Skip to main content

আকাঙ্খা

"আপনার এখন কতমাস চলছে? এখানকার ডাক্তার দেখিয়ে হল বুঝি?"
  নিজের পেটে হাত রেখে অনেক কষ্টে পাওয়া মাতৃত্বের ওমটুকু অনুভব করতে করতে উত্তর দেয় পরিধি," ছমাস চলছে এখন। হ‍্যাঁ এই ডাক্তার খুব ভালো। আসলে আমার প্রায় এগারো বছর বাদে হচ্ছে। বেশি বড় জায়গায় যেতে পারিনি খরচ বলে। তবে এখানকার চিকিৎসা কাজে লেগেছে।"
   পরিধি দেখে পাশের মহিলাটি মাতৃত্বের স্বপ্ন দেখে ঠিক ও যেমন দেখত কিছুদিন আগে। মহিলাটি বলে," তাহলে আমার সুযোগ আছে,আমার তো মাত্র পাঁচবছর। আসলে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এত কথা বলে না। আর আমার বরও খুব বাচ্চা ভালোবাসে।"
  
   হাত বাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি পরিধি। একই সমস‍্যার মধ‍্যে দিয়ে সেও পার হয়েছে গত এগারো বছর। আসলে মেয়েদের কাছে জীবন একটা কাঁটা তারের বেড়া। প্রথম থেকেই সে জেনে বড় হয় একদিন তাকে এই বাড়ি এখানকার প্রিয়জনকে ছেড়ে চলে যেতে হবে কোন অজানা দেশে কাঁটাতারের পরীক্ষা পেরিয়ে সেখানে খুঁটিয়ে দেখা হবে তার পাসপোর্ট ভিসা মানে রূপ,গুণ কখনও বাবার টাকা। তারপর অনেক খরচ আর কষ্ট করে নতুন জায়গাতে পৌঁছেও ভালো থাকতে পারবে না ফিরে আসতে হবে সেটাও বলা মুশকিল।
   মেয়ে বড় হবার আগেই তার রূপের বিচার শুরু হয়ে যায়। তারপর প্রশ্ন আসে মেয়ে তো বড় হল বিয়ে দিচ্ছ না কেন? বিয়ের পর প্রশ্ন আসে এতদিন বিয়ে হল এখনও বাচ্চা হচ্ছে না কেন?
  পরিধি একটা সময় উত‍্যক্ত হয়ে উঠেছিল এমন কত প্রশ্নে। সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছিল যখন ওর ছোট জায়ের সাধের অনুষ্ঠানে ওকে শাশুড়ি ঘরে থাকতে বলেছিলেন। মানে এটাই বলতে চেয়েছিলেন ওর ছায়াও যেন না পড়ে শুভ অনুষ্ঠানে।

 খুব কেঁদেছিল পরিধি তারপর অনয় একটা সময় দেখেছিল পরিধিকে নিয়ে আলাদা থাকাই বোধহয় ভালো। বাড়ি ছেড়ে এসেছিল ওরা একটা বাচ্চা হবার আশায় ঘুরে বেড়িয়েছে ডাক্তার,কবিরাজ আর ঠাকুরবাড়ি। হাত ভর্তি তাগা তাবিজ নিয়ে একটা আশাই করেছিল একটা সন্তান আসুক।

   অবশেষে অনয়ের এক বন্ধুর খোঁজ দেওয়া এই ডাক্তারের চেম্বারে আসে। পরিধির এখন বয়েস চল্লিশ পেরিয়েছে অনয়ের প্রায় পঁয়তাল্লিশ তবুও ওরা খুব খুশি। আর কিছু দিনের অপেক্ষা।

   জ্ঞান ফেরার পর নিজের সন্তানকে খুঁজেছিল পরিধি ডাক্তার বলেছিল মেয়ে হয়েছে সুস্থ আছে। কিছুক্ষণ বাদেই ওর কাছে দেওয়া হবে।
  বাচ্চাটাকে দেখে চমকে উঠেছিল পরিধি আর অনয়। হাত পা নাড়ছে কিন্তু সবই যেন কেমন ছোট ছোট বেটে বেটে। মাথাটা দেহের তুলনায় বড়,পা গুলো একটু বাঁকা বাঁকা। পরিধির চোখটা ছলছল করে ওঠে হঠাৎই। চিন্তার ভাজ অনয়ের কপালে। বাচ্চাটা নিজের খেয়ালে হাত পা নাড়ছে। পরিধি বলেছিল," হ‍্যাঁ গো আমাদের বাচ্চা সুস্থ তো?"
  অনয় বলেছিল," হ‍্যাঁ সুস্থ কিন্তু ডাক্তার বলছিল ও একটু আলাদা অন‍্য বাচ্চাদের থেকে। ও মনে হয়..."
   মুখের কথা মুখেই থেকে গেছিল,কী করে বলবে কথাটা? না না মন খারাপ করবে না ও তো ওদের অনেক আকাঙ্খার সন্তান। তাই অনেক অনেক ভালোবাসা দিয়ে ওকে বড় করবে।

   একটু একটু করে বড় হতে শুরু করে আকাঙ্খা,একটু দেরিতে হলেও ওর বাঁকা বাঁকা পা দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু আবার পরিধি আর ওদের সন্তানের সামনে এল এক কাঁটা তারের বেড়া। পরিধি বুঝল সারা জীবনেও এটা পার হওয়া হয়ত সম্ভব হবে না আকাঙ্খার।
   শাশুড়িমা দেখতে এসে দুঃখে ভেঙে পড়েছিলেন," ও মা শেষে এই বামন বাচ্চা আমাদের পরিবারে এল! হায় ভগবান এর থেকে বাচ্চা না হওয়া ভালো ছিল।"
-" মা এমন কথা তুমি আর কখনও বোল না। ওকে ভগবান দিয়েছেন আমাদের। ওকেই আমরা ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করব।"
  অনেকেই হাসাহাসি করে বলেছে," একেই বয়েস হয়েছে দুজনের তারপর এই বয়েসে একটা বামন মেয়ে হল। সত‍্যি কী যে হবে?"
-" কী আবার হবে? সার্কাসের দলে নিয়ে নেবে। ওখানে জোকার হয়ে মুখে রঙ মেখে ঘুরবে।"
-" আরে মেয়েমানুষ তো, ও আবার কী জোকার হবে? জোকারগুলো তো ছেলে হয়।"
   পরিধি আর অনয়ের চিন্তার আগেই সকলের মাথা ব‍্যথা শুরু হয়ে গেল।
    সন্তান যেমনি হোক সে বোধহয় বাবা মায়ের ভালোবাসার ধন হয়। ঠিক তেমন অনয় আর পরিধিও সামলে বড় করতে লাগল আকাঙ্খাকে।

    প্রথম যেদিন স্কুলে পাঠাল মেয়েকে ফিরে এসে মায়ের কাছে কাঁদতে লাগল আকাঙ্খা," মা আমি কী বামন? আমাকে দেখে সবাই হাসাহাসি করে। দিদিমণিরাও হাসে।"
    কান্না পেল পরিধির অনয় আসতেই বলল," তুমি একটা অন‍্য স্কুলের খোঁজ কর। আমি ওখানে আর মেয়েকে পাঠাব না।"
-" এখনি বলতে বলতে কী হয়? আচ্ছা আমি দেখছি কী করা যায়?"

   অনয় মেয়েকে কাছে টেনে নিল," আচ্ছা শোন আজ তোকে একটা গল্প বলি,একবার গালিভার বলে একটা অনেক লম্বা লোক আটকে পড়েছিল একটা অজানা দ্বীপে। চোখ খুলে দেখেছিল ওর বুকের ওপর আর চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ‍্য ছোট মানুষ?"
-" ছোট মানুষ কী বাবা?"
-" ছোট মানুষ মানে যারা উচ্চতাতে ছোট। দাঁড়া তোকে গালিভারের বইটা এনে দেব। কত ছবি আছে আর গল্প আছে তোকে দেখাব।"
   ছোট্ট পাঁচ বছরের আকাঙ্খার মাথায় বাবার সব কথা ঢোকেনি তবে কতগুলো কথা ঢুকেছিল। অনেকগুলো বছর পরেও সেই কবিতাটা ভুলতে পারেনি।

  পরে জীবনের যুদ্ধে আকাঙ্খার বারবারই মনে হয়েছিল গালিভারের গল্প ওর মত লিলিপুটদের ক্ষমতা কম নয় ইচ্ছে করলে তারা আটকে দিতে পারে বড় মানুষকে। আর বাবার বলা সেই কবিতাটা।


আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়
লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।
বড় হওয়া সংসারেতে কঠিন ব্যাপার
সংসারে সে বড় হয়, বড় গুণ যার।
গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে
বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।

    বড় হওয়া সত‍্যি কঠিন ব‍্যাপার। নিজেকে আয়নাতে দেখে আর লজ্জা পায়নি। কী করবে ও? ভগবান ওকে ছোট করে পাঠিয়েছেন। কিন্তু ও ছোট হয়ে থাকবে কেন? গুণে বড় হয়ে সবাইকে দেখিয়ে দেবে সব বামনের জন্ম মুখে রঙ মেখে সার্কাসে লোক হাসাবার জন‍্য হয় না। তারপর টেনে নিয়েছিল বইখাতা আর রঙ তুলি।
  পরিধি আর অনয় অবাক হয়ে দেখেছিল আকাঙ্খার একাগ্রতা। আর সেই একাগ্ৰতা আজ ওকে পৌঁছে দিয়েছে উন্নতির শীর্ষে গুণে বড় করে।

    ছোট ছোট পা ফেলে নিজের ট্রলিটা টেনে এয়ারপোর্টে ঢোকার আগে বাবা মাকে হাত নাড়ে আকাঙ্খা। পরিধির চোখটা জলে ভরে যায় হঠাৎই, ওদের সেই মেয়েটা যে একদিন কত অপমান সহ‍্য করেছে দৈহিক প্রতিবন্ধকতার জন‍্য সে আজ প‍্যারিসে যাচ্ছে আঁকার এক্জিবিশনে। স্বপ্ন দেখা কখনও ছাড়তে নেই,আশা রাখতে হয় মনে অনেক তবে তো তার সিকিভাগ হলেও পূর্ণ হয়।
  অনয় হাত নাড়ছে তখনও আবার একবার পেছনে ফেরে আকাঙ্খা মনে মনে বলে... বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে।
সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...