আকাশে তখনও ভোরের আলোর লুটোপুটি শুরু হয়নি হয়ত সূর্য মামা হামাগুড়ি দেবার আয়োজন শুরু করেছে তার আগেই অভ্যেসমত ঘুম ভেঙে যায় অমৃতার। বিছানায় খোঁজে সুগতকে তারপর চোখটা খোলে দেখে সে উঠে গেছে বিছানা থেকে।
আওয়াজ পায় সুগত উঠে বাইরে ডাইনিং স্পেশে খুটখাট করছে। নিশ্চয় এরপর আপেল কাটবে আর ফলের রস করবে। তারপর সব গুছিয়ে নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে পৌঁছে যাবে ময়দানে ওখানে হেঁটে ওয়ার্ম আপ করে তারপর ফলের রস আর আপেল খেয়ে চলে যাবে মেডিটেশন করতে। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে মোটামুটি নটার কাছাকাছি। অবশ্য তার মাঝে একদম বাজার করেই ফেরে।
অমৃতা বারণ করেছে দুএকবার। বলেছে," তোমার কী লাগবে বলবে আমি সব গুছিয়ে রাখব রাতে। সকালে উঠে কী দরকার?"
-" নিজের কাজ আমি নিজেই করতে ভালোবাসি তুমি তো জান। আর বাসী ফলের রস আর কাটা ফল আমি খাই না তুমি জান। তুমি তো ভোরে উঠতে পার না আমি জানি। আর সারাদিন কাজ করছ তো এটুকু কাজ আমিই করে নেব।"
যত্নে ফল কেটে,ফলের রস কাঁচের কন্টেইনারে ভরে সুগত। তারপর নিজে তৈরি হয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে খুশি হয় সুগত কে বলবে ওর বয়েস পঁয়ষট্টি পেরিয়ে প্রায়..না থাক মেয়েদের মত ছেলেদেরও বয়েসটা গোপন রাখাটা জরুরী। সবার কাছে বলার দরকার কী যে ও বরিষ্ঠ নাগরিকের মার্জিন পেরিয়েছে অনেক দিন। বরং লাল,নীল পোলো টিশার্ট পরে যখন ময়দানে ও হাঁটে তখন কেউ ওর বয়েসটাকে এক হ্যাঁচকা টানে পঞ্চান্নতে নামিয়ে দিলে আরও খুশি লাগে ওর। বাইরের লোকের কাছে সন্তান সন্ততির অত ডিটেইলস দেয় না সুগত। কী দরকার সব বলার? অনেকে তো আবার ছেলেমেয়ে দেখে বয়েস বোঝে? আরে বড় ছেলেমেয়েদের বাপ বলেই কী বুড়োবুড়ি হয়ে যেতে হবে? আমাদের কোন লাইফ নেই?
এখানেই অমৃতার সাথে তাঁর বিরোধ। অমৃতার সবে ষাটে পা পড়েছে। এই বয়েসে সে সাত বুড়ির এক বুড়ি। থপথপে মোটা শরীর,কপালে একটা বড় টিপ আর তাঁতের শাড়ি বা ঐ ঢোলা ম্যাক্সিতে নিজেকে ঢেকে বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। বাইরে গেলে খুব বেশি হলে একটা সিল্কের শাড়ি। সত্যি অমৃতা কোনদিনই সাজগোজ করতে শিখল না।
আজকাল ফুরফুরে স্লিম অ্যান্ড ট্রিম সুগতর নিজেকে কেমন যেন বেমানান লাগে অমৃতার পাশে। সেবার তো ওদের মর্ণিং ওয়াক অ্যাসোসিয়েশনের পিকনিকে যখন প্রথম অমৃতাকে নিয়ে গেছে ও তো একটা চেয়ারে গিয়ে বসল পা ব্যথার জন্য। সুগত ফুরফুরে মেজাজে সব তদারকি করছেন হঠাৎই একটা কম বয়েসী ছেলে এসে বলল আপনার দিদি আপনাকে ডাকছেন। কথাটা কানে লেগেছিল সুগতর।ফেরার সময় যখন অমৃতা তাঁর হাত ধরতে গেছিল উঁচু নীচু পথ বলে,সুগত বলেছিলেন," নিজেকে বদলাও অমৃতা, সারাক্ষণ রান্নাঘর আর নাহলে ঠাকুর ঘর আর উপোস। রাতে শুতে গেলে উঃ আর আঃ। কী অবস্থা হয়েছে দেখেছ?"
-" কী আবার অবস্থা হবে? এই তো বেশ আছি,তোমার হাত ধরে যাচ্ছি।"
-" না হাঁটবে তো জিমে যাও। ভর্তি হবে নাকি?"
-" ওরে বাবা ও আমার দ্বারা হবে না। সুগত রাগ করেছিলেন কানে বেজেছিল কথাটা আপনার দিদি। নিজের জন্য ভালো লাগলেও অমৃতার জন্য লজ্জিত হয়েছিলেন। অথচ অমৃতা তাঁর থেকে বেশ কয়েক বছরের ছোট। মাত্র উনিশে বিয়ে হয়েছিল ওর আর কুড়িতে মা হয়েছিল।
শরীর চর্চার কথাটা ওখানে উঠেই ওখানে শেষ হয়ে গেছিল।
অমৃতা আবার সেকেন্ড ট্রিপ ঘুমের প্রস্তুতি নেয়,এই সময়টা গড়াগড়ি করতে ওর ভালো লাগে। যদিও নতুন বৌমা তিস্তা বলেছে অনেকবারই," আচ্ছা তুমি কেন হাঁটতে যাও না? সারাদিন বলছ এখানে ওখানে ব্যথা। একটু বেরোলে ভালো থাকতে।"
অমৃতা হেসেছিল বলেছিল," আমার বাড়িই ভালো বাপু। সকালবেলা এমন ঘুমের সুযোগ ছেড়ে কে যাবে হাঁটতে?"
আসলে সেভাবে নিজের দিকে তাকানো হয়নি কোনদিনই। সেই কবে বিয়ে হয়েছিল,বিয়ের পর থেকেই দেখেছে শাশুড়ি অসুস্থ সুতরাং তাঁর দেখাশোনা আর সংসার সামলাতে সামলাতে পর পর তিনটে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। প্রথম দুই কন্যা হবার পর ছেলের আশায় আরেকবার মা হওয়া, আর তাতে সফল হয়ে সবার মুখেই হাসি ফুটেছিল। অমৃতা ভুলেছিল মা হবার কষ্ট। শাশুড়িমা নিশ্চিন্তে চোখ বুজেছিলেন নাতির মুখ দেখে।
সুগত পাকা ব্যবসায়ী,প্রথমে ব্যবসা ছোট থাকলেও ধীরে ধীরে সে বাড়িয়েছে কারবার নিজের একলা উদ্যোগেই।
অমৃতার মতই মেয়ে দুটোরও কলেজ পেরোতে না পেরোতেই বিয়ে হয়ে গেল। বড় মেয়ের নিজে দেখেশুনে বিয়ে করল। বিয়ে কোথায় আর কাকে করবে ঠিক করাই ছিল যখন সুতরাং সুগত আর আপত্তি করেননি। আর ছোট মেয়ের সম্বন্ধ ধনী ব্যবসায়ী পরিবার থেকে আসায় এক কথাতেই রাজি হয়ে গেছিলেন সুগত।
অমৃতা একটু আপত্তি করেছিল," ওকে অন্ততঃ আরেকটু পড়াও। চাকরি করুক তারপর বিয়ে হবে।"
-" চাকরি করবে আমার মেয়ে? কী দরকার তার? বিয়ের জন্য কিছুটা পড়াশোনা শিখেছে এরপর সুখে সংসার করুক। মেয়েরা বেশি জানলেই বিপদ বুঝলে। এই তুমি যেমন আছ,কত সুখী জীবন তোমার ভেবেছ?"
অমৃতা হেসেছিল," সুখী জীবন মানে? আমার কোন কাজ নেই নাকি? কত কাজ থাকে সারাদিন। একটু ঘুমোতে পারতাম না একসময়। তিনটে ছেলেমেয়ে বড় করা কী মুখের কথা নাকি?"
-" শোন অমৃতা বাড়িতে দুটো তিনটে কাজের লোক রান্নার লোক। তোমার কাজ ওদের ওপর ছড়ি ঘোরানো। এছাড়া আর কী? তবে একটু বেশিই সংসারী তুমি। অবশ্য সংসারটাই তুমি ভালো করে সামলাতে পারো। সুতরাং সেটাই ভালো করে করেছ এতদিন। মেয়েরাও তোমার মতই হয়েছে সুন্দর করে শ্বশুরবাড়ির মত মানিয়ে গুছিয়ে আছে।"
অমৃতার আর তাঁর মেয়েদের মত সুন্দর পরিপাটি ঘরণী তাঁর বৌমা তিস্তা নয়। সুগতর আপত্তি সত্ত্বেও মধ্যবিত্ত ঘর থেকে মেয়ে পছন্দ করেছিল ছেলে। তথাগত ছোট থেকেই আদরে মানুষ হয়েছে,যখন যা বলেছে তা এনে দিয়েছেন সুগত। একটা সময় অনেক বান্ধবী ছিল। অমৃতা বিরক্ত হয়েছেন,ভয়ও পেয়েছেন বলেছেন," কী রে সারাদিন বান্ধবীদের নিয়ে ঘুরছিস,এসব কী ভালো? কখন কোন ঝামেলা হলে?"
-" মা কী ঝামেলা আবার হবে? বান্ধবী থাকা কী ক্রাইম? কত বয়স্ক লোকেরা বান্ধবী নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমি ঘুরলেই বিপদ? যাঃ বাবা।"
কথাটা বলে সুগতর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুতভাবে হেসেছিল তথাগত। বুকটা কেমন যেন কেঁপে উঠেছিল সুগতর। ছেলেটা এভাবে কথা বলছে কেন? তবে কী ওর এনার কথা কিছু জানে নাকি? না না তা কী করে হবে? প্রায় পাঁচবছর ধরে যে সম্পর্ককে তিনি লুকিয়ে রেখেছেন তা ও জানবে কী করে? কোন ভোরে উঠে বেরিয়ে যান তিনি তখন তো নবাবপুত্রের মাঝরাত। আদরে আদরে বাঁদর হয়ে গেছে ছেলেটা। মেয়ে দুটোও আদর দেয় ভাইকে।
সেই তথাগত যখন অনেক বান্ধবীদের পেছনে ফেলে তিস্তাকে সিলেক্ট করেছিল সুগত অবাক হয়েছিলেন। হয়ত বিরক্তও হয়েছিলেন তিস্তাদের বাড়িতে গিয়ে ওদের স্ট্যাটাস দেখে। ইশ্ ছেলেটা শেষে গোবরের মধ্যে পা পিছলালো?
তবে অমৃতার ভালো লেগেছিল সাদামাটা তিস্তাকে। চাকরি করা মেয়েতেও আপত্তি ছিল সুগতর। সংসার কখন করবে এই মেয়ে? তবুও বিয়েটা হয়ে গেছিল।
তবে তিস্তা আর তথাগতর বক বকুম দাম্পত্যে ভাটা পড়েছিল বছর দুয়েকের মধ্যেই। তথাগত বোর হয়ে গেছিল কিছুতেই যেন তিস্তার মিডল ক্লাস মানসিকতা মেনে নিতে পারছিল না। এই মেয়ের মদ খেলে রাগ হয়,পার্টিতে গেলে তাড়াতাড়ি ফিরতে হয়। বাবা বোধহয় তখন ঠিকই বলেছিল। হঠাৎই ওর সেই পুরোনো প্লে বয় ইমেজটা আবার চাড়া দিয়ে উঠেছিল। অসহ্য হয়ে উঠেছিল তিস্তার জীবন। প্রথমে কদিন চলেছিল ঘরে চাপা ঝগড়াঝাটি তারপর কান্নাকাটি।
তথাগত বলত," আচ্ছা বিয়ে করেছি বলে আমার কী বন্ধু থাকতে পারে না। মাকে দেখে শেখো,কী সুন্দর বাবার সাথে প্রায় চল্লিশ বছর সংসার করছে। বাবা বাবার মত আছে,মা তার মত।"
-" আমি মামণির মত হতে পারব না তথাগত, আমি নিজের গন্ডীতে কাউকে ঢুকতে দেব না।" চিৎকার করেছিল তিস্তা। বাথরুম করতে গিয়ে কিছু কথা কানে এসেছিল অমৃতার। কিন্তু কিছু বলেননি।
বাপের বাড়িতে বলাতে মা বলেছিল," তোর বাবাকে বলিস না কিছু হয়ত টেনশনেই মরে যাবে।"
আজকাল মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই রাতের সিফ্ট নেয় তিস্তা। ভোরবেলা অফিস থেকে বেরিয়ে খুব ক্লান্ত লাগে। ওর বিলাসবহুল শ্বশুরবাড়ির মধ্যে বাতাসও ঢোকে না যেন ঠিকমত। বাস থেকে হঠাৎই নেমে পড়ে তিস্তা তারপর হাঁটতে থাকে ময়দানের পাশ দিয়ে। খোলা হাওয়াতে মনটা ভালো হয়ে যায়। সবুজের ছোঁয়া আলপনা আঁকে চোখে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে তিস্তা তাড়াতাড়ি নিজেকে আড়াল করে একটু দূরে গাছের আড়ালে। এ কাকে দেখছে? বাপির সাথে কে এই মহিলা?
এই সকালে ভদ্রমহিলার পরিপাটি সাজ,সুন্দর পিঠকাটা ব্লাউজ আর শাড়ি পরনে। বেশ স্লিম ছিমছাম চেহারা। তিস্তা আন্দাজ করার চেষ্টা করে বয়েস কত হবে? বুঝতে পারে না ঠিক তবে মামণির চেয়ে ছোট হবে। দুজনে এক গ্লাস থেকে ফলের রস খাচ্ছে। শেষে ঠোঁটটা মুছিয়ে দেয় বাপি,আর দেখতে পারে না তিস্তা ঘেন্নাতে গা গুলিয়ে ওঠে। ওরা দুজনে দামি গাড়িটাতে উঠেছে,মহিলা মামণির সীটে বসে।
তিস্তার মাথা কাজ করে না,অনেকটা সময় বসে থাকে গাছের তলায়। তারপরেই একটা বিদ্রূপের হাসি ফুটে ওঠে মুখে ওহ্ ঐজন্য তথাগত এমন। রক্তের দোষ ওদের,না এই বাড়ি ছেড়ে ওকে চলে যেতে হবে।
তাছাড়া একসাথে পাশাপাশি থাকা ছাড়া কোন সম্পর্ক তো আর বেঁচে নেই। আজ প্রায় দুমাস ওর শরীরে ভুলেও হাত দেয় না তথাগত।
ছেলের সংসার ভাঙার খবরে সুগত যতটা না বিচলিত হলেন ভেঙে পড়লেন অমৃতা। ছেলেকে বলে যখন কোন লাভ হল না মানে সে পরিস্কার বলল, বান্ধবী একাধিক থাকা কোন অপরাধ নয়। সে বিয়ে তো তিস্তাকেই করেছে। ফালতু ঝামেলা করছে তিস্তা। বাবা ঠিক বলেছিল ওদের সাথে আমাদের যায় না।
সুগত বেরিয়ে গেলে সেদিন ভোরেই উঠে পড়েন অমৃতা। কাল সারারাত তাঁর ভালো করে ঘুম হয়নি বারবারই বুকে কাঁটার মত বিঁধেছে একটা কথা আজ তিস্তা চলে যাবে। এই দুটো বছরে একটা বন্ডিং হয়ে গেছিল মেয়েটার সাথে। কতদিন জোর করে পার্লারে ধরে নিয়ে গিয়ে বলেছে এবার নিজের একটু যত্ন করো। বারান্দায় এসে দাঁড়ান অমৃতা,আজ ভোরের আলোও মেঘলা মুখে। চোখ পড়ে ও পাশের কোণে চেয়ারে বসে আছে তিস্তা,আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত দেন," চলেই যাবি শেষ পর্যন্ত? একটু মানিয়ে থাকতে পারতিস না। আমার কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে জানিস। তোকে খুব মিস্ করব। থেকে যা না মা? কোথায় যাবি বলত?"
চোখ মোছে তিস্তা," সরি মামণি আমি তোমার মত সব সয়ে এখানে থাকতে পারব না। যাব কোথাও একটা। তোমাকে একদিন ফোন করব,আগে একটু গুছিয়ে নিই।"
মানিয়ে নেবার কথাটা হঠাৎই বুকে ধাক্কা মারে অমৃতার,সত্যি তো সংসারে কত কী মানিয়ে নিয়ে তিনি আছেন। সুগত কী সেভাবে তাঁর দিকে নজর দেয়? কতদিন কোন স্পর্শ সুখ নেই ওদের মাঝে। প্রথমে খুব খারাপ লাগত মাধবীর তারপর পেছন ফিরে শোওয়াটা অভ্যেস হয়ে গেছিল। ছেলেটাও ভালো করে কথা বলে না। মেয়েরা ব্যস্ত আসতে পারে না নিজের সংসারে ব্যস্ত। তাঁর জীবনে আর নেই কারও সহানুভূতির ছোঁয়া। আছে শুধু কিছু দায়িত্ব কর্তব্যের নিত্য নৈমিত্তিক রুটিন।
-" সবাইকে মানিয়ে নিতে হয়। জীবন এমনি।"
-" কী মানিয়ে নিতে হয়? তোমার স্বামী কারও সাথে শুয়ে এল তুমি মানিয়ে নিতে পারবে?"
চমকে উঠেছিল অমৃতা,ধমকে বলেছিল," ছিঃ চুপ কর। যা খুশী তাই কর তোরা। আমার স্বামীকে টানিস কেন? কিছু আটকায় না তোদের মুখে।"
-" অনেক কিছু এখনও আটকায় মুখে মামণি সত্যি যদি সবটা বলতে পারতাম তোমাকে।"
নিজের ভেতরে জমে থাকা সব কথা বলতে পারেনি তিস্তা অমৃতাকে। একদিন নয় অনেকদিনই ভোরবেলা শ্বশুরের প্রেম দেখেছে। আর বুঝেছে চল্লিশের দাম্পত্যের শক্ত ভীতে যখন উঁই লেগেছে তখন ওর দুবছরের দাম্পত্য তো বড়ই নড়বড়ে। ছিঃ এত বছরের সংসারের বাঁধনে এক নারীকে আবদ্ধ করে তাকে সুখের শিলমোহরের ছাপ দিয়ে কী করে ঠকায় পুরুষ?
আর এই মহিলাই বা কেমন? অনায়াসে একজন বিবাহিত বুড়ো লোকের ঠোঁটে ঠোঁট ঘষছে। তার টাকাতে ফুর্তি করছে,দামি গাড়িতে ঘুরছে!
কোন কথাই অমৃতাকে না বলে ঘর ছেড়েছিল তিস্তা। মনে মনে ভেবেছিল থাক মামণি সুখের সংসারে, শান্তিতে পুজোর ঘরে জপ করুক বসে। কোথায় যাবে লোকটা এই বয়েসে ঘর ছেড়ে? তার থেকে সুখী সুখী মনে সব অসুখকে সরিয়ে ভালো থাক।
কিন্তু ভালো থাকতে পারেননি অমৃতা,হঠাৎই একদিন সত্যিটা সামনে এসে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে কালীঘাটে পুজো দিতে যান অমৃতা। সেদিনও গেছিলেন হঠাৎই মন ভালো না লাগাতে। সুগতকে বলা হয়নি আগে থেকে। ফেরার সময় ড্রাইভার বলল এদিকে নো এন্ট্রি করে দিয়েছে তাই গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ময়দানের পথে যেতে যেতে হঠাৎই চোখে পড়েছিল গাড়িটার আড়ালে দাঁড়ানো ঘনিষ্ঠ দুজনকে। যে সুগত বাড়িতে মেপে কথা বলেন তিনি হেসে গড়িয়ে পড়ছেন।
অমৃতার গাড়ি তখন ছুটে চলেছে কিন্তু চোখটা বারবারই পেছন ফেরে আর আবছা হয়ে যায় অভিমানে। কার সাথে সুগত এই সকালে?
সুগতকে কোন প্রশ্ন করেননি অমৃতা শুধু নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন একটু একটু করে। তারপর একদিন ফোন করেছিলেন তিস্তার নম্বরে। তিস্তা অবাক হয়েছিল প্রায় ছয়মাস বাদে মামণির ফোন পেয়ে,অবশ্য ও ইচ্ছে করেই ফোন করেনি আর। একটু একটু করে বাঁধ ভেঙেছিল অমৃতার তারপর কেঁদেছিলেন হাউহাউ করে এইজন্য তুই বারবারই মানিয়ে নেবার কথা বলছিলি তাই না? আমি বুঝতে পেরেছি তথাগতকে কেন ওর বাবা কিছু বলে না। আসলে দুজনেই তো একরকম।
-" আচ্ছা মেয়েটা কে জানিস?"
-" কী দরকার মামণি? তবে সম্পর্কটা পুরোনো। তবে তোমার সম্পর্ক তো আরও পুরোনো সেই কথা ভেবে মানিয়ে নাও। তোমার মেয়েরা আছে, নাতি নাতনি, ছেলে সবাই আছে। আমার কথা ছাড়ো আমার তো কোন পিছুটান ছিল না।"
হঠাৎই হেসে উঠেছিলেন অমৃতা," আমার প্রতি আর কারও টান নেই বুঝলি। ঐ একটা মানুষ আছি। কে ভাবে তার মনের ইচ্ছেগুলোর কথা?"
অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন তিস্তার সাথে তারপর লুকোনো অনেক কান্না কেঁদেছেন অমৃতা। অবশ্য বাড়িতে ফিরে সুগত আর তথাগত কারোরই অমৃতার মুখের দিকে তাকানোর সময় ছিল না।
আগামীকাল অমৃতার চল্লিশ বছর পেরোনোর সানাইয়ের সুরের সেই দিনটা। তার আগের দিনই ঘর ছাড়লেন অমৃতা। সুগত ভেবেছিলেন কাছাকাছি কোথাও গেছে অমৃতা তারপর অনেক রাত হয়ে যাওয়াতে সবাই খোঁজ শুরু করল। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর অমৃতাকে পাওয়া গেল না।
অথচ কেউ জানতেও পারল না কেন ঘর ছাড়ল অমৃতা। অনেক কাগজ ছিঁড়েছিল অমৃতা ভেবেছিল কিছু লিখে যাবে কিন্তু আর ইচ্ছে করেনি। ঘোর সংসারী মনটা বিদ্রোহ করে উঠে বলেছিল কোন কৈফিয়ত সে দিয়ে যাবে না কাউকে।
দুটো তিনটে কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও সুগতর সাজানো ফিটফাট সংসারের মেরুদণ্ড কেমন যেন বেঁকে গেল। সুগত বুঝতে পারলেন নিপুণ হাতে অমৃতা ঘরটা সামলাত বলেই তিনি নিজের খেয়ালে বাইরে ঘুরে কাটাতে পারতেন। শুধু নিজের জন্য এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়া জীবন নয়,একটা সংসারে অনেক কিছু করতে হয়। আজকাল সুগতর ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়। খাবার টেবিলে বসে তথাগতর কেমন যেন ফাঁকা লাগে সামনে বসে খাবার দেবার মত কেউ নেই বাড়িতে। কিন্তু কোথায় গেল অমৃতা? কেনই বা গেল?
************************
একটা বছর কেটে গেছে মাঝে। ছোট মেয়ে আর জামাইয়ের সাথে সুগত পন্ডিচেরী এসেছেন। অরবিন্দ আশ্রমে খেয়ে বাসন পরিস্কার করার জায়গায় থালা রাখতে গিয়ে চমকে ওঠেন সুগত। অমৃতা না? হ্যাঁ ঐ তো অমৃতা। থালাগুলো ধুয়ে গুছিয়ে তুলছে। ওকে চেনাই যায় না কত রোগা হয়ে গেছে। চোখের চশমাটাও বদলে ফেলেছে।
কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন সুগত। কিন্তু এক পলকে কোথায় গেল অমৃতা? ততক্ষণে মেয়েও এসেছে। ওদের বলতেই ওরা সবাই খুঁজতে থাকে এদিক ওদিক কিন্তু কোথায় অমৃতা? শেষে সুগতকে বলে নিশ্চয় তুমি ভুল করেছ বাবা। আচ্ছা আমরা দেখছি।
ওরা আশ্রম কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে ওঁরা বলেন এখানে প্রচুর বিদেশী আর এখানকার লোক ভলেন্টারি সার্ভিস দেন। নাম তেমন করে বলতে পারবেন না ওঁরা।
সমুদ্রের আওয়াজ শুনতে শুনতে ক্লান্ত শরীর ইজি চেয়ারে এলিয়ে দেন অমৃতা। সুগতর চরিত্রের কালো দিকটা আর খোলেননি ছেলেমেয়েদের কাছে। তবে বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নেননি। তাই আজও পালিয়ে এসেছেন যাতে কেউ ওঁকে ধরতে না পারে। বড় অভিমান আর ঘেন্না লোকটার ওপর। গানে ডুবে যান অমৃতা.....
সংসার যবে মন কেড়ে লয়, জাগে না যখন প্রাণ,
তখনো, হে নাথ, প্রণমি তোমায় গাহি বসে তব গান ॥
অন্তরযামী, ক্ষমো সে আমার শূন্য মনের বৃথা উপহার--
পুষ্পবিহীন পূজা-আয়োজন, ভক্তিবিহীন তান ॥
ডাকি তব নাম শুষ্ক কণ্ঠে, আশা করি প্রাণপণে--
নিবিড় প্রেমের সরস বরষা যদি নেমে আসে মনে।
সহসা একদা আপনা হইতে ভরি দিবে তুমি তোমার অমৃতে,
এই ভরসায় করি পদতলে শূন্য হৃদয় দান ॥
তিস্তা কখন ঘরে এসেছে বুঝতে পারেননি। মামণির এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দেয় তিস্তা," আজ মনটা খারাপ মনে হচ্ছে?"
-" কেন বলত?"
-" এই গানটা তো তুমি মন খারাপ হলেই শোন। ফেলে আসা সংসারের মায়া কাঁদাচ্ছে তাই না?"
হঠাৎই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে অমৃতার বলে ওঠেন,"আমরা মেয়েরা অনেকেই সংসারে আমাদের সবটা দিই সংসার আমাদের কী দেয় বলতে পারিস?"
**************************
Comments
Post a Comment