ট্রেনের জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ে মিমিষা,সিগন্যাল হয়ে গেছে। একটু বাদেই হয়ত ছাড়বে। নামার আগে সবার আড়ালে একটা উষ্ণতার আলিঙ্গনে বেঁধে দিয়েছে শুভায়ুকে তারপর বলেছে,' খুব মিস্ করব এই দিনগুলোতে। একটুও ভালো লাগবে না আমার।'
-' তাহলে এতদিনে আমার প্রেমিকার অকপট স্বীকারোক্তি পেলাম। এতদিন তো সে মোটেই আমাকে পাত্তা দিত না। মনে হত আমি কোথাও চলে গেলেই সে বাঁচে। আমি নাকি তাকে জ্বালাই,পরীক্ষার আগে পড়তে দিই না। সে এবার এম এসসি তে পাশ করতে পারবে না আমার জন্য এমন কত কথা..'
-' বলেছি তো,তবে আর ভালো লাগছে না এখন একমাস দেখা হবে না বলে।'
-' এইজন্যই মাঝে মাঝে বিরহ ভালো,স্বয়ং কালিদাস এই কথা বলে গেছেন।'
শুভায়ুর হাতটা চেপে ধরে মিমিষা,' বুঝেছি কাটা জায়গায় নুনের ছিটে দিচ্ছ।'
শুভায়ু হাসে তারপর বলে,' এবার আসুন ম্যাডাম,ট্রেনের সিগন্যাল হয়ে গেছে। আমিও তোমাকে মিস্ করব। তবে দেখা তো হবেই মাত্র একমাস বাদেই।'
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছিলো,স্টেশনে দাঁড়িয়ে হাত নেড়েছিল মিমিষা। ট্রেনের দরজায় অনেকটা সময় দাঁড়িয়েছিল শুভায়ু। একটু একটু করে অস্পষ্ট হয়েছিল মিমিষা। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে ট্রেন ছুটন্ত গাছপালাগুলোকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছিল সামনের দিকে।
বেশ কিছুটা বাদে অন্ধকার নেমে আসে,একা কোথাও যাওয়া খুব বোরিং। তেমন কিছু করার থাকে না। নিজের হাত ব্যাগটা নিয়ে ওপরের সীটে উঠে যায়,তারপর ল্যাপটপ খুলে বসে। অনেকগুলো কাজ বাকি আছে একটু সেরে ফেলার ইচ্ছে।
কিছুক্ষণ কাজ করে বোর হয়ে শুয়ে পড়ে হাতে ফোনটা নিয়ে। নীচের পরিবারটা বেশ আনন্দ করছে,মনে হয় কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে। টিফিনকৌটোতে ভালোমন্দ সাজিয়ে বসে খাচ্ছে আনন্দে। একটু আনমনা হয়ে যায় শুভায়ু,ছোটবেলাটাই ভালো ছিল। একটা সময় তো ওরাও কত জায়গায় বেড়াতে গেছে। বাবার অফিসের ছুটি থাকলেই বেরিয়ে পড়ত ওরা। তারপর দিন দশেকের একটা লম্বা ট্রিপ করে বাড়িতে ফিরে আসা। সঙ্গে থাকত এমনি কত খাবার আসলে বড় হবার সাথে সাথে চুরি হয়ে যায় কতকিছুই। শৈশব চুরি হয়,সরলতা চুরি হয়, চুরি হয়ে যায় ড্যাং গুলি আর ইকড়িমিকড়ি খেলার দিনগুলোও। ওদেরও তেমনই হয়েছিল,একটা সময় ও বড় হয়েছিল পড়ার চাপ বেড়েছিল। তারপর একটু করে কমেছিল শৈশবের আনন্দের পরিসর। তারপর বাবাও তো অসুস্থ হল হঠাৎই,তারপর অনেকটা কষ্টের পর একদিন মিলিয়ে গেল ঐ আকাশে।
মা নিজেকে সামলেছিল অনেক কষ্টে,ও কাঁদলেই চোখের জল মুছিয়ে বলত,' তুই তো বাড়িতে কম থাকতিস,আমি সবসময়ই ওর কাছে থাকতাম। প্রিয়জনের কষ্ট দেখা যায় না রে। একটা সময় আমিই বলেছি ভগবানকে ওকে মুক্তি দিতে।'
-' তুমি তাই বলতে?'
-' হ্যাঁ বলেছি একটা সময়,যখন দেখলাম শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছে। আর কোনদিনই ভালো হবে না।'
-' কী জানি আমি কেন যেন ভাবতেই পারছি না। অথচ তুমি তো বাবাকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করতে না।'
-' কী করব বল,সেই কবে বিয়ে হয়ে এসেছি তখন থেকে এই মানুষটা আমার সব সময়টুকু চুরি করে নিয়েছিল। আমার নিজের বলে কী কোন সময় ছিল নাকি?'
শুভায়ু তাকিয়ে দেখেছিল মায়ের চোখ ভর্তি জল। ও বলেছিল,' চুরি করা মানে ঠিক বুঝলাম না।'
-' ও তুই বুঝতে পারবি না,মেয়েদের সময়গুলো না চুরি হয়ে যায় বিয়ের পর। নিজের বলে কিছু থাকে না। মানে আমাদের সময় থাকত না। ঐ ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত সময়গুলো নানা জন নানা ভাবে চুরি করে নেয়।'
ও শোনার বায়না করাতে মা আবার বলতে শুরু করেছিল,' আসলে আমরা সবাই আমার আমার করে মরি। আচ্ছা বল তো সারাদিনের সময়ে আমার ভাগ কতটুকু? তবুও যারা চাকরিতে যায়,অন্ততঃ বাসে ট্রেনে যাবার সময়টা নিজের। বাকিটাতে কেউ না কেউ ভাগ বসায়। আমার তো তাও নেই।'
রাতে শুয়ে শুয়ে শুভায়ুর মায়ের কথাগুলো মনে পড়েছিল। এখনও মনে পড়ল সারাদিনের সময়ে আমার ভাগ কতটুকু? সবই তো চুরি হয়ে যায়..অথবা আমরা ভাগ করে দিই আমাদের সময়গুলো কাউকে না কাউকে।
মিমিষার নামটা ভেসে ওঠে স্ক্রীনে..' হ্যালো,কতদূর গেলে? কাজ করছ নাকি? আমি এই ডিনার করে উঠলাম। তোমার খাওয়া হয়েছে? ওখানে পৌঁছে কিন্তু কোথায় থাকছো জানিয়ো।'
সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে শেষে বলে,' সব ঠিক আছে,একদম চিন্তা কোর না। আপডেট দিতে থাকব। কিছুদিন একদম নিজের মত আনন্দ করে নাও। আমি তো অনেক সময় চুরি করেছি তোমার।'
-' কী বলছ যা তা। সময় চুরি আবার কী?'
হেসে ফেলে শুভায়ু ইশ্ মায়ের বলা কথাগুলো বলে ফেলেছে। তারপর নিজেকে সামলায়..' দাঁড়াও সামনে বছর তো বিয়ে তারপর বুঝতে পারবে সময় কী করে চুরি হয়। তবে আমি কথা দিচ্ছি আমি সবটুকুতে ভাগ বসাবো না।'
ওপারে একটু লজ্জা পায় মিমিষা,' সবই তো চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছো। আমার আর কী রইল? এখন বিরহিনী রাধিকা হয়ে দিন গুনব।'
-'সব চুরি হতে দিয়ো না সখী,নিজের ভাগে কিছু রেখো। নাহলে আমার মায়ের মত..' হঠাৎই শুভায়ু চুপ করে যায়।
ওপাশ থেকে মিমিষা বলে,' কী হয়েছে কাকিমার? আমি যাব মাঝেমাঝেই। খোঁজ নেব। তুমি ভেবো না। কী বলছিলে যেন মায়ের মত..'
-' ও কিছু না,সেটা পরে বলব। ঐ মানে মা বলে আমাদের সময় সবাই চুরি করে নেয়। মানে আমরাই তা হতে দিই। নিজের ভাগে কিছু রাখি না।'
শুভায়ু ফোন রেখে দিয়েছে অনেকক্ষণ। ট্রেনের দুলুনিতে ওর চোখ বুজে আসে। মিমিষার ঘুম আসে না। শুভায়ুর বলা শেষের কথাগুলো মনে হয় বারবারই। ডায়েরি খুলে বসে ও,মিমিষা টুকটাক লেখালেখি করে। রাত্রে কিছুটা সময় সারাদিন বাদে নিজের জন্য রাখে যা মনে আসে টুকটাক লেখে। শুভায়ু অবশ্য এই রাতজাগার অভ্যেস শুনে বলেছিল..' জেগে নাও এখন,তবে পরে কিন্তু আমি চুরি করব সময়টা। আমার আদর করার সময়ে নো লেখালেখি।'
মিমিষা গালে হাত দিয়ে কী যেন ভাবে,হঠাৎই মনে হয় শুভায়ুর মায়ের কথা। কত আর বয়েস হবে কাকিমার? অথচ এই বয়েসে কেমন যেন অকাল বার্ধক্য নেমে এসেছে। সারাদিন কাজ করে যাচ্ছে কিছু না কিছু। বললে বলে অভ্যেস হয়ে গেছে। বসে থাকতে পারি না। একটা সময় শ্বশুর শাশুড়ি পরিবৃত বড় পরিবারে থাকতে থাকতে কাজটাই অভ্যেস হয়ে গেছে। তখন বাধ্য হয়ে করতে হত,এখন কেউ বাধ্য করে না অভ্যেসে করে যান। আর অভ্যেসগুলো একটা সময় বাঁচার খোরাক হয়ে যায়।
-' ছেলে বেরিয়ে যায়,তখন কী করব? সিরিয়াল দেখতে আমার ভালো লাগে না। ঐ সারাদিন কিছু না কিছু করতে থাকি। তুই এলে দুজনে বরং বসে বসে গল্প করব। অবশ্য তোর তো পড়াশোনা থাকবে,চাকরি করবি সময় কোথায় পাবি?'
মিমিষা লক্ষ্য করেছিল একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল কাকিমার বুক থেকে। বুঝেছিল একাকীত্ব গ্ৰাস করছে কাকিমাকে। তাই বলেছিল,' তোমার গল্পের বই পড়তে ভালো লাগে? তাহলে আমি তোমাকে বই এনে দেব। আর গান শুনতে ভালো লাগে না? ফোনে কথা বলতে বা চ্যাটে আসতে? এখন তো সবাই ফেসবুক করে..'
-' না রে একটা সময় বই পড়তে ভালো লাগত,গান শুনতে ভালো লাগত। সেলাইও করতাম টুকটাক। তারপর দেখলাম ওগুলো সময়ের অপচয়। শাশুড়িমা বসে থাকলেই রাগ করতেন। একটা সময় দেখলাম ওগুলো ছেড়ে বেশ সংসারী হয়ে উঠেছি,সারাদিন কাজ করতে করতে একদম কেজো হয়ে উঠেছি। তখন নেশা লেগে গেল কাজে। রান্না করতে ভালো লাগত,এক ফার্ণিচার ঘষে ঝকঝকে করে রাখতাম।'
-' আর বেড়াতে যেতে? শুভায়ু তো বলে তোমরা বছরে দুবার ঘুরতে যেতে একসময়।'
হঠাৎই মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল কাকিমার,' হ্যাঁ ঐ কদিন বেশ আনন্দের ছিল। মানে মনে হত সব সময়টুকু আমার। বেশ জানলায় বসে গাছপালার চলে যাওয়া দেখতাম। চা আসত হাতের কাছে। তবে ঐ যে তোর কাকুকে সবসময় খাবার জোগাড় দিতে হত। রাগও করতাম কখনও। বলতাম এই কদিন আমার ছুটি কোন কাজ করব না।'
কথাগুলো বলেই হেসে উঠেছিলেন কাকিমা। তারপর আবার বলেছিলেন কিন্তু পারতাম না। সবই দিতে হত। তবুও বাইরের হাওয়াতে মনটা ভালো হত।
মিমিষা হঠাৎই বলেছিল,' যাবে বেড়াতে আমার সাথে?'
একটু সংকুচিত হয়েছিলেন কাকিমা,' আর শুভ?'
-' এখন ওকে নেব না। বিয়ের পর যাবে। আমি তো মাঝেমধ্যে পাহাড়ে যাই এবার তোমাকে নিয়ে যাব।'
ছেলের চিন্তায় হঠাৎই চুপসে গিয়ে বলেছিলেন,' শুভর অসুবিধা হবে রে। আর ইচ্ছেও করে না। শুভটা আবার কী করবে একা একা। ওকে রেখে..'
-' থাকবে একা,একটু স্বাবলম্বী হবে। সারাক্ষণ তোমাকে জ্বালাবে না। আমি,মা আর তুমি যাব। মাকে না নিয়ে গেলে আবার ঝামেলা করবে। আমাদের ফিমেল গ্ৰুপে যাব।'
চোখটা হঠাৎই কল্পনায় ভাসতে শুরু করলেও আবার সব আলো নিভে গেছিল হঠাৎই। মৃদু স্বরে মাথা নেড়েছিল মণীষা মানে শুভায়ুর মা।
হঠাৎই মিমিষার মনে হল,এই তো সুযোগ এখনই। নাহ্ একটা কিছু ভাবতে হবে। কিছুতেই সবটুকু চুরি হতে দেওয়া যাবে না। শুভায়ুও কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু বলল না। তার মানে মায়ের একাকীত্ব হয়ত ওকেও ভাবায়। আবার বিয়ের পর ওরা কোথাও গেলে হয়ত কাকিমা ওদের সাথেও যেতে চাইবে না। মাকে একদিন কথাটা বলাতে মা বলেছিল,' হ্যাঁ আসলে স্বামী চলে যাবার পর ছেলেকে নিয়েই সবটুকু জগত তো। কী জানি কোন সমস্যা হবে না তো..'
-' মা কী বলছ? কী সমস্যা?'
মা নিজেকে সামলে বলেছিল, না না দিদি কেমন যেন চুপচাপ। কম কথা বলেন,একটু ভাবুক বেশি। কোন সমস্যা না হলেই হয়। এই যা হয় মানে বৌমা আর শাশুড়ির অধিকারের লড়াই।'
মিমিষার হঠাৎই কেমন যেন বুকটা কেঁপে উঠেছিল। আগে যৌথ পরিবারে মানুষের রেষারেষির মধ্যে হয়ত এত মানসিক অসুস্থতা ছিল না। কিন্তু ক্রমে ক্রমে মানুষ যত একা হয়েছে তত সে অসুখী হয়েছে। কেন যেন কতগুলো কথা ওকে ভাবায়। কাকিমা ভালো না থাকলে তো সত্যিই সমস্যা বাড়বে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে একটা সময় ওর চোখ বুজে আসে। ঘুম ভাঙতে অনেকটা দেরি হয়ে যায়। শুভায়ুর ফোনেই ঘুম ভাঙে। ওর সাথে কিছুটা কথার পর ডায়েরি খোলে দেখে সময় চুরি কথাটাতে দাগ দেওয়া। লেখার জন্য একটা কী ওয়ার্ড সামনে রাখে মিমিষা তারপর ওটাকে কেন্দ্রে রেখে ভাবতে শুরু করে। আজও কিছুক্ষণ আবার ভাবলো কথাটা নিয়ে। মনে মনে শুভায়ুকে বলল কী যে একটা কথা বললে এখন এটাই আমাকে ভাবাচ্ছে।
সত্যিই তো আমাদের কত কিছুই চুরি হয়ে যায় তা আর পুলিশে জানালেও উদ্ধার হয় না। তবুও যদি কিছুটা ফিরিয়ে দেওয়া যায় কাউকে তো কেমন হয়? আর শুভায়ুকেও পুরোপুরি মন চুরি করতে দেওয়া যাবে না। কিছুটা অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখতে হবে নিজের জন্য। তারপর নিজের খেয়ালেই হাসে। মা এসে বকুনি দেয়,'কী রে আজ কী উঠতে হবে না নাকি? সত্যি আর পারি না।'
-' ওহ্ মা কেন এত চাপ নাও বল তো? সময় চলে যাচ্ছে তাই তাকে সবাইকে চুরি করতে না দিয়ে নিজেথ মত ভালো থাকো।'
-' এই কানমলা খাবি এবার,তোরা আমাকে ভালো থাকতে দিবি নাকি? সারাদিন তো তোদের খিদমত খাটতে খাটতে গেলাম।'
-' বেবি কুল, তুমি আমাদের ভালো রাখার দায়িত্ব ছেড়ে দাও। একদিন চুপ করে শুয়ে থাকো। দেখবে আমরা নিজেরাই সব করে নেবো হোঁচট খেয়ে।'
-' শুধু জ্ঞানের কথা। আমি শুলেই হয়েছে। এই ওঠ তো।'
-' একটু বোস না এখানে, সারাক্ষণ শুধু কাজ করে যাও। আচ্ছা ঘুরতে যাবে?'
-' কার সাথে?'
-' কেন আমার সাথে পাহাড়ে। শুভায়ু তো এখন নেই তাই ভাবছি আমি,তুমি আর কাকিমা একটা ট্রিপ করব।'
-' আর তোর বাবা? সে তো নিজেও যাবে না,আমাকেও যেতে দেবে না। আর আমি পায়ে ব্যথা নিয়ে ঐ পাহাড়ে যাব না। আর মণীষাদিকেও নেবার দরকার নেই। কোথাও অসুস্থ হলে কী হবে? শুভায়ু তোকে ছাড়বে নাকি?'
-' ওটা আমি বুঝব,তুমি বাবাকে বোঝাও। আর তোমার হাঁটুতে আমি তেল মাখিয়ে ফিট করে দেব তোমাকে।'
মা ক্ষেপে চলে গেলেও মিমিষার মাথায় পোকা নড়তেই থাকে।
******************************
এক সপ্তাহ হল শুভায়ু নেই এখানে,ওখানে গিয়ে সত্যিই খুব কাজের চাপে পড়ে গেছে। তারমধ্যেই মনে করে দিনে দুবার বাড়িতে আর মহারাণীকে ফোন করতে হয়। মা বারবারই বলে কাজ শেষ হলে যেন আর দেরি না করে। শুভ বুঝতে পারে মায়ের মন ভালো লাগছে না। কিন্তু কিছু করার নেই। ও তো নিজেও ভাবছে কবে ফিরবে।
হঠাৎই সেদিন মিমিষার অসময়ে ফোন,' একটা কথা বলব,তুমি তো নেই এখন। মানে কাকিমারও মন খারাপ। তো বলছিলাম কী যদি আমরা কোথাও ঘুরতে যাই তোমার আপত্তি আছে?'
-' কোথায়? কে যাবে?'
-' ধ্যাৎ, আরে আমি আর কাকিমা। যাব পাহাড়ে বেড়াতে।'
-' কী! সত্যি? মানে মা রাজি হয়েছে?'
-' তোমার অমত নেই তো? মানে...'
-' আরে আমি কী বলব..মা নিজেই আপত্তি করবে দেখো।'
-' আচ্ছা দেখি।'
মিমিষার মায়ের শেষ পর্যন্ত যাওয়া না হলেও অনেক বলে মণীষাকে রাজি করে ফেলেছিল মিমিষা। অবশ্য শুভও বলেছে,' মা বোর হচ্ছ,যাও ঘুরে এসো। তাছাড়া আমিও তো এখন নেই।'
বেশ কিছুটা উৎকন্ঠা নিয়েও মনে রাজি হয়েছিল মণীষা। ভেবেছিল একটু অন্য স্বাদের একটা জীবনে কদিনের জন্য পা রাখতে ক্ষতি কী? তাছাড়া মিমিষা কদিন বাদেই তো বাড়ির বৌ হয়ে আসবে। এমন বৌমা কজনের ভাগ্যে জোটে মানে যে ভেবেছে হঠাৎই কাকিমাকে একটু কোথাও নিয়ে যাবে। শুভকে বলতেই ও বলেছিল পুরোটাই মিমিষার প্ল্যান,অবশ্য ওর পারমিশন নিয়েই বলেছিল,' তোমার মা আমার মায়ের মত কেউ তাঁকে যদি সাথে নিয়ে যাই সঙ্গিনী করে কোন আপত্তি নেই তো? যদি একটু ফিরিয়ে দিতে পারি অল্প কিছুটা সময় যেটা শুধু একান্তই নিজের..'
শুভায়ু বুঝেছিল ওর লেখিকা,ভ্রমণ পিপাসু এবং পাগলী বান্ধবী ক্ষেপেছে। তবে প্ল্যানটা বেশ ভালো। সত্যিই তো ও নিজেও তো মাকে নিয়ে কোথাও যায়নি এই কয়েক বছরে। সুতরাং মা যদি রাজি থাকে তো ভালো।
মিমিষা সব ব্যবস্থাই করে নিয়েছিল একটু কেমন যেন এক্সাইটেড লেগেছিল যখনই ভেবেছে ওর ভাবী শাশুড়িমা ওর এবারের ট্যুর সঙ্গিনী। মা যেতে পারত কিন্তু বাবা বাধ সাধলো,তাই ও আর কাকিমা যাচ্ছে।
ট্রেনের জানলায় বসে হারিয়ে যায় মণীষা,কতদিন বাদে এই মন আজ নিরুদ্দেশের যাত্রী। মিমিষা সমানে খেয়াল রেখেছে অসুবিধা সুবিধার দিকে। মণীষা হেসে বলেছে,' তুই আনন্দ কর,আমি ঠিক আছি।'
-' কী আনন্দ করব আবার? তোমাকে যে আমার সঙ্গিনী করতে পেরেছি তাতেই খুব ভালো লাগছে।'
এই ট্রেনের সময়টুকু মণীষার একান্ত নিজের,ঘর গোছানোর চিন্তা নেই। কাজের মেয়েকে দরজা খুলে দেবার কোন তাড়া নেই,শুধুই অবসর।
এই ট্রেনে খাবার বিছিয়ে বসে একসাথে হৈ হৈ করে খাওয়াও অবশ্য নেই। এই মেয়েকে বলেছিল যে ওর পছন্দের কয়েকটা কড়াইশুটির কচুরী করে নিয়ে যাবে। তা একদম বারণ করে দিল যে ট্রেনেই খাবার দেবে। ট্রেনের খাবার তবে আজ বেশ লাগলো মণীষার কতদিন বাদে কেউ মোড়কে মুড়িয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে সব সামনে দিল এমন কী ফলের রস আর খাবার জলটুকুও। মণীষার একান্ত একাকীত্ব হঠাৎই একটু মুখর হয়ে উঠল ভাবী পুত্রবধূ মিমিষার পাগলামিতে। মেয়েটা কিসব লিখছে,আবার মাঝে মাঝে গল্প করছে। এরমধ্যে ছেলের সাথেও ফোনে কথা হল।
বেশ কয়েকঘণ্টার যাত্রাপথ শেষে ওরা উত্তরবঙ্গের একটা ছোট্ট পাহাড়ি জায়গাতে এসেছে। এদিকে কখনও আসেনি মণীষা,শুভ ছোট থাকতে একবার দার্জিলিং এসেছিল। ওর বাবা পাহাড়ে আসতে খুব একটা ভালোবাসতেন না। বরং সমুদ্র তাঁকে টানত বেশি। এছাড়া শাশুড়িমাকে নিয়ে হরিদ্বার,মথুরা,বৃন্দাবন,দিল্লী,আগ্ৰা গেছে। সে যাওয়ার সাথে এ যাওয়ার বিস্তর ফারাক। শাশুড়িমায়ের খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্য রান্নার সরঞ্জাম এনে তাঁকে রেঁধেও খাওয়াতে হয়েছে কখনও।
আর এবার বেড়াতে এসে মণীষা যেন একটা ছোট্ট মেয়ে যাকে আগলে রেখেছে মিমিষা। বারবারই বলছে দুটো জায়গা মাত্র রেখেছি এবারের প্ল্যানে,ঘুরে চারদিন বাদেই ফিরব। তুমি কিন্তু ঠিক থেকো নাহলে আমি বকুনি খাব।
মণীষা হাসে হঠাৎই একটু জোরে তারপর আরও জোরে এবার হেসে গড়িয়ে পড়ে। অবাক হয় মিমিষা কাকিমাকে কখনও এভাবে হাসতে দেখেনি আর হাসি আর কান্না খুব ছোঁয়াচে সুতরাং পাহাড়ি ঝর্ণার মত হেসে গড়ায় ও নিজেও। ওদের হাসি ছড়িয়ে পড়ে পাশের চা বাগানে। কাঠের বাড়ির টিনের চালে তখন রিমঝিম বৃষ্টি হচ্ছে জলতরঙ্গের মিঠে সুরে।
এখানে মণীষার বাজারে যাওয়া নেই,পাশের হরির দোকান থেকে টুকটাক কেনা নেই। শুভ বাড়িতে থাকলেও অনেক সময়ই নিজেকে বেরোতে হয় টুকটাক আনতে। অবশ্য এটুকু অভ্যেস নিজেকে সচল রাখতেই রেখেছে।
হোমস্টেটা বেশ ভালো,এমন জায়গাতে প্রথমই এসেছে মণীষা। বেশ যেন মনে হচ্ছে একটা বাড়ি বাড়ি ভাব। সময় হলেই দিয়ে যাচ্ছে গরম গরম জলখাবার। দুপুরে ধোঁয়া ওঠা ভাত আর রাতে গরম রুটি। আন্তরিকতা ভরে পরিবেশন করে খাওয়াচ্ছে বাড়ির বৌ অথবা মেয়ে। সবাই মিলে সুন্দর ব্যবসা সামলাচ্ছে হাসিমুখে।
পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙে মণীষার। বাইরে ফিকে আলো ফুটতেই চাদর মুড়ি দিয়ে বাইরে এসে চেয়ারে বসে। পাগলিটা গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। ওর গায়ে কম্বল চাপা দিয়ে আস্তে আস্তে বাইরে এসে কুয়াশার ঘোমটা টানা ভোরে হারিয়ে যায় মণীষা। কখনও কী ভেবেছিল এভাবে কোনদিন একা একা অসমবয়েসী একটা মেয়ের সাথে হঠাৎই বেরিয়ে পড়বে সংসারকে একপাশে ফেলে। অথচ একটা সময়ে সংসারে এতটুকু অনিয়মও বরদাস্ত করেনি কেউ। একটু একটু করে চুরি হয়ে গেছিল সব সময়টুকু। এমনকি মাঝরাতটুকুও বা ভোরবেলাও ছিল...কত কথা মনে পড়ে যায় মণীষার। স্মৃতি বড় নেই আঁকড়ে কিছুতেই যেন পিছু ছাড়তে চায় না। যতই তাকে ভুলতে চাও সে এসে কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে, আমি আছি গো.. আমি থাকব। কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে যাব না। যতই ভুলতে চাও তোমাকে ভুলতে দেব না। পায়ে পায়ে ছোট্ট সিঁড়ির ধাপগুলো পেরিয়ে নীচে নেমে আসে মণীষা। ভোর হওয়ার আনন্দে কত পাখি গাইছে চারদিকে একদম পাশেই চা বাগানের সবুজ গালিচা।
মণীষা গুনগুন করে আজি এ প্রভাতে রবির কর,কেমনে পশিল প্রাণের পর। কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান...
হঠাৎই পিঠের ওপর একটা আলতো স্পর্শে চমকে ওঠে। থেমে যায় গুনগুনিয়ে ওঠা..' ওমা তুই উঠে পড়েছিস! আরেকটু ঘুমোতে পারতিস। সবেই তো ভোর হল।'
-' ঘুম ভেঙে দেখলাম তুমি নেই,তাই খুঁজতে বাইরে এলাম। তারপর দেখি বারান্দা থেকে তুমি এখানে তাই নেমে এলাম। আরেকটু জোরে হোক না..প্লিজ।'
মণীষা লজ্জা পায়,' কী হবে?'
-' তোমার কবিতাটা,মানে যেটা খুব আস্তে আস্তে বলছিলে।'
-' ইশ্ তুই শুনে ফেলেছিস! না রে এমনি মনে পড়ে গেল লাইনগুলো। সেই কবে মুখস্থ করেছিলাম। তারপর একটা সময় পাথর চাপলো শখে। তারপর ধীরে ধীরে সব বন্ধ হয়ে গেল।'
মিমিষা বুঝতে পারে জমে থাকা অভিমানের কথা। তবুও আবার বলে,' যেটুকু মনে আছে সেটুকু। তুমি আবৃত্তি করতে? শিখতে কোথাও? আমি বের করে দেব বাকিটা?'
ওরা হাঁটতে শুরু করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। মণীষা হাসে,' না না তেমন কিছু না। তবে সবাই ভালো বলত। বিয়ে হল কমবয়েসে বাবা সম্বন্ধ দেখতে এলে বলেছিলেন গান তেমন জানে না তবে ভালো আবৃত্তি করে শুনবেন? ওরা মুখ কুঁচকে বলেছিলেন,রান্নাবান্না জানলেই হবে। টুকটাক সেলাই যদি জানে তাহলেই হবে। আমাদের বাড়িতে ঐসবের চর্চা নেই। তাও ভুল করে দুএকদিন করে ফেলাতে বকা খেয়েছি। একটা সময় অনভ্যাসে রুদ্ধ হয়েছে কন্ঠ,জড়তা এসে গেছে।'
মিমিষার হঠাৎই মনে হল সত্যিই বোধহয় জীবন থেকে চুরি হয়ে যায় কতকিছুই। আমরা অজান্তেই কত কিছু চুরি করি আবার চুপচাপ চুরি হতে দেখি।
মিমিষার অনুরোধে পাহাড়ি পথ চলতে চলতে মণীষা আবৃত্তি শুরু করে, ' কন্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে বাঁশী সঙ্গীত হারা..অমাবস্যার কারা।'
হঠাৎই গলাটা কেমন ঝাপসা হয়ে যায়। শিশিরবিন্দুর মত কয়েক ফোঁটা জল গাল বেয়ে ঝরে পড়ে। আর হঠাৎই সেটা বাষ্প হয়ে মিশে যায় কুয়াশাদের দলে। নিজেকে লুকোতে চেষ্টা করে মণীষা। মিমিষা দেখে কিছু বলে না,' আচ্ছা বেশ আর করতে হবে না। চল যাই ওপরে এতক্ষণে হয়ত তোমার পছন্দের দার্জিলিং চায়ের পাতলা লিকার একদম রেডি হয়ে গেছে।'
মণীষা হাসে,' হ্যাঁ হ্যাঁ চল যাই।'
ছেলের ফোন আসে ভিডিও কলে একটু হাল্কা অভিযোগ করে,' খুব ঘুরে বেড়াও দুজনে। এরপর আমিও চলে যাব একা।'
মণীষা ধমকান,' তুই তো একাই ঘুরে বেড়াস,এই তো গেছিস আমাকে ফেলে।'
-' মা আমারটা কাজ,এখানে চা বাগানে ভোরের সূর্য দেখা নেই। আনন্দ করো তোমার ভালো সঙ্গিনী আছে।'
মিমিষা মুখ টিপে হাসে,' হিংসুটে ছেলে।'
মণীষা বলে,' তোর সঙ্গিনী তোরই থাকবে আমি নেব না। ঐ তো জোর করে আমাকে আনলো।'
-' আনন্দ করছ তো? ভালো লাগছে মা?'
মণীষার হাসিটাই হয়ত বলে দেয় অনেক কিছু, শুভায়ুর ভালো লাগে মায়ের চেনা হাসিটা দেখতে। কতদিন পরে এমন হাসিখুশি দেখল মাকে। তারজন্য হয়ত আরেকটু বেশি আদর মিমিষাকে। এমনিতেই অনেকটা বিরহ এই এতদিনের তারপর মহারাণী তো সত্যি রাজ্য জয় করে ফেলেছে।
মিমিষা বলে ফেলতে যায় আজ কাকিমা আবৃত্তি করছিল। তুমি কখনও শুনেছ? তারপরেই নিজেকে সংযত করে। নাহ্ ওর মাথায় তখন কিছু প্ল্যানের আনাগোনা চলছে। দেখা যাক...
ভোরবেলাটা আরেকটু হাসিখুশি হয় ওদের হাসি আর গল্পে। বিকেলে নদীর ধারে গিয়ে বসে ওরা। একটা নানারঙের পতাকা টাঙানো ব্রীজ পেরোলেই নদীটা নামটাও সুন্দর রঙ্গভঙ্গ। সত্যি রঙ্গিলা নদীটা,পাথরের বুকে ধাক্কা দিতে দিতে আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে। মণীষাকে মিমিষা বলে,' খুব কবিতা কবিতা ইচ্ছে করছে। বলি? মানে কাল রাতে একটা লিখেছি সেটা?'
-' হ্যাঁ পড় সেটা, আমিও শুনি।'
মিমিষার চোখে দুষ্টুমি খেলা করে ও কাল রাতের লেখা কবিতাটা পড়ে। হারিয়ে যায় মণীষা কোথায় যেন। তারপর বলে,' কী যে ভালো লাগল নদীর জলের আওয়াজ আর তোর গলার যুগলবন্দী। লেখাটা ছাড়িস না। কাউকে চুরি করতে দিস না স্বপ্নগুলো।'
-' একদম না,আমি তোমার মত বোকা নাকি? একদম ঝগড়া করব..'
মণীষা হাসে,' কার সাথে?'
-' সবার সাথে যারা স্বপ্ন চুরি করবে। এবার একটা অনুরোধ করব রাখবে?'
-' কী?'
-' আমার মানে এই হতভাগ্য পাত্তা না পাওয়া কবির লেখা একটা কবিতা পাঠ করবে?'
মণীষা না করতে পারে না,সকালে যা ছিল জড়তায় অস্পষ্ট। এখন তা অনেক সাবলীল আর সুন্দর।
মিমিষা ফোনের রেকর্ডারটা চালিয়ে দেয়। নদীর জলের পাথরে আছড়ে পড়া আওয়াজের মাঝেই রয়ে যায় মণীষার বলা শব্দগুচ্ছ।
হোয়াটস অ্যাপে রেকর্ডিংটা শুনে অবাক হয়ে যায় শুভায়ু। মা পাঠ করেছে কবিতা? মানে মিমিষার লেখা?
-কতগুলো ভালোবাসা উড়িয়ে দিয়ে বাতাসে বলে,' মা কবিতা মানে আমি ঠিক...তবে খুব সুন্দর সবটা..'
-' সবটা মানে?'
-' তুমি,তোমার ভাবনা আর মায়ের পাঠ। আরও একটা আছে।'
-' কী?'
-' ঐ যে মায়ের চুরি হয়ে যাওয়া কিছুটা সময় ফিরিয়ে দেওয়া। তারজন্য আমি কিন্তু চুরি করে অনেকগুলো চুমু খাবো।'
-' অসভ্য একটা।'
মিমিষার মুখে একটা মিষ্টি হাসি খেলে যায়,সে হাসি কেড়ে নেওয়ার নয় ফিরিয়ে দেওয়ার। হয়ত কিছু পেতে হলে কখনও আগে কিছু ফিরিয়ে দিতেও হয়।
হোমস্টেতে এসে ফোনটা চালিয়ে দেয় মিমিষা। বাথরুম থেকে এসে অবাক হয়ে যায় মণীষা। সেই কবে ছেড়ে দেওয়া আবৃত্তির কন্ঠ আজ নিজের কাছেও বড় অচেনা লাগে। তবে একদমই বুঝতে ভুল হয় না সবটাই মিমিষার দুষ্টুমি। নিজের কন্ঠস্বর শুনতে শুনতে হারিয়ে যায় হঠাৎই দূর থেকে দূরে। কত স্মৃতি আর কথার জাল বুনে চলা মনে পড়ে যায়। একটা সময় যখন শুভর বাবা অসুস্থ তখন পাশের ঘরে টেপরেকর্ডারে বাপের বাড়ি থেকে আনা একটা ক্যাসেট শুনে মনটা একটু ভালো রাখার চেষ্টা করলে এই ঘর থেকে জড়ানো গলায় ডাক ভেসে আসত,' মণি কিসের শব্দ? বন্ধ করে দাও শব্দ আমার ঘুম আসছে না।'
ধরা পড়ে গিয়ে চমকে উঠতেন মণীষা,ইশ্ মানুষটা ঘুমোয়নি তাহলে? ও তো ভেবেছিল ঘুমিয়ে পড়েছে। তাড়াতাড়ি নিজের মানসিক ক্ষতে প্রলেপ দেবার ওষুধটাকে এক কানমলাতে বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এসেছিল অসুস্থ স্বামীর বিছানার পাশে। মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গুমরে বলেছিল.. "ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু। পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু।"
বড় নিষ্ঠুর সেই পথে চলা,একটা অসুস্থ মানুষের সাথে দিনের পর দিন চলতে চলতে একটু একটু করে মরতে শুরু করেছিল মণীষার মন। সারাদিন যেন যন্ত্রের মত চলতে চলতে জীবনটাই হয়ে গেছিল একসময়ে একটা বোবা যন্ত্র। যে যন্ত্র কাজ করত কিন্তু কোন আওয়াজ করত না। আর সতীনাথ চলে যাবার পরেও কোনদিনই অবকাশে লুকিয়ে কবিতার ক্যাসেট চালিয়ে শুনতে ইচ্ছে করেনি। একটা সময় খারাপ হয়ে গেছিল যন্ত্রটাই।
আজ মিমিষা হঠাৎই সবুজের ছোঁয়া দিয়ে মনটাকেই শুধু ভালো করেনি,তারসাথে হঠাৎ ফিরিয়ে দিয়েছে অনেকটা চুরি যাওয়া সময়কে রিওয়াইন্ড করে। নিজেরই অবাক লাগে মণীষার এখনও পারে নাকি সে কবিতা বলতে? মরা সোঁতার মত গলা থেকে এখনও বেরোয় স্বর? সে তো ভেবেছিল কবেই শুকিয়ে গিয়ে মরে গেছে স্বরনদী।
বারান্দায় এসে এককোণে সবুজের দিকে চোখ রেখে মণীষা চুপটি করে দাঁড়ায়। মিমিষা দেখে কিন্তু ডাকে না। বুঝতে পারে মণীষা খুঁজছে প্রাণপণে সেই কবে হারিয়ে ফেলা কবিতার সুরকে হয়ত বা খুঁজছে সামান্য ছন্দপতন অথবা মনে ভাবছে এখনও পারি।
অনেকক্ষণ থেমে গেছে ওদের কবিতা,মিমিষা এসে মণীষার পাশে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রাখে,মণীষা চমকায় না।
-' কেমন লাগছে?'
-' কী?'
-' এই তোমায় আমায় কাটানো কিছুটা সময়। যে সময়টা আমি মোটামুটি ডাকাতি করে এনে তোমাকে দিলাম। আবার শুরু করবে?'
হঠাৎই মণীষা ওকে জড়িয়ে ধরে,চোখ দিয়ে ঝরে পড়ে অনেকটা জল যে জল বহুদিন পাথরে আটকানো ছিল আজ হঠাৎই তা বাঁধনহারা।
-
Comments
Post a Comment