-'তুই কখন ফিরবি?
রাতে ট্রেন মনে আছে তো?'
-' হ্যাঁ মনে আছে,কেন থাকবে না?'
-' মানে তোর এখনও প্যাকিং হয়নি তাই বলছি।'
-' একদম চাপ নিস না,ঠিক হয়ে যাবে সব। তুই তো জানিস আমার লাস্ট মিনিটে সব হয়। যেমন তোর সাথে প্রেমটাও হয়েছিল একদম লাস্ট মোমেন্টে।'
গালে সিঁদুরের রঙের আলপনা খেলে যায় হঠাৎই আলতার ইন্দ্রর কথা শুনে। ফোনেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
-' যারা সব লাস্ট মোমেন্টে করে তাদের জীবনে অনেক কিছু কিন্তু মিস হয়ে যায়। তাই দেখিস আমাকে ধরতে পারলেও আজকের ট্রেনটা যেন মিস্ না হয়।'
-' এই প্লিজ আমার জিনিসগুলো একটু এক জায়গায় করে রাখবি? আমি গিয়ে স্যাকে নিয়ে নেব ফটাফট।'
-' তুই কী ভাবিস আমি কী বেকার? আমারও তো ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে। এখনও একটা বড় সাবমিশন বাকি আছে। তার মাঝেই তোকে ফোন করছি। কারণ আমার তো যত দায়।'
-' আচ্ছা আচ্ছা বাবা আমারটা আমিই করে নেব। তুই তো শর্ত দিয়েছিলি বিয়ের আগেই যার যার কাজ তাকে করতে হবে। ইশ্ ভুলে গেছিলাম একদম। ওকে রাখি রে বাই। আমারও একগাদা কাজ পড়ে আছে। তারপর ছুটে আসব বাড়িতে। তারপর প্যাক করে একদম কু ঝিক্ ঝিক্...'
ইন্দ্র ফোনটা ছেড়ে দেয়,আলতা আবার হাসে ইন্দ্রর পাগলামি দেখে। সত্যি লাস্ট মোমেন্টে প্রেম,দুজনের দুজনকে ভালো লাগা কতটা ছিল জানে না তবে খুনশুটি আর ঝগড়া ছিল প্রচুর। প্রতিদিনই প্রায় ঝগড়া হত দুজনের আবার না দেখা হলেও খবর নেওয়া হঠাৎই ফোন করে...' কী রে ঝগড়ুটে,আজ আসিসনি কেন? আজ আমার খিদে পাচ্ছে না বুঝলি।'
-' আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই আসিনি,খিদে হয়নি হজমোলা খেয়ে খিদে বাড়া। আমার মাথাটা খাস না।'
খটাস করে ফোনটা রেখে দিলেও আলতা বুঝতে পারে ইন্দ্র ওকে মিস্ করে তবুও কিছুতেই পাত্তা দেবে না ঐ অসভ্য ঝগড়ুটে ছেলেটাকে।
তারপর হঠাৎই একদিন ইন্দ্রর মনে আগুন জ্বলে গেছিল যখন দেখেছিল আলতার প্রেমে গড়াগড়ি খেয়ে ভালো মানুষ অভি প্রায় ওকে প্রপোজ করার জন্য প্রস্তুত। আর আলতাও হয়েছে তেমনি ওর পাশে বসছে,গল্প করছে,পিকনিকে গিয়ে সারাক্ষণ ব্যাডমিন্টন খেলল ওর সাথে।
ও কথা বলতে গেছিল, তাকালোই না ওর দিকে,আরে কথা না হলে ঝগড়াটা হবে কোথা থেকে? তাই কিছুদিন একদম ঝগড়া বন্ধ,দমবন্ধ হয়ে আসে ইন্দ্রর। বুঝতে পারে আলতার ঝগড়াটা ও মিস্ করছে। সত্যি কী শুধুই ঝগড়া না অন্য কিছু? কথাটা সোম্যকে বলতে গেলেই ও বলেছিল,' আরে ঝগড়াটে মেয়ে বলে যাকে চিরদিন জ্বালিয়েছিস আজ হঠাৎই তার জন্য জ্বলছিস কেন? তবে কী এটা প্রেমের জ্বালা নাকি? তাহলে প্রপোজ করে ফেল।'
-' কী বলছিস? আমার কী কোন প্রেস্টিজ নেই নাকি? আমি কেন যাব আগে বলতে? দেখছিস আমাকে কেমন ইগনোর করে আজকাল।'
-' দেখেছি,তবে জ্বলুনি বা চুলকুনি যাই বলিস না কেন সেটা যখন তোর তখন আগুন তো তোকেই নেভাতে হবে। আর তোর ঐ প্রেস্টিজের মাথায় যখন হকিন্স এসে হকি স্টিক মেরে যাবে তখন বুঝবি। আর কোনদিন আলতার রঙে মন রাঙা হবে না।'
অনেক ভেবেছিল সোম্যর কথাগুলো, সত্যি দারুণ কথা বলে ছেলেটা তবে আলতার সামনে মাথা নীচু করে সারেন্ডার করা হয়নি।
কিন্তু ভ্যালেন্টাইন্স ডের দিন অভির হাতে গোলাপ দেখে আর মাথা ঠিক রাখতে পারেনি তাড়াতাড়ি করে ক্লাসের ব্রেকে একটা বড় ফ্রুট আর নাট কিনে এনে অভি আর আলতার মাঝে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল,' আমি জানি তুই গোলাপের চেয়ে ক্যাডবেরি ভালোবাসিস। আমাদের এত বছরের ঝগড়া এই অভিটা থামিয়ে দেবে তা কী করে হয়? নেভার...'
হাসির রোল উঠেছিল চারদিকে,আলতা ঠোঁট বেকিয়ে বলেছিল,' আমার বয়ে গেছে ক্যাডবেরি নিতে। এখন আমি গোলাপ ভালোবাসি। চয়েজ চেঞ্জ।'
-' তাহলে তুই ক্যাডবেরিটা নিবি না? আচ্ছা আচ্ছা আমি গোলাপও দিচ্ছি। এই অভি একটা গোলাপ ধার দে তো...'
অভির সম্মতির অপেক্ষা না করেই ঝপ করে একটা গোলাপ ছিনতাই করেছিল গোলাপের গুচ্ছ থেকে তারপর হাঁটু মুড়ে বসে বলেছিল,' আই লাভ ইউ আলতা।'
সঙ্গে সঙ্গে ঝলসে উঠেছিল অনেকগুলো সেলফোন।
- 'কী নাটক করলি ইন্দ্র? আর আলতা তোর ক্যাডবেরি বেশি পছন্দ বলতেই পারতি।'
-' সরি অভি,আসলে এই ঝগড়ুটেটা সেই ক্লাস সিক্স থেকে পেছনে পড়ে আছে। আর আমি কী গোলাপ চেয়েছি তোর কাছে? তুই যেচে পয়সা খরচ করেছিস।'
এই হচ্ছে গিয়ে আলতা আর ইন্দ্রর প্রেম স্টোরি,যখন সব হাতের বাইরে চলে যাবে যাবে করছে মানে সোম্যর কথায় হকি স্টিকের বাড়ি পড়বে পড়বে করছে মাথায় ঠিক সেই সময় প্রেস্টিজ ধুলোতে মিশিয়ে হাঁটু মুড়ে প্রোপোজ করা তাও বা এক কলেজ ছেলেমেয়ের সামনে।
বেশ কয়েকবছর চুটিয়ে প্রেম আর তারপর বিয়ে। বিয়ের সময়ই আলতা একঘর লোকের সামনে শাশুড়িকে বলেছিল,' মামণি আমার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব ওকে নিতে হবে না। ও যেন নিজের দায়িত্ব ঠিক মত নেয়। ওর এই লাস্ট মোমেন্টে যুদ্ধ জিতব এই করতে গিয়ে অন্ততঃ এই কয়েক বছরে পঞ্চাশ বার দেরিতে মুভি দেখতে পৌঁচেছি। লোকাল ট্রেন মিস্ করেছি দশ পনেরো বার। মেল ট্রেন মিস্ করেছি তিন বার আর ফ্লাইট কোনরকমে গিয়ে ধরেছি দু বার। মানে ততক্ষণে হৃৎপিণ্ড হাত দিয়ে চেপে ধরে বসে আছি এত ধুকপুক করছে।'
-' আচ্ছা মা,বিয়ে করতে হলে এত প্রমিস করতে হয় কেন বল তো? এতদিন তুমি জ্বালিয়েছ এখান আবার আরেকজন। ওহ্ জীবনে শান্তি নেই।'
-' আমি এসবের মধ্যে নেই,অনেক জ্বালিয়েছ এবার নিজেরটা নিজে বুঝবে। বেশ হবে,এবার আলতাই তোর ঢিলে স্ক্রু টাইট দিয়ে দেবে।'
কান চুলকাতে চুলকাতে একবার আড়চোখে আলতাকে দেখে মনে মনে বলেছিল দেখি কে আমাকে বদলাতে পারে? আমি আমার মতই থাকব।
সুতরাং ইন্দ্রর সামান্য একটু অদল বদল হলেও সেই একই রকম আছে। তাই আজও আলতার মুভি দেখতে পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়। আর তারপরই লাগে ঝগড়া। কখনও আবার লাফিয়ে ট্রেনে উঠতে হয়,আবার কখনও দৌড়তে হয় চলন্ত ট্রেনের পেছনে পেছনে। ইন্দ্র লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠে শাহরুখের কায়দায় হাত বাড়িয়ে ছোট্টখাট্টো আলতাকে টেনে তুলে নিয়ে বীরপুরুষের হাসি হাসে। আর যারা এতক্ষণ সিনেমা দেখছিল তারা ভাবে উঃ যাক উঠতে পেরেছে শেষ পর্যন্ত। তারপর ট্রেনে উঠে আলতা রঙ না ছড়িয়ে জ্বলে ওঠে। লঙ্কা পটকার মত,পুটপাট শব্দে ফাটতে থাকে কারণ জায়গাটা ট্রেন। বাড়ি হলে লঙ্কাকান্ড হত।
একদিন শাশুড়িকে বলে ফেলেছিল আলতা,' আহা বেশ মজায় আছো তুমি আর বাপি তাই না?'
-' কেন বল তো? সারাজীবন যুদ্ধ করে এখনই তো একটু শান্তির শ্বাস ফেলব নাকি? কী হয়েছে?'
-' আরে তোমার ছেলের কান্ডকারখানা যা তা, আর জাস্ট নেওয়া যাচ্ছে না। আমি শুধু ভাবি কী করে তুমি সহ্য করতে?
আর কী এখন আমি জ্বলছি।'
মুচকি হেসেছিলেন উনি,' বাঁশ তুই নিজেই যেচে নিয়েছিস,অনেকদিন ধরে যাচাই করার সুযোগ পেয়েছিলি। এখন আমাকে কেউ দোষ দেবে না আমি ছিলাম না এর মধ্যে।'
-' তুমি ওকে একটু বকবেও না তাই বলে?'
-' তুই এত ঝগড়া করছিস তাই শুধরোচ্ছে না,আর আমি বকলেই যেন শুনবে?'
আলতা বুঝেছিল সাতপাক ঘুরে যাকে বেঁধেছে তাকে নিয়ে এভাবেই চলবে জীবন। এ বদলানোর জিনিস নয়। আর মাও ছেলেকে হাড়ে হাড়ে চেনে। তাই সব দোষকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল।
যথারীতি ইন্দ্র তেমন বদলায় নি এখনও,সুতরাং আজও এল দেরি করে। এসেই চড়কি পাক খেতে লাগল,' ইশ্ কত দেরি হয়ে গেছে,ওহ্ কখন যে কী করব! এবার ছুটতে হবে অলিম্পিক স্পীডে। আলতা ভেবেছিল কোন সাহায্য করবে না তবুও অনিচ্ছায় এসে একটু সাহায্য করে গেল। যখন গোবেচারার মত বলছে,' তুই কী শুধু দাঁড়িয়ে মজা দেখবি? কিছু করবি না? আমরা তো ঠিক সময় না গেলে ট্রেন মিস্ করব।'
-' করব,এ আর কী নতুন কথা শুনি? যতক্ষণ না উঠে বসছি বিশ্বাস নেই।'
-' এই সমস্ত বলে না। কত কষ্টে ছুটি আর টিকিট ম্যানেজ করেছি শুধু আমার বৌ টা পাহাড়ে যাবে বলে। একটু হেল্প কর প্লিজ।'
যাই হোক সব গুছিয়ে মোটামুটি দৌড়ঝাঁপ করে একদম শেষ মুহূর্তে ট্রেনে এসে উঠল ইন্দ্র আর আলতা। অবশ্য তাতেই খুশি ওরা এখনকার ফার্স্ট লাইফে বোধহয় এটাই অনেক। কথা ছিল প্যাকড ফুড সাথে নিয়ে নেবে সুতরাং ইন্দ্র ভুললেও আলতাই অর্ডার দিয়ে আনিয়ে রেখেছিল ওর পছন্দের মিক্সড ফ্রায়েড রাইস আর বোনলেস চিলি চিকেন। তাই ট্রেনে গুছিয়ে বসে খেতে খেতে চলে যাবে।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে ওরা এদিকে ট্রেনও ছেড়েছে। সীটে বসে বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দেয় এবার মিশন সাকশেসফুল,একদম পাক্কা টাইমে পৌঁছে গেছে।
ট্রেনের জানলা খুলে এখন আর হাওয়া খাওয়া হয় না। এসি কোচ তাই চারদিকে মোটামুটি বন্ধ তবুও কদিনের মুক্তির আনন্দে জানলাতে চোখ রাখে আলতা। আবছা হয়ে যাচ্ছে চেনা শহর একটু একটু করে আলো আঁধারির মাঝে ছুটে চলেছে ট্রেন আপন গতিতে।
ওদের উল্টোদিকের সীটে একটু মোটাসোটা এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা বসে। ইন্দ্র নিশ্চিন্ত হয় যাক এখানে আর কেউ ঢুকবে না। ওরা চারজন এই দিকটাতে। ট্রেন সরগরম সবাই আড্ডা আর গল্পে ব্যস্ত। তার মধ্যে মাঝে মাঝে হকার উঠছে,পানি জলের বোতল। চায়ে,কফি... কেক,বিস্কুট, চিপস্।
ঠান্ডা কোল্ড ড্রিঙ্কসও আসছে।
-' শুভা একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস নিই? তুমি যে তখন বলছিলে তোমার গরম লাগছিল খাবে নাকি?'
ভদ্রমহিলা মাথা নাড়েন।
ভদ্রলোক হাত বাড়ান কোল্ডড্রিঙ্কস নিতে আবার জিজ্ঞেস করেন স্ত্রীকে কোনটা নেবেন তিনি?
তারপর কেক আর বিস্কিট আসতে সেগুলো কেনার জন্য উদ্যোগী হতেই ভদ্রমহিলা বারণ করেন,' না আমার কেক খেতে ইচ্ছে করে না। তুমি বরং বিস্কিট নাও। সকালেই তো লাগবে আবার। আমি আনতে ভুলে গেছি।'
-' সে গেছো গেছো,কতই তো পাওয়া যাবে কিনে নেব যখন দরকার হবে। তুমি খাবে এখন একটা প্যাকেট খুলব?'
ইন্দ্র মোবাইলে ডুবে আছে,এছাড়া আর কী করার আছে? এখন খেলে মাঝ রাতে খিদে পেয়ে যাবে,আরেকটু বাদে খেয়ে একেবারে শুয়ে পড়বে।
আলতার মুঠোতেও ফোন তবে কেন যেন ফোনে মন দিতে পারে না। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে ওদের দিকে,আর চোখকে শাসন করলেও কান শুনে নিচ্ছে সবটুকুই।
-' শুভা,তোমার স্কার্ফ বার করে দিই, এসিটা বেশ জোরে চলছে। ঠান্ডা লাগছে না তো?'
-' না না আমি ঠিক আছি,তুমি ব্যস্ত হয়ো না। এখন আর ব্যাগ খোলার দরকার নেই। ঠান্ডা লাগলে এই চাদর মুড়িয়ে বসব না হয়।'
-' আচ্ছা,কখন খাবে বোলো। সব সামনেই আছে বের করে দেব। তোমার তো আবার ওষুধ খাওয়া আছে।'
আলতা ইন্দ্রর দিকে তাকায় দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়। অদ্ভুতভাবে আলতা দেখে ইন্দ্র ওদের দিকেই তাকিয়ে। আলতা কিছু বলতে পারে না ইন্দ্রকে মেসেজে লেখে..দ্যাখ কেমন কেয়ারিং ভদ্রলোক,কী সুন্দর ভদ্রমহিলাকে যত্ন করছেন।
ইন্দ্রর মুখে একটা দুষ্টুমি ভরা হাসি তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়ে দেয়, ভদ্রলোক মনে হয় স্ত্রৈণ একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন।
আলতা একটা রাগী ইমেজ পাঠিয়ে দেয়,ইন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে একটা লাভ ইমোজি। সাথে লেখে তুই তো বলেছিলি যে যার কাজ করব,তাহলে আবার কেন?
-' সে তো বাড়িতে,বেড়াতে এসে একটু ভালোবাসবি না?'
- 'বাসব তো হোটেলে গিয়ে,ট্রেনে ভালোবাসার উপায় আছে নাকি? সামনে আঙ্কেল আন্টি বসে আছেন' লিখেই আরেকটা ইমোজি পাঠায় ইন্দ্র।
খাবারের সুবাসে ফোন থেকে চোখ তোলে ইন্দ্র,ইচ্ছে না থাকলেও খাবার এমন একটা জিনিস তাতে চোখ যাবেই। সুতরাং আলতার দৃষ্টিও অবাধ্যতা করে।
আগে হাসি বিনিময় হয়েছে দু একবার। ভদ্রলোকের সাথে চোখ মিলতেই ভদ্রলোক হাসেন একটু বলেন খেয়ে নিচ্ছি।
ওরা ফোনে মনোনিবেশ করে,একটু বাদে ওরাও খাবে। আলতা আর ইন্দ্রর দেখা হয়ে গেছে ওদের খাবার টিফিন বাক্সে গুছোনো লুচি,আলুর দম আর ফুলকপির ছেচকি।
আজকাল আন হেলদি বলে এই খাবারগুলো ওদের মত মডার্ণ জেনারেশনের সাথে আড়ি করেছে বেশ কিছুদিন। ইন্দ্রর হঠাৎই ওর দিম্মার বানানো ফুলকপির ছেচকির কথা মনে হল। আহা কী অপূর্ব স্বাদ আর সুগন্ধ ছড়াত! ওদের বাড়ি এলেই দিম্মা এটা বানাতেন। কতদিন খায় না এইসব। আজকাল মোটামুটি ওটস্,স্মুদি আর নুডলসে জীবন বাঁধা। তবে ভাত,বিরিয়ানি, ফ্রায়েড রাইস তাও খায়।
আলতা শোনে ভদ্রলোক বলছেন,' শুভা একটা লুচি নাও,আমি এতগুলো খেতে পারি নাকি? কিছুই তো খেলে না।'
-' আমার ভালো লাগছে না। তুমি খাও,ঐ তো আর মাত্র দুটো আছে।'
এই ভালো লাগছে না কথাটা বেশ কয়েকবার শুনেছে আলতা ভদ্রমহিলার মুখে। উনি কী একটু বেশি ন্যাকা? মানে বর এত যত্ন করছে বলে আরও দাম বাড়াচ্ছেন? কেন যেন একটু বেশিই আহ্লাদী ভদ্র মহিলা। ভদ্রলোককে বলতে শোনে,' মিস্টিটা খাও,তোমার কালাকাঁদ পছন্দ তাই তো আনলাম। একটা খেয়ে জল খাও।'
ওদের খাওয়া শেষ হলে ইন্দ্র আর আলতা নিজেদের বক্স খুলে বসে। এখানে সার্ভ করার মত কিছু নেই। একদম আলাদা করেই প্যাক করা ছিল সুতরাং যে যার ভাগেরটা খেতে শুরু করল।
ততক্ষণে ভদ্রলোক বিছানা পাতার উদ্যোগ নিয়েছেন। ভদ্রমহিলা ইশারা করেন ওরা খাচ্ছে তাই একটু অপেক্ষা করতে।
আলতা পুরোটা শেষ করতে পারে না ইন্দ্রকে সাধে, ইন্দ্র হালকা সুরে বলে,' দে যত পারিস ডাস্টবিনে।'
ওদের কথা শুনে হাসির ছোঁয়া খেলে যায় ভদ্রলোকের ঠোঁটেও। মনে মনে ভাবেন হ্যাঁগো ওগোর দিন বোধহয় ফুরিয়েছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা তুমির বদলে তুই বলতেই বেশি ভালোবাসে। আসলে সবই তো প্রায় সমবয়েসী। তার আর শুভার তুমি আর ওগোর সম্পর্ক। তবে উনার মা তো বাবাকে আজ্ঞে আপনি করত। হয়ত বাবার চেয়ে বয়েসটা অনেক কম ছিল বলে আর তুমিতে ফেরা হয়নি। ওটাই অভ্যেস হয়ে গেছিল।
ওদের খাওয়া শেষ হলে ভদ্রলোক বিছানা করতে শুরু করেন। একদম পরিপাটি করে স্ত্রীর বিছানা পেতে,বালিশ গুছিয়ে দেন...' শুভা তুমি শুয়ে পর,বাথরুম হয়ে গেছে তো? আমি তোমার চাদরের ওপরে কম্বলটা জড়িয়ে দিই। আর শোন দুটো বালিশই তোমায় দিলাম। তোমার তো দুটো বালিশ লাগে তাই না?'
...' না না আমি শুতে পারব। তুমি কিসে শোবে?'
-' আমার লাগবে না,তুমি নাও। শুয়ে পড় এবার।'
আলতা অবাক হয়ে যায় ওদের প্রেম দেখে। সবে তো ওদের দু বছর বিয়ে হয়েছে এর মধ্যেই যেন কথা ফুরিয়ে গেছে। আজকাল ল্যাপটপ আর মোবাইলেই দিন কেটে যায়। ট্রেনের সীটে বসেও টুকটাক কথা ছাড়া চোখ ঐ মোবাইলেই।
ইন্দ্র বলে,' আমি কী হেল্প করব তোকে?'
আলতা বলে,' না না আমিই পারব,তুই তোরটা রেডি করে শুয়ে পড়।'
হয়ত ভদ্রলোককে দেখেই ইন্দ্র বলছে এই কথা, নাহলে তো ছোটখাটো কাজগুলো ওরা একা একাই করে মানে যে যারটা। ভদ্রমহিলা বেশি আদুরে তাছাড়া বয়স্ক,ওর হেল্পের দরকার নেই। নিজের কাজ নিজেই করে নেওয়া ভালো।
শোয়ার আগে দেখতে পায় ভদ্রলোক যত্নে ওষুধ খাইয়ে একদম কম্বল চাপা দিয়ে ভদ্রমহিলার পা দুটো ভালো করে ঢেকে নিজের কাজ শেষ করে এবার নিজের বিছানা করে শুয়ে পড়ার আগে বলেন ওপর থেকেই রাতে অসুবিধা হলে ডেকো।
রাতটা নিশ্চিন্তে কেটে গেছে, এনজিপি খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেল ওরা। মানে চোখ খুলেই পাহাড়ের কাছাকাছি চলে আসা। আলতা একটু আলসেমি করলেও ইন্দ্র তাড়া দেয় কানের কাছে এসে বলে,' হানি এবার উঠে পড়,নামতে হবে যে। পাহাড় কলিং।'
ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা উঠে নিজেদের সব গুছিয়ে বসে আছেন নামার অপেক্ষায়। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন,' কোথায় যাবেন?'
-' এই দু একটা অফবিট জায়গাতে যাব। আর দার্জিলিং।'
ইন্দ্র আর ঘুরিয়ে কিছু জানতে চায় না,কী হবে জেনে? এই তো এক রাতের সফর শেষ এরপর কে কোথায় যাবে কোন জায়গায় কী দরকার জেনে? আর হয়ত কোনদিন দেখাই হবে না।
ট্রেন থামতেই ওরা ঝটপট নেমে পড়ে,দুজনের পিঠে দুটো স্যাক মানে যার যার তার তার। কেউ কারও ব্যাগের অন্দরে থাবা বসাবে না। অগোছালো জিনিস গোছানো বা ব্যাগ থেকে জামা বের করে পরা সবই যার যার দায়িত্ব। এই সব সিস্টেম আলতার অবশ্য এইজন্য শাশুড়ি বাহবা দিয়েছেন বলেছেন,' যাক তুই কিছুটা হলেও পারলি,আমি তো পারিনি। বাইরে গেলে জিনিস বার করা গোছানো সব করতে হত।'
ওদের গাড়ি বলাই ছিল সুতরাং বাইরে এসেই দেখল সে অপেক্ষায় আছে সুতরাং ডাকছে পাহাড় বলে উঠে পড়া। আগামীকাল ওদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী তাই মোটামুটি ফার ফ্রম দ্য ম্যাডিং ক্রাউডে চলে আসা দুজনের সাথে দুজনের কাটানোর জন্য। তবে আলতার ইচ্ছে তে ফার হলেও দার্জিলিংয়ের ভিড়েই এসে পড়ল তবে আলতা বুঝিয়েছিল,' হোটেলের ঘরে তো আমরা দুজনেই।'
-' সে তো বাড়িতেও থাকি।'
-' বাড়িতে চাপ থাকে কত,এ এলো সে এলো। এখানে কেউ ডিস্টার্ব করবে না। তারপর বাড়িতে কী জানলা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় নাকি?'
যুক্তি অকাট্য সুতরাং আর কিছু বলতে পারেনি ইন্দ্র। আলতা রানীর ইচ্ছেমত কাজ হয়েছিল। মানে প্রথমে ভিড় থেকে এসে ভিড়ে তারপর অফবিটের নির্জনতায় মনকে শান্ত করে সবুজে চোখ ধুয়ে ফিরে যাওয়া।
দার্জিলিং পৌঁছে হোটেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে ঘোরাঘুরি করে ফিরেছিল ওরা। আগে থেকে ইন্দ্র বলেই রেখেছিল ওদের অ্যানিভার্সারির কথা সুতরাং কোন ব্যবস্থার ত্রুটি রাখেনি ওরা। বিশেষ দিনটাকে ডোন্ট ডিস্টার্ব মোডে কিছুক্ষণের জন্য নিজেদের রেখে দুজনে ভেসে গেছিল ফেলে আসা দিনগুলোতে। জানলা দিয়ে দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য্য ভালোবাসার এসেন্স বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকটা।
কয়েকটা দিন ভালোবাসার রঙ মেখে,সবুজে মন ভাসিয়ে ভালো কেটেছিল। তিনটে জায়গা এই নিয়ে ঘুরল। সত্যি বলতে কী উত্তরবঙ্গে অদ্ভুত একটা জাদু আছে আর এর টানে ছুটে আসা যায় বারবারই। মোটামুটি অল্প কয়েকদিন হাতে থাকলে বোধহয় বেস্ট কমফোর্ট জোন উত্তরবঙ্গ। ওদের ঘোরা প্রায় শেষ আরেকটা স্পট বাকি সেটা দেখেই ফেরা আবার চেনাশোনা কাজের শহরটাতে। তাই শেষটুকু চেটেপুটে দেখার অপেক্ষায় ওরা দুজন এখন। অনেকটা ভালোবাসা হলেও খুটখাট ঝগড়াও হয়েছে দুজনের। আলতা বিরক্ত হয়ে বলেছে,' আচ্ছা তোর কী ঝগড়া লগ্নে জন্ম?'
ইন্দ্র প্রথমে বুঝতে পারেনি কারণ মেজাজ তখন গরম শুধু শুধু কয়েকটা বাজে কথা বলে ঝগড়া করল আলতা। এখানে এসেও সারাদিন অফিসের ফোন নিয়ে চলেছে।
তাই বলে,' জানি না।'
পরক্ষণেই বলে,' কী বললি? ঝগড়া লগ্ন? এমন কোন লগ্ন হয় নাকি? আমার যদি ঝগড়া লগ্নে জন্ম হয় তো তোর ঝগড়ুটে রাশি।'
এক দফা ঝগড়া হয়ে গেল আবার,কিছুক্ষণ একদম চুপচাপ দুজনেই আর তারপর কিছুক্ষণ বাদে আদরে ভেসে ভাব করে নেওয়া। এটা অবশ্য শাশুড়ির টিপস,যত ঝগড়া হোক বিছানায় মিটিয়ে নিস। ঘর আছে বলে আলাদা শুতে যাস না। আমরা কাছে থাকি না বলে লাঠালাঠি করিস না দুটোতে।
কথাটা মাকে বলাতে মাও হেসেছিল আর বলেছিল ঠিকই বলেছে দিদি।
তাই ছোট ঝগড়াতে ইগোর পাথর চাপিয়ে কখনই ভারী করে না আলতা। তাছাড়া ইন্দ্র বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারে না। সুতরাং চটজলদি মিটমাট।
গাড়িতে করে আসতে আসতে সবুজের ছোঁয়া যেন আদরে স্নেহের পরশ মাখিয়ে যায় মনে। চা বাগানে মেয়েরা কাজ করছে। ওদের দেখে মনে হচ্ছে সবুজ বাগানে প্রজাপতির মত। পিঠে প্রত্যেকের ঝুড়ি।
ওদের পরবর্তী স্পটটাতে যেতে মোটামুটি দুপুর গড়িয়ে যায়। ওরা যেতেই হোটেলের মানুষ জন সাদরে আমন্ত্রণ জানান বাইরে থেকেই আলতার নজর পড়েছিল কাঁচের ঘরটা,বাইরের সবুজের ছায়া পড়েছে কাঁচের জানলায়। হোটেলটা খুব সুন্দর,আর ব্যবস্থাও খুব ভালো।
তবে ঘর দেখে আলতা বলল,এই ঘর কেন?
হোটেলের ম্যানেজার বলেন,' এহি তো বুক কিয়া আপনে। দেখিয়ে নম্বর।'
-' না ঘরটা ভালো কিন্তু কই সব দেওয়াল তো কাঠের কাঁচের নয়। ইন্দ্র তুই কিছু বল?'
-' মগর মেমসাব ও তো বুকড হ্যায়,বহত পহেলেই বুক কিয়া ও রুম ও সাহাব নে।'
-' আমরা তো একদিন থাকব,আমাদের দিন একদিনের জন্য।'
ইন্দ্র আলতাকে ইশারা করে,' আরে ওটার কথা আমি জানতাম তবে বুকড ছিল তাই এটা নিয়েছি। এখনও মনে হচ্ছে অকুপাইড তাই না?'
ইন্দ্রর কথা শুনে মাথা নাড়ায় ম্যানেজার। ওরা ঘরে চলে আসে সামনেটা বেশ সুন্দর। আলতা বারান্দার দরজা খুলে সামনেটায় বেরিয়ে আসে খুব সুন্দর চারদিকটা আর নীচে চা বাগান।
-' কী রে পছন্দ জায়গাটা? আমার কিন্তু খুব ভালো লাগছে। যাক মধুরেণ সমাপয়েৎ।'
-' মোটেও না, আমার খুব রাগ হচ্ছে ঐ কাঁচের ঘরটায় থাকতে পারলাম না বলে।'
-' আচ্ছা বাবা এবার বাইরে থেকে দেখে যা,এরপর যখন আসব অনেক আগে থেকে এটা বুক করে রাখব।'
-' ইশ্ এক জায়গায় বার বার আসতে আমার বয়েই গেছে। আচ্ছা কে আছে বলত এখানে? বেশ কিছুক্ষণ তো এলাম কাউকেই তো দেখছি না।'
-' আছে কেউ,হয়ত ঘুরতে গেছে। তোর কী সমস্যা বলত?'
-' আমার জ্বলন হচ্ছে।'
-' চল বাথরুমে স্নান করবি তাহলেই মাথা ঠাণ্ডা হবে।'
-' সবসময় শুধু মজা তাই না? এই ঠান্ডাতে স্নান করতে আমার বয়ে গেছে।'
-' এখানে কিন্তু বাথটব আছে,আর গরম জল তো আছেই,সুতরাং চিন্তা কী?'
ইন্দ্রর চোখেমুখে দুষ্টুমি মাখানো হাসি,চোখে ভালোবাসার আমন্ত্রণ। পাত্তা দেয় না আলতা। বরং বলে,' আরেকটু বাদেই তো ঝুপ করে সূর্য ডুবে যাবে,বিকেলটা কী বাথটবে ডুবে নষ্ট করব নাকি? চল পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একটু নীচে নেমে হেঁটে আসি।
হাঁটতে হাঁটতে একটু নীচের দিকে নেমে এসেছে ওরা,এই দিকটা বেশ নিরিবিলি চারদিকে চা বাগানের সবুজের মেলা আর একপাশে পাহাড়,মেঘ কুয়াশা মাঝে মাঝেই এসে পাহাড়ে চুমু খেয়ে যাচ্ছে,কখনও জড়িয়ে ধরছে আদরে। কুয়াশার সাথে পাল্লা দিয়ে পড়ন্ত বেলার সূর্যও আদরে রঙ মাখাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে। পাথরের খাঁজে খাঁজে বেশ রঙ বেরঙের ফুল ফুটেছে হঠাৎই বাঁক ঘোরার আগেই কানে আসে একটা গানের সুর মনে হচ্ছে গানটা মোবাইল বা রেডিওতে হচ্ছে তবে তার সাথে সুর মিলিয়েছে কেউ,
ওরা কান পাতে,ইন্দ্র পা বাড়ায় সামনে। আলতা ওকে টানে,' চল আমরা অন্যদিকে যাই দেখছিস না কেউ বোধহয় মগ্ন প্রেমে কারণ দুজনে গাইছে। তাই ওদের না ডিস্টার্ব করাই ভালো। এত সুন্দর পরিবেশে বসে গান গাইছে।'
ইন্দ্র পাহাড়ের গায়ে ফোটা ফুলগুলো ক্যামেরাবন্দি করতে করতে বলে,' তা ঠিক আছে,কিন্তু হঠাৎই এমন সুন্দর পরিবেশে এসে আছে দুঃখ আছে মৃত্যু গাওয়া কেন বাবা? তার থেকে তো এই আকাশে আমার মুক্তি গাওয়া ভালো ছিল।'
-' চল আমরা ওদিকে যাই,তুই বরং এই আকাশে গাইবি।'
-' আমার এখন আর ঐসব গান টান আসে না। তবে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কারা এই নিরিবিলিতে বসে জমিয়ে প্রেম করছে?'
ততক্ষণে গান থেমে গেছে,ওরা পা বাড়ায়। তবে কাউকে দেখতে পায় না। কিন্তু এদিক থেকেই তো গানটা আসছিল।
হঠাৎই ওদের অবাক করে দিয়ে বাতাসে ভেসে আসে ইন্দ্রর আকাঙ্খিত গান এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়।
অনেকটা ভালোলাগা ওদেরও ছুঁয়ে যায় কিন্তু ভেবেছিল বাঁক পেরিয়েই যাদের দেখতে পাবে তারা কোথায়? আলতা ইন্দ্রর দিকে তাকায় অবাক চোখে,কোন ভূতুড়ে ব্যাপার নাকি?
ইন্দ্র ওর হাতটা ধরে একটু ওপরের দিকে ইশারা করে। ওরা দেখে চা বাগানের বুকে দাগ কেটে যে পথ চলে চলে গেছে সেই পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন দুজন। অবশ্যই একজন নারী আর আরেকজন পুরুষ। ভালোবেসে হাত ধরেছেন একে অপরের,মহিলাটির মাথার খোঁপায় একগোছা সাদা আর বেগুনী ফুল।
তবে পেছন থেকে দেখলেও বুঝতে পারে মাঝবয়েসে পা রেখেছেন ওরা। ইন্দ্র আর আলতা বসে আছে রাস্তার পাশে থাকা সিমেন্টের বেঞ্চের ওপর। আলতা হেলান দিয়ে রয়েছে ইন্দ্রর কাঁধে,ইন্দ্র ওকে জড়িয়ে আছে। গান আর শোনা যায় না,আকাশে তখন সূর্যের সাত রঙের আল্পনা। ওরা বিভোর হয়ে দেখে সূর্যাস্তের দৃশ্য।
আকাশে যদিও তখন অস্তমিত সূর্যের ছটা ছড়িয়ে আছে তবুও ইন্দ্র তাড়া দেয়,' চল এগোই হোটেলের দিকে। কেউ নেই চারপাশে,জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। একদম প্রেম করার জন্য আদর্শ। এমন জায়গা কলকাতার বুকে থাকলে কাতারে কাতারে প্রেমিক প্রেমিকা আসত।'
-' এখানে কী আরও কোন থাকার জায়গা আছে? তুই তো বলেছিলি আর কোন জায়গা নেই এখানে। তবে যে ঐ দুজনকে দেখলাম...আমার কেমন যেন একটা মনে হচ্ছে।'
-' কী মনে হচ্ছে? তুই কী অন্য কিছু বলছিস নাকি?'
-' এই তাড়াতাড়ি ফিরে চল,আবার যদি গান শোনা যায়,তাহলে ভয় করবে আমার। ওহ্ কেমন যেন লাগছে...'
-' বীরাঙ্গনা একেবারে,চল ফিরে যাই। তার আগে এমন নিরিবিলি প্রকৃতিতে একটু প্রেম করে নেব না?'
ওরা হোটেলে পৌঁছনোর পরই অন্ধকার নেমে আসে আকাশে তারা ঝিকমিক করে। আকাশে উঁকি মারে আধ ফালি চাঁদ। হোটেলের ছেলেটা জিজ্ঞেস করে ওরা চা না কফি নেবে? আরও বলে দিল একটু পরেই যেন ডাইনিং স্পেসে এসে যায়।
একটু ফ্রেস হয়ে ডাইনিং স্পেসে ওরা আসে তখন ফায়ারপ্লেসে আগুন ধরেছে। হালকা শীতে গরম ওমটুকু ভীষণ ভালো লাগে। ওরা টুং টাং শব্দে টি টেবিলে চায়ের কাপ আর পট সাজাতে থাকে,টেবিলে গুছিয়ে দেয় মুচমুচে কুকিজ।
আলতা মুগ্ধ হয়ে দেখে,অফিস থেকে এসে আগে নিজের চা নিজেই করে খেত। এখন তো বাড়িতেই অফিস তাই এনি টাইম টী টাইম। অবশ্য ইন্দ্র অফিস থেকে এসে প্রায় দিনই চা করে নিজের জন্য,আর তখন ওকেও ভাগ দেয়।
ফারারপ্লেসে জ্বলন্ত আগুনের সামনে একদম তপ্ত ফুটন্ত চা। আহা এমন আরাম কোথায় পাবে? এইজন্য মাঝে মাঝে বেড়াতে আসা যায়।
ওদের থেকে একটু তফাতে দুটো চেয়ার মুখোমুখি পাতা সেখানেও ওরা সাজাচ্ছে চায়ের সরঞ্জাম। আলতা ইন্দ্রর দিকে তাকায়। মনে হয় এগুলো সেই গেস্টদের জন্য যারা ঐ স্পেশাল ঘরটাতে আছে। আসার পর থেকে তাদের সাথে দেখা হয়নি।
চায়ের কাপে ওরা যখন ঠোঁট ডুবিয়েছে তখন আইয়ে বাবুজী শুনে দুজনেই অবাক চোখে তাকায়। আরে এই তো সেই ট্রেনে দেখা ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা। ওরা এখানেই...
দুজনের চোখ চলে যায় ভদ্রমহিলার মাথায় গোঁজা সাদা বেগুনী ফুলে। ইন্দ্র ওকে খোঁচা মারে,হাল্কা আওয়াজে বলে ভূত...
-' আরে আপনারাও এখানে! দেখেছেন তো পৃথিবী গোল।' ভদ্রলোক বলেন।
-' হ্যাঁ সত্যি ভাবা যাচ্ছে না। আচ্ছা আপনারা কী ঐ গ্লাস হাউসটাতে আছেন?'' ইন্দ্র বলে।
-' হ্যাঁ ওটাতেই আছি,অনেক কষ্টে বুক করেছি।'
কথাটা শুনে আলতা একটু হাল্কা রাগত চোখে ইন্দ্রর দিকে তাকায়...
চায়ের কাপের টুং টাং শব্দে মিশে টুকরো কথাবার্তা চলতে থাকে। ভদ্রলোক বলতে থাকেন কোথায় কোথায় ঘুরে এলেন। ইন্দ্রও টুকটাক কথা বলে। শুধু ভদ্রমহিলা তেমন কিছু বলেন না। মাঝে মাঝে একটু হাসছেন। আলতা লক্ষ্য করে আজ ভদ্রমহিলা চা ঢেলে কাপে দুধ চিনি মিশিয়ে ভদ্রলোককে দেন। আবার ভদ্রলোক জোর করেই ওকে বিস্কুট খাওয়ান...' আরে নাও নাও দেখো খুব ভালো।'
ভদ্রমহিলার মাথার খোঁপায় এখনও যত্নে আগলানো সাদা বেগুনী ফুলের থোকা।
আলতা বলে,' আপনার মাথায় অনেক চুল,কী সুন্দর ফুলগুলো! খোঁপাকে আরও সুন্দর করেছে।'
ভদ্রমহিলা লজ্জামাখা হাসি হাসেন,' ও বলল খোঁপাতে লাগাতে।'
-' শুভা আমি লাগিয়ে দিলাম বল,না হলে তো তুমি লাগাতেই চাইছিলে না।'
-' হ্যাঁ আপনাদের গান শুনেছি দূর থেকে তবে বুঝিনি আপনাদের সাথেই আবার দেখা হয়ে যাবে।'
ভদ্রলোক কেমন যেন উদাস হয়ে যান তারপর বলেন,' হ্যাঁ হয়ত কিছু কথা বলা ছিল বাকি তাই দেখা হয়ে গেল। কিন্তু জানেন, অনেক সময় কত কথা বাকি রেখেও কেউ চলে যায় দূরে।'
-' গান কিন্তু খুব সুন্দর গান আপনি। খুব ভালো লাগছিল যখন গাইছিলেন। আমরা তো অবাক কে গাইছে ভেবে।'
-' ঐ একটু আধটু,আসলে রবিঠাকুরই তো ভুলিয়ে রেখেছেন আমাদের। না না ভুল বললাম শিখিয়েছেন গান দিয়ে ভালো থাকতে। কী লেখেননি? সবই বোধহয় লিখে গেছেন। এক একটা গান এক একটা গল্প।'
চায়ের আসর শেষে ওরা ঘরে ফিরে আসে, ঘরে ঢুকে আলতা বলে,' তুই দেখেছিস উনি ঘর পেলেন আর তুই পেলি না।'
-' এখনও ঘরের শোক? থাক না পরে আবার এই ঘরেই থাকব বলে আসা যাবে। ওদের সেকেন্ড হানিমুন এখন একটু এনজয় করুক। দেখছিলি না দুজনে হাত ধরাধরি করে চা বাগানের পথে কেমন হাঁটছিল?'
-' হ্যাঁ ওদের জীবনে এখনও কত প্রেম,আর আমাদের জীবনে বিয়ের পরই ভিডিও গেম শুরু হয়ে যায়। ফোন নিয়ে আমি বামে আর তুই ডানে।'
ইন্দ্র হা হা করে হাসে,' কী সুন্দর কথা বলেছিস তো! আসলে এখন এটা একটা ক্রেইজ বুঝলি বাবা মায়েরাও এখন ভাবে নিজেদের কথা একটা বয়েসে এসে। অবশ্যই ভালো এটা একটু নিজেদের মত করে সময় কাটায়। হানিমুনের সময় পার হলেই বা কী? চাঁদ দেখে মধুর স্বাদ সব বয়েসেই নেওয়া যায়।'
-' হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস,সবার ছেলে মেয়েরা মোটামুটি বাইরে,বাবা মা আর কী করবে? টাকাও এখন ভালোই থাকে সবার হাতে। সুতরাং কনসেপ্ট বদল।'
ইন্দ্র আলতাকে জড়ায়,' এই যে ওদের প্রেম দেখে তো আমরা আমাদের প্রেম ভুলতে বসেছি। কাল তো চলে যাওয়া। সুতরাং কথা কম এখন...'
আকাশের আধফালি চাঁদ এখন উজ্জ্বল,রাত হয়েছে। তবে ওরা কিছুক্ষণের জন্য ডুবে গেছিল এক মাদকতায়। রাতের খাবার ঘরেই বলা ছিল তাই আর বাইরে বেরোয়নি। ঘরে শুয়ে কম্বলের ওম নিতে নিতে হাওয়ার গান শোনা।
পরদিন একটু দেরিতেই ঘুম থেকে ওঠে ওরা,কারণ বিশ্রামের দিন প্রায় শেষ আবার যন্ত্র নিয়ে যন্ত্রণাময় জীবন। সকালে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাকে দেখেনি। হয়ত ভোরবেলা উঠে হাঁটতে বেরিয়েছেন অথবা ঘরে,ওরাও একটু ঘুরতে বেরোয় চারদিকটা। ঘুরে এসে ফ্রেস হয়ে প্যাকিং করে বেরোবে একেবারে।
যে পাশটায় কাল যাওয়া হয়নি সেই দিকটায় আজ হাঁটতে যায়,আলতা চা বাগানের সবুজে হারায়। বেশ কয়েকটা ছবি তুলে,পাইনের বন ঘুরে ওরা ফেরে। নিজেদের ঘরে ঢোকার আগে দেখতে পায় কাঁচের ঘরের বারান্দার দিকের দরজা খোলা,বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে রোদে পিঠ সেঁকতে সেঁকতে ওরা চা খাচ্ছেন।
ওদেরকে দেখে ভদ্রলোক বলে,' বেড়ানো হল?'
-' হ্যাঁ প্রায় শেষ,খুব ভালো জায়গাটা। তবে উপায় নেই আজই চলে যেতে হবে। আপনারা?'
-' আমরা আরও একটা দিন থাকব।'
-' হ্যাঁ এখন তো নিশ্চিন্ত জীবন আপনাদের,আর জায়গাটাও খুব সুন্দর।'
-' তাই ভেবেছি থেকে যাই,বড় ভালো লাগছে নির্জনতা। আর বাড়িতে গিয়েও তো সেই দুজনে একা একা।'
আলতা জিজ্ঞেস করে,' ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকে বুঝি?'
ভদ্রমহিলা হঠাৎই কেমন যেন একটা বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে দেন। আর ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ছুঁড়ে দিয়ে বাতাসে ম্লান হেসে বলেন,' বিদেশে থাকলে তো তবুও মাঝে মাঝে আসত। আসলে হঠাৎই ছেলেটা আমার নিরুদ্দেশের দেশে হারিয়ে গেল। তাই তো শুভাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াই এখানে ওখানে। ওকে তো তেমন কিছুই দিতে পারিনি,আর যা পেয়েছিল তাও হারালো। তাই একটু খুশি রাখতে চেষ্টা করি। আসলে নাড়ি ছেঁড়া ধন তো,শোকটা বোধহয় ওকেই বেশি ছুঁয়েছে। তাই শোকের বোঝাটা ভাগ করে নিতে চাই...বলি আমি সইতে পারব নিজের বোবা কষ্টের ভাগ কিছুটা দাও আমায়... '
হঠাৎই আলতার গলার কাছটা ভারী হয়ে ওঠে,মনে হল যেন একটা ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছে। ভদ্রমহিলার কাছে এসে বলে,' না জেনে আঘাত করে ফেলেছি,কিছু...'
-' ও কিছু নয়,হারিয়ে গিয়েও যে সে ফিরে ফিরে আসে প্রতিনিয়ত। ভুলতে চাইলেও কী ভুলতে পারি? তবে তোমাদের মত ছেলেমেয়েদের মাঝে ওকে খুঁজি। তুমি বলে ফেললাম হঠাৎই...'
-' না না,ভালো থাকবেন। আমরা আসি আমাদের যেতে হবে...'
ঘরে এসে আলতা মুখটা ঢেকে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। ইন্দ্র ওর কাঁধে হাত রাখে,' কত কী আমাদের অজানাই রয়ে যায় তাই না? সব বেড়ানো সুখের নয়,মানুষ দুঃখ ভুলতেও বেড়ায়। সব হাসিই আনন্দের নয়,কত মানুষ কান্না ঢাকতে হাসে... আসলে আমাদের ভেতরের গল্পগুলো অজানাই থেকে যায়।'
বাইরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর কানে আসে..তোমার অসীমে প্রাণ মন লয়ে যতদূরে আমি ধাই--
কোথাও দুঃখ,কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই...
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment