Skip to main content
আজ হেঁশেলের রাণী স্বপ্নার আতিথেয়তাই থাক আমার পোস্টে। নারী আমার কাছে দুর্গা স্বরূপে সংস্থিতা,মা আমাদের শক্তি দেন আমরা তাঁর সন্তান বলে। আমি নারীকে স্বাধীনচেতা দেখতে ভালোবাসি তবে স্বেচ্ছাচারী নয়। কারণ ঘরে,বাইরে,হেঁশেলে শ্রী টুকু অক্ষুণ্ন রাখি আমরাই। আমাদের হাত ধরেই সুশিক্ষা পায় আমাদের সন্তানেরা। তবে অনেকে দেখা নারীর মাঝে কোন একজন বোধহয় বিশেষ কেউ হয়ে যায় যখন তাকে দেখি হাসিমুখে সব সামলাতে।
 হঠাৎই ঝড়ের মত হাজির হয়েছিলাম আসানসোলে শুধুমাত্র পূর্বাভাস দিয়েছিলাম আগের দিন। তার মধ‍্যে একজন নারী যিনি সম্পূর্ণ একলা থাকেন বাড়িতে এত কিছু করতে পারেন!..... কী বলব? হঠাৎই থেমে গেলাম বলতে বলতে।
   আজ বলি একজন অনন‍্যার কথা,যিনি অত‍্যন্ত সাধারণ ভাবে থাকেন অথচ মোটেও সাধারণ নয়। বাড়িতে সম্পূর্ণ একা,ছেলে এখন কর্মসূত্রে বাইরে থাকে। যদিও তাকে একা বলা যায় না কারণ তার মাতৃত্বের আঁচলে জড়ানো রয়েছে পাশের বাড়ির মেয়েটা,ফুল,গাছ,পাখি আর ফলেরাও। হয়ত বা আমিও পাই সেই ছায়ার শীতলতা এখানে বসেও। কিছুদিন আগেই হারিয়েছেন একান্ত আপনজনকে। তবুও মুখে আমি বাপু রাজ‍্য জয় করতে পারি একাই এই দুষ্টুমি মাখা হাসিটা মাখানো রয়েছে। আসলে আমরা মানুষেরা শোকের বহিঃপ্রকাশ দেখতে খুব ভালোবাসি। যার কান্না আর হা হুতাশ কম সে নাকি আঘাত পায় না। শুনেছিলাম একই কথা আমার বাবার মৃত্যুর পর আত্মীয়দের বলতে যে আমার মাকে তেমন করে নাকি ছোঁয়নি বাবার মৃত্যু। কারণ মা কাঁদেনি বেশি। তবে আমি দুবছর বাদে মাকে চলে যেতে দেখে বুঝেছিলাম বাবাই শুধু ছিলেন মায়ের জীবনে আমি নয়। যদিও মা সবাইকে বলেছিলেন আমি ভেঙে পড়ব বলে মা নিজেকে শক্ত রেখেছেন। জানি না তোমরা কোন ধাতুতে গড়া,তবুও কেন যেন মনে হয় কোন একদিকে তুমি মায়ের মত। অন‍্যায় সহ‍্য কর না,সব কাজে পারদর্শী, সর্বক্ষেত্রে অপরাজিতা।
     বাড়িতে লোক আসবে সেই প্রস্তুতিতে আমরা বাড়ির গিন্নীরা ঘেমেনেয়ে রান্না করি। পুরুষ মানুষেরা ঝোলা ভরে বাজার করে এনেও আবার দৌড়ায় দই মিস্টি আনতে। আবার অনেকেই ভয় পাই লোকজন বাড়িতে এলেই। কেউ বা নানা অজুহাতে সরেও আসি ঝামেলা এড়াতে, আবার কেউ মানুষকে মিষ্টিমুখে আপ‍্যায়ন করে পরে সমালোচনার ঝুড়ি খুলে বসি। কথাগুলো শুনতে খারাপ হলেও সত‍্যি। যাক সেসব, মানে সেই কাজ করে হিমসিম খাওয়ার প্রথাকে মোটামুটি ভেঙে গুড়িয়ে সকাল সাড়ে নটায় অটো নিয়ে হাজির স্টেশনে এক ভদ্রমহিলা। বাইরে তখন চড়া রোদ উঠেছে। তৎপর মানুষটির উৎসাহ আর ভালোবাসার জোয়ার তখন উপচে পড়ছে। আমাদের গাড়ি ছিল চার নম্বরে তার তর সয়নি ছুটে এসেছিল ওভারব্রীজ পেরিয়ে স্টেশনে। আনন্দে জড়িয়ে ধরেছিলাম ওকে,কেমন মনে হয়েছিল? মনে পড়েছিল এক দীর্ঘদেহী মানুষের কথা যিনি আমার যাবার অপেক্ষায় সাত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ঘোড়াগাড়ি নিয়ে স্টেশনে উপস্থিত থাকতেন। দূর থেকে চোখে পড়ত সাদা পাঞ্জাবী ধুতি পরা একজন মানুষ যিনি আমার বাবা। আজ হঠাৎ মনে হল কিছু চেনা ছবি ঘুরে ফিরে আসে বার বার হয়ত বা একটু অন‍্য ভাবে। বকা দিলাম কেন এসেছ এই রোদে? মুখে চওড়া হাসি সাথে লম্বা অজুহাত অটোওয়ালা আমাদের চিনবে না তাই।  বললাম,"তোমার অপারেশন আছে না? কেন আবার ছোটাছুটি করছ গরমে?"
   হাসির জোয়ারে সব ভেসে গেল। বীরদর্পে আমাদের নিয়ে বড় লোহার গেট খুলে ঢুকলেন বাড়িতে। তার আগে আমাদের মোটামুটি সুদক্ষ গাইডের মত জায়গাটা চেনাতে চেনাতে এসেছেন। বাড়ির শীতলতা আমাকে মুগ্ধ করল। ছবি আর ভিডিও দেখে কত মানসভ্রমণ করেছি এই বাড়ির আনাচে কানাচে। ওর কাছে দাদার গল্প শুনে সেই মানুষটাও চেনা হয়ে গেছিলেন। হঠাৎই সুযোগ হল পা রাখার ওর বাড়িতে নিজের চোখে দেখা ওর সাম্রাজ‍্য আর চেখে দেখা জিভে জল আনা নানান পদ। আমি মোটামুটি তার দুদিন আগে থেকেই পেটের গন্ডগোলে ভুগছি। সকালেও ক্লান্ত শরীরে রওনা দিয়েছি। কিন্তু খাবার দেখে হঠাৎই পেট সাড়া দিয়ে বলল," সুযোগ ছাড়িস না চেখে নে।"
    বাড়িতে আর রান্নাঘরে ঢুকে কিছুই বুঝিনি প্রথমে। দেখলাম তাকে হাল্কা গোলাপি সুতীর সালোয়ার পরে বকবকিয়ে ঘুরে দেখাচ্ছে আমাদের সব। তারপরেই ভূতের রাজার বরের মতই তালি মেরে খাবার আনছে। আপনারা প্লিজ লোভ দেবেন না তবে দিলেও ক্ষতি নেই কারণ হজম হয়ে গেছে। প্রথমেই ম‍্যাঙ্গো লস‍্যি, তারপর হাতিপায়া লুচি মানে ইয়া বড় তার সাথে চানা উইথ চিকেন। কী যে অপূর্ব তার স্বাদ বলে বোঝাতে পারব না। সাথে ছিল কাস্টার্ড ওপরে সেমাই আর কাজু কিসমিস ছড়ানো,ক্ষীরের পুর দেওয়া পাটিসাপটা, দুই রকমের ইয়া বড় বড় মিস্টি। আমার পেট বলল একটু গোলমাল এখনও করছে তবুও পাগলা খেয়ে নে,এ স্বাদের ভাগ হবে না। খেয়ে আর যেন পারছি না। রান্নাঘরে দেখি জালের ফাঁক দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে নানা পদ,পাশে রাখা পনীর পকোড়ার সরঞ্জাম। একটু আমতা আমতা করে বললাম," এত করেছ কেন? এত কী খাওয়া যায় নাকি? কত কষ্ট হয়েছে তোমার!"
   হাসি উপচে পড়ল মুখে,সাথে যাদুকরের তালি হাতে," আরে না না সোয়া পাঁচটায় বসিয়েছি রান্না সব শেষ আটটায়।"
    আমার খিদে বাড়াবার জন‍্য এগিয়ে দিল আমলকীর কৌটো তারপর বেশ ঘুরু ঘুরু করালো ছাদে আর বাগানে। যা দেখলাম তাতেই অবাক হলাম হয়ত এইভাবেই ভালো থাকতে হয়। বাগান ভর্তি কত রকমের ফুলগাছ। তাতে আনাগোনা নানা পাখির। ওরাও জানে এই বাড়ির মানুষটা খুব ভালো, ওদের ভালোবাসে আর খোঁজ রাখে। ছাদে উঠে আমরা স্বামী স্ত্রী বাঁধনছাড়া। ফটো তোলার সময় সত‍্যি বলতে বয়েস ভুলে যাই। ছেলেমানুষী উপচে পড়ে চোখেমুখে। হয়ত সেটাই ভালো,তবুও ঐ রোদ্দুরে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে বলে কিছুক্ষণ সানগ্লাস পরেই ফটোশুট হল।
    আম গাছটা ফলে ফলে ভরা। সে তার মাতৃত্বের গর্বে গর্বিত আর আমরা তৃপ্ত তাকে দেখে। এমনি একটা আম্রপালি গাছ ছিল আমাদেরও হয়ত সেই কথা ভেবেই ইচ্ছেমত তাকে জড়ালাম একটু বিরক্তও করলাম। ছবি তুলে দিল এই বাড়ির অক্সিজেন আর ওর নির্ভরতার সঙ্গী পাশের বাচ্চা মেয়েটা। অবশ‍্য হেঁশেল রাণীও এক্সপার্ট এই ব‍্যাপারে।
    যতই এদিক ওদিক করি তবুও ক্ষিদে পায় না। এদিকে ঘড়ি ধরে আমাদের হেঁসেলের রাণী স্বপ্নাদেবী আমাকে আমলকি খেয়ে খিদে বাড়াতে বলে পনীর পকোড়া বানানোর উদ‍্যোগ নিচ্ছেন। অন‍্য সময় হলে বলতাম দুটো দাও তো খেয়ে দেখি। কিন্তু পেট নারাজ সে বলে আর চাপাস নি বাপু খা বলেছি বলে এত খেলি যে আমার তো আইঢাই। দুদিন তো মুড়ি জল খাইয়ে রাখলি আজ এত লোভ দেখাচ্ছিস যাই কোথায়? যাক আরেকটু সময় নিলাম বললাম আগে তোমার বোনাইকে দাও তারপর আমরা খাব।
           ওকে সাজিয়ে দিতেই চোখ কপালে উঠল ও মা এত কিছু? জালের ফাঁকে তো এত কিছু নজরে পড়েনি। আমার কর্তাটি সত‍্যিই আপ্লুত কারণ অনেকদিন বাদে আবার জামাই আদরে ভূষিত। আমি মেনুতে চোখ রেখেছি প্রতিটা ছোট বড় নানান বাটিতে সাজানো প্রথমে শাক,তারপর শুক্তো,ডাল,পনীর পকোড়া,নদীর টাটকা মাছের কলাপাতায় মোড়া পাতুরি,চিংড়ী মৌরলার কুমড়ো দিয়ে টক,কাতলা রেজালা,চাটনি,দই, মিস্টি, আম আর লিচু।
     ও মেজাজে খাচ্ছে আর আমি খাবি খাচ্ছি ভাবছি এত ভালো ভালো পদ পারব তো...জয় মা এই যাত্রা উদ্ধার করে দাও। যাক ও রসিয়ে খেয়ে বেশ অনেকটা সময় কাটালো। তার মাঝেই ভিডিও কল হল ছেলেটার সাথে। আহা বেচারাটা ওখানে ঝোলভাত খাচ্ছে আর আমরা চব‍্যচোষ‍্য খাচ্ছি। দেখলাম মায়ের মতই পরিতৃপ্তির হাসি তারও মুখে বলল," মাসি মা এত কিছু করে দিতে পেরেছে দেখেই শান্তি। আসলে আমি নেই তো কাছে থাকলে একটু সাহায্য হত।"
   এপার থেকে দাপটের সাথে উত্তর গেল," দেখ তোর মা ঠিক সব করে ফেলেছে।"
   মনটা উদাস হল আমারও সত‍্যিই তো ওর চিন্তা হবেই মা একলা থাকে কী করে কী করবে? কিন্তু মা যে অন্নপূর্ণা তাই চিন্তা কী? নাহলে ভোর চারটেয় উঠে সজনে ডাঁটার আচার,পায়েস নিয়ে পাড়ি দিতে পারে কলকাতায়? সবাইকে খাইয়ে মুখে পরিতৃপ্তির হাসি দেখেছি সেইদিন আর একই হাসি মাখানো মুখে গতকালও। 
    এক সাথে বসলাম দুজনে খেতে একটু একটু করে সবগুলো খেলাম। তার সাথে শুনলাম সব ইউনিক রেসিপি। মুসুর ডাল আর রসুন দিয়ে কলমি শাক ভাজা,গন্ধরাজ লেবুর পাতা দিয়ে মুগের ডাল আর সাথে পনীর পকোড়া। আহা আহা একদম জিভের শান্তি। শুক্তো,পাতুড়ি,টক,রেজালা কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব? সুতরাং বাদ দিলাম না কিছুই।
      খাওয়া শেষ,কিন্তু আরে এতো যাচ্ছেতাই অবস্থা পেট যে ঢোলক তখন। সমানে আমলকি চিবোচ্ছি। আমার কর্তা ওপরের ঘরে শুয়ে পড়লেন আমের শোভা দেখতে দেখতে। আমি স্বপ্নাদির সাথে গল্প করতে করতে বারবারই চোখ বুজে ফেলছি শীতলপাটির আরামে। দেখছি ও আস্তে আস্তে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পরম নির্ভরতায় চোখটা বুজে এল আরামে। ঘড়ি ধরে সাড়ে চারটায় ডেকে দিয়ে চা করায় ব‍্যস্ত হল রান্নাঘরে। ওরা দুজন যখন চা খেল আমি কিছুই বাদ দেব না সুতরাং আম আর লিচু সাথে সরবত সহ ভক্ষণ করলাম। তবে সূর্যের নিভু নিভু তাপের সাথে সাথে মনের আনন্দটুকু নিভতে শুরু করল চলে যেতে হবে বলে। বললাম," এবার ড্রেসটা পাল্টে নাও।"
     আমিও ব‍্যস্ত হলাম ওর ড্রেসিং টেবিল থেকে টুকিটাকি নিয়ে সাজতে। এ ব‍্যাপারেও তার টিপস দারুণ টুক করে একটা ক্রীম আর পাউডার মাখতে দিল। পরিপাটি হয়ে গেলাম মুহূর্তে। বুঝলাম এই ওস্তাদ সবেতেই একদম এ ওয়ান। ততক্ষণে ওর সারথি নাসের ভাইয়ের অটো এসে গেছে আমরা চেপে বসলাম তাতে। যাবার বেলায় মনে রয়ে গেল বাগানের মতই সবুজ আদর মাখা মুখটা আর হাসির ছোঁয়া। মিস করলাম পুচকিটাকে। অটোতেই ফটাফট সেল্ফি তুলে নিল ও। আমরা চললাম বাইপাস ধরে ঘাঘর বুড়ি মায়ের টানে। সবটাই ওরই জন‍্য হল। এতটা কম সময়ে এত কিছু যে করা যায় তা হয়ত তুমিই করে দেখাতে পার। তবে আশা রাখলাম আবার আসব কারণ আমার সাথী ভদ্রলোক ঘাঘড় বুড়ি মন্দিরের সংলগ্ন চা খেয়ে মুগ্ধ হয়ে বলল," এমন চা খেতে বারবার আসা যায় এখানে। বুঝলাম কিছু কথা গোপন রাখল। শুধু চা নয় তোমার টানেই এখানে আসতে ইচ্ছে করে বার বার। ফেরার পথেও এল সে স্টেশন পর্যন্ত আদরে জড়িয়ে ধরে পা রাখলাম চলন্ত সিঁড়িতে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফিরে তাকালাম দুজনেই পেছনে হাত নাড়লাম মনে মনে বললাম খুব ভালোবেসে ফেলেছি আজকের সারাটা দিন আর সবকিছুই.... খুব ভালো থেকো তুমি। নিজেকে ভালো রেখো,তোমাকে দেখে যে আমার মতই অনেকে ভালো থাকতে শেখে।

জগন্নাথের টানে পুরীর পানে যে কতবার ধেয়েছি মানে উনি হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছেন তার কোন সীমা সংখ‍্যা নেই। যে কোন কারণেই হোক তাঁর প্রতি জমেছিল এক সুপ্ত অভিমান। অনেকবার ভেবেছি যাব কিন্তু ইচ্ছে হয়নি শেষ পর্যন্ত যাবার। তবুও তাঁর টান যে সত‍্যি উপেক্ষা করা যায় না তা আবার টের পেলাম। সুতরাং আমাদের ট‍্যুর যেমন হয় মানে উঠল বাই তো কটক যাই সেভাবেই যেমন তেমন করে যাওয়া। যাওয়ার পথে শালিমার থেকে করমন্ডলে চেপে বসলাম পৌঁছলাম ভুবনেশ্বর রাত সাড়ে দশটায় তারপর সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে পুরীতে। পথে আসতে আসতে ডুবে গেলাম নস্টালজিয়ায়,গায়ে লাগছিল সমুদ্রের বাতাস। একই জায়গায় কত সঙ্গী নিয়ে এসেছি বারবার। একটা সময় আমার ছোটবেলায় প্রথম আসা রথযাত্রা দেখতে। সাথে ছিলেন বাবা মা,ঠাকুরদা,ঠাকুমা এবং আমার দিদা। বহু বছর পার হয়ে গেলেও সেই স্মৃতি এখনও স্পষ্ট। তারপর বিভিন্ন সময়ে কখনও বন্ধুর সাথে,কখনও মা বাবা, পিসি পিসামশাইকে নিয়ে আবার কখনও বা আমরা চারজন এসেছি জগন্নাথ দর্শনে। এবার বললাম কী চাইব তোমার কাছে? তুমি তো অন্তর্যামী সব বুঝে নাও আর অভিমানটুকু মুছে দাও। শেষ দুইবার যাদের নিয়ে এসেছিলাম তাঁরা কেউই আজ আর নেই সাথে। যাক সময়ই হয়ত প্রলেপ দেয় ক্ষতে জীবন চলে যায় আবার নিজের ছন্দে। পুরীতে এসে এবার নতুন দেখলাম চন্দনযাত্রা। আগেই আমরা ঠিক করেছিলাম এই গরমে কোথাও যাওয়ার নেই। কারণ পুরী হোটেলের ঘরে বসে সমুদ্র দেখব আর ভোরে বা সন্ধ‍্যেয় একটু সমুদ্রের ধারে বসব। তাছাড়া একদিন পুজো দেওয়া তো আছেই। পান্ডার মুখে শুনলাম এখন পুরীতে খুব ভিড় কারণ চন্দনযাত্রা চলছে। চন্দনযাত্রা সম্বন্ধে শোনা থাকলেও তা দেখিনি আগে। আমার সঙ্গীনী বন্ধুর উদ‍্যোগেই আমরা নরেন্দ্র সরোবরের দিকে রওনা দিলাম কারণ সে আগে কখনও সেখানে আসেনি। আমরা অটো থেকে নেমে দেখি পুলিশ আছে সেখানে এবং চারদিকে বেশ ভিড় আর সরোবরের চারদিকের সিঁড়িতে মানুষজন বসে। নরেন্দ্র সরোবরে ভাসছে দুটো সুন্দর সুসজ্জিত ময়ূরপঙ্খী নৌকো। গান আর ভজন কীর্তন হচ্ছে। আমরাও মোটামুটি একটু ফাঁকা দেখে সরোবরের সিঁড়িতে বসে পড়লাম। সূর্য একটু বাদেই অস্ত যাবে বেশ রোদের তাপ। তবুও যখন এসেছি তখন দেখেই যাব। সবাই বলাবলি করছিল অন‍্য দিন সাড়ে চারটে বা পাঁচটায় বেরোয় চন্দনযাত্রা। তবে আজ দেরি হচ্ছে। বেশ কিছুটা অপেক্ষার পর আস্তে আস্তে সূর্য ডুবল সরোবরের মাঝে যে মন্দির আছে ঠিক তার পেছনের দিকে। এখানেও জগন্নাথ বলরাম এবং সুভদ্রার মূর্তি আছে। শুনেছিলাম এটাকে জগন্নাথ দেবের পিসির বাড়ি বলা হয়। আস্তে আস্তে ভিড় বাড়ছে,সিঁড়িতে তখন প্রায় ঠাসাঠাসি। অনেকেই ভিডিও কলে বাড়ির আপনজনদের দেখাচ্ছে সরোবরের দৃশ‍্য। আমরা যেহেতু একটু দূরে বসে ছিলাম সেখান থেকেই দেখলাম পরপর তিনটে ছাতা এবং সিংহাসন মত কী যেন আসছে। শঙ্খ আর ঘন্টার আওয়াজ পেলাম। মদনমোহন পরিক্রমা শুরু করলেন প্রায় সাড়ে ছটার পর। নরেন্দ্র সরোবরে তখন দূর থেকে ফোকাস লাইট দেওয়া হচ্ছে। সরোবরের ডান্সিং ফাউন্টেন তখন নিজের ছন্দে ওঠানামা করছে। তার মধ‍্যেই দেখলাম পরপর দুটো ময়ূরপঙ্খী ডিঙা মন্দির পরিক্রমা করে সরোবর পরিক্রমা করল। অনেকটা সময় অপেক্ষা করে তেতে ওঠা পুকুরের সানে বসে তখন আমরা ঘেমে নেয়ে অস্থির। তবুও তার মধ‍্যেই উপলব্ধি করলাম ঈশ্বরের মহিমা। চন্দন যাত্রা বিভিন্ন জায়গায় হয়ে থাকে,শুনলাম বৈশাখের প্রচণ্ড দাবদাহে আমরা যেমন অস্থির হয়ে মুখে ফেসপ‍্যাক মাখি ঠিক তেমনি প্রভু জগন্নাথকেও অক্ষয় তৃতীয়া থেকে শুরু করে একুশ দিন চন্দন মাখিয়ে শীতল করে রাখা হয়। প্রভুর দুই চোখ বাদ দিয়ে সর্বাঙ্গে লেপন করা হয় এই চন্দন। মলয়জ চন্দন এবং কর্পূরের প্রলেপ দিয়ে প্রভুকে শীতল রাখা হয়। এবং জগন্নাথদেবের প্রতিনিধি স্বরূপ গোপীনাথকে এবং উৎসবমূর্তি বা বিগ্ৰহ গণকে নিয়ে এই শোভাযাত্রা করা হয়। কথিত আছে যে স্বয়ং জগন্নাথদেব রাজা ইন্দ্রদুম্ন‍্যকে এই চন্দন লেপনের আদেশ দিয়েছেন। যার ফলে শুভ অক্ষয় তৃতীয়ার দিন এই শুভ চন্দনযাত্রার শুরু হয়। এবং সান্ধ‍্যকালীন ভ্রমণ করেন প্রভু নরেন্দ্র সরোবরে।
      উৎসবের পুরো আমেজ অনুভব করলাম,দেখলাম অজস্র ভক্ত সমাগম হয়েছে। বুঝলাম প্রভু জগন্নাথের আরেক নতুন যাত্রা দেখার সৌভাগ্য হল এবার। রথযাত্রা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে,দোলে প্রভুর চরণে আবীর দেবার সৌভাগ্য হয়েছে এবার আরেক উৎসবে সামিল হলাম। চারদিকে একটা বেশ মেলা ফিলিংস,তারমধ‍্যে পাঁপড় আর ঝালমুড়ি বিক্রি হচ্ছে চুটিয়ে। আমরাও চন্দনযাত্রা উৎসবের শেষে ফিরলাম হোটেলে।

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...