Skip to main content

কোনারক

কোনারকের মন্দির এক অনন্য আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু পর্যটকদের কাছে। খুব ছোটবেলায় যখন কোনারকে গেছিলাম তখন যে অবস্থায় এই মন্দির দেখেছি কালের করাল থাবায় এই মন্দির আরও বিনষ্ট হয়েছে। পুরীতে এলে উদয়গিরি আর খন্ডগিরি না যেতে পারলেও কোনারকের মন্দির আমাকে ভীষণ টানে। মন্দিরের প্রতি পাথর যেন কত কথা ফিসফিস করে কথা বলে যায় অতীতের। অথচ যতটা সময় ব‍্যায় করে এই মন্দির দেখা উচিত কোনদিনই সেই অবকাশ পাইনি। সবসময় কম সময় পেয়েছি,কখনও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে গেছি অথবা কখনও ড্রাইভারের তাড়ায় ওপর ওপর সব দেখে ফিরে এসেছি। এবারও কোনারক পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ‍্যে হল। লাইট অ্যান্ড সাউন্ড দেখব বলে গেলেও ঠিকমত জানা না থাকায় দেখতে পেলাম না। শুনলাম সোমবার শো হয় না। হাতে সময় কম একজন গাইডকে নিয়ে মোটামুটি রাতের আবছা আলো আর সার্চ লাইটের আলোতে তাড়াহুড়ো করেই আবারও মন্দির দেখতে হল। কোনারক মন্দির সবাই মোটামুটি দেখেছেন,অপূর্ব সুন্দর এই মন্দির রথের আদলে বানানো। এই মন্দির মোটামুটি চব্বিশটা রথের চাকার ওপর বসানো রয়েছে। গাইডের কাছেই শুনলাম পুরীর রথের চাকার সংখ‍্যাও চব্বিশ। এই মন্দির কে বানিয়েছেন সে ব‍্যাপারে দ্বিমত আছে অনেকেই ভাবেন চন্দ্রভাগা নদীর ধারে অবস্থিত প্রাচীন মিত্রাবনে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা পূর্বগঙ্গ বংশের রাজা নরসিংহদেব। তিনি জয়ের স্মারক হিসেবে এই মন্দির তৈরী করেন। আবার দ্বিতীয় মতে বলা হয় শ্রীকৃষ্ণের পুত্র শাম্ব‍র তৈরী এই মন্দির। অপূর্ব রূপের অধিকারী শাম্ব একদিন ভুল করে শ্রীকৃষ্ণ যখন গোপিনীদের সাথে লীলায় ব‍্যস্ত সেখানে এসে পড়েছিলেন। গোপিনীরা শাম্বর দিকে আকৃষ্ট হয় তার রূপে মুগ্ধ হয়ে। আর তাতে ক্রুদ্ধ হয়ে শ্রীকৃষ্ণ অভিশাপ দিয়েছিলেন ছেলেকে যে সে রূপহীন হয়ে পড়বে। দুঃখে কাতর হয়ে কুরূপ শাম্ব তপস‍্যা করেন চন্দ্রভাগা নদীর তীরে কোনারকে এবং তার তপস‍্যায় প্রীত হয়ে সূর্যদেব তাকে বর দেন। সেইজন্য সূর্যদেবের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই মন্দির তিনি তৈরী করেন।
       এই মন্দিরে সূর্যদেবের বড় বিগ্ৰহ ছিল তা আর এখন নেই। সেই দিকটা পুরোই ভেঙে গেছে প্রায়। প্রথম এই মন্দিরকে ধ্বংস করে কালাপাহাড়। নরসিংহদেব নিজেও নাকি মন্দির ধ্বংস করেছেন কারণ তিনি মুসলিম কন‍্যাকে বিয়ে করেছিলেন। কোনারকের সূর্যের বিগ্ৰহ এবং অনেক পাথর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পুরীর মন্দিরে। নাটমন্দিরও অপ্রয়োজনীয় ভেবে ভেঙে ফেলা হয়। কোনারক থেকে অরুণ কুম্ভ নামে একটা বিশাল পাথর নিয়ে পুরীর সিংহদ্বারের সামনে স্থাপন করা হয়। কোনারকের সূর্যমন্দিরের ওপরে একটা চুম্বক বসানো ছিল যা পর্তুগীজেরা ধ্বংস করে। বন্ধ হয়ে যায় কাছের বন্দ‍রটিও। আঠেরোশো শতকের শেষে কোনারক মন্দির তার সব গৌরব হারিয়ে সম্পূর্ণ পরিত‍্যক্ত হয়ে পড়ে থাকে। অনেকটা অংশ চাপা পড়ে যায় বালির তলে। আর ঢেকে যায় ঘন জঙ্গলে। ভাবলেও অবাক হতে লাগে কত গৌরবান্বিত ভাস্কর্য এভাবে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে বালির তলায়।
  এই মন্দিরের চূড়ার আকার পিরামিডের মত। মন্দিরের সামনের নাট‍্যমন্ডপে একসময় দেবদাসীরা নৃত‍্য করত।মন্দিরের ভেতরে নাটমন্দির,ভোগমন্দির এবং গর্ভগৃহ রয়েছে। তবে অনেকটা অংশ বালির ভেতরে দেবে বসে গেলেও এখনও মন্দিরের উচ্চতা ৮৫৭ ফুট।
   এই মন্দিরের আকার বিশাল রথের মত,ঠিক যেন সূর্যের সাত জোড়া ঘোড়া সূর্যদেবের রথ টানছে। এই সাতটা ঘোড়া সপ্তাহের সাতদিনের প্রতীক। চব্বিশটা চাকা মানে চব্বিশ পক্ষ। প্রতিটা চাকা একেকটা সূর্য ঘড়ি। চাকাগুলো নষ্ট যাতে না হয় তাই সামনে ব‍্যারিয়ার দেওয়া হয়েছে। একটা সময়ে এসব ছিল না। তবে চাকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম আগের মতই। কী অপূর্ব ভাস্কর্য আর বিজ্ঞানে তৈরী এই মন্দির! ধর্ম,অর্থ,কাম এবং মোক্ষ সব চিত্রই বর্তমান শিল্পীদের খোদাই করা মূর্তিগুলোতে। যেমন আছে সামাজিক চিত্র,তেমনি আছে অতি উন্নত হাইহিল পরা রমণীর ছবি। কোথাও বা সিঁদুরের রেখা আঁকছে বিবাহিতা রমণী। আবার কোথাও দেখলাম দুই রমণীর কুস্তি,যাকে ডাব্লিউ ডাব্লিউ বলা যায়। নারী পুরুষের মিলনের নানা ভঙ্গীমার সাথে সাথে আছে কুকুরের দ্বারা রমণীর যোনিদ্বার লেহন করিয়ে যৌনরোগ থেকে মুক্তির দৃশ‍্যও। শাশুড়ি বৌয়ের ঝগড়াও ফোটানো হয়েছে কোন খোদাইয়ে। হয়ত ভালো করে সময় নিয়ে দেখলে অনেকগুলো দিন লেগে যায় পুরো মন্দিরের শিল্পকাজ বুঝতে। মন ছুঁয়ে গেল ঢোকার মুখে সিংহের মূর্তি যার নীচে রয়েছে হাতি আর এদের মাঝে পিষ্ট হচ্ছে মানুষ। এই মূর্তি নাকি অহংকার হলে যে পতন অবশ‍্যম্ভাবী তা বলে। সূর্যঘড়ির প্রতীক স্বরূপ চাকাতে আটটা করে দাড়ি আছে যার মানে অষ্টপ্রহর। এখনও নিখুঁত সময় জানা যায় এই ঘড়ি দ্বারা। কোনারকের সূর্যের প্রথম রশ্মিতে স্নান করতেন সূর্যদেবতা। কোণ এবং অর্ক এই মিলিয়েই কোনারক।
   এখানে রয়েছে ছায়াদেবী আর মায়াদেবীর মন্দিরও,ছায়া দেবী এবং মায়াদেবী সূর্যের দুই পত্নী,তাঁর দুই পুত্র যমরাজ এবং শনিদেব।
         মন্দিরের অপূর্ব কারুকার্য মনকে নিয়ে যায় আজ থেকে বহুবছর আগে আধুনিক ভারতীয় সভ‍্যতার অঙ্গনে। মৃদঙ্গ,নৃত‍্য,রামায়ণের দৃশ‍্য,শিকার এবং শৃঙ্গারের দৃশ‍্য সবই আছে এই মন্দিরে। এমনকি শিবের মাথায় বাঁকে করে জল ঢালতে যাওয়ার দৃশ‍্যও আছে।
    বিংশ শতাব্দীতে এই মন্দির আবার পুনরায় উদ্ধার হয় লর্ড কার্জনের চেষ্টায়। আমরা যাকে মূলমন্দির হিসেবে দেখি তা মূলমন্দির নয় নাট মন্দির। অনেক ভগ্নপ্রায় বিলুপ্ত ধ্বংসাবশেষের মাঝে বসেও মন মুগ্ধ হয়ে অবলোকন করে ইতিহাস আর চোখ তা যত্নে সংরক্ষণ করে হৃদয়ের প্রকোষ্ঠে। এই মন্দিরের বেশ কিছু ধ্বংসাবশেষ সূর্যমন্দিরের জাদুঘর এবং উড়িষ্যার জাদুঘরে রাখা আছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের সমাগম হয় এই মন্দির প্রাঙ্গনে আর অপার বিস্ময়ে সবাই আমরা দেখি আমাদের প্রাচীন ভারতের অতি উন্নত শিল্প,ভাস্কর্য এবং বিজ্ঞানকে।

     পুরী বাঙালীর দ্বিতীয় বাড়ি মানে ইংরেজীতে যাকে বলে সেকেন্ড হোম। আগে মধ‍্যবিত্ত বাঙালীর আল্টিমেট ডেস্টিনেশন ছিল দীপুদা মানে দীঘা,পুরী আর দার্জিলিং। এখন ভ্রমণ পিপাসু বাঙালী কবির ভাষায় বলে থাকব না আর বদ্ধ ঘরে,দেখব এবার জগৎটাকে। সুযোগ পেলেই আমরা চলে যাচ্ছি বহু দুর্গম স্থানে আর বিদেশেও। সুতরাং পুরী সম্বন্ধে সত‍্যিই নতুন করে বলার কিছু নেই তবুও আমার এক বন্ধুর জন‍্য একটু বিস্তারিত লিখতে ইচ্ছে হল পুরী নিয়ে। পুরী স্টেশনে কিছু হোটেলের গাড়ি পাঠানো হয় সেই হোটেলের যাত্রীদের নিতে সেক্ষেত্রে কোন সমস‍্যা নেই। এছাড়াও অনেক অটো দাঁড়িয়ে থাকে স্টেশনের বাইরে। দরদাম করে সেগুলো ধরা ভালো,ভাড়া মোটামুটি দুশো আড়াইশো। জগন্নাথ মন্দিরে যাবার অটোভাড়া একশো থেকে দেড়শোর মধ‍্যে। মানে যখন যেমন পায় তেমন এরা চেয়ে বসে। সুতরাং একটু দরদাম করে নেওয়া ভালো। পুজো দেওয়ার উপযুক্ত সময় ভোরবেলা। একটু ভীড় কম থাকে তখন,তবে আমি পৌনে ছটাতে পৌঁছে দেখেছি কাতারে কাতারে লোক। পরে সব জায়গায় ভীড় দেখে বুঝলাম কার্তিক মাস চলছে। অনেকেই এই মাসে পবিত্রতা পালন করেন,নিরামিষ খান আর তীর্থ করেন। আমরা না জেনেই জগন্নাথদেবের টানে চলে এসেছি। তবে পুরীতে সারা বছরই তীর্থযাত্রীদের ভীড় থাকে। অটোতে করে লোকাল সাইট সিয়িং করতে হলে মোটামুটি ছশো থেকে আটশো টাকা লাগে। কেউবা হাজার চেয়ে বসবে সেক্ষেত্রে আবার দরদাম করা। পুরীতে গিয়ে খাজা কেনা হবে না তা হয় না। খাজা কিনতে হলে নরসিংহ সুইটস বা গাঙ্গুরাম থেকে কিনতে পারেন। নরসিংহ সুইটস অনেক জায়গাতে আছে তবে মন্দিরের কাছে যে আদি নরসিংহ সুইটস আছে থেকে কিনতে পারলে ভালো হয়। পুরীর মন্দিরে পুজো দিয়ে অবশ‍্যই মন্দির চত্ত্বর ঘুরে দেখবেন একটু সময় নিয়ে। মন্দিরের চারটে গেট আছে,হাতি গেট,ঘোড়া গেট,বাঘ গেট এবং প্রধান গেটে সিংহ। উড়িষ্যার যে কয়েকটা মন্দির এবার দেখলাম সব মন্দিরেই মোটামুটি ঢোকার মুখে সিংহ আছে। সেই সিংহের গঠন শৈলী এবং সুন্দর রঙের ছোঁয়া অবশ‍্যই মন কাড়বে। তবে কোনারকের মন্দিরের সিংহ অপূর্ব সুন্দর হয়ত বা বলব সত‍্যিই পশুরাজ এখানে অহঙ্কারী। মন্দিরে মোবাইল নিয়ে যাওয়া নিষেধ সুতরাং মোবাইল নিয়ে গেলেও তা জুতো স্ট‍্যান্ডে রেখে যাবেন। শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে অবশ‍্যই যারা প্রথম যাচ্ছেন তারা বিমলা মন্দিরের ভেতরে ঢুকবেন মাকে দর্শন করবেন তবে সব মন্দিরেই হাতে কিছু দিলে নেবেন না কারণ এরা প্রচুর টাকা চেয়ে বসে এরপরে। আর না দিলে শাপশাপান্ত করে। পারলে একটা ছোট্ট মিউজিয়াম আছে মন্দিরের ভেতরেই বিমলা মন্দির থেকে একটু এগিয়ে দেখে নেবেন। শ্রী জগন্নাথদেবের নব কলেবর হয় বারো বছর বাদে বাদে। আষাঢ় মাস মলমাস পড়লে এইসময় এই নবকলেবর হয়। জগন্নাথদেবের সমাধিস্থল অবশ‍্যই দেখবেন। সেখান থেকে বেরিয়ে একটু এগিয়ে দেখবেন পাতালে এক শিবলিঙ্গ আছে যা দেখতে হলে বেশ কয়েকটা খাড়া সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে হয়। যাদের পায়ের সমস‍্যা আছে তারা নামবেন না। তবে নামলে ভালো লাগে।
      মন্দিরের ভেতেরে আনন্দবাজার আর রান্নাঘর দেখে নেবেন অবশ‍্যই। আনন্দবাজারে প্রভুর প্রসাদ পাওয়া যায় আর জগন্নাথদেবের রান্নাঘর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রান্নাঘর। রান্নাঘরে আপনাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। জোগাড় হচ্ছে দেখতে পাবেন। প্রচুর হাড়ি মাথায় নিয়ে লোকে ঢুকতেই আছে। একটু উঁকি দিলে দেখতে পারবেন ভেতরে রান্না হচ্ছে। জগন্নাথদেবের ছাপ্পান্ন রকম ভোগ হয়। আমরা যে অন্নভোগ দিয়ে থাকি তার প্রসাদ সরূপ অন্ন,খিচুড়ি,পুষ্পান্ন,দুইরকম ডাল,দুইরকম সব্জি,রসমালাই আর মালপোয়া পেয়ে থাকি। ভোগ পেতে পেতে দুপুর গড়িয়ে যায়। মোটামুটি চারটের মধ‍্যে ভোগ পাওয়া যায়। ভোগ পেয়েই গরম মালপোয়া খেয়ে মন জুড়ালো। আমাদের হিন্দু শাস্ত্রের চারধামের মধ‍্যে অন‍্যতম হচ্ছে পুরীধাম যা ভগবানের আহারের স্থান,দ্বারকা যেখানে ভগবান বিশ্রাম নেন,রামেশ্বরম প্রভুর স্নানের স্থান এবং বদ্রীনাথ ধ‍্যানের স্থান। এই চার ধাম দেখে নেওয়া খুব একটা কষ্টসাধ্য নয়।

       পুরী থেকে কোনারকের পথে কিছুটা এগোলেই বিখ‍্যাত স‍্যান্ড আর্ট শিল্পী সুদাম পট্টনায়কের স‍্যান্ড আর্ট মিউজিয়াম পড়ে। ইচ্ছে করলে সেটা দেখে নিতে পারেন তিরিশ টাকা টিকিটের বিনিময়ে। সুন্দর গাছপালা দিয়ে সাজানো গোছানো। শিল্পীর সৃষ্টি দেখলে অবাক হতে হয়। দেশ বিদেশে এখন তিনি বিখ‍্যাত স‍্যান্ড আর্টের জন‍্য। আমরাও দেখে মুগ্ধ হলাম নিখুঁত বালি দিয়ে বানানো শিল্পকাজ।

চন্দ্রভাগার গল্প:- আমাদের ড্রাইভার একটু বেশি কথা বলছিলেন তবে খুবই অভিজ্ঞ তা বুঝলাম তার কাছ থেকে শোনা নানা গল্পে। যেতে যেতে বলতে লাগলেন আমরা চন্দ্রভাগা নদীর নাম শুনেছি কিনা? সেই নাম কিভাবে হল? আমরা বললাম দুই নদীর মিলিত নাম চন্দ্রভাগা।
     চেনাব নদী যার উৎপত্তিস্থল লাহুল স্পিতী তারই দুই শাখা নদী চন্দ্র এবং ভাগা এখানে মিলিত হয়েছে তাই চন্দ্রভাগা নামেই এই নদীর সৃষ্টি। এই নদীকে ঘিরে অনেক গল্প আছে। এই নদী অত‍্যন্ত পবিত্র এবং কোনারক মন্দিরর ওঠা পড়ার সাক্ষী। এখানকার মানুষজনের বিশ্বাস এই নদীতে স্নান করলে কুষ্ঠ রোগ সেরে যায়। তবে এই নদীতে জল প্রায় থাকেই না। তবে মাঘ মাসের মহা সপ্তমীতে হাজার হাজার ভক্ত সমাগম হয় এই নদীতে। তখন এই নদীতে কোমর অবধি জল হয়। পুণ‍্যার্থীরা নদীতে স্নান করে নদীর পাড়ে বসে মাটির হাড়িতে খিচুড়ি রান্না করে খায়। আর মাটির পাত্র ভেঙে ফেলে যায় নদীর বালির চরে। তবে পরদিন আর কোন পাত্রেরই হদিশ পাওয়া যায় না। সবাই অবাক হবেন শুনে যে এত মাটির হাড়ির টুকরো গেল কোথায়? এই উৎসবকে অনেকে হাড়ি ভাঙা উৎসবও বলে থাকেন।
    আমাদের ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলেন আচ্ছা বলুন এই এত হাড়ি গেল কোথায়? আর চন্দ্রভাগা নামই বা হল কী করে? তার কাছেই এক অদ্ভুত গল্প শুনলাম যে পুরাকালে সুমন ঋষি রামচন্দ্রের দেখা পাওয়ার জন‍্য ঘোর তপস‍্যায় বসেছিলেন। অনেকদিন বাবার দেখা না পেয়ে তাঁর কন‍্যা চন্দ্রা এই স্থানে এসেছিলেন বাবার খোঁজে। কিন্তু বাবার কাছে পৌঁছনোর আগেই এক রাক্ষস তাকে ভোগের জন‍্য তাড়া করে। দেবতারা তাতে খুবই চিন্তিত হন কারণ একবার এই মেয়েকে রাক্ষস ভোগ করলে এদের ঔরসজাত সন্তানে পৃথিবীতে আরও অরাজকতা হবে। তাই চন্দ্রাকে পাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয় মাটি ভাগ করে। সুতরাং সেই থেকে এই জায়গার নাম চন্দ্রভাগা। রাক্ষস অর্ককেও নাকি পাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে পাতালে গিয়ে চন্দ্রা বোধহয় আর জীবিত থাকতে পারেনি। কিন্তু অর্ক রাক্ষস বেঁচে ছিল এবং সে ভগবানকে বলেছিল সে কী খেয়ে বাঁচবে? দেবতার আদেশে এই মাঘ সপ্তমীতে যে হাড়িভাঙা উৎসব হয় তাতে হাড়ির যে টুকরো পড়ে থাকে তা নাকি আজও অর্ক রাক্ষস খেয়ে সাবাড় করে চলেছে। এই গল্পের হয়ত কোন মাথামুন্ডু নেই। তবু লোকমুখে প্রচারিত এই মিথ আমারও মন ছুঁয়ে গেল। 
   
    বেলেশ্ব‍র শিব:- স‍্যান্ড আর্ট মিউজিয়াম ছাড়িয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল মসৃণ রাস্তা পেরিয়ে। সুরজ বাবু গল্প করেই চলেছেন। আমাকে বললেন বৌদি আজ একটা নতুন জায়গা দেখাবো। ঐ যে চন্দ্রার কথা বললাম তার বাবা সুমন ঋষিকেও দেখাবো। আমি অবাক হয়ে গল্প শুনতে লাগলাম। শুনলাম এই তল্লাটে কোন বেলের গাছ নেই। ততক্ষণে আমরা পুরী থেকে অনেকটা এসে গেছি প্রায় চোদ্দ কিমি। বাঁদিকে একটা বোর্ড দেখলাম বেলেশ্বর শিব। গাড়ি ডানদিকে ঢুকলো, চারদিকে বালি মাটিতে সত‍্যিই অনেক গাছ থাকলেও বেল গাছ নেই। অনেক কাজু গাছ দেখলাম আর দেখলাম রেড়ি গাছ। শুনলাম সুমন ঋষির আশ্রমে রামচন্দ্র এসেছিলেন তাঁর তপস‍্যায় সন্তুষ্ট হয়ে। সেখানে এসে তিনি শিবপূজা করবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু বেলপাতা নেই কোথাও অবশেষে ঋষি অনেক খুঁজে বেলফল এনেছিলেন এবং সেই আধফাটা বেলফলের আকারেই এখানে শিবলিঙ্গ। আর আশ্রমের চারপাশেই শুধু আছে বেলগাছ। কয়েক মাইলের মধ‍্যে কোথাও নেই বেলগাছ। আমাদের চোখেও পড়লো না। এই মন্দির নিরিবিলি সুন্দর। সুরজবাবুর কাছে শুনলাম চারপাশের জলে নোনা স্বাদ থাকলেও এখানকার কলের জল অত‍্যন্ত মিষ্টি এবং স্বচ্ছ। আমরাও বোতলে ভরে সেই জল নিয়ে খেলাম। মন্দিরের ভেতর খুব ছোট কিন্তু অদ্ভুত শান্তি মনকে কিছুক্ষণের জন‍্য মুগ্ধ করে রাখবে। বেশ মোটা সাপ জড়ানো শিবলিঙ্গ। শিবরাত্রির দিন অনেক পুণ‍্যার্থী ভিড় করেন এবং মেলাও বসে। সুরজবাবু মন্দিরের সামনে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চললেন বীচের দিকে। এই বীচের নাম বেলেশ্বর বীচ,অপূর্ব সুন্দর বীচ। একদম নিরিবিলি আর নিশ্চিন্তে সময় কাটানো যায়। এখানে পুরীর মত ভীড় নেই তাই স্নানও করা যায় নিশ্চিন্তে। আমাদের কোনারক যেতে হবে,সময় কম হাতে তাই একটা দুটো ছবি তুলেই চলে এলাম। শুনলাম ভিতরকণিকার মত এখানেও কচ্ছপেরা ডিম পাড়তে আসে। সেই সময় এখানে পর্যটকদের আসতে দেওয়া হয় না। আমরা এগিয়ে চললাম, সুরজবাবু বললেন ঐ দেখুন সুমন ঋষি। দেখলাম জঙ্গলের মধ‍্যে এক ধ‍্যানস্থ ঋষির মূর্তি। বুঝলাম সবটাই গল্প কথা নয়। আরেকটু এগিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখলাম যেখানে কোন গাছপালা নেই,কিছু গাছপালা শুধু কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিস্তীর্ণ অনেকটা জায়গা একদম মরুভূমির মত। জঙ্গল আর সরু রাস্তা বলে ছবি তুলতে পারলাম না তবে চাক্ষুষ করলাম ফণি নামক ঝড়ের দাপট। ফণি ওখানেই প্রথম আঘাত হেনেছিল। এই ঝড়ও একরকম বিধ্বংসী বোমার মতই তাই সে জায়গাতে এত বছর পরেও কোন কিছুই হয়নি।
        মন্দির যেহেতু জঙ্গলের মধ‍্যে তাই ঢোকার জন‍্য আমাদের তিরিশ টাকা দিতে হল। এখানে পান্ডাদের কোন উৎপাত নেই। আমরা এগিয়ে চললাম কোনারকের দিকে। কোনারকের ভাড়া বড় গাড়িতে ১৭০০ মত। আজ এটুকু থাক। আরও কিছু গল্প বলে দেব ঘোরার ছলে।

সমুদ্রে স্নান আর পুরীতে জগন্নাথের পুজো দেওয়া ছাড়া আরও কিছু দেখতে চাই আমরা অনেকেই তাই তারা ঘুরে নিই পুরীর কাছাকাছি কোনারক,ভুবনেশ্বর, উদয়গিরি,খন্ডগিরি,নন্দনকানন আর ধবলগিরি। অনেকে অবশ‍্য যান সাক্ষীগোপালও। তবে যারা একটু বেশি ধর্মপ্রাণ তারা অনেকেই হয়ত গেছেন আলারনাথ এবং নীলমাধব বলে দুটো জায়গাতে। এবার আমি নীলমাধব যাইনি কারণ পুরী থেকে নীলমাধবের দূরত্ব বেশ অনেকটা মোটামুটি সারাদিন লেগে যায় সেখানে। তবে নীলমাধব জগন্নাথদেবেরই রূপ। ওড়িষা রাজ‍্যের নয়াগড় জেলায় মহানদীর ধারে কান্তিলো জনপদে নীলমাধবের মন্দির। জগন্নাথদেবের কেন্দ্রপ্রাণ হিসেবে বিখ‍্যাত নীলমাধব। জগন্নাথদেবের মন্দিরে লক্ষ্মীদেবীর পাশে নীলমাধবের মূর্তি আছে। পুরাণ অনুযায়ী বিষ্ণুর উপাসক রাজা ইন্দ্রদুম্ন জানতে পারেন বিষ্ণু পূজিত হচ্ছেন নীলমাধব রূপে। তিনি সৈন‍্য এবং অনুচর পাঠান খোঁজ নিতে সেই বিগ্ৰহের। সেই দলে ছিলেন রাজ পুরোহিতের ভাই বিদ‍্যাপতি। বিদ‍্যাপতি জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেন এবং এক শবর রাজকন‍্যা তাকে উদ্ধার করেন। বিদ‍্যাপতি এই শবরকন‍্যা ললিতার প্রেমে পড়েন এবং তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি দেখেন শবররাজ প্রতিদিন সকালে বের হয়ে দুপুরে ফেরেন। কৌতূহলী বিদ‍্যাপতি স্ত্রীকে অনেক অনুরোধ করে জানতে পারেন তার বাবা নীলমাধবের পুজো করতে নীলগিরি পর্বতে যান। এতদিন যেই বিগ্ৰহের সন্ধান তিনি করছেন তার হদিশ পেয়ে শবররাজ বিশ্বাবসুকে অনুরোধ করেন তাকে সেখানে নিয়ে যাবার জন‍্য। বিশ্বাবসু একটা শর্ত দেন যে তাকে চোখ বেঁধে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। চিন্তিত হয়ে পড়েন বিদ‍্যাপতি তাহলে কী করে জানবেন পথের হদিশ? অবশেষে ললিতা তাকে সরষের দানা দেয় পথে ছড়ানোর জন‍্য। যাবার পথে সেই সরষে ছড়িয়ে যেতে থাকেন বিদ‍্যাপতি,কয়েকমাস বাদে সেই সরষে অঙ্কুরিত হলে বিদ‍্যাপতি রাজা ইন্দ্রদুম্নকে সাথে নিয়ে পৌঁছে যান সেখানে। কিন্তু নীলমাধব অদৃশ্য হয়ে যান।শোকে ভেঙে পড়েন ইন্দ্রদুম্ন ত‍্যাগ করেন অন্নজল। তিনদিন কেটে যায় তারপর তিনি স্বপ্ন পান যে সমুদ্রে ভাসমান কাষ্ঠখন্ড থেকে তিনি যেন বানান তিনটে বিগ্ৰহ। আর এইভাবেই নীলমাধব পূজিত হবেন জগন্নাথ দেব রূপে। নতুন করে আরেকটা মন্দির তৈরী হয়ে পাহাড়ের ওপর। সংক্ষেপে নীলমাধবের ইতিহাস এমন। এই নীলমাধব মন্দিরে ওঠার জন‍্য বেশ কিছু সিঁড়ি ভাঙতে হয়। দুপুরে পৌঁছলে ওখানে ভোগও খেতে পারেন। পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এই মন্দির খুব সুন্দর। তবে আমার কাছে কোন ছবি নেই এই মন্দিরের আমি 2015 তে গেছিলাম।
     আলারনাথ:- চিল্কা থেকে ফেরার পথে অথবা চিল্কা যাবার পথে আলারনাথ অবশ‍্যই দেখবেন। আলোয়ারের মহারাজ এই মন্দির স্থাপিত করে ছিলেন বলে এই মন্দিরের নাম আলারনাথ। মন্দিরের ভেতরে ছবি তোলার অনুমতি নেই। মন্দিরের ইতিহাস বলে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু যখন নীলাচলে এসে পৌছোন তখন তিনি কৃষ্ণপ্রেমে পাগল। তাঁর মন আকুল প্রভুকে দর্শনের জন‍্য অথচ প্রভু স্নানযাত্রার পর তখন বদ্ধ দ্বারের আড়ালে। তাহলে এবার কী হবে? মন তো আর কোন বাধা মানছে না। আকুল হয়ে কেঁদে চলেছেন মহাপ্রভু তবে কী প্রভুর দর্শন আর হবে না? স্বপ্নাদেশ দেন প্রভু জগন্নাথ তাঁকে বললেন আলরনাথে যেতে সেখানেই তিনি উপবেশন করছেন। কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা প্রভু আছড়ে পড়েন একটা পাথরের ওপর,সেই পাথরে প্রভুর দেহের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। এখানে কৃষ্ণমূর্তি অপূর্ব সুন্দর এবং বিগ্ৰহের চার হাত। মন্দিরের বিগ্ৰহ মুগ্ধ করে। তবে এখানেও পান্ডাদেরও বেশ উপদ্রব আছে। তারা প্রণামী আদায়ের জন‍্য দুর্ব‍্যবহারও করে। এবার নীলমাধব না যেতে পারলেও চিল্কা থেকে ফেরার পথে আলারনাথ ঘুরে এলাম,ভালো লাগলো। এখানকার মন্দিরও অতি প্রাচীন তবে কিছুটা সংস্কার করা হয়েছে,এখানে কৃষ্ণমূর্তি দেখলে সত‍্যি মন ভরে যায়। কষ্টিপাথরে তৈরী হাতে বাঁশী ধরা বিগ্ৰহ নারায়ণের রূপে বিরাজমান। পাশে লক্ষী দেবীর মন্দিরও আছে। তবে ঐ যে ভক্তির মাঝে পূজারীর দাবী দাওয়া সংক্রান্ত বাক‍্যযন্ত্রণা মনকে করে তিতিবিরক্ত। পুরীতে গেলে বারবারই বলব পান্ডাদের থেকে সাবধানে থাকবেন।
        আমাদের ফেরার টিকিট ছিল ভুবনেশ্বর থেকে তাই ঠিক হয়েছিল ধবলগিরি,উদয়গিরি আর খন্ডগিরি দেখে আর সাক্ষীগোপাল দেখে তারপর যাবো। আমাদের সেদিনের গাড়ি আর ড্রাইভার দুইই বদলেছে কারণ সুরজবাবুর গাড়িতে মাল সমেত আমরা জায়গা করে উঠতে পারব না। সবার পোটলা পুটলি বেড়েছে। এই ভদ্রলোক আবার আরেক রকম,ইনি আবার গান গান। গাড়ি চালাতে শুরু করেই একটু বাদেই হাই ওয়েতে এসে শুরু করলেন ওড়িয়া কীর্তন। যাক ভালোই লাগছিল। সেদিন হাইওয়েতে এসে আঠেরো নালাকে আরও ভালো করে দেখলাম। আঠেরো নালা আমার কাছে ভালো লাগে কারণ এই ব্রীজ এক অদ্ভুত আকৃতির। লাল রঙের এই ব্রীজের তলায় আঠেরো খানা মুখ আছে। অবশ্য ড্রাইভার গণনা করে দেখালো আছে উনিশটা নালা। পুরাকালে আঠেরো নালার পার্শ্ববর্তী যে জমিগুলো আছে তাতে একদিনেই ধানের বীজ ছড়িয়ে বিকেলে পাকা ধান পাওয়া যেত এমন শোনা যায়। আর সেই ধানে প্রভুর ভোগ রান্নাও হত। তবে এখন আর কিছু নেই সেইসব মানে পাপে ধুয়ে গেছে। শোনা যায় রাজা ইন্দ্রদুম্নের আঠেরো সন্তান পাপের ফলে এখানে আঠেরো নালা হয়ে আছেন এবং প্রতিনিয়ত হাজারো মানুষের পায়ের স্পর্শ পেয়ে তাদের পাপ ক্ষয় হচ্ছে।
     একটু এগোতেই পথের ধারেই এক মন্দির দেখিয়ে ড্রাইভার বলল এই মন্দির বাট মাতার মন্দির। এই মা প্রভু জগন্নাথদেবের পথ আগলে রয়েছেন। গাড়ি এগিয়ে চলল,কিছুটা যাবার পর আমরা পৌঁছে গেলাম রঘুরাজপুর। এই গ্ৰামের শিল্পকলা এখন বিখ‍্যাত। তুলির টানে অসাধারণ শিল্পকর্ম নিজের মনে করে চলেছেন প্রতি ঘরে ঘরে শিল্পীরা। এই গ্ৰাম এখন শিল্পগ্ৰাম নামে হেরিটেজ তকমা পেয়েছে। সত‍্যি ওঁদের কাজ অপূর্ব এবং রঙের বৈচিত্র্য ও ঔজ্জ্বল্য মুগ্ধ করবেই।
       রঘুরাজপুর দেখে আবার পথের টানে চললাম সাক্ষীগোপালের দিকে। একটু মনে শঙ্কা ছিল সাক্ষীগোপালের পান্ডাদের উপদ্রব নিয়ে। কিন্তু এখানে ভগবানের কৃপায় কোন উপদ্রব সইতে হল না। তখন একজন বিখ‍্যাত রাজনৈতিক নেতা আসাতে পান্ডারা তাকে নিয়েই ব‍্যস্ত সুতরাং আমরাও একদম সুন্দর ঠাকুর দর্শন করলাম। সাক্ষীগোপালের মূর্তি কিন্তু অপূর্ব সুন্দর। দর্শন করলে মন ভরে যায়। 
ততক্ষণে চড়া রোদ উঠেছে। আমার কর্তা ওখান থেকে একটা লম্বা ল‍্যাজওয়ালা একটা সঙ্কটমোচনের মূর্তি কিনল সেটা বেশ দেখতে। পিপলির আগেই গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার নিয়ে গেল এক মন্দিরে। মন্দিরের গঠনশৈলী উড়িষ্যার মন্দিরের মতই। অনেক পুরোনো মন্দির,শুনলাম এই মন্দির গোপীনাথের মন্দির। মন্দিরের ভেতরে আমরা এলাম,তখন আরতি হচ্ছিলো। বন্ধ দরজার বাইরে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। গর্ভগৃহের বাইরের অংশে ঢুকে দেখলাম জগন্নাথদেবের মূর্তি আর গড়ুর দেবতার মন্দির। বাইরে একজন বসে কাঁসর বাজাচ্ছেন। নাটমন্দিরে বাজছে সানাই আর ঢোলক। সত‍্যি খুব ভালো লাগছিল,ঠাকুর দর্শন না করে আসতে ইচ্ছে হল না। অবশেষে দরজা খুলে গেল,ভোগ দর্শন করলাম। পুরীর মন্দিরের মতই বড় বড় মাটির পাত্রে অন্ন এবং ছোট পাত্রে ডাল এবং অন্নভোগ রাখা। বিগ্ৰহ কষ্টিপাথরের গোপীনাথ,খুব সুন্দর। আমাদের হাতে সময় কম তাই ভোগ দর্শন হল কিন্তু খাওয়া হল না। পিপলির কাপড় কেটে টুকরো করে জুড়ে সেলাই করা কাজ দেখতে দেখতে আবার চলা শুরু। উদয়গিরি আর খন্ডগিরি এখন ঢোকার অবস্থায় নাকি নেই তাই বন্ধ। ধবলগিরি দেখে এগিয়ে চলা তবে সেই পথেই বিখ‍্যাত অশোকস্তম্ভ পড়ল যা দেখে মন ভরে গেল। দেখলাম দয়া নদীও। কলিঙ্গ যুদ্ধের সময় এই নদীর জল লাল হয়ে গেছিল রক্তে,তাই নাকি এই নদীর জলে আজও লালচে আভা। কলিঙ্গ যুদ্ধের পর সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন।
     ততক্ষণে গাড়ি ভুবনেশ্বরের কাছাকাছি,আমাদের শেষ গন্তব‍্য লিঙ্গরাজ টেম্পল। কোভিড পরবর্তী সময়ে নাকি কিছু রদবদল হয়েছে। তবে আমার ভীষণ ভালো লাগলো এবার লিঙ্গরাজ টেম্পল। ভুবনের সমস্ত ঈশ্বর আছেন এখানে তাই এই শহরের নাম ভুবনেশ্বর। বলতে গেলে সারা ভুবনেশ্বর শহরেই মন্দিরের ছড়াছড়ি। তার মধ‍্যে কিছু বন্ধও আছে। লিঙ্গরাজ মন্দির চত্বরেই অনেকগুলো মন্দির আছে যা অনেক পুরোনো। আমাদের ফোন,জুতো সব রেখে ঢুকলাম মন্দিরে। লিঙ্গরাজের মূল বিগ্ৰহ অবশ্যই শিবের কিন্তু মন্দিরে সারা ভারতের মন্দিরের বিগ্ৰহ আছে চারপাশের ছোট ছোট মন্দিরগুলোতে। মন্দিরের গঠনশৈলী আর নির্মাণ অত‍্যন্ত সুন্দর। একটা বড় কুয়ো আছে যা বর্তমানে নেট দিয়ে আটকানো।
    এই মন্দিরের মূল চূড়ার উচ্চতা একশো আশি ফুট প্রায়। এই মন্দির দেউল শৈলীতে বানানো যার চারটে ভাগ আছে। ভাগগুলোর নাম বিমান,জগমোহন, নাটমন্দির এবং ভোগমন্ডপ। মূল মন্দিরে ঢোকার সময় চারদিকে ফাটা দুধের গন্ধ পেলাম। আরেকটু ভালো করে পরিস্কার করা উচিত ভেতরটা। এই মন্দির একসময় আম গাছের নীচে ছিল তাই একে একাম্রা মন্দিরও বলা হয়।
      মন্দিরের গায়ের চিত্রে দেবদেবীর সাথে নরনারীর মিলনের চিত্র এবং সামাজিক চিত্রও আছে। তবে অনেক জায়গাই নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের মোটামুটি চত্ত্বর পরিক্রমা করে সারা ভারতের তীর্থ পরিক্রমা করা হয়ে গেল। পুরীর মন্দিরের মত এখানেও ভোগ বিক্রী হয়। হঠাৎই ইচ্ছে হল ভোগ খাবো তাই খুব সামান্য ভোগ আর পায়েস নিয়ে মন ভরানো হল। এরপর তৃপ্ত চিত্তে বিদায় নেওয়া পুণ‍্য তীর্থ থেকে।
              

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...