'এই মিস্টিটা খেয়ে দেখুন,আমাদের কৃষ্ণনগরের একদম নামকরা মিস্টির দোকানের সরপুরিয়া।'
সুবোধবাবু একের পর এক মিস্টির সুখ্যাতি করে যাচ্ছেন আর প্লেট এগিয়ে দিচ্ছেন ছেলেপক্ষের দিকে। দেখছেন এরা বেশ খাদ্যরসিক,আয়েশে মুখে মিস্টি পুরে বলছেন,' হ্যাঁ সত্যি দারুণ। যদিও আমার সুগার তবে আপনি যেভাবে বলছেন তাতে আর না খেয়ে থাকতে পারছি না। হ্যাঁ তা অনেক তো খাওয়া হল এবার মেয়েকে আনুন,দিনের আলোতে মেয়েকে দেখব বলে সকাল সকাল চলে এলাম। যা দিনকাল পড়েছে,আজকাল সবাইকে সুন্দরী লাগে বুঝলেন মশাই,সবই মেকআপের জাদু।'
-' হেঁ হেঁ তা যা বলেছেন,তবে আমার মেয়ে খুব সাধারণ,মানে এই পড়াশোনা নিয়ে থাকে। অত সাজগোজের বালাই নেই। দেখলেই বুঝতে পারবেন।'
-'দেখুন আমাদের আধুনিক পরিবার মেয়েরা সাজবে এটাই তো ভালো। কিন্তু ঐ যে মুখোশে আসল মুখ ঢাকা পড়ে যাবে তাতেই আমার আপত্তি। আরে বাবা যার সঙ্গে চব্বিশ ঘন্টা থাকতে হবে তাকে মুখটাই দেখানো ভালো।'
ছেলের বাবার কথা শুনে একটু দমে যান সুবোধবাবু। ভদ্রলোক পেশায় প্রধানশিক্ষক,এখনও দুবছর চাকরি আছে। ওদের একমাত্র ছেলে আজ আসতে পারেনি,হঠাৎই অফিসের ট্যুরে দিল্লি যেতে হয়েছে বলে। ওরা স্বামী স্ত্রী,মেয়ে আর ভাই,ভাইবৌকে নিয়ে এসেছেন। এসেই অবশ্য সহাস্য মুখে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন ছেলে আসতে পারেনি সেইজন্য। খেতে খেতে বারবারই বলছিলেন,' এত আয়োজন কেন করেছেন? আমাদের একটু চা হলেই বেশ হত। আসলে এইসব কালচার এখনকার ছেলেমেয়েদের পছন্দ নয়। তবে আমরা পুরোনোপন্থী,আসলে বিয়েটা শুধু তো পাত্র আর পাত্রীর মধ্যে হয় না,এক পরিবার আত্মীয়তার ডোরে বাঁধা পড়ে আরেক পরিবারের সাথে। তাই আলাপ করব বলেই চলে এলাম।'
সুবোধবাবু দেখে বুঝলেন ভদ্রলোক শুধুমাত্র দাপটে কাজের জায়গা সামলান তাই নয়,তাঁর কথার কাছে চুপচাপ মোটামুটি সবাই তিনি একাই বক্তা।
ছোটবেলায় স্কুলের হেডস্যারকে খুব ভয় পেতেন সুবোধবাবু,আজও একবার তাঁর বুক কাঁপলো। এই নিয়ে মেয়ের জন্য বেশ কয়েকটা সম্বন্ধ এল কিন্তু কোন পাত্রপক্ষই হ্যাঁ বলেনি। মেয়েও আজকাল বলে বিয়ে করবে না। কিন্তু তাঁর মা অসুস্থ খুবই ইচ্ছে নাতনির বিয়েটা দেখবেন,তাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সুবোধবাবু হঠাৎই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন কী একটা যেন চিন্তা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। দরজার দিকে তাকান এতক্ষণ তো আভার মেয়েকে তৈরি করে নিয়ে আসার কথা। অবশ্য মেয়ে নিজে ভালোই সাজতে পারে,সাজলে তাকে ভালোই লাগে। অবশ্য আজকের জন্য দাদার মেয়েকে ডেকেছেন,ও নাকি কীসব নো লুক মেকআপ করে একদম মুখকে সুন্দর করে তুলতে পারে। কথাটা যে সত্যি তা সুবোধবাবু দেখেছেন,ভাইঝিকে দেখে আজকাল অবাক হন সুবোধবাবু,আগের থ্যাবড়ানো নাক বেশ টিকোলো,মসৃণ মুখ আর সুন্দর চুল বাঁধার কায়দায় সে হঠাৎই খুব সুন্দরী হয়ে গেছে। একদিন জিজ্ঞেস করাতে হেসে ফেলেছিল,' ও কাকু,আমার বিয়ের পরই তো লকডাউন শুরু হল। কিছু করার নেই তখন বেকার বাড়িতে বসে আছি। সম্বল তখন মোবাইল তাই অবসাদ কাটাতে ঐ ফোন ঘাঁটা,আর বাড়িতে বসে কাজের মাঝে নিজেকে একটু পরিপাটি রাখা। একদিন এভাবেই ইউটিউবে মেকআপ করানো শেখানো হচ্ছে দেখে সেখানে উঁকি মারলাম। প্রথমটা শুধু দেখে গেছি কদিন,তারপর ঐ অনলাইনে কিছু জিনিসপত্র এনে শিখে নিলাম ব্যাপারটা। এখন তো নিজেও সাজি আর আসেপাশের মেয়ে বৌকেও সাজাই।'
সুবোধবাবু হেসে বলেছিলেন,' তুই তো সাজুনি ছিলি সেই ছোট থেকে।'
আজ সেই ভাইঝি বোনকে সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছে,বলেছে দাগছোপ যা আছে সব ভ্যানিস করে একদম মেকআপ করে পারফেক্ট লুক এনে দেবে। মেয়ে শৈলী যদিও আপত্তি করেছিল প্রথমে,' দিদিয়া রে আমি জানি এই সম্বন্ধ হবে না। আমি যেমন তেমনভাবে যাব,তাতে পছন্দ হলে হবে না হলে হবে না।'
বোনকে কথা বলতে না দিয়ে ধমকে চুপ করিয়েছিল দিদি,' আরে দেখ না,কত সুন্দর করে সাজিয়ে দিই।'
-' হ্যাঁ কী হল মেয়ে আসছে? আপনি একবার ভেতরে গিয়ে দেখুন বরং।'
ভদ্রলোকের কথা শুনে সুবোধবাবু ব্যস্ত হতেই ওপাশের পরদা নড়ে উঠলো। ট্রেতে চায়ের কাপ নিয়ে আভার সাথে এল মেয়ে আর সাথে ভাইঝি। সুবোধবাবু উৎসাহিত হয়ে বলে ওঠেন,' এই এসে গেছে। মা প্রণাম কর,আর হ্যাঁ এই আমার ভাইঝি। আর আভার সাথে তো আগেই..'
শৈলী প্রণাম করতে গেলে ভদ্রলোক বাধা দেন,' না না যেখানে সেখানে ঝুঁকতে নেই। আগে দেখো আমি নমস্য কিনা?'
-' ইশ্ মাস্টারমশাই এসব কী বলছেন?'
ভদ্রলোক ইশারায় সুবোধবাবুকে থামতে বলে মেয়েকে বলেন,' বোস,এখানে। একটু গল্প করি আমরা। কী গো,তুমিও কিছু জিজ্ঞেস কোরো। ভাই সবাই চুপচাপ কেন? আমি তো একাই কথা বলে যাচ্ছি।'
ভদ্রমহিলা হাসেন,' চিরকাল তো তুমিই কথা বলো,আমি শুনি। আমাদের সবার ভরসা আছে তোমার ওপর,তুমিই বল।'
সবাই হাসে ভদ্রমহিলার কথা শুনে। ছেলের বোন গিয়ে শৈলীর পাশে বসে গল্প করে। ভদ্রলোক শৈলীকে খুঁটিয়ে দেখছেন কথা বলতে বলতে সেটা সুবোধবাবুর নজর এড়ায় না। কেমন যেন বুকটা ঢিপঢিপ করে,না ওরা পছন্দ করুক তারপর বলেই দেবেন ব্যাপারটা। তবে ভদ্রলোককে দেখে মনে হচ্ছে শৈলীকে তাঁর পছন্দ। একে একে অনেক গল্পই হয় সবাই বেশ হাসিখুশি। শৈলীরও বেশ হাল্কা লাগছে। সুবোধবাবু একটু বাইরে আসেন,ভাইঝি বলে,' কাকা দেখেছ তো মনে হয় পছন্দ হবে এইবার।'
ওরা আবার ঘরে আসেন,দেখেন শৈলীর পাশে বসে কথা বলছেন ভদ্রলোক। সবই পড়াশোনার কথা,কিছু অন্য শখ আছে কিনা জিজ্ঞেস করছেন। হঠাৎই ভদ্রলোক বলেন,' একটা কথা জিজ্ঞেস করব,কিছু মনে কোরনা। তোমার বাঁদিকের গালে কী কোন দাগ আছে?'
সুবোধবাবু চমকে ওঠেন,শৈলীর বুকটা কাঁপে। দিদিকে বারবারই বলেছিল ওখানে ফাউন্ডেশন আর কনশিলার দিয়ে দাগটা না ঢাকতে। ইশ্ এখন কী বলবে? এর আগেও সবাই এই দাগটা নিয়েই আপত্তি করেছে। অথচ এটা তো ওর জন্ম দাগ। কেন যে বাবা আর সবাই বলল এবার দাগটা ঢেকে বসতে। পরে বলা যাবে সত্যিটা, আগে তো পছন্দ হোক...
শৈলী মুহূর্তে ঠিক করে নেয় ও কী বলবে, সাহস করে বলে ওঠে,' হ্যাঁ ওটা আমার জন্ম দাগ। আমার বেশ লাগে,কিন্তু যারা প্রথম দেখে তাদের ভালো লাগে না..'
-' বুঝেছি,তাই ওটাকে ঢাকা দেবার চেষ্টা করেছ। একটু মুখটা ধুয়ে আসবে একবার।'
সুবোধবাবু সহ অন্যদের অপমান লাগে ভীষণ। শৈলীর কান্না পায় তবুও বলে,' আপনারা আসুন এবার।'
ভদ্রলোক ওর দিকে সোজা তাকিয়ে বলেন,' চলে যাব বলে তো আসিনি। এসেছি যখন তখন ভালো করে দেখেই যাবো। কেন যে তোমরা মুখোশে মুখ ঢাকো? আমি অবাধ্য ছাত্রী পছন্দ করি না,যাও মুখটা ধুয়ে এসো।'
ভদ্রমহিলা মানে ছেলের মা ভদ্রলোককে বলেন,' কী শুরু করেছ। ইশ্ আমার কিন্তু এবার খুব খারাপ লাগছে।'
-' তুমি চুপ কর,কী হল সুবোধবাবু মেয়েকে বলুন একটু মুখটা ধুয়ে আসতে।'
হঠাৎই ভেতর থেকে ওর দিদি ভেতরে আসে ওর হাতে মগে জল,ক্লিনজিং মিল্ক আর তুলো। বলে ওঠে,' আমার হয়ত এখানে আসা উচিত নয়। তবে দোষ যখন আমার তাই আমাকে দায় নিতেই হবে। ও বারবারই বারণ করেছিল আমিই জোর করে একটু মেকআপ করে দাগটা ঢেকে দিয়েছিলাম। নিন দেখুন,আপনাদের সামনে সব তুলে দিচ্ছি।'
রাগে অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করে শৈলীর,লোকগুলো কী! আসুন বলল তাও যাচ্ছে না। আর দিদিয়াই বা কী? সবটাই ওর জন্য হয়েছে.. বাবা মাও দায়ী।
ততক্ষণে তুলোর টানে শৈলীর মেকআপ উঠে গেছে। জলে ভেজা নিটোল মুখটা অভিমানে রাগে লাল হয়ে গেছে, বাম গালের দাগটাও স্পষ্ট হয়ে দাঁত বের করে হাসছে। ও উঠে দাঁড়ায়,না আর এক মুহূর্ত নয় এখানে,বলে..' দেখেছেন তো? এবার আমি আসি..'
হঠাৎই ভদ্রলোক হা হা করে হেসে ওঠেন,' কী গো গীতা ওকে অনেকটা তোমার শাশুড়িমার মত দেখতে না? মায়ের গালেও তো এমন একটা দাগ ছিল,সেটা অবশ্য ডানদিকে। বাবা মজা করে বলতেন চাঁদে কলঙ্ক। শৈলী ভীষণ ভালো মেয়ে,আমাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে। কী সুন্দর সাদামাটা চাঁদপানা মুখ। আর তাতে হাল্কা কালির দাগ,ওতে কী এসে যায়?'
শৈলী কী করবে ভেবে পায় না,ভদ্রলোক কী পাগল? সুবোধবাবু বলেন,' না না আগে ছেলে দেখুক। তারপরে না হয়...সত্যি আমরা খুব দুঃখিত। আসলে এই দাগটার কথা সবাই জিজ্ঞেস করে তাই..'
হেড মাস্টারমশাই মুচকি হাসেন,' ছেলে আগেই দেখেছে ওকে ব্যাঙ্কে। কী রে তোদের বর্ধমান ইউনিভার্সিটির পাশের ব্যাঙ্কে যাস নাকি মাঝে মাঝে?'
অবাক হয় শৈলী হ্যাঁ যায় তো..কিন্তু কে আবার সেখানে?
শৈলী মাথা নাড়ে।
-' আর কী সেখানেই দেখে তার পছন্দ হয়েছে। আর ঠিকানা জোগাড় করা তো কোন ব্যাপার নয়। সেখান থেকেই তো যোগাযোগ করলাম। ঐ শুধু একটু মাঝে হেডমাস্টারের দাপটটা খাটালাম। এই যে শৈলীর দিদি তুমি রাগ কোর না। মেকআপ কিন্তু তুমি অসাধারণ কর। বিয়েতে তোমাকেই আগে থেকে বুক করে রাখলাম। দাগটা সত্যি ভ্যানিস করে দিয়েছো। কিন্তু যে দাগ দেখেই আমাদের হতভাগাটা প্রেমে পড়েছে সেটা ভ্যানিস হলে চলবে কেন? আমিও তো দেখতে চাই সাদামাটা শৈলীকে..'
শৈলীর মন খুঁজে চলে কে সেই হতভাগা? যে ওর দাগ দেখে ওর প্রেমে পড়ল?
-' কই গো গীতা,শৈলী যে একদম চুপ করে গেল..আমাদের রাজপুত্তুরের একখানা ছবি দেখাও,সে তো আজ আসতেই পারল না।'
একটু লজ্জা লজ্জা করে ছবিটা হাতে নিয়ে একঝলক দেখে শৈলী।
-' কী চেনা যাচ্ছে?'
ছবি দেখে অবাক হয়ে গেল শৈলী, ইশ্ এই তো সেই রাগী কমবয়েসী ব্রাঞ্চম্যানেজার যার সাথে একদিন ওর স্কলারশিপের টাকা তুলতে না পেরে গিয়ে রাগারাগি করেছিল....
হঠাৎই কালবৈশাখীর ঝড় উড়িয়ে নিয়ে যায় একপশলা ভালোবাসা মাখা বৃষ্টি।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment