#শপথ_হোক_জয়ের#
গল্প-১
বাবানকে স্কুলে দিতে যাবে বলে সকাল সকাল উঠতে হয় প্রতিদিনই অনিকেতকে। এই সময়টা মিতালী উঠতে পারে না। সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা ওর বরাবরের অভ্যেস ছিল মানে প্রেমের প্রথমেই বলেছিল,' আমার প্রথম প্রেম কিন্তু ঘুম তাকে আমি কিছুতেই ছাড়তে পারব না। মিতালী বড়লোকের মেয়ে যদিও হুট করে প্রেমে পড়ে বাড়ির সবার আপত্তিতেই বিয়ে করেছিল অনিকেতকে কিন্তু বাপের বাড়ি ছেড়ে এলেও সব কিছু ছাড়তে পারেনি। সত্যিই তো সব কিছু ছাড়া যায় না আর কেনই বা ছাড়বে এত বছরের অভ্যেস? তাই হাসিমুখেই সকালের রোজনামচা নিজের মত করে গুছিয়ে নিয়েছে অনিকেত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভোরের অনেকটা তাজা হাওয়ায় প্রথমে নিজেকে চনমনে করে তারপর একটু ফ্রী হ্যান্ড করে মোটামুটি বাবানকে চ্যাংদোলা করে তুলে রেডি করে বৌয়ের ঘুম না ভাঙিয়েই। তারপর যাবার সময় ছেলে মাকে একটা চুমু খেয়ে হাত নেড়ে বেরিয়ে যায় বাবার সাথে। আধো ঘুমে মিতালী আদর করে টা টা বলে।
স্কুলের প্রমীলা বাহিনী মাঝে মাঝেই বলে সুযোগ পেলেই সত্যিই মিতালী অনিকেতদার জবাব নেই।
একটু হলেও বাধ্য বরের আদরে গর্বিত হয় মিতালীও,' হ্যাঁ বাবা আগেই চুক্তি হয়ে গেছে এইসব। সকালের দায়িত্ব তোমার। না রে সত্যিই কিছু বুঝতে দেয় না আমাকে।'
বাবাদের বৈঠক সকালে বেশ জমজমাট স্কুলে। ছানাদের দিতে আসার সুযোগে একটু মিনি আড্ডা সামনের দোকানে চা খাওয়া আর সিগারেটে হাল্কা সুখটান। এইভাবেই আবার বাচ্চাদের হাত ধরে বাবাদের বন্ধুত্বের এক নতুন সমীকরণ। কদিন ধরে বাবুলকে দেখছে না আড্ডাতে অনিকেত। যদিও বাবানদের সেকশনে পড়ে না অগ্নিভ তবুও ওদের মধ্যে আলাপটা ভালো আছে। হয়ত কোথাও বেড়াতে গেছে যা বেড়ানো পাগল ছেলে। ফোন করবে ভেবেও আর ফোন করা হয়নি। তারপর যা হয় বাড়ির কাজকর্ম আর অফিস নিয়ে ব্যস্ততায় কেটে গেছে। আজ মনে হতেই ফোনটা খুঁজে নম্বরটা বের করে অনিকেত। এই প্রথম ফোন করছে ছেলেটাকে তবুও নাহ্ একটা খোঁজ নেওয়া উচিত। অনেকবার সারাদিন চেষ্টা করেও ফোনটা পেল না কখনও সুইচড অফ আবার কখনও নট রিচেবল। আজ কথাটা মিতালীকে বলল,' বুঝলে একটা ছেলের সঙ্গে বেশ আলাপ হয়েছিল বাবানদের স্কুলের, কদিন ধরে বেপাত্তা আজ ফোন করেও পেলাম না।'
-' কে বলত? আমি চিনি? মানে কার বাবা?'
-' তুমি তো যাও বেলাতে চিনবে কী করে? বেশ ভালো বুঝলে আমাদের ডুয়ার্সের প্ল্যানটা তো ও করে দিয়েছিল।'
-' হুঁ বুঝেছি,মানে নামটা শুনেছি তবে ওর ছেলে তো বাবানদের সাথে পড়ে না। তুমিও কিছু বন্ধুত্ব করতে পারো।'
মিতালী হাসলেও অনিকেত অন্যমনস্ক হয়ে থাকে।
-' আচ্ছা আমি দেখছি,কোন সোর্স থেকে খবর পাই কি না। নাও শুয়ে যাও এবার তোমার আবার ভোরে ওঠা আছে।'
মিতালী খবর নেব বললেও সেই ভুলে গেছে। অনিকেত একে ওকে জিজ্ঞেস করে হদিস পায়নি তারপর একদিন জবাব পেল হঠাৎই। বাবুলের বাচ্চাটা একটা সাইকেল থেকে নামছে নজরে পড়ে অনিকেতের তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায় সামনে,' কিছু মনে করবেন না,মানে বাবুলকে কদিন দেখছি না। ফোনও করেছিলাম।'
-' এক মিনিট আমি আসছি হ্যাঁ।'
সাইকেলটাকে একপাশে রেখে বাচ্চাটাকে আদরে কোলে জড়িয়ে স্কুলের গেটের কাছে নিয়ে গিয়ে কোল থেকে নামানোর আগে জড়িয়ে চুমু খেয়ে ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসে। ওদের মা ছেলের ভালোবাসার দৃশ্যটা মন ছুঁয়ে যায় অনিকেতের বাচ্চাটা বারবার বলছিল,' তুমি সাবধানে যাবে মা,তাড়াতাড়ি আবার চলে আসবে।'
অনিকেত শুনে ভাবে কত বুদ্ধি এইটুকু ছেলের অথচ বাবানের মতই হয়ত হবে।
স্কুলের গেটের ভিড় থেকে একটু সরে এসেছে ওরা অনিকেতের সাথে আরও দুজন সবাই এক কথা জানতে চায়।
-' আমি পুতুল,হ্যাঁ আপনাদের কথা ও বলত মাঝে মাঝে। আসলে সবটা এমন ভাবে ঘটে গেছে যে কাউকে খবর দিতে পারিনি।'
-' কী হয়েছে ওর? এখন কেমন আছে? আমি ফোন করেছিলাম।'
-' হ্যাঁ আসলে কয়েকদিন ফোনগুলো মোটামুটি বন্ধ ছিল।'
বাবুলের স্ত্রী পুতুলের কাছে জানতে পারে বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করে একটা পা হারিয়ে আপাততঃ হসপিটালে ছেলেটা। চোখ বোজে অনিকেত মনে পড়ে যায় প্রাণচঞ্চল ছেলেটাকে। ওর বাইকে এক আধদিন উঠেছেও ওর অনুরোধে। কী ভালো চালাত! হঠাৎই এমন হল? আসলে সবই বোধহয় কপাল।
পুতুল তখনও বলে যাচ্ছে,' আমাকে কোনদিন কিছু করতে দেয়নি। বাড়িতে বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ি আছেন মোটামুটি ওর ইনকামের টাকাতেই সব চলত। একটা বিরাট ঝড় গেল আমাদের ওপর দিয়ে তবুও ভালো ও বেঁচে ফিরেছে কিন্তু পা টা বাঁচানো গেল না।'
বাবুলের কাছে শুনেছে মাঝে মাঝে,' মেয়েমানুষের ঘরে থাকাই ভালো বুঝলে যত বাইরে বেরোবে চোখ মুখ ফুটবে নানা বিপদ ডেকে আনবে। তাই ছেলে আনা নেওয়া আমিই করি। ব্যবসা আমিই দেখি আবার বাজার হাটও আমি করি। ও রাঁধে বাড়ে ঘর গুছোয়।'
বাবুলের ঘরে বেঁধে রাখা পুতুলের সারা দিনের হিসেব শুনে অবাক হয় অনিকেত,' এত কিছু! কী করে সামলাচ্ছেন এত সব! মানে আপনি এখন সাইকেল চালিয়ে বড় বাজার যাবেন দোকানের মাল আনতে তারপর বাড়ি হসপিটাল রান্না ছেলে আনা সব!'
পুতুলের ম্লান হয়ে যাওয়া মুখে সব পারবোর হাসি,' উপায় নেই দাদা,বাইকটা গেছে রাখতে পারিনি। দোকান বন্ধ ছিল সংসারে টান। ছেলেটা বাড়িতে বসে কতদিন। অগত্যা আমিই এই সাইকেল ভাগ্যিস চালাতে পারতাম। তাই সাহস করে বেরিয়ে পড়েছি রাস্তায়। আসলে আমরা বোধহয় সব পারি আর কতটা পারি তা অন্যে জানবে কী করে? আসলে নিজেই তো জানতাম না।'
পুতুলের যাবার পথটা আলোতে ভরে উঠুক মনে মনে প্রার্থনা করে অনিকেত। ওর মত কত মেয়েই এই ভাবে প্রতিনিয়ত পরীক্ষা দিয়ে বলতে চায় আমরা নারী প্রয়োজনে সব পারি। 'নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিলে অধিকার'....
আজ নারী দিবস,মিতালীর অতটা মাথাব্যথা না থাকলেও অনিকেতের আছে। বেশ কিছুদিন ধরে ভেবেছে কিছু একটা করতে হবে।
দরজার টুংটাং আওয়াজ হতেই ছেলেকে বলে,' ঐ বোধহয় বাবা এল। আজ তোর বাবাকে খুব বকুনি দেব কত দেরি করে ফিরেছে।'
দরজাটা খুলে অনিকেতের দুষ্টুমি ভরা মুখটা দেখে মিতালী ও কিছু বলার আগেই অনিকেত বলে,' একবার এদিকে এস তো। দেখি কেমন পারো তুমি?'
-' কী আবার পারব? ভালো লাগছে না এমনিতেই অনেক দেরি করেছ।'
মিতালীর হাতটা ধরে গেটের সামনেটায় দাঁড় করায় অনিকেত,' এটা তোমার জন্য। প্রথমে এই স্কুটির পায়ে ভর দিয়েই সোজা হয়ে দাঁড়াও।'
-' আমি ওসব পারব না,কেন শুধু শুধু এটা কিনলে? এই টাকা দিয়ে একটা গয়না হয়ে যেত।'
-' আমার বোকা বৌটা,তুমিই তো বলেছ সাইকেল চালাতে পারো তাহলে এটা পারবে না কেন? যদি কোনদিন আমি..তাহলে বাবানটা তো..'
অনিকেতের মুখে হাত দিয়ে চাপা দেয় মিতালী,' সবসময় শুধু বাজে বকা। আমি চেষ্টা করব,তুমি থাকবে তো সাথে? নাহলে আমার ভয় করবে।'
-' সব সময় আছি তবুও এবার একটু একা চলতে শেখো। মাঝে মাঝে ভোরে উঠে বাবানকে স্কুলে দিয়ে আসবে।'
-' এবার বুঝেছি সব,সেটা হচ্ছে না। আমি সকালে উঠব না।'
-' আমার প্রিয় নারী আছি পাশে সবসময় তবুও বুঝতে শেখো আমি সব পারি আর এটা বুঝতে পারাই দরকারি। দিন দিন বরের আদরে একদম বারোটা বেজে যাচ্ছে।'
মিতালী হেসে ওঠে হাসে অনিকেতও মনে মনে ভাবে এই হাসিটাকে সাথে নিয়েই সংসারে একে অপরের পরিপূরক হয়ে যেন চলতে পারে সবসময় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে নয়।
সমাপ্ত:-
গল্প
২
বেশ অনেকদিন হয়ে গেল বাড়ির বাইরে বেরোয়নি সুরভী। কোন দিক দিয়ে যে এতগুলো দিন কেটে গেছে তা মনে মনে বুঝলেও প্রকাশ করেনি।
পাশের বাড়ির মাসিমা কত বলেছেন,' এবার নিজেকে একটু বদলাও সুরভী।' ম্লান মুখে সুরভী বলেছে,' আর কী হবে মাসিমা?'
সুরভীর ভাবনার মাঝেই তিথি এসে শাড়িটা গায়ে ফেলে মায়ের। তারপর আবার একটা শাড়ি অথচ কোনটাতেই মাকে সুন্দর দেখাচ্ছে না। নিজের মনও ভরছে না। আবার আরেকটা শাড়ি গায়ে দেয় তারপরেই বলে ওঠে,' হ্যাঁ এটা ঠিকঠাক লাগছে।'
-' কেন এত শাড়ি বের করেছিস? বলেছি না আমার ভালো লাগে না।'
-' কে শুনছে তোমার ভালো লাগা না লাগার কথা? আমার ভালো লাগছে তুমি পরবে।'
-' হ্যাঁ সারা জীবন তো তোদের ভালোলাগাই হিসেব করে গেলাম। তাই তো তোর বাবা বরাবরই বলত আমি নাকি একটা আনাড়ী নারী। আমি রাগ করলে বলত আরে আনাড়ী মানে তুমি নারী নও এমন নয়। নারী কিন্তু অদক্ষ মানে আনাড়ী। আমি আরও রেগে যেতাম শুনে। বলতাম সারাদিন সংসারের জুতো সেলাই চন্ডীপাঠ করছি তবুও আমি আনাড়ী?'
-' ঠিকই তো বলেছিল বাবা সংসারের বাইরে যে পৃথিবী সংসারটা আছে সেখানে ফেললেই তুমি আনাড়ী। মনে আছে পুরীতে গিয়ে বাবাকে খুঁজে না পেয়ে কেমন কাঁদছিলে?'
পুরোনো কথা মনে পড়তেই হেসে ফেলেন সুরভী মেয়ে ততক্ষণে শাড়ির প্লিট টা গায়ে বসায় যত্নে। গলায় লকেট দেওয়া হারটা আর কানে দুলটা পরিয়ে দেয়। আয়নাতে নিজেকে খুঁজে পেতে চায় আবার সুরভী কিন্তু কেন যেন নিজের চেনা আমিটাকে মেলাতে পারে না।
কলেজস্ট্রীটের এই দোকানটাতে কলেজের বই কিনতে এসে অমিতাভর সাথে প্রথম আলাপ হয়েছিল। তারপর কত এসেছে বই খোঁজার অছিলায়। ভালোবাসা হয়ে গেছিল বইয়ের দোকানের মালিকের সাথেই। সবে বাবা চলে যাওয়াতে অমিতাভ ব্যবসা সামলাচ্ছে। বিয়ের পর এসেছে উৎসব অনুষ্ঠানে। অমিতাভ অনেক বলেছে আনাড়ী থেকে একটু পরিপূর্ণ নারী হও কানে নেননি। আজ মেয়ে এনে হাত ধরে বসালো আবার অনেকদিন বাদে স্বপ্নের জগতে,' মা বাবার অসম্পূর্ণ কাজ তো তোমাকেই দেখতে হবে। আমার তো পড়াশোনা আছে। তুমি না দেখলে দোকানটা বন্ধ হয়ে যাবে। কাজ হারাবেন ওঁরা।'
সদ্য বাঁধানো অমিতাভর ছবিটাতে চোখ পড়ে যায় সুরভীর সেই এক মুখ হাসি..শুধু গলায় দুলছে মেয়ের পরিয়ে দেওয়া রজনীগন্ধার মালাটা।
মনে হচ্ছে সুরভীর দিকে তাকিয়ে বলছেন,' যাক তবুও এতদিনে এলে। আমি তো ভাবতাম তুমি আনাড়ীই রয়ে গেলে চিরকাল।'
সুরভী চোখ বুজলেন হাত জোড় করে মনে মনে বললেন,' তোমার সাথে এত বছর থেকে কী আর আনাড়ী হয়ে থাকা যায়? আশীর্বাদ কোর যেন এক সম্পূর্ণ নারী হয়ে তোমার ফেলে যাওয়া সব কাজ সামলাতে পারি।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment