Skip to main content

উটি সফর

মিনি ট্রিপে গিয়ে গিয়ে যখন ক্লান্ত মন বলছে নাহ্ আর ভালো লাগছে না কিন্তু যাব কোথায়? মনটা বড় পাহাড়ের গান গাইছিল অনেকদিন ধরেই একটা দার্জিলিং ট্রিপের প্ল্যানও ছিল সবাই মিলে কিন্তু সেটা ভন্ডুল হল হঠাৎই তারপর আবার সেই উড়ু উড়ু ডানা ঝাপটানো মনটাকে সামলানো দায়। কিন্তু কোথায় যাই? হঠাৎই মনে হল আমার লিভিং টুগেদার গল্পটার কথা আরে উটি ঘুরে আসি বরং এতদিন তো জাস্ট কল্পনার জাল বুনে গেছি রাণা আর মুনিয়াকে নিয়ে এবার লেখিকার কল্পনা যদি সত‍্যি হয়। কিন্তু সেই আবার গালে হাত মানে চার দিন হাতে নিয়ে একদম তামিলনাড়ু? কারণ স্কুল চলছে পুরোদমে। ছুটি নিলাম না হয় দু তিন দিন তবুও অনেকটা পথ। অবশেষে দূরত্বর বাধা না মেনেই সবাই মানে ছেলেমেয়ে সহ আমরা দুজন রওনা দিলাম উটির উদ্দেশ্যে। ওদের সাথে পেয়ে মনটা খুবই ফুরফুরে হল কারণ নানা ব‍্যস্ততায় ওদের আজকাল পাওয়া যায় না সাথে। কলকাতা থেকে উড়ানে দিল্লী হয়ে কোয়েম্বাটোর। রিসিডিউল হয়ে ফ্লাইট ছিল মাঝরাতে তাই মোটামুটি সারাটা রাতই গেল তবুও মনে বেড়ানোর আনন্দ সুতরাং কুছ পরোয়া নেই। আসলে মনটাই বোধহয় সব,মনই চালনা করে শরীরকে। কোয়েম্বাটোর নেমে ওখানে রেড ট‍্যাক্সির সাথে কথা হল প্রথমে আমাদের ব্রেকফাস্ট করাবে তারপর আদি যোগী দেখাবে তারপর সোজা উটির পথে রওনা দেব।
    ব্রেকফাস্ট করলাম অন্নপূর্ণা নামে একটা বিশাল দক্ষিণী ক‍্যাফে কাম রেস্টোরেন্টে অসাধারণ ইডলি আর বড়ার স্বাদ। কলকাতার ইডলি ধোসাতে সেই স্বাদ পাই না সাথে চাটনিও খুব সুন্দর খেতে। সুতরাং ইডলি আর বড়ার প্লেট বাড়তে শুরু করল। তবে একটা সময় হামলে পড়ে খেতে খেতে পেট ভরে যাওয়াতে নিরস্ত হলাম তার সাথে অবশ্যই ছিল গরম কফিতে চুমুক দিয়ে আহ্ বলা। বাইরে তখন গরমের দাপট ততটা নেই আসেপাশের গাছগুলো বসন্তের শোভা নিয়ে আমাদের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল। বেশ চলছিলাম হঠাৎই গাড়ি আটকালো জ‍্যামে তখন বেশ গরম লাগছে অনেকটা সময় অপেক্ষা করে জানতে পারলাম পূর্ণিমা উপলক্ষে সামনের মন্দিরে পুজো হচ্ছে। হাতি নিয়ে তারই শোভাযাত্রা চলছে। মনে হল সত‍্যিই তো আজকে দোল কলকাতা হলে বা পুরুলিয়া হলে রঙীন হতাম আমরাও তবে এবার গন্ত‍ব‍্য আলাদা এখানে রঙ মাখার চল নেই। সুতরাং আমরাও নিশ্চিন্তে যানজট খোলার পর আবার চলতে শুরু করলাম। পথে ডাবের সারি আর তালশাঁস রাখা। কিছুটা চলার পরই হাত নাড়ল নীলগিরি পর্বতমালা। পাহাড় আর সবুজ নারকেল সুপারী গাছের সারি মনকে ভালো করল। তার মধ‍্যে দিয়ে বেশ কিছুটা এগোতেই ছেলে বলল ঐ দেখ দূরে..চোখ আটকে গেল দূরের পাহাড়ের সামনের বিশালাকার মূর্তিতে মাথা নত হয়ে গেল হঠাৎ দেখা বিশালাকার মহাদেবের আবক্ষ মূর্তিতে। কপালের টিপ আর মাথার চাঁদ উজ্জ্বল বাকিটা কখনও মনে হচ্ছে কালো কখনও গাঢ় নীল। গাড়ি কিছুটা দূরেই থেমে গেল বাকি পথটুকু পায়ে হেঁটে চলতে শুরু করলাম সন্মোহিত হয়ে যত এগোচ্ছি তত মুগ্ধ হচ্ছি আবক্ষ আদি যোগীর মূর্তির বিশালতায়। তখন বেশ চড়া রোদ বারবারই মনে হচ্ছিল ইশ্ যদি ভোরে এসে ধ‍্যানে বসতে পারতাম কিছুক্ষণ এই বিশাল মূর্তির সামনে। শুনলাম রাতে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড হয়। প্রায় একশো ষাট ফুট উঁচু এই মূর্তি আর পাঁচশো টন স্টীল দিয়ে বানানো ইতিমধ্যে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম করে নিয়েছে সবচেয়ে বিশালাকার আবক্ষ মূর্তি হিসেবে। রোদকে অগ্ৰাহ‍্য করেই ছবি তোলা হল দেখলাম অনেকেই নানা ভঙ্গীতে রিলস বানাচ্ছে। তবে ছেলের জন‍্যই দেখা সম্ভব হয়েছিল এই অপূর্ব মূর্তি আমরা সত্যিই জানতাম না। বেশ কিছু সময় পরে মূর্তিকে পেছনে ফেলে আবার গাড়িতে ফেরা কিন্তু মানসচক্ষে রয়ে যাবে আজীবন এই বিরাট শিশু ভোলানাথ যিনি বিশ্ব লয়ে খেলা করছেন।
    সমতলে বেশ কিছু সময় চলার পর গাড়ি পাহাড়ে উঠতে শুরু করল পাহাড়ের আদরে মাখামাখি হলাম বেশ কিছুটা সময়। প্রতিটা পাহাড়ের এক আলাদা শোভা কারও সাথে কারও মিল নেই খুব একটা ঠিক মানুষের মতই কোথাও গিয়ে আমরা আলাদা। নীলগিরি সবুজের সমারোহ নিয়ে সাজিয়ে বসে কোথাও তার বেগুনি রঙের ফুলের ছোঁয়া আবার কোথাও হলুদের ছোঁয়া ছুট্টে চলার মাঝে উঁকি মারে অমলতাসের গোছা গোছা ফুল বলে যায় চুপি চুপি এখানেও আছি। একটু একটু করে শীতল হল শরীর আর মন। তখন ভেতরের এসি বন্ধ করে খোলা জানলা দিয়ে আসা শীতল বাতাসের আদরে মাখামাখি চুলের গোছা আর তপ্ত গাল। মন ছুঁয়ে যাচ্ছে বহুদিন বাদে দেখা পাহাড় একটু বাদেই পাহাড়ের কোলে সাজানো চা বাগানের কার্পেট মনকে একদম তাজা করে দিল। দার্জিলিং পাহাড়ের পথে দেখা চা বাগান আর উটির চা বাগান একটু আলাদা অনেকটা মুন্নারের মত তবে মুন্নার আরও সবুজ। মাঝে মাঝে উঁকি মারে কফিগাছের দল মন ভরে যায় ওদের মিলেমিশে থাকা বন্ধুত্বের বন্ধনে। দূর থেকে সুন্দরী উটিকে দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম উটিতে। অনেকদিন বাদে কোন হিল স্টেশনে এসে ভালো লাগল খুব। উটি পাহাড়ের উপত‍্যকাতে সাজানো সুন্দর শহর আমাদের হোটেলটা একটু ওপরে ছিল তাই বাস স্ট‍্যান্ড স্টেশন সব পেরিয়ে গাড়ি নিয়ে উঠে পড়লাম ওপরে। আমাদের হোটেলের নাম ক্লুনে ম‍্যানর। হোটেলে ঢুকে সবুজের ছোঁয়া আর পাখির ডাকে মন ভরে গেল। চারদিকে শুধুই সবুজের মাঝে ভিক্টোরিয়ান ভিন্টেজ রিসর্ট। প্রত‍্যেকটা ঘরের দরজা খুলেই চোখে শুধুই সবুজ। চওড়া লন তাতে পাতা সবুজ ঘাসের কার্পেট আর সাজানো প্রচুর টব আর গাছ। একটু চোখ বাড়ালেই লম্বা লম্বা গাছের হাতছানি। হোটেলের ঘরগুলো আর ঝাড়বাতিতে আভিজাত্যের ছাপ,বেশ একটা পুরোনো গন্ধমাখা। আমাদের পেটে তখন ছুঁচোর কেত্তন আর ইঁদুরের দৌড়ঝাঁপ। সুতরাং বিকেলের খাবার দাবার পেয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লাম সবাই খাবারের ওপর,পেটে কিছু দিয়ে মাথা ঠাণ্ডা হল। উটিতে সূর্যের আলো বেশ অনেকটা সময় থাকে তবে বেলা পড়ার সাথে সাথে ঠান্ডার ছোঁয়া পেলাম। গায়ে শাল জড়িয়ে তখন শুধু সবুজে চোখ রেখে বিশ্রামের পালা। রাতের ডিনার আর ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি ছিল। তবে এই হোটেলের ব‍্যবস্থাপনা একটু আলাদা দেখলাম সাধারণত সব হোটেলে বুফে ডিনার থাকে এখানে আমাদের অর্ডার দিতে বলা হল যথারীতি আমরা স‍্যুপ,ক্রিস্পি চিকেন,ফ্রায়েড রাইস,চিকেন মাঞ্চুরিয়ান নিলাম এবং ডেসার্টে লেডিকিনি আর আইসক্রীমও ছিল। মানে মোটামুটি স্টার্টার,মেন কোর্স আর ডেজার্ট খেয়ে তখন সত‍্যি একদম আইঢাই সবাই। এরপর আর কী লাগে? জাস্ট কম্বল মুড়ি দিয়ে একটা স্বপ্নিল ঘুমের দেশে ঘোরাফেরা। পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল অজস্র পাখির কিচিরমিচির শুনে। গায়ে হাল্কা চাদর জড়িয়ে পা রাখলাম ঘাসে গতকালের থেকে ঠান্ডা বেশ কম মন ভরে উপভোগ করলাম সবুজের চাদর জড়ানো সুন্দর ভোরবেলাটা। হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ালাম হোটেলের চারপাশটা সত্যি মন ভরে গেল। তোমাদের জন‍্যও অবশ‍্য একটু বন্দি করে এনেছি ভোরের টুকরো ছবি। আমরা গাড়ি নিয়ে চারপাশটা ঘুরতে চাইলে হোটেলের লোকেরা বাধা দিল বলল অটো করে যেতে আমার কর্তার খুব একটা ইচ্ছে না থাকলেও শেষে অটোতেই ঘুরব ঠিক হল। সেদিন ছিল হোলি দোল যেহেতু আমাদের পথেই কেটেছে তাই সেদিন সকালে আবীর মাখা হল কিছুটা সবুজ ঘাসও মাখলো আমাদের সাথে সাথে গোলাপি আর হলুদ রঙ। তৈরী হয়ে আবার কিছুটা সময় ব‍্যস্ত হয়ে পড়লাম ফটোশুট করতে কারণ বড়ই সুন্দর জায়গাটা। তারপর চলে গেলাম ব্রেকফাস্ট করতে এখানকার বুফে ব্রেকফাস্টে ইডলি,বড়া,পোহা উত্তাপম অমলেট ধোসা পুরি,ফ্রুট জুস চা কফি সবই মোটামুটি থাকে তবে ইডলি আর বড়ার স্বাদ অসাধারণ একদম মন ভোলানো।
 কিছু বাদে একটা অটো আসতে বুঝি এটাই আমাদের হবে এগিয়ে যেতেই দেখলাম অবাক হয়ে মহিলা চালক খুব সুন্দর হাসিমুখে আমাকে পরিস্কার হিন্দীতে জিজ্ঞেস করল যে আমরাই অটো বুক করেছি কি না? যথারীতি তার সাথে সব কথাবার্তা হয়ে গেল। তামিলনাড়ু গিয়ে অনেকেই চিন্তিত হয়ে পড়েন যে ইংরেজি ছাড়া কথা বলা যাবে না কিন্তু এখন এরা প্রত‍্যেকেই হিন্দীতে সুন্দর কথা বলেন। সুতরাং কোন অসুবিধা নেই। আমাদের অটো ড্রাইভার খুব অমায়িক এবং পরিশ্রমী। মহিলা মুখে হাসি লেগেই আছে। আমাদের মালপত্র সব গুছিয়ে তুলে আমাদের পৌঁছে দিল স্টারলিং। আমরা এখানে চেক ইন করে তারপর ঘুরতে বেরোব। 
ছেলেই সব হোটেল বুক করেছিল। তবে এই ব‍্যাপারে তার একটু আলাদা পছন্দ আছে নতুন নতুন হোটেলের অভিজ্ঞতা তার বিশেষ পছন্দের। থাকার ব‍্যাপারে সে যথেষ্ট সিলেক্টিভ মানে সে বিশ্বাস করে না শয়নং যত্রতত্র ভোজনং হট্টমন্দিরে যা আমরা শুনে এসেছি ভ্রমণপিপাসু মানুষের মুখে। তাই উটির পরের দিনটা আমাদের স্টারলিং হোটেলে কাটল। দুটো হোটেল দুই রকম। ক্লুনে ম‍্যানরে পুরোনো গন্ধ ঠাসা আর সবুজের সমারোহ চারপাশে। স্টারলিং ঝাঁ চকচকে সমস্ত আধুনিক ব‍্যবস্থাপনা সহ দাঁড়িয়ে আমাদের অভ‍্যর্থনাতে। আলাপ হল মালবাজারের মেয়ে সৃজনীর সাথে ওখানে তখন ও রিসেপশনে ছিল। একদম ছোট্ট খাট্টো আর খুব সুন্দর ব‍্যবহার। স্টারলিং থেকে খুব সুন্দর দেখা যায় পুরো উটিকে। রঙ বেরঙের বাড়ি ঘর রাস্তা আর লেকও দেখা যায় হোটেলের ব‍্যালকনি আর আমাদের ঘরের জানলাতে বসেই। ঘরও খুব সুন্দর আর পরিপাটি করে গুছোনো। একটু বাদেই আমরা বেরোলাম ঘুরতে আগেই বলেছিলাম শুধু জায়গাটা চেনার জন‍্য যতটা দরকার ততটাই ঘুরব উটির সৌন্দর্য্য আমরা অনুভব করেছি আমাদের নিজের মন দিয়ে। তাই প্রথমে বোটানিক্যাল গার্ডেন এসে পৌঁছলাম এখানে দেখার জায়গাগুলোতে টিকিটের ব‍্যবস্থা আছে। বেশ ভিড় ছিল সব জায়গাতেই কারণ তখন ছুটির মেজাজ সেখানেও চলছে। বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঢোকার মুখে দুপাশে দুটো কামান দেখলাম। উটির বিভিন্ন জায়গাতে বিদেশী ছাপ দেখা যায়। এখানে রেলপথও বসানো হয়েছিল চায়ের শিল্পের আমদানি রপ্তানির জন‍্য। বোটানিক্যাল গার্ডেনের শোভা মন কাড়ল তবে বেশ ভিড় তাই আর বেশিক্ষণ থাকতে ইচ্ছে করল না তারপর আবার সবার জল পিপাসা পাচ্ছে। উটিতে এক লিটারের বোতল চলে না পাঁচ লিটারের বোতল। আমরা উটিতে ঢোকার পথেই ড্রাইভারের নির্দেশে আমাদের বোতল গুলো ফেলে দিয়েছি সাথে স্টীলের বোতল বা অন‍্য কোন বোতল না থাকায় বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। তাই বোটানিক্যাল গার্ডেনে গোল করে একটা চক্কর কেটে ফলের রস এবং ক‍্যানড সফট ড্রিংকস খেয়ে বেরিয়ে এলাম ছবি টবি তুলে। এরপর আমাদের দ্বিতীয় গন্তব‍্য উটির সর্বোচ্চ চা প্রস্তুতি প্রকল্প। ততক্ষণে হাল্কা বৃষ্টি নেমেছে। এখানেও টিকিট আছে। কর্তা টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকার আগেই আমরা ফটো তুলে নিলাম। এই ব‍্যাপারে আমার কন‍্যা এখন পুত্রের থেকে এগিয়ে ও সাথে থাকায় অনেক মজার মজার ছবি তোলা হয়েছে। কোথাও কর্তামশাই রেগে রামগড়ুরের ছানা আর আমি দন্ত বিকশিত করে হাসছি। আমার ফটো তোলার বাতিকে তিনি কখনও বিরক্ত তবে তাকে পাত্তা না দিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ে সময় পেলেই মেয়ের তত্ত্বাবধানে ছবি তুলে নিচ্ছিলাম। আরে জিন্দেগী তো এমনি বাঁচতে হয় যাতে প্রতিটা দিনই যেন শেষ দিন সুতরাং স্মৃতি আর মুহূর্তের ছোট্ট ছোট্ট নুড়িকে যত্নে কুড়িয়ে তুলছি। ভেতরে কাঁচা চা পাতার গন্ধ আর সুন্দর করে লেখা চায়ের ইতিহাস। চায়না দেশটাকে যতই আমরা গালাগাল দিই না কেন এই চা ও এসেছিল ওদের কাছ থেকেই চাও চাও বা করোনার মতই। চায়ের ইতিহাস পড়তে পড়তে জানলাম চীনের সাথে যুদ্ধে বন্দীদের নিয়ে ইংরেজরা চায়ের চাষ করাত নীলগিরিতে সত‍্যিই এই সাদা চামড়ার মানুষগুলো আমাদের দেশকে দুশো বছর পরাধীন রাখার সাথে সাথে নিজেদের প্রয়োজনেই বিজয়ধ্বজা উড়িয়েছিল শিল্প আর কৃষিতেও। চায়ের প্রয়োজনে বসেছে রেলপথ পাহাড় কেটে। চায়ের প্রসেসিং উত্তরবঙ্গেও দেখা যায়,এখানেও দেখলাম মন দিয়ে নাক বুঝল কাঁচা চা পাতা এবং শুকনো চা পাতার গন্ধের ফারাক গোল করে পাকদন্ডী ঘুরে চায়ের ট্রান্সফরমেশন মানে দুটো পাতা একটা কুড়ি থেকে গুড়ো চা দেখে নামলাম সিঁড়ি বেয়ে আর নেমেই এক গ্লাস গরম চা একদম পর্যাপ্ত দুধ চিনি দিয়ে। তবে চুপিচুপি বলে রাখি চায়ের রাণী কিন্তু দার্জিলিং। নীলগিরির চা তার সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠবে না হয়ত বা আসাম চাও এগিয়ে। তবুও চা বাগানের শোভা সে তো অনন‍্য। ওখান থেকে বাইরে বেরিয়ে চা বিভিন্ন রকম ভেষজ তেল আর মশলা বিক্রীর স্টল প্রচুর ভিড় সেখানে করোনার কথা মনে হচ্ছে কারও মনে নেই। চা আমরা কিনলাম না ভেষজ তেল কিনল ছেলে। তারপর আবার উঠে এলাম চকোলেট ফ‍্যাক্ট্রীতে চকোলেট বানানো হচ্ছে মোল্ডে দিয়ে তবে রেসিপি পাবে না পুরোটাই প‍্যাকেটে গলানো অবস্থায়। সেখানে আরও ভিড় আমার ছানাপোনারা এবং কর্তা চকোলেট দেখে উচ্ছ্বসিত। সুইজারল্যান্ড গিয়ে যেটা চব্বিশ হাজার ছুঁয়েছিল এখানে তা মোটামুটি সবারটা মিলেমিশে হাজার পাঁচেক হবে। চকোলেট হাজার টাকা কেজি আরও বেশি দামেরও আছে। কম বলতে আটশো টাকা তার কম দেখলাম না। যাই হোক চকোলেটের ঝুলি নিয়ে আবার অটোতে ওঠা তখন বাইরে ছিপছিপে বৃষ্টি। ছেলেমেয়েরা গেল ভিউ পয়েন্ট দেখতে আমি বসে রইলাম অটোতে। একটু বাদে বৃষ্টি থামল আমরা এসে পৌঁছলাম টি গার্ডেনের কাছে।
   আমাদের সারথি খুবই অমায়িক বারবার বললেন ঘুরে আসতে চা বাগান। ওরা বলল আমাদের ওখানে কত চা বাগান এখানে আর যাব না। তবুও উনি বললেন একবার দেখে আসতে। আর দেখতে গিয়ে মনে হল নাহ্ সত‍্যিই না এলে মিস্ করতাম। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এক ফালি সুন্দর সবুজ গালিচা যত্নে পাতা। চায়ের পাতার রঙটাও খুব সুন্দর। ঐ যে একটা কথা আগে বলেছি ফারাক থাকেই কোন না কোনখানে তাই দু চোখ ভরে দেখে নাও যতদিন দেখতে পারছ। ইচ্ছেমত খুশি থাক যা পেয়েছ তাতেই নিজেকে সাজিয়ে রাখো মন ভালো রাখতে। ওখানে ঢুকেই আমার সহজাত পাগলামি শুরু হল। মানে আবার সবুজের প্রাণভরা অক্সিজেন গ্ৰহণ করে মনের আনন্দে খুশিমত হাত পা নাড়লাম ছবি তুললাম লাফিয়ে। চা বাগান দেখার পর লাঞ্চ করতে এলাম বাজার অঞ্চলে উটির ফলের দোকান খুব সুন্দর করে সাজানো চলতি পথে দেখতে ভালো লাগল স্ট্রবেরি, ড্রাগনফ্রুট এছাড়া আরও কত রকম ফলে সাজানো এমনকি পাকা কাঁচা আমও দেখলাম। ছেলেমেয়েদের কে এফ সিতে পাঠিয়ে আমি শনিবার নিরামিষ খাই তাই ওর উল্টোদিকের একটা দক্ষিণী দোকানে এলাম খেতে। ওদের থালি ট্রাই করলাম,অনেক রকম পদে ভরানো থালা পাপড় দই পায়েস সম্বর রসম সব্জি আরও কত কী। কিছু খেতে পারলাম কিছু রুচলো না মুখে। যাক সব মিলে ভালোই লাগল তারপর গেলাম আমাদের পরবর্তী দেখার জায়গা রোজ গার্ডেনে এখানেও টিকিট আছে। সিঁড়ি দিয়ে বেশ একটু নীচে নেমে গোলাপ বাগান প্রথমে সব গাছেরই মাথা কাটা দেখে একটু হতাশ লাগলেও দেখলাম নীচে অনেক ফুল। যাক কষ্ট করে নীচে নেমে আর ওপরে কিছুটা উঠে যা দেখেছি তার স্মৃতি মনে রয়ে যাবে। খুব সুন্দর রঙের সমারোহ আর গোলাপ ফুলের আকার বেশ অনেকটা বড়। ততক্ষণে বেলা পড়ে গেছে উটিতে অনেক কিছুই তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায় মানে ছটার মধ‍্যে তাই আমরা সেখান থেকে চলে এলাম লেকের ধারে তবে দেখলাম লেকে তখন প্রচুর ভীড়। সবাই বেশ আনন্দ করছে কেউ বা বোটিং করছে। বোটিংয়ের ইচ্ছে কারও তেমন ছিল না তাই শুধু দেখলাম চারদিক। বেশ ভালো লাগছিল। তবে পাহাড়ের কোলে এমন লেক দেখার অভিজ্ঞতা প্রচুর তাই তেমন কিছু নতুনত্ব লাগল না তবে উটিতে এসে লেকটা দেখব না তাই ছুঁয়ে গেলাম একবার। চারদিকে প্রচুর ভিড়ের মাঝে আই লাভ উটির সামনে টুক করে মা আর মেয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফিরে এলাম। এবার অটোতে করে হোটেলে ফেরার পালা আমাদের সদা হাস‍্যময়ী সারথি আমাদের যত্নে এনে পৌঁছে দিলেন হোটেলে পথে আসতে আসতে শুনলাম অকালে স্বামীকে হারিয়ে টুকটাক কাজ করার পর গত ছয় বছর ধরে অটো চালাচ্ছেন এইভাবেই মানুষ করেছেন দুই মেয়েকে একজন এম টেক করে চাকরি করছে আরেকজন বি কম করে ট্রেনিং নিচ্ছে। শুনে ভালো লাগল আবার মনে হল সেই একই কথা নারী তুমি আর থেকো না বন্দি ঘরের কোণে স্বাবলম্বী হতেই হবে নিজের প্রয়োজনে। পরের দিন আমাদের কুন্নুর যাবার কথা ছিল অনুরোধ করলাম সকালে পৌঁছে দিতে। সুন্দর করে হেসে অন‍্য ড্রাইভারের নম্বর দিল কারণ পরদিন রবিবার তাই ওকে চার্চ যেতে হবে। ওকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে এগোতেই সূর্যাস্তের অপরূপ শোভা নজরে এল। ছেলে ক‍্যামেরা নিয়ে চলে গেল ছবি তুলতে আমরা ঘরে এলাম জানলায় বসে দেখলাম বড় থেকে ছোট্ট হয়ে এক টুকরো লাল রুমালের মত সূর্যের ডুবে যাওয়া। মনের ক‍্যামেরা ক্লিক ক্লিক করে তুলে নিল সব ছবি। দীর্ঘদিন মনে থাকবে সেই সুন্দর দৃশ্য। সন্ধ‍্যেটা বেশ ভালো লাগল সেদিন একটু আয়েসে গা ডোবালাম বিছানায় একটু খুনশুটি হল ছেলেমেয়েদের সাথে মনটা ভালো হয়ে গেল। রাতে ডিনারে যথারীতি বুফে ছিল ওরা নিজেদের পছন্দ মত খেল আমি নিরামিষ পদ বেছে খেলাম শেষে মিষ্টির জন‍্য মনটা হায় হায় করল দেখলাম গোলাপী রঙের সাবুর পায়েস মেজাজটা খাট্টা হয়ে গেল আগের দিন বেশ গরম লেডিকিনি খেয়েছিলাম। সবুজ চিহ্ন দেখে একটা প‍্যাস্ট্রি নিলাম যাক মোটামুটি মাথা ঠাণ্ডা করে বিছানায় শুলাম এসে। জানলা দিয়ে তখন দেখা যাচ্ছে আলো ঝিকিমিকি উটি শহর অনেকটা সময় তাকিয়ে দেখলাম তারপর পরদা নামিয়ে ঘুমোনোর প্রস্তুতি কারণ পরের দিনের যাত্রাপথ বেশ লম্বা প্রথমে টয়ট্রেনে চেপে কুন্নুর যাব তারপর সেখান থেকে কুর্গ তাই বিশ্রামের খুব দরকার। উটিতে কাটানো শেষ রাতের রেশটুকু মেখে ঘুমোতে যাওয়া আনন্দে।

   পরদিন ঘুম ভেঙে গেল বেশ ভোরে এমনিতেই আমার ভোরে ঘুম থেকে ওঠা অভ‍্যেস আর তারপর যদি কোথাও যাই তাহলে বাইরে বেরোতে হবে দেখতে এই চিন্তায় মোটামুটি ঘুম ভাঙে বেশ তাড়াতাড়ি। উঠেই কাঁচের জানলার ওপর থেকে ভারী পরদা সরিয়ে চোখ রাখি বাইরে জানলার কাঁচে তখন শিশির জমেছে। নীচে চোখে পড়ল ছাদের শেড শিশিরে ভেজা। উটিতে সকালের দিকে ঠাণ্ডা কম মনে হয়েছে আমার সেই তুলনায় সন্ধ‍্যেবেলা ঠান্ডা একটু বেশি। তবে এইসময় খুব উপভোগ্য সেই ঠাণ্ডা। সকালে মোটামুটি তৈরী হয়ে আমরা ব্রেকফাস্ট করতে চলে গেলাম কারণ উটি থেকে আমাদের টয়ট্রেন ছাড়ার কথা নটা পনেরোতে তাই অটোকে বলা হয়েছে সাড়ে আটটায় আসতে তার মধ‍্যেই আমাদের সব সেরে বেরোতে হবে। বুফে ব্রেকফাস্টে মোটামুটি ডিম,সসেজ,ব্রেড,দুধ কর্ণফ্লেক্স,ফল,বড়া,ইডলি,ধোসা,উত্তাপম,ফলের রস চা কফি আরও যা যা থাকে সবই ছিল। রানিং কাউন্টার থেকে অমলেট আর ধোসা দিচ্ছিল ওরা। আমরা বারান্দায় বসে স্বচ্ছ কাঁচের ফাঁক দিয়ে প্রকৃতি অনুভব করতে করতে কামড় বসাচ্ছিলাম গরম চিজ অমলেট বড়া আর ধোসাতে। সত‍্যিই বেড়াতে যাওয়ায় এখন এটাই আনন্দ একটা সময়ের বেড়াতে যাওয়ায় এই লাক্সারি টুকু করার সামর্থ্য সত‍্যি বলতে ছিল না তবে ইচ্ছেটুকু ছিল অদম‍্য আর সেই ইচ্ছে আর মনের জোরেই উতরে গেছি সমস্ত যুদ্ধ আর প্রতিবন্ধকতা তবে এখন সত‍্যি একটু আয়েসে থাকতে বেশ ভালো লাগে। ব্রেকফাস্ট করে একটু ছোট্ট ফটোশুট করে একদম হোটেল থেকে চেকআউট করে বেরিয়ে এলাম। কারণ আমাদের সময় ভীষণ কম অথচ দেখার জায়গার লিস্ট লম্বা। মানে দূরত্বের লিস্টিটা বেশ লম্বা। তাই কথা হয়েছিল একদম ট্রেনে করে কুন্নুর গিয়ে সেখান থেকেই গাড়ি নিয়ে চলে যাব কুর্গ। ছেলে সেভাবে ক‍্যাবও বুক করেছিল। 
     অটো ছুটে চলেছে স্টেশনের দিকে মনে খুব একটা খুশির আমেজ। হ‍্যাঁ টয়ট্রেনের টিকিট আমরা কলকাতা থেকেই কেটে নিয়ে গেছিলাম কারণ ওখানে গিয়ে কাটলে টিকিট পাওয়া যায় না সবসময়। টয়ট্রেনে ওঠার শখ সবারই মোটামুটি থাকে। দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেনে উঠলেও এই সুযোগও আমি হাতছাড়া করতে নারাজ। তাই সব ব‍্যবস্থা করেই যাওয়া হয়েছিল। স্টেশনে পৌঁছলাম মোটামুটি ট্রেন ছাড়ার পনেরো কুড়ি মিনিট আগে সেই সময়টাকে একদম কাজে লাগিয়ে ফেললাম ছবি তোলায়। ছোটাছুটি করলাম বেশ লাগল কিন্তু। তবে দার্জিলিংয়ের ইঞ্জিন আলাদা ঐতিহ্যবাহী কারণ সেটা স্টীম ইঞ্জিন। এখানে কিন্তু সেই ফ্লেভারটা নেই। তবুও কাঁচের জানলার পাশে বসে পাহাড় আর চা বাগান দেখতে দেখতে খেলনা রেলগাড়ির যাত্রা বেশ মনোরম লাগল। আমিও হঠাৎই কিশোরী হয়ে উঠলাম একটু ভিডিও করে ফেললাম আনন্দে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে। মনের সরলতাটুকু বোধহয় বাঁচিয়ে রাখা উচিত যা আমার মনে হয়। অন্ততঃ তাহলে দিনের শেষে নিজেকে বলা যায় আমার একটা ভালো মন ছিল। সে যাকগে চা বাগান আর পাহাড়ের শোভা তখন আমার তৃষ্ণার্ত চোখ দেখছিল প্রাণভরে। আসলে কলকাতায় ফিরে এলে তো আর এমন দৃশ‍্য দেখা হবে না তাই সব সাজিয়ে রাখছিলাম চোখে। আমাদের সহযাত্রীরা অনেকেই রিলস বানাচ্ছে। তার মধ‍্যে একটা মিউজিক বারবার বাজছে মোটামুটি একঘন্টা আমাদের সফরের মাঝে বেজে গেল। আমি ভাবলাম রেল কোম্পানী যাত্রীদের মনোরঞ্জন করার জন‍্য বাজাচ্ছে। ছেলেমেয়েদের টিকিট পরে কাটা হয়েছিল,কারণ ওদের যাওয়া অনিশ্চিত ছিল। তাই ওরা আমাদের পাশের কামরায় ছিল। যদিও উঠে দাঁড়ালেই দেখছি ওদের। যাক এভাবেই মুগ্ধতার মধ‍্যে শেষ হল যাত্রা। নামার পর মেয়ে আবিষ্কার ক‍রল বাবার পকেটে হাত দিয়ে যে এতক্ষণ ভদ্রলোকের বাধ‍্য মোবাইল ছানাটা রেল কোম্পানীর প্রতিনিধি হয়ে এক গান বারবার বাজিয়ে কানের মাথা খাচ্ছিল সবার। অথচ আমরা দেখার আনন্দে এত মশগুল হয়ে ছিলাম যে কেউ বুঝতেই পারিনি। হেসে ফেললাম সবাই এই মজার ঘটনাতে।
 ছেলে খবর দিল ক‍্যাব ক‍্যান্সেল করে দিয়েছে। যাক একটু চিন্তা হলেও যা হয় হবে ভেবে স্টেশনের ছবি তুলে বেরোলাম বাইরে। যা শুনলাম তা শুনে এবার সত‍্যি একটু চিন্তা হল কারণ ওখান থেকে কুর্গ যাবার গাড়ি পাওয়া যাবে না। যে ড্রাইভার আমাদের নিয়ে যাবেন বললেন তিনি কথা দিলেন উটিতে পৌঁছে আমাদের একটা গাড়ি ঠিক করে দেবেন। সুতরাং আবার উটিতে এসে নতুন গাড়ি বেশ অনেকটা টাকা দিয়ে নেওয়া হল। কারণ বেলা বাড়ছে,আবহাওয়া বেশ খারাপ হচ্ছে আর আমাদের যেতেও হবে অনেকটা পথ। উটি থেকে কুর্গ মোটামুটি ২৪৫ কিমি মত ছয় সাড়ে ছয় ঘন্টার পথ। তারপর পথে আমাদের দুটো জঙ্গল পেরোতে হবে। একই বনভূমিকে তামিলনাড়ুতে বলে মধুমালাই,কর্ণাটকে বলা হয় বন্দিপুর। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই বনভূমি দিনের বেলাতেও শিহরণ জাগায়। চন্দন দস‍্যু বীরাপ্পানের বিচরণভূমি ছিল এই বনভূমি। অনেক বন‍্যপ্রাণীর বাস। সবসময় পাহারা দিচ্ছে বনকর্মীরা তাই গাড়ি থামানোর কোন উপায় নেই।
       সুতরাং যা টাকা বলল তাতেই আমরা রাজি হয়ে উঠে বসলাম গাড়িতে তবে গাড়িটা সেডান ছিল তাই বেশ হাত পা ছড়িয়ে বসা গেছিল। ড্রাইভার ছিলেন বেশ ঠান্ডা মাথার ভদ্রলোক। যেতে যেতে চোখে পড়ল বিস্তীর্ণ চা বাগান আর পাহাড়। রাস্তাতে তখন অনেক গাড়ি আর ট‍্যুরিস্টদের ভিড়। পরপর ছুটি পড়াতে অনেকেই বেরিয়ে পড়েছেন সদলবলে পরিবারের সাথে। রাস্তার ধারের ফলের দোকান আর খাবারের দোকানে তারা ভিড় জমিয়েছে। তারমধ্যে আবার নেমেছে বৃষ্টি। যাক কিছুটা বাদেই বৃষ্টি কমল। আমাদের গাড়ি চলেছে আপন খেয়ালে। যেতে যেতে অদ্ভুত বাঁশের ঝাড় দেখতে পেলাম। চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে মোটামুটি শুকনো বাঁশগুলো তার উচ্চতাও বেশ অনেকটা। আমাদের এখানে বাঁশ অনেক কাজে লাগানো হয় ওখানে গাছগুলো দেখে মনে হল এরা আমাদের মত বাঁশ দেয় না😊সে যাক আরও কিছুটা যাবার পর জঙ্গলে ঢোকার পারমিট নিতে হল। আমরাও সেই ফাঁকে একটু ওয়াশরুম ঘুরে একদম চা খেয়ে নিলাম। সেদিন সাথে একটু শুকনো খাবার আর ফল নিয়ে নিয়েছিলাম। সুতরাং নিশ্চিন্ত কিছুটা। পারমিট নেবার পর গাড়ি ধ‍রল জঙ্গলের পথ। গাছের অদ্ভুত চেহারা। তেমন কোন গাছেই পাতা নেই রয়েছে শুধু ডালপালা মাথা উঁচু করে। আমরা মাঝখানের চকচকে রাস্তা ধরে চলতে শুরু ক‍রলাম। হঠাৎই হাতি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। এটা কী জঙ্গলের হখতি নাকি? তারপর বুঝলাম পাশেই জনবসতি দেখে এটা পোষা হাতি। তবে জঙ্গল আমাদের মোটেও নিরাশ করেনি হয়ত সবুজ ঘাস পাতা কম থাকায় আমাদের চোখে পড়ল প্রচুর হরিণ আর বুনো শূকর। বেশ নিশ্চিন্তে রয়েছে রাস্তার পাশে। তবে গাড়িতে করেই যেতে যেতে ছবি তুলতে হল নামার কোন উপায় নেই। গাড়ি আস্তে ক‍রলেও অনেক সময় ওরা বাঁশি বাজাচ্ছে। শুনলাম রাত্রি নটা বাজলে এই পথে আর যাতায়াত করা যায় না। জঙ্গলের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
     আমাদের চোখ একদম সজাগ হয়ে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে। কিছু দেখলেই ফিসফিস করে কথা বলছি। তবে হঠাৎই যে এমন অভাবনীয় দৃশ্য দেখব তা ভাবিনি একদমই। গাড়ির বাঁঁ পাশের জঙ্গলে একটু দূরেই বাচ্চা সাথে করে একটা হাতি। আমরা তখন একদম সাবধানী শুধু চোখ দেখছে সবটুকু নীরবে। বুঝলাম বাচ্চাকে পাশে নিয়ে যে খাওয়াচ্ছে সেটা মা হবে। বাবার একটু বেশি বড়সড় চেহারা,একটু দূরে দাঁড়িয়ে নজর রেখেছে বৌ আর ছানার দিকে। গাড়ি চলতে চলতেই ভিডিও করা হল। উত্তেজনাতে ঠিকমত ছবিও তুলতে পারছি না তারপর আবার আমি বসেছি মাঝে। ভীষণ মনটা ভ‍রে গেল। ডুয়ার্সের সফরে হাতি দেখার জন‍্য সারা জঙ্গলে কখনও হাতির পিঠে আবার কখনও সাফারি জিপে ঘোরাঘুরি করেও দেখা পাইনি গজরাজের। উফফফ কতদিনের একটা ইচ্ছে পূরণ হল তাই সবাই খুশি। গাছগুলো নিরাভরণ মানে পাতা বিহীন থাকায় খুব সহজেই দেখা যাচ্ছে বনে থাকা প্রাণীদের। তবে হয়ত এখানেই এই জঙ্গল এগিয়ে, কারণ এখানে বন‍্যজন্তুরা কিছুটা নিরাপদ। তাই তারা গাড়ির চাকার শব্দকে অগ্ৰাহ‍্য করেই দিনের আলোতে সঙ্গী নিয়ে বেরিয়েছে বাইরে খাবার আর জল খেতে।
     মধুমালাই তামিলনাড়ুতে আর বন্দিপুর কর্ণাটকে। দুই জঙ্গল পেরিয়ে আমরা একবার পেছনে তাকিয়ে জঙ্গলকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে পা রাখলাম আবার গ্ৰামে। গাড়ি চলছে দ্রুত কারণ অনেকটা পথ বাকি। মাঝে আমাদের ড্রাইভার লাঞ্চ সারলেন। আমরাও ফল আর ইডলি খেলাম গাড়িতে বসেই। কারণ বেশি কিছু খাবার ইচ্ছে কারও ছিল না। বারবারই মনে হচ্ছে কখন কুর্গ পৌঁছব। তবে তামিলনাড়ু ছাড়ার পর কর্ণাটকের লোকালয়ে এসে পেলাম এক লিটারের বোতল। উফ এতক্ষণে শান্তি যেন। আবার পথ চলা শুরু কুর্গে আমাদের হোটেল বুক করাই ছিল। কিন্তু গুগল দেখানো রাস্তায় ড্রাইভার যেতে নারাজ হওয়ায় বেশ অনেকটা রাস্তা ঘোরাঘুরি হল। ছেলের মন খারাপ হল কারণ সূর্যাস্ত উপভোগ গাড়িতে বসেই করতে হল। ওর ইচ্ছে ছিল ওখানে বসে দেখবে। যাক আবার জঙ্গলের পথ ধরা হল পাখিরা সব তখন বাসায় ফিরছে। জনশূন্য পথ,আমার একটু ভয় ভয় করল। কারণ ড্রাইভার দেখলাম তেমন কিছুই চেনে না। আর নেটওয়ার্ক সমস‍্যা তো আছেই। তাই গুগল ম‍্যাপ খোলা যাচ্ছে না। ফরেস্ট গার্ডদের জিজ্ঞেস করে মোটামুটি এগোতে শুরু করলাম। বেশ কিছুটা এসে আবার লোকালয়ে এলাম যাক কিছুটা নিশ্চিন্ত। এরপর গুগল ম‍্যাপ কাজ করতে শুরু করল। ড্রাইভার সাহেব তখন চুপ কারণ তিনি বুঝেছেন তার বোকামিতে ফালতু ঘোরাঘুরি হল। দক্ষিণের ড্রাইভারেরা অত‍্যন্ত ভদ্র,আমাদের কদিনের ঘোরাঘুরিতে এটা বুঝেছি। আবার আমরা জঙ্গলের পথে। তবে মাঝেমধ্যে একটা করে রিসর্ট দেখছি,বুঝতে পারলাম আমাদের গন্তব্য আর বেশি দূর নয়। গুগল বলছে কিলোমিটার আর সময়ের হিসেব। গাড়িতে বসে ঝুপঝাপ,টুপটাপ শব্দ শুনছি ঠিক যেন কিছু ঝরে পড়ছে। বুঝতে পারছি না ব‍্যাপারটা কী। একটু বাদেই ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে গেলাম। কী সুন্দর অথচ উগ্ৰ গন্ধ সেই ফুলের! জানলা দিয়ে চোখ বাড়ালাম দেখতে,তবে অন্ধকারে কিছুই দেখা গেল না। নিজেরাই গবেষণা করতে লাগলাম এটা কী ফুলের গন্ধ হতে পারে।
    মেয়ে বারবারই জিজ্ঞেস করছে আর কত দূর? অবশেষে আমাদের রিসর্টের নাম দেখতে পেলাম একটু ওপরে। আলোও জ্বলছে সেখানে। গাড়ি সোজা উঠে পড়ল সিকিউরিটি চেকিং হল প্রথমে তারপর নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। হাতে সময় খুবই সময় কম। আমাদের পরের দিন চলে যেতে হবে, তাই ওখানে ঢোকার আগেই ফেরার চিন্তা। আমাদের ড্রাইভার রাজি হয়ে গেলেন আমাদের পরদিন নিয়ে যেতে। অনেকটা রাত হয়ে গেছে তাই তারও ফেরা হবে না উটিতে। যাক আমরাও নিশ্চিন্ত।
    ক্লিফ রিসর্ট একদম একটা ছোট্ট পাহাড়ের ধারে অবস্থিত। জানি না ঠিক বলতে পারলাম কী না। মানে it perched on the edge of hilltop. অনেকটা জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে পাহাড়ের ওপর বিলাসবহুল রিসর্ট। চারিদিকে কফিগাছে ঘেরা আর একটু সামনে চোখ বাড়ালেই গভীর খাদ। মানে আমাদের কটেজের বা সুইমিং পুলের পরেই পর্বতের গভীরতা অবশ্যই তা সবুজের সজ্জায় সজ্জিত। নানা গাছ সাজানো রয়েছে থরে থরে। আমরা যাওয়া মাত্র সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন ওখানকার স্টাফেরা। ওদের দেওয়া আদা এবং গুড় দিয়ে বানানো নীলগিরি চা আমাদের তরতাজা বানালো। তারপর আমাদের পৌঁছে দিল নিজেদের ঘরে। চারদিকে অন্ধকারের মাঝে তখন শুধু টিপটিপে আলো। আমাদের ঘরটা সুইট টাইপ ছিল পর পর দুটো ডাবল বেডেড রুম। বারান্দায় দাঁড়ালেই পাহাড়ের শোভা আর গাছের সারি। তখন সন্ধ‍্যে বলে আমরা বাইরে তেমন কিছু দেখতে পেলাম না। ডিনারটা কমপ্লিমেন্টারি ছিল। সুতরাং আমরা দীর্ঘ পথযাত্রার পর ফ্রেশ হয়ে নিলাম তাড়াতাড়ি। কুর্গের আবহাওয়া খুব ভালো তখন সামান্য শীতের পরশ গায়ে। বাইরে বেরোলে হাল্কা ঠান্ডা। ডাইনিংয়ে এসে দেখলাম বাইরে বেশ জোরে মিউজিক বাজছে অনেকেই ক‍্যাম্পফায়ারের আনন্দ উপভোগ করছে। ডিনারে যথারীতি নানা খাবারের সম্ভার মানে মোটামুটি যা থাকে। মাছ মাংস পনীর ডাল সব্জি সবই। চিকেন,পনীর,মাটন সবই ছিল সেই তালিকায়। কিছু দক্ষিণী পদও ছিল তালিকায়। যাক খেয়েদেয়ে একটু সুইমিং পুলের ধারে ঘুরে একদম ঘরে এসে আয়েসে গা এলিয়ে দেওয়া বিছানায়।

     খুব ভোরেই বরের উচ্ছ্বাসে চোখ মেললাম‌। আমারই এক ছেলের কাছে তার আগে শুনেছি কুর্গের কুয়াশা দেখার মত। কফিগাছের পাতাকে আদরে ঘিরে রাখে সেই কুয়াশা। টুপটাপ করে অনেক সময় ঝরে পড়ে জলের ফোঁটা হয়েও। আমিও আলস‍্য কাটিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই কুয়াশার রূপ। ততক্ষণে কুয়াশার স্তর পাতলা হয়েছে। সবুজ গাছপালা উঁকিঝুঁকি মারছে,পাখিরা আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের ডাকে ভরেছে চারপাশ। দেখতে দেখতে আমিও হারিয়ে গেলাম। ছেলে বেরোলো চারপাশটা দেখতে ক‍্যামেরা হাতে করে। আমরা তৈরি হতে শুরু করলাম। বাইরে এসে ভোরে উঠে রেডি হওয়া আমার অভ‍্যেস। মানে আমি রেডি এবার যেখানে খুশি চল। হয়ত বা জীবন এভাবেই শেখায় মানুষকে। সবসময় চেষ্টা করি আমি যেন কাউকে অসুবিধায় না ফেলি। এসব অনেকটাই আমার মায়ের কাছ থেকে শেখা। তবুও মায়ের মত হতে পারি কোথায়? অসীম ছিল তাঁর গুণ,ক্ষমতা আর সহ‍্যশক্তি। তবুও আজকাল কোথাও এসে মনে হয় কিছুটা হয়ে গেছি মায়ের মত। শুধু প্রতিবাদটাই গলা ছেড়ে ক‍রতে পারি না। যাই হোক সেসব থাক। আমরা মোটামুটি রেডি হওয়ার মাঝেই ছেলে ফিরে এল। ও ওখানকার ম‍্যানেজারের সাথে কফি প্ল‍্যানটেশন দেখে এল। এর আগে আলেপ্পি আর পেরিয়ার দেখতে গিয়ে কফি গাছের ফল গোলমরিচ সব দেখে এসেছি। তবে গতকাল রাতের মাতাল করা ফুল যে কফি ফুল তা ভাবিনি। আমাদের এখানে সাদা রঙ্গনের মত দেখতে কফি ফুল। তবে থোকা অত বড় নয়। সাজানোও আলাদা। কফি ফুল লাইন করে ফুটে থাকে ঠিক দূর থেকে দেখতে জুঁই ফুলের মালার মত। শুনলাম মার্চের একদম শেষে বা এপ্রিলের প্রথমে প্রতিটা গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়। সেই মাতাল করা গন্ধে তখন আর ঘরে থাকা সম্ভব হয় না। এমন কী হাতির দল আসে সেই মাতাল করা গন্ধে।
  গতকালই আমাদের ড্রাইভার বলেছিলেন উনি ফেরার পথে আমাদের মহীশূর প‍্যালেশ দেখাবেন। কুর্গ যাবার পথে মহীশূরের ওপর দিয়েই গেছিলাম বারবারই মনে হচ্ছিল হায়দার আলি আর টিপু সুলতানের কথা। মহীশূর শহর পুরোনো গন্ধমাখা আর বেশ সুন্দর সাজানো।
    এই কদিনের ঘোরাঘুরি আমাদের বেশ ক্লান্ত করেছে। পাহাড় থেকে সমতলে নেমে গরমেও বেশ কাহিল আমরা। তবুও মহীশূর প‍্যালেস দেখার আগ্ৰহ রয়েই গেল মনে। মহীশূর পৌঁছতে প্রায় চারটে পনেরো বাজল তারপর ভেতরে জুতো রেখে ঢুকতে ঢুকতে সাড়ে চারটা। আমরা জানতাম সাড়ে পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায় তাই হাতে সময় বেশি নেই। একজন গাইড নিলাম আর তাকে সঙ্গী করেই ঘুরতে শুরু করলাম। 

মহীশূর বা মাইসোর নামটি এসেছে মহিষাসুর থেকে। পুরাণে ওদেরই সাম্রাজ্য ছিল এই অঞ্চল। পরে চামুন্ডেশ্বরী দেবী রক্ষা করেছেন মহিষাসুর নিধন করে এখানকার মানুষদের। 

মহীশূর প‍্যালেসের পূর্ব,পশ্চিম,উত্তর,দক্ষিণ এই চারদিকেই গেট আছে এবং প্রতিটি গেটেই আছে গোপুরম ধাঁচের মন্দির। আমরা দক্ষিণ দরজা দিয়েই ঢুকলাম। হিন্দু রাজাদের অধীনে এখনও এই প্রাসাদ। কিন্তু মুসলিম স্থাপত‍্যের ছাপ রয়ে গেছে প্রাসাদের গম্বুজে। দশেরা উৎসবের সময় মহীশূর প্রাসাদ সাজে আলোক মালায়। চারদিকে বাগান আর মাঝে প্রাসাদ দেখতে খুবই সুন্দর। ওডেয়ার রাজবংশের প্রতিনিধিরা দীর্ঘ কাল এখানে শাসন করে গেছেন। প্রাসাদের ভেতরেও তাঁদের ছবি এবং সিংহাসন আর নানা পুরোনো জিনিস দেখা যায়। তবে তুলনামূলক ভাবে গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া প‍্যালেস সম্পদে এগিয়ে। তবে জানি না এদের আরও কিছু জিনিস বন্ধ দরজার ভেতরে আছে কী না? তবে শুনলাম দশেরার সময় বেরোয় কিছু মূল‍্যবান জিনিসপত্র এবং সিংহাসন। 
    তবে যা দেখেছি তা মুগ্ধ করেছে আমাদের। ঢোকার পথে যে কামানটা দেখলাম সেটা থেকে এখনও তোপধ্বনি হয়। তারপর দেখলাম খুব সুন্দর সিংহাসনে রাজার পূজিত দেবতা গণেশকে এবং পাশে সঙ্কটমোচন। তারপরেই চোখে পড়ল সত‍্যিকারের হাতির মাথা। যার আসল দাঁত পরে দেখলাম। ওপর থেকেই গাইড দেখালেন হাতি গেট। এই গেট দিয়ে হাতি ঢুকত। সুন্দর কারুকার্য করা এই গেট,তাতে হাতির ডিজাইন করা দেখলাম। একটু ঢুকতেই কামানবাহী গরুর গাড়ি, হাতি এবং ঘোড়ার সুন্দর ছবি দেখলাম। ভেষজ রঙ দিয়ে আঁকা সেই ছবি সত‍্যি এখনও খুব জীবন্ত। অলিন্দ পথে হাঁটার সময় গাইড দেখালেন একদম বিস্তীর্ণ খোলা একটা জায়গা যেখানে বসে রাজা মল্লযুদ্ধ দেখতেন। অনেক সময় সে লড়াই পশুদের সাথেও হত। সেখানে দুটো পিতলের বাঘ দুপাশে রাখা যা প্রকৃতির জল হাওয়ায় এখন সবজে রঙ হয়ে গেছে। আরেকটু এগিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল উঁচু ধাতু নির্মিত থামে। একদম সোনার মত উজ্জ্বল যাল শোভা তা সত‍্যি অপূর্ব। শুনলাম রাজাদের বিবাহ বা বিশেষ কোন অনুষ্ঠান এখানেই হত এবং এখনও হয়। প্রায় তিনতলা পর্যন্ত বসার জায়গা আছে যেখান থেকে সুন্দর সব দেখা যেত। কিছুক্ষণ অবাক বিস্ময়ে দেখলাম সব। সুন্দর কাঠের কাজ করা দরজার ওপরের অংশ পালিশ বিহীন এই কারণে যে ওটা চন্দন কাঠ। দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকে রানীর ছবি দেখতে পেলাম। রানী খুব কম বয়সে বিধবা হয়েছেন তারপর তিনি সামলেছেন এই সাম্রাজ্য। রাজা এবং রানীর ছবি দেখে মুগ্ধ হলাম। অপূর্ব শিল্পীর কাজ যেদিকে ফিরছি মনে হচ্ছে রাজার জুতো সহ বসে থাকা পুরো শরীর ঘুরে গেছে আমার দিকে। রানীর ছবিও তাই একদম আঙটি পরা আঙ্গুল যে কোন দিক থেকে একই লাগছে। রানীর পরণে মাহেশ্বরী শাড়ি দেখলাম। গাইড বললেন এমন শাড়ি এখন আর পাওয়া যায় না তবে সোনার ছোঁয়া দেওয়া পিওর মাহেশ্বরীর দাম দু লক্ষ থেকে শুরু। অবাক হয়ে শুনলাম। একটা ঘর ভর্তি সুন্দর চন্দন কাঠের বাক্স। যার সুদৃশ‍্য ডালার ভেতরে আসত নেমন্ত্রণ পত্র রাজাদের কাছে। সেখানেই আসল মহিষের পায়ের টুল দেখলাম। আরেকটু এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল রূপোর ড্রেসিংটেবল ফাইন ইটালিয়ান ডিজাইনের। সেই ঘরে আরেকটা আয়নার পাশে লাগানো সেই হাতিটার দাঁত যে রাজার প্রিয় হাতি ছিল। ঐ ঘরে দেখলাম রূপোর চেয়ার আর কাঁচের চেয়ার। আমার যেন মনে হল স্ফটিকের চেয়ার। সেই ঘরটার ওপরের ছাদে অপূর্ব খোদাই করা কাঠের কাজ। রূপোর দরজা দেখে মুগ্ধ হলাম। তবে এটা ভালো লাগল মোটামুটি সুন্দর জিনিসকে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে রাখার ব‍্যবস্থা করা হয়েছে। হাতির দাঁতের কাজ করা দরজায় সুন্দর করে স্বচ্ছ আবরণ বসানো যাতে লোকের হাতের ছোঁয়ায় নষ্ট হয়ে না যায়। 
লম্বা বারান্দা পেরিয়ে ততক্ষণে চলে এসেছি সুন্দর একটা জায়গায় যেখান থেকে সামনের পুরোটা দেখা যায়। এটাকে দেওয়ানী আম বলা যায় কারণ এখানে বসেই রাজা মন্ত্রীদের সাথে সভা ক‍রতেন। সামনে সাধারণ লোক বসে তা শুনতেও পারত। অর্থাৎ আমজনতার দরবার। ওপরে মহিলাদের বসার জন‌ সুন্দর ব‍্যবস্থা প‍রদা ঘেরা। যা এখনও খুব ভালো অবস্থাতেই আছে। আমাদের ঘোরা মোটামুটি শেষ তখন। গাইডকে ধন্যবাদ দিয়ে,জুতো সংগ্ৰহ করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। দীর্ঘ পথযাত্রার ধকলে সবাই খুব ক্লান্ত তখন। তবুও বাইরে এসে প‍্যালেসের সামনে এসে দু একটা ছবি তুললাম। তারপর গাড়িতে গিয়ে বসলাম। এবার আবার ঘরে ফেরার পালা কারণ সফর মোটামুটি শেষ।
     

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...