে দেখতে ভালোবাসি না। আমার দেখা শৈলপুত্রীর চোখে আগুন,মুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি। হাতে রঙ পেন্সিল আর টিনের বাক্স যা ইচ্ছে করলে অস্ত্র হিসেবে কারও মুখে ছুঁড়ে মারাও যায়।'
এই কথা শোনার পর বোধহয় না হেসে থাকা যায় না তাই শৈলও হেসে ফেলে।
-' বাহ্ এই তো,এবার একটু দয়া করে আপনার ঝুলি থেকে পেঁড়া,ঠেকুয়া,নাড়ু,পুরী,ভাজি বের করুন ট্রেনে উঠলে আমার খুব ক্ষিদে পায়।'
লজ্জা পায় শৈলপুত্রী সত্যিই তো সাহাব খেতে ভালোবাসেন আর ট্রেনে মুখ না চললে তার হয় না। ইশ্ সবসময় এই ভুলটাই করে এসেছে। তাই তাড়াতাড়ি করে শালপাতার প্লেটে খাবার গুছিয়ে খেতে দেয়।
নটরাজ খেতে খেতে আহ্ বলেই বলে,' কি হল অন্নপূর্ণা এবার নিজেও কিছু খান। নাহলে মামু বলবে আপনার শুকনো মুখ দেখে কোন দেখভাল করিনি আপনার। আমি তো নটরাজ বরাবরই ভিখিরি যে অন্নপূর্ণা সে ভিক্ষা দিয়ে অভুক্ত থাকবে কেন?'
নটরাজের কথার সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ধরতে পারে না শৈলপুত্রী তাই বলে,' সাহাব আপনি ভিখারি হবেন কেন? কত বড় চাকরি করেন। মা বাবা আছেন কলকাতাতে মকান আছে,মামা আছেন। ভিখারি তো আমি।'
-' কি বললাম,আর কি উত্তর! আপনি অন্নপূর্ণা। নিন এবার খান আমার সাথে। একা মুখ চালাতে ভালো লাগে নাকি?'
খাওয়ার খেতে খেতে কথায় কথায় শৈলপুত্রীর মনকে ভোলাতে চেষ্টা করে নটরাজ। ওর মুখে হাসি দেখে ভালো লাগে। সত্যিই এই জার্নিটা মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে বহুদিন। আর হয়ত কোনদিনই শৈলপুত্রীর সাথে একই কামরায় বসে রেলযাত্রা সম্ভব হবে না। তাই এই সুখের মুহূর্ত টুকু মনের খাঁচায় যত্নে বন্দি করে রাখে নটরাজ।
হয়ত এইটুকু ছোট ছোট মুহূর্ত এনে দেয় অনেকটা সুখ জীবনে। নটরাজ বলে ফেলে,' আর হয়ত এভাবে তোমার সাথে দেওঘরে যাওয়া আর হবে না। আমি কিন্তু খুব মিস্ করব কালী গাইয়ের খাঁটি দুধের চা।'
অবাক হয়ে তাকায় শৈলপুত্রী মুখে দুষ্টুমি ভরা হাসি নটরাজের মনের ক্যামেরাতে ক্লিক করে ওঠে ঐ মুখটা। তার মানে শৈলপুত্রী দুষ্টুও।
-' আমি কি কালী গাইকে সাথে করে কলকাতা যাচ্ছি নাকি? ও তো ওখানেই আছে চাচীর ঘরে। মন হলেই চলে যাবেন চাচী বানিয়ে দেবে চা।'
নটরাজ হাসে,' আপনি তো ভারী দুষ্টু দেখছি। যে বানাবে তাকে কোথায় পাব? শৈলপুত্রীর হাতের ছোঁয়ায় সেই চা তো একদম অমৃত হয়ে যায়।'
-' আচ্ছা এখানে এলে বানিয়ে খাওয়াব চা অমৃত না হলেও বিষ হবে না এটুকু বলতে পারি। একদম কড়া করে বানিয়ে দেব।'
কথা বলতে বলতে ভালো সময়টা টুক করে কেটে যায় কখন যে বুঝতেই পারে না নটরাজ। কলকাতার উঁচু উঁচু বাড়িঘর দেখে মন খারাপ করে আবার। আগে থেকেই ঠিক ছিল অপূর্ব স্টেশনে গাড়ি আর ড্রাইভার পাঠিয়ে দেবেন। কারণ শৈলপুত্রীর একমাত্র সম্বল বাক্সটা সাথে আছে। নটরাজ শৈলপুত্রীকে পৌঁছে দিয়ে বাড়িতে ফিরবে।
-' আপনি বাড়ি চলে যান,পিসিমা অপেক্ষা করবেন। আমি গাড়িতেই তো আছি চিন্তা নেই।'
-' তোমাকে অত ভাবতে হবে না আমি এই গাড়িতে ফিরব তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আমাকছ বাড়ি পৌঁছে একেবারে বাবলুদা চলে আসবে। আমাকে না দেখলে মামু আর মামিমা রাগ করবেন। তাছাড়া দায়িত্ব যখন আমার...'
নটরাজের কথাটা একটু ছুঁয়ে যায় শৈলপুত্রীকে আর কতজনের দায় আর দায়িত্ব নিয়ে বাঁচবে ও? তাই বলে ,'আমার দায়িত্ব নিতে হবে না আমি পারব সামলাতে। আমার জন্য আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।'
নটরাজ হাসে,' ভীষণ রাগ তো আপনার! আপনি আমার দায়িত্ব হবেন কেন? আমাকে মামাবাড়ি যেতে হবে। মামার সাথে দেখা করে যাব।'
শৈলপুত্রী আর কোন কথা বলে না কেন যেন মনটা খারাপ লাগে। দেওঘর ছেড়ে আসার জন্য নাকি নটরাজের সাথে আর মাঝেমাঝেই দেখা হবে না সেইজন্য? কথাটা নিজেকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পায় না শৈলপুত্রী।
-' কি হল মন খারাপ নাকি? কোন ভয় নেই নতুন কলেজ,নতুন জীবন ভালো লাগবে দেখবেন। আর সবাই তো থাকবে সাথে।'
হঠাৎই শৈলপুত্রী বলে ওঠে,' সাহাবজী আপনিও থেকে যান না এখানে তাহলে সবাই আমরা এক জায়গায় থাকব।'
শৈলপুত্রীর কথার মানে বোঝে নটরাজ হয়ত বা ওর একটা নির্ভরতা গড়ে উঠেছে নটরাজের ওপর আর সেখান থেকেই মনখারাপের বাষ্প ঢুকছে হু হু করে।
রেবা আর অপূর্ব অপেক্ষায় ছিলেন। আগের বারই একটা আলাদা থাকার ঘর দিয়েছিলেন শৈলপুত্রীকে রেবা। বাড়িতে অনেক ঘর তাই অভাব নেই। বরং মানুষ কম ঘর বেশি সেখানেই ওর বাক্সটা রেখে দেয় মন্টু এ বাড়ির সাহায্যকারী।
-' যাক মা ঘরে আসাতে এতদিনে নিশ্চিন্ত লাগছে। রেবা ওদের খেতে দাও। নাটু তুইও খেয়ে যা আজ আমাদের মা এসেছে সুতরাং একটু ভালো খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে।'
-' দেখেছিস মামুকে একটা অজুহাত পেলেই হল।'
শৈলপুত্রী একটা পোটলা নিয়ে রেবার হাতে দেয়,' চাচী দিয়েছে সব বানিয়ে নিজের হাতে আর পেঁড়া ভী আছে কাকিমা। সাহাবজী আপনার জন্য ভী নাড়ু দিয়েছে আর বড়ি ভী। পিসিমার জন্য শাক।'
**********************
লাবণ্য অশান্ত মনে কোন কিছুই করতে পারেনি ঠিকমত যদিও ছেলে কলকাতা এসেই ফোন করে দিয়েছে পৌঁছে গেছে। তবুও ভালো লাগে না মেয়েটাকে একদম ও বাড়িতে ছেড়ে আসার কী ছিল? গাড়ি তো ছিলই দিব্যি চলে যেত। ভগবান এই মেয়ের হাত থেকে কি করে বাঁচাবে ছেলেটাকে কে জানে। নটরাজের বাবা বারবার বলে দিয়েছেন মাথা না গরম করতে তাতে উল্টো ফল হতে পারে কারণ ছেলে বড় হয়েছে। আগে ও বিশ্রাম করে ঠান্ডা হোক খাওয়াদাওয়া করুক তারপর জিজ্ঞেস কোর ভালোভাবে।
তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না লাবণ্য অনেকটা সময় ধরে চেপে রাখা উত্তেজনা নটরাজ ফিরতেই বেরিয়ে আসে,' কি রে এত দেরি কেন? কখন থেকে আমরা বসে আছি তোর অপেক্ষায়। আচ্ছা শৈলপুত্রীকে নিয়ে এত কিসের মাথাব্যথা তোর? দাদা তো গাড়ি পাঠিয়েছে তুই তুলে দিতেই তো পারতিস গাড়িতে আবার কি দরকার ছিল...যত জ্বালা হয়েছে আমার।'
মায়ের মুখ চোখ আর ব্যবহার দেখে অবাক হয়ে যায় নটরাজ। বিধ্বস্ত চোখমুখ মায়ের,মুখটা রাগে লাল। নিজের খুব রাগ হয় মায়ের ব্যবহারে। এতদিন বাদে বাড়ি আসে মা বাবার সাথে সময় কাটাবে ওদের ভালো দেখবে বলে কিন্তু মা এটা কেমন ব্যবহার করছে ওর সাথে?
নিজেকে সংযত করে নটরাজ এমনিতেই ও ক্লান্ত এতক্ষণের পথযাত্রায় তারপর চিরকাল বাধ্য নটরাজ। মা বাবার মুখের ওপর কথা বলা ওর স্বভাব নয়। মানে সৌজন্যতা এবং শিক্ষায় বাধে। তবে বুঝতে পারে মায়ের কিছু একটা হয়েছে। তাই বলে,' বাড়িতে তোমাদের আদর খেতে আর ভালোমন্দ খেতে আসি ঢুকতেই এত বকা কেন দিচ্ছ মা? কি করেছি আমি? তোমার রাগ আর জ্বালা কেন বলত? আচ্ছা আমি হাত পা ধুয়ে জামাকাপড় ছেড়ে আসছি।'
বাথরুমে যেতে যেতে বাবাকে বলতে শোনে,' আহ্ লাবণ্য একটু ধৈর্য্য তোমার নেই? আশা সত্যিই তোমার মাথাটা খেয়ে ফেলেছে অজগর সাপের মত। আরে ছেলেটাকে একটু খেতে দাও জিরোতে দাও।'
একটু থমকে দাঁড়ায় নটরাজ এই আশা নামটা বড় পরিচিত কোথায় যেন শুনেছে। একটু ভাবতেই মনে পড়ে গেল হ্যাঁ এই তো কদিন আগেই মামু বলছিল। কি হল হঠাৎ?
জামাকাপড় ছাড়া হলে বাবা বলে,' আয় খেয়ে নিবি চল এবার।'
নটরাজ বাবাকে ইশারা করে থামায়,' আমি কিছু খেয়েই এসেছি মামাবাড়িতে এখন আগে মায়ের সাথে কথা বলব তারপর খাব। আগে মায়ের মন ঠিক করতে হবে।'
-' দেখেছ লাবণ্য কত ভাবে আমাদের কথা ছেলে। আর তুমি শুধু রাগ করছ।'
লাবণ্যর চোখে জল ছলছলিয়ে আসে,' হ্যাঁ কত ভাবে তাহলে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত আমাকে না জানিয়ে নিতে পারত না।'
-' কি সিদ্ধান্ত নিয়েছি মা তোমাকে না বলে? বল আমাকে।'
-' তুই নাকি শৈলপুত্রীকে বিয়ে করবি। শৈলপুত্রীকে নিয়ে তোর কোয়ার্টারে রেখেছিস সে তোর সংসার দেখে তোকে রেঁধে খাওয়ায়। আশার ছেলে দেখে এসেছে,চা খেয়ে এসেছে। তাকে কি বলেছিস তুই শুনি?'
হা হা করে হেসে ওঠে নটরাজ এই একটা বিশেষ জিনিসে মামা ভাগ্নের খুব মিল। লাবণ্য রেগে গিয়ে বলে হাসিস না।
-' তো কি করব? তোমাকে কেউ এসে বলল তোমার কান কাকে নিয়ে গেছে তুমি ছুটবে কাকের পিছনে? আচ্ছা বুঝেছি আশা নামটা চেনা লাগছিল মনে করতে পারছিলাম না।'
-' আশা শৈলপুত্রীর শাশুড়ি তার বড়ছেলে তোদের দুজনকে একসাথে থাকতে দেখে এসেছে। তুই নাকি বলেছিস ওকে বিয়ে করবি?'
নটরাজ বুদ্ধিমান এরপর আর কিছুই বলতে হয় না আগে। ও মাকে বোঝাতে শুরু করে,' এই যে আমার বোকা মা শোনো শৈলপুত্রীকে হরিহরণ চাচা নিয়ে গেছে দেওঘরে,ও ওদের বাড়িতেই থাকত। হঠাৎই পুজো দিতে গিয়ে দেববাবু দেখে ফেলেন ওকে আর কিছুতেই পিছু ছাড়েন না। শৈলপুত্রী যদি ওকে নিয়ে চাচার বাড়িতে যেত কি হত?'
লাবণ্য বলে,' কি হত?'
-' মা চাচার চাকরিটা যেত। পুলিশকে ওরা জানাতে পারত চাচা ওদের বাড়ির বৌকে এখানে এনে রেখেছিল। তখন কি হত ভেবেছ? খুব বাধ্য হয়েই আমাকে বলতে হয়েছে মিথ্যে। মানে চাচার পরিবার আর শৈলপুত্রীকে বাঁচাতে। দেববাবুও তো দেখছি কম নয় সাথে সাথেই খবর চালান করেছে আবার তুমিও তাকে বিশ্বাস করেছ যার সাথে বহু বছর তোমাদের সম্পর্ক নেই।'
-' তাহলে সব মিথ্যে তো নাটু তুই ঐ মেয়েটাকে বিয়ে করবি না তো? আমাকে ছুঁয়ে বল বাবা ওকে বিয়ে করবি না।'
-' হঠাৎ ওকে বিয়ে করতে যাব কেন? তবে ছুঁয়ে বলছি না মা কারণ মানুষ আমি যদি কখনও ভুল করে ফেলি তখন কি হবে?'
-' তার মানে আশা যা বলেছে সেটাই সত্যি তাই না? শেষে ঐ অপয়া অলক্ষ্মীটাকে তোর মনে ধরল! আগে কত বলেছি বিয়ে কর কান দিসনি। এখন সেই শৈলপুত্রীকে! ও ঘরে ঢুকে আশার পরিবারের একদম ক্ষতির পর ক্ষতি হয়ে গেছে। মেয়েটা অপয়া। এখন তোকে খাবে আর আমাদের শেষ করবে।'
ও ভেবেছিল ওর কথায় মা থেমে যাবে কিন্তু দেখল বিষফল তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। তাই বলে,' মা তুমি না একজন মা আর একজন মেয়ে? কি করে না জেনে বুঝে একটা ভদ্রলোকের মেয়েকে অপয়া বলছ? ওর নাম শৈলপুত্রী মা।'
-' সে যাই হোক,সত্যিই ও অপয়া এখন তোর আর তোর মামার ক্ষতি করবে।'
-' মা এবার আমার সত্যিই খুব রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর অপয়া নামটা আমাকেই ঘোচাতে হবে। মেয়েটা কত গুণী তুমি তো জান।'
-' আমার জানার দরকার নেই,তুই আমার মাথায় হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা কর যে আর ওর সাথে কোন সম্পর্ক রাখবি না।'
-' মা আমি মাথায় হাত না দিয়েই বলছি তোমাকে। কোন সম্পর্ক আর রাখব না ওর সাথে। কিই বা সম্পর্ক ছিল মা আমাদের? একসঙ্গে এসেছি এই টুকুই।'
-' তুই আমাকে ছুঁয়ে বল বাবা,আর তুই ও বাড়িও যাবি না।'
-' আচ্ছা মা যাব না তুমি মামুকে বলে দিয়ো যে তুমি আমাকে ঐ বাড়ি যেতে বারণ করেছ। আর হ্যাঁ মা আমি এখন শুতে গেলাম। খেতে ইচ্ছে করছে না। ওহ্ আর কালই আমি দেওঘরে চলে যাব। একটা কাজ আছে।'
-' সে কি রে আমি কত বাজার করলাম তুই আসবি বলে। কদিন তো থাকবি বলেছিলি টেলিফোনে কি হল হঠাৎ? রাগ করিস না বাবা চল খাবি চল।'
নটরাজ কোন কথা না বলে ঘরে চলে যায়।
পরদিন বাবা মায়ের কোন অনুরোধেই আর নটরাজ থাকে না বাড়িতে কলকাতা ছেড়ে নিজের কাজের জায়গায় চলে যায়। মনে খুব কষ্ট হলেও লাবণ্য ভাবেন যাক থাক একা ওখানে তাও ভালো। এই মেয়েটা সত্যিই অলুক্ষণে ওর কথা উঠতেই বাড়িতে ছেলেটা কেমন বদলে গেল।
-' লাবণ্য কাজটি তুমি কিন্তু একদম ভালো করলে না বারবার বললাম মাথা ঠান্ডা কর। ছেলে বড় হয়েছে অত বড় অফিসার সে। তার সাথে এমন করে কথা বলে! ভোরে উঠে বেরিয়ে গেল ছেলেটা রাগ করে।'
কষ্টে লাবণ্য হাউহাউ করে কাঁদে,' দেখেছ ঐ মেয়ে কেমন হাত করেছে ছেলেকে ওর সাথে সম্পর্ক রাখতে বারণ করেছি বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল!'
ট্রেনের জানলায় বসে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায় নটরাজের। ছেলেদের নাকি কাঁদতে হয় না আজ শৈলপুত্রীর মতই নিজেকে ছন্নছাড়া বলে মনে হল। মাও মেয়েটাকে অপয়া বলছে! কি ক্ষতি করেছে ও মায়ের? কত জিনিস পাঠিয়ে দিয়েছিল মায়ের জন্য। সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে মা রাগে। কিছু ভালো লাগে না নটরাজের। না আর বাড়িতে আসবে না ও বাড়ির বিষাক্ত পরিবেশে কেমন যেন দম আটকে আসছিল ওর। ভীষণ রাগ হয় দেব বাবুর ওপর ছিঃ মানুষ এমন হতে পারে! কেন যেন শৈলপুত্রীর মুখটা খুব বেশি করে ভাসতে থাকে মনে যাকে নিয়ে এত ঘটনা সে কিছু জানতেই পারল না। আজ বিকেলে শৈলপুত্রী,মামিমা আর মাকে নিয়ে ওর নিউমার্কেট যাবার কথা ছিল। মামাই বলেছিলেন,' তুই একটু যাস ওদের সাথে একদম খেয়েদেয়ে জামাকাপড় কিনে আসবে। কলেজে যাবে জামা জুতো শাড়ি ব্যাগ সবই লাগবে। আরে আমার বাড়ির মেয়ে বলে কথা।
রেবা লাবণ্যর কাছে সবটা শুনে হতবাক হয়ে যান। অপূর্ব একটা এক্জিবিশনের কাজে ব্যস্ত বলে কিছু বলেন না ওঁকে। জানলে খুবই কষ্ট পাবেন। ভাগনেটি তাঁর বড় প্রিয়। লাবণ্যর একি মতিভ্রম হল এই বয়েসে! সত্যিই ভীষণ বাজে কাজ করেছে এটা অন্যের উস্কানিতে। এই মহিলা আশার বয়েস হলেও কূটবুদ্ধি যায়নি ছিঃ।
বিকেলে বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আনমনা হয় শৈলপুত্রী সাহাব তো এখনও এলেন না বলেছিলেন কাল এসে ওর সব জিনিস কিনে দেবেন।
রেবা পেছন থেকে এসে ওর মাথায় হাত রাখেন,' কার অপেক্ষায় আছিস? নাটুটা হঠাৎই চলে গেছে আজ সকালেই দেওঘরে কাজ পড়ে গেছে বলল। আমরা বরং কাল বেরিয়ে সব কিনব,তোর কাকুকেও সাথে নেব।'
মাথা নীচু করে শৈলপুত্রী ঘরে আসে এক পশলা মন খারাপের মেঘ কুয়াশা নিয়ে। সাহাবজী কালই এসে আজই চলে গেল! একবার দেখাও করল না! ভেবেছিল কয়েকটা জিনিস আর মিঠাই পাঠাবে চাচীর জন্য।
***********************
ঘড়ি দেখে নটরাজ চিন্তার জালের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে এতটা পথ চলে এসেছে কাল থেকে ভালো করে খায়নি অথচ কোন খিদেও নেই অথচ শৈলপুত্রীকে নিয়ে ফেরার সময় কত কি খেয়েছে ট্রেনে। নিজে চেয়ে নিয়েছে সবটা বলেছে আমি ট্রেনে খুব খাই। আজ কেন যেন মুখ আর মন সবই অদ্ভুত তেতো হয়ে আছে। ট্রেনের জানলায় চা ওয়ালা এসে দাঁড়িয়েছে খুব ডাকছে যদি কেউ নেয়। নটরাজ এক কাপ চা নেয় হাত বাড়িয়ে কিন্তু ভালো লাগে না। আজ বুঝতে পারে ওরও মনখারাপ আর অরুচি হয় কান্নাও পায়। বড় হয়েও বড় হতে পারেনি নটরাজ মনটা সেই ছোটবেলায় পড়ে আছে। মা কিছু বললেই যখন কাঁদত। মা অদ্ভুতভাবে বিশ্বাস করেছে শৈলপুত্রীর শাশুড়ির বলা কথাগুলো। ভদ্রমহিলাকে মায়ের বন্ধু বলে কিছুতেই ভাবতে পারে না নটরাজ। বন্ধুত্বের বোধহয় কিছু শর্ত থাকে বন্ধুকে নীচু দেখিয়ে খুশি হয় যে জন,বন্ধুর কষ্টতে আনন্দিত হয় যে জন, যে বন্ধুকে আঘাত দিয়ে খুশি হয়,বা বন্ধুর সুখ দেখে হিংসা করে সে কখনই প্রকৃত বন্ধু নয়।
শৈলপুত্রীকে বন্ধু বা আপনজন ভেবেই তাকে বাঁচাতে মিথ্যে বলেছিল নটরাজ কিন্তু সেই মিথ্যে গাছটা যে ডালপালা মেলে কলকাতা পৌঁছে যাবে তা ভাবেনি স্বপ্নেও। মা খবর পেয়ে যাবে এত কান্ড হবে!মাথাটা কেমন যেন ব্যথা করে ওঠে নটরাজের।পরপর দুদিন জার্নি শরীরটা যেন ভেঙে আসছে। ওখানে পৌঁছে দুদিন ঘরে শুয়ে বিশ্রাম নেবে একদম। এমনিতেই ওর ছুটি নেওয়া ছিল তিনদিন। ভালো হয়েছে এই কদিন আর কেউ ওকে জ্বালাবে না। এখনও নটরাজের কোয়ার্টারে ফোন আসেনি লাইনের কাজ চলছে তাই এই উৎপাতও নেই। মথুরাকে বলে দেবে অফিসে ফোন এলে যেন বলে দেয় বাবু কদিনের জন্য বাইরে ট্যুরে গেছে। আর ফুলবন্তী যেন না আসে দুদিন,বাড়ি থেকেই একটু রান্না করে প্রতাপকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। কারও সাথেই আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না নটরাজের।
দুপুরে ভাতটুকু গলায় তুলতে পারেনি লাবণ্য বারবার কান্নাতে চোখ ভিজে গেছে। কত সুখের সাজানো সংসার ওর শিবের মত ভোলানাথ ছেলে সেই সংসারে আজ ফ্রীজ ভর্তি রান্না কর্তা গিন্নী কারও গালে ভাত উঠছে না। কাজের মেয়েকে ডেকে ভালোমন্দ দিয়ে দেন লাবণ্য।
-' বলেছিলে দাদাকে রান্না পাঠাবে। আমাকে দাও আমি দিয়ে আসি বরং এত খেটেখুটে করলে সব।'
রেগে ওঠে লাবণ্য যত রাগ ঝাল দেখানোর মানুষ তো সব মহিলাদের একটাই সুতরাং লাবণ্যও ব্যতিক্রম নয়,' কাউকে খেতে হবে না এই সব। তুমি কি ভেবেছ দাদা খাবে নাকি এগুলো? কাল বৌদি আমাকে কত বকল বলল ছেলেকে চিনলাম না। আমার ছেলেকে আমি চিনি না ও চেনে। নাটুর দূর্বলতা না থাকলে রাগ দেখিয়ে চলে গেল কেন শুনি?'
-' লাবণ্য তুমি পাগল হয়ে গেছ তাই সবার কথা তোমার খারাপ লাগছে। বৌদি বোধহয় দাদাকে কিছু বলেনি দাদা জানতে পারলে কি হবে বুঝতে পারছ? হয়ত সব কাজ ফেলে ছুটবেন দেওঘরে শৈলপুত্রীকে সাথে নিয়েই। নাটুর হয়ত কোন দূর্বলতা ছিল না ভালোলাগা ছিল কারণ মেয়েটা দুঃখী। তুমি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দূর্বলতা সৃষ্টি করবে। যাক ছেলেটা ভালো থাকলেই হল। ছেলেটা আমার বড় ভালো, বরাবরই অন্যের উপকার করে এসেছে।'
-' হ্যাঁ ও শুধু তোমারই ছেলে আমার তো কেউ নয়। আমি তো ওর সৎ মা।'
লাবণ্যকে শান্ত করা যাবে না সহজে ভেবে চুপ করে যান। একটা খবর নিতেই হবে দেখা যাক কি করে নেওয়া যায়। আজ তো হবে না কাল নেবেন অফিসে ফোন করে।
পরদিন অফিসে ফোন করাতে মথুরার কাছে নটরাজের শেখানো কথাই শুনলেন সত্যিই বাবুর জরুরী কাম ছিল মধুপুরের দিকে গ্ৰামে চলে গেছেন কামে। তবে ভালো আছেন কোন চিন্তা নেই। সাহাব বারণ করে দেওয়ায় আসল কথাটা বলতে পারে না মথুরা। গতকাল ট্রেন থেকেই গায়ে জ্বর নিয়ে নেমেছে নটরাজ তার সাথে অসহ্য মাথা ব্যথা। মথুরা জানত না বাবু আসছে তাই সে স্টেশনেও আসেনি। তবে খবর পেয়েছে পেয়ে ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে ঘর থেকে খাবার নিয়ে গেছে। কিন্তু অত জ্বরে খেতে পারেন নি বাবু। ওকে বলে দিয়েছিলেন বাড়ি চলে যেতে কিন্তু ভরসা পায়নি মথুরা বাড়ি গিয়েও ফিরে এসেছে। রাতে ওখানেই ছিল বারবার উঠে এসে দেখে গেছে। ভোরের দিকে ঘুমোচ্ছিল নটরাজ অনেকটা পরে ঘুম ভাঙতে মথুরাকে দেখে সব বলে দেয়।
মথুরা অবাক হয়ে যায় বাবুকে দেখে এই একদিনে যেন কেমন হয়ে গেছেন সাহাব। যাক অফিসে যাবার আগে ফুলবন্তীকে ডেকে দিয়ে ঘরদোর সাফ করতে বলে বেরিয়ে যায়। ফুলবন্তী অবাক হয়ে যায় অতবড় লম্বা চওড়া মানুষটা যেন বেহুঁশ হয়ে ঘুমোচ্ছে। বেশ একটু বেলা করে সাহাবকে ডাকতে যায় ফুলবন্তী দেখে তো মনে হচ্ছে এখনও বুখার আছে।
-' সাহাব?'
-' কে শৈলপুত্রী।'
-' নহি সাহাব দিদি তো কলকাত্তা মে। আপ তো লেকে গয়ে সাথ মে।'
হঠাৎই ঘুমের ঘোর কেটে যায় নটরাজের কি বলছিল ও? তাহলে কি মায়ের কথাই ঠিক অবচেতনে কোথাও শৈলপুত্রী জুড়ে রয়েছে তার মনে।
-' ওহ্ ফুলবন্তী তুম। কৌন বুলায়া তুমহে?'
-' মথুরা ভাইয়া সাহাব। অব উঠিয়ে থোড়া সা খা পী লিজিয়ে সাহাব।'
অনিচ্ছুক শরীরকে কোনরকমে তোলে নটরাজ সত্যি তো এই বিদেশে বিছানা নিলে ওরা বিপদে পড়বে আর তারপর হয়ত সামলাতে না পেরে মা বাবা সবাইকে খবর দেবে। ওর জন্য আর কেউ ব্যস্ত হোক সেটা চায় না নটরাজ।
তবুও প্রায় তিনদিন ভুগতে হল ওকে। ঐ তিনদিনের মধ্যে অবশ্য খবর চলে গেছিল শৈলপুত্রীর কাছে। প্রতাপের মালিকের গদি থেকে নম্বর মিলিয়ে দিয়েছিল প্রতাপ ফোন করেছিল ফুলবন্তী শৈলপুত্রীকে,' হাঁ দিদি ও বাবুকা তো বহত বুখার। হাম কো ভী নহি খবর দিয়া অকেলা থা ঘরমে,খানা ভী নহি খায়া। ফির মথুরা ভাইয়া নে বুলায়া মুঝে। ও তুঝে বুলা রহা থা।'
ফুলবন্তীর ফোনটা পেয়ে প্রথমে উচ্ছ্বসিত হলেও পরে একটু একটু করে নিভে যেতে থাকে শৈলপুত্রী। বাবুর মানে সাহাবের বুখার? কই এখানে তো কেউ জানে না।'
-' ক্যায়সে হ্যায় রে অব? হাঁ শুন থোড়া থোড়া করকে গরম সুপ দেনা ওউর আন্ডা। পাতলা খিঁচড়ি।'
-' দিদি তুম ইধার হোতে তো আচ্ছা হোতা। বাবুজী ভী তুমহে য়্যাদ কর রহা হ্যায়।'
হঠাৎই ফোনের এপারে এক ফোঁটা অবাধ্য জল কোথা থেকে এসে শৈলপুত্রীর গাল ভিজিয়ে দেয়। ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করে,' সব ঠিক হ্যায় না উধার? চাচী ক্যায়সে হ্যায়? বোল দেনা চাচা আয়া থা মিলনে ও আচ্ছা হ্যায়। মুন্না কো আচ্ছে সে পড়াই করনে কো বোলনা।'
ভেজা ভেজা ঝাপসা চোখে এলোমেলো কতগুলো কথা বলে ফোনটা রেখে দেয় শৈলপুত্রী। তারপর চুপ করে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। রেবা ফোনের আওয়াজ পেয়ে ধরেছিলেন পরে শৈলপুত্রীকে ডেকে রেডি হতে চলে যান রূপলেখাতে যেতে হবে। অপূর্ব স্টুডিয়োর কাজে ব্যস্ত। হঠাৎই তাকিয়ে দেখেন ওকে..' হ্যাঁ রে কি হয়েছে? তোর মুখটা এত শুকনো কেন রে? কদিন ধরেই দেখছি এবার আসার পর তোর মন ভালো নেই। দেওঘরের জন্য মন খারাপ?'
-' কাকিমা ও সাহাবজীর নাকি খুব বুখার। একদম বিছানায়। ফুলবন্তী বলছিল খুব শরীর খারাপ।'
ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠেন রেবা বড় প্রিয় একমাত্র ভাগনে ওদের। লাবণ্য এটা কি করল! বিদেশ বিভূয়ে ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। আচ্ছা তবে যে শুনেছিলেন ও ট্যুরে গেছে। তাহলে জানায়নি কিছু বাড়িতে। লাবণ্যকে কি বলবে? না না দরকার নেই তাহলে আবার বলবে কোথা থেকে খবর পেলে নিশ্চয় শৈলপুত্রীকে খবর জানিয়েছে। এমনিতেই কাল আশার উস্কানিতে নিজের তিক্ত মনের তিক্ততা কিছুটা দিতে চেয়েছে রেবাকেও,' বৌদি আমি বলছি কি ওকে কোথাও পাঠিয়ে দাও। মেয়েটা ভালো নয়।'
-' তুমি কি বলছ লাবণ্য এ কথা তুমি এসে বল তোমার দাদাকে আমার বলার ক্ষমতা নেই। অনেক দেনা ওঁর শৈলজাদার কাছে সুতরাং এই মেয়েকে আগলে রাখবে ও। তাছাড়া কত গুণী মেয়ে এই মেয়ে আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে বেরোবে এমনিতেই কত ভালো আঁকে।'
-' বৌদি মেয়েটা ডিভোর্সী,ওর জন্য আমার ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। যে বাড়িতে ওর বিয়ে হয়েছিল কেউ ভালো নেই সেখানে। শিবদা তো মারাই গেল।'
-' ঐ মেয়ের ছায়া যদি তোমার সংসারে পড়ে কোন বিপদ হয়?'
বুকটা কেঁপে ওঠে রেবার কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে লাবণ্য। অপূর্ব ছাড়া তাঁর আর সঙ্গী ঐ রূপলেখা। নিঃসন্তান ওঁরা তাই একে অপরের বন্ধু। তবুও নিজেকে শক্ত করেন বলেন,' লাবণ্য মনকে শান্ত কর কেউ অপয়া নয় সবই নিয়তি। তোমার ছেলেকে এ বাড়িতে আসতে দেবে না সে তোমার ইচ্ছে তাই বলে একটা অসহায় মেয়ে যাকে আমরাই এনেছি এখানে ডেকে তাকে তাড়াতে পারব না।'
রেবার চিন্তার জাল কেটে যায় শৈলপুত্রীর কথায়,' আমি ওখানে থাকলে ভালো হত ফুলবন্তীর হাতে সাহাবের জন্য ছানা,ঘি আর হাঁসের কষা মাংস করে পাঠাতাম ভালো হয়ে যেতেন তুরন্ত।
আচ্ছা কাকিমা এখনও তো কলেজ শুরু হতে দেরি আছে আমি তুরন্ত গিয়ে ঘুরে আসতাম একবার ভালো হত।'
আশ্চর্য হয়ে যান রেবা তবে কি শৈলপুত্রীর মনের আনাচে কানাচেও ভালোবাসা বেঁধেছে বাসা? নটরাজকে সুস্থ করতে ও যাবে দেওঘরে মাথা খারাপ হল নাকি? ধমক দেন রেবা,' কি সব বলছিস! তোর ভাসুর এখানে এসে যাতা বলেছে। সে সব শুনেছে লাবণ্য এই নিয়ে ওদের বাড়িতে খুব অশান্তি।'
কাকিমার কথা শুনে অবাক হয়ে যায় শৈলপুত্রী তারপরেই ঘটনাগুলো জুড়ে দিয়ে বুঝতে পারে কি হয়েছে। সেইজন্য সাহাব আর আসেনি তার মানে ওকে নিয়ে ওদের বাড়িতে অশান্তি, সাহাব কেন যে বলতে গেছিলেন ওকে বিয়ে....কথাটা কেমন যেন আবার মনের দেওয়ালে সুর তুলল হঠাৎই।
-' কিসের অশান্তি ওদের বাড়িতে? মানে লাবণ্যর বাড়িতে? কই তুমি তো কিছু বলনি।'
-' ওমা! তোমার কাজ শেষ? চল খাবে চল আরে ও কিছু না।'
সোফাটাতে বসে পড়েন অপূর্ব,' বেবির মুখটাই বলছে অনেক কিছু হয়েছে আর তোমার কিছু না। বল বল কি হয়েছে। আরে মা তোর মুখটা এমন শুকনো কেন? আঙ্কেলের বাড়িতে ভালো লাগছে না তাই না রে? দেওঘর ভালো ছিলি এখান থেকে আমি বুঝেছি সব। হ্যাঁ রেবা বল কি হয়েছে?
রেবা বুঝতে পারেন না কি করে সব বলবেন স্বামীর মেজাজ যে একটু বেশি কড়া তা তিনি জানেন। তবুও না বলে ছাড় নেই বলতে তো হবেই। শৈলপুত্রী রেবাকে চুপ করে থাকতে দেখে বোঝে হয়ত ও থাকাতে কাকিমার অস্বস্তি হচ্ছে। তাই চলে যেতে পা বাড়ায় রেবাই ওকে থামান,' বোস এখানে মা তোকে নিয়ে যখন কথা সব উঠেছে তখন তোর শোনা দরকার। অপয়া অলক্ষ্মী বাদ দিয়ে নটরাজ আসার আগে আর পরে যা ঘটেছে সবই বললেন রেবা অপূর্বকে তাছাড়াও বললেন ঐ আশা আরও অনেক খারাপ কথা বলেছে যা তোমার বোনের মাথায় ঢুকে গেছে সে আমি বলতে পারব না।
-' আমি জানি কি বলেছে,আমি ভিখারির মেয়ে অপয়া অলক্ষ্মী,কুৎসিত ওঁর ছেলের সাথে ঘর করেছি আবার এখন সাহাবের মাথা খাচ্ছি।'
রেবা অবাক হয়ে যান শুনে সত্যিই তো এই সব কথা। অপূর্ব ওকে চুপ করান,' তুই থাম মা আমি আর শুনতে পারছি না আসলে মেয়েরাই মেয়েদের বড় শত্রু।'
-' হ্যাঁ লাবণ্য নটরাজকে এ বাড়িতে আসতে মানা করেছে। ছেলে রাগ করে গেছে বাড়ি থেকে ওখানে গিয়ে জ্বর বাঁধিয়েছে। ফুলবন্তী বেবিকে ফোন করেছিল। তুমি এসব লাবণ্যকে বলতে যেয়ো না তাহলে এই মেয়েটার আরও দোষ হবে।'
-' আমি লাবণ্যকে কিছুই বলব না আজ আমার করুণা হচ্ছে ভেবে এইরকম একটা কম বুদ্ধিসম্পন্ন মহিলা আমার বোন। ছিঃ শেষে আশা ওর মন্ত্রণাদাতা!
ঠিক আছে ওর ছেলেকে ওরা আগলাক আমাদের ভাগ্নেকে না পেলেও চলবে তবে মেয়েকে আমরা ছাড়তে পারব না।'
সারা সন্ধ্যে আর সারাটা রাত ভেবেছে শৈলপুত্রী নাহ ওর জন্য দুটো পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের শ্যাওলা পড়বে তা কিছুতেই হবে না। একটা সময় ভাইবোনের সম্পর্কে একদম ভাঙন এসে যাবে। নিজেকে আর অপরাধী করতে চায় না ও। এভাবে কত ঘর ভাঙবে? একদিন হয়ত ওকেই দোষ দেবে কাকিমা। সত্যিই তো ওর বাবা মা নেই অনাথ। যিনি ওকে হাতে করে কলকাতায় এনেছেন তিনিও আজ আকাশের তারাদের দলে। তারাদের দিকে তাকিয়ে আর মন খারাপ করতে পারবে না ও তার থেকে ও চলে যাবে যেখানে খুশি। হঠাৎই মনে হয় কোথায় যাবে ও? ওর পড়াশোনা তার কি হবে? দেওঘর খুব টানে ওকে নাহ কিন্তু সেখানে যাওয়া যাবে না সেখানে গেলেই তো সাহাবের সাথে দেখা হবে। ওর সাথে যাতে দেখা না হয় তাই তো সাহাব আর আসবেন না কোনদিন এই বাড়িতে। একটা হাত ওকে বাঁচিয়েছিল কৃপাণ সিং দের অত্যাচার থেকে। ওকে এনে দিয়েছিল দামি রঙ আজ সেই হাতটাও সরে গেল পাশ থেকে। না না সাহাব খুব ভালো, মায়ের বাবার সাথে ভালো থাক সাহাব। শৈলপুত্রী অপয়া অনাথ সে মরে যদি মরবে কে আছে তার? আর কোন গুণই বা তার আছে। ও চলে যাবে অনেক দূরে চলে যাবে দরকার হলে লোকের বাড়িতে কাজ করবে। এত বড় শহরে কে আর ওকে চিনবে? একবার কাটিহারের কথা ভাবে কিন্তু সেখানে গিয়ে থাকবে কোথায়?
টিনের বাক্স থেকে আবার খুলে বসে নিজের পুরোনো সংসার শৈল। ঝরঝর করে কাঁদে বাবা মায়ের ছবি আঁকড়ে মা গো তোমার শৈলর আর ঘর পাওয়া হল না। খোলা আকাশের তলায় কোথায় সে তার ঘর পাবে জানে না তবুও তাকে যেতেই হবে।
এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার মত কেউ নেই আজ শৈল একাই একার মালিক তাই টিনের বাক্সের মায়া এবার ত্যাগ করে মা বাবার ছবা আর কিছু পুরোনো জিনিস কাপড়ের সাইড ব্যাগে ভরে। একপাশে পড়ে থাকে কাকিমার কিনে দেওয়া সব জিনিসপত্র। পুরোনো শালোয়ার কামিজ পরে কোমরে ওড়না বাঁধে শৈল রাতে প্রাচীরের গায়ে ওঠা বড় গাছটা দেখে নিয়েছে ও। সেই গাছে উঠেই আঙ্কেলের বাড়ির উঁচু পাঁচিল পার হবে ও কারণ গেটে দরোয়ান থাকে। হরিহরণ চাচার মত ওর সাথে কোন ভাব নেই শৈলপুত্রীর তাই যা করার ভোর রাতেই করতে হবে। সিঁড়ির দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নামে শৈলপুত্রী কিন্তু গেটে তো তালা ওহ্ ও তো জানে চাবি কোথায় থাকে। আস্তে আস্তে ওপরে উঠে চাবি নিয়ে দরজা খুলে বাগানে এসে দাঁড়ায় জামগাছটার তলায়। অন্ধকারে কেমন যেন ভয় করে ওর খুব অসহায় লাগে কিন্তু না ওকে যে চলে যেতেই হবে এই বাড়ি থেকে সাহাবের থেকে অনেক দূরে। জাম গাছে উঠতে গিয়ে ছড়ে যায় কনুইটা অনেকদিন গাছে ওঠার অভ্যেস নেই শরীর একটু ভারী হয়ে গেছে তবুও হার মানে না। প্রায় প্রাচীরের কাছাকাছি এসে গেছে ও,কিন্তু বেশ উঁচু লোহার ধারালো ফলা লাগানো এতে পা দিলে পা কাটবে। তাহলে কি করবে ডাল থেকে ঝাঁপ দিয়ে রাস্তায় পড়বে? কিন্তু অনেকটা নীচে রাস্তা পড়লে হয়ত হাত পা ভাঙবে। আর কিছু ভাবতে পারে না শৈলপুত্রী তারপর ভাবে যা হয় হবে পালাতে তাকে হবেই.....
****************
হঠাৎই একটা জোরালো টর্চের আলো ওর মুখে এসে পড়ে ভয়ে চমকে ওঠে শৈলপুত্রী। কে ওর মুখে টর্চ মারছে? নিজেকে গাছের আড়ালে করার চেষ্টা করে শৈলপুত্রী কিন্তু কিছু লাভ হয় না ততক্ষণে বাগানের সব আলো জ্বলে উঠেছে ম্যাজিকের মত। পরিস্কার আলোতে দেখতে পায় অপূর্ব আঙ্কেল দাঁড়িয়ে আছেন হাতে লম্বা টর্চ। ভয়ে একদম ফ্যাকাশে হয়ে যায় শৈলপুত্রীর মুখটা আঙ্কেলের রাগ ও জানে। এভাবে ওকে হাতেনাতে ধরে ফেলে কি বলবেন আঙ্কেল? কি করবে ও এখন?
-' এক্ষুনি নেমে আয় গাছ থেকে। অপূর্ব সান্যালকে ফাঁকি দিয়ে চুরি করে পালাবি তুই ভাবলি কি করে? এক্ষুনি নেমে আয় না হলে আমি পুলিশকে খবর দেব।'
একটা মুহূর্তে সব এলোমেলো হয়ে যায় শৈলপুত্রীর সত্যিই তো ও পালিয়ে গেলেও হয়ত ওকে খুঁজে আনত আঙ্কেল। ওর শ্বশুরবাড়ির লোকদের মত হয়ত চুপ করে বসে আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে শান্তিতে থাকতে পারতেন না। তাই কিছু করার নেই চুপচাপ গাছ থেকে নেমে আসা ছাড়া কোন উপায় ছিল না তবুও সেটা করতে গিয়েও ভয়ে আর লজ্জায় গাছ থেকে ধুপ করে পড়ল শৈলপুত্রী মাটিতে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। ততক্ষণে গাছের তলায় সাজানো পাথরে লেগে হাঁটুতে চোট পেয়েছে। তাই খোঁড়াতে থাকে।
অপূর্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেন ওকে এই মেয়েটাকেই না রেবা শৈলপুত্রী থেকে দুর্গা করে সাজিয়ে যুদ্ধ জয় করতে পাঠিয়েছিল। তা কি এই পরাজয়ের দিন দেখবে বলে?
মাথা নিচু করে আঙ্কেলের সামনে দাঁড়ায় শৈলপুত্রী
-' ওপরে আয় আমার সাথে কথা আছে।'
দোতলাতে যে কাকিমাও জেগে বসে আছে ডাইনিংয়ে তা ভাবতে পারেনি শৈলপুত্রী। ভয়ে ওর হাত পা কাঁপে এর আগেও পালিয়েছিল তখনও ভয় পেয়েছিল কিন্তু আজ মনে হচ্ছে অনেকটা ছোট হয়ে গেল সবার কাছে।
-' শেষে চুরি করে পালাচ্ছিল আমার বাড়ি থেকে দেখেছ রেবা কাকে তুমি হাতে অস্ত্র দিতে চেয়েছিলে?'
চুরি কথাটা আত্মসম্মানকে আঘাত করে শৈলপুত্রীর,' আমি কিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছি না। এই দেখুন আমার ব্যাগে কিছু নেই শুধু এই ছবিটা। আর সবই রেখে গেছি আমার বাক্সটাও।'
-' দেখেছ রেবা চুরি করেও বলছে চুরি করেনি। চুপচাপ তাহলে কেন দরজার তালা খুলে এইভাবে গাছে উঠে পাঁচিল ডিঙোচ্ছিল?'
-' আমি জানি না তুমি দেখ কাকে তুমি কলেজে ভর্তি করবে বলে এনেছ। পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙলে কি হত বল দেখি! খুড়িয়ে হাঁটছিস কনুই কেটেছে আর কত শাস্তি নিজেকে দিবি শুনি?'
-' ওর হাত পা ভাঙাই ভালো ছিল আবার বলছে চুরি করেনি। তুই চুরি করেছিস তুই চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিলি শৈলপুত্রীকে যে চাইলে দুর্গা হতে পারে তুই চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিস একটা অসামান্য মেয়েকে যে চেনেই না নিজেকে। আগে তো নিজেকে চিনতে হবে তুই কি করতে পারিস।'
তখন সবে ভোরের আলো ফুটছে বাগানে পাখির দল কিচমিচ করে সুপ্রভাতের গান গাইছে।
রেবা শৈলপুত্রীকে কাছে টেনে নেন ঘর থেকে তুলো এনে হাতটা মুছে দিয়ে ওষুধ লাগিয়ে দিতে দিতে বলেন,' আসলে আমরা নিজেরাই জানি না আমরা মেয়েরা কি করতে পারি। আসলে আমাদের তা শেখানোও হয় না মোটামুটি ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয় কি করলে আর কিভাবে চললে শ্বশুরবাড়ির লোকের মন জোগাতে পারব। আর এভাবেই মেনে আর মানিয়ে কেটে যায় কখন যে জীবনটা। এই দেখ আমি কি জানতাম আমি কি করতে পারি? তোর আঙ্কেল আমাকে শেখালো আমি কি কি করতে পারি। সবার ভাগ্যে এমন উৎসাহ দেওয়ার লোকই জোটে না।'
- ' আমি চাই আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচুক শৈলপুত্রী তার রূপে না হলেও গুণে ভরুক দশদিক। রূপের খোঁজে আমরা সবাই ঘুরি ফিরি অন্ধ হয়ে। রূপ খোঁজা সহজ তাতে শুধু চোখ লাগে তবে গুণ খুঁজতে জহুরীর নজর লাগে নাটু ভোলার সেই নজর ছিল। লাবণ্যটা চিরকালের বোকা।'
নটরাজের কথা উঠতেই শৈলপুত্রীর চোখের জল আর বাঁধা মানল না ঝরে পড়ল বোশেখের বৃষ্টির মত ওর তপ্ত গাল বেয়ে।
রেবা অপূর্বকে বলেন,' কাঁদতে দাও ওকে যত খুশি কেঁদে হাল্কা হোক। তারপর শুনব কেন ও চলে যাচ্ছিল।'
-' আমি চাই না আমার জন্য আপনাদের দুই পরিবারের মধ্যের সম্পর্কে শ্যাওলা জমুক। সাহাব কেন আসবেন না মামাবাড়িতে। আমি চলে গেলেই আবার আসতে পারবেন সাহাব। পিসিমার কোন ভয় থাকবে না অপয়া মেয়েটাকে নিয়ে।'
-' আবার সেই কথা! রেবা ওকে চুপ করতে বল। সত্যিই যদি তুই আমার নিজের মেয়ে হতিস আজ খুব মারতাম তোকে। তোকে মেয়ে ভাবতে চেয়েছিলাম আজ বুঝিয়ে দিলি সব মিথ্যে। আচ্ছা মেয়েরাই শুধু অপয়া হয় কেন বলতে পারিস?'
-' আমার মনে কোন পাপ নেই সাহাব আমাকে বাঁচাতে আর চাচাজীর কাম রাখতে মিথ্যে বলেছিল। সাহাবকে আমি সম্মান করি। সাহাবের জন্যই তো ফির সে সবাইকে পেলাম।'
-' আচ্ছা বেশ,তুই যাচ্ছিলি কোথায়? কি করতি? কোথায় থাকতি?'
-' মালুম নেই। আমি এখানে থেকে আপনার কাকিমার কোন ক্ষতি করতে পারব না। আমি যে অলক্ষ্মী আর অপয়া।'
-' বাহ কত সুন্দর কথা এটা শুধু মালুম আছে পালাতে হবে। আবার সেই কথাগুলো বলছিস! রেবা তুমি যাও ওকে বোঝাও আর আমাকে একটু ভাবতে দাও। ভাগ্যিস মাঝ রাতে স্টুডিওতে নেমেছি কাজ করতে তারপর ভালো লাগছে না দেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলাম। তাই তো চোখে পড়ল। না হলে যে কি হত!'
-' আমারও তো গায়ে কাঁটা দিয়েছে যখন তুমি ডেকেছো এসে। শোনো ঐ হতচ্ছাড়া দরোয়ান কে বলবে তার এত ঘুম যে কিছু বুঝল না।'
***************
মেয়েটাকে ওষুধপত্র দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক বুঝিয়ে ঘুমোতে বলে এসেছেন রেবা। ভাগ্য ভালো তবে দারোয়ানের চোখে পড়েনি এক কথা পাঁচ কান হয়ে মশলা চড়িয়ে তাতে আরও বদনাম হত মেয়েটার।
অপূর্ব শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছেন কেন যেন মনটা খুব ভারী লাগছে। একটা মেয়েকে এরা যেন কিছুতেই বাঁচতে দেবে না। এমন কি ওঁর নিজের বোনও শেষে আশার বুদ্ধিতে মাতল। এই আশা এক সময় ওকে কলকাতা ছাড়া করেছিল শিবনারায়ণের মন বিষিয়ে বন্ধুত্ব ভেঙেছিল বিষাক্ত করার কাজটা ভালোই করতে পারে এখনও তা আবার বুঝলেন নতুন করে।
মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা দিন অপূর্ব আর রেবা ভেবে চিন্তে একটা বুদ্ধি বের করেছেন। যাতে মেয়েটা আত্মসম্মান নিয়ে ভালো থাকতে পারে এখন ও রাজি হলেই হয়। রেবা বুঝতে পারেন এক কাপড়ে যে মেয়ে ওঁদের ভালো রাখবে বলে নিজেথ জীবন বিপন্ন করে পালাতে পর্যন্ত দ্বিধা করে না সে সত্যিই মন থেকেই ওঁদের ভালোবাসে। তাই একটু ভাবা দরকার এটা নিয়ে সত্যিই তো সেদিন রেবা অসন্তুষ্ট হয়ে লাবণ্যকে কয়েকটা কথা বলেছিল তারপর থেকে নন্দাই কখনও কথা বললেও ননদের সাথে কোন কথা হয়নি। আর অপূর্ব তো রাগে কোন কথাই বলেননি বোনের সাথে। রেবা বলেছিলেন একবার বুঝিয়ে দেখ ওকে। অপূর্বর বক্তব্য ছেড়ে যাওয়া বন্ধুই যখন ওর আপন তখন তাকে নিয়েই থাক ও।
তবে শৈলপুত্রীর মত ভাগ্নের শরীর নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন তবে যাবার কোন উদ্যোগ নেননি কারণ ওদের ঝামেলা ওরাই মেটাক। শুধু ফোনে খবর নিয়েছেন কেমন আছে ছেলেটা। শৈলপুত্রী আর সে সাহসও পায়নি কাউকে জিজ্ঞেস করতে সাহাবের কথা চাচী একদিন ফোন করেছিল বাইরে থেকে তখন শুনেছে সব ঠিক আছে ওখানে। বাচ্চারা পড়াই করছে,ফুলবন্তী কামে যাচ্ছে সাহাব ঠিক আছে।
শৈলপুত্রী ছাড়া দেওঘরে আবার নিজের কাজের জায়গায় ডুবে যায় নটরাজ যদিও শরীর বেশ দূর্বল। সবই ঠিক আছে আগের মত হয়ত শুধু দক্ষিণের খোলা জানলা দিয়ে যে ফুরফুরে বাতাসটা ঢুকত তা বন্ধ হয়ে গেছে। একলা ঘরে কাজের অবসরে বা ওর এলোমেলো সংসারের পরিপাটি বসার ঘরটা দেখে মনূ হয় এতে শৈলপুত্রীর হাতের ছোঁয়া আছে। নিশ্চয় ভালো আছে শৈলপুত্রী কারণ ফুলবন্তী এসে বকবক করছিল একদিন দিদি কলেজে যাচ্ছে,রাস্তাঘাট চেনে না তাই গাড়িতে করে যায়। কলেজের সব ভালো আছে মন লেগে গেছে ওখানে এই সবই বলে যায় নিজের মত নিজের ভাষায়। চুপটি করে শোনে নটরাজ। আজকাল আর কারণে অকারণে ফুলবন্তীর গ্ৰামে যাওয়ার দরকার পড়ে না নটরাজের আগে কখনও নিজেই চলে যেত ইচ্ছে হলে ওর পাঠশালা দেখতে। তবে ফুলবন্তীকে চেকে সই করতে দেখে ভালো লাগে নটরাজের। এই বোধহয় শিক্ষা যা অনায়াসে দান করে মানুষকে সমৃদ্ধ করা যায়।
কিছুদিন হল শৈলপুত্রী ওর নতুন ঠিকানায় উঠে এসেছে অবশ্য সবটাই রেবার ভাবনা। রেবার বাপের বাড়ি থেকে ভাগে পাওয়া একটা ছোট ফ্ল্যাট ফাঁকাই পড়েছিল ঐ ফ্ল্যাটের নীচতলায় রুবি আর ওর ভাই থাকে। সুতরাং সুরক্ষিত জায়গাটা কোন সুবিধা অসুবিধা হলে ওরা আসতে পারবে তাছাড়া ওঁদের বাড়ি থেকেও কাছে। প্রথমে ভেবেছিলেন হস্টেলে রাখবেন তারপর মন চায়নি। মেয়েটা বড় সাধাসিধে শহুরে জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত নয় তাই মানিয়ে নিতে পারবে কি না ওখানেও হয়ত অত্যাচারের শিকার হবে। তার থেকে এই ভালো। মাঝে মাঝে ও চলে আসবে, কারণ অপূর্বর কাছে এলে ওর কাজ করতে মানে আঁকতে সুবিধা হবে। আবার রূপলেখা থেকে ফেরার পথে রেবাও ঘুরে আসবেন। অনেক ভেবে নিজেরা কথা বলে এটাই ঠিক করেছেন। শৈলপুত্রী খুশি হয়ে রাজি হয়ে যায়। যাই হোক ও এখানে না থাকলে পিসিমা সাহাবজী সবাই এখানে আসত পারবে। ওদের মা ছেলের ঝামেলা ভী মিটে যাবে। ওর জন্য আর কোন অশান্তি বিপদ হোক চায় না শৈলপুত্রী। তবে ও যে কথাটা বলেছিল সেটা শুনে ওঁরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই চমকে উঠেছিলেন।
-' খুব ভালো হবে কাকিমা, আমি ঠিক থাকব ওখানে। সব কাম তো পারি আমি তাই কলেজ ভী করব আবার ছবিও আঁকব। কিন্তু আমি কিছু কাম করে নিজের খরচ চালাতে চাই। আমি ও ছুট্টিকে দিন পুরা আর অন্য দিন যদি কলেজের পর রূপলেখাতে কাজ করি?'
অপূর্বর দিকে তাকিয়েছিলেন রেবা দেখেছিলেন অপূর্বর মুখটা থমথম করছে। ওঁর হাতে হাত রেখেছেন রেবা,' তুমি রাগ কোর না,এ যে আমাদের শৈলপুত্রী ওর আত্মসম্মানটাও বোঝার চেষ্টা কর।'
-' রেবা দেখেছ যতবার আমি ওকে আপন করি ও আমাকে কেমন পর করে দেয়। ওকে রূপলেখাতে কাজ করে রোজগার করতে হবে?'
-' না না আঙ্কেলজী আমাকে রূপিয়া দিতে হবে না আমি সময় পেলে চলে যাব। একটু কাম ভী শিখে নিব আর রুবিদিকে সাহায্য করব। কাকীমাকেও করব তাই না? আমার সব খরচা তো আমি আঙ্কেলের কাছ থেকেই নিব।'
অপূর্ব রেবা দুজনেই বুঝতে পারেন এই মেয়ে শুধু আত্মসম্মান নিয়েই বাঁচে না বুদ্ধিমতী,পরিশ্রমী এবং বিদূষী তবে হঠাৎই একটা হঠকারিতা করে ফেলেছিল হয়ত রেবারও ভুল ছিল সবটা বলা উচিত হয়নি ওর সামনে।
নতুন শহর ঠিক নয় আগের দেখা কলকাতা ছিল ছাদের থেকে দুচোখ ভরে দেখা। হঠাৎই চোখ আটকাতে বাধ্য হত কোন উঁচু দেওয়ালে তবে এই কলকাতা কখনও গাড়িতে কখনও বাসে ট্রামে চেপে দেখা। রুবিদির ভাই বিনু অনেক সময় শৈলপুত্রীর অভিভাবক হয়ে ওকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে চলে যায়,' ও দিদি রাস্তা চিনে আসতে পারবে তো?'
-' হ্যাঁ এখন চিনে গেছি তো আর অসুবিধা হবে না।'
শৈলপুত্রীর কলেজ পার্কস্ট্রীটে ও থাকে চেতলায় আর আঙ্কেলজী থাকেন আলিপুরে এই কদিন যাতায়াত করে এই রাস্তাটুকু চিনে গেছে ও।
এর মধ্যে একদিন চাচা আর একদিন মালতীর মা মাসি ওর সাথে এসে দেখা করে গেছে। চাচা সামনের পূর্ণিমায় দেশে যাবে পূজা আছে শুনে উদাস হয় শৈলপুত্রী। চাচাও বলে,' তু থী তো ঘর ভরা ভরা থা অব তো চাচী কো সামালনা পড়েগী সব।'
ও থাকতে যখন পূজা হয়েছিল সে কথা খুব মনে হয় ওর। অনেক স্মৃতি জড়িয়ে দেওঘরের সাথে,দেওঘর ওকে দিয়েছে অনেক কিছু।
মালতীর মা মাসির খুব পছন্দের জায়গা হয়েছে নতুন বৌয়ের এই দু কামরার বাড়িটা। 'কি সোন্দর ছিমছাম গো, তোমার কাছেই থেকে যেতে মন করছে আমার। বড় অশান্তি ও বাড়িতে আর পারি নে এত কাজ করতে বয়েস হচ্ছে তো।'
-' আমি পড়াশোনা শিখে যখন নোকরি পাব তখন নিজের ঘর কিনে তোমাকে আর চাচাকে এনে রাখব আমার কাছে।'
-' ততদিনে আমি মরেই যাব বোধহয় এত খাটতূ খাটতে গো। বেঁচে থাক নতুন বৌ আমার।'
-' মাসি আমাকে বেবি বলে ডেকো ও নাম ভালো লাগে না আর শুনতে।'
-' নাম ধরে বলব আচ্ছা বেশ নতুন মেয়ে বলেই ডাকব।'
মালতীর মা চলে গেছে অনেকক্ষণ জানলায় দাঁড়িয়ে শৈলপুত্রী। নতুন মেয়ে নামটা কানে বাজলো আবার নতুন বৌ আবার নতুন মেয়ে সত্যিই বৌ থেকে আবার মেয়ে হয়ে জন্ম।
কলেজ থেকে ফিরে রূপলেখাতে চলে যায় শৈলপুত্রী ওখানে যা কাজ থাকে তা করে একেবারে রুবিদির সাথে বাড়ি ফেরে। কখনও কনে সাজানো থাকলে চন্দন পরিয়ে দেয়। শৈলর হাতের আঁকা তো দেখবার মত তাই রূপলেখাতে ভীড় বাড়তে থাকে। কখনও বাইরে থেকেও সাজানোর অর্ডার আসে তবে রেবা শৈলপুত্রীকে বাইরে যেতে দেন না। ও ডিজাইন করে দেয় রুবি সাজিয়ে আসে। ওর হাসিমুখ দেখে অবাক হন রেবা কত পরিশ্রম করে সারাদিন মেয়েটা অথচ কে আছে ওর আপনজন? ওঁরা কাছে টানতে চেয়েছেন তাও পারেননি।
প্রায় তিন মাস বাড়িতে ফেরেনি নটরাজ। লাবণ্য ফোনে কথা বলেন মাঝেমাঝে ছেলের সাথে শুধু বুঝতে পারেন সব স্বাভাবিক ভাবে বললেও কোথায় যেন একটা তাল কেটে গেছে।
-' কতদিন হল বাড়ি আসিস না। খুব দেখতে ইচ্ছে করে বাবা তোকে।'
-' হ্যাঁ আসব কিছু কাজ আছে এখানে দেখি কবে সম্ভব হয়।'
-' এবার কলকাতা এলে একটা মেয়ে দেখি বিয়ে কর,তোর বাবার শরীরের অবস্থা ভালো নয়।'
-' তোমরা যা ভালো বোঝ কর,আমাকে জিজ্ঞেস কোর না। কেন তোমার প্রিয় বান্ধবী কোন সম্বন্ধ এনেছে বুঝি?'
ছেলের কথার খোঁচা হজম করেন লাবণ্য। এর মধ্যে আশা সত্যি ফোন করেছিল। কথা না বলতে চাইলেও দু একটা কথখ হয়েছে। শৈলপুত্রীর কথা জিজ্ঞেস করছিল আশা লাবণ্য জানে না বলে দিয়েছেন। সত্যি দাদা বৌদি ওর সামনে মেয়েটার কোন কথাই বলেনি। আর ঐ ঘটনার পর একবার মাত্র গেছে লাবণ্য দাদার সামনাসামনি হতেই ভয় করে।
-' এমন করে বলছিস কেন? তুই আয় মামা তোকে মিস করে বুঝতে পারি।'
-' তুমি তো আমাকে সেখানে যেতে বারণ করেছ মা?'
-' কি বলেছি কবে। তুই আয় আমি নিয়ে যাব।'
-' কিন্তু সেই অপয়া মেয়েটাকে যদি দেখে ফেলি তাহলে কি হবে মা?'
লাবণ্য কিছু বলতে পারেন না তবে বোঝেন শৈলপুত্রীর খোঁজ নটরাজেরও জানা নেই তাঁর মতই।
********************
শৈলপুত্রীর মনের জানলায় মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যায় একটা ভরসামাখা মুখ যে ট্রেনে ওকে অনেকটা আনন্দ দিয়ে সাথে করে এনেছিল। দেওঘরে সাহাবজী প্রথমে ওর জীবনে শুধু একটা নাম ছিল তবে এখন বুঝতে পারে হয়ত মানুষটা অনেক কিছু ছিল ওর জন্য তাই তো নিজে ঝুঁকি নিয়ে মিথ্যে কথা বলে বাঁচিয়ে দিয়েছিল ওর আর চাচার সম্মান। কেমন আছেন সাহাবজী এখন? ফুলবন্তী এখন আর ফোন করে না অনেকদিন হয়ে গেল। সময়ের সিঁড়িতে উঠে সামনে এগোতে এগোতে কতই আর মনে রাখবে পেছনের সিঁড়িটার কথা। হয়ত সেই কবিতাটাই সত্যি আমাদের যেদিন গেছে সত্যিই তো যেদিন যায় তা আর ফিরে আসে না।
একলা ঘরে নানা চিন্তা এসে ভীড় করে ওর মনে। সেগুলো একপাশে সরিয়ে দিয়ে ছবি আঁকতে বসে। আঙ্কেলজী এসে ধমকে গেছেন যে এরপর এসে দেখবেন কতগুলো ছবি আঁকা হয়েছে। সারাদিন কলেজ রান্না আর বিউটিপার্লার করলে হবে না।
শৈলপুত্রী বলেছিল,' কলেজে তো কাম করছি অনেক। বাড়িতেও করছি।'
-' কলেজে কি করছিস আমি জানি না। সুশোভন বলছিল আনমনা হয়ে বসে থাকিস কি ভাবিস এত? এই জন্য বলেছিলাম আমার কাছে থাক দুজনে মিলে ছবি আঁকা আর মূর্তি বানানো হবে। হ্যাঁ শোন সামনের মাসে একটা এক্জিবিশন আছে সেখানে তোর তিনটে ছবি দিতে হবে সুশোভন বলেছে অবশ্য অনেকেই ছবি দেবে সেখানে। তখন আর কদিন রূপলেখাতে যাওয়া চলবে না। কি বল রেবা?'
-' আমি তো সবসময় বলি এখানে না এসে কাকুর সাথে কাজ কর তা শুনলে তো। লাফিয়ে সব কাজ করতে যায়। হ্যাঁ রে খাওয়াদাওয়া করিস তো ঠিকমত কেমন যেন শুকনো লাগছে।'
শৈলপুত্রী হাসে,' খাচ্ছি তো তুমি পাঠাচ্ছো,রুবিদি দিচ্ছে। নিজেও করে নিচ্ছি।'
-' সাবধানে থাকিস মা এই একলা ঘরে কি ভালো লাগে থাকতে নাকি? আমাদের কাছে থাকলে আমাদেরও ভালো লাগত।'
-' কত ভালো আছি তো এখানে কোন অসুবিধা নেই। আমি এখানে আছি তা কাউকে বোল না কাকিমা।'
রেবার সাথে শৈলপুত্রীর সম্পর্ক অনেক সহজ তাই বোঝেন কেউ বলতে কাকে বোঝাচ্ছে ও। নাহ্ লাবণ্য এখন আর খুব একটা আসে না। সামান্য সন্দেহের বশে অনেক কিছুই হারালো। তবে ছেলেটার জন্য খুব খারাপ লাগে শুনেছে প্রায় চার মাসের পর সে আসবে সামনের মাসে। লাবণ্যর ইচ্ছে এবার কয়েকটা মেয়ে দেখে যে কোন একটা মেয়ে ঠিক করে ছেলের বিয়ে ঠিক করার দেখা যাক কি হয় শেষ পর্যন্ত কি হয়।
অনেকদিন বাদে কলকাতা শহরটাকে আবার কাছ থেকে দেখছে নটরাজ। তবে ভালোবাসার বাঁধনটা কেমন যেন আলগা হয়ে গেছে। আর বাড়ি আসতে ঠিক তেমন উত্তেজনা নেই। অনেকটা অভিমানে বুক ভরা এখনও হয়ত মামাবাড়িতে গেলে মামা কি বলবে কে জানে? আবার যখন দেওঘরে যাবে তখন চাচীকে কি বলবে সে কেমন আছে? এবার ঠিক করেছে নিজেই কিছু কিনে নিয়ে যাবে শৈলপুত্রীর হয়ে ওদের জন্য। তারপরেই নিজেকে শাসন করে নাহ্ আর মিথ্যের বোঝা বাড়াবে না। একটা মিথ্যের শেকল এখনও জড়িয়ে হাতে পায়ে।
ছেলেকে দেখে খুশি হন ওঁরা স্বামী স্ত্রী কিছুই হয়নি এমন ভাবেই সব চলতে থাকে। নটরাজের খুব ইচ্ছে করে মামুর কাছে যেতে কিন্তু কিছু বলে না। একদিন বাদেই ফোন আসে,' কি রে নাটু ভোলা এখনও এলি না যে। আরে চলে আয় কতদিন দেখি না তোকে। একাই আসিস বুঝলি কেন যেন আজকাল মনটা ভালো নেই তোর সাথে একলা বসে অনেকক্ষণ গল্প করব।'
ছেলেকে একা ছাড়তে পারেন না লাবণ্য তবে দাদার সাথে ছেড়ে দেয় স্টুডিওতে। অনেকটা সময় মামুর সাথে গল্প করে মনটা হাল্কা হয়ে যায় নটরাজের। কিন্তু মামা তো একবারও শৈলপুত্রীর কথা বললেন না। সে আছে কোথায়? আজকে সবাই ওকে সব কিছুর বাইরে করে দিয়েছে অথচ এই শৈলপুত্রীকে তো ও খুঁজে দিয়েছিল। হয়ত একটু হলেও একটা দায়িত্ব থেকে যায় মেয়েটার প্রতি ওর। নটরাজের চোখ একতলা দোতলা সব জায়গাতেই ওকে খুঁজলো কিন্তু কোথাও নেই সে। অথচ কাউকে জিজ্ঞেস করতেও পারেনি। মা নিশ্চয় জানে ও এখানে নেই তাই নিশ্চিন্তে ওকে এখানে নিয়ে এসেছে। শৈলপুত্রী কি সত্যিই আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছে? না ওকে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে?
মনে জমে থাকে অনেকগুলো প্রশ্ন তবে দেখা মেলে না সেই মেয়েটারও এ বাড়ির কোন কোণেই আর প্রশ্নগুলো থেকে যায় সঙ্গোপনে। কি সুন্দর মানুষের চরিত্র আশা নামের মহিলা মাকে বিষাক্ত করল আর হয়ত মায়ের ইন্ধনেই মামিমা মামু সম্পর্কে গুরুত্ব দিতে যার সাথে আলগা সুতোর সম্পর্ক তাকে সরিয়ে দিয়েছে কোথাও।
বেশ কয়েকটা মেয়ে দেখে রেখেছিলেন লাবণ্য এর মধ্যে প্রত্যেকেই ভদ্র পরিবারের মেয়ে শিক্ষিত তার মধ্যে দুজনকে বেশি ভালো লেগেছে লাবণ্যর মায়ের কথাতে একটা মেয়েকে দেখতে গিয়েছিল নটরাজ এই মেয়ে নাকি সেরা। মা কি চোখে যে মানুষ যাচাই করে তা জানে না নটরাজ ওর যেন মনে হল এই মেয়ের মাপা হাসি,গুছোনো সাজ আর পরিপাটি কথা সবই কেমন যেন মেকি প্রাণহীন। যে প্রাণখোলা হাসি হাসে না,চুলের স্টাইল নষ্ট হয়ে যাবে বলে সারাক্ষণ চুল সামলাচ্ছে,শাড়ির ভাজ নিয়ে ব্যস্ত তার তো সবটাই কেমন যেন নকল। হঠাৎই নটরাজের মনে পড়ল চাচীর উঠোনে দুধের বালতি হাতে শৈলপুত্রীর দুধ দোয়ানোর কথা। ও হেসে ফেলে হঠাৎই মেয়েটা পেন্সিল দিয়ে আঁকা ভুরু তুলে ওর দিকে তাকায়,' কিছু বলবেন?'
লাবণ্য বলেন,' যাও না একটু কথা বল তোমরা। আমরা বরং ততক্ষণে গল্প করি।'
মেয়েটা ওকে নিয়ে ছাদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ায়,' আমাদের বারান্দাটা সুন্দর না? আপনি কিছু বলতে চাইছিলেন মনে হল।
নটরাজ আনমনা হয়ে চারপাশে দেখছিল বাড়ির সামনে বড় বাগান ওরা বেশ বড়লোক মনে হচ্ছে তাই মায়ের পছন্দ। তবে এপাশের ঝুল বারান্দা থেকে বেশ পাশের রাস্তার লোকজন দেখা যায়।
-' হ্যাঁ বারান্দাটা বেশ ভালো। আচ্ছা আপনি গরুর দুধ দোয়াতে পারেন?'
নটরাজের প্রশ্নে চমকে ওঠে মেয়েটা ভীষণ বিরক্তও হয়।
'এ আবার কি ধরনের প্রশ্ন! কি বলছেন আপনি! মানে আপনি কি গরু পোষেন নাকি?'
-' নাহ্ পুষিনি তবে ভাবছি পুষব।'
কথাটা বলেই হঠাৎই লাফ দিয়ে ওঠে নটরাজ
-' আচ্ছা আমাকে তাড়াতাড়ি বলুন আপনাদের সিঁড়িটা কোথায় আমাকে এক্ষুনি নামতে হবে নীচে খুব একটা জরুরী কাজ আছে। নাহলে লাফ দিতে হবে ছাদ থেকে।'
ভয়ে হাত পা পেটে ঢুকে যাবার জোগাড় হয় মেয়েটার। এ কেমন ছেলে! মনে তো হচ্ছে পাগল। তাড়াতাড়ি করে বারান্দার ও পাশের সিঁড়িটা দেখাতে গিয়ে দেখে নটরাজ পাগলের মত ছুটছে ঐ দিকেই।
লাবণ্য তখনও দোতলার হল ঘরে বসে দিব্যি গল্পে মশগুল মেয়ের মায়ের সাথে। মেয়েকে একা আসতে দেখে অবাক হয়ে বলেন,' নটরাজ কোথায়?'
-' উনি ওদিকের সিঁড়ি দিয়ে হঠাৎই লাফিয়ে নেমে গেলেন মানে আমি দেখলাম রাস্তায় বেরিয়ে ছুটে চলে গেলেন কোথায়।'
-' কি বলছ তুমি! আমাকে আর ওর বাবাকে বসিয়ে রেখে ও চলে গেল!'
-' আচ্ছা আপনার ছেলের কি মাথা খারাপ? এটা তো আমার একদমই মনে হয়েছে তাই বললাম।'
কথাটা শুনে লাবণ্যর প্রচণ্ড বিরক্তি লাগে সাহস তো কম নয় মেয়েটার এ কেমন কথা!
-' কি বলছ তুমি! আমার ছেলের মত ছেলে হয় না।'
-' তা আমি জানি না তবে উনি আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন আমি গরুর দুধ দোয়াতে পারি কি না? উনি নাকি গরু পুষবেন। তারপর হঠাৎই সিঁড়িটা কোথায় না বললে উনি নীচে লাফ দেবেন বলেই চলে যান।'
-' না না কোথাও ভুল হয়েছে। নিশ্চয় তুমি কিছু বলেছ ওকে তাই ওর খারাপ লেগেছে।'
-' এ কি আপনি আমার মেয়েকে দোষ দিচ্ছেন কেন? না না আমি এখনই বলব আমাদের এখানে সম্পর্কে আসা সম্ভব নয়। রুনা আমাদের একটা মাত্র মেয়ে।'
ভীষণ অপমানিত হয়ে ওঁরা বেরিয়ে আসেন। লাবণ্যকে বকাবকি করেন নটরাজের বাবা জোর করে ছেলেকে আনার জন্য। কি জানি সে আবার কোথায় গেল?
এদিক ওদিক কিছুক্ষণ দেখে গাড়িতে উঠে বাড়িতে আসেন ওঁরা কিছুই করার নেই দেখা যাক সেখানে গেছে কি না?
-' আচ্ছা নাটু তো ঠিকই ছিল শুধু শুধু এমন করল কেন বলতে পার? আগেই তো বলতে পারত ওর বিয়েতে মত নেই। আমাদের কতটা অসম্মানিত হতে হল ওর জন্য।'
- ' লাবণ্য তুমি এখন চুপ কর। মাথা ঠান্ডা রাখো দেখা যাক ও আসুক তারপর সব শুনি। হয়ত কোন কাজ পড়ে গেছে হঠাৎই।'
ছাদে দাঁড়িয়ে আনমনা হয়েই মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল কথাটা। তারপর সচেতন হয়ে ওটাকে মজার ছলে নিতেই হঠাৎই একটা আশ্চর্যজনক দৃশ্য চোখে পড়ে যাওয়াতে ভীষণ ছেলেমানুষী করে ফেলে নটরাজ। সত্যিই নিজেকে সামলাতে পারে না। আরে যার কথা ভেবে হঠাৎই দুধ দোয়ানোর কথা উঠে এসেছিল ঐ তো সে। বাস থেকে নেমে রাস্তায় ছুটে চলেছে উদভ্রান্তের মত তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে কোনদিকে তার কোন নজর নেই। এভাবে এখানে এসে যে ওকে দেখবে ভাবতে পারেনি নটরাজ। সামান্য একটা মেয়ে,খুবই সাধারণ তার সাজগোজ অথচ শৈলপুত্রীকে কিভাবে যেন আলাদা করা যায় পথচলতি আরও দশজনের থেকে।
উদভ্রান্তের মত পথে নেমে এসেছে নটরাজও ওর যে খুব দরকার শৈলপুত্রীর সাথে একবার কথা বলার ওর হঠাৎই খুঁজে পাওয়া এত বড় একটা প্রতিভা এভাবে শেষ হয়ে যাবে? কোথায় থাকে কি করে মেয়েটা লজ্জাত কাউকেই জিজ্ঞেস করতে পারেনি আশা করেছিল মামু অন্ততঃ একবার ওর কথা তুলবে। কিন্তু দুই ঘন্টা থেকেও একবারের জন্যও শোনেনি নামটা কারও মুখে।
হনহন করে হাঁটছে মেয়েটা কাঁধে একটা সাইড ব্যাগ পরনের শাড়ি কোমরে জড়ানো। নটরাজ অনেকটা পেছনে ওর তবুও চোখ রেখেছে। বড় রাস্তা ছেড়ে ততক্ষণে ছোট রাস্তায় ঢুকছে মেয়েটা তারপর ঢুকে যায় একটা জায়গায় অবাক হয়ে যায় নটরাজ দোকানটার সামনে এসে রূপলেখা! এটা তো মামীর পার্লার। একবার মাত্র এসেছিল এই পথে মামুর সাথে ভেতরে ঢোকেনি কখনও আর ঢুকবেই বা কেন মেয়েদের সাম্রাজ্যে। ঘড়ি দেখে নটরাজ প্রায় পাঁচটা বাজে। এখন কি করতে ঢুকছে ওখানে শৈলপুত্রী রূপচর্চা? না না ওর সাথে মেলানো যায় না সেটা। তবে কি ওখানে কাজ করে শৈলপুত্রী? নাকি মামিমার সাথে দরকার আছে বলে এসেছে? হয়ত তাই হবে। যাক বেরোবে তো নিশ্চয় তাহলে জেনে নিতে পারবে। আদৌ ওর পড়াশোনা আঁকা সব হচ্ছে কি না? কোথায় আছে?
প্রায় চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করে এদিক ওদিক পায়চারী করে নটরাজ। অনেকেই দেখছেন আসেপাশের বাড়ি থেকে ওকে। নাহ্ কোন পাত্তা নেই মেয়েটার। এদিকে ওখানে যা কান্ড করে চলে এসেছে হয়ত দক্ষযজ্ঞ হবে ওখানে। মা আবার রাগ করে থাকবে। সব সব ঐ শৈলপুত্রীর জন্য। কোথায় গেল মেয়েটা এই ভাবে? অথচ কাউকেই কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না সবাই ভাববে ও শৈলপুত্রীর নাহ্ আর ভাবতে পারে না নটরাজ। হয়ত প্রেম নয়,তবে কি কেন এত ব্যাকুল শৈলপুত্রীর জন্য ওর মন?
***************
বেশ অনেকটা সময় বাদে বাড়িতে আসে নটরাজ। লাবণ্য কোন কথা বলেন না। কারণ কি বলতে কি বলবেন তার থেকে চুপ করে থাকাই ভালো।
-' হ্যাঁ রে নাটু তুই কোথায় ছিলি এতক্ষণ? কত খুঁজলাম তোকে শেষে ফিরে এলাম না পেয়ে। ওখানে কি উল্টোপাল্টা বলে এসেছিস। ওরা আমাদের অপমান করল বলল তুই পাগল।'
লাবণ্য আর চুপ করে থাকতে পারেন না,' বলবে না মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছে দুধ দোয়াতে পারে কি না? একটা অফিসার ছেলে সে নাকি গরু পুষবে। ভাবো ঐ গ্ৰামের দেহাতীদের সাথে থেকে কি অবনতি হয়েছে ওর। আজ ওর জন্য আমাদের অপমানিত হতে হল। কেন করলি এমন?'
-' সরি মা,খুব সরি। আমি ঐ রুনা না কি যেন ওর সাথে গল্পই করছিলাম। মজা করে কথাটা বলেছিলাম। তারপর মজাটাই নষ্ট হয়ে গেল এত বাথরুম পেল যে দৌড়তে হল পাগলের মত। অত গরম কফি খেয়েছি না। তবে মা ঐ দেহাতীদের জন্যই তোমার ছেলের চাকরিটা আছে। আমাদের শহুরে মানুষদের থেকে ওরা কখনও অনেক ভালো। তোমার রুনার মত নয় ওরা মেকআপ ছাড়াই সুন্দর।'
লাবণ্য চুপ করে যান ওহ্ তাহলে বাথরুম পেয়েছিল,' ওদের বাড়িতে বাথরুম ছিল না নাকি যে এভাবে চলে গেলি।'
-' মা কি যে বল মেয়ে দেখতে গিয়ে সেখানে ইশ্ ছাড়ো এসে গেছি তো এখন আবার কি?
মাঝে তো আরেকটা দিন তারপরেই তো চলে যাওয়া আবার দেওঘরে এই কদিন বড় অশান্ত ছিল মনটা আজ অনেকটা শান্ত মন কারণ শৈলপুত্রী আছে এই শহরের কোথাও একটা ইচ্ছে হলেই হয়ত খুঁজে পেতে পারে শৈলপুত্রীকে।
লাবণ্য আর রাগ করতে পারে না ছেলের ওপর যাক যা হবার তা হয়ত ভালোই হয়েছে মেয়েটা ভীষণ উদ্ধত আর অসভ্য সত্যিই মানুষ চেনা বড় দায়। ছেলেটা মজা করেছে সেটাও বুঝল না উল্টে একটা শিক্ষিত ছেলেকে পাগল বলে দিল! আশ্চর্য সব মানুষ।
রাতে ছেলেকে খুব খুশি লাগে লাবণ্যর হয়ত বিয়ে করতে হচ্ছে না বলেই খুশি ছেলে। নটরাজের বাবাও বোঝান লাবণ্যকে,' বিয়েটা শাড়ি গয়না কেনার মত নয় শাড়ি গয়না পছন্দ না হলে কাউকে দেওয়া যায় বা দূর করে ফেলে দেওয়া যায় কিন্তু বৌ সে যদি অপছন্দের হয় তাহলে কি হবে? সুতরাং ওকে ভাবতে দাও। সময় দাও।'
অপছন্দের শ্বশুরবাড়িকে দিনরাত বাক্যবাণে পিষ্ট করতে থাকে সানন্দা বিয়ের প্রথমেই তো এদের চালাকির জন্য ওর সম্মান একদম ঢিলে হয়ে গেছে। সুতরাং নিজের পাওনা ষোল আনার চেয়ে বিশ আনা বুঝে নিতে চায় সানন্দা। খেতে বসে অনেক সময় দিব্যি আশাকে বলে...' সবসময় ছেলের পাতে বড় মাছ মুড়ো তুলে দেবেন না চাকরি আমিও করি আপনার বড় বৌয়ের মত বেকার নই সুতরাং আমার জন্য আপনার ছেলেরা যা খায় সেটাই তুলে রাখবেন।
আশা সংসারে থাকবেন না ভাবলেও সংসার তাঁকে এমন করে পেঁচিয়ে রেখেছে কোন মুক্তিও নেই। মালতীর মায়ের বয়েস হয়েছে সংসারে সব দিকে সে তাল দিতে পারে না তাই অনেক দায়িত্ব আশার। সেই চকচকে মাখনের মত গাল বয়েস আর ক্লেশে জরাজীর্ণ। নিজের মনের কালিমাকে কিছুটা শরীরেও ঠাঁই দিয়েছেন আশা।
মধুও আজকাল অনেক কথা শোনায় আশাকে। আশ্চর্য লাগে সব কথা যেন তাঁর জন্যই তোলা।
-' শুনুন মা সানন্দাকে বলবেন চাকরির দেমাক না দেখাতে। কটা টাকা সংসারে দেয় শুনি? সবই তো ওড়ায় আমোদ আহ্লাদে। সংসার চলে আমার বরের টাকায় তাই আমাদের অধিকার সবচেয়ে বেশি।'
-' যদি বলি কারখানাটা আমার তাহলে কি হবে বৌমা? তোমরা সবাই সব যদি তোমাদের বল আমার কি কিছু নেই? এই সংসারের দায়িত্ব এবার তোমরা নাও আমার গয়না,টাকা যা আছে সব আমার কাছে রাখব আমি। দেব আসুক আমি কথা বলব।'
*************
ঘড়ি দেখে নটরাজ একটু আগেই বেরিয়ে গিয়ে আজ রূপলেখার কাছের কোন একটা রাস্তায় দাঁড়াবে যেখানে হয়ত দেখা যাবে শৈলপুত্রীকে। আজ তাকে জিজ্ঞেস করতেই হবে সে কোথায় থাকে? কি করছে? কেমন আছে?
সামনেই এক্জিবিশনের দিন এগিয়ে আসছে তাই শৈলপুত্রীর আর রূপলেখা আসা হয়নি মানে এই কদিন আসতে বারণ করে দিয়েছেন অপূর্ব। আঁকাটা তো শেষ করতে হবে নাকি? কলেজ আজ ছুটি সকালে একটু রান্না করে খেয়ে রঙ তুলিতে ডুব দেয় শৈলপুত্রী তুলির আঁচড়ে আঁচড়ে ভরিয়ে দেয় ক্যানভাসের বুক। একটু একটু করে জীবন্ত হয়ে ওঠে ছবিটা। এই ছবি বড় প্রিয় ছবি ওর। রঙের অভাবে শুরু করেও শেষ করতে পারেনি। এবার আরও বড় করে আঁকছে ছবিটা। আগের বার মায়ের ছবিটা নেবার জন্য অনেকেই জোর করেছিল রাজি হয়নি শৈলপুত্রী তবে এবার এই ছবিটা কেউ নিশ্চয় পছন্দ করবে আঙ্কেল যদি বলেন তাহলে ভালো দাম পেলে বিক্রী করে দেবে কারণ টাকার দরকার ওর। নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে ওকে।
অনেকটা সময় এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে নটরাজ কিন্তু নাহ্ আজ তো শৈলপুত্রীর কোন দেখা নেই। কালকের মেয়েটা সেই ছিল তো?
হঠাৎই রুবিদিকে ওখান থেকে বেরোতে দেখে নটরাজ। নিজেকে আড়াল করে ফিরে আসে বাড়িতে। কালই ওকে ফিরতে হবে। তাছাড়া রুবিদির সাথে দেখা না হওয়াই ভালো।
********************
নটরাজ ফিরে এসেছে কাজের জায়গায় ছেলেকে আবার আগের মত দেখে ভালো লেগেছে লাবণ্যর আরও ভালো লেগেছে যখন বলেছে সময় পেলে চেষ্টা করবে আবার তাড়াতাড়ি আসার। আগের বার রাগ করে মোটামুটি কিছু না খেয়ে চলে গেছিল সেই আক্ষেপ পুরোপুরি উশুল করলেন লাবণ্য তারপর একগাদা খাবারদাবার দিয়ে পাঠালেন ছেলেকে। বারবার করে বলে দিলেন ফুলবন্তী যেন ঠিকমত রান্না করে খাওয়ায়। নিশ্চয় এত ফাঁকি দিচ্ছে যে একটা পদ করে চলে যাচ্ছে আর তার ফলে ছেলের শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। দেওঘরে যাবার পরই ফুলবন্তী কাজে আসে তবে এক নয় চাচীকে সাথে নিয়ে।
-' ও বিটিয়া ক্যায়সী হ্যায় সাহাব? মেরে বাত বোল রহী থী ক্যায়া? আপ তো আচানক চলে গেয়ে। কুছ ভেজ ভী না শকে হম।'
ইচ্ছে করেই এবার কাউকে না জানিয়ে কলকাতা চলে গেছিল এমন কি ফুলবন্তী কাজ করতে এসে দেখেছিল বাবুজী নেই। মথুরাকে জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল অচানক কুছ কাম পর গয়া।'
ব্যাগ থেকে কিছু জিনিস বের করে চাচীর হাতে দেয় নটরাজ। ফুলবন্তী আর বাচ্চাদের হাতেও দেয় কলকাতা থেকে আনা কিছু জিনিস। ওদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে,' দিদি নে ভেজি ক্যায়া?'
মিথ্যে বলবে না ভাবলেও আবার মিথ্যে বলে নটরাজ এতগুলো মানুষের মুখের আলো টুকু মুছে দিতে ইচ্ছে করে না।
-' হাঁ ও নে ভেজী মগর মোলাকাত না হো পায়া শায়েদ কোই কাম সে বাহার গয়ি। তুমলোগো কো বহত য়্যাদ করতী মামাজী নে বোলা।'
ফুলবন্তী আর চাচীর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আর ওদের এই খুশিগুলো ছুঁয়ে যায় নটরাজের মন। হঠাৎই অলক্ষ্যে শৈলপুত্রীকে দেখতে পায় ওদের মাঝে যেন ও বলছে আপনার সব দিকে কত খেয়াল। কথা মিথ্যে অথচ একঝলক মিষ্টতা ছুঁয়ে গেল নটরাজকে।
সেদিন রেবা শৈলপুত্রীকে অবশ্যই শনিবার যেতে বলেছেন বাড়িতে অপূর্ব খুব ব্যস্ত হয়েছেন অনেকদিন দেখেননি ওকে তাছাড়া সামনেই এক্জিবিশনের তারিখ তাই গাড়ি আসবে ওকে নিতে বিনু সাহায্য করবে নিশ্চয় যেন ছবি নিয়ে ও চলে যায় দু একদিন থেকে ওখানে আসবে। অপূর্বর তাই ইচ্ছে কারণ তাঁর বায়না শৈলপুত্রীর হাতের রান্না খেতেও খুব ইচ্ছে করছে।
ইতস্ততঃ করে শৈলপুত্রী ও ওখানে যাবে? মানে থাকার জন্য যাবে?
রেবা ওর মাথায় হাত রাখেন,' যাবি কেন কি আছে? না গেলে তোর আঙ্কেলের খুব মন খারাপ হবে। তাঁর কত গল্প আছে তোর সঙ্গে। আর রবিবার রুবি বিনু ওরাও তো যায়। ও হ্যাঁ ফুলবন্তী ফোন করেছিল। তোকে খুঁজছিল আমি বলেছি কলেজে আছিস শনিবার ফোন করতে।'
ফুলবন্তীর কথা শুনে মনটা নেচে ওঠে শৈলপুত্রীর হঠাৎই দেওঘরের অনেক স্মৃতি মনে এসে উঁকি দিয়ে যায়।
অপূর্বর কথা মত শনিবার গাড়িতে করে ছবি নিয়েই চলে আসে। এসে একটু কথা বলেই সোজা রান্নাঘরে ঢুকে যায়। সবাইকে রেঁধে খাওয়াতে বড় সুখ ওর তাই আঙ্কেলের যা পছন্দ তাই রাঁধতে বসে পরিপাটি করে। রেবা হাসেন পরিতৃপ্তিতে হয়ত ভগবান তাঁকে সন্তান দেননি কিন্তু ভরে রেখেছেন অপত্যসুখে কত সুখ এই হঠাৎই পাওয়া আনন্দে অথচ তেমন কোন দায় দায়িত্ব নেই শুধু একটু অকৃপণ ভালোবাসা দান করে যাওয়া। অপূর্ব কদিন ধরেই কই মাছের হরগৌরী খাবেন করে মাথা খারাপ করছেন সুতরাং সে তো একমাত্র গৌরীই বানাতে পারে সুতরাং ডেকে আন গৌরীকে। রান্নার মাঝেই ফোনটা বেজে ওঠে হঠাৎই ঘড়ি দেখে শৈলপুত্রী হয়ত ফুলবন্তী তবে কাকিমা ডাকলেই সে যাবে। রেবা ফোন ধরে একটু কথা বলেন এই মেয়েটার কাছে নাটুর খবরও পাওয়া যায় সুতরাং একটু জেনে নেন কেমন আছে সে।
বেবি...
শৈলপুত্রী গিয়ে ফোনটা ধরে ওপার থেকে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে ফুলবন্তী কত মুশকিলে প্রতাপকে ধরে ওকে ফোন লাগায় তবুও কথা হয় না। আজ কতদিন বাদে ওকে পেয়েছে। প্রথমেই জিজ্ঞেস করে,' দিদি তুম বাহার মে থী ক্যায়া? বাবুজী সে মোলাকাত নহি হুয়া মালুম। কিতনে সামান ভেজে তুম হম সবকে লিয়ে।'
শৈলপুত্রী অবাক হয়ূ শোনে সব। সেদিনের পর ও কখনই কাউকে জিজ্ঞেস করে না নটরাজের কথা। তার মানে সাহাব এসেছিলেন বাড়িতে। ফেরার সময় অনেক কিছু নিয়ে গেছেন শৈলপুত্রীর নাম করূ ওদের কে দিয়েছেন। খুব অভিমান হয় শৈলপুত্রীর কি দরকার ছিল আবার মিথ্যে বলার সাহাবের? ওরা জানত দিদি ওদের ভুলে গেছে তাই কিছু পাঠায়নি।
ওকে ভালো রাখতে যে বারবার বিপদে পড়ছে সাহাব। তবুও নিজেকে সামলায় যেন কিছুই হয়নি এই ভেবে জিজ্ঞেস করে সবাই ভালো আছে কিনা? চাচী কালীগাই সবাই কেমন আছে? চাচীর সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করে। চাচী নাকি ওর দেওয়া শাড়ি আর মিঠাই পেয়ে খুব কেঁদেছে। নিজেকে শক্ত করে শৈলপুত্রী নাহ্ এর পরে যদি কখনও দেখা হয় সাহাবের সাথে ও বারণ করবে এভাবে কাউকে কিছু দিতে ওর হয়ে। আর টাকা দিয়ে দেবে। সত্যি তো ও কে হয় সাহাবের যে ওর জন্য এত কিছু করবেন সাহাব।
শৈলপুত্রীর রান্না খেতে খেতে নস্টালজিক হয়ে যান অপূর্ব,' আহা বেবি মা তুই কেন ঐ বাড়িতে চলে গেলি বলত এখানে থাকলে প্রতিদিন ভালোমন্দ জুটত আমার। হ্যাঁ শোন আজ ছবিটা খুলিস দেখব কেমন হল। অবশ্য ঐ জন্য তো তোকে ডাকলাম।'
-' তুমি ওকে কি জন্য ডেকেছ তা তুমিই জান। আমার তো মনে হয় মাছের নানা পদ খাবে বলেই ডেকেছ।'
-'রেবা দাঁড়াও আগে খেয়েদেয়ে মাথা ঠান্ডা করি তবে তো ভালো কাজ করতে পারব। ওহ্ অসাধারণ করেছিস মা। রেবা ওকে একটু ভালো করে যত্ন কোরো চারটে দিন। মা আমার দুর্গার মতই চার দিন মাত্র হাতে করে এসেছে।'
শৈলপুত্রীর আঁকা ছবির মোড়ক খুলেই অবাক হয়ে যান অপূর্ব। এত অসাধারণ হাতের আঁকা মেয়েটার! হয়ত এটাই যে চারটে ছবি এঁকেছে তার মধ্যে সেরা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই থাকেন আর বারবার দেখেন।
-' হ্যাঁ রে মা এত প্রাণশক্তি কোথা থেকে পাস শুনি সারাদিন কলেজ ঘরের কাজ রান্নাবান্না তারপর আবার যাস পার্লারে কাজ করতে। না না আর যাস না রূপলেখাতে। কি গো রেবা?'
-' আমি বারণ করেছি গো,শোনে না কলেজ থেকে ছুটে আসে এখানে। তবে ওর চন্দন দেওয়ার হাত অসাধারণ। এখন অবশ্য মেকআপ ভালো করছে তবে আর কোন কাজে আমি হাত দিতে দিই না। তখন আমাকে সাহায্য করে হিসেব মেলাতে। জিনিস গুছোতে। বলি একটু নিজে সাজ কে শোনে কার কথা।'
-' এই মেয়ে যে সাজাতে ব্যস্ত সাজবে কখন? হ্যাঁ রে রঙের এত টান আর ছবির আইডিয়া কে দিল?'
শৈলপুত্রী পাশ থেকে একটা কাগজ বার করে,' এটা এঁকেছিলাম আগে দেওঘরে বসে তখন রঙ ছিল না তেমন পেন্সিলে করছিলাম সাহাবের খুব পছন্দের ছিল ছবিটা। কলেজে স্যারকে দেখাতে স্যার বললেন এই ছবিটাকেই বড় করে আঁকতে রঙ স্যার বলে দিয়েছিলেন। একদিন এসেছিলেন দেখতে তখন সব ছবি দেখে বলে দিলেন কিভাবে করব।'
অনেক দিন বাদে মেয়েটার মুখে সাহাব নামটা শুনলেন ওঁরা। মানুষের সন্দেহের তীর কি অনায়াসে কেড়ে নিয়েছে দুটো ছেলেমেয়ের পরস্পরের আদানপ্রদান। এবার নাটু ভোলার চোখ দুটো মনে করেন অপূর্ব। কত বারই সেই চোখে প্রশ্ন এসেও থমকে দাঁড়িয়েছে সেই চোখ খুঁজে বেরিয়েছে বেবিকে এ বাড়ির চিলেকোঠা থেকে বাগানে। কিন্তু একবারও জিজ্ঞেস করতে পারেনি ভয়ে মামু সেই যে দেওঘর থেকে শৈলপুত্রীকে এখানে রেখে গেলাম সে এখন কোথায়? লাবণ্য বোন হলেও তাকে মাফ করতে পারেন না অপূর্ব। আরও অবাক হলেন শুনে সুশোভন বেবির ওখানে এসেছিল। অবশ্য অনেক দিন নিজের কাজের চাপে যাওয়া হয়নি আর ওর কাছে ফোনও করা হয়নি।
-' হ্যাঁ রে সুশোভন তোর বাড়িতে এসেছিল বুঝি? বাহ্ তাহলে স্যার তোর গুণমুগ্ধ বল। তাই তো ভাবি মায়ের আঁকা যে কথা বলছে এবার। হ্যাঁ এবার বুঝলাম গুরু শিষ্যার যুগলবন্দী। বাহ বাহ দারুণ মা।'
-' হ্যাঁ আঙ্কেল ও স্যার আমাকে খুব প্রশংসা করেন বলেন উনি যতটা জানেন সব আমাকে শিখিয়ে দেবেন তবে আমি নাকি অনেক জানি। আমার ছবি কথা বলে। আমি তো কিছুই পারতাম না যদি সাহাবজী আর আপনি না থাকতেন। সাহাবজী তো প্রথম আমাকে...'
কথা বলতে বলতে থেমে যায় শৈলপুত্রী। অপূর্ব কথার সূত্র ধরেন,' হ্যাঁ নাটু না থাকলে তো তোকে খুঁজে পেতাম না।'
শৈলপুত্রী চুপ করে যায়।
রেবা প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলেন,' সুশোভনের গাড়িতেই একদিন ভুল বাসে উঠে ভয় পেয়ে যা তা কান্ড করে ফিরেছিল বেবি। তখনই রুবি বলেছিল ভেতরে আসতে আসেনি। পরে ছবি দেখতে এসেছিল। তোমাকে বলা হয়নি।'
-' ও বাবা এত সব হয়েছে! যাক এখন আর ভুল করিস না তো? ভুল করতে করতেই শিখবি সব। ভুল তো হতেই পারে তাই বলে থেমে যাস না। আবার নতুন করে শুরু করিস। হ্যাঁ রে দিন তো এসে গেল একটু একটু করে দুটো ছবি বাকি শেষ করছ ফেল। আর শোন একটু চা করে বসিস।'
-' আচ্ছা আঙ্কেলজী আমার ছবি বিক্রী হবে? আমার রূপিয়ার দরকার আছে।'
-' নিশ্চয় হবে, তবে টাকা নিয়ে কি করবি এত? আমার টাকা সে তো তোদেরই।'
-' আমি নিজে কিছু করব যার টাকা নাই তাকে লোক নীচা দেখে।'
-' আচ্ছা সে কথা পরে হবে দেখা যাক কি হয়। এখন আঁকাতে মন দে।'
শৈলপুত্রীর আগের এক্জিবিশনের দিন নটরাজ সাথে ছিল এমন কি ও বাড়িতে যুদ্ধ করে গয়না আনার দিনও গেছিল সাথে তবে আলাদা গাড়িতে। এবার নটরাজ সাথে নেই তবে কলেজের কিছু বন্ধু বান্ধব স্যারেরা আছেন। স্যারেদের আর বন্ধুদেরও কিছু ছবি আছে এখানে। রুবিকে দায়িত্ব দিয়েছেন রেবা যাতে মেয়েটা একটু সুন্দর করে সেজেগুজে যায় ওখানে। কিন্তু কাকে সাজাবে রুবি সেই মেয়ে চরম অবাধ্য একদিন সে সেজে গেছিল কোন কারণে তার সাজতে ভালো লাগে না সুতরাং একটা মোটামুটি শাড়ি কাঁধে ঝোলা আর ঝাঁকড়া এলোচুল ফিতে বেঁধেই সে চলে যায় রেবা বকুনি দেন দেখে,' কাল আমার কাছ থেকে আসবি,আরে না সেজেও সাজা যায় সেই সাজ সাজিয়ে দেব।'
-' আমার ভালো লাগে না। সবাই দেখেছ কেমন আমার ছবি দেখছে ও বহত আচ্ছা লাগছে আমার।'
-' আর কথা নয় তোর আঙ্কেলজীর সম্মান নেই? কলেজে যাস ঠিক আছে তবে এখানে কত লোক আসে।'
শৈলপুত্রীর ছবি মন কেড়ে নেয় সবার বিশেষতঃ যে ছবিটা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন অপূর্বও অনেকেই কেনার জন্য বলছেন তবে সুশোভন আগেই ঠিক করেছিল অপূর্ব স্যার যদি পারমিশন দেন ছবিটা বিক্রী করতে তাহলে এই ছবিটা ও নিজেই নেবে। হয়ত সুশোভন গুরু আর শৈলপুত্রী ছাত্রী তবুও শৈলপুত্রীর মত মেয়েদের বোধহয় গুরু হতে পারাও ভাগ্যের। যদি সব ঠিক চলে তবে অর্জুনের নাম যেমন দ্রোণাচার্যকে ছাড়িয়ে গেছিল তেমনি হবে।
আজ শৈলপুত্রীকে দেখেও অবাক হয় সুশোভন। কলেজের সাদামাটা শৈলপুত্রীকে আজ খুব সুন্দর লাগছে কাঁধে সেই চেকচেক থলেটা আজ নেই তার বদলে কাঁধে সুন্দর বাটিকের ব্যাগ পরনে বাটিকের সূক্ষ্ম কারুকাজের শাড়ি হাতে কানে গলায় ম্যাচিং লাল নীল পুঁতির গয়না কপালে লম্বা টিপ।
বাউন্ডুলে রঙ তুলিতের প্রেমে পাগল সুশোভন বলে,' ও মা আজ যে তোকে চেনাই যাচ্ছে না রে শ্যামা একদম অন্যরকম লাগছে। আমি কোনদিন এভাবে তোকে দেখিনি তবে আমাদের কলেজের শ্যামাও ভালো।'
রেবা হাসেন,' ও মা শ্যামা হলি কবে থেকে? ও সুশোভন বুঝি এই পাগলীটাকে শ্যামা বলে ডাক? তা একই হল উমা আর শ্যামা। মেয়েটা আমাদের সত্যিই সর্বজয়া।'
লজ্জা পায় শৈলপুত্রী এই জন্য সাজতে চায়নি সে যে সাজে মানুষকে চেনা যায় না সেই সাজ সেজে কি লাভ তবুও সাজতে হল কাকিমার জন্য। ফটোগ্রাফার ওর সেরা ছবিটার সামনে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে দেয়। কিছু ছবি তোলা হয় রেবা অপূর্ব আর সুশোভনের সাথেও।
আজ এক্জিবিশনের শেষ দিন ছবিটা বিক্রী করতে চায় শৈলপুত্রী কারণ নিজের খরচ এভাবেই সে নিজে চালাতে চায়। অপূর্বর ইচ্ছে হয় না এত সুন্দর ছবিটা বাইরের কারও হাতে চলে যাক। মেয়েটার কতটা আকুতি যে ছবিটাতে আছে তা হয়ত সবাই বুঝবে না। সুশোভনকে বলেন,' আমার একটুও ইচ্ছে নয় ছবিটা অন্য কেউ নিয়ে যাক। অথচ পাগলীকে কে বোঝাবে।'
আঙ্কেলের আর স্যারের কথা শোনে শৈলপুত্রী মনটা আনমনা হয়ে যায় বুঝতে হয়ত পারে আঙ্কেলের মনের কথা।
সুশোভন হাসে,' ছবিটা যদি আমি নিই তাহলে মানে আমি প্রথম দিন যেদিন দেখি সেদিনই ভেবেছিলাম আমার বাড়িতেই রাখব ড্রয়িংরুমে ছবিটা মানে শ্যামা যদি রাজি থাকে। আমি যথাযথ দাম দিয়েই নেব ছবিটা। দেখুন কথা বলে ও কি বলে? ওহ্ এই তো শ্যামা।'
-' এই ছবিটা আমি বিক্রী করব না স্যার।'
-' কিন্তু তুই যে বলেছিলি।'
-' হাঁ তখন বলেছিলাম মগর এখন আর ইচ্ছে করছে না। অনেকেই বলেছে সবাইকেই না বলে দিয়েছি।'
অপূর্বর মনটা হাল্কা লাগে আসলে তিনি তো নিজে ওকে বলতে পারেন না ছবিটা আমাকে দে আমি কিনে নেব। যাক থাক ছবিটা বড় জীবন্ত আঁকাটা। ওর মায়ের ছবিটা যেমন আছে তেমনি থাকবে। এমনিতেই তো দুটো ছবি বিক্রী হয়েছে।
সব কিছু গুছিয়ে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায় ওদের এত রাত্রে আর নিজের ঠিকানায় আর ফেরা হয় না শৈলপুত্রীর। আঙ্কেলের বাড়িতে এসে সব গুছিয়ে রেখে ছবিটা এনে আঙ্কেলের হাতের কাছে রাখে তারপর প্রণাম করে অপূর্বকে,' এটা আপনার মানে আমাদের ঘরেই থাক আঙ্কেল। আপনি তাই চেয়েছিলেন না?'
অপূর্ব কিছুক্ষণ কিছু বলতে পারেন না তারপর ভাবেন তাঁর মনের কথাটা কি অদ্ভুত ভাবে পড়ে ফেলেছে মেয়েটা!
শৈলপুত্রীর আঁকা সেরা ছবি হরপার্বতীর মিলনের মধুর ভঙ্গিমা শোভা পেল অপূর্ব আর রেবার সুন্দর করে সাজানো ড্রয়িংরুমের বিরাট দেওয়ালটাতে। অপূর্ব সুন্দর সোনালী ফ্রেমে বাঁধিয়ে নিয়েছেন ছবিটা।
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন শহরের জল হাওয়া আর বাসে ট্রামে যাতায়াতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে শৈলপুত্রী তার মধ্যেই মাঝে মাঝে দেরি হলে সুশোভন গাড়ি করে ছেড়ে দিয়ে যায়।
-' না স্যার লাগবে না,আমি চলে যাব আজ আসলে একটু অন্য জায়গাতে যাব। ঠিক চলে যাব একটু বাদেই বাস চলে আসবে।'
-' আচ্ছা চল না তোর অন্য জায়গাটা আমি বরং দেখে আসি শ্যামা। কি রে কোন বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবি? আচ্ছা কোথায় বল আমি নামিয়ে দিয়ে চলে যাব।'
লজ্জা পায় শৈলপুত্রী স্যার জানেন যে ও কোন বাড়িতে থাকে কিন্তু কলেজের পর যে বিউটিপার্লারে কাজ করে তা জানেন না। সেটা জানলে হয়ত আঙ্কেলের সম্বন্ধে খারাপ ধারণা হবে তাই কিছু বলতে পারে না আর ভাবে আজ আঙ্কেলজীর বাড়িতেই বরং চলে যাবে। সেই যে আঁকা দিয়ে এসেছে তারপর আর দেখা হয়নি আঙ্কেলের সাথে কাকিমার সাথে তো রোজই দেখা হয়।
স্যার একটু দেখে রাখতে বলেছেন সুতরাং সুশোভন এই দায়িত্বটা এড়াতে পারে না অনেকটা সময় ছুটির পরেও মেয়েটা রাস্তাতে দাঁড়িয়ে তাই পৌঁছে দেওয়াই ভালো। কত ছাত্রছাত্রী আসে তবে শ্যামা একদম অন্যরকম। অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে যায় ছবিতে। তখন যেন সম্পূর্ণ অন্য জগতের মানুষ। ওর অধ্যাবসায় আর যত্নে প্রতিটা ছবি হয়ে ওঠে অসাধারণ।
কলেজে ছাত্রছাত্রীরা অবশ্য একটু কানাকানি করে এটা নিয়ে অনেকেরই বক্তব্য শৈলপুত্রী ডুব দিয়েছে ওর ছবিতে আর স্যার হাবুডুবু খাচ্ছেন ওর প্রেমে যাক স্যারের অকাল বসন্তে এখন শ্যামার মানে প্রখর যৌবনের হাতছানি। ভালোই হবে ছাত্রীর সাথে মন বদল হলে।
একজন মজা করে বলে,' আমার তো মনে হয় মন বদল হয়ে গেছে এখন শুধু অপেক্ষা মালা বদলের। যাক ভালো আমরা সারা কলেজ নেমন্ত্রণ পাব। আচ্ছা স্যারের মন কি পড়েছে শৈলপুত্রী? ওর তো কোনদিকে খেয়াল নেই না আছে সাজগোজ না অন্য কিছু। তবে মেয়েটা ভালো মানে খুবই সাধারণ দেখে মনে হয় না এতটা কৃতী।'
-' অন্য কিছু মানে কি বলছিস?'
-'অন্য কিছু মানে এই একটু ন্যাকামো ঢঙ যেগুলো সবাই করে থাকে।'
-' আরে শোন এ হচ্ছে গিয়ে রঙের সাথে তুলির প্রেম আমাদের মাথা ঘামাতে হবে না এর মধ্যে।'
সুশোভন অবশ্য এত কিছু জানে না শৈলপুত্রীকে তার ভালো লাগে ওর ডেডিকেশনের জন্য অসাধারণ প্রতিভার জন্য যদিও শৈলপুত্রীকে তেমন ভাবে জানা হয়নি কখনও। শৈলপুত্রীর আর সুশোভনের মাঝে ছাত্রী আর স্যারের সীমাটাই স্পষ্ট।
সুশোভনকে অপূর্ব সান্যালের বাড়িতেই নামিয়ূ দিতে বলে ওকে। এখানে এসে স্যারের সাথে দেখা না করে যাওয়া ঠিক নয় তাই উনি আছেন কিনা খোঁজ নিয়ে একদম সোজা চলে আসে ভেতরে। ওদেরকে একসাথে দেখে খুব অবাক হন অপূর্ব। শৈলপুত্রীর তো এই সময় রূপলেখাতে থাকার কথা। হঠাৎই এখানে এল তাও আবার সুশোভনের সাথে শরীর খারাপ নয় তো? নাকি অন্য কিছু সমস্যা?
-' কি হয়েছে বেবি মা? শরীর ঠিক তো তোর?'
-' হ্যাঁ স্যার সব ঠিক আছে অনেকক্ষণ রাস্তায় অপেক্ষা করছিল আমার চোখে পড়ল তাই নিয়ে এলাম সাথে। আসতে চাইছিল না বলছিল কোথায় একটা যাবে।'
অপূর্ব সবটাই বুঝতে পারেন। শৈলপুত্রী ততক্ষণে ওপরে উঠে এসে পার্লারে ফোন করে কাকিমাকে সবটা বলে দেয় কারণ ও জানে ও না গেলে কাকিমা চিন্তা করবেন।
-' ও তুই বাড়িতে এসেছিস! ও মা খুব ভালো তো। একটু চা করে দিস সুশোভনকে। আর দেখ কি খাবার আছে ঘরে একটু খেতে দিস। কলেজ করে এসেছে তাই খিদে পাবে।'
অপূর্বর ড্রয়িংরুমে বসেই প্রথমে নজর পড়ে যায় ছবিটার দিক সুশোভনের। প্রথম থেকেই ছবিটা মনে দাগ কেটেছিল যখন শুনেছিলেন বিক্রী হবে তখন শ্যামার আঁকা ছবিটা নিজেই নেবেন ভেবেছিলেন। যাক তবুও স্যারের কাছে এলেই দেখা যাবে ছবিটা। এমন ছবি হয়ত ইচ্ছে করলে আঁকা যায় তবে মনের অনুভূতি মানুষ ভেদে ভিন্ন হয় সবাই কি একই ভাব দিয়ে সৃষ্টি করতে পারে?
সুশোভন আবার প্রশংসা করেন ছবিটার,' স্যার ছবিটা গয়নায় সেজে আরও সুন্দর হয়েছে আপনার ড্রয়িংরুমের সৌন্দর্য্য অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।'
আনমনা হয়ে যান অপূর্ব তারপর বলেন,' এই ছবিটার কথা শৈলপুত্রীকে দেখার আগেই শুনেছিলাম বুঝলে তখনই কেন যেন মনে হয়েছিল মেয়েটা শৈলপুত্রীই হবে। এই ছবি আমার খুব প্রিয়জনের প্রিয় তাই রেখে দিলাম কাছে সে দেখলে খুব খুশি হবে।'
হাতে করে আটার মোহনভোগ আর ধনেপাতা ফুলকপির পরোটা আচার আনতে আনতে পরদার আড়াল থেকে কথাটা কানে যায় শৈলপুত্রীর ওর ব্যস্ত চরণ থেমে যায়। কার কথা বলছেন আঙ্কেলজী? ওহ্ তাহলে সাহাবের কাছে শুনেছেন এই ছবিটার কথা। সেই জন্য আঙ্কেলজী চাইছিলেন না ও ছবি বিক্রী করতে। সাহাবজী আসেননি ছবিটা দেখলে খুব খুশি হবেন তাই হয়ত তাকে দেখাতে চান ছবিটা। অনেক কথা এলোমেলো হয়ে জমে যায় শৈলপুত্রীর মনে।
পরদা ঠেলে ঢুকতেই ওর হাতে খাবার দেখে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হন বাচ্চাদের মত দুজনেই।
-' দেখেছ সুশোভন মা আমার কেমন মন পড়তে পারে। কি সুন্দর চট করে খাবার বানিয়ে নিয়ে চলে এসেছে। মোহনভোগ! কতদিন খাইনি। পরটা আহা সুশোভন খেয়ে দেখ কত চমৎকার।'
-' আমি আর কথা বলছি না স্যার দেখি শ্যামা রান্নার আর্টে কতটা পটু তারপর নাম্বার দেব।'
-' কি আর নাম্বার দেবে একশো তে দুশো পাবে আমি বলছি।'
খাওয়া শেষ হলে ওদের পরিতৃপ্তি ছুঁয়ে যায় শৈলপুত্রীকে স্যার এর আগে যে এক দুদিন ওদের ফ্ল্যাটে গেছিলেন রুবিদি বা ও চা বিস্কুট দিয়েই আপ্যায়ন করেছে। কারণ এর থেকে বেশি কিছু ঐ কম সময়ে করে দেওয়া সম্ভব হয়নি।
সুশোভন বলেন,' স্যার অনেকদিন বাদে এত ভালো একজন ছাত্রী পেলাম সত্যিই রান্নাতে দুশো কেন হাজার দেওয়া যায়।'
অপূর্বর মুখে পরিতৃপ্তি,' মিশ্রা রাজ পরিবারের মেয়ে আমাদের শৈলপুত্রী ওর ঠাকুমা ভীষণ ভালো রাঁধতেন বুঝলে ওর হাতের রান্না খেয়ে আমি মাঝেমাঝে ছোটবেলায় ফিরে যাই।'
*******************
সানন্দা অফিসে টিফিনের ব্রেকে আড্ডা দিতে বসে সীমার বোনের বিয়ে হয়েছে একপাশে বসে ওরা ছবির অ্যালবাম দেখছে। সানন্দা উৎসাহ দেখায় না। সীমার বোনের বিয়ে আর কত ভালো ঘরে হবে? ওদের অবস্থা ভালো নয় তাই তো কাউকে নেমন্তন্ন করেনি বিয়েতে। হঠাৎই অনিমা ওর কাছে আসে,' একটা জিনিস দেখবি তো আয় এদিকে।'
-' কি করব,ও তোরা দেখ। আমার ভালো লাগছে না।'
-' তোর যে কি হয়েছে আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। অ্যালবামটা দেখ মন এখনই ভালো হয়ে যাবে। আমি বলছি।'
অনিমার কথায় অ্যালবাম দেখে অবাক হয়ে যায় সানন্দা।
-' বলেছিলাম না তুই দেখলে খুশি হবি। সীমা তো চেনে না তবে আমি চিনি। ভালো করে দেখ এই সেই মেয়েটা না মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল যে তুলি হাতে ওর বোনকে সাজাচ্ছে।'
সানন্দা আর কিছু বলে না শুধু অনিমাকে কাছে টেনে বলে,' একটু কায়দা করে জেনে নিস তো কোন পার্লারে কাজ করে।'
-' এবার কেন? বাবা সেদিন যে অমন সেজে এল তার এই হাল! শেষে কনে সাজায়, চুল কাটে পার্লারে। ইশ্ এই মেয়ে সেই তো? নাকি অন্য কেউ এসে তোদের চমকে গয়না নিয়ে গেছে?'
সানন্দা অবাক হয় কথাটা শুনে তাই তো? সেদিন হঠাৎই পুলিশ নিয়ে হাজির হল গয়না নিয়ে চলে গেল এত কিছু করে আবার পার্লারে কাজ করছে। বাড়িতে জায়ের কাছে শুনেছে সে নাকি বিয়ে করছে তাড়াতাড়ি। নাহ্ একবার যখন সুযোগ পেয়েছে তখন দেখতে হবে মেয়েটাকে। সানন্দা বাড়িতে কাউকে এই কথা বলে না একেবারে ওকে দিয়ে পরিচর্যা করিয়ে ছবি তুলে তারপর আনবে বাড়িতে। ওর ভাসুর,বর,শাশুড়ি সবাইকে দেখাবে কি অবস্থা হয়েছে মিশ্রাবাড়ির রাজকুমারী শৈলপুত্রীর। কাক ময়ূরপুচ্ছ লাগিয়েছিল এখন মনে হয় সব গয়না বেচে খেয়ে দিন কাটাতে না পেরে ঢুকেছে পার্লারের কাজে।
অনিমা দুদিন গিয়ে ফিরে এসেছে মেয়েটাকে দেখতে পায়নি তবে একটা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে জেনেছে ও বিকেলের দিকে আসে। ভালোই হয়েছে সেদিন সানন্দা অফিস না গিয়ে দুপুরের পর একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনিমাকে সাথে নিয়ে বিকেল বিকেল রূপলেখাতে যায়। উত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণ কলকাতা ছুটে এসেছে একটাই কারণে আজ দেখবে মিশ্রাবাড়ির রাজকুমারী কেমন ওর হাত পা ঘষেমেজে সাফ করে দেয়।
সানন্দার চোখে রঙীন চশমা পরনে আজ শালোয়ার কামিজ রেবার সাথে তখন কাজে ব্যস্ত ছিল শৈলপুত্রী অনেক মালপত্র এসেছে গোছাচ্ছে হিসেব রাখছে।
সানন্দা দূর থেকেই চিনতে পারে ওকে। রিসেপশনে বসা মেয়েটা জিজ্ঞেস করে কি কি হবে। সানন্দা মাথার চুল থেকে পায়ের নখের পরিচর্যার কথা বলে যায়। ওরা সব নোট করে ওকে বসতে বলে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সানন্দা একটা মেয়ে এসে কাছে দাঁড়ায় ওর পরিচর্যা করার জন্য। সানন্দা বলে ওঠে,' একটু শৈলপুত্রীকে ডেকে দেবে আসলে ওর কাছে করি তো বরাবর তাই ওর কাছেই করব। শৈলপুত্রীকে গিয়ে কথাটা বলে মেয়েটা অবাক হয় ও,কে এই মহিলা? তাছাড়া ও তো এই কাজ গুলো করে না। শুধু কনে সাজানো আর এখন মেকআপ করে রুবিদির কাছে শিখে তাও কাকিমা রাগ করেন বলেন শুধু হিসেব রাখবি আর কিছু নয়। খুব জোর হলে চন্দনটা দিস।
রেবার চট করে রাগ হয়ে যায় মেয়েটার ওপর,' তোমাকে পাঠানো হয়েছে তুমিই কর। জানো না বেবি এসব করে না। আচ্ছা আমি দেখছি। কত রকমের মানুষ যে আসে!
রেবা এগিয়ে যান পেছনে পেছনে শৈলপুত্রী সানন্দা পেছন ফিরে বসে তবুও চিনতে ভুল হয় না ওর অবাক হয়ে যায় এখানেও ছুটে এসেছে কেন এই সানন্দা? কোথায় খবর পেল ও এখানে কাজ করে ও কি এখানেও একটু শান্তিতে থাকতে পারবে না? রেবার হাতটা চেপে ধরে ও একটু ইশারা করে বোঝায় আমি দেখছি। রেবা বুঝতে পারেন কিছু একটা বলছে ও তাই পিছিয়ে দাঁড়ান।
সোজাসুজি সানন্দার সামনে এসে দাঁড়ায় শৈলপুত্রী এমন ভাব করে যেন ওকে চেনেই না।
-' হ্যাঁ বলুন,কেন হঠাৎ আমার খোঁজ করছেন? কি হল জবা তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে কেন তোমার কাজ শুরু করে দাও। আর হ্যাঁ টিয়া তুমি হাতটা ধর তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। কারণ অনেক দেরিতে এসেছেন উনি।'
সানন্দা কথা বলে এবার,' এক মিনিট আমি তো আগেই বলেছি তোমাকে ডেকে দিতে। আমি তোমাকে দিয়েই তো করিয়ে গেছি আগে আমার পেডিকিওর তুমিই করবে।'
রেবার আর ধৈর্য্য থাকে না শৈলপুত্রীর ভেতরে লাভার স্রোত বইলেও বাইরেটা হিমবাহের মত শীতল করে রাখে,' আপনি আমার কাছে পেডিকিওর করেন ওহ্ তাই নাকি? তা কবে করেছেন?'
সানন্দা থতমত খায় ওর বান্ধবী অনিমা ঢোক গেলে কি জানি আবার কি হবে?
-' না মানে মাস কয়েক আগে।'
-' কত মাস আগে?'
-' ঠিক মনে পড়ছে না। তোমাকে এত কৈফিয়ত দেব কেন আমি। কাজ করবে কর আমি টাকা ছাড়া তো করাবো না।'
-' আপনি মিথ্যে বলছেন, আপনি এখানে আজই প্রথম এসেছেন এবং লক্ষ টাকা দিলেও আপনার কাজ আমি করব না। এখানে অনেক মেয়ে কাজ করে কাউকে দিয়ে করিয়ে নিন।'
শেষ কামড়টা বসানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে সানন্দা,' কি আস্পর্ধা! এভাবে মানুষকে তোমরা ডিল কর? তোমাদের মালিককে ডাক আমি কমপ্লেন করব একটা দু টাকার কর্মচারী আমাকে এত কথা বলছে!'
রেবার আর সহ্য হয় না এগিয়ে যান। শৈলপুত্রী ইশারা করে।
-' কমপ্লেন আপনি আমাকেই করতে পারেন কারণ এখানকার মালিক আমার মা আর আমি ওঁর মেয়ে।'
রেবা অবাক হয়ে যান কোন শৈলপুত্রীকে দেখছেন তিনি? মা ডাকটা শুনে মনটা ভিজে যায় তাঁর।
-' তোমার মা আবার কোথা থেকে এল? তুমি নাকি অনাথ।'
-' ওহ্ এই তো আপনার আসল পরিচয় বেরিয়ে এসেছে তার মানে আপনি আমাকে চেনেন আর ইচ্ছে করেই আমাকে অপমান করতে এখানে এসেছেন। শুনুন শৈলপুত্রী মিশ্রা নিজের পার্লারে কাজ করাটাকে কোন ছোট কাজ হিসাবে দেখে না। আর কোন কাজই ছোট নয় বরং যারা ছোট মন দিয়ে সেটা দেখে সেটাই ছোট কাজ।'
অনিমা তখন গেটটা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। এই এ সি তেও সানন্দার ঘাম ঝরছে রাগে অপমানে। ততক্ষণে রুবি আর রেবা ঘিরে ধরেছে ওকে।
-' হ্যাঁ শৈলপুত্রী ঠিক বলেছে ও আমার সন্তান,এখানে সব মেয়েরাই আমার সন্তান তুল্য তবে এই দুটি আমার নিজের মেয়ে তাই ওরা আমাকে সাহায্য করতে আসে এখানে চাকরি করতে আসে না এই রূপলেখ ওদের। আপনি এখন আসতে পারেন আর কোনদিন যেন এই রূপলেখাতে আপনাকে না দেখি আমি।'
সানন্দা চারপাশে তাকিয়ে দেখে অনিমাকে দেখতে পায় না। রাগের মাথায় আরও কয়েকটা কথা বলে বেরিয়ে আসে ওখান থেকে। বাইরে এসে অনিমাকে দেখতে পায় না। গাড়িতে উঠে বসে সোজা বাপের বাড়িতে চলে যায়। কে যেন মুখে অনেকটা কালি মাখিয়ে দিয়েছে ওর। আর ফিরতে ইচ্ছে করে না ও বাড়িতে। চুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে এপাশ ওপাশ করে তারপর কাঁচের টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করে খানিকটা তরল গলায় ঢালে।
সানন্দা চলে যেতেই শৈলপুত্রীর দিকে থমথমে মুখে তাকান রেবা। শৈলপুত্রী ভয় পায়। ও অনেক কিছু বলে ফেলেছে কে জানে কাকিমা কি বলবে?
রেবা কোন কথা না বলে রুবির কাছে চাবি দিয়ে গাড়িতে করে ওকে নিয়ে চলে আসেন বাড়িতে।
-' তোর আঙ্কেলজী আসছেন এখানে চুপটি করে বোস। খাবার দিচ্ছি চুপ করে খা তোর সাথে অনেক কথা আছে।'
শৈলপুত্রীর খুব ভয় করে আবার কাকিমাকে এমন রাগ করতে কখনও দেখেনি।
আঙ্কেলজী আসতেই কাকিমা ফেটে পড়েন,' বেবি যদি আর রূপলেখাতে কাজ করতে যায় তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। আজ আমাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার মেয়ের অপমান দেখতে হল।'
অপূর্ব অবাক হয়ছ যান হঠাৎ কি হল তারপর পুরোটা শুনে বলেন,' এই তো তোমার মেয়ে রেবা,সে তো যোগ্য জবাব দিয়ে শত্রুকে একদম দেওয়ালে আটকে দিয়েছে। নাহ্ আর আমার ওকে নিয়ে চিন্তা নেই। তবে আদিত্যর বৌ ওকে এখনও এত হিংসা করে! কেন?'
-' আমি জানি না আঙ্কেল আমি তো সব ছেড়ে এসেছি।'
-' কিন্তু ওরা তোকে ছাড়তে পারেনি তুই জিতে গেছিস আর ওরা হেরেছে। তাই বারবার তোকে মনে পড়ে ওদের।'
-' তুমি চুপ কর এবার ওকে বলে দাও ও যেন আর রূপলেখাতে না যায়। ওকে আরও ভালো হয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিতে হবে শৈলপুত্রীর জায়গা কোথায়। এমন কি লাবণ্যকেও। তুই আমাকে আজ মা বলেছিস না? এটা তোর মায়ের কথা।'
রেবার চোখে জলের ধারা নামে শৈলপুত্রী জোরে কেঁদে ওঠে হাঁটুতে মাথা রেখে। অনেক দিনের জমা কান্না আজ ঝরে পড়ে শ্রাবণের ধারার মত। যত মনখারাপের মেঘ ছিল সব ভাঙতে থাকে বৃষ্টি হয়ে। অপূর্ব নিজেকে সামলাতে পারেন না ওর মাথায় হাত রেখে রেবার কাঁধে হাত রাখেন মা হয়েছ যখন মেয়েকে সামলাও ওকে এবার নিজের সাধনায় ডুবে যেতে হবে। আর অন্য কোন দিকে চোখ নয় শুধু নিজের লক্ষ্যে চোখ রাখতে হবে অর্জুনের মত।
সানন্দাকে ছাড়াই গাড়ি ফিরে যায় আদিত্যকে আনতে আজ আদিত্যর একজন নামী ক্লায়েন্ট মিট করা ছিল। সানন্দা বলেছিল ওর শরীরটা ভালো লাগছে না টানা অফিস করে আজ একটু পার্লারে যাবে তারপর একেবারে আদিত্যকে নিয়ে ফিরবে বাড়িতে। কিন্তু ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে সানন্দা বাপের বাড়ি চলে গেছে শুনে অবাক হল আদিত্য। সানন্দা সপ্তাহের শেষে ওখানে যায় অনেক সময়ই কিছু বন্ধুবান্ধব আসে উইকএন্ড ওরা নিজের মত আনন্দে কাটায় সেখানে খানাপিনা সব ব্যবস্থাই থাকে। সানন্দা আগে থেকেই মাঝে মাঝেই ড্রিঙ্ক করত এখন সেই অভ্যেস আরও বেড়েছে। বলতে গেলে এখন সপ্তাহের শেষে এই আনন্দটা নেশা হয়ে গেছে বাড়িতে এই সব করা সম্ভব নয় বলে এই বাড়িতে চলে আসে। আদিত্যর মাঝে মাঝে মনে হয় একটা অদ্ভুত অবসাদে ভুগছে ওরা দুজন কিছুতেই যেন মনে কোন সুখশান্তি নেই।
শৈলপুত্রীর কথাগুলো আবার তীরের মত বেঁধে ওকে প্রচণ্ড রাগ হয় অনিমার ওপর ওর ইন্ধনেই গেছিল এই উত্তর কলকাতা থেকে দক্ষিণ কলকাতা প্রতিশোধ নিতে কিন্তু অপমান তো হল ওর। ইশ্ ওখানকার কতগুলো কর্মচারী তাদের সামনে আজ যাচ্ছেতাই বলেছে ওকে। রাগের চোটে একটা গ্লাস গলায় ঢালে আবার এবার খুব কান্না পায়। কিছুক্ষণ কাঁদে তারপর মনে হয় ও কি পাগল হয়ে গেল নাকি?
আজকের দিনটা খুব খারাপ ছিল আদিত্যরও তারপর সানন্দা হঠাৎই বাপের বাড়িতে গেছে কি হয়েছে কে জানে? বড়লোক ক্লায়েন্টের অফিসে ও আর অফিসের কলিগ সৌম্য গেছিল। ভদ্রলোকের অফিসটা দুর্দান্ত সাজানো একদম আধুনিক আর রুচিসম্মত সব কিছু। হঠাৎই কথা শুরু হবার আগে সৌম্য বলে ওঠে,' স্যার আপনার টেস্ট কিন্তু দারুণ। কি সুন্দর সাজিয়েছেন ইন্টেরিয়র।'
ভদ্রলোক প্রশংসা শুনে খুশি হন সৌম্য বলে যায়' ঐ যে ঐ ছবিটা দারুণ জীবন্ত ওটা। এক টুকরো কলকাতার ছবি কি সুন্দর ফ্রেমবন্দি খুব নস্টালজিক ছবিটা সাদা কালো অথচ একদম ইউনিক।'
-' হ্যাঁ আমাদের গ্যালারীতেই হয়েছিল প্রদর্শনীটা অনেক ছবির মাঝে মন কেড়ে নিয়েছিল ছবিটা আসলে অনেকদিন এমন একটা সাদা কালো ছবি কেনার ইচ্ছে ছিল। তবে দারুণ আঁকে মেয়েটা এই যে কিছু ছবিও আছে এক্জিবিশনের আমরা রেখে দিই অ্যাডের জন্য।'
সৌম্য ঝুঁকে পড়ে ছবিগুলোর ওপর আদিত্য ভালো করে দেখে ছবিটা ঠিক যেন ওদের বাড়ির ছাদ থেকে দেখা পুরোনো কলকাতা। হাওড়া ব্রীজও তো দেখা যাচ্ছে,সত্যিই অসাধারণ।
-' স্যার সুন্দর ছবি দেখলাম, আচ্ছা কি নাম শিল্পীর?'
আদিত্যর তো মনে হয় ইচ্ছে করেই সৌম্য প্রশ্ন করেছিল একটা তেল মারা ন্যাকা ছেলে। ও সব জেনেশুনেই আদিত্যর গায়ে পিন ফোঁটার ব্যবস্থা করেছে।
ভদ্রলোকের উত্তর শুনে কিছুক্ষণের জন্য কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেছিল আদিত্য। উনি বলেছিলেন,' হ্যাঁ অনেক বড় শিল্পী হবে একদিন নাম শৈলপুত্রী মিশ্রা অপূর্ব সান্যালের বন্ধুর মেয়ে। অপূর্ব বললেও কম বলা হয়। কি গুণী মেয়ে এইটুকু বয়েসেই এত সুন্দর ছবি আঁকার হাত! ভগবানদত্ত প্রতিভা পুরোটাই।
শৈলপুত্রীর কি হঠাৎই ডানা পাখনা গজিয়েছে নাকি? ওদের বাড়িতে থাকতে তো বাড়ির ঝিয়ের মতই থাকতে চেয়েছিল মানে ওভাবে থাকত। হঠাৎই এত ভালো আঁকছে,দামি গাড়ি থেকে নামছে সবটাই রহস্য লাগে আদিত্যর। কথা শুনে নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখে ও সত্যিই বেঁচে আছে তো?
তারপর থেকে শুধু একরাশ বিরক্তি ওকে ঘিরূ ধরে তখনকার মত সব কাজ করে গেলেও চুপচাপ ভীষণ রাগ হয় সৌম্যর ওপর। কি দরকার ছিল ছবি দেখে যখন চিনেছিস নাম জানার?
আজ আদিত্য ভেবেছিল একবার মাকে জিজ্ঞেস করবে মা কি জানতে শৈলপুত্রী ছবি আঁকে? কারণ মা তো ওকে নজরে রাখত আদিত্যর তখন সময় ছিল না ওর প্রতিভা খুঁজে দেখার মত। তবে এই কথা কিছুতেই সানন্দাকে বলা যাবে না তাহলে কুরুক্ষেত্র হবে একেবারে। সানন্দা যদিও বলে পাঠিয়েছে আজ রাতে সে বাড়ি ফিরবে না আদিত্য যেন ও বাড়িতে চলে যায় একা তবুও যখন ড্রাইভার বলেছে মেমসাহাবের শরীর আর মুড ভালো নেই তখন একবার ঘুরে যাবে ঠিক করল আদিত্য আজকাল সানন্দা অফিসে বেশিরভাগ সময় ওদের অফিসার চৌধুরীর সাথে কথা বলে কাটায় তাই নিজেকে সংযত করতে পারে না আদিত্য। এর মধ্যেই অদ্ভুতভাবে সন্দেহের ঘুঁণপোকা ওদের মধ্যে ঢুকে গেছে।
সানন্দার অনেকটা রাগ চোখের জলের সাথে বেরিয়ে গেছে নিজে জলের ঝাপটা দেয় চোখেমুখে ততক্ষণে নেশার ঘোর পুরো যায়নি। তবে এটুকু বুদ্ধি মাথায় রাখে যে শৈলপুত্রীকে অপমানিত করতে গিয়ে নিজে অপমানিত হয়েছে তা বলা যাবে না।
বেলটা বেজে ওঠে বিরক্ত হয় সানন্দা কে এল এখন? এই বাড়িতে শান্তিতে থাকবে তারও উপায় নেই। আদিত্যকে দেখে খুব একটা অবাক হয় না। চিৎকার করে ওঠে,' তোমাকে বলেছি আমি এখানে আসতে? কেন এসেছ? আমি কি একটুও শান্তি পাব না..'
আদিত্য অবাক হয়ে যায় সানন্দা ড্রিঙ্ক করেছে এখন এই একা বাড়িতে! ভেবেছিল শরীর খারাপ থাকলে ওকে বুঝিয়ে নিয়ে যাবে বাড়িতে। না এই অবস্থায় ওকে নিয়ে গেলে বাড়িতে অশান্তি হবে রীতিমত। তার থেকে ওর চলে যাওয়া ভালো। তাই বলে,' আমি ভাবতে পারি না কারণে অকারণে তোমার আজকাল মদ খাবার অভ্যেস হয়ে গেছে।'
-' বেশ করেছি,আমার বাড়িতে আমার পয়সায় খাচ্ছি। তুমি খাও না বুঝি? জাস্ট গেট আউট ফ্রম হেয়ার। ইউ হিপোক্রীট।'
হঠাৎই মাথাটা গরম হয়ে যায় আদিত্যর থাক তুমি একা তোমার বাড়িতে আমি সেখানেই যাব যেখানে আমি বড় হয়েছি।'
দরজার ল্যাচ আর গাড়ির আওয়াজে বুঝতে পারে সানন্দা আদিত্য চলে গেছে আবার কিছুটা গালি দেয় ওকে তারপর কাঁদে নিজের মত নিজের করা ভুলের মাশুল দেয় নিজে।
আদিত্যর শরীর মন কোনটাই ভালো লাগে না। দূর থেকে দেখে মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওকে দেখে আশা বলেন, কি রে সানন্দা কোথায়? কত দেরি করলি বলত দেখি।'
আদিত্য কোন কথা বলে না শুধু বলে,' মা একবার ঘরে আসবে দরকার আছে।'
আশা যেতেই আদিত্য সব ঘটনা গুছিয়ে বলে মাকে শুধু সানন্দা কি করেছে সেটা বাকি দিয়ে। তারপর সোজাসুজি বলে,' মা শৈলপুত্রীকে ছবি আঁকতে তুমি দেখেছ ? উত্তর দাও আমার জানতে ইচ্ছে করছে।'
-' হ্যাঁ আঁকতে দেখেছি একদিন সেদিন বারণ করেছিলাম আর আঁকেনি।'
-' কি বল মা সে এঁকেছে আমি তুমি জানি না। নাহলে কি করে সে বিখ্যাত শিল্পী হল? তাঁর ছবি লোকে কিনে ঘর সাজাচ্ছে।'
আশা কথাগুলো মেলাবার চেষ্টা করে বলেন বুঝতে পেরেছি তাই বৌমা আসেনি তোর সাথে।
-' মা ওসব ছাড়,তোমরা ওকে আঁকতে দেখেছ অথচ আমাকে বলনি। কি অবস্থা ভাবো!
অযথা মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি করে আদিত্য। মধুও যোগ দেয় তার সাথে বলে মা অনেক কিছু জানতেন কিন্তু বলেনি কোন কিছুই। সত্যিই আশ্চর্যজনক এই মেয়ের এখানে কিছু ছিল না আর এখন সে গুণের ভান্ডার।
রাতে ভালো করে ঘুম হয় না আশার। মনটা তোলপাড় করে রাগে দুঃখে যতই মেয়েটা দূরে যাক না কেন ঠিক যেন প্রমাণ করছে ও সবাইকে হারিয়ে দিয়ে গেছে।
ভোর রাত্রে আশা বাথরুমে যান আর ঘরে ফেরা হয়নি সেখানেই মাথা ঘুরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান। কারও নজরেই পড়েনি ভাগ্যিস মালতীর মায়ের নজরে পড়েছিল তাই এই যাত্রায় বেঁচে গেলেন আশা তবে একটা দিক প্যারালাইসিস হয়ে গেল,মুখ বেঁকে গেল।
*****************
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। দেওঘরে কাজের মধ্যে থাকতে থাকতে কলকাতার জন্য মন খারাপ করে নটরাজের। এখন দেওঘরে শুধু কাজ আর কাজ এখানে এখন আর সেই খোলা জানলাটা নেই যেখানে গেলে হঠাৎই শোনা যেত বাচ্চাদের কলকাকলি আর একটা উচ্ছ্বসিত গলা,' সাহাব আমাদের কালী গাইয়ের দুধের চা খুব ভালো একটু খেয়ে দেখুন।'
হঠাৎই কোথায় যেন উবে গেছে মেয়েটা আগে খুব সাবলীলভাবে ওর কথা সবাইকে জিজ্ঞেস করতে পারত মা যে কান্ড করেছে এর আগে সেইজন্য আর মুখের কথা মুখেই থেকে যায়। অনেক দিন বাদে তাই আবার পা দেওয়া কলকাতা শহরে তবে এবার প্রথম থেকেই শৈলপুত্রীর খোঁজ করতে হবে। সেবার হাতে সময় ছিল না। শৈলপুত্রী কি পড়াশোনা বন্ধ করে কলেজের এখন এই বিউটিপার্লার জয়েন করেছে? নাকি একসাথে দুটোই সামলাচ্ছে?
তবে এত তাড়াতাড়ি যে সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে তা ভাবেনি। প্রতিবারের মতই কলকাতা এসে পরের দিন মামুর কাছে আসে। এবার আর লাবণ্য সাথে যান না নিজেকে বুঝিয়েছেন যে অযথা সন্দেহ করে অশান্তি বাড়বে। তাছাড়া হঠাৎই দাদার সাথে দূরত্ব বেড়ে গেছে হয়ত বা একটু লজ্জিত লাবণ্য নিজেও। আশার ফোন অনেকদিন আসেনি তবে বৌদির কাছে আশার দূরাবস্থার কথা শুনেছে।
অবাক হয়ে বলেছে,' কি বলছ বৌদি! আমি তো ভাবতেই পারছি না। তোমাকে কে বলল এই খবর?'
-' শুনেছি হরিহরণ চাচার কাছে। আশা তো অনেকদিন হসপিটালে এখন জানি না কোথায় আছে?'
-' কি করে এসব হল কে জানে?'
-' ওহ্ আমি তো ভাবলাম তুমি জান তোমার এত প্রিয় বন্ধু। দেখতে যাওয়াও তো উচিত ছিল তোমার ওর কথাতেই তো আজকাল...'
আর বলতে হয়নি রেবাকে তার আগেই লাবণ্য বলেছিলেন,' কি যে বল না! এতদিন যোগাযোগ নেই এখন আমি যাব হসপিটালে?'
-' সবই পাপের শাস্তি বুঝলে কম কিছু তো করেনি এই মহিলা। এখনও নিরপরাধ মেয়েটাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না।'
কথাটা শুনে ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন লাবণ্য। কথাটা যেন একটু হলেও ওর গায়েও লাগল হঠাৎই ছিটকে আসা গরম তেলের মত। আচ্ছা পাপ কি সেও করেছে? তাই এবার নাটুর সাথে আর দাদার বাড়িতে যায়নি ওঁরা।
অনেকদিন বাদে মামুবাড়িতে পুরোনো গন্ধটা খুঁজে পায় নটরাজ। তবে মামারবাড়িতে ড্রয়িং রুমের ছবিটা দেখে উদাস মনটা ডুব দেয় অনেক আগের দেখা একটা ছবিতে। হুবহু একই তবে অনেক অনেক সুন্দর, রঙীন আর বেশ কিছুটা বড়। ছবিটার সামনে এগিয়ে যায় নটরাজ খুঁটিয়ে দেখে ছবিটা এবং অবাক হয়ে যায় এটা শৈলপুত্রীর আঁকা ছবির মতই কিন্তু কোথাও ওর নাম নেই। তবে কি?
-’ ছবিটা কেমন রে?'
-' অসাধারণ মামু,তবে বড় চেনা তাছাড়া তোমার কালেকশন তো সবসময়ই ভালো হয়। কার আঁকা গো? নাম নেই কোন।'
-' আমাদের ঘরের মেয়ের আঁকা রে,জানিস তো কেমন সে চিরকাল বুদ্ধি কম তবে এই ছবিটাতে বোধহয় পেছনে লেখা আছে নাম। সে যাক গে এত সুন্দর ছবি বেহাত হয়ে যাচ্ছিল প্রায়।'
-' মানে? বেহাত হবে কি করে?'
-' আরে আর বলিস না সবাই কিনতে চায় ছবিটা। সুশোভনের খুব পছন্দ অবশ্য ও গাইড করেছে অনেকটাই। সুশোভন নেবে বলে হাত বাড়িয়েছে প্রায় তারপর ঐ মেয়ের কি মনে হল কে জানে ঠিক করল আর বেচবে না ছবিটা বাড়িতে এসে আমার হাতে দিল।'
-' সত্যিই ছবিটা তো দেওঘরেই আমার চোখ টেনেছিল মামু তবে তখন ছবিটাতে শুধু ভঙ্গিমা টুকু ছিল সাদা কালো আঁচড়ে। আজ এই ছবিটা বড় উজ্জ্বল। তবে সুশোভন বাবু তো নিজেই আঁকেন তাই উনি এঁকে ফেলতেই পারেন এমন একটা ছবি শুধু কিনতে গেছিলেন কেন?'
-' হয়ত আঁকতে পারবে তবে সেটা অনুকরণ হবে তাই করতে চায় না। তাছাড়া সুশোভন সবসময় বলে এমন প্রতিভা খুব কম দেখা যায়। মেয়েটার দুর্ভাগ্য এতদিন তেমন সুযোগ পায়নি। ও তো শ্যামা শ্যামা করে অস্থির।'
-' শ্যামাটা আবার কে? অন্য কোন ছাত্রী নাকি?'
-' না রে শৈলপুত্রীকে ডাকে শ্যামা বলে। আমি তো শুনে অবাক। আর ও বলে উমা শ্যামা তো একই হল তবে ও রবিঠাকুরের শ্যামা।'
-' বাবা সুশোভন বাবু তো খুব রোমান্টিক মানুষ দেখছি। যাক একদিন আলাপ করার ইচ্ছে রইল।'
-' আরে রোমান্টিক হবে না শিল্পী বলে কথা। তাছাড়া আমাদের শৈলপুত্রীর মানে বেবির মত মেয়ে কটা আছে? কথাতেই বলে জহুরী জহর চেনে। শিল্পী বলেই তো মেয়েটার কদর বোঝে।'
কেন যেন মামা আজ একটু বেশি কথা বলছেন ঐ সুশোভনের সম্বন্ধে। আগে মামার আদরের ভাগ ও একাই পেয়েছে এখন আবার ঐ সুশোভন কোথা থেকে এল? শৈলপুত্রীর অত সুন্দর নামটা থাকা সত্ত্বেও তার আবার ইচ্ছে জেগেছে ওকে শ্যামা বলে ডাকার। তাছাড়া যে অত ভালো ছবি আঁকে তাঁর আবার ছাত্রীর ছবি কিনতে হবে কেন?
'মামা তুমি কি ছবিটা কিনেছ নাকি? মানে তুমি যে বললে ছবিটা বিক্রী হচ্ছিল।'
-' না না আমি বাবা হয়ে মেয়ের ছবি কিনতে যাব কেন? তোর ভালো লাগছে ছবিটা? তুই নিবি?'
অপূর্ব পাকা গোয়েন্দার দৃষ্টিতে ভাগ্নের দিকে তাকান। নটরাজের মুখটা হঠাৎই কাচুমাচু লজ্জা মাখানো হয় পরমুহূর্তেই একটু অপ্রস্তুত ভাব। তারপরেই বলে,' আমি নিয়ে কি করব এটা? তোমার ঘরেই মানায় মামা এই ছবি।'
-' হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস আমার ঘরেই শৈলপুত্রী আর ওর ছবি মানায়। তবে আমার কপাল খারাপ মেয়েটাকে রাখতে পারলাম কই? মাঝে মাঝে দু চারদিন থাকে কাছে ঐ বাবার ঘরে মেয়ে ফেরার মত। তাও ভয়ে ভয়ে আসে আবার চলে যায়।'
নটরাজ কোন কথা বলতে পারে না ও ঠিক বুঝতে পারছে না মামা কি বলতে চাইছেন। মামাকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারে না। কারণ অহেতুক কৌতূহল প্রকাশ করে আবার মায়ের সন্দেহের তালিকায় আসতে চায় না। কিন্তু তবুও যে মন চাইছে জানতে শৈলপুত্রীর কথা তাই বলে,' তুমি কি বলছ ঠিক বুঝতে পারছি না মানে শৈলপুত্রীকে রাখতে পার না তবে কোথায় থাকে সে? হস্টেলে? ও কি মানিয়ে নিতে পেরেছে?'
রেবা গরম ফ্রাইয়ের প্লেটটা টেবিলে এনে রাখার ফাঁকে অপূর্বর দিকে তাকিয়ে নিজেই উত্তর দেন,' হ্যাঁ রে ওকে বাইরেই রেখেছি আমরা,এখানে থাকলে শুধু ছুটে কাজ করতে যায় আঁকা হয় না ঠিকমত তাই।'
অপূর্ব অবাক হয়ে যান রেবার কান্ড দেখে এই বয়েসেও ননদকে ভয় পায় রেবা তাই গোপন করে গেল সবটাই। যাতে ছেলের কানে না যায় লাবণ্যর কথাতেই পালাতে পর্যন্ত গেছিল মেয়েটা শেষে।
নটরাজ শুরু করখ কথার মাঝে আর ইতি টানতে চায় না তাই বলে,' কলেজের হস্টেলে নাকি অন্য কোথাও?'
-' না রে কাছাকাছি একটা বাড়িতেই থাকে। আচ্ছা ঠিক আছে এরপর একদিন না হয় তুই এলে ওকে ডেকে নেব আজ তো কলেজে গেছে।'
অপূর্ব বোঝেন বৃথা আশ্বাস দিচ্ছে রেবা ছেলেটাকে শৈলপুত্রী জেনেশুনে কোনদিন আসবে না এখনই নটরাজের সামনে লাবণ্যর কথাগুলো শোনার পর।
তবে কখনও অঘটন ঘটে যায় হঠাৎই হয়ত বা হয়ে যায় স্বপ্নপূরণও। নটরাজের কোন তাড়া নেই আজ বিকেলে ফ্রাই নিয়ে বসেছে একেবারে সকাল সকাল ডিনার করে ফিরবে। রেবা আজ রূপলেখাতে যাননি এই সময় কাজের চাপ কম তাছাড়া নাটু অনেকদিন বাদে এতটা সময় থাকছে।
*******************
আজ কলেজে গিয়েছিল শৈলপুত্রী তবে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে। ভেবেছিল বিনুকেই পাঠাবে তারপর ভাবল নাহ একবার ঘুরে আসাই ভালো আঙ্কেল রাগ করেছেন রুবিদিদি বলছিল। আজকাল রূপলেখাতে যাওয়া বারণ হয়ে গেছে বলে কাকিমার সাথেও দেখা হয় না। তাই চট করে কিছুটা মালপোয়া ভেজে আর ডালপুরী করে টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে রওনা দিয়েছে আঙ্কেলজীর কাছে শৈলপুত্রী। এর আগের দিনই ছেলেমানুষ হয়ে বায়না হয়েছে ওর কাছে,' তুই ডালপুরী খাওয়াবি আমাকে একদিন? আটার ডালপুরী খাব সরষের তেল দিয়ে একদম ভেজে তুলবি সাথে আলু ভাজি আর মালপোয়া।'
শৈলপুত্রীর মন ডুবে গেছিল বাবার কথায়। বাবার জন্য এই খাবার দোলের দিন বানাতেই হত সাথে থাকত পায়েসও। হঠাৎই মনে হল শৈলপুত্রীর কালকেই তো দোল তবে কাল তো বেরোনো যাবে না তাই আজই দিয়ে আসতে হবে। কাকিমা অবশ্য রাগ করবে একা হাতে এত কিছু করে আনার জন্য। কিন্তু ওর তো অভ্যেস আছে তাই খুব ভালো লাগে। তাছাড়া ওরাও তো খাবে। বেবিদির হাতের রান্না বিনুর খুব পছন্দ এই কয়েক মাসে মোটামুটি ওর ভক্ত হয়ে গেছে বিনু। রুবিদি বলে তোর ভাই না আমার ভাই কে জানে?
কলকাতার বাতাসে বসন্তের ছোঁয়া আকাশে রঙের মাখামাখি। পাড়া থেকে বেরিয়ে বাজারের সামনে দিয়ে আসে শৈলপুত্রী সব দোকানে আবিরের পসরা নিয়ে বসেছে সবাই। লাল নীল সবুজ কত রঙ। রঙ দেখে ওর মনে হল কাল ওর সাদা ক্যানভাস ভরবে রঙে রঙে কাল হরি কে হোলি খেলনে কে মনে হতেই হাসি পায় শৈলপুত্রীর। তারপর ছোট ছোট দুটো লাল গোলাপী আবিরের প্যাকেট কেনে আঙ্কেলজীকে দেবে। কাল তো রঙের উৎসব। রঙীন হয়ে ওঠে ওর মনটাও পা চালায় জোরে একদম গরম খাবারটা পৌঁছে দিতে হবে। শৈলপুত্রী এলো ঝাঁকড়া চুলে ফিতে বাঁধা পরনে হলুদ শালোয়ার কামিজ আর গোলাপী ওড়না।
গেট পেরিয়ে বাগান পেরিয়ে ছুটে আসে শৈলপুত্রী সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে উঠে আসে এই বাড়িতে আর কোন সঙ্কোচ ওর নেই এখন আবার আপনজন বলতে আঙ্কেলজী কাকিমার কথা মনে হয় তাই তো আঙ্কেলজী কিছু খেতে চাইলে চেষ্টা করে বানিয়ে দিতে। রান্নাঘরে উঁকি দেয় বেবি কাউকে না দেখতে পেয়ে ভাবে নিশ্চয় বসার ঘরে আছে সবাই কথা শোনা যাচ্ছে।
স্বভাব সুলভ হাসি মাখা উচ্ছ্বসিত গলায় এগিয়ে আসে,' কাকিমা আঙ্কেলজী আমি এসে গেছি। নিশ্চয়ই আমাকে য়্যাদ করছেন। জলদি জলদি....'
পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকে প্রথমে যার সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় তাকে দেখে পা দুটো হঠাৎই আটকে যায় মেঝেতে তারপরই মাথাটা নীচু করে বলে,' ওহ্ আমি বুঝতে পারিনি, কাকিমা আমি বাইরে আছি। একবার এসো না।'
তাড়াতাড়ি বাইরে বেরোতে যায় শৈলপুত্রী নটরাজ অবাক হয়ে যায় ওর আচরণে কি হল হঠাৎই ওকে দেখে মনে হচ্ছে কোনদিন দেখেনি আগে নটরাজকে আজই প্রথম দেখছে তাই ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। যে মেয়েটার চোখে আনন্দ উপচে পড়ত ওকে দেখে কত বকবক করত আপনমনে সে হঠাৎই এতটা বদলে গেল কেন?
শহরের জল হাওয়াতে সেই রুক্ষতা কেটে গেছে শৈলপুত্রীর। অনেকটা রুচিশীল কথার টানও বেশ পাল্টে গেছে ভালো লাগছে ওকে দেখতে। অনেকটা রঙ ছড়িয়ে পড়ল নটরাজের চোখে হঠাৎই। শৈলপুত্রীকে হয়ত কোনদিনই এমন খুঁটিয়ে দেখেনি ও বরাবর দেখেছে ওর তেজ, আত্মসম্মান আর গুণ আজ অনেকদিন ধরে খোঁজি একটা মুখকে মুহূর্তে হৃদয়বন্দি করল নটরাজ। দরজা দিয়ে বাইরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে শৈলপুত্রী নটরাজ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে ওর ঝাঁকড়া চুল এখনও অনেকটা দুষ্টুমি করে অবাধ্য হয়ে আছে সেই আগের মতই।
নটরাজকে দেখেন অপূর্ব ওর চাতকের দৃষ্টি অপূর্বকে ভারাক্রান্ত করে তোলে বুঝতে পারেন অনেকদিন বাদে চেনা মানুষকে দেখে ছেলেটা চোখ ফেরাতে পারছে না। অস্বস্তিতে পড়েন রেবা হঠাৎ আজই মেয়েটা এল এখানে বলা যায় না কথাটা যদি লাবণ্যর কানে যায় তাহলে কি হবে কে জানে? ভাববে ছেলেটার সর্বনাশ করছে দাদা। তাই নিজেই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ান,' তুই রান্নাঘরে যা আমি আসছি। না বলে কয়ে আজ হঠাৎই এসে গেলি যে?'
রেবা কথা বলতে বলতে বাইরে যান ততক্ষণে শৈলপুত্রী বাইরে নটরাজের মন উচাটন হয় শৈলপুত্রীর সাথে কথা বলে এক ঝলক মুক্ত বাতাসের স্বাদ কতই পেয়েছে দেওঘরে আজও তাই দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শৈলপুত্রীকে দেখে হয়ত চোখটা শান্ত হল কিন্তু মনে উঠল প্রশ্নের ঝড় হয়ত বা অভিমানও হল।
রেবা তখুনি ফিরে এসেছেন,' আর বোল না পাগলী মেয়ে একটা তুমি সেদিন বলেছিলে না একদিন ডালপুরী, ভাজি আর মালপোয়া খাবে সেই সব বানিয়ে ছুটে এসেছে এতটা পথ। আমি বকছি ওকে এত কাজ করতে হয় নাকি আমিও তো সাহায্য করতে পারতাম।'
অপূর্ব এতক্ষণ চুপচাপ সবটা দেখেছেন আর চুপ করে থাকতে পারেন না ভরাট গলায় ডাক দেন,' আরে বেবি দে তো মা গরম গরম ডালপুরী আর ভাজি একটু খাই।'
-' সে কি গো! এই না তুমি নাটুর সাথে বসে গরম ফ্রাই খেলে আবার ডালপুরী খাবে?'
-' খাব না! মা আমার জন্যই তো এনেছে তাছাড়া নাটুও তো খাবে নাকি? কই রে কোথায় গেলি?'
শৈলপুত্রীর নিজের খুবই খারাপ লাগে যে এতদিন বাদে সাহাবকে দেখে একটা নমস্তে পর্যন্ত বলতে পারেনি। তাছাড়া ও যদি জানত সাহাব এখানে তাহলে তো আসতই না। এখন কি করে খাবার নিয়ে ভেতরে যাবে?
কাঁপা হাতে প্লেটে খাবার সাজায় তারপর রেবাকে ডাকে,' কাকীমা সব দিয়েছি প্লেটে।'
রেবা উঠতে চাইলে অপূর্ব ইশারা করেন তারপর বলেন,' তোর কাকীমা আর কত ছুটবে? নিয়ে আয় ভেতরে।'
শৈলপুত্রী ট্রেতে খাবার নিয়ে ঢোকে ওকে এগুলো দিয়েই চলে যেতে হবে। কারণ মনে মনে শপথ করে নিয়েছে পিসিমার কথা শুনে যে ওর ছায়াও না পড়ে সাহাবজীর ওপর। ওর জন্য ওদের সংসার আর সম্পর্কে কোন জটিলতা আসে বা ক্ষতি হয় তা কখনই চায় না।
আঙ্কেলজীকে প্লেটটা দিয়ে নটরাজের দিকে হাত বাড়ায় শৈলপুত্রী। ওর এমন আচরণে খুব অভিমান আর রাগ হয় নটরাজের আগে কোন খাবার বানিয়ে খাবার জন্য ওর মাথা খারাপ করত কত উচ্ছ্বলতা ছিল সেই অনুরোধে আজ যেন শৈলপুত্রীকে দেখে মনে হয় নটরাজ এ বাড়িতে আসাতে ও খুব বিপদে পড়ে গেছে। তাই নটরাজ বলে ওঠে,' আমি খাব না এখন।'
শৈলপুত্রীর মুখের দিকে তাকায় নটরাজ। শান্ত দীঘির মত চোখ ওর তাতে কোন তাপ উত্তাপ নেই ওর কথাতে। কোনও অনুরোধ বা জোরও নেই। প্লেটটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় বেরিয়ে যাবার জন্য।
অপূর্ব ততক্ষণে মুখে খাবার দিয়েছেন,' আহ্ আমার ছোটবেলা ফিরিয়ে দিলি আজ আবার দোলের দিন কত খেয়েছি ডালপুরী ভাজি,পুয়া আর পায়েস।'
-' কাল দোল তো তাই আজ বানিয়ে আনলাম,পায়েসটা আরেকদিন করে খাওয়াব।'
নটরাজ আর কথা না বলে থাকতে পারে না,' ওহ্ এই তো কথা বেরিয়েছে আমি ভাবলাম ও বোধহয় কলেজে পড়তে কলকাতা এসে একদম বোবা হয়ে গেছে। সত্যি মানুষ যে কত বদলে যেতে পারে তাই ভাবছি। অথচ আমি যদি না চেনাতাম শৈলপুত্রীকে তোমাকে তাহলে কোথায় কলকাতা, কলা মন্দিরে এক্জিবিশন আর কলেজ এখনও তো ঐ কালী গাইয়ের দুধ দুইয়ে দিন কাটত। একটা সাধারণ ভদ্রতা মানুষের থাকে,কৃতজ্ঞতা নাই বা থাকল।'
নটরাজের মনের এতদিনে জমে থাকা যত রাগ আর ক্ষোভ বেরিয়ে আসে। নটরাজের কথা শুনে অবাক হয়ে যান অপূর্ব এভাবে কখনও কথা বলতে শোনেননি আগে। রেবার মনটাও খারাপ হয়ে যায়। অভিমান হয় শৈলপুত্রীর, রাগ হয় না কি করে বলবে সাহাবকে যে ওরও কথা বলতে ইচ্ছে করছে সাহাবের সাথে। সাহাব যেদিন ওকে কলকাতায় রেখে চলে গেলেন হঠাৎই কিছু না বলে সেদিন কত কেঁদেছে ও তারপর এ বাড়িতে ওর ছায়াও যাতে না পড়ে তাই চলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু তাও হয়নি।
নটরাজ কথা বলা শেষে তাকিয়ে দেখে পরদাটা শুধু নড়ছে মিশ্রা বাড়ির অভিমানী কন্যার তো উচিত ছিল কোমর বেঁধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার কিন্তু সে নেই চলে গেছে। রেবা তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে আসেন। অপূর্ব বলেন,' ইশ্ নাটু তুই আর বেবি মা দুজনেই আমার বড় আদরের। তুই আমার কত দিনের চেনা ওকে বরং এই পেয়েছি। এত কথা তো কোনদিন এমন ভাবে বলতে তোকে শুনিনি। মেয়েটা বড় দুঃখী বোধহয় খুবই খারাপ পেল।'
-' খারাপ ভালো বোধ আর ওর নেই মামু তাহলে কোমর বেঁধে ঠিক ঝগড়া করত। আসলে তুমি অনেক বড় জায়গায় ওকে পৌঁছে দিয়েছ এরপর হয়ত তোমাকেও চিনবে না।'
-' সে কোনদিনই হবে না আমি মানুষ চিনি। দাঁড়া আগে দেখি কোথায় গেল সে। রেবা ওকে একটু ডাক তো।'
কোন সাড়া না পেয়ে বাইরে আসেন অপূর্ব রেবাকে দেখতে পান না তারপর নিজেই একটু এগিয়ে বারান্দায় দাঁড়ান দেখেন ওড়নার শেষটুকু হাওয়ায় উড়িয়ে মেয়েটা চলে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে।
ফিরে আসতে গিয়ে নজর পড়ে টেবিলের ওপর টিফিন কৌটোর পাশে আবিরের দুটো ছোট প্যাকেট।
রেবাকে দেখতে পেয়েই জিজ্ঞেস করেন,' চলে গেল?'
-' হ্যাঁ না গিয়ে আর কি করত। চলেই তো যেত তক্ষুনি শুধু শুধু তুমি ডাকলে খাবার দিতে আর নাটু এতগুলো কথা বলল। নাটুর হঠাৎই কি হল?'
-' সে তুমি আমি বুঝব না রেবা তবে আজ লাবণ্য নেই তাই আমি নাটুকে বলব কি হয়েছিল সেটা। শুধু শুধু মেয়েটাকে ভুল বুঝেছে ও। আহা কত কি করে নিয়ে এসেছে মেয়েটা।'
-' এই যে আবিরও নিয়ে এসেছিল একটু পায়ে দেবে বলে বোধহয়।'
এতগুলো কথা একসাথে বলে নিজেকে অনেকটা হাল্কা লাগে নটরাজের। শৈলপুত্রীকে এই কথাগুলো বলা খুব দরকার ছিল। কেন ওর মনে থাকবে সাহাবজী ওর জন্য কত বড় মিথ্যে বলেছে। সবই ভাবে সহজে পাওয়া হয়ে গেছে জীবনে যারা ওকে সাহায্য করল তাদের ভুলে গেল! এবার গিয়ে বলবে চাচীকে আর অন্যদের যে ওদের ভুলে গেছে শৈলপুত্রী। একবারও ভুলে জিজ্ঞেস করেনি ওদের কথা।
অপূর্ব ঘরে ঢোকেন সাথে লাবণ্য প্রথমে অপূর্ব বলেন,' নাটু কথাগুলো তোর বলা একদম উচিত হয়নি। আমি তোকে সবটা গুছিয়ে বলতে পারব না তোর মামিমা বলবে সবটা কেন শৈলপুত্রীর এমন আচরণ। তোর সাথে কথা না বলে সে চলে গেল।'
লাবণ্যর সাথে যা যা কথা আশার হয়েছিল তার অনেকটাই জানে নটরাজ বাকিটা আজ শুনল রেবার কাছে। রেবা কোনটাই বলতে বাকি রাখলেন না মানে শৈলপুত্রীর এ বাড়ি ছেড়ে পালানোর গল্প থেকে শুরু করে সানন্দার বিউটি পার্লারে ওকে অপমান করতে আসা পর্যন্ত সবটাই বললেন।
-' সবই তো শুনলি,এবার বল তোর সাথে যদি বসে ও গল্প করত সেই দেওঘরের মত অথবা তোকে ওর ছবি দেখাত তাহলে কি ঠিক হত? তোর মা জানলে আবার তোদের মা আর ছেলের সম্পর্কে জটিলতা বাড়ত। তার থেকে একপাশে পড়ে আছে মেয়েটা থাক না কাউকে তো বিরক্ত করছে না। আমাদের কাছেও রাখিনি আমরা।'
কথাগুলো শুনতে শুনতে কেমন যেন অনেকটা বড় একটা পাথর চেপে বসল নটরাজের বুকে ইশ্ কি করল ও আজ রাগের মাথায়? শৈলপুত্রীর আত্মসম্মান কত প্রখর জানে ও না জানি মেয়েটাকে কতটা আঘাত দিয়ে ফেলেছে অজান্তেই। শৈলপুত্রীর কাছ থেকে না শুনলেও ওর রূপলেখাতে যাবার কারণ, আলাদা থাকার কারণ সবই জানা হয়ে গেল নটরাজের। দেখতে দেখতে বেশ অনেকটা রাত হয়ে গেছে মায়ের ওপর আবার অভিমান হয় নটরাজের আর সবচেয়ে বেশি রাগ হয় নিজের ওপর। ইচ্ছে করে এখনই গিয়ে ক্ষমা চাইতে ওর কাছে। তারপর ভাবে এক তলাতে রুবিদি আর বিনু থাকে ওরা কি ভাববে? তার চেয়ে বরং কলেজের থেকে ফিরবে তখন ওর সাথে কথা বলবে। এখনও তিনদিন আছে ও কলকাতায়। ওহ্ কাল তো দোল,পরশু রবিবার তার মানে হাতে রইল সেই একদিন।
শৈলপুত্রীর দেওয়া খাবারটা সরিয়ে দিয়েছিল নটরাজ। রেবা প্লেটটা সরাতে যান,নটরাজ বলে,' মামিমা থাক আমি একটু খাব।'
রেবা অপূর্বর দিকে তাকান তারপর বলেন,' দাঁড়া তবে একটু গরম করে আনি।'
*****************
হসপিটালের বেডে শুয়ে সামনের দিকে তাকান আশা। আসেপাশের দু একটা বেডে কত লোকজন এসেছে ওঁকে দেখতে তেমন কেউ আসে না। প্রথম কয়েকদিন ছেলেরা এসেছে বৌমারা একদিন করে তারপর এখন দুদিন হয়ে গেল ছেলেরা আসে না। দেবকে ব্যবসার কাজে কলকাতার বাইরে যেতে হয়েছে। আদিত্যর অফিসের কাজেথ চাপে আসা হয়নি। আর গিয়েই বা কি করবে? মা ভালো করে কথা বলতে পারে না। কত দেখবে এই দৃশ্য।
আয়াকে ইশারা করে আশা তারপর টেনে টেনে বলে,' আমার ছেলে আসবে না?'
আয়াটা গজগজ করে,' না মাসিমা আসবে না ফোন করে খবর নিয়েছে। আচ্ছা তোমার তো ছুটি হয়ূ গেছে তবুও টাকা দিয়ে এখানে ফেলে রেখেছে কেন?'
আশা ওর কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে যান। ফেলে রেখেছে! ছুটির পরও নিয়ে যাচ্ছে না! কেন?
আশা বুঝতে পারেন তিনি এখন সংসারের বোঝা তাই এই বোঝাকে আর কেউ বইতে চায় না সুতরাং ছুটির পরও তাঁকে এখানে ফেলে রেখেছে ওরা।
শৈলপুত্রী বাড়িতে ফেরার সময় বার বার চোখটা ভিজে উঠছিল তবে চোখকে শাসন করে শৈলপুত্রী সত্যিই তো সাহাব ঠিকই কথা বলেছেন কে চিনত ওকে যদি সাহাব না থাকত? আজ অপূর্ব আঙ্কেলকে তো মিলিয়ে দিয়েছেন উনিই অথচ একটা কথাও বলতে পারল না আজ সাহাবের সাথে।
সাহাব অবাক চোখে ওকে তাকিয়ে দেখছিল,চোখ সরিয়ে নিয়েছিল ও একদম মাটির দিকে তাকিয়েছিল যেন মানুষটা অচেনা। এছাড়া আর যে কোন উপায় ছিল না ওর। অথচ কত ইচ্ছে করছিল সাহাবজীর সাথে বসে দেওঘরের বাত করে সবার কথা পুছতাছ করে কিন্তু কিছুই হল না। মনটা আবার কেঁদে ওঠে ওর অভিমানে সাহাবজী ওর বানানো খাবারও খেলেন না।
ভারাক্রান্ত মনটাকে বুঝিয়ে গুছিয়ে রাখে শৈলপুত্রী নটরাজের কথায় খারাপ লাগে ওর কিন্তু জানে কোনটাই মিথ্যে নয় সবটাই সত্যি। এমন কথা মনে হওয়াটাই ঠিক। কিন্তু আজ এক অন্য নটরাজকে দেখল শৈলপুত্রী যার চোখে অসীম আগ্ৰহ ওর সাথে একটু কথা বলার ওকে দেখার কিন্তু শৈলপুত্রীর অবহেলা ওকে এমন রুক্ষ করে তুলেছে।
রাতে নামমাত্র কিছু খেয়ে চলে আসে বাড়িতে নটরাজ। মামিমার কাছে সব কথা শুনে খুব রাগ হয় নিজের ওপর। অনেক রাত পর্যন্ত স্মৃতির গলি পথে ছুটে বেড়ায় নটরাজ মেলাতে চেষ্টা করে শৈলপুত্রীকে আগে দেখার সাথে আরেকবার।
পরদিন দোল পাড়ার ছেলেরা রঙ মাখছে আনন্দে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ায় নটরাজ ওরা ওকে ডাকে। নটরাজ হাত নাড়ে মন চলে যায় এক নিরুদ্দেশ ঠিকানায় হঠাৎই ভাবে যাবে নাকি একবার শৈলপুত্রীর নতুন ঠিকানায়? কাল হয়ত মেয়েটা ভালো করে রাতে খায়নি কতই না কষ্ট পেয়েছে আর মন খারাপ করেছে। আজ দোল নটরাজের মনের অনুতাপের জল দিয়ে ধুয়ে মুছে দিতে খুব ইচ্ছে করে ওর অভিমান বলতে ইচ্ছে করে খুব ভুল করেছি আমি। আমার এমন কথা বলা উচিত নয়। তবুও শৈলর মত ভয় হয় ওরও তাই অপেক্ষা করে পরের দিনেথ মানে রবিবারের পর দিন সোমবার কলেজের পথে ওকে নিয়ে নিরিবিলিতে বসে বলবে সব কথা ক্ষমাও চাইবে। সে ও নিশ্চয় জানতে চায় দেওঘরের কথা।
দুটো দিন অস্থিরতা নিয়েই কেটে যায় নটরাজের অপেক্ষা সোমবারের। কখন যে দিনটা আসবে ভাবে। অবশেষে সেদিনটা আসতেই কলেজের উদ্দেশ্যে বেরোয় নটরাজ। লাবণ্য জিজ্ঞেস করাতে একটা কাজের অজুহাত দিয়েই বেরিয়ে যায়। বলে যায় ফিরতে একটু দেরি হতে পারে। আর্ট কলেজের বেরোনোর গেটটার উল্টোদিকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নটরাজ। আজ নটরাজের মনেও অদ্ভুত একটা দোলাচল চলছে কখনও কি ভেবেছে যে মেয়েটাকে দেওঘরে প্রথম দেখে একজন লড়াকু মেয়ে ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। মাঝেমাঝে ইচ্ছে হলে চলে যেত ক্ষেত পেরিয়ে দেখে আসত কেমন চলছে ওর পাঠশালা আজ সে কলেজে পড়ছে আর নটরাজ একটু দেখা পাবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। সত্যিই কিভাবে দিন বদলে যায়। নিজেকে অনেক প্রশ্ন করেছে নটরাজ এই দুটো দিন যে সে আসবে কি না কিন্তু না এসে পারেনি।
কলেজ ছুটি হয়ে গেছে ছেলেমেয়েরা যাচ্ছে গল্প করতে করতে এদের অনেকেরই সাজগোজ একটু আলাদা কাঁধে ব্যাগ দেখে বেশ শিল্পীদের মতই লাগছে। কিন্তু শৈলপুত্রীর দেখা নেই কেন? সত্যিই এভাবে কোন কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেনি কখনও। প্রেমের বয়েসে যা করেনি আজ তা হঠাৎই করছে এখন ভেবে হাসি পায় নটরাজের। হঠাৎই চোখে পড়ে শৈলপুত্রীকে ঠিক তেমনি অবাধ্য চুল উঁচু করে বাঁধা পরনে খুব সাধারণ একটা শাড়ি কাঁধে ব্যাগ তবে কপালের লম্বা কালো টিপে ওকে বেশ অন্যরকম লাগছে দেখতে। নটরাজ তাড়াতাড়ি করে রাস্তা পেরিয়ে এপারে আসতে যায় শৈলপুত্রীকে ওকে ধরতেই হবে অনেক কথা আছে ওর সাথে।
শৈলপুত্রীর হঠাৎই নজর পড়ে সাহাবকে কি করবে ভেবে পায় না। নাহ্ নিশ্চয় ওর সাথে দেখা করে কথা বলবেন বলেই সাহাব এসেছেন এখানে তবে ও ধরা দেবে না কিছুতেই। ও একটা সামান্য মেয়ে তারপর বিয়ে হয়ে বিয়ে ভেঙেছে কি দরকার সাহাবের ওর সাথে কথা বলার?
নটরাজ রাস্তা পেরোতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায় হঠাৎই গাড়ি চলতে শুরু করেছে ইশ্ শৈলপুত্রীকে ধরতে পারবে তো। এপারে থেকে হাত নাড়ে একটু দাঁড়াও। শৈলপুত্রী তাকায় না কিন্তু বুঝতে পারে হঠাৎই মুশকিল আসান হয়ে যায় সুশোভন স্যারের গাড়িটা পাশ দিয়ে যাওয়াতে। শৈলপুত্রী হাত দেখায় সুশোভন গাড়ি থামালে তাড়াতাড়ি করে গাড়ির সামনের সিটে উঠে বসে। সুশোভন অবাক হয়ে যায় এর আগে কত বলেছে তবুও পেছনেই বসে শ্যামা আজ হঠাৎই সামনে বসল!
' শ্যামা কোথায় যাবি? কোন সমস্যা হয়েছে? তোর মুখটা কেমন যেন লাগছে।'
-' শরীরটা ভালো নেই স্যার মাথাটা ঘুরছিল তাই হাত দেখালাম। আমাকে একটু বাড়িতে পৌঁছে দেবেন?'
-' আমি কি তোকে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে যাব? নাকি স্যারের ওখানে দিয়ে আসব তোকে?'
-'আমি ঠিক আছি স্যার বাড়িতে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।'
সুশোভনের ট্যাক্সিতে হঠাৎই শৈলপুত্রীকে দেখতে পেয়ে কিছু মাথায় ঢুকল না নটরাজের। ও নিজেও একটা ফাঁকা ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে আর গাড়িটা ফলো করতে বলে। অবশেষে দেখে শৈলপুত্রীকে রুবিদির বাড়ির সামনে নামতে। সাথের ভদ্রলোক ঠিক চেনা নয় তবে ইনিই কি সুশভোন বাবু? চোখে না দেখেও গল্প শুনে কিছুটা চিনে গেছে নটরাজ। এদিকে স্যার হয়ে ছাত্রীর ওপর এত টান যে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই শেষ নয় নিজেও চলে গেলেন ভেতরে। তার মানে উনি প্রায়ই আসেন এখানে।
নটরাজ কিছুটা সময় অপেক্ষা করে বাইরে রাস্তায় তারপর দেখে ভদ্রলোক আধঘণ্টা বাদে চলে যাচ্ছেন। খুব রাগ হয় আবার শৈলপুত্রীর ওপর মনে মনে ভাবে ওকে দেখে এই লোকটার গাড়িতে চড়ে বসল আর এখন ও অপেক্ষা করছে বাইরে। নাহ্ অযথাই মনটা ছোট হয়ে যাচ্ছে এবার ওর চলে যাওয়াই উচিত।
এ বাড়িতে ঢুকে আর শৈলপুত্রীর সাথে কথা বলা সম্ভব নয় কারণ মামিমা মামুর কানে গেলে খুবই খারাপ ভাববেন। অগত্যা সামনের দিকে পা বাড়ায় নটরাজ তবে হঠাৎই বিনুর সাথে দেখা হওয়াতে অপ্রস্তুত হয়ে যায় নটরাজ।
-' নাটু দা তুমি এখানে? চল আমাদের বাড়িতে একটু চা খেয়ে যাবে শৈলদিকে তুমি তো চেন দারুণ চা বানায় আর তেমনি ছবি আঁকে।'
-' হ্যাঁ জানি তো তবে আজ আর সময় হবে না রে একটা কাজে এখানে এসেছিলাম। পরে একদিন আসব রুবিদিকে বলিস।'
-' দিদি তো এখন নেই আসবে পরে এখন শৈলদি আছে।'
-' আচ্ছা বিনু তোমরা কি গাড়ি কিনেছ? সামনে একটা বড় গাড়ি দেখলাম।'
-' আরে না না নাটুদা আমাদের নয় ওটা তো সুশোভনদার গাড়ি। মাঝে মাঝে চলে আসে দিদির কাছে। ওর কাজ দেখে যায় কখনও বকা দেয়। আজ নাকি মাথা ঘুরে গেছে তাই ছেড়ে দিয়ে গেল।'
বিনুর কথাটা শুনে অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেল নটরাজ। একবার যাবে নাকি ওকে দেখতে? তারপর নিজেকে সংযত করে।
শৈলপুত্রীর মাথা ঘুরে গেছে শুনে ওরও একটু খারাপ লাগল তারপরেই মনে হল সত্যিই কি ওর মাথা ঘুরে গেছে নাকি শহরের কায়দা লেগেছে ওরও আচরণে হয়ত এটুকু নিছকই অভিনয় নটরাজকে ফাঁকি দেবার জন্য।
অদ্ভুতভাবে মনটা খারাপ হয়ে গেল নটরাজের আজও কোন কথা হল না শৈলপুত্রীর সাথে অথচ বলাটা খুব দরকার ছিল ও যা বলেছে সবটা খুব অভিমান করে বলেছে এত কিছু জানত না ও।
বিনুর কাছে নটরাজের ওদের বাড়ির সামনে এসে ঘুরে যাবার কথা শুনে খারাপ লাগে শৈলরও বুঝতে পারে সাহাব ওকে ফলো করেই একদম এখান পর্যন্ত চলে এসেছ।
-' হ্যাঁ রে নাটুকে নিয়ে এলি না কেন?' রুবি বলে। যদিও শৈলপুত্রী তখনও একদম চুপচাপ।
-' না না বললাম তো আসতে বলল কি একটা কাজে এসেছে তবে সুশোভনদার কথা জিজ্ঞেস করছিল।'
-' ওমা ও চেনে নাকি সুশোভনদা কে?'
-' না বলছিল গাড়িটা কার এই সব।'
ওদের গল্পের মাঝে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে শৈলপুত্রী কাজের অজুহাতে। রুবি বলে,' তোর নাকি মাথা ঘুরেছে? আজ শুধু বিশ্রাম খাবার আমি পাঠিয়ে দেব ঘরে।'
শৈলপুত্রীর ঘরে এসে হঠাৎই খুব কান্না পায় ওর সঙ্গে কি হচ্ছে কে জানে? অথচ ও তো অনেক দূরে চলে এসেছে সাহাবজীর থেকে তবুও কেন বারবার দেখা হয়ে যাচ্ছে?
নটরাজের ট্রেন অনেকটা ভোরবেলা তাই চলে যেতে হল অনেকটা জমা কথাকে হৃদয়বন্দি করে।
আশা হসপিটালে শুয়ে থেকে থেকে অস্থির হয়ে যান বারবারই মনে হয়ে কেন যে ওঁকে আর বাড়িতে ফেরাতে চায় না ছেলেরা। বাড়িতে দুই বৌমার মধ্যে অশান্তি তুঙ্গে কেউই দায়িত্ব নিতে রাজী নয় আশার।
-' শোন দিনরাত বাড়িতে একটা অসুস্থ মানুষ পড়ে থেকে কাতরাতে থাকবে এ একদম অসহ্য আমার। তারপর আমি চাকরিতে যাই আমার পক্ষে সম্ভব নয় দায়িত্ব নেওয়া।'
-' ব্যাস না বলে দিলেই সব শেষ তাই আর কিছু বলার নেই। আমি বাড়িতে থাকি বলে সব আমি সামলাব নাকি?'
তর্কবিতর্ক ভারী করে বাড়ির পরিবেশ,দেব বলে,' করা মানে কি? ঐ একটু নজর রাখা একটা লোক তো রাখতেই হবে যে চব্বিশ ঘন্টা থাকবে মায়ের কাছে।'
-' ও বুঝলাম তার মানে আবার বাড়তি খরচ। তুমি আর কত টানবে বলতে পারো?'
-' কেন দিদিভাই এই ব্যবসা তো শ্বশুরমশাই চালাতেন সুতরাং এখান থেকেই তো খরচ হবে। আমরা চালাবো নাকি?'
তর্কাতর্কি চরমে ওঠে শেষে আদিত্য বলে,' দাদা শোন মাথা গরম করিস না মায়ের পেছনে যখন খরচ হবেই তখন মা হসপিটালে থাক। আমার পরিচিত ওরা বলেছে খুব কম খরচে ওখানে থাকতে পারবে আলাদা করে কোন খরচ দিতে লাগবে না। ভালো হবে যত্নে থাকবে।'
দেব কিছু ভাবতে পারে না শুধু বলে,তাই বলে,' মা হসপিটালে থাকবে বাড়ি আসতে পারবে না?'
-' তুমি তাহলে সব দেখো আমি পারব না বলে দিলাম।'
তবুও আশা বাড়ি ফিরলেন দেবের জোরাজুরিতে। অসন্তুষ্ট হল সবাই তবুও দেব নিজেথ দায়িত্বে মাকে ফিরিয়ে নিয়ে এল। অনেকদিন বাদে নিজের ঘরে ফিরলেন আশা। এই ঘরের জন্য কত স্বপ্ন সাজিয়েছেন আজ যেন সবই বদলে গেছে। এখন আর বৌমারা তেমন কেউ কথা বলে না। মালতীর মা মাঝে মাঝে এসে চোখ মোছে আর বলে এমন কপাল যেন কারও না হয়। খবর গেল শৈলপুত্রীর কানেও খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই কারণ যে সুতো ছিঁড়ে গেছে সেখানে আর নতুন করে সম্পর্ক গড়া সম্ভব নয়। রেবা শুনে বললেন সবই কর্মফল হয়ত লাবণ্যও কিছুটা বুঝলেন কিন্তু মনে যা ঢুকেছে একবার তার থেকে বেরিয়ে এসে শৈলপুত্রীকে বলতে পারলেন না আমি ভুল করেছি। তবে কখনও সেই সুযোগ এসে যায় হঠাৎই ভগবান বুঝিয়ে দেন কোন মানুষকে যে কার দরকার হবে কেউ বলতে পারে না।
নটরাজের বাবার হার্টের অসুখ ছিল আগে থেকেই সাবধান হয়ে চলতেন সবসময় তবুও হঠাৎই একদিন এমন অবস্থা হল যে ভর্তি করতে হল সাথে সাথেই। স্বামীর অসুস্থতাতে দাদাই একমাত্র ভরসা তাই ছেলেকে জানানোর আগেই দাদার কাছে ফোনে খবর দিয়েছিলেন লাবণ্য,' দাদা ও কেমন একটা হয়ে গেছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না কী করব।'
অপূর্ব আর দেরি করেন না খুব তাড়াতাড়ি ফোনে ফোনে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। যতই মনান্তর থাক না কেন তবুও বিপদের দিনে একমাত্র বোনের পাশে দাঁড়ানো খুবই দরকার। রেবাও ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করে সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে একটা বড় নার্সিংহোমে। নটরাজকে খবর দেওয়া হয়েছে। হঠাৎই মাথাতে আকাশ ভেঙে পড়ে নটরাজের এক মাসও হয়নি ও বাড়ি থেকে এসেছে তখন তো বাবা কত ভালো। হঠাৎই এমন কি হল? তাড়াতাড়ি করে মথুরাকে কোয়ার্টারের চাবি ও অফিসের কাজের দায়িত্ব দিয়ে ট্রেনে উঠে বসে নটরাজ। ফুলবন্তী শুনেই মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে ফুল আর প্রসাদ এনে দিয়েছে,' সাহাব ডরনা মত বাবুজী তুরন্ত আ যায়েগা ঘরমে। সব কুছ ঠিক হো যায়েগা।'
বিপদের দিনে এই ভরসামাখা কথাগুলো নটরাজকে ছুঁয়ে যায়। ও বেশ কিছুটা দূরে থাকে কে জানে মা কি করছে একা একা? অবশ্য মামু বারবার বলেছে মাথা ঠান্ডা রাখতে কারণ সবাই একসাথে অস্থির হলে চলবে না। রেবাকে চলে যেতে হয়েছে লাবণ্যর কাছে। লাবণ্যকে আসতে বলেছিলেন এখানে কিন্তু বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হননি লাবণ্য।
রেবা দায়ে পড়েছেন কোন দিকে সামলাবে এই বাড়িতে অপূর্বকে একা রেখে ওখানে থাকা বাধ্য হয়ে শৈলপুত্রীকে আর রুবিকে এনে রাখতে হয়েছে এখানে।
-' কোন চিন্তা নেই তুমি যাও আমি আর রুবিদি এদিকে দেখব।'
-' হ্যাঁ রেবা তুমি যাও পারলে ওকে এখানে নিয়ে এস বুঝিয়ে।'
-' বলেছি গো কিন্তু ছেলে আসবে তাই সে বাড়ি ছাড়তে নারাজ। থাক আজকের দিনটা নাটু এলে বরং আমি চলে আসব।'
নটরাজ এসে পড়েছে লাবণ্য কিছুটা শান্ত এখন। বড় অসহায় অবস্থায় কেটেছে গতকাল রাতটা। মাকে বোঝায় নটরাজ,' মা এত ভেবো না হ্যাঁ মানছি বড় অপারেশন তবে এত বড় বড় ডাক্তার আছেন মামুর পরিচিত তাই সব ঠিক হয়ে যাবে।'
মামার বাড়িতে এসে শৈলপুত্রীকে দেখতে পায় নটরাজ রান্নাঘরে ব্যস্ত। মামিমার জলখাবার দিয়ে গেল,মামাকে চা ওর সামনেও চা জলখাবার রাখে।
-' ওদেরকে দুদিন এখানেই রেখে দিয়েছি আজ চলে যাবে আমি চলে এসেছি। ভাগ্যিস মেয়ে দুটো ছিল তাই চলে যেতৈ পেরেছি লাবণ্যর কাছে। একজন বাড়ি সামলেছে আরেকজন পার্লার। নে নাটু একটু ভালো করে খেয়ে নে অনেকটা সময় তো ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসতে দেরি হবে।'
নটরাজ শৈলপুত্রীর চলে যাওয়া দেখে। আজও শৈলপুত্রীর মুখে কোন কথা নেই শুধু চা দেবার সময় একটা নীরব চাউনি আর কিছুই নয়। তবে নটরাজের এখন আর ওকে নিয়ে ভাবার সময় নেই সুতরাং তাড়াতাড়ি করে চা খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়ে।
ডাক্তারের সাথে কথা বলে অনেকটা দেরি হয়েছে ফিরতে নটরাজের বাড়িতে দেখে মায়ের মুখটা খুব ছোট্ট তখনও না খেয়ে বসে আছে।
-' মা এত ভেবো না। কি চেহারা করেছ এই দুদিনে? চল খাবে চল। কিছু টেস্ট হবে তারপর অপারেশন। দেখবে বাবা একদম সুস্থ হয়ে ফিরবে।'
লাবণ্য কেঁদে ফেলেন এবার,' ওকে ছাড়া যে আমি একদম..সব ঠিক হবে তো?'
-' হ্যাঁ মা হবে। বিশ্বাস রেখো। শুধু আমাকে রক্ত জোগাড় করে রাখতে হবে। ডাক্তার বলেছেন। বাবার গ্ৰুপটা তো রেয়ার দেখি বন্ধুদের ফোন করব। মামুকেও বলব।'
-' হ্যাঁ রে তোর মামুর শরীর ঠিক আছে তো?'
-' হ্যাঁ মা আমি মামুকে থাকতে দিইনি আজ বেশীক্ষণ পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।'
*************
আগামীকাল বাবার অপারেশন তবে রক্ত জোগাড় করার কাজটা যতটা সহজ হবে ভেবেছিল তা হয়নি। বাবার ব্লাডগ্রুপ অনুযায়ী রক্ত পেতে হিমসিম খায় নটরাজ। অনেক চেষ্টা করে মাত্র একটা বোতল পাওয়া যায় অপূর্ব এদিক ওদিক ফোন করে চেষ্টা করছেন রক্ত জোগাড় করার জন্য।
-' আঙ্কেলজী আমি দেব রক্ত। যত লাগবে দিয়ে দেব।'
-' তুই যা নিজের কাজ কর হ্যাঁ কাল ভালোভাবে অপারেশন হয়ে গেলে ও বাড়িতে চলে যাস। আজ সুশোভন ফোন করেছিল কেন কলেজে যাচ্ছিস না।'
-' চলে যাব আঙ্কেলজী তবে রক্ত আমি দিব। কাল দিয়ে দিব।'
নটরাজের সেদিন সেই অপমান যে শৈলপুত্রীর মনে দাগ কেটেছিল তা বুঝতে পারেন অপূর্ব। তাই হয়ত যে কোন ভাবে তার জবাব দিতে চায় শৈলপুত্রী। রক্ত দেবার ব্যাপারে ও জানেই বা কতটুকু? অবশ্য শৈলজা একদিন শিবকে রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছিল তাঁরই মেয়ে তো ও।
-' পাগলামী করিস না বেবি রক্ত দেবার তুই কি বুঝিস? কোন গ্ৰুপ তোর সেটাই তো জানিস না? কখনও রক্ত দিয়েছিস?'
-' হাঁ দিয়েছি তো ও যখন কলেজে পড়তাম তারপর তো আর পড়াই হল না। আমি সব শুনেছি আমার একই গ্ৰুপের রক্ত আছে।'
-' কী বলছিস আমার মাথায় ঢুকছে না। দাঁড়া আগে দেখি টেস্ট হোক তবে বুঝব ঠিক কথা বলছিস।'
অপূর্ব রেবাকে বলাতে রেবা আঁতকে ওঠেন,' কি বলছ কি? মেয়েটা ভালো করে খায় না ঐ রোগা শরীর ও দেবে কী না রক্ত। এই সব নটরাজের কথা শুনে,ওর খারাপ লেগেছে খুব। নটরাজের ঋণ ও শোধ করতে চায়।'
-' আমি তা ভাবছি না রেবা তবে লাবণ্য জানতে পারলে কী হবে মানে ধর যদি গ্ৰুপ মিলেই গেল।'
-' ঠিক আছে এখনই ওদের কিছু বলার দরকার নেই শুধু নাটুকে বলে দিয়ো কাল যদি সব মিলে যায় তাহলে।'
-' কী বলব বেবি রক্ত দিচ্ছে?'
-' বললে ক্ষতি কী? এখন ওটাই আগে দরকার ওর বাবাকে বাঁচাতে।'
-' যদি মিলে যায় তুমি বরং লাবণ্যকে বলে দিয়ো যে মেয়েটাকে অপয়া বলেছে তার দেওয়া রক্ত দিয়ে কি বরের অপারেশন করাবে?
অপূর্বর মেজাজ জানেন রেবা কোন অন্যায় তিনি সহ্য করেন না তবে একটা কিছু ভাবতে হবে অশান্তি করলে হবে না। তাই বলেন
-' আচ্ছা যদি বলা যায় অজানা কোন ডোনার তাহলে কী হবে?'
-' না রেবা কাল আমি নিজে লাবণ্যর সাথে কথা বলব তুমি কিছু বলবে না।'
-' দেখো লাবণ্যর মনটা ভালো নেই ওকে....'
-' সেটা আমি জানি দেখো আমি কী বলি। একটু ভরসা রেখো।'
রেবা অপূর্বর কাছে এসে বুকের কাছে মাথাটা রেখে ঘুমোন মনে মনে বলেন সেই ভরসা আমার আছে। শুধু বেবিটার কথা ভাবছি,আর কত কী করবে মেয়েটা!
*****************
বারবার এখানে ওখানে ফোন করেও চার বোতল রক্ত জোগাড় হয়নি নটরাজের। মামাকেও বলা আছে তবে মামার বয়েস হয়েছে এমনিতে যথেষ্ট করছেন আর কত কি করবেন?
সকালে পুজো দিয়ে ঠাকুরকে অনেক বলেছেন লাবণ্য যেন রক্তটা জোগাড় হয়ে যায়। ছেলের সাথে মিললে তো ও দিতেই পারত কিন্তু এই মানুষের সবই অদ্ভুত একদম। আজ অপারেশন গলা দিয়ে চা টুকু নামে না লাবণ্যর খুব মনটা খারাপ হয় ছেলেটাও ভালো করে খেল না এদিক ওদিক ফোন করে চলেছে। হঠাৎই আবার ফোনটা বেজে ওঠে নটরাজ কথা বলে রাখার পরই। আজকাল ফোঞ এলেই লাবণ্য শুকনো মুখে গিয়ে দাঁড়ান কে জানে কি খবর এল। নাটু কথা বলছিল বুঝতে পারলেন দাদার ফোন।
-' মা মামু ফোনে তোমায় চাইছেন, এই নাও কথা বল।'
-' তুই বল না বাবা যা বলার আমার কথা বলতেও ভালো লাগে না।'
-' কি জরুরী কথা আছে তাই তোমাকেই চাইছেন।'
-' হ্যালো দাদা,কিছু বলবে?'
-' হ্যাঁ চিন্তা করিস না আমরা সবাই আছি। সবচেয়ে সেরা ডঃ পেয়েছি তাই সব ঠিক হয়ে যাবে। হ্যাঁ শোন নাটু কি রক্ত জোগাড় করতে পেরেছে?'
-' না দাদা মাত্র একটা বুঝতে পারছি না কি হবে?'
কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন লাবণ্য।
-' কথায় কথায় কাঁদিস না ছেলেটার খারাপ লাগবে। বলছি আমি একজন ডোনার পেয়েছি ওকে নিয়ে সকালেই চলে এসেছি এখানে হ্যাঁ ব্লাড গ্ৰুপ ম্যাচ করেছে দিতে পারবে রক্ত। কিন্তু সেই রক্ত তোর চলবে কি?'
-' তুমি কি বলছ দাদা! এটা তো খুব খুশির খবর সারা কলকাতা খোঁজা হচ্ছে আর তুমি ডোনার পেয়ে বলছ চলবে কি না?'
অপূর্ব মাথা ঠান্ডা রাখেন,রেবা বেবিকে নিয়ে তখন ভেতরে। অনাথ মেয়েটার শুকনো মুখটা মনে পড়ে যায় আবার। তারপর নিজেকে সংযত করে বলেন,' না আসলে সবার রক্ত তো নেওয়া যায় না।'
-' দাদা সে যদি সুস্থ থাকে তবে ক্ষতি কী? টাকা যা লাগবে আমরা দেব। এই নাও তুমি নাটুর সাথে কথা বল।'
-' দাঁড়া ফোনটা ছাড়িস না নাটুকে পরে বলা যাবে আগে তুই জবাব দে ভেবেচিন্তে। যে দেবে সে কোন টাকাই নেবে না। কিন্তু ডোনার সেই অপয়া অলক্ষ্মী মেয়েটা তার রক্ত নিতে কোন অসুবিধা নেই তো তোর?'
দাদার কথা শুনে মুহূর্তে লাবণ্যর পায়ের তলার মাটি সরে যায়। শৈলপুত্রী রক্ত দেবে! কি বলবেন এবার তিনি? যে মেয়েটাকে অপয়া অলক্ষ্মী বলে এতদিন কেউ তার ছায়া মাড়াননি আজ তার শরীরের লাল রক্ত প্রবাহ উজ্জ্বল করবে তাঁর সিঁথির রঙ। নাটুকেই বা কি বলবেন?'
ওপার থেকে দাদার গলা শুনতে পায় লাবণ্য
-' কি রে চুপ করে আছিস কেন? তাহলে তোর আপত্তি আছে তাই তো? মেয়েটাও বড় বোকা তখনি বলেছিলাম তোর রক্ত ওদের চলবে না। আচ্ছা যাক তোরা দেখ আমিও দেখছি।'
নটরাজ মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকায় কি এত কথা বলছে মামু? মায়ের মুখটা কেমন শুকনো। ডোনার নিয়ে কি এত কথা? এসব তো ওকে বললে হত মামুর। এমনিতেই মা মনখারাপ করে আছে।
-' দাদা আমার কোন আপত্তি নেই গো বিশ্বাস কর। এখন রক্তটাই পাওয়া জরুরী আর কিছুই ভাবার সময় নেই এখন। তুমি ব্যবস্থা কর দাদা যেভাবেই হোক। আমরাও তো বেরোব এখন।'
-' তার মানে তোর কাজের সময় অপয়া অলুক্ষণে আর কিছু মানছিস না তুই তাই তো?'
লাবণ্য দাদার খোঁচাটা বুঝতে পারে কিন্তু লাবণ্য নিরুপায় আজ। তাঁকে তো মাথা নোয়াতেই হবে আজ শৈলপুত্রীর কাছে। হয়ত যে অন্যায় সে করেছে তার জন্য আজ ভগবান শাস্তি দিচ্ছেন। নিজের কৃতকর্মের জন্য হয়ত অনুতপ্ত হবার সময়ও নেই এখন লাবণ্যর কাছে। তাই ফোনটা রেখে তাড়াতাড়ি করে বাথরুমে চলে যায় হয়ত এটাই একমাত্র চোখের জল লুকোনোর জায়গা। মা ফোনটা রেখে চলে যেতেই অবাক হয়ে যায় নটরাজ হঠাৎই মা চলে গেল ফোন রেখে তবে ব্যাপারটা কি? তবে মনে হয় একটা ভালো খবর আছে মানে মামা ডোনার পেয়েছে। কে এই ডোনার মা বলছিল টাকা লাগলে টাকা দেবে। কি কথা হল কে জানে?
লাবণ্য মুখে চোখে জল ছিটিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বাদে বেরিয়ে আসেন। কিছুটা সময় সমঝোতা করেন প্রয়োজনের সাথে বিবেকের। যে মেয়েটার মুখ দেখেননি এতদিন তাকে আজ বলতে হবে ভাগ্যিস তুমি ছিলে তাই আমরা একটা বড় বিপদের থেকে বাঁচলাম। ওর খোঁজ নিতে হবে। অথচ এতদিন ভুলেও খোঁজ নেননি এত বড় শহরে মেয়েটা কোথায় থাকে? কি করছে? কি খাচ্ছে? এমন কি নটরাজের ওপর যাতে এই মেয়েটার ছায়া না পড়ে তার জন্য সবসময় খেয়াল রেখেছেন।
তাড়াতাড়ি করে একটা শাড়ি জড়িয়ে দাঁড়িয়েছেন নটরাজের কাছে এসে,' চল নাটু সময় হয়ে গেছে। এবার আমাদের যেতে হবে। মনটা খুব ভারী রে।'
-' হ্যাঁ মা চল এবার,আমি তো রেডি। মামা কি বলছিল? রক্ত জোগাড় হয়েছে মনে হচ্ছে তাই একটু নিশ্চিন্ত লাগছে। ডোনার পেয়েছে তাই না? আমি জানতাম মামু আছে তো।'
লাবণ্য আর না বলে থাকতে পারেন না অনেক খারাপ হয়ে গেছেন ছেলের কাছে আর দাদার কাছে হয়ত বৌদির কাছেও। এই কথাটা চেপে রাখলে আরও খারাপ হবে তাই বলেন,' হ্যাঁ রক্তের ব্যবস্থা হয়েছে দাদা বললেন শৈলপুত্রীর রক্তের গ্ৰুপ ম্যাচ করে গেছে তাই আর চিন্তা নেই।'
মায়ের কথা শুনে কিছু বলতে পারে না নটরাজ। একটা অপরাধের পোকা ওকেও খোঁচা মারে মায়ের মতই ওহ্ তাহলে সবার সব ঋণ এভাবেই রক্ত দিয়ে শোধ করে দিচ্ছে শৈলপুত্রী। ইশ্ সেদিন কত কথা শুনিয়েছ মেয়েটাকে এমনও বলেছে যে নটরাজ ছিল বলেই এতটা উন্নতি করতে পেরেছে জীবনে।
লাবণ্য ভেবেছিলেন কথাটা শুনে নটরাজের কোন প্রতিক্রিয়া হবে কিন্তু একদম চুপচাপ হয়ে গেছে নটরাজ। তাই নিজেই বলেন,' হ্যাঁ রে কিছু বললি না যে।'
-' কি বলব মা,ঠিকই আছে সব। বাবা বৈদ্যনাথকে অনেক ধন্যবাদ সব এভাবে জোগাড় করে দেবার জন্য এখন ভালোভাবে অপারেশন হয়ে গিয়ে বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি আসুক।'
মাকে কথাগুলো বললেও মনে মনে নটরাজ ভাবে শৈলপুত্রীর কথা। অদ্ভুত এই মেয়ে কোথায় কখন এসে হাজির হয় তা বোঝাই যায় না। তবে মিশ্রা বাড়ির মেয়েরা সত্যি আত্মসম্মান নিয় চলতে জানে তাই তো নটরাজকে ওর কথার জবাব দিল কথায় নয় কাজে।
- 'এভাবেই জিতে যাও শৈলপুত্রী সত্যিই আর কত মার খাবে তুমি। এবার জবাব দাও সবাইকে আমিও পেয়েছি জবাব। তবে তোমার ঐ ক্ষীণ শরীর কি পারবে এত ধকল সইতে?' মনে মনে বিড়বিড় করে নটরাজ।
রেবা ধমক দেন বেবিকে ' এত ছটফট করিস না মা। এতটা রক্ত যে কি করে দিবি তুই? অথচ আর কোনও উপায় নেই।'
-' আমার শরীরে অনেক রক্ত আছে মা দেখো আমি ঠিক পারব।'
নটরাজ আর লাবণ্য পৌঁছে যায় ঠিক সময়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলে বাবার সাথে দেখা করে। ফুলবন্তীর দেওয়া ঠাকুরের ফুলটা ছুঁইয়ে দেয় বাবার মাথায়।
তারপর অনেকটা সময়ের অপেক্ষা। নটরাজের চোখ এদিকে ওদিকে খোঁজে শৈলপুত্রীকে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে পারে না। মা জিজ্ঞেস করছে মামুকে,' দাদা মেয়েটা কোথায়? রক্ত দেওয়া হয়েছে?'
-' ভাবিস না সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। তোর বৌদি আছে ওখানে।'
-' আমি কি একবার যাব?'
-' নাহ দরকার নেই তুই এখানে থাক নাটুর সাথে।'
*******************
মাঝে কেটে গেছে অনেকটা সময় এর মধ্যে বেশ কয়েকবার উঠেছে নটরাজ এদিক ওদিক করেছে কিন্তু মামিমা বা শৈল কাউকেই দেখতে পায়নি। বাবার অপারেশন ভালোভাবে হয়ে গেছে। অনেকটা শান্তি লাগে শুনে ওদের। ডাক্তারবাবু বলেন রক্তটা ভাগ্যিস জোগাড় হয়েছিল না হলে অসুবিধা হত। ওরা একটু দেখে বাইরে আসে।
অপূর্ব বলেন,' আর ভাবিস না নাটু সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে এবার একটু একটু করে সুস্থ হয়ে উঠবে মণি। মাকে নিয়ে এখন বাড়িতে চলে যা। আমার সাথেও যেতে পারিস।'
নটরাজ শৈলপুত্রীর কথা জিজ্ঞেস করতে পারে না কিন্তু লাবণ্য জিজ্ঞেস করেন। হয়ত এতক্ষণ না জিজ্ঞেস করাটাই ভীষণ অন্যায় হয়েছে। আজ ওর জন্যই অপারেশনটা ঠিকঠাক হয়েছে।
-' দাদা বৌদি কোথায়? শৈলপুত্রীকে একবার দেখা যাবে না অনেক করেছে মেয়েটা আজ আমাদের জন্য। কেমন আছে একবার দেখে যেতাম।'
'ওকে নিয়ে তোর বৌদি বাড়ি গেছে কারণ অনেকটা রক্ত বেরিয়ে গেছে আজ রোগাসোগা মেয়েটার। সুশোভন এসেছিল ও নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিয়েছে ওদের। তোর বৌদিরও খুব ধকল গেছে রে। আসবে বিকেলে আবার।'
নটরাজের মনে যে প্রশ্ন উঠেছিল তার উত্তর সবই পেয়ে গেল। কিন্তু শৈলপুত্রীর সাথে কি একবারও দেখা হবে না?'
একই প্রশ্ন লাবণ্যও করেন,' মেয়েটার সাথে কি দেখা হবে না দাদা?'
-' অমন করে বলিস না এমন মেয়ে আসুক প্রতি ঘরে ঘরে। অনেক কপালের জোরে আজ ও আমাদের ঘরে। নিশ্চয় দেখা হবে কেন হবে না?'
মাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসেছে নটরাজ মামার বলা কথাগুলো কানে বাজে এমন মেয়ে সবার ঘরে ঘরে আসুক। হয়ত সত্যিই তাই শুধু ওরা শৈলপুত্রীকে ভুল বুঝেছে অথচ আজ সেই নিজের জীবধ বিপন্ন করে তাদের পাশে। বাবা বৈদ্যনাথকে শৈলপুত্রীর জন্য আর বাবার জন্য বলে নটরাজ। তারপরেই হঠাৎই সুশোভন নামটা কানে বাজে। এই ভদ্রলোক তো কলেজের স্যার হঠাৎই এখানে এসে হাজির হয়েছেন কেন? ছাত্রীর শরীরের খবর নিতে? নাকি শৈলপুত্রীর অসুস্থতা তাঁকে একটু বেশি ভাবায়। হয়ত নটরাজের চেয়েও বেশি তাই সেদিন মাথা ঘুরছে বলাতেই এসে বাড়িতে পৌঁছে দিলেন।
নটরাজ মনের চোখে দেখতে পায় শৈলপুত্রীকে ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে তুলে দিচ্ছেন ওর স্যার সুশোভন। হঠাৎই অদ্ভুত একটা মনখারাপ হয় ওর। বুঝতে পারে না কেন?
*****************
মাঝে কেটে গেছে দুটো দিন খুব ব্যস্ততায় কেটেছে নটরাজের দিনের অনেকটা সময় নার্সিংহোমে কেটে যেত। মাকে একবার এনেই দেখিয়ে নিয়ে গেছে বাবাকে। এখন অনেকটা ভালো বাবা হয়ত আর কয়েকদিনের মধ্যে ছেড়ে দেবে। অনেকটা যুদ্ধের পর এ যেন একটা শান্তির শ্বাস ফেলা। লাবণ্যর মনও একটু নিশ্চিন্ত হবার অবকাশ পেয়েছে,একটু হলেও মন দিতে পেরেছেন সংসারে ঠাকুরের কাছে একটাই প্রার্থনা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ফিরুক মানুষটা। হয়ত এই হচ্ছে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে অটুট বন্ধন যেখানে যদি সত্যিকারের টান থাকে তাহলে এই মানুষটাই বিচলিত হয় বেশি।
সানন্দা রান্নাঘরে তেলের মধ্যে ছ্যাঁক করে মাছ ছাড়ে মাথাটা গরম হয়ে যায় প্রচণ্ড মালতীর মায়ের ওপর গতকাল শরীর খারাপ বলে হাঁটা দিয়েছে বোনঝির বাড়ি এখনও আসার নাম নেই। আর এই এত বড় গুষ্ঠীর রান্না ওকে করে অফিসে যেতে হবে। কারণ কাল জা করেছে তাই আজ ওর পালা।
-' বুড়িটা মরেও না দিব্যি খাচ্ছে দাচ্ছে বিছানায় শুয়ে আছে। তার জন্য আবার আলাদা রান্না হচ্ছে আজ। এই বয়েসে মায়ের জন্মদিন হচ্ছে। আর এতদিন বাঁচা কেন বাবা? কম তো ভোগ করে জ্বালিয়ে যাওনি এবার যাও।'
সানন্দার কথা অবশ্য কারও কানে যায় না তবে অলক্ষ্যে ভগবান হয়ত ভাবেন সংসার এমনই। যে সংসারে সন্তানকে খাইয়ে মা না খেয়ে হেসে বলেন,' তোরা খা বাবা ভালো করে আমার খিদে নেই।'
সেই সংসারই একটা সময়ের পর হিসেব নিতে শুরু করে খাওয়া পরার। সন্তানকে বাঁচানোর জন্য মা ঠাকুরের দোর ধরলেও অকেজো মায়ের মৃত্যুকামনা করে অক্লেশে সন্তানরা। আজ আশারও সেই অবস্থা পদে পদে এখানে হয় তাঁর মৃত্যু কামনা। আয়া বৌমারা এমন কি ছেলেরা মনে মনে ভাবে এবার মায়ের চলে যাওয়া ভালো। অসুস্থ সন্তানকে মা বাবা দিনের পর দিন টেনে চললেও হয়ত এটাই বাস্তব মানে সবাই বলে অকেজো মানুষকে শেষ হল খেলা এবার উঠাকে ঝোলা চল ভোলা। তবে ঝোলা কাঁধে নিলেও ভোলা আসল ভোলানাথের কৃপা তো চাই। সে কৃপা না হলে সবই বৃথা। আশা কোনরকমে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে দেখেন কাউকে ছাড়া কিছুই বোধহয় থেমে থাকে না। শিবনারায়ণের ছবির দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলেন আশা বিড়বিড় করেন,' দেখেছ তো কেমন আছি আমি? আজ আমার জন্মদিন তুমি থাকলে ফুল মিষ্টি আর শাড়ি আসত।' তারপরেই মনে হয় আশার যা আছে সবই তো রইল পড়ে। যত্নে তুলে রাখা জিনিস হয়ত যাবে অন্যদের ভোগে।
দেব এসে দাঁড়ায়,' মা আমি এসেছি,দেখি ফুলটা একটু ঠেকিয়ে দিই। পূজা দিলাম সকালে। একটু প্রসাদটা ওঁর মুখে দিয়ে দেবেন।'
আশা প্রসাদ ঠেকান মাথায়,কি বলেন বোঝা যায় না।
দেব ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বড় ভারী যেন এই ঘরের বাতাস হয়ত বা বাড়ির বাতাসটাই ভারী অথচ এই বাড়িতে একটা সময় কত হৈ চৈ ছিল। যদি একটা বাচ্চাও থাকত ওদের তাহলেও বাড়িটা ভরে উঠত। আচমকা একটা দুম করে আওয়াজ পায় বুঝতে পারে রান্নাঘরে কাজ করে বিরক্ত সানন্দা দুম করে দরজা বন্ধ করে অফিসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। নাহ্ আজ মাসির একটা খবর নিতে হবে কারখানা ফেরত। এভাবে আর চলে না। আদিত্য বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে সানন্দা সেজেগুজে বেরিয়ে যাচ্ছে।
-' তুমি এখনই বেরোচ্ছ! খেয়েছ? একসাথেই তো যাব আমরা।'
-' তুমি এস ভালো করে খেয়ে মায়ের জন্মদিনে মাকে আদর করে আমি বেরোলাম। চৌধুরী স্যারের সাথে বাইরে লাঞ্চ করব।'
জানলায় দাঁড়িয়ে দেখে আদিত্য একটা বড় সাদা গাড়ি এসে দাঁড়ায় ওদের বাড়ির সামনে সানন্দা আঁচল উড়িয়ে উঠে বসে গাড়িতে। সামনের সিটে বসে শব্দ করে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়। আদিত্যর হঠাৎই মনে পড়ে যায় এই জানলাতে অনেকদিন আগে একজন অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকত যখন ও সানন্দার সাথে দেখা করে ফিরত অনেক রাতে। আজ নিজেকে হঠাৎই অতীতের আয়নাতে ফিরে দেখতে পেল আদিত্য। আর এটাও বুঝল সানন্দার মত মেয়েরা ঘর ভাঙতে পারে বাঁধতে পারে না। গুছিয়ে রাখতে,বেঁধে রাখতে সংসার গড়তে অনেক কিছু ছাড়তে হয় সবাই তা পারে না যারা পারে তারা হয়ত সুখী। তবে ওরা পারেনি।
আজ বাবাকে দেখে নটরাজের মনটা বেশ ভালো। আজ ডাক্তারের সাথে অনেকটা সময় কথা হল কাল বাবার ছুটি হয়ে যাবে। খুব প্রশংসা করলেন ডাক্তারবাবু মামার আর শৈলপুত্রীর।
-' অপূর্ববাবু যাকে এনেছিলেন আমি সত্যিই অবাক ভাবতেই পারিনি এতটা রক্ত দিতে পারবে মেয়েটা। তবে সত্যিই যদি ওকে না পাওয়া যেত তবে খুব ক্রাইসিস হত। আপনার তো আত্মীয়া ভালো আছেন তো?'
নটরাজ মাথা নাড়ে। মনে মনে ভাবে নাহ আজ শৈলপুত্রীকে দেখে তবে যাবে বাড়িতে। সত্যিই খুব স্বার্থপর লাগছে নিজেকে। অবশ্য মা বলেছিলেন একবার আসবেন তবে আসা হয়নি কারণ বাবাই ওদের মুখ্য চিন্তার কারণ। হয়ত শৈলপুত্রীর কাছে মা ঋণী কিন্তু কি এসে যায় এমন একটা মেয়ে থাকলে বা না থাকলে। কথাটা ভেবে মনটা ভারী হয়ে যায় নটরাজের। দুপুর হয়েছে তবুও আলিপুরে মামার বাড়ি যায় ও জানে এই সময় মামিমা বাড়িতেই থাকেন।
দোতলায় উঠেই দেখতে পায় মামিমাকে। নটরাজকে দেখে রেবা বলেন,' কি রে নাটু এখন এলি যে? যাক ভালো হয়েছে খেয়ে যা তোর মামুও খাবে। এখন।'
-' মামিমা শৈলপুত্রী কোথায় গো? ওর সাথে একটু কথা বলতাম। সেদিন ও যা করেছে সত্যিই ও না থাকলে এ যাত্রা বাবার যে কি হত.. '
-' হ্যাঁ রে মেয়েটা এইরকমই আমরা ওকে ভুল বুঝি।'
-' তাই তো একটু কথা বলতে চাই সেদিন তোমাদের সামনে ওকে অনেক খারাপ কথা বলেছি। তাই বোধহয় ভগবান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন।'
-' থাক সেসব কথা তবে সে আছে নাকি? অতি কষ্টে তাকে আটকেছিলাম। আজ সে কলেজে চলে গেছে রে। সুশোভন এসেছিল ওদের একটা পরীক্ষা আছে তাই যেতেই হল। অবশ্য সুশোভনই পৌঁছে দেবে বলেছে।'
সেই আবার সেই নামটা! এই ভদ্রলোক কেমন যেন একটা ছাত্রী রক্ত দেবে সেখানে হাজির আবার সে কলেজে যাবে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। কি চায় লোকটা?
নিজেকে সামলাতে পারে না নটরাজ তাই বলে,' নাহ মামিমা ওরা কখন আসবে বলতে পারবে? তাহলে একটু অপেক্ষা করে যাব।'
-' না রে নাটু শৈলপুত্রীর জন্য তুই অপেক্ষা করিস না তুই বরং খেয়ে বাড়ি যা। লাবণ্য চিন্তা করবে।'
ওদের কথার মাঝে কখন মামা এসেছে বুঝতে পারে না। মামার গলা খুব ভারী শোনায় নটরাজ বুঝতে পারে ওর আর মায়ের সাথে যাতে শৈলপুত্রীর দেখা না হয় সেটাই মামা চান।
বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে নটরাজ। লাবণ্যর মন অনেক হাল্কা। ছেলের কাছে সবই শুনেছেন নটরাজের বাবা। তাই লাবণ্যকে বলেন,' কোথা থেকে কী হল কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে ভালো হয়ে এলাম এটাই ভগবানের আশীর্বাদ। হ্যাঁ গো শৈলপুত্রীকে একবার এখানে আনা যায় না? খুব দেখতে ইচ্ছে করে তাকে। ওর রক্তই তো বইছে শিরা দিয়ে তাই না?'
নটরাজ চুপ করে বাইরে চলে যায়। মনে মনে ভাবে মামাও চান না শৈলপুত্রীর সাথে ওদের দেখা হোক তাই ওকে সরিয়ে রেখেছেন। তবে হয়ত সেটাই স্বাভাবিক। বাবার প্রশ্নের উত্তর মা দিক মা তো একটা সময় কম করেনি ওকে নিয়ে।
মাঝে আরও দুটো দিন কেটে গেছে। অপূর্ব এসে ঘুরে গেলেও রেবার আসা হয়নি। তাই ফোন করেন লাবণ্যকে,' আজ একটু যাব আমি ওবেলা। হসপিটাল থেকে মণিদা আসার পর আমার তো যাওয়াই হয়নি।'
লাবণ্য একটা কথা ভেবেছে এই দুদিন তবুও বলতে পারেনি দাদার ভয়ে। আজ একটু সাহস করে বলে,' বৌদি একটা কথা বলব,একটু রেখো কথাটা গো।'
রেবা বুঝতে পারেন হয়ত তবুও চুপ করূ থাকেন তারপর বলেন..
-' হ্যাঁ বল কি বলবে?'
-' বৌদি তোমার ননদাই খুব শৈলপুত্রীকে দেখতে চাইছে একবার ওকে একটু দেখা করতে দাও ওর সাথে। অসুস্থ না হলে নিজেই চলে যেত।'
এরপর আর কিছুই বলা চলে না তাই রেবা বলেন,' আচ্ছা দেখছি কিন্তু সেই অপয়া মেয়েটার পায়ের ছাপ তোমার বাড়িতে পড়বে? কোন ক্ষতি হবে না তো?'
-' বৌদি আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দাও গো। দেখ যদি একবার আনা যায়।'
-' মিশ্রাবাড়ির মেয়েদের আত্মসম্মান বেশি জান তো? জানি না সে রাজি হবে কি না? তারপর তোমার দাদাকেও তো চেন।'
-' আমার সত্যিই সাহস হয় না দাদাকে বলতে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। তবে যদি ঐ অসুস্থ মানুষটার কথা ভেবে একবার। আমি বলব ওকে একবার মানে বেবিকে?'
-' থাক গো অত ব্যস্ত হয়ো না আমি কথা বলি আগে।'
মায়ের কথাগুলো কানে আসে নটরাজের। কিভাবে যে পরিস্থিতি এত জটিল হয়ে গেল কে জানে? একটা হাসিখুশি মেয়ে যে ওদের কত কি রেঁধে খাইয়েছে হঠাৎই তার প্রতি ওদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেল। কে জানে শৈলপুত্রীর সাথে কাটানো সেই সময়গুলো আর হয়ত ফেরত আসবে না কোনদিনই।
অপূর্ব রেবাকে কথা বলতে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছেন তারপর বুঝেছেন সবটাই। সত্যিই খুব রাগ হয় বোনের ওপর। না না কিছুতেই শৈলপুত্রীকে যেতে দেবেন না ওখানে। লাবণ্যর জন্য ঘরছাড়া মেয়েটা। পালাতে চেয়েছিল এই বাড়ি থেকে। তাই বলেন,' মণি ভালো হোক তখন এই বাড়িতে এসে বেবির সাথে দেখা করে যাবে। আমি বেবিকে সেখানে যেতে দেব না কিছুতেই।'
-' আঙ্কেলজী আমাকে যেতে দিন মায়ের সাথে। একজন অসুস্থ মানুষের জন্য যে আমাকে যেতেই হবে। আর উনি যে সাহাবজীর বাবা আছেন। আজ সাহাবজী না থাকলে হয়ত কিছু হত না।'
অপূর্ব বুঝতে পারেন নটরাজের বলা কোন কথাই ভোলেনি শৈলপুত্রী সব মনে আছে। তাই বলেন,' আমি আর কিছু বলতে চাই না কত আর সবার ভালো দেখবি?'
রেবা বলেন,' দেখুক সবার ভালো,সেই ভালোটাই আলো হয়ে আসবে একদিন ওর জীবনে তুমি দেখে নিয়ো।'
***************
রেবা লাবণ্যকে কিছু জানাননি আর তবুও লাবণ্য নটরাজের বাবাকে বলেন,' জানি না তুমি বা তোমরা সবাই হয়ত আমাকে খুব খারাপ ভাবছ তবুও আমি বলেছি বৌদিকে শৈলকে সাথে নিয়ে আসতে।'
-' তুমি বলেছ লাবণ্য! মন থেকে বলেছ তো? তবে জানি না সে আসবে কি না?
-' তোমার জন্য তো কত কী করি সারাদিন তাই তোমার ইচ্ছে আমি না বলে পারি?'
-' শুধু আমার ইচ্ছে? তুমি কি চাও না ওর সাথে কথা বলতে বা যা বলেছ ওর নামে তা ফিরিয়ে নিতে?'
লাবণ্য বুঝতে পারেন সংসার ভীষণ স্বার্থপর এখানে কেউ হিসেব মেলাতে ছাড়ে না। তাই যে গরমিল তিনি করেছেন তা কড়ায় গন্ডায় মিলিয়ে দিতেই হবে। নাহলে আশার মতই হয়ত তাঁরও অবস্থা হবে। হয়ত কিছুটা হাতে হাতেই ফল পেয়েছেন।
রেবা পরিপাটি করে নিজেকে রাখতে ভালোবাসেন তাঁর মতে সাজের কোন বয়েস নেই। নিজেকে ভালোবেসে সামলে রাখতে জানা চাই তা ষাটে হলেও ক্ষতি নেই। সবার জন্য ভাবে যে আমিটা তাকে তো দামি বলেই ভাবতে হবে। আজ অনেকদিন বাদে ননদের বাড়ি যাচ্ছেন। মাঝে সত্যিই একটা খারাপ লাগা ছিল। তবে মেনে আর মানিয়ে নিতে পারেন রেবা আর সেটাই তো ভালো রাখে অনেক সময়। সব অন্যায় যেমন মানতে নেই বুঝিয়ে দিতে হয় কখনও অপমানটা সুদে আসলে তেমনি সব পুরোনো কথা মনে রাখতে নেই তাতে বর্তমানের মিঠেভাব নষ্ট হয়ে যায়। আজ প্রয়োজনে যাচ্ছেন রেবা কি হবে ভাইবোনের সম্পর্কে আরও কিছুটা তিক্ততা মিশিয়ে তার থেকে প্রলেপ দেওয়াই ভালো। রক্তের টান ছোটবেলা সবই যে মিলেমিশে থাকে সম্পর্কগুলোর মধ্যে। মুছতে চাইলেও কী মোছা যায়? আর যখন বেবি নিজের ইচ্ছেতেই যেতে চাইছে তখন তো আর কোন কথাই নেই।
হাল্কা শ্লেট রঙের তসরের শাড়ি পরেছেন রেবা তাতে মেরুন টেম্পল বর্ডার। কানে গলায় আধুনিক রুচির রূপোর গয়না হাতে রূপোর বালা। রেবার সাজ অপূর্বর চোখেও মুগ্ধতার ছোঁয়া এনে দেয়। খুবই অল্প কিছু অথচ পরিশীলিত। রুচিসম্মত সাজ হয়ত নারীকে আরও বেশি সুন্দর করে। রেবার কাঁচাপাকা চুলের আলগা হাত খোঁপা আলসে আদরে পিঠে রাখা।
বেবিকে ডাক দেন রেবা,' কী রে তোর হল? নাকি এখনও ছবি আঁকছিস? আমি কিন্তু একদম রেডি। রেবার আবদারে শৈলপুত্রী মা বলেই ডাকে রেবাকে।
কিছুক্ষণ বাদে শৈলপুত্রী আসে ছুটে,' এই তো হয়ে গেছে মা। আমি তৈয়ারী হয়ে গেছি।'
-' এই তোর তৈয়ারী? তোর কবে আর বুদ্ধি হবে মা? সবসময় আমাকে বলে দিতে হয়। রুবিকে দেখেছিস কেমন সুন্দর সাজিয়ে রাখে নিজেকে।'
-' রুবিদিদিকে ভালো লাগে আমি পারি না আমাকে জোকার লাগবে।'
- ' চুপ কর দেখি এদিকে আয়,চুল তো নয় যেন বাবুই পাখির বাসা। উনি শুধু অন্যকে সাজাতে পারেন। প্রতিদিন তোর হাতে সাজার জন্য বায়না করে লোক আসে।'
রেবার ধমক শুনে চুপ করে বসে শৈলপুত্রী রেবা ওর চুলকে গুছিয়ে মুহূর্তে সুন্দর করে বেঁধে ফেলেন তারপর একটা হলুদ সিল্কের শাড়ি বের করে দেন পরার জন্য। একটু সঙ্কোচ হয় শৈলপুত্রীর তবে রেবাই বলেন মায়ের জিনিস মেয়েই তো পরবে।
নিজের আধা পুরোনো শালোয়ার কামিজ খুলে শাড়িটা পরে শৈলপুত্রী। রেবা অবাক হয়ে দেখেন শাড়ি পরে আর চুল বেঁধেই কত সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। হাল্কা ছিমছাম ছোট্ট একটা দুল আর গলার হার পরিয়ে দেন ওকে। তারপর দুজনে মিলে রওনা দেন। শৈলপুত্রীর মনে নানা প্রশ্ন আর সংশয়। এতদিন সাহাবজীর সামনে আসেনি ও আজ হঠাৎই পিসিমার ডাকে যেতে হয়েছে ও বাড়িতে। তাও হয়ত ও যেত না যদি না পিসার শরীর খারাপ থাকত।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে গাছগুলোর শুকনো পাতা হাত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলছিল নটরাজ। কদিন মা কোনদিকে মন দিতে পারেনি। হঠাৎই নজর পড়ে গাড়িটা,ওহ্ মামিমা আসছেন। মামিমা কি একাই আসছেন? সেটাই স্বাভাবিক এতটা অপমানিত হবার পর আর হয়ত কোনদিনই আসবে না শৈলপুত্রী ওর সামনে। তাই তো বারবার ওকে এড়িয়ে গেছে।
গাড়ি থেকে মামিমা নেমে গেছেন ওকে দেখতে পেয়েই ডাকেন,' ওরে নাটু একটু নীচে আয় বাবা অনেকগুলো জিনিস নিয়ে যা।'
তাড়াতাড়ি করে নীচে নেমেই গাড়ি ভর্তি ফল,মিষ্টি,হরলিক্স আরও অনেক কিছু জিনিসের মাঝে দেখল শৈলপুত্রীকে বসে থাকতে। নটরাজ হাত বাড়ায় মিষ্টিটা নিতে তারপর বলে,' নেমে আসুন আমি এগুলো নিয়ে যাব। আপনারা ওপরে উঠে যান।'
শৈলপুত্রীকে এক নজরে অনেকটা দেখে নটরাজ। মুখটা খুব শুকনো ওর চেহারাটাও বেশ খারাপ। বলে,'
'আপনি যেতে পারবেন তো?'
নটরাজ আশা করেনি অবশ্য তবুও হঠাৎই মেঘলা আকাশে রোদ উঠল খিলখিলিয়ে হেসে উঠল শৈলপুত্রী যেমন হাসত আগে তারপর বোধহয় ইচ্ছে করেই বলল তেমনি টানাটানা কথার টানে,' সাহাবজী আমি তন্দরস্ত আছি একদম সব সামান এই একাই নিয়ে যাব। আপনি দেখুন।'
নটরাজের মনের মেঘও সরে গেল হঠাৎই মনে হল মাঝের দিনগুলো বোধহয় ছিলই না কখনও এই তো সেই শৈলপুত্রী যার আধভাঙ্গা কথা শুনে ভালো লাগত নটরাজেথ যার হাসিতে মন ভরে যেত একলা প্রবাসে।
-' হ্যাঁ অনেক হয়েছে। এখানে এসে দেখছি আরও বেশি কাজের হয়ে উঠেছেন অত করতে হবে না। অনেক ধকল গেছে এখন ওপরে যান।'
রেবার মনটা হাল্কা হয় দূর থেকে দেখে বড় মিলমিশ ছিল ছেলে মেয়ে দুটোর যাক বেবির মাথায় বুদ্ধি আছে তাই বোধহয় নিজেকে একদম স্বাভাবিক করে রেখেছে। লাবণ্য এখানে নেই ওরা একটু কথা বলছে বলুক। ছেলেটার সেই চোখদুটো মনে পড়ে রেবার। যে চোখ সারাক্ষণ খুঁজত বেবিকে কিন্তু লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারত না।
শৈলপুত্রী গাড়ি থেকে নেমে আসে নটরাজ ওকে জিনিস বহন করতে দেয়নি বরং বারবার সাবধান করে আস্তে আস্তে দেখে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে এই তো কদিন আগেই এতটা রক্ত দিয়েছে।
রেবা এগিয়ে গেছেন সিঁড়িতে ওঠার ফাঁকে টুকরো কথি জিজ্ঞেস করে নটরাজ এমনকি ক্ষমাও চেয়ে নেয় সেদিনের ব্যবহারের জন্য। শৈলপুত্রী আবার হাসে,' এমন বলবেন না সত্যিই তো আজ আমি যা পেয়েছি সব আপনার জন্যই। আমি সচমুচ কিছু ভাবিনি। কিন্তু আপনি যে খাবার খেলেন না ভালো লাগেনি।'
-' খেয়েছি তো পরে।'
কথার মাঝে ওপরে উঠে এসেছে ওরা আজ লাবণ্যর সন্দেহ ওঁকে টেনে আনেনি সিঁড়িতে বরং মনটা হাল্কা হয়েছে বৌদি মেয়েটাকে সাথে করে আসায়। অন্ততঃ নটরাজের বাবার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পেরেছে।
নিজের কেউ না থাকায় বোধহয় শৈলপুত্রীর অবস্থা বয়ে যাওয়া জলের মতই যেখানেই ভালোবাসা পায় সেখানেই নিজেকে মানিয়ে নেয় তাড়াতাড়ি। লাবণ্য অবাক হয়ে গেলেন ওকে দেখে মনে হল ঠিক এ যেন দেওঘরে দেখা শৈলপুত্রী। ঘন্টা দুয়েক ছিল ওদের বাড়িতে তার মধ্যে তাড়াতাড়ি করে নটরাজের বাবার আব্দারে পাতলা পাতলা রুটি হালকা সবজি সব রান্না করে সামনে এনে বলল,' দেখুন খেয়ে আঙ্কেল দেওঘরের মত স্বাদ হয়েছে কি না?'
-' আগে বল তুই আমাদের ক্ষমা করেছিস তারপর বলব। অবশ্য তুই তো আমার মা তাই ক্ষমা তো করবিই। আজ আমার মা থাকলেও তো এমনি অস্থির হয়ে ছুটে আসত আমার জন্য। মা না হলে কি এমন করে আমাকে রক্ত দিস।'
শৈলপুত্রীর হঠাৎই চোখ চলে গেছিল লাবণ্যর দিকে কে জানে এই কথাগুলো শুনে পিসিমার কি মনূ হচ্ছে। লাবণ্য ভাবেন ওরা সবাই কি সুন্দর শৈলপুত্রীর কাছে ক্ষমা চাইছে কিন্তু তিনি কেন যেন সেই কথা বলতে পারছেন না অথচ বলাটা জরুরী। হয়ত অন্যায়ের শাস্তি এভাবেই ভগবান দিলেন তাঁকে। শৈলপুত্রীকে বলতে শোনেন,' আমি তো কারও কোন কামে আসিনি কখনও সবাই আমাকে অপয়া বলে তাই রক্ত মিলে গেছে শুনে ভাবলাম একটা কাজ করতে। তবে ভয় ছিল আমার রক্তও যদি অপয়া হয় সারাক্ষণ বৈদ্যনাথকে ডেকেছি।'
-' আর বোল না লাবণ্য অসুস্থ শরীরে কিসব সোমবার করে ওর ঠাকুরকে ডাকে জল ঢালে মাথায়। দাদাকে তো জান কি রাগ করে এই সব দেখে।'
-' হয়ত ওদের সবার প্রার্থনাতেই ও সুস্থ হয়ে উঠেছে। শৈলপুত্রীকে কিছু বলার মত মুখ আমার নেই তবে আমাদের মনগুলো বড় দূষিত তুই অপয়া হবি কেন? আজ একটা পাথরের বোঝা মন থেকে নেমে গেল। ভাগ্যিস তুই এলি।'
-' আমরা জোর করিনি ওকে নিজেই এসেছে তোমার কথা শুনে।'
নটরাজ ঘরের ভারী বাতাসটা হাল্কা করার চেষ্টা করে,' ভাগ্যিস উনি এলেন তাই তোমার রুটি করার ঝামেলাও গেল মা প্রতিদিনই তো বাবা রুটি নিয়ে ঝামেলা করে। এবার ওদের ছেড়ে দাও।'
-' হ্যাঁ লাবণ্য এবার যাই আমরা অনেকটা সময় এসেছি তোমার দাদাও খাবেন। আর কাল ওর কলেজ আছে তারপর আঁকা বাকি। সুশোভনের কাছে বকুনি খাবে তারপর রাত জাগবে।'
নটরাজের হঠাৎই কেমন যেন লাগে অনেকদিন বাদে সেই দেওঘরের মিসিং গন্ধটা পাচ্ছে তার মধ্যে হঠাৎই এই লোকটা কেন?'
-' আমাকে বৌদি একবার দেওঘর যেতে হবে।ও একটু ভালো হোক। তোমরাও যাবে তো তখন? শৈলপুত্রীকে কিন্তু যেতেই হবে।'
-' কী জন্য যাবে সেটা আগে বল তা ছাড়া এখন দেরি আছে পরে ভেবে বলব।'
-' আমার মালুম আছে পিসিমার যাবার কারণ। পূজা দিতে যাবেন। তবে ও ফুলবন্তীকে সাহাব বললে ও পূজা দিয়ে দেবে।'
-' আমি নিজে গিয়ে দেব রে।'
-' আচ্ছা মা অত ভাবনা নেই আমি যাই গিয়েই পুজো দিয়ে দেব। মামিমা চল এবার মামু রাগ করবেন।'
শৈলপুত্রী হঠাৎই নটরাজকে বলে,' সাহাবজী আপনি কবে যাবেন? আমার কিছু কাম ছিল।'
নটরাজ বুঝতে পারে কাজটা কি হয়ত শৈলপুত্রীর সেটা জানা যে নটরাজ ঠিক পৌঁছে দেয় মিঠাই জিনিসপত্র ওর হয়ে সবাইকে।
-' সামনে রবিবার যাব অনেকদিন ছুটি নিয়েছি বাবা এখন ভালো আছে। কি বাবা তাই না?'
টুকরো কথার মাঝেই শৈলপুত্রীর সাথে রেবা পা বাড়ান বাড়ির পথে। গাড়িতে ওঠার আগে নটরাজ বলে,' আপনার কি কাম আছে বললেন না তো?'
-' হাঁ একটু সামান পাঠাতাম। আমি জানি আপনি আমার নাম করে অনেক জিনিস দিয়েছেন।'
নটরাজ হাসে,' উপায় ছিল না যে নিজেকে অলক্ষ্মী ভাবে সে তো ওদের দুর্গা তাই দশ হাতে না হলেও দুই হাতে আমি একটু দিয়েছি।'
শৈলপুত্রী হাসে,রেবাও হাসেন। কতদিন ছেলেটাকে এমন হাসিখুশি দেখেননি। আজ আবার কতদিন বাদে সব যেন আগের মত।
রেবা হাত নাড়েন,' যাবার আগে আসিস। মামুর সাথে দেখা করে যাস।'
-' আমি শনিবার যাব ওকে বোলো সব গুছিয়ে রাখতে।'
অদ্ভুত একটা ভালোলাগা নিয়ে নটরাজ ওপরে উঠে আসে। অনেক দিনের আড়ি আড়ি খেলাটা খেলে মনটা খুব ভারী ছিল আজ ভাব হয়ে যাওয়াতে মন হাল্কা। তবে কিছু অনুভূতি একান্ত ব্যক্তিগত তাই এই আনন্দটাও সেই জমানো কষ্টটার মত মনে রেখে দিল নটরাজ। অনেকটা রাত পর্যন্ত ঘুম এল না নটরাজের। শনিবারের অপেক্ষায় দিন গোণা শুরু হল।
সেদিন প্রায় পুরো রাতটাই জেগে কাটল শৈলরও কারণ আঁকাটা শেষ করতেই হবে। অপূর্বকে রেবা সবটা বললেন। অপূর্ব শুনে বললেন,' বেবি যে কত বুদ্ধিমতী তা লাবণ্য জানে না। শেষ পর্যন্ত ওরই জয় হল।'
পরের দুদিন খুব ব্যস্ততায় কাটল শৈলপুত্রীর অনেকগুলো কাজ আছে সেগুলো করে নিয়ে জমা দিতে হবে। তারপর ওদের একটা বড় ওয়ার্কশপ চন্দননগরে হচ্ছে একদম গঙ্গার ধারে। তার মধ্যেই দেওঘরে পাঠানোর জিনিস কিনে সব গুছিয়ে রাখে একটা চিঠি লেখে ফুলবন্তীকে। পূজা দিতে বলে মন্দিরে।
শনিবার বিকেলে নটরাজ আসে আগেই বলেছিল আসবে। কিছুক্ষণ গল্প করার পর জিজ্ঞেস করে শৈলপুত্রীর কথা...' মামু সে কোথায়? আমাকে দিয়ে কি সব পাঠাবে বলছিল।'
-' সব গুছিয়ে গেছে ভাগ্যিস তুই বললি অবশ্য তোর মামিমা মনে করিয়ে দিত। ও তো চন্দননগরে চলে গেছে গতকাল ওখানে ওয়ার্কশপ চলছে না? তাই তো মেয়েটা রাত জেগে সব সামলালো। আগামীকাল ফিরবে।'
নটরাজের হঠাৎই মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। রাগও হয় কেমন যেন তারপরেই বলে,' কার সাথে গেছে সুশোভন বাবুর সাথে?'
-' হ্যাঁ রে সুশোভন আছে বলেই তো ভরসা। ওর সাথেই ফিরবে কাল। ওখানে অনেক ছাত্রছাত্রীরা আছে তো তাই চিন্তা নেই।'
রেবা একটা প্যাকেট এনে নটরাজের হাতে দেন,' এতে সব গুছিয়ে গেছে আর বারবার বলে গেছে তোর সাথে দেখা হল না সেই কথা। আর হ্যাঁ এই চিঠিতে সব লেখা আছে। এটা ফুলবন্তীকে দিস ও যদি না পড়তে পারে ভালো করে একটু বুঝিয়ে দিস।'
খুব রাগ হয় এবার নটরাজের,' ফুলবন্তীকে বাংলায় চিঠি! আর আমি পড়বই বা কেন? মানে অন্যের চিঠি।'
-' রাগ করিস না বাবা মনে হয় হিন্দীতে লিখেছে দেখ না খুলে একবার। দাঁড়া আমি দেখছি।'
নটরাজ বাড়ি ফিরে এসেছে শৈলপুত্রীর লেখা চিঠিটা বিছানায় শুয়ে দেখে বারবারই। সুন্দর হাতের লেখাতে লেখা হিন্দীতেই। তাতে অনেকবারই সাহাবজী ঠাঁই পেয়েছেন। নটরাজের মনটা একটু ভালো হয়ে যায়। চিঠিটা বুক পকেটে রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।
***************
নটরাজের ঘুমের ঘোরে শৈলপুত্রী আসে আজ বারবার। স্বপ্নেরা বারবার হাঁটে প্রথম আলাপের গলিপথে। দেওঘরের ক্ষেতের মাঝের বাড়িটাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক আত্মসম্মানী মেয়ে বারবার উঁকি দেয় মনের খোলা জানলায়। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায় নটরাজের বারান্দায় দাঁড়ায় আনমনে আজই ওকে চলে যেতে হবে কিন্তু হঠাৎই মন খারাপ হয় নটরাজের। যেতেই হবে অফিসের কাজ সুতরাং কিছুই করার নেই। লাবণ্যর মনটাও খারাপ লাগে ছেলেটা থাকাতে অনেকখানি সাহস ছিল। যদিও এখন অনেক ভালো আছেন নটরাজের বাবা।
তাড়াতাড়ি করে খেয়েদেয়ে বেরোয় নটরাজ বাবাকে বারবার সাবধানে থাকতে বলে। তবে হাওড়া স্টেশনে এসে হঠাৎই মনটা বাউন্ডুলে হয়ে ওঠে চট করে ঠিক করে নেয় কি করবে। বোধহয় মন যা চায় তাই করা উচিত অন্ততঃ নটরাজ সেই মুহূর্তে নিজেকে সেটাই বোঝালো।
গঙ্গার ধারটা চিনে নিয়ে চন্দননগরে আসতে অসুবিধা হল না নটরাজের। এই শহরে এর আগেও সে এসেছে জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতে। তবে হঠাৎই নেওয়া সিদ্ধান্তে এবার একটু নিজের লজ্জা লাগে বুঝতে পারে না কেমন করে নিজেকে ম্যানেজ করবে। অথচ মনটা হঠাৎই এমন পাগলামি করে বসল যে আর পারল না। গঙ্গার ধারের পার্কটাতে চোখ যায় নটরাজের। অনেকেই সেখানে আঁকাতে ব্যস্ত। কিন্তু যাকে দেখবে বলে এতদূর ছুটে এসেছে সে কোথায়? তবে কি ও ফিরে গেছে নাকি? আর যদি দেখা হয় তাহলেই বা কি বলবে? তাহলে কি কাউকে জিজ্ঞেস করবে?
এবার নিজেকে সত্যি বোকা মনে হয়। হঠাৎই চলে এল বাড়িতেও কেউ জানল না। সত্যি কি শৈলপুত্রী ওকে ছুঁয়ে আছে সবসময়?
-' আরে সাহাবজী,আপনি এখানে! আমি তো ভাবতেই পারছি না। সত্যিই হঠাৎই চলে এলাম এখানে। মা ঐ চিঠ্ঠি দিয়েছে না?'
-' হ্যাঁ দিয়েছে। আসলে আমার একটা কাজ ছিল এখানে তাই ভাবলাম এটা সেরে নিয়ে একেবারে যাব। অফিস তো কাল তার মধ্যে ঠিক পৌঁছে যাব। অবশ্য মা জানে না। এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। তারপর ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে যাই।'
-' মা বলেছে আমাদের গঙ্গার পাড়ে আছে ওয়ার্কশপ তাই না? আসুন এদিকে।'
-' আপনি কোথায় গেছিলেন?'
-' আমি স্যারের জন্য একটু চা বলতে গেছিলাম। আসুন আপনার সাথে স্যারের আলাপ করিয়ে দিই।'
-' এখানে আর কেউ নেই? আপনাকে চা আনতে হচ্ছে।'
-' স্যার আমার ছবিতে ফিনিশিং দিচ্ছেন তাই বলছিলেন এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করছে। রাস্তায় আমার ভি বহত খেয়াল রেখেছেন স্যার।'
নটরাজ শৈলপুত্রীকে তাকিয়ে দেখে গঙ্গার হাওয়াতে ওর অবাধ্য চুলগুলো আরও ফুলে ফেঁপে উঠেছে। চোখে কাজল পরেছে শৈলপুত্রী আর ঠোঁট সাদা কপালে লম্বা টিপ পরনে তাঁতের শাড়ি। আজ ওকে আরও বেশি ভালো লাগছে দেখতে।
কথা বলতে বলতে ওরা একদম পার্কের শেষ মাথায় এসে পৌঁচেছে। একটা ছবিতে মনোযোগ দিয়ে আঁকছেন এক ভদ্রলোক। মাথায় কাঁচাপাকা চুল আর দাড়ি। নটরাজের বুঝতে বাকি থাকে না এই সুশোভন। তবে শৈলপুত্রীর পাশে ওকে মানায় না। অনেকটা বয়স্ক তো ভদ্রলোক। মামা তো সুশোভন বলেই অস্থির।
-' স্যার এই সাহাবজী আছেন ও দেওঘরে যেখানে আমি থাকতাম।'
ছবি আঁকতে আঁকতে মুখ তোলেন সুশোভন,' বুঝেছি এই সাহাবজী তোমার দেওঘরের সাহাব হলেও আপনি তো নটরাজ মানে শৈলপুত্রীর আবিষ্কর্তা। আপনার কথা অনেক শুনেছি।'
-' শ্যামা আমি একাই চা খাব? ওর জন্যও চা বলে আয়।'
শ্যামা নামটা ওর মুখে শুনে রাগ হল নটরাজের কি আশ্চর্যজনক শ্যামা ছাড়া আর ডাক নেই মুখে।
-' আপনি কি এখানেই এসেছেন?'
-' হ্যাঁ এক বন্ধুর বাড়িতে এসেছিলাম ভাবলাম একবার দেখে যাই ওয়ার্কশপ।'
-' খুব ভালো করেছেন চলুন সবার সাথে আপনার আলাপ করিয়ে দিই।'
বেশ কিছুটা সময় কেটে যায় এভাবেই। নটরাজের মন আগের মত এখনও ছুঁয়ে যায় শৈলপুত্রীর আঁকা দেখে কি অসাধারণ দোলের দৃশ্য বন্দি করেছে ক্যানভাসের মাঝে।
-' এই ছবিটা খুব সুন্দর।'
-' এটা দোলের দিন এঁকেছি মন খারাপ ছিল তাই সব রঙ ঢেলে দিয়েছি ছবিটাতেই।'
নটরাজ ওর কথা বুঝতে পারে তবে কিছু বলতে পারে না ভাবে আজ তাই তো শৈলপুত্রীর মুখের হাসিটা দেখবে বলে ছুটে এসেছে এতদূর। দেওঘরে যাবার আগে হয়ত এইটুকু ছোঁয়া মনে মেখেই কাটিয়ে দেবে আবার দুটো দিন।
ঘড়ি দেখে নটরাজ ওকে এবার বেরোতে হবে। শৈলপুত্রী কিছুক্ষণ নিজের খেয়ালে কথা বলে তারপর সবাইকে ওর ভালোবাসা জানায় আর সব শেষে বলে,' সাহাবজী নিজের খেয়াল রাখবেন। পিসিমার চিন্তা হয় আপনার জন্য। সাবধানে যাবেন।'
নটরাজের হিংসে হয় সুশোভনের ওপর লোকটা শ্যামা শ্যামা করে মাথা খারাপ করছে আবার এক সাথে ওর গাড়িতেই ফিরবে শৈলপুত্রী।
নটরাজ হাত নেড়ে যেতে যেতে বলে যায়,' আমি পৌঁছে ফোন করব,কথা হবে।'
নটরাজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় শৈলপুত্রী ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজের কাজে। মনে থেকে যায় একটা হাল্কা ভালোলাগার রেশ। নিজেকে সংযত করে শৈলপুত্রী ওর মত অভাগা মেয়ের কাছে এটাই অনেক কিছু।
কলকাতা ফিরে আঙ্কেলজী আর মায়ের সাথে গল্প করতে করতে নটরাজের কথা বলে ফেলে হঠাৎই শৈলপুত্রী তারপরেই সাবধান হয় যখন রেবা জিজ্ঞেস করেন,' কি বলছিস? নাটু গেছিল ওখানে?'
-' হাঁ মা হঠাৎই নাকি বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গেছিল ওরা জোর করে নিয়ে গেছে তবে অল্প সময়ের জন্য আবার ফিরে গেলেন। তুমি পিসিমার কাছে বোল না।'
রেবা অপূর্বর দিকে তাকান, দেখেন তাঁর মুখে হাল্কা হাসি। অপূর্ব বলেন,' কেন নাটু তোকে বুঝি না করেছে?'
-' না মা বলল হঠাৎই চলে এসেছেন পিসিমার জানা নেই।'
রেবা হেসে ফেলেন এবার,' সে যাক গে ভালো করেছে তোর সাথে দেখা করে গেল। আবার কবে আসবে কে জানে?'
শৈলপুত্রী কাজের জন্য চলে যায় অন্য ঘরে। অপূর্বকে রেবা বলেন,' কি মামু ভাগ্নের খবর কি?'
-' জ্বরে ভুগছে মনে হয়। তবে এই জ্বর না বাড়তে দেওয়াই ভালো। লাবণ্যর মনে একটা খটকা তো ছিলই।'
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন সেদিন দুপুরে বসে হঠাৎই আশার কথা মনে হয় লাবণ্যর। অনেকটা বিষ মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন আশা। শৈলপুত্রীর চেষ্টায় তা আবার অমৃতের মতই সুন্দর হয়েছে। বৌদি বলেছিল আশা ভালো নেই। একটা কি খবর নেবে? কেন যেন লাবণ্য ফোন করে ফেললেন।
ফোনের আওয়াজ শুনে কান পাতেন আশা। নিজে ভালো থাকতে আগে ফোন ধরা কাজ ছিল। এখন টুকরো কথা কানে আসে। ছেলে বৌরা কেউই বাড়িতে নেই আজ আয়াও ছুটি নিয়েছে তাই মালতীর মা গিয়ে ফোন ধরে। লাবণ্যর কথা শুনে একটুখানি ভয় পায় কে জানে কি বলবে। আগে গিয়ে শুনে এসেছে এর জন্যই নতুন বৌ বাড়ি ছেড়েছে।
লাবণ্য আশার কথা শুনে অবাক হয়ে যান। এত অসুস্থ আশা? হয়ত একেই বলে মানুষের দশা কখন কেমন হবে কেউ বলতে পারে না কখনও হাতি আবার কখনও মশা। মালতীর মা ফোনটা এনে কানে দেয় 'নাও তোমার বন্ধু লাবণ্য দিদি।কথা বলবে?'
আশা মাথা নাড়েন কি কথা বলবেন আর কে বা বুঝবে?
স্বামীর কাছে আশার কথা বলেন লাবণ্য। মণিময় বলেন,' ফোনে খবর নিয়েছ ঠিকই আছে। এক শৈল যাবার পর ওদের দুর্দশা শুরু হয়েছে আর আমাদের বাড়িতে আসার পর আমরা ভালো আছি। আসলে মানুষ বড় স্বার্থপর লাবণ্য। হয়ত আমি তুমিও।'
*****************
মামুর ওখানে ফোন করে নটরাজ এখন ওর বেডরুমে ফোন সুতরাং অফিসের ফোনের ভরসায় থাকতে হয় না ইচ্ছে হলেই বাড়িতে বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে পারে। বেশ কিছুটা সময় কথা বলার পর নটরাজ বলে মামুকে,' শৈলপুত্রীর কি খবর মামু? এত জিনিস পাঠালো কোন খবর নিল না?'
অপূর্ব বোঝেন নটরাজের ইচ্ছে বেবির সাথে কথা বলার কিন্তু সে তো এখানে নেই বিনু নিয়ে গেছে তাকে। তাই বলেন,' সে ঐ বাড়িতে বিনুর সাথে চলে গেল। কয়েকদিন থাকবে ওখানে আচ্ছা এলে কথা বলিস।'
অপূর্বর আজকাল মনে হয় নটরাজ মানসিক ভাবে বেশি জড়িয়ে পড়ছে শৈলপুত্রীর সাথে। কিন্তু আর কোন অশান্তি তিনি চান না। রেবারও তাই মত। সেদিন রেবাই বলছিল,' বেবি যদি চায় আবার ওর বিয়ের জন্য ভাবা যায়।'
' হ্যাঁ আমিও ভেবেছি। আচ্ছা সুশোভনের সাথে কথা বললে কেমন হয়? অবশ্য বেবিকে জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে।'
-' সুশোভন কি বিয়ে করবে নাকি?'
-' রেবা পার্বতীকে দেখে শিবেরও পণ ভঙ্গ হয়েছিল আর সুশোভন কোন ছাড়। দুজনেই ভালো আঁকে মেয়েটার অযত্ন হবে না। তুমি যদি বেবিকে জিজ্ঞেস কর আমি কথা বলতে পারি।'
-' সে ঠিক আছে তবে বেবি কি রাজি হবে?'
***************
সেদিন স্যারের সাথে কয়েকটা আঁকায় ফিনিশিং টাচ দিতে বেশ দেরি হয়ে গেছিল শৈলপুত্রীর ওর সাথে অবশ্য অনেকেই ছিল। আর দু চারদিন বাদেই ওদের কলেজে একটা বড় প্রোগ্ৰাম আছে সুতরাং বাড়তি সময় থাকতে হচ্ছে কলেজে পর। স্যার অবশ্য আরও পরে যাবেন। তবুও ওকে এবার ফিরতে হবে রাতের কলকাতা খুব অচেনা শৈলপুত্রীর একা একা চলাচল করার তেমন অভ্যেস নেই সুশোভন অবশ্য বলছিলেন একা যেতে পারবে কি না? নাহলে একটু অপেক্ষা করতে। যাক তবে ওর দিকে যাবে এমন দুজনকে পেয়ে তাদের সাথেই পা বাড়ায় শৈলপুত্রী। যথারীতি ওরা বায়না করে ভীষণ খিদে পেয়েছে একটু খেয়ে যাবে। না করলেও ছাড় পেল না। ওরাই বলল,' এই শোন সবসময় এত ভালো মেয়ে হয়ে থাকতে নেই আজ একটু খাবি আমাদের সাথে তাতে মিশ্রার জাত যাবে না।'
-' আরে সেই বাত না আমি বাইরের খাবার তেমন খাই না।'
-' আজ খাবি আমাদের সাথে। কিছু হবে না।'
পার্কস্ট্রীটে একটা রেস্তোরাঁয় এসেছে ওরা। শৈলপুত্রীর অস্বস্তি হয় কেমন যেন। তবুও কিছু করার নেই তাড়াতাড়ি ফেরার বদলে উল্টে দেরিই হয়ে যাবে। ওরা গল্প করছে খাবার অর্ডার দিয়ে শৈলপুত্রীর হঠাৎই নজর পড়ে যায় একটা কোণের টেবিলে গল্পে মত্ত দুজনের দিকে। চিনতে অসুবিধা হয় না শৈলপুত্রীর ওহ্ সানন্দা তবে সঙ্গে একজন অপরিচিত কেউ আদিত্য নয়। সানন্দা হেসে গড়িয়ে পড়ছে ভদ্রলোক ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছেন বারবার। হঠাৎই কেমন যেন দমবন্ধ লাগে ওর। ওখান থেকে তক্ষুণি চলে যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু পারে না।
ইচ্ছে না থাকলেও গাঁইয়া শৈলপুত্রীকে আবিষ্কার করে আধুনিক রেস্তোরাঁয় সানন্দা আর সানন্দাকে অন্য কারও সাথে দেখে শৈলপুত্রী। শৈলপুত্রী কাউকে কিছু না বললেও সানন্দা নিজেরটুকু গোপন করে আদিত্যর কাছে বলে,' দিনে দিনে আর কত কি দেখতে হবে কে জানে?'
আদিত্য কোন কথা বলে না আজকাল সানন্দার বাঁকা কথা ওরও অসহ্য লাগে শুনতে। আদিত্যকে কিছু না বলতে দেখে বলে,' শৈলপুত্রীকে দেখলাম আজ চেনাই তো যায় না তাকে একদম উড়ে বেড়াচ্ছে তিন চারটে ছেলের সাথে।'
আদিত্য পাশ কাটিয়ে বলে,' তুমি কার সাথে গেছিলে চৌধুরী?'
সানন্দা কথাটা শুনে অবাক হয়ে যায় এতটা আগুন ধরানোর চেষ্টা করল অথচ আদিত্য এত শান্ত! কোন মাথা ব্যথা নেই ওর আবার উল্টে ওকেই বলছে!
-' যা বললাম সেটা কানে গেল না কি গেল না? তুমি হঠাৎই আমাকে নিয়ে পড়লে কেন?'
আদিত্যর মনে জমে থাকা থাকা রাগ বেরিয়ে আসে,' আমার অতীতের দিকে আর তাকিয়ে কি করব বর্তমানের কথাই তো ভেবে কূল পাচ্ছি না। যার সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে তার কথা শুনে কি করব? যে এক বিছানায় শুয়ে আমাকে ঠকাচ্ছে তার কথাই এখন ভাবছি।'
আদিত্য ডিভোর্সী, ওর গয়না নিয়ে নিয়েছে এই সমস্ত কথা বলে সারাক্ষণই ওকে হেনস্থা করে সানন্দা আজ আদিত্যর কথা শুনে অবাক হয়ে গেল। তবুও হার মানল না,' তোমরা আমাকে ঠকাও নি। একসাথে বৌয়ের সাথে শুয়ে আমাকে কাজে লাগিয়েছ। সব গয়না ওর পরিয়ে আমাকে অপমান করেছ। বেশ করেছি যার সাথে ইচ্ছে যাব।'
-' আমি তোমাকে কাজে লাগিয়েছি! না তুমি একজন বিবাহিত মানুষের জীবনে এসেছিলে সব জেনেশুনেই। দিনের পর দিন আমাকে লোভ দেখিয়েছ।'
-' তুমি কি বাচ্চা নাকি? যে লোভ দেখাব।'
-' বাচ্চা নই তবে অন্ধ ছিলাম তাই একবারও ভাবিনি যে অনায়াসে পরের ঘর ভাঙতে পারে। মানে সুপুরুষ বড়লোক দেখলে যার কোন মাথার ঠিক থাকে না সে এমন কাজ পরেও করতে পারে। এটা একটা নেশা।'
-' তুমি আজ শৈলপুত্রীর সম্বন্ধে একটা কথাও না বলে আমাকে অপমান করলে? ওর জন্য আজ এত অশান্তি বাড়িতে। মা অসুস্থ।'
-' ওর জন্য নয়,যখনই আমরা ওর কোন ক্ষতি করতে চেয়েছি উল্টে আমাদের ক্ষতি হয়েছে। হয়ত কোন অভিশাপ ঝরে পড়ে আমাদের ওপর।'
-' তোমাদের ন্যাকামো বন্ধ কর। একসময়ে মেয়েটাকে মেরেছিলে তুমি। ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলে। মনে পড়ে?'
-' হ্যাঁ মনে পড়ে তাই তো এই ঘরটা এত বিষাক্ত হয়ে গেছে আমাদের দুজনের কাছে।'
কথাতে কথা বাড়তে লাগল,অশান্তি ছড়িয়ে পড়ল বাড়ির পরিবেশেও। মধু উঠে দরজায় দাঁড়ায় সানন্দাকে আজকাল ওরও সহ্য হয় না উঠতে বসতে চাকরির গরম।
-' রাতে ঘুমোতেও দেবে না এরা নিত্য অশান্তি।'
-' ভাই কথা বলে তাই অশান্তি আমি চুপচাপ তাই কোন অশান্তি নেই শুধু সহ্য করে যাচ্ছি সব। কি যে হয়ে গেল? দরজায় না দাঁড়িয়ে চুপ করে শুয়ে পড়। কেউ কম নয় এখানে।'
আজকাল দেবের কথা অসহ্য লাগে মধুরও আগে এখানে কোন তুলনা ছিল না এখন কথায় কথায় শৈলপুত্রীর সাথে তুলনা হয়। বাবা যে কী সর্বনাশ করে গেছেন! তবে বিছানায় শুয়ে ভাবে সানন্দা হয়ত সে ভালো ছিল সানন্দার তুলনায় ওর মত দেমাক ছিল না। তারপরেই হঠাৎ মনে হল তুলনা তো সেও করছে।
বেশ কয়েকদিন এই বাড়িতেই আছে শৈলপুত্রী আঙ্কেলজী বলেন ওখানেই থাকতে তবুও একবার যে বাড়িটাতে ওকে রাখা হয়েছিল সেখানেই একলা ঘরে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে একটু বেশি। শৈলপুত্রী জানে সবাই হয়ত তার চারপাশএ আছে কিন্তু মনের কথা বলার মত কেউ নেই। সংসারে স্বাধীনতা থাকলেও সবাইকে খুশি রেখেই ওকে চলতে হয়। এখানে বাবা মা নেই যাদের ওপর মান অভিমান করতে পারে। তবুও ও বেঁচে আছে অনেকটা সম্মান নিয়েই আছে এমন সৌভাগ্য কার হয়? কলকাতা তে থেকে আর্ট কলেজে পড়ছে। কাজই এখন তার বন্ধু তাই কাজেই মুক্তি খোঁজে শৈলপুত্রী। আর এখানে এই একাকীত্ব টুকু ভরিয়ে রাখে কাজে।
দেওঘরে আসার পর মামুর সাথে কথা হলেও একবারও শৈলপুত্রীর সাথে কথা হয়নি নটরাজের। মনে হয়েছে বারবার ও কথা বলতে চাইলেও সে চায় না কথা বলতে অথচ নিশ্চয় মামু বলেছে ও ফোনে জিজ্ঞেস করছিল শৈলপুত্রীর কথা। তবুও একবার ফোন করতে পারত? ফুলবন্তী আগে ফোন করলে বলত। এখন সে আর বলে না কিছু। মনে মনে শৈলপুত্রীকে মিস্ করে নটরাজ।
তবে হঠাৎই শৈলপুত্রীর সাথে কথা বলার সুযোগ এল একদিন সেদিন সকালের দিকেই ফোন করেছিল। মামুই বলললেন,' তুই একদিন বেবিকে খুঁজছিলি না আজ সে এসেছে। দাঁড়া দেখি কি করছে সে। আসলে তোর মামিমা ওকে নিয়ে পড়েছে।'
-' আজ কলেজে যায়নি? এখন তো..'
-' হ্যাঁ যাবে একটু বেলাতে এখন চারদিন ওদের ফেস্ট নানা গুণীজন সমাবেশ হবে। তার সাথে প্রদর্শনী। আমিও যাব একদিন। সুশোভন বলেছে পাগলীটাকে একটু সাজিয়ে পাঠাতে। তাই তো...'
ওহ্ আবার সুশোভন!
-' হ্যাঁ মামু আমি এখন রাখছি ভালো থেকো তোমরা।'
-' বেবিকে ডাকব না? কি কথা ছিল বলছিলি?'
-' পরে বলব মামু,এমন কোন জরুরী কথা নয়। এখন উনি ব্যস্ত আছেন।'
-' হ্যাঁ তা ঠিক,সুশোভন আসবে একটু বাদেই ওকে নিতে।'
নটরাজের আর শুনতে ভালো লাগে না অভিমান হয় খুব ফোনটা রেখে দেয়।
প্রথম দিনের পর আর রেবাকে বলতে হয়নি নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়েই গেছে শৈলপুত্রী। বুঝতে পারে নিজেকে গুছিয়ে রাখাটাও বোধহয় জরুরী। সাধারণ মানুষের চোখে বোধহয় বাইরের পলিশটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হয়ত এটা যদি আগে বুঝতে পারত তাহলে আর কথায় কথায় অপমানিত হতে হত না তাকে।
-' যাক এতদিনে আমি নিশ্চিন্ত এই তো কি সুন্দর করে নিজেকে সাজাতে শিখেছিস। খুব খুশি আমি। বুঝেছ এই মেয়ে পারে সব কিছু শুধু কিছু করতে চায় না।'
-' রেবা শিল্পীরা একটু এলোমেলো হয় এমন কি আর করবে? যেমন তোমার বর তেমনি এই মেয়ে। আমরা সুন্দরের স্রষ্টা নিজেরা সুন্দর হতে চাই না। সৃষ্টিতেই আমাদের আনন্দ। ও হ্যাঁ নটরাজ কাল ফোন করেছে তোকে ডাকব ভাবলাম কিন্তু তুই বেরোবি শুনে বলল থাক। কিছু বোধহয় বলত।'
শৈলপুত্রী পরিণত আর বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা আরও পরিণত করেছে ওকে। কলেজে যাতায়াতের পথে বাসে ট্রামে নানা মানুষের সাথে তার দেখা হয়। কলেজের বন্ধুদের সাথেও কথা হয়। হয়ত সে চুপচাপ বেশি কথা ইচ্ছে করেই বলে না শোনে সবটা তবুও পুরুষের চোখ সে চেনে। প্রথম দেওঘরে দেখা সাহাবজী বদলেছেন এখন। সাহাবজী ওকে দেখতে চান আর কথা বলতে চান। হয়ত পিসিমার আচরণে পরিবর্তন হয়েছে তবে সাহাবজীকে নিজের মনটুকু খুলে দিয়ে তার সাথে হৃদয় বিনিময়ের সুযোগ কখনই দেবে না ও। নাহ্ কিছু একটা ভাবতে হবে হয়ত এবার। যদি একটা কাজ পেয়ে দূরে চলে যেতে পারত..
-' কি ভাবছিস এত? যা এবার ফ্রেশ হয়ে নে খেতে খেতে কথা হবে।' রেবা বলায় ঘরের দিকে পা বাড়ায় শৈলপুত্রী। জামাকাপড় ছেড়ে এসে একসাথে খেতে বসে ওরা। এই কদিন এখান থেকেই যাচ্ছে ও কলেজে।
খাবার রেবাকে পরিবেশন করতে দেয় না রাতে শৈলপুত্রী নিজেই খেতে দেয় বললেই বলে,' রাতে আমি খাবার দেব তোমরা খাবে। দিনে তো তুমি দিচ্ছই খেতে রাতে আমি দেব তোমরা খাবে।'
-' এই জন্য তো তোকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না মনে হয় একদম কাছে রেখে দিই।'
-' রেবা নিয়ে নাও মেয়ের আদর যত খুশি আবার কোথায় চলে যাবে তখন তোমাকে কে খেতে দেবে? সারাজীবন তো ভাত বেড়েই খেলে।'
-' এখানেই তো থাকতে হবে। কোথায় আবার যাব?'
-' বাহ রে আমরা মেয়ের বিয়ে দেব না? শ্বশুরবাড়ি হবে না তোর? একটা সঙ্গী তো দরকার।' অপূর্ব বলেন।
রেবা আর অপূর্ব দুজনেই তখন শৈলপুত্রীকে দেখছেন ওর মুখের রেখা বদলায় নাকি?
শৈলপুত্রী নিজেকে হীমশীতল রাখে। এক মুহূর্তে ভেবে নেয় কি বলবে। হয়ত এই কথাটা সে নিজেও ভেবেছে। একটা সময় গিয়ে একজন সঙ্গীর দরকার হয়ত হয় সবারই তারপর নিজের মনে হয়েছে আঁকা নিয়ে কাটিয়ে দেবে সময়টা। অনেক অনেক সৃষ্টি করবে।
শৈলপুত্রী খিলখিলিয়ে হাসে। হাসির শেষে একটা বিষাদের সুর বাজে
-' আমার সাথী তো আছেই সে আমাকে খুব ভালোবাসা দেয় কত কথা বলে। রাত জেগে বাতচিত হয় আমাদের।'
রেবা না বুঝলেও অপূর্ব বুঝে মুচকি হাসেন,'বুঝলে রেবা কার সাথে বাতচিত চলে?'
-' বুঝব না তোমার হাসিতে আরও বুঝেছি তোমার যার সাথে ভাব ভালোবাসা ওরও তেমন আর কি। ঐ রাত জেগে যত কথা তোমাদের সৃষ্টির সাথে।'
- আরে ধর এমন একজন কেউ এল মানে আমরা পেলাম যে তোর মতই ছবিকে ভালোবাসে। যার অবসর কাটে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছবি এঁকে অথবা রাত জেগে ছবির সাথে কথা বলে। দুজনের প্রেম যদি এক হয় তাহলে ভালো হবে। আর সেখানে তুই নিজের বাড়ির মতই থাকবি। তুই আর তোর ছবি ছাড়া সেখানে একজন থাকবে। দেখা হবে তোদের ছবি টাঙানো ঝুল বারান্দায়।'
অপূর্বর কথা সবাই বুঝতে পারে শৈলপুত্রী তখনও নীরব মন দিয়ে বাটিতে তরকারি ঢালছে। কিন্তু ভেতরটা কাঁপে একবার। সত্যিই তো আঙ্কেলজী হয়ত ঠিকই বলছেন কিন্তু আবার বিয়ে? আর সাহাবজী যদি? না না তা হয় না পিসিমা সইতে পারবেন না। এক শাশুড়ির নিঃশ্বাস ওকে ঘরছাড়া করেছিল আর কাউকে দুঃখ দিয়ে সে কিছু করতে পারবে না।
একটা কিছু ভাবতে হবে ওকে। নটরাজের চোখে এবার অনুরাগের ছোঁয়া দেখেছে শৈলপুত্রী তা ভালোবাসার আগুন হয়ে জ্বলে ওঠার আগেই ওকে সরে যেতে হবে।
-' তুমি কার কথা বলছ মেয়ের জন্য? আমাকে মা বলে আমিও একটু শুনি। না সবই তোমার কল্পনা?'
নটরাজের চোখের ভাষা মনের ইচ্ছে অপূর্ব নিজেও পড়েছেন ভয় তিনি নিজেও পেয়েছেন। মেয়ে হয়ে জন্মাবার অনেক জ্বালা। তাই আগুনটা জ্বলে ওঠার আগেই তাতে জল ঢালতে চান তিনি। কারণ আবার লাবণ্য....নাহ্।
-' আমি সুশোভনের কথা বলছিলাম। একটু বয়েস হয়েছে। মা বাবা ভাইবোন কেউ নেই একাই থাকে। হয়ত অভিভাবক নেই বলে আর ভাবা হয়নি কিছু। তাই প্রথম প্রেম নিয়েই আছে। যদি তুমি বল তাহলে আমি একবার...'
শৈলপুত্রীর দিকে তাকান ওঁরা খুব চুপচাপ লাগে ওকে যেন অন্য জগতে আছে।
-' আমি কি বলব? সুশোভন ভালো ছেলে বেবিকে পছন্দ করে ও তাছাড়া একা থাকে। কি রে বেবি? কি বলব? কথা বলবে?'
শৈলপুত্রী শুধু বলে..' মা আমাকে একটু সময় দাও।'
**************
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। একদিন সুশোভন বাড়িতে অপূর্ব নিজেই গিয়েছিলেন রেবার সাথে।
বিয়ের ব্যাপারে বেবিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন রেবা অদ্ভুত উত্তর দিয়েছিল বেবি বলেছিল সে একলা থাকতে চায়। আর নিজের জীবনে কাউকে এনে জটিলতা বাড়াতে চায় না। যদি এখানেও সুখ না আসে? তারপর ছাত্রী শিক্ষকের সম্পর্কে অযথা জটিলতা এনে সবার সুযোগ এসে যাবে কথা বলার। তাই নতুন করে এ ব্যাপারে আর কিছুই ভাবতে চায় না।
-' মা আমার হবে না সংসার কেন শুধু তোমরা চেষ্টা করছ। স্যারকে আমি সম্মান করি তার মধ্যে এই কথা না আনাই ভালো। আমি পড়াশোনা শেষ করে কিছু একটা কাম পেয়ে যাব তারপর একলা থাকব।'
-' সারাজীবন কী একলা থাকা যায়? কাউকে একজন লাগে মা সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতে। সুশোভনের সাথে যদি তুই বলিস আমি কথা বলব। না হলে নয়।'
কয়েকদিন আবার সময় নিয়েছিল শৈলপুত্রী কিন্তু কিছুতেই হ্যাঁ বলতে পারছিল না। কেন সেটা হয়ত নিজেও বুঝতে পারেনি অনেকবার ভেবে। তার মধ্যেই একদিন সুশোভনের আমন্ত্রণে ওর ওখানে গেছিলেন ওঁরা। সুন্দর ছবির মত সাজানো ঘর বারান্দা সুশোভনের। নিজের ইচ্ছেমত রঙ তুলির আঁচড়ে সাজিয়েছে বারান্দা,ছাদ আর দেওয়াল।
কথায় কথায় অনেক কথা জানতে পারেন রেবা। খুব কষ্ট করে বড় হয়েছে অনেক ছোটবেলায় বাবা মাকে হারিয়েছে। তারপর নিজের বড় হবার ক্ষেত্রে অপূর্বর অবদান বারবারই বলছে। ওর কাঁধে হাত রাখেন অপূর্ব,' তোমাদের মধ্যেই আমি নিজেকে দেখতে পাই। আমার সবটা জুড়ে আছে আমার সৃষ্টি পরিবার আর ছাত্রছাত্রীরা।'
-' ছোটবেলায় কষ্ট করেছ এখন তো এখানে একদম একা থাকো সংসার করার কথা ভাব নি কখনও? কেউ একজন সাথে থাকলে ভালো হত মনে হয়নি?'
হাসে সুশোভন রেবা দেখেন হাসিটা একটু করুণ অথচ মিস্টি।
-' নাহ সেভাব কখনও ভাবিনি আসলে আমরা শিল্পীরা এমনিতেই বাউন্ডুলে সেরকম নাম না করলে পাত্তাই পাওয়া যায় না। মেয়েরা ভয় পায় বিয়ে করতে এই করতে করতে দেরি হয়ে গেল তারপর চাকরি পেয়েছি অনেক দেরিতে স্যার সবটাই জানেন।'
-' হ্যাঁ এক অবস্থা আমারও প্রথম বয়েসে প্রেমে পড়া তারপর যথারীতি শিল্পী মাটির পুতুল গড়ি বলে ধাক্কা খাওয়া তারপর আবার বানভাসি নৌকায় করে ভাসতে ভাসতে হঠাৎই নোঙর বাঁধা রেবার ঘাটে। তবে রেবার শীতলতা শান্ত স্বভাব বুদ্ধি সবই বোধহয় খুব দরকার ছিল আমার মত বাউন্ডুলে অথচ পেটুক শিল্পীর জন্য। এখন ভাবি জীবন কখনও বেস্ট কিছু ঠিক উপহার দেয়।'
অপূর্বর কথা শুনে রেবার এই বয়েসেও রক্তিম হয় গাল। নিজেকে আর অপূর্বকে ভালো রাখতে ইচ্ছে করে আরও ঐ সম্মানটুকু পেয়ে। এমন খোলামেলা করে কজন পুরুষ স্ত্রীকে সম্মান দিতে পারে? আসলে স্ত্রীকে সম্মান করলে তাঁর সম্বন্ধে ভালো কিছু বললে নিজের সম্মানও যে অনেকটা বেড়ে যায় তা হয়ত কম সংখ্যক পুরুষ বোঝে।
-' সত্যি আমাদের ম্যাডামের মত কজন হয় স্যার? তবে আপনার সম্ভার সবসময়ই মুক্তোগাঁথা। শৈলপুত্রীকে দেখেও তাই ভাবি। কি অদ্ভুত আগুন আছে মেয়েটার মধ্যে অথচ একদম শীতল নদী। আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে।'
-' ও মোটেও শীতল নয় সুশোভন। সাঙ্ঘাতিক দরকারে ঝগড়া মারামারি সব করতে পারে এমন কি পাঁচিল পেরোতেও পারে দরকারে গাছে উঠে।'
-' তুমি কিন্তু আমার বেবিকে শুধু শুধু ডানপিটে বলছ। অবশ্য বোধহয় সবার এমনি হওয়া উচিত। কিন্তু তবুও তো মেয়েটা কিছুই পেল না। আসলে একটা খুঁত খুঁজে বের করে সবাই ওকে..'
-' থাক ওসব কথা ম্যাডাম। শ্যামা মানে শৈলপুত্রী একদম আলাদা আসলে সবসময়েই ভালোরাই নিগৃহীত হয়। প্রতিভাকে বিকশিত করার সুযোগ দেওয়াই হয় না তাদের। তবে ভাবি এখন আমার সাথে যদি আরও দশবছর আগে ওর দেখা হত।'
সুশোভনের কথায় অপূর্ব হেসে ওঠেন,' তখন তো পুচকে ছিল মেয়েটা। কি করতে ওকে নিয়ে? হ্যাঁ আঁকাটা শেখানো যেত।'
সুশোভনের মুখে লালচে আভা ধরে হয়ত স্বপ্ন দেখে চোখদুটোও। কিন্তু অনেকগুলো বসন্ত পেরিয়ে এসেছে এখন আর শ্যামা অনেকটা ছোট। তবে স্যার আর ম্যাডাম কিসের জন্য বারবার ওর বিয়ের কথা বলছেন? এমন কথা তো আগে কখনও বলেননি। তবে কি শ্যামার সঙ্গে? শ্যামা সুশোভনের এই কয় বছরে পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সেরা একটু যত্ন নিলে অনেক দূর যেতে পারবে। তবে নিজের ব্যাপারে উদাসীন। এখনও চেনে না নিজেকে ভালো ভাবে?
রেবা আর ঢাকা চাপা করেন না চিরকাল স্পষ্টবক্তা। তাছাড়া কেন যেন সংসারে আরও অশান্তি হোক মেয়েটা কষ্ট পাক তা তিনি নিজেও চান না। নটরাজকে খুব অন্যরকম লাগে আজকাল বুঝতে পারেন শৈলর জন্য ওর দূর্বলতা বাড়ছে। কিন্তু লাবণ্যর বলা সেই কথাগুলো ভুলতে পারেন না। তাছাড়া হয়ত একমাত্র সন্তানকে নিয়ে লাবণ্যরও অনেক স্বপ্ন। তাই বলেন সুশোভন,' মনের মিল থাকলে বয়েসটা আটকায় না আমিও তো ওঁর চেয়ে নয় বছরের ছোট। মেয়েটা পাগল ঘর পোড়া গরু তো। তাই সবসময় বলে একা থাকবে। ওর কপালে নাকি সুখ নেই। আমরা আছি এখন কিন্তু পরে? তোমাদের স্যার আর নাটু না থাকলে ঐ গরুর দুধ দুইয়ে জীবন কেটে যেত। কখনও নিজেকে চেনাতেও কাউকে লাগে।'
অপূর্ব সুশোভনের দিকে তাকান,' আমাদের তোমার ওপর ভরসা আছে ঠকবে না মেয়েটা। দেখো কথা বলে একবার।'
-' আমি ভাবব স্যার। তাড়াহুড়ো কিছু নেই। সামনের মাসে হায়দ্রাবাদ যাব আমরা আপনি তো জানেন তখন ওকে জিজ্ঞাসা করব ভালো করে। ভেবে এগোতে হবে দুজনকেই কারও মনে যেন কালো রঙের আঁচড় না পড়ে।'
সুশোভন অনেক দিনের পরিচিত কিন্তু আজ যে সুশোভনের সাথে ওঁরা কথা বললেন সে যেন এক অন্য পুরুষ কত পরিণত আর পরিশীলিত। হয়ত এমন একজন অভিবাবক শৈলর দরকার। কিন্তু মেয়েটা রাজি হলে হয়।
মাঝে অনেকটা দেরিতে কলকাতা এলেও এবার মন বড় উচাটন নটরাজের। কলকাতা তাকে টানে খুব। তাছাড়া বাবাকে দেখতে যাওয়াও দরকার। মথুরাকে সেই কথা বলাতেই ও বলে,' অভি তো আয়ে বাবুজী। ফির যায়েঙ্গে ইতনে জলদি?'
রাগ হয় নটরাজের বাড়ি যাবে তো মথুরার কি? ফুলবন্তী শুনে বলে,' দিদি কো ভী সাথ মে লানা বাবুজী। উসকি ভী তো ছুট্টি হোগী কলেজ মে।'
অবাক হয়ে যায় নটরাজ কত খবর রাখে ফুলবন্তী। হ্যাঁ ঠিকই তো সামনে ছুটি থাকার কথা এইসময় আর কলেজে যাবার ঝামেলা থাকবে না। এবার মামুর ওখানে ওকে পাওয়া যাবে ঠিক। মনে মনে কত কি ভাবে নটরাজ। শৈলপুত্রীকে সাথে নিয়ে মন ঘুরে বেড়ায় কলকাতার গঙ্গার ধারে বা কোন একান্তে। তারপর ভাবে মেয়েটা তো রাম বুদ্ধু আর মোটা মাথা। ওকে কি করে বোঝাবে যে ওর সাথে একটা দিন প্রাণখুলে কথা বলতে চায়?
অফিসের কাজ সামলে মথুরাকে বুঝিয়ে ফুলবন্তীকে চাবি দিয়ে আবার ট্রেনে বসে নটরাজ। মনটা ছুটছে হু হু করে গাছপালার সাথেই। চা পকোড়া সব খেল বারবার। মনে হল অনেক পুরোনো কথা।
তাড়াতাড়ি আবার ছেলেকে পেয়ে মন ভরল লাবণ্যর। ও এলে অনেকটা নিশ্চিন্ত। বাবার চেকআপ ও আছে। মণিময় খুশি হন ছেলেকে দেখে। তবে ছেলেটা কেমন যেন চঞ্চল। নাহ এবার ওর একটা বিয়ে দেওয়া দরকার। চোখ বুজলে তো হয়ে যেত। বুঝিয়ে বলবেন কোন সময়ে।
মাকে মামুর কথা জিজ্ঞেস করে নটরাজ।
-' এসেছিল মামু মা?'
-' হ্যাঁ এসেছিল মাঝে একদিন দুজনেই। তুই আসছিস জানাসনি?'
-' না ওটা সারপ্রাইজ থাক কাল যাব তখন দেখবে।'
রাতে ঘুম আসতে কিছুটা দেরি হয় নটরাজের। বিকেলেই যাবে ঠিক করে কারণ সকালে বাড়িতে কিছু কাজ আছে।
-' মা আমি আসছি একেবারে মামুবাড়িতে ঘুরে আসব।'
ছেলের দিকে তাকান লাবণ্য আগের বার ছেলেটাকে নজর দিতে পারেননি। নিজের ছেলেকে দেখে ভালো লাগে নিজের। খুব সুন্দর মানিয়েছে নতুন আকাশী রঙের জামাটায়।
ভাগনেকে দেখে অপূর্ব সত্যিই অবাক হন,' আরে নাটু ভোলা ইতনে জলদি।'
-' ইশ মামু তোমরা কেউ কি খুশি হওনি? এরপর ছয় মাস বাদে আসব।'
-' খুব হ্যান্ডসাম লাগছে কিন্তু তোকে। ব্যাপার কি?'
-' মামু। মামিমাকে ডাকো আমি নালিশ করব তুমি লেগপুল করছ। আর তাকেও ডাকো ওর পুজোর প্রসাদ আছে চাচীর দেওয়া ঠেকুয়া আর ফুলবন্তীর পাঠানো চুড়ি।'
' দাঁড়া তোর মামিকে ডাকি তবে পেঁড়া আর ঠেকুয়া এবার আমিই খাব। কারণ সে তো নেই।'
-' কোথায় গেছে? আসবে তো খানিক বাদে। রুবিদির ওখানে নাকি? না কলেজে?'
-' ও হায়দ্রাবাদে গেছে রে সুশোভনের সাথে। ফিরবে প্রায় পনেরো দিন বাদে। তুই কখন এলি?'
ওদের কথার মাঝে কখন যে মামিমা এসেছেন বুঝতে পারেনি নটরাজ। তবে কথাটা গিয়ে হঠাৎই বুকের মাঝে ঘা মারল কেমন যেন একটা আশাভঙ্গে মনটা বিক্ষিপ্ত হল। হঠাৎই সব সাজানো ছবি এলোমেলো ছেঁড়া কাগজ হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে উড়তে লাগল চারদিকে। শুধু ওর জন্য কেন এমন হয়? সবই তো বেশ ঠিকমতো চলছিল,অথচ শৈলপুত্রী কি একবারও বোঝে না ওর মনটা একটু কথা বলতে চায় একলা ওর সাথে?
অপূর্বর দিকে রেবা তাকান নটরাজ নিজেকে সামলায়। মনের খারাপটা আর বাইরে প্রকাশ করতে চায় না। তাই বলে,' ওহ্ আচ্ছা। আগে জানলে ভালো হত। আসলে ওখানকার মানুষজন খুব আশা করে ওকে এইসব পাঠায়। একবার যদি ফোনে জানতে পারতাম।'
-' দেখেছ রেবা ছেলের কান্ড ও আসবে তা জানায়নি একবারও তবুও বলছে একবার যদি জানতাম। আরে ও নেই তো কি আছে,কিছুটা রেখে আমি খেয়ে নেব ওর নাম করে।'
মামার ছেলেমানুষীতে হাসে নটরাজও তবে মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে মনে হয় এখানে আসাটাই যেন বেকার হয়ে গেছে। নিজেকে শাসন করে নটরাজ। এটা চন্দননগরে যাওয়া নয় যে ইচ্ছেখুশি মত চলে যাবে। যেতে হবে রীতিমত হায়দ্রাবাদ না ইমপসিবল।
নটরাজের মুখটা দেখে অপূর্ব আর রেবা যেমন কিছু বোঝেন তেমনি লাবণ্য বলেন,' কি রে খাবি না কেন রাতে? ওখানেও তো তেমন কিছু খাসনি শুনলাম।'
-' মা আজ সত্যিই খিদে নেই কাল খাব রেখে দাও।'
রাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে নটরাজ কেন যেন কলকাতার দিনগুলো বড় ফিকে লাগে।
সুশোভনের হায়দ্রাবাদের দিনগুলো বড় রঙীন এবার। এই প্রথম ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এতটা দূরে এসেছে। সুশোভন ওদের স্যার তবুও অন্যদের তুলনায় ওর বয়েস কম বলে সবার সাথেই একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে দিব্যি। সবার বায়না আর আব্দার মেটাতেই দিন কেটে যাচ্ছে। যে সুশোভনের জীবনে বসন্তের রঙের ছোঁয়া লাগেনি কখনও তার দুইচোখ অনেক সময়ই আটকে যাচ্ছে শৈলপুত্রীর জোড়া ভুরু তে। কখনও বা একলা মন খেয়া বাইছে ওর ঝাঁকড়া চুলের কালো দীঘিতে।
তবে আর ভেতরের কথা মনের দেওয়ালে বাঁধতে চায় না সুশোভন। স্যার আর ম্যাডামের ইঙ্গিত ও বুঝেছে তাই শৈলপুত্রীকে যা বলবে তা সামনাসামনি বলবে। হয়ত স্যার ওর অনেক উপকার করেছেন তাই সত্যিটা না বলতে পারলেও নিশ্চয় সুশোভনকে বলতে পারবে। তাই ঠিক করে একদম খোলামেলা কথা বলবে ওর সাথে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে তাই জীবনে কোন আর তাড়াহুড়ো নেই ওর। শুধু একজন জীবনসঙ্গী হলে হয়ত ভালো হত। স্যারের কথা শুনে ভেবেছে কদিন। শৈলপুত্রী যদি রাজি থাকে তাহলে হয়ত বাকি পথটা ওর হাত ধরে হেঁটে একটু অন্য ভাবে জীবনটা কাটিয়ে দেবে।
নটরাজের মত সময় আর সঙ্কোচ নেই সুশোভনের তাই একদিন শৈলকে সাথে নিয়েই বেরোল কাজের ফাঁকে তারপর নিভৃতে শুনল সব কথা।
-' স্যার আমাকে বলেছেন তাই তোকে বলছি। আমি তোর স্যার তোর থেকে বেশ কিছু বড় বয়েসে। তোর আমার সাথে পথ চলতে যদি ইচ্ছে করে তাহলে বলিস। কোন তাড়া নেই আমার এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তুইও তাড়াহুড়ো করিস না। হ্যাঁ বললেও আমি লাফালাফি করব না কারণ তোকে আমি শুধু ছাত্রী হিসেবে ভালোবাসি।'
-' আর যদি না বলি?'
-' তাতেও আমি কষ্ট পাব না। আসলে কোনদিন এটা ভাবিনি তোকে আমি বিয়ে করব। তোর গুণ তোর প্রতিভা আমাকে মুগ্ধ করে। প্রেম সেখানে নেই,স্নেহ আছে। মায়া আছে অনেকটা।'
-' প্রেম না থাকলে সেই সম্পর্কে কি বাঁধন থাকবে
স্যার? ওটা শুধুই পাশে থাকা হবে। আর কিছু নয়। আসলে আমি তো কখনও এভাবে কারও ভালোবাসা পাইনি তাই বলছি।'
-' আপনি আমাকে যতটা ভালোবাসা দিয়েছেন সেটার সাথে প্রেমকে গুলিয়ে ফেলতে চাই না।'
সুশোভন হেসে ফেলেন বিরিয়ানী মুখে দিতে দিতে বিষম লাগে খুব। শৈলপুত্রী ব্যস্ত হয়ে উঠে পিঠে একটা ঘা মারে।
-' দেখেছিস তো আমি প্রেমিক হিসেবে কেমন খারাপ? ভেবেছিলাম হায়দ্রাবাদের নিজামের মত রঙ তুলির গোলাপ এঁকে তোকে প্রেমের কথা বলব। কিন্তু হল না লাভ। উল্টো হল মানে বিষম খেয়ে মরলাম। তবে এই পিঠে কিল মারার জন্যও তো বুড়ো বয়েসে কাউকে লাগবে। লজ্জা পায় শৈলপুত্রী কথাটা শুনে।'
-' আচ্ছা আমি একটু ভেবে বলব পরে স্যার।'
-' হ্যাঁ একদম ভেবে বলিস কোন তাড়া বা জোরজবরদস্তি নেই। আমি সিঙ্গেল থাকতেই অভ্যস্ত। প্রথম প্রেম নিয়ে বেশ আছি। ঐ স্যার ম্যাডামের কথা শুনে মনটা একটু উতলা হয়েছে। তবে আমাকে বোধহয় কেউ গালি দিচ্ছে। কে বলত? তুই না তো? এত জোরে বিষম খেলাম।'
নটরাজের সত্যি ঐ সুশোভন নামের মানুষটার ওপর খুব রাগ হচ্ছিল। কোন কান্ড নেই লোকটার ছুটিতেও ছাত্রদের নিয়ে কোথায় একটা দূরে চলে গেছে। সবটাই একটা চক্রান্ত বলে মনে হয় ওর। যেন মামু আর মামিমাও চান না ওর সাথে শৈলপুত্রীর দেখা হোক। আচ্ছা ওরা কি মাকে ভয় পেয়ে এমন করছে?
গতকাল রাতে অনেক কিছু ভেবেছে নটরাজ আর ভেবে এটাই বুঝতে পেরেছে ও শৈলপুত্রীর প্রেমে পড়েছে। শৈলপুত্রীকে ঘিরে যে ভালোলাগা ছিল তা হঠাৎই প্রেমে পরিণত হয়েছে কিছু করার নেই ওর নিজেরও। হয়ত শৈলপুত্রীর রূপ নেই তেমন তবুও তার শ্যামলা রঙে চারদিক আলো হয়। গুণের প্রদীপ জ্বালিয়ে আলো করে রেখেছে চার পাশের সবাইকে।
আচ্ছা এত ভয় পাচ্ছে কেন ও? মা বাবা আবার মেয়ে দেখতে যাবেন বলছেন। এবার বোধহয় মা বাবা মামু সবাইকে বলা উচিত ও যদি কখনও বিয়ে করে তবে শৈলপুত্রীকে করবে। আর না হলে নয়। তবে কি শৈলপুত্রীকে রাজি করানো যাবে? আজ পর্যন্ত যার সাথে একলা কথাই বলতে পারেনি তাকে আবার প্রেম নিবেদেন!
এলোমেলো চিন্তা নটরাজকে অস্থির করলেও ওকে ফিরে আসতে হয়েছে আবার দেওঘরে কাজের তাগিদে। তবে বেশ দিন কুড়ি বাদে যখন মামুকে ফোন করে আবার। তখন মামু বলেন,' আরে তুই আগের বার বেবির খোঁজ করছিলি না? সে এসেছে রে। অবশ্য পেঁড়া আমার পেটেই গেছে। নে কথা বল এবার।'
কথা বলতে গিয়ে দু তিনবার হোঁচট খেল নটরাজ অনেকদিন বাদে কথা বলছে। অথচ এই কথা বলার জন্য কত ছটফট করেছে।
-' সবাই ভালো আছে এখানে। তোমার কালীগাই ভালো আছে। ওর বাচ্চারা বড় হয়েছে। চাচা দেশে এসেছেন। তোমার একজিবিশন কেমন হল?'
-' খুব ভালো হয়েছে। অনেক কাজ করেছি। অনেক ফরেন ডেলিগেটস ছিলেন। স্যারের সাথে অনেক কাজ করলাম এবার। খুব খুশি সবাই আমরা। ওসব বাত থাক আপনি দেওঘরের গল্প বলুন।'
কথায় কথায় অনেকটা সময় চলে যায়। রেবা এসে দুবার দেখে গেছেন বেবিকে। মেয়েটা হাসছে চোখেমুখে খুশির আভা কই এমন হাসিখুশি সব সময় তো দেখতে পান না। বাড়িতেই এত ভালো একটা ছেলে থাকতে সুশোভনের কথা তাঁরা ভেবেছেন। অবশ্য উপায় নেই লাবণ্য যে আছে মাঝখানে।
নটরাজ ওর ফোন নম্বর শৈলপুত্রীকে দিয়ে বল,'ইচ্ছে হলে ফোন কোর। আমি তো বিকেলে ফাঁকাই থাকি।'
শৈলপুত্রী বলে,' আচ্ছা সময় হলে করব। আমার অভ্যেস নেই ফোন করার আচ্ছা দেখব। আপনি ভালো থাকবেন সাহাবজী।'
অনেকদিন বাদে আজ নটরাজের বন্ধ হওয়া দক্ষিণের জানলা খুলে গেছে আজ সশব্দে মনটা ভালো হয়ে যায় নটরাজের। নিজেই বিকেলের বাজার থেকে আনা চিকেনটা রাঁধতে রান্নাঘরে যায় সাথে মনটা গান গেয়ে ওঠে। তাই গাইতে থাকে ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে।
হায়দ্রাবাদে যাবার আগেই সুশোভন বলেছিলেন ওখানে কথা বলে নেবেন শ্যামার সাথে। শৈলপুত্রীকে জিজ্ঞেস করেন রেবা কোন কথা কি বলেছে সুশোভন?
-' কি কথা?'বলেছিল বলবে তোকে বুঝিয়ে ঘর বাঁধার কথা...
রেবাকে বলতে না দিয়ে শৈলপুত্রী বলে,' হ্যাঁ মা স্যার বলেছেন। এত তাড়া নেই তাও বলেছেন। আমি একটু সময় চাই মা। আমাকে তোমরা ভাবতে একটু সময় দাও।'
********************
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো দিন শৈলপুত্রীর ভাবনার মাঝে কেউই ওকে বিরক্ত করেনি। মেয়েটার বাবা মা নেই প্রথম সংসারটা হয়নি। তাই কখনও এমন যেন মনে না হয় ওকে ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই বাঁচেন রেবা আর অপূর্ব। একটা সময় ওকে চুপচাপ দেখে মনে হয়েছে কত মানুষই তো একা আছে নিজের ভালোলাগা সঙ্গী করে থাকবে এমনি শৈলপুত্রীও। ওর সবটুকু দেবে ওর আঁকাকে উজাড় করে।
হয়ত শৈলপুত্রীর নিজেরও তাই মনে হয়েছিল কারণ সুশোভনের থেকে আর কোন ইঙ্গিত কখনই ও পায়নি। সুশোভন আগলে রেখেছিল ছাত্রী শ্যামাকে আদরে শাসনে আর সৃষ্টিতে। শুধু কোন অবকাশে হঠাৎই মনে হত শ্যামার মনে হয়ত আছে অন্য কেউ বা ভুলতে পারেনি অতীতটাকে পুরোপুরি তাই ভাবুক ও সময় নিয়ে ভাবুক। যখন শৈলপুত্রীর গভীর চোখ দুটো ডুবে যেত রঙ তুলিতে পুরোপুরি তখন বুঝতে পারতেন শ্যামা শুধুই মগ্ন ওর সৃষ্টিতে। এর মধ্যে আরও দুটো একজিবিশন হয়ে গেছে। আঁকার জগতে অনেকেই শৈলপুত্রীকে চেনে। ম্যাগাজিনে ওর আঁকা বেরোয়। হঠাৎই আবার একদিন আদিত্যর চোখে পড়ল শৈলপুত্রীর সেই ছবি। তারপরই মনে হয় সেদিন শুধুই মেয়েটার জন্য মায়ের সাথে ঝগড়া করেছিল। দোষ তো আদিত্যর কখনও চিনতে চায়নি শৈলপুত্রীকে। হয়ত পুরুষের নজরে প্রথমেই পড়ে নারীর রূপ,তারপর কালের কালো আঁচড়ে তা হয় মলিন কিন্তু গুণের ঘষামাজা হলে তা হয় চিরস্থায়ী। শৈলপুত্রীকে চেনার চেষ্টাই করেনি কখনও।
এর মধ্যে হঠাৎই মালতীর মা মাসি এসেছিল। শৈলপুত্রীকে দেখে খুব খুশি হয়ে বলে,' আজ তোমাকে অনেক ভালো দেখছি নতুন বৌ,না না নতুন বৌ না মেয়ে। নিজের ভুল শোধরায় মালতীর মা মাসি তবে শৈলপুত্রীর কাছে আসার কারণ বলাতে অবাক হয়ে গেল শৈলপুত্রী। হয়ত মনে মনে ক্ষমা করে দিল তাঁকে আজ যে মানুষটা কথায় কথায় ওর দোষ ধরত আর অপমান করত। সংসার করাও হয়নি তাঁর জন্য ওঁর তবুও ভাবে সেই শাস্তি ভগবান ওঁকে দিয়েছেন। নিজের মত করে ভেবে আর কারও কোন ক্ষতি চায় না শৈলপুত্রী
-' বৌদি ভালো করে কথা কইতে পারে না গোঙায়। তবে আমড়ার টকের ডাল মানে যেমন তুমি করতে আর কুচো মাছের চচ্চড়ি খেতে চাইছে কদিন হল। একসময় আমারেও খিটখিট করছে এখন বড় মায়া হয় গো দেখেশুনে।'
-' আমি শিখিয়ে দেব মানে বলে দেব করে খাইয়ো অসুস্থ মানুষ।'
- আমি করে দিয়েছি গো কিন্তু পছন্দ হয়নি। একটু খেয়ে আর খায়নি। তুমি যদি...'
মালতীর মাকে আর কিছু বলতে হয় না। শৈলপুত্রী বোঝে অসুস্থ মানুষের মন রাখতে এতদূর ছুটে এসেছে মানুষটা। মালতীর মাকে একটু বসিয়ে রেখে সব রান্না করে পাঠায় শৈলপুত্রী একদিন। তারপর মাথার দিব্যি দেয় ও যে বানিয়ে দিয়েছে তা যেন কেউ জানতে না পারে। এ বাড়ির লোকজন জানতে পারলেও কথা শুনতে হবে ওকে এমনকি রেবাও রাগ করবেন খুব।
-' আমি বলি নাকি? আমারেও তো তাহলে ঢুকতে দেবে না। বলব আমিই করে খাইয়েছি।'
-' কিন্তু কেউ যদি দেখে ফেলে তোমাকে খাবার নিয়ে ঢুকছ তখন?'
-' ও আমি সামলে নেব গো। বড় কষ্ট পাচ্ছে বেচারা বৌদিমণি। আমিও কষ্ট পাই দেখে। ভগবানের দয়া ঠিক হবে তোমার ওপর।'
মালতীর মায়ের কথার অত হিসেব মেলাতে পারে না শৈলপুত্রী তাই চুপ করে থাকে।
তবে এই কথাটা রুবির কাছ থেকে রেবার কাণেও যায় বকুনি খায় শৈলপুত্রী। ' মালতীর মা অতদূর থেকে ছুটে এসেছে এই জন্যে! আর তুই রেঁধে দিলি! ওরা যদি জানতে পারে? তোকে অসম্মান করে? বলে ওর মাকে খারাপ খাবার খাওয়াচ্ছিস তুই ক্ষতি করার জন্য।'
-' আমি সত্যিই অত ভাবিনি। ঠিক বলেছ তুমি,হ্যাঁ রান্না করে দিলাম গো। আসলে মালতীর মা ওঁর কষ্ট দেখতে পারছে না।'
-' যা খুশি কর আমাকে কিছু বলিস না। এভাবে নিজেকে আর কত ছোট করবি শুনি? যে যা বলছে শুনছিস। শুধু সুশোভনের কথাটা শুনিস না দেখছি কিছুই।'
-' মা স্যার কিছু বলেছেন? আমি কোন দোষ করেছি?'
-' কিছু বলেনি আমাকে। সে অন্যরকম ছেলে তবে আমি নিজেই বুঝতে পারছি। হ্যাঁ রে হায়দ্রাবাদে কিছু বলেছে সুশোভন?
মাথা নীচু করে শৈল,' হ্যাঁ মা বলেছেন স্যার তবে তেমন কিছু নয়। স্যারও আমার মতই মা। আমরা দুজনেই ছবি নিয়ে থাকতেই ভালোবাসি।'
-' আমরা জানি তো তাই তো ভেবেছি একরকম স্বভাবের মানুষের মনের মিল হয়। তোরা যদি ভালো থাকতে পারিস।'
রেবার কথা শৈলপুত্রীকে ছুঁয়ে গেলেও তার মনের দ্বিধা কাটল না পুরোপুরি। কি বলবে সুশোভনকে ভেবে পেল না। তবে শৈল আর সুশোভনের সম্পর্ক বাধ্য ছাত্রী আর অভিজ্ঞ মাস্টারমশাইয়ের মতই থাকল। বন্ধুরা হাসাহাসি করল,' নাহ্ এদের প্রেমটা হবে না মনে হয় বুঝলি। দুটোই কেমন যেন পাগল। শুধু ছবিগুলো প্রেমে প্রেমে ভরা। ভালোবাসার রঙে মাখামাখি। শ্যামা বলে কি গম্ভীর ডাক দেন স্যার শুনেছিস?'
-' আরে রীতিমত বকাঝকা করে মানে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বকুনি দেয় ওকে।'
সবার জল্পনা কল্পনা চলল কিন্তু প্রেমটা অদ্ভুতভাবে সুশোভনের কল্পনাতেই থাকল বাইরে সে কড়া শিক্ষক সেজেই রইল।
কলেজ থেকে ফিরেছে শৈলপুত্রী এই কদিন সে রুবিদির দোতলায় থাকছে। এখানে একা থাকতে তার বেশ লাগে,নিজের মত কল্পনার আঁচড়ে সাজায় ক্যানভাস। টুকটাক রান্না করে খায় আর মাঝে মাঝে টিনের বাক্স খুলে দেখে তার ফেলে আসা অতীতের স্মৃতি কত কথা বলে বাবার সাথে। সেদিনও এক একলা সন্ধ্যেতে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসে শৈলপুত্রী হঠাৎই বিনু ডাকে নীচ থেকে,' ও দিদি একবার এসো ছুটে তোমার জরুরী ফোন।'
বাক্সের ডালা চাপা দিয়ে ছুটে যায় শৈলপুত্রী নীচে নিশ্চয় আঙ্কেলজী ফোন করেছেন কদিন ও যায়নি ঐ বাড়িতে তাই হয়ত বকুনি দেবে।
তবে ফোন ধরে চমকে ওঠে শৈলপুত্রী সাহাব যে এখানে ফোন করতে পারে ও ভাবেনি। সাহাব কোথা থেকে এখানকার নম্বর পেয়েছে? ওকে হঠাৎই কেন ফোন করছে?
শৈলপুত্রীর গলাটা শুনে ভালো লাগে নটরাজের মাঝেমধ্যে ফোন করে মামুর কাছে কিন্তু শৈলপুত্রীকে পায় না কখনই। মাঝেমধ্যে মনে হয় হয়ত ইচ্ছে করেই ওঁরা বলেন যে ও এখানে নেই। তাই সেদিন হঠাৎই বলেছিল ওর একটু ফোন নম্বরটা দরকার। বিশেষ কথা আছে শৈলপুত্রীর সঙ্গে। অপূর্ব রেবার দিকে তাকান রেবা কি বলবেন আর সুতরাং কথা বলার আর কোন দরকার নেই।
নটরাজের ফোন পেয়ে অবাক হয়ে যায় শৈলপুত্রী সাহাব যে এরকম একটা প্রস্তাব দিতে পারে সে কথা ও ভাবেনি।
নটরাজ বলে,' আমি কলকাতা যাচ্ছি আপনার সাথে দেখা দেখা করতে চাই একবার। তাই ফোন করলাম।'
শৈলপুত্রী হেসে ফেলে,' দেখা তো হবে সাহাব আমি আছি তো এখন। এর মধ্যে আমার কোন কাম নেই এখানেই থাকব। আপনি আসুন। ওহ্ এইজন্য আমাকে ফোন করেছেন?'
-' আমি একটা দিন আপনার সাথে একটু দেখা করব তবে বাড়িতে নয় অন্য কোথাও। সেই সময়টা আপনি দিতে পারবেন তো?'
শৈলপুত্রীর গালে রাঙা আভা লাগে কী বলবে ভেবে পায় না। একটা দুশ্চিন্তার মেঘ হঠাৎই উঁকি দেয় মনের আনাচে কানাচে। এত সোজাসুজি কথা বলতে কখনও শোনেনি এর আগে সাহাবকে সুতরাং কেমন যেন ভয় হয় শৈলপুত্রীর। মনে পড়ে যায় পিসিমার বলা কথাগুলো। হয়ত পরিস্থিতি ঠিক হয়ে গেছে কিন্তু মানুষের মন?
নটরাজ অনেক কথা বলে যাচ্ছে একটু চুপচাপ শৈলপুত্রী। সবার কথা জিজ্ঞেস করে। তারপর জেনে নেয় নটরাজ কবে আসছে।
-' আমি আসার আগে আবার একদিন ফোন করব। আর এখানে এসেও আপনাকে জানিয়ে দেব কবে দেখা করব।'
ঠান্ডা গলায় শৈলপুত্রী বলে,' আমার মনে থাকবে সাহাব। এটা তো রুবিদির ফোন এখানে ফোন না করাই ভালো। আমি আপনার সাথে দেখা করে নেব। আপনি আঙ্কেলজীর বাড়িতে আসবেন তো?'
-' আসব তো? কিন্তু ওখানে নয় আমি অন্য কোথাও।'
-' আচ্ছা আপনি আসুন তো তারপর কথা হবে। ভালো থাকবেন সাহাব আমার একটু কাম আছে এখন রাখি।'
নটরাজ অবাক হয়ে যায় শৈলপুত্রীর কথা শুনে। অদ্ভুত ঠান্ডা ব্যবহার ওর। ফোন করতেও আর বারণ করল কিন্তু মামুর বাড়িতে ওর সাথে কথা বলবে কি করে? একটু একলা চাই শৈলপুত্রীকে। সত্যিই আর ভালো লাগছে না। যখনই যাচ্ছে তখনই একটা না একটা কারণে ওকে আটকে যেতে হচ্ছে। অথচ শৈলপুত্রীর মনটা জানা খুব দরকার। ওর হয়ত ছবি আঁকা আছে কিন্তু তাড়াতাড়ি এভাবে ফোনটা রেখে দিল? নিজেকে কেন যেন ঠিক রাখতে পারে না নটরাজ।
তবে এখনও কলকাতা যেতে বেশ কয়েকটা দিন বাকি আছে। অনেকটা স্বপ্নের জাল বুনে দিন কেটে যায় নটরাজের। মনে মনে উড়ে যায় শৈলপুত্রীকে নিয়ে কত জায়গায় অথচ আবার হঠাৎই মনে হয় হয়ত শৈলপুত্রী আছে এই দেওঘরেই কোথাও। প্রতাপ আর ফুলবন্তীকে দিয়ে নিজের থাকার জায়গাটা সুন্দর করে সাজায় নটরাজ। ফুলবন্তী জিজ্ঞেস করে 'কোই আয়েগা ক্যায়া সাহাব?'
নটরাজ হাসে,' আয়েগা কৌন? অ্যায়সে..'
-' সাহাব এক মেমসাব লে আইয়ে অব। আপ কো দেখভাল করেগী ও আচ্ছে সে।'
নটরাজ ডুবে যায় হঠাৎই নিজের চিন্তায় একটু হেসে। কিন্তু হঠাৎই সেই চিন্তার মধ্যে উঁকি মারে একটা মুখ মা...
শৈলপুত্রীকে নিয়ে এই কদিনে নটরাজ অনেক কিছু ভেবেছে। কিন্তু মা কী রাজি হবে?
- কিন্তু কেন হবে না? মা একবারও ওর মনটা দেখবে না? নাহ্ এবার গিয়ে মা বাবার সাথে কথা বলবে ও। কলকাতা যাবার আগে বাবা বৈদ্যনাথের কাছে পুজোও দেবে। অফিসের কাজেও ঠিকমত মন দিতে পারে না নটরাজ। বারবারই অবাধ্য মন ঘুরে বেড়ায় কলকাতার গলিপথে কখনও আর্ট কলেজের সামনের পথে।
কলেজ ছুটির পর সেদিন রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল শৈলপুত্রী আজ ওর বেরোতে বেশ দেরি হয়েছে। অনেকগুলো কাজ ছিল। তারপর হয়ত ইচ্ছে করেই দেরি করেছে স্যারের সাথে একটু কথা বলবে বলে। ও জানে স্যার প্রতিদিন একবার লক্ষ্য করেন ওর বেরোনোর পথে দরকারে ওকে তুলে নেন গাড়িতে তারপর পৌঁছে দেন।
শৈলপুত্রীকে দেখে যথারীতি সুশোভন গাড়িতে উঠে আসতে বলে।
-' আজ কোথায় নামবি শ্যামা?'
শৈলপুত্রী জানায় ও রুবিদির বাড়িতেই নামবে। সুশোভন নিজের মনে কথা বলে যান গাড়ি চালাতে চালাতে শৈলপুত্রীর কথাগুলো কানে ঢোকে না তেমন করে। ওর ভাবনা তখন অন্য পথে চলছে।
-' কি রে এত চুপচাপ কেন? পরীক্ষার চিন্তায় নাকি?'
-' হ্যাঁ একটু চিন্তা হচ্ছে। আচ্ছা স্যার আমি আপনাকে একটা জবাব দিতে চেয়েছিলাম সময় নিয়ে। সেটার জন্য যদি একদিন আপনার বাড়িতে যাই তাহলে নিয়ে যাবেন?'
সুশোভন হঠাৎই স্টিয়ারিংটা হাতে চেপে ধরে শক্ত করে কেমন যেন একটা ঝাঁকুনি হল শরীরে। বইটা খুলেই ভেবেছিল আর পড়া হবে না এই বই হঠাৎই সেই অধ্যায়গুলো আবার খুলছে কেন? নিজেকে হঠাৎই নার্ভাস লাগে। এতদিন কখনও ভাবেননি জীবনে কেউ আসুক। আজ হঠাৎই আবার যেন মনে একটা অকাল বসন্তের হাতছানি। নিজেকে সামলায় আবার।
ততক্ষণে চলে এসেছে প্রায় ওরা। নামার আগে সুশোভন বলে,' হ্যাঁ বাড়িটা দেখাও খুব দরকার। কবে যাবি? আমি তোকে সেদিন চিকেন রোস্ট খাওয়াব।'
-' নেহি স্যার সেদিন আমি রান্না করব,আপনি খাবেন। সবসময় তো একলাই খান। একদিন আমি রান্না করে খাওয়াব।'
সুশোভন স্বপ্ন দেখেন তাঁর ছবি দিয়ে সাজানো অন্দরে শৈলপুত্রীর রান্নার সুবাস ভাসছে।
******************
গতকাল কলকাতা এসেছে নটরাজ। পরদিন যথারীতি মামুর ওখানে গেছে। পেঁড়া পেয়ে মামু খুব খুশি। মামিমাও অনেক রান্না করে রেখেছেন। আজকাল একাই আসে ও কারণ মা বাবাকে ছেড়ে আসতে পারে না অবশ্য বাবা এখন অনেক ভালো আছেন। নটরাজের চোখ আজ শৈলপুত্রীকে খোঁজে না কারণ ও জানে শৈলপুত্রীকে কোথায় পাওয়া যাবে। বাইরে থেকে একবার ফোন করে কথা বলে নেবে শৈলপুত্রীর সাথে। রবিবার শৈলপুত্রীকে নিয়ে কোথাও একান্ত অবসরে বসে বলবে মনের কথা।
আগে কি মাকে বলবে? নটরাজের মনে দ্বিধা হয় না আগে শৈলপুত্রীর সাথে কথা বলে বাড়িতে জানাবে। মাকে রাজি হতেই হবে।
ও চলে যাবার পর রেবা অপূর্বকে বলেন,' আজ বেবির খোঁজ করল না নাটু? ওহ্ অবশ্য ওর কাছে ফোন নম্বর আছে।'
-' বেবি জানে রেবা কোথায় কি কথা বলতে হয় তাই নাটুর সাথে ঠিক কথা বলে নেবে ও। তবে আমার যেন কেমন একটা লাগছে।'
-' কি?'
-' জানি না,দেখি। নাটুটা এত ঘনঘন আসছে। কেমন যেন চঞ্চল ও। ও কি শৈলপুত্রীকে কিছু বলতে চায়?'
-' আমি লাবণ্যকে ভয় পাই। তুমি এ ব্যাপারে কোন কথা বলবে না।'
নটরাজ শৈলপুত্রীকে ফোন করে। বিনু ওকে ডেকে দেয়। বিনুর মুখে আলগা হাসি,এই নিয়ে নাটুদা তিন দিন ফোন করল। বেবিদিকে কেন খোঁজে নাটুদা কে জানে?
নটরাজের উচ্ছ্বলতার কাছে হার মানল শৈলপুত্রী অনেকটা অনিচ্ছাকৃত ধরা পড়ার মত। কথা হল নটরাজের সাথে দেখা করবে ও রবিবার তবে নটরাজকে দাঁড়াতে বলল রাস্তায়।
শনিবার অনেক রাত অবধি জেগে নটরাজ। তারপর ঘুমিয়ে পড়ে। রবিবার এগারোটা নাগাদ শৈলপুত্রীর বলা জায়গাটায় অপেক্ষা করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে নটরাজ। কি এমন হল যে এত দেরি করছে মেয়েটা? প্রায় একঘন্টা অপেক্ষা করে অধৈর্য্য হয়ে নটরাজ পায়ে পায়ে রুবিদির বাড়ির কাছে এসে বেল বাজায়। বিনু দরজা খোলে খানিক বাদে।
-' নাটুদা এসো ভেতরে। বাবা কি সারপ্রাইজ গো!'
নটরাজের অস্বস্তি হয় তবুও বলে,' একটু শৈলপুত্রীকে ডাক না। বল যে আমি এসেছি।'
-' কে বেবি দি?'
-' হ্যাঁ'
-' কিন্তু দিদি তো বাড়ি নেই। কোথায় যেন একটা গেল বলল একদম রাতে ফিরবে।'
-' মানে কোথায় গেছে?'
-' দাঁড়াও দিদিকে জিজ্ঞেস করি,আসলে আমি ঘুমোচ্ছিলাম। তুমি এসো ভেতরে।'
-' না আমি আর যাব না তুই জেনে বল।'
-' আমি বলছি,ও সুশোভন স্যারের ওখানে গেছে আজ সারাদিন ওখানেই থাকবে। স্যারকে রান্না করে খাওয়াবে বলল।'
রুবিদির কথা শুনে মাথাটা গরম হয়ে যায় নটরাজের। শৈলপুত্রী কেন এমন করল? ওকে আসতে বলে চলে গেল? আগেই বারণ করে দিতে পারত।
মাংসটা ধরে গেল হঠাৎই, শৈলপুত্রীর মনটাও পুড়ল হঠাৎই। দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ গেল সাহাব নিশ্চয় ওর জন্য অপেক্ষা করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। সাহাবের সাথে কেন এমন করল? অথচ ওর কোন উপায় নেই। তখন নটরাজকে না বলার মত শক্তি যেমন ওর ছিল না তেমনি হ্যাঁ বলার মত সাহসও নেই। তাই তো ও পালিয়ে এসেছে। আজ স্যারকে ও বলে যাবে বিয়ে করতে ওর কোন আপত্তি নেই। তাতে সবাই খুশি হবে,হয়ত ও নিজেও বাঁচবে নতুন করে কোন ভুল করার হাত থেকে।
পোড়া মনে প্রলেপ লাগিয়ে স্যারের টেবিল গুছিয়ে রাখে শৈলপুত্রী। নটরাজের মত সুশোভন নয় সেট বোঝে ও। সাহাব এখনও চঞ্চল,অগোছালো হঠাৎই একট কান্ড করে বসতে পারেন। আর স্যারের সব সাজানো গোছানো,সুন্দর রুচির ছাপ সমস্ত জিনিসে।
-' আপনার ঘর কত সুন্দর করে সাজানো। কোথাও একটুও অগোছালো নেই।'
-' আমি যে শিল্পের পূজারী তাই একটু ভালোবাসার ছোঁয়া আমার অন্দরে।'
স্যারের সাথে কথায় কথায় অনেকটা সময় কেটে যায় শৈলপুত্রীর। সুশোভন জানে কিভাবে কথা বলতে হয় তাই আজ হয়ত শৈলপুত্রীর সমস্ত ব্যথা,দুঃখ আর আনন্দ উজাড় করে বলে স্যারের কাছে। সুশোভন একটু একটু করে সুশিক্ষকের মত ছাত্রীর মনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জেনে নেন সমস্ত কিছুই। শৈলপুত্রীর মনের ব্যথা যন্ত্রণা আর আশঙ্কার অংশীদার হয়ে বলেন,' ভয় পাস না আছি সবসময় তোর সাথে। নিজেকে একা ভেবে কষ্ট পাস না আমরা সবাই তোর ভালো চাই। অনেক এগিয়ে যা জীবনে। হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব তোকে।'
সেদিন স্যারের বাড়ি থেকে আঙ্কেলের কাছেই আসে শৈলপুত্রী রাত্রিটুকু থেকে অনেক গল্প করে ওঁদের সাথে। অবশ্য ওঁরা জানতেন সুশোভনের কাছে গিয়েছিল শৈলপুত্রী। তবে ওর মনটা ভারাক্রান্ত লাগে যতবার ভেবেছে নটরাজের কথা। আর হয়ত কোনদিনই সাহাব ওকে ক্ষমা করতে পারবে না। এরপর সামনাসামনি হলে কি করে মুখ দেখাবে নটরাজকে? অনেক আশা করে এসেছিলেন সাহাব।
শৈলপুত্রী সবটা বুঝতে পারে আর হয়ত সেই আশঙ্কাতেই স্যারের কাছে সবটা বলে এসেছে। বুঝতে পেরেছে বিয়ে করা ছাড়া ওর আর কোন উপায় নেই। শৈলপুত্রী মত দিয়েছে জেনে রেবার ভালো লাগে। অপূর্ব তেমন কিছু বলেন না শুধু বলেন,' এটা তো হবারই ছিল। বেবির মত মেয়েকে সবাই জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চাইবে। সুশোভন নিশ্চয় খুশি হবে।'
গতকাল মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে গেছে নটরাজের। খুব খুব রাগ আর অভিমান হয়েছে শৈলপুত্রীর ওপর। নিজেকে কি ভাবে মেয়েটা? আগেই বলতে পারত ওর অসুবিধা আছে। তাই বলে ওকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখে ও সুশোভনের বাড়িতে চলে গেছে! নাহ্ একবার ওকে জিজ্ঞেস করতেই হবে কেন এমন করেছে?
ছেলেকে দেখে চিন্তিত হন লাবণ্যও। এই তো গতকালই কত হাসিখুশি ছিল হঠাৎই কি হল?
রাতে শরীরটা খারাপ বলে তেমন কিছু খেল না নটরাজ। লাবণ্য মণিময়কে বলেন সে কথা।
-' ওর সাথে বন্ধুর মত কথা বল লাবণ্য মনে হয় কোন একটা গভীর সমস্যা হয়েছে।'
পরদিন নটরাজ ঠিক করে মামুকে সে বলবে তার মনের কথা। ছোটবেলা থেকে এই মানুষটার কাছে অনেক আবদার করেছে আজও নাহয় তাঁকেই প্রথম বলবে তার মনের ইচ্ছে। মামু ঠিক মাকে বলবে। তবে আগে শৈলপুত্রীর সাথে কথা বলতে হবে কেন এমন করল সে? সত্যিই বদলে গেছে শৈলপুত্রী। তবুও কেন যেন এখন ওর মুখটাই মনে ভাসছে সবসময় নটরাজের।
সকালে উঠেই মাকে ফিরতে দেরি হবে বলে বাড়ি থেকে বেরোয় নটরাজ। লাবণ্য অবাক হন ছেলের ব্যবহারে। গতকালই বেরিয়ে শরীর খারাপ নিয়ে এল আবার আজই যাবার কি দরকার ছিল? তাছাড়া আর দুদিন বাদেই তো চলে যাবে ও।
ও বাড়িতে গিয়ে মামু মামি কাউকে পায় না নটরাজ। জানতে পারে মামু একটু বাদেই আসবে আর মামিমা বেরিয়েছেন। অপেক্ষা করে নটরাজ। এ বাড়ি তার চেনা খুব। সুতরাং অসুবিধা নেই। শুধু অচেনা একজনের মন। কিছুক্ষণ বাদেই নটরাজ দেখতে পায় মামু আসছেন। কিভাবে কি বলবে একটু ভাবে নটরাজ। নিজের খুব অস্বস্তি হয় তবুও তাকে জানতেই হবে কি আছে শৈলপুত্রীর মনে। ও যখন বলতে পারছে না আর দেখা করতে চাইছে না তখন মামুর কাছেই সব জানতে হবে। আজ যা হবার তা হবে দেখাই যাক।
নটরাজকে দেখে খুশি হন অপূর্ব,' আরে নাটু! ভালো হয়েছে তোর মামিমাও নেই পুজো দিতে গেল দক্ষিণেশ্বরে বেবিকে সাথে নিয়ে। একটু গল্প করে বাঁচব তোর সাথে।'
এসে ওর নামটা শুনে বুঝল নটরাজ বেবির সুশোভন বাবুর বাড়ি যাওয়াটা জানেন এঁরা। ওখান থেকে এখানেই এসেছিল সে। তারপর গেছে মামিমার সাথে।
-' তুমি গেলেও তো পারতে। মামি হঠাৎ আজই গেল পুজো দিতে?'
-' আমি আর যাইনি,ওসব ভীড়ে আর পারি না তাছাড়া মা মেয়েতে গেছে আমার কী দরকার? তবে তুই গেলে ভালো হত। আরেকটু আগে এলে তোকেই পাঠিয়ে দিতাম। সকালে উঠেই শুনলাম রেবার ইচ্ছে হয়েছে পুজো দেবার।'
-' ও আচ্ছা। না আমি গিয়ে আর কী করতাম?'
কথাটা কী করে শুরু করবে ভাবে নটরাজ। তবে মামু কথার সূত্র ধরে দেন হঠাৎই।
-' তোর মামিমার মনটা ভালো আজ বুঝলি। বেবিটাকে কারও একটা সাথে সম্পর্কে বেঁধে দিতে পারলে আমরা খুশি হতাম। জানি সে গুণী কিন্তু তবুও সবার একটা সাথী লাগে। এতদিনে মেয়ে মত দিয়েছে অনেক ভেবে সুশোভনের সাথে বিয়েতে তার আপত্তি নেই।'
গলাটা হঠাৎই শুকিয়ে যায় নটরাজের। ওর ভালোমানুষ হবার ফল বোধহয় এই হল। নিজের কথাটুকু মা অসন্তুষ্ট হবে,কে কি ভাববে এই ভেবে নিজের মধ্যেই রেখে দিয়েছে। এতদিন শৈলপুত্রীর সাথে কথা বললে ওর ভালো লাগত এখন বুঝতে পারে তাকে ছাড়া সত্যিই ভালো থাকা অসম্ভব। অদ্ভুত ভাবে দেওঘরে দেখি মেয়েটা ওর জীবনে জড়িয়ে গেছে। কি করবে ও ভেবে পায় না।
-' ও তাই মামিমা গেছেন পুজো দিতে?'
-' হ্যাঁ মনে হয় তাই হবে। আসলে মেয়েটার কোন সাথী থাকবে না আমরা এই পৃথিবীতে না থাকলে সেটা আমাদের খুব ভাবাত। তাই আজ মনটা অনেকটা হাল্কা।'
অপূর্ব হাল্কা বললেও হাল্কা হতে পারেন না কেন যেন মনে হয়েছে মেয়েটা বাধ্য হয়ে কাজটা করছে। তবুও ওঁদের মনে হয়েছে একটা কেউ হোক ভালোমন্দ শেয়ার করার মত ওর জীবনেও।
নটরাজের কেমন যেন অসহায় লাগে মামুকে বলে আর কি হবে এখন? সবই তো শেষ হয়ে গেল। কিন্তু না উপায় একটা বের করতে হবেই। শৈলপুত্রীর কিছুতেই সুশোভনবাবুর সাথে বিয়ে হতে পারে না। ততক্ষণে মুহূর্তে মোটামুটি ঠিক করে নেয় কি করবে ও।
ঘড়ি দেখে নটরাজ মনে মনে ঠিক করে নেয় কি করবে ও।
মামু নিজের মনেই অনেক কথা বলে যাচ্ছেন তারপর হঠাৎই ওর দিকে তাকিয়ে বলেন,' তুই কিছু ভাবছিস নাকি? এমন লাগছে কেন দেখতে তোকে? শরীর ঠিক নেই নাকি?'
-' হ্যাঁ কাল খুব মাথা যন্ত্রণা ছিল। আজ ঠিক আছি।'
-' তুই থাক কিছুক্ষণ রেবা এলে যাস বরং।'
-' না মামা আজ অতটা সময় থাকা হবে না। আচ্ছা সুশোভন বাবুর বাড়িটা কোথায়?'
অপূর্ব অবাক হয়ে যান ওর কথা শুনে।
-' সুশোভনের খোঁজ করছিস কেন হঠাৎই?'
-' না মামু এমনি আমাদের শৈলপুত্রীর ঠিকানা কোথায় হবে তা জিজ্ঞেস করছিলাম। আমাকে তো বলতে হবে দেওঘরে। জানই তো আমি গেলেই ফুলবন্তী চাচী বাচ্চাগুলো সবাই আসে। ওরা খুব ভালোবাসে ওকে।'
-' আরে খুব একটা দূর নয় কাছাকাছি। একদম সহজেই পাওয়া যায় ওদের বাড়ি। হরিহরণের তো চিনতেও হবে। মাঝেমধ্যে আসে তো বিটিয়াকে দেখতে।'
অপূর্ব কথায় কথায় জায়গাটা জেনে নেয়। কলকাতা শহরের মোটামুটি পুরো মানচিত্র ওর জানা সুতরাং খুব একটা অসুবিধা হবে না।
মামুর কাছ থেকে খানিক বাদে একটু কাজ আছে বলে চলে যায় নটরাজ। ঠিকানাটা আবার মনে মনে মিলিয়ে নেয়। তারপর ঠিক করে কি করবে এখন।
*******************
মামু যা বলেছিলেন সেই রাস্তায় চলে আসে নটরাজ। এদিক ওদিক তাকাতেই চোখে পড়ে যায় বাড়িটা। সুন্দর সাজানো গোছানো ছিমছাম একতলা বাড়ি দেখেই মনে হয় এই বাড়িতে যিনি থাকেন তার রুচি পছন্দ একটু অন্যরকম আর সকলের তুলনায়। শিল্পের ছোঁয়ায় সেজেছে বাড়িটা। গাছের সমারোহ সারা বাড়ি জুড়ে আর সেই আকর্ষণে এসেছে পাখিরা। সামনে একটা বড় শিমুলের গাছ তাতে ধরেছে লাল ফুল। নটরাজ অবাক হয়ে দেখে বোধহয় বসন্ত আসছে কাছেই তাই লাল লাল ফুল ফুটেছে গাছে। বাড়ির সামনের বোর্ডটা দেখে নটরাজ। গেটটা খোলা যাবে কি না ভাবে একটু। তারপর ঢুকে পড়ে। বাগানের গাছের সারি ওর ভালো লাগে। মনে মনে ভাবে শৈলপুত্রীর হয়ত এইসব দেখেই পছন্দ হয়েছে। কিন্তু সে যাই হোক এই বিয়েটা সে হতে দিতে পারে না। নিজেকে বেপোরায়া আর উদ্ধত মনে হয় আজ নটরাজের তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সব রাগ গিয়ে পড়ে শৈলপুত্রীর ওপর। ও দেখা করতে চাইল অথচ ওকে কথা দিয়েও শৈলপুত্রী এল না। এর শাস্তি ওকে পেতেই হবে। সুশোভন বাবুকে ও বলবে সবটা মানে ওর মনের কথা। আর শৈলপুত্রী যে মায়ের কথাতেই ওকে অ্যাভয়েড করেছে সেটাও বলবে। কিন্তু ওকে পছন্দ করে নিশ্চয়।
গেট খোলার আওয়াজ পেয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় সুশোভন। নটরাজকে দেখেছে ও আগে,পরিচয়ও হয়েছে সুতরাং স্বভাবের মাধুর্যে হাসিমুখেই স্বাগত জানায়,' আমি জানতাম আপনি আসবেন তবে আজই বাড়িতে আসবেন তা ভাবিনি। ভেবেছিলাম হয়ত কলেজে কখনও দেখা হবে আমাদের। লাকিলি আমি আজ বাড়িতে নাহলে ফিরে যেতে হত আপনাকে।'
-' আপনি জানতেন আমি আসব? কে বলেছে আপনাকে?'
-' কে আবার বলবে? আমার মন বলেছে। আসুন আসুন স্বাগতম এই ব্যাচেলার শিল্পীর কুঁড়েঘরে। চায়ের জলটা শুকিয়ে গেল বোধহয়। আরেকটু বসিয়ে দিই চা খাবেন তো? নাকি কফি?'
-' আপনি সব একাই করেন?'
-' হ্যাঁ একাই করি তো। একা থাকার যে কি সুখ! তবে আর বোধহয় বেশিদিন এই সুখ ভোগ করা হবে না। আসুন আসুন।'
সুশোভনের শেষ কথাগুলো ঝড় তোলে নটরাজের মনে। যেন ওকে দেখে ইচ্ছে করেই ভদ্রলোক নিজের সুখ জাহির করছেন। ইঙ্গিত দিচ্ছেন খুব তাড়াতাড়ি কেউ আসছে ওর জীবনে। তবে কি করে জানলেন যে ও আসবে এখানে? নিশ্চয়ই শৈলপুত্রী কিছু বলেছে তাহলে।
কথায় কথায় কেটে গেছে একটা ঘন্টা কখন যে তা বুঝতেই পারেনি নটরাজ। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে কখঞ কাপে মাত্র একটা চুমুক দেওয়ার পরই।
-' ইশ্ আপনার চা কখন জুড়িয়ে গেছে। কথার তালে এমন মেতে গেছি আমার খেয়ালই নেই।'
নটরাজ লজ্জা পায় সুশোভনকে কখন যে এত কাছের মনে হয়ে সব বলে ফেলেছে এক নিঃশ্বাসে ভাবতেই পারেনি। যে মানুষটার ওপর খুব রাগ হয়েছিল একটা সময় সেই মানুষটাকে এখন সত্যিই বড় দাদার মত শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করছে হয়ত বা একটা প্রণামও।
-'আরে হঠাৎই শ্যামা আমার এখানে আসতে চাইল। আমি তো অবাক। যে মেয়েকে কখনও এক কাপ চা খাওয়াতে পারিনি ক্যাফেতে বসিয়ে একসাথে। সে হঠাৎই একটা বেলা পুরো কাটিয়ে গেল এখানে তবে মনটা ছিল না তা আমি বুঝতেই পেরেছি।'
-' কি করে বুঝলেন?'
-' আরে রন্ধন পটিয়সী শ্যামা মাংস পুড়িয়ে ফেলল হঠাৎই ঘড়ির ঘন্টা শুনে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছে আর কি যেন ভাবছে।
খেলাম সেই পোড়া মাংস বুঝলেন একদম জম্পেশ করে। ভালো করে খেল না শ্যামা। তারপর বিকেলে চায়ের টেবিলে বসে আমার কাছে বলল পুরোটা।'
-' কোন পুরোটা?'
-' আরে মশাই সবটা। আপনি আপনাকে কতটা চেনেন? তার থেকে শ্যামা মানে ঐ দুর্গা চেনে আপনাকে অনেক বেশি। আপনি দেখা করতে চেয়েছেন বলেই তো চলে এসেছিল আমার কাছে।'
-' সে আবার কি? আমার বদলে আপনার সাথে দেখা করতে এল! আর আমি বোকার মত বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম..'
-' হ্যাঁ খুব কষ্ট পেয়েছে তাই তো মাংস পুড়িয়ে ফেলল। তবুও কিছুতেই ভাঙলো না বলে গেল আমাকে বিয়ের কথা।'
-' আপনি তো রাজি হয়েছেন। তাই তো মামি পুজো দিতে গেল দক্ষিণেশ্বরে।'
-' হ্যাঁ বলেছিলাম একটু সময় নিয়ে তারপর। মন তো আমিও বুঝি আপনার মায়ের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে বলে সারাজীবন আমার মত একটা বাউন্ডুলে আধবুড়ো মানুষের বৌ হয়ে জীবন কাটাবে।'
-' এমন কথা বলেছে শৈলপুত্রী আপনাকে। হ্যাঁ আমি সব শুনেছি। মাস্টারমশাই তো একটা ধমক দিতেই ভয়ে সব বলে ফেলেছে। আরে তখনই তো বুঝলাম দুইয়ে দুইয়ে চার।'
-' মানে?'
-' আরে সেদিন চন্দননগরে আপনাকে দেখে কেমন যেন একটা খটকা লেগেছিল আমার। হঠাৎই আমাদের একজিবিশনে আপনি এসেছেন। তারপর দেওঘরের সাথে মিলিয়ে সবটাই বুঝতে পারলাম। একটা নীরব মান অভিমানের পালা চলছে।'
-' কিসের মান অভিমান?'
-' এই মানে শৈলপুত্রী আপনাকে গ্ৰহণ করতে ভয় পায়। অথচ মনে মনে জানে আপনি ওকে পছন্দ করেন।'
নটরাজ কথার উত্তর না দিয়ে বলে,' আর আপনি?'
ওর আচমকা প্রশ্নে ঘায়েল হন সুশোভন তবে তিনি মাস্টারমশাই তাই এত সহজে হার মানবেন কি করে?
-' আচ্ছা সবাই মিলে যদি আমার ব্যাচেলর মনটাকে খোঁচা মারে কি করি বলুন তো? তারপর শ্যামার মত মেয়ে। হয়ত একটু দূর্বল হয়েছিলাম আমি তবে আপনার মত বোল্ড আউট নয়।'
হা হা করে হেসে ওঠেন সুশোভন তার হঠাৎই বোনা স্বপ্নের জালটা টুকরো টুকরো হয়ে ছিঁড়ে যায়। তবে একটা বোঝা নেমে যায় মন থেকে যাক হয়ত একটা বড় ভুল করে ফেলছিলেন।
-' আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব ভাবতে পারছি না। কতবড় একটা ভুল বোঝাবুঝি ভেঙে গেল আপনার জন্য।'
-' এবার মাকে বুঝিয়ে বলুন।'
-' আর শৈলপুত্রী? মানে তাকে? তার মনের কথা আপনি জানেন?'
-'আমি জানি মানে বুঝতে পেরেছি কিছুটা তবে তার মনের কথা আপনাকে জানতে হবে। শিবের মত গিয়ে পার্বতীর সামনে দাঁড়ান। দেখুন সে কি বলে।'
নটরাজ হেসে বলে,' আপনাকে যত দেখছি আমি অবাক হচ্ছি। শুধু তুলিতে ছবি আঁকেন না আপনি হয়ত মানুষের মনেও একটা সুন্দর ছবি আঁকতে পারেন।'
নটরাজের রক্তিম মুখটার দিকে তাকিয়ে ভালো লাগে সুশোভনের। পাশের শিমুল গাছটার লাল আভায় রক্তক্ষরণ হয় তাঁর বুকে। তারপর বলেন,' ওহ্! তবে একটু সামলে। হ্যাঁ অবশ্য আপনি সামলাতে সময় পাবেন। ও তো কালই চলে যাচ্ছে স্যারের সাথে দিল্লী। স্যারের ওখানে একটা কাজ আছে ও সাহায্য করবে।'
-' স্যার মানে কি কলেজের? তাহলে তো আমার কথাই বলা হবে না।'
-' না আপনার মামুর সাথে যাবে শৈলপুত্রী।
অবাক হয়ে যায় নটরাজ। মামা তো কিছুই বলল না আজ।
*******************
সুশোভনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পা রেখেছে ওর বাগানের ছোট ছোট নুড়ি দিয়ে বাঁধানো পথে নটরাজ। সুশোভন হাঁটছে ওর পাশাপাশি। নটরাজের মনটা কেন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি ছুঁয়ে আছে। কে জানে শৈলপুত্রীর মনে কি আছে? তবে সুশোভনবাবু বলেছেন ও ভয় পেয়েছে সম্পর্কে ফাটল ধরানোর। মায়ের আশীর্বাদে বিশ্বাস করে শৈলপুত্রী। কারণ আদিত্যকে বিয়ে করে তখন মায়ের আশীর্বাদ পায়নি সে বরং পদে পদে আশার দীর্ঘশ্বাস অপমান আর অসম্মানের বোঝা বয়ে বেড়াত সে। তাই হয়ত লাবণ্যর কথাগুলো মনে রেখেই পালাতে চেয়েছিল নটরাজের ভালোবাসার বন্ধন থেকে। সুশোভনের কাছে নিরুপায় হয়ে আত্মসমর্পণ করে বলেছিল,' স্যার আপনি তো সব শুনলেন,আমি আমার জীবনে আর কোন অভিশাপ বয়ে বেড়াতে পারব না। হয়ত বা আপনার পায়ের তলায় বসে সারাজীবন কাটিয়ে দিলে জীবন আমাকে দেবে অনেক কিছুই। তাই স্যার আমরা পাশাপাশি হাঁটব সারা জীবন এভাবেই।'
-' তুই সুখী হতে পারবি তো শ্যামা? নটরাজ মানে যে ছেলেটা তোকে ভালোবাসে তার দীর্ঘশ্বাস কখনও ভারী করবে না তো তোর জীবন?
কিছু না ভেবেই বলে দিয়েছিল,' সুখী হতে আমি জানি। আমার কাজই আমাকে সুখী করবে।'
-' তাহলে বিয়ের কথা ভাবছিস কেন? কাজ নিয়েই সুখী থাক। আমি তো কখনই তোকে জোর করিনি।'
শৈলপুত্রী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কি বলবে ভেবে পায় না।
-' আমি জানি তুই আমাকে বিয়ে করতে চাইছিস নটরাজ আর তার মায়ের সম্পর্ক বাঁচাতে।'
অবাক হয়ে যায় শৈলপুত্রী স্যার এত কিছু জানলেন কি করে? ও বলেছে একটু একটু করে অনেক কিছুই।
-' কি ভাবছিস? আমি কি করে জানলাম? আমি যে তোর স্যার।'
নটরাজ না এলে হয়ত আজ সুশোভন নিজেই গিয়ে অপূর্বকে বলত এই বিয়ে হতে পারে না। এভাবে বিয়ে করার চেয়ে না করাই ভালো। জীবনটা ছেলেখেলা করার জন্য নয়।
নটরাজ গেটের বাইরে চলে গেছে। সুশোভনের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে। অন্যমনস্ক সুশোভন নটরাজকে দেখে আবার শৈলপুত্রীর পাশে বোধহয় ওকেই মানায়। একটু শান্তিও লাগে ভেবে মোহের বশে একটা ভুল করে ফেললে খুবই খারাপ লাগত।
সুশোভনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঘড়ি দেখে নটরাজ মনটা ঠিক করে নেয় কি করবে। অনেকটা সময় আগে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে মা খুবই চিন্তা করছে হয়ত কারণ বাড়িতে কোন ফোনও করেনি। মা হয়ত মামুর ওখানেও ফোন করেছে শুনেছে ও এসে চলে গেছে ওখান থেকে। তাই এখন বাড়িতে যাওয়াই ভালো। তারপরই মনে হয় শৈলপুত্রীর সাথে কথা বলবে কখন? ওরা তো দিল্লী চলে যাচ্ছে।
নাহ্ আগে বাড়িতে কথা বলবে তারপর শৈলপুত্রীর সাথে কথা বলবে। দরকারে না হয় দিল্লীতেই চলে যাবে। নিজেকে প্রস্তুত করে নটরাজ বাড়ি ফেরার পথে।
ও বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। সন্ধ্যা দিয়ে লাবণ্য অস্থির হন আবার ছেলের জন্য। কখন বেরিয়েছে ছেলে এখনও সে ফেরেনি। গতকাল তার শরীর ভালো ছিল না। নটরাজের বাবাও চিন্তিত হন। তারপরই ছেলে এসে পড়াতে ওর চেহারা দেখে অবাক হন।
-' হ্যাঁ রে তোর কি খাওয়া হয়নি সারাদিন? এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন? আমি তো চিন্তায় অস্থির। ও বাড়িতে ফোন করেছিলাম। সেখান থেকে শুনলাম না খেয়েই চলে এসেছিস।'
-' মা আমি খেয়েছি ভেবো না বরং আজকের দিনটা খুব ভালো কাটিয়েছি। সত্যিই মানুষ যে কতরকম হয়। যাকে যেমন ভাবি আমরা সে তেমন নয়। আজ সেটাই বুঝলাম।'
নটরাজের কথা কিছু বুঝতে পারেন না লাবণ্য অবাক হয়ে তাকান। তাঁর মাথাতে একটাই নাম ঘোরে ফেরে তখন। বলেই ফেলেন,' তুই কি শৈলপুত্রীর কথা বলছিস? হ্যাঁ আমিও তাকে কত ভুল বুঝেছি। খারাপ কথাও বলেছি।'
কথাটা কিভাবে শুরু করবে অনেকক্ষণ ধরে ভেবেছে নটরাজ তবে মায়ের কথাতে সেটা সহজ হয়ে যায় তাই বলে ফেলে,' মা তুমি এখন শৈলপুত্রীর কথা কেমন ভাব? মানে তার সম্বন্ধে যা ধারণা ছিল তোমার সেটা কি বদলেছে? আসলে আমাদের মন তো বিষম বড় শত্রু হয়ে দাঁড়ায় কোন কোন সময়। একবার যা মাথায় ঢোকে তা বেরোতে চায় না চট করে।'
-' তোর মা কি বলবে আমিই বলছি সত্যিই বোধহয় এমন মেয়ে হয় না। না হলে সে কে হয় আমাদের যে আমার শরীর ভালো নয় রক্ত লাগবে জেনে নিজের জীবন বিপন্ন করে ফিরিয়ে দিল আমার জীবন।'
-' বাবা তুমি মাকে বলতে দাও আমি মায়ের কাছে জানতে চাই। আমার জানাটা জরুরী যে শৈলপুত্রী যেহেতু আমাদের উপকার করেছে তাই সে হঠাৎই ভালো হল না হলে কি সত্যিই সে অপয়া অলক্ষ্মী হয়ে থাকত?'
-' এই কথাগুলো বারবার করে বলিস না নাটু বড় খারাপ লাগে। নিজের অপরাধ মনের আয়নাতে দেখি আর মন খারাপ হয়। সত্যিই বাবা আমি ছিলাম ভুল আশা আমার মনে বিষ ঢুকিয়েছিল আর আমি সেই বিষ টেনে নিয়ে সারা মন বিষাক্ত করেছিলাম।'
-'হ্যাঁ মা আর সেই খেসারত দিয়ে যাচ্ছে যেমন আশা মাসিমা তেমন শৈলপুত্রী নিজেও। হয়ত বা আমরাও। আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে ভগবান দেখিয়ে দিলেন কি অন্যায় করেছি আমরা। আমিও তো তাকে অপমান করেছি না জেনেশুনে।'
-' শৈলপুত্রী খেসারত দিচ্ছে মানে? কি হয়েছে তার? আজ তো শুনলাম বৌদির সাথে সে দক্ষিণেশ্বরে গিয়েছিল।'
-' আর কিছু শোননি মা?'
-' কই না তো। বৌদি তো আর কিছু বলেননি।'
-' শৈলপুত্রীর বিয়ে।'
-' বিয়ে! কার সাথে? সে তো এখন পড়ছে। হঠাৎই আবার!'
-' হ্যাঁ মা সে হঠাৎই রাজি হয়েছে এই বিয়েতে। বিয়েটা হওয়ার কথা সুশোভন বাবুর সাথে।'
নটরাজের বাবা বলে ওঠেন,' সুশোভনকে আমি দেখেছি তার তো অনেক বয়েস বেবির চেয়ে হয়ত বারো বছরের বড় হবে। হঠাৎই তার সাথে? দাদা আর পাত্র পেল না? এই বিয়ে কি সে নিজে ঠিক করেছে না দাদা দিচ্ছে?'
-' সবটাই কেন হচ্ছে জান মা?'
-' জানি আমি মানে মনে হয় জানি। আর সবটাই মনে হয় আমার দোষে। তাই না?'
নটরাজ গিয়ে মায়ের কাঁধে হাত রাখে,' নিজেকে দোষী ভেব না মা। একটা কথা বলব বলব করেও হয়ত তোমার সংস্কারের ভয়ে তোমাকে বলতে পারিনি আমি। কিন্তু তুমি না বুঝলেও মামা মামিমা বুঝেছেন আর সেইজন্যই তাঁরা শৈলপুত্রীকে বিদায় করে দিতে চেয়েছিলেন।'
-' বিদায় মানে?'
-' মানে সুশোভনের সাথে ওকে বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যাতে শৈলপুত্রীর ছায়া কোনভাবেই আমাদের সংসারে না পড়ে।'
নটরাজ এবার সেই চরম সত্যিটা বলতে চায় কথাটা অনেকটা এগিয়ে গেছে নিজের ছন্দেই। মণিবাবু তাকান লাবণ্যর দিকে। এবার হয়ত তাঁদের কিছু বলা উচিত..' লাবণ্য তুমি কিছু বল এবার কেমন মা তুমি? ছেলের কথা বুঝতে পার না?'
-' আমি যে সবচেয়ে আগে বুঝতে পেরেছি গো। তাই তো ছেলেকে আগলাতে আশার কথা সত্যি মেনে ওকে সরিয়ে রেখেছিলাম শৈলপুত্রীর থেকে। দাদা বৌদির খুব খারাপ লেগেছিল। তাই ওরা অভিমান করে আরও সরিয়ে রেখেছে শৈলপুত্রীকে আমাদের থেকে। কতবার তোর বাবা আর আমি বলেছি। কিন্তু সেদিনের পর আর একদিনও সে আসেনি। কিন্তু এইভাবে বিয়ে দিয়ে দেবে ঐ বুড়ো ছেলেটার সাথে তা ভাবিনি।'
-' মা এমন করে বোল না সুশোভন বাবু খুবই ভালো মানুষ। হয়ত সারাজীবন আগলে রাখবেন শৈলপুত্রীকে একদম একাধারে গুরু একাধারে দায়িত্বশীল বন্ধু হয়ে। কিন্তু...'
হঠাৎই বাবাকে হা হা করে হেসে উঠতে দেখে নটরাজ তাই বাকি কথাটা আর বলা হয় না।
-' ঠিক বলেছিস সুশোভন সত্যিই খুব ভালো ছেলে একদম খাঁটি সোনা সে। দাদা ঠিক চিনেছেন। কিন্তু নটরাজ থাকতে শৈলপুত্রীর অন্য বর হবে তা কি করে হয়? আমি এটা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারব না। লাবণ্য তুমি এখনি দাদাকে ফোন কর না না তার দরকার নেই।'
-' কি বলছ দরকার নেই এখনি দাদাকে ফোন করতে হবে। দাদাই বলুক সুশোভনকে এ বিয়ে হবে না।'
বাবা মায়ের কথাবার্তা শুনে অবাক হয়ে যায় নটরাজ। যে কথা সে নিজে বলতে চেয়েছে। তা তো মা বাবাই বলছে দেখছে। কিন্তু সত্যিই কি সবটা মন থেকে বলছে ওরা? নাকি ও কিছু ভাববে বলে ওর মন রক্ষা করতে চাইছে?
**********************
ঘড়িতে তখন প্রায় আটটার বেশি বাজে এইসময় আবার কে এল? বাইরের বারান্দায় দাঁড়ান অপূর্ব। রেবা শৈলপুত্রীকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছে। মেয়েটা কেমন যেন অদ্ভুত চুপচাপ কাল থেকে। বলছে শরীরটা ঠিক লাগছে না। হতেই পারে অতটা গেছে এসেছে তাই হয়ত ধকল গেছে। রেবা বলেন,' আয় চলত একটু রান্না কর তাহলে মনটা ঠিক হবে। মন খারাপ হলে পছন্দের কাজ করতে হয় তাহলে ভালো লাগে।
লাবণ্য আর মণিকে আসতে দেখে অবাক হন অপূর্ব। এতটা রাতে হঠাৎই ওরা আসছে তাছাড়া মণি তো খুব একটা বাইরে বেরোয় না। কি ব্যাপার হল? নাটুটা আবার কোথায়?
অনেকদিন বাদে ওদের দেখে খুশি লাগে অপূর্বর।
-' কি রে লাবু এত রাতে? এস মণি অনেকদিন বাদে এই বাড়িতে এলে।'
-' হ্যাঁ দাদা,বাধ্য হয়েই আসতে হল। যা সব কান্ড করছেন আপনারা আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। তাই ছুটে এলাম ঝগড়া করব বলে। বৌদি কোথায় তাঁকে ডাকুন একবার।'
অপূর্ব অবাক হয়ে যান মণিকে দেখে কি হল আবার যে ঝগড়া করতে ছুটে এসেছে বোন জামাই।
-' আরে বোস মাথা ঠান্ডা কর তারপর বৌদিকে ডাকছি। সে রান্নাঘরে ঢুকেছে বেবিকে নিয়ে।'
লাবণ্য তাকান মণির দিকে,' ওহ সেও আছে। তাকে আমি আজ এক হাত নেব। এত বোকামি সে করে কি করে?'
-' বোকামি কি বলছ লাবণ্য? তার মাথায় তো অনেক বুদ্ধি না হলে এত কিছু করতে পারে?'
রেবা রান্নাঘরে ছিলেন ওঁদের গলা শুনে অবাক হয়ে চলে এসেছেন তারপরে কথাগুলো শুনে আরও আশ্চর্য হয়ে গেলেন। শৈলপুত্রী রান্নাঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখল আড়ালে। ভয়ে কাঁপলো ওর বুক। কে জানে কাল সাহাবজীর তবিয়ত হয়ত খারাপ করেছেন আঙ্কেলজী তো তাই বললেন। তাই হয়ত পিসিমা আবার ওকে দোষ দেবেন।
লাবণ্যকে রেবা বলেন,' কি হয়েছে বলবে তো? এত রাতে এসে সমানে বকাবকি করছ বেবিকে। আর আমিই বা কি করেছি শুনি? আমার সাথে বলছ ঝগড়া করবে। তা ননদ বৌদির ঝগড়া তো আছে সবসময়ই। বল কি বলবে?'
ঘরের দরজাটা দুম করে বন্ধ করে দেন লাবণ্য। একটু অস্বস্তি হয় অপূর্বর আজ লাবণ্য খুব বাড়াবাড়ি করছে। মণি এসেছে অসুস্থ শরীরে তাই কিছু বলতে পারছেন না। মেয়েটা ওপাশে একা একা থাকল তাছাড়া দরজা বন্ধ করার আছেই বা কি?
বাবা মা অনেকক্ষণ চলে গেছে। ছাদ বারান্দায় পায়চারী করে নটরাজ। কেমন যেন অস্থির লাগছে মা বাবার এইসব কথা শুনে মামু মামিমা কী বলবে কে জানে? তারপরে হঠাৎই একটা চিন্তা হল নটরাজের সে যে সুশোভনের ওখানে গেছিল সে কথা তো মা বাবাকে বলেনি। যদি সুশোভন ফোন করে মামুর কাছে তাহলে কি হবে? ইশ্ ঝোঁকের মাথায় যা করে ফেলেছে তারজন্য এখন কেমন একটা সঙ্কোচ হচ্ছে।
আঙ্কেলজীর জন্য পরটা আর মাংস বানাচ্ছিল শৈলপুত্রী সাথে মা ছিল। হঠাৎই মা চলে গেল। শৈলপুত্রী বুঝতে পারে আজ পিসিমা ওর ব্যাপারে কথা বলতেই এসেছেন। কারণ কাল সে নটরাজকে মিথ্যে বলে ফাঁকি দিয়েছে। হয়ত এই নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। তবে সে তো স্যারকে বলে এসেছে বিয়েটা সে করে নেবৈ কারণ দুই পরিবারের ভাঙন সে চায় না। তাহলে আবার কী? এবার সাহাবজী দেখা করতে চাইলে ও বলে দেবে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
অন্য সময় বাড়িতে কেউ এলে ঐ তাড়াতাড়ি করে চা খাবার বানিয়ে নিয়ে যায়। আজ মা কিছু বলেনি তাকে। রান্নাঘর থেকে একবার উঁকি দিয়ে দেখে দরজা বন্ধ তারপর আবার ফিরে আসে। কিন্তু রান্নাতে মন দিতে পারে না। বুকটা অদ্ভুতভাবে কাঁপে। কে জানে আর কত কী সইতে আর বইতে হবে?
ঘরের ভেতরে তখন জমাট আলোচনা চলছে। অপূর্ব আর রেবা প্রথমে অসন্তুষ্ট হলেও পরে বুঝতে পেরে সবটা হেসে ওঠেন,' তোরা কেউ তো কোন কম নয়? ওহ্ সত্যি যা টেনশন আর রাগ হচ্ছিল আমার। ভাগ্যিস মণিকে নিয়ে এসেছিলি না হলে আজ লাবণ্য কানমলা খেত আমার কাছে ছোটবেলার মত।'
-' ঠাকুরঝি আমরা তো সুশোভনের সাথে ওর বিয়ে দেব বলে ঠিক করেছি। তুমি যা বলেছ তারপর আর কোন সাহসই পাইনি কোন কথা বলতে। তারপর আমাদের নাটু ছুটে ছুটে আসে বেবিকে খোঁজে কার ভালো লাগে বল।'
-' বৌদি আমি তো এত কিছু জানি না। তোমরাও বলনি কিছু।'
-' তোমার দাদাকে বলেছি,তাই তো তাড়াতাড়ি ওর বিয়ে দিতে চাইছি। নিজেদের মধ্যে অশান্তি আর চাই না গো। মেয়েটাও বুদ্ধিমতী কাল নাটু নাকি ওর সাথে দেখা করতে চেয়েছিল। ও দেখা করেনি নাটু রাগ করবে জেনেও।'
-' বৌদি আমি খুব ভুল করেছি আজ তাই তো ছুটে এলাম। ওহ তাই জন্য ছেলেটার শরীর খারাপ। এবার বুঝেছি।'
-' দাদা আপনাদের মেয়েকে আমরা চাই নটরাজের জন্য। শৈলপুত্রীকে তো নটরাজের পাশেই মানায়। আপনি কি করে মাঝে সুশোভনকে আনলেন? সত্যিই ঝগড়া করব আপনার সাথে।'
-' সাধে কি এনেছি ভাই? তোমার ঝগড়ুটে বৌ আর আমার বোনের ভয়ে।'
-' বৌদি,ওগো শুনছ দাদা আমাকে কেমন বলছে।'
লাবণ্যর কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে সেই হাসি শোনে শৈলও।
রেবা ডাকেন,' হ্যাঁ রে বেবি,তোর পরটা মাংস হল? ওরা আজ খেয়েই যাবে। তুই একবার এদিকে আয় দেখি।'
শৈলপুত্রীর হাত কাঁপে,কি জন্য ওকে ডাকছে ওখানে?
ওড়নাটা গলায় জড়িয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। লাবণ্য হঠাৎই হবু শাশুড়িমা হয়ে ভালো করে দেখেন ওর দিকে তাকিয়ে। বেশ দেখতে মেয়েটাকে। এমনি কি ছিল? না এখন যত্ন পেয়ে বেশি সুন্দর হয়েছে? মাথা ভর্তি ঘন কালো কোঁকড়া চুল,গভীর চোখ আর জোড়া ভুরু। গায়ের রঙটা শ্যামলা তবে সব মিলে সুন্দর।
-' চুপ করে দাঁড়িয়ে কেন রে বেবি? পিসিমা পিসেমশাইকে প্রণাম কর। কতদিন বাদে এসেছেন।'
শৈলপুত্রী তাড়াতাড়ি প্রণাম করতে যায়। তারপর বলে আমি আসছি,'পিসামশাই তো পরটা খান না রোটি বানাচ্ছি।'
-' আজ পরটাই খাবে। তুই এখানে বোস দিকি আমার পাশে। হ্যাঁ রে আমার ছেলেটা বোকাসোকা বলে ওকে এমন কষ্ট দিচ্ছিস? কাল একঘন্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস যদি কিছু হত?'
-' কিছু হবে কি বলছ? অসুস্থ হয়ে পড়েছে সেটা বল।'
শৈলপুত্রীর হাত ঠান্ডা হয়ে যায়। রেবা অপূর্বর দিকে তাকান ওঁর মুখে হাল্কা হাসি।
-' খুব অন্যায় করেছিস তুই,ছেলেটা আমার মাথা যন্ত্রণা নিয়ে ফিরেছে বাড়ি। তোকে শাস্তি পেতে হবে। কেন তুই ওকে কথা দিয়ে সুশোভনের বাড়ি গেছিস?'
কি বলবে ভেবে পায় না শৈল। কি উত্তর দেবে কথার?
-' কাম ছিল স্যারের সাথে।'
-' আচ্ছা বেশ আমরাও কামে এসেছি। নটরাজের আর আমাদের সবার তোকে খুব পছন্দ। আমরা তোকে ঘরের লক্ষ্মী করে নিয়ে যেতে চাই।' এক নাগাড়ে কথা বলে থামেন লাবণ্য। শৈলপুত্রী হঠাৎই উঠে দাঁড়ায় তারপর বলে,' না না আমি অপয়া,অলক্ষ্মী এ হতে পারে না। তাছাড়া স্যারকে আমি বলেছি ওখানেই বিয়ে হবে।'
শৈলপুত্রী ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মণি লাবণ্যকে বলেন,' এই ভয়টাই আমি পেয়েছি। তুমি বৌদির সাথে ওঘরে যাও দেখো তাকে বোঝাতে পার কি না? না হলে আমাদের ছেলেটাকে যে...'
লাবণ্য রেবার কাছে উঠে গিয়ে বলে,' বৌদি আজ দেখব তুমি কেমন মা। ওকে বোঝাতে হবে না হলে আমাদের নাটুটা..সেইজন্য তো এত রাতে এলাম এখানে।
*******************
নটরাজের অধৈর্য্য লাগে মা বাবা হঠাৎই বেরিয়ে গেলেন এখনও তাঁদের পাত্তা নেই কি জানি ওদিকে কি হচ্ছে? শৈলপুত্রীকে কিছুটা হলেও চেনে নটরাজ সহজে হ্যাঁ বলার মেয়ে সে নয়। পার্বতী কোথায় শিবকে পাবে বলে তপস্যা করেছিল তা না শিবকেই উল্টে তপস্যা করে ওর মান ভাঙাতে হচ্ছে। মেয়েটা সত্যিই মাথা মোটা ঐ জন্য ওর ভালোবাসা প্রেম কিছু হয়নি। দিনরাত ঐ গরু না হলে রঙ তুলি নিয়ে আছে। আর সময় পেলেই হালুয়া ডালপুরী বানাচ্ছে। একদম যাচ্ছেতাই রকমের একটা মেয়ে অথচ সেই মেয়ের প্রেমে পড়ে ছাদে দাঁড়িয়ে চিন্তায় চারটে সিগারেটের প্রাণনাশ করেছে ও। অবশ্য এই সিগারেট খাওয়া ও একদম পছন্দ করে না সে কথা শুনেছে ট্রেনে আসতে আসতে নটরাজ। কিন্তু কিছু করার নেই আজ শুধু অশান্তি ভরা একটা সন্ধ্যে মনে ভয় কি জানি কি হয়? অথচ বেহায়ার মত মামুবাড়িতে ফোনও করা যায় না ফোন ধরেই মামু বলবে মানে ওকে একহাত নেবে ভালো করে।
শৈলপুত্রী তার নিশ্চিন্ত আশ্রয় রান্নাঘরে এসে মুখ লুকোয় ভয়ে আর লজ্জায় তার হাত পা কাঁপতে থাকে। হঠাৎই এসব কি ঘটনা ঘটলো? ইশ্ সাহাব বাড়িতে গিয়ে বলেছেন ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে শৈলপুত্রী আর আসেনি। সাহাবের শরীর খারাপ হয়েছে তারজন্য পিসিমা ওর দোষ ধরছেন। কি বলছেন পিসিমা ওকে ওঁদের বাড়ির বৌ করতে চান!
কিন্তু ও তো সবসময় একলা থাকতে চেয়েছে আর কারও সাথে নিজেকে জড়াতে চায়নি। নিজের মন্দটুকু আড়াল করে শুধু ইচ্ছেটাকে সঙ্গী করে বাঁচতে চেয়েছে। সাহাব কেন ওকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন? ওর মত একটা সামান্য মেয়ে যার একবার বিয়ে হয়ে আবার বিয়ে ভেঙেছে তাকে নিয়ে সাহাব কেন? আর ভাবতে পারে না শৈলপুত্রী। গরম মাংস ঢালতে গিয়ে হাত কেঁপে ওঠে হাতে কিছুটা ঝোল ছিটকে আসে তাড়াতাড়ি কলের তলায় হাত পাতে শৈলপুত্রী।
-' কি করছিস বেবি? দেখি দেখি হাতটা ইশ্ এভাবে লাল হয়ে গেল কি করে? নিশ্চয় হাত পুড়িয়ে ফেলেছিস। দাঁড়া ওষুধ লাগাই। আমি সত্যি পারি না।'
নিজের বিবেকের যন্ত্রণায় হাতের যন্ত্রণা গায়ে লাগে না শৈলপুত্রীর,' সাহাবজীর কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করতে পালাতে চেয়েছিল পারেনি। ধরা পড়ে গেছে। বিয়েতে মত দিয়েছে অন্য জায়গায় কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? আর স্যারই বা ওকে কি ভাববেন? স্যারের কাছে ভবিষ্যতে মুখ দেখাতে পারবে না।'
-' কি হয়েছে বৌদি,কার ওষুধ লাগবে? বেবি কোথায়?'
-' আর কার হাত পুড়িয়েছে মেয়ে।'
সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন লজ্জায় কুঁকড়ে যায় শৈলপুত্রী বারবারই বলতে থাকে আমার কিছুই হয়নি। এমন কতই তো হয়। এখুনি ঠিক হয়ে যাবে।
শৈলপুত্রীর হাতটা ধরেন লাবণ্য তারপর রেবার কাছ থেকে মলমটা নিয়ে ওকে বলেন,' একদম চুপ আর কথা নয়। হাতটা দে দেখি,বড় জেদ তোর। আমি বড় হয়ে ক্ষমা চাইছি ক্ষমা করতে পারিস না? মা মেয়ে তো কত কিছু হয়। তা বলে আমার ছেলেটাকে কষ্ট দিবি? তোর মত না থাকলে আমি জোর করব না। জোর করে বিয়ে দেওয়া যায় না। সে কথা বল তবে তোর মত নেই। আমরা চলে যাব।'
লাবণ্য শৈলপুত্রীর হাতে মলম লাগিয়ে দিচ্ছেন,হাতটা জ্বলছে। হয়ত মন জ্বলছে আরও বেশি। শৈলপুত্রী রেবার দিকে তাকায় তারপর বলে,' মা আমি যে স্যারকে বলে এসেছি। তা হয় না,ওঁকে মুখ দেখাব কি করে?'
-' তুই কি সত্যিই মন থেকে মত দিয়েছিস বেবি? তাহলে এতদিন সময় নিয়েছিলি কেন? আর সুশোভন তো পুরো মত দেয়নি। হ্যাঁ তোর আঙ্কেল বলছিলেন সুশোভন ফোন করেছিল। তুই নাকি ওকে পোড়া মাংস খাইয়েছিস। অবশ্য খুব মজা করছিল তাই নিয়ে। তুই পোড়া মাংস করেছিস ভাবতেই পারি না আমি। কেন বেবি?'
হঠাৎই কান্নায় ভেঙে পড়ে শৈলপুত্রী,' আমি আর পারছি না মা। আমি তো চলেই যেতে চেয়েছি অনেক দূরে তোমরা আমাকে আটকালে কেন?'
রেবা ওকে জড়িয়ে রাখেন। লাবণ্য ওর মাথায় হাত রাখেন,' যাব বললে কি হয়? তুই না থাকলে তোর পিসামশাই রক্ত পেত কি ভাবে?'
-' তাই কি আমাকে তুমি ঘরে তুলতে চাইছ পিসিমা? ঐ ঋণ শোধ করতে।'
শৈলপুত্রী যে এমন প্রশ্ন করতে পারে ওঁরা কেউই ভাবেননি। অপ্রস্তুত হন লাবণ্য নিজেও। তারপর বলেন,' না সবটাই হয়ত ভগবানের ইচ্ছে। আমি ঋণ শোধ করাতে বিশ্বাস করি না বরং ঋণী হয়েই থাকতে চাই।'
অপূর্বর বসার ঘরে বসে থাকতে থাকতে অস্বস্তি হয়। অনেকটা রাত হল লাবণ্যকে ফিরতে হবে। কি করছে ওরা? তারপর কাল সকালে ওঁকেও দিল্লী যেতে হবে বেবিও তো যাবে সাথে। মণিও বলছে,' দাদা আপনি গিয়ে দেখুন একবার। আজ বোধহয় পরটা মাংস খাওয়া হল না।'
এত কিছু হয়ে গেছে অথচ এর মধ্যে মণির কথা শুনে হাসি পায় অপূর্বর। কি বলবেন? নাহ্ একবার তাঁকেই বকুনি দিতে হবে সবাইকে।
হঠাৎই ফোনটা বেজে ওঠে,অপূর্ব কথা বলতে উঠে পড়েন। ওপারে সুশোভনের গলা পেয়ে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সত্যি একটা সমস্যা সৃষ্টি করেছে লাবণ্য আগে এ কথা বললেই তো পারত। তাহলে এতটা এগোতেন না ওঁরা। চিরকাল লাবণ্য এমন জলঘোলা করে এসেছে। এখন এসে বায়না বেবিকে চাই। নিজেকে সামলান অপূর্ব এই ইচ্ছে তো তাঁর মনের আনাচে কানাচেও উঁকি মেরেছে যখনই নাটু আর বেবিকে দেখেছেন। কিন্তু সাহস পাননি কিছু বলতে।
-' হ্যালো ও সুশোভন। এত রাতে?'
-' হ্যাঁ কাল তো আপনাদের রাজধানী এক্সপ্রেসে যাওয়া তাই আজই ফোন করলাম। অনেক ভেবে দেখলাম বিয়ে টিয়ে করা আমার ঠিক হবে না স্যার।'
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও অপূর্ব বলেন,' কিন্তু তুমি যে তখন বলেছিলে মানে রাজি ছিলে।'
-' না পুরো রাজি হইনি বলেছিলাম ভেবে দেখব। তবে ভেবে দেখলাম আমাদের মাস্টারমশাই আর ছাত্রীর সম্পর্কটাই থাক। এর মধ্যে আর কোন কিছু না আসাই ভালো।'
নটরাজের কথাটা আড়াল করে পুরোপুরি সুশোভন। বেচারা এসেছিল প্রেমের বিপাকে পড়ে। নিজে প্রেমিক না হলেও ভালোবাসার গভীরতা বোঝে সুশোভন। বুঝতে পারে এই ভালোবাসা বড় গভীর তাই হয়ত হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ছেলেটা চলে এসেছে ওর কাছে। এই টুকু অনায়াসেই গোপন রাখতে পারবে।
-' তাহলে বেবির কি হবে?'
দাদার কথা শুনে মণিবাবু অবাক হন। দাদা এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
-' ও পড়াশোনা করুক ভালো করে। অনেক সুন্দর ভবিষ্যত ওর। আমার তো মনে হয় অন্য কেউ অপেক্ষায় আছে ওর জন্য।'
-' আচ্ছা নাটু কি সকালে মানে এই বারোটা নাগাদ তোমার ওখানে গেছিল?'
স্যারের বোমা ফাটানোতে অবাক হয় সুশোভন। কি করে জানলেন স্যার?
-' মানে,ইয়ে।'
-' হ্যাঁ কি না বল,আমি তোমার স্যার সুশোভন।'
-' হ্যাঁ স্যার।'
অপূর্ব এবার গলার জোর আনেন মণিবাবুকে শুনিয়ে বলেন,' কি অবস্থা আবার হতচ্ছাড়া ভাগনের দেখেছ প্রেমে খাবি খেতে খেতে গড়িয়াতে পৌঁছে গেছে! আমাকে বল মনের কথা তা নয় তো..'
-' স্যার আপনি সত্যি গোয়েন্দা।'
হেসে ফেলে সুশোভন। 'আপনাকে আবার প্রণাম করতে ইচ্ছে করছে।'
-' ঘুরে আসি তারপর হবে। এখন বাড়িতে জমিয়ে যাত্রা হচ্ছে। নাটুটাকে যদি আমি কানমলা না দিই তবে আমি ওর মামু নই। তোমার কাছে ছুটেছে শেষে?'
রেবা আর লাবণ্য শৈলপুত্রীকে নিয়ে ঘরে এসেছেন একটু আগেই। অপূর্বর চোটপাট শুনে হাসি সবার মুখে। শৈলপুত্রীও কানমলা দেবার কথাতে হেসে ফেলে।
লাবণ্য আর মণির তখনি আসা হয় না মানে অপূর্ব আসতে দেন না।
-' দাদা আমরা যাই এখন,ছেলেটা না জানি কি করছে? একটা ফোনও করেনি।'
-' সে যা পারে করুক গে মহা পাজি হয়েছে সে। শেষে সুশোভনের বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে বেবির বিয়েটা ভেঙে এসেছে বোঝ তাহলে। সে নাকি তোর ভালো ছেলে? আসুক আমার সামনে তার হবে।'
শৈলপুত্রী সেখানে আর বেশীক্ষণ থাকতে পারে না তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে খাবার গোছায়। হাতের জ্বালাটা অনেকটা কমেছে। খুব লজ্জা করে ওর আঙ্কেলজীর কথা শুনে। ও ঘরে সবাই হাসি মজা করছে। শেষ পর্যন্ত সাহাবজীর মুখের কথাই সত্যি হল তাহলে। তবে সাহাবজী স্যারের বাড়ি চলে গেছেন! ইশ্ ভাগ্যিস এখন কদিন সে কলেজে যাবে না। অবশ্য অপকটে ও অনেক কথাই বলেছে স্যারকে। এমন কি নটরাজের সাথে দেখা করবে না বলে স্যারের বাড়িতে এসেছে সেটাও।
********************
দাদা বৌদির অনুরোধে রাতের খাবার খেয়েই বাড়িতে ফিরতে হল লাবণ্যদের। আসার সময় টিফিনকৌটো ধরিয়ে দেন রেবা। লাবণ্য বারণ করলেও শোনেন না,' বেবির রান্না দেখবে ও খুশি হয়ে খাবে। আজ তো খুশিই খুশি তবে প্রথমেই সুখবর দিয়ো না। আমাদের জ্বালিয়েছে ছেলেটা। ও একটু চাপে থাক।
লাবণ্য ছেলের পক্ষ নিয়ে বলেন,' না না তেমন কিছুই করেনি গো ও সবই আমি করেছি। তাই তো আজ ছুটে এসেছি।'
শৈলপুত্রীকে আবার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন লাবণ্য খুব ইচ্ছে থাকলেও হাতে কিছু দিতে পারেন না দাদার ভয়ে। সে যাই হোক পরে হবে।
-' দাদা তুমি কালই চলে যাচ্ছো,তবে নাটুর সাথে তো বেবির দেখাই হবে না এবার। ছেলেটা কত দূর থেকে আসে।'
-' কেন বেবি কি আর আসবে না নাকি?'
-' ইশ কি বলছে দেখো। ভালো করে ওরা ঘুরে আসুক তারপর ঠিক দেখা হবে ঠাকুরঝি। এখন বাড়ি যাও যখন থাকবেই না। আর নাটুকে কিছু বলার দরকার নেই। বলবে বেবির বিয়ে সুশোভনের সাথেই হবে।'
শৈলপুত্রী হাসে আবার। বাড়িতে ফিরে খুব ধমকান ছেলেকে লাবণ্য।
-' তুই তো সব কেলেঙ্কারি করে রেখেছিস আমরা আর কি করব? তুই নাকি সুশোভনের কাছে গেছিস বিয়ে ভাঙতে? ইশ্ কি লজ্জা! বিয়ে তো হবেই না উল্টে দদা তোকে কানমলা দেবে।'
নটরাজের মুখটা লজ্জায় আর দুঃখে কেমন যেন হয়ে যায়। তাহলে সব আশাই শেষ। তারপর মামা একগাদা বকুনি দেবে।
-' আরে লাবণ্য তোমার একটু মায়া হচ্ছে না ছেলেটা কেমন দাঁড়িয়ে আছে কাচুমাচু মুখ করে।'
বাবার কথা শুনে একটু স্বস্তি পায় নটরাজ তবে বাকিটা শুনতে শুনতে অনেকটা রাত হয়ে গেল। রাতে অদ্ভুত একটা মেশানো অনুভূতি হল ওর। তারপরেই মনে হল কাল একবার হাওড়া স্টেশনে যেতে হবে পরশু তো ও চলে যাচ্ছে তাহলে তো আর দেখাই হবে না শৈলপুত্রীর সাথে।
আচ্ছা প্রেমে পাগল মানে প্রেমে পড়লে মানুষ পাগল হয়ে যায় সেই অবস্থা হয়েছে ওর। কিন্তু মামু যদি স্টেশনে কানমলা দেয়..ভেবেই খুব হাসি পায়। তারপর মনে মনে বলে মামুর কানমলাও খেতে রাজি আছে শৈলপুত্রীকে একবার দেখার জন্য।
রাতে লাবণ্য চলে যাবার পর হাসিতে ফেটে পড়েন অপূর্ব। রেবাকে বলেন,' দেখেছ কেমন টাইট দিলাম লাবণ্যকে। আমাদের বেবি ফেলনা নাকি যখন খুশি তাকে কাছে টানলাম বা দূরে সরিয়ে দিলাম। আমাদের বেবি হচ্ছে খাঁটি হীরে।'
-' আমি তো অবাক ওদের দেখে ভয় পেয়ে বেবিটা হাত পোড়ালো শেষে। কি যে ভীতু মেয়েটা মুখেই শুধু বড় বড় কথা।'
অপূর্বর তবে মনটা বড় খুশি এই ইচ্ছেটাকে কবে থেকে মনে লুকিয়ে রেখেছিলেন তবে বলতে পারেননি লাবণ্যর জন্য। আজ যা নিজে থেকে হল সেটাই ভালো হল। তবে নাটু ভোলা শেষে সুশোভনের বাড়ি ধাওয়া করেছে! একবার মামুকে বলতে পারত মামু শৈলপুত্রীকে বিয়ে দিয়ো না।
-' তোমার ভাগ্নেই তো সে তার বুদ্ধিও কোন কম নয়। তবে সুশোভনের জন্য খুব খারাপ লাগছে। বিয়ে তো সে করতে চায়নি বেবিকে আমরাই তাকে রাজি করিয়েছিলাম। কিন্তু এমন হবে ভাবিনি।'
-' আমিও কি ভেবেছিলাম? তাহলে বলতাম নাকি? ইশ্ সত্যি খুব খারাপ হল। তবে নাটুটা নিজেকে সামলাতে পারে না সুশোভন তা পারবে। ও অনেক পরিণত। নাটু গলা পর্যন্ত প্রেমে ডুবে গেছে।'
অপূর্ব এমন করে বললেন যে রেবা হেসে অস্থির হলেন। তারপর হঠাৎই মনে হল মেয়েটা অনেকক্ষণ ঘরে ঢুকে গেছে অন্যদিন আঁকে আজ আর আঁকল না বলল ভালো লাগছে না তারপর কাল আবার যাওয়া আছে।
একবার দেখবে নাকি কি করছে মেয়েটা। তারপর অপূর্বকে বলেন,' আমি একবার বেবিকে দেখে আসি বুঝলে। কি জানি ওর মনে কি আছে? কোনদিনই তেমনভাবে কিছু বলেনি। মা বাবাও নেই যে তাদেরকে বলবে।'
ঘরের পরদাটা সরিয়ে দেখেন ভেতরে রেবা লাইট জ্বলছে না তবে আবছা আলোতে বোঝা যাচ্ছে বিছানায় বসে আছে বেবি মাথা নিচু করে। ও তাহলে ঘুমোয়নি।
শৈলপুত্রীর কাছে এসে ওর মাথায় হাত রাখেন রেবা চমকে ওঠে না ও। বরং মাথাটা রাখে রেবার গায়ে।
-' এখনও ঘুমোসনি,কাল যে ট্রেন।'
' ঘুম আসছে না মা আমার ভয় করছে কেমন যেন।'
-' কিসের ভয় ?'
-' আবার কোন ঝড়া উঠবে না তো?'
-' ধ্যাৎ পাগলী,এবার সব ঝড় থেমে যাবে খুব ভালো থাকবি তুই। আচ্ছা সুশোভনকে তুই কি বলেছিলি? মানে নটরাজের কথা।'
-' আমি ঝুট বলিনি মা,বলেছিলাম সাহাব দেখা করতে চান আমার সাথে তাই চলে এসেছি আমি।
তারপর সবটা বলেছি যা পিসিমা আমাকে বলেছিলেন। সেদিন স্যার সব শুনেছেন।'
' তোর কি সুশোভনের জন্য খারাপ লাগছে? আমাকে ঠিক করে বল তো? লাবণ্য যে সম্পর্কে বাঁধতে চায় তোকে তাতে তুই খুশি তো?'
হঠাৎই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে শৈলপুত্রী তারপর স্পষ্ট ভাষায় উত্তর দেয় যে ওর দেখা প্রথম ভালো একজন মানুষ সাহাবজী। যে ওকে নানাভাবে সাহায্য করেছে এগিয়ে দিতে। ওর জন্য সাহাবজী কোন বিপদে পড়ে পিসিমার সাথে সম্পর্কে ফাটল ধরে তা কখনও চায়নি। তারজন্য সে সুশোভন স্যারের সাথেই বিয়েতে রাজি হয়েছিল। তবে স্যারকে সে স্যার হিসেবে দেখতেই ভালোবাসে ওঁর বকুনি, ভালোবাসা, কেয়ারিং মনোভাব সবটাই ভালো লাগে শৈলপুত্রীর। জীবনে ও একা থাকতে চেয়েছে স্যার বা সাহাবজী কাউকেই চায়নি।
আচ্ছা আমাকে ছুঁয়ে এবার একটা সত্যি কথা বলবি? না হলে হয়ত আমার ঘুম আসবে না সারারাত। মা বলে ডেকেছিস মেয়ের মনটা জানতে খুব ইচ্ছে করছে।
-' কি কথা মা?'
-' তুই নাটুকে কি একটুও পছন্দ করিস না মানে ভালোবাসিস না? নাকি দায়ে পড়ে হ্যাঁ বলবি?'
শৈলপুত্রী আর বাঁধতে পারে না নিজেকে শাসনে তার মনও যে একজন ভালো সঙ্গী হিসেবে শুধু নটরাজকে পেতে চেয়েছে। নটরাজ ছিল তার অমাবস্যার রাতে একফালি চাঁদের মত। যাকে দেখলে মুহূর্তে সব অন্ধকার দূর হয়ে যেত। ভরসা পেত মনে। তাই আর নিজেকে আড়াল না করে বলে,' সাহাবজীর মত মানুষকে পছন্দ না করে পারা যায়? তবে মা সাহাবজীর পাশে দাঁড়ানোর মত যোগ্যতা আমার নেই মা।'
-' আর যেন কখনও এমন কথা না শুনি। নিজের কাছে যদি ছোট সাজিস তাহলে লোক তো তোকে ছোট করবেই। যাক এরপর ছেলেটা এলে একটু ভালো করে কথা বলিস ওর সাথে।'
-' আমি তো ভালোই কথা বলি মা। সাহাবজী আমার ভগবান।'
-' ভগবান না আর কিছু মহা পাজী ওটা। কাল হয়ত স্টেশনে যাবে আমার মন বলছে। একটু কথা বলিস ছেলেটার সাথে। লাবণ্যর কাছে শুনলাম কদিন ভালো করে খাওয়াদাওয়া করেনি।'
-' খাওয়াদাওয়া করেনি তো আমি কি করব? আমি খাবার পাঠাব নাকি? দেওঘর হলে পাঠাতাম।'
-' ওরে এই মেয়েও তো কম পাজি নয় দেখছি দাঁড়া আমার ভালো মানুষ নাটুটাকে কষ্ট দেওয়া এবার আমার কাছে কানমলা খাবি।'
রেবার গায়ে আরও নির্ভরতায় মাথা রাখে শৈলপুত্রী রেবা ওর ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দেন আদরে।
-' যাকে ভালোবাসিস তাকে এভাবে দুঃখ দিতে নেই। বেচারা ছেলেটা শেষে সুশোভনের কাছে ছুটেছে। ওকে আর দূরে ঠেলিস না। এবার আপন করে নে। কি বলতে চায় একবার শুনে নে।'
শৈলপুত্রীর মুখে হাসি ফোটে,' তাহলে কি আমি দিল্লী যাব না কাল? এখানে থেকে যাই কথা শুনতে?'
-' ও বাবা এই মেয়ে তো মোটেই সুবিধার নয়। তুই না গেলে তোর আঙ্কেলজীর মাথা খারাপ হয়ে যাবে। কে তার হাতে হাতে কাজ করবে?'
-' তাহলে তো এবারও কথা শোনা হল না।'
-' আবার দুষ্টুমি নে ঘুমো এখন কাল সকালে উঠতে হবে।'
শৈলপুত্রী ঘুমোনোর চেষ্টা করে কিন্তু এলোমেলো চিন্তা ঘুমোতে দেয় না ওকে। মনে পড়ে যায় দেওঘরের কত কথা। ছোটছোট ভালো লাগা আর সাহাবের সেদিনের কথাটা যেটা ওর ভাসুরকে বলেছিলেন। ইশ্ শেষ পর্যন্ত কি সেটাই সত্যি হবে? আচ্ছা সাহাবের বাগানটা কি তেমনি আছে? গাছগুলো বড় হয়ে গেছে নিশ্চয় এতদিনে। এমন কত কথা ভাবতে ভাবতে ওর চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে।
হয়ত ওদিকে এক অবস্থা নটরাজের। শুধু সুশোভনের বড় নিশ্চিন্ত লাগে এই ভেবে যে হঠাৎই বিবেচনা না করে যে কাজ করতে যাচ্ছিলো তা থেকে মুক্তি পেয়েছে। শৈলপুত্রীকে বিয়ে করলে অনেক কথাই উঠত ওদেরকে নিয়ে। তাছাড়া শৈলপুত্রী শুধু নটরাজের। ছেলেটা নিজেও ভালো চাকরি করে তবুও ভালোবাসা এমনি জিনিস যে তার টানে ছুটে এসেছে কত দূরে।
অপূর্বকে সাহায্য করতে দুজন ছাত্র ছাত্রী গেলেও রেবা আর অপূর্ব দুজনের অনুরোধেই শৈলপুত্রীর যাওয়া। আর ও গেলে রেবাও নিশ্চিন্ত কারণ ওষুধ খাবার সব গুছিয়ে দেবে ঠিক সময়।
এখন বিয়ের মরশুমে রেবার পক্ষে রূপলেখা ছেড়ে বেরোনো মুশকিল যাক ভালো হয়েছে। মোটামুটি দিন পনেরো কুড়ি লাগবে। ভালো হয়েছে এখন বেবির কলেজও বন্ধ।
সকালে ছেলেকে বেরোতে দেখেন লাবণ্য। মুখে একটা বড়সড় জিজ্ঞাসা চিহ্ন এসে ধাক্কা দিলেও কিছু বলেন না। অপেক্ষা করেন ছেলে কথা বলার ভরসায়।
-' মা আমি আসছি একটু হাওড়া স্টেশনে যাব মা। আমার জন্য মামুকে অনেক হয়রানি হতে হয়েছে। তাছাড়া শৈলপুত্রীর সাথেও দেখা হবে। এখন তো প্রায় মাস খানেকের ধাক্কা ওদের ফিরতে।'
লাবণ্যর হাসি পায় মণিবাবু হাত নাড়ান ইশারায় বলেন যেতে দাও এখন। একটু আগে গেলে কথা বলতে পারবে।
মামুকে ফোন করতে আর সাহস হয়নি নটরাজের মামিমার কাছেই জেনে নিয়েছে সবটা মানে কোন কোচে আছে ওরা। প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে স্টেশনে এসে হাজির হয় নটরাজ।
সবটা জানা অপূর্বর তবুও বলেন,'ওহ এসে পড়েছিস তাহলে যাক যাক ভালো। আমি যাই একটু তেল আনি কানটা মলতে হবে তো।
হেসে ফেলে নটরাজ, ' আচ্ছা দাও কানমলা আমি নিতে রাজী। তুমিই পারবে না।' প্রণাম করে মামাকে সাবধানে থাকতে বলে। অপূর্ব বলেন,' বড় ভালো লেগেছে আমার কাল। বাকিটা পরে বলব।' নটরাজ এদিক ওদিক তাকায়। শৈলপুত্রীর সাথে একটু কথা বলা দরকার কিন্তু সে কোথায়?
প্ল্যাটফর্মের দিকে চোখ পড়ে যায় নটরাজের কোমরে ওড়না জড়িয়ে ঐ যে উনি আসছেন হাতে জলের বোতল। নটরাজের সাথে চোখাচোখি হতেই লজ্জা পেয়ে যায়।
ওদের একলা করতে অপূর্ব বলেন,' বেবি তুই একটু বোস আমি দেখি আমার ছাত্রছাত্রীরা ঠিকমত উঠল কি না?'
শৈলপুত্রীর পা দুটো মাটিতে আটকে যায় ভয়ও হয়। সেদিন সত্যিই সে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছে। কে জানে সাহাব কী বলবেন?
-' আপনার জন্য আমার কী হয়েছে শুনেছেন তো? আরেকটু হলে হয়ত মরেই যেতাম। ভাগ্য ভালো সুশোভন বাবু বাঁচালেন। অনেক বড় শাস্তি আছে আপনার কপালে।'
-' আমাকে ক্ষমা করবেন সাহাবজী, আমার মাথার ঠিক ছিল না। খুব অন্যায় হয়ে গেছে।'
-' ক্ষমা করতে পারি তবে একটা শর্তে আর সাহাবজী বলা যাবে না।'
-' কি বলব তাহলে?'
-' কেন নটরাজ।'
-' সে নাম আমি নিতে পারব না। সাহাব ঠিক আছে।'
-' আচ্ছা আমি দেখছি কেমন নিতে পারবে না সেই নাম।'
নটরাজের জোর দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না শৈলপুত্রী হেসে ফেলে সেই পুরোনো হাসিটা। নটরাজ বলে,' ইশ্ তুমি বলে ফেললাম!'
-' ও তো ঠিকই আছে। আপনি ভালোভাবে থাকবেন। সবাইকে আমার কথা বলবেন।'
নটরাজ একটা ছোট খাম পকেট থেকে বের করে ওর হাতে দেয়,' আমি বেশি কথা কিছু বলতে পারি না। তুমি দেখে নিয়ো সময় মত। ভালো থেকো। অপেক্ষায়..'
মামুকে দেখে আর কথা বলতে পারে না নটরাজ। বরং মামুই বলেন,' হ্যাঁ এখন অপেক্ষায় থাকতে হবে নাটু। সবুর করলে সেই ফল তো মিঠে হয়।'
মামুর কথাতে লজ্জা পায় নটরাজ। শৈলপুত্রী মুখ ঢাকতে জানলায় তাকায়।
-' নেমে পড় নাটু সিগন্যাল হয়ে গেছে। সাবধানে বাড়ি যাস।'
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে নটরাজের চোখ দরজার দিকে শৈলপুত্রী দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। হাওয়াতে তার এলোচুল তখন এলোমেলো। বুকে দমকা হাওয়ার পাগলামি কি জানি কাগজে কী লিখেছে সাহাব?
**********************
এক আকাশ ভালোবাসার ভোকাট্টা ঘুড়ি ভাসিয়ে দিয়ে মেঘেদের রূপকথার রাজ্যে নটরাজ বাড়ি ফিরছে। মনটা খুব উড়ু উড়ু ইচ্ছে করছে শৈলপুত্রীকে সাথে নিয়ে কাগজের পাখা লাগিয়ে মেঘের হাওয়াই জাহাজে উঠে ভেসে যেতে দূর থেকে দূরান্তে। ইশ্ সবটা যেই জানাজানি হল তার সাথে সাথেই শৈলপুত্রীকে চলে যেতে হল দিল্লী?
লাবণ্য এক কথা বলেন মণিবাবুকে,' ছেলেটা কত কি সয়ে বুকে বোঝা নিয়ে ছিল এতদিন বল?'
-' তা তো তোমার জন্য। তোমাকে আশা কী বুঝিয়েছে তা শুনেই তুমি অস্থির। তবে আমার সেই দেওঘরেই খুব ভালো লেগেছিল মেয়েটাকে। খুব গুণী কিন্তু মেয়েটা আর একদম সহজ সরল।'
-' সহজ সরল মোটেও নয় আমি তো বলব খুব জেদ ঐ মেয়ের না হলে আমার ওপর রাগ করে কিসব কান্ড করেছে বলত?'
-' রাগ নয় লাবণ্য আমাদের বাঁচাতে নিজে মরতে বসেছিল। এমন মেয়ে তো দরকার আমাদের সংসারে যে তোমার ঐ অপদার্থ ভোলাকে সামলে রাখবে।'
-' ইশ্ আমার ছেলে অপদার্থ হবে কেন? এ কেমন কথা? তবে ছেলেটা চলে যাবে তার আগে একটু কথাবার্তা বলবে তা নয় দাদা ওকে নিয়ে চলল দিল্লী।'
-' বেশি কথা বলার দরকার নেই একদম লাবণ্য। একটু সবুর করুক। অনেক কথা বলেছে এত দিন এখন একটু বিরহে কাল কাটাক দেখি। ভালো হয়েছে তোমার দাদা ওকে নিয়ে গেছে না হলে আবার ছুটত ভোলা দেখা করতে।'
-' সে তো আজও গেছে স্টেশনে। তোমাকে বলা হয়নি তখন তুমি তো বাইরে গেছিলে।'
-' আমি জানি লাবণ্য সে যাবে কতদিন আর ভালোবাসার আগুনকে ছাই চাপা দিয়ে রাখবে? নাটুর চোখে মুগ্ধতা আমি অনেক আগেই দেখেছি। হবে না কেনই বা এমন মেয়ে কী সচরাচর দেখা যায়?'
লাবণ্য হয়ত এখন বোঝেন সত্যিই শৈলপুত্রীর মত মেয়ে হয় না শুধু সময় শিক্ষক হঠাৎই একটা শিক্ষা দিয়ে গেছে। ছেলেটাকে দেখে বাধ্য হয়েই সমস্ত অভিমান ভুলে সেদিন ছুটে গেছিলেন রাতে দাদার কাছে। তখন সত্যি মনে হয়েছিল যে শৈলপুত্রীকে নগণ্য বলে তিনি অবহেলা করেছেন সে সত্যিই দুষ্প্রাপ্য। শৈলজা দা সত্যিই তাঁর মেয়েকে হয়ত নিজের হাতে গড়ে দিয়ে গেছেন তাই বাবার সব গুণই সে পেয়েছে। তবে বাবার থেকেও বেশি আত্মাভিমানী শৈলপুত্রী। মিশ্রা বাড়ির মেয়ে বলে কথা,হয়ত মিশ্রাবাড়ির কিছুই সে পায়নি তবুও ঐ বংশের কৌলিন্য আর ঠাকুমার শিক্ষা নিয়ে বেঁচেছে এতদিন।
বাবা বৈদ্যনাথের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানান লাবণ্য ছেলেটা যেন সুখী হয়। বড় ভালো ছেলেটা,হয়ত বা খুব সরলও তাই ভালোবাসা বাঁচাতে কোথায় না ছুটে গেছে। ভাগ্যিস বুঝেছেন তার মনের কথা না হলে যে কী হত?
**********************
ট্রেন ছেড়েছে অনেকটা আগে জানলার দিকে তাকিয়ে আনমনা হয় শৈলপুত্রী। মনে তখন অনেকটা ঝড় বইলেও এটুকু বুঝেছে নটরাজকে বাধা দেবার মত শক্তি আর ওর নেই। দেওঘরের সেই প্রথম দেখার দিনটার কথা মনে পড়ে যায়। নটরাজের দেওয়া চিঠিটা খুব পড়তে ইচ্ছে করে তার সাথে কেমন যেন একটা বুকের মধ্যে কাঁপুনি হয় সাহাব কী বলতে চেয়েছেন চিঠিতে? আঙ্কেলজী ম্যাগাজিনে চোখ রেখেছেন তবে এখন কিছুতেই সেই চিঠি খুলে পড়া যাবে না। অপূর্ব ম্যাগাজিনে চোখ রেখেছেন কিন্তু মাঝেমাঝেই চোখ রেখে অনুভব করছেন বেবির চোখমুখ। তারপর কিছুটা বাদে বইটা সরিয়ে বলেন,' কী রে বেবি এত চুপচাপ কেন? তোর মা এলে সাথে ভালো হত। একটু কথা বলতে পারতি। ঐ হতভাগা নাটুটা কী বলছিল রে? তারপর থেকেই দেখছি তুই চুপ।'
যদিও অপূর্ব জানেন কিছুই বলবে না এই মেয়ে তবুও একটু খোঁচা মারা। সত্যিই রেবাকে খুব মিস্ করছেন।
-' কিছু না বলছে সাবধানে যেতে। ভালোভাবে থাকতে।'
-' বেশি খবরদারি শুরু করেছে তাই না। আমার সাথে যাচ্ছে আর ওর যত চিন্তা। হ্যাঁ রে আর কিছুই বলেনি?'
অপূর্বর মুখে হাসি,শৈলপুত্রী লজ্জা পায়,' কী আবার বলবে। তাড়াতাড়ি আসতে বলছেন। সেদিন স্যারের ওখানে গেছিলেন সেটা বললেন।'
-' সত্যিই ছেলেটার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। তা তুই হ্যাঁ বলেছিস তো? না হলে আবার দেওঘর থেকে কখন হয়ত দিল্লীতে এসে আমার কাজ পন্ড করবে।'
শৈলপুত্রীর মুখে রাঙা আভার ছোঁয়া জানলায় তাকায় আবার,' মা তো বলেছে তাই আর কী বলব। মা বলল সাহাবের তবিয়ত আচ্ছা নেই।'
-' তবিয়ত আচ্ছা নেই না আরও কিছু তাহলে আসতে পারে এখানে নাকি? সব নাটক বেটার।'
কথাগুলো বলে নিজে হেসে ফেলেন। এই বয়েসে এসে ছেলেমেয়ে দুটোর কান্ড দেখে ভালো লাগছে। আর নিশ্চিন্ত লাগছে এই ভেবে যে শৈলপুত্রীকে সুপাত্রে দিতে পারবেন। সেখানে নাটু তাকে মাথায় করে রাখবে। যাক একদিকে নিশ্চিন্ত বড় মায়া পড়ে গেছে মেয়েটার ওপর।
কিছুটা বাদেই অপূর্বর ছাত্রছাত্রীরা চারজন এল তাই অনেকটা সময় কেটে গেল। শৈলপুত্রীর মন লাগে না কোন কিছুতেই অদ্ভুত একটা অস্থিরতা চিঠিটার কথা ভেবে। কখন যে পড়তে পারবে সেটা ভেবে মনটা ব্যাকুল হয়। রাতে অপূর্ব নীচের বাঙ্কে শুয়ে পড়লে শৈলপুত্রী ওপরের বাঙ্কে শুয়ে বেডসাইড আলোটা জ্বালিয়ে নেয়। রাতে শোয়ার আগে বই পড়া তার অনেক দিনের অভ্যেস। কাটিহারের বাড়িতে সারাদিন কাজের শেষে রাতে বই পড়ত। সেসব বই কী হয়েছে কে জানে শুধু গীতবিতান, গীতা আর রামকৃষ্ণ কথামৃত খানা এসেছে ওর সাথে ট্রাঙ্কে করে।
তবুও সাবধানী হয় শৈলপুত্রী যদিও জানে আঙ্কেলের রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুতে হয়। ও নিজেই সব ধরিয়ে দিয়েছে হাতের কাছে রাতে খাবার পর।
হাত ব্যাগে থাকা বইটার মাঝ থেকে খামটা বের করে শৈলপুত্রী। প্রথমে ওপরে হাত রাখে যত্নে,এভাবে এই প্রথম বোধহয় কেউ ওকে চিঠি পাঠাচ্ছে। তবুও খামটাকে আদরে হাত বোলায় আবার। তারপর যত্নে মুখটা খোলে দুরুদুরু বক্ষে যেন কী একটা নিষিদ্ধ কাজ করতে যাচ্ছে। আবার উঁকি দিয়ে নীচে দেখে আঙ্কেলজী ঘুমোচ্ছে। আর তারপর শব্দের অনুভূতির উচ্ছ্বল স্রোতে ভাসতে থাকে শৈলপুত্রী
' প্রথমেই লিখি আমি আর কিন্তু আপনি আজ্ঞে করতে পারছি না। আজ থেকে তুমিই বলব,বন্ধুকে কী আপনি বলা যায় নাকি? শৈলপুত্রী তোমায় প্রথম দেখেছিলাম চাচীর বাড়িতে। তখন তোমার এলোমেলো ঝাঁকড়া চুলে ঘেরা মুখটা দেখে মনে হয়েছিল হঠাৎই রণচন্ডী তুমি তারপর জেনেছিলাম তোমার নাম শৈলপুত্রী। অদ্ভুতভাবে তোমার নামটা ভীষণ টেনেছিল আমাকে। নটরাজের নামের পাশে শৈলপুত্রীর নামটা সেদিনই বসিয়ে নিয়েছিলাম আমি।
এতটা পড়ার পর শৈলপুত্রীর বুকটা থরথর করে কাঁপে এ তো সব ভালোবাসার কথা। শৈলপুত্রীর জীবনে প্রেম কখনও আসেনি সেভাবে। সংসারের অভাব অনটনে কখন যে বসন্ত এসে গেছিল বুঝতেই পারেনি। শৈলপুত্রীর মনের রুক্ষ মরুভূমিতে নটরাজের মত হয়ত কেউই এমন জলসিঞ্চন করতে পারেনি।
আবার চিঠিটা বুকের থেকে হাতে নেয় শৈল পড়তে শুরু করে
' একটা সময় ছিল যখন তোমায় রণচন্ডী রূপে দেখেই মুগ্ধ হয়েছি। তারপর ধীরে ধীরে চাচীর বাড়িতে গিয়ে দেখেছি তোমাকে জয়া,বিজয়া অভয়া রূপে। কখনও তুমি লক্ষ্মীমন্ত,কখনও আবার সরস্বতীর বরপুত্রী আবার কখনও দুর্গার মত। সত্যিই প্রথমটা কিছুই বুঝিনি তবে তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগত। তোমাকে এগিয়ে দিয়ে সামনের দিকে সুখ পেয়েছি। একসাথে ট্রেনের পথটুকু লিখে রেখেছি অমর করে মস্তিষ্কের ইতিহাসে। তারপর তুমি চলে যাবার পর বুঝতে পারলাম শৈলপুত্রী নামের মেয়েটা আমার বিশেষ কেউ ছিল। কথায় বলে আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড। কিন্তু আমি বলব শৈলপুত্রীর অভাব আমি আরও বেশি করে বুঝলাম ও চলে যাবার পর। দেওঘরটা মুহূর্তে কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল ঠিক মনে হল আমার আপনজন কেউ একটা চলে গেছে। কোন কাজে মন বসাতে পারতাম না।
কলকাতা এসে দেখলাম শৈলপুত্রীকে চেনা যায় না সে যেন বহুদূর চলে গেছে। এ আমার অপরিচিত শৈলপুত্রী তার হাসিতে ছন্দ নেই,কথাতে মাটির গন্ধ নেই। মনে হল হঠাৎই শহুরে আবহাওয়া পেয়ে রঙবদল হয়ে গেছে তোমার। তবে সাজগোজের দিকে কোন ফারাক দেখিনি তেমনি সাধারণ ছিলে। মামু আর মামিমা আমার থেকে কেমন যেন দূরে দূরে রাখতেন তোমাকে। খুব রাগ হল মামুর ওপর এই ভেবে যে আমি মেয়েটাকে কলকাতায় এনে দিলাম সাথে করে আজ হঠাৎই সে মামুর সবটা হয়ে বসে আছে। মামুর আদরের একভাগও আমি পাচ্ছি না। আর শৈলপুত্রীকে তো একটুও পাচ্ছি না যার সাথে কথা বলে মনটা শীতল করব।
লজ্জা পায় শৈলপুত্রী আদর বোধহয় সবাই চায়। সেও চেয়েছিল একসময়। কিন্তু পায়নি কিছুই। একটা সময় অভ্যস্ত হয়ে গেছিল অনাদরেই তারপর অনাদরেই থাকাতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছিল।
-' সেদিন তোমাকে খারাপ কথা বলেছি তারপর মন খারাপ করেছি খুব। বড় বিস্বাদ সেই দিনগুলো। তবে এখন আবার সব আগের মত। আমার চেনা শৈলপুত্রীকে খুঁজে পেয়েছি আমি। আচ্ছা সামনাসামনি যে কথা বলতে পারব না সে কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে এখন। একটা কথা বলবে আমাকে কোনওভাবে কী আমি সুশোভন বাবুকে আহত করলাম?
আচ্ছা থাক সেসব কথা তবে ভীষণ ভালো মানুষ উনি। তোমাকে খুব সামলে রাখতেন হয়ত একদম আগলে রাখতেন তার অভিভাবক সুলভ হৃদয় দিয়ে। সেসব হয়ত ঠিকই ছিল তবে আমাকে কে সামলাত?
আমি তো একদম বেসামাল হয়ে গেছিলাম। কথাটা শুনে একদম হেসো না। এইসব কথা কি মুখে বলা যায় নাকি? তাই তো চিঠি লিখতে বসলাম।
শৈলপুত্রী আর পড়তে পারে না ভীষণ মনে দোলা দেয় কথাগুলো। তারপর নিজেই বলে,' ইশ্ এখনও ওনাকে সামলাতে হয়?' তারপর আবার চিঠিতে চোখ রাখে..
মনের কথা ভেবে ভেবে লিখছি,তোমার কিছু কথা শোনা হল না তেমন করে জানি না তুমি কী মনে করছ? তবুও কত কী বলে ফেললাম। আমিও চলে যাব একদিন বাদেই দেওঘরে। তবে আবার আসব তাড়াতাড়ি ঠিক। কত কথা বলব তোমার সাথে। এবার আর ফাঁকি দিয়ো না আমায়। আর হ্যাঁ মায়ের কথাতে কিছু মনে কোর না। মা বাবাও আমার মতই আছেন তোমারই প্রতীক্ষায়। কবে তোমার আলতা মাখা পায়ের ছাপ পড়বে আমাদের বাড়িতে। বাবা তো রীতিমত অস্থির। সেদিন ফুলবন্তী বলছিল আমার একজন মেমসাব দরকার যে আমাকে গুছিয়ে রাখবে। তুমি তো জান আমি এলোমেলো। এবার যদি শোনে আমি তোমাকে ভালোবাসি তবে ওরা কী বলবে কে জানে? ভালোবাসার কথাটাও লেখা হয়ে গেল চিঠিতে। তুমিও কী আমার কথা ভাবতে? সুশোভন বাবু বলেছেন তুমি তাঁকে বলেছ কেউ তোমাকে পছন্দ করে,আর তাকে বাঁচানোর জন্যই তুমি বিয়ে করছ। সুশোভন বাবু তো একচোট নিলেন আমাকেই সেদিন বললেন আমি নাকি ভীতু একটু হলেই ভালোবাসা বেহাত হয়ে যাচ্ছিলো।'
শৈলপুত্রীর আপন মনে হাসে।
চিঠিটা ভাজ করে ব্যাগের মধ্যে যত্নে রাখে শৈলপুত্রী। অবিরাম গতিতে ট্রেন ছুটে চলেছে। শৈলপুত্রীর মনও ছুটে চলেছে অতীত থেকে বর্তমানের পথে হয়ত কল্পনায় আল্পনা দিচ্ছে ভবিষ্যতের উঠোনেও। বারান্দায় চেয়ারে বসে তারার দিকে তাকায় নটরাজ মনে মনে ভাবে শৈলপুত্রীর কী চিঠিটা পড়া হয়েছে? ইশ্ কত কি লিখেছে চিঠিতে। হয়ত শৈলপুত্রীর হাসিও পাবে সেইসব দেখে। নিজের আসেপাশে শুনতে পায় শৈলপুত্রীর হাসির শব্দ,অদ্ভুত তীক্ষ্ম পাহাড়ী বৃষ্টির ধারার মত।
একটা হাসিমাখা মুখ নিয়ে ট্রেনের বাঙ্কে শুয়ে স্বপ্ন দেখে শৈলপুত্রী আবার কেউ আসছে ওর জীবনে তার জাদুর ছোঁয়া পেয়ে রুক্ষ্ম মরুভূমিতে হয়ত আবার ফুটবে সাদা তরতাজা ফুল।
দিল্লীর দিনগুলো ব্যস্ততায় কাটছে শৈলপুত্রীর আঙ্কেলজীর সাথে হাতে হাতে কাজ করে সারাদিন কেটে যায় তার মাঝে শিখেছেও অনেক কিছু আজকাল রঙ তুলির পাশাপাশি ছেনি দিয়েও মূর্তি গড়ার টুকরো কাজ করতে পারে ও। আঙ্কেলজী হাসেন,' তুই তো শৈলজার মতই একদম মাল্টি ট্যালেন্টেড।'
-' তাই তো বাবার কিছু হয়নি জীবনে। বাবা বলতেন জীবনে একটা দিক ধরেই এগোনো ভালো। আরেকটা দিক সাথে রাখতে হয় যে কাজ তোমাকে ভালো রাখে। ভালো রাখার কাজ মানে পছন্দের কাজ পেশা হিসেবে পায় কজন মানুষ?'
-' বাহ্ কি সুন্দর করে বললি! তবে আমি পেয়েছি পছন্দের কাজ করার সুযোগ জীবনে।'
কলকাতা থেকে মা রোজই ফোন করেন। খুব ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে শৈল। মাকে মনে পড়ে মাঝে মাঝেই। একটা বড় টিপ আর শাড়ির আঁচল মনে রয়ে গেছে। আর মায়ের বিশেষ বিশেষ দিনের সাজ। রেবা মায়ের সাথে কথা বলে আদর আর শাসনের ছোঁয়া পায় শৈল। মা দরকারে যেমন বকেন তেমন ভালোবাসেন। শুনতে পায় আজকাল পিসিমা মাঝে মাঝেই ফোন করে ওর শরীরের খবর জানতে চায় মায়ের কাছে। শৈলপুত্রীর ইচ্ছে করে জানতে সাহাবের কথা। হয়ত মা তা বুঝতে পারে তাই বলে,' হ্যাঁ নাটু ফোন করেছিল,ভালো আছে সে। তোর সাথে কথা হয়?'
-' না মা,এখানে ফোন করেননি উনি।'
শৈলপুত্রী চোখ বোজে ভাবে কত কথাই তো রোজ হয় মনে মনে। কিন্তু সাহাব ওর কাছে চিঠির জবাব চেয়েছিলেন কিন্তু ও তো চিঠি লেখেইনি। এখানে কতদূরে পোস্টঅফিস ও কিছুই জানে না। চিঠিতে সাহাব দেওঘরের ঠিকানাও দিয়েছেন। সেদিন এক্জিবিশন থেকে ফেরার পথে হঠাৎই পোস্ট অফিসটা নজরে পড়ে শৈলর। খুব একটা দূর নয় এখান থেকে। একটা খাম আনলেই তো হয়ে যায়।
অফিস থেকে এসে প্রতিদিনের অভ্যেসে লেটার বাক্সে হাত রাখে নটরাজ আজ চিঠির বাক্সে কাগজের লুকোচুরি চোখে পড়ে। তাড়াতাড়ি তালা খুলতেই চিঠিটা হাতের মুঠোতে চলে আসে। প্রেমে পড়া বোধহয় আছড়ে পড়া এক সমুদ্র ভালোবাসার গহীন দীঘিতে। প্রথমটা হাতের লেখা দেখে উত্তজনায় একটু হাঁফিয়ে নেয় নটরাজ তারপর ছুটে ঘরে এসে হাত পা ধুয়ে শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায় হাতে শৈলপুত্রীর চিঠি। এই চিঠি ফুলবন্তী কে লেখা নয় এটা ওর চিঠি।
তারপর প্রথম প্রেমের চিঠিতে চোখ রেখে কেটে যায় কতগুলো ঘন্টা বুঝতেই পারে না নটরাজ। শৈলপুত্রীকে দেওয়া চিঠির জবাব আশা করেনি। কারণ দিল্লীর ব্যস্ততা তারপর অচেনা জায়গায় কোথায় পাবে পোস্ট অফিসের হদিস সে? সুতরাং সব জবাব নিজেই মনে মনে ভেবে নিয়েছিল এতদিন। ভেবেছিল কলকাতা গেলে একদিন দেখা করে সবটা জানবে পড়তে চাইবে ওর মনটা। কিন্তু তার আগে এই চিঠিটা বাড়তি পাওয়া নটরাজের কাছে। ও জানে শৈলপুত্রী অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা। তারপর ওর জীবনে একটা ইতিহাস আছে। তাই হয়ত সে উদ্দাম ছেলেমানুষীতে ভরপুর প্রেম নিবেদন করতে পারবে না তবে বুঝবে কিছুটা হলেও নটরাজের মন। চিঠিতে চোখ রাখে নটরাজ এখন ওর আর শৈলপুত্রীর সাজানো অক্ষরের মাঝে আর কেউই নেই।
' সাহাবজী, আপনাকে এই নামে ডাকতেই আমার ভালো লাগে। প্রথম তো এই নামেই ডেকেছিলাম আর নির্ভর করেছিলাম আপনার ওপর। যখন আমি খড় কুটোর মত ভাসছি তখন আপনি কোথা থেকে যেন এসেছিলেন আমার জীবনে। আপনার চোখ দিয়ে আমি কত স্বপ্ন দেখেছি। আমার আঁকা,কাজ,পড়ানো সবই হয়েছে। নাহ আজ ক্যায়া মিলা মুঝে ও নিয়ে ভাবব না আর। একটা সময় খুব কাঁদতাম ঐ আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে বাবার জন্য। তাই বোধহয় বাবা অনেক রোশনি পাঠিয়ে দিয়েছেন আমার জন্য। আপনি,আঙ্কেলজী,মা,স্যার হলেন আমার জীবনের রোশনি। আপনাদের আলোতে আমি আলোকিত হয়ে আছি। আপনি বলেছেন আমাকে ছাড়া আপনার জীবন অন্ধকার শুনে খুব হেসেছি আমি। আপনি তো কত মানুষকে রোশনি দেন তার জীবন অন্ধকার হয় নাকি? খুব ছেলেমানুষ আপনি,পিসিমা আপনাকে বড় হতেই দেয়নি।'
নটরাজ নিজের কপাল চাপড়ায় একবার,' ইশ্ শেষে বাচ্চা বানিয়ে দিল ওকে? অথচ ও নিজে দায়িত্ব নিয়ে শৈলপুত্রীকে কলকাতা পৌঁছে দিয়েছে। নাহ্ একদম ঠিক নয় কথাটা। একটাও ভালো কথা লেখেনি মানে ভালোবাসার কথা। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত আর কী লেখা আছে। আমি রোশনি হতে চাই না শৈলপুত্রী আমি তোমার বন্ধু হতে চাই। এটা আর কবে বুঝবে?'
দিল্লীতে ওর ব্যস্ততার কথা,ও কী কী দেখেছে সব লিখেছে। তারপর একটু ভালোবাসার ছোঁয়া মাখানো অনুভূতি দিয়ে শেষ করেছে চিঠি,' আপনার কথা কখনও ভুলিনি সাহাব। এখানেও সবসময় আপনাকে য়্যাদ করি। তাই তো চিঠি লিখলাম। আপনি হয়ত ভাববেন শৈলপুত্রী জবাব দিল না তাই নিজে পোস্টঅফিস গিয়েছিলাম।'
নটরাজের ভাবনায় শৈলপুত্রী কতক্ষণ ঘোরাঘুরি করছে ঠিক বুঝতেও পারেনি শুধু ডুবে গেছে শুধু ওকে লেখা চিঠিটাতে। শৈলপুত্রীর অতীতের জানলাও খুলেছে নটরাজের কাছে, শৈলপুত্রীর ভয় ওর অভিশপ্ত জীবনের গল্প একটু হলেও বলেছে। একটা সময় ভেবেছিল ও যেমন মা বাবা হারিয়েছে তেমন হারালো শিবনারায়ণ বাবুকে তাই ভালোবাসার মানুষদের নিয়ে বড় ভয় মনে। সবসময় ভাবে তাদের যেন কোন ক্ষতি না হয়।
' আপনাকে আমি সেই কবে থেকে আপনার জন ভেবেছি তাই তো দূরে দূরে থাকি যেন আপনার কোন বিপদ না হয়। অথচ আপনিই আমাকে কাছে ডাকলেন স্যারের বাড়িতে গেলেন।'
চিঠিটা পড়া অনেকটা আগে শেষ করেছে নটরাজ মনে মনে বলে,' এখন কি কাছে টেনেছি আরও কাছে রেখে দেব তোমাকে।'
মনে পড়ে গেল গানটা আমার হাত বান্ধিবি পা বান্ধিবী মন বান্ধিবি কেমনে আমার চোখ বান্ধিবি মুখ বান্ধিবি পরাণ বান্ধিবি কেমনে?
আমার ইচ্ছা বান্ধিবি সোহাগ বান্ধিবি অনুরাগ বান্ধিবি কেমনে....
তারপরে একটা কথা মনে পড়ে গেল শৈলপুত্রীর বলা,' নেশা তো আপনি ধরিয়েছেন সাহাব আমি আমার কাম করতে চাই,অনেক দূর এগোতে চাই। আমার কামকে কোনদিন হিংসে করবেন না তো? আমি কামকে খুব ভালোবাসি হয়ত বা আমার নিজের চেয়েও অনেক বেশি। কাম আমাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছে সাহাব। আমার দুঃখ যন্ত্রণা আর আনন্দের সঙ্গী আমার রঙ তুলি ও আমি ছাড়তে পারব না।'
আবার নটরাজের চোখে শৈলপুত্রীর জায়গা অনেকটা উঁচুতে উঠে যায়। ছেলেরা যদি বিয়ের আগে মেয়েদের রান্না,পড়াশোনা আর গানবাজনা নিয়ে একগাদা কথা বলে তাদের রান্নাঘরে ঢুকিয়ে দিতে পারে কোন প্রতিশ্রুতি না রেখে তাহলে মেয়েরাই বা কেন বলবে না আমি যা জানি সেগুলো যাতে নষ্ট না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
নটরাজ আনমনা হয় নিজেই বলে মনে মনে আমি খেয়াল রাখব শৈলপুত্রী শুধু তোমাকে ছেড়ে থাকতে হবে আরও কিছুদিন। কারণ তোমার এখনও পড়াশোনা বাকি।
শৈলপুত্রীর ফেরার দিনটাতে চোখ রেখে আবার ক্যালেন্ডার দেখে নটরাজ। তারপরেই একেবারে কলকাতা যাবে ভাবে। চিঠিটা রেখে দেয় যত্নে,সামনাসামনি যে কথাগুলো হয়নি সেগুলো হল কিছুটা চিঠিতে। ফোনটা বাজে নিশ্চয় মা ফোন করেছে। ফোনটা ধরতেই মন বলল যা ভেবেছে তাই ঠিক। টুকরো ভালো খবরের পর মা বলে,' এবার তুই এলে একটু আলোচনা করব। যদি দাদা বৌদি বলে তাহলে বিয়ে ভাবছি এই বৈশাখেই দেব। আর দেরি করতে চাই না ঘরের লক্ষ্মী আসুক ঘরে। তোর বাবা বড় অস্থির হয়েছে।'
অবাক লাগে নটরাজের এই মা একটা সময় শৈলপুত্রীকে অলক্ষ্মী বলেছিল। যাক তবুও শৈলপুত্রীকে গ্ৰহণ করেছে মা মন থেকেই বাধ্য হয়ে নয়। তাহলে হয়ত ওকে নিয়ে অন্য কথাই ভাবতে হত।
মা শৈলপুত্রীর কথাও বলতে থাকে এক নাগাড়ে মামিমা খুব প্রশংসা করেছেন ওর। নিজের বাবার মতই আগলে রেখেছে মামুকে। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে।
যে কথা মা বুঝেছে আজ সেই কথা অনেক দিন আগে বুঝেছিল নটরাজ যে শৈলপুত্রীর এই লেগে থাকা আর কঠোর পরিশ্রম ওকে এগিয়ে নিয়ে যাবে অনেক দূরে। হয়ত সংসার ভাঙার গল্পটাই শৈলকে নিয়ে গেছে এক অন্য ভালোবাসার জগতে। যেখানে অন্যকে খুশি না করতে পেরে নিজের খুশির জন্য কাজকেই বেছে নিয়েছিল সে। কথার মাঝে আনমনা হয়ে যায় নটরাজ। মা জিজ্ঞাসা করে,' একদিন মামুকে ফোন করতে পারতিস হোটেলের নম্বরে। তাহলে তার সাথেও কথা হত।'
-' না মা মামু ব্যস্ত থাকেন বলে আমি আর করিনি মামিমাকে করেছি তো।'
শৈলপুত্রীর লেখা চিঠিটার কথা সঙ্গোপনে রেখে দেয় নিজের মনের মাঝে। আজ সত্যিই মনটা ভীষণ ভালো লাগছে।
মায়ের সাথে কথা শেষ করে বাবার সাথে কথা বলে নটরাজ। তারপর বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখে ফুলের গাছগুলো রঙীন হয়ে উঠেছে বসন্তের আগমনে। চারদিকে রঙের ছোঁয়া ওর মনটাকেও ভালো করে দেয়। গেটের কাছে সাইকেলের বেল বাজে প্রতাপের সাইকেল থেকে নামছে ফুলবন্তী। নটরাজের চা টিফিন দিয়ে একেবারে রাতের রুটি তরকারি করে যাবে। প্রতাপ ততক্ষণ একটু পরিচর্যা করবে গাছগুলোর। মথুরা একটু বাদেই বাজার থেকে আসবে।
চিঠিতে সবার কথাই লিখেছে শৈলপুত্রী। তবুও ফুলবন্তীকে কিছু বলতে পারে না নটরাজ। গোপনে মনে মনে স্মৃতির অনুরণনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফুলবন্তী চা দিতে এসে আনমনা দেখে নটরাজকে।
-' বাবুজী কুছ হুয়া ক্যায়া? আজ থোড়া সা আলগ লাগ রহা ..'
-' সব কুছ ঠিক হ্যায়।' নটরাজ বুঝতে পারে ওর রঙবদলের ছবি আজ ফুলন্তীর চোখেও ধরা পড়েছে।
***********************
সানন্দার উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে আদিত্য। আজকাল সানন্দা উইকএন্ড বাপের বাড়িতে কাটায়। আদিত্যর মনে হয় ওটা হোটেল। কারণ আদিত্যর আগে সেখানে প্রবেশের অধিকার থাকলেও ইদানীং ওকে আর অ্যালাউ করে না সানন্দা।
-' এই শোন তুমি বেড়ালের মত এখানে ঘুরে ঘুরে এসো না। এটা আমার বাড়ি তাই এখানে আমি যা খুশি তাই করব। সারা সপ্তাহ তোমাদের ঐ বাড়িতে নিয়মে থেকে আর তোমার রুগী মায়ের মুখ দেখে আমি অতিষ্ঠ। আমাকে আমার মত থাকতে দাও।'
হাল ছেড়ে দিয়েছে আদিত্য। প্রথমে ঝগড়া হত তারপর চেঁচামেচি এখন সবটাই হালছাড়া ব্যাপার হয়ে গেছে। আদিত্য মাথা ঘামায় না আর আসলে মাথা তো একটাই আর যেন পারছে না। সবই কেমন যেন হয়ে গেল। নিজেকেই মাঝে মাঝে দোষী মনে হয় ওর। সুখকে আগলে রাখতে পারেনি। হয়ত সুখী হতেও জানতে হয়। ছুটে গেছে নিজেকে আরও ভালো রাখার স্বপ্ন পূরণের দিকে কিন্তু শেষে মন্দবাসার ঘরে কোনরকমে অপ্রেমে দিন কাটছে। আজকাল সানন্দা কথায় কথায় ডিভোর্স চায়। হয়ত মুক্তি চায় আদিত্যও কিন্তু দাদা বলে দিয়েছে,' তুই একদম ঘাড় পাতবি না কারণ আর প্রচুর খরচ করার মত অবস্থা আমাদেরও নেই। বাড়িতে অলক্ষ্মী বাসা বেঁধেছে। ওর যদি দরকার হয় ডিভোর্স নিক তুই বাধা দিস না। তবে এত বোকা সানন্দা নয় সে ঘুরিয়ে টাকা আদায় করতে চায়।
কলেজে বন্ধ থাকলেও সুশোভন ব্যস্ত রাখে নিজেকে। এর মধ্যে অনেকগুলো ছবি এঁকেছে ও। কিছু ছাত্রছাত্রীরা প্রায় আসে। তবে সেদিনের পর আর শ্যামার সাথে দেখা হয়নি। তবে শ্যামার সাথে কাটানো সেই একটা দিনের স্মৃতি সুশোভনের মনের মণিকোঠায় রয়ে যাবে অনেক দিন। তবে সবই ভালোর জন্য হয়েছে নটরাজের প্রেম শৈলপুত্রীকে ভালো রাখুক। বড় রুক্ষ,সাদামাটা মেয়েটা। মনে মনে শৈলপুত্রীর নববধূ রূপের একটা ছবি আঁকে সুশোভন। আচ্ছা ওর মাথায় যদি একটা টায়রা থাকে না না টিকলিই ভালো। ওর ঝাঁকড়া চুল একটু অবাধ্য হয়েই ধরা দেবে। চন্দনের মাঝে একটা লাল টিপে বেশ লাগবে ওর জোড়া ভুরু জড়ানো মুখটা। নিজের মনের সাদা ক্যানভাসের পাতায় বড় করে আঁকেন ছাত্রীর মুখটা। সেরা ছাত্রী বলে কথা।
অপূর্ব দিল্লীতে থেকেও ব্যস্ত হন মনে মনে এতদিন রেবাকে ছেড়ে কখনই থাকেননি। এই বয়েসে এসে বিরহ সহ্য করা বোধহয় বড়ই কঠিন। এদিকের কাজ প্রায় শেষ হয়ে আসছে। রেবাকে যদিও কিছু বলেননি অপূর্ব কিন্তু ঠিক করেছেন চারদিন আগেই চলে যাবেন। রেবাকে সারপ্রাইজ দিতে। বেবিকে বলতেই হেসে ফেলে ও সত্যিই আঙ্কেলজীর মনটা খুব সাদা মাকে কত ভালোবাসেন। তারপরেই ওর মনে হয় এমন কেউ আছে যে ওর জন্য অপেক্ষায় বসে আছে। ভালোবাসা তার এত বেশি যে শেষ পর্যন্ত স্যারের কাছে! আবার মুখ ঢাকে শৈলপুত্রী।
ভোর রাতেই এসে নেমেছেন নিজের পুরোনো শহরে অপূর্ব। বেবি বারণ করলেও শোনেননি মোটামুটি মাঝ রাতের ফ্লাইট ধরেছেন আজ ভোরবেলা বাড়িতে ঢুকে একদম চমকে দেবেন রেবাকে। রেবার অস্থিরতা বুঝেছেন ওখানে থেকেই।
নিঃসন্তান তাঁরা ঘাত প্রতিঘাতে ক্লান্ত দুজনেই আশ্রয় নিয়েছেন দুজনের কাছে। হাতে হাত রেখে হেঁটেছেন কত চেনা অচেনা পথে। তাই রেবার অভাব সারাক্ষণ অনুভব করেন অপূর্ব। নিজের বাড়িতে আজ চুপিচুপি ঢুকলেন যদিও গেটে দারোয়ান আছে সেই খুলে দিল দরজা। রেবা এখনও ঘুমোচ্ছে তিনি জানেন। বরাবর রেবা একটু দেরিতে ওঠেন,আগে অনেকটা সময় স্বামীর সাথে জাগতেন সেই অভ্যেস রয়ে গেছে এখনও। এখন রাতে অবসরে বই পড়েন তারপর শুতে যান। আঙ্কেলের কান্ড দেখে অবাক হয় শৈলপুত্রী প্রকৃত ভালোবাসা যদি থাকে তাহলে বোধহয় তা বয়েসের সাথে আরও গাঢ় হয়। আঙ্কেলজী আর মাকে দেখে সত্যি অনেক কিছুই শেখার আছে। শুধু প্রতিমা আর মূর্তিতে রঙ চড়ান না আঙ্কেলজী ভালোবাসার রামধনু আঁকেন।
অপূর্ব চুপিসারে নিজের ঘরের দিকে যান। শৈলপুত্রীর সত্যিই হাসি পায় সে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে কিছুটা সময় হাসে ওর বাবা একটা কথা বলতেন নরানাং মাতুলক্রমঃ সেইজন্য বোধহয় সাহাবও এত রোমান্টিক। যে শৈলপুত্রী তেমন করে কখনও প্রেমের কথা ভাবেনি আজ সেও ভাবে প্রেমের কথা। সত্যিই বোধহয় ভালোবাসাও ছোঁয়াচে। তবে তার সুন্দর প্রকাশ চাই,ভালোবাসা থাক মননে আর অনুভূতিতে ভালোবাসা থাক অভ্যেসে। ভালোবাসা আতিশয্যে নয়,নীরবে শান্ত নদীর মত গভীরতা মাপা যায় না যার সেটাই বোধহয় ভালোবাসা।
ঘরে কোন আওয়াজ না করে ঢুকবেন ভেবেও আওয়াজ করে ফেলেন। চোখ খোলেন রেবা,বরাবর তাঁর ঘুম পাতলা।
অপূর্ব বলেন,' ইশ্ ভাবলাম চুপিসারে এসে তোমার ঘুম ভাঙাবো তা জেগে গেলে?'
রেবা কোন কথা না বলে চাদর মুড়ি দিয়ে আয়েশ করে চোখ বোজেন। অপূর্ব অবাক হন দেখে,এটা কি রেবা না অন্য কেউ? একটুও অবাক হল না। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বলল না তুমি এসে পড়েছ? যাই চা করে আনি। অদ্ভুত যেন চিনতেই পারল না। রেবাকে অবাক করতে গিয়ে নিজেরই অবাক হবার পালা। তাড়াতাড়ি করে বিছানার কাছে গিয়ে রেবার গায়ে হাত দেন,' কী গো শরীর তোমার ভালো তো? কোন কথা বললে না?'
কিছুক্ষণ চুপ থেকে রেবা বলেন,' তোমাকে দেখে নিশ্চিন্ত হলাম। কাল ভালো করে ঘুম হয়নি। তাই তুমি এলে এবার আমি ঘুমোব। আর সে কোথায়? তাকে বল হাত পা ধুয়ে একটু চা বসাক। কতদিন তার হাতের চা খাইনি।'
-' রেবা তুমি পারো বটে আমিও তো উল্টো পথে বোকা হয়ে গেলাম গো।'
রেবা হাসেন বিজয়িনীর হাসি। অপূর্ব আরেকবার ফিদা হয়ে যান। একটু বাদেই বেবি চা কর আনবে।
বেশ কয়েকদিনের জন্য অফিস ট্যুরে নটরাজকে ভাগলপুর যেতে হয়েছিল। মায়ের কাছে শুনেছে মামু ফিরে এসেছেন। তাই ফোন করেছিল অনেকটা সময় কথা হল। তবে শৈলপুত্রীকে পাওয়া যায়নি। ও কিছু বলার আগেই শুনেছে মামার কাছ থেকে যে ও রুবিদির ওখানে। অপূর্ব নটরাজকে জিজ্ঞেস করলেন কবে আসবে সে এখানে? কারণ ওর মা বেবিকে আশীর্বাদ করতে চাইছে তাড়াতাড়ি।
-' হ্যাঁ মামু আমাকে একটু ভাগলপুর যেতে হবে। তারপর দেখছি কবে যাই। আমিও অনেকদিন যাই না।'
হয়ত নটরাজের খারাপ লাগে তবুও কাজকে সব সময় প্রাধান্য দিতে হবে নাহলে হয়ত সবই বৃথা। তাই ভাগলপুর হয়ে কদিন কাজকর্ম সামলে আবার দেওঘরে ফিরে এসেছে নটরাজ। ইচ্ছে থাকলেও এই সপ্তাহে নয় পরের সপ্তাহে বাড়ি যাবার কথা ভেবেছে।
আজ রবিবার সকালে উঠে নিজের মত চা করে নিয়ে বারান্দায় বসে নটরাজ। মনটা উদাস হয়ে যায় কখনও একা থাকতে ভালো লাগে নিজের সাথে দোস্তি করে। হঠাৎই দেখতে পায় দূরে পুচকেগুলোকে। দল বেঁধে এদিকেই আসছে। ওকে দেখে মংলু,মুন্না, বিন্তী একসাথে চেঁচিয়ে ওঠে,' সাহাব দিদি আয়ি।'
-অবাক হয়ে যায় নটরাজ শৈলপুত্রী এসেছে নাকি? কিন্তু তা কী করে হয়?
তাই বলে,' ক্যায়া? কৌন দিদি?'
-' ও শৈলপুত্রী দিদি। ভুল গয়ে ক্যায়া ইতনি জলদি?'
অদ্ভুত একটা ভালোলাগার জাদু মুহূর্তে ছড়িয়ে গেল নটরাজের মনে। কিন্তু এতটা দূর থেকে ওদের কে খবর দিতে পাঠালো ওকে? আর শৈলপুত্রী কার সাথে এল? মামুর সাথে এলে তো এখানেই আসত।
পুচকেগুলোকে হাত দিয়ে ডাকার আগেই ওরা ছুটে এসেছে গেট খুলে বাগান পেরিয়ে একদম বারান্দায়। নটরাজ জিজ্ঞেস করে,' তুমহারা ও ম্যাডাম দিদি আয়ি কিসকে সাথ?'
-' ও নানাকে সাথ আয়া আজই। মা নে বোলি মা থোড়ি দের সে আয়েগী।'
মাথাটা কেমন যেন জট পাকিয়ে যায় নটরাজের বুঝতে পারে মহারানী কোন খবর না দিয়ে একদম ওকে সারপ্রাইজ দিতে হঠাৎই এই দেওঘরের মাটিতে পা রেখেছেন চাচার সাথে। ফুলবন্তীর পোয়াবারো কারণ একে রবিবার তাই জানে নটরাজের অফিসের তাড়া নেই তারপর এতদিন বাদে দিদির সাক্ষাৎ পেয়েছে সুতরাং একদম জমে ক্ষীর হয়ে বসে আছে। নটরাজ যাতে চিন্তা না করে তাই এই ছোট ছোট বানর সেনাগণকে পাঠিয়েছে খবর দিতে।
তবুও নটরাজের কৌতূহল যায় না মানে ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাসই হচ্ছে না তাই জিজ্ঞাসা করছে আবার,' তুমলোগো কো কৌন ভেজা ইধার?'
-' মা নে ভেজি,দিদি তো বোলি কুছ খবর নেহি দেনে কো।'
শৈলপুত্রীর মাথায় তাহলে ভালো দুষ্টু বুদ্ধি গজিয়েছে। এখানে এসেছে হঠাৎই কোন কাজ ছাড়া ওকে খবর না দিয়ে। যে মানুষটা ওকে এত ভালোবাসা দিয়ে কাছে রাখতে চায় তাকে না জানিয়ে হঠাৎই এসেছে। আবার আসার পরও ওকে জানাতে চায় না। খুব ইচ্ছে করছে নটরাজের গিয়ে একবার বকা দিয়ে আসে। কিন্তু উপায় নেই সে এখানে সবার সাহাব সুতরাং এভাবে হুট করে চাচীর বাড়িতে যাওয়া ঠিক নয়। তবে শৈলপুত্রীকে এখানে কী মামু পাঠালেন নাকি সে নিজেই বায়না করে এসেছে?
বাচ্চাগুলো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নটরাজের খেয়াল হয় ওদের পাওনা দিতে হবে। ওরা জানে সাহাবের কাছে অনেক লজেন্স বিস্কুট থাকে তাই যখনই আসে তখন নিয়ে যায় হাতে করে। ঘর থেকে তাড়াতাড়ি মুঠো ভরে চকলেট আর বিস্কুটের প্যাকেট ওদের হাতে দেয়। ওরা সেগুলো নিয়েও যায় না নটরাজকে বলে,' আপ আয়েঙ্গে সাহাব হামারে সাথ?
-' কাঁহা?'
-' ও দিদি সে মিলনে?'
নটরাজ বলে,' বাদমে যায়েঙ্গে, তুম যাও অব।' মনে মনে ভাবে তোমাদের দিদি একেবারে কে যে সে একবার আমার সাথে দেখাও করল না। মামুও একবারও বলেনি ওকে যে শৈলপুত্রীকে এখানে পাঠাচ্ছেন। সবাই ওকে নিয়ে মজা করছে।
বাচ্চাগুলো যেমন এসেছিল ঠিক তেমনি ছুটে চলে যায় ওকে হাত নেড়ে। নটরাজের মনটা অদ্ভুত একটা অস্থিরতায় ভোগে। অভিমানও হয় একটু। মা বাবাও নিশ্চয় জানে সবটা। ভাবে একবার মাকে ফোন করবে তারপর ভাবে নাহ্ থাক।
সকালের টুকটাক কাজ সারতে সারতে বারবার অন্যমনস্ক হয় নটরাজ। মনে হয় একবার ঘুরে এলেই ভালো হত। ফুলবন্তীর এখনও পাত্তা নেই ওদিকে জমে গেছে। কেউ তার খেয়াল রাখে না। হঠাৎই আবার অভিমান হয়। বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ গড়ায় আলসেমিতে। বাইরে গেটের আওয়াজ শুনতে পায় কাঁচের চুড়ির ঝুমঝুম বলে দেয় এটা ফুলবন্তী। আজ ফুলবন্তীও বকা খাবে এত বেলাতে এসেছে কাজে। প্রতাপটাও বাজারে যায়নি নিশ্চয় ফুলবন্তী কিছু একটা এনে ওকে ভোলাবে।
দরজা খুলে ফুলবন্তী ডাকে সাহাব..
নটরাজ সাড়া দেয় না। তাই আবার ডাকে,' বাবুজী একবার বাহার আইয়ে দরওয়াজা বন্ধ হ্যায় ক্যায়া?'
রাগ করেই দরজাটা খোলে নটরাজ কিন্তু তারপরে আর রাগ করতে পারে না। হঠাৎ একটা অদ্ভুত আবেশে আর আনন্দে মনটা গেয়ে ওঠে কবির লেখা গানে এসো এসো আমার ঘরে এসো। কিছুটা সময় কিছু বলতে পারে না নটরাজ। ফুলবন্তী সাহাবকে দেখে অবাক হয় অন্যসময় দিদিকে দেখলে কত বাতচিত করত সাহাব আজ কী হল? কে জানে তবিয়ত ঠিক আছে কী না?
-' সাহাব আপকে তবিয়ত ঠিক হ্যায় তো। দিদিকে সাথ কোই বাত নেহি কিয়া? থোড়ি দের হো গয়ি আপলোগ বাত কিজিয়ে ম্যায় তুরন্ত সব কর দুঙ্গী।'
নটরাজের উত্তরের অপেক্ষা না করে ফুলবন্তী হাতের ঝাঁটা নিয়ে বাগান আর উঠোন ঝাড় দিতে শুরু করে। নটরাজকে চুপচাপ দেখে শৈলপুত্রী বুঝতে পারে কিছুটা। তাই নিজেই বলে,' হরিহরণ চাচা গিয়েছিল আঙ্কেলজীর বাড়িতে আমার সাথে দেখা করতে তো ওখানেই শুনলাম যে এখানে আসবেন। তো মা বলল ঘুরে আসতে কিছুদিনের জন্য। মানে এই একটা সপ্তাহ। কলেজ খুলে যাবে আবার। আপনাকে পিসিমা কিছু বলেননি? সবাই তো জানে আমি আসছি। পিসিমা কত কিছু পাঠিয়েছেন আপনার জন্য।'
নটরাজ বুঝতে পারে এরা সবাই মিলে একটা গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত শুধুই ও জানে না কিছুই। তবে এই সময়টুকু আর মান অভিমানে কাটাবে না মনের মধ্যে শুধুই প্রেম থাক।
-' আচ্ছা বুঝতে পারছি আমি দূরে আছি বলে আমাকে কোণঠাসা করে সব প্ল্যান হচ্ছে। আমাকে কেউ কিছুই জানায় না।'
শৈলপুত্রীর মুখে একটা দুষ্টুমি ভরা হাসি নটরাজ দেখে। তার মাঝেই ঘরে ফোনটা বেজে ওঠে। শৈলপুত্রীকে চোখের ইশারা করে নটরাজ ঘরে চলে যায় ফোনের ওপারে মামুর গলা,' কি রে কি করছিস? ভাবলাম রবিবার সকালে তুই একলা বসে আছিস তাই ফোন করলাম।'
-' মামু এতসব কান্ড করে তুমি ফোন করছ এখন? আমি জানি তুমি সময় বুঝেই ফোন করেছ তাই না? একলা থাকার উপায় আছে নাকি আমার? মানে তোমাদের কান্ডকারখানায়।
-' ওহ তাহলে তোর ভালো লাগেনি সারপ্রাইজ। আচ্ছা বেবিটা কোথায় ডাক দিকি ওকে বলি একদম সোজা এখুনি চাচীর ওখানে চলে যেতে। আর যেন এই মুখো না হয়।'
নটরাজ বুঝতে পারে এরা একদম ওকে গিনিপিগ বা মুরগী বানিয়ে ফেলেছে যেখানে খুশি ছুরি চালাচ্ছে। কিছু করার নেই অনেকটা খুশি আর স্বস্তির বিনিময়ে এটুকু সহ্য করতেই হবে।
-' মামু তুমলোগো নে মুঝে মুরগা বানা দিয়া। কত বুদ্ধি তোমার! ওহ্ সত্যিই আমি পুরো বুদ্ধু হয়ে গেছি।'
-' হে হে তাহলে স্বীকার করছিস বল আরে ইচ্ছে হল একটু দুষ্টুমি করার। তুই তো কম নাকাল করিসনি এই বুড়ো বুড়িটাকে। সিধে বললেই হত আমি শৈলপুত্রীকে বিয়ে করতে চাই। তা নয় সুশো সাথে বিয়েটা যেই ঠিক হয়েছে শুনেছিস অমনি..কি নাটক করলি! তাই ভাবলাম আমিও একটু খেল দেখাই।..'
-' মামু তুমি সত্যিই খুব দুষ্টু ছিলে তা এখনও বোঝা যায়। মানে মা ঠিকই বলে।'
-' আরে ছাড় এসব কথা,তোর মাও খুব মিচকে পাজি ছিল। ওর নালিশে কত মার খেয়েছি মায়ের কাছে। তা বেবিকে ডাক। সে কোথায়?'
নটরাজ বলে,' এই তো বললে আমি একা আছি বলে ফোন করেছ। বেবি আবার আসবে কোথা থেকে এখানে? সে তার চাচার বাড়িতে আছে।'
-' তার এখন এখানেই থাকার কথা। দেখ সে হয়ত ফুলবন্তীর সাথে রান্নাঘরে ঢুকেছে। তোর মা তো একগাদা খাবার দাবার দিয়েছে সেগুলো হয়ত গোছাচ্ছে।'
নটরাজ কথা বলতে বলতে একবার উঁকি মেরে দেখে মামুর কথাই ঠিক।
-' আচ্ছা মামু তোমার কোন অদৃশ্য ক্যামেরা কী এখানে লাগানো আছে যে সব দেখতে পাচ্ছ?'
-' আছে তো,আমার মনটা। নে এখন বেবিকে ডাক একটু কথা বলে নিই। আর এই সাতদিন তোকে দেওয়া হল একটু ভালোবাসাকে চিনে নিতে। এটাই বড় মিস্টি সময় রে এরপর তো হ্যাঁ গো ওগো শুনতে হবে।'
মামার কথার ইঙ্গিতে লজ্জা পায় নটরাজ। তাহলে একটু নিরিবিলিতে সময় কাটানো যে ওর ইচ্ছে ছিল তা পূরণ করার জন্যই এই ব্যবস্থা। সত্যিই মামু তোমার জবাব নেই।
-' দাঁড়াও ওকে ডেকে দিচ্ছি।'
রান্নাঘরে এসে দাঁড়ায় নটরাজ। শৈলপুত্রীর কোমরূ আঁচল জড়ানো কি সব গুছিয়ে রাখছে। ফুলবন্তীকে বাইরে বাসন ধুতে দেখে।
-' মামু ডাকছেন আপনাকে মানে তোমাকে।'
শৈলপুত্রী হাতে ফোনটা নেয়,' হাঁ আঙ্কেল,সবাই খুব খুশ এখানে এতদিন বাদে আমাকে দেখে।'
-' জানি তো সবাই খুশি আর তুইও খুশি তবে আমার ভাগ্নেটাকে দেখিস। কিছু বলতে চাইলে শুনিস।'
-' বেবি মা এই সময়টা খুব মিঠে। চিনে নে ভালো করে দুজনে দুজনকে। তাই বললাম ঘুরে আয়। নটরাজকে অনেক ঘুরিয়েছিস এতদিন এবার একটু দেখিস ওকে।' রেবা বলেন।
-' মা এই দেওঘরে কী চিনব আর? এখানে তো সেই কবেই সাহাবকে চিনেছি জানপহেচান হয়েছে। আমার আর চিনতে হবে না। আমি এখন কদিন বাচ্চাগুলো কে পড়াই করাব। সব ভুলে গেছে ওরা। একটু আঁকা শেখাব। চাচীর সাথে কাম করব,ফুলবন্তীদের সাথে রাতে গল্প করব ওদের পড়া শিখাব।'
-' দেখেছ মেয়ের কান্ড! একে পাঠিয়ে কী লাভ হল ওখানে? সে কী করবে তার লিস্টি দিচ্ছে তার মধ্যে আমাদের নাটুর নাম নেই।'
নটরাজ সব কথা শোনে আর বুঝতে পারে এই মেয়ে সহজ নয়। খুব দুষ্টুমি বুদ্ধি মাথায়।
কিছুটা কথার পর মামু মামিমা ফোন ছাড়ল শৈলপুত্রী আবার রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কী করছে কে জানে ফুলবন্তীকে নিয়ে। নটরাজের ইচ্ছে থাকলেও যায় না। তারপর বেশ কিছুটা পরে একেবারে নটরাজের জলখাবার সাজিয়ে নিয়ে এল। জলখাবার দেখেই বুঝল এইসব মায়ের বানিয়ে দেওয়া। মা গাজরের হালুয়া করে পাঠিয়েছে ওর জন্য মনে হয় কড়াইশুটির পুরও পাঠিয়েছে শৈলপুত্রীর ব্যবস্থাতে কচুরী বানানো হয়েছে। খাবার দেখে খুশি হয় নটরাজ। তারপরে বলে,' আপনার তো অনেক কাজ এখনি চলে যাবেন তো? তবে খেয়ে যাবেন দয়া করে।'
-' কে বলেছে এখনি যাব? ফুলবন্তী যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ আছি। একা থাকাটা কী ঠিক হবে? আপনি কী বলেন?'
ফুলবন্তী একটু হাসি দিয়ে শৈলপুত্রীর খাবারটা রেখে যায় ওখানে,' দিদি তুম ভী কুছ খা লো অব।'
-' তুম ভী লে লো পহেলে তব খায়েঙ্গে।'
ফুলবন্তী জানায় সে রান্না করতে করতে খাবে। ততক্ষণে ওরা বসে গল্প করুক।
গরম কচুরী আর হালুয়াতে মন দিতে পারে না নটরাজ বারবারই শৈলপুত্রীর দিকে চোখ চলে যায়। অনেক বদলে গেছে ও। হয়ত বা দেখতেও অনেক সুন্দর হয়ে গেছে। শৈলপুত্রীর গালে লালচে আভা। টুকরো টুকরো কথায় ভেসে যায় ওরা। শৈলপুত্রীর খাবার ঠান্ডা হয়ে যায়,ঠিকমত খেতে পারে না। ফুলবন্তী আবার আসে দিদিকে ডাকে মাংসটা কষে দিতে। আজ আর শৈলপুত্রীর মাংসটা ধরে যায় না বরং অনেক বেশী যত্ন করে বানায়। অনেকদিন বাদে নাটু ভোলার ঘরে শৈলপুত্রীর যত্নের ছাপ পড়েছে আবার। এই ঘর আর ঘরের মানুষটি খুব তাড়াতাড়ি ওর হবে ভেবেই মনটা কেমন যেন ভেসে যায়।
শৈলপুত্রী চলে যাচ্ছে। ফুলবন্তী বলে গেল আগামীকাল মন্দিরে যাবে ভোরবেলায়। আসতে একটু দেরি হবে। নটরাজ আজ আর শৈলপুত্রীকে ফুলবন্তীর সাথে একলা মন্দিরে যেতে দিতে চায় না তাই বলে অনেকদিন সে নিজেও যায়নি মন্দিরে কাল ওরা যেন অপেক্ষা করে মন্দিরে ওর জন্য। ফুলবন্তী হাসে,' বহত আচ্ছা হোগা আপ ভী আইয়ে।'
মন্দিরে বাবার মাথায় জল দেবার সময় নটরাজের হাত ছুঁয়ে যায় শৈলপুত্রীর হাত। এক সাথেই প্রার্থনা করে ঠাকুরের কাছে। দেব বাবুকে বলা সেদিনের মিথ্যে কথা এইভাবে সত্যি হবে ভাবেনি। শৈলপুত্রীকে দেখতে খুব অন্যরকম লাগে নটরাজের। ওর গায়ে আঁচল কপালে ফোঁটা। ফুলবন্তী একটু ইচ্ছে করেই এগিয়ে গেছে একটা অজুহাতে। গতকাল সাবিত্রী চাচী ওকে বলেছেন একটু সময় আলাদা থাকতে দিতে ওদের। বাইরে এসে নটরাজের মাথায় ফুল ঠেকিয়ে একটা প্রসাদ ওর হাতে দেয়।
যেতে যেতে অনেকটা গল্প হয়। নটরাজ কিছু অভিযোগ করে ওকে যাবার আগে বলে যায় শৈলপুত্রী,' এই দু এক ঘন্টার জন্য প্রতিদিন যেভাবেই হোক দেখা করে যাব। আপনি আসুন আজ বিকেলে চাচার ওখানে। চাচী আপনাকে ডেকেছে।'
নটরাজ সেদিন বিকেলে যেতে পারে না অফিস থেকে ফিরতেই অনেকটা দেরি হয়ে যায় এতটা সন্ধ্যেতে আর যাওয়াটা ঠিক হবে না। আজকাল ফুলবন্তী বিকেলেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে সব কাজ সেরে চলে যায়। বলে গেছে দিদি যে কদিন থাকবে ওদের সন্ধ্যের পড়াশোনা আর গল্পের আসর ও একদম মিস্ করতে চায় না। ছোট্ট ফ্লাক্সে চা,গরম রাখার কৌটোতে টিফিন সব গুছিয়ে গেছে। আকাশ জুড়ে তখন পাখিদের কিচিরমিচির আর ঘরে ফেরার হুল্লোড়। চা খেতে খেতে আনমনা হয় নটরাজ এবার। ইশ্ একটা দিন যদি সারাটা দিন শৈলপুত্রীর সাথে কাটাতে পারত! দেখতে দেখতে দুটো দিন কেটে গেল আর হাতে গোনা কয়েকটা দিন। শৈলপুত্রী কাল এলে ওকে বলতে হবে একদিন শুধু দুজনে আসেপাশের জায়গা গুলো ঘুরবে বা জিপে করে একদম চলে যাবে জসিডি।
পরদিন সকালে ফুলবন্তী একা আসে। ওকে দেখে নটরাজ অবাক হয় ভোরের অপেক্ষায় প্রতিদিন কাটে নটরাজের। শৈলপুত্রীকে কত কথা বলে নিজের মত। সারাদিন এইটুকু সময়ের জন্য অপেক্ষায় থাকে। তাই বলে,' ও কাঁহা? আজ নহি আয়েগী।'
ফুলবন্তী একটু রহস্যময়ী হাসি হাসে। বোধহয় বাবুজীর মুখটা দেখে তারও হাসি পায়। সে নিজের মত বলে যায় দিদির ওদিকে অনেক কাজ আছে। এখানে এসে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আজ বিকেলেও আসতে পারবে না। বাবুজীকে চাচী ডেকেছে বিকেলে।
অভিমান হয় নটরাজের মামুর কাছে দরবার করতে ইচ্ছে করে কাকে পাঠিয়েছে এখানে? সে তো চাচার বাড়ি নিয়েই মত্ত। নটরাজের খেয়াল কেউ রাখে না। সে একাই পড়ে আছে এই বিদেশে। যাবে না আজ বিকেলে শৈলপুত্রী বুঝুক নটরাজের অভিমান হয়েছে। কিন্তু বিকেল হবার আগেই দুপুর থেকে মনটা কেমন যেন পাগলামি শুরু করে। কাজে মন দিতে পারে না। মনে মনে বলে কী আছে তোমার কাছে শৈলপুত্রী যার আকর্ষণে আমি বারবার ছুটে যাই? হয়ত শৈলপুত্রীর ঔদাসীন্য ওকে কাছে টানে। অদ্ভুত কাজপাগল একটা মেয়ে।
চারটে বাজার আগেই মথুরা এসে দাঁড়ায়,' সাহাব চলিয়ে। দিদি নে আপকো বুলায়া।'
-' কৌন দিদি? কাঁহা?'
-' ও কলকাত্তা সে আয়ী যো ফুলবন্তী আনে কে টাইম বোলা আপকো লে যানে কো।'
যে কথাটা একান্ত গোপনে রেখেছিল নটরাজ তা মনে হয় এই মথুরাও জেনেছে। একটা সময় চাচীর ওখানে চা খাওয়া নিয়েও যে আপত্তি করত আজ তার এত তাড়া ওখানে নেবার জন্য।
তবে চাচীর বাড়িতে গিয়ে শৈলপুত্রীকে দেখে সব অভিমান ধুয়ে মুছে যায় নটরাজের। কাদামাটি মাখা শৈলপুত্রীকে একদম অন্যরকম লাগছে দেখতে। সেই আগের মত উস্কোখুস্কো চুল হাওয়াতে উড়ছে। শৈলপুত্রীর মিস্টি হাসিতে ফিদা হয়ে যায় নটরাজ।
-' এসব কী হচ্ছে? তাই উধাও শৈলপুত্রী।'
আগের মত আধভাঙ্গা হিন্দীতে শৈলপুত্রী বলে,' সাহাবজী ক্যায়সা বন রহা দেখিয়ে না? আমি পারছি? ভাবলাম এখানে যখন আছি আর পরশু পূজা তো আমি এবার চালু করে দিই। বাচ্চাদের খুব আনন্দ।'
-' তুমি এটাও পার! মানে এত সুন্দর করে সরস্বতীর মূর্তি বানাতে শিখলে কোথায়? আমি তো জানি তুমি রঙ তুলি নিয়েই মনকে উড়িয়ে দাও।'
লজ্জা পায় শৈলপুত্রী,' আঙ্কেলজী সে শিখা। দিল্লীতে কলকাত্তাতে কত কাজে তো আমি সাহায্য করেছি। ওভাবেই শিখে নিয়েছি। ভাবলাম দেখি চেষ্টা করে।'
নটরাজ বলে,' সবার জন্য কত কি করছ শুধু আমি অধম বেচারা যার দিকে শৈলপুত্রীর কোন নজর নেই।'
-' আপকে লিয়েই তো সব কুছ। এখানে তো সেইজন্য এসেছি।'
ঝগড়া করবে ভেবেও ঝগড়া করতে পারে না ওর এখানে আসার সাড়া পেয়ে চাচা চাচীও ভেতর থেকে চলে এসেছেন। হাজির হয়েছে পুচকেগুলো তাদের মনে খুব ফূর্তি দিদি দুদিনেই ঠাকুর বানিয়েছে। কাল সকালে সাদা রঙ লাগবে তারপর রঙ হয়ে পূজা হবে। নটরাজ দেখে সবাই সব জানে। মথুরা ব্যাটা জোগাড় করে দিয়েছে রঙ। খোশমেজাজে আছে সব পাড়ার পূজা নিয়ে। ভালো লাগে নটরাজের শৈলপুত্রীকে চেনা রূপে দেখতে চাচীর এখানে না এলে হয়ত বুঝতে পারত না শৈলপুত্রীর গায়ের মাটির গন্ধ একটুও ফিকে হয়নি কলকাতার শহুরে আবহাওয়াতে।
রাতে মামুর কাছে ফোন করে নটরাজ মায়ের সাথেও কথা হয়। ও সরস্বতী গড়ছে শুনে মামু বলেন,' এই মেয়ে শেষে আমার কাজটাও নিল। একটা ছবি তুলে রাখিস নাটু দেখব কেমন শিখেছে। সরস্বতী পুজোটা আনন্দে কাটা। বসন্তের ছোঁয়া লাগুক মনে।'
-' মামু,সত্যি তুমি পার বটে। কী বললাম আর তুমি কী ভাবছ!'
মা বলে আর বেশি দেরি করতে চায় না বিয়ের জন্য, শৈলপুত্রী ফিরলে মামুর সাথে কথা বলে আশীর্বাদ সেরে রাখতে চান। আর তারপরেই বিয়েটা। কারণ বাবা খুব অস্থির হয়েছেন বিয়ের জন্য। নটরাজ বলে,' যা ভালো বোঝ কর। তবে শৈলপুত্রীর আদৌ বিয়ে করার ইচ্ছে নেই মা। সে তো মেতে আছে তার কাজ নিয়ে।'
লাবণ্য বোঝেন শৈলর কান্ডকারখানা দেখে ছেলের অভিমান হয়েছে। সত্যিই তো ওখানে গিয়ে পুজো নিয়ে মাতলো। মুখে বলেন,' ওকে ফোন করতে বলিস তোর এখানে এলে আমি বকে দেব।'
*******************
সরস্বতী পুজোটা যে এমন হতে পারে ফুলবন্তীদের কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। সবাই ওরা মেতে উঠেছে পুজো নিয়ে। পাড়ার বৌ মেয়েরা রান্নার জোগাড়ে ব্যস্ত আজ খিচুড়ি তরকারি সবাই এখানেই খাবে। নটরাজের মান ভাঙাতে শৈলপুত্রীকে ছুটে আসতে হয়েছে বকুনি দিয়েছেন লাবণ্য। তবে নটরাজকে যেতেই হয়েছে না গিয়ে পারে নাকি সে মথুরা স্বয়ং দন্ডায়মান তাকে ধরে নিয়ে যেতে। উঠোন জোড়া আল্পনা দিয়েছে শৈলপুত্রী কুচোকাচারা মেতেছে আনন্দে। সবার আনন্দ দেখে মনটা খুশি হয়ে যায় নটরাজের। শৈলপুত্রীর পরনে লাল পাড় শাড়ি ওকে দেখে হাসে চেয়ারে আদর করে বসায় তারপর বলে,' এখুনি পুজো শুরু হবে। চা খাবেন? ফুলবন্তীকে বলব?'
-' না না পুজো হয়ে যাক। তবে ঠাকুরমশাই কই?'
- এসে পড়বে এখুনি। দেখুন না। আচ্ছা আমি যদি পুজো করি?'
-' তুমি করবে? মানে এখানে এরা মেনে নেবে?'
-' কেন মানবে না? মিশ্রাবাড়ির মেয়েরা সব পারে।'
অনেকদিন বাদে কথাটা আবার শুনল নটরাজ।
শৈলপুত্রী গায়ে আঁচল জড়িয়ে আসনে বসে পুজো করতে। নটরাজ কোনদিন এত মনোযোগ দিয়ে পুজো করতে দেখেনি আজ দেখল। এ যেন এক অন্যরকম পুজো যেখানে একজনকে ঘিরেই সব কিছু আয়োজন। সত্যিই মেয়েটা পারে। আর কোন অভিমান নয় সবার মুখের হাসিতে মন ভরে গেল নটরাজের শৈলপুত্রীকে আরও বেশি ভালোবেসে ফেলল সরস্বতী পুজোর দিনে। আজ অনেকদিন বাদে একটা অন্যরকম দিন নটরাজের জীবনে। সবাইকে নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট খুশি ভাগ করে ভালো থাকার মন্ত্র বোধহয় শৈলপুত্রীই জানে।
হরিহরণের সাথেই ফিরে গেছে শৈলপুত্রী এবারও যাবার সময় কাঁদিয়ে গেছে সবাইকে। নটরাজ যাবে কিছুদিন বাদে। ওকে ট্রেনে তুলে দিয়ে খুব মনখারাপ হয়েছিল নটরাজের আবার মনে হয়েছিল এক নতুন অপেক্ষার শুরু। ফুলবন্তী চোখ মুছছিল,বিন্তি, মংলু মুন্না বারবার বলছিল কবে আসবে আবার? হঠাৎই এসে কয়েকটা দিনে সবার মন জয় করে চলে গিয়েছিল শৈলপুত্রী। নটরাজের ভালো লেগেছিল বিজয়ী শৈলপুত্রীকে দেখে।
ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে অনেকটা সময় তাকিয়েছিল পেছনের দিকে শৈলপুত্রী হাত নাড়ছিল। নটরাজের কানে ভাসছিল ওর কথাগুলো,' ফুলবন্তীর ঢাকা দেওয়া খাবার যেন পড়ে না থাকে। আমি খবর নেব।'
-' পৌঁছে ফোন করবে,আমাকে যেন মামুকে ফোন করে না জানতে হয়।'
-' আচ্ছা বাবা করব যদি সময় হয়।'
তারপর হেসেছিল একটা দুষ্টুমি ভরা হাসি শেষে বলেছিল,' আপ সাথ মে আতে তো আচ্ছা হোতা।'
কলকাতা ফিরে এসে সাথে সাথেই ফোন করেছিল পৌঁছে গেছে সে ভালোভাবে। তারপর বেশ কিছুটা সময় টুকরো কথার আলাপে কেটে গিয়েছিল। রেবা উঁকি মেরে দেখে গিয়ে অপূর্বকে বলেছিলেন,' হ্যাঁ মিশন সাকশেসফুল মনে হচ্ছে বাড়িতে ঢুকেই মা সাহাবকে ফোন করছি একটা। তারপর দীর্ঘ সংলাপ।'
-' তুমি আর ওদিকে যেয়ো না। কথা বলছে বলুক। দুজনের দুজনকে জানাটাও জরুরী। আর ওখানে কী করেছে সেটা শুনে আমাকে বোলো।'
-' সত্যিই তুমি পার বটে ভাগ্নের প্রেমের গল্পও শুনবে! ওরা তোমার ছেলেমেয়ে তো। '
-' আরে ছেলেমেয়েদের ভালো থাকতে দেখে কার না ভালো লাগে? দেখতে হবে তো কতটা মিলমিশ হল।'
স্বামীর এই ছেলেমানুষীতে অভ্যস্ত রেবা আর এই সরল সাধাসিধে খোলামেলা অপূর্বকে এইজন্য এত ভালো লাগে তাঁর।
শৈলপুত্রী ফেরার পর বিকেলেই লাবণ্য আসেন। অনেকটা সময় কথায় গল্পে কেটে যায়। শৈলপুত্রীর চোখে ভালোবাসা খোঁজেন লাবণ্যও। তারপর ওর হাতদুটো কাছে টেনে বলেন,' ছেলেটা আমার একটু বেশি আদুরে আসলে অনেকটা পরে হয়েছে তো শিবপুজো করে। ওকে একটু সময় দিস। ভালোবাসে তোকে খুব,তোর ভালো চায়।'
-' আমি জানি সব। এত কিছু তো সাহাবের জন্যই।'
-' এই যে মেয়ে আমি কোন কর্মচারী বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি না। এখন পড়াশোনা করিস কলেজে যাস তবুও এইসব ডাক কিসের শুনি? বৌদি তুমি ওকে বলে দাও নটরাজকে যেন বাবুজী, সাহাব না বলে।'
-' লাবণ্য ঠিক বলেছে,এ কি বেবি সাহাব এখনও? নাটু কিছু বলেনি তোকে? প্রভু ভৃত্যর সম্পর্কে বাঁচবি নাকি? মাইকেল মধুসূদন দত্ত পড়েছিস? এবার তোকে সেই বই পড়তে হবে যেখানে শিব পার্বতীর প্রেমের বর্ণনা আছে।'
-' এই বই আমাদের বাড়িতে ছিল তো।'
-' কিন্তু তুই তো পড়িসনি এবার পড়বি।'
লজ্জা পায় শৈলপুত্রী,' মা,তুমি যে কী!'
-' ওমা মায়েরাই তো শেখাবে। তোর নিজের মা থাকলে আজ সেও এক কথাই বলত।'
-' বৌদি ঠিক বলেছে। এই মেয়েকে নিয়ে যে কী করি! দে এবার হাতটা দেখি। মাপটা নেব,আর দেরী নয় বেশি নাটু এলেই আমি আশীর্বাদ সারব। তোর পিসামশাই বড় তাড়া করছে। মাঝে শরীর খারাপ হওয়াতে মনটা দুর্বল হয়ে গেছে।'
-' কিন্তু আমার কলেজ? সে তো এখনও আছে,আমার কাজ?'
-' কলেজ তুই করবি,যেমন করতিস। ছুটিতে দেওঘরে ঘুরে আসবি। নাটুও আসবে। এভাবেই চলবে কিছুদিন। আবার কখনও দাদার কাছেও থাকবি।'
সারাদিন অনেক কথার পর শব্দের অনুরণন হয় শৈলর মনে। এখন শুধু একটা নামই মনের মধ্যে ঘোরাঘুরি করে সাহাবজী না না আর সেটা বলা যাবে না আজ অনেক বকেছে সবাই তবে কী বলবে নটরাজ? না না নাম ধরে ও ডাকতে পারবে না,তাহলে কী ফুলবন্তীদের মত শুনিয়ে জী। ভাবতে ভাবতে চোখ জড়িয়ে আসে শৈলর।
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায় শৈলপুত্রীর আজ কলেজে যাওয়া আছে। ঐ ঘটনার পর এতদিন কলেজে যায়নি সে। আজ আবার স্যারের মুখোমুখি হতে হবে। মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত উৎকণ্ঠা হয়।
কলেজে গিয়ে স্বাভাবিক থাকবে ভেবেও স্বাভাবিক হতে পারে না। সুশোভনের সামনে এসে লজ্জা পায়। সুশোভন বুঝতে পারে তাই বলে,' এতদিন সব আঁকার কাজ হয়েছে না শুধু ঘোরাঘুরি? হ্যাঁ রে শ্যামা তোদের দিল্লীর কাজ কেমন হল? আমিও খুব ব্যস্ত ছিলাম তাই স্যারের কাছে যাওয়া হয়নি।'
কাজের কথা বলাতে শৈল অনেক স্বাভাবিক হয়ে সব বলতে থাকে এমন কি সে যে সরস্বতী ঠাকুর বানাতে পেরেছে তাও।
-' বাহ্ দারুণ ব্যাপার তো,রঙ তুলি কাগজ মাটি সব একসাথে! আচ্ছা দেখব সব এখন কাজে মন দে।'
সুশোভন নিজের অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষকসুলভ আচরণে ছাত্রী শিক্ষকের মাঝে যে আড়ষ্টতা এসেছিল তা ফিরিয়ে নিল কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরোনো ছন্দে। শৈলপুত্রীর মন ডুবে গেল সৃষ্টিতে। সুশোভন দেখল শৈলপুত্রী আরও বেশি নিজেকে শান দিয়েছে এই এক মাসে।
নটরাজ সামনের সপ্তাহে আসবে। আজকাল শৈলপুত্রীর আর ফোনে কথা বলতে লজ্জা করে না। কোন সময় বাইরে থেকেও ফোন করে নেয়। কারণ বাড়িতে সব কথা খোলামেলা বলতে পারে না। নটরাজের মন ভালো রাখতে এইটুকু করতেই হয় নাহলে বকুনি খায় সবার কাছ থেকে। বাড়ি থেকে একটা আশীর্বাদের দিন ঠিক হয়েছে। আশীর্বাদের দিনই বিয়ের দিন ঠিক হবে।
লাবণ্য আর রেবা ব্যস্ত হয়ে পড়েন কেনাকাটা করতে। রেবার হঠাৎ যেন নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হয় সন্তান না থেকেও আজ অপূর্বর জন্য শৈলপুত্রীর মত মেয়েকে পেয়েছেন তিনি। অবশ্য রুবি বিনু এরাও তো সন্তানের মতই তাঁর। হঠাৎই লাবণ্যর মনে একটা কথা আসে আচ্ছা রুবির সাথে যদি সুশোভনের বিয়ে দেওয়া যেত কেমন হত? তারপরেই মনে হয় না সে ঠিক হবে না সুশোভন কী ভাববে? শৈল মানে বেবির সাথে সম্পর্ক তাঁরাই বলেছিলেন আবার রুবি? তাছাড়া রুবিও তো বিয়ে করতে চায় না। আচ্ছা সে নাহয় পরে ভাবা যাবে। অপূর্বকে বলবেন এক ফাঁকে।
দেখতে দেখতে সামনের সপ্তাহ এসে গেল। নটরাজ এসে পড়েছে গতকালই। আগামীকাল শৈলর আশীর্বাদ। মালতীর মা হরিহরণ সবাইকে বলেছেন অপূর্ব। সুশোভনকে আসতেও বলেছেন। না বলাটা ঠিক নয়। তাছাড়া সুশোভনের সাথে এর মাঝেও দেখা হয়েছে তখনই বলেছিলেন। শৈলর বুকটা কাঁপে,এর আগে বিয়ের সময় বাবা ছিলেন। এখন ওর রক্তের সম্পর্কে আর কেউ নেই,হঠাৎই কান্না পায় ওর তারপর মনটাকে বাঁধে। ট্রাঙ্কটা খুলে বাবা মায়ের ছবিটা বের করে বুকে জড়িয়ে বলে,' আশীর্বাদ কোরো আমাকে তোমাদের বেবি যেন তার নতুন ঘরে নতুন সঙ্গীকে নিয়ে ভালো থাকে।'
শৈলপুত্রীর কাছে মা ডাকটা রেবার অনেক বড় পাওয়া তাই তিনি কোন কিছুই অপূর্ণ রাখেননি লাবণ্য মজা করে বলেছে,' ও বৌদি একমাত্র ভাগ্নের বিয়েতে তুমি শেষে পাত্রীপক্ষ হয়ে গেলে? তোমার আর দাদার সাহায্য ছাড়া আমি সব সামলাব কী করে?'
-' আমি দুই পক্ষেই আছি ঠাকুরঝি। আমাদের বড় আনন্দ যে বিয়েটা নিজেদের মধ্যেই হচ্ছে। শৈলজাদা অনেক উপকার করেছেন একটা সময়। তাঁর আদরের কন্যাকে যে সসম্মানে বাঁচতে শেখাতে পেরেছেন তোমার দাদা এটাই অনেক। তাছাড়া ভালোবাসার মানুষের হাতে তুলে দিতে পেরেও ভালো লাগছে। কম অসম্মান তো পায়নি মেয়েটা।'
শৈলপুত্রীর শাড়ি গয়না কোন কিছুতেই আগ্ৰহ নেই। এ এক মেয়ে হয়েছে। আশীর্বাদ কাল আজও সে কলেজে গেল। এইজন্য রেবা লাবণ্যকে বলেছিলেন আশীর্বাদ বিয়ের দিনই হবে। তো ননদের বায়না যে তার আর তর সইছে না আশীর্বাদ হয়ে যাক।
হলুদ দক্ষিণের সিল্কের শাড়ি পরিয়েছেন রেবা শৈলপুত্রীকে একদিকে লাল পাড় আরেকদিকে সবুজ পাড়। লকারের গয়নাতে এখন হাত দেননি একদম বিয়ের রাতে পরবে সে সব। মেয়ের হাতে কানে গলায় ছিমছাম গয়না পরিয়ে সুন্দর করে সাজিয়েছেন রেবা। অবাধ্য ঝাঁকড়া চুলকে বাধ্য করে সাজিয়েছেন সুন্দর খোঁপার আকারে। তাতে জড়িয়ে দিয়েছেন ফুলের মালা।
-' দেখ এবার কেমন লাগছে? শুধু সাজব না বায়না। বলেছি না পরিপাটি থাকতে শেখাও একটা আর্ট। তুই না শিল্পী? কত সুন্দর করে সাদা ক্যানভাসে রঙ ভরে তাকে জীবন্ত করিস। নিজে এমন পাগলী হয়ে থাকিস কেন? দেখি আমার মেয়েটাকে যেন কেউ নজর না দেয়। আজ লাবণ্য আর ওর বেটা চোখ ফেরাতে পারবে না।'
আগের বিয়েটা হঠাৎই হয়ে গেছিল শৈলপুত্রীর। যাকে বলে ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে। নিজেকে সাজাতে পারেনি কোনভাবেই। সামনে ছিলেন অসুস্থ বাবা,মনে তখন অস্থিরতা আর মাথার ওপর গুরু দায়িত্ব। রেবা মা তো তখন ছিলেন না যে সাজিয়ে সামনে আয়না ধরবেন।
হয়ত সবই নিয়তি, সেদিনের ভাঙন না থাকলে হয়ত আজ আবার জুড়ে যাওয়ার গল্পটাই থাকত না।
রেবা ওকে নিয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেন। শৈলপুত্রী নিজেকে না দেখে আগে জিজ্ঞেস করে,' সাহাবজী আসছেন?'
-' আবার সাহাবজী! হ্যাঁ আসবেই তো,তার মামুর বাড়িতে সে আসবে না? আমরা সব ভালো খাবার খাব সে বেচারা মুখ শুকিয়ে থাকবে?'
বাইরে থেকে অপূর্ব ডাক দেন,' কী গো হল তোমাদের? লাবণ্যরা রওনা দিল আধঘণ্টার মধ্যেই এসে যাবে। দেখি আমার মাকে দেখতে দাও।'
-' বাহ্ বাহ্ এই তো আমার মা দুগ্গা মা। আশীর্বাদ করি মা নিজের স্বপ্নগুলোকে নিয়ে এগিয়ে যা এভাবেই। বুঝলে নাটু ভোলাটাও আসছে। কী কান্ড বল দেখি! ও আশীর্বাদ করবে নাকি?'
-' দেখেছিস তো এই মানুষটার কান্ড ছেলেটা মামাবাড়িতে আসবে না? আমি বলেছি আসতে। ও খেতে ভালোবাসে খেতে আসবে।'
-' খাবে না আরও কিছু ও আসছে বেবিকে দেখতে।'
-' বেশ করেছে,এবার তুমি যাও কেউ কম নয় এরা। নিজের কথাগুলো মনে কর এবার তোমার তো ভাগ্নে।'
কলেজে যাবার আগে তারিখটা নজরে পড়ে সুশোভনের আজ তো শ্যামার আশীর্বাদ। স্যার বারবার করে বলে দিয়েছেন আসতে। কী করবে ভেবে পায় না। ওখানে গেলে হয়ত শ্যামার অস্বস্তি হবে। তাছাড়া ছেলেপক্ষ মানে সবাই তো জানে ব্যাপারটা। তাই ভাবে আর যাবে না। রাতে ফোন করে একটা কিছু বলবে। নিজেকে একটু শক্ত করে নেয় সুশোভন ভাবার জন্য কিছুটা সময়ও নেয়।
এমন আশীর্বাদের অভিজ্ঞতা শৈলপুত্রীর কখনও হয়নি আগে। কাটিহারে দুএকজন বন্ধুর বিয়েতে ও গেছে তবে সেখানে এমন আয়োজন দেখেনি। একটার পর একটা তত্ত্ব এসে ভরে যায় মোটামুটি ঘর। সবশেষে আসে শৈলর হবু বর। ওকে দেখেই অপূর্ব পেছনে লাগেন,' তোকে আসতেই হল এই গুরুজনদের আশীর্বাদের মাঝে?'
-' মামিমা আর মা দুজনেই তো জোর করল। বলল আসতে।'
-' বেশ এসেছ ভালো একটা জায়গায় চুপটি করে বোসো তুমি আবার আশীর্বাদ করে ফেল না বেবিকে।'
অপূর্বর কথা শুনে হেসে ফেলে সবাই। অনেকটা খুশি আর আনন্দের মধ্যে শৈলপুত্রীর বাক্ দান হয়ে যায় সবার পছন্দের আর ওকে ভালো রাখতে চায় এমন কারো সাথে। নটরাজ অবাক হল দেখে,হয়ত ওকে দেখতেই আজ আসা। এই শৈলপুত্রী কেমন যেন আলাদা,সেই মিশ্রাবাড়ির আত্মাভিমানী মেয়েটার আজও মাথা উঁচু কপালে ছোট্ট টিপে চন্দনের ছোঁয়া আর মাথার খোঁপাতে ফুল। লাবণ্য নিজেকে শাসন করেন আবার কত বড় ভুল করতে বসেছিলেন। নটরাজের পাশে যে শৈলপুত্রীকে মানায়। এই বাঁধন হয়ত জন্মজন্মান্তরের তাঁর সাধ্য কী যে তা ছিন্ন করেন।
আশীর্বাদের পর্ব শেষে খাওয়াদাওয়া যখন চলছে তখন সুশোভন এল। ওকে দেখে লাবণ্য একটু ইশারা করেন স্বামীকে নীচু স্বরে বলেন এই সুশোভন।
ইচ্ছে না থাকলেও স্যারের আমন্ত্রণ আর প্রিয় ছাত্রীর জীবনের বিশেষ দিনটাতে না এসে পারনি সুশোভন। রেবা এগিয়ে যান,' এসো তোমার স্যার বারবারই তোমার কথা বলেছেন। বেবি স্যার এসেছেন। আজ শ্যামাকে দেখে মুগ্ধ হয় সুশোভন নিজেও তবে ভালো লাগে এই ভেবে নটরাজের ভালোবাসা পাবে ও। সেদিন নটরাজ চলে যাবার পর অনেকটা সময় চুপ করে বসে থেকে বুঝতে পেরেছিল নটরাজের মত ঝড়কে থামানোর সাধ্য তার নিজের কেন শ্যামারও নেই সুতরাং ভালোবাসার জয় হোক।
শৈলপুত্রী এসে সুশোভনকে প্রণাম করে,নিজের ভালো লাগে এই ভেবে গুরু তাঁর জায়গাতেই আছেন।
-' বিদূষী হয়ে নিজের মুখ আগে তারপর সবার মুখ উজ্জ্বল কর।'
শৈলপুত্রী অবাক হয়ে তাকায় তারপর ঘাড় নাড়ে।
-' তোর বিদ্যা তোরই থাকবে। এ তোর একান্ত প্রিয় আর আপন জিনিস। তাই তাকে আগলে রাখিস।'
-' আমিও তাই বলেছি ওকে,অনেক অনেক দূর যেতে হবে। আমি এগিয়ে দেব ওকে ওর যাত্রাপথে।'
-' শ্যামা এই লোকটাকে ভালো করে চিনে নিয়েছিস তো। দরকারে তোকে ধাওয়া করে আরাকানেও পৌঁছে যেতে পারে। সত্যিই ভাগ্যিস সেদিন আমাদের দেখা হয়েছিল।'
নটরাজের স্বাভাবিক ব্যবহারে আর সকলের আন্তরিকতায় সুশোভনের জড়তা কেটে যায়। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে ওদের পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে ছবি তুলতে তুলতে বলে,' বিয়ে নিয়ে মাতামাতি করিস না বেশি। কাল চলে আসিস কলেজে। হ্যাঁ শোন আমি তোর কাজের কিছু জিনিস এনেছি। আর কিছু উপহার দেবার কথা ভাবতে পারলাম না।'
অপূর্ব ততক্ষণে এসে পড়েছেন সুশোভনকে দেখে খুশি হন,' আমিও তাই বলেছি বিয়ে নিয়ে নো মাতামাতি। নেহাত নাটুটা পাগলামি শুরু করল নাহলে আমার মাকে এত তাড়াতাড়ি কে বিয়ে দিত?'
-' মামু তুমি আর আমার প্রেস্টিজ রাখলে না ইশ্।'
সুশোভন হাসে নটরাজের দিকে তাকিয়ে,' হ্যাঁ আমিও কিছুটা বুঝেছি।'
সবার অনেকটা খুশির মধ্যে হঠাৎই শৈলপুত্রী একটা অদ্ভুত প্রস্তাব দিল। ওর কথা শুনে সবাই বেশ কিছুটা সময় চুপ করে থাকলেও প্রথমে নটরাজ তারপর অপূর্ব বলে উঠলেন,' আমি রাজি,ভোলাও রাজি বল এবার তোমাদের মত।'
-' আমিও রাজি দাদা।'
-' বাহ্ বেশ,ভোট পেয়ে গেছি এখন বাকি শুধু লাবণ্য আর রেবা। দেখা যাক ওরা কী বলে?'
-' তোমরা তো জিতে গেছ আর কী বলব আমরা?'
ঠিক হল শৈলপুত্রীর বিয়েটা দেওঘরেই হবে। লাবণ্যর কোন চিন্তা নেই কারণ বৌভাত কলকাতাতেই হবে। বিয়ে দেওঘরে শুনেই লাবণ্য আর্জি জানিয়েছেন,' বৌভাত কিন্তু কলকাতার বাড়িতেই হবে। নতুন বৌয়ের পা পড়বে না ঘরের মাটিতে তা কী করে হয়? সুতরাং সব ঠিকঠাক তো দাদা।'
সবার কথার মাঝে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় শৈলপুত্রী একটু ঝুঁকে দেখে মালতীর মা মাসি বা চাচা এল কিনা? ওরাই একটা সময় ওকে বাঁচিয়েছিল। নটরাজ এসে ওর পাশে দাঁড়ায়,' কী হয়েছে? মনখারাপ?'
-' না চাচা আর মাসির কথা ভাবছি।'
-' চাচা আর মাসি আসবে না এখন একটু আগে ফোন করেছিল চাচা। ও বাড়িতে কিছু গন্ডগোল হয়েছে।'
চাচা আর মাসিকে দেখতে চেয়েছে তার জীবনের বিশেষ দিনে শৈলপুত্রী তবে ও বাড়ির কোন কথা শোনার আগ্ৰহ ওর নেই। যা ছেড়ে এসেছে তাকে শাপশাপান্ত না করলেও মন থেকে মুছে ফেলতে চায়।
**********************
বাপের বাড়ি থেকে গত দুই রাত্রি ফেরেনি বাড়িতে সানন্দা। আদিত্য গতকাল গেছিল শুধু দেখতে ওখানে কী চলছে। অফিসের সেই ভদ্রলোক যাকে কী সত্যি ভদ্রলোক বলা যায় নাকি ভাবতে হয় তাকে সেখানে যে অবস্থায় দেখে তারপর আর ইচ্ছে করে নি সানন্দাকে বাড়িতে ফিরতে বলতে। বরং বলে এসেছিল,' তুমি এখানেই থাকো। তোমাকে আর ফিরতে হবে না বাড়িতে।'
ফলস্বরূপ পরদিনই ফিরে এসেছিল সানন্দা তারপর শুরু হয়েছে নানা অশান্তি বাড়িতে। সানন্দা সাফ বলে দিয়েছে এখনও ডিভোর্স হয়নি সুতরাং সে এই বাড়িতে আসবে ইচ্ছেমত। কাউকে কোন ভয় পায় না সে।
-' হ্যাঁ ভয় পাওনা তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ঘরে আমি রয়েছি তবুও যা খুশি তাই করে যাচ্ছ। তুমিও তো করেছিলে সেটা মনে আছে? শিক্ষা তো তোমার কাছেই পেয়েছি।'
মালতীর মা মাসি সব শোনে,এই পরিস্থিতিতে হুট করে কিছুতেই বাইরে বেরোতে পারে না ওরা কেউই। হরিহরণ বাইরে থেকে একটা ফোন করেছিল লুকিয়ে। বিটিয়াকে দেখা আজ আর হল না।
শৈলপুত্রীর জীবনের স্বপ্ন দেখার সূচনায় ওদের জীবনে ভাঙনের সময় আসন্নপ্রায়। হয়ত এইভাবেই চলে ভাঙা গড়ার খেলা।
আজকাল অফিস থেকে আলাদা ফেরে ওরা। সানন্দার সাথে সময় কাটাতে ইচ্ছে করে না আদিত্যর তাই অফিসের পর একলা বসে থাকে রবীন্দ্রসদন বা নন্দনে। যেদিন কোন ভালো থিয়েটার থাকে দেখে বাড়িতে ফেরে একেবারে রাত করে। সেদিনও তেমন নন্দনে বসে ছিল আদিত্য সন্ধ্যে তখনও হয়নি হঠাৎই দেখল শৈলপুত্রীকে সেখানে সাথে একজন পুরুষ। হাসি পায় আদিত্যর শৈলপুত্রীর মত মেয়ে নন্দনে প্রেম করতে এসেছে তাও আবার এই আধবুড়ো লোকটার সাথে! সত্যিই স্ত্রী ভাগ্য ভালো নয় আদিত্যর। তবে শৈলপুত্রীকে দেখতে এখন অনেক ভালো হয়েছে। তেমন ভাবে বলতে গেলে পাল্টে গেছে অনেকটাই। শৈলপুত্রীর কথা যতই খারাপ ভাবুক তবুও ওদের গন্তব্য কোথায় সেটা জানতে খুব ইচ্ছে হল আদিত্যর তাই বেশ তফাৎ থেকে অনুসরণ করল।
ওরা অ্যাকাডেমিতে ঢুকছে। আদিত্য বেশ কিছু তফাতে ঢোকে। শৈলপুত্রী ততক্ষণে নিজের আঁকা ছবিগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আদিত্যর চোখ আটকে যায় সেখানে। কত প্রশংসা পাচ্ছে শৈলপুত্রী। ও এই ভদ্রলোক ওকে এখানে এনেছেন। ইনি তাহলে শিক্ষক। আদিত্য আর বেশিক্ষণ থাকতে পারে না সেখানে তাড়াতাড়ি সবার অলক্ষ্যে বাইরে চলে আসে। শৈলপুত্রীর যে জগত ছিল তা বড়ই ক্ষুদ্র আজ আদিত্যর পরিচয় হল শৈলপুত্রীর কর্মক্ষেত্রের সাথে। এত ভালো ছবি আঁকে সে তা স্বপ্নেও ভাবেনি আদিত্য।
নন্দনে তখন আঁধার নেমেছে তবে রাতের আলো ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে সেই আঁধার তবে আদিত্যর জীবনের আঁধার মোছা আর হয়ত সম্ভব হবে না।
দেওঘরে এর মধ্যেই অনেকটা সেজে উঠেছে চাচীর বাড়ি। কথা হয়েছে শৈলপুত্রীর সাথে যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল নটরাজের সেখান থেকেই বিয়েটা হবে।
শর্তটা শৈলপুত্রীর ছিল মেনে নিয়েছিল সবাই সবচেয়ে আগে হই হই করে উঠেছেন অপূর্ব,' একদম হবে বিয়ে ওখান থেকেই,কাটিহারের বাড়িতে বেবি থাকলেও তো বিয়েটা ওখানেই হত।'
কাটিহারের বাড়িটা শুনে চোখ ছলছল করেছিল শৈলপুত্রীর। সত্যিই তো ওর কোন বাড়ি নেই তাই তো সব জায়গাতেই গিয়ে নিজের বাড়ি ভেবে মানিয়ে নিয়ে আছে। হয়ত এই বেশ ভালো আছে। তবে শ্বশুরবাড়ি কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে গেছে শৈলর। অনেকটা উৎকণ্ঠা মনে যদি ওকে ওঁরা পছন্দ না করেন? অবশ্য মা শুনে বকুনি দিয়েছেন জোরে,' সবসময় অতীতের চিন্তাতে মনকে ভারী করিস না। ওরা তোকে যেচে নিয়ে যাচ্ছে পছন্দ হবে না কেন? বরং ওরা এভাবে না এগোলে আমরা তো ভাবতাম না কিছু। তাছাড়া নাটু খুব ভালো তোকে একদম আগলে রাখবে।'
ছোট থেকে শোনা কথাগুলো মেয়েদের মনে গেঁথে থাকে। বাবা মায়েরা পড়াশোনা শেখানোর আগেই অনেক সময়ই বুঝতে শেখান মেয়ে পরের সম্পত্তি একদিন তাকে পরের বাড়িতে চলে যেতে হবে সেটাই তার আপন ঘর। শৈলপুত্রী নিজেও এমন শুনেছে নানা জনের কাছে তার মধ্যে আশ্রয়ের খোঁঁজে ঘর খুঁজে শৈলপুত্রী একটা সময় মরতে গিয়েছিল। তবে আজকের শৈলপুত্রী বাঁচার মন্ত্রটা শিখে নিয়েছে। হয়ত মরতে বসাটাই বাঁচতে শিখিয়েছে নতুন করে।
পরপর অনেকগুলো এক্জিবিশন করে যে টাকাগুলো পেয়েছে শৈলপুত্রী। সে চায় তার বিয়ের খরচে এগুলো লাগানো হোক। অপূর্ব খুব রাগ করেন শুনে,' আমি বাবা হয়ে মেয়ের টাকায় বিয়ে দেব! তাহলে রইল সব তোমরা যা পারো কর।'
রেবা অপূর্বকে বোঝান,' টাকাটা না নিলে ওর আত্মসম্মান আঘাত পাবে। বাবা মা নেই হয়ত সব চাপ দিতে চায় না তোমার ওপর। মিশ্রাবাড়ির মেয়ে বলে কথা।'
অপূর্ব বুঝতে পারেন তারপর বলেন আচ্ছা রাখলাম,' তোর কী কী ইচ্ছে বলিস সব হবে।'
-' একটু গ্ৰামের গরিব ছেলেমেয়েগুলো ভালো করে খাবে দু তিনটে দিন। ওদের সবার নতুন জামাকাপড় হবে এইটুকু চাই আর কিছু না। আমার জন্য কিছু করতে হবে না আঙ্কেলজী ওরা বড় গরীব। এই দুদিন ওরা একটু আনন্দের মুখ দেখবে হাসবে গাইবে।'
অপূর্ব ডুবে যান অতীতে বাড়ির অবস্থা তাঁরও ভালো ছিল না। কারও বাড়িতে মাংস রান্নার গন্ধ ভেসে এলে মন হত উচাটন। পাড়াতে বিয়েবাড়ি হলে মাকে বলতেন,' মা আমাদের নেমন্তন্ন করবে না গো? কত খাবার আসবে আজ তাহলে খেতাম।'
-' মা বলতেন আমরা গরীব বাবা তাই আমাদের সবাই ডাকে না। তুমি ভালো করে লেখাপড়া শিখে বড় মানুষ হও তারপর দেখবে এমন কত ভালো মন্দ খাবার খাবে।'
মেসো এনে ভর্তি করেছিলেন স্কুলে, গরীব বলে মাপ হয়েছিল বেতন আর হস্টেলের খরচ। তারপর কতদিন কেটে গেছে। ঘরে আজ কত খাবার স্বয়ং অন্নপূর্ণা হাত রেখেছেন সংসারে তবুও ছোটবেলার অভাবের দিনগুলো বড় মনে হয়। মাকে কোনদিন ভালোমন্দ খাওয়াতে পারেনি। আজও কথাটা ভেবে মনটা ভিজে গেল অপূর্বর। মা শৈলপুত্রী সত্যিই বোধহয় দেবীর অংশ তাই তো সে তার জীবনের বিশেষ দিনে ঐ গরীব মানুষগুলোর ভরা পেটের হাসিটুকু মেখে নতুন পথে চলতে চায়। অপূর্ব আর রেবা তাই মেয়েটার কোন ইচ্ছেই বাকি রাখলেন না। শৈলপুত্রীর নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হল এই ভেবে যে এমন সব মানুষের স্নেহ সে পাচ্ছে।
নটরাজও খুশি বিয়েটা মথুরা সহ অন্য সবাইকে নিয়ে হবে। এই গত তিন বছরে দেওঘর এখন ওর সেকেন্ড হোম। প্রথমে কথা হয়েছিল নাটু কলকাতা থেকে একদম বরযাত্রী সহ আসবে। লাবণ্য আর মণিবাবু আগেই চলে আসবেন অপূর্বদের সাথে। ওঁরা থাকবেন নটরাজের কোয়ার্টারে কারণ অত ধকল সইবে না মণিবাবুর। আর শৈলপুত্রী এই কদিন থাকবে ওর পুরোনো আস্তানায়,গ্ৰামের সবাই একটু আনন্দ করতে চায় ওকে নিয়ে। সাবিত্রী চাচীর নিজের মেয়ে নেই একটাই ছেলে তবুও সে বাড়ি আসে না। সাবিত্রীর ব্যস্ততা দেখে মনে হচ্ছে এ যেন তার নিজের মেয়েরই বিয়ে। অনেকটা আদরে জড়িয়ে রেখেছিল দুঃখী মেয়েটাকে,তার সুখের দিনে আজ যে তাই মনে ভারী আনন্দ।
তবে নটরাজ যথারীতি বাগড়া দিয়েছে প্ল্যানে অপূর্ব পেছনে লাগেন বুঝতে পারূ শৈলছাড়া সে থাকতে চায় না কলকাতার বাড়িতে তাই বলেছে...' ও মামু আমি বন্ধুবান্ধব নিয়ে বরযাত্রী যাবার জন্য এখানে থাকতে পারব না। ও ওরা ঠিক চলে যাবে ট্রেনে করে। ওরাই বলছে আমাকে চলে যেতে তোমাদের সাথে।'
-' আমাদের সাথে তো বেবিও যাবে।'
-' আমিও যাব,তাতে কী হয়েছে?'
-' কিছুই হয়নি বাবা তোমার বারোটা বেজে গেছে। এখন মেয়েটার পড়াশোনা মানে আঁকাপত্র হলে হয়।'
রেবা ওদের মামা ভাগ্নের কথা শুনে মুচকি হেসে চলে যান। শৈলপুত্রীর অনুরাগের রঙ হয় রাঙা। বুঝতেই পারে বিয়ের আগের ট্রেন যাত্রাটা মিস্ করতে চায় না নটরাজ।
*********************
হরিহরণ কদিনের জন্য বাড়ি যেতে চায় বলাতে দেব খুব রাগ করল,' চাচা আজকাল বড় তাড়াতাড়ি বাড়ি যাচ্ছ তুমি এই তো সেদিন ঘুরে এলে বাড়ি থেকে আবার যেতে হচ্ছে তোমাকে?'
-' হাঁ বাবু বড়া আর্জেন্ট কাম পড়ে গেছে তাই যেতেই হবে।'
-' বাড়িতে এমনিতেই অশান্তি এইসময় আমি ছাড়তে পারব না তোমাকে। মায়ের শরীর ভালো নয়,বাইরের আয়া আসে। না না এখন ছুটি হবে না।'
-' বাবুজী আমাকে চারটে দিন ছুটি দিন যেতেই হবে আমাকে।'
দেবের মাথাটা গরম হয়ে যায়,কখনও অনেক রাতে বাড়ি ঢুকছে সানন্দা আবার ভোরে বেরিয়ে যাচ্ছে। সবদিকে নজর রাখে কাকা। এখন গেলে সব চলবে কী করে?
-' না না এখন কিছুতেই যাওয়া হবে না।'
-' তাহলে আমার কাম ছেড়ে চলে যেতে হবে কারণ আমার বিটিয়ার শাদী আছে। যাবই আমি।'
এতদিন আছে চাচা এতটা কঠোর হতে দেখেনি কোনওদিন দেব। চাকরি ছাড়বে এতদিনের পুরোনো?
কিন্তু ওদের চলবে না চাচাকে ছাড়া পুরোনো বিশ্বাসী মানুষ। তাই বলে,' তোমার তো একটা ছেলে তার শাদী তো সেই কবে হয়ে গেছে। গ্ৰামের কারও বিয়ে হলে যেতে হবে?'
হরিহরণ কোন কথা বলে না শুধু বলে,' পরশু বাদ শাদী আছে আমি তার আগের দিন যাব শুধু এ বাড়ির কথা ভেবে। যদি না হয় তো কাম ছোড়কে চলে যাব।'
-' আচ্ছা যাও ঘুরে এস তোমাদের কথাতেই তো চলতে হবে। কে হয় তোমার? কী নাম? একটা শাড়ি নিয়ে যেয়ো তার জন্য।'
-' ঐসব লাগবে না আমার ছুট্টি দিন ব্যাস। আমার মুখ বোলি বিটিয়া আছে আমরা বিটিয়া বলে ডাকি।'
কলকাতার বাড়ি থেকে কদিনের মত ছুটি নিয়ে অপূর্ব আর রেবা রওনা দিলেন দেওঘরে। প্রথমে গাড়িতে যাবার কথা থাকলেও পরে ঠিক হয় ট্রেনেই যাওয়া হবে অবশ্য সবটাই ঐ নাটু ভোলার ষড়যন্ত্র। গাড়িতে কষ্ট হবে ট্রেনে হাত পা ছড়িয়ে যাওয়া হবে। রেবা বারবার রুবি আর বিনুকে বলে যান ওরা যেন গাড়ি নিয়ে বিয়ের দিন সকালে পৌঁছে যায় অবশ্যই। মা হয়ে মেয়েকে সাজাতে পারবেন না সে ভার রুবির।
ট্রেনের পথটুকু আজ বড়ই মিঠে ওদের সবার কাছে লাবণ্য বারবার স্মরণ করছে শিবঠাকুরের নাম। সব নাকি তাঁরই কৃপা তাই তো নাটুর দেওঘরে চাকরি, শৈলপুত্রীর সাথে সেখানেই দেখা আবার বিয়েটাও ওখানেই হচ্ছে। পৌঁছে ধুলো পায়ে আগে পূজা দেবেন বাবার কাছে সব যেন ভালোভাবে মিটে যায়।
-' আরে আমাকেও কিছু ক্রেডিট দে সবই পেল বাবা যাহ্। আমি রাজি হলাম বলেই তো বিয়েটা হল। অবশ্য আর কী করা আদরের ভাগ্নের পাগলামি রাখতে রাজি হতেই হল।'
অপূর্বর কথায় সবাই হেসে উঠলেন। নটরাজ চোখের ইশারায় শৈলপুত্রীকে ডাকে। রেবা বলেন,' যা তোরা পাশেরটাতে বসে গল্প কর। আমাদের মধ্যে বোর হচ্ছিস।'
নটরাজ চলে গেলেও শৈলপুত্রী যায় না। লাবণ্য ধমকান,' আরে যা,এই কদিন আর দেখা হবে না একদম ছাদনাতলাতে।'
শৈলপুত্রী উঠে যায় ধমক খেয়ে। লাবণ্য বলেন অপূর্বকে,' হ্যাঁ রে দাদা সুশোভনকে বলেছিস তো? নাটুকে আমি বলেছিলাম সেও বলে এসেছে।'
-' হ্যাঁ বলেছি,বেবিও বলেছে। দেখি সে কী করে?'
নটরাজ মনে করে শৈলর সাথে ট্রেনে আসার দিনটা,ওদের একসাথে চা খাওয়া আর খাবার খেতে খেতে যাওয়া।
শৈলপুত্রী বলে,' আপনার খাবার আনি,ট্রেনে উঠলেই তো খিদে পায় আপনার।'
-' একদম খিদে পাচ্ছে না শুধু ফাঁকি দিয়ে পালানো। এখানে বোসো এখন। ওখানে গেলেই বকুনি খাবে মায়ের কাছে। আচ্ছা তুমি আমার কাছে কী চাও?'
-' কী আবার চাইব? আমার তো সব আছে। আর যা নেই তা ফিরে আসবে না কখনও।'
-' সব আছে? তোমার সেই টিনের বাক্সটা?'
-' সেটাতেই তো আমার সব স্মৃতি, যেটুকু এনেছিলাম। আনতে চেয়েছিলাম আঙ্কেলজী বললেন থাক এখন পরে এসে নেব। আমি তো সচমুচ দেওঘরে থাকছি না।'
-' মানে আমি তবে একলা থাকব?'
-' হ্যাঁ থাকবেন,আমার কলেজ আছে না? আপনি বলেছেন আমাকে এগিয়ে যেতে।'
-' বুঝলাম।'
-' কী বুঝলেন?'
-' শৈলপুত্রী নামেই নটরাজের হবে সুশোভন বাবুই দেখবেন আমার শৈলপুত্রীকে আমি ফাইলের মধ্যে মুখ গুজে দিন কাটাব।'
মুখ ঢাকে শৈলপুত্রী,' ইশ্ ভীষণ হিংসুটে আপনি তো। স্যারকে নিয়ে কথা বললে আমি কিন্তু। উনি সত্যিই খুব ভালো। আমাকে খুব স্নেহ করেন।'
-' হ্যাঁ আরেকটু হলেই আমার বৌকে নিয়ে পালাচ্ছিলেন আর কী?'
-' আমি আবার বৌ হলাম কবে? আপনার মামা ঠিক বলে।'
-' কী বলে?'
-' বলে যে নাহ্ থাক..'
-' না বল শুনি।'
-' বলে যে বিয়ের জন্য আপনার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। তাই তো আমাকেও রাজি হতে হল।'
শৈলপুত্রী যে শুধুই বুদ্ধিমতী নয় বিচ্ছুও সেটা বুঝেছে আগেই নটরাজ। তবে সব মিলে শৈলপুত্রীকে সে ভালোবেসে ফেলেছে খুব।
দেওঘরে নটরাজের কোয়ার্টার আবার ভরে উঠেছে। মথুরা বাছাধন একেবারে ঝকঝকে করে ফেলেছে সব সাথে ফুলবন্তী। কোন দিকে তাল দেবে ফুলবন্তী ভেবে পায় না। তবে বলে দিয়েছে ওকে ছুটি দিতে হবে। দিদি বলেছে এই বাড়িতে রান্না হয়ে সব খাবার চলে আসবে কোয়ার্টারে। সুতরাং নটরাজের রান্নাঘর বন্ধ। লাবণ্য বলেন,' কি আবদার তুমারা ফুলবন্তী কাম নহি করোগে তো হামকো চায়ে পিলায়েগা কৌন?'
-' সব মিল যায়েগা দেখিয়ে মাজী মথুরা ভাই হ্যায় না? দিদিকে শাদী হ্যায় বহত কাম উহা পর।'
-' ছেড়ে দাও লাবণ্য সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। তুমি কী ভেবেছ বেবি আছে না? ওর সব দিকে নজর আছে।'
রেবার কথাই ঠিক মথুরা ঠিক সময়ে এসে জিপে করে সব পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে এমন কী মণিবাবুর পছন্দের পাতলা গরম গরম রুটি আর চিকেন স্টুও।
পাড়ার বাচ্চারা মেতেছে আনন্দে। দুবেলা পুরী সব্জি জিলিপি খাচ্ছে আনন্দ করে। অপূর্বকে টানছে এখানকার খোলা হাওয়া। ফেরিওয়ালার ডাক আর বাঁশীর সুর। ছেলেবেলা এসে ফিসফিসিয়ে কথা বলে যাচ্ছে কানে।
কাল শৈলপুত্রীর বিয়ে। রুবি সব গুছিয়ে নিয়েছে ওকে তো যেতেই হবে। বিনুও অস্থির বিয়েতে যাবার জন্য। মোটামুটি ভোর সাড়ে চারটায় রওনা দেবে ভেবেছে তাহলে দুপুরের মধ্যে পৌঁছে যাবে আসলে রেবা চলে যাওয়াতে সব দায়িত্ব ওর। সারারাত দেওঘরে ওদেরও যেমন ঘুম হয় না তেমন ঘুম হয় না রুবিরও। ভোরবেলায় ড্রাইভার এসে হর্ণ বাজায়। বেরোতে বেরোতে পাঁচটা বেজে যায়। সুন্দর যাচ্ছিল কিন্তু মাঝ রাস্তায় এমন বিপর্যয় হবে ভাবেনি। একটা এমন জায়গায় এসে গাড়িটা খারাপ হল যে সত্যি এবার রুবির কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কখন পৌঁছবে কিভাবে পৌঁছবে কে জানে? রাস্তায় অস্থিরভাবে পায়চারী করছে হঠাৎ পাশে একটা ডাক শোনেন। বিনু উচ্ছ্বসিত হয়ে কথা বলছে,' সুশোভন দা। কোথায় যাচ্ছেন?'
-' তোমরা যেখানে যাচ্ছ আপাততঃ সেখানেই যেতে হবে মনে হচ্ছে। উঠে এস দিদিকে নিয়ে।'
মুখটা মোছে রুবি কপালে তখনও ভাজ,সুশোভনকে বলে,' আচ্ছা আমরা পৌঁছে যাব তো? নাহলে বেবিকে কে সাজাবে?'
-' ওমা শ্যামার আবার সাজ লাগে নাকি? তার কালো রূপেই তো জগত আলো। আর সে নিজেও সুন্দর আলপনা আঁকে। দরকারে সে নিজেই সেজে নেবে। আপনি চুপ করে বসুন। খুব ক্লান্ত লাগছে আপনাকে।'
হাসে রুবি,' হ্যাঁ খুব কাজের চাপ যাচ্ছে কদিন।'
সুশোভন উইন্ডো গ্লাশে রুবিকে দেখে এর আগেও দেখেছে কয়েকবার যতবার গেছে শ্যামার ওখানে বাড়িতে থাকলেই এই মহিলার যত্নে বানানো এক কাপ কফি খেয়ে আসতেই হয়েছে। ঠাট্টা করে বলেছেন,' অভ্যেস খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এরপর কফি না পেলে অনশনে বসব।'
তবে এটা ভাবেননি এই যাত্রা পথে কফি জুটে যাবে। সুশোভনের মত মাঝবয়েসী ব্যাচেলারের জন্য গাড়ি ড্রাইভ করতে গরম স্যান্ডউইচ আর কফি পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের। তাই আবার বলে ফেলল,' ভাগ্যিস আপনাদের গাড়ি খারাপ হয়েছিল তাই জুটে গেল এত আদর। না হলে শুকনো মুখ নিয়ে যেতে হত দেওঘরে।'
-' আপনি যে বললেন আপনি অন্য কোথাও যাচ্ছিলেন? আমাদের জন্য বাধ্য হয়ে..'
-' আপনিও পারেন মশাই এই সাত সকালে অন্য কোথায় যাব? স্যারের আমন্ত্রণ প্রিয় ছাত্রীর বিয়ে সুতরাং ঐ পথেই আমি একটু মজা করছিলাম।'
রুবিদের দেরি দেখে চিন্তায় পড়েন রেবা। কী হল এতক্ষণ তো চলে আসার কথা। তবে সুশোভনের সাথে ওদের আসতে দেখবেন ভাবেননি। ওহ্ যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। রুবি ব্যস্ত হয়ে পড়ে কাজে। অপূর্ব সুশোভনের সাথে কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সুশোভনের চোখে পড়ে গোধূলিতে পা রাখা রুবির দিকে ছোট ছোট মুহূর্ত ছুঁয়ে যায় গরম কফির কাপের উষ্ণতার সাথে।
সকালে তাড়াহুড়োয় খবরের কাগজে চোখ রাখতে পারেনি দেব। কারখানায় এসে চোখ রাখে অবসরে খবরের কাগজের পাতায় হঠাৎই একটা খবরে চোখ পড়ে বেশ বড় করে দেওয়া খবরটা বিখ্যাত ভাস্কর্য অপূর্ব সান্যাল তার ভাইঝির বিয়েতে সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন পাত্র পাত্রীর নামে চোখ আটকে যায় দেবের। ওহ্ তাহলে সত্যিই বিয়েটা হচ্ছে।
খবরটা দেখে হঠাৎই বুকটা কেঁপে উঠে মনটা উচাটন হল দেবের শৈলপুত্রীকে সে ভালোবাসত। যাক ভালো থাক সে। কিন্তু বিয়েটা দেওঘরে কেন? তারিখ? সবটা দেখে দেবের ইচ্ছে হল আদিত্যকে খবরটা দিতে তারপরেই ভাবল না থাক। তবে হরিহরণের হঠাৎই দেওঘরে যাওয়া কেন? কে এই বিটিয়া? ও কী শৈলপুত্রী? মানে যার জন্য হরিহরণ কাজ ছেড়ে চলে যেতে চাইছে। অনেকগুলো প্রশ্ন জট পাকিয়ে যায় দেবের মনে।
****************
শৈলকে ঘিরে ধরেছে পাড়ার মেয়েরা,আনন্দে মেতে উঠেছে সারা পাড়া। গ্ৰামের বিয়েবাড়ির গন্ধে মশগুল চারধার। এর মধ্যে খোঁজে শৈল বাবাকে। কত শখ ছিল বাবার শৈলর বিয়েতে রোশনাই হবে,বাতি জ্বলবে। ব্যান্ডপার্টি বাজনা বাজবে কত লোক আসবে। কনের সাজে সেজে বসবে মেয়ে কিছুই দেখে যেতে পারেনি বাবা। সেই অসম্পূর্ণ বিয়েটা আজ হয়ত সম্পূর্ণ হবার পথে। রুবি বকাঝকা দিয়ে সাজাতে নাকাল শৈলকে বারবারই বলছে,' এটা দিয়ো না,সেটা দিয়োনা।'
-' আজ সব দেব,নিজের ইচ্ছেতে যেমন খুশি সাজাব তোকে।' হয়ত একটা চাপা শ্বাস বেরোয় রুবিরও এভাবে কত কনেকে সাজিয়েছে এত বছর ধরে।
দুদিন শৈলকে দেখেনি নটরাজ মানে কেউই ওকে ওপাশে যেতে দেয়নি তবে খাবারের কৌটোর সাথে মথুরার কাছ থেকে পেয়েছে ছোট্ট ছোট্ট প্রেমপত্র। মথুরা গম্ভীর হয়ে বলেছে আড়ালে এসে এ আপকে লিয়ে।
রুবি শৈলকে সাজালেও আজ নাটুকে নিজের হাতে সাজান রেবা না হলে ননদিনী দোষ ধরবে সারাক্ষণ মেয়েকে নিয়েই ব্যস্ত রইলে বৌদি আমার ছেলেটার কী হবে? তাছাড়া ছোট থেকে কম আদর আব্দার করেনি একমাত্র ভাগ্নে তাই আজ বড়ই সুখের দিন। ঘরের দুই ছেলে মেয়েকে মিলিয়ে দেওয়া।
কলকাতা থেকে নটরাজের কিছু বন্ধুবান্ধব এসেছে তাদের নিয়েই বরযাত্রী যাবার তোড়জোড় চলছে। সুশোভন ধুতি পাঞ্জাবি পরে তৈরি হয়েছে। বেশ লাগছে এখানে এসে ওর। সব জড়তা কেটে গেছে এখন মনে হচ্ছে না এলে সত্যিই মিস্ করত। হয়ত একা ড্রাইভ করে আসার একঘেয়েমি টুকুও দূর হয়ে গেছে রুবি আর বিনুর সাথে দেখা হওয়ায়। ছোট ছোট টুকরো কথা হাসি আর গল্প ছুঁয়ে রাখে সুশোভনকে। দেওঘরে শ্যামার বিয়েটা সত্যিই রিমার্কেবল মেয়েটা ভালোই করেছে।
তবে এখনও শ্যামার সাথে দেখা হয়নি সুশোভনের। একবার যেতে চেয়েছিল কিন্তু স্যারই বলেছিলেন,' এখন একটু বিশ্রাম কর একেবারে দেখবে তাকে।'
সুন্দর করে ফুল দিয়ে বানানো দোলনায় বসানো হয়েছে শৈলপুত্রীকে। রুবি মুগ্ধ হয় দেখে শৈলপুত্রীকে কানে কানে বলে,' এত রূপ কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলি বেবি? নাটু ভোলা যে একদম কুপোকাত হয়ে যাবে আজ। চিনতেই পারবে না তোকে।'
-' তাই তো বলেছিলাম এত সাজিয়ো না দিদি তুমি শুনলে না। এবার তুমি একটু সেজে নাও। আমি সাজিয়ে দেব তোমাকে?'
-' পাগলী নাকি? আমাকে সাজাবে চুপটি করে বোস।' সাবিত্রী এসে আদর করে যায় ওকে,' খুশ রহ বেটা।'
হরিহরণ আর সাবিত্রীর জন্যই তো এখানে সব কিছু হল। ফুলবন্তী সেজেগুজে এদিক ওদিক ঘুরছে। অনেকগুলো আলো আর বাজির ঝলকানিতে ভরে উঠেছে চারদিক। বাচ্চারা খাবারের গন্ধে ঘুরঘুর করছে চারপাশে সবাই বলে উঠে দুলহা আ গয়ে... বাজনা আর সবার হৈ চৈ আর তার মধ্যেই এল বরযাত্রী নিয়ে বর। কলকাতা শহরের বিয়েবাড়ি থেকে এই বিয়েবাড়ি অনেক আলাদা। তবে অদ্ভুত একটা ফ্লেভার চারদিকে। চাচীর বাড়ি আজ চেনা যায় না। সবার মুখের এই আনন্দটুকু ছুঁয়ে যায় নটরাজকেও। শৈলপুত্রীকে আবার মনে মনে সাবাস বলে। রেবা অপূর্ব শৈলকে জড়িয়ে ধরেন।
-' দেখেছ রুবি কী সুন্দর সাজিয়েছে! আমাদের মেয়েগুলো কত গুণী! হ্যাঁ রে রুবি কোথায়?'
-' এই তো আমি।'
রেবা ব্যাগ থেকে গয়না বের করে রুবিকে পরিয়ে দেন। শৈলপুত্রীর গায়ে আজ আবার মিশ্রাবাড়ির গয়না ও পরত চায়নি তবুও রেবা একটা গয়না পরিয়ে দিয়েছেন মায়ের আদরে জড়িয়ে থাকার জন্য। বাকিটা পরে পরবে।
দুদিন শৈলকে না দেখলেও শুভদৃষ্টিতে শৈলকে দেখে নটরাজ বাকিটা পুষিয়ে নিল। অপূর্ব আবার মজা করেন,' বেবি মুখ ঢাক তাড়াতাড়ি। এখনই মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকলে সারাজীবন দেখবে কী?'
বিয়ের আসরে সুশোভনের চোখও আজ বারবার করে দেখল রুবিকে কেন যেন মনে হল একটা বেদনা ছুঁয়ে আছে মেয়েটাকে। একসাথে বসে কফি খাওয়ার জন্য এমন একজন বন্ধু থাকলে মন্দ হয় না। দুজনেই তো শিল্পী ওরা। শ্যামাকে কী সুন্দর সাজিয়েছে ও।
সুন্দর করে সবার মাঝে এক হল দুটো মন। নটরাজের হল শৈলপুত্রী যতটা হয়ত তার থেকেও বেশী শৈলপুত্রীর হল নটরাজ। মনের অসীম ইচ্ছেতে বরণ করে নিল চিরসাথী করে। ছেলের বিয়ে দেখতে নেই বলে লাবণ্য আড়ালেই ছিলেন। বিয়ের পর ছেলে বৌকে দেখে সত্যিই কেন যেন চোখ ফেরাতে পারেন না এই জুটি ভাঙবেন কী করে তিনি? হয়ত নটরাজের সাথে শৈলকে মেলাতেই এত কিছু করেছেন ঈশ্বর।
*******************
দেওঘর থেকে ফেরার সময় নিজেও কেঁদেছে সবাই কে কাঁদিয়েছে শৈল। আসলে কান্না বোধহয় খুব ছোঁয়াচে। অনেকটা পথ গাড়ির পেছনে এসেছে গ্ৰামের মানুষ। আজ শৈলর বৌভাত গা ভর্তি গয়নায় সেজেছে শৈল। লাবণ্য ভরে দিয়েছেন শৈলকে। তবুও একবার সেই দুঃস্বপ্নের রাত মনে হল শৈলর। আজ হয়ত এই সম্মানের জীবন শুধু নটরাজই একমাত্র ওকে দিয়েছে। শৈলও চেষ্টা করবে এই স্বাদটুকু ধরে রাখতে মনকে কানায় কানায় পূর্ণ করে।
অপূর্ব এসে দাঁড়ান নটরাজের হাতে একটা বড় প্যাকেট দেন।
-' আরে ভীষণ ভারী সাবধানে ধর। এটা তোর।'
-' কী আছে এটাতে?'
-' এটাই তো সূচক মানে সব নষ্টের মূল তাই তোর কাছেই রাখ।'
ছবিটা দেখে অবাক হয়ে যায় নটরাজ,' মামু তোমার বসার ঘরের শিব পার্বতী!'
লজ্জা পায় শৈল।
-' হ্যাঁ শিব পার্বতীর যখন মিলন হল তখন এ ছবি তাদের কাছেই থাক। কী বল রেবা?'
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। কলকাতার আকাশ খুব একটা পছন্দের নয় শৈলর তবে নটরাজের জানলা দিয়ে আসা মিঠে চাঁদের আলো আজ ছুঁয়েছে ওদের। অপূর্ব লোক দিয়ে ঘরে টাঙিয়ে দিয়েছেন ছবিটা। শৈলপুত্রীকে আজ কারও আদেশে গয়না খুলে খাটের এক কোণে শুয়ে পড়তে হয়নি। নটরাজ শৈলপুত্রীর গা থেকে আদরে একটা একটা করে গয়না খুলে দিচ্ছে। নটরাজের উষ্ণতা ছুঁয়ে যাচ্ছে শৈলকে। ভালো থাক ওরা।
-
Comments
Post a Comment