আজকাল রাজোর অনেক সময় চলে যায় বাড়ি গোছগাছ করতে কত কাজ যে বেড়েছে তার শেষ নেই। মাঝেমধ্যে সে হাঁফিয়ে ওঠে তবুও আবার মনে আনন্দের হাজার বাতি জ্বালিয়ে একাই নেমে পড়ে ময়দানে টালমাটাল পায়ে। রাজো মানে রাজশ্রী,আপনাদের নিশ্চয় অবাক লাগছে শুনে টালমাটাল পা আবার কী? রাজো নিশ্চয় গৃহবধূ তার আবার টালমাটাল পা কেন? সত্যিই টালমাটাল রাজো তার হাঁটু নিয়ে। মাঝেমধ্যে সে ভাবে হাঁটুটা যদি মাথায় তুলে রাখা যেত। এক পায়ে তার স্ক্রু আরেক হাঁটু একসময়ের অতিরিক্ত পরিশ্রম আর হাঁটাহাঁটির ফলে এখন আর কাজ করতে চায় না,বিদ্রোহ করে সবসময়। যার ফলে রাজো মাঝেমধ্যে ভূপতিত হয় তার বিশাল বপু নিয়ে,কখনও কেটে ছড়ে একাকার হয় তার মুখ তবুও জীবন চলতেই থাকে লেংচে খুড়িয়ে। অবশ্য এই জীবন বড় পানসে তার কাছে তাই ডাক্তারের হাঁটু পাল্টানোর থ্রেট সে কানে নেয় না লড়ে যাচ্ছে নিজের মত। মনে ভাবে যা হয় হবে। তবে মাঝেমধ্যে মন দূর্বল হয়ে যায় তবুও,তখন সে একলা কাঁদে তার ইষ্টদেবতা প্রভু জগন্নাথদেবের কাছে তারপর তাকে চুপিচুপি বলে এবার থেকে রাস্তায় বেরোলে আমার হাতটা তুমি ধরে থাকবে যাতে আমি আর পড়ে না যাই। কত আর সবার বকুনি খেতে ভালো লাগে বলো? বর বলে সবাই রাস্তা দিয়ে হাঁটে পড়ে না তুমিই শুধু পড়ে যাও। আসলে তুমি হাঁটতেই শেখোনি ভালো করে।
কী করে বোঝাবে রাজো যে একসময় এই পা নিয়েই তো সে দৌড়ে বেড়িয়েছে দুই সন্তানের হাত ধরে সারা শহরে। এখনও নিজে চাকরি করেও সংসার সামলে যাচ্ছে ঐ টালমাটাল পা নিয়েই। অগত্যা ডাক্তার বোঝানোতে সে বুঝেছে সত্যি হাঁটু খারাপ হয়েছে,এখন তার নবকলেবর পাওয়ার সময় হয়েছে, তবুও তার চোখে অবহেলাটুকুই দেখে রাজো। তবে এ নিয়ে সে আর আক্ষেপ করে না। একটা সময় চোখের জল ফেলে ভাসিয়ে আজ সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এসবে। এখন নিজেই নিজেকে সামলে রাখে,বাঁচে মনের বন্ধু হয়ে।
রাজশ্রী এখন প্রায় মধ্য পঞ্চাশে,এই বয়েসে এসেও মন তার কিশোরী আর একটু ছটফটে। তবে বাইরেটাকে সে সাজিয়ে রাখে আর সবার মত। জীবনে একটা দর্শন এখন সে ঠিক করে নিয়েছে যে যতটা পারবে করবে,না পারলে করবে না। নিজের কাজটুকু সে তাই নিজেই করার চেষ্টা করে,বরের কাছে আতুসী বৌ হয়ে কোনদিন থাকেনি বলেই হয়ত সে কোনদিন সেভাবে বরের কৃপাদৃষ্টি টুকু পায়নি। সৌরজিৎ ভাবেনি কোনদিন রাজশ্রীর ঘরে পরার শাড়ি জামার দরকার,বা চটি ছিঁড়লে একটা চটি এনে দেওয়া দরকার। বরং চাকরি করা রাজো নিজেরটা কিনেই ক্লান্ত হয়নি,ইচ্ছেমত সাজিয়েছে বর আর ছেলেমেয়েদের। তাদের সবটুকুই চেষ্টা করছে নিজের মত করে করে দেওয়ার। হয়ত দোষ ওরই ছিল তাই ওরাও রাজোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভেবেছে। কোনদিন ভাবেইনি মানুষটার শরীর খারাপ হতে পারে,বা সবাইকে যত্ন করা মানুষটা নিজেও একটু যত্ন চায় কারও কাছে।
টালমাটাল পায়ে সবার সবটুকু করে দিতে ভালো লাগে রাজোর,তার আত্মতৃপ্তি হয়ত হয় এই ভেবে যে সে পারছে। হয়ত কিছু না পাওয়াকেও এভাবেই সে ঢাকে নিজের মত করেই। মনে মনে বলে ভগবানকে সবাইকে যেন করে যেতে পারি,আমাকে যেন কারও কাছ থেকে কিছু না নিতে হয়। তবুও কী মন সব লোভ ত্যাগ করতে পারে? তাই সেও মাঝেমধ্যে লোভী হয়ে পড়ে। না না শাড়ি গয়না পাওয়ার লোভ নয়। সে একটু ভালো কথা শুনতে চায়,একটু ভালোবাসা পেতে চায়,শরীর খারাপের সময় কারও শীতল হাতের ছোঁয়া পেতে চায়। একটু শুনতে চায় আজ শরীর কেমন আছে তোমার? আমাদের পোড়া দেশে রাজোর মত হয়ত অনেক মহিলারাই এভাবে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন দিনের পর দিন অবহেলায় আর মরা ভালোবাসায়। অনেকেই মুখ বুজে সয়ে গেছে ভালোবাসা না পেয়েও দেখানো ভালোবাসা দিয়ে তাদের বাসাভালো রাখতে। রাজোর কাছেও এখন ভালোবাসা বাসাভালো।
থাক রাজোর বস্তাপচা গল্প শুনতে শুনতে বোর হয়ে যাবেন সবাই। পুরুষেরা ভাববেন মেয়েলি ন্যাকামো যত,এর থেকেও কত মেয়ে দুঃখে আছে। চাকরি করছিস,খাচ্ছিস দাচ্ছিস ঘুরছিস এত শোক কিসের? সত্যিই তাই,তবে ঐ যে একেক জনের না পাওয়া এক এক রকম। কারও সাথে মেলে না কোনটাই। তাই হয়ত আমাদেরই আনমনা হয়ে ভাবতে গিয়েছে বেশি কেটে,ছড়ে পুড়ে যায়। আবার সেই আঘাতে নিজেরাই যত্নে প্রলেপ লাগিয়ে আবার বঁটি নিয়ে বসি,মাছ ভাজি আবার কখনও ছ্যাঁকা খাই। তারপর সবার মুখের পরিতৃপ্তি দেখে সব জ্বালা ভুলে যাই।
রাজশ্রীকে প্রথমে ভাড়াবাড়িতে একটা ঘরে এনে তুললেও ছেলের বিয়ে ঠিক করার পরেই বর ক্ষেপে উঠলো। ছেলের বিয়ে ঠিক করা ঠিক নয়,বিয়ে ঠিক করেছে ছেলেই। ওদের শুধু মেনে নেওয়া,মানে মানতেই তো হবে। আদরের ছেলের পছন্দ,তাছাড়া ছেলে ভালোই করেছে। ওদের অনেক কাজ কমিয়ে দিয়েছে। অ্যাড দেওয়া,মেয়ে দেখে বেড়ানো তারপর বাছাই অনেক ঝামেলা থেকে ওদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। সুতরাং আপত্তি করার মত কিছু তেমন নেই। রাজোরা মধ্যবিত্ত নিজেরা চেষ্টা করেছে যতটা সম্ভব সবটুকু দিয়ে ছেলে মানুষ করার। শিক্ষার সাথে সাথে একটু চাওয়া ছিল মনুষ্যত্ব টুকু বাঁচুক শেষে। তবে কে জানে কখনও সেই আশাও ঠোক্কর খায় রাজোর।
রাজশ্রীরা ফ্ল্যাটে থাকে,অনেক কষ্টে কেনা একটু একটু করে ইএমআই দিয়ে। একটা সময় ফ্ল্যাটের টাকা শোধ করে ওর হাতে এমন কিছু বেঁচে থাকত না। যার ফলে টাকা বাঁচাতে অনেক লম্বা পথ লম্বা পায়ে ছুটে যেত। আজ সে পা রণক্লান্ত,একটা সময় টাকা বাঁচাতে পা গেছে। আজ পা বাঁচাতে টাকা যাচ্ছে। জীবন যে কখন বিয়োগের খেলা খেলে কেউ বলতে পারে না। রাজশ্রীর বহুদিনের ইচ্ছে ছিল একটু সাদা মার্বেলের মেঝে হবে তবে তা আর হয়ে ওঠেনি,যথারীতি সস্তার মোজাইকের চামড়া উঠতে শুরু করেছিল। প্রোমোটারের কাজ আর কেমন হবে?
অবশেষে বাইশ বছর বাদে স্বপ্নপূরণের চেষ্টা,বরের বক্তব্য নতুন বৌ বাড়িতে আসছে তাই বাড়িকে সাজাতে হবে। নতুন বৌ বলে কথা সে সব কিছু ঝকঝকে দেখবে। রাজো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার অতীতের কথা ভাবছিল,অথচ সেও ছিল আদুরে একমাত্র কন্যা। তারপরে অতীতের কথা ভেবে আর মন ভারী করেনি সবই ওর নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছিল। হয়ত ওর কপালে কষ্ট লেখা ছিল তাই এমন হয়েছিল। কষ্ট তো কাউকে না কাউকে করতেই হয় আর সেই মসৃণ পথে এগিয়ে চলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আর তাতেই মা বাবাদের সুখ। প্রায় দুই মাস মিস্ত্রীদের নিয়ে নাজেহাল হয়ে গেল রাজো। নিজের ওপরেই রাগ হল নিজের খুব। কিনতে কিনতে কত জিনিস জমিয়েছে যে বাড়িতে তার শেষ নেই। খুব বকুনি খেল বরের কাছেও,সে কোন কাজে সাহায্য না করেও বাক্যবাণ আর বজ্রদৃষ্টিতে ভস্ম করল দিবারাত্রি। ভাবটা এমন বাড়ির সব জিনিসই ওর তাই যা পারে করুক একা।
মিস্ত্রীরা পোটলা বেঁধে সব রেখে গেছে পোটলা করে। পোটলায় বসে গালে হাত দিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এই মাঝ বয়েসে এসে বুকে হাঁফ ধরে যায় জিনিস গুছিয়ে আর ধুলো ঘেঁটে। তার মধ্যে ঘরে বাইরে কাজ। কতদিন কাজ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি বসে থাকবে?
বর তড়পায়,' এই পোটলা কবে খোলা হবে? সব কী এমন পড়ে থাকবে। মিস্ত্রীরা তো কাল কাজ শেষ করল। বাড়ি আর দেখা যাচ্ছে না। রাজো ভাবে কোথা দিয়ে শুরু করে কোথায় শেষ করবে? পাগলের মত লাগে। তবুও ভগবান বোধহয় সত্যি শক্তি দেন তাই সবই হল। রাজো নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ায় আহা পেরেছি বলে। সবাই স্বস্তি পায় সবচেয়ে শান্তি পায় রাজো আর খোঁচায় খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত হতে হবে না। তখনকার মত কান ধরে আর শাড়ি জামাকাপড় কিনবে না। সেই শোকে একটু কেঁদেও নেয় তারপর চোখের জল মোছে।
বাড়ি সেজে উঠতেই মেয়ের বাড়ির মানুষজন এল,মানে তাদের জন্যই এত আয়োজন। মেয়ের মা ফোনে বললো মেয়ের শাড়ি পরতে অনেক সময় লাগে খুব একটা কমফোর্ট পায় না। রাজো নিজে শ্বশুর এবং বাবার কড়া শাসনে কুড়িতে শাড়ি ধরলেও হাসিমুখে বলে না না ড্রেস পরলেই হবে। আমার কোন সমস্যা নেই। ভাবী বৌমা লং ড্রেস পরে এল,অনেক গল্প খাওয়াদাওয়ার পর ওরা চলে গেল। সাজানো বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ন করে খুব খুশি ওর বর। তবে রাজো প্রশংসা পেল না একটুও। বরং গুছোতে না পারা কিছু জিনিস যাদের বারান্দায় আড়ালে বন্দী করেছিল তারাই ফন্দী করে ওকে ধরিয়ে দিল। ওদিক থেকে প্রশ্নবাণ এল,' ওগুলো কবে গোছানো হবে? আমি তো ভাবলাম সব শেষ। এ যে দেখি অনেক জিনিস।'
সবসময় মেজাজের পারদ সঠিক তাপমাত্রায় রাখতে পারে না রাজো। বয়েসের সাথে সাথে অনেক সহনশীলতা এলেও ধৈর্য্য হারায়। তাই বলে ওঠে, একটা মানুষ আর কত করবে? ঘর পরিস্কার করে দিয়েছি তাতেই থাকো। ঐ তো একটুখানি বারান্দা তাও আবার পেছনে। কতবার আসো সেখানে? আমার সময় হলেই করব ঠিক। আমিও মানুষ,জানোয়ার নই।'
কখনও বোধহয় জানোয়ারের চিৎকারেই মানুষ ভয় পায়। তাই এক্ষেত্রেও কাজ হল তবে অপরপ্রান্তে আরেকজনের দৃষ্টিতে আগুন ঝরলো। যাক তাতে কিছু এসে গেলো না রাজোর সে সব ধুয়ে মুছে ফেলতে চায় নিজেকে ভালো রাখতে।
তবে প্রশংসা ঝরে পড়লো ভাবী বেয়ানের মুখ থেকে। এত প্রশংসা যে হজম করতে খুব কষ্ট হল রাজোর। ও জানে ওর যশভাগ্য ভালো নয়। কোনদিনই কারও কাছে তেমন প্রশংসা পায়নি,মা বাবাও মেপে প্রশংসা করতেন পাছে মেয়ে অহংকারী না হয়ে যায়। তাই ভালো রেজাল্ট করে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ালে মা বলতেন উঁচু ক্লাসে কী করলে সেটাই বড় কথা। ঈর্ষা করার মত কিছু না থাকলেও বন্ধুবান্ধব পেছনে লাগত। পরে চাকরিজীবনে সহকর্মীদের কেউ কেউ একই জিনিস করেছে। একটা সময় সংঘাত হয়েছে অনেকের সাথেই। রাজো বোঝে তার সততা,নিয়মানুবর্তিতা,নিষ্ঠা,অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেওয়া এইসবই হচ্ছে তার সাথে শত্রুতার কারণ। যাক গে মরুক গে যে যা পারে করুক,তেল মারা অভ্যেস কখনও ছিল না তাই সেটা সে পারে না। তবুও যুক্তিবাদী,প্রতিবাদী রাজো মানসিক শান্তি খুঁজতে আজকাল চুপ করে থাকে,বিতর্ক এড়াতে চায়। কিন্তু ঐ যে একদম ফোঁস করতে ভুলে গেলেও মুশকিল।
ফোনের ওপার থেকে বেয়ান বলতে থাকে,' আমার মেয়ের সাতজন্মের শিবপুজোর ফল এমন শ্বশুরবাড়ি পাওয়া। তোমার মত ভালো মানুষ কজন আছে? সত্যি কী ভীষণ ভালো আর পরিশ্রমী তুমি।'
রাজো মেনে নেয় না বলে ওঠে,আমি কিন্তু রাগীও। মানে দরকারে রাগ করি। এখনি এত কিছু বোলো না শেষ ভালো যার সব ভালো। তবে তোমার পাশে আছি, যা অসুবিধা জানিয়ো।
ছেলের মুখে ওদের আর্থিক অবস্থার কথা শুনে সত্যি মনটা ভিজে গিয়েছিল রাজোর। মনে মনে বলেছিল আহা মেয়েটা চাকরি করে বাবা মাকে দেখছে কত বুদ্ধি মেয়েটার। ভালো থাক ওরা,মানে সবাই মিলে ভালো থাকব আমরা। ঘুরব ফিরব একসাথে,একে অপরের সঙ্গী হব।
তবে ঐ যে সবার কপাল সমান হয় না,হয়ত বা কারও জীবনে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আর পরিসমাপ্তি হয় না। ঠিক সেভাবেই হল সূচনা কিছু অশান্তির। ব্যাপারটা খুব সামান্য হলেও সামান্য পর্যায়ে রইল না। রাজোর ভাবী বৌমা এল দ্বিতীয় দিন বাড়িতে পরনে হাঁটুর ওপর ছোট জামা। চাকরি করা আধুনিক রাজোর কোথাও যেন একটা অদ্ভুত কষ্ট হল ওকে দেখে। অত্যন্ত মধ্যবিত্ত পাড়ায় ওরা থাকে। আর কিছুদিন বাদে তো এই মেয়েই বেনারসী পরে আসবে বাড়িতে। একটা জিন্স টপ বা কুর্তা পরেও যদি আসত। তারপর নিজেকে সংযত করে কী এসে যায় থাক আজকাল তো মেয়েরা কত কী পরছে। তবুও আবার কষ্ট হয় বারবার ওর উড়ে যাওয়া জামা আর ওর ঢেকে বসার চেষ্টা দেখে,রান্নাঘরে গিয়ে অদ্ভুত একটা বিষাদের দলা ওঠে গলা বেয়ে। আমরা আধুনিক এখন সবাই,তবুও পোশাক তখনি সুন্দর যখন তার স্থানভেদ থাকে। এই ছোট হাঁটুর ওপরে পরা জামাই কত সুন্দর লাগবে কোন পার্টি,পাবে বা হোটেলে। সত্যি কী আধুনিকতা তবে হার মানালো রুচি আর স্থান কাল পাত্রকে?
মুখে হাসি ধরে রেখে প্লেটে খাবার সাজায় রাজো। কিছু কথা বুঝিয়ে বলতে ইচ্ছে করলেও পারে না। মনের হ্যাঁ বা না লুকিয়ে রাখে মনেই।
তবে ক্ষোভ বা দুঃখ কিছু লুকোনো থাকে না। ভীষণ বিরক্ত হয়ে ওঠে বর,' আমি তো ভেবেছিলাম মেয়ে বুদ্ধিমতী। কিন্তু এটা কী ধরনের আধুনিকতা? আমি তো সামনে বসে থাকতে না পেরে নীচে চলে গেলাম। বারবারই জামা উড়ে.....এই শোন তুমি ওর মাকে বলবে। মায়ের তো বলা উচিত ছিল এটা পরে যাস না। এ আবার কী ধরনের!'
বেশ কয়েকদিন পরে হলেও ফোনে কথাটা বলতে বাধ্য হয় রাজো আর তাতেই কেটে যায় সব সুর। ছেলে কিছু না বললেও বলে,' আমার সামনেই বলতে পারতে যা বলার ছিল। আমি বুঝতে পারছি তোমার কথা, কিন্তু ওরা বুঝতে চাইছে না।'
রাজো বলে,আমি তোকে বলেছিলাম ওকে বুঝিয়ে বলতে কিন্তু তুই বলিসনি। কী করব তোর বাবাই তো বলল...
-' হ্যাঁ আর এখন অশান্তি ভোগ করছি আমি আর তুমি।'
রাজোকে অশান্তি কুড়ে খায়,নিজের ওপর রাগও হয়। কী দরকার ছিল অত ভালোমানুষী করে বৌমার মাকে স্থান কালের কথা শেখানোর। ওর যখন সেই বোধই নেই তখন আর বুঝিয়ে কী লাভ? ওদের কাছে এটাই ঠিক পোশাক শ্বশুরবাড়ি আসার জন্য। অবশ্য বিয়ে ঠিকের পরই শুনেছে রাজো মেয়ে শাড়ি পরে না বেশি তাই বেশি শাড়ি কেনার দরকার নেই।
রাজো বুঝতে পারে আগুন লেগেছে সম্পর্কে,গন্ধ পায় অশান্তির। নিজের যুক্তিবাদী সত্ত্বা আর নীতিবোধ মার খেতে থাকে অহরহ। কারণ সে কখনই চায় না তার জন্য কারও ক্ষতি হোক। ছেলের মানসিক চাপ আর দেখতে ভালো লাগে না। ওদিক থেকে ওর সাথে ফোন,মেসেজ আর ভালোমন্দ কথা সবই বন্ধ হয়ে যায় একেবারেই। বুঝতে পারে ছেলে হয়ত মাখনের প্রলেপ দিয়ে চেষ্টা করছে সমঝোতার। নিজেকে বড় একা লাগে রাজোর কখনও বা আহাম্মক বলেও মনে হয়। আজকাল মেয়েরা ভীষণ অধিকার নিয়ে সচেতন কখনও প্রবল নারীবাদী। তাই অশান্তির আঁচে নিজেই পুড়তে থাকে।
নিজেকে প্রশ্ন করে রাজো,ওর কী করা উচিত? ওদের কী বলা উচিত ওরা যা করেছে ঠিক আছে। ভুল ওরই,ওর বলা উচিত হয়নি।
অতিরিক্ত মানসিক অস্থিরতা অসুস্থ করে তোলে মানুষকে। অথচ সবাই ঠিক আছে,যে বর ওকে দিয়ে কথাটা বলালো সেও আছে দিব্যি। একগাদা টেস্ট করে ডাক্তার দেখিয়ে কিছুটা স্বস্তি ফিরল মনে যাক খারাপ কিছু হয়নি। তবে খারাপ হওয়ার বোধহয় কোন শেষ নেই। তাই ছেলে বলল ওরা পুজোর জামাকাপড় দিতে আসবে। মনে মনে ভাবে রাজশ্রী ওরাও তো কবে কিনে রেখেছে জামাকাপড়। অবশ্য সবটাই ওর কর্তার হুজুগে,রাজো মনে মনে তেমন চায়নি। ও বরং বলেছিল,আমার বিয়েও তো ঠিক হয়েছিল পুজোর আগে। কই তোমরা তো কিছু..বাকিটা আর বলা হয়নি। ওদিক থেকে শুনেছিল সে কথা তুলে এখন ঝগড়া করবে নাকি? রাজো চুপ করেছিল,তারপর পছন্দ করে সাধ্যমত ভালো জিনিস কিনেছিল দোকানে গিয়ে।
রাজো জিজ্ঞেস করে,কে আসবে? মানে কারা আসবে?
ছেলের কথা শুনে বলেছিল,ওর মা বাবা এলেই তো ভালো। ও আবার আসবে কেন?
-' না ওর মায়ের কাজ আছে,ও আসবে বাবার সাথে।'
কদিন অসুখে ভুগে ভুগে শারীরিক আর মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত রাজো মৃদুস্বরে বলেছিল,আমি এই একটু অসুখ সামলে উঠেছি আমাকে আর কোন অশান্তির মধ্যে ফেলিস না। ছেলে বলল,' সেটা তো শুরু হয়েই গেছে,ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে তোমার কথা শুনে। আসলে ওর মা ওকে উল্টোপাল্টা বোঝাচ্ছে।'
নিজের মেয়ের মুখটা মনে পড়ে রাজোর,কোথাও যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে দু তিনটে জামা সামনে এনে কোনটা পরলে ভালো লাগবে। হয়ত বা এই বয়েসেই জানে স্থান কাল ভেবে পোশাক পরতে হয় তাতেই সুন্দর লাগে ছেলে মেয়ে উভয়কেই।
রাজো চুপ করে যায় আর কিছু বলে না। চারদিকে কত আলো জ্বলেছে আর পুজোর দুদিন বাকি। তবে মানুষজন ঠাকুর দেখে বেড়াচ্ছে হাসিমুখে আগে থেকেই। এই কটা দিন হয়ত মায়ের মুখ দেখে ভুলে যাচ্ছে সব নেগেটিভিটি। নিজেকে একটু আটপৌরে সাজে সাজিয়ে নেয় রাজো। রাজো আধুনিক তবে উগ্ৰ আধুনিক নয়। কোথাও যেন কিছু সংস্কার,রুচিবোধ আর বাবার কথা এখনও জড়িয়ে রয়েছে তাকে। ভারতীয় পোশাক তার বেশি পছন্দের তবে আজকাল ছেলেমেয়েদের বায়নায় কখনও প্যান্ট শার্টও পরে। পোশাক নিয়ে কোন সংস্কার না থাকলেও নিজেদের সংস্কৃতিকে সে ভালোবাসে আর পাঁচটা জাতির মতই। ছেলে মেয়েরা আধুনিক পোশাক পরুক তা তার খুব ভালো লাগে কিন্তু তাহলে কী সত্যিই সে ভুল করেছে কথাটা বলে? কেন মনের মধ্যে এমন দোটানা চলছে কে জানে? হয়ত কাউকে কখনও জ্ঞানত আঘাত আর এই বয়েসে করতে চায় না তাই হয়ত হবে। আবার নিজেকে বোঝায় যে তার ছেলের সাথে জীবন বাঁধতে চলছে তাকে তো কিছু সংস্কার শেখানো তারও দায়িত্ব... অবশ্য এই দায়িত্ব কখনও নিজের কাঁধে নিতে চায়নি রাজো। ও জানত যথেষ্ট পরিণত আর বুদ্ধিমতী ওর বৌমা,সুতরাং এটুকু সে নিশ্চয় বুঝে নেবে। কোথায় কী ভাবে চলতে হয়।
একটা হাল্কা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হ্যান্ডলুমের শাড়িটাকে কলমকারি ব্লাউজের ওপর পরিপাটি ভাজ করে প্লিট করে নেয়। তারপর চুলটা একটু গুছিয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে তারপর চোখে ছোঁয়ায় কাজলের রেখা। কাজল বড় প্রিয় রাজোর,যে চোখ এখন অনেক কিছু দেখে ক্লান্ত একটা সময় কাজলের ছোঁয়ায় সেই চোখ কথা বলত। বিয়ে বা বৌভাতে পার্লারে সাজ হয়নি বলে সেই সময়ে। পঁচিশের দাম্পত্য সুখের আয়োজনে পার্লারে সাজতে গেছিল রাজো। সে এক যাচ্ছেতাই কান্ড,অনেক অপেক্ষার পর মেকআপ মাখা মুখটাকে চুনকালি মাখা বলেই মনে হয়েছিল। আয়নায় নিজেকে দেখে মনে হয়েছিল,হায় ভগবান এটা কে? এতটা সময় নষ্ট করে,টাকা খসিয়ে এই সাজ! এই সময়টা কী সুন্দর পরিবারের সাথে কাটাতে পারত। সেই বিচ্ছিরি সাজ মনে মনে একটা প্রমিস করিয়েছিল রাজোকে আর কখনও সুন্দরী হওয়ার লোভে নিজেকে অন্যের হাতে সমর্পণ করবে না।
একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিজেকে রান্নাঘরে ঢোকে রাজো। ম্যারিনেট করা মাছগুলোকে যত্নে ডিমে চুবিয়ে বিস্কুটের গুড়োতে গড়াগড়ি করিয়ে নিয়ে সাজিয়ে রাখে ট্রেতে। ওরা এলেই গরম গরম ভেজে দেবে। একটু বাদেই কলিং বেল বাজে ওরা আসে। তবে ভাবী বৌমার মুখ দেখে নিজের বুকটা কেঁপে ওঠে রাজোর। প্রথম দিনে দেখা মুখের চেয়ে এ বড়ই আলাদা। এক পোচ কালি মাখানো সেই মুখে,রাগে যেন থমথম করছে মুখ। বুক কাঁপে রাজোর,ছেলেও কাজের অজুহাতে বাইরে বেরিয়েছে। হয়ত বা ইচ্ছে করেই বেরিয়েছে ওকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার পরীক্ষায় ফেলার জন্য। ওদের বসতে বলে,নিজে এসে রান্নাঘরে চায়ের জল চাপায়। হয়ত বা মুখও লুকায় অশান্তির ভয়ে। যে রুচির প্রশ্ন গত কয়েকদিন ওকে বিব্রত করেছিল। সেই রুচি যে আজ ধারালো কাঁচি হয়ে ওর মনকে এতটা ক্ষতবিক্ষত করবে তা একটু আন্দাজ করলেও পরে যা হল তা ভাবেনি।
ফিসফ্রাই আর চা এনে টেবিলে দেয় রাজো। ওর বর গল্প করছে মেয়ের বাবার সাথে। ওদের চা আর ফ্রাই খেতে বলে রাজো। যথারীতি প্রত্যাখান হয় অপর পক্ষ থেকে। রাজো শুকনো গলাতে বলে,' একটা খা,কিছু খাবি না তা হয় নাকি?'
ওর বাবাও সেই কথাই বলে,' একটা খা কিছু খাবি না কেন? উনি কষ্ট করে বানিয়েছেন।'
-' তোর মুখটা অমন কেন?' ওর বর বলে ওঠে।
ঘরে বাজ পড়ে এতক্ষণ মেঘলা আকাশ থেকে সশব্দে বাজ পড়ে সেই বজ্রাঘাতে ছিটকে পড়ে রাজো। ওদিক থেকে হুংকার আসে,' আমি তো শাড়ি পরে গায়ে আঁচল দিয়ে এসেছি যদি আমার ব্রা দেখা যায় সেই ভয়ে। আমি তো এই বাড়ির মেয়ের মতই থাকবো তাই পোশাকে কী এসে যায়? আমি মেয়ের মত পোশাকেই আসতে পারি। তাছাড়া ও জানে আমি কেমন পোশাক পরি। এখন এ কথা আসছে কেন?'
সামান্য বুঝিয়ে বলা কথা যে বিষাক্ত তীরের মত বুকে এসে বিধবে তা ভাবেনি রাজো। এইসব প্রশ্ন আর কথার উত্তর কোথা থেকে দিতে শুরু করবে? সত্যি নিজেকে অসহায় লাগে। অবশ্যই এই পরিস্থিতি তো ও নিজেই সৃষ্টি করেছে। কী দরকার ছিল বলার? যা পারত তাই করত। খুব রাগ হয় বরের ওপর। যে মানুষটা ওকে বাধ্য করেছিল কথাটা বলতে সে দিব্যি ভালোমানুষী করে বলছে,' একটু মানিয়ে নিতে হয়। এত সহজে ভেঙে পড়লে হয় নাকি?'
অবাক হয় রাজো কে মানিয়ে নেবে? এই মেয়ে মানিয়ে নেবার মত নয়। বরং মানিয়ে আর মানতে কোনটাতেই সে অভ্যস্ত নয় সেটা খুব ভালো করে বুঝতে পারে রাজো। ওদিক থেকে ক্রমাগত কথাবৃষ্টি হতে থাকে। কোনদিক থেকে বোঝাবে বুঝতে পারে না রাজো। এখন সে বুঝতে পারে গাছে তোলার জন্য অনেকেই থাকে তবে নামানোর কেউ থাকে না। যে বর প্রবল ক্ষিপ্ত ছিল তার স্বরও এখন নীচু। তবুও বলে,আমরা শ্বশুরবাড়িতে আসি বৌ পরিচয়ে। এই বাড়িতে সবাই যেমন আমাকে তোমার শ্বশুরমশায়ের বৌ বলে জানে,তেমনি তুমিও আসবে আমার ছেলের বৌ হয়ে। আর আমার মেয়েও জানে কোথায় কী ভাবে যেতে হয়। যদিও বা সে ভুল করে আমি তাকে শুধরে দিই। আমিও তো তোমার মায়ের মতই কেউ হব। আমি তবুও তোমার যদি মনখারাপ হয় তাই তোমাকে বলিনি। তোমার মা আমার সাথে বন্ধুর মত মিশত তাই তাকে বলেছিলাম তোমাকে বুঝিয়ে বলতে।
ওপার থেকে কর্কশ উত্তর আসে,' সে অধিকার আপনি অর্জন করেননি,আপনি আমার মা বা শিক্ষিকা কেউ নন। আমি মাস্টার্স করেছি,আমি কী কিছু শিখিনি?'
নিজের প্রতি করুণা হয় রাজোর আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগে সেও মাস্টার্স করছে তবে সেকথা সে গলা বড় কাউকেই বলে না। অন্য কেউ হলে এই পরিস্থিতিতে কী করত তা জানে না রাজো। তবে সেই মুহূর্তে ওর মনে হয়েছিল ছেলের সম্পর্কটা যেন ওর জন্য না ভাঙে। জীবনে নানা সময়ে আর নানা অধ্যায়ে নানাভাবে অপমানিত হয়েছে রাজো,কিছু ক্ষত আজও দগদগে মনের গভীরে। কিছু ভুলতে চেষ্টা করে ভুলে গেছে। আবার গলা মিলিয়ে ভাব করেছে তাদের সাথেই যাদের কাছে ছোট হয়েছে আর অপমানিত হয়েছে। তবুও ভাঙেনি কোন সম্পর্ক। কারও সম্পর্কের মাঝে কখনই নিজের অপমান বা ইগোকে আনেনি। সমঝোতা করতে খুব কষ্ট হয়েছে তবুও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে। অনেক ক্ষত হৃদয়ে বয়েও আজ এই বয়েসে এসে ভাবে কোন সম্পর্ক সে ভাঙেনি। হয়ত সেখানেই সে জয়ী।
নিজেকে শান্ত করে রাজো তারপর বলে যা বলেছি তার জন্য আমাকে কী করতে হবে? অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে ভেঙেচুরে দুমড়ে মুচড়ে যায় রাজো। তবুও ঐ যে সম্পর্ক রক্ষা। এই সম্বন্ধ যদি সে নিজে পছন্দ করে করত তবে সে বলত,' আপনারা আসুন,এই বিয়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।'
তবুও সে সংযত হয় আর বলে তাহলে কী আমাকে? কী বললে আমার অপরাধের বোঝা কমাতে পারব? আমাকে তাহলে কী ক্ষমা চাইতে হবে? মুচকি হাসি দেখতে পায় হবু বেয়াইয়ের মুখে। বুঝতে পারে রাজোর অসম্মান উনি উপভোগ করছেন এবং মনে মনে বাহবা দিচ্ছেন মেয়েকে যোগ্য জবাব দেওয়ার জন্য। মুখে বলেন,'আমি তালিবানি নই। মেয়েরা রকমারি পোশাক পরলে আমার ভালো লাগে। আপনি একবার ওর মায়ের সাথে বসলে সব ঠিক হয়ে যাবে।'
এরপরে আবার ওর মায়ের সাথে বসতে হবে? না আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।
নিজেকে আর সংযত করে রাখতে পারে না রাজো। অসম্মানের বোঝা বইতে না পারা চোখে জল নামে। পরে ভাবে খুব ভুল করেছিল নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করে অন্যের কাছে। কেন যে চোখদুটো বেয়ারা হয়ে ওঠে মাঝেমধ্যে।
তারপরের ঘটনাগুলো আর মনে করতে না চাইলেও বালিশে মুখ লুকিয়ে কান্নার ফাঁকে বারবারই চোখের সামনে ফুটে ওঠে অপমানিত হওয়ার দৃশ্যগুলো। অবশ্য এই অপমানের জন্য দায়ী তো সে নিজেই। হবু বৌ হটপ্যান্ট,বিকিনি বা মিনিস্কার্ট যা খুশি পরে এসে যদি সে নিজে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তবে ওর কী দরকার ছিল নীতিবোধ শেখানোর? আর সেই অধিকার যে ওর নেই তা ও শুনেছে ওর হবু বৌমার কাছে।
****************************
বিয়েটা না ভাঙলেও মন ভেঙে খান খান হয়ে গেছে রাজোর। হয়ত এই শিক্ষাটুকু হওয়া তার জন্য ভালোই ছিল। তাই নিজেকে সংযত করল রাজো। বুঝতে পারলো কিছু সম্পর্কে বেশি মাখন লাগিয়ে লাভ নেই। প্রথম ভুল ও নিজেই করেছে একদম প্রথম দিনেই শুধু শাশুড়ি হয়ে ভাবী বৌকে শাড়ি পরে আসতে বলাই উচিত ছিল। আসলে মেয়েরা মেয়েদের শত্রু একথা বহুল পরিচিত। কিন্তু মেয়েরাই বোধহয় মেয়েদের শেখায় কিছু সংস্কার,সহবত,সংযম আর রুচিবোধ। ভাবী বৌমাকে রুচি শিক্ষা দিয়ে আহত হলেও রাজো শিখল সংযম তারই কাছে আর বুঝতে শিখল অধিকার বোধের মাত্রাও। তাই সে সংযত করল আবেগকে। সংযত হল অত্যাধিক দেওয়া থোয়ার লিস্ট। বুঝতে পারল আর কোন কিছু করেই সে আর ভালো হতে পারবে না। এই কালিমা মুছতে হয়ত তার বছরের পর বছর কেটে যাবে। সুতরাং শাশুড়ি হয়েই থাকাটা বোধহয় ভালো। রাজোর অতিরিক্ত ভালোবাসা আর ফল্গুধারা হয়ে বয়ে যায় না,শক্ত পাথরের আঘাত সেই ধারাকে করেছে সংকীর্ণ। ভালোবাসার চেয়ে কর্তব্য করে যাচ্ছে এই ভেবেই মনকে বোঝায় রাজো। কথায় বলে মা হওয়া কী মুখের কথা? হয়ত বা মানুষ হওয়াই মুখের কথা নয়। তাই মান আর হুশ বিসর্জন দিতে না চাইলেও যখন এগুলো বিসর্জন দিয়ে অন্ধভাবে বাঁচতে হয় তখন তা মৃত্যুর সামিল।
নিজের ব্যথায় জর্জরিত পা কে সামলাতে শক্ত হাতে রেলিং ধরে ভারী ব্যাগটা বয়ে সিঁড়ি ভাঙে রাজো। এই কয়েক মাসে রাজ্যের কেনাকাটা সে নিজেই করেছে অতিরিক্ত উৎসাহ নিয়ে। আজ সেই উৎসাহ আর তার নেই। অপমান আর গ্লানির বোঝা তাকে নুইয়ে দিয়েছে অনেকখানি। শুধু বুঝেছে আবার এক নতুন যুদ্ধ চলবে। হয়ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ থামলেও জীবনক্ষেত্রের যুদ্ধ থামে না কখনই। সুতরাং আঘাতে আর সংঘাতে আহত মনকে টেনেটুনে চালিয়ে হাসিমুখে এই বেশ ভালো আছি বলার নামই জীবন।
সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নেয় রাজো,তারপর আবার এগিয়ে যায় ম্যাচিং সায়ার আর কিছু শাড়ির ব্যাগটা নিয়ে সামনের দিকে। যে কাজে সে প্রবল উৎসাহে হাত দিয়েছিল আজ ক্লান্ত দেহ মনে সেই কাজ করা বড় কষ্টের। তবুও সন্তানের মুখ চেয়ে তা করতেই হবে। মন গেয়ে ওঠে ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু....
Comments
Post a Comment