গতবার কোচবিহার গিয়ে মদনমোহন দর্শন হলেও পুজো দেওয়া হয়নি বিশেষ কারণে, তাই এবার আবার যাওয়া। তার সাথে বহুদিনের ইচ্ছে ছিল আমার কর্তার রাসের মেলা দেখার তাই অনেকগুলো কাজ হাতে নিয়ে খুব কম সময়ের জন্য যাওয়া কোচবিহার। পদাতিক এক্সপ্রেসে গিয়ে দুপুরে পৌঁছে বিকেলেই মদনমোহনের সান্ধ্যকালীন দর্শন ও পুজো দিয়েছিলাম তারপর গেছিলাম মেলাতে। সাথে ছিল হীরাদি,জামাইবাবু আর মুন্নী। যাদের উদ্যোগে আর সাদর আহ্বানেই আমাদের যাওয়া। সন্ধ্যেবেলাতে সব রাস্তা মোটামুটি বন্ধ থাকে,তাই গাড়ি দূরে রেখে বেশ কিছুটা পথ হাঁটতে হয় মন্দির এবং মেলাতে যেতে। তাই দিদিদের সাথে পা মেলালাম আমরা। যদিও জামাইবাবু আরও কিছুটা পথ যাতে আমরা গাড়িতে যেতে পারি সেই ব্যবস্থা করেছেন। মদনমোহন মন্দিরের অনেকটা আগেই দেখলাম রাস্তার ধার ধরে মেলা বসেছে আর দলে দলে লোক চলেছে মেলার পানে। আমরাও সেই ভীড়ে পা মেলালাম।
রাস উপলক্ষে রাতে আলোতে আলোতে সেজে ওঠে মদনমোহন ঠাকুর বাড়ি,সে এক অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। শ্বেতশুভ্র মন্দির আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে নানা রঙের আলোর সাজে। মেলার সময় মূল প্রবেশ দ্বার বন্ধ থাকে। তার থেকে এগিয়ে পাশের দরজা দিয়ে মেটাল ডিটেক্টর পেরিয়ে আমরা ঢুকলাম।
মদনমোহন মন্দিরে ঢুকেই ডান দিকে জলাশয়ে দেখলাম শ্রীকৃষ্ণ আর সখীরা,তারপর ছোট ছোট ছাউনি করে পৌরাণিক কথা অবলম্বনে বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। আর তার পাশেই রয়েছে রাসচক্র। এই রাসদচক্রের সাথে মহরমের সময়ে বানানো তাজিয়ার কিছুটা মিল আছে,তবে এখানেও সূক্ষ্ম কারুকাজ করা কাগজে এবং মাঝে মাঝে দেব দেবীর ছবি আটকানো। দিদির কাছে শুনলাম বছরের পর বছর ধরে এই রাসচক্র বানান মুসলিম পরিবার। মানে রাজার আমল থেকে তারাই বানিয়ে আসছেন। এটি বানানোর জন্য তারা একমাস যাবৎ নিরামিষ আহার করেন। রাসচক্রের সামনে প্রচুর ভীড়। প্রত্যেকেই ঘোরাতে চায় এটিকে। সুতরাং আমরাও হাত বাড়ালাম এবং ঠেলাঠেলি সয়ে গোল করে একপাক ঘুরে এলাম। রাসচক্র পেরিয়ে ডানদিকে গেলে প্রদর্শনী মত করা হয়েছে দেখলাম তাতে আঞ্চলিক শিল্পীদের বানানো বিভিন্ন মডেল আছে,আর আছে ছাত্রছাত্রীদের আঁকা ছবি। বাঁদিকে ফিরলে সাজানো রয়েছে পেতলের দশাবতারের মূর্তি। দেখেই বোঝা গেল অনেক প্রাচীন মূর্তি। তারপর রাধাকৃষ্ণের অনেকগুলো মূর্তি দেখলাম। এই মন্দিরে মদনমোহনের দুই পাশে পূজিতা হন কালী এবং দুর্গা। দুটি মূর্তিই অনন্যসাধারণ। এছাড়াও রাসের জন্য সাংস্কৃতিক মঞ্চে তখন হচ্ছিল ভাওয়াইয়া গান। মন্দির চত্তর তখন ভক্তদের সমাগমে একদম ভর্তি। তার মধ্যেই সুযোগ পেলাম মদনমোহন দর্শনের। একদম নিটোল সুন্দর সোনালী রঙে হলুদ পোশাকে বিভূষিত প্রভু। আমরা পুজো রাখলাম সামনে,এই ভোগ নিবেদন কে ভেট দেওয়া বলে। মদনমোহন কোচবিহার রাজাদের কুলদেবতা। তবে দেবতাকে হয়ত বাঁধা যায় না তাই তিনি এখন সবার এবং তাঁকে কেন্দ্র করেই প্রতিদিন অসংখ্য লোক আসে এখানে। আর রাসের সময় হয় সমুদ্রের মত মানুষের ঢেউ,প্রচুর মানুষের রুজি রোজগার এই মেলাকে কেন্দ্র করে। পুজো দেওয়া শেষে পা বাড়ালাম মন্দির চত্বরে রাখা রাজাদের ছবি আর বিশালাকার পুতনা রাক্ষসী দেখে মেলার দিকে। রাস্তায় প্রচুর ভীড় তাদের সাথে পা মেলালাম আমরাও। অবাক হলাম দেখে মেলাতে কী নেই? বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এসেছে জিনিসের পসরা নিয়ে,খাবারের দোকান,চুড়ি,মালা কানের দুলের পাশাপাশি শাড়ি কাপড়,শীতের শাল,সোয়েটার,কাঠের জিনিস,লোহার এবং কাঠের জিনিস সবই আছে। আছে ঠাকুরের পোশাক আর কাঁসা,পেতলের জিনিস আর আসবাব পত্রের দোকানও। এছাড়াও বাংলাদেশ থেকে অনেকগুলো দোকান এসেছে তাদের ঢাকাই শাড়ি এবং নোনা ইলিশের সম্ভার নিয়ে। প্রতিটা দোকানের সামনে রয়েছে নোনা ইলিশ আর পুঁটি মাছ। আমাদের দেখে হাঁকলো দিদি গুড়ও রাখসি নিয়া যান। আমি জিজ্ঞেস করলাম ভালো হইব তো? বলল হ্যাঁ খুব ভালো। অনেকেই দেখলাম কেনাকাটা করছে। আমরাও খুচখাচ কেনাকাটা করলাম।
আমাদের এখানকার মেলাতে যেরকম নাগরদোলা আসে তার থেকে অনেক উঁচু বিশালাকার ইলেকট্রিক চালিত আলো ঝলমলে নাগরদোলা বসেছে। আমার ওঠার ইচ্ছে থাকলেও সঙ্গী পেলাম না। অবশ্য পরে ভাবলাম অনেকদিনের অনভ্যাস তাই যদি শরীর খারাপ হয় তবে মুশকিল। জামাইবাবুর পাঠানো ছবি দেখে ভেটাগুড়ির জিলিপি খাবার ইচ্ছে ছিল,তাই সে সাধ এবার পূরণ হবেই। জিলিপির দোকানে দেখলাম প্রচুর লোক লাইন দিয়েছে। একটু পরে জিলিপি খাবো ঠিক করে আবার ঘুরতে শুরু করলাম মেলার মজা নিতে। দেখলাম স্টলে স্টলে ভাকা পিঠা বিক্রি হচ্ছে। এই পিঠা মা মারা যাবার পর আর খাওয়া হয়নি। কলসির মুখে কাপড়ে সেদ্ধ করা হয় এই পিঠা। তাই আমিই বায়না করলাম খাবো,সবাই মিলে একটু একটু করে স্বাদ নিলাম গরম গরম সেই পিঠার। বেশ লাগলো,তবে মায়ের হাতের মত নয়। অত বড় মেলা একদিনে ঘুরে ফেলা সম্ভব নয়। তাই ঘন্টা দুই আড়াই ঘুরে বাড়ি ফেরার উদ্যোগ নিলাম জিলিপি নিয়ে। জামাইবাবু লাইন দিয়ে ভেটাগুড়ির জিলিপি কিনলেন,মনে হল চালের গুড়ো দিয়ে বানানো সেই জিলিপি। তবে খুবই ভালো আর কুড়মুড়ে খেতে।
ফেরার সময় ম্যাজিকম্যান আইসক্রীম ওয়ালার সামনে আমার কর্তা দাঁড়ালো। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সঙ্গী আমার ভাগ্নীকে আইসক্রীম দেবার সময় নানা কায়দা করে সে আইসক্রীম দিল। বেশ নতুনত্ব লাগলো ছেলেটির টারকিস আইসক্রীমের ম্যাজিক।
সেদিন রাতের আলোকসজ্জা দেখেছিলাম মন্দিরে খুব ভালো লেগেছিল তবে মনে হল আবার একবার দিনের আলোতে ঠাকুর দেখব তাই ফেরার দিন সকালে ছুটে গিয়েছিলাম তাঁর দর্শন প্রত্যাশায়, তখনও অবশ্য তাঁর ঘুম ভাঙেনি। আমি বললাম, এবার ওঠো কত বেলা হল। তুমি এত বেলা অবধি ঘুমু ঘুমু করলে বিশ্বসংসার চলবে কী করে শুনি? যাক বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর প্রভু এলেন পুরোহিতের কোলে চড়ে,তারপর বসলেন সিংহাসনে। বহু পুরোনো রূপোর সিংহাসনে সোনার বরণ মদনমোহন বসলেন আলো করে। আমিও প্রাণভরে দেখলাম সেই দৃশ্য,ছোট থেকে আধ্যাত্মিক পরিবেশে বড় হয়েছি আমাদের বাড়িতেও আছে গোপাল গিরিধারীর প্রতিষ্ঠিত বিগ্ৰহ। তাই খুব ভালো লাগে ঠাকুর দেখতে।
ভক্ত সমাবেশে প্রভু আলোকিত করলেন চারদিক,মদনমোহনের জয়ের সাথে সাথে ভক্তদের জয়ধ্বনি ঘোষণা করা হল চারিদিকে। ভক্ত আছে বলেই তো ভগবানের জয় ঘোষিত হয় চারিদিকে। আমিও জয়ধ্বনি জানিয়ে তৃপ্ত মনে ফিরলাম বাড়ির পানে।
লেখিকা রুমাশ্রী সাহা চৌধুরীর জন্ম মালদা জেলায়। বর্তমানে কলকাতা শহর স্থায়ী ঠিকানা। ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করে কলকাতার একটি বিদ্যালয়ে সহ শিক্ষিকার পদে রয়েছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি অবসরে লেখালেখি করতে পছন্দ করেন। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং অনেকগুলো প্ল্যাটফর্মে তিনি লেখেন,অসংখ্য ছোট গল্প এবং বেশ কয়েকটি উপন্যাস তিনি লিখেছেন এছাড়াও আছে তাঁর লেখা বেশ কিছু দেশ বিদেশের ভ্রমণ কাহিনী। ইতিমধ্যেই তাঁর লেখা একটি ছোট গল্পের বই এবং একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বই দুটি পাঠকদের বিশেষ প্রশংসা পেয়েছে। টিনের বাক্স উপন্যাসটি লেখিকার লেখা তৃতীয় বই। বইটির ঘটনা প্রবাহ এবং অসামান্য শব্দ চিত্রায়ণ আশাকরি সকলের ভালো লাগবে।
কতশত পথ হেঁটেছে অবহেলায়
Comments
Post a Comment