আমার চোখে দুগ্গা মা
আমার দুর্গা সাজতে জানে..
গয়না দেয় সে গলায়, হাতে,কানে
সব ড্রেসে সে মানানসই
অবাক চোখে চেয়ে রই।
আমার দুর্গা নিজেই নিজের ডিজাইনার
ব্লাউস বলো আর গলার হার
সবেতেই হাল ফ্যাশনের
ধারণা রয়েছে তার।
আমার দুর্গা দুটি হাতেই
রান্না ঘরে হাতা খুন্তি ও ধরে
পরিবার বন্ধুস্বজনের জন্য
নানা প্রিয় পদ রান্না ও করে।
আমার দুর্গা শিক্ষকতা যার পেশা...
সমাজ ও মানুষ গড়া ই তার নেশা।
কতশত ছাত্রী আজ মাথা উঁচু করে আছে
পৃথিবীর কোণে কোণে ,
সেসব খবরে খুশিতে উজ্জ্বল
হই আমরা সকলে মনে মনে।
আমার দুর্গা ,তার ভ্রমণপিপাসু মন....
পাহাড়ের ডাকে ছুট্টে চলে যায় যখন তখন...
ঘুরে ঘুরে দেখে আর ছবি তুলে রাখে....
তার লেখা ভ্রমণ বিবরণ....
আমাদের যেতে না পারার দুঃখ ঢাকে।।
আমার দুর্গার কলম চলে..
খুঁজতে নারীর সন্মান
সভ্যতার উন্নতির সোপান বেয়ে
সব নারী যেনো পায় মান।
সব ছবিতেই সরলতা ভরা
মিষ্টি মধুর হাসি..
সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনতে
বড্ড ভালোবাসি।
আমার দুর্গা স্নিগ্ধ,কোমল হাসিতে উচ্ছল
প্রাণে থাকুক শক্তি মনে অফুরন্ত মনোবল।।
অঞ্জলি ভরে একমুঠো ফুল
দিলাম আজ মা তোমার চরণে।
শক্তিরূপী মাগো মোদের...
রেখো সদাই তোমার স্মরণে।
অষ্টমীতে অঞ্জলি ভরে ফুল বেলপাতা নিয়ে
মনের যত ইচ্ছে মাগো দিলাম আজ ভাসিয়ে।
চোখটি বুজে বললাম আমার সারাদিনের কাজে,
শক্তি হয়ে থাকিস মাগো ভীতু মনের মাঝে।
আগে যখন ভয় পেতাম সাহস দিত মা...
বলত হেসে মা আছে যার তার কিছুই হয় না।
ফাঁকি দিয়ে সে কবেই গেছে দূর তারাদের দেশে,
তবুও ভাবি দূর থেকে মা অভয় দেয় হেসে।
হারিয়ে তাঁকে তোর মুখে মা দেখি মায়ের ছবি,
কথা দে মা ত্রিশূল হাতে সদাই পাশে রইবি।
শক্তি দাও,ভক্তি দাও আর শান্তি দাও মনে,
আলোর দিশা দেখাও মাগো প্রতিটি জীবনে।
অসুর শক্তির নাশ করে শুভশক্তির কর উদয়,
অহিংসা,লোভের নাশ করে মানবতার কর জয়।
চাকরিটা জানি এবারও হবে না দুর্গা মাগো...
তবে আইডিয়া একটা পেয়ে গেছি মা দারুণ।
হাজার টাকা যদি কোন মতে হয় জোগাড়...
কিনে নেব একটা কেটলি আর কিছু ভাড়।
প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে করব ঘুরে ঘুরে চা বিক্রী..
দুর্গা পুজোতে না হলেও কালী পুজোয়,
মাকে কিনে দিতে পারব একটা ছাপা শাড়ি।
কে বলতে পারে মা তোমার আশীষে..
হয়ত চারদিনেই হবে এই বেকার কোটিপতি।
চাকরি করার স্বপ্নটা ফুটবে গরম কেটলিতে
তারপর একটা সময় ছেকে ফেলে দেব ছাকনিতে।
তবুও বাঁচতে যে মা গো ভীষণ ইচ্ছে করে...
ইচ্ছে করে না কেটলি নিয়ে করতে ঘোরাঘুরি।
তবুও অগত্যা হয়ত সেটাই করতে হবে,
বাঁচার জন্য টাকাটা যে ভীষণ দরকারী।
এবার থেকে মর্ত্যে থাকার দিনগুলো..
যদি পারিস সপ্তাহ থেকে গড়িয়ে নিস মাসে
তাহলে হয়ত বিক্রীটা জমবে বেশ ভালো,
বেশ কিছু টাকা জমবে মাসের শেষে।
ভাইটা আমার জন্ম পঙ্গু,বাবা ভুগছে ক্যান্সারে,
টিভিতে যখন দেখেছে টাকার পাহাড়...
বাবা হায় হায় করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
বলে," খোকা ওর থেকে যদি কিছু গরীবরা পেত,
তাহলে হয়ত কত মানুষের জীবন বেঁচে যেত।"
আমি তখন হঠাৎই করেছিলাম চিৎকার,
"পাপের টাকা,আর ভিক্ষার নাই কোন দরকার।
তার থেকে বলো বাবা হোক একটা চাকরি...
মেধা তো আমার যথেষ্ট আছে কেন বলতে পার
শিক্ষিত বেকার হয়ে করব হকারী অথবা হব ভিখারী?
জীবনের গল্পের বোধহয় কোন শেষ নেই। জীবন প্রতিদিন বলে যায় নতুন নতুন গল্প। হয়ত কয়েক মুহূর্ত আগেই কেউ জানতে পারে না বিধাতা আজ জীবন উপন্যাসের পাতায় কী লিখবেন? তেমনি এক উপন্যাস টিনের বাক্স। এক সাধারণ মেয়ে শৈলপুত্রীর হঠাৎই জীবনটা বন্দি হয়ে গেছিল টিনের পুরোনো ট্রাঙ্কে। বাবার অসুস্থতায় রাতারাতি বিয়ে হয়ে গেছিল বাবার বন্ধুর ছেলের সাথে। মেয়েমানুষের জীবনে সত্যি বোধহয় কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা থাকে না,স্থায়ী ঠিকানার খোঁজে হঠাৎই চলে এসেছিল বিয়ের গাঁটছড়া বেঁধে টিনের বাক্সে ফেলে আসা শৈশব আর যৌবনের সুখস্মৃতির ধূলোকণা নিয়ে। কিন্তু সেই ঠিকানা স্থায়ী হয়নি একটু ভালোবাসার কাঙাল শৈলপুত্রীর জীবনে জোটেনি ভালোবাসা। তবে জীবন উপন্যাসের পাতার গল্প পাল্টায় প্রতিনিয়ত। নিজের ফ্যাকাসে ক্যানভাসে রঙ সাজাতে থাকে শৈলপুত্রী ভুলে যেতে চেষ্টা করে সব না পাওয়া আর কষ্ট। একটা সময় বুঝতে পারে নিজের ভালোলাগা বাঁচাতে পারলে জীবনটা বেঁচে যায়,ইচ্ছেরা স্বপ্ন সাজাতে থাকে আবার চোখের পাতায়। এমনি এক হারিয়ে ফেলা খুশির বাক্স সাজানোর গল্প টিনের বাক্স। জীবনের যুদ্ধ জিততে বোধহয় ঘুরে দাঁড়ানো জরুরী এমনি এক ভালোলাগার গল্প টিনের বাক্স যা আত্মবিশ্বাস বাড়ায়,সাহসী হতে শেখায়। আমাদের সবারই বোধহয় এমন একটা করে টিনের বাক্স থাকে সেই টিনের বাক্সে ভরা থাকে কত সুখ স্মৃতি আর শৈশবের এক্কাদোক্কা খেলার দিন। টিনের বাক্স ভরা সুখস্মৃতিগুলোকে যত্নে সাজিয়ে রাখি মনের মণিকোঠায় আশায় পা বাড়াই জীবনের অন্য অধ্যায়ে একটু ভালোবাসার খোঁজে। আর সেই ভালোবাসা খুঁজতেই বোধহয় পুরো জীবনটাই কেটে যায়। তবে ভালোবাসা না পাওয়া জীবনে যদি হঠাৎই কোন এক বিষাদবেলায় টিনের বাক্স খুলে ম্যাজিক ড্রয়িং বক্স খুলে ভালোবাসার ছবি আঁকতে শেখা যায় তবে বোধহয় জীবনের অর্থটাই পাল্টে যায়। আর এই ভালোলাগার হাত ধরে বাঁচার নামই আর্ট অফ লাইফ। আশাকরি টিনের বাক্স সবার ভালো লাগবে,গল্পের পট পরিবর্তন আর বেঁচে থাকার লড়াই অনুপ্রেরণা জাগাবে অনেকের মনে।
গতকাল থেকে শুরু হয়েছে নির্মল বিদ্যালয় পাক্ষিক অভিযান। এতদিন যা ছিল সাপ্তাহিক তা এই বছরে পাক্ষিক হয়েছে। অর্থাৎ পনেরো দিন ধরে চলবে স্বাস্থ্য সচেতনতা কর্মসূচী। এই কর্মসূচীর আওতাতে পরিচ্ছন্নতা,হাত ধোয়া,বিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্নতা,সামাজিক সচেতনতা,প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ,ডেঙ্গু ম্যালেরিয়ার প্রতিরোধ সংক্রান্ত নিয়মাবলী সবই আছে। এছাড়াও আছে বর্জ্য পদার্থের রিসাইক্লিং অর্থাৎ ফেলে দেওয়া জিনিসকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়,গাছ লাগিয়ে পরিবেশ সবুজ করা,বিশুদ্ধ পানীয় জল,স্যানিটেশন,ইলেকট্রেসিটি লিকেজ ইত্যাদি সুদীর্ঘ তালিকা। এক্ষেত্রে আমি কিছু কথা না বলে থাকতে পারছি না আচ্ছা পরিবেশ বাঁচাও বাঁচাও বলে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে পথে নামলেই কী পরিবেশ বাঁচবে? এটা ঠিক যে আজকের ছাত্রছাত্রীরা ভবিষ্যতের নাগরিক সুতরাং তাদের সচেতনতা দরকার। কিন্তু সচেতনতার সাথে সাথে আরেকটা জিনিসও দরকার যার নাম ক্ষমতা। বর্তমান পরিস্থিতিতে কতটা ক্ষমতা আছে এই ছাত্রছাত্রীদের যে এরা একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে র্যালিতে হেঁটে পরিবেশ পাল্টাতে পারবে? করোনার জন্য বিদ্যালয়ের পড়াশোনা দেরীতে শুরু হয়েছে গরমের ছুটি টানা দুমাস গেছে। তারপর পনেরো দিন পরিবেশের শিক্ষাদান করতে গিয়ে ক্লাশের ক্ষতি,সিলেবাস শেষে নাকাল শিক্ষক শিক্ষিকারা। তবুও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে কুচোকাচা ছেলেমেয়েদের দল নিয়ে গতকাল থেকেই শিক্ষক শিক্ষিকারা বেরিয়ে পরেছেন স্বাস্থ্যবিধান গানের পরেই পথে। পনেরো দিন ধরে এইসব যথাযথ করে কিছু বিদ্যালয়ের কপালে হয়ত জুটবে সেরার তকমা। কিন্তু আমার প্রশ্ন সত্যিই কী নির্মল পরিবেশ পাচ্ছে সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা তার সাথে আমরা?
স্কুলের পথে নিয়মিত যাতায়াত করতে হয় আমাকে শিয়ালদা অঞ্চল দিয়ে। শিয়ালদার আগেই পড়ে একটি সরকারী নামকরা বিদ্যালয়। একসময় আমার ছেলেও পড়ত সেখানে তবে তখন বিদ্যালয়ে প্রবেশের পথ ছিল অন্যদিকে। আমার সহযাত্রীরা তেমন কেউ মাস্ক না পরলেও আমি মাস্ক পরি তবুও সেই মাস্ক পরা অবস্থাতেই ঐ বিদ্যালয় সংলগ্ন নোংরার ভ্যাটের গন্ধে দমবন্ধ হয়ে যায় আমার এবং বমি আসে। বেশিরভাগ দিন আগে থেকেই নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখি নিজেকে ভোরবেলায় বিষাক্ত বায়ুর হাত থেকে মুক্তি দিতে। শুধু ভ্যাটই শেষ কথা নয়,ওখানে বস্তা বস্তা বর্জ্য পদার্থ রাখা থাকে। ছাত্রছাত্রীদের শেখানো হচ্ছে বর্জ্য পদার্থের রিসাইক্লিং করার জ্ঞান। এই জ্ঞান কেন যাদের হাতে ক্ষমতা তাঁরা নিচ্ছেন না যে একটা বিদ্যালয় সংলগ্ন অঞ্চলে এই দুর্গন্ধের ঢিবি থাকা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। খুব মায়া হয় দেখে যখন দেখি প্রাইমারীতে পড়া প্রচুর ছাত্র মা বাবার হাত ধরে ঐ গন্ধযুক্ত পরিবেশে দাঁড়িয়ে গেট খোলার অপেক্ষায় থাকে।
ছাত্ররা ভবিষ্যতের নাগরিক তারা শিখবে কিন্তু পরিচ্ছন্ন পরিবেশ তাদের হাতে তুলে দেওয়া বা তাদের সেই পরিবেশে বড় হতে দেওয়া আমাদের দায়। সুতরাং শুধু নির্মল পাক্ষিক অভিযান করে বিদ্যালয় সাফাই করে নয় পরিস্কার করার ব্যবস্থা হোক আইনী ব্যবস্থা করে সমাজও আইন করে। এটা তো একটি বিদ্যালয়ের কথা কলকাতা শহরের অনেক বিদ্যালয়ের সামনেই হয় গাড়ির গ্যারেজ,ঠাকুর বানানোর কারখানা অথবা বেআইনী অধিকার করা মানুষদের দাদাগিরি চলে। অথবা কোন দামী আবাসনে বাস করা ভদ্রলোক নিত্য এসে বিদ্যালয়ের সামনে পোষ্যটিকে পটি করিয়ে যান এদিক ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিন্তে। নির্মল বিদ্যালয় তো নিশ্চয় হচ্ছে তবে বিদ্যালয়ের বাইরের দায়িত্ব শুধু প্ল্যাকার্ড আর র্যালি করিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শ্লোগানে কিছুই হবে না। যদি সত্যি হত তবে শিয়ালদার স্কুল সংলগ্ন ভ্যাট কবে উঠে যেত। ছাত্ররা পড়াশোনা করতে পারে,খেলাধুলা করতে পারে,ছবি আঁকতে পারে। সেগুলো ভালো করে করুক আর বিদ্যালয়ের বাইরের পরিবেশ সুস্থ রাখতে সমাজকে ভালো রাখতে এগিয়ে আসুন সবাই নির্মল মানসিকতা নিয়ে কারণ এই শহর,রাজ্য আর দেশ সবই আমাদের। তাই সাপ্তাহিক থেকে পাক্ষিকে নির্মল বিদ্যালয় অভিযানকে নিয়ে তেমন কিছুই হবে না শুধু কয়েকদিন ধরে তোতোকাহিনী আওড়ানোই হবে।
পাখি যেমন দীর্ঘদিন খাঁচায় থেকে উড়তে ভয় পায় আমাদেরও তেমন অবস্থা। বেশ অনেকদিন দূরে কোথাও না গিয়ে একটু অনভ্যস্ত হয়ে পড়েছি ভারতবর্ষের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে যেতে। কিন্তু তবুও কোথাও না গেলে মনপাখি ঘরে বসে মনখারাপে ডানা ঝাপটায়। তাই মাঝে মাঝে পাখায় খোলা বাতাস লাগাতে আমরাও চলে যাই কাছাকাছি কোথাও। উত্তরবঙ্গে আমার জন্ম,পড়াশোনার বেশিটাই ওখানে তাই নিজেকে উত্তরবঙ্গের মানুষ বলতে অনেকটাই গর্ববোধ করি। সুতরাং সময় সুযোগ পেয়ে আজকাল ছুটে যাই আমার ফার্স্ট হোমে মাঝেমাঝেই। একেক বয়েসে প্রকৃতি দেখার চোখ পাল্টে গিয়ে একেক রকম হয় তা আজকাল খুব অনুভব করি। ট্রেনে যেতে যেতে কত স্মৃতির পরদা সরে যায় মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা আর ইউনিভার্সিটির কথা। এনজিপিতে নামলে মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে যায়। বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ অনেকটাই নির্ভর করে সঙ্গীর ওপর। মনের মত সঙ্গী পেলে সেই আনন্দ হয়ত বেড়ে যায় অনেক অনেক বেশি। আসলে আমরা একটু পজেটিভ এনার্জি খুঁজতেই দাঁড়াই পাহাড়ের সামনে চোখ মেলে দেখি সবুজ। সেখানে হাসিখুশি সঙ্গী সাথে থাকলে আনন্দ বেড়ে যায় অনেকাংশে। বয়েস বাড়ার সাথে সাথে সম্পর্কের রূপ পাল্টাতে দেখেছি অকারণেই হয়েছি অনেকের কাছে অপ্রিয়। একটা সময় কষ্ট পেলেও আজকাল আর সেইসব ভাবি না বাঁচতে শিখে গেছি আজকের জন্য,বন্ধু হতে শিখেছি নিজের,আগলাতে শিখেছি মনকে। গরমের ছুটি সুদীর্ঘ হওয়ায় উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু জায়গা ঘুরেছি। আজ বলব মাহাল্দীরামের কথা। আমাদের ট্রিপে আমরা চারজন ছিলাম মানে আমি আর আমার উনি,আমার ভাই আর ভাইবৌ।
মাহাল্দীরামের খোঁজ আমাদের বাড়ির ভদ্রলোক ইউটিউব দেখে পেয়েছিলেন। আমি তো প্রথমে অবাক হয়েছিলাম নামটা শুনে সত্যি বলতে নামটা আগে শুনিনি। ইউটিউবে ফোননম্বর জোগাড় করে ফোন করে ফেলেছিল রিসর্টে আর ফোনে ফোনেই সব ব্যবস্থা হয়ে গেছিল। আমাদের পৌঁছনোর তারিখ অনুযায়ী বুকিং হয়ে গেছিল। আমাদের রিসর্টের নাম ছিল সালাম্যান্ডার জাঙ্গল ক্যাম্প। ছবিতে দেখেছিলাম একদম চা বাগান লাগোয়া ক্যাম্প আর তখনই প্রেমে পড়ে গেছিলাম। চা পানের নেশা না থাকলেও চা বাগান দেখার নেশা আমাকে মোহিত করে রাখে। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের ছটা চোখকে টানে সবুজ চুম্বকের মত। চেত্ত আমার নেত্ত করে কমলা সুন্দরী হয়ে। একটু মজা করে বললাম কথাটা। চা বাগানের সবুজ আমার কলকাতা শহরের ইট কাঠ পাথরে ঠোক্কর খাওয়া মনটাকে হঠাৎই করে তোলে একদম তরতাজা মানে যারা চা প্রেমিক তাদের চা খেলে যেমন হয় আমার দেখেই সেটা হয়। মাহাল্দীরামের ভিডিও বেশ কয়েকবার দেখেছিলাম পৌঁছনোর আগে। আমাদের থাকার জন্য দিন ধরা ছিল মাত্র এক দিন,নামেই একদিন তবে চব্বিশ ঘন্টাও নয়। তবে আপনারা যদি মাহাল্দীরামে যান তবে অবশ্যই এক দুদিন থাকবেন। ওখানকার নির্জন প্রকৃতি কানে কানে বলে যাবে কত কথা,ভাগ্য ভালো থাকলে একদম স্যালামান্ডার জাঙ্গল ক্যাম্পের ঘর থেকেই দেখবেন তুষারশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ সৌন্দর্য্য যা মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে অনেকদিন।
মাহাল্দীরামের দূরত্ব দার্জিলিং থেকে মাত্র আঠাশ কিলোমিটার সুতরাং ওখানে থেকে আপনি দিব্যি ঘুরে আসতে পারেন দার্জিলিং। সমতল থেকে পাঁচ হাজার আটশো ফিট উঁচুতে অবস্থিত হবার জন্য এখানে বেশ ঠান্ডা। স্যালামান্ডার ক্যাম্পের দোতলার ঘরে মোটামুটি একদিকের দরজা খুললে আরেকদিকের দরজা বন্ধ রাখতে হয় ঠান্ডা হাওয়ার জন্য। এখানকার আবহাওয়া রূপ বদলায় ক্ষণে ক্ষণে। কখনও কুয়াশা জড়ানো তো কখনও ঝলমলে রোদে মোড়ানো। আবার কখনও ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে তার সাথে আছে ঠান্ডা হাওয়ার দাপট। পাহাড়ের চারদিকের চা বাগানের সৌন্দর্য্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। কোন এক নিরিবিলি বিকেলে অস্তমিত সূর্যের রূপ দেখতে দেখতে গাইতে ইচ্ছে করবে এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। অথবা স্যালামান্ডার ক্যাম্পের বারান্দায় বসে চাবাগান আর কুয়াশা মোড়ানো পাইনের পেছনে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে গাইতে ইচ্ছে করবে আকাশ আমায় ভরল আলোয় আকাশ আমি ভরব গানে। এখানে দুদিন থাকলে আপনি পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখতে পারবেন কাছের মনাস্ট্রী,গাড়ি নিয়ে চলে যেতে পারবেন কার্শিয়াং বা দার্জিলিং। ঘুরে দেখতে পারবেন কাছাকাছি কমলালেবুর বাগান। এই অঞ্চল মহানন্দা স্যাংচুয়ারির অন্তর্ভুক্ত।
আমরা যখন মাহাল্দীরামে পৌঁছই তখন দুপুর গড়িয়েছে ওখানকার ম্যানেজার রায় চৌধুরী বাবু উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। যাবার সাথে সাথেই পেলাম একদম গরম গরম ভাত,ঝুরো আলুভাজা,ডাল,আলু পটলের ডালনা আর ডিমের ঝোল। খুব সুন্দর করে পরিবেশন করা হল সব খাবার কাঁসা পেতলের বাসনে। অন্য হোমস্টের থেকে এখানকার খাবারের স্বাদ অনেক ভালো কারণ রায় চৌধুরী বাবু এবং মালিক দুজনেই বাঙালী। আর রায় চৌধুরী বাবুর তুলনা নেই সারাদিন নিজেকে কর্মব্যস্ত রাখেন। দরকার হলে রান্নাঘরে ঢুকে রান্নাও করছেন। খাওয়াদাওয়া করে ঘরে এলাম,আমাদের ঘর দোতলায় ওপরে ওঠার সময় চোখ জুড়িয়ে গেল ঠিক মনে হল হাত বাড়ালেই চা গাছের সারি আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। ঘরগুলো বেশ বাংলো ধরনের দেখতে বেতের ফার্ণিচারে সাজানো। বাথরুম বেশ ভালো গরম জলের ব্যবস্থা আছে। সামনের দরজা খুললে পাহাড়,পেছনের দরজা খুললে চা বাগান। ভেবে পেলাম না কী দেখব। সাধারণতঃ সব হোটেলে একদিকেই দরজা আর বারান্দা থাকে এখানে দুদিকেই বারান্দা। আমার ভাই একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ও বিশ্রাম নেবার জন্য ঘরে গেল। আমরা একটু ছবি তুলে নিয়ে হাঁটতে বেরোলাম। বাইরে এসে শরীরের ক্লান্তি বোধহয় আনন্দে কমে যায় আমার। এগিয়ে গেলাম সামনের রাস্তা ধরে,এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল করে না দুপাশেই চা বাগান মাঝে রাস্তা। বাঁ পাশে পাহাড়ের ঢালে চা চাষ হয়েছে ডান পাশে টিলাগুলো সেজেছে চা গাছের সারিতে। আকাশে তখন পড়ন্ত বেলার রঙ। মাঝে মাঝে মেঘ এসে সেই রঙকে ধূসর রঙ মাখিয়ে যাচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম কিছুক্ষণ প্রকৃতির রূপ। তারপর হেঁটে ফিরে এলাম সেই পথ বেয়েই আমাদের স্যালামান্ডার ক্যাম্পে। তখন বেশ ঠান্ডা লাগছে। রায়চৌধুরী বাবু বললেন চা রেডি হয়ে গেছে এখন শুধু চা খেতে পারি। সন্ধ্যের পর চা আর পকোড়া পাব। আমরা বললাম মোমো পাওয়া যাবে কিনা? উনি বললেন নীচের দোকানে মোমো বানায় ওদের বললেই ওরা দিয়ে যাবে ওপরে। তবে আমাদের ভাগ্যে মোমো নেই,শুনলাম যা বানিয়েছিল ওরা তা শেষ। ওরা দোকান বন্ধ করে ফিরে যাবে এবার গ্ৰামে। সুতরাং পকোড়া সহযোগে চা খেয়ে আড্ডা দিলাম ডাইনিং হলে বসে। এখানকার ডাইনিং হলটা খুব সুন্দর করে সাজানো মানে বেশ ইউনিক দেখতে। টায়ার দিয়ে বানানো বসার জায়গা,সাইকেলের চাকা দিয়ে বানানো হয়েছে ঝাড়বাতি। ডাইনিং হলের ভেতরটা বেশ গরম টুকটাক বইপত্র আছে। এখানে এসে আলাপ হল একজন অসমীয়া লেখকের সাথে,সস্ত্রীক এসেছেন এখানে। ওয়াইল্ড লাইফের ওপর লেখেন। তাঁর লেখা বইও দেখলাম। নির্জনে থাকার জন্য এবং লেখালেখি করার জন্য এখানে এসে থাকেন।
রাতের খাবারে ভাত,রুটি,ডাল,তরকারি,চিকেন সবই ছিল। তবে আমাদের বিশেষ খিদে না থাকায় অল্প কিছু খেয়ে ঘরে এলাম। বাইরে তখন খুব ঠান্ডা হাওয়া বইছে। চায়ের সরঞ্জাম সহকারী ছেলেটি দিয়ে গেল আর ইলেকট্রিক কেটলি ঘরে ছিল সুতরাং সকালের চা আমরা ঘরে খেয়ে নিতে পারব। সারাদিন পর শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়। চোখ বুজলাম হাওয়ার বেহালা শুনতে শুনতে।
যথারীতি পরদিন ভোরেই আমার ঘুম ভাঙলো আগের রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে দেখেছি আলো ঝলমলে কার্শিয়াং শহরকে। ভোরের দৃশ্য দেখার জন্য পা রাখলাম বাইরে,গায়ে একটা হাল্কা চাদর জড়ালাম,আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে। বাইরের আবহাওয়া কুয়াশা মোড়ানো। কুয়াশার সৌন্দর্যের একটা আলাদা ভালোলাগা আছে ছবি আঁকে মনের মণিকোঠায়। আমি কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম,কান পেতে শুনলাম চা বাগানে পাখিরা ডাকছে ভোর হওয়ার আনন্দে। খুঁজতে চেষ্টা করলাম সূর্যমামাকে। তবে বুঝলাম এতক্ষণে তিনি বোধহয় হামা দেওয়া শুরু করেছেন কারণ আকাশের রঙ বেশ লাল। তবে কুয়াশা আর মেঘেদের মাঝে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সিঁড়ি দিয়ে উঠব বলে পা বাড়িয়েছি হঠাৎই চমকে উঠলাম,অভিভূত হলাম...কাঞ্চনজঙ্ঘা! ঐ তো দেখা যাচ্ছে। আহা রূপোলী মুকুটের শোভায় সেজেছে পাহাড়। মেঘ কেটে যাচ্ছে আর খুলছে মেঘের ঘোমটা। নিজেকে সামলাতে পারলাম না চিৎকার করে ডাকাডাকি শুরু করলাম অন্যদেরও কারণ ভালো কিছু একা দেখতে ভালো লাগে না। সবাই মিলে একসাথে দেখলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা। ভোরের আলোতে তাকে প্রথম দেখার রেশ রয়ে গেল মনে। সাথে ভালো ক্যামেরা না নিয়ে যাওয়াতে চোখের ক্যামেরায় দেখেই ক্ষান্ত হলাম। ছেলেকে মিস্ করলাম ও থাকলে ভালো ছবি তুলত।
অনেকক্ষণ এভাবেই লুকোচুরি চলল আমাদের সাথে কাঞ্চনজঙ্ঘার,কখনও খোলে আবার কখনও ঢাকে। একটা সময় পুরোপুরি ঢাকা পড়ল মেঘের চাদরের আড়ালে। আমরাও তৈরি হয়েছি ততক্ষণে,আমি ছাদে এসে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলাম বাইরে আহা অপূর্ব দৃশ্য। আমাদের হাতে কম সময় তাই চলে যেতে হবে দেখলাম অসমীয়া লেখক ভদ্রলোক স্ত্রীর সাথে বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন। বেশ ভালো লাগল দৃশ্যটা,হয়ত এর নামই মাঝবেলার প্রেম।
চলে এলাম ডাইনিং হলে রায়চৌধুরী বাবু ব্রেকফাস্টে আলুপরোটা খাওয়াবেন বলেছিলেন। একবার খেলে নাকি মনে থেকে যাবে এর স্বাদ সুতরাং আমরাও তথাস্তু বলেছিলাম। আমরা বসতেই চলে এল গরম গরম আলু পরোটা। আহা সত্যিই অপূর্ব সেই স্বাদ সাথে কেচাপ এবং আচার। বেশ যত্ন করে একদম সেধে খাওয়ালেন। সব শেষে ধোঁয়া ওঠা গরম চা। খাবার খেয়ে একটু হাঁটতে আর ছবি তুলতে গেলাম। ততক্ষণে মাহাল্দীরামের সৌন্দর্যের ভোলবদল হয়েছে বাইরে আবার ঝলমলে রোদ। আমাদের রীতিমত গরম লেগে গেল। ফিরে এসে জিনিসপত্র নিয়ে একদম উঠে বসলাম গাড়িতে ওদের বিদায় জানিয়ে। এখানে স্যালামান্ডার দেখা যায়,এটি গিরগিটির মত প্রাণী। আর তাই এই রিসর্টের নাম স্যালামান্ডার ক্যাম্প,এখানকার ফোন নম্বর ৯৭৩৩২৬৭৫১৭ । কিন্তু মাত্র একটা রাত এখানে কাটিয়ে মন ভরল না। এখনও যখন কলকাতার যান্ত্রিকতায় হাঁফিয়ে উঠি মন ছুটে যায় মাহাল্দীরামের নির্জনতায়।
আজ মহালয়া,ছোটবেলায় এই দিনটাকে নিয়ে ভীষণ একটা ভালোলাগা মাখানো খুশি ছিল। খুশিটাকে ভালোলাগা মাখা এই কারণে বললাম যে মহালয়ার কিছু মিঠে স্মৃতি গতকাল থেকেই মনে ভাসছে। আমাদের কাছে মহালয়ার মানে ছিল মা আসছে,চারিদিকে প্যান্ডেল হচ্ছে,গাছে শিউলি ফুটছে। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যেত শিউলি ফুল কুড়িয়ে সাজিতে তোলার জন্য তারপর হাওয়াই চটি ফটফটিয়ে একটু ছুটে দেখে আসতাম মায়ের গায়ে কী হলুদ রঙের ছোঁয়া শেষ? আজ কখন চক্ষুদান হবে?
আমাদের গ্ৰামে শরতের হাল্কা শীতের ছোঁয়া তখন লাগত ভোরের দিকে,গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে মায়ের আঁচলের গন্ধ মাখতে মাখতে মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পাঠ শুনতে শুনতে চোখটা কখন যে লেগে আসত বুঝতেই পারতাম না আবার ঘুম ভাঙত নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমঃ নমঃ শুনে। ছেলেবেলা পেরিয়ে এখন আমি অনেক পথ হেঁটে ফেলেছি জীবনের তবুও কিছু ভালোলাগার স্মৃতি আজও অমলিন মনের মণিকোঠায়। গতবার একটা মেসেজ পেলাম হোয়াটস অ্যাপে মহালয়া শুভ নয়। মহালয়াতে শুভ মহালয়া বলা ঠিক নয়। সেদিন শ্রাদ্ধাদি,পিতৃপুরুষের তর্পণ হয়। অনেকটা তাত্ত্বিক লেখায় ছোট বয়েসের অনুভূতিগুলো হঠাৎই ধাক্কা খেল যুক্তি তর্কের দেওয়ালে। আমার সেই পুজোর নতুন জামার গন্ধ নেওয়া,শিউলি কুড়োনো হাল্কা শীতের ভোরে ঘুম ভেঙে জাগো তুমি জাগো সবই কী তাহলে যুক্তি তর্কের অশুভ তকমার বেড়াতে ধাক্কা খেয়ে মনকেমনের দিন হয়ে গেল হঠাৎই। হয়ত নয়,অথবা হয়ত। গতকাল একলা মনের অন্তঃস্থল থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল চোখ বেয়ে যত্নে মুছে নিলাম আবার। আসলে কিছু শোক একান্ত ব্যক্তিগত ক্ষতের মত। মাঝে মাঝে তাতে কেন যে যন্ত্রণা হয় আর রক্তক্ষরণ হয় বুঝতে পারি না হয়ত বা জখমকে খুঁচিয়ে ফেলি বলে। মহালয়ার দুদিন বাদে যখন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে মা এসে গেছেন কোথাও বা মা আসছেন তখন কোন এক শিউলি ঝরানো ভোরে আমার মাকে আমরা বিদায় দিয়েছিলাম। নার্সিংহোমের বিছানায় শুয়ে মায়ের আর সেবার মহালয়া শোনা হয়নি,আমি সিস্টারদের বলে এসেছিলাম কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। সেই বোধহয় প্রথম মা মহালয়া মিস্ করেছিল যেমন আমি মিস্ করি প্রতি মহালয়াতে মাকে। তারপর চোখ মুছে নিজেকে সাজাই শুভ মহালয়া বলে আর মাকে খুঁজি দুর্গা মায়ের মাঝে।
আমার কাছে মহালয়া শুভ,অনেক অশুভর মাঝেও আশা রাখি মা আসছেন ধুয়ে মুছে যাবে সবার চোখের জল। কান্না চেপে,আপনজনের স্মৃতি অথবা রোগ শোকের লড়াই ভুলবেন মায়ের হাসিমাখা মুখ দেখে। জীবনে কী ঘটবে তা যে আমাদের হাতে নেই,আমরা শুধু বাঁচার লড়াই করতে পারি। তাই শুভ অশুভের তর্ক ভুলে সব ভালো হবে,সবাই ভালো থাকব আর প্রতি মুহূর্তে বাঁচব। আর এই কথাগুলো মনে রেখেই মাকে বলব আগলে রেখো আমাদের বিপদে আপদে তোমার দশহাতে।
পুজোর ছুটিতে একটা সময় কলকাতায় না থাকলেও আজকাল পুজোতে কলকাতার পুজো পুজো গন্ধ নেওয়াটাই অভ্যেস হয়ে গেছে। তেমনভাবে যে খুব ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখি তা হয়ত হয় না। কিন্তু ঐ বাড়িতে থেকেই শরতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছোটবেলার কত কথা মনে পড়ে যায়। অথবা ভোরবেলা মন ছুটে যায় শিউলি ফুল কুড়োতে যাওয়ার দিনে। দেখতে দেখতে দুর্গা পুজো আর লক্ষ্মীপুজো সব শেষ হল। আমাদের একটা ছোটখাটো ট্যুর প্ল্যান করাই ছিল অবশ্য তেমন কিছু লম্বা দৌড়ের পথ নয়। যারা আমার বন্ধুত্ব তালিকায় আছেন তারা বুঝতেই পারছেন যে জায়গাটা নিশ্চয় নর্থবেঙ্গল হবে। একদমই তাই আবার উত্তরবঙ্গে যাবার প্ল্যান। মালদাতে কিছু কাজ ছিল সেগুলো সেরে নিয়ে একঘেয়েমি কাটাতে একটু পাহাড়ের সাথে ভালোবাসা আর কুয়াশামাখা সকালে ডুব দেওয়া। মালদাতে দুটো দিন খুব ব্যস্ততায় কাটলো তারমধ্যে পেলাম অনেক কিছু। মনটাও একটু ভালো হল সবাইকে ভালো দেখে,কিছুদিন আগে মেজ মামাকে অসুস্থ দেখেছি মামার মুখে আবার হাসি দেখলাম। বড় মামীমাকে একটু ভালো দেখলাম আর তার সাথে প্রাপ্তি মামার বাড়ির ভুরিভোজ। অনেকদিন বাদে মাতৃস্থানীয় কারও কাছে গুছিয়ে পরিবেশন করে খাবার খেলাম সুখে,তার সাথে ছিল মামাদের তদারকি। ঠিক যেমন বাবা করতেন,ওদের এটা দাও সেটা দাও বলে। দেখা হল অনেকদিন বাদে প্রবাসী ভাইবৌ,ভাই এবং মিস্টি ভাইপোর সাথে। সবাইকে পেয়ে ভীষণ ভালো লাগল।
মিস্টতার পাল্লা আরও ভারী হল পিয়ার সাথে দেখা হয়ে,ফেসবুকে নিত্য মুখোমুখি হলেও অনেকগুলো বছর পর আদরের বোনকে কাছে পাওয়া। মনে হল কিছুই যেন বদলায়নি,ওর মুখের হাসিটা বলে গেল অনেক কিছুই। আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয় কত সম্পর্ক অকারণেই হারিয়ে ফেলেছি,তবে পিয়া বলে গেল চুপিসারে ভালোবাসা ফিকে হয় না। কতবারই বা ওর সাথে দেখা হয়েছে আমার? তবুও যখন জড়িয়ে ধরল তখন নিজের অজান্তেই মনে হল,সব হারিয়ে যায় না রাতের তারারা মিটমিট করে জ্বলে সূর্যের আলোর আড়ালে। মালদায় আর গাজোলে দুই বোনের সাথে দেখা করে আমাদের ছুটে চলা কালিয়াগঞ্জের দিকে সেখানে পিসি পিসামশায়কে কাছে পাওয়া বাড়তি পাওনা। সেখানে যথেষ্ট আদর যত্নে এবং ভাইয়ের এবারের পুজোর নতুন সংযোজন কালিয়াগঞ্জে ফুডস আইল্যান্ডে খেয়ে আমাদের পরিতৃপ্তি চূড়ান্তে। কালিয়াগঞ্জের মত জায়গায় সুন্দর আধুনিক রেস্তোরাঁ বানিয়েছে ওরা,ডেকোরেশন এবং খাওয়ার মান খুবই উন্নত। আমরা পর পর সমানে খেয়ে যাচ্ছি বলে বাটার নান এবং কাশ্মিরী নান নিলাম,সাথে পনীর,চিকেন,মাটন,ফিসফ্রাই এবং চিকেন ললিপপ ছিল। কাশ্মিরী নান এবং মাটনের স্বাদ লাজবাব। প্রসঙ্গত বলি কালিয়াগঞ্জের ধনকুলের হাটের পাঁঠার মাংস খুবই উপাদেয় এবং আমার ভাইবৌয়ের হাতের রান্নার গুণে তার স্বাদ মাংসভোজীদের রসনায় লেগে থাকবে আজীবন। তাই ওখানে গেলেই আমরা এই অসাধারণ পদটা পরিতৃপ্তি সহকারে খাই সব দুঃখ ভুলে।
গতবারের মত এবারের সাথী ছিল ভাই আর ভাই বৌ। আমরা তিনজন মানে এবার সাথে ছিল মেয়ে,ছেলে যেতে পারেনি তার ব্যস্ততার জন্য। তাই দলে আমরা ছিলাম পাঁচ। কালিয়াগঞ্জ থেকে আমরা বেরোই মোটামুটি সাড়ে ছটা নাগাদ। প্রতিবারই কিষণগঞ্জের কাছাকাছি একরচালায় আমরা সকালের জলখাবার খাই। অবশ্য এই রাস্তা দিয়ে যারা যাতায়াত করেন প্রত্যেকেই পরিচিত এখানকার বিখ্যাত দই বোঁদে আর ঝুরিভাজার সাথে। এখানকার কচুরি এবং চা খুবই উপাদেয়। সুতরাং ছাড়াছাড়ি নেই আমরা কচুরি ছোলার ডাল এবং শেষে টকদইয়ে ঝুরিভাজা ও বোঁদে ছড়িয়ে খেলাম। তারপর শুরু হল আবার ছুটে চলা। শিলিগুড়ির আগেই শুরু হয়ে যায় পথের দুধারে চা বাগানের সারি। আর তখন থেকেই মন ভালো হওয়া শুরু। বাগডোগরার পর কিছুটা গেলেই শিবমন্দির পড়ে। একটা সময় উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় দুটো বছর কাটালেও আজ সেখানকার রাস্তাঘাট অনেক বদলে গেছে। যদিও গেটটা একই রকম রয়ে গেছে। প্রতিবারের মত এবারও উঁকি দিয়ে দেখলাম গেটের ভেতরটা গাড়িতে বসেই মন ছুটে গেল ফেলে আসা স্মৃতিতে।
আমাদের এবারের পাহাড়ে ঘোরাঘুরি করার মেয়াদ সেই আগের মতই তিনদিন। প্রথম দিন ছিল সামেবিয়ং টি বাংলো,তারপর দিন চারখোল এবং সব শেষে সিটং। শিলিগুড়ি যখন পৌঁছলাম আকাশে হাল্কা মেঘ তার মাঝে একটু বৃষ্টিও পেলাম। আমাদের গাড়ি বদল হল। মানে ভাইয়ের গাড়ি আমাদের পৌঁছে দিয়ে চলে গেল ফেরত কালিয়াগঞ্জ। এই গাড়ি আমাদের নিয়ে রওনা দিল সামেবিয়ং টি বাংলোর উদ্দেশ্যে। এই তিনদিন এই গাড়িই আমাদের সাথে থাকবে।
শিলিগুড়ি থেকে এগিয়ে চলল গাড়ি,পথে গজলডোবা পড়ল। এখানে আগেও এসেছি তবুও একটু নামলাম সবাই চা আর টা খেয়ে একটু লকগেটের দৃশ্য দেখে আবার উঠে বসলাম গাড়িতে। তিস্তার জল বেশ ক্ষিপ্ত লকগেটের থেকে ছাড়া পেয়ে। দুরন্ত গতিতে ফেনিয়ে চলেছে সামনের দিকে এগিয়ে। গজলডোবাতে ভোরে অনেক পাখি দেখা যায়। আমরা যে দোকানে বসে চা খেলাম সেখানে গাছে দেখলাম প্রচুর পাখির আনাগোনা। বেশিরভাগ শালিক পাখি,তাদের পুরো ঝাঁক ওখানে কিচিরমিচির করে মাতিয়ে রেখেছে। তবে আমরা যখন রায়গঞ্জ পার হয়ে কুলিকের সামনে দিয়ে এলাম সেখানে দেখলাম সব গাছ ফাঁকা। আমি যখন কুলিকে গেছিলাম তখন প্রতিটা গাছ সাদা ছিল,বুঝলাম পরিযায়ী পাখিরা সব ফিরে গেছে নিজেদের দেশে। যাক গজলডোবা ছেড়ে আমরা এগিয়ে চললাম সামনের দিকে পাশে চা বাগানের সারি। আমাদের গন্তব্যের পথ মাঝেমাঝেই ঢাকলো কুয়াশার ঘোমটা। পাহাড়ের পথে পাড়ি দিয়ে চড়াই উৎরাই ভেঙে গাড়ি এগিয়ে চলল সামনের দিকে।
সামেবিয়ং টি বাংলো লাভার কাছেই,মোটামুটি লাভা থেকে আট কিলোমিটার দূরত্বে এটা অবস্থিত। তবে টি বাংলোতে পৌঁছনোর রাস্তা খুব একটা ভালো নয়। চারদিকে চা বাগানের সুন্দর শোভা দেখতে দেখতে আমরা পাথুরে রাস্তা বেয়ে উঠে এলাম সামেবিয়ং টি বাংলোর দিকে। চা বাগানের মাঝে বাংলোতে ওঠার মুখে নজর পড়ল বড় ম্যানেজার সাহেব এবং ছোট ম্যানেজার সাহেবের বাংলো। বাংলো সংলগ্ন দেখতে পেলাম চা প্রসেস করার কারখানাও। আমাদের পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ একটু বেলাই হয়ে গেছিল। ওখানকার স্টাফরা আমাদের সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। হেরিটেজ বাংলোর শোভা মনকে ছু়ঁয়ে গেল। সামনে পেছনে অনেকটা খোলা জায়গা আর পাহাড়ের কোলে একটুকরো সমতলে সুন্দর সাজানো গোছানো বাংলো। আমরা পৌঁছতেই ওরা প্রত্যেকের গলায় চাদর দিয়ে হাতে তুলে দিলেন এলাচ,আদা,গোলমরিচ, লেবু আর দারচিনি সহযোগে গরম চা। উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে মন ভরে গেল।
আমাদের দুটো ঘর বুক করা ছিল,একটা গ্লাস হাউস এবং আরেকটা লাক্সারি রুম। সামেবিয়ং টি বাংলোতে এমন গ্লাস হাউস দুটো আছে,একটা থাকার জন্য। আরেকটা বসার ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বসার ঘরের অন্দরসজ্জা অপূর্ব। ওখানে বেশ সুন্দর বুক র্যাক ভর্তি বই আছে যেগুলো পড়ে সময় কাটানো যায় নিশ্চিন্তে এছাড়াও আছে পাজল এবং দাবার বোর্ড। একটু ফ্রেশ হয়েই আমরা তাড়াতাড়ি চলে এলাম খাবার টেবিলে কারণ ততক্ষণে বেশ অনেকটা বেলা গড়িয়ে গেছে। সামবেয়িং টি বাংলোর ব্যবস্থাপনা হোমস্টের সাথে খুব একটা মেলে না। এর অন্দরের সাজগোজ,আসবাব এবং খাবার দাবার আর ফায়ারপ্লেসে আছে আভিজাত্যের ছোঁয়া। বেশ কিছু পুরোনো সাদাকালো ছবি এবং একটা ভিক্টোরিয়ান ঘড়ি বহন করছে ঐতিহ্যের সাক্ষ্য।
সুন্দর ডিনারপ্লেট এবং বোলে সাজিয়ে দিল ওরা খাবার দাবার। মেনুতে ছিল,মুড়মুড়ে তিল ছড়ানো বরবটি ভাজা,যেটা আমি প্রথম খেলাম। বরবটি ভাজা যে ক্রিস্পি চিকেনের মত হতে পারে এই প্রথম দেখলাম চেখে। সাথে ডাল,আলুভাজা, একটা মিক্সড ভেজেটেবল,মটর পনীর এবং চিকেন। ওহ্ একটা কথা তো বলাই হয়নি শেষ পাতে মিস্টিমুখও ছিল মানে খাবার শেষে পেলাম গাঢ় রসে জ্বাল দেওয়া গরম গোলাপ জাম। খাওয়া শেষ হবার পর ঘরে গিয়ে গড়াগড়ি করতে ইচ্ছে হল না। যদিও গ্লাস হাউসে বসেই দেখা যাচ্ছে পুরো প্রকৃতি তবুও মন চাইল ঘাসে পা রাখতে। বাংলোর বারান্দা থেকে নেমে সরু পাথুরে পথ বেয়ে এগিয়ে গেলাম আমরা সামনের দিকে,সমতল পেরিয়ে যেখানে চোখে ভাসে পাহাড়ের শোভা। কিছুক্ষণ মন ভরে দেখলাম সেই দৃশ্য লোহার চেয়ারে বসে। অবশ্যই তার সাথে চলল ফটো তোলাও। চোখের ক্যামেরার সাথে সাথে কিছু মুহূর্ত বন্দি করলাম মুঠোফোনে। বাইরে তখন রোদের ঝিলিক। মাঝে মাঝে টুকরো কুয়াশাও এসে বলে যাচ্ছে আছি আমি তোমাদের কাছাকাছি।
আবহাওয়া ভালো ছিল,তেমন কিছু শীতের জামা গায়ে দিতে হয়নি। দেখতে দেখতে কিছুটা সময় কেটে গেল আনন্দে। সন্ধ্যে নামার আগেই আমরা গ্লাস হাউসের বসার ঘরে এসে বসলাম। সেই সময় বাংলোতে অন্য কোন ট্যুরিস্ট না থাকায় আমরাই একদম নিজেদের মত করে সময় কাটালাম আনন্দে। গানবাজনা করার গিটারও ছিল সেখানে। নাচ,গান আনন্দে ভরে উঠল সামেবিয়ং বাংলোর সাঁঝবেলা। একটু বাদেই আমাদের ডাক পড়ল পাশের হলে। দেখলাম ফায়ারপ্লেসে কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে। ওদের কুক আমাদের জন্য নিয়ে এলেন সুন্দর টিপটে করে চা এবং কুকিজ। সান্ধ্য আড্ডার উষ্ণতার ছোঁয়া আমাদের মন ভরিয়ে দিল। অনেকটা সময় চা আর কুকিজের সাথে জমাটি আড্ডা দিতে দিতেই চলে এল সান্ধ্য স্ন্যাক্সে চিকেন মোমো এবং চিকেন পকোড়া। ওরা সাধারণত পকোড়া দেয় আমরা তিন প্লেট মোমো বলছছিলাম সেটা অবশ্য ওরা খুশি মনেই করে দিয়েছিল। বাইরে এসে আমরা মোটামুটি বকরাক্ষস হয়ে যাই। সুতরাং পর পর খাওয়া খেয়েই চললাম। বেশ কিছুটা সময় রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করে আমরা চলে এলাম ঘরে সেখানে বেশ কিছুটা সময় আবার ডুবে গেলাম গল্পে। বাইরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে দূরের পাহাড়ে ঝিকিমিকি আলোর জোনাকি।
রাতের ডিনারও ছিল জম্পেশ। রুটি,তরকারি, চিকেন স্যালাড সহযোগে ডিনার শেষে সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙলো ভোরের আলোর ছোঁয়া পেয়ে। সেদিন আবহাওয়া খুব ভালো চারদিকে সূর্যের হাসির ঝলক। ম্যানেজার বললেন আমাদের টি প্রসেসিং দেখাতে নিয়ে যাবেন ওখানকার একজন। ভোরের পাখির কিচিরমিচির শুনতে শুনতে ঘুরে দেখলাম বাংলোর চারধারটা। আমাদের চা দিয়ে গেল ওরা বাংলোর বারান্দায় সাথে মুচমুচে কুকিজ। চা বাগানের বাংলোর চা তার স্বাদ তো অসাধারণ হবেই। ওখানে কিছু টি ব্যাগ দেখলাম বিক্রির জন্য রয়েছে তবে পাতা চা পাওয়া যায় না সেটা মে মাসের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। চা শেষে স্নান করে তৈরি হয়ে আমরা গেলাম টি প্রসেসিং দেখতে। বেশ কিছু লোক কাজ করছে এখানে। তাদের মধ্যে পুরুষ এবং মহিলা আছেন। শুনলাম যে চা তৈরি হচ্ছে পাতা থেকে তা পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা কেজি এবং পুরোটাই বাইরে চলে যায়। ওখানে বিক্রির ব্যবস্থা নেই। অগত্যা আমরা পাতা চা নাড়াচাড়া করে গন্ধ নিয়েই ফিরলাম। ততক্ষণে আমাদের ব্রেকফাস্ট করার সময় হয়েছে,টেবিলে হাজির গরম এগ নুডলস এবং ফ্রেঞ্চ টোস্ট। সবাই পরম তৃপ্তিতে স্বাদ নিলাম সেই খাবারের। ওখানকার ম্যানেজার এবং কর্মচারীদের ব্যবহার মন ছুঁয়ে গেল। ওদের বিদায় জানিয়ে ছুটে চললাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের দিকে,আকাশে তখন ঝলমলে রোদ।
আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল চা বাগানের পাশ দিয়ে,সবুজ চা বাগান হাত নাড়ে আনন্দে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল চারখোল। চারখোল কালিম্পংয়ের কাছে অবস্থিত একটা ছোট গ্রাম যেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে দেখা হয় প্রতিনিয়ত। মোটামুটি অক্টোবর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে এলে ইচ্ছেপূরণ হতে পারে। আমাদের সাথে সাথে চলেছে পাইন আর বার্চের সারি মাথার ওপরে হাসছে সূর্য। আমরা এগিয়ে চলেছি গন্তব্যের দিকে। এই পথে তেমন করে দোকানে নেমে চা খাবার সুযোগ নেই। অবশ্য আমাদেরও তেমন পিপাসা নেই কারণ সামেবিয়ং আমাদের মন ভরিয়ে দিয়েছে। অসামান্য প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি আমরা কিন্তু পাহাড় মেঘে ঢাকা। মেঘেরা কখনও হাতি অথবা কখনও ছাতা হয়ে পাহাড়কে ঢেকে রেখেছে আনন্দে। তবে আমরা কিন্তু উৎসুক হয়ে আছি যদি একটু দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেই অপরূপার প্রেমেই তো ছুটে আসা বারবার এখানে। কখনও নিবিড় মেঘের ঘোমটায় ঢাকা মুখ দেখে ফিরে যাই আবার কখনও খুশি হই একটু দেখা পেয়েই। তবে এবার কী হবে? দেখা কী হবে না...
রোদ আর মেঘের লুকোচুরির মাঝেই আমরা এসে পৌঁছলাম চারখোলে। চারখোল খুব ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্ৰাম। আমাদের হোমস্টের নাম ছিল নেহা হোমস্টে। স্বাভাবিকভাবেই সামেবিয়ং থেকে এসে একটু হতাশ লাগল এখানে এসে। যদিও একদম রাস্তার ওপরে হোমস্টেটা এবং ঘরে যথেষ্ট আলো বাতাস আছে। মেয়েরও খুব পছন্দ হল ঘরটা কারণ প্রচুর সূর্যের আলো ঢুকছে ঘরে। জানলা দিয়ে তাকালেই দেখা যায় পাহাড়। তবুও খুব মিস্ করলাম সেই সবুজে মোড়ানো সুন্দর বাংলোর অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা। ততক্ষণে বেশ বেলা হয়ে গেছে,আমাদেরও ক্ষিদে পেয়েছে। বাথরুমে গরম জলের গিজার ছিল সুতরাং কোন অসুবিধা নেই আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে খেতে গেলাম খাবার জায়গাতে। ছোট্ট রান্নাঘর সুন্দর করে সাজানো তারমধ্যেই টেবিল চেয়ার পাতা। ওরা আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছে। হোমস্টেগুলোতে মোটামুটি দিনের বেলাতে ডিম আর রাতে চিকেন থাকে। এখানেও তাই ছিল মানে ডাল,তরকারি,ভাজা আর ডিমের ঝোল। রান্নার স্বাদ বেশ ভালো ছিল। ঝকঝকে রোদের তাপে তখন আমাদের চোখ ঝলসে যাচ্ছে। পরদা মানছে না সেই রোদ। ওরা বলল বেশ কয়েকদিন বাদে আজ রোদ উঠেছে। তাই ওরা খুব খুশি কারণ ভিজে জামাকাপড় শুকোতে পারবে নিশ্চিন্তে।
আমরা একটু বিশ্রাম করে,বাইরে বেরোনোর উদ্যোগ নিলাম। কারণ পাহাড়ে ঝুপ করে সূর্য নামবে আর অন্ধকার ঘনালে তখন আবার এসে হোমস্টেতেই ঢুকতে হবে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চললাম পাহাড়ের পথ বেয়ে সামনের দিকে রাস্তাটা একদম ফাঁকা। পথে তখন কুয়াশারা ফিসফিসিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। সূর্য পাটে যাবার উদ্যোগে ব্যস্ত। আবছা আলো আঁধারির খেলা পথ জুড়ে। আমাদের হাঁটা আর ছবি তোলা চলছে তার মাঝেই। সূর্যের লাল আভা কুয়াশা ভেদ করেই দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছুটা সময় কাটানোর পর অন্ধকার নামার আগেই আমরা ফিরলাম আমাদের হোমস্টের দিকে। এই দিকটায় পরপর বেশ কয়েকটা হোমস্টে আছে। আছে একটা ছোট ক্যাফে মত এবং সেটা ছাড়িয়ে গেলে একটা বড় হোমস্টে দেখতে হোটেলের মতই। আগে খোঁজ পেলে হয়ত এখানেই থাকতাম আমরা। যাক কিছুটা সময় ঠান্ডার পরশ মেখে আমরা ফিরলাম আমাদের হোমস্টেতে। ততক্ষণে চা আর গরম গরম মোমো ওরা ঘরেই দিয়ে গেল প্লেটে সাজিয়ে। মোমোটা ভেজ ছিল কিন্তু স্বাদ একদম লাজবাব। সন্ধ্যেবেলা তেমন কিছু করার থাকে না পাহাড়ে তাই আমরাও ডুবে গেলাম গল্প কথায়। জানলা দিয়ে চোখে পড়ল দূরে পাহাড়ে জ্বলে থাকা আলোর মালা। রাতের মেনু যথারীতি রুটি,সবজি আর চিকেন। তবে এদের রান্নার স্বাদ বেশ ভালো।
আমাদের হোস্টের কাছে শুনেছিলাম জানলা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। সেই চিন্তায় আমার কর্তার রাতে আড়াইটার সময় নিদ্রাভঙ্গ হল। তিনি উত্তেজিত হয়ে তখনি যান বাইরে আবহাওয়া কেমন দেখতে। যাক তাকে মোটামুটি ধমকে নিরস্ত করে ঘুমোতে বলে আমরাও ডুব দিলাম আবার ঘুমে। হঠাৎই দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে ঘুম ভাঙলো...কে যেন বলছে স্যার বাহার আইয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখ রহা হ্যায়। আর কোথায় যায় চাদর কম্বল ফেলে দরজা খুলে সোজা বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম বারান্দায়। মেয়ে জানলা দিয়ে উঁকি দিল। আহা অপূর্ব সেই দৃশ্য,তখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। সূর্য তখনও ওঠেনি তবে তার আভাতে প্রস্ফুটিত দুধ সাদা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
আমাকে পেছনে ফেলেই ভাই আর কর্তা ছুটে গেল ওয়াচ টাওয়ারে সুন্দর করে যাতে দেখা যায় এই মন ছুঁয়ে যাওয়া অপূর্ব দৃশ্য। আমি তখন হোমস্টের ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে,উত্তেজনায় ছটফট করছি। ইলেকট্রিক তারে একটু অসুবিধা হচ্ছে তাই মাঝে মাঝেই চলে যাচ্ছি গোল ঘোরানো সিঁড়ির কাছে। তবে মন ভরছে না তাই গুটিগুটি পায়ে রওনা দিলাম ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। ওয়াচ টাওয়ারের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা খুব একটা ভালো নয়,চারপাশে জঙ্গল। তবুও তার মাঝে পথ খুঁজে উঠলাম ওপরের দিকে। ওরা তখন একমনে দেখছে সেই অপূর্ব দৃশ্য। অবশেষে আমিও পৌঁছে গেলাম ওপরে,কোনরকম বাধা ছাড়াই চোখে এল সুন্দরী কাঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব রূপ। ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ পাল্টাচ্ছে। আফশোষ হল সাথে কোন ক্যামেরা আনিনি বলে,অগত্যা মুঠোফোনে বন্দি করলাম যতটা পারলাম সেই স্বর্গীয় দৃশ্যকে।
উত্তরবঙ্গ আমার ভীষণ ভালো লাগে,আমি উত্তরবঙ্গের মেয়ে তাই মাটির গন্ধ বড় চেনা এখানকার। পাখির গানে আর প্রজাপতির উড়ে বেড়ানোতে ফিরে পাই ফেলে আসা ছেলেবেলার কত মিঠে স্মৃতি। তবে এবার কাঞ্চনজঙ্ঘা সত্যি বলে গেল এই তো আছি আমি তোমার কাছাকাছি যত খুশি দেখে নাও মন ভরে। প্রায় ঘন্টা দেড়েক এইভাবেই কেটে গেল। তারপর আবার ফিরলাম আমাদের আস্তানায়,যদিও ওয়াচ টাওয়ার থেকেই দেখা যাচ্ছিল আমাদের হোমস্টে। তবুও আমাদের এখানে থাকার মেয়াদ প্রায় শেষ সুতরাং আমাদের আবার যাত্রার প্রস্তুতি নিতে হবে অন্য ডেস্টিনেশনে পৌঁছনোর। ফিরে আসতেই আমাদের হোস্ট এক গাল হাসি হাসলেন বললেন," অনেকদিন বাদে এমন দৃশ্য দেখা গেল,আপনারা লাকি।"
চায়ে চুমুক দিলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে,তখনও কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান আপন মহিমায়। রঙটা শুধু দুধ সাদা হয়ে গেছে আর মাথার ওপর নীল আকাশ তাতে টুকরো টুকরো মেঘের পদচারণা চলছে।
ওরা আমাদের ডাইনিং হলে ডাকল ততক্ষণে ব্রেকফাস্ট রেডি। সেদিন গরম গরম পুরী সবজি খেতে খেতে খোলা জানলা দিয়ে দেখলাম পাহাড়কে মন ভরে। চারখোল ছোট্ট গ্রাম,তেমন কিছু নেই তবে এখান থেকে অসাধারণ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। শোনা যায় পাখির গান আর নিস্তব্ধতা মনকে ছুঁয়ে যায়। গ্ৰামের পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করবে,হাঁটতে ইচ্ছে করবে কুয়াশা মাখা পথ বেয়ে অনেক অনেক দূরে। মন হারাবে অবশ্যই নির্জনতায়,চুপ করে বসে থাকতে ইচ্ছে করবে পথের ধারে যেখানে শুধু চুপিচুপি হাওয়া এসে ফিসফিসিয়ে কথা বলবে আপনার কানে কানে পাহাড় রোমাঞ্চ জাগাবে মনে। উত্তরবঙ্গের হোমস্টে গুলোতে মোটামুটি থাকা খাওয়া মিলে খরচ পনেরোশর মধ্যে। এখানে আমাদের জনপ্রতি খরচ পড়েছে তেরোশ পঞ্চাশ। খুব লাক্সারি কিছু নয়,তবে রাস্তার ওপর পরিচ্ছন্ন কাঠের ঘর,সুন্দর বাথরুম এবং বাথরুমে গিজার আছে। সবচেয়ে ভালো ঘরে বিছানায় শুয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব দৃশ্য দেখা যাবে অবশ্যই যদি পরিস্কার মেঘমুক্ত আবহাওয়া আপনার সাথে থাকে। এখানকার বুকিং নং 8296271571,হোমস্টের নাম নেহা হোমস্টে।
সিটংয়ের পথে
গতবার মাহাল্দীরামের থেকে ফেরার পথে সিটং ছুঁয়ে গেছি। আমাদের ড্রাইভার দেখাতে দেখাতে নিয়ে গেছিলেন কমলালেবুর গাছ। তাতে তখন ছোট্ট ডুমুরের মত সাইজের কমলালেবু। সিটংয়ে বেড়াতে আসা অনেক বন্ধুদের ছবিতে কমলালেবুর কমলা রসালো লাবণ্য দেখলেও এখনও অবধি আমার সেই সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। খুব ইচ্ছে করে একবার বাগানের সেই রূপ লাবণ্য নিজের চোখে দেখার। কাশ্মীর এবং হিমাচলে আপেলের শোভা গাছে দেখলেও আমাদের রাজ্যেই কমলালেবুর পরিপক্ব রূপ এখনও দেখা হয়নি। যদিও জানতাম এবারেও সেই রূপ অধরাই থেকে যাবে তবুও এবারে আমাদের তিনদিনের একটা দিন সিটংয়ে রাখা ছিল।
আমরা চারখোলেতে ছিলাম সেখান থেকে সিটং উল্টোদিকে। প্ল্যান করার সময় আপনারা অবশ্য এই ব্যাপারগুলো মাথায় রাখবেন। আমাদের কালিঝোরা হয়ে তিস্তার ঢালে নেমে তিস্তার সৌন্দর্য ছুঁয়ে অন্য পথে উঠতে হল। তবে আমরা যতটা সময় লাগবে ভেবেছিলাম ততটা লাগেনি। বৃষ্টির কারণে অনেক জায়গায় পথ ভেঙেছে,কোথাও বা মেরামত হচ্ছে। আমাদের এক জায়গায় একটু নেমে গাড়িকে হাল্কা করে দিতে হল। চারখোলে থেকেই একদম ঝকঝকে আবহাওয়া। সারাটা পথই ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার উঁকিঝুঁকি। মাঝে কিছুটা সময় তিনি পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেও তাকে আবার দেখলাম,উঁকি দিয়ে সাদা রুমাল দেখিয়ে হাত নাড়ছেন। আমরা সিটংয়ের পথে চলেছি এগিয়ে, শুনলাম সিটংয়ের যেখানে আমাদের হোমস্টে সেটা সিটং থ্রী। বুঝলাম জায়গাটা বেশ উঁচুতে হবে। সুতরাং কমলালেবুর সবুজ রঙও যে দেখা হবে না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম। কারণ গাড়ি তখন বেশ ওপরে উঠছে,আকাশে মেঘের লুকোচুরি খেলা। মাঝে মাঝে কুয়াশা এসে ঢেকে যাচ্ছে চারপাশটা। হাত বাড়ালেই তাদের ধরা যায় মনে হচ্ছে। আবার মাঝে মাঝেই রোদ লুকোচুরি খেলছে দুষ্টুমি করে মেঘের সাথে। তবে কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্রতা ঢাকা পড়েছে মেঘের আড়ালে। একটু টুকরো মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে বলে যাচ্ছে আছি তোমাদের কাছাকাছি।
চা বাগানের মাঝখানে রাস্তা,বেশ পাথর ছড়ানো চড়াই পথ। আমাদের গাড়ি লোকেশন জেনে নিয়ে পাড়ি দিল সেই পথে। আমাদের হোমস্টের নাম ছিল পাঁচপোখরী হোমস্টে হঠাৎই মনে হল নামটাতে কেমন যেন পাখি পাখি একটা ভাব আছে। জানি না জায়গাটা কেমন হবে? কোন কমলালেবুর গাছ নেই চাবাগানের মাঝ দিয়ে উঠছি আমরা। তবে পাঁচপোখরীতে যখন এসে পৌঁছলাম তখন দেখলাম বেশ সুন্দর দেখতে হোমস্টেটা। মাথার উপরে চা বাগান,নীচে চাবাগান তারমাঝে একটুকরো সমতল জুড়ে ওরা বানিয়েছে বাড়িঘর। সামনে বিস্তৃত উঠোন তাতে একসাথে চারটে গাড়ি রাখা যাবে। রেলিং ধরে দাঁড়ালেই দেখা যাচ্ছে বিস্তৃত চা বাগান আর গাছগাছালি। তারপর আরেকটু চোখকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেই দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়। বেশ একটা শীতের আমেজ আমাদের ছুঁয়ে গেল তখন। আর আমাদের ছুঁয়ে যাচ্ছে কুয়াশা। দেখতে দেখতেই রোদ উঠলো আবার তবে সামনের পাহাড় তখন মেঘে ঢাকা। সামেবিয়ং টি বাংলোতে আমরা একাই ছিলাম,এখানে চারখোলের মতই বেশ কিছু বাঙালী পরিবারের ভীড়। আমাদের একটু ফ্রেশ হয়ে নিতে বলল ওরা তারমাঝে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অবশ্য আমাদের চা পান করার ইচ্ছে প্রকাশ করতেই চলে এল সুন্দর গরম চা। আমরা বললাম খানিকটা বাদে লাঞ্চ করব। চায়ের কাপে চুমুক দিলাম,মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় বসে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে করতে। হঠাৎই রেলিংয়ের ধারে বেগুন গাছের মত একটা গাছে ঝুলন্ত ফল দেখে বুঝতে পারলাম না ওগুলো কী? ওরা বলল ওগুলো টম্যাটো। অবাক হলাম দেখে,হাত দিয়ে নেড়ে দেখলাম বেশ শক্ত। আমার কর্তা তার চাটনি খাবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন,ওরা হাসলো রান্না হয়ে গেছে বলল। তবে আদৌ ঐ বেগুনের মত দেখতে টম্যাটো দিয়ে চাটনি হত কিনা জানি না। অবশ্য গাছটার একটা ছবি তোলা উচিত ছিল। চা খেয়ে আমাদের একটু ছবি তোলাও হয়ে গেল। একটু বাদেই ওরা আমাদের রুমও দিয়ে দিল,আমাদের রুম নং ছিল এক আর দুই। দুটো রুম থেকেই সুন্দর পেছনের দৃশ্য দেখা যায়। আমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে জায়গাটা দেখে কুন্নুরের মত লাগল। অবশ্য কুন্নুরে ছিল কফি গাছ। প্রাকৃতিক দৃশ্য অসাধারণ লাগল।
বাইরে থেকে ডাক আসল খাবার ব্যবস্থা করা হবে আমরা কী উঠোনে পিঠে রোদ দিয়ে খাব? না ডাইনিং হলে যাব? অবশ্যই সবাই মত দিলাম প্রকৃতির মাঝে বসে খাব। সুতরাং সেই ব্যবস্থাই হল। লাঞ্চে ডাল,পাঁপড়ভাজা,দুই রকমের তরকারি এবং ডিম ছিল। এই হোমস্টেগুলোতে গরম খাবার পাওয়া যায় যেটা খুব ভালো লাগে। খাওয়া সেরে একটু প্রকৃতির মাঝে পায়চারি করে ঘরে এলাম। আমার ভাই এবং কর্তা ততক্ষণে ঘুরে দেখতে গেল চারপাশে। চারটে নাগাদ আমরাও বেরোলাম,নীচের পথ ধরে যেহেতু উঠেছি তাই ওদিকে না গিয়ে ওপরে পা বাড়ালাম। সুন্দর সবুজের সাথে হাত মিলিয়ে এগোতে লাগলাম সামনের দিকে। দেখলাম রান্নার প্রয়োজনে সবজির চাষ হয়েছে ওপরের ক্ষেতে। আরেকটু এগিয়ে পেলাম চা বাগান। শুরু হল আমার পাগলামি মানে ফটো তোলা সবুজের মাঝে। ওপর থেকে তখন দল বেঁধে মেয়েরা নেমে আসছে চা পাতার ঝুরি পিঠে করে। কত পরিশ্রম করে এরা! শুনলাম এক কেজি চা পাতা তুললে দশ টাকা পায় ওরা। মোটামুটি দিনে পনেরো কেজি তোলে। এক জায়গায় একজন লোক বসে আছে মাপার যন্ত্র নিয়ে তার কাছে এসে ঝুড়ি খালি করছে ওরা। ততক্ষণে আকাশে আলো আঁধারির খেলা আর একটু বাদে সন্ধ্যে নামবে। তাই আমরাও পা বাড়ালাম আমাদের আস্তানার দিকে। হোমস্টের উঠোনে চেয়ার পেতে বসে অনুভব করলাম শীতল প্রকৃতিকে মনপ্রাণ দিয়ে।
ভাইদের সাথে গিয়ে সন্ধেবেলাটা আমরা খুব ভালো কাটিয়েছি প্রতিদিনই। একটা বেশ জম্পেশ আড্ডা বসত আমাদের। তাতে থাকত মজার মজার কথা আর খুনশুটি। আমাদের আড্ডার মাঝেই ওরা দিয়ে গেল গরম গরম চা আর আলুর পকোড়া। বেশ ভালো খেতে এই পকোড়া। দেখলাম অনেক অতিথি রয়েছে এখানে এবং দুটি মেয়ে হাসিমুখে সবাইকে আপ্যায়ন করে যাচ্ছে। সবার ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। কম্বলের তলায় বসে শুয়ে আড্ডা দিতে দিতে রাতের খাবারের ডাক এল। এখানে মোটামুটি সাড়ে নটায় খেয়ে নিতে হয় কারণ ওরাও বাড়িতে যায় সব সেরে।
রাতে রুটি তরকারি এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে চিকেন ছিল। সব জায়গায় দেখলাম বেশ ভালো পরিমাণে চিকেন দিয়েছে। আমরাই বরং খেতে পারছিলাম না।
রাতের খাওয়া ডাইনিং হলে খেয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম ওরা আগুন জ্বালিয়েছে। অনেকেই সেই তাতে নিজেদের গরম করে নিয়ে গল্প করছেন।
আমাদের সফরের শেষ রাত ওটাই ছিল সুতরাং ঠিক করলাম কাল আর তাড়াহুড়ো করব না। ধীরেসুস্থে বিছানা ছাড়ব। কিন্তু ঘুম কেড়ে নিল আবার ভোরের কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ। আমাদের ভদ্রলোক একা একা সুন্দর দৃশ্য দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন সত্যিই বোধহয় ভালোবাসার মানুষদেরকে সাথে নিয়েই ভালো জিনিস দেখতে হয়। তাই আমরা সবাই উঠে পড়লাম এবং বারান্দায় চেয়ারে বসে প্রাণভরে দেখলাম রূপসী কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ। চারখোলে থেকে যা দেখেছিলাম এখানে মনে হল আরও কাছে। তবে তখনও সব পিকগুলো খোলেনি। তবে যা দেখলাম তা বর্ণনা করতে পারব না। ঠিক মনে হল আমাদের আর কাঞ্চনজঙ্ঘার মাঝে আর কিছুই নেই ভালোবাসা আর দেখার ইচ্ছে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। আবহাওয়া দারুণ ছিল ওরা বলল আপ আয়ে তো বাহার আয়ে। আমরাও খুশী হলাম শুনে। রোদে পিঠ দিতে সামনের উঠোনে এলাম,বারান্দায় চোখ পড়ল সেখান থেকে মনে হল দরজায় কেউ পাহাড়ের পর্দা টাঙিয়ে রেখেছে। কারণ এদিক থেকে দেখলে আর নীচের গাছপালা নজরে পড়ছে না শুধু চোখের সামনে মোহময়ী কাঞ্চনজঙ্ঘার বিশালতা। সেই রূপের সাগরে ডুব দিতে দিতেই উঠোনে বসে গরম এগ নুডলস খেলাম।
মনটা সবারই খারাপ সকাল থেকে কারণ এবার ফেরার পালা। আবার হাত মেলাবো সংসারের চাপ আর উৎকন্ঠার সাথে,ফিরতে হবে সভ্য শহরে প্রকৃতির সবুজ চাদরের আশ্রয় ছেড়ে। তবুও যেতেই হবে...
তবে বিদায় বেলাতে পাঁচপোখরীর মানুষজন সেই সামেবিয়ং টি বাংলোতে যেমন ওয়েলকাম ট্রিট পেয়েছিলাম তেমনিই আমাদের সুন্দর করে গুডবাই জানালো। আবার অভিবাদন পেলাম গলায় সুন্দর চাদর জড়িয়ে...সাক্ষী হয়ে রইল শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা আর মন্ত্রমুগ্ধ হলাম আমরা ওদের আতিথেয়তায়।
যাবার পথ দীর্ঘ হলেও ফেরার পথ যেন পার হয়ে যাই নিমেষেই। সেবকে আসার পরই মন খারাপ শুধু মনে হল আবার আসব কবে কে জানে?
শিলিগুড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে আমাদের লাঞ্চের সময় হয়ে গেল আগের বার তিনবাত্তি মোড়ের কাছে ঊষা হোটেলে খেয়েছিলাম,ওখানকার ইলিশের পিস দেখে মোহিত হয়েছিলাম। এবার একটু অন্য স্বাদের খোঁজে রাণীবালা হোটেলে পা রাখলাম। ঊষা এবং রাণীবালা পাশাপাশি প্রথমে যে থালি দেওয়া হয় দুটোই কাছাকাছি। তবে এবার রাণীবালা হোটেলে অনেকরকম পদের রান্না পেলাম আমরা। কচুপাতার চিংড়ী,চিকেন ভুনা,মাটন,ইলিশ পাতুরী আলাদা করে নিয়েছিলাম। এছাড়াও একটা নিরামিষ থালি নিয়েছিলাম তাতে আলুভাজা, উচ্ছেভাজা,বেগুনী,ডাল,তরকারি এবং ঘি চাটনি সবই ছিল। তবে সবশেষে তুলনামূলক ভাবে আমরা ঊষা হোটেলকেই বেশি নম্বর দিলাম। ঊষার পাঁঠার মাংস এবং ইলিশের স্বাদ নাকি দুর্দান্ত ছিল,আসলে আগেরবার আমি ঊষাতে নিরামিষ খেয়েছিলাম। ভীড়ও ঊষা হোটেলে বেশি হয়,আপনারা এদিকে এলে দুটোর মধ্যে যে কোনটাতেই খেতে পারেন। অথবা আমাদের মত খাবার জন্য ছুটে যেতে পারেন। রাতেও খাবার পাওয়া যায় সেটাও খবর এনেছি।
উত্তরবঙ্গের সফর শেষে আবার চেনা পথেই পাড়ি দিলাম ফিরলাম কালিয়াগঞ্জ হয়ে পিসির বাড়িতে ভালোমন্দ খেয়ে আর অনেক ভালোবাসা পেয়ে সাথে ভাইবৌ পোটলায় বেঁধে দিল পিসির বানানো নাড়ু,মোয়া আর মুড়কি।
বিশেষ তথ্য:- পাঁচপোখরীর বুকিং করতে হলে যোগাযোগ করতে পারেন Wow Gateways এর সাথে। বুকিং নং:- 08918163690
Comments
Post a Comment