Skip to main content

কেনিয়ায় কয়েকদিন


    
কেনিয়ায় কয়েকদিন
রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী

জঙ্গলপ্রেম আমার প্রথম থেকে ততটা না থাকলেও যত পরিণত হয়েছি ততই নেশাতুর হয়েছি জঙ্গলের ডাকে। তবে আজকাল কেন জানি না মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে এত কোলাহল আর কৃত্রিমতা ছেড়ে চলে যাই সবুজের কোলে যেখানে শুধু নীরবতাকে উপভোগ করব আর প্রাণভরে শ্বাস নেব। খুব ভোরে ঘুম ভাঙবে পাখির ডাকে,সারারাত টেন্টের আসেপাশে শুনব রাতজাগা পাখির গাছের ডাল ঠোকরানোর কুটুর কুটুর শব্দ অথবা কোন বন‍্যজন্তুর পায়ের খসখস আওয়াজ। আর সেইরকমই একটা ভালোবাসার টানে জঙ্গলে যাওয়ার ইচ্ছে মাঝেমধ্যে মনকে ব‍্যাকুল করে। তবে এবার আমাদের ইচ্ছে হল স্বদেশ পেরিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে যাব। বহুদিন ধরে ইচ্ছে মাসাইমারা যাব,গ্ৰেট মাইগ্ৰেশন দেখব কিন্তু কোনভাবেই তা সম্ভব হচ্ছিল না। আসলে বোধহয় কখনও জীবনে সুযোগ হঠাৎই আসে,অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা করেও কিছু হয় না। 
    মাসতুতো দেওর নাইরোবিতে থাকে,অনেকদিন ওর সাথে তেমনভাবে যোগাযোগ হয়নি। এবার হঠাৎই দেখা হল ওর সাথে। ওর সাথে দেখা হবার কিছুদিন পরে একদিন আমার স্বামী প্রস্তাব দিল কেনিয়া যাবার। ব‍্যাস ঐ আর কী উঠল বাই তো কেনিয়া যাই। শুরু হয়ে গেল তোড়জোড়। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি কেনিয়া গেলে ইয়োলো ভ‍্যাকসিন এবং পোলিও সার্টিফিকেট দুটোই লাগে। ফেরার সময় দেখলাম কোভিড সার্টিফিকেটও চাইছে,তাই ওটাও রাখতে হবে।
টিকিট যিনি কাটবেন উনি বললেন আগে ইয়োলো ভ‍্যাকসিন নিতে হবে তারপর ভিসা হবে। আর ভিসা না হলে টিকিট হবে না। পরে জানলাম ইয়োলো ভ‍্যাকসিন নেবার আগেই ভিসা হতে পারত। 
যাক মাথাব‍্যথা শুরু হল ভ‍্যাকসিন নেওয়া নিয়ে,শেষ পর্যন্ত হেস্টিংসে মেরিন হাউসে যোগাযোগ করলাম ভ‍্যাকসিনের জন‍্য। হ‍্যাঁ একটা কথা বলা দরকার ওখানে ভ‍্যাকসিন নিতে হলে অবশ‍্যই ওদের আগে থেকে মেইল করে স্লট বুক করবেন। মেইল করতে পাসপোর্টের কপি এবং ভিসার কপি অথবা ইনভিটেশন লেটার লাগে। ওখান থেকে স্লট দিলে তারপর নির্ধারিত সময়ে যেতে হবে ভ‍্যাকসিন নিতে। মেইল আইডি নিয়েছিলাম গুগল থেকেই। মোটামুটি বারোটা থেকে শুরু হয় ওদের কার্যক্রম। ভ‍্যাকসিন নেওয়া হয়ে গেলে সুন্দর হলুদ কার্ডে ওরা সার্টিফিকেট দেন যা মোটামুটি লাইফটাইম চলে যাবে। মানে এরপরে কখনও আফ্রিকা গেলে ওতেই হয়ে যাবে কাজ। ভ‍্যাকসিন নেওয়া হলে এই বয়েসে জিভ বার করে বসলাম কর্তা গিন্নী পোলিও খেতে। হাসি পেলেও খেতে হল বাধ‍্য হয়ে। সাদা ছাপানো ফর্মে তারও সার্টিফিকেট পেলাম সংশ্লিষ্ট মেডিক্যাল অফিসারের থেকে। মনে সাহস এল কিছুটা যে আমাদের আফ্রিকা সফর হয়ত হবে। 
তাই শুরু হল স্বপ্নের চাদর বোনা। যিনি আমাদের টিকিট কেটে দেবেন তিনিও একটা ট্র‍্যাভেলিং এজেন্সি চালান। আমাদের অধিকাংশ উড়ানের টিকিট আমরা ওর কাছেই করি। উনি আমাদের দুটো টিকিট এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে বুক করে রাখলেন। আমাদের যাত্রাপথের ছক হল কলকাতা থেকে দিল্লী এয়ারইন্ডিয়ার ফ্লাইটে এবং সেখানে কিছুক্ষণ ব্রেক নিয়ে আবার নাইরোবির ফ্লাইট ধরা সেটাও এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটেই। কলকাতা থেকে দিল্লীতে পৌঁছতে দুই ঘন্টা মত সময় লাগে। আর দিল্লী থেকে নাইরোবি পৌঁছনোর সময় ছয় ঘন্টা চল্লিশ মিনিট। ভাড়া ওঠানামা করে,আমাদের জনপ্রতি ভাড়া পড়েছিল তেতাল্লিশ হাজার মত। দুজনের ছিয়াশি হাজার যাতায়াত নিয়ে।
    আমাদের ই ভিসার তোড়জোড় শুরু হল। আফ্রিকা যাবার ভিসা অনলাইনে আবেদন করলেই পাওয়া যায়। যার জন‍্য লাগে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও ছবি। মোটামুটি দুদিনেই চলে আসে। এরজন্য খরচ পড়ে জনপ্রতি চার হাজার একশো। কোন ইন্টারভিউ দিতে হয় না। আমাদের সবেই ঝামেলা সুতরাং এক্ষেত্রেও কিছু সমস‍্যা হল তবে নাইরোবিতে বসবাসকারী আমাদের ট্র‍্যাভেল এজেন্ট মিঃ সোমের তৎপরতায় ভিসা তাড়াতাড়ি এসে গেল। যাক ভিসা পেয়ে টিকিট কেটে ফেলা হল আর আমরাও জানলাম যাওয়াটা হবে। কিন্তু ঐ যে বললাম দেশের বাইরে পা রাখা অনেক ঝামেলার। যতই আমরা নিজের দেশকে গালমন্দ করি না কেন এখানে আমরা স্বাধীন দিব‍্যি ব‍্যাগ থেকে খুচরো বের করে কেনা যায়,বাসে ট্রামে উঠে যত্রতত্র যাওয়া যায়। বাংলায় চেঁচামেচি করা যায়,গালগল্প করা যায় আর প্রাণখুলে হাসা যায়। তাই আরেকটা কাজ শুরু হল যার জন‍্য টিকিট দরকার। তা হল ডলারের ব‍্যবস্থা করা। ট‍্যুরের খরচ বাবদ পেমেন্ট ওখানে গিয়ে করার সুযোগটা আমরা পেয়েছিলাম কারণ আমাদের ট্র‍্যাভেলিং এজেন্ট মিঃ সোম আমার দেওরের বিশেষ পরিচিত। অন‍্য কোন এজেন্ট এই ঝুঁকি নেবেন না সবাইকেই আগেই পেমেন্ট করে দিতে হয়। কারণ কোন কারণে আমরা না গেলে উনি হোটেল বুকিং এবং গাড়ি বুকিং নিয়ে অসুবিধায় পড়বেন। তবে এক্ষেত্রে আমাদের হয়ে ঝুঁকি নিয়েছিল পুরোটাই আমার দেওর। তাই আমাদের সাথে নেওয়া ডলারের পরিমাণ কিছুটা বেশি ছিল,তাই সেক্ষেত্রেও একটু সময় লাগলো।
      আমরা ঠিক করেছিলাম বেশি লাগেজ নেব না। যারা বেড়াতে ভালোবাসেন এটা তাদের মাথায় রাখা জরুরী। তাই মাঝারি মাপের একটা ট্রলি চেকড লাগেজে রাখব ঠিক করলাম। দেওর বারবারই বলছিল ওখানে ঠান্ডা আছে,তাই খুব হাল্কা জ‍্যাকেট আর টুপি নিলাম সাথে। আর কেবিন ব‍্যাগেজ হিসেবে নিলাম একটা ছোট ট্রলি আর পিঠের ব‍্যাগ। সাথে অবশ্যই থাকলো হাত ব‍্যাগ আর ক‍্যামেরা। হাতব‍্যাগে সুন্দর করে দুটো ক্লিয়ার ব‍্যাগে গুছিয়ে নিলাম আমাদের ভিসা,পাসপোর্ট,ভ‍্যাকসিনের সার্টিফিকেট এবং টিকিট। আমাদের দিল্লীগামী ফ্লাইট সকাল ছটা পঞ্চান্নতে ছিল,তাই বেশ ভোরে বেরোতে হল। যেহেতু দুটোই এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট তাই একবারেই আমাদের ওরা কাগজপত্র চেক করে একদম নাইরোবি পর্যন্ত বোর্ডিং পাস দিয়ে দিল। জানতে পারলাম লাগেজও নাইরোবিতে গিয়েই পাব একেবারে।
      দিল্লী থেকে আমাদের ফ্লাইট ছিল বারোটা চল্লিশে। আমরা দিল্লী পৌঁছে গেলাম নটার মধ‍্যেই। তাড়াতাড়ি চলে এলাম ইমিগ্রেশনের জন‍্য। সেটাও বেশ সুন্দর ভাবে হয়ে গেল। আমরা তারপর চলে এলাম লাউঞ্জে কারণ তখনি দেখেছি ফ্লাইট একঘন্টা দেরিতে ছাড়বে। লাউঞ্জে ঢোকার জন‍্য ব‍্যাঙ্কের ভিসাকার্ড থাকলে সেখানে সুন্দর ভাবে মাত্র দুটাকার বিনিময়ে খাওয়ার এবং গরম ঠান্ডা পানীয় সহযোগে আপনি আরামে বসে ক্লান্তি দূর করতে পারেন। দুটাকায় পর্যাপ্ত খাবার খাওয়া যায়। তাই আমরাও সেখানে চলে এলাম। এয়ার ইন্ডিয়ায় খাবার দেয় সুতরাং আমাদের ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছিল। তবুও বেশ অনেকক্ষণ কেটে গেছে তাই পছন্দের কিছু খাবার নিয়ে খেলাম। দেখলাম ইন্টারন‍্যাশনাল টার্মিনালের লাউঞ্জে বিয়ারও পাওয়া যাচ্ছে চা,কফি,কোল্ডড্রিংঙ্ক এবং ফ্রুটজুসের সাথে। অনেকেই নিখরচয়ায় পানীয়ের সুখ উপভোগ করছেন। ততক্ষণে দেখলাম ফ্লাইট প্রায় আরও একঘন্টা লেটে ছাড়বে। সুতরাং আমরাও আরও কিছু খেলাম। ব্রেকফাস্টে পাউরুটি মাখন থেকে শুরু করে,ইডলি,পোহা,ধোসা,অমলেট,চিকেন সসেজ,দুধ কনফ্লেক্স,কেক,মাফিন ও ফল সবই সাজানো ছিল। আমাদের দেরি হওয়ার জন‍্য ততক্ষণে লাঞ্চও শুরু হয়ে গেল। লাঞ্চে নানা রকমের স‍্যালাডের সাথে চিকেন,পনীর,রাইস,রুটি সবই থাকে। যাক সময় মত আমরা এগিয়ে গেলাম বোর্ডিং করার জন‍্য। ফ্লাইটে মোটামুটি ভর্তি লোক আমাদের সীট কিছুটা পেছনের দিকে ছিল। ফ্লাইটে বসার পরও আরও কিছুটা বিলম্বের পর ছাড়লো আমাদের ফ্লাইট। সবার সাথে টুকটাক কথাবার্তা সেরে নিয়েছি তারমধ্যে। এবার উড়ে চলা আফ্রিকার দিকে। ফ্লাইট চলার কিছুটা বাদেই ওরা ড্রিংকস সার্ভ করতে থাকে তারমধ‍্যে আপনি নিতেই পারেন ওয়াইন, ফ্রুট জুস অথবা ক‍্যানড কোল্ডড্রিংঙ্ক। জলের বোতল,চা,কফি সবই দেয়। আমাদের ফ্লাইটে ওঠার কিছুটা বাদে লাঞ্চও দিল। মোটামুটি যেমন থাকে অর্থাৎ ব্রেড আর রাইস মেশানো সাথে চিকেন,একটা ভেজিটেবল অথবা স‍্যালাড,ইয়োগার্ট আর ডেজার্ট। বিকেলে চা কফি সহযোগে টিফিনও খেলাম। আফ্রিকার সময় আমাদের দেশের সময়ের থেকে আড়াইঘন্টা পিছিয়ে। সুতরাং আমাদের হাতঘড়ি ভারতীয় সময় দেখালেও আফ্রিকার সময় অনুযায়ী আকাশ তখনও বেশ ঝলমলে। তবে ফ্লাইট ল‍্যান্ড করার আগে ঝুপ করে সন্ধ‍্যে নামল। তার আগে আমি অনন্ত বিস্ময়ে জানলা দিয়ে দেখছি নতুন দেশকে। ওপর থেকে মনে হচ্ছে সবুজে,সবুজ সবটা। মনে পড়ে গেল কবিগুরুর কবিতা আফ্রিকা..."উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগে স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত, তাঁর সেই অধৈর্যে ঘন-ঘন মাথা নাড়ার দিনে রুদ্র সমুদ্রের বাহু প্রাচী ধরিত্রীর বুকের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল তোমায় আফ্রিকা। বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায় কৃপণ আলোর অন্তঃপুরে।"
    সত‍্যি যেন হুবহু কবির বর্ণনার সেই বনস্পতি ঘেরা আফ্রিকা দেখতে পাচ্ছিলাম। নাইরোবি কেনিয়ার রাজধানী তবে এয়ারপোর্ট খুব বড় নয়। এখানকার এয়ারপোর্টের নাম জোমো কেনিয়াত্তা। লাগেজ পেতে দেরি হলেও ইমিগ্রেশন করতে খুব বেশি সময় লাগল না। আমার প্রবাসী দেওর আমাদের সাদরে রিসিভ করল এয়ারপোর্টে হাতে ফুলের বোকে দিয়ে। এই অপরিচিত জায়গায় ওকে পেয়ে সত‍্যিই ভীষণ ভালো লাগল। ক‍্যাব চলতে শুরু করল বুঝতে পারলাম এখানকার আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। দেওরের কাছে শুনেছিলাম এখানে চব্বিশ ডিগ্ৰীর বেশি তাপমাত্রা কখনও ওঠে না। রাতে আর সকালে বেশ ঠান্ডা। নতুন শহর দেখতে দেখতে পা রাখলাম দেওরের অ্যাপার্টমেন্টে। সুন্দর খোলামেলা তিনকামরার বড়সড় ফ্ল্যাটে ও একাই থাকে। সত‍্যি কথা বলতে আমরাও এতটা পথ অতিক্রম করে একটুও ক্লান্ত হইনি। হয়ত আমাদের বেড়াতে আসার আনন্দ সব জয় করে নিয়েছিল। আমাদের ট্রিপ পরদিন থেকে শুরু, সুতরাং সেদিন বিশ্রাম নেওয়া।
      পরদিন সকাল আটটার মধ‍্যেই চলে এলেন আমাদের ট্র‍্যাভেলিং এজেন্ট নির্মাল‍্য সোম। অমায়িক তার ব‍্যবহার,তিনি আসামের বাঙালী,কর্মসূত্রে নাইরোবিতে থাকেন। আমাদের যাত্রাপথের সূচী উনিই ঠিক করেছিলেন আমাদের প্রথম গন্তব‍্য ছিল দিয়ানি। উনিই খুব জোর দিয়েছিলেন জায়গাটা দেখে আসার জন‍্য,বলেছিলেন বেশ রিল‍্যাক্স করে দুদিন কাটান। জঙ্গলে তো নিয়ে যাবই,শেষে বন‍্যপ্রাণী দেখে দেখে একঘেয়ে লেগে যাবে দেখবেন। নির্মাল‍্য বাবু নিজে ড্রাইভ করে আমাদের ওখানকার ছোট্ট ডোমেস্টিক উইলসন এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিলেন। এয়ারপোর্টে বসে দারুণ কফি খেয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হল। নাইরোবি থেকে দিয়ানি ফ্লাইটে একঘন্টার পথ। যথারীতি আমাদের সবরকম ফর্মালিটি সেরে একটু অপেক্ষা করতে হল। সবুজের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট ছোট প্লেন দেখতে বেশ লাগল। এই প্লেনগুলো চল্লিশ সীটের হয়। আমাদের সময় হতেই আমরা উঠে পড়লাম আর একঘন্টার মধ‍্যেই পৌঁছে গেলাম দিয়ানি। দিয়ানি এয়ারপোর্ট আরও ছোট,ঠিক মনে হবে হঠাৎই কোন গ্ৰামের মধ‍্যে নেমে পড়েছি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে দেখলাম রিসর্টের গাড়ি আমাদের জন‍্য অপেক্ষা করছে। রাস্তার সবুজে মোড়া অনন‍্য প্রকৃতি দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম সেখানে। আমাদের রিসর্টের নাম ছিল বাওবাব বীচ রিসর্ট অ্যান্ড স্পা। চারদিকে তখন শুধুই বিদেশীদের ভীড় এরমধ‍্যে আফ্রিকার মানুষজন যেমন আছেন তেমনি আছেন প্রচুর ইউরোপীয়। যারা এই নির্জন সী বীচে রিল‍্যাক্স করতে এসেছেন। দিয়ানি ভারত মহাসাগরের তীরে অবস্থিত সুন্দর পরিচ্ছন্ন সী বীচ। তবে এখানকার জলের রঙ এবং বালির রঙ সবাইকে মুগ্ধ করবে। সরু মসৃণ সাদা রঙের বালি একদম ঝুরঝুরে,শরীরকে স্পর্শ করে সাদা আলপনার মত তারপর আবার ঝরে পড়ে সহজেই।
    ওয়েলকাম ড্রিঙ্ক খেয়ে,একটু ঘুরে এলাম সুইমিংপুলের ধার থেকে। ওখান থেকেই দেখলাম নীচে অপূর্ব সুন্দর নীল জলের সমুদ্র। কোথায় যেন মিলে গেছে পুলের নীল জলের সাথে তার রঙ। একটু অপেক্ষার পরই আমরা আমাদের ঘর পেয়ে গেলাম। বেশ অনেকটা করিডোর পেরোলাম চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। ঘর বেশ সুন্দর সামনের পর্দা সরালে শুধু সবুজের মেলা আর একটু দূরেই সমুদ্রের উঁকিঝুঁকি। হাউসকিপিংয়ের ছেলেটা বারবারই বলে গেল আমরা যেন সামনের কাঁচের দরজা খোলা না রাখি কারণ এখানে বেবুনের খুব উপদ্রব,ওরা সুযোগ পেলেই ঢুকে পড়বে। দেখলাম দরজার বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেবুন পরিবার। আমরা ফ্রেশ হয়ে খাবারের জায়গায় চলে গেলাম। অনেকটা বড় খাবার জায়গা আর সেদিন উইকএন্ড ছিল তাই বেশ ভীড়। তবে সবটাই পরিবেশবান্ধব করে বাঁশ এবং কাঠ দিয়ে তৈরী। উঁচু ছাউনি দেওয়া খাবার জায়গায় বসে সমুদ্র দেখতে দেখতে বুফে লাঞ্চে আমরাও অংশীদার হলাম। লাঞ্চে ব্রেড,রাইস,চিকেন,ল‍্যাম্ব,ফিস,বিফ,পনীর,পিওর ভেজ,ফ্রুটস,জুস,স‍্যুপ,চা,কফি এবং হার্ড ড্রিঙ্কস সবই ছিল। এই রিসর্টে আপনি পছন্দের লাঞ্চ নিয়ে বসলে চা,কফি,জুস এবং ড্রিংক পরিবেশন করার জন‍্য সব সময় ওরা আপনার সেবায় আছে। ভীষণ ভালো ব‍্যবহার ওদের এবং ইংরেজী উচ্চারণ অনেকটাই সহজ সরল যা সুন্দর বোঝা যায়। তবে ওদের জাম্বো মানে ওয়েলকাম বলাটা আমার খুব ভালো লেগেছে,দেওরের কাছে শুনলাম উত্তরে মুজুরী বলতে হয়। সুন্দর করে জিজ্ঞেস করে ফুড ইজ গুড? কোন অসুবিধা হলে শেফ এসে জেনে যায়। ওখানকার স্থানীয় মানুষজন ভুট্টা দিয়ে বানানো একটু গলানো খাবার যার নাম উগালী এবং শাক খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছে দেখলাম। অনেকেই এসেছেন একই রঙ এবং ডিজাইনের পোষাক পরে জন্মদিন পালন করতে। তাদের ঘিরে নাচে গানে মেতে উঠেছে একদল ছেলে মেয়ে। সুন্দর এক আনন্দময় পরিবেশ,সবাই যেন এক খুশির দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিজেদের মত।
      ঘরে এসে একটু রোদ পড়লে আমরা চলে গেলাম সমুদ্রের ধারে। আফ্রিকায় ব‍্যবহৃত মুদ্রার নাম শিলিং। আমাদের দেখে অনেকেই এগিয়ে এল বোটে চড়ার অনুরোধ নিয়ে। কত শিলিং পড়বে তাও বলতে লাগল। বেশ কিছু মাসাই উপজাতির লোক তাদের ট্র‍্যাডিশনাল পোষাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক কিছু বিক্রি করার উদ্দেশ্যে এবং ফটো তোলার জন‍্য। আমার দেওর কিছু শিলিং আমাদের দিয়ে দিয়েছিল খরচের জন‍্য। তবে আমরা তখনি বোটে উঠলাম না। প্রাণভরে উপভোগ করলাম নীল নির্জন সৈকত। দেখলাম উটের সারিও ঘুরছে সমুদ্রতটে। আর তখনও কিছু মানুষ সমুদ্রে স্নান করছে আনন্দে,বাচ্চারা বসে সাদা বালি মাখছে।
আগেই বলেছি বাওবাব রিসর্টের চত্বর এক আনন্দের পরিসর যে যার মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন,কোয়ালিটি সময় উপভোগ করছেন সঙ্গীর সঙ্গে। সমুদ্র সৈকত তাই অনেকের পরনেই স্নানের পোশাক। অনেকেই পুলে লাফালাফি করছেন আনন্দে। কেউ বা পুল লাগোয়া বারে বসে সফ্ট ড্রিংকস,ককটেল অথবা মকটেল নিয়ে গল্প করছেন। আমরাও বেশ কিছুটা সময় সমুদ্রের নির্জনতা ও অস্তমিত সূর্যের অপরূপ রূপ দেখে সন্ধ‍্যে গড়ালে ঘরে এলাম। এখানে ডিনারের সময় ছিল সাড়ে সাতটা থেকে দশটা। বিকেলে চা কফি স্ন‍্যাকসও সুন্দর করে সাজানো থাকে। চা কফি পান করতে করতে সন্ধ‍্যে নামতে দেখতে বেশ লাগল।
    রাতের খাবারেও অনেক আয়োজন দিনের মতই,চারদিকে মোমবাতি জ্বলছে। অদ্ভুত একটা মায়াবী ভাব চারদিকে। আমরাও তারমধ্যে ডিনার করলাম পছন্দের খাবার বুফে থেকে নিয়ে।
      দিয়ানিতে আমরা মাঝে একটা দিন ছিলাম,আমাদের ট্র‍্যাভেলিং এজেন্ট সোমবাবু বিকেলে আমাদের গ্লাসবোটে ওঠার ব‍্যবস্থা করে দিলেন। আমাদের মাসা নামে একজন স্বাগতম জানিয়ে নিয়ে গেল বোটে। বেশ লাগছিল বোট সফর,আমাদের সাথে একদল আফ্রিকান পরিবার ছিল। তাদের সাথে গানে মেতে উঠলাম আমরাও। ওরা গাইতে লাগল রো রো রো ইওর বোট জেন্টলি ডাউন দ‍্য স্ট্রীম। হঠাৎই আমাদের বোটম‍্যান মাঝ সমুদ্রে নেমে গেল। ওর হাতে খাবার,আর মুখেও ধরা খাবার। গ্লাস বোটের কাঁচে আমরা দেখলাম ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ এসে ওর হাত আর মুখ থেকে খাবার নিচ্ছে। বাচ্চাগুলোর সাথে আমরাও খুশি হলাম,ও আমাদের হাতে দিল একটা স্টার ফিশ। একটু দেখে সেটাকে আবার ভাসিয়ে দেওয়া হল জলে। চারদিকে নীল জল আর তার মাঝে আমরা,আকাশও পাল্লা দিয়ে সেজেছে নীল রঙে। আসলে আকাশের কাছ থেকেই তো ধার নিয়েছে নীল রঙ সমুদ্র। কিছু বোট ভাসছে,অনেকেই নেমে পড়ছেন সমুদ্রে স্নরকেলিং করতে। ততক্ষণে ছেলেটা উঠে এসে আবার বোটের হাল ধরেছে। আরেকটু এগিয়ে গেলেই জলের গভীরতা বেশ কম,সেখানে বালুকাভূমি জেগে আছে। স্বচ্ছ জলের নীচে দেখা যাচ্ছে বালির স্তর। সবার মত আমরাও ঝুপ করে নেমে পড়লাম জলে,সেখানে বেশ ভীড় সবাই আনন্দ করছে নানা পোজে ছবি তুলছে। আর আমি অবাক বিস্ময়ে দেখলাম আকাশের নীল আনন্দে গায়ে মাখছে সমুদ্র। কিছুটা সময় সেখানে কাটিয়ে আমরা ফিরে এলাম। তারপর একটা সুন্দর বিকেল রিসর্টের পুলের পাশে কাটিয়ে রাত্রি নামার পর ঘরে এলাম। রাতে ডিনারের পর বেশ অনেকটা সময় কাটালাম অডিটোরিয়ামে আফ্রিকান ড‍্যান্স দেখে এবং গান শুনে। খুব ভালো লাগলো পুরো অনুষ্ঠান। পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে যখন আমরা তখন একদল ছেলেমেয়ে জুম্বা করতে করতে এল,তাদের সাথে যোগ দিল পর্যটকেরাও। সবচেয়ে মজা লেগেছিল সুইমিংপুলে ওদের শারীরিক কসরৎ,বেশ অনেককে নিয়ে একদম পেটানো চেহারার একটা ছেলে নানা ব‍্যায়াম করিয়ে ঝরঝরে করে দিল ট‍্যুরিস্টদের। দিয়ানিতে থাকার মেয়াদ আমাদের শেষ তাই ব্রেকফাস্ট শেষে ফেরার তোড়জোড়। হোটেলের গাড়িই পৌঁছে দিল আমাদের এয়ারপোর্টে, বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষার পর আমাদের উড়ান এল আমাদের উড়ানের নাম ছিল স্কাইওয়ার্ড। 
আবার একঘন্টার যাত্রা শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম নাইরোবিতে। মিঃ সোম নিজেই রিসিভ করলেন আমাদের,তারপর হঠাৎই দিলেন একটা চমক...আমাদের নিয়ে সোজা চলে এলেন ক্রোকোডাইল পার্কে। বললেন ওখানে নাকি কুমীরকে কোলে নিয়ে ছবি তোলা যায়। অবাক হলাম শুনে,ভয়ও পেলাম। তবে গাইড বললেন এখন আর নেওয়া যাবে না কারণ বর্তমানে কোন বাচ্চা কুমীর নেই। থাকলে মুখটা আটকে ওরা কোলে দেয়। যাক আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। অনেকগুলো কুমীর আছে এখানে,গাইড মুখের কাছে একটা লাঠি মত ধরতেই ওরা গর্জন করে লাফ দিয়ে জলে নেমে গেল। এই প্রথম কুমীরের গর্জন শুনলাম, বেশিরভাগই দেখি ওদের চুপটি করে শুয়ে থাকতে। হঠাৎই গাইড একটা কচ্ছপ এনে আমার কোলে দিল,বেচারা বেশ শান্তশিষ্ট কোন নড়াচড়া করল না বিশেষ। চুপটি করে আদর খেল। আমরাও জড়িয়ে ধরলাম আদরে তাকে। তারপর এলাম অস্ট্রিচের খাঁচার কাছে,গাইড অনেকটা ডালপাতা দিল। সেগুলো খাওয়ালাম আমরা। তারপরেই খুশি হয়ে আবার এগিয়ে চলা মিঃ সোমের সাথে। মোটামুটি নাইরোবি শহরও ঘোরা হয়ে যাচ্ছে। উনি যে আমাদের একদম বাড়িতে আনবেন তা ভাবতে পারিনি। মাসিমার সাদর আপ‍্যায়নে গরম ভাত,ডাল,আলুভাজা,মাছভাজা আর মাছের ঝোল সহযোগে আমাদের লাঞ্চ হল। নাইরোবিতে এসে দেশের মানুষ আর মাতৃস্নেহ পেয়ে মন ভরল।

     লোকাল একটা মল থেকে একটা সিমকার্ড কিনে দিলেন মিঃ সোম,কারণ আমরা এখান থেকে যে জিও সিম গ্লোবাল কানেকশন করিয়ে নিয়ে গেছি তিনি দুটো কল করার পরই দেড় হাজার টাকা ব‍্যালেন্স খেয়ে নিস্ক্রিয় হলেন টাকা শেষ হয়ে গেছে জানিয়ে। 
   পরদিন আমাদের অ্যাম্বাসোলি যাবার কথা,সুতরাং প্রায় সন্ধ‍্যের মুখে আমরা চলে এলাম দেওরের ফ্ল্যাটে। ও ওখানকার একটা কোম্পানীর প্রোডাকশন ম‍্যানেজার। এই প্রবাসে নিজের কাউকে পেয়ে সে ভীষণ খুশি। ওর রান্নাঘর মোটামুটি আমার কন্ট্রোলে চলে এসেছে। যে কদিন ছিলাম,দারুণ মজা করে আমাদের তিনজনের ছোট্ট ফিস্টি হয়েছে। 
   পরদিন আমাদের গাড়ি এল সকাল আটটায়,আমাদের ড্রাইভার পিটার আমাদের জাম্বো বলে অভিবাদন জানালেন।  দশ সীটের গাড়িতে আমরা দুজন,আর কেউ নেই। দেওর বলেছে মাসাইমারা ট্রিপে ও আমাদের সাথে যেতে পারে। তাই আপাততঃ আমরা স্বামী স্ত্রী রওনা দিলাম দেওরকে বিদায় জানিয়ে অ্যাম্বাসোলির পথে। সুন্দর রাস্তা চারদিকে সবুজে সবুজ। শুধু মাটির রঙ পাল্টে যাচ্ছে,কখনও বাদামী,আবার কখনও লাল,কালো বা গেরুয়া। মাঝেমধ্যে মাসাই উপজাতির লোকদের দেখছি লাল চেকচেক চাদরের মত পোষাকে নিজেদের ঋজু চেহারাকে জড়িয়ে একপাল গরু নিয়ে চড়াতে যাচ্ছে। পথে একটা কিউরিও শপে আমরা দাঁড়ালাম,কাঠের কাজ করা নানা পসরা সাজানো দোকানে। ভীষণ রঙীন দেখতে সবকিছু কিন্তু বেশি দাম। আমরা বাইরে গেলে একটা দুটো জিনিস স্মারক হিসেবে কিনি এছাড়া মধ‍্যবিত্ত পকেট সাপোর্ট করে না খুব বেশি কেনাকাটা করার মত টাকা নিয়ে যাবার। সুতরাং সাধকে গুটিয়ে রেখে,ওয়াশরুমের প্রয়োজন মিটিয়ে কফি খেয়ে আমরা ফিরে এলাম গাড়িতে। আফ্রিকাতে জলের অভাব,তবে ওয়াশরুমে কোন টাকা দিতে হয় না আর পরিস্কার পরিচ্ছন্নও। ইউরোপ ভ্রমণের সময় আমরা অনেক জায়গাতেই ইউজ অ্যান্ড পে ওয়াশরুম পেয়েছি। পিটারের কাছে বেশ অনেকগুলো জলের বোতল রাখা ছিল,যা আমরা এই দুদিনের ট্রিপে পান করেছি প্রয়োজনমত। আমাদের গাড়ি এগোতে শুরু করল চোখে পড়ল সবুজ পাহাড়ের সারি,তবে কোনটাই খুব উঁচু নয়।
         একটার একটু আগেই আমরা এসে পৌঁছে গেলাম অ্যাম্বাসোলিতে আমাদের হোটেলের নাম ছিল সোপা লজ। রাস্তা থেকে নেমে জঙ্গল ঘেরা পথ দিয়ে আমরা এগোলাম সোপা লজের দিকে। তার আগে চোখে পড়ল মাসাইদের ছোট্ট গ্ৰাম,সেখানে দেখলাম বেশ কিছু গাড়ির ভীড়। অনেক বিদেশী পর্যটক ভীড় জমিয়েছেন ওদের সাথে ফটো তুলতে। শুনলাম মাসাইদের গ্ৰাম দেখার খরচ জন প্রতি তিরিশ ডলার।
  আমরা তখনকার মত ওখানে যাবার ইচ্ছে দমন করলাম। কারণ চার পাঁচটা সাজানো বাড়ি দেখে কেন যেন মনে হল ওখানে গিয়ে ফটো তোলা ছাড়া তেমন কিছু জানা যাবে না। বাড়িগুলোর ছাদ দেখলাম একদম ফ্ল‍্যাট,পিটার বলল এই বাড়ির ছাদ কাদা আর গোবর দিয়ে তৈরী। আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল জঙ্গলের পথে,পৌঁছে গেলাম সোপা লজে। রিসেপশনে এসে মুগ্ধ হলাম। জায়গাটা ভীষণ সুন্দর, চারদিকে ইকো ফ্রেন্ডলি মাটির কটেজ,আর তাতে সুন্দর ট্রাইবাল ডেকোরেশন করা। একটা ছোট্ট ব্রীজ মত আছে যার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায় রেস্টুরেন্টে। বাঁ হাতে বিরাট মাটির ঘরে সুন্দর করে সাজানো বার ডানদিকে রেস্টুরেন্ট। ছোট্ট ব্রীজের তলায় জলাশয়ে খেলা করছে মাছেরা। রেস্টুরেন্ট থেকে আরেকটু এগোলেই বিস্তৃত খোলা জায়গা,বাইরে বসেও খাওয়া যায়,সেখানেও চেয়ার টেবিল পাতা। বারের পেছন দিকে সুইমিংপুলে স্বচ্ছ জল টলটল করছে,চারপাশটা সুন্দর করে সাজানো। দেখলাম কোন কিছুরই ত্রুটি নেই। আমাদের ওয়েলকাম জুস দিয়ে অভ‍্যর্থনা করল ওরা,তারপর পৌঁছে দিল জঙ্গলের পথ ধরে কটেজে। হনুমানদের লাফালাফি করতে দেখলাম। কটেজে ঢুকে চোখ জুড়িয়ে গেল,একদম সাজানো ছিমছাম মাটির ঘর। বিছানার চাদর পর্দা সবেতেই হাতির ছাপ। খাটের মাথার কাছেও হাতি ওপরে সুন্দর গোল রিঙে মশারী ঝোলানো। বাথরুমও খুব সুন্দর, সব জায়গাতেই নেট দেওয়া। আমরা ফ্রেশ হয়ে খাবার জায়গাতে চলে এলাম,তখন গেস্ট কম ছিল তাই ওরা কিছু মেনু রেখেছিল তার থেকেই আমরা অর্ডার দিলাম অবশ্যই তাতে স্টার্টার,মেনকোর্স ও ডেজার্ট ছিল।  পিটারের কথা মত আমাদের আড়াইটা নাগাদ ন‍্যাশনাল পার্কের দিকে যেতে হবে। তিনটে পনেরোর মধ‍্যে আমরা ন‍্যাশনাল পার্কে ঢুকে পড়লাম পথে ঢোকার আগেই দেখলাম জেব্রা ঘোরাঘুরি করছে। এখানে এন্ট্রী ফী লাগে সত্তর ডলার এক এক জনের। আমরা জিপ নিয়েই ঢুকলাম ভেতরে,পিটার বেশ কিছুটা আগেই জিপের হুড ওপরে তুলে দিয়েছে। ওর গাড়িটা খুবই সুন্দর আর একদম চকচকে।
    ঢোকার মুখেই একদম মন খুশিতে ভরে উঠল একটু এগিয়েই দেখলাম বিশাল আকৃতির কাদা মাখা কিলিমাঞ্জারো এলিফ‍্যান্ট। কিলিমাঞ্জারো আফ্রিকার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ,এটা তাঞ্জানিয়াতে অবস্থিত হলেও অ্যাম্বাসোলি থেকে দেখা যায় আকাশ পরিস্কার থাকলেই। এমনকি জেনেছিলাম সোপা লজের ডাইনিং হল থেকেও সুন্দর দেখা যায়। বিশালাকার কিলিমাঞ্জারো এলিফ‍্যান্ট দেখতে অনেকটা পাহাড়ের মতই রঙও তেমনি। আমরা গজরাজের সাক্ষাতে সন্তুষ্ট হয়ে এগিয়ে চললাম যেতে যেতে অজস্র হরিণ আর জেব্রা দেখছি। নানা পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। দূরে গাছের তলায় বসে লেপার্ড আরাম করছে। ঝলমল করে উঠছে আমাদের চোখ প্রকৃতির মাঝে বন‍্যপ্রাণী দেখে। যতই এগোচ্ছি ততই দেখছি। ঝোপের ধারে আরামে পাতা চিবোচ্ছে মা জিরাফ তার বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে। আকাশের রঙ গাঢ় নীল মেঘেরা দুলছে সুখে আকাশের দোলনায়। আমার মনে হল এখানে মেঘেরা ভাসে না তারা একটু নীচে দোল খায় সুখে। তারমধ‍্যে দেখলাম রামধনু,এমন খোলা দিগন্তবিস্তৃত প্রকৃতিতে রামধনু অনেক বছর বাদে দেখলাম।
হঠাৎই পিটার বলে উঠল ইউ আর লাকি লুক দেয়ার ইজ কিলিমাঞ্জারো। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম উল্টানো কড়াইয়ের মত দেখতে কিলিমাঞ্জারোকে। অনেকটা আগ্নেয়গিরির মুখের মতও বলা যায়,শৃঙ্গের চারপাশে বরফ জমে আছে। হঠাৎই একদল হাতিকে দেখে চোখ ফেরালাম সেদিকে পুরো পরিবার মানে মোটামুটি দশ বারোজন একসাথে আমাদের জিপের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। ওরা এগোলো,আমরাও ওদের ক‍্যামেরায় ধরছি। তারপর যে দৃশ‍্য ইন্টারনেটে দেখেছি তেমনি দেখলাম, পেছনে কিলিমাঞ্জারো আর সামনে হাতির দল। খুব ভালো লাগল,হয়ত আজীবন মনে থাকবে সেই পড়ন্ত বেলার ছবিটা।
      সন্ধ‍্যে তখনও নামেনি বেশ আলো চারদিকে। অনেকটা পথ চলে গেছি তাই আমরা ফিরছি হঠাৎই পিটার বলে উঠল.. সী,লায়ন। চোখে বাইনোকুলার লাগালাম। সে এক মন ভালো করা দৃশ‍্য সিংহ সিংহী বসে আর ছানাগুলো খেলছে তাদের পাশে, প্রথমে দেখলাম চারটে তারপর গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এলো ঘাসের ভেতর থেকে আরও দুটো। অবাক হলাম দেখে একসাথে এতগুলো ছানাকে। তবে অনেক কষ্টে জুম করে সেই দৃশ‍্য ক‍্যামেরাতে এলেও ফোনে এল না। আর সত‍্যি বলতে অত ভালো প্রফেশনাল ক‍্যামেরা আমাদের কাছে ছিল না। আমরা সবটুকুই সম্পদ করে নিলাম চোখ ক‍্যামেরায়। সেদিনের মত জঙ্গল অভিযান শেষে বেরোনোর মুখেই দেখলাম সাঁঝবেলায় ভ্রমণরত জিরাফকে,নিশ্চিন্তে মুখ নাড়াচ্ছে। 
সোপা লজে ফিরে গরম কফিতে চুমুক দিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। পিটার বলে দিল পরদিন সকাল সাতটায় বেরোনো। সারাদিন জঙ্গলে ঘোরা ওখানেই লাঞ্চ হবে। সকাল সকাল না গেলে ভালো করে পাখি আর জন্তু জানোয়ার দেখা যাবে না। তখন বাইরে বেশ ঠান্ডা ভাব,আমরা ফোন আর ক‍্যামেরায় চার্জ দিতে ব‍্যস্ত হলাম। হ‍্যাঁ এখানে আমাদের চার্জার চার্জ দিতে হলে একটা এক্সট্রা প্লাগ লাগে,ইউরোপেও লেগেছিল। ওখানে হোটেল থেকে নিতাম,এখানে দেওর একটা দিয়েছিল তবুও হোটেলে পাঁচশো শিলিং জমা দিয়ে আরেকটা নিতে হল। ওরা আগেই বলে দিয়েছিল বেশি রাতে কারেন্ট থাকে না,কারণ পুরোটাই সোলার সিস্টেমে চলছে। জল এবং বিদ্যুৎ সংরক্ষণের কথা বারবারই সব জায়গায় বলা আছে। যা নিয়ে আমরা নিজেদের দেশে মাথাই ঘামাই না। দরজায় নক হল খুলে দেখি হাউজকিপিং,দুজন এসে ঝুড়ির মত মশারীকে সুন্দর করে খুলে টাঙিয়ে একেবারে গুজে দিয়ে মশার স্প্রে করে গেল। রাতের ডিনারে বুফে ছিল না কারণ গেস্ট কম,কিছু সিলেকটেড মেনু থেকে আমরা অর্ডার দিলাম। পরদিন বেশ ভোরে উঠে তৈরী হয়ে নিলাম এখানে সব হোটেলেই মোটামুটি সাড়ে ছটা থেকে ব্রেকফাস্ট দেওয়া শুরু হয়। সুতরাং ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা পিটারের গাড়িতে উঠে বসলাম,সোপা থেকে অ্যাম্বাসোলি ন‍্যাশনাল পার্ক প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার। সোপা বেশ নাম করা রিসর্ট সারা বিশ্বে অনেক জায়গায় এদের হোটেল আছে শুনলাম।
       এই প্রসঙ্গে বলে রাখি মাসাইমারা বা অ্যাম্বাসোলির জঙ্গল ঘন জঙ্গল নয়,এখানে বেশিটাই সাভানা ঘাসের তৃণভূমি। মাঝে মাঝে গাছ আর ঝোপঝাড়। অ্যাম্বাসোলিতে বড় গাছ আর ঝোপ বেশি মাসাইমারাতে সেই তুলনায় বেশিটাই তৃণভূমি। দুই ন‍্যাশনাল পার্কের চারদিকে পাহাড়। যেতে যেতে চোখে পড়ল অনেক পাখি,প্রচুর পেলিক‍্যান,সেক্রেটারী বার্ড,আফ্রিকান জ‍্যাকানা,হোয়াইট ফেসড ডাক,হোয়াইট ব‍্যাকড ডাক,ইজিপসিয়ান গুজ,গ্ৰে ক্রাউনড কেন,আফ্রিকান সোয়ামফেন,প‍্যাংগানি লং ক্ল,কমন অস্ট্রিচ,হটেনটট টিল,গ্ৰেটার ফ্লেমিংগো,লেসার ফ্লেমিংগো,আফ্রিকান ডার্টার আরও কত নাম না জানা পাখি। পাখি সম্বন্ধে আমার জ্ঞান সীমিত তাই দুচোখ ভরে দেখলাম আর ছবি তুলে রাখলাম ক‍্যামেরায়। যেতে যেতে প্রচুর হাতি চোখে পড়ল। আজ পিটারের গাড়ি অনেক এগিয়ে গেল,দুপাশে জলাশয় তাতে মনের সুখে সাঁতার কাটছে হাঁস,খাবার জোগাড় করছে পেলিক‍্যানেরা। আবার সাদা বকের দল হাতি আর জলহস্তীদের পিঠে সফর করছে। প্রচুর জলহস্তী আরামে ডুব দিয়েছে জলে। একটু এগোতেই দেখতে পেলাম ফ্লেমিংগো, ভোরের দিকে বৃষ্টি হয়েছিল বলে তাদের অনেককেই দেখলাম। ওদের হাঁটার ছন্দ অদ্ভুত,ঠিক যেন মনে হয় জলের ওপর দিয়ে নিশ্চিন্তে হাঁটছে অথচ পা ডুবছে না।
     সেদিন সারাদিন ঘুরে দূর থেকে সিংহ আর চিতা দেখে প্রচুর পাখি,হাতি,জলহস্তী দেখে মন ভরল। জঙ্গলের মধ‍্যেই সোপা লজের রেস্তোরাঁয় আমরা ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সারলাম। তারপরে আরও কিছুটা সময় থেকে বেরিয়ে এলাম। সেদিনের বিকেলটা বেশ লাগল। সোপা থেকে সুন্দর কিলিমাঞ্জারোর শোভা দেখতে দেখতে চা খেলাম। পরের দিন আমরা নাইরোবিতে যাব সুতরাং আটটায় বেরোনো। সোপাতে কিছু মাসাই রমণী হাতের কাজের জিনিস বিক্রি করেন। এখান থেকেই কিছু স্মারক কিনে,ওদের সাথে সময় কাটালাম।
        পরদিন ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে দুপুরের মধ‍্যেই নাইরোবিতে পৌঁছলাম,পিটার নামিয়ে দিল দেওরের অ্যাপার্টমেন্টে। তারপর তাড়াতাড়ি করে ডালসেদ্ধ,আলুসেদ্ধ আর গরম গরম ডিমের ওমলেট ভেজে তৃপ্তি সহকারে হালুম হুলুম করে খেয়ে আঃ বলে ভাবলাম আহা এতক্ষণে পেট জুড়োলো। কোথায় লাগে এর কাছে ঐসব কন্টিনেন্টাল খানা। আমার মত আলুভাতে বাঙালীর কাছে এটাই তৃপ্তির খানা। পরদিন অনেকটা ভোরেই উঠতে হল,ছটায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম। দেওর আমাদের সাথে যাচ্ছে মাসাইমারাতে সুতরাং আরেকটু খুশি খুশি ভাব,দেওর মজা করে বলল সীতাকে নিয়ে রাম লক্ষ্মণের দুদিনের বনবাস যাত্রা। মাসাইমারা যাবার পথের দৃশ‍্য খুবই মনোরম। নাইরোবি থেকে কিছুটা যাবার পরই ঠিক যেন মনে হল প্রথমটা কোন শৈলশহরের পথে যাচ্ছি,গাড়ি ঘুরে ঘুরে উঠছে পাশে পাহাড় আর ভ‍্যালি। মাঝে যেখান থেকে সুন্দর গ্ৰেট রিফট ভ‍্যালি দেখা যায় সেখানে গাড়ি থামলো। নাইরোবি থেকে মাসাইমারার দূরত্ব ২৫৯.৮ কিমি সময় লাগে মোটামুটি পাঁচ ঘন্টা মত। কারণ পথে এক দুবার অবশ্যই ব্রেক নিতে হয়। পথে একটা ছোট কফি শপের পাশে একটা বড় কাঁটাগাছে ছোট ছোট মাটির হাড়ির মত বাসা দেখলাম,কিন্তু বাবুই পাখির বাসার মত নয়। খুব ভালো লাগল একদল হলুদ ছোট্ট পাখির কিচিরমিচির। তারপর এগিয়ে চলা আমাদের আবার। মাসাইমারার কিছু আগে আমাদের গাড়ি বদল হল। এবারের গাড়ি সবুজ জিপ মত,ওপরে খোলার ব‍্যবস্থা। বেশ একটা জঙ্গল ফিলিংস শুরু হয়ে গেল তখনি।
        মাসাইমারা ন‍্যাশনাল পার্কে ঢোকার বেশ কয়েকটা গেট আছে আমাদের হোটেলের নাম ছিল সেকানেনি ক‍্যাম্প। তাই আমরা সেকানেনি গেট দিয়ে ঢুকলাম। এছাড়াও এখানে ঢোকার আরও চারটে গেট আছে। ঢোকার মূল‍্য জন প্রতি সত্তর ডলার আমরা যেহেতু দুদিন থাকব তাই আমাদের একশ চল্লিশ করে মানে দুশো আশি ডলার লাগল। দেওর যেহেতু আফ্রিকায় কর্মরত তাই ওর বারোশো শিলিংয়ে হয়ে গেল। মাসাইমারা ন‍্যাশনাল পার্কে ঢোকার গেট খোলে সকাল ছটায় বন্ধ হয় সন্ধ‍্যে ছটায়। বেশ কিছু থাকার জায়গা ন‍্যাশনাল পার্কের ভেতরেই,আমাদেরটাও তেমনি ছিল। সুতরাং একেবারে দুদিনের পাস নিয়ে ঢুকে পড়া জঙ্গলে। ঢোকার মুখে একদল মাসাই রমণী তাদের পণ‍্য সামগ্ৰী বিক্রির জন‍্য ঘিরে ধরল জিপকে। 
    অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতে শুরু করল যে স্বপ্নের মাসাইমারাতে পা রাখতে চলেছি। সত‍্যি কথা বলতে জঙ্গল এবং বন‍্যজন্তু প্রীতি যাদের নেই এত ব‍্যায়বহুল ট‍্যুর তাদের জন‍্য নয়। তাই প্রকৃতিপ্রেম থাকলেই এমন ট‍্যুরের সিদ্ধান্ত নেবেন। ট‍্যুরের জন‍্য অবশ‍্যই টুপি,ফুল হাতা জামা ও ভালো জুতো আর ছাতা সাথে রাখবেন,এছাড়া অবশ‍্যই নেবেন টর্চ,মশার ওষুধ,প্রয়োজনীয় ওষুপত্র,শীতের জামা ইত‍্যাদি। ভালো ক‍্যামেরা, বাইনোকুলার এগুলো সাথে রাখবেন সাধ‍্যমত। তবে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগাবেন আপনার চোখ আর মগজাস্ত্রকে,যা চোখে দেখবেন তা চিরকালের মত স্টোর করে রাখবেন মগজে। সব অনুভূতির ভাষা হয় না,কিছু একান্তে থাকে মনে আর চোখের ক‍্যামেরায় চিরকাল।
     আমরা এগিয়ে চললাম মাসাইরার দিকে, মাসাইরা দলে দলে গরু ভেড়া নিয়ে চলেছে চড়াতে। এই গরু আর জঙ্গলের পশুই ওদের সম্পদ,আর ওরাই এখানকার রক্ষাকর্তা এবং জঙ্গলের বন্ধু। মাসাইদের বিয়ের সময় নাকি বৌকে পণে গরুই দিতে হয় আমাদের ড্রাইভার জনসন জানালো। ওর কাছে শুনলাম মাসাইরা একাধিক বিয়ে করে যার ফলে এক একজন মাসাইয়ের সন্তান সংখ‍্যা কখনও সত্তর বা আশিতেও পৌঁছে যায়। কাঁটা গাছ দিয়ে বাড়ির চারদিকে বেড়া দিয়ে ওরা মোটামুটি একদলে বসবাস করে। আট থেকে ষোলটা মত বাড়ি নিয়ে একটা করে পাড়া মত হয়। আর এই কাঁটা গাছ দিয়ে বাড়িগুলো ঘিরে রাখে বন‍্যজন্তুর হাত থেকে গবাদিপশু বাঁচাতে। গরুর দুধই ওদের প্রধান খাবার গরুর গলায় তীর মেরে রক্ত বের করে দুধ এবং রক্ত মিশিয়ে ওরা খায়। তবে গোমাংস নাকি খুব একটা খায় না ওরা। পনেরো বছরের পর একজন মাসাইকে পুরুষের মর্যাদা দেওয়া হয়,তখন তাদের একটা সিংহ শিকার করতে হত। কিন্তু বর্তমানে আইন করে তা বন্ধ করে দিয়েছে কেনিয়া সরকার। মেয়েরা ঘরের কাজকর্ম ছাড়া পুঁতি দিয়ে গলার হার,হাত,পা,কানের এবং কোমরের অলংকার বানায়। সারাদিনই তারা এভাবেই নিজেদের ব‍্যস্ত রাখে। গবাদি পশুর বাচ্চাকে তারা অনেকসময় নিজেদের সাথে এক ঘরে রেখে দেয় রাতে রক্ষণাবেক্ষণের জন‍্য। ওদের ঘরে জানলা থাকে না,একটাই দরজা। তবে ধোঁয়া বেরোনোর জন‍্য ফুটো থাকে। রঙীন পোষাক আর পুঁতির গয়নায় নিজেদের সাজায় ওরা। ওদের রঙের বৈচিত্র্য আর বর্ণময় পোষাক ওদের সুন্দর রাখে।
       আমাদের জিপ এগোতেই জেব্রা আর জিরাফ দেখতে শুরু করলাম। সামনে দিয়ে লাফ দিয়ে গেল বেবুন আর হনুমানের দল। দেখলাম একটা মাসাইদের গ্ৰাম কিছু পর্যটক সেখানে মাসাইদের পরানো পোষাকে ওদের সাথে ছবি তুলছে। বেশ লাগলো দেখতে। জনসন বলল এরা জনপ্রতি কুড়ি ডলার নেয় ছবি তোলা এবং ওদের বাড়িঘর দেখানোর জন‍্য।
       অ্যাম্বাসোলিতে মাসাই রমণীদের সাথে বেশ অনেকটা সময় কাটিয়ে সেই সাধ আমার আর তেমন নেই। সুতরাং এগিয়ে চলা,একটু এগিয়ে যেতেই লালমাটি আর সবুজের চাদরের মাঝে একটা খাড়ি নজর পড়ল সেখানে জল খাচ্ছে হরিণ আর জেব্রা। সত‍্যি কথা বলতে কী খোলা জঙ্গলে এত বন‍্যপ্রাণী এর আগে কখনও দেখিনি। বেশ গভীর জঙ্গলের পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম আমাদের ক‍্যাম্প সেকানেনিতে। একদম শান্ত নিরিবিলি অরণ‍্যে ঢাকা একটা নিশ্চিন্ত জায়গা,ছোট্ট একটা ঝুলন্ত ব্রীজ পেরিয়ে আমরা ওপরে উঠলাম। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে জলধারা। আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে গেল বেবুনের দল। মন ভরালো পাখির কিচিরমিচির।
      মাসাই গার্ডরা আমাদের টেন্টে পৌঁছে দিল,এখানটা আরও নিরিবিলি ঠিক যেন প্রকৃতি মায়ের আঁচল ধরে ঝুলে আছি। টেন্টের বারান্দার পরেই খাদ মত, আর বইছে তাতে ক্ষীণ ধারায় জলধারা। লাফালাফি করছে হনুমান,ঘুরছে হরিণ আর ডাকছে পাখি। টেন্ট হলেও তা সম্পূর্ণ আধুনিক সুবিধার এবং সুরক্ষিত। টেন্টের নেটের জানলার পর্দা সরিয়ে দিলে দেখা যাচ্ছে নীল আকাশের নীচে সবুজ প্রকৃতির নির্মল ছবি। ঘরে শুয়েই উপভোগ করা যায় পাখির ডাক আর সবুজের শোভা। তবে আমাদের বেরোতে হবে বন‍্যপ্রাণী দেখতে তাই বাথরুমে একটু ফ্রেশ হয়ে যাব খাবার খেতে। টেন্টের বাথরুমও বাথটবযুক্ত আর সুন্দর কার্পেটে মোড়া। আমরা মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে গেছি তখন টুরিস্ট কম তাই সোপা লজের মত ওরাও সিলেকটেড কিছু মেনু দেখিয়ে আমাদের পছন্দের কনটিনেন্টাল ডিস দিল। খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পরলাম জনসনের সাথে জঙ্গলের পথে। ও জিপের হুড খুলে দিয়েছে বন‍্যজন্তু দেখে আর স্থির থাকতে পারলাম না,দাঁড়িয়ে পড়লাম। 
      মাসাইমারার এক অপরূপ সৌন্দর্য আছে,এই জঙ্গলের শোভা অ্যাম্বাসোলির সাথে মেলে না। অ্যাম্বাসোলিতে মাঝে মাঝে লেক,জলাভূমি। কিছু বড় গাছ আছে আবার কোথাও ঘাসে ভরা জলাভূমি যেখানে হাতি বা জলহস্তী আনন্দে ডুবে আরাম নিচ্ছে। মাসাইমারার ন‍্যাশনাল পার্ক মূলতঃ তৃণভূমি। জানুয়ারি থেকে এখানে বৃষ্টি হয় আর ঘন হয় সাভানা ঘাসের তৃণভূমি। জুন,জুলাই,আগষ্ট এখানে শীতকাল। সুতরাং মে মাসে বেশ ঘন ঘাস। তবে শুনলাম মাইগ্ৰেশনে আসা ওয়াইল্ড বীস্টরা এবং হরিণ,বাইসন,জেব্রা আরও যেসব তৃণভোজী প্রাণী আছে তারা কিছুদিনের মধ‍্যেই এই ঘাস খেয়ে সাবাড় করবে। মাসাইদের গবাদিপশুর খাদ‍্যও এই ঘাস। ঘাস হাল্কা হলে আরও পরিস্কার দেখা যাবে চিতা,সিংহ লেপার্ড ইত‍্যাদি প্রাণী। যেতে যেতে প্রায় তিন চার প্রজাতির হরিণ দেখলাম। এখানে মূলত দেখা যায় অ্যাফ্রিকান ডিয়ার গ‍্যাজেল,এছাড়াও বড় শিঙের হরিণ এবং অ্যান্টিলোপ। দেখলাম ঝাঁকে ঝাঁকে অস্ট্রিচ আর জলহস্তীর দল। অদ্ভুতভাবে এখানকার হাতি কিন্তু কিলিমাঞ্জারো এলিফ‍্যান্টের মত নয়,আমরা সাধারণ হাতি যেমন দেখি তেমনি। দেখতে দেখতে চড়া রোদ থেকে বিকেল নেমে আসছে। ঘাস ভূমিতে দেখছি শেয়াল আর হায়নারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানকার শেয়াল এবং হায়না একটু আলাদা দেখতে বেশ ঋষ্টপুষ্ট আর শেয়ালের ল‍্যাজে সুন্দর ছোপছোপ। হঠাৎই জনসন চোখে বাইনোকুলার দিল। তারপর এগিয়ে গেল,বেশ কয়েকটা জিপ একটু দূরে দাঁড়িয়ে। অনেক হায়না আর শেয়াল ঘোরাঘুরি করছে। জনসন বলল লায়ন ইজ দেয়ার। তারপর এগিয়ে গেল,দেখলাম মাঝখানে একটা গর্ত মত ঝোপের মধ‍্যে মানে ওটাই লায়নস ডেন তখন, সেখানে একটা শিকার করা মোষকে ঘিরে সিংহ,সিংহীদের ভোজ চলছে। তাদের কারও মুখ দেখছি,কারও বা পিঠের অংশ। তারসাথে সুস্বাদু ভোজ খাবার আনন্দমাখা আওয়াজ। প্রায় সাত আটজন ওরা,হয়ত আরও বেশি হতে পারে।
    একটু দেখার পরই আমাদের গাড়ি মুখ ফেরালো,শুনলাম রেঞ্জারের হুকুম কেউই তিন মিনিটের বেশি থাকতে পারবে না।
       গাড়ি এগোতে থাকল আমরা দেখলাম সিংহ গাছের তলায় ঘুমোচ্ছে,ওখানে বেশ ঝোপ। গাছে অনেক পাখি ডাকছে। আরেকটু এগোতে আরেক পশুরাজকে ঘুমন্ত দেখলাম। জনসনকে বললাম আস্তে আস্তে গাড়িটা একদম ওর কাছে নিতে তবে ও বলল এই সিংহটা নাকি উইকেড যখন তখন আক্রমণ করতে পারে। অন্তত বেড়াতে এসে প্রাণ দেবার সাধ নেই তাই যাওয়া যাক বলা। সন্ধ‍্যের আগে পর্যন্ত মাসাইমারা ন‍্যাশনাল পার্কে ঘুরে চোখে পড়ল অসংখ্য জীবজন্তু আর নানা পাখি। একটা জিনিস লক্ষ‍্য করলাম যে মোটামুটি এরিয়া ভাগ করা আছে সবার। আর সেখানে তারা দলে ঘুরছে,কত যে জেব্রা আর গ‍্যাজেল দেখলাম বলার নয়। শুনলাম ওদের ব্রীডিং টাইম গেছে কয়েক মাস আগে,তাই বেশিরভাগই বাচ্চা। সবার ল‍্যাজই ছোট্ট রুমালের মত উড়ছে ঘন ঘন।

 আমরা ফিরে এলাম আমাদের সেকানেনি ক‍্যাম্পে। ততক্ষণে আবছা আঁধার নেমেছে। জিপের আওয়াজ পেয়েই ওখানকার মাসাই গার্ডরা এগিয়ে এসে আমাদের টর্চ নিয়ে একদম ডাইনিংয়ে নিয়ে এল। সেখানে গরম কফি খেয়ে আমরা টেন্টে যাবার আগে আমাদের রাতের ডিনার ওখানেই সার্ভ করতে বললাম। সত‍্যি কথা বলতে যে পরিমাণ জঙ্গল পেরিয়ে খেতে যাওয়া তা রাতে বেশ ভয়ংকর বটেই। অবশ‍্য মাসাই গার্ডদের সেবার তুলনা নেই ওরা হাতে বর্শা নিয়ে আমাদের সাথে টেন্ট অবধি এল। বন‍্যজন্তু এবং সিংহের আক্রমণের কথা ভেবে এরা অস্ত্র রাখে সাথে।
    বাইরে তখন একটানা পাখির কিচিরমিচির। দেওর থাকায় মাসাইমারার রাত্রিগুলো গল্পে আড্ডায় সুন্দর কেটেছিল। এমন নির্জন গা ছমছমে রাত তো সরাচর জীবনে আসে না। তাই আমাদের তিনজনের জঙ্গল অভিযান বা বনবাসের দুই রাত্রি ভীষণ আনন্দে কেটেছিল। ওরা যথাসময়ে ডিনার দিয়ে গেল। স‍্যুপ,ব্রেড,পরোটা,পনীর সবই ছিল। আমরা তাবু লক করে শুয়ে পড়লাম এই ভাবতে ভাবতে যেন সিংহ না আসে। পরের দিন সকাল সাতটায় বেরোনো,তাড়াতাড়ি উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম জনসনের সাথে। বাইরে তখন বেশ ঠান্ডা আমেজ। আমাদের ক‍্যাম্প পেরোলেই হরিণ জেব্রা আর জিরাফের দলের দর্শন পাওয়া যায়। হঠাৎই দেখলাম মাঠ ভর্তি বেজি,তাদের চেহারা বেশ হৃষ্টপুষ্ট। জনসন জানালো বেজি আছে মানে এখানে কোন সাপ নেই। আফ্রিকার দুই ন‍্যাশনাল পার্কে ঘুরতে গিয়ে আমাদের চোখে সাপ পড়েনি। তবে জনসন বললো ও কিছুদিন আগে পাইথন দেখেছে। তবে একথা ঠিক প্রকৃতি মায়ের পেতে রাখা সবুজ আঁচলে সুন্দর খেলে বেড়াচ্ছে নানা জীবজন্তু দলবলের সাথে। সমষ্টিগত জীবনযাপনের থিওরি ওদের কাছ থেকে আমাদের শেখা উচিত। অথচ আমরা মানুষেরা একই বাড়িতে থেকেও আলাদা হয়ে যাই একে অপরের থেকে।
     মাসাইদের গ্ৰাম ছাড়িয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল। অ্যাম্বাসোলিতে গাড়ি যাবার পথ থাকলেও মাসাইমারাতে তেমন নির্দিষ্ট পথ নেই। গাড়ি ঢুকে পড়ছে তৃণভূমির মাঝে। কখনও বা পাড়ি দিচ্ছে উঁচুনীচু পথ। যার ফলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ‍্য দেখতে গিয়ে ব‍্যালেন্স রাখাটা খুবই কষ্টকর। দেওর সবসময়ই সাবধান করছে,তবে প্রকৃতির ছোঁয়া মনকে করেছে অবাধ‍্য। তাই ধাক্কা খেলেও দাঁড়িয়ে উপভোগ করছি অসাধারণ দৃশ‍্য। প্রকৃতির যে কত রঙ তা না দেখলে বোঝা যায় না,ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাচ্ছে মাটির রঙ আর ঘাসের রঙ। গাড় নীল আকাশের গলা জড়িয়ে দুলছে সাদা মেঘপ্রিয়া। দিগন্তবিস্তৃত তৃণভূমি,তার মাঝে মানুষের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বিচরণ করছে তৃণভোজী প্রাণীরা। ঝোপেঝাড়ের তলায় শুয়ে সিংহ আর সিংহী। জনসন আবার এসে দাঁড়ালো সেই ঝোপের কাছে সেখানে এখনও বাসীভোজ চলছে। হঠাৎই দেখলাম এক সিংহী গম্ভীরভাবে বাইরে বেরিয়ে এল। কয়েকজনকে দেখলাম গাছের আড়ালে শুয়ে থাকতে।
    গাড়ি এগোলো,পাখি,হরিণ,হাতি যা দেখছি তারই প্রজাতির বর্ণনা শুনছি জনসনের কাছে। হঠাৎই একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা বেশ কয়েকটা জিপের মাঝে জনসনও এগিয়ে গেল। আমি খোলা হুড থেকে উঁকিঝুঁকি মারছি তারপর যা দেখলাম তা অকল্পনীয় আমাদের জিপের থেকে দুহাত দূরে আরেকটা জিপের চাকা ঘেঁষে বসে এক সিংহ আর সিংহী। গিন্নী নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন,আর কর্তাটি বসে পাহারা দিচ্ছেন। কিন্তু এত লোকের উৎপাতে বিরক্ত হয়ে প্রথমে সিংহী উঠে পড়ল তারপর দেহরক্ষীর মত পেছন পেছন সিংহ। দুজনেই একটু নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে গাছের ছায়ায় বসল। আমরাও ছবি তুলে সন্তুষ্টি নিয়ে এগিয়ে গেলাম। একটু এগোতেই আবার চমক,সুন্দর দেখতে একটা লেপার্ড ঘাসের মধ‍্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু এখানেও সেই মানুষের উৎসাহ বিরক্ত করছে প্রাণীদের। তাই সে একটু বাদেই মিলিয়ে গেল ঘাসের আড়ালে। আবার হরিণ,জেব্রা দেখতে দেখতে এগিয়ে চলতেই জনসন দেখালো এক জোড়া সেক্রেটারী বার্ড,অদ্ভুত দেখতে এই পাখি। সবচেয়ে সুন্দর দেখতে এদের পা,ঠিক যেন মনে হল কোটপ‍্যান্ট পরা সুসজ্জিত সেক্রেটারী। এদের পায়ের জোর অত‍্যন্ত বেশি,এরা পা দিয়ে থেতলে সাপ মারে।
         আবার জিপের ভিড় দেখে আমরা এগোলাম দুটো চিতা গাছের তলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে আয়েসে। তবে একই ব‍্যাপার জনতার ভিড় দেখে তারাও উঠে পড়ল। এগিয়ে এল আমাদের জিপের দিকে,ভয় পেলাম কারণ জানলা খোলা আর চিতা ভীষণ ক্ষিপ্রগতির প্রাণী। তবে ওরা একটা জিপের কাছে একটু বসে আরও এগোলো আরও সামনের দিকে। জনসন বলল ওরা শিকারের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। তবে ট‍্যুরিস্টদের জিপের উৎপাতে শিকার তখনি করা হল না। আমরা এগিয়ে চললাম,জঙ্গলে নামা বারণ তবে তাঞ্জানিয়া বর্ডারে এসে আমরা নামলাম আর মৃত বাইসনের মাথার পাশে দাঁড়িয়ে ছবিও তুললাম। অনেকেই একটু এগোলো তাঞ্জানিয়াতে পা রাখতে। আর মাইগ্ৰেশনের সময় তাঞ্জানিয়া থেকেই অসংখ্য ন‍্যু,জেব্রা,বাইসন,কেপ বাফেলো আর অ্যান্টিলোপ ছুটে আসে দেশের এক দেশের প্রাচীর ডিঙিয়ে আরেক দেশে খাদ‍্য এবং জলের সন্ধানে। ততক্ষণে সূর্য মাথার ওপরে। 
    জনসনের জিপ এসে দাঁড়ালো একটা আমব্রেলা গাছের তলায়,গাছটা সত‍্যিই ছাতার মত ছায়া বিস্তার করে ছিল বিস্তৃত তৃণভূমির মাঝে। ও চটপট করে ফোল্ডিং চেয়ার ও টেবল পেতে ফেলল। আমাদের হাতে ধরিয়ে দিল জল সমেত প‍্যাকড লাঞ্চ। এই জঙ্গলে দুপুরে অমন লাঞ্চ পেয়ে সত‍্যি মন খুশি হয়ে গেল। গাইতে ইচ্ছে হল এমন বন্ধু আর কে আছে তোমার মত জনসন,একা সব সামলাচ্ছো,সিংহ বাঘও দেখাচ্ছো। কখনও দিচ্ছো না টেনশন।
         খাওয়া শেষে টেম্পোরারি ওয়াশরুম বিহাইন্ড দ‍্য জিপ সেরে আবার রওনা দেওয়া তৃণভূমির পথে এবার আমাদের গন্তব‍্য মারা নদীর কাছে। মাসাই উপজাতি এবং মারা এই দুইয়ের সমষ্টি এই মাসাইমারা। মাসাইদের মাতৃভাষা মা আর এই অনুযায়ী এই সেরেঙ্গিটী তৃণভূমির অর্থ অজস্র বিন্দুর সমাহার। সত‍্যি দূর থেকে দেখলে তেমনি মনে হয়। নদীর ধারে গিয়ে মুগ্ধ হলাম,খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আমার আর দেওরের সেখানে নামার তবে জনসন বলল নামা বারণ। অদ্ভুত এই নদী মারা,চারপাশের মাটির রঙ নদীর জলকেও লালচে করেছে। কোথাও বেশ স্রোত আবার কোথাও কম জল। সানন্দে তাতে গা ভাসিয়েছে জলহস্তীর দল। প্রচুর জলহস্তী তৃপ্তিতে গা ডুবিয়ে রয়েছে। কুমীরেরা রোদ পোহাচ্ছে জলের ধারে,কেউ বা ভাসছে নদীতে। 
      এই মারা নদীর আকর্ষণ অনবদ‍্য ন‍্যু অথবা ওয়াইল্ড বিস্টদের কাছে। তাঞ্জানিয়া থেকে মাসাইমারা আসতে গিয়ে এরা পেরোয় এই নদী,মানে এক অদ্ভুত নেশাতে পেরোয়। ন‍্যু বা ওয়াইল্ড বিস্ট অদ্ভুত দেখতে ঠিক যেন মনে হল মোষ,ছাগল,গরু সব মিলিয়ে মিশিয়ে। একটু ছুঁচলো মুখ,মাথায় শিং গায়ের রঙ কালো,নীল,বাদামী মেশানো। মাইগ্ৰেশনের সময় এরা দলে দলে পার হয় এই মারা নদী। আর এই মাইগ্ৰেশন এখন সেভেন ওয়ান্ডার্সের মধ‍্যে। এ এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ‍্য, ঝাঁকে ঝাঁকে ওয়াইল্ড বিস্ট ধুলো উড়িয়ে ছুটে এসে একসাথে লাফিয়ে পড়ে মারা নদীতে। অনেকেরই প্রাণ যায় কুমীর,সিংহী বা চিতার আক্রমণে তবুও ঐ বাঁধ ভেঙে দাও এমন মনোভাব ওদের। মানে আসতেই হবে এপারে। হয়ত বা কেউ আসে ফেলে যাওয়া সঙ্গীর খোঁজে,অথবা নতুন সঙ্গী খুঁজতে। এখানে এসে বিচরণ করে খাদ‍্য এবং পানীয় খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে কয়েক মাস কাটিয়ে আবার ফিরে যায় সেরেঙ্গিটির গোরোঙগোরো অঞ্চলে। সেরেঙ্গিটি থেকে মাসাইমারা আবার মাসাইমারা থেকে সেরেঙ্গিটি এই যাত্রা চলছে বছরের পর বছর ধরে। জনসন পথগুলো দেখালো যেখান দিয়ে ওরা পার হয় নদী,অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ,ছবিতে দেখা দৃশ‍্য মনে ভাসলো। যেহেতু আমরা মে মাসের শেষে গেছি তাই মাইগ্ৰেশন দেখা আমাদের হল না। তবে যা দেখলাম সেটাই সারাজীবনের সম্পদ হয়ে থাকবে। 
       সেদিন একটু তাড়াতাড়ি ক‍্যাম্পে ফিরে এলাম আমরা,বিকেলটা সুন্দর কাটালাম গরম কফির কাপ নিয়ে সবুজে ডুব দিয়ে। কিছুটা সময় কাটালাম জঙ্গলে ঘেরা পুলের ধারে। জায়গাটা এত নিরিবিলি যে মনে হচ্ছে যে কোন সময় বন‍্যপ্রাণী চলে আসতে পারে। এখানে সন্ধ‍্যে হয় একটানা ঘরে ফেরা পাখির ডাকে,ঝুপঝাপ করে লাফায় বেবুন আর হনুমানেরা। জনসন বলে দিল পরদিন ভোরে ঠিক ছটায় আমাদের নিয়ে জঙ্গলে যাবে। তারপর আমরা ব্রেকফাস্ট করব সাড়ে আটটা নটা নাগাদ। বেশ ভোরে উঠে যখন হেঁটে ডাইনিং হলের দিকে যাচ্ছি তখন চারদিকে অন্ধকার। আফ্রিকায় সূর্যমামা দেখা দেন সাড়ে ছটা নাগাদ। আমাদের নিরাপত্তা রক্ষায় হাতে আলো আর বর্শা নিয়ে ছুটে এলো মাসাই গার্ডরা। আমরা কফি খেয়ে বেরোলাম জনসন রেডিই ছিল। সেদিন সকালে জনসন তন্ন তন্ন ক‍রে খুঁজতে লাগল গন্ডার। কারণ আফ্রিকার জঙ্গলে বিগ ফাইভের মধ‍্যে ওটা দেখাই বাকি ছিল। কিন্তু হায় দেখা মিলল না। কয়েকবছর আগে আমাদের এক বন্ধু এসেছিলেন তিনিও জানিয়েছেন যে তিনি দেখতে পাননি গন্ডার। তবে নিরাশ হলাম না,এক জোড়া সিংহ সিংহী,অসংখ‍্য পাখী,হরিণ,ওয়াইল্ড বিস্ট,অ্যান্টিলোপ, জিরাফ আর জেব্রা দেখে ফিরলাম স‍্যাকানেনি ক‍্যাম্পে। ব্রেকফাস্ট সেরে ফ্রেশ হয়ে আমাদের মাসাইমারা ছাড়ার কথা। ভারত থেকে অনেক আশা নিয়ে যে বনবাসের প্রত‍্যাশায় গেছিলাম তা আমাদের কাছে কানায় কানায় পূর্ণ। হয়ত কিছু দেখা হল না তবে ঐ যে কিছু আশা বোধহয় অধরা থাকাই ভালো তাহলে ইচ্ছেগুলো বাঁচে। ইচ্ছে রইলো আবার আসার...
    ফেরার সময় আমাদের মাসাই গার্ডরা পৌঁছে দিল জিপ পর্যন্ত। তারপর জঙ্গলের পশুদের হাত নেড়ে তৃণভূমি আর লালমাটির চাদর পেরিয়ে মাসাইদের গ্ৰাম দেখতে দেখতে ফিরে আসা পার্কের এন্ট্রিপথে। একদল মাসাই রমণী ঘিরে ধরল আবার। নির্জনতাকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে পা রাখলাম জনপথে। মাইলের পর মাইল ভুট্টা ক্ষেত পেরিয়ে মাসাইদের গোচারণ দেখতে দেখতে এগিয়ে চললাম নাইরোবির দিকে। পৌঁছতে দুপুর গড়ালো আমাদের,দেওরের বাড়িতে সেই রাতটা আনন্দে কাটলেও মনে রইল একটা বিষাদের সুর যে আর মাত্র চব্বিশ ঘন্টা তারপরেই আবার যাত্রা দেশের উদ্দেশ্যে।
     ভালো সময় বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়,সেভাবেই আমাদের ট‍্যুরের দশদিন যে কোথা দিয়ে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। আমাদের ট‍্যুর প্ল‍্যানার মিঃ সোমকে ধন‍্যবাদ জানিয়ে এবং দেওরকে অনেক ভালোবাসা জানিয়ে আমরা একই পথ ধরে ফেরার জন‍্য যাত্রা করলাম।
সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...