নতুন গুড়ের গন্ধে ভাসতে থাকে সুনীতির মন,আহা দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে তাতে নতুন গুড় দিয়ে কড়াইয়ে ভাসিয়ে দিতেন শাশুড়িমা সুন্দর করে গড়া অনেকটা ঝিনুকের খোলের মত দেখতে পুলি। নিজের হাতে পিঠেপুলি,পায়েস আর পাটিসাপটা করে বৌমাদের খাওয়াতে ভালোবাসতেন মা। অবশ্য সুনীতি নিজেও বসে পড়তেন পিঠে গড়তে শাশুড়িমার সাথে।
উনি বলতেন,'আরেকটু পাতলা করে বাটিগুলো গড়ো বৌমা না হলে শক্ত হবে।'
-' মা দেখুন তো এমন হয়েছে? আচ্ছা না হলে আপনি বাটি বানান আমি ক্ষীরটা ভরে দিই।'
বাটি ভরা লালচে শক্ত ক্ষীরের পুরকে আটোসাঁটো করে চালের গুড়োর বাটিতে ভরতেন সুনীতি। পিঠে যাতে শক্ত না হয় সেইজন্য ফুটন্ত গরম জলে চালের গুড়ো সেদ্ধ করার সময় ময়দা মিশিয়ে দিতেন শাশুড়িমা। তারপর দুধের সাগরে প্রেমে ডগমগ করতে করতে ফুটতে থাকত পিঠেরা। সুনীতিরা এ দেশীয় মানে ঘটি আর শাশুড়িমা ছিলেন বাঙাল। তাঁর হাত ধরে কত রান্নাই না চেখে আর চোখে দেখেছেন। তবে সেই স্বাদ আনতে পারেননি রান্নায়। কিন্তু তিনি পরপারে চলে যাবার পরেও তাঁর ঐতিহ্য টুকু ধরে রাখার চেষ্টা করেছে প্রাণপণে। যদিও একটা সময় নিজে পাকা গিন্নী হওয়ার পর খোটাখুটি লাগলেই বলেছেন,' মা এ বাড়িতে প্রচুর নিয়ম,আপনি করে গেলেন সব। আমার আর করা হবে না। আপনাদের সময়ে সারাদিন ঐ রান্ধাবাড়া নিয়ে থেকেছেন,আমাদের ছেলেমেয়েদের দেখতে হয় বাইরে বেরোতে হয় অত সময় কই?'
-' আমি তো কিছু বলিনি বৌমা,আমি যতদিন পারছি করছি। তারপর তোমরা পারলে করবে না পারলে কোর না। ছেলেপুলের মঙ্গল আর সংসারের ভালোর জন্যই করি এইসব। মানে আমার শাশুড়িমা তাই বলতেন।'
সুনীতির পরে বাড়িতে তিন জা এসেছিল এক এক করে। শাশুড়িমা সংসারের হাল টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে একটা সময় বৌমাদের হাতে ছেড়েছিলেন দায়িত্ব।
তারপর একটা সময়ের পর একটু একটু করে শুরু হয়েছিল ভাঙনের খেলা আর রেষারেষি। বেশ কিছুদিন বাদে সংসারও ভাগ হয়ে গেছিল। যে যার মত নিজের সংসারে সাজানো আসবাব আর নিয়মকানুনের মাঝে খুঁজে পেতে চেয়েছিল সুখের ঠিকানা। মাঝেমধ্যে আসা যাওয়া,কথাবার্তা সব থাকলেও কোথায় যেন কেটে গিয়েছিল সুরটা। শাশুড়িমাও হয়েছিলেন অনন্তপথের যাত্রী।
সুনীতি নিয়মকানুন ছাড়বেন ভাবলেও তাঁর সেইসব আর ছাড়া হয়নি। সংসারে দীর্ঘদিন থেকে শিখেছিলেন নরম তুলতুলে পিঠে গড়তে আর সাহেব পাটিসাপটা ভাজতে। পায়েসের গাঢ় লালচে রঙের যাদু আর সুঘ্রাণ দেখে ভাবতেন কোথাও যেন কিছুটা মিল আছে মায়ের হাতের পায়েসের সাথে। পায়েস বড় প্রিয় ওদের সব ভাইদেরই তাই শাশুড়িমা একটু বেশি করে চাল দিয়ে পায়েস রাঁধতেন তারপর তাকে দুধ আর মিষ্টি মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে দিয়ে রাখতেন। তখন তো আর ফ্রীজ ছিল না।
-' সুনীতি চোখটা খোল,ওষুধ খেতে হবে তো? সেই কখন থেকে ডাকছি।'
জড়ানো গলায় সুনীতি উত্তর দেন চোখ বুজেই,' বাজার থেকে খোয়া আর গুড় এনেছো? পিঠে হবে তো..'
মনটা ভারী হয়ে যায় প্রশান্তর সত্যি এবার আর খোয়া ক্ষীর,গুড় কিছুই আনার দরকার নেই। আর কার জন্যই বা আনবেন? যার এত শখ সেই মানুষটাই তো বিছানায়। ছেলে,মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলেও প্রতিবার চালের গুড়োর ছোঁয়া হাতে মেখে নিয়ম রক্ষা করে গেছেন সুনীতি। বলেছেন নিয়ম রক্ষা করা আর কী? খাবার মানুষ তো তুমি আর আমি। তবুও সেই কবে থেকে সংক্রান্তির পিঠে পার্বণ দেখে এসেছি তা বন্ধ করা যায় নাকি? অল্প বানাবেন ভাবলেও হয়নি। প্রশান্ত পিঠে ভালোবাসেন,সুনীতির সুগার তবুও পৌষের এই সুখটুকু মুঠোয় ভরে পেটে চালান করেছেন পিঠে,পাটিসাপটা একটা দুটো করে। কাজের মেয়েদের দিয়েছেন। গত দুমাস ধরে এতটাই অসুস্থ যে হাঁটার শক্তিও নেই। ছেলে মেয়েরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখলেও সবাই কাজে ব্যস্ত দূর শহরে।
প্রশান্ত নিজেকে সামলান তারপর বলেন," সুনীতি চোখ খোলো,গুড় আর খোয়া ক্ষীর কী হবে? কে বানাবে এইসব? তুমি একটু মাথাটা তোলো আমি ওষুধটা মুখে দিয়ে দিই। দেখি দেখি.."
-স্বপ্নের জাল কেটে যাওয়ায় মনটা ভারী হয়ে যায় সুনীতিরও। সত্যিই কী ঘুমের ঘোরে পিঠের স্বপ্ন দেখছিলেন? নাকি এ মনের অবচেতনে দেখা এক সুপ্ত বাসনার প্রতিফলন। একটা সময়ে যৌথ সংসারে এই দিনটা বড় সুখে পালিত হত। একসাথে বসে পিঠে গড়া,ছেলেপুলের আর দেওরদের আনন্দের সাথে ঘুরে ঘুরে পিঠে খাওয়া। সে বড় মিঠে দিন ছিল,ওরা শাশুড়ি বৌরা মিলে বানিয়ে শেষ করতে পারত না মোটামুটি উনোন থেকেই শুরু হত পিঠে খাওয়া। তারপর বায়না থাকত,মা বেশি করে বানিয়ো বাসী পিঠে খাব দুদিন ধরে। মেয়েটা ফোন করে একই কথা বলছিল," মা আমাদের ছোটবেলায় কী সুন্দর করে মকরসংক্রান্তির উৎসব হত তাই না? কত রকম পিঠে বানানো হত গো,আহা মনে হলেই জিভে জল আসে গো। আসলে এই দিনগুলো বোধহয় শুধুই নস্টালজিয়ায় ভেসেই মিঠে মুখে আর পিঠের সুখে কেটে যায়। মেয়ে বলাতেই মনে হল মেজ জা আরতি খুব ভালো চিতই পিঠে ভাজত। সে পিঠে দুধে জ্বাল দেবার আগেই গরম গরম ঝোলাগুড়ে ডুবিয়ে খেতে শুরু করত সবাই। সেজ জায়ের বাপের বাড়ি থেকে আসত গোকুল পিঠে, ভীষণ সুন্দর তুলতুলে নরম ক্ষীরের পুর দেওয়া সেই পিঠে। ছোট জাকে অবশ্য সেভাবে পায়নি সুনীতি ও বিয়ের পর থেকেই বাইরে। মাঝে এক দুবার ছিল বাড়িতে।
প্রশান্ত তাড়া দিচ্ছে ওষুধের জন্য আবার তাই বিরক্ত মুখে ওষুধটা গিলে নেয় সুনীতি। মনে মনে বলে হে ভগবান রোগজড়ানো এই একলা জীবন আর ভালো লাগে না। কতদিন বাড়িতে তেমন কোন লোকজন আসে না। মানুষ নিজের অসুখের কাছে বোধহয় খুব একলা,নিজের রোগ আর যন্ত্রণাটুকু সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। একটু সহানুভূতি হয়ত তাতে কিছুটা প্রলেপ দিয়ে যায়। তবে নিত্য ভিখারীর ভিক্ষা জুটলেও নিত্য রোগিণীর সহানুভূতি খুব কমই জোটে। আজকাল একলা বাড়িতে থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে ওঠে সুনীতি অথচ একটা সময়ে এই একলা অবসরটুকু পেতেই শুরু হয়ে গেছিল রেষারেষি। কাজ নিয়ে শুরু হয়েছিল ঠ্যালাঠেলি,কে বেশি কাজ করল কে কম করল এই নিয়ে শুরু হয়েছিল গুতোগুতি। ছোট ছোট ব্যাপার থেকেই হয়েছিল অনেক বড় ঝামেলার সূচনা। তারপর একে একে মনান্তরের অসন্তোষ নিয়েই ঘর ছেড়েছিল সবাই। ভেঙে গিয়েছিল যৌথ পরিবার ছোট ছোট কুঠুরিতে জমে থাকা অসুখে। সেই অসুখকে পেছনে ফেলে সুখের খোঁজ পেতেই পাড়ি দিয়েছিল এক এক করে সবাই দূরে। বন্ধন আলগা হয়ে গেছিল মনেরও,তাতে এসেছিল জটিলতা। তবে প্রথম দিকের কয়েকটা বছর বেশ ভালো কেটেছিল সবারই,এখন আর ভাগাভাগি নিয়ে রেষারেষি নেই। দিব্যি ভালোমন্দ খাওয়া যায়, ইচ্ছেমত শাড়ি গয়না কেনা যায়। ছেলেমেয়েদের সাথে দেওরদের ছেলেমেয়েদের খাওয়া দাওয়া পড়াশোনা নিয়ে টুকরো অশান্তি নেই। রান্নার লোক এসে এবেলা ওবেলা রান্না করে যাচ্ছে। তাই সংসারে নিজের মত করে থাকার সুখ উপচে পড়েছিল। তবুও এই বিশেষ দিনগুলোতে সুনীতির মনে হত সবার কথা। একা একা পুজোর কাজ করতে গিয়ে মনে হত জা আরতির কথা,ওর সাথে অনেকটা সময় ছিলেন। খুব কাজ করতে পারত। এখনও আসে মাঝে মাঝে,কখনও আবার ফোনে খবর নেয়।
সন্তানদের বিয়ে থা আর চাকরি নিয়ে দূরে চলে যাবার জন্য মোটামুটি সবার বাড়িই এখন বৃদ্ধাশ্রম। একটা সময় স্বামী স্ত্রীর প্রেমালাপের জায়গা ছিল না,আর এখন সারাদিনই কাছাকাছি তবুও প্রেম আর আলাপ কিছুই নেই। আসলে সময়ের সাথে সাথে বোধহয় কথাও কমে যায়।
রান্নার মেয়ে এসে রান্নাঘরে খুটখাট করছে,আজকাল প্রশান্তই বলে দেন কী হবে? উঠে দেখার মত ক্ষমতাই তো নেই তাই আর কী করবেন। সংসারের সারটুকু আর নেই এখন শুধুই সং সেজে থাকা। প্রশান্ত নিজের খাবারের প্লেটের সাথে স্ত্রীর প্লেটটাও হাতে নিয়ে এসে বলেন," নাও খেয়ে নাও,রুটি ছিঁড়ে টুকরো করাই আছে।"
হঠাৎই কেমন যেন রাগ হয়ে যায় সুনীতির বলে ওঠেন," আমি বিছানায় বলে নিয়ম কানুন কী সবই ভুলে গেলে? বাসী কাপড়ে এখনই খাবো? ঠাকুর পুজো করেছ? মানে ঠাকুরকে তিল দিয়েছ? তুমি কী জানো না আজ তিল দিতে হয়?"
-" না জানি না,ঠাকুর যেভাবে রেখেছে সেটাই হয়েছে। আমার খিদে পেয়েছে আগে খাব তারপর যা হবে হবে। আমি আর পারছি না সুনীতি, আমারও তো বয়েস হয়েছে নাকি?"
প্রশান্তর রাগ দেখে অভিমানে চোখের কোলে জল টলমল করে সুনীতির। আজকাল কথায় কথায় রাগ আর অভিমান হয়,মনে হয় সংসারে বড় অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছেন। তাঁকে ছাড়াই তো দিব্যি সব চলে যাচ্ছে। সারাদিন লোকের উপদেশ আর শুকনো সহানুভূতি শুনে শুনে জীবনে বিতৃষ্ণা ধরে গেছে।
থালাটা একপাশে সরিয়ে বলেন," আমি খাব না,সকালে রুটি। নিয়ে যাও এইসব,আগে পুজো হবে তারপর খাব।"
-" যা খুশি তাই কর,ওষুধ না খেয়ে থাকো। ঠাকুর তোমাকে দেখুক।"
গজগজ করতে করতে থালাটা হাতে নিয়ে প্রশান্তবাবু ও ঘরে চলে যান। সুনীতির চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। ওঘরে বাপ ছেলে মেয়ের কথা হচ্ছে শুনতে পান। রাগ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়েন,আবার নিজেকে খুব একলা মনে হয়। মনে হয় এমন নিরানন্দময় অসুস্থ জীবন নিয়ে বেঁচে কী লাভ?
বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে এভাবেই। রান্নার মেয়েটা একবার এসে বলে গেছে খাবার কথা,সাড়া দেননি সুনীতি। সেও গজগজ করেছে কষ্ট করে খাবার বানিয়ে ধন্য করছে বলে। কোন উত্তর দেননি সুনীতি।
কিছুক্ষণ বাদে কলিংবেলটা বাজে,এই আওয়াজটা বড় প্রিয় তাঁর। একলা জীবনে এ যেন পিয়ানোর টুংটাং,হয়ত কেউ এলো। তারপর ভাবেন কেই বা আসবে,আজ তাঁর আয়াও আসবে না। সেও ছুটি নিয়েছে পিঠে বানাবে বলে। শুধু তাঁর বাড়িতেই পিঠে হল না। রান্নার মেয়েকে বলতেই সে ঝনঝন করে উঠেছিল,'' আমার ছেলেপুলেকেই বানিয়ে খাওয়াতে পারি না সাত বাড়ি রান্না করার জন্য। আর তোমাদের বাড়ি বাড়ি বানাবো। আমাকেই আমার মা করে পাঠায় তাই খাই। যদি বল তো পায়েস করে দিতে পারি। ও মেসো দোকানে আজকাল পিঠে পাটিসাপটা পাওয়া যায়,মাসিকে এনে দিয়ো বরং খাবে।''
সুনীতি ধমকে উঠেছিলেন,'' হাতি কাদাতে পড়লে চামচিকেও লাথি মারে আমার হয়েছে সেই হাল। শেষে দোকান থেকে পিঠে এনে খেতে হবে?''
ওর কথা শুনে মুখ বেকিয়ে বিরক্ত হয়ে চলে গেছিলো রান্নার মেয়ে। দরজার দিকে তাকান সুনীতি। কান খাড়া করে শোনেন গেটের শব্দ,হ্যাঁ ঐ তো প্রশান্ত চাবির গোছা নিয়ে যাচ্ছেন। এই সব শব্দ তাঁর খুব চেনা,একটা সময় দিনে পঞ্চাশবার দরজা খুলতে গিয়ে বিরক্ত হতেন। আজ বোঝেন কেজো থাকার কত সুখ জীবনে,হয়ত মূল্যও প্রচুর। এখন তিনি ফালতুর খাতায়। তবুও কান খাড়া করেন কে এসেছে শুনতে। তারপর কিছুক্ষণ কোন আওয়াজ না পেয়ে নিরাশ হন তারপরে হঠাৎই চেনা গলার আওয়াজে চমকে ওঠেন.. বড়দি দেখো কারা এসেছে?
অবাক হয়ে যান সুনীতি ওমা আরতি যে সাথে মেজো ঠাকুরপো,সেজ ঠাকুরপো,সেজ জা।
সুনীতি কিছু বলার আগেই আরতি বলে,''ওমা বড়দি তুমি এখনও খাওনি,খাবার পড়ে আছে কী অন্যায় বল তো? সুস্থ হতে হবে তো নাকি?''
-''আমার ভালো লাগে না রে কিছু,তাছাড়া ঠাকুর পুজোও হয়নি। আজ সংক্রান্তি না,তোর দাদার কান্ড দেখে কিছু ভালো লাগেনি রে। কতদিন বাদে এলি সবাই। আজকে খুব পুরোনো কথা মনে হচ্ছিল। তোদের কথা,মায়ের কথা। কত পিঠে হত এ বাড়িতে..আর আজ বাড়িতে এক ছিটে গুড়ের গন্ধও নেই। আজই তোরা এলি,কী খাবি বলত? রান্নার মেয়েও তো চলে গেছে।''
আরতি অবাক হয়ে যায় একটা সময় বড়দি উঠতে বসতে নানা কথা বলত,কিছু কথার জ্বালা একটু বেশিই ছিল। আজ মানুষটা কেমন যেন বদলে গেছে,বড় অসহায় লাগছে দেখতে।
ওরা দুই জা বলে,''কেন বড়দি আমরা কী সংসার করি না নাকি? আমাদের ছেলেমেয়ে দুটোও তো বাইরে। সবাই এখন বৃদ্ধাশ্রমে থাকি একা একা। তাই আজ ভাবলাম আবার আগের মতই...''
প্রশান্ত অবাক হয়ে তাকান ওদের কথা শুনে ভাইদের ইশারা করেন যে তিনি বাজারে যাচ্ছেন। আসছেন এক্ষুনি। ওরা দাদার হাতটা চেপে ধরে,'দাদা এখন কী বাজারে যাবে,চল আগের মত গল্প করি চা নিয়ে। কই গো চা বসাও।''
প্রশান্ত বাধা দেন,'' আরে ওরা গল্প করছে করুক না,আমিই সুন্দর চা করতে পারি।''
-'' আরে বোস না দাদা,ওরাও একলা থেকে থেকে হাঁফিয়ে উঠেছে। তাই তো সবাই মিলে প্ল্যান করলাম এবার মকরসংক্রান্তির আনন্দ এখানেই হবে। পিঠেপুলি উৎসব করব আমরা।''
প্রশান্তর মনটা নেচে ওঠে, আহা সত্যিই সুনীতির জন্য খুবই খারাপ লাগছিল। যাক অনেকদিন বাদে সেই আগের মত আনন্দ। যদিও ছেলেমেয়েরা নেই,তাতে কী হয়েছে? আজ একটু স্বাদবদল হবে।
গুটিগুটি পায়ে সুনীতি আর ভাইবৌদের সামনে এসে দাঁড়ান,''মানে বলছিলাম ভাইরা বলছিল আজ এখানেই পিঠে তৈরি হবে। তা আমি বাজারে যাই? কী আনতে হবে যদি বল।''
-''দেখেছিস তোদের দাদার কান্ড,কী কী লাগে যেন ও জানে না। হে ভগবান আমায় যে কেন বিছানায় ফেললে?''
-'' দিদি তুমি রাগ কোরনা,দাদা কিছু আনতে হবে না। সব আমাদের সাথে আছে। সেজ তুই একটু চা বসা,ওরা বরং গল্প করুক বসে। তোর মেজদা অনেকক্ষণ হাঁক দিয়েছে।''
সুনীতির নাকে ভাসে নতুন গুড়ের মধুর সুবাস,পার্বণের শ্রীতে আর চালের গুড়োর ধবধবে সাদা চাদরের আদরে তৈরি হচ্ছে আস্কে পিঠে,পুলি পিঠে আর পাটিসাপটা। সুন্দর করে তিলের কদমা,খাজা আর তিলুয়া দিয়ে পুজো দিয়েছে আরতি। সুনীতি মুগ্ধ হয়ে বলেন,''তোরা কত কী পারিস রে? এই তো সেদিন বিয়ে হয়ে এলি। তখন তো ঠিকমত লেচিও কাটতে পারতিস না।''
-'' দিদি এই সেদিনও এখন কালে কালে অনেকগুলো বছর গো। একলা সংসারে হিমসিম খেলেও আস্তে আস্তে সব শিখে নিয়েছি। তবে আজকাল আর ভালো লাগে না একা একা পিঠে বানিয়ে খেতে। তাই তো দলবেঁধে চলে এলাম।''
নরম পিঠের আনন্দ ভাসিয়ে নিয়ে যায় কোন অতীতে,ওরা ভাইয়েরা থালা নিয়ে বসে আছেন তাতে এক এক করে পড়ছে পুলি পিঠে,পাটিসাপটা আর চিতই। একসাথে ভালোমন্দ খাওয়াতে যা সুখ তা বোধহয় একলা খাওয়াতে নেই।
বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে নামে,তারপর রাত। সুনীতির একলা মন আর একলা গৃহকোণে কোন অতীতে অবহেলায় হারানো সুখেরা বকবকম করছে আনন্দে।একটু কথা আর হাসির ছন্দে দূর হয়ে গেছে অনেকটা অসুখ। একটু বাদে ওরা চারজন এসে দাঁড়ায়,''বৌদি বেশ রাত হল,এবার আমরা আসি। আবার আসব...''
সুনীতির গলাটা ভেজে হঠাৎই কান্নায় তারপর একটু বুজে যাওয়া গলায় বলে,''আচ্ছা ঠাকুরপো,আবার যদি আমরা একজায়গায় থাকতে পারতাম তাহলে বেশ হত তাই না?''
-''হ্যাঁ বৌদি বেশ হত,কিন্তু সংসার ভাগ করে যে সবাই নিজের মত গুছিয়ে নিয়েছি। একসময় একা থাকব বলেই তো ভিন্ন হয়েছিলাম। তুমি মন খারাপ কোরনা আবার আসব।''
সুনীতি আরতী আর সেজ জায়ের হাতদুটো শক্ত করে ধরে বলেন,''আবার আসিস,আজকাল বড় একা লাগে। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল মাঝের একলা থাকার সময়গুলো বোধহয় ছিলই না কখনও।''
আরতি হেসে ওঠে,অতীতের সব তিক্ততা ভুলতে চায় ও নিজেও তাই বলে,''এবার থেকে ভেবেছি,তোমার কাছে এসে মাসে পনেরো দিন থেকে যাব। আমাদের ছেলেমেয়েরাও বলে মা তোমরা আবার একসাথে থাকো। তাহলে তোমরাও আনন্দে থাকবে,আর আমরাও নিশ্চিন্তে থাকতে পারব। কী দিদি থাকতে দেবে তো?"
সুনীতির মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না, চোখটা ভিজে গিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। আজ হয়ত অনেক দিন বাদে পাওয়া নতুন গুড়ের গন্ধটাই আবার নতুন করে মনে করিয়ে দিয়ে গেল হারানো পুরোনো সুখের মিঠে গন্ধটাকে।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment