Skip to main content

মধুমাখা ষষ্ঠী

শাড়ি পরবে না সালোয়ার কামিজ? নাকি একটা যে কোন ভালো টপের সাথে জিনস পরবে? দুদিন এইসব ভেবেছে মহুয়া। তারপর মাকে ফোন করেছে," আচ্ছা মা কী পরে যাব বলত? মানে আমি একটু কনফিউজড। অবশ‍্য অর্জুন বলছিল শাড়ি পরেই যেতে।"
-" আরে চেন্নাই থেকে আসবি ফ্লাইটে যেটাতে আরাম হবে তেমন কিছু পরে আয়। তোর সবসময় শাড়ি পরে হাঁটাচলা করার অভ‍্যেস আছে নাকি? অর্জুনের কথা বাদ দে। ও কী বোঝে ষষ্ঠীর?"
   হিমাদ্রি পাশ থেকে বলেন," কী সব বলছ? মেয়েটা ফোনে কথা বলছি পাশে হয়ত অর্জুনও থাকতে পারে। কী ভাববে তোমার কথা শুনে?"
    বরকে পাত্তা না দিয়ে কায়দা করে জেনে নিলেন আয়েষা অর্জুন কোথায়। যাক বাড়িতে নেই নিশ্চিন্ত। আসলে বিয়েতে প্রথম থেকেই আপত্তি ছিল তাঁর। আরে আর পাত্র পেলি না? নাগার্জুনকেই তোর পছন্দ হল শেষে? নামের মধ‍্যে কেমন যেন একটা নাগা নাগা গন্ধ। নাহ্ মানে সেটা তো আবার নাগা সন্ন‍্যাসী নয় হিমাদ্রি সন্ধি করে দেখিয়েছেন নাগ+অর্জুন মিলে নাগার্জুন হয়। 
আয়েষা অবশ‍্য নামটাকে কেটে ছেটে অর্জুন বানিয়ে ফেলেছেন। জামাই অবশ‍্য তাতেই খুশি ইংরেজিতে ধন‍্যবাদ জানিয়েছে। মাত্র ছটা মাসেই মেয়েটা প্রেমসাগরে হাবুডুবু খেয়ে একেবারে চটজলদি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। আজকালকার মেয়ে তাই কিছুই বলার নেই ঐ নামে নাকি বিখ‍্যাত হিরো আছে দক্ষিণের সিনেমায় আর তাতেই নাকি নামেই মেয়েটা ফিদা হয়ে গেল। অগত‍্যা বাধ‍্য হয়েই তাঁদের যেতে হয়েছিল চেন্নাই আর হবু জামাইকে দেখে একটু ঢোক গিলেছিলেন আয়েষা ইশ্ অমন টুকটুকে ছোটখাটো দেখতে মহুয়ার কালো,লম্বা প্রায় দৈত‍্যাকৃতি একটা বর হবে? হিমাদ্রি ধমকে ছিলেন," ছেলেটাকে চেনো ভালো করে ফ‍্যামেলি দেখো। সব ভালো হলে আপত্তি কী? আয়েষা তুমিও কিন্তু বডিশেমিং করছ। এসব কী কথা, দৈত‍্যাকৃতি মানে? আরে মহুয়া ওকে ভালোবাসে।"
  -" নিকুচি করেছে ভালোবাসার,তুমি চুপ কর তো। একটা মাত্র জামাই তার সাথে কথা বলে কোন আরাম হবে না ভাবলেই কেমন লাগছে গো। মহুয়া রে তুই এটা কী করলি?"
 মহুয়ার বকুনি শুনে থেমেছিলেন আয়েষা," মা ও তো টুকটাক হিন্দী জানে। আর বাংলা আমি শেখাবো একটু একটু করে। বলছিলাম তুমিও এবার ইংরেজী বলা শেখো বরং। মানুষটাকে দেখবে না,খুব ভালো ও। আমি ওর সাথে সত‍্যি হ‍্যাপি থাকব। ওর একটা সুন্দর মন আছে। আমাকে ভালো রাখবে মা।"
   হিমাদ্রি আয়েষাকে ইশারায় চুপ করিয়েছিলেন। তারপর দুই বাড়ির লোকজনের সামনেই ওদের বিয়ে হয়ে গেছিল। আয়েষার সেই ইচ্ছেটাও পূরণ হয়নি মানে বিয়েটা কলকাতাতে হয়নি,হয়েছিল চেন্নাইয়ে। ওঁরা দুজনে কিছু নিকট আত্মীয়স্বজন নিয়ে গেছিলেন তাদের সামনেই বিয়েটা হয়ে গেছিল দুই বাড়ির নিয়মেই। কারণ সেই সময় ওদের নাকি সম্ভব ছিল না কলকাতা এসে বিয়ে করার। অর্জুনদের পরিবারের মানুষজন খারাপ নয় শুধু একটাই সমস‍্যা ভাষার। তবে আয়েষার খুব ভালো একটা কাঞ্জিভরম প্রাপ্তি হয়েছিল। আর ঠিক যেন মনে হচ্ছিল বেশ সিনেমার বিয়ে হচ্ছে,বেশ লাগছিল দেখতে মহুয়াকে মাথায় ফুলের সাজে আর দক্ষিণী শাড়িতে। নাগার্জুনকেও সাজলে খারাপ লাগে না শুধু একটু বেশি কালো না না কালো বলতে নেই হিমাদ্রি বকবে। ঐ ভারতীয়দের মত একটু চাপা রঙ।
       মার্চের মাঝামাঝি বিয়ে হয়েছে মহুয়ার তবে এর মধ‍্যে কাজের চাপে আসা হয়নি মায়ের কাছে। মেয়ে ভালো আছে জেনে নিশ্চিন্ত আয়েষা। দিনে মোটামুটি দশবার ফোন হয়। তারপর মেসেজ তো আছেই। হিমাদ্রি আর আয়েষার এখন নিশ্চিন্ত জীবন। বরাবর আয়েষা একটু আদুরে,বড়লোক বাবার মেয়ে ছিলেন শ্বশুরবাড়িতে সেই আদরটুকু পেয়েছেন। তাছাড়া স্বামী আর মেয়ে নিয়ে কর্মসূত্রে আলাদা থাকাতে এবং কাজের আর রান্নার লোক থাকায় বেশি কাজকর্ম কোনদিনই করতে হয়নি। হিমাদ্রিও যত্নে রেখেছিলেন সুন্দরী বৌকে। গল্পের বই পড়তে খুব ভালোবাসতেন একটা সময় আর এখন সেটা গিয়ে সাথী হয়েছে মুখবুক আর হোয়াটস অ্যাপ। সারাদিন কিভাবে যে কেটে যায় বুঝতেই পারেন না।
     শরীরকে আরামে রাখতে রাখতে আর কাজ না করে করে আয়েষার কাজের অভ‍্যেস তেমন নেই। একমাত্র মেয়ে সে বড় হয়ে গেছে সেই কবেই। মায়ের কাজে অনীহা দেখে মেয়ে স্বাবলম্বী হয়ে গেছিল অনেক আগেই। বাবার ওপর তার নির্ভরশীলতা ছিল বেশি। আর এখন নির্ভরশীলতা বরের ওপর,মোটামুটি কাজের জায়গায় এই ছেলেটার যে সাহায‍্য পেয়েছিল তাতেই বুঝে গেছিল অর্জুন অনেকটা ওর বাবার মত। মানে কেয়ারিং ওকে ঠিক আয় খুকু আয় করে রাখবে। সুতরাং আর ভাবেনি। যদিও মা অনেক ভাবে ওর মন ভাঙার চেষ্টা করেছিল কিন্তু ও সম্পর্ক ভাঙেনি,বুঝেছিল এই মানুষটাই ওর জীবনের সঙ্গী হিসেবে ভালো হবে। বিয়ের পর ওদেরও প্রথম একসাথে কলকাতা আসা। দুজনেই খুব এক্সাইটেড। অর্জুনের জামাইষষ্ঠীর তেমন অভিজ্ঞতা না থাকলেও ইউটিউব দেখে ও বুঝেছে ব‍্যাপারটা কী। দুজনে মিলে এখানকার নাম করা শাড়ির দোকান থেকে আয়েষার জন‍্য একটা দামি শাড়ি কিনেছে। কারণ মহুয়া জানে যে ওর মোটুসোটু মা সাজগোজ করতে খুব ভালোবাসে। বাবার জন‍্য ধুতি না কিনে জামা প‍্যান্ট কিনেছে। আর বারবারই ভেবেছে ও নিজে কী পরে যাবে,অর্জুনকে কেমন সাজাবে।
   কারণ ওদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ও দেখছে ওদের পাশের বাড়ির বনিদি নতুন বরকে সাথে নিয়ে শাড়ি আর গয়না পরে সুন্দর করে সেজে আসছে ষষ্ঠীতে। সত‍্যি বাঙালীদের উৎসবে একটা সুন্দর নষ্টালজিক গন্ধ আছে। খাওয়াদাওয়ার ঘনঘটা,সাজগোজ সব মিলেমিশে বেশ একটা মিষ্টি গন্ধমাখা সব।
    কিন্তু মুশকিল একটাই যে ওরা ষষ্ঠীর দিনই ফ্লাইটে উঠে সেদিনই পৌঁছবে তাই সাজগোজ করে ঢোকাই ভালো। কারণ ও জানে সবাই একটু উঁকি দিয়ে দেখবে বারান্দা থেকে। ওকে গেঞ্জি আর প‍্যান্ট পরে দেখে সবাই হতাশ হবে। তাই সারপ্রাইজ থাক এটা মায়ের জন‍্যও। যাবে তো ফ্লাইটে সুতরাং সাজগোজ করে যেতে বাধা কোথায়? ও শ্বশুরবাড়ির ট্র‍্যাডিশনাল সাজেই যাবে। কত শাড়ি উপহার পেয়েছে সেগুলো হবে কী?
      আগামীকাল মেয়ে জামাই এসে ঢুকবে আয়েষার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। আয়েষাকেও একটু নড়েচড়ে বসতে হয়েছে। হিমাদ্রি বাজারের কোন ত্রুটি রাখেননি। আগেই জেনে নিয়েছেন জামাই কী কী খেতে ভালোবাসে। একটা রক্ষে জামাইটা ভেজিটেরিয়ান নয় কারণ মেয়েটার তো মাছ মাংস ছাড়া চলেই না।
  বাজার থেকে ঢুকতে ঢুকতে বলেন," ভালো ভালো যা পেয়েছি এনেছি বুঝলে। ওরা তিনদিন থাকবে এর মধ‍্যে সব করে খাইয়ে দিতে হবে।"
  ভেতরে কোন সাড়া না পেয়ে অবাক হন। এতক্ষণে তো কাজের মেয়েটার এগিয়ে এসে ওঁর হাত থেকে ঝোলা ব‍্যাগটা নেবার কথা। আয়েষাকেও দেখছেন না সব গেল কোথায়? এদিকে গরমে তাঁর হাঁফ ধরেছে শরীর ঘামে ভেজা। ব‍্যাগটা সাবধানে নামিয়ে রেখে ডাকেন," কী গো গেলে কোথায়? আর ননীই বা কোথাম?"
-" পাড়া মাথায় কোর না তো। আমার এদিকে মাথা খারাপ। কী করব কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।"
-" কেন কী হয়েছে? মহুয়ার কিছু?"
-" আরে না না,ননী কাজে আসেনি তার নাকি জ্বর।"
-" কী জ্বর! এখনই জ্বর হতে হল? আচ্ছা তাহলে তুমি বরং মালতীকে বোল একটু বেশি টাকা দেব রান্নার সাথে সাথে বাসনগুলো মেজে ঘর মুছে দেয়।"
 আয়েষা হঠাৎই চেঁচিয়ে ওঠেন," আমার কী সাধে মাথা খারাপ লাগছে? সেও আসবে না তার নাকি এই বছরেই বাপের বাড়ি যেতে হবে কারণ মা সবাইকে ডেকেছে ষষ্ঠীতে। ফোন করে খবর দিল।"
-" আরে আজ তো আসবে,আজ এলে কিছু রান্না করিয়ে ফ্রীজে রেখে দাও। বাকিটা কাল নাহয় দুজনে.."
-" ওহ্ তুমি কী কিছুই বোঝ না,সে আজই রওনা দেবে বর্ধমানে কাল মোচ্ছব করবে। কত বড় পাজি দুটোই ভাব শুধু। জানে যে মহুয়ারা আসবে। সব জেনেশুনে ইচ্ছে করে এমন করল।"
-' কবে আসবে কিছু বলেছে?"
-" বলল তো পরশু আসবে। আমার তো কালই দরকার ছিল বল। বলতেই বলল,'বৌদি জামাইরে নে রেস্তোরাঁয় খেয়ে এসো কাল। আর একবেলা বাইকে খাবার আনিয়ে নাও। বাইরের জামাই তোমার। সে কী ঘরের খাবার খাবে?"
   এমন অবস্থাতেও হাসি পায় হিমাদ্রির সত‍্যি এরাও কত কী বুঝে গেছে বাইকের খাবার মানে হল অনলাইনের খাবার। অবশ‍্য মন্দ কিছু বলেনি মালতী ঠিকই তো কাল বরং বাড়িতে বসেই অনলাইনে খাবার আনিয়ে নেবেন। কারণ আয়েষার সুগার প্রেসার আছে তারপর সে কাল ষষ্ঠীর উপোষ করে মুড়ি চিড়ে খাবে। এমনিতেই মাথা গরম করে আর্ধেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে তারপর সত‍্যি তো মেয়ে এসে যদি দেখে মা অসুস্থ বকাবকি করবে এত কিছু করার দরকার কী ছিল? আজ দেখা যাক নিজে কোমর বেঁধে লেগে যদি কিছু করতে পারেন। 
      একটা পদ নিজে করবেন বলতেই বকুনি লাগান আয়েষা," শোন তুমি বরং বাসনগুলো ধুয়ে ফেল,আমার তো সাবানে অ্যালার্জি। আর ওরা জার্নি করে এসে ষষ্ঠীর দিন বাসী খাবে নাকি? তার থেকে আমি দেখি সকালে কী করতে পারি। বাকিটা অনলাইনের খাবার আনিয়ে নিতে হবে। কারণ ক্লান্ত শরীরে ওরা বাইরে খেতে যেতে চাইবে না। যদি রাতে যায় তো যাবে।"
-" না না রাতে বাইরে কী খাবে? তুমি এত বাইরে খেতে ভালোবাসো তুমিই তো খাবে না। তোমাকে ফেলে ওরা যায় নাকি? আমিও তো যাব না তোমাকে ছাড়া।"
 এতটা মাথা গরমের মাঝেও স্বামীর মিঠে কথায় মনটা একটু জুড়োল আয়েষার। যাক সত‍্যি মানুষটা বড় খেয়াল রাখে তাঁর। এই স্বামী আদরটুকু তো সবার কপালে জোটে না। হিমাদ্রি অন্ততঃ এটুকু বোঝেন যে আয়েষা খেতে ভালোবাসেন অথচ বেশি খাটুনি খাটতে পারেন না।
        মহুয়া আর নাগার্জুন ফ্লাইটে ওঠার আগে ফোন করেছিল। মেয়ে বারবারই বলছে বেশি কিছু কোর না শুধু একটু পাতুরি,ফিশফ্রাই,পাঁঠার মাংস আর চিংড়ীর মালাইকারি থাকলেই হবে। সাথে যদি পার তবে পটলের দোরমা আর আলুভাজা থাকবে। কারণ বিয়ের পর এই প্রথম জামাইষষ্ঠী নাগার্জুনের তাই ফেসবুকে সুন্দর সুন্দর পোস্ট দিতে হবে। অবশ‍্য ফেসবুক স্ট‍্যাটাস দেওয়ার ব‍্যাপার তো আয়েষারও আছে,সুতরাং মেনুটা ভাবতেই হবে ভালো করে।
    সব মাটি করল মালতী,আগেই বলা ছিল দুদিন ধরে জোগাড়যন্ত্র করে সব করবে। যা বাকি থাকবে সেটা অর্ডার দেবেন। এখন তো পুরোটাই মাটি। যদিও হিমাদ্রি বলেছেন পাঁঠার মাংসটা তিনিই রাঁধবেন। গতকাল থেকেই পেঁয়াজ কেটে সব গুছিয়ে রেডি করেছেন। ফ্রাইয়ের মাছ ম‍্যারিনেট করে রেখেছেন। বাপ আর বেটি মিলে ফ্রাইগুলো ভেজে ফেলবেন ভেবেছেন। বাকিটা অনলাইন ভরসা। কারণ মেয়ে জামাইকে আনতে যেতে হবে এয়ারপোর্ট গাড়ি নিয়ে। যাবার পথে আয়েষাকে মন্দিরে নামিয়ে দিয়ে যাবেন।
      এয়ারপোর্টে নেমে বাতাসে ভালো করে গন্ধ নেয় মহুয়া। কতদিন বাদে আবার চেনা শহরের গন্ধ,মনটা খুশিতে ভরে যায়।
 রান্নাটা হাফ ডানও করা হল না হিমাদ্রির,সত‍্যি একটা বয়েসের পর আর পারা যায় না। অভ‍্যেসই তো চলে গেছে। সবই তো কাজের লোকই করে এখন। এমনকি সকাল বিকেলের চা করেও খাওয়ায় ওরা। আয়েষা তাড়া দিতেই বেরিয়ে এসেছেন কারণ এয়ারপোর্ট পৌঁছনোর সময় হয়ে আসছে।
-" শোন খাবারের অর্ডার দিয়ে দিয়ো বুঝলে। দেরি কোর না বেশি।"
-" আরে দেব দেব খুলতে তো দাও। ঠিক দিয়ে দেব। "
 গাড়িতে বসে বসেই অর্ডার দেবার চেষ্টা করেন হিমাদ্রি। কিন্তু হিমশিম খেলেন,লোকেশন চেঞ্জ হওয়াতে ঠিকঠাক কিছুই করতে পারছেন না। নাহ বাড়ি গিয়েই করতে হবে মনে হচ্ছে,যাক এতক্ষণে হল অর্ডার দেওয়া। দেখাচ্ছে তো ঘন্টা খানেক বাদেই দেবে। যাক ঠিকই আছে,ঠিক সময়ে দিলেই হল।
-" কী গো পৌঁছলে? আমার হয়ে গেছে প্রায় পাঁচালী শুনছি। এবার যাব শেষ হলেই। খাবার অর্ডার দিলে?"
 সত‍্যি পাঁচালী শুনতে শুনতে ফোন করছে,কী যে শুনছে কে জানে?
-" হ‍্যাঁ দিলাম,এক ঘন্টা বাদে দেবে।"
 আবার ফোন বাজে," বাবা তুমি কোথায়? আমরা বাইরে বেরিয়ে ওয়েট করছি।"
   ওদের দাঁড়াতে বলে ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে মোটামুটি দশ মিনিটে পৌঁছে যান। মহুয়া বাবাকে জড়ায় আদরে। জামাইকে দেখেন হিমাদ্রি,জিন্স আর টিশার্ট পরে বেশ ভালো লাগছে ওকে। বিয়ের সময়ের থেকে এখন একটু বোধহয় চেকনাই খুলেছে মেয়ের যত্নে।
     ওদেরকে গাড়িতে নিয়ে রওনা দিয়েই আয়েষাকে ফোন করে," উঠে পড়েছি,তুমি ফিরেছ তো?"
      গাড়িতে আসতে আসতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে মহুয়া। কলকাতা চেনাতে থাকে নাগার্জুনকে। কথার মাঝে খেয়াল করে বাবাকে যেন একটু চুপ চাপ মনে হচ্ছে।
-" বাবা কী হয়েছে গো? বারবার ফোন দেখছ। মাকেও যেন টেন্সড মনে হচ্ছে। তুমি বারবার করে বলছ কষে রেখো,কী গো? মা কী কষবে? মালতীদি আসেনি? মানে রান্না কী বাকি আছে?"
   জামাইয়ের সামনে মেয়েকে কী করে বলবেন যে সব গুবলেট হয়ে গেছে। মেয়ের সার্টিফায়েড মালতীদি যে মোটামুটি বাঙালী রান্নার শেফ হিসেবে ফাটাফাটি সে অনুপস্থিত।
   তবুও জামাই বাংলা বোঝে না সুতরাং মেয়েকে মিথ‍্যে বলে কী হবে তাই বলেই ফেলেন," আর বলিস না দুটোই ডুব দিয়েছে কাল থেকে। তোর মায়ের তো আজ ষষ্ঠী। ভেবেছিলাম কাল থেকেই কিছুটা এগিয়ে রাখব। তা তোর মায়ের আপত্তি জামাইকে বাসী খাওয়াতে।"
-" তো রান্না তুমি করবে নাকি? তোমার না গরমে শরীর খারাপ করে।"
-" আরে শুধু মাংসটা করব। বাকিটা অর্ডার দিয়েছি সুন্দরী হেঁসেলঘর থেকে। আর কোন জায়গায় পেলাম না বুঝলি। সবই হাউসফুল,আজ ষষ্ঠীতে বাঙালী রেস্তোরাঁয় প্রচন্ড ভিড়। আর ফ্রাইটা দুজনে করে নেব বুঝলি।"
    নাগার্জুন ওদের কথা বলতে দেখে বোঝে কোন সমস‍্যা হয়েছে। মহুয়াকে জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে। হিমাদ্রি একটু আলতো ইশারায় ওকে বারণ করেন। আরে জামাইয়ের কাছে ষষ্ঠীতে প্রেস্টিজ খোয়াবেন নাকি? এই প্রথম আসছে বেটা বাড়িতে।

       বাড়ির গলিতে ঢুকছে গাড়ি,নিজেকে একটু মোবাইলের ফ্রন্ট ক‍্যামেরাতে দেখে মহুয়া। নাহ সাজটা ঠিকঠাক আছে। শাড়িটা ক‍্যারী করতে পেরেছে ভালো করেই অবশ‍্য শাড়ি ড্রেপিং পুরোটাই নাগার্জুন করে দিয়েছে। ওর মাথায় ফুলটাও লাগিয়ে দিয়েছে যত্নে। তবে নিজে শাড়ি পরলে সত‍্যি এত ভালো করে পরতে পারত না। সেইজন‍্য আরেকটু এক্সট্রা ভালোবাসতে ইচ্ছে করছিল অর্জুনকে যখন ওর শাড়ির কুচি গোছাচ্ছিল নীচু হয়ে।
    ওদের বাড়ির কাছাকাছি গাড়ি আসতেই বারান্দায় বারান্দায় উঁকি দেখে মহুয়া। সবাই নতুন জামাই আর মেয়েকে দেখতে চায়। গাড়ি থেকে নেমে একটু হাসি বিনিময় করে মহুয়া। পাশের বাড়ির দুই কাকিমা যারা একসময়ে নজরে রাখতেন মহুয়াকে বললেন," যাব রে একবার গল্প করতে।"
     আবার ফোনে চোখ রাখেন হিমাদ্রি,মোটামুটি একটা বাজে। আর একটু বাদেই খাবার দেবে। যাক নিশ্চয় আয়েষা মাংস কষছে। ওরা ঢুকলেই একটু ফল মিষ্টি আর সরবত খেতে খেতেই এসে যাবে সব। তারপর বাপ বেটি মিলে একটু ফ্রাই ভেজে নেবেন।
         মহুয়াকে দেখে মন ভরে আয়েষার,মালতীকে মনে মনে আরেকবার গালি দেন। ইশ্ কতদিন পর এল মেয়েটা ঘরে! জামাইকে পাখার বাতাস দিয়ে ঠান্ডা করে ওদের হাতমুখ ধুয়ে ঠান্ডা হতে বলে সরবত মিস্টির জোগাড়ে উদ‍্যোগী হন।
 -" মা তুমি বেশি ছোটাছুটি কোর না শরীর খারাপ করবে। আমি সব শুনেছি বাবার কাছে। বাবা তো অর্ডার দিয়েছে অত ভেবো না। এখন হাল্কা একটু সরবত আর প্রসাদ দাও।"
     হিমাদ্রি রান্নাঘরের দিকে ছোটেন,অনেকগুলো খুচখাচ কাজ আছে। তারপর মাংসটাও করতে হবে। ফ্রাই ভাজতে হবে।
     হঠাৎই নাগার্জুন এসে দাঁড়ায় রান্নাঘরে। ও ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে এসেছে ওর পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। ওকে দেখে অপ্রস্তুত হন হিমাদ্রি," আরে মহুয়া ওকে এসিতে বসতে দে,গরমে রান্নাঘরে কী করছে দেখ।"
 মহুয়া রান্নাঘরের সামনে এসে হেসে গড়িয়ে পড়ে," বাবা ও সবটা বুঝে গেছে তুমি এবার বেরিয়ে এসো ও রান্না করবে। তুমি বিন্দাস আড্ডা দাও কতদিন বাদে আমি এলাম।"
 -" সে কী রে নতুন জামাই এসে রান্না করবে শ্বশুরবাড়িতে!"
-" মহুয়া যদি আমার বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করে তবে এটা তো আমারও বাড়ি। তাই মাংসটা আমি করব আপনি বসুন গল্প করুন মেয়ের সাথে। ও খুব মিস্ করে আপনাদের।"
   -" হ‍্যাঁ রে অর্জুন এত ভালো বাংলা বলতে পারে!"
 -" হ‍্যাঁ মা শেখানো হয়েছে এই তিন মাসে। তুমি গল্প করতে পারবে না তা হয় নাকি?"
     আয়েষা কী বলবেন ভেবে পান না হয়ত মেয়েটার কপাল তাঁর মতই। মহুয়া শুধু বাবারই রাজকন‍্যা নয় অর্জুনেরও নয়নের মণি। 
গল্পের মাঝে হিমাদ্রি বারবারই ঘড়ি দেখছেন সময় পেছোচ্ছে বারবারই। একঘন্টার জায়গায় প্রায় দু ঘন্টা পার। মহুয়ার সংসারের একটা ছোট টেলার এখানে বসেই দেখতে পান হিমাদ্রি,ভালো লাগলেও নিশ্চিন্ত হতে পারেন না।
 আয়েষা পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে ধমকান," কী গো কেমন অর্ডার দিলে গো,এখনও পাত্তা নেই। ছেলেটা খেটেখুটে রাঁধছে ওদিকে।"
-" জামাই কেমন ভালো দেখেছ তো? আমার কষ্টটা বুঝেছে বেটা।"
-" তা বুঝেছে কিন্তু আমার স্ট‍্যাটাস কী হবে শুনি? শুধু মাংস ভাত আর ফ্রাই দেব নাকি খেতে?"
 সত‍্যি মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে হিমাদ্রির কখন অর্ডার দিয়েছেন।
-" বাবা কী হয়েছে? দাও দেখি ফোনটা।"
  মহুয়া নম্বর ধরিয়ে দিতে ডেলিভারি বয়কে ফোন করেন হিমাদ্রি," আচ্ছা বলতে পারেন আর কত দেরি হবে? আড়াইটা তো বাজে প্রায়।"
-" স‍্যার এখানে প্রায় একশো লোক দাঁড়িয়ে মারামারি হচ্ছে খাবার পেতে। স‍্যার পুলিশ এসেছে আরও একঘন্টা দেরী হবে মনে হচ্ছে।"
   মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন হিমাদ্রি," আচ্ছা আজকাল কী শাশুড়িরা রান্নাবান্না ভুলে গেল নাকি? সবাই রেস্টোরেন্টে খাবার নিচ্ছে!"
 রাগে গজগজ করেন আয়েষা," তোর বাবার যেমন কাজ,কিছুই করতে পারে না। দেখলি তো আমাকে কেমন বলছে।"
 -" মা বাবাকে বকবে না একদম। কী করবে বাবা? চল তো গরম গরম মাংস ভাত আর ডাল ভাজা দিয়ে খেতে বসি।"
-" কিন্তু তোর বন্ধুরা কী বলবে? মানে আমাদের স্ট‍্যাটাস?"
  নাগার্জুন হেসে ফেলে ওদের কথা শুনে," ডেলিভারি এলে রাতে খাব তো। এখন আমি রান্না করেছি আর সার্ভ করছি সেটাই দিয়ে দাও স্ট‍্যাটাসে।"
    -" দেখেছ আয়েষা সব মিলে এবারের ষষ্ঠী কিন্তু আমাদের নতুন জামাই একদম নিউ থিমে ভরিয়ে দিল। তাই চল আজ জীবন যা দিয়েছে তাই নিয়েই আমরা খুশি থাকি।"

    

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...