Skip to main content

আনন্দের ছোঁয়া

আনন্দের_ছোঁয়া

পুজোর গন্ধ আকাশে বাতাসে ভাসার আগে থেকেই বাঙালীর পুজোর কেনাকাটা শুরু হয়ে যায়। বাজারের দোকানগুলোতে উঁকি মারে নানা রঙের শাড়ি জামাকাপড়। আজ থেকে প্রায় ছাব্বিশ বছর আগের স্মৃতিতে ডুবে যায় লিলি তখন অনলাইন শপিং ঢোকেনি মধ‍্যবিত্ত বাঙালীর অন্দরে। জামাকাপড় কিনতে যেতেই হত বাজারে অবশ‍্য এখনও বাজারে যায় মানুষজন। অবশ‍্যই যাবে,নাহলে বাজারের দোকানীদের কী হবে শুনি? 
   লিলি কলিংবেলের আওয়াজে দরজা খোলে ডেলিভারি বয় দাঁড়িয়ে ওকে ওটিপি বলতেই প‍্যাকেটটা দিয়ে চলে যায়। প‍্যাকেটের ভাজ খুলতে খুলতে হঠাৎই মনের মাঝের স্মৃতির ঝাঁপি যে কখন খুলে গেছে বুঝতেই পারেনি। সোফাতে বসে জামাটায় হাত বোলাতে বোলাতে মনে হয় সেই সময় একটা দুটো দিন ধরা থাকত বাজারের জন‍্য। সপ্তাহান্তে সেটা ছুটির দিনই হত,আগের দিন থেকেই থাকত উত্তেজনা সেটা নিয়ে। আর তৈরী হত একটা লম্বা লিস্ট। এখনকার মত তখন হাতে টাকা দিয়ে দেওয়া বা ফোন পে গুগল পে করে দেবার চল ছিল না। বাজারের ফর্দে যোগ হত শ্বশুর শাশুড়ির জামাকাপড়, ননদদের শাড়ি,নন্দাইদের শার্ট প‍্যান্টের কাপড়,বাচ্চাদের জামা প‍্যান্ট,বাড়ির কাজের লোকের শাড়ি আর লিলির মা বাবার জামাকাপড়।
    সকাল সকাল স্নান করে কোনরকমে একটু সেদ্ধভাত খেয়ে সারাদিনের নামে বেরোনো। বিল্টু যখন খুব ছোট ওকে বাড়িতে কাজের লোকের কাছে রেখেই বেরোত ওরা। সারাদিন ধরে নিউমার্কেট গড়িয়াহাট ঘুরে যখন ফিরত তখন ছেলেটার শুকনো মুখটা দেখে খুব কষ্ট হত। মাকে দেখে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে আসত ছেলেটা। ওকে কোলে বসিয়ে নিজেরা একটু ঠান্ডা হয়ে খুলত বাজারের ব‍্যাগ। মুচমুচে পলিথিনের প‍্যাকেটের ভেতর থেকে বেরোত পর পর সবার জামাকাপড়। তারপর আবার সেগুলো পৌঁছে দেওয়াও ছিল এক পার্বণ। পুজোর আগে দিয়ে শাড়ি জামা আলতা সিঁদুর নিয়ে ননদদের বাড়ি বা আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া ছিল এক অন‍্যতম কাজ। সেখানে জিনিসপত্র দিয়ে ভালোমন্দ খেয়ে বাড়ি ফেরা। আবার ওদের বাড়িতেও আসত অনেকে জামাকাপড় দিতে। পুজোর আগে জমত প‍্যাকেটের বোঝা,পুজোকে ঘিরে খুশীর ঝাঁপি খুলে যেত আর বাড়িতে বসত আড্ডাখানা। তোমার জন‍্য এবার এই শাড়িটা এনেছি বুঝলে বৌদি কথাটা শুনেই লিলি প‍্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুলে বসত, সবসময় যে পছন্দ হত তা নয় তবুও হাতে করে কারও আনা জিনিসকে আনন্দে নিয়ে বলত ভালো হয়েছে।
            স্মৃতির ঝাঁপি খুলে হঠাৎই হাসি পায় লিলির,বিল্টুর তখন বছর দুয়েক বয়েস। বাড়ির অন‍্যদের জামাকাপড় কেনা হয়ে গেছে তখন। একদিন ছেলেকে নিয়ে বেরিয়েছে ওরা কর্তা গিন্নী ওর জামা কিনবে বলে। তখন সত‍্যি বলতে অত বেশি টাকা হাতে থাকত না। অমিতের বোনাস আর পুজো অ্যাডভান্সে বাজার হত। তাই লিলির শাড়িটা কেনা হত সব শেষে মানে অমিতের বোনাস হওয়ার পর। রাতে শুয়ে বরের বুকে মুখ রাখত লিলি। অমিত বলত," তোমার শাড়িটা কিনতে যাব বুঝলে বোনাস পেয়েই।"
  ঠোঁট ফোলাত লিলি," হ‍্যাঁ সবাই সব ভালো শাড়ি কিনে নিয়ে চলে যাবে তারপর আমি শাড়ি কিনতে যাব। তাও আবার ষষ্ঠীর দিনে। কখন ব্লাউজ বানাবো শুনি?"
-" অন‍্য কিছু দিয়ে পরে নেবে,তারপর বানাবে। তুমিই তো বল পুজোর সময় দর্জিরা ভালো ব্লাউজ বানায় না।"
    তারপর সত‍্যিই শাড়ি কেনা হত আর ব্লাউজ বানানো হত না। একটা রেডিমেড ব্লাউজ কিনে সেই শাড়ি পরে কপালে বড় সিঁদুরের টিপ এঁকে আর গয়না পরে পাড়ার পুজোর প‍্যান্ডেলে অঞ্জলি দিতে যেত। একে অন‍্যের শাড়ি দেখত সেখানেই অঞ্জলির পর চেয়ারে বসে শুরু হত শাড়ি গয়নার কত গল্প। ওরা আগে যেখানে থাকত সেখানে তখন বৌরা অষ্টমীর অঞ্জলি দিত সোনার গয়না পরেই।
      নিজের শাড়ির পুরোনো কথা ছেড়ে দিয়ে আবার বিল্টুর কথায় আসে লিলি। হ‍্যাঁ সেবার বিল্টুকে নিয়ে ওরা ট্রেজার্স আইল‍্যান্ডে জামা কিনতে গেছে। সত‍্যি কথা বলতে এর আগে ওখানে আসেনি ওরা,ভাবত ওখানে জামাকাপড়ের দাম অনেক যা ওদের ক্ষমতার বাইরে। অমিত বলেছিল," এবার নিউমার্কেট যাব বুঝলে,ওখানে নাকি বেশ দরদাম করে কেনা যায়। আর তারপর সিরাজের বিরিয়ানী খেয়ে আসব বুঝলে। অনেকদিন বাইরে খাই না।"

    ট্রেজার আইল‍্যান্ডে বাচ্চাদের জামাকাপড় দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছিল লিলির। কী সুন্দর সুন্দর জামাকাপড়! বিল্টুকে সামলাতে সামলাতে ড্রেস দেখতে হাত বাড়িয়েছিল। দোকানের লোকটা একটার পর একটা বক্স নামাচ্ছিল। হঠাৎই বিল্টু একটা সেট দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল," এই যে মিকি মাউস,আমি এতা নেব।"
  সেটটা খুলে ভালো লাগল ওরও, প‍্যান্টের কাপড়ে বেশ মিকি মাউসের ছবি দেওয়া। সাথে গোল গলা গেঞ্জির টি শার্ট। ওটা নিয়ে বাকি কেনাকাটা করে বিরিয়ানি খেয়ে ওরা ফিরল বাড়িতে। বাড়ি এসেই বিল্টু প‍্যাকেট ধরে টানাটানি শুরু করল," আমারটা কই? আমাকে পরিয়ে দাও। আমি মিকি মাউস পরব।"
     কোন উপায় নেই কারণ ছেলের বায়না উঠেছে সুতরাং দিতেই হবে। সেই বোধহয় শুরু,তারপর প্রতিদিন ঐ ড্রেসটাই পরা শুরু হল। ভাগ‍্যিস তখন পুজো এসে গেছে প্রায়। পুজোতে আরও বেশ কয়েকটা জামা হয়েছে কিন্তু বিল্টু ওটা ছাড়া আর কিছুই পরবে না। পুজোর আগেই লিলিকে বাধ‍্য হয়ে ওটাকে কাচতে হল। কারণ ততক্ষণে ওটা ময়লা হয়ে গেছে। ওপরের টিশার্ট না পরলেও পুজোর চার দিন ঐ একটা মিকি মাউস প‍্যান্ট পরেই বেরোল ছেলে। লিলির বাবা রাগ করলেন," কী একটা ড্রেস কিনে দিয়েছো ছেলেকে যে সারাক্ষণ সে ওটাই পরে থাকল। দাদুভাই আমার দেওয়া ড্রেস পরতেই চাইছে না।"

    বিল্টুর সেই মিকিমাউসের ছাপ দেওয়া ফুল প‍্যান্ট আজ অতীত। অনেক বড় হয়ে গেছে বিল্টু, লিলি পা রেখেছে মাঝ বয়েসে। আকাশে বাতাসে ভাসে পুজোর গন্ধ। এই গন্ধ বড় প্রিয় লিলির মন ভেসে যায় কোন অতীতে। কখনও ছেলেবেলার কথা মনে করে চোখের কোণে চিকচিক করে জল। হঠাৎই বুকের সিন্দুকে জমে থাকা স্মৃতির বাক্সের ডালা খুলে ওরাও উড়তে শুরু করে শ‍রতের আগমনে। লিলির মন ফিরে আসে বিল্টুর ডাকে," মা এটা তোমার,একটু খুলে দেখ তো তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা?"
মোড়ক খোলে যত্নে লিলি বুঝতে পারে অনেকটা দাম শাড়িটার,চোখটা হঠাৎই হাল্কা ভেজে। নিজেকে সামলায় লিলি বলে," এত দাম দিয়ে এনেছিস কেন?"
-" তোমার পছন্দ হয়েছে মা?"
  লিলি অবাক হয়,সেদিনের মিকি মাউসের প‍্যান্ট পরে ঘুরে বেড়ানো বিল্টু কখন যে ওর বাবার মত হয়েছে বুঝতেই পারেনি। শাড়িটা বিছানার পাশে রাখা,সারাদিন অনেকবার গায়ে ফেলে দেখেছে লিলি,গন্ধ নিয়েছে ভালোবাসার। মনে মনে ভেবেছে আহা ছেলেটা কত কষ্ট করে রোজগার করে কী দরকার ছিল এত খরচ করার? বিছানার পাশে রাখা শাড়িটা আবার আদরে জড়ায় লিলি,একটা মুচমুচে শব্দ পায় নতুন প্লাস্টিকের। হঠাৎই নিজেকে সেই বিল্টুর ছেলেবেলার মত মনে হয় লিলির হয়ত এই অনুভূতিটার নামই আনন্দ... সেটা কেমন দেখতে কেউ জানে না তবে তাঁর ছোঁয়া পেলে মন ভালো হয়ে যায়। লিলি আবার মুচমুচে আওয়াজটা শোনে নাকে ভাসে নতুন শাড়ির গন্ধ,আবার গায়ে ফেলে দেখতে ইচ্ছে করে বিল্টুর মত।
  সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...