Skip to main content

ডিসট‍্যান্ট রিলেশনশিপ

চড়ুইগুলো এসে বারান্দায় অনেকক্ষণ ধরে কিচমিচ করছে কিন্তু তবুও আজ উঠতে ইচ্ছে করছে না সুনিতার। বড় ক্লান্ত মনটা,যেন বহুদিনের বয়ে চলা শোকের যাত্রাপথ পেরিয়ে সে ভেঙেচুরে গেছে। সুনিতা কান পাতে এক সুরে পাখিগুলো কিচিরমিচির করে যাচ্ছে সমানে,আসলে তন্ময় ওদের অভ‍্যেস খারাপ করেছে। সকালে ফুলগাছকে আদরে জল দিয়ে ওদের পরিচর্যা করার সময়ে এই পাখিগুলোর সাথেও বকবক করত। নিজের জন‍্য ভিজিয়ে রাখা ছোলা আর বাদামের ভাগ দিতে দিতে কত কথাই না বলত। শেষে তো সুনিতা নিজেই রাগ করে বলত,' আচ্ছা এগুলো খাও নিজের শরীর ঠিক রাখার জন‍্য। বল এতে শক্তি হয়,বি টুয়েলভ আছে। তা এই ভিটামিন আর পুষ্টি সবই তো ছাদে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর পাখিদের পেটে যাচ্ছে।'
    তন্ময় হাসত,' আরে ওরা আর কতটুকু খায়,আমিই তো খাই। অতগুলো করে ভেজাও আর কত খাওয়া যায়?'
   একটা সময়ের পর পাখিদের জন‍্য দানাশস‍্য এনে সেগুলোই ছড়িয়ে দিত ছাদে তন্ময়। ওরা আনন্দে খেত সেগুলো। তন্ময় চলে যাবার পরেও সুনিতা সেই গম,ছোলা দিয়ে পাখিদের খেতে দেয় রোজ। প্রথম কয়েকদিন কিছুই করতে পারেনি,তারপর ওদের চিৎকারে মনে হয়েছিল ওরা যেন বলছে আমাদের খুব খিদে পেয়েছে। একটু খাবার দাও। তাই পায়ে ব‍্যথা নিয়ে ছাদে উঠেছে বেশ অনেকদিন পরে। এসে দেখেছে অযত্নে মরে গেছে কতগুলো গাছ,পাখিগুলো ভবঘুরে হয়ে ছাদে ঘোরাঘুরি করছে। অবশ‍্য ওরা তো কিছুটা ভবঘুরেই শুধু খাওয়ার পেলেই হয়ত নিয়মিত অভ‍্যেসে আসে কোন বারান্দায় বা ছাদে। শুকনো গাছগুলো দেখে আবার কান্না পেয়েছিল সুনিতার। তারপর সিঁড়ির ধাপের ঘরটা থেকে কৌটোতে রাখা দানাশস‍্য এনে ছড়িয়ে দিয়েছিল কিছুটা ছাদে। ছাদের কোণের কলটা থেকে বালতি করে জল এনে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে দিয়েছিল গাছগুলোতে। ওরা আনন্দে দুলে উঠেছিল। তারপর থেকে কষ্ট করে উঠেছে ছাদে,আবার পাখিরা আসে দানাশস‍্য খায়। মাটির গামলায় রাখা বাথটবে স্নান করে জল ছড়ায় আনন্দে,কখনও আবার ঠোঁট ডোবায় সেই জলে। সুনিতা কিছুটা সময় বসে থাকে ছাদে। শুকিয়ে যাওয়া গাছগুলোতে আবার একটা দুটো করে পাতা গজিয়েছে। ওরাও যেন সুনিতাকে বলছে এভাবে মরে যেয়ো না। বেঁচে থেকো ইচ্ছেগুলো নিয়ে,তোমার ইচ্ছেগুলো মরে গেলে আমরাও তো শুকিয়ে যাব।  তন্ময় চলে যাবার পর অনেকদিন কোথাও বেরোয়নি সুনিতা। ভাই মাঝেমধ্যে এসে অফিসের কাজগুলো করে দিয়ে গেছে। ওর সাথেই গাড়িতে দুএকদিন বেরিয়েছে বন্ধ কাঁচের আড়ালে। কেমন যেন লেগেছে সব কিছু। আগে তন্ময় সাথে করে নিয়ে যেত সব জায়গাতে। স্বামীর সাথে এক অদ্ভুত নির্ভরতায় হাঁটত,হয়ত বা ঘিরে থাকত এক ভালোলাগাও। ওয়াড্রোব ভরা শাড়ির মধ‍্যে থেকে ভুলভুলাইয়াতে হারিয়ে যাওয়া সুনিতা আদুরে গলায় বলত,' কোন শাড়িটা পরি বল তো আজ?'
-' তোমাকে তো সবেতেই ভালো লাগে সুনিতা,আবার আমাকে কেন জিজ্ঞেস কর। মাথায় খোঁপা বেঁধে কপালে বড় টিপ পরে তাঁত ঢাকাই যা পরো তাতেই তো আমি মুগ্ধ হয়ে যাই।'
    হয়ত বিয়ের এতগুলো বছর পরেও এই কথাটা শুনবে বলেই এত আদুরে অভিনয় করে সুনিতা। সেই কোন কালে ওর প্রেমে পড়েছিল তন্ময়। সুনিতা তখন ক্লাশ এইটে পড়ে। আর তন্ময় ক্লাশ টুয়েলভে। প্রেমের পাঠ তখন তেমন জানা ছিল না ওর,তবে ঐ যে দাদার হেংলু বন্ধুটা মাঝেমধ্যে এসে ওদের পেয়ারা গাছে চড়ে বসে কটরমটর করে ডাসা পেয়ারাগুলো খেয়ে যেত হনুমানের মত সেটা দেখে ওর খুব রাগ হত। 
    চিৎকার করে মাকে ডাকত,' মা দেখ না,একটা হনুমান আমাদের গাছে উঠে সব পেয়ারা খেয়ে যাচ্ছে। তুমি বকো তো..'
   মা ছুটে এসে হেসে ফেলত,' ওমা এযে তন্ময়,ভুলুর বন্ধু তো। ছিঃ অমন বলতে নেই। খা বাবা ইচ্ছে মত। এমনিতেই তো কত বাদুরে খেয়ে ফেলছে।'
   সুনিতা বিড়বিড় করত রাগে,' হ‍্যাঁ, বাদুরে আর বাঁদরেই সব খেয়ে যাক। আমি খাব না কিছু।'
   হঠাৎই দাদা কোথা থেকে উদয় হয়ে বলত,' এই তনু এই হিংসুটি বুড়িটাকে কয়েকটা পেয়ারা পেড়ে দেতো গাছ থেকে। নিজে তো গাছে উঠতে পারে না তাই নালিশ করছে।'
     হঠাৎই ঠকাস করে একটা পেয়ারা ছুঁড়ে দিয়েছিল তন্ময় ওর দিকে বলেছিল,' এই যে লুফে নে দেখি কেমন পারিস।'
   পারেনি লুফতে সুনিতা,হেসে উঠেছিল ওরা দুজনেই। খুব রেগে গেছিল ও। তারপর অনেকগুলো পেয়ারা দিয়ে ওর মান ভাঙিয়েছিলো ওরা। তারপর থেকে পেয়ারা পাড়তে এলেই তন্ময় হাতে করে আনত কখনও কাঁচামিঠে আম,কখনও আচার,আবার কখনও ওদের গাছের জাম বা জামরুল। বলত,' এই নে নাকের বদলে নরুণ দিলাম।'
  সেই তুই তোকারি সম্পর্কে কখন যে অনুরাগের রঙ ধরেছিল বুঝতেই পারেনি। একটু দেখা,ভালোলাগা,খুনশুটি পরিণত প্রেমের রূপ নিয়েছিল ধীরে ধীরে। তন্ময়ের হৃদয়ের পলাশরাঙা রঙে রাঙা হয়েছিল সুনিতার সরলতা মাখা সুন্দর মুখটা। তারপর একটা সময় প্রজাপতি উড়ে এসেছিল পাখা মেলে,আর লাজে রাঙা হয়ে সুনিতা আলতা মাখা পায়ে পা ফেলেছিল তন্ময়দের বাড়ির উঠোনে। সরলতা মাখা হাসিমুখে চন্দনের সাজ আর লাল বেনারসীতে শ‍্যামা মেয়ের রূপের ছটায় আরেকবার মুগ্ধ হয়েছিল তন্ময়। আর তারপর থেকে দোকানে শাড়ি কিনতে গেলেই লাল রঙ ছাড়া কিছু পছন্দ হত না তন্ময়ের। সুনিতা আপত্তি করলেও বলতেন,' তোমাকে লালেই যেন বেশি সুন্দর লাগে। আমি দেখেছি সুনিতা সেই প্রথম দিন থেকেই।'
-' ইশ্ কালো রঙে লাল শাড়ি। প্রথম প্রথম পরেছি ঠিক আছে। তাই বলে এখনও? মেয়ে বড় হয়েছে কলেজে যাচ্ছে।'
-' তুমি কী মেয়ের বড় হওয়ার সাথে সাথে জীবনের রঙকে ফিকে করে দেবে নাকি সুনিতা? আমাদের সবার একটা মন থাকে যদিও সেটা দেখা যায় না। তবুও তার অনুভূতিগুলোকে রাঙিয়ে রেখো গাঢ় রঙের আল্পনায় তবেই তো ভালো থাকবে।'
   সারাদিন হিসেবের খাতায় চোখ রাখা মানুষটা সত‍্যি বোধহয় একটু বেশিই রঙীন ছিলেন মনের দিক থেকে। কালো অক্ষরের অলিগলিতে হেঁটে বেড়ালেও মনের রক্তিম অনুভূতি বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
     চিরকাল দক্ষ হাতে সংসার সামলানোর দায়িত্ব ছিল সুনিতার আর সেটাই অভ‍্যেস হয়ে গেছিল। তন্ময় বললেই বলত,' আমার এত বাইরের কাজ ভালো লাগে না। আমি ঘরের চাকরি টুকু নিলাম,এখানে তো আমিই হোলটাইমার আর বাইরে তুমি।'
   -' একটু অভ‍্যেস কর বাইরেটা দেখতে,না হলে পরে মুশকিল হবে।'
    চায়ের কাপ টেবিলে রাখতে রাখতে হাসত সুনিতা,' তুমি তো আছই সেই কোন মেয়েবেলা থেকে তোমার আদরে শাসনে দিন কেটেছে এভাবেই কেটে যাবে।'
    তবে ঐ যে চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। তন্ময়ের হঠাৎ করে চলে যাওয়ার পর তা বুঝতে পেরেছিল সুনিতা। একমাত্র মেয়েও বিয়ের পর বিদেশে সুতরাং গ্ৰাস করেছে এক শূন‍্যতা। চারদিকে শুধু স্মৃতি আর স্মৃতি তার মাঝেই এক অশান্ত মন নিয়ে বাস করা।
    ব‍্যাঙ্কের সামনে মন্টুকে টোটো নিয়ে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে যায় সুনিতা। যখন বেরিয়ে আসে তখন ব‍্যাগে অনেকগুলো টাকা। সবটাই তন্ময়ের এখন তার অবর্তমানে সুনিতার। বাড়ি এসে এক অদ্ভুত অপরাধবোধ গ্ৰাস করে। হঠাৎই কান্না পায় মনে হয় মানুষটা চলে গেলো আর তার যত্নে গচ্ছিত টাকাগুলো এখন তার? ওপারে মেয়ে ফোনে তখন সে বোঝায়,' মা তুমি এতদিন বাবাকে যত্ন করেছো,খাইয়ে দাইয়ে টিফিন গুছিয়ে বাড়িতে পাঠিয়েছো। এমন ভাবছো কেন? এ তোমার নিজের মানুষের টাকা,হঠাৎই ভোগ করার কথা আসছে কেন? এবার একটু স্বাধীনতা ভোগ কর,নিজের মত থাকো। আমার কাছে আসতে কত বলছি,কবে আসবে বল?'
    তখনকার মত আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না সুনিতার। অদ্ভুত এক ভাল্লাগে না অসুখ তাকে গ্ৰাস করে ফেলছে। কিছু যেন ভাল্লাগে না,না রাঁধতে না খেতে। এমন কী বাইরের মানুষের কাছে মুখ দেখাতেও যেন ভালো লাগে না,মনে হয় যেন অপরাধ করে ফেলেছে বিধবা হয়ে। যখন বাইরে বেরিয়েছে সাথে তন্ময় থাকত আজ সে একদম একা,সবাই যেন তার শুকনো,নিষ্প্রভ মুখটার দিকে তাকিয়ে। ফ‍্যাটফেটে শাড়িগুলো তাকে জড়িয়ে অদ্ভুত এক মলিনতার দেশে ভ্রমণ করায় দিন রাত্রি। কাকে বোঝাবে সে এই যন্ত্রণা? সবাই সহানুভূতির ঝুড়ি নিয়ে আসে,কিছু যেন ভালো লাগে না।
  আজকাল ঐ কোনরকমে ছাদে উঠে আকাশ দেখা,তারপর ঐ যা হোক কিছু একটা খাওয়া আর কোনরকমে দিন কাটানো। মেয়েকেও বলতে পারে না সব কথা। ওদের ব‍্যস্ত জীবনে নিজের ধূসর মনের হদিসটুকু মেলে দিতেও ভালো লাগে না।
                বাইরে ভাদ্র মাসের রোদে প্রকৃতি তপ্ত। প্রতি বছর এই রোদে ছাদে কাপড় দেওয়া সুনিতার অভ‍্যেস। অনেকদিন বাদে আলমারি খুলে বসেছে,প্রতিটা শাড়ির ভাজে ভাজে লুকিয়ে কত স্মৃতি আর গল্প। কোনটা বিবাহবার্ষিকীতে তন্ময় দিয়েছেন,কোনটা পয়লা বৈশাখে। আবার কখনও জন্মদিনের আগের দিন শাড়ির মোড়ক খুলে বলতেন,' কাল এটা পরবে,আমি এসে একটু বেরোব তোমাকে নিয়ে।'
  সুনিতা হাসত,' এই বুড়ো বয়েসে জন্মদিন!'
-' এমন বলতে নেই ঐ একটা দিনেই তো আমরা আবার ছোট হয়ে যাই। মনে পড়ে যায় কত ছোটবেলার কথা। আমি যেন দেখি তোমাকে এই শাড়িটা পরতে।'
-' ইশ্ আবার লাল!'
 -' তোমার পছন্দ হয়নি?'
  -' না না পছন্দ হয়েছে, আচ্ছা পরব।'

অনেকদিন ধরে ভেবে আজ সুনিতা অকাজের মাঝে একটা কাজ করবে বলে মনকে বেঁধেছে কদিন ধরেই। বড় কঠিন এই কাজ তবুও করতে হবে। আজ লালে লালে জড়ানো আলমারির মুক্তি দিতে তাই বসা। তার সাথে আলাদা করবে তন্ময়ের কিছু জামাকাপড়। অনেক কষ্টে মধ‍্যের ঘরে রাখা আলমারির হাবিজাবি সরিয়ে খালি করে সেখানেই পাশাপাশি রেখে দেবে লাল শাড়িদের আর তার সাথে তন্ময়ের জামাকাপড়। আলমারি খোলা যেন বড় দায় হয়ে গেছে।
       মেয়েকে এসব কথা বলা যায় না। এমন কিছু অনুভূতি আছে যার ভাগ হয়ত কাউকেই দেওয়া যায় না। সকাল থেকে বসে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল শাড়িদের গলিপথে হেঁটে হেঁটে। একটা সময় নতুন শাড়ি গায়ে ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়াতে যে কী ভালো লাগত! নিজেকে ঠিক মহারাণী বলে মনে হত। আজ আর তেমন ইচ্ছে হল না,মনে হল এসব যেন আবর্জনা। কেন যে এত কিছু জমিয়েছে?
          সারাদিন স্মৃতির গলিপথে হেঁটে হেঁটে বড় ক্লান্ত সুনিতা। আজ খুব কেঁদেছে সে তন্ময়ের দেওয়া শেষ শাড়িখানা বুকে জড়িয়ে। বিষ্ণুপুরে অফিসের কাজে গিয়ে দুটো বালুচরী কিনে এনে ফিসফিস করে বলেছিল,' এই লালটাই তোমার জন‍্য পছন্দ করেছিলাম,তুমি রাগ করবে সবসময় লাল কিনি তাই এই চাঁপা রঙে লাল সুতোর কাজে পাড় আর আঁচল তোমার আর ঐ টকটকে লালটা মেয়ের। দুটো হারও এনেছি ডোকরার....'
   শাড়িটা পরাই হয়নি,আসলে সময় কোথায় হল? দামি জিনিস গায়ে চাপাবার দিনক্ষণ দেখতে দেখতে কখন যে সময় ফুরোলো তা বোঝাই যায়নি...'
    শাড়িটা বুকে জড়িয়ে অনেক কেঁদে যত্নে তুলে রাখে এটা মেয়েকেই দিয়ে দেবে। যদিও ও কষ্ট পাবে শাড়িটা দেখে। এমনিতেই শাড়ি পরার সময় পায় না মেয়েটা...

     পরেরদিন ঘুম ভাঙতে দেরি হয় বেশ,কাজের বৌয়ের বাজানো ঘন্টিতে চমকে উঠে দরজা খোলে। ও কাজ করে যাওয়ার পর আবার নিস্তব্ধতা,মনে মনে ভাবে সুনিতা আজ কী করবে? আবার বেল বাজে,বিরক্ত লাগে দরজা খুলতে যেতে। দরজা খুলতেই অবাক হয়ে যায়..হয়ত কাল ওকেই মনে মনে খুঁজেছে। কিন্তু তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে কোথায় শ্বশুরবাড়ি সেই গুজরাটের কোন গ্ৰামে।
          মেয়েটা ওকে দেখে চমকে যায় প্রথমে,সুনিতার মুখে সেই হাসি নেই। রুক্ষ শুষ্ক বিবর্ণ রূপ আর কপাল থেকে উধাও সেই গোল চাঁদের মত লাল সিঁদুরের টিপ। আমাদের বাঙালী নারীর এই আভূষণই বোধহয় একসময় তার বৈধব‍্যকে বেশি করে সামনে আনে,হয়ত বা আয়নাও কখনও উপহাস করে জিজ্ঞেস করে লাল টিপ আর রক্তিম সিঁথির কথা।
    নিজেই এগিয়ে আসে স্বভাবজাত রিনরিনে গলায় বলে,'কেমন আছো মাসি? এই দু তিনদিন আগে এসেছি এখানে তাই ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে আসি।'
     সুনিতা অবাক চোখে দেখছে ওর ঢলঢলে রূপ,হাত ভর্তি চুড়ি কপালে বিন্দি আর লাল শাড়িতে নবযৌবনে লেগেছে আগুন। স্বামী সোহাগে সোহাগিনী বিন্দিয়াকে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সুনিতা।
    লজ্জা পায় বিন্দিয়া হয়ত নিজেকে লুকোতে চায়। মাসিকে যে এমনভাবে দেখবে ভাবতেই পারেনি। কখন হল এইসব? অবশ‍্য প্রায় ছমাস পর সে এসেছে এই বাড়িতে,সেই যে বিয়ের সময় দেশে গেছে আর আসা হয়নি। ও যখন বিয়ে করতে গেল তখন মাসি ওকে একটা লাল টুকটুকে শাড়ি দিয়েছিল,মেসো দিয়েছিল টাকা। ছোট থেকেই মায়ের সাথে এই বাড়িতে আসত স্টীলের বাসন নিয়ে,কখনও বাঁধনি শাড়ি,বিছানার চাদর আর কুশনও থাকত। মাসির মুখে হাসি ফুটত ওদের দেখলেই। কেনাকাটার ফাঁকে হত কত কথা হাসি আর গল্প।
    নিজেকে সামলায় সুনিতা,' আয় ভেতরে,তোর কথা কাল ভাবছিলাম। আর আজই তুই এলি। তোর মেসো আর নেই রে...হঠাৎই চলে গেল।'
   বলতে বলতে চোখটা আবার ভিজে হঠাৎই কিছুটা জল গড়িয়ে পড়ে সুনিতার। বিন্দিয়ারও খুব খারাপ লাগছে,তবুও ফেরাতে চেষ্টা করে মাসিকে মনখারাপ থেকে।
       কিছুটা বাদে বলে,' আমাকে কেন য়‍্যাদ করছিলে বললে না তো?'
-' না ঐ আলমারি পরিস্কার করছিলাম তো তাই। অনেক শাড়ি জমে গেছে তাই ভাবছিলাম তুই থাকলে কিছু.. হ‍্যাঁ রে তোর মা আর বেরোয় না ফেরি করতে? এদিকেও তো আসে না।'
-' না গো মায়ের পা ভেঙেছে, তাই তো এলাম। তো ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই। মাসি তোমার চুলের কী অবস্থা! তোমার আর কোন কাপড় নেই নাকি? এমন পরেছো কেন? আর তোমার ঐ বিন্দি?'
-' ওগুলো আর পরতে নেই রে,কাপড় আছে তো অনেক। এখন আর ভালো লাগে না। তোর মেসো চলে গেল,এখন এগুলো কী হবে আর?'
-' কেন? তুমি তো জিন্দা আছো।'
-' মরণ হলেই ভালো হত। এই মুখ আর দেখতে দেখাতে কিছু ইচ্ছে করে না।'
-' বহত কী বলে না হাজিবাজি বলছ তুমি।'
অনেকদিন বাদে কথাটা শুনে হেসে ফেলে সুনিতা,হাসে বিন্দিয়াও। বলে,' এই তো কত খুবসুরত লাগছো। কেন যে হাজিবাজি বাত বলো.. এসো তোমার চুল আঁচড়ে দিই।'
   এই মেয়ে এলে অনেক সময়ই কেনাকাটার ফাঁকে সুনিতার মাথায় তেল দিয়ে পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে দিত। বড় আরামে সেই চিরুনীর আদর উপভোগ করত সে। ঘুম এসে যেত মনে হত। আজ ইচ্ছে না করলেও সেই মেয়ের বায়নাতে অগোছালো অযত্ন লালিত কেশরাশিকে শাসনের ভার দিতেই হল।
    চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বকবক করতে লাগলো মেয়েটা,' শোনো এই যদি তুমি মরে যেতে আগে তো মেসো কী করত? আরে কাঁদত ভী না..'
-' না রে ও আমাকে খুব ভালোবাসত যত্ন করত। কষ্ট পেত খুব।'
-' মানছি কষ্ট পেত,তবে কী চুল আঁচড়াতো না? সফেদ শাড়ি পরত? চিকেন,মছলি খেত না?'
-' ধুৎ ছেলেরা কেন ওসব করবে? এগুলো মেয়েদের জন‍্য।'
 -' তুমি তাহলে মেসোকে প‍্যায়ার করতে না। ও শুধু দেখাই কর..'
 হঠাৎই রাগ হয়ে যায় সুনিতার,' এই তুই যা এখন,কাল আসিস কতগুলো শাড়ি নিয়ে যাস। আমার বাসন লাগবে না।'
  -' রাগ করলে? আমি ছোট মেয়ে আছি হাবিজাবি বলি। আমি মানি যাকে তুমি প‍্যায়ার করতে তার পছন্দের চিজ খেতে পরতে হয়। তোমাকে খুশ দেখে আসমানে সে ভী ভালো থাকে।'
    সুনিতা অবাক হয়ে যায় ওর কথা শুনে একটা অল্প পড়াশোনা জানা মেয়ে,আঠেরো পেরোতে না পেরোতেই বিয়ের পিড়িতে বসেছে তার কী অদ্ভুত জীবনদর্শন!
 বিন্দিয়া বকবক করতে থাকে,' আমি চলে যাচ্ছি,তুমি তো আর হালুয়া খাওয়াবে না। মরো তো মরো কিন্তু ও তো তোমার হাতে নেই। তাই জিন্দা থাকলে বাঁচার মত বাঁচো। কেন লোকে বলবে তোমাকে আহা আহা..'
-' তো কী করব ধেই ধেই করে নাচব? যা খুশি করব? লোকে বদনাম করবে না?'
-' কী এসে যায় তাতে? তবুও তো লোকে একটা কাম পাবে। তুমি ভালো থাকবে,আর মেসোও..'
     এতক্ষণে চেতনা হয় সুনিতার মেয়েটা হালুয়া ভালোবাসে,তার আটপৌরে গৃহবধূ জীবনে অনেকটা জুড়ে ছিল মেয়েটা। তন্ময়ও ভালোবাসতেন শুনতে ওর হাবিজাবি কথা। সত‍্যি তো বিয়ের পর এসেছে কিছু খেতে দেওয়া দরকার। তবে বাধা দিল মেয়েটা। সুনিতার চুলের খোঁপা করে চলে গেল বাড়িতে।
              নিজেকে আয়নায় দেখে অন‍্যরকম লাগে সুনিতার,যত্নে বাঁধা খোঁপাতে আবার যেন একটু হলেও শ্রী ফিরেছে হতশ্রী মুখে। 
       ওকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটা পরদিন আবার আসে,সাথে আরেকজনকে দেখে অবাক হয়ে যায় ও। বুঝতে পারে হয়ত শাড়ি নিয়ে যাবে বলে আরেকজনকে নিয়ে এসেছে। ও বলে যায়নি আর আসবে তবে ওর কথাগুলো মনের মধ‍্যে সারাদিন ঘুরপাক খেয়েছে সুনিতার। হয়ত সেইজন্যই নিজের অযত্ন লালিত শরীরে একটু যত্নের ছোঁয়া পড়েছে আজ। 
   বিন্দিয়ার পরনে আজ লাল টুকটুকে শাড়ি,হাতে সবুজ চুড়ি আর পায়ে মল। সাথের মহিলার দিকে তাকায় সুনিতা ওদের দিকে তাকিয়ে নিজেকে কেমন যেন নিষ্প্রভ লাগে। সাথের মহিলার পরনেও লাল বাঁধনি শাড়ি।
  বিন্দিয়া বলে,' আমার পিসিমা,নিয়ে এলাম তোমার কাছে।'
-' আগে তো দেখিনি,এখানেই থাকে নাকি? তোরা বস আমি কাপড়গুলো নিয়ে আসি। আজ হালুয়া খেয়ে যাবি।'
-' কাপড় নিতে আমি আসিনি মাসি,একটু গল্প করে তোমাকে তেল মাখিয়ে যাব। ইনি আমার যে ও আছে না উনার পিসিমা। কলকাত্তা ঘুরতে এলেন। আমাকে খুব প‍্যায়ার করেন।'
      - ' কোথায় থাকেন? তোদের শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি?'
-' আমরা একসাথে থাকি মাসি,পিসির ও নেই তো। সব তাই একসাথে মিলেমিশে থাকি।'
    সুনিতা এবার ভালো করে দেখে ওর মতই আরেকজনকে। কী জানি এদের সমাজে কী নিয়ম? এখনও লাল শাড়িতে লাবণ‍্যময়ী এই মাঝবয়েসী মহিলা।
 বিন্দিয়া সুনিতার চোখের ভাষা পড়ে নেয় নিমেষেই তারপর বলে,' ও যো তুমি নিয়ম বলছিলে না? ও নাম বদনাম...এসব সব জায়গাতেই আছে। কিন্তু আমার শ্বশুর মানে না,বলে ও আমার বোন ছোট থেকে যেভাবে থেকেছে ওভাবেই থাকবে। লাল রঙ কী পতি দেয় নাকি? লাল রঙ আসমানের সূরয দিয়েছে তো যতদিন সূরয থাকবে লাল ভী থাকবে।'
       এই দুদিনে নমিতার মনে জমে থাকা সংস্কারের কালো মেঘের ভার কখন যে মেয়েটা ওর হাবিজাবি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে বুঝতেই পারেনি।

     এলোমেলো চুলগুলোকে যত্নে গুছিয়ে নিয়েছে সুনিতা,বেশ কিছুদিন হল কাছাকাছি একটা যোগাসন সেন্টারে ভর্তি হয়েছে। শরীর,মন দুইই এখন অনেকটা ভালো। কপালে টিপ পরে,শাড়িটাকে যত্নে গুছিয়ে ব‍্যাগে সাদা সালোয়ার কামিজ ভরে নেন। আজকাল যেন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে তন্ময়ের প্রেমিকা বলে মনে হয়,সিঁথি শূন‍্য হলেও তন্ময়ের পছন্দে নিজেকে ডুবিয়ে ডিসট‍্যান্ট রিলেশনশিপে বেশ আছে নমিতা। ভালোবাসার মানুষ না ফেরার দেশে চলে গেলে তাকে ভোলা যায় না হয়ত কোনদিনই,কোনমতেই ফেরানো যায় না। তবে চেহারায় বৈধব‍্যকে ফুটিয়ে তুলে প্রতিমুহূর্তে কী দরকার হাহাকার করে তুমি নেই তুমি নেই...
  বিন্দিয়া চলে গেছে,তার আগে শিখিয়ে গেছে সুনিতাকে বাঁচার মন্ত্র। ননদের বিয়ে উপলক্ষে মেয়ে এসেছে,বিয়ের দিন মা আর মেয়ে দুজনে একসাথে পরল তন্ময়ের এনে দেওয়া বালুচরী। শাড়িটার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে যেন তন্ময়ের আঙ্গুলের আদুরে স্পর্শ। কতবার হয়ত নেড়েচেড়ে দেখে কিনেছে শাড়িটা। গলায় পরল তন্ময়ের আনা ডোকরার দুর্গার লকেট মনে মনে বলল শক্তি দিয়ো মা যেন টানতে পারি একা জীবনরথের চাকা শত দুঃখেও হাসিমুখে। মেঘের চাদর সরিয়ে তন্ময়ও হয়ত দেখলো আর ভাবলো আজ কিন্তু সুনিতাকে বেশ লাগছে দেখতে।
সমাপ্ত:-
          


Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...