Skip to main content

বাজলো বিয়ের সানাই

পা রাখতে চলেছি নারী জীবনের আরেক অধ‍্যায়ে,এবার শাশুড়ি হওয়ার পালা। একদিকে একটু মন কেমন আর নষ্টালজিয়ায় ভেসে যাওয়া। বারবারই মনে হয় জীবন বড় তাড়াতাড়ি চলেছে এগিয়ে,এই তো যেন সেদিনই প্রাণ ভরে নিয়েছিলাম প্রথম মা হওয়ার আনন্দ। সব কষ্ট ভুলে গেছিলাম বেবি কটে শুয়ে থাকা বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে। সদ‍্য মা হওয়া যুবতী মেয়েটার তখন অবাক হওয়া মনটা বলেছিল এই আমার সন্তান? মানে এতদিন এই পুচকেটাই একটু একটু করে বড় হয়েছে আমার শরীরে? তারপর ওকে ঘিরে কত স্বপ্ন আর ভালোবাসার বন‍্যা। প্রথম নাতি হওয়ার আনন্দে বাবা আত্মহারা হয়ে ছুটে গিয়ে কিনে এনেছিলেন আমার সোনা চাঁদের কণা,ভুবনে তুলনা নেই গানের ক‍্যাসেট। মা গিয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে। সবাইকে খুব আনন্দ দিয়েছিল আমাদের প্রথম সন্তান তাই তার নাম হয়েছিল জয়। তারপর ছোট্ট গোলাপী তোয়ালে জড়িয়ে দিদার কোলে চেপে একদিন ভরিয়েছিল আমাদের শোবার খাটটা। 
        চোখ বুজলে আজও সব দেখতে পাই মনের আয়নায়। তারপর শুরু হয়েছিল মা হিসেবে সন্তানকে আদরে শাসনে গড়ে পিটে মানুষ করার লড়াই। ও হবার ছয় বছর বাদে এসেছিল আমার দ্বিতীয় সন্তান কন‍্যা। এক এক সময় হাঁফিয়ে উঠে ভাবতাম ভগবান কবে এরা বড় হবে? চাকরি সামলে অনেক প্রতিকূলতার মধ‍্যে এদের দুজনকে ঠিকমত বড় করতে পারব তো? একটা সময় তাই আর কোন দিকে তাকাতে পারিনি। না পরেছি ভালো জামাকাপড় না করেছি সাজগোজ। কপালে একটা ধ‍্যাবড়ানো টিপ আর যা হোক একটা কিছু পরে শুধু ছুটে গেছি সারাদিন ধরে। 
      ওরা বড় হল,আমারও ছোটাছুটি কমল। ওরা চাইলো মা ভালো থাক,আমিও চেষ্টা করেছি ভালো থাকতে। কিন্তু ঐ যে যে সময় চলে যায় তা আর ফেরত আসে না। তবু পড়ে থাকা সময়টাকে একটু ভালো করে উপভোগ করার জন‍্য মরিয়া হয়ে ওঠা। তখন মনে হল কোথা দিয়ে যেন পার করে ফেলেছি এতগুলো বছর বুঝতেই পারিনি। কত ঝড়ঝাপ্টা আর অশান্তি আমিও সয়েছি ওরাও সয়েছে। কখনও আমার ভালো না থাকার খেসারত দিয়েছে ওরাও। তবুও দিন শেষে হয়ত এটাই শান্তি যে কাক ভোরে কাঁধে ব‍্যাগ ঝুলিয়ে রোজগার করতে বেরিয়ে যাওয়া মায়ের ছোট ছোট ছানাপোনাগুলো ডানা মেলে আকাশে উড়তে শিখেছে নিজের মতই। মা হিসেবে আমি নিজেকে শূন‍্য দিয়ে ওদেরই দশ দেবো। কারণ বরাবর শূন‍্য পেতে পেতে একসময় শূন‍্যটাই আমার বড় প্রিয় সংখ‍্যা হয়ে গেছে। আসলে এই সংখ‍্যাটাকে ইচ্ছেমত সবাইকে ধার দিয়ে বেশ বড়লোক করে দেওয়া যায়। তাই ওদের চেষ্টা ছিল,আমরা পাশে থেকেছি। নজর রেখেছি যখন ছোট ছিল তারপর একটা সময়ের পরে দিয়েছি স্বাধীনতা। ভালো মন্দ বোঝার সুযোগ দিয়েছি,আর খুব একটা মাথা ঘামাইনি। বুঝিয়ে দিয়েছি এবার তোমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভালো করছ না মন্দ। আমাদের ছাড়া এবার পথ চলতে শিখতে হবে।
 একলা পথে চলতে হলে পাশে একজন ভালো বন্ধু হলে ভালো হয়। তাই স্বাধীনতা দিয়েছিলাম চেনার..

     তবুও মা বাবার ছত্রছায়ায় মানুষ হওয়া সন্তানের ভয় হয়েছে এই ভেবে সে কী একলা চলতে পারবে? সংসারের এত দায়িত্ব নিতে পারবে? তাই কখনও আদুরে সুরে এসে বলেছে,' মা আমি সবসময় তোমার কাছেই থাকতে চাই। আমি বিয়ে করব না।' শুনে আমার চোখ ভিজেছে,কেন জানি না। চিরাচরিত কাল থেকে শাশুড়ি বনাম বৌমা যুদ্ধটা বড় চেনা(যদিও আমি আমার বিয়ের আগেই শাশুড়ি মাকে হারিয়েছি),তাই হয়ত হবে। একদিকে সন্তানের সাথে বাঁধন আলগা হওয়ার ব‍্যথা আবার অন‍্যদিকে আনন্দ এই ভেবে যে মা হিসেবে আমার অন‍্যতম কর্তব‍্য ছেলের সংসার বেঁধে দেওয়া সেটা করতে পারছি। এটাও তো আমার এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। অনেকদিন ধরে চলছে আরেক যুদ্ধের প্রস্তুতি। এখন দিন প্রায় আসন্ন। ছেলে খুবই ব‍্যস্ত থাকে তার শ্বাস ফেলার সময় নেই। তাই নীরবে টুক টুক করে আয়োজন আমাদেরকেই এগিয়ে নিয়ে চলতে হয়েছে। 
তার মাঝেই মাসি পিসিদের কাছে আইবুড়ো ভাত খাওয়া হল। আমরাও অংশীদার হলাম আনন্দ আর ভুরিভোজের। 
এক এক সময় কর্মব‍্যস্ততা বড় ক্লান্ত করে তোলে,যখনই ক্লান্ত হই মনে পড়ে বড় বেশি করে মা বাবাকে। তাঁরা থাকলে না জানি কতই আনন্দ হত আজ। আমার দুঃখ,আনন্দ,যন্ত্রণা কান্নার সঙ্গী মাকে বড়ই মনে পড়ে প্রতি পদক্ষেপে,চুপিচুপি বলি পাশে থেকো। বাবাকে বলি চওড়া হাতের তালু দিয়ে অশান্ত মাথাটাকে শান্ত করে রেখো। যাতে কোন কিছুতেই বিচলিত না হই।
      আমার জীবনে আরেক খেতাব প্রাপ্তির সূচনায় আমাদের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত বিগ্ৰহ গোপাল গিরিধারীর,মামা,মামীমা,কাকু,কাকিমা, দাদু,দিদা,পিসি,পিসামশাই সবার আশীর্বাদ নিলাম। কাকু খুবই অসুস্থ ছিলেন। এখন বেশ একটা বড় অপারেশন কাটিয়ে সবে একটু সুস্থ। কাকু কাকিমার আশীর্বাদ আমার ছেলের জীবনে বড় প্রাপ্তি। ওদের ভবিষ্যত জীবন আনন্দের আর সুখের হোক এই প্রার্থনা ভগবানের কাছে।

কথায় বলে লাখ কথা না বললে নাকি বিয়ে হয় না। তবে আমি দেখলাম উল্টো,বিয়ের জন‍্য আমার লাখ লাখ কাজ বেড়ে গেল। মোটামুটি একবছর আগে থেকেই লেগে পড়লাম আমরা কর্তা গিন্নী। ছেলে ভুরু কোঁচকালো মা বাবার উদ‍্যম দেখে। আমরা তখন যেন কচি কাচা মনে অফুরান খুশি,নিজেদের বিয়েতে যা করতে পারিনি ছেলের বিয়েতে তাই হোক। আমার নিজের বিয়ের দুদিন আগে ইউনিভার্সিটি থেকে এসেছিলাম। কয়েকদিনের জন‍্য বই খাতা আর নোটগুলো যত্নে গুছিয়ে ওদের বলে আসা এখানেই ইতি নয় বইখাতার সাথে দোস্তি থাকবেই। এখনও সেই প্রমিস রেখে যাচ্ছি। 
এখন মেয়েরা কত্ত কিছু করে বিয়ের আগে,কেউ বা ডায়েট আর ফিজিক্যাল ফিটনেসের ট্রেনিং নেয় আর তার সাথে রূপচর্চার রুটিন তো থাকেই। থাকে ড্রেস সিলেকশন,দু তিন দফায় ফোটোশুট আরও অনেক কিছু। আমি নর্থবেঙ্গল ট্রান্সপোর্টের বাস থেকে নেমে ধুলো ঝেড়ে সাবান মেখে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা তখন ভীষণ ব‍্যস্ত,আমাদের গ্ৰামের বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। তাই আমার পাশে শুয়ে আমার মনের কথা শোনার সময় তার নেই। স্বামী,ননদ,জা,দেওর,ভাসুর,ভাইদের সবাইকে সাথে নিয়ে তখন মা যুদ্ধে নামার জন‍্য প্রস্তুত। এতই ব‍্যস্ততা তার ছিল যে আমার বিয়ের সময় জামাই বরণের গরদটা তার তখন পরা হয়নি। বাবার হুঙ্কারে জামদানি তাঁতের শাড়ির ঘোমটা জড়িয়ে সবার সাথে বরণডালা হাতে চলে গেছিল জামাই বরণে।
        বিয়েতে কখন কী পরবে তা সাজানো গোছানোর সময় আর সাধ‍্য এবং সর্বোপরি শখ কোনটাই তার ছিল না। যদিও মা নিজে শিক্ষিকা,মোটামুটি উপার্জন ছিল কিন্তু সাজগোজে তার অনীহা ছিল। আমার বাবার রূপের জ‍্যোতিতে আলোকিত হওয়াই বোধহয় বেশি পছন্দ ছিল তার। আর তার চেয়েও বেশি পছন্দের ছিল ইতিহাস বই আর রান্নাঘরটা। শুধু নিজের রান্নাঘর নয়,কোথাও বেড়াতে গেলে তাদের রান্নাঘরেও ঢুকে কাজ করাও খুব পছন্দের ছিল তার। অনায়াসেই জমিয়ে কাজ করতে পারত অন‍্যের সংসারে। মায়ের রান্নার ছোঁয়া পেয়ে সেই বাড়িও হয়ে উঠত আনন্দক্ষেত্র। আমি তখন পড়াশোনা করছি বেকার সুতরাং আমারও ক্ষমতা ছিল না মাকে সাজানোর। আর স্বভাবে তিনি ছিলেন ভীষণ ব‍্যক্তিত্বময়ী আর সাধারণ সুতরাং আমার কোন মতামত সেখানে খাটত না।
    ছেলের বিয়ে দিতে যাবার সময় নিজে মা হয়ে বারবারই মায়ের সাথে নিজেকে মিলিয়ে ফেলছি। মনে পড়ে যাচ্ছে পুরোনো কত কথা,চোখে ভাসছে কত মুছে না যাওয়া মধুর স্মৃতি। আমিও মায়ের মত শিক্ষিকা হলেও সাজগোজ ভালোবাসি। তবে অনেক আগে থেকে একটু একটু করে গুছিয়েও এখন শেষ বেলায় এসে মনে হচ্ছে ওরে তোরা আর আমাকে সাজতে বলিস না।
      ছেলে মেয়ে দুজনেই চায় মা ভালো থাক আর সাজগোজ করুক। এখন মেয়েও চাকরি করে তবে সেও নিজের জন‍্য তেমন কিছু কেনে না। বলে মায়ের বিন্দু বিন্দু করে জমানো শাড়ি আর সাজগোজের জিনিসের সিন্ধুতেই তার জীবন কেটে যাবে। তবে মায়ের জন‍্য সুযোগ পেলেই কিনে আনে এটা ওটা। তার উদ‍্যোগেই লাখো কাজের ফাঁকে গোছানো গাছানো নিজেদেরটা। 
     ঘর পরিস্কার করতে আর সারাতে গিয়ে নিজের গুপ্তভান্ডারের নির্লজ্জ জামাকাপড় গুলো বাইরের আলো পেয়ে দাঁত বার করে হেসেছে। তাদের গুছিয়ে তুলতে তুলতে আমি নাকাল হয়ে নাক মুলেছি অনুশোচনায় আর তেমনি মুখ শুনেছি বরের কাছে। দাঁত খিচুনি দিয়ে বলেছে এত জিনিস তোমার!
   হায় ভগবান কী করি তখন? ওদের ঘেটি ধরে লুকোতে লুকোতে বলেছি কী করব? আমার তো লাগে....তারপর সবটাই ড‍্যাস ড‍্যাস থাক।
    তাই নাক মুলেছিলাম নো শপিং বিফোর বেটাস শাদী। কিন্তু বাধ সাধলো আমার এক বান্ধবী,সে বললো..এ আবার কী তুমি ছেলের মা তোমায় তো নতুন শাড়ি পরতে হবে গায়ে হলুদে,আইবুড়ো ভাতে,যখন জল সাজবে..দই খই খাওয়াবে,বৌ বরণ করবে। হায় হায় আবার পণ ভাঙবো? বর কী বলবে?
   হ‍্যাঁ বললো মানে আগে বন্ধুকে কিছুটা দিলো তারপর আমাকে বলল যত সব ছুতো। মেয়েকে বললাম সে বললো পাত্তা দিয়োনা। কিনে নাও। রোজ রোজ ছেলের বিয়ে হবে নাকি?
     ঠিকই তো ছেলের বিয়ে বলে কথা সুতরাং বৌমার শাড়ির পাশাপাশি কয়েকটা ঝুলিতে ভরলাম নিজের জন‍্য। আর আপনজনেদের জন‍্য।
     শপিং মোটামুটি শেষ করেও যেন শেষ হয় না। খুচখাচ আছেই,আজ এটা তো কাল সেটা। ননদাই বায়না করল তার দুটো পাঞ্জাবী চাই পছন্দের দোকান থেকে। সুতরাং তাকে নিয়ে একদিন গেলাম পাঞ্জাবীর দোকানে। আগে থেকেই পছন্দ করে রেখেছিল সে নিজের জন‍্য দুইখান জবরদস্ত পাঞ্জাবী। সুতরাং আমার ঝামেলা কমল শুধু পকেট হাল্কা হল বেশ কিছুটা। অবশ‍্য আদরের ছেলের বিয়েতে আমার কাছের আত্মীয়স্বজন সবাইকে নিজের সাধ‍্যের মধ‍্যে কিছু দেবার ইচ্ছে ছিল আমার। তাই মনটা খুশিই হল যাক ওকে পছন্দের কিছু দিতে পারলাম। তারপর মনে মনে ভাবলাম যাক যতই বকাঝকা করুক বরটা,ননদাই ভাগ্নে সবাই যখন ডিজাইনার পাঞ্জাবী ধুতিতে সাজবে তখন সে আর বাকি থাকে কেন? সুতরাং তার জন‍্য সাহস করেই একটা নীল সাদা কাঁথা কাজের পাঞ্জাবী আর খুঁজে পেতে নীল ধুতি কিনে ফেললাম। ছেলে সেদিন আমাকে ঐ দোকান থেকে নিয়ে নেমন্তন্ন করতে যাবে দুই দাদার বাড়িতে এমনটাই ঠিক ছিল তাই সে দোকানে হাজির হওয়াতেই তাকেও বললাম, সবার জন‍্য এত সুন্দর সব ড্রেস কেনা হচ্ছে তোর ড্রেসটা সাদামাটা হয়ে যাচ্ছে না বাবা? ছেলে হাত জোড় করে হেসে ফেললো। বললো মা এবার দোকান ছাড়ো চলো আমরা যাই,অনেক কিনেছো আর নয়। তাছাড়া এইসব পড়ে থাকবে। আমার সময় কোথায় এগুলো পরব? 
       প্রথম শপিং শুরু করেছিলাম ছেলেকে দিয়েই। ওরই তো বিয়ে সুতরাং সবচেয়ে আগে বরই থাক। ছেলের সময় নেই এইসবে মন দেবার। পাত্রী নির্বাচন করেই সে বিরাট বড় কাজ করেছে সুতরাং যত ঝামেলা বিয়ে সংক্রান্ত তা আমরা কর্তাগিন্নী ঘাড়ে নিয়েছি। তাই সে যখন যেতে পারবে না বিয়ের পাঞ্জাবী কিনতে শুনলাম তখন আমি,কর্তা আর আমার কন্যাই গেলাম। পছন্দ করে দুটো পাঞ্জাবী কিনলাম, একটা বিয়েতে পরবে অন‍্যটা বাসী বিয়ের। সাথে ম‍্যাচিং কনট্রাস্ট ধুতি। যথারীতি একটা তার ছোট হল আর আরেকটা গলা কুটকুট করল কারণ সাইডে বোতাম। তার আগেই আমি বরের আলমারি গুছিয়েছি। মাঝেমধ্যে গোছানোর কাজ আমি করি। যদিও আজ গোছাবো কাল গোছাবো করে দিন কাটাই বেশ অনেকগুলো অবশেষে একদিন কোমর বাঁধি।
     তবে আলমারি গোছানো খুব ভালো আপনার কেনাকাটা কমাতে একটু হলেও সাহায্য করে। কারণ হিসাবে প্রথমত দেখবেন কিছু জামাকাপড় বহুদিন পরেন না,আবার কিছু জামাকাপড় শখে কিনেছেন কিন্তু মনেই নেই,আবার কিছু স্মৃতি হিসেবে পড়ে আছে আলমারি জুড়ে। আবার কিছু পরে পরব বলে পরাই হয়নি। তারপর হঠাৎই খুব আপশোস হয় বাজে খরচের জন‍্য। তখন মনে হয় একটা সময় শ্বশুরবাড়ির চাপে বাড়িতে শাড়ি পরতাম তখনকার সময়টাই খুব ভালো ছিল। আটপৌরে শাড়ি পরে বেশ কিছু শাড়ি ছিঁড়ে ফেলা যেত। এখন আরামদায়ক পোশাক ঢিলেঢালা ম‍্যাক্সি হওয়াতে শাড়ি পরা উঠে গেছে। তবুও আমি ভোরবেলা স্কুলে গেলেও অনেক অসুবিধা ছিন্ন করেও বেশিরভাগ শাড়ি পরি। যাক নিজের গল্প না করে ছেলের বিয়ের পাঞ্জাবীর কথা বলি। বরের আলমারি গুছিয়ে একটা নতুন তসরের পাঞ্জাবী পাই। বড় যত্নে একদম প‍্যাকেটবন্দি সেই জামাতে হাত বোলাই। এই পাঞ্জাবী আমার বাবার,তাঁর বাহাত্তর বছরের জন্মদিনে হঠাৎই শখ হয়েছিল জন্মদিন ঘটা করে হবে। অনেক মানুষ আসবে নেমন্তন্ন খেতে। সেইসময় অনেক মানুষ না এলেও তাঁর প্রিয় ছাত্রদের অনেকেই এসেছিল এমনি কারও দেওয়া উপহার এই পাঞ্জাবী। বেশ কয়েকটা প্রাপ্তি হওয়াতে জামাইকে দিয়ে গেছেন একটা। তবে সেই ভদ্রলোকেরও ঐ পাঞ্জাবী পরা হয়নি। অদ্ভুতভাবে ভাবে বাবা চলে যাবার সাতবছর বাদে ঐ পাঞ্জাবী নাতির পছন্দ হল ভীষণ। সাদামাটা তসরের পাঞ্জাবীতে হাল্কা কাজ আর মাঝের বোতাম ছেলের মনে ধরল। তবে মায়ের মন ভরল না তাতে। তবে বুঝলাম অলক্ষ্যে এ দাদুরই আশীর্বাদ নাতির জন‍্য। আসলে নাতি তার প্রাণ ছিল তবে যে নাতি একসময় দাদুর জন‍্য পাগল ছিল সেও বদলেছিল বয়েস বাড়ার সাথে সাথে। যে মুঠো শক্ত করে ধরে দাদুর হাত ধরে এদিক ওদিক যাবার বায়না করত সেই মুঠোও আলগা হয়েছিল। বাবা কষ্ট পেয়েছিল আমি বুঝিয়েছিলাম বড় হবার সাথে সাথে পরিবর্তন মেনে নিতে হয়। ওদের অন‍্য জগত হচ্ছে,আমি তো আছি তোমাদের সাথে। তবে সত‍্যি বোধহয় কেউ কারও সাথে থাকে না। একদিন পৃথিবীর আলো দেখতে পাওয়া মায়ের পেট থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানুষ একলাই তার শেষ যাত্রাপথে যাত্রা করে। বাবাও ঠিক সেইভাবেই একলা চলে গেছেন তার অনন্ত যাত্রায়। হবু ডঃ নাতির কোনো সাহায‍্যই তার লাগেনি।
     তবুও বাবা মায়ের আশীর্বাদ আমাদের সবাইকে জড়িয়ে আছে এটা বিশ্বাস করি। হঠাৎ পাওয়া নতুন পাঞ্জাবী তেমনি এক অলিখিত ইচ্ছার দলিল। বাবা বেঁচে থাকলে ওর ধুতিটা বাবাই যত্নে পরিয়ে দিত।
      আমি পাঞ্জাবীটা একটু সাজিয়ে নিলাম। খুব ছিমছাম একটু আঁকিয়ে নিলাম তাতে। দাদুর পাঞ্জাবী রঙীন স্বপ্নের তুলির ছোঁয়া পেয়ে ফ‍্যাসন দুরস্ত হল।
     
 

 তবে নেমন্তন্ন করতে যাওয়াটা যে এত কষ্টকর ধর এবং উদর দুটোর জন‍্যই তা আগে বুঝতে পারিনি। ছেলের বিয়ের নেমন্তন্ন কার্ড আসতেই বরের তোড়জোড় আগে আমাদের গুরুদেবের ওখানে যাওয়া হবে তারপর অন‍্য কোথাও। সুতরাং বস্তা বোঝাই কার্ড গাড়ির পেছনে নিয়ে চললাম বরানগর পাঠবাড়িতে।





বাড়ি বাড়ি ঘুরে নেমন্তন্ন শুরু করলাম,সকালে স্কুলে পড়ানো শেষ করে আবার ছুট নেমন্তন্ন করতে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি। কোথাও বা অনেক সিঁড়ি বেয়ে দোতলা,তিনতলা আর চারতলা।  কষ্ট হলো খুব আর পায়ে চাপ পড়লো। তবুও কর্তার ইচ্ছেতেই কর্ম আজকাল হোয়াটস অ্যাপে ই কার্ড বিলি করার যুগেও আমরা সাবেকি কায়দায়  এবাড়ি ও বাড়ি ঘুরতে লাগলাম তাদের সময়  বুঝে। এদিকে কোথাও মিষ্টি,কোথাও চা আর সিঙারা খেয়ে শরীরেরও বারোটা বাজলো। কলকাতার পর্ব বেশ কিছু শেষ করে চেনা পরিচিত আত্মীয়দের যারা দূরে থাকেন তাদের ইকার্ড পাঠিয়ে ঠিক করলাম এবার মালদা যেতে হবে। একটা বড় কাজ করতে চলেছি একবার জন্মভূমিতে মাথা ঠেকাতেই হবে। মা বাবা নেই কিন্তু তাঁদের রাখা সংসার রয়েছে।  আছেন আমার মামারা,পিসি,পিসামশাই,কাকু,কাকিমা আর ভাইবোনেরা। আর আছেন আমাদের গ্ৰামের বাড়ির প্রতিষ্ঠিত বিগ্ৰহ গোপাল গিরিধারী। তাঁর দেখা তো পেতেই হবে। ট্রেনে টিকিট পাওয়া খুব মুশকিল তবে অবশেষে পাওয়া গেলো। প্রস্তুতি নিলাম যাবার সাথে দুই ট্রলি জামাকাপড়। ছেলের বিয়েতে ইচ্ছে ছিল প্রত‍্যেককে কিছু দেব যেটুকু কুলায় আমার সামর্থ‍্যে। যদিও জানি কেউ কোনদিনই বলবে না তোমার দেওয়া শাড়ি বা পাঞ্জাবী খুব ভালো হয়েছিল গো। তবুও ঐ যে যশভাগ‍্য না থাকলেও মনের টানে করে ফেলি অনেক কিছুই। 
         ছেলের বিয়েতে নিজের জন‍্য তেমন কিছু না কিনলেও সবার জন‍্য কিনতে শুরু করেছিলাম বেশ অনেকদিন আগে থেকেই। হাতে টাকা পেয়েছি আর একটু একটু করে কেনাকাটা করতে শুরু করেছি। কখনও পরিচিত দোকানের লোকজন বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে চার পাঁচটা ব‍্যাগ।। তবে সব করেছি একা একাই,একটু একটু করে স্কুলের ফাঁকে। শুধু বেনারসী কিনতে দোকা গেছিলাম। সেসব এনে গুছোনো,ব্লাউজ করানো সবই করতে হয়েছে। আত্মীয়স্বজনকে দেবার শাড়িতে স্টীকার মেরেছিলাম প্রথমেই যাতে নামের গন্ডগোল না হয়। মেয়ের বাড়ির সঙ্গে আমাদের নমস্কারী কাটাকুটি হয়েছিল তবুও আমি মা বাবা আর দিদার জন‍্য কিনেছিলাম।

         রাতের ট্রেনে দুটো বড় ট্রলী টেনে উঠলাম দুজনে,আজকাল আর বাপের বাড়ির দেশে যেতে মন ভালো লাগে না। হয়ত স্মৃতিটুকু ছাড়া সেখানে আর কিছুই নেই। একটা সময়ে বাবা খুব চাইতেন আমাকে তখন সংসারের জন‍্য ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন‍্য থাকতে পারতাম না। আজ বাবার কথাটা খুব মনে পড়ে,বাবা বলতেন..' এখন আসছো না,একটা সময় আর ডাকার কেউ থাকবে না তখন বাপের বাড়ি বলে আর কিছুই থাকবে না।'
     সত‍্যিই এখন তাই হয়েছে,মালদা স্টেশনে নামি ওখানে বড় জলের বোতল কিনি। কারণ জানি গিয়ে জলটুকুও পাবো না। চা বিস্কুট ছাতুর প‍্যাকেট মুড়ি সাথে রাখি। ভুলে গেলে দোকান থেকে কিনতে হয়। নাহলে না খেয়ে থাকতে হয় অনেকটা সময়। বাড়ি ঢুকেই ফোন করি সাফাই করার একটা ছেলেকে,তাকে সারাদিনের মজুরী দিয়ে ঘর সাফ করাই। তারপর নিজেরা সাফসুতরো হয়ে চায়ের জল বসাই। চা খেতেই এগারোটা বাজে। টোটো থেকেই চোখ পড়ে ফাঁকা বারান্দায়, কেউ আর সেখানে অপেক্ষা করে না। কোন ফোন আসে না আমাদের জন‍্য। আগে ভোরবেলা থেকে ফোন বাজতো কোন স্টেশনে আছি,ট্রেন কী লেট?
     বেশ কিছুটা বেলা হলে ফোন আসে মামাদের, কখনও ভাইয়ের বা কাকিমার। মা চলে যাবার পর মামারা খাওয়ায়। তাঁরা খেতে বলেন নিজেদের অনেক অসুবিধা সত্ত্বেও। এটাই অনেক পাওয়া আমাদের কাছে। এবারও গিয়ে ছোট মামার কাছে খেলাম। তবে তার আগের অনেক বিভ্রাট হল ইলেকট্রিক নিয়ে।
          ছোটমামা অসুস্থ তবুও অনেক জোগাড় করেছে,খাওয়াদাওয়া ভালো হল। কিন্তু আমাদের তো শান্তি নেই মাথায় তখন ঘুরছে কতক্ষণে সব সারবো। বড় মামী খুব খেতে ভালোবাসতেন। কিন্তু এখন একদম বিছানায়,আজকাল প্রায় মনে হয় কত তাড়াতাড়ি দিনগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। বড়মামার বিয়ে আমার আবছা মনে পড়ে। শুধু এইটুকু মনে আছে মামী পাশের বাড়ির মেয়ে হওয়ায় সারা মালদা শহর ঘুরে বরযাত্রী পাশের বাড়িতে এসেছিল। আমিও ছিলাম সেই গাড়িতে। মামীকে দেখতে খুব সুন্দর ছিল,একটু বেটেখাটো,কোঁকড়া চুল মাথাভর্তি ভাসা ভাসা কটা চোখ আর ফরসা রঙ। মামীকে ভিকো টারমারিক ক্রীম মাখতে দেখেছি আমার ছোটবেলায়। আমার বয়েস তখন ছয়। আমিও মাঝেমধ্যে গালে মাখতাম সেই ক্রীম।পাশের বাড়ির মেয়ে হওয়ায় আমার দিদাদের পুরোনো ভাঙা বাড়িতে মামী সুন্দর মানিয়ে নিয়েছিল। মামা স্টেট ব‍্যাংকে চাকরি করত বিহারে। মামী প্রাইমারী স্কুলে পড়াতো তাই বরের কাছে সবসময় থাকা হত না। ছুটিছাটায় যেতো। তবুও দিদাদের যৌথ পরিবারে সবার মধ‍্যে সুন্দর মিলেমিশে ছিল মামী। আমি কখনও মামীর মলিন মুখ দেখিনি। মামা এলে খুবই কষ্ট করে থাকতে হত কারণ ঐ বাড়িতে ঘর কম ছিল। আমি মামীকে প্রথমে হাসিমাসি বললেও পরে মামীতে এসেছিলাম। আমরা বড়মামাকে খুব ভয় পেতাম। বড় মামা মায়ের চেয়ে একবছর দশমাশের ছোট। এখন মামাবাড়িতে গেলে খুব কষ্ট হয়। একসময় কত লোকজন ছিল বাড়িতে,এখন সবার আলাদা সংসার। দাদু দিদা নেই,ভাইবোনের বিয়ে হয়ে গেছে তাই সব জায়গাতেই শুধু নীরবতা। আমার হাসি মামীর মুখে এখন আর তেমন হাসি দেখি না। মনের কষ্ট মনে চেপেই বলে ভালো আছি রে,তোরা ভালো থাকিস।
   আগে কথা হলেই রান্নার গল্প হত,কত রেসিপি জানতে চাইতো আমার কাছে। এখন বলে আর খেতে ভালো লাগে না রে। তবুও খাই সবই। শাড়ির থেকেও গয়না খুব পছন্দের ছিল মামীর। হাত ভরা থাকত রকমারি সোনার গয়নায়। সময় সাজায় আবার সময় কেড়ে নেয়। এখন খুলে রাখতে হয়েছে সব কিছু। বড় কষ্ট হয় আপনজনেদের কষ্ট দেখে। মামার খুব ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারবে না জানি। মামাতো ভাই আর বৌ এসেছে আয়ারল‍্যান্ড থেকে,ওরাও চলে যাবে। ওদের ছেলেটা খুব সুইট। খুব সুন্দর মিশে গেল আমাদের সাথে।
     মালদাতে কয়েকটা বাড়ি ঘুরে রাতে একদম খাওয়াদাওয়া করে ফিরলাম ফ্ল্যাটে। পরদিনই গ্ৰামের বাড়িতে যাওয়া। ওখানে ঘুরে,গাজোল ঘুরে একদম কালিয়াগঞ্জে পিসির বাড়ি।
          সকালে উঠে রেডি হয়ে নিলাম, চেয়ারে রাখা মা বাবার ছবিতে প্রণাম করে বুকে জড়ালাম বললাম, চলি..আশীর্বাদ কোরো যেন সুস্থ শরীরে সব করতে পারি ঠিকমত। তোমরা ভালো থেকো,আমাদেরও ভালো রেখো। সেদিন দুপুরে খেতেই হবে এমন আবদার ছিল মামাতো বোনের। তার বাড়িতে আমি কোনদিনই যাইনি। সে রন্ধনপটিয়সী,ওটাই ওর ভালোলাগা। ও অনেকটা আমার মায়ের মতই। আমার মায়েরও রান্নাঘর বড় প্রিয় জায়গা ছিল,আমার দিদারও। বরং আমার ঠাকুমাকে দেখেছি অনেক কম বয়েসে রান্নাঘর থেকে বিরতি নিতে।
      শহরের সীমা ছাড়িয়ে গাড়ি চললো গ্ৰামের দিকে,মালদা থেকে গাজোলের দিকে যাবার হাইওয়ে দারুণ ঝকঝকে আমরাও এগিয়ে চললাম গাজোলের দিকে সেখানে পিসতুতো বোনের বাড়ি হয়ে চললাম আমাদের গ্ৰামের বাড়ি চাঁচল মকদমপুরের দিকে। ও যত্নে গুছিয়ে দিল হাতে বানানো আমসত্ত্ব আর বড়ি।
  আমি জানলার কাঁচ নামিয়ে মাটির গন্ধ শুকছি তখন। চারদিকে সরষের ক্ষেত ফুলে ফুলে হলুদের বন‍্যায় ভাসছে আর বাতাসে অদ্ভুত সুন্দর একটা সুবাস। মাইলের পর মাইল খেত দেখতে দেখতে আর স্মৃতির গলিপথে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম গ্ৰামের বাড়িতে। বাড়িতে ঢোকার আগেই থমকে দাঁড়ালাম গেটের সামনে আসলে আপনজনের মত জড়িয়ে সেই বাড়িটাও...যে বাড়িতে খুব ছোটবেলায় যখন আসতাম তখন চাঁচল থেকে গরুর গাড়িতে ক‍্যাঁচক‍্যাঁচ শব্দ করতে করতে কাঁচা রাস্তা পাড়ি দিতে দিতে কখন যে মায়ের কোলে ছইয়ের তলায় ঘুমিয়ে পড়তাম বুঝতেই পারতাম না। তারপর একটা সময় ঘুম ভাঙত গ্ৰামে ঢোকার মুখে আপনজনের সাথে বাবার কুশল বিনিময়ে। প্রথমে দেখা হত আমার জেঠামণির সাথে,তারপর কাকুর স্কুলের সামনে দিয়ে আসতে আসতে দেখা হত কখনও কাকুর সাথেও স্কুল খোলা থাকলে। তারপর গাড়ি এসে দাঁড়াতো আমাদের বড় গেটওয়ালা বাড়িটার সামনে। আমার কর্তামা অপেক্ষা করত বাইরে বসে,তারপর খবর পেয়েই ছুটে আসতো বাড়ির ভেতর থেকে সবাই। উৎসবের দিনে বাড়ি ভরে থাকত কত লোকে। সে এক যেন আনন্দক্ষেত্র। আমরা প্রথমে ঠাকুর মন্দিরে প্রণাম করে যেতাম ভেতর মহলে। কত কথা,কত স্মৃতি আর আনন্দের দিন আজ ধুয়ে মুছে গেছে আপনজনেদের মৃত্যুতে। অতীতের সেই দিন আর নেই,অত বড় বাড়িতে এবার গিয়ে দেখলাম চারটে প্রাণীকে। অব‍্যবহারে আর কালের থাবায় আমাদের বাড়িও হয়েছে জীর্ণ। গোপাল গিরিধারীর পুজোও সংকটের মুখে। তবুও মন যেতে চায় ছোট্টবেলার সেই মিষ্টি গাঁয়ে একবার।
        গাড়ি এসে থামলো গেটের সামনে,জানি কেউ অপেক্ষা করার মত আর নেই। হঠাৎই দেখলাম ভাইবৌ বসে আছে বাইরে আমাদের অপেক্ষায়, মনে হল কত কথা। তারপর মনে হল যাক কেউ তো আছে অপেক্ষায়। কিছুটা সময় মনকেমনের অলিন্দে হেঁটে ফিরে আসা কিছু স্মৃতি নিয়ে।
      ভাইবৌ যত্ন করল,জেঠতুতো বৌদির সাথে গল্প হল তবে কোথাও যেন রয়ে গেল কিছু হারিয়ে ফেলার কষ্ট। ততক্ষণে প্রায় সন্ধ‍্যে হয় হয়। আমাদের তুলহীহাটা হয়ে যেতে হবে কালিয়াগঞ্জে তাই আর দেরী করা যাবে না,এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। আমার দুই খুড়তুতো ভাই ডঃ,বড় ভাই মাটন রান্না করে ওর সহকারীকে দিয়ে গেছে। সেটা নিতেই হবে,ও বারবার ফোন করছে,তাই ওটা চাঁচলে নিয়ে রওনা দিলাম তুলসীহাটা। আমার কর্তামা(ঠাকুমা) এখানকার মেয়ে। তাঁর বিয়ে হয়েছিল আট বছর বয়েসে আর তাঁর বোনের বিয়ে হয়েছিল তিন বছর বয়েসে একই বাড়িতে জেঠতুতো খুড়তুতো ভাইয়ের সাথে। আমার ঠাকুমার বোনকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন কোলে করে নিয়ে ঘুরত। ভাবলেই অবাক লাগে এখন। অদ্ভুত রসিক ছিলেন এই কর্তামা। আমরা মাঝেমধ্যে কর্তামার কাছে শুতাম আর গল্প শুনতাম। মামা বাড়িতে যাওয়া খুব পছন্দের ছিল আমার বাবার। সব মামাই খুব ভালোবাসতেন তাঁকে। তারমধ্যে ছোটমামা আবার বাবার চেয়েও বয়েসে ছোট। তাই তাদের মধ‍্যে দোস্তি ছিল খুব। দাদু আমাকে দিদিমণি বলেন,আজও কাঁদেন বাবা মায়ের জন‍্য। বলেন তোমার মধ‍্যে ওদের দেখি আমি দিদিভাই।
       কিছুটা সময়ে দাদুর সাথে কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম কালিয়াগঞ্জের দিকে,এখানে এসে এবার শান্তি। অনেক দৌড়ঝাঁপ করার পর একটু বিশ্রাম। আমার এবাড়ির ভাইবৌটি খুবই অতিথি বৎসল। তার যত্ন অতিরিক্ত দিদিকে খাওয়াবে বলে সে পিঠে পায়েস পাটিসাপটায় ঘর ভরিয়ে রেখেছে। সবার আদর ভালোবাসায় দুটো দিন কাটিয়ে ফিরে আসা বাড়িতে। আবার পরের ধাপ নেমন্তন্নের,সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

    মেয়েদের কাছে বাপের বাড়ির স্বাদ বড় মিঠে,কোথায় লাগে তার কাছে পায়েস আর পিঠে? মা বাবাহীন বাপের বাড়ির পানে যেতে যেমন পা ওঠে না,তেমনি ফেরার সময় আবার জড়িয়ে পড়ি নিকট আত্মীয়স্বজনের মায়ায়। আমার ছোট পিসিমা,বাবাদের পাঁচ ভাইবোনের সবচেয়ে ছোট। ছোট কাকু আর পিসিই বর্তমানে আছেন বাবাদের ভাইবোনদের মধ‍্যে। আমি যখন জন্মাই তখন মা চাকরী করতেন। আমার জন্ম মালদা হসপিটালে,আমার জন্মের আগে আমাদের বাড়িতে জ‍্যাঠামণির ঘরে দুই মেয়ের জন্ম হয়ে গেছে। সুতরাং আমার কর্তামার বিশেষ আশা ছিল যে বাড়িতে এবার ছেলের জন্ম হোক। পুত্র সন্তানই বংশ রক্ষা করবে,এখনও তো তা হল না। তবে আমার কালো মা যখন আমাকে প্রসব করলেন তখন কর্তামা খুবই মুষড়ে গেলেন আবার মেয়ে হল বলে। কাঁদলেন শোকে যে আর বুঝি বংশরক্ষা হল না। বড় বৌমার পর মেজোবৌমাও মেয়ের জন্ম দিলো? তবে কর্তামা মুখ ফিরিয়ে থাকেনি বাসে উঠলেই বমি করে নাকাল হওয়া সত্ত্বেও আমাদের গ্ৰামের বাড়ি থেকে এলেন শহরে মেজো ছেলের প্রথম সন্তানকে দেখতে। আমি বেশ বড়সড় চেহারা নিয়ে জন্মে মাকে খুব কষ্ট দিয়েছিলাম। তবে গায়ের রঙ তখন নাকি ফর্সা ছিল বাবার মতই। তাই দেখে কর্তামা খুশি হয়ে বলেছিলেন,' বিছানায় ফুল ফুটে আছে মনে হচ্ছে।'
    জীবনের কন্টকময় পথে চলা আমি ফুল হয়ে গেছিলাম ঠাকুমার কাছে। মায়ের তখন ওল্ডমালদায় চাকরি,ভাড়াবাড়িতে ঠাঁই। ছোট পিসিকে গ্ৰামের বাড়ি থেকে পড়াশোনার জন‍্য রাখা হয়েছিল সেখানে। তার সাথে রাখা হয়েছিল রমা পিসিকে,আজ সেই মুখটা অনেকদিন না দেখায় খুব অস্পষ্ট। রমা পিসি আর আমার ছোটপিসির কাছে আমি তখন একটা ছোট্ট পুতুল। ছোটপিসির মন ছিল ঘরকন্নার দিকেই বেশি তাই পড়াশোনা খুব একটা এগোলো না। আমার যখন ছয় মাস বয়েস তখন বাবার চাকরি বদল হল। তার অস্থায়ী চাকরি চলে গেছিল কিছু শিক্ষকের চক্রান্তে। বাবা হরিশ্চন্দ্রপুর হাইস্কুলে পড়তেন সেখানে হেডমাস্টার মশাই ছিলেন মহেন্দ্র কুমার ভাদুড়ী তখনকার সময় এখনকার মত ছিল না। হেডমাস্টার মশাই চাকরি দেবার ক্ষমতা রাখতেন। তিনি বাবাকে ভালুকা রাইমোহন মোহিনী মোহন বিদ‍্যাপীঠে জয়েন করতে বললেন। প্রত‍্যন্ত গ্ৰামে একটা বড় উচ্চমাধ্যমিক স্কুল,তবে বাবাকে বললেন..' আমাদের স্কুল কো এডুকেশন কিন্তু কোন মহিলা টিচার নেই,তুই যদি বৌমাকে এখানে আনিস তোর চাকরি এখনই পার্মানেন্ট করে দেব।' 
শহরে থাকার ইচ্ছে ছিল বরাবর বাবার তাই রাজি হতে মন চাইলো না। মাকে বললেন,' তুমি এখানেই থাকো মেয়ে নিয়ে আমি প্রতি সপ্তাহে বাড়ি আসব।'
   মায়ের কাছে শুনেছি তখন সারাদিনে মাত্র একটা বাস আর একটা ট্রেন চলত ওখানে আসার। স্টেশন বেশ দূরে,বাবার শনিবার স্কুল করে পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে যেত। ছোট বাচ্চা নিয়ে মায়ের সপ্তাহ ফুরোতে চাইত না। একটা রাত কোনমতে কাটিয়ে আবার পরদিন বিকেলে রওনা দিয়ে রাতে কর্মস্থলে ঢোকা। তার মধ‍্যে আমি তখন প্রায় জ্বরে ভুগতাম তাই মা আর একা একা পেরে উঠছিল না। তাই বাবার আপত্তি সত্ত্বেও আমাকে ছমাস বয়েসে কোলে নিয়ে ওল্ড মালদার পাট চুকিয়ে চলে এল ভালুকা বাজারে। মায়ের বয়স তখন কত হবে? মনে হয় বাইশ তেইশ। প্রত‍্যন্ত গ্ৰামে তখন হায়ার সেকেন্ডারী স্কুল,মা বাবা সংসার পাতলেন একদম স্কুল লাগোয়া হস্টেলের একটা ঘরে। খাওয়া দাওয়া হত হস্টেলে। তারপর কয়েক মাস বাদে উঠে এলেন স্কুল লাগোয়া ঘরে ভাড়া নিয়ে। সেই থেকে ঠিকানা হল ভালুকাবাজার। আমার গ্ৰামবিমুখ বাবা ভালোবেসে ফেললেন গ্ৰামটাকে আর গ্ৰামের মানুষগুলোকে। নিজের অত‍্যন্ত কম টাকা মাইনে থেকে সাধ‍্যমত সাহায্য করতেন ছাত্রছাত্রীদের। কত ছাত্রকে দেখেছি আমাদের বাড়িতে খেয়ে স্কুলে গিয়ে ক্লাস করেছে। পাড়া প্রতিবেশী বৌদের মা দিতেন শাড়ি জামা। ওরাই হয়ে উঠলো আমাদের সুখ দুঃখের সঙ্গী। এই স্কুলের হেডমাস্টার মশাই যেহেতু বাবার শিক্ষক ছিলেন তাই মা ঘোমটা দিয়ে স্কুলে যেতেন তাঁকে সম্মান দেখাতে। তাছাড়া হয়ত এই ঘোমটা তখন সম্মানের এক অঙ্গও ছিল। ছাত্রছাত্রীরা মাকে যেমন ভয় পেত তেমন শ্রদ্ধা করত মাকে। একা মহিলা শিক্ষিকা হয়েও দাপটে পড়াতেন ছাত্রছাত্রীদের মা দুর্গার মত,কখনও তাঁর চোখে থাকত শাসন আবার কখন স্নেহ।
    আমি ছোট বলে মাকে টানা ক্লাশ নিতে দিতেন না হেডমাস্টার মশাই। তখন আয়া কালচার ছিল না,আমাদের গ্ৰামের বাড়িতে অনেক লোকজন থাকলেও আমাকে দেখার জন‍্য এখানে এসে থাকা আর কারও পক্ষে সম্ভব হল না। আমাকে দেখার জন‍্য একটা ছোট মেয়েকে রাখা হয়েছিল মায়ের কাছে শুনেছি। তখন শিশু শ্রমিক নিয়ে কড়াকড়ি ছিল না। এমন ছোট মেয়েরা অনেক বাড়িতে কাজ করত। ওর নাম ছিল শুটকি,মায়ের কাছে শুনেছি। ও আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরে ডেড়াতো,কখনও আমাকে ভুলিয়ে রাখতে বারান্দায় বসে থাকতো। বাবা মা ক্লাস নিতে নিতে জানলা দিয়ে দেখতে পেত আমায়। আমাদের বাড়ি আর স্কুলের মাঝখানে মাঠ ছিল। বাবার মনের সেই ব‍্যথা আমি অনেক বড় হয়েও শুনেছি। প্রায় বলতেন,' জানলা দিয়ে চোখে পড়ত ছোট মেয়েটা অসহায় ভাবে বসে ধুলোমাখা বারান্দায় বসে খেলছে,কখনও ধুলো মাখছে। কী যে কষ্ট হত তা বলার নয়।'

    হয়ত এর নামই পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব,আমি পরে বাবাকে বলেছি,' তুমি তো তাও আমাকে দেখতে পেতে জানলা দিয়ে। আর এই যে আমি তোমার নাতিকে ফেলে কত দূরে চলে যাই কোন ভোরবেলায়..'
   আমার ছেলে বড় মা ন‍্যাওটা ছিল ছোটবেলায়। এক মুহূর্ত তার মা ছাড়া চলত না। আমার বরাবর মর্ণিং স্কুল আমি ওঠার আগে থেকেই সে উশখুশ করে আমাথ জামা আকড়ে ঘুমোতো,পাছে আমি উঠে পড়ি। সে এক বিপত্তি,কখনও আমি হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে ঘুরতাম যাতে সে খাট থেকে আমাকে দেখতে না পায়। তারপর হঠাৎ দেখতাম সে উল্টো হয়ে বুকের ভরে উঠে ঘাড় উঁচু করে আমাকে দেখছে। তারপর শুরু হত চিল চিৎকার। এমন বায়না মিটিয়েছি দিনের পর দিন,তারপর দেরি হয়ে গেছে দেখে ছুটতে ছুটতে এগিয়ে গেছি বাসস্ট্যান্ডে। হেডমিস্ট্রেস খুব কড়া ছিলেন,এক মিনিট লেটে গেলেও লাল কালি দিতেন। বাস দেরি করলে বুকের ভেতর ঠান্ডা হয়ে যেত। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কত আছাড় খেয়েছি। এখন এই করে পা আর চলতে চায় না। যেই পা নিয়ে একটা সময় যা খুশি করে বেরিয়েছি,বলতে গেলে অপব‍্যবহার করেছি। এখন তাকে অতি সাবধানে নিয়ে পথ চলতো হয়। জীবন তো চলার পথে কত কী কেড়ে নেয়..কত শ্রম আর ভালোবাসা একটা সময় মূল‍্যহীন হয়ে যায়। কে তার দাম দেয়? এখনকার মেয়েরা অনেক ভালো আমি বলব। আমরা বোকা ছিলাম,আমাদের চেয়েও বোকা ছিল আমাদের মা আর ঠাকুমা। তবে এই বোকা মানুষগুলোর জীবনে সুখ ছিল,হাসি ছিল, গল্প ছিল। এখনকার মত স্ট‍্যাটাস দেখানো,ব্লক,ব্রেকআপ ছিল না।
      একটা সময় এসে জীবনকে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে,তখন আর সুখের দিনের জন‍্য অপেক্ষা না করে। সুখের দিনগুলো রিওয়াইন্ড করে দেখাই ভালো।
      বাবার কথায় ধুলোতে বসে থাকা সেই মেয়ে আমিও একটু একটু করে বড় হলাম। বাজার তখন খুব সস্তা,মা রান্না করত কয়লায়। আমাদের রান্নাঘরে ঘুঁটেও থাকতো। ওখানে বিকেলে বাজার বসত আর মঙ্গলবারে বালুপুরে হাট। তখন আমাদের ফ্রীজ ছিল না। বাবা বিকেলে বাজার নিয়ে এলে মা কিছু মাছ রাতে টাটকা রান্না করে কিছু মাছ পরের দিনের জন‍্য ভেজে রেখে দিত মিটসেল্ফে। পরের দিন আবার সেই মাছের ঝোল হত। মাকে পরে জিজ্ঞেস করেছি কেমন ছিল মায়ের প্রথম সংসারের দিনগুলো?
  মা বলত,' শাড়ি খুব ভালো পরতে পারিনি,তখন খুব হাল্কা রঙের চল ছিল। বিয়েতে রোলেক্স বেনারসী পরেছি তাও আবার ঘিয়ে রঙের। তবে খাওয়ার কষ্ট কোনদিনই পাইনি রে। আমার বাবা তোর দাদুকে বলেছিলেন মেয়ে আমার মাছ ছাড়া ভাত খাইতে পারে না। এখানেও প্রচুর মাছ খেয়েছি। একপোয়া চিংড়ি কত কম দামে তোর বাবা আনত,খেয়ে শেষ করতে পারতাম না।'
-আর আমি খেতাম না?
-'তুই তো তখন ছোট।'
-আর শুটকি?
-' শুটকি তোকে একটু বড় করেই চলে গেলো। ওর দোষ নেই ওর মা ওকে রায়গঞ্জে দিল কাজ করতে। সেই মেয়ের কী কান্না। আমি ওকে কানের মণিপুরী দুল করে দিয়েছিলাম। তারপর অনিল বলে একটা ছেলেকে রাখলাম,ও বেশ কিছুদিন কাজ করেছিল।'
           আমার ছোটপিসির কথা বলতে বলতে অনেক গল্প করে ফেললাম। আমার যখন তিনবছর বয়েস তখন নাকি পিসির বিয়ে হয়েছিল। আমার পিসি অনেক লম্বা,আমার বাবা কাকারা সবাই খুব লম্বা। সবাই মোটামুটি ছয়ফুট,পিসিও পাঁচ সাতের বেশি। পিসির আর বর পাওয়া যায় না,ছোট পিসি সবার ছোট তাই খোঁজ চলতে লাগলো। কিন্তু ঐ যে বলে কপালে যার যেখানে লেখা। অনেক খুঁজে পিসির বর পাওয়া গেল,পাত্র ফুটফুটে ফরসা,কটা চোখ খুবই ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ কিন্তু উচ্চতায় পিসির থেকে ছোট। সেই পিসামশায়ের সাথে পিসির সংসার করা হয়ে গেল প্রায় চুয়ান্ন বছর। পিসামশাই চোখে খুব ভালো দেখেন,এখনও খালি চোখে সব দেখেন কিন্তু কানে কিছু শুনতে পান না। পিসি আর পিসামশাইয়ের বয়েসের ফারাক ছিল অনেকটা। আজকাল পিসামশাইয়ের জন‍্য পিসির আর কোথাও যাওয়া হয় না। আমার বাবার খুব আদরের বোন পিসি,আর মেজদার কোন কথার অবাধ‍্য হবার ক্ষমতা পিসির ছিল না। পিসির অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। আমাদের গ্ৰামের পিসির সমসাময়িক এবং বড় আর ছোট সবার বয়েস তাঁর মুখস্থ।
   আমার ছেলে হবার পর পিসি এলেন আমার ছেলেকে দলাই মলাই করে পালোয়ান তৈরী করতে। তখন আমরা রেল কোয়ার্টারে থাকি। সেখানে রীতিমত মাটির হাড়িতে করে ঘুটের আগুন করে পিসি দক্ষ হাতে ছেলেকে মালিশ করে সেঁকে দিতেন আগুনে। কয়েকদিনের মধ‍্যে বেশ মোটকু সোটকু হয়ে উঠলো ছেলে মালিশ দিদার যত্নে। মেয়ে হল ছেলে হবার তিন বছর বাদে। আবার পিসি এলেন,মেয়েও শক্তপোক্ত হল পিসির সেবাযত্নে। ওরা আমার ছোট পিসিকে মালিশদিদা বলে আর পিসামশাই ওদের মালিশদাদু। পিসির অনারে পিসামশাই মালিশদাদু উপাধি পেলেন।
     ছেলের বিয়েতে পিসির আসা হল না,পিসামশাই এখন খুব স্লো হয়ে গেছেন চলতে ফিরতে খুব অসুবিধা। ছেলে বারবারই বলছিল কিন্তু কিছু করা গেল না। হয়ত মামার বাড়ির যত্ন আর পিসির বাড়ির আহ্লাদ পাই বলে আজও যাই মালদাতে। পিসামশাই আমার বরকে বলেন,' ওকে একটু দেখো শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে মেয়েটার।'
    মন ভিজে যায় এইটুকু কথাতেই,আপনজনেদের আদর আর যত্ন যে বড়ই মিষ্টি মধুর। এবার পিসির বাড়ি থেকে আসতেও তাই চোখ ভিজল।

        তখনও অনেক নেমন্তন্ন বাকি এদিকে দিন এগিয়ে আসছে। ননদদের বায়না হল যখন আমরা শাশুড়ির বাপের বাড়ির দিকটা মানে নৈহাটি,কাঁচড়াপাড়া আর হালিশহরে নেমন্তন্ন করতে যাবো ওরাও সবাই সাথে যাবে। ছেলের বিয়ে তাই সবাইকে আনন্দ দেবার চেষ্টা করব আমার মত করে। সুতরাং এই দাবী মেনে নেওয়া হল,সবাই মিলে একটা বড় গাড়ি ভাড়া করে চললাম নেমন্তন্ন করতে। এতগুলো মানুষজন নিয়ে নেমন্তন্ন করতে যাওয়া হয়ত বা বিপত্তির কারণ হতে পারে যাদের বাড়িতে যাচ্ছি তাদের কাছে। একজন তো মোটামুটি শুনে না করে দিল,বললো ই কার্ড পাঠিয়ে দিলেই হবে। তারা নাকি থাকবে না। আমিও নাছোড়বান্দা খুটিনাটি জানলাম খুটিয়ে যে কেন তারা থাকবে না,কখন বেরোবে আর কখন ফিরবে? তা শুনে বলেই ফেললাম তোমরা যাবার আগেই যাবো,তারপর একটু বসেই বেরিয়ে যাবো কারণ আমাকে অনেক জায়গায় যেতে হবে। অগত‍্যা তারা মত দিল। আমার যাওয়ার উদ্দেশ‍্য ছিল ওদের উপহারটা হাতে হাতে দেবার জন‍্য। সেদিনও সাথে অনেকগুলো শাড়ি। এভাবেই সব বাড়ি বাড়ি ঘুরে নেমন্তন্ন করতে করতে আমরা যা প্ল‍্যান করেছিলাম বাইরে কোথাও খেয়ে নেব দুপুরে,অযথা লোকের ভয়ের কারণ হব না। তার আর দরকার হল না। কোথাও লুচি,কোথাও কচুরী আবার কোথাও বা পিঠে পায়েস আর কেক খেয়েই আমাদের পেট ফুলে ঢোল। প্রায় বারোটার সময় এসে বাড়িতে ঢুকলাম নয় বাড়িতে নেমন্তন্ন করে। আমার ছোট ননদাই ভীষণ রগুড়ে মানুষ, ননদরাও একসাথে থাকলে বেশ মজা করে। তাই সারাটা পথই কেটে গেল হাসি মজাতে। 
      তারমধ্যে ননদাই আমার এক দেওরের বাড়িতে গিয়ে যা কান্ড করল তা দেখে আমি আর আমার মেয়ে হাসতে হাসতে মরি। ওদের বাড়িতে একটা পাগ কুকুর ছিল,অবশ‍্য আমি এই প্রথম গেছি ওদের বাড়িতে। আমার জা কুকুরটাকে এনে বিছানায় রেখে চা করতে যাবে,দেখি কুকুরটা মুখ দিয়ে হ‍্যা হ‍্যা করে একটা আওয়াজ করছে। আমি প্রাণীচরিত্র সম্বন্ধে অতটা ওয়াকিবহাল নই তাই জাকে জিঞ্জেস করলাম ওর কী শ্বাসকষ্ট হচ্ছে? জা বললো না ও এমনি করে,এটা ওর অভ‍্যেস। জা চা করতে গেলো,বেচারা পাগ যথারীতি মুখ দিয়ে হ‍্যা হ‍্যা আওয়াজ করতে লাগলো। ওকে দেখিয়ে আমার ননদাইও সেম আওয়াজ আরও জোরে বেশ কয়েকবার করল। আর কোথায় যায় একদম চুপ কুকুরটা,তারপর থেকে আড়চোখে চেয়ে থাকলো আমার ননদাইয়ের দিকে। অভ‍্যেসবশত কয়েকবার মুখ দিয়ে আওয়াজ বের করতে গিয়েও আবার চুপ করে গেল ওকে দেখে। শেষে সরে গিয়ে দেওয়ালের সাথে গিয়ে বসলো বালিস ডিঙিয়ে। আমার জায়ের মেয়ে একটু বাদে এসে ওকে সামনে টানতে গেলে কিছুতেই আসতে চাইলো না,নখ দিয়ে চাদর টেনে রইলো।
   ওর চাউনি আর কান্ড দেখে আমরা হেসে বাঁচি না,শেষে অনেক টানাটানি করে ওকে সামনে আনা হল। আমার ননদাই আসার সময় বলে এলো,' ওসব করতে নেই,ওগুলো বাজে অভ‍্যেস। ভালো ছেলেরা ওসব করে না।' আর আমার মেয়ে একদম হেসে কুটোপাটি। যা শিক্ষা পেয়েছে আর বোধহয় মুখ দিয়ে শব্দ বের করবে না ও।
       আমাদের নেমন্তন্ন করতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সত‍্যিই গোল্ডেন মেমোরি হয়ে রয়ে গেলো।

      একটা বিয়েতে তো কম কাজ থাকে না,নেমন্তন্ন শেষ হলে বসলাম তত্ত্ব নিয়ে। ছোট ননদাই খুবই ভালো তত্ত্ব সাজায় কিন্তু বেচারাকে আর কষ্ট দিলাম না। বর অনেক আগেই কিনে এনেছিল তত্ত্ব সাজানোর সামগ্ৰী,সেগুলো নিয়েই বসলাম আমার কর্তার ছোটবেলার বন্ধু তপুর সাথে। আলমারী থেকে একে একে নামিয়ে ফেললাম এতদিনে যা কিনেছি একটু একটু করে। ও দেখে অবাক হল,এত জিনিস আমি কিনেছি। তবে ঐ যে সাধ মনে থাকে আর সেই সাধ পূরণ করতেই কখনও ছুটে গেছি উত্তরে আবার কখনও দক্ষিণে। আবার কখনও জামাকাপড় কিনেছি অনলাইনে। ব‍্যাগ,ছাতা,শীতের জামা,শাড়ি,কসমেটিকস, শাল,পঞ্চু,সোয়েটার আরও কত কী সাজগোজের জিনিস। দুজনে মিলে গল্প করতে করতে সুন্দর গুছিয়ে নেওয়া হল তত্ত্ব দুই তিন ধরে। ক‍্যালেন্ডার কেটে কেটে তাতে নাম্বারিং করলাম। মনে পড়ে গেলো আমার বিয়ের কথা আমার বিয়েতে গ্ৰামের বাড়িতে বরযাত্রী এসেছিল কলকাতা থেকে। তারা যেভাবে তত্ত্ব সাজিয়ে দিয়েছিল তাতেই আমাদের পাড়ার লোকজন মুগ্ধ হয়ে গেছিল। আমার বিয়ের ছয় সাত বছর আগেই জেঠতুতো দিদিদের বিয়ে হয়েছিল সেই সময় একটা ভিআইপি সুটকেসে করে একটা দুটো শাড়ি,সায়া,ব্লাউজ আর সাজগোজের জিনিস দেওয়ার চলই ছিল বেশি। আর অবশ্যই সেই বাক্সে থাকত একখানা বল খোঁপা বাঁধার বল। এখন যা মডার্ন বানের রূপ নিয়েছে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে আমার পরিচিত দোকান থেকে বান কিনে আমি বুদ্ধু হয়েছিলাম। কোনমতেই তাকে সাইজ করতে না পেরে অগত‍্যা ফেলে দিয়েছিলাম। একটা সময় কাজে এসে গেল ইউটিউব,ওখানেই শিখলাম বান দিয়ে কি করে পাতলা চুলকে ম‍্যানেজ করে সহজেই খোঁপা বাঁধা যায়। তারপর আবার কিনলাম বান,প্রথমে একটু আয়ত্ত করতে অসুবিধা হলেও এখন বেশ পারি ঐ খোঁপা বাঁধতে।
     আমার ছেলের বিয়ের তত্ত্বে মেয়ে একটা হাঁস বানিয়ে দিল তোয়ালে দিয়ে। আমার বিয়েতে ওরা বেড়াল বানিয়ে দিয়েছিল। আমসত্ত্ব আর আপেল দিয়ে বানিয়েছিল তবলা ডুগী। আমি অত কিছু করলাম না,শোলার রঙীন বল দিয়ে আর সেলোফেন পেপার দিয়ে মুড়ে দিলাম জিনিস ভরে ট্রে গুলোকে। তপু লাগিয়ে দিল ওপরে রিবন আর ফুল। বেশ ভালো হল সাজানো। নম্বরও দেওয়া হল একদম সিরিয়ালি যাতে সব ঠিকমতো যায়।
        স্পেশাল মিষ্টি,দই,চিত্রকূট,সন্দেশের অর্ডার দেওয়া হল,সাজানো হল ড্রাইফ্রুটস আর নোনতা এবং শুকনো মিষ্টির ট্রে। একটা ট্রলিতে রাখা হল বাসী বিয়ের সাজ। তাতে নম্বর দেওয়া হল ৩৩।
      সবাই মিলে গল্পে গল্পে কাজ করতে বেশ লাগলো। সুব্রতদা তত্ত্বসূচীতে কী আছে তা লিখতে লাগলেন। আমার বর যে তত্ত্বসূচী এনেছিল তা বড়ই ছোট। তাই
নতুন করে তত্ত্বসূচী বানানো হল একটা ডেট ক‍্যালেন্ডার দিয়ে। তাপসদার সূক্ষ্ম আর সুচারু হাতে তা হয়ে উঠলো অসামান্য।
     এই তত্ত্ব বলতে গিয়ে যেমন আমার বিয়ের কথা বললাম তেমন আমার মায়ের বিয়ের কথাও বলি। আমাদের দেশের বাড়িতে তখন সেভাবে গায়ে হলুদের তত্ত্ব যেত না। বরং একদিন ছেলে আশীর্বাদ আর আরেকদিন মেয়ে আশীর্বাদ হত। সেইসময় দারুণ খাওয়ানোর ব‍্যবস্থা করা হত। পুকুর থেকে উঠত জ‍্যান্ত মাছ। বাড়িতে ভিয়েন বসত,ঠাকুর রাঁধত সকালে জলখাবারে লুচি থেকে নানান পদ।
       আশীর্বাদ মানেই ছোটখাটো একটা বিয়ে,তখন রেজেস্ট্রীর চল ছিল না। আশীর্বাদ হয়ে যাওয়া মানেই পাত্র বা পাত্রী বুকিং ফাইনাল। অবশ‍্য এই ফাইনাল বুকিংয়ের পরও ক‍্যানসেল হত বুকিং। আমার জ‍্যাঠামণির ঘটা করে আশীর্বাদ হওয়ার পরেও বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল।
        আমার মায়ের আশীর্বাদও নাকি ঘটা করে হয়েছিল। আমার বড় মামীমার কাছে সেই গল্প শুনেছি অনেকবার। তখন ট্রেতে করে মেকি তত্ত্ব সাজানোর ব‍্যাপার ছিল না। তবে দেখানোর বিষয়টা সব জায়গাতেই সব সময়েই ছিল। আমার ঠাকুরদা গ্ৰাম থেকে টিনে করে ক্ষীর পাঠিয়েছিলেন পাঁচ টিন,তার সাথে পাঁচটিন রসগোল্লা,কুড়িকেজি মাছ,দশকেজি মুগডাল,আতপচাল,ক্ষেতের সব্জি আরও কত কী যে এসেছিল তার কোন শেষ ছিল না। মামী বলেছিল যে যা জিনিস এসেছিল তাতে আরেকটা বিয়ে হয়ে যেতে পারত দিব‍্যি। মামীর সেই গল্প অবাক হয়ে শুনতাম আমি।
    আমার বিয়েতেও গ্ৰামের বাড়িতে ভিয়েন বসেছিল,নানা পদের মাছ হয়েছিল। তবে বাড়িতে গোপাল গিরিধারীর মূর্তি থাকায় এবং সেই বিগ্ৰহের সামনে আমার বিয়ে হওয়ায় বাড়িতে মাংস হয়নি।
    কলকাতা থেকে ট্রেনে বরযাত্রী এসেছিল সুতরাং তারা সকালেই পৌঁছে গেছিলো বিয়েবাড়িতে। ভাবুন একবার একশো জন বরযাত্রী সকাল থেকে বাড়িতে। ঠাকুমা মানে আমার কর্তামা বিয়ের প্রায় পনেরো দিন আগে থেকেই ক্ষীর জ্বাল দেওয়া শুরু করেছিলেন। কর্তামার হাতের ক্ষীর ছিল অপূর্ব খেতে। একটানা নাড়তে হত ঐ ক্ষীর লোহার কড়াইয়ে বসিয়ে।
       মায়ের ইচ্ছে ছিল সকালে বরযাত্রী আসবে ট্রেন জার্নি করে সুতরাং তাদের ফলার খাওয়ানো হবে। আমাদের বাড়িতে শোবার ঘরেও মুড়ির টিন থাকতো। মানে বিয়ের জন‍্য সারি সারি মুড়ির টিন। আমার ননদাইরা দেখে খুব মজা পেয়েছিল অত মুড়ির টিন।
     বরযাত্রীদের জন‍্য খই,মুড়কি,মুড়ি,মিষ্টি,কলা ইত‍্যাদি ব‍্যবস্থা করা হল। তবে ক্ষীর পাতে দেবার সময় হল বিপত্তি। পরিবেশন আমার মা করছিলেন,সবাই হাত নাড়ছে দেবেন না দেবেন না। কেউ বা বলছে প্রসাদ তো,মানে সিন্নী তাই একফোঁটা দিন মাসিমা।
    মাসিমা মিটিমিটি হেসে বললেন,' ঠিক আছে একফোঁটা দিলাম একটু মুখে দিন।'
    তারপর মুখে দেবার পর যা হল তা বলব পরের পর্বে।

**********************
  আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমার মায়ের বয়েস পঁয়তাল্লিশও হয়নি,তখন মায়ের কত উদ‍্যম তা ভাবলে অবাক লাগে এখন। অবশ‍্য তখন তেমনি ছিল,আমার মায়ের আগের জেনারেশন মানে আমার কর্তামা যখন মেয়ের বিয়ে দেয় তখন তাঁর বয়েস তেত্রিশ আর ছেলের বিয়ের সময় ছত্রিশ। আমার কর্তামাকে আমি কখনও সাদা বা ঘিয়ে শাড়ি ছাড়া পরতে দেখিনি। সবসময় দেখেছি পাড় ওয়ালা তাঁতের শাড়ি পরতে। আমরা তখন ছোট তবে তাঁর সন্তানেরা কখনও ভাবেনি হয়ত শাশুড়ি বা ঠাম্মা হয়ে যাওয়া মহিলার বয়েস কত? শাশুড়ি হওয়ার শিলমোহর তাঁকে মুড়িয়ে দিয়েছিল আপাদমস্তক শাশুড়িয়ানাতে। আমাদের ভালো লাগত,আমারই মত অনেকটা গোলগাল কর্তামাকে চওড়া পাড় তাঁতের শাড়িতে দেখতে। আমার কর্তামার নাম ছিল সাবিত্রী,গায়ের রঙ চাপা তবে মাথাভর্তি চুল। কর্তামার সেই চুল আমরা কেউই পাইনি। সেই চুলের বোঝা বইতে বিরক্ত হয়ে উঠত একসময়। তখন হেয়ার স্পা,স‍্যালন,শ‍্যাম্পু ইত‍্যাদি ছিল না। ঠাকুমাকে দেখতাম লাইফবয় সাবান দিয়ে মাথা ঘষতে। এই একটা সাবান যা অনায়াসেই মানুষ মুখে,গায়ে আর মাথায় মাখতো। গ্ৰামের বাড়িতে ঋতুস্রাব হওয়ার পর নারীর শুদ্ধিকরণে মাথায় সাবান দিতে হত‍। সেক্ষেত্রে দেখতাম সরষের খোল ভিজিয়ে মাথার সামনে দিতে। কেউ মারা গেলেও একই ভাবে শুদ্ধিকরণে খোল ভেজানো দিয়ে মাথা ঘষতে হত। আমিও ছোটবেলায় দিয়েছি সরষের খোল মাথাতে। এতে চুল সিল্কের মত চকচক করত। চুলে সুন্দর একটা তেলভাব থাকত তার সাথে।
     ঠাকুমার কানে থাকত কানপাশা,হাতে শাঁখা পলার সাথে বাউটি আর গলাতে সাবিত্রী বিছে। ছেলের বৌরা তাড়াতাড়ি এসে যাওয়াতে ঠাকুমার রিটায়ারমেন্ট হয়ে গেছিল রান্নাঘর থেকে। অদ্ভুত এক ছেড়ে দেবার প্রবণতা ছিল তাঁর। তবে বাড়িতে আসা চাল,মুড়ি আর ফসলের হিসাব তাঁকেই রাখতে হত। বাড়িতে নাড়ু,মোয়া,পিঠে আর ক্ষীর হলে কর্তামাই বানাতেন বৌ আর মেয়েদের সাথে নিয়ে। সে এক উৎসব ছিল সবাই এক জায়গায় হলে প্রচুর জনসমাগম। আমার বড় পিসির ছয় সন্তান,জেঠামণির চার,বাবার একমাত্র সন্তান আমি,কাকুর দুই ছেলে,ছোট পিসির তিন সন্তান। সবাই এক জায়গাতে হলে বাড়িতে আনন্দের হাট বসে যেত।
        চালেরগুড়ো করতে পিসিরা আর দিদিরা চলে যেত যাদের বাড়িতে ঢেকি আছে সেই বাড়িতে। চালের গুড়ো এলে চলত পিঠে পুলি উৎসব। যেদিন পিঠে হত সেদিন আর রাতে ভাত হত না। আমাদের গ্ৰামের বাড়িতে দুধপুলি,পাটিসাপটা এসব ছাড়াও ভাকা নামে একটা পিঠে হত। এখন মালদা শহরে গেলে আমি দেখি জায়গায় জায়গায় ভাকা বানানো হচ্ছে। কেকের মতই এই পিঠে,চালেরগুড়ো শুকনো অবস্থায় থাকে যখন সেটাকে একটু একটু করে জল ছড়িয়ে রেডি করতে হয়। তারপর কলসীতে জল ফুটতে থাকে বাটির মধ‍্যে সেই গুড়ো দিয়ে তাতে গুড় দিয়ে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে একদম উল্টে বসিয়ে দেওয়া কলসীর মুখে। তারপর আলতো করে বাটি সরিয়ে নেওয়া। সেই ভাকা পিঠে ক্ষীর আর মাছের চচ্চড়ি দিয়ে খাওয়া ছিল অদ্ভুত এক পছন্দের মেনু আমার বাবার। এখনও স্মৃতির পাতা উল্টে চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই সব। বাবা কাকারা সবাই পরম তৃপ্তিতে বসে পিঠে খাচ্ছে আনন্দে। মা কাকীমারা পরিবেশন করছে। আর ওদিকে রান্নাঘরে পিসি,কর্তামা,জেঠিমা ভাকা বানাচ্ছে। কনকনে শীতে গরম পিঠে খাওয়া কত যে মিঠে স্বাদের ছিল তা বলে বোঝাতে পারব না।
     তবে আমার কর্তামার বানানো ক্ষীর আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা প্রথমে সিন্নি ভেবে না খেতে চাইলেও একফোঁটা পাতে নিয়েই আর নিজেদের সংযত করে রাখতে পারল না। তারপর আরেকটু চাই করতে করতে এত বেশি খেয়ে ফেললো যে সবার অবস্থা টাইট। তারপর দুপুরে দু রকমের মাছ আর রাতে ইলিশ আর চিতল খেয়ে মাঝরাতে বিয়ে দেখা শেষ করে যখন সবাই এসে শুলো তখন অনেকেই কুপোকাত পেটের সমস‍্যায়। মানে বাথরুমে যাচ্ছে আর আসছে। পাশেই আমার জ‍্যাঠামণির ডিসপেনসারি ছিল বলে বাঁচোয়া। সেখানে গিয়ে ওষুধ খেয়ে অনেকেই মুক্তি পেলো পেট কামড়ানো থেকে।
     অনেকগুলো বছর পেরিয়ে আজ আমিও শাশুড়ি। সদ‍্য ছেলের বিয়ে দিলাম তবুও আমার বিয়ের কথা আজও সবাই বলে। আমিও চেষ্টা করেছি একটু হলেও সেই আমেজ ধরে রাখতে আমার ছেলের বিয়েতে তবে যা যায় তা হয়ত সত‍্যিই যায়। তেমন আর কিছু হয় না যতই চেষ্টা করি না কেন।

         বিয়ের গন্ধ তখন ভাসছে আকাশে বাতাসে এতদিন যে কাজকে দূরে রেখে একটু একটু করে এগিয়েছি তা একদম দোরগোড়ায়। ছেলের ইচ্ছে বৌমা ওর কাজের জায়গার কাছাকাছি থাক। ওর তাহলে চাকরি করতে সুবিধা হবে। আমি মেনে নিলাম,মনে মনে ভাবলাম যেখানে থাকলে ওরা খুশি থাকে সেখানেই থাকুক। আমি ভালোবাসা জড়িয়ে থাকার দলে নই। বরং ভালোবাসার ঘুড়িকে আকাশে উড়তে দেখে তার আনন্দ দেখে শান্তি পাই মনে মনে। তবে সত‍্যিই কী তা শান্তি এনে দেয়? হয়ত বা দেয় না,তবে ভালোবাসা আকড়ে না থেকে ছেড়ে দেওয়াতে আমি বিশ্বাসী। যদিও এই পথে হাঁটতে গিয়ে ঠকেছি অনেক বার। যখন নিজের মানুষের ভালোবাসার রান্না করছি বাড়িতে ঘেমে নেয়ে তখন হয়ত আমার বিশ্বাস ভরা ভালোবাসা রান্না হয়ে যাচ্ছে অন‍্য কোথাও অবিশ্বাসের পাত্রে। তবুও আবার বারবারই সেই পথে হাঁটি মনে মনে এই কথাই ভাবি যা আমার তা আমারই থাকবে,তা কোথাও হারিয়ে যাবে না। যা আমার নয়,তা কোনদিনই আমার ছিল না,অযথা তার পেছনে কত সময় নষ্ট করেছি। তবে সে নিয়েও আক্ষেপ করি না যে কখন কী করেছি কার জন‍্য।হয়ত আমার কোন জন্মের ঋণ ছিল তাদের কাছে তাই তো ভগবান আমাকে দিয়ে এইসব করাচ্ছেন। নিজের ভাগ‍্যের জন‍্য কাউকে দোষ দিই না কখনও। কোনদিন যেমন বাবা মাকেও কিছু বলিনি এখনও বলি না সন্তানদের। আমি জানি আমার কর্মফল আমি ভোগ করছি,এই কর্মফল আমার একে আমাকেই খন্ডাতে হবে কর্ম দ্বারা প্রায়শ্চিত্ত করে। মানুষকে বিশ্বাস করে যখন ঠকেছি তাতে বিচলিত হইনি। তবে কষ্ট পেয়েছি খুব যখন নিজের মানুষদের কাছে ঠকেছি। উনত্রিশ বছরের ছেলেকে কোনদিনই কাছ ছাড়া করিনি। হয়ত আমার সৌভাগ্য যে আমার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা এবং কাজ সবই করেছে বাড়িতে থেকে।
        সেই ছেলেকে এবার ছাড়তে হবে,এগিয়ে দিতে হবে ওর সংসার জীবনের দিকে তা সহজভাবেই মেনে নিয়েছিলাম। যতই আমরা বলি শাশুড়ি বৌয়ের সম্পর্ক মা মেয়ের মত, আমি জানি তা কোনদিনই হয় না। আর হবেই বা কী করে? মা যে কষ্টে সন্তানকে মানুষ করেন তার কোন তুলনা নেই,এই মাতৃত্বকে যে সন্তান অস্বীকার করে সে ভুল করে বলে মনে করি। আবার নিজের সন্তানের ওপর যে অধিকার বোধ থাকে মায়ের তা কখনই জামাই বা বৌমার ওপর থাকে না। তবুও জাগতিক নিয়মে এই সম্পর্কগুলো আমরা চেষ্টা করি মিষ্টি মধুর করে গড়ে তোলার। তাই বৌমার কাছে এমন কোন আশা আমার নেই যে সে আমার মেয়ে হবে এবং নিজের ওপর তেমন ভরসাও নেই যে আমি তার মা হতে পারবো। বরং আমি চেয়েছি আমি বিয়ের পর বাসগৃহ সংক্রান্ত এবং যে পরিমাণ আর্থিক অনটন সয়েছি তা যেন আমার বৌমাকে সইতে না হয়। আজকাল তো নিজেকে মা হিসেবেই অযোগ্য মনে হয়,কী এমন করতে পারলাম সবার জন‍্য?
          বাসগৃহ বিহীন অবস্থায় ভাড়া বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসে একটা ঘরের মধ‍্যে আমি সাঙ্ঘাতিক কষ্ট করেছি আমার জীবনে। তবে নিজের উপার্জনে কলকাতা শহরে ঠিকানা বানাতে আমার কষ্ট হলেও তা পেরেছিলাম ধীরে ধীরে। তাই ছেলেকেও বললাম একটা ফ্ল্যাট তো ফাঁকাই পড়ে আছে,সেখানে তোরা থাকতে পারিস স্বাধীন মত। আমি নিজের জীবন থেকে আর শিক্ষকতা করার সুবাদে এইটুকু এখন অনুভব করতে শিখেছি যে স্বাধীনতা সবাই চায়, প্রতি মেয়েরাই স্বপ্ন দেখে তার নিজের একটা সংসার হবে। সেখানে পর্দার রঙ তার পছন্দের হবে। নিজের খেয়ালখুশিতে সে সেখানে থাকবে। আমাদের জেনারেশনের শিক্ষা আর সহনশীলতা এখনকার মেয়েদের সাথে মেলে না। আমাদের বাবা মায়েরা শিক্ষা দিয়ে পাঠিয়েছিলেন কখনও ঝগড়া করে বাপের বাড়ি আসবে না। আমাদের সময় ঝগড়াঝাটি হলেও তা চিঠিতে লিখে পাঠানো সম্ভব ছিল না। আর পাঠানো হলেও বাপের বাড়ি সেই ঝামেলার খবর যেতে যেতে ঝগড়া পুরোনো হয়ে ভাব জমে যেত। এখন মুঠোফোনের কল‍্যাণে সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে ঘুমোনো পর্যন্ত সব রোজনামচা বাপের বাড়িতে পাঠানো যায়। দরকারে ভিডিও কলে দেখানো যায় সবটুকুই। এই আধুনিকতার ভালো এবং খারাপ দুটো দিকই আছে। সুতরাং খারাপ শাশুড়ি হওয়ার দায়টুকু একটু হলেও নিজের মাথা থেকে সরানোর চেষ্টা করলাম। ছেলেকে চোখের আড়াল করতেও রাজি হলাম তাই জন‍্য। আর ছাড়তে তো শিখতেই হবে,এটাই তো জীবন দর্শন। একটু একটু করে কাটতে হবে সব বন্ধন নিজের হাতে আর তবেই হবে আমার মুক্তি। আজকাল কেন জানি না এই মুক্তির পথ চেয়ে থাকি। এমন সময় পেতে ইচ্ছে করে যেখানে থাকবে না কোন ভয়,অপরাধ বোধ,অবজ্ঞা,তাচ্ছিল‍্য আর শাসনের দায়ভার। কিন্তু পাই কোথায় এমন দিন? হয়ত বা যেদিন পরম করুণাময় ঈশ্বর তাঁর চরণে আশ্রয় দেবেন তখন তেমন দিন আসবে। কথাগুলো লিখতে চোখটা ছলছল করল,আসলে অনেক শোকতাপ পেয়েও যে নিজেকে ভালোবেসে একটু বাঁচতে ইচ্ছে করে। মরে যেতে চাই বলা সহজ,তবে সত‍্যিই কী আমরা মরতে চাই? অনেক তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, ষড়যন্ত্র আর অবজ্ঞা সয়েও এই শরীর সাজে নতুন শাড়িতে,মন ভুলে থাকতে চায় কখনও রান্নাবাটি অথবা গয়নার বাক্স সাজিয়ে নিজেকে ভালো রাখতে। কখনও বা চোখ ডুবে যায় বাসের জানলা দিয়ে দেখা অজানা পথে তারপর নিজেকে বোঝায় অনেক ভীড়ের মাঝেও কোথাও যেন আমরা একা। অনেক একা মানুষের ভীড়ে মিলে গিয়ে আমিও হেঁটে চলি একলা পথে আবার কাজ শেষে ফিরে আসি বাড়িতে।

       আমার আত্মীয়স্বজন আর আমি ছেলের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে ফ্ল্যাট ভরলো। বিয়ের ভাবনা থেকে ছেলেকে অব‍্যাহতি দিয়েছিলাম। বললাম ফ্ল্যাটটা মোটামুটি সাজিয়ে নে রঙ করে নিজেদের মত। সব সারা হলে একটা পুজো করলাম বিয়ের আগে দিয়েই। আমার প্রিয়জনেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই কাজও সুন্দর উদ্ধার করে দিল। ছেলে আর বৌয়ের নতুন আস্তানা ভালো লাগলো। আজ থেকে প্রায় বারো বছর আগে এই ফ্ল্যাট কিনলেও আমাদের থাকা হয়নি। অনেক কষ্ট করে কেনা প্রথম ফ্ল্যাটটা ভালোবাসা আমার সুতরাং সেটা ছেড়ে কখনই এখানে আসা হয়নি। ঠাকুরের চরণে প্রণাম করে বললাম সুখে সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক ওদের জীবন। আমাদের বিদ্ধিশ্রাদ্ধ আমরা বিয়ের একদিন আগেই মিটিয়ে নিয়েছিলাম। পুরোহিতের মত অনুযায়ী সবটাই হয়েছিল। সেদিনের জোগাড় ঠাকুরমশাই করলেন তবে সাথে ছিলেন তাপসদা আর তপু। আমিও শেষ স্কুলে জয়েন করে এলাম বিয়ের আগে। আপনজনকে জল দিলো আমার ছেলে। আমার বাবার খুব ইচ্ছে ছিল নাতির হাতে জল নেবেন এতদিনে বোধহয় সেই আশা পূরণ হল। বাবা আর মা দুজনেরই শেষ কাজ আমিই করেছিলাম। বাবার ধুতি পাঞ্জাবী পরেই সব কাজ করল ছেলে। অনেক আনন্দের মধ‍্যেও চোখে জল এল। কষ্ট হল শাশুড়ি মায়ের জন‍্য। আজ আমাদের ঠাকুরের আশীর্বাদে আর কোন কষ্ট নেই। অথচ সেই মানুষটা ছেলের বিয়েও দেখে যাননি। অনেক কষ্ট করেছেন সংসারের জন‍্য তবে সংসার তাকে সুখ দেয়নি। আমিও এসেছিলাম তার ফেলে যাওয়া সংসারে তবে আমার উপার্জন আর বাবা মায়ের সাপোর্ট আমাকে ভাগ‍্য ফেরাতে সাহায‍্য করেছিল। যে ভাগ‍্য আমি কষ্ট করে অর্জন করেছি,সেই ভাগ‍্য যেন আমার ছেলের বৌয়ের না হয় সেইজন্য আমি তার পায়ের তলায় বিছিয়ে দিলাম গোলাপের পাপড়ি। এরপরও যদি কোন কাঁটা এসে তার পায়ে বেঁধে সেটা তাকেই নির্মূল করতে হবে কারণ লাইফ ইজ নট আ বেড অফ রোজেজ....

            আইবুড়ো ভাত নামটা শুনেছি কলকাতায় তবে আমাদের গ্ৰামে একে থুবড়া খাওয়ানো বলত। আইবুড়ো বা কী আর থুবড়াই বা কী আমি জানি না। ধন‍্য আমাদের এই পৃথিবীর বিশাল ভাষার সম্ভার,সারা পৃথিবীতে এমন কত শব্দ ছড়িয়ে আছে। এই শব্দ ই ভাব প্রকাশ করে আবার ভাবের অভাবও হয় এই শব্দের অপপ্রয়োগে। কথাই কাঁদায়,কথাই হাসায় আবার কথাই ভালোবাসার স্রোতে ভাসায়। কথা নিয়ে কথকতা আরেকদিন হবে না হয়। আমার ছেলের আইবুড়ো ভাত খাওয়ানো অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছিল প্রথম আইবুড়ো ভাত খেয়েছিল পিসির বাড়িতে। আমার ছোট ননদের কন‍্যা এখন থাকে আমেরিকাতে,সে বিয়েতে আসতে পারবে না বলে বিয়ের আগেই ঘুরে গেলো। তারই উদ‍্যোগেই ভাইয়ার আইবুড়ো ভাত হল তাড়াতাড়ি করে। একটা অনুষ্ঠানে থাকবে তার বড় ইচ্ছে। তাই তাকে নিয়ে আমরা ফ‍্যামেলি আউটিং করতে ঘুরে এলাম ভগবতীপুরে। ছেলের সাথে আমরাও ছিলাম নেমন্তন্ন খাবার তালিকায় সুতরাং পেটপুজো হল আমাদেরও। তবে বিরাট আয়োজন দেখে আমি তো পুরো হতবাক। ইলিশ মাছ,মাংস,চিতল মুইঠ‍্যা ভাজাভুজি কিছু বাকি ছিল না। তার সঙ্গে ছিল অসামান্য ডেকোরেশন। সেই খাবার ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে
           আমার কর্তার ছোটবেলার বন্ধুর বাড়িতে সবার নেমন্তন্ন হল। আমার ছেলে মোটামুটি ভেবেই নিয়েছিল যেখানে সবার নেমন্তন্ন হবে সেখানে ও যাবে,না হলে যাবে না। শেষের দিকে একটু রোগা হবার চেষ্টায় ছিল তাই খাওয়াতে অনীহা এল। নেমন্তন্ন এলেই মোটামুটি নারাজ যেতে। তবে এই বাড়িতে যেতেই হবে কারণ এরা স্বামী আর স্ত্রী আমার বরের একদম ছোট বেলার বন্ধু। আর ওদের ছেলে এদের ছোটবেলায় বাঁদরামি করার সঙ্গী। যার ফলে সবাই গেলাম। ওরা বাবার বন্ধুকে তাপস কাকু বলে আর তাপসদার গিন্নীকে তপু পিসি মানে সম্পর্কে ভাইবোন বানিয়ে ছেড়েছে ওদের। পিসির রান্নার হাতটি বড়ই সরেস তাই ডাব চিংড়ী,চিকেন মালাইকারি,রুই মাছ থেকে ভাজা ডাল চাটনি সবই খাওয়া হল সেখানে। তারপর পরবর্তী আকর্ষণ আমার ইউনিভার্সিটির বান্ধবীর সৌজন‍্যে হিমুস হেঁশেলে বাংলাদেশী পদ খাওয়া। সেদিন ছিল জানুয়ারী মাসের এক তারিখ সুতরাং বছরের প্রথম দিন পেটে ভালোমন্দ পড়ল আবার জমাটি আড্ডা আর আউটিংও হল। খুব সুন্দর কাটলো সন্ধ‍্যেটা। সমানেই আইবুড়ো ভাতের ডাক আসতে লাগলো কাছের মানুষজনের কাছ থেকে তবে আমাদের পক্ষে আর যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠলো না। কারণ ছেলের হসপিটালে ডিউটি,মেয়ের চাকরি সব নিয়েই সমস‍্যা।
        অনেক ডাককে ফিরিয়ে দিলাম সময় নেই বলে,তাদের বলেই দিলাম বিয়েবাড়ির আইবুড়ো ভাত খাইয়ে দিতে ছেলেকে। তবে আমার ছোট কাকিমা যখন খুব করে বলল যেতে সেই ডাককে আর অবহেলা করতে পারলাম না। অবশ‍্য অনেকটাই আমার মেয়ের জন‍্য। আমার মেয়ের বক্তব‍্য,'আমাদের দাদু আর দিদা নেই,তাই ছোটদিদা যখন ডেকেছে সেখানে যাওয়া খুবই উচিত।" দেখলাম ছোট হলেও মাথায় বুদ্ধি আছে মেয়ের। সত‍্যিই একটা শুভ কাজে যাচ্ছে ছেলে সেক্ষেত্রে দাদু দিদার আশীর্বাদ মাথায় থাকাটা জরুরী। আমার ছোট কাকিমা ভীষণ পরিশ্রমী আর চুপচাপ,এদিকে কাকুর একটা বড় অপারেশন হল। তাও যা আয়োজন করেছে কাকিমা একা তা ভাবা যায় না। সেদিন মনটা বড় আনমনা হয়ে গেল খুবই মনে হল বাবা মায়ের কথা। আমরা শ্বশুর শাশুড়ি হতে চলেছি অথচ মা বাবা এই দিনটা দেখতে পেল না। আইবুড়ো ভাত পর্ব শেষ হল ভালোভাবেই, অনেকটা খুশি নিয়ে আর কাকিমার হাতে রান্না খেয়ে।

        হাতে তখনও বেশ কয়েকটা দিন তারমধ্যে আমাকে সেরে ফেলতে হবে।এত কাজ বুঝিনি প্রথমে। তারপর মনে মনে ঠিক করলাম একটা একটা করে কাজ গুছিয়ে করব। প্রথমেই পড়লাম ছেলের জামাকাপড় নিয়ে আইবুড়ো ভাত,গায়ে হলুদ,বিয়ে,বাসী বিয়ে,রিসেপশন কখন কী পরবে তা ইনার আর গেঞ্জী দিয়ে সাজিয়ে রাখা প‍্যাকেট বন্দি করে।
  ছেলেদের জামাকাপড় গোছানো সাজানো তাও বেশ সহজে হয়ে যায়। কিন্তু মেয়েদের টা গোছানো মানে প্রলয় কান্ড। যাক শাড়ি,কখনও গয়না সব ওকে দিয়েই প্রথমে বলে রেখেছিলাম কখন কি পরবে। সবই একটু একটু করে কিনে রেখেছিলাম বিভিন্ন জায়গা থেকে। ছেলের বিয়ে নিয়ে বড় আশা ছিল আমার, কত প্ল‍্যান করেছি যে এভাবে ছেলের বিয়ে দেব। সবার কী ড্রেস কোড হবে,কী মেনু হবে? 
    এবার পড়লাম বরের জামাকাপড় নিয়ে,চেষ্টা করলাম আমাদের সবার সাথে মিলিয়ে ডেট অনুযায়ী গুছোনোর। ঠান্ডাটা বেশ কনকনে পড়েছিল সেই সময়ে তাই শীতের জামা ও শালও রাখলাম হাতের কাছে।
     সবার শেষে নিজেকে নিয়ে পড়লাম, ছেলের বিয়েতে আমি মুখ শুকিয়ে ঘুরবো এমন ইচ্ছে আমার ছিল না। আমার মাকে দেখেছি আমার বিয়ের সময়ে জামাই বরণ করবেন বলে একটা গরদ কিনলেও সময়ে তা আর পরা হয়ে ওঠেনি। বাবার তাড়াহুড়ো ঠেকাতে তাঁতের শাড়ি পরেই জামাই বরণ করেছিলেন। আমি মায়ের মত উদাসীন নই সাজগোজের ব‍্যাপারে,বরং একটু বেশিই শৌখিন। আমার কষ্টার্জিত অর্থ যেমন অনেকটাই বাড়িঘর করতে আর সাজাতে গেছে। তেমনি অনেকটা ব‍্যায় হয়েছে আমার শৌখিনতা মেটাতে। হয়ত বা বলতে পারি অনেক একাকীত্ব,অসম্মান আর মন খারাপ ভুলেছি নিজেকে সাজিয়ে রেখে। সাজগোজের প্রলেপ যদি ঠিকমত দিতে জানতে পারা যায় তবে তাতে কিছুটা হলেও মন ভালো হয়ে যায়। কত মন খারাপের বেলায় প্রত‍্যন্ত গ্ৰাম থেকে কলকাতা শহরে আসা মেয়েটার কাটতো হাতিবাগানের ফুটপাতে হেঁটে হেঁটে। আজকাল বরং আর সেভাবে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে জিনিস কেনাই হয় না আমার।
    তাই নিজের জন‍্য কিনব না ভাবলেও ছেলের বিয়ের কিছু আচার অনুষ্ঠানে নতুন শাড়ি পরতে হয় বলে শাড়ি কেনা হয়েছে। সুন্দর ভাবে সেগুলো সাজালাম ম‍্যাচিং ব্লাউজ দিয়ে। গয়নাগুলো বাছাই করে রাখলাম কোনটা পরব। সব রাখলাম হাতের কাছে যাতে খুঁজে পাগল না হতে হয়। পর্যাপ্ত সেফটিপিন, ক্লিপ আর কাঁটা কিনে রাখলাম যাতে অন‍্যদেরও দিতে পারি। আমার বরের একদম ছোটবেলার ভাইকে ফুলের মালা এনে দেবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বিয়ের দিন একেকটা মালা আশি টাকা। কুছ পরোয়া নেই তাতেই রাজি হয়ে গেলাম, কাউকে চুল বাঁধাতে পারবো না বিউটি পার্লার থেকে লোক এনে বরযাত্রী যাবার  তাড়াহুড়ো থাকায়,কিন্তু মালার ব‍্যাপারে নো কমপ্রোমাইজ।


      বাঙালী মেয়েরা শাড়িতে অনন‍্যা এটা আমার চোখ বলে। আমরা সময়ের অভাবে অনেক রকম পোশাককে আপন করে নিয়েছি। বাইরে বেড়াতে গেলে অবশ‍্য সেই পোশাক পরলেই সুন্দর লাগে আর সুবিধা হয়। পোশাকের ব‍্যাপারে আমার ফিলোসফি হল যস্মিন দেশে যদাচার। যেখানে বেড়াতে যাচ্ছো তেমন পোশাক বেছে নাও। যা পরলে তোমার মন ভালো থাকবে কোন অস্বস্তি হবে না তেমন পোশাক পর। আর শাড়ির সঙ্গে আনুসঙ্গিক ভাবেই আসে গয়না। গয়না আর শাড়িতে নারী হয়ে ওঠে অনন‍্যা। ছেলের বিয়ের জন‍্য আমরা মোটামুটি শাড়িই বেছেছিলাম,শুধু একটা দিন ঘরোয়া বৌভাতের দিন আমরা লেহেঙ্গা রেখেছিলাম। যদিও সবাই তা পরেনি,কিন্তু তাতেও সবাইকে খুব সুন্দর লেগেছিল। বিয়েতে বরযাত্রী যাবার দিন সবার ছিল ট্র‍্যাডিশনাল সাজ। ছেলেদের পোশাক ছিল ধুতি পাঞ্জাবী আর মেয়েদের ছিল বেনারসী শাড়ি। তবে পরে হাবড়াতে বরযাত্রী গিয়ে দেখলাম আমার আইডিয়া মোটামুটি ফ্লপ ছিল কারণ হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় ধুতি পরে একদম যাচ্ছেতাই অবস্থা হয়ে গেছিল বরযাত্রীদের। আমাকে সবাই লেগপুলিং করল যে আমার ড্রেসকোডে গন্ডগোল ছিল। তবে সবাই যখন ধুতি পরে বেরোলো তখন ভীষণ ভালো লাগছিল সবাইকে। দেখে মনে হচ্ছিলো পুরো বাঙালীয়ানা সাজে কমবয়েসী আর বেশি বয়েসী সবাই সমৃদ্ধ। আসলে নিজের নিজের ঐতিহ্য একটা আলাদা মাত্রা রেখে যায় আমাদের জীবনে। তাই ঐতিহ্য কখনও ছাড়তে নেই। আমাদের দেশের অনেক পুরোনো আদিবাসী সংস্কৃতি এখনও নিজেদের ঐতিহ্য আঁকড়ে ভালো আছে। আমরা বাঙালীরা অনুকরণপ্রিয় হলেও বিশেষ বিশেষ দিনে বাঙালীদের নিজস্ব সাজ সত‍্যিই খুব সুন্দর। আমরা মেয়েরা সবাই সাজলাম বেনারসীতে, যারা খোঁপা বাঁধলো তারা মাথায় জড়ালো করম ফুলের মালা। আমার পছন্দের সেরা মালা হল জুঁই ফুলের মালা,তবে সেই মালা এখন পাওয়া যায় না তাই করম ফুলের দ্বারস্থ হওয়া।
          কলকাতাতে বিবাহসূত্রে বসবাস করলেও আমি উত্তরবঙ্গের মেয়ে। এখনও আমার নিঃশ্বাসে জড়িয়ে আছে মাটির গন্ধ। তাই সাবেকি বিয়েবাড়ি আছে আমার মন জুড়ে। উত্তর কলকাতায় বসবাসসূত্রে এখনও আমাদের গায়ে পুরোপুরি দক্ষিণ কলকাতার শহুরে গন্ধ লাগেনি। যদিও আমার কাজের জায়গা দক্ষিণ কলকাতায়। তবুও আমার কেন যেন মনে হয় উত্তর কলকাতার লোকেরা একটু বেশি আন্তরিক দক্ষিণ কলকাতার লোকেদের থেকে। অবশ‍্য সেটাও আপেক্ষিক। কলকাতার বিয়েবাড়িতে বাজনার চল তেমন একটা না দেখলেও আমার ছেলের বিয়েতে আমার আবদার ছিল বাজনা হতেই হবে। সেই বাজনদারেরা আগের দিন বিকেলে এসে বাজনা বাজিয়ে চলে গেল তারপর রাত্রি বারোটায় এসে কম্বল দিন বলে বায়না করে আমাদের মাথা খেল। তারপর আবার মাঝ রাতেই বেপাত্তা হয়ে গেল। পরের দিন ছেলের বিয়ে আর তার সাথে রামলালার মন্দিরের ওপেনিং। সুতরাং সেই দিন সারা পাড়া সেজেছে পুরো কুচো পতাকায়। আর মাইকে গান বাজছে রাম জীকে নিকলি সওয়ারী। আর এই সওয়ারী নিকলেনি কে মামলামে আমাদের ব‍্যান্ডপার্টি হাওয়া। ছেলেকে বিদায় করানোর সময় তাদের আর দেখতে পাওয়া গেল না। প্রাচীনকাল থেকে শুনে আসছি ছেলের মা এবং মেয়ের মাকে ছেলে মেয়েদের বিয়ে দেখতে হয় না। কারণ জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম মায়েদের নজর লাগে। মাথাটা গরম হয়ে গেছিল শুনে,সেই সন্তানকে গর্ভে লালন করা থেকে মা সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকে। ঐ অবস্থায় সমস্ত কাজকর্ম চালিয়ে যায় সন্তানকে পেটে নিয়েই। তার নজর লাগবে! অবাক এবং অসন্তুষ্ট দুটোই হয়েছিলাম শুনে। 
    আমার দুই সন্তানই জন্মেছিল আমি চাকরি পাওয়ার পর। প্রথম সন্তানের সময় মেট্রো পুরো চালু হয়নি। আর তখন ট‍্যাক্সির টাকা খরচ করে স্কুলে যাবার মত ক্ষমতা আমার ছিল না,সুতরাং বেশ কিছুটা পথ হেঁটে তারপর দুটো বাস পাল্টেই আমাকে যাতায়াত করতে হত। ছুটির পর দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম বাস স্টপেজে একটা ফাঁকা বাস পেলে তাতে উঠবো,বা বসতে পারবো সেই আশায়। এতো গেলো একটা সামান্য কষ্টের কথা,সত‍্যি কথা বলতে একটা সন্তান বড় করতে যে ক্ষয় মায়ের হয় তার বোধহয় কোন তুলনা হয় না। প্রতিনিয়ত মায়ের যত্ন,মায়ের নজর আর অক্লান্ত পরিশ্রম এবং যন্ত্রণা ভোগের পর সে পরিণত হয় একজন পরিপূর্ণ মানুষে। কতটা ত‍্যাগ করে মা আর সন্তানসুখ কতটা ভোগ করে তার হিসেব মেলানো বড় কঠিন। কোন মা তার হিসেব মেলাতেও যায় না মনে হয়। মেলাতে গেলেই তার কপালে স্বার্থপর,বদমাশ ইত‍্যাদি উপাধি জোটে তা আমি হলফ করে বলতে পারি। তাই আমি অনেকদিন ধরেই ভেবেছিলাম আমি কোন আশা রাখব না,শুধু চাইব ওরা ভালো থাক। আমার মন আমাকে ফিরিয়ে যে জিজ্ঞেস করেনি তা বলব না..সে বলেছিল সব পরিশ্রম শেষে দিনের শেষে তোর ক্লান্ত শরীর মন যখন একটু ভালোবাসা আর অবলম্বন চাইবে তখন কোথায় যাবি? কেউই যে রইবে না তোর সাথে..ঠাকুরকে বলেছিলাম তুমি থেকো তাহলেই হবে। তারপর একদিন জানলাম ননীচোরা কৃষ্ণ শুধু ননীই চুরি করে না,সে চুরি করে মানুষের সব কিছু। তারপর তাকে নিঃস্ব করে এনে ফেলে নিজের চরণে।
       তখন মনের জোর বাড়াতে মা দুর্গা আর কালীকে বলি ত্রিশূল আর খড়্গ ধার দিয়ো মা দরকারে যাতে নিজেই নিজের সবটুকু আগলে চলতে পারি। কিন্তু তা কি আর হয়? অশক্ত শরীর আর সামলাতে পারে না ত্রিশূলের ভার আর তখনই দরকার হয় সন্তানের শক্ত কাঁধ। তবে কজনের সেই সৌভাগ্য হয় আমি জানি না।
             নিজের অধিকার ছাড়ার লম্বা লিস্টে এই অধিকারটুকু আমি ছাড়ব বলেই ঠিক করে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম যাবো না ছেলের বিয়েতে ওর শ্বশুর বাড়ি। কিন্তু তা আর রক্ষা হল না ছেলে মেয়েদের দাবীতে। আমি গেলাম ছেলের সাথে তবে ওর গাড়িতে নয়,আলাদা গাড়িতে। মাইকে তখন উচ্চৈস্বরে রামজীকে নিকলে বরাত বাজছে। ছেলেকে নিতে ওর শ্বশুরবাড়ির দুজন এলো। আমাদের কথা ছিল ছেলে আশীর্বাদ আর মেয়ে আশীর্বাদ ওদের বাড়িতেই হয়ে যাবে ছোট্ট করে,আলাদা সময় ব‍্যায় করব না। তবে ওরা ছেলেকে আশীর্বাদ করতে চাইল,ছেলেকে আশীর্বাদ করে হঠাৎই আমার হাতে একটা শাড়ির ট্রে ধরিয়ে দিল। অবাক হলাম আমি,জিজ্ঞেস করলাম এটা কেন? ওরা বললো দিতে হয়। তখন ছেলেকে বের করার শুভ সময় নিয়ে বর এত বাড়াবাড়ি করছিল যে আমি আর কোন রকম তিক্ত কথা বলতে চাইলাম না। শাড়িটা হাত পেতে নিলাম। এমন নিয়ম কে করেছে জানি না। আমি ছেলেকে আদরে জড়ালাম,আমার তখন দুচোখ ভরা জল। মনে হল যেন কেউ আমাকে শাড়ি ঘুষ দিয়ে ওকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। তবুও চোখের জল খুব তাড়াতাড়ি সামলে নিলাম ওকে আদর করার মাঝেই। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলাম তোদের আগামী জীবন সুখে,শান্তিতে আর সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক। বাইরে গান বাজনা আর কোলাহলে চাপা পড়ে গেল মায়ের কান্নার সেই ক্ষণ। 

       পুরোনো কায়দাতেই একটা বাস ভাড়া করা হয়েছিল বরযাত্রীদের জন‍্য। এছাড়া আমার কর্তামশাই মানে থুড়ি বরকর্তা তিনি সঙ্গে কয়েকজনকে নিয়ে চেপে বসলেন নিজের জন‍্য বরাদ্দ করা ইনোভাতে। ছেলে উঠলো বন্ধুদের সাথে তার জন‍্য বরাদ্দ বরের গাড়িতে। আমি মোটামুটি বরযাত্রীদের নিয়ে র‍্যালি করে উঠলাম বরযাত্রীদের বাসে। সেই বাসটা বড়ই উঁচু,আমি লম্বা হলেও আমার উঠতে বেশ অসুবিধা হল। তবে বাসে উঠে একটু নিরাল হলাম,বরযাত্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়াতে মোটামুটি এই বাসটা ফাঁকা। বাস ভর্তি হলে যে আনন্দধারা বইতো এক্ষেত্রে সেটা একটু মিসিং। দেখলাম সবাই মোটামুটি সস্ত্রীক বসে পড়েছে গাড়িতে। আমি আর তপু পাশাপাশি বসলাম। এই বিয়েতে মোটামুটি ওরা ছিল আমাদের ছায়াসঙ্গী। মনে পড়ে গেল আমার বরের মুখে শোনা ওদের বরযাত্রী আসার গল্প। ওরা কলকাতা থেকে গিয়েছিল আমাদের গ্ৰামের বাড়িতে চাঁচল মকদমপুরে। তবে এতদূর হলেও বরযাত্রীদের লিস্টি খুব একটা কম ছিল না ওরা একশোজন বরযাত্রী নিয়ে ট্রেনে চেপেছিল। আমার তো সত‍্যি অবাক লেগেছিল এরা কিভাবে একশোজন বরযাত্রী একজায়গায় করে ট্রেনে উঠেছিল! আমার শ্বশুরমশাই এবং বর মানে পর পর দুই প্রজন্ম রেলে কর্মরত। শুনেছিলাম শ্বশুরমশাই তাঁর সব বন্ধুবান্ধবের পাস জোগাড় করে এই বাহিনীকে নিয়ে গেছিলেন আর কিছু টিকিট কেটেছিলেন। তিনি সিনিয়র গার্ড ছিলেন তাই এ ব‍্যাপারগুলো তাঁর হাতের মধ‍্যেই ছিল। এরপর যা কান্ড হল তাতে এই একশোজন বরযাত্রী মোটামুটি সারা ট্রেনে লোককে জানান দিল যে তারা ট্রেনে উঠে বিয়ে করাতে নিয়ে যাচ্ছে বরকে। হঠাৎ বাঁশী বেজে উঠছে ট্রেন ছাড়ার সিগন্যাল পরার আগেই,আরও অনেক রকম দুষ্টুমি আর মজা করতে করতে তারা পৌঁচেছিল। আমার বরমশাই থেকে গেলেন চাঁচল হোটেলে কারণ তাকে পাছে লোকে দেখে ফেলে আগে থেকে এইজন‍্যই। তার সঙ্গী হল আমার দুই ননদাই।
          চাঁচল থেকে মকদমপুরের রাস্তায় তখন তেমন কোন আলো ছিল না। এদিকে সন্ধ‍্যে হয়ে গেলেও তাদের মানে বরবাবাজী আর সাঙ্গপাঙ্গদের পাত্তা নেই,আর তখন ফোনাফুনির ব‍্যবস্থাও ছিল না তাই আমার বাবা গাড়ি নিয়ে ছুটলেন জামাইকে মোটামুটি গ্ৰেপ্তার করে আনতে। জামাইকে গ্ৰেপ্তারের পরোয়ানা দিয়ে বাবা এগিয়ে গেছেন। ওরা চলেছে অন্ধকারে হঠাৎই পথ আটকালো সামনে থেকে একটা গাড়ি,সেইসময় সেখানে ডাকাতের উপদ্রবও ছিল। এরা বেশ ভয় পেয়ে গেল,কিন্তু বাধ‍্য হয়ে গাড়ি থামাতেই হল কারণ সামনের গাড়ির মানুষ পথ আটকেছে। ওরা চেঁচাচ্ছে কাঁচ নামাও আমরা বর দেখবো। বর ভয়ে ভয়ে কাঁচ নামাতেই দাবী উঠলো আরে ভয় নেই,দরজা খোলো আমরা বর দেখবো। অবশেষে জানা গেলো উনারা আমার বাবার স্কুলের মাস্টারমশাইরা। ওরা ভালুকাবাজার থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে এনে খেয়েদেয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন বরের দেখা না পেয়েই। অবশেষে অভীষ্ট পূরণ রাস্তাতে বরের দেখা পেয়ে তাঁরা তৃপ্ত হয়ে ফিরলেন।
     আমাদের গ্ৰামের বাড়িতে বন্দুক ছিল অনেকেরই বাড়িতে। মানে এখনও আছে,এবং তা দিয়ে দরকারে মানুষও মারা যায়। এগুলো সবই লাইসেন্স প্রাপ্ত। আমাদের গ্ৰামের বাড়িতে রেওয়াজ ছিল বাড়িতে ছেলে হলে ফায়ারিং হবে। মেয়ে হলে ঢুন্ডুরাম। মেয়েরা যে অবহেলার পাত্রী তার নিদর্শন এটাও বলা যায়। যাই হোক আমার বাবা সকালে যখন বরযাত্রী ঢুকেছিল তখনও ফায়ারিং করেছিলেন আর বর যখন এলো তখনও। ফায়ারিং মানে কনেপক্ষের হাতে বন্দুক দেখে প্রথমে তো বরযাত্রীদের প্রাণ পাখী উড়ে গেছিল পরে অবশ‍্য এরা এই নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি করেছে। তবে এতগুলো বছর পরেও সেই রীতি আমাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বনেদীয়ানার সাক্ষ‍্য বহন করে চলেছে।
          আমার বরের মুখখানা দেখার মত ছিল তখন। অবশ‍্য আমি তখন দোতালার ঘরে বন্দী,আমাকে সাজিয়ে দিয়েছিল আমার মামাতো দিদি আর ভাই। তখনও আমার শাড়ি পরা হয়নি,একখানা হলুদ শাড়ি জড়িয়ে বসে আছি। এই দৃশ‍্য আমি দেখেছি পরে ভিডিও ক‍্যাসেটে।
         আমার ছেলের বিয়ে দিতে গিয়ে দশঘন্টার জার্নি না হলেও দুই ঘন্টার পথ জ‍্যাম কাটিয়ে আমরা মোটামুটি পাড়ি দিলাম পৌনে তিন ঘন্টায়। বরের গাড়ি ছোট গাড়ি বলে আগেই পৌঁছে গেছে,বরকর্তা তারপরে পৌঁচেছেন। এদিকে বরযাত্রী বাসের লোকজন তখন ক্ষিদেতে অস্থির। আমার ননদাই প্রস্তাব দিল সে চা আর চিপস খাওয়াবে সবাইকে। আমি ভয় পেলাম শুনে কারণ বাস থামানো মানেই দেরী। ছেলের বিয়েতে বসার লগ্ন শেষ হবার আগেই আমাকে পৌঁছতে হবে। কারণ আশীর্বাদ করব পুত্রবধূকে। তাই অনেক অনুরোধ করে বুঝিয়ে বললাম আর কুড়ি মিনিট চলো গিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়বে খেতে। ওখানে নামার আগেই বরকর্তা ঘন ঘন ফোন করে জানতে লাগলো আমরা কোথায়। শুরু হল ধমক ধামক। তারপর পৌঁছে আশীর্বাদ করার পর তার মাথা ঠান্ডা হল। আমি সবাইকে বললাম কে কী বলছে আর দেখো না সবাই চা কফি আর স্টার্টার খেয়ে নাও। আমি বরযাত্রীদের একটু ভালো করে আপ‍্যায়ন করতে বলেছিলাম এছাড়া আমার আর কোন দাবী ছিল না। তবে দেখলাম সেখানে তেমন কেউ ছিল না। বুঝলাম খুব ঠান্ডা তাই সবাই খেয়ে দেয়ে যে যার বাড়িতে চলে গেছে। মেয়ের বাবা মা এদিক ওদিক ছুটছে। সুতরাং বরযাত্রীদের বললাম ওসব দেখো না সবাই খেতে শুরু করো। ছেলে এখন ওদের হাতে সুতরাং একটু পেট ঠান্ডা করে তারপর বিয়ে দেখো। আমার নাকি বিয়ে দেখতে নেই সুতরাং এই নিয়ে কোন ঝামেলা না করে আমি নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিলাম। এদিকে এক ঝামেলা হয়েছে যা ভাগ‍্যিস গাড়িতে মনে পড়েছে আমার। অতি যত্নে সাজানো তত্ত্ব সূচী না মিলিয়ে তাড়াহুড়ো করে সকালে এরা আনতে গিয়ে ট্রলি ব‍্যাগ বাদ দিয়েছে যেটা তেত্রিশ নম্বরে ছিল। আমারও খেয়াল হয়নি তাহলে সঙ্গে করে আনতাম। জানি একথা বরকে বললে খুবই বকা খাবো কারণ এই ট্রলিতেই ভরেছি বাসী বিয়ের সাজ। তবুও তার মাথা ঠান্ডা দেখে আগেই প্রমিস করালাম চিৎকার করবে না,একটা ভুল হয়েছে তুমি ড্রাইভার বলে দাও আমাকে সকালে ট্রলি নিয়ে এখানে আসতে হবে। নাকি তোমার ইনোভা গাড়িটা ফেরত গিয়ে আবার কাল আসবে? ঐ গাড়ি আমার ননদেরা হোটেলে থাকবে বাসী বিয়ে করানোর জন‍্য,তাদের জন‍্য ওখানে রাখার কথা ছিল। পরেরদিন ঐ গাড়িতেই ফিরবে তারা। যাক সেই ড্রাইভার শুনে রাজি হয়ে গেল কলকাতা আসতে,ঠিক হল সে ঐ ট্রলি নিয়ে পৌঁছে দেবে সকালে। রাতটুকু সে বাড়িতে বিশ্রাম নেবে। যাক সব ব‍্যবস্থা করে আমার মাথাটা ঠান্ডা হল। বরযাত্রী তখন খাচ্ছে,বিয়ে চলছে। আমিও খেলাম অবশ্যই,কারণ আমারও ক্ষিদে পেয়েছিল। তাছাড়া আমাদের বাড়িতে ফিরতে হবে। খোলামেলা বিয়েবাড়িতে শীতের মধ‍্যে অনেকেই তখন ঠান্ডাতে কাঁপছি। ছেলের বিয়ে শেষ হতে,বরযাত্রীদের নিয়ে বাস বেরিয়ে গেল। ইনোভা গাড়ি ননদদের পৌঁছতে গেলো হোটেলে। আমরা চারজন সেই গাড়িতে ফিরব বলে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাইরে তখন খুব ঠান্ডা। ছেলে আর বৌমা বিয়ের পর আমার কাছে এসে বসলো। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল তখন। ওদের আশীর্বাদ করে অপেক্ষা করতে লাগলাম গাড়ির জন‍্য। গাড়ি আসতেই ছুটে চললাম কলকাতার দিকে,বুঝলাম পৌঁছতে মাঝরাত হয়ে যাবে।

         বাইরে কনকনে ঠান্ডা,গাড়িতে আমরা চারজন বসে আছি। এতক্ষণে মেয়ের ঠান্ডা লেগেছে। বিয়েবাড়িতে সাজুগুজু করার জন‍্য এতক্ষণ সে শীতের কথা কিছু বলেনি। এবার পিসিমণির শালের আঁচলে ঢুকলো সবাই মিলে। আমরা কিছুটা যেতেই আমার কর্তামশাই থুড়ি বরকর্তা ফোন করল,তোমরা কোথায়? আমি বললাম আমরা এই বেরোলাম তবে বেশ কিছুটা এসেছি। সে বললো ওরা চাপাডালি মোড়ের কাছাকাছি। গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে,আমরাও গল্পে মেতে রয়েছি। হঠাৎই দেখি সামনে অনেক লরির লাইন। আমাদের সারথী তার পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো,তারপর কিছুটা বাদেই বললো বৌদি ঐ দেখুন বরযাত্রীদের বাস দাঁড়িয়ে। আমিও ঘাড় ঘোরালাম,সত‍্যিই তো। ইশ্ ওদের তো অনেক দূর চলে যাবার কথা এতক্ষণে। তাহলে ওরাও জ‍্যামে পড়েছে। আমি বললাম কী করি এখন? ড্রাইভার বললো কোন উপায় নেই,চলুন এগিয়ে সামনের দিকে। কাকে ছেড়ে কাকে তুলবেন গাড়িতে? তাছাড়া এই মাঝ পথে দাঁড়ানো যাবে না। অগত‍্যা আমরা এগোলাম সামনের দিকে। একটা মোড় মত জায়গায় পৌঁছতেই দেখি সামনে পুরো পথ বন্ধ জ‍্যামে। একটা লোক আমাদের ড্রাইভারকে ধমক দিল,আমি তো ভাবলাম সে বোধহয় পুলিশ। তবে পরে বুঝলাম না সেই লোকটা রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করলেও পুলিশ নয়। অবশেষে তারই নির্দেশে আমরা চলতে লাগলাম এগিয়ে বাঁদিকে। প্রথমে মনে হল আবার পেছনের দিকে যাচ্ছি। পরে দেখলাম না,একটা অন‍্য রাস্তা দিয়ে গিয়ে কিছুটা পেছোলেও আমরা শেষে আসল পথেই এসে পড়লাম অনেকটা ঘুরপাক খেয়ে। শেষে আমাদের পরিত্রাণ করল গুগল। তবে একটু যে ভয় করছিল না তা কি করে বলি? চারটে মেয়ে আমরা একলা গাড়িতে। তবে আজকাল তেমন ভয়ও পাই না,সুতরাং একটাই কথা এগিয়ে তো যাই,যা হয় হবে। বাড়ির গেটের সামনে যখন এলাম তখন প্রায় দেড়টা। বরকে ফোন করলাম আবার,শুনলাম তাদের গাড়ি সবে নড়েছে। যাক একটু নিশ্চিন্ত হলাম।

     তবে কোন মানুষের জীবন থেকে কখনও চিন্তা যে যায় না তা অনুভব করলাম একটু বাদেই। বাড়িতে মাসিমা ছিলেন,উনি যাননি বরযাত্রী তাই তালা খুলে ঢুকতে হল না। উনিই দরজাট্রলিটা খুলে দিলেন। অবশ‍্য তার আগে আমি সকালের একটা ঝামেলা দূর করলাম। আমাদের ড্রাইভারকে বললাম যে আপনি তো সকালে যাবেন মেয়ের বাড়িতে  দিতে তা এখনই ট্রলিটা নিয়ে আপনি বেরিয়ে যান। তাহলে সকালে সাত তাড়াতাড়ি উঠে আসতে হবে না। এই কথাটা শুনে সে খুবই খুশি হল কারণ সে নিশ্চিন্তে বাড়িতে গিয়ে ঘুমোতে পারবে তারপর সকালে একদম সোজা বেরিয়ে যাবে মেয়ের বাড়িতে। 
        আমরা জামাকাপড় আর গয়নাগাটি খুলছি,এবার একটু ফ্রেশ হয়ে ঘুমোনো। এই মানে গড়ানো কারণ এখনও সবাই পথে। হঠাৎই মনে হল পাশের যেই ফ্ল্যাটটা বিয়ের জন‍্য নিয়েছি সেটা একটু গুছিয়ে রাখি মানে বিছানা গুছিয়ে রাখি। তবে ফ্ল্যা৬টের দরজা খুলতে গিয়ে আমার আক্কেল গুড়ুম। ফ্ল্যাটের নাইট ল‍্যাচ টেনে কেউ বেরিয়ে গেছে। আর সেই চাবিও নেই আমার কাছে। ওখানে অনেকগুলো মানুষ ঘুমোচ্ছিলো কোথায় শুতে দেব ওদের? এতটা জার্নি করে এসে যদি শুতে দিতে না পারি তো কী হবে? মনে মনে ভাবছি কী করে ফ্ল্যাটেই সবাইকে জায়গা দিতে পারি। কোথায় যাবে মানুষ গুলো?
     একটু ব‍্যবস্থা করতে গিয়ে আমার চোখ কপালে উঠলো। হায় ভগবান লেপ কম্বল কোথায়? ভাইবৌয়ের কাছে জানলাম সে সবই এই ফ্ল্যাটকে ছিমছাম রাখতে ঐ ফ্ল্যাটে রেখেছে। এমনকি পরের দিন তার মেয়ের সম্বন্ধ দেখতে যাবে সেগুলোও রেখেছে। হায় ভগবান এবার কী হবে?

    আমি আর কিছুই ভাবতে না পেরে শুয়ে পড়লাম মেঝেতেই বিছানা করে,সাথে আরও তিনজন। ওরা এলো প্রায় সাড়ে তিনটাতে। তারপর যা হল তা না বলাই ভালো। সেই বস্ত্রহরণ আর কী...ভোর রাতে কারও পেটিকোট আছে তো নাইটি নেই,কারও আবার পায়জামা লাগবে,কেউ শাড়ি খুঁজছে কেউ বা পালাজো,কারও বা ব্লাউজ নেই। যাক কোনরকমে সবাইকে ম‍্যানেজ করিয়ে যখন বিছানায় গা ফেলতে দিলাম তখন প্রায় পাঁচটা বাজে। ভোরের কাক তখন ডাকছে। আমার চোখটা লেগে গেল। হঠাৎই ঘুম ভাঙলো ঘ‍্যাচ ঘ‍্যাচ শব্দে। দেখলাম বর পাশের ফ্ল্যাটের নাইট ল‍্যাচের চাবি বানাতে চাবিওয়ালা ডেকে এনেছে ভোরে,সেই ব‍্যাটাই ঘ‍্যাচোর ঘ‍্যাচোর করে চাবি ঘষছে। অবশেষে সমস‍্যা মিটলো,বস্ত্রহরণ যাদের হয়েছিলো তারা নিজেদের বস্ত্র পেয়ে খুশি হল। ভাইরা রেডি হতে লাগলো,ওদের আবার যেতে হবে হলদিয়া।
ওহ্ কী একটা সমস‍্যা পার হলাম!
     তবে বিয়েবাড়িতে এমন ঘটনা না ঘটলেও চলে না। সেদিন সকালে সবাই হাল্কা টিফিন করে নিলাম। বৌ আসবে সন্ধ‍্যেতে।
      দুপুরে খাওয়ার পর্ব শুরু করার আগেই হাড়ি ভর্তি ভাত আর সব তরকারি গুছিয়ে রাখা হল ভরে ভরে। সসপেনে দুধ রাখা হল উথলানোর জন‍্য। কত নিয়ম দেখি,সব নিয়মের বিপক্ষে যেতেও পারি না এ যে বড় লক্ষীমন্ত সংসারের এক ছবি। সংসারে নতুন বৌ আসুক লক্ষ্মীরূপে,আর তার পদস্পর্শে সংসার হোক সুজলা সুফলা,ভর ভরন্ত। আমার দিদার বাড়িতে আবার নিয়ম নতুন বৌকে পিঠে ভেজে খাওয়ানোর। বড়মামীর যখন বিয়ে হয় তখন আমি ছোট তাই মনে নেই কিছু। তবে মেজো মামীর বিয়ের সময় দেখেছি দিদাকে চিতই পিঠা ভাজতে। এই পিঠেকে বলা হত মন চিতই। মানে নতুন বৌয়ের চিত্তরঞ্জন করতে শাশুড়ির পিঠে খাওয়ানো। চিরকাল সব জায়গাতে শুনেছি শাশুড়ি বদমাশ,অত‍্যাচারী কেন যেন যতই যুগ পাল্টাক এই সম্পর্ক কোনদিনই আর মধুরতা পেল না তেমন ভাবে। আমাকে অনেকেই বলে আমি ভালো শাশুড়ি হব। তবে আমি আমার নিজের কাজ পারফেক্টলি করার চেষ্টা করলেও আর ভালো হবার কোন চেষ্টা করি না। কারণ অনেকগুলো বছরের বিবাহিত জীবন কাটিয়ে আজ আর নতুন করে কোন সার্টিফিকেট পাবার ইচ্ছে আমার নেই। আমি আমার মত যেটুকু পারবো করে যাবো,সাধ‍্যের অতিরিক্ত করার ক্ষমতা আর ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই।
     সব মানুষকে একটা নির্দিষ্ট গন্ডীর মধ‍্যে থেকে ভালো থাকতে শিখতে হয় আর নিজেকে ভালো রাখাও প্রয়োজন। কারণ তোমার মনে ফাটল তৈরী করার জন‍্য অনেকেই আছে তবে রিপেয়ারিং করার দায় তোমারই। সুতরাং সম্পর্কে বেশী মাত্রাতিরিক্ত আবেগ ঢেলে ফেললে, সেই ভাঙন সহ‍্য করা অসহনীয় হয়ে পড়ে। তাই অনেক বছর সংসার করে অনেক ঘাত প্রতিঘাত সয়ে শেষ খড়কুটোর মত ভেসে না গিয়ে খড়কুটোকে আগলে ধরে থাকা আমিও একটু হলেও বুঝতে পারি কোথায় থামা জরুরী।

        বৌ বরণের জন‍্য একটা ঘিয়ে শাড়িতে লাল পাড়ের ছোঁয়া কিনেছিলাম। আমি সব রকমের পোশাক পরতেই অভ‍্যস্ত কিন্তু শাড়ি আমার ভীষণ প্রিয়। আর সেই প্রিয়তমার অন্বেষণে থাকতে থাকতেই তাদের পরিবেষ্টিত হয়ে এখন আমার শাড়ি পরিবেষ্টিত দশা হয়ে গেছে। যার জন‍্য অনেক বকাঝকা খেয়ে থাকি সবসময়ই,তবুও বড় মায়া ওদের ওপর। কত ইতিহাস আর ভালোবাসা অথবা ঘাম ঝরানো উপার্জনের টাকায় কেনা সেগুলো। তাই মাঝেমধ্যে একান্তে ওদের গায়ে পিঠে ফেলে আদর করি।
      যাক সেসব কথা,সেদিনও বধূবরণ করব তাই যত্নে জড়ালাম শাড়িটা। খুব মনে পড়ছিল আমার মায়ের কথা। মা এমনি একটা লাল পাড় পরে আমার বরকে বরণ করেছিল। তবে আমার মত সেই সাজে পরিপাটি ছিল না। নেহাতই সাদামাটা ছিল সেই সাজ‍। আমাকে পরিপাটি করে শাড়িটা পরিয়ে সাজিয়ে দিল তপু। আটপৌরে শাড়িতে সেজে বেশ ভালো লাগছিল নিজেরই নিজেকে। তবে নাকে নথ পরে নিজের বেশ লজ্জা লজ্জা করছিল। তপু বললো আজ মায়ের দিন,সুতরাং সাজো ভালো করে। বাইরে তখন বাজনা বাজছে,বৌ এসে পড়লো বলে...আমরা পাঁচজন এয়ো মিলে এগিয়ে এলাম বৌ বরণ করব বলে। 
     ননদরাই সব নিয়ম বলে দিলো সেই মত ছেলে বৌমাকে বরণ করে নিয়ে এলাম ঘরে। দুধে আলতাতে পা ডুবিয়ে বৌ লাল পাড় সাদা শাড়িতে পা দিয়ে এগিয়ে আসতেই বাধা পেলো ননদ আর দেওরদের কাছে। দাদার কাছে ওদের আবদার শুরু হল। এতগুলো ভাই বোন তাই পকেট খালি হল অনেকটাই। দক্ষিণা দিয়ে ভেতরে ঢুকে ঠাকুরকে আর বড়দের প্রণাম করানোর পর শুরু হল খেলা,আর এই খেলার রেশটুকু নিয়ে চলে যাবে সারা জীবন।

       আমি বিয়ের পরদিন সারারাত ট্রেনজার্নি করে ভোরবেলা নেমেছিলাম শিয়ালদহ স্টেশনে। ট্রেনে আসবো বলে আমার বধূবেশ ছাড়িয়ে আমাকে একটা সাধারণ তাঁতের শাড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল আসার সময়। তবে হয়ত মাথাভর্তি সিঁদুর দেখে অনেকেই বুঝতে পেরেছিল আমি নতুন বৌ। আমাদের বাড়ি থেকে গাড়ি করে আমাদের সোজা স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়েছিল। গৌড় এক্সপ্রেসের ফার্স্ট ক্লাস কুপে আমাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল ননদ আর শ্বশুরমশাইয়ের সাথে। সুতরাং আমার কালরাত্রি মানে বিয়ের পরদিন যে রাতকে কালরাত্রি বলা হয় সেই মনসামঙ্গলের যুগে বেহুলা লক্ষ্মীন্দরের সময় থেকে তা আমাদের ট্রেনেই কেটে গেছিল। তবে শ্বশুরবাড়ির লোকজন এই নিয়ম মানেনি তারা আমাকে ওদের বাড়িতে এনে কালরাত্রি পালন করিয়ে নিয়েছিল। ফুলশয‍্যাও পিছিয়েছিল একদিন আর বৌভাত হয়েছিল মোটামুটি বিয়ের চারদিন বাদে। আমাকে ট্রেন থেকে নামিয়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল বর সমেত আমার মায়ের এক বান্ধবীর বাড়িতে। উনাকে আমি মামণি বলতাম,স্কটিশ চার্চ স্কুলে পড়াতেন থাকতেন সাহিত্য পরিষদ স্ট্রীটে। সময় চলে যায়,শুধু স্মৃতিটুকু রয়ে যায় সাথে। এখনও প্রতিদিন সকালে বাসে করে ঐ পথ দিয়েই স্কুলে যাই। একসময় খুব চেনা রাস্তাটা আজ অচেনা,ঐ পথে কতদিন পড়েনি আমার পায়ের ছাপ। মামণিও মারা গেছেন প্রায় ছয়বছর হয়ে গেলো।
           আমাদের শ্বশুরবাড়ির নিয়ম যেহেতু সন্ধ‍্যেবেলা বৌ ঢোকে সুতরাং আমাদের কাটাতে হল একটা বেলা ওখানেই। আজকালকার যুগ হলে হয়ত হোটেল ভাড়া করে রাখা হত,মানে আমার ছেলে এমন পরিস্থিতিতে তাই করত। কিন্তু আমার বর দিব‍্যি রয়ে গেছিল মামণির বাড়িতে। দুপুরে ওর অফিসের অনেকগুলো মহিলা স্টাফ এসেছিল আমাকে দেখতে মামণির ওখানে। তারমধ্যে একজন দিদি আমাকে একটা মজার প্রশ্ন করেছিল যা মনে করলে আমার এখনও হাসি পায়। তবে আমি উত্তর দিয়েছিলাম বেশ বুদ্ধি করে।
       আমার তখন সদ‍্য বিবাহিতা বুঝতেই পারছেন,তারপর সম্বন্ধ করে বিয়ে। বিয়ের আগে একবার ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয়েছিল কিন্তু তারপরে কোন চিঠির আদানপ্রদান বা দেখা সাক্ষাৎ কিছুই হয়নি। কেন এই ব‍্যাপারে ভদ্রলোকের কোন উৎসাহ ছিল না জানি না। অনেকেই সেই যুগেও বিয়ে ঠিকের পর দেখা সাক্ষাৎ করত কিন্তু হয়ত আমাদের বাড়ির দূরত্ব অনেক বেশি বলে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বাবা এবং বোনেদের একান্ত বাধ‍্য ভদ্রলোক কি অজুহাতেই বা বাড়ি থেকে দু তিনদিন ছুটি নিয়ে যাবে হবু বৌয়ের সাথে দেখা করতে? এ ব‍্যাপারে আমি অভিযোগ করেছি বিয়ের পর তবে তাতে কী এসে যায়? সময় যা চলে যায় তা আর ফিরে আসে না। আমি ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্রী,বয়েস তখন বাইশ অনেক স্বপ্নের কাজল চোখে মাখা। মনে ভেবেছিলাম প্রেম তো আর হল না,তা নাই বা হল...এবার করব প্রেম হবু বরের সাথে। হয়ত কোন একদিন সে হঠাৎই সারপ্রাইজ দিয়ে এসে দাঁড়াবে আমাদের হস্টেলের সামনে। তারপর একান্ত আলাপচারিতায় কাটাবো কতটা সময় নিজেদের মত। ও রাতের ট্রেন ধরবে বলে চলে যাবে,আমি মন খারাপ করে ফিরব হস্টেলে। ডাকবাক্স খুঁজতাম যদি কখনও চিঠি আসে...তবে নাহ্ সে আশাও পূরণ হয়নি। চিঠিপত্র যা পেয়েছি সবই বিয়ের পরে।
           আবার বিয়ের কথাতেই আসি,আমাদের নিতে এল ছোটননদাই একটা ট‍্যাক্সি নিয়ে। এই প্রথম আমার শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া,এখনকার মেয়েরা আগে থেকেই ঘর আর বর চেষ্টা করে চিনে নিতে ভালো করে। আমার সেই সৌভাগ্য কোনটাই হয়নি। শ্বশুরবাড়ি আমি চোখেও দেখিনি,বাবা মা দেখে গেছিলেন। পরে ভেবেছিলাম কী দেখে তারা রাজি হয়েছিলেন তাও জানি না। অনেক ভেবেও কোন উত্তর না পেয়ে নিজের কপালকেই দায়ী করেছিলাম। যা কিছু কষ্ট ভোগ করেছি তার জন‍্য দায়ী করেছি সবসময়ই নিজের কর্মফলকে। হয়ত আমার কোন জন্মের পাপ আমাকে এই দুঃখের দিনগুলো দেখিয়েছে। বাড়িয়েছে আমার অপমান আর অসম্মানের বোঝা,কুড়ে কুড়ে খেয়েছে আমাকে মানসিক কষ্ট।
           শ্বশুরবাড়ি ঢোকার মুখে দেখলাম একটু হেঁটে একটা পুরোনো চারতলা ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে কিছু লোকজন উৎসুক হয়ে আমাকে দেখছে। আমাকে বরণ করতে এসেছিলেন আমার দিদি শাশুড়ি, মানে আমার বরের ঠাকুমা আর কাকিমা। আমার শাশুড়ি আমার বিয়ের তিন বছর আগেই মারা গেছিলেন। 
          শাশুড়িমায়ের শাশুড়ি কোমর হেলাতে হেলাতে এলেন বরণ ডালা নিয়ে। নাতির সাথে কিছু মশকরাও করলেন বিয়ে সংক্রান্ত ব‍্যাপারে। তার হাতে এক অদ্ভুত ঝাড়বাতি দেখেছিলাম যা আর পরে দেখিনি কখনও। এরা বাংলাদেশের মানুষ এবং জমিদার বাড়ি ছিল এদের তবে এদেশে এসেছিলেন সর্বহারা হয়ে তবে কিছু পুরোনো বাসনকোশন ছিল। হয়ত এই অদ্ভুত ঝাড়বাতি খানা হয়ত সেই বাড়ি থেকেই আনা হয়েছে। জিনিসটা আমার স্মৃতিতে এখনও স্পষ্ট। ওনার বরণের কায়দা অদ্ভুত রকম ছিল। তাতে ছিল এক নৃত‍্যশৈলীর ছাপ। মানে বেশ যেন নেচে নেচে বরণ করার মত। আর শরীর শীর্ণ জীর্ণ হলেও গায়ের রঙ ছিল হলুদ ফর্সা তবে উলুর জোর ছিল গগনভেদী। মোটামুটি সারা পাড়াতে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই তীক্ষ্ম উলুর আওয়াজ। বরণ শেষে আমি প্রবেশাধিকার পেয়েছিলাম কাপড়ে রাঙা চরণের ছাপ ফেলে। একটা সরু জায়গা দিয়ে ঢুকলাম আমরা,বাঁদিকে একটা ছোট ঘর পেরিয়ে এলাম একটা মাঝারি মাপের ঘরে। একদমই সাদামাটা বৈচিত্রহীন ঘর। পুরোটাই আসবাবপত্রে ঠাসা। মেঝেতে একটা মাদুর পাতা,তাতে আমার দিদি শাশুড়ি বসে। তারই দু পাশে আমাদের বসানো হল। আমি শুনলাম ওদের নিয়মে ছেলে বৌমাকে কোলে নেওয়ার কথা। তবে আমাদের দুই ধেড়ে গোদা নাতি আর নাতবৌকে কোলে নেওয়া সম্ভব নয়। দিদিশাশুড়ি বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে নাতিকে বলতে বললেন,' কি আনছিস আমার জন‍্য? এবার ক তোমার জন‍্য দাসী আনছি। ক দাসী আনছি বাড়ীর জন‍্য।'
   তার অত‍্যন্ত বাধ‍্য নাতি বলে উঠলো,তোমার জন‍্য দাসী আনতে গেছিলাম।'
     সবাই হেসে উঠলো,আমার বর গর্বিত হল বাড়ির মানুষের বাধ‍্য হয়ে। আমার কেমন যেন অদ্ভুত একটা অপমানবোধ এল বুঝতে পারলাম পড়াশোনা শিখে শিক্ষিত হলেও দাসীত্বর লেবেল আটকানো হয়ে গেল আজ থেকেই। আমি এই বাড়ির লক্ষ্মী নই,স্বামীর বন্ধু নই আমি এখন থেকে দাসী। কোন প্রতিবাদ করতে পারিনি সেদিন তবে খারাপ লাগাটা মনে গেঁথে আছে আজও। এখনও যখন কথায় কথায় বরের ধমকানি খেয়ে চুপ করতে হয় এই শুনে যে তুমি চুপ করো তো..তখন আর প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করে না,হয়ত প্রতিবাদ করতে পারি এই বলে কেন চুপ করব আমি?সারাদিন খাটি,টাকা রোজগার করে আনি তবুও আমার কথা বলার অধিকার থাকবে না কেন? কিন্তু এই কথাগুলোও আজকাল আর বলতে ইচ্ছে করে না নিজেকে ভালো রাখতে।
       আমার ছেলের বৌ যখন বাড়ি এলো তখন অনেক খেলা থাকলেও এই কথাগুলো বলতে হয়নি। তবে ছেলে বিয়ে করতে যাবার আগে এই কথা বলতে হয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম,কোথায় যাচ্ছিস বাবা?ও বললো লক্ষ্মী আনতে। কথাটা আমি শিখিয়ে দিয়েছিলাম। একটা আত্মতৃপ্তির শ্বাস বেরিয়ে গেছিলো হঠাৎই আমার ক্লান্ত দেহ থেকে মিশে গেছিলো দূর আকাশে। মনে হয়েছিল আমি অন্ততঃ অন‍্য কারও মেয়েকে দাসীত্ব থেকে মুক্তি দিলাম। 

          সেদিন আমাদের কালরাত্রি পালিত হল,আমার বাপের বাড়ি থেকে শুকনো খাবার মিষ্টি প্রভৃতি পাঠালেও তাতে পেট ভরে না। দুপুরের খাবার খেয়ে এসেছিলাম মামণির বাড়িতে। রাতের খাবার এলো পাশের বাড়ি থেকে। বর ঐ ছোট্ট ফ্ল্যাটের আনাচে কানাচে কোথাও রইলো তাকে চোখে দেখলাম না। আমার সাথে আসার মত কেউ ছিল না,বরের সাথেও তেমন ভাব জমেনি। কিছু কথা হয়েছিল মামণির বাড়িতে। এখন ভাবি আমি কিভাবে একাই কাটিয়ে দিয়েছিলাম সবার মাঝে কে জানে? আমি এখন কথাবার্তা ভালো বলতে পারলেও সেই সময় একটু চুপচাপ গোছের ছিলাম। তবে বাধ‍্য মেয়ে বলে আমার বাপের বাড়িতে সুখ‍্যাতি ছিল। আর তাই বাবা আমার বিয়ের ব‍্যাপারে মোটামুটি স্বেচ্ছাচারীতা করেছিলেন। পড়তে পড়তে আমার বিয়ে দেবার জন‍্য তিনি ক্ষেপে উঠেছিলেন। তাদের ভয় ছিল পাছে এই শ‍্যামাঙ্গী এবং ধিঙ্গী মেয়ে পড়াশোনা করে ঘরে জুড়ে বসে এবং তার বিয়ে না হয়। যদিও পরবর্তী কালে কিছুদিনের মধ‍্যেই অবাধ্য এবং বেয়ারা বৌয়ের তকমাও লেগেছিল আমার চরিত্র সার্টিফিকেটে। 
           আমার বৌমা কলকাতার মেয়ে,সে বিয়ে হয়ে কলকাতাতেই এসেছিল। সাথে তার এক মাসতুতো বোন এসেছিল। আমাদের বাড়ি তার চেনা,বিয়ের আগে খুব বেশি যাতায়াত আমার পছন্দ ছিল না। তবে তাকে আমি সুযোগ দিয়েছিলাম শ্বশুরবাড়ি চাক্ষুষ করতে। সুতরাং এই সূত্রে সে মোটামুটি তিনবার ঘুরে গেছে এই বাড়ি থেকে। যাক কালরাত্রিতে তাকে একটা ঘরে থাকতে বললো আমার ননদেরা,ছেলে রইলো আরেকটা ঘরে। তবে রাতে সে কি খাবে সেই ব‍্যাপারে যখন কথা হল তখন জানলাম ওদের বাড়ি থেকে কোন খাবার দেয়নি। আমি বললাম তাহলে সুইগি করে দেওয়া হোক। তাতেও বাধ সাধলো আমার মামী। বললো,টাকা তুমি দিতে পারবে না। অবশেষে ছেলে অর্ডার করল,টাকা কে দিল জানি না। তার জন্য ফ্রায়েড রাইস,চিলিচিকেন কম্বো এল। যাক আমি নিশ্চিন্ত হলাম। বৌমার খাওয়ার আগে প্রায় রাত দশটার সময় হঠাৎই তার মনে হল তার মা চাল আর আলু দিয়েছে ফুটিয়ে খেতে। আমি বললাম থাক,এখন যা আসছে তাই খাও। ভালোয় ভালোয় কাল রাত্রি কেটে গেলো। আমিও চাপে ছিলাম পাছে ওদের দেখা না হয়ে যায়..তবে এসবে আমার কোন বিশ্বাস নেই। কিন্তু তবুও মেনেছি এই কারণে সন্তান মায়ের বড় দূর্বল জায়গা। হয়ত এই মঙ্গল অমঙ্গলের দোহাই দিয়েই বহু কুসংস্কার বেঁচে আছে বহাল তবিয়তে আমাদের সমাজে।
         আমার রিসেপশন পরে হয়েছিল আমাদের অনেকটা দূরত্ব পার করে আসতে হয়েছিল বলে। ছেলেরটা যেদিন বৌভাত হওয়ার কথা তার পরের দিন হল। কারণ আমাদের বিয়েবাড়ি সেদিন পাওয়া যায়নি। সুতরাং আলাদা করে একটা ঘরোয়া বৌভাতের আয়োজন করতেই হল। খরচ এতে বেশ কিছুটা বাড়লেও আনন্দের পরিসরের মেয়াদও বাড়লো একদিন। আমরা কাছের লোকজনকে মোটামুটি ছয় দিনের নেমন্তন্ন করে এসেছিলাম। যার ফলে কিছু লোকজন এসে পড়েছিলেন আইবুড়ো ভাত থেকেই। আর কিছু মানুষজন যাতায়াত করছিলেন বিয়ে বাড়ি ভায়া নিজের বাড়ি। আমরা ফ্ল্যাটে থাকি অতিথিদের কিছু রেখেছিলাম ফ্ল্যাটে। কয়েকজন ছিল হোটেলে। এছাড়াও দুটো বাড়ি নেওয়া হয়েছিল পাশেই। তাতে মোটামুটি সবার হয়ে গেছিলো।
         ঘরোয়া বৌভাতের দিন আমার স্কুলের কলিগদেরও আসার কথা ছিল। আমার বাড়ির কিছু আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধব এল সেদিন। বৌমাকে আটপৌরে করে কাঁথাস্টীচ শাড়ি পরানো হল। এক্ষেত্রেও পরিত্রাতা সেই সর্ব ঘটে কাঁঠালী কলা।
আমি বিয়েতে ড্রেসকোড করেছিলাম,ঘরোয়া বৌভাতের দিন ছিল স্টীচ করা শাড়ি। মোটামুটি সেই অনুযায়ী সবাই ড্রেস পরে এসেছিল। অবশ‍্য এই ড্রেসকোড করতে হয়েছিল আমারই কিছু নিকট আত্মীয়ের আব্দারে,তাদের খুবই দাবী ছিল দিদি একটু অন‍্যরকম কিছু করো বিয়েতে। আমি ড্রেসের ব‍্যাপারে আর কী অন‍্যরকম করব,অতএব রঙ আর ডিজাইনে নজর দিলাম। এ নিয়ে আবার সমালোচনা শুনেছি আড়ালে। কেউ বলেছে,বলে দিলেই হল একটা কিছু। কোথায় পাবো কাঁথা শাড়ি? আবার কেউ বলেছে দিতেই তো পারত একখানা। আমি অবশ‍্য আত্মীয়দের সবাইকে শাড়ি দিয়েছি তবে একটা ভ‍্যারাইটি দিয়েছি। তখন একটু কষ্ট হয়েছিল মনে কথাগুলো শুনে,পরে ভাবলাম যাক গে আড়ালে তো লোকে রাজার নিন্দাও করে। তবে অনেকেই খুব মজা করেই ড্রেস পরেছে একদম কোড মেনে।
       আমার ক‍্যাটারিং সার্ভিস পাবারও একটা মিঠে গল্প আছে। প্রথমে ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ হয়েছিল ইনবক্সে বই কেনার সূত্র ধরে,বয়েসে আমার ছোট সে। পরে তাকে বোনের মত ভাবতে শুরু করি। এরপর গতবছর আমার উপন‍্যাস টিনের বাক্স বেরোলো তখন ওর বরের সাথেও আলাপ হল আরও ভালো করে। শুনলাম ভদ্রলোক কেটারিং করেন। তখন ছেলের বিয়ে দেব এমনটা জানি,তাই তাকে বললাম সবটাই। তারপর ছেলের বিয়ের তারিখ ঠিক হলে মৌ ওর বরকে নিয়ে এলো। ওদের ক‍্যাটারিং সুপিরিয়র ক‍্যাটারার। আমার কর্তা প্রথমে ঠিক করেছিল ঘরোয়া রান্নার বাজার ও করে দেবে,রান্না হবে বাড়িতেই। আর পরিবেশন করব আমরা সবাই মিলে।
     আমি তো শুনে অবাক..হিসেব করে দেখেছিলাম আমাদের আত্মীয় যতই থাক কোমরে গামছা জড়িয়ে আমার বিয়ের সময় যারা খেটেছিল তেমন লোকজন নেই। কে করবে এত কিছু? উল্টে আনন্দ পন্ড হবে আর আমার বাড়ির মানুষটা অযথা অতিরিক্ত মানসিক আর শারীরিক চাপ নিয়ে লাফালাফি করে বেড়াবে। আমি উপার্জন করি,সংসারের অনেক কিছুই নিজে করি তবুও কোথাও এসে যেন সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আজও আমরা জড়িয়ে। মাকেও দেখেছি নিজে চাকরি করলেও বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত বাবাই নিয়েছে এমনকি আমার বিয়ে দেওয়াটাও। আমরা মেনে নিয়েছি সবটাই। ছোট থেকে হয়ত এমনটাই দেখতে অভ‍্যস্ত আমি বরের অনেক সিদ্ধান্ত চুপটি করে মেনে নিই,কখনও বাধ‍্য হই মেনে নিতে অশান্তির ভয়ে। আবার কখনও বা প্রতিবাদ করি যখন দেখি সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হচ্ছে না। এই ক্ষেত্রেও প্রতিবাদ করলাম,বললাম কিছুতেই এত ঝামেলা আমি তোমাকে করতে দেব না। প্রথমটা খুবই রেগে গেলো,বলল..বাজারে আমার কত পরিচিত মানুষ জানো? তাদের বলে রেখেছি ছেলের বিয়ে তারা আশা করে আছে মাছ দেবে ওরা। ওদের একটু লাভ হবে এই আশায় আছে।
    আমি একটু কঠোর হলাম,ওদের লাভ দেখতে গিয়ে তো আমি নিজের ক্ষতি করতে পারব না? এত ঝামেলা কে করবে? অনেক বিয়েবাড়ি আছে ঐ তারিখে ওরা মাছ সাপ্লাই দেবে সেখানে। তুমি পুরোটা কেটারিং কে দিয়ে দাও।
    বেশ ঝামেলা হল এই নিয়ে তবে অবশেষে আমার কথাই থাকলো। যে মেয়েটিকে এখন বোন বলে মনে করি তার কর্তাকেই বিশ্বাস করে দিলাম সব দায়িত্ব। বিশ্বাস করে জীবনে অনেকবার ঠকেছি,তবুও মানুষকে বিশ্বাস করি কারণ এই সহজ সরল বোধগুলো যদি জীবন থেকে সরে যায় তো বাঁচবো কী নিয়ে? তাই এই চিন্তা নিয়েই এগোবো যতটুকু বুদ্ধি আছে সেটুকু নিয়েই এগিয়ে যাবো বিশ্বাসটুকু সাথে নিয়েই। নিশ্চয় তাতে কোন না কোনদিন এমন কাউকে পাবো যেখানে ঠকবো না। 
          ওদের ওপর যেমন পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলাম ওরাও তেমন নিজের পরিবারের অনুষ্ঠানের খাবার দিচ্ছেন এইভাবেই কাজটা করেছেন। আমি ঘুরতে পারিনি এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে। ওনারা নজর রেখেছিলেন সবার প্রতিই। সুতরাং ভাত কাপড়ের থালা ওরাই সাজালেন নিজেদের মত করে পরম যত্নে। তাতে পাঁচ রকমের ভাজা থেকে শুরু করে সবই ছিল যত্নে সাজানো। যথারীতি ফটোশুট হল,ছেলে বৌমার হাতে তুলে দিল সুন্দর করে সাজানো থালা। তবে এই কাঁসার থালা আমাদের শ্বশুর বাড়ির পুরোনো সম্পদ। বলতে পারেন কিছু ছিটেফোঁটা জমিদারীর শেষ চিহ্ন। সুতরাং ভীষণ ভারী এগুলো। অত বড় থালা আর অনেক বাটি তার সাথে যোগ হয়েছে খাবার,সুতরাং সারা জীবনের ভাত কাপড়ের ভার অনেকটাই বেশি। আমার এক বন্ধু ওর সুন্দর সুচারু শিল্পের ছোঁয়া দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিল একটা ছোট কাঠের গোল ট্রে যেটা অপূর্ব সুন্দর হয়েছিল দেখতে।
      পরে ওদের ভাত কাপড়ের ছবিগুলো দেখে নিজের সেই বিশেষ দিনটা আবছা মনে হল। আমার ভাত কাপড়ের জন‍্য কেনা হয়েছিল একটা স্বর্ণকাতান শাড়ি। সেই সময় ঐ শাড়ির খুব প্রচলন ছিল। এখনও সেই শাড়িটা আমার কাছে আছে,এখন মসলিন বলে যে শাড়িগুলো বিক্রি হয় অনেকটা সেই ধরনের পাতলা গা। তবে জড়ির ফুল আর লতাপাতা দিয়ে সাজানো। আমার শাড়ির রঙ ছিল টম‍্যাটো কালার। ওরা বাড়িতে রান্না করেই আমাকে সাজিয়ে দিয়েছিল খাবার থালাতে। আমাকে ওরা এক জোড়া তাঁতের শাড়ি দিয়েছিল। কেন জানি না? সারাজীবনের ভাত কাপড় তো একটা শাড়িতে কী হবে? তাই বোধহয় দুখানা শাড়ি। আমিও সেই প্রথা মেনেই বৌমাকে দুটো শাড়িই দিয়েছিলাম। দুখানা ঢাকাই কিনেছিলাম সেই জন‍্য।
         আমার সবার পাতে ঘি দেওয়ার কথা আর মনে নেই। তবে বৌমাকে সবার পাতে ঘি দেওয়ার ব‍্যবস্থা করেছিলেন আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ভগ্নীপতি। সবাইকে ঘি ভাত দেবার শেষে আমরা পুরো পরিবার খেতে বসলাম একসাথে আমার ননদদের পরিচালনায়। আমাদের চারজনের মাঝে যোগ হল আরেকজন আজ থেকে। এভাবেই বংশগতি এগিয়ে চলে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে। 

      আমার বাড়ির ভদ্রলোক মানে ছেলের বাবা খুবই সঙ্গীতপ্রেমী তাই আমাদের ঘরোয়া বৌভাতের রাতে একটু গানবাজনা আয়োজন করা হয়েছিল। আর সত‍্যিই তো একটা দিন কী আর করব? সুন্দর ভাবে কাটানোই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। তাছাড়া নতুন বৌকে একটু সুগাস্বাতম জানানো দরকার। মেয়েও বারবারই বলছিল আমাদের মেহেন্দী জাতীয় কোন অনুষ্ঠান আমরা রাখব না কারণ যে কোন কারণেই হোক আমার বা মেয়ের কারোরই তেমন হাত রাঙানো পছন্দের নয়। যদিও আমার বাড়িতে আসা রূপচর্চা কারিণী মেয়েটা আমাকে প্রবল উৎসাহ দিয়েছিল এই ব‍্যাপারে। ও বললো,আরে মেহেন্দী রাখো। এসব এখন সবাই করে। তুমি ছেলের মা সাজবে না? এমন সুযোগ আর আসবে নাকি?
     তবুও একবার করব ভেবেও আবার না করে দিলাম। সেই মুহূর্তে কেন যেন মনে হল,আমার এই কর্মঠ সাদামাটা হাতটাই থাক। দেখলাম কেউই তেমন হাতে রং করেনি। আমার ভাইবৌ অবশ‍্য বাড়ি থেকেই করে এসেছিদ বিয়ে উপলক্ষ্যে। হলুদ কোটার সময় বারবারই ফটো তোলার সময় ঐ হাতটাই ওপরে উঠে আসছিলো ফটোর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করতে। তবে আর কেউই মেহেন্দী করেনি বিয়ে উপলক্ষ্যে। এখন মেহেন্দীর নানা রকম ডিজাইন বেরিয়েছে,আর এটা বাঙালী সমাজেও একটা প্রথার জায়গা করে নিয়েছে। আজকাল বাঙালী মেয়েরাও নানা অনুষ্ঠানের সময় সৌন্দর্যের সন্ধানে হাত রাঙায় কারুকার্য করে।
    আগেই বলেছি এখন ভালো লাগে না তেমন মেহেন্দী করতে। কিন্তু ছোটবেলায় যখন এইসবের তেমন চল ছিল না তখন আমার খুব ভালো লাগত হাত রাঙাতে। তখন আমাদের স্কুলে পড়া কিছু মেয়ে ঈদে অথবা রাখীর দিন হাত রাঙিয়ে আসত। তার মধ‍্যে তেমন কারুকার্য ছিল না,ঘরে মেহেন্দী পাতা বেটে কাঠি দিয়ে হাতে ডিজাইন আঁকা হত। সেই মেহেন্দী পাতার গাছ অনেক বাড়িতে থাকত। যাদের বাড়িতে সেই গাছ থাকত তাদের বাড়িতে অনেকেই গিয়ে পাতা পেড়ে আনত। এমন একটা গাছ ছিল আমাদের বাজারের কাছে একটা বাড়িতে,সেখান থেকে পাতা জোগাড় করে এনে তা শিলে বেটে হাতে লাগিয়ে খুব খুশিতে অপেক্ষা করতাম রঙের জন‍্য। বেশিরভাগ সময় পছন্দের রঙ পেতাম না,তাতে মন খারাপ হত খুব। আমার শ‍্যামলা গায়ের রঙে অনেক সময়ই সেই রঙ খুলত না তেমন করে। তবে মেহেন্দী বাটার ঐ গন্ধটা আমার খুব ভালো লাগত। এখন কত রকম ডিজাইন বেরিয়েছে কিন্তু ঐ যে সময় থাকতে সাধ পূরণ না হলে তার আর মিষ্টতা থাকে না। আমারও তেমনি হয়েছে। কারুকার্য করতে গেছিলাম একবার আমার পঁচিশ বছরের বিবাহ বার্ষিকীতে। বড় শখ ছিল বিয়ের সময় পার্লারে সাজিনি এবার সাজব। কিন্তু ঐ যে যে সময় চলে যায় তা চলেই যায় আর ফেরত আসে না। কলকাতা শহরের মোটামুটি নামী পার্লারে বেশ কয়েক হাজার টাকা খরচ করে যে সাজ সেজেছিলাম অনেকটা সময় নষ্ট করে তার জন‍্য নিজেরই নিজের গালে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করে। আমার পঁচিশ বছরের বিবাহবার্ষিকী যেদিন সেদিন মুখে চুনকালি মেখে সবার চেয়ে পরে পৌঁচেছিলাম আমি। বাইশে কনে হওয়ার যে স্নিগ্ধতা থাকে তা পঁচিশ বছর পরে যতই আধুনিক সাজে নিজেকে সাজানো হোক না কেন থাকে না। সুতরাং সবই যেন বৃথা মনে হল,হাতের মেহেন্দী আর মুখের মেকআপ আর চুলের রোল সবই আমাকে ডুবিয়ে দিল এক অদ্ভুত অপরাধবোধে। মনে হল বাড়ি থেকে সেজে এলে এই এতটা সময় আর টাকা নষ্ট হত না। আরও নষ্ট হল আমার প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটানোর মেয়াদ। তারপরেই পণ করেছিলাম আর কোনদিন পার্লারে সাজতে যাব না। আমার বৌমাকে সাজানোর জন‍্য যে মেয়েটাকে ঠিক করা হয়েছিল সে আমাকে বারবারই বলেছিল তোমাকে আমি সাজাবো। আমি না করে দিয়েছিলাম। আমার আত্মীয়স্বজনেরা বিয়ের দিন কেন আমি কোন খোঁপা বেঁধে দেওয়ার মেয়ে ডাকিনি সেই নিয়ে অভিযোগ করায় আমি রিপেপশনে তাদের সাধ পূরণ করেছিলাম। নিজের চুলেও ঢেউ খেলিয়েছিলাম। আর যথারীতি সেদিনও পৌঁছতে কিছুটা দেরী হয়ে গেল,অবশ‍্য গাড়ির বিভ্রাটও ছিল। সবাইকে আগে সাজার সুযোগ দিয়ে আমি অসুস্থ লাগছে বলে একটু ঘুমিয়ে পড়াতে বিভ্রাট হল। যাকগে তবুও শেষটা ম‍্যানেজ হল।
           ছেলের ঘরোয়া বৌভাতের দিন ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সাথে আরও কিছু লোকজন আমরা বলেছিলাম যারা কেউ কেউ অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। সেদিনের ড্রেসকোড করা হয়েছিল লেহেঙ্গা। আমার বৌমার রিসেপশনে লেহেঙ্গা পরার ইচ্ছে ছিল। সেখানে আমি মৃদু ভাবে নিজের মতামত জানিয়েছিলাম লেহেঙ্গা তো অনেকেই পরবে। তার থেকে তুমি বৌয়ের সাজে থেকো সেটাই সুন্দর লাগবে। ও মেনে নিয়েছিল। তবে আমার একটু কষ্ট হয়েছিল তাই একটা দিন ওকে লেহেঙ্গা পরার সুযোগ করে দিয়েছিলাম। অনেকে শাড়ি পরলেও আমরা অনেকেই লেহেঙ্গা পরেছিলাম। অবশ‍্য আমার লেহেঙ্গা মেয়েই কিনে দিয়েছে শখ করে,সাথে জাঙ্ক জুয়েলারি। আমি যদিও ভেবেছিলাম মেয়ের একখানা পুরোনো লেহেঙ্গা পরে কাজ চালাবো। কারণ ঐ পোশাক আর তেমন করে পরা হবে না কখনও শুধু শুধু কিনে কি হবে?
   তাই হাল ধরলেন মা জননী,প্রথমে বকাঝকা করে পরে তিনিই উদ‍্যোগী হলেন ড্রেস কেনার ব‍্যাপারে। যাক ভালোই হল,উপহার পেয়ে সকলেরই দিল খুশ্ থাকে আমারও হল। রাতের গানের অনুষ্ঠানে প্ল‍্যান পরিকল্পনা অনেক করা হলেও দেরিতে শুরু করার কারণে ছোট করতে হল অনুষ্ঠান। আমার বরের বান্ধবী খুবই ভালো গায় প্রথমে ও হাল ধরলো তবে অনুষ্ঠানে স্ত্রোত্র পাঠ করলেন ওর সুপ্রভাত সাথীর এক দিদি। বর আর ননদরাও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করল।তবে গানের অনুষ্ঠান দীর্ঘায়িত হওয়াতে মন খারাপ হল আমার মেয়ের। সে তার নাচে একদম আনাড়ী মাকে অনেক কষ্টে চারদিন রিহার্সাল করিয়ে বকাঝকা দিয়ে একটা নাচ শিখিয়েছে মোটামুটি। সেটা বোধহয় আর হবে না। কারণ ততক্ষণে মানুষজন খেতে বসে পড়েছেন। যাক অনেক কষ্টে নাচটা রাখা গেল সব শেষে। আমি ভুলভাল হাত পা নাড়লাম টেনশনে। তবে পাবলিকের উত্তেজনা তখন ফুটছে গানের পর নাচে। সুতরাং ঐ নাচেই কাঁপলো মঞ্চ,অনেকেই এলো অংশগ্ৰহণ করতে নাচের শেষে গানটাকে আবার বাজিয়ে। সব মিলিয়ে ফাটাফাটি পারফরম্যান্স হয়ে গেল সবার খুশিতে। যেমন বৌমাও পারল না থেমে থাকতে তাকেও টেনে আনলো আমার বান্ধবী,সুতরাং শাশুড়ি বৌমার পাশাপাশি নাচও হল।
        সব কিছু শেষ করতে করতে বেশ রাত হল। আমি বিয়ের পর ঘরের কষ্টে নাকাল হয়েছি,আমার কোন পার্সোনাল ঘর ছিল না। তাই আমার ইচ্ছে ছিল বৌমার আলাদা কিছু থাক যেখানে সে স্বাধীন ভাবে থাকতে পারবে। হয়ত স্বাধীনতা কখনও মানুষকে স্বেচ্ছাচারী করেও তোলে। আমাদের কাছ থেকেই ভবিষ্যত প্রজন্ম শেখে অনেক কিছুই। তবে কেন যেন আমার নিজেকে শিক্ষক হিসেবে অযোগ্য মনে হয়েছিল তাই প্রথমেই ভেবেছি,আমার হাত ধরে নয় ও শিখুক নিজের বিচার বুদ্ধি দিয়ে। আমি ওর শিক্ষিকাও নই আবার গর্ভধারিণী মাও নই সুতরাং নিজের অধিকার বিষয়ে আমার সচেতন থাকাই ভালো। হয়ত তাতে আমিও ভালো থাকব। আমার বিয়ের সময় ভাড়া শ্বশুরবাড়িতে উঠলেও আমার চুয়াল্লিশ বছর বয়েস না হতেই আমরা কলকাতা শহরে দুটে বাসস্থান আর একটা জমি কষ্ট করেই কিনেছিলাম। তার পেছনে অনেকটা অবদান ছিল আমার বাবা মায়ের। সুতরাং একটা ফ্ল্যাট সুন্দর করে আগেই সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওদের প্রয়োজন অনুযায়ী। এই সংসার বৌমার নিজের হবে আমি সেখানে মাতব্বরি করব না এই ভেবেই এগিয়ে গেছিলাম। ভালো কিছু ভালো দিনে শুরু করাই ভালো তাই ওদের ফুলশয‍্যা হল বৌমার নিজের সংসারে। ওদেরকে ঐ ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দিয়ে আমি শুতে এলাম। বুঝতে পারলাম বুকটা কোথায় যেন ফাঁকা হয়ে গেছে। তাতে একটা যন্ত্রণা আছে,আমার হলুদ পাখি আর হয়ত ফিরবে না কোনদিনই। সে এবার উড়ে যাবে দূর থেকে দূর আকাশে আর সেখানেই হয়ত মা হিসেবে আমার পূর্ণতা...আমি উড়তে শিখিয়েছি ওদের উন্মুক্ত খোলা আকাশে। চুপিচুপি মনটা বলে ওঠে আর কী ফিরবে সে কোনদিন নতুন সাজানো অন্দরের সুখ ছেড়ে আমার এই অগোছালো পুরোনো সংসারে?
    তবুও ছাড়তে তো শিখতেই হবে আমাকে,একদিন যে সবই ছেড়ে চলে যেতে হবে সব বন্ধন কাটিয়ে। হয়ত মুক্ত হওয়ার দিন শুরু আজ থেকেই....

        বিয়ের অনুষ্ঠান যেহেতু অনেকগুলো দিনের তাই একটা ভীষণ চিন্তা ছিল মনে। কারণ আমাদের বাড়িতে গৃহ শ্রমিক আমরা দুজন। ছেলেমেয়েদের সাজুগুজু করে বিয়েতে অংশগ্রহণ করা ছাড়া তেমন কোন ভূমিকা ছিল না। যদিও আমার বরকে দেখেছি নিজের বিয়ের জোগাড় নিজেকেই করতে। এমনকি নিমন্ত্রণও কিছু ক্ষেত্রে বাবার প্রতিনিধি হয়ে করতে গেছে। অবশ‍্য আমি নিজের বিয়েতে তেমন কিছু করিনি বিয়েটা করতে আসা ছাড়া। ছেলেমেয়েদের ব‍্যস্ত জীবনে আর কোন চাপ ওরা নিক তা আমরাও চাইনি আর ওরাও আগ্ৰহ দেখায়নি। এমনকি ছেলে কখন কী পরবে সে ব‍্যাপারেও তার কোন উৎসাহ আমি দেখিনি। ও জানতো মা আছে সব পছন্দ করে কিনে গুছিয়ে রাখবে।
    রিসেপশনের আগের দিন রাত থেকেই মনে হল যেন আর পারছি না। গলা ভেঙে এল,গলা বসে আওয়াজ বেরোনো মোটামুটি বন্ধ। আমি ঘাচঘেচে গলায় চেঁচাতে লাগলাম তবুও। কারণ কথা তো বলতেই হবে। পরদিন সকালে আর চোখই খুলতে ইচ্ছে করল না। মনে হচ্ছে চোখ বুজেই শুয়ে থাকি,আজকে আর পারছি না। তবুও দায়িত্বের ভার বড় বেশী। দায়িত্ব মাথার ওপর চেপে বসে পাথরের মত। যতক্ষণ সেই পাথর না সরবে আমাদের মুক্তি হয় না কিছুতেই। 
      দুপুরটা কাটলো কোনরকমে,সেদিন আরও কিছু অতিথির সমাগমে বাড়ি হয়ে উঠলো আনন্দক্ষেত্র। অনেকেই ব‍্যস্ততা বা ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার জন‍্য আসতে পারেননি। তারা সেদিন এলেন।
       ননদদের আবদার ছিল বিউটি পার্লারের মেয়েদের কাছে খোঁপা বাঁধবে। সুতরাং সেদিন ব‍্যবস্থা করেছিলাম চুল বাঁধার। খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমোতে আর দিলাম না কাউকে লাইনে বসালাম। তবে আমাকে সবাই ঠেলে পাঠালো বিশ্রাম নিতে। ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়লাম যে কখন বুঝতেই পারিনি। বৌমাকে তো অনেক আগেই সাজতে পাঠিয়েছি। আমাদের রিসেপশনের জন‍্য যে ব‍্যাঙ্কোয়েট নেওয়া হয়েছিল সেখানেই একটা ফ্ল্যাট নেওয়া হয়েছিল কয়েক ঘন্টার জন‍্য। তাই তাকে খাইয়ে সেখানেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।
     আমি শুধু চুলটা কার্ল করব তেমনি ইচ্ছে ছিল। তবে ততক্ষণে প্রায় সন্ধে হয় হয়। তাড়াহুড়ো করতে লাগলাম,তাড়া দিলাম মেয়েটিকে। এই তাড়াহুড়ো করা আমার স্বভাবসিদ্ধ,যার জন‍্য অনেক বিপদ আপদ ঘটে। যাক অবশেষে হল,তবে দেখলাম আমার টেনশনের রুগী বর সেদিন বেশ খোশ মেজাজে আছেন। ঐ মানে মেরে এসেছি এমন ভাবসাব। তিনি প্রমীলাবাহিনীর জন‍্য ফুল কিনে নিজে চুলে ছাট দিয়ে ফেসিয়াল করে এসেছেন। বিয়েবাড়িতে যাওয়া নিয়েও তড়িঘড়ি নেই। যারা রেডি তাদের পাঠাতে লাগলাম গাড়ি করে। আমার সাধ জাগলো বরের সাথেই একসাথে যাব। আর তাতেই কাল হল,গাড়ি আর কিছুতেই আসে না। অপেক্ষা করে আমি রাগে হট হয়ে উঠলাম,আর বর দিব‍্যি কুল। ততক্ষণে বিয়েবাড়িতে লোকজন এসে পড়েছে। সেই চিন্তাতেই আমি বাড়ি বসে মাথার চুল ছিঁড়ছি। নিজেকেই কিছুটা সময় দোষ দিলাম কেন আগে বেরিয়ে গেলাম না। কর্তা আবার বড় গাড়ির ড্রাইভারকে তার বৌ আনতে বাড়ি পাঠিয়েছে শুনে আরও রাগ হল। আমার বকাঝকা শুনে সে ফোন করল বড় গাড়ির ড্রাইভারকে। ভাগ‍্যিস সে তখনও আমাদের অঞ্চলেই ছিল তাই তাকে আনা সহজ হল। যাক অবশেষে বিয়েবাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। বর পরের গাড়িতে যাবে বলে রয়ে গেল বাড়িতেই। তাকে সঙ্গ দিতে রয়ে গেল আমার ভগ্নীপতি। আমি যখন অনুষ্ঠানে পৌঁছলাম তখন সেখানে জনজোয়ার। সবাই বলছে তোমাকে খুঁজছি।
  আমিও পাগলের মত এই মাথা থেকে ঐ মাথা ঘুরছি আর হাই হ‍্যালো করছি সবাইকে। তার মধ‍্যেই আমাদের ক‍্যাটারিং যিনি করেছিলেন মানে আমার ভগ্নীপতি তিনি আমাকে ঘুরিয়ে দেখালেন তাদের অন্দরসজ্জা। সত‍্যিই অপূর্ব হয়েছে সব কিছু, আমি তো ভেবেছিলাম কী করে এইটুকু জায়গায় সব করবে কিন্তু দেখে মুগ্ধ হলাম।
   উনি আমার হাতে তুলে দিলেন এক প্লেট স্টার্টার বললেন,দিদি খেয়ে নিন এরপর আপনার সময় হবে না। আমি একটু হেসে ভীড়ে ভেসে একটাতে কামড় বসিয়েই আর খেতে পারলাম না। সেটা ভালো দেখায় না প্রথমতঃ আর দ্বিতীয়তঃ সেই সময়ও যে নেই হাতে। তখন কাউকে বাড়িতে পার্সেল দেব,আবার কাউকে ড্রাইভারের পার্সেল দেব। সবাই যারা বাড়ি ফিরবে তাড়াতাড়ি করছে। তার মাঝেই কারও সাথে দাঁড়িয়ে ফটো তুলছি। সবাই তো একটু স্মৃতি রাখতে চায়। তবুও ফটো তোলা হয়নি হয়ত অনেকেরই সাথে। ছেলে বৌমার কাছে সমানেই ভীড়। সেখানে খুব একটা ভিড়তে পারছি না। সবাই দাঁড়িয়ে লাইন পাবার জন‍্য। যাক তার মাঝেই আমি ঢুকে পড়ছি মাঝেমধ্যে। তারপরেই আবার ছুটছি খাবার জায়গার দিকে।
         এভাবে ঘন্টা দেড়েক কাটার পর যেন মনে হল অনেকটা হাল্কা হল। এতক্ষণ যেন আমি ভেসে বেড়ালাম মেঘেদের মত এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। দেখলাম আমি শুধু নয় আমার পরিবারের সবাই তাদের বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব‍্যস্ত আছে। এদিকে প্রেজেন্টেশন প্রচুর জমে গেছে। আমার দেওরের ছেলে,তাপসদার পুত্র আর স্বপ্নাদির পুত্র সেগুলো ম‍্যানেজ করে কিছুটা তুললো গাড়িতে। তবুও অনেক পড়ে রইলো তখনও ওখানে। আমরা মোটামুটি সব শেষ করে যখন খেতে বসলাম তখন প্রায় পৌনে বারোটা। আমাদের বন্ধু,পরিজনেরাও না খেয়ে অনেকেই বসে ছিলেন আমাদের জন‍্য। তারাও বসলেন খেতে আমাদের সাথে। মেনু ভালো হয়েছে কিন্তু তখন আর আমাদের খাওয়ার ইচ্ছে নেই।
       যাক এভাবেই মোটামুটি সব শেষ হল ঠাকুরের আশীর্বাদে ভালোভাবে।
      অনেকটা রাত হয়ে গেল এবার বাড়ি ফেরার পালা। ছেলে আর ওদের নতুন আস্তানায় যেতে চাইল না সেদিন। সুতরাং সবাই মিলে এবার লটবহর নিয়ে বাড়ি ফেরার পালা।
         ক্লান্ত শরীর তবুও মনে এক অপার শান্তি যে একটা বিরাট কাজের সমাপন হল মোটামুটি ভালোভাবে। পরের দিন ঘরে যা খাবার ছিল আমার কর্তা উদার হস্তে তা মোটামুটি বিলিবন্টন করা শুরু করলেন আমি চোখ খোলার আগে থেকেই। দুপুরে আমি মোটামুটি চিন্তায় সতেরো জন মানুষকে ঠিক করে খেতে দিতে পারব তো? ভালোমন্দ সবই তো প্রায় শেষ। দুপুরের পর্ব শেষ হলেও রাতে খাবার অর্ডার করতে হল। যাক অনুষ্ঠানের পরদিন থেকেই আস্তে আস্তে বাড়ি খালি হতে শুরু করল। দুদিন বাদে একদমই খালি। আমার সংসার তখন অগোছালো,শরীর ভেঙে আসছে। গায়ে জ্বর,গলা ব‍্যথা,গলা বসা। যেখানে শুই আর উঠতে ইচ্ছে করে না। এই করে কোনরকমে কয়েকদিন কাটলো। ভাইবৌ কয়েকদিন ছিল বলে সে আমাদের জামাকাপড় গুছিয়ে দিয়ে গেল যতটা পারলো।
        বলল দিদি অসুস্থ শরীরে অগোছালো বাড়ি দেখলে আরও শরীর খারাপ হবে। তখন দেখি সেও কাশছে। মোটামুটি বিয়েবাড়িতে যারা এসেছিল পরে শুনলাম অনেকেরই ঠান্ডা লেগেছে। অবশ‍্য তার জন‍্য আমাদের স্টাইল মারা অনেকাংশে দায়ী ছিল। কী আর করা যাবে,ছেলের বিয়ে বলে কথা...
    লোকজন চলে গেল,ছেলে আর ছেলের বৌ হানিমুনে চলে গেল। এই কদিন উৎসবের তৎপরতা আর আলোর রেশটুকুর শেষে আমিও যেন আঁধারে ডুবে গেলাম। বারবারই মনে হল বেশ ছিল অনুষ্ঠানের দিনগুলো। আসলে আমরা সবাই একা থাকতে চাই আজকাল,একা থাকাতেই সবার সুখ আর আনন্দ। তবুও যে আনন্দ সবাই মিলে একসাথে থাকার মধ‍্যে আছে তা একলা থাকায় নেই।
       আমার একাকীত্বের দিনযাপনের আবার শুরু হল,সেই একঘেয়েমি,সকালে স্কুল আর স্কুল ফেরত চার দেওয়ালের মধ‍্যে বন্দী জীবন। দুজন মানুষ কী আর কথা বলব সারাদিন। ছেলে বৌমা হানিমুন ফেরত বাসা বেঁধেছে ওদের নতুন আস্তানায়। রাতের টেবিলে উপস্থিত সদস‍্য সংখ্যা আর বাড়েনি বরং কমেছে একজন। মায়ের বুকটা ফাঁকা লাগে বড্ড,আসলে জড়িয়ে থাকার অভ‍্যেস অনেকগুলো বছরের তো। ছেলে আসে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়,দুপুরে খায় আমার কাছে। মৃদুস্বরে কখনও বলি কখনও অভিযোগ করি এখান থেকে কী একদিন অফিস করতে পারে না বৌমা? তারপর আবার মনকে শান্ত করি। মানিয়ে আর মেনে নেওয়ার নামই তো জীবন। হয়ত দূরে থাকাই ভালো,তবুও দূরত্ব আবার সবটুকু মুছে নিয়ে যাবে না তো? কেন যেন সেই ভয়ও হয়। ঘুম না আসা আঁধার রাতে ছেলের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কখনও ওর অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াই...আসলে মা তো তাই নাড়ীর টান যে বড় বেশি। ছিঁড়ে দেব ভেবেও ছিঁড়তে পারি কই?
সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...