আমাদের জীবনের যে দিনগুলো চলে গেছে তা নিয়ে আর আফশোস করি না। তবুও মাঝেমধ্যে মনে হয় আমরা বোধহয় একটু বেশিই বাধ্য আর ভীতু ছিলাম। যার ফলে আমাদের কিশোরীবেলা আর সদ্য যৌবনে পা রাখা জীবনের কঠোর অনুশাসন মেনে নিয়েছি চুপ করে। মেনে নিয়ে,মানিয়ে নিয়ে আর ভয় পেয়ে কেটে গেছে কখন যে জীবনের অগুনতি দিন তার কোন হিসেব নেই,হয়ত বা মুছে গেছে কিছু আলো ঝরানো সোনালী দিনও। আমাদের সেই সময়ে ছিপছিপে গড়ন থাকা সত্ত্বেও সরু ফিতের তো দূর অস্ত এমনকি হাত কাটা জামা পরার কথা স্বপ্নেও ভাবা হয়নি,কারণ সেটা ছিল অশালীন পোশাক আমাদের বড়দের কাছে। তাছাড়া আরেকটা বড় বিষয় ছিল লোকে কী বলবে? যত বড় হতে শুরু করলাম জামাতে কুচির সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। বাবার শাসন চোখে কাজল পরা যাবে না, কোন সাজগোজ করা যাবে না। যাতে মেয়েকে দেখতে সুন্দর লাগে বা ছেলে ছোকরাদের নজর পড়ে এমন কিছুই করা যাবে না। এখন কম বয়েসেই মেয়েরা সাজে,নানা ড্রেস পরে মুখকে চোখকে সাজায় মনের মত করে। পার্লারে গিয়ে চুল কাটে নিজের মত পছন্দ করে। আমাদের লম্বা চুলকে শাসন করতে মা বসতো টুলের ওপর,আমি মাটিতে। তারপর চলত ঘ্যাচাঘ্যাচ চিরুনির টান আর তেলের আদর। তারপরে সেই তেল মাখা চুলকে দুই ভাগ করে সরু কালো ফিতে দিয়ে প্রাণপণ টাইট করে গোড়া বেঁধে কলা বিনুনী করে ঝুলিয়ে দেওয়া হত দুইদিকে। কখনও বা কানবেণী নামে এক বিশেষ চুলের স্টাইলে চুল বেঁধে দেওয়া হত। কণি সিনেমাতে আমি নায়িকার এমন চুল বাঁধা দেখেছি। লোকজনের সামনে এমন চুল বেঁধে আসতে বেশ লজ্জিত হলেও কিছু করার ছিল না। বিকেলের বিশেষ সাজ ছিল সেটাই। মুখে শীতকালে মাখানো হত রগড়ে রগড়ে পন্ডস্ অথবা চার্মিস ক্রীম,আর গরমে স্নো। তবে গরম কালে কিছু না মাখলেও চলে যেত,মানে ঘেমো সরল সাধাসিধে মুখটা এমনিতেই চকচক করত। তখন পাউডার মাখাটা বেশ একটা আদুরে সোহাগের প্রলেপ ছিল। বেশ গলা ভর্তি পাউডার মেখে গরমকালে থাকতে হত। বাবার পাউডার কেনাটা বিলাসিতা ছিল,সুন্দর গন্ধ দেখে পাউডার কেনা হত পয়লা বৈশাখের বাজার করতে গেলেই। এখন মনে হয় আমাদের প্রজন্মের মানুষজন এক অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে,মানে যারা একাধারে যেমন শ্বশুরবাড়ির অথবা বাবা মা আর স্বামীর মন জুগিয়ে যেমন চলেছে তেমন এখন আধুনিক মনস্ক ছেলে,মেয়ে আর বৌমার মন জুগিয়ে চলছে। একটা সময় বাবা মায়ের মুখের ওপর কথা বলতে পারেনি। তারপর মেনে নিয়েছিল শ্বশুরবাড়ির নিয়ম কানুন আর অনুশাসন। এমনকি তাকে সারাজীবন ভালো রাখার দায়িত্ব নেবে বলে গাল ভরা মন্ত্র পড়া স্বামীটিও কোন প্রতিবাদ করে তার পাশে এসে দাঁড়ায়নি যখন তার সালোয়ার কামিজ পরে বেড়াতে যাওয়া নিয়ে ঝড় উঠেছিল শ্বশুর বাড়িতে।কথায় কথায় উঠতে বসতে অপমানিত হয়ে বৌয়ের জীবন কাটলেও। তা দেখেও সে মুখ বুজে সয়েছে তার শয্যাসঙ্গিনীর অপমান। কারণ তাকেও মানুষ করা হয়েছিল একই অনুশাসনে,আর বৌ মানেই সে নেহাতই দাসী তেমনি শেখানো হত বিয়ে করতে যাবার সময়। সেই সময়ে কঠোর অনুশাসন মেনে নেওয়া আমাদের মত অনেকেই বুঝতে শিখি সংসারে টিকে থাকতে হলে এভাবেই মেনে নিয়েই খুশি থাকতে হবে। এভাবেই আমাদের জীবনে পার হয়ে গেছে চোদ্দ,পনেরো,ষোল,আঠেরো উনিশ কুড়ির কত বসন্ত একটা সময় এই করতে করতে আজ আমরা আধ বুড়ি। মায়ের যত্ন করা চুল এখন হাল্কা,চামড়া ঢিলে,শরীরে মেদ আর মুখে বলিরেখা। প্রশংসা পেতে সাজানো গোছানো এডিট করা ছবি পোস্ট করি, যে পোশাক সময়ে পরা হয়নি তা পরে দাঁড়াই আয়নার সামনে। মনকে বুঝিয়ে বলি ভালোই লাগছে,কী বলিস্। যে কটা দিন বাঁচবো এবার নিজের মত করে বাঁচবো। কিন্তু সত্যিই কী তা হয়? যা যায় তা চলেই যায়। সত্যিই কী যা কিছু চকচকে তা কী তেমনি? নাকি অনেক ক্ষত চিহ্ন আমাদের মুখ আর মন জুড়ে। আমাদের মত মানুষজনেরা এখন ভালো থাকতে চায়। নিজের মত বাঁচতে চায়। সবার মন রক্ষা করতে করতে,আর মাপা কথা বলার অভিনয় করতে করতে তারা ক্লান্ত। অনেকেই নিজে বিন্দুমাত্র প্রশংসা কোনদিন না পেয়েও,গলা তুলে প্রশংসা করে অন্যের। সারাদিন পজেটিভ কথা বলে আড়াল করতে চায় মনে জমে থাকা অনেক নেগেটিভিটি। অবহেলা পেতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মনটাকে ভালোবেসে নিজেই বলে ভাবিস কেন মন? থাকবো আমরা দুজনকে জড়িয়ে বাঁচবো যতক্ষণ। অবহেলিত আমরা যখন আমাদের চারদিকে কত ভালোবাসার,আদরের আর যত্নের গল্প দেখি মন বিদ্রোহ করে,কখনও কাঁদে আবার কখনও চিৎকার করে প্রতিবাদ করে বলে কী করিনি আমি সবাইকে ভালো রাখতে...তাহলে আমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব কেন কেউ একটুও নেবে না?
নিজের মাল নিজের দায়িত্বে রাখুন একটা বহুল পরিচিত কথা ছোটবেলা থেকে বাসে লেখা থাকতে দেখেছি। এখন বুঝি নিজের মন নিজের দায়িত্বে রাখুন,মাঝেমধ্যে তাকে দিন একটু খোলা হাওয়া। 💝
বেরিয়ে পরলাম তাই☺️
দু দিনের জন্য একটু অবকাশ আর ছুটির ঘন্টা বাজতেই আমাদের মাঝবয়েসী জীবনে হঠাৎই ভেসে আসে কত আনন্দের স্বপ্নপূরণের গন্ধ। ট্রেনে উঠে মনে হল,এই দুটো দিন শুধু আমার। এই দুটো দিনে ভাববো না আজ কী রান্না হবে? বাজার থেকে কী কী সব্জি আসবে?কেউ তাড়া দেবে না চায়ের জন্য। ঘড়ির অ্যালারামের হাঁকডাকে ভোরে উঠে ভোকাট্টা ঘুড়ির মত ছুটতে হবে না বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে বাস ধরতে। এই দুটো দিন আমার সামনে আসবে গরম ভাতের থালায় সাজানো ডাল,ভাজা,সব্জি আর মাছের ঝোল।
সাজিয়ে গুছিয়ে দেবে কেউ গরম কড়াই থেকে নামানো টোল না খাওয়া ফুলকো লুচি। আয়েসে বসে পাহাড় দেখতে দেখতে উপভোগ করব তার স্বাদ। সন্ধ্যেতে গরম চায়ের সাথে কামড় দেবো পেঁয়াজ পকোড়ায় অথবা তুলতুলে নরম মোমোতে। রাতে গরম ধোঁয়া ওঠা মুরগীর তেল মাখো মাখো ঝোলের আদরে মাখানো রুটি নিশ্চিন্তে পুরব মুখে। খাওয়া সারার পর সব গুছিয়ে ফ্রীজে তোলা নেই,নেই টেবিল গুছিয়ে আর রান্নাঘর সাফাই করে ঘুমোতে যাওয়া। এই দুদিন শুধু পাহাড় দেখবো,কান পেতে শুনব হাওয়ার শব্দ আর মাখব সবুজ চোখে মুখে যত পারি। ধুসর হয়ে যাওয়া মনেও মেখে নেব কিছুটা সবুজ রঙ।
তবুও পিছুটান ছাড়ে না আমাদের সংসারী মনকে,পাহাড় দেখতে দেখতে আনমনা মন হঠাৎই ভাবে যাদের রেখে এলাম তাদের কী খাওয়া হল? ঝরা পাতাদের সোনালী রঙ দেখতে দেখতে বেজে ওঠে ফোনের টুং টাং আওয়াজ। ওপাশ থেকে শোনা যায় মেয়ের গলা,কেমন আছো? সব ঠিক তো? সাবধানে হাঁটছো তো? পাহাড়ের ধারে চলে যেয়ো না আবার ফটো তুলতে গিয়ে। হয়ত সেও জানে মায়ের দায়িত্বের বোঝা বয়ে ক্ষয়ে যাওয়া মনের ভেতরে বাস করা কিশোরী মনের হদিস। বুঝতে পারে ক্ষণিক স্বাধীনতা আর সঙ্গীনীদের পেয়ে সেই মন হয়ে উঠবে বাঁধনছাড়া করতে চাইবে যা খুশি আর মা হয়ে উঠবে অবাধ্য এক কিশোরী...যে নিষেধের গন্ডী পেরিয়ে হয়ে উঠবে বাঁধভাঙা তিস্তা নদীর মতই উচ্ছ্বল।
আমার মন তখন এলোমেলো,চোখ বিস্ময়ে দেখছে পাতা ঝরার ছবি। এই ছবি কাশ্মীরের বা বিদেশের কোন দেশের নয়,বিদায়ী বসন্তে উত্তরবঙ্গের গাছপালা সেজেছে এক অপরূপ সাজে। পাতার রঙ আমাকে মুগ্ধ করল। প্রতি ধাপে আলাদা আলাদা রঙ। কোথাও পাতারা সবুজ,কোথাও বা হলদে কোথাও সোনালী,কোথাও লাল আর কমলা। ঈশ্বর তাঁর রঙের বাক্স খুলে দিয়ে ইচ্ছেমত রঙ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলেছেন চারদিকে। প্রকৃতি আমাদের শেখায়,প্রকৃতি ভালো রাখে..প্রকৃতি আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। এমন সুন্দরী প্রকৃতির রঙ নেশা ধরায় চোখে। আমাদের গাড়ি এল লাভার্স পয়েন্টে,এ পথে আরও কয়েকবার গেছি। তবে এবার বসন্তে সোনালী ঝরা পাতার সারি ভালোবাসার পথকে করেছে মনোমুগ্ধকর। গাড়ি থেকে নেমে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না সেই দৃশ্য দেখে। লাভার্স পয়েন্ট.. এখানে কী সত্যিই ভালোবাসা হয়? নাকি এ পথ ভালোবাসার? হয়ত বা নীচে বয়ে যাওয়া তিস্তা আর রঙ্গিতের ভালোবেসে জড়িয়ে থাকার প্রেমকথাই এই জায়গার বিশেষত্ব। তবে প্রকৃতি আমাকে মুগ্ধ করলো এবার। চোখ মুগ্ধ হল মন ভালোবেসে ফেললো সোনালী পাতাদের,আর গাছেদের আদরে জড়িয়ে থাকা।
আমি উত্তরবঙ্গের কন্যা,নিজেকে উত্তরবঙ্গ কন্যা বলতে ভালোবাসি। গভীর প্রেম আমার এখানকার মাটির সাথে। তাই ছুটে ছুটে যাই বারবার এখানকার মাটির গন্ধ নিতে।
সমতলের দাবদাহে দগ্ধ হওয়া শরীর আর মনে তখন পাহাড়ের হাওয়ার ঝাপটা। ঠান্ডা হাওয়ার মিঠে আদরে মন তখন এলোমেলো,চোখ জানলা থেকে সরতেই চায় না অবাধ্য খুকির মত উঁকিঝুঁকি করে দেখছে অবাক বিস্ময়ে পাহাড়ের রঙ আর প্রকৃতির মন ভালো করা রূপ। অবাধ্য মন তখন শুধু দেখতে চায়,হয়ত বা তার হঠাৎই আসা মনকেমন আর কষ্টে সে প্রলেপ দিতে চায় ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা দিয়ে। চোখ কখনও মুগ্ধ হয়ে জানলা দিয়ে একবার সামনে উঁকি দেয় আবার তার পরেই উঁকি দিয়ে দেখে পেছনে ফেলে আসা পাতাদের বাহার। হঠাৎই দেখা যায় সোনালী পাতারা অদৃশ্য। এখানে গাঢ় সবুজ চাদরে নিজেকে ঢেকেছে পাহাড়। পাহাড়ী মেয়েদের দেখি সবুজ পাতাদের ছিঁড়ে তাদের হাতের মুঠোয় মুড়ে পিঠের ঝুড়িতে রাখছে। আমরা বলে উঠি ঐ যে চা বাগান দেখা যাচ্ছে! মনটা আবার চঞ্চল হয়ে ওঠে,মনে পড়ে যায় প্রথম চা বাগানের প্রেমে মাতাল হবার স্মৃতি। ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা সবুজের গালিচায় মন হারিয়ে আদর করতাম পাতাদের মন ভরে,আর চা বাগানের পাতা সরিয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতাম। সময়ের সাথে সাথে কত কী বদলায়... তবুও স্মৃতি বাছাধন বড়ই নাছোড়বান্দা,সে ঠিক থেকে যায় মনের মণিকোঠায় প্রাণের বন্ধু হয়ে তা সুখস্মৃতিই হোক বা দুঃখের স্মৃতি। আমাদের গাড়ি থামলো পেশক টি গার্ডেনে। এ বাগানের শোভা যেন এর আগে আরও মনোরম দেখেছি। আমার সঙ্গিনীদের শখ হল এখানকার বাহারি রঙীন পোশাকে ছবি তোলার। আমরা দুজন প্রথমে না করলেও মন চাইলো আমরাও আর বাকি থাকি কেন? আকাশে তখন তেজী সূর্যদেবতা,আর তার প্রখর তাপে ঝলসে বেগুন পোড়া হয়ে লাফালাফি করছে একটু ছোট্ট ছুটির আনন্দে মশগুল পাঁচ কন্যা। শুধু এক কন্যে ক্লান্ত হয়ে গাড়িতে বসে। বয়েসের সীমারেখা পেরিয়ে আজ তারা শুধুই কন্যা মনে তাদের সুখের বন্যা।
ছবির ফ্রেমে বন্দী হচ্ছে লাফালাফি করে ইচ্ছেমত চা গাছের হাত ধরে। কিছুটা লাফালাফির পর আবার ছুটে চলা পাহাড়ী পথ বেয়ে ওপরের দিকে। তারপর আমাদের সর্ব কনিষ্ঠ সঙ্গিনী কাম গ্ৰুপ লিডার বলে ওঠে,আরে ওটাই তো আমাদের হোমস্টে মনে হচ্ছে।
মনটা জুড়িয়ে যায় দেখে হঠাৎই,বাড়ি দুটো দেখলে প্রথমেই মনে হবে এ বাড়ির ডিজাইন অনেকটা কোচির মত,সামনে লম্বা লম্বা গাছের সারি আর রাস্তা। তবে চা বাগান আর রঙীন বৌদ্ধস্তূপ বলে দেবে এ জায়গা কোথায় হতে পারে? জায়গাটার নাম কোঠিধুরা,এ পথে আগে গেলেও এই জায়গার নাম জানা ছিল না। জানি না এখানে আসেপাশে আরও হোমস্টে আছে কিনা? তবে পথের ধারে,পাহাড়ের ধাপে চা বাগানে পা ডুবিয়ে আর সূর্যের আলোর চুমুতে মন ভালো করে দাঁড়িয়ে আর দুহাত বাড়িয়ে এই বাড়িটা। গুগলে কোঠিধুরা হোমস্টে বলে সার্চ করলেই আসবে এই বাড়ির ছবি।
আমাদের হাসিমুখে আপ্যায়ন করল ইম্পি ঐ হোমস্টের সাতভুজাই তাকে বলা যায়। কারণ হাসিমুখে আমাদের যা লাগবে সবেরই জোগান দিচ্ছিলো ও। আমাদের থাকার জন্য বরাদ্দ ছিল পাশাপাশি দুটো ঘর দোতলায়। যেখানে ঘর থেকে চোখ সোজা ধাক্কা খাবে পাহাড়ে এসে। সুন্দর কাঁচের জানলার পাশের বিছানায় বসে কল্পনার জাল বুনে আর এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে একাকীত্বকে সঙ্গী করেও কাটিয়ে দেওয়া যাবে অনেকটা সময়। এখান থেকে খুব সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। তবে বড় খামখেয়ালী আর মর্জির মালিক এই কন্যাটি,বেশিরভাগ সময়ই মেঘচাদরের তলায় আরামে ঘুমু ঘুমু করেন। তাই আলো ঝলমলে রোদ্দুরে পাহাড় স্নান করলেও তিনি বিশ্রাম নিলেন মেঘের চাদর গায়ে জড়িয়েই সেইদিন। আর আমরা কান্নাকাটি করলাম একটু দেখা দাও আমাদের লক্ষ্মীসোনা বলে। তবুও তার আলসেমি কাটিয়ে তাকে বাইরে বের করা গেল না।
আজ আর বাড়ির মত সবাইকে হাঁকডাক করে ঘর থেকে এনে বেড়েবুড়ে খেতে দেওয়া নেই। নেই শেষবেলায় একলা বসে ভাতের দলা মুখে তোলা। আমাদের জন্য যত্নে সাজানো গরম গরম ডাল সব্জি,ভাজা আর ডিমের ঝোল। খিদের সময় সামনে বেড়ে দেওয়া গরম ডাল,ভাত আর সামনে প্রকৃতির আকাশছোঁয়া স্ক্রীনে পাহাড় দেখা...আর কী চাই?
ছোটবেলায় রবিদাদুর কবিতা পড়ে বীরপুরুষের মত মাথায় পাগড়ি আর হাতে তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করতে ইচ্ছে করত। নাই বা হলাম আমি ছেলে, যুদ্ধ তো মেয়েরাও করতে পারে।
তারপর মায়ের আঁচলের নরম আবেশে ডুবে রবীন্দ্রনাথের লেখা শুনতে শুনতে কখনও মনে মনে আমি হয়েছি অমল আবার কখনও দাসী শ্রীমতি। কল্পনার জাল বুনতে বুনতে কোথায় যে পৌঁছে যেতাম আনমনে তা বুঝতেই পারতাম না। এখন বুঝি সব কল্পনা সত্যি হয় না,তবুও এই বয়েসে এসেও স্বপ্ন দেখার শেষ নেই।
একদম ছোটবেলায় ছোট রবির মত আমারও একটা জগত ছিল যেখানে আপন খেয়ালে বকবক করেই মরতাম কত। কতরকম ছিল সেই ভাবনা আর নিজের মনে খেলা করেই কেটে যেত কতটা সময়। মা বাইরে ঘুরে বেড়ানো,আড্ডা দেওয়া পছন্দ করত না একদম। তাই আমাকে ছোট থেকেই শিখিয়েছিল নিজেই নিজের বন্ধু হয়ে কিভাবে ভালো থাকা যায়। কিভাবে করা যায় একলা মনের অবসরযাপন। যত বড় হয়েছি ততই বুঝেছি এই একলা মনের অবসরযাপন কত জরুরী।
আসলে অনেক ভীড়ের মধ্যেও আমাদের ভাবনা আর চাওয়া পাওয়াগুলো বড় একা। সেগুলো এতই লাগামছাড়া আর বেহিসেবি যে তার মূল্য কেউ বোঝে না। তবে এই ভাবনাগুলো সত্যিই অমূল্য আমার কাছে। এগুলো আছে বলেই তো আমি আছি,সবাই কী সব বোঝে? আর কেনই বা বোঝাতে যাবো আমি কী চাই? এখানে মন বড় অভিমানী,কখনও আত্মসম্মানীও বটে। মনে বড় সাধ হয় আমাকে যে খুব ভালোবাসে সে নিশ্চয়ই বুঝবে আমি কী চাই?
একটা বয়েসের পর আমরা পরিণত হয়ে যাই,ছোটবেলার বকবকিয়া ছেলেটা বা মেয়েটা চুপ করতে শেখে। না পাওয়াগুলো নিয়ে আর সে ঝগড়া করে না। একটু একটু করে ছাড়তে শেখে অনেক কিছুই,সরে আসতে শেখে অনেক কিছু থেকে। আজকাল আর চোখের জলও আসে না সবসময়। একা থাকতে শিখে যাই আমরা,কাউকে আর বলি না আমার শরীরটা খুব খারাপ অথবা থেকে যা না আরেকটু। বা বলি না একটু কথা বলো আমার সাথে,আমার খুব একা লাগছে। যান্ত্রিকতার জীবনে এখন আমাদের কারও নিত্যসঙ্গী মুঠোফোন,কেউ বা বেছে নেয় ভ্রমণ। আর অনেকটা পরিণত অনেকেই করে নিজেকে ভালোবেসে একাকীত্বের যাপন।
কবিই যে বলে গেছেন..' প্রত্যেকটি মানুষের ভিতরে একটি চমৎকার একলা মানুষ লুকিয়ে আছে। নীরবে নিভৃতে প্রতিদিন একা হয়ে এই চমৎকার মানুষটির সাথে একটু কথা বলুন এর মত পরম বন্ধু আর চমৎকার মানুষ দ্বিতীয় আর কেহই নাই।'
Comments
Post a Comment