সকাল থেকেই গিন্নীর ঝাঁঝালো ছ্যাঁক ছোঁক চলছে রান্নাঘরে আর তার সাথে গজগজ চলছে সমান তালে...' ওহ্ যবে থেকে এসেছি এই বাড়িতে প্রাণটা পুড়ে কয়লা হয়ে গেল। যবে চিতায় উঠব তবে মুক্তি হবে। সকাল থেকে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত আমার কথা আর কার মনে থাকে?'
কানটা আবার খাড়া করে একবার সাধনার অভিযোগ শোনেন অতীনবাবু। তারপর আবার ডুবে যান রেডিওটা নিয়ে,ওহ্ এই তো একটা সঙ্গী তাঁর যার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে তাঁর দিন কাটে। একটু গালে হাত দিয়ে গাল টিপলেই বেশ সুন্দর গান গেয়ে তাঁকে জ্বালা যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে। অবশ্য এই রেডিওটা দিয়ে গেছে তার একমাত্র কন্যা চাকরি পেয়ে পুণাতে যাবার আগে। অতীনবাবুর বাবার আমলের রেডিওটা নাভিশ্বাস তুলছিল অনেকদিন থেকেই,ঘরঘর খড়খড় করে আওয়াজ করত। ঠিক যেন মনে হত এই যেন প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাবে। অবশ্য সেটাই হল একটা সময় একেবারে অচল হয়ে গেল।
অতীনবাবু বরাবর হিসেবী,আসলে ছেলেবেলার বড় হওয়ার ওপর বোধহয় অনেক কিছুই নির্ভর করে। মা বাবা যেমন হন,তাঁদের অভ্যেস যেমন তার ছাপ সন্তানের ওপরেও পড়ে। একটা সময় টানাটানিতে মানুষ হয়ে ওটাই অভ্যেস হয়ে গেছিল তাই নিজের জীবনেও বরাবর দড়ি টানাটানি করে কাটিয়েছেন। মানে ভেবেছেন যতটা জমানো যায় কম খরচ করে। খুব ভালো জামাকাপড় কখনও পরেননি,সাধনাকেও রেখেছেন খুব সাধারণ ভাবেই। তবে মেয়েটাকে পড়াশোনা শেখাতে গিয়ে টাকার হিসেব করেননি। অবশ্য সেই টাকা সুদে আসলে বেড়ে উঠে আসবে আশা করা যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে টুলটুল চাকরি পেয়েছে। সুতরাং একটা দিকে নিশ্চিন্ত। মেয়েই চাকরি পেয়ে রেডিওটা উপহার দিয়ে গেল বাইরে যাবার আগে,' বাবা আমি জানি তোমার গান শুনতে ভালো লাগে। পুরোনোটা তো গেছে,এটাতে প্রচুর গান আছে তাছাড়া এফ এম ও আছে তাই যা মনে হয় শুনবে ।
সেটা নিয়ে সুখেই দিন কাটে অতীনবাবুর। একেই রেডিও শুনে এসেছেন বরাবর তারপর তেমন কিছু খরচ নেই একটু মাঝে সাঝে ইলেকট্রিক খাবার দিলেই সে খুশি,এতে ব্যাটারীও লাগে না। তাই অল্পে সাধ পূরণ। বোতাম টিপলেই কখনও লতা,আবার কখনও আশা আবার কখনও মান্না,হেমন্ত বা কিশোরে ডুব দেওয়া যায়। গান শুনতে শুনতে মন ভেসে যায় সদ্য যৌবনে পা রাখা ঝলমলে দিনগুলোতে।
টিভি তাঁর ভালো লাগে না। একটা সময় মেয়ের পড়াশোনার অজুহাতে টিভি একটা ঘরে থাকলেও কেবল কানেকশন নেননি। তারপর সেটা অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছিল,মানে ঘরে বোকা বাস্কটি রয়েছে তবে সে মোটেই বকবক করে না। তবে মায়ের অভিযোগ শুনে টুলটুল টিভিটা চালু করার ব্যবস্থা করেছে সে সাবালিকা হবার পরই। বাবাকে জোরালো গলায় বলেছে,' আমার জন্য তোমরা আর কতদিন স্যাক্রিফাইস করবে শুনি? মা টিভি দেখতে ভালোবাসে,বাবা এবার কানেকশনটা নাও।'
সাধনা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল,' কাকে বলছিস? আমাকে কলুর বলদের মত ঘানিতে জুতে দিয়েছেন আর কোনদিন কী মনে আছে নাকি আমার শখ আহ্লাদের কথা? যন্ত্র করে দিয়েছে জীবনটাকে।'
মা মেয়ের কথার ধারালো তরবারি আর ঢাল দিয়ে কাটতে না পেরে অবশেষে বোকা বাক্সকে সবাক করার ব্যবস্থা করেছেন বেশ কয়েক বছর আগেই। তবুও সবার অগোচরে মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন,' নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা দেখছে রাতদিন,কোথায় রমলা বৌদি ঝগড়া করল,কোথায় উমা মাসি বৌমাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করল রাতদিন এইসব চলছে বাড়িতে। তার থেকে ঐ টাকাটা রেকারিং করলে তো তোমারই থাকত।'
-' নিকুচি করেছে তোমার রেকারিংয়ের,কিপ্টের ডিম একটা। টাকা জমিয়ে হবেটা কী শুনি? কী হবে? ভোগই যদি না করলাম তবে টাকা কী কাজে লাগবে? হায় ভগবান এই কিপ্টেটার পাল্লায় পড়ে সারাজীবন আমার নষ্ট হয়ে গেল।'
-' কী করি বল সাধনা,ঐ তো একার ইনকামে বুঝে চলেছি বলেই তো আজ সব মোটামুটি গুছিয়ে ফেলেছি।'
-' হ্যাঁ কষ্ট শুধু তুমি করনি আমিও করেছি। মানছি একটা সময় অভাব ছিল। তবে এখন তোমার স্বভাব হয়ে গেছে। যাও তো এখান থেকে সবে টিভিটা খুলে বসেছি,দেখতে দাও। তুমি টাকার হিসেব কর গিয়ে। কোনদিন একটা ভালো শাড়ি দিয়েছো?'
কথাটা বলতে বলতে চোখটা ছলছলিয়ে ওঠে সাধনার। বৌয়ের চোখের জলে মনটা একটু পিছলে যায় অতীনবাবুরও,' আহা আহা,সিরিয়াল দেখতে দেখতে আবার কান্না কেন? শাড়ি তো আছে কত তোমার? এই তো মেয়ে কিনে দিল।'
-' হ্যাঁ মেয়েই কিনে দিয়েছে, তুমি তো সেই কোনরকমে টেনেটুনে সেই আদ্যিকালের বাসন্তী স্টোর্সে গিয়ে চিরকালই গুছিয়ে বসে সেই একঘেয়ে তাঁতের শাড়ি কিনে দিলে।'
-' ওতে তোমায় যে বড় ভালো দেখায় সাধনা, তবে এমন বোলনা সিল্কও দিয়েছি কখনও কিনে।'
-' ছাই দিয়েছ,পচা পচা সব শাড়ি। চিরকালের কিপ্টে তুমি। সিরিয়ালে রমলা বৌদি ঘরে কী সুন্দর সব বেনারসী পরে। এক একদিন এক এক রকম।"
-" এই মরেছে,আমি তো জানি বিয়ের দিনই বেনারসী পরে। তা আমাদের সেই দিন তো কবে চুকেবুকে গেছে। এমনিতেই দেরিতে বিয়ে করেছি,তারপর মেয়ে হয়েছে আরও পরে। এই বয়েসে আবার বেনারসী!'
-' ওমা! তুমি আমার বয়েস খুড়ছ! তুমি নিজে একটা বুড়ো। তোমার শখ আহ্লাদ সব গেছে। আমার তাই বলে শখ থাকতে নেই নাকি? আর শোন বেনারসী পরার কোন বয়েস নেই। ঐ তো সিরিয়ালের উমা মাসি নাতির বিয়েতে কী সুন্দর একটা কাতান বেনারসী পরেছিলেন।'
-' কাতান বেনারসী! সেটা আবার কী? সে যাক গে,বিয়ের বেনারসী তো আছেই ওটাই বের করে পর না মন চাইলে। তুমিও না হয় বেনারসী পরেই বসে টিভি দেখলে একদিন।'
-' দেখেছ তোমার বুদ্ধির ঢেঁকি কেমন উল্টো তালে চলে! আরে বিয়ে হয়েছে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর,বিয়ের আট বছর বাদে মেয়ে। সেই বেনারসী পরিয়ে তো সর্বত্র ঘুরিয়েছ। যে বিয়েবাড়িতে গেছি হয় এ বাড়ির বেনারসী না হয় ঐ বাড়ির বেনারসী। সেগুলো কী আর পরার উপযুক্ত আছে শুনি?'
-' আরে ঘরে একদিন পরে বসবে তা কী হয়েছে?'
মেজাজটা চড়াৎ করে গরম হয়ে যায় সাধনার,' মরণ,ঘরে পরব কেন শুনি? সামনের মাসে বোনের ছেলের বিয়ে সেখানে কী পরব শুনি? আমারও চাই অমন একখানা কাতান বেনারসী। বেশ হাল্কা,অথচ সুন্দর দেখতে।'
অতীনবাবু মনে মনে গজগজ করেন,'কাতান না শয়তান কে জানে? এখন শাড়ি কেনার ভূত চেপেছে এ কবে নামবে কে জানে?'
-' কী বিড়বিড় করছ শুনি? শোন না বহুদিনের শখ আমার একটা কাতান বেনারসী পরি। বিয়ের সময় তো দিয়েছিলে একখানা ছেদো বেনারসী। আর বাপের বাড়ির টা ছিল জম্মের ভারী।'
-' টুলটুল আসুক তারপর না হয় দেখা যাবে। এখন তো দেরি আছে।'
-' তোমার বিজবিজে বুদ্ধির খেলা শুরু হল তো? টুলটুল নতুন চাকরি নিয়ে গেছে। তখন ছুটি পাবে কি না ঠিক নেই। তারপর এখন কত টাকাই বা পায় মেয়েটা। আর শোন এই শাড়ি তুমিই কিনে দেবে। শুধু চালাকি করে মেয়ের ঘাড়ে সব চাপানোর।'
ওরে বাবা এ তো ভুলবে না কিছুতেই তাই তখনকার মত অতীনবাবু আচ্ছা দেখছি বলে নিস্তার পেলেন। হঠাৎই সাধনা লাফিয়ে উঠলেন,' ঐ তো উমা মাসিমা ঘিয়ে কাতান পরে পুজোর ঘরে যাচ্ছে। দেখো দেখো।'
গা পিত্তি জ্বলে যায় অতীনবাবুর, এই সিরিয়াল মাথা খাচ্ছে বুড়িটার। ওরে বাবা বুড়ি বললে তো খেয়ে ফেলবে। তার চেয়ে আপাততঃ এখান থেকে গিয়ে রেডিওখানা বুকে চেপে একখানা রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে দেওয়াই ভালো।
টিভি দেখতে দেখতে সাধনা শুনতে পান ও ঘরে বাজছে... আমায় থাকতে দে আমায় থাকতে দে না আপনমনে...
-' উঃ মরণ দিনরাত গান শোনা। যেই বলেছি শাড়ির কথা অমনি আপন মনে থাকতে চায়। দেখাচ্ছি তোমার আপন মনে থাকা।'
মেয়ের কাছে দরবার করেও কোন লাভ হয়নি অতীনবাবুর। টুলটুল মায়ের পক্ষে সে বলে দিয়েছে,' বাবা মাকে কিনে দাও একটা কাতান বেনারসী। সত্যি তো সামনে বিয়েবাড়ি।'
-' আরে তুই তো বলেই খালাস, কী করবে শুনি উনি কাতান কিনে? যত্তসব শয়তান।'
-' দেখেছিস,টুলু তোর বাবা আমাকে শয়তান বলল। ওমা একটা শাড়ির জন্য এত হেনস্থা!'
-' মা তুমি চুপ কর,আমার তো মনে হয় বাবা আমাকে শয়তান বলেছে। কী বাবা? আমারও কিন্তু খুব রাগ হচ্ছে।'
-' উঃ মা আর মেয়ে মিলে আমার মাথাটাই তোরা খারাপ করে দিবি। আমি শাড়িকে শয়তান বলেছি।'
-' দেখেছিস কেমন কথা ঘোরাচ্ছে। একটা শখ আহ্লাদ কোনদিন পূরণ করল না লোকটা আমার...'
মর্ণিং ওয়াকের পথে কথায় কথায় ওঠে গলার কাঁটার গল্প। রবীনদা বেশ রঙীন মানুষ মাঝে মাঝেই গিন্নীকে নিয়ে ঘুরে আসছেন এদিক ওদিক। অমলা বৌদিকে চেনেন অতীনবাবু,খুব স্টাইলে থাকে। আর চিন্তা কী ছেলে বিদেশে থাকে ডলারে টাকা আসে,তার মত তো নয় চিরকালই সং সেজে সংসার ঠেললেন। রবীনদা হেসে বললেন,' আরে ভায়া মেয়েদের মন খুশি রাখতে এইটুকু করতেই হয়,তাও ভালো বৌদি তেমন কিছু চায়নি। কী চুপচাপ কেন? আরে বাজেট কম নাকি? তাহলে চলে যাও বড়বাজার। আরে ওখানে জলের দরে শাড়ি পাবে। এসব ব্যাপারে আমাদের অমলা একদম ওস্তাদ, বোনকে নিয়ে তো মাঝে মাঝে চলে যায়। পুজোর আগে কিনে আনে ব্যাগ ভর্তি শাড়ি।'
-' হ্যাঁ দাদা আমিও শুনেছি তবে সেখানে তো ডজনখানেক শাড়ি কিনতে হয়।'
-' আরে ধুর,তা হবে কেন? আমি গেছি দুএকবার। একখানা চাইলে তাও পাবে। তবে দেখবে কেমন সস্তা। একটা বড় ব্যাগ নিয়ো সাথে।'
-' বড় ব্যাগ কেন?'
-' আরে এত সস্তায় সব পাবে দেখবে অনেক কিছু কিনতে ইচ্ছে হবে।'
কয়েকদিন ভেবে রবীনদার কাছ থেকে দোকানের নামটা নিয়েছেন অতীনবাবু। সামনেই পুজো তারপর বিয়েবাড়ি। তাই বেশ কয়েকটা শাড়িই কিনতে হবে,পুজো ভাইফোঁটা মিলে সুতরাং ভালোই হবে। ওদিকে যা সাশ্রয় হবে তা দিয়ে সাধনার বেনারসীর টাকার কিছুটা উঠে যাবে।
এক রবিবার দেখে বেশ সকাল সকাল চলে গেছেন বড়বাজারে অতীনবাবু সাধনাকে নিয়ে। সাধনা বেশ খুশি, অনেকদিন বাদে বরের সাথে বেরোনো। একটা সময় টুকটাক বেরোতেন আজকাল কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে লোকটা। বিভিন্ন জিনিসের দোকানে দোকানে ছয়লাপ জায়গাটা,তেমনিভাবে এই তল্লাটে আসা হয়নি আগে। অন্য কাজে এসেছেন তবে এই রাস্তায় ঢোকেননি। ওহ্ কী নেই এখানে! সাধনা তো অবাক সব দেখে বলেই ফেলল,' কী সস্তা গো আমি কিন্তু আরও কিছু কিনব। কত সস্তায় সব পাওয়া যাচ্ছে।'
-' হবে হবে আগে সেই শয়তান...'
-' আবার সেই কথা!'
-' না না আগে কাতান বেনারসী হোক তারপর দেখা যাবে।'
যে দোকানের নাম দিয়েছিলেন রবীনদা তাতে তো ঢোকার জন্য বিরাট লাইন। ওমা পয়সা দিয়ে কাপড় কিনবেন তাতেও লাইন! লোকের ধুমসো ধুমসো ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে। বস্তা বললেও ভুল হবে না। যাক তারাও দাঁড়িয়ে পড়লেন বেশ অনেক মানুষের পেছনে। লোক নামে আবার লোক ঢোকে,এইভাবে যেতে যেতে প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে তারা সুযোগ পেলেন। সাধনা অন্য সময় হাঁটু ব্যথাতে কোঁকায় তবে অবাক হয়ে অতীনবাবু দেখলেন আজ আর কিছু বলছে না সে।
ওহ্ ভেতরে ঢোকা নয় তো যেন এতক্ষণ স্বর্গের সিঁড়িতে পা রেখেছিলেন এবার স্বর্গে ঢোকার সুযোগ পেলেন। ঢোকার মুখে একটা হিন্দুস্থানী লোক বলল,' জুতো খুলে ঢুকুন,ভেতরে জুতো পরে যাবার নিয়ম নেই।'
অতীনবাবু ইতস্ততঃ করলে সাধনা ধমকান,' কী গো জুতো খুলে রাখো,ভেতরে যাব না নাকি?'
চারপাশে প্রায় পঞ্চাশ পাটি জুতো রাখা অতীনবাবু ভেবে পান না জুতো কোথায় রাখবেন। লোকটাই বলে,ঐ যে সাইডে র্যাক আছে ওখানে রাখুন। যাক দুজনে কর্তা গিন্নী সেখানে জুতো রেখে দোকানে ঢোকেন।
ভেতরে ঢুকে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় দুজনের,ওরে বাবা এভাবে কেনাকাটা হয়! এক এক জনের পাশে স্তূপ কাপড়ের। তারপর সাইড দিয়ে গেলে বিছানার চাদর,গেঞ্জি,পাঞ্জাবী, গামছা কী নেই?
অতীনবাবু কী বলবেন ভেবে পেলেন না। সাধনা মুখ ঝামটা দেয়,' খুব তো রবীনদা বলেছেন সস্তায় জিনিস পাওয়া যায় বলে এখানে এলে। কিছু বল।'
-' আরে কী বলব এখানে তো মারামারি চলছে দেখছি।'
-' সামনে পুজো,তাই লোকে কিনছে ভীড় করে।'
-' এত কিনছে?'
-' কিনবে না,সবাই তোমার মত কিপ্টে নাকি?'
-' আরে বাবু হট যাইয়ে,লাগ যায়েগা তো।' মাল ঘাড়ে করে নিয়ে যেতে যেতে লোকটা বলে।
অতীনবাবু অগত্যা একজনকে জিজ্ঞেস করে,' আচ্ছা ভাইয়া এখানে কাতান মিলতা হ্যায়?'
লোকটা বলে,' হাঁ মিলেগা,কোন সা কাতান?...'
সাধনার রাগ হয় কী রে বাবা লোকটা! তারপর নিজেই বলে,' কাতান বেনারসী হ্যায়।'
লোকটা ক্ষয়াটে দাঁত বার করে হাসে। ঠোঁট দিয়ে পানের রস গড়ায়,' ও বারানসী চাহিয়ে,ও তো উপর মে হ্যায়। ইধার পহেলে লে লিজিয়ে ফির উধার যানা।'
সাধনা অগত্যা আর যা নেবার ছিল সেগুলো নিতে ঝাঁপায়। সেটাও মোটামুটি খন্ডযুদ্ধ করে। মোটা মোটা মহিলারা মোটামুটি জায়গা দখল করে আছে,তাদের কনুইয়ের ফাঁক দিয়ে সাধনা চেঁচায়,' আরে ঐ চাদরটা দিন দাদা,হ্যাঁ ঐ যে...'
লোকটা ছুঁড়ে দেয় সাধনাকে চাদরখানা। এভাবে মোটামুটি লোফালুফি খেলা খেলতে খেলতে
চাদর, বালিশের ওয়ার, অতীনবাবুর পাঞ্জাবী, গেঞ্জি,কয়েকটা তাঁতের শাড়ি কেনার পর সাধনা দেখেন গামছা রুমাল সবই সস্তা। কষ্ট করে এত দূরে এসেছেন সুতরাং যখন সস্তা তখন কিছু তো নিতেই হবে। আজ তার কিপ্টে বর দিলখুলে খরচ করতে দিয়েছে সুতরাং ঝাঁপিয়ে পড়া।
ততক্ষণে মোটামুটি মালের পাহাড় জমেছে,অতীনবাবু বেশ খুশি যাক এক বছরের চাদর,গামছা,বালিশের ওয়ার কেনার জন্য আর ঘ্যান ঘ্যান করবে না সাধনা। তাছাড়া দেওয়া থোয়ার ব্যাপারটাও বেশ নিশ্চিন্ত। লেগেই তো আছে আজ আইবুড়ো ভাত তো কাল সাধের নেমন্তন্ন।
সাধনা এসে এবার শুকনো মুখে দাঁড়ায়,' হ্যাঁ গো সবই তো কেনা হল,তোমার কাছে টাকা আছে তো? যে জন্য এখানে আসা সেই বেনারসী কী হবে?'
-' আর কী হবে,যদি টাকা থাকে তো হবে। না থাকলে হবে না। তুমি তো এগুলো কিনতেই ব্যস্ত।'
সাধনার শরীর খারাপ লাগে,সত্যি তো টাকা না থাকলে বেনারসী হবে কী করে? অথচ এতটা দূর এইজন্য আসা।
-' এই শোন,এখন মোটেও বিল করাবে না। একপাশে জড়ো করা থাক। আগে বেনারসী দেখি তারপর এগুলো নেব।'
অতীনবাবু বলেন,' ভয় পেয়ো না আমার কাছে কার্ড আছে,নাও যা ইচ্ছে করে।'
সাধনার মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে,' তাই! তুমি পারবে কার্ডে কিনতে?'
' কেন পারব না। আজ কিপ্টে বদনাম ঘুচিয়ে ছাড়ব।'
-' ইশ্ এটা দোকান চুপ কর। হয়েছে বাবা হয়েছে।'
সাধনার মুখের হাসিতে বুকে দোলা লাগে অতীনবাবুরও।
-' চল দেখি কোথায় শয়তান বেনারসী।'
-' আবার!'
নাহ রবীনদা খারাপ আইডিয়া দেয়নি,প্রচুর আছে শাড়ি তার মধ্যে সাধনার বেনারসীও আছে। বরং বলতে হবে কী নেই এখানে। এটা ওটা সেটা ঘাঁটার পর সাধনা গায়ে ফেলে একটা বেনারসী। অতীনবাবু দেখেন তাকিয়ে,পঁয়ত্রিশ বছরে রূপে আঁচড় পরলেও বেনারসী গায়ে ফেলে হঠাৎই সাধনার চেকনাই অনেকটা বেড়ে গেছে। অন্ততপক্ষে সিরিয়ালের উমা মাসির থেকে অনেক ভালো দেখাচ্ছে। যাক অবশেষে শাড়ি বগলদাবা করে নীচে নামলেন তারা। এবার বাছাইয়ের পালা। মানে পকেট কতটা মালের খরচ বহন করতে পারে সেই চিন্তা।
যাক সাধনাকে হতাশ না করে অতীনবাবু দিলদরিয়া হয়ে মোটামুটি সব বিলই মিটিয়ে বড় পোটলা নিয়ে বাইরে বেরোলেন। অবশ্য এই পোটলা বাঁধা কাজটা ওরা বেশ করে দেয়, সমস্ত মাল বিল ধরে গুনে গেঁথে একদম ঝোলায় ভরে দিল।
অতীনবাবু ঝোলা গুছিয়ে নিচ্ছেন বুঝে বুঝে, এমন সময় সাধনার আর্তচিৎকার কানে আসে,' হ্যাঁ গো আমার জুতো? একি তোমারটাও তো দেখছি না...'
-' আরে দেখো,এখানেই কোথাও হবে,দাঁড়াও আমি আসছি।'
সাধনা ততক্ষণে পাগলের মত পা দিয়ে জুতো সরিয়ে সরিয়ে দেখছেন। কোথ্থাও নেই তাদের দুজনের জুতো। হে ভগবান কোথায় গেল জুতো?
সাধনা গেটের লোকটিকে জিজ্ঞেস করে,' এই যে আপনিই তো বলেছিলেন এখানে জুতো রাখতে। কোথায় আমার জুতো?'
লোকটা না জানার ভান করে,' মুঝে ক্যা মালুম,কত আদমি আসছে যাচ্ছে।'
ততক্ষণে অতীনবাবু এসেও খোঁজাখুঁজি করছেন,সত্যি তো কোথায় গেল দুজনের জুতো? ইশ্ দুজনেই মেয়ের কিনে দেওয়া নতুন জুতোজোড়া পরে এসেছেন আজ। এখন কী হবে?
ততক্ষণে সাধনা গলা চড়িয়েছে,' মালুম নেই মানে? আপনিই তো বললেন ঐ র্যাকে রাখতে।'
-' আরে মাঈজী আপ চিল্লাচিল্লি করছেন কেন? এখানে হাজারো আদমী আসে। আমার কাম গেট পাহারা দেওয়া আমি কী জুতা দেখব নাকি? নিজের মাল নিজেরা দেখে রাখবেন।'
-' মানে ভেবেছেন কী? জুতা খোলাবেন অথচ চুরি হয়ে যায় সেটা দেখবেন না... এখানেই আছে কেউ চোর।'
-' আরে কী বলছেন আমরা চোর নাকি?'
অতীনবাবু বলেন,' আরে আপনি ভুল করছেন,যদি জুতো খুলতে হয় তবে সেটা ঠিক আছে কিনা সে দায় তো আপনাদেরই। জানি না বললে কী হবে শুনি?'
ওদের চেচামেচি শুনে ততক্ষণে দোকান থেকে লোক বেরিয়ে আসে আর সাধনার মনে হয় একদল ছেঁড়া জুতো ওদের দিকে তাকিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। হে ভগবান এখানে তো সবই আলতু ফালতু ছেঁড়া জুতো। তার মানে এখানে কেউই কোন ভালো চটি পরে আসে না। ও মাগো কী মরতে তারা নতুন জুতো পরে এসেছেন এখানে। দুএকজন হেসে বলে,' কী জুতো ছিল? আরে মশাই এখানে এলে ছেঁড়া চটি পরে আসবেন। না হলে একপাটি এখানে রেখে অপর পাটি নিয়ে দোকানের এক কোণে রাখবেন।'
সাধনা কপাল চাপড়ান,অতীনবাবুর শুকনো মুখ।
-' সস্তায় কিনবে তাই না? দেখো এবার কেমন? মরণ আমার! কেন যে হেথায় এসেছিলাম তোমার বুদ্ধিতে।'
-' কত লোকই তো এসেছে,আমি কী জানি এমন হবে? রবীনদা তো কিছু বলেনি। বৌদি তো আসে মাঝেমধ্যেই...'
-' একদম চুপ কর,আমার পায়ে ব্যথা বলে মেয়ে কত দাম দিয়ে জুতোখানা কিনে দিয়েছে এই তো দুমাস আগে... আমি কিচ্ছুটি জানি না। ওদের বল আমাদের জুতোর দাম দিতে।'
কে শোনে কার কথা? সবাই ওদেরই দোষ দিচ্ছেন।অবশেষে দোকানের লোক দুপাটি জুতো এগিয়ে দিল। এক জোড়া হাওয়াই আর এক জোড়া সস্তা পলিথিনের চটি।
-' এই লিন এটা পায়ে দিয়ে এখুন বাড়িতে যান। আর কিছু করার নেই। আরে এখানে কেউ নতুন জুতা পরে আসে?'
জুতো দেখে মাথায় আগুন জ্বলে যায় সাধনার-
-' শোন এই নোংরা চটি আমি কিছুতেই পায়ে দেব না। মামদোবাজি পেয়েছে এরা? এরা সব জানে...'
সাধনার চেঁচামেচি কোন কাজে লাগল না। অগত্যা সেই ছেঁড়া চটি পায়ে দিয়েই ব্যাগের বোঝা টেনে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালেন। ভেবেছিলেন ট্যাক্সিতে যাবেন,কিন্তু না যতটা বাঁচানো যায়। এমনিতেই কতগুলো টাকা গচ্চা গেল সস্তায় বাজার করতে। বাসে বসে চটিটার দিকে তাকান আর নিজের গদিওয়ালা নরম জুতোর শোকে বুকটা টনটন করে সাধনার। কান্না পায়,আর ভীষণ রাগ হয় মানুষটার ওপর।
হঠাৎই অতীনবাবু ডাকেন,' এসো নামতে হবে।'
-' এখানে কেন নামব শুনি?'
-' ওহ্ যা বলছি শোন,আমার দরকার আছে তাই নামব।'
অগত্যা কষ্টে বাস থেকে নামলেন আর গজগজ শুরু করলেন আবার,' তোমার কাজের ঠেলায় আমি অস্থির,আমার যে দিকে দুচোখ যায় চলে যাব। এই চটি পরে হাঁটা যায়। ইশ্ মেয়েটা কত ভালোবেসে কিনে দিয়েছিল...'
-' এস আমার হাতটা ধর,আস্তে আস্তে চল দেখি,আর একটুখানি কষ্ট কর।'
হঠাৎই মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন মায়া হয় সাধনার। যতই বকেন ঝকেন,এই পঁয়ত্রিশ বছর এই মানুষটাই তো সাথে রয়েছেন আগলে রেখেছেন। তাই রাস্তা পার হতে হাতটা বাড়িয়ে দেন। কী জানে হঠাৎ বাস থেকে নেমে কোথায় নিয়ে চললেন একেই শরীর,মন সব অস্থির হয়ে আছে। তারপর হাতে ভারী ব্যাগের বোঝা।
অতীনবাবু একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়ান,বাজারের পথ পেরিয়ে।
-' ওমা! এখানে কেন?'
-' তোমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে সাধনা,তাছাড়া এই নোংরা জুতো পরে বাড়ি ফিরব নাকি? এসো চল ভেতরে...'
-' তাই বলে,এত খরচের পর আবার গচ্চা দেবে। কয়েকটা মাস না হয় পুরোনো জুতো পরেই কাটাবো।'
-' তা হয় না সাধনা তাছাড়া সামনে বিয়েবাড়ি, আর টুলুই বা কী বলবে?'
-' কী বলবে?'
-' আহ্ ওসব কথা পরে হবে... এখন ভেতরে চল দিকিনি।'
ভীড় থেকে এসে রণক্লান্ত অতীনবাবু ঠান্ডা জুতোর দোকানে ঢুকে ভারী ব্যাগটা রেখে একটু জিরিয়ে নিয়ে বলেন,' আহ্ বাঁচলাম দাদা,জুতো দেখান দেখি উনার পায়ের,ঐ যে ডঃ ছাপ মারা যে জুতো সেগুলো।'
সাধনার গাটা চড়চড় করে জুতোর শোকে,হায় ভগবান সস্তায় জিনিস কিনতে গিয়ে শেষে এই দুর্গতি হবে কে জানত? তারপর বলেন,' না না ঐ জুতো লাগবে না। ওর অনেক দাম...তুমিও তো কিনবে নাকি? তোমারও তো লাগবে।'
-' তুমি চুপ কর এবার, হ্যাঁ যা বলছিলাম, দুজনেরই জুতো দেখাবেন বুঝলেন। আর এই চটিগুলো দোকানেই ছেড়ে যাচ্ছি কোন ভিখিরিকে দিয়ে দেবেন।'
অনেক দেখেশুনে টুলটুল যেমন জুতো কিনে দিয়েছিল ঠিক তেমন জুতোই কিনলেন দুজনে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন,' যাক,মেয়েটা কিছু বুঝতে পারবে না বল। বড় ভালোবেসে কিনে দিয়েছিল তোমাকে আমাকে জুতোগুলো। ভেবেছিল বাপ মায়ের পরিশ্রমী পা দুটো একটু আরাম পাক।'
সাধনার চোখটা ঝাপসা লাগে,' কিন্তু কত টাকা খরচ হয়ে গেল বলত?'
নতুন জুতোতে পা গলিয়ে মেজাজটা ফুরফুরে লাগে সাধনবাবুর,ব্যাগটা হাতে তুলে নেন। দোকানের সেলসম্যান বলে,' আবার আসবেন স্যার,আর কখনও নতুন জুতো পরে চোরাবাজার যাবেন না। অবশ্য গেছিলেন বলেই আবার নতুন হল।'
কথাটা শুনে রাগ হল সাধনার কারও পৌষমাস আর কারও সর্বনাশ তবে চোরাবাজার কথাটা শুনে হাসি পেল। সত্যি চোরাবাজারই বটে... ছিঃ ছিঃ এ কথা কাউকে বলার নয়।
-' এসো সাধনা,হাঁটতে পারছ তো? এই আরেকটুখানি।'
-' আবার কোথায়? বাসে উঠব না?'
-' আরে উঠব তো,বুঝলে এতক্ষণে মনটা শান্ত হল। কতদিন বাদে তোমার সাথে বেরিয়েছি একটু না খেয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমিও তো অনেকক্ষণ কিছু খাওনি। সামনেই তো আসলামের বিরিয়ানির দোকান,এসো এসো...'
সত্যি এতক্ষণ বুঝতেই পারেননি খিদেটা। তবে আবার খরচ! কী হয়েছে আজ তার কর্তার?
-' আহ্ এতক্ষণে প্রাণটা জুড়োলো বুঝলে সাধনা।'
-' আমার কিন্তু একটুও ভালো লাগছে না জুতোর কথা মনে হলেই মুখটা তেতো হয়ে যাচ্ছে।'
-' সাধনা,ভুলে যাও। গতস্য শোচনা নাস্তি, মনের থেকে মুছে ফেলো ঘটনাটা। আর শোন আমাদের এই বোকা হওয়ার গল্পটা আমাদের মধ্যেই রেখো বুঝলে।'
-' সে কী! টুলুকেও বলব না।'
-' না বলবে না,সব কথা বলতে নেই। থাক না কিছু কথা শুধু তোমার আমার হয়ে গোপনে। বুড়ো বয়েসের বোকামির গল্প শুনে লোকে উল্টে আমাদেরই বোকা বলবে। তাই নতুন জুতোর সাথে ভাব করে পুরোনোর শোক ভুলে যাও...চল সাধনা সারাদিন অনেক ধকল গেছে। তবে বাড়ি গিয়ে ঐ কাতান বেনারসী খানা একবার গায়ে ফেলে আমায় দেখিয়ো।'
-' এখনি কেন? সে তো পরবই পরে।'
-' না আজই গায়ে দেবে একবার, আমি প্রথম দেখব।'
পড়ন্ত বেলার সূর্যের আলো রঙ ছড়িয়েছে সাধনার গালে আর তাতে মিশেছে কিছুটা লজ্জা। ট্রামটা টুং টাং ঘন্টি বাজিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে,দুজনে পাশাপাশি সীটে বসে হারিয়ে যান অদ্ভুত নীরবতায়।
Comments
Post a Comment