১
যাত্রীরা অনুগ্রহ করে শুনবেন আপ দার্জিলিং মেল বারো নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে কথাগুলো শুনে হঠাৎই বুকটা কেঁপে উঠল দেবাঙ্গীর। আবার দার্জিলিং মেলে চড়বে কতগুলো বছর পরে কিন্তু আজ আর মেয়েবেলার বেড়াতে যাবার আনন্দের ঢেউয়ের ধাক্কা বুককে এলোমেলো করছে না বরং কত ঘটনা প্রবাহ মনকে নাড়িয়ে যাচ্ছে একের পর এক। স্টেশনের অনেক আলোর ঝলকানিতে চোখটা কেমন যেন ধাঁধিয়ে যায় ওর। বিন্দু বিন্দু আলোর বিচ্ছুরণ অবশ করতে চায় স্মৃতিকে। কিন্তু স্মৃতি যে বড়ই প্রিয় বন্ধু মনের সে কিছুতেই ছেড়ে যায় না মনকে আঁকড়ে ধরে রাখে ভালোবেসে প্রাণপনে। ঠিক মনে করিয়ে দেয় খুব ভালো লাগার আর খারাপ লাগার মুহূর্তগুলোকে।
-" মা কী ভাবছ বলত? চল চল তাড়াতাড়ি ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্ট হয়ে গেছে। এরপর দেরী করলে ভীড় বাড়বে। এমনিতেই কত লোক। দাও তোমার ব্যাগটাও আমাকে দাও।"
দেবাঙ্গী তাড়াতাড়ি করে পা বাড়ায় মেয়ের সাথে। সেই ছোট্ট সম্রাজ্ঞী যাকে পৃথিবীতে আনার জন্য একাই রুখে দাঁড়িয়েছিল সবার বিপক্ষে সে আজ কত বড় হয়ে গেছে। দেবাঙ্গীর মত না থাকলেও নিজের জেদ পূরণ করতেই পড়তে চলেছে নর্থবেঙ্গলে।
দেবাঙ্গীর সাথে মিলিয়ে মেয়ের নাম সম্রাজ্ঞী রাখলেও অত বড় নামে না ডেকে সবাই ওকে কুইন বলেই ডাকে। দেবাঙ্গী শ্যামলা,মুখের লাবণ্যের ছোঁয়া অকালে চুরি করেছে মানসিক অশান্তির চোরা শত্রু। এখন চল্লিশ পেরোনোর ভারে বেশ কিছুটা পৃথুলা। কুইনের মুড ভালো থাকলে বলে," আমার মোটি মা,দিন দিন এত বেড়ে গিয়ে একদম গোল ফুটবল হয়ে যাচ্ছ কেন? একদম নিজেকে মেইনটেন কর না।"
-" বয়েস কী বাড়ছে না নাকি? মায়েরা এমনি হয় মানে গোলগাল মোটু। তুইও এমন হবি একটা সময় আমার মত।"
-" আমি তো তোমার মত নই মা। কেন তোমার মত হব? একবার বলতো আমাকে দেখে কোথায় মনে হয় তোমার সাথে আমার মিল আছে?"
সত্যি কতবার মেয়ের মুখে নিজের ছায়া খুঁজেছে দেবাঙ্গী কিন্তু পায়নি দেখতে।
-" চুপ কর সবসময় একই কথা বলিস কেন? মা আর মেয়েকে কী একরকম দেখতে হতেই হবে নাকি?"
-" আমি তাহলে কার মত মা? আমি কী আমার বাবার মত? ও আমার তো বাবাই নেই,মানে তোমার তো প্রেমিক ছিল আর তোমাদের তো আবার বিয়েই হয়নি। নাকি আমি সেই লোকটার মত দেখতে যাকে নিয়ে অনেক কথা..."
আর বেশি কিছু বলতে পারেনি সম্রাজ্ঞী, তার আগেই উত্তেজিত দেবাঙ্গীর হাত উঠেছিল ওর ওপর। দেবাঙ্গীর পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়েছিল সম্রাজ্ঞীর গালে। কান্নায় ভেঙে পড়েছিল দেবাঙ্গী রাগে ফুঁসেছিল কুইন ওর বয়েস তখন আঠেরো। দেবাঙ্গী বুঝেছিল এবার মেয়ের কাছে খুলতে হবে ওর মনের গোপন কুঠুরিতে রাখা চোরা বাক্স। কিন্তু পরের কথাগুলো কী বলল কুইন? কোন লোকটার কথা বলছে কুইন? কে বলেছে ওকে এইসব কথা?
ওদের মা মেয়ের অশান্তির মধ্যে এসে পড়েছিলেন কুইনের আম্মা। বুকে টেনে নিয়েছিলেন নাতনিকে হাত রেখেছিলেন দেবাঙ্গীর মাথায়। তারপর বলেছিলেন," দিদিভাই মাকে কেন কষ্ট দিচ্ছ? কত দুঃখী আমার মেয়েটা। সারাজীবন কিছুই পায়নি তোমাকে নিয়েই একটু হাসিমুখে থাকতে চায়। তুমি তো বড় হয়েছ এবার মাকে তো তোমাকেই ভালো রাখতে হবে। আমি আর কদিন।"
-" মা কী আমাকে ভালো রেখেছে? আমাকে কত কথা শুনতে হয়। এর থেকে আমার মরে যাওয়া ভালো ছিল। তোমরা কেন আমাকে মেরে ফেলনি বল।"
দেবাঙ্গী পাশের ঘরে চলে গেছিল খুব কেঁদেছিল কষ্টে। সন্তান নাকি মায়ের মনের মত হয়,সে মায়ের কষ্ট বোঝে। এ কেমন সন্তান সে তিল তিল করে বড় করেছে যে নিজে কষ্ট পেলে তা শতগুণে ফিরিয়ে দেয় মায়ের বুকে বিষাক্ত বাণের মত।
বন্ধু হতে চাইলেও একটা জটিল মনস্তত্ত্ব আপন হতে দেয়নি দেবাঙ্গীকে মেয়ের কাছে। তবুও সে দুহাতে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় তার ভালোবাসার একমাত্র সুখস্মৃতির এই অমূল্য চিহ্নকে।
লোকের ভীড়ের মধ্যে গা বাঁচিয়ে এগিয়ে চলে দেবাঙ্গী। কুইন এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে ওর পরনে থ্রী কোয়ার্টার জিন্স আর টিশার্ট। সাধারণ পোশাকেও সম্রাজ্ঞী অনন্যা। ওর লম্বা গড়ন,টানটান চেহারা আর আকর্ষণীয় মুখশ্রী নজর কাড়ে সবারই। এক নজরে দেখলে অনেকেরই মনে হবে হয়ত মডেলিং করে মেয়েটা। যে মেয়েকে আগলে বুকে জড়িয়ে সমস্ত ক্ষত সয়ে মানুষ করেছে এতগুলো বছর,তাকে ছেড়ে থাকতে দেবাঙ্গীর নিজেরও খুব কষ্ট হচ্ছে।
গতকাল ওর জিনিসগুলো গোছাতে গোছাতে চোখ মুছেছিল," রেজাল্ট তো তোর ভালোই ছিল,কলকাতা বা যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে হয়ে যেত তো মনে হয় একটু চেষ্টা করলে। কী দরকার ছিল অত দূরে যাবার? আমার কেন যেন ভয় করছে কুইন। আমার কথা একটুও ভাবলি না?"
২
-" কিসের ভয় মা? তোমার কাছেই শুনেছি উত্তরবঙ্গের আকাশে বাতাসে প্রেমের গন্ধ ভাসে। চায়ের বাগানের সবুজ চোখে নেশা লাগায়। পাহাড়ের কুয়াশার চাদরের আদর গায়ে মেখে ভাসতে ইচ্ছে করে মেঘেদের মত নিরুদ্দেশে। আর এমন একটা জায়গাতে আমি যাব না? সব ভালো শুধু তুমিই দেখবে,আর আমাকে শুধু না না করবে তা হয় নাকি?"
-" না না এসব তোকে কে বলেছে? ওখানকার বাতাসে নেশা আছে যে নেশা সর্বনাশ করে। চা বাগানের সবুজের ভেতরে লুকিয়ে থাকে চিতাবাঘ আর কুয়াশার চাদরের আদর মাখতে গিয়ে খাদে পড়ে হতে পারে সর্বনাশ। এখনও বলছি তুই যাস না ওখানে।"
-" মা তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। সারাক্ষণ শুধু ভয় আর ভয়। আমি কোনদিন কোথাও যাইনি তোমার এই ভয়ে। আর আমি শুনব না কিছু। তোমাকে যেতে হবে না আমি একাই যাব।"
খরস্রোতা পাহাড়ী ঝর্ণার ধারাকে আর ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের দেওয়াল দিয়ে আটকানো যাবে না বুঝে গেছিল দেবাঙ্গী। ওর মা বলেছিলেন," যাক,যেতে দে ওকে। তোকে তো বলেছিলাম তুই যাস না সাথে। কেন যে এত বছর বাদে আবার যাচ্ছিস ওখানে?জোহানকে বলতে পারতিস।"
হঠাৎই খুব রেগে যায় কুইন চিৎকার করে ওঠে," সারাক্ষণ শুধু জোহান আর জোহান। আমি চলে গেলে ওকে নিয়েই এবার থেকো তোমরা। ও কী আমার গার্জেন নাকি?"
-" এ কেমন কথা বলছিস তুই? গার্জেন হবে কেন? ও তোর ভালো বন্ধু। ও না থাকলে এত ভালো রেজাল্ট করতে পারতি? দিনের পর দিন যখন কলেজ যেতিস না ও এসে নোটস দিয়ে যেত। কথাও বলতিস না কখনও ভালো করে।"
-" মা ওরকম ন্যাকা বোকা ছেলে আমার জাস্ট অসহ্য লাগে। কে বলেছে আমাকে নোটস দিয়ে যেতে?"
-"দিদিভাই এমন বলতে নেই উপকার যে করে তার উপকার ভুলতে নেই। জোহান ভালো ছেলে,কেন যে তুই ওকে সহ্য করতে পারিস না কে জানে?"
মা আর দিদার পক্ষপাতিত্ব দেখে রাগ হলেও আর কথা বাড়ায়নি কুইন মাথা ঠান্ডা রেখেছিল। এমনিতেই ওর বন্ধুবান্ধব কম,ছোট থেকেই নানা প্রশ্নের জবাব দিয়ে ক্লান্ত কুইন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে একটা শামুকের মত যেখানে রাগ আর অভিমান ওর নিত্যসঙ্গী। ভালো না লাগলে নিজের হতাশা ঢাকতে ছাদে গিয়ে সিগারেট খায়। একদিন আম্মা দেখতে পেয়ে খুব বকেছিল। তবে এখন সবাই জানে ওর খারাপ দিকগুলো,সবার খারাপ দিক যদি থাকতে পারে তাহলে ও কী দোষ করল? মাথাটা গরম হয়ে যায় কুইনের যখন মনে হয় ওর মা যদি পাহাড়ের নিভৃতে বিয়ের আগেই প্রেমিকের সাথে ফূর্তি না করত তাহলে আর ওর কপালে অবৈধ সন্তান তকমাটা জুটত না। আসেপাশের মানুষ বলত না কে জানে কার বাচ্চা। যেমন মা তেমন তার মেয়ে হয়েছে।
নিজের ফরসা ধবধবে মুখে কতরকম কালির পোঁচ যে মাখিয়েছে লোকে তা ভাবতে গেলে রাগে অপমানে জ্বলে ওঠে সম্রাজ্ঞী। নিজের নামটাও আজকাল যেন অসহ্য লাগে ওর তারসাথে মায়ের নামটাও। দিদা আবার আদর করে মাকে ডাকে দেবী,সত্যি দেবীই বটে তাই বোধহয় গান্ধর্ব মতে বিয়েটা হওয়ার আগেই ফুলশয্যা সেরে ফেলেছিল। পাপ শুধু পাপ আর তার শাস্তি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ওকে। এর থেকে অ্যাবরসন করিয়ে তো নিতে পারত। তাহলে তো এত জবাব ওকে দিতে হত না। কেউ ওকে মেনে নেয়নি শুধু দাদু আর আম্মা ওদের একমাত্র মেয়ে দেবীর কলঙ্ককে ঠাঁই দিয়েছিলেন আর ওর রূপ দেখে ভালোবেসে নাম রেখেছিলেন কুইন। দাদুর কাছে বাবার আদর পেয়েছে কুইন খুব মনে পড়ে দাদুর কথা। ওর যখন সাত বছর বয়েস তখন হঠাৎই দাদু চলে গেলেন তারাদের দেশে। খুব কেঁদেছিল কুইন শোকে পাথর হয়ে গেছিল দেবী। বুঝতে পেরেছিল এখন থেকে লড়াইটা ওকে একাই করতে হবে। আর কেউ মাথায় হাত রেখে বলবে না আমি আছি সাথে তোর ভয় কী?
কুইনের ছোটবেলার ম্যাজিকম্যান হাসতে হাসতে এসে আর বলত না এই নে দিদিভাই তোর জন্য কত চকলেট এনেছি আজ দুজনে ছাদে গিয়ে ঘুড়ি ওড়াব।
-" দাদু সেই ঘুড়ি আমার বাবার কাছে চলে যাবে তাই না? গিয়ে বাবাকে বলবে তোমার মেয়ে খুব মিস্ করে তোমাকে তাড়াতাড়ি চলে এসো।"
দাদু কথাগুলো শুনে হঠাৎই চুপ করে গেছিল তারপরই হেসে বলেছিল," আচ্ছা বলে দিস ঘুড়িটার কানে কানে তোর মনের কথা। মেঘের বাড়ির দেওয়াল টপকে সে যদি সেখানে যেতে পারে তাহলে ঠিক বলে আসবে তোর মনের কথা।"
কুইনের মনটা সবসময় বাবা বাবা করলেও সেই ডাক গিয়ে পৌঁছয়নি ওর বাবার কাছে। পরে খুব অভিমান করেছে আর ঘুড়ি ওড়াতে চায়নি বুঝেছিল সবই দাদুর বানানো কথা। তারপর দাদু চলে যাবার পর বাবার মত কাউকে মিস্ করেই কাটিয়ে দিয়েছে এতগুলো বছর।
মা যাই বলুক ও নিজেও জানে এমন কিছু ভালো রেজাল্ট করেনি ও। তবে যেটুকু ভালো করেছে তা হয়ত সত্যি জোহানের জন্য। কী চায় জোহান? কেন ওর জন্য এত কিছু করেছে? সে কথা কখনও ভেবে দেখেনি কুইন। যদিও ইরা বলেছে," সবসময় কেন ওকে বাজে কথা বলিস বলত? ওর চোখ দুটো দেখে বুঝতে পারিস না ও তোকে ভালোবাসে।"
৩
কথাটা শুনে হি হি করে হেসেছিল সম্রাজ্ঞী দুষ্টুমিতে চকচক করে উঠেছিল ওর দুই চোখ," আচ্ছা তুই কী করে ভাবলি বলত ঐ ক্যাবলা ছেলেটা আমার প্রেমিক হবার যোগ্য? ওকে বরং ওয়েটিং লিস্টে নাম লিখিয়ে রাখতে বল। এই কলেজে প্রায় পঞ্চাশজন আছে লাইনে আর আমার পাড়াতে দশজন তাদের পেছনে দাঁড়াতে হবে কিন্তু।"
-" এত দেমাক ভালো নয় কুইন। আমার মনে হয় তুই জোহানের সাথে একটু কথা বল। ও এলেই এত হাসাহাসি করিস যে ছেলেটার মুখটা একদম ছোট হয়ে যায়।"
-" শোন আমাকে জ্ঞান দিস না। তোর যখন এত দয়া ওর ওপর তুই ওকে লাইন মার আমার ট্র্যাকে ওরকম ক্যাবলা কারও জায়গা হবে না। আর কী আছে ছেলেটার বলত? মা আম্মাও ওর প্রশংসা করে এখন তুইও বলছিস এক কথা।"
-" ওর একটা ভালো মন আছে,মানুষের ভালো চায় খুব উপকারী ছেলেটা। কত সাহায্য করেছে তোকে বলত।"
কথাটা শুনে রাগে জ্বলে উঠেছিল কুইন তারপর সাতদিন কথা বলেনি ইরার সাথে। একটা সময় জোহানই ওদের ভাব করে দিয়েছিল তবে শুধু জানতে পারেনি ওদের ঝগড়ার কারণটা।
কলকাতা ছাড়ার খবরটা ইচ্ছে করেই জোহানকে বলেনি কুইন। অবশ্য পরীক্ষার রেজাল্টের পর আর দেখা হয়নি অনেকদিন জোহানের সাথে। মা একদিন বলেছিল," হ্যাঁ রে জোহানের কী খবর? ভালো আছে তো?"
-" আছে হয়ত শুনেছিলাম ফাদারের সাথে কোথায় যেন সোশ্যাল ওয়ার্ক করতে গেছে। পরোপকারী ছেলে তো।"
-" ছেলেটা খুব ভালো রে সত্যি মানুষের উপকার করে। একটু ভালোবাসার কাঙাল ছেলেটা। ভালো কথা শুনলে কত খুশি হয় ছেলেটা। একটু ভালো করে কথা বলিস ওর সাথে।"
-" আমি জানি না ওর মধ্যে কী আছে,গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। বলে তো বাবা মা নেই অনাথ। আর সেইজন্যই আমার অসহ্য লাগে ওকে। ওর বাবা নেই তবুও ও হ্যাপি আর আমিই তো জানি না বাবা কী জিনিস। আমার বাবা কে? তাই আমি আনহ্যাপি। ওর মত হোমে মানুষ হলে আমাকেও কাউকে কৈফিয়ৎ দিতে হত না। কেন যে তোমরা আমাকে এমন একটা জীবন দিলে?"
জোহানের কথা ওঠার পর যে অশান্তির ঢেউ উঠেছিল তাতেই থেমে গেছিল দেবী আর ওর মা। অনেকটা ট্রমা মনে জমে থাকলেও শেষ পর্যন্ত দেবাঙ্গী মেয়েকে সাথে নিয়ে রওনা দিয়েছিল উত্তরবঙ্গের দিকে। গতকাল রাতেও অদ্ভুত একটা মনখারাপ ঘিরে ধরেছিল ওকে খুব একা মনে হয়েছিল নিজেকে। কুইনকে বলেছিল ওর কাছে শুতে। নিজের জগতে একা থাকতেই ভালোবাসত কুইন। দেবাঙ্গীদের বড় বাড়িতে একদম পাশাপাশি তিনটে ঘরে ওরা তিনজন থাকে যে যার বৃত্তে। একটা সময়ে দীর্ঘদিন মানসিক অবসাদে ভোগা দেবাঙ্গীর তেমন ভাবে কোন কাজ করা হয়নি। এমনকি পরের পড়াশোনাও শেষ করতে পারেনি। বাবার রেখে যাওয়া টাকায় আর বাড়ি ভাড়ার টাকাতে ওদের চলে যায়। তবে কিছুদিন হল নীচের ঘরের একটা দিক খালি হয়ে যাওয়াতে ওখানে ছোট একটা কস্টিউম জুয়েলারি শপ করেছে। অবশ্য সবটাই মেয়ের উদ্যোগে, বারবারই বলত," সারাদিন মা মেয়ে তোমরা ঘরে বসে থাক আর অতীতের পাতা ওল্টাও তার থেকে ঐ ঘরে একটা ছোট শপ করে চালাও। আমি যখন সময় পাব বসব ওখানে। ভালো হবে তোমার দোকানের মডেল আমি হব।"
মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল দেবাঙ্গী," দোকান করব! একটা ব্যবসা চালানোর কত ঝামেলা জানিস? আমি পারব না এত কিছু করতে। বেশ তো চলে যাচ্ছে আর কী দরকার?"
-" মা সত্যি কী চলে যাচ্ছে? নাকি একটা ভয়ে সবসময় গুটিয়ে থাক? একটা বিয়েও তো করতে পারতে। তাহলেও তো আমি একটা বাবা পেতাম। অবশ্য জানি না তিনি সৎ না অসৎ হতেন। তবুও আমাকে মেনে নিলে জীবনটা অন্যরকম হত।"
-" তোর মুখে কী কিছু আটকায় না! আমি বিয়ে করলে তোর কী হত? আমার কী কোন দায়িত্ব ছিল না তোর প্রতি?"
-" হ্যাঁ সারাজীবন শুধু দায় টেনে যাও তোমার কবেকার মৃত প্রেমিকের। তাই তো আমার ইচ্ছে করে তোমাকে মুক্তি দিয়ে কোথাও চলে যাই। আমার কী আবার হত? যা হোক হত। তুমি তো একটা সঙ্গী পেতে। আমি বলছি তাই তুমি দোকান করবে। আমি এনে দেব জিনিস। ইরার দিদি ব্যবসা করে আমি জেনে নেব কোথা থেকে কী নিয়ে আসে।"
অবশেষে মা আর মেয়ে দুজনের ইচ্ছেতেই খুলেছিল দোকান। পাড়া প্রতিবেশী কিনতে না এলেও মেয়ের কল্যাণে একটু একটু করে বিক্রি শুরু হয়েছিল। ওদের একঘেয়ে জীবনে একটুকরো খোলা জানলা হয়েছিল দোকানটা। অনেক কিছু ভুলে যেত দেবাঙ্গী কাজের মধ্যে থাকলে। সন্ধ্যেবেলা কলেজ থেকে এসে কখনও কুইন এসে বসত দোকানে। মেয়ের রূপ আর কথা বলার কায়দায় বেশ বিক্রি হত জুয়েলারি। অনেক সাধারণ জিনিসকেও অসাধারণ করে নিজের গলায় পরে বিক্রেতাকে মুগ্ধ করত কুইন।
৪
আজ সব কিছু মিলে দেবাঙ্গী আবার যেন ভীষণ একা হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা মেজাজী,অভিমানী, খামখেয়ালী তবুও তো ওকে জড়িয়েই ভালো ছিল ওরা মা মেয়ে। কথা শোনানোর সাথে সাথে অনেক কাজও করে দিত। স্কুটি চালিয়ে দিব্যি এ মাথা ও মাথা ঘুরে নিয়ে আসত দিদার ওষুধ আর সংসারের প্রয়োজনের জিনিস।
কুইনের গায়ে হাত রেখেছিল দেবাঙ্গী, অনেকদিন বাদে মেয়েটার পাশে শুয়েছে। প্রথমে একটু রেগে গেছিল," মা আমাকে একটু শ্বাস ফেলতে দাও। আমার বন্ধুরা ওখানে কেউ যাচ্ছে না। তবুও ওখানে গিয়ে একটু শান্তি পাব। পাড়ার লোকজন ফিসফিস করবে না আমাকে তোমাকে নির্লজ্জ বলে। কলেজের ছেলেমেয়েরা বাবাকে নিয়ে প্রশ্ন করবে না।"
দেবাঙ্গী শ্বাস ফেলেছিল আর ভেবেছিল প্রশ্নেরা বোধহয় কখনও পিছু ছাড়ে না। ঠিক তাড়া করে বেড়ায় সারাজীবন।
মেয়েটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে, দেবাঙ্গী ওর শরীরের গন্ধ নেয়। হাতের আঙুলগুলো ছুঁয়ে দেখে,মেয়েটা দেখতে একদম ওর মত...অনেকদিন বাদে যেন আজ একটা অনেক দিনের পরিচিত ছোঁয়া পাচ্ছে দেবাঙ্গী অদ্ভুত একটা গন্ধ ওকে জড়িয়ে আছে। একসময় খুব রাগ করত বলত জামা পাল্টাওনি তাই না? ইশ্ গায়ে সেই গন্ধটা। কুইন বড় হয়েছে এখন আর ওর গায়ে পাউডারের গন্ধ নেই শুধু জড়িয়ে আছে সেই পরিচিত গন্ধটা।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে বেশ কিছুটা আগে। মাকে বাড়িতে রেখে আসার জন্য মানবীদিকে দেখাশোনা করতে বলে এসেছে। ওর ফিরতে হয়ত কয়েকটা দিন লাগবে। একদম মেয়েকে হস্টেলে রেখে আসবে। মানবীদি ওদের অনেক দিনের পুরোনো লোক।
জানলার ধারে বসেছে দেবী ওর সাইড লোয়ার সীট উল্টোদিকে লোয়ার সীটের জানলার ধারে বসেছে কুইন। ওর অবাধ্য চুলে পাখার হাওয়া খেলা করছে। ট্রেন ছাড়তে সামান্য একটুই বাকি। বাড়ি থেকে খেয়েই বেরিয়েছে ওরা সাথে এনেছে শুকনো খাবার আর জলের বোতল সুতরাং কিছু দরকার নেই। ট্রেন ছাড়ার কিছুটা পরেই ঘুমিয়ে পড়বে। সকালে নামতে হবে এন জিপিতে তারপর ওখান থেকে কিছু একটা করে একদম গন্তব্যে পৌঁছনো।
ততক্ষণে গাড়ির সিগন্যাল হয়ে গেছে কারণ যারা ট্রেনে এসেছিলেন পরিচিত কাউকে সী অফ করতে তারাও নেমে পড়ছেন এক এক করে। একটু বাদেই ট্রেন ছাড়ল কপালে হাত ঠেকায় দেবী এই অভ্যেস ওর বাবার কাছ থেকে শেখা। বাবা যাত্রা শুরুর প্রথমেই ঠাকুরকে স্মরণ করতেন। ছোটবেলায় শুনেছে বাবাকে বলতে," অতটা পথ যাব তাই দুর্গা নাম নিলাম। সব বিপদে মা সাথে থাকবেন। ত্রিশূল দিয়ে রক্ষা করবেন অনিষ্ট।"
ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে,মেয়ে বসেছে প্ল্যাটফর্মের উল্টোদিকে দেবীর দিকে প্ল্যাটফর্ম। হঠাৎই দেবীর একটু ঝুঁকে দেখতে ইচ্ছে করল অনেক বছর আগের মত। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে ওর বুকের মধ্যে তখন ইঞ্জিনের ধকধক শব্দ সম্রাট কী তবে আসবে না? ও তো অনেক আগে বাড়ি থেকে বেরোবে বলেছিল। কী হবে তাহলে? বন্ধুরা বলেছিল ঠিক আসবে দেখিস,দেবীর জন্য সম্রাট দরকারে ট্রেনের পেছনে দৌড়ে পৌঁছে যাবে।
দেবীর চোখ তখন জলে ভর্তি,শখ করে সাজানো কাজল চোখ তখন জলে টলটলে। এক দুফোঁটা গড়িয়ে পড়েছে গালে। দরজা দিয়ে ঝুঁকে পড়েও ওকে দেখতে পায়নি, ট্রেন ছেড়ে দেওয়ায় শেষে জানলা দিয়ে দেখেছে মাথা রডের গায়ে ঠেকিয়ে। চোখের জল তখন বাঁধনহারা,অভিমানে মনে হচ্ছিল নেমে যাবে পরের স্টেশনে। তারপর হঠাৎই পেছনে শুনতে পায় হাসির আওয়াজ আর ওর দরাজ গলা," এসে গেছি,কী ভেবেছিলি আমি আসব না? আরে লোকাল ট্রেনটা যা তা করল। কোনরকমে এসে পৌঁছে যা দৌড় লাগালাম না তারপর ট্রেনের ল্যাজ ধরে ঝুলে পড়ার মত অবস্থা। ওহ্ সত্যি খুব চিন্তা হচ্ছিল আমার দেবীর জন্য। কী যে করছে মেয়েটা!"
বন্ধুরা হই হই করে উঠেছিল," ও তো ঝাঁপ দিচ্ছিল প্ল্যাটফর্মে,ঘুরতে যাবে না বলে। আমরা কোনরকমে ওড়না ধরে টেনে এনেছি ভেতরে। কেঁদেকেটে অস্থির হয়েছে। এবার তোর জিনিস তুই সামলা কী করে সামলাবি। আমরা কিছু দেখব না। সবাই চোখ বন্ধ করে আছি।"
কাজল লেপা চোখমুখে তখন হাল্কা খুশীর ছোঁয়া দেবীর তবুও ঠোঁট ফোলায় অভিমানে। সম্রাট ওর হাত ধরে টেনে এনে দরজার কাছে দাঁড়ায়,কানে কানে বলে একটা কথা। লজ্জায় লাল হয়ে গেছিল দেবী," ইশ্ কী বাজে তুমি! আমার যে কী হচ্ছিল তা আমি বলে বোঝাতে পারব না।"
-" জানি তো আমি,আচ্ছা নে এবার তাহলে কিল চড় ঘুষি মার যত খুশি।"
দেবী আরেকটু কাছে এসেছিল সারা শরীরে অদ্ভুত রোমাঞ্চ হয়েছিল। সম্রাটের গায়ের গন্ধটা ছড়িয়ে গেছিল ওর গায়েও তারপর ফিরে এসেছিল বন্ধুদের মাঝে। সারারাত শুধু গল্প আর আড্ডা চলেছিল,ভাগ্যিস পর পর সব সীটগুলো ওদেরই ছিল।
আজও জানলা দিয়ে অনেকটা পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করে দেবী হঠাৎই চমকে ওঠে তারপর কী করবে ভেবে পায় না। ডাকে মেয়েকে," কুইন দ্যাখ একটু তাড়াতাড়ি দরজায় গিয়ে জোহান মনে হচ্ছে তো। ও ছুটছে কেন? ওর কী আসার কথা ছিল? কী করব বলত? চেন টানব?"
৫
মায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে যায় কুইন ভীষণ বিরক্তও হয়," মা তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে? জোহান কেন আসবে এখানে? আর এলেই বা আমার কী আমি তো ওকে আসতে বলিনি।"
প্ল্যাটফর্ম আর দেখা যাচ্ছে না। মেয়ের সাথে কথা বলার মাঝের সময় টুকু অনেকটা লম্বা মনে হল দেবীর। ছেলেটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল হঠাৎই। কী জন্য এসেছিল কে জানে? বড় ভালো ছেলেটা কেন যে মেয়েটা ওকে দেখতে পারে না কে জানে?
ফাদারের সাথে মাঝে মাঝেই সোশ্যাল ওয়ার্ক করতে বেরিয়ে যায় জোহান। এবারও অনেকগুলো দিন ছিল না এখানে। পরীক্ষার পর আর তেমন করে যোগাযোগ হয়নি কুইনের সাথে। ও নিজেকেও ব্যস্ত রেখেছিল পড়াশোনাতে। খুব ইচ্ছে ছিল ডাক্তারী পড়ার কিন্তু সুযোগ পায়নি,তাই কলেজে ভর্তি হয়ে গেছিল। কিন্তু পড়াশোনাটা ছাড়েনি সময় পেলেই চেষ্টা করত আর তাই বোধহয় সময়ের হাত ধরেই সাফল্য এল দেরিতে হলেও। বন্ধুরা নাক তুলেছিল শুনে," একবার ব্যাচেলার ডিগ্ৰী নিয়েও আবার সেই শুরু করবি এই বয়েসে! সত্যি তুই পারিস বটে! এত ভালো রেজাল্ট করেছিস মাস্টার্স কর হয়ত কলেজে চাকরিও পেয়ে যাবি। কতদিন আবার ঘষামাজা করবি ডিগ্ৰীর জন্য।"
চুপ করে গেছিল জোহান কোন কথা বলেনি। মনে পড়ে গেছিল ওর মায়ের কথা যে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছিল আর বাবা সাপের কামড়ে। যদি একটা ডাক্তার থাকত ওদের গ্ৰামে তাহলে হয়ত মা আর বাবা এভাবে মারা যেত না। সবাই বলেছিল ভাগ্যের দোষ,জোহান অভাগা। অবশ্য তখন তো ওর নাম জোহান ছিল না ওর নাম তখন ছিল পঞ্চু। মা বাবা মারা যাবার পর খাওয়া জুটত না,স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছিল। তখন বাড়ির পাশের বুধন কাকা বলেছিল," একলা বাড়িতে কী করে থাকবে এই টুকুনি ছেলে। ওকে বরং পাশের গাঁয়ের চার্চে দিয়ে আসি। ওদের ওখানে অনাথ বাচ্চারা থাকে সেখানেই যদি একটা জায়গা পেয়ে যায়।"
পঞ্চুকে ভালো লেগেছিল ফাদার জোনাথনের। নিজের ছেলেবেলা দেখেছিলেন ওর মধ্যে। সেইদিনের ছোট্ট পঞ্চু আজ জোহান। ফাদারই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তাঁর সাহায্যে আর নিজের মেধাতে ভালো কলেজে পড়াশোনা করেছে। কিন্তু সুযোগ পেলেই চলে যায় ফাদারের কাছে। সেখানে থেকে গ্ৰামের মানুষদের জন্য কাজ করে। যেখানে বড় হয়েছে সেখানকার উন্নতির জন্য চেষ্টা করে। তেমনি একটা কাজ নিয়ে চলে গেছিল বাঁকুড়াতে।
ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পেয়ে নিজেও অনেক ভেবেছে। হয়ত এই সুযোগ প্রথম বছর পায়নি কিন্তু তার পরের বছর পেতে পারত চেষ্টা করলেই। কিন্তু তখন কলেজ ছাড়তে ইচ্ছে করেনি। বারবারই মনে হয়েছিল ও কলেজ ছেড়ে গেলে কুইনের সাথে আর দেখা হবে না। কুইন বদমেজাজী ওর সাথে ভালো করে কথাও বলে না তবুও কুইন ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নিজের মনকে অনেকবার প্রশ্ন করেছে কেন ওর কুইনকে ভালো লাগে কুইন সুন্দরী বলে?
উত্তর পায়নি জোহান ও কুইনের মনটাকে ছবির মত দেখতে পেয়েছিল প্রথমেই। একটা গভীর দুঃখ ছুঁয়ে আছে ওকে হয়ত বা অনেক বেশি অপমানও লুকিয়ে আছে মনের ভিতর আর সেটা ঢাকতেই হঠাৎই মুড সুইং হয় ওর। জোহানের মনে পড়ে যায় কলেজে আসার প্রথম দিনটার কথা। বাঁকুড়া থেকে আসা জোহান কলেজে ঢোকার মুখেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হোঁচট খেয়ে পড়েছিল মুখ থুবড়ে। সবাই হেসে উঠলেও কুইন দৌড়ে এসে ওকে ধরে তুলেছিল তারপর বকেছিল অন্যদের," তোরা কেমন রে? একটা ছেলে মানে আমাদেরই বন্ধু হবে,সে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেল আর তোরা হাসছিস? সত্যি কেউ ভাবছিস না ওর ব্যথা লাগতে পারে।"
ওদের গ্ৰামে এমন সুন্দরী মেয়ে এর আগে কখনও দেখেনি জোহান। হঠাৎই মনে হয়েছিল কোন পরী এসে বোধহয় ওর হাত ধরেছে। ওর ভেজা চুলের গন্ধ আর হাতের স্পর্শ ঘিরে রেখেছিল জোহানকে অনেকক্ষণ। হঠাৎই মনে হয়েছিল খুব মায়ের কথা। এমন করেই মা ওর হাত ধরে রাখত নিজের মুঠোতে শক্ত করে।
কিছুক্ষণ কোন কথা বলেনি জোহান নিজের হাত পা ঝেড়েছিল। কুইনের তৎপরতায় ছেলেমেয়েরা এগিয়ে এসেছিল ওর হাতের কনুইয়ে ওরাই ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিল।
কুইন আবার হাতটা বাড়িয়েছিল," আমি সম্রাজ্ঞী, ফার্স্ট ইয়ার। তুমি?"
-" আমি জোহান,আসলে আমার আসতে কয়েকদিন দেরি হয়ে গেছে। শরীর ভালো ছিল না।"
-" ওহ্ বুঝেছি তাই হয়ত পড়ে গেছ মাথা ঘুরে। কিন্তু ইঞ্জেকশান নিতে হবে।"
জোহান আপত্তি করেছিল," এমন অনেক কেটেছে আমার। আমরা গ্ৰামের মানুষ,কিছু হবে না।"
-" এই শোন গ্ৰামে থাকলেই তো পারতিস এখানে কী করতে এসেছিস? এসেই উনি দুম করে পড়ে গিয়ে হাত পা কাটলেন তারপর আবার বাহাদুরী। এক্ষুনি চল বলছি।"
হঠাৎই মুড বদলে গেছিল জোহানের সেই পরীর ওর ধমকে বাধ্য হয়েই জোহানকে ইঞ্জেকশন নিতে হয়েছিল। ওষুধও খেতে হয়েছিল।
৬
কুইন সে কথা ভুলে গেলেও জোহান ভোলেনি একটুও। ছোটবেলা থেকে একটু ভালোবাসা পাওয়ার কাঙাল হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে সে তাই ছোট্ট ছোট্ট উপকার আর টুকরো ছোঁয়ার স্মৃতি যত্নে ভরে রেখেছে হৃদয়ের বটুয়াতে। আর তারপর একটু একটু করে কেটে গিয়েছিল কলেজের দিনগুলো। জোহানের পড়াশোনা আর কাজ একসাথে চলেছিল। তবে কুইনের মুখোমুখি অনেকবার হলেও মুখের কথা বলতে পারেনি সাহস করে কখনই।
কেন যেন মনে হয়েছিল কুইন ওকে অপছন্দ করে,অবশ্য নিজেকে কুইনের পাশে বসাবেই বা কেমন করে? কী আছে ওর? হয়ত ছিল শুধু মেধাটাই,তবুও এমন মেধাবী ছেলেমেয়ে তো ঘরে ঘরে আছে। তাই তো জীবনে সবসময় সুযোগ পেতে দেরি হয়ে গেছে ওর। সবকিছুই চলে গেছে হাতের বাইরে যা চেয়েছে তা কখনই পায়নি। অকালে মা বাবাকে হারিয়ে হোমে আর চার্চে বড় হয়েছে।
প্রথমদিন কলেজে পড়ে যাবার পর কুইনের যত্ন ওর মন ছুঁয়েছিল তাই বলতে এসেছিল," থ্যাঙ্ক ইউ, সেদিন অনেকটা কেটে গিয়েছিল বাড়ি গিয়ে দেখলাম। তোমরা সাহায্য করেছিলে তাই শুকিয়ে গেল তাড়াতাড়ি..."
-" এই আবার এত ভদ্রতা কোথা থেকে শিখে এসেছিস রে? থ্যাঙ্ক ইউ! তুমি! এই যে সহপাঠীগণ দেখো ওনার কান্ড এরপরেও কী ওকে ক্ষমা করা যায়?"
পাশ থেকে একদল ছেলেমেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল,না না শাস্তি চাই। ছেলেটা বড়ই অসভ্য,কোন ম্যানার্স জানে না।
অবাক হয়ে গেছিল জোহান,আবার কী অসভ্যতা করল ও? এত ভালো করে কথা বলল তবুও!
নাহ এদের সাথে পারা মুশকিল, তাই মুখটা বন্ধ করে রাখাই ভালো। কেন যে থ্যাঙ্ক ইউ বলতে এসেছিল?
;______________-__________________________
-" এই চুপ করে কী ভাবছিস? কোন স্কুল থেকে এসেছিস ভাই? আমাদের তুই বলবি বুঝেছিস। আর বন্ধুদের কেউ থ্যাঙ্ক ইউ,সরি টরি বলে না। যাক ভুল করেছিস আর যেন না হয়।"
জোহান বোকার মত তাকিয়ে বলে," আচ্ছা,আর বলব না আমি আসছি তাহলে।"
কুইন ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল পথ আটকে। ওর শরীরের গন্ধ পেয়েছিল জোহান। কী যেন একটা গন্ধ কোথায় পেয়েছিল আগে, তারপর মনে পড়েছিল ও যেদিন প্রাইজ পেয়েছিল টুয়েলভের পর তখন মহিলা বিডিও যিনি দিচ্ছিলেন তাঁর শরীরেও ছিল এমন একটা গন্ধ মাখা।
গন্ধটা কেমন যেন আবিষ্ট করে জোহানকে। পুরুলিয়ার পরবে বড় হওয়ার পর দু একবার গিয়ে হাড়িয়া খেয়েছে,তবে কেন যেন ভালো লাগেনি। ধরা পড়ে গেছিল ফাদারের কাছে। ফাদার বলেছিলেন," ও তুই সেই ফুকু ওঝার ডাকে গিয়েছিলি তাই না? কত মেধাবী তুই,সুন্দর পড়াশোনা শেখাচ্ছি তোকে। তুই কিনা শেষে ঐ ঝাড়ফুঁক করা মানুষটার খপ্পড়ে পড়েছিস?"
জোহান কোন কথা বলেনি,চুপ করে ছিল। কী করে বলবে ফাদারকে যে ফুকু ওঝা বলে ওর মাকে নাকি দ ঐ দূরের বটগাছ তলায় অমাবস্যার রাতে দেখা যায়। আর সেইজন্যই তো গেছিল ও,কতদিন মাকে দেখেনি। কেন যেন হাড়িয়া খেয়ে সব ধোঁয়া ধোঁয়া মনে হয়েছিল। তারপর আর কিছু বুঝতে পারেনি। ফুকু ওঝা আগুন জ্বালিয়ে সমানে তন্ত্র মন্ত্র উচ্চারণ করে যাচ্ছিলো তারপর হঠাৎই বলেছিল," কী রে দেখতে পাচ্ছিস নাকি মাকে?"
জড়ানো গলায় জোহান বলেছিল," না সব ধোঁয়া ধোঁয়া ঝাপসা লাগছে। মা কোথায়? তাকে তো দেখতে পাচ্ছি না।''
-" নেশা করে তুয়ার সব গেছে, আমি তো দেখছি তুই পাচ্ছিস না কেনে? দে তো এদিকে তোর হাত টো দে।"
ততক্ষণে যেন কিছুটা ঘোর কেটে গেছে জোহানের তবুও হাতটা বাড়িয়ে দেয়,ওর হাত ধরে আছে ফুকু ওঝা আর সমানে মন্ত্র পড়ে যাচ্ছে। আগুনে আর ধোঁয়ায় চোখে ফুলকি লাগে জোহানের। হঠাৎই দেখেছিল ফুকু ওঝার হাতে চকচক করছে একটা ধারালো খাড়া। চমকে উঠেছিল জোহান তাড়াতাড়ি হাত ছাড়াতে গেছিল,ফুকু ওঝা শক্ত করে চেপেছিল ওর হাত।
-" আরে ছাড়ো কেনে মোর লাগছে।"
-" মায়েরে দেখবি না? মা তো রক্ত চাইছে। আগে রক্ত দিলে তবে তো দেখা দিবে।"
মরিয়া হয়ে উঠেছিল জোহান ভয়ে,সারা শরীরের জোরকে একজায়গায় করে পালিয়ে এসেছিল। তারপর ধুম জ্বরে সাতদিন উঠতে পারেনি। স্বপ্নে মাকে দেখেছিল জোহান মা যেন বলেছিল," ওরে বোকা ছেলে আমি তো আছি তোর কাছাকাছি,তুই পড়াশোনা করে ভালো মানুষ হ। গেরামের লোকগুলো খুব কষ্টে আছে।"
ফাদার শুনে আঁতকে উঠেছিলেন,ওকে বলেছিলেন," খুব বেঁচে গেছিস,আর হয়ত বাঁচাতে পারতাম না তোকে। হয়ত তোর মা তোকে বাঁচিয়েছে।"
-" কেন ফাদার?"
-" আমি শুনেছি এই ওঝা,তান্ত্রিকদের নিজেদের সিদ্ধিলাভের জন্য রক্ত দরকার হয়। আর যার রক্ত নেওয়া হয় সে বেশিদিন বাঁচে না। জানি না সত্যি কিনা তবে শুনেছি আমি। তোকে অনেক বড় হতে হবে জোহান। তোর মত ছেলেরাই তো সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। ফুকু ওঝার মত লোকেরা নিপাতে যাবে।"
৭
গ্ৰাম থেকে জোহানকে শহরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ফাদার। শহরের কলেজে এসে প্রথমেই বন্ধুদের কাছে বোকা হল গ্ৰামের ছেলেটা। তাই বোকা বোকা হয়ে বলল," তুই মানে তুমি কী বলবে আমাকে?"
-" একটা গাট্টা মারব তোর মাথায় এখনও তুমি? এই শোন চল সবাইকে আজ ক্যান্টিনে খাওয়াবি। এটাই তোর শাস্তি।''
মুখটা কাচুমাচু হয়ে গেছিল জোহানের এতগুলো ছেলেমেয়ে খাবে,অনেক টাকা লাগবে তো? ওর পকেটে তো মাত্র কয়েকটা টাকা গাড়ি ভাড়ার জন্য রয়েছে।
-" কী ভাবছিস?"
-" না আসলে আমার কাছে টাকা নেই,মানে এতটা টাকা।"
মুখটা বেঁকিয়েছিল কুইন," কিপ্টেরাম তুই বুঝেছি,কেন মা বাবা টাকা দেয় না? যা আছে বের কর তারপর আমরা ধার দিয়ে দিচ্ছি পরে দিস।"
জোহান হঠাৎই ওদের সামনে ওর না পারার পর্দাটা খুলে দিয়ে বলেছিল," আমার মা বাবা নেই,আমরা খুব গরীব ঠিকমত খেতে পেতাম না। একটা চার্চে থেকে পড়াশোনা শিখেছি। এখনও ফাদার..."
কুইনের মুখটা কুঁচকে গেছিল হঠাৎই সবাই ঠান্ডা হয়ে গেছিল। কুইন ওর হাতে আলতো ছোঁয়া দিয়ে বলেছিল," সরি,আচ্ছা থাক। চল আমি বরং আজ চা খাইয়ে দিই আর সাথে কেক।"
জোহান অবাক হয়েছিল প্রথম দিনের আলাপের পর আর কুইন ওর সাথে তেমন কথা বলেনি। তবে প্রিয়জন না হলেও প্রয়োজনে থেকেছে,একদিন হঠাৎই বলে ফেলেছিল," যাদের বাবা নেই তাদের আমার ঠিক ভালো লাগে না। আসলে আয়নাতে আমার মতই দুর্ভাগা একজনকে যদি পাশে দেখি ঠিক ভালো লাগে না। "
ওর কথাগুলো একটুও বুঝতে পারেনি জোহান। তারপর এই কয়েক বছরে ওদের বাড়িতে যাতায়াত করে একটু একটু করে জানতে পেরেছিল কুইনের অতীত। কুইনের মা বাবার বিয়ে হয়নি,ও কুমারী মায়ের সন্তান। আর সেইজন্য কারণে অকারণে ও আন্টির সাথে খারাপ ব্যবহারও করে,অসম্মানিত করে। নিজে যে প্রশ্নগুলো শোনে সেগুলো তীর করেই ফিরিয়ে দেয় মাকে।
দেবাঙ্গীর পছন্দ জোহানকে,কুইনের যখন পরীক্ষার আগে পক্স হল তখন তো এই ছেলেটা কিছু না মেনেই প্রতিদিন এসেছে বাড়িতে। কুইনকে নোট দিয়েছে,নিজে পড়েছে কুইনকে শুনিয়ে শুনিয়ে মুখস্থ করিয়েছে। এইরকম একটা ছেলের সাথে যদি কুইনের বন্ধুত্ব,প্রেম অথবা সম্পর্ক হয় ক্ষতি কী?
ছেলেটা কালো,তাতে কী হয়েছে? এমনিতে সুন্দর, মায়াবী আর পরোপকারী। গায়ের রঙে কী এসে যায়? এমন একটা ছেলের সাথে কুইনের সম্পর্ক হলে অন্ততঃ কোনদিনই কুইনকে ওর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না।
তবে মেয়ের কাছে কিছুটা বলতেই ওরা মা আর মেয়ে মানে দেবী আর কুইনের আম্মা যা কথা শুনেছিল আর সাহস হয়নি কিছু বলার। কুইনের উদ্ধত স্বভাব দেবীকে গুটিয়ে রাখত মানসিকভাবে।
ট্রেনের পেছনে কিছুটা দৌড়ে একটা সময় হাল ছেড়ে দেয় জোহান। আসলে খবরটা পেয়েই দৌড়ে এসেছিল,কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়াতে আর দেখাটা হল না। মনের কথা মনেই রয়ে গেল,আজ বলতে চেয়েছিল তুই হঠাৎই কেন শহর ছেড়ে চললি এত দূরে? তবুও এই শহরের কোথাও তুই ছিলি। ইচ্ছে হলেই একবার ছুটে আসতে পারতাম। জানি তুই খুব বিরক্ত হতিস আমাকে দেখে। তবুও আমি সবসময়ই চেয়েছি তুই ভালো থাক।
৮
স্টেশনের বেঞ্চে বসে থাকে জোহান কিছুক্ষণ তারপর হঠাৎই মনে হয় ওর ডাক্তারীতে সুযোগ পাওয়ার খবরটাও তো দেওয়া হল না। অবশ্য খবর পেলে অন্যদের মত কুইনও মজা করত যে রবার্ট ব্রুশের থেকে কোন কম ধৈর্য্য নেই তোর বাবা এই বুড়ো বয়েসে বিএসসি পাশ করে তারপর আবার ডাক্তারী পড়তে যাবি? তুই যখন ডাক্তার হয়ে বেরোবি তখন তো বন্ধুদের ছেলের বিয়েও হয়ত হয়ে যাবে!
কয়েকজন বন্ধুকে খবর দিতে গিয়ে এই কথাটা শুনেছে জোহান,হয়ত কুইনও তাই বলবে। কিন্তু কুইনকে তো ও বলতে পারবে না,প্রথমবারের পরীক্ষায় পাইনি সত্যি। কিন্তু তারপরে আর চেষ্টাই করিনি তোকে দেখতে পাব না বলে। মা প্রায়দিনই স্বপ্নে এসে বলত তাই তো আবার...
অনেকটা দৌড়ে এসে ক্লান্ত জোহানের শরীরটা ছেড়ে দেয়। কিছুটা সময় স্মৃতির গলিপথে অকারণ পায়চারী করে স্টেশনের ঠান্ডা জলের জায়গায় এসে কিছুটা জল চোখমুখে ছিটায়। তারপর ধীরে ধীরে পা বাড়ায় ওর গন্তব্যের দিকে,হয়ত আর কোনদিনই দেখা হবে না। তাই কাউন্সেলিংয়ের অপেক্ষা করে জোহান।
স্বপ্নপূরণের লড়াইয়ে একদিন নিজেদের গ্ৰামের কুঁড়েঘর ছেড়ে এসেছিল চার্চে,তারপর শহরে। এই শহরে আর রইল না তার কোন বন্ধন,কুইন ওকে কোনদিনই ভালোবাসেনি এমনকি পছন্দও করেনি। আর আজ তো মনে হল ও ওকে বন্ধু বলেই ভাবেনি তাই তো শহর ছাড়ার আগে একবারও বলে গেল না,জোহান আমি চলে যাচ্ছি অনেক দূরে...
ট্রেন ততক্ষণে ছুটে চলেছে দৈত্যের মত,কুইন আনমনা হয়ে জানলাতে বসে। হয়ত কিছুটা মনকেমনের ছোঁয়া ওকেও ঘিরে রয়েছে। মা বারবারই বলছিল জোহানের কথা,ও ছুটছিল ট্রেনের সাথে। কী চায় ছেলেটা? নাহ্ তবে এখন আর কাউরও কথা ভাববে না ও। এক নতুন জায়গাতে গিয়ে নিজের মত থাকবে। যেখানে চেনা পরিচিত বন্ধুবান্ধব আর স্তাবক কেউ থাকবে না। চোখের সামনে দেখতে হবে না জোহানটাকেও।
একবার সীট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের ওখানে এসে দাঁড়ায়। মা হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে,চোখটা বোজা। আবছা আলোতে দেখা যাচ্ছে মায়ের বুকটা ওঠানামা করছে। আম্মার ইচ্ছে ছিল না মা আসুক ওর সাথে তবুও মা এল জোর করে। কিছুতেই শুনল না। কেন যে সবাই ওকে এভাবে কৃতজ্ঞতা দিয়ে বাঁধতে চায় কে জানে?
'' কী রে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? ঘুমিয়ে পড় আবার তো নামতে হবে।"
মা তাহলে ঘুমোয়নি এমনি চোখ বুজে পড়ে আছে।
-'' তোমার ঘুম আসছে না?"
-" না রে,অনেকদিন বাদে তো উঠেছি ট্রেনে তাই ঘুম আসছে না। ঘুমিয়ে পড়ব,তুই ভাবিস না।''
আপার বাঙ্কে উঠে শুয়ে পড়ে কুইন,কেমন যেন একটা অস্থিরতা মনের ভেতর। তবে এমন তো হবার কথাই নয়, ও তো বাড়ি ছাড়তেই চেয়েছিল। তবুও কেন যেন হঠাৎই খারাপ লাগল ফেলে আসা শহরটার জন্য আর ঐ মানুষ দুটোর জন্য যারা ওকে আগলে রেখেছিল এতদিন,হয়ত বা মুখবন্ধ করে সয়েছিল অনেক উৎপাতও। আম্মা বাড়িতে,আর মা ওর সাথে চলেছে মেঘ কুয়াশার পথে। তবে আরেকটা মুখও মনে হল সেটা জোহানের যে তার চলার পথে সারাক্ষণ চেষ্টা করেছে একটু বেশি করেই পাশে থাকতে। যে হাতটা ও বাড়িয়ে দিয়েছিল একদিন সেই হাতটা ধরতে। কিন্তু তাকে সুযোগ দেয়নি কুইন কেন যেন খুব বিরক্ত লাগত ছেলেটাকে দেখলেই। আজ আবার মায়ের কাছে শুনল ও নাকি ছুটছিল ট্রেনের পেছনে।
আবছা আলো আঁধারিতে মাথাটা উঁচু করে দেবাঙ্গী দেখে মেয়েটা পাশ ফিরে শুয়েছে। যতই বলুক তবুও একা ছাড়া যায় নাকি মেয়েকে? নতুন জায়গা,নতুন ইউনিভার্সিটি একটু চিনিয়ে না দিলে হবে কেন? মা হিসেবে ওরও তো দায়িত্ব আছে।
চোখ বোজে দেবাঙ্গী চোখের সামনে ভাসে অনেক বছর আগে ফেলে আসা কিছু টুকরো টুকরো ছবি। বন্ধুরা যে যার সীটে শুয়ে পড়েছে অনেকটা আগে। তার আগে বেশ অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা চলেছে। শুধু দেবাঙ্গী আর সম্রাটের চোখে ঘুম ছিল না। সাইড লোয়ার সীটে দুজনে খুব কাছাকাছি বসে মোটামুটি সারারাত গল্প করে ভোর হবার আগে শুয়েছিল। সম্রাট লুকিয়ে চুমু খেয়েছিল ওখানেই,ওকে ছুঁয়েছিল বারবার। প্রথম যৌবনের সেই ছোঁয়া মনে করলে এখনও শিহরণ জাগে দেবাঙ্গীর বুকে। থরথর করে কাঁপে শরীর,সেই উত্তরবঙ্গে যাবার ট্রেনে আজ ও আবার উঠেছে শুধু ছবিটা বদলে গেছে। এখানে আজ ও একা একা সীটে শুয়ে স্মৃতির রোমন্থন করছে।
৯
সম্রাটের সেই চুরি করে চুমু খাওয়ার কথা মনে করে ঠোঁট কাঁপলো দেবীর। কুইনের এখন যা বয়েস তার থেকে ও ছোট ছিল যখন প্রেম করেছে সম্রাটের সাথে। সত্যি বোধহয় বয়েস অনুপাতে একটু বেশি পাকামো করে ফেলেছিল। কুইন সুন্দরী অনেক বন্ধু আছে ওর,তবে কোন প্রেমিক নেই। দেবীর প্রেমিক ছিল ক্লাস ইলেভেন থেকেই আর সেই প্রেমের আবেগকে আর বাক্সবন্দী করে রাখতে পারেনি ওরা।
স্বাধীনতা পেয়ে একে অপরের প্রেমে ডুবে গেছিল,ট্রেন থেকেই ভেসেছিল আবেগে। আর সেই আবেগের ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল ওদের দূরে অনেক দূরে। বন্ধুরাও সুযোগ করে দিয়েছিল ওদের একা থাকার। সম্রাটের বাবা বড়লোক,তাই টাকার অভাব ছিল না ওর তাই একসাথে বন্ধুরা মিলে এলেও ওরা হঠাৎ হঠাৎই আলাদা হয়ে যেত। আর সেই আলাদা হতে গিয়েই ঘটেছিল অঘটন...
একটা রাত্রির জন্য কার্শিয়াং ছাড়িয়ে আরও অনেকটা ওপরে একটা নির্জন জায়গাতে চলে এসেছিল ওরা। বন্ধুদের সম্রাট বলে এসেছিল ওদের সাথে কার্শিয়াংয়ে দেখা করবে। গাড়ির ড্রাইভার কাঁচে ওদের দেখছে দেখে লজ্জা পেয়েছিল দেবাঙ্গী বলেছিল," এখন না পরে,লোকটা দেখছে।"
সম্রাট তখন কেমন যেন ঘোরে,বারবারই দেবীকে জড়িয়ে ধরছিল আর বলছিল," দেখুক ও কী আমাদের চিনে রাখবে নাকি? কত লোকই তো আসে বেড়াতে। আমি আর পারছি না। কত ম্যানেজ করে এসেছি বলত।"
দেবী বাধা দিতে পারেনি শালে জড়ানো দেবীকে জাপ্টে ছিল একদম সম্রাট। দুজনেই তখন ফুটছে উত্তেজনায়,মাত্র তো একটা রাতের অবসর। তারপর আবার দলে মিশে যেতে হবে। সম্রাট ম্যানেজ করেছে ওর মেসোর বাড়ি যাচ্ছে বলে।
সম্রাট ফিসফিসিয়ে বলেছিল," সারা রাত আজ জাগব,ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলবে আর সেই আগুনের ওমে শরীরটাকে..."
দেবী মুখটা ঢেকেছিল,তার আগে চোখে পড়েছিল ড্রাইভারটা অদ্ভুত চোখে দেখছে ওদের। হয়ত অপছন্দ করছে সম্রাটের বাড়াবাড়ি, তবে ও কী বাংলা বোঝে?
কী জানি হয়ত বোঝে,কত রকমের মানুষই তো যায় ওদের সাথে। তাই ভাষা না বোঝার কী আছে?
চা বাগানের ভেতরে ছোট্ট একটা কটেজ,একদম ফাঁকা সেখানে ওদের একটা রাত্রি থাকার কথা। পুরোটাই একদম চুপিচুপি। যৌবনের উত্তেজনা ভেঙে দিয়েছিল সব নিয়ম কানুনের বেড়াজাল। দুজনের উত্তেজনার থার্মোমিটারে তখন পারদের মাত্রা ছাড়িয়েছিল,জমে থাকা প্রেমের মেঘ ঝরেছিল মেঘভাঙা বৃষ্টি হয়ে অঝোরে। পাহাড়ের নিস্তব্ধতা আর ফায়ারপ্লেসে জ্বলন্ত কাঠের টুকরো নেশা ধরিয়েছিল সম্রাটের দুই চোখে বলেছিল,'' ট্রেন থেকে ডুবে আছি নেশাতে,তোকে আরও কাছে চাই দেবী। আরও কাছে, তোর ভালো লাগছে না এখানে তো কেউই নেই চারপাশে। তাই আর নেই লুকোচুরি করে প্রেমের খেলা,যত জমা প্রেম ছিল মনে সব সেরে নেব এই বেলা।''
আদরে ভাসতে ভাসতে দেবী বলেছিল," এখানেও কবিতা!"
-" কবিতাদের এন্ট্রি আছে সবখানেই সোনা,তা হোক বিছানা অথবা কবরখানা।"
বাইরে থেকে কেউ একটা এসে কড়া নেড়েছিল," খানা সাহাব..."
" ইশ্ এদের আর কোন কাজ নেই? কবিতা বলতে বলতে প্রেম করছি...."
-" দরজা খোল,বেল বাজছে।"
-" আমি এই খাবার রেখে যাচ্ছি না। তাই হাঁক
মারে..বাহার মে রাখ দো, মে রাখ দো, লে লেঙ্গে।"
তখন হয়ত অন্য খিদের চাহিদাতে মন ভুলেছিল সব কিছু। সম্রাটের আদরে আদরে দেবীর শরীরের প্রতিটা খাঁজ জেগে উঠেছিল। তারপর একটা সময় যুদ্ধ শেষের স্বস্তিতে ভয় পেয়েছিল দেবী।
সম্রাটকে জড়িয়ে রেখেছিল শক্ত হাতে ওর বুকের গভীরে মুখ গুজে খুঁজতে চেয়েছিল নির্ভরতা। তারপর বলেছিল," এটা আমরা কী করলাম! আমার এখন ভয় করছে।"
-" ভয় করছে,তাই নাকি? কই একটু আগে তো ভয় টয় কিছু দেখিনি। কত সাহসী মনে হয়েছিল তখন। কী করেছিস দেখ! একদম আঁচড়ে কামড়ে এক করেছিস। দেবী তুই তো চিতা বাঘের না না বাঘিনীর চেয়েও ভয়ঙ্কর দেখছি।"
-" ইশ! আমি কিন্তু কথা বলব না একদম। আমার যে এখানে জ্বালা করছে এই গলাটার কাছে..."
গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে,ঘুম ভেঙে যায় দেবীর। যদিও চোখ খুলতে একদম ইচ্ছে করে না। এত সুন্দর অতীতের স্মৃতিতে ডুবে যাওয়ার পর কার ইচ্ছে করে বাস্তবে ফিরতে? মাঝে কতগুলো বছর,কিন্তু ঘুমের মধ্যে মনে হয়েছিল সম্রাটের স্পর্শ পাচ্ছে। ওর আঁচড়,জড়িয়ে ধরা সবই যেন ওকে জড়িয়ে ধরেছিল এতক্ষণ ধরে। কম্বলের ভেতরে শরীরের গরমে হাল্কা ঘাম জমেছে দেবীর ব্লাউজের ভেতর। বুকের আঁচলটা সরিয়ে,কম্বলটা বুক থেকে নামিয়ে একটু হাল্কা হয় নিজে। তারপর আধশোয়া হয়ে হাত বাড়িয়ে জলের বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে গলায় ঢালে। মাথাটা উঁচু করে কুইনকে দেখে আবার মেয়েটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।
ট্রেনের প্রচন্ড গতিটা বাইরে এসে অনুভব করে দেবী,ওহ্ কী জোরে চলছে! যদিও মেয়ে বলেছিল বাথরুমে যাবার সময় ওকে ডাকতে। কিন্তু কেন ডাকবে শুধু বাথরুমে যেতে ওকে? কোথাও কোথাও কুইন সম্রাটের মত,সেদিন ট্রেনেও ও নিয়ে গেছিল বাথরুমের ঐ পথটুকু। বন্ধুরা আওয়াজ দিয়েছিল..কী কেয়ারিং রে,আরে বাথরুমের ভেতরে ঢুকে যাস না আবার। তখন না হলেও দেবী যখন ভোর রাতে বাথরুমে গেছিল তখন সম্রাট ওকে...চোখে মুখে একটু জল দেয় দেবী গাটা আবার একবার একটু কাঁপে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সম্রাট দেবী দরজা খুলতেই ঢুকে পড়েছিল হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল দরজায়,দেবীকে আঁকড়ে ধরে ওর ঠোঁটে... দেবী আঃ করে উঠেছিল। সম্রাট বলেছিল ইশ্ একটু জোরে হয়ে গেছে উত্তেজনার ঠ্যালায়। সরি রে একদম সরি... আবার এক সেকেন্ডের আদর বন্ধ বাথরুমে। তারপরই বেরিয়ে এসেছিল দুজনেই।
১০
দেবী বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে তারপর সীটে শুয়ে আবার চোখ বোজে। ঘুম আর আসে না মনে হয় আর কিছুটা বাদেই আলো ফুটবে ভোরের,তারপর একটু একটু করে সেই আলো ছড়িয়ে যাবে আর দিগন্ত হবে সেই আলোতে উদ্ভাসিত।
দেবীর মন ডুবে যায় স্মৃতির অনুরণনে,নর্থবেঙ্গলের নাম আর সবুজের সমারোহ ওদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল আগেই। বন্ধুরা বলে উঠেছিল," হ্যাঁ হ্যাঁ ওখানেই যাব আমরা,কাছাকাছি অথচ সুন্দর জায়গা। অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য সেখানকার। "
-"আমার ভাইয়ের বন্ধুরা সব ঘুরে এল। দারুণ জায়গা অথচ পকেট ফ্রেন্ডলি।"
উচ্ছ্বসিত হয়ে মানব বলেছিল।
সম্রাট সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বলেছিল," হ্যাঁ উত্তরবঙ্গের কুয়াশা প্রেমের মতই মায়াবী,আর চা বাগানের সবুজ মনের মতই অবুঝ। তবে শোন আমাদের সাথে কিন্তু দেবীও যাবে। মানব তোদের ক্লাসের চারটে মেয়ে তো যাচ্ছে। ওরা থাকবে একসাথে।"
-" কিন্তু দেবীর বাড়ি থেকে ছাড়বে নাকি? ওর বাবা কিন্তু খুব কড়া। কে ম্যানেজ করবে?"
-" মানব তুই ম্যানেজ করবি,দেবী তো তোকে দাদা বলে রাখী বাঁধে। তুই পারবি না?"
-" অগত্যা বন্ধুর জন্য আমাকেই হাড়িকাঠে গলা দিতে হবে দেখছি। কী জানি কপালে কী আছে? শোন বাড়াবাড়ি কিছু করিস না। মানে আমাকেই আগলে রাখতে হবে দেবীকে। তোর যা প্রেমের ঘটা...কী অঘটন ঘটবে কে জানে। তাই সামলে..."
বাবাকে রাজি করাতে মানবদা বেশ কয়েকদিন গেছিল ওদের বাড়িতে। তারপর মা অনেক বলাতে বাবা রাজি হয়েছিল,অবশেষে ছাড়া পেয়েছিল দেবী। মনের মধ্যে উড়ে বেড়ানো এক ঝাঁক প্রজাপতিকে উত্তেজনায় বাক্সবন্দি করে একদিন সন্ধ্যেতে মানবদার সাথেই উত্তরবঙ্গে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিল। পেছন থেকে মা বারবার বলেছিল," দুগ্গা,দুগ্গা সাবধানে থাকিস মা ঠান্ডা লাগাস না। ফটো তুলতে পাহাড়ের ধারে যাস না।"
বাবা বলেছিল," মানব একটু খেয়াল রেখো আসলে একা ছাড়িনি তো আগে। আর দেবী একটু শান্ত চিরকালের তুমি তো জানোই।"
কথা রাখতে পারেনি মানবদা হার মেনেছিল সম্রাটের জেদের কাছে। সম্রাট ঠিক ওকে নিয়ে একা বেরিয়ে এসেছিল একদিনের জন্য নিরালায় মিথ্যে কথা বলে। মা ঠান্ডা লাগাতে বারণ করলেও দেবী শরীরের সবটুকু আবরণই খুলে দিয়েছিল স্বেচ্ছায় তারপর একটা সময় ঠান্ডায় কেঁপেছিল।
ততক্ষণে সম্রাট বাইরে থেকে খাবার এনে ওকে কম্বলে জড়িয়ে হাতে প্লেট নিয়ে খাওয়াতে খাওয়াতে বলেছিল," আর শীত করছে না তো? এই তো জড়িয়ে রেখেছি। নে চিকেনটা খা খুব ভালো হয়েছে।"
দেবীর কেমন যেন ভয় করছিল তখন,কোন মানুষের সাবধান বাণী ওরা শোনেনি। সম্রাট নিজের খেয়ালে ওকে নিয়ে এসেছিল আর ও সবটুকু দিয়েছে আজ ভালোবেসে। পরদিন দুপুরের আগেই ওদের চলে যাবার কথা ছিল কারণ ওরা গিয়ে ওদের দলের সাথেই মিট করবে। তবে দেবীর সাথে কাটানো সময়কে আরও দীর্ঘ করেছিল সম্রাট,বারবারই ডুব দিচ্ছিল উষ্ণতায়। ওর কানের কাছে ঠোঁট ঘষতে ঘষতে বলছিল," একটু দেরি না হয় হবে। এমন দিন তো আর আসবে না..."
দেবী হঠাৎই জিজ্ঞেস করেছিল," কেন আমরা যখন বিয়ে করব,তখন তো একসাথেই থাকব তাই না?"
-" ধুর পাগলী,সেই ভালোবাসা আর এই ভালোবাসা কী এক নাকি? নিষিদ্ধ সব কিছুতেই এক অনন্য সুখ।"
বাইরে থেকে গাড়ির হর্ণ শুনেছিল,দরজায় মৃদু টোকা পড়েছিল। সম্রাট সাড়া দিয়েছিল," কৌন?"
-" সাহাব রুম ছোড়না পড়েগা,দের হো গয়া।"
বিরক্ত গলায় সম্রাট বলেছিল বাড়তি টাকা দিয়ে দেবে। একটু বাদে আবার জিপের হর্ণ বাজছিল। অস্থির হয়েছিল দেবী," এবার ছাড়ো,পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। অনেকটা পথ যেতে হবে। এই দুষ্টু ছেলে... ছাড়ো।"
গাড়িতে উঠে বসার আগেই ড্রাইভার রাগত গলায় বলেছিল," ইতনা দের কর দিয়া সাহাব,পহৌচনে মে তো বহত দের হো যায়েগা। কব সে হর্ণ দে রহা হুঁ।"
সম্রাট বলেছিল," ঠিক হ্যায় চলা যায়েঙ্গে,রূপিয়া দে দেঙ্গে এক্সট্রা আপকো।"
লোকটা দেবীকে দেখছিল,হয়ত বা মাপছিলও। দেবী গলাটা স্কার্ফ দিয়ে ঢাকবে বলে হাতব্যাগটা খোলে। ইশ্ আয়নাতে দেখেছে ও দাগদুটো... আগেই সাবধানী হওয়া উচিত ছিল। লোকটা কী দেখছে অমন করে?
সম্রাটের কথা শুনে লোকটা বলে ওঠে," ইয়ে পাহাড়কা রাস্তা হ্যায় সাহাব,কোই বাত্তি নেহি রাত মে,আসপাশমে কোই গাঁও ভী নেহি। চিতা আওর দুসরা জানোয়ার ভী আ যাতা। পয়সা সব কুছ নহী, মেরে লিয়ে জান কিমতি হ্যায়। মেমসাহেব ভী উমর মে ছোটি,ক্যায়া পতা..."
দেবী সম্রাটের হাতটা ধরে ভয় পায়,লোকটা কী বলতে চাইছে?
১১
লোকটা মাঝপথে হঠাৎই গাড়ি থামালো। সম্রাটের সাথে নীচে নেমে কথা বলতে লাগলো উত্তেজিত গলায়। ও মাথা ঠান্ডা রেখে লোকটাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কিছুটা আগে আবার গাড়িতে উঠে পড়েছে। বেশ কিছু টাকা গুজে দিয়েছে ওর পকেটে। দেবীকে পাগলের মত ভালোবাসলেও সম্রাট স্বভাবে বেশ বদ মেজাজী এবং উদ্ধত,অবশ্য সেটা হয়ত ওর দোষ নয়। বাড়ির পরিবেশ ওকে এমন করেছে। ওর যখন পনেরো বছর বয়েস তখন মা বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। দেবীকে একদিন বলতে গিয়ে চোখটা ভিজে গেছিল সম্রাটের," জানিস পরে শুনলাম মা বাবা দুজনেরই এক্সট্রা ম্যারিটাল রিলেশন ছিল। কী জানি কেন আমাকে জন্ম দিয়েছিল ওরা? বাবা তার নতুন বৌকে নিয়ে দিনরাত হানিমুন করছে। আর মা তার বড়লোক বরের সাথে দেশ বিদেশ ঘুরছে। আমার অবশ্য অভাব নেই,টাকা পাই হাতে প্রচুর। দেবী তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি না তো?"
বড়লোক বাড়ির ছেলে সম্রাট প্রেমে পড়েছিল মধ্যবিত্ত ঘরের শান্ত মেয়ে দেবীর। দেবী যখন বাড়ি থেকে টিফিন এনে ওর মুখে লুচি পরোটা গুজে দিত আর ধমকাত অনেকক্ষণ কিছু খায়নি বলে...তখন সম্রাটের মনে হত কেউ একজন আছে যে ওর খেয়াল রাখে। বাড়িতে তো খাবার কথাই কেউ বলে না। বাবা সারাক্ষণ ব্যস্ত নিজের কাজকর্ম নিয়ে,মাঝেমধ্যে দেখা হলে শাসনজনিত কথোপকথন হয়। আর ওর বর্তমান মা মানে বাবা যাকে আবার বিয়ে করেছেন তিনি আবার মা বলাতে ফোঁস করে উঠেছিলেন,বলেছিলেন.." মা! আমি আবার কবে থেকে তোমার মা হলাম? শোন মা হওয়া মুখের কথা নয়। আমি অত মহান হতে পারব না। আর তারপর একটা বুড়ো ধাড়ি ছেলে আমাকে মা বলে ডাকবে তা জাস্ট আনবিয়ারেবল। শোন আমার বন্ধুবান্ধব আসবে তাদের সামনে ম্যা ম্যা করবে না।"
-" তাহলে কী বলব?"
-" মিসেস সেন বলতে পারো,অথবা আন্টি।"
সম্রাটের হাসি পেয়েছিল কিন্তু কিছু বলেনি। যাক ও তাহলে বুড়ো ধাড়ি ছেলে। আর ওর বাবা? বাবারও তো অনেকটা বয়েস মিসেস সেনের তুলনায়। বাবা অবশ্য ভদ্রমহিলার হানি,আসলে বাবার কাছে আছে মানি। কথাটা মনে হতেই আবার হাসি পেয়েছিল।
পনেরো বছরের ছেলেটা জেনেছিল কেউ তাকে চায় না। তার আর আপন বলতে কেউ নেই এই পৃথিবীতে। দেবীরা থাকত ওদের পাশের পাড়াতে। ওখানে ও ফুটবল খেলতে যেত,একদিন বলের আঘাতে চোখের ওপরটা যখন খুব বড় ঢিপির মত ফুলে গেছে তখন মাঠের উল্টোদিকের বাড়ি থেকে ছুটে এসেছিল ওরা মা আর মেয়ে বরফ নিয়ে। মাসিমা বলেছিলেন," দেবী দে তো বরফটা ওর কপালে চেপে ধরি,উহ্ আমি বারান্দা থেকে দেখছি ছেলেটা কপালটা চেপে বসে। উঃ কতটা ফুলে গেছে!"
কতদিন এমন কোন ছোঁয়া পায়নি সম্রাট,দেখলো একটা শান্তশিষ্ট মেয়ে সমানে মায়ের সাথে ওর সেবা করে যাচ্ছে।
প্রথম ছোঁয়া নাড়া দিয়েছিল সম্রাটের মনে,তারপর থেকে খেলতে এলেই একবার তাকিয়ে দেখত বারান্দায়। কিন্তু সে সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি,ওর বাবা নতুন বাড়ি কিনে চলে এসেছিলেন সল্টলেকে। পুরোনো পাড়াতে আর যাওয়া হয়নি। তবে কিছু সম্পর্ক বোধহয় ওপর থেকেই হয়ে আসে। তাই দেবীকে খুঁজে পেয়েছিল হঠাৎই একদিন নিউমার্কেটে.. দু তিন বছরের ফারাকেও ভুলে যায়নি মুখটা। এগিয়ে এসে বলেছিল," একটা কথা বলব? মানে তুমি কী টালাপার্কের কাছে থাকো?"
দেবীর চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলা করে," থাকি তো? কেন শুনি? আবার ফুটবল খেলতে যাবে নাকি ওখানে?"
হেসে উঠেছিল দুজনেই,বোঝা গেল কেউই কাউকে ভোলেনি। তারপর আবার যোগাযোগ হয়ে গেছিল দুজনের মধ্যে। প্রথম প্রথম লুকিয়ে দেখা,তারপর প্রেম। সম্রাটের মনে হয়েছিল শুকিয়ে যাওয়া সম্পর্কের মরুভূমিতে এক অনন্য ওয়েসিস দেবী। যার সাথে ঝগড়া, অভিমান, মারামারি সবই করা যায়। হয়ত বা কামড়েও দেয়া যায় ভালোবেসে।
টুকরো কথা আর টুকরো প্রেম একটা সময় জমে উঠেছিল বরফের পাহাড়ের মত। সেই বরফের জমাট শীতলতা হঠাৎই গলে গেছিল নিভৃতে ফায়ারপ্লেসের আগুনে।
জিপটা বেশ জোরে চালাচ্ছে ড্রাইভার, দেবী সম্রাটের হাতটা চেপে ধরে বসে আছে। সম্রাটের শরীরে তখনও ভালোবাসার উত্তাপ,তাই সে আদরে জড়িয়ে রেখেছে দেবীকে। মাঝে মাঝেই ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর আঙ্গুলগুলো দেবীর শরীরের হারমোনিয়ামের রীডগুলো। প্রেমের পিয়ানো বাজছে টুংটাং মিঠে সুরে।
-" ওকে একটু আস্তে চালাতে বলো না,আমার কেমন যেন ভয় করছে।"
সম্রাট ওকে আরও কাছে টেনে নেয় চাপা গলায় বলে," কিছু বলতে হবে না। চালাচ্ছে চালাক। আমাদের পৌঁছতেই হবে দেবী যত রাতই হোক। মানব বারবার বলে দিয়েছে। তুই তো জানিস কিভাবে ম্যানেজ করে এসেছি।"
-" ইশ্ একদম জলজ্যান্ত মিথ্যে বলেই তো এসেছ। তোমার মাসির বাড়ি...আর সেখানে মাসি মেসো আমাদের একটা ঘর ছেড়ে দিয়েছেন হানিমুনের জন্য।"
লোকটা বাঁকগুলো তীব্র গতিতে টানছে,ততক্ষণে অন্ধকার নেমেছে। সম্রাট এবার একটু সচেতন করার চেষ্টা করে ওনাকে..." ধীরে ভাইয়া,আঁন্ধেরা হো গয়া।"
-" মালুম হ্যায়, আপকো তো লে জানা ভী হ্যায় হমকো। ফালতু দের কর দিয়া। জলদি নিকলতে তো ইতনা প্রবলেম নহি হোতা..."
লোকটা গজগজ করতে থাকে,দেবীর কেমন যেন ভয় লাগে। অন্ধকারে ও জড়িয়ে বসে আছে সম্রাটকে। হঠাৎই জোরে ব্রেক কষে লোকটা, ওরাও নিজেদের ভারসাম্য হারিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তারপরেই দেখে জিপের সামনে দাঁড়িয়ে একটা চিতাবাঘ। লোকটা কোন আওয়াজ করতে বারণ করে। ওরা ভয় পায়,জিপের পেছনটা খোলা সেখানে মোটা ক্যাম্বিসের কাপড় ঝুলছে,বাঘটা যদি সেখানে উঠে আসে মানুষের গন্ধে?
নাহ্ তেমন কিছু হয়নি,ধীরে ধীরে চিতাটা চলে যায় সামনের জঙ্গলের দিকে। লোকটা আবার গাড়ি চালাতে শুরু করে,ততক্ষণে প্রায় নটা বেজে গেছে। লোকটা বলেছে আরও ঘন্টা দুয়েক লাগবে হয়ত। তবে রাস্তা খুব খারাপ। হঠাৎই একটা ঝমঝমিয়ে আওয়াজ হয়,আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ খেলে যায় তীব্র চিৎকারে। ওরা দেখে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
দেবী কান্না মেশানো গলাতে বলে," কী হবে এখন? লোকটা এই এত বৃষ্টিতে গাড়ি চালাবে কী করে?"
সম্রাট চাপা গলাতে বলে," চোখ বুজে বোস,ভয় পাস না ঘুমো আমাকে জড়িয়ে। আমি তো আছি,এত ভয় কী? ওদের অভ্যেস আছে ঠিক নিয়ে যাবে। আর বেশিক্ষণ লাগবে না।'
সত্যি বোধহয় আর বেশিক্ষণ লাগেনি সব শেষ হয়ে যেতে। পাহাড়ের পিছল রাস্তায় আর অন্ধকারে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল জিপ একদম পড়েছিল খাদে। পরে শুনেছিল দেবী ড্রাইভার লোকটা নাকি বেঁচে গেছিল। যদিও ও সম্রাটকে জড়িয়ে ধরেছিল তবুও যখন জ্ঞান ফিরেছিল তখন আর কিছু মনে করতে পারেনি। আঁকড়ে ধরেছিল একটা হাতকে,জড়িয়ে ধরেছিল তাকেই পরম অবলম্বনে সম্রাট মনে করে।
কথাগুলো মনে হওয়াতে চোখ বেয়ে জলের ধারা নামল ওর, গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছল নিজেই। সেই যে তখন ঘুম ভেঙেছে আর ঘুম আসেনি। চোখ বুজে পড়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এই এতগুলো বছর কাটিয়েছে তবুও স্মৃতি ফিকে হয়ে যায়নি। সম্রাটের প্রেমের ছোঁয়া এখনও জড়িয়ে ধরে ওকে। আরও মনে পড়ে আরেকজনের ছোঁয়া,যাকে সম্রাট ভেবেই প্রায় একমাস জড়িয়ে ধরেছিল।
১২
পাহাড়ি রাস্তা তখন পিছল,অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। ড্রাইভার এলোপাথাড়ি গাড়ি চালাচ্ছে,সেও কেমন যেন দিশেহারা হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে রেগে যাচ্ছে,ওদের দোষারোপ করছে। সম্রাটের রাগ হলেও চুপ করে থাকে। দেবী ওর হাত চেপে ধরেছে কিছু বলতে গেলেই। ছোট্ট খরগোশের মত গুটিয়ে গেছে দেবী। ওর বুকের কাছে জড়িয়ে আছে। লম্বা চওড়া সম্রাট ওকে শক্ত বাহুবন্ধনে আটকে রেখেছে। হঠাৎ একটা সরু বাঁক পেরোতে গিয়ে আর গাড়ি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারল না। সম্রাট চিৎকার করছে তখন দেবী ওকে জড়িয়ে আছে। দেবী চিৎকার করে," বাঁচাও,কে আছো? ও ড্রাইভার... শুনতে পায় সম্রাট বলছে,"সব শেষ হবে না দেবী,আমরা বাঁচবো ঠিক,শক্ত করে ধরে থাক আমাকে।"
ড্রাইভার বিপদ বুঝে একটা গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়েছিল। ওরা পাহাড়ের মানুষ,পাহাড় ওদের বন্ধু তাই সাহায্য করেছিল বেঁচে যেতে।
সম্রাটকে দেবী আঁকড়ে ধরে রাখলেও বিষম ঝাকুনিতে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছিল ওদের। দুজনে ছিটকে পড়েছিল দুদিকে। সম্রাট লাফ দেবার চেষ্টা করেছিল বোধহয় গিয়ে পড়েছিল কয়েকশো ফিট নীচে। ওর রক্তাক্ত শরীরটা নাকি... দেবী আর ভাবতে পারে না।
তবে দেবীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেক জল্পনা কল্পনা হয়েছিল প্রথমে। দেবীর ব্যাপারে অনেক কুৎসা রটেছিল। সম্রাটের বাবা শাসিয়ে গেছিল যে ঐ মেয়েই নাকি ওর ছেলেকে খুন করে কোথাও চলে গেছে টাকা পয়সা নিয়ে। আবার অনেকেই বলেছিল এটা নিশ্চয় ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। মানে ষড়যন্ত্রকারী আরও কেউ তার সাথে হাত মিলিয়ে দেবী এই অ্যাক্সিডেন্টটা করেছে।
আসলে গোপনীয়তা ব্যাপারটা খারাপ,মানুষ হয়ত দায়ে পড়ে অনেক সত্য গোপন করে যায়। কিন্তু কোন কারণে সমস্যা হলে গোপনীয়তার শেকড়ের সন্ধান করাই প্রচন্ড সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
মানবরা কিছুই তেমনভাবে জানত না ওরা কোথায় গেছে। সম্রাট ওদের বলে গেছিল ওর মেসো চাবাগানের কোয়ার্টারে থাকেন। উনিই একবার ওদের যেতে বলেছেন,আসলে মাসী বলেছে তাই কথাটা ফেলতে পারেনি। মা না থাকলে মাসীর ভালোবাসা আর আদর আরও মিঠে হয়ে যায়। মানব বলেছিল," তুই যা ঘুরে আয়,আর যদি দেবী যায় তো আমরা কী দোষ করলাম? আমরা সবাই যাব,একটা নতুন জায়গাও দেখা হবে।"
দেবী সম্রাটের দিকে আড়চোখে তাকিয়েই মাথা নীচু করেছিল হাসি চাপতে। মনে মনে ভেবেছিল বোঝ এবার কী করে গোপনে অভিসার করবে? সত্যি ভীষণ দুষ্টু সম্রাট,উঃ কী জোরে কাল ঠোঁট কামড়ে দিয়েছে! সারাক্ষণ খাই খাই করছে। ওকে ফিসফিসিয়ে বলে," দেবী তোকে দেখলেই আমার কামড়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।"
-" তাই কর তাহলে,আমি তো রসগোল্লা তাই কামড়ে না দিয়ে গিলে ফেল।"
-" খুব কথা শিখেছিস তাই না? এই রসগোল্লা কামড়ে খেতেই ভালো।"
দেবী বুঝতে পারে বাড়ির অবহেলা আর অনাদর ওকে এমন বেপরোয়া আর সাহসী করে তুলেছে। হয়ত বা মেজাজীও। ও রাগ করলে দেবীও ভয় পায়। তারপর বলে," আমি আর কথা বলব না,এত রাগী ছেলের সাথে আমার প্রেম করতে বয়ে গেছে।"
রাগ কমলেই দেখত এক অন্য সম্রাটকে তখন দেবীর মন পেতে কানও ধরেছে। ছাড়তে পারেনি দেবী ওকে মেনে নিয়েছে ওর সব আব্দার আর আঁচড় কামড়।
সম্রাট দেবীর চোরা হাসিটা দেখতে পায়,রাগে ওর গা পিত্তি জ্বলে। যেমন ন্যাকা মানবটা তেমনি দেবী। এখন দশজন মিলে ওখানে গিয়ে হাজির হবে! অভিসার না হয় জলে গেল। ওরা থাকবে কোথায় ওখানে?
এক মুহূর্ত ভেবে নেয় কী বলবে,তারপর বলে," সত্যি মানব তোর আর বুদ্ধি হবে না। মেসোর ওখানে এতজন মিলে যাওয়া যায়? মাসী অসুস্থ আর বয়স্ক। দেবীকেও নিয়ে যেতাম না আমি। মাসীই বারবার বলেছে," মা তোর থেকেও নেই,আমার বোন যে এমন হবে ভাবিনি। যাক আমাকে একবার দেখাবি না কাকে পছন্দ করেছিস? তোর জীবনে ভালো কেউ আসুক আমি চাই বাবা।"
দেবী অতি কষ্টে নিজেকে সামলায়,ওহ্ কী নাটক করছে সম্রাট। হা হা হা আবার চোখ মুছছে। ওর কাছেই শুনেছে প্রেমে যুদ্ধে মিথ্যে বলা যায়।
মানবদা তবুও হাল ছাড়ে না," আরে আমরাই রয়েছি এক একটা ওস্তাদজী। আমিই রান্না করে দেব।"
-" বোকার মত কথা বলিস না,শুবি কোথায়? চা বাগানে? তারপর চিতা এসে তোর চেম্বারে হানা দেবে তখন বুঝবি।"
সম্রাটের কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠেছিল। মানব বলল বুঝেছি," আমাদের নিয়ে যাবি না। এই প্রোগ্রাম যদি আগে বলতি তো তোকে নিয়েই আসতাম না শালা। বাইরে আসব একসাথে আর তোমরা হাঁটা মারবে ভিন্ন পথে?"
-" এই গালাগালি দিবি না বললাম। আরে একটা তো রাত বাবা,কেটেই যাবে। কালই তো আসছি।"
সেই কাল আর আসেনি,মানব শুধু জায়গাটার নাম জেনে নিয়েছিল। ইচ্ছে না থাকলেও সম্রাট বলেছিল,মনে মনে ভেবেছিল ধুর জায়গা জানলে কী পৌঁছে যাবে নাকি? আর কালই তো ফিরছে ওরা। আর বেশি মিথ্যে বলা যাচ্ছে না। অন্যরাও রীতিমত খিস্তি দিচ্ছে দেবীকে নিয়ে সরে যাচ্ছে বলে। কেউ কেউ তো বলেই বসল," কী জানি ভাই ওখানে হানিমুনটাই সারবি নাকি? দেবীকে পাঠালাম, অক্ষত ফিরিয়ে দিস।"
কোন কথাই রাখেনি সম্রাট প্রথমে ভালোবাসার ক্ষতে দেবীকে ভরিয়ে দিয়েছিল মনের সুখে আঁচড়ে কামড়ে। তারপর দেবীর ক্ষতবিক্ষত শরীরটা আটকে ছিল একটা পাথরে। ওদের আর ফেরা হয়নি।
পরেরদিন দুপুরের আগেই বন্ধুরা খোঁজ করতে বেরিয়ে পড়েছিল। পথে জানতে পেরেছিল একটা দুর্ঘটনা হয়েছে গতকাল রাতে। মানবের বুকটা কেঁপে উঠেছিল ও থানায় গেছিল,বাকিরা সেই জায়গাটাতে যার ঠিকানা সম্রাট দিয়ে গেছিল। অনেক খুঁজে চা বাগানের মধ্যে ছোট্ট কটেজের খোঁজ পেয়েছিল। ছবি দেখাতে ওরা বলেছিল যে হ্যাঁ এরা ছিল ওখানে...
ওরা আর কিছু বলেনি,পুরোটাই বুঝতে পেরেছিল, তারপর জিজ্ঞেস করেছিল কখন এসেছিল? কখন গেছে? ওখানকার সার্ভিস বয় ছেলেটা গড়গড় করে বলেছিল সব কথা যে ঘরে ঢুকে সাহাব আর ও যো ছোকরিকে লে আয়া নিকালা নেহি আর। খানা ভী ঠিক সে খায়নি। ক্যায়া কিয়া কে জানে?
কথা বলতে বলতে ছেলেটা কেমন যেন বাঁকা চোখে তাকায় তারপর বলে ড্রাইভার খুব রাগ করছিল তবুও ওরা কামরা সে বহত দের মে নিকলা।
ওরা আর কিছু বলেনি মানে মুখ খুলতে চায়নি। তবে বারবারই সম্রাটের আচরণের অভিযোগ জানাচ্ছিল,বেশ অনেকটা পরে মানব এসেছিল পুলিশের গাড়িতে করে। পুলিশের জেরায় আর সম্রাটের পরনের কাপড় দেখে জানা গেছিল সবটা। তবে তখনও দেবীকে পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ ছিল ড্রাইভারটাও।
সম্রাটের শরীরটাকে পরদিন পাওয়া গেছিল,কান্নায় ফুঁপিয়ে উঠেছিল সবাই। মানব হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিল পাগলের মত চেঁচিয়েছিল," শালা এত তোর প্রেমের শখ! আমাদের সবাইকে এভাবে বোকা বানিয়ে দিলি! দেবী কোথায় বল? কোথায় দেবী? আমি কী বলব ওর বাবা মাকে? এভাবে আমাকে ফাঁসিয়ে গেলি? ওহ্ কী করব? কী হবে এখন!"
১৩
এই সবই সুলেখার কাছে শুনেছিল অনেক পরে দেবী। মানব কেমন যেন পাগলের মত হয়ে গেছিল ট্রমাতে,অনেক সময় লেগেছে ওকে সুস্থ করতে। এখন আর কোন যোগাযোগ নেই মানবদার সাথে ওর। প্রচন্ড একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। দেবীকে খুব খারাপ ভাবে অপমান করেছিল মানব। তারপর আর কোনদিনই যোগাযোগ রাখেনি। আসলে সম্রাটের বডি প্রথমে ওকেই আইডেন্টিফাই করতে হয়েছিল। আর দেবীকে অনেক বুঝিয়ে বাড়ি থেকে বের করে এনেছিল ও নিজেই। সুতরাং যা করেছিল ওরা সেটা বিশ্বাস ভাঙা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই অনেকেই দেবীর সঙ্গ ত্যাগ করেছিল আর কখনও ওর পাশে এসে দাঁড়ায়নি।
-" মা ওঠো,একটু বাদেই তো নামতে হবে,তোমার ঘুম হয়েছে তো?"
একটু তন্দ্রার ঘোর ছিল দেবীর,অতীতের স্রোতে ভাসতে ভাসতে মনটা ক্লান্ত হয়ে একটা সময় বিশ্রামের আশায় চোখ বুজেছিল।
-" ওহ এসে গেছে বুঝি? আমি উঠেছিলাম খুব ভোরে তারপর আবার শুয়ে পড়েছি।"
-" আধঘণ্টা মত লাগবে আর,তবে দেখো পাহাড় আর চা বাগানের বিউটিফুল সিনিক বিউটি কিন্তু দেখা যাচ্ছে। ও সো ওয়ান্ডারফুল মনে হচ্ছে স্বর্গে এসে পড়েছি। সবুজের চাদরকে এক্ষুণি ছুটে গিয়ে আদর করে আসতে ইচ্ছে করছে।"
মেয়ের ডাকে তাড়াতাড়ি উঠে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিল দেবী। মনটাকে জোর করে ফিরিয়ে এনেছিল অতীত থেকে বর্তমানে। বাথরুমের আয়নাতে নিজেকে দেখেছিল একবার, মাথার দুপাশে রূপোলি রেখা লুকোচুরি খেলছে। সম্রাটের কামড়ে দেওয়া ঠোঁট এখন পুরুষ্ট আর ভারী,শুকনো ঠোঁটে জিভ রাখে দেবী। আজকাল লিপস্টিক পরতেও ভালো লাগে না। তাড়াতাড়ি সীটে ফিরে এসে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সীটের তলা থেকে মালপত্র নিতে। মেয়ে বকুনি লাগায়," চুপ করে বোস,আমি দেখছি ওগুলো। কোমর ব্যথা হলে নিজেই কষ্ট পাবে।"
দেবীকে ছুঁয়ে যায় মেয়ের সহানুভূতি মাখা কথাগুলো। যাবার সময় তো তবুও বেশ যাচ্ছে,যদিও স্মৃতির জানলা মাঝেমধ্যে খুলে যাচ্ছে জোরালো শব্দ করে। তবুও একটা ভরসা মেয়েটা আছে সাথে। ফিরতে হবে তো ওকে একা একদিন বাদেই।
এনজিপিতে নেমে ওভারব্রীজের ওপর দিয়ে হেঁটে আসে ওরা। দেবী উঁকিঝুঁকি করে,ওকে এখানে দাঁড় করিয়েই গলাটা জড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখিয়েছিল সম্রাট। বলেছিল," দেখ কী সুন্দর তুষারশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমি তো প্রেমে পড়ে যাচ্ছি।"
-" কার?"
-" অবশ্যই পাহাড়ের,একদমই তোর নয়।"
-" তবে পাহাড়ের কাছেই যাও,আমার কাছে আসবে না।"
-" রাগ দেখো মেয়ের,দেখি কে আসতে না দেয়? আমাকে থামাতে পারবি তো?"
-" মা কী হল? এখানে দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? ভাগ্যিস আমি দেখেছি পেছনে। এত অন্যমনস্ক থাকো কেন বলত?"
-" না মানে ইয়ে আমি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে গেছিলাম।"
-" মা...আকাশে কুয়াশা। চলো তাড়াতাড়ি। আমাকে ওখানে অনেকগুলো অফিসের কাজ সারতে হবে।"
-" হ্যাঁ যাই।"
-" কেমন মেঘলা দেখেছ তো? যদিও এখনও বৃষ্টি নামেনি তবে যখন তখন নামতে পারে।"
তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ওরা বাইরে আসে। ওখান থেকে একটা অটো ভাড়া নিয়ে ওরা চলে আসে ইউনিভার্সিটি। সেখানে জিনিসপত্র এক জায়গায় রেখে বেশ কিছুটা অফিসিয়াল কাজ সারে কুইন। দেবী মেয়েকে ছাড়ে না,একসাথেই থাকে। তারপর সব কাজ সেরে কাছাকাছি একটা হোটেলে চলে আসে ওরা। কুইন আগামীকাল হস্টেলে ঘর পেয়ে যাবে। দেবী ওকে একটু গুছিয়ে দিয়ে পরের দিন ট্রেনে উঠবে এমনই কথা ছিল। হোটেলটা ভালো, চারদিকে বেশ ফাঁকা জায়গা। একটু ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয় দেবী। ঘরে সে যতই কাজ করুক না কেন বাইরে এলে তার ক্লান্তি বাড়ে বহুগুণ। তাছাড়া গতরাতে স্মৃতির হাতছানি তাকে নিয়ে গেছে বারবারই অতীতের গলিপথে। কখনও সেই প্রেমের রোমাঞ্চে ভেসে গেছে নীল সমুদ্রে,ঘুরে বেরিয়েছে কুয়াশা মাখা সাগরে। আবার কখনও চমকে উঠেছে ঘটনার বিভৎসতায়।
-'' এই যে আদরিণী,আহ্লাদী মা নিশ্চয়ই তোমার মাথা ধরেছে। তাই না? বললাম আমাকে পাহারা না দিয়ে হোটেলে এসে বিশ্রাম কর তা শুনলে না। তুমি রেস্ট নাও আমি একটু বেরোই।"
-" কোথায় যাবি একা একা? না না এখন শুয়ে থাক তো। কাল দেখা যাবে।"
-" তুমি শুয়ে থাক,আমি একটু চিনে নিই চারপাশটা। আমাকে যে এখানে থাকতে হবে ম্যাডাম।"
দেবী বুঝতে পারে মেয়ের মুডটা খুব ভালো আছে।
নতুন জায়গা ওর ভালো লেগেছে। যাক মেয়েটা ভালো থাকতে পারে যেন এখানে। ওর মত মেয়েটাকেও তো কম অপমান সইতে হয়নি।
চোখটা আধবোজা করেই মেয়েকে বলে," আমিও যাব তোর সাথে এই একটু পাঁচমিনিট বাদে।"
আকাশে তখন অস্তমিত সূর্যের হাতছানি,মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে দেবী ঘুরে দেখে শিবমন্দির অঞ্চলের আসেপাশে। জায়গাটা মোটামুটি জমজমাট বাজার দোকান সবই আছে। ছোটখাটো সব প্রয়োজনীয় জিনিসই পাওয়া যায় সেখানে। আগামীকাল আরেকবার এসে মেয়ের যা যা লাগবে সব কিনে নেবে।
কুইন বায়না ধরে পরের দিন কোথাও একটা ঘুরতে যাবে কাছাকাছি। দেবী রাগ করে," সকাল থেকে কত জায়গা ঘোরাঘুরি হল,তোর ঘর গুছোলি। এবার একটু বিশ্রাম নে। আমাকে তো আবার কাল চলে যেতে হবে।"
-" একটু কাছাকাছি চল কোথাও ঘুরে আসি,তিস্তা দেখে আসি। অথবা কোন ছোট্ট পাহাড়ি নদীর পাশে বসে কাটাই কিছুক্ষণ। মা আই লাভ দ্য প্লেস। ভাগ্যিস এখানে এসেছিলাম।"
দেবীও তো খুব ভালোবেসে ফেলেছিল এখানকার আকাশ,বাতাস,নদী আর পাহাড়কে কিন্তু গত কয়েকবছর আর ভাবেনি এখানে আসার কথা। শুধু মেয়ের জন্য এখানে আসা এতগুলো বছর পরে।
মেয়ের বায়নাতে খুব কাছাকাছি পানিট্যাঙ্কিতে এল ওরা। সুন্দর ঝুলন্ত ব্রীজ তবে এখন যেন কেমন নড়বড়ে। নীচ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাওয়া নদীর পাশে ওরা বসে। দেবী পাথরের ওপর চুপ করেই বসে থাকে। মেয়ে ছটফট করে ছবি তোলে।
-" মা কী ভাবছ? জায়গাটা খুব সুন্দর না? আচ্ছা তোমরা এখানে বেড়াতে এসেছিলে?"
-" না রে এখানে কখনও আসিনি। অন্যদিকে গেছিলাম। সে কথা এখন থাক কুইন। আমি সব ভুলে গেছি। আর মনেও করতে চাই না।''
কুইনের মুখে একটা বাঁকা হাসি খেলে যায়,"আমি যে তোমার সামনে ঘুরছি ফিরছি মানে স্মৃতির আয়না থেকে খসে পড়া একটা কাঁচ,তাকে দেখলেই তো তোমার সব কথা উঁকিঝুঁকি মারে মনে। তাই না?"
দেবী আর কোন উত্তর দেয় না। চুপচাপ পাথরে বসে জলের খেলা দেখে। তারপর একটা সময়ে বলে," চল যাই এবার। গাড়িটা অপেক্ষা করছে। তুই বায়না করলি তাই চলে এলাম। খুশী তো? আমি না থাকলে এদিক ওদিক বেশী ঘুরিস না।"
গাড়িটা চলছে পাহাড় পেরিয়ে, আকাশে বিদ্যুৎ খেলে যায়। দেবী ভয় পায় হঠাৎই মেয়েকে চেপে ধরে," হ্যাঁ রে বৃষ্টি নামবে না তো? আর কতক্ষণ লাগবে?"
-" মা এত ভয় কিসের তোমার? বৃষ্টি নামলে নামুক,ভয় ভেঙে ফেল মা। এত ভয় নিয়ে বাঁচবে কী করে?"
পাহাড়ের ঢালগুলো দেবী দেখে না। কুইন একবার চা বাগানে নেমে ছবি তুললো। দেবী তাড়া দিল ফেরার জন্য। যাক মোটামুটি সন্ধ্যের আগেই ওরা ফিরে এল। মাকে কলকাতাতে ফোন করল দেবী। কুইন খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে সারাদিন কী করেছে,জায়গাটা কেমন সব বলল।
১৪
মাকে ট্রেনে তুলে দেয় কুইন,সকালের দিকের ট্রেনেই টিকিট কাটা ছিল। যাতে মাকে রাত্রিটা ট্রেনে থাকতে না হয়। কুইনেরও চিন্তা ছিল মাকে নিয়ে,কিন্তু কোন উপায়ও ছিল না কারণ ওকে এখানেই থাকতে হবে। ট্রেন ছাড়ার আগে চোখটা ভরে ওঠে দেবীর,মেজাজী হোক বা বেপোরোয়া হোক তবুও তো ছিল মেয়েটা চোখের সামনে। হাত বাড়িয়ে আরেকবার ছুঁয়ে মেয়েকে বলে ভালো থাকিস মা,সাবধানে থাকিস। বাড়িতে ফোন করবি নিয়মিত,আমি কিন্তু চিন্তা করব।"
-" আমি ভালো থাকব মা,তুমি সাবধানে যেয়ো। খাবার খেয়ে নিয়ো। আমি ফোন করব।"
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে শরীরটা এলিয়ে দেয় দেবী,ঝড়ের বেগে সরে যাচ্ছে সব কিছু সামনে থেকে। হয়ত কুইনও এতক্ষণে পৌঁছে গেছে হস্টেলে। একটু বাদে ওকে একটা ফোন করে দেখবে,এখন থাক যদি রাস্তায় থাকে।
অনেকটা ভয় আর উৎকণ্ঠাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে দেবী। অনেকগুলো বছর আগে এভাবেই ফিরেছিল মা বাবার সাথে। ওকে পেয়ে মা বাবা যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন। দেবীকে পাওয়া যায়নি প্রায় একমাসের কাছাকাছি। পুলিশ খোঁজাখুঁজি করেছিল অনেক তারপর হঠাৎই একদিন খোঁজ পাওয়া গেছিল দেবীর।
যখন গাড়িটা গড়াতে শুরু করেছিল তখনই ড্রাইভার দরজা খুলে একটা ডাল ধরে ফেলেছিল। পাহাড় বড় চেনা ওদের তাই কেটে ছড়ে গেলেও বেঁচে গেছিল লোকটা। সম্রাটের দেহ প্রায় চেনা যায়নি কিন্তু পাওয়া গেছিল। কিন্তু দেবী কোথায়? প্রচুর জল্পনা কল্পনা হয়েছিল অনেকবার সম্রাটের বাড়ির লোকজন এসে শাসিয়ে গেছিল ওদের বাড়িতে। দেবীর মা বাবার তখন নাজেহাল অবস্থা,একে মেয়েকে হারানোর শোক তারপর কলঙ্কের বোঝা। পাড়া প্রতিবেশী বলেছিল," পেপারে দেখলাম আপনার লক্ষ্মী মেয়ে নাকি একটা ছেলের সাথে রাত কাটিয়ে ফিরছিল আর তখনি..."
দুঃখে লজ্জায় বাড়ি থেকে বেরোনো ছেড়ে দিয়েছিলেন ওরা। দেবী তখন অনেকটা দূরে একটা ছোট পাহাড়ী কুঁড়েঘরে শুয়ে আছে,চোখ খুলে দেখেছিল একটা মুখ। তারপরে আবার চোখ বুজেছিল সারা শরীরে তখন যন্ত্রণা,হাতে অসহ্য যন্ত্রণা। কেউ একটা কী যেন প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছে ওর শরীরে। অনেকটা ঠান্ডা লাগে তাতে একটু আরাম হয়।
দেবীর শরীর গড়িয়ে পড়েছিল অনেকটা নীচে,সম্রাট নিজেও লাফ দিয়েছিল আর দেবীকে টানতে চেয়েছিল সাথে কিন্তু পারেনি। জিপটা দেশলাই বাক্সের মত গড়াতে থাকে ততক্ষণে ইঞ্জিনের সামনেটা আগুন ধরেছে। দেবী পাগলের মত চিৎকার করতে থাকে বাঁচাও বাঁচাও বলে তারপর আর কিছুই মনে নেই।
গতরাতে খুব জোরে বৃষ্টি হয়েছিল,পাহাড়ের শীত আরেকটু বেড়েছে তাতে। ঠান্ডাতে হাতগুলো জমে আসে সাংশার,একটু আগুন জ্বালানোর জন্য বাইরে বেরিয়ে কাঠ আনতে গিয়ে দেখে,কাঠ প্রায় নেই বললেই চলে আর যেটুকু আছে সেটাও ভিজে জবজবে হয়ে আছে। আকাশ তখন রোদ ঝলমলে, বাইরে পাখী ডাকছে কিচিরমিচির করে। মা প্রায় একমাসের জন্য গতকালই দিদার বাড়ি গেছে। ওর দিদার বাড়ি সিকিমের প্রান্তে তবে মাসি পাশের গ্ৰাম থেকে এসেছিল তাই একসাথেই গেল। মা আর ছেলের সংসারে ছেলেটাকে রেখে যাবার ইচ্ছে না থাকলেও মায়ের অসুখের খবর শুনে আর না গিয়ে থাকতে পারেনি। সাংশা পাহাড়ের চড়াই পেরিয়ে অনেকটা উঁচুতে উঠে মাঝে মাঝে পিঠে পাথর বয়ে কুলির কাজ করে আসে,এছাড়া রাস্তা সারাইয়ের কাজ পেলে তাও করে। আর কোন কাজ না থাকলে মা আর ছেলে ওদের ছোট্ট ঝুপড়ি লাগোয়া এক ফালি জমিতে চাষ করে সেটুকু খেয়েই দিন কাটায়। মায়ের সরকারী সাহায্যের টাকাটাও কাজে লেগে যায় অভাবের সময়। কয়েকটা ছাগল আর মুরগী আছে বাড়িতে।
সাংশাদের ঝুপড়িটা একদম পাহাড়ের এক কোণে যেন ঠিক খাদের পাশে ঝুলন্ত একটা বাড়ি। তেমনি মনে হয় দূর থেকে দেখলে। তবে কিছুটা দূরত্ব আছে পাহাড়ের ঢাল থেকে।
মুরগীগুলোকে দানা ছড়িয়ে দিয়ে,ছাগল দুটোকে নিয়ে সাংশা বেরোয় বাইরে। একটু কাঠ নিয়ে আসবে তারপর রোদে ফেলে শুকনো করে সেগুলো জ্বালানী হিসেবে কাজে লাগাবে। মা কিছু রুটি করে রেখে গেছে তা দিয়ে ওর দু দিন চলে যাবে।
ছাগলগুলোকে চড়তে দিয়ে সাংশা পাহাড়ি পথ ধরে একটু এগিয়ে যায়,জায়গাটাতে জঙ্গল হলেও এখানে শুকনো কাঠ পাওয়া যায়। জঙ্গল সরাতে সরাতে এগিয়ে যেতে যেতেই হঠাৎই চোখে পড়ে একটা লাল চাদর। হাতের মুঠোতে ধরে চাদরটা,কী সুন্দর নরম চাদর! কিন্তু এটা কোথা থেকে এল এখানে? তারপর সামনের দিকে এগোতেই পাতার খসখস আওয়াজ শুনতে পায়। কী যেন নড়ছে... কান খাড়া করে সাংশা হাতে ধরা লাঠি আর দাঁকে শক্ত হাতে ধরে আবার। এখন কোন জংলী জানোয়ার তো বেরোবে না, তবে কী কোন মানুষ? কোথা থেকে এল এই চাদর?
এই দিকটাতে আর তেমন কোন পথ নেই,বড় বড় গাছের শিকড় ঝুলছে। আবার একটা ঝাপটানো আওয়াজ আসে ওর কানে,পাশের সরু পথটা দিয়ে গাছের ডাল ধরে উঁকি মারতে যা দেখলো তাতে বুকটা কেঁপে উঠল হঠাৎই। দুটো গাছের জড়ানো ডালের মাঝে ডানা মেলা পাখীর মত জড়িয়ে একটা মেয়ে। হাত দুটো দুপাশে ছড়ানো আর শরীরটা আটকে রয়েছে ডালে। গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ বেরোয় সাংশার,ও কথা বলতে পারে না তাই যদি কথা বলতে পারত তাহলে হয়ত চিৎকার করে উঠত। কিন্তু মেয়েটা ওখানে এল কী করে? তাহলে এই চাদরটা ওরই। মেয়েটার পাগুলো মাঝে মাঝে নড়ছে আর তার ঝাপটাতেই পাতাগুলো নড়ছে এবং শব্দ হচ্ছে।
বেঁচে আছে মেয়েটা,কিন্তু ওকে এখান থেকে নামাবে কী করে? গাছের ডাল বেয়ে ওপরে ওঠে সাংশা,মেয়েটাকে কাছ থেকে দেখে। কপাল ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে, মুখে রক্ত মাখা। হাতটা ঝুলছে,জামাকাপড় ছিঁড়ে গেছে,কয়েকটা পিঁপড়ে ঘুরছে ওর মুখের আসেপাশে। চাদর ছুড়ে পিঁপড়েগুলোকে সরায় সাংশা। কিছুক্ষণ ভাবে কী করবে ও?
সাবধানে নেমে ছুটে যায় বাড়ির দিকে,ছাগলগুলোকে আটকে রাখে বাড়িতে। তারপর দড়ি,তার,হুক আর একটা বস্তা নিয়ে আসে। বুকের ভেতরটা ঢিপঢিপ করে আতঙ্কে। কাউকে ডাকবে? অনেকটা দূরে সুগম বস্তীতে পরিচিত একজন থাকে। তবে কাউকে ডাকলে যদি কোন ঝামেলা হয়? সাংশা জন্ম থেকে বোবা,ওর কোন তেমন বন্ধু নেই। মা বিধবা,অনেক আগে ওর বাবা মারা গেছে। তারপর মা ছেলে কষ্ট করেই দিন গুজরান করে।
মাঝে কেটে গেছে প্রায় তিন ঘন্টা আসেপাশে তাকায় সাংশা নাহ্ কেউ কোথাও নেই। মেয়েটাকে নামিয়ে আনতে আর কাঁধে করে বয়ে নিয়ে ঝুপড়িতে ঢুকতে একদম হিমসিম খেয়ে যায়। তারপর ওকে ভেতরের ঘরে রেখে হাঁফাতে থাকে। এখন কী করবে ভেবে পায় না। তারপর খেয়াল হয় ওর মায়ের রাখা জড়িবুটি তো আছেই ওদের ঘরে সেগুলো বেটেই কাজ চালাতে হবে। মা এসব শিখেছিল ওর দিদার কাছে। অসুস্থ হলে এভাবেই ওরা নিজেদের সুস্থ রাখে। কখনও দূরের গ্ৰাম থেকেও মানুষ এসে নিয়ে যায়।
১৫
পুলিশ প্রথম দিকে খোঁজ করেছে ড্রাইভারের পায়নি। আসলে বেশ কয়েকটা দিন লোকটা গা ঢাকা দিয়েছিল। ওর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়েছিল ছেলেমেয়ে দুটোর ওপর,ওদের ঢং আর কান্ড কারখানা দেখে রাগে ফুঁসেছিল। ছেলেটার কী টাকার গরম! কথায় কথায় টাকা বের করে দিচ্ছে,আর তেমনি বেহায়া আর বেয়াদপ সারা রাত বোধহয় মেয়েটাকে ছিঁড়ে খেয়েছে,আর মজা লুটেছে। গাড়িতে বসেও সমানে সোহাগ করে যাচ্ছে,কোন হুঁস নেই। মাঝে একবার নেমে কিছুটা চুল্লু খেয়ে ও গাড়ি চালাতে শুরু করেছিল। ছেলেটা আর মেয়েটা ওর শরীরের জন্তুটাকেও জাগিয়ে তুলেছিল,বৌ মরে গেছে এক বছর আগে এরকম একটা ছুকরিকে পেলে খারাপ হত না। তাই গা ঢাকা দিয়ে কদিন সমানে খু়ঁজেছে ছুকরিটাকে এদিক ওদিক। খবর পেয়েছে ছেলেটাকে পেলেও মেয়েটাকে পাওয়া যায়নি। তো কোথায় গেল ও ছোকরি? ওকে পাহাড়ের কোথাও পেলে ও নিয়ে যাবে তুলে,কয়েকদিন চুটিয়ে ফূর্তি করে তারপর বেচে দেবে নেপালে। ওখানে শালী থাকবে বাজারে...
তবে পায়নি কোথাও খুঁজে,বরং কাছাকাছি বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে নিজে অস্থির হয়ে গেছিল আর একদম মুখোমুখি পড়েছিল পুলিশের। তারপর ধরা পড়ে সব স্বীকার করেছিল।
সাংশা সারাদিন ধরে মেয়েটার কাছে বসে আছে, মেয়েটা মাঝে মাঝে উঃ আঃ করে একটু চোখ খোলে আর ওর হাতটা জড়িয়ে ধরে। মেয়েটাকে খাওয়াতে হিমসিম খায়,প্রথম কদিন ছাগলের দুধে বার্লি মিশিয়ে চামচে করে খাইয়েছে। মেয়েটা চোখ খুলতেই চায় না,খাবার গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। মায়ের একটা জামা জড়িয়ে ওকে রেখেছে। মেয়েটার জামা ছাড়াতে গিয়ে নিজেকে সংযত করেছিল সাংশা তখন শুধু একটা অসুস্থ দেহ ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি মেয়েটাকে। সাংশা চব্বিশ বছরের ছেলে,এই বয়েসে ওদের বিয়ে হয়ে যায়। তবে গরীব ঘরের বোবা ছেলেটাকে কেউ মেয়ে দিতে চায়নি বলে ওর বিয়েও হয়নি। মা আর ছেলে কোনরকমে পাহাড়ের কোণে বানানো বাড়িতে দিন গুজরান করে।
অনেকগুলো দিন কেটে গেছে,পুলিশ মাঝে মাঝে খোঁজ করলেও হাল ছেড়েছে। বুঝেছে হয়ত কোন বন্য জন্তুর পেটে গেছে মেয়েটার ক্ষতবিক্ষত দেহটা। তবুও যতক্ষণ না মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে শান্তি নেই।
ততদিনে দেবী অনেকটা ভালো,তবে একটা পায়ে কোন জোর নেই,একটা হাত ভাঙা। সাংশা হাতটা বেঁধে দিয়েছে জড়িবুটি দিয়ে। পায়ে নিত্যদিন তেল মালিশ করে,আর দেবী ঘুমিয়ে থাকলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে বিহ্বল হয়ে। ওর কাঁধে ভর দিয়ে ঝুপড়ির এক কোণে কাপড় ঢাকা জায়গাটাতে বাথরুম করে দেবী। এ এক অন্য জীবন। প্রথম কদিন,চোখই খোলেনি। তারপর সবই আবছা লেগেছে,কিছু যেন মনে করতে পারেনি। যখন মনে পড়েছে,তখন চিৎকার করেছে সম্রাট আমি বাড়িতে যাব। সাংশা কাছে এলে ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছে," তুমি কে? আমি সম্রাটের কাছে যাব। আমি বাড়ি যাব।"
সাংশা কোন উত্তর দিতে পারেনি,ওকে চুপ করতে বলেছিল ইশারায়। দেবী শোনেনি পাগলের মত চিৎকার করছিল বলছিল আমি বাড়ি যাব,তুমি আমাকে এখানে রেখেছ কেন? কিন্তু পখ ফেলতে গিয়ে পড়ে গেছিল। বুঝেছিল ওর পক্ষে একা কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। সাংশাকে খিমচে ধরেছিল,সাংশা আকারে ইঙ্গিতে ওকে বোঝাতে চেয়েছিল কিছুটা। দেবী বুঝতে পেরেছিল ছেলেটা বোবা,একা থাকে কোনরকমে হয়ত ওকে বাঁচিয়ে এনেছে মৃত্যুর হাত থেকে। সত্যি তো কেউ আসেও না এদিকে যাকে ও বলবে যে ও বাড়ি যাবে। ছেলেটা মাঝে মাঝে ওকে তালা দিয়ে কোথাও যায় খানিক বাদে ফিরে আসে। দেবী চাইলেও নামতে পারে না বিছানা থেকে। একটা হাত কাজ করে না। জামাকাপড় ছাড়িয়ে দেয় ছেলেটা অন্যদিকে তাকিয়ে,কখনও তাকিয়ে ফেললে দেবী চিৎকার করে। আবার মনখারাপ হলে ওকে জড়িয়ে কাঁদে।
এর মাঝে একদিন ওপরের পাহাড়ে গিয়ে শুনে এসেছিল পুলিশ একটা মেয়েকে খুঁজছে। কেমন যেন ভয় পেয়েছিল সাংশা,এতদিন মেয়েটাকে ঘরে রেখেছে। পুলিশ যদি ওকে ধরে নিয়ে যায়...কী হবে? ও তো কথাও বলতে পারে না। কী বলবে পুলিশকে? আর মা যদি এসে ওকে না দেখতে পায়,তাহলে তো মা পাগল হয়ে যাবে। সবাই তো ভাববে ও মেয়েটাকে...
ভয়ে অস্থির লাগে সাংশার অথচ কে বুঝবে ওর ভাষা? কী করে বোঝাবে মেয়েটাকে কেমনভাবে উদ্ধার করে এনেছে সাংশা।
দেবীকে ঝুপড়ির ভেতরের ঘরে রেখেছে সাংশা,ঘরের ভেতরেই এক কোণে বাথরুম করে দিয়েছে। ছেলেটাকে দেখে অবাক লাগে দেবীর কত ধৈর্য্য আর বুদ্ধি ছেলেটার। আজকাল আর দেবী চিৎকার করে না,নিজের ভাগ্যের দুর্দশায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। শুধু আশাতে দিন গোণে নিশ্চয় একদিন সম্রাট ওকে নিয়ে যাবে এসে। ও যখন আছে তখন সম্রাটও আছে। হয়ত ওকে অনেক খুঁজেও পায়নি তাই বাড়িতে ফিরে গেছে।
সাংশাকে ইশারায় বোঝায় একটা কাগজ আর কলম দিতে,সে চিঠি লিখবে। প্রথমে বুঝতে পারে না সাংশা তারপর ইশারায় বলে এনে দেবে সামনের সপ্তাহে শহরে গিয়ে।
হঠাৎই একদিন সন্ধ্যেবেলাতে জোরে জোরে কড়া নাড়লো কে যেন। সকালের দিকটা বেশিরভাগ সাংশা বাইরে থাকত,এদিকে তেমন কেউ আসে না। কখনও কেউ এলেও কোন লাভ ছিল না কারণ ওর মুখে কোন কথা নেই। তবে হঠাৎ এখন কে কড়া নাড়ছে?
ইশারায় চুপ করে বসতে বলে দেবীকে তারপর ভেতরের ঘরের চটের পর্দা ফেলে দিয়ে বাইরে আসে,ওপার থেকে মায়ের গলা শুনতে পায়...
দরজা খুলে দেয় সাংশা কিন্তু বুকটা ঢিপঢিপ করে কেমন যেন। এতদিন ধরে মেয়েটাকে ঘরে রেখেছে এখন মা এসে কী বলবে?
সাংশা যা ভেবেছিল তাই হল দেবীকে দেখে সাংশার মা হৈ হৈ করে উঠল। ছেলেকে গালি দিতে লাগল,ছিঃ ছিঃ যেই দেখেছে মা নেই অমনি কোথা থেকে ছুকরিকে এনে ঘরে ঢুকিয়েছে! কোথায় পেয়েছে একে?
দেবী এক কোণে কাঁটা হয়ে বসে থাকে,সাংশার মা পারলে অন্ধকারে এখনি তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দেয়। মায়ের হাতে পায়ে ধরে কোনরকম করে ঠান্ডা করে সাংশা। মহিলা ছুটে গিয়ে দেবীর চুলের মুঠি ধরে বলে ওঠে ডাইন নিশ্চয় মেয়েটা,না হলে এখানে কোথা থেকে এল? এই এতদিন ধরে ছেলের রক্ত খেয়েছে। কালই মুখিয়াকে ডাকবে,বিচার হবে মেয়েটার।
দেবী মাথা নেড়ে চিৎকার করতে থাকে," আমি ডাইন নই,আমার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। তোমার ছেলে কথা বলতে পারে না, ও বুঝতে পারছে না কিছু। তুমি আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দাও। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি আমার বাড়ি থেকে লোক এসে আমাকে নিয়ে যাবে। টাকা পাবে তোমরা।"
টাকার কথা হঠাৎই সাংশার মায়ের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে,ছুকরি যদি ঠিক বলে তো রূপিয়া মিলবে। তাহলে তো ভালো হবে। চেঁচামেচি করলেও মাথা ঠান্ডা করে একটু বাদে। তবে কাউকে কিছু বলা যাবে না এখন,দেখা যাক কী হয়...
দেবীর লেখা চিঠি কলকাতা পৌঁছতেই হঠাৎই প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন ওর মা বাবা। মেয়ে বলেছে কাউকে কিছু না জানাতে। পুলিশ জানতে পারলে যদি ওদের ওপর অত্যাচার করে? না না তা যেন না হয়,বোবা ছেলেটা দেবীর প্রাণ বাঁচিয়েছে তার যেন কোন ক্ষতি না হয়। তবে এই চিঠি যদি ঠিক না হয়? এর পেছনে কোন অসৎ লোক নেই তো? অনেক চিন্তা তাদের গ্ৰাস করলেও স্বামী স্ত্রী বেশ কিছু টাকা নিয়ে এসেছিলেন।
ভাইপোর বন্ধু যে পুলিশ অফিসার অগত্যা তার সাহায্য নিয়েছিলেন,বারবারই বলেছিলেন যে পরিবার তাদের মেয়েকে বাঁচিয়েছে তাদের যেন কোন ক্ষতি না হয়।
সবার নজর বাঁচিয়ে কিভাবে যে মেয়েকে উদ্ধার করে এনেছিলেন তা তাঁরাই জানেন। তবে সাথে পুলিশ না থাকলে রাতের অন্ধকারে মেয়েকে নিয়ে আসা মুশকিল ছিল। দেবীকে দেখে চমকে উঠেছিলেন ওরা,এ কী চেহারা হয়েছে মেয়েটার! কতদিন যেন খায়নি। পরনে একটা লুঙ্গি মত পোশাক জড়ানো।
হঠাৎই অবাক হয়েছিলেন দেখে যে আসার সময় মেয়েটা বোবা ছেলেটাকে ধরে অঝোরে কাঁদলো,ছেলেটার মুখ দিয়ে একটা গোঙানো আওয়াজ বেরোলো। ওর মা হাতে টাকা নিয়ে ছেলেকে টেনে ধরে ঘরের দিকে রওনা দিল। বারবারই পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল ছেলেটা,দেবী হাত নাড়ছিল বলছিল বন্ধু ভালো থেকো।
পুলিশ অফিসার বলছিলেন," এতগুলো টাকা না দিলেই পারতেন ওদের,এটা ঠিক হল না।"
-" টাকাটা খুশি হয়েই দিলাম,এটা দেবীর ইচ্ছে। ও লিখেছিল খুব গরীব ওরা। খেতে পায় না ভালো করে। তারমধ্যে আমাদের মেয়েকে রেখেছে এতদিন। সারিয়ে তুলেছে একটু একটু করে।"
১৬
দেবীকে নিয়ে ফ্লাইটে করে ফিরে এসেছিল ওরা। তখন আস্তে আস্তে হাঁটতে পারে দেবী। সাংশার যত্নে পায়ে জোর এসেছে,হাতটাও অনেকটা ভালো। তবে বাড়িতে এসে যখন শুনেছিল সম্রাট আর নেই,মানে কোনদিনই ফিরবে না তখন আর সেই ধাক্কাটা নিতে পারেনি। আবার একটা ট্রমা ওকে গিলে খেয়েছিল। চোখ বুজলেই দেখত অ্যাক্সিডেন্টটা, সম্রাটের থাকা না থাকা আরও কত কী ভাসত চোখের সামনে। বাড়িতে ফিরিয়ে এনেও প্রায় তিনমাস লেগেছিল মেয়েকে অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে স্বাভাবিক করতে। তাও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি দেবী,কখনও ঘুমের ঘোরে সে সম্রাটকে খুঁজত আবার কখনও বন্ধু বলে চিৎকার করে ডাকত।
একটা সময় বাধ্য হয়ে হসপিটালে ভর্তি করতেও হয়েছিল আর তখনি ধরা পড়েছিল দেবী মা হতে চলেছে আর ততদিনে প্রায় তিনমাস পেরিয়ে গেছে।
মাথা কপাল চাপড়েছিল ওর বাবা মা। কী হবে এখন? অসুস্থ মেয়ের গালে থাপ্পড় বসিয়েছিল ওর মা," বল কোথা থেকে নিয়ে এসেছিস একে? এটা কী সম্রাটের না ঐ ছেলেটার?"
চুপ করেছিল দেবী কোন উত্তর দেয়নি। ভালো লাগেনি কিছু বলতে,সম্রাট ওকে ছুঁয়েছিল আদর করেছিল রাতভোর। আর সাংশা? না না সাংশা ওকে ছুঁত,জামাকাপড় ছাড়িয়ে দিত। কিন্তু কখনও ওর কাছে সেভাবে অন্ততঃ ওর মনে পড়ে না। তেমন কিছু কখনও করেনি বন্ধু...
না না মা যা বলছে তা হতে পারে না। বাড়িতে তখন তুমুল অশান্তি,নির্বাক হয়ে গেছে দেবী। ওর মা বলছিল," সম্রাটের বাবা তো এত অপমান করে গেছে আমাদের। এবার বল যে তার ছেলে কী করে গেছে হাল আমাদের মেয়ের? এই মেয়েকে নিয়ে এখন আমরা কী করব?"
-" চুপ কর,আর কেলেঙ্কারি বাড়িয়ো না। এমনিতেই হসপিটালে কিছু লোক জানাজানি হয়ে গেছে। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি সামনের সপ্তাহেই বাচ্চাটাকে..."
-" না বাবা ওকে মেরো না,ও আমার শুধু আমার। আমি কিছুতেই ওকে মারতে দেব না।"
-" পাগলের মত কথা বলিস না দেবী,শুধু আমার বলে কিছু হয় না। কার সর্বনাশের গল্প এটা বল? আমি সম্রাটের বাবাকে গিয়ে বলব। খুব অত্যাচার করেছে আমাদের আর কুকথা বলে গেছে এই কদিন।"
দেবী কোন উত্তর দেয়নি,ডাক্তারের কাছেও যায়নি। একটা সময় ওর মা মরিয়া হয়ে উঠেছিল..."ডাক্তারের কাছে তোকে যেতেই হবে,কী পরিচয় দিবি ওর শুনি? কে ওর বাবা বল? চুপ করে থাকবি না... ছিঃ ছিঃ আমি তো ভাবতেই পারছি না বেড়াতে গিয়ে এত কেলেঙ্কারি করবি। ইশ্ সেই ছেলেটাও কিছু করেছে নাকি তোকে? বলতেই হবে তোকে..."
দেবী তখন পাগলের মত হেসেছিল," যা খুশি তোমরা বল আমি কিছু বলব না। আমাকে বরং বিষ দাও আমি মরে যাব।"
বাবা এসে ওর মাথায় হাত রেখে মাকে বকেছিলেন," তুমি কী পাগল হলে? কী শুরু করেছ? আচ্ছা দাঁড়াও আমি দেখছি।"
একটা সময় সবার অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেবী সাংশার কাছে চলে যেতে চেয়েছিল," বাচ্চাটাকে নিয়ে যখন তোমাদের এত সমস্যা,আমাকে এত সন্দেহ তো ঐ বোবা ছেলেটার সাথেই আমার বিয়ে দিয়ে দাও। আমি ওর সাথেই থাকব। ও আমাকে এত বিষ ঢালবে না তোমাদের সবার মত। খুব যত্ন করত আমাকে। ওর জন্যই তো বেঁচে আছি।"
এত বছর বাদেও দেবীর হাসি পায়,বাবা একটা সময় সাংশার খোঁজেও লোক পাঠিয়েছিলেন। যদি ছেলেটা রাজি থাকে তাহলে টাকা পয়সার বিনিময়ে ওর সাথেই মেয়ের বিয়ে দেবেন। তবুও তো বাচ্চাটা পিতৃপরিচয় নিয়ে বড় হবে। কিন্তু যাকে পাঠিয়েছিলেন সে কোন হদিশ পায়নি ওদের। খবর এনেছিল ওরা বেশ অনেকদিন আগে সিকিমে না নেপালে কোথায় যেন চলে গেছে মা আর ছেলে। এতগুলো বছর পর আবার সেই বোবা বন্ধুর কথা বেশি করে মনে পড়ল দেবীর। সম্রাটকে সে যেমন ভোলেনি তেমনি বোবা ছেলেটার যত্নও ভোলেনি। এখনও পথের ধারে কোন বোবা মানুষ দেখলে থমকে দাঁড়ায়।
সবার সব কটুকথা আর অপমান হজম করেই কুইনের জন্ম দিয়েছিল দেবী। মাকে বলেছিল বিশ্বাস কর এ সম্রাটেরই মেয়ে,কিন্তু সম্রাটের বাড়ির কেউই দেবী বা কুইনকে মেনে নেয়নি। ওর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ওদের অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন... "কী বলছেন আপনারা! ঐ নষ্ট চরিত্রের মেয়ের জন্য আমাদের বাড়ির ছেলে আজ নেই। শুনেছি তো একমাস বাদে ফিরেছে,কতজনের সাথে শুয়েছে ঠিক নেই.. ঐ পাপ বাচ্চার নামও নেবেন না এখানে।"
পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে বাচ্চার জন্ম দিয়ে দেবী নিজে যেমন কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়েছিল তেমনি পিতৃপরিচয় হীন কুইন লাঞ্ছিত হয়েছে প্রতি মুহূর্তে। আর সেই লজ্জাই একটা সময় তাকে করে তুলেছিল উদ্ধত। কুইন সম্রাটের মতই অনেকটা,নিজের যা চাই তা হাসিল করেই ছাড়ে। ওর জেদের কাছে দেবীকে মাথা নোয়াতেই হয় যেমন অনেক বছর আগে সম্রাটের জেদে নিজেকে...
কুইন বলে কথায় কথায়," নাম তোমার দেবাঙ্গী হা হা হা, দেবীর কোন গুণই তোমার মধ্যে নেই,তুমি একটা ভীতু পার্সোনালিটি লেস মানবী।"
মেয়ের কথা শুনে মাঝে মাঝে মনে হয় আর কত সইতে হবে কে জানে? হয়ত এ তারই মা বাবার দীর্ঘশ্বাস আর অপমান সওয়ার ফল। মেয়ে হয়ে মা বাবার মুখ উজ্জ্বল না করে কলঙ্কের কালি মাখিয়ে দিয়েছিল তাদের মুখে। নিজের হঠকারিতার ফল তো ভুগতেই হবে। সম্রাট থাকলেও কী মেনে নিত ওর হঠাৎ মা হওয়াকে? এখনি ওকে বিয়ে করত? কে জানে?
যাক মা ঠিকমত পৌঁছে গেছে,অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগে কুইনের। আর একটা দিন বাদেই ওর ক্লাশ শুরু হবে। এরমধ্যে একটু চারপাশটা দেখে চিনে নেওয়া। ওর রুমমেট এখনও আসেনি। এখানে দুজনের শেয়ারিং রুম,ক্যাম্পাসের চারপাশটা বেশ প্রেম প্রেম। বিকেলে একটু ঘুরতে বেরিয়েছিল কুইন চারপাশটা,দেখল জুটি বেঁধে ছেলেমেয়েরা ঘুরেফিরে প্রেম করছে। শালবাগানের আসেপাশে বেশ কয়েকজন বসে গল্পে মশগুল। কেউ আবার সাইকেলে বান্ধবীকে নিয়ে বিকেলের প্রেমে ব্যস্ত। কুইনকে দেখে অনেকেই আবার একবার তাকিয়ে দেখে। নিজেকে মেলে ধরতে পেরে ভালো লাগে কুইনের মনে মনে বলে দেখো,দেখো যতখুশি। তোমাদের মত কেবলু সিংদের কোন ঠাঁই নেই আমার মনে। শুধু একটু নাচবে চারপাশে তারপর ল্যাং খেয়ে ধপাস করে পড়বে।
যেমন ঐ বোকা জোহানটা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। হ্যাঁ এটা ঠিক যে ছেলেটা প্রচন্ড সৎ,সাহসী আর তেমনি বুদ্ধিমান। কিছুটা ভাবল জোহানের কথা আবার কুইন না না সাহসী কী করে বলবে? কই কোনদিনই তো ওর সামনে এসে বলেনি সম্রাজ্ঞী তোকে আমি ভালোবাসি। কত নোটসের খাতাই তো ওকে দিয়েছে তার মধ্যেও তো কোন প্রেমপত্র মানে লাভ লেটার দেয়নি। মাকে মাঝেমধ্যে মুড ভালো থাকলে বলত আচ্ছা মা যদি ধর তোমার প্রেমিক সম্রাটই আমার বাবা হয় তাহলে তোমাদের লাভ স্টোরি কেমন ছিল বল না। আমার বাবার স্বভাব কেমন ছিল? তার সাথে আমার মিল আছে কিনা সব জানতে ইচ্ছে করে।
প্রথমদিকে কুয়াশার মত আবছা ঘোমটাতে অতীতকে ঢাকলেও একটু একটু করে বন্ধুর মত বলেছিল মেয়েকে সবটাই। শুনে হঠাৎই মেয়ের রাগে মুখ লাল হয়ে গেছিল," নিজেকে এত সস্তা করে তুললে তুমি মা? আর ঐ সম্রাটকে বিশ্বাস করে বিয়ের আগেই সব দিয়ে দিলে? যদি বেঁচে থাকতেও সে তোমাকে বিয়ে না করত!"
-" ও আমাকে খুব ভালোবাসত কুইন.. তাই তো ওর জেদে সায় দিয়েছিলাম। ও যে তোর মতই জেদী.."
-" মা ছাড়ো,তোমার ইচ্ছেও ছিল। আর সেই ভোগান্তি আমি ভুগছি।"
মেজাজ হারিয়েছিল দেবী," তাই তো তোদের কাউকে আমি কৈফিয়ৎ দিই না। জানি তো কেউ আমাকে বিশ্বাস করিস না।"
-" মা চুপ কর, ঐ বাড়ির বুড়োটাকে আমি দেখে নেব দাঁড়াও। আর ঐ বুড়িটাকে তো..."
-" চুপ কর,আর ঝামেলা বাড়াস না। ওদের সাথে সম্পর্ক নেই আমাদের। যাকে নিয়ে সম্পর্ক সেই তো নেই।"
-" আর আমি? আমার তো সম্পর্ক আছে ঐ বুড়োটার সাথে। আমার বাপেরও বাপ বলে কথা। তাকে মাফ করলে হবে?"
-" ছিঃ দিদিভাই,তোমার দিকে চেয়ে আমরা বেঁচে আছি। কোন হঠকারিতা করবে না একদম।"
-" ইচ্ছে করে বোম মেরে উড়িয়ে দিই বাড়িটা।"
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করেছিল দেবী।
মায়ের তবুও একটা লাভ স্টোরি ছিল মানে বিরাট বড় থ্রিলিং স্টোরি। আর ওর জীবনে এখনও কোন গল্পই নেই। কয়েকটা ছেলে সারাক্ষণ ফেউ ফেউ করছে, কুইন কুইন করে মরছে। ব্যাস গল্প শেষ এখানেই। আরে ওর কাউকে পছন্দই তো হয় না। কুইনের পছন্দ এমন কেউ যে ওর বাবার মত হবে,অনেক বলে মায়ের কাছে বাবার কয়েকটা পুরোনো ছবি দেখেছিল। আয়নাতে নিজেকে দেখেছে ছবিটাকে পাশে রেখে,বারবারই মিল খুঁজতে চেয়েছে। একটা সময় বিরক্ত হয়েছে ধ্যাৎ এতটুকু একটা ছবিতে কিছু বোঝা যায় নাকি? তারপর একদিন স্টুডিয়োতে দিয়ে বড় করে এনেছিল ছবিটা। মা সেদিন খুব কেঁদেছিল ছবিটা জড়িয়ে। নিজেকে লুকিয়েছে কুইন তারপর মায়ের মাথায় হাত রেখে বলেছে," কেঁদে নাও বোকা মা আমার যত খুশি পুরোনো প্রেমিককে জড়িয়ে।"
কুইনের তেমন কোন কাঁদার জায়গা নেই,অবশ্য ও কাঁদতেও চায় না। অত ইমোশন ওর আসে না। একটা সময় চোখে জল ছিল এখন আর সেই জল ঝরে না চোখ বেয়ে। জল গিলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে জীবন তরী বাইতে বাইতে। জোহান ওর কাছে আসতে চেয়েছিল কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েছিল স্টেশনে, একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে। গায়ে পড়া ছেলেটাকে সত্যি অসহ্য লাগত,তার ওপর অনাথের তকমা আছে আর গায়ের রঙ সেই কালো কুচকুচে,ইশ্!
১৭
কুইনের ক্লাশ শুরু হবে আগামীকাল,গতকাল ওর রুমমেট মেধা এসেছে। কুইন একঝলক দেখে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল..."হাই আমি সম্রাজ্ঞী,একটু আগেই এসে পড়েছি তোর থেকে। তুই করেই বললাম কিন্তু। তোর নাম? কী সাবজেক্ট?"
মেয়েটা হেসেছিল ওর গজদাঁত দুটো উঁকি মেরেছিল হাসির ঝলকে..." আমি মেধা,ইতিহাসের। তুই?"
-" আমি ফিজিক্স।"
-" ওহ্ হাইফাই ব্যাপার তাহলে,মানে সায়েন্স। আমি আবার খুব কাঁচা সায়েন্সে।"
কুইন ওকে হাল্কা করে বন্ধুত্বের হাসিতে," কোন চাপ নেই,আমি আবার ইতিহাসে খুব কাঁচা। মাধ্যমিকে অনেক কষ্টে ষাট তুলেছিলাম। ছাড় ওসব কথা,নে এখন থেকে ভাগাভাগি করে দিন শুরু। ঘরে তো এদিক ওদিক মিলিয়ে দুটো জানলা। আমি এদিকেরটা নিয়েছি। তোর আপত্তি আছে? তাহলে ছেড়ে দিতে পারি।"
-" কোন আপত্তি নেই,আমি দেওয়ালের দিকেই শোব বাবা,আমার আবার একটু ভয় বেশি।"
-" কিসের ভয়?"
-" না না জানলায় যদি কেউ টোকা মারে,বা উঁকি দেয়।"
-" কে টোকা মারবে এই দোতলার ছাদে? ভূত?"
-" মানুষও হতে পারে,এখানকার ছেলেগুলো কিন্তু পাজি।"
কুইন হো হো করে হাসে," ওমা তাই নাকি? তাহলে তো ভালোই হবে। আমিও এপাশ থেকে একটা লাঠি দিয়ে খোঁচা মারব। তা এত খবর কে দিল শুনি?"
-" আমার মাসতুতো দিদি পড়ত তো,দিদির কাছেই শুনেছি। তুই খুব দুষ্টু তো। আর একটা কথা বলব,তুই কিন্তু খুব সুন্দরী... মানে এমন সুন্দরী খুব একটা দেখা যায় না। আমি তো তখন থেকে দেখেই যাচ্ছি,ঠিক যেন হিরোইন।"
-" হ্যাঁ সবাই বলে রে,আর এত দুঃখের কথা যে এখনও কোন পরিচালকের নজরে পড়লাম না..."
-" তোর বাড়ি কোথায়? আমি তো কাছেই থাকি মানে আলিপুরদুয়ার। তাই একটু পরেই এলাম।"
-" আমি কলকাতা থেকে এসেছি।"
-" কলকাতা ছেড়ে এখানে এলি? কত ভালো ইউনিভার্সিটি ওখানে। আমার দাদাই তো যাদবপুরে পড়ে।"
প্রসঙ্গটা ভালো লাগল না কুইনের,এই হচ্ছে মেয়েদের বদ অভ্যেস একটু আলাপ জমলেই বাড়ি,হাড়ি সবেই উঁকিঝুঁকি মারতে চায়। সোজাসাপটা উত্তর দেয় কুইন- " না ওখানে সুযোগ হয়নি,এখানে পেলাম তাই চলে এলাম। তাছাড়া নর্থবেঙ্গল আমাকে খুব টানে তাই।"
-" তোর মা মনখারাপ করল না? আমার মা তো চিন্তাতেই অস্থির। দাদা থাকে না,তাই আমি চলে আসায় খুব মনখারাপ।"
কুইনের বোরিং লাগে আলোচনাটা তাই পাশ কাটিয়ে বলে," হ্যাঁ খারাপ তো লাগেই,তবে পড়াশোনা করতে চাইলে তো থাকতেই হবে। নে নে সব গুছিয়ে নে। তুই গল্প করতে ভালোবাসিস দেখছি। ওকে পরে কথা হবে। আমি একটু বেরোব বাজারের দিকে। তুই গুছিয়ে নে ততক্ষণ।"
বাইরের খোলা হাওয়ায় এসে ভালো লাগে কুইনের। মাকে ফোন করে জানায় সব ঠিক আছে,ওর রুমমেট চলে এসেছে। দেখে ভালোই মনে হচ্ছে কিন্তু ইতিহাসের মেয়ে তাই একটু পাতিহাঁসের মত প্যাঁক প্যাঁক করে।
দেবী ফোনে ধমকায়," ছিঃ কুইন,বন্ধুকে এমন কেউ বলে নাকি? ওর সাথে মিলেমিশে থাকবি।"
-" একসাথে থাকব ব্যাস তুমি তো জান আমার বেশি মিলমিশ হয় না কারও সাথে। তাই যদি হত তবে কলকাতা ছেড়ে আসতাম না। একা একা নিজের হাত ধরে আর পিঠ চাপড়েই তো বেঁচেছি।"
দেবী অভিমানের জালটা কাটতে চায় টুকরো কথা বলে। টুকটাক কথা বলে ফোন ছেড়ে দেয় কুইন। তারপর এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় নিজের মত। দেখা যাক একটা সাইকেল যদি কিনে ফেলা যায় তাহলে বেশ খেয়াল খুশিতে ঘুরে বেড়ানো যাবে চারধার। এত হাঁটা আর পোষায় না।
হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পাসের একদম শেষ মাথাতে এসে গেছে কুইন। এখন অনেকটা পথ যেতে হবে,ভেবেছিল একটু বাজারের দিকে যাবে। কিন্তু নেচারকে এক্সপ্লোর করতে গিয়ে বেশ দেরি করে ফেলেছে। এখানে কিছু নিয়ম কানুন আছে মানে একটা সময়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। অনেককেই গতকাল দেখেছে খাঁচার ভেতরে দাঁড়িয়ে বয়ফ্রেন্ডের সাথে গল্প করতে। প্রেম বিষম জ্বালার বস্তু তাই একবার প্রেমে পড়লে আর রক্ষা নেই। মানুষের তখন বোধহয় আর বাস্তববুদ্ধি বলে কিছু থাকে না,যেমন ওর মা...
নাহ্ এবার ফিরতে হবে,সূর্যমামা মোটামুটি টা টা বলেছে কিছুটা আগে। পুরো অন্ধকার না নামলেও আবছা হয়েছে দিনের আলো।
কুইন দ্রুত পা চালায়,হঠাৎই পেছনে একটা হর্ন শুনতে পায় কুইন একটু সরে রাস্তা দেয়। তবুও আবার বাজে হর্নটা,বিরক্ত হয় কুইন। ক্যাম্পাসের মধ্যে আবার এসব কী? ইচ্ছে না থাকলেও পেছন ফেরে...
-" আমি তো রাস্তা ছেড়ে দিয়েছি,আবার কেন?"
-" আবার যখন হর্ন দিচ্ছি তখন নিশ্চয় দরকার আছে,উঠে আয় পেছনে। নিউ হস্টেলটাতে এসেছিল তো? ফিজিক্স পার্ট ওয়ান?"
কুইন স্মার্ট সুতরাং পিছপা হয়নি বলেছিল,"গোয়েন্দা নাকি? মগজাস্ত্র তো ভালোই চলে দেখছি। তবে আমার এত খোঁজ খবর জোগাড় করে লাভ নেই।"
-" কী লাভ আছে পরে শুনবি,এখন উঠে আয়। সন্ধ্যে পড়ছে, কাছাকাছি হুক্কাহুয়া আছে কিছু। সাপখোপও থাকতে পারে। তোকে পৌঁছে দিচ্ছি।"
কুইন আর কোন কথা না বলে উঠে বসেছিল বাইকের পেছনে। যাক ভালোই হয়েছে বাহনে চেপে ধা করে পৌঁছে যাবে হস্টেলে। নাকি ওকে বলবে বাজারে ছেড়ে দিতে? মায়ের সাথে বেরিয়ে দেখেছিল এক জায়গাতে দারুণ ডেভিল বানায়। উঃ ওটা মনে হতেই আবার জিভে জল এল।
না না থাক অত লোভে কাজ নেই,আজ বরং ডেভিল থাক। এখন দেখা যাক যে সাধ করে বাইকে লিফ্ট দিল আর এই এক দুইদিনে ওর নারী নক্ষত্র জেনেছে সে কোন ডেভিল?
অন্ধকারে তো মুখই ভালো করে দেখতে পায়নি শুধু দাড়িটা চোখে পড়েছে। দেখতে হবে ভালো করে মাল...নিজেকে সামলায় কুইন মানে ছেলেটাকে।
ততক্ষণে বাইক এসে হস্টেলের গেটে দাঁড়িয়েছে। তখনও বেশ কিছু ছেলেমেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে। কেউ বা বারান্দায় বসে। কুইনকে নামিয়ে একটা হিপ হিপ হুররে টাইপের আওয়াজ করে ছেলেটা...ওদিক থেকে আওয়াজ আসে সাবাশ...
কুইনের হঠাৎই মাথাটা গরম হয়ে যায়,গটগট করছ ছেলেটার সামনে দাঁড়িয়ে ভালো করে মুখটা দেখে। তারপর বলে," এত চিৎকারের কী হল? আর সাবাশের বা কী শুনি? কে রে তুই?"
১৮
-" আর একদম বাড়াবাড়ি না, এবার মুখ সামলে নে,আমি সিনিয়ার তাই তুই তোকারী করিস না। তুমি বলতে পারিস। আসলে ক্যাম্পাসে সুন্দরী মেয়ে এসেছে আর আমি তাকে লিফ্ট দেব না তাই হয়? ওরা বলেছিল তুই আমার বাইকে উঠবি না। মানে আমাকে পাত্তা দিবি না। তাই বাজি ধরেছিলাম। ব্যাস হেরে গেল ওরা। দশমিনিটে দেখালাম রকি কী পারে।"
ওদিকে তখন হাসির বাঁধ ভেঙেছে,তাতে যোগ দিয়েছে কিছু নেকু সিনিয়ার দিদিও।
কুইন রাগ দেখায় না,বলে," ইশ্ আগে বলবেন তো মিঃ রকি দাদা তাহলে তো আপনার কোমর জড়িয়ে একদম নামতাম। আপনার আরও বেশি জিত হত। ওকে বাই পরে দেখা হবে।"
-'' দুর্দান্ত সুন্দরী শুধু নয়,দেখেছিস কথাও দারুণ বলে। যাক একদিন নিয়ে যাব ঠিক তোকে পাহাড়ের পথে..." কুইনের যাবার পথের দিকে তাকায় রকি।
একটা ঘটনাতেই কুইনকে সবাই চিনে গেছিল ক্লাস শুরু হবার আগেই। মেধার কানেও এসেছিল কথাটা ও রুমে ঢোকার আগেই। ও বলেছিল," আরে তুই তো দারুণ সাহসী! প্রথমে এসেই তো ছক্কা মারলি।"
কুইনের মাথাটা গরম ছিল," এখানে তো খবর হাওয়ার থেকেও দ্রুত ওড়ে রে,এরমধ্যেই দোতলায় পৌঁছে গেল?"
কুইনের মুড অফ বুঝতে পারে মেধা তাই একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে," রাগ করিস না,আমি বারান্দায় ছিলাম তখন আমাদের ওখানকার এক সিনিয়ার দিদি বলল তোর কথা।"
-" তা কী বলল শুনি?"
-" না বলল যে তুই খুব সাহসী,রকিদা তো নাকি খুব বেয়ারা টাইপের। আসলে বড়লোকের ছেলে তো আবার নাকি এখন জি এস।"
-" বাহ বাহ তুই তো ঘরে বসেই অনেক খবর জেনে গেছিস। এইজন্য ইতিহাসের বিস্তার এত। আমি ছেলেটাকে ফর্মূলাতে ফেলেও কিছু করতে পারলাম না।"
অল্প কিছুটা সময়ের আলাপ তবুও মেয়েটাকে যেন কিছুটা চিনতে পেরেছে মেধা। বেশ মেজাজী আর উদ্ধত। যাক যা পারে করুক গে।
হস্টেলের খাওয়াদাওয়াটা খুবই খারাপ লাগে কুইনের,মা অবশ্য শুকনো কিছু খাবারদাবার কিনে দিয়ে গেছে। সুতরাং ভালো না লাগলে সেগুলো ভরসা আর ভরসা বাইরের খাবার।
অনেকদিন বাদে এই পথে পা রেখেছে জোহান,আর কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যাবে ও বাইরে। কুইনের মত ছাড়তে হবে তাকেও এই শহর। অবশ্য পরিচিত জায়গাতে নানা প্রশ্নের ভিড়ে না থাকাই ভালো। নিজেকেও বারবার প্রশ্ন করেছে বি এস সি করে আবার ডাক্তারী পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কী ঠিক করছে? অনেকটা পিছিয়ে যাওয়া হয়ত পেছনের দিকে। তবুও বারবারই মায়ের কথাগুলো কানে বেজেছে। আর তখনি আবার নিজেকে বুঝিয়েছে মায়ের কথা ভেবে।
ছাদে কাপড় মেলছিল দেবী,নীচে বেল বাজার শব্দ পেয়ে কাপড়গুলো কোনরকমে ছড়িয়ে নেমে আসে। ওদের সহকারী দিদিও নেই এখন তাই ওকেই যেতে হবে।
দরজা খুলে অবাক হয়ে যায় দেবী,তারপর হাসিমুখে বলে," ও তুই! আয় আয় ভেতরে আয়। আন্টি আর গ্ৰ্যানিকে তো ভুলেই গেছিস।"
জোহানকে সেদিন দেখেছিল দেবী কিন্তু ভুলেও সেই কথা বলে না। বললে কী ভাববে ছেলেটা? খুবই খারাপ লাগছিল ছেলেটার জন্য।
আমতা আমতা করে জোহান বলে," আমি চলে যাচ্ছি আন্টি তাই একবার গ্ৰ্যানিকে দেখতে এলাম।"
-" হ্যাঁ আয়,মা তোকে দেখে খুশী হবে। তা কোথায় যাচ্ছিস আবার? তোর তো খুবই ভালো রেজাল্ট।"
নিজের ডাক্তারী পড়তে যাবার কথাটা দেবীকে বলে জোহান,খুবই খুশি হয় দেবী," বাহ্ খুব ভালো, তুই ডাক্তারী পড়বি? আমার খুব আনন্দ হল জেনে।"
-" কী জানি ঠিক করছি কিনা.. তবুও ভাবছি পড়ব। আর আমার জীবনে পড়াশোনা ছাড়া আর আছেই বা কী? আচ্ছা কুইন কী?..."
-" আর বলিস না,নিশ্চয় তোকেও বলেনি তাই না? মেয়ে জেদ করে চলে গেল নর্থবেঙ্গল। আমি তো গেছিলাম সাথে। আমি পারি নাকি এত? এরপর নিজেই আসবে যাবে। বলে কিনা ওখানেই থেকে যাবে,ইচ্ছে হলে আসবে নাহলে নয়। কী পাগলের মত কথা তাই না?"
জোহানের চোখটা উদাস হয়ে ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা খায় যেখানে কুইনের ছবিটা ওর দিকে তাকিয়ে হাসে আর বলে, বোকুরামের মত কথা বলিস না, কিছুই তো শিখলি না। এখনও ভালো করে কথাই বলতে শিখলি না।"
দেবী মাকে নিয়ে ঘরে আসে, ওর হাতে খাবারের প্লেট। জোহান গ্ৰ্যানিকে দেখে খুশি হয়,এই পরিবারের ছোঁয়া পেতেই মাঝেমাঝে চলে এসেছে এই বাড়িতে। দেবীর মা ওকে বলেন," বুড়ি গ্ৰ্যানিকে ভুলে যাস না জোহান,তোর হাতের ওষুধ খেয়ে তবেই মরবে এই বুড়ি।"
ঘরের থমকে যাওয়া ভারী বাতাসটা আবার হাল্কা হয়ে বইতে শুরু করে। দেবীর মত জোহানও কিছু বলে না যে সে সেদিন স্টেশনে গেছিল। শুধু জেনে নেয় কুইন কোথায় আছে।
-" একবার গিয়ে ঘুরে আসিস কোন ছুটিতে,তোর বন্ধুকে দেখে আসিস। ওদের ক্যাম্পাসটা খুব সুন্দর। আর ওর নং আছে তো তোর কাছে। ফোন করিস..."
জোহান মাথা নেড়ে হেসে চলে এসেছিল। ও ভালো করেই জানত যে ওর সাথে ফোনে কথা বলতে বা দেখা করতে কোনটাতেই কোন আগ্ৰহ নেই কুইনের।
দেবী ছেলেটার চলে যাওয়া দেখলো বহুক্ষণ,ঠিক যেন মনে হল আর হয়ত কোনদিনই আসবে না ছেলেটা। তবু যতদিন কাছে ছিল কুইনের বন্ধু হিসেবেই বিপদে আপদে কাছে পেয়েছে ওকে। সময়ের সাথে সাথে ক্ষয়ে যায় স্মৃতি,মানসপটে আসে কত মুখ। একটা সময় তাদের সাথে বিচরণ করতে করতেই আড়ালে চলে যায় পরিচিত মুখ। কুইন কোনদিনই ছেলেটাকে বুঝবে না,ওর জীবনে এমন কেউ আসুক যে ওকে বুঝবে। বড় একা ছেলেটা।
******************
কয়েকটা জামাকাপড় এনে বিছানায় ফেলে কুইন,আজ কী পরে যাবে ভাবছে। ওর রুমমেট মেধা বেশ চটপটে,এই হস্টেলে ওর বেশ কিছু পরিচিত বন্ধুবান্ধব আছে। তাদের সাথেই সকাল থেকে ঘুরু ঘুরু করে বেড়াচ্ছে হস্টেলের এ ঘর থেকে ও ঘর। কুইনের তেমন কেউই পরিচিত নয়। দুদিনে কথা হয়েছে অনেকেরই সাথে তবে কাউকে এখনও তেমন করে কাছের বলে মনে হয়নি। অনেকেই আবার ওকে টেরিয়ে দেখে কানাকানি করেছে,কেউ বা মেধার মতই জানতে চেয়েছে কলকাতা থেকে এখানে এল কেন? কুইনের বলতে ইচ্ছে হয়েছে,আমার ইচ্ছে তাই এসেছি। কেন নর্থবেঙ্গল কী তোমাদের কেনা নাকি?
অবশ্য বলতে পারেনি, এক কথায় বলে দিয়েছে সুযোগ হয়নি ওখানে। ওর ইচ্ছে উত্তরবঙ্গের সেই জায়গাগুলোতে ও যাবে যেখানে ওর মা বেড়াতে এসেছিল। মাঝে মাঝে মনে হয় ওর বাবা যে লোকটা সে হয়ত বেঁচে আছে,বডিটা হয়ত অন্য কারও ছিল। আর মায়ের সেই সাংশা বন্ধু যে টাকা নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিল। সে কী আবার ফিরে এসেছে ওদের সেই ছোট্ট কুঁড়েঘরটাতে?
সেই চা বাগানের ভেতরে কটেজটা কী আছে এখনও? যদি কোনদিন বিয়ে করে তবে ওখানেই হানিমুনে আসবে ও। মাকে কথাটা একদিন বলতে মা প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলেছিল," ভেবেছিলাম তুই আমার বন্ধু হবি বড় হলে। এখন দেখছি আমাকে অপমান করাই তোর কাজ।"
পুরোনো চিন্তা ফেলে সামনের দিকে তাকায় কুইন,হাঁটতে হাঁটতে প্রায় ওদের ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে গেছে। কেমন যেন একটা উত্তেজনা হয় নতুন সিঁড়িতে পা দিয়ে। জীবনের এক অন্য সিঁড়িতে উত্তরণ,অপরিচিত ছেলেমেয়েদের বন্ধু বানিয়ে আবার কাটানো দুটো বছর।
ক্লাশে বসতেই টুকটাক আলাপ হয়ে যায় কয়েকজনের সাথে। অনেকেই বলে ওকে গ্ল্যামারাস গার্ল, কুইনের গালে লালচে ছোঁয়া লাগে না। ছোট থেকে সুন্দরী কথাটা বহুবার শুনেছে। তার পাশাপাশি শুনেছে সুন্দরী হলে আর কী বাকিটা তো কালি লেপা। এই মেয়ের যে কী হবে ভবিষ্যতে?
-" ওয়েলকাম আমাদের ভবিষ্যত,ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট তোদের স্বাগত জানাচ্ছে। বাই দ্য ওয়ে আমি তোদের সিনিয়ার..."
পুরো কথাটা শেষ হয় না তার আগেই ছেলেমেয়েরা অনেকেই আওয়াজ দেয় রকিদা রকিদা রকিদা।"
রকি তখন কুইনের দিকে তাকিয়ে,কুইনও ওকে দেখছে। লম্বা,ছিপছিপে ফ্যাটফেটে ফর্সা একটা ছেলে। মাথার চুলের কাট বেশ আলাদা তাতে রঙের দাগছোপ। কুইন বুঝতে পারে এই বাঁদর ছেলেটা বেশ জনপ্রিয় ওদের ছাত্রমহলে। আর হবেই না কেন,একেই নেতা তারপর সিনিয়র সুতরাং সবাই তেল মারছে। তবে ও কিছুতেই বেশি পাত্তা দেবে না ওকে যতই সিনিয়ার দাদা হোক আর যেই হোক না কেন।
-" সবাই একটু ছোট্ট ইনট্রো দিয়ে ফেল দেখি,তারপর বাকিটা হবে ফ্রেশার্শে।"
ছেলেমেয়েগুলো বাধ্য হয়ে নিজেদের নাম এবং ধাম বলতে লাগল। কুইন উঠে দাঁড়ায় না,ওকে পাশের মেয়েটা ঠ্যালা মারে," কী রে?"
রকি হাসি মেশানো মুখে ওর দিকে তাকায়.." থাক থাক ওকে আর বলতে হবে না। ওকে আমি চিনি,আর বাকিটা ঠিক চিনে নেব। একই ডিপার্টমেন্ট মোটামুটি কাছাকাছি ক্লাশরুম সবসময়ই তো দেখা হবে।"
১৯
ওকে এত ফেভার দেখানোতে গা পিত্তি জ্বলে যায় কুইনের,কিছু বলে না চুপ করে বসে থাকে।
আসলে এগুলো কিছুই নয়,একধরনের ছোটখাটো র্যাগিং। আজ আবার হস্টেলে সিনিয়ার মেয়েদের সভাতে হাজিরা দিতে হবে। তাদের কী বক্তব্য কে জানে? মা অবশ্য বারবার বলে দিয়েছে," কিছু বলবি না। একদম চুপ করে শুনবি সব কথা। জানিস তো বোবার কোন শত্রু নেই।"
-" ওহ্ জানি তো,তোমার জীবনের মূলমন্ত্র যেটি। মা কোন কোন সময় এমন পরিস্থিতি আসে যখন বোবাকেও কথা বলতে হয়। আমি তোমার মত হতে পারব না। আর আমারটা আমাকে বুঝতে দাও।"
-" যা ভালো বুঝিস তাই কর,হ্যাঁ জোহান এসেছিল কাল।"
-" আমাকে বলছ কেন? আমি কী করব?"
-" না এমনি বলছি,ডাক্তারী পড়তে বাইরে চলে যাচ্ছে।"
-" হঠাৎ এই বুড়োকালে ডাক্তারীতে কেন? এতদিন কী করছিল? সত্যি পাগল যে কত রকমের হয়। ছাড়ছি এখন..."
মায়ের ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল কুইন,কী সব পাবলিক এদের কিছুতেই সুখ নেই। ডাক্তার হয়ে মাথা কিনবে। এতদিন কেন পড়তে যাসনি বাপু? এত কষ্ট করে অঙ্ক আর ফিজিক্স পড়ে কী লাভ হল? যাক গে মরুক গে ওকে নিয়ে ভাবার সময় এখন আর ওর নেই।
এর মধ্যে দুটো ক্লাশ হয়ে গেছে। আজকের ক্লাশে তেমন কোন কিছু নেই। সবটাই মোটামুটি ইনট্রোডাকটরি। স্যারেরা তাদের কথা বললেন,ভালো করে পড়াশোনা করতে বললেন। আর ওদের কথা জানতে চাইলেন।
একটু ব্রেক আছে,বাইরে এসে দাঁড়ায় কুইন বন্ধুদের সাথে। গাছে পাখিরা ছোটাছুটি করছে, হাওয়াতে গাছের পাতাগুলো নড়ছে,তারমধ্যে রকি মস্তান দাদা এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে কলার তুলে। স্যারেদের কমনরুমে তার অবাধ বিচরণ। যখন তখন ঢুকছে বেরোচ্ছে। মাঝেমধ্যে কুইনদের ক্লাশে এসেও উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। আর একটা ফ্লাইং লুক আর লাফিং উইন্ড ছুঁড়ে যাচ্ছে ওর দিকে তাকিয়ে। ওর পাশে বসে থাকা মেয়েদুটো বলে," রকিদা বারবারই ঢুকছে এখানে,তোকে কবে থেকে চেনে? আগে থেকে আলাপ নাকি?
-" না,গতকাল আলাপ হয়েছে।"
-" ওহ্! আর তুই যা সুন্দরী তোকে সবারই নজরে পড়ে। দেখছিস না বুড়ো স্যারেরাও তোকে দশমিনিট ধরে নানা কথা জিজ্ঞেস করল। পিকে স্যার তো বলেই ফেললেন অ্যাপ্রোপ্রিয়েট নেম,তোমাকে দেখলে তো এমনিতেই এমপ্রেস বলবে যে কেউ। তবে এই রাজকন্যের যে কোন রাজপুত্র আসবে..."
হা হা হা করে সবাই উঠেছিল হেসে। স্যার খুব মজা করেন সেটা ওরা বুঝেছিল,কিন্তু এতটা যে তা বোঝেনি। কুইনের একটুও মজা হয়নি বরং রাগ হয়েছিল সবার হাসি দেখে। এখানকার স্যারেরা একটু বেশিই কথা বলেন,মানে অপ্রয়োজনীয় কথা।
তবে কুইনের ধারনা ভুল হল পরবর্তী স্যারকে দেখে যিনি ওদেরকে তেমন কোন পাত্তা না দিয়েই শুরু করলেন বইয়ের প্রথম চ্যাপ্টার আর প্রবলেম সল্ভিং দিয়ে। কুইন অবাক হয়ে গেল,সবাই ওকে দেখেছে কথা বলেছে অথচ এই স্যার কারও সাথেই কোন কথা বলল না? অনেকেই একটু বিরক্ত মানে পড়ার মুডে নেই,তারা সবে বলতে শুরু করেছিল," স্যার আমরা কী নিজেদের ইন্ট্রোডিউস করব?"
ওপাশ থেকে গম্ভীর উত্তর এসেছিল,"নো নট নেসেশারী,আমার পড়ানো কাজ তাই সেটাই শুরু করব। আমি চিনে নেব পড়াতে পড়াতে। অন্য কোন ইন্ট্রোডাকশনের দরকার নেই। সিট ডাউন অ্যান্ড জাস্ট লিশন অ্যান্ড টেক দ্য নোট।"
কুইনের কেমন যেন অপমানিত লেগেছিল,বেশি সিরিয়াস স্যারটা। মানে বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত।
আস্তে আস্তে পাশের মেয়েটাকে কিছু বলতে গেছিল হঠাৎই শোনে," ইউ,ইয়েস দ্যাট সেকেন্ড রো,স্ট্যান্ড আপ। কাম হেয়ার..."
কুইন অবাক হয়নি,ডাকবে না মানে? ডাকতে বাধ্য। কলকাতায় বন্ধুরা বলত তোকে দেখলে মুনী ঋষির ধ্যান ভেঙে যাবে আর এ তো সামান্য মানুষ। তবে শুধু মানুষ নয় একদম বিজ্ঞ স্যার। তবে স্যারকে কিন্তু দারুণ হ্যান্ডসাম দেখতে।
স্মার্টলি স্যারের দিকে এগিয়ে যায় কুইন,ছেলেমেয়েরা একদম চুপ সবাই মজা দেখার অপেক্ষায় আছে। যাদের দাদা দিদিরা এখানে পড়েছে এক দুই বছর আগে তারা সবাই জানে রাজা সেনের বয়েস অন্য স্যারদের তুলনায় কম হলেও মেজাজটা বড় খাসা সুতরাং এবার দেবে ওকে। কুইনের পাশে বসা মেঘনাও ভয়ে সিঁটিয়ে যায় এবার না ওকে ডাকে। মেয়েটা আর কথা বলার সময় পেলোনা?
কুইন অবাক হল একদম কাছে গিয়ে দাঁড়ালেও ওর দিকে একবারও তাকালেন না স্যার। তিনি তখন বোর্ডে লিখে যাচ্ছেন তারপরই ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন," সলভ দিস। আই হোপ ইউ ক্যান ডু ইট,বিকজ ইউ লিস্টনিং কেয়ারফুলি।"
মুহূর্তে সবটাই জলের মত পরিস্কার হয়ে গেল ওর কাছে। বুঝতে পারল একদম কারও দিকে না তাকিয়েও স্যারের নজর আছে সবারই দিকে। ওহ্ ও কথা বলছিল তাই এই শাস্তি। আচ্ছা ঠিক আছে চ্যালেঞ্জটা তো নিতেই হবে। তাই কোন উত্তর না দিয়ে ভালো করে বোর্ডের দিকে তাকায়,কেমন যেন নার্ভাস লাগে হঠাৎই। তারপর একটা পচা ছেলের কথাগুলো মনে পড়ে যায় ... প্রবলেম উইল কাম,সো ডোন্ট লেট ইট আনটাচড... জাস্ট স্টেপ ইন ইনটু দ্য প্রবলেম,ইট উইল বি সলভড্ ন্যাচারালি।
যদিও তখন বলেছিল বেশি জ্ঞান দিস না তো,নিজে সলভ করে দে না সমস্যাটা। আমার মাথায় ঢুকছে না।
হঠাৎই জোহানের মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছিল," ইউ উইল সলভ দ্য প্রবলেম। নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান কর।"
মুখটাকে সিরিয়াস করে কুইন,কিছুতেই হার মানা চলবে না। তারপর এগিয়ে যায় বোর্ডের দিকে তার আগে হঠাৎই একবার ক্রস এঁকে নেয়,এটা অবশ্য জোহান করত। তারপর প্রবলেমে হাত দেয় প্রস্তুত হয় টু স্টেপ ইন ইনটু দ্য প্রবলেম।
মেয়েটাকে দেখে উদ্ধত মনে হয়েছিল,যখন একটা সিরিয়াস জিনিস শেখাচ্ছেন তখনই ওকে কথা বলতে হল। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছিল,ইচ্ছে করেছিল একটু শিক্ষা দিতে প্রথম দিনই। বেড়ালটা প্রথমেই মারা ভালো, তাহলে পরে আর সাহস দেখাবে না। এইসব সুন্দরী মেয়েরা নিজেদের রানী বলে মনে করে।
রাজা সেন চোখ রাখেন বোর্ডে,মেয়েটা পেছন ফিরে বোর্ড আড়াল করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সারা ক্লাস চুপচাপ। সবাই ভাবছে কী হবে এবার? স্যার এতক্ষণ কিছু বলেননি তবে এবার তো বাজ পড়বে নিশ্চয়। মেয়েটা তো মনে হয় কিছুই শোনেনি।
২০
রাজা সেন ডাস্টারটাকে গোল করে ঘোরান টেবিলে। সামনের দিকে তাকিয়ে বেশ মজা লাগে উৎকন্ঠিত মুখগুলো দেখে।
-" প্লিজ গিভ মি দ্য ডাস্টার স্যার।"
রাজা সেনের সম্মতির অপেক্ষা না করেই কুইন ডাস্টারটা হাতে তুলে নিয়ে পেছন ফেরে। আর একটু বাদেই বলে, আই হোপ দ্যাট আই সলভড্ ইট।"
-আর তারপরেই সরে যায় বোর্ডের সামনে থেকে। মুখে হাসির রেখাটা একটু ফিকে হয়ে যায় স্যারের,কুইন তখন সোজাসুজি তাকিয়ে স্যারের দিকে।
একটু অবাক হলেও প্রকাশ করেন না,ওহ্ তাহলে মেয়েটা সত্যি ফলো করছিল ক্লাস নাকি আগের শেখার মধ্যে পেয়েছে বলে করে ফেলল?
-" ওকে,ইউ মে গো। ইটস কারেক্ট। ইয়োর নেম? ফ্রম হুইচ কলেজ?"
কুইন হাসিটাকে যত্নে লুকায় খুব সিরিয়াস মুখ করে বলে," সম্রাজ্ঞী বোস,নিক নেম কুইন ফ্রম সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ কলকাতা।"
কয়েকটা প্রশ্ন মনে এলেও আর করতে পারলেন না রাজা সেন। হঠাৎই একটা ফাজিল ছেলে বলে উঠল," স্যার ওর নামের সাথে আপনার বেশ সিমিলারিটি আছে তাই না?"
ওদের চাপা হাসির মধ্যে বেলটা বেজে যায়। তারপরে হাসির হুল্লোর ওঠে। ছেলেগুলো বলে," ব্রেভো কুইন আজ কিংয়ের অবস্থা টাইট করে ছেড়েছিস। শুনেছি খুব দেমাক লোকটার আর সুন্দরী মেয়েদের খুব নাস্তানাবুদ করে।"
কুইনের মুখেও জয়ের হাসি। তারপর বলে," কেন সুন্দরী মেয়েদের ওপর রাগ কেন? স্যার কী আনম্যারেড? মানে কোন পাস্ট স্টোরি আছে নাকি?"
-" আরে তোর এত খোঁজে দরকার কী ঐ চল্লিশ পেরোনো স্যারের? কত আনম্যারেড ছেলে এরমধ্যেই ফিদা হয়ে গেছে তোর জন্য।" মেঘনা একটা গুতো মারে।
ছুটি হয়ে গেছে ওরা বেরিয়ে এসেছে বাইরে। মেঘনা বলে,'' চল লাইব্রেরী যাই,ফেরার পথে ক্যান্টিন হয়ে ফিরব। দেখি কী কী বই পাই? কিং স্যার প্রথম থেকেই যা পড়ার চাপ দিল,কাল না আবার আমাকে ডাকে বোর্ডে।"
-" আর ডাকবে না,বেচারা স্যার আমাকে খাঁচায় না পুরতে পেরে নিজেই ইঁদুর হয়ে গেছে।"
দুজনে হাসতে হাসতে লাইব্রেরীর দিকে এগোচ্ছে,একটা গাড়ির হর্ণ শুনে দুজনেই সরে দাঁড়ায়। বিরক্ত হয় কুইন এতটা রাস্তা থাকতে এমন বাজে ভাবে আওয়াজ করা কেন?
গাড়িটার দিকে এক ঝলক তাকাতেই চোখে পড়ে স্যারকে। দুজনেই বেশ লাফ দিয়ে সাইড হয় আর পরে জিভ কাটে কে জানে ওদের কথা শুনে ফেলল কিনা স্যার?
ক্লাসে মেয়েটাকে দেখলেও এখন রাস্তায় দেখে বুঝলেন রাজা সেন মেয়েটা বেশ অনেকটা লম্বা। দুই বন্ধুতে হেসে কুটোপাটি হয়ে যাচ্ছে,গাড়ি আসছে কোন খেয়ালই নেই। তবে মেয়েটা পড়াশোনা করে এসেছে মনে হচ্ছে। তাই রাগ হলেও রাগ করতে পারেন না। পড়াশোনা করলে অনেক কিছুই মাফ করে দেওয়া যায়। তবে সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করে এখানে কেন? ওখানেই তো কোথাও ভর্তি হতে পারত। যাক তবুও এমন কোন মেয়ে এলে রেজাল্টটাও ভালো হবে।
লাইব্রেরীতে বই দেখতে দেখতে মেঘনা ফিসফিস করে," হ্যাঁ রে তুই প্রবলেমটা সলভ করলি কী করে? তুই তো শুনছিলিস না তখন কিছু। মানে আগে থেকে জানতিস?"
-" হ্যাঁ একটু জানতাম তাই সুবিধা হল, আমার এক ব্রিলিয়ান্ট বন্ধু ছিল তার কাছেই শেখা।"
-" তোর বন্ধু? তার মানে তো দারুণ কেউ। বল না রে সে কে আর কোথায়?"
-" তুই যা ভাবছিস তেমন কেউ নয়,এমনি সাধারণ ছেলে,আমাকে হেল্প করত।"
-" আর কিছু না?
সে এখন কোথায়? "
কুইন নিজেকে সামলায় বেশি মন খুলে কাউকে কিছু বলা যাবে না। তাছাড়া সত্যি তো জোহানের সাথে এখন আর কোন যোগাযোগ নেই। তাই কী করে বলবে ওর হাঁড়ির কথা? সত্যি এদের কিছু কৌতূহল বয়ফ্রেন্ড সংক্রান্ত।
-" কোন যোগাযোগ নেই রে এখন। "
একটু নিরাশ হয় মেঘনা তারপর বলে,''ডানাকাটা সুন্দরী সম্রাজ্ঞী তার কোন ছেলেবন্ধু নেই ব্যাপারটা কেমন যেন ফেক লাগল। যাক জুটে যাবে এখানে,আর রকিদা তো তোকে প্রথম দিনই মনে বন্দি করেছে। একটু বেয়ারা ছেলেটা তবে শুনেছি ভালো পরিবারের ছেলে,তাছাড়া পড়াশোনাতেও বোধহয় খুব খারাপ নয়।"
-" তুই তো ওর পুরো বায়োডেটা জোগাড় করে ফেলেছিস। তুই বরং ঝুলে যা।"
-" ধ্যাৎ কী যে বলিস,আমার আছে একজন বাড়ির কাছাকাছি থাকে। এখানে যখন আসবে তোর সাথে আলাপ করিয়ে দেব। তবে সুন্দরী বন্ধুর সাথে আলাপ করাতেও ভয় লাগে।"
-" ভয় নেই,আমি নজর দেব না। আর নজরেও পড়তে চাই না।"
ওরা লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে কিছুটা হেঁটে এগিয়ে আসে ক্যান্টিনের দিকে। এখানে কী খাবার পাওয়া যায় কুইনও জানে না। তবে দেখতে হবে কী পাওয়া যায়। ক্যান্টিনের খাওয়ার বেশ সস্তা তবে তেমন কিছু নেই,ডিমটা বেশ কম দামে পাওয়া যায়। ওরা কেক আর চা নিয়ে বসে মেঘনা অমলেটের অর্ডার দেয়।
-" আরে সুবলদা,তোমার ক্যান্টিনে নতুন ছেলেমেয়েরা এসেছে তুমি তাদের ঐ শক্ত কেক আর চা খাওয়াচ্ছো? তোমার স্পেশাল কফি আর ডিমের চপটা কই? আমি এখানে বসলাম পাঠিয়ে দাও ওগুলো।"
মেঘনা একটা চিমটি কাটে হালকা করে কুইনকে। কিন্তু কিছু বলার আগেই রকি এসে বসে পড়ে ওদের টেবিলে। আগ বাড়িয়ে বলে, " এই চা টা খাস না,কফি আসছে। তোদের জন্য বলেছি।"
-" আমার কফি খেতে ভালো লাগে না। তুমি খাও দাদা।"মেঘনা বলে।
-" আর সম্রাজ্ঞী তুইও কী খাবি না নাকি?"
কুইন এক মুহূর্তে ঠিক করে নেয় একে চটিয়ে খুব একটা লাভ নেই। তাই বলে," খেতে পারি।"
-" এই তো একটু আড্ডা দেওয়া যাবে তাহলে। আরে আজ তো প্রথম দিনেই ওভার বাউন্ডারি মেরেছিস শুনলাম।"
কুইন কিছু বলে না হাসে।
-"না সত্যি তোকে আবার বলতে ইচ্ছে করছে ইউ আর বিউটি উইথ ব্রেইন। বহত রগচটা স্যারটা,সুন্দরী মেয়েদের কোথায় একটু ভালোবাসা দেবে তা নয় পেছনে লাগা প্রথম দিন থেকেই। নিজের বৌ পালিয়েছে তার রাগ তোলে সব মেয়েদের ওপর। খুব নাকি ভালোবাসত বৌকে। আরে অমন খচু স্যারের সাথে কে থাকবে?"
কুইন চুপ করে শোনে,বাবা এই রকিদা তো মোটামুটি সব খবরই রাখে। স্যারের বৌ পালিয়েছে সেই খবরও জানা তার। ওর অবশ্য এসব ব্যাপারে কোন উৎসাহ নেই। তবে স্যারকে তো দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম হঠাৎ করে বৌ পালিয়ে গেল কেন? কে জানে এইসব ইনটেলেকচুয়াল মানুষদের সব বড় বড় ব্যাপার স্যাপার। তা বৌ পালিয়েছে বলে নারী বিদ্বেষী!
রকিদা ওর দিকে তাকিয়ে গল্পে মশগুল,কুইনের বিরক্ত লাগে মাঝেমধ্যে। টুকটাক কথাবার্তা চালানোর পর ওঠার উদ্যোগ নেয়। রকি বলে," তোদের ছেড়ে দেব নাকি?"
-" না এখন যথেষ্ট বেলা আছে,আর ক্যান্টিন থেকে তো এই একটুখানি পথ।"
মেঘনা পাশের হস্টেলে থাকে ও পা বাড়ায় সেদিকে বলতে বলতে," প্রথম দিনটা বেশ ঘটনাবহুল তাই না। রানী এল জয় করল। তবে রানীর হৃদয়ে রাজা হবার লড়াইয়ে কারা কারা নামবে কে জানে? ওকে কাল দেখা হচ্ছে।"
সন্ধ্যেবেলাতে মাকে ফোন করে কুইন সব কিছু মাকে বলে না। আসলে শেয়ারিং অ্যান্ড কেয়ারিং দুটোই ওর ঠিক আসে না। মা মাঝেমধ্যে অভিযোগ করে,তবে স্বভাব পাল্টাতে পারেনি। আর মা যা ভীতু তাতে বলেও লাভ নেই সে আবার সবেতেই ভয় পাবে। হয়ত স্যার ডেকেছেন বা রকিদা ক্যান্টিনে কথা বলেছে তা নিয়েও চিন্তা হবে। নিজেকে সামলানোর মত বড় হয়ে গেছে কুইন।
ইউনিভার্সিটির মধ্যেই স্যারেদের কোয়ার্টার বেশ কিছুটা দূরে মোটামুটি একটু শেষ মাথায়। এখানে চাকরি নিয়ে আসার পর এটাই মোটামুটি ভালোবাসা বিহীন বাসা হয়ে গেছে রাজা সেনের। অবশ্য পুরোপুরি তা বলা যায় না,ভালোবাসা কিছু চিহ্ন রেখে যায় সবসময় তাই তাকে ভোলা যায় না। গাড়িটা আসতেই ওপর থেকে আওয়াজ ভেসে আসে বাপি এসে গেছে আমাকে ছেড়ে দাও। আমি গাড়িতে উঠব।
- "আরে দুধটা তো পড়ে রইলো,দাদাবাবু আগে ঘরে আসুন তারপর যেয়ো। এখন যেতে হবে না।"
-" না আমি এক্ষুনি যাব,ছাড়ো আমাকে।"
-" মাসি ওকে ছেড়ে দাও,একটু ঘুরিয়ে আনি।"
একটু বাদেই সিঁড়ি দিয়ে ছুটে নেমে আসে তিস্তা।
তারপর চুলের ঝুটি নাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসে অভিযোগ করতে করতে," আমাকে আসতেই দিচ্ছিলো না তোমার কাছে দেখেছো তো কেমন দুষ্টু মাসি।"
২১
প্রতিদিনই মেয়েকে নিয়ে এইসময় একটু বেরোতে হয়,তারপর ও একটু ঘুরে,খেলা করে শান্ত হলে তারপর বাড়ি ফেরার পালা। মেয়ে এই অবসরটুকু নিতে চায় মুঠোভরে। প্রায়ই ওকে নিয়ে একটু ফাঁকা জায়গাতে অথবা চা বাগানের ধারে,বা ঐ যে নদীর কাছে যে পরিত্যক্ত লাইনটা আছে সেখানে ঘুরতে যেতে হয়। তিস্তার বয়েস এখন তিন সবেই স্কুলে যাচ্ছে। এই বয়েসেই মায়ের আদরে বঞ্চিত মেয়েটা। কিছু করার নেই অবশ্য,যে মা শুধুই নিজের কেরিয়ারের কথা ভাবে তার কাছে সন্তান আর কী মূল্য রাখে? হয়ত প্রেমে ভেসে গিয়ে বাস্তবটা ভুলে গেছিলেন রাজা সেন। তোর্সার গমের মত ফর্সা রঙ,বুদ্ধিদীপ্ত কথা আর ট্যালেন্ট ছাড়া তখন আর কিছুই চোখে পড়েনি। একটু সিনিয়ার রাজাদাকে কাজে লাগবে ওর ভবিষ্যতে সেটা ভেবেই এগিয়ে গেছিল তোর্সা, যদিও ওর বাবা বারবারই বলেছিলেন এইসব মিডলক্লাস ছেলেরা যতই ব্রিলিয়ান্ট হোক না কেন মেন্টালিটি কিন্তু হাই নয়। তোমার লাইফস্টাইল কিছুতেই ম্যাচ করবে না ওদের সাথে। শোনেনি তোর্সা,ভেসেছিল নিজে আর ভাসিয়েছিল রাজাদাকে। তারপর রাজাদার সাহায্যে সুন্দর ভাবে থিসিসটা কমপ্লিট করে জমা দিয়েই নিজের কথা রেখেছিল। মানে একদম ছাদনাতলাতে এসে ঢুকেছিল। বিয়ে,হনিমুন আর এতদিনের জমে থাকা উচ্ছ্বাসের ফলে খুব তাড়াতাড়ি তিস্তা আসছে সেটা জানান দিয়েছিল। খুবই বিরক্ত হয়েছিল তোর্সা," ইশ্ দিলে তো সব গুবলেট করে,আরে বললাম তো ওখানেই একটু সাবধানী হতে। ধ্যাৎ ভালো লাগে না, আমার সব প্ল্যান নষ্ট হয়ে যাবে।"
তোর্সাকে আদর করতে করতে রাজা বলেছিল," এখন তো এগুলোই আমাদের প্ল্যান তোর্সা,তুমি তো পরীক্ষা দিয়েছো হয়ত লেকচারারশিপটা হয়েই যাবে। ব্যাস তুমি আর আমি আর আমাদের সন্তান এই আমাদের পৃথিবী। বরং ভালোই হবে বাচ্চাটা তোমার চাকরিটা হতে হতে একটু বড়ও হয়ে যাবে। আই লাভ বেবি,আমাদের একটা মেয়ে হলে ভালো হয় একদম তোমার মত ফুটফুটে।"
তোর্সা অন্যমনস্ক ছিল তারপরে বলেছিল,আমি বাপিকে বলেছি একটা ডঃ মানে অ্যাপো..."
-" হ্যাঁ তা তো ভালোই,ডঃ তো দেখাতেই হবে।"
-" রাজা তুমি ভুল করছ,আমি ওকে রাখতে চাইছি না। আমার তাহলে আর এগোনো সম্ভব হবে না। বাপিরও সেটাই ইচ্ছে। কত স্বপ্ন আমাকে ঘিরে বাপির।"
মাঝে কয়েকটা দিন চলেছিল টানাপোড়েন আর অশান্তি। রাজার বাড়ির লোকজন রাগ করেছিল শুনে বলেছিল বাবাই বা কিরকম কে জানে? রাজার রাগ হলেও খুব বুঝিয়েছিল তোর্সাকে," প্লিজ ওকে মেরোনা ওকে আসতে দাও, আমি ওকে দেখব। তুমি কেরিয়ার গড়বে,কী করতে চাও করবে। আমি প্রমিস করছি কখনও বাধা দেব না।"
তিস্তা এসেছিল পৃথিবীতে তোর্সা খুশি হয়নি মা হয়ে। ও ওর মত নিজের কাজকর্ম করে চলেছিল তারপর যখন তিস্তার যখন আট মাস বয়েস তখন পোস্ট ডক্টরেটশিপ পেয়ে বিদেশে চলে যাবে বলে মনস্থ করেছিল। রাজা বারবারই বলেছিল," ও একটু বড় হোক তুমি যেয়ো,এখন এখানেই চাকরি কর না। তোমার এমনকি বয়েস হয়েছে তোর্সা?"
-" অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বোল না, তুমি এভাবে আমাকে বেঁধে রাখতে পারো না। বাবা ঠিকই বলেছিলেন বড্ড মিডলক্লাস মানসিকতা তোমার। তখন বুঝিনি এখন বুঝছি।"
-" মানে কী বলতে চাইছ তুমি? এত কিছু করার পরও এত বড় কথা বলছ! তোমার পিএইচডি হত আমি না থাকলে?"
-" হ্যাঁ তাই তুমি যা বলবে তাই শুনতে হবে আমাকে তাই না? ইউ আর জেলাস আমি বুঝতে পারছি।"
ঝগড়া তর্ক অনেক দূর গড়িয়েছিল তারপর একটা সময় তোর্সা নিজের জেদ অটুট রেখেছিল,মেয়েকে ফেলে রেখে চলে গেছিল বিদেশে।
-" ঐ টুকু বাচ্চা কী করে থাকবে তোমাকে ছাড়া?"
-" তখনই বলেছিলাম আমি,তুমি বলেছিলে তুমি সামলাতে পারবে সবটা। সামলে নেবে ওকে ঠিক তুমি। ও তো তোমার কাছে থাকতেই ভালোবাসে। আমি দূর বিদেশে একা কী করে সামলাব ওকে ভেবেছ? তুমি চল আমার সাথে তাহলে। একজন স্ত্রী যদি স্বামীর সাথে যেতে পারে তুমি পার না কেন?"
না আর কোন জবাব ছিল না রাজা সেনের কাছে,তোর্সা চলে গেছিল। তারপরে তিস্তাকে নিয়ে তার একার জগত। বাড়িতে থাকাও সম্ভব হয়নি চাকরির জন্য। মা এসেও থাকতে পারেন না কারণ বাবা অসুস্থ,তাই তিস্তাকে দেখাশোনা করার জন্য মাসিই ভরসা। আর বাকিটা সময় বই আর বেবিকে নিয়ে কেটে যায় মোটামুটি। প্রথম প্রথম তোর্সা সপ্তাহে দুদিন ফোন করত। তারপর একদিন বেশ কিছুটা বাদে সেটা মাসে একদিন হয়েছে। রাজা মেসেজ করলেও সেগুলো আনসিন পড়ে থাকে। ফোন করলে ধরত না। পরে রাজার এক বন্ধুর কাছেই শুনেছিল তোর্সা নাকি ওখানে কোন একজনের সাথে লিভ ইনে আছে। আর ফোন করেনি রাজা। একটা সময় ওর বাবার কাছে জানতে চেয়েছিল কী করবে ও? তিস্তারই বা কী হবে?
উনি বলেছিলেন সোজা তোর্সা ডিভোর্স নিতে চায় কারণ যে সম্পর্কে প্রাণ নেই সেই সম্পর্কে থাকতে সে চায় না। সব কাগজপত্র রেডি হচ্ছে পাঠানো হবে কিছুদিনের মধ্যেই। আর তিস্তাকে দরকারে উনি রাখবেন কাছে যতদিন না তোর্সা ফেরে। কথাগুলো শুনে জেদ চেপে গেছিল রাজা সেনের তোর্সা যা পারে করুক তবে তিস্তাকে কিছুতেই ছাড়বে না ওর মায়ের কাছে।
তারপর থেকেই চলছে বাবা মেয়ের সংসার এভাবেই। সারাদিন বাদে মেয়েকে কাছে পেয়ে কিছুটা শীতলতার ছোঁয়া মেলে রুক্ষ মনটাতে। আজকাল সুন্দরী মেয়ে দেখলে আর তাকাতে ইচ্ছে করে না,কেন যেন মনে হয় রূপের দেমাকে এরা সব পারে। আজও মেয়েটাকে অদ্ভুত প্রাউড মনে হচ্ছিল। একদম নিজেকে যেন ময়ূরের মত সুন্দর ভেবে ঘাড় বেকিয়ে বসে আছে। কাউকে তোয়াক্কা করে না। ইচ্ছে ছিল ওকে জব্দ করবে কিন্তু হল না। উচিত শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল ক্লাসে অমনোযোগী থাকার জন্য।
তবে কুইনকে জব্দ করা হয়নি রাজা সেনের কয়েকদিন ক্লাস নেবার পর বুঝতে পেরেছিলেন মেয়েটা বুদ্ধিমতী তবে ফাঁকিবাজ,একটু ছটফটেও। তবে সেদিনের পর আর অন্যমনস্ক থাকে না। মোটামুটি হাতে পেন আর খাতা নিয়ে নোটস নেয়। এখানে এসে কুইন দেখেছে অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। আর অপরিচিত জায়গাতে এসে বাবা সংক্রান্ত আলোচনা খুব একটা আসে না। মেধা একদিন জিজ্ঞেস করেছিল তোর বাবা মা ছাড়া আর কে আছে বাড়িতে? কুইন বলে দিয়েছে ওর বাবা মারা গেছে অনেক বছর আগে। ওরা দিদার কাছেই থাকে। কথাকে শুরুতেই শেষ করে দিয়েছিল। এর মধ্যে তো কোন মিথ্যে নেই,কেউ তো ওকে জন্ম নিতে সাহায্য করেছে,অবশ্য সাহায্য কথাটা বলতে কেমন যেন শরীর গুলিয়ে উঠল। যাক গে কারও কামনার ফল হয়ত ও আর তাকে বাবা ছাড়া আর কী বলবে? কারণ সে ধর্ষক নয় অবশ্যই,মা তাকে এখনও ভালোবাসে। তার ফটো জড়িয়ে কাঁদে। যাক মোটামুটি সেট করে গেছে এখানে। শুধু ঐ রকিদা নামের বাঁদরটা মাঝেমধ্যে ডিস্টার্ব করছে। তবে ফ্রেশার্স ওয়েলকাম খুব ভালো করে দিয়েছে ওদের সিনিয়াররা। এটা নিয়ে সবারই একটু চিন্তা ছিল যদি কোন র্যাগিং করে। তবে সবাইকে কিছু না কিছু করতে হয়েছে এটাই সমস্যা। কুইনের কিছু শেখার মত ধৈর্য্য কোনদিনই ছিল না দেবী যথেষ্ট চেষ্টা করেছে একটা সময় মেয়েকে গান শেখাতে পারেনি। বলেছে গান নাচ নাকি শিখতে হয় না পয়সা খরচ করে। এমনিতেই আয়ত্ত করা যায়।
গানটা মন্দ গায় না কুইন আর নাচটাও মোটামুটি চালিয়ে নেয়। ওদের কলেজে খুব ভালো প্রোগ্রাম হত,সেখানে অনেকবার নাটক বা নাচেও অংশ নিয়েছে ও।
ফ্রেশার্সের দিন মেঘনা বলছে বারবার," আমার খুব ভয় করছে বুঝলি,ওরা কী বলবে করতে কে জানে? আমার তো আবৃত্তি ছাড়া তেমন কিছুই আসে না বুঝলি।"
-" তাই করবি, আমি তো কিছুই পারি না তেমন। তবে যা বলবে ম্যানেজ করে নেব।"
-" সে আমি জানি,প্রথম দিন যেভাবে স্যারকে ম্যানেজ করেছিস। এখন তো মোটামুটি তোর গুণমুগ্ধ স্যার।"
-" কী যে বলিস না! তবে স্যারকে আমারও খুব ভালো লাগে। মানে দারুণ পার্সোনালিটি, বেশ আলাদা অন্যদের থেকে। অথচ কেয়ারিং আবার দরকারে শাসন করেন। বেশ একটা বাবা বাবা ভাব।"
-" কার বাবা তোর?"
কথাটা শুনে কুইনের হঠাৎই রাগ হয়ে যায়," কী যা তা বলছিস! আমার বাবা হতে যাবে কেন? স্যারের তো বাচ্চা আছে শুনেছি,তার বাবা। আমার স্যারকে ভালো লাগে সুন্দর পার্সোনালিটি ভদ্রলোকের। ন্যাকামি যারা করে তাদের চেয়ে রাগী মানুষ ভালো।"
মেঘনা বুঝতে পারে কুইনের রাগ হয়েছে তাই কথা না বাড়িয়ে ডিপার্টমেন্টের দিকে পা বাড়ায় ওরা। কুইন শাড়িতে কমফোর্ট ফিল করে না,আজ সবাই শাড়ি পরবে আগে থেকেই বলেছে। অগত্যা কুইনকে মেখলা পরতে হয়েছে,ভাগ্যিস মা দিয়েছিল দুটো মেখলা সাথে। ও আপত্তি করাতে বলেছিল," কখনও যদি এথনিক পরতে হয় তো পরিস। তুই তো শাড়ি সামলাতে পারিস না,আর আমিও নেই কে পরিয়ে দেবে শাড়ি?"
যাক আজই কাজে লেগে গেল। কিছু কিছু ব্যাপারে মায়ের বুদ্ধি কাজে লেগে যায়। কে জানে কেমন করে সব সামলাচ্ছে? বলছে তো সব ঠিক আছে। ব্যবসাটা ঠিকমত করতে পারছে কিনা কে জানে?
২২
ফ্রেসার্স ওয়েলকামের দিন কুইন একটা নীল মেখলা পরেছে,তাতে সুন্দর সাদা আর লাল সুতো দিয়ে কাজ করা। তার সাথে ওদের দোকান থেকেই নেওয়া একটা আনকমন কস্টিউম জুয়েলারীর সেট পরেছে। একটু অন্যরকম সাজে রূপের আগুনের জাদু ছড়িয়েছে আরও বেশি করে চারদিকে। অনেকে মুখে বলেছে আবার কারও চোখ বুঝিয়ে দিয়েছে ওকে সুন্দর লাগছে।
ডিপার্টমেন্টে ঢোকার মুখে অন্যদিন বাঁদরটাকে ঠিক দেখতে পায়, সেদিন আর দেখে না। হয়ত ব্যস্ত আছে অনুষ্ঠান নিয়ে। ওদেরকে ফুল আর চন্দন দিয়ে স্বাগত জানানো হয় তার সঙ্গে সুন্দর করে ওয়েলকাম লেখা একটা রাইটিং প্যাড আর কলম।
অনুষ্ঠান শুরুর পর আড়াল থেকে অ্যানাউন্সমেন্টে বুঝতে পেরেছিল রকিদা আছেন তবে অন্তরালে,পরে আত্মপ্রকাশ করবেন। যাক যতক্ষণ না আসেন ততই মঙ্গল। সুন্দর গান বাজনা চলছিল,ওদের ক্লাসের কিছু ছেলেমেয়েরা গাইলো,দুএকজন নাচলোও। স্যারেরা উপস্থিত ছিলেন তখন,বয়স্ক স্যার ওকে দেখে বললেন," এ কী রাণীমা তুমি কিছু করলে না?" কুইন মাথা নাড়ে। প্রথমদিনের পর উনি এই নামেই ডাকেন,প্রথমটা অদ্ভুত লাগলেও এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। একজন সিনিয়ার এসে বলে গেল," রকি বলছে স্যারেরা ওর কিছু পারফরম্যান্স দেখতে চায়,সুতরাং একটা কিছু করতে হবে।" কুইন বোঝে এটাও এক ধরনের জুলুম। যাক কী আর করা যাবে একটা গান শুনিয়ে দেওয়া যাক।
কুইন জগতে আনন্দযজ্ঞে গানটা ধরার আগে বলে,ও গান শেখে না তাই কোন ভুল ত্রুটি হলে যেন স্যারেরা কিছু মনে না করেন।
গানের একটা লাইন শুরু করতেই দেখেছিল রাজা সেন উঠে আস্তে করে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছিলেন। অবাক হয়েছিল কুইন খুব রাগও হয়েছিল ওহ্ ওর গান বুঝি শোনার যোগ্য নয়।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়িতে বসে গাড়িটা স্টার্ট দিয়েছিলেন রাজা সেন। এই গান বড় চেনা তার,প্রথম এই গানটাই তোর্সার গলায় শুনেছিলেন। তখন এই গান শুনে অনুরাগ এলেও আজ যেন কেমন অসহ্য লাগল তাই বেরিয়ে এলেন।
কুইনের গান শুনে সবাই প্রশংসা করল। ওদের অনুষ্ঠান শেষ হতেই স্যারেরা বেরিয়ে গেলেন। কুইনও উঠে পড়তে যায়,আর ভালো লাগছে না। কিন্তু বাধা পায় ওদিক থেকে আওয়াজ আসে.."কেউ এখন বেরোবে না,বাত অভি বাকি হ্যায়।"
-" মেঘনা দেখেছিস আড়াল থেকে কেমন আমাদের বাঁদর নাচাচ্ছে বাঁদরটা!"
-" চুপ করে বোস,কিছু বলিস না।"
একটু বাদেই অদ্ভুত প্রস্তাব এল মোটামুটি জুটি বেঁধে দেওয়া হবে,আর সবাইকে যা করতে বলা হবে সেটাই করতে হবে। যখন একটা চিরকুট তুলতে বলা হল কুইনকে সে অদ্ভুতভাবে দেখল তাতে লেখা ডান্স উইথ রকি। মাথাটা গরম হল কুইনের শুধু বলল," এগুলো তো একদম প্ল্যান করে সাজানো মনে হচ্ছে।"
ওরা মাথা নাড়ল," তোদের সামনেই কাগজ ছিল, তোরা নিজের হাতে তুলেছিস। কারচুপি হবে কী করে?"
এদের সঙ্গে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই তবে এভাবে ওকে ফাঁদে ফেলবে ভাবতেই পারেনি। কেউ একজন অ্যানাউন্সমেন্ট করল.."নাউ দ্য মোস্ট এক্সাইটিং ইভেন্ট কামিং আপ। আমরা বুঝতে পারছি সম্রাজ্ঞী একটু আপসেট হয়ে গেছে। হয়ত ওর রাগও হচ্ছে কিন্তু কিছু করার নেই। এমনি কথা ছিল যে পার্ট ওয়ান আর পার্ট টু জুটি বেঁধে পারফর্ম করবে। অনেকেই তো করেছ এরমধ্যে তাই না? আর ইউ এনজয়িং না? রকি তোর নাম অ্যানাউন্স করা হয়েছিলো, তুই তাড়াতাড়ি চলে আয় ভেতরে।"
কিছুটা বাদেই আবির্ভাব হয় বাঁদরটার,রকিকে দেখে চাপা উচ্ছ্বাস আর হাততালিতে মেতে ওঠে সবাই। ছেলেমেয়েদের কান্ড দেখে গা জ্বলে যায়,তেল মারতে বোধহয় সবাই পারে। শুধু মেঘনা ফিসফিস করে বলল," দেখেছিস রকিদার ড্রেসটা?কেমন নীল জামা পরে এসেছে, তাই বোধহয় এতক্ষণ দেখা দেয়নি। তোকে দেখে দোকান থেকে কিনে নিয়ে এল নাকি? ওরে বাবা এত লাভবার্ড ড্রেস।"
-" মেঘনা চুপ কর,সবার কাছেই এই কমন কালারটা থাকে। হয়ত কাকতলীয় ভাবে ম্যাচিং হয়ে গেছে।
ওরা কুইনকে ডাকে,বিরক্তিকে চাপা দিয়ে স্মার্টলি উঠে যায় কুইন। ওকে দেখে রকি হাত বাড়িয়ে দেয়,ইশ্ শেষে ওর হাতটা ধরতে হল! স্পীকারে তখন বাজছে... আজকাল তেরে মেরে প্যায়ার কী চর্চে হর জবান মে,সব কো মালুম হ্যায় সবকো খবর হো গয়া।"
বাঁদরটি যে সর্ব গুণে গুণান্বিত তা বুঝতে বাকি থাকে না কুইনের। ওর নাচের সাথে তাল মিলিয়ে পা চালায় গানের ছন্দে। বুঝতে পারে রীতিমত রিহার্স করে এসেছে রকি,তবে হার মানতে রাজি নয় কুইনও। সবাই মুগ্ধ হয়ে ওদের দেখছে। শেষ হতেই হাততালিতে মুখর হয় হল।
হাততালি থামার সাথে সাথে আওয়াজ আসে জিয়ো বস। সত্যিই তোমার তুলনা নেই।
কুইনের চোখমুখ দিয়ে আগুন ছুটছে,নাচতে নাচতে দু তিনবার ওকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরেছিল রকি। কী যে অসহ্য লাগছিল তখন। হয়ত এই গায়ে পড়া স্বভাবের জন্য একদম না পসন্দ ছেলেটাকে। একদম রোস্ট করে ফেলল ওকে প্রি প্ল্যানড। প্রথম দিন বাইকে চড়িয়েছিল আজ বুকে জড়ালো।
নিজের জয়জয়াকার প্রাণভরে উপভোগ করে বলল," তোরা আমাকে শুধু চিয়ার্স করলি, আরেকজনের কথা বললি না? থ্যাঙ্ক ইউ সম্রাজ্ঞী এত সুন্দর একটা পারফরম্যান্স করার জন্য। ও সাপোর্ট না করলে সব কিছু এত ভালো হত না।"
তেলমারা কথাগুলো জাস্ট অসহ্য লাগছিল তখন। কুইনের চলে যেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু তবুও বসে থাকতে হল। অদ্ভুতভাবে ওকে ট্র্যাক করছে প্রথম থেকেই ছেলেটা।
তারপর কয়েকটা দিন জঘন্য কেটেছিল কুইনের ওকে দেখলেই ঝোপের আড়াল থেকে অথবা মাঠ থেকে গান ভেসে আসত আজকাল তেরে মেরে প্যায়ার কে চর্চে হর জবান পর... সত্যি মাথা খাটিয়ে একটা গান বের করেছিল বটে।
এসবের কিছু অবশ্য মাকে বলেনি কুইন,ও বুঝেছিল কুৎসিত মেয়েদেরও যেমন অপমানের শেষ নেই ঠিক তেমনি সুন্দর মেয়েদেরও হাজার জ্বালা। আর তাই হয়ত অনেকের জীবন এভাবেই দুর্বিষহ হয়ে যায় ওর মতই। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে একটা থাপ্পড় বসায় ওর গালে কিন্তু উপায় নেই।
-" কতদিন বাড়িতে আসিস না একবার এসে ঘুরে যা কুইন একটু কদিন ছুটি পেলে। খুব ফাঁকা হয়ে গেছে বাড়িটা।"
-" কথা তো হচ্ছে মা সবসময়। একটা সময় তো আমাকে নিয়ে তোমাদের সমস্যার শেষ ছিল না। এখন এত ব্যস্ততা কেন আমাকে নিয়ে? আমি নেই এখন তোমরা মা আর মেয়ে শান্তিতে থাকো। আমি ঠিকই আছি এখানে,পড়াশোনা করছি।"
দেবী আর কিছু বলেনি শুধু বলেছিল," আচ্ছা যখন ইচ্ছে হবে তখন আসিস। আমি নাহয় একবার চলে যাব।"
আরও রেগে গিয়ে কুইন বলেছিল," হঠাৎই এত ভালোবাসা কেন উত্তরবঙ্গের ওপর? সাংশার খোঁজে যাবে নাকি? নাকি সেই বাংলোটাতে?"
ফোনটা কেটে দিয়েছিল দেবী, ভেবেছিল নতুন জায়গাতে এসে মেয়েটা একটু পাল্টাবে। নাহ্ স্বভাব বোধহয় কোনদিনই পাল্টায় না মানুষের। তবুও সন্তানের কাছ থেকে আহত হয়েও ঠাকুরের কাছে বলে ও যেন ভালো থাকে ঠাকুর। ওর জীবন যেন ভালো হয়।
নিজের জীবনকে নিজের মত চালাতেই চায় কুইন। তাই সবারই অলক্ষ্যে ছোট্ট ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নিরুদ্দেশের পথে, কাউকে না বলে। খুব ভোরে কখনও চলে যায় নদীর ধারে বসে থাকে আবার
কখনও বা বিকেলে। খোলা প্রকৃতির মাঝে একটু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়। মেধাকেও কিছু বলে না। আজকাল মেধাও বিশেষ কথা বলে না ওর সাথে,ও বুঝে গেছে কুইন মেজাজী, আসলে সুন্দরী বলে হয়ত অহংকার বেশি। তাই ভেবেই নিয়েছে এই কয়েক মাস পার করে নতুন ক্লাসে উঠলে রুমটা পাল্টে নেবে। অদ্ভুত চরিত্র মেয়েটার কোন ছেলেকে পাত্তা দেয় না অথচ ওর চারদিকে ছেলেদের ভীড়। রকিদা তো মরিয়া হয়ে গেছে ওকে পাবার জন্য। ফ্রেশার্সের ভিডিও ওকে দেখিয়েছে একজন,ওটা তো মোটামুটি ভাইরাল হয়ে গেছে ক্যাম্পাসে। মাঝেমধ্যেই কোথায় উধাও হয়ে যায়। রকিদা ওকে ধরেছিল একদিন,ও তো ভয়েই অস্থির, বলেছিল..." আরে ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি কী বাঘ নাকি? আরে ইয়ে তোর রুমে সম্রাজ্ঞী বলে রাগী মেয়েটা থাকে না? একটু ওর খবরগুলো আমাকে দিস তো?"
মেধা অবাক চোখে তাকিয়েছিল," মানে?"
-" আরে মানে ঐ কোথায় যায়? কী করে? কোন বয়ফ্রেন্ড আছে নাকি? কাউকে তো পাত্তাই দিচ্ছে না।"
-" ও আমার সাথেও ভালো করে কথা বলে না রকিদা। মনে হয় মাথার গন্ডগোল আছে। কী করে কোথায় যায় জানি না। ঘুম থেকে উঠে দেখি গায়েব।"
-" বুঝলাম,যাক আমিও পাত্তা লাগাচ্ছি। ঠিক আছে কিছু জানলে বলিস।"
কথাগুলো বলে তাড়াতাড়ি পালিয়ে এসেছিল মেধা। রকিদা ওকে এইসব বলেছে একবার যদি ওর রুমমেট জানতে পারে তাহলে আর রক্ষা নেই। কথাবার্তা ভালো নয় ওর,খুব শান জিভে। কী দরকার ওর রকিদার চামচে হয়ে? নিজের মত নিজের পড়াশোনা নিয়ে থাকাই ভালো। ওপরের ঝুম্পা বলছিল রকিদার স্বভাব একদম ভালো নয়,অনেক মেয়েকে নাচিয়েছে। তাছাড়া পাড়াতেও বোধহয় একজন প্রেমিকা রেখে এখানে এসেছে। নিজেরটা নিজে বুঝুক মরুক গে।
হস্টেলে কিছু বিধিনিষেধ থাকাতে এখনও একা খুব বেশি দূরে যায়নি কুইন তবে মোটামুটি কাছাকাছি জায়গাগুলো ঘুরে ফেলেছে। আজ ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বেরিয়ে গেছিল ক্যাম্পাস থেকে। এমনও হয়েছে অনেকদিন রকিদা ওকে ফলো করেছে,এমনও হয়েছে সেবক পর্যন্ত ধাওয়া করেছে ওর পেছনে। কী যে করবে ঐ বাঁদরটাকে ভাবলেই অসহ্য লাগে। তবে যাই হোক কোন প্রোপোজাল দেয়নি। আর দিলেই ও সোজা না করে দেবে। এই কয়েকমাসে ওর অনেক কীর্তি শুনেছে তবে আমল দেয়নি তেমন,নতুন জায়গাতে এসেছে সুতরাং চোখ কান খোলা রেখে চলতে হবে।
২৩
এরমধ্যে বেশ কয়েকবার এই জায়গাটাতে এসেছে,এখানে ভালো লাগে ওর। শিবমন্দির পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা রাস্তা পেরিয়ে চা বাগানের কাছে এসে পৌঁছয়। চা পাতাগুলো ছুঁয়ে নেয় একটু আদরে তারপর আবার এগিয়ে যায় সামনের দিকে। ছোট্ট একটা জলধারা কুলকুল করে বয়ে চলেছে সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে। তারপর রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকে কিছুটা সময়। এই মিটার গেজের লাইনটা খুব প্রিয় ওর। কলকাতাতে এমন লাইন ধরে হাঁটার সুযোগ কোথায়? এই দিক দিয়ে বোধহয় আর ট্রেন যায় না। মানে ও অন্ততঃ দেখেনি যেতে। তবে জায়গাটা বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন,অনেকে এখানে প্রেম করতে আর ফটো তুলতে আসে। মেঘনার বয়ফ্রেন্ড যখন এসেছিল তখন ওরাই জোর করে এনেছিল এখানে। তারপর থেকে নেশা হয়ে গেছে রেললাইনে হাঁটা,চুপটি করে বসে থাকা। কখনও এখানে বসে পড়াশোনাও করে। মা শুনলে বকবে ও জানে,বন্ধুরাও হয়ত পাগল বলবে তবুও ওর ভালো লাগে এই পাগলামি করতে। আরে সব মানুষই তো পাগল।
সোজা ইউনিভার্সিটি থেকে চলে এসেছে তাই কাঁধে ব্যাগটাও ছিল,ব্যাগটা খুলে একটা গল্পের বই বের করে নাড়াচাড়া করে বসে। এই বইটা ওকে জোহান দিয়েছিল একবার জন্মদিনে, তখন পড়া হয়নি। মানে ওর দেওয়া বলেই আর সেভাবে খুলে দেখেনি কিন্তু অনেক পরে লাইনগুলো ছুঁয়েছিল ওকে প্রথমে লেখা ছিল টু দ্য মোস্ট বিউটিফুল মাইন্ড,অবাক হয়ে গেছিল কুইন সবাই যখন ওর রূপে মগ্ন হঠাৎ এই ছেলেটা ওর মন নিয়ে পড়ল কেন? আর ওর মনে কিছুই সুন্দর নেই,আর যেটুকু আছে সেটা ঢেকে রাখতেই ওর ভালো লাগে। বইটা মাউন্টেনিয়ারিংয়ের ওপর,খুব সুন্দর সুন্দর ছবি আছে। পাতা ওল্টালেই মন ভালো হয়ে যায়। তাই মাঝেমধ্যে মন ভালো করার জন্য দেখে বইটা ও। বেশ লাগছে এমন একটা নির্জনতায় বসে বরফে মোড়ানো পাহাড়ের ছবি দেখতে।
পড়তে পড়তে একদম ডুবে গেছিল কুইন,হঠাৎই পেছন থেকে কে যেন একটা এসে ওর স্কার্টটা টেনে ধরে। একটু চমকে ওঠে কুইন কারণ জায়গাটা নিরিবিলি,যদিও এখনও বেলা আছে অনেকটাই।
একটু চমকে উঠেই ও পেছনে ঘোরে তারপর মনটা ভালো হয়ে যায় পুচকেটাকে দেখে,ততক্ষণে পুচকেটা ওর গলা জড়িয়ে ধরেছে। কুইনও ওকে জড়িয়েছে আদরে তারপর বলেছে," এটা কে রে? কোথা থেকে এল পরীটা এখানে?"
-" আমি তো তোমাকে দেখতে পেয়েই চলে এলাম,কত খুঁজি তোমাকে। তুমি এখানে কেন?"
-" ওমা পাকু বুড়ি তুই আমাকে খুঁজিস কেন?"
ওদিক থেকে একটা ডাক শোনা যায় তিস্তা, প্রিন্সেস কোথায় গেলি?
-" আমাকে একটু লুকিয়ে নাও তো তোমার ব্যাগের ভেতরে,আমি বাপিকে দেখা দেব না।"
-" এমন করতে নেই,আয় আমার কোলে আয়। কোথায় তোর বাপি? চল কোথা থেকে ডাকছে দেখি।"
-" না আমি যাব না,আমি তোমার কাছে থাকব। বাপি মিথ্যে কথা বলে।"
কুইন কিছু একটা বলতে যায় কিন্তু মুখের কথা মুখেই রয়ে যায়। এমন জায়গায় যাকে দেখল তাকে এখানে দেখবে স্বপ্নেও ভাবেনি।
হাতে একখানা বই নিয়ে স্যার এসে সামনে দাঁড়াবেন এটা কখনও ভাবেনি। একদম চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ে কুইন,পুচকেটা ওর পেছনে লুকিয়ে আছে ওকে দুহাতে জড়িয়ে।
-" ওহ্ তুমি এখানে? মানে ক্লাস বাঙ্ক করে এখানে চলে আস নাকি?"
দেখা হতেই জেরা শুরু ভদ্রলোকের।
-" না স্যার আজ লাস্ট ক্লাসটা ছিল না, তাই এসেছি এখানে। এই জায়গাটা আমার খুব পছন্দের।"
-" ওহ্ আচ্ছা,সঙ্গে কেউ আছে না একা? মানে একা একা সন্ধ্যে পর্যন্ত এখানে থাকা ঠিক নয়।"
-" না না আমি একটু বাদেই চলে যাব। স্যার এই কী আপনার মেয়ে? খুব সুইট আর কিউট,আমার কাছে লুকোতে চাইছিল।"
-" হ্যাঁ দুষ্টুর শিরোমণি,কারও কথা শোনে না। যেই আমি বই খুলেছি অমনি পালিয়ে এসেছে। অবশ্য এই জায়গাটা ওর মোটামুটি চেনা। প্রায়ই আসে রেললাইনে হাঁটতে।"
কুইনের অবাক লাগে স্যারকে দেখে,আজ স্যারের ক্লাস ছিল না। স্যারের পরনে পাজামা পাঞ্জাবী বেশ অন্যরকম লাগছে দেখতে। ক্লাসে যা গম্ভীর হয়ে থাকেন রীতিমত ভয় লাগে। এখন সুন্দর কথাও বলছেন।
-" প্রিন্সেস চল,এবার বাড়ি যেতে হবে। তুই চকলেট খাবি তো? সেটাও কিনতে হবে।"
বাবার নাম রাজা তাই বোধহয় মেয়ের নাম প্রিন্সেস,আবার তিস্তাও। দুটোই খুব সুন্দর নাম। তবে একটা নামের সাথে ওর নামেরও বেশ মিল আছে।
কুইনের ভাবনাকে হঠাৎই ছিঁড়ে দিল প্রিন্সেসের চিৎকার," না আমি যাব না। আমি মাম্মার সাথে থাকব। তুমি আমাকে মিথ্যে কথা বলেছ যে মাম্মা চলে গেছে। এই তো মাম্মা।"
কুইন কী করবে ভেবে পায় না। দেখে স্যারের মুখের রেখায় কাঠিন্য,কিছুটা লালচে আভা ধরেছে। সেটা রাগ না অস্বস্তি বুঝতে পারে না। স্যার ওর হাতটা ধরে টানেন," চল চল তাড়াতাড়ি এখন। আর এটা একটা দিদি হয়। সী ইজ মাই স্টুডেন্ট।"
-" নো সী ইজ মাই মাম্মা। আমি থাকব ওর কাছে।"
কুইনের অস্বস্তি তখন চরমে পুচকেটা ওর স্কার্টটা একদম চেপে ধরে আছে। খুব জেদ তো মেয়ের,কোন কথাই শুনছে না।
অগত্যা কুইন ওকে কোলে তুলে নিয়ে ভোলাতে শুরু করে,কিছুটা নিজেই দৌড়ে নেয় রেললাইনের ওপর ওকে পিঠে নিয়ে। তারপর অনেক ভুলিয়ে ভালিয়ে আবার আসবে প্রমিস করে ওকে গাড়িতে তুলে দেয়।
মেয়েকে গাড়িতে তুলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন রাজা সেন। কী সাঙ্ঘাতিক মেয়ে! অদ্ভুত বিহেভ শুরু করল সম্রাজ্ঞীকে দেখে। ইশ্ ভীষণ বাজে পরিস্থিতি, শেষে ওকেই ছাত্রীকে সরি বলতে হয়েছে। তবে মেয়েটাকে আর গাড়িতে উঠতে বলতে পারলেন না। ওকে নিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরাটা বোধহয় ঠিক হত না। তাছাড়া প্রিন্সেস একটু ভুলেছে ওকে দেখলে ছাড়তে চাইত না। কিন্তু হঠাৎ ওর মাথায় এই মাম্মার ভূতটা ঢুকলো কী করে?
গাড়িটা চলে যাবার সময় পুচকেটা মুখটা বাড়িয়ে সমানে হাতটা বাড়িয়ে বাই মাম্মা,তুমি আবার আসবে তো? আমি কিন্তু তোমার কাছে যাব। বলতে বলতে গেল। কুইন ওর নরম হাতের ছোঁয়া এখনও অনুভব করল। তারপর এলোমেলো হাঁটা আর পথচলার মধ্যে টুকটাক স্ন্যাক্স খেয়ে ফিরল ক্যাম্পাসে। হস্টেলে ঢোকার মুখেই রকিদাকে দেখল ওকে দেখেই হাসল তারপর বলল," কী রে কোথা থেকে?"
-" এই একটু শপিং ছিল তাই।"
-" এখানে একটু বসে যা, আমরা বেশ আড্ডা মারছি।"
-" নাহ্ তোমরা গল্প কর,আমি রুমে যাচ্ছি,মাথাটা ধরেছে।"
একজন কেউ আওয়াজ দেয়,রকি মাথা ব্যথা বলছে,কিছু ওষুধ এনে দে,নাকি মাথা টিপে..."
কুইন সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় ওদের কথা আর হাসাহাসি পাত্তা না দিয়ে।
ঘরে এসে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে, মাথার মধ্যে অনেকগুলো চিন্তা জট পাকিয়ে যায় বারবারই চোখের সামনে পুচকেটার মুখটা ভেসে ওঠে। অদ্ভুত সুন্দর নাম আর মিস্টি দেখতে বাচ্চাটা। দুটো নামই খুব সুন্দর, তবে ও হঠাৎই মাম্মা মাম্মা করছিল কেন ওকে? প্রথম এসেই শুনেছিল স্যারের বৌ নাকি চলে গেছে তাই উনি সুন্দরী মেয়েদের দেখতে পারেন না। তবে আর জানা হয়নি স্যারের পার্সোনাল লাইফের কিছু। তবে এই কয়েক মাসে মানুষটার প্রতি একটা অদ্ভুত ভালোলাগা আর ভয় দুটোই তৈরী হয়েছিল। স্যারও ওকে প্রায়োরিটি দিতেন,ওর সাথে ইংরেজীতেই কথাবার্তা বলতেন। বুঝতে পেরেছিল মোটামুটি স্যারের ক্লাশ ভালো করে ফলো করে বলে আর বিরক্তির তালিকাতে ও নেই। স্যারের চোখে আর গলায় একটা অদ্ভুত মাদকতা আছে। নিজের বাবাকে কোনদিনই দেখার সুযোগ হয়নি। তবে আজ পুচকেটার বাবাকে দেখে সত্যিই কেমন যেন মনটা উদাস হয়ে গেল,হয়ত ওর বাবা থাকলে ওকেও এমন নিয়ে যেত বাইরে বেড়াতে। ও দুষ্টুমি করলে বকত,লুকোচুরি খেলতে খেলতে হারিয়ে গেলে খুঁজত। কুইনের বন্ধ চোখের আসেপাশে ঘুরতে থাকে দুটো মুখ বারবারই, আর একটা ডাক মাম্মা। ও মাকে মা বলেছে বরাবরই, ছোটবেলায় মা ডাক যত বেশি ডেকেছে এখন ততই কম ডাকে। ফোনে মা বলে কী শুরু করে কথা? অথবা কী ডাকে মা বলে? মনে করার চেষ্টা করে কুইন। মা কলকাতা থাকতে একদিন অভিযোগ করেছিল," মা বলে ডাকতে তো ভুলেই গেছিস। সারাদিনে কবার মা বলিস একবার মনে করিস তো?"
-" আমার অত সময় নেই মনে করার,সবাই জানে তুমি আমার মা,তুমিও জানো। মা মা বলে অত জানান দেবার দরকার নেই।"
-" যখন থাকব না তখন বুঝবি,আর কাউকে পাবি না মা ডাকার।"
কথাটা শুনে দুম করে মায়ের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল কুইন। দেবীর চোখ ভিজেছিল। অবশ্য সেটা ম্যাটার করেনি মেয়ের কাছে।
আজ বাচ্চাটা ওকে অন্ততঃ দশবার ঐটুকু সময়ে মাম্মা করে ডেকেছে। কুইনের হাসি পায় ওর মাম্মা মানে স্যারের... ইশ্ তাই বোধহয় স্যারের মুখটা অমন রাগী হয়ে উঠেছিল। তবে এমন একটা সুইট বেবির মাম্মা হলে মন্দ হয় না,আর স্যারকে তো...ভাবতে ভাবতে চোখটা কখন বুজে গেছিল বুঝতে পারেনি।
২৪
রাস্তায় মেয়েকে আর কিছু বলেন না রাজা সেন। কী আর বলবেন ঐটুকু মেয়েকে? আজ আবার খুব মনে হয় তোর্সাকে। ওদের ভালোবাসার দিনগুলোতে আবার ডুবে যায় মন। কত রঙীন ছিল দিনগুলো, হঠাৎ যে কী হয়ে গেল কে জানে? আজকাল নিজেকেই দায়ী মনে হয়। তোর্সার মত মেয়েদের যে কখনই বাঁধনে বাঁধা যায় না তা আগেই ভাবা উচিত ছিল। তখনকার মত ভালোবাসা দিয়ে মন জিতে নিলেও ও প্রায়োরিটি দিয়েছে নিজের কেরিয়ার সবসময়। আসলে মানসিকতার অনেকটা ফারাক ছিল দুজনের। তবুও কেন যেন ভুলতে পারেন না এখনও তোর্সাকে,হয়ত প্রথম প্রেম হয়ত এত সহজে বোঝা যায় না। শুধু খুব খারাপ লাগে মেয়েটার জন্য, কেমন মা তোর্সা? একবারও ভাবেনি মেয়ের কথা। আসলে বন্ডিংটাই তৈরী হয়নি ওর মেয়ের সাথে,মা বলেন বাচ্চাকে কোলে না নিলে,বুকে জড়িয়ে বুকের দুধ না খাওয়ালে মা আর সন্তানের বন্ডিং তৈরি হয় না।
তিস্তাকে তো কখনই বুকে জড়ায়নি তোর্সা। মেয়েকে পাশের ঘরে আয়ার কাছে রেখে রাত অবধি পড়াশোনা করে ঘুমিয়ে পড়েছে। অবশ্য তাতে কখনও বাধা দেননি রাজা সেন,পড়াশোনা করুক তোর্সা সেটা তো তিনিও চাইতেন। তবুও মাতৃত্ব একটু হলেও নরম করে মন তোর্সার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। যাক সেসব কথা,আর এখন তো সম্পর্কের ছেঁড়া সুতো বিচ্ছেদের কাগজের সইয়ে একদমই ছিন্নভিন্ন। কতদিন হবে?এই তো একমাস আগেই সবটাই শেষ হয়ে গেল মোটামুটি। তোর্সার অনেক কথা জেনেও অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু ও রাজি হয়নি। সাফ বলেছিল," দেখ এ ভাবে কোন সম্পর্কে থাকতে আমি রাজি নই। আমি এখানে তুমি ভারতে এভাবে কী করে হয়? দুজনেরই কিছু চাহিদা আছে। তবে মেয়েকে রাখতে না পারলে আমি নিয়ে যাব।"
-" ওকে তো একবারও দেখলেই না কত বড় হয়েছে,কেমন হয়েছে।"
-" দেখে মায়া বাড়িয়ে কী লাভ? জানি তুমি দেবে না ওকে। অবশ্য বাপি বলছিল ওকে নিতে।"
মুখটা কঠিন হয়েছিল রাজা সেনের বলেছিলেন," না ও আমাকে চেনে,থাক আমার কাছেই।"
কোয়ার্টারে এসে আজ মাসিকে ডাকেন রাজা সেন...
-"আচ্ছা তুমি কী ওকে ওর মায়ের কোন ছবি দেখিয়েছ এর মধ্যে? ইশ্ আজকে তো যাতা কান্ড করেছে।"
ওদের কথার মাঝেই ছুটে আসে তিস্তা," মাসি আমার মাম্মা খুব ভালো, আজ দেখেছি। আমাকে কোলে নিয়েছে,আদর করেছে। বাবা খুব দুষ্টু আমাকে জোর করে নিয়ে এল। মাম্মাকে গাড়িতে উঠতে দিল না।"
কিছু জবাব দিতে পারে না মাসি প্রথমে তারপর একটা ফটো নিয়ে আসে হাতে করে। ছবিটা দেখে কয়েক মুহূর্ত নিজেও কিছু বলতে পারেন না রাজা সেন। এই ছবিটা তিনিও তো দেখেননি কখনও,কোথা থেকে এল এটা? ছবিটা তিস্তার তবে অনেক কম বয়েসের,ওর পরনে একটা স্কার্ট, টপ,কাঁধে ব্যাগ। ঠিক এমনি লাগছিল সম্রাজ্ঞীকে দেখতে আজ।
-" কোথায় পেয়েছ এটা?"
-" ঐ ঘরে কিছু বই আছে না,একটা বইয়ের ভেতরে ছিল। সেদিন ঝাড়ামোছা করতে গিয়ে পড়ল,আর তিস্তা তখন ওখানেই ছিল। ছবিটা নিয়ে বলতে লাগল কার ছবি? তাই আমি বলেছিলাম।"
আর কিছু বলার অপেক্ষা থাকে না,পুরোটাই এবার পরিস্কার। তবে ঘটনা প্রবাহের ইতি হয় না এখানেই,বরং ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে।
যে কুইনকে রাজা সেন পছন্দ করতেন না তেমন,এখনও সে যে খুব পছন্দের তালিকায় তা নয়। তাকে আজকাল প্রায়ই দেখা যায় তিস্তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে কোয়ার্টারের কাছাকাছি। কখনও বা ওদের সাথে আরও দু একটা বাচ্চা মেয়েও থাকে। তিস্তা এখন ঐটুকু খুশি পেতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে,ও জানে যে মাম্মা শুধু খেলতে আসে ওর সাথে তারপর আবার বাড়িতে চলে যায়,আসলে ওর মত মাম্মাকেও যে স্কুলে যেতে হয়,পড়াশোনা করতে হয়। তাই সবসময় থাকতে পারে না।
কোন কিছুই চাপা থাকা সম্ভব নয়,প্রথম এক দুই মাস কেউ তেমনভাবে কিছু জানতে পারেনি। তবে আস্তে আস্তে সবটাই একটু হলেও প্রকাশিত হয়েছে।
কুইন নিজেকে আড়ালে রাখতে পারেনি রকিদার কাছ থেকে। মেয়েটার পেছনে পড়ে থেকে রীতিমত আপসেট রকি,কিছুতেই ওকে পাত্তা দিতে চায় না। একদম যেন অন্য জগতে বাস করে। কথা বললে উত্তর দেয় বলো কী চাই? আমার এখন অন্য কাজ আছে,এখন ক্যান্টিনে যেতে পারব না।
-" আরে চল বরং ঐ দিকটাতে ঘুরে আসি,তুই তো মাঝে মাঝে যাস ওখানে।"
ভুরু তুলে কুইন জিজ্ঞেস করে,"কোন দিকটাতে? বলছি না আমার অন্য কাজ আছে।"
-" আরে ঐ যে চাবাগানের ওদিকে রেললাইনের ধারে। জায়গাটা খুব সুন্দর। তুই তো যাস মাঝেমাঝে ওখানে।"
-" এত খবর রাখো,রকিদা সত্যি তুমি জিনিয়াস।"
বোকার মত হাসে রকি," শুধু তুই বুঝলি না। বাইকে করে চল দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।"
কুইন কোনদিন রকির সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। শুধু একটা ঠান্ডা আচরণ করে গেছে তাই কাটানোর জন্য বলে," আচ্ছা পরে একদিন যাব,সাথে মেঘনা,টুসি ওরাও যাবে। তুমি বরং সেদিন গাড়ি নিয়ে এসো।"
রকিকে পেছন থেকে দলের একটা ছেলে ডাকে ও চলে যায়। ওহ্ কিছুতেই মেয়েটাকে কব্জা করা যাচ্ছে না। এমন একটা মেয়ে বাইকের পেছনে বসে গেলে তো ওর স্ট্যাটাস এয়নিতেই বেড়ে যাবে। কিন্তু হচ্ছে কোথায়?
*********************
কুইন মাঝে ছুটিতে বাড়ি গেছিল,অনেকদিন বাদে বাড়িতে এসে ভালোই লাগছিল। সবই যেন একটু বেশি করে পাওয়া। মা ভালো মন্দ রান্না করছে আম্মা আদর করছে। নীচের দোকানটা মা ভালোই সামলাচ্ছে,তবে বেশ কিছুটা মাল এনে দিল নিজে পছন্দ করে। সাজালো আবার নতুন করে দোকানটা।
তিস্তাকে বলে এসেছিল,ওকে বাড়ি যেতে হবে কয়েকদিন বাদেই ফিরবে। কথাটা শুনেই বায়না ধরেছিল," তুমি যেয়ো না মাম্মা,আমার মন খারাপ করবে খুব।"
-" তোকে বলেছি না মাম্মা বলতে নেই,উই আর ফ্রেন্ড।"
-" বলেছ তো সবার সামনে মাম্মা না বলতে,বাবা রাগ করবে। সবাই তোমাকে বকবে। একবার লুকিয়ে লুকিয়ে মাম্মা বলি না...ফ্রেন্ড তুই যাস না রে।"
হাসি পায় কুইনের ওর আহ্লাদীপনা দেখে। আজকাল মাঝেমধ্যে ওকে আদর করে তুই বলে ফেলে।
প্রতিদিনই একবার করে ফোন করে,অনেকক্ষণ বকবক করে। তারপর স্যারের বকুনি খেয়ে থেমে যায়। ওপাশ থেকে স্যারের গলাটা শুনতে পায় কুইন অথচ কোনদিনই ওর সাথে কোন কথা বলেন না। একদিন বরং ওকে বলেছিলেন," তুমি এখানে এসো না,প্রিন্সেসের অভ্যেস খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তুমি তো একটা সময় বাদে চলে যাবে। ওকে এভাবেই বড় হতে হবে। তাছাড়া তোমার পড়াশোনা আছে তার ক্ষতি হোক আমি চাই না।"
-" আমি তো আসি না প্রতিদিন,মাঝেমধ্যে আসি।"
-" না মাঝেমধ্যেটা একটু একটু করে কম করে দাও ওর অভ্যেস হয়ে যাবে।"
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছিল কুইনের যায়নি কয়েকদিন, তারপর একদিন স্যারের ফোন থেকেই মাসি ফোন করেছিল একবার আসতে মেয়েটা ভীষণ কান্নাকাটি করছে। কুইন তাও যায়নি,তবে ঘোরাঘুরি করছিল ক্যাম্পাসের ওদিকটা হঠাৎই দৌড়ে এসেছিল প্রিন্সেস খামচে ধরেছিল ওর জামা। ওর ছোট্ট গলাটা কেঁপে উঠেছিল অভিমানে তুমি আসছ না কেন গো?
- বেশ কিছুটা কথা আর মাম্মা না বলার প্রমিস করিয়ে ফিরে এসেছিল কুইন। ও বলেছিল লুকিয়ে লুকিয়ে বলব। কুইন ফিসফিস করে বলেছিল আমি তোর মাম্মা নই,তোর মাম্মা আলাদা। আসবে ঠিক একদিন তারপর তিস্তাকে কোলে তুলে নিয়ে অনেক আদর করবে।
ছোট্ট তিস্তার মাথায় কিছু ঢোকেনি ও ঝাঁপিয়ে এসে পড়েছিল কুইনের কোলে তারপর ওর কাঁধে পিঠে উঠে আদর খেয়েছিল। হঠাৎই দৃশ্যটার রকির চোখে পড়ে গেছিল।
-" সম্রাজ্ঞী এই বাচ্চাটা কে রে? তোকে তো খুব চেনে দেখছি। ও কী কোয়ার্টারে থাকে?"
কুইন কিছু বলে না। রকি অবশ্য উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে," ও ওকে তো দেখেছি আমি,স্যারের মেয়ে। নেড়ু হয়েছে বলে চিনতে পারিনি।"
নেড়ু কথাটা খুব বাজে লেগেছিল তিস্তার,বলেছিল," তুমি আমাকে নেড়ু বললে কেন? তুমি পচা ছেলে।"
কুইনের হাসি পেয়েছিল একটা বাচ্চাও বুঝতে পারছে ছেলেটা পচা।
রকি গায়ে মাখেনি বলেছিল," আমি পচা! আর এই মেয়েটা যার কোলে উঠেছ ও?"
-" ও ভালো, ও আমার ফ্রেন্ড।"
-" বুঝলাম সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র, বাচ্চাও করে সুন্দরীদের কদর। আমার ভাগ্যটাই শুধু খারাপ। আমার কদরের দাম আর কেউ দিল না।"
******************
দেবী দেখে গেছে কয়েকবার মেয়ে গল্পে মগ্ন কার সাথে যেন ফোনে। কিছুটা দেখে একবার ভাবে হয়ত ওখানে কোন বন্ধু হয়েছে। যাক এই মেয়ের যদি একটা ভালো বন্ধু হয় তো ভালো হয়। কাউকেই তো যেয়ের মনে ধরে না। বেশ কিছু বাদে এসে জিজ্ঞেস করে যায় একবার," চা যে ঠান্ডা হয়ে গেল রে,কার সাথে কথা বলছিস? নতুন বন্ধু নাকি?"
কুইন তাচ্ছিল্যের ভাব করে হাত নাড়ে।
দেবী তাকায়, তারপর হঠাৎই শুনতে পায় স্পীকারে একটা কচি গলার আওয়াজ। কুটুর কুটুর করে চড়ুই পাখির মত কিচমিচ করে যাচ্ছে। তার কত কথা শেষই হয় না। দেবী কিছুটা প্রশ্ন নিয়ে চলে যায়। তারপর ওদের কথা শেষ হলে জিজ্ঞেস করে," কে রে?"
কুইন হাসে," আমার বাচ্চা মা। দেখছ না কত মিস্ করছে আমাকে।"
হঠাৎই বুকটা কেমন যেন কেঁপে ওঠে দেবীর।
-"এইসব কী ধরনের ইয়ার্কি কুইন? তোর বাচ্চা আসবে কোথা থেকে শুনি? যা মুখে আসে তাই বলিস নাকি?"
-" সত্যিই আমার বেবি ওটা আমাকে মাম্মা বলে ডাকে,কী যে সুইট বলে বোঝাতে পারব না। দেখলেই চটকাতে ইচ্ছে করে। দাঁড়াও তোমাকে ওর গল্প বলব। তুমি শুনলে আর ওকে দেখলে অবাক হয়ে যাবে।"
২৫
মেয়ের কাছেই প্রিন্সেসের গল্প শুনেছিল দেবী,তারপর মায়েরা যেমন বলে তেমনি বলেছিল," তোর নামের সাথে বেশ মিল আছে বাচ্চাটার।"
-" ধুৎ ওর বাবার নাম রাজা তাই ও প্রিন্সেস ওর আরেকটাও নাম আছে তিস্তা। ওহ্ মা খুব হ্যান্ডসাম দেখতে বুঝলে স্যারকে। আমি তো মোটামুটি স্যারকে দেখলেই একদম ক্র্যাশ খেয়ে যাই। কোন কথা বলতে পারি না। প্রথম দিনই তো টক্কর দিয়েছিলাম স্যারকে। ওহ্ কী পার্সোনালিটি মা..."
-" চুপ কর,তোর মুখে কিছু আটকায় না। স্যারের তো অনেক বয়েস তারপর বিবাহিত। এসব চিন্তা মাথাতেও আনিস না কখনও।"
-" ধ্যাৎ কী যে বল,এমনি বললাম। তবে বিবাহিত না ছাই,বৌ নাকি পালিয়ে গেছে। কেমন মা কে জানে? কত কিউট বেবিটা মাকে সবসময় মিস্ করে। বাচ্চাটা কাজের লোকের কাছে মানুষ হচ্ছে।"
-" ওটা ওদের ব্যাপার। কার দোষ ওরাই জানে। তবে স্যারের সাথে দূরত্ব রাখাই ভালো কুইন। আজকাল দিনকাল ভালো নয়। অপরিচিত জায়গা,কখন কী হয় কে বলতে পারে? আর বাচ্চাটার সাথেও বেশি মাখামাখি করিস না। অন্যদিকে তোর অসুবিধা হবে।"
-" মা এইজন্য তোমাকে কিছু শেয়ার করি না আমি। যেই শুনলে সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল। একটা ছোট বাচ্চা আমাকে ভালোবাসে তাকে নিয়েও তোমার সমস্যা! বেচারির মা নেই আমাকে ভালোবাসে,কত আদর করে। কী অন্যদিকে অসুবিধা মা?"
-"আরে তোর পড়াশোনার ক্ষতি হবে। রাগ করিস না,কিন্তু তোর তো মোটামুটি আর একটা বছর আছে। অনেকগুলো মাসই তো কেটে গেল,তুই চলে এলে ওর কত কষ্ট হবে ভেবে দেখেছিস? যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয়?"
-" মা কী বলছ? উল্টোপাল্টা আবার কী হবে?"
-" আরে বাচ্চাদের একটা অভ্যেস হয়ে যায় ও মায়ের মত তোকে ভালোবেসে ফেলছে। যা হয় আরকি মানে স্কুলে দেখে সবার মা আছে,নিতে দিতে আসে। ওর নেই.."
-" আমি জানি মা,এই অপোজিট ফিলিংসটা তো আমারও ছিল। অপোজিট বলছি কেন মানে সেম ফিলিংস,আমি দেখতাম সবার পাপা আছে আমার নেই। আমি ফিল করতে পারি মা ওর কষ্ট।"
-" ওর মা আছে কুইন,আর যদিও বা ডিভোর্স হয়েও যায় মায়ের অধিকার সবসময় থাকে বাচ্চার ওপর। যে কোন সময়ে ওর মা এসে ওকে নিয়ে যেতে পারে,ও নেহাত শিশু।"
-" মা দেখেছ তো? কেমন জটিল তুমি মানে কমপ্লেক্স ক্যারেকটার। একটা ছোট্ট বাচ্চা আমাকে ফোন করেছে সেটা নিয়ে কত কথা বলছ। এইজন্য তোমার জীবনে কিছু হল না।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেবী," জানি তো কিছুই হয়নি,তাই তো মনেপ্রাণে চাই আমার মেয়েটা যেন ভালো থাকে। খুব ভালো থাকে। আচ্ছা ছাড় ওসব কথা, বল ওখানে তোর কার কার সাথে বন্ধুত্ব হল? কোথায় কোথায় ঘুরলি? আগের বার তো এসেই চলে গেলি তেমন করে কথাই হয়নি।"
-" কী আর বন্ধু হবে? ঐ ডিপার্টমেন্টের দুএকজন আর হস্টেলে সবাই মুখচেনা বাট তেমন জমে না কারও সাথে। আমার একা থাকতেই ভালো লাগে মা। আসলে আমার গল্প করার মত কিছু নেই। আর অন্যদের নেকু গল্প শুনতেও ভালো লাগে না।"
-" সেসব তো গেল,আর ছেলেবন্ধু? মানে বয়ফ্রেন্ড?"
-" প্লিজ চুপ কর,ঐসব নেকু ছেলে আর বোকা বোকা প্রেমিক আমার চলবে না। আর একট বাঁদর তো জ্বালিয়ে মারছে সেই প্রথম থেকে।"
-" কে সেই ছেলে? তোদের ব্যাচের?"
-" না সিনিয়র,আমাদের ডিপার্টমেন্টের। একদম বদের বাসা ছেলেটা,হাজার একটা মেয়ের বারোটা বাজিয়ে আমার পেছনে লেগেছে। বড়লোকের বখাটে ছেলে,এখানকার নেতা। সামনে বছর বিদায় হলে বাঁচি,অসহ্য।"
মায়ের কাছে রকির গল্প করে কুইন। প্রথম দিকটা মজা করে শুনলেও ছেলেটা যেভাবে টকখাই করে মেয়ের পেছনে লেগেছে সেটা শুনে বেশ চিন্তা হল দেবীর। কুইন তো বলছে ছেলেটা ভালো নয়। তারপর আবার ওকে জ্বালাচ্ছে সবসময়,ও পাত্তা দিচ্ছে না। কোন ক্ষতি করবে না তো?
মেয়েকে কথাটা বলতে ও চটে যায়," মা, ছাড়ো ওর কোন দম নেই। তবে ফলো করাটা ইরিটেটিং। আমাকে ফলো করে ও সেবক চলে গেছিল জান?"
-" তুই একা একা সেবক গেছিলি নাকি?"
-" হ্যাঁ গেছিলাম,তো কী হয়েছে? আমি তো একা একাই সব জায়গায় যাই। আমার ভালো লাগে। ভাবছি একদিন সেই গ্ৰামটার হদিশ করব যেখানে তুমি ছিলে।"
-" আর একদম এই কথা বলবি না,আর কোথাও যাবি না একা একা। আমাকে কথা দে কুইন। আমি নিজের বর্তমানে অনেক ভালো আছি। তুই যদি আমার অতীত নিয়ে আর কোনদিন কথা বলিস আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।"
কুইন বুঝতে পারে না হঠাৎ করে মা এত উত্তেজিত হয়ে উঠল কেন?
ওরও রাগ হয়ে যায় শুধু বলে," এইজন্য আমি কম কথা বলি। বেশি কথা বললেই মুশকিল।"
দেবী উঠে ঘর থেকে চলে যায়। আজ আবার ওর কান্না পায়,হঠাৎই কেমন যেন ভয় হয়। কে জানে কুইনের এই মন মর্জি মত চলাটা ওকে শেষপর্যন্ত কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে?
*******************
বাতাসে বসন্তের হাতছানি,ক্যাম্পাসে কয়েকটা পলাশের গাছে পলাশের কুঁড়ি তার ভালোবাসার রঙ ছড়িয়েছে। হয়ত কিছুদিন বাদেই ফুটবে ফুল। তবে ফেব্রুয়ারী জুড়ে প্রেম বসন্তের হাতছানি। ওদের ক্যাম্পাসেও তার প্রভাব পড়েছে,একটার পর একটা ডে আসছে আর সবাই ভাসছে প্রেমের খুশিতে। রকির চলে যাবার ঘন্টা বেজে গেছে তবুও দলের অজুহাতে রয়ে গেছে ইউনিভার্সিটির হস্টেলে। অজুহাত শুধু দল নয় কুইনকেও কাছে থেকে দেখা আরও কিছুদিন। তবে এবার ভ্যালেন্টাইন ডের সুযোগটা মিস করতে চায় না রকি। কেন যেন কুইনের কাছে এলে একটু গুটিয়ে যায় ও,ঠিকমত সব কথা গুছিয়ে বলতে পারে না। তবে এবার ঠিক বলবেই হাতে গোলাপ নিয়ে।
মা আসার সময় বারবারই বলে দিয়েছে," রাগ করিস না মা,কোন ঝামেলাতে জড়াস না। ওই বাচ্চাটার কাছেও বেশি যাওয়ার দরকার নেই। একেই স্যারের বাচ্চা তুই স্টুডেন্ট। কী দরকার সেখানে বেশি যাওয়ার? আর বাচ্চাটার অভ্যেসও খারাপ না করা ভালো। যার মা নেই তাকে মা ছাড়া থাকতেই অভ্যেস করতে হবে।"
-" বুঝেছি ও আমার মত মানে বাবা নেই সেই অভ্যেস নিয়েই বয়ে বেড়াচ্ছি এতগুলো বছর ধরে। ও তেমন মাম্মা মাম্মা করে কাঁদবে,কোনদিনই কাউকে পাবে না যে একটু সিমপ্যাথি দেখাতে পারে।"
-" সিমপ্যাথি দেখানোর দায়িত্ব কী তোরই?"
-" একটু যদি দেখাই তো ক্ষতি কী? টাকা তো খরচ করে কিছু করছি না।"
ট্রেনে আসতে আসতে মায়ের কথাগুলো বারবারই ভেবেছে। অন্য ছেলেমেয়েদের মত কুইনের হোমসিকনেশ নেই,বরং বাড়িতে না আসতে হলেই ওর ভালো লাগে। কথায় কথায় এটা করিস না আর ওটা করিস না এইসব লেগেই আছে।
বেশ কিছুদিন ছুটি কাটানোর পর আবার ফিরে আসা হস্টেলে,একটা বছর পার করে নতুন ক্লাসে পা রাখা। এখন ওদের মধ্যে বেশ দিদি দিদি ভাব। এসেই দেখেছে মেধা ঘর পাল্টে ফেলেছে,কিছুদিন একদম ভালো করে কথা বলত না মেধা।
মেঘনা বলেছিল আজকাল রকিদার সাথে নাকি প্রায়ই দেখা যায় মেধাকে। হঠাৎই দুইয়ে দুইয়ে চার হয়েছিল যখন দেখেছিল ও যেখানে যাচ্ছে সেখানেই গিয়ে হাজির হচ্ছে রকিদা। একদিন মেধাকে বলেছিল," হ্যাঁ রে রকিদা তোকে কী স্পাই রেখেছে নাকি? আমার সব খবর পাঠানোর জন্য কী দিচ্ছে তোকে? না ভালোই করেছিস,অমন সুন্দর বয়ফ্রেন্ডকে সব বলা যায়।"
রেগে উঠেছিল মেধা," কী বলছিস তুই? নিজেকে এত বড় ভাবিস না। যা মুখে আসছে তাই বলছিস! রকিদাকে নিয়ে আমাকে..."
কুইন বুঝেছিল মেধা ঝগড়া করতে পারে না,তাই ওর চোখ ছলছলিয়ে উঠল। আর ও একটু চাপা মেয়ে বলে বোধহয় রকিদা ওকে চট করে নিজের হাতের মুঠোতে আনতে পেরেছে। কেন যে মানুষ এত ভীতু হয়? তারপরে পেয়েছিল আসল খবরটা মানে রকিদার রুমমেটের সাথে মেধার প্রেমের খবর। পুরোটাই বুঝতে পেরেছিল কুইন,হয়ত ও কিছু বলেনি রকিদাকে সোজাসুজি কিন্তু ভায়া মিডিয়া কথাগুলো ঠিকই চলে যায়। যাক যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।
এখন কুইন ঘরে একা হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই কোন পার্টওয়ান এসে যাবে ঠিকই। জানলার পাশের বিছানায় শুয়ে মন তলিয়ে যায় সুখবিলাসে। সাধ করে করা কফি জুড়িয়ে যায় যখন মনে হয় স্যারের কথা। এইকদিন আর ও তিস্তার সাথে দেখা করেনি। ও ফিরে এসেছে সেই কথাও বলেনি,ফোন করলে বেশি কথা বলেনি নিজেকে সংযত করতে চেষ্টা করেছে।
আজ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাইরেটা দেখছিল,মেঘনা আজ আসেনি। স্যারকে দেখে একটু সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে,মুহূর্তে চোখাচোখি হয়ে যায়। স্যার দাঁড়িয়ে পড়েন তারপর বলেন," বন্ধুকে মিথ্যে বলছ কেন? এনি প্রবলেম? ওদিকে তারও মুড অফ। আজকাল বেড়াতে যেতেও চায় না। খুবই ঝামেলা করছে মাঝে মাঝে। পারলে একটু দেখা করে নিয়ো।"
কুইনের বলতে ইচ্ছে করল আপনি তো বলেছেন ঝর অভ্যেস খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তাই আমিও চেষ্টা করছি যদি ও আমাকে ভুলে যায়।
-" না আসলে ওর অভ্যেসটা খারাপ.. তাই আমি আর যাইনি।"
-" আপাতত ভীষণ মন খারাপ প্রিন্সেসের তারপর কাল আবার ওর..."
পুরো কথাটা না বলে স্যার চলে গেলেন হঠাৎই। কুইন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সত্যিই লোকটা কিছুটা পাগলাটে,এই বলে মেয়ের অভ্যেস খারাপ হচ্ছে,আবার এই বলে মন খারাপ। কাল আবার কী কে জানে?
যাকগে যা হয় হবে,এখনও দুটো ক্লাস বাকি আছে সে দুটো করে একবার ঘুরে আসবে না হয়। এবার এখানে এসে কুইন একটা সাইকেল কিনেছে ওর জন্মদিনের পাওয়া টাকাতে। স্কুটিটা তো ওখানেই পড়ে,আসলে এভাবে হেঁটে হেঁটে আর ভালো লাগছে না। মা তাও বাগড়া দিচ্ছিলো। বলেছে এখান থেকে যাবার সময় বিক্রি করে দেবে। একটু কম দাম হলেও বেশ সুন্দর সাইকেলটা। এখন সাইকেলে করেই এদিক ওদিক যায়,রকিদা আওয়াজ দিয়েছে," আরেব্বাস নতুন বাহন! কিন্তু মহারাণী তো সাইকেলে চড়ে না। রথ বা হাতি না হলে একটা চার চাকা বা বাইক হলেও হত। শেষে সাইকেল..."
কুইন হেসে হাল্কা করেছিল," আপাততঃ এটাই থাক পরে দেখা যাবে। নিজেকে নিজেই বহন করার মত ক্ষমতা আমার আছে। তোমার রেজাল্ট কেমন হল?"
-"ভালোই হয়েছে, আর চাকরিও মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।"
-" ওহ্ তাই নাকি! খুব ভালো।"
পাশ কাটিয়ে সাইকেল নিয়ে চলে এসেছিল কুইন। আর ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রকি গেয়েছিল চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছ... তারপর নিজেই বলেছিল মনে মনে আর কয়েকদিনের অপেক্ষা।
ক্লাসের পর ব্যাগটা ক্যারিয়ারে রেখে সাইকেলটা নিয়ে সোজা স্যারের কোয়ার্টারের সামনে গিয়ে টিং টিং করে বেল দিয়েছিল। কাউকে বেরোতে না দেখে নিজেই হেসেছিল,ও তো সাইকেল নিয়ে এর আগে আসেনি প্রিন্সেস কী করে জানবে? তারপরেই দুহাত মুখে দিয়ে শিস দিয়েছিল,অবশ্য এইজন্য বকুনিও খেয়েছে একদিন স্যারের কাছে। তবুও আজ ইচ্ছে হল কারণ ও জানে এখনও স্যার ফেরেননি,গাড়িটাও নেই। হয়ত কোন মিটিং আছে বা লাইব্রেরীতে আছেন।
- বন্ধু এসে গেছে, আমার মাম্মা এসে গেছে। মাসি আমি নীচে যাব,দরজা খুলে দাও।"
মনটা ভালো হয়ে যায় কুইনেরও, দরজা খুলে প্রথমে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় তিস্তা তারপর নীচে নেমে আসে..সাইকেল! এটা তোমার? এতদিন কোথায় ছিলে? মাসি পচা বলছিল তুমি আর আসবে না।"
কুইনের কোলে উঠে পড়েছে অনেকক্ষণ আর সমানে বকবক করছে। মাসিকে হাত দেখিয়ে ওকে সাইকেলে বসিয়ে সামনের মাঠটাতে চক্কর মারে কুইন। তারপর এক জায়গায় বসে এতদিনের জমে থাকা কথার ব্যাগ খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
প্রতিদিনের মত আজও গাড়ির হর্নটা বাজে মাসি এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলে," দাদাবাবু সে তো বেরিয়ে গেছে গিয়া ওর বন্ধুর সাথে।"
ওপরে উঠে শরীরটা সোফাতে এলিয়ে দেন রাজা সেন। কেন যেন মনটা আজ খুব হাল্কা লাগছে। প্রতিদিন বাড়ি ফিরে মেয়ের এক কথার জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন এতদিন। কিন্তু কাল যে ওর জন্মদিন সেটা তো বলা হল না।
২৬
তিস্তা আদরে আদরে অস্থির করে তোলে কুইনকে। অনেক অভিযোগ করে তারপর বলে," মাম্মা কাল আমার বার্থডে তোমার মনে আছে তো? তুমি না আসলে আমি কেকই কাটব না। বাপিকে বলেছিলাম তো আমি।"
-" মাম্মা বলতে নেই বলেছি না। যদি সবার সামনে বলিস এমন মাম্মা মাম্মা তাহলে আমি আবার ভ্যানিস হয়ে যাব। আমরা ফ্রেন্ড, আমি তোর বন্ধু।"
কুইন বুঝতে পারে মেয়ের অভিমান ভাঙাতে ওকে আসতে বলেছেন স্যার। কী মায়াতে যে বেঁধেছে মেয়েটা,কেন যেন নিজেকে অনেকটা রিলেট করতে পারে ওর সাথে কুইন। তবে ওর এমন কোন বন্ধু ছিল না। তিস্তাকে লোকে সিমপ্যাথি দেখায় হয়ত বলে আহা রে এই বাচ্চা মেয়েটাকে মা ছেড়ে গেছে,কী কষ্ট মেয়েটার। আর ওকে লোকে ঘেন্না করত বলত ইশ্ কার বাচ্চা কে জানে? বাবার তো কোন ঠিকই নেই।
তবে স্যারের ওপর অভিমান হয় কুইনের,কেন যেন স্যার ওকে এখনও অপছন্দ করেন। দায়ে পড়ে কথা বলেন যেন। এতদিনের মধ্যে কোনদিনই ভেতরে আসতে বলেননি,ও তিস্তাকে নিয়ে বাইরে খেলা করেই চলে যায়। মেয়েটা সত্যি জাদু জানে নাহলে ওর মত কাঠখোট্টা মেয়ের মন জিতে নিয়েছে।
গোল গোল করে কিছুটা ঘুরিয়ে নিয়ে সাইকেলে ওকে বাড়ি ফেরানোর জন্য আসে কুইন। তার আগে ফিসফিসিয়ে বলে," কাল কী চাই বার্থডেতে? চকোলেট? পুতুল?"
--" তুমি আসবে তো কালকে আমার কেক কাটার সময়?"
কেমন যেন অস্বস্তি হয় কুইনের আজ অবধি কোনদিনই ও স্যারের ঘর বা মন কোন কিছুর অন্দরেই ঢুকতে পারেনি হঠাৎই কিভাবে জন্মদিনে ওর সাথে থাকবে কেক কাটার অনুষ্ঠানে?
-" আমি আসব তো,তোর সাথে দেখা করে এত্ত আদর করে চলে যাব। আর অনেক বড় একটা চকোলেট নিয়ে আসব। আমি রাত্রে কী করে আসব শুনি? আমি পড়তে না বসলে আমাকে যে বকবে স্যার। তুই কী চাস আমি বকা খাই?"
কিছুক্ষণ ভেবে মাথা নাড়ে তিস্তা,তারপর বলে এসো কিন্তু বিকালে।
সাইকেলের ঘন্টি শোনা যায় তার সাথে তিস্তার কচি গলার আওয়াজ। রাজা বলেন,
-" মাসি দরজাটা খুলে ওকে নিয়ে এসো,এলেন আমার রাজকন্যা। এবার বাড়িটা জেগে উঠবে।"
কুইন চলে গেছে একবার বারান্দায় তাকিয়ে, কখনও স্যার এসে বারান্দায় দাঁড়ান। হাল্কা হাসির রেখা দেখা যায় মুখে,সেটুকুই উজ্জ্বল করে কুইনের সাঁঝবেলা,কোথায় যেন স্যারের চেহারার সাথে ওর বাবার মিল পায়। আর মেয়েরা হয়ত বাবার ছায়াকেই বেশি ভালোবাসে। আজ স্যারকে দেখতে পায় না। ও সাইকেল নিয়ে চলে যায়,একটু বাদেই বিকেল শেষে সন্ধ্যে নামবে।
মেয়ের আব্দারে সামনের দরজাটা খুলে বাইরে দাঁড়ান রাজা সেন। বারবারই মেয়ে বলছে," তুমি বন্ধুকে আসতে বল বাপি, বন্ধু বলল বন্ধু এলে স্যার বকবে। চল না নীচে গিয়ে বন্ধুকে বলে আসি।"
-" তোর বন্ধু চলে গেছে এতক্ষণে,আচ্ছা দেখছি দাঁড়া। চল তো বাইরে।"
সত্যিই কুইন চলে গেছে,তিস্তার মুখ ভার হয়। কী করবেন ভেবে পান না। এই দুবছর তেমনভাবে মেয়ের জন্মদিন পালন করেননি,ও তখন কিছু বুঝতেও পারত না। এখন ও স্কুলে যায় সবার বার্থডে দেখে। তাই ওর বার্থডে করতেই হবে বলে বায়না। আসেপাশে যারা ওর বন্ধু তাদেরকে তো বলেছে ও নিজেই। তবে সম্রাজ্ঞীকে কী করে বলবেন? একটা মেয়ে বার্থডে থেকে রাতে হস্টেলে ফিরবে? না না তা হয় না। তাহলে কী ওর সাথে আরও কয়েকজনকে? না না তাহলে তো পুরো ডিপার্টমেন্টকে বলতে হয়। হিজিবিজি চিন্তাতে মাথাটা কেমন ভারী লাগে। যাক দেখা যায় কী হয়? তোর্সার কথা খুব মনে হয় আবার। মন থেকে তো একজনকেই ভালোবেসেছিলেন,কেন যে তোর্সা সেটা ভুলে গেল?
অনেক চেষ্টা করেছিলেন সম্পর্ক বাঁচাতে প্রিন্সেসের জন্য,তবে তোর্সা রাজি হয়নি ও বলেছিল," তুমি চলে এস কাজ ছেড়ে এখানে মেয়েকে নিয়ে। আমি আর ফিরব না ওখানে।"
হঠাৎই ঝিমিয়ে পড়া ব্রেনটা হাঁটতে থাকে ডাউন মেমোরি লেন ধরে,বুকে জড়ানো তিস্তাকে ধরে ঘুমের ঘোরে ঘুরে বেড়ান প্রফেসর রাজা সেন তোর্সার হাত ধরে।
***********************
অনেকটা ইগো আবার কিছুটা সামাজিক সম্মানের চাদর পরা রাজা সেনকে হাঁটতে দেয়নি সম্রাজ্ঞীর সাথে পাশাপাশি। সত্যিই তো একটা ছাত্রীকে নিয়ে আদিখ্যেতা করার কী আছে? আর এই মেয়েও হয়েছে তেমনি। নাহ্ ওকে কিছু বলার দরকার নেই আর। তাছাড়া তিস্তাকে ও যা বুঝিয়েছে সেটাই বলবেন। বিকেলে হয়ত আসবে একবার তা আসুক,তিস্তাকে দিয়ে একটা বক্স পাঠিয়ে দেবেন, বা মাসিকে বলবেন। নিজে দিলে ভালো হত তবে ওটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে হয়ত,ক্লাসের স্যার ইমেজে একটুও মোম লাগুক আর নরম উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ুক তা তিনি নিজেও চান না।
প্রিন্সেসের জন্য সুন্দর একটা টেডি আর অনেক বড় চকোলেটের বাক্স কিনে সেগুলো প্যাক করে যেতে একটু দেরি হয়ে যায়,তাও একটা ক্লাস বাঙ্ক করতে হল। তবুও ভাগ্যিস সাইকেলটা ছিল। আজ ওকে আরও সুন্দর লাগে দেখতে,অন্যদিন একদম সাদামাটা সাজে থাকা কুইনের চোখে আজ আইলাইনার,সুন্দর একটা ড্রেস গায়ে আর পায়ে হিল জুতো। এখানে এসে সাজের ইচ্ছে আরও কমে গেছে,কলেজে থাকতে বেশি সাজত। প্রিন্সেসের জন্মদিনে যাচ্ছে তাই একটু স্পেশাল...
তবে ক্যান্টিন পেরোতেই মুডটা খারাপ হয়ে যায় কুইনের,ইশ্ এটা এখনও এখান থেকে যায়নি। কালো বিল্লীর মত রাস্তা কাটলো।
-" আজ তো তোকে দেখে ফিদা হয়ে গেলাম, পুরো ক্যাটরিনা লাগছে তো? তবে সাইকেলে ঠিক... কোথায় যাচ্ছিস?"
-" আমার একটু তাড়া আছে রকিদা,আজ প্রিন্সেসের জন্মদিন, তাই ওর কাছে যাব একটু।"
-" দাঁড়া দাঁড়া কী ব্যাপার বল তো? স্যারকে তেল মারছিস এত? হ্যাঁ শুনেছি পার্ট ওয়ানে সেকেন্ড হয়েছিস।"
-" হ্যাঁ হয়েছি তবে সেটা নিজের যোগ্যতার ফলে তেল মেরে নয়। এখন সর,আমার তাড়া আছে।"
কথাগুলো বলে সাঁ করে সাইকেলটা রকির পাশ দিয়ে চালিয়ে বের হয়ে যায়। আর এই ছেলেটাকে পাত্তা দেবে না একদম। এতদিন সিনিয়র ছিল এখন তো এক্স স্টুডেন্ট, কেন যে এখানে পড়ে আছে কে জানে?
রকি রাগে তাকিয়ে দেখে ওর চলে যাওয়া মনে মনে বলে খুব দেমাক বেড়েছে তোর। আমি ভালোমানুষ বলে এতদিন সহ্য করছি। তবে ঐ আধবুড়ো স্যারটার বাড়িতে এত কিসের যাওয়া? বুঝতে পারছি তেল মেরে নিজের পজিশন ঠিক রাখছিস। আচ্ছা আমিও দেখব।
তেতো মেজাজ নিয়ে কুইন এসে সাইকেলের বেল বাজায়। প্রজাপতির মত বারান্দায় এসে দাঁড়ায় তিস্তা কচি গলাতে ওকে ডাকে।
-" তুই আয় নীচে দেখ কত কিছু এনেছি তোর জন্য।"
তিস্তার পাশে মাসি এসে দাঁড়ায় ওকে ডাকে কিন্তু যায় না কুইন। যার বাড়ি তিনিই তো বলেননি,ওর কী কোন আত্মসম্মান নেই? তাছাড়া ও তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে চায়।
আজও তো স্যার ওকে একবার বলতে পারত? যেন মনে হল ওকে চেনেনই না। তিস্তা ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়,এক অনন্য বন্ডিং যেন ওদের মধ্যে। কেন যে হঠাৎ এভাবে জড়িয়ে গেল বাচ্চাটার সাথে? আজ আর ওকে নিয়ে বেশি সময় কাটায়না কুইন। মাঠে ঘুরতে নিয়ে যায় না। ওর ড্রেস আর চুলটা দাঁড়িয়ে ঠিক করে দিয়েই,ওকে আদর করে গিফ্ট দিয়ে চলে আসবার উদ্যোগ নেয়। চোখটা ছলছল করে তিস্তার," তুমি থাকবে না চলে যাচ্ছো?"
-" আমাকে যে স্যার বকবে বলেছি না? তোর বন্ধুরা আসবে তো? খুব মজা করিস ওদেরকে নিয়ে। আমি আবার আসব পরে।"
কথাগুলো বলতে বলত চোখটা কেন যেন অভিমানে ভিজে যায় কুইনের। এখানেও অসম্মান তবুও ছুটে এল শুধু পুচকেটার টানে। আসলে ওকে কেউই কোনদিনই ভালোবাসেনি। সবার ওপর অভিমান হয় ওর। ঘরের ভেতরে থাকলেও আজ বেরোতে পারেননি রাজা সেন,একটা খারাপ লাগা তাকেও ঘিরে ছিল। বেলুন সাজাতে সাজাতে মাসিকে বলে," ওমা এটা ওকে দাওনি! তাড়াতাড়ি এই বক্সটা ওকে দিয়ে এসো তো। ও তো হয়ত এখনি হস্টেলে ফিরে যাবে। ইশ্ আমি তো তোমাকে বলে রেখেছিলাম। একটুও মনে রাখো না।"
একটু বাদেই মাসির সাথে তিস্তা ফিরে আসে। মাসির হাতে খাবারের প্যাকেটটা.." ও দাদাবাবু সেই মেয়ে চলে গেছে তো। আমি গিয়ে দেখি সে সাইকেল নিয়ে চলে গেছে খানিক দূরে। ডাকলাম সাড়া দিল না।"
মনটা হঠাৎই কুয়াশামাখা হয়ে যায় রাজা সেনের,হয়ত তিনি নিজে একবার গিয়ে মেয়েটার হাতে খাবারের বক্সটা দিলে খুশি হত মেয়েটা...
তিস্তা বন্ধুদের সাথে মিলেছে,ওদের হুটোপাটিতে আজ কোয়ার্টার জমজমাট। পাশের রিনি বৌদি এসে মোটামুটি সামলাচ্ছেন। এছাড়াও তিস্তার দুএকজন বন্ধুর মা বাবা এসেছেন। বাইরের খাবারেই আপ্যায়ন হল সবার। অনেকদিন বাদে কোথায় যেন আনন্দের মাঝেও একটা সুর কাটার মনখারাপ হল প্রফেসর সেনের।
-" তোমাকে কী সুন্দর লাগছে দিদি! কোথায় গেছিলে গো? আমি এসে দেখি তুমি নেই।"
-" এই একটু কাছাকাছি রে,এই নে এগুলো খা।"
রিমি কুইনের নতুন রুমমেট,মেয়েটা একটু ছেলেমানুষ তবে ভালো। ওকে কতগুলো চকোলেট দেয় কুইন। আগেই কিনেছিল সেগুলো। মনটা খারাপ হলেও ভাবলো যাক আজ প্রিন্সেসের জন্মদিনে নিজেরাই একটু সেলিব্রেশন করে নেবে।
গেস্টরা চলে গেছে,তিস্তা গিফ্টগুলো নাড়াচাড়া করছে তবে ওর সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে মাম্মার দেওয়া টেডি আর বড় ডলটা। মাম্মা.. না না বন্ধু বলেছে যখন মিস করবি আমাকে টেডিটাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকবি,ও আজ থেকে তোর বন্ধু। নিজের অজান্তেই নিজের মত করেই ভালো থাকতে শিখিয়ে গেল তিস্তাকে কুইন।
ল্যান্ড ফোনটা বাজছে, মাসি ফোনটা ধরে ডাকে দাদাবাবু ফোন..
২৭
ফোনটা ধরেই চমকে ওঠেন প্রফেসর সেন,তোর্সা ফোন করেছে!
কেমন যেন একরাশ রাগ আর অভিমান জড়িয়ে ধরে ওকে। অথচ গতকাল শুধু তোর্সার কথাই ভেবেছেন রাতে।
নিজেকে দূর্বল না করে জিজ্ঞেস করেন,"কী চাই তোমার আবার?"
ওদিক থেকে হাসির আওয়াজ পাওয়া যায়," কী দিতে পারো তুমি? মানে এখনও কিছু কী আছে..."
তোর্সার গলাতে সেই রহস্যময়ী মজার সুর যা একসময় তাকে মুগ্ধ করত তবে এখন শুধু বিরক্ত করল," কাজের কথা বল তোর্সা। আর আমার দেওয়ার বা পাওয়ার আর কোন কিছুই নেই।"
-" আচ্ছা ছাড়ো,কাজের কথাই বলছি,তোমার আবার সেন্স অফ হিউমার আছে নাকি? আমার মেয়েকে ডেকে দাও।"
-" হা হা তোমার মেয়ে? মেয়ের প্রতি কোন কর্তব্য দায়িত্ব পালন করেছ তুমি?"
-" জন্ম তো দিয়েছি দশমাস পেটে রেখে তাই যতই বল সে আমার মেয়ে। তিস্তাকে এখনি ডেকে দাও। আর হ্যাঁ সেলফোনের নম্বরটা পাল্টে ফেলেছ দেখছি। তাই বাধ্য হয়ে এখানে ফোন করলাম। ইচ্ছে ছিল ভিডিও কলে ওকে দেখব।"
-" এতদিন বাদে হঠাৎ?"
-" আমার ইচ্ছে হল তাই। এরপর দেশে গেলে ওকে একটা আইফোন দিয়ে আসব যাতে ওর সাথে ইচ্ছে হলেই কথা বলতে পারি।"
-" তোমার কী যা খুশি তাই করবে?"
-" তোমাকে তো কিছু করছি না,আমার মেয়েকে দেব। ওকে ডাকো আমি কথা বলব। কোর্ট আমাকে বলে দিয়েছে আমি মেয়ের সাথে দেখা করতে পারি, কথা বলতে পারি,ওকে কাছে রাখতেও পারি।"
বুকটা কেঁপে ওঠে রাজা সেনের, তোর্সা হঠাৎই এত ডিমান্ডিং টোনে কথা বলছে কেন? কী চায় ও? না না প্রিন্সেসকে ছাড়া তিনি বাঁচবেন না।
ফোনটা রেখে তিস্তাকে কোলে নিয়ে ফোনের কাছে এসে বলেন,"কথা বল,তোর মা ফোন করেছে।"
তিস্তা অবাক চোখে তাকায় তারপর পাকা বুড়ির মত বলে," মাম্মা?"
ফোনের রিসিভার টেনে বলে," হ্যালো মাম্মা।"
তোর্সার বুকটা কাঁপে হঠাৎই কেমন যেন, কী সুইট গলাটা হয়েছে মেয়েটার... তারপর নিজেকে শক্ত করে নিয়ে বলে," হ্যাপি বার্থডে বেবি।"
-" তুমি তো হ্যাপি বার্থডে বললে বিকেলে,তোমার টেডিটাকে আমি আদর করছিলাম মাম্মা। তুমি কেন কেক কাটার সময় এলে না?"
-" অবাক লাগে তোর্সার কী বলে যাচ্ছে মেয়েটা ফোনে? কে ওকে টেডি দিয়েছে? কার কথা বলছে ও? তাহলে কী রাজার নতুন কোন বান্ধবী হয়েছে?"
অনেকগুলো প্রশ্ন জট পাকিয়ে যায় মনে,মেয়েটা বকবক করে ফোন রেখে দিয়েছে। অ্যান্ডারসন বাড়িতে গেছে আজ অনেকটা অবকাশ তোর্সার। অনেকগুলো কথা মনের মধ্যে ভাসতে থাকে। মেয়েকে ফেলে এলেও মা হবার জন্মদিনটা মনে রেখেছিল তোর্সা,পুরোনো ছবির অ্যালবাম খুলে দেখতে দেখতে হঠাৎই মনে হয়েছিল কী হচ্ছে আজ রাজার ওখানে? আজ তো তিস্তার জন্মদিন, নিশ্চয় এখন ভালো করে কথা বলে তিস্তা। তারপরেই দেখেছিল ফোন নং বদলে ফেলেছে রাজা,অবশ্য ও নিজেও তো নং বদলে ফেলেছে সেই কবে। একটা সময় প্রচুর ফোন করত রাজা,রীতিমত হুমকি দিত বলত আমার ভালোমানুষীর সুযোগ এভাবে তুমি নিতে পারো না তিস্তা। আমি শুনেছি তুমি ওখানে একটা বিদেশীর সাথে লিভ ইনে আছ। ছিঃ ছিঃ বর আর মেয়েকে ফেলে রেখে শেষে এইসব করছ ওখানে?
মাথা গরম হয়ে যেত রাজার অধিকারের আদিখ্যেতা দেখে তাই বলেছিল," তাতে কী হয়েছে? ও আমার গাইড। এখানে তো একজন দরকার নাকি যে আমাকে লুক আফটার করতে পারে। আর শোন এত যদি সন্দেহ তোমার ঐ ফালতু চাকরি ছেড়ে আমার কাছে চলে এসো। আমি তোমাকে আর মেয়েকে খাওয়াতে পারব।"
একটা সময় ভুল বোঝাবুঝি চূড়ান্ত হয়েছিল। ঠান্ডা, উত্তাপবিহীন হাইফাই পার্সোনালিটি সম্পন্ন রাজা সেনকে আর ভালো লাগেনি তোর্সার। আর মেয়ের সাথে তো ওর কোন বন্ডিং তৈরি হয়নি। ওর প্রতিও খুব বিরক্তি ছিল তখন। মনে হত ও এসে ওর সব প্রোগ্রাম গুবলেট করে দিল। তবে আজ ওর কথাগুলো সারাদিনই মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় তোর্সার। খুব দেখতে ইচ্ছে করল ওকে। এবার দেশে গেলে কয়েকদিন নিজের কাছে এনে রাখবে ওকে। দেখা যাক প্রফেসর কী করে তখন?
তারপর আবার মনে হল বারবারই টেডির কথা বলছিল মেয়েটা,কাকে চাইছিল ও কেক কাটার সময়? তাহলে কী রাজা নিজে কোন গিফ্ট কিনে বলেছে মাম্মা দিয়েছে? হতেও পারে...
********************************
আগামীকাল ভ্যালেন্টাইন ডে,এইসব অমুক ডে তমুক ডের খবর বেশ কয়েক দিন ধরেই দেখছে কুইন। হস্টেলে বেশ হুল্লোড় হচ্ছে এ নিয়ে। মায়েদের সময় আবার এসব ছিল না,তখন সরস্বতী পুজোর সময় অঞ্জলি প্রেম ছিল। আর এখন রোজাঞ্জলি প্রেম,মানে একগুচ্ছ রোজ নিয়ে অথবা পয়সাতে না কুলোলে একটা গোলাপ নিয়েই আই লাভ ইউ বলা প্রেমিকাকে তারপর একটা গোলাপের বিনিময়ে বেশ মাখো মাখো একটা গোলাপী দিন উপভোগ করা। তবুও ভালো প্রেম উৎসবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়নি। কিন্তু অনেকেই আজ আসেনি,তারা গেছে প্রেম দিবস পালন করতে। তবে তাদের খোঁজ হয়ত কাছাকাছি গেলেই মিলবে।
কুইন ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ায়। ওখানে একটু চা খেয়ে নেবে। তারপর কয়েকটা জিনিস কিনে নিয়ে একদম প্রিন্সেসকে দেখে ফিরবে হস্টেলে। ওর বার্থডের পর আর যাওয়া হয়নি,অবশ্য তিনি মাঝে মাঝেই ফোন করেন। কুইন বলেছে ওর পড়াশোনা আছে স্যার বকবেন। তিস্তা বকবক করেছে তুমি আমার বার্থডেতে ফোন করেছিলে তাই না?
কুইন অবাক হয়ে যায় শুনে,ও আবার কখন ফোন করল?
তবুও আর কথা বাড়ায় না। ওরও খারাপ লাগছে তিস্তার জন্য। তবে সেদিন স্যারের আচরণ ওর ভালো লাগেনি,নিজেকে কেন যেন অবাঞ্ছিত মনে হয়েছিল। বুঝতে পেরেছিল স্যার ভেতরেই আছেন কিন্তু একবারও বাইরে আসেননি। এমনকি পরের দিনও কিছু বলেননি।
ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে সাইকেলে জিনিসগুলো নিয়ে একটু এগোতেই সামনে বাইকটা এসে দাঁড়ায়। অবশ্য প্রথম দিন থেকেই তো এভাবেই জ্বালাচ্ছে ছেলেটা। সুতরাং সেই একই ভাবে বলে," কী চাই? আমার তাড়া আছে,পরীক্ষা আছে কালকে।"
তাকিয়ে দেখে ওর সাথে দুজন ছেলে আরও আছে, কোন ডিপার্টমেন্টের ঠিক মনে করতে পারে না,হবে হয়ত ওর দলেরই কেউ।
-" দেখেছিস তো ভাই,আজ এক বছর ধরে একই কথা বলে যাচ্ছে,সবসময় শুধু তাড়া আর তাড়া। আজ একটু দাঁড়া কথা আছে।"
কুইনের মুখটা শক্ত হয়," এই একবছর ধরে তো কম কথা হয়নি তোমার সাথে,আজ কী বলবে আবার নতুন করে? যেখানে গেছি সেখানে গেছ। এখান থেকে বেরোলে আমি শান্তি পাই।"
-" দেখেছিস তো আমাকে দেখলে কেমন তেলে বেগুনে জ্বলে যায়,অথচ রকির একটু ফেভার পেলে কত মেয়ে ধন্য হয়ে যায়।"
-" জানি তো,তবে আমি তেমন নই।"
-" একদম জানি তুই সম্রাজ্ঞী তাই তো তোর জন্য সব স্পেশাল। আজ আর বেশি কিছু বলব না,এক্ষুনি চলে যাবি। কী রে দে..."
কুইন রকির অসভ্যতা দেখেছে তবে এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎই রাস্তার মধ্যে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে রকি,ওর বন্ধুরা একটা সুন্দর লাল গোলাপের বোকে ওর হাতে দেয়। সেটা হাতে নিয়ে কুইনের দিকে তাকিয়ে বলে,"আই লাভ ইউ অনেক দিন বলব ভেবেছি কিন্তু বলা হয়নি। আজ ওদের সামনে বলছি সেই প্রথম দিন থেকে তোকে মনের দেওয়ালে আটকে রেখেছি.. আই লাভ ইউ।"
সাথের ছেলেগুলোকে ভিডিয়ো করতে দেখে মাথাটা গরম হয়ে যায় কুইনের। চিৎকার করে ওঠে," এসব কী হচ্ছে? কেন তোমরা ছবি তুলছ আর ভিডিও করছ? রকিদা তুমি সিনিয়ার আর এখানকার নেতা বলে আমি কিছু বলিনি এতদিন। আমাকে প্রেম নিবেদন করার আগে ভাবলে না তোমার পুরোনো বান্ধবী পরীর কী হবে? আর এখানে যাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াও সেই উর্মিলার কী হবে? তোমার সব গুণপনা আমার জানা। কী করে সাহস পাও এত কিছুর পরেও!"
একটু ঘাবড়ে যায় রকি এত কিছু খবর রাখে মেয়েটা! দেখে তো মনে হত কারও সাথে মেশে না।
-" তাতে কী হয়েছে? আমি যাকে চাই তাকে ঠিক হাসিল করেই ছাড়ি।"
-" আর আমি যাকে চাই না তাকে পাত্তাও দিই না।"
রকির সব ভালোমানুষীর আবরণ খসে পড়ে," তাই নাকি? কাকে পাত্তা দিস শুনি ঐ আধবুড়ো স্যারটাকে? কী জন্য ঘুরঘুর করিস রাজা সেনের কোয়ার্টারের আসেপাশে? আদিখ্যেতা করিস বাচ্চাটাকে নিয়ে তাই না? আসলে তোর মন পড়েছে ঐ বুড়ো স্যারটার ওপর তাই ওখানে অত ঘুরঘুর করা।ছিঃ ছিঃ এর আগেও ছাত্রী প্রফেসর কেস হয়েছে,তবে এত এক বাচ্চার বাপ।"
-" মুখ সামলে কথা বল রকিদা,যা মনে হচ্ছে তাই বলছ? তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছ। আমি কমপ্লেন করব তোমার নামে।"
-" তাই নাকি? যা যা এখনি যা ভি সির কাছে। কেউ শুনবে না কিছু। কাজটা ভালো করলি না সম্রাজ্ঞী। তোর অনেক ইতিহাস আমি জানি,যাক সেগুলো আর বলতে চাই না। ভেবেছিলাম একটা অনাথ... না না তোকে তো অনাথও বলা যায় না।"
-" বাঃ বাঃ কত খোঁজ রাখো,হ্যাঁ যা খুশি ভাবো আমার কিছু এসে যায় না। তোমার মত ছেলেদের আমি জাস্ট ঘেন্না করি।"
সাইকেলটা নিয়ে জোরে চালিয়ে বেরিয়ে যায় কুইন,কেমন যেন অসহায় মনে হয় নিজেকে। খুব কান্না পায়। আজকের দিনটা যে এত খারাপ কাটবে তা কখনই ভাবেনি। এত রীতিমত শাসালো ওকে রকিদা। কী করবে? কমপ্লেন করবে? না না তাতে আরও জলঘোলা হবে। একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে নিজেকে বোঝায় কুইন তারপর নিজের মাথায় নিজের হাতটা রেখে বলে কত কী তো সয়েছিস আরও না হয় সইতে হবে। তবে রকিদা শেষে কী বলে গেল? তার মানে ওর ব্যাপারে সব খবরই জোগাড় করে ফেলেছে।
যাক ভালো হয়েছে দেখা যায় কী করতে পারে? যখন এখানে এসেছে তখন যে সিলেবাস শুরু করেছে সেটা শেষ করেই যাবে।
নিজেকে একটু ঠান্ডা করে বারান্দাটার সামনে এসে সাইকেলের বেল বাজায়। স্যারের গাড়িটা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে স্যার বাড়িতেই আছেন। রকিদার বলা কথাগুলো আবার মনে পড়ে যায় ওর.. তোর মন পড়েছে ঐ বুড়ো স্যারটার ওপর তাই এত ঘুরঘুর করিস ওখানে। ভাগ্যিস তিস্তাকে খুব বুঝিয়ে বারণ করেছে মাম্মা বলে ডাকতে ওকে না হলে আরও কত কথা যে শুনতে হত কে জানে?
তিস্তা এসে দাঁড়িয়ে ওর দিকে হাত বাড়ায় বলে," আমাকে কোলে নাও, বেরু বেরু চল।"
কোন কথা না বলে ওকে সাইকেলে তুলে মাঠের কাছে নিয়ে গিয়ে বসে। তিস্তা বকবক করতে থাকে আপন মনে।
তারপর বলে," কথা বল আমার সাথে,কথা বলছ না কেন?"
-" আমি আর আসব না রে এখানে। তুই এরপর বাবার সাথে বেরু করতে যাস।"
-" তুমি কক্ষোনো আসবে না? কেন গো? তোমাকে কে বকেছে? বাবা?"
কোন উত্তর দিতে পারে না কুইন ওর চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
২৮
কদিন ক্যাম্পাসে হাঁটা মুশকিল হয়ে গেছে কুইনের রকিদা ওকে মোটামুটি ট্রোলড করে ছেড়ে দিয়েছে। অনেকের ফোনেই ঘুরেছে ফিরেছে ওকে প্রেম নিবেদন করার ভিডিও। নিজেও দেখেছে সেই ভিডিও ওর রুমমেট আর মেঘনা দেখিয়েছে। মনে হয়েছিল সব ছেড়েছুড়ে কলকাতা চলে যায় কিন্তু হার মানবে এভাবে? যখনই মনে হয়েছে আর ভালো লাগেনি। একটা সময় মনে হয়েছে ওর বোধহয় কাউন্সেলিংয়ের দরকার। মনটা সেই ছোট্টবেলা থেকে খোঁচা খেতে খেতে কোনদিন না একদম অসুস্থ হয়ে পড়ে। আজকাল লুকিয়ে অনেক সিগারেট খায় কুইন,অথচ এখানে এসে একদম প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল অভ্যেসটা। কেন যেন এত চাপ আর নিতে পারছে না। আজকাল কুইন খুব অনুভব করে ওর কোন ভালো বন্ধু নেই। কলেজের বন্ধুরাও আর বেশি ফোন করে না,যা হয় আরকি সবাই নিজের আবর্তে ঘুরছে। আচ্ছা ইরাকে বলবে? না না গত একমাস ওর সাথে কথাই হয়নি তেমন। তাহলে কী মাকে বলবে? নাহ্ থাক সে তো নিজেই প্যানিকের রুগী হয়ত ভয় পেয়ে এখানে চলেই আসবে। তারপর ওকে একদম বগলদাবা করে ফিরবে।
তবে কী জোহানকে? ফোনটা স্ক্রল করে ওর নম্বরটা দেখে কুইন। জোহান ভালো কাউন্সেলিং করতে পারত,যদিও খুব মাথা গরম হত ওর ফালতু জ্ঞান শুনে। তবে কলেজে অনেকেই বুদ্ধি নিত আর সাহায্য নিত ওর কাছে,ব্যাটা বেশ মহাপুরুষ ছিল অনেকের কাছে। না না ওর সাথে তো অনেকদিন কোন কথা হয়নি,তাছাড়া কোথায় আছে কে জানে? সেই যে স্টেশনে ছুটে এসে ওর দেখা পায়নি তারপর আর কেউ কাউকে ফোন করেনি। না না নিজে পারবে সব সামলাতে ঠিক পারবে। এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় কুইন। রকির সাথে ওর দেখাও হয়েছে কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার যে আর ওর সাথে কথা বলেনি। যাক তবুও ভালো ছেলেটার লজ্জা আছে।
তবে যে ঠোঁটে ছিল কামনা,যে চোখে ছিল আগুন সেই আগুন কী এত তাড়াতাড়ি কখনও নেভে? রকি কুইনের সাথে আর যেচে কথা বলতে আসেনি। তবে প্রতি মুহূর্তে নিঃশব্দে ওকে অনুসরণ করেছে। আর জিইয়ে রেখেছে অপমানের প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছেটা।
-" বাপি আমার বন্ধু কেন আসে না? আমি ফোন করলে আর কথা বলে না। ও বাপি,আমি বন্ধুর কাছে যাব।"
সত্যিই বেশ অনেকদিন আসে না সম্রাজ্ঞী, মেয়েটাও বায়না করে না কোথাও নিয়ে যাবার জন্য। বিকেল হলেই বারান্দায় এসে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর একসময় বলে বন্ধু আজও এল না। ছোট হলেও কুইনের কান্না ছুঁয়ে গেছিল তিস্তাকেও বারবারই বলেছিল কে বকেছে তোমাকে বল,আমি বকে দেব তাকে। তোমার মন খারাপ কেন? আমি একবার তোমাকে মাম্মা বলব? তুমি আর আসবে না?"
কুইন ওকে জড়িয়ে চুপ করে বসেছিল তারপর বলেছিল," আজ আমার মনটা ভালো নেই,আমার পরীক্ষা হলে আবার আসব। তুই ভালো করে থাকিস,দুষ্টু করিস না।"
নিজেকে সব কিছু থেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছে কুইন,আজকাল কথা বলতে এমন কী ভালো করে খেতেও ওর ভালো লাগে না। ফোনটা বেজে যায় নিজের মত ইচ্ছে হলে ফোন ধরে নাহলে চুপ করে শুয়ে থাকে। নিজেকে বুঝিয়েছে আর যাবে না স্যারের ওখানেও। যেসব নোংরা কথা রকিদা বলছিল সেগুলো যদি সবাই শুনতে পায় ইশ্ কী হবে? তিস্তা হয়ত কাঁদবে তারপর ঠিক ভুলে যাবে ওকে একদিন।
সেদিন বিকেলে তিস্তা খুবই কান্নাকাটি করেছে বারবারই বলেছে," বন্ধু কেন আসে না বাপি? বলছিল তো পরীক্ষার পরে আসবে। বন্ধুর পরীক্ষা কী শেষ হয়নি? আমি যাব বন্ধুর কাছে। মাম্মা তুমি কোথায়? আমাকে নিয়ে চল,আমি যাবই,আমি কিছু শুনব না।"
মাসি দুধ খাওয়াতে এলে দুধের গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে দেয় আর হঠাৎই ধাক্কা দেয় মাসিকে। নিজেকে সামলাতে পারেন না রাজা সেন যেটা কোনদিনই করেননি আজ তা করলেন একটা চড় বসিয়ে দিলেন মেয়ের গালে হঠাৎই। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ঐ নাক উঁচু মেয়েটার ওপর। প্রতিদিন এসে এসে ও অভ্যেস খারাপ করেছে মেয়েটার। আর এখন আর ওর কথা মনে হয় না। কদিন তো ডিপার্টমেন্টে ওকে দেখছেন না। বাড়িই যদি যাবি তো একবার ওকে বলে গেলেই হয়। মেয়েটা ফোন করলে ফোনও ধরছে না... আর ঐ বেয়াদপ মেয়েটার জন্য এ এদিকে কেঁদে অস্থির হচ্ছে।
একবার ভেবেছিলেন আজ মেঘনাকে জিজ্ঞেস করবেন সম্রাজ্ঞী আসছে না কেন তারপর ভাবলেন কী দরকার মিছিমিছি কৌতূহল দেখিয়ে।
গালটা লাল হয়ে গেছে তিস্তার, নিজেকে সামলে মাসি ছুটে আসে তাড়াতাড়ি.." এটা কী করলেন দাদাবাবু? ঐ টুকু শিশু তারপর মা.."
-" থাক মাসি তুমি আর আহ্লাদ দিয়ো না,আর মায়ের কথা কক্ষনো বোল না। তোমরা সবাই মিলে আমার মাথাটা খারাপ করেই ছাড়বে দেখছি।"
প্রথমে জোরে তারপর মাম্মা মাম্মা করতে করতে মুখ গুঁজে দেয় টেডিটার বুকে আর ফোঁপাতে থাকে। কিছুতেই তাকে ঠান্ডা করা যায় না। মাসির চোখ ছলছল করে আড়ালে গিয়ে বলে," যেমন জেদ বাপের আর তেমন হয়েছে মেয়ে। মায়ের তো কোন তুলনাই নেই। আর এই মেয়েটা হয়েছে তেমনি, তোকে যখন ভালোবাসে মেয়ে সবসময় বন্ধু করে অস্থির হচ্ছে তখন একবার আসছিস না কেন বাপু? কী যে করি এখন?"
********************
খবরটা পেয়ে কুইন আর থাকতে পারেনি,যেভাবে ছিল সেভাবেই চলে এসেছিল। তিস্তার তখন প্রচন্ড জ্বর। ডাক্তার দেখে গেছেন,স্যার একদিকে গুম হয়ে বসে তাঁর মুখে কোন কথা নেই। ডাক্তারবাবু বলেন," রাত্রিটা ওকে খুব দেখে রাখতে হবে। আর হ্যাঁ আর কিছু এমন করবেন না যাতে ও আরও শকড হতে পারে।"
মেয়ের মুখ চেয়ে সন্ধ্যেবেলাতেই খবর পাঠিয়েছিলেন সম্রাজ্ঞীকে। সেই প্রথম ভয়ে ভয়ে কাঁপা বুকে স্যারের অন্দরে পা রেখেছিল কুইন। আর তারপর তিন দিন আর ফেরা হয়নি,জ্বরই নামছিল না তিস্তার। আর ওকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়েনি, একটু সরলেই কেঁদে উঠেছে আর ভয়ে ফুঁপিয়েছে। এত কথা বলে মেয়েটা অথচ কোন কথা বলেনি কারও সাথে। শুধু কুইনের কাছে আশ্রয় খুঁজেছে। স্যারকে দেখলে কেঁদেছে। ডাক্তার এসে দেখে গেছেন বলেছেন কিছুটা ভালো ভর্তি করার কোন দরকার নেই তবে খুব সাবধানে ওর সাথে বিহেভ করতে হবে,কোন কারণে খুব ভয় পেয়েছে।
চিৎকার করে মেয়েটাকে বলতে ইচ্ছে করে দেখেছ তো তোমার জন্য আজ আমার মেয়ের কী অবস্থা! তোমরা মেয়েরা এমনি হও বোধহয়,মানুষকে ভোলাতে তোমাদের কোন জুড়ি নেই।
কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না,এই কয়েকটা দিন মেয়েটা ঘুমোয়নি,খায়ওনি তেমন কিছু। মাসি খাবার আনলে ফিরিয়ে দিয়েছে। কখনও জল বিস্কুট আর শুধু চা খেয়েই আছে। বলেছে তাহলে ঘুম আসবে না।
হস্টেলে ফোন করে স্যারই জানিয়েছেন যে সম্রাজ্ঞী ওর বাড়িতে আছে,সবটাই বলেছেন। তা সত্ত্বেও কুইন যখন ফিরল হস্টেলে তখন সমালোচনার ঝড় উঠল। সবাই এবার সামনাসামনি বলল," কী সব হচ্ছে হস্টেলে বল তো? লোকে বাহানা করে যেখানে সেখানে রাত কাটিয়ে আসবে। আর আমরা চুপচাপ থাকব?"
-" মানে কী বলতে চাইছিস তোরা? স্যার ফোন করে তো সব বলেছেন সুপার দিদিকে। বাচ্চাটা খুবই অসুস্থ ছিল তাই আমাকে থেকে যেতে হল। ও আমাকে ছাড়ছিলই না।"
-" ও তাই নাকি? ওর বাবা আছে, তুই ওর কে যে তোকে ছাড়বে না? শোন আমাদের কানে আগেই এসেছে কিছু কিছু কথা। আমাদের পক্ষে এমন মেয়ের সাথে একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়।"
-" মানে? আমি কী করেছি?"
-" সেটা নিজেকে জিজ্ঞেস কর,তুই এখানে থাকতে পারবি না।"
-" ও আচ্ছা, আমি স্যারের বাচ্চাটার অসুস্থতার জন্য ওখানে ছিলাম সেটা অন্যায়? আর কতজন যে কত কী করে বেড়াচ্ছে তার বেলা?"
-" মুখ সামলে কথা বলবি, তুই আমাদের অপমান করছিস।"
ওদের চিৎকারে সুপার দিদি বেরিয়ে আসেন,অদ্ভুত ভাবে কুইনকে জরিপ করেন মহিলা। তারপর বলেন, কয় রাত্রি ঘুমাওনি তুমি? কী অবস্থা তোমার!"
-" আমি একটু বিশ্রাম নিতে চাই দিদি,আমার শরীর চলছে না। এরা আমাকে যাতা বলছে দিদি স্যার তো আপনাকে বলেছে। তিস্তা খুব অসুস্থ ছিল.."
-" হ্যাঁ উনি বলেছেন,আসলে তখন এমন করে বললেন যে মেয়ের জীবন মরণ সমস্যা। তাই আমি আর কিছু বলতে পারিনি,আমি ভেবেছিলাম তুমি পরদিনই ফিরে আসবে। তারপর আসছ না দেখে ভাবলাম ওখানেই রয়ে গেলে বুঝি।"
মেয়েদের চাপা হাসির আওয়াজ পায় কুইন। ও ঘরের দিকে পা বাড়ায় কানে আসে মেয়েদের কথা," ম্যাডাম আমরা জয়েন্ট অ্যাপলিকেশন দেব ও এখানে থাকতে পারবে না কিছুতেই।"
পরপর কদিনের রাতজাগার ফলে মাথাটা ঘুরে ওঠে কুইনের ও বুঝতে পারে একটা বিরাট চক্রান্ত শুরু হয়েছে ওকে ঘিরে আর এই চক্রান্তের পেছনে আছে রকিদা। কোনরকমে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। কী জানি আর কী কী ওর কপালে আছে?
***********************
ইউনিভার্সিটি জুড়ে সাঙ্ঘাতিক অশান্তি শুরু হয় ঘেরাও করে ওরা স্যারকে। স্যারের সাথে সম্রাজ্ঞীকে নিয়ে পোস্টার পড়ে চারদিকে। কুইনকে হস্টেলের মেয়েরা ঘর থেকে বেরোতে দিতে চায় না। প্রফেসর রাজা সেন কিছুতেই বোঝাতে পারেন না মেয়ে খুব অসুস্থ হয়ে পড়াতে তিনি সম্রাজ্ঞীকে ডেকেছিলেন। এছাড়া কোন উপায় ছিল না। তাঁর কথা শুনে অনেকেই তামাশা করে বলেন," মেয়ে অসুস্থ তো ডাক্তার ডাকবেন। তা এখন আমাদের ইউনিভার্সিটির সেরা সুন্দরী মেয়েটাকেই ডাকতে হল আপনাকে? তাও আবার রাতের বেলায়?"
-" আমি ডাক্তারও ডেকেছিলাম,আসলে তিস্তা সম্রাজ্ঞীকে খুব ভালোবাসে। ওকে না দেখলে কান্নাকাটি করে।"
-" ও তা এই ভালোবাসার ব্যাপারটা কতদিন চলছে? মানে আপনাদের বাবা আর মেয়ের?"
-" কী বলছেন আপনারা?"
-" আমাদের কাছে সব খবর আছে প্রফেসর সেন,প্রথম দিনই এই মেয়েটাকে আপনি টার্গেট করেছেন। আর আপনার মেয়ে ওকে মাম্মা বলে কেন?"
-" কী বলছেন আপনারা,ঐটুকু বাচ্চা মেয়ে ওর কী কোন বুদ্ধি আছে?"
-" আপনার তো বুদ্ধি আছে, আপনি কেন একটা হস্টেলের মেয়েকে বাড়িতে রাখলেন তিন চারদিন ধরে?"
-" বিশ্বাস করুন ওকে কোনদিনই আমার কোয়ার্টারে অ্যালাউ করিনি আমি,সেদিন বাধ্য হয়েই.."
-" আমরা শুনেছি আপনি মেয়ের গায়ে হাত তুলেছেন সেখানে ও কী করছিল?"
উত্তেজনা চরমে পৌঁছে যায় প্রফেসর সেনের, সত্যি এত কিছু আর নেওয়া যাচ্ছে না। যা ইচ্ছা ওরা করুক। চিৎকার করে ওঠেন," ব্যাস অনেক হয়েছে,সে কৈফিয়ত আমি কাউকে দেব না আমার মেয়েকে কেন মেরেছি। আচ্ছা ঠিক আছে আমি আমার রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দেব।"
বাইরে তখন সমানে স্লোগান চলছে.. ইউনিভার্সিটির পরিবেশ নষ্ট করা চলবে না,প্রফেসর সেনকে আমরা বয়কট করব,সম্রাজ্ঞী তুমি ক্যাম্পাস ছাড়। এইসব এখানে চলবে না,মানছি না। আমাদের দাবী মানতে হবে।"
ক্যাম্পাসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে মজা দেখে রকি ওর সাকরেদদের বলে," ভালো করে আওয়াজ দে,এবার দেখব সুন্দরীর দেমাক কোথায় থাকে? দেখ ওর কী করি আমি। রকিকে অপমান করা,এর শাস্তি তো ওকে পেতেই হবে।
২৯
ক্যাম্পাসের আগুনের তাত কুইনের গায়েও লাগে পুরোদমে। নিজের ঘরে মোটামুটি দুদিন গৃহবন্দী ও আর আজ তো পুরো ক্যাম্পাস যেন কাঁপছে। ও বাইরে বেরোতে চায়,না না ওরা স্যারকে অযথা ভিক্টিম করছে। ও তো নিজের ইচ্ছেতেই গেছে তিস্তার শরীর খারাপ শুনে,এর দায় কখনই স্যারের হতে পারে না। বিছানা থেকে মাটিতে পা দিতে গিয়ে পা কাঁপতে থাকছ ওর। এই কয়েকদিন মায়ের সাথে টুকটাক কথা হয়েছে। বলেছে ভালো আছে,তবে শরীরটা ঠিক নেই।
দেবী একটু বেশি কিছু বলতেই ফোনটা রেখে দিয়েছিল,মেয়ে মুডি তাই ও নিজেও সাহস পায়নি আর কিছু বলতে। শুধু বলেছিল," আমি যাব?"
-" তুমি একা বাড়ি থেকে বেরোতে চাও না,আর এত দূর আসবে? এত প্যানিক কোরনা।"
এত ঘটনা কী করে বলবে মাকে? এমনিতেই তার যন্ত্রণার জীবন,ও নিজেও একসময় মাকে অনেক বাজে কথা বলেছে আর খারাপ ব্যবহার করেছে। তার ফল হয়ত এখন ভোগ করছে। এত কিছু জানলে তো মা নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বে।
ওকে যেতেই হবে সবার মাঝে ও গিয়ে বলবে যে যা শাস্তি ওকে দেবে ও রাজি স্যারকে আর যেন অপমান না করে। তারপর মনে হয় এসব বলবে কেন? কী করেছে ও? তবুও ও বেরোতে যায়।
ওর রুমমেট বাধা দেয় ,"তুমি কী করছ বল তো? কোথায় যাবে? নিজের চেহারা একবার দেখেছো? এভাবে কেউ যায় নাকি? এরপর তো মাথা ঘুরে পড়ে মরবে।"
-" ও তুই এখনও এখানে আছিস? চলে যা তোর চরিত্র খারাপ হয়ে যাবে।"
-" তুমি চুপ কর আমি ভয় পাই না।"
হঠাৎই মনে হয় কেউ তো আছে ওর সাথে। কিন্তু তিস্তা কী করছে? কাল থেকে তো ওর কোন খবর নেওয়া হয়নি।
একবার ফোন করে দেখবে? ফোন করে কুইন, ফোনটা অনেকটা সময় বাজার পর মাসি এসে ধরে ওর গলাটা শুনে হাহাকার করে ওঠে," তুমি শুনেছ কী সব হচ্ছে ওদিকে? আমাকে বৌদি বলল গো পাশের বাড়ির। দাদাবাবু কোনদিনই শান্তি পেল না,অথচ কত ভালো মানুষটা।"
-" শুনেছি,তিস্তা কী করছে গো? ও ঠিক আছে তো?"
-" ওকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি কোনরকমে গো। কান্না করছিল একটু,তারপর ওষুধ আর দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়ালাম।"
একটু শান্তি লাগে শুনে কুইনের। তবে ও এখানে আর থাকবে না। ওর ভবিষ্যত নষ্ট হয় হবে...
ব্যাপারটা নানা রঙ চড়িয়ে এতটাই জটিল হয়ে গেছে ততক্ষণে যে কুইনের থাকা না থাকা আর ম্যাটার করে না। শরীর আর মন ভারী হয়ে আসে ওর,কী মুখ নিয়ে নিজের পরিবার আর বন্ধুদের কাছে ফিরবে ও? অনেক বড় মুখ করে মাকে বলেছিল যে আর কলকাতাতে পড়বে না ও,নতুন জায়গাতে গিয়ে সব ভুলে আবার নতুন করে সব শুরু করবে। আসলে ওর জীবনটাই বোধহয় কাদা মাখা তাই যেখানেই যায় সেখানেই কলঙ্কের কালি ওর পেছনে পেছনে আসে।
প্রফেসর রাজা সেনের সাথে ডাক পড়ে কুইনেরও ওদের একটা মিটিংয়ের পর। সেখানে উপস্থিত আছে অনেকেই,আছে ছাত্র নেতারাও। জেরাতে জেরাতে অস্থির হয়ে ওঠে কুইন। মনে হচ্ছিল এবার সত্যিই মনের বাঁধ ভেঙে ও পাগল হয়ে যাবে।
-" তুমি কেন যেতে স্যারের ওখানে? তোমার সাথে কী সম্পর্ক ছিল ডঃ সেনের।"
-" একজন ছাত্রীর সাথে শিক্ষকের যা সম্পর্ক সেটাই। এর আগে আমি কখনও ঘরে ঢুকিনি। তিস্তার জন্মদিনেও যাইনি।"
-" কে হয় তোমার তিস্তা?"
-" কেউ নয়,তবে এখন অনেক কিছু।"
ওর উত্তর শুনে অনেকেই হাসে। আবার প্রশ্ন ভেসে আসে," অনেক কিছু মানে?"
-" অনেক কিছু মানে কী?"
-" ও আমাকে খুব ভালোবাসে,সী ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড।"
-" ঐ টুকু বাচ্চার সাথে কতদিনের পরিচয় তোমার যে এত বন্ধুত্ব? আর কিছু ছিল না?"
-" মানে,কী বলতে চাইছেন আপনারা?"
-" তোমার ওখানে এতদিন ধরে থাকা অনেক কিছু মিন করে।"
রাজা সেন ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আর মেজাজ হারান," আমি তো বলেছি আমি আগামীকালই রেজিগনেশন দেব। ওকে কেন অযথা আপনারা হেনস্থা করছেন?"
কথাটা শুনে চোখ টেপাটেপি হয় কুইন ভীষণ অপমানিত বোধ করে দেখে। তারপর বলে ওঠে," না স্যার ওদের প্রবলেম আমাকে নিয়ে আপনার কোন ইস্যু নেই এখানে। যখন থেকে আমি ভর্তি হয়েছি তখন থেকে আমার লাইফ এখানে হরিবল হয়ে গেছে। আমাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে,শাসানো হয়েছে। বিকজ আই ডোন্ট অ্যাকসেপ্ট সামওয়ানস প্রপোজাল।"
রকির চোখটা জ্বলে ওঠে হঠাৎই মেয়েটা কী বলতে চাইছে? ও কী এখানে হব বলবে নাকি? যা বলে বলুক তবে কেউই ওর কথা বিশ্বাস করবে না। তবে যদি ভিডিওটা দেখায়? হঠাৎই একটা অস্বস্তি হয়,এত সাধ করে বিছানো জালটা এভাবে ছিঁড়ে যাবে।
ওরা অনেকে মিলে বলে ওঠে," ও পারসোনাল ইস্যুকে এভাবে সামনে আনছে।"
-" পুরোটাই পার্সোনাল ব্যাপার যখন তখন সব বলব আমি।"
-" আর কোন কথা নয়,একজন স্টুডেন্ট আমার জন্য সাফার করবে এটা কিছুতেই হতে পারে না। আই উইল রিজাইন।"
হঠাৎই একটা আলোচনার পর ওরা গুজগুজিয়ে ওঠে," আপনার রেজিগনেশন সব সলভ করবে না প্রফেসের সেন। নো বডি উইল অ্যালাউ সম্রাজ্ঞী হেয়ার। ওকে ছাড়তে হবে পড়া।"
-" এত বড় শাস্তি হবে মেয়েটার! ওকে অন্ততঃ এক্সামটা দিতে দেওয়া হোক।"
-" আমরা ভেবে দেখব সেটা। তবে আমরা একটা কথা বলতে চাই..."
ওদের ডিপার্টমেন্টের রসিক স্যারটি বলে ওঠেন," প্রফেসর সেন আপনার মত একজন ব্রাইট প্রফেসর চলে যাবেন তাও হয় না। আর মেয়েটার ভবিষ্যতও তো আছে। আমরা একটা ওয়ে আউট ভেবেছি। কী বলব?"
-" হ্যাঁ স্যার বলুন,এটাই তো সবারই কথা। এমন ইনস্ট্যান্স থাকলে ভবিষ্যতে আর কেউ এই কাজ করার আগে একবার ভাববে।"
যে প্রস্তাবটা আসে সেটা শুনে ছিটকে উঠেছিল কুইন ওর গাটা শিউরে ওঠে। এতক্ষণ যা ভেবেছিল পুরোটাই তাহলে সত্যি।
বিনীত ভদ্রভাবে ওদের খুব উপকার করতে বলে ওঠেন একজন," প্রফেসর সেন আপনার মিসেস তো চলে গেছে আপনাকে ছেড়ে, মানে আপনাদের তো সেপারেশন হয়ে গেছে। আপনার বেবি ছোট,আপনিও ইয়ঙ্গ। সো একটা ভালো ওয়ে আউট আছে তাহলে ইন ফিউচার সম্রাজ্ঞীর মত আর কাউকে যখন তখন ডাকতে হবে না।"
-" হোয়াট ডু ইউ মিন... আমি আর এক মুহূর্তের জন্যও এখানে থাকতে চাই না। লেটস এন্ড ইট।"
ওরা স্যারকে ওকে বিয়ে করতে বলছেন! কী অদ্ভুত প্রস্তাব। ছিটকে উঠে দাঁড়ায় কুইন শীট্.. ইটস্ ইমপসিবল।
পেছন থেকে আওয়াজ আসে.. ওমা শীট্ কেন? রাতের অন্ধকারে আর লুকিয়ে যেতে হবে না তাহলে।
স্যার চলে গেছেন,কুইনের আজ আর মাথা উঁচু করতে ইচ্ছে করে না। একটা নোংরা রাজনীতি ওর মাথাটা একদম নুইয়ে দিয়েছে। স্যারের মুখের দিকে তাকানোর কোন উপায় আর রইল না,রকিদার মত ছেলে যে সব পারে। সেটা আরেকবার বুঝল,প্রথমে ছেলেটাকে ক্যাবলা মনে হয়েছিল হার্মফুল ভাবেনি। কিন্তু এখন দেখছে সব করতে আর করাতে পারে ও।
কুইনের আর কাউকে বিশ্বাস হয় না জীবন থেকে বিশ্বাস শব্দটা মুছে গেছে ওর। খুব ভয় করে আর একা লাগে ওরা যদি স্যারকে গিয়ে বলে এখন,কুইন স্যারকে পছন্দ করত,যদি বোঝায় স্যারের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েই দিনের পর দিন গেছে তিস্তার সঙ্গে খেলতে তাহলে কী হবে? কিন্তু ও তো স্যারকে তাঁর আসনেই বসিয়ে এসেছে চিরকাল। স্যারকে বিয়ে করবে একথা স্বপ্নেও কখনও ভাবেনি। হ্যাঁ তবে স্যারকে ওর ভালো লাগত,এমন তো অনেক ছাত্রীরই স্যারকে ভালো লাগে,এর মধ্যে কী অপরাধ আছে?
আসলে ভুল স্যারের মেয়ের অসুখে দিশাহারা হয়ে তার বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল। একবারও মনে হয়নি এর পরিণতি কী হতে পারে?
মাথাটা সাঙ্ঘাতিক যন্ত্রণা করে প্রফেসর সেনের,কোনরকম করে বাড়ি ফিরে আসেন। তারপর মাসিকে বলেন," মোটামুটি গুছিয়ে নাও,কালই আমরা এখান থেকে চলে যাব,তার আগে আমার একটা অফিসের কাজ আছে। তিস্তা কী করছে এখন? খেলছে নাকি?"
না হঠাৎ বলল ঘুমোবো, তাই ঘুমোচ্ছে আসলে শরীরটা সারেনি এখনও।"
-" কাল কোথায় যাব?"
-" কলকাতাতে যাব আগে বাড়িতে তারপর দেখি.. আমি একটু শুলাম আর পারছি না।"
পরদিন সকালে আর কেউ সম্রাজ্ঞীকে খুঁজে পায় না। প্রথমে ওর রুমমেট খুঁজেছে এদিক ওদিক তারপর অপেক্ষা করেছে অনেকটা সময় পরে ফোন করেছে দেখেছে সুইচড অফ এরমধ্যে অনেক কথা ছড়িয়ে গেছে হস্টেলে অনেকেই এসে দেখে গেছে বইপত্র আর জিনিস সবই মোটামুটি আছে শুধু কাঁধের ব্যাগটাই নেই।
-" আরে কোথায় আর যাবে? মুখ লুকোতে ভেগেছে। নাহলে হয়ত স্যারের সাথেই কোথাও পালিয়েছে। খোঁজ নে স্যার আছে না তালা কোয়ার্টারে। অথবা স্যারই দিয়েছে গোপনে কোথাও পাঠিয়ে।"
-" তোমরা চুপ করে যাও প্লিজ, একটা মেয়ে এভাবে কোথায় চলে গেল খোঁজ নিতে হবে না? ওর বাড়ির নম্বর নিশ্চয় আছে সেখানে জানাতে হবে।"
ইউনিভার্সিটির ফোন পেয়ে দেবী মাথায় হাত দিয়ে বসে,যদিও পুরো ঘটনা তাকে তেমন বিশদে বলা হয় না। জানতে চাওয়া হয় সে বাড়িতে ফোন করেছে কিনা? রাজা সেনের কথা কী জানে দেবী?"
- কী বলবে ভেবে পায় না দেবী,ও জানে না বলে দেয়। বারবারই জানতে চায় কী হয়েছে? ওরা ওখানে আসতে বলে ওকে,আজকের দিনটা অপেক্ষা করে। যদি কোন যোগাযোগ করে অথবা পৌঁছে যায় বাড়িতে।
সারারাত সেদিন ঘুমোয়নি কুইন,ওর চোখে সহসা জল আসে না। সেদিনও আসেনি,শুধু নোংরা কথাগুলো কুড়ে কুড়ে খেয়েছে ওকে। আর ভেবেছে কী করবে? না মাথা নীচু করে আর ফিরবে না বাড়িতে। এমনিতেই ওদের কলঙ্কের শেষ নেই তারপর এখন তো আর মুখ দেখাতেই পারবে না। অপেক্ষা করে দরজা খোলার,আর তারপরেই নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়।
জায়গাটাতে অনেকবার এসেছে কুইন একটু এগোলেই গভীর খাদ। এখানে একবার পড়লে আর কেউ ওকে খুঁজে পাবে না। হয়ত এই পাহাড়ের কোথাও ওর বাবা আছে, মানে মা যাকে ওর বাবা বলে। কী অদ্ভুত ভাগ্য ওদের? রাজা,সম্রাট সবাই ওদের ভাগ্যের সাথে কোনভাবে জড়িয়ে অথচ কারও কপালেই সুখ নেই। আরেকটু বাদে সব শেষ হয়ে যাবে,অবশ্য মা আর আম্মা ছাড়া তেমন কাউকে হয়ত ছোঁবে না ওর মৃত্যু। আজ তিস্তার কথা খুব মনে হচ্ছে, বেচারা জানতে পারল না ওদের বন্ধুত্বের ফলে একটা বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেল। যাক স্যারকে আর মুখ লুকিয়ে পালাতে হবে না,অত ভালো একজন স্যার না থাকলে তো পুরো ডিপার্টমেন্টের ক্ষতি। তিস্তা কাঁদবে আবার ওকে খুঁজে বায়না করবে। তবে আর ওকে মারবেন না স্যার। তারপর একটা সময় ভুলে যাবে সব। একটা চিঠি লিখে যাবে মাকে? না থাক। ওড়নাটা আগে উড়িয়ে দেয় কুইন বাঃ কী সুন্দর করে পাখনা মেলা পাখির মত উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে গহ্বরে। একটু বাদেই এবার ও এমনভাবেই পড়বে নীচে। চোখ বন্ধ করে কুইন,ব্যাগটাকে পেছনে ফেলে রাখে,আরও কত স্মৃতি রইল পড়ে,ভালোবাসার খাতাই তো খোলা হল না। হয়ত ওর কোন প্রেমিক থাকলে সে ওকে নিয়ে কবিতা লিখত,ওকে খুঁজত পাহাড়ের খাদে, না আর নয় এবার ও তলিয়ে যাবে মরণ খেলার সেই রোগটা আবার এসে নাচছে মনে। এর আগেও ও একবার ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল তবে মরা হয়নি,এবার ও মরবেই,মরতে হবেই ওকে। দুই হাত বাড়িয়ে মৃত্যুকে ধরার জন্য লাফ দেয় কুইন।
**************************
৩০
ইউনিভার্সিটি থেকে ফোনটা আসার পর দেবীর চোখের জল শুকায়নি,পাগলের মত হাউমাউ করে কেঁদেছে মাকে জড়িয়ে। পাথরের মত বসে আছেন কুইনের আম্মা,আর কত কী সইতে হবে কে জানে? অমন ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটা কী উধাও হয়ে গেল হঠাৎই? ওকে কী তাহলে কেউ মানে কিডন্যাপ করেছে? এমন ঘটনা তো হচ্ছেই কত।
দেবী কাঁদতে থাকে,'' মা আমি কী করব আমার তো মাথাই কাজ করছে না কোন। তখনি বলেছিলাম যে ঐ প্রফেসারের বাচ্চাটাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করিস না। এই থেকেই তো এত কিছু হল।"
-" এসব তুই কী বলছিস দেবী? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।"
-" মা ওকে বারবারই বলেছিলাম কারও একটা ফোন নং দিতে,তা মেয়ে তো কিছুতেই রুমমেটের নং দেবে না। অনেক বলে কদিন আগে নিয়েছি। মেয়েটাকে আমি ফোন করেছিলাম,ওদিকে অনেক ঝামেলা হয়ে গেছে মা।"
-" কী বলছিস তুই?"
"আমি তোমাকে সব গুছিয়ে বলতে পারব না। আমার শরীর অস্থির করছে।"
অনেক শোক দুঃখ কাটিয়ে আজ তিনি বটবৃক্ষের মত। দেবীকে আগলেছেন,ওর মেয়েকেও আগলেছেন আর সেইটুকু ভরসা নিয়েই দেবীর মাথাতে হাত রাখেন," আমাদের দিদিভাইয়ের কিছু হবে না,হয়ত মেয়েটা একটু পাগলাটে কিন্তু মনটা তার বড় ভালো। একটু ভালোবাসার কাঙাল মেয়েটা। সে ঠিক ফিরে আসবে দেবী। ভগবান এত বড় অন্যায় আমার মেয়ের সাথে করতে পারেন না। তাহলে আমিও তাকে আর কোনদিন ডাকব না।"
-" মা..."
-" হ্যাঁ ভরসা রাখ।"
- "আমাকে যেতে হবে মা এক্ষুণি যেতে হবে ওখানে যেভাবেই হোক।"
-" এ অবস্থায় তুই একা যাবি কী করে? না না তুই এমনিতেই.. কাউকে সাথে নিতে হবে। একটু অপেক্ষা কর মা,যদি সে আসে মানে সে যা মুডি হয়ত খুব মনখারাপ তাই কোথাও গিয়ে বসে আছে..."
-" মা তাই যেন হয়,কিন্তু আমি যে ভরসা পাচ্ছি না। তাহলে কী জোহানকে খবর দেব? হ্যাঁ হ্যাঁ জোহান.. এই তো মনে পড়েছে। কাউকে বলা যাবে না এখনি কিছু, চারদিকে লোকে ওত পেতে আছে। লোকের এত কৌতূহল তাই তো মেয়েটা আর সইতে না পেরে শহর ছাড়ল...মা জোহানকে ফোন করি তাই না?"
-" হ্যাঁ মা তাই কর,দেখ ও কোথায় আছে। ছেলেটা বড় ভালো। আমাদের অনেক বড় ভরসা ছিল। দিদিভাই যে কেন ওকে পছন্দ করত না..."
দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে বেশ কয়েকবার মানে প্রায় পঞ্চাশবার জোহানকে ফোন করেছে দেবী কিন্তু প্রতিবারই ফোন নট রিচেবল বলেছে কখনও বলেছে সুইচড অফ। হায় ভগবান কোথায় আছে ছেলেটা? ওকে যে ভীষণ দরকার এখন।
ফোন করেছে ইউনিভার্সিটির সেই মেয়েটাকে। মেয়েটা বলেছে কোন খবর নেই এখনও পর্যন্ত। ওরা পুলিশকে খবর দিয়েছে,পুলিশ খোঁজ করছে।
-" কাকিমা তুমি কোন চিন্তা কোর না,সম্রাজ্ঞী দিদি ঠিক ফিরে আসবে। আমরা এবার একটা অ্যান্টি ক্যাম্পেনিং করব ঠিক করেছি। অনেকেই আছে আমাদের দলে। এমন অন্যায় কিছুতেই ইউনিভার্সিটি করতে পারে না।"
দেবী এগুলো শুনে কী করবে? ওর মেয়েটা কোথায় গেছে সেটা তো কেউ জানে না। না ও নিজে যাবে...
সারাদিনের ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে দেবী তবুও স্টেশনে এসেছে ওকে যে যেতেই হবে। ও নিজে বিচার চাইবে কেন ওর নিরপরাধ মেয়ের ওপর এমন অবিচার করা হল? ওর মেয়ের ক্ষতি কেন করা হল এইভাবে? জবাব দিতেই হবে ওদের।
বাইরে না বেরিয়ে চালাক চতুর নয় দেবী,আগেরবার মেয়ে ছিল সাথে। এবার তার টিকিটও কাটা হয়নি,সে ঠিক করেছে স্টেশনে গিয়ে যা টিকিট পাবে সেই ট্রেনেই উঠে বসবে,দরকার হলে দাঁড়িয়ে যাবে। বারবার স্টেশনে আসা যাওয়া মানুষগুলোর মধ্যে মেয়েকে খোঁজে দেবী। হয়ত ও ফিরছে,বা অভিমান করে বসে আছে কোন বেঞ্চে। না না কী ভাবছে ও?
হঠাৎই দেবীর হাতের মুঠোতে ধরে রাখা ফোনটা বেজে ওঠে, স্ক্রীনে জোহানের নামটা দেখে দেবীর চোখে জল আসে। এতক্ষণে ছেলেটা ফোন করল! কত চেষ্টা করেছে ওকে ফোনে পাওয়ার জন্য।
জোহানকে কিছু বলার আগেই ও বলে," একবার আসতে হবে এখানে।"
-" কোথায় যাব? তোমাকে সারাদিন কত ফোন করেছি পাইনি। জানো আমার কুইনকে .."
-" আমি জানি আন্টি,পারলে আজই চলে এসো। কুইন আছে.."
নিজেকে সামলাতে পারে না দেবী," কুইন আছে কোথায় আছে? আমার মেয়েটা বেঁচে আছে তো? তুমি কোথায় পেলে..."
-" ও ভালো আছে, তুমি পারলে আজই চলে এসো।"
অনেকগুলো প্রশ্ন ধাক্কা মারে দেবীকে তবুও হঠাৎই একটা শান্তির পালক এসে গায়ে হাত বুলিয়ে যায় বলে যায় মেয়েটা তাহলে আছে। তাড়াতাড়ি মাকে ফোন করে দেবী।
দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় টিকিট কাউন্টারের দিকে,ওকে যে যেতেই হবে...
************************
কয়েকদিন ঘোরের মধ্যেই কেটেছে কুইনের, জ্ঞান এলে এতই চেঁচামেচি করেছে আর রেস্টলেস হয়ে উঠেছে যে মোটামুটি ঘুম পাড়িয়ে রেখে দিয়েছেন ওকে ডাক্তাররা।
দেবী টানা বেশ কয়েকদিন থেকে ফিরে এসেছে কলকাতায়। মেয়েকে সাথে নিয়েই ফিরতে চেয়েছিল কিন্তু বারণ করেছে জোহান আর ওখানকার ডাক্তাররা। দার্জিলিংয়ের এই মেন্টাল হসপিটালটা শহরের হৈ হট্টগোল থেকে দূরে। কুইন এখানে ভালোই আছে তবে ওর আরও বেশ কিছুদিন চিকিৎসা দরকার। কারণ সুইসাইডাল আটেম্পটের রেকর্ড আছে কুইনের। সুতরাং একদম সুস্থ না হলে ওকে ছাড়া ঠিক হবে না। মায়ের সাথেও কথা বলতে চায়নি কুইন,বলতে গেলে কোন কথাই বলেনি। কারও সাথেই কোন কথা বলে না সে,চুপ করে জানলায় বসে থাকে। জানলা বন্ধ করে দিলে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়।
এই বিছানা আর ঘরটা তার বড়ই আরামের জায়গা। এখানে কেউ ওকে তেমন বিরক্ত করে না। সব কথা ঠিক মনে করতে পারে না কুইন। ওরা কিসব ওষুধ খাওয়ায় খুব ঝিমুনি আসে।
মাঝে কেটে গেছে দুটো মাস,চাকরিটা রাজা সেনের ছাড়া হয়নি। ছেলেমেয়েরা এসে অনশনে বসেছিল,তাদের স্যারের জন্য। প্রায় টানা দশদিন জ্বর থেকে উঠে বুঝেছিলেন এতদিন যাদেরকে পড়াশোনা শিখিয়েছেন তা সম্পূর্ণ বৃথা যায়নি। শুধু ক্লাসরুমে এসে প্রতিদিনই চোখ পড়ে যায় ঐ সিটটার দিকে। মনটা বিষাদে ভরে যায়,একটা ভালো মেয়ে শুধু শুধু হারিয়ে গেল কোথায় যেন। হ্যাঁ হয়ত অনেকেই ভুলে গেছে এই দুই মাসে মেয়েটাকে। তবে তাঁর অপরাধবোধ হয় নিজেকে কাপুরুষ বলে মনে হয় যখনই ভাবেন একটা মেয়েকে বাঁচাতে পারেননি। পুলিশ খবর এনেছিল মেয়েটাকে রেসকিউ করেছে কোন একটা চার্চের ফাদার ওরাই দায়িত্ব নিয়ে রেখেছে ওকে। মেয়েটা নাকি সুইসাইড করতে গেছিল। খবরটা শুনে বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেছিল তাঁর। যদিও এসব কথা শেয়ার করতে পারেননি কারও সাথেই। তিস্তাও আর সাহস পায় না বাপিকে বন্ধুর কথা বলতে।
মাসিকে নাকি জিজ্ঞেস করে মাঝে মাঝে বন্ধু কী আর কোনদিন আসবে না? সেকথা মাসির কাছে শুনেছেন রাজা সেন।
সেদিন হঠাৎই বারান্দায় বসে তিস্তা যখন বকবক করছিল টেডিটার সাথে তখন রাজা সেন পেছনে এসে দাঁড়ান। মেয়ের মাথায় হাত রাখেন," কী রে ওকে কী বলছিস?"
ভয়ে চুপ করে যায় তিস্তা। মেয়েটা কেমন গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে।
-" তোর বন্ধুকে মিস্ করছিস তাই বলছিস তো? আমি কিন্তু সব শুনতে পেয়েছি মা। একদিন যাবি নাকি বন্ধুকে দেখতে?"
তিস্তার নিভে যাওয়া মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে হঠাৎই। বাবার মুখের দিকে আশা নিয়ে তাকায় কোলের কাছে ঘেঁষে আসে।
-" বন্ধুর তো অসুখ করেছে মাসি বলছিল,আমরা যাব বাবা দেখতে?"
নিজেকে অনেক কঠিন করে রেখেও আজ বিকেলে হঠাৎই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল রাজা সেনের।
-" হ্যাঁ আমরা একদিন যাব চুপিচুপি, তোর বন্ধুকে দেখে আসব। কাউকে বলিস না যেন।"
ফিসফিস করে তিস্তা," মাসিকেও বলব না তো?"
-" পাগলী একটা,আমার সোনা মেয়ে।"
বাগানের এক কোণে পাইন গাছের তলাতে একটা চেয়ারে বসে আছে কুইন। জোহান তার গায়ে চাদরটা জড়িয়ে দেয়,তারপর বলে চা টা দেব এখন? ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে যে।"
মুখে একটা ম্লান হাসি নিয়ে মাথা নাড়ে কুইন,একটা সময় যাকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল আজ সেই জোহান ওকে আদরে আগলে রেখেছে। হয়ত ও না থাকলে বেঁচে গেলেও পুরোপুরি পাগল হয়ে যেত কুইন।
সেদিন যখন ও মৃত্যুর অপেক্ষায়, তাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে মুক্তি পেতে আর কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষায় পা বাড়িয়েছে ঠিক তখনি পেছন থেকে টেনে ধরেছিল কেউ ওকে। কিছুক্ষণ জোর খাটিয়ে নেতিয়ে পড়েছিল কুইন। তারপর আর কিছু মনে নেই,অদ্ভুতভাবে ঐ অঞ্চলের ফাদারই রেসকিউ করেছিলেন ওকে। তারপর নিয়ে গিয়েছিলেন কাছের মেডিক্যাল কলেজে,আর সেখানেই জোহানের নজরে পড়ে কুইনকে। সবটাই কেমন যেন সিনেমার মত তবুও সত্যি। আসলে বাইরে পড়তে গিয়ে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে আবার ফিরে এসেছিল সেকেন্ড কাউন্সেলিংয়ে এই কলেজে। ও শুনেছিল কুইন কাছাকাছি থাকে,তবে একটা অভিমানের হাল্কা মনখারাপ যোগাযোগ করতে দেয়নি ওকে। কিন্তু কলেজে দেখা সুন্দরী উদ্ধত মেয়েটাকে এইভাবে এমার্জেন্সীর সামনে ট্রলিতে দেখবে ভাবেনি। হয়ত ভগবান যা করেন তা ভালোই করেন। তারপর ও নিজেই খবর দিয়েছিল সব জায়গায়। আর ও নিজেও যেহেতু চার্চের সাথে যুক্ত তাই কোন অসুবিধা হয়নি।
কুইন চা খাচ্ছে তবে চোখদুটো যেন অন্য ভাবনাতে ডুবে আছে। সপ্তাহের শেষে এই দিনটা আসার জন্য সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকে জোহান। কুইন তেমন কোন কথা বলে না তবে হয়ত একমাত্র আপনজন ভেবে ওরই অপেক্ষায় থাকে। দুজনের নীরবতা বলে যায় অনেক কিছুই।
*******************
রাজা সেন এসে হসপিটালের ভেতরে রিসেপসনের সামনে দাঁড়ান। একজন জিজ্ঞেস করে,
-" আপনারা কার সাথে দেখা করতে চান?"
-" আমি ফোন করেছিলাম মানে আমার একজন ছাত্রী।"
-" ও হ্যাঁ দেখছি।"
বাবার মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায় তিস্তা।" বন্ধু কোথায়? এটা কোন জায়গা?"
-" হ্যাঁ স্যার শুনুন আমি বলেছি তবে বাচ্চা অ্যালাউ নেই ভেতরে। এখানে আসলে সব মেন্টাল পেশেন্ট।"
কেমন যেন অস্থির লাগে রাজা সেনের তিস্তার দিকে তাকিয়ে, মেয়েটার মুখটা একদম ছোট্ট হয়ে নিভে গেছে, হয়ত ভাবছে তবে কী দেখা হবে না বন্ধুর সাথে? শুকনো গলায় বলে,
-" বাপি আমি যাব না?"
-" বন্ধুর তো অসুখ,তুমি তো ছোট্ট আচ্ছা দেখছি আমি।"
প্রফেসর সেন আবার কথা বলেন আর অনুরোধ করেন। মেয়েটা ভেতরে যায়,এবার জোহান বাইরে বেরিয়ে আসে। যদিও ওদের দেখেনি কখনও তবুও কুইনের মুখে শুনেছে স্যার আর তিস্তার কথা আর তাতেই চেনা হয়েছে। এই মানুষটাকে বাঁচাতেই হয়ত নিজেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল আর তার সাথে ছিল জমে থাকা পুরোনো ক্ষত আর অবসাদের পাহাড়। যা আগ্নেয়গিরির মত হঠাৎই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। হয়ত এমন একটা মুহূর্তেই মানুষের মন বেপোরোয়া হয়ে মুক্তি খোঁজে মৃত্যুতে। তবে সত্যিই কী মৃত্যুই শেষ কথা বলে? একবারও মনে হয় না,তিল তিল করে যাদের ভালোবাসা বড় করল তাদের কী হবে?
জোহান একটু এগিয়ে এসে বলে," আপনি সম্রাজ্ঞীর স্যার তো? আর এই বুঝি তিস্তা? আপনারা এই পাশের ঘরে অপেক্ষা করুন আমি ওকে নিয়ে আসছি। ওহ্ আমার কথা তো বলাই হয়নি,আমি জোহান।"
ছেলেটাকে এর আগে কখনও দেখেননি, ও বোধহয় এখানে কাজ করে। যাক দেখা যাক কী করে ও?
জোহানের সাথে এসে দাঁড়িয়েছে কুইন ওকে দেখে
চমকে ওঠেন প্রফেসর সেন, এই কী সেই মেয়ে যার রূপে মজেছে কত ছেলে? এমন কী তাকেও হেনস্থা করা হয়েছে রূপের দোহাই দিয়েই।
তিস্তা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ওকে, কতদিন বাদে আজ মেয়েটা আবার বাঁধনছাড়া ভুলে গেছে আজ যে মাম্মা বলা তার বারণ সে কাতরে ওঠে," মাম্মা তুমি কেন আস না আর? তোমার কী আমার মত জ্বর হয়েছে? আমি বারান্দায় বসে থাকি যে তোমার জন্য...আমি তোমার কাছে থাকব।"
এতদিন তেমনভাবে কুইনকে কাঁদতে দেখেনি জোহান। আজ কুইনের চোখের জলের বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল ওর দুই গাল,অবাক হয়ে তিস্তা তাকিয়ে দেখল সেই কান্না। ওর হাসিখুশি বন্ধু কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কুইনকে জড়িয়ে ধরে তিস্তা তারপর বলে, তুমি কেঁদো না মাম্মা। এই তো আমি এসেছি তোমার কাছে। তোমার বুঝি খুব অসুখ? তোমার সাইকেলটা কই গো?"
তিস্তা বলতেই সেই পুরোনো দিনগুলো মনে পড়ে কুইনের, সবই তো পড়ে আছে ওখানে। ওর বই,খাতা,জিনিসপত্র আর ভবিষ্যত। অনেকেই জানে না যে ও এখন এখানে।
তবে দেবীর সব রাগ ঝরে পড়েছিল ঐ স্যারের ওপর,তাই সে মেয়ের ফোন থেকে নম্বর নিয়ে ফোনে প্রতিবাদ করে উঠেছিল," আমার মেয়েটাকে এইভাবে শেষ করে দিলেন আপনারা?"
বিরক্ত হয়েছিলেন প্রথমে রাজা সেন তারপর সব শুনতে শুনতে তারও মনের কোণে মেঘ আর চোখের কোণে জল জমেছিল। জানতে পেরেছেন প্রজাপতির মত ছটফটে আর ময়ূরের মত সুন্দর আর অহঙ্কারী মেয়েটা এখন কঠিন মনের অসুখে ভুগছে,নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে সব কিছু থেকে। তাকে দেখলে আর চেনা যায় না।
-" স্যার চলুন আমরা একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি। ওরা দুই বন্ধুতে কথা বলুক।" অন্যমনস্ক রাজা সেনকে জোহান বলে।
ওরা চলে যেতেই কুইনের মেঘলা মনকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল তিস্তার ঢেউ। সেই ঢেউয়ের ধাক্বাতে ভেসে গেছিল মনে জমা অনেক অবসাদের পাথর। দুজনে তখন দুজনকে জড়িয়ে আদর করতে ব্যস্ত। তিস্তার বান খুশির বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কুইনকে। ঢোকার মুখে ওদের হাসির শব্দ শুনতে পায় ওরা দুজনেই। ছেলেটাকে স্বল্প আলাপে খুব ভালো লেগেছে প্রফেসর সেনের,দেখে যেন মনে হয় আদিবাসী ছেলে অথচ কী যে সফ্ট আর সুন্দর ব্যবহার ভাবাই যায় না। অনেক কিছু জেনে গেলেন ওর সম্বন্ধে,খুবই সরল আর অপকট ছেলেটা।
দুজনেই দরজার মুখে থমকে দাঁড়ায় কুইনকে হাসতে দেখে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে যায় জোহানের, আস্তে ইশারায় দেখায় ওদের। তারপর আস্তে আস্তে বলে," আফটার আ লঙ পিরিয়ড সী ইজ স্মাইলিং।"
অনেকদিন বাদে চেনা সম্রাজ্ঞীকে দেখতে পান প্রফেসর সেন,হয়ত মেঘলা আকাশে এই উজ্জ্বল রোদটুকু ফুটেছে বলেই এতটা শোভা সেই হাসির।
এগিয়ে যান প্রফেসর সেন অনেকটা হাল্কা লাগে নিজেকে আজ। মেয়েটাকেও তো কিছু বলতে পারেননি এতদিন,হয়ত তাকাতেও পারেননি ওর মুখের দিকে ভালো করে। জোহানের জন্য এতটা সম্ভব হল আজ। নাহলে হয়ত ফিরেই যেতে হত,আর তিস্তাকে কী বলে বোঝাতেন কে জানে?
ওদের হাসির ঝর্ণার মাঝেই বলেন প্রফেসর সেন," প্রিন্সেস চল আমাদের এবার ফিরতে হবে। অনেকটা পথ যাব তো আর বন্ধু এবার একটু ঘুমোক।"
-" আরেকটু থাকি না বাপি? বন্ধু তুমি ঘুমোবে না তো?"
রাজা সেনের সামনে চুপ করে যায় কুইন। হয়ত আগের অনেক কথা মনে পড়ে যায়।
ওরা চলে যাবে এখন তিস্তা তখনও জড়িয়ে ওর বন্ধুকে। জোহান ওকে একটা গোলাপ ফুল দেয়," বেবি ডার্লিং ইটস ফর ইউ,যখন মন খারাপ হবে আবার চলে আসবে এখানে। আমরা অনেক খেলা করব।"
প্রিন্সেসের মুখটা ঝলমলে হয়ে ওঠে ও সামনের দিকে পা বাড়িয়েছে বাবার সাথে,হাত নাড়ছে পেছনের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎই রাজা সেন পেছনের দিকে তাকান তারপর পিছিয়ে আসেন হঠাৎই বলে ফেলেন কুইনকে," ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড,জানি না কী করে বলব। তুমি ইচ্ছে করলে ইউ মে জয়েন আস। মানে প্রিন্সেসের মাম্মা হয়ে থাকতে পার। আমি ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দেব,তারপর বাইরে কোথাও চলে যাব আমরা।"
আকস্মিক ভাবে কথাটা শুনে কুইনের মুখটা নিভে যায়,তাতে কোন আনন্দ আর দেখেন না প্রফেসর সেন। ও জোহানের হাতটা ধরে ওর জামাটা খামচে ধরে পরম নির্ভরতায়। কখনও ছোট ছোট চোখের দৃষ্টি আর শরীরের ভাষা বলে যায় অনেক বড় কথাও..
জোহান সম্রাজ্ঞীর হাতটা ধরেছে ওরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বারবার ফিরে তাকাচ্ছে সম্রাজ্ঞী, তিস্তা তখনও হাত নাড়ছে আর টা টা করছে...
বাইরে বৃষ্টি নেমেছে,গাড়িটা একজায়গায় থামান রাজা সেন,লম্বা লাল ছাতাটা খুলে হঠাৎই হাতটা আকাশের দিকে তুলে উঁচু করে ধরেন ছাতাটাকে। আজ মনের সব জমে থাকা কালো মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে যাক...
বাগানটা পেরোনোর আগেই বৃষ্টি নামে,গা থেকে কোটটা খুলে তাড়াতাড়ি সম্রাজ্ঞীকে আড়াল করে জোহান। সম্রাজ্ঞী বাচ্চাদের মত হুটোপুটি করে ভিজতে চায় বৃষ্টিতে,হয়ত এমন একটা বৃষ্টির জন্য ও নিজেও অনেকদিন অপেক্ষা করেছিল যখন ওকে বৃষ্টির থেকে বাঁচাতে চাইবে কেউ ভালোবাসার আদরের চাদর দিয়ে...
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment