আজকাল আমরা কর্তা গিন্নী বেশিরভাগই দুজনে একাই ঘুরতে যাই ছেলেমেয়েদের ছাড়া। অনেকেই মজা করে বলে হানিমুন ভালোই চলছে। কেউ বা বলে ভালোই তো ফূর্তি করে বেড়াচ্ছো,বাড়িতে যে মেয়েটা রয়েছে তার খবর নিচ্ছো তো? অথবা ভালোই তো আছো,দুদিন বাদে বাদেই হিল্লী দিল্লী ঘুরে বেড়াচ্ছো।
হিল্লী,দিল্লী ঘুরেই হোক বা যার যা পছন্দ করেই হোক সবারই উচিত ভালো থাকার চেষ্টা করা। অনেক খারাপ থাকা আর খারাপ লাগা পেরিয়ে একটা বয়েসের পর আমরা সবাই একটু ভালো থাকতে চাই। তাতে হয়ত অনেকেই বলে বুড়োবুড়ি ফূর্তি করে বেড়াচ্ছে(অবশ্য যারা বলে তারা ভাবে না চিরকাল ছুড়ি কেউ থাকে না),কেউ বা বলে ওদের অনেক টাকা,আমাদের অত নেই বাপু খরচ করার মত। অনেকেই আবার সুলুক সন্ধান করেন মগজাস্ত্র খাটিয়ে আমরা কোথায় টাকা পাই?
আসলে আমাদের জীবনের কষ্টের দিনগুলো যেমন একাই সইতে হয় ঠিক তেমনি আনন্দের দিনগুলোরও প্ল্যানিংও একাই করতে হয়। যেমন আমরা করেছি ছেলের বিয়ের সময়। সেটা কিভাবে কতটা পরিকল্পনা করে এগোতে হয় তা জানাটাও ভীষণ জরুরী,যেটা আমার ব্যক্তিগত মত। তবে অবশ্যই কাউকে কষ্ট দিয়ে বা স্বার্থপর হয়ে নয়।
জীবন আমাদের বড় ছোট তা এখন খুব বুঝি যখন হাতে পড়ে থাকা বছরের দিকে তাকাই। তবুও নষ্ট হওয়া সময়ের কথা ভেবে আমাদের এই মাঝবয়েসে আর আক্ষেপ করতে আর মন চায় না। ইচ্ছে করে সব ভুলে গিয়ে ভালো থাকতে। একটু বেশি করে বাইরেটা দেখতে। তবুও ভুলে যাব বলে কী সব ভোলা যায়?
খুব খারাপ ঘটনা যেমন চিরকাল মনে থাকে,তেমনি মনে থাকে খুব ভালো ঘটনাও।
আর ভালো থাকার ব্যাপারটা আপেক্ষিক,অনেকে এমনও আছেন যাদের বাইরে বেড়াতে যেতে ভালো লাগে না। কেউ বেশি বৈষয়িক,কেউ বা অন্য কিছু ভালোবাসেন।
তবে এটাও ঠিক যে জীবনে কোন পরিকল্পনা করতে গেলে অর্থ লাগে। তবে আবার অর্থ থাকলেও সদিচ্ছার অভাবে অনেক কিছুই করা হয় না জীবনে। পরে আক্ষেপ হয় অন্যকে দেখে,কখনও বা হিংসাও। সুতরাং সেক্ষেত্রে ঐ একটা কথাই বলার সময় থাকতেই ভাবো। অন্যকে দেখে যেমন ভালোটা শিখতে হয় তেমনি সবসময় নিজের পক্ষে কতটা সম্ভব সেটাও ভাবতে হয়।
রেষারেষির রেসের দড়ি জীবনে না টানাই ভালো। তাতে ভালো থাকা যায় না। তার চেয়ে বরং সযত্নে সু ইচ্ছেগুলোকে যত্নে মনের কোণে আগলে রাখলে পূরণ করা যায়। ছেলেমেয়েরা যদি স্বাবলম্বী হয় তবে এখন আপনাদের দিন। আর সত্যি কথা বলতে আমাদের সন্তানেরা তখনই স্বাবলম্বী হয় যখন তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
ছেলে বিদেশে যাচ্ছে বৌকে নিয়ে,গাড়ি নিয়ে ঘুরছে। এখানে ওখানে টাকা ছড়াচ্ছে। ছেলে বিদেশে থাকে সেখানে বৌমা গেল আপনার যাওয়া হল না। পরে এসব ভেবে আক্ষেপ করে কী লাভ? তার থেকে আপনাকে দেখে বরং ওরা শিখুক যে কিভাবে চললে শূন্য থেকে জীবন শুরু করলেও ঐ শূন্যগুলোর আগে সংখ্যা বসিয়ে নিতে পারা যায়।
অনেকে আদর্শ ইয়ে,ইয়ে,ইয়ে....হতে চান। আমিও চেয়েছি একসময় তবে সত্যি কথা বলতে এর তেমন কোন মূল্য নেই এখনকার সমাজে। সবাই আপনাকে বলবে কেন করেছ এত?কে করতে বলেছে?
ভাবুন একবার সত্যিই কী জীবনে ভালো হতে গিয়ে আমরা যা যা করেছি তার খুবই দরকার ছিল? বা দুটাকা চারটাকা বাঁচাতে গিয়ে যত কষ্ট করেছি তারও বোধহয় দরকার ছিল না। যা সময়ে বুঝিনি,এখন বুঝি অনেক কিছু খুইয়ে।
যাক সে সব জ্ঞানের কথা। হানিমুনের কথা শুনলে হাসি পেলেও এই বয়সে স্বামী স্ত্রী পাশাপাশি হাত ধরে হেঁটে বেড়ানোতে রোমান্স হয়ত কিছু নেই তবে আছে পারস্পরিক অবলম্বনের আলতো সোহাগ।
আজও মুন ওঠে আর হাবির সাথে থাকে হানি তবে উত্তাপটুকু না থাকলেও থেকে যায় একান্তে কাটানো কয়েকটা দিন,কখনও বরের হাতে বানানো এক কাপ কফির আস্বাদ। কখনও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে সেই মানুষটার হাতটা শক্ত করে ধরা।
তবে হানিমুনের কথায় মনে পড়ে যায় আমাদের প্রথম দীঘা যাবার কথা,মানে বাঙালীর দীপুদার অন্যতম স্থান। আমি তখন পড়াশোনা করছি,চাকরি করি না। বরেরও মাইনেপত্র খুবই কম। তারপর সংসার খরচের পর ঐ সামান্য কিছু হাতখরচ হাতে পড়ে থাকা।
আমার তখন গরমের ছুটি চলছে,হস্টেল থেকে শ্বশুরবাড়ি এসেছি। হঠাৎই অফিস থেকে এসে বলল পরশু দীঘা যাবো। আমার মন নেচে উঠল আনন্দে।
বলল তোমার সালোয়ার কামিজ আছে? আমি মাথা নাড়লাম। বিয়ের আগে যা পরতাম সবই বাপের বাড়িতে রাখা,এখানে শাড়ি পরতে হয় তাই কিছু আনিনি। আমাকে নিয়ে গিয়ে একখানা সালোয়ার কামিজ কিনে দিল। তার রঙ আর ডিজাইন আমার মনে আজও অম্লান। একদম সাদামাটা ওড়না দেওয়া গোলাপী কালো রঙের চেকচেক।
ও ভয়ে ভয়ে বাড়িতে দীঘা যাবার কথা বলাতেই মেঘ দেখলাম শ্বশুরমশাইয়ের মুখে। তবুও ভোরে বেরোলাম আমরা। ও চুপিচুপি বলল আমরা ভোরে বেরোবো,তুমি কিন্তু সালোয়ার পরেই যাবে। বাসে করে গিয়ে পৌঁছেই সমুদ্রে নামব দুজনে।
ভোরবেলা যখন বেরোলাম সবাই ঘুমন্ত। আর আমরা তখন ছুটছি মুক্তির আনন্দে। সেই স্টেট বাসে করে নতুন জীবন সাথীর সাথে প্রথম বাইরে যাওয়ার স্মৃতির প্রতিটা মুহূর্ত এখনও যত্নে বেঁচে আছে মনে আমার। তবে ফিরে আসার পর চৌকাঠ ডিঙোতে পারিনি বিদ্ধ হয়েছিলাম বাক্যবাণে।
যদিও যখন ফিরেছি আমার পরনে তখন শাড়ি,কিন্তু গতকাল আমি ভোরবেলা সালোয়ার কামিজ পরে গিয়ে গর্হিত অন্যায় করে ফেলেছি। আর তা পাড়ার কোন জেঠু নাকি দেখে ফেলেছেন। সুতরাং আমার বর তার নির্বুদ্ধিতার জন্য তিরস্কৃত হল পর্যাপ্ত পরিমাণে।
কথা শুনলাম আমিও,ওর না হয় বোধবুদ্ধি নেই। নতুন বৌ হয়ে তুমি বা কী করে শাড়ি না পরে বেরোও? কথার কাঁটায় মন কাটলো,ভয়ে বুক কাঁপলো,চোখে জল ঝরলো আড়ালে।
তবে এখনকার সময়ের মত ফেসবুকে বা হোয়াটস অ্যাপে স্ট্যাটাস দিয়ে মনের ঝাল মেটাতে পারলাম না। বা মমতা শংকরের বক্তব্যের নিরিখে মহাভারত রচনা করতে পারলাম না। জানলাম সালোয়ার নিষিদ্ধ পোশাক তা আর পরা যাবে না সকলের সামনে।
এভাবেই কেটে গেছে বছরের পর বছর। কখনও নিয়ম মেনেছি কখনও ভেঙেছি লুকিয়ে। বেড়াতে গিয়ে চুপিচুপি বরের একখানা জিন্স পরেছি। কখনও সালোয়ার কামিজ দুএকটা দর্জির কাছে বানিয়ে রেখেছি বাইরে পরব বলে।
সময় বয়ে গেছে দেখতে দেখতে দুই সন্তানের মা হয়েছি। নিজের দিকে তাকানোর অবকাশ আর হয়নি। ঘরে বাইরে খেটেছি,যা পেয়েছি খেয়েছি খিদের মুখে। শরীর বেড়েছে নিজের খেয়ালে। বেড়াতে
গেছি প্রায় প্রতি বছরই। তবে ছানাপোনা কোলে নিয়ে শাড়ি পরে কখনও ঘুরে বেড়িয়েছি নেপালে,কখনও সিমলায় আবার কখনও কেদারনাথে। কখনও উঠেছি ধর্মশালায়,কখনও ভারত সেবাশ্রমে,ভোলাগিরি আশ্রমে আবার কখনও হোটেলে। একটু ভালো হোটেলে উঠে মনে হয়েছে স্বর্গরাজ্যে এলাম। তবুও ঘোরাঘুরি আমাদের বন্ধ হয়নি।
ওরা বড় হয়েছে,ওদের পড়াশোনা শুরু হয়েছে। ওজনের বাড়ন্ত চাপে আর ছুটোছুটি করতে গিয়ে পড়েছি ধুপধাপ, স্কুলের পথে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভেঙেছি পায়ের হাড়। তবুও ছোটা থেমে থাকেনি। জীবনের পথে চলতে গিয়ে কখনও ভাঙে মন,কখনও বা ভাঙে আমাদের শরীর। আমরা সয়ে সয়ে ক্ষয়ে যেতে থাকি প্রতিনিয়ত।
তবুও এখন এই বয়েসে এসে ভাবি নিজেদের দিকেও একটু তাকানো দরকার। ছেলেমেয়েদের দেখতে গিয়ে অনেক সময় ব্যয় করার পর সময় দেওয়া উচিত ঐ দশটা পাঁচটা অফিস করে আসার পর অবসরে থাকা মানুষটাকেও। যে মানুষটা আমাদের সন্তানদের সকালের পুরো পরিচর্যা নিজের হাতে করত তারপর তাদের স্কুলে ছাড়তে যেত তারপর ছুটতে ছুটতে যেত অফিসে।
শাশুড়ি হয়েছি কয়েকমাস আগে। তাতে কী হয়েছে? বৌমাকে তার নিজের সংসারে রাণী করে রেখেছি,তাকে আমার ভয়ে বাঁচতে হয় না। সে আছে নিজের মত। আমি প্রথম জীবনে ভালো থাকার সুযোগ পাইনি একটা সময়ে,বরং আমার সামান্য সুখ যাতে অসুখে পরিণত হয় তার জন্য সচেষ্ট ছিল অনেকেই। তবে ঐ যে ফিরিয়ে দিতে চাই না কোন কিছুই যা সয়েছি আমার জীবনে। কারণ ভগবান আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন রয়েছি তাঁরই স্মরণে। আজ অপূর্ণতা আর কিছুই নেই,যা পাবার আমি যোগ্য তার থেকে পেয়েছি অনেক অনেক বেশি। আর পেয়েছি আমার দুই সন্তানের ভালোবাসা আর সমর্থন। বঞ্চিত করিনি তাদেরও। ইউরোপ ট্যুর তাদের নিয়েও করে এসেছি দশবছর আগেই,ঘুরিয়ে এনেছি আঙ্কোরভাট আর থাইল্যান্ড যা আমাদের সাধ্যের মধ্যে ছিল। আইফেল টাওয়ার থেকে নীচে চোখ রেখেছি সবাই মিলে,মজা করে শুনেছি কুক্কু ক্লকের ঘন্টা। তবে এখন সবাই মিলে যাওয়া হয় কম।
তবুও বলব ওদের জন্যই সম্ভব হয় বেশি করে আমাদের মাঝবয়েসের হানিমুন। বেড়াতে গিয়ে বুঝতে পারি আপনজন সন্তানই যারা রাত দুটো পর্যন্ত জেগে বারবার ফোন করে আমরা ঠিকমত পৌঁছেছি কিনা? বাইরে যাবার আগে একটা দামী ফোন নিয়ে এসে বলে তোমার তো ভালো ফোন নেই,এটা দিয়ে ছবি তুলবে।
কী জানি কেন চোখে জল আসে হঠাৎই। আগে হাসতাম না,এখন হাসি। সব ছবি দাঁত কেলিয়ে তুলি,কারণ এখন ভাবি দাঁত যতদিন ঠিক আছে বার করি।
আগে ব্যথা লাগত বেশি,এখনও লাগে তবে কম। হয়ত বা বয়েসের সাথে সাথে অনুভূতিরাও বুড়ো হয় একটু একটু করে। আগে গলার জোর ছিল,এখন চুপচাপ থাকতে ভালো লাগে। আগে শাড়ি পরে পাহাড়ে হাঁটতাম তবে এখন শাড়ি পরে বাইরে বেড়াতে গিয়ে ভয় পাই,যদি পায়ে জড়িয়ে পড়ে গিয়ে আবার হাড় ভাঙি? এমনিতেই মাঝেমধ্যেই ধরিত্রী মায়ের সাথে আমার আলিঙ্গন হয়। সুতরাং সবই পরি যা আমাকে আরাম দেয়।
এগিয়ে যে চলতেই হবে তোমাকে আনাড়ী নারী কারণ পরম স্নেহে আর ভালো হওয়ার মেডেল পাওয়ার লোভে যে সংসারের ভার বয়ে চলেছো,তুমি নিজে অচল হয়ে পড়লে কেউ আর তোমার ভার বইবে না। হোমিওপ্যাথি,অ্যালোপ্যাথি পেলেও সিমপ্যাথি পাবে না। আর সিমপ্যাথি নিয়ে জীবনে বেঁচে না থাকাই ভালো এটা আমার ব্যক্তিগত মত। তাই যৌথ আনন্দের দিন হোক বা একলা থাকার দিন হোক,ভালো থাকুন আর ভালো রাখুন নিজেকে..ভালোবেসে ভালো থাকুন। ভালো থাকতে দিন সব নেগেটিভিটি সরিয়ে।
Comments
Post a Comment