হঠাৎই প্ল্যান আর বেরিয়ে পড়া,তবে সবটাই হয়েছিল আমাদের স্কুলের পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য জয়িতার জন্য। দলে টেনেছিল দু একজন ছাড়া মোটামুটি সবাইকেই। আমিও রাজি হয়ে গেছিলাম। যদিও উত্তরবঙ্গ আমার ভালোবাসার জায়গা মন ভাসে মাটির গন্ধে,সবুজে ভেজে চোখ আর আমের সুবাসে মেশে ছোটবেলার গন্ধ। মালদা থেকে ভালুকা রোড পর্যন্ত প্রতিটা স্টেশনে মিশে আছে ছোটবেলার কত স্মৃতি আর ভালোবাসার কথা। জায়গার খোঁজ করতে করতে শেষ পর্যন্ত ঠিক হল তাবাকোশিতে যাওয়া হবে কারণ আমাদের হাতে সময় কম আর তাবাকোশির সৌন্দর্য অসাধারণ। চারদিকে চা বাগান ঘেরা একটা সুন্দর নিরিবিলি জায়গা। রাতে বৃষ্টির শব্দ আর রঙ্গভঙ্গ নদীর জলের আওয়াজ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। যদিও আমি গতবছর ঘুরে এসেছি তাবাকোশি তবুও এই সুযোগটা মিস্ করতে মন চাইলো না। সবাই মিলে যাব একসাথে,আর সবাই মহিলা সুতরাং এটার আবার একটা অন্যরকম আনন্দ আছে। জয়িতাই টিকিট কাটলো,এনজিপিতে রিটায়ারিং রুম বুক করল এবং ফেরার টিকিট বন্দেভারতে কাটলো। তাবাকোশিতে হোমস্টে ঠিক করা,গাড়ির সাথে কথা বলা সবই ও করল। বুঝলাম আমাদের সর্বকনিষ্ঠা সদস্যটি খুবই পারদর্শী সব ব্যাপারেই। আর সফর শেষেও একটা কথাই বললাম সবটাই তোর জন্য সম্ভব হল। তুই এসেছিলি বলে এই জগদ্দল পাথরগুলো একসাথে নড়ল। তাও আবার একদম নর্থবেঙ্গল মানে শান্তিনিকেতন বা ডায়মন্ডহারবার নয়।
প্রতিদিনই আলোচনা হত টুকটাক,সবাই খুবই উত্তেজিত ছিলাম যাওয়াটা নিয়ে। আর অবশেষে যাওয়ার দিন এলো,উঠে বসলাম শতাব্দীতে। তার আগে মিট করলাম সবাই বড় ঘড়ির কাছে। অবশ্য দুজনের আসতে দেরি হওয়ায় প্রত্যেকে খুব চিন্তিত হলাম। যাক শেষ পর্যন্ত নিশ্চিন্তে দুগ্গা বলা। আমাদের অন্যতম কনিষ্ঠা কলিগ যার উৎসাহে বেরোনো সে আগেই বুক করে রেখেছিল রিটায়ারিং রুম। সুতরাং আনন্দযাত্রার দীর্ঘপথ অতিক্রম করে হাসি আর মজাতে আমরা পৌঁছে গেলাম প্রায় পৌনে এগারোটা নাগাদ এনজিপিতে। সেখানে গিয়ে ঘর পেতে আরও মিনিট পনেরো মত লাগলো। এনজিপিতে তেমন ভালো হোটেল নেই একদম স্টেশনের কাছে সেই তুলনায় এখানকার ঘর আমার কাছে ভালোই লাগলো। বেশ বড়সড় ঘর,লাগোয়া বাথরুম আর তাতে গিজারও আছে। সুতরাং একরাতের থাকার জন্য ঠিকঠাক সব। আমরা খেয়ে এসেছিলাম ট্রেনেই সুতরাং ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়া। পরদিন সকালে আমাদের গাড়ি আসবে। বেশ ঘুমিয়ে পড়লাম আর পরদিন একদম ভোরে ঘুম ভেঙে গেল ইঞ্জিনের ধকধকে,সবাই ফ্রেশ হলাম যে যার ঘরে। আমরা চারটে ঘর নিয়েছিলাম। সব ডাবল বেড ছিল। পাশেই ব্রেকফাস্ট পাওয়া যাচ্ছে সুতরাং সেখানে টোস্ট আর চা খেয়ে যাত্রা শুরু করলাম। হোমস্টে থেকেই দুটো গাড়ি সাড়ে সাতটার মধ্যে এসে গেছিল।
আমরা এগোতে শুরু করলাম,আমাদের মধ্যে যোগ দিল আরেকজন সদস্য। সুতরাং দশ হয়ে গেলাম সংখ্যাতে।
গাড়ি এগোতে শুরু করল পাহাড়ের পথে। চা বাগানের সবুজে মন ভরে গেল। আমাদের কথা ছিল তাবাকোশি যাবার পথে আমরা মিরিক আর গোপালধারা হয়ে যাব। সুতরাং সেই পথেই এগোনো,মিরিক ঘুরে এগিয়ে গেছিলাম তাবাকোশির পথে। মাঝে টুক করে গোপালধারাতে নেমে চাবাগানের সবুজে ডুবে গেছিলাম সবাই কিছুক্ষণের জন্য,উড়ে গেছিলাম প্রজাপতির মত ডানা মেলে। সত্যি বলতে কী উত্তরবঙ্গের এত সৌন্দর্য্য যে এখানে এলে মনে হয় পাহাড়ের কোলে ফুল দিয়ে সাজানো কোন একটা বাড়িতে থেকে যাই। অথবা ঐ যে দূরে চাবাগানের মাঝে যে ছোট্ট দোতলা বাড়িটা আছে সেখানে থাকলে তো আরও ভালো হত। আমরা দলে যেহেতু দশজন ছিলাম সুতরাং আমাদের কিচিরমিচির আর ফটোশুটে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। আমাকে দেখে কে বলবে যে আমি এর আগেও এখানে এসেছি। আসলে বয়েস যত বাড়ছে তত প্রতি মুহূর্তের জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করে। একটা দিন বা কয়েকটা ঘন্টা খারাপ কাটলে মন খারাপ হয়। আবার কোনদিন খুব ভালো কাটলে ভীষণ ভালো লাগে।
যাই হোক আবার সবুজে চোখ ডুবিয়ে মনকে মেঘেদের হাত ধরে ভাসিয়ে দিয়ে আবার আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের গন্তব্যে। ছোট পাহাড়ি পথ বেয়ে আসছে চা পাতা তোলার জন্য মেয়েরা। যারা বাগানে গিয়ে চা পাতা তুলবে। এই পথের দৃশ্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অনন্য।
আমরা মোটামুটি পারফেক্ট লাঞ্চ টাইমে পৌঁছে গেলাম তাবাকোশি। আগের বার রঙ্গভঙ্গ নদীর পাশেই ইয়োমলোতে ছিলাম এবার আরেকটু উঁচুতে উঠে এলাম। হোমস্টের নাম তাবাকোশি টি ভিলেজ রিসর্ট। এইসব পাহাড়ের হোমস্টেতে আন্তরিকতা একটা অঙ্গ,সুন্দর ভাবে আপ্যায়ন করে এরা ভালো লাগে। আমরা ব্যাটেলিয়নরা যে যার ঘরে ঢুকে পড়লাম ফ্রেশ হতে। পেটে তখন চুঁই চুঁই সুতরাং খাবার টেবিলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সবই গরমাগরম খানা,সুতরাং অমৃত।ভাত,ডাল,আলুভাজা,পাঁপড়ভাজা,স্কোয়াশের তরকারি আর ডিমের ঝোল দিয়ে একদম চাকুমচুক আর হুস হাস করে প্লেট সাফ করে দিলাম। যারা ডিম খেল না তাদেরটাও আমাদের পেটেই গেল।
বেশ কিছুটা হাসি মজার পর একটু গড়াগড়ি করতেই ঘুমিয়ে পড়লাম কারণ শরীর ক্লান্ত ছিল। সন্ধ্যেতে ঘুম ভাঙলো চা আর পেঁয়াজির ডাকে। আমরা আবার তার সাথে এক গামলা মুড়ি মাখলাম। একটু চিন্তা ছিল উঠবে কিনা সবটা,তবে একদম উঠে গেল সব কিছু। আমাদের চা পানের মাঝেই টিনের চালে খটখট আওয়াজ শুনে বুঝলাম শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। আর কোথায় যায়,সবাই বেরিয়ে পড়লাম শিল দেখতে। অনেকদিন বাদে এমন শিল পড়তে দেখলাম। উঠোনে তখন ছড়ানো শিল।
আমাদের দলে যারা বাচ্চা ছিল,তাদের সাথে আমাদের মধ্যেও দুএকজন চলে গেলো লুডো খেলতে। ততক্ষণে শিল পড়া থেমেছে তবে বৃষ্টি হচ্ছেই। সত্যিই পাহাড়ে বৃষ্টির একটা আলাদা মাধুর্য আছে মন ভরে যায় বৃষ্টির রিমঝিম আওয়াজে। আমরা কয়েকজন বিভিন্ন টপিক নিয়ে জমিয়ে খাটে বসে কম্বলে পা মুড়িয়ে আড্ডা মারলাম।
ওরা আগেই বলে রেখেছিল সাড়ে নটার মধ্যে খেয়ে নিতে। সুতরাং আমরা সময় হতেই চলে গেলাম ডাইনিং হলে। রাতে রুটি,ভাত,চিকেন,ডাল,সব্জি সব ছিল। তবে আমাদের তখন আর খিদে নেই। আরে এত খাবার পর আর কী খিদে থাকে? যাক ঐ যতটুকু পারা যায় খেলাম। তারপর ঘরে ফিরলাম সবাইকে শুভরাত্রি জানিয়ে। বৃষ্টির টুপটাপ আওয়াজ আর আমার রুমমেট কোলিগের সাথে গল্প করতে করতে একটা সময় চোখ জুড়িয়ে এলো গরম কম্বলের আশ্রয়ে। পরদিন ভোরে ঘুম ভাঙলেও একটু গড়াগড়ি খেলাম। এমনিতে সেদিনটা ওখানে থাকার প্ল্যান থাকলেও একটু এদিক ওদিক না ঘুরলে হয় নাকি? মানে টুকটাক সাইটসিয়িং। সকালে গাঢ় চা আর লুচি,তরকারি এবং ডিমসেদ্ধ সহযোগে ব্রেকফাস্ট বেশ হল। ততক্ষণে সবাই মোটামুটি রেডি হয়ে গেছে।
প্রথমে আমরা সীমানায় গেলাম,এটা বর্ডার অঞ্চল। এখানে একটা গ্ৰেভইয়ার্ডের ওপরে বাজার বসে। ওদের কাছে শুনলাম এটা পরিত্যক্ত এখন। যাই হোক এখানে এসেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল শপিং করতে। মানে যা পাওয়া যায় টুকটাক সেখান থেকেই বাড়ির জন্য কেনাকাটা করল।
তারপর জোড়পোখরী হয়ে এক জায়গায় চা কিনে,টেস্ট করে বেশ অনেকটা সময় কাটিয়ে আমরা এগোলাম লেপচজগতের দিকে। লেপচাজগত তখন কুয়াশার ঘোমটা জড়ানো,কাঞ্চনজঙ্ঘা ঢেকেছে কুয়াশায়। শুধু শনশনে হাওয়া আর মেঘলা আকাশ। খুব অল্প সময় সেখানে কাটিয়ে রওনা দিলাম আরও উঁচুতে ঘুমের দিকে। একবার প্ল্যান হয়েছিল দার্জিলিং যাব কিন্তু ওদিকে জ্যাম থাকে বলে আর এগোলাম না। ঘুম আমার খুব প্রিয় জায়গা,অদ্ভুত নস্টালজিয়ায় ভাসি এখানে এলে। একটা ভালোলাগা ঘিরে রাখে। তখন কোন ট্রেন ছিল না স্টেশনে। শুধু একটা ইঞ্জিন ধকধক করে গেল। কিছুক্ষণ স্টেশনে কাটিয়ে একটু কফি আর চা খেয়ে আবার যাত্রা হোমস্টের দিকে। কারণ আমাদের হোস্ট বলে দিয়েছিলেন আমরা যেন সাড়ে তিনটের মধ্যে ফিরি। তবে কেউ কথা রাখেনি তাই আমরাও ইচ্ছে থাকলেও কথা রাখতে পারলাম না সুতরাং আমাদের ফিরতেও দেরি হয়ে গেল প্রায় চারটে দশ পনেরো হয়ে গেল। তবে গিয়েই হাত ধুয়ে চটজলদি বসে পড়লাম সবাই টেবিলে আর হাপুস হুপুসে সব চালান দিতে শুরু করলাম পেটে। দুদিন থাকলে ওরা নাকি পরের দিন মাছ খাওয়ায়,সুতরাং মাছ ছিল টেবিলে। আর মাছ থাকলে বাঙালীর আর কী চাই? তাই ডাল তরকারি ভাজা সহযোগে মাছের ঝোল দিয়ে মাখা গরমভাত চালান হল ক্ষুধার্ত পেটে।
আজ আর কম্বলের ডাকে সাড়া দিলাম না,কারণ পড়ন্তবেলাটা তাহলে আর দেখা হবে না। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম সামনের পাহাড়ে আস্তে আস্তে ম্লান হচ্ছে দিনের আলো। পাখিরা ঘরে ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছে। আমাদের ছুটকি দুটোর প্ল্যানে সবাই এক পোশাক কিনেছিল,বাকি ছিলাম আমরা দুই। একজনকে আর রাজি করানো গেল না আর আমি বললাম আমি ঐরকম একটা কিছু পরে ম্যানেজ করে নেব। এসব ব্যাপারে আমি খুবই উৎসাহী,সাজটাকে আমি আগে থেকেই চোখে গুছিয়ে নিতে ভালোবাসি।
জামা কিনলে কী হবে? এইসব ল্যাদ খাওয়া পাবলিকদের তৈরী করানো কী সহজ? যাই হোক ডেকে হেঁকে সব ঘরে হানা দিয়ে ওদেরকে রেডি করালাম ফটোশুটের জন্য। সত্যিই এক পোশাকে দারুণ লাগছিল সবাইকে। আমাদের হোমস্টের মালকিনও অভিভূত হলেন সবাইকে দেখে। তিনিই বললেন সামনের বাগানে চলে যেতে ফটো তুলতে। সত্যি জায়গাটা দারুণ ছিল ফটোগ্ৰাফির জন্য। নানা পোজে ওদের ছবি তুলে দিচ্ছি এমন সময় আমাদের ছোট বোন স্বাগতা এসে আমাকেও ওদের মাঝে ঢুকিয়ে দিয়ে খুব সুন্দর একটা পোজে সবাইকে গুছিয়ে ছবি তুলে দিল। সত্যিই বোধহয় নবীন প্রজন্মের কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার থাকে। সন্ধ্যে নামার আগেই আমাদের হোমস্টের ভদ্রলোক ক্যাম্পফায়ারের আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। হাল্কা শীতে সেই আগুন বেশ আদরণীয় লাগছিল।
একটু বাদেই এল গরমাগরম মোমো আর চা। বেশ আয়েশ করে সবাই শরীরকে আগুনে তেতে নিয়ে মোমোতে মেতে উঠলাম। তবে ঐ যে প্রকৃতি,তিনি আমাদের আরেকটু আরাম দিতে বৃষ্টি নামালেন। তাই আমরা এসে বসলাম ডাইনিং স্পেশে। সেখানেই পূর্ণ হল বাকি আনন্দটুকু মন ভরে। রাতের খাবার টেবিলে বসে মনে বাজলো বিষাদের সুর চলে যেতে হবে এই অসামান্য প্রকৃতিকে ছেড়ে তবুও যেতেই হবে কারণ একগাদা দায়দায়িত্ব আর চাকরির টান রয়েছে সুতরাং রাতে কম্বলে ঢুকে পড়লাম। পরের দিন গরম গরম আলুপরটা,ফুলকপির ভাজি আর আচার এবং ডিমসেদ্ধ খেয়ে রওনা দিলাম এনজিপিতে। আমাদের ফেরা ছিল বন্দেভারতে। সুতরাং জিনিসপত্র গুছিয়ে আবার পাহাড়ের শোভা চোখে মাখতে মাখতে ফেরা সেই পরিচিত এনজিপিতে।
Comments
Post a Comment