গোলাপী কার্ডের মাঝে একগুচ্ছ গোলাপের ভীড়ে অনেকগুলো প্রজাপতি খুশিতে উড়ে বেড়াচ্ছে আর এক কোণে লেখা ইউ আর করডিয়ালি ইনভাইটেড অন দ্য অকেশন অফ লাভ অ্যান্ড কমিটমেন্ট।
মনটা হঠাৎই উড়ে যায় বত্রিশ বছর আগের অতীতে,একদম ছিপছিপে সুন্দরী একটা মেয়ে সবসময় ডান হাতে ঘড়ি পরত। দুপাশে কাটা লকস্ আর পিঠে শাসন করা সুন্দর সোজা কালো চুলের লুটোপুটি। কথা বললেই মুখে ঝলমল করত একটা মিষ্টি হাসি। ওর রুমমেট একটু বকবকিয়া হলেও ওর মুখে বেশি দেখা যেত হাসিই আর কথা কম। তাপ্তীর জন্য আমাদের ডিপার্টমেন্টে কজন ফিদা ছিল জানি না। কারণ ওর রোগা পাতলা চেহারাতেও বেশ ব্যক্তিত্বের ছাপ ছিল। চট করে নিজের ভারী মলাটের আবরণ খুলে বেরিয়ে আসত না কারও কাছেই।
তবুও আমাদের ওকে নিয়ে ফিসফাস আর কৌতূহল কম ছিল না। মাঝেমধ্যেই এর ওর সাথে ওকে জুড়ে আমরা ক্ষ্যাপাতাম। ও মিটমিট করে হাসতো কিছু বলত না। কখনও বা বলত,' ইশ্ ঐ প্যাংলা কাঠি,ক্যাবলা ছেলেটা ওকে আমার পাত্তা দিতে বয়েই গেছে। অমন কারও সাথে প্রেম করব ভাবলে তো সেই কবেই করতে পারতাম।'
আমাদের হাসির রোল উঠত। তারপর কেউ একজন ফাজলামি করে বলে উঠত,' তাহলে ঐ যে হিরো সুমন ও তো বেশ দেখতে। তোকে দেখলেই তো কথা বলতে চায়। ওকে দেখব নাকি?'
-' ইশ্,ঐ ঢ্যাঙা টা! আমার বয়েই গেছে ওর সাথে প্রেম করতে। আমার অমন প্রেমিক চাই না।'
-' তাই নাকি? তবে কেমন চাই?'
-' যেমন আমি পছন্দ করি।'
আমরা আবার পেছনে লাগতাম,' ও বুঝেছি,তার মানে আছে বিশেষ কেউ? এই আর পরিশ্রম করিস না আমাদের তাপ্তী রাণী ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে।'
একটা সময় শুনেছিলাম ওর আছে কেউ ভালোলাগার। অনেক বলে কয়ে একবার ছবিও দেখেছিলাম একটা পাসপোর্ট সাইজের। তারপরে হতাশ হয়েছিলাম দেখে,' ওরে এটা তো মনে হচ্ছে কারও মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ডের ছবি।'
তারপরেই শুরু হয়েছিল আমাদের হাসির হুল্লোড়। আর তাপ্তীর প্রেম চাপা পড়ে গেছিল কথায় কথায়। পাশ করার আগেই আমাদের কারও কারও বিয়ে হয়ে গেছিল আবার অনেকের তখনও বিয়ে হয়নি।
আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছিলাম ছেঁড়া পুঁতির মালার মত এদিকে ওদিকে। কেউ তখন মন দিয়ে সংসারধর্ম পালন করছি,আবার কেউ চাকরি করছে। কেউ আবার বরের চাকরির সূত্র ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশ থেকে দেশান্তরে।
মোটামুটি পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের সবারই বিয়ে হয়ে গেছিল। শুধু কয়েকজন ছাড়া। তবে সংসার আর ছেলে মেয়ে নিয়ে নাকাল হওয়া আমাদের হুল্লোড়বাজ মনটা একটু একটু করে ডুবে গেছিলো ঘোর সংসারী হয়ে গভীর ঝিলে। মনের চারপাশে সবাই টেনে দিয়েছিলাম এক অদৃশ্য গন্ডী।
কত দায়িত্ব তখন একদিকে শ্বশুরবাড়ির সাথে মানিয়ে চলা,তারপর সন্তান মানুষের দায় দায়িত্ব। তার ওপর কাঁধে বাড়তি জোয়াল চাকরি,সুতরাং হাঁফ ছাড়া তো দূরের কথা। দায়িত্ব আর কর্তব্যের বোঝা বইতে বইতে হাঁসফাঁস জীবন।
দু একজনের সাথে টুকটাক ফোনে যোগাযোগ থাকলেও হারিয়ে গেছিলো অনেকে। তাপ্তীও হারিয়ে গেছিল,হারিয়ে গেছিল রেখা,অনুপা,এষা আর শিউলিও। তবে মনের গভীরে সবাই কোথাও একটা ছিল লুকিয়ে। হঠাৎই ঝড় এলে ছাদে কাপড় তুলতে গেলে কোন বৈশাখী দিনে মনে পড়ে যেত এষা বা তাপ্তীর কথা। আবার একদিন কলেজ স্কোয়ারে আনমনা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয়ে গেছিল অনুপার সাথে। অবাক হয়ে বলেছিলাম,' অনুপা না? কোথায় আছিস এখন?'
তারপর কথায় কথায় জেনেছিলাম অনুপাও বিয়ে করেনি,আসলে ওর মা অসুস্থ তাই মাকে কে দেখবে এই ভেবে আর হয়নি।
-' তোর ইচ্ছে থাকলে করে ফেল,বিয়ের পর কী মাকে দেখা যায় না?'
-' দেখছি রে,মাও বলছে এই কথাই। দিদি একটা সম্বন্ধও এনেছে।'
-' তার মানে ফুল ফোটার চান্স আছে। হ্যাঁ রে আর কারও সাথে যোগাযোগ আছে? মানে আমাদের তাপ্তী সুন্দরীর কী খবর? ও কী চাকরি করছে।'
-' তেমন যোগাযোগ নেই রে,তবে তাপ্তী বিয়ে করেনি এটুকু শুনেছি। দাঁড়া এরপর ফোন নং পেলে তোকে দেব। ঘটকালি করিস পারলে।'
কিছুটা সময় হঠাৎই উড়ে চলে গিয়েছিলাম ভোকাট্টা ঘুড়ির মত তারপর আবার ফিরে এসেছিলাম। অনুপাই বলেছিল,' হ্যাঁ রে মৌসুমীর কী খবর রে?'
-' আমার কাছে তেমন কোন খবর নেই রে। ওর তো খুব ভালো বিয়ে হয়েছে। নিশ্চয়ই ভালো আছে। ওর সাথে আবার তাপ্তীর খুব ভাব ছিল। তবে ওর বিয়েতে আমার যাওয়া হয়নি সেইসময় আমি প্রেগন্যান্ট ছিলাম।'
অনুপা ওর ফোন নম্বর দিয়ে হারিয়ে গেছিলো মানুষের ভীড়ে। আমিও ট্রামটাকে হাত দেখিয়ে উঠে বসেছিলাম। একেবারে ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে ফিরব বলে।
অনেকগুলো বছর সংসারে কাটানোর পর আমাদের ছেলেমেয়েদের বড় হওয়ার সাথে সাথে আমাদের জীবনে এলো এক খুড়োর কল। প্রথমে হাতের মুঠোতে বোতাম টেপা ফোন তারপরে হাত ছোঁয়ালেই আলো জ্বলে আর ফোনেই হয় বিশ্ব ভ্রমণ।
ছেলের উদ্যোগেই আমার প্রথমে অরকুটে তারপর ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলা হল। প্রথমটা মনে হত এ যেন এক স্বপ্নের জগত। কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝেই উঁকি মারতাম ফেসবুকে। তারপর এল হোয়াটস অ্যাপ,ফোন নম্বরের সাথে আরও বেশি আত্মীয়তা আর দোস্তি বাড়লো। শুরু হল টুকুরটাকুর বাক্যালাপ,ছবি পাঠানো আর কেমন আছো ভালো আছি এইটুকু।
তবে এই ফোন সত্যিই মায়াময়ী আর মোহময়ী সুতরাং একটু অবকাশপাওয়া প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের মাতৃদেবীরা ডুবলাম সেই মোহময়ী ফোনের প্রেমে। ওরে ফোনের কী হল রে? ফেসবুক কেন দেখতে পাচ্ছি না ইত্যাদি ইত্যাদি। আরেকটা দারুণ ব্যাপার হল ফেসবুক গৃহের ছাদের তলে এক এক করে সব বন্ধুদের টিকিটি ধরে খুঁজে আনা হল। সবাইকে এক ছাদের তলে পেয়ে সে কী আনন্দ! আহা সবার কত ছবি দেখতে পাচ্ছি। সবাই কেমন আছে জানতে পারছি। তাপ্তীকেও খুঁজে পেলাম,এক এক করে খুঁজে পেলাম মৌসুমী,এষা,অনুপাকেও আরও অনেকেই এল ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্ট ভারী হতে লাগলো। কিন্তু কমতে শুরু হল কথা। আগের মত আর কারও সাথেই কথা হয় না। ঐ কালে ভদ্রে হাই হ্যালো,আর ছবি বলে যেত কে এখন কোথায় বা কেমন আছে?
তবে ঐ দেখাটুকু পেয়েই আমরা খুশি হতে শুরু করলাম এই ভেবে যে তোমার ঐ বিশ্ব থেকে কিছুই হারায়নি,আছি সবাই কাজের ভীড়ে আর মানুষের ভীড়ে।
আমাদের সুন্দরী তাপ্তীর বিয়ে হয়নি,তবে এখন আরও সুন্দরী আর পরিণত তাপ্তী। সাজগোজ করা মডার্ণ আউটফিটে তাপ্তীকে দেখে যে কোন ছেলেদেরই দিল ধড়কতা হ্যায় হবে। ছেলেই বললাম পুরুষ না বলে,যদিও আমরা এখন সবাই মধ্যবয়স্ক। তবুও তাপ্তীর ছবি দেখলে মনে হয় প্রজাপতি আদর করে গেছে ঐ মুখটাতে,চুল আর চোখে এখনও শরবতী নেশা। তবুও তাপ্তী বিয়ে করেনি। আমার সাথে মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হয়েছে। বলে বিয়ে করবে না,আসলে এই বয়েসে অনেকগুলো অভ্যেস হয়ে যায় তারমধ্যে নতুন করে একজনকে আর আনতে চায় না।
বলল,' ধ্যাৎ বয়েস কম হল নাকি? তোদের ছেলেমেয়েদের এবার বিয়ে হবে আর আমি বিয়ে করব এখন?'
-' করলেই বা কী ক্ষতি? একজন সঙ্গী তো হবে যার সঙ্গে দুটো মনের কথা বলবি। পাহাড়ের সফরে বারান্দায় বসে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিবি। তারপর অসুখ বিসুখ আছে..'
তাপ্তী সুর টেনেছিল,' না রে আর ইচ্ছে করে না। তোরা আর বলিস না এই বয়েসে বিয়ে হয় নাকি? তার থেকে এই বেশ আছি। ঘুরছি,বেড়াচ্ছি,খাচ্ছি আর চাকরি করছি। মাথার ওপর বসিং করার মত কেউ নেই।'
তা অবশ্য ঠিক,বসিং শুধু বললে ভুল হবে। বক্সিং খেলার লোক তো আমাদের আছে সুতরাং মনের চোটে আর দেহের চোটে আমরা ক্ষতবিক্ষত।
তবে এটা ঠিক যে তাপ্তী সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ায়। আর ওর বেড়াতে যাওয়ার ছবিগুলো দারুণ। খুব সুন্দর আর স্মার্ট লাগে নানারকম ড্রেসে। ওদের মোটামুটি একটা চিরকুমারী সভা আছে,সেই গ্ৰুপের সদস্য পদ নিয়ে তাপ্তী ঘুরে বেড়ায় এদিক ওদিক বেশ।
তবে বেশ কয়েকদিন আগে যা গুজগুজ করে ফিসফিসিয়ে শুনেছি তা যে এমন সত্যি হবে ভাবিনি একদম। আরেব্বাস আমাদের তাপ্তী আইবুড়ো নামকে একেবারে ঝাঁটা মেরে ঘুচোচ্ছে। ইশ্ বন্ধুদের সাথে উল্টোপাল্টা ইয়ারকি মেরে আমার মুখটাও গেছে। অবশ্য আইবুড়ো নামকে আদরে যত্নে ওর বিশেষ পছন্দের নির্ভরযোগ্য কেউ ঘোচাবে। আমাদের মত হুট করে একজনের গলায় ঝুলে পড়েনি পিতার আদেশে। বরং অনেকদিন স্বাধীনতা ভোগ করে আমাদের স্বাধীনতা মনস্ক তাপ্তী এবার জীবনসঙ্গী নির্বাচন করছে অনেক ভেবেচিন্তে।
আমার পাকা সদ্য বেশ বড় হয়ে ওঠা মেয়ে শুনে বলেছিল,'দ্যাটস দ্য রাইট টাইম টু বী ম্যারেড। বিয়ে করলে করতে হবে এই সময়ে।'
-' এই তুই যা তো,এখন বিয়ে করে কী হবে?'
-' কী আবার হবে? একজন সঙ্গী হবে,যে ওনাকে খুব ভালোবাসবে এই মাঝবেলায় একজন সুন্দরী সাথী পেয়ে। ইসু্ হবার ঝামেলা নেই। তোমার মত বাড়ির মেম্বারদের সাথে বক্সিং খেলা নেই। দারুণ দারুণ। তুমি কবে যাচ্ছো? আমার হয়ে একটা বিগ কনগ্ৰ্যাটস জানিয়ে দিয়ো।'
আমাদের হোয়াটস অ্যাপ গ্ৰুপে একটা প্ল্যানিং হয়ে গেছিল ঝটপট করে। কারা কারা যাচ্ছে তাদের নিয়ে। তাপ্তী মোটামুটি আমাদের সবাইকে নেমন্তন্ন করেছিল সুতরাং সবারই একটা আলাদা এক্সাইটমেন্ট ছিল যাবার জন্য। আমরা যখন মোটামুটি অর্ধ মৃত সৈনিক সংসারের রণক্ষেত্রে ঠিক সেই সময় তাপ্তীর জীবনে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি উড়ে আসার ব্যাপারটা ঠিক কেমন হবে?
শুনেছি ওর হবু বর খুবই কেয়ারিং,জীবনের বসন্ত পেরিয়ে হেমন্তে এসে হঠাৎ তাপ্তীর মনে হয়েছিল একদম নিজের করে পাশে থাকার জন্য কাউকে লাগে। যে ওর যত্ন নেবে,ওর কিছু হলে যার মনে চোট লাগবে। ওর একলা কাঁধে চাপানো অনেক দায়িত্বের মধ্যে কিছু ভাগ করে নেবে। সারাদিন বাদে বাড়ি ফিরে এসে কথা বলার কাউকে পাবে।
আবার অবকাশের পর দুজনে মিলে ঘুরে বেড়াতে পারবে যেখানে খুশি। আর সঙ্গী খুঁজতে হবে না। আসলে নারী পুরুষ একজন আরেকজনের পরিপূরক যদি সে তোমার মন বোঝে। এটা একসময় এসে মন বোঝার মত কাউকে পেয়ে তাপ্তী বুঝেছিল। আর সত্যিই তো জীবন একটাই তাই বাকি পথটুকু একটু ভরসা আর কাঁধে দেওয়ার মত একটা হাত থাকলে ক্ষতি কী? একা লাগতে হয়ত শুরু করেছিল এক সময়ে তাপ্তীরও। আর জীবনে হেমন্ত,শীত নিজের নিয়মে এলেও মনের বয়েস হয়ত কখনও হয় না। আসলে আমাদের মনকে বৃদ্ধ করে আমাদের চারপাশের লোকজন আর তারপর আমরা সেগুলো মানতে শুরু করি। তাই প্রেমে পড়ারও বয়েস নেই,যখন খুশি প্রেমে পড়া যায়। আমরা সবাই খুশি হয়েছিলাম তাপ্তীর বিয়ের খবরে।
দেখতে দেখতে তাপ্তীর বিয়ে এসে গেছিল। আমরা সবাই এক জায়গায় হয়েছিলাম। অনেকদিন বাদে মিলেমিশে গেছিলাম জেলা আর রাজ্যের সীমা ভুলে সবাই একসাথে। আনন্দে মেতে উঠেছিলাম সবাই,অতি কষ্টে ম্যানেজ করা দিন তিনেকের ছুটির আনন্দ চেটেপুটে সবাই নিয়েছিলাম ভাগ করে।
তাপ্তী শর্টকাটে সব সারতে গেলেও সারা হয়নি। সবাই হই হই করে উঠেছিল হচ্ছে যখন ভালো করেই হোক। সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিল মৌসুমী। আসলে ওর সাথেই তাপ্তীর বন্ধুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি।
তাপ্তীর সাজগোজ,শাড়ি পরা,বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো নিপুণভাবে করা সবই করেছিল মৌসুমী। আমরা অনেকেই মজা করেছিলাম,হ্যাঁ রে তোর বর ছাড়লো তোকে? এর আগে কোথাও যেতে হলে তো যেতিস না। বলতিস বর ছাড়বে না,আমি চলে গেলে ওদের খুব অসুবিধা। তোর বর নাকি তোকে ছাড়া থাকতেই পারে না।
- 'হ্যাঁ রে তেমনটাই ছিল,তবে যত দিন যায় বন্ধন আলগা হয়। আমিও চেষ্টা করলাম একটু আলগা দিতে।'
-' কী সব বলছিস? আলগা আর টাইট,বাবা সংসার নামক ঘানিতে আবার আলগা আছে নাকি? সবসময়ই তো কিছু না কিছু কাজ আছে।'
-' হ্যাঁ তা আছে,তবে সেগুলোর অনেকগুলোই অকাজ। যেগুলো না করলেও চলে। আমরা সেগুলো করি সবাইকে খুশি রাখতে তাই না? তো দেখলাম এবার আমাকে খুশি থাকতে হবে আরে প্রিয় বন্ধুর জীবনে ফুল ফুটেছে তার সেলিব্রেশন হবে না? তাই দীর্ঘ ছুটিতে চলে এলাম।'
আমরা অনেকেই বিয়ের দিন বা আগের দিন এসেছি। মৌসুমী এসেছে তার একদিন আগে। দীর্ঘ ছুটি আবার কী? তাপ্তীর বিয়ে হয়ে যাবে ওরা মরিশাসে হানিমুনে যাবে। মৌসুমী এখানে কী করবে? সবার মত ওকেও ফিরতে হবে।
মনে অনেক প্রশ্ন থাকলেও মৌসুমী কথাগুলো বলে ঝপাং করে গাড়িতে উঠে তাপ্তীকে নিয়ে পার্লারে চলৈ যাওয়াতে আর জিজ্ঞেস করা হয়নি।
তবে আমরা কানাকানি করেছিলাম,' মৌসুমীর কথাগুলো শুনলি? কী সব বলছে বন্ধন আলগা,মুক্তি,দীর্ঘ ছুটি?'
-' হ্যাঁ শুনলাম,মনে হল মনে মেঘ জমেছে। দেখলি না তাড়াতাড়ি করে চশমাটা মুছেই তাপ্তীর সাথে বেরিয়ে গেল। তবে মৌসুমী কিন্তু সুন্দর কথা বলে আজকাল।'
আমাদের সবার চুটিয়ে মজা হয়েছিল তাপ্তী আর তপেন্দুদার বিয়েতে। তপেন্দুদাকে বাসর ঘরে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমরা,' তাপ্তীকে তো আপনি চিনতেন তবে এত দেরী করলেন কেন? আই লাভ ইউ তো আগেই বলে দিতে পারতেন।'
তপেন্দুদা হেসে বলেছিলেন,' ঐ বিয়ে করব করব সেটাই বেশ ভালো। আর ঐ রক্ত যখন গরম থাকে তখন জীবনের ড্রাইভিং সিটে অন্য কাউকে মাতব্বরি না করতে দেওয়াই ভালো। সেটা আমরা কেউই দিইনি,মন ভরে আনন্দ করেছি। কী তাপ্তী?'
-' হ্যাঁ তুমি কী করেছো আমি কী করে জানবো? আমার তো একলা সংসার করতেই দিন কেটে গেছে।'
-' ভালো তো দুজনেই এখন অনেক অভিজ্ঞ। আমি এই বয়েসে এসে বুঝেছি এখন কেউ একজন লাগে যে অসুখ হলে ওষুধটা এগিয়ে দেবে,একটু খাবার দেবে হাতের কাছে।'
মৌসুমী হাসতে হাসতে বলেছিল,' বুঝেছি মায়ের আদরটা বৌয়ের কাছে চাই। তবে তাপ্তীর অসুখ হলেও কিন্তু একই ভাবে পাশে থাকতে হবে। একটু গরম খাবার করে খাইয়ে দিতে হবে। পারবেন তো?'
তপেন্দুদা হাসতে হাসতে বলেছেন,' একদম পারব। ঘরের কাজে আমি এক্সপার্ট। আপনাদের সখীকে আমি মাথায় করে রাখব।'
তাপ্তী বলেছিল,' মুখ খোলাস না বেশি। কী বলতে কী বলবে তারপর। ইশ্..'
মৌসুমী,' লজ্জা পাচ্ছিস কেন? এইটুকু সুখ পেতেই লোকে সঙ্গী খোঁজে। আজ আমরা সবাই শুনলাম কিন্তু। কথার খেলাপ যেন না হয়। আমাদের শান্তশিষ্ট বন্ধুটা কিন্তু খুবই ভালো। তবে ঘরের কাজ না জানলেও হবে,ঘরের মানুষকে একটু কদর করতে জানলেই চলবে।'
-' একদম প্রমিস। এই তাপ্তীকে ছুঁয়ে বলছি।'
যে বয়েসে আমরা মোটামুটি আপদ বিদেয় হলেই বাঁচি এমন সম্পর্কে গিয়ে গলাগলি না গালাগালি দিয়ে আছি।
সেই বয়েসে এসে তাপ্তীটা তবুও একজন মনের মানুষ পাবে। আমাদের মনের মানুষরা এখন মোটামুটি বনের মানুষ বা বনমানুষ হয়ে গেছে। কথাগুলো আমরাই বললাম ভোররাতে শুয়ে শুয়ে আর খুব জমাটি হাসাহাসি করলাম।
তপেন্দুদার আর তেমন কেউ নেই,তাই ওরা একজায়গাতেই থাকবে আপাততঃ। তাপ্তীটাও লাকি যে ওকে নিজের ঘর আর বিছানা ছাড়তে হবে না,বাড়তি বোনাস একটা বরও হল খবর নেবার মত।
সত্যিই আমাদের হা হা হি হি দেখলে কে বলবে আমাদের বয়েস হয়েছে। মৌসুমীই বলল,' তোদের যে একটুও বয়েস বাড়েনি সেটা বোঝাই যাচ্ছে। এমনি থাকিস সবাই।'
-' দ্যাখ,এমন করে বলছে যে ও যেন সাত বুড়ির এক বুড়ি। আজকের ছবিগুলো যা উঠেছে না.. কে বলবে যে মৌসুমী বহু বছর বিবাহিত। যেন বিয়ে দিলেই আবার হয়। তোর বর দেখলে পাগল হয়ে যাবে ছবিগুলো।'
-' তার এইসব দেখার সময় নেই,এগুলো ন্যাকামি তার কাছে। আমাদের এই ফেসবুক নাকি আমাদের মত আধবুড়িদের বারোটা বাজাচ্ছে। ছাড় ওসব,মজা করতে এসেছি মজা করব।'
আমরা সবাই ফিরে গেলাম আবার আড্ডা বিয়ের মেজাজে। বেশ একটা পরিণত বিয়ে,যখন আর বিয়ে নিয়ে কোন চাপ নেই। শুধু একটা অবসরের সঙ্গী খুঁজতে দুজন পরিণত মানুষের পাশাপাশি আসা।
তাপ্তী না না করলেও তাপ্তীর বিয়ের কোন অনুষ্ঠানই বাদ গেল না বিশেষতঃ মৌসুমীর উদ্যোগে। আমরা শুধু বৌভাতেই খেয়ে নিরস্ত হলাম না। এই মাঝ বয়েসেও আড়ি পাতলাম বন্ধুর ফুলশয্যার ঘরে।
সত্যিই বিয়ে করলো তাপ্তী আর আমরা রীতিমত উত্তপ্ত হয়ে ফুটলাম উত্তেজনায়। আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া হাত সাজলো মেহেন্দীর কারুকার্যে ওর সাথেই,হলুদ মেখে খানিক হুল্লোড় করলাম সবাই। তারপর আর যা যা দুষ্টু পচা কাজকর্ম করা যায় সবই করলাম হা হা হি হি করতে করতে।
তাপ্তীর বৌভাতের পরের দিন থেকেই বাজলো আমাদের বিদায়ের বাদ্যি কারণ অনেকেরই ফেরার ট্রেন পরের দিন রাতে। আবার দুই একজন সকালেই চলে গেছে মনখারাপ করে যার যার সংসার পানে। সেও এক মনখারাপের বেলা। পড়া শেষের পরের কান্নাটা আবার আমরা কাঁদলাম। আসলে এই কয়েকদিনের আনন্দে ভুলেই গেছিলাম মাঝের বছরগুলোর কথা। ইশ্ মনে হচ্ছিলো মাঝখানের বছরগুলোতে যেন কিছু ছিল না,আমরা এমনি কাছাকাছি ছিলাম বরাবরই।
আমরা সবাই এলেও মৌসুমী আমাদের সাথে ফিরল না। ওর নাকি কয়েকদিন ফিরতে দেরি হবে, ওর বাপের বাড়িতে যদিও কেউ নেই এখন। তবুও বাড়িটা নিয়ে খুব সমস্যা হচ্ছে তাই সেগুলো একটু মিটিয়ে ফিরবে।
আমরা আবার ঠাট্টা করলাম,' কী রে কতদিনের ছুটি নিয়ে এসেছিস? তোর বর ছাড়লো? আমাদের গুলো তো প্রতিদিন একবার করে খোঁজ নেয় কবে আসছি?'
-'আরে করবে না এমন চব্বিশ গুণ তিনশো পয়ষট্টির সেবিকা কোথায় পাবে?'
তাপ্তীর বিয়ের কয়েকটা দিন মনের সিন্দুকে অমূল্য স্মৃতি করে আমরা ফিরে এসেছিলাম আনন্দে।
তবে বেশ কিছুদিন বাদে খবর পেয়েছিলাম মৌসুমী আর ফেরেনি।
আমরা সবাই একই কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম,' ফেরেনি মানে? ও তো বলেছিল বাপের বাড়ি হয়ে ফিরবে। তবে সেখানে কী যায়নি?'
-' হ্যাঁ গিয়েছিল শুনেছি,কিন্তু তারপরে কোথায় গেছে জানা যায়নি।'
আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছিলো একটা বন্ধু মৌসুমী। যাকে মাঝেমধ্যে ফেসবুকে দেখা যেত সুখের মোড়কে,হঠাৎই কী হল ওর?
তবে কী কেউ কিডন্যাপ করলো? নাকি সম্পত্তির জন্য খুন?
অনেকেই বলল হবে হয়ত। নিশ্চয় ওর বর তদন্ত করাচ্ছে। বিয়েবাড়িতে এসে একটা মানুষ হঠাৎই উধাও হয়ে যাবে তা হতে পারে নাকি?
নিশ্চয়ই মেয়েটাকে কেউ....মেয়ে কী বলিস রে?
এখন আবার কী হবে?
কে জানে কার কখন কী হয় কে বলতে পারে?
হয়ত বা ইয়ে টিয়ে ছিল কারও সাথে। কে বলতে পারে?
************************
মৌসুমীকে আমরা সবাই চিনলেও ও ছিল তাপ্তীর খুব কাছের বন্ধু। মোটামুটি এই বিয়ের সবটাই ও করেছিল একদম পাকা গিন্নীর মত।
মুঠোফোনে তাপ্তীর সাথে আর আমাদের সাথে তোলা মৌসুমীর ছবিগুলো দেখতে দেখতে আনমনা হয়ে গেছিলাম আমি। মৌসুমীর গালে টোল পড়া মিষ্টি হাসি ওর মেহেন্দী লাগানো হাত আর বিয়ের দিনের লাল বেনারসীটা সত্যিই বারবারই চোখটা নিয়ে যাচ্ছিলো ওর দিকে।
আমরা অনেকেই লেগ পুলিং করছিলাম ও....' আরে বিয়েটা কার তো বুঝতেই পারছি না। এখনও তোকে আবার ছাদনাতলায় বসানো যায়। মৌসুমী হেসেছিল,' না বাবা আর দরকার নেই নিজের বিয়ে পরের প্রজন্মের বিয়ে সবই সম্পন্ন করেছি। এবার যা ভাববো তা নিজের মনকে খুশি করতে আর যে কিছু করার নেই। এখন লাল,কালো,সাদা,হলুদ যা খুশী পরব।
এই বয়েসটা আমাদের যা খুশি করার সময়,ঐ যে কবিগুরু বলে গেছেন না,' নাই নাই ভয়,হবে হবেই জয়।'
-'বাপরে আর কত কী জয় করবি শুনি? ভালো বৌমা ছিলি শুনেছি। বরের ভালো বৌ,ছেলের ভালো মা আর কী চাই? এখন ইস্যু কী পরের প্রজন্ম? সেখানেও তুই জয়ী হবি নিশ্চয়।'
মৌসুমী পান চিবোতে চিবোতে বলেছিল,' ধ্যাৎ পরের প্রজন্ম আমাদের মত বোকা নয়,ওরা না বলতে পারে। সবার কাছে ভালো হতে হবে সেই শিক্ষা ওরা নেয়নি। নিজের যাতে ভালো হয় সেটাই তারা করে। আমাদের মত বোকা ওরা নয়।'
-' আমাদের একটা ডিসিপ্লিন ছিল রে আর সেটাই ভালো। এখনকার ছেলে মেয়েরা তো একেবারে যা খুশি করছে।'
-' ভালোই তো করছে এখন মনে হয় জানিস। আসলে জীবন তো একটাই। ছোট বয়েসে কাঁচের চুড়ি পরতে ইচ্ছে করত বাবা পরতে দেয়নি। বাবার পছন্দকে দাম দিতে ছোটবেলার সেই খামখেয়ালী মনটাই কোথায় হারিয়ে গেল।'
-' সত্যিই রে আমরা বড় ভীতু ছিলাম। জানিস তো আমি মিহিরদাকে পছন্দ করতাম। মিহিরদাও আমাকে.. বাবা তো ওরা বামুন নয় বলে কী সাঙ্ঘাতিক কান্ড করল। আর আমার ভাইঝি দিব্যি খ্রীষ্টান বিয়ে করে ফেলল। বাবা এখন চুপ।'
-' তোরও কেউ ছিল নাকি রে মৌসুমী? অবশ্য এখন বললেও আর কি হবে?'
-' যা হবে না কখনও তা জেনেছিলাম ছোট থেকেই। তাই আর সে পথেই হাঁটিনি। বাবার সম্মান তখন অনেক বড়,আমাদের মন ছিল বড়ই ঠুনকো। যে কেউ এসেই তা দুমড়ে ভেঙে দিতে পারত। তাপ্তীটা ভালো করেছে বুঝলি।'
অনেক কিছুর মধ্যেই খোলামেলা হয়ে সকলেই মনের পুরোনো কিছু ক্ষতকে আবার খুলে ক্ষতস্থানের কাটাটা একটু দেখিয়েছিলাম সবাই সবাইকে। হয়ত কারও ক্ষতস্থান গভীর হলেও তা প্রকাশ্যে আনা যায় না বলে দেখানো যায়নি। কে জানে মৌসুমীরও তেমন কোন গোপন ক্ষত ছিল কিনা?
একটু একটু করে সবই চাপা পড়ে যায় তেমনি আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছিল একটা নাম মৌসুমী। তাপ্তী বেশ ভালো আছে ওর নতুন জীবনে তবে ওকেও কথা শোনাতে ছাড়েনি নাকি মৌসুমীর বর। বলেছে নাকি মৌসুমীও হয়ত আধবুড়ি বয়েসে ছুড়ি হয়ে কাউকে নিয়ে ভেগেছে। আর যদি ফেরত আসেও কখনও তো ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বিদায় করবে ঐ মাথা খারাপ নষ্ট মহিলাকে।
তাপ্তী কথাগুলো বলতে বলতে খুব উত্তেজিত হয়েছিল। বলেছিল,' ছিঃ ছিঃ আমার সাথে কয়েকবার কথা হয়েছে ওর বরের। দেখাও হয়েছে। তবে তখন চরিত্রে প্লাস্টার করে রঙ করা ছিল।
মৌসুমী যাওয়াতে সবই খসে পড়েছে। ভাবছে আমার বরের কোন বন্ধুর সাথেই নাকি ও...থাক ছাড়। আর মৌসুমীটাও..ভীষণ রাগ হয় ওর ওপর একবারও যোগাযোগ করল না! ফোন নংটাও নেই।'
মানুষের মন বড় জটিল তাই আমরাও ভাবলাম নিজেদের মত করেই কত কিছু। তারপর আবার সবাই চলতে শুরু করলাম জীবনের উঁচু নীচু পথে নিজেদের মত করেই ব্যালেন্স করে আর আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেল মৌসুমী।
মাঝেমধ্যে মৌসুমী বায়ুর মতই মনে পড়ত সেই নামটা,কিছুটা বৃষ্টি ঝড়ত যারা ওকে ভালোবাসতাম তাদের মনের গহীনে। তারপর আবার সব চাপা পড়ে যেত।
অনেকগুলো বছর কেটে গেছে,আমরা এখন সত্যিই বোধহয় বয়সে বার্ধক্যের তকমা পেয়েছি। আমাদের ষাট পেরিয়েছে। আমার খুব স্বাধীনচেতা কন্যা সন্তানটিও ছাদনাতলায় গাটছড়া বেঁধেছেন অনেক নাক উঁচু করে। আমার কিন্তু জামাইকে বেশ ভালোই মনে হয়। ওদের পরিবারও আমাদের পছন্দ হয়েছে।
দুজনের ভাব ভালোবাসা বেশ ভালোই হয়েছে। একজনের আরেকজনকে ছাড়া চলে না। যাক তবুও ভালো যে তার কাউকে পছন্দ হয়েছে। আমার কর্তা আজকাল তেমন কোথাও যেতে চান না। তার নাকি বেড়াতে আর ভালো লাগে না। ঠিক মনের জোর পান না বাড়ির বাইরে বেরোতে। আসলে এক্ষেত্রে দোষ বোধহয় আমরাই করে ফেলি একটা বয়েসের পর ওদের বিশ্রামের মেয়াদ বাড়িয়ে। যাক এখন আর ভেবে কী হবে? তবে উনি নিজের বাড়িতে খোশ মেজাজে থাকেন রান্নার লোক কাজের লোক আছে সুতরাং কোন ত্রুটি থাকে না সংসার চলায়।
তাই অনেকদিন কোথাও না যাওয়া হওয়ায় মেয়ে আর জামাইয়ের আবদারেই ওদের পরিবারের সাথে আমিও বেরিয়ে পড়লাম দক্ষিণ ভারতের দিকে। আমার বেয়ান আমার বন্ধু বেশি সুতরাং কোন অসুবিধা নেই। আর মেয়ে,জামাই আর বেয়াইও আছে।
বেশ কিছু জায়গা ঘুরে আমরা পন্ডিচেরী পৌঁছোলাম। এই জায়গা আমার বেয়াইয়ের বড় প্রিয়। উনি এখানে বেশ কিছুটা সময় অধ্যাপনা করেছেন। আমরা এখানে কয়েকটা দিন থাকবো সেটা আগেই নির্ধারিত হয়েছিল। ওনার এক বন্ধুর বাড়িতে তাঁরা থাকেন না সেখানেই তাঁদের অনুরোধে আমরা উঠেছিলাম। এই জায়গাটা বড় সুন্দর আর নিরিবিলি। সত্যিই ভদ্রলোক খুবই সুন্দর জায়গায় বাড়িটা করেছেন।
আগেরদিন অনেকটা জার্নি করে সবাই ঘুমোচ্ছে কিন্তু আমার ঘুম গেছে ভোরেই। তাই বেয়ানকে বলে একটু বেরোলাম বাইরেটা দেখব বলে। আর সঙ্গী ফোন তো রইলোই যদি ভুল পথে চলে যাই তো ফোন করে নেব। বাইরে বেড়াতে এলে আমার ঘুম হয় না,দেখার ইচ্ছে বাড়ে। এছাড়া ছবি তোলার শখ তো আছেই। কর্তাকেও আপডেট দিতে হয় প্রতিদিনের।
হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম যেন এক পবিত্র জায়গায়। এই জায়গাটাকে অরোভিল বলে,এখানে দেশী বিদেশী সবাই থাকতে পারে শান্তিপূর্ণ ভাবে। মানুষের সুখ সুবিধার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এখানে আছে তবে সবাই এখানে সেবক। খুবই সরল সাধাসিধে জীবন যাপন করে মানুষ এখানে। জায়গাটা ঘিরে এক অদ্ভুত পবিত্রতা। মনে হচ্ছে সুন্দর সাজানো গোছানো একটা নিরিবিলি স্বর্গরাজ্যে এসে পড়েছি। মানুষ বড় শান্ত আর নম্র,কোন চিৎকার নেই। পাশ দিয়ে কেউ গেলে শুধু নীরব হাসির বিনিময়। একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে মাতৃমন্দির।
হঠাৎই আমার পা আটকে যায় একটা ছোট্ট বাড়ির সামনে। ভেতর থেকে গান ভেসে আসছে তানপুরার সাথে বহে নিরন্তর আনন্দধারা। এ গান আমি আগেও শুনেছি বেশ কয়েকবার,গলাটাও আমার খুব চেনা। তবে আগে যে উচ্ছ্বাস ছিল গলায় তা আর নেই। কেউ যেন আপনমনে নিজেকে শোনাতেই গেয়ে চলেছে এই গান। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি আর কিছুতেই সরে আসতে পারি না ওখান থেকে।
এ তো মৌসুমীর গলা,তাপ্তীর বিয়েতেও বাসরে এই গানটাই গেয়েছিল। তবে কী আমাদের হারিয়ে যাওয়া মৌসুমী হারায়নি? আছে এখানেই?
কিন্তু কার সঙ্গে? নাকি একা?
কাউকে কী ফোন করব? নাহ্ থাক,হয়ত মেয়ে ফোন করবে উঠে তখন বলব। আমি গান থামার অপেক্ষা করি তারপর আস্তে আস্তে গেট সরিয়ে ভেতরে এসে দাঁড়াই। ভেতর থেকে ইংরেজীতে কথা ভেসে আসে খুবই মৃদুস্বরে, জানতে চায় আমি কে?
আমিও নাম বলি। তারপরে যে বাইরে এসে দাঁড়ায় তাকে দেখে প্রথমটা পাঁচ বছর আগে লাল বেনারসী পরা মৌসুমীর সাথে মেলাতে না পারলেও পরে আস্তে আস্তে মিলে যায় সবটুকুই। যাকে দেখলাম সে যেন এক স্নিগ্ধ সাধিকা। গলায় স্ফটিকের মালা পরনে দুধ সাদা শাড়িতে সরু পাড়ে সুন্দর কাজ। মাথার চুল চূড়ো করে বাঁধা।
আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না,'তুই এখানে!'
ও এগিয়ে এসে আমার হাত ধরল,' বলল ভেতরে আয়।'
ছিমছাম ঘরের অন্দর সাজ আমাকে মুগ্ধ করল,মন নিয়ে গেল এক পবিত্র তীর্থে। টেবিলে বড় করে বাঁধানো শ্রীমা এবং ঋষি অরবিন্দের ছবি। সামনে সুন্দর করে সাজানো কয়েকটা সাদা ফুল।
আমি তখন উত্তেজনায় ফুটছি,আমার ফোনটা বেজে ওঠে। মেয়েকে বলি এক বন্ধুর সাথে হঠাৎই দেখা হয়ে গেছে,তাই হয়ত একটু দেরি হবে। চিন্তা না করতে।
আমি শুরু করি,' তুই এখানে,আর সবাই তোকে কত খুঁজেছে। তুই এখানে সবাই জানে?'
-' কে সবাই?'
-' মানে তোর বর,ছেলে আর আত্মীয়স্বজন কেউ?'
-' না রে কেউ তেমন জানে না। আর আমি তো ডিভোর্সের পেপারে সই করেই দিয়ে এসেছিলাম। পরে বলেওছিলাম আর ফিরবনা। তখন অবশ্য সবাই বিশ্বাস করেনি,ভেবেছিল আমি এমনিই বলছি।
থাক সেসব কথা। তুই কেমন আছিস? আর সবাই ভালো তো?'
-' তুই তো আমাদের সবাইকে ভুলে গেছিস।'
-' না রে সব কী ভোলা যায়? তবুও চেষ্টা করি ভুলে গিয়ে ভালো থাকতে।'
আমি ওর চোখের দিকে তাকাই এবার তারপর হঠাৎই বলি,' কেন চলে এলি সব ছেড়েছুড়ে? একাই থাকিস?'
-' একা কোথায়? এই তো আছি মায়ের চরণে। এখানে কত কাজ সময়ই পাই না। আজ ছুটি তাই একটু তানপুরা নিয়ে বসেছি।'
আমার সব কথার জবাব কিন্তু পেলাম না,' সাজানো সংসার ফেলে এই বয়েসে কেন চলে এলি? সবাই কত কী বললো?'
-' কী এসে যায় তাতে? জন্মের পর থেকেই তো কত কী শুনেছি..আমি কেন কালো,আমি উড়নচন্ডী কেন? পড়াশোনা মেয়েদের বেশি করে কী হবে? প্রেম করা চলবে না। এটা করতে নেই,সেটা কোর না,তুমি মেয়ে সুতরাং সহবত শেখো। বেশ সুন্দর করে নিজেকে গড়তে চেষ্টা করেছিলাম রে বাবার ভয়ে,মায়ের শাসনে। কাউরও দিকে তাকাইনি যদি প্রেমে পড়ে যাই? পরে শ্বশুরবাড়ি এসে বুঝলাম এতদিন যা শিক্ষা নিয়েছি তা কিছুই নয়। ভয় পেতে শুরু কললাম আরও। চাইলাম আরও বেশী মনোযোগী ছাত্রী হয়ে সিলেবাস শেষ করতে। কিন্তু জীবনে ভালো হওয়া বোধহয় সবার ভাগ্যে থাকে না।'
-' কী হয়েছিলো?'
-' কিছুই না রে তেমন। আর ভয় অবহেলা সইতে পারছিলাম না। কেমন যেন দমবন্ধ লাগত। যখন অসুস্থ হয়ে পড়তাম বুঝতে পারতাম আমার কেউ নেই।'
-' কেন তোর বর?'
-' আমি ভুলে যেতে চাই সব অবহেলা,ওগুলো আর মনে করিয়ে আমাকে ব্যথা দিস না। এই বাণপ্রস্থে আমি বেশ আছি। কোন ভয় নেই,প্রত্যাশা নেই,কাউকে খুশি করার চেষ্টা নেই,না পারার লজ্জা নেই,শাসন নেই। তুই এসেছিস হঠাৎই আজ আমার অজ্ঞাতবাসে তা বেশ লাগছে। ছাড় না আমি আর অতীতটাকে এক্স রে করে ভাঙাচোরা সম্পর্কে উঁকি দিতে চাই না।'
মৌসুমীর দুচোখ বেয়ে হঠাৎই জল উপচে গালে এসে পড়ে। আমিও কেন যেন সামলাতে পারি না নিজেকে। আরও কিছুটা সময় বসে একথা সেকথা বলি। ও বলে ওর নিজের যতটুকূ ছিল সবটা নিয়ে এখানে চলে এসেছিল বাকিটা হয়ত মা করে দিয়েছেন। আসলে সংসার সবার জন্য নয়।
আসার আগে গলাটা জড়িয়ে ধরলাম,' তোর নম্বরটা দিবি? কিছু না মাঝেমধ্যে কথা বলব। আর কী দেখা হবে কখনও?'
-' আমার কোন নম্বর নেই রে, মানে ফোন আর রাখিনি। এখানে দরকার পড়ে না। আসলে সংসার থেকে হারিয়ে গিয়ে বিশ্বসংসারে মিশে গেলে আর কোন ব্যক্তিগত জীবন থাকে না। এ আমার জীবনের একলা বাণপ্রস্থ।'
বন্ধুর জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে মৌসুমী,যে আলমারীর দরজা বন্ধ করতে চায় তা বারবাই কেন খুলে যায় কে জানে? তুলি শুনতে চাইছিল কিন্তু ও বলতে পারেনি একটু ভালোবাসা পাবার জন্য বরের পায়ের কাছে লুটিয়ে কান্না করা সেই দিনগুলোর কথা..'আমার যে কেউ নেই গো,আমি তোমাকেই ভালোবেসেছি বিশ্বাস করো। আমাকে এত অবহেলা কোর না। একটু ভালো করে তাকাও,একটু ভালো করে কথা বলো তাহলেই হবে। নাইবা ভালোবাসলে।
নিজেকে ভিখারী বানিয়েছিল একটু ভালোবাসা পাবার জন্য। আর ওরা পেয়ে বসেছিল ওকে। বুঝেছিল ওর যাওয়ার কোন জায়গা নেই এভাবেই পড়ে পড়ে অবহেলা আর অপমানের মার খেতে খেতে একদিন মরে যাবে। ও মরে গেলে আর বেশি কী হত?
তার চেয়ে এই জীবন অনেক ভালো ওর কাছে। এখানেও ও সেবিকা,সেবাই ওর পরম ধর্ম। তবে কোন প্রত্যাশা নেই। আছে এক অপার অসীম শক্তির কাছে নিজেকে ধূপের মত পুড়িয়ে শান্তি লাভ করা।
মৌসুমীর খোলা গেট থেকে বাইরে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে আবার ফিরে তাকিয়েছিলাম। হয়ত শেষবারের মতই দেখেছিলাম আরেকবার ওকে। তারপর দুজনেই হারিয়ে গেছিলাম জনমানুষের অপার সমুদ্রে। পরের দিন,তার পরের দিন ওখানে থাকলেও আর দেখা করতে যাইনি ওর সাথে।
ফিরে এসেছিলাম অনেক কথা মনের ঘরে কপাটবন্ধ করে। বুঝেছিলাম বন্ধুত্বেরও কিছু মূল্যবান শর্ত থাকে তার মধ্যে একটা হয়ত গোপনীয়তা। মৌসুমী ভালো থাক ওর বাণপ্রস্থে।
Comments
Post a Comment