Skip to main content

মন চুরি

'মা আমি প্রেম করে নিজে কিছু সিলেক্ট করিনি বলে তোমাদের ইচ্ছেমত হাসি হাসি মুখ করে লক্ষ্মীসোনা সেজে অপরিচিত লোকদের সামনে বসতে পারব না কিন্তু। তার থেকে চল আমরা বরং আগে ছেলে দেখে আসি।'
     -' তোর মাথাটা গেছে একেবারে,এই তো বললি বিয়ে করবি তাই তো আমরা ছেলে দেখলাম। মানে তুই তো কয়েকটা বেছে বললি এগুলো চলতে পারে।'
-' হ‍্যাঁ বলেছিলাম,দেখলাম তো আর দশটা মত ছেলেকে ঠিকঠাক মনে হল। দশদিন মানে এক একটা উইকএন্ডে এক এক বাড়িতে যাব তারপর একটা সিলেক্ট করে নেব যেটা পছন্দ হবে। প্রথমে ফোনে কথা বলব,তারপর ডেটে যাব তারপর বিয়ে।'

   মেয়ের কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসেন ওর মা তনিমা,' আরে তুই কী যাবি ছেলে দেখতে? ওনারাই তো আসবেন তোকে দেখতে। তারপর পছন্দ হলে তখন...'
-' মানে? আমাকে গিয়ে যেখানে থাকতে হবে সেটা আমার থাকার মত কিনা তা আমি আগে দেখব না?'
-' না বেবি,এই সিস্টেম এখনও খুব একটা চালু হয়নি। তাই তুমি দয়া করে দশটাকে চারটে কর আবার একটু বাছাই করে,তারপর দেখা যাবে..'
-' বা রে যে এসে আমাদের বাড়িঘর দেখবে,সে তো এখানে থাকবেই না। অবশ‍্য আমি আনব ঠিক জোর করে প্রতি সপ্তাহে। তার এত দেখার কী আছে?
-' উঃ তুই যা তো মা,আমার মাংস কষানো হয়ে গেছে জল দিতে হবে।'
-' মা ওটা বাবাকে করতে দাও,শুধু বসে বসে খেলে হবে? তুমি আমার কাছে বোসো,সারাদিন তো তোমার কাজ। এসো একটু বিয়ের গল্প করি।'
   তনিমা বোঝেন ঝিনুকের মনে রঙ লেগেছে,বিয়ের গল্প,মজা,আড্ডা এইগুলো খুব এনজয় করছে। এতদিন তো মেয়েকে রাজিই করানো যায়নি। এই নিয়ে ওর বাবার কাছেও বকুনি খেয়েছেন, ওর বক্তব‍্য মেয়ের বন্ধু হতে পারনি,নিশ্চয় কারও সাথে অ্যাফেয়ার্স আছে?
  যাক তবুও অনেক কষ্টে সে হ‍্যাঁ করেছে,কিন্তু সবটাতেই এখন একটাই কথা ছেলে মেয়ে দুজনের এত আলাদা নিয়ম কেন?
   এখন আবার জেদ ধরেছে পাত্রী সেজে বসবে না। উঃ এতো মহা মুশকিল, বিয়েটা কী করে হবে কে জানে?
   কিছুক্ষণ বাদে ফোনটা বাজে,তনিমা তাকিয়ে দেখেন অসিত ওকে ইশারা করছেন ফোনটা ধরতে। এই এক হয়েছে,ঘরে থাকলেও ফোন ধরতে চায় না।
    ফোন ধরে তনিমা,তারপর গলাটাকে মোলায়েম করে কথা বলতে শুরু করে। পাশের ঘর থেকে চিৎকার ভাসে,' বাবা আমাকে দু পিস মাংস দিয়ে যাও না..'
  তনিমা ফোনটা ডানহাতে চেপে অসিতকে ইশারা করেন মেয়েকে চুপ করতে বলতে। বেশ কিছুটা টানা কথার পর তনিমা ফোনটা রেখে সোফায় বসে পড়ে। ততক্ষণে ওরা বাবা আর মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে,দুজনের চোখেই প্রশ্ন কার ফোন?
-' আরে তুই সেদিন যেখানে মেইল করলি না ওরা ফোন করেছে।'
-' আরে কারা বলবে তো?'
-' ওহ্ সেই যে ফুলবাগানে যে ছেলে থাকে,আরে তুই বললি না দেখে হ‍্যান্ডসাম লাগছে,সেই বাড়ি থেকে।'
-' কী বলল?'
-' ওরা একদিন আসতে চায়।'
-' আমাকে দেখতে নিশ্চয়..বললে না কেন যে আমি গিয়ে দেখা দিয়ে আসব।'
 -' তুই চুপ কর,তোকে শুধু দেখবে কেন? আমরাও তো আলাপ পরিচয় করব নাকি? বিয়ে মানে কী শুধু দুটো মানুষের একসাথে থাকা নাকি? আরে সবার সাথে সবার আলাপ হওয়াও তো জরুরী।'
-' তুমি কী আসতে বলে দিয়েছো?'
-' না তা আর বললাম কোথায়? বললাম জানাবো একটু কথা বলে,কারণ মেয়ে তো সবদিন থাকে না বাড়িতে...তুই ভেবে বল কবে আসতে বলব? আর তোর যদি আপত্তি থাকে তবে আমরা কোন জায়গাতে মানে ক‍্যাফেতেও দেখা করতে পারি। আমি বলেছি সে কথা। ওদেরও খুব একটা আপত্তি নেই দেখলাম। কথা শুনে ভালোই লাগল।'
-' উফফ্ একজন ফোন করতেই তোমার ভালোলাগা শুরু হয়ে গেল। একটা ছেলে কত মেয়ে দেখে একজনকে পছন্দ করে জানো? আমার কিছুই মনে হচ্ছে হবে না তোমাদের জন‍্য।'
   ওদের মা মেয়ের কথা শুনে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন না অসিত। এই সংসারে তনিমা আর মেয়ের ওপর তিনি তেমন কিছু না বললেও,মেয়েটার পাগলামি যেন বেড়ে চলেছে দিন দিন। এসব কী বলছে? ছেলে দেখতে আসে মেয়েকে এমন ঘটনা তো সেই কবে থেকে চলে আসছে,মনে করার চেষ্টা করেন তাঁর ঠাকুমা বা তার শাশুড়ির আগেরও আমল থেকে। হঠাৎই এইসব কী পাগলামি শুরু করেছে ঝিনুক? ওর বুদ্ধিতে এখন ওরা তিনজনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছেলে দেখে বেড়াবে! কোথায় যেন একটা ঘা লাগে তাঁর আত্মসম্মানে। অপরিচিত বাড়িতে মেয়েকে নিয়ে ঢুকবেন তারপর কী হবে কে জানে?
-' শোন ঝিনুক তোর এইসব পাগলামি এবার বন্ধ কর,আমার ভালো লাগছে না একটুও। এভাবে কী তুই নিয়মগুলো বদলাতে পারবি? তাছাড়া অপরিচিত বাড়িতে তোকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো আমি? অসম্ভব..'
-' ওরা যদি অপরিচিত বাড়িতে আসতে পারে তো আমরা গেলে ক্ষতি কী?'
-' ক্ষতি আবার কী আমরা অভ‍্যস্ত হয়ে গেছি এই নিয়মে। মেয়েরা ঘরের লক্ষ্মী,সে গেছো সর্দার হয়ে যাবে ছেলে দেখতে? তনিমা তুমি বোঝাও মেয়েকে। আমি এসবের মধ‍্যে নেই।'

******************
 বাড়িতে এই নিয়ে ছোটোখাটো অশান্তি হয়ে গেল,অসিত খুব বকলেন ওদের দুজনকেই। তনিমা রাগ করে রাতে খেলেন না। মেয়েকে বললেন,' তোর বিয়ে না করাই ভালো, এত হিসেব করে কোথাও মানিয়ে নিতে পারবি না।'
    রাত বাড়ে ঝিনুকের ঘুম আসে না,বুঝতে পারে না নিয়মের উল্টোদিকে হাঁটলে মুশকিল কোথায়? মা কেন বলবে না পাত্রপক্ষকে যে ওদের আসতে হবে না কষ্ট করে। আসলে মেয়েকেই যখন ঐ বাড়ি গিয়ে থাকতে হবে তখন সে আগে দেখুক। 
     একটা সময় চোখ জুড়িয়ে আসে,ভাবে ধ‍্যাৎ ছেলে মেয়ে নাকি সমান সমান। তাহলে এখনও মেয়েদের অন‍্যের বাড়ি চলে যেতে হয় কেন? বিয়ে হয়ে গেলেই বাবা মা পর হয়ে যায়,হাজারটা বিধিনিষেধ আসে শ্বশুরবাড়ির থেকে...তার থেকে বিয়ে না করাই ভালো।

     পরদিনও বাড়িতে মেঘলা আকাশ,মায়ের মুখ থমথমে বাবা একদম চুপচাপ। ঝিনুক অফিসে বেরিয়ে পড়ে। স্কুটিতে বসে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখে মা দাঁড়িয়ে বারান্দায়,তবে আজ হাসিটা মিসিং। বাড়ির মেঘলা ওয়েদার কাটিয়ে রোদ ঝলমলে পথে পা রাখে ঝিনুক। একটু তাড়াতাড়ি অফিসে পৌঁছনোর জন‍্য,কলকাতা স্টেশনের পাশ দিয়ে এসে একেবারে সল্টলেকের রাস্তায় পড়ে। সল্টলেকের এই দিকটা ওর খুব প্রিয় বেশ ফাঁকা ফাঁকা,হঠাৎই ওর মনটাও মেঘ কাটিয়ে খুশি হয়ে ওঠে। একটু অন‍্যমনস্কও হয়ে যায় তারপরেই বিপদ একদম একটা গাড়ির সামনে এসে আর তাল রাখতে পারে না। একদম স্কুটি নিয়ে উল্টে পড়ে,তেমন কিছু লাগেনি তবে উঠতে একটু সময় লাগে। ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে এসেছেন এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা। মহিলা তো ড্রাইভারকে প্রচন্ড বকছেন,' কী করিস বলতো? মেয়েটাকে দিলি তো ধাক্কা দিয়ে। না না এ কী কান্ড! আহা রে বাচ্চা মেয়েটা।' এবার হাসি পেয়ে যায় ঝিনুকের ও মোটেই বাচ্চা মেয়ে নয়,সাতাশ পেরিয়েছে তারপর চাকরি করে।
    ততক্ষণে ভদ্রলোক আর ড্রাইভার দুজনে এগিয়ে এসে ওর স্কুটিকে ধরেছেন। ভদ্রমহিলা সাঙ্ঘাতিক ব‍্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারপরই আঁতকে ওঠেন,' ওমা,তোমার কনুইটা তো ছড়ে গেছে! ইশ্ না না একটু ফার্স্ট এড করতেই হবে।'
  অস্বস্তি হয় ঝিনুকের দোষ তো ওরই ছিলো,অথচ ওঁরা এমন করছেন যে সব দোষ ওদের। আসলে ভীতু বাঙালী, ঝামেলার ভয় পাচ্ছে। তাই নিজেই সামলাতে যায়,' আন্টি আমি ঠিক আছি,আমি অন‍্যমনস্ক ছিলাম। ড্রাইভারের দোষ নেই কোন। বরং উনি ব্রেক কষাতে আমি বেঁচে গেছি। আমি অফিসে গিয়ে একটু কিছু লাগিয়ে নেব।'
-' ওমা তুমি আবার চাকরিও কর নাকি? আমি তো ভাবছিলাম কলেজে পড়।'
   ওহ্ এই বাঙালীর স্বভাব,সবাইকে বাচ্চা বানিয়ে রাখতে চায়। তবে ঝিনুকের মুক্তি মিলল না,ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোক জোর করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন,ওদের বাড়ি রাস্তার উল্টোদিকেই। স্বামী স্ত্রী নাকি বাজার করে ফিরছিলেন। ভদ্রলোক ডাক্তার সুতরাং ফার্স্ট এড তিনি না করেই ছাড়বেন না। অগত‍্যা ও অফিসে ফোন করে একটু আসতে দেরি হবে বলে। 
     বাড়িটা সুন্দর ছিমছাম,ও দেখলো দুজনেই সমান তৎপর। ভদ্রলোক বাবলি বলে অস্থির। মুহূর্তে বাবলি সব এনে হাতের কাছে রাখলেন,তার সাথে ঝিনুকের জন‍্য এক গ্লাস ফলের রস। ও আপত্তি করলেও কিছুতেই শুনলেন না,নিজে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়ালেন। ততক্ষণে ভদ্রলোক দক্ষ হাতে একটু ড্রেসিং করে,ব‍্যথার ওষুধ দিয়ে দিলেন। বললেন যদি পরে ব‍্যথা হয় তবে খেতে। দুজনেই খুব কথা বলেন, ঐটুকু সময়ের মধ‍্যে ঝিনুকের সাথে অনেক গল্প করলেন। ঝিনুক দেখল তারমধ‍্যেই ভদ্রলোক মনে করিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলার প্রেসারের ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে। ভদ্রমহিলা ভদ্রলোককে চট করে এক কাপ চা এনে দিয়ে বললেন,' অনেকক্ষণ আগেই বলেছিল চা খাবে। নাও এটা খেয়ে নাও..'
     ওর বাবা মায়ের সাথে অনেকটা অমিল দেখল এই বাড়িতে। ওদের বাড়িতে মা স্ত্রীলোক আর বাবা পুরুষ,মা বাবাকে কখনও ভয় পায়। আবার কখনও ঝগড়া করে। অথচ এদের সম্পর্ক বেশ বন্ধুত্বের,দুজনে কী সুন্দর নিজেদের ছোটছোট দরকারগুলোর খেয়াল রেখেছেন। একজন চা দিচ্ছেন তো আরেকজন কৌটো থেকে বিস্কিট বের করে ওটা খেয়ে ওষুধ খেতে বলছেন।
         ঝিনুক ওদের হাত নেড়ে স্কুটিতে স্টার্ট দিতে যায় হঠাৎই ভদ্রমহিলা বলেন,' ওমা আমাদের ক্ষণিকের অতিথির তো ফোন নংটাই নেওয়া হল না।'
-' আপনি সুন্দর কথা বলেন তো..আর আপনাদের বাড়িটাও খুব সুন্দর।'
 হাসেন ওঁরা তারপর বলেন,
'একদিন অবশ্যই এসো আবার মা বাবাকে নিয়ে,আমি ফোন করব।'
 ঝিনুকের মুখ থেকে হঠাৎই বেরিয়ে যায়,' কেন?'
 -' ওমা খবর নেব না তোমার কেমন আছো? দেখেছো আমাদের কিন্তু বলছে না ওদের বাড়ি যেতে।'
  লজ্জা পায় ঝিনুক, এইজন‍্যই মা বলে যে কথাবার্তা কিছু শিখলি না। তারপর বলে,' হ‍্যাঁ নিশ্চয় আসবেন।'
 ভদ্রলোক বলেন,' কিন্তু কোথায়?'
 -' আমি ঠিকানা দিয়ে দেব।'
  গেটের বাইরে শিমূল গাছটা লাল ফুল দুলিয়ে হাসছে,হাসে ঝিনুকও তারপর অফিসের দিকে যায়। ওহ্ আজ কিছু একটা দিন গেল। মাকে আজ বলবে যে মায়ের হাসিমুখ দেখে আসেনি বলে এত কিছু হল।
   তারপর নিজেই ভাবে,অনেক কিছু হতে পারত হয়নি। তবে দুজন নতুন মানুষের বন্ধুত্ব বেশ দেখল,স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে কী সুন্দর সুইট কেমিস্ট্রি।
          মনটা উড়ে যায় ঝিনুকের হঠাৎই এলোমেলো হয়ে,যারা ফোন করেছিলেন গতকাল কে জানে কেমন হবে সেই ছেলে? নাহ্ মাকে বলতে হবে একদিন বাইরে কোথাও দেখা করার ব‍্যবস্থা করতে।
    হাতটা নাড়তে গিয়ে দেখে একটু ব‍্যথা হয়েছে,ঠিক করে কিছু খেয়ে একটা ওষুধ খেয়ে নেবে। হঠাৎই ক্ষণিকের অতিথি কথাটা মনে পড়ে যায় আবার।

     বাড়িতে এসে মাকে কথাটা বলতেই মা লাফালাফি শুরু করে,' কতবার বলেছি ঐসব চালাতে হবে না, বাসে করে যা। তা এই মেয়ে শুনলে তো..আমার বাবা হাত পা ভাঙার ভয়ে সাইকেলেও চড়তে দেয়নি। ভাগ‍্যিস ওরা ছিলেন,উঃ কী যে হত?'
     -' কিছু হয়নি মা,ভবিষ‍্যতেও হবে না। একটা ছোট ঘটনার জন‍্য আমি তো গাড়ি চালানো বন্ধ করব না। যেমন তুমি বাবার আর আমার ওপর রাগ ঝাল করে বল বিয়ে হয়ে তোমার জীবন নষ্ট হয়ে গেল। আবার আমাকেও বিয়ে দিতে চাও। একমাত্র মেয়ের জীবন কেউ নষ্ট করে?
ওদের কথার মাঝে ফোন বেজে ওঠে,ট্রু কলারে দেখে বেবি সোনা। এ আবার কে বাবা? ইতস্ততঃ করে ফোনটা ধরেই বুঝতে পারে সকালের আন্টি। হাসে ঝিনুক,বলে বেবিসোনা দেখে অবাক হয়েছিলাম প্রথমে।
   -'ওপার থেকে হাসি ভেসে আসে,আর বোল না। তোমার আঙ্কেলের আদরে ডাকা নাম। তুমি কেমন আছো বল এখন?'
 -' আমার তো কিছুই হয়নি,এখন ভালো আছি একদম। থ‍্যাঙ্ক ইউ আন্টি..'
-' কেন হঠাৎ থ‍্যাঙ্কস?'
-' সেদিনের জন‍্য।'
-' তবে রে,তোর মা হলে তাকে থ‍্যাঙ্ক ইউ বলতে পারতিস? ইশ্ তুই বলে ফেললাম পুচকে মেয়েকে,ও না তুই তো আবার চাকরি করিস..'
 হেসে ওঠে ঝিনুকও,' পুচকে বলা চলবে না বাকি সব ঠিক আছে।'
   দুই পক্ষই হেসে উঠেছিল বন্ধুত্বের হাসি। তারপর বেবিসোনার কাছ থেকে সাদর আমন্ত্রণ পেয়েছিল ঝিনুক উইথ বাবা মা। বলেছিল সময় পেলে যাবে।

     সেদিনের বাড়ির থমথমে অবস্থাকে আর বাড়তে না দিয়ে ছেলেপক্ষের সাথে মিট করতে রাজিই হয়ে গেছিল ঝিনুক। তবে বাড়িতে নয় বাইরে কোথাও...
 পরের রবিবার ওরা একটা ক‍্যাফেতে বসে সেদিন ফুলবাগানে যাদের বাড়ি তারা আসবেন। ঝিনুক শাড়িতে তেমন স্বচ্ছন্দ না হলেও ভালোবেসেই শাড়ি পরে তাই তনিমাকে তেমন কিছু বলতে হল না,একবার বলতেই রাজি হয়ে গেল শুধু বলল,' ছেলে কী ধুতি পরে আসবে?'
-' আর ঝামেলা পাকাস না,সবাই মেয়েদেরকে দেখে তাই তার সাজগোজ ঠিক হওয়া উচিত।'
 -' মেয়েদের দেখে,ছেলেদের দেখে না কেন? আমি কিন্তু দেখব ভালো করে।'
-' যা খুশি করিস,এখন চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।'
  আয়নাতে নিজেকে দেখে ঝিনুক,মন্দ লাগছে না। বেশ লুকটা পাল্টেছে। অবশ‍্য বেবিসোনা দেখলে হাসত,বলত পুচকে আবার শাড়ি পরেছে..'
 আন্টির নাম মনে এলে এখন বেবিসোনাই মনে আসে।
   ওরা পৌঁছে দেখে ছেলেপক্ষ তখনও আসেনি,কিছুক্ষণ বাদে ওরা পাঁচজন এলেন। ছেলের মা বাবা,মাসি মেসো আর ছেলে। 
   টুকটাক আলাপচারিতার পর ঝিনুকের মনে হল ছেলে যেন কেমন গোমড়ামুখো একটা দুটো কথা বলেই চুপ করে আছে। শুধু বলল কিছুদিন বাদে ওর ট্রান্সফার হয়ে যাবে ঝিনুক তখন কী করবে? মানে বিয়েটা যদি এগোয়.. ঝিনুক বলল সে চাকরি ছাড়বে না। ছেলের মা আর্তনাদ করে ওঠে,' ঐ জন‍্যই তো বিয়ে করা,তা তুমি এখানে থাকলে ওর কী হবে?'
-' আমি কী করে বলব? উনিও চাকরি ছেড়ে আমার সাথে থাকতে পারেন। সবসময় মেয়েরাই বা চাকরি ছাড়বে কেন?'
   ছেলের মা কথার জবাব দেয় না তবে নিজেদের মধ‍্যে দৃষ্টি বিনিময়ে বোঝে কথাটা খুব অপছন্দ।
   ছেলের মা আবার বলে,' সে যাক যা হয় হবে,তা সাংসারিক কাজকর্ম মানে রান্নাবান্না পার তো? আমরা খেতে ভালোবাসি আর ছেলে তো আরও খেতে ভালোবাসে।'
 তনিমা পরিস্থিতি হাল্কা করতে বলে,' আমরাও খুব খেতে ভালোবাসি।'
 -' হ‍্যাঁ আমরাও ভালোবাসি খুব খেতে।'
-' বাহ্ সবাই আমরা খেতে ভালোবাসি,কিন্তু আমি তেমন কিছু রান্না করতে পারি না। মাঝে মাঝে ইউটিউব দেখে করি ইচ্ছে হলে।'
   ছেলের মা অবাক হয়,সোজাসুজি সুন্দর না বলে দিল বেশ।
  -' যাক ইচ্ছেটাই আসল,বিয়ের পর চাপ পড়লে শিখে নেবে।'
  -' উনি পারেন রান্না?'
  ছেলেটাই এবার জবাব দেয়,' নাহ্ করিনি কখনও, পড়াশোনা,কাজের চাপ এইসব নিয়েই কেটে যায়। মা সব সামলায়।'
  হাসে ঝিনুক,' আমারও সেম,মা সামলায় সব। শুধু ঐ আর কী আপনি রান্না না জানলেও চলে। তবে আমাকে শিখে নিতে হবে।'
   ফ্রাই আর কফি প্রায় শেষ ছেলের মাসি একটু তাড়াহুড়ো করেন বলেন,' যাক ছেলেমেয়ে মোটামুটি সমান সমান,ভালোই তো। আসলে সবাই আজকাল একটা আধটা ছেলেমেয়েদের আগলে রাখেন। আমার একটু তাড়া আছে,দিদি তোরা কী বসবি?'
      ঝিনুক বুঝতে পারে বৈষম‍্যের দরজায় ঘা পড়েছে তাই ওরাও তাড়া করছেন।

**************************
   কয়েকটা দিন কেটে গেছে,এর মধ‍্যে আরও দুটো সিটিং হয়েছে ঝিনুকের। প্রতিবারই বাবা এসে ফেটে পড়েছেন,' তোমার মেয়েকে একটু সহনশীল হতে বল,যদি না পারে তো মুখটা বন্ধ রাখতে বল। বাবা মেয়েকে ছেলেদের মত মানুষ করতে গিয়ে তো অন‍্যায় করে ফেলেছি।'
   তর্ক বাড়ে,মেজাজ হারায় ঝিনুকও,' আমি মেয়েই বাবা,সেটাই আমার গর্ব। তোমার এই পাত্রপক্ষের প্রশ্নগুলো পাল্টাতে বল। কী আশ্চর্য দেখেছ! ওদের ছেলে একা একা ট‍্যুরে যাবে ট্রেকে যাবে আর আমি সোলো ট্রিপে যেতে পারব না? নাহ্ আমি বিয়ে করব না,অনেক হয়েছে।'
   তনিমার কান্না পায়,একবার মেয়ের কাছে কথা শুনছেন আরেকবার বরের কাছে। ফেটে পড়েন মেয়ের কাছে,' তোরা কী আমাকে বাঁচতে দিবি না?'
 -' তোমাকে দেখেই সত‍্যি বিয়ে করতে ইচ্ছে করে না মা। আমি এত কথা শুনতে পারব না।'
-' তুই বা কী কম? বাপ মেয়ে দুজনেই সমান।'
  ওদের কথার মাঝে ঝিনুকের ফোনটা বেজে ওঠে। ট্রু কলারে নামটা দেখে ঝিনুক বেবিসোনা। 
অনেকদিন আন্টি ফোন করে না,অবশ‍্য ও আর যোগাযোগ করেনি। মানে সময়ও হয়নি।
   এই পরিস্থিতিতে আর কী কথা বলবে এখন? তাই ফোনটা ধরে না আর। পরে কথা বলবে।
    বিকেলে ছাদে উঠে ঝিনুক ফোন করে ওপার থেকে উচ্ছ্বাসে ভরা গলা শোনা যায়,' ওহ্ আমি ভাবলাম তুই ব‍্যস্ত বোধহয়।'
   ঝিনুক শুকনো গলায় বলে,' হ‍্যাঁ ঐ একটু কাজ ছিল।'
-' কী ব‍্যাপার মন খারাপ নাকি? এমন শুকনো গলা।'
-' না না,ঠিক আছে।'
 'একদমই নেই মনে হচ্ছে।
'কেন? কী করে বুঝলেন?'
-' কোথায় ভাবলাম আমি এতদিন বাদে ফোন করে একটু কথা বলব। তা থাক পরে আবার কথা হবে..আমাদের বাড়িতে একদিন আসতে বলেছিলাম তা কী হল?'
-' হ‍্যাঁ দেখি যাব একদিন।'
-' এই সপ্তাহে একদিন আয় না,একটু গল্প করব। সেদিন তো কোন কথাই হয়নি তেমন। আর আমাদের বাড়িতে একটা নতুন অতিথি এসেছে তোর সাথে আলাপ করাব।'
' কে এসেছে?'
-' সারপ্রাইজ.. আগে তো আয়।'
-'আচ্ছা,আসব একদিন দেখি..'
-' দেখি না,আসিস কিন্তু।'

   যাবে না ভেবেও খারাপ মনে একটু অন‍্য ছোঁয়া দিতে সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে বাইরের গেটটা খুলে ভেতরে পা রাখে ঝিনুক,আজ ওর মর্ণিং ছিল একটু তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে। বেলটা বাজাতেই ভেতর থেকে আওয়াজ পেয়ে বুঝতে পারে নতুন অতিথি কে? অবশ‍্য ও একটু আন্দাজ করেছিল আগেই।
   বেবিসোনা দরজা খোলেন একগাল হাসি নিয়ে কোলে একটা ফুটফুটে সাদা ছোট্ট ডগি। সমান তালে কুই কুই করেই যাচ্ছে। উনি বলেন,' ওমা! ক্ষণিকের অতিথি তো! আয় আয় ভেতরে..ওরে এতো পুচকে,ওকে চিনে রাখ এ হল আমার বান্ধবী।'
   কে শোনে কার কথা? কিছুক্ষণ ডেকে তারপর চুপ করল,তখন ঝিনুক হাত বাড়ালো ওকে নিতে। ব‍্যাস ওকে কোলে নিয়ে সোফায় বসে একটু আদর দিতেই ঘুমিয়ে পড়ল আয়েশে।
   বেবিসোনা হাসেন,' দেখেছিস..কত মস্তানি করছিল। ব‍্যাস যেই দোস্তি হয়ে গেল ঘুম দিলো কোলে শুয়ে।'
  ঝিনুকের মনের মেঘ অনেকটা কেটে যায়, এই কদিন বাবা ভালো করে ওর সাথে কথাও বলেনি। মাও কেমন যেন একটা ভয়ে ভয়ে আছে,ভাবছে হয়ত এই মুখরা মেয়ের আর কোনদিনই বিয়ে হবে না।
  -' একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আমি তো বেবিসোনা বলে ট্রু কলারে সেভ করেছি। আপনার নাম?'
-' আগে তুই আমাকে তুমি বল। আমার নাম বাবলি ।'
-'  আদুরে নাম আর বেবিসোনাও।'
  -' খুব মজা হচ্ছে তাই না?'
   বাবলির সঙ্গে আড্ডা জমে যাওয়ার মাঝে ঝিনুক বলল আঙ্কেল নেই?
-' আছে তো,দাঁড়া একটু বাদেই আসবে।'
 -' চেম্বারে আছেন?'
-' না রে ওদের শখের রান্নাঘরে। এটা আমার আর কমলার। আগের দিন তো তোকে ওপরে নিয়ে যাওয়া হয়নি। আজ নিয়ে যাব..'
  ঝিনুক ওদের কথাটা শুনে অবাক হয়। কমলাকে আগের দিনই দেখেছে,ও আসার সাথে সাথে সরবত দিয়ে গেছে। চা খাবার কথা জিজ্ঞেস করাতে বেবি সোনা বলল,না ওপরে গিয়ে খাবো।
   সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসে ওরা,চারদিক সুন্দর করে সাজানো,মাঝখানের ধাপে সুন্দর মূর্তি। দোতলায় উঠে আসে ওরা,সুন্দর মার্জিত রুচি আর আভিজাত‍্যের ছাপ অন্দর সজ্জায়। বেবিসোনাও বেশ সাজুগুজু করে থাকে বাড়িতে,হয়ত নিজেকে ভালো রেখেই মন ভালো রাখে। 
      -' আয় চল ছাদে যাই' 
 সিঁড়িতে কিছুটা উঠতেই রান্নার গন্ধ পায়। তারসাথে হাসি আর মজার কথাবার্তা বলে কেউ হাসছে হো হো করে। একটু অস্বস্তি হয় ঝিনুকের মনে হয় বাড়িতে ভদ্রলোকের কোন বন্ধু এসেছেন তাই রান্নার সাথে সাথে আড্ডা চলছে। ইশ্ ওর একবার ফোন করে আসা উচিত ছিল।
    বেবিসোনা রান্নাঘরের দিকে যায়,ঝিনুক চারপাশটা তাকিয়ে দেখে। বেশ কিছুটা ফাঁকা ছাদ তার ওপরে ঝুলন্ত বাগান ফুলে ফুলে ভরা,আর একপাশে একটা ওপেন কিচেন মত,সামনে সুন্দর শেড করে টেবিল পাতা। চিকেন তন্দুর বা তেমন কিছু একটা গন্ধ আসছে। ঝিনুকের ফোনটা বেজে ওঠে,মা ফোন করেছে। মাকে বলে ও এখানে এসেছে,অনেকদিন ধরে বলছিলেন আন্টি।
    তনিমা অবাক হয়,এই মেয়ে মোটেও তো কোথাও যেতে চায় না। যাক দেখুক,মানুষের সাথে মিশলে হয়ত কিছু শিখতেও পারবে। এত বৈষম‍্য ওর মনে কোথা থেকে এল কে জানে? হয়ত মেয়ে বলে ঠাকুমার একচোখা আচরণ মনে দাগ কেটেছে কোথাও।

   -' আরে তুই এখানে দাঁড়িয়ে কেন? আয় আয়..'
-' না বাগানটা দেখছিলাম।'
-' দেখবি আগে খেয়ে নিই তারপরে।'
   লজ্জা পায় ঝিনুক,বেবিসোনা ওর হাত ধরে টানে।
   রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা ওমা আঙ্কেল একদম অ্যাপ্রন পরে পাক্কা শেফ,পাশে কে? দুজনে গল্প করতে করতে রান্না করছে। ইশ্ কে একজন ভিডিও তো করছে।
 -' বেবি সোনা ফিসফিস করে বলে,বাপ বেটার রান্নার ভিডিও হচ্ছে। চল আমরা বাইরেটায় বসি। প্রচুর ফলোয়ার্স ওদের।'
     ঝিনুক বাড়ি যেতে চায় এবার,ইশ্ কেমন যেন লাগছে! ধমকায় বেবিসোনা,'তুই নাকি টমবয়। লজ্জা তো মেয়েদের থাকে,তোর কেন? এটা ঠিক নয়।'
-' আসলে কোন কোন জায়গায় মেয়েরা মেয়েই,কিছু জিনিস আমাদের জড়িয়েই থাকে যেমন লজ্জা,স্নেহ,যত্ন,আদর,দায়িত্ববোধ। আর সেগুলো থাকে বলেই আমরা নারীরা সুন্দর।'
   অবাক লাগে ঝিনুকের বেবিসোনা কী মন পড়তে পারেন? কী সুন্দর কথা বলেন!

      ওদের ভিডিওশুট শেষ হয়ে গেছে,ওরা বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। আঙ্কেল উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন,' ক্ষণিকের অতিথি কখন এল বেবি?'
 -' অনেকক্ষণ,তোমরা রান্নায় মশগুল তাই বিরক্ত করিনি। বুডঢা তোর সাথে আলাপ করিয়ে দিই,এই ঝিনুক,সেই বলেছিলাম না।'
-' মা আমাকে ওর সামনে বুডঢা বোলনা,বোধি বল অন্ততঃ।'
  -' তাতে কী হয়েছে? আচ্ছা আচ্ছা ওর নাম বোধিসত্ত্ব। বন্ধুরা বোধি বলে আমি বলি বুডঢা,মানে বুদ্ধা না বলে..। তুই কখনও দেখেছিস ওর চ‍্যানেল?'
  ঠোঁট ওল্টায় ঝিনুক,' আসলে আমার রান্নাতে তেমন ইন্টারেস্ট নেই। তাই দেখা হয় না।'
-' কেন রান্না ইজ ভেরি ইন্টারেস্টিং ব‍্যাপার,মন ভালো রাখে। আপনি চট করে কাউকে ইমপ্রেস করতে চাইলে তাকে খাইয়ে দেখুন একদম আপনার মন জিতে নেবে সে। আই লাভ কুকিং..'
-' আপনি রান্না ভালোবাসেন? ছেলে হয়ে? আমি তো জানি রান্না মেয়েরাই বেশি করে। আসলে যেগুলো মেয়েদের করতে হয় সেগুলো আমার ভালো লাগে না।'
-' আরেব্বাস তবে তো টপিকস জমে গেছে। আমার আবার যেগুলো একান্তই মেয়েদের কাজ বলা হয়েছে সেগুলো করতে দারুণ লাগে। তাই না মা? তাই বলে আমি কিন্তু মেয়েলি নই,আপনার কী মনে হয় আমাকে দেখে?'
  ঝিনুকের দিকে বোমাটা ছুঁড়ে দিয়ে মিটিমিটি হাসে বুডঢা। হাসেন আঙ্কেলও। কী বলে ভেবে পায় না ঝিনুক।
  বোধি আবার হাসে বলে,' বেবিসোনা তুমি বল আমি কী মেয়েলি না ম‍্যানলি? অথচ রান্না পারি,সেলাই পারি,ঘর সামলাই। আবার জিমে যাই,ট্রেক করি। এই যে আমার প‍্যাক..
   ঝিনুক ততক্ষণে প্রায় বোল্ড আউট হয়ে গেছে। কী বলবে ভেবে পায় না,ইশ্ ছেলেটা কী সলমন হয়ে এখন মাসল দেখাবে নাকি?
   অবশেষে ত্রাণকর্তা হয়ে এলেন আঙ্কেল আর বেবিসোনা।
-' এই আমার কিন্তু খুব খিদে পেয়েছে,মেয়েটাকে কেন এভাবে লেগপুল করছিস বুডঢা? বেচারা এসেছিল একটু গল্প করতে। নে নে খাবারগুলো খা..'
    খাবারটা মুখে দিয়ে চোখ বুজে আসে ঝিনুকের, কী ভালো স্বাদ রান্নার! আঙ্কেল এত ভালো রান্না করেন? আর এই প‍্যাকযুক্ত বুঢডা তো নিশ্চয় বাবার মত ডাক্তার।
 ওরা গল্পে মেতে ওঠে,নিজের বাড়ির থেকে একটু অন‍্য আবহাওয়া এখানে। ওদের বাড়িতে ওরা মা আর মেয়ে বেশি গল্প আর খুনশুটি করে। বাবা কেমন যেন সকাল থেকে কর্তব‍্য করে চলেছেন। অথচ ঠিক সময়ে হাতের কাছে সবকিছু না পেলে মেজাজ হারান। মা ঘোরতর সংসরী,সংসারের ফাঁকে তার আর কোন জীবন নেই। সংসারই তার ধ‍্যানজ্ঞান। সেখান থেকে এক মুহূর্ত সরে আসতে নিজেকে অপরাধী মনে করে। সবসময়ই তার মনে চিন্তা কোন কাজটা হল না,কাজের তাড়াতে সারাদিন ছুটে চলেছে। কখনও ক্লান্ত হয়ে পড়ছে,চ‍্যাঁচামেচি করছে।
    হঠাৎই নিজেকে প্রশ্ন করে ঝিনুক ও তো এই বুডঢার মত মাঝেমধ্যে রান্নাঘরে ঢুকে মাকে সাহায‍্য করতে পারে। কিন্তু করে কী? মা সারাদিন যে কাজগুলো করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে ওর অফিসের ছুটির পর বাড়িতে এসে একটু এগিয়ে দিলে মাকে হয়ত ভালোই হয়। কিন্তু পারে না,কেমন যেন ল‍্যাদ লাগে। নিজে কিছু না করে বাবাকে বরং অর্ডার করে আর বকুনিও খায়। তবে এই বাড়িতে কেমন যেন একটা পজেটিভ ভাইবস,হয়ত ওরা বড়লোক কাজের লোক আছে বাবলি আন্টিকে তেমন কিছু করতে হয় না তাই।
 -' হ‍্যাঁ আপনি হঠাৎ চুপ করে গেলেন কেন? মানে ভালো হয়নি কাবাব আর তন্দুর? খুব কম অয়েলে বানানো আর একটা নতুন হার্বস দিয়েছি আজ কাবাবটাতে..'
-' না না ঠিক আছে একদম,খুব ভালো হয়েছে। আসলে আমি তো এগুলো কিছু বানাতে পারি না তাই ভাবছিলাম।'
-' আরে আমিও তো এসব বানাতে পারি না তেমন,তবে এখন বুডঢার কাছে শিখেছি কিছু কিছু। তোর আঙ্কেল অবশ‍্য খুব ইন্টারেস্টেড কুকিংয়ে।'
-' আরে মম ইউ আর দ‍্য বেস্ট শেফ,তোমার হাতের রুই পোস্ত,কচি পাঁঠার পাতলা ঝোল,চিকেন পাতুরি এসব তো অমৃত।'
-' সত‍্যি বেবিসোনা ঘরোয়া রান্না তুমি দারুণ কর। ডোন্ট বি সো হাম্বল।'
   এইটুকু সময়ের মধ‍্যে এসে অবাক হয়ে যায় ঝিনুক, কী সুন্দর একজন আরেকজনের প্রশংসা করছে। আর তাতে প্রত‍্যেকের মুখে হাসি ফুটে উঠছে,বাড়িতে খুশির মহল তৈরি হচ্ছে। ছেলে কী সুন্দর টুক করে এসে মায়ের মুখে একটুকরো চিকেন দিয়ে গেল।
    অনেকটা সময় কেটে গেছে ঘড়ি দেখে ঝিনুক।
-' আন্টি আমি এবার যাব।'
-' হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ একদম,আর আটকাবো না।'
 হঠাৎই বোধি বলে ওঠে,' কিন্তু মা আমাদের সেই কথাগুলো তো হলই না,মানে আমার মেয়েদের কাজগুলো ভালো লাগে। আর আমি কোন কাজকেই ছেলেমেয়েদের বলে ভাগ করি না।'
  -' বুডঢা বেচারাকে কেন জ্বালাচ্ছিস? আচ্ছা সে হবে আরেকদিন। অফিস থেকে এসেছে এবার ওকে বাড়ি যেতে দে।'
    ততক্ষণে কমলার কোলে করে নতুন অতিথি ওপরে উঠে এসে একদম বুডঢার কোলে আশ্রয় নিয়েছে।
     ওকে কোলে নিয়েই রান্নাঘরে ঢুকে যায় বোধি তারপর একটা প‍্যাকেট মায়ের হাতে এনে দেয়।
-' এটা বাড়িতে নিয়ে যাবি তোর আঙ্কেলের হুকুম। ও নীচে নামার আগে বলে গেছে।'
-' না না,আমি তো খেয়ে গেলাম।'
-' তা বললে হবে কেন? আমাদের বাড়ির ছেলেরা কত কাজের সেটা তো মাকে বলবি একদম প্রুফ সমেত।'
   ঝিনুকের বোকা বোকা মুখটা দেখে হাসে ওরা মা আর ছেলে। বোধি আবার বলে,' নেক্সট টাইম যখন আসব তখন আবার আসবেন,আপনাকে একটা দারুণ আইটেম খাওয়াবো। আর একটা ফাটাফাটি ডেজার্ট।'
 অবাক হয় ঝিনুক,' আপনি এখানে থাকেন না?'
-' মা ভেরি ব‍্যাড তুমি ওকে বলনি যে ইউ হ‍্যাভ আ গুড বয় লাইক মি?'
-' বুডঢা সুযোগ হয়নি,আচ্ছা ওর সাথে আমি কত কথা বলেছি বল? হ‍্যাঁ রে ও এখানে থাকে না। এই তো আর তিনদিন বাদে চলে যাবে। এখন মুম্বাইয়ে একটা বড় হোটেলে শেফ। তবে চেষ্টা করছে ওদের এখানকার হোটেলে চলে আসতে। খুব হোমসীক। দেশের বাইরে খুব ভালো একটা অফার পেল গেল না। বলে তোমাদের ছেড়ে অতদূরে গেলে তো লাইফের একটা এপিসোড মিস হয়ে যাবে। দেখ বুড়ো ছেলের কান্ড! সাধে কী ওকে বুডঢা বলি।'
    ঝিনুক একটা ধাক্কা খায়,ডাক্তার বাবার ছেলে পাঁচতারা হোটেলের শেফ! কী অদ্ভুত প্রফেশনের অদলবদল। তবুও যে যার জগতে ভালোই আছেন ওরা। ছেলেকে নিয়ে বেশ গর্বিত মা বাবা।

  ***********************
বেশ কিছুটা আগে বাড়িতে ফিরে এসেছে ঝিনুক। মায়ের হাতে খাবারের প‍্যাকেটটা দিয়ে বলেছে,'বেবিসোনা দিয়েছে।'
-' কেন হঠাৎ?'
-' ওরা বানিয়েছে বাড়িতে,আমি খেলাম। তোমাদের টেস্ট করতে দিয়েছে। আর একদিন যেতেও বলেছে। বেবিসোনার ছেলে আর আঙ্কেল রান্না করেছে।'
       -' ওমা আগে তো ছেলের কথা শুনিনি।'
  -' ওহ্ মা আমি নিজেই তো জানতাম না।'
  তনিমা বুঝতে পারে মেয়ের মেজাজ ঠিক নেই,হয়ত ক্লান্ত থাক পরে কথা হবে।
    বিছানায় শুয়ে হাত পা ছড়ায় ঝিনুক ওর মনের মধ‍্যে বুডঢার কথাগুলো ভাসে মেয়েদের কাজ আর ছেলেদের কাজ বলে কিছু হয় না। কাজ মানে কাজই,সত‍্যি তো রান্না করার যে কাজ মেয়েরা নিজেদের বলে ভাবে তা তো অনেকটাই হোটেলে বা বিয়েবাড়িতে ছেলেরাই করে।
     নিজে এতদিন জেদ করেই মেয়েদের কাজ বলে অনেক কিছু করেনি। বরং ছেলেরা যা করে সেগুলো করেছে। আজ খুব অল্প সময়ের জন‍্য হলেও বুডঢার কথাগুলো অনেক কিছু শিখিয়ে গেল ঝিনুককে।
    ফেসবুকটা স্ক্রল করে অকারণেই ঝিনুক,তারপর দেখে ইনস্টাগ্রাম। তারপর ওর অবাধ‍্য আঙুলগুলো চলে আসে ইউটিউব বেড়াতে। কী যেন নাম বলেছিল চ‍্যানেলটার ও হ‍্যাঁ মনে পড়েছে,এই তো খুঁজে পায় একটু সার্চ করেই। মুখগুলো যেহেতু চেনা তাই খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। আর তারপরই দেখতে থাকে একটার পর একটা এপিসোড। ওমা আঙ্কেলই বা কম কী? কে বলবে আঙ্কেল ডক্টর? কী সুন্দর ছেলেকে সাহায্য করে যাচ্ছেন। কয়েকটা এপিসোডে বেবিসোনা এসেছে টেস্টার হিসেবে,মাকে দিয়ে খাইয়ে বুডঢা বলছে আমার লাইফে দেখা বেস্ট শেফ যখন বলছে ভালো তো খুব ভালো হয়েছে। কারণ উনি কখনও আমাকে ফুল মার্কস দেন না আর এই সমালোচনা আছে বলেই আমি ভালো কাজ করি।
      ঝিনুক সাবস্ক্রাইব না করে আর পারে না চ‍্যানেলটা। তারপর থেকে নতুন কিছু এলেই দেখতে পায় ঝিনুক। হঠাৎই দেখা এই বুডঢা,হাসি পায় ঝিনুকের মনে মনে বলে না না বোধিসত্ত্ব ঝিনুকের রান্না প্রীতি বাড়িয়ে দিয়েছে। তনিমা অবাক হয়ে যায় ওকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে। আগে যে মেয়ে রান্নার ধারেপাশে আসতে চাইত না সে এখন উইকএন্ডে রান্নাঘরে ঢোকে,আর সবচেয়ে আশ্চর্য যে একদম রান্নাঘর গুছিয়ে বেরোয় মেয়ে। অবাক হন বাবাও মনে মনে ভাবেন হঠাৎ কী হল মেয়ের? না পেরে তনিমাকে জিজ্ঞেস করেন। তনিমা মুচকি হেসে বলে পরিবর্তন আসছে,তবে সেটা ভালো। মানে ইউটিউব দেখার ফল। দেখা যাক এই নেশাটা কদিন থাকে...

**********************
         সারাদিন কাজের পর রাতে নিজের চ‍্যানেলটা একবার দেখে বোধি,প্রতিদিনই সাবস্ক্রাইবার বাড়ছে। তবে এখানে থাকাতে বাবাকে পায় না তাই একা একাই করতে হয় সবটা। বাবা থাকলে খুব সুন্দর হয় ব‍্যাপারটা,আর সেই ভিডিওগুলো বেশি পপুলার হয়। বাবাকে বলাতে কলার তোলে বাবা,' দেখেছিস তো এই বয়েসে আমার কেমন পপুলারিটি? আরে আমাকে বেশিদিন না দেখলে তোর ফ‍্যানেরা কমেন্ট করে হোয়ারস পাপা? মিসিং হিম।'
-' বাবা,তুমি আমাকে পেছনে ফেলে দিচ্ছো রিয়েলি। আই অ্যাম ফিলিং জেলাস।'
-' এই বয়েসে দেখেই এই অবস্থা। তাহলে ভাব আমার ইয়ঙ্গ এজটা। তোর থেকে ছোট বয়েসে আমার বান্ধবী ছিল,চুরি করে প্রেম করতাম। এই বয়েসে বিয়ে করে ফেলেছিলাম। আর তুই শুধু রান্নার সাথেই প্রেম করে গেলি।'
-' বাবা তোমার আবার বয়েস হয়েছে নাকি? আমি তো ভাবি তুমি চিরকিশোর। এখনও তোমাকে দেখে কতজন প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।'
-' বোধি বেবিসোনা পাশে বসে আছে। আমাদের দুজনকেই এবার ফুটপাতে দাঁড়াতে হবে। কারণ ফোনটা স্পীকারে দেওয়া।'
   হঠাৎই একপশলা বসন্তের হাওয়া এসে ভাসিয়ে দেয় ওদের। হাসেন বাবলিও বলেন,' খুব ফ্লার্ট করছিস বাবাকে তাই না? এই বয়েসে বাবাকে লেগপুল না করে নিজের একটা বান্ধবী দেখ তো। কলকাতা এলে এবার তোর একটা বিয়ে দেব। কী রে আছে নাকি কেউ?'
   ওপার থেকে একটা দমকা হাওয়ার মত হাসির ঝাপটা আসে,' অনেক আছে মা,কেউ হাত জড়িয়ে আছে। কেউ বা গালে কিস্ করছে। আবার কারও জন‍্য পাগল আমি নিজেই।'
-' অসভ‍্য,পাজি ছেলে। বাইরে থেকে একদম গেছে স্বভাবের বারোটা বেজে। আর কী বাপ কা বেটা.. বাবা এখনও দেখে রেগুলার ইনবক্সে কতজন তাকে প্রশংসা করছে।'
   -' বেবিসোনা,আমাকে কেন আবার আনলে? আমার মন চুরি সেই কবেই হয়ে গেছে। কে সেই চোর তুমি তো জান? তোমার পাজি ছেলে যে দূরে বসে কিসব করছে তার একটা বিহিত কর। চল বরং দেখে আসি কারা জড়িয়ে আছে তাকে।'
   ওপার থেকে দমফাটা হাসি হাসে বুডঢা,' আরে চলে এসো তাড়াতাড়ি গোয়েন্দাগিরি করতে। দেখবে কারা আমার মন চুরি করছে। অবশ‍্য মা সাবধান বাবারও মন চুরি হয়ে যেতে পারে..'
  বাবলি বুঝতে পারেন মজা করছে ছেলে তাই বলেন,' বুঝেছি সবটাই কে আবার মন চুরি করবে? ঐ হয়ত বেগম বাহার,রঙ্গিলা চিকেন, বা পার্সে বঙ্গ সুন্দরী অথবা তন্বী হিলসা তাই না?'
   -' বাবা আমাদের সব চুরি কলকাতাতেই বসে ধরতে পারেন এই মহিলা। ওহ্ সত‍্যি ছয়বছর ধরে প্রেম করে একটা পাক্কা গোয়েন্দা জোগাড় করেছ।'
    বাবা,মা আর ছেলের এই অবসরের আড্ডাটুকু বাবলির বড় প্রিয়। বারবারই মনে হয় এমন প্রাণখোলা ছেলে কজনের আছে? ওর সাথে কথা বললেই মন ভালো হয়ে যায়। অথচ সত‍্যি ছেলের মন চুরি করতে কেউ এল না কেন? আসলে পাজি ছেলেটাই,সারাদিন কাজ কাজ করলে প্রেমটা করবে কখন?
     ফোনটা বেশ কিছুটা আগেই রেখে দিয়েছেন বাবলি। বুডঢার কথাগুলো মনের মধ‍্যে ঘোরাফেরা করে। সত‍্যি এবার একটা ওর পছন্দের কাউকে দেখতে হবে। সেকথা ওর বাবাকে বলতেই তিনি হেসে উড়িয়ে দিলেন,' ধুৎ ওটাকে দিয়ে কিছু হবে না। ও সত‍্যিই বুডঢা হয়ে গেছে। আদর দিয়ে ছেলেকে বুড়ো বলে ডাকো,সে আর কী হবে? কোন ক‍্যালি নেই ছেলেটার,আমি সুযোগ পেলে এখনও তো কত সুন্দরীর মন চুরি করতে পারি।
 -' আরে মহা মুশকিল তো.. আমি ছেলের কথা বলছি উনি নিজের বাজার এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছেন। মাথায় টাক পড়েছে,নব্বই ভাগ চুল পাকছে সে খেয়াল নেই। সুন্দরীদের মন চুরি করবেন উনি..যাও যা খুশি করো তোমরা বাবা আর ছেলে আমি দিদির ওখানে চলে যাব একমাস দুমাস যতদিন খুশি থেকে আসব।'
 -' ও বুঝেছি জামাইবাবুর সাথে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করার জন‍্য। ঐ বুড়োটা এখনও আমার বেবি সোনার পেছন ছাড়েনি! সেই কবে বলেছিল শালী আধা ঘরওয়ালী। ওহ্ লাইফ হেইল করে দিল সেই থেকে। আর ইনি কিছু হলেই দিদির বাড়ি যাবে।'
-' আচ্ছা বাবা আর বলব না। এতগুলো বছরে তুমি অভ‍্যেস হয়ে গেছ বেবিসোনা। ভালো লাগে না তুমি ছাড়া। ওহ্ কবেই তো মনটা চুরি করেছ.. শুধু শুধু ঐ জামাইবাবুর ভয় দেখাও কেন?'
-' বেশ করি,জামাইবাবুর মত কেউ আমাকে ভালোবাসে না।'
-' আচ্ছা বাবা দাঁড়াও আমাদেরই একটা মেয়ে দেখতে হবে। আচ্ছা ঝিনুক কেমন হবে?...হ‍্যাঁ মেয়েটা তো বেশ ভালো। এই তো পেয়ে গেছি।'
-' কুল ডাক্তারবাবু, ঝিনুককে মাত্র দুদিন দেখেছি। হ‍্যাঁ মেয়েটা ভালো। কিন্তু ওর তো বয়ফ্রেন্ড থাকতে পারে। তারপর বুডঢার ঝিনুককে ভালো নাও লাগতে পারে। আর বুডঢার সাথে ঝিনুকের মিলবে না।'
-' কেন?'
-' আরে ঝিনুকের রান্নাঘর ভালো লাগে না,রান্নাতেও কোন ইন্টারেস্ট নেই। আর আমাদের বুডঢার রান্নাঘর প্রথম প্রেম। সুতরাং কী করে মিলবে?'
-' আরে সেখানেই তো মিল হবে। অপোজিট ক‍্যারেক্টারের বন্ডিং ভালো হয়। ইভেন অপোজিট লুকও পছন্দ করে মানুষজন। এই যেমন লম্বা ছেলে বেঁটে মেয়ের প্রেমে পড়ে যেমন আমি। তালপাতার সেপাই খ‍্যাংড়াকাঠি ছেলের ভালো লাগে মোটুসোটু মেয়ে। আবার ধবধবে ফর্সা ছেলের পছন্দ কোন শ‍্যামাকে। আবার সুন্দরী মেয়েরা হনুমানের মত দেখতে ছেলের প্রেমে পড়ে। আরে স্টিফেন লিককের ওল্ড প্রোভারবস মেড নিউ পড়নি?'
-' ওহ্ বাবা তুমি কিছু বকবক করতে পারো বটে। আমি ভেবে দেখি। ঝিনুকের তো বিয়ের ইচ্ছে নেই আমাকে বলছিল একদিন। সে পুরুষের বশে থাকতে নারাজ। তারপর ওর মা বাবা কেমন,কিছুই তো জানি না।'
-' একদিন কথা বল ওর মা বাবার সাথে। দরকারে ঘুরে এসো ওদের বাড়ি। ও তো বলছিল যেতে।'
-' ওহ্ তুমি চুপ কর,আমাকে ভাবতে দাও।'

     মিসেস বাবলির ভাবনাটা অবশ‍্য তারপরে খুব একটা এগোয়নি। কারণ জামাইবাবুর শরীর খারাপ শুনে সত‍্যি পুণে যেতে হয়েছিল দুজনকে। তারপর ছেলের সাথে দেখা করে ফিরতে ফিরতে বেশ কিছুটা সময় চলে গেছিল। তবে তার সাথে একটা ভালো খবর নিয়ে এসেছেন ছেলে আগামী মাসে কলকাতার একটা নামী হোটেলে জয়েন করছে।

**********************
  ইউটিউবে বোধিসত্ত্বর কিচেন মানে বুডঢার কিচেন দেখা ঝিনুকের নেশা হয়ে গেছে। আর সেখানেই বুঝতে পারে বোধি এখন কোথায়। আসলে রান্না করতে করতে অনেক কথাই শেয়ার করে বোধি। হাসে ঝিনুক মা বাবার মতই খুব হাসিখুশি বোধি। নতুন ভিডিও না এলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরোনোগুলোই দেখে। শুধু কমেন্টে আসবে ভেবেও কমেন্ট করে না। 
       তবে বেশ কয়েকদিন নিজেকে সংযত করে রাখলেও বোধির স্ট‍্যাটাস না দেখে পারে না। একটা অদ্ভুত ভালোলাগায় ডুবে গেছে ঝিনুক। রান্নার জগত যে এত জাদুভরা হয় কখনও বুঝতেই পারেনি। সেদিন অফিসের টিফিন টাইমে ওকে রান্নার ভিডিও দেখতে দেখে অবাক হয় জিনিয়া,' ওমা তুইও শেষে রান্নায় এলি? কী রে প্ল‍্যান কবে? কে মন চুরি করল? বুঝেছি সে খেতে ভালোবাসে।'
-' আরে না না এমনি দেখছি। এই নে খা এটা আমি রান্না করেছি।'
-' তুই রান্না! ও দেখি দেখি বুডঢার কিচেন তুইও দেখিস? দারুণ রে শেফটা। খুব ভালো হয়েছে রে খেতে।'
    ঝিনুকের মনে তখন প্রেমের নেশা। সত‍্যিই বোধহয় ও বুড্ঢার প্রেমে পড়ে গেছে। যদিও জানে এই প্রেমের ভবিষ‍্যত অন্ধকার।
 
    প্রতিদিন রাতে সময় পেলে স্টোরির ভিউয়ার দেখে বোধি। তবে আজকাল একটা নাম বোধহয় বোধিও খোঁজে। আর রান্নাবান্না না পছন্দ করা কেউ একজনের প্রোফাইলে গিয়ে ও টর্চ জ্বালিয়ে দেখে এসেছে একদিন। আরে এ তো সেইই মানে যার সাথে একটু বেশি ঝগড়া করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু হল না।

   দেখা যাক কলকাতা গিয়ে যদি একবার সুযোগ পাওয়া যায় তো ধরবে একদম,' কী মশাই রান্না ভালোবাসেন না তো আমার স্টোরি দেখেন কেন শুনি? না না মা খুব বকবে তাহলে। তাছাড়া এটা বললে ইমপর্টেন্স পেয়ে যাবে।'
    তবে মা যে ওকে অলরেডি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছে তা কলকাতা এসে কদিন বাদেই বুঝল। বাবাও যোগ দিয়েছে দলে,দুজনেই গম্ভীর মুখে বলল,' আজ একটা ইনভিটেশন আছে যাবি আমাদের সাথে। অনেকদিন একসাথে কোথাও যাওয়া হয়নি। না বলবি না।'
-' আরে কোথায় বলবে তো'
   বাবা মায়ের কাছে শুনে একটু আপত্তি করলেও তা টিকল না ধোপে। অগত‍্যা যাওয়া....

   ঝিনুকের আজ জন্মদিন, ও জানত আঙ্কেল আর আন্টি আসবে। তবে বোধিকে দেখে অযথা বুকের বাঁদিকটা ভীষণ নাচানাচি শুরু করল। বেবিসোনা অবশ‍্য মনে মনে একটা গভীর ষড়যন্ত্র নিয়েই এসেছিলেন। আজকের ঝিনুক একটু অচেনা ওদের কাছে। এই কয়েকমাসে বেশ অন‍্যরকম ঝিনুক,বেশ একটু মেয়ে মেয়ে মানে মাথায় লম্বা চুল পরনে শাড়ি। চুলে ফুল।
 -' আরে একদম লুক চেঞ্জ হয়ে গেছে তো। কী ব‍্যাপার টমবয়?'
   বোধি একদম চুপচাপ ওর চোখে দুষ্টুমি ভরা হাসি ঝিনুককে হ‍্যাপি বার্থডে জানিয়ে বলে,' আসলে যারা রান্নাবান্না ভালোবাসে না। আমার ঠিক তাদের...'
  ঝিনুক ওর হাতে একটা সরবতের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলে,' আমি জানি আপনি খুব ঝগড়ুটে। আর আজ আমার জন্মদিন আজকে ঝগড়া করতে নেই। এটা টেস্ট করে আঙ্কেল বলবে কেমন হয়েছে?'
   -' ওহ্ একদম নতুন বোধি খেয়ে দেখ একবার।'
   বাবলির মুখে হাসি বুডঢার এক্সপ্রেশন দেখে।
-' ঠিকঠাক হয়েছে,বাট এইরকম একটা মকটেল আমি দেখিয়েছিলাম কদিন আগে। আমার আইডিয়া নিয়ে একটু মিলিয়ে মিশিয়ে করেছে।'
   -' খুব নিন্দুক তো আপনি..আমি দেখি না আপনার চ‍্যানেল।'
-' মম সী ইজ...'
  হঠাৎই আর কিছু বলে না বোধি শুধু একটা চোরা হাসি ছুঁড়ে বলতে চায় বলে দেব নাকি...
     ঝিনুক আর তনিমা মিলে সব বাঙালী রান্না করেছে আজ। তারমধ‍্যে কিছু ওর দিদার রান্না। এবার অবশ‍্য বোধি আর ভালো না বলে পারে না।'
    ওরা বাড়িতে ফিরে এসেছে বেশ কিছুটা আগে। বাবলি বোধিকে বকুনি দেন,' তুই মেয়েটাকে এত লেগপুল করছিলি কেন? বেচারা কত কী করেছে..'
-' মা সী ইজ লাইং ও চুরি করে আমার চ‍্যানেল, স্ট‍্যাটাস সব দেখে।'
-' তুই কী করে জানলি? তার মানে তুইও নোটিশ করিস.. যাক স্ট‍্যাটাস দেখুক চুরি করে। অন‍্য কিছু চুরি না করলেই হল।'
-' কী চুরি করবে আবার বেবিসোনা?'
-' তুমি তো এ ব‍্যাপারে এক্সপার্ট, তুমিই বল।'
-' ও বুঝেছি মন টন চুরি তাই না? না না বোধি কবেই রান্নাকে মন দিয়েছে। আর কে চুরি করবে?'
   বোধিসত্ত্ব হঠাৎই একটা হাল্কা হাসি ছড়িয়ে ওর ডগিটাকে কোলে নিয়ে ওপরে উঠে যায়। হঠাৎই একটা অদ্ভুত ভালোলাগা সবকিছু এলোমেলো করে দেয়।
   -'বেবিসোনা,সাকসেসফুল মনে হচ্ছে। চোর আর চুরি দুটোই বোধহয় ধরা পড়বে খুব তাড়াতাড়ি মনে হচ্ছে।'
সমাপ্ত:-
       
     

 


     





  





  
  

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...