তখন কলকাতায় বিয়ের পর নতুন এসেছি এসেই টুকটাক হোঁচট খেতে শুরু করেছি ঘরে বাইরে। প্রথম কথা উত্তরবঙ্গের মেয়ে আমি,পথঘাট ঠিকমত চিনি না। বি.এড কলেজে ভর্তির ফর্ম জমা দিতে গিয়ে কখনও উল্টো দিকের বাসে চেপে বসছি। কখনও বা কাউকে পথের হদিস জিজ্ঞেস করাতে সে আমাকে আনাড়ি ভেবে পিছনে ধাওয়া করছে। যাক এই হোঁচট ঠ্যালা গুতো খেয়ে মোটামুটি প্রথমে এসেই আমি বেসামাল। তারমধ্যে আবার দেখলাম এখানকার মানুষ জন যেন কেমন একটা, মানে আজ আপনাকে রাস্তায় দেখে দাঁত ক্যালালো অনেক গপ্প করল যেচে যেচে আবার কাল যখন আপনি হাসি বিনিময় করবেন বলে সবে দাঁত বের করবেন সে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল।
প্রথম প্রথম খুব মনখারাপ হলেও একটা সময় বুঝলাম এখানকার মানুষজন এমনি,কাজের বেলায় কাজি আর কাজ ফুরোলে পাজি। প্লিজ এটা অবশ্য সবার জন্য নয়,অমায়িক মানুষও আছেন।
সে যাক দেখতে দেখতে কলকাতার বুকে পা রাখার প্রায় ছয় বছর পুরো হল। ততদিনে আমি বি এড শেষ করে চাকরি করছি। তবে আমার বর যে কথাটা বলেছিল একটা সময় দেখলাম সেটাও সত্যি মানে কাজের জায়গায় বন্ধু হয় না। অবশ্য যাদের আছে এমন বন্ধু তারা বলবেন হয়। অবশ্য এটা আমিও ভেবেছি আর নিজেকে অপদার্থ হিসেবে দশ, আর ভালো বন্ধু হিসেবে দুই দিয়েছি। আমার যারা বন্ধু ছিল তাদের তখন ফেলে এসেছি উত্তরবঙ্গে। সেই সময় ফেসবুকের মাখামাখি ছিল না,ছিল না আমার শ্বশুরবাড়িতে ল্যান্ডফোন তাই যোগাযোগের তার কেটে গেছিল। ঐ একটা দুটো চিঠি লেখা কখনও সখনও। কলকাতা এসে আক্ষেপ হল ভালো বন্ধু আর তেমন করে জুটলো কোথায়? তখন আমারই কিছু ত্রুটি আছে ভাবতে শুরু করলাম। কারণ সাজালাম একটা যে আমি উত্তরবঙ্গের মেয়ে,তাই এখানে ঠিকমত মিশতে পারছি না
ততদিনে আমার ছেলে হয়েছে,ওকে তিনবছর বয়েসে ভর্তি করলাম পাড়ারই একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। আমি স্কুল ফেরত ওকে নিয়ে ফিরতাম বাড়িতে। আমি একটু আগেই এসে যেতাম,অপেক্ষা করতাম বাইরে দাঁড়িয়ে সেখানেই আলাপ হয়েছিল রাত্রির সাথে। কোলে আরেকটা ছানা নিয়ে ও আসত ছেলেকে নিতে। কিছুদিনের মধ্যেই আলাপ গাঢ় হয়েছিল। শুনেছিলাম ওর বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি দুই ওপার বাংলাতে,পড়াশোনাও ওখানে করেছে। বিয়ের পর এখানে এসেছে। এখনও ওপার বাংলাতে ওদের বাড়ি সেখানে ভাসুর থাকেন। একটু একটু করে স্কুলের গেটের বাইরের আলাপের সূত্র ধরে আমরা ঢুকে পড়েছিলাম একে অপরের অন্দরে।
প্রথমে ও আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বাড়িতে। ওদের নিজেদের বাড়ি। আমি তখন রেলের কোয়ার্টারে থাকি,বাপের বাড়ি দূরে। ওদের বাড়িতে গিয়ে বাড়ির ফ্লেভার খুঁজে পেয়েছিলাম। আমার ছেলেটা মেতে উঠেছিল ওর দুই ছেলের সাথে খেলায়। ওদের বাড়িতে সেদিন লোটে মাছের চপ দিয়েছিল খেতে। এর আগে কোনদিনই ঐ মাছ আমি খাইনি তবে দেখেছিলাম ভালোই খেতে।
এরপর থেকে যাতায়াত বেড়েছিল। আমাদের কোয়ার্টার ছিল বিশাল আকৃতির মানে পুরোনো ব্রিটিশ আমলের। বারান্দায় সাইকেল চালানো যেত,আর বিরাট বিরাট ঘর। ওর ছেলেরা এসে খুব আনন্দ পেত আমাদের কোয়ার্টারে। আমার ছেলের একটা সাইকেল আর একটা মোটর গাড়ি ছিল যেগুলোতে চড়া যেত। আর ছিল কয়েক পোটলা গাড়ি। তার গাড়ি বিলাস ছোট থেকেই ছিল। বিছানাতে শুয়ে শুয়ে গাড়ি চালানো ছিল তার অন্যতম প্রিয় খেলা। কখনও সে মেঝেতে পাতা মাদুরে শুয়ে শুয়ে লাইন দিয়ে একই খেলা খেলত চুপ করে। ছোট থেকেই স্বভাবে শান্ত ছিল এবং বোকাও ছিল। যার জন্য নানা ভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
ওরা আসার পরই শুরু হত গাড়িতে বসা নিয়ে ঝামেলা। আমাদের গল্পের মাঝেই শুরু হত নালিশ আর কান্নাকাটি। তারপর আবার মিল হত দেখতাম বারান্দায় বসে পোটলার সব খেলনা আর গাড়ি ফেলে ছড়িয়ে ওরা খেলছে। কখনই বড় কিছু আপ্যায়ন করতাম না একে অপরকে,ঐ কিছু ঘরোয়া খাবার মানে ফ্রেঞ্চ টোস্ট বা লুচি পরোটা দিয়েই আপ্যায়ন সারা হত। কিন্তু ছেলেদের বন্ধুত্বের কলরবে আর আমাদের বন্ধুত্বের সুবাসে বেশ কাটত বিকেলগুলো অন্যরকম ভাবে।
আমার যেহেতু তেমন আত্মীয়স্বজন ছিল না তাই ছেলের জন্মদিনে রাত্রি আর ওর ছেলেরা আসতই। সাথে আসত আরও কিছু আসেপাশের বাচ্চা ছেলেমেয়েরা। সবার রান্না আমি নিজেই করতাম স্কুল থেকে ফিরে গিয়ে। বেশিরভাগই লুচি,আলুরদম,মাংস,পায়েস বা ফ্রায়েড রাইস আর পনীর,মাংস থাকত। কখনও নিজেরাই ফিলে এনে বানাতাম ফিসফ্রাই বা বাটার ফ্রাই। আমার হাতের ফ্রাই ছেলের খুব পছন্দ ছিল। ছোট থেকেই সে ছিল খাদ্য রসিক। ওদের বন্ধুত্বের মিঠে কলকাকলিতে ভরত বাড়িটা,কখনও সেদিনও ঝগড়া করেই যেত ওরা বাড়িতে। আমরা হাসতাম ওদের কান্ড দেখে। রাত্রি খুব সাহায্য করত জন্মদিনে এসে। আমার থেকে অনেক বেশি কর্মঠ ছিল ও। আমি চিরকালই একটু কম সংসারী,আমার সংসার গুছোনো নয়। বড় এলোমেলো আর উড়ু উড়ু মন আমার সংসারের শেকলে তা বাঁধা যায় না। তবুও সংসার করে যাচ্ছি অনেক বছর ধরে।
ছেলে হওয়ার প্রায় ছয় বছর পরে আমার মেয়ে হল। ছেলেকে পাঁচ বছর দুমাসেই আমি ওয়ানে দিয়েছিলাম তাই তখন সে টুয়ে পড়ে। আমি যখন নার্সিংহোমে তখন আমার বাবা প্রতিদিন তাকে স্কুল থেকে নিয়ে আমাকে দেখিয়ে আনতেন। বড় কষ্ট হত তাকে ছেড়ে থাকতে তখন।
ততদিনে রাত্রির আর আমার ছেলের স্কুল আলাদা হয়ে গেছে। কিন্তু দোস্তিটা আরও গভীর হয়েছে। আমার সাধেও ও এসেছিল,আর নার্সিংহোমে এসে আমার মেয়েকে জামা সোয়েটার দিয়ে আদর করে গেছিল। ওর খুব মেয়ের শখ ছিল তাই ভীষণ ভালোবাসত আমার মেয়েকে।
রাত্রিরা আমাদের কোয়ার্টার থেকে খুব দূরে থাকত না তাই সুযোগ পেলেই মেয়েকে কোলে নিয়ে ছেলের হাত ধরে একটু স্বাদবদল করতে চলে যেতাম ওর কাছে।
ততদিনে আমার বাবা মা,বর,শ্বশুরবাড়ির সবার সাথেই ওদের দোস্তি হয়ে গেছে। ওর বরকে আমি দাদা করে বলতাম ভরসাও করতাম দাদার মতই। একদিন ও বলল ওরা এই বাড়ি ছেড়ে আমাদের ওখান থেকে তিন চারটে স্টপেজ দূরে চলে যাবে। খুব মনখারাপ হল আমার বললাম ইশ্ তাহলে তো আর যখন তখন যাওয়া হবে না। বন্ধুত্বটা রেখো গো। খুব ভালোবাসি তোমাকে। ও বলল এই তো এতটুকু পথ তুমিও যাবে আমিও আসব।
আমার মনে হল হঠাৎই কোন প্রিয়জন খুব দূরে চলে গেল। তবে ততদিনে আমার বাড়িতে ফোন এসে গেছে সুতরাং এবার বন্ধুত্ব রয়ে গেল ফোনে ফোনে। প্রায়দিনই কথা হত ফোনে।
একদিন ওরা ওদের বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন করল। সেদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে বুঝেছিলাম ওরা বেশ অবস্থাপন্ন তবে ওদের ব্যবহার কোনদিনই আগে বলেনি সে কথা। ওদের বাড়িতে গিয়ে আমার চোখ জুড়োলো বললাম কী সুন্দর বাড়ি করেছ গো?
সেদিন অনেক রান্না করেছিল ও,সেই প্রথম ওর বাড়িতে ইলিশ পোলাও খেয়েছিলাম আমরা সাথে মুরগির একটা ইউনিক রেসিপি। সবই ঢাকার রান্না। সাথে ছিল ভাপা দই আর বেসনে চুবিয়ে পমপ্লেট ফ্রাই।
আমার বরের সাথে ওর বরেরও বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। দুজনেই বাঙাল তবে একটু মানসিকতায় তফাৎ ছিল কারণ ওরা ব্যবসায়ী পরিবার আর আমরা চাকরিজীবী। ওদের সবই বেশি আমাদের মেপে চলতে হত সীমিত আয়ে। খেয়ে দেয়ে পরম তৃপ্তিতে আমরা ফিরলাম বিকেলে। আমার মেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোলো ওদের বিছানায় শুয়ে। আসার সময় জড়িয়ে ধরে বললাম," কত কী খাওয়ালে গো! খুব আনন্দ করে গেলাম আজ। তোমরা কিন্তু একদিন আসবে জা আর ভাসুরকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে। আমারও ওঁদের খাওয়াতে ইচ্ছে করে।"
রাত্রি মাঝে মাঝেই যেত কিন্তু ওর জা ভাসুর ওপার বাংলাতে থাকতেন তাই খুব ইচ্ছে হল ওদের একদিন খাওয়াব।
অবশেষে একদিন সুযোগ এসে গেল। আমি বাঙাল রান্না করেছিলাম মানে বেশ কয়েক পদের মাছ,মাছের চচ্চড়ি,কাঁটা দিয়ে ভাঙাচোরা শুক্তো,ভাজা ডাল এইসব। ওরা খেয়ে খুশী হয়েছিলেন ওর জা বলেছিলেন," তুমি এইসব রান্না কী করে শিখলে?" বলেছিলাম সব মায়ের কাছে শেখা। দিদারা তো ঢাকার মানুষ।"
এভাবেই কেটে গেছিল বন্ধুত্বের মিঠে সুবাসে দিন। তারপরের কথা নিয়ে আসব আবার।
চলবে:-
আমার বাবা মা দুজনেই স্কুল শিক্ষক ছিলেন। তাঁরা দুজনেই খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন এবং ভীষণ অতিথিবৎসল ছিলেন। আমাদের বাড়িতে গরীব ভিখারীদের ডেকে পেটভরে খাওয়াতেন বাবা। বাবার মন ছিল শিশুর মত,লোকজনের বাড়ি যেতে ভালোবাসতেন। একটু আন্তরিকতা পেলেই সেখানে ছুটে যেতেন। আসলে ঐ সময় মানুষ মেকি ভদ্রতা দেখাতে অভ্যস্ত ছিল না। লোকের বাড়ি লোকে গেলে সুইগি থেকে খাবার আনাব তবে দেব বা অনেক কিছু খাওয়াতেই হবে এমন ব্যাপার ছিল না। খুব সাধারণ কিছু মানে হালুয়া,চা বিস্কুট বা মুড়ি চানাচুরেই জমত আড্ডা। আর বেশি সময়ের জন্য গেলে ভাত খেতেই হত। তাতেও পদের আধিক্য ছিল না। আমার এক বান্ধবী ছিল নিতা, ওদের বাড়িতে কলেজের অফে আমরা মাঝেমাঝেই যেতাম। গেলেই মাসিমা জোর করে মাছের ঝোল ভাত খাওয়াতেন। আমরাও বেশ বসে পড়তাম খেতে। কখনও এই চিন্তা করিনি আমরা মাছগুলো খেয়ে যাচ্ছি ওরা কী খাবে?
জানি না হয়ত বেশি থাকত বলেই দিতেন অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে। বন্ধুর মায়ের কাছে মায়ের ছোঁয়া পেতাম মাঝেমাঝেই। আরেক বান্ধবীর সাথে কলেজ যাবার আর ফেরার পথে নিত্য তার বাড়ির ওপর দিয়ে আসতে হত। হাঁসের ডিমের ঝোল আমার খুব প্রিয় খাদ্য ছিল। তখন দেশী হাঁসের ডিম আমাদের গ্ৰামে বাড়িতে বেচতে আসত রহিম বলে একজন। তার চেহারা আজও অস্পষ্ট আমার মনে পড়ে। সেই ডিমের ঝোল মা রাঁধতেন। আজও সেই অপূর্ব স্বাদ মুখে লেগে। বাবা কুসুম দিয়ে ভাত মাখতেন ওটার একটা দলা মুখে তোলা আমার বাড়তি পাওনা ছিল। এখন সেই স্বাদ পেতে কুসুম ডিমে চটকে মাখিয়ে খাই তবে স্বাদটা অধরাই থেকে যায়। বাবার মত হয় না। মাসিমাকে কোন একদিন বলেছিলাম সেই কথা। তারপর থেকে ওদের বাড়িতে ডিম হলেই কলেজ ফেরার পথে খেয়ে যেতে হত আমাকে। আর আমিও দিব্যি খেতাম সাধ মিটিয়ে। আসলে বড় সরলতা ভরা জীবন ছিল তখন। আমার ছেলে মেয়ে কিন্তু খাবে না এখন এমন হঠাৎ কেউ বললে। আমরা এতটাই সরল ছিলাম যে একটু ভালোবাসা পেলে নিজের অধিকারেই ভালোবাসা গ্ৰহণ করতাম হাত পেতে। তাতে অনেক গভীরতা ছিল,এমন নয় যে সেল্ফিতেই বন্ধুত্ব শুরু আর শেষ।
যাক যে কথা বলছিলাম,বাবা ওদের বাড়ি যেতে ভালোবাসতেন খুব। বাবা মা এলেই একদিন ওদের বাড়ি নিয়ে যেতাম। বাবা বলতেন রাত্রি আমার আরেক মেয়ে,ভীষণ ভালো মানুষ তোমরা। এভাবেই বন্ধু হয়ে থেকো। আমার মেয়েটা বড় একা।
ততদিনে ছেলে হাইস্কুলে উঠেছে। দুইজনের দুই স্কুল তবুও দেখা হলেই ওরা মেতে উঠত আনন্দে। একদিন গরমের ছুটিতে ছেলেমেয়েদের নিয়ে ওদের বাড়ি গেলাম দুপুরের দিকে। ও বলেইছিল আগে একদিন চলে এসো ছুটিই তো আছে,ছেলেরা একটু খেলবে। তবে কেন যেন মনে হল এমন হুট করে আসাটা ঠিক হয়নি। সেদিন রাত্রিকে কেমন যেন আলাদা মনে হয়েছিল,ঠান্ডা ব্যবহার করেছিল। অনিচ্ছায় দেওয়া ডিমের ঝোল ভাত খেয়ে ফিরে এসেছিলাম আমরা।
তারজন্য আমি অবশ্য নিজের হুজুগে স্বভাবকেই দায়ী করেছিলাম মানে যখন তখন কোথাও চলে যেতে নেই বিনা আমন্ত্রণে শুধু মুখের কথায় সেটা বুঝেছিলাম।
তারপর থেকে যাওয়া একটু কমেছিল কারণ তখন আমিও নতুন ফ্ল্যাটে উঠে এসেছি। মেয়ের স্কুল শুরু হয়েছে,বাড়িতে অসুস্থ শ্বশুর দিদিশাশুড়ি সব মিলে নাজেহাল আমিও। তবে কথা হত নিয়মিত। ও আমাদের এদিকে ওদের পুরোনো বাড়িতে এলে ঘুরে যেত। আমাদের বন্ধুত্ব এমন পর্যায়ে ছিল যে শীতকালে পাটিসাপটা,পায়েস বিনিময় হত। ও নোনতা পুলি ভাজতে জানত না একদিন আমি গড়ে কৌটোতে ভরে দিলাম বললাম বাড়িতে গিয়ে সবাই মিলে ভেজে খেয়ো। ওকে একটু কিছু দিতে পারলে আমার ভালো লাগত,আমার পছন্দের কোন জিনিস ওর ভালো লাগলে সেটা ওকে দেবার চেষ্টা করতাম। পুজোর সময় জামাকাপড় আদান প্রদানও ছিল। এখনও আমার আলমারিতে রাত্রির দেওয়া শাড়ি আছে।
একদিন কথায় কথায় ওরা বলল ওদের কখনও পুরী যাওয়া হয়নি। আমাদের মাথায় তখন থেকেই ঘুরতে লাগল যে ওদের সাথে নিয়েই পুরী যাব। আমার বরের অফিসের হলিডে হোম বুক করা হল। সবার মন খুশিতে ভাসল যে আমরা পুরী যাচ্ছি। সারা ট্রেন খুব আনন্দ করতে করতে গেলাম। আগে পুরীতে গেলে হলিডে হোমে আমরা রান্না করেই খেতাম। পুরীর বাজারে পাওয়া কই মাছ আমার খুব প্রিয় ছিল। যাক ওদেরকে পেয়ে আনন্দে আমার বর প্রচুর মাছ নিয়ে এলো। আমি বললাম তোমাদের তো পুরীতে আসা হয়নি তোমরা ঘোরাঘুরি কর আমি রান্না করে নেব। আমার বর ওদের নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে ফটোশুট করল আনন্দে। আমারও খুব ভালো লাগল যে ওদের আনন্দ দিতে পারছি। আমার দুই ছেলেমেয়ে ওর ছেলেদের সাথে মেতে উঠল খুশিতে কখনও আবার ঝগড়াও লাগল। সব মিলে এক মধুর স্মৃতি। পুরীতে গিয়ে একদিনের মেনুতেই মোটামুটি চিংড়ী,ইলিশ আর কই হয়ে গেল। একদম জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হত। সেই সব ভিডিও করে আমার বরের হ্যান্ডিক্যামে রাখা। সেই সময় আমার পায়ে একটা বীভৎস বড় ফোঁড়া হয়েছিল তবুও সেটা নিয়েই হাসিমুখে রান্নার দায়িত্ব নিয়ে মোটামুটি আটজনের রান্না করছিলাম। রাত্রি অবশ্য সাহায্য করত মাছ ধোয়া কাটাকুটি করাতে। সব মিলে বেশ পিকনিক মুড সবার। রান্নার পর একটা বড় দায়িত্ব রাত্রি নিত ও সবাইকে খেতে দিত। আমার তাতেই অনেকটা হাল্কা লাগত। পায়ে ফোঁড়া নিয়ে সমুদ্রে স্নান না করতে পারলেও যোগ দিয়েছিলাম ওদের আনন্দে। ঘুরে এসেছিলাম কোণারক ভুবনেশ্বর। আমাদের ফেরার ট্রেন ছিল ধৌলী ওরা বাইরের খাবার তেমন খায় না তাছাড়া সাথে বাচ্চা আছে তাই ভোরবেলা উঠে ফ্রায়েড রাইস পনীর করে কিছুটা পেটে দিয়ে আর কিছুটা হাড়িতে করে নিয়ে উঠলাম ট্রেনে। হাড়িটা পুরী থেকেই কেনা হয়েছিল। ওর কাছেই শুনেছিলাম পুরীতে এলে হাড়ি কিনতে হয়। আমিও কিনেছিলাম একটা হাড়ি।
সারা ট্রিপে মাখোমাখো ভালোবাসা আর ভালোলাগার পর রাত্রির আর আমার দুজনেরই চোখ ভিজল। ও বলল কখনও এত আনন্দ পায়নি। ও হ্যাঁ আমার কর্তাও কিছুটা আমার বাবার মত মানে মানুষজনকে খুশি করতে সেও অনেক কিছু করতে পারে। সুতরাং এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। ওদের সমুদ্রে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলতে গিয়ে ঢেউয়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে পরে গিয়ে ক্যামেরাতে নোনা জল ঢুকিয়ে সব ছবি এবং ক্যামেরা দুটোই নষ্ট করে এলেন। সে যাক গিয়ে ক্যামেরা বন্ধুত্ব তার চেয়ে ঢের বেশি মিঠে। ওরা খুশি দেখে আমরাও পরিতৃপ্ত হলাম। অবশ্য পরে আমাদের আনন্দ দেবার ঋণ পুরোপুরি শোধ করেছিল রাত্রির স্বামী। হঠাৎই আমাদের একদিন ডেকে খাইয়ে আমাকে উপহার দিয়েছিল একটা পলা বসানো সোনার লকেট। আমি খুবই লজ্জিত হয়েছিলাম খুব রাগ করছিলাম কিন্তু এমনভাবে বললেন দাদা যে দুটো লকেট বানিয়েছেন তিনি একটা রাত্রির এবং একটা আমার। দুই বন্ধু একসাথে পরব তাই দিয়েছেন আমাকে লকেটটা।
বুঝেছিলাম দাদা ব্যবসায়ী মানুষ সব হিসেব কড়ায় গন্ডায় চুকিয়ে দিতে জানেন। শুধু আমার অঙ্কটাই বরাবর কাঁচা রয়ে গেল,মাধ্যমিক পরীক্ষাতে অঙ্কে এক নম্বরের জন্য লেটার পাইনি। তারপর আর অঙ্কের ধার পাশ দিয়ে যাইনি। দামী উপহারটা গলায় কাঁটার মত বিঁধলো বরের কাছেও বকুনি খেলাম। বলল এত দেয়া থোয়া করছ তোমরা কদিন সম্পর্ক থাকবে কে জানে?
আমি সম্পর্ক হারাতে ভয় পাই তাই আঁকড়ে ধরে রাখলাম রাত্রিকে। ছন্দপতন হল না কোথাও একটুও। তবে ওদের গয়না দেবার বিনিময়ে আমার গয়না দিতে কোথায় যেন একটু খারাপ লাগল। আমি সেবার পুজোতে ওকে একটা দামী ইক্কত দিলাম। রাত্রি বলল,
-' এখন আর এই শাড়িগুলো পরতে ভালো লাগে না। কতগুলো একে ওকে দিয়ে দিলাম।"
কথাগুলো আমার বুকে এসে ধাক্কা দিল। শুকনো গলায় বললাম," এটা একদম আলাদা গো দেখতে। রঙটাও খুব ভালো, তোমাকে মানাবে সুন্দর।"
বুঝলাম সত্যি বোধহয় সম্পর্কে দেওয়া নেওয়া জটিলতা আনে। অথবা অতি ভাবও হয়ত ভালো নয়।
আমি সংসারের গতানুগতিক কাজ করতে খুব পছন্দ না করলেও ক্রিয়েটিভ ছিলাম। হাতের কাজ করতে ভালো লাগত। শ্বশুরমশাই মারা যাবার পর হঠাৎই শখ হয়েছিল বিউটিশিয়ান কোর্স করার সেই সময় রাত্রি ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে মাঝে মাঝেই আসত। আমি হাত পাকাতে বিনা পয়সাতেই ফেসিয়াল,হেনা,ব্লিচ ও হেয়ারস্টাইল করতাম। সবচেয়ে মজার কথা আমার পরিচিত ও বরের পরিচিত যারা আসত তারা খেয়েদেয়ে রূপচর্চা করে বাড়ি যেত। সেইসময় ওর ভাসুরের মেয়ে আমার কাছে আসত প্রায়ই হেনা করতে। ওর তখন বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়েকে উপলক্ষ করে ওদের বাড়িতে যাতায়াত বাড়ল আবার। ওর ভাসুর জায়ের সাথেও খুব ভালো সম্পর্ক হল।এবং বারবার তারা নেমন্তন্ন করলেন ওপার বাংলা যাবার জন্য ।
আমার মা ঢাকার মেয়ে আর বর ময়মনসিংহের দুজনেই দেশ দেখতে চায় সুতরাং বছর খানেক বারবারই আমন্ত্রণ পাবার পর একবার একজায়গায় বসে ঠিক হল হ্যাঁ ছেলে মাধ্যমিক দেবার পর আমরা যাব বাংলাদেশ।
রাত্রি আর ওর স্বামী বারবারই বলত তবে দাদা আর দিদি বলাতে আরও জোরালো হল যাওয়ার ইচ্ছেটা। তাই ভিসা করার জন্য উদ্যোগী হল ওরা।
রাত্রির ভাসুর আর জা ওপার বাংলাতেই থাকতেন, বারবারই বলছেন,"কোন অসুবিধা নেই,শোন তোমরা আমাদের বাড়িতে উঠবে কিন্তু।"
আমরা বললাম," তা কী করে হয়? আমরা ছয়জন মানে মা বাবা তো যাবে?"
-" আরে তাতে কী হয়েছে, এটা তো আমাদের ভাগ্য যে মাসিমা মেসোমশাই যাবেন। আমাদের বড় বাড়ি, কাজের লোক আছে সবসময়ের। কোন অসুবিধা নেই। এসো তোমরা খুব খুশি হব।"
বাংলাদেশ আমাদের প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। তারপর আরও তিনবার নানা জায়গায় গেছি তবে সবই এজেন্ট ধরে। এক্ষেত্রে ওদের আন্তরিকতা দেখে মনের সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভুলে আমরা রওনা দিলাম বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। ঠিক হল আমরা প্রথমে ওদের বাড়িতে উঠব। তারপর ঢাকা ঘুরে চলে যাব চট্টগ্ৰাম আর রাঙামাটি। ফেরার পথে যদি সম্ভব হয় যাব বগুড়া আমার শাশুড়ির বাপের বাড়ির দেশে।
ভোরের বাসে রওনা দিলাম বেনাপোল বর্ডারের দিকে তারপর বর্ডার পার হয়ে ঢুকব এক অন্য দেশে যা একসময় আমাদের দেশেরই অংশ ছিল। তাই ভাষা একই আর আন্তরিকতা দিয়ে মোড়ানো এ দেশের মানুষ।
অনেকটা আশা নিয়ে মা বাবাকে নিয়ে রাত্রিদের আপ্যায়নে সেখানে গিয়ে কী অভিজ্ঞতা হয়েছিল?
হ্যাঁ সেটা বলব পরের ভাগে.......
আমরা সাথে পর্যাপ্ত টাকা পয়সা নিয়ে গেছিলাম। কিন্তু বর্ডারে রাত্রির বর আমাদের অত টাকা বাংলাদেশের মুদ্রাতে ট্রান্সফার করতে দিল না কিছুতেই বলল," অত টাকা কেন ভাঙাবেন? আরে রাখেন সাথে পরে দেখা যাবে। দাদা তো আছেই,যদি লাগে দাদা দিয়ে দেবেন। এখানে এলে দাদার তো টাকা লাগেই তখন দেবেন।"
যাক সারাদিন অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে আমাদের ঢাকা পৌঁছে ওদের বাড়ি যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যে লেগে গেল। দেখলাম নদীর ধারে বড় কারখানা সমেত বাড়ি ওদের। বাংলাদেশের বিখ্যাত ব্রান্ডের ময়দা বানানো হত ওদের মিলেই। পেটে তখন সবারই ইঁদুর দৌড়োচ্ছে,ছেলেমেয়েদের ক্ষিদে পেয়েছে তার উপর প্রচন্ড গরম মানে মে মাস তখন।
দেখলাম আমরা যাব বলে তেমন কিছু জোগাড় নেই ওদের। রাত্রির জায়ের ভারী শরীর তেমন কাজ করতে পারেন না আর কাজের বৌ মানে যার ভরসাতে আমরা গেছি সে অতগুলো লোক দেখে আলগা দিয়েছে। প্রথমেই আবার হোঁচট খেলাম,মনে হল ইশ্ সেই আবার নেমন্তন্ন পেয়েই ছুট লাগিয়ে এলাম এতজন মিলে! এরপর কী হবে? সত্যি অঙ্কটা ভীষণ কাঁচা আমার। তখনকার মত চা বিস্কিট খেয়ে একটু শান্ত হল সবাই। ভাবলাম যাক কালকের দিনটা কেটে গেলে পরশু তো চট্টগ্রামে চলে যাব ওদেরকে আর বিব্রত হতে হবে না। ঝোঁকের মাথায় হয়ত নেমন্তন্ন করেছিলেন তবে আমরা এসে হাজির হব তা হয়ত ভাবেননি। তবে ওঁরা জানতেন আমরা আসছি।
রাতের খাওয়া একটু তাড়াতাড়ি হল,আয়োজন খুবই সামান্য। তা আর বলছি না কারণ অসামান্য করা সম্ভব ছিল না এতগুলো লোক গেছি আমরা।
পরেরদিন ভোরে উঠলাম, ওদের বাড়ি বড় হলেও শোওয়ার ঘর কম তাই রাতে ওপর নীচ করে শুলাম। যথারীতি দমবন্ধ করা গরমে মশারির ভেতরে খুব কষ্ট পেলাম।
সেদিন আমাদের বারদী ঘুরে ঢাকা শহর দেখার কথা ছিল। সকালে চা খেয়ে বেরোলাম সবাই শুনলাম বারদীতে বাল্যভোগ পাব। বারদী মন্দিরে গিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। পুজোর পর অপেক্ষা করলাম ভোগের খুব যত্ন করে আমাদের ওরা সেদ্ধ ভাত মানে ডাল সেদ্ধ আলু সেদ্ধ,অন্ন,কাঁচা তেল আর লঙ্কা দিলেন পরম তৃপ্তিতে সেই ভোগ আমরা খেলাম। তারপর দেখলাম দিদি ওখানে প্লাস্টিকের ঢাকা দেওয়া বালতি দিয়ে গেলেন বললেন ফেরার সময় আমরা দুপুরের ভোগ নিয়ে যাব।
আমাদের সাথে দুটো গাড়ি ছিল। অবাক হলাম রাত্রি আর ওর বর এবং জা এক গাড়িতে উঠল। আমাদের পথের গল্প আর আড্ডা কিছুই জমল না। আমার ভ্রমণ পিপাসু বরের অবশ্য কোন দিকে মন নেই সে ছবি তুলছে নিজের খেয়ালে। আমার মন খারাপ হল হঠাৎই যেন মনে হল রাত্রিরা অন্য পরিবারের আর আমরা বাইরের লোক। বুঝতে পারলাম ওদের নিজেদের কিছু ব্যক্তিগত কথাবার্তা আছে হয়ত তাই এই সীমারেখা। সারাদিন আমরা ঢাকা শহর দেখলাম, হ্যাঁ মাঝপথে ওর ভাসুর আমাদের সাথে যোগ দিলেন। বাচ্চাদের ক্ষিদে পেয়েছে তাই দাদা আমাদের সবাইকে নিয়ে এলেন রেস্টোরেন্টে সেখানে বার্গার অর্ডার দিলেন। আমার মা পেঁয়াজ রসুন মাংস খান না,বাবা তখন মাংস খেতেন না তাই তাঁরা গাড়ি থেকে নামলেন না সুতরাং তাঁদের খাওয়া হল না।
যেহেতু অন্যের বাড়িতে এসেছি তাই আমি ওদের কিছু ফল কিনে খাওয়াব তা ভালো দেখায় না। যাই হোক বিকেলে আবার বারদী গিয়ে সেই প্লাস্টিকের বালতি ভরা প্রসাদ গাড়িতে তুলে ফিরলাম।
মা ক্ষিদে সহ্য করতে পারলেও বাবা পারতেন না। বাড়িতে আমরা আগে ফিরে এলাম আমাদের গাড়িতে দাদা মানে রাত্রির ভাসুর ছিলেন। ওদের গাড়ি তখনও ফেরেনি শুনলাম ওরা এক আত্মীয়ের বাড়ি হয়ে আসবে। আমি এসেই কাজের বৌটাকে বললাম ও দিদি একটু মুড়ি আর দুধ বা চানাচুর কিছু হবে? বাবাকে একটু খেতে দিতাম। বৌটা বলল ফ্রীজে দুধ আছে, আমাকেই নিতে বলল। আমি বাচ্চাদের আর বাবার খাবার দেব বলে অগত্যা ফ্রীজে হাত দিলাম। আর ওদের বিশাল ফ্রীজ খুলে অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম ফ্রীজে বড় বড় থালা ভর্তি ইলিশ মাছ রান্না করা।
তাড়াতাড়ি কিছুটা দুধ নিয়ে ফ্রীজ বন্ধ করলাম। বাবা আর ছেলেমেয়েদের একটু কিছু পেটে পড়লেও আমাদের খাওয়া হল না। বেশ অনেকটা সময় পরে রাত্রিরা আর ওর জা ফিরল। আমি বলেই ফেললাম, 'দিদি মন্দিরের যে প্রসাদ এনেছেন গাড়ি করে তা এখন সবাইকে দিয়ে দি খেতে?'
দিদি বলে উঠলেন,' না না এই তো সব খাইছে হোটেলে এখন নয়,প্রসাদ রাতে খাইব নে।'
অবাক হলাম শুনে,এই তো কোথায়? সে তো দুপুরের কথা, হয়ত ওরা আবার খেয়ে এসেছেন আত্মীয়দের বাড়ি থেকে।
আমি মায়ের দিকে তাকালাম মা আমাকে ইশারায় বারণ করলেন। রাত্রি তখন বাথরুমে ঢুকেছে গা ধুতে।
রাতের খাবারটুকু বাঁচাতে দিদি আমাদের প্রসাদ সেবার ব্যবস্থা রাতে করলেন। দুঃখজনক রাতে যখন প্রসাদ বের করা হল দেবার জন্য তখন তা নষ্ট হয়ে গেছে। সুতরাং তাড়াতাড়ি করে সেদ্ধভাত বসল, গরম গরম সেদ্ধভাত খেয়ে আমরা সারাদিনের ক্লান্তিতে শুয়ে পড়লাম। পরেরদিন আমাদের চট্টগ্রাম চলে যাবার কথা,বরের কাছে শুনলাম রাত্রির বর ওকে বলেছে ওদের পক্ষে চট্টগ্রাম যাওয়া সম্ভব নয়।
পরেরদিন সকালে উঠে রাত্রিও এক কথা বলল," তোমরা ঘুরে এসো আমাদের যাওয়া হবে না। জা রাগ করছে এত ঘোরাঘুরি করছি বাড়িতে থাকা হচ্ছে না।"
যে মুডে এসেছিলাম মনটা খারাপ হল,ছেলেটাও বলল মা বন্ধু যাবে না তাহলে আমরা একাই যাব? আমি কিছু না বলে তৈরী হলাম। আমাদের তো যেতেই হবে কারণ আমরা দেখতেই এসেছি তা ছাড়া লোকের বাড়িতে কদিন থাকব? ওদের অত্যন্ত আপ্যায়নে আসা,তাছাড়া এভাবে কখনই আসতাম না। এলেও হোটেলেই থাকতাম।
বেশ বেলা হয়েছে তখনও গাড়ির দেখা নেই,এদিকে ঘরে ওদের মধ্যে কথা হচ্ছে শুনছি। অগত্যা আমার বর ওর ভাসুরকে বলল দাদা গাড়িটা কখন আসবে? তাহলে আমরা চলে যাব।
ওদের বাড়িতে এক মুসলিম ভদ্রলোক নিয়মিত আসেন উনি বললেন আপনারা নতুন এখানে তারপর আমাদের মেহমান। এভাবে চট্টগ্রামে আপনাদের একা ছাড়তে পারি না। ওদিকে মাঝে মাঝে অসুবিধা হয়। কথা বলছি দেখি কী করা যায়। কাউকে সঙ্গে দিয়ে পাঠাব আপনাদের কারণ সাথে মহিলা,বাচ্চা আর বয়স্ক মানুষ আছেন।
রাত্রির বরের আমূল পরিবর্তন এখানে এসে। হয়ত পাশাপাশি এক ছাদের তলায় থাকলেও মানুষ চেনা যায় না। কখনও মানুষ চিনতে কেটে যায় সারাটা জীবন। উনি গোঁ ধরেছেন যাবেন না। শরীর ভালো নেই অতটা জার্নি পোষাবে না। অথচ এক সময় আমাদের বাড়িতে বসে একসাথে বেরোব বলে কত প্ল্যান হয়েছে। উনি বলেছেন আপনাদের কক্সবাজার দেখাবো দেখবেন,আপনাদের পুরী কী লাগে।
আমাদের মনটা সত্যি অপরাধী হয়ে আছে বারবারই মনে হচ্ছে কেন এলাম এভাবে?
আমরা বাইরে ডাইনিং স্পেশে বসে ঘরে ওদের আলোচনা চলছে হঠাৎই শুনলাম রাত্রির ভাসুর বলছেন তোমরা না গেলে আমার যাইতে লাগে কাম ছাইর্যা কারণ হাসান সাহেব বলতেছেন ওনাগো একা ছাড়ন ঠিক হইব না।
হঠাৎই হাওয়া বদল হয়ে গেল নিমেষে শুনলাম ওরা যাবে আমাদের সাথে। মনখারাপের দমকা হাওয়া জানলা দিয়ে চলে গেল নিমেষে দেখলাম তাড়াহুড়ো করে ওরা সব গুছোচ্ছে। আমরাও বেশি জামাকাপড় নিইনি কারণ তিনদিন বাদেই তো ফিরব। তাই আমাদের ট্রলি ওদের বাড়িতে রেখে অল্প জামাকাপড় নিয়ে বেরোলাম। ওরা তৈরী হতে হতেই গাড়ি এল। রাত্রির জা মন খারাপ করলেন ওরা চইল্যা যাইতাছে মনটা ভালো লাগতাসে না।
আমার মা আন্তরিকতার সাথে ওঁর দুহাত ধরে বলল বেবি তুমিও চল আমাদের সাথে। খুব ভালো লাগবে আমাদের। এক কথায় দিদি রাজি হয়ে গেলেন। আমরা গরম ভাত আলু সেদ্ধ আর ডিম সেদ্ধ সহযোগে খেয়ে বেরোলাম। মা বাবা ডিম খেতেন না তাই নিরামিষ সেদ্ধ ভাত খেলেন। বিশাল ফ্রীজের রান্না ইলিশ পড়েই রইল। অবশ্য ওরা জানে না আমি অনিচ্ছাকৃত ওদের সঞ্চিত ভান্ডারে ঢুকে পড়েছি।
যাক শেষ অবধি বেশ একটা বড় ম্যাজিক ভ্যানে আমরা রওনা দিলাম। ছেলেরা গল্পে মাতল,আমরাও জমে গেলাম আনন্দে সকালের মনখারাপ ভুলে।
আমার বর ভ্রমণপিপাসু, এই দেশ তার বাপ ঠাকুরদা আর মায়ের দেশ। সে খুব নস্টালজিক হয়ে উঠেছে গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলছে মন ভরে। ওরা ভীষণ বিরক্ত ওর আচরণে মানে রাত্রির স্বামী আর জা। সরল ছেলে মানুষের মত তার চোখে বিস্ময় সে অত কিছু তোয়াক্কা করছে না। হঠাৎই রাত্রির জা বলে উঠলেন," কী সব পাগল ছাগল লইয়্য বারাইছি বাপ। অসহ্য লাগতাছে আমার।"
বর ফিরে আসতে ওদের অলক্ষ্যে চোখের ভাষায় শাসন করলাম তাকে বললাম সে আমাকে পাত্তা দিল না।
একটু ঘুরে কক্স বাজারে পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের প্রায় সন্ধ্যে লেগে গেছিল। ওখানে হোটেলে ছিলাম আমরা। খুব সুন্দর কক্সবাজার বীচ,আমাদের মন ভরে গেল। কাছাকাছি কোরাল দ্বীপ,সুন্দর বনের কিছুটা অংশ আর একটা মনাস্ট্রী দেখে আমরা পরদিন বেশ ভালো কাটালাম। তারপর দিন আমাদের রাঙামাটি দেখে ফেরার কথা।
খুব ভালো লাগল রাঙামাটি, কক্সবাজার সব কিছুই। আমাদের রাতে চট্টগ্ৰামে থাকার কথা ছিল। পরদিন দুপুরে ফেরার কথা কিন্তু হঠাৎ চট্টগ্রাম স্টেশনের কাছে এসেই রাত্রির বর ঝামেলা শুরু করল বারবার বলতে লাগল," ওনারা বেড়াতে আসছেন দেখছেন,আমাদের আর থাকা যাবে না। আমাকে আজ ফিরতেই হবে রাতে। আপনারা এখানে থেকে যান সব দেখে আসবেন একেবারে।"
আমার বরের চট্টগ্রামের রেলের অফিসে একটা কাজ ছিল। তাই আমাদের আগামীকাল অফিস না খোলা অবধি থাকতেই হবে। আমরা কিছু বললাম না,মা বাবাকে বললাম তোমরা বরং ওদের সাথে চলে যাও ছেলেকে নিয়ে। আমরা থাকি মেয়ে থাক আমাদের সাথে। কিন্তু মা বাবা কেউ রাজি হল না আমাদের এত রাতে স্টেশনের কাছে মালপত্র শুদ্ধ রেখে চলে যেতে। আমরা তখন মাল নামাতে শুরু করেছি। রাত্রির আচরণে অবাক হচ্ছিলাম, ওর বর তখন যেন অদ্ভুত ক্ষিপ্ত আমাদের মানে বিশেষতঃ আমার বরের ওপর। পেছন থেকে বারবারই বৌদি উস্কানি দিচ্ছেন বাড়ি চলে যেতে। রাত্রি একবারও বলল না কেন ওদের ফেলে যাবে এত রাতে এখানে? কাল একসাথে যাব সবাই।
আমরা মালপত্র নামিয়ে নিয়েছি তখন গাড়ির ড্রাইভার হঠাৎই বেঁকে বসল। এই কদিনে আমার বরের সাথে তার বেশ ভালো বন্ডিং হয়েছিল। মনে হয় সেও মন থেকে মানতে পারছিল না এত রাতে ওরা আমাদের এভাবে এখানে ছেড়ে চলে যাবে।
সে বলল," সারাদিন গাড়ি চালাইছি আমি,এখন টানা এত রাতে গাড়ি চালাইয়্যা ঢাকা যেতে পারুম না। শরীর দিতাছে না। পৌঁছাইতে মাঝ রাতের বেশি হইয়্যা যাইব।"
রাত্রির জা ওকে ধমকালো," মহা পাজি ব্যাটামানুষ তো একটা। যেই সুযোগ পাইছে অমনি পিছটান দিতাছে।"
বৌদির কথার টান ধরে রাত্রির বর ওকে ধমকায় বলে," ঠিক আছে,তোমার কথা মানা ছাড়া তো উপায় নাই। কাল একদম অন্ধকার থাকতে বারাইমু তখন কিছু কইতে পারবা না।"
হঠাৎই এক চিলতে আশার আলো দেখলাম আমরা যাক একসাথে রাতটা কাটানো যাবে। এখন কোথায় হোটেল কী কিছু তো জানি না।"
চট্টগ্রামের রামঠাকুরের আশ্রমে আমরা এলাম তখন অনেকটা রাত হয়েছে। আশ্রমের মানুষজন আমাদের তবুও খুব যত্নে খাওয়ালেন। দুদিন বাদে মায়ের পেটে ভাত পড়ল। মা একদম পেঁয়াজ রসুন খান না তাই হোটেলে খেতে পারেননি মুড়ি ছাতু খেয়ে ছিলেন। সবাই খুব পরিতৃপ্ত হলাম। মা ওদের বললেন তোমাদের জন্যই আজ এখানে আসা হল। ভগবান সব লিখে রাখেন।
ঘুমোনোর আগে রাত্রি বলল কাল ভোরে দেখা হবে কী না জানি না। কারণ আমরা অন্ধকার থাকতেই বেরিয়ে যাব। আমার খুব বলতে ইচ্ছে করল," তোমরা আসতে বলেছিলে বলে এসেছিলাম তোমাদের সাথে। আমাদের ছেড়ে যেয়ো না গো। আর তো কয়েকঘন্টা একসাথে যাব সবাই।"
কিন্তু ওর বর আর জায়ের যে মূর্তি কিছু আগেই দেখেছি সেটা মনে করে আর কিছু বলতে ইচ্ছে করল না। রাতে শুয়ে আমার চোখ জলে ভরল,বারবারই চোখ মুছলাম অভিমানে। মনে হল এমন করেই যদি ছেড়ে যাবে তবে এনেছিলে কেন সাথে? ও বুঝেছি আমরা থাকাতে তোমাদের আদরের ভাগ হয়ত কম পড়ছে। ঠিক আছে যাও তোমরা আমরা একাই হয়ে গেলাম।
মাঝ রাত থেকেই ওদের খুটখাট আওয়াজ পেলাম, বুকটা আবার কাঁপলো মনখারাপের করুণ ঘন্টার আঘাতে। তারপর একটা সময় উঠে পড়লাম। বাইরে তখন ভোরের আলো সবে ফুটেছে। ওরা রেডি হয়ে গাড়ির দিকে যাচ্ছে। আমাদের দেখে একটা শুকনো হাসি হাসলো ওর জা," ডাকতে বারণ করছিলাম, কইলাম ঘুমাচ্ছে ঘুমাক ওরা। আসি তাইলে আমরা।"
রাত্রির মুখে শুকনো হাসি। ড্রাইভারটা করুণ চোখে তাকালো আমাদের দিকে যেন বলতে চাইলো আপনাদের ছেড়ে যেতে মন চায় না তবু যেতে হচ্ছে।
আমি অভিমান আর কান্না বুকে চেপে হাত নাড়লাম। চোখের সামনে দেখলাম আমার প্রায় তেরঝ বছর ধরে গড়ে তোলা বন্ধুত্বের বন্ধনের বাঁধনটা কেমন ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্ৰামের মাটিতে।
ওরা কেউ আমাদের বলল না বা জিজ্ঞেস করল না আমরা কিভাবে ফিরব? কখন যাব ওদের বাড়িতে। অবশ্য করবেই বা কেন? আমি বুঝলাম যে রাবণের গুষ্ঠি নিয়ে আমি অবিবেচক হয়ে একটা গাধার মত অন্যের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছি তার জন্য এটাই শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল। আমরা যাতে আর ওদের বাড়ি না যাই তাই আমাদের এখানে ফেলে গেল।
সেদিন আমার ছেলের জন্মদিন ছিল,আগে থেকে অনেক পরিকল্পনা করেছিলাম এবার নতুন দেশে অনেকের মাঝে সুন্দর করে পালন হবে জন্মদিন। রাত্রিও জানত সেদিন ছেলের জন্মদিন। আমরা ঠিক করেছিলাম ভালোমন্দ খাওয়াব সেদিন ওদের সবাইকে। কিন্তু ওরা চলে যাওয়ার পর দেখলাম আমাদের হাতে যে খুব বেশি টাকা আছে তা নয়। কারণ ওরা আমাদের পুরো টাকা ভাঙাতে দেয়নি। বলেছিল দাদার কাছ থেকে নিয়ে খরচ করতে পরে দিতে দাদাকে। এখন ভাবি কী মোটা মাথা ছিলাম তখন। তাই ঠিক করলাম এই টাকাতেই চালিয়ে নিতে হবে আমাদের। বাবা বললেন আর ওদের ওখানে ফেরার দরকার নেই,যে দুটো দিন আছে হাতে ঢাকাতেই কোথাও একটা থেকে যাব। আপাতত এখান থেকে আমাদের ঢাকা পৌঁছাতে হবে।
সকালে আশ্রমে বাল্যভোগ হয়। সেই ভোগ আমরা খেলাম সবাই। ওদের দেওয়া পায়েস নাতির মুখে দিয়ে মা ওর পরমায়ু বৃদ্ধির কামনা করলেন। তারপর আমরা ওখান থেকে বেরিয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলাম। কারণ কর্তার কিছু অফিসের কাজ ছিল সেখানে।
অফিসের লোকেদের ব্যবহারে আমরা অভিভূত হয়ে" গেলাম। কেউ চা খাওয়াবে বলে ব্যস্ত আবার কেউ বা বাচ্চাদের কেক কিনে দিচ্ছেন। রাণুদি বলে একজনের সাথে খুব আলাপ হয়ে গেল। যাক বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর কাজ হয়ে গেলে রেলেরই এক অফিসার বললেন,"ঢাকা যাইবেন তো? এই ট্রেনেই চইল্যা যান। তবে সীট পাইবেন না প্যান্ট্রির পাশে বইসা যাইতে হইব।"
মাথায় হাত দিলাম এত ঘন্টার পথ কী করে যাব? কিন্তু উপায় নেই যেতেই হবে। এই ট্রেনই প্রায় এগারোটাতে পৌঁছবে। ভগবানের আশীর্বাদ তাই কোনরকমে ব্যবস্থা হল দু তিনটে সীটের পাল্টাপাল্টি করে বসে এগিয়ে চললাম আমরা। আমার বর ভিডিও করতে ব্যস্ত। অনেকের সাথেই আলাপ করছে। ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে বারবার মনটা ভারাক্রান্ত হচ্ছে,আজ ওর জন্মদিন কিন্তু সেই কখন
একটু সেদ্ধভাত খেয়ে এসেছে আর তেমন কিছু খাওয়া হয়নি কেক ছাড়া। জন্মদিনে কেক আর পায়েসটুকু যে ভগবান ভিনদেশে জুটিয়েছেন সেটাই অনেক।
আমার বর আমাকে ট্রেনের প্যান্ট্রির ছোট্ট হলে নিয়ে গেল দেখাতে। সেখানে একটা ছেলের সাথে ওর বন্ধুত্ব হয়েছে। ছেলেটার সাথে নানা কথা বলতে বলতে ও বলল এখানে তো জামাকাপড় সস্তা তাই না?
ছেলেটা বলল," হ্যাঁ বিদেশের ব্রান্ডেড বেশিরভাগই এখানে তৈরি হয় কারণ এখানে মেকিং চার্জ কম।"
ছেলেটা নামার আগে হঠাৎই বেশ কয়েকটা গেঞ্জি আমার বরকে দিয়ে বলল," দাদা আপনারা আমাদের মেহেমান এগুলো আমার তরফ থেকে আপনাকে উপহার। ঢাকাতে কোথায় আছেন? আমি এসে আরও কিছু দিয়ে যাব।"
আমার বর বেশ লজ্জিত সাথে সাথে মুগ্ধও এমন আন্তরিকতায়। তাই বোধহয় বলে ভগবান আছেন। ছেলেটাকে নতুন জামা দিয়ে গেল !
হ্যাঁ একটা কথা বলা হয়নি রাত্রির ভাসুর আমাদের একটা মোবাইল ফোন দিয়েছিলেন ওখানকার সিমকার্ড পরানো ছিল তাতে। বলেছিলেন রেখে দিতে যদি কোন কাজে লাগে। রাত্রির ভাসুর সত্যি খুব আন্তরিক,ভালো এবং দূরদর্শী ঠিক ওর বরের উল্টোটা। মানে হঠাৎই মনে হয়েছিল। ছেলেটাকে ঐ নম্বরটাই দেওয়া হল। ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে খুব আশা করেছিলাম রাত্রিরা কেউ একটা ফোন করে জানবে আমরা কোথায়? কিন্তু না কেউই ফোন করল না এমনকি দাদাও নয়। বুঝলাম ওরা দাদাকেও হয়ত বিষাক্ত করেছে। যাক ফোন থাকায় আমার কর্তা ঢাকা শহরে থাকেন এমন এক আত্মীয়ের নম্বরে ফোন করল।
রাত্রির ভাসুরের বাড়ি ঢাকা থেকে কিছুটা বাইরে। আমাদের যে আত্মীয়কে ফোন করা হয়েছিল উনি আমাদের ঢাকার লোকনাথ মিশনে ওঠার পরামর্শ দেন। আর সেটাই আমাদের জন্য বেস্ট অপশন ছিল।
মানে অল্প খরচে কারও ঘাড়ে না চেপে থেকে সাধ মেটানো যায়। তাছাড়া মায়ের খাওয়ার অসুবিধা হবে না। পরের দিন সবচেয়ে আগে আমরা ফেরার টিকিট কাটলাম। আমাদের ফেরার টিকিট কাটা ছিল না। হাতে দুটো দিন ছিল,আগে ভেবেছিলাম বগুড়া যাব। কিন্তু অত গরমে জামাকাপড়ের হাল খারাপ কারণ দুদিন পরার মত অল্প কিছু সাথে নিয়ে সবই রেখে গেছিলাম ওদের বাড়িতে। ঠিক করলাম যাবার আগের দিন গিয়ে ট্রলি নিয়ে দেখা করে আসব। ওদের কোন ফোন না পেয়ে আমরা দাদাকে ফোন করলাম যে আমরা ঢাকাতে আছি পরশু যাব জিনিস আনতে। দাদার গলাটা অদ্ভুত লাগল শুনতে। যেন মনে হল খুব বিরক্ত আমাদের ওপর।
লোকনাথ মিশনে থেকেই ঘুরে এলাম মায়ের বাপের বাড়ির গ্রামের থেকে,গ্ৰামের নাম কয় কীর্তন। দেখলাম আচার্য জগদীশচন্দ্র বোসের বাড়ি আর স্কুল। মায়ের আবেগ দেখে মন ছুঁয়ে গেল,ভালো লাগল গ্ৰামের মানুষের আন্তরিকতা। বিশাল কালী ঠাকুর দেখলাম ওখানে। পরের দিন যমুনা ব্রীজ দেখলাম। দেখতছ গেছিলাম দেখা সম্পূর্ণ হল।
পরের দিন আমাদের যাওয়া সুতরাং আমাদের সেদিন যেতে হবে। আবার দাদাকে ফোন করলাম, উনি আমাদের রাতে খেয়ে আসতে বললেন। হয়ত না বললেই ভালো হত কিন্তু দাদার কথা ফেলতে পারলাম না। প্রথম যেদিন ঐ বাড়িতে এসেছিলাম কত আনন্দ মনে ছিল সেদিন শুধু অস্বস্তি নিয়ে ঢুকলাম।
দাদা নীচে ছিলেন বললেন," আপনাদের না আসাতে অবাক হইছিলাম পরে শুনলাম ছেলের জন্মদিন পালনের জন্য রইয়্যা গেছেন চট্টগ্রামে।"
আমরা অবাক হলাম না এমনি কিছু একটা অনুমান করছছিলাম আমরা। কারণ আমাদের যে ওরা ওখানে ইচ্ছে করে রেখে এসেছিল সে কথা ঢাকতে এমন কিছু একটা বলবে দাদার কাছে।
ততক্ষণে রাত্রির বর এসেছে নীচে আমরা বন্ধুত্বকে মনে করেই আর কিছু না বলে শুধু হাসলাম আর বললাম," না না তা নয় অফিসে একটা কাজ ছিল।"
পাঁচদিন আগে দেখা ইলিশ মাছের ভাগ পেয়েছিলাম সেদিন। মোটামুটি দারুণ মেনু খাইয়ে ওরা নাম কিনেছিল আর আমরা তা গিলেছিলাম।
পরেরদিন ভোরে বেরিয়ে এসেছিলাম লোকনাথ মিশন থেকে। শ্যামলী পরিবহনের বাসে করেই ফিরেছিলাম ক্লান্ত শরীর মনে। বুকে ব্যথা হয়েছিল হৃদয়ে চিড় ধরার ব্যথা।
আমরা ফেরার বেশ কয়েকদিন বাদে ওরা ফিরেছিল। কদিন বাদে গিয়ে ওদের টাকা দিয়ে এসেছিলাম। তারপরে কয়েকবার গেছি ওদের বাড়িতে খুব চেষ্টা করেছিলাম বন্ধুত্ব যদি রাখা যায়। কষ্ট পেয়েছিলাম, দিনের পর দিন মাথাতে ঘুরেছে একই কথা। খুব সীমিত বন্ধু ছিল আমার যার থেকে হারালাম প্রিয় বান্ধবীকে। আসলে দায়টা আমাদেরই ছিল অর্থাৎ বেড়াটা ডিঙিয়ে ফেলেছিলাম। বন্ধুত্ব প্রেম আর সম্পর্কে গন্ডী রাখাটা বোধহয় জরুরী। সেটা লঙ্ঘন করলেই বোধহয় আর টেকে না সম্পর্ক। ও এসেছিল আমার বাবার আর মায়ের মৃত্যুর পর। মা চলে যাবার পর তখন আমি একদমই নিঃস্ব কারণ মা ছিলেন একমাত্র আশ্রয়। তবুও আমার ভাঙা মনের হদিশ রাত্রিকে দিইনি আমি। সময় আমাকে নিজেকে সামলাতে শিখিয়েছে,এখন নিজের সাথে ভাব করে বেশ আছি আমি। আজকাল আর খুব একটা বিচ্ছেদ হয় না কারও সাথে কারণ নিজের চারপাশের গন্ডীটা দিব্যি চক দিয়ে কাটতে শিখে গেছি আমি।
রাত্রির সাথে দেখা হয় না চার বছর। আমি ওদের ক্ষমা করে দিলেও আমার বর ভুলতে পারেনি সেই অপমান। সেদিন ওদের বাড়ির গলিটা দিয়ে আসছিলাম হঠাৎই বায়না ধরলাম," একটু দাঁড়াও না এখানে ওকে একবার দেখে যাই।"
বকা খেলাম তবুও ফোন করলাম তোমার বাড়ির নীচে দাঁড়িয়ে একবার বাইরে আসবে...
কিছুক্ষণ বাদে ও এল,আমাকে দেখে খুশি হল। বাড়িতে ডাকল আমি বললাম," বৃষ্টি আসছে,আজ যাব না। একটু দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই ডাকলাম।"
সত্যি কী বন্ধুত্ব ভোলা যায়? হয়ত যায় না কোনদিনই। শুধু ফুরিয়ে যায় কথা একসময়.............
ও আমাকে রোজ খোঁজে স্ট্যাটাসে আমি খুঁজি প্রোফাইলে....
দুদিন
Comments
Post a Comment