Skip to main content

বেনারস আর অণুগল্প

আর মাত্র কয়েক ঘন্টা তারপর জন্ম নেবে আরেকটা নতুন বছর। বাঙালী আবার ভাসবে বাঙালীআনায়। বসবে নতুন বছরের বৈঠক,লাল পাড়ের শাড়ি পরে অনেকেই ভীড় করবেন পুজো দিতে মন্দিরে। হালখাতার সেই পুরোনো নস্টালজিক গন্ধ ফিকে হলেও সাজবে দোকানগুলো। বাঙালী একটা দিন চাইনিজ বা মোগলাইয়ের বদলে খাবে বাঙ্গালী খাবার কোন ভালো বাঙালী রেস্তোরাঁয় গিয়ে। নতুন বছর নিয়ে আসুক সবার ঘরেই অনেক অনেক ভালো খবর। সবাই যেন ভালো থাকে প্রতি ঘরে ঘরে। বছর শেষের দুটো দিন বেনারসে কাটিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি নিয়ে ফিরলাম আমিও। এই নিয়ে আমার ওখানে তৃতীয় বার যাওয়া। গত দুই বারই বাবা মা সাথে ছিলেন। এবার তাঁরা দুজনেই আর নেই সাথে। তবে তাঁদের সাথে দেখা জায়গাগুলোতে গিয়ে মাঝে মাঝেই হারিয়ে গেছি ছেলেবেলার দিনগুলোতে। কেদার ঘাটে গিয়ে মনে পড়েছে মাকে খুব। একটা সময় আমরা একমাস ছিলাম বেনারসে। তখন মা প্রতিদিন এখানে গঙ্গায় স্নান করে মন্দিরে জল ঢালতেন। এবার আমি নীল পূজার দিন ওখানেই জল দিলাম। নৌকা বিহার,প্রদীপ ভাসানো সব আগে করেছি। শুধু গঙ্গা আরতি এবার নতুন দেখলাম। আগে দেখিনি বেনারসে। সব কিছু মিলে অদ্ভুত একটা নস্টালজিয়া। ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে দাঁড়িয়েছি হোটেলের জানলায় ওখান থেকে গঙ্গাকে দেখা যায়। গঙ্গার ধারে অনুভব করেছি কত কী যে সবটা হয়ত বলতে পারব না। আসলে কিছু চিন্তা,অনুভূতির ভাগ হয় না। বেনারসের আকর্ষণ গঙ্গার ঘাট। যার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো বাড়িগুলোতে এখনও ইতিহাস ঘোরে ফেরে আর ফিসফিস করে কথা বলে। আবার কখনও বজরায় অনুভব করি মগনলালকে। মনে পড়ে যায় আমাদের প্রিয় ফেলুদাকে। তাই আমার তোলা কিছু ঘাটের ছবি শেয়ার করলাম। অনুভূতি টুকু ব‍্যক্তিগতই থাক হয়ত সেখানে মিশে ছিল কিছু বিষাদ আর আনন্দ মেশা স্মৃতির অনুরণন।
ভেবেছিলাম বান্ধবীর ল‍্যাজ ধরে বেনারসে যাব কিন্তু হল না। হবেই বা কী করে? ও যাবে শুনে হঠাৎ করে এমন বেনারস যাবার তাল উঠলে কী টিকিট পাওয়া যায় নাকি? যাক তবুও বাবা বিশ্বনাথের বোধহয় খুব জোরালো ডাক এসেছিল সুতরাং সব ব‍্যবস্থা তিনিই করে দিয়েছেন। তাই গরম,টিকিট না পাওয়া সব সমস‍্যার সমাধান হল ওম্ নমঃ শিবায় বলে। মাঝরাতে পৌঁছে প্রথমেই নৌকোভ্রমণ তারপর কাশীর কোতোয়াল কাল ভৈরব দর্শন করা। কারণ কাশীর রাজা বিশ্বনাথ দর্শন করার জন‍্য প্রথমেই কালভৈরব দেখাটাই নিয়ম। যথারীতি সেখানে প্রচুর মানুষের ভীড়। তাদের পেছনে লাইন দিয়ে দর্শন করলাম কালভৈরব। কালভৈরবের পুজো দেবার জন‍্য দোকানী আমাদের প্রসাদের সাথে প্লাস্টিকের প‍্যাকেটে করে সরষের তেল দিলেন। সেই প‍্যাকেট মাথার ওপর সাতবার ঘুরিয়ে একটা ড্রামে ফেলতে হয়। কালভৈরব দর্শন শেষে মোটামুটি সেল্ফ পুজো সেরে আমরা বেরোলাম। পেটে তখন জ্বালা ধরেছে। কিন্তু কর্তামশাই রামভান্ডারের কচুরী খাবেন সুতরাং চলো কচৌরী গলিতে। সেখানে অনেকটা সময় অপেক্ষা করে অবশেষে হাতে এল শালপাতার প্লেটে গরম গরম কচুরী। এক পিস মাত্র পঁচিশ টাকা,দুই পিস পঞ্চাশ। শুনে চোখ কপালে উঠল? হ‍্যাঁ তা ওঠারই কথা। সাইজ মোটামুটি,একটু মোটুসোটু। তবে খাঁটি ঘিয়ে ভাজা। একটু ভয় পেলাম সইবে তো পেটে? হ‍্যাঁ সইল,কারণ খুব ক্ষিদে পেয়েছিল। কচুরী আর গরম ঘিয়ে ভাজা জিলিপি তরকারি সহযোগে খেয়ে আহ্ বলা। এরপর হোটেলে এসে একটু আরাম করা। দুপুরের খাবার খাওয়ার পর বিশ্রাম নিয়ে উদ‍্যোগ নিলাম আরতি দেখার। আমাদের হোটেলের ছেলেটি গলিপথ দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে এল একদম দশাশ্বমেধ ঘাটে। সেখানে তখন অনেক লোকের ভীড়। তার মাঝেই ছেলেটি আমাদের বেশ একটা ভালো জায়গায় বসিয়ে দিল। গঙ্গায় তখন একটু একটু করে জমেছে নৌকো। আরতি দেখে মন ভরে গেল। কিছু ছবি শেয়ার করছি। যদিও অনেকেই দেখেছ এই ছবি তবুও ভালোলাগা ভাগ করে নিলাম। পরের দিন আবার দশাশ্বমেধ ঘাটের ওপাশের আরতি দেখলাম উঁচু মন্দিরের চাতালে বসে। মনে হল ঐ দিকটাতে ভীড় বেশি। বড় স্ক্রীন লাগানো আছে যাতে দূর থেকে সব দেখা যায়। সেখানে দেখলাম আরতি করছে সাতজন। আগের দিন পাঁচজনকে দেখেছি আরতি করতে। পোশাকের রঙও কিছুটা আলাদা। তবে আরতি দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে তাই মন ছুঁয়ে গেল দুদিনের দেখা আরতির দৃশ‍্যই। আরতি শেষে গঙ্গায় ভাসালাম প্রদীপ সকলের মঙ্গল কামনা করে। তারপর শেষে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো মালাই লস‍্যি খেয়ে শরীর মন ঠান্ডা করে এগিয়ে চললাম।

ভেবেছিলাম নীলপুজোর দিনই বাবা বিশ্বনাথ দর্শন করব। কিন্তু এক নম্বর গেটে হঠাৎই ঢুকে পড়লেন কর্তামশাই আমাদের নিয়ে। আমি খুশি হয়ে উঠলাম চুড়ির দোকান দেখে। অনেক আগের দেখা বেনারস অনেকটা বদলে গেছে বিশ্বনাথের গলির সেই কাঠের পুতুলের দোকানগুলো একদম মিসিং মোটামুটি খুব খুঁজে একটা চোখে পড়ল তবে আগের মত কিছুই প্রায় নেই। আমি খুঁজে দেখতে লাগলাম সেই পেটমোটা হ‍্যাপি ফ‍্যামেলী পুতুল,ড্রাম বাজানো পুতুলের সেট। কাঠের ঘোড়া অথবা উট কিন্তু কিছুই তেমন নেই। তার বদলে ঝুলছে কাঠের বিডস দেওয়া কিছু ঝালর মত। যাক মনটা খারাপ হল দেখে। ততক্ষণে সামনে এগিয়ে চলেছি পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে আর ছবি মেলাতে মেলাতে। কোন দোকানেই ভদ্রলোকের তাড়াতে দাঁড়াতে পারলাম না। একদম এসে হাজির হলাম এক নম্বর গেটের শেষ মাথায় সেখানে লাইন পড়েছে। আমাদের আর বেরোনোর উপায় নেই সুতরাং দাঁড়িয়ে পড়লাম লাইনে। প্রথমে খালি হাতেই দাঁড়িয়েছিলাম পরে জুতো রাখার জন‍্য প্রসাদের ডালি নিতে হল। তবে অনেকটা লাইন দিয়ে যুদ্ধজয় করে বাবার দর্শন লাভের পর মনে হল ভাগ‍্যিস প্রসাদটা হাতে নিয়েছিলাম কারণ পরদিন এত যুদ্ধ করে যাওয়া আর সম্ভব হত না। অনেকক্ষণ লাইন দিয়ে করিডোরে এসে পৌঁছলাম। অন‍্য কারও কী অনুভূতি হবে বলতে পারব না আমার কেমন যেন সবটাই খুব অচেনা মনে হল। স্মৃতির ঝাঁপি হাতড়ে পুরোনো মন্দির মেলাতে চাইলাম কিছুতেই পারলাম না। যাক ততক্ষণে ভক্তদের ঠেলাঠেলি সহ‍্য করতে করতে মোটামুটি এসে পড়েছি মূল মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে। ভক্তদের সব ছোঁয়াছুঁয়ির ওপরে তখন বাবা। মোটামুটি দেখো মালা চড়াও আর কেটে পড় বাছা। আমরাও বাবাকে না ছুঁয়েই ওম্ নমঃ শিবায় বলে চলে এলাম লাইনের ধাক্কাধাক্কি থেকে বাইরে। মনে রয়ে গেল আগের অনুভূতি আর এবারের না ছুঁতে পারার দুঃখ। তবে ভেবেছিলাম পরেরদিন টিকিট কেটে দর্শন করব তবে পুলিশের কাছে যা শুনলাম যে টাকা দিয়ে ঢুকলেও অনেক কিছু অনিশ্চিত এবং ভীড় সেখানেও। তাই পরের দিনের আসার ইচ্ছে ত‍্যাগ করলাম তখনই। মন্দির থেকে বেরিয়ে অন্নপূর্ণা মায়ের দর্শন করলাম। একই চত্ত্বরেই মায়ের মন্দির। আর পাশেই জ্ঞানবাপী মসজিদ। মনে পড়ল আমার ছোটবেলায় বেনারসে অন্নকূটের দিন অন্নপূর্ণা দর্শন করে ভোগ পাওয়ার কথা। আবারও খুব মনে হল মা বাবার কথা। আমার সঙ্গীনীর মন খারাপ হল কারণ সে খুবই আশা করেছিল বিশ্বনাথ মন্দিরে নীলের দিন আসবে। যেহেতু আগে বেনারসে আমি এসেছি এবং অনেকদিন থেকেছি ছোটবেলায় তাই বললাম কাল তোমাকে খুব সুন্দর মন্দিরে নিয়ে যাব যেখানে শান্তিতে পুজো দেবে একদম স্পর্শ করে জল ঢালবে। যাক পরদিন ভোরবেলা আমাদের হোটেলের ছেলেটি গলিপথ দিয়েই আমাদের নিয়ে এল কেদার ঘাটে। আমিই বলেছিলাম ওখানে যাব কারণ যখন আমরা বেনারসে একমাস ছিলাম মা প্রতিদিন গঙ্গায় স্নান করে ঐ মন্দিরেই জল ঢালতেন। মা নেই কিন্তু ছেলেবেলার স্মৃতিটুকু রয়ে গেছে মনে। যাক তাই হয়ত অন‍্যভাবে ইচ্ছেপূরণ হল। দেখলাম মন্দিরের সামনে পুজোর সামগ্ৰী বিক্রী হচ্ছে। সেখান থেকে ফুলের মালা বেলপাতা আর দুধ মেশানো গঙ্গাজল পেয়ে গেলাম। বেনারসে বসবাস করা অনেক বাঙালী মহিলাকে দেখলাম সন্তানের মঙ্গলকামনায় পুজো দিতে এসেছেন সেখানে। তবে খুব শান্তিতে পুজো দিয়ে মন্দির পরিক্রমা করলাম আর বাইরে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালালাম। মন্দির থেকে বেরিয়েই একদম গঙ্গায় নামার সিঁড়ি। মনে পড়ে গেল ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ভেজা ফ্রকে কত উঠেছি মায়ের সাথে সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে। এখন পায়ের সমস‍্যার জন‍্য সিঁড়ি ভাঙতে গেলেই চিন্তা হয়। ঠাকুরদার বলা প্রবাদ বাণী খুব বেশি করে মনে হল মানুষের দশ দশা কখনও হাতি কখনও মশা। জীবন যে কত অভিজ্ঞতা আর গল্প বলে যায়। শুধু তা মেনে নিয়ে হাসিমুখে থাকাই বোধহয় জীবন দর্শন। কেদার মন্দির থেকে বেরিয়ে একদম বাঁ পাশেই নীলেশ্বর শিবমন্দির। সেখানেও দেখলাম অনেকে পুজো দিচ্ছেন। ততক্ষণে আমাদের জল শেষ সুতরাং আবার জল আনানো হল। এবার জল ঢেলে প্রার্থনা করে শান্তি লাভ করলাম। নীলেশ্বর শিবলিঙ্গ আকারে অনেকটা বড়,শুনলাম রাজা হরিশ্চন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন এই শিবলিঙ্গ। কেদারঘাটের কেদারনাথ অনেকটাই কেদারের শিবলিঙ্গের আকৃতির। তবে কিছুটা ভিন্ন,অবশ‍্য সেটা হবারই কথা। তবে মন্দিরের চারধার খুবই পুরোনো গন্ধে ভরা,সুন্দর পেতলের রথ দিয়ে সাজানো আর রয়েছে নানা দেব দেবীর মূর্তি।
     কেদার মন্দির থেকে বেরিয়ে টোটো ধরে এলাম তিলভান্ডেশ্বর দেখতে। ছোটবেলায় যখন বেনারসে একমাস ছিলাম তখনই দেখেছিলাম এই মন্দির। শোনা কথা বছরে এক তিল পরিমাণে বাড়ে এই শিবলিঙ্গ। তাই নাম তিলভান্ডেশ্বর। সেখানেও দেখলাম জল ঢালার সব ব‍্যবস্থা আছে সুতরাং নীল পুজোর দিন যথাযথ আত্মতৃপ্তিতে পুজো করলাম সন্তানের মঙ্গলকামনায়। বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে নীলের দিন পুজো দিতে না পারার দুঃখ মিটে গেল,ষোলকলা পূর্ণ হল। দশ্বাশ্বমেধ ঘাটের পথ দিয়ে হাঁটার সময় দেখলাম খিচুড়ি বাবার মন্দির,বারবার পড়তে চেষ্টা করলাম ঠিক দেখছি তো? খিচুড়ি বাবা! হ‍্যাঁ একদম ঠিক তবে সেখানে খিচুড়ি রান্নার প্রণালী দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম সবাই। ঘরঘর করে একটা মেশিন ঘুরছে তলায় বসানো বড় পাত্র, রাঁধুনি সেখানে প্লাস্টিকের প‍্যাকেট খুলে খুলে পরিমাণ মত আদা লঙ্কা মশলা ইত‍্যাদি মেশাচ্ছেন। ঘরঘর করে ঘোরা মেশিনে সব মিলেমিশে যাচ্ছে ফুটন্ত চাল ডালের সাথে। তলায় জ্বলছে চুল্লী। খুন্তি নেড়ে হাত ব‍্যথা করার থেকে এ বোধহয় ঢের ভালো। তাই এই অভিনব মেশিন। মানে আমার কাছে অভিনব আগে দেখিনি। 
     পরের দিন আমাদের বিদায়ের পালা,হাতে সীমিত সময়। বেনারসের গরমের কারণে আমরা মোটামুটি সকাল দশটার পর বেরোতাম না। আবার বেরোতাম একদম সন্ধ‍্যের আগে। তাতে শরীর ঠিকঠাক ছিল কোন অসুবিধা হয়নি। তবে হোটেলের কাছাকাছি যে দোকানগুলো ছিল সেখানে ঢুঁ মারব না তাই হয় নাকি? সুতরাং দুজনে মিলে বেরোলাম টুকরো শপিং করতে।
মোটামুটি দুই পোটলা নিয়ে ফেরলাম। ফেরার পথে আমাদের হোটেলে ঢোকার মুখে দেখলাম বাংলাদেশের বারো ভুঁইঞার অন‍্যতম প্রতাপাদিত্যের প্রতিষ্ঠিত দুর্গা মন্দির। বহু পুরোনো মন্দির নিরেট পেতলের বানানো,অপরদিকে মা চামুন্ডেশ্বরী মূর্তি। মন ভরে গেল দেখে। আমি আবার পুরোহিত কাম দোকানীর কাছ থেকে কিনলাম ধূপের প‍্যাকেট। আমাদের হোটেলের নাম ওমকার প‍্যালেস,ঘরে শুয়ে বসে গঙ্গা দেখা যায়। বারান্দায় দাঁড়ালে মন ভালো হয়ে যায়। কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট আছে তবে ঘর মধ‍্যম মানের। শুনলাম ওঙ্কারনাথের আশ্রমের কিছু অংশ কিনে ওরা এই হোটেল বানিয়েছে। ঘরগুলো পুরোনো ছাদে যেমন ছিল সেগুলো রিনোভেশন করে বানানো হয়েছে এই হোটেল। তবে বাইরের উঠোনটা খুব সুন্দর ওখানে বসে অনেকটা সময় কেটে যায়। সুন্দর দোলনাও আছে টাঙানো।
 বিকেলে আরতি দেখাকালীন আমার সঙ্গিনী শাড়ি কিনতে গেল। আমি নিজেকে বহুত শাসন করে গেছিলাম এবার কোন শাড়ি কিনব না। তাই আরতি দেখাতেই মনসংযোগ করলাম। আরতি শেষে কর্তার ইচ্ছেতেই চৌরাহা পেরিয়ে গেলাম কাশী চাট ভান্ডারের চাট চাখতে। উনি খেলেও আমি জয় শিবশম্ভুর নামে বিরত থাকলাম। সেখানে প্রচণ্ড ভিড় আর তেমন গরম। ইউটিউবের কল‍্যাণে আজকাল মানুষ ভিডিও দেখে ছুটছে এইসব ফুটেজ পাওয়া দোকানে। তবে চাটের চেহারা দেখে মনে হল এর থেকে আমাদের পাড়ার ফুচকাওয়ালা ভালো চাট বানায়। যাক চাট পর্ব সারতেই মোটামুটি আমরা চ‍্যাটচেটে গরমে চটকে গেছি। তবে কর্তার মনটা খুঁতখুঁত করছে আমার কিছু খাওয়া হয়নি বলে তাই দোকান না জেনেই ভিড় দেখে হাজির হলাম একটা মিঠাইয়ের দোকানে। সেখানে রাবড়ি খেলাম,এখানকার রাবড়ি একটু আলাদা। কলকাতার দোকানে বা হুগলীর রাবড়িগ্ৰামে যে রাবড়ি খেয়েছি তাতে সরের টুকরো বেশি,এখানে দেখলাম ঘন ক্ষীরে পেস্তা কুচি ছড়ানো আর তাতে শুধু একটুকরো সর। মনটা কেমন যেন সরের টুকরোর জন‍্য হায় হায় করল। তবে ঐ ঘন ক্ষীরের রাবড়ি খেয়ে পেট ফুলে টাকডুমাডুম হল। তবুও পেল্লায় সাইজের রাজভোগ দেখে চেখে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। সুতরাং চুক্তি হল পঁচিশটাকার বোম তুমি হাফ আমি হাফ। যাক ভাগাভাগি করে সাবাড় করলাম দুজনে। এরপর হাঁটা মারলাম পেড়া আর পানমশলা কেনার জন‍্য। পথে আমার সঙ্গিনীর সাথে দেখা হল। ওর হাতে মোটকু সোটকু ঝোলা মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। বলল বেনারসী কিনেছি,শুনে খুশির হাসি আমিও হাসলাম। যাক বাবা বিশ্বনাথ মনস্কামনা পূর্ণ করেছেন। ওদের সাথে যে মেয়েটি ছিল তার বেনারস খুবই পরিচিত ওর কাছেই শুনলাম আমরা যে দোকানে রাবড়ি খেয়েছি সেটা নাকি বিখ‍্যাত দোকান ওরা এবার সেখানেই যাচ্ছে রাবড়ি খেতে।
   আমরা ওদের কাছেই জেনে নিলাম বিখ‍্যাত জর্দার দোকান আর পেড়ার দোকানের নাম। ছোটবেলায় দেখা বিশ্বনাথের গলিতে পরপর ছিল মিষ্টি মশলার দোকান। প্রতিদিন সেখানে চাখতে দিত মশলা। আমি ছেলেমানুষ তখন তাই দিলেই হাত বাড়াতাম আর ওরাও বেশ খুশি হত আমাকে দিয়ে। যাক সেসব কথা,আমরা অনিলের জর্দার দোকানে এলাম। সেটা এক নম্বর গেটের উল্টোদিকে। সেখানে বেশ কিছু মশলা ওরা চাখতে দিল। আবার সেই মশা হবার গল্প,ছোটবেলা গাল ভরে কুড়মুড়িয়ে খেতাম যে মশলা এখন যেন মনে হল মুখ মেরে যাচ্ছে। ওরা এক চামচ দিলে আমি বলি এক চিমটি দাও। স্বাদ নিলাম যা কিছু দিল তারপর নিলাম কয়েকটা কৌটো। এরপর গন্তব‍্য পেড়ার দোকানে। কুঞ্জ সাউয়ের দোকান এক নম্বর গেট দিয়ে ঢুকেই সেখান থেকে কিনলাম। বেশ বড় বপু নিয়ে বসে আছেন সেই ভদ্রলোক,তারপর যথাযথ মাপ জেনে নিয়ে দিচ্ছেন চটপট করে প‍্যাকেটে ভরে। সব কেনাকাটা সেরে আমি উশখুশ করতে শুরু করলাম। কারণ সামনেই চুড়ির দোকান। সাজুগুজু,চুড়ি,দুল সবই আমার ভালো লাগে। তাই সবাইকে উপহার দেব এই অজুহাতে সেখানে হানা দিলাম। মার্কেট তখন বন্ধ হবার মুখে তাই তাড়াহুড়ো করে বেছে নিলাম পছন্দ মত চুড়ির সেট। বেনারসের চুড়ি সত‍্যিই মনকাড়া। চুড়ি কিনতে গিয়ে বাবার কথা খুব মনে হল। এইসব সাজগোজ একদম না পসন্দ ছিল বাবার। চুড়িওয়ালি আমাদের পাড়াতেই থাকত তৃষিত নয়নে তাকিয়ে দেখতাম কিন্তু উপায় ছিল না কেনার। নিজেই নিজের অভিভাবক এখন বরকে তোয়াক্কা না করেই কিনে ফেললাম সব। তারপরেই চোখ পড়ল ঠাকুরের পোশাকের দোকানের দিকে,সবাই যখন গিফ্ট পাচ্ছে ওরাই বা বাকি থাকবে কেন? সুতরাং ঠাকুরের জামা আর মুকুট কিনলাম। যাক সব শেষে মন শান্ত করে রওনা দিলাম হোটেলের দিকে।

    পরের দিন রাতে আমাদের ট্রেন দিনদয়াল উপাধ‍্যায় মানে মোগলসরাই থেকে তাই হাতে সকালটুকু আছে। তাই সেই সময়টাকে নষ্ট না করে পরের দিন সকালে আমরা আবার নৌকোভ্রমণ করে দেখলাম তুলসীমানস মন্দির,দুর্গা মন্দির আর সঙ্কোটমোচন। দুর্গামন্দিরে ঢুকে পুরোনো গন্ধ পেলাম। তুলসীমানস মন্দির জরাজীর্ণ লাগল,আগের দেখা মন্দিরের থেকে। তবে ওপরে অনেক বাক্স ফাঁকা হলেও ইলেকট্রিক চালিত রাম সীতা কথা এখনও চালু আছে। পুতুলগুলো যদিও পুরোনো হয়েছে। তবে সঙ্কটমোচন মন্দিরে এসে খুব মন খারাপ হল। ওখানকার ঝোঁপ জঙ্গল উধাও,নেই বাঁদরের দল। এক সময় যাদের দেখেছি কল খুলে জল খেয়ে কল বন্ধ করতে। মোটামুটি এখন সঙ্কটমোচনই সঙ্কটে,ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছে হনুমান আর বাঁদরের দল। লম্বা বাঁধানো করিডর দিয়ে মেটালডিটেক্টর পেরিয়ে ব‍্যাগপত্রের তদন্ত করিয়ে হাজির হলাম সঙ্কোটমোচনের উদ্দেশ্যে। চোখ কচলে বারবার দেখলাম,মেলাতে চেষ্টা করলাম। তাড়া করল পুলিশ হটিয়ে হটিয়ে বলে। মহিলা পুলিশ বলে উঠল জলদি কিজিয়ে। অগত‍্যা সেল্ফ পুজো আর প্রার্থনা সেরে একদম হাজির হলাম পুরোহিতের সামনে। ওখান থেকে তুলসী পেলাম। যাক বাইরে এসে প্রসাদী পেড়া মুখে ফেলে বললাম জয় সঙ্কোচন হনুমান জী। তবে বেনারসে একটা জিনিস ভালো লাগল পুরোহিতেরা কেউই টাকা নেবার জন‍্য হাত বাড়িয়ে নেই সবাই মোটামুটি দানপেটিতে ফেলতে বলছে টাকা। পুরীর মত ধাইকিড়িকিড়ি টঙ্কা ফেল তাড়াতাড়ি দৃশ‍্য এখানে নেই। আর না ফেলতে পারলেই শাপশাপান্ত। যাক সবটাই ভালো যার শেষ ভালো। সুতরাং ভ্রমণ শেষে আমরাও হোটেল ফিরে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট করে আর লাঞ্চ সেরে মোটামুটি ফাইনাল প‍্যাকিং করে রেডি কলকাতা ফেরার জন‍্য। বেলা পড়তেই আমরা বেরোলাম মূল রাস্তায় আসার জন‍্য। হোটেলের ছেলেরা আমাদের পৌঁছে দিল গলিপথ দিয়ে রাস্তায়। মদনপুরা পেরিয়ে মূল রাস্তায় আসার পথে অজস্র শাড়ির দোকান আর কারখানা। এখানে পাওয়ারলুমের শাড়ি বোনা হয় বেশি। যাক জয় শিবশম্ভু বলে এবার বেরোনো ঘরের টানে বাড়ির পানে। ফেরার পথে দিনদয়াল উপাধ‍্যায় স্টেশনে একশো টাকা দিয়ে জাম্বো সাইজ মানে প্রায় সাড়ে আটশো নশ গ্ৰাম ওজনের পেয়ারা খাওয়ার কথা অনেকদিন মনে থাকবে। কাশীর পেয়ারা বলে কথা। খুবই সীমিত সময় হাতে নিয়ে গেছিলাম, অতীতের মিঠে স্মৃতির সাথে না মিললেও সুখস্মৃতি নিয়েই ফিরলাম। কলকাতা শহরে আবার পা রাখলাম বছর শুরুর ভোরে।


চিনি
কুনালের সাথে হায়দ্রাবাদ গিয়ে আলাপ,তারপর প্রেমের জোয়ারে ভেসে যাওয়া। খুব অল্প দিনের প্রেমের পরই দুই বাড়ির চাপে ছাদনাতলায় যাবার উদ‍্যোগ। কারণ মা মোটামুটি জানিয়ে দিয়েছে সাফ,' এই শোন ঐসব লিভ ইন চলবে না,কারণ একেই এক শহরে থাকো তারপর এক বাড়িতে থাকা শুরু করবে। তারপর বলবে আর বিয়ে করার দরকার নেই।'
-' মা তুমিও সত‍্যিই পারো,টিভি দেখে একদম মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে তোমার।'
   এইসব বলেও মাকে থামাতে পারেনি জয়ী একদম ফোন করে কুনালদের বাড়িতে গিয়ে হাজির। আর তারপর লাখ কথা নয় মোটে কয়েক হাজার কথা খরচের বিনিময়ে পাকা হয়ে গেল জয়ীর বিয়ে। বিয়ে পাকা করে একটা কথা মেয়েকে বলেছিলেন জয়ীর মা,' তোর শাশুড়ির সবই মোটামুটি ঠিক শুধু একটু চিনি কম।'
-' সে আবার কী? ওরা কী চায়ে চিনি কম দিয়েছে নাকি? তুমি তো আবার বেশি চিনি খাও।'
-' এই মেয়েটা সত‍্যিই বোকার হদ্দ,আরে কেমন যেন কাঠখোট্টা রাগী রাগী মুখটা,মুখে মিষ্টতা নেই।'
  কিছু কথা মনে গেঁথে যায়। বিয়ের পরে শাশুড়িমাকে দেখে সেটাই মনে হয়েছিল ওর। তবুও শ্বাস ফেলেছিল ওঁর সাথে একসাথে খুব বেশি সময় থাকতে হবে না।
      মাধুরী কথা কম বলেন,কেন যেন জয়ীর মনে হল ছেলে,বর সবাই যেন ভয় পায় মহিলাকে। 
      বিয়ের পর এই প্রথম পনেরো দিনের ছুটিতে বাড়িতে এসেছে জয়ী আর কুনাল। কয়েকদিন বাদে বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছে কয়েকজন বন্ধুকে। জয়ী দেখেছে খুব সুন্দর সুন্দর ডিনারসেট শ্বশুরবাড়িতে। বন্ধুরা আসবে তাই শাশুড়িমাকে বলে ডিনারসেট নামিয়েছে জয়ী। কুনাল অবশ‍্য দেখেই বলেছে,' এটা নামালে কেন?'
' কী হয়েছে তাতে?'
' মা কিছু বলেননি?'
-' না তো।'
-' এটা মায়ের খুব প্রিয় সেট,শুনেছিলাম দাদুর দেওয়া উপহার।'
    কুনালের কথায় খুব একটা গুরুত্ব দিল না জয়ী,যত বাড়াবাড়ি। কিন্তু বোলে মাংস সাজাতে গিয়ে যখন জয়ীর হাত ফসকে একটা বোল পড়ে ভাঙল তখন প্রমাদ গুনল কুনাল। মুখটা কাচুমাচু হয়ে গেল জয়ীর,হয়ত বা বুকও কাঁপল। বাপের বাড়িতে এমন একটা সেটের প্লেট ভেঙে মায়ের কাছে থাপ্পড়ও খেয়েছিল,খুব বকেছিল মা।
     ভাঙার আওয়াজ গেছে মাধুরীর কানেও। রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ান। কিছু বলার আগেই জয়ী মাথা নীচু করে সামনে এসে দাঁড়ায়,' খুব খারাপ লাগছে আমার,কুনাল বলেছিল এটা তোমার খুব প্রিয় সেট।'
   মাধুরীর থমথমে মুখটার দিকে তাকায় জয়ী। কী হবে এবার?
 -' টুকরোগুলো তুলে ফেলে দাও। মানুষই মরে যাচ্ছে,আর এ তো সামান‍্য একটা বাটি।'
  চমকে ওঠে জয়ী,মায়ের বলা কথাটা মনে পড়ে গেল চিনি কম। কিন্তু অদ্ভুত এক জীবন দর্শনের গল্প শুনল জয়ী।

     অনেকগুলো বছরের ব‍্যবধানে জয়ী এখন পরিণত। মাধুরী আর নেই। কাবার্ড গোছাতে গোছাতে সেই অসম্পূর্ণ সেটটাতে হাত বোলায় জয়ী। সত‍্যিই
তো জীবনই অস্থায়ী তাই জিনিসে মোহ করে আর কী হবে?
   খুব বেশি করে ওর চিনি কম শাশুড়িমাকে মিস করল জয়ী আজ। যত্নে বোলগুলো মুছে আবার তুলে রাখল কাবার্ডে। মাধুরীর জীবন দর্শনের চিনির মিঠাস আজ পরিপূর্ণ করেছে জয়ীকে।

#প্রাণ ভরিয়ে#

'প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো দাও প্রাণ
তব ভুবনে তব ভবনে মোরে আরো আরো দাও স্হান।'
            গানের কথাগুলো মনকে ভরিয়ে দেয় তৃষার,এমন শীতের চাদর জড়ানো ভোরে কে এমন করে গাইছে? কাঁচের জানলাটা খুলে একবার দেখতে ইচ্ছে করল। কিন্তু কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়াতে যদি ঘুম ভেঙে যায় পিয়ালের? এখনও আদরে জড়িয়ে রেখেছে ওকে। গতরাতের ভালোবাসা এখনও উষ্ণতার চাদরে জড়ানো। কিন্তু খুব টানছে গানটা ওকে। দেখতে ইচ্ছে করছে এই ঠান্ডাতে বসে কে গাইছে?
     পিয়ালকে আলতো হাতে একটু সরিয়ে জানলায় এসে দাঁড়ায় তৃষা,পরদা সরায় কিন্তু কিছু দেখতে পায় না ঝাপসা কুয়াশায়। তারপর বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, ঐ তো দেখা যাচ্ছে দূরে গাছতলায় চাদর জড়িয়ে গাইছেন এক মহিলা। মুখটা বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। পায়ে পায়ে নীচে নেমে যায় তৃষা। ততক্ষণে গানটা থেমে গেছে তবে মানুষটার প্রেমে পড়ে যায় তৃষা। মাসিমা বলতে চেয়েছিল কিন্তু বাধা পেয়েছিল- "না না আমি এতটা বুড়ো হইনি তুমি আমাকে দিদি বলবে।"
          অনেকটা গল্প হয়ে গেছিল ঐটুকু সময়ের মধ‍্যে দুজনের। অনেকটা মায়ের মত মনে হয়েছিল তৃপ্তিদিকে। হয়ত বা মাতৃহারা তৃষার বারবার মনে হয়েছিল মায়ের কথা।
 - " কী ভালো গান করেন আপনি! কিন্তু ঠান্ডা লেগে যাবে না? দাদা কী হোটেলের ঘরে?"
-" দেখো মেয়ের কত প্রশ্ন। দাঁড়া বাপু এক এক করে বলি,গান আমি নিজের ভালোলাগাতে গাই রে। এখন আর চর্চা নেই,তোর ভালো লেগেছে? বেড়াতে এসে কেউ ভোরে ঘুমোয় নাকি? তাই উঠে পড়েছি। আর দাদা আসেনি রে।'
-' আচ্ছা তাহলে ছেলে এসেছে বুঝি?'

********************
 মনটা ভালোলাগায় ভরে গেল হঠাৎই তৃষার,অনেকদিন বাদে যেন মায়ের মত কাউকে দেখল। খুব মনে হল মায়ের কথা ওর মাও তো এমনটাই হতে পারত। অথচ সংসার সংসার করেই শেষ পর্যন্ত চলে গেল অকালে। না ছিল সাজগোজ, না ছিল নিজের প্রতি যত্ন। শুধু সবাইকে খুশি করা ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না জীবনে। আনমনা তৃষা এগিয়ে আসছিল হঠাৎই পিয়ালের ডাক শুনতে পায়..."তৃষা একা একা ওখানে কী করছ?"
     ওপরে উঠে পিয়ালের কাছে গল্পের ঝুলি খুলে বসে উচ্ছ্বসিত তৃষা..." সত‍্যিই একজন সুন্দর মানুষকে দেখে মনটা ভরে গেল। জানো তৃপ্তিদি একা এসেছেন বেড়াতে। ভাবতে পার! মামণি যদি এমনটা হত।"
    তৃষার কাছে পুরোটা শুনে প্রচণ্ড বিরক্ত হয় পিয়াল," সত‍্যিই কালে কালে কী হচ্ছে! বাড়ির গিন্নী ঘর সংসার ফেলে অসুস্থ স্বামীকে রেখে ঢ‍্যাং ঢ‍্যাং করে বেড়াতে এসে আবার গান গাইছেন মনের সুখে। আর তুমি ওঁকে বলছ ভালো। আমি হলে দুচার কথা শুনিয়ে দিতাম।"
    তৃষা অবাক হয়ে পিয়ালকে দেখে মডার্ন হ‍্যান্ডসাম পিয়ালের আড়ালে দেখতে পায় চিরাচরিত সমাজের ধ্বজাধারী পুরুষকে হয়ত বা ওর বাবাও ছিলেন এমনি। নিজে বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরতেন। ইচ্ছে হলেই বেরিয়ে পড়তেন বাইরে। অথচ মাকে দেখেছে বাবার অফিস থেকে ফেরার সময় বাড়িতে না থাকতে পারলে চরম অস্বস্তি তে পড়তে। পিয়ালকে বলল," আমার মা তো নেই,তবে মামণি যদি বেড়াতে আসতে চায় এমন তো আমিই পাঠাব।"
 রেগে ওঠে পিয়াল," আমার মা এমন ছন্নছাড়া হলে সংসারটা কবেই উচ্ছন্নে যেত,যত্তসব।"
     বেড়াতে এসে সকালটা আর তেতো করতে ইচ্ছে করল না তৃষার। তবে কানে বাজল তৃপ্তিদির কথাগুলো,''সবাইকে ভালোবেসে তো কাটালাম এতগুলো বছর। জীবনের শেষবেলায় এসে নিজের ভালোলাগার কিছু করতে ইচ্ছে করে। তোর দাদা অসুস্থ ঘরকুনো সে মোটেই যায় না বাইরে তাই মেয়ে টিকিট কেটে পাঠিয়ে দিল এই যাযাবর গ্রুপটার সাথে।"


  প্রশ্ন

শুভাকে ভাইবৌ হিসেবে নিদারুণ অপছন্দ হলেও ভাইয়ের বাড়ির মেয়ের বিয়েতে না এসে পারেননি মনতোষ। যদিও রেবা বলেছিলেন," কী সম্পর্ক রেখেছে অংশু চলে যাবার পর ওর বৌ সবার সাথে? যে তোমাকে যেতেই হবে? সব নিজে গুছিয়ে নিল।"
-" যেতে হবে রেবা,কারণ আত্মীয়স্বজন বলবে যে বাবা নেই মেয়েটার জেঠুও এল না একবার। আমাদের নিন্দা হবে। তাই চল,ঘুরে আসি আর দেখেও আসি।"
   অবশ‍্য শুভাও নেমন্তন্নের ত্রুটি রাখেনি কোনও। বারবার ফোন করে কথা বলেছে দেশের বাড়িতে থাকা বড় ভাসুরের আর জায়ের সাথে। যতই ওকে অপছন্দ করুক ও বাড়ির মানুষজন মৌসেনা তো ওদের বাড়িরই মেয়ে। মানে যেমন শুনেছে ওদের মুখে আগে। অনেক জলঘোলা করে মনতোষ আর রেবা বিয়ের দুদিন আগেই এসেছেন। অনেকদিন বাদে বিধবা ছোট জাকে দেখে অবাক হন রেবা ও মাগো কোন লজ্জাশরম নেই গো দুদিন বাদে শাশুড়ি হবে,ভাসুর আর লোকজন এসেছে বাড়িতে সে কিনা স্কার্ট পরে খুকি হয়ে ঘুরছে। মাথায় ছোট ছোট করে কাটা চুল,গাল চকচক করছে। আর হবেই না কেন অংশু তো কম রেখে যায়নি। একটা পয়সাও তো শ্বশুর বাড়িতে ঠেকালো না বর মরার পর। অথচ এই দেওর মোটামুটি লক্ষ্মণের মত বৌদি বাধ‍্য ছিল। যাক এখন সঠিক নিয়ম মেনে বিয়েটা হলেই ভালো। নিজে তো অকালে কপাল পুড়িয়েছে মেয়েটা যেন ভালো থাকে। 
     বিয়ের নিয়ম কানুন ঠিকঠাক যাতে হয় সেইজন‍্য নিজেই চোখ রাখলেন। কিন্তু মাথা ঠিক রাখা মুশকিল হল রেবার যখন দেখলেন বিয়ের দিন দুপুরে মা মেয়ে   দিব‍্যি পাতলা মাছের ঝোল আর ভাত ঘরে বসে খাচ্ছে। ওহ্ তাঁদের বিয়েবাড়িতে খেতে পাঠিয়ে এইসব হচ্ছে বাড়িতে! কী অলুক্ষুণে কান্ড! 
-" হ‍্যাঁ রে মৌ আজ যে তোর বিয়ে তা কী ভুলেছিস? খিদে পেয়েছে তা বলতে পারতিস একটু সরবত আর রসগোল্লা দিতাম। আর শুভা তুমিও শেষে মেয়ের বিয়ের দিনে মাছ ভাত খেতে বসেছ!"
   মৌসেনা উঠে দাঁড়ায় মায়ের হাতে মাখা গ্ৰাসটা মুখে না তুলেই, কারণ ও জানে এরপর আর কী কথা বলবে জেঠিমা। নিশ্চয় বলবে বরকে খেয়েছ তা মনে নেই বুঝি? কতবার যে এই কথাটা শুনেছে আগে সেই ছোটবেলা থেকে... 
  -" মৌ আয় আয়, মুখের ভাত ফেলে কেউ ওঠে নাকি? দিদি যা খুশি বলুক গিয়ে। রাত দুটোয় বিয়ের লগ্ন। কতক্ষণ মেয়েটা না খেয়ে থাকবে দিদি? এই তো সেদিনই গলব্লাডারে স্টোন অপারেশন হয়েছে। খালি পেটে থাকা একদম বারণ। আর ওর বায়নাতেই আমাকে..."
    শুভার কথা শুনে একটু থমকে গেলেও রেবা বলেন," সে যাকগে,তাই বলে ওর কথাতে তুমিও মাছ ভাত নিয়ে বসেছ খেতে?"
-" দিদি নিজের বিয়ের দিন মা সেই সূর্য ওঠার আগে একটুখানি খেতে দিয়ে সারাদিন জলটুকুও দেয়নি। বাড়িতে কত কী রান্না হয়েছিল আমার কিছুই খাওয়া হয়নি। শুধু লোভ হয়েছিল খাবার কিন্তু মাঝ রাতে বিয়ে শেষ হবার পর আর খেতে পারিনি। কী লাভ হল এত কিছু করে?"
-" জেঠিমা তুমি এখন যাও,আমিই মাকে জোর করে খেতে বসিয়েছি,বলেছি নাহলে আমি খাব না। বাবা চলে যাবার পর মা একাই তো সব আগলে রেখেছে। মায়ের অনেক ধকল যাচ্ছে,মাকে আমাকে সুস্থ রাখতেই হবে। কদিন আগেই তো লো প্রেসার হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেছিল। অবশ‍্য তোমরা তো এতদিন তেমন করে কোন খবরই নাওনি।"
      রাগে অপমানে গা জ্বলে ওঠে রেবার মনে মনে বলেন," কে বলে এই বাড়ির মেয়ে? যেমন মা তেমন মেয়ে কেউ কম যায় না। যা পারে করুক গে।"
   শুভার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে,মৌসেনা মায়ের চোখের জল মুছিয়ে বলে," আমাদের পাশে কেউই কোনদিন ছিল না মা। এতগুলো দিন যখন কাটিয়েছি তখন আমাদের মত করেই কেটে যাবে বাকি দিনগুলো। আচ্ছা মা এই নিয়মগুলো কে বানিয়েছিল?"

 ***************************
লক্ষ্মীমন্ত না দুরন্ত
   
    "শোন ও যতই বলুক তুমি এবার কোমর বেঁধে লাগো তো দেখি।"
   প্রতিদিনই ব্রেকফাস্টে একই কথা দিয়ে দিন শুরু হয় অতীনবাবুর। 
 আর মেয়েটাও হয়েছে তেমনি বাবা মায়ের ওপর দিব‍্যি ছড়ি ঘোরাচ্ছে। অবশ‍্য ওর মা তো বলে হাড় জ্বালাচ্ছে,এমন মেয়ে যে ঘরে যাবে তার হয়ে গেছে। মেয়েটা কত আদর আব্দার করে বাবার কাছে। তবুও উপায় নেই কারণ দিনে দিনে দাম্পত‍্য অশান্তি বাড়ছে। আগে একখানা চিঠি পাঠালেই হত এখন বায়োডাটা মেইল করতে হয়। সুতরাং তোর্সাকেই ধরতে হবে। তবে আদৌ মেইলটা পাঠাবে তো মেয়ে? মনের সন্দেহের কথা গিন্নীকে বলতেই বলেন," আমি সামনে বসে পাঠাব,পাঠাবে না মানে?
         মায়ের অত‍্যাচারে  ল‍্যাপটপটা নিয়ে বসল ব‍্যাজার হয়ে তোর্সা। সত‍্যি বিয়ে করতে ওর ইচ্ছে করে না। হাজার একটা লোকের মন জোগাতে জীবন চলে যায়। সম্বন্ধে চোখ রাখে আবার,বাবার পছন্দ খুব একটা খারাপ নয় তবে ও যা মেইল পাঠাবে পাত্রপক্ষ আর এমুখো হবে না। 
           মেইলটা পৌঁছে যায় মুহূর্তে ওপারে। " নাও পাঠিয়ে দিয়েছি এই দেখ সেন্ট দেখাচ্ছে।"
    তবে তোর্সা যা ভেবেছিল তা হল না সপ্তাহখানেক বাদে অফিস থেকে ফিরতেই মা বলল," সামনের রবিবার ওঁরা আমাদের ডেকেছেন।"
-" মানে?"
-" আরে সেদিন যে মেইল করেছিলি ওঁরা।"
  -" কেন?"
  -" আরে ওদের বাড়িতে। ভদ্রলোক খুবই ভালো বলেছেন তোর বায়োডেটা ওঁদের খুবই ভালো লেগেছে। শুধু তুই যদি ওঁদের সবটা দেখে নিস তাহলেই একেবারে পাকা কথা সেরে নেওয়া যাবে।"
    অবাক লাগে তোর্সার,বাড়িতে ডাকছেন!
-" আমি কিন্তু কথা দিয়ে ফেলেছি"
    তোর্সা আপত্তি করেনি তেমন,ওরও দেখার ইচ্ছে বাবার লেখা লক্ষ্মীমন্তের জায়গায় দুরন্ত মেজাজী এইসব বিশেষণের পরেও ওকে কে পছন্দ করেছে?

   
   বাড়ির সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোককে কেমন যেন চেনা লাগল তোর্সার।
" তুমিই তো তোর্সা মানে দুরন্ত আর বদমেজাজী সেই মেয়ে।"
   লজ্জা পায় তোর্সা,রাগও হয়। রীতিমত লেগপুলিং। 
   তবে ভেতরে গিয়ে কাকিমাকে দেখে চেনে তোর্সা। আরে সেবার আন্দামান বেড়াতে গিয়ে এই কাকিমাকেই তো রক্ত দিয়েছিল।
   সত‍্যি বোধহয় পৃথিবীটা গোল তাই তোর্সাকে এক দেখাতেই চিনেছিলেন নীলের বাবা সুকোমলবাবু। ছেলেকে বলেছিলেন," আমাদের তো তখনই ভীষণ ভালো লেগেছিল মেয়েটাকে তবে তুই দেখ একবার।"
-" বাবা তুমি ওদের ডেকে নাও। তোমাদের গল্প শুনে এই দুরন্ত মেয়ে তো আমার আগেরই পরিচিত।"
       তোর্সার জীবনে সানাই বাজল,ফুলশয‍্যার রাত্রে তোর্সাকে আদরে জড়ায় নীল," আজ দেখব কে বেশি দুরন্ত।"


*******************

রায়ার বিয়েতে

     রায়ার ছোটমাসির যখন বিয়ে হয় ও তখন অনেকটা ছোট। কত আর বয়েস হবে? মনে হয় চার বছর। মা ওকে খুব সুন্দর একটা ঘাগড়া পরিয়ে দিয়েছিল। 
   বোনের বিয়েতে রায়ার মা রাঙা তখন উচ্ছ্বসিত। সমানে বরকে বুস্ট আপ করছে," আরে তোমরা আরও তোল ওকে ওপরে। আমাদের জিততে হবে।"
   রায়া দেখছিল বাবাকে খামচে ধরে আছে মিমি,ওর মনে হচ্ছিল পড়ে যাবে এক্ষুণি পিঁড়ে থেকে। হঠাৎই কেঁদে ফেলেছিল ভ‍্যাঁ করে," আমার মিমিকে নামিয়ে দাও বাপি,মিমি তো হাঁটতে পারে কেন পিঁড়েতে তুলেছ?"
    তারপর থেকে অনেকবারই মনে হয়েছে,বলেও ফেলেছে কথাটা যে মেয়েরা যখন হাঁটতে পারে সুন্দর ভাবে তখন অযথা লোকের কাঁধে হাত দিয়ে আর পিঁড়েতে বসে বিয়ে করতে আসে শুনি?
   ওর বন্ধুরা ওকে পাত্তা না দিয়ে বলেছিল," আরে এটাও একটা রিচুয়াল,আমার কিন্তু বেশ লাগে ঐ একটা দিনের বেশ ইউনিক নিয়মগুলো।"
-" হ‍্যাঁ নেকু সেজে চোখ ঢেকে তোরা বিয়ে করতে যাস পিঁড়ে চেপে আমি যাচ্ছি না। বাপরে কী হরিবল ব‍্যাপার রোগা পাতলা হলেও চলে যায়। একটা আশি নব্বই কেজির মেয়েকে কাঁধে তোলা ভেবেছিস।"
-" আচ্ছা তোর হয়েছে কী বলত? পিঁড়ে নিয়ে পড়েছিস কেন‍? তার চেয়ে ভাব আমরা বনির বিয়েতে কী করব।"
 -' আরে সেটাই তো ভাবনা,বনির ওজন তো মোটামুটি বিরানব্বই কেজি। ও যদি পড়ে যায় ওভাবে আসতে গিয়ে? আর লোকগুলো,মানে যারা বইবে?"
    -" সত‍্যি কী হবে বলত?"
   বন্ধুদের কথার মাঝে চাপা পড়ে যায় রায়ার কথা। তবে বনিকে সত‍্যিই একপাক ঘুরিয়ে নামাতে বাধ‍্য হয়েছিল ওরা।
   রাতে ঠাম্মার কাছে শুয়ে রায়া জিজ্ঞেস করে," ও ঠামু তুমি হাসবে না বল?"
-" কী হয়েছে বলবি তো? "
-" মেয়েরা কী হাঁটতে পারে না যে বিয়েতে পিঁড়েতে বসে আসতে হয়?"
-" দিদি আগের দিনে ছোট্ট থাকতেই বে হত। তাই বরের মাথায় মাথায় করার জন‍্য পিঁড়েতে তুলে ছাদনাতলায় আনত। এখন তো কত বড় হয়ে বিয়ে হয় কিন্তু নিয়মটা রয়েই গেছে।"
    বালিশে চোখ ঢাকে রায়া,ওর বিয়েতে কিন্তু ও একদম মানবে না এসব পচা নিয়ম। অনি ফিরলে হয়ত সামনে বছরই বিয়েটা হবে।

  *******************
 হানিমুনে এসে বিয়ের ভিডিওটা দেখে নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়ল অনির গায়ে।
 অনি বলল," আরে আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে গলায় মালা পরিয়ে ঢেকেঢুকে,কোথায় বৌ পিঁড়েতে বসে আসবে মুখ ঢেকে তা নয় উনি মোটর স্কুটারে এসে মন্ডপে হাজির। ফটাফট ঘুরে নিয়ে চোখ রাঙিয়ে বলে ওই মালাটা পরা তাড়াতাড়ি।"
 -" মিমির সাথে বাজি ধরেছিলাম যে ওদের মত হ‍্যান্ডিক‍্যাপড সেজে বিয়ে করতে পারব না। বিয়ে করব তো নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে।"
-" দাঁড়িয়ে বলিস না বল ছুটে এসে।"
   ওদের আদরমাখা হাসিতে লজ্জায় মেঘের আড়ালে লুকোয় চাঁদও।

সমাপ্ত:-

ক্ষমা কর প্রভু


"কি বলছিস এমিলি! ও আচ্ছা তার মানে তো খ্রীষ্টান। আচ্ছা বাবি আমাদের এই পোড়া বঙ্গদেশে কী কোন মেয়ে ছিল না?"
-"বাবা তোমার কেন আপত্তি বলবে?আমরা দুজনে দুজনকে পছন্দ করি। তাছাড়া এমিলি খুব ভালো মেয়ে। তুমি কথা বললেই বুঝতে পারবে।"
   নাহ্ কথা বলেননি শিবদাস,এমনকি ছেলের সাথেও এই নিয়ে যথেষ্ট দূরত্ব তৈরী হয়েছিল। বাবা আর ছেলের মধ‍্যে ভাব করাতে পারেননি বিভাও। রাগ করে বলেছিলেন," বাপ কা বেটা তো,কেউ কারও থেকে কম নয়। মরণ হয়েছে আমার কাউকেই ফেলতে পারি না।" 
    দেখতে দেখতে পাঁচবছর কেটে গেছে মাঝে। হয়ত শীতলতার বরফ একটু গলেছে কিন্তু এমিলিকে মেনে নেননি শিবদাস। বাবিও বৌ নিয়ে দেশে আসেনি। মায়ের সাথে ফোনে কথা হত নিয়মিতই। বাবার সাথে মাঝেমধ্যে। বাবার মেজাজ জানে বাবি তাই সামনাসামনি হওয়ার সাহস পায়নি। মা অনেকবারই বলেছে," কতদিন তোকে দেখিনি,দিদিভাইকে তো একটু আদর করতেও ইচ্ছে করে। ভিডিও কলে কী সব হয়?"
-" মা তুমিই শুধু বল,বাবা তো কখনও বলেন না।"
-" এই চিনলি বাবাকে? একবার আয় সব ঠিক হয়ে যাবে।"
          তবে মায়ের শরীর খারাপ শুনে আর না এসে পারল না বাবি যদিও এমিলি আর এলিসা কাউকেই সঙ্গে করে নিয়ে আসেনি। হয়ত ছেলেকে দেখার জন‍্যই অপেক্ষা করছিলেন বিভা,দুদিনের মধ‍্যেই সব শেষ হয়ে গেল।
    আক্ষেপে,কষ্টে কেমন যেন পাগল পাগল লাগল বাবির বাবাকে বলতে ইচ্ছে করল," তোমার জেদের জন‍্য সব শেষ হয়ে গেল। মাকেও কাছে পেলাম না। তারপরই মনে হল জেদ তো ও নিজেও কম করেনি।"
      আস্তে আস্তে বসার ঘরে এসে বাবার দুই পায়ের মধ‍্যে মাথা রাখল। অদ্ভুত চুপচাপ হয়ে গেছে বাবা,শরীরটাও ভেঙে গেছে অনেক। নিজেকে অপরাধী লাগে বাবির।

  ************************
 মাসখানেক বাদে ফেরার সময় অনেক বুঝিয়ে বাবাকে নিয়ে ফিরেছে বাবি। এমিলি পরদার আড়াল থেকে দেখে,মেয়ে দৌড়ে যেতে চাইলে ওকে থামায় ইশারায় বলে গ্ৰান্ড পা টায়ার্ড রেস্ট নিতে দাও। 
         অনেকটা জার্নির পরিশ্রমে চোখ বুজে আসে শিবদাসের। বাবি বলেছে," এখন ঘুমোও কাল কথা হবে।"
     এমিলি বা নাতনি কেউই সামনে আসেনি তাহলে কী ওরা নেই বাড়িতে?
   ভোরবেলা গানের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় শিবদাসের কে এমন করে গাইছে এখানে? চাদর জড়িয়ে ঘর থেকে বাইরে এসে দাঁড়ান...এমিলি গাইছে, "ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু" কোলের কাছে ছোট্ট এলিসা। দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে শিবদাসের গাল বেয়ে অনুতাপে,কেন যে অভিমানে নষ্ট করলেন জীবনের পাঁচটা বছর। প্রাণের ঠাকুরের সঙ্গীতসুধায় আজ দেশ বিদেশ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। হঠাৎই শিবদাসের কাছে ছুটে আসে মায়ের কোল থেকে উঠে এলিসা,জড়িয়ে ধরে গলাটা ওর ছোট্ট দুহাত দিয়ে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে শিবদাসের আর বিভাকে বলতে ইচ্ছে করে সব দোষ আমার,আমিই তোমাকে স্বর্গসুখ থেকে বঞ্চিত করেছি।


সমাপ্ত


****************************

   অমর প্রেম

অনেক বছরের মিঠে কড়া দাম্পত‍্যে মলি আর পুলকেশ একদম রাজযোটক। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যে যার সংসারে এখন ব‍্যস্ত তাই কর্তা গিন্নীর এখন একান্ত অবসর। তবুও মলি যেন দিন দিন বড় নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন পুলকেশের ওপর। এককালে দুইহাতে সংসার সামলানো মলির এখন চলা ফেরাতে বড় কষ্ট। কোনরকমে এদিক ওদিক করেন। বসে শুয়ে থাকতেই বেশি ভালো লাগে। হাঁটলেই হাঁটু বেয়াদপি করতে শুরু করে কিন্তু পুলকেশ বলেন না হেঁটেই তোমার হাঁটু এত বেয়াদপ হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরাও একই কথা বলে। মলি ভীষণ আদুরে হয়ে উঠছেন দিনকে দিন কথাটা রাগ করে ছেলে মেয়ে বললেও নো তোয়াক্কা তাঁর। টেবিলে থাকা ওষুধটুকুও নিজে নিয়ে খেতে তাঁর বড় অনীহা।
-" কী গো কোথায় গেলে,আমার ওষুধ আর জলের গ্লাসটা দাও। সময় হয়েছে খাবার।"
   সবসময় মুখ বন্ধ থাকে না পুলকেশের," ওষুধের সময় হয়েছে মনে রাখতে পার আর নিতে পারছ না। সামনেই তো রয়েছে।"
-" রাগ করছ কেন দাওনা গো.."
  এহেন আদরের ডাকে আর কিছু বলা যায় না। তবে আজকাল এই কাজগুলো অভ‍্যেস হয়ে গেছে পুলকেশের। গিন্নীর কষ্টটা বুঝেই হোক আর আদরেই হোক সব এগিয়ে দেন হাতের কাছে। দশটা পাঁচটা নয় একটা বৌ,একসময় মলির মন পেতে কত কী না করেছেন। মেয়ে বকলে বলেন," যতদিন পারি করে যাই,বুঝবে না থাকলে।"
 -" তোমার মুখে কী কিছুই আটকায় না? আমি যেন আগে যাই। তুমি আগে গেলে আমাকে দেখবে কে?"

     হঠাৎই অজ্ঞান হলেন মলি,বাজ পড়ল পুলকেশের মাথায়। মনে হল, তবুও তো ছিল মানুষটা। অদ্ভুত উৎকন্ঠাতে দিশেহারা লাগল। মেয়ের সাথে নিজেও এলেন নার্সিংহোমে তারপর আর কিছু মনে নেই। টেনশনে নিজেও অজ্ঞান হয়ে গেছেন। সবাই শুনে বলল অমর প্রেম।

     জ্ঞান ফিরে পুলকেশকে পাশের বেডে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হলেও খুশি হলেন মলি। একটু বাদেই হঠাৎই বলে উঠলেন," আমাকে একগ্লাস জল দেবে গো।"
-" মা তুমি কী গো? এটা নার্সিংহোম।"
-" দেখেছিস তোর মায়ের কান্ড আমাকে এখানেও ফরমায়েস করছে।" বিপদের মধ‍্যেও মলির কান্ড দেখে হাসি পায় পুলকেশের।
সমাপ্ত:-


প্রাপ্তি

অনেকদিন বাদে আবার জগন্নাথ দর্শনের সুযোগ এসেছে। কথাটা সুযোগই বলব কারণ তাঁর কৃপা না হলে নাকি শ্রীক্ষেত্রে যাওয়া যায় না। আমাদের প্রায়ই উঠল বাই তো কটক যাই করে ট‍্যুর প্রোগ্রাম হয়। সুতরাং চালু ট্রেনে টিকিট পেলাম না। অগত‍্যা শালিমার করমন্ডলের টিকিট কাটা হল। যাক তবুও শান্তি যে যাওয়াটা হচ্ছে। ঠিক হল ট্রেনে যাব আমরা ভুবনেশ্বর পর্যন্ত। তারপর ধরব গাড়ি ব‍্যাস পুরীতে পৌঁছে যাব। যথারীতি ট্রেনের টিকিট দেরিতে কাটায় সীট পড়ল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। একসাথে করার চেষ্টা করলেও হল না। যাক দুপুর তিনটে কুড়ি থেকে রাত্রি দশটা পঞ্চাশ যে করে হোক কেটে যাবে। কর্তা গিন্নী দুজনে ঠাঁই নিলাম নিজের নিজের জায়গায়। 
কিন্তু মুখ বন্ধ করে কতক্ষণ থাকা যায় বাপু? সুতরাং আলাপ জমল উল্টো দিকের সীটে বসা ভদ্রমহিলার সাথে। আমাদের মেয়েদের গল্প, সুতরাং সেটা শাখা প্রশাখা বিস্তার করে মোটামুটি মহীরুহ বিস্তার করল কয়েক ঘন্টাতেই। জানতে পারলাম উনি অসুস্থ, চিকিৎসার জন‍্য চেন্নাই যাচ্ছেন।  
মুখটা একটু করুণ করে বললেন," সবাই কত আনন্দ করে ঘুরতে যাচ্ছে আর আমি ডাক্তারের কাছে।" আমি ভরসা দিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে। 
 আমাদের গল্পের মাঝে আমাদের সহযাত্রী বান্ধবী পাশের কোচ থেকে এসে যোগ দিল। তাতে আরও বেশি জমল আড্ডা। ভদ্রমহিলা ব‍্যান্ডেলে থাকেন সুতরাং সেখানকার কথা,মা হংসেশ্বরী মন্দিরের গল্প সবই হল। এমনকি আমাদের আলমারিতে শাড়ির প্রাচুর্য উঠে এল গল্পে। দেখলাম কেনাকাটার বাতিক আমার মত অনেকেরই আছে। একটু নিশ্চিন্ত হলাম শুনে। অনেকটা গল্পের পর একটু শুয়ে গড়িয়ে নিলাম। ততক্ষণে কটক পেরিয়ে গেছে। আমার কর্তাও নিজের জায়গা থেকে উঠে এসেছেন কারণ আমাদের একটু বাদেই নামতে হবে। অনেকটা গল্পের মাঝে ভদ্রমহিলার হাসিমুখটা ভালো লাগছিল,শুনলাম আগের দিনই ছাড়া পেয়েছেন নার্সিংহোম থেকে। বারবারই বললাম একদম সুস্থ হয়ে চেন্নাই থেকে আরও কিছু শাড়ি কিনে ফিরবেন। দেখলাম ওর কর্তামশাই মুচকি হাসছেন।
        বাইরে তাকালাম ট্রেন ভুবনেশ্বর ঢুকছে। কাঁধে তুলে নিলাম মালপত্র। হঠাৎই ভদ্রমহিলা বললেন," এতক্ষণ কত গল্প করলাম অথচ নামটাই জানা হল না।"
  বললাম," সত‍্যিই তো কত কথা হল অথচ নামটা জানা হয়নি। আমি রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী। আপনি?"
     কথাগুলো বলতে বলতেই মুখে হাসি নিয়ে পা বাড়িয়েছি সামনের দিকে নামতে হবে আমাদের।
   হঠাৎই ভদ্রমহিলা আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন," আপনিই রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী? প্রতিলিপিতে লেখেন তাই না? আমি পড়ি আপনার গল্প। ইশ্ এতক্ষণ জানতেই পারিনি!"
    নিজেকে লেখক বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পাই। কী এমন লিখি আমি? তবুও হয়ত এই প্রাপ্তিটুকু আনন্দ দিল আমাকেও। লজ্জা লজ্জা মুখ করে বরের দিকে তাকালাম। তারপর শুক্লার সাথে অনেকটা শুভেচ্ছা বিনিময় করে হাত মিলিয়ে এগোলাম সামনের দিকে।
সমাপ্ত:-


  ক্ষিদে  

আয়নার সামনে দাঁড়ায় উৎপল,ভালো করে গায়ে সুগন্ধ ছড়ায়। বিছানায় শুয়ে নাকটা জ্বালা করে অহনার। ও তো জানে অহনা এত উগ্ৰ গন্ধ সহ‍্য করতে পারে না তবুও কেন.. 
-" তুমি কোথায় যাচ্ছ?"
-" এক কথা বারবার জিজ্ঞেস কর কেন অহনা? কালই তো বলছি অফিসের কাজে যাব কাল রাতে ফিরব।"
-" আমাকে কে দেখবে? এখন তো নেলিও নেই এখানে। ও কলেজের হস্টেলে আছে।"
-" তোমাকে যে দেখে সেই দেখবে,কেন আমি লোক রাখিনি নাকি?"
-" আগে তো এত বাইরে যেতে না,এখন কেন?"
  মেজাজ হারায় উৎপল,আজকাল অহনার ঐ হাড়গিলে অসুস্থ চেহারাটার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না ওর। মানে কেমন যেন আর নিতে পারে না। অথচ নিতে হয়,চোখ মেলে দেখতে হয় ওর যন্ত্রণা। মেয়েটা হস্টেলে গিয়ে বেঁচেছে বোধহয়। কিন্তু ওর তো মুক্তি নেই। সাতপাকে বেঁধে জন্মজন্মান্তরের বাঁধনে বাঁধা সঙ্গীকে ফেলবে কী করে? কিন্তু আজকাল মন বিদ্রোহ করে ওঠে,ভালো লাগে না এই দমবন্ধ জীবন। 
চিৎকার করে ওঠে," আচ্ছা কত টাকা তোমার আর মেয়ের পেছনে খরচ হয় হিসেব রাখো। বাড়তি কাজ না করলে টাকাটা আসবে কী করে শুনি? সব কৈফিয়ত ওকে দিতে হবে।"
  কান্নায় গলাটা বুজে আসে অহনার,আর কত কষ্ট দেবে ভগবান। সত‍্যিই তো কত খরচ ওর জন‍্য। তবুও অভিমানে বলে," আর একটা বছর সহ‍্য কর মেয়েটা বলেছে ও চাকরি করলে তোমার আর কষ্ট থাকবে না। সব টাকা ও দেবে।"
-" ও মেয়েটাকেও বিষাক্ত করে দলে টানছ? শুয়ে শুয়ে মাথায় যত দুর্বুদ্ধি বাড়ছে।"
     
        বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাথাটা হাল্কা লাগে কিছুটা যাক একটা রাত নিশ্চিন্ত। শহর থেকে অনেকটা গিয়ে একটা রিসর্টের সামনে গাড়িটা থামায়। ওকে দেখেই ওরা ঘরের চাবিটা দিয়ে দেয়। ঘরে এসে গা এলিয়ে দেয় বিছানায় এখন শুধু অপেক্ষা। শরীরটা জেগে ওঠে পঞ্চান্নর উৎপলের। একটু বাদেই বাইরে থেকে নক শুনে আরেকটু গন্ধ ছড়িয়ে নিজেকে আয়নাতে দেখে দরজা খুলে দেয় উৎপল। এক ঝলক মেয়েটাকে দেখে চমকে ওঠে। একদম নেলির মত দেখতে মেয়েটাকে বয়েসটা ওর থেকেও মনে হয় কম। হঠাৎই শরীরটা মনের মারা চাবুকে কেমন যেন গুটিয়ে যায়। ততক্ষণে মেয়েটা ঘরে ঢুকে এসেছে,উৎপল কিছু বলার আগেই টান মেরে খুলে ফেলেছে নিজের পোশাক," কী হল আসুন,হ‍্যাঁ আমি কিন্তু পুরো রাত থাকতে পারব না। তাই তাড়াতাড়ি এলাম,অবশ‍্য একদম স‍্যাটিসফাই করেই যাব।"
 উৎপলের গলা কাঁপল তবুও বলল," এত তাড়াতাড়ি সব খুলে দিলে?"
-" মানে? আমার টাকা চাই,আর আপনার শরীর। আসুন, আরে বললাম না তাড়া আছে।"
-" পড়াশোনা কর না?"
-" আরে আপনি পড়াবেন নাকি? হ‍্যাঁ করি,বাড়িতে মায়ের অসুখ তাই টাকার দরকার।"
-" তোমার বাবা?"
-" অত কথায় আপনার কী দরকার? শুতে চেয়েছেন সেটাই করুন। বাবা অন‍্য মেয়েমানুষ নিয়ে থাকে,আমাদের দেখে না।"

         হঠাৎই উৎপলের মনে হল আবার নেলির কথা। যদি নেলিও এমনভাবে মায়ের জন‍্য টাকা ইনকাম...
  উৎপল আর ভাবতে পারে না।

       রাতের খাবার না খেয়ে শুয়ে পড়েছে অহনা,খুব কেঁদেছে আজ। আয়া মাসি না খাওয়াতে পেরে হাল ছেড়েছে।
  -" রাতে খাওনি কেন অহনা?"
 -" তুমি কোথা থেকে এলে?"
-" অফিস থেকে বারণ করল ফোন করে তাই ফিরে এলাম..."
     অহনা নির্ভরতায় জড়িয়ে ধরে উৎপলকে। আত্মগ্লানি জড়িয়ে ধরে উৎপলকে,ইশ্! এভাবে কী মুক্তি পাওয়া যায়?

সমাপ্ত:-

 মাতৃ স্নেহ 

আজ দুপুরের পর থেকেই শরীরটা খুব খারাপ অমির। কোন কারণে মনে হয় ফুড পয়জন হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে কেন যে লোভে পড়ে বাজার থেকে আনা তালশাঁসগুলো গপ গপ করে খেল? ফল স্বরূপ পেটে ব‍্যথা তারপর সন্ধ‍্যের পর থেকে শুরু হল ঘন ঘন বাথরুমে যাওয়া আর তার সাথে অনেক বমি। কষ্টে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল মুখ দিয়ে বেরোল হঠাৎই মা মাগো। তারপরই মনে হল মাকে ডেকে কোন লাভ নেই,মা হারিয়ে গেছে না ফেরার দেশে। মা ছাড়া বোধহয় সন্তান সত‍্যিই অসহায় যে কোন বয়েসে। আসলে মায়ের মত তো কেউই মন পড়তে পারে না। এই কথাটা হয়ত অমির আরও বেশি মনে হয় কারণ সে একমাত্র সন্তান মা বাবার। কষ্টের মুহূর্তে আরও বেশি করে মনে হয় মায়ের নরম হাতের ছোঁয়া,আঁচলের গন্ধ আর যত্নের কথা। শুধু মনে হয় তোমার মত কেউই বোধহয় এত যত্ন করতে পারে না। কেউ বোঝে না আমার কষ্ট, মাগো একটু যদি তোমার হাতের ছোঁয়া পেতাম।
 বারবার বাথরুমে গিয়ে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয় বিছানায় অমি। পেটের ব‍্যথায় ছটফট করতে করতে ঘুম জড়িয়ে আসে চোখে। তবুও বিরক্ত করতে ইচ্ছে করে না পাশের মানুষটাকে। হঠাৎই ঘুমের মধ‍্যে বিভোর হয়ে যায় এক নরম হাতের ছোঁয়ায়। তারপরই দেখে ওর পেটে হাত বুলিয়ে ওর ছেড়ে রাখা জামাটা যত্নে কেচে জল নিংড়াচ্ছে মা।
-" তুমি আবার এটা কাচতে নিয়েছো কেন মা?"
-" তোর যে শরীর খারাপ তাই তো এলাম একটু যত্ন করতে। ঘুমো মা নিশ্চিন্তে,সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।"
    হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে যায় দেখে ওর পাশে শুয়ে থাকা মানুষটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। ওহ্ তাহলে সবই স্বপ্ন ছিল? আবার চোখ বোজে অমি,চোখ খুলতে ইচ্ছে করে না মনে মনে বলে," জানি তোমাকে আর ডাকতে নেই। তবুও ডেকে ফেলি কষ্ট পেলেই। যেখানেই থাকো শুধু তোমার স্নেহের ছায়াটুকু ছড়িয়ে রেখো মাথায় মা গো। আর বলে দিয়ো ভাবিস না সব ঠিক হয়ে যাবে।"


   

লাভ বার্ড

 লতুর লাভ বার্ড সাজের বিটকেল বায়নাতে প্রথমটা খুবই বিরক্ত লাগলেও আজকাল বেশ লাগে অভয় বাবুর। লতিকা যখন নীল শাড়ি পরে তখন তাঁকে পরতে হয় নীল পাঞ্জাবী,লতিকা হলুদ শাড়ি পরলে তাঁকে পরতে হয় হলুদ। এইভাবে সবুজ,কমলা,লাল গোলাপী রঙে এখন তাঁর জীবনে বেশ গোলাপের সৌরভ। শুধু খাটনি আর খরচ বেড়ে গেছে। মানে এই যেমন লতু বেগুনী শাড়ি পরবে,ওদিক থেকে কড়া হুকুম আসে," শুনছ পনেরো দিন বাদে তো জলির বিয়ে আমি ভেবেছি বেগুনী বালুচরী পরব তোমাকেও বেগুনী পাঞ্জাবী পরতে হবে।"
  অভয়বাবুর মুখটা বেগুন পোড়ার মত হয়ে যায়," এই বয়েসে আমি বেগুনী? মানে নিন্দুকেরা বলত আমার গায়ের রঙ নাকি বেগুনের মত। তবে মা বলতেন আমি একদম খাঁটি সোনা।"
-" ঠিকই বলত নিন্দুকেরা,তুমি বেগুন পোড়া একটা।সব সময় ফুট কেটো না তো,দেখো আলমারিতে ভালো কিছু আছে কি না? না থাকলে দোকানে গিয়ে কিনতে হবে।"
  লতুর এই শখে গাদাগুচ্ছের জামাকাপড় জমছে ঘরে। একটা আবার দুবার পরা যাবে না কারণ ফেসবুক দেখেছে মানে নেট দুনিয়ার পাবলিকেরা দেখেছে। তবে কমেন্টগুলো পড়তে বেশ লাগে অভয়বাবুর,মানে নিজেকে বেশ ইয়ে ইয়ে লাগে। এই বয়েসেও জোয়ার জাগে প্রাণে, সুর করে গাইতে ইচ্ছে করে,"যা খুশি বলে বলুক নিন্দুক,বেঁচে থাক লতুর ফেসবুক।"
    সামনেই অভয়বাবুর ভাইপোর বিয়ে। কিন্তু লতুর যেন কোন মাথাব্যথা নেই তাঁকে নিয়ে,সে নিজের শাড়ি কেনা নিয়েই ব‍্যস্ত। অগত‍্যা নিজেই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন," ও লতু তুমি কী রঙের শাড়ি পরবে?"
-" ভেবেছি তো সবুজ পরব আর বৌভাতের দিন হলুদ।"
 -" তাহলে তো আমাকে একটা সবুজ পাঞ্জাবী কিনতে হবে,হলুদও ভালো কিছু..."
  -" এই শোন তুমি একদম সবুজ,হলুদ পাঞ্জাবী পরবে না।"
  ভ‍্যাবাচাকা হয়ে বলেন," কেন পরব না? আমাদের লাভ বার্ড সাজ হবে না?"
 -" লাভ বার্ড সেজে আজকাল ফেসবুকে কত নেত্ত হচ্ছে জান না যেন? যত্তসব,যাও তো বাপু শ্বশুর হচ্ছ এত সাজের ঘটা কিসের শুনি? যা খুশী পর তুমি।"
    হঠাৎই লতুর লাভ বার্ড সাজে অনীহা দেখে বিষম খান অভয়বাবু।




রিনির জন্মদিন

নাতনি রিনির চুলে চিরুনী চালাতে চালাতে বকবক করেন ঠাকুমা ইভা," হ‍্যাঁ রে সোনাই দেখতে দেখতে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে গেলি,কবে চুলটা লম্বা করবি শুনি? এত লম্বু তুই আর ছোট ছোট চুল। কেমন যেন লাগে দেখতে।"
 -" কেমন লাগবে আবার বেশ লাগে। বাবা! লম্বা চুলের হাজার একটা ঝামেলা ও আমি রাখব না।"
-" তোর বয়েসে আমার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল জানিস। কী দেখে বলত?"
-" ঠাম্মু এই গল্প অনেক শুনেছি,তোমার চুল দেখে সবাই তোমার প্রেমে পড়ে যেত। তারপর শেষে দাদান টিকেছিল লিস্টে।"
-" বাবা সে এক কান্ড! তাই তো বলি তুইও চুল বড় কর দেখবি লম্বা চুলের পেছনে লাইন পড়ে যাবে।"
-" ঠাম্মু আমার কোন দরকার নেই চুলের লাইনে প্রেমিকদের দাঁড় করানোর। আমাকে আগে পড়াশোনা করতে দাও।"
    অথচ এই নাতনিই যখন মাস ছয়েক পরে হঠাৎই এসে ঠাম্মুর কাছে চুল লম্বা করার টিপস চাইল তখন বাড়ির সবাই অবাক হল।
-" বৌমা দেখেছ তো? মেয়েমানুষ চুল বড় না করে যাবে কোথায়? কী রে কে পড়েছে পিছে?"
  তবে ঠাম্মুর মজায় কান না দিয়েও ঠাম্মুর যত্নেই রিনির চুল বাড়তে শুরু করল। মোটামুটি একবছরে তা কোমর ছুঁল। রিনির চুল দেখে ওর মা অলকাও খুব খুশি," মা ওকে বোঝান যেন চুল না কাটে। কত সুন্দর চুল হয়েছে আপনার যত্নে।"
   মুচকি হাসে রিনি," চুল তো আমি কাটবোই।"
  -" মানে?"
  অলকার প্রচণ্ড রাগ হল যখন জন্মদিনের দিন চুল কেটে এল মেয়ে। " মা দেখুন কী করে এসেছে,মনে হচ্ছে দিই একটা..." 
অলকাকে থামালেও ইভারও নাতনিকে দেখে দুঃখে চোখে জল এল," এটা কী করলি সোনাই? কত যত্ন করেছি এতদিন চুলগুলোকে!"
 -" তাই তো তোমার যত্ন করা চুলটাকে ভালো কাজে দিয়ে এলাম।"
-" মানে?"
  ঠাম্মুর কোল ঘেঁষে বসে রিনি," আমার চুল থেকে ক‍্যান্সার পেশেন্টদের উইগ হবে ঠাম্মু। আজ জন্মদিনে হঠাৎই একটা ভালো কাজ করতে ইচ্ছে হল। কী গো মা,ঠিক করিনি?"
 মেয়েকে আদরে বুকে জড়ায় অলকা,নাতনির গর্বে মুখটা চকচক করে আনন্দে ইভার," বেঁচে থাক সোনাই।"

সমাপ্ত:-

  কয়েকটা গ্ৰুপে শ্রীজিতা সেনের গল্প পড়ে একদিন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েই দিল মণিকা। এমন একজন উঠতি লেখিকার বন্ধু হয়ে থাকলে তাকে কমেন্ট বক্সে উৎসাহিত না করলেও নিঃশব্দে লেখাগুলো পড়ে নিয়ে অন্ততঃ একটু আইডিয়া পাওয়া যাবে। ভদ্রমহিলা আবার বেশি নারীদের নিয়ে লেখেন মানে লেখাতে ঘুরে ফিরেই আসে নারী জীবনের কথকতা। আর আজকাল তো এইসব গল্পই লোকে খায় মানে বাজারে চলে। একই প্লট দিনের পর দিন টিভি সিরিয়ালে চলছে তবুও লোকে রেডিওর কানমলা বাদ দিয়ে টিভি নিয়ে বসে সকাল সন্ধ‍্যে দেখছে পারিবারিক অশান্তি।
     মণিকা খুব সুন্দর কথা বলতে পারে ও জানে ওর মধ‍্যে এমন কিছু একটা আছে যাতে লোকে চট করেই ওকে ভালোবেসে ফেলে। সুতরাং প্রথম কিছুদিন নিঃশব্দে বন্ধু হয়ে থাকলেও হঠাৎই একদিন শ্রীজিতার একটা গল্প পড়ে বেশ একটা লম্বা চওড়া কমেন্ট করে বসল ইনবক্সে। শ্রীজিতা বেশি কথা বলতে পারে না,মুখের চেয়ে কলমে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তবে নতুন লেখালেখি করার কারণে এবং পারিবারিক শিক্ষা আর মূল‍্যবোধে মানুষকে কাছে টানতেই বেশি ভালোবাসে। কারণ শ্রীজিতা জানে পাঠকদের জন‍্যই ওর লেখা আজ এত এগিয়ে গেছে।
    তাই মণিকার ইনবক্সের লেখা মেসেজের উত্তর দিতে বসে। তবে অদ্ভুতভাবে তখনই মণিকা অনলাইনে চলে আসায় আলাপ এগিয়ে যায় তরতর করে। মণিকা ভূয়সী প্রশংসা করতে থাকে ওর লেখার," সত‍্যি কী ভালো লেখো তুমি গো! কত পাঠক তোমার!"
   নিজের প্রশংসা শুনে একটু অস্বস্তি হয় শ্রীজিতার কারণ নিজেকে লেখক বলে ভাবতে গেলেই মনে হয় কত শত মানুষ লেখেন। বড় বড় কবি সাহিত্যিক আছেন তাঁদের মাঝে তো ও একদম সামান‍্য কেউ। সুতরাং বলে ফেলে," ইশ্ খুব লজ্জা পাচ্ছি,ঐ তো লিখি খুব সাধারণ ভাবে আমাদের মেয়েদের কথা এর মধ‍্যে আর এমন কী আছে?"
-" কী বলছ গো! কী ভালো প্লট তোমার! কত চুরি হয় তোমার প্লট জান?"
-" চুরি হয় জানি গো,আমার ছোট লেখাগুলো তো বেনামেই লোকে ব‍্যবহার করে ইচ্ছেমত। আর বড় গল্পের অনুকরণে তো অনেক নামজাদা লেখককেও লিখতে দেখেছি। কিন্তু কী বলব বল?"
     কথা এগিয়ে যায় তর তর করে। মণিকাকে ভালো লেগে যায় শ্রীজিতার। বেশ আন্তরিক কথাবার্তা। কয়েকদিন কথাবার্তা হবার পরেই বিনিময় হয় ফোন নম্বর। মণিকা বলে," আমিও টুকটাক লিখি,তবে তোমার মত পারি না। বাবা তুমি তো নিত‍্যদিন নতুন নতুন প্লটের ওপর লিখেই যাচ্ছ। যত দেখি তত অবাক হই। আর একটুও অহঙ্কার নেই গো তোমার। দেখতেও কী সুইট তুমি।"
-" ইশ্ এত কিছু বলছ! আমি ভাই দেখতে ভালো নয়। কোথায় সুইট দেখলে?"
   মণিকা পরপর প্রশংসার বুলি আওড়ে যায়,শ্রীজিতা হাসে। ততদিনে বিনিময় হয়েছে ফোননম্বর। প্রায়ই কথা হয়। মণিকা কোন লেখা লিখে শ্রীজিতাকে পাঠায়," তুমি একটু পড়ে দেখো না গো লেখাটা কেমন হয়েছে? আমি ঠিক ভরসা পাই না।"
    শ্রীজিতা ঘোর সংসারী,সব সামলে সময় পেলে টুকটাক লেখালেখি করে। আসলে লেখাটা একটা মনখারাপ হটানোর দাওয়াই,হয়ত বা ভালোলাগার একটুখানি খোলা জানালা ওর কাছে। সত‍্যিই ওর সময় কম তাছাড়া অন‍্যের লেখার মূল‍্যায়ন করার যোগ‍্যতা ওর আছে এমন বিশ্বাস করে না। তাই বলে," কী যে বল! তুমি তো সুন্দর লেখ। আমার অত যোগ‍্যতা নেই গো।"
-" না বললে আমি শুনবই না। তুমি দেখে দিলে তবেই বুঝব ঠিক আছে। সময় নাও,কোন তাড়া নেই।"

     মণিকার কিছু লেখা দেখতে গিয়ে শ্রীজিতার মনে হয় কোথায় যেন ওর গল্পের ছায়া খেলা করে। কিন্তু তার মধ‍্যেই একটু ভাবনা আর নামের অদল বদল। তবুও কিছু বলতে পারে না তেমন করে। যাক মেয়েটা ভালো ঠিক আছে একটু চেষ্টা করছে ভালো লেখার লিখুক না। আসলে বন্ধুত্ব হারাতে একটু ভয় পায় শ্রীজিতাও। কারণ ও নিজে লেখালেখি করলেও তেমন বেশি কোন বন্ধু নেই ওর। নিজের নরম মনে অনেকবার আঁচড় খেয়েছে বন্ধুত্ব করতে গিয়ে তাই হয়ত একটু ভয়ও পায়।
    তবে আজকাল শ্রীজিতার অবসরের অনেকটা সময়ে থাবা বসিয়েছে মণিকা। টুকটাক লেখার সময়ের অনেকটাই চলে যায় মণিকার মনের দুঃখের কথা শুনতে,দুঃখ নিজেরও কোন কম নেই শ্রীজিতার। সুতরাং বিশ্বাস করে অনেক কিছুই শেয়ার করে। হঠাৎই একদিন মণিকা ওর বাড়িতে শ্রীজিতাকে নেমন্তন্ন করে," আসতেই হবে তোমাকে। একটু আড্ডা মারব আর আনন্দ করব।"
   শ্রীজিতার একটু কিন্তু করলেও মণিকার আদুরে আবদার ফেলতে পারে না। মণিকার মিঠে কথা আর খাওয়াদাওয়ার যত্নে অভিভূত হয় শ্রীজিতা। অনেকগুলো পপুলার প্ল‍্যাটফর্মে লেখে তখন শ্রীজিতা। খাওয়াদাওয়ার পর মণিকা বলে," তোমাকে বলছিলাম না ফোনে শুনে কিছুতেই প্রোফাইল খুলতে পারছি না। একটু খুলে দাও না গো।"
   শ্রীজিতা বসে বসে দুটো প্ল‍্যাটফর্মে ওকে প্রোফাইল খুলে দেয় আর বুঝিয়ে দেয় কীভাবে কী করবে।

      পরিতৃপ্ত হয়ে শ্রীজিতা বাড়ি ফিরে আসে মনে হয় এতদিনে বেশ মনের মত একজন বন্ধু পেয়েছে। মণিকা আজকাল প্রায়ই ফোন করে ওকে অনেক কথা বলে। তবে মণিকাকে কেন যেন আজকাল খুব নেগেটিভ মনে হয় শ্রীজিতার। শ্রীজিতার মনে শুধু নয় জীবনে আর শরীরের ওপর দিয়েও হঠাৎই অনেকগুলো ঝড় বয়ে যায়। ওর মেয়ে ওর ওপর বিরক্ত হয়," মা এত নেগেটিভ সব সময় কেন শোন এই মহিলার কাছে? আমাদেরও তো সব খারাপ হচ্ছে। তোমার শরীর কত খারাপ লেখা লিখতে পারছ না।"
    মণিকা একদিন ফোন করে হা হুতাশ করতে থাকে," তুমি তো গল্পের মেশিন গো,প্রতিদিন গল্প লেখো। আর আমার গল্পগুলো ফেসবুক পেজেই দেয় না ওরা। তুমি আমাকে ওদের নম্বর দেবে গো? বলেছিলে ওদের এডিটরের নং আছে তোমার কাছে।"
   শ্রীজিতা এড়িয়ে যেতে পারে না,এই কথা তো ও নিজেই বলেছে মণিকাকে যে ভদ্রমহিলা ওকে অনেক হেল্প করেন। খুব বন্ধুত্বের সম্পর্ক ওদের। একটা ভুল করে ওঁকে না জিজ্ঞেস করেই নম্বরটা দিয়ে দেয় মণিকাকে।"

   আর তারপর থেকেই মণিকা কথা কমিয়ে দেয় একদমই। আর ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন করে বকবক করে না। আজকাল শ্রীজিতা দেখে ও যেখানে লিখত সেখানে ওর লেখা আর ফেসবুক পেজে প্রকাশিত হয় না। অনেক বেশি মণিকার লেখা থাকে, যার অনেক প্লট শ্রীজিতার গল্পের ছায়াতে লেখা। তবুও খুশি হয় শ্রীজিতা যাক মেয়েটির অনেক অভিযোগ ছিল ও এখন একটা জায়গা পেয়েছে। তবে একটা সময় শ্রীজিতা পুরোপুরি বোল্ড আউট হয়ে বুঝেছিল কিছু মানুষ সত‍্যি সুযোগসন্ধানী আর নিন্দুক। তারা বন্ধু নয় বরং তাদের বন্দুক বলা চলে এরা দরকারে বুকেও গুলি করতে পারে।
    মণিকাকে চিনেছে শ্রীজিতা। ও এখন ব্লকড আর আনফ্রেন্ড মণিকার কাছে। তবে বন্ধু ভেবে যাকে বিশ্বাস করা যায় তার ছোঁড়া বুলেটের আঘাত বড্ড খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যন্ত্রণা দেয় সারাক্ষণ। 
     
    
 

   

    
  
            



Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...