স্কুলে যাবার আগে মেয়েকে বকুনি দেয় কুহু," কী রে তোর স্কার্ট কী ছোট হয়ে গেছে নাকি? এত উপরে তুলেছিস কেন?"
-"মা তুমি সব কথাতে টিক টিক কোরনা তো। এইখানেই সবাই স্কার্ট পরে। তোমাদের যুগ নাকি এখন যে হাঁটুর নীচে জামা পরে স্কুলে যাব? দাও আমার টিফিন আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।"
সদ্য যৌবনে পা রাখা মেয়ের সাথে পেরে ওঠে না কুহু। আর তখন মৌমী হাওয়াতে ভাসছে। ক্লাশ এইটে উঠতে না উঠতেই তার অ্যাডমায়ারের সংখ্যা দশ ছাড়িয়ে গেছে। চেক স্কার্ট পরে সে যখন স্কুলের বাসে ওঠে তখন তাকে নচিকেতার গানের নীলাঞ্জনার সাথে তুলনা না করে উর্মিলা বা আগের সিনেমার ববির সাথে দিব্যি তুলনা করা যায়। ওর ফর্সা পা দেখে অনেকেরই মনে দোলা লাগত। নিজেকে সন্তর্পণে হরিণীর মত শান্ত রেখে একটা কুল লুক দিলেই একদম ফিদা হয়ে যেত ছেলেদের দল। আর সেটা দেখেই ওর মনে জাগত একটা অদ্ভুত আনন্দ।
স্কুলের কড়াকড়িতে চোখে চোখে কথা বলার মতই প্রেমগুলো ওখানেই আটকে রইল মানে একটু দেখা ইশারা বা হাত ধরে গল্প করা তার বেশি কিছু নয়। তবে আরেকটু বড় হওয়ার পর কুহুর পক্ষে মেয়েকে সামলানো দুরূহ হয়ে উঠল। মাকে পাত্তাই দিত না মৌমী। বাবা সারাদিন বাইরে বাইরে কাজ করে তাই মাকে বোকা বানিয়ে ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়াত। বাইরে না বেরোতে দিলে ঝামেলা করত। ওদের পাড়ার জিকো থেকে শুরু করে সুমন,ঋষভ অনেকেই পাগল হল মৌমীর প্রেমে। তবে মৌমীর তেমন করে মনে ধরল না কাউকেই।
আড়ালে আবডালে লোকেরা বলত," ছেলে নাচানী মেয়ে হয়েছে একটা। কত ছেলের সাথে যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ঠিক নেই। যত জ্বালা হয়েছে আমাদের।"
-" আরে আর বোল না বাবাটা কী কাজ করে কে জানে? ফেরে রাত করে। বাবারও তো স্বভাব ভালো নয়। নেশাটেশা করে। আর ঐ মেয়ে মোটেই মাকে পাত্তা দেয় না। কিছু বললেই জিনিসপত্র ভেঙেচুরে এক করেছে। আমি তো থাকি পাশের বাড়িতে সব দেখি।"
কুহুর শাসন সবই বৃথা হত যখন বাবা আরও বেশি প্রশ্রয় দিত মেয়েকে। যা চাইত সব এনে দিত।
তবে মৌমী যখন পাশের পাড়ার শিবমকে বিয়ে করার বায়না করল টুয়েলভ না পেরোতেই তখন ওরা আর সইতে পারলেন না। এত কষ্ট করে মেয়ে মানুষ করে শেষে ঐ মস্তান শিবমটাকে জামাই করতে হবে? কতটুকু বয়েস মেয়েটার? ওরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই ভেঙে পড়ে।
তবে এক্ষেত্রে পাড়ার লোকেদের সাহায্য খুব কাজে লাগে।
কুহুর বাপের বাড়িতে ওরা রাতরাতি চলে এল প্রায় পালিয়ে মেয়েকে সাথে নিয়ে। তার আগে এমন বাজে অবস্থা যে পারলে মেয়েকে তুলেই নিয়ে যায় ঐ গুন্ডাটা।
মেয়ের গালে একটা চড় দিয়েছে কুহু," কথায় বলে অতি বড় সুন্দরী না পায় বর আর অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর। তোর হয়েছে সেই হাল। শেষে ঐ গুন্ডাটাই তোর মন নিল। হে ভগবান এখন আমরা কী করব?"
উপায় খুব তাড়াতাড়ি একটা বের করেছিল সবাই ভেবে মোটামুটি কুহুর অমতেই ওর বিয়েটা হয়ে গেছিল। অনেক রাগারাগি আর জেদ করেও কিছু করতে পারেনি। বেশ বড়লোক বনেদী বাড়িতে ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছিল। আসলে বোধহয় সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র তাই সুন্দরী কুহুকে ওদের পছন্দ হয়ে গেছিল।
তখনকার মত অনেক গয়না আর শাড়ি পরে বড়লোক শ্বশুরবাড়িতে এলেও শুভব্রতকে কিছুতেই শিবমের জায়গাতে মেনে নিতে পারল না মৌমী। শিবম মস্তান হলেও সে ছিল সুন্দর দেখতে। তার যৌবনের বলিষ্ঠ চেহারায় পাগল পাগল লাগত মৌমীর। ওর বাইকের পেছনে উঠলে নিজেকে হিরোইন বলেই মনে হত।
এ কোন ছেলের সাথে তাকে বিয়ে দিল বাবা মা? কোন তেজ নেই,নেই কোন পৌরুষের তান্ডব। কেমন যেন একটা ম্যাদামারা একটা ছেলে। কথাটা মাকে বলতেই মা রেগে উঠেছিল," শোন একটাও কথা বলবি না শুভব্রত ভালো ছেলে বলে তোকে মাথায় করে রেখেছে। যখন যা বলছিস তা এনে দিচ্ছে। আর কত কী চাস?"
বড় জটিল বোধহয় মানুষের মনস্তত্ত্ব তার থেকেও জটিল অনেক সময় নারী চরিত্র। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও খুব সত্যি। এই পৃথিবীতে কত শত যুদ্ধ,সামাজিক অশান্তি সবই হয়ত হয়েছে নারীকে ঘিরে। আবার গৃহকোণেও নারীই অনেক সময় নারীর প্রতিদ্বন্দ্বী।
মৌমী সুখের ছোঁয়া পেলেও সুখী হতে পারল না। শুভব্রতকে তার ভালো লাগে না। মৌমী ছটফটে সুন্দরী,স্লিম। সেই তুলনায় শুভব্রত কালো,মোটা আর হাবভাবে বয়স্ক। শুভব্রতকে বায়নাতে উত্যক্ত করে মৌমী," আমি বাবার কাছে থাকতে রোজ বিকেলে বেরোতাম। আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে হবে।"
ব্যবসার ফাঁকে সময় বের করে প্রতিদিন শুভব্রত নিজে গাড়ি চালিয়ে বৌকে খুশি করতে বেরোত বাইরে। মৌমীর ছেলেমানুষী প্রথমে ভালো লাগলেও পরে মনে হত অদ্ভুত একটা জেদ আর পাগলামি আছে ওর মধ্যে। হঠাৎই রেগে যায়,পছন্দের কোন জিনিস না পেলে ভাঙচুর করে। একদিন তো এমন করে কাপ ছুঁড়ল ওর কপাল কেটে গেল।
আবার ওর কপালে রক্ত দেখে কেঁদে অস্থির হল। অনেকটা ছেলেমানুষী আর পাগলামি ছাড়াও মৌমীর শারীরিক চাহিদাও অনেকটা বেশি ছিল। সেই তুলনায় শুভব্রত অনেকটা ধীর স্থির আর সংযত। তবুও বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই মৌমীর শরীরে মাতৃত্বের আভাস দেখা গেল। শ্বশুরবাড়ির সবাই খুব খুশি।
অবশ্য ওকে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে হয় না। বিয়ের পর থেকে আলাদাই থাকে আরেকটা বাড়িতে। সেই সময় শুভব্রত ওর যত্নের জন্য আরও একজনকে রাখল। কারণ মৌমী ছেলেমানুষ নিজের দেখভাল করা মানে ওর কাছে সাজগোজ করা। তাই কুহু আর ওর স্বামীও এলেন মেয়ের বাড়িতে। একমাত্র মেয়ে তাদের সুতরাং সে যেন যত্নে থাকে।
ছেলের জন্ম দিল মৌমী কিন্তু অত দায়িত্ব নিতে তার ভালো লাগে না। সে ছেলেকে আয়ার কাছে রেখে প্রতিদিনই বেরোয়। শুভব্রত আজকাল একটু বিরক্ত হয় বলে মৌমী," ওর তোমাকে দরকার। কিছুদিন না হয় থাকলে বাড়িতে।"
-" বলেছি না বিকেলে না বেরোলে আমার ভালো লাগে না। তুমি না নিয়ে গেলে আমি একাই চলে যাব।"
একটু একটু করে বুল্টু বড় হতে লাগল। মৌমী কোনদিনই সকালে উঠতে পারে না তাই শুভই তাকে তৈরী করে স্কুলে নিয়ে যায়। ছেলে মশারীর ভেতর থেকে মাকে হাত নেড়ে বেরিয়ে যায়।
মৌমীর দাম্পত্য জীবন প্রায় পনেরো বছর পেরিয়েছে তবে এখনও তার সংসারে মন বসেনি। সে তৃপ্ত নয় শুভব্রতের আদরে। পুরোনো অভ্যেসে এখনও সে পুরুষের মুগ্ধতা দেখে খুশি হয়। তবে তার পছন্দ কম বয়েসী পুরুষ। শুভর মত পুরুষ তার পছন্দ নয়।
এখন সে ছেলেকে শ্বশুরবাড়ি রেখে নিজের খেয়াল খুশিতে ঘুরে বেড়ায়। প্রতিদিন বিকেলে না বেরোলে তার ভালো লাগে না। বুল্টুর খাওয়া দাওয়া ঠাকুমা দেখে আর পড়াশোনা শেখাতে দিদিমণি বহাল হয়েছে।
হঠাৎই একদিন বাড়ি ছাড়ল মৌমী। এমনিতে বেশ কয়েকদিন লক্ষ্য করেছে শুভ মৌমী সন্ধ্যেবেলাতে বেরিয়ে বেশ রাতে ফেরে। কিছু বললে রেগে বলে," বলেছি না আমার অত সংসার করতে ভালো লাগে না। আমার জন্য কোন কাজ আটকে আছে শুনি? তুমি কী সন্দেহ করছ নাকি আমাকে?"
-" হ্যাঁ করছি,রোজ বাইরে কী আছে এত? আর তোমার গয়না কোথায়? ওগুলো দেখছি না কেন?"
মৌমী নিজেকে সামলাতে বলে," সব আছে মায়ের কাছে। গয়নাতে তোমার কী দরকার? ওগুলো বেচে দেবে নাকি?"
অশান্তির ভয়ে চুপ করে গেছিল শুভ।
বান্ধবীদের সাথে দেখা করতে যাবে বলে সেজেগুজে গিয়ে আর ফেরেনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করে হাল ছেড়ে দিয়েছিল শুভ যখন মৌমী মেসেজ করেছিল সে খুব ভালো আছে তাকে যেন আর খোঁজা না হয়।
শুভব্রত উকিলের পরামর্শ নিয়েছিল,সত্যি সেও আর পারছে না। হঠাৎই একদিন মৌমী একটা সিঁদুর পরা ছবি দিয়েছিল শুভর ফোনে যে সে বিয়ে করেছে তাকে যেন আর খোঁজা না হয়।
বুল্টু একটু বড় হয়েছে মায়ের কথা সে শোনে আর বুঝেছিল যে তার মা পালিয়ে গেছে কোথাও। সন্তানকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছিল শুভ। মেয়ের কৃতকর্মের অনুশোচনায় জামাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে এসে নাতির মুখ চেয়ে রয়ে গেছিলেন সেখানে কদিন।
শুভ কখনও মুখোমুখি কথা বলতে পারেনি এই তিনমাসে মৌমীর সাথে। তবে অবাক হয়েছিল জেনে প্রায় পঁয়ত্রিশের মৌ চলে গেছে কোন পঁচিশ বছরের কোন ছেলের সাথে তাদের গ্ৰামে।
ঋত্বিকের তেমন টাকা পয়সা নেই। সে বস্তীতে থাকত একটা কারখানায় কাজ করত। কিভাবে যে মৌমীর তার সাথে ভালোবাসা হল তা এখনও বুঝে পায়নি শুভ। তবে অনেকেই বলেছে ওদের ঘুরতে দেখেছে এদিক ওদিক।
মৌমীর গয়না বিক্রির টাকাতে কয়েকটা দিন বেশ চলেছে ওদের। ঋত্বিকের সাথে কাটানো দিনগুলোতে মনে হয়েছে ওর জীবনে না পাওয়া সব সুখ ওকে দিয়েছে ছেলেটা। শুভর সংসারে আর কোনদিন ফিরবে না সে।
মৌমীকে শুভ আদরে মুড়িয়ে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু সে ভালোবাসা তার সয়নি। ঋত্বিকের মত দেহের সুখ সেখানে কোথাও সে পায়নি।
তবে কয়েক মাস বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ানোর পর বাস্তবে ধাক্কা খায় মৌমী। এখন আর কোন টাকা ওর কাছে নেই। ঋত্বিক ওকে নিয়ে ঘুরতে লজ্জা পায় একটা সময় টাকার লোভে আর মোহে বড়লোকের বৌ নিয়ে পালিয়েছিল সে। কিন্তু এখন দেখে মৌমীকে সামলাতে সে অস্থির। বস্তীর ঘরে ঠাঁই হয়েছে ওদের,এখানে ওর বাড়ি বা হোটেলের মত নরম বিছানা নেই। শক্ত কাঠের চৌকিতে শুয়ে ভালো লাগে না মৌমীর। রান্না করার অভ্যেস তার একদম নেই। ভাতের ফ্যানটুকু সে গালতে পারে না। এখানে তাকে স্টোভ ধরিয়ে রাঁধতে হয়।
হঠাৎই একদিন বাড়ির ল্যান্ডফোনটা বেজে ওঠে শুভ তখন সেখানে ছিল না। বুল্টু দৌড়ে যায় ফোনটা ধরতে তারপর বলে হ্যালো।
অনেকদিন বাদে ছেলেটার গলার আওয়াজ পেয়ে কান্না পায় মৌমীর বলে," বুল্টু কেমন আছিস বাবা?"
-" মা তুমি কোথায়? কবে আসবে? তোমার জন্য আমার মন খারাপ করে। সবাই তোমাকে খারাপ বলছে।"
-" তোর বাবাকে বলবি আমার কিছু জামাকাপড় দিয়ে যেতে। আমার খুব অসুবিধা এখানে। আমি কী করে যাব বল?"
হঠাৎই মৌমী ওপার থেকে একটা কঠোর গলা শোনে," যা লাগবে এসে নিয়ে যাবে। কেউ যাবে না দিতে।"
-" আমি আর পারছি না খুব ভুল করে ফেলেছি, এখানে খাওয়ার খুব কষ্ট। আমাকে ক্ষমা করে দাও।"
কথাগুলো বলে কেঁদে ফেলে মৌমী। ফোনের এপাশ থেকে ছেলেটা বলে বাবা মাকে নিয়ে এসো,মায়ের খুব কষ্ট। কাঁদছিল যে। আমি যাব মায়ের কাছে।
গতকাল রাতে সারারাত ঘুমোয়নি শুভ বারবারই চোখ গেছে ঘুমন্ত ছেলেটার দিকে। মনে মনে মৌমীকে বলেছে তুমি কী নিষ্ঠুর মৌমী এখন বলছ আমাকে ক্ষমা করে দাও। এত ভালো ঘর থাকতে শেষে.......
মৌমী ফিরে এসেছে দিন সাতেক হল। ঋত্বিককে খুঁজে পাওয়া যায়নি আর। অবশ্য পেলেই বা কী হত? স্বেচ্ছায় কেউ যদি ঘর ছাড়ে তাহলে ওর কী দোষ?
পাড়ার লোকরা ছিঃ ছিঃ করেছে। মৌমী প্রায় একমাস ঘর থেকে বেরোয়নি। ওকে সবার থেকে আড়াল করে রেখেছিল শুভ। ভালো ভালো ডাক্তার দেখিয়েছে শরীর আর মন সুস্থ করতে।
যদিও এটা এক মানসিক অতৃপ্তিতে ভোগা নারীর গল্প। তবুও নারীর এই গল্পে বিজয়ী শুভ একজন পুরুষ। নিজের সংসার বাঁচাতে আর বুল্টুর মুখ চেয়ে ফিরিয়ে এনেছিল মৌমীকে। তার ভুল ক্ষমা করে আবার বসিয়েছিল সংসার সিংহাসনে।
Comments
Post a Comment