Skip to main content

kashmir trip

ভূস্বর্গ কাশ্মীরের আকর্ষণ বোধহয় অমোঘ তাই কয়েকবার যাওয়া হলেও বারবারই হাতছানি দেয় কাশ্মীর তার সৌন্দর্যের ডালি বাড়িয়ে। তাই দুহাজার পনেরোর পর আবার কাশ্মীরে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে আমরা ব‍্যস্ত হয়ে পড়লাম। দুহাজার এগারোতে গেছিলাম কাশ্মীর বেড়াতে আর একটু মিলিয়ে নিতে যে ছোটবেলায় বাবা মায়ের হাত ধরে যে কাশ্মীর দেখেছি তা এখনও কতটা সুন্দর। ভরিয়ে দিয়েছিল ভূস্বর্গের মনভোলানো সৌন্দর্য্য। দুহাজার পনেরোতে গেছিলাম অমরনাথ যাত্রায় আর তার সাথে ঘুরে এসেছিলাম লেহ এবং লাদাক,অভিভূত হয়েছিলাম আরেকবার। তবে এবার গিয়ে বুঝতে পারলাম এ যাওয়াই শেষ নয় আরেকবার যেতে চাই অপরূপার রূপের সন্ধানে। পরে যদি সত‍্যিই কখনও যেতে পারি তবে চুপিচুপি বলব আবার সে কথা।
  আসলে কাশ্মীরের সাথে আমরা যে জায়গারই তুলনা করি না কেন তা বোধহয় ফিকে পড়ে যায়।কাশ্মীরের রূপ,রঙ আর মোহ বোধহয় সম্পূর্ণ আলাদা। কোন কিছুর সাথেই বোধহয় মেলে না এই রূপের মাধুর্য। গাছে গাছে লাল আপেল ঝুলছে,সবুজ পহেলগাও যাবার পথে বেগুনী রঙের কেশরের ফুল দেখতে দেখতে যাওয়া এই সৌন্দর্য যেমন অতুলনীয়,ঠিক তেমনি অতুলনীয় বরফ বিছানো সাদা পথের পাশে জমে যাওয়া ন‍্যাড়া গাছের সারি দেখা। অথবা ঝুরো বরফ গায়ে মেখে ঘোড়াদের টগবগিয়ে পথ চলা। আর এপ্রিলের রঙীন টিউলিপ সে তো কাশ্মীরকে রূপে অনন‍্যা করে তোলে। তাই এই রূপের হাতছানি বারবারই আকুল করে তোলে অসংখ‍্য পর্যটকের মন।
   পুজোর ছুটির পরেই মোটামুটি শুরু হয়ে যায় শীতে বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা। মালপত্র ঠাসা আমার ছোট্ট আস্তানায় মোটামুটি দুটো ট্রলি এবং একটা কিট ব‍্যাগ রেডিই হয়ে থাকে রেডি স্টেডি গো বলার জন‍্য। ছোট ট্রলি নিয়ে আমার পুত্র বেরিয়ে যায় ইচ্ছে হলেই। আর মাঝারিটা নিয়ে আমরা। এবারও দুজনে যখন গালে হাত দিয়ে ভাবছি কোথায় যাব শীতে তখন ছেলেই বলল চল কাশ্মীরে যাই,তবে ডিসেম্বরে নয় জানুয়ারিতে যাব। সুতরাং ডিসেম্বরে সমুদ্রে দুদিন ঘুরে আসার আগেই মোটামুটি প্ল‍্যানিং শুরু হয়ে গেছিল কাশ্মীরের। আমাদের হাতে সময় কম কারণ প্রত‍্যেকেরই নিজস্ব কাজকর্ম আছে তাই কাশ্মীরে তিনটে রাত কাটাবো এটাই প্ল‍্যান হল। কথায় বলে শখের নাম লাখ টাকা,হয়ত এইক্ষেত্রে সেটাই প্রযোজ্য। জীবনের ছোট্ট খাতার পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে এমন কিছু স্মৃতিকে এভাবেই বোধহয় বন্দি করতে হয়। ছেলে হোটেল বুক করার পুরো দায়িত্ব নেয় ও সাথে থাকলে,সুতরাং এ ব‍্যাপারে আমাদের কোন চিন্তা নেই। কারণ জানি সে অনেকবার দেখেশুনে জায়গাটার মানচিত্র মোটামুটি গুলে খেয়ে সব বুক করে। তাই আমাদের কাজ শুধুমাত্র মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া। অনেকেই হয়ত অবাক হবেন শুনে বাহ্ বেড়াতে যাবে তার আবার মানসিক প্রস্তুতি কিসের?
   সবার না হলেও আমার দরকার ছিল এই কারণে যে আমি খুবই শীতকাতুরে,সুতরাং মনকে সাহসী করে তুলতে হবে আমি সব পারব ভেবে। এই কারণে আমরা বারবারই ইউটিউবে ভিডিও দেখেছি আমাদের হোটেলগুলোর। বারবারই দেখেছি পর্যটকরা কী বলছে? এইসময় কী ধরনের পোশাক পরা দরকার এইসব। যাক ধীরে ধীরে মনকে প্রস্তুত করলাম যে যতই ঠান্ডা হোক কোন সমস‍্যা হবে না। এদিকে যে শুনছে সেই বলছে,এই সময়ে কাশ্মীরে যাবে খুব ঠান্ডা তো...এখানেই তো হাত পা জমে যাবার জোগাড়। ওখানে কত তাপমাত্রা? মুখে শুকনো হাসি এনে বলেছি,হ‍্যাঁ শুনেছি তো মাইনাস থাকবে,মানে রাতের দিকে মাইনাস সেভেন। দেখি কী হয়,ভালো জুতো জ‍্যাকেট সবই কিনেছি। অপরপক্ষ থেকে উত্তর এসেছে হু হু এখানেই কাঁপছি,তারপর আবার টাকা পয়সা খরচ করে ঠান্ডায় জমতে যাওয়া..এত শখ আমাদের নেই বাপু।
    আমার মন চুপিচুপি ফিসফিস করে বলেছিল,আমার শখ আছে বাপু,বহুদিনের স্বপ্ন এমন বরফ পড়ার দৃশ‍্য দেখব। জমাট বরফ তো দেখেছি,কাজার পথে,রোটাং পাসে,নুবরা যাবার পথে এমন কী সুইজারল্যান্ডের মাউন্ট টিটলিসেও। তবে বেশ সারা গায়ে ঝুরো বরফ মাখার ইচ্ছে যে অধরাই রয়ে গেল। ঘরের জানলায় বসে তো দেখাই হল না আমার সামনেই বরফ মেখে একটু একটু করে সাদা হয়ে যাচ্ছে বাড়ি ঘর,ছাদ,গাছপালা সব। মনে অনেক চিন্তা,আচ্ছা সত‍্যি কী এমন দৃশ‍্য দেখা হবে? নাকি ঠান্ডায় জমে রাস্তার পাশে কিছু জমা পুরোনো বরফ দেখেই ফিরতে হবে?
         তারপর ভাবলাম আচ্ছা দেখাই যাক কী হয়। মালপত্র আমরা বেশি কিছু করিনি,কারণ শীতের জায়গাতে নিত‍্যনতুন পোশাক দেখানোর ব‍্যাপার নেই। মোটা জ‍্যাকেট,আর উলিকট সবই গায়ে চাপিয়ে নিয়েছিলাম যাতে ট্রলি হাল্কা থাকে। ইউটিউব দেখে জেনেছিলাম,লেয়ারে লেয়ারে জামাকাপড় পরাই বুদ্ধিমানের কাজ। সুতরাং আমাদের কর্তাগিন্নীর একটা ট্রলি আর ছেলের একটা ট্রলি,এই দুটোই আমাদের লাগেজ ছিল। বড় কিছু চিন্তা করার আগে সবসময়ই বাধা বিপত্তি আসে,এক্ষেত্রেও তার অন‍্যথা হল না। মেয়ের টিকিট কাটা থাকলেও তার কাজের জায়গার চাপের জন‍্য সে কিছুতেই চারটে দিনের অবকাশও বের করতে পারল না। মনখারাপ হল খুব সবারই,কিন্তু কিছুই করার নেই সুতরাং যাবার তিনদিন আগে তার টিকিট ক‍্যানসেল করা হল। মায়ের মন কাঁপলো,হয়ত বা খুব কাঁদলোও। কারণ সবাই আশা করেছিলাম চারজনের একসাথে একটা স্মরণীয় ট্রিপ হবে। সেটা হল না কিছুতেই সম্ভব। তবুও বুক বাঁধলাম,ভাবলাম এখন এভাবেই জীবন চলবে। কারণ ওরাও বড় হয়েছে,ওদের ব‍্যস্ততা বেড়েছে,সুতরাং ওদের বাদ দিয়েও কখনও আমাদের চলতে হবে। ওদের সামনে অনেক সময়,আমাদের সময় কমছে। সুতরাং পরিকল্পনা যেমন আছে তেমনি থাকুক। জীবন এভাবেই আমাদের যে কত পরীক্ষা নেয় তার কোন শেষ নেই।

   দেখতে দেখতে আমাদের যাবার দিন এগিয়ে এলো,আমাদের ফ্লাইট ছিল কলকাতা থেকে দিল্লী, তারপর সেখানে বেশ কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা তারপর দিল্লী থেকে শ্রীনগরের ফ্লাইট। টারমিনালও চেঞ্জ করতে হয়েছিল আমাদের,শুধু লাগেজের ঝামেলাটা করতে হয়নি। ওটা একেবারেই এক ফ্লাইট থেকে অন‍্য ফ্লাইটে চলে গেছিল। দিল্লীর লাউঞ্জে বেশ কিছুক্ষণের অপেক্ষা তারপর শ্রীনগরের ফ্লাইট ধরে আমরা পৌঁছে গেলাম শ্রীনগরে। আবহাওয়ার জন‍্য ফ্লাইট রিসিডিউল হওয়াতে আমাদের শ্রীনগর পৌঁছতে মোটামুটি সাড়ে আটটা হল। দিল্লী লাউঞ্জে আমরা একটু কিছু খেয়ে একদম ফ্রেশ হয়ে এসেছিলাম তাই আর অন‍্য ঝামেলা ছিল না সুতরাং লাগেজ নিয়ে একদম বেরিয়ে এলাম বাইরে। এয়ারপোর্টে নেমেই বুঝেছিলাম বৃষ্টি হয়েছে,ছেলে বলল কাশ্মীরের ওয়েদার খারাপ সেটা কলকাতা থেকেই দেখছি। মনটা একটু ভারী হল শুনে। আমাদের সারথী তার ইনোভা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল,এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই তার সাথে দেখা হল। সুতরাং মালপত্র নিয়ে একদম উঠে বসলাম গাড়িতে। অন‍্য এয়ারপোর্টের মত শ্রীনগর অতটা বড় নয়,অনেকটাই ছোট। আর এখানে কোন ছবি তোলাও নিষেধ,মানে এয়ারপোর্ট অঞ্চলের।

     আমাদের গন্তব‍্য ছিল পহেলগাঁও,সুতরাং রওনা দিলাম সেই উদ্দেশ্যে। শ্রীনগর থেকে মোটামুটি ঘন্টা দুয়েকের মধ‍্যে পহেলগাঁও পৌ়ঁছনো যায় তবে আমাদের সময় লেগেছিল আড়াইঘন্টার কিছু বেশি। গাড়ির উইন্ডস্ক্রীন বেয়ে জলের ধারা পড়ছে,হাল্কা ছিটছিটে বৃষ্টি পড়ছে। আকাশের মুখ গোমড়া,দূরে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে অল্প বরফ,তাতেই মনটা খুশি হচ্ছে কিন্তু তবুও একটু উৎকণ্ঠা গ্ৰাস করছে তেমন বরফ তো কোথাও নেই। তবে কী কাশ্মীরে আসা বৃথাই হল? যদিও ড্রাইভার হেসে হেসে বলছে উধার বহত বরফ মিলেগা। মনে মনে ভাবছি যাক মিললেই ভালো।
    বেশ কিছুটা চলার পর গাড়ি থামল একটা জায়গাতে এই পথে আগে যাওয়ার সময়ও এখানে গাড়ি থামিয়ে আমন্ড,আখরোট এবং কেশর কিনেছি। এবার অবশ‍্য মূল লক্ষ্য ছিল এই ঠান্ডাতে কাওয়া টি খেয়ে শরীরকে চাঙ্গা করা। চা বানানো হচ্ছে তারমধ্যে দোকানে ঢুকে আমন্ড এবং আখরোট কিনলাম। আখরোটটা বেশ ভালো লাগলো তবে আমন্ডের দানা ছোট বলে মনে হল। কাশ্মীরে কতরকমের ফল হয় তা ভাবলেও অবাক লাগে,দোকানে পেস্তা,ব্লুবেরি সবই ছিল। দোকান থেকে বেরিয়েই চুমুক দিলাম চায়ে,মুখ দিয়ে বেরোনো ধোঁয়ার সাথে চায়ের ধোঁয়া মিলেমিশে গেল। বাইরে তখন ঠান্ডা তবে অসহ‍্য কিছু নয়। অসাধারণ লাগল খেতে চা কারণ চায়ের মধ‍্যে কেশর আর ড্রাইফুটসের কুচি দেওয়া। সুতরাং এই চা পান করলে কিছুটা পেটও ভরে যায় শরীর গরম হবার পাশাপাশি।
   চা পান করে বেশ তরতাজা হয়ে আবার গাড়ি চলতে শুরু করল। তৃষিত নয়নে তাকিয়ে আছি পথের দিকে,অপূর্ব তার শোভা। তবে বরফ দেখে মন ভরছে না। হঠাৎই দেখলাম ন‍্যাড়া গাছে প্রচুর আপেল। এক ঝলক দেখেই মনটা খুব খুশি। ড্রাইভারকে বললাম এখনও গাছে আপেল! একটু দাঁড়িয়ে ছবি তুললে হত। ও বলল যে এগুলো সব আটকে রেখেছে ওরা পথিকদের আনন্দ দিতে,হতাশ হলাম শুনে। সুতরাং আবার এগিয়ে যাওয়া আর বেশ কিছুটা যাওয়ার পর দেখলাম হঠাৎই ম‍্যাজিকে আবহাওয়ার পরিবর্তন হল ঝকঝকে সোনালী রোদে ভরে গেল চারদিক। আর তারপরেই চমকে গেলাম দুই পাশের স্বর্গীয় দৃশ‍্য দেখে। সাদা ধবধবে বরফে মোড়ানো পথঘাট আর গাছপালা সব কিছু। এই বরফে কোন মলিনতা নেই, ঠিক যেন ফেনিল শুভ্র আর একদম ঝুরঝুরে। মন ভরে গেল দেখে। গাড়ি এগিয়ে চলেছে যত বরফ তত বাড়তে লাগল। আমাদের ড্রাইভার বেশ সচেতন ভাবে গাড়ি চালাতে লাগল কারণ ওর গাড়িতে চেধ লাগানো ছিল না তাই স্কিড করার সম্ভাবনা থাকে। ঝুরো বরফে কখনও পিছল ভাব থাকে না তবে বরফ যখন শক্ত হয়ে কঠিন কাঁচের মত হয়ে যায় তখন সেখানে খুব সাবধানে পা ফেলতে হয়।
   আমরা তখন শুধু মুগ্ধ আর মুগ্ধ,যা দেখছি তাই ভালো লাগছে। ইচ্ছে করছে সব ভরে নিয়ে যাই মুঠোফোনে। কিন্তু অত কী সম্ভব নাকি? চোখ যত্নে সব ধরে নিয়ে স্মৃতিতে বন্দি করছে। আনন্দে তখন মুখ ভাষা হারিয়েছে,চোখ বিস্ময়ে গিলছে চারপাশের দৃশ‍্য। মন বলছে যা দেখতে এসেছি তা যেন সবই চোখের সামনে। এখানে আসাটা স্বার্থক হল এতদিনে। কত বরফ মোড়ানো পথঘাট দেখেছি,গড়িয়েছি বরফে। তবে এই সৌন্দর্যের কোন তুলনা নেই,এ যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। লিডার নদী বয়ে চলেছে পাশ দিয়ে,তার পাশের বড় বড় পাথর সাদা হয়ে আছে। আকাশের প্রতিফলনে জলের রঙ তখন নীল,সে এক অতুলনীয় দৃশ‍্য। লাদাকের মত এ পাহাড় শূন‍্য নয়,সবুজ গাছ যত্নে আঁকড়ে রয়েছে এই পাহাড়কে। আর গাছে গাছে চকচকে সাদা বরফ। সুতরাং তারা আরও সুন্দরী রূপোলি মুকুট পরে মাথায়।

   একটা ছোট ব্রীজ পেরিয়ে আমরা আবার অন‍্য রাস্তায় উঠলাম,নিরাপত্তারক্ষীরা পাহারায় আছে,তারা জানতে চাইল আমরা কোথায় যাব। হোটেলের নাম বলা হল তাদের। গাড়ি আবার চলতে লাগল। পহেলগাঁও যাবার পথে আমরা অনন্তনাগ এবং পুলওয়ামা দুটো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পার হয়ে এলাম। 
  তাই এই অঞ্চলে পাহারার ব‍্যবস্থায় বেশ কড়াকড়ি। তবে এইসময় অতটা কঠোর কিছু দেখলাম না,অমরনাথ যাত্রার সময় যা দেখেছি তার তুলনায় এ কিছুই নয়।
    ততক্ষণে আমরা প্রায় পহেলগাঁও চলে এসেছি,দেখছি লাইন দিয়ে ঘোড়া চলেছে টুংটাং ঘন্টা বাজিয়ে গলায়। হঠাৎই দেখলাম হাল্কা ঝুর ঝুরে বরফ পড়ছে। অসাধারণ লাগল দৃশ‍্যটা বুঝলাম ঘোড়াগুলো কত কষ্ট করে আমাদের আনন্দ দেয় আর মালিকদের রুজি রোজগারের ব‍্যবস্থা করে। কিছুক্ষণ বাদে আবারছ ঐ ঝুরঝুরে বরফ পড়া বন্ধ হয়ে গেল,রোদ উঠল ঝলমলিয়ে। আর আমরাও ঢুকে পড়লাম পহেলগাঁও, সেদিন রবিবার ছিল তাই দেখলাম বাজারের অনেক দোকান বন্ধ। আর সব দোকানের সামনেই বেশ বরফ পড়েছে। আরেকটু এগোতেই দেখলাম সারি সারি ঘোড়া দাঁড়িয়ে,গাছপালা এবং উপত‍্যকা সবই বরফ মেখেছে। সে এক মনকাড়া সৌন্দর্যের ছটা। পহেলগাঁও আগেও এসেছি তিনবার,তবে আমার কাছে সবুজ পহেলগাঁও অনন‍্য। তার রূপও অসাধারণ। এতদিন সেই ছবি মনে গাঁথা ছিল,এবার দেখলাম আরেক রূপে চেনা জায়গাকে। ছেলে বরাবরই একটু নিভৃতবাস পছন্দ করে,যেখানে হইচই,হাজারো মানুষের ভিড় সেই জায়গা তার ভালো লাগে না। তাই আমরা এগিয়ে চললাম আরও দূরে আর কিছু বাদেই চোখে পড়ল দূর থেকে আমাদের হোটেল। রাস্তা থেকেই দেখলাম হোটেলের সামনে দিয়ে লিডার নদী বয়ে চলেছে,তার চারপাশে জমাট বরফ। বরফ মাখানো চারপাশের মধ‍্যে সুদৃশ‍্য বিদেশীঁ কায়দার কাঠের বাড়ি। আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়াতেই ঘোড়াওয়ালারা এগিয়ে এল,তারা আমাদের আরু ভ‍্যালি ঘুরিয়ে আনতে চায়। আগে গেছি সেখানে তাছাড়া আমরা তখন হোটেলে চেক ইন করব বলে রাজি হলাম না। হোটেল থেকে লোক চলে এল লোহার ব্রীজ পেরিয়ে ওরাই আমাদের মালপত্র নিয়ে যাবে। বাইরে তখন ঝকঝকে রোদ,সাদা বরফে তার বিচ্ছুরণে রীতিমত চোখে লাগছে। ঠান্ডা তেমন কিছুই নেই। আমরা রীতিমত উচ্ছ্বল হয়ে উঠলাম অনেকটা পথযাত্রার পর আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে। তবে সাবধানে পা ফেলতে বলল ওরাই কারণ যেখানেই বরফ জমে কাঁচের মত হয়ে গেছে সেখানেই পা হড়কাতে পারে।
    ব্রীজের ওপরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেললাম আনন্দে,তারপর এগিয়ে চললাম হোটেলের দিকে চারিদিকে শুধু সাদা আর সাদা। মনটা ভেসে গেল এক অনির্বচনীয় আনন্দে। আমাদের ঘর পেতে একটু দেরি হবে তখনও রেডি হয়নি তাই আমরা রিসেপসনে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। দেখলাম সব জায়গাতেই রুম হিটার চলছে। তবে আমরা এমনিতেই তখন উত্তেজনায় উত্তপ্ত তাই ওদের দেওয়া কাওয়া টি খেয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে,বেশ কিছুটা সময় আবার বরফে হুটোপুটি করলাম,ছবি তুললাম। দুজন বাঙালী দম্পতির সাথে দেখা হল তাদের কাছেই শুনলাম যে আমরাই আজ রোদ্দুর এনেছি। গত দুইদিন আবহাওয়া খুবই খারাপ ছিল। মনে হল যাক আজ শুধু আনন্দধারায় অবগাহন করার দিন। অনেকেই রিসেপসনে বসে বাইরের দৃশ‍্য উপভোগ করছেন,আলসে রোদে ভেসে। চারদিকে কাঁচ লাগানো সুতরাং প্রাকৃতিক দৃশ‍্য সুন্দর উপভোগ করা যায় এখানে বসেই। 
বেশ কিছুটা বাদে আমরা ঘর পেলাম,আমাদের হোটেলের নাম হিভান। ছেলে অনলাইনে বুক করেছিল আগে থেকেই। ঘরে ঢুকেও মন জুড়িয়ে গেল,চারদিকে কাঁচ লাগানো,আর বিছানায় শুয়েই উপভোগ করা যায় প্রকৃতির সুন্দর দৃশ‍্য। ওরা সাদা কাশ্মীরী কাজ করা পর্দা তুলে দিয়ে গেছে,নরম রোদে ভেসেছে ঘর আর মনে তখন শুধুই ভালোবাসার চাদর পাতা। প্রিয়জনদের আর মেয়ের সাথে ভিডিও কলে ফোনে কথা বললাম। এখানে ওয়াইফাই আছে তাই অসুবিধা হল না। আমি সত‍্যিই চিন্তায় পড়েছিলাম আমার উপন্যাস নিয়ে,তবে কোন অসুবিধা হয়নি। যখন সুযোগ পেয়েছি পোস্ট দিয়েছি।
    একটু বাদেই দেখলাম জানলাতে এসে গুরুগম্ভীর মুখে বসলেন এক অতিথি তাকে দেখে অবাক হলাম। ওরে বাবা এত ঠান্ডাতে বাঁদর! পরে দেখলাম একটা নয় মোটামুটি একদল বাঁদর ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। আর সুযোগ পেলেই জানলায় বসে আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে গম্ভীর মুখে।
    আমরা চট করে ফ্রেশ হতে শুরু করলাম সবাই কারণ দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। হোটেলে ডিনার এবং ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি ছিল। তাই আমরা লাঞ্চের অর্ডার আগেই দিয়েছিলাম,যথারীতি রোগনজুস সব্জি এবং ডাল ও স‍্যালাড সহযোগে খাওয়া শুরু করলাম। বেশ ক্ষিদে পেয়েছিল তাই অনেকটা খেয়ে ফেললাম। বাইরে বেড়াতে এসে দুপুরে ঘুম আমার একদম না পসন্দ,আরে ঘুমোবো তো একদম রাতে যখন কিছু দেখার থাকবে না। যতক্ষণ দেখার আছে দুচোখ মেলে দেখব। শুধু খুব গরমের জায়গায় এলে দুপুরে বাধ‍্য হয়ে হোটেলের ঘরে থাকতে হয়। সুতরাং খেয়েদেয়ে বেশ অনেকটা সময় জানলায় তাকিয়ে বসে রইলাম। তারপর আবার গরম চা খেয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম প্রাকৃতিক দৃশ‍্য দেখতে। এ দেখা যেন অন্তহীন তাই যতক্ষণ না আলো নিভল ডুবে গেলাম সেই সৌন্দর্যে।
     সন্ধ‍্যের অন্ধকার নামার আগেই হোটেলে আর ব্রীজে জ্বলে উঠল সুন্দর আলোর মালা। বরফের সাদা মাখলো সেই আলোর কিরণ সুতরাং সেই সৌন্দর্য আবার অন‍্যরকম। আমি একটু পা বাড়িয়েছিলাম বাইরেটা দেখতে কিন্তু একটু বেরিয়ে বুঝতে পারলাম বাইরে তখন প্রচন্ড ঠান্ডা। সুতরাং বাধ‍্য বাঙালী আর বেশি সাহসী না হয়ে ঘরে এলাম। জানলা দিয়ে দেখলাম বাইরেটা। ডিনার করতে আমরা নটার পরেই চলে গেলাম,কারণ আর কিছুই করার নেই তাই এবার ক্লান্ত শরীরকে আরামের বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে ঘুমের দেশে ডুবে যাওয়া।
  কমপ্লিমেন্টারি ডিনারে যেমন থাকে ঠিক তেমনি আয়োজন ছিল। ফিসফ্রাই থেকে,পনীর,চিকেন,রুটি,ভাত,পোলাও,ডাল,সব্জি,পাস্তা,স‍্যালাড,ফিরনি সবই ছিল। সুতরাং আয়েশ করে খেয়ে ঘরে ফিরে এলাম। চোখে বরফের রাজ‍্যের স্বপ্ন মেখে তলিয়ে গেলাম ঘুমের দেশে।
   বাইরে বেরোলে আমার ঘুম তাড়াতাড়ি ভাঙে,সুতরাং পরদিনও তাই হল। তবে দেখলাম আমার কর্তা আরও আগে উঠে পড়েছে। বাইরে যদিও তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার,আলোতে যেটুকু দেখা যাচ্ছে সেটুকুতেই বুঝতে পারলাম ঝুরঝুর করে বরফ পড়ছে। একটু আলসেমি নিয়ে গড়িয়ে উঠে,নিজেকে ফ্রেশ করতে গেলাম। আর বেরিয়েই দেখলাম ভোরের আলো ফুটেছে তারমধ‍্যে চলছে অবিরাম ঝুরঝুর করে বরফের বৃষ্টি। আমি তৈরি হয়ে দেখলাম আর ঘরে থাকা যায় না,ছেলে ততক্ষণে বাইরে চলে গেছে। আমিও স্নো ফল গায়ে মাখার লোভ সামলাতে না পেরে খুব সাবধানে বাইরে পা রাখলাম, তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম রেলিংয়ের ধারে। যেখান থেকে দেখা যায় লিডার নদীকে মন ভরে। কিছুক্ষণ সেই দৃশ‍্য উপভোগ করে মাথা গা ঝেড়ে নিয়ে আবার এলাম রিসেপসনে,হিটারে হাত সেঁকে একেবারে চলে এলাম ব্রেকফাস্ট করতে আমরা। কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট সুতরাং সবই সাজানো থরে থরে,ফলের রস, চা কফি,দুধ,কর্ণফ্লেক্স,ব্রেড,অমলেট,উপমা,পোহা,ইডলি,পুরি,মিঠাই সবই আছে। পছন্দসই কিছু খাবার খেয়ে ঘরে এলাম,তুষারপাত তখনও চলছে। গাড়ি রাস্তায় রাখা ছিল,দেখলাম তার ছাদ আর চাকার অর্ধেক ডুবেছে বরফে। ছেলে একটু চিন্তিত হল,যাওয়া ঠিকভাবে হবে কিনা? কারণ সেদিন আমাদের টাঙ্গমার্গ যাবার কথা। ফোন করাতে ড্রাইভার অভয় দিল সে চেন হায়ার করেছে,কিছুটা বাদেই আমরা রওনা দেব।
     মনভোলানো আশ্রয়স্থলকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চললাম টাঙ্গমার্গের দিকে। অভিভূত হলাম আরেকবার প্রকৃতি দেখে। তবে কিছুটা পথ পেরোতেই বিলীন হল তুষারশুভ্র পথ আর গাছপালা। ঐদিকে সাধারণ পথঘাট,রোদ উঠেছে। আমরা এগিয়ে চললাম গাড়ি নিয়ে পথে যেতে যেতে প্রচুর উইলো গাছের কাঠ দেখলাম বাড়ির ছাদে ছাদে আর দেখলাম ব‍্যাটের দোকান। আমার কর্তার ইচ্ছেতে আবার নামলাম কাওয়া টি খেতে আর তারপরে শুরু আবার পথ চলা। টাঙ্গমার্গ যেতে হলে শ্রীনগরকে পেছনে ফেলেই এগিয়ে যেতে হবে সুতরাং আমরাও এগিয়ে চললাম আমাদের গন্তব‍্যের দিকে বাইপাস ধরে।

  শ্রীনগরের যত কাছাকাছি এলাম মন ডুবে গেল নস্টালজিয়ায়,কারণ শ্রীনগরের অনেক রূপ দেখেছি। তবে এবার আমরা ডাল লেককে না ছুঁয়েই ফিরলাম,যদিও ইচ্ছে ছিল আমাদের স্বল্প সময়ে সম্ভব হলে একটু যাব শ্রীনগর। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি ফেরার পথেও। আগেই বলেছি যতই এগোচ্ছি শ্রীনগরের দিকে প্রকৃতির পরিবর্তন চোখে পড়ছে। চারদিকে সবুজ গাছপালা আর ঘরবাড়ি,এছাড়া তেমন কিছুই নেই। কোন কোন বাড়ির ছাদে জমে আছে পুরোনো বরফ। আমরা এগোতে লাগলাম টাঙ্গমার্গের দিকে। টাঙ্গমার্গ শ্রীনগর থেকে ঊনচল্লিশ কিমি দূরে। গুলমার্গ যাবার আগেই টাঙ্গমার্গ মোটামুটি গেটওয়ের মত। আর টাঙ্গমার্গের একটু দূর থেকেই আবার শুরু হয়ে গেল সেই সুন্দর মনভোলানো দৃশ‍্য। সাদা বরফে মোড়ানো পথঘাট চোখকে আবার শান্তি দিল। এইটুকু তো দেখতে এখানে আসা। দেখতে দেখতে আমরা টাঙ্গমার্গ পৌঁছে গেলাম,জানলা খুলেই টের পেলাম বেশ হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। আমরা জ‍্যাকেট খুলে রেখেছিলাম,ভেতরে থ্রী লেয়ার ছিল। এবার সবাই জ‍্যাকেট চাপালাম গায়ে,সাথে পরলাম গ্লাভস এবং টুপি। সেদিন আমাদের টাঙ্গমার্গ থাকার কথা,এই জায়গাতে এর আগে কখনও থাকিনি। গুলমার্গ দেখে ফিরে গেছি শ্রীনগরে,তবে এবার পরিকল্পনা একটু অন‍্যরকম। ছেলে সব পরিকল্পনা সাজিয়েছে,সুতরাং সেদিনটা আমাদের টাঙ্গমার্গে কাটবে। পরেরদিন চলে যাব আমরা গুলমার্গ। আমাদের ড্রাইভার জানাল আমাদের এবার গাড়ি বদল হবে। কারণ আমাদের এই গাড়ি টাঙ্গমার্গের ভেতরে ও গুলমার্গ যাবে না। ও আবার আমাদের গুলমার্গ ঘুরে আসার পর এখান থেকেই তুলে নেবে।
    টাঙ্গমার্গ চারদিকে বরফের পাহাড় ঘেরা সুন্দর উপত‍্যকা। উপত‍্যকার গাছপালা আর বাড়িঘর সবই বরফে জমে গেছে মোটামুটি। সেই দৃশ‍্য অত‍্যন্ত মনোরম। মুঘল আমলে এই জায়গাকে গেটওয়ে অফ গুলমার্গ বলা হত,এখান থেকে গুলমার্গ তেরো কিলোমিটার মত। এই উপত‍্যকাকে ভ‍্যালি অফ পিয়ার ও বলা হয়। এটা বরমুলা জেলায় অবস্থিত। যখন নাসপাতি ফলে তখন এখানে প্রতিটা নাসপাতি গাছে নাসপাতি ঝুলতে দেখা যায় এবং তা অত‍্যন্ত সুস্বাদু।
   আমরা অবশ‍্য এইসময়ে সেই দৃশ‍্য দেখা থেকে বঞ্চিত হলেও অন‍্য দৃশ‍্যে ডুব দিলাম। পাতা ঝরা নাড়া গাছে বরফ জমে থাকার দৃশ‍্য অবর্ণনীয়।

   টাঙ্গমার্গের গাড়ির স্ট‍্যান্ড একদম জমজমাট,চারদিকে প্রচুর গাড়ি তার সাথে আছে স্কুটার বাইক,যেগুলো বরফের ওপর চলে। বেশ অনেকটা চওড়া আর রেসিং কারের মত দেখতে,ড্রাইভার ছাড়া আরও একজন বসতে পারে পেছনে। আমাদের টাঙ্গমার্গ পৌঁছতে পৌঁছতে মোটামুটি তিনটের বেশি বেজে গেছিল। টাঙ্গমার্গ থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে ড্রুঙ্গ ওয়াটার ফলস্,এই ফলস্ প্রাকৃতিক নয়। তাই গরমকালে এর সৌন্দর্যের মহিমা আপনাকে আকর্ষণ করবে না তেমন। তবে শীতকালে ড্রুঙ্গ ফলস্ অসাধারণ দেখতে। কারণ ঝরণার কিছু জল ওপর থেকে ঝরঝরিয়ে পড়লেও,বেশিরভাগ জমে আছে স্ফটিকের মত। ঝকঝকে রূপোলি স্বচ্ছ্ব সেই স্ফটিক দেখার মত। এর সৌন্দর্যের কোন তুলনা নেই।
   যদিও আমাদের হোমস্টেতে লাঞ্চ বলা ছিল তবুও দেখলাম আমাদের পৌঁছতে পৌঁছতে আর লাঞ্চের সময় থাকবে না। সুতরাং এই ফলস দেখেই হোটেলে ঢুকব এটাই ঠিক হল। এই বাইকের ভাড়া যাওয়া আসা নিয়ে দুইহাজার করে নিল। এরা সবসময়ই চড়া দাম বলতে অভ‍্যস্ত,সুতরাং এক্ষেত্রেও আমাদের সেটাই মেনে নিতে হল। আমরা তিনজন তিনটে বাইকে উঠে বসলাম,সামনে চালক বসল। আমাদের মোট দিতে হল ওদের ছয়হাজার টাকা। ঐ যে বলেছি শখের দাম লাখ টাকা,সুতরাং চল কিছু করার নেই। এই বাইকের পেছনে বসাটা বেশ মজার। কারণ বেশ চওড়া পেছনটা,সুতরাং ধরে বসলে ভয়ের তেমন কিছু নেই। গাদাগুচ্ছের জামাকাপড় গায়ে চাপিয়ে মোটামুটি ফুলে কোলাব‍্যাঙ হয়েছি ততক্ষণে। উঠে বসলাম বাইকে,বর আর ছেলে দুজনেই সাবধান করল আমাকে। বাইক চলাতে বুঝতে পারলাম বেশ কনকনে ঠান্ডা চারপাশ, কিন্তু চারপাশের দৃশ‍্য দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। চুপিচুপি একহাতের গ্লাভস খুলে,ফোন বের করে ছবি তুললাম আর ভিডিও করলাম। দেখতে দেখতেই ফলসের কাছে চলে এলাম। একটা ব্রীজ পেরিয়ে আসতে হয় ড্রুঙ্গ ফলসের ওখানে। বেশ কিছুটা আগে থেকেই জলের শব্দ কানে এলো। তারপর তাকিয়ে দেখি মনোমুগ্ধকর দৃশ‍্য। অনেকটা জায়গা জুড়ে ধারালো ফলার মত আকারে গ্লেসিয়ার মত জমে আছে। তখন পড়ন্ত বেলায় সূর্যের আলো ছিল না। তবে আমার মনে হয় সূর্যের আলোর বিচ্ছুরণে এই দৃশ‍্য দেখার মাধুর্য আরও বেশি। এই জায়গায় বেশ অনেক পর্যটকের ভীড়,সবাই স্কুটার বাইকে করেই এসেছে এখানে। তবে অনেক লোক হাঁটার জন‍্য বরফ জমে কাঁচের মত হয়ে পথ ভীষণ পিছল। যে কোন সময় পড়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। ওখানে বেশ কনকনে ঠান্ডা, আমরা সেই ঠান্ডাকে গায়ে মেখেই দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সেই দৃশ‍্য উপভোগ করলাম,ঝরঝর করে জল পড়ার শব্দ কিছুক্ষণ ধরে। তারপর আবার রওনা দিলাম আমাদের পথে যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম।
  এত ঠান্ডাতে পাহাড়ে অজস্র পাখির গান শোনা যাবে আমি ভাবিনি,প্রতিটা গাছে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে মন ভরে গেল। নীচের উপত‍্যকার সৌন্দর্যের হাতছানি বারবার বলে গেল দুচোখ ভরে দেখে নাও আমার অপরূপ রূপ।
            স্কুটার বাইক থেকে নেমেই আমরা পেয়ে গেলাম আমাদের নতুন ড্রাইভারকে,আমাদের জিনিসপত্র আগেই ট্রান্সফার হয়ে গেছিল এক গাড়ি থেকে অন‍্য গাড়িতে। আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের হোমস্টের দিকে। টাঙ্গমার্গের একটু গ্ৰাম‍্য পরিবেশ দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল,চারপাশে বরফের মধ‍্যে বাড়িঘর। দেখে মনে হল সুইজারল্যান্ডের কোন গ্ৰাম দিয়ে চলেছি। তবে বাড়িঘরের দৈন‍্যদশা কোথাও কোথাও নজর কাড়ে,প্রতি বাড়ির সাথেই লাগোয়া বাগান। সম্ভবতঃ সেগুলো নাশপাতি আর আপেল গাছ।
   আমাদের গাড়ি একটা বড় বন্ধ গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো,গ্ৰামের ভেতরেই জায়গাটা। দেখলাম স্থানীয় কিছু মানুষ সামনে দিয়ে চলাফেরা করছে বরফ মাখা পথ দিয়ে। 
    কেয়ারটেকারকে ফোন করাতে ওরা কিছুক্ষণ বাদে এসে গেটটা খুলে দিল। আর গেট খুলতেই একটা স্বপ্নের জগতের দরজা যেন খুলে গেল চোখের সামনে। আমি রীতিমত ওয়াও বলে চিৎকার করে উঠলাম। সত‍্যি কথা বলতে একদম গ্ৰামের মধ‍্যে একটা জং ধরা বিশাল গেটের সামনে গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল তখন ছেলে বলেই ফেলেছিল পহেলগাও তে আরেকদিন থাকলেই ভালো হত মনে হচ্ছে। তবে দরজা খোলার পর মনে হল স্বর্গ এখানেই স্বর্গ এখানেই। পুরো জায়গাটা বরফে মোড়ানো সমুদ্রের মত। এত বরফ এখানে কোথা থেকে এল? অথচ বাইরে তো এত দেখিনি।
   আমাদের গাড়িটা ভেতরে একটু ঢুকেই আর যেতে পারল না,দেখলাম চারদিকে সাদা বরফের মাঝে একটা ছোট্ট ব্রীজ পেরিয়ে আমাদের হোমস্টে। জায়গাটার নাম চীজ কটেজ হোমস্টে। আরও কিছু চমক বাকি ছিল ভেতরে ঢুকে। বাইরের ঠান্ডা থেকে কয়েকটা সিঁড়ি উঠে আমরা ঢুকে পড়লাম একটা ছোট্ট খাট্টো দোতলা বাড়িতে। দরজা খুলে যেখানে আমাদের সাদরে বসতে দেওয়া হল সেটা ওদের ডাইনিং কাম ড্রয়িংরুম আর তার অন্দরসজ্জা নিয়ে কোনও কথা হবে না। তেতরে রুম হিটার চলছে তাই ঠান্ডার কোন অনুভূতি হল না। ওখানেই এক টুকরো ওপেন কিচেন,শেফ ব‍্যস্ত আমাদের খাবার তৈরিতে। যেহেতু তখন বিকেল গড়িয়েছে তাই তাড়াতাড়ি করে আমাদের জন‍্য বানিয়ে দিল গরম গরম পকোড়া,অমলেট আর ব্রেড সাথে একদম গরম গরম চা আর কফি। মানে যে যেমন খেতে চায়।
   আমরা একটু ফ্রেশ হয়ে আগে খেয়ে নিলাম,কারণ সবারই বেশ খিদে পেয়েছে। আমাদের থাকার জায়গা দোতলায়। মানে একদিনের জন‍্য ঐ পুরো বাড়িটা আমাদের আর ওরা আমাদের সেবায় তৎপর সারাক্ষণ। এত সুন্দর করে কথাগুলো বলল যে নিজেদের বেশ রাজা বলে মনে হল। বুঝলাম তালি দিলেই থালি চলে আসবে হাতে। চীজ কটেজ একসময় কাশ্মীরের রাজার ফার্ম হাউস ছিল,এখন চারপাশে যে পাতাহীন গাছগুলো দেখলাম সেগুলো বেশিরভাগই ফলের গাছ। শরত কালে এসে এখানে দেখতে পাবেন আপেল,ন‍্যাসপাতি এবং আখরোটের গাছ।
         কফিতে চুমুক দিতে দিতে জানলা দিয়ে দেখা দৃশ‍্যে মন ভরে গেল। উঠে এলাম ওপরে,সুন্দর ছবির মত সাজানো সব কিছু। ঘরে রুমহিটার এবং আধুনিক বাথরুম সম্পন্ন ঘর। ওপরে দুটো ঘর ছিল,আর দুটোই আমাদের। ওরা এভাবেই এটাকে ভাড়া দেয়,মানে একই পরিবারের লোকেদের জন‍্যই। মোটামুটি ছয়জন থাকতে পারে এখানে। আমরা চারজন যাব বলে দুটো ঘরই নেওয়া হয়েছিল। ওপরের ঘরের বিছানায় শুয়ে দেখা যায় বরফের দৃশ‍্য। আর বারান্দায় এলে দেখা যায় পুরোটা। ঘর থেকে বেরোলেই একটা পুরোনো আমলের টেলিফোনের কাঁচের ঘর রাখা আছে,যা ইংরেজী সংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করছে বলে নজর কাড়ে। ওপরে এবং নীচে অনেক সুন্দর সুন্দর পোট্রেট ও বই আছে। যা মনকে খুশি করে দেবে।
   বাইরে তখন অন্ধকার নেমে আসছে,ওরা সুন্দর আলো জ্বালিয়ে ফেলল চারদিকে। কটেজ থেকে বেরিয়ে পিয়ানো রুম আছে,বাইরে আছে পিয়ানোর স্ট‍্যান্ড। ইচ্ছে করলে সেখানেও বাজনা বাজানো যায়। মনে হয় গরমকালে এখানে গানবাজনার ব‍্যবস্থা করা যায়। তবে এই শীতে চারদিকে শুধু সাদা আর সাদা। আমরা এবার একটু গড়ালাম গরম বিছানায়,প্লাগের সুইচ অন করে সুন্দর ভাবে বিছানা গরম করে নেওয়া যায়।
  ওদের বলেছিলাম সাড়ে নটা নাগাদ খাব। এখানে শুধু ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি। ওদের ননভেজ খাবারের দাম সাতশো এবং এগ ও ভেজ পাঁচশো। তাতে মোটামুটি ডাল,তরকারি,ডিম,মাংস সবই থাকে। আমাদের ওরা পনীর,ডাল,স‍্যালাড,ডিম এবং চিকেন রিস্তা দিল। তার সাথে ভাত আর রুটি ছিল। তবে আমরা অত কিছু খেয়ে উঠতে পারলাম না। কারণ বিকেলের টিফিন খেয়েই আমাদের পেট ভর্তি ছিল।
   ওদের জিজ্ঞেস করে নিলাম তখনই সকালে ব্রেকফাস্টে কী থাকবে? কারণ আমরা ছাড়া ওখানে আর কেউ নেই,আমরা না খেলে খাবার দাবার নষ্ট হবে। ওখানে দুজন স্টাফ রাতে থাকে,একজন রান্না করে আরেকজন কেয়ারটেকার।
    যাক রাতের ডিনার করে আমরা ফিরলাম ঘরে,ওপরে ওঠার সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভেতর থেকে সব লক করে দিলাম কারণ বাইরে বেরোনোর আর প্রশ্ন নেই। গরম বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম আরামে বাইরে তখন শুধু নিস্তব্ধতা। সত‍্যি কথা বলতে আমার মনে একটু শিহরণ হল যখন মনে হল এই দিগন্ত বিস্তৃত বরফের রাজ‍্যে এত বড় বাড়িতে মোটামুটি আমরা একা। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়লাম ক্লান্তিতে,ঘুম ভাঙলো ভোরে। আগেই বলেছি কাশ্মীরে সকাল হয় দেরিতে। তবে আমাদের যেহেতু পরদিনই গুলমার্গ যেতে হবে আর আগে থেকেই গন্ডোলা মানে রোপওয়ের টিকিট কাটা সুতরাং তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।
   জলদি রেডি হয়ে নিলাম,একটু ছবি তুললাম ওখানে। তবে সব জায়গায় এগিয়ে যাওয়া গেল না কারণ ওরা বলল,পাশের দিকে যে জায়গা আছে সেখানে গভীর বরফ। ছোট্ট সাঁকোর তলা দিয়ে একটা জলধারা বয়ে চলেছে। সত‍্যি বলতে প্রেমে পড়ে গেলাম চীজ কটেজের বলতে ইচ্ছে করল তু চীজ বড়ি হ‍্যায় মস্ত। ততক্ষণে ব্রেকফাস্ট রেডি,আমরা চলে এলাম নীচের ড্রয়িং কাম ডাইনিংয়ে। আমাদের হাতও জমে গেছে বরফ নাড়াচাড়া করে। তাই রুমহিটারে হাত সেঁকে খেতে বসলাম। ওরা উপমা,পুরি,ব্রেড,অমলেট,চা সবই দিয়েছিল। সুতরাং খেয়েদেয়ে একেবারে বেরোনোর জন‍্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমাদের পরবর্তী গন্ত‍ব‍্য গুলমার্গ,আগের দিন যে গাড়ি আমাদের এখানে ছেড়ে গেছিল সেই উমর ভাই এসেছে গাড়ি নিয়ে। সুতরাং একরাতের রাজত্ব ছেড়ে অলবিদা বলে রওনা দেওয়া...
চলবে:-

গুলমার্গ

আমরা রওনা দিলাম গুলমার্গের পথে,তবে টাঙ্গমার্গের চীজ কটেজে এবার আর গাড়ি ঢুকলো না। কারণ গতরাতের তুষারপাতে আরও ঢেকেছে পথ তাই ড্রাইভার রাজি হল না গাড়ি ভেতরে নিতে। পথ যদিও খুব সামান‍্য কিন্তু বরফ জমে কাঁচের মত হয়ে গেছে,সুতরাং পা পিছলানোর সম্ভাবনা। তাই আমাদের বেশ সাবধানে ঐ পথটা হেঁটে পার হয়ে গাড়ির কাছে আসতে হল। মালপত্র অবশ‍্য ওরাই বহন করল সুতরাং নিরাপদেই পৌঁছে গেলাম গাড়ির কাছে,পেছনে পড়ে রইল একরাত রাজকীয় আপ‍্যায়নে নিজের বাড়ির মত কাটানোর স্মৃতিটুকু।
   টাঙ্গমার্গ থেকে গুলমার্গের দূরত্ব মোটামুটি ১৩.৬ কিমি। এই পথ পার হতে আধঘণ্টা মত সময় লাগার কথা তবে আমাদের একটু বেশি সময় লাগল যেহেতু পথে বরফ ছিল। চারদিকের নয়ানাভিরাম সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পাহাড়ের পথ বেয়ে উঠতে থাকলাম ওপরের দিকে। এই পথ যেন স্বর্গীয়,যে গাছে কোন পাতা নেই তাতে জমে থাকা বরফের দৃশ‍্যসত‍্যি নয়নাভিরাম,রূপোলি তুলিতে ছবি আঁকা প্রকৃতি কোথাও একটুও মলিনতা নেই। মন চোখ সব জুড়িয়ে গেল,মনে হল সব যদি নিয়ে যেতে পারতাম সাথে মুঠোতে ভরে। তবে স্বর্গকে মুঠোতে ভরব এমন সাধ‍্যি কী আমার? আমি তাই মুঠোফোনে কিছু দৃশ‍্য বন্দি করলাম আর বাকিটা ধরে রাখলাম মন কুঠুরিতে চোখের লেন্স দিয়ে যত্নে ধরে।
   আমাদের গাড়ি কিছুক্ষণ বাদেই চলে এল গুলমার্গে তার আগেই দেখলাম লেখা আছে গুলমার্গ ইজ দ‍্য ভ‍্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স। আমি এর আগেও গুলমার্গ এসেছি,ফুল তেমনভাবে দেখিনি। তবে গুলমার্গ মানে তো ফুল ছড়ানো পথই হয়। যদিও অন‍্যসময়ে দেখা গুলমার্গ আমার কাছে গুলে ভরাই লেগেছে। একবার তো ড্রেস বুট ভাড়া করে রোপওয়ে করে খিলানমার্গে গিয়ে বরফ পাবার আশায় গিয়ে দেখি কিছু নেই। আর সেদিন সেকেন্ড ফেজে যেতে পারলাম না সুতরাং জ‍্যাকেট আর বুট সব নেওয়াই বৃথা। তবে এবারের দেখা গুলমার্গ স্বর্গ। চারদিকে প্রচুর ভিড়,এত বরফেও মানুষের সমাগমের ঘাটতি নেই। প্রতিটা হোটেল ভর্তি,সবাই মোটামুটি পরিবারের সাথে গেছে বরফে আনন্দ করবে বলে। অনেকেই স্কী করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তড়তড়িয়ে নামছে উঠছে। প্রচুর মানুষ মনের আনন্দে উপভোগ করছে সাদা বরফের চাদরে মোড়ানো মসৃণ রূপোলি প্রকৃতিকে প্রাণভরে।
   আমিও অবাক হয়ে দেখলাম আমার ভাবনার গুলে ভরা গুলমার্গ পুরো ভোল পাল্টে ফেলেছে। বুঝলাম কে যে কোন বয়েসে সুন্দরী হবে তা বলা যায় না,একটু মজা করলাম। আসলে আমরা মানুষেরাও কেউ যৌবনে সুন্দর আবার কাউকে ভালো লাগে মাঝবয়েসে আবার কারও শেষবেলার পাকা চুলের সৌন্দর্যের কাছে হার মানে যৌবনের ঔজ্জ্বল্য। গুলমার্গ ঠিক তেমনি, যারা গরমে বা শরতে গুলমার্গ দেখেছেন তারা শীতে এখানে এলে মোহিত হয়ে যাবেন। অপূর্ব সুন্দর তখন এখানকার রূপ।
    আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়ালো গন্ডোলার কাছে,মানে রোপওয়েতে ওঠার জন‍্য এখানেই আমাদের নামতে হবে। অবশ‍্য তার আগে আমাদের মালপত্র নামিয়ে আসা হল হোটেলে। পহেলগাঁওতে আমরা যে হোটেলে উঠেছিলাম সেই হিভানেই এখানেও উঠলাম। তবে পহেলগাঁওয়ের হিভান একটু বেশি জায়গা নিয়ে বানানো,এটা তুলনায় ছোট।

     হোটেলে ওঠার সিঁড়িতে বরফ আর চারদিকেই বরফ। বাইরের আবহাওয়া তখন বেশ রোদ ঝলমলে। আমরা এবার হাতে গ্লাভস পরে নিলাম। ছেলে সাথে বডি ওয়ার্মার নিয়ে গেছিল। বডি ওয়ার্মার একধরনের পাউচের মত,এটা শরীরে পরা জামাকাপড়ের প্রথম লেয়ারের সাথে লাগিয়ে নিলে শরীর গরম থাকে বেশ। এই ধ‍রনের হ‍্যান্ড ওয়ার্মারও পাওয়া যায়,ওগুলো কিউবের মত দেখতে হাত মোজা বা পায়ের মোজার ভেতরে রাখলে হাত পা গরম থাকে। আমি একটু অনিচ্ছুক ছিলাম লাগাতে কিন্তু বরের ধমকে লাগাতে হল। যাক ঠিকই আছে,ঠান্ডা লাগলে আবার মুশকিল আছে। সুতরাং চল একদম অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে।
   রোপওয়েতে ওঠার আগে মোবাইলে টিকিট চেকের সাথে সাথে আইকার্ডও লাগে। আমাদের ড্রাইভার বলল একজন গাইড রাখতে সাথে আমাদের সুবিধা হবে। যদিও জানতাম তেমন কিছু করার নেই গাইডের তবুও নিয়ে নিলাম। একটাই সুবিধা হল সিঁড়িতে ওঠানামা বা পিছল পথে ওঠানামার সময় সে আমাদের সাহায‍্য করল। রোপওয়েতে চড়ার জন‍্য ঢোকার পথে স্থানীয় ব‍্যবসায়ীরা আমাদের জ‍্যাকেট,বুট,চশমা ইত‍্যাদি নেবার জন‍্য খুবই বলল আমাদের ড্রাইভারও বলেছিল সেকথা টাঙ্গমার্গেই। তবে আমরা বলে দিলাম যে আমাদের যা আছে তা যথেষ্ট আমরা ভাড়া নেব না কিছু।
       লাইনে দাঁড়ানোর কিছুটা বাদেই আমাদের জন‍্য নির্ধারিত কেবল কার আসামাত্রই মোটামুটি দোদুল্যমান অবস্থাতেই তাতে চড়ে বসতে হয়। আমাকে নিয়েই ওদের চিন্তা,কারণ আমি ওদের মধ‍্যে নড়বড়ে তাই আগে আমি উঠলাম তারপর ঝপাঝপ ওরা উঠে বসল। রোপওয়ে দড়ির টানে চলতে লাগল। কাঁচের জানলা দিয়ে চারপাশে শুধু তুষারশুভ্র রূপের বাহার দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। নীচে দেখলাম উঁচু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বেশ অনেকেই স্কী করে নামছে। খুব সুন্দর সেই দৃশ‍্য। একটু বাদেই আমরা পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের ওপর খিলানমার্গে। এমনটাই দেখব জানতাম তবে মেলাতে পারলাম না আগের দেখার সাথে এই মনোরম সৌন্দর্যকে। ওপরে তখন প্রচুর ভিড়,সবাই আনন্দ করছে বাচ্চা কাচ্চা আর সঙ্গী নিয়ে। সবাই ফটো তুলছে,কেউ বা আছাড় খাচ্ছে বরফে হাঁটতে গিয়ে। অনভ‍্যস্ত কেউ কেউ স্কী করতে গিয়ে ধপাসও হচ্ছে। আবার অনেকে ঐ কায়দা করে ছবিও তুলছে। ঐ যে আগেই বলেছি শখের দাম লাখ টাকা। আমরাও ছবি তুললাম,আমাদের গাইড আমাদের কিছু ছবি তুলে দিল ওর নাম রাজা। ও আমাদের বেশ কিছুটা দূরে আইস স্কুটারে চড়তে বলছিল বারবারই। ওগুলো চড়তে মোটামুটি দুহাজার টাকা জনপ্রতি লাগে। তবে আমরা তখন অপেক্ষা করছি সেকেন্ড ফেজে যাব বলে। কারণ সেকেন্ড ফেজে এমনিতে সবসময়ই বরফ থাকে আর এখন তো খুব ভালো হবে সেই দৃশ‍্য। তবে কোন অ্যানাউন্সমেন্ট না শুনে ওখানেই একটা জায়াগায় কাওয়া টি খেয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম আইস স্কুটারে চড়ব বলে। প্রচুর স্থানীয় ফেরিওয়ালা সিগারেট,চিপস,চকোলেট বিক্রি করছে ঘুরে ঘুরে। আমাদের গাইড আমাকে হাঁটার ব‍্যাপারে খুবই সাহায্য করছিল। বারবারই বলছিল ঝুরো বরফের ওপর দিয়ে পা ফেলতে তাতে পা হড়কাবার ঝুঁকি কম। তবে বেশে কিছুটা এগোনোর পর দেখলাম মেঘলা হয়ে চারদিক ঢেকে গেল মেঘে। হাওয়া বইতে লাগল। আমরা তাই আর এগোলাম না কারণ যদি কোন কারণে বৃষ্টি নামে তাহলে আর দুর্গতির সীমা থাকবে না। কারণ রোদ ঝলমলে দিন বলে আমাদের ছাতা আর রেনকোট সবই হোটেলে রাখা। 
সুতরাং ঠিক হল আমরা ফিরে আসব,আর যাব না। একটু অপেক্ষা করব যদি সেকেন্ড ফেজ চালু হয়। আর না হলে ফিরতি কেবল কারে করে নেমে আসব। আবহাওয়া দেখে বুঝলাম আর খুলবে না সেকেন্ড ফেজ সুতরাং এবার আবার ফেরার পালা সেই একই ভাবে। নামার পথের শোভা একই রকম স্বর্গীয়, আপন খেয়ালে স্কী করে যাচ্ছে অনেকেই। মনে হল যদি আমিও পারতাম এমন তরতরিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে যেতে। দেখতে দেখতেই চলে এলাম আমরা গুলমার্গ। সাবধানে নেমে আসতে হল কারণ ওগুলো চলন্ত অবস্থায় থাকে মোটামুটি।
   গাইড আমাদের গাইড করে বরফ বিছোনো পথ বেয়ে একদম নিয়ে চলে এল বাইরে। বাইরে তখন অনেক গাড়ি আর মানুষজনের ভীড়। একটু বাদেই আমাদের গাড়ি এল তারপর গাড়িতে উঠে চললাম একদম হোটেলের দিকে। হোটেলের ঘর রেডিই ছিল তাই একেবারে চলে এলাম ঘরে। এই হিভানের ঘর গুলমার্গের ঘরের চেয়ে বেশ ছোট যদিও এটা স‍্যুইটই ছিল তবুও একটু কম জায়গা আমার মনে হল। বিছানায় শুয়ে দেখা যায় বাইরের প্রকৃতি মন ভরে। বাইরে শুধু তখন তুষারমাখা সাদা প্রকৃতির মনোরম শোভা। তবে এখানেও পহেলগাঁওর মতই বাঁদরের উৎপাত আছে। তারা মাঝে মাঝেই উঁকি মারছে জানলায় এসে। আমরা টাঙ্গমার্গ থেকে স্নান করে এসেছিলাম সুতরাং সেই ঝামেলা ছিল না। ঘরে এসে একটু চা কফি খেয়ে নিজেদের তরতাজা করে নিলাম। ফোনে লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে দেওয়া হল। ডিনার এবং ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারি ছিল।

      বেশ কিছুটা বাদে ওরা ফোন করল খাওয়ার রেডি,জানলার ধারে বসে প্রাকৃতিক দৃশ‍্য দেখতে দেখতে খাওয়ার যে কী মজা তা বলে বোঝানো যাবে না। সত‍্যি কথা বলতে খাব কী মন ভরে গেল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। এখানে সত‍্যি কথা বলতে আমাদের কিছু করার ছিল না,আমরা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দৃশ‍্য উপভোগ করব বলে এখানেই এসেছি। বিকেলের আগেই শুরু হয়ে গেল স্নো ফল। সমানে ঝুর ঝুর করে বরফ পড়ে যাচ্ছে। বাইরে বেরোলেই নিমেষে জ‍্যাকেটে আর মাথায় ঝুরো বরফ পড়ে সাদা হয়ে যাচ্ছে। আবার ঝেড়ে নিলেই তা পড়ে যাচ্ছে। আমাদের ঘর ছিল দোতলায় সেখান থেকে নেমে আমরা নীচতলায় এসে বসে থাকতাম হল ঘরে। সেখানে রকিং চেয়ারে অথবা দোলনায় বসে প্রকৃতি দেখতে আরও ভালো লাগছিল। সামনে,পেছনে চারদিকে বরফ আর লম্বা লম্বা গাছ। তারমধ‍্যে হঠাৎই দেখি একজন মানুষ স্কী করতে করতে হঠাৎই বেশ কিছুটা ওপরে উঠে বরফের মধ‍্যে শুয়ে পড়ল। অনেকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে বরফে,আমি তো তাকিয়েই আছি ভাবছি কী জানি শরীর খারাপ হল নাকি? তারপর দেখি সে উঠে কিছু বাদে তরতরিয়ে নীচে নামল তারপর আবার ওখানে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেয়ে বরফে শুয়ে পড়ল। তারপর আবার কিছুটা বাদে উঠে,ওপরে উঠলো। আমি অবাক চোখে ওর কান্ডকারখানা দেখছি। আমার কর্তা বললেন ও নাকি স্কী করার পথ বানাচ্ছে। আমি অবাক হলাম শুনে এই নির্জন পাহাড়ে গাছের মাঝখানে কী করছে কে জানে লোকটা?
   ধীরে ধীরে অন্ধকার নামলো,লাইট জ্বলে উঠলো আর তাতেই দেখলাম তখনও পালকের মত ঝুরো বরফ পড়ছে। ঘরে রুমহিটার চলছে,বেশ আরামদায়ক ঘর। যথারীতি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গল্পে মাতলাম আমরা। তার সাথে ছবি দেখা তো ছিলই। পরের দিন আমাদের চলে যাবার কথা,সেদিনই আমাদের ফ্লাইট। গুলমার্গ থেকে শ্রীনগর যেতে খুব একটা সময় লাগবে না,বড়জোর দুই থেকে আড়াইঘন্টা মানে বরফ চারদিকে তাই। আমরা ঠিক করলাম দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ বেরোব।
      রাতের ডিনার বেশ ভালো ছিল,মোটামুটি এক ধরনের খাবার। তবে পহেলগাঁও হিভান সব দিক দিয়েই একটু এগিয়ে। রাতের খাবার খেয়ে আমরা ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। বাইরের আলোতে বুঝতে পারলাম সমানে তুষারপাত হয়ে চলেছে।
    সকালে ঘুম ভাঙলো বেশ তাড়াতাড়ি, অবাক হয়ে দেখলাম সামনের জায়গাগুলো উচ্চতায় দ্বিগুণ হয়েছে বরফে। হোটেলে ঢোকার পথেও প্রচুর বরফ। তারমধ্যে অনেক কর্মচারী সমানে বাইরে থেকে মালপত্র নিয়ে ঢুকছে। সকালের দৃশ‍্য উপভোগ করতে আমিও নামলাম নীচে তবে আজকের তুষারপাত গতকালের থেকে বেশ বেশী।
    ছেলের মনখারাপ হল,বারবারই বলল এত তুষারপাতে পথই হয়ত বন্ধ হয়ে যাবে। তখন যে কিভাবে যাব সেটাই চিন্তা। সেই চিন্তাকে একপাশে ফেলে তৈরি হয়ে নিলাম তিনজনে। তারপর সোজা চলে গেলাম ব্রেকফাস্টে। যেমন থাকে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট তেমন সবই ছিল। সুতরাং ইচ্ছেমত খেয়ে চলে এলাম ঘরে। তারপর একটু নামলাম নীচে,আমি আর ছেলেতে মিলে কিছু ছবি তুললাম। তাতেই দুজনেই মোটামুটি বরফ জড়ানো হয়ে ফিরলাম। তারপর মাথা ভালো করে ঝেড়ে নিলাম। তাতেই আর বিশেষ কোন অসুবিধা হল না।
   দেখতে দেখতে যাবার সময় এগিয়ে এল,প্রকৃতির মুখ তখনও ভার আর সমানে তুষারপাতে পথঘাট ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। ড্রাইভার ফোন ধরল কিন্তু সে জানালো যে সে গন্ডোলার কাছে ফেঁসে আছে তাই পৌঁছতে আধঘণ্টা আবার একঘন্টাও লাগতে পারে।
   ছেলে রাগ করল,তবে আমি বুঝলাম এত বরফ কেটে গাড়ির ওপরে উঠে আসা সম্ভব নয়।
   হোটেলের লোকেরাও একই কথা বলল,ওরাই আশ্বাস দিল যে গন্ডোলা পর্যন্ত আমাদের মালপত্র এবং আমাদের পৌঁছে দেবে।
    গুলমার্গের হোটেলকে টা টা করে আমরা এগোলাম খুব সাবধানে পা ফেলে সামনের দিকে। ঝুরো বরফে পা রাখতে বলল ওরা বারবার। আমাদের সাথে বহু লোক হাঁটছে কেউ বা স্কী করছে আবার কেউ টানা গাড়িতে বসে গড়গড়িয়ে চলছে। আমরাও ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে এসে পড়লাম গাড়ির কাছে। আমাদের ছিল স্করপিও। তবে ওখানে দেখলাম গাড়ির ছড়াছড়ি। অনেক কষ্টে গাড়িকে উঠানো হল তারপর গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে জয় মা বলে যাত্রা শুরু।
      ফেরার পথে আর পলক ফেলা যায় না। চারদিক তখন আরও সুন্দর আর সাদা। তারমধ‍্যে দিয়ে গাড়ি এগোতে লাগল। প্রতিটা দৃশ‍্য অসাধারণ,যেন কথা বলছে রূপে শ্রেষ্ঠ ভূস্বর্গের অসাধারণ পটচিত্র। তবে এখানে রঙের তেমন কোন বৈচিত্র্য নেই।
    আমরা এগিয়ে চলেছি শ্রীনগরের দিকে। পথে টাঙ্গমার্গ পড়লো সেখানেও একই চিত্র। আর বৃষ্টির থামার  কোন লক্ষণ নেই। পথেই ঠিক করা হয়েছিল আমরা আর শ্রীনগর যাব না। এবারের মত অধরাই রয়ে গেল শ্রীনগর,কারণ পরের দিন ছিল ছাব্বিশে জানুয়ারি। তাই শ্রীনগরের এয়ারপোর্টে চলে এলাম।
  যদিও ছেলের মন খারাপ হল কারণ তার মুঘল দরবারে খাওয়া হল না। তবু কিছু করার নেই সুতরাং শুরু অপেক্ষা বাড়ি ফেরার...
সমাপ্ত:;
      

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...