Skip to main content

আনন্দীর আকাশ


অফিস ফেরত সেদিন জোর করেই অর্চা নিয়ে গেল ওর ওখানে। বলল, এই শোন মাঝেমাঝেই তুই শ্রী মার্কেটে আসিস জামা বানাতে দিস ব্লাউজ বানাস। আর আমার বাড়িতে আসিস না। আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছে তোকে একদম আমাদের বাড়িতে নিয়েই যাব। একটু টিফিন করে তারপর তোর টেলারিং শপ ঘুরে যাবি। অর্চাকে না করতে পারল না আনন্দী কিন্তু বেশ একটু অস্বস্তি হল তার। তাই বলল শোন না আজ জোর করিস না আসলে আমার বরও আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে আর আমাকে বাড়িতে না দেখলে তার মাথা গরম হয়ে যায়। এক কাপ চা আমার হাতে তাকে খেতেই হয়।
   বরের গল্প দিনরাত করে আনন্দী,ওর বর এই আর সেই,ওকে চোখে হারায় আরও কত কী। অথচ ওর বাড়িতে আজ পর্যন্ত কোনদিনই নিয়ে যায়নি। কোন না কোন ছলছুতো করে এড়িয়ে গেছে। অবশ‍্য পারমিতা একদিন চুপিচুপি বলেছিল আরে নিয়ে যাবে কী বলত? আমাকে তো কিছুতেই নিয়ে গেল না,একদিন হঠাৎই ওদের পাড়াতেই দেখা হয়েছিল বলল ওকে নাকি ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তারপর ঢুকলো একটা গলির মধ‍্যে,ইশ্ ঐ গলিতে কী মানুষ থাকে নাকি? মনে হয় বাড়িঘরের অবস্থা খুব খারাপ বুঝলি তাই ডাকে না আমাদের।
       বরের গল্প করে কোথায় যেন জিতে যায় আনন্দী,ওর বর ওকে চোখে হারায় বলতে বলতে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আনন্দে। ওরা বলে আনন্দী তুই তো প্রায় দুই বছর আমাদের সাথে আছিস,  একদিন নিয়ে চল বাড়িতে তোর বেটার হাফকে দেখা আমাদের।
   উজ্জ্বল মুখে নিভন্ত একটা আলোর ছটা ছড়িয়ে বলেছে আসলে আমাদের পুরোনো বাড়ি,তোদের সব নতুন নতুন ফ্ল্যাট তাই আর বলি না কিছু। তারপর তেমন করে গোছানোও নয়।
    ওরা একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিল শুনে তারপর বলেছিল ও আচ্ছা। তা একটু নিজের মত গুছিয়ে নিবি ভালো করে থাকবি। নিজে চাকরি করিস তা ইচ্ছে করে না একটু ভালো থাকতে?
    -ওমা কে বলেছে আমি ভালো নেই,আছি রে ওর মধ‍্যেই ভালো আছি। আসলে শাশুড়িমা অত গোছাতে পারতেন না। চিরকালই রান্নাটাকেই জীবনে গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাকেও তাই শিখিয়েছিলেন বলেছিলেন খাওয়ার জোগাড়টা ঠিক করে করবে বৌমা বুঝলে,যাতে ওরা সুস্থ থাকে। ঘরদোর বেশি পরিপাটি করে কী হবে? প্রথম প্রথম ইচ্ছে করত অনেক কিছু তবে এখন আর ইচ্ছে করে না।
  - সে আবার কী রে? আমার তো অগোছালো ঘরদোর দেখলে মাথা গরম হয়ে যায়। আমার তো ঘর পরিস্কারের জন‍্যই দুজন আছে। আর সমীর তো জানিসই বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকে। ওর জন‍্যই আমাকে আরও টিপটপ রাখতে হয় ঘরদোর। ওদের কথার মাঝেই অর্চা ছোট করে শুনিয়ে দিয়েছিল।
  অন‍্যরাও বলেছিল নিজেদের কথা,শুধু আনন্দী একটু হাসিমাখা মুখে বলেছিল মনে হয় কিছুটা অভ‍্যেস হয়ে যায় জানিস। আমি আবার গুছোতে গেলেই জিনিস গুলিয়ে ফেলি,খুঁজে পাই না।
   সবার হাসিতে টিফিনের সময়টা বেশ মুখরোচক হয়ে উঠেছিল। তবে প্রত‍্যেকের মনের কোণে একটু ইচ্ছে ছিল যে একবার আনন্দীর অগোছালো সংসারটা দেখার। তাই ওরা ঠিকই করেছিল আনন্দীকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যাবে যে কোন ভাবে। তাহলে হয়ত ভদ্রতার খাতিরে কখনও বলবে যাবার কথা। 

আনন্দী যদি খুবই সাদামাটা হত তাহলে কিছু বলার ছিল না। বরং কিছুদিন হল বেশ সাজগোজ বেড়েছে ওর। নিত‍্য নতুন কুচি দেওয়া ডিজাইনার ব্লাউজ আর পরিপাটি ম‍্যাচিং গয়না পরে এসে যখন দাঁড়ায় তখন একটু হলেও অনেকেরই মনে হয় ঐ এঁদো গলিতে থেকেও কত সাজের বাহার। এদিকে কাউকে এতদিনের মধ‍্যে একদিনও ডাকল না।

   অর্চা একদম নাছোরবান্দা হয়েই নিয়ে গেল বাড়িতে। আনন্দী সোফাতে সাবধানে বসে,খুব দামি প্লেটে কুকিজ কফি সাজিয়ে অর্চাই নিয়ে আসে। 
 ও একটু কুন্ঠিত হয়ে বলে,এত কিছু কেন? এই আমার দেরি হয়ে যাবে রে,আসলে ও বসে থাকে একসাথে চা খাবে বলে। 
 - আরে কী দিলাম এমন? খা খা এই কুকিজগুলো সব সমীর এনে রাখে বাইরে গেলেই। আর এই কফিটা তো কেনিয়া থেকে আনা।
 সাবধানে কফির কাপটা ধরে চুমুক দেয় আনন্দী এত দামি কাপে তার চা বা কফি খাবার অভ‍্যেস নেই। খুবই সাধারণ ঘরের মেয়ে সে,তবুও খুব শখ ছিল যে শ্বশুরবাড়ি এসে একটু নিজের মত করে গুছিয়ে থাকবে। কিন্তু তা হয়নি,একটা সময়ে নিজের অভ‍্যেসগুলো আর চাওয়াটা ওদের মতই করে ফেলেছিল। শুধু বাইরে বেরোনোর সময় একটু নিজেকে বদলে আর সাজিয়ে বেরোয় অবশ‍্য সেটাও বর ভালোবাসে বলে। 
   ওর চিন্তার জালটা ছিঁড়ে যায় অর্চার কথাতে, হ‍্যাঁ রে কফিটা ঠিক আছে তো? কড়া হয়নি তো? 
- না একদম ঠিক আছে। আমি এবার উঠব রে,তোর বাড়ি খুব সুন্দর একদম ছবির মত। ভালো লাগল।

- বাড়ি নয় এটা ফ্ল্যাট তবে হ‍্যাঁ এতটাই বড় যে বাড়ির মতই। ছাড় ওসব কথা,হ‍্যাঁ আমার গাড়িটা তো আছেই বের করা। তোকে পৌঁছে দিই?
-না না আমি বেশ ট্রামে করে চলে যাব এটুকু তো পথ। তুই বিশ্রাম নে,তাছাড়া আমি একদম দোকানের কাজ সেরেই যাব ঐজন‍্য তো আসা এখানে।
- আচ্ছা সাবধানে যাস তবে এরপর একদিন তোর বাড়িতে যাব। তোর আদুরে বরকে দেখতে মানে যার এক মুহূর্ত তোকে ছাড়া চলে না।
   আনন্দী একটা আলতো হাসি ছড়ায় তারপর বলে বড় অগোছালো আমার সংসার রে তোদের মত পরিপাটি নয়। তা যেতেই পারিস একদিন দেখে আসবি। কিন্তু তোদের ভালো লাগবে না।
  - আমরা ভুলছি না,অফিসের সবাই বলছিল আনন্দী সারাক্ষণ ফাঁকি মারে,নিজে সাজুগুজু করে আসে আর বলে ও অগোছালো। একবার হানা দিতেই হবে ওর বাড়িতে।
  ঘড়িটা দেখে আনন্দী তারপর কথাগুলোকে পাশ কাটিয়ে অর্চাকে হাত নেড়ে এগিয়ে যায় লিফ্টের দিকে। লিফ্টের ভেতরে কেমন যেন দম আটকে আসে ওর। তারপর রাস্তায় নেমে শ্বাস ফেলে। কেমন যেন একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে,সাজানো গোছানো ফ্ল‍্যাটে গিয়ে চেপে রাখা বাথরুমের কথাও বলতে পারেনি আনন্দী। অর্চাকে দেখছিল বারবারই কাজের মেয়েটাকে টেবিল মুছতে বলছে,ও কুকিজ খেতে গিয়ে একটু গুড়ো পড়েছিলো টেবিলে তাড়াতাড়ি মেয়েটা এসে গুড়োগুলো মুছে আবার দামি টেবিলটাকে চকচকে করে দিয়ে যায়। অর্চার কাছে শোনে শ‍্যামবাজারের কাছে ওর বরদের পুরোনো বাড়ি ছিল,ওর সবার মধ‍্যে থেকে দম আটকে আসত সেখানে। তবে ওর বর এখনও মা ন‍্যাওটা তাই বাড়ি ছাড়লেও মায়ের কাছাকাছি থাকবে বলে বেশিদূর না গিয়ে একটা স্টপেজ দূরে এই কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাট কিনেছে।
     এসিটা বাড়াতে বাড়াতে অর্চা বলেছিল, নিজের মত সাজিয়েগুছিয়ে থাকব না তো কী? ঐ দরজার ওপর গামছা ঝুলছে বা খাটের ছত্রিতে শাড়ি ঝুলছে এসব আমার পোষায় না রে। শান্তি একটাই আমার ইচ্ছেমত এখানে আছি।

    সুলভ কমপ্লেক্সের ছেলেটাকে ব‍্যাগ থেকে খুচরো টাকা দিয়ে টেলারিং দোকানে এসে ব্লাউজটা নিয়ে ট্রামে উঠে বসে আনন্দী। বাথরুমে না গিয়ে আর ভালো লাগছিল না,অথচ কেন যেন বলতেও পারেনি অর্চাকে টয়লেটে যাবে। যদিও অর্চা ওকে টয়লেটটা খুলেও দেখিয়েছে,ওর শখের বাথটবে বরের সাথে সোহাগে ভাসে সেই গল্পও করেছে।
   ট্রামের জানলায় বসে অন‍্যমনস্ক হয়ে যায় আনন্দী মনে পড়ে যায় ওর ঠিকানা বত্রিশ বাই সাতের এ বাড়িটার কথা। রাস্তা থেকে সরু গলিটা ফেলে আবার একটা গলিতে ঢুকলে কোণের বাড়িটা ওদের। বাইরেটা রঙ চটে কালচে হয়ে গেছে,সিঁড়ির রেলিংয়ের খাঁজে খাঁজে ধুলো। পুজোর সময় এক দুবার ঝাড়পোছ হয় তারপর আবার যা ছিল তেমনি। 
   ভালোবেসে বিয়ে করেছিল আকাশকে,আনন্দী তখন চাকরি করত না। আকাশ একটা বেসরকারি চাকরি করত। মাইনে মোটামুটি ভালো পেত,যা পেত তা দিয়ে ওদের সংসার মোটামুটি চলে যেত। শাশুড়িমা বলতেন,ওসব ঘর সাজানো ছাড়ো পেটে দিলে পিঠে সইবে। বরের কাছে রাতে শুয়ে চুপিচুপি বলত,আমার ঘরটা একটু নিজের মত করে সাজাতে ভালো লাগে। আমাকে এই পুজোতে শাড়ি দিতে হবে না। তার চেয়ে কয়েকটা পর্দা কিনে ফেলি বল।
 - মা খুব একটা এইসব ব‍্যাপারে অপচয় পছন্দ করে না বুঝলে। এখন তো চলছে পরে তোমাকে দেব। তারচেয়ে বরং তুমি একটা শাড়ি কেন। বাইরে বেরোবে যখন আমার বৌ তখন কেউ যেন মন্দ বলতে না পারে।
 আকাশের বুকের কাছে মিশে গিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল আনন্দী মন্দ বলবে কেন?
- না বলতে পারে যে আমি বৌকে ভালো রাখতে পারিনি। ঘরে কী খাচ্ছ,কেমন ভাবে আছ তা কজন দেখতে আসছে? বাইরের সাজটাই আসল। বাইরে যখন যাবে তখন একটু টিপটপ হয়ে যাবে।
  - আমার যে নিজের মত একটু ঘর সাজাতে ভালো লাগে।
- সাজিয়ো,সব হবে একটু সবুর কর।
   একটা সময় শখগুলো কখন যে অবহেলায় জল না পেয়ে পেয়ে মরে গেছিল বুঝতেই পারেনি আনন্দী। এখন অভ‍্যেস হয়ে গেছে সবটা। কাঠের চেয়ারে ভেজা গামছাটা ঝুলিয়ে শুকোতে শুকোতে মনে হয় এই বেশ তো আছি।

**************************

     তবে এই বেশ আছি মানুষদের নিয়ে ঘরে বাইরে নানা জনের মাথাব‍্যথা থাকে যেমন আনন্দীকে নিয়েও সবার ছিল। অফিসে সুন্দর সেজে এসে যে আনন্দী অবলীলাক্রমে পাতার পর পাতা টাইপ করে তার অন্দরে উঁকি দেবার ইচ্ছেতে একদিন ওরা পা রাখল সেই সরু গলিটাতে। অর্চা একটু গজগজ করল, ইস্ কী সরু রাস্তা দেখেছিস! এখানে তো গাড়িই ঢুকবে না রে। ওহ্ আমার এত সাধের জুতোটা এবার যাবে। 
    পুরোনো জং ধরা কড়াটা নাড়ে ওরা। আনন্দী চমকে যাবে খুব ভালো লাগে ওকে এই সারপ্রাইজ দিয়ে চমকে দেবে এটা ভেবেই। বাপরে কিছুতেই বাড়িতে আসতে বলে না!

    বেশ কিছুটা সময় কড়া নাড়ার পর দরজাটা খুলে যায়। ওমা এই তো আনন্দী দেখে তো চেনাই যায় না ওকে,অফিসে একদম অন‍্যরকম লাগে দেখতে। হঠাৎই মুখটা একটু নিভে যায় তারপরেই আবার জ্বলে ওঠে একটা নিভু নিভু মুখ বলে ওঠে,ওমা তোরা! আগে বলিসনি কেন? এভাবে কেউ আসে নাকি?
- হ‍্যাঁ শুনলাম আজ নাকি তোর অ্যানিভার্সারি তাই চলে এলাম সবাই। তুই তো আর আসতে বলবি না।

   - আয় ভেতরে সবাই,ইশ্ আমার চারদিকে যা অগোছালো! আয় আয় ভেতরে।
 - আনন্দী তোর বর কোথায়? মানে অফিসে নাকি বাড়িতে? যে তোকে আজকের দিনে ছাড়লই না।

   ওরা ভেতরে পা রাখে,শ‍্যাওলা জমা উঠোনের একপাশে বাথরুম আর আরেকদিকে রান্নাঘর। ওদেরকে বারান্দায় পাতা লম্বা হেলান দেওয়া বেঞ্চটাতে বসতে দিয়ে আনন্দী বলে,একমিনিট হ‍্যাঁ, আমি আসছি। তোদের তারপরে ঘরে নিয়ে যাব,আর হ‍্যাঁ চা খাবি তো?
   আনন্দী শাড়ির আঁচলে হলুদের দাগ মুছতে মুছতে রান্নাঘরে ঢোকে।
   ওরা বাড়িটা দেখে তাকিয়ে তাকিয়ে।
  হঠাৎই চমকে ওঠে ঘরের ভেতর থেকে একটা ডাক শুনে, আনন্দ ও আনন্দ একবার এসো না এদিকে আমার জামাটা পাচ্ছি না।
   তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে আনন্দী তারপর ওদেরকে ইশারা করে ঘরে চলে যায়।

  ওরা শুনতে পায় ঘর থেকে ভেসে আসা শব্দমালা,বলেছি না আমার সব যেমন ছিল তেমন থাক। তুমি গুছিয়ো না। কারা এসেছে? তোমার অফিসের সবাই নাকি?
 সবাই নয় কয়েকজন,নাও তুমি জামাটা পরে নাও ওদের সাথে দেখা করবে তো?
   বাইরে থেকে কথাগুলো শোনা যাচ্ছে,অর্চা কাকলিকে হাত দিয়ে টোকা দেয়,ফিসফিসিয়ে বলে কী প্রেম দেখেছিস?

    -এই দেখ কে এসেছে, এই যে আমার এক টুকরো আকাশ আর আমি ওর আনন্দ।
  ভদ্রলোক হাত তুলেছেন,ওরা প্রতিনমস্কার করতে পারে না সহসাই একটু থমকে যায় আনন্দীর এক টুকরো আকাশকে দেখে।

       আনন্দী চা মিস্টি এনে টেবিলে রেখেছে ওরা কথা বলতে পারে না। অর্চার গলার কাছটাতে খুব ভারী লাগে। কী বলবে ওরা আনন্দীর গোছানো সংসার দেখে?
  গলাটা একটু পরিস্কার করে অর্চা তারপর বলে,আমাদের কিছু তো বলিসনি কখনও। আমরা সবসময় তোর সুখী দাম্পত‍্যকে হিংসেই করেছি জানিস। তোর বর তোকে মিস্ করবে,তোর জন‍্য বসে থাকবে সবই কেমন যেন লাগত। কত কথা তোর শুনেছি বরের আদরে গদগদ হয়ে বলতি। আমার মনে হত সমীর শুধু কাজ আর কাজ করে তোর বরের মত আমাকে সময়ই দেয় না।
   চোখের কোণে টলটল করা মুক্তোটাকে যত্নে গুছিয়ে রাখে আনন্দী,ওর মুখে ফুটে ওঠে সেই ঝলমলে হাসিটা তারপর বলে,আসলে সুখটুকু বড় যত্নে আঁচলে বেঁধে রেখেছি রে। একটা সময় হঠাৎই আবছা দেখতে শুরু করল ডাক্তার দেখালাম,হায়দ্রাবাদ, ব‍্যাঙ্গালোর সব জায়গাতেই নিয়ে গেলাম। খুব একটা লাভ হল না বুঝলি,ডাক্তার বলল গ্লুকোমা হয়ত একটা সময় আর কিছুই দেখতে...
  ওরা বলল থাক বুঝতে পেরেছি রে। তাই আর তোর...
  না না বিশ্বাস কর ওর চোখটা নিভে গেলেও আমি ওর মনটাকে নিভতে দিইনি কখনও। প্রতিদিন আমাকে নেড়ে চেড়ে দেখে অনুভব করে আজ কেমন সেজেছি আমি। আসলে ও খুব সাজগোজ দেখতে ভালোবাসত জানিস। খুব দামি কিছু নয় তবে কোথাও গেলেই কানের দুল আর গলার হারে ভরিয়ে দিত আমার সাজের বাক্স।
  বিকেলে অফিস থেকে ফিরলে আমাকে ছুঁয়ে দেখে ঠিক বুঝতে পারে এই দুলটা অফিসের টুরে গিয়ে এনে দিয়েছিল। তাই নিজেকে যত্নে গুছিয়ে রাখি রে নাহলে আমার আকাশের মন মেঘলা হয়। ও ভাবে আমার মন ভালো নেই তাই সাজছি না।
  ওদের কথার মাঝেই ও ঘর থেকে ডাক আসে আবার আনন্দ আমার পকেট রেডিওটা বালিশের পাশে নেই তো,তুমি কী আবার সব গুছিয়ে রেখেছো?
  আনন্দী সাড়া দেয়, না না গুছাইনি তেমনি আছে যেমন তুমি দেখেছ। একটু হাতটা বাড়াও দেখতে পাবে।
   ওরা অবাক হল কী সুন্দর আনন্দী ছুঁতে পারাটাকে দেখতে পারবে বলছে। ওরা বুঝতে পারে আকাশদার দেখা এলোমেলো ঘরটাকে তাই আর সাজায় না আনন্দী তাহলে হয়ত মানুষটার সব কিছু খুঁজে পেতেই অসুবিধা হবে।

   -আমরা আসি রে,শুধু একটা বিবাহবার্ষিকী নয় আকাশে ঝলমলে রোদ দেখে ভালো থাক আমাদের আনন্দী।
  নিজেকে আর সামলাতে পারে না আনন্দী যত্নে ধরে রাখা মুক্তোর দুটো দানা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। বলে মা চলে যাবার পর ভেবেছিলাম এই বাড়িটা ছেড়ে একটা গুছোনো ফ্ল‍্যাটে চলে যাব,দাদারাও তাই বলেছিল। কিন্তু আর হয়নি,তাহলে আকাশ হয়ত কিছুই খুঁজে পেত না এই অগোছালো ঘরগুলো যে ওর সেই ছোট্ট থেকে চেনা। সাবধানে যাস তোরা,আরেকদিন তোদের ডাকব আজ কিছুই খাওয়ানো হল না।

   অর্চা গাড়িতে উঠে চোখ বন্ধ করে এফ এমটা চলছে হঠাৎই বেজে ওঠে আমাকে আমার মত থাকতে দাও আমি নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছি। সত‍্যি বোধহয় আনন্দীও এমনই গুছিয়ে নিয়েছে নিজেকে। আজ ওর বাড়িতে হঠাৎ করে না গেলে ওর অগোছালো সুখটুকু আর একফালি আকাশটা হয়ত না দেখাই রয়ে যেত।
সমাপ্ত:-


Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...