"মা কাল আমার পুতুলের বিয়ে তোমার মনে আছে তো? আমার কিন্তু ছোট্ট শাড়ি চাই,একটা মালা চাই,একটা ছোট্ট ব্যাগ চাই। আর তুমি আমার পুতুলের বিয়েতে ছোট ছোট লুচি ভেজে দেবে তো মা? ও মা.."
পুতুলের বকবক শুনতে শুনতে কখন যে চোখটা লেগে গেছিল মাধবীর। তারপরেই মেয়ের কথা শুনে চোখটা খোলে," সব হবে মা,তুই বলেছিস যা যা জোগাড় করব বলেছি তো। এখন তুই ঘুমো দেখি। আমাকে আবার সকালে উঠে রাজ্যের কাজ করতে হবে।"
পুতুলের মাথার এলোমেলো চুলগুলো আদরে নাড়তে নাড়তে ঘুম পাড়াতে থাকে মাধবী। পাগলী একটা মেয়ে পড়াশোনার নাম নেই সারাদিন শুধু খেলা আর খেলা। বাবা পড়াতে বসালে তবুও একটু পড়ে নাহলে তো তার নামগন্ধ নেই। দেখতে দেখতে দশ পেরিয়ে এগারোতে পা রাখল মেয়ে ফাইভ পেরিয়ে সিক্সে উঠেছে।
-" মা বাবা কবে আসবে? সেই কবে তো গেছে। তারপর তো আর খবরও দিল না। আমার বাবার জন্য খুব মন খারাপ করছে। তুমি বাবাকে একটা চিঠি লিখে বলে দাও বাবা যেন তাড়াতাড়ি এখানে চলে আসে।"
মেয়ের একটানা বকবকানির মাঝে আনমনা হয়ে যায় মাধবী সত্যি প্রায় মাসখানেক হতে চলল প্রসূন বাড়িতে নেই। সেই যে কাশী থেকে চিঠি এল শাশুড়ি মায়ের শরীর খারাপ ওকে দেখতে চান শেষবারের মত।
তারপর মাধবীই বলেছিল," তোমার মায়ের শরীর খারাপ,এখন আর রাগ করে থেকো না চলে যাও কালই। এরপর হয়ত বেশি দেরি হয়ে যাবে।"
প্রসূনের মুখে অনেকগুলো রেখা ফুটে উঠেছিল, তারপর বলেছিল," কিন্তু তুমি কী করবে? আর পুতুল?"
-" ও আমি কয়েকটা দিন চালিয়ে নেব ঠিক। পুতুল এখন বড় হয়েছে। বাবা তোমাকে চিঠি দিয়ে ডাকছেন তাই না যাওয়াটা ঠিক হবে না। তুমি যাও,পুরোনো সব অভিমান মিটিয়ে ফেল।"
-" কিন্তু ওঁরা তো তোমাকে ডাকেননি,শুধু আমাকে আসতে বলেছেন। তাহলে পুরোনো অভিমান মিটবে কী করে শুনি? সবটাই তো তোমাকে ভালোবেসেছি বলেই।"
মাধবীর পুরোনো কথা ভেবে কষ্ট হলেও বলেছিল," গ্ৰামের বড়লোক বাড়ির ছেলে যদি হঠাৎই মায়ায় পড়ে এক বিধবা গরীব চাষীর মেয়েকে বিয়ে করে তাহলে কী করে মানবে বল তো মা বাবা? একেই গরীব আমরা,তারপর আবার আমি বিধবা।"
-" মাধবী এই কথা বারবার কেন বল মানে গরীব, বিধবা। সেই কবেই তো তোমাকে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছি,কী সুন্দর টুকটুকে আলতা পরা পা তোমার। কপালে সিঁদুরের টিপ পরে পুতুলকে কোলে নিয়ে যখন বসতে সাক্ষাৎ জগদ্ধাত্রী লাগত।"
লজ্জা পেয়ে প্রসূনের বুকে মুখ লুকায় মাধবী। হয়ত অনেকটা অপমানিত হয়েও এই ভালোবাসা টুকু পাবার জন্যই সংসার করে মেয়েরা।
-" তোমার ছেলে এই কাজ করলে তুমিও করতে এমন। আর কোন কথা নেই মা অনেক কষ্ট পেয়েছেন এবার তুমি কাছে গিয়ে দাঁড়াও।"
প্রসূনের মাধবীকে বিয়ে করা কিছুতেই মানতে পারেননি শিবশংকর আর আরতি। হয়ত অলক্ষ্যে অনেকটা শাপশাপান্তও করেছেন ছেলের বৌকে যা দেখে নিয়তিও হেসেছিল তখন।
একমাত্র ছেলেকে ত্যাজ্য করে গ্ৰাম ছেড়ে স্বামী স্ত্রী সব বিক্রি করে উঠে এসেছিলেন তাঁদের কাশীর বাড়িতে। জানিয়েছিলেন শেষ সময়টা ওখানে কাটিয়েই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবেন তাঁরা। শ্বশুরবাড়ির আদর ভালোবাসা স্বীকৃতি কিছুই পায়নি মাধবী। দাপুটে শ্বশুরমশাইয়ের সামনে দাঁড়ানোরই সাহস পায়নি বরং উল্টে বরকে বলেছিল," তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। আমার জন্য তাঁদের কষ্ট দিয়ো না। বড় আঘাত পেয়েছেন তাঁরা। জানি না তাঁদের অভিশাপ আমার কোন ক্ষতি করবে কিনা? আসলে আমি ঘর পোড়া গরু তো।"
-" থাক মাধবী বাকিটা আর বলার দরকার নেই। আমি কোন অপরাধ করিনি যে তোমাকে ছাড়ব। ওদের ধ্যানধারণা বদলের দরকার। ঠিক আছে যা খুশি করুক ওঁরা। আমিও ধর্মভ্রষ্ট হতে পারব না।"
বাবা আর ছেলে যে কেউ কারও চেয়ে কম যায় না তা বুঝেছিল নিজেও। সুতরাং আর কিছু বলেনি।
একসাথে রাজীবপুর ছেড়েছিল ওরাও,মানে প্রসূন চলে এসেছিল চাঁপাবেড়াতে এক বন্ধুর কাছে। সেখানেই একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরিও পেয়ে গেছে। আর শিবশংকর আরতিকে নিয়ে চলে গেছিলেন কাশী যাতে আর ছেলেকে না দেখতে হয়।
শিবশংকর আর আরতি পড়ে থেকেছেন বাবা বিশ্বনাথের চরণে। প্রসূন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সংসারে তারমধ্যে হয়ত মন খারাপের মেঘ বৃষ্টি হয়েছে বাবা মা আর ছেলে উভয়ের মনেই। আরতির মনের হদিশ শিবশংকর জানতেন তাই কয়েকটা বছর ঘুরে বেড়িয়েছেন তীর্থে তীর্থে। তবে প্রসূন তার মনের খবর তেমনভাবে মাধবীকে দেয়নি। মাঝেমধ্যে কথা হলেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে। মনখারাপ হলে একটু বেরোচ্ছি বলে বসে থেকেছে পুকুর ঘাটে এসে। তারপর একটা সময় পুতুলের জন্ম হবার পর একটু একটু করে পুতুলকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ওরা দুজনে।
স্বপ্নের সংসারের অসম্পূর্ণ ছবি সম্পূর্ণ করে মাধবী পুতুলের সংসার বানিয়ে। একটা সময় যে পুতুলখেলা তার শখ ছিল অদ্ভুতভাবে মেয়েটাও সেই শখ পেয়েছে। প্রসূন মাঝেমধ্যে রাগ করে," আচ্ছা মাধবী,ওকে কেন পুতুল বানিয়ে দাও তুমি? নামও রাখলে পুতুল। আমি কত ভালো একটা নাম দিয়েছি রুদ্রাণী। মেয়ে আমাদের রাগে,তেজে শক্তিতে মা দুর্গা হবে। তা নয় মেয়েকে বানালে পুতুল। তুমিও যেমন নরম সরম,ভীতু তোমার মেয়েও তেমনই হবে দেখো।"
মাধবীর চোখ ছলছল করে," এমন করে বলছ কেন? পুতুল বানাতে আমার ভালো লাগে। ও খেলে আমার বেশ লাগে। ওর মধ্যে আমার ছোটবেলা দেখতে পাই গো। খেলুক এখন,বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।"
নিজেকে সামলায় প্রসূন,সত্যি তো মেয়েটাই বা কী করবে? আর এখন তো খেলারই বয়েস।
পুতুলের পুতুল খেলার সংসার একটু একটু করে বেড়েছে। ওর বাক্সের পুতুলদের বাবা মা,ঠাকুরদা,ঠাকুমা সব বানিয়ে দিয়েছে মা। সত্যি মা যে কী সুন্দর পুতুল বানায় তুলো আর কাপড় দিয়ে।
পাশের বাড়ির মিতুল বলে," আমিও বানাবো কাম্মাকে দিয়ে পুতুল।"
মাধবীর সংসার সামলে বিকেলের কাজ পুতুল বানানো। পুতুলের বিয়ের রান্নাবান্না সবই করে পরম আহ্লাদে। যখন বাস্তব ছেড়ে মেয়ের সাথে পুতুল খেলায় ডুবে যায় তখন এক নিমেষে ভুলে যায় সব অপূর্ণতা আর না পাওয়ার কষ্ট। ওর জন্য প্রসূন যে মা বাবাকে ছেড়েছে সেটা ভুলতে কিছুতেই পারে না। ভাবলেই খুব কষ্ট হয় মনে। কী জানি ওঁদের দীর্ঘশ্বাসে যদি..ভাবতেই চমকে উঠে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আবার ঘুমোনোর চেষ্টা করে।
মায়ের শরীর খারাপ জানিয়ে বাবার চিঠিকে প্রসূনকে কিছুতেই অগ্ৰাহ্য করতে দেয়নি মাধবী। তবে বেশ অনেকগুলো দিন হয়ে গেল এখনও তো এল না মানুষটা। অবশ্য চিঠি দিয়েছে,জানিয়েছে মা সুস্থ হবার নয়। হয়ত মাধবীর কথা শুনে এসে ভালো করেছে,নাহলে পরে অনুতপ্ত হতে হত। মা বারবারই বলছে একবার বৌমাকে আর নাতনীকে দেখতে চান। বাবাও মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ করার জন্য বারবারই বলছেন। তাই মাধবীর যদি আপত্তি না থাকে তাহলে টিকিট পেলেই প্রসূন এসে নিয়ে যাবে ওদের। আর হয়ত হাতে সময় বেশি নেই,তাই যত তাড়াতাড়ি করা যায় দেখছে।
পুতুল কিছু না বুঝলেও মাধবীর মন উতলা,প্রায় বারোটা বছর বাদে আবার দাঁড়াবে একবার মানুষগুলোর সামনে। কেমন হবে সে অভিজ্ঞতা? বাইরে সে তেমন কোথাও যায়নি,গ্ৰামেই তার সময় কেটেছে। কাশী কেমন জায়গা? আচ্ছা যদি ওকে দেখে আবার কোন অশান্তি করেন শ্বশুরমশাই?
তারপর মনে হয় প্রসূন আছে তো। সুতরাং সে নিশ্চয়ই সামলে নেবে সব। যাক জানে না এখন কবে হঠাৎই যেতে হবে। যাক কাল মেয়ের পুতুলের বিয়ে তাই সব বায়নার কথা ভেবে নিয়ে সামাল দিতে হবে কী করে কী করবে?
খাটের পাশে রাখা বড় কাঠের বাক্সটার ওপর চোখ পড়ে যায় বিছানায় শুয়ে মাধবীর। ওর হাতে বানানো পুতুলের বাড়ি আর ওদের সংসার। সেখানে তারা কত নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। ওর বুকের কাছে ঘুমোচ্ছে ওর মেয়েটাও শুধু ওর চোখেই ঘুম নেই।
তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি।
সকালে উঠেই তাড়াহুড়ো করে সংসারের কাজ সামলে মেয়ের পুতুলের বিয়ের জোগাড়ে বসে মাধবী। বারবারই এসে বলে যাচ্ছে," মা লুচি হবে তো? ছোট্ট প্যান্ডেল শাড়ি দিয়ে কখন করে দেবে? ওরা তো এখনও গায়ে হলুদ আনল না.."
-" ওহ্ পাকা বুড়ি একটা! পুতুলের আবার কিসের গায়ে হলুদ?"
-" কেন মা ওর বড়দির বেলায় তো তুমি গায়ে হলুদ দিয়েছিলে। এবারও হবে ওরা বলেছে,একটু বাদেই তত্ত্ব আসবে।"
সারাদিন একটা বিয়েবাড়ির মেজাজে কাটে মাধবীর। প্রসূন থাকলে বকা দিত," তোমারই আসলে পুতুল খেলার শখ। শুধু মেয়ের নামে দোষ দিয়ে এখনও পুতুল খেলে যাচ্ছ।"
ও বাড়ির মিতুলের মা এসেছিল মেয়ের সাথে তত্ত্ব দিতে সেও একই কথা বলে গেল মাধু তুই পারিস বটে। কী সুন্দর হলুদ শাড়ি গয়না পরিয়েছিস রে বৌটাকে! ওরে পুতুল তোর মেয়ে কিন্তু আমার বাড়িতেই থাকবে। আর আসতে দেব না।"
পুতুলের মুখ ভারী হয়," না না আমার মণিকে আমি নিয়ে আসব। এতো মিছিমিছি বিয়ে। পুতুলদের সত্যি সত্যি বিয়ে হয় নাকি?"
-" ওরে বাবা কত জানে এই মেয়ে। আচ্ছা তবে দুটো রাত তো থাকবে মানে বৌভাতের পর ফেরত দেব।"
পুতুল অবাক হয়ে দেখে কাকিমা মায়ের কানে কানে কী যেন বলছে।
"মাধু ওদের ফুলশয্যার পর ফেরত দেব বুঝলি পুতুলটা। সব যখন হল তখন আর ওটা.."
-" ইশ্ ময়না তুইও পারিস বটে,চুপ চুপ ওরা শুনতে পাবে। দেখছিস না কেমন তাকিয়ে এদিকে..."
-" মা কী বলছ তোমরা? হাসছ কেন?"
-" ও এমনি,নে নে এবার মণিকে এদিকে আন তো একটু হলুদ দিয়ে স্নান করাই। কত বেলা হল এরপর যে সাজতে দেরি হয়ে যাবে।"
পুতুলের বিয়ে দিতে গিয়ে হারিয়ে গেছিল মাধবী হয়ত ভালোলাগার দক্ষিণের খোলা জানলাটা এমনি হয়। যেখানে দাঁড়ালে মানুষ ভুলে যায় সব চিন্তা আর দুঃখ কষ্ট।
অনেকটা আগে মিতুলের বাড়ি থেকে বরযাত্রী এসেছে,মিতুলও বায়না করে মাকে দিয়ে শাড়ি পরিয়ে গিন্নী সেজে এসেছে। মেয়ের মা যদি শাড়ি পরে ও পরবেই না বা কেন?
বেশ অনেকদিন প্রসূন এখানে নেই তাই ঘরে একটু টানাটানি চলছে। তবুও মেয়ের মন রাখতে নিজের জমানো লক্ষ্মীর ভাঁড়ে হাত দিয়েছে মাধবী লুচি, পায়েস,রসগোল্লা আর আলুর দম সবই বানিয়েছে। তাও আবার পুচকুন্নি লুচি বানাতে হয়েছে। পুতুলের বিয়ে বলে কথা।
মেয়ের পুতুল মণির বিয়েতে ওর ছোট্ট মেয়েটাকে শাড়ি পরে ছুটোছুটি করতে দেখে কেমন যেন মনটা খারাপ করে মাধবীর। ওরও তো বিয়ে হয়ে যাবে একদিন। তবে না না আগে ভালো করে পড়াশোনা শেখাবে মেয়েকে তারপরে বিয়ে দেবে। মেয়েমানুষের বোধহয় বেশি পড়াশোনা শেখা দরকার, নিজের পায়ে দাঁড়ানো দরকার। সবাই তো প্রসূনের মত বর পায় না।
প্রসূন ওকে আপন করে না নিলে কী হত কে জানে? হয়ত কোন অসৎ মানুষের সর্বনাশা হাতছানিতে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যেত সেই কবেই।
পুতুলের মেয়ের বিয়ে নিয়ে দারুণ মজা হল ওদের। হয়ত ভালো লাগার এটাও একটা ছোট্ট আয়োজন মাধবীর জন্য। সেভাবে শ্বশুরবাড়ির রান্না করার সুযোগ পায়নি কখনই তবে এই সুযোগে চুটিয়ে খেলনাবাটি খেলে নেয় মাধবী নিজেও।
তবে বিয়ের পরদিন হঠাৎই যে খবরটা পেল তারজন্য ওরা কেউই প্রস্তুত ছিল না। পুতুল তো কেঁদেই অস্থির হল মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে। মেয়ের কান্না থামাতে দুচোখে জল ভরল মাধবীর কিন্তু কিছু বলতে পারল না ওদের যে যেতেই হবে। কিন্তু কোথায় যাবে? কেমন হবে সেই জায়গা?
বিয়ের পরদিন যখন পুতুলের মেয়ের বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে ওদের ব্যস্ততা তুঙ্গে তখনই এসে দাঁড়িয়েছিল প্রসূন। বাবাকে দেখেই ছুটে গিয়েছিল পুতুল," বাবা আমার মণির বিয়ে ছিল কাল। কত মজা হল। তুমি কেন এত দেরি করে এলে গো? এখন তো মণি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে।"
মেয়ের উচ্ছ্বাস দেখে কিছু বলতে পারে না প্রসূন। কেমন করে বলবে যে ওদেরও এখান থেকে চলে যেতে হবে। কবে ফেরা হবে তার ঠিকও নেই। মাকে কথা দিয়ে এসেছে ও যে বৌ আর মেয়েকে সাথে নিয়েই ফিরবে। মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের এই অনুরোধটুকু রাখতে চায় ও একমাত্র সন্তান হিসেবে। তাই ছুটে এসেছে,অবশ্য আসতে তো ওকে হতই কারণ বেশ অনেকগুলো দিন বাড়িছাড়া ও।
-" হ্যাঁ মা এই তো আমি এসে পড়েছি। এবার তোমার মেয়ের বিয়ে দেখব আমি।"
-" বাবা তুমি সত্যি বোকা। বিয়ে তো হয়েই গেছে,আজ তো ও চলে যাবে। আমি মিতুলকে বলে দিয়েছি বৌভাতের পরের দিন যেন আমার মেয়েকে দিয়ে যায়। আচ্ছা বাবা তুমি আমার জন্য নতুন জামা এনেছ? কাঠের পুতুল এনেছ?"
-" সব এনেছি মা,ঘরে এসো সব দেব। কিন্তু আমাদের যে যেতে হবে।"
-" কোথায় যাব আমরা? কবে যাব? আমার পুতুলের কী হবে?"
হঠাৎই কেঁদে উঠল মেয়ে। মাধবী কিছুটা আগেই শুনেছে ওর বুকের ভেতরে ততক্ষণে জমেছে মনখারাপের মেঘ। চোখ ছলছল করছে ওরও। এতদিনের সংসার ছেড়ে চলে যেতে হবে? কবে ফিরবে? হঠাৎই কেন শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা ওকে ডাকছেন? অনেকগুলো জিজ্ঞাসা ভিড় করলেও মনে তখনকার মত চুপ করে যায় মাধবী। শুধু অদ্ভুত একটা মনখারাপ হয় যা প্রকাশ করতে পারে না।
পুতুলের মণি শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে একটু বাদেই। হঠাৎই আসল কান্না কাঁদল ওরা মা আর মেয়ে। কারণ ততক্ষণে মোটামুটি সবাই জানতে পেরেছে ওরা চলে যাবে।
-" ও মিতুল আমার মণিকে কালই তুই দিয়ে যাবি। আমি তো চলে যাব কাশীতে।"
মিতুলের মনখারাপ হয়ে যায় বন্ধু চলে যাবে শুনে।
-" তুই কাল যাস না রে কাল যে আমার বাড়িতে বৌভাত। তুই তো মেয়ের মা তুই না থাকলে কিছু হবে না।"
-" তুই আজকেই বৌভাত করে নে মিতুল,আমার মণিকে আমি নিয়ে যাব।"
মাধবী ঘরে আসে নিজেকে লুকোতে,এখন ওর অনেক কাজ। প্রসূন বলেছে শাশুড়িমা ওদের দেখতে চান। কিন্তু শ্বশুরমশাইকে বড় ভয় তার,তিনি যদি ওদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন তাহলে কী হবে? এই বাড়ি ছিল তবুও ওর নির্ভরতার জায়গা। এখানে ও ছিল স্বাধীন, নিজের ইচ্ছেমত সংসার সাজিয়েছিল। আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল সবার সাথেই,পাড়া প্রতিবেশীরা সকলেই ভালোবাসত। মেয়েটাও এই গ্ৰামটাকেই নিজের বাসস্থান হিসেবে দেখে বড় হয়েছে। তাই অনিশ্চিত আশ্রয়ের পানে মন ছুটে যেতে চায় না সে গুটিয়ে নিতে চায় নিজেকে তার নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে।
প্রসূন তাকে ভরসা দেয়," কী এত ভাবছ? কিছু দিনের জন্য তো যাওয়া। আসলে মা বাবার জন্য তো তেমন কিছুই করতে পারিনি। একটা অপরাধবোধ তোমার মত আমাকেও তাড়া করে বেড়ায় জান তো। তাই মায়ের শেষ সময়টা তাঁর কাছে থাকতে চাই আমরা সবাই।"
" কিন্তু তোমার চাকরি,আমার এই কষ্টে সাজানো সংসার এর কী হবে? পুতুলের পড়াশোনা?"
-" এখন আর এত কিছু ভাবতে পারছি না গো,হাতে সময় কম আমাদের যেতে হবে। আমরা কাল দুপুরের পরই বেরোব। রাতে ট্রেন আছে আমাদের টিকিট আমি সাথে করে কেটে নিয়ে এসেছি। জানি না আমি মানে আমরা ফিরে মাকে দেখতে পাব কিনা?"
-" অমন কথা বলতে নেই যদি সত্যি উনি মন থেকে আমাদের দেখতে চান তাহলে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করবেন আমাদের জন্য। নাহলে আমিও যে অপরাধী হয়ে যাব।"
-" তুমি একথা বলছ কেন হঠাৎ?"
-" আমি যে বুঝতে পেরেছি তুমি মা বাবাকে কতটা ভালোবাসো অথচ আমার জন্য এতগুলো বছর ধরে আলাদা রয়েছ। এখন হয়ত তোমারও অনুতাপ হচ্ছে তাই না?"
-" আমি তোমাদের সবাইকে একসাথে নিয়ে ভালো থাকতে চাই মাধবী। যা গেছে তার জন্য অনুতাপ করে কী লাভ? এখন শুধু ভাবছি মা যদি আরও কিছু দিন..."
" সব ঠিক হয়ে যাবে ভেবো না। আমরা তো যাচ্ছি,নাতনিকে দেখেই উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।"
নিজের আশঙ্কা আর ভয়কে একপাশে সরিয়ে প্রসূনকে ভরসা দেয় মাধবী।
পুতুলের কান্নাকাটি দেখে মিতুলের মা ঠিক করেছেন আজই বৌভাত হবে। মেয়েটা চলে যাবার আগে একটু আনন্দ করে যাক। পুতুলের বিয়েতে আবার অত কালরাত্রি নিয়মের কী আছে? মিতুলকে বলাতে ও খুশি হয়ে উঠল। গড়গড় করে বলে গেল কী মেনু হবৈ বৌভাতে। মিতুলের মা তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসে ওর বাবাকে বাজারে পাঠালেন পাশাপাশি থাকতে থাকতে মাধবীর আর ওর মেয়ের সাথে ওদের মা আর মেয়ের খুবই বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। তাই আজকের রাতে আর কালকের দুপুরে ওরা এখানেই খাবে।
প্রসূন ঠাকুরপো যা বললেন তা শুনে বোঝা গেল কবে ওরা ফিরবেন তা অনিশ্চিত। সুতরাং মাধবীকে অনেক কিছু গুছিয়ে যেতে হবে। যদিও বারবারই বলছেন আসবেন ফিরে তাড়াতাড়ি কিন্তু কেন যেন একটা প্রশ্নচিহ্ন রয়েই যাচ্ছে।
মাধবী মেয়েকে মিতুলদের বাড়িতে পাঠিয়ে গোছাতে বসে সব। বারবারই চোখ ভিজে যায়,অনেকটা স্বপ্ন দিয়ে সাজিয়েছিল সংসার আজ তা বন্দি করছে সুটকেশে। কিছু যত্নে তুলে রাখছে কাঠের আলমারিতে নষ্ট যাতে না হয়। প্রসূন স্কুলে ছুটির দরখাস্ত জমা দিতে গেছে। হাতে আর খুব বেশি ছুটি নেই এরপর হয়ত মাইনে কাটা যাবে। কিন্তু কিছু করার নেই যে মা বাবা তাকে জন্ম দিয়ে বড় করেছে তাদের সাথে আজ মিলে যাবার সুযোগ এসেছে,তাদের পাশে থেকে যত্ন করতে চায় জীবনের শেষবেলাতে ও নিজেও। হয়ত পুতুলকেও দিতে চায় ঠাকুমা দাদুর স্নেহের ছোঁয়া। মেয়েটা একটা সময় কত বায়না করেছে ওর কেন কোন দাদু আম্মা নেই।
ও বাড়িতে ডাক পড়েছে মাধবীর আর প্রসূনের রাতে। মিতুলের মা মন খারাপ নিয়েও ছোট্ট মেয়েদুটোকে খুশি করতে সব আয়োজন করেছে। এমনকি পাড়ার বৌ মেয়েদের সাহায্যে ফুলের মালা গেঁথে পুতুলের মণিকে সাজিয়ে খাটে বসিয়েছে।
পুতুলটা একটা নতুন জামা পরে মিতুলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মা আর বাবাকে দেখেই ছুটে আসে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ফুলের মালা পরা ওর ছোট্ট পুতুল বৌ দেখাতে।
মাধবী আর মিতুলের মা দুজনেরই চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। মাধবী বলে," খুব মনে হবে সবার কথা। জানি না কেমন করে ওখানে থাকব? কত কী আয়োজন করেছিস তোরা! আমার পুতুলটা ওখানে গিয়ে কার সাথে খেলবে কে জানে?"
-" ধুর পাগলী এতদিন আক্ষেপ করতিস শ্বশুরবাড়ি যেতে পারলি না বলে। এখন সেই সুযোগ এসেছে মনখারাপ কেন শুনি? তুই তো সুন্দর পুতুল বানাতে পারিস। মেয়েকে বানিয়ে দিবি,ও তো খেলা পেলে আর কিছু চায় না। এক মনে বসে খেলবে।"
রাতে ভালো করে ঘুম আসে না ওদের দুজনেরই। প্রসূনের শরীরটা খুব ক্লান্ত, প্রথম রাতে ঘুমিয়ে পড়লেও ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। দেখে মাধবী মেয়েকে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। কেমন যেন অদ্ভুত একটা মনখারাপ হয় ওরও।
ওরা রওনা দেবার আগে মিতুলকে নিয়ে ওর মা এসেছে," বুড়ি পুতুলের মণিকে দিয়ে দে ওরা কাশীতে চলে যাচ্ছে যে ওর পুতুলকে ও নিয়ে যাক সাথে।"
-" হ্যাঁ রে পুতুল তোরা আর আসবি না এখানে? কয়েকদিন নাহয় থাকত মণি পুতুল আমাদের বাড়িতে। আমার ছেলে পুতুলটা কাঁদবে যে।"
-" পাকা বুড়ি একটা,কিছু কাঁদবে না। তুই ওর পুতুল দিয়ে দে।"
মাধবী পুতুলের কানে কানে কী যেন বলে তারপর পুতুল ছুটে আসে মিতুলের কাছে ওর গলা জড়িয়ে বলে," মা বলেছে তোকে মণি পুতুল দিয়ে যেতে। ও এখানেই থাক। কাশীতে গিয়ে মা আমাকে অনেক পুতুল বানিয়ে দেবে। আমি যখন আসব তখন মণি পুতুলকে নেব তোর কাছ থেকে। ওকে দেখে রাখিস বুঝলি আমার আদরের মেয়ে তো।"
অনেকটা মনখারাপের একপশলা বৃষ্টিতে চোখের কাজল ধেবড়ে গেল পুতুলের মাধবী নিঃশ্বাস ফেলল আবার কবে আসবে কে জানে? তুলসীতলায় প্রণাম করে ঘরে তালা দিয়ে এক নতুন দিশার দিকে পা বাড়ালো ওরা।
ট্রেনে উঠে পুতুল চঞ্চল হয়ে উঠল এর আগে বাসে করে এদিক ওদিক ঘুরেছে। অনেক আগে একবার ট্রেনে উঠেছে তেমন করে কোথাও যাওয়া হয়নি ওদের। মেয়ের খুশি দেখে মনের ভার হাল্কা হয় ওদের দুজনের। সাথে আনা খাবার খেয়ে বিছানা করে শুয়ে পড়ে। সকালেই পৌঁছে যাবে কাশীতে।
স্টেশনে নেমে রঘুদাকে দেখতে পায় প্রসূন। রঘুদা ওদের পুরোনো কাজের লোক,এখানে আসার সময় বাবার সঙ্গে রঘুদা এসেছিল। আর তারপর থেকে এখানেই রয়ে গেছে। বলতে গেলে প্রসূনের অনুপস্থিতিতে আগলে রেখেছে বাবা মাকে ও।
মাধবী ঘোমটা টানে আর পুতুলের হাত ধরে শক্ত করে। পুতুলের তখনও ঘুম ঘুম চোখ কারণ অনেকটা যাতায়াতের ধকল পড়েছে ওর। প্রথমে গ্ৰাম থেকে এসেছে লোকাল ট্রেনে হাওড়াতে তারপর সেখান থেকে কাশী সুতরাং ছোট শরীর একদম ক্লান্ত।
রঘুদা ওদের সুটকেশ নিয়ে নিয়েছে আরেকটা নিতে হাত বাড়ালে প্রসূন বারণ করে," মা এখন ঠিক আছে তো? তুমি কেন এলে শুধু শুধু। আমরা ঠিক চলে যেতাম।"
-" তা হয় নাকি দাদাভাই বাবু কাল রাতেই বলে রেখেছেন আজ ভোরে ডাকছেন আমাকে। আমি তো কখনই উঠে পড়েছি। এসো এসো পুতুলরাণী আমার কোলে এস।"
-" তুমি আমার নাম কী করে জান? আমি তোমাকে চিনি না। আমি বড় হয়ে গেছি কোলে উঠব কেন?"
-" আরে আরে কত কথা শিখেছে মেয়ে আমাদের। আমি তো সেই কবে থেকেই তোমার নাম জানি। সবাই তোমাকে চিনি আমরা। চল চল নিজের বাড়িতে।"
প্রসূনকে জড়িয়ে ধরে পুতুল," বাবা আমরা তো কদিন বাদেই চলে যাব তাই না? আমাদের বাড়ি তো অনেক দূরে। সেখানে আমার মণি পুতুল আছে। আমি এখানে থাকব না।"
-" অমন বলতে নেই মা বলেছি না আম্মার শরীর খারাপ তোমাকে দেখতে চান। আর এটাও আমাদের বাড়ি,সবাই তোকে ভালোবাসবে।"
ততক্ষণে রঘুদা একটা গাড়িতে মালপত্র চড়িয়ে দিয়েছে। মাধবী আর পুতুলকে নিয়ে প্রসূন উঠে বসে গাড়িতে। ওদের বাড়িটা গঙ্গার ঘাটের কাছে সরু গলির ভেতর। এখানে অনেক বাঙালী পরিবার আছে। একটা সময় বাবা বার্ধক্যে কাশীবাস করবেন বলে বাড়িটা কিনেছিলেন। কিন্তু বার্ধক্য আসার আগেই যে কেবলমাত্র জেদের বশে এখানে চলে আসবেন তা বোধহয় কেউই জানতেন না।
গাড়ি থেকে নেমে বেশ কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে একটা পুরোনো ছোট দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়ায় ওরা। রঘুদা বলে," এসো এসো দিদিমণি এই তো এসে গেছি তোমাদের বাড়িতে আমরা। আমাদের কর্তামাও অসুস্থ নাহলে নিজে এসে আমাদের বৌদিমণিকে আশীর্বাদ করতেন।"
মাধবীর বুক কাঁপে এক অজানা আশঙ্কায় মনে পড়ে যায় বহু বছর আগের কথা যখন আশীর্বাদ চাইতে গিয়ে পেয়েছিল শুধুই অভিশাপ। আর সেটা সম্বল করেই বাড়ি ছেড়েছিল। প্রসূন বলেছিল," মন খারাপ কোর না মা বাবার অভিশাপ কখনও লাগে না। আমরা সুখী হবই।"
হয়ত কথাটা ঠিকই ছিল তাই ভাঙা বাড়িতে থেকেও সুখের নৌকা বেয়েছে ওরা দুজনে,মধ্যমণি করে আদরে রেখেছে মেয়েকে। এখন জানে না কিভাবে এখানে সব শুরু করবে? ওঁদের মুখোমুখি হবে কেমন করে?
পুতুল মায়ের দিকে তাকায় আঁচলটা চেপে ধরে। এই জায়গাটা যেন কেমন ওদের গ্ৰামের মত খোলামেলা নয়। চারদিকে শুধু বাড়ি আর বাড়ি আর সরু সরু গলি। মা বলেছে ঠাকুমা আর দাদু আছে এখানে তাই ওরা এসেছে কিছুদিন থেকেই চলে যাবে।
প্রসূন মাধবীকে আসতে বলে ভেতরে। মাধবী ঘোমটা টেনে নেয় ভালো করে তারপর পা রাখে ভেতরে মেয়ের হাত ধরে।
শ্বশুরমশাইকে দেখে অবাক হয় মাধবী অনেক বছর আগে দেখা মানুষটাকে আর মেলাতে পারে না। বাড়িটার সাথে আজ জরাজীর্ণ মানুষটাও।
গলার স্বরে নেই আর সেই তেজ পুতুলকে দেখে হাত বাড়ান,"এসো এসো দিদিভাই,কত বড় হয়ে গেছ তুমি অথচ আমার সাথে তোমার দেখাই হল না। আমি তোমার দাদুভাই আর তুমি আমার দিদিভাই। প্রসূন বৌমাকে বল নিজের মত করে সব দেখতে। আজ থেকে আমি নিশ্চিন্ত।"
মাধবী এসে প্রণাম করে ওর মাথায় আজ হাত রাখেন শিবশংকর। প্রসূনের মনেও মাধবীর মত হয়ত আসে একটা পরম শান্তি যাক ভাঙা পরিবারটা এবার জুড়ে গেল আবার। রঘুদা মাধবীকে ইশারা করে দেখায় কোণের ঘরটা। প্রসূনও বলে," বাবা তাহলে আমরা মায়ের কাছে যাই। ও হ্যাঁ মাধু ওদিকে কলতলা তুমি একটু পুতুলকে নিয়ে হাত পা ধুয়ে নাও।"
-" মা আমরা কবে বাড়ি যাব? এই বাড়িটা ভালো না। আমি এখানে থাকব না। মিতুলের সাথে খেলব আমি। আমার পুতুলের বাক্সটা কই?"
-" ইশ্ এমন বলতে নেই কদিন থাকি তারপর তো চলে যাব। আর তোর পুতুলের বাক্স তো আমি এনেছি সাথে। আরও কত পুতুল বানিয়ে দেব। এখানেও সুন্দর সুন্দর পুতুল পাওয়া যায় বাবা কিনে দেবে। এখন চল মা তাড়াতাড়ি। ঠাম্মাকে দেখবি না? তাঁর যে বড় অসুখ।"
শাশুড়িকে দেখে অদ্ভুত একটা মন খারাপ হয় মাধবীর। ঠিক যেন একটা কঙ্কাল শুয়ে আছে বিছানায়। ইশ্ এই কী সেই চওড়া লাল পাড়ের শাড়ি পরা দাপুটে মানুষটা! যিনি ওকে ডেকে বলেছিলেন," আর কী কোন ছেলে ছিল না পাড়াতে যে আমার ছেলেটার মাথা খেলে বিধবা হয়ে। না না এর প্রায়শ্চিত্ত আমাদেরই করতে হবে।"
তাহলে এর নামই কী প্রায়শ্চিত্ত? মানে নিজে নিজেকে শেষ করেছেন একটু একটু করে?
মাধবীকে দূরেই থাকতে বলেন আরতি ছেলেকে বলেন," এত কাছে ওদের এনেছিস কেন? এই রোগ ছোঁয়াচে তুই তো জানিস। যা ওদের কিছু খেতে দে এবার। আলোটা জ্বালা,জানলাগুলো খুলে দে আমি ওদের একটু ভালো করে দেখি।"
মাধবী জানলাটা খুলতেই অবাক হয়ে যায় কী সুন্দর গঙ্গা দেখা যাচ্ছে জানলা দিয়ে। অথচ এমন একটা ঘরে জানলা বন্ধ কেন? এই জানলা দিয়ে আসা খোলা হাওয়াটাই তো দরকার। প্রসূন কে বলে,
-" জানলা বন্ধ করে রাখা হয় কেন?"
" মায়ের ঠান্ডা লেগে যাবে গঙ্গার হাওয়ায় তাই বন্ধ করে রাখা হয়। মানে ডাক্তার বলে গেছেন তাই।"
মাধবী অবাক হয়ে ভাবে আজব দেশের ডাক্তার আর চিকিৎসা।
আরতি ইশারায় ডাকেন কাছে মাধবীকে। মাধবী আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়। পুতুল এদিক ওদিক তাকায়। এই তাহলে ঠাকুমা কিন্তু মিতুলের আম্মার মত নয়। বিছানায় শুয়ে আছে ওর সাথে খেলতে পারবে না। বাবা ওকে বলছে বাইরে যেতে ঐ রঘুদার সাথে। পুতুল বাবাকে ছাড়ে না।
আরতি মাধবীকে বলেন," অনেক দেরী হয়েছে মা আর হাতে বেশি দিন নেই। আমাদের আর তেমন কিছু নেই। সবই গেছে চিকিৎসায়।"
-" কিছু লাগবে না মা শুধু আশীর্বাদ করুন যাতে আমরা ভালো থাকি?"
আরতি জীর্ণ হাতটা তুলে কপালে ঠেকান আর বিড়বিড় করে বলেন," আগের কথা ভুলে যেও,সুখী থেকো সবসময়। ছেলেটাকে আর তোমার এই সংসার দেখো। তুমি ছাড়া আর কে দেখবে?"
হাতের বালার সাথে সাথে দায়িত্বের এক অদৃশ্য হাতকড়া মাধবীর হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন আরতি তা কিছু দিনের মধ্যেই বুঝতে পেরেছিল মাধবী।
সবাই জানত আরতি আর বেশিদিনের অতিথি নয় তাই এই ক্ষণিকের অতিথির হিসেবের খাতায় যা প্রাপ্য জমেছে তা সুদে আসলে মিটিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে মাধবী। কয়েকদিনের মধ্যে বেনারসের গঙ্গার ধারে অবস্থিত এই নড়বড়ে জীর্ণ বাড়িটার হাল ধরেছিল একদম নিপুণ হাতে।
বাইরে থেকে আওয়াজ এসেছিল," মছলি চাহিয়ে মাজী মছলি।"
ছুটে বাইরে আসে মাধবী এটা বাঙালীদের পাড়া তাই এখানে মাছ পাওয়া যায়। ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে দরদস্তুর করে কারণ প্রসূনও নেই সে ওষুধ কিনতে বাইরে গেছে। পুতুল এসে অবাক চোখে দেখে মাছগুলো।
-" কী মাছ মা? কত বড়!"
-" মহা শোল মছলি আছে খোকি। গঙ্গাসে লয়ি পকড়কে তাজা তাজা অভি।"
আসলে মাছগুলো অনেকটাই রুই মাছের মত দেখতে ওরা বলে মহা শোল।
মাছ এনে কাটতে বসে মাধবী ঘর থেকে আরতির ক্ষীণ কন্ঠস্বর পাওয়া যায়," মাছ পেয়েছ বৌমা? আমার মাছটা সেদিনের মত পাতলা ঝোল করে দিয়ো।"
-" হ্যাঁ মা পেয়েছি,এই কাটছি আপনি দেখবেন মাছ?"
-" না না তুমি নিজের কাজ কর,দিদিভাইকে বঁটির সামনে আসতে দিয়ো না।"
রঘুদা জল তুলতে তুলতে বলে," তোমরা আসাতে বাড়িটা কেমন যেন বাড়ি হয়ে গেছে বৌমণি। মাও কত কথা বলেন। আগে চুপটি করে শুয়ে থাকতেন। আর বাবু ওপরের ঘরে বসে জানলা দিয়ে গঙ্গা দেখতেন।"
মাধবী নীচের ঘরেই থাকে তবে দিনে বেশ কয়েকবার ছাদে উঠতে হয় তাকে। কাপড় মেলা, শুকনো শ্বশুরকে জলখাবার দেওয়া এমন কত টুকরো কাজ থাকে।
পুতুলের বায়নাতে ছাদের একটা কোণায় যেখানে বেশি রোদ আসে না সেখানে কাপড় দিয়ে করে দিতে হয়েছে ওর পুতুলের ঘর। শিবশংকর বই পড়ার ফাঁকে নজর রাখেন নাতনির দিকে। দেখেন একমনে বিড়বিড় করে কথা বলছে আর নিজের মনে ডুবে আছে পুতুল খেলা নিয়ে নাতনি।
-" পুতুল নাম রেখেছ আর সারাদিন সে পুতুল খেলছে। মেয়েরা তো এমনিতেই খেলার পুতুল। ওকে একটু শক্ত করে গড় বৌমা। কী রে লাঠি খেলা শিখবি নাকি? আমাদের গ্ৰামে হলে তোকে লাঠিখেলা শেখাতাম। সব হিসেবে কেমন যেন ভুল করে ফেললাম।"
শ্বশুরের কথার মধ্যে কথা বলে না মাধবী উনি থামলে বলে," পুতুল তোর ভালো নাম বলিসনি দাদুভাইকে?আর এই মেয়ে এরপর পড়াশোনাতে মন দে। আর বেশি খেলা নয়। বাবা যখন যাবে স্কুল খুললে তখন তোকেও পাঠিয়ে দেব।"
মাকে ছেড়ে যাবার কথা শুনে বুক কেঁপে ওঠে পুতুলের। চমকে ওঠেন শিবশংকর নিজেও," না না বৌমা এইটুকনি মেয়ে মা ছেড়ে কী করে থাকবে? তাছাড়া প্রসূনই বা যাবে কী করে মাকে ছেড়ে? তোমরা আছ বলে এই শূন্যপুরী আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে।"
মাধবী মনে মনে হাসে আর ভাবে মানুষ বড়ই স্বার্থপর একদিন যে মা বাবা অবলীলাক্রমে সন্তানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকে ত্যাগ করেছিলেন। আজ তাঁরাই পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন সন্তানের ওপর। কিন্তু মেয়েটার কী হবে? প্রসূনের চাকরিটাও তো থাকবে না আর।
রাতে শুয়ে সারাদিনের পরিশ্রমের পরও চোখে ঘুম আসে না ওর। গঙ্গার ঢেউয়ের কুলকুল বয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নিজেদের ভবিষ্যত ভেবে হঠাৎই ঘেমে ওঠে মাধবী তারপর কিছুটা সময় জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজাটা খুলে দেখে মায়ের ঘরের সামনের দড়ির খাটটায় মশারীর ভেতরে ঘুমোচ্ছে প্রসূন। আর বারান্দায় একপাশে শুয়ে আছে রঘুদা।
মাঝে মাঝে ভোরবেলা প্রসূন উঠে আসে সবার অগোচরে। মাধবী পরম নির্ভরতায় জড়িয়ে ধরে স্বামীকে সবার অগোচরে এক হয় দুটো শরীর। বেশি কথা বলতে পারে না মাধবী শুধু অনুভব করে প্রসূনকে চুপ করে। তারপর একটা সময় পরে বলে," আমরা কবে যাব ওখানে? সব যে পড়ে আছে। তোমার চাকরি,আমার ঘর আর পুতুলের পড়া।"
-" হ্যাঁ যাব তাড়াতাড়ি, আগে আমি একা যাব তারপর তোমাদের নিয়এ যাব। মাকে এই অবস্থায় ফেলে যাই কী করে? সবসময় তো আমাদের ডাকেন। ততদিন পুতুলকে এখানেই একটা স্কুলে ভর্তি করে দিই। পাশের বাড়ির ফুল আর উমি যেখানে পড়ে।"
মাধবী বুঝতে পারে মিথ্যে কথাটা ঘুরিয়ে বলছে প্রসূন যদিও কখনও যাওয়া হয় আর থাকা হবে না সেখানে। প্রসূন তার মা বাবার দূরাবস্থা দেখে মনে হয় ঠিক করে নিয়েছে এখানেই ওদের রাখবে। নাহলে পুতুলের স্কুলের কথা বলছে কেন?
*******************
প্রসূনের চাকরির জায়গায় যাবার কথা থাকলেও যাওয়া হল না কারণ কদিন ধরেই আরতির শরীর খুব খারাপ। আর মাছের খবর নেন না আরতি,মাধবী এই কদিনেই জেনে নিয়েছে কী ভালোবাসতেন আরতি। কিন্তু প্রথম দিকে ভালোবেসে একটু খেলেও দুদিন আর তেমন কিছু খাননি। কাশির সাথে রক্ত এসেছে চাপ চাপ। প্রসূন হসপিটালে দিতে চাইলেও রাজি হননি শিবশংকর বলেছেন," ওকে আর কষ্ট দিস না। বাড়িতেই শান্তিতে থাক শেষবেলাটা। তোরা বরং জানলাটা খুলে দে। একটু গঙ্গা দেখুক। বড় প্রিয় ছিল এই ঘরের জানলাটা ওর। মন খারাপে কত দাঁড়িয়ে থাকত এখানে আর কাঁদত।"
প্রসূনের চোখ তখন জলে ভেজা। বড় ভালোবাসতেন মা ওকে হয়ত জেদের বশে ত্যাগ দিলেও পরে সেই দুঃখই কুড়ে খেয়েছে।
মাধবী রান্না করতে করতে কথাগুলো শোনে রান্না ধরে যায় নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হয়। মনে হয় ওর জন্যই মা এত কষ্ট পেয়েছেন। হঠাৎই মনে হয় মেয়েটা ছাদে উঠে খেলছে অনেকক্ষণ কোন সাড়া নেই কেন? ডাক দেয়," পুতুল....ও রঘুদা একটাবার দেখ তো। কী করছে সে?"
রঘু ছাদে এসে দেখে পুতুলের সংসার সামলাতে সামলাতে মাদুরের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে দিদিভাই। মেয়েটাকে দেখে মন খারাপ হয়ে যায় মাধবীরও কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে মেয়েটা। পাশের ছাদ থেকে ফুল আর উমি ডাকে ওকে মেয়েদুটো যমজ। ওদের সাথেও খেলতে যেতে চায়না। অবশ্য এই অচেনা জায়গায় মেয়েকে এর ওর বাড়িতে ছাড়তেও ভয় পায় মাধবী।
দুটো রাত কাটল না আরতি সংসারের মায়া ছেড়ে সধবা অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করলেন। প্রসূনের মনে হল হঠাৎই সব কিছু খালি হয়ে গেল। কেউ আর বারবার ডাকে না খোক কোথায় গেলি? বৌমা কী মাছ গো? হ্যাঁ গো শুনছ জানলাটা একটু খুলবে গঙ্গা দেখব। ও দিদি তোর পুতুলকে একটু দেখা দিকি।
মাধবী আরও কঠিন হল। শাশুড়ির দেওয়া বালা জোড়া হাতে পরে শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরল রঘুদাকে সাথে নিয়ে। শিবশংকর নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিলেন,মোটামুটি আশ্রয় নিলেন ওপরের ঘরে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন গঙ্গার দিকে। আর মাঝে মাঝে নাতনির পুতুলের সংসার দেখতে দেখতে বলতেন," ও দিদিভাই, পুতুল খেলতে খেলতে তো এবার পুতুলই হয়ে যাবে তুমি। আমি হলে এই নাম দিতাম না। আমি তোমাকে রুদ্রাণী বলেই ডাকব। সংসার মানুষকে কিছুই দেয় না।"
পুতুল হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তেমন কিছুই বোঝে না। শুধু বলে," আমি কেন পুতুল হব? আমি তো জ্যান্ত পুতুল? দাদু সংসার কী?"
সংসার যে কী তা এখন আরও বেশি করে বুঝতে পারছে প্রসূন আর মাধবী। বাবার আর তেমন কিছু নেই এখন খুব অল্প যা সঞ্চিত টাকা তাতে কষ্টে সংসার চলে। প্রসূনও গত মাসের মাইনে পায়নি। বসিয়ে বসিয়ে কে আর কতদিন টাকা দেবে?
শাশুড়ির কাজের পরদিনই চিঠি এল প্রসূন যদি এর মধ্যে কাজে যোগদান না করে তাহলে স্কুল কর্তৃপক্ষ এবার অন্য কিছু ভাববে।
বেশ কয়েকমাস এই শহরটাতে থেকে প্রসূনের একটা অভ্যেস হয়ে গেছে। মনে হয়েছিল সবাই মিলে এক জায়গায় থেকে শাকভাত খেয়েও বোধহয় সুখ। কিন্তু টাকা সেটাও তো দরকার। তারপর মেয়েটাকে স্কুলে দিয়েছে তারও তো একটা খরচ আছে।
সুতরাং প্রসূন আবার ফেরার উদ্যোগ নেয়। মাধবীর খুব মনখারাপ হয়," এখানে এই বাড়িটা ছাড়া আর কী আছে বলতো? আচ্ছা বাবাকে আর রঘুদাকে নিয়ে যদি আমরা আমাদের বাড়িতে উঠি। তাহলে কেমন হয়?তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার ভালো লাগে না। এই গলিটা কেমন যেন দমবন্ধ করা,শুধু এই ছাদটুকু ভালো।"
মাধবীর শেখানো কথা বাবাকে গিয়ে বলে প্রসূন। শিবশংকর বলেন," আমাদের গ্ৰামের বাড়ির অংশ তো কবেই বেচে দিয়েছি। আর আমার হাতে আছেই বা কটা বছর? আমাকে আর কাশী ছাড়া কোর না। বাবা বিশ্বনাথের চরণে আশ্রয় নিয়ে এখানেই গঙ্গাপ্রাপ্তি হোক আমার।"
মাধবীর মন খারাপ আর পুতুলের বায়নাকে পেছনে ফেলেই কাজের জায়গাতে ফিরতে হয় প্রসূনকে যাবার সময় রঘুদাকে বলে যায়," তুমি ওদের দেখো। বাবা তো খুব একটা বেরোন না। পুতুলকে স্কুলে পৌঁছতে হবে,বাজার আনতে হবে। এদিকে ঘরের কত কাজ। জানি না মাধু কী করে সামলাবে?"
-" আমি আছি তো দাদাবাবু তুমি যাও নিশ্চিন্তে তবে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। এদিকে যদি একটা কাজ পাওয়া যেত ভালো হত তাহলে।"
দেখছি কী করা যায় বলে অনেকদিন প্রসূন চলে গেছে। মাধবী অপেক্ষায় থাকে কখন সে চিঠি লিখবে কারণ তখন ফোনের ব্যবস্থা ছিল না। মোটামুটি প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি পাঠায় প্রসূন আর মাস গেলে মানি অর্ডার। চিঠিতে সব খবর পায় মাধবী শোনে তার সংসার ঠিকই আছে তবে তেমন গুছিয়ে কিছু করতে পারে না প্রসূন। কোনরকমে সেদ্ধভাত বা ঝোলভাত বানায়। মাঝে মাঝে মিতুলের মা তরকারি বা মাছ মাংস পাঠিয়ে দেয়। বারণ করলেও শোনে না। মিতুল মাঝে মাঝেই বলে পুতুলের কথা।
মাধবী চিঠি লেখে রাতে সব কাজ সেরে প্রসূনকে ছাড়া তারও এখানে ভালো লাগে না। তবে সে কাশীর গলিপথ চিনেছে অনেকটাই। পুতুলকে নিজেই স্কুলে দিয়ে আসে। ফেরার সময় কখনও মেয়ের বায়নায় তাকে দশাশ্বমেধ ঘাটে ঘুরিয়ে বিশ্বনাথের গলিতে পুতুলের দোকানে নিয়ে যেতে হয়। পড়াশোনার চেয়ে খেলাতেই বেশি ঝোঁক মেয়ের। আর কিছু বললেই বলে বাবার কাছে পড়ব তোমার কাছে পড়ব না। পাশের বাড়ির মেয়েদুটো খেলতে আসে ওদের সাথে ভালো মিশে গেছে। দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন কেটে গেল কবে প্রসূন আসবে তা যেন জানায়।
প্রসূন জানায় সে পুজোর ছুটিতে আসবে কারণ ওর সব ছুটি ফুরিয়েছে। কমিটি জানিয়েছে এরপর ছুটি নিলে আর মাইনে দেওয়া হবে না এমনকি চাকরিটাও হয়ত থাকবে না।
বেনারসের পুরোনো বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে মেয়ের সাথে বকবক করতে করতে দিন গোণে মাধবী আর তো মাঝে দুটো মাস তারপরেই প্রসূন আসবে। হঠাৎই নীচে খেলনাওয়ালা হাঁক মারে চঞ্চল হয়ে ওঠে পুতুল," মা চল না নীচে আমি দেখব খেলনা।"
-" এই তো সেদিন কিনলি আবার কেন? আমার কাছে টাকা নেই একটাও।"
-" বৌমা এই নাও এটা দিয়ে ওকে কিনে দাও যা কিনতে চায়। ছেলেমানুষ খেলনার বায়না তো করবেই।"
মুখ ভার হয় মাধবীর এমনিতে শোনে টাকার টানাটানি সব গেছে মায়ের চিকিৎসার জন্য এদিকে নাতনীকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন।
ততক্ষণে পুতুল ছোট্ট প্লাস্টিকের সেলাই মেশিন,টেবিল ফ্যান আর চাকতি বেলনা হাতে তুলে নিয়েছে নেবে বলে।
পাশের বাড়ির মেয়েদুটোও এসেছে খেলনা কিনবে বলে ওদের সাথে আবার খেলনা দেখতে ব্যস্ত হয়ে যায় পুতুল। মাধবী ওকে কোনমতে সামলে ওপরে নিয়ে আসে। রঘুদাকে বলে দেয় ঐ খেলনাওয়ালাকে বলে দিতে এখানে যেন বেশি হাঁকডাক না করে।
পুতুল ওর খেলনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। মাধবীর রাগ হয় প্রসূনের ওপর সব দায় ওর ঘাড়ে ফেলে ওকে এক আঁধার পুরীর রাণী করে বিদায় নিয়েছে প্রসূন। আজকাল হাঁফিয়ে ওঠে মাধবী মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ হয় ওর।
পুতুলকে বোঝায়," মা বাবা তো এখানে থাকে না। আমার অত টাকা কোথায় যে প্রতিদিন তোমাকে খেলনা কিনে দেব?"
-" দাদু তো কিনে দিয়েছে আমাকে। তুমি কেন বকছ আমাকে? উমিরা তো রোজ খেলনা কেনে।"
কী করে মেয়েকে বোঝাবে যে দাদুর হাতে এখন কিছুই নেই। সবই কোনমতে টেনেটুনে চলে। তাই বলে," আচ্ছা আগে কী তুই এত খেলনা কিনেছিস? আমিই তো বানিয়ে দিতাম তোকে পুতুল। এখন কেন বায়না করিস মা?"
পুতুল আর কিছু বলে না শুধু বলে," তুমি রাগ কোরনা মা আর কিনব না।"
মেয়ের কথা শুনে মাধবীর মন খারাপ হয়,চোখে জল ভরে আসে। হে ভগবান আর কত পরীক্ষা নেবে আমার?
মাধবীর কথা শুনে হয়ত অলক্ষ্যে বাবা বিশ্বনাথ বলেছিলেন," তোর পরীক্ষার তো সবে শুরু। কখনও দেবতারা নারীর এমন পরীক্ষা নেন যে তা সীতার অগ্নিপরীক্ষাকেও ছাড়িয়ে যায়। সীতার পাশে ধরিত্রী মা আর দ্রৌপদীর সাথে সখা শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন। কিন্তু মাধবীর মত মেয়েরা কাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবে তা না ভেবেই শুধু ভগবান কষ্ট দিয়ে যান।
দেখতে দেখতে পুজোর ছুটি আসছে,মাধবীর মনে অপেক্ষার দিনগোণা। কত আশা জমেছে মনে এবার প্রসূন এলে সে বলবে," আর গিয়ে কাজ নেই সেখানে বরং এখানেই কোথাও একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়ে সবাই একসাথে থাকব। প্রাইমারি স্কুলের চাকরিতে কটা টাকাই বা পাও তাতে দুটো সংসার চালিয়ে কী করে কী করছ তা জানি না।"
পুতুলও অস্থির হয়েছে বাবাকে দেখবে বলে। তারমধ্যে হঠাৎই চিঠি এল ওখান থেকে। মিতুলের মায়ের চিঠি দেখে অবাক হল মাধবী, ও তো ভেবেছিল ওকে সবাই ভুলেই গেছে। তাড়াতাড়ি পড়তে বসে চিঠিটা। অনেক টুকটাক কথার পর ও লিখেছে," এবার প্রসূনদা ওখানে গেলে আর আসতে দিস না। এখানে একা একা থাকে,ভালো করে খায় না। প্রচুর টিউশন করে টাকার জন্য। তারাও ঠিকমত টাকা দেয় না। তুই তো জানিস এখানকার হাল। অতিরিক্ত পরিশ্রম করে আর ইচ্ছে করে না রাঁধতে জল মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ে বেশিরভাগ। আমরা খাবার দিতে গেলেও রাগ করেন।"
মাধবীর চোখটা ঝাপসা হয় এই কথা সে নিজেও ভেবেছে। এবার মাথার দিব্যি দিয়ে আটকে রাখবে এখানে। আর যেতে হবে না,আর যেতে চাইলে ও যাবে সাথে মেয়েকে নিয়ে। বাবা যখন যাবেন না রঘুদাকে নিয়ে থাকবেন।
ষষ্ঠীর দিন ভোরে প্রসূন এল। এবার ওদের শাশুড়িমা মারা গেছেন তাই পুজো নিয়ে তেমন কোন উৎসাহ কারও নেই। হয়ত বা সামর্থ্যও নেই। শ্বশুরমশাই তবুও দোকানে গিয়ে একটা তাঁতের শাড়ি আর পুতুলের জন্য দুটো জামা কিনে এনেছেন। মাধবী রাগ করেছে," বাবা পুতুলের জন্য এনেছেন ঠিক আছে। আমি এ বছর কিছুতেই নতুন কিছু পরব না। টাকাটা থাকলে অন্য কাজে লাগত।"
শিবশংকর কষ্ট পান,একটা সময় কত কী ছিল অথচ এখন একটা সামান্য শাড়ি কিনতেও তাঁকে ভাবতে হয়। কী জানি কার দীর্ঘশ্বাস পড়েছে এই সংসারে? হয়ত বা বৌমারই,তাকে সময়ে ঘরে তুললে সংসারের এত দূরাবস্থা আজ হত না।
প্রসূনকে দেখে চমকে ওঠে মাধবী," একি চেহারা হয়েছে তোমার! চোখ কোটরে ঢুকে গেছে,শরীর কঙ্কালসার মনে হয় কতদিন ভালো করে খাওনি। তাহলে মিতুলের মা চিঠিতে ঠিকই লিখেছিল। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না তোমাকে দেখে।"
-" আহ্ মাধু কতদিন বাদে সেই কোথা থেকে ছুটে ছুটে আসছি নিজের সংসারটাকে দেখব বলে। আর তুমি শুরু করেছ বকবক। আরে ট্রেনে চড়ে এতটা পথ এলাম তারপর রাতে ঘুম নেই ক্লান্ত তো লাগবেই। পুতুল কী ঘুমোচ্ছে? কতদিন দেখিনি মেয়েটাকে। আর বাবা কী উঠেছেন? রঘুদা বা কোথায়? তুমি কী এখন সব কাজ একাই কর নাকি?"
-" নিজে যে বকবক করছ সে বেলা কী শুনি? রঘুদাকে একটু পাঠিয়েছি বাজারে। বাবার শরীরটা গতকাল একটু খারাপ ছিল বোধহয় শুয়ে আছেন। আর তুমি তো ঠিকমতো বলনি যা আজকে আসবে। তবুও আমি ভেবেছি তুমি আজই আসবে।"
মাধবী আপনমনে বকবক করে প্রসূন ওকে দেখে এই কয় মাসে মাধবীর শরীরও খারাপ হয়ে গেছে। সেই সুন্দর নিটোল মুখখানাতে চিন্তার আকিবুকি। দীঘল চোখে দুশ্চিন্তা আর না ঘুমোনোর ছাপ। সুন্দর হাসিতে মাখানো মলিনতা। কে জানে কেমন ছিল ওরা এতদিন? ওর পাঠানো সামান্য টাকাতে কিভাবে সংসার চালাত মাধবী? সংসারে বাঁধতে গিয়ে অনেক বেশি দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে মেয়েটার ওপর প্রসূন।
প্রসূনকে হাত পা ধুতে বলে রান্নাঘরে যাবার উদ্যোগ নেয় মাধবী চা বানাতে। ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে প্রসূন,মাধবীও হয়ত অপেক্ষা করছিল এই ছোঁয়া টুকু প্রাণভরে নেবার। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে। প্রাণভরে নিতে চায় একে অপরের অবলম্বনটুকু। মাধবীর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জল কতদিন মানুষটাকে ছুঁয়ে দেখতে পারেনি এ যেন এক জীবন্ত কঙ্কাল হয়েছে প্রসূন।
কিছুক্ষণ বাদে বলে," রঘুদা এসে পড়বে একটু বাদেই। বাবাও হয়ত উঠে পড়েছেন। এখন ছাড়ো একটু চা খাও আর খাবার। হ্যাঁ গো সব টাকাই কী এখানে পাঠাতে নাকি? উঃ ভগবান,আর তোমাকে যেতে হবে না ওখানে।"
-" পাগলী না গেলে খাব কী? সংসার চলবে কেমন করে? তারপর এখানে পুতুলকে স্কুলে দিয়েছি।"
-" এখানে যা কাজ পাবে করবে। দরকারে আমি সেলাইয়ের কাজ নেব। শাড়িতে চুমকি বসানোর কাজ পাওয়া যায় রঘুদা বলছিল। কোনমতে চলে যাবে।"
-" কী বলছ বৌমা আমার বাড়ির বৌ শেষে ঐ করিমদের কারখানায় শাড়ি সেলাই করবে! হে ভগবান আমাকে তুলে নাও এসব দেখার আগে। কেমন আছিস বাবা? শরীরের একি হাল করেছিস বাবা?"
-" ঠিক আছে বাবা এই কদিনে একদম ফিট হয়ে যাব মনে হচ্ছে। মাধবী তো আসা মাত্রই বকাঝকা শুরু করেছে। তোমাদের মধ্যে এসে গেছি ব্যাস এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।"
ওদের কথা শুনে ততক্ষণে পুতুলের ঘুম ভেঙে গেছে। বাবার কাছে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বাবাকে। প্রসূন মেয়েকে পেয়ে খুশীতে ঝলমলিয়ে ওঠে। ওর কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখটা আনন্দে নেচে ওঠে," এই তো আমার পুতুল মা এবার তো আমার শরীর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।"
পুতুল জিজ্ঞেস করে," তুমি আর যাবে না তো বাবা আমাদের ছেড়ে? তোমার জন্য আমি খুব কাঁদি। মা আমাকে ভালো করে পড়াতে পারে না শুধু বকে। পুতুল কিনলে রাগ করে।"
মাধবী মাছ তরকারি বেশি বেশি করে খাওয়ায় প্রসূনকে। নিজের ভাগটাও তুলে দিতে চায় স্বামীর পাতে। কয়েকদিনের জন্য পুজোর ছুটিতে এসে প্রসূন আবার ভালোলাগায় ভেসে যায়। মেয়ের বায়নাতে রঘুদাকে আর মাধবীকে সাথে নিয়ে কাছের দুর্গা ঠাকুর দেখতে যায়। শিবশংকর বলেন," দেখে এসো, মা কী বারবার আসে নাকি? গতবার অনেক কষ্টে তোমাদের মাকে নিয়ে দেবীর মুখটা একবার দেখিয়ে এনেছিলাম। এবার সে কোথায়?"
পুতুল বায়না ধরে," দাদু তুমিও চল না সাথে। আমি বেলুন কিনব।"
-" আচ্ছা তুই কী কোনদিন বড় হবি না? বেলুন কিনবি!"
-" আমাকে বকছে মা দেখেছ বাবা?"
-" তোমার আর বাবার প্রশ্রয়ে মেয়েটা বিগড়োচ্ছে। আর রঘুদা তো আছেই।"
পকেট খুঁজে নাতনীকে টাকা দেন শিবশংকর বলেন," কিছুমিছু খেয়ো।"
-" দাদু সেটা কী গো?"
-" ঐ টুকটাক যা ইচ্ছে করে কিনে খেয়ো।"
বাবা মায়ের হাত ধরে নতুন জামা পরে পুতুল লাফাতে লাফাতে চলে যায় হাত নেড়ে। শিবশংকর ঘরে আসেন তারপর আস্তে আস্তে ছাদে ওঠেন। আরতির ছবিতে আজ মালা পরানো চিরশান্তির দেশে গিয়ে সে ভালোই আছে হয়ত। কে জানে সেখানে পুজো হয় কিনা? ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দেন শিবশংকর দূর থেকে পুজোর ঢাকের আওয়াজ পাওয়া যায়। ঘরে বসেই হাত তুলে প্রণাম করেন মা দুর্গা দুর্গতি নাশ কোরো।
পুজোর দিনগুলো বাবাকে কাছে পেয়ে খুশিতে ভরে উঠল পুতুল। কদিনের জন্য আর তেমন উঁকি মারেনি ওর পুতুলদের সংসারে। বাবার হাত ধরে গলি পথ ধরে চলে যায় দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে আবার কখনও বা কেদার ঘাটের দিকে। মাধবীও সকালে বেশ কয়েকদিন গঙ্গা স্নান করে এসেছে। বাড়ির সামনে গঙ্গা হলেও রোজ স্নান করতে যেতে পারে না। সংসারের সব সামলে সময় কোথায়? তাছাড়া প্রসূনও বারবারই বলে গেছিল যেন একা একা গঙ্গায় না যায় মাধবী। কারণ মাধবী সাঁতার জানে না তাই কী দরকার অযথা জলে নামার। পুতুলকে ওপরে সিঁড়িতে বসিয়ে রেখে প্রসূনের সাথে গঙ্গায় নেমেছে মাধবী। নিজেরা স্নান করে তারপর মেয়েকে দুটো ডুব দিইয়ে উঠে আসার আগে ঘটি ভরে গঙ্গা জল নেয় কেদার ঘাটে শিবের মাথায় দেবে বলে। এই মন্দিরে মাঝেমধ্যে এক দুদিন এসেছে উমির মায়ের সাথে এই জায়গাটা খুব প্রিয় ওর। বিশ্বনাথের মন্দিরের ভীড় এড়িয়ে অনেকটা শান্তি পায় এখানে। সন্ধ্যের আরতিও দেখেছে এখানে। মনটা যেন এক অদ্ভুত পবিত্রতায় ভরে যায়।
কেদার ঘাটের কাছেই ওদের পুরোনো বাড়ি তাই মাধবী আর শাড়ি ছাড়ে না। আঁচল আর কুচির জল নিংড়ে গায়ে গামছা দিয়ে পা বাড়ানোর আগে প্রসূনকে বাড়িয়ে দেয় শুকনো ধুতি আর গামছা। মেয়েকে চট করে পরিয়ে নেয় শুকনো জামা।
প্রসূন আপত্তি করলে বলে," তোমার খুশখুশে কাশি হয়েছে। একদম ভিজে কাপড়ে থেকো না।"
-" আমার কিছু হয়নি মাধবী নিজে ভিজে কাপড়ে থাকবে আর আমাকে শাসন করবে। তোমার ঠান্ডা লাগবে না বুঝি?"
-" না আমার কিছু হবে না। তোমাকে নিয়েই আমার চিন্তা। কী শরীরের হাল করেছ দেখেছো?"
ওদের কথার মাঝেই ভীম সিং হঠাৎই সামনে এসে দাঁড়ায়। এই লোকটাকে আগেও দেখেছে মাধবী। লোকটা যেন কেমন একটা। শ্বশুরমশাইয়ের সাথে কথা বলতে এলেও প্রতিবারই জলের ফরমায়েশ করে। রঘুদা থাকলে ওকেই ধরিয়ে দেয় জল বাতাসা মাধবী। নাহলে ওকেই দাঁড়াতে হয় জল নিয়ে,লোকটা হাসে ঘোমটার আড়ালে মাধবীকে দেখে। চাউনিটা ভালো লাগে না মাধবীর।
শ্বশুরমশাইকে বলেছিল," বাবা এই লোকটা কেন আসে মাঝে মাঝে? আপনার সাথে কী দরকার?"
-" কেন বৌমা? আসলে তোমাকে আর কী গোপন করব। ওর কাছে কিছু ধার আছে। তোমার মায়ের চিকিৎসার জন্য তো কম খরচ হয়নি। কথায় আছে না রাজার ধনও বসে খেলে ফুরোয়। আমার হয়েছে সেই হাল বুঝেছ মা। লোকটা খারাপ নয়,অসময়ে সাহায্য করেছে। এখন ঐ চেষ্টা করি অল্প অল্প করে যদি কিছু দেওয়া যায়।"
-" কত টাকা বাবা?"
-" ওসব এখন থাক,আমি ঠিক ব্যবস্থা করে নেব। তুমি আবার প্রসূনকে কিছু বোলনা। এমনিতেই ছেলেটার মাথায় অনেক চিন্তা। সব ঠিক হয়ে যাবে সময়ে মা।"
-" ও ছোটাবাবু যে? কবে আইলেন কলকাত্তা সে?"
মাধবী অবাক হয় লোকটাকে কী প্রসূন চেনে? এমন করে কথা বলছে যেন চেনা।
-" কয়েকদিন আগে এসেছি।"
কথার মাঝেই মাধবীর ভিজে কাপড় জড়ানো শরীরটা দেখে ভীম সিং। মাধবী তাড়াতাড়ি করে গামছাটা ভালো করে জড়িয়ে মেয়েকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে। ভীম সিং প্রসূনকে ছাড়ে না,অবশ্য মাধবী সেকথা শুনতে পায় না। তবে প্রসূন দেখে কথা বলতে বলতে ভীম সিং দেখছে মাধবীর ভেজা কাপড় জড়ানো নিতম্ব পেছন থেকে।
প্রসূনের রাগ হয় মাধবীর ওপর,কাপড়টা ছেড়ে নিলে কী হত এমন? ভেজা কাপড়ে জড়ানো মাধবীর ওপর কত মানুষের নজর পড়বে আসা যাবার পথে।
মাধবী সিঁড়ি দিয়ে একদম ওপরে উঠে পেছন ফিরে দেখে। প্রসূন সিঁড়ি বেয়ে খুব ধীরে ধীরে উঠছে। কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে উঠেই একটাতে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। মনটা হঠাৎই খারাপ হয়ে যায় মাধবীর কেন যে বায়না করল আজ দশমী তাই গঙ্গায় আসবে স্নান করতে। প্রসূনের শরীর খারাপ খুশখুশে কাশি তার মধ্যে এতগুলো সিঁড়ি উঠতে ওর নিশ্চয় কষ্ট হচ্ছে। মাধবীকে দাঁড়াতে দেখে প্রসূন হাত নেড়ে ইশারা করে এগিয়ে গিয়ে মন্দিরে ঢুকতে। তাড়াতাড়ি করে শিবের মাথায় জল ঢেলে মেয়ের হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে আসে মাধবী প্রসূন ততক্ষণে ওপরে উঠে এসেছে।
ও হঠাৎই তাড়া লাগায়," তোমার হয়েছে? আর কতক্ষণ ভেজা কাপড়ে থাকবে মাধু? আমার হয়েছে যত জ্বালা। কথা একদমই শোন না তুমি।"
প্রসূনের গলায় রাগের ছোঁয়া পায় মাধবী। মনটা একটু খারাপ হয়ে যায় তবুও সামলে বলে," এই তো এখনি বাড়ি গিয়ে শুকনো কাপড় পরব।"
-" হ্যাঁ ততক্ষণে গলির সবার দেখা হয়ে যাবে গামছা জড়ানো ভেজা শরীরটা।"
মাধবী আর কিছু বলে না ওর হঠাৎই চোখটা টলটল করে ওঠে। প্রসূন কী ওর ওপর বিরক্ত হয়েছে হঠাৎই। এমন করে কথা বলছে কেন ও? পুতুল এসে বাবার হাত ধরে,গামছাটা দিয়ে শরীরটা ভালো করে জড়ায় মাধবী তারপর পা চালিয়ে এসে বাড়িতে ঢুকে প্রায় ছুটে কলতলায় চলে যায়।
বাথরুমে ঢুকে মাধবীর চোখের জল আর বাধা মানে না। হঠাৎই কেন প্রসূন এমন করে কথা বলল ওর সাথে। বাড়ি থেকে আর কতটুকু গঙ্গার ধার? শুধু ঘুরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয় বলে একটু সময় লাগে। এইটুকু পথ ভিজে কাপড়ে আসাটা কী অন্যায়?
অনেকটা চোখের জল ফেলে হাল্কা হয় মাধবী। মেয়ে তখন বাইরে থেকে ডাকছে মা খিদে পেয়েছে খুব। রঘুদা কচৌড়ী এনেছে খাব। তুমি এসো তাড়াতাড়ি।
মাধবীর রাগ হয় খুব এই বাড়িতে যেন ওর কোন নিজের জায়গা নেই সবার ইচ্ছে মেটাতেই ওর দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। হয়ত কোথাও ভগবান ওর হাত পা বেঁধে রেখেছেন, মানে বারবারই মনে হয় প্রসূন ওকে বিয়ে করে উদ্ধার করেছে। নাহলে অত কম বয়েসে বিধবা হয়ে জীবন কী করে কাটত কে জানে? তাই প্রসূন যা চেয়েছে তাই করে এসেছে এতদিন।
একটা সময় মা বাবার থেকে দূরে থেকেছে প্রসূন ও বললেও শোনেনি কখনও আর দেখা করতে আসেনি। হঠাৎই শ্বশুরমশাই ডাকলেন বাবা ছেলের মাঝের জমা থাকা বরফটা গলে গেল।
আর এখন প্রসূনের প্রতিনিধি হয়ে একটু একটু করে বুঝে নিয়েছে এ বাড়ির সবটা। কোন কিছুতেই মন ছোট না করে হাসিমুখে অভাব অভিযোগ সবটুকু মানিয়ে নিয়ে আছে। মেয়েরা হয়ত একটু ভালোবাসা পেলে এমন সংসারের পুতুল খেলায় নিজেও আজ্ঞাবাহী পুতুল হয়ে দিন কাটিয়ে দিতে পারে।
তবে আজ প্রসূনের ব্যবহারে খুব দুঃখ পেয়েছে মাধবী। সবটুকু অভিযোগ, দুঃখ আর অভিমান জল হয়ে ঝরে পড়ল।
মাধবী আশ্চর্য হয়ে গেল প্রসূনকে দেখে তেমন কিছু ভালো করে খেলেও না এমনকি মাধবীর মুখের দিকে ভালো করে তাকালও না। একবার একটু ভালো করে কথা বললেও হয়ত ওর অভিমানের পাথরটুকু সরে গিয়ে ফোকর দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকত। সবাইকে খেতে দিয়ে মাধবী রান্নাঘরে ঢোকে আজ দশমী মায়ের বিদায়ের দিন মাধবীর বুকেও যেন সেই বিষাদের ছোঁয়া। নিজের আর কিছু খেতে ইচ্ছেও করল না।
রান্না বসিয়ে বারবারই চোখ মুছল,ও খেলো কিনা তাতে কার কী এসে যায়? ও তো এখন প্রসূনের সংসারের কাজের লোক সারাদিন মুখ বুজে কাজ করে যাও।
আনমনা মাধবী বারবারই ডুবে যাচ্ছিল অভিমানে হঠাৎই ওর পিঠে একটা ছোঁওয়া পায়। ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে না ওর যদিও এই স্পর্শ ওর চেনা।
-" কী হয়েছে মাধু? মন খারাপ? গঙ্গা থেকে এসে একটাও কথা বললে না। আসলে ঐ ভীম সিং লোকটা এমন ভাবে তোমাকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল যে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। ভেজা কাপড়ে তোমার শরীরের স্পষ্ট ভাজগুলো উপভোগ করছিল লোকটা।"
মাধবী কানে আঙ্গুল দেয় হঠাৎই আর চিৎকার করে ওঠে," যে লোকটা মাঝে মাঝে বাড়িতে এসে আমার হাতে জল বা চা খেয়ে যায় তাকে দেখে এত অবাক হলে কেন? সে কী আমাকে নতুন দেখছে নাকি? বলতে পার মাঝে মাঝে কেন আসে লোকটা এখানে? কী চায় ও?"
-" চুপ কর মাধু বাবা শুনলে কষ্ট পাবেন। লোকটা এমনিতে খারাপ নয়। আমাদের দুঃসময়ে অনেকগুলো টাকা ধার নিয়েছেন বাবা। তাই হয়ত কিছু তুলতে আসেন।"
-" কত টাকা পাবে লোকটা? আমার যা টুকটাক গয়না আছে তা বিক্রি করে হবে না শোধ? মাথার ওপরে এত বোঝা নিয়ে আমি আর বাঁচতে পারছি না। তুমি বাড়িতে থাক না,রঘুদা এদিক ওদিক যায়। আমাকেই দরজা খুলতে হয় লোকটা এলে। তুমি আমাকে নিয়ে চল,আমি আর এখানে থাকব না। এত যখন মনের মাঝে সন্দেহ তোমার তাহলে আমাকে এখানে রেখে যাও কিভাবে?"
বৌমার এতটা উঁচু গলা শিবশংকর কোনদিন শোনেননি। তবে এই কয়েকমাসে এটুকু বুঝতে পেরেছেন যে অনেক কিছু সামলাতে পারে মেয়েটা। আর মেজাজও তার খুব কম নয় কারণ মনের অনেক রাগ মেয়েকে বকাঝকা করে উশুল করে।
এই তো সব স্নান করে এল গঙ্গা থেকে তারপর হল কী? এক পা দুপা করে নীচে যাবেন বলে পা বাড়ান। কিন্তু মাঝপথে রঘু বাধা দেয়," বাবু নীচে নামছেন কেন? কিছু লাগবে? আমি এনে দিচ্ছি।"
-" না না বৌমা হঠাৎই চেচামেচি করছে তাই ভাবছিলাম একটু দেখি।"
-" ওদের স্বামী স্ত্রীর কথাতে আমরা থেকে কী করব? কিছু হয়েছে আবার হয়ত মিটে যাবে।"
-" হ্যাঁ রে দিদিভাই কোথায়?"
-" ও পাশের বাড়িতে গেছে খেলতে। আমিই তো দিয়ে এলাম। খানিকটা বাদে নিয়ে আসব।"
প্রসূন ইশারায় মাধবীকে চুপ করতে বলে। তারপর বলে," বাবা শুনলে কষ্ট পাবেন। বাবা আর কদিন বল,বয়েস হয়েছে। বাবা তো এই বাড়ি ছাড়তে চান না। তোমার ঐ টুকটাক গয়না দিয়ে কিছু হবে না। আমি ঠিক করেছি এই বাড়িটা ভীম সিংকে বেচে দেব একটা সময়। সেভাবেই কথা হয়েছে। তারপর আমরা সবাই চলে যাব চাকরির জায়গায়।"
-" আর বাবা?"
-" এখনই নয়,পরে।"
মাধবী বুঝতে পারে বাবার অবর্তমানের কথা বলছে প্রসূন।
মাধবীর শুকনো ঠোঁটে কষ্ট মেশানো একটা হাসি খেলে যায়। "ওহ্ বুঝেছি তোমার কথা,তুমি সেই স্বপ্নই দেখো।"
-" এখন চুপ কর,দেখি সকাল থেকে তো কিছুই খাওনি। একটা মিস্টি মুখে দিয়ে জল খাও।"
এইটুকু ভালো কথাতেই মাধবী দুঃখে পাথর চাপা দেয়। প্রসূনের দিকে তাকায় চিন্তায় চিন্তায় আধখানা হয়ে গেছে মানুষটা। ওর হাত থেকে মিস্টিটা নিয়ে মুখে দিয়ে জল খায়। তারপর নিজেরই খারাপ লাগে যে পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ নেই তার সাথে মানিয়ে চলাই বুঝি ভালো। শুধু শুধু মাথা গরম করে কি হবে?
*********************
ভোরবেলা গঙ্গা মাইয়াতে ডুবকি না দিলে ভীম সিংহের দিন আচ্ছা কাটে না। আজ ছোটাবাবুর সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগল। বড়াবাবুকে অনেকদিন চেনে ভীম সিং যখন ওর কাছে টাকা ধার নিত তখনই ও ছক কষেছিল এই বাড়িটা ওরই হবে একটা সময়। কারণ সুদে আসলে এত টাকা হবে যে শোধ করতে পারবে না। তবে ছেলে যে হঠাৎই চলে আসবে তা ভাবেনি ভীম সিং এখন একটু একটু করে টাকা দিচ্ছে বড়াবাবু তবে খুবই কাতর অনুরোধ করে যে এই ঘটনা যেন বাড়ির বৌ জানতে না পারে।
কিন্তু ভীম সিং পাক্বা মহাজন সে প্রতি মাসেই একবার আসে। আগেও এসেছে এই বাড়িতে তবে এখন এসে চোখ জুড়িয়ে যায়। বাড়িটা বেশ সাফ সুতরো করে রাখা। উঠোনে তুলসীগাছ তাতে ধূপ জ্বলে। বাড়িতে ঢুকেই পায় ধুনোর গন্ধ। কখনও দেখে চৌকাঠে লক্ষ্মীর পা আঁকা।
নিজের বাড়ির কথা মনে হয় ভীম সিংয়ের সব আছে কিন্তু বাড়িটা যেন লক্ষ্মীছাড়া। ওর বৌ জানকী ছিল আধপাগলী। লুকিয়ে বড়লোকের মেয়েকে ওর ঘাড়ে চাপিয়েছিল ওরা। টাকার লোভে বিয়েও করেছিল ছোট বয়েসে। শরীরের সুখ যতটুকু মিটিয়েছিল তার ফসল হিসেবে হয়েছিল একটা বিটিয়া। সেই কবে তার বিয়ে হয়ে গেছে কানপুরে। বাবার বাড়ি সে মোটেই আসার সময় পায় না। জানকী একটা সময়ের পর আর কোন কাজ করত না এমনকি ভীমকে আসেপাশে ঘেষতে দিত না। বাইরের ঔরতের কাছেও গেছে ভীম শরীরের সুখ পেতে। কখনও গেছে বৈজুবাঈয়ের কোঠিতে গান শুনতে কিন্তু সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখা আর হল না ভীমের।
আজ ছোটবাবু কী সুন্দর বিবি বাচ্চাকে নিয়ে গঙ্গাতে ডুবকি দিতে এসেছে। সকাল সকাল লছমী দরশন হয়ে গেল ভীমের। বড়াবাবুর বাড়িতে অভাব হলেও সংসারটাকে বেঁধে দিয়েছে এই কয় মাহিনাতে ও মাধবী ভাবী। ভীম নামটা শুনেছে তবে জল বাতাসা ঘোমটা টেনে দিলেও কখনও কথা হয়নি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভীম এমন একটা সংসার যদি ওর হত। তারপরেই হাসি পায় নিজের বয়েসের কথা ভেবে কদিন বাদে ওর নাতনির শাদী হবে। ইচ্ছে করলে সংসার করতে পারত কিন্তু আর করা হয়নি। সারাদিন হিসাব কিতাব নিয়েই দিন কেটে যায়। বাড়িতে নোকর হরিয়া সব সামলায়। পাড়ার লোকেরা বলে ভীম লোকের রক্ত চোষে বলে ওর জীবনে সুখ নেই।
ঘরে ছিল পাগলী বৌ একটা সময় সেও মরে গেল। তবে বৌয়ের সম্পত্তি পেয়ে লাল হয়ে গেছে লোকটা।
ভীমের চোখে ভাসে মাধবীর আটোসাটো চেহারাটা। ওকে দেখে নিজেকে আড়াল করলেও ভীম চোখ ফেরাতে পারেনি। এই বাড়িতে এসে কত তকলিফে আছে বৌটা কে জানে?
আজ মায়ের বিসর্জন মেয়ের বায়নাতে প্রসূন আর রঘুদা দুজনেই ওকে নিয়ে গঙ্গার ঘাটে গেছিল। মাধবীর গত বছরের কথা মনে হল। মিতুলের মা আর পাড়ার বৌদের সাথে প্রতিবারই গ্ৰামের দুর্গামন্ডপে গিয়ে সিঁদুর খেলত মাধবী। এটা ওর কাছে একটা নেশার মত ছিল। কারণ যখন সিঁদুর মুছে শ্বশুরবাড়ি থেকে অপয়া বলে নানা কথা শুনেছিল তখন চোখ মুছেছিল দশমীর দিনে ভেবেছিল সিঁদুর খেলার দিন আর ওর জীবনে কখনও আসবে না।
প্রসূনের সঙ্গে যখন অনেক লড়াই করে ঘর বাঁধলো মাধবী তখন শুনেছিল ও নির্লজ্জ বেহায়া। ওর চরিত্রের দোষ আছে গ্ৰামের ভালোমানুষ ছেলেটাকে বিধবা হয়েও কেমন ভুলিয়ে নিলো। নিন্দুকেরা বলেছিল," আরে শরীর দিয়ে ভুলিয়েছে। কোন লজ্জা নেই কেমন বুক উচিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেখেছ? কখনও দেখেছো আঁচল দিয়ে শরীর ঢাকতে?"
মাধবীর আটোসাটো চেহারার নেশাতে মাততো ওর আগের স্বামীও। ভালোবেসে বলত আমার বৌটাকে যেন কেউ নজর না দেয়,তোমার বুকে মুখ ঢুকিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
লোকটা পাগলের মত আদর করত ওকে,কামড়ে আঁচড়ে শেষ করে দিত। কষ্ট হলেও স্বামীর আদরকে আগলে রাখত মাধবী,বাবার পছন্দের পাত্রকেই খুশিতে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু মাধবীর সেই আগলে রাখা ছোট্ট সুখ টুকুতেও নজর পড়েছিল বোধহয় সবার। তাই বেশিদিন ঘর করা হয়নি সেখানে। কারখানা থেকে ফেরার পথে রেল লাইন পেরোতে গিয়ে ওর প্রথম স্বামী আর ঘরে ফেরেনি। নেশা করত প্রায়ই,আর নেশা করলে কোন হুঁশ থাকত না। আবার সকালে উঠে একদম ঠিকঠাক হয়ে যেত। অনেক অশান্তি করত মাধবী কিন্তু শোধরাতে পারেনি পরে আদর করত আর হাতে পায়ে ধরত। বলত," রোজ তো খাই না,এখন একদমই কম করে দিয়েছি। ঐ মাঝে মাঝে কারখানার বন্ধুবান্ধবদের সাথে একটু। ওরা যে পেছনে লাগে বলে আমি বৌয়ের কথাতে উঠবোস করি।"
মাধবীকে শূন্য করে চলে গেছিল লোকটা। টাকা পয়সা তেমন কিছু জমানো ছিল না বড় সংসারে দিন আনি দিন খাই রোজের পাপক্ষয় ছিল। বিধবা হয়ে মাধবীর ঠাঁই হয়েছিল বাবার কাছে। বাবা প্রতিনিয়ত হা হুতাশ করত,তবে মরার আগে দেখতে পেয়েছিল মাধবী শ্বশুরবাড়ি না যেতে পারলেও নিজের একটা ঘর পেয়েছে। বরটা ভালো, ছেলেটা সবার বিপক্ষে গিয়ে বিয়ে করেছে মেয়েকে। পাড়া পড়শী বলেছিল," বাঁচা গেছে নাহলে কত ছেলের মাথা খেত ওর শরীর দেখিয়ে। দেখলে কে বলবে যে ভালো করে খেতে পেত না।"
সিঁদুর মুছে গিয়েও আবার রঙ ফিরে এসে ভরিয়ে দিয়েছিল মাধবীকে। প্রসূন ওর আগের স্বামীর মত পাগলের মত আঁচড়ে আদর না করলেও ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিল মাধবীকে। তাই আবার মাধবী যেত মা দুর্গার বরণে সিঁদুরের কৌটো থেকে যত্নে সিঁথি রাঙিয়ে লাল পাড়ের শাড়ি পরে। যখন ফিরত তখন নাকে,গালে সিঁদুরের লাল রঙের মাখামাখি। প্রসূন বলত," কী সুন্দর লাগছে তোমাকে! জান মাকেও এমন সুন্দর দেখতে লাগত বড় সিঁদুরের ফোটা কপালে। আমি বলতাম আমাকেও একটু রঙ মাখিয়ে দাও আমি লাল রঙ মাখব। মা গালে একটু লাল রঙ লাগিয়ে বলত এই নে দিলাম মাখিয়ে লাল রঙ। ছেলেরা সিঁদুর পরে নাকি? কী ভালো ছিল ছোটবেলার দিনগুলো।"
প্রসূন এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যায়,মাধবী হাতে বরণের থালাটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে যায়। হয়ত ওর জন্য সব এলোমেলো হয়ে গেল আর প্রসূন সব হারালো।
প্রসূন ওদের পাশের বাড়ি আসত। মাধবী তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকত,সবসময় ঘরে থাকতে দমবন্ধ হয়ে আসত। চোখে চোখে মিতালি প্রথমে তারপর প্রসূনের অভ্যেস হয়ে গেছিল ওদের বাড়ির সামনে এসে মাধবীকে খোঁজা। অনেক দিন দুষ্টুমি করে আড়াল থেকে দেখত পিপাসু দৃষ্টিতে কাকে যেন খুঁজছে প্রসূন। একটু একটু করে ভালোলাগা ভালোবাসাতে পরিণত হয়েছিল। মাধবী প্রসূনকে প্রশ্রয় দিয়েছিল হয়ত তখন নিজের নিরাপত্তাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল। লোকের কথা শুনে বাবা যখন বলেছিলেন," কী শুনছি এই সব? চারদিকে তো কান পাতা যাচ্ছে না। বিধবা হয়ে তুই কী করে বেড়াচ্ছিস এইসব?"
-" কী করেছি বাবা? ভালোবাসা কী অপরাধ? আঠেরো পেরোতে না পেরোতে পড়াশোনা ছাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দিলে এক মাতালের সাথে। তা সেখানেই ছিলাম সব মেনে নিয়ে,কিন্তু থাকতে পারলাম কই? আচ্ছা বাবা তুমি চলে গেলে এই একলা বাড়িতে আমি কী করব কী খাব ভেবেছ কখনও? এখনই তো খাওয়া জোটে না। সবাই তোমরা স্বার্থপর শুধু নিজেদের আর লোকের কথা ভাব।"
রাগ করে কদিন বাবার সাথে কথা বলেনি। প্রসূনের কাছে খুব কেঁদেছিল বলেছিল," আর এই বিধবাটার পেছনে ঘুরোনা। একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে কর।"
প্রসূনের তখন প্রেমের নেশা লেগেছে,চোখ আটকেছে মাধবীর চোখে। অনুভব করে মাধবীর স্পর্শ ওকে না দেখলে ভালো লাগে না।
তাই সবাইকে অবাক করেই লুকিয়ে বিয়ে করল দুজনে। মাধবী বুঝেছিল এই ভালোবাসা ফিরিয়ে দেবার সাধ্য ওর নেই। তবে বিয়ের পর ওর শ্বশুরবাড়ির লোকরা বাবাকেও ছাড়েনি। নানা কুকথা আর গালমন্দে অস্থির করে তুলেছিল। আর এখন তাঁদের প্রয়োজনে ওকে কাজে লাগিয়েছেন। কম বয়েসে ছেলেকে তাড়িয়েছিলেন এখন ছেলের দরকার তাই আকড়ে ধরেছেন। অবশ্য এইসব কথা প্রসূনকে বললে ও কষ্ট পাবে। বলবে আসলে সেই সময় আমি যা করেছিলাম তা মেনে নেওয়া তাঁদের পক্ষে কষ্টকর ছিল। হয়ত আমি বাবা হলে নিজেও কষ্ট পেতাম। জান মাধবী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মশাই সেই কবে বিধবা বিবাহ চালু করলেও এখনও আমরা সেই মধ্যযুগীয় মানসিকতায় পরে আছি। পরিবর্তন হওয়া দরকার মনের।
মাধবী মনে মনে ভেসে যায় অতীতের সুখ এবং দুঃখের স্মৃতিতে। এবার শাশুড়িমা মারা গেছেন ওদের কালাশৌচ চলছে তাই এবার আর মাকে বরণ করতে গেল না মাধবী। প্রসূন ঠিকই বলে আসলে আমরাই সংস্কারের বাইরে বেরোতে পারি না। মেয়েকে নিয়ে অনেকটা আগে বেরিয়েছে ওরা। প্রসূনের শরীরটা ভালো নয়,বেশি হাঁটলে হাঁপিয়ে যায়। তাই রঘুদাকে বলে দিয়েছে বারবার ওকে গঙ্গার ধারে মন্দিরের বারান্দায় বসিয়ে মেয়েকে নিয়ে ঠাকুর দেখায়।
মেয়েটা না থাকলে বাড়িটা শূন্যপুরী মনে হয়। দেখতে দেখতে মেয়েটাও বড় হচ্ছে। এইসময় একা মাধবীর পক্ষে ওকে সামলানো মুশকিল। অথচ প্রসূন বলে চাকরি না করলে খাব কী। মাধবী বেশি ভাবতে পারে না,মনটা ভারী হয়ে যায়। দূরে মন্দিরের ঘন্টা কানে আসে সন্ধ্যা লেগে আসছে। শ্বশুরমশাই বেশিরভাগই দোতলার ঘরে থাকেন। সেখান থেকে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে নাকি প্রশান্তি লাভ করেন।
সন্ধ্যের পর চা নিয়ে ওপরে দিয়ে আসবে। মাধবী সন্ধ্যে দেবার উদ্যোগ নেয়। মাথায় কাপড় দিয়ে প্রদীপ আর ধূপ জ্বালিয়ে হাতে নেয়। সারা বাড়িতে ঘুরিয়ে দেখাবে। আলো জ্বালিয়ে দেয় উঠোনের আর ঘরের।
হঠাৎই দরজার কড়াটা কর্কশ শব্দে নড়ে ওঠে। মাধবী বিরক্ত হয় এখন হাতে প্রদীপ নিয়ে ছুটতে হবে দরজা খুলতে। সাড়া দেয় আসছি বলে তারপর তুলসীতলায় ধূপ প্রদীপ রেখে যায় দরজা খুলতে।
দরজাটা খুলে হঠাৎই বুকটা কেঁপে ওঠে মাধবীর। তাড়াতাড়ি করে মাথায় ঘোমটা দেয়। লোকটা হাসে," ঘরমে কোই নেই মানে বড়াবাবু,ছোটাবাবু? আমি ভাবলাম আজ বিজয়া দশমী আছে একটু পেঁড়া দিয়ে আসি ও কুঞ্জ সাউয়ের দুকানের। বড়াবাবুর খুব পছন্দের এই পেঁড়া।"
মাধবীর রাগে শরীর জ্বলতে থাকে,নিশ্চয় লোকটা দেখেছে প্রসূন আর রঘুদাকে বেরোতে আর সেই সুযোগেই এসে হাজির হয়েছে। কী করবে এখন? লোকটাকে কী ঢুকতে দেবে? বাবা তো দোতলায়।
ও কিছু বলার আগেই লোকটা বলে," আরে ভাবি বড়াবাবু আছেন তো ঘরমে? বলুন ভীম এসেছে। আমি নমস্তে বলে মিঠাই দিয়েই চলে যাব।"
মাধবী কিছু না বলে ওপরের সিঁড়ির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে দেয়। লোকটা তার নাগরাই জুতো সিড়ির মুখে খুলে মাধবীর দিকে একটা হাসি ছড়িয়ে দিয়ে ওপরে উঠে যায়। ঠাকুর ঘরে এসে প্রদীপ ধূপ ঠাকুরের সামনে রেখে কেমন যেন হাঁফ ধরে যায় মাধবীর। লোকটাকে আগে ভালো লাগত না। তবে আজ প্রসূনের কথা শুনে কেমন যেন গা ঘিনঘিন করেছে। আবার কেন লোকটা এসেছে ঘরে? এই শহরটা ছেড়ে স্বামী আর মেয়ের হাত ধরে অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে করে মাধবীর।
ওপর থেকে শ্বশুরমশাই ডাকেন," বৌমা দুই কাপ চা দিয়ে যাও।"
মাধবীর পারব না বলতে ইচ্ছে করলেও পারে না চা বসায় স্টোভে। তারপর ভাবে আবার কী করে চা দিতে যাবে ওপরে?
আবার দরজার আওয়াজ পায়। বাইরে থেকে মেয়ের গলা পেয়ে ভালো লাগে মাধবীর। যাক ওরা তবে এসেছে। রঘুদাকে দিয়ে চা পাঠাবে ওপরে।
ওপরে নানা কথার ফাঁকে ভীমের চোখ দরজার দিকে চলে যায় হয়ত অপেক্ষা করে চায়ের। শিবশংকর বলেন," তুমি টাকার জন্য যখন তখন এসো না। আমি গিয়ে দিয়ে আসব।"
-" এ বাবু আপনি কেন তকলিফ করবেন। আমি তো আপনার লেড়কা মাফিক আছি।"
ভীম কল্পনা করে এই বাড়িটা ওর হবে। গঙ্গার ধারে এমন একটা বাড়ির ওর খুব শখ। ওর নিজের বাড়ি ও পেছনের দিকের গলিতে।
ওদের কথার মাঝেই রঘুদা চা আনে। রঘুদাকে দেখে মুখটা তেতো হয়ে যায় ভীমের। সকালে দেখা মাধবীকে আবার দেখা হল না কাছ থেকে,নাহ্ এখানে আসাটাই বেকার হয়ে গেল।
রঘুদাকে ওপরে পাঠিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয় মাধবী হঠাৎই কাঁদতে থাকে প্রসূনের বুকে মাথা দিয়ে। মায়ের কান্না দেখে অবাক হয়ে যায় পুতুল।
-" কী হয়েছে মা কাঁদছ কেন? বাবা মায়ের কী হয়েছে?"
প্রসূনের শরীরটা ভালো লাগছিল না বলে বাড়ি ফিরে এসেছে ওরা তাড়াতাড়ি। কিন্তু এর মধ্যে কী হল মাধবীর?
-" আমাকে তুমি এবার সঙ্গে নিয়ে যাবে আমি কিছু জানি না। আমি এখানে থাকব না এই বলে দিলাম। বাবা যদি না যান তবে রঘুদাকে নিয়ে থাকবেন। তুমি এসে মাঝেমধ্যে ঘুরে যাবে।"
-" কী হয়েছে বলবে তো? কেন এত কাঁদছ? আমার শরীরটা অস্থির করছে মাধু।"
-" ঐ লোকটা আবার এসেছে। আমি একা তখন বাড়িতে তোমরা কেউ নেই। আমার কেমন যেন ভয় আর ঘেন্না করছিল লোকটাকে দেখে।"
প্রসূন অবাক হয়ে যায় ভীম সিং কেন এসেছে এই সন্ধ্যেবেলাতে? কোথায় সে?
মাধবীকে বলতেই ও ওপরের দিকে হাত দেখিয়ে দেয়। প্রসূন বলে," মাধু দরজাটা খোল আমাকে কথা বলতে হবে যে লোকটা যেন এখানে বারবার না আসে। আমার কেন যেন ভালো লাগে না লোকটাকে। বিশেষ করে আজকের পরে। দেখি এখনি যাই ওপরে।"
মাধবী তাড়াতাড়ি প্রসূনের হাতটা চেপে ধরে," নাহ তুমি কিছু বলবে না। তাহলে কে জানে আমাদের কোন ক্ষতি করে দেবে কিনা? এইসব লোকের অনেক সাঙ্গপাঙ্গ আছে। আমাদের পুতুল স্কুলে যায়।"
-" অত সহজ নয় মাধু জীবনটা সিনেমা নয়। ছাড়ো আমাকে যেতে দাও।"
মাধবী তবুও ওর হাত ধরে থাকে। প্রসূন এক ঝটকায় ওর হাত ছাড়াতে যায়।
চা টা কেমন বিস্বাদ লাগে ভীম সিংয়ের আধা খেয়েই পা বাড়ায় সিঁড়ির দিকে। দেখে সিঁড়ির নীচে একপাশে বেঞ্চে রঘুদাকে বসে থাকতে। ভীমের চোখ এদিক ওদিক ঘোরে কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। রঘুদা ওকে তাড়াতাড়ি করে আইয়ে বলে দরজা খুলে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
প্রসূন বাইরে বেরিয়ে এসেছে ওর শরীরটা কেমন যেন কাঁপছে মাথায় যন্ত্রণা করছে। এত চিন্তা আর মানসিক চাপ ও নিতে পারছে না। কী করে শোধ করবে এত দেনা? এখন একটাই হয় বাড়িটা বেচে দিয়ে সবাই মিলে ওর চাকরির জায়গাতে চলে যাওয়া। কারণ দুটো সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছে প্রসূন তারপর প্রতি মাসে সুদের টাকা গোণা। কিন্তু বাবা কিছুতেই রাজি নন বাড়ি বিক্রী করতে। জীবনের শেষটুকু কাশীবাসী হয়েই কাটাতে চান। কী যে করবে? যাক সে ভাববে পরে। আপাততঃ ঐ লোকটাকে আজ কিছু কথা বলতেই হবে।
কিন্তু ওপরে ওঠার আগেই খবর পায় লোকটা চলে গেছে। ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে এসেছে মাধবী ওর আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে মেয়ে। পুতুল এখন মা বাবার মধ্যে হওয়া আলোচনা,রাগ,ঝগড়া সবই বোঝে।
মাকে বলে আস্তে আস্তে," মা তুমি যখন যাবে বাবার সাথে আমাকে নিয়ে যাবে তো?"
মেয়ের কথা শুনে কান্না পায় মাধবীর," তোকে নিয়ে যাব মা,তোকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে কী আমি থাকতে পারি? বোকা মেয়ে একটা।"
একটা অশান্তির ঝড় হয়ত উঠত কিন্তু উঠল না হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মাধবী। কিন্তু ঝড়ের দাপট এলে তা হয়ত থামিয়ে রাখা যায় না কারণ ভাগ্যের আকাশে তখন জমেছে মেঘ। সেই মেঘের কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেল ওদের ভাগ্য হঠাৎই।
রাতে প্রসূন খেতে চাইল না। মাধবী জোর করাতে হঠাৎই রাগ করল," আচ্ছা আমার কী কোন ইচ্ছে অনিচ্ছা নেই নাকি? আজ সত্যি খেতে ইচ্ছে করছে না। শরীরটা খুব খারাপ লাগছে।"
মাধবীর মনটা খারাপ হয়ে যায় কোনরকমে দুটো ভাত নিয়ে বসলেও গলা দিয়ে নামতে চায় না তা। রান্নাঘর সামলে বাসন মেজে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বেশ কিছুটা দেরি হয়ে যায়। বাইরের কাজ রঘুদা সামলালেও বাসন মাজাটা মাধবী নিজেই করে। কেন যেন বাধো বাধো লাগে। প্রসূন অনেক আগে থেকে বিছানায়,বলছিল মাথা যন্ত্রণা করছে।
মাধবীর খারাপ লাগে তখন গঙ্গা থেকে আসার পর ওকে ওভাবে না বললেই হত। হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল প্রসূন। তাই হয়ত শরীর আর মন কিছু ভালো নেই।
মাঝ রাত থেকে হঠাৎই ধুম জ্বর আসে প্রসূনের। কী করবে ভেবে পায় না মাধবী। তাড়াতাড়ি করে জল এনে জলপটি দিতে শুরু করে। ঘরে তো ওষুধপত্র তেমন কিছুই নেই। প্রসূন জ্বরে অচৈতন্য হয়ে শুয়ে থাকে। মাধবী বারবার জানলার ফাঁক দিয়ে আসা আলোর জন্য অপেক্ষা করে। একটু আলো ফুটলেই ও রঘুদাকে ডাকবে। যদি কোন ডাক্তার ডেকে আনতে পারে রঘুদা। কিন্তু ঘরে তো তেমন টাকাও নেই প্রসূন ওকে হাতে করে যা এনে দিয়েছিল তার অনেকটাই খরচ হয়ে গেছে পুজোর কদিন একটু ভালোমন্দ খেতে। বাধা দিলেও শোনেনি প্রসূন সবার জন্য টুকটাক জামাকাপড় কিনেছিল মেয়েকে কিনে দিয়েছিল পুতুল আর খেলনা।
মাধবীর চোখ ছলছল করে,বারবারই চোখ মোছে আর প্রসূনের তাপ মাপে। মেয়েটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। প্রসূন জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে মাকে ডাকে। মাধবী ওকে ডাকে ফেরাতে চায় ওকে জ্ঞানে। হঠাৎ কেন মাকে ডাকছে প্রসূন? মাকে স্মরণ করে মাধবী দেখো যেন তোমার ছেলের কোন ক্ষতি না হয়। তুমি যেখানেই থাকো ভালো থেকো। সেতো কম করেনি তোমার জন্য শেষবেলায়। আমাদের কী দোষ ছিল বল?
প্রসূন আবার বলতে থাকে," মাধু তুমি আর গঙ্গাতে যেয়ো না। ঐ লোকটা ভালো না ওকে আমি আর ঢুকতে দেব না।"
মাধবী ওর গরম শরীরে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে," চুপ কর তুমি। এই তো আমি তোমার কাছে আমার কিছু হবে না।"
ভোরের দিকে প্রসূন একটু শান্ত হয়। মাধবীর শরীর মন ভেঙে আসে সারা রাতের উৎকন্ঠায়। দরজা খুলে বাইরে এসে রঘুদাকে ডাকে," রঘুদা একটু ওঠ তোমার দাদাবাবুর খুব জ্বর। আমার একটুও ভালো লাগছে না। তুমি ডাক্তার ডাকো তাড়াতাড়ি।"
ধড়ফড়িয়ে ওঠে রঘু বলে," আমাকে কেন ডাকনি রাতে বৌমণি? দেখি দেখি চল। কাল বারবারই বলছিল রঘুদা শরীরটা যেন আর টানতে পারছে না। চল বাড়ি চল,কিন্তু মেয়ের বায়নাতে রইল বসে ঘাটের পাশের বাড়িটার উঠোনে। তারপর তো চলে এলাম তাড়াতাড়ি।"
-" আমাকে তো তোমরা কিছুই বল না আসলে আমি তো কেউ নই। ওসব কথা থাক এখন তাড়াতাড়ি যাও ডাক্তার দেখ।"
-" কাছাকাছি কোন বড় ডাক্তার নেই একজন বাঙালী হোমিওপ্যাথি ডাক্তার আছে তাকে ডাকি? আর আছে বিহারী কবিরাজ,তার ওপর আমার ভরসা নেই।"
-" তাই ডাক রঘুদা এখনও ভালো জ্বর আছে। যদিও ঘুমোচ্ছে অঘোরে। আচ্ছা জ্বরের কোন ওষুধ পাওয়া যাবে? দেখ না রঘুদা।"
কথা বলতে বলতে মাধবী কাঁদতে থাকে। রঘুদা দেখছি বলে ছুটে যায় বাইরে।
ভোরবেলা গঙ্গামাইয়া দর্শন ওখানে একটু কসরত করে একেবারে ডুবকি দিয়ে আসে ভীম সিং। রঘুকে পাগলের মত ছুটতে দেখে থমকে দাঁড়ায়," রঘু ভাইয়া ইতনা শুভে মে,ঘরমে সব ঠিক হ্যায় না?"
গতকাল এই লোকটাকে নিয়ে অশান্তির কিছু কথা রঘুর কানেও গেছে। উঃ এই লোকটাকেই দেখল সকাল সকাল,এর কী কোন কাজ নেই?
রঘু হাত নাড়ে বলে," কাম হ্যায় অব। বাদমে বাত করব।"
ভীমের তীক্ষ্ম নজর বলে দেয় বাড়িতে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। তাহলে কী বড়াবাবুর কিছু হল নাকি? বাড়িটা যত তাড়াতাড়ি খালি হয়ে যায় ততই ভালো। তারপর মনে হয় যতদিন বড়বাবু আছে ততদিন ঐ ভাবি আর ওর লেড়কি আছে এখানে দেখভালের জন্য। কেন যেন ভাবিকে বারবারই দেখতে ইচ্ছে করে ভীমের। কোঠিবাড়িতে গিয়ে ঔরতের কাছে রাত গুজরান করেও এত সুখ পায় না ভীম। বয়স হচ্ছে এখন ঐসব বাজে কাম ছেড়ে বাকি জীবনটা গঙ্গামায়ের দর্শন করে কাটাবে। তবে এমন যদি একটা লছমী ওর কাছে থাকত তবে ওর জীবন শুধরে যেত।
এমন ভরভরন্ত জোয়ানী ছেড়ে ও ছোটাবাবু কলকাত্তা থাকে কী করে কে জানে?
গঙ্গার ধারে বসে উদাস হয়ে যায় ভীম। বাড়িটা পেলে কিছুদিন নিজে থাকবে সেখানে। দোতলায় চেয়ার লাগিয়ে গঙ্গা মাইয়াকে দেখবে। তারপর বাড়িটাকে ভেঙে একটা ছোটামোটা হোটেল করবে। বহত বিদেশী আদমী আসে থাকতে চায় ঘাটের পাশের হোটেলে। আজব শখ এই সাহেব মেমসাহেবদের ফটো খিচতে আসে ঘাটের। কী আছে এই ঘাটে ওরাই জানে? চারপাশে পুরানা কিছু হাভেলী আর তাতে কবুতরের ঘর। তবে এই ঘাট তো নেশাতে বেঁধেছে ওকে ছোট থেকে কত স্মৃতি এই ঘাটের সাথে জড়িয়ে। তখন গঙ্গাতে কত ঢেউ ছিল তবুও এপার ওপার হতে পারত সাঁতরে। গঙ্গার পারে সময় কাটাতে ওর ভালো লাগে অবশ্য ইচ্ছে করলেই গঙ্গাতে ভাসতে পারে অনেকটা সময়। এই গঙ্গাতে ভাড়া খাটে ওর দুটো নৌকা একটা ছোটামোটা বজরা ভী আছে।
সাধারণ আদমীরা এত ভাড়া দিয়ে চাপতে চায় না তবে রহিস আদমী আর ও সাহাব মেমসাহেবদের অনেক সময় পছন্দ হয় এই বজরা। ছাদে বসে কেউ কেউ ছবি আঁকে আবার কেউ গঙ্গার ওপরে ভাসতে ভাসতেই ফূর্তি করে। কথাটা ভেবে এই বয়সেও শরীর গরম হয়ে ওঠে ভীমের। সেই ফূর্তির কত নিশান দেখেছে ও নিজের চোখে তারপর মাঝিকে বলেছে," আরে আদমীলোগ জানে কে বাদ ইশকো সাফা রাখো। ইয়ে ক্যায় হাল বানায়া। আগে একটা সময় ও নিজেও ভেবেছে এখানে গঙ্গা মাইয়ার ওপর ভেসে তারপরই নিজেকে শাসন করেছে। আসলে জানকীটা তো কোনদিন ওকে সুখ দিতে পারেনি শুধু দিয়েছিল একটা বিটিয়া। কবে তার বিয়ে হয়ে গেছে,মা নেই বাবা ছন্নছাড়া সে তাই আর আসে না তেমন একটা। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সাথে মানিয়ে সে বেশ আছে আর এখন তো নিজেই বেটির বিয়ে দেবে।
জানকীর শরীর খারাপ দেখে ছোটা উমরে শাদী দিয়েছিল আর ও ভী ছোটা উমরেই লড়কীর শাদী দেবে। তবে মেয়ের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যে ত্রুটি রাখেনি ভীম। টাকা পয়সা মিঠাই পাঠিয়ে দেয় সব অনুষ্ঠানে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভীম কখনও কারও ভালোবাসা পেল না জীবনে। ও নিজেও চিনেছে রূপিয়া আর ওর সাথে তারই সম্পর্ক মানুষের। শুধু ওকে দেখলেই লোকে চমকে ওঠে বলে দিন খারাপ যাবে।
যেমন সকালে রঘুদা চমকে উঠেছিল। পারে বসে ডন বৈঠক দিয়ে তেল মালিশ করিয়ে গঙ্গাতে ডুবকি দিয়ে ভীম আবার ভাবে কী হল বড়াবাবুর বাড়িতে?
রঘু অনেকটা অপেক্ষা করে পাড়ার হোমিওপ্যাথি ডাক্তারকে ধরে নিয়ে আসে। তবুও অনেক টাকার বিনিময়ে আসতে রাজি হয় ডাক্তার,নাহলে এই ভোরের ঘুম নষ্ট করে কে আসে?
কাজ করতে গিয়ে হাত কাঁপে মাধবীর। ততক্ষণে শিবশংকর উঠে পড়েছেন ছেলের শরীর খারাপ দেখে বুকটা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে তাঁর। হে ভগবান কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছ আমাকে মনে মনে বলেন।
মাধবীকে বলেন," ওকে তুলে একটু কিছু খাবার দাও। কাল রাতে কিছু না খেয়ে শুয়ে পড়েছে। বরং একটু সাবু জ্বাল দাও। ছেলেটাকে খাওয়াও।"
মাধবী রান্নাঘরে যায় স্টোভে দুধ বসায়। শিবশংকর ছেলের মাথায় আস্তে আস্তে হাত বোলান। বুকে হাত রাখেন,কী চেহারা হয়েছে ছেলেটার!
রঘুদা ডাক্তার নিয়ে ঢোকে। স্টেথোস্কোপ দিয়ে একটু দেখে আর নাড়ি দেখে বুঝতে পারেন ডাক্তার এই রোগী তাঁর হাতের বাইরে। বেশী ভুগিয়ে ভুগিয়ে পয়সা আদায় করে লাভ নেই। তার চেয়ে বরং হসপিটালে দেবার কথা বলে দেওয়াই ভালো।
-" শুনুন অবস্থা ভালো বুঝছি না। ওনার কী কাশিতে রক্ত পড়ে? আমার মনে হচ্ছে রোগ উনি বেশ অনেক দিন চেপে আছেন। খাওয়াদাওয়া না করে শরীরের অবস্থা কাহিল। আমি কতগুলো পুরিয়া দিচ্ছি,এগুলো আধঘণ্টা পরপর খাওয়াবেন তাহলে জ্বরটা কমবে। তবে বাড়িতে না রেখে হসপিটালে দেওয়া ভালো।"
মাধবী নিজেকে সামলাতে পারে না একদম ভেঙে পড়ে। কী হবে এটা ভেবেই মাথা ঘুরে যায় শাশুড়ির ঘরে ঢুকে ফটোর সামনে আছড়ে পড়ে," আমি জানি না তোমার কী ক্ষতি করেছি। আমাকে শাস্তি দিতে তোমার ছেলের ক্ষতি কোর না। ওকে ভালো করে দাও মা।"
গলিপথে গাড়ি ঢোকে না এখান থেকে প্রসূনকে নিয়ে হসপিটালে ভর্তি করা সহজ ছিল না। পাড়ার লোকদের সাহায্যে আর ভীম সিংয়ের ঠিক করা লোকদের সাহায্যে কোনরকমে ঠেলাতে প্রসূনকে তুলে গলি পার করে বড় রাস্তায় আনা হল। মাধবীর ঘোমটা খসে পড়েছে। মেয়েকে অনেক বুঝিয়ে শ্বশুরমশাইয়ের কাছে রেখে সে হসপিটালে যায় রঘুদাকে নিয়ে। যাবার সময় ঐ লোকটাকে আবার দেখল মাধবী। আজ প্রসূন অসুস্থ ও দেখতেও পাচ্ছে না ওর মাধুর ঘোমটা সরে গেছে,শাড়ি এলোমেলো। মাধবী শোনে লোকটা রঘুদাকে বলছে," কোই চিন্তা নেই যা তকলিফ হবে আমাকে বলে দিবে। আমি আছি সবসময়।"
পাশের উমির মা মাধবীকে বলে," ভরসা রাখো বহেন। বাবা বিশ্বনাথ সব ঠিক কর দেগা।"
কিন্তু যমের সাথে লড়াইয়ে হার মানলেন বাবা বিশ্বনাথও। মাধবী আর রঘুদার পাঁচদিন লড়াইয়ের পরও প্রসূনকে বাঁচানো গেল না। আর চোখই মেলল না প্রসূন। মাধবী অবাক হয়ে গেল দেখে মানুষটার কী একবারও মনে পড়ল না তার আর মেয়ের কথা। মা মা করে শেষে মায়ের কোলেই চলে গেল। এত যদি মাকে ভালোবাসতে তাহলে আমাকে ঘরে এনেছিলে কেন? পাগলের মত হয়ে গিয়ে মাধবী শাপশাপান্ত করে সবাইকে। পুতুল মায়ের রূপ দেখে কাছে আসতে ভয় পায়। শিবশংকর অনেক ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে ঘুম পাড়ান। চোখের জল শুকনো হয়ে গালে বসে,দাদুর কোলের কাছে ঘুমিয়ে পড়ে পুতুল। বৃষ্টির জলে ভিজে যায় তার যত্নে সাজানো পুতুলের সংসার। সেদিকে এখন মা আর মেয়ে কারও লক্ষ্য নেই অথচ একটা সময় মা মেয়ে কত ছাদে বসে পুতুলদের সংসার গুছিয়ে সব ভুলে থাকত।
বুকে পাথর বেঁধে শিবশংকর ছেলের কাজ করার উদ্যোগ নেন। মাধবীর তো কোনদিকে খেয়ালই নেই,সারাদিন হয় কাঁদছে নাহয় চুপ করে বসে থাকছে। রঘুদা যেমন তেমন কিছু করে মুখের সামনে ধরে ওর তাতেও সব পড়ে থাকে। পাশের বাড়ির উমির মা এসে কোনরকমে শাড়ি কাপড় পরিয়ে সামলায় ওকে বুকে জড়িয়ে। অনেকটা কান্না কেঁদে হাল্কা হয় মাধবী বারবারই বিলাপ করে বলে এই কাশীতে আসাই ওদের কাল হয়েছে দিব্যি তো ছিল কলকাতায়। কাশী ওদের সর্বনাশ করেছে মাধবী আজকাল তোয়াক্কা করে না শিবশংকরকেও চিৎকার করে বলে," যখন আমরা গিয়ে হাতে পায়ে ধরেছিলাম তখন আমাদের তাড়িয়ে দিয়ে নিজেদের দরকারে ছেলেকে ডাকলেন। দিনের পর দিন মায়ের সেবা করে সে মায়ের হাত ধরে স্বর্গে চলে গেল। এখন আমাদের কী হবে বলতে পারেন? কী করে বড় করব আমি মেয়েকে? আমি তো তেমন পড়াশোনাও জানি না।"
মাধবীর এই প্রশ্নের কোন উত্তর শিবশংকরের কাছে নেই। আজকাল তিনি যে কী অবস্থাতে কাটাচ্ছেন তা হয়ত ভগবানও জানেন না। এই পৃথিবীতে সব চেয়ে বড় শোক সন্তান শোক। আরতি চলে গেলে ছেলেটার সংসার আর নাতনিকে নিয়ে ছিলেন। এখন তিনি কী করবেন? দেশের বাড়ির সব বিক্রি করেছিলেন একটু করে। কিছু সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছিল,লোকে দখল করে নিয়েছিল সুযোগ পেয়ে। আর সেসব এত বছরে একটু একটু করে নিঃশেষ করে বড় ঋণের বোঝা ঘাড়ে নিয়েছেন। ছেলেটার পাঠানো টাকা থেকে কিছু কিছু করে টাকা শোধ করছিলেন। এখন তো আর সেই পথও বন্ধ হল। দিদিভাইকে স্কুলে পাঠানো বড় করা। চারটে মানুষের খাবার জোগাড় সব কী করে হবে?
শুধু বলে ওঠেন," এরপর হয়ত আমাকেই বিষ খেতে হবে বৌমা। এই বিষবৃক্ষ তো আমারই লাগানো। সত্যি তখন যদি তোমাদের মেনে নিতাম আজ গ্ৰামেই ভালো থাকতাম আমরা। জমির ফসলে দিন কাটত ভালো করে। সব দোষ আমার আমি স্বীকার করছি আমার মৃত্যু ছাড়া কোন পথ নেই।"
-" আরে বড়াবাবু এসব কী বলছেন আপনার নিজের লেড়কা নেই তো কী আছে? আমি ভীম তো আছি। আমি থাকতে আমাদের কাশীতে আপনার মত উঁচু বংশের আদমী ও আত্মহত্যা করবে! আমার টাকা এখন কিছু দিতে হবে না। বরং ও রঘুদাকে আমি কিছু কাম দেব,ও কিছু কামাই করবে আর আমি আপনাদের যা লাগে তা ভেজ দেব।"
মাধবী ঘরের তক্তপোষে শুয়ে ছিল। হঠাৎই সেখান থেকে লাফ দিয়ে উঠে আসে এই কদিন অনেক বার এই লোকটা এসেছে এখানে। ওর টাকা ওরা নেবে কেন? ঐ মানুষটাই প্রসূনকে মেরেছে। সকাল থেকেই প্রসূনের মন খারাপ ছিল।
-" আপনি এখান থেকে যান। কেন আসেন এখানে? আমরা দরকারে সবাই বিষ খাব। বাবা বিশ্বনাথ যদি তা চান তাই হবে। আপনাকে কোন টাকা দিতে হবে না।"
উত্তেজনায় মাধবীর মাথার ঘোমটা খুলে পড়েছে। চুলের খোঁপা খুলে তা এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। ভাবিকে এমনভাবে এর আগে দেখেনি ভীম। সফেদ কাপড়াতে ভী খুবসুরত। কতই বা উমর হবে ভাবীর হয়ত পঁয়ত্রিশ। তবে তেজ বহত আছে। অবশ্য এমন তেজ দেখতে ভালো লাগে ভীমের। কিন্তু কতদিন রাখতে পারবে এমন তেজ?
নিজেকে শান্ত করে ভীম একটু একটু করে এগোতে হবে তাড়াহুড়ো করলে হবে না তাই বলে," মরনা ইতনা ও কী বলে মানে সোজা বাত নেই ভাবি। আত্মহত্যা বড় পাপ। আর ও আপনার গুড়িয়ার দিকে তাকিয়েছেন? ওর কী হবে? বেচারি লড়কি শুখ গয়া একদম। কুছ বাত ভী নহি করতী। আচ্ছা রঘুদা এসব সামান রাখ লো আমি আসছি এখন যদি কিছু লাগে খবর করবেন।"
অভাবের সংসারে বাড়তি পাওয়া ফল,আতপ চাল,মিস্টি,ডাল আর সব্জি যত্নে তুলতে যায় রঘুদা। হঠাৎই মাধবী এসে ওগুলো এলোমেলো করে ছুঁড়ে ফেলে,"রঘুদা এগুলো তুলবে না এক্ষুনি ফেলে দাও দূর করে। ঐ অশুভ লোকটাই আমাদের বাড়িটাকে খেলো। ওর জন্য আজ তোমাদের দাদাবাবু আর নেই।"
মাধবীর অগ্নিমূর্তি দেখে ভয় পায় রঘু। একটু থেমে আবার জিনিসগুলো এক জায়গায় করে তারপর বলে," বৌদিমণি এসব হবিষ্যির জিনিস ফেলতে নেই।"
-" কী বলছ তুমি এই দিয়ে তোমরা দাদাবাবুকে খেতে দেবে নাকি? আমি বেঁচে থাকতে তা কিছুতেই হতে দেব না।"
-" ওগুলো দাদাবাবুকে দিতে হবে না আমিই খাব। আমারও তো পেটে কিছু দিতে হবে নাকি?"
রঘুদার কথা শুনে হঠাৎই চুপ করে যায় মাধবী। রঘুদা ওদের অনেক পুরোনো কাজের লোক ছোটবেলায় এসেছিল বাবার হাত ধরে তারপর আর বিয়ে থা করা হয়নি,রয়ে গেছে শিবশংকরের বিশ্বস্ত অনুচর হয়ে এই বাড়িতেই। নিঃশব্দে এ বাড়ির প্রতিটা অভাব অনটন দুঃখ কষ্ট সয়ে সারাদিন কাটায়। কে জানে এই কদিন ওরা কী খেয়েছে? মেয়েটাও তো আজকাল ওপরেই থাকে দাদুর কাছে। মাধবীর এই সাজ দেখে ভয় পায় কাছে আসতে চায় না। রঘুদা কী করে সব সামলাচ্ছে কে জানে? মাধবী তো কিছুই করেনি এই সাতদিন কোনদিকে তাকায়ওনি।
রঘুদার ছোট্ট কটা কথা মাধবীকে বাস্তবে ফেরায়। কে যেন বলে যায় কানে কানে মাধু এই তো তোমার পরীক্ষা শুরু এবার তোমাকে শক্ত হতে হবে।
বাড়িতে পাড়া প্রতিবেশী আসছে মাঝেমাঝেই। পাশের বাড়ির উমির মা পুতুলকে নিয়ে চলে যায়,অনেকটা সময় ওখানে থেকে আসে পুতুল। তারই ফাঁকে কখনও মাধবীর এলোমেলো ঘরটাকে একটু গুছিয়ে ওকে বুঝিয়ে মাথায় একটা এলো খোঁপা বেঁধে যায়।
শিবশংকরকে উমির বাবা বলেছেন প্রসূনের স্কুলে জানাতে। ওখান থেকে কিছু টাকা পয়সা তো পাবেই তারপর যদি মাধবীর একটা চাকরি আর পেনসন হয়ে যায় তাহলে কোন অসুবিধাই থাকবে না।
প্রসূনের মৃত্যু সংবাদ গ্ৰামে গিয়ে পৌঁছলে সবাই অবাক হয়ে যায়। মিতুলের মা কেঁদে ফেলে," হ্যাঁ গো মাধবী এবার কী করবে? ওর শ্বশুরের তো নাকি কিছুই নেই। যা প্রসূনদা পাঠাত তাতেই চলত। ওর একটা চাকরি হবে তুমি খোঁজ নিয়ো তো? আর পেনসন?"
-" আমি খবর নিয়েছি বুঝলে ওদের হেডমাস্টার মশাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। প্রসূনের এখন নাকি মাত্র আট বছর চাকরি হয়েছে। তাই ওরা খোঁজ নিচ্ছে কী পাবে মাধবী? তবে যথেষ্ট চেষ্টা ওঁরা করবেন। কিছু টাকা পয়সা হয়ত পাবে এখন। তবে বৌদিকে তো একবার এখানে আসতে হবে।"
মিতুলের মা মাধবীকে চিঠি লেখে সব জানিয়ে। চিঠি লিখতে লিখতে বারবারই জল গড়িয়ে পড়ছিল চোখ বেয়ে। কতদিন বা ওদের বিয়ে হয়েছে? ঐ টুকু একটা মেয়ে এখন দিন কাটবে কী করে? অথচ এখানে থাকতে ভালোই ছিল,হয়ত প্রাচুর্য ছিল না তবে সুখটুকু ছিল। মেয়েদের পুতুল খেলার দিনগুলো খুব মনে পড়ল। খুব সুন্দর পুতুল বানাত মাধবী ছেঁড়া ধুতি আর কাপড় দিয়ে। ঐ নিয়েই মেয়েরা ভুলে থাকত।
মাধবী একটু একটু করে নিজেকে সামলে কোন রকমে প্রসূনের শেষ কাজটুকু সেরেছে। বেনারসে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে শ্রাদ্ধ করে বাড়িতে শান্তি জল ছিটিয়ে আর এগারোজন ব্রাম্ভণ ভোজন করিয়ে অশৌচ মুক্তি হয়েছে। আসেপাশের লোকেরা তাই বলেছিল শিবশংকরকে। রঘুর কাছে খোঁজ নিয়েছিল ভীম রঘু তাকে বারবারই বারণ করেছে বাড়িতে আসতে বলেছে," আমার সাথে তো দেখা হয় মাঝেমাঝেই বাবু কিছু দিলে বা আপনার কোন দরকার থাকলে আমি বলে দেব। বৌদিমণির শরীর মন কিছু ভালো নেই রাগারাগি করে খুব।"
-" আচ্ছা আচ্ছা আমি যাব না। তা ভাবি এখন ঠিক আছে তো? বেচারী ভাবি ইশ উমরমে সব খো গয়ি..."
রঘু তাড়াতাড়ি সামনের দিকে পা বাড়িয়েছিল তবুও ভালো বৌদিমণির আগের ঘটনা এখানকার লোকজন জানে না। ওরা কোনদিনই এখানকার লোকজনকে জানতে দেয়নি যে কী কারণে ছেলের বিয়েকে ওরা মেনে নেননি। বা ছেলে আসে না কেন?
স্কুলের পাঠানো চিঠিটা আসার পর মিতুলের মায়ের চিঠি আসে। মাধবী আবার কাঁদে চোখের জল ফেলে অনেকটা হাল্কা হয়। তবে এভাবে কী হাল্কা হওয়া যায়?
তারপর একটা সময় উঠে শাড়িটা ঠিক করে মুখেচোখে জলের ঝাপটা দেয়। উমির মা জোর করে একটা ছাপা শাড়ি এনে পরিয়ে দিয়েছিল নিয়মভঙ্গের দিন বলেছিল," বহত হো গয়া অব লড়কিকে লিয়ে জীনা হোগা।"
পুতুল জানে বাবা নেই তারাদের দেশে চলে গেছে। আর কোনদিনই সুন্দর পুতুল আর জামা কিনে ওর কাছে আসবে না। বলবে না," ওরে এবার রুদ্রাণী হয়ে ওঠ মা। আর কতদিন পুতুল খেলবি? সব তোর মায়ের জন্য। গাদা গাদা পুতুল বানাচ্ছে নিজেও খেলছে আর মেয়েকেও খেলতে দিয়েছে।"
মা বলত কোমরে আঁচল জড়িয়ে," আমার সারাদিন কত কাজ থাকে তুমি জান? মেয়েকে কে সামলাবে? ওর সংসারে ও ভুলে থাকে আমি সেই ফাঁকে কাজ করি।"
দাদুর কাছে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে পুতুল। মায়ের সামনে কাঁদতে দাদু বারণ করেছেন। তবে দাদু বলেছেন," দিদি মায়ের কাছে গিয়ে এবার শোও। মাকে বলবে আমি তো আছি তোমার সব দুঃখ মুছিয়ে দেব।"
নাতনিকে বুঝিয়ে নিজের বুকে হাত দিয়ে সামলান নিজেকে। সব শোক সামলে যে বুকে পাষাণের ভার। এই ভার বয়ে আর সয়ে তিনি বাঁচবেন কেমন করে?
তারপরেই নিজেকে সংযত করেন তাঁকে যে বাঁচতেই হবে নাহলে বৌমা আর দিদিভাইকে কে দেখবে? কিছু না করতে পারলেও বটগাছের মত শাখা প্রশাখা দিয়ে আড়াল করে রেখেছেন ওদের।
************************
খুব কষ্টে টেনেটুনে সংসার চলছে ওদের। শিবশংকরের আর মাধবীর বারণ সত্ত্বেও রঘু ভীম সিংয়ের গোলাতে কাজ করতে যায়। এই পরিবারের প্রতি যে তার অনেক কৃতজ্ঞতা। এই পরিবারের টাকাতেই একটা সময় তার মা বাবা খেতে পরতে পেত। এত বছর এই বাড়িতে থেকে নিজেকে এই পরিবারের সদস্য বলেই মনে করে ও। শিবশংকরের পায়ের কাছে বসে বলে," বাবু আমিও তো আপনার ছেলে নাকি? দাদাবাবু থাকলে যা করত তা তো করতে পারব না। তবুও যদি একটু কিছু করতে পারি।"
শিবশংকরের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে শুধু বলতে পারেন না," তুই হয়ত প্রসূনের চেয়েও বেশি জড়িয়ে ছিলি আমাকে। আমি তোকে কিছু দিতে পারিনি।"
রঘুর মাইনে ছাড়াও ভীমের কাছে মাঝেমাঝে টাকা বাড়তি ধার করে। মেয়েটার স্কুলের খরচ চালানো সংসারের খরচ চালানো সবই তো করতে হয়। বৌদিমণির গয়নাগুলো একটা একটা করে চলে যাচ্ছে এই করে। থাকার মধ্যে আছে শুধু ঐ বালা জোড়া। সেদিন চোখ মুছে বলেছিল," রঘুদা এটা আমি কিছুতেই বেচতে পারব না। এ আমার পুতুলের থাকবে। মায়ের দেওয়া একমাত্র চিহ্ন এটা। আচ্ছা কবে ওর স্কুল থেকে খবর আসবে বল তো? কিছু টাকা তো আমাদের পাওনা। যদি আমার একটা কাজ হয়ে যেত। তাহলে আর কোন কষ্ট হত না..আচ্ছা রঘুদা এখানে কোন কাজ পাওয়া যায় না? আমি তো পুতুল বানাতে পারি।"
কথা বলতে বলতে চোখটা চকচক করে মাধবীর।
-" আমি খোঁজ করছি কোন কাজ নেই। আর তুমি গেলে বাইরে মেয়েকে কে দেখবে? চিঠি এলে স্কুল থেকে তোমাকে তো যেতে হবে সেখানে।"
কত আশা নিয়ে পা রেখেছিল কাশীতে ভেবেছিল এখানকার কাজ সারা হলে ফিরে যাবে আবার। ওদের বাড়ি ভাড়াটা ছেড়ে দিতে বলেছিল মিতুলের মাকে। অনেক জিনিসই নষ্ট হয়েছে আর কিছু জিনিস আছে মিতুলদের বাড়িতে। সেখানে ফিরে যাবার কথা ভাবতেই মাধবীর বুকটা কেঁপে ওঠে। প্রসূনের সাথে ছাড়া কখনও কোথাও যেত না মাধবী একদম আটপৌরে গৃহবধূ ছিল। সেখানে এই বৈধব্য বেশে কী করে দাঁড়াবে?
তবে সত্যি যখন চিঠি এল টাকা পয়সা কিছু পাওয়া যাবে তখন মাধবীকে যেতেই হবে এমনটাই ঠিক হল। কিন্তু কার সাথে পাঠাবেন শিবশংকর বৌমাকে? পুতুলকে রেখে যাবে ভাবল মাধবী কিন্তু সেও কান্নাকাটি করে অস্থির মাকে ছাড়া সে থাকবে না।
শেষে ঠিক হল শিবশংকরের কদিন দেখভাল পাশের বাড়ির উমির মা করবে। ওদের চাকরটা এসে ঘুমোবে রাতে। রঘুদার সাথেই যাবে ওরা মা আর মেয়ে।
ভীম সিংয়ের কাছে রঘু ছুটি চাইতেই আকাশ থেকে পড়ল সে? এই কাশী থেকে কোথাও চলে যাচ্ছে নাকি ওরা? সত্যি বলতে বিধবা বৌটার ওপর মায়া পড়ে গেছে ওর। ইচ্ছে তো করে প্রতিদিনই একবার গঙ্গা দর্শন করতে কিন্তু হয় কোথায়? কখনও বাড়িতে গেলে চা করে দিলেও মাধবী বড় করে ঘোমটা তুলে রাখে মাথায়। ভীম সিংয়ের কাছে মাধবী আরেক গঙ্গা। তবে এই গঙ্গার দর্শন পাওয়াই কঠিন।
রঘু গোপন করে যায় টাকা পয়সা পাবার জন্য ওদের যাওয়া। ও বলে ওখানকার জিনিসপত্র দেখে নিয়ে আসতে আর বাড়ি ছাড়তেই ওরা যাচ্ছে। এরপর আর যাওয়া নেই।
ট্রেনের পথটুকু আনমনা হয়ে যায় মাধবী। বারবার তার আগের কথা মনে পড়ে আর চোখে জল ভরে যায়। ওখানে পৌঁছতেই সবাই ঘিরে ধরে ওকে। অনেকদিন বাদে পুরোনো চেনামুখ দেখতে পেয়ে আর নিজেকে সামলাতে পারে না মাধবী। একসময় ভেবেছিল এটাই ওদের গ্ৰাম ঐ ঘরেই তার স্বর্গ। সেই বাড়ি ছেড়ে দিতে হয়েছে। মিতুলের মা ওদের নিয়ে যায়,পুতুলকে মিতুলের সাথে অন্য ঘরে পাঠায়। তারপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে অনেকটা চোখের জল ফেলে। প্রসূনের কথা বলে বাড়িতে টাকা পাঠানোর চিন্তায় সে একদমই ভালো করে খাওয়াদাওয়া করত না। তাছাড়া চিরকালই সে আদরে মানুষ হাতের কাছে সব পেয়েছে। একা রেঁধে বেড়ে খাবার অভ্যেস তার ছিল না। কেন যে মাধবী জেদ করে চলে আসেনি সাথে? শ্বশুরমশাই ঠিক থাকতেন রঘুদাকে নিয়ে। মিতুলের মায়ের খুব রাগ হয় ওর শ্বশুরমশাইয়ের ওপর।
রাগ অভিমান কম করেনি মাধবী নিজেও প্রসূনের মৃত্যুর পর অনেক কথা শুনিয়েছে শ্বশুরকে। যা খুশি বলেছে কিন্তু কোন উত্তর দেননি মানুষটা শুধু বলেছেন," জানি বৌমা সবটাই আমার দোষ। ছেলেটা তোমাদের রেখে গেলেও আমার রাজি হওয়া উচিত ছিল না। আমিই তোমাদের বাড়ি ছাড়া করে এই পথ তৈরি করেছি।"
মাধবী বলে," ছাড় ওসব কথা,আসলে আমার ভাগ্যে স্বামীর সুখ নেই বুঝলি। দুবার তো বিয়ে হল,পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস হতে না হতেই দুবার বিধবা হলাম। আসলে অপয়া আমি।"
-" ওসব একদম বলিস না,মেয়েকে মানুষ করতে হবে না? ঠাকুরপোর পরমায়ু না থাকলে তুই কী করবি?"
চারটে দিন মিতুলদের বাড়িতে থেকে পুতুল ভুলেই গেছিল আবার তাদের ফিরতে হবে কাশীতে। ফেরার সময় চোখ ভরে জল এল বলল," মা ওখানে আমার ভালো লাগে না আমি থেকে যাই না এখানে?"
মিতুলের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে," থাকবি? তাহলে খুব ভালো হয় রে। দুজনে আগের মত খেলব আর পুতুলকে বিয়ে দেব। কতদিন কোন আনন্দ হয় না।"
-" আবার আসব রে। তোরাও কাশীতে বেড়াতে যাস।"
মাধবী হাতে কিছু টাকা নিয়ে ফিরল মানে প্রসূনের শেষ সঞ্চয়। তবে চাকরির আশা তেমন নেই আর পেনসন পাবার মেয়াদের চাকরির কাল শেষ করেনি প্রসূন। তবুও হেডমাস্টার মশাই বললেন তাঁরা চেষ্টা করবেন।
*********************
বেশ কয়েকদিন বাদে রঘুকে দেখে ভীম বুঝতে পারে ওরা ফিরে এসেছে। কতদিন গঙ্গার দর্শন হয়নি,কথাটা ভেবে হাসি পায় ভীমের। ও শেষে ভাবির নাম গঙ্গা রেখে ফেলেছে। আসলে ছোট থেকে এই কাশীতে বড় হয়ে গঙ্গা বড় প্রিয় ভীমের। আর তাই তো ওদের বাড়িটার ওপর লোভ ওর। তবে সাদা শাড়ি পরা মাধবীকে এখন গঙ্গার মতই লাগে ওর। কিন্তু এই গঙ্গা খুব চঞ্চল কিছুতেই দেখা দেয় না। বহত জিদ্দী আছে।
রঘুকে জিজ্ঞেস করে," কাল আয়া ক্যায়া? সব ঠিক আছে তো উধার? কোই রূপিয়া মিলা ক্যায়া ছোটা বাবুকা?"
টাকার কথা শুনে চমকে ওঠে রঘু শকুনটার সব দিকে নজর! ও কী করে জানল যে ওরা টাকার জন্য গেছে?
টাকার গন্ধে হাজির হয় ভীম কয়েকদিন বাদেই। মনে মনে ভাবে অনেকদিন হয়েছে। বহত ভালোমানুষী করেছে এতদিন। এদিকে সুদে আসলে টাকা বেড়ে অনেক টাকা হয়েছে। ও রঘুদা কখনও দু পাঁচশো টাকা করে দেয় তাতে হয় নাকি? প্রায়ই বলে হয় বাবুর তবিয়ত আচ্ছা নেই তো ও বিটিয়ার কিতাব কিনতে হবে তো কখনও বলে ঘরে চাল আনাজ নেই। এবার সে ঠিক করেই এসেছে ছোটাবাবুর চাকরির জায়গা থেকে যে টাকা লিয়ে এসেছে ওরা তার থেকে কিছু মোটা রকম হাসিল করবে। যদি না দেয় তো বলতে হবে কুছ রূপিয়া রাখ লো আর মকান ছাড়ো অব। বহত দয়া দেখিয়েছি আপনাদের,আর আমি পারছি না। এদিকে রঘুকেও ছোটামোটা কাম দিয়েছি সব আপনারা যদি খেয়ে লেন তো কী করে হবে?
রঘুদা বাড়িতে নেই কাজে গেছে। বাবা অনেক বারণ করেছিলেন শোনেনি বলেছে এখানেও তো কোন কাজ নেই বৌদিমণি সব করে। তাই যখন যেচে কাজ দিয়েছে লোকটা ছাড়বে কেন?
-" আমার পোড়া কপাল রঘু। ছেলেটা চলে গেল হঠাৎই। তোকে মাইনে দিয়ে কাজে রেখেছিলাম এখন তুই আমাদের খাওয়াচ্ছিস।"
-" ঠিক আছে বাপু তোমাদের যা খুশি কর গিয়ে আমি গ্ৰামে চলে যাব। কাজ খুঁজে একটা কিছু করে কাটাব ঠিক।"
মাধবী চমকে উঠেছিল,রঘুদা ছাড়া চলবে কী করে? ঐ একটা মোটামুটি শক্ত পুরুষ মানুষ বাড়িতে আছে বলে ভরসা। এই অপরিচিত জায়গাটা না চিনতে চিনতেই তো সব এলোমেলো হয়ে গেল। পুতুলকে স্কুলে পৌঁছনো আনা সবই রঘুদা করে। মাঝের সময় টুকু কাজ করে। যা রোজগার করে তা দিয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটের বাজার থেকে প্রতিদিনের আনাজপাতি জোগাড় করে। প্রসূনের স্কুল থেকে কটা টাকাই বা পেয়েছে। শ্বশুরমশাই বলেছেন টাকা রাখতে ব্যাঙ্কে ভবিষ্যতের জন্য।
-" কিন্তু বাবা ঐ লোকটা? মানে ও যে টাকা চাইতেই আসে। কোথা থেকে দেবেন সেই টাকা?"
-" দেখি মা কী হয়? মাঝে মাঝে ভাবি ওর হাঁ তে এই বাড়িটাই না ঢুকে যায়। আচ্ছা বল তো এটা গেলে থাকব কোথায়? তবুও তো একটা মাথা গোজার আশ্রয় আছে। নাহলে থাকব কোথায় আর খাব কী?"
ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে মাধবীর মেয়েটাও একটু একটু করে বড় হচ্ছে। ওকে নিয়ে কোথায় যাবে? নিজের কথা ভাবে না মাধবী তবে এই মেয়ে প্রসূনের বড় আদরের ওর গায়ে যেন আঁচড় না লাগে। বাবা বাবা করে এখনও কেঁদে অস্থির হয় মেয়ে,বোঝালেও বুঝতে চায় না। তারপর মা কাঁদলে আবার মাকে জড়িয়ে আদর করার ছলে আরও কিছুটা কেঁদে নেয়।
দরজার আওয়াজ পেয়ে শ্বশুরমশাইকে ডাকে মাধবী। দুপুরটা শিবশংকর ওপরে আর যান না কারণ রঘুও থাকে না। ভীম আশা করেনি যে বড়াবাবু দরজা খুলবে কারণ বড়াবাবুর তো দোতলায় থাকার কথা। তো গঙ্গা গেল কোথায়?
-" আপ? ঘরমে কোই নেই কী?"
-" আর কে থাকবে? রঘু তো তোমার ওখানে।"
ভীম কথা না বাড়িয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দরজার সামনে রাখা বেঞ্চে বসে বলে," আপনি ভী বসুন। আসলে আমার কিছু রূপিয়া দরকার। একটা নতুন কাম শুরু করেছি অনেক টাকা লাগছে। অনেকদিন তো হল এবার আমার টাকা শোধ দিন। নাহলে হামাকে দুসরা উপায় ভাবতে হবে।"
শিবশংকরের বুকটা কাঁপতে থাকে ভীমের খাতা দেখে। এতদিন শুধু সুদই দিয়ে গেছেন। আসল তো কিছু শোধ হয়নি। ভীমের এই রূপ এর আগে দেখেননি। টাকার দরকার হলেই দিয়েছে মিস্টিমুখে। এখন কী বলতে চায়?
শিবশংকর আকুতি মিনতি করেন," ছেলেটা চলে গেছে এখনও একটা বছর হয়নি। মানে কয়েক মাসের মধ্যে মা বেটা চলে গেল। আমাকে একটু সময় দাও।"
-" কিন্তু আমার তো টাকার জরুরত আছে। না দিতে পারলে মকানটা দিয়ে দিন।"
মোক্ষম কামড় দেয় ভীম। ঠাকুর ঘরে চুপচাপ বসেছিল মাধবী। আর সইতে পারে না বেরিয়ে এসে বলে," বাবা ছেড়ে দিন উনি মকান নিয়ে আমাদের বাড়িছাড়া করতে চান করুন। আমরা গাছতলায় গিয়েই নাহয় থাকব। প্রতিনিয়ত এত কথা সহ্য করে আর পারছি না।"
মাধবীকে দেখে হঠাৎই চুপ করে যায় ভীম। কে বলবে ভাবি বিধবা? এখনও শরীরে জওয়ানির মাখামাখি। মাথা ভর্তি চুল আর ও ফিগার...টিভিতে অনেক কিছু দেখে ভীম। কী করবে আর টাকা ছাড়া জীবনে কী আছে? তবে ভাবি প্রথম থেকেই ওর মন আলো করে আছে।
সুর পাল্টে ফেলে ভীম," এই তো ভাবি। এই কাশী শহরে এসে আপনি পথে দাঁড়াবেন তা ভীম দেখবে কী করে? আচ্ছা আচ্ছা মকান থাক এখন ও আমি বলে ফেলেছি আসলে রূপিয়া লাগবে আমার। এখন কিছু টাকা দিন আমাকে মানে এই মাহিনাতে দিন। আমি আর কিছু বলব না।"
শ্বশুরের মুখের দিকে তাকায় মাধবী। শিবশংকরের চোখ ওকে বারণ করে। তবুও মাধবী বলে," আমি দেখছি,রঘুদাকে দিয়ে খবর পাঠাব।"
ভীমের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এইবার বাগে পেয়েছে ওদের আরে রূপিয়া এনে ছুপাকে রাখ দিয়া? কুছ তো নিকালো।
মাধবীকে দেখে সুর বদলালেও নিজেকে নরম করে না ভীম। বলে যায় কিছুদিন সময় দিচ্ছে ও মানে যতদিন না ছোটাবাবুর বাৎসরিক কাজ হচ্ছে। কারণ এই মকানের চারপাশে তাদের আত্মা আছে। তবে বাৎসরিকের পরে ঘর খালি করে দিতে হবে। কারণ এত টাকা এভাবে ফেলে রাখতে পারবে না ভীম।
শিবশংকর শুধু বলেন," আমাকে একটু সময় দাও।"
মাধবী ঘরে চলে যায়। ভীম তাকিয়ে থাকে সেদিকে। ভীমের দৃষ্টির লালসা চোখ এড়ায় না শিবশংকরের। নিজেকে আবার অভিশাপ দেন কেন যে ওদের এখানে এনেছিলেন আর নিজের প্রয়োজনে ছেলেটাকে কাছে রেখেছিলেন? এখন নাতনি আর বৌমাকে নিয়ে এই বয়েসে কোথায় যাবেন?
*******************
প্রসূনের রেখে যাওয়া শেষ সম্বল গুছিয়ে রাখতে পারল না মাধবী অনেকটাই ছুঁড়ে দিতে হল হাঙরের মুখে। দিন গোণে মাধবী বছর ঘুরতে চলল প্রসূনের যাবার। এবার তো আবার বাড়ি ছাড়ার হুমকি দেবে লোকটা। মাঝেমধ্যেই ভালোমানুষী করে লোকটা আসে। শিবশংকর কিছু বলতে পারেন না। মাধবী রাগ করলে ওকে বোঝান," বৌমা দুষ্টু লোককে চটাতে নেই। ঐ আসে একটু চা খায় গল্প করে। ওর বাড়িতেও নাকি কেউ নেই বলছিল।"
-" বাবা ওর বাড়িতে কেউ নেই বলে কী এখানে আসবে? লোকটা যেন হাঁ করে আছে আমাদের সংসারটা গেলার জন্য। আপনার ছেলে তো ওর জন্যই..."
হঠাৎই অনেকটা চোখের জলে ভাসে মাধবী। দেখতে দেখতে পুতুলের ক্লাশ সেভেন হয়েছে। এখন পড়াশোনাতে অনেকটা মন দিয়েছে মেয়ে।
মাধবী মিতুলের মাকে চিঠি লেখে," হ্যাঁ রে আমি যদি মেয়েকে নিয়ে ওখানে যাই থাকতে দিবি? আয়ার কাজ বা রান্নার কাজ করব। তোর কাছে পুতুল থাকলে আমি নিশ্চিন্ত। কেন যেন এই শহরে খুব ভয় লাগে আমার।"
মিতুলের মায়ের চিঠির জবাবের আশায় থাকে মাধবী। কিন্তু মিতুলের মা ভয় পায়,ওর ছোট সংসারে কোথায় ঠাঁই দেবে ওদের? মাধবী এখন বিধবা। গ্ৰামের লোক নানা কথা বলবে। আর এখানে কোথায় কাজ?
অনেকদিন বাদে চিঠির জবাব আসে..মাধু এখানে কাজ কোথায়? তাছাড়া তোর বৃদ্ধ শ্বশুর আছেন,রঘুদা আছে। তাঁরা কোথায় যাবেন? তোরা বরং কলকাতা চলে আয় ওখানে কাজ হয়ত পাবি কিছু।
মাধবী ভয় পায়,ও কলকাতার মত বড় শহর কিছুই চেনে না। কোথায় থাকবে আর কী করবে? মেয়েটারই বা কী হবে? মনে মনে ঠাকুরের কাছে দিবারাত্রি প্রার্থনা করে বলে," তুমি রক্ষা কর ঠাকুর।"
কোনরকমে বাৎসরিক সারে প্রসূনের। ওদের জমানো টাকা প্রায় শেষের মুখে। বাৎসরিক শেষ হবার পর ভয়ে ভয়ে দিন গোনে মাধবী। শ্বশুরকে বলে," বাবা লোকটা সময় দিয়ে গেছিল কী হবে এবার? আচ্ছা বাবা কলকাতা চলে যাবেন?"
-" না না বৌমা এমন বোল না। কলকাতা গিয়ে খাব কী? থাকব কোথায়?"
-" তাহলে চলুন না আমাদের পুরোনো গ্ৰামে কোনরকমে কুড়ে ঘর বেঁধে থাকব।"
-" কিছু তো নেই সেখানে। বসে বসে খেয়ে সব শেষ করেছি।"
ওদের কথার মাঝে বুকটা কেঁপে ওঠে মাধবীর দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে। এখানে থেকে এই আওয়াজ তার পরিচিত। শ্বশুরকে বলে," বাবা নিশ্চয় ঐ লোকটা,দেখেছেন তো বলেছিলাম আসবে ঠিক। এবার আমরা কোথায় যাব?"
মাধবী চোখ মুছে চলে যায় ঘরে। শিবশংকর কাঁপা হাতে দরজা খোলেন আজকাল ভীমকে দেখলে তাঁরও ভয় হয়। রঘু থাকলে অনেকটা সাহস পান অথচ ও ঠিক রঘু যখন না থাকে তখনই আসে।
টুকরো কিছু কথা বাইরে থেকে কানে যায় ভীমের। দরজা খুলতে দেরি হওয়ায় ডাক ছাড়ে," আরে কুছু ভয় নেই বড়াবাবু আমি ভীম আছি। দরওয়াজা তো খোলিয়ে।"
ভীমকে দেখে অবাক হয়ে যান শিবশংকর ওর সাথে আরও দুজন লোক। তাদের মাথাতে ফল আর আনাজের ঝুড়ি,ভীমের হাতে রাবড়ির হাড়ি আর মিঠাইয়ের বাক্স।
শিবশংকর বিরক্ত হন বলেন," এসব কী বাড়ি থেকে আমাদের দূর করার জন্য? বলেছি তো চলে যাব। তবে বয়স্ক বামুনকে ভিটেছাড়া করবে তার ফল কী ভালো হবে? এই কয় বছরে কম টাকা তো দিইনি তোমাকে?"
- " আরে বাবুজী আমাকে তো অন্দরেই আসতে দিলেন না ফালতু এত টেনশন লিচ্ছেন। আরে তুমলোগ ক্যায়া কর রহে হো সমান রাখকে অন্দরমে নিকালো।"
মাধবীর ইচ্ছে করে ছুটে বাইরে গিয়ে বলতে এই জিনিস নিয়ে যেন লোকটা বিদায় হয়। কিন্তু আর এত মানসিক চাপ নেবার মত ক্ষমতাও যেন তার নেই।
লোকদুটোকে বিদায় করে ভীম ভেতরে গুছিয়ে বসে। ওর হাতে তখনও মিঠাই আর রাবড়ি ধরা। হুকুমের স্বরে শিবশংকরকে বলে," আরে ভাবি কো বুলাইয়ে মিঠাই কী আমি ধরে থাকব নাকি? ও গুড়িয়ার জন্য আনলাম। সেদিন দেখলাম রঘুর কাছে মিঠাই খেতে চাইছিল।"
অবাক হল মাধবী আজকাল পুতুল মোটেও বায়না করে না।
ঘর থেকে বাইরে আসে মাধবী বলে," না না মেয়ের.."
-" ও ছোড়িয়ে,ইয়ে রখ দিজিয়ে। সামান ভী রাখ দিজিয়েগা।"
মাধবী কলের পুতুলের মত আবার ঘরে ঢুকে যায়। মাধবীকে দেখে যেন আশ মেটে না ভীমের। শিবশংকর বিরক্ত হন বলেন," কী বলবে বল,আমি সব শুনতেই প্রস্তুত। অনেক তো সইলাম।"
তবে ভীম যা বলল তা সহ্য করা রীতিমত অসম্ভব হল শিবশংকরের।
শিবশংকরের বুক কেঁপেছিল ভীমকে দেখেই তা বুঝতে ভীমেরও বাকি ছিল না। কারণ সে তো আগেই বলে গেছে বাড়ি ছেড়ে দেবার কথা। ফল মিঠাই আর আনাজ নীচে রেখে ভীম ওপরে উঠে গেছিল বড়াবাবুর সাথে কিছু কথা আছে বলে। সেদিন আর চা বা জল কিছু খেতে চায়নি। তবে মাধবী নিজেই একটু সরবত করে দিয়ে এসেছিল একবার। শ্বশুর মশাইয়ের কথাটা মনে পড়ে গেছিল যে দুষ্টু লোককে চটাতে নেই। সরবতটা পেয়ে ভীমের চোখটা চকচক করে উঠেছিল খুশীতে উচ্ছ্বল হয়ে বলেছিল," আরে ভাবি মনকে বাত জেনে গেছে। আমি ও দোপহরের টাইমে একটু সরবতই চাইছিলাম। মগর বলতে পারছিলাম না। দিল খুশ হো গয়া।"
মাধবী কথাটা শুনতে শুনতেই নীচে নেমে আসে। তারপর কী কথা হয়েছে আর জানে না। নীচে ঘরের দরজা ভেজিয়ে কাজ করতে থাকে। একটা সময় আওয়াজ পায় দরজার লোকটা বলছে," দরওয়াজা বন্ধ কর দিজিয়ে বড়াবাবু।"
মাধবী কান পাতে,দরজা খোলার আওয়াজ হলেও বন্ধের আওয়াজ হয় না। তাহলে বাবা কী আর নামেননি নীচে? ও ঘর থেকে বেরিয়ে খোলা দরজাতে খিল দেয়। ওপরের দিকে তাকায় সিঁড়িতে শ্বশুরকে দেখতে পায় না। ভাবে হয়ত বিশ্রাম নিচ্ছেন বাবা।
আবার চিন্তা হয় কেজানে লোকটা কী বলে গেল বাড়ি ছাড়ার ব্যাপারে। একবার গিয়ে জিজ্ঞাসা করবে নাকি? তারপর ভাবে থাক বিকেলেই বরং কথা বলবে।
কিছুটা বাদেই পুতুল আর রঘুদা এসে ঢোকে। মাকে পেয়েই তার অনেক গল্প শুরু হয়। সারাদিন কী করেছে?কোন দিদিমণি কী বলেছে সব গল্প না করলে ভালো লাগে না। মাধবীকে অন্যমনস্ক দেখে বারবারই বলে," ও মা শোন না কী বলছি। মা কিছু খেতে দাওনা খুব খিদে পেয়েছে।"
-" হ্যাঁ আনছি তো এক্ষুনি ভাত মেখে দাঁড়া মা। রঘুদা তুমিও কিছু খেয়ে নাও। রুটি খেয়েছিলে দুপুরে? এখন কী ভাত খাবে?"
-" মা আমাকে মিস্টি দাও আমি খাব। আজ আর ভাত খাব না। আমি রান্নাঘরে দেখে এসেছি মিস্টির বাক্স।"
হঠাৎই মাধবীর অদ্ভুত রাগ হয়ে যায় ধমকে ওঠে মেয়েকে," এত কিসের লোভ তোর শুনি এসেই ছুটেছিস রান্নাঘরে। ভাত খাবি না যা খুশি খা। আমাকে আর কিছু বলবি না। কেন যে এত কষ্ট করে রান্না করি? ইচ্ছে করে সব ছেড়ে যেদিকে দুই চোখ যায় চলে যাই।"
-" আমি কী বললাম আবার? মিস্টি দেখলাম তাই বললাম খাব। মা তুমি আমাকে খুব বক আজকাল। বাবা নেই আর কেউ আমাকে ভালোবাসে না।"
হঠাৎই পুতুলের চোখ ছাপিয়ে জল এল কাঁদল মাধবীও। সত্যি তো ওর কী দোষ? ছেলেমানুষ মিস্টি দেখে খেতে চেয়েছে। ও কী জানে কে এনেছে এইসব?
রঘু এক নিমেষে এত জিনিস দেখেই বোঝে কে এনেছে এইসব। তারপর মনে মনে বলে শয়তানটা এখানে এসেছিল? যখন আমি থাকি না তখন আসে কেন? হাত দিয়ে যার জল গলে না হঠাৎ তার হল কী? এত কিছু নিয়ে এসেছে নিশ্চয় কোন মতলব আছে।
পুতুল তখনও কাঁদছে মাধবী জানে মেয়ের খুব জেদ। তারপর খিদের মুখে আরও জেদ বেড়েছে। বাপ সোহাগী ছিল মেয়েটা তাই কথায় কথায় বলে বাবা নেই তাই তাকে কেউ ভালোবাসে না। তবে রঘুদা আর শ্বশুরমশাই একদম জড়িয়ে রাখেন ওকে। যখন যা বলছে এনে দিচ্ছেন।
-" কই আমার দিদি? ওঠ দেখি,তুমি না বড় হয়েছ। এত বড় মেয়ে কাঁদে নাকি? দেখ তো মাও কাঁদছে। চল চল ওঠ মিস্টি খাবে। এই দেখ আমি সব সুন্দর করে গুছিয়ে দিয়েছি।"
-" তুমি নিয়ে যাও,আমি খাব না মা আমাকে লোভী বলেছে। আমি না খেয়েই থাকব আজ।"
-" এমন বলতে নেই মায়ের কষ্ট হবে। তুমি না খেলে তো আমরা কেউই খেতে পারব না। তখন সব শুদ্ধু উপোস দেব।"
অনেক বুঝিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে পুতুলকে খাওয়ায় রঘুদা। মাধবী আদর করে চুল বেঁধে দেয়। পাশের বাড়ির উমি ডাকতে এলে খেলতে যায় পুতুল।
মাধবী চা করে তারপর রঘুদাকে বলে," তুমি ওপরে গিয়ে বাবাকে চা দাও। আর দেখে এসো বাবা কী করছেন? সেই লোকটা যাবার পর বাবা আর নীচে নামেননি।"
-" হ্যাঁ গো বৌদিমণি লোকটা কী মতলবে এসেছিল এত জিনিস নিয়ে? বাড়ি ছাড়তে বলে গেল নাকি? কী হবে এবার বুঝতে পারছি না। তেমন হলে.."
-" না আমার সামনে তো কিছু বলেনি,বাবাকে ওপরে নিয়ে গিয়ে কী বলেছে জানি না।"
রঘুদাকে চা দিয়ে পাঠিয়ে মাধবী রাতের রান্নার জোগাড় করে। সকাল সকাল রাতেরটুকু সেরে নিয়ে মেয়েটাকে একটু পড়তে বসায়। এখন আর মেয়ের পড়ায় তেমন সাহায্য করতে পারে না,ঐ কাছে বসে থাকে। একটু সঙ্গ দেয়,কখনও কিছু রিডিং পড়ে শোনায়,কবিতা পড়ায় বা মেয়ের সাথে গান গায়। গলায় সুর আছে মাধবীর কিন্তু তেমনভাবে কোনদিনই গান শেখা হয়নি।
রঘুদা চা দিয়ে নীচে নেমে এসেছে। আটা মাখতে মাখতেই মাধবী বলে," বাবা কী করছেন? শরীর ঠিক আছে তো?"
-" হ্যাঁ, চেয়ার নিয়ে ছাদের কোণে বসেছিলেন বাবু। বলেছেন রাতে খাবেন না। পেটটা ভার লাগছে। আর তুমি সব কাজ সেরে একবার ওপরে যেয়ো। তাড়া নেই দিদিভাইকে খাইয়ে গেলেও হবে।"
মাধবীর বুকের ভেতরে কাঁপে বাবা কী জন্য ডাকছেন? তবে কী সত্যি বাড়ি ছাড়তে হবে? কিন্তু ওরা যাবে কোথায়? অনেকগুলো প্রশ্নের জট মাথায় এসে একদম ঘুরপাক খেতে থাকে। আজ তার কোন কাজেই মন লাগে না। পুতুলকে পড়তে বসিয়ে আনমনা হয়ে শুয়ে থাকে। পুতুল বলে," ওমা তুমি কী রাগ করে আছ এখনও? আমি আর কোনদিনই বায়না করব না গো। যা দেবে তাই খাব।"
মাধবী বলে," চুপ কর মা,পড়ে নে তাড়াতাড়ি। এরপর তো ঘুমিয়ে পড়বি। তাড়াতাড়ি খাইয়ে দেব তোকে।"
মাধবী পুতুলকে পড়তে বসিয়ে একবার ছাদে উঠেছিল। শ্বশুরের শুকনো মুখটা দেখে চমকে উঠেছিল," বাবা কী হয়েছে? আপনি কী বলবেন বলুন। আমি জানি কী বলবেন আপনি।"
-" এখন নয় বৌমা তুমি বরং সব কাজ সেরে এসো আজ তোমার সাথে অনেক আলোচনা আছে আমার। কী যে বলব তোমাকে? হায় ভগবান, এত কিছু দেখার আগে মরে গেলেই ভালো হত। আচ্ছা বৌমা একটু বিষ আনিয়ে দিতে পার?"
-" বাবা কী বলছেন আপনি! আমিও যে কত কী সয়ে আছি তার হিসাব রাখেন আপনি? তবুও আছি বেঁচে ঐ মেয়েটার মুখ চেয়ে।"
ওপর থেকে চলে এসেছিল মাধবী কিন্তু শান্তি পায়নি। পুতুলটা খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল,মাধবী ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে মশারী টাঙিয়ে দিয়েছিল। রঘুদাও তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়েছে। সারাদিন অনেক পরিশ্রম করে,বয়েস তো কম হয়নি। এই মানুষটার কাছে ওদের ঋণের শেষ নেই। মনিবের ঋণ শোধ করছে পুরোনো ভৃত্য। ভাবা যায়? সত্যি বোধহয় যা আমরা কখনও ভাবি না তেমন কিছুও ঘটে যায় কখনও।
মাধবী ওপরে ওঠে সাথে একটু জল আর মিস্টি নিয়ে ওঠে। যদি বাবা একটু খান রাতে। মেয়েটা ছাড়া ঐ মিস্টি কেউই খায়নি সব পড়েই আছে।
শিবশংকর কপালে হাত দিয়ে বসে আজ তার দুচোখে জল। মাধবী এসে কপালে হাত রাখে," বাবা কী হয়েছে এবার বলুন। আর একটু জল মিস্টি খাবেন রাতে শোবার সময়।"
-" কী করে বলব তা বুঝতে পারছি না। আচ্ছা বৌমা আজ যদি এমন কিছু বলি তুমি আমাকে মাফ করবে তো?"
ভয় পায় মাধবী এই জগতে নারীর কলঙ্কের শেষ নেই। কী বলতে চান বাবা? তবুও সে সাহসে বুক বাঁধে। কিন্তু শিবশংকরের কথা শুনে তার সারা শরীর ঘেন্নায় গুলিয়ে ওঠে। নিজেকে হঠাৎই বেশ্যা বলে মনে হয়। আর কতবার নিজের শরীরের বিনিময়ে পুরুষের মন কিনবে ও? আর বাবা তাকে এমন প্রস্তাব দিচ্ছেন কেমন করে?
পাথরের মত স্থির হয়ে যায় মাধবী কিছুক্ষণের জন্য তার বাকশক্তি লুপ্ত হয়ে যায়।
-" আচ্ছা বৌমা আমি তো কোন অন্যায় করছি না বল। বিধবা বৌমাকে তো আমি বিয়ে দিতেই পারি। তুমি যখন প্রসূনকে বিয়ে করেছিলে তখন তো... আর ও তোমাকে বিয়েই করবে বুঝলে। দিদিভাই আমাদের কাছে থাকবে,অবশ্য ওকে তুমিও নিয়ে যেতে পার বৌমা। এই তো কাছাকাছি সব। শুধু আমাদের বাড়িটা বেঁচে যাবে তাহলে,এই বয়েসে আর পথে দাঁড়াতে হবে না।"
সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করে মাধবী," ছিঃ বাবা এত স্বার্থপর আর নীচ আপনি! যখন আপনার ছেলে আমাকে বিয়ে করেছিল তখন তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। নিজেদের দরকারে আবার ছেলেকে এনে তাকে মারলেন। এখন আপনাদের প্রয়োজনে আমাকে বিক্রী করবেন ঐ শয়তানটার কাছে? এর থেকে আমার মরে যাওয়াও ভালো,আমার মেয়েটা কী দেখবে? ও পারবে সইতে এইসব? ছিঃ ছিঃ একটু আগে আপনি বিষ খাবার কথা বলছিলেন না? আপনি বিষ খাবেন কেন? এখন তো আপনার আনন্দের সময় বৌমাকে বিক্রী করে সারাজীবন সুখে আর নিশ্চিন্তে কাটাবেন। ভালোমানুষী করছেন না সব আমি বুঝি।"
-" আমার আর কোন পথ নেই মা,অত টাকা আমি শোধ করতে পারব না।"
-" কে বলেছিল টাকা ধার নিতে? আমরা?"
-" আপনার পাপের বোঝা আমি বইব কেন বলতে পারেন? হে মা গঙ্গা তুমি কী করে সইছ এত পাপ একটা কিছু কর?"
-" চুপ কর বৌমা তুমি আর কেঁদো না। সে এলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব তারপর যা হয় হবে।"
মাধবী কোন কথা না বলে নীচে নেমে আসে। চুপ করে দরজা বন্ধ করে প্রসূনের ছবিটা বুকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকে। ইচ্ছেমত কাঁদে মেঝেতে গড়িয়ে গড়িয়ে নিজের গালে নিজেই চড় থাপ্পড় মারে। মেয়েটা ছটফট করে ঘুমের চোখেই বলে মা.. মাধবী তাড়াতাড়ি করে গিয়ে ওর মাথায় হাত রাখে চোখ মুছে বলে," এই তো আমি,ঘুমো মা।"
****************************
পরদিন সকালে আর মাধবীকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
সদর দরজা খোলা দেখে অবাক হয়েছিল রঘু। মনে মনে চিন্তা করছিল কী বার আজকে? অনেক সময়ই মাধবী সোমবার ভোরে গঙ্গায় যায় স্নান করতে,শিবের মাথায় জল ঢেলে আসে। অবশ্য সাথে উমির মা গেলেই যায়। রঘু বেশ অনেকটা সময় অপেক্ষা করে, আজ বৌদিমণি কোথায় গেল? ওকেও তো বেরোতে হবে। এইসময় অন্যদিন মাধবীর উনুনে আঁচ দেওয়া হয়ে যায়। একটু বাদে তো দিদিভাইকেও তুলতে হবে। বাধ্য হয়ে ওপরে যায়,শিবশংকরের রাতে ঘুম হয়নি। মাধবীর কথাগুলো বুকের মধ্যে হাতুড়ির মত ঘা মেরেছে বারবারই। না খুব অন্যায় করছেন তিনি,এই শহর ছেড়ে চলে যাবেন। কাশী তাঁর জীবনে অমৃতের বদলে বিষই ঢেলে দিয়েছে।
-" রঘু কী হয়েছে? বৌমা কী করছে?"
-" ঐ জন্যই তো এলাম ওপরে। আপনারে বলে গেছে নাকি? আমি উঠে দেখি সদর খোলা। ভাবলাম গঙ্গায় গেছে। তবুও এখন তো এসে পড়া দরকার নাকি?"
বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে শিবশংকরের কাল মেয়েটা পাগলের মত করছিল,ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল। তবে কী? না না তা হবে কেন? দিদিভাইকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না।
কিন্তু শিবশংকরের অনুমান মিথ্যে হল যখন সব জায়গা খুঁজেও পাওয়া গেল না মাধবীকে। বাড়িতে তখন মানুষের ভিড়,যারা ভোরে গঙ্গায় যায় তারা কেউই দেখেনি মাধবী। শিবশংকরের হঠাৎই প্রসূনের ছবির পেছনে রাখা কাগজের দিকে নজর পড়ে। মাধবীর আঁকাবাঁকা হাতে লেখা একটা চিঠি যেখানে লেখা গঙ্গাতে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে পাপ ধুইয়ে সে শুদ্ধ হতে চায়। পুতুলকে দেখতে বলে গেছে রঘুদাকে। শ্বশুরকে কোন দায়িত্ব দিয়ে যায়নি সে। কাউকে দায়ী করেনি তার মৃত্যুর জন্য।
শিবশংকর কান্নায় ভেঙে পড়েন। হঠাৎই ভীমকে দেখে পাগলের মত হয়ে ওঠেন," সব তোমার জন্য,নাও এবার গ্ৰাস কর আমার বাড়ি। যা খুশি কর। বাড়ির চিন্তায় আমার ঘরের লক্ষ্মী চলে গেল। আমার দিদিভাইকে কে দেখবে?"
ভীম চমকে ওঠে বড়াবাবুকে বলা কথা শুনেই তাহলে ভাবি মরে গেল। বাবু আবার সবার সামনে এইসব বলবে না তো? সে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে সরে আসে। গঙ্গাতে জাল ফেলে ডুবুরী নামিয়ে সারাদিনেও মাধবীর হদিশ পাওয়া যায় না। পুলিশ বলে গঙ্গায় জোয়ার ছিল বডি হয়ত ভাসতে ভাসতে কোথাও চলে গেছে।
রঘুদাকে এক মুহূর্ত ছাড়েনি পুতুল। উমির মা এসে কোনরকমে সামলেছে ওকে। কেউই বুঝতে পারল না হঠাৎই এমন ফুলের মত মেয়েকে রেখে মাধবী মরল কেন? সন্তানের মুখ চেয়ে তো কত কী সয় মানুষ। শিবশংকর হয়ত তাই ভেবেছিলেন সবার জন্য এইটুকু সইবে মাধবী। কিন্তু মাধবী নিজের সন্তানের কাছে ছোট হয়ে ঐ শয়তান লোকটার কাছে দেহ বিক্রী করে বাঁচতে চাইল না। একটা ভয়ানক সত্যি সবার থেকে লুকোলেন শিবশংকর।
পরেরদিনও চেষ্টা চলল মাধবীকে খুঁজে পাবার। রঘুর কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে মাঝ রাত থেকে গঙ্গায় লোক স্নান করে। জেলেরা থাকে নৌকো নিয়ে সেখানে কী করে বৌদিমণি ডুবে মরল? কেউ দেখল না? আর দেহটাই বা গেল কোথায়?
পুতুলকে বুক দিয়ে সামলায় রঘু সে ঠিক করেছে আর ভীমের ওখানে সে কাজ করবে না। দরকারে রিক্সা চালাবে তাও ঠিক আছে। তবে ঐ লোকটার জন্যই আজ বৌদিমণি নেই,সেদিন কী বলতে এসেছিল কে জানে? হঠাৎই মনে পড়ে রঘুর সেদিন ফিরে এসে ভীষণ মনমরা দেখেছিল বড়বাবুকে। রাতেও কিছু খাননি আর বৌদিমণিকে ওপরে আসতে বলেছিলেন কী কথা হয়েছিল ওদের? বড়বাবু কী কিছু বলেছিলেন?
পরপর মৃত্যু শোকে পাথর হয়ে যান শিবশংকর। বৌটা চলে গেল বোকার মত আরে একবার ভাবলি না তোর মেয়েকে কে দেখবে? মেয়েটার বাপ নেই মা নেই দিন দিন বড় হচ্ছে। বাড়িতে একটাও মেয়েমানুষ রইল না কার কাছে থাকবে মেয়েটা? তারপর আছে ঐ ভীম সিংয়ের হুমকি।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে পুতুল ওর পুতুলগুলোকে বুকে ধরে," মা তুমি খুব খারাপ, তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসতে না। শুধু বাবাকেই ভালোবাসতে। আমি এখন কার কাছে থাকব? কে আমাকে পুতুল বানিয়ে দেবে?"
*******************
অনেক লোকের ভিড়ের মাঝে পালিয়ে এসেছিল ভীম সিং। কিছুটা ভয়ে আর কিছুটা অনুশোচনায় কেঁপে উঠেছিল ওর সুদ খাওয়া মনটাও। গতকাল যে আশা নিয়ে অতগুলো জিনিসপত্র নিয়ে ও ঐ বাড়িতে গেছিল তাতে যে এমন ছাই পড়বে তা ভাবেনি। তারপর বাড়িতে পুলিশ এসেছে। কোনভাবে যদি বড়াবাবু বানাকে ওর নাম বলে বা বলে ওর হুমকি শুনে ভাবি মরে গেছে তবে কী হবে কে জানে?
ভীমের চোখের সামনে মাধবীর চেহারাটা ভাসে,অদ্ভুত মায়াবী ছিল মাধবীকে দেখতে। আর তেমন সুন্দর ছিল শরীরের বাঁধন। কে বলবে বিধবা মেয়েছেলে আর অত বড় লড়কী আছে? এখনও জওয়ানী উছলে পড়ে শরীর থেকে। শাদী নাই বা করত তবে মরতে গেল কেন ভাবি? মনে হয় ও যঝ বড়াবাবু আছে না খামোকা চাপ দিয়েছে শাদী কে লিয়ে। তাই এইসব হয়েছে? মাধবী আর ওর পরিবারের কথা ভেবে আজ খারাপ লাগে ভীমের। চাকরটা রুটি সব্জি দিয়ে যায় খেতে ইচ্ছে করে না খেতে। ওকে বলে কাঁচের আলমারি থেকে বোতল,জল আর বরফ দিতে।
চাকরটা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ভীম ধমকায়," আরে শুনাই নহি দেতা ক্যায়া। বোলা না কুছ আচ্ছা নহি লগ রহা। ও দারুকা বটল,পানি,গ্লাস লেকে আ।"
একটা সময় নিয়মিত মদ খেলেও নিজেকে অনেক বদলে ফেলেছিল ভীম। মাস দুয়েক ধরেই একটা কল্পনার জাল বুনেছিল মনে মনে যে ও একটা আচ্ছা কাম করবে। মানে সাপ ভী মরবে আর লাঠি ভী টুটবে না। ও ভাবি যো বিধবা আছে তাকে শাদী করলে লোকে বলবে বহত আচ্ছা কাম কিয়া ভীম,এক বিধবা কো উদ্ধার কিয়া। আবার হয়ত অনেকে নিন্দাও করবে। নিজের মেয়ে গালাগালি দেবে বাবাকে,বলবে হয়ত তোমার জন্য শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছে মাথা হেঁট হল আমার।
সে যে যা বলে বলুক,এই ষাট বছর বয়েসেও এখনও ভীমের নারীসঙ্গের আকাঙ্খা আছে। তবে জানকী থাকতে বা না থাকতে কোঠিতে অনেক গেছে। এখন আর সেসব ভালো লাগে না। মনে হয় এমন একজন থাক ঘরে যার জন্য ঘরে ফিরতে মন চাইবে। ইচ্ছে হলেই ঘরমে বহতী গঙ্গামে স্নান ভী করবে কেউ কিছু বলার নেই। ভাবিকে তো ও রানী করে রাখতে চেয়েছিল,সব ধার দেনা মাফ করে দিতে চেয়েছিল যদি ভাবি ওর হয়। আর ও বিটিয়াকো ভী আপনাতে চেয়েছিল। হঠাৎ কী এমন হল যে ভাবি গঙ্গামে ডুবে জান দিয়ে দিল?
আজ একটু বেশিই নেশা করে ফেলেছে ভীম। একটা সময়ে শরীর এলিয়ে পড়ে চেয়ারে,কোনরকমে চাকরের ঘাড়ে ভর দিয়ে খাটে এসে শুয়ে পড়ে। তবে দুঃস্বপ্নে তার ঘুম হয় না ভালো করে। সে দেখে মাধবীকে ঘুমের মধ্যে। মাধবীর চোখে ঘৃণা ভীমকে অভিশাপ দিচ্ছে। ভীম ভয় পেয়ে উঠে বসে বিছানায় জল খায়,আলো জ্বালিয়ে চাকরটাকে ডাকে। ব্যাটা সাড়া দেয় না মোষের মত ঘুমোচ্ছে। আবার গালাগালি করে ভীম। তারপর পরের দিন ভোরে উঠে গঙ্গার দিকে যায়। গঙ্গাতে স্নান করতে গিয়েও কেমন যেন চমকে ওঠে বারবার মনে হয় মাধবীর কথা।
দূরে দেখতে পায় অজয়কে,ওর নৌকো নিয়ে এদিকেই আসছে। হঠাৎই ভীমের মনে পড়ে অজয় তো সারা রাত গঙ্গাতেই কাটায়। ও কী মাধবীকে মানে ভাবিকে দেখেছে স্নান করতে আসতে?
কথাটা মনে হতেই অজয়কে ডেকে ঘটনাটা বলে। অজয় বলে সেও শুনেছে ঘটনাটা কিন্তু তার চোখে কিছু পড়েনি। তাছাড়া সে তখন ঘুমিয়ে ছিল নৌকোর ভেতর। আর কোন ঘাটে গিয়ে ডুবে মরেছে বৌটা কে জানে? অজয় চোখ টেপে ইঙ্গিত করে বলে বিধবা মেয়েমানুষ নিশ্চয় কারও সাথে কোন কুকীর্তি করে পেট সে হয়ে গেছিল তাই ডুবে মরেছে। নাকি ভেগে গেছে কারও সাথে কে জানে?
-" আরে মালুম হোতা ও ভাগ গয়ী কিসিকে সাথ। ডুব গয়ি তো বডি কিঁয়ু নহি মিলি হাঁ। আরে ভাইয়া জওয়ানী বহত দুশমন হ্যায়। ক্যায়া আপকা ভী কোই নজর থা উসমে?"
অজয়ের ইঙ্গিতে রাগে গা জ্বলে যায় ভীমের। এতদিন দেখছে ভাবিকে কোনদিনই মনে হয়নি বদচলন। আর ও পরিবার ভী বহত আচ্ছা। ইসি লিয়ে তো পয়সা দিয়া উনলোগকো।
তাই অজয়কে বলে," আরে চুপ হো যা,বহত আচ্ছা পরিবারকে বহু থী। মেরে জান পহেচানকে থে। নজর সে ক্যায়া মতলব হাঁ?"
অজয় একটা হাসি হাসে আবার," ইতনে পহচানথে উনকো। ক্যায়া বাত ভাইয়া?"
এমনিতেই ভীমের মেজাজ ঠিক নেই তারপর সারারাত ভালো করে ঘুম হয়নি বারবারই ভাবিকে দেখেছে মনে হচ্ছে ওকে অভিশাপ দিচ্ছে। তাই ভাবছিল যদি কোন খোঁজ পাওয়া যায়? কোনরকমে স্নানের পাট চুকিয়ে বাড়ি ফেরে ভীম।
আজ ইচ্ছে করেই বাড়িটার সামনে দিয়ে যায়। বাড়িটা একদম নিশ্চুপ ভেতরে কোন আওয়াজ নেই। মনটা ভারী হয় ভীমের কেন যে বড়াবাবুকে বলতে গেল? ওর জন্য একজন মরে গেল এটা ভেবে ওর আবার খারাপ লাগল। লোকের অভিশাপকে তোয়াক্কা করে না ভীম। কিন্তু কেন যেন খারাপ লাগল পরিবারটার কথা ভেবে।
রঘু আর শিবশংকর হিমসিম খেয়েছে পুতুলকে সামলাতে। উমির মা এসেছে উমি আর লীলু এসেছে পুতুলকে ওদের বাড়ি নিয়ে যেতে কোথাও যায়নি পুতুল। বারবারই দরজায় কড়া নাড়লে কেউ ছুটে গেছে ঐ বোধহয় মা এল বলে। পুতুল বড় হয়েছে অনেক কথাই বোঝে ওর বিশ্বাস যে মায়ের বডি যখন পাওয়া যায়নি তখন মা নিশ্চয় ফিরবে।
শিবশংকর হা হুতাশ করেন কী করে বোঝাবেন ওকে যে তাঁর কৃতকর্মের জন্য আজ এই মেয়েটা মা হারা। যে কাজ বৌমা করেছে তা তো তিনি করতে পারবেন না। তাঁর কাছে নাতনিকে রেখে তাঁকে শিক্ষা দিয়ে চলে গেছে সে।
ভীমের মন ভারী অশান্ত। আজকাল সে মদ খায় নিয়মিত। নাহলে ঘুম আসে না। ঘুমের মধ্যে শিবশংকর আর মাধবী আসে মাঝেমাঝেই। তার অবচেতন মনে জমে থাকা পাপ তাকে শান্তি দেয় না।
একদিন সাহস করে ও বাড়ি গেছিল রঘুদা আর বড়াবাবু তাকে ঢুকতে দেয়নি। বলেছে আর মাসখানেকের মধ্যেই তারা বাড়ি ছেড়ে দেবে। পুতুলের পরীক্ষা তাই একটু সময় যেন তাদের দেওয়া হয়।
পুতুল কথাটা শুনে ছুটে এসেছিল," আমাদের এখানে থাকতে দিন আপনি। আমরা চলে গেলে আমার মা এসে তো পাবে না। আমার মা ঠিক বেঁচে আছে। আমি জানি,মা আমাকে বলেছে তো।"
ভীম কিছু বলার আগেই রঘু দরজা বন্ধ করে দেয় মুখের ওপর।
অশান্ত মনকে শান্ত করতে সেদিন রাতে ভীম নয়না বাঈয়ের ওখানে যাবে ঠিক করল। চাকরকে বলে গেল তার ফিরতে দেরি হবে সে যেন শুয়ে পড়ে। আজ ভেবেছে একটু গান শুনে আর গল্প করেই আসবে। এককালে দেহের প্রয়োজনে এসেছে এখন আমেজটা নিতেই ভালো লাগে। ওখানে অনেকের মধ্যে নয়নাকেই ওর ভালো লাগে। নয়নারও বয়েস হয়েছে এখন মেয়েদের দেখভাল করে ও। আর বিশেষ বিশেষ মানুষকে সময় দেয়। তাছাড়া তেমন কাজ আর করে না। ভীম বললে দুঃখ করে বলে," বাবুজী ও বারাণসী অব কাঁহা। গঙ্গা ভী শুখ গয়ী আদমী লোগ ভী শুখা শুখা। পহেলে শাদী মে হমলোগ যাতে কিতনে গানা বাজানা হোতা? অব ও সব কাহা। ও যো নয়ে নয়ে ছোকরী লোগ আতে না উনকো ভী সঙ্গীত মে কোঈ মতলব নেহি। আ যাতা রোজগার কে লিয়ে। ইয়ে অব পুরা কোঠি বন গয়া।"
ভীম আবদারের সুরে বলেছে," হম তো পুরানা আদমী না। হম তো আতে গানা শুননে কে লিয়ে। গঙ্গা পারমে তুমহারা কোঠিমে বৈঠকে গানা শুনকে দিল ভর যাতা।"
-" এইসে কিতনে আদমী হ্যায় বাবুজী? ও ছোড়ে লোগ আতা মগর ঠিক সে রূপিয়া ভী নহি দেতা। অব হামারা ভী ঐসে দিন নহি রহা। আ যানা বাবুজী কভি কভি য়্যাদ করকে।"
সুদের আর মালগুদামের মালিক ভীম সিং মাঝে মাঝে একটা দুটো রাত রাজার মেজাজে আসে এখানে। পুরোনো ভেঙে পড়া হাভেলীর ছাদে বসে নয়নার গান শুনে মদ খায় আর কখনও নয়নাকে আদর করে চলে যায়।
নতুন মেয়ে এলেই নয়না বলে," বাবুজী এক ছোড়ী আয়ি নয়ী হ্যায় নথ তোড়েঙ্গে ক্যায়া? মগর হামে আচ্ছা রূপিয়া চাহিয়ে। ছোড়ি বিলকুল নয়ী হ্যায়। একদম ফুল য্যায়সে নাজুক।"
নয়নার কথা শুনে ভীমের বার্ধক্যের দোড়গোড়ায় উপস্থিত মনে যৌবনের রক্তের ঝিলিক ওঠে। দেখতে ইচ্ছে করেছে মেয়েটাকে,কিন্তু দেখে কেন যেন পিছিয়ে এসেছে বারবারই। নয়না অবাক হয়েছে ভেবেছে কঞ্জুস আছে বাবুজী খরচের ভয়ে পিছিয়ে আসছে। থাক পরে ভালো দাম আদায় করেই এই মেয়েকে তুলে দেবে কোন শাঁসালো খদ্দেরের হাতে।
ভীমের বারবারই মনে হয়েছে তার মেয়েটার মুখ ঐ কচি মেয়েটাকে দেখে। জানকী অসুস্থ বলে যখন মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছিল বিয়ের বয়েস হয়নি মেয়েটার। খুব কেঁদেছিল,জানকীর চিন্তা করার মত মন না থাকলেও ভীমের মনে হয়েছিল নথ ভাঙার গল্প। বারবারই মনে হয়েছিল বছরে বারো বছরের বড় ছেলেটা কতই না কষ্ট দেবে বাচ্চা মেয়েটাকে। আর তাই হয়েছিল তেরো বছরের কচি মেয়ে বছর না ঘুরতেই মা হয়েছিল।
তাই এক দুবার নয়নার কথাতে কচি মেয়ে দেখে নিজেই বারণ করে দিয়েছিল। নয়না দরদাম কম করতে পারে ইঙ্গিত করাতে স্পষ্ট বলেছিল এমন কোন কচি মেয়ে নয়। যদি কোন বড় কেউ হয় তাহলে ভীম ভাববে। নাহলে নয়নাই ঠিক আছে....
হা হা করে হেসেছিল নয়না তার নথ আর টিকলি দুলিয়ে," আরে আপকো মুঝ জ্যায়সে চাহিয়ে ক্যায়া? ও তো পহেলে সে সব কুছ... হা হা উসকি ক্যায়া নথ তোড়েঙ্গে আপ? বাবুজী আপ ভী না?"
গায়ে আতরের গন্ধ ছড়িয়ে হাতে মালা নিয়ে মিঠে পান মুখে ভীম সিং নয়না বাঈয়ের কোঠিতে এসে দাঁড়ায়। সামনে দাঁড়িয়ে কতগুলো মেয়ে হাসিতে ঢলে পড়ছে। তাদের সুরমা টানা চোখের ছুরিতে ভীমের জ্বালা ধরে না। তারা ইশারায় ভীমকে ডাকে তাদের ঘরে আসার জন্য। একজন এসে হাত ধরে,ওর হাতে জড়ানো মালার গন্ধ শোকে। মুন্না ওদেরকে থামিয়ে ভীম সিংকে নিয়ে ভেতরে যায়। ফরাস পাতা ঘরে বসে ভীম। মনুকে বলে নয়নাকে ডেকে দিতে। ভীমের দেওয়া টাকাটা হাতে নিয়ে মুন্না ভেতরে চলে যায় বলে যায় ভীমকে বসতে।
একটু বাদে এসেই খবর দেয় আজ দেখা হবে না কারণ বাঈ খুব ব্যস্ত আছে কারণ একজন অসুস্থ। তার জান নিয়ে টানাটানি একটু বাদে ডাক্তার আসবে। বাঈ বলেছে দরকারে অন্য কারও ঘরে আজ ভীম যেতে পারে আর মাফি ভী চেয়েছে সাহাবের কাছে।
ভীম অবাক হয়ে যায় কার আবার শরীর খারাপ হল?
জিজ্ঞেস করে," কিসকে তবিয়ত খারাব? ম্যায় কুছ করু ক্যায়া? নয়না ঠিক হ্যায় তো?"
-" মুঝে মালুম নেহি সাহাব। আপ দো চারদিন বাদ আ যাইয়ে মালুম হোতা তব তক সব ঠিক হো যায়েগা।"
ভীম বোঝে মুন্না মালকিনের পোষা অনুগত কুত্তার মত। একটা কথাও বলবে না।
মুন্না ইশারায় একটা মেয়েকে দেখায় ভীমকে ঘরে নিয়ে যেতে। সেখানে গিয়ে ভীমের মন টিকলো না। মেয়েটাকে একটু আদর করে অল্প মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে এল।
বাড়িতে এসে মুড খারাপ হয়ে যায় ভীমের ওখানে আজকাল যায় নয়না বাঈয়ের গান শুনতে একটু সুখ দুঃখের কথা বলতে তা আজ বাঈয়ের দেখাই পেল না। সুতরাং মনের ভার আর হাল্কা হল না। আরে জেনানা তো জরুর চাহিয়ে লাইফ মে। মগর মনের মত কেউ হলে তবেই তাকে ভালো লাগে ভীমের। ও কোঠিবাড়িতে তো রোজ যায় না যখন যায় তো নয়নাকেই ভালো লাগে। খুব ছোট থেকে কষ্ট করে বড় হয়েছে ভীম ওর কপালে মা বা বৌ কারও যত্নই ছিল না। টাকার লোভে বাবা বিয়ে দিয়েছিল আধপাগলী জানকীর সাথে। চিকিৎসা করিয়েছে প্রথম প্রথম। তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে দহেজে পাওয়া সম্পত্তি আর টাকাকে বাড়াতে শুরু করেছিল। মেয়ের বিয়েও ঠিক করেছিল দাদুর বাড়ির লোকেরা কম বয়েসে মেয়েকেও বিয়ে দিতে হয়েছিল।
কিন্তু ওখানে কার এত বিমার? কারও কী বাচ্চাকাচ্চা হবে নাকি? মুন্নাকে যেন কেমন লাগল ভীমের। ওর কথার কোন জবাবই দিল না। ভীম বাড়িতে এসে ঘুমিয়ে পড়ল কিন্তু আজকাল ঘুমের মধ্যে মাধবী আসে ঐ মুখটা কেন যেন সে ভুলতে পারে না।
মাধবী চলে যাবার পর শিবশংকর নাতনিকে নিয়ে দোতলাতেই থাকেন। আজকাল ওকে কাছে নিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে পড়তে বসান। স্কুলে রঘুকে দিয়ে খবর দিয়েছিলেন, একজন দিদিমণি এসেছিলেন বলে গেছেন বারবারই রুদ্রাণীকে যেন স্কুলে পাঠানো হয়। নাহলে এই ট্রমা থেকে ও বের হতে পারবে না।
শিবশংকরের রাতে ঘুম হয় না,বুকের ভেতর তোলপাড় করতে থাকে ঘুমন্ত নাতনির দিকে তাকিয়ে। ভগবানের কাছে মৃত্যু নয় পরমায়ু ভিক্ষা করেন। বৌমা তাঁকে কোন দায়িত্ব না দিলেও এই মেয়েকে যে তাঁকেই আগলে রাখতে হবে। কিন্তু এই বয়েসে কী পারবেন তিনি? ঘরদোর ছেড়ে এই মেয়ের হাত ধরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন? এই কদিন ভীম একবারও আসেনি। রঘুও আর যায় না ওখানে কাজে।
কাজে মন দিতে পারে না ভীম একটা অদ্ভুত অশান্তি তাকেও তাড়া করে বেড়ায়। ভোরবেলা গঙ্গার ঘাটে এসে তার চোখ খোঁজে স্নান করতে আসা মহিলাদের মধ্যে ভাবির মত কাউকে।
অপঘাতে মৃত্যু বলে মাধবীর কাজ তাড়াতাড়ি কোনরকমে হয়েছে। কোনরকমে সব সেরেছে রঘু। তবে কেন যেন বারবার মনে হয়েছে বৌদিমণি মরতে পারে না। আচ্ছা সেই শয়তানটা বৌদিমণির কোন ক্ষতি করেনি তো? ভেবেই রাগে গা জ্বলে ওঠে রঘুর। মেয়েটাকে স্কুলে পৌঁছে শিবনারায়ণকে বলে," আমাদের বৌদিমণি মরেনি বাবু আমার তো মনে হয় ঐ বদমাশটা বৌদিমণিকে.."
শিবশংকর হঠাৎই কানে হাত দেন," তুই চুপ কর সব আমার দোষ। কারও দোষ নয়। আমার জন্য বৌমা চলে গেছে।"
রঘু এই কথা আগেও বলতে শুনেছে তাই বলে," বাবু আমাকে একটু বলবেন বৌদিমণি চলে যাবার আগের রাতে কেন ডেকেছিলেন তাকে? আমি সেদিন খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।"
চমকে ওঠেন শিবশংকর, রঘু কী জানতে চায়?
-" আমি সে কথা বলতে পারব না। রঘু তুই আমাকে আর কখনও জিজ্ঞেস করিস না। একটু দু পয়সা আনিস সংসারে বলে কী ..সবাই চলে যা আমাকে ছেড়ে।"
রঘু আর কিছু বলেনি কিন্তু মনটা হঠাৎই খুব খারাপ হয়ে গেছিল বাবুর কথা শুনে,বুঝতে পারে কিছু একটা লুকোচ্ছেন বাবু। বৌদিমণি তো রাতে ঠিকই ছিল বরং বাবুর মন খারাপ দেখেছিল ও। না ওকে জানতেই হবে কী হয়েছিল? বাচ্চা মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যায় না।
গায়ে আতর ঢালে আজ আবার ভীম অশান্ত মনকে শান্ত করতে পা বাড়ায় নয়না বাঈয়ের কোঠির দিকে। আজ নিরাশ হয় না ভীম অপেক্ষা করার পরই একটু বাদেই নয়না আসে।
-" আরে হম তো ধোকে মে থা আজ ভী দেবী দরশন হোগা কিঁয়ু নহি। সব কুছ ঠিক হ্যায় তো উধার? উসদিন ক্যায়া হুয়া? কোঈ বিমার হ্যায় ক্যায়া?"
-" ও ছোড়িয়ে সাহাব,সব ঠিক হ্যায় অব। বোলিয়ে ক্যায়া লেঙ্গে আপ?"
নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে ভীম একটু অসন্তুষ্ট হয় তবে বোঝে ওকে এড়িয়ে যেতে চাইছে নয়না। আসলে এখানে মাঝে মাঝেই নতুন আমদানি হয়। তাকে পোষ মানাতে কয়েকদিন লেগে যায়। আবার কেউ আসে নিজের ইচ্ছেয়। অনেকদিন এই তল্লাটে রাতের আঁধারে যাতায়াত করে ভীম। তাই অনেক ছবি তার চেনা।
নয়না গান ধরে,গঙ্গার বাতাসে ভীমের নেশা ধরে। হঠাৎই গানের সুর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় একটা আওয়াজে। সাথে অনেক কিছু ভাঙার আওয়াজ। মুন্না ছুটে যায়,মাফ কিজিয়ে সাব বলে তাড়াতাড়ি করে ভেতরের দিকে যায় নয়না। ভীমের কানে আসে কিছু কথা আর চিৎকার। পরিস্কার বাংলাতে কেউ যেন বলছে আমাকে মরতে দাও। কেন এই নরকে আমাকে নিয়ে এসেছ তোমরা? সব শেষ করে দেব আমি।"
মুন্নার চাপা গলায় হুমকি শোনে। তারপরেই নয়নার গলা শোনে ধমকের সুরে বলছে," চুপ হো যা কাঁহা যায়েগী তু হাঁ?"
ভীম পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ভেতরের দিকে। এই গলা তার বড় চেনা, কে আছে ভেতরে? তবে কী এরই বিমার ছিল? নয়না কাকে আটকে রেখেছে?
-" বাবুজী আপ ইধার কিঁউ? বাঈ দেখেগী তো বহত মুশিবত হোগা। চলিয়ে বাহার মে।"
মুন্নার শাসনে ভরা গলাকে উপেক্ষা করতে পারে না ভীম। তবে ওকে জানতেই হবে ভেতরে কে আছে? কী হয়েছে?
নয়না বেশ কিছুক্ষণ বাদে আসে। ভীমকে বলে অনেকটা সময় নষ্ট হল,বেশ রাত হয়ে গেছে। ওর গান গাওয়ার মুডও এখন নেই। ভীম ইচ্ছে করলে এখন বাড়ি চলে যেতে পারে বা থাকতেও পারে। আজ অত টাকা না দিলেও চলবে।
নয়নার সামনে নোটের গোছা ফেলে দেয় ভীম। তারপরে ভেলভেটের ব্যাগটা ঢেলে দেয়। তারপর বলে," বহত মিলেগা রূপিয়া,মগর মুঝে বাতাও অন্দর মে কৌন হ্যায়? মুঝে দেখনা হ্যায় উসকো।"
নয়না হা হা করে ঝঙ্কারে হেসে ওঠে," বাবুজীকো ক্যায়া হুয়া? যব ছোড়িলোগো কী নথ তোড়নেকো বোলা তো ডর গয়ে। অব ইতনে ক্যায়া জলদি? শোচিয়ে পহেলে বহত খতরনাক পাগলী য্যায়সে হ্যায়। কাটতী ভী হ্যায়।"
কথাটা বলে নিজের ওড়না ঢাকা হাতটা বের করে দেয় নয়না। ভীম দেখে হাতের মধ্যে নীল জমাট রক্ত আর কামড়ের দাগ।
ভালোমানুষী করে ভীম," তো পাগলখানেমে ডাল দো? ইঁহা কিঁয়ু রাখা উসকো?"
নয়নার উত্তরে হতবাক হয়ে যায় ভীম। সোমবার অন্ধকার থাকতে সে গঙ্গায় নেমেছিল। এমনি নামে প্রতিদিন কারণ লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে চায় বলে। স্নান করে যখন ডুব দিয়ে ঘটিতে জল তুলছিল বাবার মাথায় ঢালবে বলে তখনই ওর হাতে লাগে দেহটা। জোয়ারের জলে কোথাও থেকে ভেসে এসেছিল বোধহয়। নয়না অনেক কষ্টে টেনে তুলেছিল তারপর দেখেছিল গলায় কলসি বাঁধা প্রচুর জল খেয়েছে। সোমবার বাবাই ওকে মিলিয়ে দিয়েছেন তাই হাতছাড়া করতে চায় না ওকে। অনেক কষ্টে একটু একটু করে সুস্থ করছে তবে প্রথম সাতদিন প্রায় বেহুশ ছিল। এখনও ঘোরে থাকে,ডঃ নিন্দের সুঁই দিয়েছে। এখনি একটা লাগানো হল তাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
ভীম নিজের গলার চেনটা খুলে নয়নার গলায় পরিয়ে বলে আরও টাকা ও দেবে তবে একবার দেখতে চায় ও মেয়েটাকে।
-" আরে কৌন বোলা ও লড়কী হ্যায়? আরে উমর হোয়ি মালুম হোতা বিধবা থী।"
ভীমের টাকার মোহ ছাড়তে পারে না নয়না। আজকাল তেমন ইনকাম নেই,ওরও বয়েস হচ্ছে। তাই হয়ত ভগবান জুটিয়ে দিয়েছেন। আর একদিন না একদিন তো বেশ্যাবৃত্তিই করতে হবে ওকে একবার যখন এখানে এসেছে। কে কতদিন বসিয়ে খাওয়াবে?
এই প্রথম নয়নার অন্দরে পা রাখে ভীম। খাটের ওপর যাকে শোয়া দেখে তাকে দেখে আর কিছুই বলতে পারে না। ওর চাওয়া আর কল্পনা যে এভাবে মিলে যেতে পারে তা ভাবেনি ভীম।
নয়নার কোঠিতে রাত কাটিয়ে রফা করে ফিরেছিল ভীম। যত টাকা লাগে ও দেবে কিন্তু ওই মেয়েমানুষকে ও নেবে। নিজের করে রাখবে তাকে। আর কেউ যেন ওর গায়ে হাত না দেয়। ঘুমের ইঞ্জেকশনের ঘোরে মেয়েমানুষটার মালিকানা বদল হয়ে গেল চিরাচরিত প্রথা মেনে। নারীর শরীর পণ্য রূপে বিকোলো এক হাট থেকে অন্য হাটে। ভীমের হাত ভরখ টাকাতে আর গয়নাতে সাজলো নয়না মাথা ঠুকলো ঘোমটা টেনে ভোর রাতে মন্দিরে। মনে মনে বলল এতে কী পাপ আছে? এক বেসাহারা বিধবাকে ঘর দিলাম পুরুষ দিলাম। অনেকের ভোগ্য না হয়ে একজনের রখেল হয়ে থাকবে। আরে ভাগ্য তোর ভালোই ছিল। নারী জীবনের কী এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়? গঙ্গা ভী যাকে গোদ দিল না তাকে ও রাখবে কী করে?
মাধবীর অতীত পুরো চেপে গেল ভীম। অতবড় কাশী শহরের একঘাট থেকে অন্য অনেক ঘাট পেরিয়ে ভেসে আসা মাধবীর খোঁজ একসময় আর পুলিশও নিল না।
সেদিন ভোরে নিজের শরীরটাকে গঙ্গা মাইয়াতে ভাসিয়ে দিল ভীম পাপ ধুয়ে দেবার জন্য। মনে মনে ভাবল হয়ত পরিতৃপ্তিতে কাটবে এবার তার জীবন ঘরে ভী গঙ্গা আর ঘাটমে ভী। রাতমে ও গঙ্গা আর শুভেমে এ।
ঘুমের ঘোরেই মাধবীর ঠাঁই বদল হল মাঝ রাতে। নয়নার লোকজন ভীম সিংয়ের বজরাতে তুলে দিল মাধবীকে। বাড়ির চাকরবাকর লোকজন জানল তীর্থ করতে বেরিয়েছে ভীম সিং। গঙ্গা মাইয়া পরিক্রমা করে ফিরবে।
সময় ঘড়ির চাকা টিকটিক করে ঘুরতে থাকে ভীমের বজরাতে মাত্র গুটিকয়েক অতি বিশ্বস্ত লোক। যারা বাইরে থেকেই সমস্ত কাজ পরিচালনা করছে। ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ সাথে নিয়েছে ভীম আর তার সাথে নয়না বাঈয়ের অভিজ্ঞ উপদেশ। দুধ মে থোড়া থোড়া করকে আফিম ডালকে পিলা দেনা। তন্দরস্ত ভী রহেগী নিন্দ ভী আয়েগী। হামকো ভুলনা মত বাবুজী।
বাইরের একজন রান্নার লোক আর মাঝি মাল্লা। ভীমের বজরা ভাসতে থাকে গঙ্গার বুকে। ঘুমন্ত মাধবীর বুকের কাছে এসে ওকে দেখে ভীম। সৌন্দর্য্য যেন উপচে পড়ছে এলোমেলো বুকের কাপড়ের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে মাধবীর বুকের খাঁজ। ভীম বাড়িতে এলে মাধবী বড় করে ঘোমটা টানত শরীরে কাপড় পেঁচিয়ে। কারণ প্রসূনের বলা কথা তার মনে কাঁটার মত বিঁধত। আজ সেই মাধবীর ঘুমের ঘোরে সবটুকুই খোলামেলা ভীমের কাছে।
ভীমের শরীর জেগে ওঠে দৃষ্টিতে ঝরে পড়ে লালসা। হয়ত সব নিয়তি তাই এত সহজে এভাবে ভাবিকে হাতের মুঠোতে পেয়ে গেছে। মনে মনে বলে আরে গঙ্গা মরনা কী এত সহজ আছে? এখন থেকে তুমি ভীম সিংয়ের আর তুমি কোথাও ফিরতে পারবে না। একবার ঘর সে নিকলানা সহজ বাত আছে কিন্তু কোঠিবাড়িতে এতদিন কাটিয়ে ঘরে ফেরা সহজ বাত নেই। তোমার খুদ কী লড়কি ভী তোমাকে ছুঁবে না। কিন্তু আমি তো ছুঁব ভী আর বহত প্যায়ার ভী করব। আরে রূপিয়া থাকলেই বা কী ঘরমে লছমী নেই। তুমি থাকবে লছমী হয়ে আমার।
ঘুমের ইঞ্জেকশন ছাড়াও ঘুমের ওষুধ আর আফিমের প্রভাবে মাধবী ঘুমিয়েই আছে গত দুদিন। মাঝে মাঝে চোখ খোলে এদিক ওদিক শূন্য দৃষ্টিতে তাকায় তারপর আবার চোখ বোজে।
পুতুল আর পুতুল খেলে না ও বুঝতে পেরেছে যে জীবনটা পুতুল খেলা নয়। ওকে ভালো করে পড়াশোনা করে বড় হতে হবে। স্কুলের শকুন্তলা ম্যাডাম ওকে খুব ভালোবাসেন। যখন খুব কাঁদছিল তখন জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন আজ থেকে বই তোমার সব,বইয়ের চেয়ে বড় বন্ধু কেউ হয় না। তাকে নিয়ে বাঁচতে হবে,একার লড়াই লড়তে হবে। ম্যাডামের দেওয়া বই নিয়ে বাড়ি আসে পুতুল কোথায় যেন ম্যাডামের মধ্যে মাকে দেখতে পায়। মা যেন বলছে তোকে বড় হতে হবে পুতুল। শুধু রাতে শোবার আগে ওর পুতুলগুলোকে আদর করে ওদের সাথে কথা বলে ঘুমোতে যায়। মা একটু একটু করে সাজিয়ে দিয়েছিল ওর পুতুলের সংসার। ওদের মধ্যে মায়ের হাতের ছোঁয়া পায়।
পুতুলের পুতুল খেলা শেষ হলেও ভীমের পুতুল খেলা শুরু। সুদখোর মহাজন ভীম মাধবীকে নিয়ে পুতুল খেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘুমন্ত মাধবীর কাপড় ছাড়ানো,গা মুছিয়ে দেওয়া সবই সে করছে তাকে ঘুম পাড়িয়ে। মাধবীকে জাগতে দেখলে সে ভয় পায়,না জানি কী কান্ড করবে আবার। গঙ্গার কুলকুল শব্দে সে মাধবীকে সাথে নিয়ে স্বপ্নে ভাসতে ভাসতে হরিদ্বারের কাছাকাছি এসে পড়ে। ততদিনে মাধবীর শরীর তার চেনা হয়ে গেছে,সেই শরীর তার বার্ধক্যের সীমায় উপনীত প্রৌঢ় মনকে ক্ষুধার্ত করে তুলেছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেছে ঝড় তুলে এলোমেলো করে দিতে মাধবীর শরীর তারপর ভয় পেয়েছে। গঙ্গা মাইয়াতে ডুব দেবার সময় যেমন আগে প্রণাম করে ডুব দেয়। তেমনি অপেক্ষা করবে মাধবীর সম্মতির। ধর্ষণ নয়, মাধবীর পূর্ণ সম্মতিতেই তাকে সে গ্ৰহণ করবে। রখেল করে রাখবে না,মাধবী যদি রাজি থাকে তবে সে তাকে বিয়ে করবে।
হরিদ্বারের কাছাকাছি একটু দূরে একটা নিরিবিলিতে বজরা রেখেছে ভীম সিং। চাকরটা বাজার করে জিনিস মজুত করতে গেছে,মাঝি মাল্লারাও ঘাট পেয়ে নেমে গেছে একটু স্থলে পা রাখতে। মদের বোতল নিয়ে চুমুক দিতে দিতে ভীম মাধবীকে দেখে। বজরার ভেতরে বিছানা জুড়ে মাধবী শুয়ে,শরীরে তার অস্থিরতা এপাশ ওপাশ করছে পায়ের কাপড় উঠে গেছে বুকের কাপড় খসে পড়েছে।
মাধবী ঘুমের ঘোরে জল জল করতে থাকে ভীম তাড়াতাড়ি করে জল নিয়ে এসে মাথাটা একটু তুলে চামচ দিয়ে জল দেয় ঠোঁট ফাঁক করে। তারপর গড়িয়ে পড়া জল মুছিয়ে দেয়। মাধবীর ঠোঁট মোছাতে গিয়ে ভীমের তৃষিত শরীর কেন যেন আর নিজেকে সামলাতে পারে না। বহুদিন ধরে যে লাম্পট্য আর তৃষ্ণা জমেছে শরীরে মনে তা আজ বিদ্রোহ করে বসে। সব প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গিয়ে ভীম মাধবীর পুরু ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে ডুবে যায় আদিম নেশায়। তারপর ঘুমন্ত মাধবীর শরীরে জড়ানো কাপড় খুলতে থাকে একটু একটু করে। গঙ্গার জোয়ারের মত আজ তার শরীরেও জোয়ার,সেই স্রোত মানতে চায় না কোন বাধা। অবশ্য বাধা দেবার মত অবস্থাতে মাধবী নেই,ঘুমের ইঞ্জেকশনের ঘোরে ঘুমোচ্ছে। আসেপাশেও কেউ নেই শুনশান চারিধার। এমনিতে দরজা বন্ধই থাকে, সাবধানী হয়ে প্রতিটা জানলা বন্ধ করে দেয় ভীম। আবছা আলোকে জোরালো করতে ঘরে জ্বালিয়ে দেয় বাতির আলো। আর সেই আলোতে একটু একটু করে বিবস্ত্র করে মাধবীকে তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ওপর।
তার আগে একবার শুধু ভেবে নেয় অনেক টাকা দিয়ে সে কিনেছে ভাবিকে নয়না বাঈয়ের কাছ থেকে। সুতরাং ওর কিনে আনা সম্পত্তিকে তো ও নিজেই ভোগ করবে। শাদীর পরও তো শোবে,সোহাগ করবে তাই আগে শুতে বাধা কোথায়?
আর কতদিন এভাবে ঘুম পাড়িয়ে রেখে গঙ্গা মাইয়ার ওপর ভেসে বেড়াবে? এবার তো ওকে ফিরতে হবে কাশীতে। আর এই ইঞ্জেকশন আর আফিমের আদত পড়ে গেলে দিনের পর দিন এটা ছাড়ানো যাবে না। তার চেয়ে বরং আগে শরীর চিনে নেওয়া ভালো। এরপর ধীরে ধীরে সব কমিয়ে একটু একটু করে পোষ মানাবে।
ঘুম যদি ভাঙে ভাঙবে,চিল্লায়েগী তো চিল্লায়েগী। কিন্তু বাইরে যদি সে চিৎকার পৌঁছয়? এর আগে কেউ যে জিজ্ঞেস করেনি তা নয়। ভীম বলেছে তার বিবি অসুস্থ মাথার গন্ডগোল আছে, ডঃ বলেছে খোলা গঙ্গার হাওয়ায় ঘুরে হাওয়া বদল করতে। তাই সে গঙ্গা পরিক্রমা করতে করতে হরিদ্বারের দিকে যাচ্ছে। বজরা তার নিজের তাই ইচ্ছে তো আছে পটনা আর কলকাত্তা ভী যাবে একদম কালীঘাট কী কালী মাইয়ার দর্শন করে আসবে।
মাধবীর ঠোঁট বন্ধ করে রেখেছে ভীম,তার পুরো স্বাদ গন্ধ সে আজ শোষণ করে নিতে চায়। মাধবী ছটফট করে ওঠে,হাত দিয়ে ভীমকে সরাতে চায়। মাথা ঝাঁকাতে থাকে। ভীমের জেদ চেপে যায় মাধবীর শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে উত্তেজনায় ওর মুখ বেঁধে ফেলে গোঙাতে থাকে মাধবী। ভীমের মনে পড়ে যায় মাধবীর ভিজে কাপড় জড়ানো নিতম্বদেশ,মাধবীর বুকের খাঁজে আটকানো ভেজা শাড়ি আর খোলা চুলের লুকোচুরি। মাধবীর ছটফটানি তাকে উন্মাদ করে তোলে। রীতিমত কুস্তি আর শরীরচর্চা করা ভীমের কাছে মাধবী তখন একটা ছোটখাটো নরমসরম পুতুল। ওর হাতদুটো চেপে ধরে ভীম,পা বেঁধে দেয় বিছানার পায়ার সাথে। নিজের অজান্তেই ধর্ষিতা হয় মাধবী শুধু ওর আচ্ছন্ন আর দীর্ঘদিনের অনভ্যস্ত শরীরটা যন্ত্রণা অনুভব করে ছটফটিয়ে ওঠে।
ওর যৌবনের ভরা বাগানে স্বামী রূপে বিচরণ করেছিল এক সময় দুই পুরুষ। একজনকে সে মেনে নিয়েছিল,যেমন মেয়েরা মেনে নেয় স্বামীত্বের অধিকার। আর প্রসূনকে সে ভালোবেসেছিল হয়ত বা তার নিরাপত্তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে নিজেকে পরিপূর্ণ রূপে সমর্পণ করেছিল প্রসূনের কাছে আর সেই ভালোবাসার ফল স্বরূপ এসেছিল পুতুল।
আজ কোন ফুলের বিছানায় নয়,মাধবীর পরনে নেই কোন বেনারসী। কেউ তাকে আদরে টেনে নেয়নি কাছে বরং তাকে অসুস্থ করে ঘুম পাড়িয়ে তাকে অসতী বানিয়ে মুখ পোড়ালো ভীম যাতে এই নষ্ট মেয়েমানুষটা আর কোনদিনই বাড়ি ফিরে যেতে না পারে আর ওকেও ছেড়ে না যেতে পারে। মাধবীর তেজ ভাঙতে পেরে আজ কুমারী মেয়ের নথ ভাঙার চেয়েও অনেক অনেক বেশি পরিতৃপ্ত হল ভীম। একসময় অনেক অপমান করেছে এই ভাবি ওকে আজ ওর বাহুতে শুয়ে কেমন ছটফট করছে খরগোশের মত।
অনেকদিনের জমে থাকা ক্ষিদে মাধবীকে কাছে পেয়ে বেড়ে গেল ভীমের। নিজের লালসা চরিতার্থ করল বারবার সে। মাধবী চোখ বুজে গোঙাতে লাগল,তার ভেঙে পড়া শরীরে হঠাৎই উন্মত্ত হাতির আক্রমণে সে কাহিল হয়ে পড়েছে। রাতে মাধবীকে ইঞ্জেকশন দুধ কিছুই খাওয়ায়নি ভীম,সে নিজেও কিছু খায়নি। দরজাও খোলেনি,পরম পরিতৃপ্তিতে আর বহুদিন বাদে নিজের কামনা চরিতার্থ করার শ্রমে মাধবীর নগ্ন শরীরে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না। চাকরটা দরজায় টোকা দিয়েছে কয়েকবার,সে একান্ত অনুগত এবং তার প্রভুর অনেক কুকীর্তির সাক্ষী সে সুতরাং আর বিরক্ত না করে বন্ধ দরজার পাহারায় থেকে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছে। বজরা এগিয়ে চলেছে তার নিজস্ব গতিপথে।
একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটছে তখন,জানলার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে আবছা আলো। ভীমের জ্বালানো বাতি নিভে গেছে সেই কখনই। মাধবী ছটফট করে আবার তার ঘুমের ঘোর কেটে গেছে। গতকাল সকালের ওষুধের কাজ ফুরিয়েছে সারাদিনে। গতকাল ভীম নিজেই উন্মত্ত ছিল তাই মাধবীকে কিছুই সে দেয়নি শুধু দুহাতে লুটপাট করেছে দস্যুর মত যা পেয়েছে।
চোখ খোলে মাধবী,কতদিন বাদে সে যেন চোখ খুলতে পেরেছে। এতদিন চোখের পাতা এত ভারী ছিল যে সে খুলতেই পারেনি তবে আজ তা হাল্কা। কিন্তু ওর গা হাত পা এত ভারী কেন? পা গুলো যেন কোথায় আটকানো মনে হচ্ছে আর কোনদিনই সে হাঁটতে পারবে না।
চোখের পাতা হাল্কা হলেও চোখ খুলতে ভয় পায় মাধবী মনে হয় কোন নরকে সে আছে মৃত্যুর পর। সে তো মরে গেছিল গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে তারপর হয়ত সেই অপরাধে তাকে নরকে এনে রাখা হয়েছে। নরকে খুব ভয় মাধবীর ছোটবেলায় মা বলত নরকে অনেক শাস্তি দেয়। হঠাৎই চোখ খুলে যায় মাধবীর আবছা আলোতে দেখে তার বুক খোলা সেখানে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। মাধবী চিৎকার করে ওঠে কে? কে?
নিজেকে ঢাকতে কাপড় খোঁজে কিন্তু খুঁজে পায় না। বিছানা ছেড়ে উঠতে যায় উঠতেও পারে না ভীম তখনও ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে,পা দুটো বাঁধা পায়ার সাথে। মাধবীর একটু একটু করে মনে পড়ে ও মরেনি,কেউ একটা ওকে বাঁচিয়েছিল। নাচ গান হত একটা বাড়িতে সেখানে এনেছিল ওকে। মাধবী চিৎকার করেছিল থাকবে না সেখানে ওরা হেসেছিল হা হা করে। শুধু একজন এসে ওর মাথায় হাত রেখে বলেছিল এটা কোঠিবাড়ি এখানে আসা সহজ বেরোনো শক্ত। এখানে যারা থাকে তাদের বেশ্যা বলে,কত ভদ্রলোক এখানে আসে তাদের গায়ে দাগ লাগে না। কিন্তু বেশ্যাদের কেউ ঘরে তোলে না।
মাধবী বলেছিল আমাকে মরতে দাও আমি মরতে চাই। সব ভাঙচুর করছিল ওরা ওকে সবাই ধরে কী একটা ইঞ্জেকশন দেয় তারপর আর কিছু মনে নেই।
মাধবী এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় লোকটাকে ভীষণ ভয় হয় ওর নিজেকে নগ্ন দেখে ওকে কী ওরা বেশ্যা করে দিয়েছে? লোকটা কে? তারপর একটু একটু করে অনুভূতিরা বলে দেয় নিজের শরীরের সর্বনাশের কথা। লোকটাকে সরিয়ে পাগলের মত চিৎকার করে কেঁদে ওঠে মাধবী,পা বাঁধা তাই গড়িয়ে গড়িয়ে খোঁজে অন্ধকারেই কাপড়। তারপরে সেই নরম কাপড়ের একটা কোণা হাতে লাগতেই সেটা টেনে নিয়ে নিজেকে আড়াল করতে চায়।
মাধবীর চিৎকারে ভীমের ঘুম ভেঙে যায় মনে পড়ে একটা ভুল সে করে ফেলেছে কাল কোন ওষুধই তো দেয়নি। তাহলে হয়ত একটু সময় পেত। এই চিৎকার আর কান্নাতে তো...
তাড়াতাড়ি এসে মাধবীর মুখ চেপে ধরে চাপা গলায় বলে," চিল্লানা মত,ক্যায়া বোলেগা সব লোগ? চুপ হো যাও। নহি তো মুখ বান্ধকে রাখ দেঙ্গে।"
মাধবীর খুব চেনা লাগে লোকটার গলাটাকে কিন্তু মনে করতে পারে না। তারপর হঠাৎই অনেকটা আলো এসে মনের জানলাগুলো একটু একটু করে খুলে দেয়। সব মনে পড়ে যায় ওর। বুঝতে পারে যার পাতা ফাঁদে পা দেবে না বলে পালিয়েছিল অজান্তেই সেই লোকটার ফাঁদে পা ফেলেছে ও। চিৎকার করে শাপশাপান্ত করে মাধবী,ভীমকে পুলিশে দেবে বলে। নরকের কীট হয়ে জন্মাবে ভীম। বাধ্য হয়ে ওর মুখ বেঁধে ফেলে ভীম। অর্ধনগ্ন মাধবীর লজ্জা নিবারণের কাপড়টা একটানে সরিয়ে ওর বুকটা চেপে ধরে। মাধবী ব্যথায় কুকড়ে ওঠে।
-" আঃ ছাড় শয়তান লাগছে।"
-" পহেলে চুপ হো যা তব ছোড় দুঙ্গি নহী তো অব একবার হোঁশ মে..কাল তো বেহোঁশ থী। আজ অভী হোঁশ মে হো যায়ে। বহত নেশা হ্যায় তুঝমে গঙ্গা দিল চাহতা হ্যায় ডুবকে মর যাউ।"
মাধবী ভয়ে কুকড়ে যায়,তার কোথাও পালানোর উপায় নেই সে বুঝতে পারে। চুপ করে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে মাধবী। হঠাৎই অদ্ভুত একটা দোলা খায় শরীরটা মাধবী বুঝতে পারে সে কোন বাড়িতে নেই মনে হয় গঙ্গাতে আছে। কিন্তু কোথায় আছে সে? এখানে থেকে কী ওদের বাড়িটা দেখা যাবে? পুতুলকে দেখা যাবে? কেমন আছে মেয়েটা? কবে বাড়ি থেকে এসেছে আজ কতদিন হল এতদিন কোথায় ছিল কিছু বুঝতে আর মনে করতে পারে না মাধবী।
মাধবী বাথরুমে যেতে চায়,ভীম বুঝতে পারে না কী বলছে ও। মাধবী গোঙাতে থাকে। ভীম মুখটা খুলে দেয় মাধবী ইশারা করে,ভীম ওকে বাথরুমের দরজা দেখিয়ে দেয়। মাধবী উঠতে চেষ্টা করে দাঁড়াতে পারে না সারা শরীর অবশ লাগে যন্ত্রণায়। ভীম ওকে জড়িয়ে ধরে মাধবীর নগ্ন শরীরটাকে পাঁজকোলা করে ধরে বাথরুমে বসিয়ে দেয় ভীম। মাধবীর সমস্ত লজ্জা আর আবরণ নিজের চোখের সামনে খশে পড়ল ঐ শয়তানটার কাছে। একেই বোধহয় নরক বলে বাথরুমে বসে মনে হল মাধবীর। ভীমকে ইশারায় সরে যেতে বলে নিজেকে জল দিয়ে সমানে ধুয়ে যেতে লাগল কিন্তু এই স্পর্শ আর লজ্জা যে আর ধোয়া যাবে না। তা বাইরের দিকে তাকিয়ে বুঝল মাধবী কোন অচেনা জায়গা দিয়ে ভেসে যাচ্ছে ওরা। এই জায়গা কখনও দেখেনি মাধবী। চোখটা জলে ভরে গেল,ডুকরে ডুকরে কাঁদল আর বারবারই ক্ষমা চাইল শ্বশুরমশাইয়ের কাছে আর মেয়ের কাছে। কেন শ্বশুরমশাইয়ের ওপর রাগ করে সেদিন গঙ্গায় ডুবে মরতে গেছিল? ও যদি রাজি না হত তাহলে তো কিছুতেই কিছু হত না। হে ভগবান কেমন আছে মেয়েটা? সে যে মা ছাড়া কিছু বোঝে না। কিন্তু মাধবী কী করে পৌঁছবে মেয়ের কাছে?
বাইরে থেকে দরজায় আলতো টোকা শোনে মাধবী," হুয়া ক্যায়া? ম্যায় আ যাউ অন্দরমে?"
নিজের নগ্ন ভেজা শরীরের দিকে তাকায় মাধবী আজ প্রসূনকে বলে মনে মনে তোমার মাধবীকে তুমি রক্ষা করতে পারলে না তুমি তোমার বাবা কেউই। সত্যি তোমরা সবাই কাপুরুষ।
ওদিক থেকে আবার তাড়া আসে,মাধবী চারদিকে তাকায় কোন কাপড় নেই বাথরুমে। এমনকি ভেতরে কোন ছিটকিনিও নেই সেটাও ভাঙা। ভীম দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করেছিল এবার সে নিজেই অধৈর্য্য হয়ে খুলে ভেতরে আসে। নগ্ন আর সম্পূর্ণ ভেজা মাধবী নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করে হাত দিয়ে,ঠান্ডায় সে কাঁপছে মনে হচ্ছে গঙ্গাজলের শীতলতা তাকে গ্ৰাস করছে।
ভীম বলে কিঁউ ঠান্ড লগ গয়া ক্যায়া? আরে চল অব মাধবীকে জড়িয়ে ভীম ঘরে নিয়ে যায় তারপর শরীরের প্রতিটা খাঁজ শুকনো করে কম্বলের ভেতরেঅব নিয়ে ঢোকে। মাধবী শুধু চাপা আওয়াজে গোঙায় তার শরীর ভেঙে আসে সম্পূর্ণ সচেতন অবস্থায় আবার ধর্ষিতা হয় মাধবী। তারপর ডুবে যায় কম্বলের অন্ধকারে তার দূর্বল শরীর।
অনেকটা বেলায় ঘর থেকে বাইরে বেরোয় ভীম ততক্ষণে বজরা নোঙর করেছে এক জায়গায়। বাইরে গিয়ে আজ দরাজ হাতে সবাইকে মিঠাই খাওয়ার টাকা দেয় ভীম। আর চাকরটাকে বলে গরম দুধে কেসর আর হলুদ দিয়ে দু গ্লাস তাড়াতাড়ি দিতে। সাথে যেন অন্য খাবারও আনে। কাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। চাকরটা মিনমিন করে বলে," হম তো নক কিয়া আপ শো গয়ে মালুম। কোই জবাব নহি মিলা অন্দর সে।"
বাইরের খোলা হাওয়া শরীরে লাগায় ভীম চাকরটাকে বলে আজ স্নানের আগে যেন ভালো করে তাকে মালিশ করে দেয়। আজ গঙ্গাতে নেমে ভালো করে স্নান করবে বাথরুমের তোলা জলে আর পোষাচ্ছে না।
চাকরটা বাইরে থেকেই হাঁক দেয় খাবার আর দুধ নিয়ে। হাত বাড়িয়ে সেগুলো নেয় ভীম। মাধবীকে ডাকে প্রথমে ভাবে কী বলবে? ভাবি? তারপর ভাবে না গঙ্গা বলেই ডাকবে। মাধবী ওঠে না ডাক শুনেও। ভীম তাকে কোলের কাছে তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে দুধ খাওয়াতে থাকে মাধবী ধাক্কা দিয়ে গ্লাস সরাতে যায় বলে ওঠে আমাকে বিষ দিন আমি মরতে চাই।
-" আরে গঙ্গা এখন তোমার মরণ নাই,দেখলে না গঙ্গা মা ভী তোমাকে ঠাঁই দিল না। সেই আমার কাছে ভেজে দিল। ও কোঠিবাড়িতে বেশ্যা হয়ে থাকার চেয়ে হামি কত প্যায়ার করছি। হমার মকান ভী বিলকুল ফাঁকা বিবিকে মরণে কী বাদ। হম তুমকো শাদী করেঙ্গে গঙ্গা।"
মাধবী ভয়ে কেঁপে ওঠে যে লজ্জায় সে মরতে চেয়েছিল আজ সেই যম তার সামনে। মাধবী মুখ টিপে ধরে ভীম জোর করে ওকে ধরে দুধটুকু ঢেলে দেয় মুখে।
তারপর বলে," আচ্ছা সে খাও পিও,ও নিন্দবালা দাওয়াই বন্ধ আজ সে। মুঝে সুবহ শাম গঙ্গামে নাহানা হ্যায় না। শাদী হোগী হামারা রাণী বানাকে রাখুঙ্গী তুঝে। ও বাঙ্গালী ছোটাবাবু ক্যায়া দিয়া থা তুঝে?"
দাঁতে দাঁত চেপে মাধবী মনে মনে ভাবে সেই জ্যোতিষীর কথাই সত্যি হল শেষে?
প্রসূনের সাথে যখন বিয়ে নিয়ে খুব অশান্তি চলছে বাবা মায়ের তখন ওরা লুকিয়ে পাশের গ্ৰামের মেলায় গেছিল ওরা। একজন জ্যোতিষীর কাছে ওরা হাত দেখিয়েছিল প্রসূন বলেছিল," আমাদের বিয়ে হবে তো?"
মাধবীর হাত দেখে জ্যোতিষী বলেছিলেন একবার কেন অনেকবার বিয়ে হবে। ওরা হাসতে হাসতে বাড়ি এসেছিল।
***********************
শিবশংকর নাতনিকে দেখে অবাক হন। যে মেয়ের পেছনে মা সবসময় পড় আর পড় বলে মাথা খারাপ করত সে মোটেই এখন বই থেকে মুখ তোলে না। কথা খুব কম বলে,দাদু ঘুমোতে বললে বলে," বই আমার বন্ধু দাদু আগে বুঝতাম না। মা দেখলে কত খুশি হত। এখন বুঝতে পারি।"
-" আর তোমার পুতুল খেলা? তুমি খেল না আমার মন কেমন করে।"
-" খেলি তো রাতে শোয়ার সময় তখন তো তুমি ঘুমোও। দাদু আমার এইট হবে ভালো করে পড়তে হবে। মা বাবা দূর থেকে দেখে খুশি হবে ম্যাডাম বলেছেন।"
বজরা ভাসতে ভাসতে কলকাতায় এসেছে। মাধবী কলকাতা শহরে পা রেখেছিল আবার একবার অন্য কারও সাথে। এই এতগুলো দিন ভীম ইচ্ছেমত গঙ্গাতে ডুব দিয়েছে। আগে মাধবী চিৎকার করত গোঙাতো এখন কিছু বলে না। সে বুঝেছে তার মুক্তি নেই সে পাপের শাস্তি ভোগ করছে কোন জন্মের পাপ আর অভিশাপ সেী নিজেও জানে না। বিয়েতে মত দিয়েছে মাধবী বেশ্যা বা রক্ষিতা হয়ে বাঁচার চেয়ে হয়ত এই জীবন ভালো তবে তার আগে নয়না যেমন টাকা নিয়েছিল মাধবী বলল তার কিছু শর্ত আছে তাহলেই সে বিয়ে করবে ভীমকে।
-" আরে হামি জানি সব,বহত বোকা আছিস তুই। পহেলে রাজি হো যাতা তো ইতনা কুছ নহি হোতা। ও নয়না তো মুঝে লুট লী। যাক যো হুয়া মুঝে তো কোহিনূর হীরা মিল গয়া। ইতনা সুখ তো মুঝো জিন্দেগী মে নেহি মিলা।"
গঙ্গাতে ডুবে মরতে চেয়েছিল মাধবী তারপর গঙ্গাতে ভাসতে ভাসতেই ধর্ষিতা হয়েছিল গঙ্গার বুকে। মা গঙ্গার মত ও নিজেও নীরবে সইতে আর বইতে শিখেছিল পাপীর পাপ। আজ কালীমাকে সামনে রেখে মাধবীর সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিল ভীম। মাধবীর দায়িত্ব নেবার সাথে সাথে কথা দিল আর কোনদিনই ঐ বাড়ির দিকে নজর দেবে না বরং এতদিন যা টাকা নিয়েছে তা ফিরিয়ে দেবে ওদের। পুতুলের পড়াশোনা বাবদ কিছু খরচ লাগলে তাও দেবে। ভীমের কাছ থেকে নেওয়া টাকায় মেয়েকে পড়াশোনা শেখাবে ভেবে ঘেন্নায় কেঁপে উঠেছিল মাধবী। তারপর নিজেই পাগলের মত হা হা করে হেসে উঠেছিল এও তো এক ধরনের জীবিকাভিত্তিক চুক্তি মেয়েটার জন্য তো কিছুই করতে পারেনি। এটা তো তার পারিশ্রমিকের টাকা আবার হেসেছিল মাধবী কৃতদাসীর পারিশ্রমিক।
মাধবীর সাথে অনেক রাত দিন সকাল কাটিয়েছে ভীম। তবে বিয়ে হল আর সুহাগ রাত হবে না তা হয় নাকি?
বজরার ঘর সাজল ফুলে। ভীম ইচ্ছেমত আদর করল মাধবীকে। মাধবীর জীবনে এই করে এক একটা দিন আর রাতে জমতে লাগল ধর্ষিতা সুদের হিসেব। দাঁতে দাঁত চেপে সব সইতে সইতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল সে।
আনন্দে ডগমগ হয়ে ভীম বলল," কৌন জানে ইশ উমরমে মেরে ভাগ্য মে সুহাগ রাত ছিল? তুমনে মুঝে হর খুশি দিয়া গঙ্গা। পহেলে শাদী সে কুছ নহি মিলা মুঝে।"
মাধবী মরে গেল গঙ্গাবক্ষেই আজ থেকে সে গঙ্গা সিং ভীম সিংয়ের বিবি।
মাধবীকে দেখে কে বলবে সে বাঙালী বাড়ির বৌ ছিল একসময়। ভীমের পাশে যখন দাঁড়ালো মাধবী তখন তার মাথায় লম্বা ঘোমটা,নাকে নথ আর সিঁথি ভর্তি মেটে সিঁদুর।
************************
বলতে গেলে রক্ষক ভক্ষক মানে মাধবীর রক্ষণাবেক্ষণ,ধর্ষণ,পাণিগ্ৰহন আর হানিমুন সব সেরে একদিন গভীর রাতে ভীমের বজরা এসে ভিড়ল কাশীতে তবে মাধবীকে নিয়ে নিজের বাড়িতে উঠতে ভরসা পায় না ভীম। কে জানে কোন সমস্যা হয় হঠাৎই। জানতে পেরেছে রঘু ওর বাড়িতে এসে এর মধ্যে দুদিন হাজির হয়েছিল। তবে ভীমের দেখা না পেয়ে ফিরে গেছে।
শিবশংকরকে না বলেই রঘু এসেছিল ভীমের ওখানে ওর কিছু সঞ্চিত টাকা দিয়ে আপাতত কিছু দিনের জন্য ওকে ঠান্ডা রাখতে। তবে এতদিন ভীম বাড়িতে নেই দেখে অবাক হয়েছিল। শুনেছিল গুরুদেবকে দর্শন করতে গেছে ভীম।
শিবশংকর নিজেও অবাক হয়েছিলেন সেদিন সেই যে বৌমা চলে যাবার পর ভীমকে ভিড়ের মধ্যে দেখেছিলেন তারপর আরেকদিন এসেছিল রঘু ঢুকতে দেয়নি। তারপর থেকে বেপাত্তা,কে জানে আবার যখন আসবে কী মতলব নিয়ে আসবে।
মাধবী জানতে পারে ওরা কাশীতে ফিরছে ওর বুকটা কাঁপতে থাকে হঠাৎই। অদ্ভুত এক মনখারাপ ওকে ঘিরে থাকে মনে হয় কেন ফিরছে এখানে? কোনদিনই তো মেয়েকে গিয়ে বলতে পারবে না মা আমি মরিনি রে এই তো বেঁচে আছি। কত না কেঁদেছে মেয়েটা ওর জন্য,মা বাবা দুই হারালো মেয়েটা।
আত্মহত্যা যে মহাপাপ তা পৃথিবীতে থেকে নরকযন্ত্রণা ভোগ করে বুঝছে মাধবী। রাগের মাথায় যে কাজ করেছিল তার ফল যে এই জীবন্ত নরক দর্শন হবে ভাবেনি। হে ভগবান! এর থেকে তো মেয়ের হাত ধরে পথে দাঁড়ানো ভালো ছিল।
ভীমকে প্রথমে হুমকি দিয়েছিল ও পুলিশকে বলবে যে ভীম ওকে আটকে রেখেছে। মরিয়া হয়ে ভীম বলেছিল," হম সব বোল দেঙ্গে তুম কোঠিমে থে। ম্যায়নে তুঝকো উঠাকে লে আয়া শাদী ভী কিয়া। আরে যাওনা আপস ঘরমে কে তোমাকে ঘরে তুলবে দেখো। ও বড়াবাবু যখন এইসব শুনবে তো আত্মহত্যা করবে। আর ও তোমার লড়কী ভী থুকবে তুম পর। সইতে পারবে তো সব? বাত তো হো গয়া ফির কিঁউ এইসব বলছ? আমি ও ঘরমে নজর দিব না। সুদ আসল ভী লিব না। উল্টে রূপিয়া দিব বলব সব সুদ ফিরত করছি। হামার দিমাগ গুরুর কাছে গিয়ে বদল হয়ে গেছে। মাফি চেয়ে লিব বড়াবাবুর কাছে বলব আমার জন্য ভাবি চলে গেছে তাই ইয়ে সব কাম মুঝে করনা।"
মাধবী নিজের ক্ষতবিক্ষত শরীর আর মনকে আয়নায় দেখে। খুঁজতে চায় সেই দাপুটে গৃহবধূ মাধবীকে যে প্রসূনকে আর মেয়েকে বকত ঝকত। সারাদিন ঘর সামলাত। নিজেকে খুঁজে পায় না মাধবী তার মাথার দাসত্বের মেটে রঙে রক্তক্ষরণের আঁশটে গন্ধ,হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি হাতকড়ার মত চেপে বসে আছে। গলার পাশে ভীম সিংয়ের লালসার শুকনো লাল দাগ। কী মুখ নিয়ে সে যাবে ঐ বাড়িতে? জীবিত থেকেও মাধবী মৃত হয়ে গেল সবার কাছে। বেঁচে থাকল বন্দিনী গঙ্গা যার শরীর কলঙ্কের কালো রঙে কালো হলেও সে আলো করে রইল ভীম সিংয়ের রামনগরের বাড়িতে।
কাশী থেকে কিছুটা দূরে এই বাড়িটা অনেকদিন আগেই কিনেছিল ভীম। কিন্তু এই বাড়িতে কেউ থাকত না। আপাততঃ মাধবীর ঠিকানা হল সেখানে। কাশীতে এসে আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ভীম। এখন তার বাড়ি ফেরার টান খুব বেশি মাধবীর অস্থির লাগে ভীমের দমবন্ধ করা ভালোবাসার আদিখ্যেতা দেখে। বিধবা মাধবী আবার সধবা হল তবে এ এক অনিচ্ছার সিঁদুরের সাজ। তবুও মেটে সিঁদুর পরে পায়ের ভারী রূপোর মল বাজিয়ে মাথার ঘোমটা নাক পর্যন্ত টেনে বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নেমে খিড়কির দরজা খুলে গঙ্গাতে নামে মাধবী। অবশ্য সবসময়ই সাথে পাহারাদার থাকে,ভীম কড়া পাহারায় রেখেছে মাধবীকে। অনেক কষ্টে ময়নাকে সে খাঁচায় পুরেছে তার মাথায় লাগিয়েছে কলঙ্কের টিপ,শরীরে বসিয়েছে আঁচড় কামড় তাকে কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারবে না সে। জানকীর সঙ্গে জীবনে কোন সুখ ছিল না না ছিল শরীরের না মনের। মাধবী কথা তেমন বলে না তবে শরীরের ঢেউ ভীমকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাছাড়া বাড়িতে এলে মেলে গরম খানা।
প্রসূনের সংসারে মাধবী লক্ষ্মীর ছোঁয়া কতটা আনতে পেরেছিল জানে না। হয়ত পারেইনি,পারলে তাকে মরতে হত না। তবে গঙ্গা সিং ভীম সিংয়ের ঘরে লছমী উপচে দিল। ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠল ভীমের। তবে বাবার বিয়ের খবর যখন ওর মেয়ের কাছে পৌঁছল তখন মরাকান্না কাঁদতে বসল মেয়ে। এতদিন সে জানত বাবার সম্পত্তি তারই আর কেউ ভাগীদার নেই। শুনেছে বাবা একটা কচি বৌ এনেছে তার যদি বাচ্চাকাচ্চা হয় তাহলে তো আর কিছুই থাকবে না তার?
একই চিন্তা মাধবীরও হয়েছিল যদি সত্যি কোনদিন এই ধর্ষণের ফলে অঘটন ঘটে? ভীম ওকে যতই স্ত্রীর মর্যাদা দিক মাধবীর জন্য ভীমের সাথে সহবাস ধর্ষণেরই সামিল। প্রতিবারই সে সারা শরীরে জল ঢেলে নিজেকে শুদ্ধ করে। তবে এক্ষেত্রে বোধহয় ভগবান মাধবীকে নিস্কৃতি দিলেন তাই তেমন কোন ঘটনা ঘটেনি এই কয়েকমাসে।
দেখতে দেখতে মাস পেরিয়ে বছর ঘু্রল। ভীম সিং নিজের শর্ত মত শিবশংকরের পা ধরে এসে ক্ষমা চেয়েছিল। ফিরে এসে কদিন বাদেই ও বাড়িতে গিয়ে বলেছিল আজ ওর জন্যই সব হয়েছে। তাই ও প্রায়শ্চিত্ত করতে গুরুদেবের কাছে গেছিল এখন থেকে আর কখনও টাকার জন্য এখানে আসবে না। শিবশংকর নিশ্চিন্তে থাকুন নিজের বাড়িতে। নিজের পকেট থেকে বের করেছিল নোটের গোছা। দেখে অবাক হয়ে গেছিলেন শিবশংকর। আজ রঘু সামনে তাই দুজনেই সামলে কথা বলছেন।
শিবশংকর হঠাৎই উত্তেজিত হলেন," একি টাকা কেন বের করছ? সেদিন ঘুষ দিতে এসেছিলে মিস্টি নিয়ে। আজ কী চাও? আমাদের তোমার কিছু চাই না আর দেবার মত কিছু নেই।"
-" আরে বাবু এ রূপিয়া হামার নেহি এ তো আপনার আছে। সমানে তো সুদ লিয়েছি আপনার কাছে। ও রঘুদাকে ভী ঠিক সে রূপিয়া নহি দিয়া। ও সব রূপিয়া এখন হিসাবে বেড়ে এত হয়েছে। আপনার রূপিয়া আপনি রেখে দিন। মুঝে মাফ কর দিজিয়ে।"
আবার শিবশংকরের পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছিল ভীম। অবাক হয়েছিল রঘু ওর আচরণ দেখে বারবারই বলছিল সবই ওর জন্য হয়েছে। তবে কী বৌমণির মারা যাওয়ার সাথে ওর কোন যোগ আছে? শিবশংকরের পাশের টেবিলে টাকার গোছা রেখে বিদায় হয়েছে ভীম। অবশ্য বুঝিয়ে বলে গেছে শিবশংকরের কাছে নেওয়া সুদের টাকা আবার খাটিয়ে সে সেই টাকা বাড়িয়েছে।
রঘু আজ শিবশংকরের মুখোমুখি দাঁড়ায় যে প্রশ্ন তার মনে বহুদিন ঘুরপাক খেয়েছে আজ তার জবাব তাকে জানতেই হবে।
-" বাবু অনেকদিন আছি এই বাড়িতে সেই ছোট্টবেলা থেকে। মাথার চুলে পাক ধরেছে,নিজে সংসার করিনি এই সংসারই আমার সব ছিল। আপনাদের সেবা করেই দিন কাটিয়েছি। আপনি বলেন আমি নাকি আপনার বড় ছেলে,বলেন আজ আমাকে সেদিন রাতে কী বলেছিলেন বৌমণিকে? আমাকে যখন খেতে দেয় সে ঠিকই ছিল। আজ বললেন ঐ বদমাইশটা সেদিন মিস্টি এনে ঘুষ দিতে এসেছিল। কিসের জন্য ঘুষ? টাকা চাইতে এলে লোকে তত্ত্ব সাজিয়ে আনে নাকি ফল,আনাজ,রাবড়ি আর মিঠাই দিয়ে?
আজ আমারে সত্যি বলেন এই আমার মাথার দিব্যি।"
শিবশংকর আর নিজেকে সামলাতে পারেন না সব হারিয়ে এখন ভরসা ঐ রঘুর ওপর। ও আগলে রেখেছে সংসারটা। পুতুলের তো এক মুহূর্ত চলে না রঘুদাকে ছাড়া ওর দারোয়ান,বন্ধু সব ঐ রঘুদা।
শিবশংকর একটু একটু করে সব বলে দেন রঘুর কাছে। অবাক হয়ে যায় রঘু," আপনার কী বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছিল বাবু? আপনি আপনার বিধবা বৌমাকে বেচতে চেয়েছিলেন ঐ শয়তানের কাছে! তাই বৌমণি আর সইতে পারেনি। শেষে গঙ্গাতে ডুবে গিয়ে পাপ জুড়োলো।"
-" বিশ্বাস কর রঘু আমার উপায় ছিল না। আমি ওকে বেচব কেন? ভীম তো বলেছিল ওকে বিয়ে করবে। আচ্ছা রঘু বৌমা তো আগেও বিধবা অবস্থায়..."
শিবশংকরের আর বাকিটা বলা হয় না রঘু বলে," হ্যাঁ
বিধবা অবস্থায় দাদাবাবুকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু সে বিয়ে আপনারা কেউ মানেননি প্রায়শ্চিত্ত করতে সব গুটিয়ে কাশী চলে এসেছিলেন। আর সেই থেকে পাপের শুরু।"
-" রঘু তুই আমাকে একথা বলতে পারলি? তোর ওপর নির্ভর করি বলে যা খুশি তাই বলবি? আমি তো তাকে জোর করিনি। তার মেয়ে আছে তাকে ছেড়ে সে মরতে গেল কোন বুদ্ধিতে?"
-" আপনি যে বুদ্ধিতে তাকে বিয়ে করতে বলেছিলেন ঐ শয়তানটাকে সেই বুদ্ধিতেই। ছিঃ ছিঃ এত কিছু হল অথচ আমি কিছু জানি না। আমার তো মনে হয় ঐ বদমাশটা আমাদের বৌমণির কোন ক্ষতি করেছে। মেয়েকে রেখে কিছুতেই মরতে পারে না সে।"
রঘুর মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে আজ শিবশংকরের ওপরও তার রাগ হয়। সত্যি মানুষ ভীষণ স্বার্থপর।
মাথা গরম অবস্থায় সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় পুতুলকে স্কুল থেকে আনতে।
রাতে শুয়ে রঘুর চোখে ঘুম আসে না একটা হিসেব কিছুতেই সে মেলাতে পারে না। তখন পুলিশ বলেছিল বৌমণির বডি ভেসে গেছে গঙ্গার স্রোতে। কিন্তু এত খোঁজ করে কোথাও তো পাওয়া যায়নি দেহ। তবে কী সত্যি সে বেঁচে আছে? ছোট্ট মেয়েটা বাবা মাকে হারিয়ে পাথর হয়ে গেছে আর সে খেলনা পুতুল কেনার বায়না করে না। সারাক্ষণ মুখ গুজে থাকে বইয়ে।
রঘুর ভাবনাতে হঠাৎই জোয়ার এল যখন মাস দুয়েক বাদে পুজোর ছুটিতে ওদের বাড়িতে দাদাবাবুর চাকরির পুরোনো জায়গার মিতুলের মা এল। মাধবীর চলে যাবার খবর মিতুলের মাও পেয়েছিল। মাধবীর হাতে বানানো দু চারটে পুতুল এখনও তাদের ঘরে আছে।
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে সে খুব কেঁদেছিল পুতুলের কথা ভেবে। একটা পরিবার কেমন করে যেন শেষ হয়ে গেল। অথচ সামান্য আয়ে কী সুন্দর করে সংসার চালাত মাধবী,কাজের শেষে তাদের বৈকালিক আড্ডা বসত। সেই আড্ডাতে গল্প হাসি মজা সবই হত। একে অপরের দেখে আসনে ডিজাইন তুলত কখনও উলের লাছি ছাড়াত তারপর সেই উলে বোনা হত সোয়েটার আর মোজা। কখনও আড্ডাতে চলে আসত ঘরের আর বরের কথাও,মুখ টিপে হাসত মাধবী।
মাধবীর শরীরের বাঁধন খুব ভালো ছিল একদম আটোসাটো যা পরত সেটাতেই সুন্দর লাগত। কপালে বড় সিঁদুরের টিপ পরা মাধবীকে ভাগ্যিস বিধবার সাজে দেখতে হয়নি।
মিতুলের ছুটিতে ওরা এসেছিল বেনারসে সাথে আরও জায়গা ঘুরে একদম বাড়ি যাবে ঠিক করাই ছিল। মিতুলের বেশি উদ্যোগ ছিল এখানে আসার পেছনে খুব দেখতে ইচ্ছে করে তার পুতুলকে।
রাতে পৌঁছে ওরা একটা হোটেলে উঠেছিল ঠিক করেছিল পরের দিন ভোরে পুজো দিয়ে বিকেলের দিকে একবার যাবে পুতুলকে দেখতে। না জানি মেয়েটা কেমন আছে?
হোটেলের পান্ডা বলে দিয়েছিল বারবারই খুব ভোরে উঠে বাবার দর্শন করতে কারণ সেদিন সোমবার খুব ভিড় হবে।
ঠেলাঠেলির মধ্যে বাবাকে দর্শন করে আসার সময় হঠাৎই ধাক্কা লেগেছিল এক মহিলার সাথে। ঝুড়ি থেকে পড়েছিল কিছুটা ফুল। ডালা সামলাতে ঘোমটা খসে পড়াতে এক ঝলক মুখটা দেখেই চমকে উঠেছিল মিতুলের মা। ও দুঃখ প্রকাশ করতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। একদম হুবহু মাধবী যেন কিন্তু নাকে নথ আর কপালে মেটে সিঁদুর। ওর সাথে চোখাচোখি হওয়াতে কেমন যেন অবাক হয়ে চমকে উঠেই হঠাৎই ঘোমটা টেনে কোথায় যে মিলিয়ে গেছিল আর দেখতে পায়নি।
এক মুহূর্তের দেখার রেশ রয়ে গেছিল মিতুলের মায়ের মনে শুনেছে কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরে অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে। তাহলে কী মাধবীর কথা এত মনে হচ্ছিল বলে সে দেখা দিয়ে গেল এভাবে? মুখটা আবার চোখের সামনে ভাসে। কিন্তু এ কোন মাধবী? মনে হচ্ছে যেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা, এক মুহূর্ত দেখেছিল যাকে তার গলায় হাতে মোটা গয়না নাকে নথ আর সিঁথিতে সিঁদুর ভরা ভরন্ত চেহারা।
কথাটা মিতুলের বাবাকে বলাতে সে হেসেই উড়িয়ে দিল বলল," ইশ্ পুজো দেবার পর কোথায় শিবকে দেখবে তা নয় মাধবীর ভূতকে দেখলে?"
মনটা খচখচ করলেও আর কিছু বলে না তবে সারাদিন মুখটা ঘুরছে ফিরছে ওর চোখের সামনে। কোথায় যে গেল আর দেখতেই পেল না। আরেকটু যদি দেখতে পেত তাহলে...উফ্ মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে কেমন।
পুজো দিয়ে নৌকোতে করে গঙ্গায় ভাসতে ভাসতে বারবার মাধবীর কথাই মনে পড়ে ওর।
********************
আজ পুতুলের জন্মদিন,একই শহরে থেকে এই এতগুলো দিন কখনই মেয়ের সামনে আসেনি মাধবী। ভীমকেও কখনও জিজ্ঞেস করেনি ও বাড়ির কথা। ভীম নিজে যেদিন গেছিল সেদিন এসে মাধবীকে বলে," সব শর্ত পুরা করে দিলাম,যা বাত ছিল আজ সব শোধ করে দিলাম। তু মুঝে খুশ কিয়া ম্যায়নে তেরি পরিবারকো খুশ রাখা।"
তারপর গড়গড় করে বলেছিল ওখানে কী হয়েছে। শেষে রঘুর ওপর রাগ প্রকাশ করেছিল," ও বেটা রঘু বহত হারামি আর চালু আছে। একদম ও ফ্যামেলির মাথা হয়ে গেছে। হামাকে শাসাচ্ছে,সব বাত শুনছে। ইয়ে ক্যায়া?"
মাধবীর রাগে গা জ্বালা করে কিন্তু তবুও কিছু বলে না। এই লোকটার গর্তে এসে যখন ঢুকে পড়েছে তখন তো সবই খুইয়েছে কিছুই আর বাকি নেই। তবু একে চটালে যদি মেয়েটার কোন ক্ষতি হয়? ভাবতেই বুকটা কেঁপে উঠেছিল মাধবীর। কতদিন তাকে দেখেনি। ভীমই খবর এনেছে সে এখন ভালো পড়ালেখা করছে। ও রঘুই ওকে স্কুলে লিয়ে যায় আবার লিয়ে আসে। অবশ্য ভীম কথা দিয়েছে মাধবীকে এই কাশীতে ও থাকতে ও লড়কির কোন লোকসান হবে না।
মাধবী আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করেছিল," ও ছিল না বাড়িতে?"
-" তেরী লড়কি? না না হামি তো দুপুরে গেছি সে তখন স্কুলে বোধহয়। তেরী জান হ্যায় না সমঝ গয়া। "
পুতুলের জন্মদিন বলে সে আগেই ভীমকে বলেছিল পুজো দিতে মন্দিরে যাবে।
-" আচ্ছা যাওগী মগর হাম ভী যায়েঙ্গে। তিন সাড়ে তিন বাজে যায়েঙ্গে,বাবা কা পহেলা দর্শন করেঙ্গে। মগর সামালকে চলনা,ঘুঙ্গট মত খোলনা।"
এত সাধ্য সাধনা করে পাওয়া গঙ্গাকে এক মুহূর্ত ঘরের বাইরে ছাড়তে নারাজ ভীম। পান্ডাকে বলাই ছিল সে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। পুজো দিয়ে মাধবী মন্দির পরিক্রমা করছিল,ভীম ছিল ওর একটু পেছনে। হঠাৎই ধাক্কা লাগে মিতুলের মায়ের সাথে প্রসাদী ফুল পড়ে যাওয়াতে বিরক্ত হয়েছিল মাধবী। কিন্তু তারপরে আর দাঁড়াতে পারেনি। মুহূর্তে ঘোমটা টেনে ওখান থেকে সরে গিয়েছিল থামের আড়ালে।
বুকটা কেঁপেছিল থরথর করে,সত্যি কী পৃথিবী গোল? নাহলে এখানেও মিতুলের মা!
ভীম ওকে খুঁজে না পেয়ে একটু ঘাবড়ে গেছিল তারপর এদিক ওদিক তাকাতেই দেখেছিল মাধবীকে। ঘটনাটা ভীমের কাছে চেপে গেছিল একদম।
রঘু দরজা খুলেই মিতুলদের দেখে অবাক হয়ে গেছিল তারপর ডাক দিয়েছিল," দিদিমণি দেখে যাও কারা এসেছে।"
পুতুল অবাক হয়ে গেছিল ওদের দেখে তারপর মিতুলকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেছিল। দুই মেয়েকে বুকে জড়ায় মিতুলের মা। রঘু ওদের ঘরে এনে বসায়।
মাধবী থাকতে কত বলেছিল," একবার কাশীতে আয়,মাধবী কেমন শ্বশুর ঘর পেল দেখবি না?"
আসা হয়নি, তবে যখন এল তখন আর সে নেই।" বাড়িটার অবস্থা দেখলে বোঝা যায় কোনরকমে দিন কাটে ওদের। শিবশংকর এলেন কথা বলতে বলতে বারবারই ছেলে আর বৌমার কথা বলতে লাগলেন। মিতুলকে ওর মা বলল," যা তোরা একটু বাইরে খেল।"
পুতুল মিতুলকে নিয়ে ছাদে আসে। অনেক জমে থাকা কথা ওকে বলতে থাকে। মিতুল বলে,তোদের ছাদটা কী সুন্দর! ঐ তো গঙ্গা দেখা যাচ্ছে।"
-" আমারও তাই মনে হত বুঝলি এখন আর ভালো লাগে না। ঐ গঙ্গাতেই তো মা ডুবে গেল আর ফিরল না। এখনও ভোরে ঘুম ভেঙে ছুটে আসি দেখি যদি মাকে দেখা যায়।"
-" মন খারাপ করিস না। আমার মা বলে মায়েরা নাকি বাচ্চাদের ছেড়ে যায় না কখনও। দেখবি হয়ত কাছাকাছি কোথাও আছে তোকে দেখছে। তোর খেয়াল রাখছে। তাই তো তুই এত ভালো রেজাল্ট করছিস।"
অনেকটা দমবন্ধ বাতাস বেরিয়ে যায় আজ ওদের বাড়ি থেকে। কিছুক্ষণের জন্য কলরবে ভরে ওঠে বাড়িটা। রঘুদা প্লেটে করে পায়েস আর মিস্টি নিয়ে আসে। ওরা বলে," এসব কেন রঘুদা? একটু চা করলেই তো হত।"
-" এটুকু নিতেই হবে বৌদিমণি আজ যে আমাদের পুতুলের জন্মদিন। আমি নিজের হাতে পায়েস করেছি। ওর মা চলে যাবার পর তো আর হয় না কিছু। এবার আমিই জোর করে করলাম। সে থাকলে ভোরে পুজো দিয়ে আসত মন্দিরে তারপর পায়েস বানাতো,লুচি ভাজত।
আবার গায়ে কাঁটা দেয় মিতুলের মায়ের আজ পুতুলের জন্মদিন? ও নিজেও ভুলে গেছে। তাহলে সকালে যাকে দেখেছে মন্দিরে সে কী? অনেকগুলো জিজ্ঞাসা আর ভয় ওকে হঠাৎ গ্ৰাস করে। নিজেকে সামলাতে বলে," রঘুদা একটু রান্নাঘরে যাই চল,ওরা গল্প করছে করুক একটু লুচি ভেজে দিই মেয়েটাকে। আজ ওর জন্মদিন।"
-" আমি বলেছিলাম মেয়ে রাজি হয়নি কিছুতেই,দেখো যদি খাওয়াতে পার। ঘরে আমি সব এনে রেখেছি দোকান থেকে।"
রঘু শোনে না ময়দা মাখতে বসে নিজেই। মিতুলের মা আলুর দম বসিয়ে হঠাৎই রঘুকে বলে," হ্যাঁ রঘুদা তখন কী যেন বলছিলে? মানে মাধবী পুতুলের জন্মদিনে পুজো দিতে যেত?"
-" হ্যাঁ গো এখানে আসার পর সে যেতই গো,আর ওখানেও নাকি শিবপুজো করত। আমাকে বলেছিল একবার দুঃখ করে এত শিবপুজো করেছি রঘুদা যে শিব দুটো বর দিয়েছিল এই বয়েসেই। কিন্তু দেখ কাউকেই রাখতে পারলাম না।"
-" রঘুদা আজ ভোরবেলা আমরা মন্দিরে গেছিলাম পুজো দিতে হঠাৎই যেন মাধবীকে দেখলাম জান। একটা মুহূর্তে সেও যেন চমকে গিয়ে ঘোমটা টেনে কোথায় হারিয়ে গেল আর খুঁজে পেলাম না। বলতে বলতে আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।"
থমকে যায় রঘুও,তার হাত তখন থেমে গেছে," কী বলছ বৌদিমণি? তুমি ঠিক দেখেছ?"
-" আমি আর কিছু বলতে পারব না রঘুদা, দেখলাম সিঁথি ভরা মেটে সিঁদুর নাকে নথ আর গায়ে গয়না পরা ঠিক যেন মাধবী।
সারাদিন আজ মুখটা ঘুরে ফিরে আসছে আমার চোখের সামনে। মিতুলের বাবা তো হেসেই উড়িয়ে দিল। এখন তোমার মুখে মাধবীর পুজো দিতে যাবার কথা শুনে আমার কেন যেন ভয় করল। মেয়েটাকে আজ দেখে রেখো বুঝলে। মা তো সে যেখানেই থাক তার মন পড়ে থাকে সন্তানের কাছে।"
অনেকদিন বাদে বাড়িটাকে হাসিখুশিতে ভরিয়ে দিয়ে মিতুলরা চলে গেছে। যাবার সময় জোর করে পুতুলকে টাকা দিয়ে গেছে বলেছে একটা পুতুল কিনে নিস।
-" আমি আর পুতুল খেলি না কাকিমা,বই পড়তে ভালো লাগে।"
-" আচ্ছা তবে বই কিনিস। ভালো থাকিস মা। রঘুদা ওকে একটু দেখে রেখো। সবসময় সাথে সাথে থেকো। দেখি যদি কাল সময় পাই আরেকবার ঘুরে যাব। পরশু তো চলে যাব।"
দিদিমণি ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। বাবুও পাশের বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। রঘু ঘরের বাইরে বসে থাকে রাতে। কতগুলো কথা ওকে আজ ঘুমোতে দিচ্ছে না। বৌদিমণি বলল ভোর রাতে মন্দিরে একজনকে দেখেছে একদম নাকি বৌমণির মত। তবে তার গা ভরা গয়না আর মাথায় সিঁদুর। কে সে? সত্যি কী কেউ ছিল? নাকি ভুল দেখেছে এই বৌদিমণি?
হঠাৎই একটা অঙ্ক মাথায় আসে রঘুর। মনে পড়ে যায় যে লোকটা ওদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল বাড়ি ছাড়ার জন্য সে আর আসে না বিরক্ত করতে। টাকা আদায় করা তো দূরের কথা বরং উল্টে টাকা দিয়ে গেছে তাদের। কেন হঠাৎই এই ভালোমানুষী? ও চাকর সব কথায় থাকতে পারে না কিন্তু.....
অনেকগুলো কিন্তু রঘুকে পাগল পাগল করে দেয়। সে ছাদে গিয়ে দাঁড়ায় মা গঙ্গাকে বলে কেমন যেন লাগছে আমার। আমাকে শান্তি দাও মা,কেন এত অশান্ত হয়ে উঠছে মনটা?
পরদিন পুতুলকে স্কুলে ছেড়ে দিয়ে রঘু ভীম সিংয়ের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। বৌমণি চলে যাবার পর এখানকার কাজ ছেড়ে দিয়েছে সে। ও বাইরে বাইরে কাজ করলে বাড়ি কে দেখবে? প্রসূনের পাওনা টাকা তখনও কিছু ছিল তাই দিয়ে চলছিল কোনমতে। এখন পুতুলের স্কুলে আর মাইনে দিতে লাগে না,বইপত্র সব ওখান থেকেই পায়। খাতাপত্র শকুন্তলা ম্যাডাম কিনে দেন। স্কুলে ভালো রেজাল্ট করার জন্য ম্যাডাম স্কলারশিপেরও ব্যবস্থা করেছেন ওর জন্য।
এখন বেশ কিছুটা সময় ওর হাতে। বাড়িটার সামনে এসে অবাক হয়ে যায় রঘু মনে হচ্ছে কতদিন এখানে থাকে না। বাইরে দুটো ষাঁড় দাঁড়িয়ে যথেচ্ছে গোবর ফেলছে। একটা ছাগল বসে আছে। তবে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। একটা সময় মাঝে মাঝে এসেছে সুদ দিতে। তখন ভীম সিংয়ের দাপটে গমগম করত বাড়ি।
কিছুক্ষণ ভেবে কড়া নাড়ে রঘু। অনেকটা সময় কড়া নাড়ার পর চোখ ডলতে ডলতে এসে চাকরটা দরজা খোলে।
-" ক্যায়া চাহিয়ে? বাবু ঘরমে নহি হ্যায়।"
-" কাহা হ্যায়?"
-" মুঝে নহী পাতা। রূপিয়া দেনে আয়ে হো তো দে দো মুঝে।"
রঘু বলে বাদ মে আয়েঙ্গে। বুঝতে পারে এখানে এখন ভীম থাকে না। আর এর সাথে ফালতু কথা বলে লাভ নেই। পা বাড়ায় রঘু, বুঝতে পারে এখানে এখন ভীম থাকে না। আর এর সাথে ফালতু কথা বলে লাভ নেই। পা বাড়ায় রঘু ভীম সিংয়ের গোলার দিকে সেখানেও ওকে দেখতে পায় না। এখানে কিছুদিন কাজ করার দৌলতে ওকে অনেকেই চেনে। ওরা জানতে চায় আবার কী রঘু কাজ করবে এখানে নাকি? রঘু মাথা নেড়ে বলে," বাবুজী সে থোড়া কাম হ্যায়। আতে হ্যায় ক্যায়া ইধার?"
-" পতা নেহি কভী কভী আ যাতে।"
অবাক হয় রঘু নিজের বাড়িতেও ভীম থাকে না। চাকরটা পড়ে ঘুমোচ্ছে। গোলাতে আসছে না। তাহলে লোকটা থাকে কোথায়?
রঘুর মনের সব প্রশ্নের উত্তরের অভিমুখ এখন একমাত্র ভীম সিং। তবে তার মুখোমুখি দাঁড়ানোর মত সাহস ওর নেই। ভয় পায় যদি ওর কোন ক্ষতি করে লোকটা তবে ঐ অসহায় বৃদ্ধ আর বাচ্চা মেয়েটার কী হবে?
আগে ওকে জানতেই হবে কোথায় থাকছে এখন শয়তানটা।
হাল না ছাড়লে সত্যি বোধহয় সাফল্য আসে একদিন। ঠিক তেমনি রঘু হঠাৎই একদিন ভীম সিংকে ফলো করে ওর রামনগরের বাড়ির হদিশ পেয়ে গেল অনেক কষ্টে।
রাস্তার পাশের একটা দোকানের কর্মচারী ওর পরিচিত ছিল। তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল এই বাড়িটা অনেকদিন পড়ে আছে। হঠাৎই এখানে এই বাবু আস্তানা গেড়েছে। বাবু প্রতিদিন আসে তারপর আবার সকালে চলে যায়।
-" শুভে মে কিতনে বাজে নিকলতে বাবু? আর কোঈ হ্যায় ক্যায়া ঘরমে?"
লোকটা কেমন যেন সাবধানী হয়ে ওঠে ওর কথা শুনে। তারপর বলে," কিঁউ? তুমসে ক্যায়া মতলব? হামলোগ আম আদমী হ্যায় হামে ক্যায়া? শুনা তো হ্যায় ও মকান আচ্ছা নহি প্রেত কা চক্কর হ্যায় কুছ। ইসি লিয়ে তো খালি পড়া থা। অভি কুছদিন সে আদমী দেখ রখা হুঁ। পহেলে তো কোই নেহি থে।"
রঘুর অদ্ভুত কৌতূহল হয়। এটা ভূতের বাড়ি? তাহলে ভীম এখানে কী করতে আসে? সত্যি কী বৌমণিকে সেদিন মন্দিরে দেখা গেছে? নাকি ঐ শয়তানটা বৌমণিকে মেরে ফেলেছে? আর ভাবতে পারে না রঘু।
আজকাল রঘুর কোন কাজে মন নেই। বাড়ির গিন্নীর মত সব কাজ তাকে সামলাতে হয়। কিন্তু একটা অদ্ভুত চিন্তা তাকে কুড়ে কুড়ে খায়। অনেক ভোরে বেরিয়ে যায়। নৌকো করে গঙ্গায় ঘোরে,তারপর ভোরে রামনগরের কাছে এসে কখনও গঙ্গা থেকে কখনও বা দূর থেকে বাড়িটার দিকে লক্ষ্য রাখে।
পুতুল স্কুলে বেরোনোর আগে কোনরকমে তাকে একটু কিছু করে খাইয়ে ছুট লাগায় স্কুলের দিকে। শিবশংকর একদিন রাগ করেন," এই তোর কী হয়েছে বলবি? সারাদিন প্রায় বাড়ি থাকিস না। কাজকর্ম করিস না ঠিক করে। বাড়িটার কী অবস্থা! তুই কী কোন খপ্পড়ে পড়েছিস নাকি?"
রঘু অবাক হয়ে যায়," কী খপ্পড়ে পড়ব আবার? মনটা ভালো লাগে না কেন জানি। দম আটকে আসে বাড়িটাতে তাই ঘুরে বেড়াই।"
রঘুর মনের হদিশ শিবশংকর পান না। নিজেই গজগজ করেন," সবাই ঘোর এদিক ওদিক শুধু আমার কোথাও যাবার নেই।"
বেশ অনেকদিন ধরে নজর রেখে বাড়িটার মানচিত্র এখন রঘুর নখদর্পণে। ও জেনে গেছে বাড়িতে কজন থাকে,আর কে কখন বেরোয়। কতক্ষণ বাড়িটা ফাঁকা থাকে সেটাও বুঝেছে অনেকদিন ধরে বাজ পাখির মত চোখ রেখে। শুধু কাউকে বুঝতে দেয়নি সে এখানে কেন ঘোরাঘুরি করে। কখনও গামছায় মুখ ঢেকে,কখনও বা রাতের বেলা এসেও দেখে গেছে ভীম সিং কখন ঢোকে বেরোয়।
মাধবীর নেশায় বুঁদ ভীম সিং,দাম্পত্যের নামে সিঁদুরের রঙে মাধবীকে আজ সে বানিয়েছে গঙ্গা। আদর করে তাকে ডাকে সে ছোটি বহু। ওর দেখা শোনার জন্য দুজন লোক রেখেছে। প্রথমজন পুরুষ মানে দারোয়ানগিরির সাথে সাথে বাজার হাট রক্ষণাবেক্ষণ সব দায়িত্বে সে। আরেকজন মহিলা যে মাধবীর পরিচর্যা করে মানে তার চুল আচড়ানো,পায়ে আলতা পরানোর সাথে সাথে ঘরের কাম কাজ আর রান্নাবান্না সবই করে।
বদ্ধ ঘরে কয়েদীর মত থেকে মাঝে মাঝে হাঁফ ধরে যায় মাধবীর। ভীম তাকে নিয়ে খেলা করে যে সুখ পায় সে সুখের ছোঁয়া অসুখের মত দীর্ঘস্থায়ী জ্বালা যন্ত্রণায় পোড়ায় ওকে। আগে আগে জেদ করত মন্দিরে যাবে বলে বলত এভাবে থাকার চেয়ে মরা ভালো ছিল। মা গঙ্গা যখন ঠাঁই দেয়নি তখন ও ফাঁসী দিয়ে মরবে গলায়।
ভীম ওকে শাসিয়েছিল," তু মর যায়েগী তো শোচ লে ও লোগ ভী মর যায়েগা। ও তুমাহারা গুড়িয়া ভী। পুরা রূপিয়া হাসিল করেঙ্গে হম।"
মাধবীর বুক কেঁপে উঠেছিল বাথরুমে কল চালিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল," কেন আমার মুক্তি নেই ঠাকুর? না না আমার মরলে চলবে না তাহলে মেয়েটার কী হবে?"
একটা সময়ের পর ক্রীতদাসীর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল মাধবী। আর সেদিন মন্দিরে হঠাৎই মিতুলের মায়ের সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার পর একটা অদ্ভুত ভয় ওকে ঘিরে ধরেছে। কোনমতেই ওর কলঙ্কের কালির ছিটে যেন মেয়ের গায়ে না পড়ে।
মাধবীকে ঘরে রাখতে পেরে ভীম নিশ্চিন্ত। আদর করতে করতে বলে," আরে গঙ্গা তু তো মুঝকো বদল ডালা। কিতনা খুশ হো যাতা মন যব ঘরমে আকে তুঝে দেখতা। বোল ক্যায়া চাহিয়ে তুঝে? আচ্ছা থোড়া দিনকে বাদ হম যায়েঙ্গে ফির বজরা লেকে বাহার। ওহ বহত আচ্ছা থে ও দিন বজরামে।"
বজরার কথা বলতে বলতে ভীমের উত্তেজনা বাড়ে। সে মাধবীকে জড়িয়ে ধরে। পাশ ফেরে মাধবী। ভীম ওকে বুকের ওপর তুলে নেয়। এমন গায়ের জোর হয়ত প্রসূনের ছিল না তবে ভালোবাসাতে ভাসত সে। এখন যেন মনে হয় কালো পচা জলে ডুবে যাচ্ছে।
-" ছোটি বহু মুড খারাব কিঁউ? আরে বোলা তো তীর্থ মে যায়েঙ্গে হম। বোল ক্যায়া চাহিয়ে তুঝে? চুপচাপ রহতী কিঁউ।"
মাধবী আস্তে আস্তে বলে," আমার ভালো লাগে না সারাদিন কোন কাজ নেই চুপ করে বসে থাকি। শরীর কেমন যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে।"
-" আরে ও তেরা ঘর মে তো কিতনা কাম করতী থী,অব রাণী য্যায়সে জী লে মেরে গঙ্গা।"
ভীমকে হঠাৎই কিছু কাপড়,সুতো,জড়ি এইসব আনতে বলে মাধবী। এই এতগুলো দিনে যে কিছু চায়নি। বরং ভীমই জোর করে গয়না পরিয়েছে ওর ভালো লাগে বলে,চুড়ির ঝমঝম আওয়াজ আর পায়ে মল না হলে নাকি বিবির মত লাগে না। সে হঠাৎ কী করবে এইসব দিয়ে?
মাধবী বলে এমনি বসে বসে হাতের কাজ করবে মন ভালো না লাগলে। ভীম গোলা থেকে ফেরার পথে বাজারে যায় জিনিস কিনতে,চাকরকে বলতে পারত কিন্তু সে নিজে আনতে চায় গঙ্গার জন্য জিনিস। মাধবী দোকান বলে দিয়েছিল,রঘুদাকে নিয়ে সে নিজেও কত গেছে দোকানে। জরি চুমকি দিয়ে বানিয়ে দিয়েছে পুতুলকে কত পুতুলের সুন্দর ঘাগড়া,আর নাগরা জুতো। পুতুলকেও বানিয়ে দিয়েছে ঘাগরা।
কয়েকদিন লোকটাকে দেখেনি রঘু আজ হঠাৎ দোকানে দেখে অবাক হল।
বলল," নমস্তে বাবুজী, জরি খরিদ রহা হ্যায় ক্যায়া? হাম ভী লেতে থে ইধার সে বৌমণিকে লিয়ে। ভাইয়া হামকো ভী দেনা ও বালা।"
কথাগুলো বলতে বলতে রঘু ভীমের দিকে তাকায়। ভীমের মুখের আকিবুকি ভয়ের রেখা ওর চোখ এড়ায় না।
ভীম ওর কথার কিছু উত্তর না দিয়ে ভালোমানুষী করে বলে," যা লাগবে লে লো হম পয়সা দে দেঙ্গে। গুড়িয়া কে লিয়ে ক্যায়া?"
রঘু বলে," হাঁ স্কুলকা কাম,অব তো মা ভী নহী রহী বেচারী। হাম আয়ে সামান লেনে।"
অদ্ভুতভাবে দুজনেই জিনিস কিনল। একজন মায়ের জন্য আর আরেকজন মেয়ের জন্য।
রঘুর মনের প্রশ্নগুলো আবার ভিড় করল ওর সন্দিগ্ধ মনের আসেপাশে।
মাধবী জিনিসগুলো দেখে খুশি হল। এত খুশি হতে তাকে এর আগে দেখেনি ভীম। বারবারই হাত বোলাচ্ছে জিনিসগুলোর ওপর। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ও বিশ্বনাথ গলির ডানহাতের দোকান থেকে এনেছেন তো? কত গেছি ওখানে রঘুদাকে নিয়ে মেয়ের বায়না মেটাতে। অনেক কিছু পাওয়া যায় ওখানে।
রঘুর কথা শুনে ভীম বলে," ও হাঁ রঘুকো দেখা উধার। ও ভী কুছ সামান খরিদতে এসেছিল গুড়িয়া স্কুলের কাম করবে তাই। ও লিতে চাইছিল না হামি জোর করেই উসকা ভী দাম দিলাম। আরে তুম হামারা বিবি গুড়িয়া তো আমারও লড়কি য্যায়সে।
মাধবীর হঠাৎ কথাটা শুনে রাগ হয় মনে হয় একটা থাপ্পড় মারে লোকটার গালে। ওকে যে দিনের পর দিন ধর্ষণ করছে সে হবে ওর মেয়ের বাবা?
তবে পুতুলের কথা শুনে মনটা কেন যেন শান্ত হয়ে গেল হঠাৎই। ভাবল ইশ্ মেয়েটা কী সেলাই পারবে?
রঘু আজকাল সত্যি অবাক ভীমের কান্ড দেখে। অনেক অন্যরকম হয়ে গেছে লোকটা। অথচ কত অত্যাচার করত একটা সময় টাকার জন্য।
*******************************
চাকরটা বাজারে যাবার নাম করে বেরোলো। মাধবী জানে লোকটা গাঁজা খেতে যায়। তবে ভীমকে কিছু বলেনি কখনও। কাজের বৌটা সব করে দিয়ে আজ বাড়ি গেছে। মাধবী ছেড়ে দিয়েছে কারণ ও জানে যে ও বন্দি ওর কোথাও যাবার জায়গা নেই। অবশ্য চাকরটা সব দিকে তালা দিয়ে বেরিয়েছে। মাধবী ঘরের মধ্যে বসে সেলাই করছে। পুতুল বানাতে বসে মনটা ভেসে গেছে কোন ছেলেবেলাতে,মনে পড়ছে কত পুরোনো কথা। হঠাৎই একটা আওয়াজ পায় মাধবী,বেশ জোরে কিছু একটা পড়ার আওয়াজ। ভয় পায় মাধবী,একটা অদ্ভুত ভয় ওর মধ্যে চেপে বসেছে। আগের সে সাহস তার নেই। সেদিন পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হবার পর বারবার মনে হয়েছে কখনও যদি লোকে জেনে যায় বিধবা মাধবী নকল মৃত্যুর অভিনয় করে লোকের চোখে ধুলো দিয়ে শ্বশুরবাড়ি আর সন্তান ছেড়ে দিব্যি গা ভর্তি গয়না পরে সুখের সংসারে সহবাস করছে আরেক অন্য পুরুষের সাথে। তাহলে সমাজ কী বলবে? আর পুতুল? সে তো এখন বড় হয়েছে তার কাছে এই নষ্টা মায়ের চেয়ে বোধহয় তার মৃতা মাই ভালো। অনেকদিন রাতে স্বপ্ন দেখেছে মাধবী পুতুল তাকে দেখে ঘেন্না করেছে বলেছে তুমি তো মরে গেছিলে মা আবার কেন ফিরে এসেছ? তুমি নোংরা হয়ে গেছ মা,যাও এখান থেকে।
ঘুমের মধ্যে ডুকরে কেঁদেছে মাধবী ভীম উঠে বলেছে," আরে ক্যায়া হুয়া? রো রহী কিঁউ আ মেরে পাশ।"
ভীমের বাহুর নাগপাশে আবার ছটফট করে উঠেছে মাধবী।
বাইরের উঠোনে একপাশে একটা বড় কুয়ো আছে। ভীম বলেছিল ওখানে নাকি কে ডুবে মরেছিল কোন একসময় তাই বাড়িটা বিক্রি হচ্ছিল না। কিন্তু এ বাড়ি তার কাছে তো স্বর্গ।
-"বাহার কা আদমী না আসে তো আচ্ছা। মেরে লিয়ে তো এ বিলকুল হাওয়া মহল হ্যায়। পাস মে ভী গঙ্গা আর সাথ মে ভী গঙ্গা।"
ভূতে ভয় নেই মাধবীর সে ভয় পায় মানুষকে। তাহলে কী চাকরটা ফিরে এল? মাধবী ডাক দেয় চাচা..
ওদিক থেকে কোন সাড়া না পেয়ে মাধবী বাইরে এসে দাঁড়ায় ঘোমটা টেনে,দরজার দিকে তাকায় সবই তো বন্ধ। তাহলে?
হঠাৎই পেছন থেকে কে যেন তার মুখ চেপে ধরে। মাধবী চিৎকার করে উঠতে যায় কিন্তু কথা বলতে পারে না। শুধু হাত ছুঁড়তে থাকে,তার চুড়ির আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে টুংটাং করে।
মাধবীকে এক ঝটকায় লোকটা ঘাড়ে হাত দিয়ে সামনের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। ততক্ষণে মাধবীর ঘোমটা খুলে গেছে মাথা থেকে। দুজনেই দুজনকে দেখে চমকে ওঠে। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় হঠাৎই মাধবীর,আতঙ্কে চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি করে রঘু ওকে ধরে বারান্দার খাটিয়াতে বসিয়ে দেয়।
রঘুর চোখে অগাধ বিস্ময় তাহলে মিতুলের মায়ের কাছে শুনে যে ছবি সে এঁকেছিল,যে চিন্তা তাকে রাতের পর রাত ঘুমোতে দেয়নি তা ঠিক।
এক নিমেষে সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায়। বৌমণি বেঁচে আছে,বিশ্বনাথ মন্দিরে যাকে মিতুলের মা দেখেছিল সে আর কেউ না বৌমণি। তাই তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তার মানে বাবুর কাছে বিয়ের কথা শুনে বৌমণি হয়ত মরতে গেছিল ঠিকই কিন্তু ঐ শয়তানটা যে করেই হোক তাকে ধরে এনে এইখানে আটকে রেখেছে।
এতক্ষণে মাধবীর দিকে ভালো করে তাকায় রঘু। একি! বৌমণির সিঁথি ভরা সিঁদুর,হাত ভর্তি চুড়ি পায়ে মল এ কাকে দেখছে সে?
রঘুর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে," ছিঃ আর কত নাটক দেখাবে বৌমণি? মেয়েটার এখনও চোখের জল শুকায়নি আর তুমি তো মহা সুখে আনন্দে রাজরাণী হয়ে আছ। গরীবের ঘরে মন টিকছিলো না তাই বুঝি পালিয়ে এসেছ এভাবে? মেয়েকে বলব তোর মায়ের জন্য চোখের জল ফেলিস নে সে মহাসুখে আছে। হে ভগবান কাকে বিশ্বাস করেছিলাম!"
হঠাৎই রঘুর পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে মাধবী," আমার পুতুলকে তুমি কিছু বোল না। কবেই আমি গলায় দড়ি দিতাম। শুধু মেয়েটার জন্য এত কিছু সয়েও বেঁচে আছি।"
-" কী করে এত কিছু হল আমাকে বল? আমি পুলিশ নিয়ে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। পুতুলের স্কুলের শকুন্তলা ম্যাডাম খুব ভালো। ওঁর স্বামী উকিল কিছু ব্যবস্থা হবেই। তুমি চল আমার সাথে।"
ফুঁপিয়ে কাঁদে মাধবী," তোমাদের বৌমণি যে নষ্ট হয়ে গেছে, পাকে ডুবে গেছে তার গলা অবধি আমার আর ফেরার উপায় নেই।"
হঠাৎই বাইরে পায়ের শব্দ শোনা যায়,চমকে ওঠে মাধবী," রঘুদা তুমি এক্ষুনি পালাও যেভাবেই হোক। নাহলে লুকোও কোথাও। তোমাকে দেখলে অনেক বড় বিপদ হবে।"
রঘু ছুটে গিয়ে বাগানের কোণে গাছটাতে তড়তড়িয়ে উঠে পাশের জঙ্গলে নেমে যায়। মাধবী নিজেকে সামলে ঘরে গিয়ে দরজা দেয়। চাকরটা এদিক ওদিক দেখে একবার তারপর দরজার পাশে ওর থাকার ছোট ঘরটাতে ঢোকে। ও জানে এইসময় বহু রাণী বিশ্রাম নেয়।
রঘুকে দেখে অবাক হন শিবশংকর আজ সারা দুপুর তার পাত্তা নেই। অগত্যা নিজে একটু কিছু মুখে দিয়েছেন। কোথায় গেল সে? দিদিভাই কার সাথে ফিরবে খুব চিন্তা হয় তাঁর।
বিকেলে দেখেন সে ফিরল দিদিভাইকে সঙ্গে নিয়ে। রাগে ফেটে পড়েন শিবশংকর," হতভাগা গাজা মদ ধরেছিস নাকি? কোথায় থাকিস আজকাল?"
-" আপনি চুপ থাকেন,আমার মাথা খারাপ করেন নি। সে ধরলে বরং ভালো ছিল। অনেক কিছু ভুলে গিয়ে শান্তিতে থাকতাম।"
পুতুল ব্যস্ত হয়ে ওঠে," ও দাদু তুমি এখন চুপ কর,এই দেখ রঘুদার হাত পা কেমন ছড়ে গেছে পড়ে গিয়ে। দাঁড়াও আমি ওষুধ লাগিয়ে দিই তোমাকে।"
-" কী করে হল সব?"
রঘু কোন উত্তর দেয় না। পুতুল ঘর থেকে ওষুধ এনে লাগাতে যায়। রঘু বলে," লক্ষ্মী মা আমার,বড় মায়াতে জড়িয়ে ফেলেছ দিদি আমারে।"
রঘুর মন শান্ত হয় না,কিছুই তো জানা হল না কী করে এমন হল বৌমণির? তার বিয়েই বা হল কিভাবে? তাহলে ভীমই তাকে বিয়ে করে আটকে রেখেছে? এত লোভ ছিল লোকটার বৌমণির ওপর? তাই ওর খারাপ চোখের হদিশ দাদাবাবুও পেয়েছিলেন। আগে জানলে অন্ধ করে দিত লোকটাকে। ইশ্ এই লোকটার ঋণ শোধ করে এই পরিবারকে বাঁচাতে ওর কাছে কাজও করেছে। কেন ওকে মেরে জেলে গেল না?
সুযোগের অপেক্ষায় রইল রঘু দিন পনেরো বাদে আবার সুযোগ এল পেছনের জঙ্গল পেরিয়ে গাছ বেয়ে বাড়িটাতে ঢোকার। আজ আর তাকে দেখে অবাক হল না মাধবী। সেদিন রঘুকে দেখে সে অবাক হলেও পরে মনকে শান্ত করেছিল এই ভেবে যে অন্ততঃ কেউ জানবে তার জীবনের গল্প। নিজের অনিচ্ছাকৃত কাদায় ডুবে যাওয়া কালিমালিপ্ত জীবনের গল্প কাউকে বলে সে হাল্কা হবে।
ভীম এখন মাধবীকে বিশ্বাস করে সে জানে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছে ভারী শেকল বুকে বেঁধে ওকে যে আর নিস্তার নেই মেয়েমানুষটার। দক্ষ শিকারীর মত শিকারকে খাঁচায় ভরে পরিতৃপ্ত সে। মাঝে একদিন হঠাৎই নয়না বাঈয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। ভীম এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। নয়না বাঈ এগিয়ে এসেছিল," কভী হমকো ভী য়্যাদ কিজিয়ে সাহাব। ও রখেল কো রাখ দিয়া ক্যায়া? না বেচ ডালা?"
ভীম মুখ খোলেনি শুধু বলেছিল," ক্যায়া চাহিয়ে?"
-" আরে ইতনা আচ্ছা মাল মিলা আপে কুছ বকশিশ হামে ভী দিজিয়ে। বাজার বহত খারাব হ্যায়।"
কিছু না বলে বেশ কিছু টাকা দিয়ে রাগে গজগজ করেছিল ভীম।
কাজের বৌটা ছুটি নিয়েছে,ভীম রাগ করলেও মাধবী বলেছে ও সামলে নেবে। সব কাজ করার অভ্যেস আছে ওর। চাকরটাকে সব দেখতে বলে গেলেও ও মাধবীকে তোষামোদ করে ঠিক বেরোয় বাইরে।
আজ রঘুর কাছে নিজের পাপের জীবনের খাতা একটু একটু করে খুলতে থাকে মাধবী। সেদিন অন্ধকার থাকতে রাগের মাথায় আত্মহত্যা করে গঙ্গায় ঝাঁপ দেওয়া থেকে শুরু করে কোঠিবাড়িতে ঠাঁই পাওয়া থেকে এবং পরে ভীমের খপ্পড়ে পরা পর্যন্ত সব।
মাধবীর চোখের জল এখন শুকিয়ে গেছে। নিজের জীবনের কাহিনী বলতে বলতে তার চোখ রাগে দুঃখে লাল হয়ে যায়।
-" রঘুদা আমাকে এই লোকটা কিনে নিয়েছে অনেক টাকার বিনিময়ে। আমাকে ওরা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুমের ঘোরে....সে যে কী নিষ্ঠুর অত্যাচার! তারপর একটা চুক্তি করলাম বুঝলে হা হা হা হা। আরে ব্যবসাই যখন করছি তো আমি বা আমার শর্ত রাখব না কেন? বললাম ঐ বাড়িতে আর যেন কখনও বিরক্ত করতে না যায়। সব সুদের টাকা ফেরত দিয়ে আসে। আর বাবার কাছে যেন ক্ষমা চায়। আমার মেয়ের যেন কোন ক্ষতি না হয়। শর্তের বিনিময়ে তোমাদের বৌরাণী ঢুকল এক শয়তানের গর্তে।"
রঘু কানে আঙুল দেয় আর সহ্য করতে পারে না।
-" ওহ্ এত পাপ করেও কী করে ভালো আছে লোকটা!ইচ্ছে করছে ওকে খুন করে আমি জেলে যাই।"
মাধবী পাগলের মত হেসে গড়িয়ে পড়ে," রঘুদা আমাকে আর বিধবা কোর না। ওকে মারলে যে আমাকে আবার কোঠিতে ফিরতে হবে। তার থেকে এই জীবন মেনে নিয়ে বেঁচে থাকাই বোধহয় ভালো। আমার জন্য আমার মেয়ের গায়ে যেন কালি না লাগে। তাই আমি লুকিয়ে জীবন কাটিয়ে দেব। আমার যে এখনও অনেক কাজ বাকি।"
-" বৌমণি আমরা যদি অনেক দূরে কোথাও চলে যাই।"
-" তা হয় না রঘুদা। একবার মাধবী বিধবা হয়ে এই পরিবারে ঢুকে অনেক অভিশাপ কুড়িয়েছে। আজ ব্যাভিচারিণী মাধবী আর ফিরবে না তোমাদের সমাজে। তবে মেয়েটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে।"
রঘুর চোখটা চকচক করে," দেখবে তাকে? একদিন আসবে স্কুলের ওখানে দূর থেকে দেখবে।"
-" না রঘুদা,তুমি ওকে দেখো। আর তুমিও এখানে কখনও এসোনা। তোমাকে কেউ ধরে ফেললে আমাদের সবার বিপদ।"
রঘু ফিরে এসেছিল সেদিন তারপরে আর কখনও যায়নি সেখানে। শুধু মাঝে মাঝে দূর থেকে বাড়িটাতে চোখ রাখত মনে মনে ভাবত তার বৌমণি আছে সেখানে।
ভীমের কাছ থেকে ওর ফেলে আসা সংসারের কিছু কিছু খবর পায় মাধবী। জানতে পারে ওর শ্বশুরমশাইয়ের শরীর খারাপ শুনে ডাক্তার পাঠিয়ে দিয়েছিল ভীম। দেখতে দেখতে কয়েক বছর পেরোল ছোট্ট পুতুল এখন রুদ্রাণী। তাকে রুদ্রাণী বলে ডাকলেই সে খুশি হয় এখন। তবে বারো ক্লাসের বোর্ডের পরীক্ষাতে যে সে এত ভালো করবে তা নিজেও ভাবেনি তেমনভাবে।
অনেকদিন বাদে রঘু বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ আর গাছ বেয়ে সে আসেনি। চাকরটাকে বেরিয়ে যেতে দেখে দরজার কড়া নাড়ে। মাধবী অবাক হয় বাইরে তালা তবুও কে কড়া নাড়ছে। দরজার ফাঁক দিয়ে একটা কাগজ গলিয়ে দিয়ে চলে যায় রঘু। অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে এসেছে সে,কিন্তু জানে বৌমণি নিশ্চয় এসেছে দরজার ওপাশে। সে মলের আওয়াজ পেয়েছে।
মাধবী তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে কাগজ নেয়। কে কড়া নেড়ে কাগজ দিয়ে গেল? লেখাগুলো পড়ে চোখের জল আটকাতে পারল না মাধবী। সে বারণ করেছে বলে রঘুদা আর আসে নি। তবে রঘুদা যা লিখেছে সেটা শুনে ঘরে রাখা ঠাকুরের ছবির সামনে শুয়ে পড়ে অনেক কাঁদল মাধবী। ওর মেয়ে খুব ভালো ফল করেছে সাবিত্রী ম্যাডাম ওকে এলাহাবাদ নিয়ে যেতে চান। ওখানে হস্টেলে থেকে পড়বে মেয়ে পড়াশোনার খরচ সব পাবে। মাধবী কী একবার তাকে দেখতে চায়? রঘুদা তাকে নিয়ে মন্দিরে যাবে আগামীকাল ভোরে কারণ আর কয়েকদিন বাদেই সে চলে যাবে।
রাতে ভীম ফিরলে মন্দিরে যাবার কথা বলে ভোরে মাধবী। ভীম এক কথায় রাজি হয়ে যায় তবে বলে সে যেন সাথে কাজের মেয়েটাকে নিয়ে যায়। কাল সকালে তার অন্য কাজ আছে।
মাধবীর রাতে ঘুম হয় না। সে ছটফট করে, যদি ঘুমিয়ে পড়ে আর দেরি হয়ে যায়? ভোরবেলা তাড়াতাড়ি করে তৈরী হয়ে সে বেরিয়ে পড়ে ঘাটের পথ ধরে গঙ্গা বেয়ে। মন্দিরের গেট দিয়ে ঢোকার সময় বুকের ভেতর কাঁপতে থাকে মাধবীর রঘুদা কোথায়? কোথায় ওর মেয়ে? ওরা আসবে তো? হঠাৎই দেখে রঘুদা একটু দূরে দাঁড়িয়ে। এক সাথেই মন্দিরে ঢোকে ওরা একটু আগে পিছে। মাধবীর মুখ ঘোমটা ঢাকা আজ তার ঠাকুর দর্শনে মন নেই মেয়েকে দেখে তার আর চোখ সরে না। কত বড় হয়ে গেছে পুতুল! কার মত দেখতে হয়েছে? এখন তো একদম প্রসূনের মতাই লাগছে। অনেকদিন বাদে প্রসূনের মুখটা বিবর্ণ স্মৃতিতে হাতড়াতে থাকে মাধবী। মেয়ে জল ঢালছে,মাধবী দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছনের লোক তাড়া দেয়। ওর কাজের মেয়েটা ওর হাত ধরে বাইরে আনে।
বাইরে এসে আবছা আলোতে মাধবী ঘোমটা ফাঁক করে মেমেটাকে দেখে যেন আর মন ভরে না। তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে কিন্তু উপায় নেই। রঘুদা ওকে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়। ঘাটের দিকে পা বাড়ায় মাধবী। আকাশে তখন সূর্যের হামাগুড়ি,লাল আলোতে রাঙা আকাশ। মাধবীর মনটা রাঙা আজ অপত্য সুখের ভালোবাসার সুবাসে।
মাধবী বেরোনোর পরই ভীম বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে মন্দিরের উদ্দেশ্যে। কেন যেন খটকা লেগেছিল হঠাৎই মাধবীর মন্দিরে যাওয়া নিয়ে। তাই বেড়ালের মত অনুসরণ করেছিল। আর যা ভেবেছিল ঠিক তাই। তাহলে কী ওর বন্দিনী গঙ্গার সাথে রঘুর যোগাযোগ আছে? নাহলে একই সময়ে দুজনে মন্দিরে? মেয়ের জন্যই তাহলে মন্দিরে গেছিল গঙ্গা। হঠাৎই রাগ হয়ে যায় ভীমের। সত্যি বোধহয় নারীর মনের খবর জানা শিবের অসাধ্য। কিন্তু কী করে যোগাযোগ হল ওদের?
ওকেই বলতে পারত মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে করছে। দুএকবার ভীম বলেছেও সে কথা। তখন নৌটঙ্গী করেছে সে মেয়ের ছায়া মাড়াবে না। তাহলে এখন কী হল?
বাড়িতে এসে ভীমকে দেখে অবাক হয় মাধবী। ওর পরনে ধুতি কপালে টিকা। যেন মন্দির থেকে পুজো দিয়ে এসেছে। চমকে ওঠে মাধবী তাহলে কী? নিজেকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে মাধবী। দেখা যাক ভীম কী বলে? আজ সে আর কাউকে ভয় পায় না।
প্রসাদ মাথায় ঠেকিয়ে ভীম নিয়ে মাধবীকে বলে," ছোটি বহু ঘর মে আ যাও। বাত আছে।"
মাধবী বুঝতে পারে আজ মন্দিরে না যেতে চাওয়া থেকে সব কিছুই ভীমের চালাকি। সে নিশ্চয় জানে যে মেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে। কিন্তু কিছু বলেনি ওকে। অথচ সে কথা দিয়েছিল যে মাধবীর সাথে সাথে ওর পুরো পরিবারের দায়িত্ব নেবে।
আজ আর ভীম বাইরে বেরোয় না। ভীমের বাইরে বেরোনোর সময়টা মাধবীর কাছে একমুঠো খোলা আকাশ। সেই সময়টা সে নিজের খেয়ালে ডুবে যায় তার পুতুলের সংসারে। নানান পুতুল বানিয়ে তাদের সংসারের তদারকিতে আর সুখী জীবনের স্বপ্নের জাল বুনে সময় কেটে যায় মাধবীর। ঘর সংসার সামলে সে একটা কাজই পারত তা হচ্ছে পুতুল বানানো। নিজের অনেক অতৃপ্তি,শখ আর ভালোলাগা খুঁজে পেত এই কাজটাতে। এই সংসারে হাতা খুন্তি নিয়ে ঠুকঠাক করা তার নেই। এখানে লোকই সব করে যায়। ছোটি বহু এই অন্ধকার পাতালপুরীর বন্দিনী। তার ছাদে ওঠা বারণ,জানলা খোলা বারণ। পরপুরুষের মুখ দেখা বারণ। হাসি পায় মাধবীর এই মধ্যবয়স্ক পুরুষটাকে দেখে সে নিয়মিত চুল রঙ করে শরীরচর্চা করে দামী সুগন্ধি আতর মেখে ওকে যৌনতার পাগল করা সুবাসে ভাসাতে চায়। যেখানে কোন সুখ পায় না মাধবী বরং তার দেহের কোটরে কোটরে এখন শুধুই অসুখ। বারবার স্নান করে মাধবী নিজেকে শুচি করে প্রচণ্ড শীতেও রাতে ঘটি ঘটি জল ঢালে। অথচ তাকে নিয়ম করে মাথায় মেটে সিঁদুর পরতে হয় হাতে চুড়ি বালা পরে পূর্ণ শৃঙ্গারে সাজতে হয় ওকে।
মাধবীর হাতে দাসত্বের বালা চুড়ি আর তার প্রভুর পরানো সিঁদুর না দেখলে রাগ হয় ভীমের বলে," আরে ও কোঠিবাড়িতে ছিলে তুঝে লায়া ইতনা রূপিয়া দেকে,সিন্দুর ভী ডালা। ফির অ্যায়সে রহতী কিঁউ। পিছলে জীবন কো ভুল যা অব তু মেরে বিবি। কথাটা শুনে প্রথমে অসুখে মন ভরে যেত চিৎকার করতে ইচ্ছে করত। এখন আর কিছু বলে না,মনে পড়ে যায় জ্যোতিষীর কথা। বিয়ে হবে,অনেকবার বিয়ে হবে।
সমস্ত অসুখের মধ্যে দুটো জায়গা তার শান্তির জায়গা ঠাকুরের সংসার আর পুতুলের সংসার। যদিও ঠাকুরের কাছে সে প্রতিনিয়তই মনের অসুখে বলে আমাকে মৃত্যু দাও তারপর আবার নিজেকে সংযত করে বলে না না এখনি নয়। আমি মরে গেলে তো ওরা ভেসে যাবে। আমার মেয়েটাকে ভালো রেখো ঠাকুর ও যেন মানুষের মত মানুষ হতে পারে।
এতদিন যা করেনি সে আজ তা করেছে ঘোমটার তলা থেকে দু চোখ ভরে দেখেছে তার সন্তানকে। ইশ যদি একবার তাকে ছুঁয়ে দেখতে পারত মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতে পারত। আশীর্বাদের কথা ভেবে চমকে ওঠে মাধবী। না না ওর ছোঁয়া যেন না লাগে মেয়েটার গায়ে।
দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পায় মাধবী। ভীম নির্লজ্জ সে বাড়িতে থাকা দুজন কাজের লোককে তোয়াক্কা করে না। ইচ্ছেমত মাধবীকে নিয়ে ঘরে ঢোকে। অনেক টাকা খরচ করছে ছোটি বহুর জন্য তাই এটুকু কে সে তার অধিকার বলে সে মানে।
মাধবী একটু চমকে ওঠে তার সকালের খুশিটুকু অনেক আগেই উবে গেছে ভীমকে দেখে। দরজা বন্ধ করে কী করবে লোকটা? সেই আদিম খেলায় মাতবে? না অন্য কিছু?
-" ডর গয়ি ক্যায়া? আরে ডর তো মুঝে লগ রহা অব। তুঝে ছুপাকে রখ্যা আর তুনে পাঙ্খ মেল দি?"
মাধবী বলে," কী বলতে চাইছেন আপনি?"
-" আরে ও যো লড়কীর সাথে দেখা করতে মন্দির মে ভাগকে গয়ী সুবহ সুবহ যদি ওর মালুম হয় ওর মা বেশ্যাবাড়িতে ছিল আর এখন ভী বেশ্যাবৃত্তিই করছে তো কেমন লাগবে? ওদের ভালোর জন্য তোকে ছুপাকে রখা ম্যায়নে ইঁহা। তো তু ঝুট বোলকে বাহানা বানাকে গয়ী ভেট করনে বেটি সে। ও শালা রঘু উসে তো ম্যায় দেখ লুঙ্গা।"
মাধবী কঠোর স্বরে বলে," আমি কোন কথা বলিনি,ওরা আসবে আমি জানতাম না।"
-" মগর মুঝে পতা থা তু কিঁউ যা রহী মন্দির মে।"
মাধবী চোখে চোখ রেখে বলে কেন?
-" আরে বেটি কি খুশ খবর মিলা না?"
-" কোন খবর? কই আপনি তো কিছু বলেননি আমাকে। কী খবর পুতুলের? আপনি বলেছিলেন সব খবর আমাকে দেবেন ওর।"
ভীম চুকচুক আওয়াজ করে," আমি কী স্কুলের মাস্টার আছি যে সব খবর মিলবে আমাকে? মগর তুঝে ক্যায়সে মিলা ও তো মুঝে জাননা থা। জান ভী গয়ে। ও রঘুকো পাতা হ্যায় যো তু ইধার হ্যায় জিন্দা। কব আয়া ও শালা হারামী ইধার? ক্যায়সে খবর মিলা?"
-" আমি ছাদে পর্যন্ত উঠি না কেউ জানে না আমি কোথায়? কী করে জানব আমি? নিশ্চয় আপনার ডেরাতে ও গেছিল সেখানে কেউ ওকে বলেছে কিছু?"
-" সব শালে কো দেখেঙ্গে হম। এত সাহস কার হবে? কিসিকো পতা নহি কুছ। হামি এখানে থাকি কে জানে? ঐ জন্য তো সারাদিন কভী রাত মে ভী ওদিকে থেকে যাই। রঘু এখানে এসেছিল নাকি? বোল মুঝে? লড়কির বাত ক্যায়সে মালুম তুঝে?
মাধবী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আজ ও দাঁতে দাঁত চেপে সব সইবে কিন্তু রঘুদার কথা বলবে না। একটা খবরের কাগজের টুকরো নিয়ে আসে মাধবী ওটা চিঠির সাথে রঘুদাই দিয়েছিল। ও বলে কাজের বৌটা এটাতে করে কিছু এনেছিল তাতেই ও দেখেছে খবরটা।
ভীম বিশ্বাস করে না ওর কথা একটা গভীর চক্রান্ত ওর চোখে ধরা পড়ে। বারবার মনে হয় রঘু নিশ্চয় আসে এখানে।
মাধবীর হাত দুটো চেপে ধরে ভীম কামড় বসায় ওর বুকে তারপর বলে," যেদিন গঙ্গামে ডুবতে গেছিলি। কোথায় ছিল ও লড়কী। হাম খুদ দেখা তু দেখ রহী থী উসে দূর সে ও রঘু ভী থা সাথমে। তবে ও রঘুকে যদি এখানে কখনও দেখি তো জান লিয়ে লিব ওর।"
মাধবীর বুক কাঁপতে থাকে,ভীম ওর বুকে চেপে বসেছে ওর থাবা,নখ বসাচ্ছে ওর শরীরে। আস্তে আস্তে বলছে," সব ভুল যা গঙ্গা,ম্যায় তেরী পতি তু মেরী সেবা দাসী ব্যাস। আর ক্যায়া চাহিয়ে বোল তুঝে?"
মাধবী জানে ভীম এখন দিলদরিয়া হয়ে গেছে মাধবীর শরীরের স্রোতে ভেসে। সব হারিয়ে বোধহয় একটা অস্ত্রই আছে ওর যা দিয়ে এই বুড়ো জানোয়ারটাকে কাবু করা যায়।
ভীম ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে," ভুল যা সব কুছ। ম্যায় হুঁ না সব ভুলা দুঙ্গী তুঝে। কী কাম আছে ও আবার পুরোনো কথা মনে রাখার। মেরে ভী তো এক লড়কী হ্যায় না,রাগ করে কোন বাত করে না। হম ভী ছোড়ে দিয়েছি,আরে সারা জিন্দেগী বাপ সুখ পায়নি একবার সেটা তো ভাব। আরে এ সমাজ বহত খারাব হ্যায়। তেরা ও শ্বশুর বুঢ্ঢা কো দেখ না। ও ভী কম ক্যায়া?"
আজও শিবশংকরকে মাফ করেনি মাধবী। তার কাছে কোন প্রত্যাশা নেই তার। শুধু মেয়েটা ভালো থাক তাই ডুকরে কেঁদে ওঠে মাধবী," আপনার মেয়ের তো সংসার আছে ছেলে মেয়ে আছে। আমার পুতুলের যে কেউ নেই।"
-" আরে পাগলী হম সব হ্যায় না,মগর তুঝে পহচান লেতে তো ক্যায়া হোতা? আমি নজর রেখেছি না ওর ওপর। শ্বশুরজীকে রূপিয়া ভী দিচ্ছি মাঝে মাঝে। ওর মা বেঁচে আছে, ভেগে গিয়ে শাদী করেছে এই বাত জেনে তো জিতে জী মরে যাবে ও বেচারী। কুথাও মুখ ভী দেখাতে পারবে না।"
-" আর কখনও যাব না বাইরে,আপনি ওদের কোন ক্ষতি করবেন না।"
-" আরে তেরে বাত টালব সে জোর ভী নেই আমার। কিন্তু ও রঘুর কী হবে? মালুম করনা পড়েগা ও শালে ক্যায়সে ঢুন্ড নিকালে এ মকান?"
"রঘুদা এখানে আসেনি,আপনি বলেছেন না কোন ক্ষতি করবেন না ওদের। যদি শুনেছি ওদের কোন ক্ষতি হয়েছে সেদিনই এ বাড়িতে আমার শেষদিন হবে।"
মাধবী শরীরে কাপড় জড়াতে জড়াতে বলে। ভীম একটু ভয় পায় ওর রাগ দেখে তারপর নরম হয়। কিন্তু মনে একটা ধোক থেকেই যায় তার মানে কখনও ছোটি বহুর সাথে রঘুর দেখা হয়েছিল। সে যে বেঁচে আছে তা একমাত্র জানে রঘু। তাই রঘুকে চটিয়ে লাভ নেই শুধু নজর আরও কড়া করতে হবে। তবে যেভাবে সে ছোটিবহুকে হাতের মুঠোতে বন্দি করেছে তার আর মুক্তি নেই।
ভীম যেমন আড়াল থেকে মাধবীকে দেখেছিল ঠিক তেমনি রঘুর চোখেও ভীম ধরা পড়ে গেছিল। সাবধানী রঘু চোখ রেখেছিল চারদিকে কারণ বৌমণির তো ঐ শয়তানটার সাথেই আসার কথা। সে জায়গাতে অন্য কাউকে দেখে অবাক হয়েছিল সে। তবে তার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি ভীম। মাধবী চলে যাবার পরই তাকে দেখেছিল রঘু।
মনটা খারাপ হয়ে গেছিল না জানি আজ কী দুর্গতি হবে বৌমণির।
রঘুকে ঐ বাড়িতে আর যেতে বারণ করেছিল মাধবী বিপদের কথা ভেবেই তাই সে আর ওখানে যায়নি। তবে রঘুর অস্থির মন একটু শান্ত হলেও ঐ কপালপোড়া মেয়েটার জন্য সে প্রার্থনা করে দিবারাত্রি। ঠাকুরকে বলে মরণ দাও ওরে,আর কত?
শকুন্তলা ম্যাডাম এলাহাবাদ চলে গেছেন। শিবশংকরের সাথে কথা বলে পুতুলকে ওখানেই ভর্তি করেছেন। বাড়ি ছেড়ে যেতে খুব মন খারাপ হয়েছে ওর,কত স্মৃতি এই বাড়িটার সাথে জড়িয়ে। মা চলে যাবার পর সারারাত জেগে থাকত,দরজায় খুট করে আওয়াজ হলেই ভাবত ঐ বোধহয় মা আসছে। এখনই ডাকবে। অনেকটা বড় হয়ে যাওয়া পুতুল বাস্তবের দেওয়ালে ধাক্কা খাওয়া শক্ত মনটাকে বোঝাতে শিখেছে যে আর মা ফিরবে না কোনদিনই।
শিবশংকরের বুকটা ফাঁকা হয়ে যায় নাতনি চলে যাওয়াতে। রঘু ওর জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে বাক্সে দেখে মেয়ে সাজিয়ে গেছে ওর পুতুলের সংসার। একবার বলেছিল রঘু," তুমি ঐ বাস্কটা নেবে না দিদি? রাতে তো ওগুলো খেলতে তুমি?"
-" রঘুদা আমি এখন কলেজে যাব আর কতদিন পুতুল খেলব? তোমাদের পুতুল এখন রুদ্রাণী। ওগুলো মায়ের বানানো তাই দেখতাম মাঝে মাঝে।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল রঘু,এখনও বৌমণি পুতুল বানায়। ও দেখে এসেছিল ঘরের মেঝেতে ছড়ানো জরি চুমকি। রঘু বলেছিল," এখনও পুতুল বানাও নাকি?"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল বৌমণি," নিজের সংসার করার খুব শখ ছিল রঘুদা। এখন এই অভিশাপের জীবনে ওরাই আমার সঙ্গী। ওদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে সময় কাটাই।"
রঘু বুঝতে পেরেছিল পুতুলদের মধ্যে মেয়েকে খোঁজে বৌমণি।
একটা সময় একই শহরে থেকেও রঘু বিপন্ন হয়ে আর তেমন যোগাযোগ রাখতে পারেনি বৌমণির সাথে। এই কয়েক বছরে শারীরিক আর মানসিক দুই ক্ষমতাই তার কমেছে। প্রথম যেদিন পুরোনো অভ্যেসে তড়তড়িয়ে গাছে উঠেছিল সেই গায়ের জোর এখন আর তেমন নেই। তবে ভীমকে দেখে বুঝতে পারে সবই ঠিক আছে হয়ত। বৌমণি তার যন্ত্রণার জীবন মানিয়ে নিয়ে বেঁচে আছে। মাঝে মাঝে গঙ্গায় ভাসতে ভাসতে বাড়িটার দিকে তাকায় রঘু যদি একবার দেখতে পায় বৌমণিকে।
সেদিনের পর একদিন অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল বাড়িটার সামনে। তালাবন্ধ দরজায় কড়া নেড়েছিল। আওয়াজ পেয়েছিল কৌন? চাপা গলাতে বলেছিল রঘু..
-" আর কখনও এসো না রঘুদা বৌমণি মরে গেছে ভেবে নিয়ো। ও জানতে পারলে তোমাকে মেরে ফেলবে।"
***********************
বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে। শিবশংকরের শরীর খুব খারাপ তাই শকুন্তলা ম্যাডাম আর কাজটা ফেলে রাখতে চাননি যদিও পুতুল আর আশীষ দুজনেই বলেছিল আর কিছুদিন বাদেই বিয়েটা হোক।
হাসতে হাসতে আদরে ভাইপোর কানটা মলে দিয়েছিলেন শকুন্তলা," আমার ছাত্রীর পেছনে সেই কবে থেকে পড়ে আছিস পাজি ছেলে। মেয়েটাকে জ্বালিয়ে মেরেছিস ঠিকমত পড়াশোনা করতে দিসনি। আর এখন বিয়ে করতে বলাতেই বলছে পরে হবে। আমি ওসব জানি না বাইরে যাচ্ছ বিয়ে করেই যাও।"
-"ও পিসি তোমার ছাত্রীটা যে আস্ত একটা রামগড়ুরের ছানা ছিল তাকে মানুষ করলাম তার কোন মূল্য নেই কী তোমার কাছে? শুধু আমার দোষ দেখলে,ওকে এত অঙ্ক করালাম সেটা বুঝলে না।"
শকুন্তলা হেসে ফেলেন। তিনি নিজে নিঃসন্তান। স্কুলের অসংখ্য ছাত্রছাত্রীদের মাঝেই পেয়েছেন সন্তানসুখ। তবে রুদ্রাণী যেদিন মাকে হারিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিল একটু সহানুভূতি পেয়ে অদ্ভুত মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। একটু একটু করে মেয়েটার অবসাদ কাটিয়ে তাকে আলোতে ফেরাতে চেষ্টা করেছিলেন। ছাত্রী থেকে মেয়েটা হয়ে উঠেছিল সন্তানের মতই খুব কাছের।
আশীষ তাঁর দাদার ছেলে,বৌদি মারা যাবার পর দাদা বেশিরভাগ ঋষিকেশে থাকতেন। এলাহাবাদে পড়াশোনা করার সময় আশীষ তাঁর কাছেই থাকত। রুদ্রাণী মাঝে মাঝে হস্টেল থেকে এলেই চলত আশীষের ওর সাথে খুনসুটি।
-" ম্যাডাম দেখুন না আমার খাতাতে কিসব অঙ্ক করছে দাদা। সবসময় বিরক্ত করে,আমার ভালো লাগে না। আমি আর আসব না।"
শকুন্তলা বকেছেন ভাইপোকে," আচ্ছা তুই তো ওর চেয়ে বড়। মেয়েটা খুব শান্ত, অনেক কষ্ট পেয়েছে জীবনে ওকে জ্বালাস না। একটু চাপা স্বভাবের।"
-" ঐজন্য তো ওকে জ্বালাবো ওকে বলে দাও পড়াশোনা আমিও করি তবে বই ছাড়াও বাইরেটা দেখা জরুরী।"
একটা সময় রুদ্রাণী মানে পুতুলের রাগকে একটু একটু করে অনুরাগে পরিণত করেছিল আশীষ।
রিসার্চের জন্য আশীষ বাইরে যাবে তাই শকুন্তলার ইচ্ছে বিয়েটা হয়ে যাক। ওখানে গিয়ে মেয়েটাও পড়াশোনা করবে। ওর দাদুর শরীর যেমন খারাপ তেমন দাদারও তেমনি ইচ্ছে।
শকুন্তলা নিজে গিয়ে শিবশংকরের সাথে কথা বলে এসেছেন," মেয়েটাকে একদম নিজেদের করে নেব বলে এসেছি।"
-" ওকে তো কবেই আপনার মেয়ে করে আমরা নিশ্চিন্ত,আপনিই তো ওর মা। আমার অনুমতি কী হবে?"
মা শব্দটা ছুঁয়ে যায় পুতুলকে,শকুন্তলা দেবীর মনটাও নরম হয়ে যায়। ওরা কথা বলছে, পুতুল ঘরে ঢুকেছে অনেকদিন বাদে মা শব্দটা ওকে ছুঁয়ে গেছে।
মায়ের স্মৃতি জড়ানো ওর ছেলেবেলার পুতুলের বাক্সটা বুকে জড়িয়ে ধরল।
শিবশংকরের নেমন্তন্ন করার মত তেমন কেউ ছিল না আসেপাশের বাড়ির কয়েকজন। তবে শকুন্তলা দেবী বলে গেছেন ওঁদের কিছু করতে হবে না তাঁর এলাহাবাদের বাড়ি থেকেই বিয়ে হবে মেয়ের। রঘু আর শিবশংকর কয়েকদিন ওখানেই থাকবেন।
রঘু নিশ্চিন্ত হয়েছিল,হাঁফ ছেড়েছেন শিবশংকর। বাড়িতে কোন মহিলা নেই কে করত বিয়ের জোগাড়? এত বছরে মোটামুটি সব আত্মীয়ের সাথেই সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। তবুও যার কেউ নেই তার হয়ত ভগবান আছেন।
নেমন্তন্ন তালিকায় ভীমকে রেখেছেন শিবশংকর। অবশ্য সেটা মনে করিয়ে দিয়েছে রঘু। বলেছে," একটা কার্ড লেখেন ভীম সিংয়ের নামে।"
-" ওকে নেমন্তন্ন করবি? এলাহাবাদে যাবে নাকি সে?"
-" সে যা পারে করুক। নাহলে আবার রেগে কী ক্ষতি করবে।"
আজ নিজেই গেছে সেই ঘৃণ্য লোকটার গদিতে। রঘুকে দেখে অবাক হয় ভীম।
-" ক্যায়া বাত আচানক? রূপিয়া লাগবে নাকি?"
রঘু মাথা নেড়ে কার্ডটা এগিয়ে দেয় বলে," বাবু দিয়েছেন।”
আজ বাড়িতে ফিরে আর কিছু গোপন করে না ভীম কার্ডটা রাখে টেবিলে। এই কয়েক বছরে ভীম অনেকটা নড়বড়ে। মাধবীর চুলেও পাক ধরেছে চোখে চশমা। প্রায়ই নানা অসুখে ভোগে সে। ভীম বাইরে গেলে মাধবী কার্ডটা দেখে,হঠাৎই একমুঠো খুশির আলো ছড়িয়ে পড়ে তার মুখে চোখে। তা আনন্দধারায় ঝরে পড়ে। পুতুলের বিয়ে!
ভীম এসে পড়াতে তাড়াতাড়ি কার্ডটা রাখে মাধবী।
-" লড়কীর শাদী আছে আজ রঘু এসেছিল। যাওগী ক্যায়া? মন কী বলছে দেখতে ইচ্ছা করছে নাকি?"
বুকটা কাঁপে মাধবীর কথাটা শুনে মাধবীর অসহায় অবস্থায় হাসে ভীম। "
"হামে তো যানা পড়েগা,তোমার লড়কীর শাদী।"
মাধবীর রাগে শরীর জ্বালা করে শয়তানের ছায়া কেন পড়বে ওর মেয়ের ওপর?
-" ক্যায়া হুয়া? আরে আমি গেলে তো জানতে পারবে ক্যায়সে ঘর মে শাদী হুয়া। লড়কা কেমন আছে? ক্যায়া দোগে উসে শোচ।"
মাধবী কিছু বলেনি চুপ করে ডুবে গেছিল চিন্তার ঘোরে।
************************
আজ পুতুলের বিয়ে,ভীম এলাহাবাদে যাবে। রাতেই ফিরবে। মাধবীকে সে বলে গেছে তার মেয়ে জামাইয়ের একটা ছবি ঠিক সে জোগাড় করে আনবে।
মাধবী তার কল্পনায় সব দেখছে ছোটবেলায় যেমন পুতুলদের বিয়ে হত ঠিক তেমনি আজ ওর পুতুলের বিয়ে। এতক্ষণে হয়ত গায়ে হলুদ হয়ে গেছে। আচ্ছা মিতুলের মা কী বিয়েতে এসেছে? পরপর বিয়ের কাজগুলো ভাসে মাধবীর চোখে। ভীম চলে গেছে সন্ধ্যের মুখে বিয়েবাড়িতে।
একান্ত অবসরে পুতুলের বাক্স সাজায় মাধবী। এই পুতুলগুলোকে খুব সুন্দর দেখতে। আগের থেকেও অনেক সুন্দর। মাধবীর একান্ত অনুভূতি আর ভালোবাসা দিয়ে বানানো। কাজের বৌটা অনেকদিন এই বাড়িতে আছে মাধবীকে সে ভালোবাসে।
আজ মাধবী তাকে একটা দায়িত্ব দেয়,বিনিময়ে নিজের গলার একটা হার তাকে খুলে দেয়। শুধু বলে কেউ যেন কিছু জানতে না পারে।
ভীম অনেকটা রাতে ফেরে,মাধবী ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে। আজ মাধবীকে কোন বিরক্ত করে না ভীম সে বুঝতে পারে হয়ত তার মনটা খারাপ।
অনুষ্ঠানে ভীমকে দেখে খুশি হয়েছিল রঘু। অন্ততঃ বৌমণি জানতে পারবে মেয়ের কথা।
সকালে মাধবীকে কাছে বসিয়ে গল্পের ঝুড়ি খুলে বসে ভীম। আরও বলে সে ফটোও এনে দেখাবে ওকে। মাধবী হাসে শুনে আর কিছু বলে না। সব ছবিই তো ও মনে মনে দেখেছে সারাদিন,এমন কত পুতুলের বিয়ে দিয়েছে ও।
বিয়েবাড়িতে রঘুর বারবারই মনে হয়েছে বৌমণির কথা। মেয়েটাকে খুশি দেখে ভালো লাগে ওর। এখন আর মরে গেলেও কোন চিন্তা নেই ওর।
মাকে জড়িয়ে ধরে পুতুলের কান্না নেই,এই বাড়িটাতে তার শ্বশুরবাড়ি আর বাপের বাড়ির সব উৎসব হচ্ছে একসাথে। তবুও কান্না পেল পুতুলের। আশীষ ওর হাতে হাত রাখল,শকুন্তলা বুকে জড়ালেন।
মাধবী দিন গোণে একটার পর একটা স্বপ্ন সাজায় চোখে আজ যে পুতুলের ফুলশয্যা। ভালোবাসায় ভালোবাসায় ভরে উঠুক ওর জীবনটা। সারাজীবন যেন ভালোবাসার মানুষের সোহাগে আদরে আর সহানুভূতির মিঠে ছায়ায় কাটে মেয়েটার জীবন। পরদিন ভোর হয় মাধবীর মন জুড়ে থাকে পুতুলের ফুলশয্যা আর বৌভাতের ছবি। ঠাকুরের আসনে বসে তাদের স্নান করাতে আর খেতে দিতে দিতে মনে মনে কত কী বলতে থাকে। দুপুরে ভীম এল বাড়িতে খেতে।
মাধবীর চোখ চেপে ধরে ভীম ছটফট করে মাধবী। তারপর চোখের সামনে ধরে কয়েকটা ছবি। মাধবীর মনের স্বপ্ন দেখা অনুভূতি হঠাৎই বাস্তবে ফিরে আসে। হয়ত আজকের দিনটার জন্য ভীমের প্রতি কৃতজ্ঞ সে। তবে এই কৃতজ্ঞতা সে শোধ করেছে একদম সুদে মূলে। আর যেটুকু বাকি আছে তাও সে শোধ করবে।
ভীম আবার বেরিয়ে গেছে,বলে গেছে তার ফিরতে সন্ধ্যে হবে। নিজের শরীরের যত্নে কেশর মালাই আর অশ্বগন্ধার সরবত খায় ভীম। আর কিছু না করলেও এটুকু ছোটি বহুর হাতেই খেতে পছন্দ করে সে।
প্রতিদিনের মত আজও যত্ন করে সরবত বানিয়েছে মাধবী দিয়েছে তাতে সুন্দর করে কেশর আর গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে। আজ মাধবী নিজেকে সাজিয়েছে গয়নাতে পরেছে লাল বেনারসী তাতে সোনার জলে ডোবানো জরির কাজ। এত দামি বেনারসী এর আগে কোনদিন পরেনি মাধবী। ভীম এনে দিলেও সে পরেনি আজ সে পরেছে তা যত্নে। মধ্যবয়স্ক মাধবীর লালিত্য লাল রঙে আজ উদ্ভাসিত।
ভীম তাকে দেখে অবাক হয়,গঙ্গার আদরে ভাসতে ইচ্ছে করে সারারাত। কাজের মেয়েটাকে আজ ছুটি দিয়েছে মাধবী। নিজের হাতে সব রান্না করে টেবিলে সাজিয়ে ভীমকে খেতে দেয়। নিজেও খায়।
-" আজ তুমহে দেখকে দিল নাচছে গঙ্গা। আরে মার দোগে ক্যায়া? বয়েস বাড়ছে এখন আগের জোশ অত নাই। তবুও আজ ভাসব সারারাত গঙ্গার বুকে। খাওয়া শেষে রাবড়ী দেয় ভীমকে মাধবী। সবশেষে নিয়ে আসে সুগন্ধী পান। ভীমকে বলে ওকে পান খাইয়ে দিতে। মাধবীকে এত খুশি কখনও দেখেনি ভীম।
বলে," ইতনা খুশ ও লড়কীকে তসবির দেখে ক্যায়া?"
ঘাড় নাড়ে মাধবী। ততক্ষণে ও নিজের হাতে ভীমকে পান দিয়েছে। আনন্দে ভীম ওর ঠোঁটে ঠোঁট ডোবায়। তারপর কিছুক্ষণ বাদে হারিয়ে যায় দুজনেই।
অনেকটা বেলা পর্যন্ত দরজা বন্ধ দেখে দারোয়ান, ভাবে কাল খাওয়া দাওয়া করে বাবু ঘুমোচ্ছেন। কিন্তু একটা সময় আর থাকতে পারে না ডাকাডাকি শুরু করে। তারফর নিজেই দরজা ভাঙে,ঢুকেই অবাক হয়ে যায় তারপর চোখ বন্ধ করে ভয়ে।
মাধবী নিজেকে বৈধব্য থেকে মুক্ত করে শাঁখা সিঁদুর সহ প্রতিশোধ নিয়েই পুতুলের সংসার সাজিয়ে চোখ বুজল চিরতরে।
**********************
পুতুলের ওদেশে যাওয়ার ছয়মাসের মধ্যেই দাদুর চলে যাবার খবর পেল। মৃত্যু আর এখন তেমন করে ছোঁয় না ওকে। মনকে শান্ত করে দাদুর বয়েস হয়েছিল।
গঙ্গার ধারে বাড়িটাতে একা ভূতের মত ঘোরে রঘু। মাধবীর চলে যাওয়ার খবর তার কানেও গেছিল। বাড়িটার ধারপাশ এখন আর কেউ মাড়ায় না। সবাই বলেছে ঐ প্রেতাত্মারাই প্রতিশোধ নিয়েছে।
খবরটা পেয়ে রঘুর চোখের জল পড়েনি বরং সে তিনদিন বাদে গঙ্গায় তিল জল দিয়েছিল বৌমণির মুক্তি হোক এই ভেবেই।
বেশ বছর খানেক বাদে শকুন্তলা দেবী পুতুলকে ফোন করেন যে এবার তার একবার দেশে আসা দরকার। আশীষ না আসতে পারলে সে যেন একাই আসে। কারণ বেনারসের বাড়িটা আর রাখা যাচ্ছে না। রঘুদাও চলে গেছে মাস ছয়েক। তাই পুতুল এসে ওটা বিক্রি করে দিয়ে যাক। একজন লোকও পাওয়া গেছে।
বাড়ি বিক্রির কথা শুনে মন খারাপ হয় ওর। আশীষ বলে," যখন থাকবেই না ওখানে তখন ওটা আর না রাখাই ভালো। তুমি বরং যাও গিয়ে সব ব্যবস্থা করে এসো। আমার তো সামনেই থিসিস জমা দেওয়া। আমি আছি তোমার সাথে সবসময়। আর পিসিমা তো আছেনই তাঁর কাছেই তো চাবি।"
শকুন্তলার কাছ থেকে চাবিটা নিয়ে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ায় পুতুল। কত কথা মনে পড়ে যায় এক নিমেষে সেই প্রথম যখন এসেছিল এখানে তখন থেকে চলে যাবার দিনটাও। কঙ্কালসার বাড়িটার খুলিটা যেন হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে।
শকুন্তলা বারবারই বলেছেন রঘু মোটামুটি ওর জিনিসপত্র একটা ঘরে গুছিয়ে রেখেছিল। একবার দেখে নিতে কিছু নেবার মত আছে কিনা? তারপর যা পড়ে থাকবে সবই বিক্রী হয়ে যাবে।
সব ঘরগুলো ফাঁকা শুধু ওর ঘরেই বইপত্র কিছু জামাকাপড় একটা কাঠের বাক্স আর মা বাবার ছবি। ছবিটার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ায় পুতুল তারপর। বইপত্র ঘাটতে থাকে। একটা সময় হাঁফিয়ে উঠে কিছু জিনিস ব্যাগে ভরে। ওর সাথে শকুন্তলার ড্রাইভার এসেছে সে বাইরে চৌকিতে বসে অপেক্ষা করছে।
পুতুল কাঠের বাক্সটা খোলে। এক মুহূর্তে ডুবে যায় অতীতে। নিজের আসল সংসার সামলাতে সামলাতে ভুলেই গেছিল পুতুলের বাক্সটার কথা। কিন্তু কালের থাবায় কাপড় কেটে বানানো পুতুলগুলো বড় জীর্ণ হলেও তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে মায়ের ছোঁয়া আনুভব করে ও। হঠাৎই একটা সুন্দর বড় চকচকে বাক্সে নজর পড়ে। এটা কী? ওর বিয়েতে পাওয়া কোন উপহার নাকি? হয়ত এখানকার কেউ দিয়ে গেছে। রঘুদা আর খোলেনি যত্ন করে রেখে দিয়েছে।
মোড়কটা খোলে পুতুল। ওমা কী সুন্দর বাক্সটা! বাক্সটা খুলে অবাক হয়ে যায় পুতুল। কী অপূর্ব তিনটে পুতুল ঠিক যেন বাবা মা আর তাদের মেয়ে। ঠিক ওদের মতই। ছোট বাচ্চা পুতুলটা কী সুন্দর! আচ্ছা এমন একটা ফ্রক তো ওরও ছিল। তারপর হঠাৎই ছোট পুতুলটার ফ্রকের ভেতর থেকে খসে পড়ে ভাজ করা কাগজ।
ড্রাইভারটা বাইরে বসে অপেক্ষা করতে করতে চৌকিতে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। পুতুল স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ওর হাতে ভাজ করা কাগজটা সম্পূর্ণ খোলা। এই কয়েক ঘন্টায় একটা ইতিহাসের পাতা খুলে গেছে ওর সামনে। পুতুলের চোখটা টকটকে লাল বিড়বিড় করে বলে তুমি ফিরে এলে না কেন মা তোমাকে নিয়ে আমি চলে যেতাম কোথাও দূরে....
মাধবী হারিয়ে গেছে সেই কবে দূর আকাশে আজ তার অতৃপ্ত আত্মা তৃপ্ত। পুতুল তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। ঠাকুরের সিংহাসন থেকে নেতিয়ে পড়া দেশলাইটা নেয় পুতুল তারপর ঘষে ঘষে ওটাকে জ্বালিয়ে কুচিকুচি করে ছেঁড়া চিঠিটাকে পুড়িয়ে দেয়। ছাইটা কুড়িয়ে জয়ো করে একটা ছোট কাগজে তারপর গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয় মেয়েকে বলা মায়ের কলঙ্কিত জীবনের গোপন কথা। এই পুতুলের বাক্সটাই কাজের মেয়েটাকে দিয়ে রঘুর কাছে পাঠিয়েছিল মাধবী বলে দিয়েছিল ওর মেয়েকে দিতে। রঘু আর তা খোলেনি যত্নে রেখে দিয়েছিল।
পুতুল ফিরে এসেছে প্রায় মাসখানেক বাদে। অনেকটা মনখারাপের ভার বয়ে বেড়ানো বাড়িটাকে বিক্রী করে টাকাটা ম্যাডামকে দিয়ে এসেছে বিধবা মহিলাদের স্বনির্ভর করার কাজে খরচ করার জন্য। ফেরার সময় সাথে নিয়ে এসেছে মায়ের বানানো পুতুলগুলোকে। ওগুলো যে বারবারই বলে যাচ্ছিল ক্ষতবিক্ষত আর আহত ওর দুঃখিনী মা শেষদিন পর্যন্ত ওকে কখনও ভোলেনি। তবে ও মায়ের মত মানুষের হাতের পুতুল হয়ে বাঁচবে না,বাঁচবে রুদ্রাণী হয়ে।
Comments
Post a Comment