Skip to main content

মাসকাবারি

প্রতিবারই আগের দিন ডাক্তারের কাছে যেমন নাম লেখায় তেমনি নাম লিখিয়েছিল কামিনী। ওপাশ থেকে ভারী গলায় শুনতে পেয়েছিল,হ‍্যাঁ বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ চলে আসবেন। আর ডাক্তারবাবুর ভিজিট এখন ছশো টাকা। দেখানো হয়ে গেলে ওষুধটা এখান থেকেই নেবেন বুঝলেন।
        এর আগেও এই ডাক্তারকে দেখিয়েছে কামিনী,তখন মুখে বিচ্ছিরি রকম ব্রণ বেরিয়েছিল। তবে তখন ভিজিট ছিল তিনশো। ডাক্তার বাবু মোটামুটি মাসে দেড়মাসে একবার করে সময় দিয়ে ডেকে সেই ব্রণ সারিয়েছিলেন আড়াই না তিন বছর ধরে। প্রথমে একরকম ক্রীম আর সাবান,পরের বার ক্রীম বদল,তারপর আবার রাতে এক রকম আর দিনে এক রকম এইভাবেই দীর্ঘ গবেষণাতে সেরেছিল মুখ। কামিনীর মুখের চামড়া কখনও লাল,কখনও কালো,কখনও ঘেমো,কখনও শুকনো হয়ে অবশেষে তিন বছরে একটা জায়গায় এসেছিল। ব্রণ ফুসকুড়ি ভেগেছিল ডাক্তারের চিকিৎসায়। প্রতি মাসের মাসকাবারি ডাক্তারের আর ওষুধের খরচ বন্ধ হয়েছিল বেশ অনেকটা অধ‍্যাবসায় আর আর্থিক গচ্চায়। তবুও কামিনী নিজেকে বুঝিয়েছিল মুখ বলে কথা,কত লোকেই তো হিজিবিজি মেখে আর ফেসিয়াল করে পয়সা খসায়। ও ডাক্তারের পেছনে করেছে তা যাক,তবুও তো মুখটা আবার ঠিকঠাক হয়েছে।
    তবে ডাক্তারের কোন ওষুধে যে মুখ সাফসুতরো হল তা বোঝার উপায় নেই। কারণ প্রতি মাসেই বদলেছে ক্রীম। সুতরাং নিজে নিজে কখনও সেই ক্রীম লাগিয়ে মাতব্বরি করবে তার উপায় নাই।

    যেদিন শুনেছিল আর আসতে হবে না,সেদিন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল এই ভেবে যে যাক এই মাসকাবারি খরচটা এবার বন্ধ হল।
    মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর। তবে ঐ বলে না যে অসুখ কখনও পেছন ছাড়ে না। অনেক সুখের মাঝেও কোথায় যে সে ঘাপটি মেরে বসে আছে তা আমরা বুঝতেই পারি না। সুতরাং কামিনীর ত্বকে আবার অসুখ আঁচড় বসালো,প্রথমে পায়ের কয়েক জায়গাতে চাকা চাকা,গুড়ি গুড়ি আর লাল লাল। বেশ চুলকোয় সেগুলোতে। নিজের পা দুটো দেখে অস্থির লাগে কামিনীর। ইশ্ কী অবস্থা! একটা সারছে আবার আরেকটা হচ্ছে। এগুলো কী দাদ না চুলকুনি? নামগুলো মনে হতেই কেমন যেন শরীরটা আরও অস্থির হয়। তারপর কী করবে ভেবে না পেয়ে আবার সেই চামড়ার ডাক্তারবাবুর কাছে নাম লিখিয়ে গুটিগুটি পায়ে হাজির হয়। জানতে পারে ডাক্তারের ভিজিট এখন ছশো।
    মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে,' ডাক্তারবাবু এগুলো যে কী বুঝতে পারছি না। এমন কোনদিনই হয়নি আমার।'
-' আমাদের তো অনেক কিছুই কোনদিনই হয়নি। তাই বলে যে কোনদিন হবে না এমন হতে পারে? এই যে আপনার ছানাপোনা হয়েছে...'

ডাক্তারের এই দুর্মুখ স্বভাবের সাথে সে পূর্বপরিচিত তবুও কেমন যেন বিরক্ত লাগে কথাগুলো শুনে।

'তাহলে কী হবে?'

-' কী আবার হবে? সারবে তবে সময় লাগবে। এগুলো দিলাম আবার পরের মাসে অমুক দিনে আসবেন। ডেটটা মনে রাখবেন।'

 খেয়াল করলো সে ডাক্তারবাবু খসখস করে লিখে রাখলেন তার নাম তারিখ দিয়ে একটা খাতায়।'

   বাইরে এসে নির্দেশ পেলো একেবারে ওষুধ কিনে নিয়ে যাবার। ওষুধ দুদিন লাগাতেই ভংঙ্কর ফল পেলো কামিনী,তার সারা পা ভরে গেলো লাল লাল বড় বড় সংক্রমণে,যেমন তার জ্বালা যন্ত্রণা তেমনি চুলকোনো। আর ওষুধ খেলে রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অপেক্ষা করল অসহ‍্য কষ্ট নিয়ে পরের সপ্তাহ পর্যন্ত। কারণ ডাক্তার সপ্তাহে সেখানে একদিনই বসেন। পরের সপ্তাহেই অসহ‍্য কষ্ট নিয়ে হাজির হল ডাক্তারের ওখানে,সেদিন অবশ‍্য ভিজিট দিতে হল না,তবে ডাক্তার বললেন এমন হবে। এটুকু সহ‍্য করতেই হবে। এতে ভয়ের কিছু নেই,শুধু একটা খাবার ওষুধ পাল্টে দিলেন।
     এভাবেই পার হল ছয় মাস,ধন্বন্তরি ডাক্তারের ওষুধে কখনও পায়ের সংক্রমণ একদম কমে গেলে ডাক্তার আবার এমন ওষুধ দেয় যে আবার বেড়ে যায়। কোন কারণে যেতে দেরী হলে বকুনি শোনে..এমন করলে আপনার এটা সারতে কুড়ি বছরও লাগতে পারে।

       ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙে কামিনীরও, আর কতদিন চলবে এভাবে? কিছুটা বেপরোয়া হয়ে ভাবে নাহ্ আর নয় এই ডাক্তারের কাছে। কী এমন হয়েছে ওর যেটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মাসকাবারি ওষুধ দিয়ে চলেছেন উনি? প্রতিমাসে ওর নাম নথিভুক্ত হয়ে যায় খাতায় আর তারপরে ভিজিট আর ওষুধ নিয়ে একহাজার থেকে দেড়হাজার খরচ করে ফেরে। অথচ ভালো হচ্ছে না তেমন করে কিছুই। যখনই আনন্দে ডাক্তারকে বলে বেশ কমে গেছে তারপরেই দেখে পরের ক্রীমে বাড়ছে। মানে ডঃ হয়ত ভাবছেন যে মুরগী এবার তো হাতছাড়া হয়ে যাবে,সুতরাং আবার রোগ ছড়ানোর ওষুধ দাও।
     ছশো টাকার ডাক্তারকে বদলে কামিনী এবার তাদের পুরোনো ডাক্তারের কাছেই যায় অনেক ভাবনা চিন্তা করে।  উনি চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ নন বলেই তার কাছে যায়নি সে। তবুও দিশাহারা হয়ে ভাবলো দেখা যাক কী বলেন?
           এই ডাক্তারের ভিজিট এক হাজার টাকা,তবে উনি মাসকাবারি মুদিখানার মত ব‍্যবসা করেন না। মাত্র একটা ছোট ক্রীম,ভেসলিন লোশন আর একটা ওষুধ কামিনীকে সুস্থ শুধু করে তোলেনি। ভ‍্যানিশ করে দিয়েছে ওর পায়ের আর মনের দাগ। যে দাগ আর ক্ষত নাকি সারবেই না কোনদিনই নিয়মিত না আসলে এমনি বলেছিলেন ডাক্তারবাবু। অথচ তা সেরে যাচ্ছে ম‍্যাজিকের মত অল্প ওষুধেই। তার মানে রোগকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মানুষকে সুস্থ না করে মাসকাবারি একটা টাকার অঙ্ক পকেটস্থ করাই উনার কাজ। আসলে মানুষের মধ‍্যেই শয়তান আর ভগবান দুইয়েরই বাস। যারা অন‍্যের উপকার করে,ক্ষতি করে না তারা ভগবান,আর নিজের পকেট ভরতে যারা শুধুই অন‍্যায় ভাবে ব‍্যবসা করে তারাই শয়তান।
  

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...