ছোটবেলা থেকেই মায়ের কাছে সবসময় শুনতাম মেয়ে তো নয় যেন তালগাছ। ছয় বছরের মেয়েকে লোকে দশবছর বলে দেখে। আমি ভাবতাম আমি কী দোষ করেছি বাপু? তবে মাঝে মাঝে ভগবানকে খুব দোষ দিতাম যখন দেখতাম ক্লাশ ফাইভে পড়া আমিটাকে লম্বু হবার অপরাধে একদম সিনিয়ার গ্ৰুপে ফেলে দেওয়া হল স্কুলের স্পোর্টসে।
অত্যন্ত উদ্যমের সাথে দৌড় শুরু করেও নাইন টেনের বাঘা মেয়েদের সাথে দৌড়ে আমি হাঁফিয়ে পড়লাম অবশেষে আমার পজিশন প্রথমই হল তবে সেটা শেষের দিক থেকে। মা অবশ্য এটা বলেই আমাকে স্বান্তনা দিল বলল প্রথম তো হয়েছিস মানে শেষের দিক থেকে। আমি লজ্জা পেয়ে বললাম কী যে বল মা,আমি তো লাস্টই হয়েছি। তবে যাক কনসোলেশন প্রাইজটা শেষে আমাকে মা দিয়েছিল। আমি তাতেই খুশি হয়েছিলাম। অবশ্য তারপর থেকে নিজেই বুঝেছিলাম আমার দৌড়ের কতদূর দৌড় তাই আর কষ্ট করে দৌড়োতে মাঠে না নেমে মস্তিষ্কের দৌড়ে নেমেছিলাম। মাকে বলেছিলাম আমার দ্বারা দৌড়নো হবে না,আমি ভালো করে পড়াশোনা করব। যাক খেলার প্রাইজ বলতে ঐ দু একবার কলসি মাথায় ব্যালেন্স করে পেয়েছি। আর তাতেই খুব খুশি হয়েছিলাম।
বয়েসের থেকে বেশি লম্বা হয়ে যাওয়াতে মা আমাকে আর ওয়ানে পড়তে পাঠাননি সেই সময়ে একেবারে বাড়িতে ওয়ানের পড়া পড়িয়ে ছয়ে পা দিতেই টুয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন। তখন ভালো জুতোর দোকান বলতে বাটাকেই বোঝানো হত আর সেখানে গিয়ে মা মুখবন্ধ করা জুতো কিনে আমার পাকে চেপেচুপে রাখার চেষ্টা করতেন। মায়ের বক্তব্য ছিল চাপা জুতো না পরলে আমার হাল ছোট পিসির মত হবে। তার পায়ের মাপের জুতো কোথাও পাওয়া যায় না,বেশিরভাগ সময় অনেক খুঁজে দু এক পাটিও পাওয়া না গেলে তাকে দাদাদের হাওয়াই চটি পরেই কাটাতে হত।
কথায় কথায় আমার সাথে ছোট পিসির তুলনা হত। এই যেমন পা ঢাকা জুতো পর,বেশি লম্বা হলে ছোট পিসির মত হবে মানে ছেলে পাওয়া যাবে না। আমার যখন তিন বছর বয়েস তখন ছোটপিসির বিয়ে হয়ে গেছিল। আমি জ্ঞানত তাকে বিবাহিতই দেখেছি। তাই বলতাম কেন ছোটপিসির তো বিয়ে হয়েছে। লম্বা হওয়া ভালো,সবাই দিদি বলে ডাকে।
-হ্যাঁ বিয়ে হয়েছে তবে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে,আর অত খুঁজে পেতেও দেখা গেল বর ওর থেকে বেটে। আমি ছোটমানুষ অত খেয়াল করিনি। মা বলতে দেখলাম হ্যাঁ কথাটা তো সত্যিই। এইজন্য বোধহয় পিসি আর পিসামশাই কখনও পাশাপাশি হাঁটে না। আমার কৌতূহল বাড়ল তখন। চোখ পড়ল দেওয়ালে ঝোলানো বাঁধানো ফটোতে,আসলে তখন নতুন বিয়ের পর বরকে সাথে নিয়ে স্টুডিয়োতে গিয়ে ফটো তোলার রেওয়াজ ছিল খুব।
অবাক হয়ে বললাম,ওমা এখানে তো পিসামশাই বেশ লম্বা গো,পিসির থেকে পিসামশাইয়ের ঘাড়টা উঁচু। বসলে বুঝে মানুষ বড় হয়ে যায়?
- তোর আর বুদ্ধি হল না,কী সব বলছিস! যা এখন খেলা কর। আমার কাজ আছে।
-আরে ওকে আসল কথাটা বল,তুমি তো জানোই সবটা।
বাবা কথাটা বলাতে মা বকুনি দিল,তুমি চুপ কর,সব ওর জানার কী আছে?
- আরে জানলেই বা কী? আরে সোনাই শোন, আমরা যখন ছবি তুলতে নিয়ে গেছি,দুটো বালিশ নিয়ে গেছিলাম। আর তার ওপর বসিয়েই তোর পিসামশাইকে ছবি তুলিয়েছি। আইডিয়াটা অবশ্য আমার বালিশে বসাতেই সব মেকআপ হয়ে গেছে,সুতরাং নো প্রবলেম।
-কী প্রবলেম বাবা? বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেছিল মানে বেটে বর আর লম্বা বৌ সেটা কেউ বুঝতে পারবে না।
সেই ছোট্ট আমি তখনি প্রতিবাদ করেছিলাম, আমি কিন্তু পিসির মত বেটে বর বিয়ে করব না। আমার লম্বা বর চাই। বাবা আদর করে বলেছিলেন আমার মেয়েকে আমি বিয়েই দেব না,আর দিলেও লম্বা সুন্দর দেখতে রাজপুত্র আনব।
অবশ্য আমাদের পুটোর বরই বা কী কম,ঐ একটু বেটে এই যা। এমন গায়ের রঙ কজনের আছে?
হ্যাঁ আমার পিসেমশাইয়ের রঙ ধবধবে ফর্সা,স্বভাবেও মানুষটা খুবই নরমসরম। তবে ছোট হাইট হওয়ার জন্য পিসি কেন যেন পাত্তা দিত না তেমন করে। পিসেমশাই হয়ত এসে জিজ্ঞেস করল পুটো বাজারে যাই? পিসি ধাওয়া দিয়ে উঠল,কেন বাজারে যাবার জন্যও আমার অনুমতি লাগে নাকি? যাও মেলা বকবক কোরনা। আর তাড়াতাড়ি এসো,জ্বালিয়ে খেলো আমাকে।
আমরা বুঝতাম না কিসের জ্বালাতন,হয়ত সেই বেটে বরের গলায় মালা দেবার জ্বালা। লম্বা হাইটের পিসিমা সবসময়ই হম্বিতম্বি করে পিসামশাইকে দমিয়ে রাখতে রাখতে আরও ছোট করে ফেলেছে এখন। বাহান্ন বছরের মিঠেকড়া দাম্পত্যের শেষে পিসামশাই এখন আরও ছোট আর নুব্জ,পিসির শাসন আরও বেড়েছে তবে অটুট দাম্পত্যের টক ঝাল মিষ্টি রসায়ন। তবে এখন আর পিসামশাই কানে তেমন শোনেন না,পিসির বকুনি শেষে দেখা যায় মুখভর্তি একটা হাসির ছোঁওয়া। বুঝতে পারেন হয়ত পুটো ভালোবাসে তাই বকে।
বাবার ওপর আমার বিশ্বাস ছিল না,কারণ বোনের জন্য যখন বেটে বর নির্বাচন করেছে তখন হয়ত আমারও সেই হালই হবে। কারণ ইতিমধ্যেই আমার একটা সম্বন্ধ এসেছে যেখানে ছেলের বাবা জানিয়েছেন আমার থেকে ছেলে এক ফিট বেটে। তবে তার কোন আপত্তি নেই। মাথাটা গরম হয়ে গেছিল,হায় ভগবান আমার বরকেও কী শেষে বালিশে বসিয়ে ছবি তুলতে হবে নাকি? অমিতাভর গানটা কানে ভেসেছিল। যাক সেই সম্বন্ধ আমার আর হয়নি। তবে আমার বর যখন আমাকে দেখতে আসে তখন সে বসেছিল যখন আমি ঘরে ঢুকেছি,আবার যখন আমি ইন্টারভিউ দিয়ে বেরোচ্ছি তখনও তিনি বসে।
বিয়ের কথা প্রায় পাকা হঠাৎই আমার মাথায় ভূত চাপল,বললাম ছেলে বেটে ওখানে আমি বিয়ে করব না। বাবা বোঝালেও বুঝতে চাইলাম না। অবশেষে আমার মামাকে পাঠানো হল হাইট চেক করতে। তবে বসা গোপালকে বড় মামা দাঁড় করিয়ে দেখে আমাকে বুঝিয়ে বললেন,রাজি হয়ে যা।
আর সেই থেকে পিসির মত আমিও সংসারী তবে বরের হাইট বেশি হবার জন্য কথা তারই চলে আমি আজ্ঞাবাহী। তবে তা নিয়ে আক্ষেপ নেই এখন মাঝে মাঝে সেই গানটাই মনে পড়ে তুমি হো মাতা,পিতা তুমি হো। তুমি হো বন্ধু সখা তুমি হো...
Comments
Post a Comment