Skip to main content

নতুন কিছু

'বিয়ে তো এগিয়ে এল বৌমা তা আমাদের দাদুভাই কবে আসছে?'
  ছাদে কাপড় মেলতে মেলতে শ্রমণা শাশুড়িমাকে বলে,' হ‍্যাঁ এক সপ্তাহ আগে হয়ত আসবে মা। দেখা যাক কেমন ছুটি পায়। এদিকে তো সব গোছগাছ আমাদের করতে হচ্ছে। উনি বিয়ে করে আমাদের ধন‍্য করবেন শুধু।'
-' তাও ভালো যে বিয়ে করছে। মানে সেটাই তোমাদের ভাগ‍্যি।'
  আচারে রোদ দিতে দিতে সুষমাদেবী বলেন। রান্নাঘরের দায়িত্ব শ্রমণাকে দিলেও আচার সামলান একদম নিজের হাতে। কোন মরশুমে কী আচার বানানো হবে,কী উপকরণ লাগবে,কেমন পাক দেবেন সবই তাঁর নখদর্পণে। সুতরাং এই বিষয়টা মানে বড়ি, আচার ইত‍্যাদি--- ওহ্ আরও আছে মানে পিঠে,পায়েস ইত‍্যাদিও নিজের হাতেই করতে তিনি ভালোবাসেন।

   দেখতে দেখতে শ্রমণা শাশুড়ি হতে চলল তবুও তিনি ভরসা পান না। বললেই বলেন,' আরে যতদিন আমি আছি ততদিন করে খাওয়াই। এসব না থাকলে তো একদম বেকার হয়ে যাব।'
     কোনদিনই কোন অধিকার বুঝে নিতে শ্রমণা মরিয়া হয়ে ওঠেনি,একটা সময় দায়িত্ব নিজেই চেপে গেছিল কাঁধে।
    শাশুড়িমা অবশ‍্য কথায় কথায় বলেন,' এই তো সেদিন বিয়ে হয়ে এলে বৌমা,এরমধ্যেই কেমন পাকা গিন্নীর মত ভাব সাব হয়ে গেছে তোমার। সবই যেন তুমিই জানো।'
   শাশুড়িমাকে ঠান্ডা করতে বলে,' মা সবই তো আপনি হাতে করে শিখিয়েছেন। বাপের বাড়িতে তো কিছু জানতাম না।'
  ঐ কথাটুকু শুনেই খুশি হয়ে গেছিলেন শাশুড়িমা।
   
  -' হ‍্যাঁ মা বিয়ে করছে বলে আমাদের ভাগ‍্যি কী যেন বলছিলেন? আমাদের ভাগ‍্যি হবে কেন?'
-' তোমাদের ভাগ‍্যিই তো,আজকালকার ছেলেমেয়েরা বিয়ে করতে চায় নাকি? বেশিরভাগই তো ঐসব কী যেন রিলেশনে থাকে। ঐ তো সেদিন পাশের বাড়ির ডাক্তার গিন্নী বলছিল তার ছেলে নাকি কোন মেমসাহেব কে নিয়ে আছে...'
-' হি হি হি মা আপনিও জানেন এইসব?'
-' কেন বাছা আমি কী কোন খবর রাখি না নাকি? তা বেশ করে। হয়ত আগে থেকে জেনে বুঝে চিনে নেয় নিজেদের। বদ গুণ কিছু থাকলে তাও জানতে পারে।'
-' কী জানি মা আমার এসব ঠিক ভালো লাগে না। তাই তো ছেলে প্রেম করছে শুনেই তাড়া দিয়েছি বিয়ে করার জন‍্য।'
-' যা বলেছ বাপু,মন পড়তে পারা ভালো। একটু চেনা জানা,ঘোরাঘুরি সেও বেশ ভালো। তবে শরীর চিনে ফেললে আর থাকে কী?...

    শাশুড়িমা এত খবর রাখেন জেনে একটু অবাক লাগল শ্রমণার, তবে রাখবেনই না কেন? রীতিমত এক ঘন্টা খবরের কাগজ পড়েন,টিভি দেখেন,বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারেন তাই তাঁর মত আধুনিকমনস্ক মহিলা এইসব জানবেন এতে আশ্চর্য হবার কী আছে?
 -' হ‍্যাঁ মা আমারও তাই মনে হয়,যাক আমাদের সময় তো শেষ তাই নতুন জেনারেশনের কাছে আবার এগুলো ওল্ড কনসেপ্ট। মা আমি যাই নীচে কিছু কাজ পড়ে আছে। আর হ‍্যাঁ অত্রি কিছু পাঞ্জাবীর কথা বলছিল,তা রীনা মাসিমাকে একটু বলবেন তো আমাকে হোয়াটস অ্যাপ করতে।'
  -' পাঞ্জাবী তো দাদুভাই খুব একটা পছন্দ করে না। তা কিছু মানে তো বেশ কয়েকটা তাইনা?...'
-' ও মা প্রি ওয়েডিং ফটোশুট হবে,তাতে পরবে  এথনিক ড্রেস,শুধু ছবি তোলার জন‍্য কয়েকটা লাগবে। তারপর জানি না আর পরবে কিনা?'

-' সেটা আবার কী বৌমা?'

-' মা আপনি এটা শোনেননি? আসলে আপনি তো ফেসবুক করেন না। আজকাল ফেসবুক জুড়ে এটা একটা হিড়িক চলছে। অনেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করছে এর পেছনে। ঐ কোন পুরোনো জায়গায় ট্র‍্যাডিশনাল ড্রেসে ওদের প্রেমের স্মৃতি রোমন্থন নানা পোজে। আচ্ছা আমি আপনাকে দেখাবো কেমন হয় এই ধরনের ছবি। তাছাড়া অত্রি আর শিবাংশীরটাই তো দেখবেন।'

   -' বুঝলাম, এত কিছু শুনে তো আমারই আবার বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে বৌমা,দাদুভাই ফোন করলে এবার বলব সেই কথা..'
    কাজ আছে বললেও মাদুরে শাশুড়ির পাশে বসে হেসে অস্থির হয় শ্রমণা__' মা আপনি পারেন বটে, সত‍্যি আমাদের সময়েই তো এসব ছিল না। আপনাদের সময় তো দূর... তবে সে বিয়েতে আবার অন‍্যরকম ফ্লেভার ছিল। ভিয়েন বসত,সানাই বাজত,বাড়িতে লোকজন গমগম করত সাতদিন ধরে।'
-' বৌমা দেখ তো আমের আচারটা কেমন হয়েছে?'
-' এখনই খাব মা?'
-' খাও না,তোমাকে দিয়েই তো সব টেস্ট করাই আমি।'
-' ভীষণ ভালো হয়েছে মা,একদম সব ঠিকঠাক পড়েছে। আরেকটু দিন না। আপনার হাতের আচার সত‍্যি অমৃত।'
    শ্রমণার সাথে কত বছরের সম্পর্ক সুষমাদেবীর,এত বছরে কখন যে দুজনে দুজনের ভালো মন্দের সঙ্গী হয়ে উঠেছেন বুঝতেই পারেননি। স্বামী চলে যাওয়ার পর এই সংসারের ছোট ছোট ভালোলাগার কাজে নিজেকে ডুবিয়ে মনকে ভুলিয়ে রেখেছেন।

   শ্রমণা আমের আচারের আঁটিটা চেটেপুটে খাচ্ছে পরম তৃপ্তিতে। ছোট থেকেই আচার তার বড় প্রিয়,এখন পঞ্চাশ পেরিয়েও তাতে ছেদ পড়েনি। আর আনন্দে তার জোগাড় দিয়ে চলেছেন শাশুড়িমা। অবশ‍্য মায়ের আচারে অনেকেই ভাগ বসায়। অত্রি তো মাঝে মাঝেই বলে,' ও ঠাম্মু তুমি এবার ইউটিউবে একটা চ‍্যানেল খোল,নাম দাও.. দাদি কী আচার কা ডিব্বা।'
  সুষমাদেবী হেসে অস্থির,' ওসব আমার দ্বারা হবে না,তোর মা বরং খুলুক। সেও তো ভালো রান্না করে।'
   অবশ‍্য আলোচনা ওখানে উঠেই শেষ হয়ে গেছিল। তবে শ্রমণা মাঝে আচারের শিশির ভিডিও পোস্ট করেছিল তবে তা দেখে এত বন্ধু ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যে আর করেনি।
-' হ‍্যাঁ বৌমা এই যে ওরা প্রি ওয়েডিং ফটোশুট করবে,তা তুমি কিছু করবে না?'

-' আমি আবার কী করব মা? ছেলের বিয়ে দিয়ে আমি শাশুড়ি হব আপনার মত।'

-' সে কী দু চারবছর প্রেম করে যদি ওদের অত স্মৃতি জমে যায় তবে তোমার মনের বাক্সে কী কোন স্মৃতি নেই?'
-' সে তো মা কত স্মৃতি,এই তো মনে হয় সেদিন মা হলাম। ও পেটে আসা থেকে ওকে বড় করা,লেখা পড়া শেখানো,পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়া কত স্মৃতি। আপনারও তো কত স্মৃতি ওকে ঘিরে তাই না?'
-' হ‍্যাঁ বৌমা,একমাত্র ছেলের ঘরের একমাত্র নাতি,ও চলে যাবার পর ঘর ফাঁকা। একটা সময় পিঠেপুলি,আচার সবই তো ওর জন‍্য বানাতাম। তবুও তুমি মা,তোমার আরও কত পরিশ্রম আর সাধনা ছেলের পেছনে...'

   'সাধনা' কথাটা শুনে হঠাৎই উদাস হয়ে যায় শ্রমণা,সত‍্যি বোধহয় ছোট্ট মাংসপিন্ড থেকে পূর্ণবয়স্ক সন্তানের পথচলা এর পেছনে মায়ের কতই না সাধনা থাকে। কিন্তু সব কথা কী মুখে বলা যায়?
 যেমন সুন্দর শাড়ি পাঞ্জাবী পরে একে ওপরের গায়ে হেলান দিয়ে ছবি তুলে প্রমাণ করা যায় না এই ভালোবাসা কতটা খাঁটি।

    সব কাজকর্ম সেরে আলমারিতে হাত দেয় শ্রমণা,মা একটু ঘুমোন এই সময়ে। অত্রির বাবা বেরিয়েছে ফিরবে সেই রাতে,এই সময়টা শ্রমণার একার। নিজের মত খেয়াল খুশিতে কাটায় এই দুটো ঘন্টা। তারপর আবার লেগে পড়ে কাজে। আলমারি গুছোতে গুছোতে হঠাৎই একটা ভাবনা মাথায় লুকোচুরি খেলে। ভাবনাটা বেশ অন‍্যরকম বেশ মজার হবে কিন্তু ব‍্যাপারটা। তবে ছেলে কী রাজি হবে?

**************************

বিয়ের দশদিন আগেই এল অত্রি,এর মধ্যে অনেকগুলো কাজ সারতে হবে ওকে,অফিসের কিছু কাজও করবে বাড়ি থেকে। ছেলে বাড়িতে আসাতে উৎসবের মেজাজে সেজে ওঠে বাড়ি। মা আর ঠাম্মার আদরে মোটামুটি নাজেহাল হয়ে বলল,' মা একটু ওজন কমিয়ে এসেছি,সামনে বিয়ে মোটা হয়ে গেলে ছবি ভালো আসবে না। শিবাংশীর পাশে কেমন লাগবে ভেবেছো?'
-' তা বলে কিছু খাবি না? আমি আর মা মিলে কত কী করেছি যা যা তুই ভালো খাস। সব নষ্ট হবে?'
-' মা কাল সারাদিন কিন্তু আমি থাকব না,ও আচ্ছা পাঞ্জাবীগুলো আমাকে দেখিয়ো। অবশ‍্য শিবাংশীও কিছু ড্রেস কিনেছে।'
-' দাদুভাই কাল কী তোমার প্রাক বিয়ে ছবি তোলা হবে?'
  -' ঠাম্মু তুমিও জানো?
-' জানি তো,আমাকে দেখাস কিন্তু ছবি। দেখব আমার দাদুভাই দিদিভাইকে কেমন লাগছে। তা কোথায় যাবি?'
 -' কিছু জায়গা ঠিক করা হয়েছে,আর যেসব জায়গাতে আমরা ঘুরতাম সেখানেও কিছু ছবি তোলা হবে। ফটোগ্ৰাফার সব এডিট করে দেবে। তারপর দেখাবো।'

    দুপুরে খেয়েদেয়ে মায়ের খাটে এসে শোয় অত্রি। অনেকদিন বাদে ছেলেকে পেয়ে আদরে মাথায় হাত রাখে শ্রমণা। তারপর বলে,' আচ্ছা তোর ফটোশুটে কদিন লাগবে?'
-' কেন মা? আমি একদিনই বলেছিলাম,হয়ত দুদিনও লাগতে পারে।'
 -' আচ্ছা একটা দিন,না না একটা বেলা হলেও চলবে। মানে একটা দিন আমার জন‍্য রাখবি?'
-' তোমার কাছেই তো আছি মা। কেন এমন করে বলছ? ও বুঝেছি তোমার শপিং বাকি আছে। আমি যে শাড়ি কিনতে বলেছিলাম তা কেননি।'
-' আরে না না সব হয়ে গেছে। একটা কথা বলব তুই রাগ করবি না তো? মানে তোর ঠাম্মাই আমার মাথাতে পোকাটা ঢুকিয়েছে।'
 অত্রি আবার জিজ্ঞেস করাতে শ্রমণা একটু কাচুমাচু হয়ে কথাটা বলে। 'মা আইডিয়াটা বেশ ইউনিক কিন্তু এত কথা তোমার মাথায় এল কী করে? শিবাংশীকে বলব কথাটা? ও চমকে যাবে শুনলে।'
  ব‍্যস্ত হয়ে ওঠে শ্রমণা,' না না ওকে এখনি কিছু বলিস না। আসলে কেন যেন আমার মনে হল এই দিনগুলো আর আসবে না।'
-' কোন দিনগুলো মা?'
-' এই যে তুই বালিশে মুখ গুজে শুয়ে আছিস আর আমি মাথায় হাত দিয়ে তোর এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিচ্ছি। তারপর দুজনে পাশাপাশি শুয়ে কত কী বকবক করছি।'
-' আর ইউ ফিলিং ইনসিকিওরড মম? মনে হচ্ছে আমার...এইজন্য আমি বিয়ে করতে চাইনি।'

-' ধুৎ বোকা ছেলে,সবার একটা সঙ্গী দরকার। ও তোকে বুঝবে,তোর বন্ধু হবে। আমরা কী চিরকাল থাকব?'
-' মা এবার আমি রাগ করছি,বাবা এখনও ঠাম্মুর আদর খায়। তুমি এমন কথা বলছ কেন? বুঝতে পারছি একটা ভয় তোমার মধ‍্যে কাজ করছে, মানে হারানোর ভয়।'
-'না না ওসব কিছু নয় তুই রাজি কিনা বল,মানে যেটা বলেছি।'
-' হ‍্যাঁ বাবা রাজি,তোমার জন‍্য একটা দিন দিতে পারব না?'

    ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে,শ্রমণা মনে মনে টুকরো টুকরো ছবিগুলো সাজাতে থাকে। না থাক এখন আর কাউকে বলবে না। অত্রির বাবাকে বললে তো রীতিমত বকবে,বলবে শ্রমণা সত‍্যি তুমিই এখনও ছেলেমানুষ। আর ঐ ফেসবুক তোমার মাথাটা খাচ্ছে।

    অত্রির প্রি ওয়েডিং ফটোশুট হয়ে গেছে,মোটামুটি ফটো তুলতে সারা কলকাতা চষতে হয়েছে। মানে প্রিন্সেপঘাট থেকে শুরু করে ভিক্টোরিয়া,বাবুঘাট,ট্রামলাইন,ক‍্যাফে,মন্দির,পার্ক আবার ফাইভস্টার হোটেল কোথায় না যেতে হয়েছে। ওহ্ সত‍্যি! শিবাংশী অবশ‍্য খুব খুশি। সবার হচ্ছে ফটোশুট ওদের হবেই না বা কেন?
   শিবাংশীকে বাড়িতে ছাড়ার আগে অত্রি বলে,' কাল মায়ের সাথে একটু বেরোব। তাছাড়া কতগুলো কাজ আছে।'
-' ও আচ্ছা,কোথায় যাবে?'
  -'মা বলছিল কোথায় নিয়ে যাবে। আচ্ছা, রাতে বলব ঘুরে এসে কোথায় গেছিলাম।'

     মা আর ছেলের আজ বেরোনোর কথা,অত্রি গাড়ি নিতে চাইলে শ্রমণা বারণ করে বলে,'আজ সেই পুরোনো দিনের মত ঘুরব যখন আমাদের গাড়ি ছিল না।'
-' মা তোমার কষ্ট হবে না তো?' না না তুই সাথে থাকলে কিসের কষ্ট? অসুবিধা হলে ট‍্যাক্সি নিয়ে নেব।'

     একটা বাসকে হাত দেখিয়ে শ্রমণা উঠে পড়ে,আজ রবিবার তাই বাস ফাঁকা। ভোরের হাওয়া গায়ে মেখে বেশ লাগে বাসের জানলাতে বসে থাকতে। তারপর একটা সময় স্টপেজ এলে নেমে যায়। 
-'মা আমরা কোথায় যাচ্ছি বলবে তো?'
-' আজ তোকে নিয়ে সেই জায়গাগুলোতে যাব যেখানে কত সময় কাটিয়েছি শুধু তুই আর আমি। এই কথাগুলো ভুলতেই বসেছিলাম জানিস,মানে কোথা দিয়ে যে তোর সাতাশ বছর বয়েস হয়ে গেল বুঝিই নি। তোদের প্রি ওয়েডিং ফটোশুটের কথা শুনে মা বললেন বৌমা তুমি কিছু করবে না? তোমার কত পরিশ্রম আর সাধনা...'
   কথাগুলো বলতে বলতে চোখের কোলটা ভিজে যায় শ্রমণার, 'এই তো এসে গেছি,জানিস বাবু এই হসপিটালে তুই হয়েছিলি। তখন তো অত টাকা ছিল না তাই বেশ অনেকটা লাইন দিয়ে এখানে দেখাতে আসতাম। আর ঐ যে দোকানটা ওখানে খেতাম পাউরুটি টোস্ট বুঝলি,অনেকটা বেলা হয়ে যেত তো...

 আর যেদিন তোকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম ওহ্ সেকি আনন্দ! পেটের সেলাই ব‍্যথা সব ভুলে গেছি তখন।'
   অত্রি লক্ষ‍্য করে মায়ের চোখের কোণটা ভেজা। তাই বলে,' আজ খাবে নাকি ঐ দোকানটাতে? চল মা আজ বরং এখানে একটা ছবি তুলি আমরা। আমাদের ফটোগ্ৰাফার আমরাই। সেদিনের সেই তোয়ালে মোড়ানো বাচ্চাটা আজ বড় হয়েছে।''

   সারা দিনের অনেকটাই ওরা মা ছেলে আজ হেঁটে বেড়িয়েছে ডাউন মেমোরি লেনে স্মৃতির হাত ধরে। অত্রির মনে হয়েছে আজ হঠাৎই মা ছেলেবেলার দিনগুলোকে একসাথে কাগজে সেটে একটা ছোট ভাজ করা পাখা বানিয়ে দিয়েছে।
  মায়ের কথাগুলো কানে ভাসে অত্রির...' ঐ দেখ বাবু তোর ছোটবেলার স্কুল। ওহ্ প্রথমদিন কিছু কেঁদেছিলি তুই। তারপর তো আসতেই চাইতি না। দিনের পর দিন আমি ঐ যে দোকানটা তার পাশের রকে বসে থাকতাম। ওরা অবশ‍্য প্রথম প্রথম বসতে বারণ করলেও পরে আর কিছু বলত না।'
-' তাহলে এখানে একটা ছবি হোক,আচ্ছা মা এখানে কত বছর আগে পড়তাম?

 প্লে স্কুল,বড় স্কুল, কলেজ সব পথই কখনও হেঁটে,কখনও বা গাড়িতে চেপে পার হয়। কোচিং থেকে বেরিয়ে যেখানে রোল খেত অনেকদিন বাদে সেখানে রোল খেল দুজনে। মা বলল,' জানিস একসময় তোকে রোল কিনে দিতাম আর আমি...'
  মনে আছে মা তুমি বলতে,' আমার খিদে নেই তুই খা।'
-' আমি বুঝতাম একটু একটু, বলতাম তুমি একটু কামড়ে খাও এখান থেকে। আজ কিন্তু রোলটা আমি খাওয়াবো।'

     স্মৃতির গলিপথ হাঁটতে হাঁটতে কত পুরোনো কথা মনে পড়ে গেছে দুজনেরই। অত্রির মনে পড়েছে পার্কের সেই কোণটার কথা সেখানে মা আলো আঁধারিতে মশার কামড়ে বসে অপেক্ষা করত ওর ছুটির জন‍্য। অবশ‍্য বাবাও কতদিন আনতে এসেছে ওকে। বাবা সময় পায় না দোকান সামলে নাহলে বাবা সাথে থাকলেও বেশ হত।

     সারাদিন ঘুরে বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় বিকেল হয়ে যায় ওদের। সাথে প্রফেশনাল ফটোগ্ৰাফার না থাকলেও সব পুরোনো জায়গাগুলোকে ওরা বেঁধেছে ক‍্যামেরাতে। মা আর ছেলে ছবি তুলেছে আপন খেয়ালে। কখনও বা খেয়েছে ফুচকা,আইসক্রিম। একটা সময় ফুচকা খাবার জন‍্য মাকে রাজি করানোটাই মুশকিল ছিল। আজ মা নিজেই উদ‍্যোগী হয়েছে ফুচকা খাওয়াতে।

  -' থ‍্যাঙ্ক  ইউ মা,আমার ছোটবেলায় কিছুক্ষণের জন‍্য যেন চলে গিয়েছিলাম সেই তোমার হাত ধরে। কত হাজার ঘন্টা মিনিট আর সেকেন্ড পার করেছ আমার অপেক্ষায় আবার কখনও বা আমাকে স্টেশনে পৌঁছে অলক্ষ‍্যে চোখ মুছতে মুছতে ফিরে গেছ বাবার সাথে।'

   ছবিগুলো দেখতে দেখতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে শ্রমণার মুখটাও,একটা কথাও যেন ডিলিট হয়ে যায়নি ওর মেমোরি থেকে। কোথাও একটা অদৃশ‍্য মেমোরি কার্ডে যত্নে সাজানো অত্রিকে একটু একটু করে বড় করে তোলার দিনগুলো।
    ওদের মাঝে কখন যে ওর বাবা এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি ওরা।
 -' কোথায় গেছিলে আজ তোমরা? মা কী যেন সব বলল, আমার মাথায় ঢুকল না।'
-' বাবা আজ আবার মায়ের সাথে ছোটবেলাটা মুঠোতে ধরতে চলে গেছিলাম। তবে তুমি থাকলে আরও ভালো হত।'

    এডিটিং করার জন‍্য কাউকে লাগেনি। অত্রিই সবটা করে দিয়েছে,শ্রমণা খুব খুশি। বলে,' কী ক‍্যাপশন দেওয়া যায় বলত তোর আর আমার আজকের এই অ্যাডভেঞ্চারের?'
- 'ফটোশুট বিফোর বিয়িং শাশুমা' এটাই বোধহয় ভালো হবে।'
  দুজনে হেসে গড়িয়ে পড়ে কথাটা শুনে।

 - 'বৌমার কাছে প্রি ওয়েডিং ফটোশুট শুনছি সেইদিন। আবার শাশুড়ি হবার আগেও যে এমন ফটোশুট হয় তা তো কখনও শুনি নাই বৌমা। আমি তাহলে সবই মিস্ করছি জীবনে কী বল?'

    -' মা জীবনের সব ছবি কী ক‍্যামেরায় তোলা যায়? আপনার আঁকা সব ছবি যে আপনার ছেলের মেমোরিতে একদম লোড হয়ে আছে এই বয়েসেও তা কী আপনি জানেন না? ঐ দেখুন আপনাকে ডাকছে খাবে বলে। ওকে খেতে দিন। ততক্ষণে আমরা মা ছেলে আমাদের ছবিগুলো ফেসবুকে দিয়ে দিই..'

   সুষমাদেবী হাসতে হাসতে বলে যান,' ও বুঝছি ফেসবুকে দেবার জন‍্য এই ঘটা।'
   ঠাম্মার কথা শুনে অত্রি হাসে আর বলে,' মা আমি ভাবছি আইডিয়াটা শিবাংশীকেও দেব,বিয়ের আগে একদিন আন্টির সাথে ঘুরে আসুক নিজের ফেলে আসা মেয়েবেলাতে। আন্টিরও একটা নতুন ইভেন্ট ট্রাই করা হবে... ফটোশুট বিফোর বিয়িং শাশুমা।'


    




Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...