Skip to main content

কাজল নয়না

-সত‍্যি বহ্নিদি আমার মনে হয় তোমার ঐ কাজলকালো চোখের দীঘিতে হাঁস না হলেও যদি মাছি হয়েও ডুবে যেতে পারতাম তো বেশ হত।

-'ইশ্ খুব ফিচেল হয়েছিস তাই না? দাঁড়া তোর হচ্ছে। আরে আমার চোখের দীঘিতে মাছি হয়ে ডুব মারলে তো আমার চোখ দুটোই তো যাবে। তারপর মরে গিয়ে সারাক্ষণ চোখ গেল,চোখ গেল বলে কাঁদব।'

-বালাই ষাট,অমন কথা বলতে নেই,তুমি এমন বললে তো সন্দীপ দা আমাকে পেটাবে। হায় রে যদি এই বান্দা ছেলে হত..তবে সন্দীপদাকে লেঙ্গী মেরে তোমাকে ইলোপ করতাম। আই লাভ ইউ বহ্নিদি।
      বহ্নিদি কথাগুলো শুনে পাহাড়ি ঝর্ণার মত খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিল। বহ্নিদির চোখদুটোও হেসেছিল হাসির দোলায়। চোখে টানা কাজলের রেখা যেন আরও মায়াবী করে রেখেছিল চোখদুটোকে।
       আমাদের পাড়াতে দুটো বাড়ি পরেই বহ্নিদিরা থাকত। এখনকার মত তখনকার পাড়া কালচার ছিল না। বেশ বিকেল হলেই আমরা জমায়েত হতাম,তাতে খেলাধুলার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনার কথাও হত। আবার নানাবিধ চক্রান্তও হত,মানে কাদের গাছের জামরুল পেকেছে,কাঁচা আমের মাখা কাদের গাছের আমে ভালো হয় এইসব নানাবিধ গল্পও হত। ছোট থেকেই দেখেছি বহ্নিদি আমাদের টিমলিডার আবার আদর্শও বলতে পারো। তাই আমরা বেশ মন দিয়ে দেখতাম ওর সাজগোজ,কাজল পরার ধরন আবার তরতরিয়ে গাছে ওঠা। সত‍্যি কী যে ভালো ছিল সেই দিনগুলো। দেখতে দেখতে আমরা বড় হলাম। আমাদের পাড়ার স্কুলে আমরা পড়তাম। একসাথে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে নাটক করতাম আমরা। বহ্নিদির কাছে আব্দার থাকত তুমি সাজিয়ে দেবে নিজেরটা শেষ করে,তোমার মত কাজল পরিয়ে দিতে হবে। ঠোঁটটা ঠিক তোমার মত ভরাট করে রাঙিয়ে দাও। তোমার নতুন লিপস্টিক লাগাতে দিয়ো একটু। এমন কত আব্দার যে করতাম তার ঠিক নেই। বহ্নিদি নিজে সাজগোজ করে আমাদের কারও ঠোঁটে লিপস্টিক আবার কারও চোখে নিপুণ হাতে কাজলের রেখা টানত।
    আয়না দেখে বলে উঠতাম আমাকে তোমার মত সুন্দর লাগছে না তো..তোমার চোখে কী সুন্দর লাগে কাজলের ছোঁয়া।
  -' কী পাজি দেখ! এই নিজে সাজ যা..কত সুন্দর করে সাজিয়ে দিলাম বলে কী না ভালো হয়নি।'
   আমি বলতাম,ভালো হয়নি কোথায় বললাম? আমি বলছি আমাকে তোমার মত কাজলনয়না হরিণী লাগছে না..'
 -' দাঁড়া কাকিমাকে বলছি,মেয়ে তোমার পড়াশোনা না করে কবিতা আর গল্প লিখে লিখে দিন দিন একদম ডেঁপো হয়ে যাচ্ছে। পাকাবুড়ি একটা...'
   আমি প্রতিবাদ করে উঠেছিলাম,আবার মাকে কেন? প্লিজ বোলো না। তাহলে আমার কবিতার খাতা ছিঁড়ে পুকুরে ফেলে দেবে। তোমাকে ভালোবাসি তাই আব্দার করি তুমি এমন করলে তো...
  বহ্নিদি জড়িয়ে ধরেছিল,পেয়েছিলাম গায়ের মিস্টি গন্ধ। আবার বলেছিলাম কী মেখেছো গো আমার গায়েও দাও না একটু..কী সুন্দর গন্ধ।
-' এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না,সব চাই ওর যা দেখে আমার।'
  তারপর আমার আব্দার মেনে ব‍্যাগ থেকে ছোট্ট একটা শিশি বের করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিল আমার কানের পাশে,হাতে।
    আমাদের ঐ ছোট্ট গ্ৰামে থেকে বহ্নিদি এত আধুনিক কী করে হল তা ভাবলেই অবাক লাগত বড় হওয়ার পর। সবচেয়ে সুন্দর লাগত ওর কাজল পরা চোখদুটো। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম ছোটবেলায় চোখ ব‍্যথা করত বলে জেঠিমা গরম কাজল চোখে পরিয়ে দিত আর সেই থেকে কাজল পরা অভ‍্যেস হয়ে গেছিল।
    আর আমার বলা কথা একদিন সত‍্যি কাব‍্য হয়ে এসেছিল বহ্নিদির জীবনে। আমি তখন উচ্চমাধ‍্যমিকের দরজায়,বহ্নিদি কলেজে পড়ছে হঠাৎই আমাদের বাড়িতে সন্দীপদা এল পুজোর ছুটিতে। সন্দীপদা,দাদার বন্ধু তখন যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে ফাইনাল ইয়ারে। শহর থেকে গ্ৰামে এসে তো রীতিমত মুগ্ধ সন্দীপদা শশা মুড়ি হোক বা নারকেল চিঁড়ে মাখা হোক সবই তার মুখে অমৃতের মত লাগছে। আমাদের সাথে সুন্দর মিশে গেল সন্দীপদা,আলাপ হল বহ্নিদির সাথেও। প্রতিদিনই বিকেল হলে নদীর বাঁধের ওপর আমাদের আড্ডা বসত। হাসি গল্পে দারুণ জমে উঠত সেই আড্ডা। পুজোর পর বিজয়া সম্মেলনীতে আমাদের পাড়াতে আমরাই একটা ছোট জলসা করতাম। ছোট্ট নাটক একটা,তার সাথে গান আর আবৃত্তি কিছু নাচ এইসব। চুপিচুপি বলি,নাটকটা বড় হওয়ার পর আমিই লিখতাম। সবাই প্রশংসাও করতেন,আমার উৎসাহ বাড়ত। যদিও মায়ের কাছে মাঝেমাঝেই বকুনি খেতাম,মা বলতেন..' শুধু সারাদিন ঐ কবিতা আর গল্প লেখার খাতা নিয়ে আছিস। পড়াশোনা না করে কী মূর্খ কবি হবি নাকি?'
        আমাদের নাটকে বরাবরের মত এবারও বহ্নিদিই মেন রোলটা করবে। আমিও অবশ‍্য নিজে একটা রোল নিয়েছি। বহ্নিদি যখন মেকআপ করে এলো,তখন আমি বলে উঠলাম হঠাৎই..মম শিরশি মন্ডনম্,দেহি পদপল্লব মুদারম। শ্রী রাধিকা তোমাকে দেখে যে আমি চোখ ফেরাতে পারছি না। যৌবনের কুসুম রাঙা আবরণ আর তোমার প্রসাধন তোমাকে তো অনন‍্যা করে তুলেছে একদম..'
   বহ্নিদির মুখে লাল আভা ছড়ায়,' ফিসফিসিয়ে বলে,হ‍্যাঁ রে ভালো লাগছে আমাকে দেখতে? আর চোখটা? মানে কাজলটা ঠিক আছে তো?'
  -একদম ঠিক আছে,এবার দয়া করে আমাকে একটু প্রসাদী কাজল ছুঁইয়ে দাও দেখি।
   কাজল পরাতে পরাতে হঠাৎই বহ্নিদি জিজ্ঞেস করে, 'হ‍্যাঁ রে দাদা আর সন্দীপদা কী আসবে?'
  আমি একটু অবাক হই,তারপর বলি, হ‍্যাঁ আসবেই তো। আর ওরা কী যেন করবে..আমাদের ছাদের ঘরে দুজনে কিসব প্র‍্যাকটিস করছিল দরজা দিয়ে।
   বহ্নিদি আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ওর শরীরে সুগন্ধ ছড়ানো তারপর ফিসফিস করে বলে লাজুক হেসে,' কী করবে ওরা জানিস?'
   আমি সব জেনেও ঠোঁট ওল্টাই,কী জানি? দেখতেই তো পাবে খানিক বাদে। ভেতরে ভেতরে মিটমিটিয়ে হাসি আর মজা পাই খুব। মনে মনে ভাবি আমি তো সবই জানি। বহ্নিদি কী হল তোমার? হঠাৎ দাদাদের খোঁজ কেন শুনি? তুমি আমাকে যতই ছোট বলে ইগনোর করো আমি কিন্তু সব বুঝতে পারছি। তবে দাদাটা ভীষণ পাজি,কিছুতেই বলল না ওরা কী করবে?
 শুধু বলল,'কিছু একটা করব,তোর কী এত মাথাব‍্যথা,সারাক্ষণ এই নাটক কবিতা নিয়ে আছিস তাই তো দেখছি। সামনে পরীক্ষা না? ভালো না করতে পারলে কানমলা খাবি একদম।'
    খুব রাগ হয়েছিল মনে মনে ভাবলাম কতক্ষণ আর লুকাবে? যখন স্টেজে উঠবে তখন তো সবাই দেখবে আর শুনবে।
   যাক ব‍্যাপারটা যে সামথিং সামথিং অনুরাগ মেশানো তা আমার যৌবনে পা রাখা মন বুঝে গেল।
     বহ্নিদিকে দারুণ দেখাচ্ছিলো আর আমরা সবাই বেশ ভালো করে অভিনয় করে দারুণ উৎরে দিলাম নাটকটা। ও একটু লজ্জা লজ্জা করেই বলি আমি আবার একটা মেডেলও পেলাম লেখা এবং নির্দেশনার জন‍্য। দেখলাম নাটক চলাকালীন দাদা তার বন্ধুকে নিয়ে একদম সামনের আসনে বসে আছে। আমার মা বাবা,বহ্নিদি আর সবারই মা বাবারা এসেছিলেন।
    আমাদের নাটক শেষ হবার পর আমরা সবাই মঞ্চে উপস্থিত হতেই দেখলাম চরম উৎসাহে হাততালি দিচ্ছে আমাদের বাড়ির মানুষজন। আর দাদা এবং সন্দীপদার উৎসাহ দেখার মত।
       দু একটা নাচ হবার পরই দাদা এবং সন্দীপদা গিয়ে স্টেজে উঠল। ততক্ষণে আমরাও একদম মেকআপ তুলে পরিস্কার হয়ে বসে পড়েছি অনুষ্ঠান দেখতে। তবে দাদা আর সন্দীপদার প্রোগ্রামের গান শুনে অবাক হয়ে গেলাম। গীটার বাদক দাদা আর গায়ক সন্দীপদা গান ধরল,ওগো কাজল নয়না হরিণী..
    পাশে বসে দেখলাম বহ্নিদির চোখে ঝিকমিক করছে তারার মেলা আর গালে আবীরের রঙ লেগেছে। আমি ঠেলা দিলাম,ফিসফিস করে বললাম কেমন ষড়যন্ত্র দেখেছো? যে গান আমি তোমাকে ডেডিকেট করেছি সেই কবেই সেটা ওরা চুরি করল? আর তোমার দিকেই তাকিয়ে তো গাইছে সন্দীপদা। দেখেছো দুজনের মুখে কেমন মুচকি হাসি। আজ আমার সাথে দাদার ঝগড়া হবে। পেছনের মহিলা বিরক্ত হলেন ওরা কথা বলছে বলে। 
 তবুও আমি বলি,কী গো কিছু বলবে না? এটা ভীষণ অন‍্যায়..
  বহ্নিদি একটা ঘোরের মধ‍্যে যেন তারপর বলল,' সন্দীপদা কিন্তু দারুণ গায়,আর শিবাশীষদাও তো দারুণ বাজাচ্ছে।
  হায় ভগবান কী বলছি আর কী বলছে? এই মেয়ে গেছে একদম। দাদা কলকাতায় গীটার শিখছে,হিরোগিরি করতে হবে না?
    গান থামতেই আওয়াজ উঠলো,আরেকটা হোক। সন্দীপদা একবার লাজুক মুখে এদিকে তাকিয়ে ধরল লাজবতী নূপুরের রিনিঝিনি ঝিনি। বুঝলাম যে হেমন্তের গানে দখল আছে সন্দীপদার।
      যাক গে অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পথে ওরা বারবারই পিছিয়ে পড়ছিল। আমার খুবই রাগ হচ্ছিলো। তারপর আমাকে বকুনিও খেতে হল আমরা কথা বলছি,তুই ছোট বুঝবি না।
   কিছুটা তখন বুঝলেও বাকিটা পরে বুঝেছিলাম যে সন্দীপদা বহ্নিদি মানে কাজলনয়না হরিণীর প্রেমে একদম লাট্টু। আর বহ্নিদিও সন্দীপদার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
      সন্দীপদা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ভালো চাকরি পেয়ে গেছিল। তবে প্রথমে ওদের বাড়িতে খুবই আপত্তি ছিল,কারণ সন্দীপদা বামুন আর বহ্নিদিরা কায়স্থ। তবে বেশ কিছুটা বাধাবিপত্তি কাটিয়ে বিয়েটা হয়ে গেছিল। শুনেছিলাম সন্দীপদা খুব ভালোবেসে চোখের মণি করে রাখলেও শাশুড়িমা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি বহ্নিদিকে। 
    আমার জীবন থেকেও কাজলনয়না বহ্নিদি দূরে চলে গেল। কারণ আমি যখন আসতাম গ্ৰামে দিদি আসত না। এমনিতেই বাপের বাড়ি কম আসত সে।
     দিন পেরোলো,দাদাও চাকরি নিয়ে আমেদাবাদে চলে গেল। আমিও প্রথমে কলেজে পড়তে গেলাম বাইরে তারপর মুম্বাইয়ে এমবিএ করতে এলাম। তার মাঝে দাদা আবার চলে গেল বিদেশে। বাবা মা বিয়ে দিতে চাইলে বলল বিদেশ থেকে ফিরে ভাববে। এত তাড়াতাড়ি সে নিজেকে সংসারে জড়াতে রাজি নয়,তারপর হেসে বলল,' তোমরা বরং বোনের বিয়েটা দিয়ে দাও। আমি কিন্তু খুচরো খবর পাচ্ছি। মা কী কিছু জানো?'
       আমি চেঁচাই,' না না সব ভুল ভাল বলছে,আমি এখন বিয়ে করব না। আগে চাকরি করব তারপরে। দাদার খবর নাও তোমরা,কী রে তোর গুজরাটি বান্ধবীর কী খবর?'
   দাদা ছোটবেলার মত কান ধরতে আসে আমি পালাই।
****************************
আরও দুটো বছর কেটে গেছে আমি একমাসের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছি। দাদাও ফিরবে বিদেশ থেকে। আমার পাত্র আমিই দেখেছি দিন পনেরো বাদে বিয়ে। 
         মায়ের কাছে শুনলাম বহ্নিদিকে নিয়ে এসেছে জেঠিমারা। গতবছর মুম্বাই থাকার সময়ই শুনেছিলাম হঠাৎই পাঁচদিনের জ্বরে চলে গেছে সন্দীপদা। বেশ কয়েকটা দিন মনটা ভারী হয়েছিল,একদিন সাহস করে ল‍্যান্ডফোনে ফোন করেছিলাম ওর শাশুড়িমা ধরেছিলেন। বহ্নিদিকে ডেকে দিতে বলতেই ফোনটা নামিয়ে রেখেছিলেন।
       আমাদের গ্ৰামের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমরাও কত বদলে গেছি। বদলে গেছে আমার ছোটবেলার কাজলনয়না বহ্নিদি। হঠাৎই মনটা ভারী হয়ে যায় বলে ফেলি,' তুমি কাজল পরো না আর বহ্নিদি? কেন? তোমার নিরাভরণ মুখটা আর চোখদুটো আমাকে কেমন যেন কাঁদাচ্ছে। সত‍্যি তোমাকে চিনতে পারছি না।'
   বহ্নিদি আমাকে জড়িয়ে ধরে,' মিলি তুই এখনও কবিতা লিখিস বুঝি? কতদিন এমন করে কেউ আমাকে ডাকেনি তোর সন্দীপদা চলে যাবার পর। ধ‍্যাৎ পাগলী আমি তো বিধবা,এত সাজতে নেই। অবশ‍্য শাশুড়ি কাজল পরা পছন্দ করতেন না বলে ঐ শখটুকু কবেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে তোর সন্দীপদা বললে তখন পরতাম ও ভালোবাসত আমার সাজগোজ। শাশুড়িমা তো বলতেন সেজেই ভুলিয়েছি ওঁর হীরের টুকরো ছেলেকে। আমার চোখটাই তাঁর অপছন্দ ছিল।'
    আমি কেঁদে ফেলি হঠাৎই,কাঁদে বহ্নিদিও। আমি বলি,তোমার চোখদুটোই বেশি পছন্দ আমার। সেই কাজল পরা দুটো চোখ। তুমি আবার কাজল পরো বহ্নিদি,আমার জন‍্য। তুমি তো জানো একসময় আমি তোমার প্রেমে পাগল ছিলাম। কথাটা বলে নিজেই হাসি,হাসে বহ্নিদিও। তারপর বলে,' তোর তো বিয়ে,কেমন সে? ভালো করে জেনে নিয়েছিস তো তাকে?'
   আমি ছোটবেলার অভ‍্যেসে বহ্নিদির গায়ের গন্ধ নিতে নিতে বলি,ভালোই তো মনে হয়। তবে মানুষ চেনা কী এত সহজ? তুমি কিন্তু আসবে আমার বিয়েতে। তুমি আমাকে কাজল পরিয়ে দেবে তো?'
  বহ্নিদি হাসে,' ধুৎ এখন কী তুই তেমন ছোট নাকি? আর কত বিউটি পার্লার আছে। আমি আর কাজলের রেখা টানতে পারি না হাত কাঁপে।'
    তাকিয়ে দেখলাম কত বয়েস আর হবে বহ্নিদির? আমার থেকে তিনবছর মত বড় ছিল। এই কয়েক বছরে কেমন যেন হয়ে গেছে। সময় আর সম্পর্কের ক্ষত বড় তাড়াতাড়ি মানুষকে বয়স্ক করে দেয়।
     বহ্নিদি আসবে না বলে জেদ ধরলেও আমার জেদের কাছে পারেনি। আমি সবাইকে বলে তাকে মোটামুটি হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছিলাম বাড়িতে। জোর করে আইবুড়ো ভাতের দিন কাজল পরেছিলাম বহ্নিদির কাছেই। আমার চোখে কাজলের রেখা টেনে,ঠোঁট এঁকে গায়ে সুগন্ধ ছড়িয়ে বলেছিল,' মিলি তুই আর বড় হলি না। এত জেদ না তোর..'
  আমি বলেছিলাম হবে না,এবার কপালে একটা চুমু দাও। জড়িয়ে ধর আদর করে।
 -' পাগলী একটা এখন তো আমি তোর প্রেমে পড়ে যাচ্ছি। কী সুন্দর লাগছে তোকে!..'
   হঠাৎই বহ্নিদি চুপ করে যায়,আমি তাকিয়ে দেখি দাদা এসেছে। দাদা বরাবরই ভালো ছাত্র,এবং একটু চুপচাপ। তাই নিজের জগতে থাকত বলে আমাদের সাথে খুব একটা মিলত না।
   আজ দাদাই এগিয়ে আসে,' মিলি,সত‍্যি তুই কত বড় হয়ে গেছিস। মনে আছে স্কুলে যাবি না বলে খাটের তলায় লুকিয়ে থাকতিস। আমি কাঠি দিয়ে খোঁচাতাম তোকে..'
-' তা তো খোঁচাবিই,নিজেকে যে জেঠু ভাবতিস সবসময়।'
-' বহ্নি কেমন আছিস? অনেকদিন বাদে তোকে দেখলাম।'
-' ঠিক আছি শিবাশীষ দা,ও মাঝেমাঝেই বলত তোমার কথা। তুমি বাইরে চলে গেলে,যোগাযোগ কমিয়ে দিলে। ও বলত তোমার জন‍্যই তো আমাদের বিয়েটা হয়েছিল..'
  দাদা হঠাৎই চুপ করে যায়। তারপর বলে,' আমি আসি রে.. ও হ‍্যাঁ বহ্নি সময় তো থেমে থাকে না। তুই নিজেকে আবার একটু করে গুছিয়ে নে,প্রলেপ দে ক্ষতে। আবার কাজল পরা..'
   ওদিক থেকে বাবার ডাক শুনে দাদা চলে যায়। আমি বলি দেখেছ তো দাদাও লক্ষ‍্য করেছে তুমি চোখে আর কাজল পরো না। কী যেন বলছিল...
    বহ্নিদির কোন নিষেধ না শুনেই আমি ওর চোখে কাজল পরিয়ে দিই। আর মুহূর্তে শুকিয়ে যাওয়া চোখদুটো ভরা দীঘি হয়ে ওঠে আবার..হয়ত সেই দীঘি কিছুটা ছোট এখন তবুও তাতে ছাপিয়ে নামল বর্ষা আর সেই জলে কাজল লেপল। হঠাৎই খুব কাঁদলো বহ্নিদি।
      আমার বিয়েটা ভালোভাবেই হয়ে গেছিল অমিতের সাথে। তবে ওপরের বাসরঘরে অমিতের সাথে রাতে গল্প করতে করতে হঠাৎই রবিঠাকুরের শেষের কবিতা অমিতের সাথে একসাথে পড়ার ইচ্ছে হয়েছিল। আর বইটা বের করতেই একটা পৃষ্ঠার ভাঁজের ভেতর থেকে টুপ করে পড়েছিল একটা পুরোনো চিঠি। অমিত ঝুঁকে পড়লেও আমি ওকে বকেছিলাম,একদম নয়,অন‍্যের চিঠি পড়তে নেই।
-' কার প্রেমপত্র, তোমার নয় তো?'
-হলেই বা কী তোমার?
  তারপর অবাক হয়েছিলাম সেই চিঠিটা দেখে,দাদা বহ্নিদিকে ভালোবাসত একসময়? অথচ বলব বলেও বলতে পারেনি,তার আগেই সন্দীপদা এসে গেছিল আর বহ্নিদিকে দেখেছিল সন্দীপদাকে ভালোবাসতে। সুতরাং ভালোবাসা অব‍্যক্তই রয়ে গেছিল। আমি অতীতে ডুব দিয়ে একে একে দুই করতে চেষ্টা করলাম।
   অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এলাম,তার আগে কদিন অমিতের সাথে কষে প্ল‍্যান হল। 
-' অমিত বলল,দাদা তোমাকে ছোটবেলায় খাটের তলা থেকে খোঁচা মেরে বের করত না? তুমি এবার খোঁচাটা দাও। সত‍্যি তো বয়েস তো মন্দ হল না। এখনও সে ব‍্যাচেলার কেন?কোন মেয়েই তার পছন্দ হয় না কেন? তবে কী সে এখনও খোঁজে তার অব‍্যক্ত প্রেমকে?'
   আমি হাসি,বাপরে আবার কাব‍্যির ছোঁয়া তো তোমাকেও ভাসালো দেখছি? তবে তোমার ভাবটা পাকা গোয়েন্দার মত।
   অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি এলাম,একবার ঢুঁ মারলাম বহ্নিদির বাড়িতে যথারীতি আবার সে কাজল মুছে ফেলেছে। ডাগর চোখে আবার তার একরাশ শূন‍্যতা। তাকে একচোট বকুনি দিলাম। তারপরে রাতে ছাদের আড্ডার আসরে একদম প্রমাণ সহ গ্ৰেপ্তার করলাম দাদাকে। বহ্নিদিকে দেখে বোধহয় মনটা ভিজেই ছিল তাই সহজেই স্বীকার করল। তারপর বলল,' প্রথম একটা জাস্ট ভালোলাগা ছিল। ইশ্ তুই এতদিন বাদে সেটা খুঁড়ে বের করলি..'
-' হুঁ বাবা আমি মিলি গোয়েন্দা,তুমি আমাকে খুঁচিয়ে খাটের তলা থেকে বের করতে আর আমি এই সুযোগটা ছাড়ব কেন? অবশ‍্য সবটাই তোর ভালো ভেবে। ইশ্ যদি সময়ে মনের কথা বলতিস তাহলে সন্দীপদাটা উড়ে এসে জুড়ে বসত না।'
    অমিত মজা করতে শুরু করল। দাদা হেসে বলল,' সন্দীপটা যে ভালো গাইত,আমার গীটার কেউ শুনলোই না।'
-' ঠিক আছে তখন শোনেনি এখন দেখাই যাক না চেষ্টা করে।'
   আমি লেগে পড়েছিলাম,আগে মা বাবার সাথে কথা বলেছিলাম। প্রথমে একটু আপত্তি উঠলেও দাদাও বিয়ে করছে না আর বহ্নিদিও সবার প্রিয় সুতরাং সব ঠিকঠাক হয়ে গেছিল।
    তবে কিছুতেই রাজি করানো যায়নি বহ্নিদিকে, দাদারও কাজের জায়গায় ফেরার সময় হয়ে গেছিল। এরপর আর দুবছর ফিরবে না দাদা। সুতরাং একলাফে বয়েসটা আরও বেড়ে যাবে,শুকোবে বহ্নিদির চোখও। একদিন অনেক করে ওদের একলা দেখা করাতে পেরেছিলাম,বলেছিলাম দাদা গাইতে পারে না তবে সন্দীপদার আগে থেকে তোমাকে ভালোবাসে,আসলে ও তো আমার মত নয়। আমি হলে সোজাসুজি ডুয়েট লড়াইয়ে নামতাম সন্দীপদার সাথে আর ছিনিয়ে নিতাম তোমায়। আমার বৌদি হও না বহ্নিদি প্লিজ। বহ্নিদি আমার ঘাড়ে মাথা রেখেছিল,মনে হচ্ছিল যেন আশ্রয় খুঁজছে একান্ত নির্ভরতায়।
 দাদার ফেরার একসপ্তাহ আগে হঠাৎই মত দিয়েছিল বহ্নিদি অনেক বোঝানোর পরে। খুব সাদামাটা ঘরোয়া পরিবেশে ওদের বিয়ে হয়ে গেছিল। আমি নিপুণ হাতে বহ্নিদিকে যত্নে কাজল পরিয়ে কপালে এঁকে দিয়েছিলাম লাল টিপ। তারপর বলেছিলাম গায়ে সুগন্ধ মাখাতে মাখাতে.. যত কাজল পরিয়েছো এতদিন আজ সব শোধ করে দিলাম। ভরে থেকো ভরিয়ে রেখো।
    কেঁদে ফেলেছিল বহ্নিদি বলেছিল,' তোর মত ননদ যেন সবাই পায় মিলি। খুব সুখী হবি তুই।'
   আমি যত্নে চোখ বেয়ে পড়া মুক্তোদানা মুছিয়ে বলেছিলাম.. বহ্নি আই হেট টিয়ার্স। আমার কথা শুনে হেসে উঠেছিল বহ্নিদি।
    ওরা যেদিন চলে গেল আমি আর অমিত এয়ারপোর্টে এসেছিলাম। পাশাপাশি খুব মানিয়েছে দুজনকে। দাদা ওকে আগলে নিয়ে ভেতরে গেল যাবার আগে আদরে জড়িয়ে গেল দুজনেই আমাদের দুজনকে। বলে গেল, ভালো থাকিস পাকাবুড়ি।
       নতুন দেশে দাদার সাথে ভালো আছে বহ্নিদি। কাজলে আঁকা গভীর কালো দীঘিতে ডুব দিয়ে ভালো আছে দাদাও।
 দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে গেছে,আজ ওরা আসছে। আমি আর অমিত আমাদের ছোট্ট পুচকেকে কোলে নিয়ে আবার এয়ারপোর্টে এসেছি।
     ঐ তো দাদা আর বহ্নিদি,না না বৌদি আর ওদের কোল জুড়ে রয়েছে আমার মিষ্টি ডলের মত দেখতে ভাইঝি। অমিত ফিসফিস করে বলে,'যাক দাদা একটা ব‍্যাপারে কিন্তু পাক্কা খেলোয়াড়ের মত খেলেছে। মানে দেরি করেনি।'
  -' অসভ‍্য একটা,তুমিও কম কী?'
   ওরা কাছে এসে গেছে,আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরি। বহ্নিদির কাজলের রঙ সেইরকম গাঢ় আর নিখুঁত টানে আঁকা। আমার কপালে নয় এবার একদম গালে চুমু দেয় বহ্নিদি।
সমাপ্ত:-
  


Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...